HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ আঁকড়ে ধরা ও বিদ‘আত থেকে সতর্ক থাকা

লেখকঃ আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন বায রহ.

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ আঁকড়ে ধরা ও বিদ‘আত থেকে সতর্ক থাকা

আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন বায রহ.

অনুবাদক: মুহাম্মদ রকীবুদ্দীন হুসাইন

সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ আঁকড়ে ধরা ও বিদ‘আত থেকে সতর্ক থাকা
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি দীনকে পূর্ণতা দান করেছেন এবং আমাদের জন্য সকল কল্যাণ বিধান করে ইসলামকে দীন হিসেবে নির্বাচন করেছেন। শান্তি ও করুণা বর্ষিত হউক তাঁরই বিশেষ বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদের ওপর যিনি অতিরঞ্জন, বিদ‘আত (নব প্রথা) ও পাপাচার হতে মুক্ত থেকে তাঁর রবের আনুগত্য করার প্রতি আহ্বান করেছেন। আল্লাহ তাঁর ওপর, তাঁর বংশধর ও সাহাবী এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা তাঁর প্রদর্শিত পথের অনুসারী হবে সকলের ওপর করুণা বর্ষণ করুন।

ভারতের উত্তর প্রদেশের শিল্পনগরী কানপুর থেকে প্রকাশিত ‘ইদারত’ নামক এক উর্দূ সাপ্তাহিকীর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ সম্পর্কে আমি অবহিত হলাম। এতে প্রকাশ্যভাবে সৌদী আরবের অনুসৃত ইসলামী আকীদাসমূহ এবং বিদ‘আত বিরোধিতার উপর আক্রমণাত্মক অভিযান চালানো হয়েছে। সৌদী সরকার কর্তৃক অনুসৃত সালাফে সালেহীনের আকীদাকে সুন্নাহ বিরোধী বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। লেখক আহলে সুন্নাতের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করে তাদের মধ্যে বিদ‘আত ও কুসংস্কারের প্রসার সাধনের দুরভিসন্ধি নিয়েই উক্ত প্রবন্ধটি রচনা করেছেন।

নিঃসন্দেহে এটি একটি জঘন্য আচরণ ও ভয়ানক চক্রান্ত, যার উদ্দেশ্য ইসলাম ধর্মের ক্ষতি, ভ্রষ্টতা ও বিদ‘আতের প্রসার সাধন। লেখক রাসূলুল্লাহর জন্মানুষ্ঠান বা মীলাদ মাহফিল আয়োজনের উপর পরিষ্কারভাবে জোর দিয়েছেন এবং এ প্রসঙ্গ ধরে সৌদী আরব ও তার নেতৃত্বের বিশুদ্ধ আকীদার উপর বিরূপ আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। অতএব, জনসাধারণকে এ সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য প্রার্থনা করে আমি নিম্নোক্ত বক্তব্য প্রদান করছি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অন্য কারো জন্মোৎসব পালন করা জায়েয নয়; বরং তা থেকে মানুষকে বারণ করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা এটি ধর্মে নব প্রবর্তিত একটি বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও এ কাজ করেন নি। তাঁর নিজের বা তাঁর পূর্ববর্তী কোনো নবী বা তাঁর কোনো দুহিতা, স্ত্রী, আত্মীয় অথবা কোনো সাহাবীর জন্মদিন পালনের কোনো নির্দেশ তিনি দেন নি। খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবীয়ে কেরাম (আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের সকলের উপর সন্তুষ্ট হউন) অথবা তাদের সঠিক অনুসারী তাবেয়ীনদের মধ্যেও কেউই এমন কাজ করেন নি। এমনকি, আমাদের পূর্ববর্তী অধিকতর উত্তম যুগে কোনো আলেমও এ কাজ করেননি। অথচ তাঁরা সুন্নাহ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞান রাখতেন এবং আল্লাহর রাসূল ও তাঁর শরী‘আত পালনকে সর্বাধিক ভালোবাসতেন। যদি এ কাজটি এমনই সওয়াবের হতো তাহলে তাঁরা আমাদের আগেই তা করতেন।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দীন। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূলের মাধ্যমে যে শরীয়ত প্রবর্তন করেছেন তা স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধায় আমাদেরকে তা অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বিদ‘আত বা নতুন কোনো প্রথার সংযোজন থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এ শিক্ষা সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের সঠিক অনুসারী তাবেঈনদের কাছ থেকে সদন্তঃকরণে গ্রহণ করেছেন।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,

«مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ، فَهُوَ رَدٌّ»

“যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন বিষয় তৈরি করবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা হবে প্রত্যাখ্যাত।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৬৯৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৮]

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত অন্য এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ»

“যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করলো যার ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই, তবে সে কাজটি প্রত্যাখ্যাত।” [সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১৭১৮]

তিনি অন্য এক হাদীসে বলেন,

«فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَة »

“তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত পালন করবে। আর তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করবে। সাবধান! কখনও ধর্মে নব প্রবর্তিত কোনো বিষয় গ্রহণ করবে না। কেননা প্রত্যেক নব প্রবর্তিত বিষয়ই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা।” [সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৬০৭]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিন খুতবায় বলতেন,

« فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ، وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ، وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا، وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ »

“নিশ্চয়ই সর্বোত্তম কথা হলো আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম তরীকা হলো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা। সর্ব নিকৃষ্ট বিষয় হলো মনগড়া নব প্রবর্তিত বিষয় বিদ‘আত এবং এরূপ প্রতিটি বিদ‘আত-ই পথভ্রষ্টতা।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৬৭]

এই সমস্ত হাদীসে বিদ‘আত প্রবর্তনের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং উম্মতকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। আর এতে লিপ্ত হওয়া থেকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আরো অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ ﴾ [ الحشر : ٧ ]

“রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদের বারণ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣﴾ [ النور : ٦٣ ]

“যারা তাঁর (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের) হুকুমের বিরোধিতা করে তাদের ভয় করা উচিত যে, তাদের ওপর কোনো ফিৎনা বা কোনো মর্মন্তুদ শাস্তি আসতে পারে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١﴾ [ الاحزاب : ٢١ ]

“প্রকৃতপক্ষে, তোমাদের মধ্যে যারা পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব বেশি করে স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে এক সর্বোত্তম আদর্শ বর্তমান রয়েছে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ وَأَعَدَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي تَحۡتَهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١٠٠﴾ [ التوبة : ١٠٠ ]

“সে সব মুহাজির ও আনসার, যারা সর্বপ্রথম ঈমানের দাওয়াত কবুল করেছিল এবং যারা নিতান্ত সততার সাথে তাদের অনুসরণ করেছিল তাদের ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন এবং তারাও আল্লাহ তা‘আলার উপর সন্তুষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য এমন জান্নাতসমূহ তৈরি করে রেখেছেন যার নিুদেশে ঝর্ণাধারা সর্বদা প্রবাহমান। এ জান্নাতে তারা চিরস্থায়ী হবে। বস্তুত: এটা এক বিরাট সাফল্য।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০০]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿ ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ ﴾ [ المائ‍دة : ٣ ]

“আজ আমি তোমাদের দীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসাবে পছন্দ করে নিলাম।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৩]

এই আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রবর্তিত দীনকে ও তাঁর নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ওপর অর্পিত বালাগে মুবীন বা স্পষ্ট বার্তাকে পৌঁছাবার এবং কথায় ও কাজে শরী‘আতকে বাস্তবায়িত করার পরই পরলোক গমন করেন। তিনি এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলে গিয়েছেন যে, তাঁর পরে লোকেরা কথায় বা কাজে যেসব নব প্রথার উদ্ভাবন করে শরী‘আতের সাথে সম্পৃক্ত করবে সেসব বিদ‘আত বিধায় প্রত্যাখ্যাত হবে। যদিও এসব বক্তব্যের প্রবক্তার উদ্দেশ্য সৎ থেকে থাকে। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ বিদ‘আত থেকে জনগণকে সতর্ক ও ভয় প্রদর্শন করেছেন। কেননা এটা ধর্মে অতিরিক্ত সংযোজন যার অনুমতি আল্লাহ তা‘আলা কাউকে দেন নি এবং এটা আল্লাহর শত্রু ইয়াহূদী ও খ্রিস্টান কর্তৃক তাদের ধর্মে নব নব প্রথা সংযোজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে। এরূপ করার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ইসলামকে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ বলে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার সুযোগ প্রদান করা। এটা যে কত বড় ফাসাদ ও জঘন্য কর্ম এবং আল্লাহর বাণীর বিরোধী তা সর্বজন বিদিত।

আল্লাহ বলেন,

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ﴾ [ المائ‍دة : ٣ ]

“আজ আমি তোমাদের দীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিলাম।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৩]

সেই সাথে এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিষ্কার হাদীসসমূহ যেগুলোতে তিনি বিদ‘আত থেকে সতর্ক ও দূরে থাকতে বলেছেন সেগুলোরও সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

মীলাদ মহফিল বা নবীর জন্মোৎসব পালন বা এ জাতীয় অন্যান্য উৎসবাদির প্রবর্তনের মাধ্যমে এ কথাই বোঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা এই উম্মতের জন্য ধর্মকে পূর্ণতা দান করেন নি এবং যা যা করণীয় তার বার্তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের নিকট পৌঁছাননি। তাই পরবর্তী কালের এই সব লোকেরা এসে এমন কিছু প্রবর্তন করেছে যার অনুমতি আল্লাহ তা‘আলা তাদের দেননি। অথচ তারা ভাবছে এতে আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হবে। নিঃসন্দেহে এতে মারাত্মক ভয়ের কারণ রয়েছে এবং তা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আপত্তি উত্থাপনের শামিল। অথচ আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের ধর্মকে সর্বাঙ্গীনভাবে পূর্ণ করেছেন ও তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও স্পষ্ট বার্তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়েছেন। তিনি এমন কোনো পথ যা জান্নাতের পানে নিয়ে যায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে উম্মতকে তা বাতলাতে কসূর করেন নি। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

« إِنَّهُ لَمْ يَكُنْ نَبِيٌّ قَبْلِي إِلَّا كَانَ حَقًّا عَلَيْهِ أَنْ يَدُلَّ أُمَّتَهُ عَلَى خَيْرِ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ، وَيُنْذِرَهُمْ شَرَّ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ »

“আল্লাহ আমার পূর্বে যেই নবীই প্রেরণ করেছিলেন, উম্মতের প্রতি তাঁদের দায়িত্ব এই ছিল যে, উম্মতের জন্য যা কিছু ভাল জানেন, তাই বলবেন আর যা কিছু মন্দ বলে জানেন, তা থেকে তাদেরকে সতর্ক করবেন।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৪৪; সুনান নাসাঈ, হাদীস নং ৪১৯১]

এ কথা সকলের জানা আছে যে, আমাদের নবী সকল নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ। তিনি সবার চেয়ে অধিক পরিপূর্ণভাবে দীনের পয়গাম ও উপদেশ বার্তা পৌঁছিয়েছেন। যদি মীলাদ মাহফিল আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দীনের অংশ হতো তাহলে তিনি নিশ্চয়ই উম্মতের কাছে বর্ণনা করতেন। যেহেতু এমন কিছু পাওয়া যায় না, তাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের সাথে এ মীলাদ মাহফিলের কোনোই সম্পর্ক নেই; বরং এটি বিদ‘আত যা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। যেমন পূর্বোল্লিখিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

এক দল উলামা উপরোক্ত ও অন্যান্য দলীলের ওপর ভিত্তি করে মীলাদ মাহফিল পালনের বৈধতা অস্বীকার করতঃ এ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। এটা জানা কথা যে, বিরোধপূর্ণ বিষয় এবং হালাল বা হারামের ব্যাপারে শরী‘আতের নীতি হলো কুরআন ও হাদীসে রাসূল-এর মীমাংসা অনুসন্ধান করা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩ ﴾ [ النساء : ٥٩ ].

“হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে কর্তা ব্যক্তিদের। যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মত বিরোধ দেখা দেয় তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও যদি তোমরা আল্লাহ তা‘আলা ও কিয়ামতের উপর বিশ্বাস করে থাক। এটাই উৎকৃষ্ট এবং পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম পন্থা।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৫৯]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿ وَمَا ٱخۡتَلَفۡتُمۡ فِيهِ مِن شَيۡءٖ فَحُكۡمُهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِۚ ﴾ [ الشورا : ١٠ ]

“তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ করো না কেন তার মীমাংসা আল্লাহরই নিকট রয়েছে।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১০]

যদি এ মীলাদ মহফিলের বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন শরীফের দিকে ফিরে যাই তাহলে দেখতে পাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ যা আদেশ বা নিষেধ করেছেন আমাদের তা-ই অনুসরণ করার নির্দেশ দেন এবং জানান যে, তিনি এ উম্মতের জন্য দীনকে পূর্ণতা দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার মধ্যে মীলাদ অনুষ্ঠানের কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। সুতরাং এ কাজ সে দীনের অন্তর্ভুক্ত নয় যা আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য পূর্ণ করে দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে আমাদেরকে তাঁর রাসূলের পদাঙ্ক অনুসরণ করার নির্দেশ রয়েছে।

এভাবে যদি আমরা এ ব্যাপারে সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ এ কাজ করেন নি, এর আদেশও দেন নি। এমনকি তাঁর সাহাবীগণও (তাঁদের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি বর্ষিত হউক) তা করেননি। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, এটা ধর্মীয় কাজ নয় বরং বিদ‘আত এবং ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের উৎসবসমূহের অন্ধ অনুকরণ। যে ব্যক্তির সামান্যতম বিচক্ষণতা আছে এবং হক গ্রহণে ও তা অনুসন্ধানে সামান্যতম বিবেক ও আগ্রহ রাখে তার বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে না যে, ধর্মের সাথে মীলাদ মহফিল বা যাবতীয় জন্ম বার্ষিকী পালনের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং যে বিদ‘আতসমূহ থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নিষেধ ও সতর্ক করেছেন এটি সেগুলোরই অন্তর্ভুক্ত।

বিভিন্ন স্থানে অধিক সংখ্যক লোককে এই বিদ‘আতী কাজে লিপ্ত দেখে কোনো বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে প্রবঞ্চিত হওয়া সংগত নয়। কেননা ন্যায় বা হক, লোকের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে জানা যায় না বরং শরী‘আতের দলীলসমূহের মাধ্যমে তা অনুধাবন করা হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের সম্পর্কে বলেছেন,

﴿ وَقَالُواْ لَن يَدۡخُلَ ٱلۡجَنَّةَ إِلَّا مَن كَانَ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ تِلۡكَ أَمَانِيُّهُمۡۗ قُلۡ هَاتُواْ بُرۡهَٰنَكُمۡ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١١١ ﴾ [ البقرة : ١١١ ]

“তারা বলে ইয়াহূদী ও খ্রিস্টান ছাড়া অন্য কেউ জান্নাতে কখনও প্রবেশ করবে না। এটা তাদের মিথ্যা আশা। আপনি বলুন, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে যুক্তি প্রমাণ নিয়ে এসো।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১১১]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿ وَإِن تُطِعۡ أَكۡثَرَ مَن فِي ٱلۡأَرۡضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ ﴾ [ الانعام : ١١٦ ]

“যদি আপনি এই পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের অনুসরণ করেন তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহ তা‘আলার পথ থেকে বিভ্রান্ত করে দেবে।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১১৬]

এই মীলাদ মাহফিলসমূহ বিদ‘আত হওয়ার সাথে সাথে অনেক এলাকায় প্রায়শঃ তা অন্যান্য পাপাচার থেকেও মুক্ত হয় না। যেমন নারী-পুরুষের সংমিশ্রণ, গান-বাজনা ও মাদক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। সর্বোপরি এই সব মাহফিলে শির্কে আকবর সংঘটিত হয়ে থাকে। আর তা হলো: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য আওলিয়ায়ে কেরামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা। তাদের কাছে দু‘আ করা, সাহায্য ও বিপদ মুক্তির প্রার্থনা করা। এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, তাঁরা গায়েব জানেন। এ সকল কাজ এমন যা করলে লোক কাফের হয়ে যায়। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে রয়েছে, তিনি বলেছেন,

«يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِي الدِّينِ، فَإِنَّهُ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِي الدِّينِ»

“সাবধান! ধর্মে অতিরঞ্জন করো না। তোমাদের আগে যারা ছিল তারা ধর্মে অতিরঞ্জনের ফলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।” [সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২৯]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,

« لاَ تُطْرُونِي، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ، وَرَسُولُهُ »

“তোমরা আমার এমন অতি প্রশংসা করো না যেমন খ্রিস্টানগণ ইবনে মারইয়ামের (ঈসা ‘আলাইহিস সালাম) অতি প্রশংসায় লিপ্ত হয়েছিল। আমি একজন বান্দা, তাই আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলে উল্লেখ করো।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৪৪৫]

অতীব আশ্চর্য ও বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, অনেক লোক এ ধরনের বিদ‘আতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য খুবই তৎপর ও সচেষ্ট এবং এর স্বপক্ষে যুক্তি প্রমাণ দাঁড় করাতে স্বতঃ প্রস্তুত। অথচ তারা জামাতের নামাযে ও জুমার নামাযে অনুপস্থিত থাকতে কুণ্ঠাবোধ করে না, যদিও তা আল্লাহ ওয়াজিব করেছেন। এমনকি এ বিষয়ে তারা মস্তক উত্তোলনও করে না এবং এটাও উপলব্ধি করে না যে, তারা একটি মারাত্মক অন্যায় কাজ করছে। নিঃসন্দেহে ঈমানের দুর্বলতা, ক্ষীণ বিচক্ষণতা ও নানা রকম পাপাচার হৃদয়ে আসন করে নেওয়ার ফলেই এ রকম হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমাদের এবং সকল মুসলিমের জন্য সংযম ও নিরাপত্তা কামনা করি।

এর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, অনেকের ধারণা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীলাদ মহফিলে উপস্থিত হন। তাই তারা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দাঁড়িয়ে যায়। এটা মস্ত বড় অসত্য ও হীন অজ্ঞতা বৈ কিছু নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের পূর্বে তাঁর কবর থেকে বের হবেন না, বা কারো সাথে যোগাযোগ করবেন না এবং কোনো সমাবেশেও উপস্থিত হবেন না; বরং তিনি কিয়ামত পর্যন্ত স্বীয় কবরেই অবস্থান করবেন এবং তাঁর পাক রূহ রবের নিকট ঊর্ধ্বস্থিত ইল্লিয়ীনের সম্মানজনক স্থানে সংরক্ষিত থাকবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ ثُمَّ إِنَّكُم بَعۡدَ ذَٰلِكَ لَمَيِّتُونَ ١٥ ثُمَّ إِنَّكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ تُبۡعَثُونَ ١٦ ﴾ [ المؤمنون : ١٥، ١٦ ]

“এরপর তোমাদের অবশ্যই মরতে হবে, অতঃপর কিয়ামতের দিন তোমাদের অবশ্যই পুনরুজ্জীবিত করা হবে।” [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ১৫-১৬]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«أَنَا أَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ، وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ»

“কিয়ামতের দিন আমার কবরই সর্ব প্রথম বিদীর্ণ হবে। আমিই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমারই সুপারিশ সবার আগে গৃহীত হবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২৭৮]

এ আয়াত ও হাদীস শরীফ এবং এই অর্থে যেসব আয়াত ও হাদীস এসেছে তার দ্বারা বুঝা যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ অন্যান্য সব মৃত লোক শুধু কিয়ামতের দিনই তাদের কবর থেকে বের হবেন। সমস্ত মুসলিম আলেমের মধ্যে এ ব্যাপারে ঐক্যমত (ইজমা‘) প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এতে কারো মত বিরোধ নেই। সুতরাং সকল মুসলিমের উচিত এসব বিষয়ে অবহিত হওয়া এবং অজ্ঞ লোকেরা যেসব বিদ‘আত ও কুসংস্কার আল্লাহ পাকের নির্দেশ ব্যতিরেকে প্রবর্তন করেছে সেসব বিষয়ে সতর্ক থাকা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ ও সালাম পড়া নিঃসন্দেহে একটি ভাল আমল এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক উত্তম পন্থা।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ وَمَلَٰٓئِكَتَهُۥ يُصَلُّونَ عَلَى ٱلنَّبِيِّۚ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ صَلُّواْ عَلَيۡهِ وَسَلِّمُواْ تَسۡلِيمًا ٥٦ ﴾ [ الاحزاب : ٥٦ ]

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ও ফিরিশতাগণ নবীর প্রতি রহমত পাঠান। হে মুমিনগণ তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ ও সালাম পাঠাও।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৬]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

« مَنْ صَلَّى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى الله عَلَيْهِ عَشْرًا »

“যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠায় আল্লাহ তা‘আলা এর প্রতিদানে তার উপর দশবার রহমত নাযিল করেন।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪০৮]

সব সময়ই দরূদ পড়ার বৈধতা রয়েছে। তবে নামাযের শেষে পড়ার জন্য বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে বরং অনেক আলেমের মতে নামাযের মধ্যে শেষ তাশাহহুদের সময় দরূদ পড়া ওয়াজিব। অনেক ক্ষেত্রে এই দরূদ পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। যেমন, আযানের পরে, জুম‘আর দিনে ও রাতে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উল্লেখ করা হলে। এ ব্যাপারে অনেক হাদীস রয়েছে। এ বিষয়ে আমি যা সতর্ক করতে চেয়েছিলাম তা করেছি। আশা করি, আল্লাহ তা‘আলা যার প্রতি উপলব্ধির দ্বার খুলেছেন ও যার দৃষ্টি শক্তিতে আলো দান করেছেন তার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।

আমার জেনে খুবই দুঃখ হয় যে, এরূপ বিদ‘আতী অনুষ্ঠান এমন সব মুসলমান দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে যারা তাদের আকায়েদ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতের ব্যাপারে খুবই দৃঢ়তা রাখেন। যে এই সবের প্রবক্তা তাকে বলছি, যদি তুমি সুন্নী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী হওয়ার দাবি রাখ তাহলে বল, তিনি স্বয়ং বা তাঁর কোনো সাহাবী বা তাঁদের সঠিক অনুসারী কোনো তাবেঈ কি এ কাজটি করেছেন, না এটা ইয়াহূদী ও খ্রিস্টান বা তাদের মত অন্যান্য আল্লাহর শত্রুদের অন্ধ অনুকরণ? এ ধরনের মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা প্রতিফলিত হয় না। যা করলে ভালোবাসা প্রতিফলিত হয় তা হলো তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করা, যা কিছু তিনি বলেছেন তা বিশ্বাস করা, যা কিছু নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা। আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ করেছেন কেবল সেভাবেই তাঁর ইবাদাত করা। এমনিভাবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উল্লেখ করা হলে, সালাতের সময় ও সদা সর্বদা যে কোনো উপলক্ষে তাঁর ওপর দুরূদ পাঠ করার মাধ্যমে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রমাণিত হয়।

এ সমস্ত বিদ‘আতী বিষয় অস্বীকার করে ওয়াহাবী আন্দোলন (লেখকের ভাষায়) নতুন কিছু করে নি। বস্তুতঃ ওয়াহাবীদের আকীদা হলো নিম্নরূপ:

কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঁকড়ে ধরা এবং রাসূল, তাঁর খুলাফায়ে রাশেদীন ও তাঁদের সঠিক অনুসারী তাবেঈনদের প্রদর্শিত পথে চলা। আল্লাহর মারেফাতের ক্ষেত্রে সালাফে সালেহীন, আইম্মায়ে দীন ও ধর্মীয় শাস্ত্রবিদগণের পথ অনুসরণ করা এবং আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে (গুণাবলি) সেভাবে গ্রহণ করা যেভাবে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এবং যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ সমর্থন ও গ্রহণ করেছেন। ওহ্হাবীগণ আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে অবিকৃত ও দৃষ্টান্তহীন এবং কোনো ধরন ব্যতিরেকে বিনা দ্বিধায় সেভাবে প্রমাণিত ও বিশ্বাস করে চলেন যেভাবে তা তাদের কাছে পৌঁছেছে। তারা তাবেঈন ও তাদের অনুসারী (যারা ছিলেন ইলম, ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী) সালাফে সালেহীন ও আইম্মায়ে দীনের পথই আঁকড়ে ধরে আছেন। তাঁরা এ-ও বিশ্বাস করেন যে, ঈমানের মূল ভিত্তি হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ (আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্যিকার মা‘বূদ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।) এটাই এক আল্লাহর উপর বিশ্বাসের মূল ভিত্তি ও ঈমানের প্রধান কথা। তাঁরা এ-ও বিশ্বাস করেন যে, এ ঈমানী ভিত্তির প্রতিষ্ঠায় ইলম, আমল এবং ইজমায়ে মুসলিমের (সমগ্র মুসলিমদের ঐক্যমত) স্বীকৃতি অপরিহার্য।

এ মৌল বাক্যের অর্থ হলো: একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করা অবশ্য কর্তব্য, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য যা কিছু বা যে কেউ হোক কারোর উপাসনা করা যাবে না। এ সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যার জন্য জিন্ন ও ইনসানকে সৃষ্টি করা হয়েছে, রাসূলগণকে প্রেরণ করা হয়েছে এবং আসমানী গ্রন্থসমূহ অবতীর্ণ করা হয়েছে। এতে রয়েছে একমাত্র আল্লাহরই প্রতি বিনয় ও ভালোবাসা, আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন। এরই নাম ইসলাম ধর্ম যা ব্যতীত অন্য কোনো দীন না পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে না পরবর্তীদের কাছ থেকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য। সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম দীনে ইসলামের অনুগামী ছিলেন এবং ইসলামের অন্তর্নিহিত আত্মসমর্পণের গুণে গুণান্বিত ছিলেন। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে এবং সেই সাথে অন্যের কাছেও আত্মসমর্পণ করে বা প্রার্থনা করে সে মুশরিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে না, সে আল্লাহর ইবাদাত করতে অহংকারী দাম্ভিক বলে বিবেচিত।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ﴾ [ النحل : ٣٦ ]

“আমি প্রত্যেক জাতির প্রতি রাসূলুল্লাহ প্রেরণ করেছি এই নির্দেশ দিয়ে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাগুত (শয়তান ও অনুরূপ ভ্রান্ত শক্তি) থেকে দূরে থাক।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]

ওয়াহাবীরা ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষীর বাস্তবায়নে বিদ‘আত, কুসংস্কার এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ প্রবর্তিত শরী‘আত বিরোধী আচার অনুষ্ঠান বর্জনে দৃঢ় বিশ্বাসী।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহাবের (তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার রহমত বর্ষিত হউক) এ ছিল আকীদা। এ আকীদার ভিত্তিতেই তিনি আল্লাহর বন্দেগী করেন এবং এর প্রতিই লোকদের আহ্বান জানান। যে ব্যক্তি এ ছাড়া অন্য কিছু তাঁর প্রতি সম্পৃক্ত করে, সে মিথ্যা এবং বানোয়াট বলে স্পষ্ট পাপ করছে। সে এমন কথা বলছে, যা তার জানা নেই। আল্লাহ তাকে এবং তার মত এইরূপ অপবাদকারীদের যথাযথ শাস্তি দিবেন।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহাব যেসব মূল্যবান বিবৃতি দিয়েছেন এবং অতি উচ্চমানের অনন্য গবেষণাপত্র ও পুস্তিকাদি রচনা করেছেন তাতে তিনি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা‘র আলোকে তাওহীদ, ইখলাস ও শাহাদাতের আলোচনা করে আল্লাহ ছাড়া অন্য সকলের ইবাদতের যোগ্যতা খণ্ডন করেছেন এবং ছোট বড় সকল প্রকার শির্ক থেকে পাক হয়ে শুধুমাত্র আল্লাহকেই পূর্ণভাবে ইবাদাতের যোগ্য বলে স্বীকার করার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। যে ব্যক্তি তাঁর পুস্তিকাদি যথাযথ অধ্যয়ন করেছে এবং তাঁর সুশিক্ষিত ও যোগ্যতা সম্পন্ন সহচর ও শিষ্যদের মতাদর্শ সম্পর্কে অবহিত হয়েছে সে সহজেই বুঝতে পারে যে, তিনি সালাফে সালেহীন ও আইম্মায়ে দীনের মতাদর্শেরই অনুসারী ছিলেন। তিনি তাঁদেরই মত একমাত্র আল্লাহর এবাদতের কথা বলতেন এবং কুসংস্কার-বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করতেন। সৌদী সরকার এই মতের উপরই প্রতিষ্ঠিত এবং সৌদী উলামায়ে কেরামও এই মতাদর্শের উপরই চলেছেন। সৌদী সরকার একমাত্র ইসলাম ধর্ম বিরোধী বিদ‘আত ও কুসংস্কার এবং ধর্মীয় ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিষিদ্ধ সীমাতিরিক্ত ভক্তি ও অতিরঞ্জনের বিরুদ্ধেই কঠোরভাবে সোচ্চার। সৌদী আলেম সমাজ, জনগণ ও শাসকবর্গ প্রতিটি মুসলিমকে অঞ্চল ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেন। তাদের মনে সবার জন্য রয়েছে গভীর ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও মর্যাদা বোধ। কিন্তু যারা ভ্রান্ত ধর্মে বিশ্বাস রাখে এবং বিদ‘আতী ও কুসংস্কার পূর্ণ উৎসবাদি পালন করে তাদের এই কার্যকলাপ তাঁরা অস্বীকার করেন ও করতে নিষেধ করেন। কেননা এসব কাজ ধর্মে নতুন সংযোজন হিসেবে পরিগণিত আর সব নতুন সংযোজনই বিদ‘আত।

আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল এ সবের অনুমতি দেন নি। ইসলামী শরীয়ত একটি পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ দীন। এতে নতুন কিছু সংযোজনের কোনো প্রয়োজন বা অবকাশ নেই। মুসলিমদের এ দীনকেই শুধুমাত্র অনুকরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে. নব-নব ধর্মপ্রথা প্রবর্তনের জন্য বলা হয়নি। সাহাবী ও তাঁদের সঠিক অনুসারী তাবে‘য়ীন থেকে সকল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এ বিষয়টি সম্যকভাবে সমর্থন ও গ্রহণ করেছেন। এ কথা মনে করা ঠিক নয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মোৎসব পালন বা এর সংশ্লিষ্ট শির্ক ও অতিরঞ্জনকে নিষেধ করা কোনোরূপ অনৈসলামিক কাজ এবং এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়। বরং এটা তো রাসূলেরই আনুগত্য ও তাঁরই নির্দেশ পালন। তিনি বলেছেন,

«يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِي الدِّينِ، فَإِنَّهُ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِي الدِّينِ»

“সাবধান! ধর্মে অতিরঞ্জন করো না। তোমাদের আগে যারা ছিল তারা ধর্মে অতিরঞ্জনের ফলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।” [সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২৯]

তিনি আরও বলেছেন,

«لاَ تُطْرُونِي، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ، وَرَسُولُهُ»

“তোমরা আমার এমন অতি প্রশংসা করো না যেমন খ্রিস্টানগণ ইবনে মারইয়াম (ঈসা ‘আলাইহিস সালাম) এর অতি প্রশংসা করেছে। আমি তো মাত্র একজন বান্দা। তাই আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলে উল্লেখ করো।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৪৪৫]

উল্লিখিত প্রবন্ধ সম্পর্কে এটুকুই আমার বক্তব্য। আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের ও অন্যান্য সকল মুসলমানকে সঠিক দীন উপলব্ধি করার, এর ওপর কায়েম থাকার, সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃঢ়ভাবে ধারণ করার এবং বিদ‘আত থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করেন। নিশ্চয় তিনি অশেষ দাতা ও পরম করুণাময়।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন।

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন