HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
মাসায়েলে কুরবাণী ও আক্বীক্বা
লেখকঃ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাসায়েলে কুরবাণী ও আক্বীক্বা
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ০৫
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম প্রকাশ : জুলাই ১৯৮৭
৫ম সংস্করণ : নভেম্বর ২০০৯।
নির্ধারিত মূল্য : ২০ (বিশ) টাকা মাত্র।
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ০৫
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম প্রকাশ : জুলাই ১৯৮৭
৫ম সংস্করণ : নভেম্বর ২০০৯।
নির্ধারিত মূল্য : ২০ (বিশ) টাকা মাত্র।
আরবী ‘কুরবান’ ( قربان ) শব্দটি ফারসী বা ঊর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। পারিভাষিক অর্থে القُرْبَانُ مَا يُتَقَرَّبُ بِهِ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়’।[1] প্রচলিত অর্থে, ঈদুল আযহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ তরীকায় যে পশু যবহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়’। সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে ‘কুরবানী’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে।[2] যদিও কুরবানী সারাদিন ও পরের দু’দিন করা যায়।
(২) গুরুত্ব
আল্লাহ বলেন,
(ক) وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ ( الحج ৩৬)-
‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ২২/৩৬)।
(খ) আল্লাহ আরও বলেন, وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ، وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ ( الصافات ১০৭-১০৮)- ‘আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী’। ‘এবং আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/১০৭-১০৮)।
(গ) আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ( الكوثر ২)- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (সূরা কাওছার ১০৮/২)। কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও বিভিন্ন কবর ও বেদীতে পূজা দেয় ও মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ মুসলমানকে আল্লাহর জন্য ‘ছালাত আদায়ের ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করার’ হুকুম দেওয়া হয়েছে। ঈদুল আযহার দিন প্রথমে আল্লাহর জন্য ঈদের ছালাত আদায় করতে হয়, অতঃপর তাঁর নামে কুরবানী করতে হয়। অনেক মুফাসসির এভাবেই আয়াতটির তাফসীর করেছেন।[3]
(ঘ) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةً وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرِبَنَّ مُصَلاَّنَا رواه ابن ماجه بإسناد حسن -
‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’।[4]
(ঙ) এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ ( شعار عظيم ), যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।[5]
(৩) উদ্দেশ্য
কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা। যাতে মানুষ এটা উপলব্ধি করে যে, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কারণেই শক্তিশালী পশুগুলি তাদের মত দুর্বলদের অনুগত হয়েছে এবং তাদের গোশত, হাড়-হাড্ডি-মজ্জা ইত্যাদির মধ্যে তাদের জন্য রূযী নির্ধারিত হয়েছে। জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের অসীলা হিসাবে তাদের মূর্তির নামে কুরবানী করত। অতঃপর তার গোশতের কিছু অংশ মূর্তিগুলির মাথায় রাখত ও তার উপরে কিছু রক্ত ছিটিয়ে দিত। কেউবা উক্ত রক্ত কা‘বা গৃহের দেওয়ালে লেপন করত। মুসলমানদের কেউ কেউ অনুরূপ করার চিন্তা করলে নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়।[6] আল্লাহ বলেন,
لَنْ يَّنَالَ اللَّهَ لُحُوْمُهَا وَلاَ دِمَاؤُهَا وَ لَكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ ( الحج ৩৭)-
অর্থঃ ‘কুরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর নিকটে পৌঁছে না। বরং তাঁর নিকটে পৌঁছে কেবলমাত্র তোমাদের ‘তাক্বওয়া’ বা আল্লাহভীতি’ (হজ্জ ২২/৩৭)।
(৪) হুকুম : কুরবানী সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। এটি ওয়াজিব নয় যে, যেকোন মূল্যে প্রত্যেককে কুরবানী করতেই হবে। লোকেরা যাতে এটাকে ওয়াজিব মনে না করে, সেজন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) ও ওমর ফারূক্ব (রাঃ) অনেক সময় কুরবানী করতেন না। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, বেলাল, আবু মাসঊদ আনছারী প্রমুখ ছাহাবী থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।[7]
(৫) তাৎপর্য : (১) আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জাযবা সৃষ্টি করা (২) ইবরাহীমের পুত্র কুরবানীর ন্যায় ত্যাগ-পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা (৩) উত্তম খানা-পিনার মাধ্যমে ঈমানদারগণের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেওয়া এবং (৪) আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করা।
(৬) ফাযায়েল
(ক) মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ مِنْ عَمَلٍ يَوْمَ النَّحْرِ أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ مِنْ إِهْرَاقِ الدَّمِ، وَ إِنَّهُ لَيُؤْتَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُوْنِهَا وَ أَشْعَارِهَا وَ أَظْلاَفِهَا، وَ إِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللهِ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَّقَعَ بِالْأَرْضِ، فَطِيْبُوْا بِهَا نَفْسًا رواه الترمذى وابن ماجه -
‘কুরবানীর দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় আমল আল্লাহর নিকটে আর কিছু নেই। ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন কুরবানীর পশুর শিং, লোম ও ক্ষুর সমূহ নিয়ে হাযির হবে। আর কুরবানীর রক্ত যমীনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর নিকটে বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানী দ্বারা নিজেদের নফ্সকে পবিত্র কর’।[8]
(খ) যিলহাজ্জ মাসের ১ম দশকের ফযীলত
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيْهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنْ هذِهِ الْاَيَّامِ الْعَشَرَةِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَ لاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيْلِ اللهِ؟ قَالَ وَلاَ الْجِهَادُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَ مَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْئٍ رواه البخارىُّ -
‘যিলহাজ্জ মাসের ১ম দশকের নেক আমলের চেয়ে প্রিয়তর কোন আমল আল্লাহর কাছে নেই। ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তি, যে নিজের জান ও মাল নিয়ে বেরিয়েছে, আর ফিরে আসেনি (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে)’।[9]
(গ) আরাফার দিনের ছিয়াম
আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُّكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِىْ قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِىْ بَعْدَهُ رواه مسلم -
‘আরাফার দিনের নফল ছিয়াম (যারা আরাফাতের বাইরে থাকেন তাদের জন্য) আমি আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তা বিগত এক বছরের ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে’।[10]
(৭) কুরবানীর ইতিহাস
আল্লাহ বলেন,
وَلِكُلِّ اُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْ مبَهِيْمَةِ الْأَنْعَامِ طـــــــَهُكُمْ إِلـهُ وَّاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوْا ط وَ بَشِّرِ الْمُخْبِتِيْنَ - ( الحج ৩৪)-
‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমরা কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা যবহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এজন্য যে, তিনি চতুষ্পদ গবাদি পশু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন। অনন্তর তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন। অতএব তাঁর নিকটে তোমরা আত্মসমর্পণ কর এবং আপনি বিনয়ীদের সুসংবাদ প্রদান করুন’ (হজ্জ ২২/৩৪)।
আদম (আঃ) -এর দুই পুত্র ক্বাবীল ও হাবীল -এর দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল। তবে সেই সব কুরবানীর নিয়ম-কানূন আমাদেরকে জানানো হয়নি। মুসলিম উম্মাহর উপরে যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে।[11] যা মুক্বীম ও মুসাফির সর্বাবস্থায় পালনীয়।[12] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাদানী জীবনে দশ বছর নিয়মিত কুরবানী করেছেন।[13]
ইবরাহীমী কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْىَ قَالَ يَابُنَىَّ اِنِّىْ اَرَى فِى الْمَنَامِ اَنِّىْ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَىط قَالَ ياَأَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِىْ إِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصَّابِرِيْنَ- فَلَمَّا أَسْلَمَا وَ تَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ- وَ نَادَيْنَاهُ أَنْ يَّا إِبْرَاهِيْمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ج إِنَّا كَذَالِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِيْنَ- إِنَّ هذَا لَهُوَ الْبَلاَءُ الْمُبِيْنُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ- وَ تَرَكْنَا عَلَيْهِ فِى الْآخِرِيْنَ- سَلاَمٌ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ - ( الصافات ১০২-১০৯)-
‘যখন সে (ইসমাঈল) তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হ’ল, তখন তিনি (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। অতএব বল, তোমার মতামত কি? ছেলে বলল, হে আববা! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা প্রতিপালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/১০২)। অতঃপর যখন পিতা ও পুত্র আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে ফেলল’ (১০৩), ‘তখন আমরা তাকে ডাক দিলাম, হে ইবরাহীম (১০৪)! ‘নিশ্চয়ই তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এমনিভাবে সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরষ্কৃত করে থাকি’ (১০৫)। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’ (১০৬)। ‘আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী’ (১০৭)। ‘এবং আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদেরকে মধ্যে রেখে দিলাম’ (১০৮)। ‘ইবরাহীমের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক’ (১০৯)!
হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮৬ বৎসর বয়সে ইসমাঈল বিবি হাজেরার গর্ভে এবং ৯৯ বছর বয়সে ইসহাক্ব বিবি সারাহর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আঃ) সর্বমোট ২০০ বছর বেঁচে ছিলেন।[14]
ঘটনা: ফার্রা বলেন, যবহের সময় ইসমাঈলের বয়স ছিল ১৩ বছর। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ঐ সময় তিনি কেবল সাবালকত্বে উপনীত হয়েছিলেন।[15] এমন সময় পিতা ইবরাহীম স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান নয়নের পুত্তলি ইসমাঈলকে কুরবানী করছেন। নবীদের স্বপ্ন ‘অহি’ হয়ে থাকে। তাদের চক্ষু মুদিত থাকলেও অন্তরচক্ষু খোলা থাকে। ইবরাহীম (আঃ) একই স্বপ্ন পরপর তিনরাত্রি দেখেন। প্রথম রাতে তিনি স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে ভাবতে থাকেন, কি করবেন। এজন্য প্রথম রাতকে (৮ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুত তারবিয়াহ’ ( يوم الةروية ) বা ‘স্বপ্ন দেখানোর দিন’ বলা হয়। দ্বিতীয় রাতে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখার পর তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ হ’তে নির্দেশ হয়েছে। এজন্য এ দিনটি (৯ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমু আরাফা’ ( يوم عرفة ) বা ‘নিশ্চিত হওয়ার দিন’ বলা হয়। তৃতীয় দিনে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখায় তিনি ছেলেকে কুরবানী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য এ দিনটিকে (১০ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুন নাহর’ ( يوم النحر ) বা ‘কুরবানীর দিন’ বলা হয় ।[16]
এই সময় ইবরাহীম (আঃ) শয়তানকে তিন স্থানে তিনবার সাতটি করে পাথরের কংকর ছুঁড়ে মারেন।[17] উক্ত সুন্নাত অনুসরণে উম্মতে মুহাম্মাদীও হজ্জের সময় তিন জামরায় তিনবার শয়তানের বিরুদ্ধে কংকর নিক্ষেপ করে থাকে এবং প্রতিবারে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে থাকে।[18]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে মুসনাদে আহমাদে[19] বর্ণিত হয়েছে যে, ইবরাহীম (আঃ) ছেলেকে কুরবানীর প্রস্ত্ততি নিলেন এবং তাকে মাটিতে উপুড় করে ফেললেন। এমন সময় পিছন থেকে আওয়ায এলো ( يَا اِبْرَاهِيْمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ) ‘হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্ন সার্থক করেছ’ (ছাফফাত ১০৫)। ইবরাহীম পিছন ফিরে দেখেন যে, একটি সুন্দর শিংওয়ালা ও চোখওয়ালা সাদা দুম্বা ( كَبْشٌ أَبْيَضُ أَقْرَنُ أَعْيَنُ ) দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর তিনি সেটি মিনা প্রান্তরে (‘ছাবীর’ টীলার পাদদেশে) কুরবানী করেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এজন্য আমরা কুরবানীর সময় অনুরূপ ছাগল-দুম্বা খুঁজে থাকি।[20] তিনি বলেন, ঐ দুম্বাটি ছিল হাবীলের কুরবানী, যা জান্নাতে ছিল, যাকে আল্লাহ ইসমাঈলের ফিদ্ইয়া হিসাবে পাঠিয়েছিলেন।[21] ইবরাহীম উক্ত দুম্বাটি ছেলের ফিদ্ইয়া হিসাবে কুরবানী করলেন ও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন ( يَا بُنَىَّ اَلْيَوْمَ وُهِبْتَ لِىْ ) ‘হে পুত্র! আজই তোমাকে আমার জন্য দান করা হ’ল।[22]
নিঃসন্দেহে এখানে মূল উদ্দেশ্য যবহ ছিলনা, বরং উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও তাক্বওয়ার পরীক্ষা নেওয়া। সে পরীক্ষায় উভয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন পিতার পূর্ণ প্রস্ত্ততি এবং পুত্রের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ও আনুগত্যের মাধ্যমে।
ইমাম কুরতুবী উপরোক্ত ১০৭ নং আয়াত وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ উল্লেখ করে বলেন, এ আয়াতটি দলীল হ’ল এ বিষয়ে যে, উট ও গরুর চেয়ে ছাগল কুরবানী করা উত্তম’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও শিংওয়ালা দু’টো করে ‘খাসি’ কুরবানী দিতেন। অনেক বিদ্বান বলেছেন, যদি এর চাইতে উত্তম কিছু থাকত, তবে আল্লাহ তাই দিয়ে ইসমাঈলের ফিদ্ইয়া দিতেন’।[23] তবে উট, গরু, ভেড়া বা ছাগল দ্বারা কুরবানীর ব্যাপারে স্পষ্ট হাদীছ রয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হজ্জের সময় গরু ও উট কুরবানী করেছেন।
[1]. মাজদুদ্দীন ফীরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৬/১৯৮৬) পৃঃ ১৫৮।
[2]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো ছাপাঃ ১৩৯৮/১৯৭৮) ৬/২২৮ পৃঃ।
[3]. মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাছাবীহ (লাক্ষ্ণৌ ছাপাঃ ১৯৫৮) ২/৩৪৯; ঐ, (বেনারস ছাপাঃ ১৯৯৫) ৫/৭১ পৃঃ।
[4]. ইবনু মাজাহ, আলবানী-ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৫৩২; আহমাদ, বায়হাক্বী, হাকেম, দারাকুৎনী, মির‘আত (বেনারস) ৫/৭২; নায়লুল আওত্বার ৬/২২৭ পৃঃ।
[5]. মির‘আত ৫/৭১, ৭৩ পৃঃ।
[6]. তাফসীরে ইবনে কাছীর (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৮/১৯৮৮) ৩/২৩৪; তাফসীরে কুরতুবী (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫) ১২/৬৫ পৃঃ।
[7]. বায়হাক্বী (হায়দারাবাদ, ভারতঃ ১৩৫৬ হিঃ; ঐ, বৈরুতঃ দারুল মা‘রিফাহ, তারিখ বিহীন) ৯/২৬৪-২৬৬; মির‘আত ৫/৭২-৭৩; তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩/২৩৪; তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৮-১০৯ পৃঃ।
[8]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত-আলবানী (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫), হা/১৪৭০; ঐ, মির‘আত সহ হা/১৪৮৭, সনদ ‘হাসান’। ইবনুল ‘আরাবী বলেন যে, কুরবানীর ফযীলত বর্ণনায় কোন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যায় না’। ছাহেবে মির‘আত বলেন, বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’ -এর কারণে সম্ভবতঃ ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। দ্রঃ মির‘আত ২/৩৬২-৬৩ পৃঃ; ঐ, ৫/১০৪; তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিযী (কায়রো ছাপাঃ ১৯৮৭) ৫/৭৫ পৃঃ।
[9]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৬০ ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।
[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪ ‘ছওম’ অধ্যায়, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ।
[11]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২২৮ পৃঃ।
[12]. তাফসীরে কুরতুবী (বৈরুত: ১৪০৫/১৯৮৫) ১৫/১০৯ পৃঃ; নায়ল ৬/২৫৫পৃঃ।
[13]. তিরমিযী, মিশকাত হা/১৪৭৫ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।
[14]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৬; মুওয়াত্ত্বা, তাফসীরে কুরতুবী ২/৯৮-৯৯ পৃঃ।
[15]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/৯৯ পৃঃ।
[16]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০২ পৃঃ।
[17]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৬ পৃঃ।
[18]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/২৬২১, ২৬২৬ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘কংকর নিক্ষেপ’ অনুচ্ছেদ।
[19]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৭০৭, তাহক্বীক্ব: আহমাদ শাকির ১/২৯৭পৃঃ; সনদ ছহীহ, তাহক্বীক্ব তাফসীরে ইবনে কাছীর (কায়রো ছাপাঃ দারুল হাদীছ ২০০২) ৭/২৮ পৃঃ।
[20]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৭ পৃঃ; ঐ, তাহক্বীক্ব, সনদ ছহীহ ৭/২৮ পৃঃ ।
[21]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
[22]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
[23]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
(২) গুরুত্ব
আল্লাহ বলেন,
(ক) وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ ( الحج ৩৬)-
‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ২২/৩৬)।
(খ) আল্লাহ আরও বলেন, وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ، وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ ( الصافات ১০৭-১০৮)- ‘আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী’। ‘এবং আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/১০৭-১০৮)।
(গ) আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ( الكوثر ২)- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (সূরা কাওছার ১০৮/২)। কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও বিভিন্ন কবর ও বেদীতে পূজা দেয় ও মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ মুসলমানকে আল্লাহর জন্য ‘ছালাত আদায়ের ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করার’ হুকুম দেওয়া হয়েছে। ঈদুল আযহার দিন প্রথমে আল্লাহর জন্য ঈদের ছালাত আদায় করতে হয়, অতঃপর তাঁর নামে কুরবানী করতে হয়। অনেক মুফাসসির এভাবেই আয়াতটির তাফসীর করেছেন।[3]
(ঘ) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةً وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرِبَنَّ مُصَلاَّنَا رواه ابن ماجه بإسناد حسن -
‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’।[4]
(ঙ) এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ ( شعار عظيم ), যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।[5]
(৩) উদ্দেশ্য
কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা। যাতে মানুষ এটা উপলব্ধি করে যে, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কারণেই শক্তিশালী পশুগুলি তাদের মত দুর্বলদের অনুগত হয়েছে এবং তাদের গোশত, হাড়-হাড্ডি-মজ্জা ইত্যাদির মধ্যে তাদের জন্য রূযী নির্ধারিত হয়েছে। জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের অসীলা হিসাবে তাদের মূর্তির নামে কুরবানী করত। অতঃপর তার গোশতের কিছু অংশ মূর্তিগুলির মাথায় রাখত ও তার উপরে কিছু রক্ত ছিটিয়ে দিত। কেউবা উক্ত রক্ত কা‘বা গৃহের দেওয়ালে লেপন করত। মুসলমানদের কেউ কেউ অনুরূপ করার চিন্তা করলে নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়।[6] আল্লাহ বলেন,
لَنْ يَّنَالَ اللَّهَ لُحُوْمُهَا وَلاَ دِمَاؤُهَا وَ لَكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ ( الحج ৩৭)-
অর্থঃ ‘কুরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর নিকটে পৌঁছে না। বরং তাঁর নিকটে পৌঁছে কেবলমাত্র তোমাদের ‘তাক্বওয়া’ বা আল্লাহভীতি’ (হজ্জ ২২/৩৭)।
(৪) হুকুম : কুরবানী সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। এটি ওয়াজিব নয় যে, যেকোন মূল্যে প্রত্যেককে কুরবানী করতেই হবে। লোকেরা যাতে এটাকে ওয়াজিব মনে না করে, সেজন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) ও ওমর ফারূক্ব (রাঃ) অনেক সময় কুরবানী করতেন না। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, বেলাল, আবু মাসঊদ আনছারী প্রমুখ ছাহাবী থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।[7]
(৫) তাৎপর্য : (১) আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জাযবা সৃষ্টি করা (২) ইবরাহীমের পুত্র কুরবানীর ন্যায় ত্যাগ-পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা (৩) উত্তম খানা-পিনার মাধ্যমে ঈমানদারগণের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেওয়া এবং (৪) আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করা।
(৬) ফাযায়েল
(ক) মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ مِنْ عَمَلٍ يَوْمَ النَّحْرِ أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ مِنْ إِهْرَاقِ الدَّمِ، وَ إِنَّهُ لَيُؤْتَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُوْنِهَا وَ أَشْعَارِهَا وَ أَظْلاَفِهَا، وَ إِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللهِ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَّقَعَ بِالْأَرْضِ، فَطِيْبُوْا بِهَا نَفْسًا رواه الترمذى وابن ماجه -
‘কুরবানীর দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় আমল আল্লাহর নিকটে আর কিছু নেই। ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন কুরবানীর পশুর শিং, লোম ও ক্ষুর সমূহ নিয়ে হাযির হবে। আর কুরবানীর রক্ত যমীনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর নিকটে বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানী দ্বারা নিজেদের নফ্সকে পবিত্র কর’।[8]
(খ) যিলহাজ্জ মাসের ১ম দশকের ফযীলত
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيْهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنْ هذِهِ الْاَيَّامِ الْعَشَرَةِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَ لاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيْلِ اللهِ؟ قَالَ وَلاَ الْجِهَادُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَ مَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْئٍ رواه البخارىُّ -
‘যিলহাজ্জ মাসের ১ম দশকের নেক আমলের চেয়ে প্রিয়তর কোন আমল আল্লাহর কাছে নেই। ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তি, যে নিজের জান ও মাল নিয়ে বেরিয়েছে, আর ফিরে আসেনি (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে)’।[9]
(গ) আরাফার দিনের ছিয়াম
আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُّكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِىْ قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِىْ بَعْدَهُ رواه مسلم -
‘আরাফার দিনের নফল ছিয়াম (যারা আরাফাতের বাইরে থাকেন তাদের জন্য) আমি আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তা বিগত এক বছরের ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে’।[10]
(৭) কুরবানীর ইতিহাস
আল্লাহ বলেন,
وَلِكُلِّ اُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْ مبَهِيْمَةِ الْأَنْعَامِ طـــــــَهُكُمْ إِلـهُ وَّاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوْا ط وَ بَشِّرِ الْمُخْبِتِيْنَ - ( الحج ৩৪)-
‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমরা কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা যবহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এজন্য যে, তিনি চতুষ্পদ গবাদি পশু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন। অনন্তর তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন। অতএব তাঁর নিকটে তোমরা আত্মসমর্পণ কর এবং আপনি বিনয়ীদের সুসংবাদ প্রদান করুন’ (হজ্জ ২২/৩৪)।
আদম (আঃ) -এর দুই পুত্র ক্বাবীল ও হাবীল -এর দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল। তবে সেই সব কুরবানীর নিয়ম-কানূন আমাদেরকে জানানো হয়নি। মুসলিম উম্মাহর উপরে যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে।[11] যা মুক্বীম ও মুসাফির সর্বাবস্থায় পালনীয়।[12] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাদানী জীবনে দশ বছর নিয়মিত কুরবানী করেছেন।[13]
ইবরাহীমী কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْىَ قَالَ يَابُنَىَّ اِنِّىْ اَرَى فِى الْمَنَامِ اَنِّىْ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَىط قَالَ ياَأَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِىْ إِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصَّابِرِيْنَ- فَلَمَّا أَسْلَمَا وَ تَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ- وَ نَادَيْنَاهُ أَنْ يَّا إِبْرَاهِيْمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ج إِنَّا كَذَالِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِيْنَ- إِنَّ هذَا لَهُوَ الْبَلاَءُ الْمُبِيْنُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ- وَ تَرَكْنَا عَلَيْهِ فِى الْآخِرِيْنَ- سَلاَمٌ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ - ( الصافات ১০২-১০৯)-
‘যখন সে (ইসমাঈল) তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হ’ল, তখন তিনি (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। অতএব বল, তোমার মতামত কি? ছেলে বলল, হে আববা! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা প্রতিপালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/১০২)। অতঃপর যখন পিতা ও পুত্র আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে ফেলল’ (১০৩), ‘তখন আমরা তাকে ডাক দিলাম, হে ইবরাহীম (১০৪)! ‘নিশ্চয়ই তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এমনিভাবে সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরষ্কৃত করে থাকি’ (১০৫)। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’ (১০৬)। ‘আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী’ (১০৭)। ‘এবং আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদেরকে মধ্যে রেখে দিলাম’ (১০৮)। ‘ইবরাহীমের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক’ (১০৯)!
হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮৬ বৎসর বয়সে ইসমাঈল বিবি হাজেরার গর্ভে এবং ৯৯ বছর বয়সে ইসহাক্ব বিবি সারাহর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আঃ) সর্বমোট ২০০ বছর বেঁচে ছিলেন।[14]
ঘটনা: ফার্রা বলেন, যবহের সময় ইসমাঈলের বয়স ছিল ১৩ বছর। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ঐ সময় তিনি কেবল সাবালকত্বে উপনীত হয়েছিলেন।[15] এমন সময় পিতা ইবরাহীম স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান নয়নের পুত্তলি ইসমাঈলকে কুরবানী করছেন। নবীদের স্বপ্ন ‘অহি’ হয়ে থাকে। তাদের চক্ষু মুদিত থাকলেও অন্তরচক্ষু খোলা থাকে। ইবরাহীম (আঃ) একই স্বপ্ন পরপর তিনরাত্রি দেখেন। প্রথম রাতে তিনি স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে ভাবতে থাকেন, কি করবেন। এজন্য প্রথম রাতকে (৮ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুত তারবিয়াহ’ ( يوم الةروية ) বা ‘স্বপ্ন দেখানোর দিন’ বলা হয়। দ্বিতীয় রাতে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখার পর তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ হ’তে নির্দেশ হয়েছে। এজন্য এ দিনটি (৯ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমু আরাফা’ ( يوم عرفة ) বা ‘নিশ্চিত হওয়ার দিন’ বলা হয়। তৃতীয় দিনে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখায় তিনি ছেলেকে কুরবানী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য এ দিনটিকে (১০ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুন নাহর’ ( يوم النحر ) বা ‘কুরবানীর দিন’ বলা হয় ।[16]
এই সময় ইবরাহীম (আঃ) শয়তানকে তিন স্থানে তিনবার সাতটি করে পাথরের কংকর ছুঁড়ে মারেন।[17] উক্ত সুন্নাত অনুসরণে উম্মতে মুহাম্মাদীও হজ্জের সময় তিন জামরায় তিনবার শয়তানের বিরুদ্ধে কংকর নিক্ষেপ করে থাকে এবং প্রতিবারে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে থাকে।[18]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে মুসনাদে আহমাদে[19] বর্ণিত হয়েছে যে, ইবরাহীম (আঃ) ছেলেকে কুরবানীর প্রস্ত্ততি নিলেন এবং তাকে মাটিতে উপুড় করে ফেললেন। এমন সময় পিছন থেকে আওয়ায এলো ( يَا اِبْرَاهِيْمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ) ‘হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্ন সার্থক করেছ’ (ছাফফাত ১০৫)। ইবরাহীম পিছন ফিরে দেখেন যে, একটি সুন্দর শিংওয়ালা ও চোখওয়ালা সাদা দুম্বা ( كَبْشٌ أَبْيَضُ أَقْرَنُ أَعْيَنُ ) দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর তিনি সেটি মিনা প্রান্তরে (‘ছাবীর’ টীলার পাদদেশে) কুরবানী করেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এজন্য আমরা কুরবানীর সময় অনুরূপ ছাগল-দুম্বা খুঁজে থাকি।[20] তিনি বলেন, ঐ দুম্বাটি ছিল হাবীলের কুরবানী, যা জান্নাতে ছিল, যাকে আল্লাহ ইসমাঈলের ফিদ্ইয়া হিসাবে পাঠিয়েছিলেন।[21] ইবরাহীম উক্ত দুম্বাটি ছেলের ফিদ্ইয়া হিসাবে কুরবানী করলেন ও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন ( يَا بُنَىَّ اَلْيَوْمَ وُهِبْتَ لِىْ ) ‘হে পুত্র! আজই তোমাকে আমার জন্য দান করা হ’ল।[22]
নিঃসন্দেহে এখানে মূল উদ্দেশ্য যবহ ছিলনা, বরং উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও তাক্বওয়ার পরীক্ষা নেওয়া। সে পরীক্ষায় উভয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন পিতার পূর্ণ প্রস্ত্ততি এবং পুত্রের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ও আনুগত্যের মাধ্যমে।
ইমাম কুরতুবী উপরোক্ত ১০৭ নং আয়াত وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ উল্লেখ করে বলেন, এ আয়াতটি দলীল হ’ল এ বিষয়ে যে, উট ও গরুর চেয়ে ছাগল কুরবানী করা উত্তম’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও শিংওয়ালা দু’টো করে ‘খাসি’ কুরবানী দিতেন। অনেক বিদ্বান বলেছেন, যদি এর চাইতে উত্তম কিছু থাকত, তবে আল্লাহ তাই দিয়ে ইসমাঈলের ফিদ্ইয়া দিতেন’।[23] তবে উট, গরু, ভেড়া বা ছাগল দ্বারা কুরবানীর ব্যাপারে স্পষ্ট হাদীছ রয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হজ্জের সময় গরু ও উট কুরবানী করেছেন।
[1]. মাজদুদ্দীন ফীরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৬/১৯৮৬) পৃঃ ১৫৮।
[2]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো ছাপাঃ ১৩৯৮/১৯৭৮) ৬/২২৮ পৃঃ।
[3]. মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাছাবীহ (লাক্ষ্ণৌ ছাপাঃ ১৯৫৮) ২/৩৪৯; ঐ, (বেনারস ছাপাঃ ১৯৯৫) ৫/৭১ পৃঃ।
[4]. ইবনু মাজাহ, আলবানী-ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৫৩২; আহমাদ, বায়হাক্বী, হাকেম, দারাকুৎনী, মির‘আত (বেনারস) ৫/৭২; নায়লুল আওত্বার ৬/২২৭ পৃঃ।
[5]. মির‘আত ৫/৭১, ৭৩ পৃঃ।
[6]. তাফসীরে ইবনে কাছীর (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৮/১৯৮৮) ৩/২৩৪; তাফসীরে কুরতুবী (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫) ১২/৬৫ পৃঃ।
[7]. বায়হাক্বী (হায়দারাবাদ, ভারতঃ ১৩৫৬ হিঃ; ঐ, বৈরুতঃ দারুল মা‘রিফাহ, তারিখ বিহীন) ৯/২৬৪-২৬৬; মির‘আত ৫/৭২-৭৩; তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩/২৩৪; তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৮-১০৯ পৃঃ।
[8]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত-আলবানী (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫), হা/১৪৭০; ঐ, মির‘আত সহ হা/১৪৮৭, সনদ ‘হাসান’। ইবনুল ‘আরাবী বলেন যে, কুরবানীর ফযীলত বর্ণনায় কোন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যায় না’। ছাহেবে মির‘আত বলেন, বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’ -এর কারণে সম্ভবতঃ ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। দ্রঃ মির‘আত ২/৩৬২-৬৩ পৃঃ; ঐ, ৫/১০৪; তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিযী (কায়রো ছাপাঃ ১৯৮৭) ৫/৭৫ পৃঃ।
[9]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৬০ ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।
[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪ ‘ছওম’ অধ্যায়, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ।
[11]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২২৮ পৃঃ।
[12]. তাফসীরে কুরতুবী (বৈরুত: ১৪০৫/১৯৮৫) ১৫/১০৯ পৃঃ; নায়ল ৬/২৫৫পৃঃ।
[13]. তিরমিযী, মিশকাত হা/১৪৭৫ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।
[14]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৬; মুওয়াত্ত্বা, তাফসীরে কুরতুবী ২/৯৮-৯৯ পৃঃ।
[15]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/৯৯ পৃঃ।
[16]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০২ পৃঃ।
[17]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৬ পৃঃ।
[18]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/২৬২১, ২৬২৬ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘কংকর নিক্ষেপ’ অনুচ্ছেদ।
[19]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৭০৭, তাহক্বীক্ব: আহমাদ শাকির ১/২৯৭পৃঃ; সনদ ছহীহ, তাহক্বীক্ব তাফসীরে ইবনে কাছীর (কায়রো ছাপাঃ দারুল হাদীছ ২০০২) ৭/২৮ পৃঃ।
[20]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৭ পৃঃ; ঐ, তাহক্বীক্ব, সনদ ছহীহ ৭/২৮ পৃঃ ।
[21]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
[22]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
[23]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
(১) চুল-নখ না কাটা: উম্মে সালামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ وَ أَرَادَ بَعْضُكُمْ أَنْ يُّضَحِّىَ فَلاَ يَمُسَّ مِنْ شَعْرِهِ وَ أَظْفَارِهِ شَيْئًا رواه مسلم و زاد النسائىُّ : حَتَّى يُضَحِّىَ -
‘তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানী দেওয়ার এরাদা রাখে, তারা যেন যিলহাজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার পর হ’তে কুরবানী সম্পন্ন করা পর্যন্ত স্ব স্ব চুল ও নখ কর্তন করা হ’তে বিরত থাকে’।[1]
(খ) কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তিগণ কুরবানীর খালেছ নিয়তে এটা করলে ‘আল্লাহ্র নিকটে তা পূর্ণাঙ্গ কুরবানী’ হিসাবে ( فذلك تمامُ أُضحِيَتِكَ عِنْدَ الله ) ’ গৃহীত হবে।[2]
(গ) ইমাম নববী বলেন, ‘উহার তাৎপর্য হ’ল যাতে অকর্তিত নখ চুল সহ পূর্ণাঙ্গ দেহ নিয়ে মুমিন বান্দা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়’।[3] তাছাড়া এর তাৎপর্য এটাও হ’তে পারে যে, ইসমাঈল (আঃ) হাসিমুখে তাঁর জীবন দিয়ে আল্লাহ্র হুকুম পালন করেছিলেন। তার অনুসরণে আমরা আমাদের দেহের একটা অংশ নখ-চুল ইত্যাদি কুরবানী দিয়ে মনের মধ্যে এই সংকল্প করতে পারি যে, আল্লাহ্র দ্বীনের খাতিরে প্রয়োজনে আমরাও ইসমাঈলের ন্যায় জীবন কুরবানী দিতে প্রস্ত্তত। এর ফলে আমরা নবীর সুন্নাত অনুসরণের নেকী তো পাবই, উপরন্তু ‘দ্বীনের জন্য মুজাহিদ বেশে মৃত্যুবরণের আকাংখা পোষণের কারণে ‘মুনাফেকী হালতে মৃত্যুবরণ’ থেকে বেঁচে যাব ইনশাআল্লাহ।[4]
দুর্ভাগ্য, এই সুন্নাতটি বর্তমানে মুসলিম সমাজ প্রায় ভুলতে বসেছে।
(২) কুরবানীর পশু:
(ক) উহা তিন প্রকারঃ উট, গরু ও ছাগল। দুম্বা ও ভেড়া ছাগলের মধ্যে গণ্য। প্রত্যেকটির নর ও মাদি। এগুলির বাইরে অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায় না।[5] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘উপরে বর্ণিত পশুগুলি ব্যতীত অন্য কোন পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হবে না’।[6]
(খ) ছাগল কুরবানী করাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় থাকাকালীন সময়ে উট, গরু পাওয়া সত্ত্বেও সর্বদা ‘খাসি’ কুরবানী দিতেন।[7] ইসমাঈলের বিনিময়ে জান্নাতী পশুর যে কুরবানী দেওয়া হয়, সেটাও ছিল দুম্বা। তবে রক্ত প্রবাহিত করার বিবেচনায় জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে উত্তম হ’ল উট অতঃপর গরু অতঃপর দুম্বা ও ছাগল-ভেড়া।[8]
(গ) ‘খাসি’ কুরবানী নিঃসন্দেহে জায়েয বরং উত্তম। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় মুক্বীম এমনকি মুসাফির অবস্থায়ও সর্বদা দু’টি করে ‘খাসি’ ( مَوْجُوْئَيْنِ ) কুরবানী দিতেন।[9] ছহীহ বুখারীর সর্বশেষ ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘খাসি’ করার কারণে কেউ কেউ এটাকে খুঁৎওয়ালা পশু বলে অপসন্দ করেছেন। কিন্তু মূলতঃ এটি কোন খুঁৎ নয়। বরং এর ফলে গোশত রুচিকর হয়, দুর্গন্ধ দূরীভূত হয় ও সুস্বাদু হয়।[10] ইবনু কুদামা বলেন, খাসিই কুরবানীর জন্য যথেষ্ট। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি খাসি দিয়েই কুরবানী করতেন।[11] সূরায়ে নিসা ১১৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাধারণভাবে পশুকে দাগানো ও খাসি না করা বিষয়ে কয়েকজন ছাহাবী ও তাবেঈর মতামত[12] কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের নিয়মিত আমলই অগ্রগণ্য ও অনুসরণীয়।
(ঘ) কুরবানীর পশু সুঠাম, সুন্দর ও নিখুঁত হওয়া চাই। চার ধরনের পশু কুরবানী করা নাজায়েয। যথাঃ স্পষ্ট খোঁড়া, স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট রোগী ও জীর্ণশীর্ণ এবং অর্ধেক কান কাটা বা ছিদ্র করা ও অর্ধেক শিং ভাঙ্গা।[13] এসবের চাইতে নিম্নস্তরের কোন দোষ যেমন অর্ধেক লেজ কাটা ইত্যাদি থাকলে তার দ্বারাও কুরবানী হবে না। তবে নিখুঁত পশু ক্রয়ের পর যদি নতুন করে খুঁৎ হয় বা পুরানো কোন দোষ বেরিয়ে আসে, তাহ’লে ঐ পশু দ্বারাই কুরবানী বৈধ হবে।[14]
(৩) ‘মুসিন্নাহ’ দ্বারা কুরবানী:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
لاَ تَذْبَحُوْ ا إِلاَّ مُسِنَّةً إِلاَّ أَنْ يَّعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوْا جُذْعَةً مِّنَ الضَّأْنِ رواه مسلم -
অর্থঃ ‘তোমরা দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত ওঠা (মুসিন্নাহ) পশু ব্যতীত যবহ করো না। তবে কষ্টকর হ’লে এক বছর পূর্ণকারী ভেড়া (দুম্বা বা ছাগল) কুরবানী করতে পার’।[15] জমহূর বিদ্বানগণ অন্যান্য হাদীছের আলোকে এই হাদীছে নির্দেশিত ‘মুসিন্নাহ’ পশুকে কুরবানীর জন্য ‘উত্তম’ হিসাবে গণ্য করেছেন।[16]
‘মুসিন্নাহ’ পশু ষষ্ঠ বছরে পদার্পণকারী উট এবং তৃতীয় বছরে পদার্পণকারী গরু বা ছাগল-ভেড়া-দুম্বাকে বলা হয়।[17] কেননা এই বয়সে সাধারণতঃ এই সব পশুর দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত উঠে থাকে। তবে অনেক পশুর বয়স বেশী ও হৃষ্টপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সঠিক সময়ে দাঁত ওঠে না। এসব পশু দ্বারা কুরবানী করা ইনশাআল্লাহ কোন দোষের হবে না।
(৪) নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি পশুই যথেষ্ট:
(ক) মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি শিংওয়ালা সুন্দর সাদা-কালো দুম্বা আনতে বললেন.... অতঃপর নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লেন,
بِسْمِ اللهِ أَللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُّحَمَّدٍ وَّ آلِ مُحَمَّدٍ وَّ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ رواه مسلم -
‘আল্লাহ্র নামে (কুরবানী করছি), হে আল্লাহ! তুমি এটি কবুল কর মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে, তার পরিবারের পক্ষ হ’তে ও তার উম্মতের পক্ষ হ’তে’। এরপর উক্ত দুম্বা দ্বারা কুরবানী করলেন’।[18]
(খ) বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে সমবেত জনমন্ডলীকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
يَآ أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِىْ كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَةً وَ عَتِيْرَةً ... رواه الترمذي وابوداؤد -
‘হে জনগণ! নিশ্চয়ই প্রত্যেক পরিবারের উপরে প্রতি বছর একটি করে কুরবানী ও আতীরাহ’। আবুদাঊদ বলেন, ‘আতীরাহ’ প্রদানের হুকুম পরে রহিত করা হয়।[19]
(গ) ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরিবার পিছু একটি করে বকরী কুরবানীর রেওয়াজ ছিল। যেমন ছাহাবী আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) বলেন,
كَانَ الرَّجُلُ يُضَحِّىْ بِالشَّاةِ عَنْهُ وَ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ فَيَأْكُلُوْنَ وَ يُطْعِمُوْنَ حَتَّى تُبَاهِىَ النَّاسُ فَصَارَتْ كَمَا تَرَى رواه الترمذى وابن ماجه -
অর্থঃ ‘একজন লোক একটি বকরী দ্বারা নিজের ও নিজের পরিবারের পক্ষ হ’তে কুরবানী দিতেন। অতঃপর তা খেতেন ও অন্যকে খাওয়াতেন এবং এভাবে লোকেরা বড়াই করত। এই নিয়ম রাসূলের যুগ হ’তে চলে আসছে যেমন তুমি দেখছ’।[20]
(ঘ) একই মর্মে ধনাঢ্য ছাহাবী আবু সারীহা (রাঃ) প্রমুখাৎ ছহীহ সনদে বর্ণিত ইবনু মাজাহ্র একটি হাদীছ[21] উদ্ধৃত করে ইমাম শাওকানী বলেন, والحق أنها ةجزئ عن أهل البية و إن كانوا مائة نفس أو أكثر كما قضة بذلك السنة ‘সঠিক কথা এই যে, একটি বকরী একটি পরিবারের পক্ষ হ’তে যথেষ্ট, যদিও সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা শতাধিক হয় এবং এভাবেই নিয়ম চলে আসছে’।[22]
(ঙ) মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, যারা একটি ছাগল একজনের জন্য নির্দিষ্ট বলেন এবং উক্ত হাদীছগুলিকে একক ব্যক্তির কুরবানীতে পরিবারের সকলের ছওয়াবে অংশীদার হওয়ার ‘তাবীল’ করেন বা খাছ হুকুম মনে করেন কিংবা হাদীছগুলিকে ‘মানসূখ’ বলতে চান, তাঁদের এইসব দাবী প্রকাশ্য ছহীহ হাদীছের বিরোধী এবং তা প্রত্যাখ্যাত ও নিছক দাবী মাত্র’।[23]
(চ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় মুক্বীম অবস্থায় নিজ পরিবার ও উম্মতের পক্ষ হ’তে দু’টি করে ‘খাসি’ এবং হজ্জের সফরে মিনায় গরু ও উট কুরবানী করেছেন।[24]
(৫) কুরবানীতে শরীক হওয়া:
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,
كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ فِىْ سَفَرٍ فَحَضَرَ الْأَضْحَى فَاشْتَرَكْنَا فِى الْبَقَرَةِ سَبْعَةٌ وَ فِى الْبَعِيْرِ عَشَرَةٌ رواه الترمذى والنسائى وابن ماجه بإسناد صحيح كما قاله الألبانى -
(ক) অর্থঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হ’ল। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হ’লাম’।[25]
(খ) হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহ্র রাসূলের সাথে হজ্জ ও ওমরাহ্র সফরে সাথী ছিলাম।... তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম’।[26] সফরে সাত বা দশজন মিলে একটি পরিবারের ন্যায়। যাতে গরু বা উটের ন্যায় বড় পশু যবহ ও কুটাবাছা এবং গোশত বন্টন সহজ হয়। জমহূর বিদ্বানগণের মতে হজ্জের হাদ্ঈর ন্যায় কুরবানীতেও শরীক হওয়া চলবে।[27]
(গ) হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জের সফরে মিনায় নিজ হাতে ৭টি উট (অন্য বর্ণনায় এর অধিক) দাঁড়ানো অবস্থায় ‘নহর’ করেছেন এবং মদীনায় (মুক্বীম অবস্থায়) দু’টি সুন্দর শিংওয়ালা ‘খাসি’ কুরবানী করেছেন’। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সফরসঙ্গী স্ত্রী ও পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি গরু কুরবানী করেন’।[28] অবশ্য মক্কায় (মিনায়) নহরকৃত উটগুলি ছাহাবীগণের পক্ষ থেকেও হ’তে পারে।
আলোচনা: ইবনু আববাস (রাঃ)-এর হাদীছটি নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহতে, জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি মুসলিম ও আবুদাঊদে এবং আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি বুখারীতে সংকলিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারীতে যথাক্রমে ‘হজ্জ’ ও ‘মানাসিক’ অধ্যায়ে এবং সুনানে ‘কুরবানী’ অধ্যায়ে হাদীছগুলি এসেছে। যেমন (১) তিরমিযী ‘কুরবানীতে শরীক হওয়া’ অধ্যায়ে ইবনু আববাস, জাবির ও আলী (রাঃ) থেকে মোট তিনটি হাদীছ এনেছেন। যার মধ্যে প্রথম দু’টি সফরের কুরবানী ও শেষেরটিতে কোন ব্যাখ্যা নেই।[29] (২) ইবনু মাজাহ উক্ত মর্মের শিরোনামে ইবনু আববাস, জাবের, আবু হুরায়রা ও আয়েশা (রাঃ) হ’তে যে পাঁচটি হাদীছ (৩১৩১-৩৪ নং) এনেছেন, তার সবগুলিই সফরে কুরবানী সংক্রান্ত। (৩) নাসাঈ কেবলমাত্র ইবনু আববাস ও জাবির (রাঃ) থেকে পূর্বের দু’টি হাদীছ (২৩৯৭-৯৮ নং) এনেছেন (৪) আবুদাঊদ শুধুমাত্র জাবির (রাঃ)-এর পূর্ব বর্ণিত সফরে কুরবানীর হাদীছটি এনেছেন তিনটি ছহীহ সনদে (২৮০৭-৯ নং), যার মধ্যে ২৮০৮ নং হাদীছটিতে اَلْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْجَزُوْرُ عَنْ سَبْعَةٍ ) ) কোন ব্যাখ্যা নেই।
বিভ্রাটের কারণ: মিশকাত শরীফে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর সফরের হাদীছটি (নং ১৪৬৯) এবং জাবির (রাঃ) বর্ণিত ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছটি (নং ১৪৫৮) সংকলিত হয়েছে। সম্ভবতঃ জাবির (রাঃ) বর্ণিত ‘মুত্বলাক্ব’ বা ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছটিকে ভিত্তি করেই এদেশে মুক্বীম অবস্থায় গরুতে সাতভাগা কুরবানীর প্রথা চালু হয়েছে। অথচ ভাগের বিষয়টি সফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা ইবনু আববাস ও জাবির (রাঃ) বর্ণিত বিস্তারিত হাদীছে উল্লেখিত হয়েছে।[30] আর একই রাবীর বর্ণিত সংক্ষিপ্ত হাদীছের স্থলে বিস্তারিত ও ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদীছ দলীলের ক্ষেত্রে গ্রহণ করাই মুহাদ্দিছগণের সর্ববাদী সম্মত রীতি।
তাছাড়া মুক্বীম অবস্থায় মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরাম কখনো ভাগে কুরবানী করেছেন বলেও জানা যায় না। ইমাম মালেক (রহঃ) কুরবানীতে শরীক হওয়ার বিষয়টিকে মকরূহ মনে করতেন।[31] দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এদেশে কেবল সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নয়, বরং মুক্বীম অবস্থায় সাত পরিবারের সাত -এর অধিক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি গরু কুরবানী দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে অনেকের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ভাগা নিয়ে অনাকাংখিত বিবাদ ও মনকষাকষি।
পরিশেষে যদি কেউ বলেন, মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানীর ব্যাপারে তো কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। উত্তরে বলা চলে যে, এ ব্যাপারে তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন নির্দেশ বা আমলও নেই। অথচ কুরবানী হ’ল একটি ইবাদত। যা রাসূলের তরীকা অনুযায়ী সম্পন্ন করা অপরিহার্য। যেটা তিনি বলেছেন বা করেছেন, সেটাই শরী‘আত। যা তিনি বলেননি বা করেননি, সেটা শরী‘আত নয়। যেটা তিনি করেননি সেটা করার মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি হাছিল করা যাবে?
বিগত বিদ্বানগণের যুগে সম্ভবতঃ মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানীর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। যেমন আজকাল পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানীর সাথে একটি গরুর ভাগা নেওয়া হচ্ছে মূলতঃ গোশত বেশী পাবার স্বার্থে। ‘নিয়ত’ যখন গোশত খাওয়া, তখন কুরবানীর উদ্দেশ্য কিভাবে হাছিল হবে? অনেকে হাযার হাযার টাকা দিয়ে বড় গরুর ভাগী হন। কিন্তু তার অর্ধেক টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনতে রাযী নন। এর দ্বারা কি বুঝা যায়? ‘কুরবানী’ হ’ল পিতা ইবরাহীমের সুন্নাত। যা তিনি পুত্র ইসমাঈলের জীবনের বিনিময়ে করেছিলেন। আর তা ছিল আল্লাহ্র পক্ষ হ’তে পাঠানো একটি পশুর জীবন অর্থাৎ দুম্বা। এক্ষণে যদি আমরা ভাগা কুরবানী করি, তাহ’লে পশুর হাড়-হাড্ডি ও গোশত ভাগ করতে পারব, কিন্তু তার জীবন ভাগ করতে পারব কি? গোশত সাত জনের ভাগে গেল, কিন্তু পশুর জীবনটা কার ভাগে গেল? অতএব ইবরাহীমী ও মুহাম্মাদী সুন্নাতের অনুসরণে নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হ’তে আল্লাহ্র রাহে একটি জীবন তথা একটি পূর্ণাঙ্গ পশু কুরবানী দেওয়া উচিত, পশুর দেহের কোন খন্ডিত অংশ নয়।
(ঘ) ‘কুরবানী ও আক্বীক্বা দু’টিরই উদ্দেশ্য আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিল করা’ এই (ইসতিহসানের) যুক্তি দেখিয়ে কোন কোন হানাফী বিদ্বান কুরবানীর গরু বা উটে এক বা একাধিক সন্তানের আক্বীক্বা সিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন (যা এদেশে অনেকের মধ্যে চালু আছে)।[32] হানাফী মাযহাবের স্তম্ভ বলে খ্যাত ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) এই মতের বিরোধিতা করেন। ইমাম শাওকানী (রহঃ) এর ঘোর প্রতিবাদ করে বলেন, এটি শরী‘আত। এখানে সুনির্দিষ্ট দলীল ব্যতীত কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব নয়।[33] বলা আবশ্যক যে, কুরবানীর পশুতে আক্বীক্বার ভাগ নেওয়ার কোন প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরামের কথা ও কর্মে পাওয়া যায় না। এটা স্রেফ ধারণা ভিত্তিক আমল, যা হানাফী মাযহাবের দোহাই দিয়ে এদেশে চালু হয়েছে। যদিও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) থেকে এ বিষয়ে কোন নির্দেশ নেই। বরং তিনি বলেছেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘যখন হাদীছ ছহীহ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।[34]
(৬) কুরবানী করার পদ্ধতি:
(ক) উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবার’ বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘যবহ’ করতে হয়।[35] কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন। ছুরি ধার করা ছাড়াও যবহের কাজ এমনকি ঋতুবতী মেয়েদের দ্বারাও করানো জায়েয।[36]
(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে কুরবানী যবহ করেছেন। অন্যের দ্বারা যবহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম। হাকেম ও বায়হাক্বীর একটি যঈফ সূত্র অনুযায়ী আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) এ মর্মে কন্যা ফাতেমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।[37]
(গ) ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিনদিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে।[38] তবে অনেক ছাহাবী, ইমাম শাফেঈ ও বহু বিদ্বানের মতে ঈদুল আযহার পরের তিনদিন কুরবানী করা যাবে। ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী এটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।[39] অনেকে সন্ধ্যার পরে কুরবানী করা নাজায়েয মনে করেন। এটা ঠিক নয়।
(ঘ) যদি যবহকারী ক্বিবলামুখী হ’তে ভুলে যান, তাহ’লেও ইনশাআল্লাহ কোন দোষ বর্তাবে না।[40]
(৭) যবহকালীন দো‘আ:
(১) বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার (অর্থঃ আল্লাহ্র নামে, আল্লাহ মহান) (২) বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী (আল্লাহ্র নামে, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ হ’তে)।
এখানে কুরবানী অন্যের হ’লে তার নাম মুখে বলবেন অথবা মনে মনে নিয়ত করে বলবেন ‘বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন ফুলান ওয়া মিন আহলে বায়তিহী’ (আল্লাহ্র নামে, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর অমুকের ও তার পরিবারের পক্ষ হ’তে)। এই সময় নবীর উপরে দরূদ পাঠ করা মাকরূহ’।[41] (৩) ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী কামা তাক্বাববালতা মিন ইবরাহীমা খালীলিকা’ (...হে আল্লাহ! তুমি আমার পক্ষ হ’তে কবুল কর যেমন কবুল করেছ তোমার দোস্ত ইবরাহীমের পক্ষ থেকে)।[42] (৪) যদি দো‘আ ভুলে যান বা ভুল হবার ভয় থাকে, তবে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে।[43] (৫) উপরোক্ত দো‘আগুলির সাথে অন্য দো‘আও রয়েছে। যেমন ‘ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরযা ‘আলা মিল্লাতি ইবরাহীমা হানীফাঁও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না ছালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রবিবল ‘আলামীন। লা শারীকা লাহু ওয়া বিযালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা; (মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী) বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’।[44]
(৮) ঈদের ছালাত ও খুৎবা শেষ হওয়ার পূর্বে কুরবানী করা নিষেধ। করলে তাকে তদস্থলে আরেকটি কুরবানী দিতে হবে।[45]
(৯) গোশত বন্টন: জাহেলী আরবরা কা‘বার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত পশুর গোশত নিজেরা খেত না। বরং সবটুকু ছাদক্বা করে দিত।[46] ইসলাম আসার পরে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবহকৃত কুরবানীর পশুর গোশত নিজেরা খাওয়ার ও অন্যকে খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে বলা হয় فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ ‘অতঃপর তোমরা তা থেকে নিজেরা খাও এবং অন্যদের খাওয়াও যারা চায় না ও যারা চায়’ (হজ্জ ২২/৩৬)। অন্য আয়াতে এসেছে, فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ ‘আর তোমরা খাও এবং খাওয়াও দুস্থ-অভাবীদেরকে’ (হজ্জ ২২/২৮)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কুরবানীর গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজ পরিবারকে খাওয়াতেন ও একভাগ অভাবী প্রতিবেশীদের দিতেন ও একভাগ সায়েলদের মধ্যে ছাদাক্বা করতেন’।[47] অতএব কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজ পরিবারের খাওয়ার জন্য, এক ভাগ অভাবী প্রতিবেশী যারা কুরবানী করতে পারেনি তাদের জন্য হাদিয়া স্বরূপ ও একভাগ সায়েল ফক্বীর-মিসকীনদের মধ্যে ছাদাক্বা স্বরূপ বিতরণ করবে (নায়ল ৬/২৫৪)। প্রয়োজনে উক্ত বন্টনে কমবেশী করায় কিংবা সবটুকু বিতরণ করায় কোন দোষ নেই।[48]
বন্টন বিষয়ে উত্তম হ’ল, মহল্লার স্ব স্ব কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ এক স্থানে জমা করে মহল্লায় যারা কুরবানী করতে পারেনি, তাদের তালিকা করে তাদের মধ্যে সুশৃংখলভাবে বিতরণ করা এবং প্রয়োজনে তাদের বাড়ীতে কুরবানীর গোশত পৌঁছে দেওয়া। বাকী এক তৃতীয়াংশ সায়েল ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করা।
আল্লাহ্র নামে উৎসর্গীত কুরবানীর পবিত্র গোশত মুসলিমদের মধ্যেই বিতরণ করা উত্তম। তবে অমুসলিম প্রতিবেশী দুস্থ-অভাবীদের কিছু দেওয়ায় দোষ নেই। কেননা এটি যাকাত বহির্ভূত নফল ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত।[49] আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) তাঁর ইহুদী প্রতিবেশীকে দিয়েই গোশত বন্টন শুরু করেছিলেন।[50] ‘তোমরা মুসলমানদের কুরবানী থেকে মুশরিকদের আহার করাইয়ো না’ মর্মে যে হাদীছ এসেছে সেটি ‘যঈফ’।[51]
(১০) গোশত সংরক্ষণ : কুরবানীর গোশত যতদিন খুশী রেখে খাওয়া যায়। এমনকি ‘এক যুলহিজ্জাহ থেকে আরেক যুলহিজ্জাহ পর্যন্ত’ এক বছর।[52] তবে মহল্লায় অভাবীর সংখ্যা বেশী থাকলে বা দেশে ব্যাপক অভাব দেখা দিলে তিনদিনের পর গোশত সবটুকু বিতরণ করা যরূরী।[53]
(১১) মৃত ব্যক্তির নামে পৃথকভাবে কুরবানী দেওয়ার কোন ছহীহ দলীল নেই। হযরত আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত হিসাবে তাঁর জন্য পৃথক একটি দুম্বা কুরবানী দিয়েছেন বলে তিরমিযী শরীফের যে হাদীছটি মিশকাতে (হা/১৪৬২) এসেছে, তা নিতান্তই যঈফ। অন্য কোন ছাহাবী রাসূলের জন্য বা কোন মৃত ব্যক্তির জন্য এভাবে কুরবানী দিয়েছেন বলে জানা যায় না। মৃত ব্যক্তিগণ পরিবারের সদস্য থাকেন না এবং তাদের উপরে শরী‘আত প্রযোজ্য নয়। অথচ কুরবানী হয় জীবিত ব্যক্তি ও পরিবারের পক্ষ হ’তে। এক্ষণে যদি কেউ মৃতের নামে কুরবানী করেন, তবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) বলেন, তাকে সবটুকুই ছাদাক্বা করে দিতে হবে।[54]
(১২) কুরবানীর গোশত বিক্রি করা নিষেধ। তবে তার চামড়া বিক্রি করে[55] শরী‘আত নির্দেশিত ছাদাক্বার খাত সমূহে ব্যয় করবে (তওবা ৬০)। এগুলি মহল্লায় বায়তুল মাল ফান্ডে জমা করে আল্লাহ ভীরু বিশ্বস্ত মুতাওয়াল্লীর মাধ্যমে সুশৃংখল ভাবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার সাথে ব্যয় করা উত্তম। আজকাল বড় বড় শহরে পেশাদার ভিক্ষুক ও তাদের সহযোগীদের দেখা যায় অনেক পরিমাণ কুরবানীর গোশত সংগ্রহ করে তা পরে কম দামে অন্যের কাছে বিক্রি করে। এ ধরনের দুষ্কর্ম থেকে এখুনি তওবা করা উচিত। মনে রাখা ভাল যে, আল্লাহ্র ন্যায় বিচারে ধনী-গরীব কেউ ছাড় পাবে না।
(১৩) কুরবানীর পশু যবহ করা কিংবা কুটা-বাছা বাবদ কুরবানীর গোশত বা চামড়ার পয়সা হ’তে কোনরূপ মজুরী দেওয়া যাবে না। ছাহাবীগণ নিজ নিজ পকেট থেকে এই মজুরী দিতেন। অবশ্য ঐ ব্যক্তি দরিদ্র হ’লে হাদিয়া স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়ায় দোষ নেই।[56]
(১৪) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎরের দিন কয়েকটি বেজোড় খেজুর খেয়ে ঈদগাহে বের হ’তেন এবং ঈদুল আযহার দিন ছালাত আদায় না করা পর্যন্ত কিছুই খেতেন না।[57] তিনি কুরবানীর পশুর কলিজা দ্বারা ইফতার করতেন।[58]
দুর্ভাগ্য, বর্তমানে ঈদুল আযহাতে সকাল থেকে সেমাই-জর্দার ধুম পড়ে যায়। অথচ এটা সুন্নাত বিরোধী কাজ। মা-বোনদের এ ব্যাপারে কঠোর হওয়া উচিত।
(১৫) কুরবানীর বদলে তার মূল্য ছাদাক্বা করা নাজায়েয। আল্লাহ্র রাহে রক্ত প্রবাহিত করাই এখানে মূল ইবাদত। যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য ছাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন।[59] ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, কুরবানী ছাদাক্বার চাইতে উত্তম, যেমন ঈদের ছালাত অন্য সকল নফল ছালাতের চাইতে উত্তম।[60]
(১৬) কুরবানীর অন্যান্য মাসায়েল:
(ক) পোষা বা খরিদ করা কোন পশুকে কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করলে ও সেই মর্মে ঘোষণা দিলে তা আর বদল করা যাবে না। অবশ্য যদি নির্দিষ্ট না করে থাকেন, তবে তার বদলে উত্তম পশু কুরবানী দেওয়া যাবে। (খ) কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট গাভিন গরু বা বকরী যদি কুরবানীর পূর্বেই জীবিত বাচ্চা প্রসব করে, তবে ঐ বাচ্চা ঈদের দিনগুলির মধ্যেই কুরবানী করবে। কুরবানীর পূর্ব পর্যন্ত বাচ্চার প্রয়োজনের অতিরিক্ত দুধ মালিক পান করতে পারবে বা তার বিক্রয়লব্ধ পয়সা নিজে ব্যবহার করতে পারবে। তবে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মতে দুধ বা দুধ বিক্রির পয়সা ছাদাক্বা করে দেওয়া ভাল। অবশ্য কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট না করলে ও সেই মর্মে ঘোষণা না দিলে, সেটাকে যবহ করাও যেতে পারে, রেখে দেওয়াও যেতে পারে। (গ) যদি কুরবানীর পশু হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তবে তার পরিবর্তে অন্য কুরবানী যরূরী নয়। যদি ঐ পশু ঈদুল আযহার দিন বা পরে পাওয়া যায়, তবে তা তখনই আল্লাহ্র রাহে যবহ করে দিতে হবে। (ঘ) যদি কুরবানীর পূর্বে কুরবানী দাতা মৃত্যুবরণ করেন এবং তার অবস্থা এমন হয় যে, ঐ পশু বিক্রয়লব্ধ পয়সা ভিন্ন তার ঋণ পরিশোধের আর কোন উপায় নেই, তখন কেবল ঋণ পরিশোধের স্বার্থেই কুরবানীর পশু বিক্রয় করা যাবে।[61]
[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৯; নাসাঈ, মির‘আত হা/১৪৭৪-এর ব্যাখ্যা, ৫/৮৬ পৃঃ।
[2]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৪৭৯; মির‘আত হা/১৪৯৩, ৫/১১৭ পৃঃ; ‘আতীরাহ’ অনুচ্ছেদ; হাকেম (বৈরুতঃ তাবি), ৪/২২৩ পৃঃ। হাকেম একে ছহীহ বলেছেন ও যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। তবে শায়খ আলবানী বলেন, অত্র হাদীছের সনদে ঈসা ইবনে হেলাল আছ-ছাদাফী রয়েছেন। ‘যার ব্যাপারে আমার নিকটে অপরিচিতি রয়েছে ( فيه عندى جهالة ) ’। ইবনু আবী হাতেম এ বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে ইবনু হিববান তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন। যদিও কাউকে বিশ্বস্ত বলার ব্যাপারে তাঁর উদারতা সুপরিচিত’। দ্রঃ ঐ, মিশকাত ১/৪৬৬ পৃঃ টীকা-২
[3]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার, ৬/২৩৩ পৃঃ।
[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১৩ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[5]. আন‘আম ৬/১৪৩-৪৪; মির‘আত ৫/৮১ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯ পৃঃ।
[6]. কিতাবুল উম্ম (বৈরুত ছাপাঃ তারিখ বিহীন) ২/২২৩ পৃঃ।
[7]. শাওকানী, আস-সায়লুল জাররার (বৈরুত ছাপাঃ তারিখ বিহীন), ৪/৮৮ পৃঃ; ছান‘আনী, সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৭/১৯৮৭) ৪/১৮৫ পৃঃ; তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
[8]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৩৫ পৃঃ; মির‘আত ৫/৮০ পৃঃ।
[9]. বায়হাক্বী ৯/২৬৮; মিশকাত হা/১৪৬১; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫), ৪/৩৫১ সনদ ‘হাসান’।
[10]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শরহ ছহীহুল বুখারী (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৭ হিঃ) ১০/১২ পৃঃ।
[11]. মির‘আত (বেনারস ছাপা) ৫/৯১ পৃঃ।
[12]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা নিসা ১১৯; ১/৫৬৯ পৃঃ।
[13]. মুওয়াত্ত্বা, তিরমিযী প্রভৃতি মিশকাত হা/১৪৬৫, ১৪৬৩, ১৪৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯২) ২/৩০ পৃঃ।
[14]. মির‘আত ২/৩৬৩; ঐ, ৫/৯৯ পৃঃ।
[15]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৫; নাসাঈ তা‘লীক্বাত সহ (লাহোর ছাপাঃ তারিখ বিহীন), ২/১৯৬ পৃঃ।
[16]. মির‘আত (লাক্ষ্ণৌ) ২/৩৫৩ পৃঃ; ঐ, (বেনারস) ৫/৮০ পৃঃ।
[17]. মির‘আত, ২/৩৫২ পৃঃ; ঐ, ৫/৭৮-৭৯ পৃঃ।
[18]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৪।
[19]. তিরমিযী, আবু দাঊদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/১৪৭৮; মির‘আত হা/১৪৯২, ৫/১১৪-১৫ পৃঃ। হাদীছটির সনদ ‘শক্তিশালী’ (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ১০/৬ পৃঃ); সনদ ‘হাসান’ আলবানী, ছহীহ নাসাঈ (বৈরুতঃ ১৯৮৮) হা/৩৯৪০; ছহীহ আবুদাউদ (বৈরুতঃ ১৯৮৯), হা/২৪২১; ছহীহ তিরমিযী (বৈরুতঃ ১৯৮৮) হা/১২২৫; ছহীহ ইবনু মাজাহ (বৈরুতঃ ১৯৮৯) হা/২৫৩৩। ইমাম তিরমিযী ও বাগাভী বলেন, চারটি সম্মানিত মাসের প্রথম ও পৃথক মাস হিসাবে রজব মাসের সম্মানে লোকেরা যে কুরবানী করত, তাকে ‘আতীরাহ’ বা ‘রাজীবাহ’ বলা হ’ত (শারহুস সুন্নাহ, বৈরুত: ১৪০৩/১৯৮৩) হা/১২২৮-এর ব্যাখ্যা, ৪/৩৫০ পৃঃ; মির‘আত ৫/১১১ পৃঃ)। শাওকানী বলেন, প্রতি বছর রজব মাসের প্রথম দশকে যে কুরবানী করা হ’ত, তাকেই ‘রাজীবাহ’ বা ‘আতীরাহ’ বলা হয়। ইমাম নবভী বলেন, আতীরাহ্র এই ব্যাখ্যায় সকল বিদ্বান একমত হয়েছেন’ (নায়ল ৬/২৭০ পৃঃ)।
[20]. ছহীহ তিরমিযী, হা/১২১৬; ছহীহ ইবনু মাজাহ, হা/২৫৪৬; মির‘আত ২/৩৬৭ পৃঃ; ঐ, ৫/১১৪ পৃঃ।
[21]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৭।
[22]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৪৪ পৃঃ।
[23]. মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৬ পৃঃ ।
[24]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৫৩; বুখারী (মীরাট ছাপাঃ ১৩২৮ হিঃ) ১/২৩১ পৃঃ; ছহীহ আবূদাঊদ হা/১৫৩৯ ।
[25]. তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৬৯ সনদ ছহীহ।
[26]. মুসলিম (বৈরুতঃ ১৯৮৩) হা/১৩১৮।
[27]. মির‘আত ২/৩৫৫ পৃঃ; ঐ, ৫/৮৪ পৃঃ।
[28]. বুখারী (মীরাট ছাপাঃ ১৩২৮ হিঃ) ১/২৩১ পৃঃ; আলবানী-ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৫৩৯।
[29]. তিরমিযী তুহফা সহ, হা/১৫৩৭-৪০, ৫/৮৭-৮৮ পৃঃ।
[30]. মিশকাত হা/১৪৬৯; মুসলিম হা/১৩১৮; বুখারী ১/২৩১ পৃঃ।
[31]. মুওয়াত্ত্বা মালেক (মুলতান ছাপাঃ তারিখ বিহীন) পৃঃ ২৯৯।
[32]. আশরাফ আলী থানভী, বেহেশতী জেওর (ঢাকাঃ এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১০ম মুদ্রণ ১৯৯০) ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায়, মাসআলা-২, ১/৩০০ পৃঃ; বুরহানুদ্দীন মারগীনানী, হেদায়া (দিল্লীঃ ১৩৫৮ হিঃ) ‘কুরবানী’ অধ্যায় ৪/৪৩৩ পৃঃ; ঐ (দেউবন্দ ছাপা ১৪০০হিঃ) ৪/৪৪৯ পৃঃ।
[33]. নায়লুল আওত্বার, ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায় ৬/২৬৮ পৃঃ।
[34]. শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী ছাপা: ১২৮৬ হিঃ) ১/৬৩ পৃঃ; শামী (বৈরুত ছাপা) ১/৬৭ পৃঃ।
[35]. সুবুলুস সালাম, ৪/১৭৭ পৃঃ; মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৫ পৃঃ।
[36]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৪৫-৪৬ পৃঃ।
[37]. মির‘আত ২/৩৫০ পৃঃ; ঐ, ৫/৭৪ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩১ পৃঃ।
[38]. মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৪৭৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ৬/২৫৩।
[39]. ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাদাবীহ ৫/১০৬-০৯ পৃঃ।
[40]. শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম ২/২২৩ পৃঃ।
[41]. মির‘আত ২/৩৫০ পৃঃ; ঐ, ৫/৭৪ পৃঃ।
[42]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৪ হিঃ) ২৬/৩০৮ পৃঃ।
[43]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী (বৈরুত ছাপাঃ তারিখ বিহীন) ১১/১১৭ পৃঃ।
[44]. বায়হাক্বী ৯/২৮৭; আবু ইয়া‘লা, মির‘আত ৫/৯২; সনদ হাসান, ইরওয়া ৪/৩৫১।
[45]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৭২; মুসলিম, নায়ল ৬/২৪৮-২৪৯ পৃঃ।
[46]. তাফসীরে কুরতুবী, ‘হজ্জ’ ২২/২৮, ৩৬ আয়াত।
[47]. মির‘আত ৫/১২০ পৃঃ।
[48]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ১১/১০৮-০৯; মির‘আত ২/৩৬৯; ঐ, ৫/১২০ পৃঃ।
[49]. আল-মুগনী ৩/৫৮৩ পৃঃ।
[50]. বুখারী, আদাবুল মুফরাদ হা/১২৮, সনদ ছহীহ- আলবানী, ‘ইহুদী প্রতিবেশী’ অনুচ্ছেদ।
[51]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৯১১৩ ‘প্রতিবেশীকে সম্মান করা’ অনুচ্ছেদ।
[52]. আহমাদ হা/২৬৪৫৮ ‘সনদ হাসান’ তাফসীরে কুরতুবী হা/৪৪১৩।
[53]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, নায়ল ৬/২৫২ পৃঃ; তাফসীরে কুরতুবী হা/৪৪০৯, ৪৪১২ প্রভৃতি।
[54]. তিরমিযী তুহফা সহ, হা/১৫২৮, ৫/৭৯ পৃঃ; মির‘আত ৫/৯৪ পৃঃ।
[55]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, আহমাদ, নায়ল ৬/২৫৫-৫৬; মির‘আত ৫/১২১; আল-মুগনী ১১/১১১ পৃঃ।
[56]. আল-মুগনী, ১১/১১০ পৃঃ।
[57]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩৩; তিরমিযী, মিশকাত, হা/১৪৪০ সনদ ছহীহ।
[58]. বায়হাক্বী, মির‘আত ২/৩৩৮ পৃঃ; ঐ, ৫/৪৫ পৃঃ।
[59]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/৩০৪; মুগনী, ১১/৯৪-৯৫ পৃঃ।
[60]. তাফসীরে কুরতুবী (সূরা ছাফফাত ৩৭/১০২), ১৫/১০৮ পৃঃ।
[61]. মির‘আত, ২/৩৬৮-৬৯; ঐ, ৫/১১৭-১২০; কিতাবুল উম্ম ২/২২৫-২৬।
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ وَ أَرَادَ بَعْضُكُمْ أَنْ يُّضَحِّىَ فَلاَ يَمُسَّ مِنْ شَعْرِهِ وَ أَظْفَارِهِ شَيْئًا رواه مسلم و زاد النسائىُّ : حَتَّى يُضَحِّىَ -
‘তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানী দেওয়ার এরাদা রাখে, তারা যেন যিলহাজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার পর হ’তে কুরবানী সম্পন্ন করা পর্যন্ত স্ব স্ব চুল ও নখ কর্তন করা হ’তে বিরত থাকে’।[1]
(খ) কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তিগণ কুরবানীর খালেছ নিয়তে এটা করলে ‘আল্লাহ্র নিকটে তা পূর্ণাঙ্গ কুরবানী’ হিসাবে ( فذلك تمامُ أُضحِيَتِكَ عِنْدَ الله ) ’ গৃহীত হবে।[2]
(গ) ইমাম নববী বলেন, ‘উহার তাৎপর্য হ’ল যাতে অকর্তিত নখ চুল সহ পূর্ণাঙ্গ দেহ নিয়ে মুমিন বান্দা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়’।[3] তাছাড়া এর তাৎপর্য এটাও হ’তে পারে যে, ইসমাঈল (আঃ) হাসিমুখে তাঁর জীবন দিয়ে আল্লাহ্র হুকুম পালন করেছিলেন। তার অনুসরণে আমরা আমাদের দেহের একটা অংশ নখ-চুল ইত্যাদি কুরবানী দিয়ে মনের মধ্যে এই সংকল্প করতে পারি যে, আল্লাহ্র দ্বীনের খাতিরে প্রয়োজনে আমরাও ইসমাঈলের ন্যায় জীবন কুরবানী দিতে প্রস্ত্তত। এর ফলে আমরা নবীর সুন্নাত অনুসরণের নেকী তো পাবই, উপরন্তু ‘দ্বীনের জন্য মুজাহিদ বেশে মৃত্যুবরণের আকাংখা পোষণের কারণে ‘মুনাফেকী হালতে মৃত্যুবরণ’ থেকে বেঁচে যাব ইনশাআল্লাহ।[4]
দুর্ভাগ্য, এই সুন্নাতটি বর্তমানে মুসলিম সমাজ প্রায় ভুলতে বসেছে।
(২) কুরবানীর পশু:
(ক) উহা তিন প্রকারঃ উট, গরু ও ছাগল। দুম্বা ও ভেড়া ছাগলের মধ্যে গণ্য। প্রত্যেকটির নর ও মাদি। এগুলির বাইরে অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায় না।[5] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘উপরে বর্ণিত পশুগুলি ব্যতীত অন্য কোন পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হবে না’।[6]
(খ) ছাগল কুরবানী করাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় থাকাকালীন সময়ে উট, গরু পাওয়া সত্ত্বেও সর্বদা ‘খাসি’ কুরবানী দিতেন।[7] ইসমাঈলের বিনিময়ে জান্নাতী পশুর যে কুরবানী দেওয়া হয়, সেটাও ছিল দুম্বা। তবে রক্ত প্রবাহিত করার বিবেচনায় জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে উত্তম হ’ল উট অতঃপর গরু অতঃপর দুম্বা ও ছাগল-ভেড়া।[8]
(গ) ‘খাসি’ কুরবানী নিঃসন্দেহে জায়েয বরং উত্তম। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় মুক্বীম এমনকি মুসাফির অবস্থায়ও সর্বদা দু’টি করে ‘খাসি’ ( مَوْجُوْئَيْنِ ) কুরবানী দিতেন।[9] ছহীহ বুখারীর সর্বশেষ ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘খাসি’ করার কারণে কেউ কেউ এটাকে খুঁৎওয়ালা পশু বলে অপসন্দ করেছেন। কিন্তু মূলতঃ এটি কোন খুঁৎ নয়। বরং এর ফলে গোশত রুচিকর হয়, দুর্গন্ধ দূরীভূত হয় ও সুস্বাদু হয়।[10] ইবনু কুদামা বলেন, খাসিই কুরবানীর জন্য যথেষ্ট। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি খাসি দিয়েই কুরবানী করতেন।[11] সূরায়ে নিসা ১১৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাধারণভাবে পশুকে দাগানো ও খাসি না করা বিষয়ে কয়েকজন ছাহাবী ও তাবেঈর মতামত[12] কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের নিয়মিত আমলই অগ্রগণ্য ও অনুসরণীয়।
(ঘ) কুরবানীর পশু সুঠাম, সুন্দর ও নিখুঁত হওয়া চাই। চার ধরনের পশু কুরবানী করা নাজায়েয। যথাঃ স্পষ্ট খোঁড়া, স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট রোগী ও জীর্ণশীর্ণ এবং অর্ধেক কান কাটা বা ছিদ্র করা ও অর্ধেক শিং ভাঙ্গা।[13] এসবের চাইতে নিম্নস্তরের কোন দোষ যেমন অর্ধেক লেজ কাটা ইত্যাদি থাকলে তার দ্বারাও কুরবানী হবে না। তবে নিখুঁত পশু ক্রয়ের পর যদি নতুন করে খুঁৎ হয় বা পুরানো কোন দোষ বেরিয়ে আসে, তাহ’লে ঐ পশু দ্বারাই কুরবানী বৈধ হবে।[14]
(৩) ‘মুসিন্নাহ’ দ্বারা কুরবানী:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
لاَ تَذْبَحُوْ ا إِلاَّ مُسِنَّةً إِلاَّ أَنْ يَّعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوْا جُذْعَةً مِّنَ الضَّأْنِ رواه مسلم -
অর্থঃ ‘তোমরা দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত ওঠা (মুসিন্নাহ) পশু ব্যতীত যবহ করো না। তবে কষ্টকর হ’লে এক বছর পূর্ণকারী ভেড়া (দুম্বা বা ছাগল) কুরবানী করতে পার’।[15] জমহূর বিদ্বানগণ অন্যান্য হাদীছের আলোকে এই হাদীছে নির্দেশিত ‘মুসিন্নাহ’ পশুকে কুরবানীর জন্য ‘উত্তম’ হিসাবে গণ্য করেছেন।[16]
‘মুসিন্নাহ’ পশু ষষ্ঠ বছরে পদার্পণকারী উট এবং তৃতীয় বছরে পদার্পণকারী গরু বা ছাগল-ভেড়া-দুম্বাকে বলা হয়।[17] কেননা এই বয়সে সাধারণতঃ এই সব পশুর দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত উঠে থাকে। তবে অনেক পশুর বয়স বেশী ও হৃষ্টপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সঠিক সময়ে দাঁত ওঠে না। এসব পশু দ্বারা কুরবানী করা ইনশাআল্লাহ কোন দোষের হবে না।
(৪) নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি পশুই যথেষ্ট:
(ক) মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি শিংওয়ালা সুন্দর সাদা-কালো দুম্বা আনতে বললেন.... অতঃপর নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লেন,
بِسْمِ اللهِ أَللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُّحَمَّدٍ وَّ آلِ مُحَمَّدٍ وَّ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ رواه مسلم -
‘আল্লাহ্র নামে (কুরবানী করছি), হে আল্লাহ! তুমি এটি কবুল কর মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে, তার পরিবারের পক্ষ হ’তে ও তার উম্মতের পক্ষ হ’তে’। এরপর উক্ত দুম্বা দ্বারা কুরবানী করলেন’।[18]
(খ) বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে সমবেত জনমন্ডলীকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
يَآ أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِىْ كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَةً وَ عَتِيْرَةً ... رواه الترمذي وابوداؤد -
‘হে জনগণ! নিশ্চয়ই প্রত্যেক পরিবারের উপরে প্রতি বছর একটি করে কুরবানী ও আতীরাহ’। আবুদাঊদ বলেন, ‘আতীরাহ’ প্রদানের হুকুম পরে রহিত করা হয়।[19]
(গ) ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরিবার পিছু একটি করে বকরী কুরবানীর রেওয়াজ ছিল। যেমন ছাহাবী আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) বলেন,
كَانَ الرَّجُلُ يُضَحِّىْ بِالشَّاةِ عَنْهُ وَ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ فَيَأْكُلُوْنَ وَ يُطْعِمُوْنَ حَتَّى تُبَاهِىَ النَّاسُ فَصَارَتْ كَمَا تَرَى رواه الترمذى وابن ماجه -
অর্থঃ ‘একজন লোক একটি বকরী দ্বারা নিজের ও নিজের পরিবারের পক্ষ হ’তে কুরবানী দিতেন। অতঃপর তা খেতেন ও অন্যকে খাওয়াতেন এবং এভাবে লোকেরা বড়াই করত। এই নিয়ম রাসূলের যুগ হ’তে চলে আসছে যেমন তুমি দেখছ’।[20]
(ঘ) একই মর্মে ধনাঢ্য ছাহাবী আবু সারীহা (রাঃ) প্রমুখাৎ ছহীহ সনদে বর্ণিত ইবনু মাজাহ্র একটি হাদীছ[21] উদ্ধৃত করে ইমাম শাওকানী বলেন, والحق أنها ةجزئ عن أهل البية و إن كانوا مائة نفس أو أكثر كما قضة بذلك السنة ‘সঠিক কথা এই যে, একটি বকরী একটি পরিবারের পক্ষ হ’তে যথেষ্ট, যদিও সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা শতাধিক হয় এবং এভাবেই নিয়ম চলে আসছে’।[22]
(ঙ) মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, যারা একটি ছাগল একজনের জন্য নির্দিষ্ট বলেন এবং উক্ত হাদীছগুলিকে একক ব্যক্তির কুরবানীতে পরিবারের সকলের ছওয়াবে অংশীদার হওয়ার ‘তাবীল’ করেন বা খাছ হুকুম মনে করেন কিংবা হাদীছগুলিকে ‘মানসূখ’ বলতে চান, তাঁদের এইসব দাবী প্রকাশ্য ছহীহ হাদীছের বিরোধী এবং তা প্রত্যাখ্যাত ও নিছক দাবী মাত্র’।[23]
(চ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় মুক্বীম অবস্থায় নিজ পরিবার ও উম্মতের পক্ষ হ’তে দু’টি করে ‘খাসি’ এবং হজ্জের সফরে মিনায় গরু ও উট কুরবানী করেছেন।[24]
(৫) কুরবানীতে শরীক হওয়া:
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,
كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ فِىْ سَفَرٍ فَحَضَرَ الْأَضْحَى فَاشْتَرَكْنَا فِى الْبَقَرَةِ سَبْعَةٌ وَ فِى الْبَعِيْرِ عَشَرَةٌ رواه الترمذى والنسائى وابن ماجه بإسناد صحيح كما قاله الألبانى -
(ক) অর্থঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হ’ল। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হ’লাম’।[25]
(খ) হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহ্র রাসূলের সাথে হজ্জ ও ওমরাহ্র সফরে সাথী ছিলাম।... তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম’।[26] সফরে সাত বা দশজন মিলে একটি পরিবারের ন্যায়। যাতে গরু বা উটের ন্যায় বড় পশু যবহ ও কুটাবাছা এবং গোশত বন্টন সহজ হয়। জমহূর বিদ্বানগণের মতে হজ্জের হাদ্ঈর ন্যায় কুরবানীতেও শরীক হওয়া চলবে।[27]
(গ) হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জের সফরে মিনায় নিজ হাতে ৭টি উট (অন্য বর্ণনায় এর অধিক) দাঁড়ানো অবস্থায় ‘নহর’ করেছেন এবং মদীনায় (মুক্বীম অবস্থায়) দু’টি সুন্দর শিংওয়ালা ‘খাসি’ কুরবানী করেছেন’। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সফরসঙ্গী স্ত্রী ও পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি গরু কুরবানী করেন’।[28] অবশ্য মক্কায় (মিনায়) নহরকৃত উটগুলি ছাহাবীগণের পক্ষ থেকেও হ’তে পারে।
আলোচনা: ইবনু আববাস (রাঃ)-এর হাদীছটি নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহতে, জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি মুসলিম ও আবুদাঊদে এবং আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি বুখারীতে সংকলিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারীতে যথাক্রমে ‘হজ্জ’ ও ‘মানাসিক’ অধ্যায়ে এবং সুনানে ‘কুরবানী’ অধ্যায়ে হাদীছগুলি এসেছে। যেমন (১) তিরমিযী ‘কুরবানীতে শরীক হওয়া’ অধ্যায়ে ইবনু আববাস, জাবির ও আলী (রাঃ) থেকে মোট তিনটি হাদীছ এনেছেন। যার মধ্যে প্রথম দু’টি সফরের কুরবানী ও শেষেরটিতে কোন ব্যাখ্যা নেই।[29] (২) ইবনু মাজাহ উক্ত মর্মের শিরোনামে ইবনু আববাস, জাবের, আবু হুরায়রা ও আয়েশা (রাঃ) হ’তে যে পাঁচটি হাদীছ (৩১৩১-৩৪ নং) এনেছেন, তার সবগুলিই সফরে কুরবানী সংক্রান্ত। (৩) নাসাঈ কেবলমাত্র ইবনু আববাস ও জাবির (রাঃ) থেকে পূর্বের দু’টি হাদীছ (২৩৯৭-৯৮ নং) এনেছেন (৪) আবুদাঊদ শুধুমাত্র জাবির (রাঃ)-এর পূর্ব বর্ণিত সফরে কুরবানীর হাদীছটি এনেছেন তিনটি ছহীহ সনদে (২৮০৭-৯ নং), যার মধ্যে ২৮০৮ নং হাদীছটিতে اَلْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْجَزُوْرُ عَنْ سَبْعَةٍ ) ) কোন ব্যাখ্যা নেই।
বিভ্রাটের কারণ: মিশকাত শরীফে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর সফরের হাদীছটি (নং ১৪৬৯) এবং জাবির (রাঃ) বর্ণিত ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছটি (নং ১৪৫৮) সংকলিত হয়েছে। সম্ভবতঃ জাবির (রাঃ) বর্ণিত ‘মুত্বলাক্ব’ বা ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছটিকে ভিত্তি করেই এদেশে মুক্বীম অবস্থায় গরুতে সাতভাগা কুরবানীর প্রথা চালু হয়েছে। অথচ ভাগের বিষয়টি সফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা ইবনু আববাস ও জাবির (রাঃ) বর্ণিত বিস্তারিত হাদীছে উল্লেখিত হয়েছে।[30] আর একই রাবীর বর্ণিত সংক্ষিপ্ত হাদীছের স্থলে বিস্তারিত ও ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদীছ দলীলের ক্ষেত্রে গ্রহণ করাই মুহাদ্দিছগণের সর্ববাদী সম্মত রীতি।
তাছাড়া মুক্বীম অবস্থায় মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরাম কখনো ভাগে কুরবানী করেছেন বলেও জানা যায় না। ইমাম মালেক (রহঃ) কুরবানীতে শরীক হওয়ার বিষয়টিকে মকরূহ মনে করতেন।[31] দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এদেশে কেবল সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নয়, বরং মুক্বীম অবস্থায় সাত পরিবারের সাত -এর অধিক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি গরু কুরবানী দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে অনেকের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ভাগা নিয়ে অনাকাংখিত বিবাদ ও মনকষাকষি।
পরিশেষে যদি কেউ বলেন, মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানীর ব্যাপারে তো কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। উত্তরে বলা চলে যে, এ ব্যাপারে তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন নির্দেশ বা আমলও নেই। অথচ কুরবানী হ’ল একটি ইবাদত। যা রাসূলের তরীকা অনুযায়ী সম্পন্ন করা অপরিহার্য। যেটা তিনি বলেছেন বা করেছেন, সেটাই শরী‘আত। যা তিনি বলেননি বা করেননি, সেটা শরী‘আত নয়। যেটা তিনি করেননি সেটা করার মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি হাছিল করা যাবে?
বিগত বিদ্বানগণের যুগে সম্ভবতঃ মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানীর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। যেমন আজকাল পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানীর সাথে একটি গরুর ভাগা নেওয়া হচ্ছে মূলতঃ গোশত বেশী পাবার স্বার্থে। ‘নিয়ত’ যখন গোশত খাওয়া, তখন কুরবানীর উদ্দেশ্য কিভাবে হাছিল হবে? অনেকে হাযার হাযার টাকা দিয়ে বড় গরুর ভাগী হন। কিন্তু তার অর্ধেক টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনতে রাযী নন। এর দ্বারা কি বুঝা যায়? ‘কুরবানী’ হ’ল পিতা ইবরাহীমের সুন্নাত। যা তিনি পুত্র ইসমাঈলের জীবনের বিনিময়ে করেছিলেন। আর তা ছিল আল্লাহ্র পক্ষ হ’তে পাঠানো একটি পশুর জীবন অর্থাৎ দুম্বা। এক্ষণে যদি আমরা ভাগা কুরবানী করি, তাহ’লে পশুর হাড়-হাড্ডি ও গোশত ভাগ করতে পারব, কিন্তু তার জীবন ভাগ করতে পারব কি? গোশত সাত জনের ভাগে গেল, কিন্তু পশুর জীবনটা কার ভাগে গেল? অতএব ইবরাহীমী ও মুহাম্মাদী সুন্নাতের অনুসরণে নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হ’তে আল্লাহ্র রাহে একটি জীবন তথা একটি পূর্ণাঙ্গ পশু কুরবানী দেওয়া উচিত, পশুর দেহের কোন খন্ডিত অংশ নয়।
(ঘ) ‘কুরবানী ও আক্বীক্বা দু’টিরই উদ্দেশ্য আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিল করা’ এই (ইসতিহসানের) যুক্তি দেখিয়ে কোন কোন হানাফী বিদ্বান কুরবানীর গরু বা উটে এক বা একাধিক সন্তানের আক্বীক্বা সিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন (যা এদেশে অনেকের মধ্যে চালু আছে)।[32] হানাফী মাযহাবের স্তম্ভ বলে খ্যাত ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) এই মতের বিরোধিতা করেন। ইমাম শাওকানী (রহঃ) এর ঘোর প্রতিবাদ করে বলেন, এটি শরী‘আত। এখানে সুনির্দিষ্ট দলীল ব্যতীত কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব নয়।[33] বলা আবশ্যক যে, কুরবানীর পশুতে আক্বীক্বার ভাগ নেওয়ার কোন প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরামের কথা ও কর্মে পাওয়া যায় না। এটা স্রেফ ধারণা ভিত্তিক আমল, যা হানাফী মাযহাবের দোহাই দিয়ে এদেশে চালু হয়েছে। যদিও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) থেকে এ বিষয়ে কোন নির্দেশ নেই। বরং তিনি বলেছেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘যখন হাদীছ ছহীহ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।[34]
(৬) কুরবানী করার পদ্ধতি:
(ক) উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবার’ বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘যবহ’ করতে হয়।[35] কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন। ছুরি ধার করা ছাড়াও যবহের কাজ এমনকি ঋতুবতী মেয়েদের দ্বারাও করানো জায়েয।[36]
(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে কুরবানী যবহ করেছেন। অন্যের দ্বারা যবহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম। হাকেম ও বায়হাক্বীর একটি যঈফ সূত্র অনুযায়ী আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) এ মর্মে কন্যা ফাতেমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।[37]
(গ) ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিনদিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে।[38] তবে অনেক ছাহাবী, ইমাম শাফেঈ ও বহু বিদ্বানের মতে ঈদুল আযহার পরের তিনদিন কুরবানী করা যাবে। ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী এটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।[39] অনেকে সন্ধ্যার পরে কুরবানী করা নাজায়েয মনে করেন। এটা ঠিক নয়।
(ঘ) যদি যবহকারী ক্বিবলামুখী হ’তে ভুলে যান, তাহ’লেও ইনশাআল্লাহ কোন দোষ বর্তাবে না।[40]
(৭) যবহকালীন দো‘আ:
(১) বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার (অর্থঃ আল্লাহ্র নামে, আল্লাহ মহান) (২) বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী (আল্লাহ্র নামে, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ হ’তে)।
এখানে কুরবানী অন্যের হ’লে তার নাম মুখে বলবেন অথবা মনে মনে নিয়ত করে বলবেন ‘বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন ফুলান ওয়া মিন আহলে বায়তিহী’ (আল্লাহ্র নামে, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর অমুকের ও তার পরিবারের পক্ষ হ’তে)। এই সময় নবীর উপরে দরূদ পাঠ করা মাকরূহ’।[41] (৩) ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী কামা তাক্বাববালতা মিন ইবরাহীমা খালীলিকা’ (...হে আল্লাহ! তুমি আমার পক্ষ হ’তে কবুল কর যেমন কবুল করেছ তোমার দোস্ত ইবরাহীমের পক্ষ থেকে)।[42] (৪) যদি দো‘আ ভুলে যান বা ভুল হবার ভয় থাকে, তবে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে।[43] (৫) উপরোক্ত দো‘আগুলির সাথে অন্য দো‘আও রয়েছে। যেমন ‘ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরযা ‘আলা মিল্লাতি ইবরাহীমা হানীফাঁও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না ছালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রবিবল ‘আলামীন। লা শারীকা লাহু ওয়া বিযালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা; (মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী) বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’।[44]
(৮) ঈদের ছালাত ও খুৎবা শেষ হওয়ার পূর্বে কুরবানী করা নিষেধ। করলে তাকে তদস্থলে আরেকটি কুরবানী দিতে হবে।[45]
(৯) গোশত বন্টন: জাহেলী আরবরা কা‘বার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত পশুর গোশত নিজেরা খেত না। বরং সবটুকু ছাদক্বা করে দিত।[46] ইসলাম আসার পরে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবহকৃত কুরবানীর পশুর গোশত নিজেরা খাওয়ার ও অন্যকে খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে বলা হয় فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ ‘অতঃপর তোমরা তা থেকে নিজেরা খাও এবং অন্যদের খাওয়াও যারা চায় না ও যারা চায়’ (হজ্জ ২২/৩৬)। অন্য আয়াতে এসেছে, فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ ‘আর তোমরা খাও এবং খাওয়াও দুস্থ-অভাবীদেরকে’ (হজ্জ ২২/২৮)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কুরবানীর গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজ পরিবারকে খাওয়াতেন ও একভাগ অভাবী প্রতিবেশীদের দিতেন ও একভাগ সায়েলদের মধ্যে ছাদাক্বা করতেন’।[47] অতএব কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজ পরিবারের খাওয়ার জন্য, এক ভাগ অভাবী প্রতিবেশী যারা কুরবানী করতে পারেনি তাদের জন্য হাদিয়া স্বরূপ ও একভাগ সায়েল ফক্বীর-মিসকীনদের মধ্যে ছাদাক্বা স্বরূপ বিতরণ করবে (নায়ল ৬/২৫৪)। প্রয়োজনে উক্ত বন্টনে কমবেশী করায় কিংবা সবটুকু বিতরণ করায় কোন দোষ নেই।[48]
বন্টন বিষয়ে উত্তম হ’ল, মহল্লার স্ব স্ব কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ এক স্থানে জমা করে মহল্লায় যারা কুরবানী করতে পারেনি, তাদের তালিকা করে তাদের মধ্যে সুশৃংখলভাবে বিতরণ করা এবং প্রয়োজনে তাদের বাড়ীতে কুরবানীর গোশত পৌঁছে দেওয়া। বাকী এক তৃতীয়াংশ সায়েল ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করা।
আল্লাহ্র নামে উৎসর্গীত কুরবানীর পবিত্র গোশত মুসলিমদের মধ্যেই বিতরণ করা উত্তম। তবে অমুসলিম প্রতিবেশী দুস্থ-অভাবীদের কিছু দেওয়ায় দোষ নেই। কেননা এটি যাকাত বহির্ভূত নফল ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত।[49] আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) তাঁর ইহুদী প্রতিবেশীকে দিয়েই গোশত বন্টন শুরু করেছিলেন।[50] ‘তোমরা মুসলমানদের কুরবানী থেকে মুশরিকদের আহার করাইয়ো না’ মর্মে যে হাদীছ এসেছে সেটি ‘যঈফ’।[51]
(১০) গোশত সংরক্ষণ : কুরবানীর গোশত যতদিন খুশী রেখে খাওয়া যায়। এমনকি ‘এক যুলহিজ্জাহ থেকে আরেক যুলহিজ্জাহ পর্যন্ত’ এক বছর।[52] তবে মহল্লায় অভাবীর সংখ্যা বেশী থাকলে বা দেশে ব্যাপক অভাব দেখা দিলে তিনদিনের পর গোশত সবটুকু বিতরণ করা যরূরী।[53]
(১১) মৃত ব্যক্তির নামে পৃথকভাবে কুরবানী দেওয়ার কোন ছহীহ দলীল নেই। হযরত আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত হিসাবে তাঁর জন্য পৃথক একটি দুম্বা কুরবানী দিয়েছেন বলে তিরমিযী শরীফের যে হাদীছটি মিশকাতে (হা/১৪৬২) এসেছে, তা নিতান্তই যঈফ। অন্য কোন ছাহাবী রাসূলের জন্য বা কোন মৃত ব্যক্তির জন্য এভাবে কুরবানী দিয়েছেন বলে জানা যায় না। মৃত ব্যক্তিগণ পরিবারের সদস্য থাকেন না এবং তাদের উপরে শরী‘আত প্রযোজ্য নয়। অথচ কুরবানী হয় জীবিত ব্যক্তি ও পরিবারের পক্ষ হ’তে। এক্ষণে যদি কেউ মৃতের নামে কুরবানী করেন, তবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) বলেন, তাকে সবটুকুই ছাদাক্বা করে দিতে হবে।[54]
(১২) কুরবানীর গোশত বিক্রি করা নিষেধ। তবে তার চামড়া বিক্রি করে[55] শরী‘আত নির্দেশিত ছাদাক্বার খাত সমূহে ব্যয় করবে (তওবা ৬০)। এগুলি মহল্লায় বায়তুল মাল ফান্ডে জমা করে আল্লাহ ভীরু বিশ্বস্ত মুতাওয়াল্লীর মাধ্যমে সুশৃংখল ভাবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার সাথে ব্যয় করা উত্তম। আজকাল বড় বড় শহরে পেশাদার ভিক্ষুক ও তাদের সহযোগীদের দেখা যায় অনেক পরিমাণ কুরবানীর গোশত সংগ্রহ করে তা পরে কম দামে অন্যের কাছে বিক্রি করে। এ ধরনের দুষ্কর্ম থেকে এখুনি তওবা করা উচিত। মনে রাখা ভাল যে, আল্লাহ্র ন্যায় বিচারে ধনী-গরীব কেউ ছাড় পাবে না।
(১৩) কুরবানীর পশু যবহ করা কিংবা কুটা-বাছা বাবদ কুরবানীর গোশত বা চামড়ার পয়সা হ’তে কোনরূপ মজুরী দেওয়া যাবে না। ছাহাবীগণ নিজ নিজ পকেট থেকে এই মজুরী দিতেন। অবশ্য ঐ ব্যক্তি দরিদ্র হ’লে হাদিয়া স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়ায় দোষ নেই।[56]
(১৪) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎরের দিন কয়েকটি বেজোড় খেজুর খেয়ে ঈদগাহে বের হ’তেন এবং ঈদুল আযহার দিন ছালাত আদায় না করা পর্যন্ত কিছুই খেতেন না।[57] তিনি কুরবানীর পশুর কলিজা দ্বারা ইফতার করতেন।[58]
দুর্ভাগ্য, বর্তমানে ঈদুল আযহাতে সকাল থেকে সেমাই-জর্দার ধুম পড়ে যায়। অথচ এটা সুন্নাত বিরোধী কাজ। মা-বোনদের এ ব্যাপারে কঠোর হওয়া উচিত।
(১৫) কুরবানীর বদলে তার মূল্য ছাদাক্বা করা নাজায়েয। আল্লাহ্র রাহে রক্ত প্রবাহিত করাই এখানে মূল ইবাদত। যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য ছাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন।[59] ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, কুরবানী ছাদাক্বার চাইতে উত্তম, যেমন ঈদের ছালাত অন্য সকল নফল ছালাতের চাইতে উত্তম।[60]
(১৬) কুরবানীর অন্যান্য মাসায়েল:
(ক) পোষা বা খরিদ করা কোন পশুকে কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করলে ও সেই মর্মে ঘোষণা দিলে তা আর বদল করা যাবে না। অবশ্য যদি নির্দিষ্ট না করে থাকেন, তবে তার বদলে উত্তম পশু কুরবানী দেওয়া যাবে। (খ) কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট গাভিন গরু বা বকরী যদি কুরবানীর পূর্বেই জীবিত বাচ্চা প্রসব করে, তবে ঐ বাচ্চা ঈদের দিনগুলির মধ্যেই কুরবানী করবে। কুরবানীর পূর্ব পর্যন্ত বাচ্চার প্রয়োজনের অতিরিক্ত দুধ মালিক পান করতে পারবে বা তার বিক্রয়লব্ধ পয়সা নিজে ব্যবহার করতে পারবে। তবে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মতে দুধ বা দুধ বিক্রির পয়সা ছাদাক্বা করে দেওয়া ভাল। অবশ্য কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট না করলে ও সেই মর্মে ঘোষণা না দিলে, সেটাকে যবহ করাও যেতে পারে, রেখে দেওয়াও যেতে পারে। (গ) যদি কুরবানীর পশু হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তবে তার পরিবর্তে অন্য কুরবানী যরূরী নয়। যদি ঐ পশু ঈদুল আযহার দিন বা পরে পাওয়া যায়, তবে তা তখনই আল্লাহ্র রাহে যবহ করে দিতে হবে। (ঘ) যদি কুরবানীর পূর্বে কুরবানী দাতা মৃত্যুবরণ করেন এবং তার অবস্থা এমন হয় যে, ঐ পশু বিক্রয়লব্ধ পয়সা ভিন্ন তার ঋণ পরিশোধের আর কোন উপায় নেই, তখন কেবল ঋণ পরিশোধের স্বার্থেই কুরবানীর পশু বিক্রয় করা যাবে।[61]
[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৯; নাসাঈ, মির‘আত হা/১৪৭৪-এর ব্যাখ্যা, ৫/৮৬ পৃঃ।
[2]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৪৭৯; মির‘আত হা/১৪৯৩, ৫/১১৭ পৃঃ; ‘আতীরাহ’ অনুচ্ছেদ; হাকেম (বৈরুতঃ তাবি), ৪/২২৩ পৃঃ। হাকেম একে ছহীহ বলেছেন ও যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। তবে শায়খ আলবানী বলেন, অত্র হাদীছের সনদে ঈসা ইবনে হেলাল আছ-ছাদাফী রয়েছেন। ‘যার ব্যাপারে আমার নিকটে অপরিচিতি রয়েছে ( فيه عندى جهالة ) ’। ইবনু আবী হাতেম এ বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে ইবনু হিববান তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন। যদিও কাউকে বিশ্বস্ত বলার ব্যাপারে তাঁর উদারতা সুপরিচিত’। দ্রঃ ঐ, মিশকাত ১/৪৬৬ পৃঃ টীকা-২
[3]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার, ৬/২৩৩ পৃঃ।
[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১৩ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[5]. আন‘আম ৬/১৪৩-৪৪; মির‘আত ৫/৮১ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯ পৃঃ।
[6]. কিতাবুল উম্ম (বৈরুত ছাপাঃ তারিখ বিহীন) ২/২২৩ পৃঃ।
[7]. শাওকানী, আস-সায়লুল জাররার (বৈরুত ছাপাঃ তারিখ বিহীন), ৪/৮৮ পৃঃ; ছান‘আনী, সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৭/১৯৮৭) ৪/১৮৫ পৃঃ; তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
[8]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৩৫ পৃঃ; মির‘আত ৫/৮০ পৃঃ।
[9]. বায়হাক্বী ৯/২৬৮; মিশকাত হা/১৪৬১; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫), ৪/৩৫১ সনদ ‘হাসান’।
[10]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শরহ ছহীহুল বুখারী (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৭ হিঃ) ১০/১২ পৃঃ।
[11]. মির‘আত (বেনারস ছাপা) ৫/৯১ পৃঃ।
[12]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা নিসা ১১৯; ১/৫৬৯ পৃঃ।
[13]. মুওয়াত্ত্বা, তিরমিযী প্রভৃতি মিশকাত হা/১৪৬৫, ১৪৬৩, ১৪৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯২) ২/৩০ পৃঃ।
[14]. মির‘আত ২/৩৬৩; ঐ, ৫/৯৯ পৃঃ।
[15]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৫; নাসাঈ তা‘লীক্বাত সহ (লাহোর ছাপাঃ তারিখ বিহীন), ২/১৯৬ পৃঃ।
[16]. মির‘আত (লাক্ষ্ণৌ) ২/৩৫৩ পৃঃ; ঐ, (বেনারস) ৫/৮০ পৃঃ।
[17]. মির‘আত, ২/৩৫২ পৃঃ; ঐ, ৫/৭৮-৭৯ পৃঃ।
[18]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৪।
[19]. তিরমিযী, আবু দাঊদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/১৪৭৮; মির‘আত হা/১৪৯২, ৫/১১৪-১৫ পৃঃ। হাদীছটির সনদ ‘শক্তিশালী’ (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ১০/৬ পৃঃ); সনদ ‘হাসান’ আলবানী, ছহীহ নাসাঈ (বৈরুতঃ ১৯৮৮) হা/৩৯৪০; ছহীহ আবুদাউদ (বৈরুতঃ ১৯৮৯), হা/২৪২১; ছহীহ তিরমিযী (বৈরুতঃ ১৯৮৮) হা/১২২৫; ছহীহ ইবনু মাজাহ (বৈরুতঃ ১৯৮৯) হা/২৫৩৩। ইমাম তিরমিযী ও বাগাভী বলেন, চারটি সম্মানিত মাসের প্রথম ও পৃথক মাস হিসাবে রজব মাসের সম্মানে লোকেরা যে কুরবানী করত, তাকে ‘আতীরাহ’ বা ‘রাজীবাহ’ বলা হ’ত (শারহুস সুন্নাহ, বৈরুত: ১৪০৩/১৯৮৩) হা/১২২৮-এর ব্যাখ্যা, ৪/৩৫০ পৃঃ; মির‘আত ৫/১১১ পৃঃ)। শাওকানী বলেন, প্রতি বছর রজব মাসের প্রথম দশকে যে কুরবানী করা হ’ত, তাকেই ‘রাজীবাহ’ বা ‘আতীরাহ’ বলা হয়। ইমাম নবভী বলেন, আতীরাহ্র এই ব্যাখ্যায় সকল বিদ্বান একমত হয়েছেন’ (নায়ল ৬/২৭০ পৃঃ)।
[20]. ছহীহ তিরমিযী, হা/১২১৬; ছহীহ ইবনু মাজাহ, হা/২৫৪৬; মির‘আত ২/৩৬৭ পৃঃ; ঐ, ৫/১১৪ পৃঃ।
[21]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৭।
[22]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৪৪ পৃঃ।
[23]. মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৬ পৃঃ ।
[24]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৫৩; বুখারী (মীরাট ছাপাঃ ১৩২৮ হিঃ) ১/২৩১ পৃঃ; ছহীহ আবূদাঊদ হা/১৫৩৯ ।
[25]. তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৬৯ সনদ ছহীহ।
[26]. মুসলিম (বৈরুতঃ ১৯৮৩) হা/১৩১৮।
[27]. মির‘আত ২/৩৫৫ পৃঃ; ঐ, ৫/৮৪ পৃঃ।
[28]. বুখারী (মীরাট ছাপাঃ ১৩২৮ হিঃ) ১/২৩১ পৃঃ; আলবানী-ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৫৩৯।
[29]. তিরমিযী তুহফা সহ, হা/১৫৩৭-৪০, ৫/৮৭-৮৮ পৃঃ।
[30]. মিশকাত হা/১৪৬৯; মুসলিম হা/১৩১৮; বুখারী ১/২৩১ পৃঃ।
[31]. মুওয়াত্ত্বা মালেক (মুলতান ছাপাঃ তারিখ বিহীন) পৃঃ ২৯৯।
[32]. আশরাফ আলী থানভী, বেহেশতী জেওর (ঢাকাঃ এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১০ম মুদ্রণ ১৯৯০) ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায়, মাসআলা-২, ১/৩০০ পৃঃ; বুরহানুদ্দীন মারগীনানী, হেদায়া (দিল্লীঃ ১৩৫৮ হিঃ) ‘কুরবানী’ অধ্যায় ৪/৪৩৩ পৃঃ; ঐ (দেউবন্দ ছাপা ১৪০০হিঃ) ৪/৪৪৯ পৃঃ।
[33]. নায়লুল আওত্বার, ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায় ৬/২৬৮ পৃঃ।
[34]. শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী ছাপা: ১২৮৬ হিঃ) ১/৬৩ পৃঃ; শামী (বৈরুত ছাপা) ১/৬৭ পৃঃ।
[35]. সুবুলুস সালাম, ৪/১৭৭ পৃঃ; মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৫ পৃঃ।
[36]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৪৫-৪৬ পৃঃ।
[37]. মির‘আত ২/৩৫০ পৃঃ; ঐ, ৫/৭৪ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩১ পৃঃ।
[38]. মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৪৭৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ৬/২৫৩।
[39]. ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাদাবীহ ৫/১০৬-০৯ পৃঃ।
[40]. শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম ২/২২৩ পৃঃ।
[41]. মির‘আত ২/৩৫০ পৃঃ; ঐ, ৫/৭৪ পৃঃ।
[42]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৪ হিঃ) ২৬/৩০৮ পৃঃ।
[43]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী (বৈরুত ছাপাঃ তারিখ বিহীন) ১১/১১৭ পৃঃ।
[44]. বায়হাক্বী ৯/২৮৭; আবু ইয়া‘লা, মির‘আত ৫/৯২; সনদ হাসান, ইরওয়া ৪/৩৫১।
[45]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৭২; মুসলিম, নায়ল ৬/২৪৮-২৪৯ পৃঃ।
[46]. তাফসীরে কুরতুবী, ‘হজ্জ’ ২২/২৮, ৩৬ আয়াত।
[47]. মির‘আত ৫/১২০ পৃঃ।
[48]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ১১/১০৮-০৯; মির‘আত ২/৩৬৯; ঐ, ৫/১২০ পৃঃ।
[49]. আল-মুগনী ৩/৫৮৩ পৃঃ।
[50]. বুখারী, আদাবুল মুফরাদ হা/১২৮, সনদ ছহীহ- আলবানী, ‘ইহুদী প্রতিবেশী’ অনুচ্ছেদ।
[51]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৯১১৩ ‘প্রতিবেশীকে সম্মান করা’ অনুচ্ছেদ।
[52]. আহমাদ হা/২৬৪৫৮ ‘সনদ হাসান’ তাফসীরে কুরতুবী হা/৪৪১৩।
[53]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, নায়ল ৬/২৫২ পৃঃ; তাফসীরে কুরতুবী হা/৪৪০৯, ৪৪১২ প্রভৃতি।
[54]. তিরমিযী তুহফা সহ, হা/১৫২৮, ৫/৭৯ পৃঃ; মির‘আত ৫/৯৪ পৃঃ।
[55]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, আহমাদ, নায়ল ৬/২৫৫-৫৬; মির‘আত ৫/১২১; আল-মুগনী ১১/১১১ পৃঃ।
[56]. আল-মুগনী, ১১/১১০ পৃঃ।
[57]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩৩; তিরমিযী, মিশকাত, হা/১৪৪০ সনদ ছহীহ।
[58]. বায়হাক্বী, মির‘আত ২/৩৩৮ পৃঃ; ঐ, ৫/৪৫ পৃঃ।
[59]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/৩০৪; মুগনী, ১১/৯৪-৯৫ পৃঃ।
[60]. তাফসীরে কুরতুবী (সূরা ছাফফাত ৩৭/১০২), ১৫/১০৮ পৃঃ।
[61]. মির‘আত, ২/৩৬৮-৬৯; ঐ, ৫/১১৭-১২০; কিতাবুল উম্ম ২/২২৫-২৬।
(১) সংজ্ঞা: ‘ঈদ’ ‘আওদুন’ ( عَادَ يَعُوْدُ عَوْدًا ) ধাতু হ’তে উৎপন্ন, যার অর্থ বারবার ফিরে আসা। জাহেলী আরবে যে কোন বার্ষিক আনন্দ মেলাকে ‘ঈদ’ বলা হ’ত। অতঃপর ইসলামী পরিভাষায় ‘ঈদ’ ঐ দু’টি বার্ষিক ধর্মীয় উৎসবকে বলা হয়, যা শরী‘আত নির্ধারিত পন্থায় উদযাপিত হয়। যেদিন বারবার আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করে তাঁর নামে তাকবীর ধ্বনি উচ্চারিত হয় এবং যা প্রতি বছর বান্দার উপরে আল্লাহর বিশেষ ক্ষমা ও অনুগ্রহের বারতা নিয়ে ফিরে আসে’। পর পর দুই ঈদকে একত্রে ‘ঈদায়েন’ বলা হয়।
(২) প্রচলন: ঈদায়নের ছালাত ২য় হিজরী সনে ছিয়াম ফরয হওয়ার সাথে সাথে চালু হয়। ঈদায়নের ছালাত কিতাব ও সুন্নাত ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত। এটি সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমৃত্যু নিয়মিতভাবে এটি আদায় করেছেন এবং ছোট-বড় নারী-পুরুষ সকল সক্ষম মুসলমানকে ঈদের জামা‘আতে শরীক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
(৩) করণীয়: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এদিন সর্বোত্তম পোষাক পরিধান করতেন ও স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে ঈদগাহে যেতেন।[1] (খ) তিনি এক পথে যেতেন ও অন্য পথে ফিরতেন।[2] (গ) মুক্বীম-মুসাফির সবাই ঈদের দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবেন। (ঘ) এ দিন সকালে মিসওয়াক সহ ওযূ-গোসল করে তৈল-সুগন্ধি মেখে উত্তম পোষাকে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে তাকবীর দিতে দিতে রওয়ানা হওয়া মুস্তাহাব।[3] (ঙ) জামা‘আত ছুটে গেলে একাকী বা জামা‘আত সহকারে ঈদের তাকবীর সহ দু’রাক‘আত পড়বে।[4] (চ) ঈদগাহে আসতে না পারলে বাড়ীতে মেয়েরা সহ বাড়ীর সকলকে নিয়ে তাকবীর সহকারে জামা‘আতের সাথে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে।[5]
(৪) ঈদায়নের সময়কাল: ঈদুল আযহায় সূর্য এক ‘নেযা’ পরিমাণ ও ঈদুল ফিৎরে দুই ‘নেযা’ পরিমাণ উঠার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদের ছালাত আদায় করতেন। এক ‘নেযা’ বা বর্শার দৈর্ঘ্য হ’ল তিন মিটার বা সাড়ে ছয় হাত।[6] অতএব ঈদুল আযহার ছালাত সূর্যোদয়ের পরপরই যথাসম্ভব দ্রুত শুরু করা উচিত।
(৫) ফযীলত ও নিয়ত: ঈদায়নের ছালাত সকল নফল ছালাতের মধ্যে সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ।[7] হজ্জ ও ওমরাহর ‘তালবিয়াহ’ ব্যতীত ঈদায়েন সহ কোন ইবাদতের জন্য নিয়ত মুখে বলতে হয় না, বরং হৃদয়ে সংকল্প করতে হয়।[8]
(৬) ঈদায়নের তাকবীর ধ্বনি:
ঈদায়নের তাকবীর ধ্বনি করা সুন্নাত। এটি হ’ল ‘ঈদের নিদর্শন’ ( شعار العيد )। ঈদুল ফিৎরে রামাযানের মাসব্যাপী ছিয়াম পূর্ণ করা এবং আল্লাহ পাকের বিশেষ অনুগ্রহ ও হেদায়াত প্রাপ্তির শুকরিয়া স্বরূপ এটা করতে হয়। আল্লাহ বলেন, وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘(ছিয়াম ফরয করা হয়েছে এজন্য যে,) আল্লাহ তোমাদের হেদায়াত দান করেছেন সেজন্য তোমরা আল্লাহ বড়ত্ব ঘোষণা করবে এবং তোমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। অতঃপর ঈদুল আযহাতে কুরবানীর পশুগুলিকে মানুষের অনুগত করে দেওয়া ও শিরক থেকে মুক্ত হয়ে স্রেফ আল্লাহর নামে জীবন উৎসর্গ করার হেদায়াত প্রাপ্তির শুকরিয়া স্বরূপ (হজ্জ ২২/৩৭) আল্লাহর নিরংকুশ তাওহীদ ও বড়ত্ব ঘোষণা করে বার বার তাকবীর ধ্বনি করতে হয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় চাচা আববাস, চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, ফযল ইবনে আববাস, জামাতা আলী, তার ভাই জা‘ফর, নাতি হাসান-হোসায়েন, গোলাম যায়েদ ইবনে হারেছাহ, তৎপুত্র উসামা ইবনে যায়েদ ও আয়মান ইবনে উম্মে আয়মান প্রমুখ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদায়নের সকালে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর ও তাহলীলসহ ঈদগাহ অভিমুখে ঘর হ’তে রওয়ানা দিতেন ও এইভাবে তিনি ঈদগাহ পর্যন্ত পৌঁছতেন।[9] তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম ইবনু শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ) বলেন যে, লোকেরা ঈদের দিন সকালে তাকবীর ধ্বনি করতে করতে ঈদগাহে আসত। অতঃপর ইমাম এলে তাকবীর বন্ধ করত। এ সময় ইমামের সাথে তারাও তাকবীর দিত।[10] নিতান্ত কোন ওযর না থাকলে পায়ে হেঁটেই তাকবীর ধ্বনি সহকারে ঈদগাহে আসতে হয়।[11]
ছাহাবায়ে কেরাম থেকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ রেওয়ায়াত অনুযায়ী আরাফার দিন ফজর থেকে মিনার শেষ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ই যিলহাজ্জ ফজর থেকে ১৩ ই যিলহাজ্জ ‘আইয়ামে তাশরীক্ব’-এর শেষ দিন আছর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত ছালাত শেষে কমপক্ষে তিন বার করে ও অন্যান্য সকল সময়ে উচ্চকণ্ঠে তাকবীর ধ্বনি করা সুন্নাত। ঈদুল ফিৎরের দিন সকালে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়া থেকে খুৎবা শুরুর আগ পর্যন্ত তাকবীর ধ্বনি করবে।[12]
তাকবীরের শব্দাবলী : ইমাম মালেক ও আহমাদ (রহঃ) বলেন, তাকবীরের শব্দ ও সংখ্যার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ওমর, আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) ইবনে আববাস প্রমুখ ছাহাবীগণ তাকবীর দিতেন ‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, ওয়া লিল্লা-হিল হাম্দ’।[13] অনেক বিদ্বান পড়েছেন, ‘আল্লা-হু আকবার কাবীরা, ওয়াল হামদু লিল্লা-হি কাছীরা, ওয়া সুবহানাল্লা-হি বুকরাতাঁও ওয়া আছীলা’। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এটাকে ‘সুন্দর’ বলেছেন।[14]
সূরায়ে বাক্বারাহ্ ১৮৫ ও হজ্জ ৩৭ নং আয়াতের মর্ম অনুযায়ী তাকবীর ধ্বনির গুরুত্ব সর্বাধিক। মহিলাগণও সরবে (তবে উচ্চকণ্ঠে নয়) তাকবীর পাঠ করবেন।[15] আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীগণ আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলিতে বাজারে গমন করে তাকবীর ধ্বনি করতেন। লোকেরাও তাঁদের সাথে জোরে জোরে তাকবীর ধ্বনি করত। ওমর ফারূক্ব (রাঃ) মিনাতে নিজের তাঁবুতে এত জোরে তাকবীর দিতেন যে, পার্শ্ববর্তী মসজিদের মুছল্লী ও বাজারের লোকেরা সবাই তাঁর সাথে তাকবীর ধ্বনি করে উঠত, যা এলাকাকে মুখর করে তুলত।[16]
(৭) ঈদায়নের ছালাত আদায়ের পদ্ধতি:
কোনরূপ আযান-এক্বামত ছাড়াই প্রথমে ক্বিবলামুখী দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে বাম হাতের উপরে ডান হাত বুকের উপরে বাঁধবে। অতঃপর ‘ছানা’ (দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ) পড়বে। অতঃপর ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ধীর-স্থিরভাবে দুই তাকবীরের মাঝে স্বল্প বিরতিসহ পরপর সাতটি তাকবীর দিবে। প্রতি তাকবীরে হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে, অতঃপর পূর্বের ন্যায় বুকে বাঁধবে। তাকবীর শেষ হ’লে প্রথম রাক‘আতে আ‘ঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পূর্ণভাবে পড়ে ইমাম হ’লে সরবে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বে। মুক্তাদী হ’লে নীরবে কেবল সূরা ফাতিহা ইমামের পিছে পিছে পড়বে ও ইমামের ক্বিরাআত শুনবে। অতঃপর দ্বিতীয় রাক‘আতে উঠে দাঁড়িয়ে পূর্বের নিয়মে ধীর-স্থিরভাবে দুই তাকবীরের মাঝে স্বল্প বিরতিসহ প্রথমে পরপর পাঁচটি তাকবীর দিবে। তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ অন্তে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বে।
দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বিরাআতের শুরুতে ‘আঊযুবিল্লাহ’ পড়তে হয় না। কেবল ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তে হয়। ঈদায়নের ছালাতে ১ম ও ২য় রাক‘আতে যথাক্রমে সূরা আ‘লা ও গাশিয়াহ অথবা সূরা ক্বাফ ও ক্বামার পড়া সুন্নাত।[17]
ঈদায়নের জন্য প্রথমে ছালাত ও পরে খুৎবা প্রদান করতে হয়।[18] তার আগে পিছে কোন ছালাত নেই, আযান বা এক্বামত নেই। ঈদগাহে বের হবার সময় উচ্চকণ্ঠে তাকবীর এবং পৌঁছার পরেও তাকবীর ধ্বনি ব্যতীত কাউকে জলদি আসার জন্য আহবান করাও ঠিক নয়।[19] কোন কোন ঈদগাহে ইমাম পৌঁছে যাওয়ার পরেও ছালাতের পূর্বে বিভিন্নজনে বক্তৃতা করে থাকেন। এটা সুন্নাত বিরোধী কাজ।
খুৎবা: ঈদায়নের ছালাতের পর খুৎবা দেওয়া ও তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা সুন্নাত। ঈদায়নের খুৎবা একটি হওয়াই ছহীহ হাদীছ সম্মত। যেমনঃ
عَن أَبِىْ سَعِيْدِنِ الْخُدْرِىِّ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى إِلَى الْمُصَلَّى فَأَوَّلُ شَيْئٍ يَّبْدَأُ بِهِ الصَّلاَةُ ثُمَّ يَنْصَرِفُ فَيَقُوْمُ مُقَابِلَ النَّاسِ وَالنَّاسُ جُلُوْسٌ عَلَى صُفُوْفِهِمْ فَيَعِظُهُمْ وَ يُوْصِيْهِمْ وَيَأْمُرُهُمْ وَ إِنْ كَانَ يُرِيْدُ أَنْ يَّقْطَعَ بَعْثًا قَطَعَهُ اَوْ يَأْمُرَ بِشَيْئٍ أَمَرَ بِهِ ثُمَّ يَنْصَرِفُ، متفق عليه -
‘আবুসাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহার দিনে ঈদগাহের দিকে বের হ’তেন। (ঈদগাহে পৌঁছে) তিনি প্রথমে ছালাত আদায় করতেন। অতঃপর ছালাত শেষে মুছল্লীদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন, মুছল্লীরা তখন নিজ নিজ কাতারে বসা থাকত। তিনি তাদেরকে উপদেশ দিতেন, নছীহত করতেন এবং নির্দেশ দিতেন। কোথাও সৈন্য প্রেরণের ইচ্ছা করলে বাছাই করতেন অথবা কোন বিষয়ে নির্দেশ দেওয়ার থাকলে নির্দেশ দিতেন। অতঃপর বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করতেন’।[20]
মিশকাতে সংকলিত উপরোক্ত হাদীছ ও একই মর্মে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত পরবর্তী হাদীছ (হা/১৪২৯) দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঈদায়নের খুৎবা একটিই ছিল। মাঝখানে বসে দু’টি খুৎবা প্রদান সম্পর্কে ইবনু মাজাহ (হা/১২৮৯) ও বাযযারে কয়েকটি ‘যঈফ’ হাদীছ রয়েছে, যা ছহীহ হাদীছ সমূহের বিপরীতে গ্রহণযোগ্য নয়। ছাহেবে সুবুলুস সালাম ও ছাহেবে মির‘আত বলেন, ‘প্রচলিত দুই খুৎবার নিয়মটি মূলতঃ জুম‘আর দুই খুৎবার উপরে ক্বিয়াস করেই চালু হয়েছে। এটি রাসূলের ‘আমল’ দ্বারা এবং কোন নির্ভরযোগ্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়’।[21] খুৎবা শেষে বসে দু’হাত তুলে সকলকে নিয়ে দো‘আ করার রেওয়াজটিও হাদীছ সম্মত নয়। বরং এটিই প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের ছালাত শেষে দাঁড়িয়ে কেবলমাত্র একটি খুৎবা দিয়েছেন, যার মধ্যে আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, তাকবীর, দো‘আ সবই ছিল।[22] ইবনু মাজাহ কর্তৃক যঈফ সনদে রাসূলের মুওয়াযযিন সা‘দ আল-ক্বারায (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের খুৎবার মধ্যে বেশী বেশী তাকবীর ধ্বনি করতেন’।[23] এ সময় মুছল্লীগণ ইমামের সাথে সাথে তাকবীর ধ্বনি করবেন’।[24] এটি কুরআনী নির্দেশের অনুকূলে। কেননা ছিয়াম ফরয করার উদ্দেশ্য বর্ণনায় আল্লাহ বলেন, وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ এটা এজন্য যে, তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করবে একারণে যে, তিনি তোমাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)।
অনেক মুছল্লী খুৎবার সময় অন্যদিকে মনোযোগ দেন, অনেকে চলে যান, অনেক ঈদগাহে খুৎবার সময় পয়সা তোলা হয়, এগুলি খুৎবা অবমাননার শামিল। কেননা খুৎবার সময় অন্য কাজে লিপ্ত হওয়া, পরষ্পরে কথা বলা, এমনকি অন্যকে ‘চুপ কর’ একথা বলাও নিষেধ।[25] সবচেয়ে বড় কথা, ঐ ব্যক্তি খুৎবা শোনার ছওয়াব ও বরকত থেকে মাহরূম হয় এবং সুন্নাত তরক করার জন্য গোনাহগার হয়।
(৮) মহিলাদের অংশগ্রহণ:
ঈদায়নের জামা‘আতে পুরুষদের পিছনে পর্দার মধ্যে মহিলাগণ প্রত্যেকে বড় চাদরে আবৃত হয়ে যোগদান করবেন। প্রত্যেকের চাদর না থাকলে একজনের চাদরে জড়িয়ে দু’জন আসবেন। খত্বীব ছাহেব নারী-পুরুষ সকলকে লক্ষ্য করে মাতৃভাষায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে খুৎবা প্রদান করবেন। ঋতুবতী মহিলাগণ কেবল খুৎবা শ্রবণ করবেন এবং মুখে তাকবীর, তাহলীল, আমীন ইত্যাদি বলবেন। যেমন,
عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ أُمِرْنَا أَنْ نُّخْرِجَ الْحُيَّضَ يَوْمَ الْعِيْدَيْنِ وَذَوَاتِ الْخُدُوْرِ فَيَشْهَدْنَ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَ دَعْوَتَهُمْ وَ تَعْتَزِلُ الْحُيَّضُ عَنْ مُّصَلاَّهُنَّ قَالَتِ امْرَأَةٌ يَّا رَسُوْلَ اللهِ إِحْدَانَا لَيْسَ لَهَا جِلْبَابٌ قَالَ لِتُلْبِسْهَا صَاحِبَتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا، متفق عليه -
‘উম্মে ‘আত্বিইয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হ’ল, আমরা যেন ঋতুবতী ও পর্দানশীন মহিলাদেরকে দুই ঈদের দিনে বের করে নিয়ে যাই। যেন তারা মুসলমানদের জামা‘আত ও দো‘আয় শরীক হ’তে পারে। তবে ঋতুবতী মহিলারা একদিকে সরে বসবে। জনৈকা মহিলা তখন বলল, আমাদের অনেকের বড় চাদর নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার সাথী তাকে নিজের চাদর দ্বারা আবৃত করে নিয়ে যাবে’।[26]
মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, হাদীছের শেষে বর্ণিত دعوة المسلمين কথাটি ‘আম’। এর দ্বারা ইমামের খুৎবা ও ওয়ায-নছীহত শ্রবণে শরীক হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। কেননা ঈদায়নের ছালাতের পরে প্রচলিত নিয়মে সম্মিলিত ভাবে হাত তুলে দো‘আ করার প্রমাণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন দলীল নেই।[27]
(৯) ময়দানে ঈদের জামা‘আত:
ময়দানে ঈদের জামা‘আত করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীন সর্বদা ঈদের ছালাত ময়দানে পড়তেন। অন্যান্য মসজিদের চেয়ে এক হাযার গুণ বেশী নেকী এবং অতি নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কখনো মসজিদে নববীতে ঈদের ছালাত আদায় করেননি। ঈদের এই ময়দানটি ছিল মদীনার মসজিদে নববীর পূর্ব দরজা বরাবর মাত্র পাঁচশ’ গজ ( الف ذراع ) দূরে ‘বাত্বহান’ সমতল ভূমিতে অবস্থিত।[28] একটি ‘যঈফ’ বর্ণনা অনুযায়ী তিনি একবার মাত্র বৃষ্টির কারণে মসজিদে নববীতে ঈদের ছালাত আদায় করেছেন।[29] অতএব বৃষ্টি কিংবা ভীতি বা অন্য কোন বাধ্যগত কারণে ময়দানে যাওয়া অসম্ভব হ’লে মসজিদে ঈদের জামা‘আত করা যাবে।[30] কিন্তু বায়তুল্লাহ শরীফ ব্যতীত অন্য কোথাও বিনা কারণে বড় মসজিদের দোহাই দিয়ে সেখানে ঈদের ছালাত আদায় করা সুন্নাত বিরোধী কাজ।
(১০) জুম‘আ, ঈদ ও আক্বীক্বা একই দিনে:
জুম‘আ ও ঈদ একই দিনে হওয়াতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টিই পড়েছেন। তবে যারা ঈদ পড়েছেন, তাদের জন্য জুম‘আ অপরিহার্য করেননি।[31] অনুরূপভাবে আক্বীক্বা ও কুরবানী একই দিনে হ’লে এবং দু’টিই করা সাধ্যে না কুলালে আক্বীক্বা অগ্রাধিকার পাবে। কেননা সাত দিনে আক্বীক্বা করাই ছহীহ হাদীছ সম্মত।[32]
(১১) ঈদায়নের ছালাতে অতিরিক্ত তাকবীর:
প্রথম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা ও ছানা পড়ার পরে ক্বিরাআতের পূর্বে সাত ও দ্বিতীয় রাক‘আতে ছালাতের তাকবীর ব্যতীত ক্বিরাআতের পূর্বে পাঁচ মোট বারো তাকবীর দেওয়া সুন্নাত। যদি কেউ ভুলে যায় ও কিরা‘আত শুরু করে দেয়, তাহ’লে পুনরায় তাকবীর দিতে হবে না।[33] যদি গণনায় কমবেশী হয়ে যায়, তাতে সিজদায়ে সহো লাগে না। দুই তাকবীরের মাঝে স্বল্প বিরতি সহ ধীরে-সুস্থে প্রতিটি তাকবীর দিবে। প্রতি তাকবীরে দু’হাত উঠাবে ও বাম হাতের উপর ডান হাত বুকে বাঁধবে।[34]
চার খলীফা ও মদীনার শ্রেষ্ঠ সাত জন তাবেঈ ফক্বীহ সহ প্রায় সকল ছাহাবী, তাবেঈ, তিন ইমাম ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ও মুজতাহিদ ইমামগণ এবং ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর দুই প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রহঃ) বারো তাকবীরের উপরে আমল করতেন। ভারতের দু’জন খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী ও আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী বারো তাকবীরকে সমর্থন করেছেন।[35]
বারো তাকবীর সম্পর্কে ছহীহ, হাসান ও যঈফ সনদে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ তিনটি ছহীহ হাদীছ নিম্নে প্রদত্ত হ’লঃ
(১) মা আয়েশা (রাঃ) বলেন,
كان رسولُ الله صلى الله عليه وسلم يُكَبِّرُ فى الفِطْرِ والأَضْحَى فى الأُوْلَى سَبْعَ تكبيراتٍ وفى الثانيةِ خمسًا سِوَى تكبيرتَى الركوعِ رواه ابوداؤد، وفى الدارقطنى : سِوَى ةكبيرةٍ الإِسْتِفْتَاحِ -
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহাতে প্রথম রাক‘আতে সাত তাকবীর ও দ্বিতীয় রাক‘আতে পাঁচ তাকবীর দিতেন রুকুর তাকবীর ব্যতীত’।[36] দারাকুৎনীর বর্ণনায় এসেছে ‘তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’।[37]
শায়খ আলবানী বলেন, অত্র হাদীছের সনদে ইবনু লাহী‘আহ থাকার কারণে অনেকে হাদীছটিকে ‘যঈফ’ বলেছেন। কিন্তু যখন তিন আব্দুল্লাহ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব এবং আব্দুল্লাহ আল-মুক্বরী তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করেন, তখন সেটি ‘ছহীহ’ হিসাবে গণ্য হয়। আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত অত্র হাদীছটি আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব বর্ণনা করেছেন ইবনু লাহী‘আহ থেকে তিনি খালেদ ইবনু ইয়াযীদ থেকে। অতএব হাদীছটির সনদ ছহীহ।[38]
২ নং হাদীছ:
عن كثير بن عبد الله عن أبيه عن جده أَنَّ النبىَّ صلى الله عليه و سلم كَبَّرَ فِى الْعِيْدَيْنِ فِى الأُوْلَى سَبْعًا قَبْلَ الْقِرَاءََةِ وَ فِى الآخِرَةِ خَمْسًا قَبْلَ الْقِرَاءََةِ، رواه الترمذى وابن ماجه -
অনুবাদঃ কাছীর ইবনে আব্দুল্লাহ স্বীয় পিতা হ’তে তিনি স্বীয় দাদা ‘আমর ইবনে ‘আওফ আল-মুযানী (বদরী ছাহাবী) হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের প্রথম রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে সাত ও দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে পাঁচ তাকবীর দিতেন’।[39]
হাদীছটি সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী বলেন,
حديث جد كثير حديث حسن و هو أحسن شيئ روى فى هذا الباب عن النبى صلى الله عليه و سلم- قال ابو عيسى سألت محمدا يعنى البخارى عن هذا الحديث فقال ليس فى هذا الباب شيئ أصح من هذا و به أقول -
অর্থঃ হাদীছটির সনদ ‘হাসান’ এবং এটিই ঈদায়নের অতিরিক্ত তাকবীর সম্পর্কে বর্ণিত ‘সর্বাধিক সুন্দর’ বর্ণনা’। তিরমিযী বলেন, এটাই মদীনাবাসীদের আমল এবং একথাই বলেন ইমাম মালেক, শাফেঈ, আহমাদ ও ইসহাক্ব প্রমুখ।[40] তিনি আরও বলেন যে, আমি এ সম্পর্কে আমার উস্তায ইমাম বুখারীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ঈদায়নের ছালাতের অতিরিক্ত তাকবীর সম্পর্কে এর চাইতে অধিক আর কোন ছহীহ রেওয়ায়াত নেই’।[41] তবে ছাহেবে তুহফা ও ছাহেবে মির‘আত বলেন, বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে তিরমিযী একে ‘হাসান’ বলেছেন’।[42] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, হাদীছটির সনদ ‘খুবই যঈফ’। কিন্তু বহু ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে হাদীছটি শক্তিশালী হয়েছে’।[43]
৩ নং হাদীছ:
عن عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده أَنَّ رسولَ الله صلى الله عليه و سلم كَبَّرَ فِى الْعِيْدَيْنِ الْأَضْحَى وَالْفِطْرَ ثِنْتَىْ عَشَرَةَ تَكْبِيْرَةً فِى الْأُوْلَى سَبْعًا وَفِي الْأَخِيْرَةِ خَمْسًا سِوَى تَكْبِيْرَةِ الْإِحْرَامِ، وفى رواية : سِوَى تَكْبِيْرَةِ الصَّلاَةِ، رواه الدارقطنى والبيهقى -
অনুবাদ: ‘আমর ইবনে শু‘আইব তার পিতা হ’তে তিনি তার দাদা আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিৎরে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত প্রথম রাক‘আতে সাতটি ও শেষ রাক‘আতে পাঁচটি (অতিরিক্ত) তাকবীর দিতেন’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘ছালাতের তাকবীর’ ব্যতীত।[44]
অত্র হাদীছটি সম্পর্কে ছাহেবে তুহফা ও ছাহেবে মির‘আত উভয়ে বলেন, الظاهر أن حديث عبد الله بن عمرو أصح شيئ فى الباب ‘সনদ হিসাবে এটা পরিষ্কার যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর বর্ণিত অত্র হাদীছটিই এ বিষয়ে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীছ’।[45]
শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী ও তাঁর উসতায আলী ইবনুল মাদীনী হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন। আল্লামা নীমভী বলেন, হাদীছটির সনদের মূল কেন্দ্রবিন্দু ( مدار ) হ’লেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান আত-ত্বায়েফী। তাঁকে কোন কোন বিদ্বান ‘যঈফ’ বলেছেন। ছাহেবে মির‘আত বলেন, আহমাদ, বুখারী, আলী ইবনুল মাদীনী প্রমুখ বিদ্বানগণের ন্যায় হাদীছ শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিবর্গের ( جهابذة ) বক্তব্যের পরে অন্যদের বক্তব্যের প্রতি দৃকপাত না করলেও চলে। মুজতাহিদ ইমামগণ এ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন। ইবনু ‘আদী বলেন, আমর ইবনু শু‘আইব থেকে আব্দুর রহমান আত-ত্বায়েফীর সকল বর্ণনা সুদৃঢ় ( مسةقيمة )। হাফেয ইরাক্বী বলেন, إسناده صالح ‘অত্র হাদীছের সনদ দলীলযোগ্য’। তিরমিযীর ভাষ্যকার ছাহেবে তুহফা বলেন,
فالحاصل أن حديث عبد الله بن عمرو حسن صالح الاحتجاج و يؤيده الأحاديث التى أشار إليها الترمذى -
‘সারকথা এই যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদীছটি ‘হাসান’ ও দলীল গ্রহণের যোগ্য এবং একে শক্তিশালী করে ঐ সকল হাদীছ, যেগুলির দিকে তিরমিযী ইঙ্গিত করেছেন’।[46]
তাকবীরে তাহরীমা সহ কি-না?
এক্ষণে উক্ত বারো তাকবীর ‘তাকবীরে তাহরীমা’ সহ, নাকি ওটা বাদে, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইমাম শাফেঈ, আওযাঈ, ইবনু হাযম প্রমুখ বিদ্বানগণ তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত প্রথম রাক‘আতে সাত তাকবীর বলেন। পক্ষান্তরে ইমাম মালেক ও আহমাদ তাকবীরে তাহরীমা সহ সাত তাকবীর বলেন।[47]
(১) এ বিষয়ে বুলূগুল মারামের ভাষ্যকার ছাহেবে সুবুলুস সালাম বলেন,
ويحتمل أنها بتكبيرة الافتتاح و أنها من غيرها والأوضح أنها من دونها ... و قال : الأولى العمل بحديث عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده و أنه أشفى شيئ فى الباب ‘এটি তাকবীরে তাহরীমা সহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এটি তা ব্যতীত। বরং এটাই অধিকতর স্পষ্ট যে, এটি তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত।... তিনি বলেন, সর্বোত্তম হ’ল আমর ইবনে শু‘আইব কর্তৃক তার পিতা, অতঃপর তার দাদা খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছের উপরে আমল করা। এটিই অত্র বিষয়ে সর্বাধিক হৃদয় শীতলকারী বস্ত্ত’।[48]
(২) ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,
أن يقرأ دعاء الاستفتاح عقب الإحرام كغيرها ثم يكون فى الأولى سبع تكبيرات سوى تكبيرة الإحرام والركوع وفى الثانية خمسًا سوى تكبيرة القيام -
‘অন্যান্য ছালাতের ন্যায় তাকবীরে তাহরীমার পরে দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ (‘ছানা’) পাঠের পর তাকবীরে তাহরীমা ও তাকবীরে রুকূ ব্যতিরেকে সাত তাকবীর দিবে এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বওমার তাকবীর বাদে পাঁচ তাকবীর দিবে’।[49]
(৩) ছাহেবে ফিক্বহুস সুন্নাহ বলেন,
صلاة العيد ركعةان يسن فيهما أن يكبر المصلى قبل القراءة فى الركعة الأولى سبع ةكبيراة بعد ةكبيرة الإحرام وفى الثانية خمس ةكبيراة غير ةكبيرة القيام مع رفع اليدين مع كل ةكبيرة -
‘ঈদের ছালাত দু’রাক‘আত। এতে সুন্নাত হ’ল প্রথম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমার পরে ও ক্বিরাআতের পূর্বে সাত তাকবীর ও দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বওমার তাকবীর ব্যতীত পাঁচ তাকবীর দেওয়া এবং প্রতি তাকবীরে দুই হাত উঠানো’।[50]
(৪) তিরমিযীর ভাষ্যকার ছাহেবে তুহফা বলেন, واحتج من قال إن تكبيرة الإحرام معدودة من السبع فى الأولى بإطلاق الأحاديث - ‘যারা তাকবীরে তাহরীমাকে প্রথম রাক‘আতের সাত তাকবীরের মধ্যে গণ্য করেছেন, তারা হাদীছ সমূহের ‘মুত্বলাক্ব’ বা সাধারণ (সাত) শব্দ থেকে দলীল নিয়েছেন’।[51] অথচ উছূলে হাদীছের নিয়ম অনুযায়ী ‘মুত্বলাক্ব’ বা ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছের উপরে বিস্তারিত হাদীছ অগ্রগণ্য। যা দারাকুৎনীতে ১৭১২ ও ১৭১৪ নং হাদীছে আমর ইবনে শু‘আইব তার পিতা ও দাদা হ’তে বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে দারাকুৎনী ১৭০৪ নং হাদীছে আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, سِوَى تَكْبِيْرَةِ الْإِسْتِفْتَاحِ ‘তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’।
(৫) মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন, الأظهرُ بَلِ الْمُتَعَيَّنُ أَنَّهَا من دونها ‘এটাই সর্বাধিক স্পষ্ট বরং নির্দিষ্ট যে, ওটা তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’।[52] কেননা তাকবীরে তাহরীমা হ’ল ফরয। যা সকল ছালাতেই দিতে হয়। আর এগুলি হ’ল অতিরিক্ত বা নফল তাকবীর। যা কেবল ঈদের ছালাতে দিতে হয়।
(৬) তাঁদের আরেকটি দলীল হ’ল আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) -এর কয়েকটি ‘আছার’, যার বর্ণনাসূত্র ছহীহ হ’লেও তা ৭, ৯, ১১, ১২, ১৩ মর্মে পরষ্পরের বিরোধী।[53] অতএব একজন ছাহাবীর পরষ্পর বিরোধী আমলের বিপরীতে রাসূলের স্পষ্ট ছহীহ মারফূ‘ হাদীছ নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য। তাছাড়া এটা স্পষ্ট যে, আববাস (রাঃ)-এর বংশধর আববাসীয় খলীফাগণ সকলে ১২ তাকবীরের উপরে আমল করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নিয়মিত আমল ১২ তাকবীরের উপরেই ছিল।[54]
(৭) শায়খ আলবানী উক্ত তাকবীর সমূহকে ‘ঈদায়নের সাথে খাছ অতিরিক্ত তাকবীর’ হিসাবে গণ্য করেছেন।[55] এতএব সাময়িক অতিরিক্ত তাকবীর কখনো নিয়মিত ফরয তাকবীরে তাহরীমা ও তাকবীরে ছালাত-এর সাথে যুক্ত হ’তে পারে না।
(৮) কূফার গবর্ণর সাঈদ ইবনুল ‘আছ হযরত আবু মূসা আশ‘আরীকে ঈদায়নের তাকবীর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিভাবে দিয়েছিলেন, সেকথা জিজ্ঞেস করেন।[56] তিনি নিশ্চয়ই সেখানে তাকবীরে তাহরীমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেননি, যা সকল ছালাতেই ফরয। বরং ‘অতিরিক্ত তাকবীর’ ভেবেই তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, এগুলি কিভাবে দিতে হবে সেটা জানার জন্য।
(৯) উক্ত তাকবীরগুলি ছিল ক্বিরাআতের পূর্বে, ছানার পূর্বে নয়। কেননা হাদীছে উক্ত তাকবীরগুলিকে স্পষ্টভাবেই قبل القراءة অর্থাৎ ‘ক্বিরাআতের পূর্বে’ বলা হয়েছে। এটা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকবীরে তাহরীমার পরে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকতেন ও তখন ‘ছানা’ (দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ) পাঠ করতেন।[57] অতএব ‘ছানা’ পড়ার পরে অতিরিক্ত তাকবীরগুলি দিলে ফরয তাকবীরে তাহরীমা থেকে এগুলিকে পৃথক করা সহজ হয়।
ছয় তাকবীর: হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ প্রথম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমার পরে ক্বিরাআতের পূর্বে পরপর তিনটি অতিরিক্ত তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে উঠে ক্বিরাআতের পরে রুকুর তাকবীর ছাড়াই অতিরিক্ত তিনটি তাকবীর দিয়ে থাকেন। বস্ত্ততঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছয় তাকবীরে ঈদের ছালাত আদায় করেছেন মর্মে ছহীহ বা যঈফ কোন স্পষ্ট মারফূ হাদীছ নেই। তবে কয়েকজন ছাহাবীর আমল বা ‘আছার’ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে স্পষ্টভাবে ছয় তাকবীরের কথা নেই। এরপরেও সেগুলি সবই ‘যঈফ’। যেমন আবু মূসা আশ‘আরী ও হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বর্ণিত ‘আছার’, যেখানে ‘জানাযার তাকবীরের ন্যায় চার তাকবীর’ বলা হয়েছে।[58] অনুরূপভাবে ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে ৫+৪ মোট ৯ তাকবীরের একটি ‘আছার’ মুসনাদে আব্দুর রাযযাক ও মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাতে এবং ইবনু আববাস ও মুগীরা ইবনে শো‘বাহ (রাঃ) হ’তে নয় তাকবীরের আরেকটি ‘আছার’ মুসনাদে আব্দুর রাযযাকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সবগুলিই ‘যঈফ’।[59]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর ‘আছার’টি মূলতঃ তাঁর নিজস্ব উক্তি। তিনি এটিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে সম্পর্কিত করেননি। উপরন্তু উক্ত রেওয়ায়াতের সনদ সকলেই ‘যঈফ’ বলেছেন।[60] সুতরাং ইবনু মাস‘উদ (রাঃ)-এর সঠিক আমল কি ছিল, সে ব্যাপারেও সন্দেহ থেকে যায়। এ বিষয়ে ইমাম বায়হাক্বী বলেন,
هذا رأى من جهة عبد الله رضى الله عنه والحديث المسند مع ما عليه من عمل المسلمين أولى أن يتبع و بالله التوفيق -
অর্থঃ ‘এটি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদের ‘ব্যক্তিগত রায়’ মাত্র। অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত মারফূ হাদীছ, যার উপরে মুসলমানদের আমল চালু আছে (অর্থাৎ বারো তাকবীর) তার উপরে আমল করাই উত্তম’।[61]
উল্লেখ্য যে, ছয় তাকবীর সাব্যস্ত করার জন্য ‘জানাযার চার তাকবীরের ন্যায়’ বলে দুই রাক‘আতে ৪+৪ মোট ৮ তাকবীর, তন্মধ্যে ১ম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা সহ ক্বিরাআতের পূর্বে চার তাকবীর এবং ২য় রাক‘আতে রুকুর তাকবীর সহ ক্বিরাআতের পরে চার তাকবীর বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে তাকবীরে তাহরীমা ও রুকুর মূল তাকবীর দু’টি বাদ দিলে অতিরিক্ত তিন তিন ছয়টি তাকবীর হয়। অথচ উক্ত হাদীছে ক্বিরাআতের আগে বা পরে বলে কোন কথা নেই। অনুরূপভাবে মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ্তে বর্ণিত ‘নয় তাকবীর’ থেকে তাকবীরে তাহরীমা এবং ১ম ও ২য় রাক‘আতের রুকুর তাকবীর দু’টি সহ মোট তিনটি মূল তাকবীর বাদ দিলে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবীর হয়। এভাবেই ব্যাখ্যা করে ছয় তাকবীর সাব্যস্ত করা হয়েছে।[62]
ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন, সবচেয়ে উত্তম হ’ল প্রথম রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে সাত এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে পাঁচ মোট বার তাকবীর দেওয়া। কারণ এর উপরে এসেছে অনেকগুলি মরফূ হাদীছ, যার কতকগুলি ‘ছহীহ’ ও কতকগুলি ‘হাসান’। বাকীগুলি ‘যঈফ’ হ’লেও এদের সমর্থনকারী। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, ৭ ও ৫ বারো তাকবীর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে ‘হাসান’ সূত্রে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, জাবের, আয়েশা, আবূ ওয়াক্বিদ, আমর ইবনু ‘আওফ প্রমুখ ছাহাবীগণ থেকে। কিন্তু শক্তিশালী বা দুর্বল কোন সূত্রে এর বিপরীত কিছুই বর্ণিত হয়নি।
দ্বিতীয় কারণ হ’ল বারো তাকবীরের উপরে আমল করেছেন মহান চার খলীফা হযরত আবুবকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)’।[63]
অতএব ১২ তাকবীরের স্পষ্ট ছহীহ মরফূ হাদীছের উপরে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের অনুসৃত সুন্নাতের উপরে সকলে আমল করলে সুন্নী মুসলমানগণ অন্ততঃ বৎসরে দু’টি ঈদের খুশীর দিনে ঐক্যবদ্ধ হ’য়ে ছালাত ও ইবাদত করতে পারতেন। কিন্তু দ্বীনের দোহাই দিয়েই আমরা দ্বীনদার মুসলমানদের বিভক্ত করে রেখেছি। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ছহীহ হাদীছের উপরে আমলের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!!
(১২) ঈদায়নের অন্যান্য মাসায়েল:
(ক) মুসলমানদের জাতীয় আনন্দ উৎসব মাত্র দু’টি, ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহা।[64] এক্ষণে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামে তৃতীয় আরেকটি ঈদ-এর প্রচলন ঘটানো নিঃসন্দেহে বিদ‘আত, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
(খ) দুই ঈদের দিন ছিয়াম পালন নিষিদ্ধ এবং আইয়ামে তাশরীক্বের তিনদিন ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহাজ্জ খানা-পিনার দিন।[65]
(গ) ঈদের দিন পরষ্পরে কুশল বিনিময়, খানাপিনা ও নির্দোষ খেলাধূলা: ঈদের দিন ছাহাবায়ে কেরাম পরষ্পরে সাক্ষাৎ হ’লে বলতেন ‘তাক্বাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ (অর্থঃ আল্লাহ আমাদের ও আপনার পক্ষ হ’তে কবুল করুন!)।[66] অতএব ‘ঈদ মোবারক’ বললেও সাথে সাথে উপরোক্ত দো‘আটি পড়া উচিত। ঈদের দিন এবং ঈদুল আযহার পরের তিনদিন পরষ্পরের বাড়ীতে খানাপিনা এবং নির্দোষ খেলাধুলা ও ইসলামী সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি করা যাবে।[67] অতএব উভয় ঈদের সরকারী ছুটি কমপক্ষে ছয়দিন থাকা উচিত। উল্লেখ্য যে, ঈদের খুশীতে গান-বাজনা, পটকাবাজি, মাইকবাজি, ক্যাসেটবাজি, চরিত্র বিধ্বংসী ভিডিও-সিডি প্রদর্শন, বাজে সিনেমা দেখা এবং খেলাধূলার নামে নারী-পুরুষের অবাধ সমাবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
(ঘ) ঈদের ক্বাযা: ‘যদি কেউ প্রথমে চাঁদ দেখতে না পেয়ে ছিয়াম রাখে ও পরে দিনের শেষে জানতে পারে, সে ব্যক্তি ছিয়াম ভঙ্গ করবে ও পরের দিন সকালে ঈদের ক্বাযা আদায় করবে’।[68] অনুরূপভাবে অন্য কোন বাধ্যগত কারণে কেউ ঈদের দিন ঈদের ছালাত আদায়ে ব্যর্থ হ’লে পরের দিন সকালে ক্বাযা আদায় করবে‘।[69]
[1]. মির‘আত ৫/২১-২২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩১৭-১৮।
[2]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩৪ ‘ঈদায়নের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।
[3]. বুখারী, মিশকাত হা/১৩৮১ ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘পরিচ্ছন্নতা ও তাকবীর’ অনুচ্ছেদ-৪৪; আল-মুগনী ২/২২৮ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৭ পৃঃ।
[4]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪০ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫১।
[5]. ফাৎহুল বারী ২/৫৫০-৫১ ‘ঈদায়েন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ২৫; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪০ পৃঃ।
[6]. আওনুল মা‘বূদ শরহ সুনানে আবুদাঊদ (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৭/১৯৮৭) ৩/৪৮৭; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৮ পৃঃ।
[7]. তাফসীর তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৮ পৃঃ।
[8]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১।
[9]. বায়হাক্বী, হাদীছ ছহীহ; ইরওয়াউল গালীল (বৈরুত: ১৪০৫/১৯৮৫) হা/৬৫০, ৩/১২৩ পৃঃ।
[10]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, সনদ ছহীহ, ইরওয়া ৩/১২১ পৃঃ; দারাকুৎনী হা/১৬৯৬, ১৭০০।
[11]. নায়ল ৪/২৩৬ পৃঃ; মির‘আত ৫/৭০ পৃঃ।
[12]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, সনদ ছহীহ, ইরওয়া ৩/১২৫ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪২-২৪৩ পৃঃ; নায়ল ৪/২৭৮ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫৪-৫৬ পৃঃ।
[13]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, বায়হাক্বী, সনদ ছহীহ, ইরওয়া ৩/১২৫ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪৩ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫৪-৫৬ পৃঃ।
[14]. যাদুল মা‘আদ (বৈরুত ১৪১৬/১৯৯৬) ২/৩৬১ পৃঃ; নায়ল ৪/২৫৭ পৃঃ।
[15]. তাফসীরে কুরতুবী, ২/৩০৭, ৩/২-৪; বায়হাক্বী ৩/৩১৬ পৃঃ।
[16]. বুখারী, তা‘লীক্ব, সনদ ছহীহ, ইরওয়া হা/৬৫১, ৩/১২৪ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ৪/২৭৪ পৃঃ।
[17]. ইমাম নববী, রওযাতুত ত্বালেবীন (বৈরুত ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯১) ২/৭১-৭২ ‘ছালাতুল ঈদের বিবরণ’ অধ্যায়; মির‘আত ৫/৫৩; ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) পৃঃ ১১৪।
[18]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত, হা/১৪২৬, ১৪৩১।
[19]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫১; নায়ল ৪/২৫১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩১৯ পৃঃ।
[20]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪২৬, ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৩৪২।
[21]. সুবুলুস সালাম ১/১৪০; মির‘আত ৫/২৭; নায়লুল আওত্বার ৪/২৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪০ পৃঃ।
[22]. মির‘আত ৫/৩১; বায়হাক্বী ৩/২৯৯; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪০ পৃঃ।
[23]. মির‘আত ৫/৭০ পৃঃ।
[24]. আল-মুগনী ২/২৪৪ পৃঃ।
[25]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৮৫।
[26]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৩১; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৩৪৭।
[27]. মির‘আত, ২/৩৩১; ঐ, ৫/৩১ পৃঃ।
[28]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৭-৩৮; মির‘আত ২/৩২৭; ঐ, ৫/২২ পৃঃ।
[29]. আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৪৮ সনদ ‘যঈফ’।
[30]. আল-মুগনী ২/২৩৫ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩১৮; ঐ, ১/২৩৭ পৃঃ।
[31]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩১৬; ঐ, ১/২৩৬ পৃঃ; নায়ল ৪/২৩১ পৃঃ।
[32]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪১৫৩ ‘শিকার ও যবহ সমূহ’ অধ্যায় ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
[33]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ২/২৪২ পৃঃ; মির‘আত ৫/৫৩ পৃঃ।
[34]. বায়হাক্বী ৩/২৯৩ পৃঃ; মির‘আত ৫/৫৪ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৪২ পৃঃ; বুখারী, মিশকাত হা/৭৯৮ ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ।
[35]. মির‘আত ২/৩৩৮, ৩৪১ পৃঃ; ঐ, ৫/৪৬, ৫১, ৫২ পৃঃ।
[36]. আবু দাঊদ হা/১১৪৯; ছহীহ আবুদাঊদ হা/১০১৮-১৯।
[37]. দারাকুৎনী (বৈরুতঃ ১৪১৭/১৯৯৬) হা/১৭০৪।
[38]. ইরওয়াউল গালীল হা/৬৩৯-এর ব্যাখ্যা, ৩/১০৭-১০৮ পৃঃ।
[39]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৪১; এখানে মিশকাতে ‘দারেমী’ লেখা হয়েছে, যেটা ভুল। কেননা দারেমীতে এ হাদীছ নেই; আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/৪৪২; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১০৬৪। এতদ্ব্যতীত ছহীহ আবুদাঊদে আয়েশা ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে ৪টি হাদীছ নং ১০১৮, ১০১৯, ১০২০, ১০২১ এবং ছহীহ ইবনু মাজাহতে রাসূলের অন্যতম মুওয়াযযিন সা‘দ আল-ক্বারায, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ও আয়েশা (রাঃ) হ’তে আরও ৩টি হাদীছ নং ১০৬২, ১০৬৩, ১০৬৫ বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, হাদীছগুলির কোন কোনটি সরাসরি ‘ছহীহ’ নয়। বরং ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে ‘ছহীহ’।
[40]. জামে তিরমিযী (দিল্লীঃ ১৩০৮ হিঃ), ১/৭০ পৃঃ; আলবানী, ছহীহ তিরমিযী, হা/৪৪২; ইবনু মাজাহ (বৈরুতঃ তাবি) হা/১২৭৯; মির‘আত ৫/৪৮ পৃঃ।
[41]. বায়হাক্বী (বৈরুতঃ তাবি), ৩/২৮৬ পৃঃ; মির‘আত, ২/৩৩৯ পৃঃ; ঐ, ৫/৪৮ পৃঃ।
[42]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৮২ পৃঃ; মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৫৫ পৃঃ।
[43]. মিশকাত হা/১৪৪১ -এর টীকা ১, ১/৪৫৩ পৃঃ।
[44]. দারাকুৎনী হা/১৭১২, ১৭১৪ ‘ঈদায়েন’ অধ্যায়; বায়হাক্বী ২/২৮৫ পৃঃ। হাদীছটির শেষাংশটি দারাকুৎনী ও বায়হাক্বীতে এসেছে। এতদ্ব্যতীত হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে আবুদাঊদ হা/১১৫১, আলবানী-ছহীহ আবুদাঊদ হা/১০২০; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১০৬৩।
[45]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৮২; মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৫৫ পৃঃ। ইমাম শাওকানী (রহঃ) ঈদায়নের অতিরিক্ত তাকবীর বিষয়ে ১০টি মতভেদ উল্লেখ করে ১২ তাকবীরকেই ‘সর্বাগ্রগণ্য’ ( أرجح الأقوال ) হিসাবে মন্তব্য করেছেন। দ্রঃ নায়ল ৪/২৫৭ পৃঃ।
[46]. আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ জামে‘ তিরমিযী (মদীনাঃ মাকতাবা সালাফিইয়াহ ১৩৮৪/১৯৬৪) ৩/৮৫ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৩৮ পৃঃ।
[47]. মির‘আত ৫/৪৬ পৃঃ।
[48]. মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আমীর ছান‘আনী, সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম (কায়রোঃ দারুর রাইয়ান ১৪০৭/১৯৮৭) হা/৪৬১ -এর ব্যাখ্যা, ২/১৪১-৪২ পৃঃ।
[49]. ইয়াহ্ইয়া বিন শারফ নববী, রওযাতুত ত্বালেবীন (বৈরুত: ১৪১২/১৯৯১) ‘ছালাতুল ঈদের বিবরণ’ অধ্যায় ২/৭১ পৃঃ ।
[50]. সাইয়েদ সাবেক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রোঃ দারুল ফাৎহ ১৪১২/১৯৯২) ১/২৩৯ পৃঃ।
[51]. তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৫৩৪ -এর ব্যাখ্যা, ৩/৮৩ পৃঃ।
[52]. মির‘আত, ২/৩৩৮ পৃঃ; ঐ, ৫/৪৬ পৃঃ।
[53]. ইরওয়াউল গালীল ৩/১১২ পৃঃ; জাওহারুন নাক্বী শরহ বায়হাক্বী ৩/২৮৭।
[54]. বায়হাক্বী ৩/২৯১ পৃঃ।
[55]. ইরওয়াউল গালীল ৩/১১৩ পৃঃ।
[56]. আবুদাঊদ, মিশকাত, হা/১৪৪৩।
[57]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৮১২।
[58]. আবুদাঊদ, মিশকাত, হা/১৪৪৩ হাদীছ যঈফ-আলবানী; হেদায়াতুর রুওয়াত হা/১৩৮৮, ২/১২১ পৃঃ; মির‘আত ৫/৪৬, ৫০-৫১ পৃঃ।
[59]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৮৬; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ (বোম্বাইঃ ১৯৭৯), ২/১৭৩ পৃঃ।
[60]. বায়হাক্বী, ৩/২৯০; নায়ল, ৪/২৫৪, ২৫৬; মির‘আত ৫/৫০-৫১ পৃঃ।
[61]. বায়হাক্বী, ৩/২৯১; মির‘আত ৫/৫১ পৃঃ।
[62]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৮৬, ৮৮ পৃঃ।
[63]. মির‘আত ৫/৫৩ পৃঃ।
[64]. আবুদাঊদ, মিশকাত, হা/১৪৩৯।
[65]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত, হা/২০৪৮; মুসলিম, মিশকাত হা/২০৫০।
[66]. আল-মুগনী ২/২৫৯ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩১৫ পৃঃ; ঐ, ১/২৪২ পৃঃ।
[67]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩২২ পৃঃ; ঐ, ১/২৪১ পৃঃ।
[68]. আহমাদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, সনদ ছহীহ, ইরওয়া হা/৬৩৪।
[69]. ঐ, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪১ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫০-৫১ পৃঃ ।
(২) প্রচলন: ঈদায়নের ছালাত ২য় হিজরী সনে ছিয়াম ফরয হওয়ার সাথে সাথে চালু হয়। ঈদায়নের ছালাত কিতাব ও সুন্নাত ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত। এটি সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমৃত্যু নিয়মিতভাবে এটি আদায় করেছেন এবং ছোট-বড় নারী-পুরুষ সকল সক্ষম মুসলমানকে ঈদের জামা‘আতে শরীক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
(৩) করণীয়: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এদিন সর্বোত্তম পোষাক পরিধান করতেন ও স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে ঈদগাহে যেতেন।[1] (খ) তিনি এক পথে যেতেন ও অন্য পথে ফিরতেন।[2] (গ) মুক্বীম-মুসাফির সবাই ঈদের দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবেন। (ঘ) এ দিন সকালে মিসওয়াক সহ ওযূ-গোসল করে তৈল-সুগন্ধি মেখে উত্তম পোষাকে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে তাকবীর দিতে দিতে রওয়ানা হওয়া মুস্তাহাব।[3] (ঙ) জামা‘আত ছুটে গেলে একাকী বা জামা‘আত সহকারে ঈদের তাকবীর সহ দু’রাক‘আত পড়বে।[4] (চ) ঈদগাহে আসতে না পারলে বাড়ীতে মেয়েরা সহ বাড়ীর সকলকে নিয়ে তাকবীর সহকারে জামা‘আতের সাথে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে।[5]
(৪) ঈদায়নের সময়কাল: ঈদুল আযহায় সূর্য এক ‘নেযা’ পরিমাণ ও ঈদুল ফিৎরে দুই ‘নেযা’ পরিমাণ উঠার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদের ছালাত আদায় করতেন। এক ‘নেযা’ বা বর্শার দৈর্ঘ্য হ’ল তিন মিটার বা সাড়ে ছয় হাত।[6] অতএব ঈদুল আযহার ছালাত সূর্যোদয়ের পরপরই যথাসম্ভব দ্রুত শুরু করা উচিত।
(৫) ফযীলত ও নিয়ত: ঈদায়নের ছালাত সকল নফল ছালাতের মধ্যে সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ।[7] হজ্জ ও ওমরাহর ‘তালবিয়াহ’ ব্যতীত ঈদায়েন সহ কোন ইবাদতের জন্য নিয়ত মুখে বলতে হয় না, বরং হৃদয়ে সংকল্প করতে হয়।[8]
(৬) ঈদায়নের তাকবীর ধ্বনি:
ঈদায়নের তাকবীর ধ্বনি করা সুন্নাত। এটি হ’ল ‘ঈদের নিদর্শন’ ( شعار العيد )। ঈদুল ফিৎরে রামাযানের মাসব্যাপী ছিয়াম পূর্ণ করা এবং আল্লাহ পাকের বিশেষ অনুগ্রহ ও হেদায়াত প্রাপ্তির শুকরিয়া স্বরূপ এটা করতে হয়। আল্লাহ বলেন, وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘(ছিয়াম ফরয করা হয়েছে এজন্য যে,) আল্লাহ তোমাদের হেদায়াত দান করেছেন সেজন্য তোমরা আল্লাহ বড়ত্ব ঘোষণা করবে এবং তোমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। অতঃপর ঈদুল আযহাতে কুরবানীর পশুগুলিকে মানুষের অনুগত করে দেওয়া ও শিরক থেকে মুক্ত হয়ে স্রেফ আল্লাহর নামে জীবন উৎসর্গ করার হেদায়াত প্রাপ্তির শুকরিয়া স্বরূপ (হজ্জ ২২/৩৭) আল্লাহর নিরংকুশ তাওহীদ ও বড়ত্ব ঘোষণা করে বার বার তাকবীর ধ্বনি করতে হয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় চাচা আববাস, চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, ফযল ইবনে আববাস, জামাতা আলী, তার ভাই জা‘ফর, নাতি হাসান-হোসায়েন, গোলাম যায়েদ ইবনে হারেছাহ, তৎপুত্র উসামা ইবনে যায়েদ ও আয়মান ইবনে উম্মে আয়মান প্রমুখ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদায়নের সকালে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর ও তাহলীলসহ ঈদগাহ অভিমুখে ঘর হ’তে রওয়ানা দিতেন ও এইভাবে তিনি ঈদগাহ পর্যন্ত পৌঁছতেন।[9] তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম ইবনু শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ) বলেন যে, লোকেরা ঈদের দিন সকালে তাকবীর ধ্বনি করতে করতে ঈদগাহে আসত। অতঃপর ইমাম এলে তাকবীর বন্ধ করত। এ সময় ইমামের সাথে তারাও তাকবীর দিত।[10] নিতান্ত কোন ওযর না থাকলে পায়ে হেঁটেই তাকবীর ধ্বনি সহকারে ঈদগাহে আসতে হয়।[11]
ছাহাবায়ে কেরাম থেকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ রেওয়ায়াত অনুযায়ী আরাফার দিন ফজর থেকে মিনার শেষ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ই যিলহাজ্জ ফজর থেকে ১৩ ই যিলহাজ্জ ‘আইয়ামে তাশরীক্ব’-এর শেষ দিন আছর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত ছালাত শেষে কমপক্ষে তিন বার করে ও অন্যান্য সকল সময়ে উচ্চকণ্ঠে তাকবীর ধ্বনি করা সুন্নাত। ঈদুল ফিৎরের দিন সকালে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়া থেকে খুৎবা শুরুর আগ পর্যন্ত তাকবীর ধ্বনি করবে।[12]
তাকবীরের শব্দাবলী : ইমাম মালেক ও আহমাদ (রহঃ) বলেন, তাকবীরের শব্দ ও সংখ্যার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ওমর, আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) ইবনে আববাস প্রমুখ ছাহাবীগণ তাকবীর দিতেন ‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, ওয়া লিল্লা-হিল হাম্দ’।[13] অনেক বিদ্বান পড়েছেন, ‘আল্লা-হু আকবার কাবীরা, ওয়াল হামদু লিল্লা-হি কাছীরা, ওয়া সুবহানাল্লা-হি বুকরাতাঁও ওয়া আছীলা’। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এটাকে ‘সুন্দর’ বলেছেন।[14]
সূরায়ে বাক্বারাহ্ ১৮৫ ও হজ্জ ৩৭ নং আয়াতের মর্ম অনুযায়ী তাকবীর ধ্বনির গুরুত্ব সর্বাধিক। মহিলাগণও সরবে (তবে উচ্চকণ্ঠে নয়) তাকবীর পাঠ করবেন।[15] আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীগণ আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলিতে বাজারে গমন করে তাকবীর ধ্বনি করতেন। লোকেরাও তাঁদের সাথে জোরে জোরে তাকবীর ধ্বনি করত। ওমর ফারূক্ব (রাঃ) মিনাতে নিজের তাঁবুতে এত জোরে তাকবীর দিতেন যে, পার্শ্ববর্তী মসজিদের মুছল্লী ও বাজারের লোকেরা সবাই তাঁর সাথে তাকবীর ধ্বনি করে উঠত, যা এলাকাকে মুখর করে তুলত।[16]
(৭) ঈদায়নের ছালাত আদায়ের পদ্ধতি:
কোনরূপ আযান-এক্বামত ছাড়াই প্রথমে ক্বিবলামুখী দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে বাম হাতের উপরে ডান হাত বুকের উপরে বাঁধবে। অতঃপর ‘ছানা’ (দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ) পড়বে। অতঃপর ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ধীর-স্থিরভাবে দুই তাকবীরের মাঝে স্বল্প বিরতিসহ পরপর সাতটি তাকবীর দিবে। প্রতি তাকবীরে হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে, অতঃপর পূর্বের ন্যায় বুকে বাঁধবে। তাকবীর শেষ হ’লে প্রথম রাক‘আতে আ‘ঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পূর্ণভাবে পড়ে ইমাম হ’লে সরবে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বে। মুক্তাদী হ’লে নীরবে কেবল সূরা ফাতিহা ইমামের পিছে পিছে পড়বে ও ইমামের ক্বিরাআত শুনবে। অতঃপর দ্বিতীয় রাক‘আতে উঠে দাঁড়িয়ে পূর্বের নিয়মে ধীর-স্থিরভাবে দুই তাকবীরের মাঝে স্বল্প বিরতিসহ প্রথমে পরপর পাঁচটি তাকবীর দিবে। তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ অন্তে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বে।
দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বিরাআতের শুরুতে ‘আঊযুবিল্লাহ’ পড়তে হয় না। কেবল ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তে হয়। ঈদায়নের ছালাতে ১ম ও ২য় রাক‘আতে যথাক্রমে সূরা আ‘লা ও গাশিয়াহ অথবা সূরা ক্বাফ ও ক্বামার পড়া সুন্নাত।[17]
ঈদায়নের জন্য প্রথমে ছালাত ও পরে খুৎবা প্রদান করতে হয়।[18] তার আগে পিছে কোন ছালাত নেই, আযান বা এক্বামত নেই। ঈদগাহে বের হবার সময় উচ্চকণ্ঠে তাকবীর এবং পৌঁছার পরেও তাকবীর ধ্বনি ব্যতীত কাউকে জলদি আসার জন্য আহবান করাও ঠিক নয়।[19] কোন কোন ঈদগাহে ইমাম পৌঁছে যাওয়ার পরেও ছালাতের পূর্বে বিভিন্নজনে বক্তৃতা করে থাকেন। এটা সুন্নাত বিরোধী কাজ।
খুৎবা: ঈদায়নের ছালাতের পর খুৎবা দেওয়া ও তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা সুন্নাত। ঈদায়নের খুৎবা একটি হওয়াই ছহীহ হাদীছ সম্মত। যেমনঃ
عَن أَبِىْ سَعِيْدِنِ الْخُدْرِىِّ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى إِلَى الْمُصَلَّى فَأَوَّلُ شَيْئٍ يَّبْدَأُ بِهِ الصَّلاَةُ ثُمَّ يَنْصَرِفُ فَيَقُوْمُ مُقَابِلَ النَّاسِ وَالنَّاسُ جُلُوْسٌ عَلَى صُفُوْفِهِمْ فَيَعِظُهُمْ وَ يُوْصِيْهِمْ وَيَأْمُرُهُمْ وَ إِنْ كَانَ يُرِيْدُ أَنْ يَّقْطَعَ بَعْثًا قَطَعَهُ اَوْ يَأْمُرَ بِشَيْئٍ أَمَرَ بِهِ ثُمَّ يَنْصَرِفُ، متفق عليه -
‘আবুসাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহার দিনে ঈদগাহের দিকে বের হ’তেন। (ঈদগাহে পৌঁছে) তিনি প্রথমে ছালাত আদায় করতেন। অতঃপর ছালাত শেষে মুছল্লীদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন, মুছল্লীরা তখন নিজ নিজ কাতারে বসা থাকত। তিনি তাদেরকে উপদেশ দিতেন, নছীহত করতেন এবং নির্দেশ দিতেন। কোথাও সৈন্য প্রেরণের ইচ্ছা করলে বাছাই করতেন অথবা কোন বিষয়ে নির্দেশ দেওয়ার থাকলে নির্দেশ দিতেন। অতঃপর বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করতেন’।[20]
মিশকাতে সংকলিত উপরোক্ত হাদীছ ও একই মর্মে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত পরবর্তী হাদীছ (হা/১৪২৯) দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঈদায়নের খুৎবা একটিই ছিল। মাঝখানে বসে দু’টি খুৎবা প্রদান সম্পর্কে ইবনু মাজাহ (হা/১২৮৯) ও বাযযারে কয়েকটি ‘যঈফ’ হাদীছ রয়েছে, যা ছহীহ হাদীছ সমূহের বিপরীতে গ্রহণযোগ্য নয়। ছাহেবে সুবুলুস সালাম ও ছাহেবে মির‘আত বলেন, ‘প্রচলিত দুই খুৎবার নিয়মটি মূলতঃ জুম‘আর দুই খুৎবার উপরে ক্বিয়াস করেই চালু হয়েছে। এটি রাসূলের ‘আমল’ দ্বারা এবং কোন নির্ভরযোগ্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়’।[21] খুৎবা শেষে বসে দু’হাত তুলে সকলকে নিয়ে দো‘আ করার রেওয়াজটিও হাদীছ সম্মত নয়। বরং এটিই প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের ছালাত শেষে দাঁড়িয়ে কেবলমাত্র একটি খুৎবা দিয়েছেন, যার মধ্যে আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, তাকবীর, দো‘আ সবই ছিল।[22] ইবনু মাজাহ কর্তৃক যঈফ সনদে রাসূলের মুওয়াযযিন সা‘দ আল-ক্বারায (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের খুৎবার মধ্যে বেশী বেশী তাকবীর ধ্বনি করতেন’।[23] এ সময় মুছল্লীগণ ইমামের সাথে সাথে তাকবীর ধ্বনি করবেন’।[24] এটি কুরআনী নির্দেশের অনুকূলে। কেননা ছিয়াম ফরয করার উদ্দেশ্য বর্ণনায় আল্লাহ বলেন, وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ এটা এজন্য যে, তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করবে একারণে যে, তিনি তোমাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)।
অনেক মুছল্লী খুৎবার সময় অন্যদিকে মনোযোগ দেন, অনেকে চলে যান, অনেক ঈদগাহে খুৎবার সময় পয়সা তোলা হয়, এগুলি খুৎবা অবমাননার শামিল। কেননা খুৎবার সময় অন্য কাজে লিপ্ত হওয়া, পরষ্পরে কথা বলা, এমনকি অন্যকে ‘চুপ কর’ একথা বলাও নিষেধ।[25] সবচেয়ে বড় কথা, ঐ ব্যক্তি খুৎবা শোনার ছওয়াব ও বরকত থেকে মাহরূম হয় এবং সুন্নাত তরক করার জন্য গোনাহগার হয়।
(৮) মহিলাদের অংশগ্রহণ:
ঈদায়নের জামা‘আতে পুরুষদের পিছনে পর্দার মধ্যে মহিলাগণ প্রত্যেকে বড় চাদরে আবৃত হয়ে যোগদান করবেন। প্রত্যেকের চাদর না থাকলে একজনের চাদরে জড়িয়ে দু’জন আসবেন। খত্বীব ছাহেব নারী-পুরুষ সকলকে লক্ষ্য করে মাতৃভাষায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে খুৎবা প্রদান করবেন। ঋতুবতী মহিলাগণ কেবল খুৎবা শ্রবণ করবেন এবং মুখে তাকবীর, তাহলীল, আমীন ইত্যাদি বলবেন। যেমন,
عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ أُمِرْنَا أَنْ نُّخْرِجَ الْحُيَّضَ يَوْمَ الْعِيْدَيْنِ وَذَوَاتِ الْخُدُوْرِ فَيَشْهَدْنَ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَ دَعْوَتَهُمْ وَ تَعْتَزِلُ الْحُيَّضُ عَنْ مُّصَلاَّهُنَّ قَالَتِ امْرَأَةٌ يَّا رَسُوْلَ اللهِ إِحْدَانَا لَيْسَ لَهَا جِلْبَابٌ قَالَ لِتُلْبِسْهَا صَاحِبَتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا، متفق عليه -
‘উম্মে ‘আত্বিইয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হ’ল, আমরা যেন ঋতুবতী ও পর্দানশীন মহিলাদেরকে দুই ঈদের দিনে বের করে নিয়ে যাই। যেন তারা মুসলমানদের জামা‘আত ও দো‘আয় শরীক হ’তে পারে। তবে ঋতুবতী মহিলারা একদিকে সরে বসবে। জনৈকা মহিলা তখন বলল, আমাদের অনেকের বড় চাদর নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার সাথী তাকে নিজের চাদর দ্বারা আবৃত করে নিয়ে যাবে’।[26]
মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, হাদীছের শেষে বর্ণিত دعوة المسلمين কথাটি ‘আম’। এর দ্বারা ইমামের খুৎবা ও ওয়ায-নছীহত শ্রবণে শরীক হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। কেননা ঈদায়নের ছালাতের পরে প্রচলিত নিয়মে সম্মিলিত ভাবে হাত তুলে দো‘আ করার প্রমাণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন দলীল নেই।[27]
(৯) ময়দানে ঈদের জামা‘আত:
ময়দানে ঈদের জামা‘আত করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীন সর্বদা ঈদের ছালাত ময়দানে পড়তেন। অন্যান্য মসজিদের চেয়ে এক হাযার গুণ বেশী নেকী এবং অতি নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কখনো মসজিদে নববীতে ঈদের ছালাত আদায় করেননি। ঈদের এই ময়দানটি ছিল মদীনার মসজিদে নববীর পূর্ব দরজা বরাবর মাত্র পাঁচশ’ গজ ( الف ذراع ) দূরে ‘বাত্বহান’ সমতল ভূমিতে অবস্থিত।[28] একটি ‘যঈফ’ বর্ণনা অনুযায়ী তিনি একবার মাত্র বৃষ্টির কারণে মসজিদে নববীতে ঈদের ছালাত আদায় করেছেন।[29] অতএব বৃষ্টি কিংবা ভীতি বা অন্য কোন বাধ্যগত কারণে ময়দানে যাওয়া অসম্ভব হ’লে মসজিদে ঈদের জামা‘আত করা যাবে।[30] কিন্তু বায়তুল্লাহ শরীফ ব্যতীত অন্য কোথাও বিনা কারণে বড় মসজিদের দোহাই দিয়ে সেখানে ঈদের ছালাত আদায় করা সুন্নাত বিরোধী কাজ।
(১০) জুম‘আ, ঈদ ও আক্বীক্বা একই দিনে:
জুম‘আ ও ঈদ একই দিনে হওয়াতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টিই পড়েছেন। তবে যারা ঈদ পড়েছেন, তাদের জন্য জুম‘আ অপরিহার্য করেননি।[31] অনুরূপভাবে আক্বীক্বা ও কুরবানী একই দিনে হ’লে এবং দু’টিই করা সাধ্যে না কুলালে আক্বীক্বা অগ্রাধিকার পাবে। কেননা সাত দিনে আক্বীক্বা করাই ছহীহ হাদীছ সম্মত।[32]
(১১) ঈদায়নের ছালাতে অতিরিক্ত তাকবীর:
প্রথম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা ও ছানা পড়ার পরে ক্বিরাআতের পূর্বে সাত ও দ্বিতীয় রাক‘আতে ছালাতের তাকবীর ব্যতীত ক্বিরাআতের পূর্বে পাঁচ মোট বারো তাকবীর দেওয়া সুন্নাত। যদি কেউ ভুলে যায় ও কিরা‘আত শুরু করে দেয়, তাহ’লে পুনরায় তাকবীর দিতে হবে না।[33] যদি গণনায় কমবেশী হয়ে যায়, তাতে সিজদায়ে সহো লাগে না। দুই তাকবীরের মাঝে স্বল্প বিরতি সহ ধীরে-সুস্থে প্রতিটি তাকবীর দিবে। প্রতি তাকবীরে দু’হাত উঠাবে ও বাম হাতের উপর ডান হাত বুকে বাঁধবে।[34]
চার খলীফা ও মদীনার শ্রেষ্ঠ সাত জন তাবেঈ ফক্বীহ সহ প্রায় সকল ছাহাবী, তাবেঈ, তিন ইমাম ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ও মুজতাহিদ ইমামগণ এবং ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর দুই প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রহঃ) বারো তাকবীরের উপরে আমল করতেন। ভারতের দু’জন খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী ও আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী বারো তাকবীরকে সমর্থন করেছেন।[35]
বারো তাকবীর সম্পর্কে ছহীহ, হাসান ও যঈফ সনদে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ তিনটি ছহীহ হাদীছ নিম্নে প্রদত্ত হ’লঃ
(১) মা আয়েশা (রাঃ) বলেন,
كان رسولُ الله صلى الله عليه وسلم يُكَبِّرُ فى الفِطْرِ والأَضْحَى فى الأُوْلَى سَبْعَ تكبيراتٍ وفى الثانيةِ خمسًا سِوَى تكبيرتَى الركوعِ رواه ابوداؤد، وفى الدارقطنى : سِوَى ةكبيرةٍ الإِسْتِفْتَاحِ -
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহাতে প্রথম রাক‘আতে সাত তাকবীর ও দ্বিতীয় রাক‘আতে পাঁচ তাকবীর দিতেন রুকুর তাকবীর ব্যতীত’।[36] দারাকুৎনীর বর্ণনায় এসেছে ‘তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’।[37]
শায়খ আলবানী বলেন, অত্র হাদীছের সনদে ইবনু লাহী‘আহ থাকার কারণে অনেকে হাদীছটিকে ‘যঈফ’ বলেছেন। কিন্তু যখন তিন আব্দুল্লাহ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব এবং আব্দুল্লাহ আল-মুক্বরী তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করেন, তখন সেটি ‘ছহীহ’ হিসাবে গণ্য হয়। আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত অত্র হাদীছটি আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব বর্ণনা করেছেন ইবনু লাহী‘আহ থেকে তিনি খালেদ ইবনু ইয়াযীদ থেকে। অতএব হাদীছটির সনদ ছহীহ।[38]
২ নং হাদীছ:
عن كثير بن عبد الله عن أبيه عن جده أَنَّ النبىَّ صلى الله عليه و سلم كَبَّرَ فِى الْعِيْدَيْنِ فِى الأُوْلَى سَبْعًا قَبْلَ الْقِرَاءََةِ وَ فِى الآخِرَةِ خَمْسًا قَبْلَ الْقِرَاءََةِ، رواه الترمذى وابن ماجه -
অনুবাদঃ কাছীর ইবনে আব্দুল্লাহ স্বীয় পিতা হ’তে তিনি স্বীয় দাদা ‘আমর ইবনে ‘আওফ আল-মুযানী (বদরী ছাহাবী) হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের প্রথম রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে সাত ও দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে পাঁচ তাকবীর দিতেন’।[39]
হাদীছটি সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী বলেন,
حديث جد كثير حديث حسن و هو أحسن شيئ روى فى هذا الباب عن النبى صلى الله عليه و سلم- قال ابو عيسى سألت محمدا يعنى البخارى عن هذا الحديث فقال ليس فى هذا الباب شيئ أصح من هذا و به أقول -
অর্থঃ হাদীছটির সনদ ‘হাসান’ এবং এটিই ঈদায়নের অতিরিক্ত তাকবীর সম্পর্কে বর্ণিত ‘সর্বাধিক সুন্দর’ বর্ণনা’। তিরমিযী বলেন, এটাই মদীনাবাসীদের আমল এবং একথাই বলেন ইমাম মালেক, শাফেঈ, আহমাদ ও ইসহাক্ব প্রমুখ।[40] তিনি আরও বলেন যে, আমি এ সম্পর্কে আমার উস্তায ইমাম বুখারীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ঈদায়নের ছালাতের অতিরিক্ত তাকবীর সম্পর্কে এর চাইতে অধিক আর কোন ছহীহ রেওয়ায়াত নেই’।[41] তবে ছাহেবে তুহফা ও ছাহেবে মির‘আত বলেন, বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে তিরমিযী একে ‘হাসান’ বলেছেন’।[42] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, হাদীছটির সনদ ‘খুবই যঈফ’। কিন্তু বহু ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে হাদীছটি শক্তিশালী হয়েছে’।[43]
৩ নং হাদীছ:
عن عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده أَنَّ رسولَ الله صلى الله عليه و سلم كَبَّرَ فِى الْعِيْدَيْنِ الْأَضْحَى وَالْفِطْرَ ثِنْتَىْ عَشَرَةَ تَكْبِيْرَةً فِى الْأُوْلَى سَبْعًا وَفِي الْأَخِيْرَةِ خَمْسًا سِوَى تَكْبِيْرَةِ الْإِحْرَامِ، وفى رواية : سِوَى تَكْبِيْرَةِ الصَّلاَةِ، رواه الدارقطنى والبيهقى -
অনুবাদ: ‘আমর ইবনে শু‘আইব তার পিতা হ’তে তিনি তার দাদা আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিৎরে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত প্রথম রাক‘আতে সাতটি ও শেষ রাক‘আতে পাঁচটি (অতিরিক্ত) তাকবীর দিতেন’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘ছালাতের তাকবীর’ ব্যতীত।[44]
অত্র হাদীছটি সম্পর্কে ছাহেবে তুহফা ও ছাহেবে মির‘আত উভয়ে বলেন, الظاهر أن حديث عبد الله بن عمرو أصح شيئ فى الباب ‘সনদ হিসাবে এটা পরিষ্কার যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর বর্ণিত অত্র হাদীছটিই এ বিষয়ে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীছ’।[45]
শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী ও তাঁর উসতায আলী ইবনুল মাদীনী হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন। আল্লামা নীমভী বলেন, হাদীছটির সনদের মূল কেন্দ্রবিন্দু ( مدار ) হ’লেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান আত-ত্বায়েফী। তাঁকে কোন কোন বিদ্বান ‘যঈফ’ বলেছেন। ছাহেবে মির‘আত বলেন, আহমাদ, বুখারী, আলী ইবনুল মাদীনী প্রমুখ বিদ্বানগণের ন্যায় হাদীছ শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিবর্গের ( جهابذة ) বক্তব্যের পরে অন্যদের বক্তব্যের প্রতি দৃকপাত না করলেও চলে। মুজতাহিদ ইমামগণ এ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন। ইবনু ‘আদী বলেন, আমর ইবনু শু‘আইব থেকে আব্দুর রহমান আত-ত্বায়েফীর সকল বর্ণনা সুদৃঢ় ( مسةقيمة )। হাফেয ইরাক্বী বলেন, إسناده صالح ‘অত্র হাদীছের সনদ দলীলযোগ্য’। তিরমিযীর ভাষ্যকার ছাহেবে তুহফা বলেন,
فالحاصل أن حديث عبد الله بن عمرو حسن صالح الاحتجاج و يؤيده الأحاديث التى أشار إليها الترمذى -
‘সারকথা এই যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদীছটি ‘হাসান’ ও দলীল গ্রহণের যোগ্য এবং একে শক্তিশালী করে ঐ সকল হাদীছ, যেগুলির দিকে তিরমিযী ইঙ্গিত করেছেন’।[46]
তাকবীরে তাহরীমা সহ কি-না?
এক্ষণে উক্ত বারো তাকবীর ‘তাকবীরে তাহরীমা’ সহ, নাকি ওটা বাদে, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইমাম শাফেঈ, আওযাঈ, ইবনু হাযম প্রমুখ বিদ্বানগণ তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত প্রথম রাক‘আতে সাত তাকবীর বলেন। পক্ষান্তরে ইমাম মালেক ও আহমাদ তাকবীরে তাহরীমা সহ সাত তাকবীর বলেন।[47]
(১) এ বিষয়ে বুলূগুল মারামের ভাষ্যকার ছাহেবে সুবুলুস সালাম বলেন,
ويحتمل أنها بتكبيرة الافتتاح و أنها من غيرها والأوضح أنها من دونها ... و قال : الأولى العمل بحديث عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده و أنه أشفى شيئ فى الباب ‘এটি তাকবীরে তাহরীমা সহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এটি তা ব্যতীত। বরং এটাই অধিকতর স্পষ্ট যে, এটি তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত।... তিনি বলেন, সর্বোত্তম হ’ল আমর ইবনে শু‘আইব কর্তৃক তার পিতা, অতঃপর তার দাদা খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছের উপরে আমল করা। এটিই অত্র বিষয়ে সর্বাধিক হৃদয় শীতলকারী বস্ত্ত’।[48]
(২) ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,
أن يقرأ دعاء الاستفتاح عقب الإحرام كغيرها ثم يكون فى الأولى سبع تكبيرات سوى تكبيرة الإحرام والركوع وفى الثانية خمسًا سوى تكبيرة القيام -
‘অন্যান্য ছালাতের ন্যায় তাকবীরে তাহরীমার পরে দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ (‘ছানা’) পাঠের পর তাকবীরে তাহরীমা ও তাকবীরে রুকূ ব্যতিরেকে সাত তাকবীর দিবে এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বওমার তাকবীর বাদে পাঁচ তাকবীর দিবে’।[49]
(৩) ছাহেবে ফিক্বহুস সুন্নাহ বলেন,
صلاة العيد ركعةان يسن فيهما أن يكبر المصلى قبل القراءة فى الركعة الأولى سبع ةكبيراة بعد ةكبيرة الإحرام وفى الثانية خمس ةكبيراة غير ةكبيرة القيام مع رفع اليدين مع كل ةكبيرة -
‘ঈদের ছালাত দু’রাক‘আত। এতে সুন্নাত হ’ল প্রথম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমার পরে ও ক্বিরাআতের পূর্বে সাত তাকবীর ও দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বওমার তাকবীর ব্যতীত পাঁচ তাকবীর দেওয়া এবং প্রতি তাকবীরে দুই হাত উঠানো’।[50]
(৪) তিরমিযীর ভাষ্যকার ছাহেবে তুহফা বলেন, واحتج من قال إن تكبيرة الإحرام معدودة من السبع فى الأولى بإطلاق الأحاديث - ‘যারা তাকবীরে তাহরীমাকে প্রথম রাক‘আতের সাত তাকবীরের মধ্যে গণ্য করেছেন, তারা হাদীছ সমূহের ‘মুত্বলাক্ব’ বা সাধারণ (সাত) শব্দ থেকে দলীল নিয়েছেন’।[51] অথচ উছূলে হাদীছের নিয়ম অনুযায়ী ‘মুত্বলাক্ব’ বা ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছের উপরে বিস্তারিত হাদীছ অগ্রগণ্য। যা দারাকুৎনীতে ১৭১২ ও ১৭১৪ নং হাদীছে আমর ইবনে শু‘আইব তার পিতা ও দাদা হ’তে বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে দারাকুৎনী ১৭০৪ নং হাদীছে আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, سِوَى تَكْبِيْرَةِ الْإِسْتِفْتَاحِ ‘তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’।
(৫) মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন, الأظهرُ بَلِ الْمُتَعَيَّنُ أَنَّهَا من دونها ‘এটাই সর্বাধিক স্পষ্ট বরং নির্দিষ্ট যে, ওটা তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’।[52] কেননা তাকবীরে তাহরীমা হ’ল ফরয। যা সকল ছালাতেই দিতে হয়। আর এগুলি হ’ল অতিরিক্ত বা নফল তাকবীর। যা কেবল ঈদের ছালাতে দিতে হয়।
(৬) তাঁদের আরেকটি দলীল হ’ল আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) -এর কয়েকটি ‘আছার’, যার বর্ণনাসূত্র ছহীহ হ’লেও তা ৭, ৯, ১১, ১২, ১৩ মর্মে পরষ্পরের বিরোধী।[53] অতএব একজন ছাহাবীর পরষ্পর বিরোধী আমলের বিপরীতে রাসূলের স্পষ্ট ছহীহ মারফূ‘ হাদীছ নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য। তাছাড়া এটা স্পষ্ট যে, আববাস (রাঃ)-এর বংশধর আববাসীয় খলীফাগণ সকলে ১২ তাকবীরের উপরে আমল করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নিয়মিত আমল ১২ তাকবীরের উপরেই ছিল।[54]
(৭) শায়খ আলবানী উক্ত তাকবীর সমূহকে ‘ঈদায়নের সাথে খাছ অতিরিক্ত তাকবীর’ হিসাবে গণ্য করেছেন।[55] এতএব সাময়িক অতিরিক্ত তাকবীর কখনো নিয়মিত ফরয তাকবীরে তাহরীমা ও তাকবীরে ছালাত-এর সাথে যুক্ত হ’তে পারে না।
(৮) কূফার গবর্ণর সাঈদ ইবনুল ‘আছ হযরত আবু মূসা আশ‘আরীকে ঈদায়নের তাকবীর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিভাবে দিয়েছিলেন, সেকথা জিজ্ঞেস করেন।[56] তিনি নিশ্চয়ই সেখানে তাকবীরে তাহরীমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেননি, যা সকল ছালাতেই ফরয। বরং ‘অতিরিক্ত তাকবীর’ ভেবেই তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, এগুলি কিভাবে দিতে হবে সেটা জানার জন্য।
(৯) উক্ত তাকবীরগুলি ছিল ক্বিরাআতের পূর্বে, ছানার পূর্বে নয়। কেননা হাদীছে উক্ত তাকবীরগুলিকে স্পষ্টভাবেই قبل القراءة অর্থাৎ ‘ক্বিরাআতের পূর্বে’ বলা হয়েছে। এটা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকবীরে তাহরীমার পরে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকতেন ও তখন ‘ছানা’ (দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ) পাঠ করতেন।[57] অতএব ‘ছানা’ পড়ার পরে অতিরিক্ত তাকবীরগুলি দিলে ফরয তাকবীরে তাহরীমা থেকে এগুলিকে পৃথক করা সহজ হয়।
ছয় তাকবীর: হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ প্রথম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমার পরে ক্বিরাআতের পূর্বে পরপর তিনটি অতিরিক্ত তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে উঠে ক্বিরাআতের পরে রুকুর তাকবীর ছাড়াই অতিরিক্ত তিনটি তাকবীর দিয়ে থাকেন। বস্ত্ততঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছয় তাকবীরে ঈদের ছালাত আদায় করেছেন মর্মে ছহীহ বা যঈফ কোন স্পষ্ট মারফূ হাদীছ নেই। তবে কয়েকজন ছাহাবীর আমল বা ‘আছার’ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে স্পষ্টভাবে ছয় তাকবীরের কথা নেই। এরপরেও সেগুলি সবই ‘যঈফ’। যেমন আবু মূসা আশ‘আরী ও হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বর্ণিত ‘আছার’, যেখানে ‘জানাযার তাকবীরের ন্যায় চার তাকবীর’ বলা হয়েছে।[58] অনুরূপভাবে ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে ৫+৪ মোট ৯ তাকবীরের একটি ‘আছার’ মুসনাদে আব্দুর রাযযাক ও মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাতে এবং ইবনু আববাস ও মুগীরা ইবনে শো‘বাহ (রাঃ) হ’তে নয় তাকবীরের আরেকটি ‘আছার’ মুসনাদে আব্দুর রাযযাকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সবগুলিই ‘যঈফ’।[59]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর ‘আছার’টি মূলতঃ তাঁর নিজস্ব উক্তি। তিনি এটিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে সম্পর্কিত করেননি। উপরন্তু উক্ত রেওয়ায়াতের সনদ সকলেই ‘যঈফ’ বলেছেন।[60] সুতরাং ইবনু মাস‘উদ (রাঃ)-এর সঠিক আমল কি ছিল, সে ব্যাপারেও সন্দেহ থেকে যায়। এ বিষয়ে ইমাম বায়হাক্বী বলেন,
هذا رأى من جهة عبد الله رضى الله عنه والحديث المسند مع ما عليه من عمل المسلمين أولى أن يتبع و بالله التوفيق -
অর্থঃ ‘এটি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদের ‘ব্যক্তিগত রায়’ মাত্র। অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত মারফূ হাদীছ, যার উপরে মুসলমানদের আমল চালু আছে (অর্থাৎ বারো তাকবীর) তার উপরে আমল করাই উত্তম’।[61]
উল্লেখ্য যে, ছয় তাকবীর সাব্যস্ত করার জন্য ‘জানাযার চার তাকবীরের ন্যায়’ বলে দুই রাক‘আতে ৪+৪ মোট ৮ তাকবীর, তন্মধ্যে ১ম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা সহ ক্বিরাআতের পূর্বে চার তাকবীর এবং ২য় রাক‘আতে রুকুর তাকবীর সহ ক্বিরাআতের পরে চার তাকবীর বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে তাকবীরে তাহরীমা ও রুকুর মূল তাকবীর দু’টি বাদ দিলে অতিরিক্ত তিন তিন ছয়টি তাকবীর হয়। অথচ উক্ত হাদীছে ক্বিরাআতের আগে বা পরে বলে কোন কথা নেই। অনুরূপভাবে মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ্তে বর্ণিত ‘নয় তাকবীর’ থেকে তাকবীরে তাহরীমা এবং ১ম ও ২য় রাক‘আতের রুকুর তাকবীর দু’টি সহ মোট তিনটি মূল তাকবীর বাদ দিলে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবীর হয়। এভাবেই ব্যাখ্যা করে ছয় তাকবীর সাব্যস্ত করা হয়েছে।[62]
ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন, সবচেয়ে উত্তম হ’ল প্রথম রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে সাত এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে পাঁচ মোট বার তাকবীর দেওয়া। কারণ এর উপরে এসেছে অনেকগুলি মরফূ হাদীছ, যার কতকগুলি ‘ছহীহ’ ও কতকগুলি ‘হাসান’। বাকীগুলি ‘যঈফ’ হ’লেও এদের সমর্থনকারী। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, ৭ ও ৫ বারো তাকবীর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে ‘হাসান’ সূত্রে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, জাবের, আয়েশা, আবূ ওয়াক্বিদ, আমর ইবনু ‘আওফ প্রমুখ ছাহাবীগণ থেকে। কিন্তু শক্তিশালী বা দুর্বল কোন সূত্রে এর বিপরীত কিছুই বর্ণিত হয়নি।
দ্বিতীয় কারণ হ’ল বারো তাকবীরের উপরে আমল করেছেন মহান চার খলীফা হযরত আবুবকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)’।[63]
অতএব ১২ তাকবীরের স্পষ্ট ছহীহ মরফূ হাদীছের উপরে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের অনুসৃত সুন্নাতের উপরে সকলে আমল করলে সুন্নী মুসলমানগণ অন্ততঃ বৎসরে দু’টি ঈদের খুশীর দিনে ঐক্যবদ্ধ হ’য়ে ছালাত ও ইবাদত করতে পারতেন। কিন্তু দ্বীনের দোহাই দিয়েই আমরা দ্বীনদার মুসলমানদের বিভক্ত করে রেখেছি। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ছহীহ হাদীছের উপরে আমলের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!!
(১২) ঈদায়নের অন্যান্য মাসায়েল:
(ক) মুসলমানদের জাতীয় আনন্দ উৎসব মাত্র দু’টি, ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহা।[64] এক্ষণে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামে তৃতীয় আরেকটি ঈদ-এর প্রচলন ঘটানো নিঃসন্দেহে বিদ‘আত, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
(খ) দুই ঈদের দিন ছিয়াম পালন নিষিদ্ধ এবং আইয়ামে তাশরীক্বের তিনদিন ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহাজ্জ খানা-পিনার দিন।[65]
(গ) ঈদের দিন পরষ্পরে কুশল বিনিময়, খানাপিনা ও নির্দোষ খেলাধূলা: ঈদের দিন ছাহাবায়ে কেরাম পরষ্পরে সাক্ষাৎ হ’লে বলতেন ‘তাক্বাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ (অর্থঃ আল্লাহ আমাদের ও আপনার পক্ষ হ’তে কবুল করুন!)।[66] অতএব ‘ঈদ মোবারক’ বললেও সাথে সাথে উপরোক্ত দো‘আটি পড়া উচিত। ঈদের দিন এবং ঈদুল আযহার পরের তিনদিন পরষ্পরের বাড়ীতে খানাপিনা এবং নির্দোষ খেলাধুলা ও ইসলামী সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি করা যাবে।[67] অতএব উভয় ঈদের সরকারী ছুটি কমপক্ষে ছয়দিন থাকা উচিত। উল্লেখ্য যে, ঈদের খুশীতে গান-বাজনা, পটকাবাজি, মাইকবাজি, ক্যাসেটবাজি, চরিত্র বিধ্বংসী ভিডিও-সিডি প্রদর্শন, বাজে সিনেমা দেখা এবং খেলাধূলার নামে নারী-পুরুষের অবাধ সমাবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
(ঘ) ঈদের ক্বাযা: ‘যদি কেউ প্রথমে চাঁদ দেখতে না পেয়ে ছিয়াম রাখে ও পরে দিনের শেষে জানতে পারে, সে ব্যক্তি ছিয়াম ভঙ্গ করবে ও পরের দিন সকালে ঈদের ক্বাযা আদায় করবে’।[68] অনুরূপভাবে অন্য কোন বাধ্যগত কারণে কেউ ঈদের দিন ঈদের ছালাত আদায়ে ব্যর্থ হ’লে পরের দিন সকালে ক্বাযা আদায় করবে‘।[69]
[1]. মির‘আত ৫/২১-২২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩১৭-১৮।
[2]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩৪ ‘ঈদায়নের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।
[3]. বুখারী, মিশকাত হা/১৩৮১ ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘পরিচ্ছন্নতা ও তাকবীর’ অনুচ্ছেদ-৪৪; আল-মুগনী ২/২২৮ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৭ পৃঃ।
[4]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪০ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫১।
[5]. ফাৎহুল বারী ২/৫৫০-৫১ ‘ঈদায়েন’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ২৫; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪০ পৃঃ।
[6]. আওনুল মা‘বূদ শরহ সুনানে আবুদাঊদ (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৭/১৯৮৭) ৩/৪৮৭; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৮ পৃঃ।
[7]. তাফসীর তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৮ পৃঃ।
[8]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১।
[9]. বায়হাক্বী, হাদীছ ছহীহ; ইরওয়াউল গালীল (বৈরুত: ১৪০৫/১৯৮৫) হা/৬৫০, ৩/১২৩ পৃঃ।
[10]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, সনদ ছহীহ, ইরওয়া ৩/১২১ পৃঃ; দারাকুৎনী হা/১৬৯৬, ১৭০০।
[11]. নায়ল ৪/২৩৬ পৃঃ; মির‘আত ৫/৭০ পৃঃ।
[12]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, সনদ ছহীহ, ইরওয়া ৩/১২৫ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪২-২৪৩ পৃঃ; নায়ল ৪/২৭৮ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫৪-৫৬ পৃঃ।
[13]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, বায়হাক্বী, সনদ ছহীহ, ইরওয়া ৩/১২৫ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪৩ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫৪-৫৬ পৃঃ।
[14]. যাদুল মা‘আদ (বৈরুত ১৪১৬/১৯৯৬) ২/৩৬১ পৃঃ; নায়ল ৪/২৫৭ পৃঃ।
[15]. তাফসীরে কুরতুবী, ২/৩০৭, ৩/২-৪; বায়হাক্বী ৩/৩১৬ পৃঃ।
[16]. বুখারী, তা‘লীক্ব, সনদ ছহীহ, ইরওয়া হা/৬৫১, ৩/১২৪ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ৪/২৭৪ পৃঃ।
[17]. ইমাম নববী, রওযাতুত ত্বালেবীন (বৈরুত ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯১) ২/৭১-৭২ ‘ছালাতুল ঈদের বিবরণ’ অধ্যায়; মির‘আত ৫/৫৩; ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) পৃঃ ১১৪।
[18]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত, হা/১৪২৬, ১৪৩১।
[19]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫১; নায়ল ৪/২৫১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩১৯ পৃঃ।
[20]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪২৬, ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৩৪২।
[21]. সুবুলুস সালাম ১/১৪০; মির‘আত ৫/২৭; নায়লুল আওত্বার ৪/২৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪০ পৃঃ।
[22]. মির‘আত ৫/৩১; বায়হাক্বী ৩/২৯৯; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪০ পৃঃ।
[23]. মির‘আত ৫/৭০ পৃঃ।
[24]. আল-মুগনী ২/২৪৪ পৃঃ।
[25]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৮৫।
[26]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৩১; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৩৪৭।
[27]. মির‘আত, ২/৩৩১; ঐ, ৫/৩১ পৃঃ।
[28]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৭-৩৮; মির‘আত ২/৩২৭; ঐ, ৫/২২ পৃঃ।
[29]. আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৪৮ সনদ ‘যঈফ’।
[30]. আল-মুগনী ২/২৩৫ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩১৮; ঐ, ১/২৩৭ পৃঃ।
[31]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩১৬; ঐ, ১/২৩৬ পৃঃ; নায়ল ৪/২৩১ পৃঃ।
[32]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪১৫৩ ‘শিকার ও যবহ সমূহ’ অধ্যায় ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
[33]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ২/২৪২ পৃঃ; মির‘আত ৫/৫৩ পৃঃ।
[34]. বায়হাক্বী ৩/২৯৩ পৃঃ; মির‘আত ৫/৫৪ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৪২ পৃঃ; বুখারী, মিশকাত হা/৭৯৮ ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ।
[35]. মির‘আত ২/৩৩৮, ৩৪১ পৃঃ; ঐ, ৫/৪৬, ৫১, ৫২ পৃঃ।
[36]. আবু দাঊদ হা/১১৪৯; ছহীহ আবুদাঊদ হা/১০১৮-১৯।
[37]. দারাকুৎনী (বৈরুতঃ ১৪১৭/১৯৯৬) হা/১৭০৪।
[38]. ইরওয়াউল গালীল হা/৬৩৯-এর ব্যাখ্যা, ৩/১০৭-১০৮ পৃঃ।
[39]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৪১; এখানে মিশকাতে ‘দারেমী’ লেখা হয়েছে, যেটা ভুল। কেননা দারেমীতে এ হাদীছ নেই; আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/৪৪২; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১০৬৪। এতদ্ব্যতীত ছহীহ আবুদাঊদে আয়েশা ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে ৪টি হাদীছ নং ১০১৮, ১০১৯, ১০২০, ১০২১ এবং ছহীহ ইবনু মাজাহতে রাসূলের অন্যতম মুওয়াযযিন সা‘দ আল-ক্বারায, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ও আয়েশা (রাঃ) হ’তে আরও ৩টি হাদীছ নং ১০৬২, ১০৬৩, ১০৬৫ বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, হাদীছগুলির কোন কোনটি সরাসরি ‘ছহীহ’ নয়। বরং ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে ‘ছহীহ’।
[40]. জামে তিরমিযী (দিল্লীঃ ১৩০৮ হিঃ), ১/৭০ পৃঃ; আলবানী, ছহীহ তিরমিযী, হা/৪৪২; ইবনু মাজাহ (বৈরুতঃ তাবি) হা/১২৭৯; মির‘আত ৫/৪৮ পৃঃ।
[41]. বায়হাক্বী (বৈরুতঃ তাবি), ৩/২৮৬ পৃঃ; মির‘আত, ২/৩৩৯ পৃঃ; ঐ, ৫/৪৮ পৃঃ।
[42]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৮২ পৃঃ; মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৫৫ পৃঃ।
[43]. মিশকাত হা/১৪৪১ -এর টীকা ১, ১/৪৫৩ পৃঃ।
[44]. দারাকুৎনী হা/১৭১২, ১৭১৪ ‘ঈদায়েন’ অধ্যায়; বায়হাক্বী ২/২৮৫ পৃঃ। হাদীছটির শেষাংশটি দারাকুৎনী ও বায়হাক্বীতে এসেছে। এতদ্ব্যতীত হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে আবুদাঊদ হা/১১৫১, আলবানী-ছহীহ আবুদাঊদ হা/১০২০; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১০৬৩।
[45]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৮২; মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৫৫ পৃঃ। ইমাম শাওকানী (রহঃ) ঈদায়নের অতিরিক্ত তাকবীর বিষয়ে ১০টি মতভেদ উল্লেখ করে ১২ তাকবীরকেই ‘সর্বাগ্রগণ্য’ ( أرجح الأقوال ) হিসাবে মন্তব্য করেছেন। দ্রঃ নায়ল ৪/২৫৭ পৃঃ।
[46]. আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ জামে‘ তিরমিযী (মদীনাঃ মাকতাবা সালাফিইয়াহ ১৩৮৪/১৯৬৪) ৩/৮৫ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৩৮ পৃঃ।
[47]. মির‘আত ৫/৪৬ পৃঃ।
[48]. মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আমীর ছান‘আনী, সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম (কায়রোঃ দারুর রাইয়ান ১৪০৭/১৯৮৭) হা/৪৬১ -এর ব্যাখ্যা, ২/১৪১-৪২ পৃঃ।
[49]. ইয়াহ্ইয়া বিন শারফ নববী, রওযাতুত ত্বালেবীন (বৈরুত: ১৪১২/১৯৯১) ‘ছালাতুল ঈদের বিবরণ’ অধ্যায় ২/৭১ পৃঃ ।
[50]. সাইয়েদ সাবেক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রোঃ দারুল ফাৎহ ১৪১২/১৯৯২) ১/২৩৯ পৃঃ।
[51]. তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৫৩৪ -এর ব্যাখ্যা, ৩/৮৩ পৃঃ।
[52]. মির‘আত, ২/৩৩৮ পৃঃ; ঐ, ৫/৪৬ পৃঃ।
[53]. ইরওয়াউল গালীল ৩/১১২ পৃঃ; জাওহারুন নাক্বী শরহ বায়হাক্বী ৩/২৮৭।
[54]. বায়হাক্বী ৩/২৯১ পৃঃ।
[55]. ইরওয়াউল গালীল ৩/১১৩ পৃঃ।
[56]. আবুদাঊদ, মিশকাত, হা/১৪৪৩।
[57]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৮১২।
[58]. আবুদাঊদ, মিশকাত, হা/১৪৪৩ হাদীছ যঈফ-আলবানী; হেদায়াতুর রুওয়াত হা/১৩৮৮, ২/১২১ পৃঃ; মির‘আত ৫/৪৬, ৫০-৫১ পৃঃ।
[59]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৮৬; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ (বোম্বাইঃ ১৯৭৯), ২/১৭৩ পৃঃ।
[60]. বায়হাক্বী, ৩/২৯০; নায়ল, ৪/২৫৪, ২৫৬; মির‘আত ৫/৫০-৫১ পৃঃ।
[61]. বায়হাক্বী, ৩/২৯১; মির‘আত ৫/৫১ পৃঃ।
[62]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৮৬, ৮৮ পৃঃ।
[63]. মির‘আত ৫/৫৩ পৃঃ।
[64]. আবুদাঊদ, মিশকাত, হা/১৪৩৯।
[65]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত, হা/২০৪৮; মুসলিম, মিশকাত হা/২০৫০।
[66]. আল-মুগনী ২/২৫৯ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩১৫ পৃঃ; ঐ, ১/২৪২ পৃঃ।
[67]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/৩২২ পৃঃ; ঐ, ১/২৪১ পৃঃ।
[68]. আহমাদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, সনদ ছহীহ, ইরওয়া হা/৬৩৪।
[69]. ঐ, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪১ পৃঃ; আল-মুগনী ২/২৫০-৫১ পৃঃ ।
হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর যুগে দু’ধরনের মানুষ ছিল। তারকাপূজারী ও মূর্তিপূজারী। তারকা অথবা মূর্তির অসীলায় মানুষ আল্লাহর নৈকট্য কামনা করত এবং এসব অসীলাকে খুশী করার জন্য কুরবানী করত। এর প্রতিবাদ স্বরূপ ইবরাহীম (আঃ) সরাসরি আল্লাহর নামে ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাঁরই হুকুমে স্বীয় প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে কুরবানী দেন। পুত্রের বিনিময়ে আল্লাহর হুকুমে দুম্বা কুরবানী হয় এবং তা পরবর্তীদের জন্য নিয়ম হিসাবে চালু হয় (ছাফফাত ৩৭/১০৮)।
ইতিপূর্বে ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় মূতিপূজারী কওমকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
قَالَ اَتَعْبُدُوْنَ مَا تَنْحِتُوْنَ- وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُوْنَ- قَالُوا ابْنُوْا لَهُ بُنْيَانًا فَأَلْقُوْهُ فِى الْجَحِيْمِ- فَأَرَادُوْا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِيْنَ - ( الصافات ৯৫-৯৮)-
‘আপনারা নিজ হাতে মূর্তি তৈরি করেন, আবার তারই পূজা করেন?’ ‘অথচ আল্লাহ আপনাদের ও আপনাদের সকল কর্মকে সৃষ্টি করেছেন’। লা-জওয়াব নেতারা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, ‘এর জন্য একটা দেওয়াল নির্মাণ কর। অতঃপর ওকে সেই অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ কর’। ‘এভাবে তারা তার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র আঁটলো। কিন্তু আমরা তাদের পরাভূত করে দিলাম’ (ছাফফাত ৯৫-৯৮)। পরবর্তীকালে ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসারীরা তাওহীদের মর্ম ভুলে যায় এবং জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহকে স্বীকার করা সত্ত্বেও তাদের ধারণা মতে বিভিন্ন মৃত সৎ লোকের অসীলায় পরকালে মুক্তি পাওয়ার আশায় তাদের মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয় এবং এইসব অসীলাকে খুশী করার জন্য মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে থাকে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের প্রাক্কালে কা‘বাগৃহ ৩৬০টি মূর্তিতে ভরে যায়। যার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেন ও কা‘বাগৃহ সহ সমগ্র আরব জাহানকে মূর্তিমুক্ত করেন। অথচ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মতগণ জাহেলী আরবের মুশরিকদের ন্যায় আজ বিভিন্ন পীরের দরগায় গিয়ে গরু-খাসি-মুরগী কুরবানী দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনীতির নামে একদল মুসলমান নিজেদের তৈরি কথিত শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন ইত্যাদি বানিয়ে সেখানে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করছে। অতঃপর সেখানে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করছে। অথচ সেখানে কোন লাশও নেই কবরও নেই। এ দৃশ্য ইবরাহীম (আঃ)-এর যুগে প্রচলিত শিরক-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জীবন্ত মানুষ ক্ষুধায় মরে। তার প্রতি কেউ দয়া করে না। অথচ মৃতের কবরে মানুষ লাখ টাকা ঢালে, যার কিছুরই প্রয়োজন নেই। সেখানে গিয়ে কাঁদে, যার কোনই ক্ষমতা নেই। সেখানে গিয়ে শ্রদ্ধা দেখায়, যে দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না, অনুভবও করে না। অথচ মানুষ সেখানেই জমা হয়। এর চেয়ে মূর্খতা আর কী হ’তে পারে?
জানা আবশ্যক যে, ঈদুল আযহার কুরবানীর আনন্দ মূলতঃ শিরক মুক্তির আনন্দ, তাওহীদের ঝান্ডাকে আপোষহীনভাবে উন্নীত করার আনন্দ। অথচ আমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর সেই নির্ভেজাল তাওহীদী চেতনা হারিয়ে ফেলেছি। অন্যদিকে একদল লোক কুরবানীকে স্রেফ গোশতখুরীর উৎসবে পরিণত করেছে। প্রচলিত এই চেতনা ইবরাহীমী চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই অনতিবিলম্বে শিরকী চেতনা হ’তে তওবা করে তাওহীদী চেতনা প্রতিষ্ঠিত করা অপরিহার্য। নইলে কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য ‘তাক্বওয়া’ বা একনিষ্ঠ আল্লাহভীতি কখনোই অর্জিত হবে না। আর প্রকৃত আল্লাহভীতিই জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। ইবরাহীমী ঈমান যদি আবার জাগ্রত হয়, তবে আধুনিক জাহেলিয়াতের গাঢ় তমিশ্রা ভেদ করে পুনরায় মানবতার বিজয় নিশান উড্ডীন হবে। সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। উর্দূ কবি বলেন,
আগার হো যায়ে ফের হাম মেঁ ইবরাহীম কা ঈমাঁ পয়দা
আ-গ মেঁ হো সেকতা হায় ফের আন্দা-যে গুলিস্তাঁ পয়দা।
অর্থঃ যদি আমাদের মাঝে ফের ইবরাহীমের ঈমান পয়দা হয়, তাহ’লে অগ্নির মাঝে ফের ফুলবাগের নমুনা সৃষ্টি হ’তে পারে’।
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন
ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণকেতু লক্ষ্য ঐ তোরণ
আজি আল্লাহর নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন\
গৃহীতঃ কাজী নজরুল ইসলাম -এর ‘কুরবানী’ কবিতা হ’তে।
ইতিপূর্বে ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় মূতিপূজারী কওমকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
قَالَ اَتَعْبُدُوْنَ مَا تَنْحِتُوْنَ- وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُوْنَ- قَالُوا ابْنُوْا لَهُ بُنْيَانًا فَأَلْقُوْهُ فِى الْجَحِيْمِ- فَأَرَادُوْا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِيْنَ - ( الصافات ৯৫-৯৮)-
‘আপনারা নিজ হাতে মূর্তি তৈরি করেন, আবার তারই পূজা করেন?’ ‘অথচ আল্লাহ আপনাদের ও আপনাদের সকল কর্মকে সৃষ্টি করেছেন’। লা-জওয়াব নেতারা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, ‘এর জন্য একটা দেওয়াল নির্মাণ কর। অতঃপর ওকে সেই অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ কর’। ‘এভাবে তারা তার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র আঁটলো। কিন্তু আমরা তাদের পরাভূত করে দিলাম’ (ছাফফাত ৯৫-৯৮)। পরবর্তীকালে ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসারীরা তাওহীদের মর্ম ভুলে যায় এবং জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহকে স্বীকার করা সত্ত্বেও তাদের ধারণা মতে বিভিন্ন মৃত সৎ লোকের অসীলায় পরকালে মুক্তি পাওয়ার আশায় তাদের মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয় এবং এইসব অসীলাকে খুশী করার জন্য মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে থাকে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের প্রাক্কালে কা‘বাগৃহ ৩৬০টি মূর্তিতে ভরে যায়। যার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেন ও কা‘বাগৃহ সহ সমগ্র আরব জাহানকে মূর্তিমুক্ত করেন। অথচ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মতগণ জাহেলী আরবের মুশরিকদের ন্যায় আজ বিভিন্ন পীরের দরগায় গিয়ে গরু-খাসি-মুরগী কুরবানী দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনীতির নামে একদল মুসলমান নিজেদের তৈরি কথিত শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন ইত্যাদি বানিয়ে সেখানে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করছে। অতঃপর সেখানে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করছে। অথচ সেখানে কোন লাশও নেই কবরও নেই। এ দৃশ্য ইবরাহীম (আঃ)-এর যুগে প্রচলিত শিরক-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জীবন্ত মানুষ ক্ষুধায় মরে। তার প্রতি কেউ দয়া করে না। অথচ মৃতের কবরে মানুষ লাখ টাকা ঢালে, যার কিছুরই প্রয়োজন নেই। সেখানে গিয়ে কাঁদে, যার কোনই ক্ষমতা নেই। সেখানে গিয়ে শ্রদ্ধা দেখায়, যে দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না, অনুভবও করে না। অথচ মানুষ সেখানেই জমা হয়। এর চেয়ে মূর্খতা আর কী হ’তে পারে?
জানা আবশ্যক যে, ঈদুল আযহার কুরবানীর আনন্দ মূলতঃ শিরক মুক্তির আনন্দ, তাওহীদের ঝান্ডাকে আপোষহীনভাবে উন্নীত করার আনন্দ। অথচ আমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর সেই নির্ভেজাল তাওহীদী চেতনা হারিয়ে ফেলেছি। অন্যদিকে একদল লোক কুরবানীকে স্রেফ গোশতখুরীর উৎসবে পরিণত করেছে। প্রচলিত এই চেতনা ইবরাহীমী চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই অনতিবিলম্বে শিরকী চেতনা হ’তে তওবা করে তাওহীদী চেতনা প্রতিষ্ঠিত করা অপরিহার্য। নইলে কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য ‘তাক্বওয়া’ বা একনিষ্ঠ আল্লাহভীতি কখনোই অর্জিত হবে না। আর প্রকৃত আল্লাহভীতিই জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। ইবরাহীমী ঈমান যদি আবার জাগ্রত হয়, তবে আধুনিক জাহেলিয়াতের গাঢ় তমিশ্রা ভেদ করে পুনরায় মানবতার বিজয় নিশান উড্ডীন হবে। সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। উর্দূ কবি বলেন,
আগার হো যায়ে ফের হাম মেঁ ইবরাহীম কা ঈমাঁ পয়দা
আ-গ মেঁ হো সেকতা হায় ফের আন্দা-যে গুলিস্তাঁ পয়দা।
অর্থঃ যদি আমাদের মাঝে ফের ইবরাহীমের ঈমান পয়দা হয়, তাহ’লে অগ্নির মাঝে ফের ফুলবাগের নমুনা সৃষ্টি হ’তে পারে’।
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন
ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণকেতু লক্ষ্য ঐ তোরণ
আজি আল্লাহর নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন\
গৃহীতঃ কাজী নজরুল ইসলাম -এর ‘কুরবানী’ কবিতা হ’তে।
সংজ্ঞা:
شعر المولود من بطن امه او الذبيحة التى تُذْبَحُ عن المولود يوم سُبُوْعِهِ عند حلق شعره -
‘নবজাত শিশুর মাথার চুল অথবা সপ্তম দিনে নবজাতকের চুল ফেলার সময় যবহকৃত বকরীকে আক্বীক্বা বলা হয়’।[1]
আক্বীক্বার প্রচলন
(১) বুরায়দা (রাঃ) বলেন, জাহেলী যুগে আমাদের কারও সন্তান ভূমিষ্ট হ’লে তার পক্ষ হ’তে একটা বকরী যবহ করা হ’ত এবং তার রক্ত শিশুর মাথায় মাখিয়ে দেওয়া হ’ত। অতঃপর ‘ইসলাম’ আসার পর আমরা শিশু জন্মের সপ্তম দিনে বকরী যবহ করি এবং শিশুর মাথা মুন্ডন করে সেখানে ‘যাফরান’ মাখিয়ে দেই’ (আবুদাঊদ)। রাযীন -এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐদিন আমরা শিশুর নাম রাখি’।[2]
(২) হযরত আলী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, হাসান -এর আক্বীক্বার দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কন্যা ফাতেমাকে বলেন, হাসানের মাথার চুলের ওযনে রূপা ছাদাক্বা কর। তখন আমরা তা ওযন করি এবং তা এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) বা তার কিছু কম হয়’।[3]
µ উল্লেখ্য যে, ‘চুলের ওযনে স্বর্ণ অথবা রৌপ্য দেওয়ার ও সপ্তম দিনে খাৎনা দেওয়ার’ বিষয়ে বায়হাক্বী ও ত্বাবারাণী বর্ণিত হাদীছ ‘যঈফ’।[4]
হুকুম
আক্বীক্বা করা সুন্নাত। ছাহাবী, তাবেঈ ও ফক্বীহ বিদ্বানগণের প্রায় সকলে এতে একমত। হাসান বাছরী ও দাঊদ যাহেরী একে ওয়াজিব বলেন। তবে আহলুর রায় (হানাফী) গণ একে সুন্নাত বলেন না। কেননা এটি জাহেলী যুগে রেওয়াজ ছিল। কেউ বলেন, এটি তাদের কাছে ইচ্ছাধীন বিষয়।[5] নিঃসন্দেহে এটি প্রাক-ইসলামী যুগে চালু ছিল। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও ধরন পৃথক ছিল। ইসলাম আসার পর আক্বীক্বার রেওয়াজ ঠিক রাখা হয়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও ধরনে পার্থক্য হয়। জাহেলী যুগে আশুরার ছিয়াম চালু ছিল। ইসলামী যুগেও তা অব্যাহত রাখা হয়। অতএব প্রাক-ইসলামী যুগে আক্বীক্বা ছিল বিধায় ইসলামী যুগে সেটা করা যাবে না, এমন কথা ঠিক নয়।
গুরুতব :
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَعَ الْغُلاَمِ عَقِيْقَةٌ فَأَهْرِيْقُوْا عنه دَمًا وأَمِيْطُوا عَنْهُ الْأَذَى رواه البخارىُّ ‘সন্তানের সাথে আক্বীক্বা জড়িত। অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত কর এবং তার থেকে কষ্ট দূর করে দাও (অর্থাৎ তার জন্য একটি আক্বীক্বার পশু যবহ কর এবং তার মাথার চুল ফেলে দাও)।[6]
(২) তিনি বলেন, كُلُّ غُلاَمٍ رَهِيْنَةٌ اومُرْتَهَنٌ بعقيقَتِهِ تُذْبَحُ عنه يومَ السابع و يُسَمَّى وَ يُحْلَقُ رَأْسُهُ رواه الخمسة ‘প্রত্যেক শিশু তার আক্বীক্বার সাথে বন্ধক থাকে। অতএব জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু যবহ করতে হয়, নাম রাখতে হয় ও তার মাথা মুন্ডন করতে হয়’।[7]
µ ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আক্বীক্বার সাথে শিশু বন্ধক থাকে’-একথার ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, যদি বাচ্চা আক্বীক্বা ছাড়াই শৈশবে মারা যায়, তা’হলে সে তার পিতা-মাতার জন্য ক্বিয়ামতের দিন শাফা‘আত করবে না’। কেউ বলেছেন, আক্বীক্বা যে অবশ্য করণীয় এবং অপরিহার্য বিষয়, সেটা বুঝানোর জন্যই এখানে ‘বন্ধক’ ( مرتهن বা رهينة ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিশোধ না করা পর্যন্ত বন্ধকদাতার নিকট বন্ধক গ্রহিতা আবদ্ধ থাকে’।[8] ছাহেবে মিরক্বাত মোল্লা আলী ক্বারী বলেন, এর অর্থ এটা হ’তে পারে যে, আক্বীক্বা বন্ধকী বস্ত্তর ন্যায়। যতক্ষণ তা ছাড়ানো না যায়, ততক্ষণ তা থেকে উপকার গ্রহণ করা যায় না। সন্তান পিতা-মাতার জন্য আল্লাহর বিশেষ নে‘মত। অতএব এজন্য শুকরিয়া আদায় করা তাদের উপর অবশ্য কর্তব্য’।[9]
(৩) সাত দিনের পূর্বে শিশু মারা গেলে তার জন্য আক্বীক্বার কর্তব্য শেষ হয়ে যায়।[10]
আক্বীক্বার পশু:
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ছাগ হৌক বা ছাগী হৌক, ছেলের পক্ষ থেকে দু’টি ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি আক্বীক্বা দিতে হয়’।[11] পুত্র সন্তানের জন্য দু’টি দেওয়াই উত্তম। তবে একটা দিলেও চলবে।[12] ছাগল দু’টিই কুরবানীর পশুর ন্যায় ‘মুসিন্নাহ’ অর্থাৎ দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁতওয়ালা হ’তে হবে এবং কাছাকাছি সমান স্বাস্থ্যের অধিকারী হ’তে হবে। এমন নয় যে, একটি মুসিন্নাহ হবে, অন্যটি মুসিন্নাহ নয়।[13] একটি খাসী ও অন্যটি বকরী হওয়ায় কোন দোষ নেই।
(২) ত্বাবারাণীতে উট, গরু বা ছাগল দিয়ে আক্বীক্বা করা সম্পর্কে যে হাদীছ এসেছে, তা ‘মওযূ’ অর্থাৎ জাল।[14] তাছাড়া এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন আমল নেই।
(৩) পিতার সম্মতিক্রমে অথবা তাঁর অবর্তমানে দাদা, চাচা, নানা, মামু যেকোন অভিভাবক আক্বীক্বা দিতে পারেন। হাসান ও হোসায়েন -এর পক্ষে তাদের নানা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আক্বীক্বা দিয়েছিলেন।[15]
(৪) সাত দিনের পরে ১৪ ও ২১ দিনে আক্বীক্বা দেওয়ার ব্যাপারে বায়হাক্বী, ত্বাবারাণী ও হাকেমে বুরায়দা ও আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছকে শায়খ আলবানী ‘যঈফ’ বলেছেন।[16]
(৫) শাফেঈ বিদ্বানগণের মতে সাত দিনে আক্বীক্বার বিষয়টি সীমা নির্দেশ মূলক নয় বরং এখতিয়ার মূলক ( للاختيار لا للتعيين )। ইমাম শাফেঈ বলেন, সাত দিনে আক্বীক্বার অর্থ হ’ল, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সাত দিনের পরে আক্বীক্বা করবে না। যদি কোন কারণে বিলম্ব হয়, এমনকি সন্তান বালেগ হয়ে যায়, তাহ’লে তার পক্ষে তার অভিভাবকের আক্বীক্বার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সে নিজের আক্বীক্বা নিজে করতে পারবে।[17]
µ উল্লেখ্য যে, নবুঅত লাভের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের আক্বীক্বা নিজে করেছিলেন বলে বায়হাক্বীতে আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি ‘মুনকার’ বা যঈফ[18] বরং এটাই প্রমাণিত যে, তাঁর জন্মের সপ্তম দিনে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর আক্বীক্বা করেন ও ‘মুহাম্মাদ’ নাম রাখেন।[19]
আক্বীক্বার দো‘আ:
আল্লা-হুম্মা মিনকা ওয়া লাকা, আক্বীক্বাতা ফুলান। বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবর। এ সময় ‘ফুলান’-এর স্থলে বাচ্চার নাম বলা যাবে।[20] মনে মনে নবজাতকের আক্বীক্বার নিয়ত করে মুখে কেবল ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবর’ বললেও চলবে।
শিশুর নামকরণ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নাম হ’ল ‘আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান’।[21]
অমুসলিমদের সাথে সামঞ্জস্যশীল ও শিরক-বিদ‘আতযুক্ত নাম বা ডাকনাম রাখা যাবে না। তাছাড়া অনারবদের জন্য আরবী ভাষায় নাম রাখা আবশ্যক। কেননা অনারব দেশে এটাই মুসলিম ও অমুসলিমের নামের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। আজকাল এ পার্থক্য ঘুচিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। তাই নাম রাখার আগে অবশ্যই সচেতন ও যোগ্য আলেমের কাছে পরামর্শ নিতে হবে।
µ উল্লেখ্য যে, শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পরপরই নাম রাখা যায়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ফজরের পরে সবাইকে বলেন, গত রাতে আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেছে। আমি তাকে আমার পিতার নামানুসারে ‘ইবরাহীম’ নাম রেখেছি’।[22] এভাবে তিনি আবু ত্বালহার পুত্র আব্দুল্লাহ ও আসওয়াদপুত্র মুনযির-এর নাম তাদের জন্মের পরেই রেখেছিলেন’।[23] তবে আক্বীক্বা সপ্তম দিনেই হবে।
নামকরণ বিষয়ে জ্ঞাতব্য:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মন্দ নাম পরিবর্তন করে দিতেন।[24] এমনকি কোন গ্রাম বা মহল্লার অপসন্দনীয় নামও তিনি পরিবর্তন করে দিতেন। যেমন চলার পথে একটি গ্রামের নাম তিনি শুনেন ‘ওফরাহ’ ( عُفْرَة ) অর্থ ‘ধূসর মাটি’। তিনি সেটা পরিবর্তন করে রাখেন ‘খুযরাহ’ ( خُضْرَة ) অর্থ ‘সবুজ-শ্যামল’।[25] তাঁর কাছে আগন্তুক কোন ব্যক্তির নাম অপসন্দনীয় মনে হ’লে তিনি তা পাল্টে দিয়ে ভাল নাম রেখে দিতেন।[26]
‘আল্লাহর দাস’ বা ‘করুণাময়ের দাস’ একথাটা যেন সন্তানের মনে সারা জীবন সর্বাবস্থায় জাগরুক থাকে, সেজন্যই ‘আব্দুল্লাহ’ ও ‘আব্দুর রহমান’ নাম দু’টিকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। অতএব আল্লাহ বা তাঁর গুণবাচক নামের সাথে ‘আব্দ’ সংযোগে নাম রাখাই উত্তম। এমন নাম রাখা কখনোই উচিত নয়, যা আল্লাহর স্মরণ থেকে সন্তানকে গাফেল করে দেয়। কেননা ভাল ও মন্দ উভয় নামের প্রভাব সন্তানের উপর পড়ে থাকে। যেমন ‘হায্ন’ (কর্কশ) নামের জনৈক ব্যক্তি রসূলের দরবারে এলে তিনি তার নাম পাল্টিয়ে ‘সাহ্ল’ (নম্র) রাখেন। কিন্তু লোকটি বলল, আমার বাপের রাখা নাম আমি কখনোই ছাড়ব না। পরবর্তীতে লোকটির পৌত্র খ্যাতনামা তাবেঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহঃ) বলেন, দেখা গেছে যে, আমাদের বংশে চিরকাল রুক্ষতা বিদ্যমান ছিল’।[27]
অনেকে সার্টিফিকেটের দোহাই দিয়ে নিজেদের অপসন্দনীয় নামসমূহ পরিবর্তন করেন না। সারা জীবন ঐ মন্দ নাম বহন করে তারা কবরে চলে যান। অথচ ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে তার পিতার নামসহ ডাকা হবে। যেমন অঙ্গীকার ও বিশ্বাস ভঙ্গকারী ( غادر ) ব্যক্তিদের ডেকে সেদিন বলা হবে, এটি ‘অমুকের সন্তান অমুকের বিশ্বাসঘাতকতা’ ( هذه غَدْرَةُ فُلاَنِ بْنِ فُلاَنٍ )।[28] অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের যখন তাদের পিতার নামসহ ডাকা হবে, তখন ঈমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের অবশ্যই তাদের স্ব স্ব পিতার নামসহ ডাকা হবে, এটা পরিস্কার বুঝা যায়। যেমন অন্য হাদীছে এসেছে, ‘তোমাদেরকে তোমাদের পিতার নামসহ ক্বিয়ামতের দিন ডাকা হবে। অতএব তোমরা তোমাদের নামগুলি সুন্দর রাখো’।[29] আলবানী হাদীছটির সনদ ‘যঈফ’ বলেছেন। কিন্তু বক্তব্য ছহীহ হাদীছের অনুকূলে। এক্ষণে পিতার নাম যদি ‘পচা’ হয়, আর ছেলের নাম যদি ‘দুখে’ হয়, তাহলে হাশরের ময়দানে কোটি মানুষের সামনে ‘দুখে ইবনে পচা’ ‘পক্কু ইবনে ছক্কু’ বা ‘কালা ইবনে ধলা’ কিংবা ‘ফেলনা বিনতে পাপ্পু’ বলে ডাকলে বাপ-বেটার বা বাপ-বেটির শুনতে কেমন লাগবে? অতএব মৃত্যুর আগেই এবিষয়ে সাবধান হওয়া ভাল।
প্রচলিত কিছু ভুল নামের নমুনা:
আব্দুন্নবী, আব্দুর রাসূল, গোলাম নবী, গোলাম রসূল, গোলাম মুহাম্মাদ, গোলাম আহমাদ, গোলাম মুছতফা, গোলাম মুরতযা, নূর মুহাম্মাদ, নূর আহমাদ, মাদার বখ্শ, পীর বখ্শ, রূহুল আমীন, সুলতানুল আওলিয়া প্রভৃতি। এতদ্ব্যতীত (১) অহংকার মূলক নাম, যেমন খায়রুল বাশার, শাহজাহান, শাহ আলম, শাহানশাহ প্রভৃতি; (২) নবীগণের উপাধি, যেমন আবুল বাশার, নবীউল্লাহ, খলীলুল্লাহ, কালীমুল্লাহ, রূহুল্লাহ, মুহাম্মাদ আবুল কাসেম; (৩) কুরআনের আয়াতসমূহ, যেমন আলিফ লাম মীম, ত্বোয়াহা, ইয়াসীন, হা-মীম, লেতুনযেরা; (৪) অনর্থক নাম, যেমন লায়লুন নাহার, ক্বামারুন নাহার, আলিফ লায়লা ইত্যাদি। (৫) কুখ্যাত যালেমদের নাম, যেমন নমরূদ, ফেরাঊন, হামান, শাদ্দাদ, ক্বারূণ, মীরজাফর প্রমুখ। (৬) এতদ্ব্যতীত শী‘আদের অনুকরণে নামের আগে বা পিছে আলী, হাসান বা হোসায়েন নাম যোগ করা। (৭) এছাড়াও ঝন্টু, মন্টু, পিন্টু, মিন্টু, হাবলু, জিবলু, বেল্টু, শিপলু, ইতি, মিতি, খেন্তী, বিন্তী, মলী, ডলী ইত্যাদি অর্থহীন নামসমূহ।
(৭) নবজাতকের জন্মের পরপরই তার ডান কানে আযান ও বাম কানে এক্বামত শুনানোর হাদীছ ‘মওযূ’ বা জাল।[30] (ক) কেবল আযান শুনানোর বিষয়ে আবুদাঊদ ও তিরমিযী বর্ণিত হাদীছ সম্পর্কে শায়খ আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন।[31] তবে সর্বশেষ তাহক্বীক্বে তিনি এটাকে ‘যঈফ’ বলেছেন।[32] (খ) ইমাম তিরমিযী বলেন, নবজাতকের কানে আযান শুনানোর উপরে আমল জারি আছে ( والعمل عليه )।[33] (গ) সাবেক সঊদী মুফতী শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন বলেন, এতে কোন অসুবিধা নেই ( لابأس به )। যদিও এর সনদে কিছু বিতর্ক ( مقال ) রয়েছে’। (ঘ) হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) শিশুর কানে আযানের তাৎপর্য বর্ণনা করে বলেন, দুনিয়াতে আগমনের সাথে সাথে তার কানে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বড়ত্বের ও শ্রেষ্ঠত্বের বাণী শুনানো হয়। যেমন দুনিয়া থেকে বিদায়কালে তাকে তাওহীদের কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর তালক্বীন করানো হয়। আযান বাচ্চার মনে দূরবর্তী ও স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে এবং শয়তানকে বিতাড়িত করে’।[34]
আক্বীক্বার গোশত বন্টন:
(ক) আক্বীক্বার গোশত কুরবানীর গোশতের ন্যায় তিন ভাগ করে একভাগ ফকীর-মিসকীনকে ছাদাক্বা দিবে ও একভাগ বাপ-মা ও পরিবার খাবে এবং একভাগ আত্নীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে হাদিয়া হিসাবে বন্টন করবে।[35] চামড়া বিক্রি করে তা কুরবানীর পশুর চামড়ার ন্যায় ছাদাক্বা করে দিবে।[36]
আক্বীক্বার অন্যান্য মাসায়েল:
(ক) আক্বীক্বা একটি ইবাদত। এর জন্য জাঁকজমকপূর্ণ কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না। এ উপলক্ষে আত্নীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে উপঢৌকন নেওয়ারও কোন দলীল পাওয়া যায় না।
(খ) আক্বীক্বা ও কুরবানী দু’টি পৃথক ইবাদত। একই পশুতে কুরবানী ও আক্বীক্বা দু’টি একসাথে করার কোন দলীল নেই।
(গ) আক্বীক্বা ও কুরবানী একই দিনে হ’লে সম্ভব হ’লে দু’টিই করবে। নইলে কেবল আক্বীক্বা করবে। কেননা আক্বীক্বা জীবনে একবার হয় এবং তা সপ্তম দিনেই করতে হয়। কিন্তু কুরবানী প্রতি বছর করা যায়।
(ঘ) শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর হাদীছপন্থী কোন দ্বীনদার আলেমের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁর নিকট থেকে শিশুর ‘তাহনীক’ করানো ও শিশুর জন্য দো‘আ করানো ভাল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা করতেন।[37] ‘তাহনীক’ অর্থ খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবিয়ে বাচ্চার মুখে দেওয়া। হিজরতের পর মদীনায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মুহাজির সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিয়ে ‘তাহনীক’ করেছিলেন। এভাবে তিনিই ছিলেন প্রথম সৌভাগ্যবান শিশু যার পেটে প্রথম রাসূলের পবিত্র মুখের লালা প্রবেশ করে। পরবর্তী জীবনে তিনি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আনছারগণ তাদের নবজাতক সন্তানদের রাসূলের কাছে এনে ‘তাহনীক’ করাতেন। আবু ত্বালহা (রাঃ) তার সদ্যজাত পুত্রকে এনে রাসূলের কোলে দিলে তিনি খেজুর তলব করেন। অতঃপর তিনি তা চিবিয়ে বাচ্চার গালে দেন ও নাম রাখেন ‘আব্দুল্লাহ’।[38] ‘তাহনীক’ করার পর শিশুর কল্যাণের জন্য দো‘আ করবেন- ‘বা-রাকাল্লা-হু আলায়েক’ ‘আল্লাহ তোমার উপরে অনুগ্রহ বর্ষণ করুন’।[39]
(ঙ) শিশু অবস্থায় প্রয়োজন বোধে মেয়েদের কান ফুটানো জায়েয আছে। কেননা জাহেলী যুগে এটা করা হ’ত। কিন্তু ইসলামী যুগে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটাতে কোন আপত্তি করেন নি। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা করা মাকরূহ।[40]
[1]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব।
[2]. মিশকাত হা/৪১৫৮ ‘যবহ ও শিকার’ অধ্যায়, ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
[3]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪১৫৪; আহমাদ, ইরওয়া হা/১১৭৫।
[4]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৮৩, ৩৮৫ পৃঃ।
[5]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৩/৫৮৬; নায়ল ৬/২৬০ পৃঃ।
[6]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৪৯ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
[7]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, আহমাদ; ইরওয়া হা/১১৬৫।
[8]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২৬০ পৃঃ ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায়।
[9]. মিরক্বাত শরহ মিশকাত (দিল্লী ছাপা, তারিখ বিহীন) ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ ৮/১৫৬ পৃঃ।
[10]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬১ পৃঃ।
[11]. নাসাঈ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪১৫২, ৪১৫৬; ইরওয়া হা/১১৬৬।
[12]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪১৫৫; নায়লুল আওত্বার ৬/২৬২,২৬৪ পৃঃ।
[13]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬২ পৃঃ; আওনুল মা‘বূদ হা/২৮১৭-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[14]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/১১৬৮।
[15]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৪১৫৫।
[16]. ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭০।
[17]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬১ পৃঃ।
[18]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬৪ পৃঃ।
[19]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত (বৈরুতঃ ১৯৮৫) ১/১১৩ পৃঃ; সুলায়মান মানছূরপুরী, রাহমাতুল লিল আলামীন (দিল্লী, ১৯৮০) ১/৪১ পৃঃ।
[20]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, আবু ইয়া‘লা, বায়হাক্বী ৯/৩০৪ পৃঃ; নায়ল ৬/২৬২ পৃঃ।
[21]. মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৭৫২‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘নামসমূহ’ অনুচ্ছেদ; ইরওয়া হা/১১৭৬।
[22]. মুসলিম, হা/২৩১৫ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় হা/৬২।
[23]. মুগনী ১১/১২৫; আওনুল মা‘বূদ হা/২৮২১-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৭৫৯ ‘নামসমূহ অনুচ্ছেদ।
[24]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৭৭৪; ছহীহাহ হা/২০৭।
[25]. ত্বাবারাণী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৮।
[26]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৯।
[27]. বুখারী হা/৬১৯০, ৬১৯৩ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ১০৭ অনুচ্ছেদ।
[28]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৭২৫ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।
[29]. আহমাদ, আবদাঊদ, মিশকাত হা/৪৭৬৮ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘নামসমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[30]. ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭৪।
[31]. ছহীহ তিরমিযী হা/১২২৪; ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭৩।
[32]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১২১; হেদায়াতুর রুওয়াত শরহ মিশকাত হা/৪০৮৫, ৪/১৩৮ পৃঃ।
[33]. তিরমিযী হা/১৫৬৯; আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/১২২৪; ‘কুরবানী’ অধ্যায়, ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ নং ১৫; তুহফা হা/১৫৫৩।
[34]. ইবনুল ক্বাইয়িম, তুহফাতুল মওলূদ পৃঃ ২৫-২৬।
[35]. বায়হাক্বী ৯/৩০২ পৃঃ।
[36]. ইবনে রুশদ কুরতুবী, বেদায়াতুল মুজতাহিদ (রাবাত্ব, মরক্কো: ১৪১৯ হিঃ) ১/৪৬৭ পৃঃ।
[37]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪১৫১ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
[38]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৩/৫৯০ পৃঃ।
[39]. মিরক্বাত (দিল্লী ছাপা : তারিখ বিহীন) ৮/১৫৫ পৃঃ।
[40]. ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রোঃ দারুল ফাৎহ ১৪১২/১৯৯২) পৃঃ ২/৩৪।
شعر المولود من بطن امه او الذبيحة التى تُذْبَحُ عن المولود يوم سُبُوْعِهِ عند حلق شعره -
‘নবজাত শিশুর মাথার চুল অথবা সপ্তম দিনে নবজাতকের চুল ফেলার সময় যবহকৃত বকরীকে আক্বীক্বা বলা হয়’।[1]
আক্বীক্বার প্রচলন
(১) বুরায়দা (রাঃ) বলেন, জাহেলী যুগে আমাদের কারও সন্তান ভূমিষ্ট হ’লে তার পক্ষ হ’তে একটা বকরী যবহ করা হ’ত এবং তার রক্ত শিশুর মাথায় মাখিয়ে দেওয়া হ’ত। অতঃপর ‘ইসলাম’ আসার পর আমরা শিশু জন্মের সপ্তম দিনে বকরী যবহ করি এবং শিশুর মাথা মুন্ডন করে সেখানে ‘যাফরান’ মাখিয়ে দেই’ (আবুদাঊদ)। রাযীন -এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐদিন আমরা শিশুর নাম রাখি’।[2]
(২) হযরত আলী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, হাসান -এর আক্বীক্বার দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কন্যা ফাতেমাকে বলেন, হাসানের মাথার চুলের ওযনে রূপা ছাদাক্বা কর। তখন আমরা তা ওযন করি এবং তা এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) বা তার কিছু কম হয়’।[3]
µ উল্লেখ্য যে, ‘চুলের ওযনে স্বর্ণ অথবা রৌপ্য দেওয়ার ও সপ্তম দিনে খাৎনা দেওয়ার’ বিষয়ে বায়হাক্বী ও ত্বাবারাণী বর্ণিত হাদীছ ‘যঈফ’।[4]
হুকুম
আক্বীক্বা করা সুন্নাত। ছাহাবী, তাবেঈ ও ফক্বীহ বিদ্বানগণের প্রায় সকলে এতে একমত। হাসান বাছরী ও দাঊদ যাহেরী একে ওয়াজিব বলেন। তবে আহলুর রায় (হানাফী) গণ একে সুন্নাত বলেন না। কেননা এটি জাহেলী যুগে রেওয়াজ ছিল। কেউ বলেন, এটি তাদের কাছে ইচ্ছাধীন বিষয়।[5] নিঃসন্দেহে এটি প্রাক-ইসলামী যুগে চালু ছিল। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও ধরন পৃথক ছিল। ইসলাম আসার পর আক্বীক্বার রেওয়াজ ঠিক রাখা হয়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও ধরনে পার্থক্য হয়। জাহেলী যুগে আশুরার ছিয়াম চালু ছিল। ইসলামী যুগেও তা অব্যাহত রাখা হয়। অতএব প্রাক-ইসলামী যুগে আক্বীক্বা ছিল বিধায় ইসলামী যুগে সেটা করা যাবে না, এমন কথা ঠিক নয়।
গুরুতব :
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَعَ الْغُلاَمِ عَقِيْقَةٌ فَأَهْرِيْقُوْا عنه دَمًا وأَمِيْطُوا عَنْهُ الْأَذَى رواه البخارىُّ ‘সন্তানের সাথে আক্বীক্বা জড়িত। অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত কর এবং তার থেকে কষ্ট দূর করে দাও (অর্থাৎ তার জন্য একটি আক্বীক্বার পশু যবহ কর এবং তার মাথার চুল ফেলে দাও)।[6]
(২) তিনি বলেন, كُلُّ غُلاَمٍ رَهِيْنَةٌ اومُرْتَهَنٌ بعقيقَتِهِ تُذْبَحُ عنه يومَ السابع و يُسَمَّى وَ يُحْلَقُ رَأْسُهُ رواه الخمسة ‘প্রত্যেক শিশু তার আক্বীক্বার সাথে বন্ধক থাকে। অতএব জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু যবহ করতে হয়, নাম রাখতে হয় ও তার মাথা মুন্ডন করতে হয়’।[7]
µ ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আক্বীক্বার সাথে শিশু বন্ধক থাকে’-একথার ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, যদি বাচ্চা আক্বীক্বা ছাড়াই শৈশবে মারা যায়, তা’হলে সে তার পিতা-মাতার জন্য ক্বিয়ামতের দিন শাফা‘আত করবে না’। কেউ বলেছেন, আক্বীক্বা যে অবশ্য করণীয় এবং অপরিহার্য বিষয়, সেটা বুঝানোর জন্যই এখানে ‘বন্ধক’ ( مرتهن বা رهينة ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিশোধ না করা পর্যন্ত বন্ধকদাতার নিকট বন্ধক গ্রহিতা আবদ্ধ থাকে’।[8] ছাহেবে মিরক্বাত মোল্লা আলী ক্বারী বলেন, এর অর্থ এটা হ’তে পারে যে, আক্বীক্বা বন্ধকী বস্ত্তর ন্যায়। যতক্ষণ তা ছাড়ানো না যায়, ততক্ষণ তা থেকে উপকার গ্রহণ করা যায় না। সন্তান পিতা-মাতার জন্য আল্লাহর বিশেষ নে‘মত। অতএব এজন্য শুকরিয়া আদায় করা তাদের উপর অবশ্য কর্তব্য’।[9]
(৩) সাত দিনের পূর্বে শিশু মারা গেলে তার জন্য আক্বীক্বার কর্তব্য শেষ হয়ে যায়।[10]
আক্বীক্বার পশু:
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ছাগ হৌক বা ছাগী হৌক, ছেলের পক্ষ থেকে দু’টি ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি আক্বীক্বা দিতে হয়’।[11] পুত্র সন্তানের জন্য দু’টি দেওয়াই উত্তম। তবে একটা দিলেও চলবে।[12] ছাগল দু’টিই কুরবানীর পশুর ন্যায় ‘মুসিন্নাহ’ অর্থাৎ দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁতওয়ালা হ’তে হবে এবং কাছাকাছি সমান স্বাস্থ্যের অধিকারী হ’তে হবে। এমন নয় যে, একটি মুসিন্নাহ হবে, অন্যটি মুসিন্নাহ নয়।[13] একটি খাসী ও অন্যটি বকরী হওয়ায় কোন দোষ নেই।
(২) ত্বাবারাণীতে উট, গরু বা ছাগল দিয়ে আক্বীক্বা করা সম্পর্কে যে হাদীছ এসেছে, তা ‘মওযূ’ অর্থাৎ জাল।[14] তাছাড়া এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন আমল নেই।
(৩) পিতার সম্মতিক্রমে অথবা তাঁর অবর্তমানে দাদা, চাচা, নানা, মামু যেকোন অভিভাবক আক্বীক্বা দিতে পারেন। হাসান ও হোসায়েন -এর পক্ষে তাদের নানা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আক্বীক্বা দিয়েছিলেন।[15]
(৪) সাত দিনের পরে ১৪ ও ২১ দিনে আক্বীক্বা দেওয়ার ব্যাপারে বায়হাক্বী, ত্বাবারাণী ও হাকেমে বুরায়দা ও আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছকে শায়খ আলবানী ‘যঈফ’ বলেছেন।[16]
(৫) শাফেঈ বিদ্বানগণের মতে সাত দিনে আক্বীক্বার বিষয়টি সীমা নির্দেশ মূলক নয় বরং এখতিয়ার মূলক ( للاختيار لا للتعيين )। ইমাম শাফেঈ বলেন, সাত দিনে আক্বীক্বার অর্থ হ’ল, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সাত দিনের পরে আক্বীক্বা করবে না। যদি কোন কারণে বিলম্ব হয়, এমনকি সন্তান বালেগ হয়ে যায়, তাহ’লে তার পক্ষে তার অভিভাবকের আক্বীক্বার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সে নিজের আক্বীক্বা নিজে করতে পারবে।[17]
µ উল্লেখ্য যে, নবুঅত লাভের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের আক্বীক্বা নিজে করেছিলেন বলে বায়হাক্বীতে আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি ‘মুনকার’ বা যঈফ[18] বরং এটাই প্রমাণিত যে, তাঁর জন্মের সপ্তম দিনে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর আক্বীক্বা করেন ও ‘মুহাম্মাদ’ নাম রাখেন।[19]
আক্বীক্বার দো‘আ:
আল্লা-হুম্মা মিনকা ওয়া লাকা, আক্বীক্বাতা ফুলান। বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবর। এ সময় ‘ফুলান’-এর স্থলে বাচ্চার নাম বলা যাবে।[20] মনে মনে নবজাতকের আক্বীক্বার নিয়ত করে মুখে কেবল ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবর’ বললেও চলবে।
শিশুর নামকরণ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নাম হ’ল ‘আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান’।[21]
অমুসলিমদের সাথে সামঞ্জস্যশীল ও শিরক-বিদ‘আতযুক্ত নাম বা ডাকনাম রাখা যাবে না। তাছাড়া অনারবদের জন্য আরবী ভাষায় নাম রাখা আবশ্যক। কেননা অনারব দেশে এটাই মুসলিম ও অমুসলিমের নামের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। আজকাল এ পার্থক্য ঘুচিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। তাই নাম রাখার আগে অবশ্যই সচেতন ও যোগ্য আলেমের কাছে পরামর্শ নিতে হবে।
µ উল্লেখ্য যে, শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পরপরই নাম রাখা যায়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ফজরের পরে সবাইকে বলেন, গত রাতে আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেছে। আমি তাকে আমার পিতার নামানুসারে ‘ইবরাহীম’ নাম রেখেছি’।[22] এভাবে তিনি আবু ত্বালহার পুত্র আব্দুল্লাহ ও আসওয়াদপুত্র মুনযির-এর নাম তাদের জন্মের পরেই রেখেছিলেন’।[23] তবে আক্বীক্বা সপ্তম দিনেই হবে।
নামকরণ বিষয়ে জ্ঞাতব্য:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মন্দ নাম পরিবর্তন করে দিতেন।[24] এমনকি কোন গ্রাম বা মহল্লার অপসন্দনীয় নামও তিনি পরিবর্তন করে দিতেন। যেমন চলার পথে একটি গ্রামের নাম তিনি শুনেন ‘ওফরাহ’ ( عُفْرَة ) অর্থ ‘ধূসর মাটি’। তিনি সেটা পরিবর্তন করে রাখেন ‘খুযরাহ’ ( خُضْرَة ) অর্থ ‘সবুজ-শ্যামল’।[25] তাঁর কাছে আগন্তুক কোন ব্যক্তির নাম অপসন্দনীয় মনে হ’লে তিনি তা পাল্টে দিয়ে ভাল নাম রেখে দিতেন।[26]
‘আল্লাহর দাস’ বা ‘করুণাময়ের দাস’ একথাটা যেন সন্তানের মনে সারা জীবন সর্বাবস্থায় জাগরুক থাকে, সেজন্যই ‘আব্দুল্লাহ’ ও ‘আব্দুর রহমান’ নাম দু’টিকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। অতএব আল্লাহ বা তাঁর গুণবাচক নামের সাথে ‘আব্দ’ সংযোগে নাম রাখাই উত্তম। এমন নাম রাখা কখনোই উচিত নয়, যা আল্লাহর স্মরণ থেকে সন্তানকে গাফেল করে দেয়। কেননা ভাল ও মন্দ উভয় নামের প্রভাব সন্তানের উপর পড়ে থাকে। যেমন ‘হায্ন’ (কর্কশ) নামের জনৈক ব্যক্তি রসূলের দরবারে এলে তিনি তার নাম পাল্টিয়ে ‘সাহ্ল’ (নম্র) রাখেন। কিন্তু লোকটি বলল, আমার বাপের রাখা নাম আমি কখনোই ছাড়ব না। পরবর্তীতে লোকটির পৌত্র খ্যাতনামা তাবেঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহঃ) বলেন, দেখা গেছে যে, আমাদের বংশে চিরকাল রুক্ষতা বিদ্যমান ছিল’।[27]
অনেকে সার্টিফিকেটের দোহাই দিয়ে নিজেদের অপসন্দনীয় নামসমূহ পরিবর্তন করেন না। সারা জীবন ঐ মন্দ নাম বহন করে তারা কবরে চলে যান। অথচ ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে তার পিতার নামসহ ডাকা হবে। যেমন অঙ্গীকার ও বিশ্বাস ভঙ্গকারী ( غادر ) ব্যক্তিদের ডেকে সেদিন বলা হবে, এটি ‘অমুকের সন্তান অমুকের বিশ্বাসঘাতকতা’ ( هذه غَدْرَةُ فُلاَنِ بْنِ فُلاَنٍ )।[28] অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের যখন তাদের পিতার নামসহ ডাকা হবে, তখন ঈমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের অবশ্যই তাদের স্ব স্ব পিতার নামসহ ডাকা হবে, এটা পরিস্কার বুঝা যায়। যেমন অন্য হাদীছে এসেছে, ‘তোমাদেরকে তোমাদের পিতার নামসহ ক্বিয়ামতের দিন ডাকা হবে। অতএব তোমরা তোমাদের নামগুলি সুন্দর রাখো’।[29] আলবানী হাদীছটির সনদ ‘যঈফ’ বলেছেন। কিন্তু বক্তব্য ছহীহ হাদীছের অনুকূলে। এক্ষণে পিতার নাম যদি ‘পচা’ হয়, আর ছেলের নাম যদি ‘দুখে’ হয়, তাহলে হাশরের ময়দানে কোটি মানুষের সামনে ‘দুখে ইবনে পচা’ ‘পক্কু ইবনে ছক্কু’ বা ‘কালা ইবনে ধলা’ কিংবা ‘ফেলনা বিনতে পাপ্পু’ বলে ডাকলে বাপ-বেটার বা বাপ-বেটির শুনতে কেমন লাগবে? অতএব মৃত্যুর আগেই এবিষয়ে সাবধান হওয়া ভাল।
প্রচলিত কিছু ভুল নামের নমুনা:
আব্দুন্নবী, আব্দুর রাসূল, গোলাম নবী, গোলাম রসূল, গোলাম মুহাম্মাদ, গোলাম আহমাদ, গোলাম মুছতফা, গোলাম মুরতযা, নূর মুহাম্মাদ, নূর আহমাদ, মাদার বখ্শ, পীর বখ্শ, রূহুল আমীন, সুলতানুল আওলিয়া প্রভৃতি। এতদ্ব্যতীত (১) অহংকার মূলক নাম, যেমন খায়রুল বাশার, শাহজাহান, শাহ আলম, শাহানশাহ প্রভৃতি; (২) নবীগণের উপাধি, যেমন আবুল বাশার, নবীউল্লাহ, খলীলুল্লাহ, কালীমুল্লাহ, রূহুল্লাহ, মুহাম্মাদ আবুল কাসেম; (৩) কুরআনের আয়াতসমূহ, যেমন আলিফ লাম মীম, ত্বোয়াহা, ইয়াসীন, হা-মীম, লেতুনযেরা; (৪) অনর্থক নাম, যেমন লায়লুন নাহার, ক্বামারুন নাহার, আলিফ লায়লা ইত্যাদি। (৫) কুখ্যাত যালেমদের নাম, যেমন নমরূদ, ফেরাঊন, হামান, শাদ্দাদ, ক্বারূণ, মীরজাফর প্রমুখ। (৬) এতদ্ব্যতীত শী‘আদের অনুকরণে নামের আগে বা পিছে আলী, হাসান বা হোসায়েন নাম যোগ করা। (৭) এছাড়াও ঝন্টু, মন্টু, পিন্টু, মিন্টু, হাবলু, জিবলু, বেল্টু, শিপলু, ইতি, মিতি, খেন্তী, বিন্তী, মলী, ডলী ইত্যাদি অর্থহীন নামসমূহ।
(৭) নবজাতকের জন্মের পরপরই তার ডান কানে আযান ও বাম কানে এক্বামত শুনানোর হাদীছ ‘মওযূ’ বা জাল।[30] (ক) কেবল আযান শুনানোর বিষয়ে আবুদাঊদ ও তিরমিযী বর্ণিত হাদীছ সম্পর্কে শায়খ আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন।[31] তবে সর্বশেষ তাহক্বীক্বে তিনি এটাকে ‘যঈফ’ বলেছেন।[32] (খ) ইমাম তিরমিযী বলেন, নবজাতকের কানে আযান শুনানোর উপরে আমল জারি আছে ( والعمل عليه )।[33] (গ) সাবেক সঊদী মুফতী শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন বলেন, এতে কোন অসুবিধা নেই ( لابأس به )। যদিও এর সনদে কিছু বিতর্ক ( مقال ) রয়েছে’। (ঘ) হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) শিশুর কানে আযানের তাৎপর্য বর্ণনা করে বলেন, দুনিয়াতে আগমনের সাথে সাথে তার কানে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বড়ত্বের ও শ্রেষ্ঠত্বের বাণী শুনানো হয়। যেমন দুনিয়া থেকে বিদায়কালে তাকে তাওহীদের কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর তালক্বীন করানো হয়। আযান বাচ্চার মনে দূরবর্তী ও স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে এবং শয়তানকে বিতাড়িত করে’।[34]
আক্বীক্বার গোশত বন্টন:
(ক) আক্বীক্বার গোশত কুরবানীর গোশতের ন্যায় তিন ভাগ করে একভাগ ফকীর-মিসকীনকে ছাদাক্বা দিবে ও একভাগ বাপ-মা ও পরিবার খাবে এবং একভাগ আত্নীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে হাদিয়া হিসাবে বন্টন করবে।[35] চামড়া বিক্রি করে তা কুরবানীর পশুর চামড়ার ন্যায় ছাদাক্বা করে দিবে।[36]
আক্বীক্বার অন্যান্য মাসায়েল:
(ক) আক্বীক্বা একটি ইবাদত। এর জন্য জাঁকজমকপূর্ণ কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না। এ উপলক্ষে আত্নীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে উপঢৌকন নেওয়ারও কোন দলীল পাওয়া যায় না।
(খ) আক্বীক্বা ও কুরবানী দু’টি পৃথক ইবাদত। একই পশুতে কুরবানী ও আক্বীক্বা দু’টি একসাথে করার কোন দলীল নেই।
(গ) আক্বীক্বা ও কুরবানী একই দিনে হ’লে সম্ভব হ’লে দু’টিই করবে। নইলে কেবল আক্বীক্বা করবে। কেননা আক্বীক্বা জীবনে একবার হয় এবং তা সপ্তম দিনেই করতে হয়। কিন্তু কুরবানী প্রতি বছর করা যায়।
(ঘ) শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর হাদীছপন্থী কোন দ্বীনদার আলেমের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁর নিকট থেকে শিশুর ‘তাহনীক’ করানো ও শিশুর জন্য দো‘আ করানো ভাল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা করতেন।[37] ‘তাহনীক’ অর্থ খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবিয়ে বাচ্চার মুখে দেওয়া। হিজরতের পর মদীনায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মুহাজির সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিয়ে ‘তাহনীক’ করেছিলেন। এভাবে তিনিই ছিলেন প্রথম সৌভাগ্যবান শিশু যার পেটে প্রথম রাসূলের পবিত্র মুখের লালা প্রবেশ করে। পরবর্তী জীবনে তিনি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আনছারগণ তাদের নবজাতক সন্তানদের রাসূলের কাছে এনে ‘তাহনীক’ করাতেন। আবু ত্বালহা (রাঃ) তার সদ্যজাত পুত্রকে এনে রাসূলের কোলে দিলে তিনি খেজুর তলব করেন। অতঃপর তিনি তা চিবিয়ে বাচ্চার গালে দেন ও নাম রাখেন ‘আব্দুল্লাহ’।[38] ‘তাহনীক’ করার পর শিশুর কল্যাণের জন্য দো‘আ করবেন- ‘বা-রাকাল্লা-হু আলায়েক’ ‘আল্লাহ তোমার উপরে অনুগ্রহ বর্ষণ করুন’।[39]
(ঙ) শিশু অবস্থায় প্রয়োজন বোধে মেয়েদের কান ফুটানো জায়েয আছে। কেননা জাহেলী যুগে এটা করা হ’ত। কিন্তু ইসলামী যুগে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটাতে কোন আপত্তি করেন নি। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা করা মাকরূহ।[40]
[1]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব।
[2]. মিশকাত হা/৪১৫৮ ‘যবহ ও শিকার’ অধ্যায়, ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
[3]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪১৫৪; আহমাদ, ইরওয়া হা/১১৭৫।
[4]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৮৩, ৩৮৫ পৃঃ।
[5]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৩/৫৮৬; নায়ল ৬/২৬০ পৃঃ।
[6]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৪৯ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
[7]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, আহমাদ; ইরওয়া হা/১১৬৫।
[8]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২৬০ পৃঃ ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায়।
[9]. মিরক্বাত শরহ মিশকাত (দিল্লী ছাপা, তারিখ বিহীন) ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ ৮/১৫৬ পৃঃ।
[10]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬১ পৃঃ।
[11]. নাসাঈ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪১৫২, ৪১৫৬; ইরওয়া হা/১১৬৬।
[12]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪১৫৫; নায়লুল আওত্বার ৬/২৬২,২৬৪ পৃঃ।
[13]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬২ পৃঃ; আওনুল মা‘বূদ হা/২৮১৭-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[14]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/১১৬৮।
[15]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৪১৫৫।
[16]. ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭০।
[17]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬১ পৃঃ।
[18]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬৪ পৃঃ।
[19]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত (বৈরুতঃ ১৯৮৫) ১/১১৩ পৃঃ; সুলায়মান মানছূরপুরী, রাহমাতুল লিল আলামীন (দিল্লী, ১৯৮০) ১/৪১ পৃঃ।
[20]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, আবু ইয়া‘লা, বায়হাক্বী ৯/৩০৪ পৃঃ; নায়ল ৬/২৬২ পৃঃ।
[21]. মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৭৫২‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘নামসমূহ’ অনুচ্ছেদ; ইরওয়া হা/১১৭৬।
[22]. মুসলিম, হা/২৩১৫ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় হা/৬২।
[23]. মুগনী ১১/১২৫; আওনুল মা‘বূদ হা/২৮২১-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৭৫৯ ‘নামসমূহ অনুচ্ছেদ।
[24]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৭৭৪; ছহীহাহ হা/২০৭।
[25]. ত্বাবারাণী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৮।
[26]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৯।
[27]. বুখারী হা/৬১৯০, ৬১৯৩ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ১০৭ অনুচ্ছেদ।
[28]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৭২৫ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।
[29]. আহমাদ, আবদাঊদ, মিশকাত হা/৪৭৬৮ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘নামসমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[30]. ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭৪।
[31]. ছহীহ তিরমিযী হা/১২২৪; ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭৩।
[32]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১২১; হেদায়াতুর রুওয়াত শরহ মিশকাত হা/৪০৮৫, ৪/১৩৮ পৃঃ।
[33]. তিরমিযী হা/১৫৬৯; আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/১২২৪; ‘কুরবানী’ অধ্যায়, ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ নং ১৫; তুহফা হা/১৫৫৩।
[34]. ইবনুল ক্বাইয়িম, তুহফাতুল মওলূদ পৃঃ ২৫-২৬।
[35]. বায়হাক্বী ৯/৩০২ পৃঃ।
[36]. ইবনে রুশদ কুরতুবী, বেদায়াতুল মুজতাহিদ (রাবাত্ব, মরক্কো: ১৪১৯ হিঃ) ১/৪৬৭ পৃঃ।
[37]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪১৫১ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।
[38]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৩/৫৯০ পৃঃ।
[39]. মিরক্বাত (দিল্লী ছাপা : তারিখ বিহীন) ৮/১৫৫ পৃঃ।
[40]. ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রোঃ দারুল ফাৎহ ১৪১২/১৯৯২) পৃঃ ২/৩৪।
প্রত্যেক মুসলিম শিশুর জন্য খাৎনা করা সুন্নাত। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
عن أبي هريرة قال قال رسولُ الله صلى الله عليه وسلم : الْفِطْرَةُ خَمْسٌ، الخِتَانُ والإِسْتِحْدَادُ وقَصُّ الشَّارِبِ وتَقْلِيْمُ الأَظْفَارِ ونَتْفُ الإِبِطِ، متفق عليه -
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, পাঁচটি বিষয় মানুষের স্বভাবজাত (১) খাৎনা করা (২) নাভির নীচের লোম ছাফ করা (৩) গোঁফ ছাটা (৪) নখ কাটা ও (৫) বগলের লোম ছাফ করা’।[1]
খাৎনা বিষয়ে জ্ঞাতব্য:
উপরোক্ত হাদীছে খাৎনা করাকে মানুষের ফিৎরাত বা স্বভাবজাত বলা হ’লেও এটি মূলতঃ নবীগণের সুন্নাত এবং নিঃসন্দেহে এটি চিরন্তন মানবীয় সভ্যতার পরিচায়ক। খাৎনা করায় যে স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে এবং এর মধ্যে যে অফুরন্ত কল্যাণ রয়েছে, সে বিষয়ে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণ সকলে একমত। শিশুকালে খাৎনা করার কারণে বয়সকালে ঐ ব্যক্তি অসংখ্য অজানা রোগ থেকে বেঁচে যায়। হযরত ইবরাহীম (আঃ) ৮০ বছর বয়সে আল্লাহর নির্দেশে নিজের খাৎনা করেছিলেন।[2]
অতএব শিশুর আক্বীক্বা করা যেমন যরূরী, খাৎনা করা তার চেয়ে বেশী যরূরী। শিশুকালেই এ কর্তব্য সম্পন্ন করা আবশ্যক। খাৎনা হ’ল ফিৎরত এবং নবীগণের সুন্নাত। সাথে সাথে এটি স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য অনুসঙ্গ। এটি মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে পার্থক্যও বটে। উল্লেখ্য যে, কন্যা শিশুর খাৎনা করার কোন দলীল নেই।
করনীয় ও বর্জনীয়:
খাৎনা একটি ইবাদত। আল্লাহভীরু এবং অভিজ্ঞ মুসলিম খাৎনা কারীর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে এটি করানো কর্তব্য।
বর্জনীয়: খাৎনা উপলক্ষ্যে বাচ্চার হাতে ও কোমরে তাগা বা মাদুলী বাঁধা, গলায় তাবীয ঝুলানো, ঘর বন্ধ করা, বাপ-মায়ের না খেয়ে থাকা, ধামা বা কাঠার উপরে বাচ্চাকে বসানো ও পান দিয়ে তার চোখ ধরা, খাৎনার কাটা অংশ কাঁসার পাতিলে রাখা, খাৎনার পরে বাচ্চার হাতে কিছুদিন সর্বদা লোহা রাখা, খাৎনার কয়েক দিন পর বাচ্চার গোসলের দিন আনন্দ অনুষ্ঠান করে ছেলে-মেয়েদের নাচানাচি, রং মাখা-মাখি, কাদা মাখা-মাখি, মাইক বাজানো, গান-বাজনা ইত্যাদি কুসংস্কার ও কোনরূপ শিরক-বিদ‘আত করা যাবে না। একইভাবে ‘সুন্নাতে খাৎনা’র নামে কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না বা একে উপঢৌকন নেওয়ার মাধ্যমে পরিণত করা যাবে না। তাতে সুন্নাত পালনের নেকী পাওয়া যাবে না। বরং বিদ‘আতের গোনাহ কামাই করতে হবে। অতএব পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণ সাবধান!!
سبحانك اللهم و بحمدك أشهد أن لآ إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك، اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب -
[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৪২০ ‘পোষাক’ অধ্যায় ‘চুল আঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ।
[2] . বুখারী, আবু হুরায়রা হ’তে হা/৩৩৫৬, ৬২৯৭।
عن أبي هريرة قال قال رسولُ الله صلى الله عليه وسلم : الْفِطْرَةُ خَمْسٌ، الخِتَانُ والإِسْتِحْدَادُ وقَصُّ الشَّارِبِ وتَقْلِيْمُ الأَظْفَارِ ونَتْفُ الإِبِطِ، متفق عليه -
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, পাঁচটি বিষয় মানুষের স্বভাবজাত (১) খাৎনা করা (২) নাভির নীচের লোম ছাফ করা (৩) গোঁফ ছাটা (৪) নখ কাটা ও (৫) বগলের লোম ছাফ করা’।[1]
খাৎনা বিষয়ে জ্ঞাতব্য:
উপরোক্ত হাদীছে খাৎনা করাকে মানুষের ফিৎরাত বা স্বভাবজাত বলা হ’লেও এটি মূলতঃ নবীগণের সুন্নাত এবং নিঃসন্দেহে এটি চিরন্তন মানবীয় সভ্যতার পরিচায়ক। খাৎনা করায় যে স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে এবং এর মধ্যে যে অফুরন্ত কল্যাণ রয়েছে, সে বিষয়ে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণ সকলে একমত। শিশুকালে খাৎনা করার কারণে বয়সকালে ঐ ব্যক্তি অসংখ্য অজানা রোগ থেকে বেঁচে যায়। হযরত ইবরাহীম (আঃ) ৮০ বছর বয়সে আল্লাহর নির্দেশে নিজের খাৎনা করেছিলেন।[2]
অতএব শিশুর আক্বীক্বা করা যেমন যরূরী, খাৎনা করা তার চেয়ে বেশী যরূরী। শিশুকালেই এ কর্তব্য সম্পন্ন করা আবশ্যক। খাৎনা হ’ল ফিৎরত এবং নবীগণের সুন্নাত। সাথে সাথে এটি স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য অনুসঙ্গ। এটি মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে পার্থক্যও বটে। উল্লেখ্য যে, কন্যা শিশুর খাৎনা করার কোন দলীল নেই।
করনীয় ও বর্জনীয়:
খাৎনা একটি ইবাদত। আল্লাহভীরু এবং অভিজ্ঞ মুসলিম খাৎনা কারীর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে এটি করানো কর্তব্য।
বর্জনীয়: খাৎনা উপলক্ষ্যে বাচ্চার হাতে ও কোমরে তাগা বা মাদুলী বাঁধা, গলায় তাবীয ঝুলানো, ঘর বন্ধ করা, বাপ-মায়ের না খেয়ে থাকা, ধামা বা কাঠার উপরে বাচ্চাকে বসানো ও পান দিয়ে তার চোখ ধরা, খাৎনার কাটা অংশ কাঁসার পাতিলে রাখা, খাৎনার পরে বাচ্চার হাতে কিছুদিন সর্বদা লোহা রাখা, খাৎনার কয়েক দিন পর বাচ্চার গোসলের দিন আনন্দ অনুষ্ঠান করে ছেলে-মেয়েদের নাচানাচি, রং মাখা-মাখি, কাদা মাখা-মাখি, মাইক বাজানো, গান-বাজনা ইত্যাদি কুসংস্কার ও কোনরূপ শিরক-বিদ‘আত করা যাবে না। একইভাবে ‘সুন্নাতে খাৎনা’র নামে কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না বা একে উপঢৌকন নেওয়ার মাধ্যমে পরিণত করা যাবে না। তাতে সুন্নাত পালনের নেকী পাওয়া যাবে না। বরং বিদ‘আতের গোনাহ কামাই করতে হবে। অতএব পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণ সাবধান!!
سبحانك اللهم و بحمدك أشهد أن لآ إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك، اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب -
[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৪২০ ‘পোষাক’ অধ্যায় ‘চুল আঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ।
[2] . বুখারী, আবু হুরায়রা হ’তে হা/৩৩৫৬, ৬২৯৭।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন