HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসীর [সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১-১৪১]
লেখকঃ কতিপয় উলামা
بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে
﴿الٓمٓ ١﴾ [ البقرة : ١ ]
১. আলিফ লাম মীম১।
১. আল-কুরআনের বেশ কয়েকটি সূরার শুরুতে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন হরফ রয়েছে। এগুলোর সঠিক মর্মার্থ একমাত্র মহান আল্লাহ তা‘আলাই জানেন।
﴿ ذَٰلِكَ ٱلۡكِتَٰبُ لَا رَيۡبَۛ فِيهِۛ هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ ٢ ﴾ [ البقرة : ٢ ]
২. এটি (আল্লাহর) কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত।২
২. ‘হূদা’ অর্থ হিদায়াত তথা সঠিক পথ বা দিক-নির্দেশনা। তবে এ গ্রন্থ থেকে পথ-নির্দেশ পেতে মানুষকে প্রথমে হতে হবে মুত্তাকী। অর্থাৎ তাদেরকে অন্তর্যামী মহান আল্লাহকে ভয় করে সবসময় মন্দ থেকে বেঁচে থাকতে ও ভালোকে গ্রহণে আগ্রহী হতে হবে।
﴿ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ٣﴾ [ البقرة : ٣ ]
৩. যারা গায়েবের৩ প্রতি ঈমান, আনে সালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।
৩. এখানে গায়েব তথা অদৃশ্য অর্থ মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, ফিরিশতা, অহী, জান্নাত, জাহান্নাম ও যা কিছু ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে অবস্থিত অথচ আল-কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসে তার বর্ণনা এসেছে, ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে –এসবের ওপর অকুন্ঠ বিশ্বাস ও প্রত্যয় এ কুরআন থেকে সঠিক পথ লাভের পূর্ব শর্ত।
﴿وَٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ وَبِٱلۡأٓخِرَةِ هُمۡ يُوقِنُونَ ٤﴾ [ البقرة : ٤ ]
৪. এবং যারা ঈমান আনে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে তৎপ্রতি। আর আখিরাতের প্রতি তারা ইয়াকীন রাখে।
﴿أُوْلَٰٓئِكَ عَلَىٰ هُدٗى مِّن رَّبِّهِمۡۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٥﴾ [ البقرة : ٥ ]
৫. তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।৪
৪. এ আয়াতগুলোর সারমর্মে বুঝা যায় যে, আল-কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করার জন্য ৬টি পূর্ব শর্ত রয়েছে:
ক. মুত্তাকী তথা তাকওয়ার গুণ অর্জন করা, অর্থাৎ কুরআন যা মানতে বলে তা মানা আর যা ছাড়তে বলে তা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত থাকা।
খ. গায়েব বা অহী কর্তৃক নির্দেশিত সব অদৃশ্যে বিশ্বাস রাখা।
গ. সালাত কায়েম তথা যথার্থরূপে আদায় করা।
ঘ. আল্লাহর দেওয়া রিযিক থেকে তাঁরই পথে ব্যয় করা।
ঙ. পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি অহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত সব আসমানী কিতাবে ঈমান রাখা।
চ. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আখিরাত সম্পর্কে যা বলেছেন তাতে সম্পূর্ণ সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস রাখা।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ سَوَآءٌ عَلَيۡهِمۡ ءَأَنذَرۡتَهُمۡ أَمۡ لَمۡ تُنذِرۡهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ٦﴾ [ البقرة : ٦ ]
৬. নিশ্চয় যারা কুফুরী করেছে, আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন কিংবা না করুন, উভয়ই তাদের জন্য বরাবর,৫ তারা ঈমান আনবে না।
৫. অর্থাৎ আল-কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করার জন্য উল্লিখিত ৬টি শর্তের সবগুলোকে বা কোনোটিকে যারা মানতে অস্বীকার করেছে এবং শর্তগুলোকে পূর্ণ করেনি, তাদেরকে আখিরাতের ভয় দেখানো আর না দেখানো সমান কথা।
﴿خَتَمَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَعَلَىٰ سَمۡعِهِمۡۖ وَعَلَىٰٓ أَبۡصَٰرِهِمۡ غِشَٰوَةٞۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ٧﴾ [ البقرة : ٧ ]
৭. আল্লাহ তাদের অন্তরে এবং তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে পর্দা ৬; আর তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব।
৬. এর অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়ার কারণেই তারা ঈমান আনতে পারে নি; বরং এর মর্মার্থ হলো, এ হতভাগ্যরা যখন উপরোক্ত ৬টি মৌলিক বিষয়কে অস্বীকার করেছে এবং কুরআনের দেখানো পথের বিপরীতে চলতে পছন্দ করেছে, তার সক্রিয় বিরোধিতা করতেও দ্বিধা করছে না, তখন আল্লাহ তা‘আলাও তাদের অন্তর ও ইন্দ্রিয়ের সত্যানুসন্ধিৎসু শক্তি ও আলোকিত জীবনের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত আকর্ষণকে বিকল করে দেন। তাদের হৃদয়ের দরজা রুদ্ধ করে দেন তথা মহর লাগিয়ে দেন।
‘কান, চোখ ও অন্তঃকরণ’ মানুষের জন্য আল্লাহর দেওয়া এ ৩টি অমূল্য নি‘আমতের যথাযথ ব্যবহার অপরিহার্য, এগুলো হাশরে জিজ্ঞাসিত হবে (দেখুন: সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৩৬; আল-মুমিনূন, আয়াত: ৭৮)।
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨﴾ [ البقرة : ٨ ]
৮. আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি’ অথচ তারা মুমিন নয়।৭
৭. এরা মুনাফিক। মুসলিমদের সাথে মুসলিম পরিচয়ে আর কাফিরদের সাথে ঘনিষ্ট থাকে কাফির হিসেবে। মহান আল্লাহ সুবিধাবাদী এ নিকৃষ্টদের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে দিয়েছেন। সর্বকালে ও সব এলাকায় এ চরিত্রের মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে।
﴿يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ ٩﴾ [ البقرة : ٩ ]
৯. অথচ তারা নিজদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না। তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন।৮
৮. সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্যে অথবা কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য ধোঁকা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সব মানুষকে চিরদিনের জন্য ধোঁকায় ফেলে রাখা যায় না। তাই মুনাফিকদের লাভবান হওয়া এক নিশ্চিত দূরাশা। এ জগতে যেমন সমাজে বিশ্বস্ততা ও প্রকৃত সম্মান হারিয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তেমনি আখিরাতে তো তাদের দাঁড়াতে হবে অন্তর্যামী মহাবিচারকের সামনে।
﴿فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ ١٠﴾ [ البقرة : ١٠ ]
১০. তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি।৯, অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন।১০; আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। কারণ তারা মিথ্যা বলত।
৯. এ ব্যাধিটিই হল মুনাফিকী বা কপটতা।
১০. আল্লাহ কপটদেরকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেন না - এটি তাঁর নিয়ম বা বিধিও না; বরং অবকাশ দেন, ফলে তাদের মুনাফিকীর বোঝা ভারী হতে থাকে -রোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ قَالُوٓاْ إِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُونَ ١١﴾ [ البقرة : ١١ ]
১১. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা যমীনে ফাসাদ করো না, বলে, ‘আমরা তো কেবল সংশোধনকারী’।
﴿أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلۡمُفۡسِدُونَ وَلَٰكِن لَّا يَشۡعُرُونَ ١٢﴾ [ البقرة : ١٢ ]
১২. জেনে রাখ, নিশ্চয় তারা ফাসাদকারী; কিন্তু তারা বুঝে না।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ كَمَآ ءَامَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوٓاْ أَنُؤۡمِنُ كَمَآ ءَامَنَ ٱلسُّفَهَآءُۗ أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلسُّفَهَآءُ وَلَٰكِن لَّا يَعۡلَمُونَ ١٣﴾ [ البقرة : ١٣ ]
১৩.আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা ঈমান আন যেমন লোকেরা ঈমান এনেছে’, তারা বলে, ‘আমরা কি ঈমান আনব যেমন নির্বোধরা১১ ঈমান এনেছে’? জেনে রাখ, নিশ্চয় তারাই নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না।
১১. মুনাফিকদের দৃষ্টিতে এই ‘নির্বোধেরা (?)’ হলো সেই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব যারা নিষ্কলুশ হৃদয়ের নিষ্ঠাবান মুমিন - সত্যের পথে চলতে গিয়ে যদি কখনো কষ্ট, বিপদ, উৎপীড়ন, নির্যাতন, শত্রুতা বা সাময়িক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, তা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁরই অনুগ্রহে বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্য্যের সাথে মোকাবিলা করে আলোর পথে থাকে অবিচল; কিন্তু মুনাফিকদের দৃষ্টিতে এটি নিরেট বোকামী (!), কারণ তারা মনে করে সত্য ও মিথ্যার বিতর্কে না জড়িয়ে আল্লাহর বিধান পালনের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দিয়ে হলেও নিজেদেরকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ -যা দিয়ে সাময়িকভাবে মানুষকে প্রতারিত করা যেতে পারে তবে তা নিঃসন্দেহে আল্লাহকে ধোঁকা দেয়ার নিষ্ফল প্রচেষ্টা, বরং এ হতভাগ্যরা নিপুণভাবে ধোঁকা দেয় তাদের নিজেদেরকেই।
﴿وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوۡاْ إِلَىٰ شَيَٰطِينِهِمۡ قَالُوٓاْ إِنَّا مَعَكُمۡ إِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَهۡزِءُونَ ١٤﴾ [ البقرة : ١٤ ]
১৪. আর যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং যখন গোপনে তাদের শয়তানদের১২ সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো কেবল উপহাসকারী’।
১২. ইমাম তাবারির মতানুযায়ী প্রত্যেক সীমালংঘনকারী ও দাম্ভিককেই শয়তান বলা হয়। মানুষ ও জিন্ন উভয়ের ক্ষেত্রেই এ শব্দটি প্রযোজ্য। কুরআনের অধিক স্থানে এটি জিনদের প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হলেও কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে শয়তান প্রকৃতির মানুষের জন্যে। বিশেষ করে যারা দুষ্কর্মে নেতৃত্ব দেয় তাদের জন্য। আলোচনার প্রসঙ্গ বিচারে ‘শায়াতীন’ বলতে এখানে মুশরিকদের সেই নেতৃস্থানীয়দের বুঝানো হয়েছে যারা তখন ইসলামের বিরোধিতায় ছিল কর্ম-তৎপর।
﴿ٱللَّهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَيَمُدُّهُمۡ فِي طُغۡيَٰنِهِمۡ يَعۡمَهُونَ ١٥﴾ [ البقرة : ١٥ ]
১৫. আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন।
﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلضَّلَٰلَةَ بِٱلۡهُدَىٰ فَمَا رَبِحَت تِّجَٰرَتُهُمۡ وَمَا كَانُواْ مُهۡتَدِينَ ١٦ ﴾ [ البقرة : ١٦ ]
১৬. এরাই তারা, যারা হিদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে। কিন্তু তাদের ব্যবসা লাভজনক হয় নি এবং তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না।
﴿مَثَلُهُمۡ كَمَثَلِ ٱلَّذِي ٱسۡتَوۡقَدَ نَارٗا فَلَمَّآ أَضَآءَتۡ مَا حَوۡلَهُۥ ذَهَبَ ٱللَّهُ بِنُورِهِمۡ وَتَرَكَهُمۡ فِي ظُلُمَٰتٖ لَّا يُبۡصِرُونَ ١٧﴾ [ البقرة : ١٧ ]
১৭. তাদের উপমা ঐ ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালাল। এরপর যখন আগুন তার চারপাশ আলোকিত করল, আল্লাহ তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিলেন১৩ এবং তাদেরকে ছেড়ে দিলেন অন্ধকারে। তারা কিছু দেখছে না।
১৩. যেসব মুনাফেক বাহ্যত ঈমান আনে অথচ অন্তরে থাকে অবিশ্বাসী তারা অবচেতনভাবে অন্ধাকরে হাতড়ে বেড়ায়, আলোতে বের হওয়ার কোনো পথ খোঁজে পায় না। ঠিক ওই লোকদের মতো যাদের কেউ আধার রাতে আলো জ্বালাল, এবং সে আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত হলো, ঠিক সেসময় আলো নিবে গেল; ফলে সবাই অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। বের হওয়ার কোনো পথ পেল না। আসলে যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে সত্যের আলোর প্রত্যাশী নয়, হিদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহীকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর, আর সত্যের আলোকোজ্জ্বল চেহারা দেখার কোনো আগ্রহই যার নেই, সে হতভাগাই হারিয়ে বসে তার অন্তর্দৃষ্টির আলো -যা আল্লাহপ্রদত্ত এক অমূল্য নি‘আমত।
﴿صُمُّۢ بُكۡمٌ عُمۡيٞ فَهُمۡ لَا يَرۡجِعُونَ ١٨﴾ [ البقرة : ١٨ ]
১৮. তারা বধির-মূক-অন্ধ। ১৪; তাই তারা ফিরে আসবে না।
১৪. হক কথা শোনার সময় কানে শোনে না, হক কথা বলার ক্ষেত্রে বোবা, আর সত্য ও সুন্দরের আলোকোজ্জ্বল পথে চলার প্রশ্নে চোখে দেখে না; এদের আল্লাহর পথে ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই, ধ্বংস অবধারিত। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে হিফাযত করুন! আমীন।
﴿أَوۡ كَصَيِّبٖ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فِيهِ ظُلُمَٰتٞ وَرَعۡدٞ وَبَرۡقٞ يَجۡعَلُونَ أَصَٰبِعَهُمۡ فِيٓ ءَاذَانِهِم مِّنَ ٱلصَّوَٰعِقِ حَذَرَ ٱلۡمَوۡتِۚ وَٱللَّهُ مُحِيطُۢ بِٱلۡكَٰفِرِينَ ١٩﴾ [ البقرة : ١٩ ]
১৯. কিংবা আকাশের বর্ষণমুখর মেঘের ন্যায়, যাতে রয়েছে ঘন অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। বজ্রের গর্জনে তারা মৃত্যুর ভয়ে তাদের কানে আঙুল দিয়ে রাখে।১৫ আর আল্লাহ কাফিরদেরকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
১৫. এটি নিশ্চিত ধ্বংস থেকে বাঁচার এক ব্যর্থ চেষ্টা। কারণ, ধোঁকাবাজদের অবস্থান সর্বশক্তিমান আল্লাহর পাকড়াও-এর মধ্যে।
﴿يَكَادُ ٱلۡبَرۡقُ يَخۡطَفُ أَبۡصَٰرَهُمۡۖ كُلَّمَآ أَضَآءَ لَهُم مَّشَوۡاْ فِيهِ وَإِذَآ أَظۡلَمَ عَلَيۡهِمۡ قَامُواْۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ لَذَهَبَ بِسَمۡعِهِمۡ وَأَبۡصَٰرِهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٠﴾ [ البقرة : ٢٠ ]
২০. বিদ্যুৎচমক তাদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার উপক্রম হয়। যখনই তা তাদের জন্য আলো দেয়, তারা তাতে চলতে থাকে। আর যখন তা তাদের উপর অন্ধকার করে দেয়, তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, অবশ্যই তাদের শ্রবণ ও চোখসমূহ কেড়ে নিতেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।১৬
১৬. এ উপমাটি সেই সব দোদুল্যমান ব্যক্তিদের ব্যাপারে, যারা প্রকৃত সত্য সুস্পষ্ট হয়ে পড়ার পরও অবিরাম সন্দেহ, দ্বিধা-দ্বন্দ ও বিশ্বাসের দুর্বলতায় ভোগে। তারা অনুকূল পরিবেশে সুবিধাজনক সত্যগুলোকে স্বীকার করে নিলেও অবস্থার প্রেক্ষিতে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলে তা থেকে সরে পড়ে।
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে
﴿الٓمٓ ١﴾ [ البقرة : ١ ]
১. আলিফ লাম মীম১।
১. আল-কুরআনের বেশ কয়েকটি সূরার শুরুতে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন হরফ রয়েছে। এগুলোর সঠিক মর্মার্থ একমাত্র মহান আল্লাহ তা‘আলাই জানেন।
﴿ ذَٰلِكَ ٱلۡكِتَٰبُ لَا رَيۡبَۛ فِيهِۛ هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ ٢ ﴾ [ البقرة : ٢ ]
২. এটি (আল্লাহর) কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত।২
২. ‘হূদা’ অর্থ হিদায়াত তথা সঠিক পথ বা দিক-নির্দেশনা। তবে এ গ্রন্থ থেকে পথ-নির্দেশ পেতে মানুষকে প্রথমে হতে হবে মুত্তাকী। অর্থাৎ তাদেরকে অন্তর্যামী মহান আল্লাহকে ভয় করে সবসময় মন্দ থেকে বেঁচে থাকতে ও ভালোকে গ্রহণে আগ্রহী হতে হবে।
﴿ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ٣﴾ [ البقرة : ٣ ]
৩. যারা গায়েবের৩ প্রতি ঈমান, আনে সালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।
৩. এখানে গায়েব তথা অদৃশ্য অর্থ মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, ফিরিশতা, অহী, জান্নাত, জাহান্নাম ও যা কিছু ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে অবস্থিত অথচ আল-কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসে তার বর্ণনা এসেছে, ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে –এসবের ওপর অকুন্ঠ বিশ্বাস ও প্রত্যয় এ কুরআন থেকে সঠিক পথ লাভের পূর্ব শর্ত।
﴿وَٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ وَبِٱلۡأٓخِرَةِ هُمۡ يُوقِنُونَ ٤﴾ [ البقرة : ٤ ]
৪. এবং যারা ঈমান আনে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে তৎপ্রতি। আর আখিরাতের প্রতি তারা ইয়াকীন রাখে।
﴿أُوْلَٰٓئِكَ عَلَىٰ هُدٗى مِّن رَّبِّهِمۡۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٥﴾ [ البقرة : ٥ ]
৫. তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।৪
৪. এ আয়াতগুলোর সারমর্মে বুঝা যায় যে, আল-কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করার জন্য ৬টি পূর্ব শর্ত রয়েছে:
ক. মুত্তাকী তথা তাকওয়ার গুণ অর্জন করা, অর্থাৎ কুরআন যা মানতে বলে তা মানা আর যা ছাড়তে বলে তা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত থাকা।
খ. গায়েব বা অহী কর্তৃক নির্দেশিত সব অদৃশ্যে বিশ্বাস রাখা।
গ. সালাত কায়েম তথা যথার্থরূপে আদায় করা।
ঘ. আল্লাহর দেওয়া রিযিক থেকে তাঁরই পথে ব্যয় করা।
ঙ. পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি অহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত সব আসমানী কিতাবে ঈমান রাখা।
চ. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আখিরাত সম্পর্কে যা বলেছেন তাতে সম্পূর্ণ সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস রাখা।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ سَوَآءٌ عَلَيۡهِمۡ ءَأَنذَرۡتَهُمۡ أَمۡ لَمۡ تُنذِرۡهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ٦﴾ [ البقرة : ٦ ]
৬. নিশ্চয় যারা কুফুরী করেছে, আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন কিংবা না করুন, উভয়ই তাদের জন্য বরাবর,৫ তারা ঈমান আনবে না।
৫. অর্থাৎ আল-কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করার জন্য উল্লিখিত ৬টি শর্তের সবগুলোকে বা কোনোটিকে যারা মানতে অস্বীকার করেছে এবং শর্তগুলোকে পূর্ণ করেনি, তাদেরকে আখিরাতের ভয় দেখানো আর না দেখানো সমান কথা।
﴿خَتَمَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَعَلَىٰ سَمۡعِهِمۡۖ وَعَلَىٰٓ أَبۡصَٰرِهِمۡ غِشَٰوَةٞۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ٧﴾ [ البقرة : ٧ ]
৭. আল্লাহ তাদের অন্তরে এবং তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে পর্দা ৬; আর তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব।
৬. এর অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়ার কারণেই তারা ঈমান আনতে পারে নি; বরং এর মর্মার্থ হলো, এ হতভাগ্যরা যখন উপরোক্ত ৬টি মৌলিক বিষয়কে অস্বীকার করেছে এবং কুরআনের দেখানো পথের বিপরীতে চলতে পছন্দ করেছে, তার সক্রিয় বিরোধিতা করতেও দ্বিধা করছে না, তখন আল্লাহ তা‘আলাও তাদের অন্তর ও ইন্দ্রিয়ের সত্যানুসন্ধিৎসু শক্তি ও আলোকিত জীবনের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত আকর্ষণকে বিকল করে দেন। তাদের হৃদয়ের দরজা রুদ্ধ করে দেন তথা মহর লাগিয়ে দেন।
‘কান, চোখ ও অন্তঃকরণ’ মানুষের জন্য আল্লাহর দেওয়া এ ৩টি অমূল্য নি‘আমতের যথাযথ ব্যবহার অপরিহার্য, এগুলো হাশরে জিজ্ঞাসিত হবে (দেখুন: সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৩৬; আল-মুমিনূন, আয়াত: ৭৮)।
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨﴾ [ البقرة : ٨ ]
৮. আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি’ অথচ তারা মুমিন নয়।৭
৭. এরা মুনাফিক। মুসলিমদের সাথে মুসলিম পরিচয়ে আর কাফিরদের সাথে ঘনিষ্ট থাকে কাফির হিসেবে। মহান আল্লাহ সুবিধাবাদী এ নিকৃষ্টদের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে দিয়েছেন। সর্বকালে ও সব এলাকায় এ চরিত্রের মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে।
﴿يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ ٩﴾ [ البقرة : ٩ ]
৯. অথচ তারা নিজদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না। তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন।৮
৮. সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্যে অথবা কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য ধোঁকা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সব মানুষকে চিরদিনের জন্য ধোঁকায় ফেলে রাখা যায় না। তাই মুনাফিকদের লাভবান হওয়া এক নিশ্চিত দূরাশা। এ জগতে যেমন সমাজে বিশ্বস্ততা ও প্রকৃত সম্মান হারিয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তেমনি আখিরাতে তো তাদের দাঁড়াতে হবে অন্তর্যামী মহাবিচারকের সামনে।
﴿فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ ١٠﴾ [ البقرة : ١٠ ]
১০. তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি।৯, অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন।১০; আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। কারণ তারা মিথ্যা বলত।
৯. এ ব্যাধিটিই হল মুনাফিকী বা কপটতা।
১০. আল্লাহ কপটদেরকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেন না - এটি তাঁর নিয়ম বা বিধিও না; বরং অবকাশ দেন, ফলে তাদের মুনাফিকীর বোঝা ভারী হতে থাকে -রোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ قَالُوٓاْ إِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُونَ ١١﴾ [ البقرة : ١١ ]
১১. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা যমীনে ফাসাদ করো না, বলে, ‘আমরা তো কেবল সংশোধনকারী’।
﴿أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلۡمُفۡسِدُونَ وَلَٰكِن لَّا يَشۡعُرُونَ ١٢﴾ [ البقرة : ١٢ ]
১২. জেনে রাখ, নিশ্চয় তারা ফাসাদকারী; কিন্তু তারা বুঝে না।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ كَمَآ ءَامَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوٓاْ أَنُؤۡمِنُ كَمَآ ءَامَنَ ٱلسُّفَهَآءُۗ أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلسُّفَهَآءُ وَلَٰكِن لَّا يَعۡلَمُونَ ١٣﴾ [ البقرة : ١٣ ]
১৩.আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা ঈমান আন যেমন লোকেরা ঈমান এনেছে’, তারা বলে, ‘আমরা কি ঈমান আনব যেমন নির্বোধরা১১ ঈমান এনেছে’? জেনে রাখ, নিশ্চয় তারাই নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না।
১১. মুনাফিকদের দৃষ্টিতে এই ‘নির্বোধেরা (?)’ হলো সেই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব যারা নিষ্কলুশ হৃদয়ের নিষ্ঠাবান মুমিন - সত্যের পথে চলতে গিয়ে যদি কখনো কষ্ট, বিপদ, উৎপীড়ন, নির্যাতন, শত্রুতা বা সাময়িক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, তা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁরই অনুগ্রহে বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্য্যের সাথে মোকাবিলা করে আলোর পথে থাকে অবিচল; কিন্তু মুনাফিকদের দৃষ্টিতে এটি নিরেট বোকামী (!), কারণ তারা মনে করে সত্য ও মিথ্যার বিতর্কে না জড়িয়ে আল্লাহর বিধান পালনের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দিয়ে হলেও নিজেদেরকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ -যা দিয়ে সাময়িকভাবে মানুষকে প্রতারিত করা যেতে পারে তবে তা নিঃসন্দেহে আল্লাহকে ধোঁকা দেয়ার নিষ্ফল প্রচেষ্টা, বরং এ হতভাগ্যরা নিপুণভাবে ধোঁকা দেয় তাদের নিজেদেরকেই।
﴿وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوۡاْ إِلَىٰ شَيَٰطِينِهِمۡ قَالُوٓاْ إِنَّا مَعَكُمۡ إِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَهۡزِءُونَ ١٤﴾ [ البقرة : ١٤ ]
১৪. আর যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং যখন গোপনে তাদের শয়তানদের১২ সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো কেবল উপহাসকারী’।
১২. ইমাম তাবারির মতানুযায়ী প্রত্যেক সীমালংঘনকারী ও দাম্ভিককেই শয়তান বলা হয়। মানুষ ও জিন্ন উভয়ের ক্ষেত্রেই এ শব্দটি প্রযোজ্য। কুরআনের অধিক স্থানে এটি জিনদের প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হলেও কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে শয়তান প্রকৃতির মানুষের জন্যে। বিশেষ করে যারা দুষ্কর্মে নেতৃত্ব দেয় তাদের জন্য। আলোচনার প্রসঙ্গ বিচারে ‘শায়াতীন’ বলতে এখানে মুশরিকদের সেই নেতৃস্থানীয়দের বুঝানো হয়েছে যারা তখন ইসলামের বিরোধিতায় ছিল কর্ম-তৎপর।
﴿ٱللَّهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَيَمُدُّهُمۡ فِي طُغۡيَٰنِهِمۡ يَعۡمَهُونَ ١٥﴾ [ البقرة : ١٥ ]
১৫. আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন।
﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلضَّلَٰلَةَ بِٱلۡهُدَىٰ فَمَا رَبِحَت تِّجَٰرَتُهُمۡ وَمَا كَانُواْ مُهۡتَدِينَ ١٦ ﴾ [ البقرة : ١٦ ]
১৬. এরাই তারা, যারা হিদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে। কিন্তু তাদের ব্যবসা লাভজনক হয় নি এবং তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না।
﴿مَثَلُهُمۡ كَمَثَلِ ٱلَّذِي ٱسۡتَوۡقَدَ نَارٗا فَلَمَّآ أَضَآءَتۡ مَا حَوۡلَهُۥ ذَهَبَ ٱللَّهُ بِنُورِهِمۡ وَتَرَكَهُمۡ فِي ظُلُمَٰتٖ لَّا يُبۡصِرُونَ ١٧﴾ [ البقرة : ١٧ ]
১৭. তাদের উপমা ঐ ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালাল। এরপর যখন আগুন তার চারপাশ আলোকিত করল, আল্লাহ তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিলেন১৩ এবং তাদেরকে ছেড়ে দিলেন অন্ধকারে। তারা কিছু দেখছে না।
১৩. যেসব মুনাফেক বাহ্যত ঈমান আনে অথচ অন্তরে থাকে অবিশ্বাসী তারা অবচেতনভাবে অন্ধাকরে হাতড়ে বেড়ায়, আলোতে বের হওয়ার কোনো পথ খোঁজে পায় না। ঠিক ওই লোকদের মতো যাদের কেউ আধার রাতে আলো জ্বালাল, এবং সে আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত হলো, ঠিক সেসময় আলো নিবে গেল; ফলে সবাই অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। বের হওয়ার কোনো পথ পেল না। আসলে যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে সত্যের আলোর প্রত্যাশী নয়, হিদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহীকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর, আর সত্যের আলোকোজ্জ্বল চেহারা দেখার কোনো আগ্রহই যার নেই, সে হতভাগাই হারিয়ে বসে তার অন্তর্দৃষ্টির আলো -যা আল্লাহপ্রদত্ত এক অমূল্য নি‘আমত।
﴿صُمُّۢ بُكۡمٌ عُمۡيٞ فَهُمۡ لَا يَرۡجِعُونَ ١٨﴾ [ البقرة : ١٨ ]
১৮. তারা বধির-মূক-অন্ধ। ১৪; তাই তারা ফিরে আসবে না।
১৪. হক কথা শোনার সময় কানে শোনে না, হক কথা বলার ক্ষেত্রে বোবা, আর সত্য ও সুন্দরের আলোকোজ্জ্বল পথে চলার প্রশ্নে চোখে দেখে না; এদের আল্লাহর পথে ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই, ধ্বংস অবধারিত। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে হিফাযত করুন! আমীন।
﴿أَوۡ كَصَيِّبٖ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فِيهِ ظُلُمَٰتٞ وَرَعۡدٞ وَبَرۡقٞ يَجۡعَلُونَ أَصَٰبِعَهُمۡ فِيٓ ءَاذَانِهِم مِّنَ ٱلصَّوَٰعِقِ حَذَرَ ٱلۡمَوۡتِۚ وَٱللَّهُ مُحِيطُۢ بِٱلۡكَٰفِرِينَ ١٩﴾ [ البقرة : ١٩ ]
১৯. কিংবা আকাশের বর্ষণমুখর মেঘের ন্যায়, যাতে রয়েছে ঘন অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। বজ্রের গর্জনে তারা মৃত্যুর ভয়ে তাদের কানে আঙুল দিয়ে রাখে।১৫ আর আল্লাহ কাফিরদেরকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
১৫. এটি নিশ্চিত ধ্বংস থেকে বাঁচার এক ব্যর্থ চেষ্টা। কারণ, ধোঁকাবাজদের অবস্থান সর্বশক্তিমান আল্লাহর পাকড়াও-এর মধ্যে।
﴿يَكَادُ ٱلۡبَرۡقُ يَخۡطَفُ أَبۡصَٰرَهُمۡۖ كُلَّمَآ أَضَآءَ لَهُم مَّشَوۡاْ فِيهِ وَإِذَآ أَظۡلَمَ عَلَيۡهِمۡ قَامُواْۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ لَذَهَبَ بِسَمۡعِهِمۡ وَأَبۡصَٰرِهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٠﴾ [ البقرة : ٢٠ ]
২০. বিদ্যুৎচমক তাদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার উপক্রম হয়। যখনই তা তাদের জন্য আলো দেয়, তারা তাতে চলতে থাকে। আর যখন তা তাদের উপর অন্ধকার করে দেয়, তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, অবশ্যই তাদের শ্রবণ ও চোখসমূহ কেড়ে নিতেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।১৬
১৬. এ উপমাটি সেই সব দোদুল্যমান ব্যক্তিদের ব্যাপারে, যারা প্রকৃত সত্য সুস্পষ্ট হয়ে পড়ার পরও অবিরাম সন্দেহ, দ্বিধা-দ্বন্দ ও বিশ্বাসের দুর্বলতায় ভোগে। তারা অনুকূল পরিবেশে সুবিধাজনক সত্যগুলোকে স্বীকার করে নিলেও অবস্থার প্রেক্ষিতে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলে তা থেকে সরে পড়ে।
بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ﴾ [ البقرة : ٢١ ]
২১. হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।১৭
১৭. একমাত্র আল্লাহর ইবাদত চর্চা ও দাসত্ব মেনে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে পৃথিবীতে অসত্য-চিন্তা, ভুল-দৃষ্টিভঙ্গি ও অসার-অশ্লীল কাজ থেকে মুক্তি, আর পরকালে ব্যর্থ পরিণতি ও আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়।
﴿ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢ ﴾ [ البقرة : ٢٢ ]
২২. যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিযিকস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।১৮
১৮. অর্থাৎ জগতসমূহ ও এতে বিরাজিত সকল উপায়-উপাদানের সৃষ্টি যখন একমাত্র দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা-অনুগ্রহ ও কর্তৃত্বে সম্পন্ন হয়েছে, তখন সৃষ্টির সেরা মানুষের সব বন্দেগী, দাসত্ব ও মুখাপেক্ষিতা নির্দিষ্ট হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহরই জন্য। মানুষ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে মানবে না। অন্য কারও আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান মানবে না; বরং জীবনে সকল ক্ষেত্রে অন্বেষণ করে যাবে একমাত্র আল্লাহর রেজামন্দি, ইবাদত-আরাধনা নিষ্ঠার সাথে নির্দিষ্ট করবে একমাত্র আল্লাহই জন্য। জীবনের সকল স্তর ও ক্ষেত্র সঁপে দিবে আল্লাহর নাযিলকৃত পবিত্র বিধানের হাতে।
﴿ وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِۦ وَٱدۡعُواْ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٢٣ ﴾ [ البقرة : ٢٣ ]
২৩. আর আমি আমার বান্দার ওপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস।১৯ এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
১৯. ইতিপূর্বে মক্কায় এ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছিল, যদি তোমরা এ কুরআনকে মানুষের রচনা মনে করে থাকো তাহলে এর সমমানের কোনো একটি বাণী রচনা করে আনো। এবার মদীনায় সে একই চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। আরো জানার জন্য দেখুন: সূরা ইউনুস: ৩৮, সূরা হূদ: ১৩, সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮ এবং সূরা তূর: ৩৩-৩৪ আয়াত।
﴿ فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ وَلَن تَفۡعَلُواْ فَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِي وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُۖ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ٢٤ ﴾ [ البقرة : ٢٤ ]
২৪. অতএব যদি তোমরা তা না কর- আর কখনো তোমরা তা করবে না- তাহলে আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর,২০ - যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য।
২০. অর্থাৎ সেখানে শুধুমাত্র সত্যদ্রোহী মানুষই জাহান্নামের জ্বালানী (নরকের ইন্ধন) হবে না বরং তাদের সাথে নিগৃহীত হবে তাদের সে সব উপাস্য নিথর প্রস্তর মূর্তিগুলোও।
﴿ وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ كُلَّمَا رُزِقُواْ مِنۡهَا مِن ثَمَرَةٖ رِّزۡقٗا قَالُواْ هَٰذَا ٱلَّذِي رُزِقۡنَا مِن قَبۡلُۖ وَأُتُواْ بِهِۦ مُتَشَٰبِهٗاۖ وَلَهُمۡ فِيهَآ أَزۡوَٰجٞ مُّطَهَّرَةٞۖ وَهُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٥ ﴾ [ البقرة : ٢٥ ]
২৫. আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। যখনই তাদেরকে জান্নাত থেকে কোনো ফল খেতে দেওয়া হবে, তারা বলবে, ‘এটা তো পূর্বে আমাদেরকে খেতে দেওয়া হয়েছিল’। আর তাদেরকে তা দেওয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করে২১ এবং তাদের জন্য তাতে থাকবে পূতঃপবিত্র সঙ্গী-সঙ্গিনী এবং তারা সেখানে হবে স্থায়ী।
২১. জান্নাতবাসীদেরকে যে সব ফল-ফলাদি পরিবেশন করা হবে তা তাদের পরিচিত আকার-আকৃতিরই হবে, তবে নিশ্চিতভাবেই তা হবে স্বাদে-গন্ধে অকল্পনীয়-অতুলনীয়, কারণ সেগুলো তো দুনিয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ আপ্যায়ন।
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَسۡتَحۡيِۦٓ أَن يَضۡرِبَ مَثَلٗا مَّا بَعُوضَةٗ فَمَا فَوۡقَهَاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَيَعۡلَمُونَ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّهِمۡۖ وَأَمَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِهَٰذَا مَثَلٗاۘ يُضِلُّ بِهِۦ كَثِيرٗا وَيَهۡدِي بِهِۦ كَثِيرٗاۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِۦٓ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٦ ﴾ [ البقرة : ٢٦ ]
২৬. নিশ্চয় আল্লাহ মাছি কিংবা তার চেয়েও ছোট কিছুর উপমা দিতে লজ্জা করেন না। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারা জানে, নিশ্চয় তা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। আর যারা কুফরি করেছে তারা বলে, আল্লাহ এর মাধ্যমে উপমা দিয়ে কী বুঝাতে চেয়েছেন? তিনি এ দিয়ে অনেককে পথভ্রষ্ট করেন এবং এ দিয়ে অনেককে হিদায়াত দেন।২৪ আর এর মাধ্যমে কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন।
২৩. এখানে একটি আপত্তি ও প্রশ্নের উল্লেখ না করেই তার জবাব দেওয়া হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য সুস্পষ্ট করার জন্য মশা-মাছি ও মাকড়শা ইত্যাদির দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। এতে বিরোধীদের আপত্তি উঠেছিল: 'এটা কোন ধরনের আল্লাহর কালাম, যেখানে এসব তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের উপমা দেওয়া হয়েছে?'
২৪. যারা প্রকৃত অর্থে সত্যের প্রতি সমর্পিত হতে প্রস্তুত নয়, আন্তরিকভাবে কথা বুঝতে চায় না, সত্যের মর্ম অনুসন্ধান ও তা মেনে নেওয়া যাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, সমালোচনা করা আর খুঁত বের করাই যাদের কাছে মুখ্য, তাদের দৃষ্টি থাকে কেবল শব্দের বাইরের কাঠামোর ওপর নিবদ্ধ, ফলে তা থেকে এ হতভাগ্যরা অস্পষ্টতা ও বক্রতা উদ্ধার করে সত্য থেকে আরো দূরে সরে যায়।
অপরদিকে যারা সত্য-সন্ধানী, আগ্রহী, যারা মনন ও সঠিক দৃষ্টিশক্তির অধিকারী, তারা আল-কুরআনের ঐ সব বক্তব্যের পরতে পরতে শুভ্র-সুস্পষ্ট জ্ঞানের আলোকচ্ছটা খুঁজে পায়। এ ধরনের দৃষ্টি-উন্মোচনকারী (eye-opener) ও জ্ঞানগর্ভ কথামালার উৎস একমাত্র মহান আল্লাহই হতে পারেন বলে তাদের সমগ্র হৃদয়-মন সাক্ষ্য দিয়ে উঠে।
﴿ ٱلَّذِينَ يَنقُضُونَ عَهۡدَ ٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ مِيثَٰقِهِۦ وَيَقۡطَعُونَ مَآ أَمَرَ ٱللَّهُ بِهِۦٓ أَن يُوصَلَ وَيُفۡسِدُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٢٧ ﴾ [ البقرة : ٢٧ ]
২৭. যারা আল্লাহর সুদৃঢ় অঙ্গীকার ভঙ্গ করে,২৫ এবং আল্লাহ যা জোড়া লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে২৬ এবং যমীনে ফাসাদ করে;২৭ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
২৫. এখানে সৃষ্টির সূচনাতেই সমগ্র মানবাত্মার কাছ থেকে গৃহীত একমাত্র মহান আল্লাহর আনুগত্য করার অঙ্গীকার পূরণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার উল্লেখ রয়েছে এখানে:
"আর (স্মরণ করো), যখন তোমাদের প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদেরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্পর্কে স্বীকৃতি আদায় করলেন (বললেন): 'আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই'? তারা বললো: 'হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিলাম'। (এটি এ জন্য) যেনো তোমরা পুণরুত্থানের (কিয়ামতের) দিন একথা বলতে না পার যে, 'আমরা তো এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলাম'!" (সূরা আল আ’রাফ: ১৭২)
২৬. এ সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে রয়েছে অর্থের অশেষ ব্যাপকতা। যেসব সম্পর্ককে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত রাখার ওপর নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণ, আল্লাহ তা‘আলা সেগুলোকে ত্রুটিমুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
যুবাইর ইবন মুতইম (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী (সা:)-কে বলতে শুনেছেন: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। -- সহীহ আল বুখারী, ৫ম খন্ড, হাদীস নং- ৫৫৪৯।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: অপরিহার্য সম্পর্কগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা ও যত্ন না নিয়ে অহেতুক সম্পর্ক গড়ে তোলা মু’মিনের জন্য কখনো উচিত নয়। বিশেষ করে যাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা ইসলামে নিষিদ্ধ; যেমন ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু, তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক-চর্চা অবশ্যাই বর্জনীয়।
সম্পর্ক-চর্চার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরি। তা হলো, বন্ধু-বান্ধবের সম্পর্ককে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে, আত্মীয়-স্বজনদেরকে ভুলে যাওয়া, আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্ককে যথার্থরূপে পরিচর্যা না করা মারাত্মক অপরাধ। যারা এরূপ করে, তারা, উক্ত আয়াতের ভাষ্যানুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল।
২৭. এ তিনটি বাক্যের মাধ্যমেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যকার অঙ্গীকার কর্তন করা এবং মানুষে-মানুষে যে সম্পর্ক পরিচর্যার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করা এবং জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করার অনিবার্য পরিণতি হলো বিপর্যয়।
﴿ كَيۡفَ تَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَكُنتُمۡ أَمۡوَٰتٗا فَأَحۡيَٰكُمۡۖ ثُمَّ يُمِيتُكُمۡ ثُمَّ يُحۡيِيكُمۡ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٨ ﴾ [ البقرة : ٢٨ ]
২৮. কীভাবে তোমরা আল্লাহর সাথে কুফরী করছো অথচ তোমরা ছিলে মৃত? অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জীবিত করেছেন। এরপর তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দেবেন অতঃপর জীবিত করবেন। এরপর তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।২৮
২৮. এ আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে নিচের আয়াত দু'টির বক্তব্য লক্ষণীয়:
যারা কাফির (আল্লাহকে অস্বীকারকারী), তাদেরকে (শেষ বিচারের দিন) বলা হবে: 'আজ তোমাদের (পরিণতি দেখে) নিজেদের প্রতি তোমাদের যে কঠিন ক্রোধ অনুভূত হচ্ছে, তার চেয়ে আল্লাহ তোমাদের প্রতি আরো অধিক ক্রুদ্ধ হতেন, যখন তোমাদেরকে (দুনিয়ায়) ঈমান আনতে বলা হতো, আর তা তোমরা অস্বীকার করতে'! তারা বলবে: 'হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদের দু'বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু'বার জীবন দিয়েছেন। এখন আমাদের অপরাধগুলো স্বীকার করে নিচ্ছি। এখনও নিষ্কৃতির কোনো উপায় আছে কি'? [দেখুন: সূরা আল-মু'মিন, আয়াত: ১০-১১]
﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰٓ إِلَى ٱلسَّمَآءِ فَسَوَّىٰهُنَّ سَبۡعَ سَمَٰوَٰتٖۚ وَهُوَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ٢٩ ﴾ [ البقرة : ٢٩ ]
২৯. তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আসমানের প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাকে সাত আসমানে২৯ সুবিন্যস্ত করলেন। আর সব কিছু সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাত।৩০
২৯. সাত আকাশের তাৎপর্য কি? সাত আকাশ বলতে কি বুঝায়? এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন। মানুষ প্রতি যুগে যুগে আকাশ বা অন্য কথায় পৃথিবীর বাইরের জগত সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ ও ধারণা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিভিন্ন চিন্তা ও মতবাদের অনুসারী হয়েছে। এ চিন্তা ও মতবাদগুলো বিভিন্ন সময় বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই এর মধ্য থেকে কোনো একটি মতবাদ নির্দিষ্ট করে তার ভিত্তিতে কুরআনের এ শব্দগুলোর অর্থ নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। তবে সংক্ষেপে এটুকু বুঝে নেওয়া দরকার যে, সম্ভবত পৃথিবীর বাইরে যতগুলো জগত আছে সবগুলোকেই আল্লাহ তা‘আলা সাতটি সুদৃঢ় স্তরে বিন্যস্ত করে রেখেছেন অথবা এ বিশ্ব-জগতসমূহের যে স্তরে পৃথিবীর অবস্থিতি সেটি সাতটি স্তর সমন্বিত।
৩০. এখানে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে:
ক. যে আল্লাহ আমাদের সব ধরনের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের খবর রাখেন এবং যাঁর দৃষ্টি থেকে আমাদের কোনো কার্যক্রমই গোপন থাকতে পারে না, তাঁর মোকাবিলায় মানুষ অস্বীকৃতি ও বিদ্রোহের পথ বেছে নেওয়ার সাহস কী করে করতে পারে?
খ. যে আল্লাহ যাবতীয় সত্য জ্ঞানের অধিকারী ও প্রকৃত উৎস, তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অগ্রসর হলে অজ্ঞতার অন্ধকারে পথভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কী পরিণতি হতে পারে?
﴿ وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَجۡعَلُ فِيهَا مَن يُفۡسِدُ فِيهَا وَيَسۡفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَۖ قَالَ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٠ ﴾ [ البقرة : ٣٠ ]
৩০. আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করব,৩১ তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে?৩২ আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি? ৩৩ তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না।৩৪
৩১. খলীফা বলতে এখানে পৃথিবীকে কর্ষণ-চাষাবাদ ও পৃথিবীতে থাকাবস্থায় স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে আল্লাহর দাসত্ব ও ইবাদত চর্চার ক্ষেত্রে প্রজন্মান্তরে একে অন্যের প্রতিনিধি হওয়া। কারও কারও মতে জিন্ন জাতি আল্লাহর ইবাদত চর্চায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ার পর আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর কর্ষণ-চাষাবাদ ও স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে ইবাদত চর্চার জন্য জিন্নদের স্থলাভিষিক্তরূপে মানবপ্রজাতিকে সৃষ্টি করেছেন।
মানুষ আল্লাহর খলীফা ঠিক এমনভাবে বলা উচিত নয়। কেউ মারা গেলে অথবা পদত্যাগ করলে তার জায়গায় যে আসে তাকেই মূলতঃ খলীফা বলা হয়। আর আল্লাহ যেহেতু চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর এবং তিনি কখনো তার চেয়ার অন্যের জন্য ছেড়ে দেবেন না তাই মানুষ আল্লাহর খলীফা অভিধানের এ ব্যবহার সালাফদের অধিকাংশ আলেমের নিকট অনুচিত।
৩২. এটি ফিরিশতাদের ভিন্নমত পোষণের বহিঃপ্রকাশ নয় - এর শক্তিই তাদের নেই, বরং তা ছিল মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জিজ্ঞাসা। মূল কথা হলো, 'খলীফা' হিসেবে যার সৃষ্টি, তাকে কিছু স্বাধীন কর্তৃত্বও দেওয়া হবে, তার থাকবে কিছু ইচ্ছার স্বাধীনতা - যা হতে পারে গোলযোগ ও বিশৃংখলার কারণ - এ ধারণাটির স্পষ্টকরণের জন্যই ছিল তাদের আবেদন।
৩৩. ফিরিশতাদের এ কথার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা এবং তাঁর সব নির্দেশ যথাযথভাবে পালনে তাদের কোনো অসম্পূর্ণতা রয়েছে কিনা, যার ফলে খলীফা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, বিনীতভাবে বিষয়টি আল্লাহর দরবারে পেশ করা।
৩৪. এটি ফিরিশতাদের দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব। খলীফা প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন, তারা জানে না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পৃথিবীতে এমন এক প্রজাতি সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়েছে যাদেরকে দেওয়া হবে সীমিত ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা, যার ফলে তারা হবে ফিরিশতাদের চেয়েও অনেক সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ ও প্রতিদানপ্রাপ্য।
﴿ وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبُِٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١ ﴾ [ البقرة : ٣١ ]
৩১. আর তিনি আদমকে নামসমূহ৩৫ সব শিক্ষা দিলেন, তারপর তা ফিরিশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।
৩৫. কোনো বস্তুর নামের মাধ্যমে মানুষ সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে থাকে। তাই সর্বপ্রথম সৃষ্ট মানুষ আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দেয়ার মানেই হলো তাঁকে সব ধরনের বস্তুর জ্ঞান দান করা হয়েছিল।
﴿ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ ٣٢ ﴾ [ البقرة : ٣٢ ]
৩২. তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। ৩৬ নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’।
৩৬. এখানে ধারণা হয় যে, প্রত্যেক ফিরিশতার এবং তাদের প্রত্যেকটি শ্রেণীর জ্ঞান তাদের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেমন বায়ু-প্রবাহের ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের উদ্ভিদজগত সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অন্যান্য বিভাগে নিয়োজিতদের অবস্থাও তাই। তবে অবশ্যই মহান আল্লাহ সঠিক জানেন। অথচ মানুষকে দেওয়া হয়েছে ব্যাপকতর জ্ঞান, তাদের রয়েছে উদ্ভাবনী (innovative), প্রাসঙ্গিক (correlative), প্রায়োগিক (implementing) ও সমন্বয় (coordination) জ্ঞানসহ অমিত সৃজনশীল প্রতিভা। তাই তো তারা বিবেকসম্পন্ন, সীমিত-স্বাধীন, অথচ দায়বদ্ধ ও সৃষ্টির সেরা। ফলে তাদের রয়েছে একদিকে সম্মান ও পুরস্কার অথবা অন্যদিকে শাস্তি ও চরম অপমান; আর ফিরিশতাদের তা নেই, কারণ তাদের আছে নিয়ন্ত্রিত, সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ জ্ঞান এবং দায়িত্ব; পাশাপাশি নেই অস্বীকার ও সীমালংঘনের কোনো ক্ষমতা।
﴿ قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئۡهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَأَعۡلَمُ مَا تُبۡدُونَ وَمَا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٣٣ ﴾ [ البقرة : ٣٣ ]
৩৩. তিনি বললেন, ‘হে আদম, এগুলোর নাম তাদেরকে জানাও’। সুতরাং যখন সে এগুলোর নাম তাদেরকে জানাল, তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ ও যমীনের গায়েব জানি এবং জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা তোমরা গোপন করতে’?৩৭
৩৭. আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক সবকিছুর নাম বলে দেয়ার এ মহড়াটি ছিলো ফিরিশতাদের প্রথম সন্দেহের জবাব। তাদের উপস্থাপনাটি ছিলো: 'আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, যে সেখানে অশান্তি ও রক্তপাত ঘটাবে'? [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩০]
এখানে ব্যাপারটি এরূপ যে, আল্লাহ তা'আলা ফিরিশতাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি আদমকে শুধুমাত্র ইচ্ছার স্বাধীনতাই দেননি, তাকে দিয়েছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আর খলীফা সৃষ্টির সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ। বিপর্যয়ের দিকটির তুলনায় এ কল্যাণের গুরুত্ব ও মূল্যমান অনেক বেশি।
﴿ وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ وَٱسۡتَكۡبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٤ ﴾ [ البقرة : ٣٤ ]
৩৪. আর যখন আমি ফিরিশতাদেরকে বললাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদা৩৮ কর’। তখন তারা সিজদা করল, ইবলীস ছাড়া।৩৯ সে অস্বীকার করল এবং অহঙ্কার করল। আর সে হল কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।
৩৮. ফিরিশতাদেরকে মানুষের সামনে নত হবার নির্দেশটির মর্মার্থ হলো: পৃথিবীর সকল কিছু মানুষের অধীনস্থ করে দেয়া। কেননা ফিরিশতাগণ আল্লাহর নির্দেশে মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয় পরিচর্যা ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আর এ ফিরিশতাগণকেই যখন আল্লাহ তা‘আলা আদমের সামনে নত হতে বললেন তার অর্থ এ মহাবিশ্বের সকল কিছুকেই মানুষের অধীনতা স্বীকার করিয়ে নেওয়া হলো।
৩৯. এখানে একটি প্রশ্ন: ইবলীস একজন জিন্ন আগুনের তৈরী; [সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১৫; সূরা আল-হিজর, আয়াত: ২৭] হয়ে ফিরিশতাদের (আলোর তৈরী) প্রতি আল্লাহর নির্দেশের আওতায় এল কী করে?
এর ব্যাখ্যা হলো: সে আল্লাহর ইবাদত করতে করতে ফিরিশতার মর্যাদা লাভ করে। তাই সেও ছিলো ঐ নির্দেশের আওতাধীন। তাছাড়া সে নিজেই ঐ আদেশ অমান্যের কারণে একথা বলেনি যে, সে তো একজন জিন্ন, ফিরিশতা না; বরং সে সুস্পষ্টভাবে করেছে অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। [সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১২]
তাছাড়া আরেকটি ব্যাপার হলো: আসলে ফিরিশতাদের আল্লাহর নির্দেশ না মানার কোনো শক্তি নেই। [দেখুন, সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬ ও সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫০], আর জিন্নদের সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলেই ইবলীস তা অমান্য করার দুঃসাহস করেছে।
﴿ وَقُلۡنَا يَٰٓـَٔادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ وَكُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَيۡثُ شِئۡتُمَا وَلَا تَقۡرَبَا هَٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٣٥ ﴾ [ البقرة : ٣٥ ]
৩৫. আর আমি বললাম, ‘হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং তা থেকে আহার কর স্বাচ্ছন্দ্যে, তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী এবং এ গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না,৪০ তাহলে তোমরা যালিমদের৪১ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’।
৪০. পৃথিবীতে পাঠানোর আগে প্রথম মানব-মানবীকে জান্নাতে রেখে তাদের মানসিক প্রবণতা উন্মোচিত করার উদ্দেশ্যে এ পরীক্ষা। এতে একটি গাছ নির্দিষ্ট করে তার কাছে যেতে নিষেধ করা হয়। আর তা অমান্যের পরিণামও জানিয়ে দেওয়া হয়। সে গাছটি কি, তার ফলের নাম কি, তাতে কি প্রাকৃতিক দোষ ছিল ইত্যাদি এখানে গৌণ। মূলতঃ এটি ছিল একটি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে পরীক্ষা।
আর এখানে জান্নাতকে পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে একথা বুঝিয়ে দেওয়া যে, মানবিক মর্যাদার প্রেক্ষিতে জান্নাতই তাদের উপযোগী স্থায়ী বাসস্থান; কিন্তু অভিশপ্ত শয়তান নিরবচ্ছিন্ন প্ররোচনার মাধ্যমে মানুষকে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ও বিমুখ করে জান্নাত থেকে বের করে জাহান্নামে তার সঙ্গী করার চেষ্টায় রত। তাই পরম করুণাময়ের ক্ষমা ও জান্নাত লাভের জন্য মানুষকে সজাগ থেকে সে কুমন্ত্রণাদানকারী শয়তানের সফল মোকাবিলা করতে হবে।
৪১. 'যালিম' শব্দটি গভীর অর্থবোধক। 'যুলুম' বলা হয়, কোনো জিনিসকে তার নির্ধারিত জায়গায় না রেখে ভিন্ন জায়গায় রাখা। সে হিসেবে সকল অন্যায়-অনাচার-অধিকার হরণকে যুলুম বলা হয়। অতঃপর যে ব্যক্তি কারো অধিকার হরণ করে সে যালিম। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশনাবলী অমান্য করে এবং সীমালংঘনে সক্রিয় হয়, সে আসলে ৩টি বড় বড় মৌলিক অধিকার হরণ করে:
ক. প্রথমত সে আল্লাহর অধিকার হরণ করে। কারণ আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালনকারী আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করতে হবে, এটা আল্লাহর অধিকার।
খ. দ্বিতীয়ত আল্লাহর নির্দেশনাবলী অমান্য করতে গিয়ে সে যেসব উপকরণ ব্যবহার করে তাদের সবার অধিকার ক্ষুন্ন করে। কারণ তার বিবেক-বুদ্ধি, যোগ্যতা, ক্ষমতা, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার সাথে বসবাসকারী সমাজের অন্যান্য লোক, তার ইচ্ছা ও সংকল্প পূর্ণ করার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ফিরিশতাগণ এবং যে সব বস্তু-সামগ্রী সে তার কাজে ব্যবহার করে – এদের সবার ওপর তার অধিকার ছিল যে, এদেরকে কেবলমাত্র এদের মালিক তথা আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করবে; কিন্তু তাঁর নির্দেশনার বিরুদ্ধে এসব ব্যবহার করায় তাদের ওপর যুলুম করা হয়।
গ. তৃতীয়ত সে তার নিজের অধিকার হরণ করে। কারণ তার নিজের সত্ত্বাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করা তার দায়িত্ব; কিন্তু অমান্যকারী ও বিদ্রোহী হয়ে যখন সে নিজেকে আল্লাহর শাস্তিলাভের যোগ্য করে তোলে, তখন সে আসলে তার আপন ব্যক্তিসত্ত্বার ওপরই যুলুম করে।
এসব কারণে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে 'গুনাহ' শব্দটির জন্য 'যুলুম' আর 'গুনাহগার' শব্দটির জন্য 'যালিম' পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।
﴿ فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيۡطَٰنُ عَنۡهَا فَأَخۡرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِۖ وَقُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ بَعۡضُكُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوّٞۖ وَلَكُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُسۡتَقَرّٞ وَمَتَٰعٌ إِلَىٰ حِينٖ ٣٦ ﴾ [ البقرة : ٣٦ ]
৩৬. অতঃপর শয়তান তাদেরকে জান্নাত থেকে স্খলিত করল। অতঃপর তারা যাতে ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল, আর আমি বললাম, ‘তোমরা নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু৪২। আর তোমাদের জন্য যমীনে রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবাস ও ভোগ-উপকরণ’।
৪২. অর্থাৎ মানুষের শত্রু শয়তান এবং শয়তানের শত্রু মানুষ। শয়তান মানুষের শত্রু, একথা সুস্পষ্ট। কারণ সে মানুষকে আল্লাহর নির্দেশনার পথ থেকে সরিয়ে অজ্ঞতা ও ধ্বংসের পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করে; কিন্তু শয়তানের শত্রু মানুষ – একথার অর্থ কি? বস্তুতঃ মানুষের সঠিক পথে অবিচল থাকার স্বার্থে তাকে শয়তানের প্রতি শত্রুতার মনোভাব পোষণ করা অপরিহার্য। কারণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার সামনে শয়তান যে সব আকর্ষণীয় প্রলোভন অথবা ভয়-ভীতি বা ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে, মানুষ তাতে প্রতারিত হয়ে তাকে নিজের বন্ধু ভেবে বসে। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে আপাতঃ দৃষ্টিতে যৌক্তিক কিন্তু প্রকৃত বিবেচনায় সত্য ও সুন্দর থেকে বিচ্যুত বা আরেকটু অগ্রসর হয়ে সে সত্য-বিমুখ হয়ে পড়ে। যা তাকে ঈমান, জ্ঞান ও সততার আলোকিত রাজপথ থেকে সরিয়ে অন্ধকার অলি-গলিতে চলতে তৃপ্তি দেয় তথা ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। তাই সত্যপন্থীদেরকে তাদের আত্মরক্ষার লক্ষ্যেই শয়তান, তার কুমন্ত্রণা, তার উৎস এবং সহযোগীদের থেকে সচেতনভাবে দূরে থেকে তার বিরোধিতা করে যেতে হবে আর সব সময় চাইতে হবে আল্লাহর সাহায্য। (দেখুন: সূরা আন-নাস)
﴿ فَتَلَقَّىٰٓ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَٰتٖ فَتَابَ عَلَيۡهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٣٧ ﴾ [ البقرة : ٣٧ ]
৩৭. অতঃপর আদম তার রবের পক্ষ থেকে কিছু বাণী পেলো৪৩ ফলে আল্লাহ তার তাওবা৪৪ কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী, অতি দয়ালু।৪৫
৪৩. দয়াময় আল্লাহ আদম ‘আলাইহিস সালামকে তাওবার বা অনুশোচনার যে বাক্যগুলো শিখিয়ে দেন তা রয়েছে সূরা আল-আ'রাফের ২৩ নং আয়াতে –
﴿ رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٢٣ ﴾ [ الاعراف : ٢٣ ]
হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের ওপর যুলুম করেছি। এখন যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি রহম না করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।
৪৪. 'তাওবা' অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং প্রকৃত আত্মোপলব্ধি ও বাস্তব কর্ম-সংশোধন, ভবিষ্যতে পাপ না করার সংকল্পের সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা।
৪৫. 'পাপের পরিণামে শাস্তি অবশ্যম্ভাবী এবং মানুষকে তা যে কোনো অবস্থাতেই ভোগ করতে হবে, ক্ষমার কোন সুযোগ তার নেই' – এটি মানুষের স্বকল্পিত ভ্রষ্টকারী মতবাদের একটি। কেননা যে ব্যক্তি একবার পাপ-পঙ্কিল জীবনে প্রবেশ করে, এ মতবাদ তাকে চিরদিনের জন্য নিরাশ করে দেয়।
এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এখানে যে কোনো মুহূর্তে ভুল বুঝতে পারলে তার স্বীকৃতি দিয়ে, লজ্জিত হয়ে, তাৎক্ষণিকভাবে তা পরিত্যাগ করে, অনুশোচনা করে এবং অমান্য, অবহেলা আর বিদ্রোহের পথ ত্যাগ করে করুণাময় আল্লাহর আনুগত্য, নৈকট্য ও ক্ষমার দিকে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে উন্মুক্ত ও অবারিত। তবে অবশ্যই তা হতে হবে আন্তরিকতাপূর্ণ ও কার্যকরী।
আরেকটি বিষয় হলো, কোনো ভুল উপলব্ধির পরও নিস্ক্রিয় থেকে – সময় ক্ষেপণ করে – তা থেকে ফিরে আসার শুধু পরিকল্পনা করতে থাকা এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা ও ক্ষতিকারক প্রবৃত্তি। কারণ 'ভবিষ্যতে' তাওবা করার উপযুক্ত 'সময় ও সুযোগ' পাওয়া সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তাই যখনই বিচ্যুতি বা ভুল করে ফেলা বা বুঝতে পারা – অনুতাপের সময় তখনই, সংশোধিত হতে হবে অনতিবিলম্বে, দয়াময় আল্লাহর করুণা, ক্ষমা ও রহমত লাভের মাধ্যমে ফিরে আসতে হবে সত্য, সুন্দর আর সাফল্যের পথে।
﴿ قُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ مِنۡهَا جَمِيعٗاۖ فَإِمَّا يَأۡتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدٗى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٣٨ ﴾ [ البقرة : ٣٨ ]
৩৮. আমি বললাম, ‘তোমরা সবাই তা থেকে নেমে যাও।৪৮ অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোনো হিদায়াত৪৯ আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’।৫০
৪৮. এ বাক্যটির পুনরাবৃত্তি তাৎপর্যপূর্ণ। ৩৬নং আয়াতেও ছিল একই বাণী। সেখানে 'জান্নাত থেকে নেমে যাও' অর্থ মানুষকে তার কর্মস্থল তথা পৃথিবীতে চাষাবাদ ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইবাদত-দাসত্বের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হলো। আর সে মিশনে সার্বক্ষণিক প্ররোচক ও শত্রু হিসেবে ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী শয়তানকে পরিচিত করে দেওয়া হলো। এরপর (৩৭নং আয়াত) আদম ‘আলাইহিস সালাম তাওবা করলেন এবং মহান আল্লাহ তা কবুল করে নিলেন। এখন আর কোনো তিরস্কার না, বরং তাঁকে মহান নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হলো। কাজেই একটি ভুলের কারণে পৃথিবীতে মানুষকে আসতে হলো– এটি নিরেট ভ্রান্ত ধারণা।
৪৯. যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠতম মানুষদের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কাছে পৌঁছে গেছে সে সব পথ-নির্দেশ। সে ধারাবাহিকতার সর্বশেষ নির্দেশনা হলো আল-কুরআন।
৫০. দুনিয়া ও আখিরাতে সুখ, শান্তি, স্বস্তি, প্রকৃত সাফল্য ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
﴿ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَكَذَّبُواْ بَِٔايَٰتِنَآ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٣٩ ﴾ [ البقرة : ٣٩ ]
৩৯. আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।
﴿ يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَوۡفُواْ بِعَهۡدِيٓ أُوفِ بِعَهۡدِكُمۡ وَإِيَّٰيَ فَٱرۡهَبُونِ ٤٠ ﴾ [ البقرة : ٤٠ ]
৪০. হে বনী ইসরাঈল৫১! তোমরা আমার নিয়ামতকে স্মরণ কর, যে নিয়ামত আমি তোমাদেরকে দিয়েছি এবং তোমরা আমার অঙ্গীকার পূর্ণ কর, তাহলে আমি তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর কেবল আমাকেই ভয় কর।
৫১. 'ইসরাঈল' শব্দের অর্থ আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর বান্দাহ। এটি ইয়াকুব ‘আলাইহিস সালামের আল্লাহ-প্রদত্ত উপাধি। তিনি ইসহাক ‘আলাইহিস সালামের পুত্র ও ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের প্রপুত্র। তাঁরই বংশধরকে বলা হয় বনী ইসরাঈল। এ জাতিধারায় মনোনীত হয়ে এসেছেন অগণিত নবী ও রাসূলগণ। ইউসুফ, ইউনুস, আইউব, দাউদ, সোলাইমান, যাকারিয়া, ইয়াহহিয়া, মূসা, হারূন আ'লাইহিমুস সালামসহ আমাদের অজানা আরো অনেক নবী-রাসূলগণের ধারাবাহিকতায় ঐ বংশ-ধারার শেষে আগমন করেছেন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম। আর ইসমাঈল ‘আলাইহিস সালামের বংশ-ধারায় আগমন করেন বিশ্ব-জাহানের সর্বশেষ নবী রাহমাতুল্লিল আ'লামীন মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম।
﴿ وَءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلۡتُ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَكُمۡ وَلَا تَكُونُوٓاْ أَوَّلَ كَافِرِۢ بِهِۦۖ وَلَا تَشۡتَرُواْ بَِٔايَٰتِي ثَمَنٗا قَلِيلٗا وَإِيَّٰيَ فَٱتَّقُونِ ٤١ ﴾ [ البقرة : ٤١ ]
৪১. আর তোমাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারীস্বরূপ আমি যা নাযিল করেছি তার প্রতি তোমরা ঈমান আন।৫২ এবং তোমরা তা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। আর তোমরা আমার আয়াতসমূহ সামান্যমূল্যে বিক্রি করো না৫৩ এবং কেবল আমাকেই ভয় কর।
৫২. বনী ইসরাঈলের সাথে মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে অঙ্গীকারগুলো ছিলো, আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় তার বর্ণনা চলছে।
৫৩. 'সামান্য দাম' বলে দুনিয়ার স্বার্থ ও লাভের কথা বুঝানো হয়েছে। এ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ও সাময়িক অর্জনের ধোঁকায় পড়ে মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও উপদেশকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে বা আরেকটু অগ্রসর হয়ে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে দূরে চলে যায়।
এক্ষেত্রে সাধারণের চেয়ে সমাজে যারা বিভিন্নভাবে দিক-নির্দেশনা ও নেতৃত্ব দানের সাথে জড়িত, তাদের যথেষ্ট উপলব্ধির ও সতর্ক হবার অবকাশ রয়েছে। কোনো কিছুর স্পষ্টকরণ বা ব্যাখ্যা প্রদানে অযাচিত ও অন্যায়ভাবে কারো পক্ষ নেওয়া, কারো মনোতুষ্টি বা বিরাগভাজন হওয়া, জনপ্রিয়তা ও পদ-পদবীলাভ বা তা সংরক্ষণ অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো বৈষয়িক অর্জনকে সচেতনভাবে পরিহার করতে হবে। শুধুমাত্র মহান অন্তর্যামী আল্লাহ ও তাঁর ক্রোধকে ভয় করে, তাঁর নিষ্ঠাবান প্রতিনিধির উপযুক্ত মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের কথা বিবেচনা করে আল্লাহ-প্রদত্ত নির্দেশনাবলীর অনুসরণ করে যেতে হবে।
﴿ وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤٢ ﴾ [ البقرة : ٤٢ ]
৪২. আর৫৪ তোমরা হককে বাতিলের সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে হককে গোপন করো না।৫৫
৫৪. বনী ইসরাঈলের সাথে মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে অঙ্গীকারগুলো ছিলো, আগের আয়াতসমূহের ধারাবাহিকতায় তার বর্ণনা চলছে।
৫৫. তৎকালীন আরববাসীদের মধ্যে খ্রিস্টান বিশেষতঃ ইয়াহূদীরা যথেষ্ট শিক্ষিত ছিল। ফলে সাধারণ আরবরা মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়ত প্রসঙ্গে শিক্ষিত ইয়াহূদী পুরোহিতদের কাছে জানতে চাইত; কিন্তু তাদের আসমানী কিতাবের ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী সুস্পষ্ট ও নির্ভুল বৈশিষ্ট্য ও প্রমাণাদি লক্ষ্য করেও তারা সত্য-মিথ্যাকে মিশ্রিত করে বা গোপন করে প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ও সন্দেহ সঞ্চার করতে থাকে।
আরো জানতে দেখুন:
সূরা নং- ২ আল-বাকারা: ১১১, ১১৩, ১৩৫, ১৪০
সূরা নং- ৩ আলে-ইমরান: ৬৭
সূরা নং- ৪ আন-নিসা: ৪৬
সূরা নং- ৫ আল-মায়িদা: ১৮, ৪১, ৪৪, ৬৪, ৮২
সূরা নং- ৭ আল-আ’রাফ: ১৬৭
সূরা নং- ৬১ আস-সাফ্: ৫-৬
এছাড়া মহান আল্লাহ তা‘আলার চিরন্তন এ বাণী থেকে আমরা সত্য ও মিথ্যার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ কি হওয়া উচিত সে নির্দেশনাও পাই।
﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣ ﴾ [ البقرة : ٤٣ ]
৪৩. আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর৫৭ এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর।৫৮
৫৬. বনী ইসরাঈলের প্রতি মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে নির্দেশনাগুলো ছিলো, সে আলোচনাই এখানে চলমান।
৫৭. সালাত ও যাকাত প্রতি যুগে যুগে দ্বীন ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে এসেছে; কিন্তু ইয়াহূদীরা এ ব্যাপারে অনীহা প্রদর্শন করে জামা‘আতে সালাত পড়ার ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত প্রায় বিলুপ্ত করে বেশির ভাগ লোক ব্যক্তিগত পর্যায়ে সালাত ছেড়ে দেয়। আর যাকাত দেয়ার পরিবর্তে তারা অভ্যস্ত ছিলো সুদের ব্যবসায়।
এখানে আমাদেরও ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সালাত ও যাকাত অনুশীলনে উপলব্ধির অবকাশ রয়েছে।
৫৮. পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতগুলো জামা‘আতে আদায় করার তাকিদ।
﴿ ۞أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّ وَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ وَأَنتُمۡ تَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٤٤ ﴾ [ البقرة : ٤٤ ]
৪৪. তোমরা কি মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দিচ্ছ আর নিজেদেরকে ভুলে যাচ্ছ? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত কর।৫৯ তোমরা কি বুঝো না?
৫৯. হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা কার্যতঃ করো না? আল্লাহর কাছে এটি অত্যন্ত ক্রোধ উদ্রেককারী ব্যাপার যে, তোমরা বলবে এমন কথা, যা করো না। [সূরা আস-সাফ, আয়াত: ২-৩]
﴿ وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى ٱلۡخَٰشِعِينَ ٤٥ ﴾ [ البقرة : ٤٥ ]
৪৫. আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা বিনয়ী ছাড়া অন্যদের ওপর কঠিন।
﴿ ٱلَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُّلَٰقُواْ رَبِّهِمۡ وَأَنَّهُمۡ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ٤٦ ﴾ [ البقرة : ٤٦ ]
৪৬. যারা বিশ্বাস করে যে, তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং তারা তাঁর দিকে ফিরে যাবে।
﴿ يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَنِّي فَضَّلۡتُكُمۡ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ٤٧ ﴾ [ البقرة : ٤٧ ]
৪৭. হে বনী ইসরাঈল, তোমরা আমার নি‘আমতকে স্মরণ কর, যে নি‘আমত আমি তোমাদেরকে দিয়েছি এবং নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে বিশ্ববাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।৬০
৬০. এখানে সে যুগের কথা বলা হয়েছে, যখন দুনিয়ার সব জাতির মধ্যে একমাত্র বনী ইসরাঈল বা ইয়াহূদীদের কাছে আল্লাহ-প্রদত্ত সত্যজ্ঞান ছিল এবং তাদেরকেই বিশ্বের জাতিসমূহের নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। অন্যান্য জাতিদেরকে আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বের পথে আহবান করা ছিল তাদের দায়িত্ব।
﴿ وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا يُؤۡخَذُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٤٨ ﴾ [ البقرة : ٤٨ ]
৪৮. আর তোমরা সে দিনকে ভয় কর, যেদিন কেউ কারো কোনো কাজে আসবে না। আর কারো পক্ষ থেকে কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং কারো কাছ থেকে কোনো বিনিময় নেওয়া হবে না। আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না। ৬১
৬১. 'জবাবদিহির দিনের' কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই বনী ইসরাঈলের মাঝে চরম পদস্খলন ঘটেছিল। বস্তুতঃ আখিরাত তথা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা, কিয়ামত, পুনরুত্থান, হাশর, জবাবদিহি ও অনন্তকালের জীবন সম্পর্কিত সুস্পষ্ট ধারণা, বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি বা দুর্বলতাই মানুষের চরিত্র ও জীবনধারায় বিকৃতির অন্যতম প্রধান কারণ। তাই তো মানুষের প্রকৃত কল্যাণকামী প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন পবিত্র কুরআনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বর্ণনা করেছেন আখিরাতের কথা।
﴿ وَإِذۡ نَجَّيۡنَٰكُم مِّنۡ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ يَسُومُونَكُمۡ سُوٓءَ ٱلۡعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبۡنَآءَكُمۡ وَيَسۡتَحۡيُونَ نِسَآءَكُمۡۚ وَفِي ذَٰلِكُم بَلَآءٞ مِّن رَّبِّكُمۡ عَظِيمٞ ٤٩ ﴾ [ البقرة : ٤٩ ]
৪৯. আর স্মরণ কর,৬২ যখন আমি তোমাদেরকে ফিরআউনের দল থেকে রক্ষা করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠিন আযাব দিত। তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে যবেহ করত এবং তোমাদের নারীদেরকে বাঁচিয়ে রাখত। আর এতে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ছিল মহা পরীক্ষা।
৬২. এখান থেকে পরবর্তী কয়েক রুকূ ক্রমাগতভাবে বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ অংশ তুলে ধরা হয়েছে। এখানে একদিকে তাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত দয়া-অনুগ্রহ, অপরদিকে তার বিপরীতে তাদের সীমাহীন অকৃতজ্ঞতা ও দুষ্কর্মের সারাংশ বর্ণনা করা হয়েছে।
﴿ وَإِذۡ فَرَقۡنَا بِكُمُ ٱلۡبَحۡرَ فَأَنجَيۡنَٰكُمۡ وَأَغۡرَقۡنَآ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٠ ﴾ [ البقرة : ٥٠ ]
৫০. আর যখন তোমাদের জন্য আমি সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে নাজাত দিয়েছিলাম এবং ফির‘আউন দলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তোমরা দেখছিলে।
﴿ وَإِذۡ وَٰعَدۡنَا مُوسَىٰٓ أَرۡبَعِينَ لَيۡلَةٗ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُونَ ٥١ ﴾ [ البقرة : ٥١ ] ﴾
৫১. আর যখন আমি মূসাকে চল্লিশ রাতের ওয়াদা দিয়েছিলাম,৬৪ অতঃপর তোমরা তার যাওয়ার পর বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করেছিলে,৬৫ আর তোমরা ছিলে যালিম।
৬৪. মিশর থেকে মূসা ‘আলাইহিস সালামের নেতৃত্বে মুক্তি লাভের পর বনী ইসরাঈল বা ইয়াহূদীরা যখন সাইনা (সিনাই) উপত্যকায় পৌঁছে, তখন মহান আল্লাহ তাঁকে ৪০ দিন-রাতের জন্য তূর পাহাড়ে ডেকে নেন। ফিরাউনের দাসত্ব থেকে এখন মুক্ত জাতিটির জন্য জীবন-যাপনের বিধান দান করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
৬৫. সিনাই উপত্যকায় বনী ইসরাঈলের বসবাসের স্থানে প্রতিবেশি গোত্রদের মধ্যে গাভী ও ষাঁড় পূজার প্রথা বিদ্যমান ছিল। তা থেকে প্রভাবিত হয়ে এবং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তারা মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর অনুপস্থিতিতে এবং হারুন ‘আলাইহিস সালামকে অগ্রাহ্য করে বাছুর আকৃতির মূর্তি নির্মাণ করে তার পূজা করতে শুরু করে।
﴿ ثُمَّ عَفَوۡنَا عَنكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٢ ﴾ [ البقرة : ٥٢ ]
৫২. অতঃপর আমি তোমাদেরকে এ সবের পর ক্ষমা করেছি, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।
﴿ وَإِذۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡفُرۡقَانَ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ٥٣ ﴾ [ البقرة : ٥٣ ]
৫৩. আর যখন আমি মূসাকে দিয়েছিলাম কিতাব ও ফুরকান৬৭ যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।
৬৭. ফুরকান হচ্ছে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্টকারী 'মানদণ্ড'। এর মর্মার্থ হলো দ্বীনের এমন জ্ঞান, বোধ (perception) ও উপলব্ধি যার মাধ্যমে মানুষ সঠিক ও সত্য এবং মিথ্যা ও বিকৃতিকে পৃথক করে চিনে নিতে পারে।
﴿ وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦ يَٰقَوۡمِ إِنَّكُمۡ ظَلَمۡتُمۡ أَنفُسَكُم بِٱتِّخَاذِكُمُ ٱلۡعِجۡلَ فَتُوبُوٓاْ إِلَىٰ بَارِئِكُمۡ فَٱقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ لَّكُمۡ عِندَ بَارِئِكُمۡ فَتَابَ عَلَيۡكُمۡۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٥٤ ﴾ [ البقرة : ٥٤ ]
৫৪. আর যখন মূসা তার কওমকে বলেছিল, ‘হে আমার কওম, নিশ্চয় তোমরা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করে নিজদেরকে যুলুম করেছ। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তাওবা কর। অতঃপর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর।৬৮ এটি তোমাদের জন্য তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট উত্তম। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের তাওবা কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
৬৮. অর্থাৎ তাদের মধ্যে যেসব লোক গো-শাবককে উপাস্য বানিয়ে তার পূজা করেছে তাদেরকে হত্যা করো।
﴿ وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نُّؤۡمِنَ لَكَ حَتَّىٰ نَرَى ٱللَّهَ جَهۡرَةٗ فَأَخَذَتۡكُمُ ٱلصَّٰعِقَةُ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٥ ﴾ [ البقرة : ٥٥ ]
৫৫. আর যখন তোমরা বললে, ‘হে মূসা, আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব না, যতক্ষণ না আমরা প্রকাশ্যে আল্লাহকে দেখি’। ফলে বজ্র তোমাদেরকে পাকড়াও করল আর তোমরা তা দেখছিলে।
﴿ ثُمَّ بَعَثۡنَٰكُم مِّنۢ بَعۡدِ مَوۡتِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٦ ﴾ [ البقرة : ٥٦ ]
৫৬. অতঃপর আমি তোমাদের মৃত্যুর পর তোমাদেরকে পুনর্জীবন দান করলাম, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।৬৯
৬৯. এখানে ইঙ্গিতকৃত ঘটনাটি হলো, মূসা ‘আলাইহিস সালাম ৪০ দিনের জন্য তূর পাহাড়ে গমনের সময় মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী বনী ইসরাঈল থেকে ৭০জন বাছাইকৃত ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে যান। অতঃপর তাঁকে সেখানে 'কিতাব ও ফুরকান' দেওয়া হলে (দেখুন: আল-বাকারা, আয়াত: ৫৩) তিনি সেগুলো উক্ত ব্যক্তিদেরকে প্রদর্শন করেন। তখন এসবের মধ্য থেকে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক ধৃষ্টতার সাথে একথা বলতে থাকে যে, আল্লাহকে দৃশ্যমান আকারে আমাদেরকে দেখাও। তাদের ঐ আচরণের প্রেক্ষিতে তাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হয়।
আরো জানতে দেখুন: সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৫৫।
﴿ وَظَلَّلۡنَا عَلَيۡكُمُ ٱلۡغَمَامَ وَأَنزَلۡنَا عَلَيۡكُمُ ٱلۡمَنَّ وَٱلسَّلۡوَىٰۖ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡۚ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَٰكِن كَانُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ يَظۡلِمُونَ ٥٧ ﴾ [ البقرة : ٥٧ ]
৫৭. আর আমি তোমাদের ওপর মেঘের ছায়া দিলাম৭০ এবং তোমাদের প্রতি নাযিল করলাম ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’।৭১ তোমরা সে পবিত্র বস্তু থেকে আহার কর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। আর তারা আমার প্রতি যুলুম করেনি, বরং তারা নিজেদেরকেই যুলুম করত।
৭০. মিশর থেকে প্রস্থানকালে বনী ইসরাঈলের সংখ্যা ছিল এক লাখের মত। আর সিনাই উপদ্বীপে ঘর-বাড়ী তো দূরের কথা, মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই পর্যন্ত ছিল না। তখন মহান আল্লাহ যদি দীর্ঘকাল পর্যন্ত আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন না রাখতেন, তাহলে এ জাতি প্রখর রোদে ধ্বংস হয়ে যেতো।
৭১. 'মান্না' এক প্রকার আঠা জাতীয় মিষ্টি খাদ্য (sweet gum), কুয়াশার মত এগুলো বর্ষিত হতো। আর 'সালওয়া' ছিল কোয়েলের মত এক প্রকার ছোট পাখী (quails)। সিনাই উপদ্বীপের প্রতিকূল পরিবেশে (severely adverse topography & terrain) এক লাখ লোকের ৪০ বছরের উদ্বাস্তু জীবনে এভাবেই দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন বিনা শ্রমে রিযিকের সংস্থান করেছিলেন (আরো জানতে দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং-৪১২০)।
﴿ وَإِذۡ قُلۡنَا ٱدۡخُلُواْ هَٰذِهِ ٱلۡقَرۡيَةَ فَكُلُواْ مِنۡهَا حَيۡثُ شِئۡتُمۡ رَغَدٗا وَٱدۡخُلُواْ ٱلۡبَابَ سُجَّدٗا وَقُولُواْ حِطَّةٞ نَّغۡفِرۡ لَكُمۡ خَطَٰيَٰكُمۡۚ وَسَنَزِيدُ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٥٨ ﴾ [ البقرة : ٥٨ ]
৫৮. আর স্মরণ কর, যখন আমি বললাম, ‘তোমরা প্রবেশ কর এ জনপদে। আর তা থেকে আহার কর তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী, স্বাচ্ছন্দ্যে এবং দরজায় প্রবেশ কর মাথা নীচু করে। আর বল ‘ক্ষমা’। তাহলে আমি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং নিশ্চয় আমি সৎকর্মশীলদেরকে বাড়িয়ে দেব’।
﴿ فَبَدَّلَ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ قَوۡلًا غَيۡرَ ٱلَّذِي قِيلَ لَهُمۡ فَأَنزَلۡنَا عَلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ رِجۡزٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ بِمَا كَانُواْ يَفۡسُقُونَ ٥٩ ﴾ [ البقرة : ٥٩ ]
৫৯. কিন্তু যালিমরা পরিবর্তন করে ফেলল সে কথা তাদেরকে যা বলা হয়েছিল, তা ভিন্ন অন্য কথা দিয়ে। ফলে আমি তাদের ওপর আসমান থেকে আযাব নাযিল করলাম, কারণ তারা পাপাচার করত।
﴿ ۞وَإِذِ ٱسۡتَسۡقَىٰ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦ فَقُلۡنَا ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡحَجَرَۖ فَٱنفَجَرَتۡ مِنۡهُ ٱثۡنَتَا عَشۡرَةَ عَيۡنٗاۖ قَدۡ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٖ مَّشۡرَبَهُمۡۖ كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ مِن رِّزۡقِ ٱللَّهِ وَلَا تَعۡثَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِينَ ٦٠ ﴾ [ البقرة : ٦٠ ]
৬০. আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার কওমের জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, ‘তুমি তোমার লাঠি দ্বারা পাথরকে আঘাত কর’। ফলে তা থেকে উৎসারিত হল বারটি ঝরনা;৭৬ প্রতিটি দল তাদের পানি পানের স্থান জেনে নিল।৭৭ তোমরা আল্লাহর রিযিক থেকে আহার কর ও পান কর এবং ফাসাদকারী হয়ে যমীনে ঘুরে বেড়িয়ো না।
৭৬. ঐ পাথর গুলোর অস্তিত্ব এখনো মিসরের সিনাই উপদ্বীপ এলাকায় বিদ্যমান।
৭৭. বারোটি ঝরনার উদ্ভবের কারণ, বনী ইসরাঈলে ছিল ১২টি গোত্র, যাতে পানি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিবাদ না হয়।
দেখুন: সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ১৬০
﴿ وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نَّصۡبِرَ عَلَىٰ طَعَامٖ وَٰحِدٖ فَٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُخۡرِجۡ لَنَا مِمَّا تُنۢبِتُ ٱلۡأَرۡضُ مِنۢ بَقۡلِهَا وَقِثَّآئِهَا وَفُومِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَاۖ قَالَ أَتَسۡتَبۡدِلُونَ ٱلَّذِي هُوَ أَدۡنَىٰ بِٱلَّذِي هُوَ خَيۡرٌۚ ٱهۡبِطُواْ مِصۡرٗا فَإِنَّ لَكُم مَّا سَأَلۡتُمۡۗ وَضُرِبَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلذِّلَّةُ وَٱلۡمَسۡكَنَةُ وَبَآءُو بِغَضَبٖ مِّنَ ٱللَّهِۗ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ يَكۡفُرُونَ بَِٔايَٰتِ ٱللَّهِ وَيَقۡتُلُونَ ٱلنَّبِيِّۧنَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّۗ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ ٦١ ﴾ [ البقرة : ٦١ ]
৬১. আর যখন তোমরা বললে, ‘হে মূসা, আমরা এক খাবারের ওপর কখনো ধৈর্য ধরবো না। সুতরাং তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দো’আ কর, যেনো তিনি আমাদের জন্য বের করেন, ভূমি যে সব্জি, কাঁকড়, রসুন, মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করে, তা’। সে বলল, ‘তোমরা কি যা উত্তম তার পরিবর্তে এমন জিনিস গ্রহণ করছো যা নিম্নমানের? তোমরা কোনো এক নগরীতে অবতরণ কর। তবে নিশ্চয় তোমাদের জন্য (সেখানে) থাকবে, যা তোমরা চেয়েছ’। আর তাদের ওপর আরোপ করা হয়েছে লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য এবং তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হল। তা এ কারণে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করত৭৮ এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করত। ৭৯ তা এ কারণে যে, তারা নাফরমানী করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত।৮০
৭৮. মহান আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করার কয়েকটি অবস্থা রয়েছে:
ক. আল্লাহ-প্রদত্ত বিধি-বিধানের মধ্যে যেসব বিধান নিজের খেয়াল-খুশীর বিপরীত সেগুলো মানতে সরাসরি অস্বীকার করা।
খ. কোনো বিধানকে আল্লাহ-প্রদত্ত জেনেও গর্ব-অহংকারের সাথে তার বিপরীত কাজ করা এবং আল্লাহর নির্দেশের কোনো পরওয়া না করা।
গ. মহান রাব্বুল আ’লামীনের বাণীর মর্মার্থ ভালোভাবে জানা ও বুঝার পরও প্রবৃত্তির চাহিদা অনুসারে তার পরিবর্তন করা।
৭৯. বনী ইসরাঈল-কর্তৃক নবী-হত্যাসহ গুরুতর অপরাধসমূহের বিবরণ তাদের নিজেদের ইতিহাসেই লিপিবদ্ধ রয়েছে, তার দু-তিনটি উদাহরণ নীচে দেওয়া হলো। আপনি আগ্রহী হলে লিঙ্কগুলো দেখতে পারেন:
ক. ইয়াহ্ইয়া আ: (যোহন)-কে হত্যা: মার্ক, অধ্যায় - ৬, শ্লোক ১৭-২৯. http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbnew/Mark.pdf
খ. নবী ইয়ারমিয়ার (যেরেমিয়া) ওপর নির্যাতন: যেরেমিয়া, অধ্যায় - ১৮, শ্লোক ১৩-২৩
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Jeremiah.pdf
গ. যাকারিয়া আ:-কে প্রস্তরাঘাত করা:
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Zechariah.pdf
ঘ. ঈসা আ: এর বিরূদ্ধে মামলা, বিচার ও ফাঁসির রায়: মথি, অধ্যায় - ২৭, শ্লোক ২০-২৬
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbnew/Matthew.pdf
৮০. যুগে যুগে যে সব জাতি মহান আল্লাহ তা‘আলার অসীম নিয়ামত ও নিদর্শন লাভের পরও সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মানব তথা নবী-রাসূলদেরসহ সৎ, সত্য-পন্থী ও আল্লাহর পথে আহবানকারীদের নির্যাতন করেছে, বয়কট করেছে, হত্যা করেছে; অবাধ্যতা, সীমালংঘন আর মানুষের ন্যায্য অধিকার হরণের প্রতিযোগিতা করেছে, আর ফাসিক ও দুশ্চরিত্র লোকদের নেতৃত্বে নিজদেরকে চালিত করেছে - তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত অনিবার্য।
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱلَّذِينَ هَادُواْ وَٱلنَّصَٰرَىٰ وَٱلصَّٰبِِٔينَ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا فَلَهُمۡ أَجۡرُهُمۡ عِندَ رَبِّهِمۡ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ﴾ [ البقرة : ٦٢ ]
৬২. নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা ইয়াহূদী হয়েছে এবং খ্রিস্টান ও সাবিঈনরা-৮১ (তাদের মধ্যে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও আখিরাতের দিনের প্রতি এবং নেক কাজ করেছে - তবে তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।৮২
৮১. সাবেয়ীদের ধর্মীয় বিশ্বাস কি ছিল তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহমতুল্লাহি ‘আলাইহি. বলেছেন, সাবেয়ীদের ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহমতুল্লাহি ‘আলাইহির মতে সাবেয়ীরা বৃহৎ একটি দল যাদের কেউ ছিল মু’মিন আবার কেউ কাফির। সাবেয়ীরা নবী-রাসূলদের অস্বীকার করত না, তবে তাদের আনুগত্যকেও বাধ্যতামূলক মনে করত না। তারা সর্বজ্ঞাত প্রজ্ঞাময় আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত তবে তাদের অধিকাংশের বক্তব্য ছিল, মাধ্যম গ্রহণ ব্যতীত আল্লাহর কাছে পৌঁছা কখনো সম্ভব নয়। তাই তারা ঐসব মাধ্যমকে উপাসনার পাত্ররূপে গ্রহণ করে নিয়েছিল। সাবেয়ীরা যে ধর্মে যে বিষয়টাকে ভালো মনে করত তারা সেটাকেই আপন করে নিত। তারা সুনির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের পক্ষপাতিত্ব করত না; বরং সাবেয়ীদের কাছে সকল ধর্মের বিধানগুলো পৃথিবীর কল্যাণার্থেই প্রবর্তিত হয়েছে।
তবে সাবেয়ীরা দুটি মৌল ধারায় বিভক্ত ছিল বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। একটি ধারায় ছিল হুনাফা, অর্থাৎ একত্ববাদী সাবেয়ীরা, আরেকটি ছিল মুশরিক সাবেয়ীরা। (দ্র: আররাদ্দু আলাল মান্তেকিয়ীন: ১৮৭-৪৫৪, ২৯০-৪৫৮ )
৮২. মহান আল্লাহর কাছে মূল্য ও মর্যাদা একমাত্র যথাযথ ঈমান ও সৎ কাজের। যে ব্যক্তি এ সম্পদ নিয়ে তাঁর সামনে হাযির হতে পারবে, সে লাভ করবে পূর্ণ পুরস্কার।
﴿ وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱذۡكُرُواْ مَا فِيهِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٦٣ ثُمَّ تَوَلَّيۡتُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَۖ فَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ لَكُنتُم مِّنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٤ ﴾ [ البقرة : ٦٣، ٦٤ ]
৬৩-৬৪. আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের ওপর উঠালাম।৮৪ আমি (বললাম) ‘তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা শক্তভাবে ধর এবং তাতে যা রয়েছে তা স্মরণ কর, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার’।৮৫
অতঃপর তোমরা এ সবের পর বিমুখ হয়ে ফিরে গেলে। আর যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না হত, তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে।৮৬
৮৫. মুত্তাকী তারা যারা সবসময় দয়াময় আল্লাহর ক্ষমা ও পুরস্কার লাভের আশায় সতর্কাবস্থায় চলে এবং সৎকাজে সদা তৎপর থাকে; আর মহাবিচার দিনের মালিক আল্লাহর শাস্তিকে সব সময় ভয় পায়, তাই সদা সর্বদা অন্যায়-অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকে।
৮৬. এ হলো করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর পরম প্রিয়সৃষ্টি মানুষকে - জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নয়- বরং নিজ আগ্রহে সংশোধিত হয়ে তাঁর ক্ষমা লাভে ধন্য হবার সুযোগ যা বার বার মানুষের দরজায় কড়া নাড়ে। তারপরেও কি আমাদের তাঁর সন্তষ্টির পথে পুরোপুরি ফিরে এসে আলোকিত জীবন গড়ার সময় হবে না?
﴿ وَلَقَدۡ عَلِمۡتُمُ ٱلَّذِينَ ٱعۡتَدَوۡاْ مِنكُمۡ فِي ٱلسَّبۡتِ فَقُلۡنَا لَهُمۡ كُونُواْ قِرَدَةً خَٰسِِٔينَ ٦٥ فَجَعَلۡنَٰهَا نَكَٰلٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهَا وَمَا خَلۡفَهَا وَمَوۡعِظَةٗ لِّلۡمُتَّقِينَ ٦٦ ﴾ [ البقرة : ٦٥، ٦٦ ]
৬৫. আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের৮৭ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল, তাদেরকে অবশ্যই তোমরা জান। অতঃপর আমি তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’।৮৮
৬৬. আর আমি একে বানিয়েছি দৃষ্টান্ত, সে সময়ের এবং তৎপরবর্তী জনপদসমূহের জন্য এবং মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।
৮৭. ‘সাব্ত’ অর্থ কালের একটি ক্ষণ যা আরাম-বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বনী ইসরাঈলের প্রতি এ বিধান ছিল যে, শনিবার দিনকে তারা বিশ্রাম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট রাখবে। এদিনে তারা পার্থিব কোনো কাজ-কর্ম নিজেরা বা পরিচারকদের দিয়েও করাতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে এমন কড়া আইন ছিল যে, এ পবিত্র দিনের নির্দেশ অমান্যকারীর শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। বর্তমান বিকৃত বাইবেলেও (যাত্রা পুস্তক: অধ্যায় ৩১, শ্লোক ১২-১৭) এ নির্দেশনাটি দেখতে পাবেন এ লিঙ্কে-
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Exodus.pdf
কিন্তু তারা নৈতিক ও ধর্মীয় পতনের শিকার হবার পর এ বিধানের সুস্পষ্ট অবমাননা করতে থাকে। এমনকি তাদের শহরগুলোতে শনিবারে প্রকাশ্যে চলতে থাকে সব ধরনের কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য।
৮৮. তাদেরকে বানরে পরিণত করার অর্থ তাদের মস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তিকে পূর্ববৎ রেখে শারীরিক বিকৃতি ঘটিয়ে বানরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
# আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৬৩-১৭১।
﴿ وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تَذۡبَحُواْ بَقَرَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَتَّخِذُنَا هُزُوٗاۖ قَالَ أَعُوذُ بِٱللَّهِ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡجَٰهِلِينَ ٦٧ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨ ﴾ [ البقرة : ٦٧، ٦٨ ]
৬৭. আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার কওমকে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা একটি গাভী যবেহ করবে’।৮৯ তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ?’ সে বলল, ‘আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি।’৯০
৬৮. তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন গাভীটি কেমন হবে।’ সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, নিশ্চয় তা হবে গরু, বুড়ো নয় এবং বাচ্চাও নয়। এর মাঝামাঝি ধরনের। সুতরাং তোমরা কর যা তোমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’৯১
৮৯. এ আয়াতের ‘বাকারাহ’ (গাভী) শব্দ থেকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
৯০. এখানে উল্লেখিত ঘটনাটি সংক্ষেপে এ যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে একটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল; কিন্তু হত্যাকারীকে সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তাই তারা মূসা ‘আলাইহিস সালামের স্মরণাপন্ন হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দিয়ে একটি গাভী যবেহ-এর মাধ্যমে নিহত লোকটিকে জীবিত করে তার হত্যাকারীর পরিচয় উদঘাটন করান। এটি ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা।
৯১. আসলে মহান আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে যে কোনো একটি গাভী কুরবানী করাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু দ্বীনের যে কোনো বিধান পালনে অযথা সন্দেহ-সংশয়, অন্বেষণ ও প্রশ্ন করা ছিল তাদের চিরাচরিত স্বভাব।
﴿ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا لَوۡنُهَاۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ صَفۡرَآءُ فَاقِعٞ لَّوۡنُهَا تَسُرُّ ٱلنَّٰظِرِينَ ٦٩ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَ إِنَّ ٱلۡبَقَرَ تَشَٰبَهَ عَلَيۡنَا وَإِنَّآ إِن شَآءَ ٱللَّهُ لَمُهۡتَدُونَ ٧٠ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا ذَلُولٞ تُثِيرُ ٱلۡأَرۡضَ وَلَا تَسۡقِي ٱلۡحَرۡثَ مُسَلَّمَةٞ لَّا شِيَةَ فِيهَاۚ قَالُواْ ٱلۡـَٰٔنَ جِئۡتَ بِٱلۡحَقِّۚ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُواْ يَفۡعَلُونَ ٧١ ﴾ [ البقرة : ٦٨، ٧١ ]
৬৯. তারা বলল,৯২ ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, কেমন তার রঙ?’ সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, নিশ্চয় তা হবে হলুদ রঙের গাভী, তার রঙ উজ্জ্বল, দর্শকদেরকে যা আনন্দ দেবে।’
৭০. তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, তা কেমন? নিশ্চয় গরুটি আমাদের জন্য সন্দেহপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আর নিশ্চয় আমরা আল্লাহ চাহে তো পথপ্রাপ্ত হব।’
৭১. সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, ‘নিশ্চয় তা এমন গাভী, যা ব্যবহৃত হয়নি জমি চাষ করায় আর না ক্ষেতে পানি দেয়ায়। সুস্থ, যাতে কোনো খুঁত নেই।’ তারা বলল, ‘এখন তুমি সত্য নিয়ে এসেছ।’ অতঃপর তারা তা যবেহ করল অথচ তারা যবেহ করার ছিল না।৯৩
৯২. পূর্বের দুটি আয়াতের সাথে মিলিয়ে অধ্যয়ন করলে মর্মার্থ বুঝা সহজ হবে। গাভী সম্পর্কে বনী ইসরাঈলের বিভিন্ন প্রশ্ন ও সন্দেহ নিরসন চলছে।
৯৩. বনী ইসরাঈলের লোকেরা তৎকালীন মিশরের ফিরাউনের যুলুম ও অত্যাচার থেকে মহান আল্লাহর অসীম-অলৌকিক সাহায্যে মুক্তিলাভের পর সিনাই উপদ্বীপে অবস্থান নেয়। এসময় আশপাশের গো-পূজারী জাতিসমূহ থেকে তাদের মাঝে ‘গাভীর শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার’ ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়ে; আর তারা শুরু করে দেয় গো-বৎস পূজা। ঐ গর্হিত কাজ থেকে ফিরিয়ে আনতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে গাভী কুরবানীর নির্দেশ দিলেন। এটি তাদের জন্যে ছিল ঈমানের এক কঠিন পরীক্ষা। তাই তারা এ আদেশ এড়িয়ে যেতে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে; কিন্তু তার জবাবে সে ‘সোনালী বর্ণের বিশেষ ধরনের গাভী’ই তাদের সামনে এসে পড়ে, যাকে সে সময় তারা পূজা করতো!
বর্তমান বিকৃত বাইবেলের গণনা পুস্তকের ১৯ অধ্যায়ের ১-১০ শ্লোকগুলোতে এ ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে ।
﴿ وَإِذۡ قَتَلۡتُمۡ نَفۡسٗا فَٱدَّٰرَٰٔتُمۡ فِيهَاۖ وَٱللَّهُ مُخۡرِجٞ مَّا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٧٢ ﴾ [ البقرة : ٧٢ ]
৭২. আর স্মরণ কর, যখন তোমরা একজনকে হত্যা করলে অতঃপর সে ব্যাপারে একে অপরকে দোষারোপ করলে। আর আল্লাহ বের করে দিলেন তোমরা যা গোপন করছিলে।
﴿ فَقُلۡنَا ٱضۡرِبُوهُ بِبَعۡضِهَاۚ كَذَٰلِكَ يُحۡيِ ٱللَّهُ ٱلۡمَوۡتَىٰ وَيُرِيكُمۡ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٧٣ ﴾ [ البقرة : ٧٣ ]
৭৩. অতঃপর আমি বললাম, ‘তোমরা তাকে আঘাত কর গাভীটির (গোস্তের) কিছু অংশ দিয়ে। এভাবে আল্লাহ জীবিত করেন মৃতদেরকে। আর তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখান, যাতে তোমরা বুঝ।৯৪
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
৯৪. এটি ছিল বনী ইসরাঈলের সময়ের অসংখ্য মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনার একটি। এখানে নিহত ব্যক্তি শুধুমাত্র তার হন্তার পরিচয় বলতে প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশে জীবন ফিরে পেয়েছিল।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
﴿ ثُمَّ قَسَتۡ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَٱلۡحِجَارَةِ أَوۡ أَشَدُّ قَسۡوَةٗۚ وَإِنَّ مِنَ ٱلۡحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنۡهُ ٱلۡأَنۡهَٰرُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخۡرُجُ مِنۡهُ ٱلۡمَآءُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَهۡبِطُ مِنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٧٤ ﴾ [ البقرة : ٧٤ ]
৭৪. অতঃপর তোমাদের অন্তরসমূহ এর পরে কঠিন হয়ে গেল যেনো তা পাথরের মত কিংবা তার চেয়েও শক্ত। আর নিশ্চয় পাথরের মধ্যে কিছু আছে, যা থেকে নহর উৎসারিত হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা চূর্ণ হয়। ফলে তা থেকে পানি বের হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।৯৫ আর আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে গাফেল নন।
৯৫. উপমাটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। পাথর আপাতঃ দৃষ্টিতে এক নির্জীব প্রাকৃতিক কঠিন বস্তু; কিন্তু তার মাঝেও রয়েছে কোমলতা, যার অনুপম বর্ণনা করেছেন স্বয়ং তার সৃষ্টিকর্তা। এ বস্তুটির সাথে মানুষের হৃদয়ের তুলনা করেছেন রাব্বুল আলামীন। এখানে ৩ ধরনের পাথরের উল্লেখ করা হয়েছে:
ক. যা থেকে প্রবাহিত হয় ঝরনাধারা তথা নদী-নালা, যা সৃষ্ট জীবের উপকারে আসে।
খ. যা ফেটে গলে বের হয়ে আসে পানি, অর্থাৎ বাইরে কঠিন হলেও অন্তঃস্থল সুকোমল;
গ. কিছু পাথর, আরো সংবেদনশীল, যা যমীনে ধ্বসে পড়ে মহান আল্লাহর ভয়ে।
কিন্তু মানুষের মাঝে এমনও কিছু হৃদয় আছে, বিশেষতঃ এ আয়াতের প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখিত ইয়াহূদীদের অন্তর এতোই কঠিন যে, সৃষ্ট-জীবের দুঃখ-দুর্দশায়ও ঐ পাষাণদের চোখ অশ্রুসজল হয় না, আল্লাহর আক্রোশের ভয়ে হৃদয়গুলো এতটুকু প্রকম্পিত হয় না, অন্তরগুলো বিগলিত হয় না আল্লাহর কুদরতের অসংখ্য নিদর্শন দেখেও।
﴿ ۞أَفَتَطۡمَعُونَ أَن يُؤۡمِنُواْ لَكُمۡ وَقَدۡ كَانَ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۡ يَسۡمَعُونَ كَلَٰمَ ٱللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُۥ مِنۢ بَعۡدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٧٥ ﴾ [ البقرة : ٧٥ ]
৭৫. তোমরা কি এ আশা করছো যে, তারা তোমাদের প্রতি ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দল ছিল৯৬ যারা আল্লাহর বাণী শুনত,৯৭ অতঃপর তা বুঝে নেওয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে।৯৮
৯৬. বনী ইসরাঈলের আলেম-ওলামা ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাদের বুঝানো হয়েছে।
৯৭. তাওরাত, যাবূর ও অন্যান্য কিতাবকে বুঝানো হয়েছে, যা নবীদের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছেছে।
৯৮. ‘তাহরীফ’ অর্থ বিকৃতি বা পরিবর্তন; যা দু’ভাবে হতে পারে:
ক. কথার মূল অর্থ গোপন রেখে নিজ ইচ্ছা, প্রবৃত্তি ও সুবিধার অনুকূলে তার ব্যাখ্যা করা, যা মূল বক্তার লক্ষ্য ও ইচ্ছার খেলাফ।
খ. উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাক্যের শব্দ পরিবর্তন।
বনী ইসরাঈলের আলেমগণ আল্লাহর কিতাবে এ উভয় ধরনের বিকৃতিই করেছে।
﴿ وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَا بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ قَالُوٓاْ أَتُحَدِّثُونَهُم بِمَا فَتَحَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمۡ لِيُحَآجُّوكُم بِهِۦ عِندَ رَبِّكُمۡۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٧٦ ﴾ [ البقرة : ٧٦ ]
৭৬. আর যখন তারা মু’মিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি।’ আর যখন একে অপরের সাথে একান্তে মিলিত হয় তখন বলে, ‘তোমরা কি তাদের সাথে সে কথা আলোচনা কর, যা আল্লাহ তোমাদের ওপর উম্মুক্ত করেছেন, যাতে তারা এর মাধ্যমে তোমাদের রবের নিকট তোমাদের বিরুদ্ধে দলীল পেশ করবে?৯৯ তবে কি তোমরা বুঝো না’?১০০
৯৯. আতা ইবন ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে বললাম, তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় (বর্ণিত) আছে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন। তিনি বলেন, হ্যাঁ, ঠিক কথা। কুরআনে বর্ণিত তাঁর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের কিছুটা তাওরাতে উল্লেখিত হয়েছে: ‘হে নবী! আমি আপনাকে (সত্য-দ্বীনের) সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি এবং উম্মিদের রক্ষাকারী হিসেবে পাঠিয়েছি। আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনার নাম দিয়েছি মুতাওয়াক্কিল বা ভরসাকারী। আপনি দুশ্চরিত্র বা রূঢ় ও কঠোর হৃদয় নন এবং বাজারে ঝগড়া ও হৈ-হুল্লোড়কারী নন’। (আপনি এমন ব্যক্তি) যে কোনো মন্দ দিয়ে মন্দকে প্রতিহতকারী নয়, বরং মাফ করে দেয়। আল্লাহ তাঁকে (মৃত্যু দিয়ে) ততদিন পর্যন্ত দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন না যতদিন না সবাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই) একথা স্বীকার করার মাধ্যমে সৎপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং তা দিয়ে অন্ধের চোখ, বধিরের কান এবং (অসত্যের অন্ধকারে) আচ্ছাদিত হৃদয় ও মন-মানসিকতা উন্মুক্ত না হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৭৭)
১০০. ইয়াহূদীদের নিজেদের মধ্যে আলোচিত ছিল যে, তাওরাত ও অন্যান্য আসমানী কিতাবে মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এবং যে সব আয়াত ও শিক্ষাবলী তাদের পবিত্র কিতাবসমূহে রয়েছে যা দিয়ে তাদের মানসিকতা ও কর্মনীতিকে দোষারোপ করা যায় সেগুলো যেনো মুসলিমদের কাছে প্রকাশ না পায়; কিন্তু তা ছিল এক ব্যর্থ চেষ্টা-দেখুন পরবর্তী আয়াত।
﴿ أَوَ لَا يَعۡلَمُونَ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعۡلِنُونَ ٧٧ ﴾ [ البقرة : ٧٧ ]
৭৭. তারা কি জানে না যে, তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে, তা আল্লাহ জানেন?
﴿ وَمِنۡهُمۡ أُمِّيُّونَ لَا يَعۡلَمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّآ أَمَانِيَّ وَإِنۡ هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ ٧٨ ﴾ [ البقرة : ٧٨ ]
৭৮. আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর,১০১ তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই ধারণা করে থাকে।১০২
১০১. এখানে ইয়াহূদীদের দ্বিতীয় ধরনের লোকদের তথা জনসাধারণের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আর প্রথম ধরনের দলটি ছিল তাদের আলেম-ওলামা ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাদের, যার উল্লেখ ছিল ৭৫নং আয়াতে।
১০২. আল্লাহর কিতাবের কোনো জ্ঞানই তাদের ছিল না, তাতে দ্বীনের কি বিধি-বিধান রয়েছে, চারিত্রিক সংশোধন ও শরীয়তের নিয়ম-নীতি তথা মানবজীবনের প্রকৃত সাফল্য ও ব্যর্থতা কিসের ওপর নির্ভরশীল, তার প্রতি তাদের মোটেও মনোযোগ ছিল না। ওহীর জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী না হয়ে তারা নিজেদের ইচ্ছা-আকাঙ্খা অনুসারে নিজেদের মনগড়া কথাগুলোকে দ্বীন মনে করতো, আর মিথ্যামিথ্যি রচিত কিস্সা-কাহিনী আর ধারণা-অনুমানের ওপর ভর করে কালাতিপাত করতো।
এখানে গভীর আশংকার সাথে উল্লেখ্য যে, বর্তমান বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠির অবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে অনুরূপ, যা আমাদের চলমান সামগ্রিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে অনতিবিলম্বে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং প্রকৃত কল্যাণের স্বার্থেই।
﴿ فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشۡتَرُواْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا يَكۡسِبُونَ ٧٩ ﴾ [ البقرة : ٧٩ ]
৭৯. সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে। তারপর বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, যাতে তা তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতে পারে।১০৩ সুতরাং তাদের হাত যা লিখেছে তার পরিণামে তাদের জন্য ধ্বংস, আর তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস।
১০৩. যুগে যুগে আসমানী কিতাবকে বিকৃত করে বিভিন্ন ভাষ্যকারের মনগড়া বিশ্লেষণ, মুখরোচক কল্প-কাহিনী জুড়ে দেওয়া এবং উদ্ভাবিত সুবিধাজনক ও জনপ্রিয় আইন-কানুনের সংযোজনের মূল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে দুনিয়ার সাময়িক স্বার্থ, অর্থ বা অবস্থান লাভ করা। যার অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান রয়েছে অতীতের সব আসমানী কিতাব, ধর্মগ্রন্থ ও তাদের রক্ষকদের(!) মধ্যে।
এ থেকে আমাদের দীন-শরিয়া ও জীবন-ব্যবস্থার বিধি-বিধানের ব্যাখ্যাতাদের শিক্ষা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে।
তবে একমাত্র এবং শুধুমাত্র আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে প্রায় দেড় হাজার বছরেও কেউ, কোনো শক্তি আজ পর্যন্ত তার কোনো শব্দ এমনকি একটি অক্ষরও স্পর্শ করতে পারেনি, আর পারবেও না; যা সমগ্র মানবজাতির সামনে অনন্তকালের জন্য এক জাজ্জ্বল্যমান মু‘জিযা। কারণ, এর সুসংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি বলেছেন,
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [ الحجر : ٩ ]
আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক। [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯]
﴿ وَقَالُواْ لَن تَمَسَّنَا ٱلنَّارُ إِلَّآ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَةٗۚ قُلۡ أَتَّخَذۡتُمۡ عِندَ ٱللَّهِ عَهۡدٗا فَلَن يُخۡلِفَ ٱللَّهُ عَهۡدَهُۥٓۖ أَمۡ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٨٠ ﴾ [ البقرة : ٨٠ ]
৮০. আর তারা বলে, ‘গোনা-কয়েকদিন ছাড়া আগুন আমাদেরকে কখনো স্পর্শ করবে না’।১০৪ বল, ‘তোমরা কি আল্লাহর নিকট ওয়াদা নিয়েছ, ফলে আল্লাহ তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না?১০৫ নাকি আল্লাহর ওপর এমন কিছু বলছ, যা তোমরা জান না’?
১০৪. এটি ছিল ইয়াহূদী সমাজের একটি সাধারণ ভুল ধারণা। তারা ভাবতো, যেহেতু তারা ইয়াহূদী, তাই জাহান্নামের আগুন তাদের জন্য নিষিদ্ধ। আর যদি তাদেরকে শাস্তি দেয়াও হয়, তাহলে তা হাতে-গোনা কয়েকদিনের জন্য মাত্র, তারপর তাদেরকে জান্নাতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে!
১০৫. মুফাস্সিরগণের মতে, যদি আল্লাহ ক্ষমা না করেন তবে ঈমানদার ব্যক্তি গুনাহগার হলে জাহান্নামের শাস্তি পাবে, তবে চিরকালের জন্য নয়, শাস্তি ভোগের পর মুক্তি পাবে।
ইয়াহূদীদের বিশ্বাস, মূসা আ:-এর ধর্ম রহিত হয়নি, তাই তারা ঈমানদার এবং তাঁর পরবর্তী নবী ঈসা আ: ও শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত অস্বীকার করলেও তারা কাফির নয়, যা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কারণ কোনো আসমানী কিতাবেই এটি লেখা নেই যে, মূসা এবং ঈসা ‘আলাইহিমুস সালামের আনীত দীন হলো চিরকালের জন্যে; বরং পরবর্তী এবং শেষ নবীর পূর্বাভাষ রয়েছে তাদের কিতাবে। অনেকগুলো প্রমাণের একটি এখানে দেখুন: দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮, শ্লোক ১৫-১৯ এ লিঙ্কে http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Deuteronomy.pdf।
শেষনবীর উম্মত হিসেবে তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান পোষণ করা সন্দেহাতীতভাবে অপরিহার্য। কাজেই নবুওয়াত অস্বীকারকারী কাফির; আর কাফিররা কিছুদিন শাস্তি ভোগ করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে - একথাও কোনো আসমানী কিতাবে উল্লেখ নেই।
﴿ بَلَىٰۚ مَن كَسَبَ سَيِّئَةٗ وَأَحَٰطَتۡ بِهِۦ خَطِيَٓٔتُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨١ ﴾ [ البقرة : ٨١ ]
৮১. হাঁ, যে মন্দ উপার্জন করবে এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে নেবে,১০৬ তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। তারা সেখানে থাকবে স্থায়ীভাবে।
১০৬. ‘গুনাহ দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়া’ শুধুমাত্র (মহাসত্যগুলোকে অস্বীকারকারী) কাফিরদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, কুফরের ফলে তাদের কোনো সৎকর্মই গ্রহণযোগ্য হয় না। এমনকি কুফরের পূর্বে কিছু ভালো কাজ করে থাকলেও তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এজন্যে একথার মর্মার্থ এ যে, কাফিরদের গোটা সত্ত্বা ও কৃতকর্মগুলো যেনো নিরেট অপরাধ ও অবাধ্যতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে; সত্যের আলো যেনো গাঢ় অন্ধকারের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা তাদের অস্তিত্বে প্রবেশের কোনো পথ আর খুঁজে পায় না। তাই তাদের পরিণতি এতো ভয়াবহ।
﴿ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَنَّةِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨٢ ﴾ [ البقرة : ٨٢ ]
৮২. আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে,১০৭ তারা জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানে থাকবে স্থায়ীভাবে।
১০৭. ঈমানদারদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রথমতঃ ঈমানের জন্যে নির্দেশিত ও প্রয়োজনীয়, আপাতঃদৃষ্টিতে ‘অদৃশ্য ও দৃশ্যমান’ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভেজাল বিশ্বাস ও প্রত্যয় ধারণ করাটাই এক বিরাট সৎকর্ম।
দ্বিতীয়তঃ দুনিয়ার জীবনে পরিলক্ষিত তথাকথিত অফুরন্ত চাকচিক্য, আরাম-আয়েশ, অবৈধ উপার্জন আর ভোগের হাতছানিগুলোকে ধোঁকা হিসেবে বিবেচনা করে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে, শয়তানের সার্বক্ষণিক প্ররোচনাগুলোকে পরিহার করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভয়-ভীতি, ক্ষয়-ক্ষতি, হুমকি, যুলুম-নির্যাতন ইত্যাদিকে মাথা পেতে নিয়ে মু’মিন ব্যক্তিরা যে সৎকাজগুলো করেন, মহান রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে তার প্রতিদান কতই না মূল্যবান হতে পারে!
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ﴾ [ البقرة : ٢١ ]
২১. হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।১৭
১৭. একমাত্র আল্লাহর ইবাদত চর্চা ও দাসত্ব মেনে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে পৃথিবীতে অসত্য-চিন্তা, ভুল-দৃষ্টিভঙ্গি ও অসার-অশ্লীল কাজ থেকে মুক্তি, আর পরকালে ব্যর্থ পরিণতি ও আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়।
﴿ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢ ﴾ [ البقرة : ٢٢ ]
২২. যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিযিকস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।১৮
১৮. অর্থাৎ জগতসমূহ ও এতে বিরাজিত সকল উপায়-উপাদানের সৃষ্টি যখন একমাত্র দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা-অনুগ্রহ ও কর্তৃত্বে সম্পন্ন হয়েছে, তখন সৃষ্টির সেরা মানুষের সব বন্দেগী, দাসত্ব ও মুখাপেক্ষিতা নির্দিষ্ট হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহরই জন্য। মানুষ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে মানবে না। অন্য কারও আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান মানবে না; বরং জীবনে সকল ক্ষেত্রে অন্বেষণ করে যাবে একমাত্র আল্লাহর রেজামন্দি, ইবাদত-আরাধনা নিষ্ঠার সাথে নির্দিষ্ট করবে একমাত্র আল্লাহই জন্য। জীবনের সকল স্তর ও ক্ষেত্র সঁপে দিবে আল্লাহর নাযিলকৃত পবিত্র বিধানের হাতে।
﴿ وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِۦ وَٱدۡعُواْ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٢٣ ﴾ [ البقرة : ٢٣ ]
২৩. আর আমি আমার বান্দার ওপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস।১৯ এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
১৯. ইতিপূর্বে মক্কায় এ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছিল, যদি তোমরা এ কুরআনকে মানুষের রচনা মনে করে থাকো তাহলে এর সমমানের কোনো একটি বাণী রচনা করে আনো। এবার মদীনায় সে একই চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। আরো জানার জন্য দেখুন: সূরা ইউনুস: ৩৮, সূরা হূদ: ১৩, সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮ এবং সূরা তূর: ৩৩-৩৪ আয়াত।
﴿ فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ وَلَن تَفۡعَلُواْ فَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِي وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُۖ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ٢٤ ﴾ [ البقرة : ٢٤ ]
২৪. অতএব যদি তোমরা তা না কর- আর কখনো তোমরা তা করবে না- তাহলে আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর,২০ - যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য।
২০. অর্থাৎ সেখানে শুধুমাত্র সত্যদ্রোহী মানুষই জাহান্নামের জ্বালানী (নরকের ইন্ধন) হবে না বরং তাদের সাথে নিগৃহীত হবে তাদের সে সব উপাস্য নিথর প্রস্তর মূর্তিগুলোও।
﴿ وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ كُلَّمَا رُزِقُواْ مِنۡهَا مِن ثَمَرَةٖ رِّزۡقٗا قَالُواْ هَٰذَا ٱلَّذِي رُزِقۡنَا مِن قَبۡلُۖ وَأُتُواْ بِهِۦ مُتَشَٰبِهٗاۖ وَلَهُمۡ فِيهَآ أَزۡوَٰجٞ مُّطَهَّرَةٞۖ وَهُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٥ ﴾ [ البقرة : ٢٥ ]
২৫. আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। যখনই তাদেরকে জান্নাত থেকে কোনো ফল খেতে দেওয়া হবে, তারা বলবে, ‘এটা তো পূর্বে আমাদেরকে খেতে দেওয়া হয়েছিল’। আর তাদেরকে তা দেওয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করে২১ এবং তাদের জন্য তাতে থাকবে পূতঃপবিত্র সঙ্গী-সঙ্গিনী এবং তারা সেখানে হবে স্থায়ী।
২১. জান্নাতবাসীদেরকে যে সব ফল-ফলাদি পরিবেশন করা হবে তা তাদের পরিচিত আকার-আকৃতিরই হবে, তবে নিশ্চিতভাবেই তা হবে স্বাদে-গন্ধে অকল্পনীয়-অতুলনীয়, কারণ সেগুলো তো দুনিয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ আপ্যায়ন।
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَسۡتَحۡيِۦٓ أَن يَضۡرِبَ مَثَلٗا مَّا بَعُوضَةٗ فَمَا فَوۡقَهَاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَيَعۡلَمُونَ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّهِمۡۖ وَأَمَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِهَٰذَا مَثَلٗاۘ يُضِلُّ بِهِۦ كَثِيرٗا وَيَهۡدِي بِهِۦ كَثِيرٗاۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِۦٓ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٦ ﴾ [ البقرة : ٢٦ ]
২৬. নিশ্চয় আল্লাহ মাছি কিংবা তার চেয়েও ছোট কিছুর উপমা দিতে লজ্জা করেন না। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারা জানে, নিশ্চয় তা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। আর যারা কুফরি করেছে তারা বলে, আল্লাহ এর মাধ্যমে উপমা দিয়ে কী বুঝাতে চেয়েছেন? তিনি এ দিয়ে অনেককে পথভ্রষ্ট করেন এবং এ দিয়ে অনেককে হিদায়াত দেন।২৪ আর এর মাধ্যমে কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন।
২৩. এখানে একটি আপত্তি ও প্রশ্নের উল্লেখ না করেই তার জবাব দেওয়া হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য সুস্পষ্ট করার জন্য মশা-মাছি ও মাকড়শা ইত্যাদির দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। এতে বিরোধীদের আপত্তি উঠেছিল: 'এটা কোন ধরনের আল্লাহর কালাম, যেখানে এসব তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের উপমা দেওয়া হয়েছে?'
২৪. যারা প্রকৃত অর্থে সত্যের প্রতি সমর্পিত হতে প্রস্তুত নয়, আন্তরিকভাবে কথা বুঝতে চায় না, সত্যের মর্ম অনুসন্ধান ও তা মেনে নেওয়া যাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, সমালোচনা করা আর খুঁত বের করাই যাদের কাছে মুখ্য, তাদের দৃষ্টি থাকে কেবল শব্দের বাইরের কাঠামোর ওপর নিবদ্ধ, ফলে তা থেকে এ হতভাগ্যরা অস্পষ্টতা ও বক্রতা উদ্ধার করে সত্য থেকে আরো দূরে সরে যায়।
অপরদিকে যারা সত্য-সন্ধানী, আগ্রহী, যারা মনন ও সঠিক দৃষ্টিশক্তির অধিকারী, তারা আল-কুরআনের ঐ সব বক্তব্যের পরতে পরতে শুভ্র-সুস্পষ্ট জ্ঞানের আলোকচ্ছটা খুঁজে পায়। এ ধরনের দৃষ্টি-উন্মোচনকারী (eye-opener) ও জ্ঞানগর্ভ কথামালার উৎস একমাত্র মহান আল্লাহই হতে পারেন বলে তাদের সমগ্র হৃদয়-মন সাক্ষ্য দিয়ে উঠে।
﴿ ٱلَّذِينَ يَنقُضُونَ عَهۡدَ ٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ مِيثَٰقِهِۦ وَيَقۡطَعُونَ مَآ أَمَرَ ٱللَّهُ بِهِۦٓ أَن يُوصَلَ وَيُفۡسِدُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٢٧ ﴾ [ البقرة : ٢٧ ]
২৭. যারা আল্লাহর সুদৃঢ় অঙ্গীকার ভঙ্গ করে,২৫ এবং আল্লাহ যা জোড়া লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে২৬ এবং যমীনে ফাসাদ করে;২৭ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
২৫. এখানে সৃষ্টির সূচনাতেই সমগ্র মানবাত্মার কাছ থেকে গৃহীত একমাত্র মহান আল্লাহর আনুগত্য করার অঙ্গীকার পূরণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার উল্লেখ রয়েছে এখানে:
"আর (স্মরণ করো), যখন তোমাদের প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদেরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্পর্কে স্বীকৃতি আদায় করলেন (বললেন): 'আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই'? তারা বললো: 'হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিলাম'। (এটি এ জন্য) যেনো তোমরা পুণরুত্থানের (কিয়ামতের) দিন একথা বলতে না পার যে, 'আমরা তো এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলাম'!" (সূরা আল আ’রাফ: ১৭২)
২৬. এ সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে রয়েছে অর্থের অশেষ ব্যাপকতা। যেসব সম্পর্ককে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত রাখার ওপর নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণ, আল্লাহ তা‘আলা সেগুলোকে ত্রুটিমুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
যুবাইর ইবন মুতইম (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী (সা:)-কে বলতে শুনেছেন: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। -- সহীহ আল বুখারী, ৫ম খন্ড, হাদীস নং- ৫৫৪৯।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: অপরিহার্য সম্পর্কগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা ও যত্ন না নিয়ে অহেতুক সম্পর্ক গড়ে তোলা মু’মিনের জন্য কখনো উচিত নয়। বিশেষ করে যাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা ইসলামে নিষিদ্ধ; যেমন ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু, তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক-চর্চা অবশ্যাই বর্জনীয়।
সম্পর্ক-চর্চার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরি। তা হলো, বন্ধু-বান্ধবের সম্পর্ককে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে, আত্মীয়-স্বজনদেরকে ভুলে যাওয়া, আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্ককে যথার্থরূপে পরিচর্যা না করা মারাত্মক অপরাধ। যারা এরূপ করে, তারা, উক্ত আয়াতের ভাষ্যানুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল।
২৭. এ তিনটি বাক্যের মাধ্যমেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যকার অঙ্গীকার কর্তন করা এবং মানুষে-মানুষে যে সম্পর্ক পরিচর্যার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করা এবং জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করার অনিবার্য পরিণতি হলো বিপর্যয়।
﴿ كَيۡفَ تَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَكُنتُمۡ أَمۡوَٰتٗا فَأَحۡيَٰكُمۡۖ ثُمَّ يُمِيتُكُمۡ ثُمَّ يُحۡيِيكُمۡ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٨ ﴾ [ البقرة : ٢٨ ]
২৮. কীভাবে তোমরা আল্লাহর সাথে কুফরী করছো অথচ তোমরা ছিলে মৃত? অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জীবিত করেছেন। এরপর তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দেবেন অতঃপর জীবিত করবেন। এরপর তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।২৮
২৮. এ আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে নিচের আয়াত দু'টির বক্তব্য লক্ষণীয়:
যারা কাফির (আল্লাহকে অস্বীকারকারী), তাদেরকে (শেষ বিচারের দিন) বলা হবে: 'আজ তোমাদের (পরিণতি দেখে) নিজেদের প্রতি তোমাদের যে কঠিন ক্রোধ অনুভূত হচ্ছে, তার চেয়ে আল্লাহ তোমাদের প্রতি আরো অধিক ক্রুদ্ধ হতেন, যখন তোমাদেরকে (দুনিয়ায়) ঈমান আনতে বলা হতো, আর তা তোমরা অস্বীকার করতে'! তারা বলবে: 'হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদের দু'বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু'বার জীবন দিয়েছেন। এখন আমাদের অপরাধগুলো স্বীকার করে নিচ্ছি। এখনও নিষ্কৃতির কোনো উপায় আছে কি'? [দেখুন: সূরা আল-মু'মিন, আয়াত: ১০-১১]
﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰٓ إِلَى ٱلسَّمَآءِ فَسَوَّىٰهُنَّ سَبۡعَ سَمَٰوَٰتٖۚ وَهُوَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ٢٩ ﴾ [ البقرة : ٢٩ ]
২৯. তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আসমানের প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাকে সাত আসমানে২৯ সুবিন্যস্ত করলেন। আর সব কিছু সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাত।৩০
২৯. সাত আকাশের তাৎপর্য কি? সাত আকাশ বলতে কি বুঝায়? এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন। মানুষ প্রতি যুগে যুগে আকাশ বা অন্য কথায় পৃথিবীর বাইরের জগত সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ ও ধারণা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিভিন্ন চিন্তা ও মতবাদের অনুসারী হয়েছে। এ চিন্তা ও মতবাদগুলো বিভিন্ন সময় বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই এর মধ্য থেকে কোনো একটি মতবাদ নির্দিষ্ট করে তার ভিত্তিতে কুরআনের এ শব্দগুলোর অর্থ নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। তবে সংক্ষেপে এটুকু বুঝে নেওয়া দরকার যে, সম্ভবত পৃথিবীর বাইরে যতগুলো জগত আছে সবগুলোকেই আল্লাহ তা‘আলা সাতটি সুদৃঢ় স্তরে বিন্যস্ত করে রেখেছেন অথবা এ বিশ্ব-জগতসমূহের যে স্তরে পৃথিবীর অবস্থিতি সেটি সাতটি স্তর সমন্বিত।
৩০. এখানে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে:
ক. যে আল্লাহ আমাদের সব ধরনের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের খবর রাখেন এবং যাঁর দৃষ্টি থেকে আমাদের কোনো কার্যক্রমই গোপন থাকতে পারে না, তাঁর মোকাবিলায় মানুষ অস্বীকৃতি ও বিদ্রোহের পথ বেছে নেওয়ার সাহস কী করে করতে পারে?
খ. যে আল্লাহ যাবতীয় সত্য জ্ঞানের অধিকারী ও প্রকৃত উৎস, তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অগ্রসর হলে অজ্ঞতার অন্ধকারে পথভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কী পরিণতি হতে পারে?
﴿ وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَجۡعَلُ فِيهَا مَن يُفۡسِدُ فِيهَا وَيَسۡفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَۖ قَالَ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٠ ﴾ [ البقرة : ٣٠ ]
৩০. আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করব,৩১ তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে?৩২ আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি? ৩৩ তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না।৩৪
৩১. খলীফা বলতে এখানে পৃথিবীকে কর্ষণ-চাষাবাদ ও পৃথিবীতে থাকাবস্থায় স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে আল্লাহর দাসত্ব ও ইবাদত চর্চার ক্ষেত্রে প্রজন্মান্তরে একে অন্যের প্রতিনিধি হওয়া। কারও কারও মতে জিন্ন জাতি আল্লাহর ইবাদত চর্চায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ার পর আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর কর্ষণ-চাষাবাদ ও স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে ইবাদত চর্চার জন্য জিন্নদের স্থলাভিষিক্তরূপে মানবপ্রজাতিকে সৃষ্টি করেছেন।
মানুষ আল্লাহর খলীফা ঠিক এমনভাবে বলা উচিত নয়। কেউ মারা গেলে অথবা পদত্যাগ করলে তার জায়গায় যে আসে তাকেই মূলতঃ খলীফা বলা হয়। আর আল্লাহ যেহেতু চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর এবং তিনি কখনো তার চেয়ার অন্যের জন্য ছেড়ে দেবেন না তাই মানুষ আল্লাহর খলীফা অভিধানের এ ব্যবহার সালাফদের অধিকাংশ আলেমের নিকট অনুচিত।
৩২. এটি ফিরিশতাদের ভিন্নমত পোষণের বহিঃপ্রকাশ নয় - এর শক্তিই তাদের নেই, বরং তা ছিল মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জিজ্ঞাসা। মূল কথা হলো, 'খলীফা' হিসেবে যার সৃষ্টি, তাকে কিছু স্বাধীন কর্তৃত্বও দেওয়া হবে, তার থাকবে কিছু ইচ্ছার স্বাধীনতা - যা হতে পারে গোলযোগ ও বিশৃংখলার কারণ - এ ধারণাটির স্পষ্টকরণের জন্যই ছিল তাদের আবেদন।
৩৩. ফিরিশতাদের এ কথার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা এবং তাঁর সব নির্দেশ যথাযথভাবে পালনে তাদের কোনো অসম্পূর্ণতা রয়েছে কিনা, যার ফলে খলীফা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, বিনীতভাবে বিষয়টি আল্লাহর দরবারে পেশ করা।
৩৪. এটি ফিরিশতাদের দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব। খলীফা প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন, তারা জানে না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পৃথিবীতে এমন এক প্রজাতি সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়েছে যাদেরকে দেওয়া হবে সীমিত ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা, যার ফলে তারা হবে ফিরিশতাদের চেয়েও অনেক সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ ও প্রতিদানপ্রাপ্য।
﴿ وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبُِٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١ ﴾ [ البقرة : ٣١ ]
৩১. আর তিনি আদমকে নামসমূহ৩৫ সব শিক্ষা দিলেন, তারপর তা ফিরিশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।
৩৫. কোনো বস্তুর নামের মাধ্যমে মানুষ সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে থাকে। তাই সর্বপ্রথম সৃষ্ট মানুষ আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দেয়ার মানেই হলো তাঁকে সব ধরনের বস্তুর জ্ঞান দান করা হয়েছিল।
﴿ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ ٣٢ ﴾ [ البقرة : ٣٢ ]
৩২. তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। ৩৬ নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’।
৩৬. এখানে ধারণা হয় যে, প্রত্যেক ফিরিশতার এবং তাদের প্রত্যেকটি শ্রেণীর জ্ঞান তাদের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেমন বায়ু-প্রবাহের ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের উদ্ভিদজগত সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অন্যান্য বিভাগে নিয়োজিতদের অবস্থাও তাই। তবে অবশ্যই মহান আল্লাহ সঠিক জানেন। অথচ মানুষকে দেওয়া হয়েছে ব্যাপকতর জ্ঞান, তাদের রয়েছে উদ্ভাবনী (innovative), প্রাসঙ্গিক (correlative), প্রায়োগিক (implementing) ও সমন্বয় (coordination) জ্ঞানসহ অমিত সৃজনশীল প্রতিভা। তাই তো তারা বিবেকসম্পন্ন, সীমিত-স্বাধীন, অথচ দায়বদ্ধ ও সৃষ্টির সেরা। ফলে তাদের রয়েছে একদিকে সম্মান ও পুরস্কার অথবা অন্যদিকে শাস্তি ও চরম অপমান; আর ফিরিশতাদের তা নেই, কারণ তাদের আছে নিয়ন্ত্রিত, সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ জ্ঞান এবং দায়িত্ব; পাশাপাশি নেই অস্বীকার ও সীমালংঘনের কোনো ক্ষমতা।
﴿ قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئۡهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَأَعۡلَمُ مَا تُبۡدُونَ وَمَا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٣٣ ﴾ [ البقرة : ٣٣ ]
৩৩. তিনি বললেন, ‘হে আদম, এগুলোর নাম তাদেরকে জানাও’। সুতরাং যখন সে এগুলোর নাম তাদেরকে জানাল, তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ ও যমীনের গায়েব জানি এবং জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা তোমরা গোপন করতে’?৩৭
৩৭. আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক সবকিছুর নাম বলে দেয়ার এ মহড়াটি ছিলো ফিরিশতাদের প্রথম সন্দেহের জবাব। তাদের উপস্থাপনাটি ছিলো: 'আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, যে সেখানে অশান্তি ও রক্তপাত ঘটাবে'? [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩০]
এখানে ব্যাপারটি এরূপ যে, আল্লাহ তা'আলা ফিরিশতাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি আদমকে শুধুমাত্র ইচ্ছার স্বাধীনতাই দেননি, তাকে দিয়েছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আর খলীফা সৃষ্টির সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ। বিপর্যয়ের দিকটির তুলনায় এ কল্যাণের গুরুত্ব ও মূল্যমান অনেক বেশি।
﴿ وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ وَٱسۡتَكۡبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٤ ﴾ [ البقرة : ٣٤ ]
৩৪. আর যখন আমি ফিরিশতাদেরকে বললাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদা৩৮ কর’। তখন তারা সিজদা করল, ইবলীস ছাড়া।৩৯ সে অস্বীকার করল এবং অহঙ্কার করল। আর সে হল কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।
৩৮. ফিরিশতাদেরকে মানুষের সামনে নত হবার নির্দেশটির মর্মার্থ হলো: পৃথিবীর সকল কিছু মানুষের অধীনস্থ করে দেয়া। কেননা ফিরিশতাগণ আল্লাহর নির্দেশে মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয় পরিচর্যা ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আর এ ফিরিশতাগণকেই যখন আল্লাহ তা‘আলা আদমের সামনে নত হতে বললেন তার অর্থ এ মহাবিশ্বের সকল কিছুকেই মানুষের অধীনতা স্বীকার করিয়ে নেওয়া হলো।
৩৯. এখানে একটি প্রশ্ন: ইবলীস একজন জিন্ন আগুনের তৈরী; [সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১৫; সূরা আল-হিজর, আয়াত: ২৭] হয়ে ফিরিশতাদের (আলোর তৈরী) প্রতি আল্লাহর নির্দেশের আওতায় এল কী করে?
এর ব্যাখ্যা হলো: সে আল্লাহর ইবাদত করতে করতে ফিরিশতার মর্যাদা লাভ করে। তাই সেও ছিলো ঐ নির্দেশের আওতাধীন। তাছাড়া সে নিজেই ঐ আদেশ অমান্যের কারণে একথা বলেনি যে, সে তো একজন জিন্ন, ফিরিশতা না; বরং সে সুস্পষ্টভাবে করেছে অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। [সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১২]
তাছাড়া আরেকটি ব্যাপার হলো: আসলে ফিরিশতাদের আল্লাহর নির্দেশ না মানার কোনো শক্তি নেই। [দেখুন, সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬ ও সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫০], আর জিন্নদের সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলেই ইবলীস তা অমান্য করার দুঃসাহস করেছে।
﴿ وَقُلۡنَا يَٰٓـَٔادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ وَكُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَيۡثُ شِئۡتُمَا وَلَا تَقۡرَبَا هَٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٣٥ ﴾ [ البقرة : ٣٥ ]
৩৫. আর আমি বললাম, ‘হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং তা থেকে আহার কর স্বাচ্ছন্দ্যে, তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী এবং এ গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না,৪০ তাহলে তোমরা যালিমদের৪১ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’।
৪০. পৃথিবীতে পাঠানোর আগে প্রথম মানব-মানবীকে জান্নাতে রেখে তাদের মানসিক প্রবণতা উন্মোচিত করার উদ্দেশ্যে এ পরীক্ষা। এতে একটি গাছ নির্দিষ্ট করে তার কাছে যেতে নিষেধ করা হয়। আর তা অমান্যের পরিণামও জানিয়ে দেওয়া হয়। সে গাছটি কি, তার ফলের নাম কি, তাতে কি প্রাকৃতিক দোষ ছিল ইত্যাদি এখানে গৌণ। মূলতঃ এটি ছিল একটি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে পরীক্ষা।
আর এখানে জান্নাতকে পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে একথা বুঝিয়ে দেওয়া যে, মানবিক মর্যাদার প্রেক্ষিতে জান্নাতই তাদের উপযোগী স্থায়ী বাসস্থান; কিন্তু অভিশপ্ত শয়তান নিরবচ্ছিন্ন প্ররোচনার মাধ্যমে মানুষকে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ও বিমুখ করে জান্নাত থেকে বের করে জাহান্নামে তার সঙ্গী করার চেষ্টায় রত। তাই পরম করুণাময়ের ক্ষমা ও জান্নাত লাভের জন্য মানুষকে সজাগ থেকে সে কুমন্ত্রণাদানকারী শয়তানের সফল মোকাবিলা করতে হবে।
৪১. 'যালিম' শব্দটি গভীর অর্থবোধক। 'যুলুম' বলা হয়, কোনো জিনিসকে তার নির্ধারিত জায়গায় না রেখে ভিন্ন জায়গায় রাখা। সে হিসেবে সকল অন্যায়-অনাচার-অধিকার হরণকে যুলুম বলা হয়। অতঃপর যে ব্যক্তি কারো অধিকার হরণ করে সে যালিম। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশনাবলী অমান্য করে এবং সীমালংঘনে সক্রিয় হয়, সে আসলে ৩টি বড় বড় মৌলিক অধিকার হরণ করে:
ক. প্রথমত সে আল্লাহর অধিকার হরণ করে। কারণ আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালনকারী আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করতে হবে, এটা আল্লাহর অধিকার।
খ. দ্বিতীয়ত আল্লাহর নির্দেশনাবলী অমান্য করতে গিয়ে সে যেসব উপকরণ ব্যবহার করে তাদের সবার অধিকার ক্ষুন্ন করে। কারণ তার বিবেক-বুদ্ধি, যোগ্যতা, ক্ষমতা, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার সাথে বসবাসকারী সমাজের অন্যান্য লোক, তার ইচ্ছা ও সংকল্প পূর্ণ করার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ফিরিশতাগণ এবং যে সব বস্তু-সামগ্রী সে তার কাজে ব্যবহার করে – এদের সবার ওপর তার অধিকার ছিল যে, এদেরকে কেবলমাত্র এদের মালিক তথা আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করবে; কিন্তু তাঁর নির্দেশনার বিরুদ্ধে এসব ব্যবহার করায় তাদের ওপর যুলুম করা হয়।
গ. তৃতীয়ত সে তার নিজের অধিকার হরণ করে। কারণ তার নিজের সত্ত্বাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করা তার দায়িত্ব; কিন্তু অমান্যকারী ও বিদ্রোহী হয়ে যখন সে নিজেকে আল্লাহর শাস্তিলাভের যোগ্য করে তোলে, তখন সে আসলে তার আপন ব্যক্তিসত্ত্বার ওপরই যুলুম করে।
এসব কারণে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে 'গুনাহ' শব্দটির জন্য 'যুলুম' আর 'গুনাহগার' শব্দটির জন্য 'যালিম' পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।
﴿ فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيۡطَٰنُ عَنۡهَا فَأَخۡرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِۖ وَقُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ بَعۡضُكُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوّٞۖ وَلَكُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُسۡتَقَرّٞ وَمَتَٰعٌ إِلَىٰ حِينٖ ٣٦ ﴾ [ البقرة : ٣٦ ]
৩৬. অতঃপর শয়তান তাদেরকে জান্নাত থেকে স্খলিত করল। অতঃপর তারা যাতে ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল, আর আমি বললাম, ‘তোমরা নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু৪২। আর তোমাদের জন্য যমীনে রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবাস ও ভোগ-উপকরণ’।
৪২. অর্থাৎ মানুষের শত্রু শয়তান এবং শয়তানের শত্রু মানুষ। শয়তান মানুষের শত্রু, একথা সুস্পষ্ট। কারণ সে মানুষকে আল্লাহর নির্দেশনার পথ থেকে সরিয়ে অজ্ঞতা ও ধ্বংসের পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করে; কিন্তু শয়তানের শত্রু মানুষ – একথার অর্থ কি? বস্তুতঃ মানুষের সঠিক পথে অবিচল থাকার স্বার্থে তাকে শয়তানের প্রতি শত্রুতার মনোভাব পোষণ করা অপরিহার্য। কারণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার সামনে শয়তান যে সব আকর্ষণীয় প্রলোভন অথবা ভয়-ভীতি বা ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে, মানুষ তাতে প্রতারিত হয়ে তাকে নিজের বন্ধু ভেবে বসে। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে আপাতঃ দৃষ্টিতে যৌক্তিক কিন্তু প্রকৃত বিবেচনায় সত্য ও সুন্দর থেকে বিচ্যুত বা আরেকটু অগ্রসর হয়ে সে সত্য-বিমুখ হয়ে পড়ে। যা তাকে ঈমান, জ্ঞান ও সততার আলোকিত রাজপথ থেকে সরিয়ে অন্ধকার অলি-গলিতে চলতে তৃপ্তি দেয় তথা ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। তাই সত্যপন্থীদেরকে তাদের আত্মরক্ষার লক্ষ্যেই শয়তান, তার কুমন্ত্রণা, তার উৎস এবং সহযোগীদের থেকে সচেতনভাবে দূরে থেকে তার বিরোধিতা করে যেতে হবে আর সব সময় চাইতে হবে আল্লাহর সাহায্য। (দেখুন: সূরা আন-নাস)
﴿ فَتَلَقَّىٰٓ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَٰتٖ فَتَابَ عَلَيۡهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٣٧ ﴾ [ البقرة : ٣٧ ]
৩৭. অতঃপর আদম তার রবের পক্ষ থেকে কিছু বাণী পেলো৪৩ ফলে আল্লাহ তার তাওবা৪৪ কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী, অতি দয়ালু।৪৫
৪৩. দয়াময় আল্লাহ আদম ‘আলাইহিস সালামকে তাওবার বা অনুশোচনার যে বাক্যগুলো শিখিয়ে দেন তা রয়েছে সূরা আল-আ'রাফের ২৩ নং আয়াতে –
﴿ رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٢٣ ﴾ [ الاعراف : ٢٣ ]
হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের ওপর যুলুম করেছি। এখন যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি রহম না করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।
৪৪. 'তাওবা' অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং প্রকৃত আত্মোপলব্ধি ও বাস্তব কর্ম-সংশোধন, ভবিষ্যতে পাপ না করার সংকল্পের সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা।
৪৫. 'পাপের পরিণামে শাস্তি অবশ্যম্ভাবী এবং মানুষকে তা যে কোনো অবস্থাতেই ভোগ করতে হবে, ক্ষমার কোন সুযোগ তার নেই' – এটি মানুষের স্বকল্পিত ভ্রষ্টকারী মতবাদের একটি। কেননা যে ব্যক্তি একবার পাপ-পঙ্কিল জীবনে প্রবেশ করে, এ মতবাদ তাকে চিরদিনের জন্য নিরাশ করে দেয়।
এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এখানে যে কোনো মুহূর্তে ভুল বুঝতে পারলে তার স্বীকৃতি দিয়ে, লজ্জিত হয়ে, তাৎক্ষণিকভাবে তা পরিত্যাগ করে, অনুশোচনা করে এবং অমান্য, অবহেলা আর বিদ্রোহের পথ ত্যাগ করে করুণাময় আল্লাহর আনুগত্য, নৈকট্য ও ক্ষমার দিকে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে উন্মুক্ত ও অবারিত। তবে অবশ্যই তা হতে হবে আন্তরিকতাপূর্ণ ও কার্যকরী।
আরেকটি বিষয় হলো, কোনো ভুল উপলব্ধির পরও নিস্ক্রিয় থেকে – সময় ক্ষেপণ করে – তা থেকে ফিরে আসার শুধু পরিকল্পনা করতে থাকা এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা ও ক্ষতিকারক প্রবৃত্তি। কারণ 'ভবিষ্যতে' তাওবা করার উপযুক্ত 'সময় ও সুযোগ' পাওয়া সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তাই যখনই বিচ্যুতি বা ভুল করে ফেলা বা বুঝতে পারা – অনুতাপের সময় তখনই, সংশোধিত হতে হবে অনতিবিলম্বে, দয়াময় আল্লাহর করুণা, ক্ষমা ও রহমত লাভের মাধ্যমে ফিরে আসতে হবে সত্য, সুন্দর আর সাফল্যের পথে।
﴿ قُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ مِنۡهَا جَمِيعٗاۖ فَإِمَّا يَأۡتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدٗى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٣٨ ﴾ [ البقرة : ٣٨ ]
৩৮. আমি বললাম, ‘তোমরা সবাই তা থেকে নেমে যাও।৪৮ অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোনো হিদায়াত৪৯ আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’।৫০
৪৮. এ বাক্যটির পুনরাবৃত্তি তাৎপর্যপূর্ণ। ৩৬নং আয়াতেও ছিল একই বাণী। সেখানে 'জান্নাত থেকে নেমে যাও' অর্থ মানুষকে তার কর্মস্থল তথা পৃথিবীতে চাষাবাদ ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইবাদত-দাসত্বের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হলো। আর সে মিশনে সার্বক্ষণিক প্ররোচক ও শত্রু হিসেবে ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী শয়তানকে পরিচিত করে দেওয়া হলো। এরপর (৩৭নং আয়াত) আদম ‘আলাইহিস সালাম তাওবা করলেন এবং মহান আল্লাহ তা কবুল করে নিলেন। এখন আর কোনো তিরস্কার না, বরং তাঁকে মহান নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হলো। কাজেই একটি ভুলের কারণে পৃথিবীতে মানুষকে আসতে হলো– এটি নিরেট ভ্রান্ত ধারণা।
৪৯. যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠতম মানুষদের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কাছে পৌঁছে গেছে সে সব পথ-নির্দেশ। সে ধারাবাহিকতার সর্বশেষ নির্দেশনা হলো আল-কুরআন।
৫০. দুনিয়া ও আখিরাতে সুখ, শান্তি, স্বস্তি, প্রকৃত সাফল্য ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
﴿ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَكَذَّبُواْ بَِٔايَٰتِنَآ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٣٩ ﴾ [ البقرة : ٣٩ ]
৩৯. আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।
﴿ يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَوۡفُواْ بِعَهۡدِيٓ أُوفِ بِعَهۡدِكُمۡ وَإِيَّٰيَ فَٱرۡهَبُونِ ٤٠ ﴾ [ البقرة : ٤٠ ]
৪০. হে বনী ইসরাঈল৫১! তোমরা আমার নিয়ামতকে স্মরণ কর, যে নিয়ামত আমি তোমাদেরকে দিয়েছি এবং তোমরা আমার অঙ্গীকার পূর্ণ কর, তাহলে আমি তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর কেবল আমাকেই ভয় কর।
৫১. 'ইসরাঈল' শব্দের অর্থ আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর বান্দাহ। এটি ইয়াকুব ‘আলাইহিস সালামের আল্লাহ-প্রদত্ত উপাধি। তিনি ইসহাক ‘আলাইহিস সালামের পুত্র ও ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের প্রপুত্র। তাঁরই বংশধরকে বলা হয় বনী ইসরাঈল। এ জাতিধারায় মনোনীত হয়ে এসেছেন অগণিত নবী ও রাসূলগণ। ইউসুফ, ইউনুস, আইউব, দাউদ, সোলাইমান, যাকারিয়া, ইয়াহহিয়া, মূসা, হারূন আ'লাইহিমুস সালামসহ আমাদের অজানা আরো অনেক নবী-রাসূলগণের ধারাবাহিকতায় ঐ বংশ-ধারার শেষে আগমন করেছেন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম। আর ইসমাঈল ‘আলাইহিস সালামের বংশ-ধারায় আগমন করেন বিশ্ব-জাহানের সর্বশেষ নবী রাহমাতুল্লিল আ'লামীন মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম।
﴿ وَءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلۡتُ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَكُمۡ وَلَا تَكُونُوٓاْ أَوَّلَ كَافِرِۢ بِهِۦۖ وَلَا تَشۡتَرُواْ بَِٔايَٰتِي ثَمَنٗا قَلِيلٗا وَإِيَّٰيَ فَٱتَّقُونِ ٤١ ﴾ [ البقرة : ٤١ ]
৪১. আর তোমাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারীস্বরূপ আমি যা নাযিল করেছি তার প্রতি তোমরা ঈমান আন।৫২ এবং তোমরা তা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। আর তোমরা আমার আয়াতসমূহ সামান্যমূল্যে বিক্রি করো না৫৩ এবং কেবল আমাকেই ভয় কর।
৫২. বনী ইসরাঈলের সাথে মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে অঙ্গীকারগুলো ছিলো, আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় তার বর্ণনা চলছে।
৫৩. 'সামান্য দাম' বলে দুনিয়ার স্বার্থ ও লাভের কথা বুঝানো হয়েছে। এ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ও সাময়িক অর্জনের ধোঁকায় পড়ে মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও উপদেশকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে বা আরেকটু অগ্রসর হয়ে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে দূরে চলে যায়।
এক্ষেত্রে সাধারণের চেয়ে সমাজে যারা বিভিন্নভাবে দিক-নির্দেশনা ও নেতৃত্ব দানের সাথে জড়িত, তাদের যথেষ্ট উপলব্ধির ও সতর্ক হবার অবকাশ রয়েছে। কোনো কিছুর স্পষ্টকরণ বা ব্যাখ্যা প্রদানে অযাচিত ও অন্যায়ভাবে কারো পক্ষ নেওয়া, কারো মনোতুষ্টি বা বিরাগভাজন হওয়া, জনপ্রিয়তা ও পদ-পদবীলাভ বা তা সংরক্ষণ অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো বৈষয়িক অর্জনকে সচেতনভাবে পরিহার করতে হবে। শুধুমাত্র মহান অন্তর্যামী আল্লাহ ও তাঁর ক্রোধকে ভয় করে, তাঁর নিষ্ঠাবান প্রতিনিধির উপযুক্ত মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের কথা বিবেচনা করে আল্লাহ-প্রদত্ত নির্দেশনাবলীর অনুসরণ করে যেতে হবে।
﴿ وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤٢ ﴾ [ البقرة : ٤٢ ]
৪২. আর৫৪ তোমরা হককে বাতিলের সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে হককে গোপন করো না।৫৫
৫৪. বনী ইসরাঈলের সাথে মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে অঙ্গীকারগুলো ছিলো, আগের আয়াতসমূহের ধারাবাহিকতায় তার বর্ণনা চলছে।
৫৫. তৎকালীন আরববাসীদের মধ্যে খ্রিস্টান বিশেষতঃ ইয়াহূদীরা যথেষ্ট শিক্ষিত ছিল। ফলে সাধারণ আরবরা মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়ত প্রসঙ্গে শিক্ষিত ইয়াহূদী পুরোহিতদের কাছে জানতে চাইত; কিন্তু তাদের আসমানী কিতাবের ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী সুস্পষ্ট ও নির্ভুল বৈশিষ্ট্য ও প্রমাণাদি লক্ষ্য করেও তারা সত্য-মিথ্যাকে মিশ্রিত করে বা গোপন করে প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ও সন্দেহ সঞ্চার করতে থাকে।
আরো জানতে দেখুন:
সূরা নং- ২ আল-বাকারা: ১১১, ১১৩, ১৩৫, ১৪০
সূরা নং- ৩ আলে-ইমরান: ৬৭
সূরা নং- ৪ আন-নিসা: ৪৬
সূরা নং- ৫ আল-মায়িদা: ১৮, ৪১, ৪৪, ৬৪, ৮২
সূরা নং- ৭ আল-আ’রাফ: ১৬৭
সূরা নং- ৬১ আস-সাফ্: ৫-৬
এছাড়া মহান আল্লাহ তা‘আলার চিরন্তন এ বাণী থেকে আমরা সত্য ও মিথ্যার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ কি হওয়া উচিত সে নির্দেশনাও পাই।
﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣ ﴾ [ البقرة : ٤٣ ]
৪৩. আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর৫৭ এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর।৫৮
৫৬. বনী ইসরাঈলের প্রতি মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে নির্দেশনাগুলো ছিলো, সে আলোচনাই এখানে চলমান।
৫৭. সালাত ও যাকাত প্রতি যুগে যুগে দ্বীন ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে এসেছে; কিন্তু ইয়াহূদীরা এ ব্যাপারে অনীহা প্রদর্শন করে জামা‘আতে সালাত পড়ার ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত প্রায় বিলুপ্ত করে বেশির ভাগ লোক ব্যক্তিগত পর্যায়ে সালাত ছেড়ে দেয়। আর যাকাত দেয়ার পরিবর্তে তারা অভ্যস্ত ছিলো সুদের ব্যবসায়।
এখানে আমাদেরও ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সালাত ও যাকাত অনুশীলনে উপলব্ধির অবকাশ রয়েছে।
৫৮. পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতগুলো জামা‘আতে আদায় করার তাকিদ।
﴿ ۞أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّ وَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ وَأَنتُمۡ تَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٤٤ ﴾ [ البقرة : ٤٤ ]
৪৪. তোমরা কি মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দিচ্ছ আর নিজেদেরকে ভুলে যাচ্ছ? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত কর।৫৯ তোমরা কি বুঝো না?
৫৯. হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা কার্যতঃ করো না? আল্লাহর কাছে এটি অত্যন্ত ক্রোধ উদ্রেককারী ব্যাপার যে, তোমরা বলবে এমন কথা, যা করো না। [সূরা আস-সাফ, আয়াত: ২-৩]
﴿ وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى ٱلۡخَٰشِعِينَ ٤٥ ﴾ [ البقرة : ٤٥ ]
৪৫. আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা বিনয়ী ছাড়া অন্যদের ওপর কঠিন।
﴿ ٱلَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُّلَٰقُواْ رَبِّهِمۡ وَأَنَّهُمۡ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ٤٦ ﴾ [ البقرة : ٤٦ ]
৪৬. যারা বিশ্বাস করে যে, তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং তারা তাঁর দিকে ফিরে যাবে।
﴿ يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَنِّي فَضَّلۡتُكُمۡ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ٤٧ ﴾ [ البقرة : ٤٧ ]
৪৭. হে বনী ইসরাঈল, তোমরা আমার নি‘আমতকে স্মরণ কর, যে নি‘আমত আমি তোমাদেরকে দিয়েছি এবং নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে বিশ্ববাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।৬০
৬০. এখানে সে যুগের কথা বলা হয়েছে, যখন দুনিয়ার সব জাতির মধ্যে একমাত্র বনী ইসরাঈল বা ইয়াহূদীদের কাছে আল্লাহ-প্রদত্ত সত্যজ্ঞান ছিল এবং তাদেরকেই বিশ্বের জাতিসমূহের নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। অন্যান্য জাতিদেরকে আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বের পথে আহবান করা ছিল তাদের দায়িত্ব।
﴿ وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا يُؤۡخَذُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٤٨ ﴾ [ البقرة : ٤٨ ]
৪৮. আর তোমরা সে দিনকে ভয় কর, যেদিন কেউ কারো কোনো কাজে আসবে না। আর কারো পক্ষ থেকে কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং কারো কাছ থেকে কোনো বিনিময় নেওয়া হবে না। আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না। ৬১
৬১. 'জবাবদিহির দিনের' কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই বনী ইসরাঈলের মাঝে চরম পদস্খলন ঘটেছিল। বস্তুতঃ আখিরাত তথা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা, কিয়ামত, পুনরুত্থান, হাশর, জবাবদিহি ও অনন্তকালের জীবন সম্পর্কিত সুস্পষ্ট ধারণা, বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি বা দুর্বলতাই মানুষের চরিত্র ও জীবনধারায় বিকৃতির অন্যতম প্রধান কারণ। তাই তো মানুষের প্রকৃত কল্যাণকামী প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন পবিত্র কুরআনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বর্ণনা করেছেন আখিরাতের কথা।
﴿ وَإِذۡ نَجَّيۡنَٰكُم مِّنۡ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ يَسُومُونَكُمۡ سُوٓءَ ٱلۡعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبۡنَآءَكُمۡ وَيَسۡتَحۡيُونَ نِسَآءَكُمۡۚ وَفِي ذَٰلِكُم بَلَآءٞ مِّن رَّبِّكُمۡ عَظِيمٞ ٤٩ ﴾ [ البقرة : ٤٩ ]
৪৯. আর স্মরণ কর,৬২ যখন আমি তোমাদেরকে ফিরআউনের দল থেকে রক্ষা করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠিন আযাব দিত। তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে যবেহ করত এবং তোমাদের নারীদেরকে বাঁচিয়ে রাখত। আর এতে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ছিল মহা পরীক্ষা।
৬২. এখান থেকে পরবর্তী কয়েক রুকূ ক্রমাগতভাবে বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ অংশ তুলে ধরা হয়েছে। এখানে একদিকে তাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত দয়া-অনুগ্রহ, অপরদিকে তার বিপরীতে তাদের সীমাহীন অকৃতজ্ঞতা ও দুষ্কর্মের সারাংশ বর্ণনা করা হয়েছে।
﴿ وَإِذۡ فَرَقۡنَا بِكُمُ ٱلۡبَحۡرَ فَأَنجَيۡنَٰكُمۡ وَأَغۡرَقۡنَآ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٠ ﴾ [ البقرة : ٥٠ ]
৫০. আর যখন তোমাদের জন্য আমি সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে নাজাত দিয়েছিলাম এবং ফির‘আউন দলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তোমরা দেখছিলে।
﴿ وَإِذۡ وَٰعَدۡنَا مُوسَىٰٓ أَرۡبَعِينَ لَيۡلَةٗ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُونَ ٥١ ﴾ [ البقرة : ٥١ ] ﴾
৫১. আর যখন আমি মূসাকে চল্লিশ রাতের ওয়াদা দিয়েছিলাম,৬৪ অতঃপর তোমরা তার যাওয়ার পর বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করেছিলে,৬৫ আর তোমরা ছিলে যালিম।
৬৪. মিশর থেকে মূসা ‘আলাইহিস সালামের নেতৃত্বে মুক্তি লাভের পর বনী ইসরাঈল বা ইয়াহূদীরা যখন সাইনা (সিনাই) উপত্যকায় পৌঁছে, তখন মহান আল্লাহ তাঁকে ৪০ দিন-রাতের জন্য তূর পাহাড়ে ডেকে নেন। ফিরাউনের দাসত্ব থেকে এখন মুক্ত জাতিটির জন্য জীবন-যাপনের বিধান দান করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
৬৫. সিনাই উপত্যকায় বনী ইসরাঈলের বসবাসের স্থানে প্রতিবেশি গোত্রদের মধ্যে গাভী ও ষাঁড় পূজার প্রথা বিদ্যমান ছিল। তা থেকে প্রভাবিত হয়ে এবং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তারা মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর অনুপস্থিতিতে এবং হারুন ‘আলাইহিস সালামকে অগ্রাহ্য করে বাছুর আকৃতির মূর্তি নির্মাণ করে তার পূজা করতে শুরু করে।
﴿ ثُمَّ عَفَوۡنَا عَنكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٢ ﴾ [ البقرة : ٥٢ ]
৫২. অতঃপর আমি তোমাদেরকে এ সবের পর ক্ষমা করেছি, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।
﴿ وَإِذۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡفُرۡقَانَ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ٥٣ ﴾ [ البقرة : ٥٣ ]
৫৩. আর যখন আমি মূসাকে দিয়েছিলাম কিতাব ও ফুরকান৬৭ যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।
৬৭. ফুরকান হচ্ছে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্টকারী 'মানদণ্ড'। এর মর্মার্থ হলো দ্বীনের এমন জ্ঞান, বোধ (perception) ও উপলব্ধি যার মাধ্যমে মানুষ সঠিক ও সত্য এবং মিথ্যা ও বিকৃতিকে পৃথক করে চিনে নিতে পারে।
﴿ وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦ يَٰقَوۡمِ إِنَّكُمۡ ظَلَمۡتُمۡ أَنفُسَكُم بِٱتِّخَاذِكُمُ ٱلۡعِجۡلَ فَتُوبُوٓاْ إِلَىٰ بَارِئِكُمۡ فَٱقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ لَّكُمۡ عِندَ بَارِئِكُمۡ فَتَابَ عَلَيۡكُمۡۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٥٤ ﴾ [ البقرة : ٥٤ ]
৫৪. আর যখন মূসা তার কওমকে বলেছিল, ‘হে আমার কওম, নিশ্চয় তোমরা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করে নিজদেরকে যুলুম করেছ। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তাওবা কর। অতঃপর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর।৬৮ এটি তোমাদের জন্য তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট উত্তম। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের তাওবা কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
৬৮. অর্থাৎ তাদের মধ্যে যেসব লোক গো-শাবককে উপাস্য বানিয়ে তার পূজা করেছে তাদেরকে হত্যা করো।
﴿ وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نُّؤۡمِنَ لَكَ حَتَّىٰ نَرَى ٱللَّهَ جَهۡرَةٗ فَأَخَذَتۡكُمُ ٱلصَّٰعِقَةُ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٥ ﴾ [ البقرة : ٥٥ ]
৫৫. আর যখন তোমরা বললে, ‘হে মূসা, আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব না, যতক্ষণ না আমরা প্রকাশ্যে আল্লাহকে দেখি’। ফলে বজ্র তোমাদেরকে পাকড়াও করল আর তোমরা তা দেখছিলে।
﴿ ثُمَّ بَعَثۡنَٰكُم مِّنۢ بَعۡدِ مَوۡتِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٦ ﴾ [ البقرة : ٥٦ ]
৫৬. অতঃপর আমি তোমাদের মৃত্যুর পর তোমাদেরকে পুনর্জীবন দান করলাম, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।৬৯
৬৯. এখানে ইঙ্গিতকৃত ঘটনাটি হলো, মূসা ‘আলাইহিস সালাম ৪০ দিনের জন্য তূর পাহাড়ে গমনের সময় মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী বনী ইসরাঈল থেকে ৭০জন বাছাইকৃত ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে যান। অতঃপর তাঁকে সেখানে 'কিতাব ও ফুরকান' দেওয়া হলে (দেখুন: আল-বাকারা, আয়াত: ৫৩) তিনি সেগুলো উক্ত ব্যক্তিদেরকে প্রদর্শন করেন। তখন এসবের মধ্য থেকে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক ধৃষ্টতার সাথে একথা বলতে থাকে যে, আল্লাহকে দৃশ্যমান আকারে আমাদেরকে দেখাও। তাদের ঐ আচরণের প্রেক্ষিতে তাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হয়।
আরো জানতে দেখুন: সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৫৫।
﴿ وَظَلَّلۡنَا عَلَيۡكُمُ ٱلۡغَمَامَ وَأَنزَلۡنَا عَلَيۡكُمُ ٱلۡمَنَّ وَٱلسَّلۡوَىٰۖ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡۚ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَٰكِن كَانُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ يَظۡلِمُونَ ٥٧ ﴾ [ البقرة : ٥٧ ]
৫৭. আর আমি তোমাদের ওপর মেঘের ছায়া দিলাম৭০ এবং তোমাদের প্রতি নাযিল করলাম ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’।৭১ তোমরা সে পবিত্র বস্তু থেকে আহার কর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। আর তারা আমার প্রতি যুলুম করেনি, বরং তারা নিজেদেরকেই যুলুম করত।
৭০. মিশর থেকে প্রস্থানকালে বনী ইসরাঈলের সংখ্যা ছিল এক লাখের মত। আর সিনাই উপদ্বীপে ঘর-বাড়ী তো দূরের কথা, মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই পর্যন্ত ছিল না। তখন মহান আল্লাহ যদি দীর্ঘকাল পর্যন্ত আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন না রাখতেন, তাহলে এ জাতি প্রখর রোদে ধ্বংস হয়ে যেতো।
৭১. 'মান্না' এক প্রকার আঠা জাতীয় মিষ্টি খাদ্য (sweet gum), কুয়াশার মত এগুলো বর্ষিত হতো। আর 'সালওয়া' ছিল কোয়েলের মত এক প্রকার ছোট পাখী (quails)। সিনাই উপদ্বীপের প্রতিকূল পরিবেশে (severely adverse topography & terrain) এক লাখ লোকের ৪০ বছরের উদ্বাস্তু জীবনে এভাবেই দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন বিনা শ্রমে রিযিকের সংস্থান করেছিলেন (আরো জানতে দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং-৪১২০)।
﴿ وَإِذۡ قُلۡنَا ٱدۡخُلُواْ هَٰذِهِ ٱلۡقَرۡيَةَ فَكُلُواْ مِنۡهَا حَيۡثُ شِئۡتُمۡ رَغَدٗا وَٱدۡخُلُواْ ٱلۡبَابَ سُجَّدٗا وَقُولُواْ حِطَّةٞ نَّغۡفِرۡ لَكُمۡ خَطَٰيَٰكُمۡۚ وَسَنَزِيدُ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٥٨ ﴾ [ البقرة : ٥٨ ]
৫৮. আর স্মরণ কর, যখন আমি বললাম, ‘তোমরা প্রবেশ কর এ জনপদে। আর তা থেকে আহার কর তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী, স্বাচ্ছন্দ্যে এবং দরজায় প্রবেশ কর মাথা নীচু করে। আর বল ‘ক্ষমা’। তাহলে আমি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং নিশ্চয় আমি সৎকর্মশীলদেরকে বাড়িয়ে দেব’।
﴿ فَبَدَّلَ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ قَوۡلًا غَيۡرَ ٱلَّذِي قِيلَ لَهُمۡ فَأَنزَلۡنَا عَلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ رِجۡزٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ بِمَا كَانُواْ يَفۡسُقُونَ ٥٩ ﴾ [ البقرة : ٥٩ ]
৫৯. কিন্তু যালিমরা পরিবর্তন করে ফেলল সে কথা তাদেরকে যা বলা হয়েছিল, তা ভিন্ন অন্য কথা দিয়ে। ফলে আমি তাদের ওপর আসমান থেকে আযাব নাযিল করলাম, কারণ তারা পাপাচার করত।
﴿ ۞وَإِذِ ٱسۡتَسۡقَىٰ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦ فَقُلۡنَا ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡحَجَرَۖ فَٱنفَجَرَتۡ مِنۡهُ ٱثۡنَتَا عَشۡرَةَ عَيۡنٗاۖ قَدۡ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٖ مَّشۡرَبَهُمۡۖ كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ مِن رِّزۡقِ ٱللَّهِ وَلَا تَعۡثَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِينَ ٦٠ ﴾ [ البقرة : ٦٠ ]
৬০. আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার কওমের জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, ‘তুমি তোমার লাঠি দ্বারা পাথরকে আঘাত কর’। ফলে তা থেকে উৎসারিত হল বারটি ঝরনা;৭৬ প্রতিটি দল তাদের পানি পানের স্থান জেনে নিল।৭৭ তোমরা আল্লাহর রিযিক থেকে আহার কর ও পান কর এবং ফাসাদকারী হয়ে যমীনে ঘুরে বেড়িয়ো না।
৭৬. ঐ পাথর গুলোর অস্তিত্ব এখনো মিসরের সিনাই উপদ্বীপ এলাকায় বিদ্যমান।
৭৭. বারোটি ঝরনার উদ্ভবের কারণ, বনী ইসরাঈলে ছিল ১২টি গোত্র, যাতে পানি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিবাদ না হয়।
দেখুন: সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ১৬০
﴿ وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نَّصۡبِرَ عَلَىٰ طَعَامٖ وَٰحِدٖ فَٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُخۡرِجۡ لَنَا مِمَّا تُنۢبِتُ ٱلۡأَرۡضُ مِنۢ بَقۡلِهَا وَقِثَّآئِهَا وَفُومِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَاۖ قَالَ أَتَسۡتَبۡدِلُونَ ٱلَّذِي هُوَ أَدۡنَىٰ بِٱلَّذِي هُوَ خَيۡرٌۚ ٱهۡبِطُواْ مِصۡرٗا فَإِنَّ لَكُم مَّا سَأَلۡتُمۡۗ وَضُرِبَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلذِّلَّةُ وَٱلۡمَسۡكَنَةُ وَبَآءُو بِغَضَبٖ مِّنَ ٱللَّهِۗ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ يَكۡفُرُونَ بَِٔايَٰتِ ٱللَّهِ وَيَقۡتُلُونَ ٱلنَّبِيِّۧنَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّۗ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ ٦١ ﴾ [ البقرة : ٦١ ]
৬১. আর যখন তোমরা বললে, ‘হে মূসা, আমরা এক খাবারের ওপর কখনো ধৈর্য ধরবো না। সুতরাং তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দো’আ কর, যেনো তিনি আমাদের জন্য বের করেন, ভূমি যে সব্জি, কাঁকড়, রসুন, মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করে, তা’। সে বলল, ‘তোমরা কি যা উত্তম তার পরিবর্তে এমন জিনিস গ্রহণ করছো যা নিম্নমানের? তোমরা কোনো এক নগরীতে অবতরণ কর। তবে নিশ্চয় তোমাদের জন্য (সেখানে) থাকবে, যা তোমরা চেয়েছ’। আর তাদের ওপর আরোপ করা হয়েছে লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য এবং তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হল। তা এ কারণে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করত৭৮ এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করত। ৭৯ তা এ কারণে যে, তারা নাফরমানী করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত।৮০
৭৮. মহান আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করার কয়েকটি অবস্থা রয়েছে:
ক. আল্লাহ-প্রদত্ত বিধি-বিধানের মধ্যে যেসব বিধান নিজের খেয়াল-খুশীর বিপরীত সেগুলো মানতে সরাসরি অস্বীকার করা।
খ. কোনো বিধানকে আল্লাহ-প্রদত্ত জেনেও গর্ব-অহংকারের সাথে তার বিপরীত কাজ করা এবং আল্লাহর নির্দেশের কোনো পরওয়া না করা।
গ. মহান রাব্বুল আ’লামীনের বাণীর মর্মার্থ ভালোভাবে জানা ও বুঝার পরও প্রবৃত্তির চাহিদা অনুসারে তার পরিবর্তন করা।
৭৯. বনী ইসরাঈল-কর্তৃক নবী-হত্যাসহ গুরুতর অপরাধসমূহের বিবরণ তাদের নিজেদের ইতিহাসেই লিপিবদ্ধ রয়েছে, তার দু-তিনটি উদাহরণ নীচে দেওয়া হলো। আপনি আগ্রহী হলে লিঙ্কগুলো দেখতে পারেন:
ক. ইয়াহ্ইয়া আ: (যোহন)-কে হত্যা: মার্ক, অধ্যায় - ৬, শ্লোক ১৭-২৯. http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbnew/Mark.pdf
খ. নবী ইয়ারমিয়ার (যেরেমিয়া) ওপর নির্যাতন: যেরেমিয়া, অধ্যায় - ১৮, শ্লোক ১৩-২৩
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Jeremiah.pdf
গ. যাকারিয়া আ:-কে প্রস্তরাঘাত করা:
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Zechariah.pdf
ঘ. ঈসা আ: এর বিরূদ্ধে মামলা, বিচার ও ফাঁসির রায়: মথি, অধ্যায় - ২৭, শ্লোক ২০-২৬
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbnew/Matthew.pdf
৮০. যুগে যুগে যে সব জাতি মহান আল্লাহ তা‘আলার অসীম নিয়ামত ও নিদর্শন লাভের পরও সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মানব তথা নবী-রাসূলদেরসহ সৎ, সত্য-পন্থী ও আল্লাহর পথে আহবানকারীদের নির্যাতন করেছে, বয়কট করেছে, হত্যা করেছে; অবাধ্যতা, সীমালংঘন আর মানুষের ন্যায্য অধিকার হরণের প্রতিযোগিতা করেছে, আর ফাসিক ও দুশ্চরিত্র লোকদের নেতৃত্বে নিজদেরকে চালিত করেছে - তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত অনিবার্য।
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱلَّذِينَ هَادُواْ وَٱلنَّصَٰرَىٰ وَٱلصَّٰبِِٔينَ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا فَلَهُمۡ أَجۡرُهُمۡ عِندَ رَبِّهِمۡ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ﴾ [ البقرة : ٦٢ ]
৬২. নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা ইয়াহূদী হয়েছে এবং খ্রিস্টান ও সাবিঈনরা-৮১ (তাদের মধ্যে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও আখিরাতের দিনের প্রতি এবং নেক কাজ করেছে - তবে তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।৮২
৮১. সাবেয়ীদের ধর্মীয় বিশ্বাস কি ছিল তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহমতুল্লাহি ‘আলাইহি. বলেছেন, সাবেয়ীদের ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহমতুল্লাহি ‘আলাইহির মতে সাবেয়ীরা বৃহৎ একটি দল যাদের কেউ ছিল মু’মিন আবার কেউ কাফির। সাবেয়ীরা নবী-রাসূলদের অস্বীকার করত না, তবে তাদের আনুগত্যকেও বাধ্যতামূলক মনে করত না। তারা সর্বজ্ঞাত প্রজ্ঞাময় আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত তবে তাদের অধিকাংশের বক্তব্য ছিল, মাধ্যম গ্রহণ ব্যতীত আল্লাহর কাছে পৌঁছা কখনো সম্ভব নয়। তাই তারা ঐসব মাধ্যমকে উপাসনার পাত্ররূপে গ্রহণ করে নিয়েছিল। সাবেয়ীরা যে ধর্মে যে বিষয়টাকে ভালো মনে করত তারা সেটাকেই আপন করে নিত। তারা সুনির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের পক্ষপাতিত্ব করত না; বরং সাবেয়ীদের কাছে সকল ধর্মের বিধানগুলো পৃথিবীর কল্যাণার্থেই প্রবর্তিত হয়েছে।
তবে সাবেয়ীরা দুটি মৌল ধারায় বিভক্ত ছিল বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। একটি ধারায় ছিল হুনাফা, অর্থাৎ একত্ববাদী সাবেয়ীরা, আরেকটি ছিল মুশরিক সাবেয়ীরা। (দ্র: আররাদ্দু আলাল মান্তেকিয়ীন: ১৮৭-৪৫৪, ২৯০-৪৫৮ )
৮২. মহান আল্লাহর কাছে মূল্য ও মর্যাদা একমাত্র যথাযথ ঈমান ও সৎ কাজের। যে ব্যক্তি এ সম্পদ নিয়ে তাঁর সামনে হাযির হতে পারবে, সে লাভ করবে পূর্ণ পুরস্কার।
﴿ وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱذۡكُرُواْ مَا فِيهِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٦٣ ثُمَّ تَوَلَّيۡتُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَۖ فَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ لَكُنتُم مِّنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٤ ﴾ [ البقرة : ٦٣، ٦٤ ]
৬৩-৬৪. আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের ওপর উঠালাম।৮৪ আমি (বললাম) ‘তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা শক্তভাবে ধর এবং তাতে যা রয়েছে তা স্মরণ কর, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার’।৮৫
অতঃপর তোমরা এ সবের পর বিমুখ হয়ে ফিরে গেলে। আর যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না হত, তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে।৮৬
৮৫. মুত্তাকী তারা যারা সবসময় দয়াময় আল্লাহর ক্ষমা ও পুরস্কার লাভের আশায় সতর্কাবস্থায় চলে এবং সৎকাজে সদা তৎপর থাকে; আর মহাবিচার দিনের মালিক আল্লাহর শাস্তিকে সব সময় ভয় পায়, তাই সদা সর্বদা অন্যায়-অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকে।
৮৬. এ হলো করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর পরম প্রিয়সৃষ্টি মানুষকে - জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নয়- বরং নিজ আগ্রহে সংশোধিত হয়ে তাঁর ক্ষমা লাভে ধন্য হবার সুযোগ যা বার বার মানুষের দরজায় কড়া নাড়ে। তারপরেও কি আমাদের তাঁর সন্তষ্টির পথে পুরোপুরি ফিরে এসে আলোকিত জীবন গড়ার সময় হবে না?
﴿ وَلَقَدۡ عَلِمۡتُمُ ٱلَّذِينَ ٱعۡتَدَوۡاْ مِنكُمۡ فِي ٱلسَّبۡتِ فَقُلۡنَا لَهُمۡ كُونُواْ قِرَدَةً خَٰسِِٔينَ ٦٥ فَجَعَلۡنَٰهَا نَكَٰلٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهَا وَمَا خَلۡفَهَا وَمَوۡعِظَةٗ لِّلۡمُتَّقِينَ ٦٦ ﴾ [ البقرة : ٦٥، ٦٦ ]
৬৫. আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের৮৭ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল, তাদেরকে অবশ্যই তোমরা জান। অতঃপর আমি তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’।৮৮
৬৬. আর আমি একে বানিয়েছি দৃষ্টান্ত, সে সময়ের এবং তৎপরবর্তী জনপদসমূহের জন্য এবং মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।
৮৭. ‘সাব্ত’ অর্থ কালের একটি ক্ষণ যা আরাম-বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বনী ইসরাঈলের প্রতি এ বিধান ছিল যে, শনিবার দিনকে তারা বিশ্রাম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট রাখবে। এদিনে তারা পার্থিব কোনো কাজ-কর্ম নিজেরা বা পরিচারকদের দিয়েও করাতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে এমন কড়া আইন ছিল যে, এ পবিত্র দিনের নির্দেশ অমান্যকারীর শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। বর্তমান বিকৃত বাইবেলেও (যাত্রা পুস্তক: অধ্যায় ৩১, শ্লোক ১২-১৭) এ নির্দেশনাটি দেখতে পাবেন এ লিঙ্কে-
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Exodus.pdf
কিন্তু তারা নৈতিক ও ধর্মীয় পতনের শিকার হবার পর এ বিধানের সুস্পষ্ট অবমাননা করতে থাকে। এমনকি তাদের শহরগুলোতে শনিবারে প্রকাশ্যে চলতে থাকে সব ধরনের কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য।
৮৮. তাদেরকে বানরে পরিণত করার অর্থ তাদের মস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তিকে পূর্ববৎ রেখে শারীরিক বিকৃতি ঘটিয়ে বানরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
# আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৬৩-১৭১।
﴿ وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تَذۡبَحُواْ بَقَرَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَتَّخِذُنَا هُزُوٗاۖ قَالَ أَعُوذُ بِٱللَّهِ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡجَٰهِلِينَ ٦٧ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨ ﴾ [ البقرة : ٦٧، ٦٨ ]
৬৭. আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার কওমকে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা একটি গাভী যবেহ করবে’।৮৯ তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ?’ সে বলল, ‘আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি।’৯০
৬৮. তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন গাভীটি কেমন হবে।’ সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, নিশ্চয় তা হবে গরু, বুড়ো নয় এবং বাচ্চাও নয়। এর মাঝামাঝি ধরনের। সুতরাং তোমরা কর যা তোমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’৯১
৮৯. এ আয়াতের ‘বাকারাহ’ (গাভী) শব্দ থেকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
৯০. এখানে উল্লেখিত ঘটনাটি সংক্ষেপে এ যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে একটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল; কিন্তু হত্যাকারীকে সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তাই তারা মূসা ‘আলাইহিস সালামের স্মরণাপন্ন হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দিয়ে একটি গাভী যবেহ-এর মাধ্যমে নিহত লোকটিকে জীবিত করে তার হত্যাকারীর পরিচয় উদঘাটন করান। এটি ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা।
৯১. আসলে মহান আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে যে কোনো একটি গাভী কুরবানী করাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু দ্বীনের যে কোনো বিধান পালনে অযথা সন্দেহ-সংশয়, অন্বেষণ ও প্রশ্ন করা ছিল তাদের চিরাচরিত স্বভাব।
﴿ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا لَوۡنُهَاۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ صَفۡرَآءُ فَاقِعٞ لَّوۡنُهَا تَسُرُّ ٱلنَّٰظِرِينَ ٦٩ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَ إِنَّ ٱلۡبَقَرَ تَشَٰبَهَ عَلَيۡنَا وَإِنَّآ إِن شَآءَ ٱللَّهُ لَمُهۡتَدُونَ ٧٠ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا ذَلُولٞ تُثِيرُ ٱلۡأَرۡضَ وَلَا تَسۡقِي ٱلۡحَرۡثَ مُسَلَّمَةٞ لَّا شِيَةَ فِيهَاۚ قَالُواْ ٱلۡـَٰٔنَ جِئۡتَ بِٱلۡحَقِّۚ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُواْ يَفۡعَلُونَ ٧١ ﴾ [ البقرة : ٦٨، ٧١ ]
৬৯. তারা বলল,৯২ ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, কেমন তার রঙ?’ সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, নিশ্চয় তা হবে হলুদ রঙের গাভী, তার রঙ উজ্জ্বল, দর্শকদেরকে যা আনন্দ দেবে।’
৭০. তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, তা কেমন? নিশ্চয় গরুটি আমাদের জন্য সন্দেহপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আর নিশ্চয় আমরা আল্লাহ চাহে তো পথপ্রাপ্ত হব।’
৭১. সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, ‘নিশ্চয় তা এমন গাভী, যা ব্যবহৃত হয়নি জমি চাষ করায় আর না ক্ষেতে পানি দেয়ায়। সুস্থ, যাতে কোনো খুঁত নেই।’ তারা বলল, ‘এখন তুমি সত্য নিয়ে এসেছ।’ অতঃপর তারা তা যবেহ করল অথচ তারা যবেহ করার ছিল না।৯৩
৯২. পূর্বের দুটি আয়াতের সাথে মিলিয়ে অধ্যয়ন করলে মর্মার্থ বুঝা সহজ হবে। গাভী সম্পর্কে বনী ইসরাঈলের বিভিন্ন প্রশ্ন ও সন্দেহ নিরসন চলছে।
৯৩. বনী ইসরাঈলের লোকেরা তৎকালীন মিশরের ফিরাউনের যুলুম ও অত্যাচার থেকে মহান আল্লাহর অসীম-অলৌকিক সাহায্যে মুক্তিলাভের পর সিনাই উপদ্বীপে অবস্থান নেয়। এসময় আশপাশের গো-পূজারী জাতিসমূহ থেকে তাদের মাঝে ‘গাভীর শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার’ ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়ে; আর তারা শুরু করে দেয় গো-বৎস পূজা। ঐ গর্হিত কাজ থেকে ফিরিয়ে আনতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে গাভী কুরবানীর নির্দেশ দিলেন। এটি তাদের জন্যে ছিল ঈমানের এক কঠিন পরীক্ষা। তাই তারা এ আদেশ এড়িয়ে যেতে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে; কিন্তু তার জবাবে সে ‘সোনালী বর্ণের বিশেষ ধরনের গাভী’ই তাদের সামনে এসে পড়ে, যাকে সে সময় তারা পূজা করতো!
বর্তমান বিকৃত বাইবেলের গণনা পুস্তকের ১৯ অধ্যায়ের ১-১০ শ্লোকগুলোতে এ ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে ।
﴿ وَإِذۡ قَتَلۡتُمۡ نَفۡسٗا فَٱدَّٰرَٰٔتُمۡ فِيهَاۖ وَٱللَّهُ مُخۡرِجٞ مَّا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٧٢ ﴾ [ البقرة : ٧٢ ]
৭২. আর স্মরণ কর, যখন তোমরা একজনকে হত্যা করলে অতঃপর সে ব্যাপারে একে অপরকে দোষারোপ করলে। আর আল্লাহ বের করে দিলেন তোমরা যা গোপন করছিলে।
﴿ فَقُلۡنَا ٱضۡرِبُوهُ بِبَعۡضِهَاۚ كَذَٰلِكَ يُحۡيِ ٱللَّهُ ٱلۡمَوۡتَىٰ وَيُرِيكُمۡ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٧٣ ﴾ [ البقرة : ٧٣ ]
৭৩. অতঃপর আমি বললাম, ‘তোমরা তাকে আঘাত কর গাভীটির (গোস্তের) কিছু অংশ দিয়ে। এভাবে আল্লাহ জীবিত করেন মৃতদেরকে। আর তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখান, যাতে তোমরা বুঝ।৯৪
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
৯৪. এটি ছিল বনী ইসরাঈলের সময়ের অসংখ্য মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনার একটি। এখানে নিহত ব্যক্তি শুধুমাত্র তার হন্তার পরিচয় বলতে প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশে জীবন ফিরে পেয়েছিল।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
﴿ ثُمَّ قَسَتۡ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَٱلۡحِجَارَةِ أَوۡ أَشَدُّ قَسۡوَةٗۚ وَإِنَّ مِنَ ٱلۡحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنۡهُ ٱلۡأَنۡهَٰرُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخۡرُجُ مِنۡهُ ٱلۡمَآءُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَهۡبِطُ مِنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٧٤ ﴾ [ البقرة : ٧٤ ]
৭৪. অতঃপর তোমাদের অন্তরসমূহ এর পরে কঠিন হয়ে গেল যেনো তা পাথরের মত কিংবা তার চেয়েও শক্ত। আর নিশ্চয় পাথরের মধ্যে কিছু আছে, যা থেকে নহর উৎসারিত হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা চূর্ণ হয়। ফলে তা থেকে পানি বের হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।৯৫ আর আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে গাফেল নন।
৯৫. উপমাটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। পাথর আপাতঃ দৃষ্টিতে এক নির্জীব প্রাকৃতিক কঠিন বস্তু; কিন্তু তার মাঝেও রয়েছে কোমলতা, যার অনুপম বর্ণনা করেছেন স্বয়ং তার সৃষ্টিকর্তা। এ বস্তুটির সাথে মানুষের হৃদয়ের তুলনা করেছেন রাব্বুল আলামীন। এখানে ৩ ধরনের পাথরের উল্লেখ করা হয়েছে:
ক. যা থেকে প্রবাহিত হয় ঝরনাধারা তথা নদী-নালা, যা সৃষ্ট জীবের উপকারে আসে।
খ. যা ফেটে গলে বের হয়ে আসে পানি, অর্থাৎ বাইরে কঠিন হলেও অন্তঃস্থল সুকোমল;
গ. কিছু পাথর, আরো সংবেদনশীল, যা যমীনে ধ্বসে পড়ে মহান আল্লাহর ভয়ে।
কিন্তু মানুষের মাঝে এমনও কিছু হৃদয় আছে, বিশেষতঃ এ আয়াতের প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখিত ইয়াহূদীদের অন্তর এতোই কঠিন যে, সৃষ্ট-জীবের দুঃখ-দুর্দশায়ও ঐ পাষাণদের চোখ অশ্রুসজল হয় না, আল্লাহর আক্রোশের ভয়ে হৃদয়গুলো এতটুকু প্রকম্পিত হয় না, অন্তরগুলো বিগলিত হয় না আল্লাহর কুদরতের অসংখ্য নিদর্শন দেখেও।
﴿ ۞أَفَتَطۡمَعُونَ أَن يُؤۡمِنُواْ لَكُمۡ وَقَدۡ كَانَ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۡ يَسۡمَعُونَ كَلَٰمَ ٱللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُۥ مِنۢ بَعۡدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٧٥ ﴾ [ البقرة : ٧٥ ]
৭৫. তোমরা কি এ আশা করছো যে, তারা তোমাদের প্রতি ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দল ছিল৯৬ যারা আল্লাহর বাণী শুনত,৯৭ অতঃপর তা বুঝে নেওয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে।৯৮
৯৬. বনী ইসরাঈলের আলেম-ওলামা ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাদের বুঝানো হয়েছে।
৯৭. তাওরাত, যাবূর ও অন্যান্য কিতাবকে বুঝানো হয়েছে, যা নবীদের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছেছে।
৯৮. ‘তাহরীফ’ অর্থ বিকৃতি বা পরিবর্তন; যা দু’ভাবে হতে পারে:
ক. কথার মূল অর্থ গোপন রেখে নিজ ইচ্ছা, প্রবৃত্তি ও সুবিধার অনুকূলে তার ব্যাখ্যা করা, যা মূল বক্তার লক্ষ্য ও ইচ্ছার খেলাফ।
খ. উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাক্যের শব্দ পরিবর্তন।
বনী ইসরাঈলের আলেমগণ আল্লাহর কিতাবে এ উভয় ধরনের বিকৃতিই করেছে।
﴿ وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَا بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ قَالُوٓاْ أَتُحَدِّثُونَهُم بِمَا فَتَحَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمۡ لِيُحَآجُّوكُم بِهِۦ عِندَ رَبِّكُمۡۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٧٦ ﴾ [ البقرة : ٧٦ ]
৭৬. আর যখন তারা মু’মিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি।’ আর যখন একে অপরের সাথে একান্তে মিলিত হয় তখন বলে, ‘তোমরা কি তাদের সাথে সে কথা আলোচনা কর, যা আল্লাহ তোমাদের ওপর উম্মুক্ত করেছেন, যাতে তারা এর মাধ্যমে তোমাদের রবের নিকট তোমাদের বিরুদ্ধে দলীল পেশ করবে?৯৯ তবে কি তোমরা বুঝো না’?১০০
৯৯. আতা ইবন ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে বললাম, তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় (বর্ণিত) আছে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন। তিনি বলেন, হ্যাঁ, ঠিক কথা। কুরআনে বর্ণিত তাঁর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের কিছুটা তাওরাতে উল্লেখিত হয়েছে: ‘হে নবী! আমি আপনাকে (সত্য-দ্বীনের) সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি এবং উম্মিদের রক্ষাকারী হিসেবে পাঠিয়েছি। আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনার নাম দিয়েছি মুতাওয়াক্কিল বা ভরসাকারী। আপনি দুশ্চরিত্র বা রূঢ় ও কঠোর হৃদয় নন এবং বাজারে ঝগড়া ও হৈ-হুল্লোড়কারী নন’। (আপনি এমন ব্যক্তি) যে কোনো মন্দ দিয়ে মন্দকে প্রতিহতকারী নয়, বরং মাফ করে দেয়। আল্লাহ তাঁকে (মৃত্যু দিয়ে) ততদিন পর্যন্ত দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন না যতদিন না সবাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই) একথা স্বীকার করার মাধ্যমে সৎপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং তা দিয়ে অন্ধের চোখ, বধিরের কান এবং (অসত্যের অন্ধকারে) আচ্ছাদিত হৃদয় ও মন-মানসিকতা উন্মুক্ত না হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৭৭)
১০০. ইয়াহূদীদের নিজেদের মধ্যে আলোচিত ছিল যে, তাওরাত ও অন্যান্য আসমানী কিতাবে মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এবং যে সব আয়াত ও শিক্ষাবলী তাদের পবিত্র কিতাবসমূহে রয়েছে যা দিয়ে তাদের মানসিকতা ও কর্মনীতিকে দোষারোপ করা যায় সেগুলো যেনো মুসলিমদের কাছে প্রকাশ না পায়; কিন্তু তা ছিল এক ব্যর্থ চেষ্টা-দেখুন পরবর্তী আয়াত।
﴿ أَوَ لَا يَعۡلَمُونَ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعۡلِنُونَ ٧٧ ﴾ [ البقرة : ٧٧ ]
৭৭. তারা কি জানে না যে, তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে, তা আল্লাহ জানেন?
﴿ وَمِنۡهُمۡ أُمِّيُّونَ لَا يَعۡلَمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّآ أَمَانِيَّ وَإِنۡ هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ ٧٨ ﴾ [ البقرة : ٧٨ ]
৭৮. আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর,১০১ তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই ধারণা করে থাকে।১০২
১০১. এখানে ইয়াহূদীদের দ্বিতীয় ধরনের লোকদের তথা জনসাধারণের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আর প্রথম ধরনের দলটি ছিল তাদের আলেম-ওলামা ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাদের, যার উল্লেখ ছিল ৭৫নং আয়াতে।
১০২. আল্লাহর কিতাবের কোনো জ্ঞানই তাদের ছিল না, তাতে দ্বীনের কি বিধি-বিধান রয়েছে, চারিত্রিক সংশোধন ও শরীয়তের নিয়ম-নীতি তথা মানবজীবনের প্রকৃত সাফল্য ও ব্যর্থতা কিসের ওপর নির্ভরশীল, তার প্রতি তাদের মোটেও মনোযোগ ছিল না। ওহীর জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী না হয়ে তারা নিজেদের ইচ্ছা-আকাঙ্খা অনুসারে নিজেদের মনগড়া কথাগুলোকে দ্বীন মনে করতো, আর মিথ্যামিথ্যি রচিত কিস্সা-কাহিনী আর ধারণা-অনুমানের ওপর ভর করে কালাতিপাত করতো।
এখানে গভীর আশংকার সাথে উল্লেখ্য যে, বর্তমান বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠির অবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে অনুরূপ, যা আমাদের চলমান সামগ্রিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে অনতিবিলম্বে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং প্রকৃত কল্যাণের স্বার্থেই।
﴿ فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشۡتَرُواْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا يَكۡسِبُونَ ٧٩ ﴾ [ البقرة : ٧٩ ]
৭৯. সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে। তারপর বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, যাতে তা তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতে পারে।১০৩ সুতরাং তাদের হাত যা লিখেছে তার পরিণামে তাদের জন্য ধ্বংস, আর তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস।
১০৩. যুগে যুগে আসমানী কিতাবকে বিকৃত করে বিভিন্ন ভাষ্যকারের মনগড়া বিশ্লেষণ, মুখরোচক কল্প-কাহিনী জুড়ে দেওয়া এবং উদ্ভাবিত সুবিধাজনক ও জনপ্রিয় আইন-কানুনের সংযোজনের মূল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে দুনিয়ার সাময়িক স্বার্থ, অর্থ বা অবস্থান লাভ করা। যার অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান রয়েছে অতীতের সব আসমানী কিতাব, ধর্মগ্রন্থ ও তাদের রক্ষকদের(!) মধ্যে।
এ থেকে আমাদের দীন-শরিয়া ও জীবন-ব্যবস্থার বিধি-বিধানের ব্যাখ্যাতাদের শিক্ষা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে।
তবে একমাত্র এবং শুধুমাত্র আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে প্রায় দেড় হাজার বছরেও কেউ, কোনো শক্তি আজ পর্যন্ত তার কোনো শব্দ এমনকি একটি অক্ষরও স্পর্শ করতে পারেনি, আর পারবেও না; যা সমগ্র মানবজাতির সামনে অনন্তকালের জন্য এক জাজ্জ্বল্যমান মু‘জিযা। কারণ, এর সুসংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি বলেছেন,
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [ الحجر : ٩ ]
আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক। [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯]
﴿ وَقَالُواْ لَن تَمَسَّنَا ٱلنَّارُ إِلَّآ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَةٗۚ قُلۡ أَتَّخَذۡتُمۡ عِندَ ٱللَّهِ عَهۡدٗا فَلَن يُخۡلِفَ ٱللَّهُ عَهۡدَهُۥٓۖ أَمۡ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٨٠ ﴾ [ البقرة : ٨٠ ]
৮০. আর তারা বলে, ‘গোনা-কয়েকদিন ছাড়া আগুন আমাদেরকে কখনো স্পর্শ করবে না’।১০৪ বল, ‘তোমরা কি আল্লাহর নিকট ওয়াদা নিয়েছ, ফলে আল্লাহ তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না?১০৫ নাকি আল্লাহর ওপর এমন কিছু বলছ, যা তোমরা জান না’?
১০৪. এটি ছিল ইয়াহূদী সমাজের একটি সাধারণ ভুল ধারণা। তারা ভাবতো, যেহেতু তারা ইয়াহূদী, তাই জাহান্নামের আগুন তাদের জন্য নিষিদ্ধ। আর যদি তাদেরকে শাস্তি দেয়াও হয়, তাহলে তা হাতে-গোনা কয়েকদিনের জন্য মাত্র, তারপর তাদেরকে জান্নাতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে!
১০৫. মুফাস্সিরগণের মতে, যদি আল্লাহ ক্ষমা না করেন তবে ঈমানদার ব্যক্তি গুনাহগার হলে জাহান্নামের শাস্তি পাবে, তবে চিরকালের জন্য নয়, শাস্তি ভোগের পর মুক্তি পাবে।
ইয়াহূদীদের বিশ্বাস, মূসা আ:-এর ধর্ম রহিত হয়নি, তাই তারা ঈমানদার এবং তাঁর পরবর্তী নবী ঈসা আ: ও শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত অস্বীকার করলেও তারা কাফির নয়, যা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কারণ কোনো আসমানী কিতাবেই এটি লেখা নেই যে, মূসা এবং ঈসা ‘আলাইহিমুস সালামের আনীত দীন হলো চিরকালের জন্যে; বরং পরবর্তী এবং শেষ নবীর পূর্বাভাষ রয়েছে তাদের কিতাবে। অনেকগুলো প্রমাণের একটি এখানে দেখুন: দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮, শ্লোক ১৫-১৯ এ লিঙ্কে http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Deuteronomy.pdf।
শেষনবীর উম্মত হিসেবে তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান পোষণ করা সন্দেহাতীতভাবে অপরিহার্য। কাজেই নবুওয়াত অস্বীকারকারী কাফির; আর কাফিররা কিছুদিন শাস্তি ভোগ করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে - একথাও কোনো আসমানী কিতাবে উল্লেখ নেই।
﴿ بَلَىٰۚ مَن كَسَبَ سَيِّئَةٗ وَأَحَٰطَتۡ بِهِۦ خَطِيَٓٔتُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨١ ﴾ [ البقرة : ٨١ ]
৮১. হাঁ, যে মন্দ উপার্জন করবে এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে নেবে,১০৬ তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। তারা সেখানে থাকবে স্থায়ীভাবে।
১০৬. ‘গুনাহ দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়া’ শুধুমাত্র (মহাসত্যগুলোকে অস্বীকারকারী) কাফিরদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, কুফরের ফলে তাদের কোনো সৎকর্মই গ্রহণযোগ্য হয় না। এমনকি কুফরের পূর্বে কিছু ভালো কাজ করে থাকলেও তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এজন্যে একথার মর্মার্থ এ যে, কাফিরদের গোটা সত্ত্বা ও কৃতকর্মগুলো যেনো নিরেট অপরাধ ও অবাধ্যতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে; সত্যের আলো যেনো গাঢ় অন্ধকারের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা তাদের অস্তিত্বে প্রবেশের কোনো পথ আর খুঁজে পায় না। তাই তাদের পরিণতি এতো ভয়াবহ।
﴿ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَنَّةِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨٢ ﴾ [ البقرة : ٨٢ ]
৮২. আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে,১০৭ তারা জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানে থাকবে স্থায়ীভাবে।
১০৭. ঈমানদারদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রথমতঃ ঈমানের জন্যে নির্দেশিত ও প্রয়োজনীয়, আপাতঃদৃষ্টিতে ‘অদৃশ্য ও দৃশ্যমান’ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভেজাল বিশ্বাস ও প্রত্যয় ধারণ করাটাই এক বিরাট সৎকর্ম।
দ্বিতীয়তঃ দুনিয়ার জীবনে পরিলক্ষিত তথাকথিত অফুরন্ত চাকচিক্য, আরাম-আয়েশ, অবৈধ উপার্জন আর ভোগের হাতছানিগুলোকে ধোঁকা হিসেবে বিবেচনা করে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে, শয়তানের সার্বক্ষণিক প্ররোচনাগুলোকে পরিহার করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভয়-ভীতি, ক্ষয়-ক্ষতি, হুমকি, যুলুম-নির্যাতন ইত্যাদিকে মাথা পেতে নিয়ে মু’মিন ব্যক্তিরা যে সৎকাজগুলো করেন, মহান রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে তার প্রতিদান কতই না মূল্যবান হতে পারে!
اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই অভিশপ্ত শয়তান থেকে; পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে শুরু করছি।
﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ لَا تَعۡبُدُونَ إِلَّا ٱللَّهَ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَانٗا وَذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَقُولُواْ لِلنَّاسِ حُسۡنٗا وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ ثُمَّ تَوَلَّيۡتُمۡ إِلَّا قَلِيلٗا مِّنكُمۡ وَأَنتُم مُّعۡرِضُونَ ٨٣ ﴾ [ البقرة : ٨٣ ]
৮৩. আর স্মরণ কর, যখন আমরা বনী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করবে না, সদাচার করবে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে। আর মানুষকে উত্তম কথা বল,১০৮ সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক ছাড়া১০৯ তোমরা ফিরে গেলে। আর তোমরা (স্বীকার করে অতঃপর তা থেকে) বিমুখ হও।
১০৮. এখানে রয়েছে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে ইবাদাতের সকল অনুভূতি, তা বাস্তবায়ন করার তাগিদ, মাতা-পিতার প্রতি সদাচার, আত্মীয়-পরিজন, ইয়াতীম, অসহায়দের সাথে উত্তম ব্যবহার এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে সদাচার, নম্র ব্যবহার ও ভালো কথা বলার তাগিদ; তবে সদাচারের অজুহাতে কারও ক্ষেত্রেই দীনের ব্যাপারে ছাড় দেওয়া যাবে না। এমনকী কেউ ফিরআউন তুল্য হলেও বিনম্র ভাষায় দীনের আদর্শ প্রচারে সর্বাত্মক সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োগ করতে হবে তাকে বুঝাতে সকল পথ ও পদ্ধতি।
১০৯. এরা তাওরাতের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন এবং আল্লাহ তাদেরকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রেখেছিলেন।
﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ لَا تَسۡفِكُونَ دِمَآءَكُمۡ وَلَا تُخۡرِجُونَ أَنفُسَكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ ثُمَّ أَقۡرَرۡتُمۡ وَأَنتُمۡ تَشۡهَدُونَ ٨٤﴾ [ البقرة : ٨٤ ]
৮৪. আর যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা নিজদের রক্ত প্রবাহিত করবে না এবং নিজদেরকে তোমাদের গৃহসমূহ থেকে বের করবে না। অতঃপর তোমরা স্বীকার করে নিলে। আর তোমরা তার সাক্ষ্য প্রদান করছিলে।
১০০. মানব হত্যা আসমানী ধর্মে নিষিদ্ধ। বনী ইসরাঈলদের কাছ থেকেও আল্লাহ তা‘আলা মানব হত্যা না করার অঙ্গিকার নিয়েছিলেন। কেবল যুদ্ধের ময়দানে যতটুকু না হলেই নয় এবং শরী‘আতের বিধান মোতাবেক কিসাস ও হুদূদ বাস্তবায়নের জন্যই, সীমিত ক্ষেত্রে, রক্তপাতের বৈধতা রয়েছে।
﴿ثُمَّ أَنتُمۡ هَٰٓؤُلَآءِ تَقۡتُلُونَ أَنفُسَكُمۡ وَتُخۡرِجُونَ فَرِيقٗا مِّنكُم مِّن دِيَٰرِهِمۡ تَظَٰهَرُونَ عَلَيۡهِم بِٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِ وَإِن يَأۡتُوكُمۡ أُسَٰرَىٰ تُفَٰدُوهُمۡ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيۡكُمۡ إِخۡرَاجُهُمۡۚ أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥﴾ [ البقرة : ٨٥ ]
৮৫. অতঃপর তোমরাই তো তারা, যারা নিজদেরকে হত্যা করছ এবং তোমাদের মধ্য থেকে একটি দলকে তাদের গৃহ থেকে বের করে দিচ্ছ; পাপ ও সমীলঙ্ঘনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে সহায়তা করছ। আর তারা যদি বন্দী হয়ে তোমাদের নিকট আসে, তোমরা মুক্তিপণ দিয়ে তাদেরকে মুক্ত কর। অথচ তাদেরকে বের করা তোমাদের জন্য হারাম ছিল।১১০ তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? দুনিয়ার জীবনে। আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে।১১১ আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।
১১০. এ ব্যাপারটি বুঝতে একটু ধৈর্য্যের সাথে তৎকালীন প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নেওয়া দরকার। মদীনার আওস ও খাযরাজ নামে দু’টি গোত্র পরস্পর শত্রু ছিল, তাই তাদের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত। মদীনার উপকণ্ঠে বাস করত বনী কুরায়যা ও বনী নাযীর নামের দু’টি ইয়াহূদী গোত্র। বনী কুরায়যা ছিল আওস গোত্রের মিত্র; অপরদিকে খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল বনী নাযীর।
বনী কুরায়যার লোকদেরকে হত্যা ও বহিষ্কার করার পেছনে খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনী নাযীরের সক্রিয় ভূমিকা থাকত। অনুরূপভাবে বনী নাযীরকে হত্যা ও বহিষ্কারে ইন্ধন যোগাতো আওস গোত্রের মিত্র বনী কুরায়যা। তবে একটি ব্যাপারে উভয় ইয়াহূদী গোত্র ছিল এক ও অভিন্ন। তাহল, ইয়াহূদী গোত্রদ্বয়ের কেউ যদি অন্য গোত্রের কারো হাতে বন্দী হতো, তাহলে নিজ মিত্রদের অর্থে তাকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিত। কেউ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তারা বলত, বন্দী মুক্তকরণ আমাদের ওপর ওয়াজিব। আবার আরব গোত্রদ্বয়ের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তারা বলত, মিত্রদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকা লজ্জার ব্যাপার!
তাই এ-আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদের এ-দ্বিমুখী আচরণের নিন্দা করেছেন এবং খুলে দিয়েছেন তাদের ঘৃণ্য কূট-কৌশলের মুখোশ।
১১১. এ-হল সর্বকালের সর্বযুগের মানবগোষ্ঠির জন্যে আসমানী বিধান। অর্থাৎ যারা কিতাবের সুবিধাজনক অংশগুলোকে বিশ্বাস করে ও মানে, আর নিজেদের তথাকথিত দুনিয়াবী স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে ছল-চাতুরীর মাধ্যমে অথবা স্পষ্টভাবে অবিশ্বাস ও অমান্যে করে, তাদের পরিণতি হলো কঠিনতম আযাব যাতে তারা নিক্ষিপ্ত হবে।
﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا بِٱلۡأٓخِرَةِۖ فَلَا يُخَفَّفُ عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابُ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٨٦﴾ [ البقرة : ٨٦ ]
৮৬. তারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে খরিদ করেছে।১১২ সুতরাং তাদের থেকে আযাব হালকা করা হবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।
১১২. অথচ যা হওয়া উচিৎ, তা মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন এভাবে: নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। দেখুন: সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ১১১।
﴿وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ وَقَفَّيۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِۦ بِٱلرُّسُلِۖ وَءَاتَيۡنَا عِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَأَيَّدۡنَٰهُ بِرُوحِ ٱلۡقُدُسِۗ أَفَكُلَّمَا جَآءَكُمۡ رَسُولُۢ بِمَا لَا تَهۡوَىٰٓ أَنفُسُكُمُ ٱسۡتَكۡبَرۡتُمۡ فَفَرِيقٗا كَذَّبۡتُمۡ وَفَرِيقٗا تَقۡتُلُونَ ٨٧ ﴾ [ البقرة : ٨٧ ]
৮৭. আর আমরা নিশ্চয় মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ।১১৩ আর তাকে শক্তিশালী করেছি পবিত্র আত্মার১১৪ মাধ্যমে। তবে কি তোমাদের নিকট যখনই কোনো রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখন তোমরা অহঙ্কার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ।
১১৩. ‘সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী’র দ্বারা সেই উজ্জ্বল আলামত ও চিহ্নগুলোকে বুঝানো হয়েছে, যা দেখে প্রতিটি সত্যপ্রিয় ও সত্যানুসন্ধিৎসু মানুষ ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর নবী হিসেবে চিনতে পারে।
১১৪. ‘পবিত্র রূহ’ বলতে এখানে জিবরীল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে।
﴿وَقَالُواْ قُلُوبُنَا غُلۡفُۢ ۚ بَل لَّعَنَهُمُ ٱللَّهُ بِكُفۡرِهِمۡ فَقَلِيلٗا مَّا يُؤۡمِنُونَ ٨٨ ﴾ [ البقرة : ٨٨ ]
৮৮. আর তারা বলল, আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত; ১১৫ বরং তাদের কুফুরীর কারণে আল্লাহ তাদেরকে লা‘নত করেছেন। অতঃপর তারা খুব কমই ঈমান আনে।১১৬
১১৫. ইয়াহূদীরা বুঝাতে চায় যে, তাদের অন্তরগুলো দৃঢ় আচ্ছাদন দিয়ে সুরক্ষিত; তা পরিবর্তনের জন্যে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ -এমন কি আল্লাহর আয়াতসমূহের বক্তব্যের আলোকে চেষ্টা করলেও তাতে কোনো প্রভাব পড়ে না। এটি তাদের নিরেট একগুঁয়েমি, অজ্ঞতা, মুর্খতা ও বিদ্বেষপ্রসুত একধরণের হঠকারী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। বস্তুতঃ তারা তাদের কিতাবে উল্লিখিত পরবর্তী নবী আগমনের পূর্বাভাষ অনুযায়ী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সুস্পষ্টভাবে চিনতে পেরেও সচেতনভাবে তাঁকে অস্বীকার করেছে।
এছাড়া বর্তমান বিকৃত তাওরাত ও বাইবেলের কয়েকটি উদ্ধৃতি হুবহু এখানে তুলে দেওয়া হলো যেখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে:
প্রকৃত ও নকল নবী
১৮আমি ওদের জন্য ওদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার মতো এক নবীর উদ্ভব ঘটাব ও তার মুখে আমার বাণী রেখে দেব; আমি তাকে যা কিছু আজ্ঞা করব, তা সে তাদের বলবে।১৯ আর আমার নামে সে আমার যে সকল বাণী বলবে, সেই বাণীতে কেউ যদি কান না দেয়, তবে তার কাছে আমি জবাবদিহি চাইব।
তাওরাত: দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮, শ্লোক ১৮-১৯
××× ××× ××× ××× ××× ×××
বিদায় উপদেশ
সহায়ক পবিত্র আত্মার আগমন, শিষ্যদের আনন্দ
৫এখন কিন্তু আমি তাঁরই কাছে যাচ্ছি যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, অথচ তোমাদের কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করছে না, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? ৬কিন্তু এ সমস্ত তোমাদের বলেছি বিধায়ই তোমাদের মন দুঃখে ভরে গেছে। ৭তা সত্ত্বেও আমি তোমাদের সত্যকথা বলছি: আমার চলে যাওয়াটা তোমাদের পক্ষে ভালো। কারণ, আমি চলে না গেলে সেই সহায়ক তোমাদের কাছে আসবেন না; বরং যদি যাই, তাহলে আমি তাঁকে তোমাদের কাছে পাঠাব ৮আর তিনি এসে জগৎকে পাপের বিষয়ে দোষী বলে সাব্যস্ত করবেন, (এবং ব্যক্ত করবেন)
××× ××× ××× ××× ××× ×××
ধর্মময়তা ও বিচার কী।
১২তোমাদের কাছে আমার আরও অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু তোমরা এখন তা সহ্য করতে পার না। ১৩তবে তিনি যখন আসবেন, সেই সত্যময় আত্মা, তিনিই পূর্ণ সত্যের মধ্যে তোমাদের চালনা করবেন। কারণ, তিনি নিজে থেকে কিছুই বলবেন না; কিন্তু যে সমস্ত কথা শোনেন, তিনি তা-ই বলবেন; যা যা ঘটবার, তাও তিনি তোমাদের বলে দেবেন। ১৪তিনি আমাকে গৌরবান্বিত করবেন, কারণ যা আমার, তা-ই তুলে নিয়ে তিনি তা তোমাদের বলে দেবেন।
বাইবেল: যোহন-রচিত সুসমাচার, অধ্যায় ১৬, শ্লোক ৫-৮ এবং ১২-১৪
১১৬. অর্থাৎ ইয়াহূদীরা তাদের গর্ব-অহংকারের কারণে মনে করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য এমনই যে, তা কোনো জ্ঞানী লোকের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না; অথচ প্রকৃত ব্যাপার এর সম্পূর্ণ বিপরীত। নিঃসন্দেহে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থাপনা পুরোপুরি অহী-ভিত্তিক, অত্যন্ত সারগর্ভ ও হৃদয়গ্রাহী। কিন্তু তাদের কুফুরী ও হঠকারিতার ফলে মহান আল্লাহ তাদের অন্তরের উপর অভিশম্পাত বর্ষণ করেছেন, আর তাই কোনো যুক্তিপূর্ণ ও জ্ঞানময় কথা মনে-প্রাণে গ্রহণ করার কোনো যোগ্যতাই তাদের আর অবশিষ্ট নেই।
﴿وَلَمَّا جَآءَهُمۡ كِتَٰبٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ وَكَانُواْ مِن قَبۡلُ يَسۡتَفۡتِحُونَ عَلَى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَمَّا جَآءَهُم مَّا عَرَفُواْ كَفَرُواْ بِهِۦۚ فَلَعۡنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ ٨٩ ﴾ [ البقرة : ٨٩ ]
৮৯. আর যখন তাদের কাছে, তাদের সাথে যা আছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার সত্যায়নকারী১১৭ কিতাব আসলো, আর তারা (এর মাধ্যমে) পূর্বে কাফিরদের ওপর বিজয় কমনা করত।১১৮ সুতরাং যখন তাদের নিকট আসল যা তারা চিনত১১৯ তখন তারা তা অস্বীকার করল। অতএব, কাফিরদের ওপর আল্লাহর লা‘নত।
১১৭. কুরআন মাজীদকে তাওরাতের ‘মুসাদ্দিক’ বা সত্যায়নকারী এজন্য বলা হয়েছে যে, তাওরাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব এবং কুরআন নাযিল সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, কুরআনের মাধ্যমে সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। তাই তাওরাতকে যারা মানে, তারা কিছুতেই কুরআন অমান্যকারী হতে পারে না। কেননা কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে তাওরাতকে অমান্য করার নামান্তর। এ ছাড়া তাওরাতের অবিকৃত অংশগুলো আল্লাহর অহী হওয়ার বিষয়টিও কুরআন সত্যায়ন করেছে। তবে আল কুরআনের পর কেবল আল-কুরআন অনুযায়ী আমল হবে।
১১৮. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে ইয়াহূদীরা অস্থিরতার সাথে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। কারণ তাদের নবীগণ সর্বশেষ নবীর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং তারা এ মর্মে আল্লাহর কাছে দো‘আও করতেন যে, শেষ নবীর আগমন যেন তাড়াতাড়ি হয়, তাহলে কাফিরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব হবে এবং পুণরায় তাদের উত্থানের যুগ শুরু হবে।
মদীনাবাসীগণ এ-কথার সাক্ষী যে, তাদের প্রতিবেশী ইয়াহূদীরা প্রায়শই বলে বেড়াত যে, ‘তোমাদের যার যার মন চায় আমাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাও, আখেরী নবী যখন আসবেন, তখন আমরা সেসব অত্যাচারীদের দেখে ছাড়ব’। মদীনার অধিবাসীগণ এসব কথা শুনতেন এবং তাই যখন তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মন্ধে অবগত হলেন, তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন, দেখো! ইয়াহূদীরা যেন আমাদের আগে এ নবীর দীন গ্রহণ করে বাজিতে জিতে না যায়! চলো, আমরাই প্রথমে এ নবীর উপর ঈমান আনি; কিন্তু তাদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যে ইয়াহূদীরা এতদিন নবীর আগমনের প্রতীক্ষায় দিন গুণত, তারাই সে নবীর আবির্ভাব হবার পর তাঁর সবচে’ বড় শত্রুতে পরিণত হলো!
১১৯. এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। এখানে একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ঘটনা উল্লেখ করা হলো। আর তা তুলে ধরেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনীন সাফিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি নিজে ছিলেন মদীনার উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত ইয়াহূদী গোত্র বনী নাযীরের নেতৃস্থানীয় এক আলেম হুয়ায় ইবন আখতাব-এর মেয়ে এবং আরেকজন বড় মাপের ইয়াহূদী আলেমের ভ্রাতুষ্পুত্রী। তিনি তার ইসলাম গ্রহণের আগের এ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় আগমনের পর আমার বাবা ও চাচা দু’জনই তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষণ তাঁর সাথে কথাবার্তা বলার পর তারা ঘরে ফিরে আসেন। এ সময় আমি নিজের কানে তাদেরকে এভাবে আলাপ করতে শুনি:
চাচা: আমাদের কিতাবে যে নবীর খবর দেওয়া হয়েছে, ইনি কি সত্যিই সেই নবী?
পিতা: আল্লাহর কসম, ইনিই সেই নবী!
চাচা: এ ব্যাপারে তুমি কি একেবারে নিশ্চিত?
পিতা: হ্যাঁ।
চাচা: তাহলে এখন কি করতে চাও?
পিতা: যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, এর বিরোধিতা করে যাব। একে সফলকাম হতে দেব না।
(সূত্র: সীরাতে ইবন হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৫, আধুনিক সংস্করণ)
﴿بِئۡسَمَا ٱشۡتَرَوۡاْ بِهِۦٓ أَنفُسَهُمۡ أَن يَكۡفُرُواْ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بَغۡيًا أَن يُنَزِّلَ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۖ فَبَآءُو بِغَضَبٍ عَلَىٰ غَضَبٖۚ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٞ مُّهِينٞ ٩٠ ﴾ [ البقرة : ٩٠ ]
৯০. যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে১২০ তা কত জঘন্য (তা এই) যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা তারা অস্বীকার করেছে এই জিদের বশবর্তী হয়ে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার ওপর তাঁর অনুগ্রহ নাযিল করেছেন।১২১ সুতরাং তারা ক্রোধের ওপর ক্রোধের উপযুক্ত হয়ে গেল। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।১২২
১২০. অর্থাৎ নিজেদের কল্যাণ, শুভ পরিণাম ও পরকালীন মুক্তিকে জলাঞ্জলি দিয়েছে।
১২১. ইয়াহূদীদের আশা ছিল যে, শেষনবী তাদের অর্থাৎ ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করবেন; কিন্তু যখন তিনি বনী ইসরাঈলের বাইরে ইসমাঈলী বংশধারায় প্রেরিত হলেন, যাদেরকে তারা নিজেদের মোকাবিলায় তুচ্ছ-জ্ঞান করত, তখন তারা তাঁকে শুধুমাত্র তাদের একগুঁয়েমি ও হঠকারি মানসিকতার কারণে অস্বীকার করতে উদ্যত হলো। তাদের মনোভাব এমনই যেন, আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করে নবী পাঠালেন না কেন! আল্লাহ যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস না করে নিজের অনুগ্রহে নিজ পছন্দ অনুযায়ী নবী পাঠালেন, তখন তারা বিগড়ে গিয়ে তাঁকে সুস্পষ্টভাবে চিনতে পেরেও সর্বাত্মক বিরোধিতা করতে শুরু করে।
১২২. ‘লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি’ কাফিরদের জন্যেই নির্দিষ্ট। যারা ঈমানদার, তবে গুনাহগার (দয়াময় আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন) আর যদি তিনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তা হবে তাদের পাপমুক্ত করার লক্ষ্যে, লাঞ্ছিত করার উদ্দেশ্যে নয়।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ نُؤۡمِنُ بِمَآ أُنزِلَ عَلَيۡنَا وَيَكۡفُرُونَ بِمَا وَرَآءَهُۥ وَهُوَ ٱلۡحَقُّ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَهُمۡۗ قُلۡ فَلِمَ تَقۡتُلُونَ أَنۢبِيَآءَ ٱللَّهِ مِن قَبۡلُ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٩١ ﴾ [ البقرة : ٩١ ]
৯১. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তার প্রতি ঈমান আন’। তারা বলে, ‘আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে আমরা তা বিশ্বাস করি’। আর এর বাইরে যা আছে তারা তা অস্বীকার করে।১২৩ অথচ তা সত্য, তাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারী। বল, ‘তবে কেন তোমরা আল্লাহর নবীদেরকে পূর্বে হত্যা করতে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’?
১২৩. এখানে ইয়াহূদীদের উদ্ধৃত বক্তব্যে রয়েছে কুফর ও তাদের অন্তরের হিংসা-বিদ্বেষের প্রমাণ। যেসব আসমানী কিতাব তাদের প্রতি নাযিল হয় নি, সেগুলোকে অস্বীকার করে তারা কুফুরী করেছে। যেমন, আমাদের ঈমানের একটি অন্যতম শর্ত হলো, পূর্ববর্তী সব আসমানী কিতাবসমূহের ওপর বিশ্বাস (দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪)।
এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাদের সামনে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন:
ক. অন্যান্য গ্রন্থের সত্যতার অকাট্য যুক্তি থাকা সত্ত্বেও সেগুলো অস্বীকার করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
খ. কুরআন মাজীদও অন্যান্য আসমানী কিতাবের অন্তর্ভুক্ত একটি কিতাব। এটা তাওরাতের সত্যায়নকারীও বটে। তাই কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করা তাওরাতকে অস্বীকার করার নামান্তর।
গ. সব আসমানী কিতাব মতেই মহান নবী-রাসূলদেরকে হত্যা করা কুফুরী। ইয়াহূদীরা নবীদেরকে হত্যা করেছে, অথচ তাঁরা, বিশেষ করে, তাওরাতের শিক্ষাই প্রচার করতেন। তাই আসলে তাদের তাওরাতের উপর ঈমান আনার দাবীটাই অসার।
﴿وَلَقَدۡ جَآءَكُم مُّوسَىٰ بِٱلۡبَيِّنَٰتِ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُونَ ٩٢ ﴾ [ البقرة : ٩٢ ]
৯২. আর অবশ্যই মূসা তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে১২৪! অতঃপর তোমরা তার পরে বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করলে। আর তোমরা তো যালিম।
১২৪. মূসা আলাইহিস সালামকে মহান আল্লাহ তা‘আলা ৯টি সুস্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘আমি মূসাকে নয়টি প্রকাশ্য নিদর্শন দান করেছি’ (দেখুন: সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ১০১)। এগুলোর বর্ণনা রয়েছে সূরা আল-আ‘রাফ ও সূরা আয-যুখরুফ-এ।
﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱسۡمَعُواْۖ قَالُواْ سَمِعۡنَا وَعَصَيۡنَا وَأُشۡرِبُواْ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡعِجۡلَ بِكُفۡرِهِمۡۚ قُلۡ بِئۡسَمَا يَأۡمُرُكُم بِهِۦٓ إِيمَٰنُكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٩٣ ﴾ [ البقرة : ٩٣ ]
৯৩. আর স্মরণ কর, যখন আমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমাদের উপর তূরকে উঠিয়েছিলাম, (বলেছিলাম) ‘আমরা তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা শক্তভাবে ধর এবং শোন’। তারা বলেছিল, ‘আমরা শুনলাম এবং অমান্য করলাম১২৬! আর তাদের কুফুরীর কারণে তাদের অন্তরে পান করানো হয়েছিল গো বাছুরের প্রতি আকর্ষণ। বল, ‘তোমাদের ঈমান যার নির্দেশ দেয় কত মন্দ তা! যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’।
১২৬. অথচ মুমিনের বক্তব্য হওয়া উচিৎ: আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। ‘আমরা শুনলাম এবং অমান্য করলাম’ এ-ধরনের কথা আল্লাহর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী কাফেররাই কেবল বলতে পারে।
﴿قُلۡ إِن كَانَتۡ لَكُمُ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ عِندَ ٱللَّهِ خَالِصَةٗ مِّن دُونِ ٱلنَّاسِ فَتَمَنَّوُاْ ٱلۡمَوۡتَ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٩٤ ﴾ [ البقرة : ٩٤ ]
৯৪. বল, ‘যদি আল্লাহর নিকট আখিরাতের আবাস তোমাদের জন্যই নির্দিষ্ট থাকে অন্যান্য মানুষ ছাড়া। তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর১২৭, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’।
১২৭. ইয়াহূদীদের দুনিয়া-প্রীতির প্রতি এটি সূক্ষ্ম বিদ্রুপ বিশেষ। আখিরাতের জীবন সম্পর্কে যারা সচেতন এবং তারা কখনো পার্থিব লোভ-লালসায় নিমজ্জিত জীবন যাপন করতে পারে না; কিন্তু ইয়াহূদীদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল এবং এখনো আছে।
﴿وَلَن يَتَمَنَّوۡهُ أَبَدَۢا بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيهِمۡۚ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلظَّٰلِمِينَ ٩٥ ﴾ [ البقرة : ٩٥ ]
৯৫. আর তারা কখনো তা কামনা করবে না, তাদের হাত যা পাঠিয়েছে তার কারণে। আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত।
﴿وَلَتَجِدَنَّهُمۡ أَحۡرَصَ ٱلنَّاسِ عَلَىٰ حَيَوٰةٖ وَمِنَ ٱلَّذِينَ أَشۡرَكُواْۚ يَوَدُّ أَحَدُهُمۡ لَوۡ يُعَمَّرُ أَلۡفَ سَنَةٖ وَمَا هُوَ بِمُزَحۡزِحِهِۦ مِنَ ٱلۡعَذَابِ أَن يُعَمَّرَۗ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِمَا يَعۡمَلُونَ ٩٦ ﴾ [ البقرة : ٩٦ ]
৯৬. আর তুমি তাদেরকে পাবে জীবনের প্রতি সর্বাধিক লোভী মানুষরূপে।১২৮ এমনকি তাদের থেকেও যারা শির্ক করেছে। তাদের যে কেউই কামনা করে, যদি হাজার বছর তাকে জীবন দেওয়া হত! অথচ দীর্ঘজীবী হলেই তা তাকে আযাব থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারবে না। আর তারা যা করে আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
১২৮. আল-কুরআনের মূল শব্দে এখানে على حياة বলা হয়েছে। এর মানে, কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকা; তা যে কোনো ধরনের জীবন হোক না কেন, সম্মানের ও মর্যাদার বা হীনতার, দীনতার, লাঞ্ছনা-অবমাননার হোক না কেন, তার প্রতিই তাদের লোভ।
﴿قُلۡ مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّـجِبۡرِيلَ فَإِنَّهُۥ نَزَّلَهُۥ عَلَىٰ قَلۡبِكَ بِإِذۡنِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَهُدٗى وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُؤۡمِنِينَ ٩٧ ﴾ [ البقرة : ٩٧ ]
৯৭. বল, ‘যে জিবরীলের শত্রু হবে১২৯ (সে অনুশোচনায় মরুক) কেননা নিশ্চয় জিবরীল তা আল্লাহর অনুমতিতে তোমার অন্তরে নাযিল করেছে১৩০, তার সামনে থাকা কিতাবের সমর্থক১৩১, হিদায়াত ও মুমিনদের জন্য সুসংবাদরূপে’।১৩২
১২৯. ইয়াহূদীরা কেবল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ওপর যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকেই গালমন্দ করত না, বরং তারা আল্লাহর প্রিয় মহান ফিরিশতা জিবরাঈল আলাইহিসসালামকেও শত্রু বলে গালি দিত।
১৩০. এ জন্যেই তাদের গালমন্দ জিবরাঈল আলাইহিস সালামের ওপর নয়, আল্লাহর মহান সত্তার ওপর আরোপিত হয়।
১৩১. জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এ কুরআন মাজীদ বহন করে এনেছেন বলেই তারা তাকে গালমন্দ করে। অথচ কুরআন সরাসরি তাওরাতের সত্যতা সমর্থন করছে। ফলে তাদের এ বিষোদগার তাওরাতের বিরুদ্ধেও উচ্চারিত হচ্ছে।
১৩২. এখানে সূক্ষ্মভাবে একটি আক্ষেপের ব্যাপার তুলে ধরা হয়েছে যে, ইয়াহূদীদের সব অসন্তুষ্টি হচ্ছে হিদায়াত ও সত্য-সহজ পথের বিরুদ্ধে। নির্বোধের মতো তারা লড়ছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালতের বিরুদ্ধে। অথচ এই রিসালত মেনে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত ছিল তাদের ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ।
﴿مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّلَّهِ وَمَلَٰٓئِكَتِهِۦ وَرُسُلِهِۦ وَجِبۡرِيلَ وَمِيكَىٰلَ فَإِنَّ ٱللَّهَ عَدُوّٞ لِّلۡكَٰفِرِينَ ٩٨ ﴾ [ البقرة : ٩٨ ]
৯৮. ‘যে শত্রু হবে আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাদের, তাঁর রাসূলগণের, জিবরীলের ও মীকাঈলের, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের শত্রু’।
﴿وَلَقَدۡ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ءَايَٰتِۢ بَيِّنَٰتٖۖ وَمَا يَكۡفُرُ بِهَآ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقُونَ ٩٩ ﴾ [ البقرة : ٩٩ ]
৯৯. আর আমরা অবশ্যই তোমার প্রতি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নাযিল করেছি, ফাসিকরা ছাড়া১৩৩ অন্য কেউ তা অস্বীকার করে না।
১৩৩. আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও পথ-নির্দেশসমূহ অগ্রাহ্য ও অমান্যকারী।
﴿أَوَ كُلَّمَا عَٰهَدُواْ عَهۡدٗا نَّبَذَهُۥ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۚ بَلۡ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ١٠٠ ﴾ [ البقرة : ١٠٠ ]
১০০. তবে কি যখনই তারা কোন ওয়াদা করেছে, তখনই তাদের মধ্য থেকে কোনো এক দল তা ছুড়ে মেরেছে? বরং তাদের অধিকাংশ ঈমান রাখে না।
﴿وَلَمَّا جَآءَهُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ نَبَذَ فَرِيقٞ مِّنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ كِتَٰبَ ٱللَّهِ وَرَآءَ ظُهُورِهِمۡ كَأَنَّهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ١٠١﴾ [ البقرة : ١٠١ ]
১০১. আর যখন তাদের নিকট আল্লাহর কাছ থেকে একজন রাসূল আসল, তাদের সাথে যা আছে তা সমর্থন করে, তখন আহলে কিতাবের১৩৪ একটি দল আল্লাহর কিতাবকে তাদের পেছনে ফেলে দিল, (এভাবে যে) মনে হয় যেন তারা জানে না।
১৩৪. পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহ তথা তাওরাত ও ইঞ্জিলের অনুসারীবৃন্দ।
﴿وَٱتَّبَعُواْ مَا تَتۡلُواْ ٱلشَّيَٰطِينُ عَلَىٰ مُلۡكِ سُلَيۡمَٰنَۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيۡمَٰنُ وَلَٰكِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُونَ ٱلنَّاسَ ٱلسِّحۡرَ وَمَآ أُنزِلَ عَلَى ٱلۡمَلَكَيۡنِ بِبَابِلَ هَٰرُوتَ وَمَٰرُوتَۚ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنۡ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَآ إِنَّمَا نَحۡنُ فِتۡنَةٞ فَلَا تَكۡفُرۡۖ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنۡهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِۦ بَيۡنَ ٱلۡمَرۡءِ وَزَوۡجِهِۦۚ وَمَا هُم بِضَآرِّينَ بِهِۦ مِنۡ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۚ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡۚ وَلَقَدۡ عَلِمُواْ لَمَنِ ٱشۡتَرَىٰهُ مَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖۚ وَلَبِئۡسَ مَا شَرَوۡاْ بِهِۦٓ أَنفُسَهُمۡۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ١٠٢ ﴾ [ البقرة : ١٠٢ ]
১০২. আর তারা১৩৫ অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা১৩৬ সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফুরী করে নি; বরং শয়তানরা কুফুরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শিখাত১৩৭ এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফিরিশতা হারূত ও মারূতের ওপর। আর তারা কাউকে (যাদু) শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফুরী করো না’।১৩৮
এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত।১৩৯ অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা নিশ্চয় জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা বুঝত।
১৩৫. বনী ইসরাঈল বা ইসরাঈল প্রজন্ম।
১৩৬. এখানে ‘শায়াতীন’ বলতে জিন্ন ও মানুষ উভয়েই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
১৩৭. ইসরাঈল গোত্রের মধ্যে যখন চরম নৈতিক অধঃপতন দেখা দিল; গোলামি, মূর্খতা, অজ্ঞতা, দারিদ্র, লাঞ্ছনা ও হীনতার ফলে যখন তাদের জাতিগত মনোবল ও উচ্চাকাঙ্খার বিলুপ্তি ঘটল, তখন তারা যাদু-টোনা, তাবীজ-তুমার, টোটকা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকল। তারা এমন সব পন্থার অনুসন্ধান করতে লাগল যাতে কোনো পরিশ্রম ও সংগ্রাম-সাধনা ছাড়াই ঝাড়-ফুঁক ও তন্ত্র-মন্ত্রের জোরে সাফল্য লাভ করা যায়। তখন শয়তানরা তাদেরকে প্ররোচনা দিতে লাগল। তাদেরকে বুঝাতে থাকলো যে, সুলাইমান আলাইহিস সালামের বিশাল রাজত্ব ও তার বিস্ময়কর ক্ষমতা তো আসলে কিছু মন্ত্র-তন্ত্র ও কয়েকটা আঁচড়, নকশা তথা তাবীজের ফল। তারা তাদেরকে সেগুলো শিখিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিল। আর বনী ইসরাঈল জাতি প্রত্যাশিত মহামূল্যবান সম্পদ মনে করে এতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
১৩৮. সমগ্র বনী ইসরাঈল জাতি যখন ব্যাবিলনে বন্দী ও গোলামির জীবন যাপন করছিল, মহান আল্লাহ তখন তাদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে দু'জন ফিরিশতাকে মানুষের বেশে পাঠিয়েছিলেন। লূত জাতির কাছে যেমন ফিরিশতারা গিয়েছিলেন সুদর্শন বালকের বেশে তেমনি বনী ইসরাঈলের কাছে হয়তো তারা দরবেশ ও ফকীরের ছদ্মবেশে হাযির হয়ে থাকবেন। তারা তাদের ফিরিশতাসুলভ বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখেই সেখানে মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জ্ঞান দান করেছিলেন। তাদের শিখানো জ্ঞান ছিল নিঃসন্দেহে জায়েয, উপকারী এবং কার্যকরী। তারা লোকদের এই মর্মে সতর্কও করে দিয়েছেন যে, দেখো, আমরা কিন্তু তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। কাজেই নিজেদের পরকাল নষ্ট করো না, অর্থাৎ কোনরূপ অসৎ ও ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার করো না। কিন্তু ইয়াহূদীরা তাদের চরম চারিত্রিক বিকৃতি নিয়ে তা শিখেছিল খারাপ উদ্দেশ্যে এবং তার প্রয়োগও করতো নিকৃষ্টতম লক্ষ্যে। ফলে সেই উপকারী জ্ঞান তাদের কাছে যাদু ও যাদুকরী বিদ্যায় পরিণত হলো। আর এর প্রতি তারা এতই ঝুঁকে পড়ল যে, আল্লাহর কিতাবের সাথে তাদের আর কোনো সম্পর্কই রইল না। আর যাদের সাথে নামমাত্র সম্পর্ক ছিল, তাও শুধুমাত্র ‘আমল ও তাবীজ’ পর্যায়ে সীমিত ছিল।
১৩৯. অর্থাৎ সেই বাজারে সব থেকে বেশি চাহিদা ছিল এমন জাদু-টোনার, যার সাহায্যে এক ব্যক্তি অন্য একজনের স্ত্রীকে তার স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে। তাদের মধ্যে যে নৈতিক পতন দেখা দিয়েছিল এটি ছিল তার নিকৃষ্টতম পর্যায়।
﴿وَلَوۡ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ وَٱتَّقَوۡاْ لَمَثُوبَةٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ خَيۡرٞۚ لَّوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ١٠٣ ﴾ [ البقرة : ١٠٣ ]
১০৩. আর যদি তারা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে (তাদের জন্য) প্রতিদান উত্তম হত। যদি তারা জানত।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقُولُواْ رَٰعِنَا وَقُولُواْ ٱنظُرۡنَا وَٱسۡمَعُواْۗ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٞ ١٠٤ ﴾ [ البقرة : ١٠٤ ]
১০৪. হে মুমিনগণ,১৪০ তোমরা ‘রাইনা’ বলো না; বরং বল, ‘উনজুরনা’১৪২ আর শোন,১৪৩ কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।
১৪০. এই আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে সংক্ষেপে সেই প্রেক্ষাপটটি সামনে রাখা দরকার যে, যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আগমন করলেন এবং মদীনার চারপাশে ইসলামের আহ্বান ছড়িয়ে পড়তে লাগল, তখন ইয়াহূদীরা স্থানে স্থানে মুসলিমদেরকে ধর্মীয় বিতর্কে জড়িয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখার অপচেষ্টা অব্যাহত রাখল। তাদের উল্লেখযোগ্য বাধা-দানকারী কার্যক্রমগুলো ছিল নিম্নরূপ:
ক. তুচ্ছ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো
খ. গুরুত্বহীন বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের অবতারণা করা
গ. অপপ্রচারের মাধ্যমে নব্য মুমিনদের অন্তরে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা
ঘ. প্রশ্নের ওপর অনর্থক প্রশ্ন করে কুরআন ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্যকে দূর্বোধ্য করে তোলা
ঙ. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে বসে প্রতারণামূলক কথাবার্তা বলে গোলযোগ সৃষ্টি করা
এই রুকু হতে পরবর্তী রুকুগুলোতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী তথা মুমিনদেরকে এসব অনিষ্টকর কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, যা তাদের বিরুদ্ধে ইয়াহূদীরা করছিল। সেসব সন্দেহ-সংশয়ের জবাবও দেওয়া হয়েছে, যেগুলো তারা মুসলিমদের অন্তরে সৃষ্টির চেষ্টা করছিল।
১৪১. এ শব্দটির অর্থ ‘আমাদের একটু সুযোগ দিন’। কিন্তু ইয়াহূদীদের ভাষায় এর অর্থ ‘শোনো, তুমি বধির হয়ে যাও’। ইয়াহূদীরা যখন মুসলিমদেরকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ভালো করে বুঝে নেওয়ার উদ্দেশে ব্যবহার করতে দেখল, তখন তারা এটাকে সুযোগ হিসেবে গণ্য করে তাদের ভাষায় ব্যবহৃত গালির অর্থে শব্দটিকে প্রয়োগ করতে লাগল। আবার কখনো বা তারা শব্দটির উচ্চারণ একটু টেনে ‘রাইনা’ ( رَاعِيَنَا )ও বলার চেষ্টা করতে লাগল, যার অর্থ ‘ওহে আমাদের রাখাল’! এর সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাহমাতুল্লিল আলামীনকে তুচ্ছজ্ঞান ও অপদস্ত করা। ইয়াহূদীদের এই ছলচাতুরি বন্ধ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে ‘রাইনা’ বর্জন করতে বললেন। এর একার্থবোধক শব্দ ‘উনযুরনা’ অর্থাৎ আমাদের প্রতি নজর দিন বলতে নির্দেশ দিলেন। শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতার বিষয়টি আমরা এ আয়াত থেকে বুঝতে পাচ্ছি।
১৪২. তাই মুমিনদেরকে যথাযথ কুলুষমুক্ত শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হলো ঐ শব্দটি বলো না, বরং বলো ‘উনযুরনা’। যার অর্থ ‘আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন’ বা ‘আমাদের প্রতি দৃষ্টি দিন’ অথবা ‘আমাদেরকে একটু বুঝতে দিন’।
১৪৩. কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা শৈথিল্যের সাথে শোনার প্রশ্নই উঠে না, তাতে বরং কথা শোনার মাঝখানে সম্ভাবনা থাকে নিজেদের চিন্তাজালে বার বার জড়িয়ে পড়ার। ফলে ভুল বুঝার এবং প্রশ্নের পর প্রশ্ন করার অবকাশ সৃষ্টি হয়, যা প্রায়ই ঘটত ইয়াহূদীদের ক্ষেত্রে। তাই মুমিনদের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাদেরকে আলোর পথে চলার পাথেয় শুনতে হবে স্বতঃস্ফুর্ত আগ্রহ ও গভীর মনোযোগের সাথে, আর মানতে হবে খুশি মনে, তৃপ্তির সাথে।
﴿مَّا يَوَدُّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ وَلَا ٱلۡمُشۡرِكِينَ أَن يُنَزَّلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ خَيۡرٖ مِّن رَّبِّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَخۡتَصُّ بِرَحۡمَتِهِۦ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِيمِ ١٠٥ ﴾ [ البقرة : ١٠٥ ]
১০৫. আহলে কিতাব১৪৪ ও মুশরিকদের১৪৫ মধ্য থেকে যারা কুফুরী করেছে, তারা চায় না যে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর কোন কল্যাণ নাযিল হোক। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তাঁর রহমত দ্বারা খাস করেন এবং আল্লাহ মহান অনুগ্রহের অধিকারী।
১৪৪. পূর্বে অবতীর্ণ আসমানী কিতাবসমূহের অনুসারী।
১৪৫. যারা আল্লাহর সাথে অন্যকাউকে শরীক করে অথবা আল্লাহর ইবাদাতের সাথে অন্য কারও ইবাদাত করে।
﴿مَا نَنسَخۡ مِنۡ ءَايَةٍ أَوۡ نُنسِهَا نَأۡتِ بِخَيۡرٖ مِّنۡهَآ أَوۡ مِثۡلِهَآۗ أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ١٠٦ ﴾ [ البقرة : ١٠٦ ]
১০৬. আমরা যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মতো১৪৬ আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
১৪৬. এখানে একটি বিশেষ সন্দেহের জবাব দেওয়া হয়েছে, যা মুসলিমদের অন্তরে সৃষ্টির জন্য ইয়াহূদীরা চেষ্টা চালাত। তাদের অভিযোগগুলো ছিল নিম্নরূপ:
ক. পূর্ববর্তী কিতাবগুলো যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে থাকে এবং এ-কুরআনও তাঁর পক্ষ থেকেই এসে থাকে, তাহলে ঐ কিতাবগুলোর কিছু বিধানের ক্ষেত্রে এখানে ভিন্নতর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেন?
খ. একই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিধান কীভাবে আসতে পারে?
গ. আবার কুরআন দাবি করছে যে, ইয়াহূদী ও খৃষ্টানরা তাদেরকে দেওয়া শিক্ষার কিছু অংশ ভুলে গেছে। আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষা হাফেযদের মন থেকে কি করে মুছে যেতে পারে?
হিদায়াত অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে নয় বরং আল-কুরআন যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, এ ব্যাপারে মুসলিমদের মনে সন্দেহ সৃষ্টির লক্ষ্যেই তারা এগুলো করতো।
এর জবাবে মহান আল্লাহ বলছেন, তিনিই মালিক, তাঁর ক্ষমতা সীমাহীন, তিনি তাঁর যে কোন নির্দেশকে ইচ্ছা করে রহিত করে দেন বা যে কোনো বিধানকে বিলুপ্ত করেন; কিন্তু যা তিনি রহিত বা বিলুপ্ত করেন, তার চেয়ে উওম অথবা কমপক্ষে সমতুল্য কল্যাণময় ও উপযোগী বিধান সেখানে স্থলাভিষিক্ত করেন। আর বিধান প্রদানে মূল লক্ষ্য হলো আনুগত্যের পরীক্ষা নেওয়া। তাই তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিধান দিয়ে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। এতে সন্দেহ করার কিছুই নেই।
﴿ أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۗ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٠٧ ﴾ [ البقرة : ١٠٧ ]
১০৭. তুমি কি জান না যে, নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহর। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।
﴿ أَمۡ تُرِيدُونَ أَن تَسَۡٔلُواْ رَسُولَكُمۡ كَمَا سُئِلَ مُوسَىٰ مِن قَبۡلُۗ وَمَن يَتَبَدَّلِ ٱلۡكُفۡرَ بِٱلۡإِيمَٰنِ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَآءَ ٱلسَّبِيلِ ١٠٨ ﴾ [ البقرة : ١٠٨ ]
১০৮. নাকি তোমরা চাও তোমাদের রাসূলকে প্রশ্ন করতে, যেমন পূর্বে মূসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল?১৪৭ আর যে ঈমানকে কুফরে পরিবর্তন করবে, সে নিশ্চয় সোজা পথ বিচ্যুত হলো।
১৪৭. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বললেন: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য হজ ফরয করেছেন’। তখন সে উপস্থিতি থেকে একজন (আকরা ইবন হাবেস) দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল! প্রতি বছরই কি হজ ফরয’? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথার উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন। এমনকি লোকটি তিনবার এ প্রশ্ন করল। পরে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম তাহলে তোমাদের জন্য অবশ্যই প্রতি বছর হজ্জ ফরয হয়ে যেত। তখন তা তোমরা পালন করতে সক্ষম হতে না’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘আমি যতক্ষন কিছু না বলি, ততক্ষণ তোমরাও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। অতিরিক্ত প্রশ্ন করে শরী‘আতকে কঠিন করো না। তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিরাও এভাবে তাদের নবীদেরকে অধিক প্রশ্ন করে এবং সে ব্যাপারে নিজেরা মতানৈক্য করে ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং যখন আমি তোমাদেরকে কিছু করার নির্দেশ দেই, সাধ্যানুসারে তা পালন করো; আর যখন কিছু থেকে বিরত থাকতে বলি, তা তোমরা পরিত্যাগ করো’। (সহীহ মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধী ঐ ব্যক্তি, যে এমন জিনিস সম্পর্কে প্রশ্ন করল যা হারাম ছিল না, কিন্তু তার প্রশ্নের কারণে তা হারাম হয়ে গেল’। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ‘তোমরা বাজে কথা, সম্পদ বিনষ্ট করা এবং বেশি প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকো’। (সহীহ আল-বুখারী)
﴿وَدَّ كَثِيرٞ مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ لَوۡ يَرُدُّونَكُم مِّنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِكُمۡ كُفَّارًا حَسَدٗا مِّنۡ عِندِ أَنفُسِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلۡحَقُّۖ فَٱعۡفُواْ وَٱصۡفَحُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٠٩ ﴾ [ البقرة : ١٠٩ ]
১০৯. আহলে কিতাবের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর কাফির অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারত! সত্য স্পষ্ট হওয়ার পর তাদের পক্ষ থেকে হিংসাবশত (তারা এরূপ করে থাকে)। সুতরাং তোমরা ক্ষমা কর এবং এড়িয়ে চল,১৪৮ যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর নির্দেশ দেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
১৪৮. বিরোধীদের হিংসা-বিদ্বেষ দেখে মুমিন ব্যক্তিরা উত্তেজিত হয়ে পড়বে না, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে না। ধৈর্য্যের সাথে আল্লাহর স্মরণ, তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) ও সৎকর্মে তৎপর থাকবে। বিরোধীদের কথায় উৎকন্ঠিত না হয়ে তা বরং এড়িয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ বলেন: নিশ্চয় তারা ভীষণ কৌশল করছে। আর আমিও ভীষণ কৌশল করছি। অতএব, কাফিরদেরকে কিছুটা অবকাশ দাও, কিছু সময়ের তাদেরকে অবকাশ দাও। (দেখুন: সূরা আত-তারিক, আয়াত ১৫-১৭)
﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ١١٠ ﴾ [ البقرة : ١١٠ ]
১১০. আর তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং যে নেক আমল তোমরা নিজদের জন্য আগে পাঠাবে, তা আল্লাহর নিকট পাবে।১৪৯ তোমরা যা করছ নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
১৪৯. পরকালের প্রস্তুতি সম্পর্কে আরো পড়তে ক্লিক করুন নিম্নের দুটি লিংক:
http://www.islamhouse.com/p/41497 http://www.islamhouse.com/p/41478
﴿وَقَالُواْ لَن يَدۡخُلَ ٱلۡجَنَّةَ إِلَّا مَن كَانَ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ تِلۡكَ أَمَانِيُّهُمۡۗ قُلۡ هَاتُواْ بُرۡهَٰنَكُمۡ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١١١ ﴾ [ البقرة : ١١١ ]
১১১. আর তারা বলে, ইয়াহূদী কিংবা নাসারা ছাড়া অন্য কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এটা তাদের মিথ্যা আশা।১৫০ বল, ‘তোমরা তোমাদের প্রমাণ নিয়ে আস, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’।
১৫০. এটি মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের আরেকটি প্ররোচনা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে, নাজাত তথা পরকালে মুক্তির পথ হলো ইয়াহূদী অথবা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করা। তাদের দাবি অনুযায়ী এ দু’টিই আল্লাহ প্রদত্ত এবং তা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় নতুন কোনো জীবন-ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, তারা পরস্পর চরম শত্রু হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের বিরোধীতায় তারা ঐক্যবদ্ধ, যা মুসলিমদের বিরোধীদের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য।
﴿بَلَىٰۚ مَنۡ أَسۡلَمَ وَجۡهَهُۥ لِلَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَلَهُۥٓ أَجۡرُهُۥ عِندَ رَبِّهِۦ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١١٢ ﴾ [ البقرة : ١١٢ ]
১১২. হ্যাঁ, যে নিজকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও, তবে তার জন্য রয়েছে তার রবের নিকট প্রতিদান। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।১৫১
১৫১. অর্থাৎ পরকালে মুক্তি ও জান্নাত প্রাপ্তির জন্য ইয়াহূদী বা খৃষ্টান নয়, বরং প্রকৃত অর্থে আল্লাহর জন্য হতে হবে সমর্পিত, মুসলিম। সাথে থাকতে হবে ইহসান অর্থাৎ:
ক. পূর্ণ নিষ্ঠা, সততা ও মহান আল্লাহর ভয় এবং আশা বুকে ধারণ করে শরী‘আতের বিধি-নিষেধ পালনে সচেষ্ট হওয়া।
খ. লোক-দেখানো কোনো উদ্দেশ্যে নয়, বরং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই কেবল ইবাদাত-বন্দেগী আদায় করা।
গ. প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত সুন্নাহ অনুসরণ করে সকল কর্ম যথার্থরূপে সম্পাদন করা।
যারা এভাবে ইবাদাত ও আনুগত্যের জীবনধারা গড়ে তুলবে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে নিশ্চিত প্রতিদান। তাদের কোনো শঙ্কা বা ভয়ের কারণ নেই।
মহান আল্লাহ বলেন:
(নিশ্চয় যারা বলে, ‘আল্লাহই আমাদের রব’ অতঃপর অবিচল থাকে, ফিরিশতারা তাদের কাছে নাযিল হয় (এবং বলে,) ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল’।
আমরা দুনিয়ার জীবনে তোমাদের বন্ধু এবং আখিরাতেও। সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আরো থাকবে যা তোমরা দাবি করবে।) (দেখুন: সূরা হা-মীম আস-সাজ্দাহ, আয়াত ৩০-৩১)
﴿وَقَالَتِ ٱلۡيَهُودُ لَيۡسَتِ ٱلنَّصَٰرَىٰ عَلَىٰ شَيۡءٖ وَقَالَتِ ٱلنَّصَٰرَىٰ لَيۡسَتِ ٱلۡيَهُودُ عَلَىٰ شَيۡءٖ وَهُمۡ يَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۗ كَذَٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ مِثۡلَ قَوۡلِهِمۡۚ فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ فِيمَا كَانُواْ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَ ١١٣ ﴾ [ البقرة : ١١٣ ]
১১৩. আর ইয়াহূদীরা বলে, ‘নাসারাদের কোনো ভিত্তি নেই’ এবং নাসারারা বলে ‘ইয়াহূদীদের কোনো ভিত্তি নেই’। অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবেই, যারা কিছু জানে না,১৫২ তারা তাদের কথার মতো কথা বলে। সুতরাং আল্লাহ কিয়ামতের দিন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত সে বিষয়ে তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।
১৫২. মুশরিক (অংশীবাদী) ও নাস্তিকেরা।
﴿وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ أَن يُذۡكَرَ فِيهَا ٱسۡمُهُۥ وَسَعَىٰ فِي خَرَابِهَآۚ أُوْلَٰٓئِكَ مَا كَانَ لَهُمۡ أَن يَدۡخُلُوهَآ إِلَّا خَآئِفِينَۚ لَهُمۡ فِي ٱلدُّنۡيَا خِزۡيٞ وَلَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١١٤ ﴾ [ البقرة : ١١٤ ]
১১৪. আর তার চেয়ে অধিক যালেম কে, যে আল্লাহর মাসজিদসমূহে তাঁর নাম স্মরণ করা থেকে বাধা প্রদান করে এবং তা বিরাণ করতে চেষ্টা করে? তাদের তো উচিৎ ছিল ভীত হয়ে তাতে প্রবেশ করা।১৫৩ তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা আর আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব।
১৫৩. ইবাদাতগৃহগুলো কখনো যালেম (অধিকার হরণকারী)-দের কর্তৃত্ব ও পরিচালনাধীনে থাকতে পারে না। বরং ঐ বিশেষ দীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও শাসন-কর্তৃত্বে থাকতে হবে এমন সব লোক, যারা মহান আল্লাহকে ভয় করে এবং সর্বোতভাবে তাঁর প্রতি অনুগত। তাহলে দুষ্কৃতিকারীরা সেখানে উপস্থিত হলেও দুষ্কর্ম করার সাহস পাবে না। কারণ তারা জানবে, সেখানে গিয়ে কোনো যুলুমের কাজ করলে তাদের শাস্তি পেতে হবে।
মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অপর স্থানে বলেন: “মুশরিকদের অধিকার নেই যে, তারা আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করবে, নিজদের উপর কুফুরীর সাক্ষ্য দেওয়া অবস্থায়। এদেরই আমলসমূহ বরবাদ হয়েছে এবং আগুনেই তারা স্থায়ী হবে।” (দেখুন: সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১৭-১৮)
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡمَشۡرِقُ وَٱلۡمَغۡرِبُۚ فَأَيۡنَمَا تُوَلُّواْ فَثَمَّ وَجۡهُ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ١١٥ ﴾ [ البقرة : ١١٥ ]
১১৫. ১৫৪আর পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও, সে দিকেই আল্লাহর চেহারা।১৫৫ নিশ্চয় আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।১৫৬
১৫৪. এ আয়াতটি ‘কিবলা পরিবর্তন’ তথা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে বায়তুল্লাহ (কা‘বা শরীফ)-এর দিকে কিবলা পরিবর্তনের পর অবতীর্ণ হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিযরতের ১৬/১৭ মাস পর এই নির্দেশ দেওয়া হয় এভাবে:
(আকাশের দিকে বার বার তোমার মুখ ফিরানো আমি অবশ্যই দেখছি। অতএব, আমরা অবশ্যই তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরাব, যা তুমি পছন্দ কর। সুতরাং তোমরা চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকেই তোমাদের চেহারা ফিরাও। আর নিশ্চয় যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা অবশ্যই জানে যে, তা তাদের রবের পক্ষ থেক সত্য এবং তারা যা করে, সে ব্যাপারে আল্লাহ গাফিল নন।) (দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৪)
কিবলা পরিবর্তনের এ ব্যাপারটিকে নিয়ে বিরোধী-অবিশ্বাসীরা যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছিল, তার জবাবে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আরো জানতে দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪২, ১৪৫; সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭; সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৯৭)
১৫৫. অর্থাৎ মহান আল্লাহ সব দিক ও স্থানের মালিক। কাজেই তাঁর নির্দেশ মতো যে কোনো দিকে মুখ করে ইবাদাত করলে তাঁর উদ্দেশেই ইবাদত সমর্পিত হবে।
১৫৬. অর্থাৎ মহান আল্লাহ সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত, তিনি অসীম, অনন্ত। কোনো কোনো বিভ্রান্ত মানুষ তাঁকে নিজেদের মতো ভেবে থাকতে পারে! কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহর কর্তৃত্ব বিশাল ও বিস্তৃত এবং তাঁর অনুগ্রহ দানের ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক। তাঁর কোনো বান্দা কোথায় কোন সময় কি উদ্দেশ্যে তাঁকে স্মরণ করছে, তা তিনি সার্বক্ষণিকভাবে জানেন।
﴿وَقَالُواْ ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ وَلَدٗاۗ سُبۡحَٰنَهُۥۖ بَل لَّهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ كُلّٞ لَّهُۥ قَٰنِتُونَ ١١٦ ﴾ [ البقرة : ١١٦ ]
১১৬. আর তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র মহান; ১৫৭ বরং আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তা তাঁরই। সব তাঁরই অনুগত।
১৫৭. আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন: মানুষ আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, অথচ তাদের জন্য এটা উচিৎ নয়। আর মানুষ আমাকে গালি দেয়, অথচ এটা তার জন্য উচিৎ নয়। তাদের আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হলো, তারা বলে, আমি তাদেরকে (মৃত্যুর পরে) জীবিত করে আগের মতো করতে সক্ষম নই। আর তাদের আমাকে গালি দেওয়া হলো, তারা বলে যে, আমার পুত্র আছে। অথচ স্ত্রী বা সন্তান রাখার মতো বিষয় থেকে আমি পবিত্র। (দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৪১২৪)
﴿بَدِيعُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ وَإِذَا قَضَىٰٓ أَمۡرٗا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ١١٧ ﴾ [ البقرة : ١١٧ ]
১১৭. তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। আর যখন তিনি কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন কেবল বলেন ‘হও’ ফলে তা হয়ে যায়।
﴿وَقَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ لَوۡلَا يُكَلِّمُنَا ٱللَّهُ أَوۡ تَأۡتِينَآ ءَايَةٞۗ كَذَٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِم مِّثۡلَ قَوۡلِهِمۡۘ تَشَٰبَهَتۡ قُلُوبُهُمۡۗ قَدۡ بَيَّنَّا ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ١١٨ ﴾ [ البقرة : ١١٨ ]
১১৮. আর যারা জানে না, তারা বলে, ‘কেন আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কিংবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আসে না’?১৫৮ এভাবেই, যারা তাদের পূর্বে ছিল তারা তাদের কথার মতো কথা বলেছে।১৫৯ তাদের অন্তরসমূহ একই রকম হয়ে গিয়েছে। আমরা তো আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে দিয়েছি এমন কাওমের জন্য, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।১৬০
১৫৮. এখানে পথভ্রষ্টদের দুটি অভিযোগ:
ক. আল্লাহ নিজে এসে তাদের সাথে কথা বলেন না কেন?
খ. তাদের কাছে কোনো নিদর্শন (sign) আসে না কেন?
১৫৯. অর্থাৎ আজকের পথভ্রষ্টরা কোনো নতুন অভিযোগ বা দাবি উত্থাপন করে নি, যা এর আগের বিরোধীরা করেনি। প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পথভ্রষ্টতার স্বরূপ ও প্রকৃতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বার বার একই ধরনের সংশয়, সন্দেহ, অভিযোগ, দাবি ও প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিই তারা করে চলছে।
১৬০. প্রথম অভিযোগটি এতো বেশি অর্থহীন যে, তার জবাব দেওয়া অপ্রয়োজনীয়। এখানে শুধু দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাবে বলা হয়েছে, নিদর্শন তো রয়েছে অগণিত, কিন্তু যে মানতেই চায় না, প্রকৃতিগত বক্রতা যাকে গ্রাস করে নিয়েছে, পরম সত্যের প্রতি বিশ্বাস করাকে যে সযত্নে পাশ কাটিয়ে যেতে সদা তৎপর, তারই মুখে একথা মানায়!
﴿إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۖ وَلَا تُسَۡٔلُ عَنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلۡجَحِيمِ ١١٩ ﴾ [ البقرة : ١١٩ ]
১১৯. নিশ্চয় আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি সত্যসহ, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে১৬১ এবং তোমাকে আগুনের অধিবাসীদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না।১৬২
১৬১. অর্থাৎ অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে এক অন্যতম ও উজ্জ্বল প্রতীক হচ্ছেন স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর জীবন ও তাঁর ব্যক্তিত্ব। যে দেশ ও জাতিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল তার তৎকালীন অবস্থা, যেভাবে তিনি প্রতিপালিত হন, তাঁর ৪০ বছরের নবুয়তপূর্ব জীবনযাপন এবং নবী হবার পরে তিনি যে মহান, বিষ্ময়কর ও যুগান্তকারী কার্যাবলি সম্পাদন করেন, এসব কিছুই মানুষের জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন।
১৬২. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনের অপর স্থানে আরো বলেন:
﴿وَلَن تَرۡضَىٰ عَنكَ ٱلۡيَهُودُ وَلَا ٱلنَّصَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمۡۗ قُلۡ إِنَّ هُدَى ٱللَّهِ هُوَ ٱلۡهُدَىٰۗ وَلَئِنِ ٱتَّبَعۡتَ أَهۡوَآءَهُم بَعۡدَ ٱلَّذِي جَآءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ مَا لَكَ مِنَ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٢٠ ﴾ [ البقرة : ١٢٠ ]
১২০. আর ইয়াহূদী ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর।১৬৩ বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত’ আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তার পর, তাহলে আল্লাহর বিপরীতে তোমার কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না।
১৬৩. তাদের অসন্তুষ্টির কারণ এ নয় যে, ইয়াহূদী ও খৃষ্টানরা যথার্থই সত্যসন্ধানী, অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত সত্যকে তাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারেন নি! বরং তাঁর প্রতি তাদের অসন্তুষ্টি এজন্য যে, তারা তাদের ধর্মকে ইচ্ছেমত বিকৃতির মাধ্যমে মুনাফেকী করে যেভাবে লাভবান হয়ে আসছিল; যেভাবে ছল-চাতুরী, প্রতারণা এবং অন্তঃসারশূন্য স্বেচ্ছাচারী প্রদর্শনীমূলক কর্মকাণ্ডকে ধর্ম হিসেবে চালিয়ে আসছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের সে ভ্রষ্টতাগুলোকে উন্মোচন করেন, যাতে তাদের ভীষণ স্বার্থহানী ঘটে এবং তাদেরকে সর্বশেষ আসমানী কিতাব তথা আল-কুরআনের অনুসারী হবার আহ্বান জানান, যার সবই তাদের জন্য ছিল চরম অসহনীয়।
﴿ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ يُؤۡمِنُونَ بِهِۦۗ وَمَن يَكۡفُرۡ بِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ١٢١ ﴾ [ البقرة : ١٢١ ]
১২১. যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তারাই তার প্রতি ঈমান আনে।১৬৪ আর যে তা অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
১৬৪. এখানে আহলে কিতাবদের অন্তর্গত কিছু সৎলোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা সততা ও দায়িত্বশীলতার সাথে আল্লাহর কিতাব পড়ে। তাই আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে যা সত্য তাকেই তারা সঠিক বলে মেনে নেয়।
﴿يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَنِّي فَضَّلۡتُكُمۡ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٢٢ ﴾ [ البقرة : ١٢٢ ]
১২২. হে বনী ইসরাঈল,১৬৫ তোমরা আমার নি‘আমতকে স্মরণ কর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। আর নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি সৃষ্টিকুলের ওপর।
১৬৫. বিগত ৫৬-১২১ আয়াতমালায় মহান আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে তাদের ঐতিহাসিক অপরাধসমূহ এবং আল-কুরআন নাযিল হবার সময়ে তাদের যে অবস্থা ছিল, তা পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করেছেন। এখান থেকে আরেকটি ধারাবাহিক বক্তব্য শুরু হচ্ছে, যা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে:
এক. নূহ আলাইহিস সালামের পরে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম প্রথম নবী ছিলেন। মহান আল্লাহ তাকে ইসলামের শাশ্বত আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রথমে তিনি নিজে স্বশরীরে ইরাক থেকে মিশর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তীন থেকে নিয়ে আরবের মরু অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত বছরের পর বছর সফর করে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের তথা ইসলামের দিকে আহবান করতে থাকেন। এরপর এ মিশন সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। পূর্ব জর্দানে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র লূত আলাইহিস সালামকে নিযুক্ত করেন। সিরিয়া ও ফিলিস্তীনে নিযুক্ত করেন নিজের পুত্র ইসহাক আলাইহিস সালামকে এবং আরবের অভ্যন্তরে নিযুক্ত করেন নিজের বড় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে। তারপর মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় কাবাগৃহ নির্মাণ করেন এবং আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী এটিকেই এই মিশনের কেন্দ্র গণ্য করেন।
দুই. ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধারা দুটি বড় বড় শাখায় বিভক্ত হয়। একটি হলো ইসমাঈল আলাইহিস সালামের সন্তান-সন্ততিবর্গ। তাঁরা আরবে বসবাস করতেন। কুরাইশ ও আরবের আরো কতিপয় গোত্র এ ধারারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর যেসব আরব গোত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধারাভুক্ত ছিল না তারাও তাঁর প্রচারিত ধর্মে কমবেশী প্রভাবিত ছিল বলে তাঁর সাথেই নিজেদের সম্পর্ক জুড়তো।
দ্বিতীয় শাখাটি ইসহাক আলাইহিস সালামের সন্তানবর্গের। এই শাখায় ইয়াকুব আলাইহিস সালাম, ইউসুফ আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম, দাউদ আলাইহিস সালাম, সুলাইমান আলাইহিস সালাম, ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম প্রমুখ অসংখ্য নবী জন্মগ্রহণ করেন। ইতিঃপূর্বেই আমরা জেনেছি, যেহেতু ইয়াকুব আলাইহিস সালামের আরেক নাম ছিল ‘ইসরাঈল’, তাই তাঁর বংশ ‘বনী ইসরাঈল (ইসরাঈল প্রজন্ম)’ নামে পরিচিত হয়।
তিন. ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রধান কাজ ছিল তাওহীদী আদর্শের গোড়াপত্তন করা। তাওহীদাশ্রিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা যারা একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদত চর্চার পাশাপাশি অন্যদেরকেও আল্লাহপ্রদত্ত দীন ও আদর্শের প্রতি আহ্বান করবে। এই মহান ও বিরাট কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতেই তাঁকে তাওহীদী জনতার পিতা হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়। তারপর তাঁর বংশধারা থেকে যে শাখাটি বের হয়ে ইসহাক আলাইহিস সালাম ও ইয়াকুব আলাইহিস সালামের নামে অগ্রসর হয়ে ‘বনী ইসরাঈল’ নাম ধারণ করে সেই শাখাটি তাঁর এ দায়িত্বের উত্তরাধিকার লাভ করে। এই শাখায় নবীদের জন্ম হতে থাকে এবং তাঁদেরকে সত্য-সঠিক পথের জ্ঞানদান করা হয়। বিশ্বের জাতিসমূহকে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার উদ্দেশে বনী ইসরাইলকে গঠন করার কার্যক্রম চালু থাকে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো বনী ইসরাঈলের লোকেরা নিজেরাই তাওহীদ ও তাওহীদী আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলের সাথে তার অঙ্গীকার কর্তন করেন। এবং বনী ইসমাঈল (ইসমাঈল বংশধারায়) এ দায়িত্ব অর্পন করেন। তাওহীদ চর্চা ও বিশ্বময় তাওহীদী আদর্শ প্রচারের জন্য যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন বনী ইসমাঈলকে আরবের বিরান ভূমিতে রেখে সেসব যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা ব্যবস্থা করেন।
নিচের আয়াতগুলোতে ইবরাহীম আলাইসি সালামের তাওহীদ চর্চা, তাওহীদ প্রচার এবং খানায় কাবা পূনঃনির্মাণ, পূনঃনির্মাণের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
﴿وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا تَنفَعُهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ١٢٣ ﴾ [ البقرة : ١٢٣ ]
১২৩. আর তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না এবং কোনো ব্যক্তি থেকে বিনিময় গ্রহণ করা হবে না আর কোন সুপারিশ তার উপকারে আসবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।
﴿وَإِذِ ٱبۡتَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِۧمَ رَبُّهُۥ بِكَلِمَٰتٖ فَأَتَمَّهُنَّۖ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامٗاۖ قَالَ وَمِن ذُرِّيَّتِيۖ قَالَ لَا يَنَالُ عَهۡدِي ٱلظَّٰلِمِينَ ١٢٤ ﴾ [ البقرة : ١٢٤ ]
১২৪. আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন,১৬৬ অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের জন্য নেতা বানাব’। সে বলল, ‘আমার বংশধরদের থেকেও’? তিনি বললেন, ‘যালিমরা আমার ওয়াদাপ্রাপ্ত হয় না’।১৬৭
১৬৬. যেসব কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁকে বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করার যোগ্য প্রমাণিত করেছিলেন কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সত্যের আলো তাঁর সামনে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সমগ্র জীবন ছিল কুরবানী আর ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। দুনিয়ার যা কিছুকে মানুষ ভালোবাসতে পারে, এমন প্রতিটি বস্তুকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মহান আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সত্যের জন্য কুরবানী করেছিলেন। দুনিয়ার যে সব বিপদকে মানুষ ভয় করে, সত্যের খাতিরে তার প্রত্যেকটিকে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন।
১৬৭. অর্থাৎ এ অঙ্গীকারটি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তানদের কেবলমাত্র সেই অংশটির সাথে সম্পর্কিত যারা সদাচারী, সত্যনিষ্ঠ ও সৎকর্মশীল। তাদের মধ্য থেকে যারা যালিম (অধিকার হরণকারী ও সীমালঙ্ঘনকারী), তাদের জন্য এ অঙ্গীকার নয়। এ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, পথভ্রষ্ট ইয়াহূদীরা ও মুশরিক বনী ইসরাঈলরা এ অঙ্গীকারের আওতায় পড়ে না।
﴿وَإِذۡ جَعَلۡنَا ٱلۡبَيۡتَ مَثَابَةٗ لِّلنَّاسِ وَأَمۡنٗا وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِۧمَ مُصَلّٗىۖ وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ ١٢٥ ﴾ [ البقرة : ١٢٥ ]
১২৫. আর স্মরণ কর, যখন আমরা কা‘বাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম১৬৮ এবং (আদেশ দিলাম যে,) ‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর’।১৬৯ আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকূকারী-সাজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’।১৭০
১৬৯. মাকামে ইবরাহীম সে-ই জান্নাতী পাথর, যার উপর দাঁড়িয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাবা ঘর নির্মাণ করেছিলেন। জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের এক পর্যায়ে তিনি বলেন: যখন মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফ শেষ করেন, তখন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: এটা কি আমাদের পিতার (হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের) মাকাম? তিনি জবাবে বলেন: হ্যাঁ। তারপর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবার জিজ্ঞেস করেন: আমরা কি এখানে সালাত পড়বো না? তখন আল-কুরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয়:
﴿ وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِۧمَ مُصَلّٗىۖ﴾ [ البقرة : ١٢٥ ]
“তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানিয়ে নাও।”
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি তিন বিষয়ে আমার রবের সাথে কিংবা আমার রব তিন বিষয়ে আমার সাথে একমত হয়েছেন। এর একটি হচ্ছে, আমি বললাম: ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি যদি মাকামে ইবরাহীমে সালাত পড়তেন’! তখন ঐ আয়াতটি নাযিল হয় যে, তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানিয়ে নাও। এটি একটি বড় হাদীসের অংশ বিশেষ। (দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৪১২৫)
১৭০. পাক-পবিত্র রাখার অর্থ শুধু ময়লা-আবর্জনা থেকে পরিষ্কার রাখা নয়। আল্লাহর ঘরের আসল পবিত্রতা হলো, সেখানে আল্লাহর ছাড়া আর কারোর নাম উচ্চারিত হবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরে বসে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মালিক, প্রভু, মা‘বুদ, অভাবপূরণকারী বা ফরিয়াদ শ্রবণকারী হিসেবে ডাকে, সে আসলে তাকে নাপাক ও অপবিত্রই করে দেয়।
﴿وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِۧمُ رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا بَلَدًا ءَامِنٗا وَٱرۡزُقۡ أَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ مَنۡ ءَامَنَ مِنۡهُم بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ قَالَ وَمَن كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُۥ قَلِيلٗا ثُمَّ أَضۡطَرُّهُۥٓ إِلَىٰ عَذَابِ ٱلنَّارِۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ١٢٦ ﴾ [ البقرة : ١٢٦ ]
১২৬. আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলল, ‘হে আমার রব, আপনি একে নিরাপদ নগরী বানান এবং এর অধিবাসীদেরকে ফল-মুলের রিয্ক দিন১৭১ যারা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসে ঈমান এনেছে’। তিনি বললেন, ‘যে কুফুরী করবে, তাকে আমি স্বল্প ভোগোপকরণ দিব।১৭২ অতঃপর তাকে আগুনের আযাবে প্রবেশ করতে বাধ্য করব। আর তা কত মন্দ পরিণতি’।
১৭১. পবিত্র সেই নগরীতে শান্তি, নিরাপত্তা ও আহার্য নিশ্চিত করে মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অন্যত্র বলেন:
১৭২. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন মানবজাতির নেতৃত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ তালাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জবাবে তাকে বলা হয়েছিল, তার সন্তানদের মধ্য থেকে একমাত্র মুমিন ও সত্যনিষ্ঠরাই এ পদের অধিকারী হবে, যালিমদের এ অধিকার নেই। এখানে তিনি যখন রিযিকের জন্য প্রার্থনা করলেন, তখন আগের ফরমানটিকে সামনে রেখে কেবলমাত্র নিজের মুমিন সন্তান ও বংশধরদের জন্য দোয়া করলেন। কিন্তু এখানে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিলেন, সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব এক কথা, আর রিযিক ও আহার্য দান ভিন্ন বিষয় যা এই দুনিয়ায় মু'মিন ও কাফির নির্বিশেষে সবাইকে দেওয়া হবে। এ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, কারোর অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য দেখে এ ধারণার কারণ নেই যে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট আছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সে-ই নেতৃত্ব লাভের অধিকারী।
﴿وَإِذۡ يَرۡفَعُ إِبۡرَٰهِۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَيۡتِ وَإِسۡمَٰعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ١٢٧ ﴾ [ البقرة : ١٢٧ ]
১২৭. স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবার ভিতগুলো উঠাচ্ছিল (এবং বলছিল,) হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবূল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।
﴿رَبَّنَا وَٱجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةٗ مُّسۡلِمَةٗ لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبۡ عَلَيۡنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٢٨ ﴾ [ البقرة : ١٢٨ ]
১২৮. হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে আপনার অনুগত কাওম বানান।১৭৩ আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদাতের বিধি-বিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
১৭৩. সন্তান-সন্ততির প্রতি মায়া-মমতা শুধুমাত্র স্বভাবগত ও সহজাত প্রবৃত্তিই না; বরং তা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশও বটে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সন্তানদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন, আর এভাবে প্রার্থনা করার জন্য তিনি মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছিলেন। আল-কুরআনের অপর স্থানে তিনি দো‘আ করেন এভাবে:
﴿رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِيۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلۡ دُعَآءِ ٤٠ ﴾ [ ابراهيم : ٤٠ ]
“হে আমার রব! আমাকে সালাত কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা! আমার দো‘আ কবুল করুন”। (দেখুন: সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪০)
﴿رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيهِمۡۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٢٩ ﴾ [ البقرة : ١٢٩ ]
১২৯. হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে১৭৪ এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত১৭৫ শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে।১৭৬ নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।১৭৭
১৭৪. তিলাওয়াতের মূল অর্থ অনুসরণ করা। শব্দটি কুরআন মাজীদ ও অন্যান্য আসমানী কিতাব পাঠ করার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে। মানবরচিত কোনো গ্রন্থ পাঠে এ শব্দটি প্রয়োগ করা হয় নি। তাই আল্লাহর কিতাব অনুধাবন-অনুসরণের উদ্দেশ্য ছাড়া শুধু আবৃত্তি করলে তিলাওয়াতের হক আদায় হয় না।
১৭৫. এখানে ‘কিতাব’ বলতে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ কিতাবকে বুঝানো হয়েছে। আর ‘হিকমাহ’ শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি। পরিভাষাটি আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হলে অর্থ দাঁড়ায় বাস্তব ও অনস্তিত্বের সব বস্তুর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান এবং অসীম ও সুদৃঢ় উদ্ভাবনী শক্তি। আর অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় বিদ্যমান সব বস্তুর বিশুদ্ধ জ্ঞান এবং সৎকর্ম, ন্যায় ও সুবিচার, সত্য কথা ইত্যাদি। আল-কুরআনে হিকমাহ বলে সুন্নাহকেও বুঝানো হয়ে থাকে।
১৭৬. পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করার অর্থ জীবনকে সত্য, সঠিক ও পরিচ্ছন্ন মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, চরিত্র-নৈতিকতা, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সামগ্রিকভাবে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে সুসজ্জিত করে গড়ে তোলা।
১৭৭. এখানে একথা বুঝানোই উদ্দেশ্য যে, মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব আসলে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ঐ দো‘আর প্রতু্ত্তর!
﴿وَمَن يَرۡغَبُ عَن مِّلَّةِ إِبۡرَٰهِۧمَ إِلَّا مَن سَفِهَ نَفۡسَهُۥۚ وَلَقَدِ ٱصۡطَفَيۡنَٰهُ فِي ٱلدُّنۡيَاۖ وَإِنَّهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ لَمِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ١٣٠ ﴾ [ البقرة : ١٣٠ ]
১৩০. আর যে নিজকে নির্বোধ বানিয়েছে, সে ছাড়া কে ইবরাহীমের আদর্শ থেকে বিমুখ হতে পারে? আর অবশ্যই আমরা তাকে দুনিয়াতে বেছে নিয়েছি এবং নিশ্চয় সে আখিরাতে নেককারদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
﴿إِذۡ قَالَ لَهُۥ رَبُّهُۥٓ أَسۡلِمۡۖ قَالَ أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٣١ ﴾ [ البقرة : ١٣١ ]
১৩১. যখন তার রব তাকে বললেন, তুমি আত্মসমর্পণ কর।১৭৮ সে বলল, 'আমি সকল সৃষ্টির রবের কাছে নিজকে সমর্পণ করলাম।
১৭৮. যে আল্লাহর অনুগত হয়, আল্লাহকে নিজের মালিক, প্রভু ও মা‘বুদ হিসেবে গ্রহণ করে, নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেয় এবং দুনিয়ায় তাঁর দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করে, সে-ই মুসলিম। এই বিশ্বাস, প্রত্যয়, দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মপদ্ধতির নাম ‘ইসলাম’। মানব জাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ও জাতিতে যেসব নবী ও রাসূল এসেছেন, এটিই ছিল তাঁদের সবার এক ও অভিন্ন দীন, জীবন পদ্ধতি, আহবান ও মিশন।
﴿وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ يَٰبَنِيَّ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٣٢ ﴾ [ البقرة : ١٣٢ ]
১৩২. আর এরই উপদেশ দিয়েছে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়াকূবও১৭৯ (যে,) হে আমার সন্তানেরা, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দীনকে চয়ন করেছেন।১৮০ সুতরাং তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মারা যেয়ো না।
১৭৯. বনী ইসরাঈল (ইসরাঈল প্রজন্ম) সরাসরি হযরত ইয়াকূব আলাইহিস সালামের বংশধর হবার কারণে বিশেষভাবে তার নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮০. ‘দীন’ বিশ্বাস ও আচরণের কিছু মৌলনীতি যার পরিধি ইহলৌকিক জীবনের পুরো অঞ্চল জুড়ে সুবিস্তৃত। দীন আলাদাভাবে উল্লেখ থাকলে দীন ও শরী‘আহ উভয়টাকেই বুঝাবে। আর দীন ও শরিয়া একত্রে উল্লিখিত হলে, দীনের অর্থ হবে মৌলিক বিশ্বাস ও ইবাদত যা সকল তাওহীদী উম্মতকেই পালন করতে হতো। আর শরী‘আহর অর্থ হবে বিধানমালা যা জাতি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হতো।
﴿أَمۡ كُنتُمۡ شُهَدَآءَ إِذۡ حَضَرَ يَعۡقُوبَ ٱلۡمَوۡتُ إِذۡ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعۡبُدُونَ مِنۢ بَعۡدِيۖ قَالُواْ نَعۡبُدُ إِلَٰهَكَ وَإِلَٰهَ ءَابَآئِكَ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗا وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٣ ﴾ [ البقرة : ١٣٣ ]
১৩৩. নাকি তোমরা সাক্ষী ছিলে, যখন ইয়াকূবের নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়েছিল? যখন সে তার সন্তানদেরকে বলল, আমার পর তোমরা কার ইবাদাত করবে? তারা বলল, আমরা ইবাদাত করব আপনার ইলাহের, আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহের, যিনি এক ইলাহ। আর আমরা তাঁরই অনুগত।
﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسَۡٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٣٤ ﴾ [ البقرة : ١٣٤ ]
১৩৪. সেটা এমন এক উম্মত যা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের জন্যই, আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্যই। আর তারা যা করত সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না।
﴿وَقَالُواْ كُونُواْ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰ تَهۡتَدُواْۗ قُلۡ بَلۡ مِلَّةَ إِبۡرَٰهِۧمَ حَنِيفٗاۖ وَمَا كَانَ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٣٥ ﴾ [ البقرة : ١٣٥ ]
১৩৫. আর তারা বলে, তোমরা ইয়াহূদী কিংবা নাসারা হয়ে যাও, হিদায়াত পেয়ে যাবে। বল, বরং আমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করি, যে একনিষ্ঠ ছিল এবং যে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।১৮১
১৮১. এই জবাবটির মর্মার্থ বুঝতে দু’টি বিষয় সামনে রাখা দরকার:
এক. খৃষ্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ শতকে ইয়াহূদীবাদ আর ঈসা আলাইহিস সালামের সময়কালের বেশ কিছুকাল পরে খৃষ্টবাদের অভ্যুদয় ঘটে। তাই প্রশ্ন জাগে, ইয়াহূদী বা খৃষ্টবাদ গ্রহণ করাই যদি সঠিকপথ লাভের ভিত্তি হয়, তাহলে এর শত শত বছর আগে জন্মগ্রহণকারী ইবরাহীম আলাইহিস সালামসহ অন্যান্য নবীগণ ও সৎব্যক্তিবর্গ, যাঁদেরকে এরাই সৎপথপ্রাপ্ত বলে স্বীকার করে, তাঁরা সৎপথপ্রাপ্ত হলেন কিভাবে? আসল কথা হলো, বিশ্বব্যাপী যুগে যুগে প্রয়োজন অনুযায়ী মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবী-রাসূলদের মাধ্যমেই মানুষ বিশ্বাস ও দিক-নির্দেশনার অভিন্ন উপাদানের ভিত্তিতে চিরন্তন, শাশ্বত ও সহজ-সত্য পথের সন্ধান লাভ করেছে।
দুই. ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থগুলোই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত-বন্দেগী, উপাসনা-আরাধনা, প্রশংসা ও আনুগত্য না করার সাক্ষ্য দেয়। মহান আল্লাহর গুণ-বৈশিষ্ট্যের সাথে আর কাউকে শরীক না করাই ছিল তাঁর মিশন। কাজেই সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে চিরন্তন সত্য-সরল একত্ববাদী পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, ইয়াহূদী ও খৃষ্টবাদ তা থেকে সুস্পষ্টভাবে বিচ্যুত হয়েছে। কারণ তাদের উভয়ের মধ্যে ঘটেছে শির্কের প্রকাশ্য মিশ্রণ।
﴿قُولُوٓاْ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيۡنَا وَمَآ أُنزِلَ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَمَآ أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَآ أُوتِيَ ٱلنَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمۡ لَا نُفَرِّقُ بَيۡنَ أَحَدٖ مِّنۡهُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٦ ﴾ [ البقرة : ١٣٦ ]
১৩৬. তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের ওপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের ওপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে নবীগণকে। আমরা তাদের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তাঁরই অনুগত’।১৮২
১৮২. নবীদের মধ্যে পার্থক্য না করার অর্থ হচ্ছে, তাঁদের কেউ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন আর কেউ তার উপর কায়েম ছিলেন না অথবা কাউকে মানি আর কাউকে মানি না আমরা তাদের মধ্যে এভাবে পার্থক্য করি না। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সব নবীই যুগে যুগে একই চিরন্তন সত্য ও একই সরল-সোজা পথের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। কাজেই যথার্থ সত্যপ্রিয় কারো পক্ষে সব নবীকে সত্যপন্থী ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক। যিনি এক নবীকে মানেন আর অন্য নবীকে করেন অস্বীকার, তিনি আসলে যে নবীকে মানেন তাঁরও অনুগামী নন। কারণ মূসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীগণ যে বিশ্বব্যাপী চিরন্তন সহজ-সত্য পথ দেখিয়েছিলেন তিনি আসলে তার সন্ধান পান নি, বরং তিনি নিছক বাপ-দাদার অনুসরণ করে নিজের পছন্দমত একজন নবীকে মানছেন। তার আসল ধর্ম হয়ে পড়ছে বর্ণবাদ, বংশবাদ অথবা কোনো ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ সংক্রমিত এবং বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ, কোনো নবীর অনুগামিতা নয়।
﴿فَإِنۡ ءَامَنُواْ بِمِثۡلِ مَآ ءَامَنتُم بِهِۦ فَقَدِ ٱهۡتَدَواْۖ وَّإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّمَا هُمۡ فِي شِقَاقٖۖ فَسَيَكۡفِيكَهُمُ ٱللَّهُۚ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ١٣٧﴾ [ البقرة : ١٣٧ ]
১৩৭. অতএব, যদি তারা ঈমান আনে, তোমরা যেরূপে তার প্রতি ঈমান এনেছ, তবে অবশ্যই তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে তারা রয়েছে কেবল বিরোধিতায়, তাই তাদের বিপক্ষে তোমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।১৮৩
১৮৩. মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অন্য এক আয়াতে বলেন:
﴿وَٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِأَعۡدَآئِكُمۡۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَلِيّٗا وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ نَصِيرٗا ٤٥ ﴾ [ النساء : ٤٥ ]
“আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের ভালো করেই জানেন এবং তোমাদের সাহায্য-সমর্থনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট”। (দেখুন: সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৫)
﴿صِبۡغَةَ ٱللَّهِ وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ صِبۡغَةٗۖ وَنَحۡنُ لَهُۥ عَٰبِدُونَ ١٣٨ ﴾ [ البقرة : ١٣٨ ]
১৩৮. (বল,) আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করলাম। ১৮৪ আর রং এর দিক দিয়ে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক সুন্দর? আর আমরা তাঁরই ইবাদাতকারী।
১৮৪. صِبْغَةً ‘সিবগাহ’ শব্দের অর্থ রং বা বর্ণ, colour, dye, stain; পারিভাষিক অর্থে ‘যা ধারণ করা হয়’ বা ‘ধর্ম’ অথবা ‘দীন’ অর্থাৎ religion, creed, doctrine, belief আয়াতটির অর্থ হবে আমরা আল্লহর দীন ইসলামকে ধারণ করলাম।
খ্রিষ্টানদের মধ্যে একটি বিশেষ রীতির প্রচলন ছিল। কেউ তাদের ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে গোসল করানো হতো। আর এ গোসলের অর্থ ছিল, তার সব গুনাহ যেন ধুয়ে-মুছে গেলো এবং তার জীবন নতুন এক রং ধারণ করলো। তাদের কাছে এর পারিভাষিক নাম হচ্ছে ‘ইসতিবাগ’ বা ‘রঙ্গীন করা’ (ব্যাপটিজম: debut, launching or initiation)। তাদের ধর্মে যারা প্রবেশ করে কেবল তাদেরকেই ব্যাপটাইজড বা খৃষ্ট ধর্মে রঞ্জিত বলে ধারণা করা হয়। এমনকি খৃষ্টানদের শিশুদেরকেও ব্যাপটাইজড করা হয়।
এ ব্যাপারেই আল-কুরআন বলছে, এ লোকাচারমূলক ‘রঞ্জিত’ হবার যৌক্তিকতা কোথায়? বরং মহান আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গীন হও। যা কোনো পানি দিয়ে হওয়া যায় না; বরং তাঁর বন্দেগীর পথ অবলম্বন করেই এ রঙ্গে রঙ্গীন হওয়া যায়।
﴿قُلۡ أَتُحَآجُّونَنَا فِي ٱللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمۡ وَلَنَآ أَعۡمَٰلُنَا وَلَكُمۡ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُخۡلِصُونَ ١٣٩ ﴾ [ البقرة : ١٣٩ ]
১৩৯. বল, তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করছ অথচ তিনি আমাদের রব ও তোমাদের রব?১৮৫ আর আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের আমলসমূহ এবং তোমাদের জন্য রয়েছে তোমাদের আমলসমূহ এবং আমরা তাঁর জন্যই একনিষ্ঠ।১৮৬
১৮৫. ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের পক্ষ থেকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে মুমিনদের সাথে বিবাদ করার কিছু নেই। বরং বিতর্ক যদি করারই থাকে তবে তা হতে পারে মুমিনদের তরফ থেকেই, কেননা তারাই তো মহান আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে ইবাদাতের যোগ্য বানিয়ে নিয়েছে, মুমিনেরা নয়!
১৮৬. অর্থাৎ বিরোধীতাকারীদের কাজের জন্য তারা দায়ী, আর মুমিনদের কাজের জন্য মুমিনরা দায়বদ্ধ। তারা যদি তাদের বন্দেগীকে বিভক্ত করে থাকে এবং অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করে আরাধনা-উপাসনা ও আনুগত্য করে, তাহলে সে ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরিণাম তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। মুমিনরা বলপূর্বক তাদেরকে ঐ কাজ থেকে বিরত রাখতে চায় না। তবে তাঁরা নিজেদের বন্দেগী, আনুগত্য ও উপাসনা-আরাধনা সবকিছুই একমাত্র আল্লাহর জন্যই একমুখী হয়ে নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। যদি বিরোধীরা একথা স্বীকার করে নেয় যে, মুমিনদেরও এক আল্লাহর ইবাদাত করার ক্ষমতা ও অধিকার আছে, তাহলে তো সব বিবাদই মিটে যায়!
﴿أَمۡ تَقُولُونَ إِنَّ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطَ كَانُواْ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ قُلۡ ءَأَنتُمۡ أَعۡلَمُ أَمِ ٱللَّهُۗ وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن كَتَمَ شَهَٰدَةً عِندَهُۥ مِنَ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ١٤٠ ﴾ [ البقرة : ١٤٠ ]
১৪০. নাকি তোমরা বলছ, ‘নিশ্চয় ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানেরা ছিল ইয়াহূদী কিংবা নাসারা? বল, ‘তোমরা অধিক জ্ঞাত নাকি আল্লাহ’?১৮৭ আর তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে যে সাক্ষ্য রয়েছে তা গোপন করে?১৮৮ আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।
১৮৭. ইয়াহূদী ও খৃষ্টান জনতার মধ্যে যারা অজ্ঞতা ও মূর্খতাবশত মনে করত যে, এই বড় বড় মহান নবীদের সবাই ইয়াহূদী অথবা খৃষ্টান ছিলেন, তাদেরকে সম্বোধন করে এখানে একথা বলা হয়েছে।
১৮৮. এখানে সম্বোধন করা হয়েছে ইয়াহূদী ও খৃষ্টান আলেমদেরকে।
﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسَۡٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٤١ ﴾ [ البقرة : ١٤١ ]
১৪১. সেটা ছিল একটি উম্মত, যারা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে, তা তাদের জন্য আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্য। আর তারা যা করত, সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না।১৮৯
১৮৯. এ বক্তব্যটি এই সূরার ১৩৪ নং আয়াতের অনুরূপ।
সমাপ্ত
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই অভিশপ্ত শয়তান থেকে; পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে শুরু করছি।
﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ لَا تَعۡبُدُونَ إِلَّا ٱللَّهَ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَانٗا وَذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَقُولُواْ لِلنَّاسِ حُسۡنٗا وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ ثُمَّ تَوَلَّيۡتُمۡ إِلَّا قَلِيلٗا مِّنكُمۡ وَأَنتُم مُّعۡرِضُونَ ٨٣ ﴾ [ البقرة : ٨٣ ]
৮৩. আর স্মরণ কর, যখন আমরা বনী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করবে না, সদাচার করবে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে। আর মানুষকে উত্তম কথা বল,১০৮ সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক ছাড়া১০৯ তোমরা ফিরে গেলে। আর তোমরা (স্বীকার করে অতঃপর তা থেকে) বিমুখ হও।
১০৮. এখানে রয়েছে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে ইবাদাতের সকল অনুভূতি, তা বাস্তবায়ন করার তাগিদ, মাতা-পিতার প্রতি সদাচার, আত্মীয়-পরিজন, ইয়াতীম, অসহায়দের সাথে উত্তম ব্যবহার এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে সদাচার, নম্র ব্যবহার ও ভালো কথা বলার তাগিদ; তবে সদাচারের অজুহাতে কারও ক্ষেত্রেই দীনের ব্যাপারে ছাড় দেওয়া যাবে না। এমনকী কেউ ফিরআউন তুল্য হলেও বিনম্র ভাষায় দীনের আদর্শ প্রচারে সর্বাত্মক সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োগ করতে হবে তাকে বুঝাতে সকল পথ ও পদ্ধতি।
১০৯. এরা তাওরাতের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন এবং আল্লাহ তাদেরকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রেখেছিলেন।
﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ لَا تَسۡفِكُونَ دِمَآءَكُمۡ وَلَا تُخۡرِجُونَ أَنفُسَكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ ثُمَّ أَقۡرَرۡتُمۡ وَأَنتُمۡ تَشۡهَدُونَ ٨٤﴾ [ البقرة : ٨٤ ]
৮৪. আর যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা নিজদের রক্ত প্রবাহিত করবে না এবং নিজদেরকে তোমাদের গৃহসমূহ থেকে বের করবে না। অতঃপর তোমরা স্বীকার করে নিলে। আর তোমরা তার সাক্ষ্য প্রদান করছিলে।
১০০. মানব হত্যা আসমানী ধর্মে নিষিদ্ধ। বনী ইসরাঈলদের কাছ থেকেও আল্লাহ তা‘আলা মানব হত্যা না করার অঙ্গিকার নিয়েছিলেন। কেবল যুদ্ধের ময়দানে যতটুকু না হলেই নয় এবং শরী‘আতের বিধান মোতাবেক কিসাস ও হুদূদ বাস্তবায়নের জন্যই, সীমিত ক্ষেত্রে, রক্তপাতের বৈধতা রয়েছে।
﴿ثُمَّ أَنتُمۡ هَٰٓؤُلَآءِ تَقۡتُلُونَ أَنفُسَكُمۡ وَتُخۡرِجُونَ فَرِيقٗا مِّنكُم مِّن دِيَٰرِهِمۡ تَظَٰهَرُونَ عَلَيۡهِم بِٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِ وَإِن يَأۡتُوكُمۡ أُسَٰرَىٰ تُفَٰدُوهُمۡ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيۡكُمۡ إِخۡرَاجُهُمۡۚ أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥﴾ [ البقرة : ٨٥ ]
৮৫. অতঃপর তোমরাই তো তারা, যারা নিজদেরকে হত্যা করছ এবং তোমাদের মধ্য থেকে একটি দলকে তাদের গৃহ থেকে বের করে দিচ্ছ; পাপ ও সমীলঙ্ঘনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে সহায়তা করছ। আর তারা যদি বন্দী হয়ে তোমাদের নিকট আসে, তোমরা মুক্তিপণ দিয়ে তাদেরকে মুক্ত কর। অথচ তাদেরকে বের করা তোমাদের জন্য হারাম ছিল।১১০ তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? দুনিয়ার জীবনে। আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে।১১১ আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।
১১০. এ ব্যাপারটি বুঝতে একটু ধৈর্য্যের সাথে তৎকালীন প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নেওয়া দরকার। মদীনার আওস ও খাযরাজ নামে দু’টি গোত্র পরস্পর শত্রু ছিল, তাই তাদের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত। মদীনার উপকণ্ঠে বাস করত বনী কুরায়যা ও বনী নাযীর নামের দু’টি ইয়াহূদী গোত্র। বনী কুরায়যা ছিল আওস গোত্রের মিত্র; অপরদিকে খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল বনী নাযীর।
বনী কুরায়যার লোকদেরকে হত্যা ও বহিষ্কার করার পেছনে খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনী নাযীরের সক্রিয় ভূমিকা থাকত। অনুরূপভাবে বনী নাযীরকে হত্যা ও বহিষ্কারে ইন্ধন যোগাতো আওস গোত্রের মিত্র বনী কুরায়যা। তবে একটি ব্যাপারে উভয় ইয়াহূদী গোত্র ছিল এক ও অভিন্ন। তাহল, ইয়াহূদী গোত্রদ্বয়ের কেউ যদি অন্য গোত্রের কারো হাতে বন্দী হতো, তাহলে নিজ মিত্রদের অর্থে তাকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিত। কেউ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তারা বলত, বন্দী মুক্তকরণ আমাদের ওপর ওয়াজিব। আবার আরব গোত্রদ্বয়ের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তারা বলত, মিত্রদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকা লজ্জার ব্যাপার!
তাই এ-আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদের এ-দ্বিমুখী আচরণের নিন্দা করেছেন এবং খুলে দিয়েছেন তাদের ঘৃণ্য কূট-কৌশলের মুখোশ।
১১১. এ-হল সর্বকালের সর্বযুগের মানবগোষ্ঠির জন্যে আসমানী বিধান। অর্থাৎ যারা কিতাবের সুবিধাজনক অংশগুলোকে বিশ্বাস করে ও মানে, আর নিজেদের তথাকথিত দুনিয়াবী স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে ছল-চাতুরীর মাধ্যমে অথবা স্পষ্টভাবে অবিশ্বাস ও অমান্যে করে, তাদের পরিণতি হলো কঠিনতম আযাব যাতে তারা নিক্ষিপ্ত হবে।
﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا بِٱلۡأٓخِرَةِۖ فَلَا يُخَفَّفُ عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابُ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٨٦﴾ [ البقرة : ٨٦ ]
৮৬. তারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে খরিদ করেছে।১১২ সুতরাং তাদের থেকে আযাব হালকা করা হবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।
১১২. অথচ যা হওয়া উচিৎ, তা মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন এভাবে: নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। দেখুন: সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ১১১।
﴿وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ وَقَفَّيۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِۦ بِٱلرُّسُلِۖ وَءَاتَيۡنَا عِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَأَيَّدۡنَٰهُ بِرُوحِ ٱلۡقُدُسِۗ أَفَكُلَّمَا جَآءَكُمۡ رَسُولُۢ بِمَا لَا تَهۡوَىٰٓ أَنفُسُكُمُ ٱسۡتَكۡبَرۡتُمۡ فَفَرِيقٗا كَذَّبۡتُمۡ وَفَرِيقٗا تَقۡتُلُونَ ٨٧ ﴾ [ البقرة : ٨٧ ]
৮৭. আর আমরা নিশ্চয় মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ।১১৩ আর তাকে শক্তিশালী করেছি পবিত্র আত্মার১১৪ মাধ্যমে। তবে কি তোমাদের নিকট যখনই কোনো রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখন তোমরা অহঙ্কার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ।
১১৩. ‘সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী’র দ্বারা সেই উজ্জ্বল আলামত ও চিহ্নগুলোকে বুঝানো হয়েছে, যা দেখে প্রতিটি সত্যপ্রিয় ও সত্যানুসন্ধিৎসু মানুষ ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর নবী হিসেবে চিনতে পারে।
১১৪. ‘পবিত্র রূহ’ বলতে এখানে জিবরীল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে।
﴿وَقَالُواْ قُلُوبُنَا غُلۡفُۢ ۚ بَل لَّعَنَهُمُ ٱللَّهُ بِكُفۡرِهِمۡ فَقَلِيلٗا مَّا يُؤۡمِنُونَ ٨٨ ﴾ [ البقرة : ٨٨ ]
৮৮. আর তারা বলল, আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত; ১১৫ বরং তাদের কুফুরীর কারণে আল্লাহ তাদেরকে লা‘নত করেছেন। অতঃপর তারা খুব কমই ঈমান আনে।১১৬
১১৫. ইয়াহূদীরা বুঝাতে চায় যে, তাদের অন্তরগুলো দৃঢ় আচ্ছাদন দিয়ে সুরক্ষিত; তা পরিবর্তনের জন্যে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ -এমন কি আল্লাহর আয়াতসমূহের বক্তব্যের আলোকে চেষ্টা করলেও তাতে কোনো প্রভাব পড়ে না। এটি তাদের নিরেট একগুঁয়েমি, অজ্ঞতা, মুর্খতা ও বিদ্বেষপ্রসুত একধরণের হঠকারী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। বস্তুতঃ তারা তাদের কিতাবে উল্লিখিত পরবর্তী নবী আগমনের পূর্বাভাষ অনুযায়ী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সুস্পষ্টভাবে চিনতে পেরেও সচেতনভাবে তাঁকে অস্বীকার করেছে।
এছাড়া বর্তমান বিকৃত তাওরাত ও বাইবেলের কয়েকটি উদ্ধৃতি হুবহু এখানে তুলে দেওয়া হলো যেখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে:
প্রকৃত ও নকল নবী
১৮আমি ওদের জন্য ওদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার মতো এক নবীর উদ্ভব ঘটাব ও তার মুখে আমার বাণী রেখে দেব; আমি তাকে যা কিছু আজ্ঞা করব, তা সে তাদের বলবে।১৯ আর আমার নামে সে আমার যে সকল বাণী বলবে, সেই বাণীতে কেউ যদি কান না দেয়, তবে তার কাছে আমি জবাবদিহি চাইব।
তাওরাত: দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮, শ্লোক ১৮-১৯
××× ××× ××× ××× ××× ×××
বিদায় উপদেশ
সহায়ক পবিত্র আত্মার আগমন, শিষ্যদের আনন্দ
৫এখন কিন্তু আমি তাঁরই কাছে যাচ্ছি যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, অথচ তোমাদের কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করছে না, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? ৬কিন্তু এ সমস্ত তোমাদের বলেছি বিধায়ই তোমাদের মন দুঃখে ভরে গেছে। ৭তা সত্ত্বেও আমি তোমাদের সত্যকথা বলছি: আমার চলে যাওয়াটা তোমাদের পক্ষে ভালো। কারণ, আমি চলে না গেলে সেই সহায়ক তোমাদের কাছে আসবেন না; বরং যদি যাই, তাহলে আমি তাঁকে তোমাদের কাছে পাঠাব ৮আর তিনি এসে জগৎকে পাপের বিষয়ে দোষী বলে সাব্যস্ত করবেন, (এবং ব্যক্ত করবেন)
××× ××× ××× ××× ××× ×××
ধর্মময়তা ও বিচার কী।
১২তোমাদের কাছে আমার আরও অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু তোমরা এখন তা সহ্য করতে পার না। ১৩তবে তিনি যখন আসবেন, সেই সত্যময় আত্মা, তিনিই পূর্ণ সত্যের মধ্যে তোমাদের চালনা করবেন। কারণ, তিনি নিজে থেকে কিছুই বলবেন না; কিন্তু যে সমস্ত কথা শোনেন, তিনি তা-ই বলবেন; যা যা ঘটবার, তাও তিনি তোমাদের বলে দেবেন। ১৪তিনি আমাকে গৌরবান্বিত করবেন, কারণ যা আমার, তা-ই তুলে নিয়ে তিনি তা তোমাদের বলে দেবেন।
বাইবেল: যোহন-রচিত সুসমাচার, অধ্যায় ১৬, শ্লোক ৫-৮ এবং ১২-১৪
১১৬. অর্থাৎ ইয়াহূদীরা তাদের গর্ব-অহংকারের কারণে মনে করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য এমনই যে, তা কোনো জ্ঞানী লোকের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না; অথচ প্রকৃত ব্যাপার এর সম্পূর্ণ বিপরীত। নিঃসন্দেহে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থাপনা পুরোপুরি অহী-ভিত্তিক, অত্যন্ত সারগর্ভ ও হৃদয়গ্রাহী। কিন্তু তাদের কুফুরী ও হঠকারিতার ফলে মহান আল্লাহ তাদের অন্তরের উপর অভিশম্পাত বর্ষণ করেছেন, আর তাই কোনো যুক্তিপূর্ণ ও জ্ঞানময় কথা মনে-প্রাণে গ্রহণ করার কোনো যোগ্যতাই তাদের আর অবশিষ্ট নেই।
﴿وَلَمَّا جَآءَهُمۡ كِتَٰبٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ وَكَانُواْ مِن قَبۡلُ يَسۡتَفۡتِحُونَ عَلَى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَمَّا جَآءَهُم مَّا عَرَفُواْ كَفَرُواْ بِهِۦۚ فَلَعۡنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ ٨٩ ﴾ [ البقرة : ٨٩ ]
৮৯. আর যখন তাদের কাছে, তাদের সাথে যা আছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার সত্যায়নকারী১১৭ কিতাব আসলো, আর তারা (এর মাধ্যমে) পূর্বে কাফিরদের ওপর বিজয় কমনা করত।১১৮ সুতরাং যখন তাদের নিকট আসল যা তারা চিনত১১৯ তখন তারা তা অস্বীকার করল। অতএব, কাফিরদের ওপর আল্লাহর লা‘নত।
১১৭. কুরআন মাজীদকে তাওরাতের ‘মুসাদ্দিক’ বা সত্যায়নকারী এজন্য বলা হয়েছে যে, তাওরাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব এবং কুরআন নাযিল সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, কুরআনের মাধ্যমে সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। তাই তাওরাতকে যারা মানে, তারা কিছুতেই কুরআন অমান্যকারী হতে পারে না। কেননা কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে তাওরাতকে অমান্য করার নামান্তর। এ ছাড়া তাওরাতের অবিকৃত অংশগুলো আল্লাহর অহী হওয়ার বিষয়টিও কুরআন সত্যায়ন করেছে। তবে আল কুরআনের পর কেবল আল-কুরআন অনুযায়ী আমল হবে।
১১৮. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে ইয়াহূদীরা অস্থিরতার সাথে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। কারণ তাদের নবীগণ সর্বশেষ নবীর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং তারা এ মর্মে আল্লাহর কাছে দো‘আও করতেন যে, শেষ নবীর আগমন যেন তাড়াতাড়ি হয়, তাহলে কাফিরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব হবে এবং পুণরায় তাদের উত্থানের যুগ শুরু হবে।
মদীনাবাসীগণ এ-কথার সাক্ষী যে, তাদের প্রতিবেশী ইয়াহূদীরা প্রায়শই বলে বেড়াত যে, ‘তোমাদের যার যার মন চায় আমাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাও, আখেরী নবী যখন আসবেন, তখন আমরা সেসব অত্যাচারীদের দেখে ছাড়ব’। মদীনার অধিবাসীগণ এসব কথা শুনতেন এবং তাই যখন তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মন্ধে অবগত হলেন, তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন, দেখো! ইয়াহূদীরা যেন আমাদের আগে এ নবীর দীন গ্রহণ করে বাজিতে জিতে না যায়! চলো, আমরাই প্রথমে এ নবীর উপর ঈমান আনি; কিন্তু তাদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যে ইয়াহূদীরা এতদিন নবীর আগমনের প্রতীক্ষায় দিন গুণত, তারাই সে নবীর আবির্ভাব হবার পর তাঁর সবচে’ বড় শত্রুতে পরিণত হলো!
১১৯. এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। এখানে একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ঘটনা উল্লেখ করা হলো। আর তা তুলে ধরেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনীন সাফিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি নিজে ছিলেন মদীনার উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত ইয়াহূদী গোত্র বনী নাযীরের নেতৃস্থানীয় এক আলেম হুয়ায় ইবন আখতাব-এর মেয়ে এবং আরেকজন বড় মাপের ইয়াহূদী আলেমের ভ্রাতুষ্পুত্রী। তিনি তার ইসলাম গ্রহণের আগের এ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় আগমনের পর আমার বাবা ও চাচা দু’জনই তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষণ তাঁর সাথে কথাবার্তা বলার পর তারা ঘরে ফিরে আসেন। এ সময় আমি নিজের কানে তাদেরকে এভাবে আলাপ করতে শুনি:
চাচা: আমাদের কিতাবে যে নবীর খবর দেওয়া হয়েছে, ইনি কি সত্যিই সেই নবী?
পিতা: আল্লাহর কসম, ইনিই সেই নবী!
চাচা: এ ব্যাপারে তুমি কি একেবারে নিশ্চিত?
পিতা: হ্যাঁ।
চাচা: তাহলে এখন কি করতে চাও?
পিতা: যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, এর বিরোধিতা করে যাব। একে সফলকাম হতে দেব না।
(সূত্র: সীরাতে ইবন হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৫, আধুনিক সংস্করণ)
﴿بِئۡسَمَا ٱشۡتَرَوۡاْ بِهِۦٓ أَنفُسَهُمۡ أَن يَكۡفُرُواْ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بَغۡيًا أَن يُنَزِّلَ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۖ فَبَآءُو بِغَضَبٍ عَلَىٰ غَضَبٖۚ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٞ مُّهِينٞ ٩٠ ﴾ [ البقرة : ٩٠ ]
৯০. যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে১২০ তা কত জঘন্য (তা এই) যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা তারা অস্বীকার করেছে এই জিদের বশবর্তী হয়ে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার ওপর তাঁর অনুগ্রহ নাযিল করেছেন।১২১ সুতরাং তারা ক্রোধের ওপর ক্রোধের উপযুক্ত হয়ে গেল। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।১২২
১২০. অর্থাৎ নিজেদের কল্যাণ, শুভ পরিণাম ও পরকালীন মুক্তিকে জলাঞ্জলি দিয়েছে।
১২১. ইয়াহূদীদের আশা ছিল যে, শেষনবী তাদের অর্থাৎ ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করবেন; কিন্তু যখন তিনি বনী ইসরাঈলের বাইরে ইসমাঈলী বংশধারায় প্রেরিত হলেন, যাদেরকে তারা নিজেদের মোকাবিলায় তুচ্ছ-জ্ঞান করত, তখন তারা তাঁকে শুধুমাত্র তাদের একগুঁয়েমি ও হঠকারি মানসিকতার কারণে অস্বীকার করতে উদ্যত হলো। তাদের মনোভাব এমনই যেন, আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করে নবী পাঠালেন না কেন! আল্লাহ যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস না করে নিজের অনুগ্রহে নিজ পছন্দ অনুযায়ী নবী পাঠালেন, তখন তারা বিগড়ে গিয়ে তাঁকে সুস্পষ্টভাবে চিনতে পেরেও সর্বাত্মক বিরোধিতা করতে শুরু করে।
১২২. ‘লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি’ কাফিরদের জন্যেই নির্দিষ্ট। যারা ঈমানদার, তবে গুনাহগার (দয়াময় আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন) আর যদি তিনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তা হবে তাদের পাপমুক্ত করার লক্ষ্যে, লাঞ্ছিত করার উদ্দেশ্যে নয়।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ نُؤۡمِنُ بِمَآ أُنزِلَ عَلَيۡنَا وَيَكۡفُرُونَ بِمَا وَرَآءَهُۥ وَهُوَ ٱلۡحَقُّ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَهُمۡۗ قُلۡ فَلِمَ تَقۡتُلُونَ أَنۢبِيَآءَ ٱللَّهِ مِن قَبۡلُ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٩١ ﴾ [ البقرة : ٩١ ]
৯১. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তার প্রতি ঈমান আন’। তারা বলে, ‘আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে আমরা তা বিশ্বাস করি’। আর এর বাইরে যা আছে তারা তা অস্বীকার করে।১২৩ অথচ তা সত্য, তাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারী। বল, ‘তবে কেন তোমরা আল্লাহর নবীদেরকে পূর্বে হত্যা করতে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’?
১২৩. এখানে ইয়াহূদীদের উদ্ধৃত বক্তব্যে রয়েছে কুফর ও তাদের অন্তরের হিংসা-বিদ্বেষের প্রমাণ। যেসব আসমানী কিতাব তাদের প্রতি নাযিল হয় নি, সেগুলোকে অস্বীকার করে তারা কুফুরী করেছে। যেমন, আমাদের ঈমানের একটি অন্যতম শর্ত হলো, পূর্ববর্তী সব আসমানী কিতাবসমূহের ওপর বিশ্বাস (দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪)।
এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাদের সামনে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন:
ক. অন্যান্য গ্রন্থের সত্যতার অকাট্য যুক্তি থাকা সত্ত্বেও সেগুলো অস্বীকার করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
খ. কুরআন মাজীদও অন্যান্য আসমানী কিতাবের অন্তর্ভুক্ত একটি কিতাব। এটা তাওরাতের সত্যায়নকারীও বটে। তাই কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করা তাওরাতকে অস্বীকার করার নামান্তর।
গ. সব আসমানী কিতাব মতেই মহান নবী-রাসূলদেরকে হত্যা করা কুফুরী। ইয়াহূদীরা নবীদেরকে হত্যা করেছে, অথচ তাঁরা, বিশেষ করে, তাওরাতের শিক্ষাই প্রচার করতেন। তাই আসলে তাদের তাওরাতের উপর ঈমান আনার দাবীটাই অসার।
﴿وَلَقَدۡ جَآءَكُم مُّوسَىٰ بِٱلۡبَيِّنَٰتِ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُونَ ٩٢ ﴾ [ البقرة : ٩٢ ]
৯২. আর অবশ্যই মূসা তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে১২৪! অতঃপর তোমরা তার পরে বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করলে। আর তোমরা তো যালিম।
১২৪. মূসা আলাইহিস সালামকে মহান আল্লাহ তা‘আলা ৯টি সুস্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘আমি মূসাকে নয়টি প্রকাশ্য নিদর্শন দান করেছি’ (দেখুন: সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ১০১)। এগুলোর বর্ণনা রয়েছে সূরা আল-আ‘রাফ ও সূরা আয-যুখরুফ-এ।
﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱسۡمَعُواْۖ قَالُواْ سَمِعۡنَا وَعَصَيۡنَا وَأُشۡرِبُواْ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡعِجۡلَ بِكُفۡرِهِمۡۚ قُلۡ بِئۡسَمَا يَأۡمُرُكُم بِهِۦٓ إِيمَٰنُكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٩٣ ﴾ [ البقرة : ٩٣ ]
৯৩. আর স্মরণ কর, যখন আমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমাদের উপর তূরকে উঠিয়েছিলাম, (বলেছিলাম) ‘আমরা তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা শক্তভাবে ধর এবং শোন’। তারা বলেছিল, ‘আমরা শুনলাম এবং অমান্য করলাম১২৬! আর তাদের কুফুরীর কারণে তাদের অন্তরে পান করানো হয়েছিল গো বাছুরের প্রতি আকর্ষণ। বল, ‘তোমাদের ঈমান যার নির্দেশ দেয় কত মন্দ তা! যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’।
১২৬. অথচ মুমিনের বক্তব্য হওয়া উচিৎ: আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। ‘আমরা শুনলাম এবং অমান্য করলাম’ এ-ধরনের কথা আল্লাহর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী কাফেররাই কেবল বলতে পারে।
﴿قُلۡ إِن كَانَتۡ لَكُمُ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ عِندَ ٱللَّهِ خَالِصَةٗ مِّن دُونِ ٱلنَّاسِ فَتَمَنَّوُاْ ٱلۡمَوۡتَ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٩٤ ﴾ [ البقرة : ٩٤ ]
৯৪. বল, ‘যদি আল্লাহর নিকট আখিরাতের আবাস তোমাদের জন্যই নির্দিষ্ট থাকে অন্যান্য মানুষ ছাড়া। তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর১২৭, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’।
১২৭. ইয়াহূদীদের দুনিয়া-প্রীতির প্রতি এটি সূক্ষ্ম বিদ্রুপ বিশেষ। আখিরাতের জীবন সম্পর্কে যারা সচেতন এবং তারা কখনো পার্থিব লোভ-লালসায় নিমজ্জিত জীবন যাপন করতে পারে না; কিন্তু ইয়াহূদীদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল এবং এখনো আছে।
﴿وَلَن يَتَمَنَّوۡهُ أَبَدَۢا بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيهِمۡۚ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلظَّٰلِمِينَ ٩٥ ﴾ [ البقرة : ٩٥ ]
৯৫. আর তারা কখনো তা কামনা করবে না, তাদের হাত যা পাঠিয়েছে তার কারণে। আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত।
﴿وَلَتَجِدَنَّهُمۡ أَحۡرَصَ ٱلنَّاسِ عَلَىٰ حَيَوٰةٖ وَمِنَ ٱلَّذِينَ أَشۡرَكُواْۚ يَوَدُّ أَحَدُهُمۡ لَوۡ يُعَمَّرُ أَلۡفَ سَنَةٖ وَمَا هُوَ بِمُزَحۡزِحِهِۦ مِنَ ٱلۡعَذَابِ أَن يُعَمَّرَۗ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِمَا يَعۡمَلُونَ ٩٦ ﴾ [ البقرة : ٩٦ ]
৯৬. আর তুমি তাদেরকে পাবে জীবনের প্রতি সর্বাধিক লোভী মানুষরূপে।১২৮ এমনকি তাদের থেকেও যারা শির্ক করেছে। তাদের যে কেউই কামনা করে, যদি হাজার বছর তাকে জীবন দেওয়া হত! অথচ দীর্ঘজীবী হলেই তা তাকে আযাব থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারবে না। আর তারা যা করে আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
১২৮. আল-কুরআনের মূল শব্দে এখানে على حياة বলা হয়েছে। এর মানে, কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকা; তা যে কোনো ধরনের জীবন হোক না কেন, সম্মানের ও মর্যাদার বা হীনতার, দীনতার, লাঞ্ছনা-অবমাননার হোক না কেন, তার প্রতিই তাদের লোভ।
﴿قُلۡ مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّـجِبۡرِيلَ فَإِنَّهُۥ نَزَّلَهُۥ عَلَىٰ قَلۡبِكَ بِإِذۡنِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَهُدٗى وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُؤۡمِنِينَ ٩٧ ﴾ [ البقرة : ٩٧ ]
৯৭. বল, ‘যে জিবরীলের শত্রু হবে১২৯ (সে অনুশোচনায় মরুক) কেননা নিশ্চয় জিবরীল তা আল্লাহর অনুমতিতে তোমার অন্তরে নাযিল করেছে১৩০, তার সামনে থাকা কিতাবের সমর্থক১৩১, হিদায়াত ও মুমিনদের জন্য সুসংবাদরূপে’।১৩২
১২৯. ইয়াহূদীরা কেবল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ওপর যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকেই গালমন্দ করত না, বরং তারা আল্লাহর প্রিয় মহান ফিরিশতা জিবরাঈল আলাইহিসসালামকেও শত্রু বলে গালি দিত।
১৩০. এ জন্যেই তাদের গালমন্দ জিবরাঈল আলাইহিস সালামের ওপর নয়, আল্লাহর মহান সত্তার ওপর আরোপিত হয়।
১৩১. জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এ কুরআন মাজীদ বহন করে এনেছেন বলেই তারা তাকে গালমন্দ করে। অথচ কুরআন সরাসরি তাওরাতের সত্যতা সমর্থন করছে। ফলে তাদের এ বিষোদগার তাওরাতের বিরুদ্ধেও উচ্চারিত হচ্ছে।
১৩২. এখানে সূক্ষ্মভাবে একটি আক্ষেপের ব্যাপার তুলে ধরা হয়েছে যে, ইয়াহূদীদের সব অসন্তুষ্টি হচ্ছে হিদায়াত ও সত্য-সহজ পথের বিরুদ্ধে। নির্বোধের মতো তারা লড়ছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালতের বিরুদ্ধে। অথচ এই রিসালত মেনে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত ছিল তাদের ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ।
﴿مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّلَّهِ وَمَلَٰٓئِكَتِهِۦ وَرُسُلِهِۦ وَجِبۡرِيلَ وَمِيكَىٰلَ فَإِنَّ ٱللَّهَ عَدُوّٞ لِّلۡكَٰفِرِينَ ٩٨ ﴾ [ البقرة : ٩٨ ]
৯৮. ‘যে শত্রু হবে আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাদের, তাঁর রাসূলগণের, জিবরীলের ও মীকাঈলের, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের শত্রু’।
﴿وَلَقَدۡ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ءَايَٰتِۢ بَيِّنَٰتٖۖ وَمَا يَكۡفُرُ بِهَآ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقُونَ ٩٩ ﴾ [ البقرة : ٩٩ ]
৯৯. আর আমরা অবশ্যই তোমার প্রতি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নাযিল করেছি, ফাসিকরা ছাড়া১৩৩ অন্য কেউ তা অস্বীকার করে না।
১৩৩. আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও পথ-নির্দেশসমূহ অগ্রাহ্য ও অমান্যকারী।
﴿أَوَ كُلَّمَا عَٰهَدُواْ عَهۡدٗا نَّبَذَهُۥ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۚ بَلۡ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ١٠٠ ﴾ [ البقرة : ١٠٠ ]
১০০. তবে কি যখনই তারা কোন ওয়াদা করেছে, তখনই তাদের মধ্য থেকে কোনো এক দল তা ছুড়ে মেরেছে? বরং তাদের অধিকাংশ ঈমান রাখে না।
﴿وَلَمَّا جَآءَهُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ نَبَذَ فَرِيقٞ مِّنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ كِتَٰبَ ٱللَّهِ وَرَآءَ ظُهُورِهِمۡ كَأَنَّهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ١٠١﴾ [ البقرة : ١٠١ ]
১০১. আর যখন তাদের নিকট আল্লাহর কাছ থেকে একজন রাসূল আসল, তাদের সাথে যা আছে তা সমর্থন করে, তখন আহলে কিতাবের১৩৪ একটি দল আল্লাহর কিতাবকে তাদের পেছনে ফেলে দিল, (এভাবে যে) মনে হয় যেন তারা জানে না।
১৩৪. পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহ তথা তাওরাত ও ইঞ্জিলের অনুসারীবৃন্দ।
﴿وَٱتَّبَعُواْ مَا تَتۡلُواْ ٱلشَّيَٰطِينُ عَلَىٰ مُلۡكِ سُلَيۡمَٰنَۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيۡمَٰنُ وَلَٰكِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُونَ ٱلنَّاسَ ٱلسِّحۡرَ وَمَآ أُنزِلَ عَلَى ٱلۡمَلَكَيۡنِ بِبَابِلَ هَٰرُوتَ وَمَٰرُوتَۚ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنۡ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَآ إِنَّمَا نَحۡنُ فِتۡنَةٞ فَلَا تَكۡفُرۡۖ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنۡهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِۦ بَيۡنَ ٱلۡمَرۡءِ وَزَوۡجِهِۦۚ وَمَا هُم بِضَآرِّينَ بِهِۦ مِنۡ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۚ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡۚ وَلَقَدۡ عَلِمُواْ لَمَنِ ٱشۡتَرَىٰهُ مَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖۚ وَلَبِئۡسَ مَا شَرَوۡاْ بِهِۦٓ أَنفُسَهُمۡۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ١٠٢ ﴾ [ البقرة : ١٠٢ ]
১০২. আর তারা১৩৫ অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা১৩৬ সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফুরী করে নি; বরং শয়তানরা কুফুরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শিখাত১৩৭ এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফিরিশতা হারূত ও মারূতের ওপর। আর তারা কাউকে (যাদু) শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফুরী করো না’।১৩৮
এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত।১৩৯ অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা নিশ্চয় জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা বুঝত।
১৩৫. বনী ইসরাঈল বা ইসরাঈল প্রজন্ম।
১৩৬. এখানে ‘শায়াতীন’ বলতে জিন্ন ও মানুষ উভয়েই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
১৩৭. ইসরাঈল গোত্রের মধ্যে যখন চরম নৈতিক অধঃপতন দেখা দিল; গোলামি, মূর্খতা, অজ্ঞতা, দারিদ্র, লাঞ্ছনা ও হীনতার ফলে যখন তাদের জাতিগত মনোবল ও উচ্চাকাঙ্খার বিলুপ্তি ঘটল, তখন তারা যাদু-টোনা, তাবীজ-তুমার, টোটকা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকল। তারা এমন সব পন্থার অনুসন্ধান করতে লাগল যাতে কোনো পরিশ্রম ও সংগ্রাম-সাধনা ছাড়াই ঝাড়-ফুঁক ও তন্ত্র-মন্ত্রের জোরে সাফল্য লাভ করা যায়। তখন শয়তানরা তাদেরকে প্ররোচনা দিতে লাগল। তাদেরকে বুঝাতে থাকলো যে, সুলাইমান আলাইহিস সালামের বিশাল রাজত্ব ও তার বিস্ময়কর ক্ষমতা তো আসলে কিছু মন্ত্র-তন্ত্র ও কয়েকটা আঁচড়, নকশা তথা তাবীজের ফল। তারা তাদেরকে সেগুলো শিখিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিল। আর বনী ইসরাঈল জাতি প্রত্যাশিত মহামূল্যবান সম্পদ মনে করে এতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
১৩৮. সমগ্র বনী ইসরাঈল জাতি যখন ব্যাবিলনে বন্দী ও গোলামির জীবন যাপন করছিল, মহান আল্লাহ তখন তাদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে দু'জন ফিরিশতাকে মানুষের বেশে পাঠিয়েছিলেন। লূত জাতির কাছে যেমন ফিরিশতারা গিয়েছিলেন সুদর্শন বালকের বেশে তেমনি বনী ইসরাঈলের কাছে হয়তো তারা দরবেশ ও ফকীরের ছদ্মবেশে হাযির হয়ে থাকবেন। তারা তাদের ফিরিশতাসুলভ বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখেই সেখানে মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জ্ঞান দান করেছিলেন। তাদের শিখানো জ্ঞান ছিল নিঃসন্দেহে জায়েয, উপকারী এবং কার্যকরী। তারা লোকদের এই মর্মে সতর্কও করে দিয়েছেন যে, দেখো, আমরা কিন্তু তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। কাজেই নিজেদের পরকাল নষ্ট করো না, অর্থাৎ কোনরূপ অসৎ ও ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার করো না। কিন্তু ইয়াহূদীরা তাদের চরম চারিত্রিক বিকৃতি নিয়ে তা শিখেছিল খারাপ উদ্দেশ্যে এবং তার প্রয়োগও করতো নিকৃষ্টতম লক্ষ্যে। ফলে সেই উপকারী জ্ঞান তাদের কাছে যাদু ও যাদুকরী বিদ্যায় পরিণত হলো। আর এর প্রতি তারা এতই ঝুঁকে পড়ল যে, আল্লাহর কিতাবের সাথে তাদের আর কোনো সম্পর্কই রইল না। আর যাদের সাথে নামমাত্র সম্পর্ক ছিল, তাও শুধুমাত্র ‘আমল ও তাবীজ’ পর্যায়ে সীমিত ছিল।
১৩৯. অর্থাৎ সেই বাজারে সব থেকে বেশি চাহিদা ছিল এমন জাদু-টোনার, যার সাহায্যে এক ব্যক্তি অন্য একজনের স্ত্রীকে তার স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে। তাদের মধ্যে যে নৈতিক পতন দেখা দিয়েছিল এটি ছিল তার নিকৃষ্টতম পর্যায়।
﴿وَلَوۡ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ وَٱتَّقَوۡاْ لَمَثُوبَةٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ خَيۡرٞۚ لَّوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ١٠٣ ﴾ [ البقرة : ١٠٣ ]
১০৩. আর যদি তারা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে (তাদের জন্য) প্রতিদান উত্তম হত। যদি তারা জানত।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقُولُواْ رَٰعِنَا وَقُولُواْ ٱنظُرۡنَا وَٱسۡمَعُواْۗ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٞ ١٠٤ ﴾ [ البقرة : ١٠٤ ]
১০৪. হে মুমিনগণ,১৪০ তোমরা ‘রাইনা’ বলো না; বরং বল, ‘উনজুরনা’১৪২ আর শোন,১৪৩ কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।
১৪০. এই আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে সংক্ষেপে সেই প্রেক্ষাপটটি সামনে রাখা দরকার যে, যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আগমন করলেন এবং মদীনার চারপাশে ইসলামের আহ্বান ছড়িয়ে পড়তে লাগল, তখন ইয়াহূদীরা স্থানে স্থানে মুসলিমদেরকে ধর্মীয় বিতর্কে জড়িয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখার অপচেষ্টা অব্যাহত রাখল। তাদের উল্লেখযোগ্য বাধা-দানকারী কার্যক্রমগুলো ছিল নিম্নরূপ:
ক. তুচ্ছ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো
খ. গুরুত্বহীন বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের অবতারণা করা
গ. অপপ্রচারের মাধ্যমে নব্য মুমিনদের অন্তরে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা
ঘ. প্রশ্নের ওপর অনর্থক প্রশ্ন করে কুরআন ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্যকে দূর্বোধ্য করে তোলা
ঙ. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে বসে প্রতারণামূলক কথাবার্তা বলে গোলযোগ সৃষ্টি করা
এই রুকু হতে পরবর্তী রুকুগুলোতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী তথা মুমিনদেরকে এসব অনিষ্টকর কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, যা তাদের বিরুদ্ধে ইয়াহূদীরা করছিল। সেসব সন্দেহ-সংশয়ের জবাবও দেওয়া হয়েছে, যেগুলো তারা মুসলিমদের অন্তরে সৃষ্টির চেষ্টা করছিল।
১৪১. এ শব্দটির অর্থ ‘আমাদের একটু সুযোগ দিন’। কিন্তু ইয়াহূদীদের ভাষায় এর অর্থ ‘শোনো, তুমি বধির হয়ে যাও’। ইয়াহূদীরা যখন মুসলিমদেরকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ভালো করে বুঝে নেওয়ার উদ্দেশে ব্যবহার করতে দেখল, তখন তারা এটাকে সুযোগ হিসেবে গণ্য করে তাদের ভাষায় ব্যবহৃত গালির অর্থে শব্দটিকে প্রয়োগ করতে লাগল। আবার কখনো বা তারা শব্দটির উচ্চারণ একটু টেনে ‘রাইনা’ ( رَاعِيَنَا )ও বলার চেষ্টা করতে লাগল, যার অর্থ ‘ওহে আমাদের রাখাল’! এর সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাহমাতুল্লিল আলামীনকে তুচ্ছজ্ঞান ও অপদস্ত করা। ইয়াহূদীদের এই ছলচাতুরি বন্ধ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে ‘রাইনা’ বর্জন করতে বললেন। এর একার্থবোধক শব্দ ‘উনযুরনা’ অর্থাৎ আমাদের প্রতি নজর দিন বলতে নির্দেশ দিলেন। শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতার বিষয়টি আমরা এ আয়াত থেকে বুঝতে পাচ্ছি।
১৪২. তাই মুমিনদেরকে যথাযথ কুলুষমুক্ত শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হলো ঐ শব্দটি বলো না, বরং বলো ‘উনযুরনা’। যার অর্থ ‘আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন’ বা ‘আমাদের প্রতি দৃষ্টি দিন’ অথবা ‘আমাদেরকে একটু বুঝতে দিন’।
১৪৩. কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা শৈথিল্যের সাথে শোনার প্রশ্নই উঠে না, তাতে বরং কথা শোনার মাঝখানে সম্ভাবনা থাকে নিজেদের চিন্তাজালে বার বার জড়িয়ে পড়ার। ফলে ভুল বুঝার এবং প্রশ্নের পর প্রশ্ন করার অবকাশ সৃষ্টি হয়, যা প্রায়ই ঘটত ইয়াহূদীদের ক্ষেত্রে। তাই মুমিনদের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাদেরকে আলোর পথে চলার পাথেয় শুনতে হবে স্বতঃস্ফুর্ত আগ্রহ ও গভীর মনোযোগের সাথে, আর মানতে হবে খুশি মনে, তৃপ্তির সাথে।
﴿مَّا يَوَدُّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ وَلَا ٱلۡمُشۡرِكِينَ أَن يُنَزَّلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ خَيۡرٖ مِّن رَّبِّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَخۡتَصُّ بِرَحۡمَتِهِۦ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِيمِ ١٠٥ ﴾ [ البقرة : ١٠٥ ]
১০৫. আহলে কিতাব১৪৪ ও মুশরিকদের১৪৫ মধ্য থেকে যারা কুফুরী করেছে, তারা চায় না যে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর কোন কল্যাণ নাযিল হোক। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তাঁর রহমত দ্বারা খাস করেন এবং আল্লাহ মহান অনুগ্রহের অধিকারী।
১৪৪. পূর্বে অবতীর্ণ আসমানী কিতাবসমূহের অনুসারী।
১৪৫. যারা আল্লাহর সাথে অন্যকাউকে শরীক করে অথবা আল্লাহর ইবাদাতের সাথে অন্য কারও ইবাদাত করে।
﴿مَا نَنسَخۡ مِنۡ ءَايَةٍ أَوۡ نُنسِهَا نَأۡتِ بِخَيۡرٖ مِّنۡهَآ أَوۡ مِثۡلِهَآۗ أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ١٠٦ ﴾ [ البقرة : ١٠٦ ]
১০৬. আমরা যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মতো১৪৬ আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
১৪৬. এখানে একটি বিশেষ সন্দেহের জবাব দেওয়া হয়েছে, যা মুসলিমদের অন্তরে সৃষ্টির জন্য ইয়াহূদীরা চেষ্টা চালাত। তাদের অভিযোগগুলো ছিল নিম্নরূপ:
ক. পূর্ববর্তী কিতাবগুলো যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে থাকে এবং এ-কুরআনও তাঁর পক্ষ থেকেই এসে থাকে, তাহলে ঐ কিতাবগুলোর কিছু বিধানের ক্ষেত্রে এখানে ভিন্নতর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেন?
খ. একই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিধান কীভাবে আসতে পারে?
গ. আবার কুরআন দাবি করছে যে, ইয়াহূদী ও খৃষ্টানরা তাদেরকে দেওয়া শিক্ষার কিছু অংশ ভুলে গেছে। আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষা হাফেযদের মন থেকে কি করে মুছে যেতে পারে?
হিদায়াত অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে নয় বরং আল-কুরআন যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, এ ব্যাপারে মুসলিমদের মনে সন্দেহ সৃষ্টির লক্ষ্যেই তারা এগুলো করতো।
এর জবাবে মহান আল্লাহ বলছেন, তিনিই মালিক, তাঁর ক্ষমতা সীমাহীন, তিনি তাঁর যে কোন নির্দেশকে ইচ্ছা করে রহিত করে দেন বা যে কোনো বিধানকে বিলুপ্ত করেন; কিন্তু যা তিনি রহিত বা বিলুপ্ত করেন, তার চেয়ে উওম অথবা কমপক্ষে সমতুল্য কল্যাণময় ও উপযোগী বিধান সেখানে স্থলাভিষিক্ত করেন। আর বিধান প্রদানে মূল লক্ষ্য হলো আনুগত্যের পরীক্ষা নেওয়া। তাই তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিধান দিয়ে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। এতে সন্দেহ করার কিছুই নেই।
﴿ أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۗ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٠٧ ﴾ [ البقرة : ١٠٧ ]
১০৭. তুমি কি জান না যে, নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহর। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।
﴿ أَمۡ تُرِيدُونَ أَن تَسَۡٔلُواْ رَسُولَكُمۡ كَمَا سُئِلَ مُوسَىٰ مِن قَبۡلُۗ وَمَن يَتَبَدَّلِ ٱلۡكُفۡرَ بِٱلۡإِيمَٰنِ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَآءَ ٱلسَّبِيلِ ١٠٨ ﴾ [ البقرة : ١٠٨ ]
১০৮. নাকি তোমরা চাও তোমাদের রাসূলকে প্রশ্ন করতে, যেমন পূর্বে মূসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল?১৪৭ আর যে ঈমানকে কুফরে পরিবর্তন করবে, সে নিশ্চয় সোজা পথ বিচ্যুত হলো।
১৪৭. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বললেন: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য হজ ফরয করেছেন’। তখন সে উপস্থিতি থেকে একজন (আকরা ইবন হাবেস) দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল! প্রতি বছরই কি হজ ফরয’? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথার উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন। এমনকি লোকটি তিনবার এ প্রশ্ন করল। পরে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম তাহলে তোমাদের জন্য অবশ্যই প্রতি বছর হজ্জ ফরয হয়ে যেত। তখন তা তোমরা পালন করতে সক্ষম হতে না’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘আমি যতক্ষন কিছু না বলি, ততক্ষণ তোমরাও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। অতিরিক্ত প্রশ্ন করে শরী‘আতকে কঠিন করো না। তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিরাও এভাবে তাদের নবীদেরকে অধিক প্রশ্ন করে এবং সে ব্যাপারে নিজেরা মতানৈক্য করে ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং যখন আমি তোমাদেরকে কিছু করার নির্দেশ দেই, সাধ্যানুসারে তা পালন করো; আর যখন কিছু থেকে বিরত থাকতে বলি, তা তোমরা পরিত্যাগ করো’। (সহীহ মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধী ঐ ব্যক্তি, যে এমন জিনিস সম্পর্কে প্রশ্ন করল যা হারাম ছিল না, কিন্তু তার প্রশ্নের কারণে তা হারাম হয়ে গেল’। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ‘তোমরা বাজে কথা, সম্পদ বিনষ্ট করা এবং বেশি প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকো’। (সহীহ আল-বুখারী)
﴿وَدَّ كَثِيرٞ مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ لَوۡ يَرُدُّونَكُم مِّنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِكُمۡ كُفَّارًا حَسَدٗا مِّنۡ عِندِ أَنفُسِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلۡحَقُّۖ فَٱعۡفُواْ وَٱصۡفَحُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٠٩ ﴾ [ البقرة : ١٠٩ ]
১০৯. আহলে কিতাবের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর কাফির অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারত! সত্য স্পষ্ট হওয়ার পর তাদের পক্ষ থেকে হিংসাবশত (তারা এরূপ করে থাকে)। সুতরাং তোমরা ক্ষমা কর এবং এড়িয়ে চল,১৪৮ যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর নির্দেশ দেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
১৪৮. বিরোধীদের হিংসা-বিদ্বেষ দেখে মুমিন ব্যক্তিরা উত্তেজিত হয়ে পড়বে না, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে না। ধৈর্য্যের সাথে আল্লাহর স্মরণ, তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) ও সৎকর্মে তৎপর থাকবে। বিরোধীদের কথায় উৎকন্ঠিত না হয়ে তা বরং এড়িয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ বলেন: নিশ্চয় তারা ভীষণ কৌশল করছে। আর আমিও ভীষণ কৌশল করছি। অতএব, কাফিরদেরকে কিছুটা অবকাশ দাও, কিছু সময়ের তাদেরকে অবকাশ দাও। (দেখুন: সূরা আত-তারিক, আয়াত ১৫-১৭)
﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ١١٠ ﴾ [ البقرة : ١١٠ ]
১১০. আর তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং যে নেক আমল তোমরা নিজদের জন্য আগে পাঠাবে, তা আল্লাহর নিকট পাবে।১৪৯ তোমরা যা করছ নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
১৪৯. পরকালের প্রস্তুতি সম্পর্কে আরো পড়তে ক্লিক করুন নিম্নের দুটি লিংক:
http://www.islamhouse.com/p/41497 http://www.islamhouse.com/p/41478
﴿وَقَالُواْ لَن يَدۡخُلَ ٱلۡجَنَّةَ إِلَّا مَن كَانَ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ تِلۡكَ أَمَانِيُّهُمۡۗ قُلۡ هَاتُواْ بُرۡهَٰنَكُمۡ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١١١ ﴾ [ البقرة : ١١١ ]
১১১. আর তারা বলে, ইয়াহূদী কিংবা নাসারা ছাড়া অন্য কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এটা তাদের মিথ্যা আশা।১৫০ বল, ‘তোমরা তোমাদের প্রমাণ নিয়ে আস, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’।
১৫০. এটি মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের আরেকটি প্ররোচনা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে, নাজাত তথা পরকালে মুক্তির পথ হলো ইয়াহূদী অথবা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করা। তাদের দাবি অনুযায়ী এ দু’টিই আল্লাহ প্রদত্ত এবং তা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় নতুন কোনো জীবন-ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, তারা পরস্পর চরম শত্রু হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের বিরোধীতায় তারা ঐক্যবদ্ধ, যা মুসলিমদের বিরোধীদের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য।
﴿بَلَىٰۚ مَنۡ أَسۡلَمَ وَجۡهَهُۥ لِلَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَلَهُۥٓ أَجۡرُهُۥ عِندَ رَبِّهِۦ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١١٢ ﴾ [ البقرة : ١١٢ ]
১১২. হ্যাঁ, যে নিজকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও, তবে তার জন্য রয়েছে তার রবের নিকট প্রতিদান। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।১৫১
১৫১. অর্থাৎ পরকালে মুক্তি ও জান্নাত প্রাপ্তির জন্য ইয়াহূদী বা খৃষ্টান নয়, বরং প্রকৃত অর্থে আল্লাহর জন্য হতে হবে সমর্পিত, মুসলিম। সাথে থাকতে হবে ইহসান অর্থাৎ:
ক. পূর্ণ নিষ্ঠা, সততা ও মহান আল্লাহর ভয় এবং আশা বুকে ধারণ করে শরী‘আতের বিধি-নিষেধ পালনে সচেষ্ট হওয়া।
খ. লোক-দেখানো কোনো উদ্দেশ্যে নয়, বরং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই কেবল ইবাদাত-বন্দেগী আদায় করা।
গ. প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত সুন্নাহ অনুসরণ করে সকল কর্ম যথার্থরূপে সম্পাদন করা।
যারা এভাবে ইবাদাত ও আনুগত্যের জীবনধারা গড়ে তুলবে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে নিশ্চিত প্রতিদান। তাদের কোনো শঙ্কা বা ভয়ের কারণ নেই।
মহান আল্লাহ বলেন:
(নিশ্চয় যারা বলে, ‘আল্লাহই আমাদের রব’ অতঃপর অবিচল থাকে, ফিরিশতারা তাদের কাছে নাযিল হয় (এবং বলে,) ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল’।
আমরা দুনিয়ার জীবনে তোমাদের বন্ধু এবং আখিরাতেও। সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আরো থাকবে যা তোমরা দাবি করবে।) (দেখুন: সূরা হা-মীম আস-সাজ্দাহ, আয়াত ৩০-৩১)
﴿وَقَالَتِ ٱلۡيَهُودُ لَيۡسَتِ ٱلنَّصَٰرَىٰ عَلَىٰ شَيۡءٖ وَقَالَتِ ٱلنَّصَٰرَىٰ لَيۡسَتِ ٱلۡيَهُودُ عَلَىٰ شَيۡءٖ وَهُمۡ يَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۗ كَذَٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ مِثۡلَ قَوۡلِهِمۡۚ فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ فِيمَا كَانُواْ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَ ١١٣ ﴾ [ البقرة : ١١٣ ]
১১৩. আর ইয়াহূদীরা বলে, ‘নাসারাদের কোনো ভিত্তি নেই’ এবং নাসারারা বলে ‘ইয়াহূদীদের কোনো ভিত্তি নেই’। অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবেই, যারা কিছু জানে না,১৫২ তারা তাদের কথার মতো কথা বলে। সুতরাং আল্লাহ কিয়ামতের দিন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত সে বিষয়ে তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।
১৫২. মুশরিক (অংশীবাদী) ও নাস্তিকেরা।
﴿وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ أَن يُذۡكَرَ فِيهَا ٱسۡمُهُۥ وَسَعَىٰ فِي خَرَابِهَآۚ أُوْلَٰٓئِكَ مَا كَانَ لَهُمۡ أَن يَدۡخُلُوهَآ إِلَّا خَآئِفِينَۚ لَهُمۡ فِي ٱلدُّنۡيَا خِزۡيٞ وَلَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١١٤ ﴾ [ البقرة : ١١٤ ]
১১৪. আর তার চেয়ে অধিক যালেম কে, যে আল্লাহর মাসজিদসমূহে তাঁর নাম স্মরণ করা থেকে বাধা প্রদান করে এবং তা বিরাণ করতে চেষ্টা করে? তাদের তো উচিৎ ছিল ভীত হয়ে তাতে প্রবেশ করা।১৫৩ তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা আর আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব।
১৫৩. ইবাদাতগৃহগুলো কখনো যালেম (অধিকার হরণকারী)-দের কর্তৃত্ব ও পরিচালনাধীনে থাকতে পারে না। বরং ঐ বিশেষ দীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও শাসন-কর্তৃত্বে থাকতে হবে এমন সব লোক, যারা মহান আল্লাহকে ভয় করে এবং সর্বোতভাবে তাঁর প্রতি অনুগত। তাহলে দুষ্কৃতিকারীরা সেখানে উপস্থিত হলেও দুষ্কর্ম করার সাহস পাবে না। কারণ তারা জানবে, সেখানে গিয়ে কোনো যুলুমের কাজ করলে তাদের শাস্তি পেতে হবে।
মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অপর স্থানে বলেন: “মুশরিকদের অধিকার নেই যে, তারা আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করবে, নিজদের উপর কুফুরীর সাক্ষ্য দেওয়া অবস্থায়। এদেরই আমলসমূহ বরবাদ হয়েছে এবং আগুনেই তারা স্থায়ী হবে।” (দেখুন: সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১৭-১৮)
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡمَشۡرِقُ وَٱلۡمَغۡرِبُۚ فَأَيۡنَمَا تُوَلُّواْ فَثَمَّ وَجۡهُ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ١١٥ ﴾ [ البقرة : ١١٥ ]
১১৫. ১৫৪আর পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও, সে দিকেই আল্লাহর চেহারা।১৫৫ নিশ্চয় আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।১৫৬
১৫৪. এ আয়াতটি ‘কিবলা পরিবর্তন’ তথা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে বায়তুল্লাহ (কা‘বা শরীফ)-এর দিকে কিবলা পরিবর্তনের পর অবতীর্ণ হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিযরতের ১৬/১৭ মাস পর এই নির্দেশ দেওয়া হয় এভাবে:
(আকাশের দিকে বার বার তোমার মুখ ফিরানো আমি অবশ্যই দেখছি। অতএব, আমরা অবশ্যই তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরাব, যা তুমি পছন্দ কর। সুতরাং তোমরা চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকেই তোমাদের চেহারা ফিরাও। আর নিশ্চয় যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা অবশ্যই জানে যে, তা তাদের রবের পক্ষ থেক সত্য এবং তারা যা করে, সে ব্যাপারে আল্লাহ গাফিল নন।) (দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৪)
কিবলা পরিবর্তনের এ ব্যাপারটিকে নিয়ে বিরোধী-অবিশ্বাসীরা যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছিল, তার জবাবে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আরো জানতে দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪২, ১৪৫; সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭; সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৯৭)
১৫৫. অর্থাৎ মহান আল্লাহ সব দিক ও স্থানের মালিক। কাজেই তাঁর নির্দেশ মতো যে কোনো দিকে মুখ করে ইবাদাত করলে তাঁর উদ্দেশেই ইবাদত সমর্পিত হবে।
১৫৬. অর্থাৎ মহান আল্লাহ সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত, তিনি অসীম, অনন্ত। কোনো কোনো বিভ্রান্ত মানুষ তাঁকে নিজেদের মতো ভেবে থাকতে পারে! কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহর কর্তৃত্ব বিশাল ও বিস্তৃত এবং তাঁর অনুগ্রহ দানের ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক। তাঁর কোনো বান্দা কোথায় কোন সময় কি উদ্দেশ্যে তাঁকে স্মরণ করছে, তা তিনি সার্বক্ষণিকভাবে জানেন।
﴿وَقَالُواْ ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ وَلَدٗاۗ سُبۡحَٰنَهُۥۖ بَل لَّهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ كُلّٞ لَّهُۥ قَٰنِتُونَ ١١٦ ﴾ [ البقرة : ١١٦ ]
১১৬. আর তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র মহান; ১৫৭ বরং আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তা তাঁরই। সব তাঁরই অনুগত।
১৫৭. আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন: মানুষ আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, অথচ তাদের জন্য এটা উচিৎ নয়। আর মানুষ আমাকে গালি দেয়, অথচ এটা তার জন্য উচিৎ নয়। তাদের আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হলো, তারা বলে, আমি তাদেরকে (মৃত্যুর পরে) জীবিত করে আগের মতো করতে সক্ষম নই। আর তাদের আমাকে গালি দেওয়া হলো, তারা বলে যে, আমার পুত্র আছে। অথচ স্ত্রী বা সন্তান রাখার মতো বিষয় থেকে আমি পবিত্র। (দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৪১২৪)
﴿بَدِيعُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ وَإِذَا قَضَىٰٓ أَمۡرٗا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ١١٧ ﴾ [ البقرة : ١١٧ ]
১১৭. তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। আর যখন তিনি কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন কেবল বলেন ‘হও’ ফলে তা হয়ে যায়।
﴿وَقَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ لَوۡلَا يُكَلِّمُنَا ٱللَّهُ أَوۡ تَأۡتِينَآ ءَايَةٞۗ كَذَٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِم مِّثۡلَ قَوۡلِهِمۡۘ تَشَٰبَهَتۡ قُلُوبُهُمۡۗ قَدۡ بَيَّنَّا ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ١١٨ ﴾ [ البقرة : ١١٨ ]
১১৮. আর যারা জানে না, তারা বলে, ‘কেন আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কিংবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আসে না’?১৫৮ এভাবেই, যারা তাদের পূর্বে ছিল তারা তাদের কথার মতো কথা বলেছে।১৫৯ তাদের অন্তরসমূহ একই রকম হয়ে গিয়েছে। আমরা তো আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে দিয়েছি এমন কাওমের জন্য, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।১৬০
১৫৮. এখানে পথভ্রষ্টদের দুটি অভিযোগ:
ক. আল্লাহ নিজে এসে তাদের সাথে কথা বলেন না কেন?
খ. তাদের কাছে কোনো নিদর্শন (sign) আসে না কেন?
১৫৯. অর্থাৎ আজকের পথভ্রষ্টরা কোনো নতুন অভিযোগ বা দাবি উত্থাপন করে নি, যা এর আগের বিরোধীরা করেনি। প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পথভ্রষ্টতার স্বরূপ ও প্রকৃতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বার বার একই ধরনের সংশয়, সন্দেহ, অভিযোগ, দাবি ও প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিই তারা করে চলছে।
১৬০. প্রথম অভিযোগটি এতো বেশি অর্থহীন যে, তার জবাব দেওয়া অপ্রয়োজনীয়। এখানে শুধু দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাবে বলা হয়েছে, নিদর্শন তো রয়েছে অগণিত, কিন্তু যে মানতেই চায় না, প্রকৃতিগত বক্রতা যাকে গ্রাস করে নিয়েছে, পরম সত্যের প্রতি বিশ্বাস করাকে যে সযত্নে পাশ কাটিয়ে যেতে সদা তৎপর, তারই মুখে একথা মানায়!
﴿إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۖ وَلَا تُسَۡٔلُ عَنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلۡجَحِيمِ ١١٩ ﴾ [ البقرة : ١١٩ ]
১১৯. নিশ্চয় আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি সত্যসহ, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে১৬১ এবং তোমাকে আগুনের অধিবাসীদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না।১৬২
১৬১. অর্থাৎ অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে এক অন্যতম ও উজ্জ্বল প্রতীক হচ্ছেন স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর জীবন ও তাঁর ব্যক্তিত্ব। যে দেশ ও জাতিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল তার তৎকালীন অবস্থা, যেভাবে তিনি প্রতিপালিত হন, তাঁর ৪০ বছরের নবুয়তপূর্ব জীবনযাপন এবং নবী হবার পরে তিনি যে মহান, বিষ্ময়কর ও যুগান্তকারী কার্যাবলি সম্পাদন করেন, এসব কিছুই মানুষের জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন।
১৬২. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনের অপর স্থানে আরো বলেন:
﴿وَلَن تَرۡضَىٰ عَنكَ ٱلۡيَهُودُ وَلَا ٱلنَّصَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمۡۗ قُلۡ إِنَّ هُدَى ٱللَّهِ هُوَ ٱلۡهُدَىٰۗ وَلَئِنِ ٱتَّبَعۡتَ أَهۡوَآءَهُم بَعۡدَ ٱلَّذِي جَآءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ مَا لَكَ مِنَ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٢٠ ﴾ [ البقرة : ١٢٠ ]
১২০. আর ইয়াহূদী ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর।১৬৩ বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত’ আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তার পর, তাহলে আল্লাহর বিপরীতে তোমার কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না।
১৬৩. তাদের অসন্তুষ্টির কারণ এ নয় যে, ইয়াহূদী ও খৃষ্টানরা যথার্থই সত্যসন্ধানী, অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত সত্যকে তাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারেন নি! বরং তাঁর প্রতি তাদের অসন্তুষ্টি এজন্য যে, তারা তাদের ধর্মকে ইচ্ছেমত বিকৃতির মাধ্যমে মুনাফেকী করে যেভাবে লাভবান হয়ে আসছিল; যেভাবে ছল-চাতুরী, প্রতারণা এবং অন্তঃসারশূন্য স্বেচ্ছাচারী প্রদর্শনীমূলক কর্মকাণ্ডকে ধর্ম হিসেবে চালিয়ে আসছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের সে ভ্রষ্টতাগুলোকে উন্মোচন করেন, যাতে তাদের ভীষণ স্বার্থহানী ঘটে এবং তাদেরকে সর্বশেষ আসমানী কিতাব তথা আল-কুরআনের অনুসারী হবার আহ্বান জানান, যার সবই তাদের জন্য ছিল চরম অসহনীয়।
﴿ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ يُؤۡمِنُونَ بِهِۦۗ وَمَن يَكۡفُرۡ بِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ١٢١ ﴾ [ البقرة : ١٢١ ]
১২১. যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তারাই তার প্রতি ঈমান আনে।১৬৪ আর যে তা অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
১৬৪. এখানে আহলে কিতাবদের অন্তর্গত কিছু সৎলোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা সততা ও দায়িত্বশীলতার সাথে আল্লাহর কিতাব পড়ে। তাই আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে যা সত্য তাকেই তারা সঠিক বলে মেনে নেয়।
﴿يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَنِّي فَضَّلۡتُكُمۡ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٢٢ ﴾ [ البقرة : ١٢٢ ]
১২২. হে বনী ইসরাঈল,১৬৫ তোমরা আমার নি‘আমতকে স্মরণ কর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। আর নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি সৃষ্টিকুলের ওপর।
১৬৫. বিগত ৫৬-১২১ আয়াতমালায় মহান আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে তাদের ঐতিহাসিক অপরাধসমূহ এবং আল-কুরআন নাযিল হবার সময়ে তাদের যে অবস্থা ছিল, তা পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করেছেন। এখান থেকে আরেকটি ধারাবাহিক বক্তব্য শুরু হচ্ছে, যা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে:
এক. নূহ আলাইহিস সালামের পরে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম প্রথম নবী ছিলেন। মহান আল্লাহ তাকে ইসলামের শাশ্বত আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রথমে তিনি নিজে স্বশরীরে ইরাক থেকে মিশর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তীন থেকে নিয়ে আরবের মরু অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত বছরের পর বছর সফর করে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের তথা ইসলামের দিকে আহবান করতে থাকেন। এরপর এ মিশন সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। পূর্ব জর্দানে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র লূত আলাইহিস সালামকে নিযুক্ত করেন। সিরিয়া ও ফিলিস্তীনে নিযুক্ত করেন নিজের পুত্র ইসহাক আলাইহিস সালামকে এবং আরবের অভ্যন্তরে নিযুক্ত করেন নিজের বড় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে। তারপর মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় কাবাগৃহ নির্মাণ করেন এবং আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী এটিকেই এই মিশনের কেন্দ্র গণ্য করেন।
দুই. ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধারা দুটি বড় বড় শাখায় বিভক্ত হয়। একটি হলো ইসমাঈল আলাইহিস সালামের সন্তান-সন্ততিবর্গ। তাঁরা আরবে বসবাস করতেন। কুরাইশ ও আরবের আরো কতিপয় গোত্র এ ধারারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর যেসব আরব গোত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধারাভুক্ত ছিল না তারাও তাঁর প্রচারিত ধর্মে কমবেশী প্রভাবিত ছিল বলে তাঁর সাথেই নিজেদের সম্পর্ক জুড়তো।
দ্বিতীয় শাখাটি ইসহাক আলাইহিস সালামের সন্তানবর্গের। এই শাখায় ইয়াকুব আলাইহিস সালাম, ইউসুফ আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম, দাউদ আলাইহিস সালাম, সুলাইমান আলাইহিস সালাম, ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম প্রমুখ অসংখ্য নবী জন্মগ্রহণ করেন। ইতিঃপূর্বেই আমরা জেনেছি, যেহেতু ইয়াকুব আলাইহিস সালামের আরেক নাম ছিল ‘ইসরাঈল’, তাই তাঁর বংশ ‘বনী ইসরাঈল (ইসরাঈল প্রজন্ম)’ নামে পরিচিত হয়।
তিন. ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রধান কাজ ছিল তাওহীদী আদর্শের গোড়াপত্তন করা। তাওহীদাশ্রিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা যারা একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদত চর্চার পাশাপাশি অন্যদেরকেও আল্লাহপ্রদত্ত দীন ও আদর্শের প্রতি আহ্বান করবে। এই মহান ও বিরাট কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতেই তাঁকে তাওহীদী জনতার পিতা হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়। তারপর তাঁর বংশধারা থেকে যে শাখাটি বের হয়ে ইসহাক আলাইহিস সালাম ও ইয়াকুব আলাইহিস সালামের নামে অগ্রসর হয়ে ‘বনী ইসরাঈল’ নাম ধারণ করে সেই শাখাটি তাঁর এ দায়িত্বের উত্তরাধিকার লাভ করে। এই শাখায় নবীদের জন্ম হতে থাকে এবং তাঁদেরকে সত্য-সঠিক পথের জ্ঞানদান করা হয়। বিশ্বের জাতিসমূহকে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার উদ্দেশে বনী ইসরাইলকে গঠন করার কার্যক্রম চালু থাকে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো বনী ইসরাঈলের লোকেরা নিজেরাই তাওহীদ ও তাওহীদী আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলের সাথে তার অঙ্গীকার কর্তন করেন। এবং বনী ইসমাঈল (ইসমাঈল বংশধারায়) এ দায়িত্ব অর্পন করেন। তাওহীদ চর্চা ও বিশ্বময় তাওহীদী আদর্শ প্রচারের জন্য যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন বনী ইসমাঈলকে আরবের বিরান ভূমিতে রেখে সেসব যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা ব্যবস্থা করেন।
নিচের আয়াতগুলোতে ইবরাহীম আলাইসি সালামের তাওহীদ চর্চা, তাওহীদ প্রচার এবং খানায় কাবা পূনঃনির্মাণ, পূনঃনির্মাণের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
﴿وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا تَنفَعُهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ١٢٣ ﴾ [ البقرة : ١٢٣ ]
১২৩. আর তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না এবং কোনো ব্যক্তি থেকে বিনিময় গ্রহণ করা হবে না আর কোন সুপারিশ তার উপকারে আসবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।
﴿وَإِذِ ٱبۡتَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِۧمَ رَبُّهُۥ بِكَلِمَٰتٖ فَأَتَمَّهُنَّۖ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامٗاۖ قَالَ وَمِن ذُرِّيَّتِيۖ قَالَ لَا يَنَالُ عَهۡدِي ٱلظَّٰلِمِينَ ١٢٤ ﴾ [ البقرة : ١٢٤ ]
১২৪. আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন,১৬৬ অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের জন্য নেতা বানাব’। সে বলল, ‘আমার বংশধরদের থেকেও’? তিনি বললেন, ‘যালিমরা আমার ওয়াদাপ্রাপ্ত হয় না’।১৬৭
১৬৬. যেসব কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁকে বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করার যোগ্য প্রমাণিত করেছিলেন কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সত্যের আলো তাঁর সামনে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সমগ্র জীবন ছিল কুরবানী আর ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। দুনিয়ার যা কিছুকে মানুষ ভালোবাসতে পারে, এমন প্রতিটি বস্তুকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মহান আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সত্যের জন্য কুরবানী করেছিলেন। দুনিয়ার যে সব বিপদকে মানুষ ভয় করে, সত্যের খাতিরে তার প্রত্যেকটিকে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন।
১৬৭. অর্থাৎ এ অঙ্গীকারটি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তানদের কেবলমাত্র সেই অংশটির সাথে সম্পর্কিত যারা সদাচারী, সত্যনিষ্ঠ ও সৎকর্মশীল। তাদের মধ্য থেকে যারা যালিম (অধিকার হরণকারী ও সীমালঙ্ঘনকারী), তাদের জন্য এ অঙ্গীকার নয়। এ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, পথভ্রষ্ট ইয়াহূদীরা ও মুশরিক বনী ইসরাঈলরা এ অঙ্গীকারের আওতায় পড়ে না।
﴿وَإِذۡ جَعَلۡنَا ٱلۡبَيۡتَ مَثَابَةٗ لِّلنَّاسِ وَأَمۡنٗا وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِۧمَ مُصَلّٗىۖ وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ ١٢٥ ﴾ [ البقرة : ١٢٥ ]
১২৫. আর স্মরণ কর, যখন আমরা কা‘বাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম১৬৮ এবং (আদেশ দিলাম যে,) ‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর’।১৬৯ আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকূকারী-সাজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’।১৭০
১৬৯. মাকামে ইবরাহীম সে-ই জান্নাতী পাথর, যার উপর দাঁড়িয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাবা ঘর নির্মাণ করেছিলেন। জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের এক পর্যায়ে তিনি বলেন: যখন মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফ শেষ করেন, তখন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: এটা কি আমাদের পিতার (হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের) মাকাম? তিনি জবাবে বলেন: হ্যাঁ। তারপর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবার জিজ্ঞেস করেন: আমরা কি এখানে সালাত পড়বো না? তখন আল-কুরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয়:
﴿ وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِۧمَ مُصَلّٗىۖ﴾ [ البقرة : ١٢٥ ]
“তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানিয়ে নাও।”
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি তিন বিষয়ে আমার রবের সাথে কিংবা আমার রব তিন বিষয়ে আমার সাথে একমত হয়েছেন। এর একটি হচ্ছে, আমি বললাম: ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি যদি মাকামে ইবরাহীমে সালাত পড়তেন’! তখন ঐ আয়াতটি নাযিল হয় যে, তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানিয়ে নাও। এটি একটি বড় হাদীসের অংশ বিশেষ। (দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৪১২৫)
১৭০. পাক-পবিত্র রাখার অর্থ শুধু ময়লা-আবর্জনা থেকে পরিষ্কার রাখা নয়। আল্লাহর ঘরের আসল পবিত্রতা হলো, সেখানে আল্লাহর ছাড়া আর কারোর নাম উচ্চারিত হবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরে বসে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মালিক, প্রভু, মা‘বুদ, অভাবপূরণকারী বা ফরিয়াদ শ্রবণকারী হিসেবে ডাকে, সে আসলে তাকে নাপাক ও অপবিত্রই করে দেয়।
﴿وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِۧمُ رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا بَلَدًا ءَامِنٗا وَٱرۡزُقۡ أَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ مَنۡ ءَامَنَ مِنۡهُم بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ قَالَ وَمَن كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُۥ قَلِيلٗا ثُمَّ أَضۡطَرُّهُۥٓ إِلَىٰ عَذَابِ ٱلنَّارِۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ١٢٦ ﴾ [ البقرة : ١٢٦ ]
১২৬. আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলল, ‘হে আমার রব, আপনি একে নিরাপদ নগরী বানান এবং এর অধিবাসীদেরকে ফল-মুলের রিয্ক দিন১৭১ যারা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসে ঈমান এনেছে’। তিনি বললেন, ‘যে কুফুরী করবে, তাকে আমি স্বল্প ভোগোপকরণ দিব।১৭২ অতঃপর তাকে আগুনের আযাবে প্রবেশ করতে বাধ্য করব। আর তা কত মন্দ পরিণতি’।
১৭১. পবিত্র সেই নগরীতে শান্তি, নিরাপত্তা ও আহার্য নিশ্চিত করে মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অন্যত্র বলেন:
১৭২. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন মানবজাতির নেতৃত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ তালাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জবাবে তাকে বলা হয়েছিল, তার সন্তানদের মধ্য থেকে একমাত্র মুমিন ও সত্যনিষ্ঠরাই এ পদের অধিকারী হবে, যালিমদের এ অধিকার নেই। এখানে তিনি যখন রিযিকের জন্য প্রার্থনা করলেন, তখন আগের ফরমানটিকে সামনে রেখে কেবলমাত্র নিজের মুমিন সন্তান ও বংশধরদের জন্য দোয়া করলেন। কিন্তু এখানে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিলেন, সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব এক কথা, আর রিযিক ও আহার্য দান ভিন্ন বিষয় যা এই দুনিয়ায় মু'মিন ও কাফির নির্বিশেষে সবাইকে দেওয়া হবে। এ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, কারোর অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য দেখে এ ধারণার কারণ নেই যে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট আছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সে-ই নেতৃত্ব লাভের অধিকারী।
﴿وَإِذۡ يَرۡفَعُ إِبۡرَٰهِۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَيۡتِ وَإِسۡمَٰعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ١٢٧ ﴾ [ البقرة : ١٢٧ ]
১২৭. স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবার ভিতগুলো উঠাচ্ছিল (এবং বলছিল,) হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবূল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।
﴿رَبَّنَا وَٱجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةٗ مُّسۡلِمَةٗ لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبۡ عَلَيۡنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٢٨ ﴾ [ البقرة : ١٢٨ ]
১২৮. হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে আপনার অনুগত কাওম বানান।১৭৩ আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদাতের বিধি-বিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
১৭৩. সন্তান-সন্ততির প্রতি মায়া-মমতা শুধুমাত্র স্বভাবগত ও সহজাত প্রবৃত্তিই না; বরং তা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশও বটে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সন্তানদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন, আর এভাবে প্রার্থনা করার জন্য তিনি মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছিলেন। আল-কুরআনের অপর স্থানে তিনি দো‘আ করেন এভাবে:
﴿رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِيۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلۡ دُعَآءِ ٤٠ ﴾ [ ابراهيم : ٤٠ ]
“হে আমার রব! আমাকে সালাত কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা! আমার দো‘আ কবুল করুন”। (দেখুন: সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪০)
﴿رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيهِمۡۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٢٩ ﴾ [ البقرة : ١٢٩ ]
১২৯. হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে১৭৪ এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত১৭৫ শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে।১৭৬ নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।১৭৭
১৭৪. তিলাওয়াতের মূল অর্থ অনুসরণ করা। শব্দটি কুরআন মাজীদ ও অন্যান্য আসমানী কিতাব পাঠ করার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে। মানবরচিত কোনো গ্রন্থ পাঠে এ শব্দটি প্রয়োগ করা হয় নি। তাই আল্লাহর কিতাব অনুধাবন-অনুসরণের উদ্দেশ্য ছাড়া শুধু আবৃত্তি করলে তিলাওয়াতের হক আদায় হয় না।
১৭৫. এখানে ‘কিতাব’ বলতে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ কিতাবকে বুঝানো হয়েছে। আর ‘হিকমাহ’ শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি। পরিভাষাটি আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হলে অর্থ দাঁড়ায় বাস্তব ও অনস্তিত্বের সব বস্তুর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান এবং অসীম ও সুদৃঢ় উদ্ভাবনী শক্তি। আর অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় বিদ্যমান সব বস্তুর বিশুদ্ধ জ্ঞান এবং সৎকর্ম, ন্যায় ও সুবিচার, সত্য কথা ইত্যাদি। আল-কুরআনে হিকমাহ বলে সুন্নাহকেও বুঝানো হয়ে থাকে।
১৭৬. পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করার অর্থ জীবনকে সত্য, সঠিক ও পরিচ্ছন্ন মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, চরিত্র-নৈতিকতা, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সামগ্রিকভাবে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে সুসজ্জিত করে গড়ে তোলা।
১৭৭. এখানে একথা বুঝানোই উদ্দেশ্য যে, মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব আসলে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ঐ দো‘আর প্রতু্ত্তর!
﴿وَمَن يَرۡغَبُ عَن مِّلَّةِ إِبۡرَٰهِۧمَ إِلَّا مَن سَفِهَ نَفۡسَهُۥۚ وَلَقَدِ ٱصۡطَفَيۡنَٰهُ فِي ٱلدُّنۡيَاۖ وَإِنَّهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ لَمِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ١٣٠ ﴾ [ البقرة : ١٣٠ ]
১৩০. আর যে নিজকে নির্বোধ বানিয়েছে, সে ছাড়া কে ইবরাহীমের আদর্শ থেকে বিমুখ হতে পারে? আর অবশ্যই আমরা তাকে দুনিয়াতে বেছে নিয়েছি এবং নিশ্চয় সে আখিরাতে নেককারদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
﴿إِذۡ قَالَ لَهُۥ رَبُّهُۥٓ أَسۡلِمۡۖ قَالَ أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٣١ ﴾ [ البقرة : ١٣١ ]
১৩১. যখন তার রব তাকে বললেন, তুমি আত্মসমর্পণ কর।১৭৮ সে বলল, 'আমি সকল সৃষ্টির রবের কাছে নিজকে সমর্পণ করলাম।
১৭৮. যে আল্লাহর অনুগত হয়, আল্লাহকে নিজের মালিক, প্রভু ও মা‘বুদ হিসেবে গ্রহণ করে, নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেয় এবং দুনিয়ায় তাঁর দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করে, সে-ই মুসলিম। এই বিশ্বাস, প্রত্যয়, দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মপদ্ধতির নাম ‘ইসলাম’। মানব জাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ও জাতিতে যেসব নবী ও রাসূল এসেছেন, এটিই ছিল তাঁদের সবার এক ও অভিন্ন দীন, জীবন পদ্ধতি, আহবান ও মিশন।
﴿وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ يَٰبَنِيَّ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٣٢ ﴾ [ البقرة : ١٣٢ ]
১৩২. আর এরই উপদেশ দিয়েছে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়াকূবও১৭৯ (যে,) হে আমার সন্তানেরা, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দীনকে চয়ন করেছেন।১৮০ সুতরাং তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মারা যেয়ো না।
১৭৯. বনী ইসরাঈল (ইসরাঈল প্রজন্ম) সরাসরি হযরত ইয়াকূব আলাইহিস সালামের বংশধর হবার কারণে বিশেষভাবে তার নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮০. ‘দীন’ বিশ্বাস ও আচরণের কিছু মৌলনীতি যার পরিধি ইহলৌকিক জীবনের পুরো অঞ্চল জুড়ে সুবিস্তৃত। দীন আলাদাভাবে উল্লেখ থাকলে দীন ও শরী‘আহ উভয়টাকেই বুঝাবে। আর দীন ও শরিয়া একত্রে উল্লিখিত হলে, দীনের অর্থ হবে মৌলিক বিশ্বাস ও ইবাদত যা সকল তাওহীদী উম্মতকেই পালন করতে হতো। আর শরী‘আহর অর্থ হবে বিধানমালা যা জাতি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হতো।
﴿أَمۡ كُنتُمۡ شُهَدَآءَ إِذۡ حَضَرَ يَعۡقُوبَ ٱلۡمَوۡتُ إِذۡ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعۡبُدُونَ مِنۢ بَعۡدِيۖ قَالُواْ نَعۡبُدُ إِلَٰهَكَ وَإِلَٰهَ ءَابَآئِكَ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗا وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٣ ﴾ [ البقرة : ١٣٣ ]
১৩৩. নাকি তোমরা সাক্ষী ছিলে, যখন ইয়াকূবের নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়েছিল? যখন সে তার সন্তানদেরকে বলল, আমার পর তোমরা কার ইবাদাত করবে? তারা বলল, আমরা ইবাদাত করব আপনার ইলাহের, আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহের, যিনি এক ইলাহ। আর আমরা তাঁরই অনুগত।
﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسَۡٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٣٤ ﴾ [ البقرة : ١٣٤ ]
১৩৪. সেটা এমন এক উম্মত যা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের জন্যই, আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্যই। আর তারা যা করত সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না।
﴿وَقَالُواْ كُونُواْ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰ تَهۡتَدُواْۗ قُلۡ بَلۡ مِلَّةَ إِبۡرَٰهِۧمَ حَنِيفٗاۖ وَمَا كَانَ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٣٥ ﴾ [ البقرة : ١٣٥ ]
১৩৫. আর তারা বলে, তোমরা ইয়াহূদী কিংবা নাসারা হয়ে যাও, হিদায়াত পেয়ে যাবে। বল, বরং আমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করি, যে একনিষ্ঠ ছিল এবং যে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।১৮১
১৮১. এই জবাবটির মর্মার্থ বুঝতে দু’টি বিষয় সামনে রাখা দরকার:
এক. খৃষ্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ শতকে ইয়াহূদীবাদ আর ঈসা আলাইহিস সালামের সময়কালের বেশ কিছুকাল পরে খৃষ্টবাদের অভ্যুদয় ঘটে। তাই প্রশ্ন জাগে, ইয়াহূদী বা খৃষ্টবাদ গ্রহণ করাই যদি সঠিকপথ লাভের ভিত্তি হয়, তাহলে এর শত শত বছর আগে জন্মগ্রহণকারী ইবরাহীম আলাইহিস সালামসহ অন্যান্য নবীগণ ও সৎব্যক্তিবর্গ, যাঁদেরকে এরাই সৎপথপ্রাপ্ত বলে স্বীকার করে, তাঁরা সৎপথপ্রাপ্ত হলেন কিভাবে? আসল কথা হলো, বিশ্বব্যাপী যুগে যুগে প্রয়োজন অনুযায়ী মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবী-রাসূলদের মাধ্যমেই মানুষ বিশ্বাস ও দিক-নির্দেশনার অভিন্ন উপাদানের ভিত্তিতে চিরন্তন, শাশ্বত ও সহজ-সত্য পথের সন্ধান লাভ করেছে।
দুই. ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থগুলোই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত-বন্দেগী, উপাসনা-আরাধনা, প্রশংসা ও আনুগত্য না করার সাক্ষ্য দেয়। মহান আল্লাহর গুণ-বৈশিষ্ট্যের সাথে আর কাউকে শরীক না করাই ছিল তাঁর মিশন। কাজেই সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে চিরন্তন সত্য-সরল একত্ববাদী পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, ইয়াহূদী ও খৃষ্টবাদ তা থেকে সুস্পষ্টভাবে বিচ্যুত হয়েছে। কারণ তাদের উভয়ের মধ্যে ঘটেছে শির্কের প্রকাশ্য মিশ্রণ।
﴿قُولُوٓاْ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيۡنَا وَمَآ أُنزِلَ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَمَآ أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَآ أُوتِيَ ٱلنَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمۡ لَا نُفَرِّقُ بَيۡنَ أَحَدٖ مِّنۡهُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٦ ﴾ [ البقرة : ١٣٦ ]
১৩৬. তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের ওপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের ওপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে নবীগণকে। আমরা তাদের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তাঁরই অনুগত’।১৮২
১৮২. নবীদের মধ্যে পার্থক্য না করার অর্থ হচ্ছে, তাঁদের কেউ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন আর কেউ তার উপর কায়েম ছিলেন না অথবা কাউকে মানি আর কাউকে মানি না আমরা তাদের মধ্যে এভাবে পার্থক্য করি না। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সব নবীই যুগে যুগে একই চিরন্তন সত্য ও একই সরল-সোজা পথের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। কাজেই যথার্থ সত্যপ্রিয় কারো পক্ষে সব নবীকে সত্যপন্থী ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক। যিনি এক নবীকে মানেন আর অন্য নবীকে করেন অস্বীকার, তিনি আসলে যে নবীকে মানেন তাঁরও অনুগামী নন। কারণ মূসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীগণ যে বিশ্বব্যাপী চিরন্তন সহজ-সত্য পথ দেখিয়েছিলেন তিনি আসলে তার সন্ধান পান নি, বরং তিনি নিছক বাপ-দাদার অনুসরণ করে নিজের পছন্দমত একজন নবীকে মানছেন। তার আসল ধর্ম হয়ে পড়ছে বর্ণবাদ, বংশবাদ অথবা কোনো ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ সংক্রমিত এবং বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ, কোনো নবীর অনুগামিতা নয়।
﴿فَإِنۡ ءَامَنُواْ بِمِثۡلِ مَآ ءَامَنتُم بِهِۦ فَقَدِ ٱهۡتَدَواْۖ وَّإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّمَا هُمۡ فِي شِقَاقٖۖ فَسَيَكۡفِيكَهُمُ ٱللَّهُۚ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ١٣٧﴾ [ البقرة : ١٣٧ ]
১৩৭. অতএব, যদি তারা ঈমান আনে, তোমরা যেরূপে তার প্রতি ঈমান এনেছ, তবে অবশ্যই তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে তারা রয়েছে কেবল বিরোধিতায়, তাই তাদের বিপক্ষে তোমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।১৮৩
১৮৩. মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অন্য এক আয়াতে বলেন:
﴿وَٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِأَعۡدَآئِكُمۡۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَلِيّٗا وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ نَصِيرٗا ٤٥ ﴾ [ النساء : ٤٥ ]
“আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের ভালো করেই জানেন এবং তোমাদের সাহায্য-সমর্থনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট”। (দেখুন: সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৫)
﴿صِبۡغَةَ ٱللَّهِ وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ صِبۡغَةٗۖ وَنَحۡنُ لَهُۥ عَٰبِدُونَ ١٣٨ ﴾ [ البقرة : ١٣٨ ]
১৩৮. (বল,) আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করলাম। ১৮৪ আর রং এর দিক দিয়ে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক সুন্দর? আর আমরা তাঁরই ইবাদাতকারী।
১৮৪. صِبْغَةً ‘সিবগাহ’ শব্দের অর্থ রং বা বর্ণ, colour, dye, stain; পারিভাষিক অর্থে ‘যা ধারণ করা হয়’ বা ‘ধর্ম’ অথবা ‘দীন’ অর্থাৎ religion, creed, doctrine, belief আয়াতটির অর্থ হবে আমরা আল্লহর দীন ইসলামকে ধারণ করলাম।
খ্রিষ্টানদের মধ্যে একটি বিশেষ রীতির প্রচলন ছিল। কেউ তাদের ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে গোসল করানো হতো। আর এ গোসলের অর্থ ছিল, তার সব গুনাহ যেন ধুয়ে-মুছে গেলো এবং তার জীবন নতুন এক রং ধারণ করলো। তাদের কাছে এর পারিভাষিক নাম হচ্ছে ‘ইসতিবাগ’ বা ‘রঙ্গীন করা’ (ব্যাপটিজম: debut, launching or initiation)। তাদের ধর্মে যারা প্রবেশ করে কেবল তাদেরকেই ব্যাপটাইজড বা খৃষ্ট ধর্মে রঞ্জিত বলে ধারণা করা হয়। এমনকি খৃষ্টানদের শিশুদেরকেও ব্যাপটাইজড করা হয়।
এ ব্যাপারেই আল-কুরআন বলছে, এ লোকাচারমূলক ‘রঞ্জিত’ হবার যৌক্তিকতা কোথায়? বরং মহান আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গীন হও। যা কোনো পানি দিয়ে হওয়া যায় না; বরং তাঁর বন্দেগীর পথ অবলম্বন করেই এ রঙ্গে রঙ্গীন হওয়া যায়।
﴿قُلۡ أَتُحَآجُّونَنَا فِي ٱللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمۡ وَلَنَآ أَعۡمَٰلُنَا وَلَكُمۡ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُخۡلِصُونَ ١٣٩ ﴾ [ البقرة : ١٣٩ ]
১৩৯. বল, তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করছ অথচ তিনি আমাদের রব ও তোমাদের রব?১৮৫ আর আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের আমলসমূহ এবং তোমাদের জন্য রয়েছে তোমাদের আমলসমূহ এবং আমরা তাঁর জন্যই একনিষ্ঠ।১৮৬
১৮৫. ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের পক্ষ থেকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে মুমিনদের সাথে বিবাদ করার কিছু নেই। বরং বিতর্ক যদি করারই থাকে তবে তা হতে পারে মুমিনদের তরফ থেকেই, কেননা তারাই তো মহান আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে ইবাদাতের যোগ্য বানিয়ে নিয়েছে, মুমিনেরা নয়!
১৮৬. অর্থাৎ বিরোধীতাকারীদের কাজের জন্য তারা দায়ী, আর মুমিনদের কাজের জন্য মুমিনরা দায়বদ্ধ। তারা যদি তাদের বন্দেগীকে বিভক্ত করে থাকে এবং অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করে আরাধনা-উপাসনা ও আনুগত্য করে, তাহলে সে ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরিণাম তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। মুমিনরা বলপূর্বক তাদেরকে ঐ কাজ থেকে বিরত রাখতে চায় না। তবে তাঁরা নিজেদের বন্দেগী, আনুগত্য ও উপাসনা-আরাধনা সবকিছুই একমাত্র আল্লাহর জন্যই একমুখী হয়ে নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। যদি বিরোধীরা একথা স্বীকার করে নেয় যে, মুমিনদেরও এক আল্লাহর ইবাদাত করার ক্ষমতা ও অধিকার আছে, তাহলে তো সব বিবাদই মিটে যায়!
﴿أَمۡ تَقُولُونَ إِنَّ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطَ كَانُواْ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ قُلۡ ءَأَنتُمۡ أَعۡلَمُ أَمِ ٱللَّهُۗ وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن كَتَمَ شَهَٰدَةً عِندَهُۥ مِنَ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ١٤٠ ﴾ [ البقرة : ١٤٠ ]
১৪০. নাকি তোমরা বলছ, ‘নিশ্চয় ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানেরা ছিল ইয়াহূদী কিংবা নাসারা? বল, ‘তোমরা অধিক জ্ঞাত নাকি আল্লাহ’?১৮৭ আর তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে যে সাক্ষ্য রয়েছে তা গোপন করে?১৮৮ আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।
১৮৭. ইয়াহূদী ও খৃষ্টান জনতার মধ্যে যারা অজ্ঞতা ও মূর্খতাবশত মনে করত যে, এই বড় বড় মহান নবীদের সবাই ইয়াহূদী অথবা খৃষ্টান ছিলেন, তাদেরকে সম্বোধন করে এখানে একথা বলা হয়েছে।
১৮৮. এখানে সম্বোধন করা হয়েছে ইয়াহূদী ও খৃষ্টান আলেমদেরকে।
﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسَۡٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٤١ ﴾ [ البقرة : ١٤١ ]
১৪১. সেটা ছিল একটি উম্মত, যারা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে, তা তাদের জন্য আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্য। আর তারা যা করত, সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না।১৮৯
১৮৯. এ বক্তব্যটি এই সূরার ১৩৪ নং আয়াতের অনুরূপ।
সমাপ্ত
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন