HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
ইহসান ইলাহী যহীর
লেখকঃ নূরুল ইসলাম
আহলেহাদীছ আন্দোলনের জ্বলন্ত প্রতিভা বন্ধুবর ইহসান ইলাহী যহীর (১৯৪৫-৮৭)-কে নিয়ে তার মৃত্যুর পরে লিখতে হবে ভাবিনি। তবুও তাক্বদীরের লিখন খন্ডাবার নয়। কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে, তার কীর্তিগাথা বাংলাভাষীদের কাছে তুলে ধরার সূচনা আল্লাহ আমাদের দ্বারা করালেন। স্নেহাষ্পদ ছাত্র ও গবেষণা সহকারী নূরুল ইসলাম একাজে এগিয়ে আসায় এটি সম্ভব হয়েছে। এজন্য তাকে দো‘আ রইল। বইটি তিনি হাদীছ ফাউন্ডেশন-কে দান করেছেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। এটি যেন তার জন্য ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ হিসাবে আল্লাহর দরবারে কবুল হয়, সেই দো‘আ করি। ইতিপূর্বে লেখাটি মাসিক আত-তাহরীক-এর ১৪ বর্ষ ৮, ১০-১২ ও ১৫ বর্ষ ১ম সংখ্যায় (মে, জুলাই-অক্টোবর ২০১১) প্রকাশিত হয়।
অনুবাদ কর্ম খুবই কঠিন কাজ। নবীনদের আমরা এ ময়দানে উৎসাহিত করছি। সাথে সাথে যাতে সেটি মান সম্পন্ন হয়, সেজন্য ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’ থেকে প্রকাশিত হওয়ার আগে যেকোন বই পরিচালক কর্তৃক সম্পাদিত হয়। সেমতে এ বইটিও আমরা সম্পাদনা করেছি। যেমন ইতিপূর্বে কাবীরুল ইসলামের বই ও অন্যান্য বইসমূহ সম্পাদনা করেছি। উদ্দেশ্য, যাতে তারা যোগ্য হয়ে গড়ে ওঠেন। আমাদের এরাদা রয়েছে ইহসান ইলাহী যহীরের সব বই বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশ করার। সেটা সম্ভব হ’লে শী‘আ, কাদিয়ানী, বাহাঈ ও সুন্নী নামধারী বাতিল ফেরক্বাগুলির নষ্ট আক্বীদা ও আমল সম্পর্কে এদেশের পাঠক সমাজ দলীল সহকারে অবহিত হ’তে পারবেন এবং তাদের থেকে সাবধান হবেন।
আরবী, উর্দূ ও ফার্সী থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে আরবী, উর্দূ বা ইংরেজীতে অনুবাদে আগ্রহী তরুণদের ও দক্ষ অনুবাদকদের আমরা আহবান জানাচ্ছি সংস্কারধর্মী প্রকাশনায় হাদীছ ফাউন্ডেশনকে সহায়তা করার জন্য। যাদেরকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন তারা যেন গবেষণা বিভাগকে সমৃদ্ধ করার জন্য উদার হস্তে এগিয়ে আসেন। এমনভাবে যেন তাদের ডান হাতের দান বাম হাতে জানতে না পারে। যাতে তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় লাভকারী সাত শ্রেণীর মুমিনের অন্যতম শ্রেণীভুক্ত হতে পারেন। কারণ হাদীছ ফাউন্ডেশনের প্রতিটি প্রকাশনাই ছাদাক্বায়ে জারিয়ার সর্বোত্তম ক্ষেত্র। আল্লাহ তাঁর দ্বীনের স্বার্থে আমাদের সকলের শুভ প্রচেষ্টাসমূহ কবুল করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পরিচালক
হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
অনুবাদ কর্ম খুবই কঠিন কাজ। নবীনদের আমরা এ ময়দানে উৎসাহিত করছি। সাথে সাথে যাতে সেটি মান সম্পন্ন হয়, সেজন্য ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’ থেকে প্রকাশিত হওয়ার আগে যেকোন বই পরিচালক কর্তৃক সম্পাদিত হয়। সেমতে এ বইটিও আমরা সম্পাদনা করেছি। যেমন ইতিপূর্বে কাবীরুল ইসলামের বই ও অন্যান্য বইসমূহ সম্পাদনা করেছি। উদ্দেশ্য, যাতে তারা যোগ্য হয়ে গড়ে ওঠেন। আমাদের এরাদা রয়েছে ইহসান ইলাহী যহীরের সব বই বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশ করার। সেটা সম্ভব হ’লে শী‘আ, কাদিয়ানী, বাহাঈ ও সুন্নী নামধারী বাতিল ফেরক্বাগুলির নষ্ট আক্বীদা ও আমল সম্পর্কে এদেশের পাঠক সমাজ দলীল সহকারে অবহিত হ’তে পারবেন এবং তাদের থেকে সাবধান হবেন।
আরবী, উর্দূ ও ফার্সী থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে আরবী, উর্দূ বা ইংরেজীতে অনুবাদে আগ্রহী তরুণদের ও দক্ষ অনুবাদকদের আমরা আহবান জানাচ্ছি সংস্কারধর্মী প্রকাশনায় হাদীছ ফাউন্ডেশনকে সহায়তা করার জন্য। যাদেরকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন তারা যেন গবেষণা বিভাগকে সমৃদ্ধ করার জন্য উদার হস্তে এগিয়ে আসেন। এমনভাবে যেন তাদের ডান হাতের দান বাম হাতে জানতে না পারে। যাতে তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় লাভকারী সাত শ্রেণীর মুমিনের অন্যতম শ্রেণীভুক্ত হতে পারেন। কারণ হাদীছ ফাউন্ডেশনের প্রতিটি প্রকাশনাই ছাদাক্বায়ে জারিয়ার সর্বোত্তম ক্ষেত্র। আল্লাহ তাঁর দ্বীনের স্বার্থে আমাদের সকলের শুভ প্রচেষ্টাসমূহ কবুল করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পরিচালক
হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) পাকিস্তানের একজন খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের নির্ভীক মর্দে মুজাহিদ ছিলেন। ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানে’র সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল বিশ্ববরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব একাধারে অনলবর্ষী বাগ্মী, সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, কলমসৈনিক, শিকড় সন্ধানী গবেষক, ধর্মতাত্ত্বিক ও স্পষ্টবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে আহলেহাদীছ যুবকদের মাঝে ইসলামের রূহ সঞ্চারে তাঁর আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টা ছিল অতুলনীয়। কাদিয়ানী, শী‘আ, ব্রেলভী, বাহাইয়া, বাবিয়া প্রভৃতি ভ্রান্ত ফিরকার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ছিল ‘নীরব টাইমবোমা’ সদৃশ। শাহাদতপিয়াসী আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই নওজোয়ান সিপাহসালার ১৯৮৭ সালে লাহোরে এক বিশাল ইসলামী জালসায় বক্তৃতারত অবস্থায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়ে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন। পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনে গতিসঞ্চারকারী এই মনীষীর জীবন ও কর্ম আমাদের প্রেরণার উৎস।
১৯৪৫ সালের ৩১শে মে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত শিয়ালকোটের* আহমদপুরা মহল্লায় এক ধার্মিক ব্যবসায়ী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। তাঁর পিতা হাজী যহূর ইলাহী মুত্তাক্বী-পরহেযগার ও তাহাজ্জুদগুযার ছিলেন।[1] তাঁর মাতা (মৃঃ ১৪১৭ হিঃ) পিতার চেয়েও পরহেযগার ছিলেন। তিনি অত্যধিক নফল ছালাত আদায়ে অভ্যস্ত ও আল্লাহর পথে খরচে উদারহস্ত ছিলেন। যহীরের ভাই আবেদ ইলাহী বলেন, পিতা তাঁদের মায়ের ইবাদত-বন্দেগী দেখে বিস্মিত হয়ে কখনো কখনো মাকে বলতেন, ‘আমি যখনই তোমার কাছে আসি তখনই দেখি তুমি ছালাতে রত আছ’।[2] তাঁর বংশপরিক্রমা হল- ইহসান ইলাহী যহীর বিন যহূর ইলাহী বিন আহমাদুদ্দীন বিন নিযামুদ্দীন বিন আলতাফ।[3]
* পাঞ্জাব প্রদেশের উত্তরে অবস্থিত শিয়ালকোট পাকিস্তানের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর। মহাকবি আল্লামা ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮), পঞ্চাশের অধিক বুখারীর দরস প্রদানকারী শায়খুল হাদীছ হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবী (১৮৯৭-১৯৮৫), ‘তারীখে আহলেহাদীছ’ গ্রন্থের রচয়িতা মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী (মৃঃ ১৩৭৬ হিঃ) প্রমুখ এখানকার কৃতী সন্তান।
[1]. মিয়াঁ মুহাম্মাদ ইউসুফ সাজ্জাদ, ‘ইয়াদূ কী বারাত’, মুমতায ডাইজেস্ট, লাহোর, পাকিস্তান, ইহসান ইলাহী যহীর ও তাঁর শহীদ সাথীবর্গের স্মরণে বিশেষ সংখ্যা-২, অক্টোবর ’৮৭, পৃঃ ১১৬।
[2]. ড. আলী বিন মূসা আয-যাহরানী, শায়খ ইহসান ইলাহী যহীর (রিয়ায : দারুল মুসলিম, ১ম প্রকাশ, ১৪২৫ হিঃ/২০০৪ খ্রিঃ), পৃঃ ৪৪-৪৫।
[3]. ইবরাহীম বিন আব্দুল্লাহ আল-হাযিমী, মাওসূ‘আতু আ‘লামিল কারনির রাবি‘ আশার ওয়াল খামিস আশার আল-হিজরী ফিল ‘আলামিল আরাবী ওয়াল ইসলামী (রিয়াদ : দারুশ শরীফ, ১ম প্রকাশ, ১৪১৯ হিঃ) ১/২০৯ পৃঃ; মুহাম্মাদ খায়ের রামাযান ইউসুফ, তাতিম্মাতুল আ‘লাম (বৈরূত : দারু ইবনি হাযম, ১ম প্রকাশ, ১৪১৮ হিঃ) ১/২৩ পৃঃ
* পাঞ্জাব প্রদেশের উত্তরে অবস্থিত শিয়ালকোট পাকিস্তানের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর। মহাকবি আল্লামা ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮), পঞ্চাশের অধিক বুখারীর দরস প্রদানকারী শায়খুল হাদীছ হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবী (১৮৯৭-১৯৮৫), ‘তারীখে আহলেহাদীছ’ গ্রন্থের রচয়িতা মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী (মৃঃ ১৩৭৬ হিঃ) প্রমুখ এখানকার কৃতী সন্তান।
[1]. মিয়াঁ মুহাম্মাদ ইউসুফ সাজ্জাদ, ‘ইয়াদূ কী বারাত’, মুমতায ডাইজেস্ট, লাহোর, পাকিস্তান, ইহসান ইলাহী যহীর ও তাঁর শহীদ সাথীবর্গের স্মরণে বিশেষ সংখ্যা-২, অক্টোবর ’৮৭, পৃঃ ১১৬।
[2]. ড. আলী বিন মূসা আয-যাহরানী, শায়খ ইহসান ইলাহী যহীর (রিয়ায : দারুল মুসলিম, ১ম প্রকাশ, ১৪২৫ হিঃ/২০০৪ খ্রিঃ), পৃঃ ৪৪-৪৫।
[3]. ইবরাহীম বিন আব্দুল্লাহ আল-হাযিমী, মাওসূ‘আতু আ‘লামিল কারনির রাবি‘ আশার ওয়াল খামিস আশার আল-হিজরী ফিল ‘আলামিল আরাবী ওয়াল ইসলামী (রিয়াদ : দারুশ শরীফ, ১ম প্রকাশ, ১৪১৯ হিঃ) ১/২০৯ পৃঃ; মুহাম্মাদ খায়ের রামাযান ইউসুফ, তাতিম্মাতুল আ‘লাম (বৈরূত : দারু ইবনি হাযম, ১ম প্রকাশ, ১৪১৮ হিঃ) ১/২৩ পৃঃ
ইহসান ইলাহী যহীরের পরিবার কাপড়ের ব্যবসায় খ্যাতি লাভ করেছিল। তাঁর পূর্বপুরুষ থেকে এ ব্যবসা খান্দানী ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছিল। এ পরিবারের অধিকাংশ সদস্য উক্ত পেশাতেই জড়িত ছিল। ধার্মিকতা ও সম্পদ দু’দিক থেকেই এ পরিবার ছিল ঐশ্বর্যমন্ডিত। যহীরের বাবা আমানতদার ব্যবসায়ী ছিলেন। আহলেহাদীছ আলেমগণের সাথে তাঁর উঠাবসা ছিল। তিনি মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটীর দরসে বসতেন। তাছাড়া তিনি মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (১২৮৭-১৩৬৭ হিঃ), শায়খুল হাদীছ মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী, মাওলানা দাঊদ গযনবী (মৃঃ ১৯৬৩), মাওলানা আব্দুল্লাহ রৌপড়ী (১৩০৪-১৩৮৪ হিঃ/১৯৬৪ খ্রিঃ) প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। যহীরের পরদাদা নিযামুদ্দীন তাঁর চাচাতো ভাই মিয়াঁ মুহাম্মাদ রামাযানের পরামর্শে আহলেহাদীছ আক্বীদা গ্রহণ করেন। সেই থেকে এ পরিবার আহলেহাদীছ পরিবার হিসাবে খ্যাত।[1]
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৫, ৩৮-৪২
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৫, ৩৮-৪২
ইহসান ইলাহী যহীর দ্বীনী পরিবেশে ও আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে প্রতিপালিত হন। পরিবারেই তাঁর শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। বাল্যকাল থেকেই তিনি জামা‘আতে ছালাত আদায়ে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর পিতা হাজী যহূর ইলাহী সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই সজাগ ও সচেতন ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, তাঁর সব ছেলে ‘দাঈ ইলাল্লাহ’ (আল্লাহর পথের দাঈ) হৌক। বড় ছেলে হিসাবে যহীরের প্রতি তাঁর বিশেষ মনোযোগ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, আয়-উপার্জনের চিন্তা বাদ দিয়ে যহীর একনিষ্ঠভাবে জ্ঞান অর্জন করুক।[1] যহীর বলেন, طالبني والدى بأن أكون طالب علم فقط وأوقفني في سبيل الله . وحثنى على الاتجاه إلى الدعوة إلي الله - ‘আমার পিতা চেয়েছিলেন, আমি যেন শুধু তালেবে ইলম (জ্ঞানান্বেষী) হই। তিনি আমাকে আল্লাহর পথে ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর পথে দাওয়াতে মনোনিবেশ করার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন’।[2]
প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য তাঁকে দাহারওয়াল গ্রামের এম.বি প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখানে পাঠ শেষে উঁচী মসজিদ বাজার পানসারিয়াতে কুরআন মাজীদ হিফয করার জন্য ভর্তি করা হয়। যহীর অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় মাত্র দেড় বছরে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করেন।[3] মাহবূব জাবেদকে দেয়া জীবনের সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে নিজের বাল্যজীবন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি শিয়ালকোটের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার পিতা যহূর ইলাহী ছালাত-ছিয়ামে অভ্যস্ত এবং ইসলামের প্রতি দারুন অনুরাগী ছিলেন। তিনি মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম শিয়ালকোটির অত্যন্ত আস্থাভাজন ও ভক্ত ছিলেন। এজন্য তিনি বাল্যকালেই আমাকে কুরআনের হাফেয বানানো এবং ইসলামের খিদমতে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি যখন প্রাইমারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, তখন আমার আববা আমাকে কোন (মাধ্যমিক) স্কুলে ভর্তি না করে হিফয খানায় ভর্তি করেন। ঐ সময় আমার বয়স ছিল সাড়ে সাত বছর। আলহামদুল্লিাহ, আমি নয় বছর বয়সে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করি এবং হিফয শেষে রামাযান মাসে তারাবীহর ছালাত পড়াতে শুরু করি’।[4]
হিফয সম্পন্ন করার পর তাঁকে শিয়ালকোটের ‘দারুল উলূম শিহাবিয়াহ’ মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। এখানে তিনি মাধ্যমিক স্তর শেষ করেন। এরপর শিয়ালকোট থেকে ৪০ কিঃ মিঃ দূরে গুজরানওয়ালার বিখ্যাত মাদরাসা ‘জামে‘আ ইসলামিয়া’য় ভর্তি হন। এখানে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ, পঞ্চাশের অধিকবার বুখারীর দরস প্রদানকারী, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, ‘পশ্চিম পাকিস্তান জমঈয়তে আহলেহাদীছ’-এর আমীর আল্লামা হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবীর (১৮৯৭-১৯৮৫) কাছে হাদীছের দরস গ্রহণ করেন।[5] হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবী শুধু জমঈয়তে আহলেহাদীছের আমীরই ছিলেন না; বরং তিনি এ সম্মানও অর্জন করেছিলেন যে, পাক-ভারতের অধিকাংশ আহলেহাদীছ আলেম সরাসরি বা কোন না কোন মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে হাদীছের পাঠ গ্রহণ করেছেন। মাওলানা গোন্দলবীর কাছে হাদীছের গ্রন্থাবলী অধ্যয়নের পর কিছুদিন জামে‘আ সালাফিইয়াহ ফয়ছালাবাদেও ছিলাম। বিশেষ করে আমি ওখানে মাওলানা মুহাম্মাদ শরীফুল্লাহর কাছে মা‘কূলাতের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করি। মাওলানা শরীফুল্লাহ দিল্লীর ফতেহপুর সিক্রি থেকে হিজরত করে ফয়ছালাবাদে এসেছিলেন এবং মা‘কূলাতের বিষয়াবলী পড়ানোতে তাঁর পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি তাঁর কাছে দর্শন ও মানতিক (যুক্তিবিদ্যা) পড়েছি এবং এই দুই বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছি। ১৯৬০ সালে আমি শুধু ফারেগ হয়েছিলাম তাই নয়; বরং পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে আরবী সাহিত্যে বি.এ (অনার্স) ডিগ্রীও অর্জন করেছিলাম’।[6]
[1]. ঐ, পৃঃ ৩৯, ৪৭।
[2]. ‘আল-মাজাল্লাহ আল-আরাবিয়াহ’, সংখ্যা ৮৭, বর্ষ ৮ম, রবীঊল আখের ১৪০৫ হিঃ, ৯০ পৃঃ।
[3]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬।
[4]. আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর সে আখেরী ইন্টারভিউ, সাক্ষাৎকার গ্রহণে : মাহবূব জাবেদ, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর ’৮৭, পৃঃ ৪২।
[5]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬।
[6]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪২-৪৩।
প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য তাঁকে দাহারওয়াল গ্রামের এম.বি প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখানে পাঠ শেষে উঁচী মসজিদ বাজার পানসারিয়াতে কুরআন মাজীদ হিফয করার জন্য ভর্তি করা হয়। যহীর অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় মাত্র দেড় বছরে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করেন।[3] মাহবূব জাবেদকে দেয়া জীবনের সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে নিজের বাল্যজীবন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি শিয়ালকোটের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার পিতা যহূর ইলাহী ছালাত-ছিয়ামে অভ্যস্ত এবং ইসলামের প্রতি দারুন অনুরাগী ছিলেন। তিনি মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম শিয়ালকোটির অত্যন্ত আস্থাভাজন ও ভক্ত ছিলেন। এজন্য তিনি বাল্যকালেই আমাকে কুরআনের হাফেয বানানো এবং ইসলামের খিদমতে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি যখন প্রাইমারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, তখন আমার আববা আমাকে কোন (মাধ্যমিক) স্কুলে ভর্তি না করে হিফয খানায় ভর্তি করেন। ঐ সময় আমার বয়স ছিল সাড়ে সাত বছর। আলহামদুল্লিাহ, আমি নয় বছর বয়সে কুরআন মাজীদ মুখস্থ করি এবং হিফয শেষে রামাযান মাসে তারাবীহর ছালাত পড়াতে শুরু করি’।[4]
হিফয সম্পন্ন করার পর তাঁকে শিয়ালকোটের ‘দারুল উলূম শিহাবিয়াহ’ মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। এখানে তিনি মাধ্যমিক স্তর শেষ করেন। এরপর শিয়ালকোট থেকে ৪০ কিঃ মিঃ দূরে গুজরানওয়ালার বিখ্যাত মাদরাসা ‘জামে‘আ ইসলামিয়া’য় ভর্তি হন। এখানে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ, পঞ্চাশের অধিকবার বুখারীর দরস প্রদানকারী, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, ‘পশ্চিম পাকিস্তান জমঈয়তে আহলেহাদীছ’-এর আমীর আল্লামা হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবীর (১৮৯৭-১৯৮৫) কাছে হাদীছের দরস গ্রহণ করেন।[5] হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবী শুধু জমঈয়তে আহলেহাদীছের আমীরই ছিলেন না; বরং তিনি এ সম্মানও অর্জন করেছিলেন যে, পাক-ভারতের অধিকাংশ আহলেহাদীছ আলেম সরাসরি বা কোন না কোন মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে হাদীছের পাঠ গ্রহণ করেছেন। মাওলানা গোন্দলবীর কাছে হাদীছের গ্রন্থাবলী অধ্যয়নের পর কিছুদিন জামে‘আ সালাফিইয়াহ ফয়ছালাবাদেও ছিলাম। বিশেষ করে আমি ওখানে মাওলানা মুহাম্মাদ শরীফুল্লাহর কাছে মা‘কূলাতের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করি। মাওলানা শরীফুল্লাহ দিল্লীর ফতেহপুর সিক্রি থেকে হিজরত করে ফয়ছালাবাদে এসেছিলেন এবং মা‘কূলাতের বিষয়াবলী পড়ানোতে তাঁর পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি তাঁর কাছে দর্শন ও মানতিক (যুক্তিবিদ্যা) পড়েছি এবং এই দুই বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছি। ১৯৬০ সালে আমি শুধু ফারেগ হয়েছিলাম তাই নয়; বরং পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে আরবী সাহিত্যে বি.এ (অনার্স) ডিগ্রীও অর্জন করেছিলাম’।[6]
[1]. ঐ, পৃঃ ৩৯, ৪৭।
[2]. ‘আল-মাজাল্লাহ আল-আরাবিয়াহ’, সংখ্যা ৮৭, বর্ষ ৮ম, রবীঊল আখের ১৪০৫ হিঃ, ৯০ পৃঃ।
[3]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬।
[4]. আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর সে আখেরী ইন্টারভিউ, সাক্ষাৎকার গ্রহণে : মাহবূব জাবেদ, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর ’৮৭, পৃঃ ৪২।
[5]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬।
[6]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪২-৪৩।
বাল্যকাল থেকেই আল্লামা যহীর তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলেন। মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি তিনি ১৯৬০ সালে ফার্সী, ১৯৬১ সালে উর্দূ এবং ১৯৬২ সালে আরবী সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি দর্শন, ইসলামিক স্টাডিজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তাছাড়া করাচী ইউনিভার্সিটি থেকে এল.এল.বি ডিগ্রিও অর্জন করেন। এভাবে একজন মাদরাসাপড়ুয়া হয়েও ছয়টি বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি লাভের অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী হন।[1] আল্লামা যহীর বলেন, ‘আমি এই মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছি যে, অল্প সময়ের ব্যবধানে এখন আমার নিকট ৬টি বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি আছে এবং আমি এল.এল.বিও করে রেখেছি। দ্বীনী জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি আমি মসজিদ ও মাদরাসায় চাটাইয়ে বসে এসব ডিগ্রি অর্জন করেছি’।[2]
[1]. মুহাম্মাদ আসলাম তাহের মুহাম্মাদী, ‘আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর শহীদ : এক হামাপাহ্লু শাখছিয়াত’, মাসিক শাহাদত (উর্দূ), ইসলামাবাদ, পাকিস্তান, বর্ষ ১৫, সংখ্যা ৩, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬, ১১৮, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩।
[1]. মুহাম্মাদ আসলাম তাহের মুহাম্মাদী, ‘আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর শহীদ : এক হামাপাহ্লু শাখছিয়াত’, মাসিক শাহাদত (উর্দূ), ইসলামাবাদ, পাকিস্তান, বর্ষ ১৫, সংখ্যা ৩, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৬, ১১৮, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩।
ইহসান ইলাহী যহীর ১৯৬০ সালে জামে‘আ সালাফিইয়াহ (লায়ালপুর, ফয়ছালাবাদ, পাকিস্তান) থেকে ফারেগ হওয়ার পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদগ্র বাসনায় পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের উৎসাহে ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় পাকিস্তানী ছাত্র হিসাবে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম পাকিস্তানী ছাত্র ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ শরীফ আশরাফ। যিনি পরবর্তীতে ওখানকার শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। এখানে ভর্তি হওয়ার পর তিনি আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য আরব ছাত্রদের সাথে থাকতেন ও তাদের সাথে বেশী বেশী মিশতেন। এর ফলে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে যহীর আরবীতে কথা বলা, বক্তব্য দেয়া ও লেখার যোগ্যতা অর্জন করেন।[1] যহীর বলেন, ‘মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে আমি আরবী বলার দক্ষতা অর্জন করি। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিই একমাত্র অনারব ছাত্র ছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরব ছাত্রদের সাথে কোন প্রকার ইতস্ততঃ ছাড়াই আরবী বলত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আরব ছাত্র একথা বলতে পারত না যে, সে আমার চেয়ে ভাল আরবী বুঝতে বা বলতে পারে। আমার প্রচুর আরবী কবিতা মুখস্থ ছিল এবং আমি কুরআন মাজীদের হাফেযও ছিলাম। এজন্য আরবী ভাষায় খুব সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতাম’।[2]
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যেসব শিক্ষকের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিছ, মুহাক্কিক্ব শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯), সঊদী আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, বিশ্ববিখ্যাত সালাফী বিদ্বান শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (১৩৩০-১৪২০ হিঃ/১৯৯৯), তাফসীর ‘আযওয়াউল বায়ান’ এর রচয়িতা শায়খ মুহাম্মাদ আমীন আশ-শানক্বীতী (১৩২০-১৩৯৩ হিঃ), শায়খ আব্দুল কাদের শায়বাতুল হামদ মিসরী (জন্ম : ১৩৪০ হিঃ), শায়খ আতিয়াহ মুহাম্মাদ সালিম (১৩৪৬-১৪২০ হিঃ), শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ, শায়খ মুহাম্মাদ মুনতাছির কাত্তানী (১৩৩২-১৪১৯ হিঃ), শায়খ হাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-আনছারী (১৩৪৪-১৪১৮ হিঃ), শায়খ আবূ বকর আল-জাযায়েরী (জন্ম : ১৯২১), ড. মুহাম্মাদ সুলায়মান আল-আশক্বার, শায়খ মুহাম্মাদ শুক্বরাহ, আব্দুল গাফফার হাসান রহমানী (১৯১৩-২০০৭ খ্রিঃ) প্রমুখ।[3]
যহীরের বন্ধু ড. লোকমান সালাফী বলেন, ‘তিনি ক্লাস থেকে বের হয়ে যুগ্রশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-কে অনুসরণ করতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কঙ্করের উপর তাঁর সামনে বসে হাদীছ, উছূলে হাদীছ (হাদীছের মূলনীতি শাস্ত্র), হাদীছের বর্ণনাকারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন এবং অনেক বিষয় তাঁর সাথে আলোচনা-পর্যালোচনা করতেন। দরাযদিল শায়খ আলবানীও যহীরের কথা শুনতেন এবং তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতেন।[4]
১৯৬৭ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ অনুষদ থেকে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেন। ফাইনাল পরীক্ষায় ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে ৯২টি দেশের ছাত্রদের মাঝে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।[5]
কোন কোন শিক্ষক বিদ্যাবত্তায় তাঁর চেয়ে কম হলেও তিনি তাঁদের সামনে ভদ্র ও অনুগত ছাত্রের মতো বসতেন এবং তাদেরকে যথাযথভাবে শ্রদ্ধা করতেন। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন আলেমদের পদাংক অনুসরণ করে আরবী ব্যাকরণের আলফিয়া ইবনে মালেক, শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আল-ফাওযুল কাবীর, ইবনু হাজার আসক্বালানীর নুখবাতুল ফিকার ফী মুছত্বালাহি আহলিল আছার, তালখীছুল মিফতাহ প্রভৃতি গ্রন্থের মতন (Text) মুখস্থ করেছিলেন। অসংখ্য হাদীছ এবং আরবী, ফার্সী ও উর্দূ কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল।[6]
[1]. মুহাম্মাদ খালেদ সাইফ, ‘মাতায়ে দ্বীন ও দানেশ জো লুট গায়ী’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১২৭; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৫।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩।
[3]. মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, আল-ইমাম আল-আলবানী (কায়রো : দারুল গাদ আল-জাদীদ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৭ হিঃ/২০০৬), পৃঃ ১৪৩; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৭; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১২-১২২; মাসিক ‘ছাওতুল উম্মাহ’ (আরবী), বেনারস : জামে‘আ সালাফিয়া, জানুয়ারী ২০১৩, পৃঃ ৫০।
[4]. ‘আল-ইস্তিজাবাহ’, সংখ্যা ১১, যুলক্বা‘দাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৩।
[5]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৫, ১২৭।
[6]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৭-৮৮।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যেসব শিক্ষকের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিছ, মুহাক্কিক্ব শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯), সঊদী আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, বিশ্ববিখ্যাত সালাফী বিদ্বান শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (১৩৩০-১৪২০ হিঃ/১৯৯৯), তাফসীর ‘আযওয়াউল বায়ান’ এর রচয়িতা শায়খ মুহাম্মাদ আমীন আশ-শানক্বীতী (১৩২০-১৩৯৩ হিঃ), শায়খ আব্দুল কাদের শায়বাতুল হামদ মিসরী (জন্ম : ১৩৪০ হিঃ), শায়খ আতিয়াহ মুহাম্মাদ সালিম (১৩৪৬-১৪২০ হিঃ), শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ, শায়খ মুহাম্মাদ মুনতাছির কাত্তানী (১৩৩২-১৪১৯ হিঃ), শায়খ হাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-আনছারী (১৩৪৪-১৪১৮ হিঃ), শায়খ আবূ বকর আল-জাযায়েরী (জন্ম : ১৯২১), ড. মুহাম্মাদ সুলায়মান আল-আশক্বার, শায়খ মুহাম্মাদ শুক্বরাহ, আব্দুল গাফফার হাসান রহমানী (১৯১৩-২০০৭ খ্রিঃ) প্রমুখ।[3]
যহীরের বন্ধু ড. লোকমান সালাফী বলেন, ‘তিনি ক্লাস থেকে বের হয়ে যুগ্রশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-কে অনুসরণ করতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কঙ্করের উপর তাঁর সামনে বসে হাদীছ, উছূলে হাদীছ (হাদীছের মূলনীতি শাস্ত্র), হাদীছের বর্ণনাকারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন এবং অনেক বিষয় তাঁর সাথে আলোচনা-পর্যালোচনা করতেন। দরাযদিল শায়খ আলবানীও যহীরের কথা শুনতেন এবং তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতেন।[4]
১৯৬৭ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ অনুষদ থেকে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেন। ফাইনাল পরীক্ষায় ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে ৯২টি দেশের ছাত্রদের মাঝে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।[5]
কোন কোন শিক্ষক বিদ্যাবত্তায় তাঁর চেয়ে কম হলেও তিনি তাঁদের সামনে ভদ্র ও অনুগত ছাত্রের মতো বসতেন এবং তাদেরকে যথাযথভাবে শ্রদ্ধা করতেন। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন আলেমদের পদাংক অনুসরণ করে আরবী ব্যাকরণের আলফিয়া ইবনে মালেক, শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আল-ফাওযুল কাবীর, ইবনু হাজার আসক্বালানীর নুখবাতুল ফিকার ফী মুছত্বালাহি আহলিল আছার, তালখীছুল মিফতাহ প্রভৃতি গ্রন্থের মতন (Text) মুখস্থ করেছিলেন। অসংখ্য হাদীছ এবং আরবী, ফার্সী ও উর্দূ কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল।[6]
[1]. মুহাম্মাদ খালেদ সাইফ, ‘মাতায়ে দ্বীন ও দানেশ জো লুট গায়ী’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১২৭; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৫।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩।
[3]. মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, আল-ইমাম আল-আলবানী (কায়রো : দারুল গাদ আল-জাদীদ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৭ হিঃ/২০০৬), পৃঃ ১৪৩; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৭; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১২-১২২; মাসিক ‘ছাওতুল উম্মাহ’ (আরবী), বেনারস : জামে‘আ সালাফিয়া, জানুয়ারী ২০১৩, পৃঃ ৫০।
[4]. ‘আল-ইস্তিজাবাহ’, সংখ্যা ১১, যুলক্বা‘দাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৩।
[5]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৫, ১২৭।
[6]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৭-৮৮।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আল্লামা যহীর ‘আল-কাদিয়ানিয়াহ : দিরাসাত ওয়া তাহলীল’ ( القاديانية دراسات وتحليل ) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। মূলত এগুলি ছিল তাঁর ঐসব লেকচারের সমাহার, যেগুলি তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সামনে প্রদান করতেন। কারণ তখন কাদিয়ানীদের ব্যাপারে আরব শিক্ষকদের জ্ঞান ছিল একেবারেই সীমিত। সেজন্য তিনি ধর্মতত্ত্ব ক্লাসে ছাত্রদেরকে এ বিষয়ে লেকচার প্রদান করতেন এবং এগুলি সমৃদ্ধাকারে আরবী পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করতেন।
উক্ত গ্রন্থটি প্রকাশের সময় প্রকাশক যহীরকে বলেন, যদি লেখকের পরিচয়ে ‘মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’র ( طالب الجامعة الإسلامية بالمدينة المنورة ) পরিবর্তে ‘মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ’ ( خريج الجامعة الإسلامية بالمدينة المنورة ) লেখা হয়, তাহ’লে এ বইয়ের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাবে। যহীর বলেন, ‘আমি প্রকাশকের এই আগ্রহের কথা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন) ভাইস চ্যান্সেলর শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায-এর কাছে ব্যক্ত করলাম। উনি বিষয়টি ইউনিভার্সিটির গভর্ণিং বডির কাছে উপস্থাপন করলে আমার বইয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে গভর্ণিং বডি এই সিদ্ধান্ত নেন যে, আমার বইয়ে আমার নামের সাথে ‘মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ’ লেখার অনুমতি দেয়া যায় এবং আমাকে এই অনুমতি প্রদানও করা হ’ল। আমার প্রথম গৌরব এটা ছিল যে, আমি আমার ক্লাসে শিক্ষকদের পরিবর্তে ছাত্রদেরকে কাদিয়ানী মতবাদের উপর লেকচার প্রদান করেছি এবং আমার এই লেকচারসমগ্র বই আকারে আমার ছাত্র জীবনেই প্রকাশিত হয়েছে। আর আমার দ্বিতীয় গৌরব এটা ছিল যে, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উঁচু মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই আমাকে ‘ফারেগ’ সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছিল। আমার স্মরণ আছে, যখন আমাকে এই সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছিল তখন আমি ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়কে একদিন রসিকতা করে বলেছিলাম, ‘মাননীয় শায়খ! যদি আমি ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করি তাহলে এই সার্টিফিকেটের কী হবে’? ভাইস চ্যান্সেলর মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যদি ইহসান ইলাহী যহীর ফেল করে তাহ’লে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ করে দিব’। মূলত এটা আমার যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর আস্থার বহিঃপ্রকাশ ছিল এবং নিজেকে আমি এই আস্থার যোগ্য প্রমাণ করতে কখনো কার্পণ্য করিনি’।[1]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৪-৪৫।
উক্ত গ্রন্থটি প্রকাশের সময় প্রকাশক যহীরকে বলেন, যদি লেখকের পরিচয়ে ‘মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’র ( طالب الجامعة الإسلامية بالمدينة المنورة ) পরিবর্তে ‘মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ’ ( خريج الجامعة الإسلامية بالمدينة المنورة ) লেখা হয়, তাহ’লে এ বইয়ের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাবে। যহীর বলেন, ‘আমি প্রকাশকের এই আগ্রহের কথা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন) ভাইস চ্যান্সেলর শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায-এর কাছে ব্যক্ত করলাম। উনি বিষয়টি ইউনিভার্সিটির গভর্ণিং বডির কাছে উপস্থাপন করলে আমার বইয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে গভর্ণিং বডি এই সিদ্ধান্ত নেন যে, আমার বইয়ে আমার নামের সাথে ‘মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ’ লেখার অনুমতি দেয়া যায় এবং আমাকে এই অনুমতি প্রদানও করা হ’ল। আমার প্রথম গৌরব এটা ছিল যে, আমি আমার ক্লাসে শিক্ষকদের পরিবর্তে ছাত্রদেরকে কাদিয়ানী মতবাদের উপর লেকচার প্রদান করেছি এবং আমার এই লেকচারসমগ্র বই আকারে আমার ছাত্র জীবনেই প্রকাশিত হয়েছে। আর আমার দ্বিতীয় গৌরব এটা ছিল যে, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উঁচু মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই আমাকে ‘ফারেগ’ সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছিল। আমার স্মরণ আছে, যখন আমাকে এই সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছিল তখন আমি ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়কে একদিন রসিকতা করে বলেছিলাম, ‘মাননীয় শায়খ! যদি আমি ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করি তাহলে এই সার্টিফিকেটের কী হবে’? ভাইস চ্যান্সেলর মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যদি ইহসান ইলাহী যহীর ফেল করে তাহ’লে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ করে দিব’। মূলত এটা আমার যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর আস্থার বহিঃপ্রকাশ ছিল এবং নিজেকে আমি এই আস্থার যোগ্য প্রমাণ করতে কখনো কার্পণ্য করিনি’।[1]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৪-৪৫।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি আরবী পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ‘আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা’ গ্রন্থের লেখক মোস্তফা আস-সিবাঈ (১৩৩৩-১৩৮৪ হিঃ) সম্পাদিত সিরিয়ার দামেশক থেকে প্রকাশিত উঁচু মানের আরবী পত্রিকা ‘হাযারাতুল ইসলামে’ কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।[1] এ পত্রিকায় বড় বড় লেখক ও আলেমগণ লিখতেন। লেখনীর বলিষ্ঠতার কারণে ছাত্র হলেও তাঁর লেখা উক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হ’ত। এমনকি এ সময় তিনি একটি আরবী পত্রিকাও বের করেন। তিনি কুয়েতের একটি বহুল প্রচারিত আরবী পত্রিকায় ১৯৬৫ সালে ধর্মতত্ত্বের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখে সাহিত্যাঙ্গনে হৈচৈ ফেলে দেন। পরবর্তীতে একই প্রবন্ধ অন্যান্য পত্রিকাও লুফে নেয়। ঐ প্রবন্ধের জন্য তিনি বিশেষ সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।[2]
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯।
[2]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৭।
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯।
[2]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৭।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তাঁর প্রতিভার দ্যুতি ওখানকার আলেমগণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। সেজন্য পাঠ চুকানো মাত্র সেখানে অধ্যাপনার জন্য তাঁর নিকট প্রস্তাব পেশ করা হয়। কিন্তু তিনি সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ না করার কারণ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সম্ভবত আমার এই প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, আমি দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি এবং যা কিছু আমার কাছে আছে তা দিয়ে আমার দেশের সেবা করব। স্বদেশবাসীর কাছে আমার জ্ঞান পৌঁছাব। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং অপরিসীম দেশপ্রেমের কারণেই আমি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ না করে পাকিস্তানে চলে এসেছি। কুরআন মাজীদের হুকুমও এই যে, একদল লোক এমন থাকা চাই যারা জ্ঞান অর্জন করে নিজের জাতির কাছে ফিরে এসে নিজের অর্জিত জ্ঞান তাদের মাঝে বিতরণ করবে’। অন্য আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে আমার ফিরে আসার একটা উদ্দেশ্য তো এটাও ছিল যে, আমি জমঈয়তে আহলেহাদীছকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করব। পাকিস্তানে আমার ফিরে আসার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠা। কারণ পাকিস্তান ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল’।[1]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৬।
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৬।
দেশে থাকা অবস্থাতেই তিনি বিভিন্ন উর্দূ পত্র-পত্রিকায় কাদিয়ানীদের সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ লিখেন।[1] দেশে ফিরে এসে তিনি ‘চাটান’, ‘লায়েল ওয়া নাহার’, ‘আক্বদাম’, ‘কোহিস্তান’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে উর্দূতে প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। তিনি ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’-এর মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘আল-ই‘তিছাম’ এবং পরে সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ ও ‘আল-ইসলাম’-এর সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানে’র মুখপত্র রূপে ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে ‘তরজুমানুল হাদীছ’ নামে একটি মাসিক উর্দূ পত্রিকাও বের করেন। এ পত্রিকার তিনি প্রধান সম্পাদক ছিলেন।[2] এ পত্রিকায় তিনি কাদিয়ানী, বাবিয়া, হাদীছ অস্বীকারকারী, পুঁজিবাদী বিভিন্ন ভ্রান্ত মতাদর্শের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার প্রবন্ধ লিখেন। মন্ত্রী ও গভর্ণরদের বিভিন্ন ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপেরও এতে সমালোচনা করেন। অধ্যাবধি পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তানে কুরআন ও সুন্নাহর দাওয়াত প্রচারে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।[3]
[1]. ইহসান ইলাহী যহীর, আল-কাদিয়ানিয়্যাহ দিরাসাতুন ওয়া তাহলীল (রিয়াদ : কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ৯।
[2]. আহমাদ শাকির, ‘আল-ই‘তিছাম কী চালীসবেঁ জিলদ কা আগায; মাযী আওর হাল কী মুখতাছার সারগুযাশত’ (সম্পাদকীয়), সাপ্তাহিক ‘আল-ই‘তিছাম’, বর্ষ ৪০, সংখ্যা ১-২, ১-৮ জানুয়ারী ১৯৮৮, লাহোর, পাকিস্তান, পৃঃ ৪; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮-১৯; বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৫, ১১৮; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩২-৩৩।
[1]. ইহসান ইলাহী যহীর, আল-কাদিয়ানিয়্যাহ দিরাসাতুন ওয়া তাহলীল (রিয়াদ : কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ৯।
[2]. আহমাদ শাকির, ‘আল-ই‘তিছাম কী চালীসবেঁ জিলদ কা আগায; মাযী আওর হাল কী মুখতাছার সারগুযাশত’ (সম্পাদকীয়), সাপ্তাহিক ‘আল-ই‘তিছাম’, বর্ষ ৪০, সংখ্যা ১-২, ১-৮ জানুয়ারী ১৯৮৮, লাহোর, পাকিস্তান, পৃঃ ৪; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮-১৯; বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৫, ১১৮; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩২-৩৩।
বাল্যকাল থেকেই ইহসান ইলাহী যহীরের বক্তৃতার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল। অনলবর্ষী বাগ্মী হওয়ার স্বপ্নের জাল তিনি আশৈশব বুনতেন। এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাল্যকাল থেকেই বক্তৃতার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। আমার ফুফা প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী (রহঃ)-এর মাজলিসে আহরার-এর সদস্য এবং তার অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর বক্তৃতার কথা আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আলোচিত হ’ত এবং বাল্যকাল থেকেই আমার মনে এই আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল যে, আমিও বড় হয়ে বক্তা হব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর ব্যক্তিত্ব আমার জন্য অনুপ্রেরণা ছিল। আমি কুরআন মাজীদ মুখস্থ করে তারাবীহর ছালাত পড়াতে শুরু করি। এভাবে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং বয়স ও জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে আমার বক্তৃতাশিল্পও সুদৃঢ় হ’তে থাকে’।[1]
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৬৬ সালে আরব ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাঝে বক্তৃতা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন। ফলে হজ্জের সময় মক্কায় হাজীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে দায়িত্ব প্রদান করে। তিনি প্রথমে উর্দূতে বক্তৃতা দিতেন। তারপর আরবীতে অনুবাদ করতেন।[2]
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হজ্জের সময় ভারতীয় ও পাকিস্তানী হাজীদেরকে হজ্জের মাসআলা-মাসায়েল বর্ণনা করার জন্য মসজিদে নববীতে যহীরের জন্য ‘বাবুস সঊদ’ (সঊদ দরজা) নির্দিষ্ট ছিল। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে উর্দূতে বক্তৃতা দিতেন। একদিন মসজিদে নববীতে প্রচুর লোক সমাগম হয়। তিনি তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে বক্তৃতা দেয়া শুরু করার পর লক্ষ্য করেন যে, চতুস্পার্শ্বে ভারতীয় ও পাকিস্তানী হাজীরা ছাড়াও বহু সংখ্যক আরব হাজী অবস্থান করছেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে আরবীতে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। প্রথমে সামান্য বাধো বাধো ভাব হ’লেও দ্রুত তা দূর হয়ে যায় এবং অনুভব করেন যে, তিনি আরবী ভাষায় বক্তব্য দিতে সক্ষম। এরপর থেকে প্রত্যেক বছর হজ্জের মওসুমে সেখানে আরবীতে বক্তৃতা দিতেন।[3]
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের সময় মসজিদে নববীতে ইহূদীদের আক্রমণের আশংকায় মসজিদের বাতিগুলি বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন আল্লামা যহীরের তেজোদীপ্ত ঈমান তাঁর বাগ্মীসত্তাকে জাগিয়ে তুলে। ফলে তিনি সেখানে উপস্থিত লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে জিহাদের উপর অগ্নিঝরা বক্তৃতায় বলেন, ‘পৃথিবী সবসময় মদীনায় আগন্তুক কাফেলাগুলির পদভারে মুখরিত হওয়ার খবর শুনত। আর আজ আমরা মদীনার রাস্তাঘাটে ইহূদীদের আক্রমণের খবর শুনছি’। একথা বলার সাথে সাথে উপস্থিত যুবক ও বৃদ্ধদের ‘আল-জিহাদ’ ‘আল-জিহাদ’ শ্লোগানে মসজিদে নববী প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। গোটা মদীনায় যেন প্রতিশোধের বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়।[4] সে সময় মসজিদে নববী যিয়ারত করছিলেন আরব বিশ্বের খ্যাতিমান বাগ্মী মোস্তফা আস-সিবাঈ। তিনি শ্লোগান শুনে এগিয়ে গিয়ে যহীরের বক্তব্য শুনেন। বক্তৃতা শেষে যহীরকে ডেকে বলেন, তোমার নাম কি? তিনি বললেন, ইহসান ইলাহী যহীর। সিবাঈ বললেন, তুমিই আমার পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখ। তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। সিবাঈ বললেন, كنت أظن نفسي أخطب العرب ولكن حينما رأيتك اليوم وسمعتك عرفت أنك أخطب العرب ‘আমি নিজেকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বাগ্মী বলে মনে করতাম। কিন্তু আজ তোমাকে দেখে ও তোমার বক্তব্য শুনে আমি বুঝতে পারলাম যে, তুমিই আরবের শ্রেষ্ঠ বাগ্মী’।[5]
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর বিদ্যাবত্তা ও বক্তৃতার খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে আসার পর তিনি ১৯৬৮ সালে লাহোরের ‘প্রাচীন ও প্রথম আহলেহাদীছ জামে মসজিদ’ বলে কথিত[6] চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর আগুনঝরা জুম‘আর খুৎবা শোনার জন্য লাহোরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ মসজিদে লোকজনের ঢল নামত।[7] এখানে খুৎবা প্রদানের ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন। দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ তিনি এখানে খুৎবা প্রদান করেন। যার সুযোগ তিনি খুব কমই হাতছাড়া করতেন।[8]
ছাত্রজীবন থেকেই আল্লামা যহীর বক্তব্য দেয়া শুরু করলেও চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই মূলত তাঁর নিয়মতান্ত্রিক বক্তৃতার নবযাত্রা শুরু হয়। মাতৃভাষা পাঞ্জাবী হ’লেও তিনি সবসময় উর্দূতে বক্তৃতা দিতেন। দেশের যে প্রান্তেই বক্তৃতা দিতে যেতেন সেখানেই প্রচুর লোক সমাগম হ’ত। শ্রোতা সংখ্যা লাখ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকত। মুক্বাল্লিদরাও তাঁর বক্তব্য শুনতে যেত। যেকোন বিষয়েই বক্তব্য দিয়ে বাজিমাত করতেন। অধিকাংশ মানুষ তাঁকে ‘সুরেশে ছানী’ (দ্বিতীয় সুরেশ) বলত। বক্তব্যের হক তিনি যথাযথ আদায় করতেন। কুরআন ও হাদীছ থেকে দলীল এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর উদাহরণ পেশ করতেন।[9] উল্লেখ্য যে, আগা সুরেশ কাশ্মীরী (১৯১৭-১৯৭৫) উপমহাদেশের খ্যাতনামা বাগ্মী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।[10]
১৯৬৮ সালে আইয়ূব খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করার দুঃসাহস দেখাত না। করলেই জেলে পুরে নাস্তানুবাদ করা হ’ত। এমনই এক সন্ধিক্ষণে আল্লামা যহীর লাহোরে ঈদের মাঠে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘১৯৬৮ সালের ঘটনা। আমি মূলতঃ চীনাওয়ালী মসজিদের খতীবের পদে আসীন ছিলাম। সেই সময় ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। ইকবাল পার্কে- যাকে মিন্টু পার্কও বলা হয়, চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব হিসাবে ঈদের জামা‘আতে ইমামতি করার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। মাওলানা দাঊদ গযনবীর সময় থেকেই ইকবাল পার্কের ঈদের জামা‘আতকে লাহোরে ‘ঈদে আযাদগাঁ’ রূপে আখ্যায়িত করা হ’ত এবং এখানকার জামা‘আত লাহোরের কয়েকটি বড় ঈদের জামা‘আতের মধ্যে গণ্য হ’ত।
এ সময় ঈদের কয়েকদিন পূর্বে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আনওয়ার-এর উপরে পুলিশের উদ্ধত আচরণের ফলে লাহোর শহরে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। লোকদের প্রত্যাশা ছিল, ঈদে আযাদগাঁর খুৎবায় আইয়ূব খানের সরকারকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত করা হবে। এজন্য ঈদের পূর্বেই আমার কাছে প্রতিনিধি দল আসা শুরু হয়ে যায়। কিছু লোকের ধারণা ছিল, আমি রাজনীতিবিদ নই। সুতরাং আমি অনুমতি দিলে তারা ওখানকার খুৎবার জন্য এমন ব্যক্তিকে নিয়ে আসবেন, যিনি ঐ ঈদের জামা‘আতের ইমামের মর্যাদা, ভাবমূর্তি ও সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখবেন। তখন আমি ঐ বন্ধুদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলি। অতঃপর সেদিন ঈদের খুৎবায় আমি যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তাকে আমার জীবনে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্যও বলা যেতে পারে। আমার ঐ বক্তব্যের প্রভাব এতই গভীর ছিল যে, (বক্তব্যের পর) অনেক মানুষ আবেগের আতিশয্যে নিজেদের জামা ছিঁড়ে ফেলেছিল। আমার স্মরণ আছে, আগা সুরেশ কাশ্মীরীও উক্ত ঈদের খুৎবার শ্রোতা ছিলেন। ঈদের ছালাতের পর আমাকে উনি মিয়াঁ আব্দুল আযীয বার এট ল-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেন, ‘আমি নিজেই বক্তৃতা শিল্পে অনেক দক্ষতা রাখি। কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, ইহসান ইলাহী! যদি তুমি ভবিষ্যতে বক্তৃতা দেয়া ছেড়েও দাও তাহ’লে তোমার এই এক বক্তৃতার দ্বারাই তোমাকে পাক-ভারতের কতিপয় বড় বক্তাদের মাঝে গণ্য করা যেতে পারে’।[11]
মিয়াঁ আব্দুল আযীয ঐ সময় বলেছিলেন, ‘যদি পাক-ভারতের বাগ্মীদের উল্লেখযোগ্য বক্তব্যগুলোকে একত্রিত করা হয় তাহ’লে এই বক্তব্যই শীর্ষস্থানে থাকবে’।[12]
১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার এশার ছালাতের পর শিয়ালকোটের ইকবাল রোডে অবস্থিত আহলেহাদীছ জামে মসজিদে ষষ্ঠ কুরআন ও হাদীছ মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে আল্লামা যহীর তাওহীদের উপর এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। মাসূনন খুৎবা পাঠের পর কুরআন মাজীদের সূরা আ‘রাফের ১৫৮ আয়াত তেলাওয়াতের মাধ্যমে তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিকট জীবিত ব্যক্তিদের ভয় করাও শিরক এবং মৃত ব্যক্তিদের ভয় করাও শিরক। আমরা তাওহীদের তত্ত্বাবধায়ক। আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেই ভয় করি না। আর যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীবের ভয় স্থান দেয়, তিনি তাকে সৃষ্টিজগতের ভয় থেকে মুক্ত করে দেন। এই শিক্ষাই আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) দিয়েছেন’। তিনি আরও বলেন, ‘শুনুন! তাওহীদের সবচেয়ে বড় উপকারিতা এই যে, তাওহীদী আক্বীদা পোষণের পর মানুষ গায়রুল্লাহর ভয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়। এরপর সে আর কাউকে ভয় করে না। কারণ তাওহীদপন্থীর এ দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয় যে, لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ يُحْيِىْ وَيُمِيْتُ ‘তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবিত করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন’ (আ‘রাফ ৭/১৫৮)। মরণও তাঁর আয়ত্ত্বাধীন এবং জীবনও তাঁর আয়ত্ত্বাধীন। তিনি ব্যতীত কেউ মারতে পারেন না, কেউ জীবিত করতেও পারে না। যার বিশ্বাস এরূপ হবে সমগ্র সৃষ্টিজগত তার কিছুই করতে পারবে না’। এরপর আহলেহাদীছদেরকে সম্বোধন করে তিনি দরদমাখা কণ্ঠে বলেন,
اهل حديثو ! الله كا تم پر انعام ہے كہ تم توحيدوالوں كے گهر ميں پيدا ہوئے ہو- تمہيں نهيں معلوم توحيد كى قدر كياہے؟ توحيد كى قدر كسى سے پوچهنى ہے تو اس سے پوچهو جس كو الله نے بعد ميں ہدايت دى ہے -
‘আহলেহাদীছগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হ’ল তোমরা তাওহীদপন্থীদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছ। তাওহীদের মর্যাদা কি- তা তোমাদের জানা নেই? তাওহীদের মর্যাদা জানতে চাইলে ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস কর যাকে আল্লাহ পরে হেদায়াত দান করেছেন’।
او لوگو ! توحيد كى قدر پوچهنى ہے تو ان سے پوچهو، جو شرك كى پستيوں سے نكل كر توحيد كى بلنديوں پہ آئے- اهل حديثو ! كعبہ كے رب كى قسم، تم زندگى كى آخرى لمحات تك اگر خدا كا شكر ادا كرتے رہو، تو اس كے كئے ہوئے انعام كا شكر ادا نهيں كر سكتے كہ الله نے تمہيں اپنى توحيد كا علمبردار بنايا ہے -
‘ওহে লোকসকল! তাওহীদের মর্যাদা জানতে চাইলে ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস কর, যে শিরকের নীচুতা থেকে বের হয়ে তাওহীদের উচ্চতায় পৌঁছেছে। আহলেহাদীছগণ! কা‘বার রবের কসম! তোমরা যদি জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে থাক তাহ’লেও তাঁর কৃত (এই) অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করতে পারবে না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় তাওহীদের ধারক-বাহক বানিয়েছেন’। তিনি আরো বলেন, ‘আজ আমাদের দেশ, জাতি ও জনগণের যত রোগ আছে সেগুলোর মূল হ’ল শিরক’।[13]
আরবী ভাষাতেও আল্লামা যহীর চমৎকার বক্তৃতা দিতেন। যা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। যখন তিনি এ ভাষাতে বক্তব্য দিতেন তখন মনে হ’ত এটা তাঁর মাতৃভাষা। বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে তিনি আরবীতে বক্তৃতা দিয়েছেন। আরবী ভাষার বড় বড় পন্ডিত তাঁর আরবী বক্তৃতা শুনে প্রভাবিত হয়েছে। একজন অনারবের মুখ থেকে বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় বক্তৃতা শুনে তারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে যেত। মোদ্দাকথা, তিনি আরবী ও উর্দূ উভয় ভাষায় প্রথম সারির বক্তা ছিলেন।[14]
শায়খ আব্দুল আযীয আল-ক্বারী বলেন, وكان بالأردية خطيبا مؤثرا بارعا يهيج الجماهير . ‘তিনি উর্দূতে প্রভাব বিস্তারকারী অসাধারণ বক্তা ছিলেন। তিনি জনগণকে আন্দোলিত করতেন’।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর শায়খ মুহাম্মাদ বিন নাছের আল-‘আবূদী বলেন, كان خطيبا مةفوقا قليل النظير في فصاحةه وخاصة باللغة العربية ‘তিনি শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ছিলেন। শুদ্ধভাষিতায় বিশেষ করে আরবী ভাষায় তাঁর সমকক্ষ খুব কমই ছিল’।[15]
ড. লোকমান সালাফী বলেন, ‘তিনি কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী বক্তৃতা করতেন। আর তাঁর হাতে থাকত কুরআন মাজীদ। তিনি সত্য প্রকাশ করতেন এবং নিরবচ্ছিন্ন ও অবিশ্রান্তভাবে বাতিলকে প্রতিরোধ করতেন। আর শ্রোতারা পিন-পতন-নীরবতার সাথে তাঁর বক্তব্য শ্রবণ করতো। তারা নড়াচড়া করত না এবং বিরক্তও হ’ত না। বরং আরো বেশিক্ষণ বক্তব্য দিতে বলত। এভাবে তিনি এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদ এবং এক স্টেজ থেকে আরেক স্টেজে ছুটে বেড়াতেন। যেন তিনি তাঁর সময়ে ইসলামের সবচেয়ে বড় মুখপাত্র এবং ইসলামের দুঃসাহসী প্রতিরক্ষক। ভীরুতা ও দুর্বলতা কী জিনিস তা তিনি জানতেন না’।[16]
তিনি ‘খতীবে মিল্লাত’ ও ‘খতীবে কওম’ রূপে সর্বমহলে বরিত হতেন। বিরোধী দলের অনেক লোকও বক্তব্য শেখার জন্য তাঁর কাছে আসত। পাকিস্তানীরা এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেন যে, তিনি ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী।[17]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩।
[2]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৪।
[3]. ঐ, পৃঃ ৪৩-৪৪।
[4]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২-২৩।
[5]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩।
[6]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন (পিএইচ.ডি থিসিস), পৃঃ ৩৮২।
[7]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[8]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩।
[9]. প্রফেসর মুহাম্মাদ ইয়ামীন মুহাম্মাদী, ‘ইসলাম কা বেবাক সিপাহী, বেমেছাল মুছান্নিফ ইহসান ইলাহী’ মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৭।
[10]. তিনি আতাউল্লাহ শাহ বুখারী এবং মাওলানা আবুল কালাম আযাদের রাজনৈতিক শিষ্য ছিলেন। তিনি খাঁটি তাওহীদপন্থী এবং শিরক ও বিদ‘আতের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার উল্লেখ্যযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে ছিল (১) মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর জীবন ও চিন্তাধারা (২) মাওলানা আবুল কালাম আযাদের জীবন ও চিন্তাধারা (৩) তাহরীকে খতমে নবুঅত (৪) তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘মাযামীনে সুরেশ’।
[11]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫২।
[12]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[13]. হাফেয হাফীযুল্লাহ, ‘শিয়ালকোট মেঁ শহীদে মিল্লাত হযরত আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর কা আখেরী ইয়াদগার খেতাব’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ৩৮-৫২।
[14]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২২, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৭-১৮।
[15]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৬।
[16]. ‘আল-ইস্তিজাবা’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৩-৩৪।
[17]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩, ২১৫।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৬৬ সালে আরব ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাঝে বক্তৃতা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন। ফলে হজ্জের সময় মক্কায় হাজীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে দায়িত্ব প্রদান করে। তিনি প্রথমে উর্দূতে বক্তৃতা দিতেন। তারপর আরবীতে অনুবাদ করতেন।[2]
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হজ্জের সময় ভারতীয় ও পাকিস্তানী হাজীদেরকে হজ্জের মাসআলা-মাসায়েল বর্ণনা করার জন্য মসজিদে নববীতে যহীরের জন্য ‘বাবুস সঊদ’ (সঊদ দরজা) নির্দিষ্ট ছিল। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে উর্দূতে বক্তৃতা দিতেন। একদিন মসজিদে নববীতে প্রচুর লোক সমাগম হয়। তিনি তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে বক্তৃতা দেয়া শুরু করার পর লক্ষ্য করেন যে, চতুস্পার্শ্বে ভারতীয় ও পাকিস্তানী হাজীরা ছাড়াও বহু সংখ্যক আরব হাজী অবস্থান করছেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে আরবীতে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। প্রথমে সামান্য বাধো বাধো ভাব হ’লেও দ্রুত তা দূর হয়ে যায় এবং অনুভব করেন যে, তিনি আরবী ভাষায় বক্তব্য দিতে সক্ষম। এরপর থেকে প্রত্যেক বছর হজ্জের মওসুমে সেখানে আরবীতে বক্তৃতা দিতেন।[3]
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের সময় মসজিদে নববীতে ইহূদীদের আক্রমণের আশংকায় মসজিদের বাতিগুলি বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন আল্লামা যহীরের তেজোদীপ্ত ঈমান তাঁর বাগ্মীসত্তাকে জাগিয়ে তুলে। ফলে তিনি সেখানে উপস্থিত লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে জিহাদের উপর অগ্নিঝরা বক্তৃতায় বলেন, ‘পৃথিবী সবসময় মদীনায় আগন্তুক কাফেলাগুলির পদভারে মুখরিত হওয়ার খবর শুনত। আর আজ আমরা মদীনার রাস্তাঘাটে ইহূদীদের আক্রমণের খবর শুনছি’। একথা বলার সাথে সাথে উপস্থিত যুবক ও বৃদ্ধদের ‘আল-জিহাদ’ ‘আল-জিহাদ’ শ্লোগানে মসজিদে নববী প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। গোটা মদীনায় যেন প্রতিশোধের বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়।[4] সে সময় মসজিদে নববী যিয়ারত করছিলেন আরব বিশ্বের খ্যাতিমান বাগ্মী মোস্তফা আস-সিবাঈ। তিনি শ্লোগান শুনে এগিয়ে গিয়ে যহীরের বক্তব্য শুনেন। বক্তৃতা শেষে যহীরকে ডেকে বলেন, তোমার নাম কি? তিনি বললেন, ইহসান ইলাহী যহীর। সিবাঈ বললেন, তুমিই আমার পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখ। তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। সিবাঈ বললেন, كنت أظن نفسي أخطب العرب ولكن حينما رأيتك اليوم وسمعتك عرفت أنك أخطب العرب ‘আমি নিজেকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বাগ্মী বলে মনে করতাম। কিন্তু আজ তোমাকে দেখে ও তোমার বক্তব্য শুনে আমি বুঝতে পারলাম যে, তুমিই আরবের শ্রেষ্ঠ বাগ্মী’।[5]
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর বিদ্যাবত্তা ও বক্তৃতার খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে আসার পর তিনি ১৯৬৮ সালে লাহোরের ‘প্রাচীন ও প্রথম আহলেহাদীছ জামে মসজিদ’ বলে কথিত[6] চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর আগুনঝরা জুম‘আর খুৎবা শোনার জন্য লাহোরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ মসজিদে লোকজনের ঢল নামত।[7] এখানে খুৎবা প্রদানের ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন। দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ তিনি এখানে খুৎবা প্রদান করেন। যার সুযোগ তিনি খুব কমই হাতছাড়া করতেন।[8]
ছাত্রজীবন থেকেই আল্লামা যহীর বক্তব্য দেয়া শুরু করলেও চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই মূলত তাঁর নিয়মতান্ত্রিক বক্তৃতার নবযাত্রা শুরু হয়। মাতৃভাষা পাঞ্জাবী হ’লেও তিনি সবসময় উর্দূতে বক্তৃতা দিতেন। দেশের যে প্রান্তেই বক্তৃতা দিতে যেতেন সেখানেই প্রচুর লোক সমাগম হ’ত। শ্রোতা সংখ্যা লাখ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকত। মুক্বাল্লিদরাও তাঁর বক্তব্য শুনতে যেত। যেকোন বিষয়েই বক্তব্য দিয়ে বাজিমাত করতেন। অধিকাংশ মানুষ তাঁকে ‘সুরেশে ছানী’ (দ্বিতীয় সুরেশ) বলত। বক্তব্যের হক তিনি যথাযথ আদায় করতেন। কুরআন ও হাদীছ থেকে দলীল এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর উদাহরণ পেশ করতেন।[9] উল্লেখ্য যে, আগা সুরেশ কাশ্মীরী (১৯১৭-১৯৭৫) উপমহাদেশের খ্যাতনামা বাগ্মী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।[10]
১৯৬৮ সালে আইয়ূব খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করার দুঃসাহস দেখাত না। করলেই জেলে পুরে নাস্তানুবাদ করা হ’ত। এমনই এক সন্ধিক্ষণে আল্লামা যহীর লাহোরে ঈদের মাঠে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘১৯৬৮ সালের ঘটনা। আমি মূলতঃ চীনাওয়ালী মসজিদের খতীবের পদে আসীন ছিলাম। সেই সময় ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। ইকবাল পার্কে- যাকে মিন্টু পার্কও বলা হয়, চীনাওয়ালী মসজিদের খতীব হিসাবে ঈদের জামা‘আতে ইমামতি করার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। মাওলানা দাঊদ গযনবীর সময় থেকেই ইকবাল পার্কের ঈদের জামা‘আতকে লাহোরে ‘ঈদে আযাদগাঁ’ রূপে আখ্যায়িত করা হ’ত এবং এখানকার জামা‘আত লাহোরের কয়েকটি বড় ঈদের জামা‘আতের মধ্যে গণ্য হ’ত।
এ সময় ঈদের কয়েকদিন পূর্বে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আনওয়ার-এর উপরে পুলিশের উদ্ধত আচরণের ফলে লাহোর শহরে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। লোকদের প্রত্যাশা ছিল, ঈদে আযাদগাঁর খুৎবায় আইয়ূব খানের সরকারকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত করা হবে। এজন্য ঈদের পূর্বেই আমার কাছে প্রতিনিধি দল আসা শুরু হয়ে যায়। কিছু লোকের ধারণা ছিল, আমি রাজনীতিবিদ নই। সুতরাং আমি অনুমতি দিলে তারা ওখানকার খুৎবার জন্য এমন ব্যক্তিকে নিয়ে আসবেন, যিনি ঐ ঈদের জামা‘আতের ইমামের মর্যাদা, ভাবমূর্তি ও সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখবেন। তখন আমি ঐ বন্ধুদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলি। অতঃপর সেদিন ঈদের খুৎবায় আমি যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তাকে আমার জীবনে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্যও বলা যেতে পারে। আমার ঐ বক্তব্যের প্রভাব এতই গভীর ছিল যে, (বক্তব্যের পর) অনেক মানুষ আবেগের আতিশয্যে নিজেদের জামা ছিঁড়ে ফেলেছিল। আমার স্মরণ আছে, আগা সুরেশ কাশ্মীরীও উক্ত ঈদের খুৎবার শ্রোতা ছিলেন। ঈদের ছালাতের পর আমাকে উনি মিয়াঁ আব্দুল আযীয বার এট ল-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেন, ‘আমি নিজেই বক্তৃতা শিল্পে অনেক দক্ষতা রাখি। কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, ইহসান ইলাহী! যদি তুমি ভবিষ্যতে বক্তৃতা দেয়া ছেড়েও দাও তাহ’লে তোমার এই এক বক্তৃতার দ্বারাই তোমাকে পাক-ভারতের কতিপয় বড় বক্তাদের মাঝে গণ্য করা যেতে পারে’।[11]
মিয়াঁ আব্দুল আযীয ঐ সময় বলেছিলেন, ‘যদি পাক-ভারতের বাগ্মীদের উল্লেখযোগ্য বক্তব্যগুলোকে একত্রিত করা হয় তাহ’লে এই বক্তব্যই শীর্ষস্থানে থাকবে’।[12]
১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার এশার ছালাতের পর শিয়ালকোটের ইকবাল রোডে অবস্থিত আহলেহাদীছ জামে মসজিদে ষষ্ঠ কুরআন ও হাদীছ মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে আল্লামা যহীর তাওহীদের উপর এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। মাসূনন খুৎবা পাঠের পর কুরআন মাজীদের সূরা আ‘রাফের ১৫৮ আয়াত তেলাওয়াতের মাধ্যমে তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিকট জীবিত ব্যক্তিদের ভয় করাও শিরক এবং মৃত ব্যক্তিদের ভয় করাও শিরক। আমরা তাওহীদের তত্ত্বাবধায়ক। আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেই ভয় করি না। আর যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীবের ভয় স্থান দেয়, তিনি তাকে সৃষ্টিজগতের ভয় থেকে মুক্ত করে দেন। এই শিক্ষাই আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) দিয়েছেন’। তিনি আরও বলেন, ‘শুনুন! তাওহীদের সবচেয়ে বড় উপকারিতা এই যে, তাওহীদী আক্বীদা পোষণের পর মানুষ গায়রুল্লাহর ভয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়। এরপর সে আর কাউকে ভয় করে না। কারণ তাওহীদপন্থীর এ দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয় যে, لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ يُحْيِىْ وَيُمِيْتُ ‘তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবিত করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন’ (আ‘রাফ ৭/১৫৮)। মরণও তাঁর আয়ত্ত্বাধীন এবং জীবনও তাঁর আয়ত্ত্বাধীন। তিনি ব্যতীত কেউ মারতে পারেন না, কেউ জীবিত করতেও পারে না। যার বিশ্বাস এরূপ হবে সমগ্র সৃষ্টিজগত তার কিছুই করতে পারবে না’। এরপর আহলেহাদীছদেরকে সম্বোধন করে তিনি দরদমাখা কণ্ঠে বলেন,
اهل حديثو ! الله كا تم پر انعام ہے كہ تم توحيدوالوں كے گهر ميں پيدا ہوئے ہو- تمہيں نهيں معلوم توحيد كى قدر كياہے؟ توحيد كى قدر كسى سے پوچهنى ہے تو اس سے پوچهو جس كو الله نے بعد ميں ہدايت دى ہے -
‘আহলেহাদীছগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হ’ল তোমরা তাওহীদপন্থীদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছ। তাওহীদের মর্যাদা কি- তা তোমাদের জানা নেই? তাওহীদের মর্যাদা জানতে চাইলে ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস কর যাকে আল্লাহ পরে হেদায়াত দান করেছেন’।
او لوگو ! توحيد كى قدر پوچهنى ہے تو ان سے پوچهو، جو شرك كى پستيوں سے نكل كر توحيد كى بلنديوں پہ آئے- اهل حديثو ! كعبہ كے رب كى قسم، تم زندگى كى آخرى لمحات تك اگر خدا كا شكر ادا كرتے رہو، تو اس كے كئے ہوئے انعام كا شكر ادا نهيں كر سكتے كہ الله نے تمہيں اپنى توحيد كا علمبردار بنايا ہے -
‘ওহে লোকসকল! তাওহীদের মর্যাদা জানতে চাইলে ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস কর, যে শিরকের নীচুতা থেকে বের হয়ে তাওহীদের উচ্চতায় পৌঁছেছে। আহলেহাদীছগণ! কা‘বার রবের কসম! তোমরা যদি জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে থাক তাহ’লেও তাঁর কৃত (এই) অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করতে পারবে না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় তাওহীদের ধারক-বাহক বানিয়েছেন’। তিনি আরো বলেন, ‘আজ আমাদের দেশ, জাতি ও জনগণের যত রোগ আছে সেগুলোর মূল হ’ল শিরক’।[13]
আরবী ভাষাতেও আল্লামা যহীর চমৎকার বক্তৃতা দিতেন। যা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। যখন তিনি এ ভাষাতে বক্তব্য দিতেন তখন মনে হ’ত এটা তাঁর মাতৃভাষা। বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে তিনি আরবীতে বক্তৃতা দিয়েছেন। আরবী ভাষার বড় বড় পন্ডিত তাঁর আরবী বক্তৃতা শুনে প্রভাবিত হয়েছে। একজন অনারবের মুখ থেকে বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় বক্তৃতা শুনে তারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে যেত। মোদ্দাকথা, তিনি আরবী ও উর্দূ উভয় ভাষায় প্রথম সারির বক্তা ছিলেন।[14]
শায়খ আব্দুল আযীয আল-ক্বারী বলেন, وكان بالأردية خطيبا مؤثرا بارعا يهيج الجماهير . ‘তিনি উর্দূতে প্রভাব বিস্তারকারী অসাধারণ বক্তা ছিলেন। তিনি জনগণকে আন্দোলিত করতেন’।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর শায়খ মুহাম্মাদ বিন নাছের আল-‘আবূদী বলেন, كان خطيبا مةفوقا قليل النظير في فصاحةه وخاصة باللغة العربية ‘তিনি শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ছিলেন। শুদ্ধভাষিতায় বিশেষ করে আরবী ভাষায় তাঁর সমকক্ষ খুব কমই ছিল’।[15]
ড. লোকমান সালাফী বলেন, ‘তিনি কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী বক্তৃতা করতেন। আর তাঁর হাতে থাকত কুরআন মাজীদ। তিনি সত্য প্রকাশ করতেন এবং নিরবচ্ছিন্ন ও অবিশ্রান্তভাবে বাতিলকে প্রতিরোধ করতেন। আর শ্রোতারা পিন-পতন-নীরবতার সাথে তাঁর বক্তব্য শ্রবণ করতো। তারা নড়াচড়া করত না এবং বিরক্তও হ’ত না। বরং আরো বেশিক্ষণ বক্তব্য দিতে বলত। এভাবে তিনি এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদ এবং এক স্টেজ থেকে আরেক স্টেজে ছুটে বেড়াতেন। যেন তিনি তাঁর সময়ে ইসলামের সবচেয়ে বড় মুখপাত্র এবং ইসলামের দুঃসাহসী প্রতিরক্ষক। ভীরুতা ও দুর্বলতা কী জিনিস তা তিনি জানতেন না’।[16]
তিনি ‘খতীবে মিল্লাত’ ও ‘খতীবে কওম’ রূপে সর্বমহলে বরিত হতেন। বিরোধী দলের অনেক লোকও বক্তব্য শেখার জন্য তাঁর কাছে আসত। পাকিস্তানীরা এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেন যে, তিনি ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী।[17]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৩।
[2]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৪।
[3]. ঐ, পৃঃ ৪৩-৪৪।
[4]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২২-২৩।
[5]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩।
[6]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন (পিএইচ.ডি থিসিস), পৃঃ ৩৮২।
[7]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৮; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[8]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩।
[9]. প্রফেসর মুহাম্মাদ ইয়ামীন মুহাম্মাদী, ‘ইসলাম কা বেবাক সিপাহী, বেমেছাল মুছান্নিফ ইহসান ইলাহী’ মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৭।
[10]. তিনি আতাউল্লাহ শাহ বুখারী এবং মাওলানা আবুল কালাম আযাদের রাজনৈতিক শিষ্য ছিলেন। তিনি খাঁটি তাওহীদপন্থী এবং শিরক ও বিদ‘আতের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার উল্লেখ্যযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে ছিল (১) মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর জীবন ও চিন্তাধারা (২) মাওলানা আবুল কালাম আযাদের জীবন ও চিন্তাধারা (৩) তাহরীকে খতমে নবুঅত (৪) তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘মাযামীনে সুরেশ’।
[11]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫২।
[12]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[13]. হাফেয হাফীযুল্লাহ, ‘শিয়ালকোট মেঁ শহীদে মিল্লাত হযরত আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর কা আখেরী ইয়াদগার খেতাব’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ৩৮-৫২।
[14]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২২, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৭-১৮।
[15]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৬।
[16]. ‘আল-ইস্তিজাবা’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৩-৩৪।
[17]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩, ২১৫।
আল্লামা যহীর একজন বড় মাপের মুবাল্লিগ ছিলেন। দ্বীনের তাবলীগের জন্য তিনি পাকিস্তানের শহর-নগর, গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন। কখনো কখনো এক রাত্রিতে তিনি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লাহোর ও করাচীতে ৪টি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন ও জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেছেন।[1] হাযার হাযার মানুষ তাঁর বক্তব্য শুনে ইসলামের নিকটবর্তী হয়েছে। যারা বংশগতভাবে মুসলমান ছিল তারা আমলী মুসলমানে পরিণত হয়েছে। বহু লোক তাঁর বক্তব্য শুনে শিরক-বিদ‘আত ছেড়ে তাওহীদের আলোকোজ্জ্বল পথে ফিরে এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন কনফারেন্সে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। সঊদী আরব ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্র ছাড়াও তিনি বেলজিয়াম, হল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, স্পেন, ইতালী, ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া, ভিয়েনা, ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, হংকং, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, চীন, ইরান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য তাবলীগী সফর করেছেন।[2] তাঁর তাবলীগী সফর প্রায় দশ লক্ষ মাইল অতিক্রম করেছে।[3]
[1]. ঐ, পৃঃ ২১৯।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২০, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৮।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২২।
[1]. ঐ, পৃঃ ২১৯।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২০, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৮।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২২।
১৯৬৮ সালে লাহোরে ঈদের মাঠে আইয়ূব খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ইহসান ইলাহী যহীর যে জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেছিলেন তা তাঁকে রাজনীতিতে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘ঈদের ছালাতের খুৎবায় আমি যে বক্তব্য প্রদান করি তাকে আমার প্রথম রাজনৈতিক ভাষণও বলা যেতে পারে’। তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও বাগ্মী আগা সুরেশ কাশ্মীরী বলেছিলেন, ‘তুমি যদি ভবিষ্যতে বক্তৃতা দেয়া ছেড়েও দাও তাহ’লে তোমার এই এক বক্তৃতার দ্বারাই তোমাকে পাক-ভারতের কতিপয় বড় বক্তাদের মাঝে গণ্য করা যেতে পারে’। আগা সুরেশ কাশ্মীরীর এই প্রশংসাসূচক মন্তব্য সম্পর্কে আল্লামা যহীর বলেন, ‘আগা সুরেশ কাশ্মীরীর এই কথাগুলো আমার আগ্রহের পারদ বাড়িয়ে দেয় এবং আমার এই বক্তৃতা আমাকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত করে তুলে। অনেক দিন পর্যন্ত আমার এই বক্তব্যের গর্জন দেশময় শুনা গিয়েছিল। এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনিতে পুরা লাহোর শহর কেঁপে উঠেছিল। বস্ত্ততঃ আমার এই ভাষণ আমাকে রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ ময়দানে নিয়ে এসেছিল’।[1] এভাবে আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে তিনি শরীক হন। নওয়াবযাদা নাছরুল্লাহ খান আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে ‘জমহূরী মাহায’ নামে আন্দোলন জোরদার করলে আল্লামা যহীর তার সাথে যোগ দেন।[2]
জেনারেল ইয়াহ্ইয়া খান, যুলফিকার আলী ভুট্টো (মৃঃ ১৯৭৯) ও যিয়াউল হকের (১৯২৪-৮৮) সময়ও তিনি রাজনীতিতে পুরাপুরি সক্রিয় ছিলেন। এসব স্বৈরশাসকদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন। এজন্য তাঁকে জেলের ঘানিও টানতে হয়েছে। ভুট্টোর সময় তাঁর বিরুদ্ধে ৯৫টি রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়। যার মধ্যে হত্যা মামলাও ছিল।[3] মাহবূব জাবেদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যদি আপনি যুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে ইসলামী দলগুলির প্রতি দৃষ্টি দেন, তাহ’লে সেগুলির মধ্যে জমঈয়তে আহলেহাদীছ এবং এর নওজোয়ান মুখপাত্র ইহসান ইলাহী যহীর-এর ভূমিকা যেকোন ইসলামী সংগঠন বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের তুলনায় কম কার্যকর দেখবেন না। যুলফিকার আলী ভুট্টোর সময় আমাকে জেল-যুলুমের সম্মুখীন হ’তে হয়েছে। ওলামায়ে কেরাম এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে আমিই বৃষ্টির প্রথম ফোঁটার ভূমিকা পালন করেছিলাম। আমাকে শারীরিকভাবে কষ্টও দেয়া হয়েছিল’।[4]
উল্লেখ্য, জেল-যুলুমে নাস্তানাবুদ করেও বাগে আনতে না পেরে ভুট্টোর পক্ষ থেকে তাঁকে তাঁর পছন্দমত যেকোন আরব রাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আপোষহীন ইহসান ইলাহী যহীর সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।[5]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর ’৮৭, পৃঃ ৫২।
[2]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[3]. ঐ।
[4]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫২।
[5]. Dr. Ali bin Musa az-Zahrani, The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, p. 78.
জেনারেল ইয়াহ্ইয়া খান, যুলফিকার আলী ভুট্টো (মৃঃ ১৯৭৯) ও যিয়াউল হকের (১৯২৪-৮৮) সময়ও তিনি রাজনীতিতে পুরাপুরি সক্রিয় ছিলেন। এসব স্বৈরশাসকদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন। এজন্য তাঁকে জেলের ঘানিও টানতে হয়েছে। ভুট্টোর সময় তাঁর বিরুদ্ধে ৯৫টি রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়। যার মধ্যে হত্যা মামলাও ছিল।[3] মাহবূব জাবেদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যদি আপনি যুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে ইসলামী দলগুলির প্রতি দৃষ্টি দেন, তাহ’লে সেগুলির মধ্যে জমঈয়তে আহলেহাদীছ এবং এর নওজোয়ান মুখপাত্র ইহসান ইলাহী যহীর-এর ভূমিকা যেকোন ইসলামী সংগঠন বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের তুলনায় কম কার্যকর দেখবেন না। যুলফিকার আলী ভুট্টোর সময় আমাকে জেল-যুলুমের সম্মুখীন হ’তে হয়েছে। ওলামায়ে কেরাম এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে আমিই বৃষ্টির প্রথম ফোঁটার ভূমিকা পালন করেছিলাম। আমাকে শারীরিকভাবে কষ্টও দেয়া হয়েছিল’।[4]
উল্লেখ্য, জেল-যুলুমে নাস্তানাবুদ করেও বাগে আনতে না পেরে ভুট্টোর পক্ষ থেকে তাঁকে তাঁর পছন্দমত যেকোন আরব রাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আপোষহীন ইহসান ইলাহী যহীর সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।[5]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর ’৮৭, পৃঃ ৫২।
[2]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[3]. ঐ।
[4]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫২।
[5]. Dr. Ali bin Musa az-Zahrani, The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, p. 78.
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর একবার বুরেওয়ালায় বক্তব্য প্রদান করে ট্যাক্সিযোগে খানেওয়াল যাচ্ছিলেন। তাঁর সাথে একজন উকিল ও ছাত্রনেতা ছিল। নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ট্যাক্সি ড্রাইভারের তন্দ্রা আসলে ট্যাক্সি নদীতে পড়ে যায়। এতে তিনি ও তাঁর সাথীদ্বয় আহত হন। কিন্তু ট্যাক্সি ড্রাইভার ঘটনাস্থলেই মারা যায়। সে সময় পাঞ্জাবের গভর্ণর গোলাম মোস্তফা খার ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টির’ (পিপিপি) সদস্য বলে দাবী করেন এবং তাকে হত্যার জন্য যহীরকে দায়ী করে লাহোরে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের করেন। যহীর বলেন, ‘পাঞ্জাবের শতবর্ষের পুরনো ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথম ঘটনা ছিল যে, খোদ পাঞ্জাবের গভর্ণর কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন’। তিনি আরো বলেন, ‘আমাকে রামাযান মাসে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কিছু খেতে দেয়া হয়নি। আমার ১০৪ ডিগ্রী জ্বর হয়েছিল এবং এই অবস্থায় যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তখন গোলাম মোস্তফা খারের নির্দেশে শুধু হাসপাতালে পুলিশ প্রহরাই বসানো হয়নি; বরং আমার পায়ে বেড়ীও পরানো হয়েছিল’। এই মিথ্যা মামলায় যামিন নেয়ার জন্য সেশন কোর্ট, হাইকোর্ট থেকে ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।[1] জেলখানায় থাকা অবস্থায়ও তিনি কয়েদীদেরে মধ্যে দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যান এবং অনেকেই তাঁর দাওয়াতে প্রভাবিত হয়।[2]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৩।
[2]. The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, p. 78.
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৩।
[2]. The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, p. 78.
রাজনৈতিক তৎপরতা ও জ্বালাময়ী ভাষণের কারণে আল্লামা যহীর ভুট্টো সরকার বিশেষত পাঞ্জাবের তদানীন্তন গভর্ণর গোলাম মোস্তফা খার-এর কোপানলে পড়েন। পাকিস্তানের প্রায় সকল শহরেই তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়। একা তাঁর পক্ষে এ সকল মামলার মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘মোকদ্দমাগুলো পরিচালনার জন্য প্রত্যেক শহরে উকিলের প্রয়োজন হ’ত। আমি চিন্তা করলাম, আমাকে কোন রাজনৈতিক দলে যোগদান করতে হবে। আমি এয়ার মার্শাল আছগর খানের ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম। আমি (১৯৭২ সালে) ‘তাহরীকে ইস্তেকলাল’ পার্টিতে যোগদান করি এবং আমাকে এ পার্টির কেন্দ্রীয় তথ্য সম্পাদক বানানো হয়। ১৯৭৭ সালের আন্দোলনের সময় আমি তাহরীকে ইস্তেকলাল-এর ভারপ্রাপ্ত প্রধানও ছিলাম’।
১৯৭৮ সালে নিম্নোক্ত কারণে তিনি এ দল ত্যাগ করেন। এক- উক্ত পার্টিতে যোগদানের পর আছগর খানের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতা লক্ষ্য করেন। তিনি খেয়াল করেন যে, আছগর খান চামচা স্বভাবের লোকদের বেশী পসন্দ করেন। যারা তাঁর সব কথায় ‘জো হুকুম’ বলে কপট আনুগত্য প্রকাশ করে। এ ধরনের লোকদেরকেই তিনি দলের সক্রিয় (?) নেতা-কর্মী বলে মনে করতেন। দুই- উক্ত পার্টি ত্যাগ করার দ্বিতীয় কারণ ছিল মালেক উযীর আলী। যহীর বলেন, ‘ইনি এক আজব কিসিমের লোক ছিলেন। যখনই দলের উপর কোন ঝক্কি-ঝামেলা আসত, তখনই ইনি ছুটি নিতেন’। ইনিও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন না। সেজন্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী যারা দলে ছিল তাদের বিরুদ্ধে আছগর খানের কান ভারি করতেন। তাছাড়া তিনি সমাজতান্ত্রিকও ছিলেন। ইসলামকে মোটেই সহ্য করতেন না। তিনি আছগর খানকে ক্ষমতা দখলের চোরাগলি দেখাতেন। ফলে আছগর খানও তার প্ররোচনায় ক্ষমতা লাভের নেশায় মদমত্ত হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার জন্য তার যেন আর তর সইছিল না। ভুট্টোর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্য মনে করতে থাকেন। জেনারেল যিয়াউল হক তার এই উচ্চাভিলাষ আঁচ করতে পেরে তাকে প্রধানমন্ত্রী করার লোভ দেখান। এতে তিনি যিয়াউল হকের কাছে ঘেঁষতে থাকেন। এদিকে যিয়াউল হক তাঁর ক্ষমতা নিষ্কণ্টক ও মার্শাল ল’ প্রলম্বিত করার জন্য ভুট্টোর পতনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী রাজনৈতিক জোট ‘পাকিস্তান কওমী ইত্তেহাদ’ (Pakistan National Alliance) ভেঙ্গে যাক তা মনে-প্রাণে কামনা করছিলেন। তাই তিনি আছগর খানকে ইরান সফরে গিয়ে ইরানী প্রেসিডেন্ট রেযা শাহ পাহলভীর এন.ও.সি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নিয়ে আসতে বলেন। ইরান থেকে ফিরে আছগর খান ‘কওমী ইত্তেহাদ’-এর সাথে ‘ইস্তেকলাল পার্টির’ সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করেন। ফলে রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে যহীর ইস্তেকলাল পার্টি ত্যাগ করেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার নিকট ঐ দুঃসময়ে ‘কওমী ইত্তেহাদ’-এর সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা জাতির সাথে বড় ধরনের গাদ্দারীর শামিল ছিল’।[2]
সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা অবস্থায় তিনি কখনো আপোষকামিতাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিতেন না। কোন লোভ-লালসা তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি। জেনারেল যিয়াউল হক তাঁকে ধর্মমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।[3]
[1]. ১৯৭২ সালের ১লা মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে এই পার্টির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। এয়ার মার্শাল আছগর খান এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে এটি ‘গণঐক্য আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছিল। দ্রঃ Nadeem Shafiq Malik, The formation of the Tehrik-i-Istiqlal and the General Elections of 1970, Pakistan Journal of History and Culture, Vol. 13, No. 2, July-December 1992, National Institute of Historical and Cultural Research, Islamabad, Pakistan, p. 89-92.
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৪-৫৫।
[3]. The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 78.
১৯৭৮ সালে নিম্নোক্ত কারণে তিনি এ দল ত্যাগ করেন। এক- উক্ত পার্টিতে যোগদানের পর আছগর খানের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতা লক্ষ্য করেন। তিনি খেয়াল করেন যে, আছগর খান চামচা স্বভাবের লোকদের বেশী পসন্দ করেন। যারা তাঁর সব কথায় ‘জো হুকুম’ বলে কপট আনুগত্য প্রকাশ করে। এ ধরনের লোকদেরকেই তিনি দলের সক্রিয় (?) নেতা-কর্মী বলে মনে করতেন। দুই- উক্ত পার্টি ত্যাগ করার দ্বিতীয় কারণ ছিল মালেক উযীর আলী। যহীর বলেন, ‘ইনি এক আজব কিসিমের লোক ছিলেন। যখনই দলের উপর কোন ঝক্কি-ঝামেলা আসত, তখনই ইনি ছুটি নিতেন’। ইনিও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন না। সেজন্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী যারা দলে ছিল তাদের বিরুদ্ধে আছগর খানের কান ভারি করতেন। তাছাড়া তিনি সমাজতান্ত্রিকও ছিলেন। ইসলামকে মোটেই সহ্য করতেন না। তিনি আছগর খানকে ক্ষমতা দখলের চোরাগলি দেখাতেন। ফলে আছগর খানও তার প্ররোচনায় ক্ষমতা লাভের নেশায় মদমত্ত হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার জন্য তার যেন আর তর সইছিল না। ভুট্টোর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্য মনে করতে থাকেন। জেনারেল যিয়াউল হক তার এই উচ্চাভিলাষ আঁচ করতে পেরে তাকে প্রধানমন্ত্রী করার লোভ দেখান। এতে তিনি যিয়াউল হকের কাছে ঘেঁষতে থাকেন। এদিকে যিয়াউল হক তাঁর ক্ষমতা নিষ্কণ্টক ও মার্শাল ল’ প্রলম্বিত করার জন্য ভুট্টোর পতনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী রাজনৈতিক জোট ‘পাকিস্তান কওমী ইত্তেহাদ’ (Pakistan National Alliance) ভেঙ্গে যাক তা মনে-প্রাণে কামনা করছিলেন। তাই তিনি আছগর খানকে ইরান সফরে গিয়ে ইরানী প্রেসিডেন্ট রেযা শাহ পাহলভীর এন.ও.সি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নিয়ে আসতে বলেন। ইরান থেকে ফিরে আছগর খান ‘কওমী ইত্তেহাদ’-এর সাথে ‘ইস্তেকলাল পার্টির’ সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করেন। ফলে রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে যহীর ইস্তেকলাল পার্টি ত্যাগ করেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার নিকট ঐ দুঃসময়ে ‘কওমী ইত্তেহাদ’-এর সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা জাতির সাথে বড় ধরনের গাদ্দারীর শামিল ছিল’।[2]
সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা অবস্থায় তিনি কখনো আপোষকামিতাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিতেন না। কোন লোভ-লালসা তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি। জেনারেল যিয়াউল হক তাঁকে ধর্মমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।[3]
[1]. ১৯৭২ সালের ১লা মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে এই পার্টির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। এয়ার মার্শাল আছগর খান এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে এটি ‘গণঐক্য আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছিল। দ্রঃ Nadeem Shafiq Malik, The formation of the Tehrik-i-Istiqlal and the General Elections of 1970, Pakistan Journal of History and Culture, Vol. 13, No. 2, July-December 1992, National Institute of Historical and Cultural Research, Islamabad, Pakistan, p. 89-92.
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৪-৫৫।
[3]. The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 78.
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) নিছক ক্ষমতালিপ্সার বশবর্তী হয়ে রাজনীতিতে জড়াননি; বরং পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের জন্য এটিকে আল্লাহ্র পথে দাওয়াতের একটা ক্ষেত্র হিসাবে তিনি এটাকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতিতে জড়িত থাকা অবস্থায় আক্বীদার ব্যাপারে কখনো আপোষ করেননি। আহলেহাদীছ চিন্তাধারার প্রচার-প্রসারে ও নিজেকে আহলেহাদীছ বলে পরিচয় দিতে তিনি কখনো বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর উপস্থিতি সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে আহলেহাদীছদেরকে পরিচিত করেছিল- এতে কোন সন্দেহ নেই।[1]
২. তিনি মনে করতেন যে, ইসলাম সকল যুগ-কাল ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে ধর্মকে বিদায় দিয়ে ( فصل الدين عن الدولة ) ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করতেন।[2]
৩. রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় থাকাকালে তিনি কখনো সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ( الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر ) থেকে বিরত থাকেননি; বরং যখনই রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শরী‘আত বিরোধী কোন কাজ সংঘটিত হতে দেখেছেন তখনই নির্ভীকচিত্তে দৃপ্তকণ্ঠে তার প্রতিবাদ করেছেন।
যেমন- (ক) একবার এক স্থানে কয়েকজন মন্ত্রী একত্রিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আললামা যহীর সেখানে শিরক ও ব্রেলভীদের সম্পর্কে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। অথচ উপস্থিতির মধ্যে অধিকাংশই ব্রেলভী ছিলেন এবং অনেক মন্ত্রীও ব্রেলভীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি সেখানে বলেন, ‘ব্রেলভীরা মৃত ব্যক্তিদের নিকট সাহায্য চায় এবং এতদুদ্দেশ্যে তাদের কবর যিয়ারত করে। এটা প্রকাশ্য শিরক’। তাঁর বক্তব্য শুনে অনেকে বলা শুরু করে, যদি এটাই ওহাবীদের আক্বীদা হয়, তাহলে আমরাও ওহাবী। কারণ আমাদের অনেকেই মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য চাওয়া এবং এজন্য তাদের কবর যিয়ারত করায় বিশ্বাস করে না। তাছাড়া ব্রেলভীদের বিরুদ্ধে ‘আল-ব্রেলভিয়া আক্বাইদ ওয়া তারীখ’ নামে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছিলেন। যদি ক্ষমতার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে তিনি রাজনীতি করতেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের বই লিখে তাদের ক্রোধের পাত্র হতেন না। কারণ সে সময় অনেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সাধারণ অনেক মানুষ ব্রেলভী মতবাদে বিশ্বাসী ছিল।[3]
খ. একদিন পাঞ্জাবের জনৈক গভর্ণর (সম্ভবতঃ গোলাম মোস্তফা খার) আলেমদেরকে ডেকে তাদেরকে গালি-গালাজ করে শাসান এবং অসম্মান করেন। সেখানে যহীরও উপস্থিত ছিলেন। গভর্ণর তাঁর বক্তব্য শেষ করলে নির্ভীক আল্লামা যহীর তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন এবং আলেমদেরকে অসম্মান করার পরিণতি ভাল হবে না বলে উল্টো গভর্ণরকে হুঁশিয়ার করে দেন। তাঁর এই সাহসী ভূমিকার জন্য আলেমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।[4]
গ. পাঞ্জাবের আরেকজন গভর্ণর ছূফী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ৫ম শতকের লাহোরের খ্যাতিমান ছূফী আলী হুজূরী লাহোরীর (মৃঃ ৪৬৫ হিঃ) কবরে গিয়ে বরকত হাছিল করতেন এবং গোলাপপানি দিয়ে তার কবর ধুয়ে দিতেন। আল্লামা যহীর তাকে এ শিরকী ও শরী‘আত বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন।[5]
৪. যুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে তাঁর পসন্দমত যেকোন আরব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হওয়ার এবং জেনারেল যিয়াউল হক ধর্মমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।[6] এসব প্রস্তাবকে পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের আন্দোলন এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ থেকে বিরত রাখার একটা সস্তা মূল্য ও অপকৌশল মনে করে তিনি এ দু’টি প্রস্তাবই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যদি তিনি ক্ষমতাগৃধুণ হতেন তাহলে এসব লোভনীয় প্রস্তাব কখনই ফিরিয়ে দিতেন না।
৫. জেনারেল যিয়াউল হক তাঁকে ওলামা এডভাইজারী কাউন্সিলের সদস্য করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নে আন্তরিক ভেবেই আল্লামা যহীর এই কাউন্সিলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাষায় ‘যখন আমার এই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো যে, জেনারেল মুহাম্মাদ যিয়াউল হক ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নে আন্তরিক নন, তখন আমি এডভাইজারী কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে ইস্তেফা দিয়েছিলাম। (১০/১২ জন আলেমের মধ্যে) আমিই একমাত্র সদস্য ছিলাম, যে নিজেই এডভাইজারী কাউন্সিলকে ত্যাগ করেছিল। আমার সাথে অন্য যে ব্যক্তিরা সেই কাউন্সিলে ছিল তাদেরকে এডভাইজারী কাউন্সিলই পরিত্যাগ করেছিল। তারা শেষাবধি ওটাকে আঁকড়ে ধরেছিল’।[7]
এডভাইজারী কাউন্সিল ত্যাগের পর তিনি যিয়াউল হকের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। তিনি তাঁকে বলতেন, ‘যদি আপনি কথায় নয় বাস্তবে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়ন করেন, তাহলে আমি কস্মিনকালেও আপনার বিরোধিতা করব না’।[8]
মোটকথা, পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের ঈপ্সিত লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং এতে আহলেহাদীছ আন্দোলন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।[9]
[1]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 77.
[2]. ‘আল-ইস্তিজাবা’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৫।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৭-২৮।
[4]. ঐ, পৃঃ ৫২-৫৩।
[5]. ঐ, পৃঃ ৫৩।
[6]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, p. 78.
[7]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৭।
[8]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫১।
[9]. রাজনীতিতে যোগদান করাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।- সম্পাদক।
২. তিনি মনে করতেন যে, ইসলাম সকল যুগ-কাল ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে ধর্মকে বিদায় দিয়ে ( فصل الدين عن الدولة ) ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করতেন।[2]
৩. রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় থাকাকালে তিনি কখনো সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ( الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر ) থেকে বিরত থাকেননি; বরং যখনই রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শরী‘আত বিরোধী কোন কাজ সংঘটিত হতে দেখেছেন তখনই নির্ভীকচিত্তে দৃপ্তকণ্ঠে তার প্রতিবাদ করেছেন।
যেমন- (ক) একবার এক স্থানে কয়েকজন মন্ত্রী একত্রিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আললামা যহীর সেখানে শিরক ও ব্রেলভীদের সম্পর্কে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। অথচ উপস্থিতির মধ্যে অধিকাংশই ব্রেলভী ছিলেন এবং অনেক মন্ত্রীও ব্রেলভীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি সেখানে বলেন, ‘ব্রেলভীরা মৃত ব্যক্তিদের নিকট সাহায্য চায় এবং এতদুদ্দেশ্যে তাদের কবর যিয়ারত করে। এটা প্রকাশ্য শিরক’। তাঁর বক্তব্য শুনে অনেকে বলা শুরু করে, যদি এটাই ওহাবীদের আক্বীদা হয়, তাহলে আমরাও ওহাবী। কারণ আমাদের অনেকেই মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য চাওয়া এবং এজন্য তাদের কবর যিয়ারত করায় বিশ্বাস করে না। তাছাড়া ব্রেলভীদের বিরুদ্ধে ‘আল-ব্রেলভিয়া আক্বাইদ ওয়া তারীখ’ নামে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছিলেন। যদি ক্ষমতার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে তিনি রাজনীতি করতেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের বই লিখে তাদের ক্রোধের পাত্র হতেন না। কারণ সে সময় অনেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সাধারণ অনেক মানুষ ব্রেলভী মতবাদে বিশ্বাসী ছিল।[3]
খ. একদিন পাঞ্জাবের জনৈক গভর্ণর (সম্ভবতঃ গোলাম মোস্তফা খার) আলেমদেরকে ডেকে তাদেরকে গালি-গালাজ করে শাসান এবং অসম্মান করেন। সেখানে যহীরও উপস্থিত ছিলেন। গভর্ণর তাঁর বক্তব্য শেষ করলে নির্ভীক আল্লামা যহীর তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন এবং আলেমদেরকে অসম্মান করার পরিণতি ভাল হবে না বলে উল্টো গভর্ণরকে হুঁশিয়ার করে দেন। তাঁর এই সাহসী ভূমিকার জন্য আলেমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।[4]
গ. পাঞ্জাবের আরেকজন গভর্ণর ছূফী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ৫ম শতকের লাহোরের খ্যাতিমান ছূফী আলী হুজূরী লাহোরীর (মৃঃ ৪৬৫ হিঃ) কবরে গিয়ে বরকত হাছিল করতেন এবং গোলাপপানি দিয়ে তার কবর ধুয়ে দিতেন। আল্লামা যহীর তাকে এ শিরকী ও শরী‘আত বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন।[5]
৪. যুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে তাঁর পসন্দমত যেকোন আরব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হওয়ার এবং জেনারেল যিয়াউল হক ধর্মমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।[6] এসব প্রস্তাবকে পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের আন্দোলন এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ থেকে বিরত রাখার একটা সস্তা মূল্য ও অপকৌশল মনে করে তিনি এ দু’টি প্রস্তাবই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যদি তিনি ক্ষমতাগৃধুণ হতেন তাহলে এসব লোভনীয় প্রস্তাব কখনই ফিরিয়ে দিতেন না।
৫. জেনারেল যিয়াউল হক তাঁকে ওলামা এডভাইজারী কাউন্সিলের সদস্য করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নে আন্তরিক ভেবেই আল্লামা যহীর এই কাউন্সিলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাষায় ‘যখন আমার এই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো যে, জেনারেল মুহাম্মাদ যিয়াউল হক ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নে আন্তরিক নন, তখন আমি এডভাইজারী কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে ইস্তেফা দিয়েছিলাম। (১০/১২ জন আলেমের মধ্যে) আমিই একমাত্র সদস্য ছিলাম, যে নিজেই এডভাইজারী কাউন্সিলকে ত্যাগ করেছিল। আমার সাথে অন্য যে ব্যক্তিরা সেই কাউন্সিলে ছিল তাদেরকে এডভাইজারী কাউন্সিলই পরিত্যাগ করেছিল। তারা শেষাবধি ওটাকে আঁকড়ে ধরেছিল’।[7]
এডভাইজারী কাউন্সিল ত্যাগের পর তিনি যিয়াউল হকের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। তিনি তাঁকে বলতেন, ‘যদি আপনি কথায় নয় বাস্তবে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়ন করেন, তাহলে আমি কস্মিনকালেও আপনার বিরোধিতা করব না’।[8]
মোটকথা, পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের ঈপ্সিত লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং এতে আহলেহাদীছ আন্দোলন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।[9]
[1]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 77.
[2]. ‘আল-ইস্তিজাবা’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৫।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৭-২৮।
[4]. ঐ, পৃঃ ৫২-৫৩।
[5]. ঐ, পৃঃ ৫৩।
[6]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, p. 78.
[7]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৭।
[8]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫১।
[9]. রাজনীতিতে যোগদান করাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।- সম্পাদক।
১৯৭৮ সালে ইস্তেকলাল পার্টি ত্যাগের পর অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে জমঈয়তে আহলেহাদীছে ফিরে এসে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করার জন্য অনুরোধ করেন। ইতিপূর্বে উক্ত পার্টিতে যোগ দিলেও তাঁর ভাষায় তিনি কখনো ‘চিন্তাধারার’ দিক থেকে জমঈয়ত থেকে পৃথক হননি। অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তাঁর উদ্যোগে ১৯৮১ সালে জামে‘আ মুহাম্মাদিয়া, গুজরানওয়ালাতে বিশাল সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনে জমঈয়তে আহলেহাদীছ নতুনভাবে গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চার হাযার আলেমের মধ্য থেকে বাছাইকৃত ৮ জন বিশিষ্ট আলেমের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি ইহসান ইলাহীকে জমঈয়তের আমীর করার সুফারিশ করে। কিন্তু তিনি উক্ত দায়িত্ব নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে জমঈয়তের একজন সদস্য হিসাবে কাজ চালিয়ে যাওয়াকে প্রাধান্য দেন। ফলে ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’ নামে উক্ত সম্মেলনে গঠিত নতুন এই সংগঠনের প্রথম আমীর হন শায়খুল হাদীছ মাওলানা আব্দুল্লাহ এবং সেক্রেটারী জেনারেল হন মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন শেখুপুরী।[1]
‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’ গঠনের পর সংগঠনটি প্রেসিডেন্ট যিয়াউল হকের কোপানলে পড়ে। আল্লামা যহীরের উপর মিথ্যা মামলার খড়গ ঝুলানো হয়। কিন্তু তাতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তিনি বলেন, ‘মার্শাল ল’ সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে যখন বার বার হেনস্তা করা হ’তে থাকে তখন আমার আহলেহাদীছ বন্ধুবর্গ জমঈয়তের দায়িত্ব পালনের জন্য জোরাজুরি শুরু করেন। জমঈয়তের জেনারেল সেক্রেটারী আমার জন্য পদত্যাগ করেন এবং আমাকে সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত করা হয়’।[2] জর্ডানের ‘আশ-শরী‘আহ’ পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, وفي عام ১৯৮৩ م انتخبت أمينا عاما لجمعية أهل الحديث في باكستان والجمعية تضم ৭৫০ فرعا في باكستان . ‘আমি ১৯৮৩ সালে জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানের সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত হই। পাকিস্তানে জমঈয়তের ৭৫০টি শাখা রয়েছে’।[3] তখন জমঈয়তের সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ছিল বলে তিনি উক্ত সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।[4] তিনি আরো বলেন, কোন গ্রাম বা শহর পাওয়া যাবে না যেখানে জমঈয়তের কোন শাখা নেই’। জমঈয়তের অধীনে পাঁচ হাযার বিশিষ্ট আলেম রয়েছেন বলে তিনি এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।[5]
১৯৮৩ সালে বাধ্য হয়ে উক্ত পদ গ্রহণের পর তিনি ঘুমন্ত আহলেহাদীছ সমাজকে জাগানোর প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ড. আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আযীয ইয়াহ্ইয়া বলেন, There is no doubt that he presented as much as he was able to at the time all of which had a good effect for Ahl ul-Hadeeth in Pakistan and their Salafi brothers in other parts of the world. ‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সে সময় তিনি তাঁর সাধ্যানুযায়ী যতটুক করতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের আহলেহাদীছ এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে তাদের সালাফী ভাইদের জন্য তার একটা কার্যকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল’।[6]
পাকিস্তান ও বহির্বিশ্বে জমঈয়তের পরিচিতি বৃদ্ধিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। জালসা, সম্মেলন, প্রেস কনফারেন্স প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি আহলেহাদীছ আন্দোলনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন। ড. অছিউল্লাহ মুহাম্মাদ আববাস বলেন, He was an example of sincerity and dedication to dawah to Allah via the media, sermons in masajid, general gatherings. He also has huge efforts in guiding the youth to the salafi aqeedah and made many long travels in the path of dawah. ‘মিডিয়া, মসজিদের খুৎবা, জালসা-সম্মেলন প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহর পথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে তিনি আন্তরিকতা ও ত্যাগের এক দৃষ্টান্ত ছিলেন। যুবকদেরকে সালাফী আক্বীদার দিকে পরিচালিত করার জন্য তাঁর দারুণ প্রচেষ্টা ছিল এবং দাওয়াতের জন্য তিনি দীর্ঘ সফর করেছেন’।[7] যুবক-বৃদ্ধ, আলেম, মুবাল্লিগ, শিক্ষক, চিন্তাবিদ সবাই তাঁর তরুণ নেতৃত্বের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাওয়াতী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খতমে নবুঅত কনফারেন্সে তিনি বলেছিলেন, ‘সম্মানিত ভ্রাতৃমন্ডলী! আহলেহাদীছের একজন সামান্য খাদেম হিসাবে আমার জন্য এটা বড়ই সৌভাগ্যের কথা যে, এমন এক সময় এ ঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করা হয়েছিল, যখন ঘরের লোকেরা নিদ্রামগ্ন ছিল।... অল্প কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর আমি অনুভব করছি যে, এখন ঘরের মালিক জেগে উঠেছে। আমার এই বিশ্বাস ছিল যে, ঘুমন্ত সিংহ যখন জেগে ওঠে তখন সে সিংহমূর্তিই ধারণ করে। আর আজ এই সিংহ শুধু জেগেই ওঠেনি; বরং স্বীয় আবাস থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে’।[8]
রাজনৈতিক বিষয়ে ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছে’র (প্রতিষ্ঠা : ২৪শে জুলাই ১৯৪৮) নীরব ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে আল্লামা যহীর ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’ গঠনের পর জমঈয়তকে দেশের রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং আহলেহাদীছ যুবকদের জন্য ‘আহলেহাদীছ ইয়ুথ ফোর্স’ গঠন করেন। তাদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জনশক্তিতে পরিণত করেন।[9]
যুবকদেরকে সচেতন করার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবাদতুল্য। ১২ই রবীঊল আউয়াল ১৪০৭ হিজরীতে জিন্নাহ হল, লাহোরে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন,
ميرى ايک ہی خواہش ہے ميرى ايک ہی آرزو ہے - ميرى تگ ودو كا ايك ہی مقصدہے- ميرى جد وجهد كا ايک ہی مطلوب ہے اور وه يہ ہے كہ اہل حديث كے جوان اپنے آقا كى شجاعت كو اپنے سينے ميں بهر ليں- خدا كى قسم ہے اگر يہ آقا كى شجاعت كے وارث بن جائيں تو پورے پاكستان كى كوئى قوت ان كے مقابل كھڑا ہونے كى جرات نهيں كر سكتى -
‘আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা, একটাই বাসনা, আমার দৌড়ঝাঁপ ও উদ্যম-প্রচেষ্টার একটাই উদ্দেশ্য। আর সেটা হ’ল- আহলেহাদীছ যুবকরা স্বীয় প্রতিপালক প্রদত্ত সাহস নিজেদের বুকে পুরে নিক। আল্লাহর কসম! যদি তারা আল্লাহ প্রদত্ত সাহসিকতার উত্তরাধিকারী হয়ে যায়, তাহ’লে সমগ্র পাকিস্তানের এমন কোন শক্তি নেই যা তাদের মোকাবিলায় দাঁড়ানোর দুঃসাহস রাখে’।[10]
১৯৮৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী কাছূর-এ এক জালসায় তিনি বলেন,
لوگو ! سن لو اہل حديث كسى كى بهيڑ بكرى نہيں ہيں- اہل حديث اس كائنات كى وه قوت اور طاقت ہيں كہ اگر اسے احساس ذوق ہو جائے تو دنيا كى كوئى جماعت اس كا مقابلہ نهيں كر سكتى -
‘লোকসকল, শুনো! আহলেহাদীছ কারো ভেড়া-বকরী নয়। আহলেহাদীছ এই জগতের ঐ শক্তির নাম, যদি তাদের আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হয়, তাহ’লে দুনিয়ার কোন জামা‘আত তাদের মুকাবিলা করতে পারবে না’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমার জাতির যুবকেরা জাগো! তোমাদের মাসলাক ও জামা‘আতের তোমাদের আজ বড়ই প্রয়োজন। কিন্তু কেন? হকের ঝান্ডা উড্ডীন করার জন্য, দেশে কুরআন-সুন্নাহর ঝান্ডা উড্ডীন করার জন্য, রাসূল (ছাঃ)-এর নাম উচ্চকিত করার জন্য, তাওহীদের প্রচার-প্রসার, শিরক ও ভ্রষ্টতা দূর এবং কুরআন-সুন্নাহর প্রসারের জন্য’। তিনি আরো বলেন,
انشاء الله ايك دن آنے والا ہےجب پاكستان كى فضاؤں ميں پرچم لهرائے گا يا تو كتاب الله كا لهرائے گا يا سنت رسول الله كا لهرائے گا اور اس دن طلوع ہونے سے دنيا كى كوئى طاقت نهيں روك سكتى -
‘ইনশাআল্লাহ, একদিন এমন আসবে যখন পাকিস্তানের আকাশে কুরআন ও সুন্নাহর ঝান্ডা উড়বে। আর ঐ দিন আসতে দুনিয়ার কোন শক্তি বাধা দিতে পারবে না’।[11]
তিনি দেশময় বড় বড় সম্মেলনের আয়োজন করে জ্বালাময়ী ভাষণ ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনে গতিসঞ্চারে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন এবং আহলেহাদীছদের নতুন করে গাত্রোত্থানের জানান দিতে থাকেন। ১৯৮৬ সালের ১৮ই এপ্রিল লাহোরের মুচী দরজায় তিনি এক বিশাল সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালে মুচী দরজায় হওয়া সব সম্মেলন থেকে এটি বড় ছিল। (জেনারেল যিয়া বিরোধী) এম.আর.ডি (Movement for the Restoration of Democracy) এবং জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলন থেকেও বড় ছিল। জামায়াতে ইসলামী সর্বশক্তি দিয়ে উক্ত জায়গায় আমাদের চেয়ে বড় সম্মেলন করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সম্মেলনের উপস্থিতি আমাদের সম্মেলনের তুলনায় ১০০ ভাগের এক ভাগও ছিল না। সে সময় এম.আর.ডির উত্থানের যুগ ছিল। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, জমঈয়তে আহলেহাদীছ এম.আর.ডির চেয়েও বড় সম্মেলন করেছিল। আমাদের এক সপ্তাহ পূর্বে ‘জমঈয়তে ওলামায়ে পাকিস্তান’-এর সম্মেলনও উক্ত স্থানে হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকার ফাইলগুলোতে সাক্ষ্য রয়েছে যে, আমাদের সম্মেলন সবার চেয়ে বড় ছিল। এই প্রথমবারের মতো জনগণের বোধোদয় হয় যে, জমঈয়তে আহলেহাদীছের ব্যাপারে এ ধারণা ভুল যে, এটি একটি ছোট জামা‘আত। এরপর আমরা ধারাবাহিকভাবে রাওয়ালপিন্ডি, হায়দরাবাদ, ফয়ছালাবাদ, সাহিওয়াল, শিয়ালকোট (২রা মে ১৯৮৬), মুলতান এবং গুজরানওয়ালায় (৯ই মে ১৯৮৬) সম্মেলন করি। এসকল সম্মেলন দারুণভাবে সফল হয়েছিল’।[12]
জমঈয়তের অত্যাধুনিক অফিস তৈরির জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন দেখা দেয়। এক অনুষ্ঠানে এজন্য প্রথম তিনি ৫০ হাযার রূপী দান করেন। তখন উপস্থিত জনগণ তাদের সাধ্যানুযায়ী দান করতে থাকে। এভাবে এজন্য ৭ মিলিয়ন (৭০ লাখ) রূপী সংগ্রহ করা হয়।[13] এ অর্থ দিয়ে তিনি ৫৩ লরেন্স রোড, লাহোরে বিশাল জায়গা ক্রয় করেন। এখানে তিনি নবআঙ্গিকে একটি মসজিদ, হাসপাতাল, মাদরাসা, অডিটরিয়াম এবং জমঈয়তের অফিস স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। এখানে তিনি তারাবীহ ছালাতের জামা‘আত এবং দরসে কুরআনের প্রোগ্রামও শুরু করেছিলেন। বহু লোক তাঁর দরসে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ১৯৮৭ সালের ২৯শে মার্চ তিনি এখানে জুম‘আর খুৎবা দেয়ার মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু এর পূর্বেই বোমা বিস্ফোরণে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়।[14] উল্লেখ্য, ৫০, লোয়ারমাল রোডে প্রশস্ত জমির উপর বর্তমানে ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’-এর সর্বাধুনিক ব্যবস্থাপনা সজ্জিত বিরাট অফিস অবস্থিত।[15]
আহলেহাদীছরা তাক্বলীদের ঘোর বিরোধী; ইজতিহাদের প্রবক্তা। তাই যুগ-সমস্যার সমাধান কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে প্রদানের জন্য আল্লামা যহীর সঊদী আরবের ‘হাইআতু কিবারিল ওলামা’ ও মিসরের ‘আল-মাজলিসুল আ‘লা লিশ-শুউনিল ইসলামিয়াহ’-এর আদলে মুহাক্কিক্ব আহলেহাদীছ আলেমদের সমন্বয়ে একটি ফৎওয়া বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যেখানে আলেমরা প্রত্যেক মাসে উপস্থিত হয়ে নিত্য-নতুন মাসআলার ব্যাপারে তাদের গবেষণালব্ধ মতামত ব্যক্ত করবেন। এতদুদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালের ১৮ই মার্চ নিজ বাড়ীতে তিনি ওলামায়ে কেরামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আহবান করেন। এ মিটিংয়ে আল্লামা যহীর ইসলামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন এবং আগামী মিটিংয়ে তাহকীকের জন্য ‘মুরাবাহা’ ক্রয় আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করেন। উক্ত মিটিংয়ে তিনি উপস্থিত ওলামায়ে কেরামকে এ সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, এই তাহক্বীক্বী কাজের জন্য তিনি ২০ লাখ রূপীতে কম্পিউটার ক্রয় করেছেন। এই কম্পিউটার এবং ৫৩, লোয়ারমাল রোডে অবস্থিত জমঈয়তের অফিসে অবস্থান করে প্রায় ১ লাখ পুস্তক সংবলিত তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরী থেকে তারা উপকৃত হ’তে পারেন। তিনি এও বলেছিলেন যে, ‘আপনাদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াত ও অন্যান্য সব খরচ আমি বহন করব’।[16]
মোদ্দাকথা, ইহসান ইলাহী যহীরের গতিশীল নেতৃত্বে পাকিস্তানে আহলেহাদীছদের মাঝে নবচেতনার উন্মেষ ঘটে। মানুষের মাঝে কুরআন-সুন্নাহর মর্মমূলে জমায়েত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তাঁর ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, জ্বালাময়ী বক্তব্য, দাওয়াতী কর্মতৎপরতা ও বিশ্বব্যাপী পরিচিতির কারণে জমঈয়তের উত্তরোত্তর অগ্রগতি সাধিত হয়। তিনি যদি রাজনীতির গ্যাড়াকলে জড়িয়ে না পড়ে নিরঙ্কুশভাবে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন, তাহ’লে পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলন আরো বেশী মযবুত ভিত্তির উপর দন্ডায়মান হ’ত এবং আহলেহাদীছ জামা‘আত তাঁর কাছ থেকে আরো বেশী খেদমত পেত।
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৭-৫৮; বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৯; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩৭৯-৮০।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৮-৫৯।
[3]. ‘মাজাল্লাতুশ শরী‘আহ’, সংখ্যা ২৪২, জুমাদাল উলা ১৪০৬ হিঃ, পৃঃ ৪।
[4]. ঐ, পৃঃ ৪।
[5]. আল-মাজাল্লাতুল আরাবিয়্যাহ, সংখ্যা ৮৭, ১৪০৫ হিঃ, পৃঃ ৯১।
[6]. The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 64.
[7]. Ibid, P. 61.
[8]. মিয়াঁ জামীল আহমাদ, ‘খতমে নবুঅত কা কনফারেন্স সে আখেরী খেতাব’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৬৬।
[9]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[10]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ৪।
[11]. ঐ, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৮১।
[12]. ঐ, পৃঃ ৫৯।
[13]. The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 34-35.
[14]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২০।
[15]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩৮০।
[16]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২৫-২৬।
‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’ গঠনের পর সংগঠনটি প্রেসিডেন্ট যিয়াউল হকের কোপানলে পড়ে। আল্লামা যহীরের উপর মিথ্যা মামলার খড়গ ঝুলানো হয়। কিন্তু তাতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তিনি বলেন, ‘মার্শাল ল’ সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে যখন বার বার হেনস্তা করা হ’তে থাকে তখন আমার আহলেহাদীছ বন্ধুবর্গ জমঈয়তের দায়িত্ব পালনের জন্য জোরাজুরি শুরু করেন। জমঈয়তের জেনারেল সেক্রেটারী আমার জন্য পদত্যাগ করেন এবং আমাকে সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত করা হয়’।[2] জর্ডানের ‘আশ-শরী‘আহ’ পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, وفي عام ১৯৮৩ م انتخبت أمينا عاما لجمعية أهل الحديث في باكستان والجمعية تضم ৭৫০ فرعا في باكستان . ‘আমি ১৯৮৩ সালে জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানের সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত হই। পাকিস্তানে জমঈয়তের ৭৫০টি শাখা রয়েছে’।[3] তখন জমঈয়তের সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ছিল বলে তিনি উক্ত সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।[4] তিনি আরো বলেন, কোন গ্রাম বা শহর পাওয়া যাবে না যেখানে জমঈয়তের কোন শাখা নেই’। জমঈয়তের অধীনে পাঁচ হাযার বিশিষ্ট আলেম রয়েছেন বলে তিনি এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।[5]
১৯৮৩ সালে বাধ্য হয়ে উক্ত পদ গ্রহণের পর তিনি ঘুমন্ত আহলেহাদীছ সমাজকে জাগানোর প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ড. আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আযীয ইয়াহ্ইয়া বলেন, There is no doubt that he presented as much as he was able to at the time all of which had a good effect for Ahl ul-Hadeeth in Pakistan and their Salafi brothers in other parts of the world. ‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সে সময় তিনি তাঁর সাধ্যানুযায়ী যতটুক করতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের আহলেহাদীছ এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে তাদের সালাফী ভাইদের জন্য তার একটা কার্যকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল’।[6]
পাকিস্তান ও বহির্বিশ্বে জমঈয়তের পরিচিতি বৃদ্ধিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। জালসা, সম্মেলন, প্রেস কনফারেন্স প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি আহলেহাদীছ আন্দোলনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন। ড. অছিউল্লাহ মুহাম্মাদ আববাস বলেন, He was an example of sincerity and dedication to dawah to Allah via the media, sermons in masajid, general gatherings. He also has huge efforts in guiding the youth to the salafi aqeedah and made many long travels in the path of dawah. ‘মিডিয়া, মসজিদের খুৎবা, জালসা-সম্মেলন প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহর পথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে তিনি আন্তরিকতা ও ত্যাগের এক দৃষ্টান্ত ছিলেন। যুবকদেরকে সালাফী আক্বীদার দিকে পরিচালিত করার জন্য তাঁর দারুণ প্রচেষ্টা ছিল এবং দাওয়াতের জন্য তিনি দীর্ঘ সফর করেছেন’।[7] যুবক-বৃদ্ধ, আলেম, মুবাল্লিগ, শিক্ষক, চিন্তাবিদ সবাই তাঁর তরুণ নেতৃত্বের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাওয়াতী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খতমে নবুঅত কনফারেন্সে তিনি বলেছিলেন, ‘সম্মানিত ভ্রাতৃমন্ডলী! আহলেহাদীছের একজন সামান্য খাদেম হিসাবে আমার জন্য এটা বড়ই সৌভাগ্যের কথা যে, এমন এক সময় এ ঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করা হয়েছিল, যখন ঘরের লোকেরা নিদ্রামগ্ন ছিল।... অল্প কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর আমি অনুভব করছি যে, এখন ঘরের মালিক জেগে উঠেছে। আমার এই বিশ্বাস ছিল যে, ঘুমন্ত সিংহ যখন জেগে ওঠে তখন সে সিংহমূর্তিই ধারণ করে। আর আজ এই সিংহ শুধু জেগেই ওঠেনি; বরং স্বীয় আবাস থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে’।[8]
রাজনৈতিক বিষয়ে ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছে’র (প্রতিষ্ঠা : ২৪শে জুলাই ১৯৪৮) নীরব ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে আল্লামা যহীর ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’ গঠনের পর জমঈয়তকে দেশের রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং আহলেহাদীছ যুবকদের জন্য ‘আহলেহাদীছ ইয়ুথ ফোর্স’ গঠন করেন। তাদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জনশক্তিতে পরিণত করেন।[9]
যুবকদেরকে সচেতন করার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবাদতুল্য। ১২ই রবীঊল আউয়াল ১৪০৭ হিজরীতে জিন্নাহ হল, লাহোরে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন,
ميرى ايک ہی خواہش ہے ميرى ايک ہی آرزو ہے - ميرى تگ ودو كا ايك ہی مقصدہے- ميرى جد وجهد كا ايک ہی مطلوب ہے اور وه يہ ہے كہ اہل حديث كے جوان اپنے آقا كى شجاعت كو اپنے سينے ميں بهر ليں- خدا كى قسم ہے اگر يہ آقا كى شجاعت كے وارث بن جائيں تو پورے پاكستان كى كوئى قوت ان كے مقابل كھڑا ہونے كى جرات نهيں كر سكتى -
‘আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা, একটাই বাসনা, আমার দৌড়ঝাঁপ ও উদ্যম-প্রচেষ্টার একটাই উদ্দেশ্য। আর সেটা হ’ল- আহলেহাদীছ যুবকরা স্বীয় প্রতিপালক প্রদত্ত সাহস নিজেদের বুকে পুরে নিক। আল্লাহর কসম! যদি তারা আল্লাহ প্রদত্ত সাহসিকতার উত্তরাধিকারী হয়ে যায়, তাহ’লে সমগ্র পাকিস্তানের এমন কোন শক্তি নেই যা তাদের মোকাবিলায় দাঁড়ানোর দুঃসাহস রাখে’।[10]
১৯৮৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী কাছূর-এ এক জালসায় তিনি বলেন,
لوگو ! سن لو اہل حديث كسى كى بهيڑ بكرى نہيں ہيں- اہل حديث اس كائنات كى وه قوت اور طاقت ہيں كہ اگر اسے احساس ذوق ہو جائے تو دنيا كى كوئى جماعت اس كا مقابلہ نهيں كر سكتى -
‘লোকসকল, শুনো! আহলেহাদীছ কারো ভেড়া-বকরী নয়। আহলেহাদীছ এই জগতের ঐ শক্তির নাম, যদি তাদের আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হয়, তাহ’লে দুনিয়ার কোন জামা‘আত তাদের মুকাবিলা করতে পারবে না’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমার জাতির যুবকেরা জাগো! তোমাদের মাসলাক ও জামা‘আতের তোমাদের আজ বড়ই প্রয়োজন। কিন্তু কেন? হকের ঝান্ডা উড্ডীন করার জন্য, দেশে কুরআন-সুন্নাহর ঝান্ডা উড্ডীন করার জন্য, রাসূল (ছাঃ)-এর নাম উচ্চকিত করার জন্য, তাওহীদের প্রচার-প্রসার, শিরক ও ভ্রষ্টতা দূর এবং কুরআন-সুন্নাহর প্রসারের জন্য’। তিনি আরো বলেন,
انشاء الله ايك دن آنے والا ہےجب پاكستان كى فضاؤں ميں پرچم لهرائے گا يا تو كتاب الله كا لهرائے گا يا سنت رسول الله كا لهرائے گا اور اس دن طلوع ہونے سے دنيا كى كوئى طاقت نهيں روك سكتى -
‘ইনশাআল্লাহ, একদিন এমন আসবে যখন পাকিস্তানের আকাশে কুরআন ও সুন্নাহর ঝান্ডা উড়বে। আর ঐ দিন আসতে দুনিয়ার কোন শক্তি বাধা দিতে পারবে না’।[11]
তিনি দেশময় বড় বড় সম্মেলনের আয়োজন করে জ্বালাময়ী ভাষণ ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনে গতিসঞ্চারে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন এবং আহলেহাদীছদের নতুন করে গাত্রোত্থানের জানান দিতে থাকেন। ১৯৮৬ সালের ১৮ই এপ্রিল লাহোরের মুচী দরজায় তিনি এক বিশাল সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালে মুচী দরজায় হওয়া সব সম্মেলন থেকে এটি বড় ছিল। (জেনারেল যিয়া বিরোধী) এম.আর.ডি (Movement for the Restoration of Democracy) এবং জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলন থেকেও বড় ছিল। জামায়াতে ইসলামী সর্বশক্তি দিয়ে উক্ত জায়গায় আমাদের চেয়ে বড় সম্মেলন করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সম্মেলনের উপস্থিতি আমাদের সম্মেলনের তুলনায় ১০০ ভাগের এক ভাগও ছিল না। সে সময় এম.আর.ডির উত্থানের যুগ ছিল। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, জমঈয়তে আহলেহাদীছ এম.আর.ডির চেয়েও বড় সম্মেলন করেছিল। আমাদের এক সপ্তাহ পূর্বে ‘জমঈয়তে ওলামায়ে পাকিস্তান’-এর সম্মেলনও উক্ত স্থানে হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকার ফাইলগুলোতে সাক্ষ্য রয়েছে যে, আমাদের সম্মেলন সবার চেয়ে বড় ছিল। এই প্রথমবারের মতো জনগণের বোধোদয় হয় যে, জমঈয়তে আহলেহাদীছের ব্যাপারে এ ধারণা ভুল যে, এটি একটি ছোট জামা‘আত। এরপর আমরা ধারাবাহিকভাবে রাওয়ালপিন্ডি, হায়দরাবাদ, ফয়ছালাবাদ, সাহিওয়াল, শিয়ালকোট (২রা মে ১৯৮৬), মুলতান এবং গুজরানওয়ালায় (৯ই মে ১৯৮৬) সম্মেলন করি। এসকল সম্মেলন দারুণভাবে সফল হয়েছিল’।[12]
জমঈয়তের অত্যাধুনিক অফিস তৈরির জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন দেখা দেয়। এক অনুষ্ঠানে এজন্য প্রথম তিনি ৫০ হাযার রূপী দান করেন। তখন উপস্থিত জনগণ তাদের সাধ্যানুযায়ী দান করতে থাকে। এভাবে এজন্য ৭ মিলিয়ন (৭০ লাখ) রূপী সংগ্রহ করা হয়।[13] এ অর্থ দিয়ে তিনি ৫৩ লরেন্স রোড, লাহোরে বিশাল জায়গা ক্রয় করেন। এখানে তিনি নবআঙ্গিকে একটি মসজিদ, হাসপাতাল, মাদরাসা, অডিটরিয়াম এবং জমঈয়তের অফিস স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। এখানে তিনি তারাবীহ ছালাতের জামা‘আত এবং দরসে কুরআনের প্রোগ্রামও শুরু করেছিলেন। বহু লোক তাঁর দরসে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ১৯৮৭ সালের ২৯শে মার্চ তিনি এখানে জুম‘আর খুৎবা দেয়ার মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু এর পূর্বেই বোমা বিস্ফোরণে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়।[14] উল্লেখ্য, ৫০, লোয়ারমাল রোডে প্রশস্ত জমির উপর বর্তমানে ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’-এর সর্বাধুনিক ব্যবস্থাপনা সজ্জিত বিরাট অফিস অবস্থিত।[15]
আহলেহাদীছরা তাক্বলীদের ঘোর বিরোধী; ইজতিহাদের প্রবক্তা। তাই যুগ-সমস্যার সমাধান কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে প্রদানের জন্য আল্লামা যহীর সঊদী আরবের ‘হাইআতু কিবারিল ওলামা’ ও মিসরের ‘আল-মাজলিসুল আ‘লা লিশ-শুউনিল ইসলামিয়াহ’-এর আদলে মুহাক্কিক্ব আহলেহাদীছ আলেমদের সমন্বয়ে একটি ফৎওয়া বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যেখানে আলেমরা প্রত্যেক মাসে উপস্থিত হয়ে নিত্য-নতুন মাসআলার ব্যাপারে তাদের গবেষণালব্ধ মতামত ব্যক্ত করবেন। এতদুদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালের ১৮ই মার্চ নিজ বাড়ীতে তিনি ওলামায়ে কেরামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আহবান করেন। এ মিটিংয়ে আল্লামা যহীর ইসলামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন এবং আগামী মিটিংয়ে তাহকীকের জন্য ‘মুরাবাহা’ ক্রয় আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করেন। উক্ত মিটিংয়ে তিনি উপস্থিত ওলামায়ে কেরামকে এ সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, এই তাহক্বীক্বী কাজের জন্য তিনি ২০ লাখ রূপীতে কম্পিউটার ক্রয় করেছেন। এই কম্পিউটার এবং ৫৩, লোয়ারমাল রোডে অবস্থিত জমঈয়তের অফিসে অবস্থান করে প্রায় ১ লাখ পুস্তক সংবলিত তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরী থেকে তারা উপকৃত হ’তে পারেন। তিনি এও বলেছিলেন যে, ‘আপনাদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াত ও অন্যান্য সব খরচ আমি বহন করব’।[16]
মোদ্দাকথা, ইহসান ইলাহী যহীরের গতিশীল নেতৃত্বে পাকিস্তানে আহলেহাদীছদের মাঝে নবচেতনার উন্মেষ ঘটে। মানুষের মাঝে কুরআন-সুন্নাহর মর্মমূলে জমায়েত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তাঁর ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, জ্বালাময়ী বক্তব্য, দাওয়াতী কর্মতৎপরতা ও বিশ্বব্যাপী পরিচিতির কারণে জমঈয়তের উত্তরোত্তর অগ্রগতি সাধিত হয়। তিনি যদি রাজনীতির গ্যাড়াকলে জড়িয়ে না পড়ে নিরঙ্কুশভাবে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন, তাহ’লে পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলন আরো বেশী মযবুত ভিত্তির উপর দন্ডায়মান হ’ত এবং আহলেহাদীছ জামা‘আত তাঁর কাছ থেকে আরো বেশী খেদমত পেত।
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৭-৫৮; বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৯; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩৭৯-৮০।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৮-৫৯।
[3]. ‘মাজাল্লাতুশ শরী‘আহ’, সংখ্যা ২৪২, জুমাদাল উলা ১৪০৬ হিঃ, পৃঃ ৪।
[4]. ঐ, পৃঃ ৪।
[5]. আল-মাজাল্লাতুল আরাবিয়্যাহ, সংখ্যা ৮৭, ১৪০৫ হিঃ, পৃঃ ৯১।
[6]. The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 64.
[7]. Ibid, P. 61.
[8]. মিয়াঁ জামীল আহমাদ, ‘খতমে নবুঅত কা কনফারেন্স সে আখেরী খেতাব’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৬৬।
[9]. শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[10]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ৪।
[11]. ঐ, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৮১।
[12]. ঐ, পৃঃ ৫৯।
[13]. The Life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 34-35.
[14]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২০।
[15]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩৮০।
[16]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২৫-২৬।
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের বাল্যকাল কাটে জন্মস্থান শিয়ালকোটে। যেখানে কাদিয়ানী, বাহাঈ, হানাফী, ব্রেলভী, দেওবন্দী, শী‘আ, আহলেহাদীছ প্রভৃতি দলের লোকজন বসবাস করত। প্রত্যেক দলের লোকজন পরস্পর বাহাছ-মুনাযারায় প্রায়শই লিপ্ত হত। আল্লামা যহীরের ভাষায়, ‘এই পরিবেশে জ্ঞানের চোখ উন্মীলন করে দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের জন্য শহর-নগর, দেশ-দেশান্তর ভ্রমণকারী ইহসান ইলাহী যহীরের চেয়ে ধর্মতত্ত্ব আর কে ভাল বুঝতে পারে’?[1]
ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর মধ্যে এসব ফিরকা সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। তখন তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিয়ে বাহাইয়া, কাদিয়ানী ও খৃষ্টানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন তাদের বক্তব্য শোনার জন্য ও তাদের সাথে বাহাছ করার জন্য। শিয়ালকোটে একবার তাঁকে কাদিয়ানী মুবাল্লিগের সাথে মুনাযারার জন্য আহবান জানানো হলে তিনি তাদের প্রস্তাবে সম্মত হন। তবে শর্ত হ’ল- গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর বই তাঁকে পড়ার জন্য ধার দিতে হবে। কাদিয়ানীরা এ শর্তে রাযী হয়ে তাকে ‘আনজামে আছেম’, ‘ইযালাতুল আওহাম’, ‘দুর্রে ছামীন’, ‘হাক্বীক্বাতে অহী’, ‘সাফীনায়ে নূহ’-এই পাঁচটি বই পড়তে দেয়। প্রথম ও তৃতীয় বইটি তিনি এক রাতে পড়ে শেষ করেন। অন্য বইগুলোও দুই/তিন দিনে পড়ে শেষ করেন। নির্ধারিত দিনে কয়েকজন বন্ধুসহ কাদিয়ানী মসজিদে উপস্থিত হন। সেখানে বিতর্কের বিষয় নির্ধারিত হয় ‘গোলাম আহমাদের ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ’। কারণ সে তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে মিথ্যা নবুঅতের মানদন্ড হিসাবে পেশ করেছিল। তিনি বিতর্কে বলেন, গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, আব্দুল্লাহ আছেম ১৫ মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করবে।[2] কিন্তু সে এ সময়ের মধ্যে মরেনি। কাজেই তোমাদের কথিত ভন্ড নবীর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক না হওয়ায় সে যে মিথ্যা নবুঅতের দাবীদার তা প্রমাণিত হল। কারণ নবীদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সঠিক হয়। যহীরের এ যুক্তিতে কাদিয়ানী মুবাল্লিগের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তিনি জবাব দেয়ার চেষ্টা করে যহীরের অকাট্য দলীলের কাছে ব্যর্থ হয়ে নতি স্বীকার করেন এবং বলেন, আমি তার্কিক নই। ‘রাবওয়া’ থেকে কাদিয়ানী তার্কিক আসলে আমি তোমাদেরকে তার সাথে বাহাছের জন্য ডাকব। এভাবে সেখান থেকে যহীর ও তার বন্ধুরা বিজয়ী বেশে ফিরে আসেন এবং কাদিয়ানীদের আরো কিছু বই পড়ার জন্য ধার নিয়ে আসেন। আল্লামা যহীর বলেন, وهكذا بدأة أدرس هذا المذهب بدون أية واسطة . ‘এভাবে কোন মাধ্যম ছাড়াই আমি এই ফিরকা সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে শুরু করি’।[3]
এ ঘটনার পর আল্লামা যহীর ও তাঁর বন্ধুরা বাহাঈদের মাহফিল, খৃষ্টানদের ইনস্টিটিউটসমূহ এবং কাদিয়ানীদের কেন্দ্রসমূহে যাতায়াতের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। এমনকি তিনি কাদিয়ানীদের কেন্দ্র ‘রাবওয়া’তে গিয়েও তাদের সাথে বিতর্ক করে বিজয়ী হন।[4] পরবর্তীতে তিনি প্রত্যেক সপ্তাহের বৃহস্পতিবার শিয়ালকোটে যেতেন এবং কাদিয়ানী সেন্টারে গিয়ে তাদের সাথে বিতর্ক করতেন ও তাদের বইপত্র সংগ্রহ করে আনতেন।[5]
মাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনা করার সময় একদিন তিনি বাহাঈদের একটি সভার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বক্তারা আক্বীদা সম্পর্কিত একটি বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি সেই সভায় গিয়ে তাদের বক্তব্য শুনেন। ইতিপূর্বে তাদের সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না। তিনি ৮ দিন ঐ সভায় গিয়ে তাদের বক্তব্য শুনে তাদের আক্বীদা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে অবগত হন এবং জনগণকে এ বিষয়ে সজাগ করেন। ফলে সেই সভা বন্ধ করে দেয়া হয়।[6]
দেশে লেখাপড়া শেষ করার পর আল্লামা যহীর উচ্চশিক্ষার জন্য মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে ধর্মতত্ত্বে শিক্ষকদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা লক্ষ্য করে তিনি এ বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সেখানে অধ্যয়নকালে القاديانية عملية للاستعمار শিরোনামে আরবীতে প্রথম তাঁর একটি প্রবন্ধ দামেশকের ‘হাযারাতুল ইসলাম’ পত্রিকার ১৩৮৬ হিজরীর তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিদ্বানমহলে সাড়া পড়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকবৃন্দ তাঁকে কাদিয়ানীদের সম্পর্কে এ জাতীয় প্রবন্ধ লেখার জন্য উৎসাহিত করেন। ফলে তিনি আরবীতে এ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা অব্যাহত রাখেন।[7]
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে তিনি দ্বীনের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি বক্তৃতা জগতে সুদৃঢ়ভাবে পদচারণা অব্যাহত রাখেন এবং বিভিন্ন বাতিল ফিরকার ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস জনসমক্ষে তুলে ধরা তাঁর বক্তব্যের অবিচ্ছেদ্য উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য বক্তব্যের প্রয়োজনে তাঁকে এ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা করতে হয় বলে মাহবূব জাবেদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন।[8]
ধর্মতত্ত্বের উপর বক্তৃতা দেয়া ও লেখালেখির জন্য প্রচুর পড়াশুনার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে বাতিল ফিরকাগুলির আক্বীদা বিশ্লেষণ এবং দলীল ও যুক্তিভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সেগুলির দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য। আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের মধ্যে এই গুণ পুরা মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তিনি ছাত্র জীবনেই কাদিয়ানীদের সম্পর্কে বইপত্র পড়া শুরু করেন। যেমন ‘আল-কাদিয়ানিয়াহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন, فدرست هذه الحركة أثناء دراستي في المدارس الشرعية، بواسطة كتب شيخ الإسلام العلامة ثناء الله الأمرتسري، وإمام عصره الشيخ محمد إبراهيم السيالكوتي، وشيخنا الجليل العلامة المحدث الحافظ محمد جوندلوي، وغيرهم من العلماء . ‘ইসলামিয়া মাদরাসাগুলিতে পড়াশুনা করার সময় শায়খুল ইসলাম আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, স্বীয় যুগের ইমাম শায়খ মুহাম্মাদ ইবরাহীম শিয়ালকোটী, আমাদের সম্মানিত শায়খ আল্লামা মুহাদ্দিছ হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবী ও অন্যান্য আলেমদের বইপত্রের বদৌলতে আমি এই আন্দোলন সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছিলাম’।[9] তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে পরিশ্রমকে মোটেই ভয় পেতেন না। ‘আল-ব্রেলভিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থটি লেখার জন্য তিনি তিন শতাধিক বই অধ্যয়ন করেন।[10]
এক লাখ গ্রন্থ সম্বলিত তাঁর একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল। নানাবিধ কর্মব্যস্ততার মাঝে তিনি যখনই সময় পেতেন তখনই এই লাইব্রেরীতে বসে জ্ঞানসমুদ্রের মণি-মাণিক্য আহরণে মশগুল হয়ে যেতেন। মাহবূব জাবেদকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি যখনই অবসর পাই, তখনই সেই সময়টুকু আমার বাড়ির লাইব্রেরীতে কাটাই। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে বিভিন্ন ফিরকার উপর পৃথিবীর যেকোন বড় লাইব্রেরীর চেয়ে বেশী বই আছে। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে হাযার হাযার বই মওজুদ রয়েছে। এগুলি সবই আমি অধ্যয়ন করেছি। আপনি এটা জেনে আশ্চর্য হবেন যে, আমি ৩/৪ ঘণ্টা ঘুমাই। সারাজীবন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ ঘণ্টার বেশী আমি কখনো ঘুমাইনি। যখন পৃথিবী ঘুমের সাগরে ডুবে থাকে, তখন আমি আমার লাইব্রেরীতে অবস্থান করি। আমি আমার বিবিধ কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কাগজ-কলমের সাথে যোগসূত্র বজায় রেখে আসছি’।[11]
কাদিয়ানী, শী‘আ, বাহাইয়া, বাবিয়া, ব্রেলভী, ইসমাঈলিয়া, ছূফী প্রভৃতি ভ্রান্ত ফিরকাগুলোর আক্বীদা জনসম্মুখে তুলে ধরে ইসলামের নির্মল রূপ প্রকাশ করাই তাঁর ধর্মতত্ত্ব গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল। কাউকে সন্তুষ্ট, ক্রুদ্ধ অথবা নিছক গবেষণার জন্য তাঁর লেখালেখি পরিচালিত হয়নি। তিনি বলেছেন, ‘আমি কঠোর পরিশ্রম করে বিভিন্ন ফিরকার উপর প্রামাণ্য বইপত্র লেখার চেষ্টা করেছি। ধর্মতত্ত্বের উপর বই লিখে আমি ইসলামের খিদমত করেছি; বিভেদ সৃষ্টি করিনি। ভ্রান্ত ফিরকাগুলোর আক্বীদা বর্ণনা করেছি মাত্র। মানুষকে রাসূল (ছাঃ) আনীত ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করার এবং ইসলামকে স্রেফ কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে দেখার জন্য উৎসাহ যুগিয়েছি’।[12] তিনি ‘আল-ইসমাঈলিয়াহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হককে বাতিল থেকে, সঠিককে বেঠিক থেকে, হেদায়াতকে পথভ্রষ্টতা থেকে, ইসলামকে কুফরী থেকে পৃথক করা এবং মানুষকে বক্র পথ, শয়তানী আদর্শ ও মানুষের মতামত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া শ্বেত-শুভ্র-নিষ্কলঙ্ক পথের দিশা প্রদান করে ইসলামের পবিত্রতার প্রতিরক্ষা-ই বাতিল ফিরকাসমূহ সম্পর্কে কলমী জিহাদ চালানোর পিছনে আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। যেমন তিনি বলেন,
فهذا هو الهدف، وهذه هي الحقيقة من البحث والكتابة في الفرق الضالة، المنحرفة، والطوائف الباغية الخارجة على الإسلام ممن كتبنا عنهم حتى اليوم .
‘পথভ্রষ্ট, ভ্রান্ত ও ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া বিদ্রোহী দলগুলির যাদের সম্পর্কে অদ্যাবধি আমরা গবেষণা করেছি ও লিখেছি, তার উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা এটিই’।[13]
এক্ষণে প্রশ্ন হল, তিনি তাঁর মাতৃভাষা উর্দূ বাদ দিয়ে আরবীতে কেন ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত বই লিখলেন তাঁর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাহবূব জাবেদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি ধর্মতত্ত্বের উপর বেশী বই লিখেছি। এই বইগুলি গোটা মুসলিম বিশ্বে পড়ানো হোক সে উদ্দেশ্য ছিল। এজন্য আমি আমার এই বইগুলি আরবীতে লিখেছি’।[14] আরবীতে বই লেখার আর একটা কারণ হল- এসব বাতিল ফিরকাগুলির আক্বীদা-বিশ্বাসধারী বিভিন্ন ফিরকা মুসলিম দেশগুলিতে বিভিন্ন নামে বিদ্যমান আছে। ‘আল-ব্রেলভিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন,
إنها جديدة من حيث النشأة والإسم، ومن فرق شبه القارة من حيث التكوين والهيئة، ولكنها قديمة من حيث الأفكار والعقائد، ومن الفرق المنتشرة الكثيرة في العالم الإسلامي بأسماء مختلفة وصور متنوعة من الخرافيين وأهل البدع، لذلك أردت أن أكتب عنهم في اللغة العربية كما كتبت عن الفئات الضالة المنحرفة الأخرى .
‘নাম ও উদ্ভব এবং গঠন ও আকৃতির দিক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ফিরকাগুলির মধ্যে এটা নতুন। কিন্তু চিন্তাধারা ও আক্বীদা এবং মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন নাম ও আকৃতিতে বিস্তৃত বহু বিদ‘আতী ও কুসংস্কারপন্থী ফিরকার দিক থেকে এটা পুরাতন। এজন্য আমি এদের সস্পর্কে আরবীতে লিখতে মনস্থ করেছি, যেমনভাবে অন্যান্য পথভ্রষ্ট ভ্রান্ত ফিরকাগুলো সম্পর্কে লিখেছি’।[15]
ধর্মতত্ত্ব গবেষণায় তাঁর মানহাজ বা পদ্ধতি ছিল ভিন্ন স্টাইলের। তিনি যেই ফিরকার উপর বই লিখতেন সেই ফিরকার লিখিত বই-পত্র থেকেই তাদের ইতিহাস ও আক্বীদা-বিশ্বাস বর্ণনা করতেন। ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন,
وقد التزمنا في هذا الكتاب أن لا نذكر شيئا من الشيعة إلا من كتبهم، وبعباراتهم أنفسهم، مع ذكر الكتاب، والمجلد، والصفحة، والطبعة، بحول الله وقوته .
‘আমরা এই গ্রন্থে এ নীতি অবলম্বন করেছি যে, শী‘আদের থেকে আমরা যা কিছুই উল্লেখ করব আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিতে তা তাদের বই-পুস্তক থেকেই নাম, খন্ড, পৃষ্ঠা ও ছাপা সহ তাদের উদ্ধৃতি দিয়েই উল্লেখ করব’।[16] এ পদ্ধতি কঠিন, কণ্টকাকীর্ণ ও দুর্গম হলেও এটাই ধর্মতত্ত্ব গবেষণার ‘সঠিক পদ্ধতি’ ( الطريقة الصحيحة المسةقيمة ) বলে তিনি মনে করেন।[17] এজন্য তিনি আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাওয়ার ব্যাপারেও দৃঢ় বিশ্বাসী।[18]
২. আল্লামা যহীর বাতিল ফিরকাগুলোর আক্বীদা-বিশ্বাস বর্ণনার ক্ষেত্রে পূর্ণ আমানতদারিতার পরিচয় দিয়েছেন। যে শব্দে ও বাক্যে তাদের বইগুলোতে সেগুলো উদ্ধৃত হয়েছে তিনি কোন প্রকার কমবেশী করা ছাড়াই তা হুবহু উল্লেখ করেছেন। ‘আল-ইসমাঈলিয়াহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন,
إن مدار الاستشهاد والاستدلال ليست إلا على كتب القوم أنفسهم بالأمانة العلمية ونقل العبارات الكاملة بدون تحريف وتبديل وتغيير التي بها امتازت كتبنا ومؤلفاتنا بفضل من الله وتوفيقه -
‘ইলমী আমানত এবং কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিকৃতি ছাড়াই পূর্ণ বর্ণনা উদ্ধৃত করার মাধ্যমে গোষ্ঠীটির নিজেদের গ্রন্থাবলীই যুক্তি-প্রমাণের কেন্দ্রবিন্দু। আল্লাহর অনুকম্পায় আমাদের সকল গ্রন্থই এ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত’।[19] যেমন ‘আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন’ গ্রন্থে কুরআনের বিকৃতি সাধন সম্পর্কে শী‘আ মুহাদ্দিছ নেয়ামাতুল্লাহ জাযায়েরীর (জন্ম : ১০৫০ হিঃ) লিখিত ‘আল-আনওয়ারুন নু‘মানিয়া’ (২/৩৫৭) গ্রন্থ থেকে হুবহু উদ্ধৃতি পেশ করেছেন।[20]
৩. তিনি বাতিল ফিরকাগুলোর মত খন্ডনের ক্ষেত্রে কুরআন, হাদীছ ও সালাফে ছালেহীনের বুঝের উপর নির্ভর করেছেন। ভ্রান্ত ফিরকা ইসমাঈলিয়ারা মনে করে যে, ‘আল্লাহর কোন নাম ও গুণাবলী নেই’। আল্লামা যহীর তাদের এই ভ্রান্ত মত খন্ডন করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, এটি কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফে ছালেহীনের মানহাজের খেলাফ। কুরআন-সুন্নাহ প্রমাণ করে যে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলী রয়েছে। এর প্রমাণে তিনি কুরআন মাজীদের ৩৫টি আয়াত উদ্ধৃত করেছেন।[21] ব্রেলভীদের আক্বীদা- ‘নবী, রাসূল ও অলী-আওলিয়া অদৃশ্যের খবর জানেন’-এর খন্ডনে নামল ৬৫, ফাতির ৩৮, হুজুরাত ১৮, হূদ ১২৩, ইউনুস ২০, আন‘আম ৫৯, লোকমান ৩৪ মোট ৭টি আয়াত পেশ করেছেন।[22] অনুরূপভাবে ঈদে মীলাদুন্নবী সম্পর্কে ব্রেলভীদের মত খন্ডন করতে গিয়ে একে ‘বিদ‘আত’ বলে আখ্যা দেন এবং এর প্রমাণে مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ . ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’[23] হাদীছটি উল্লেখ করেছেন।[24] তাছাড়া ছূফীদের বৈবাহিক জীবনে অনীহার খন্ডনে কুরআন ও হাদীছ থেকে দলীল উল্লেখের পর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। মহামতি ইমাম বলেন, ليس العزوبة من أمر الإسلام في شيء . ‘চিরকুমার থাকা ইসলামী শরী‘আতের কোন বিধানই নয়’।[25]
৪. শক্তিশালী যুক্তির মাধ্যমে তিনি বাতিল ফিরকাগুলির মতামত খন্ডন করেছেন। শী‘আ ইমাম মুহাম্মাদ বিন বাকির আল-মাজলেসী (১০৩৭-১১১১ হিঃ) তাঁর ‘হায়াতুল কুলূব’ গ্রন্থে (২/৬৪০) উল্লেখ করেছেন যে, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আবূ যর গিফারী, মিক্বদাদ বিন আসওয়াদ ও সালমান ফারেসী- এই তিনজন ব্যতীত সবাই মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল’ (নাঊযুবিল্লাহ)। আল্লামা যহীর শক্তিশালী যুক্তির অবতারণা করে তার এ ভ্রান্ত মত খন্ডন করে বলেন,
ولسائل أن يسأل هؤلاء الأشقياء وأين ذهب أهل بيت النبى بما فيهم عباس عم النبى، وابن عباس ابن عمه، وعقيل أخ لعلى، وحتى على نفسه، والحسنان سبطا رسول الله؟
‘এই হতভাগ্যদেরকে কোন প্রশ্নকারীর জিজ্ঞেস করা উচিত, তাহলে রাসূল (ছাঃ)-এর আহলে বায়েত বা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত তাঁর চাচা আববাস, চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আববাস, আলী (রাঃ)-এর ভাই আক্বীল এমনকি খোদ আলী এবং রাসূল (ছাঃ)-এর নাতিদ্বয় হাসান ও হুসাইন তখন কোথায় গিয়েছিলেন’?[26]
অনুরূপভাবে ব্রেলভীদের আক্বীদা- ‘রাসূল (ছাঃ) সর্বত্র হাযির ও সবকিছু দেখেন’-এর খন্ডনে সূরা ফাতহ-এর ১৮নং আয়াত উল্লেখ করেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তো মুমিনগণের উপর সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা গাছের নিচে তোমার নিকট বায়‘আত করল’। এরপর তিনি এত্থেকে যুক্তিসিদ্ধ দলীল সাব্যস্ত করে বলেন,
فكان هذا في الحديبية في العام السادس بعد الهجرة حيث لم يكن فى المدينة كما لم يكن في مكة ولم يكن في الحديبية موجودا قبله ولم يبقى فيها بعد رجوعه إلى المدينة .
‘হিজরতের পরে ষষ্ঠ বর্ষে হুদায়বিয়াতে এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। তখন তিনি যেমন মদীনায় ছিলেন না, তেমনি মক্কাতেও ছিলেন না। আর ইতিপূর্বে তিনি হুদায়বিয়াতে উপস্থিত ছিলেন না এবং সেখান থেকে মদীনায় ফিরে আসার পর সেখানেও অবস্থান করেননি’।[27]
৫. একটি মাসআলায় বাতিল ফিরকাগুলোর বই থেকে একাধিক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যাতে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ-সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ না থাকে। তাঁর সকল গ্রন্থেই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন- শী‘আদের ইমাম মাহদী সম্পর্কে বিশ্বাস সম্পর্কে ৬৯টি, ইসমাঈলিয়াদের আল্লাহ সম্পর্কে বিশ্বাস সম্পর্কে ৭৬টি, ছূফীদের সন্ন্যাসব্রত সম্পর্কে ১৪৬টি, ব্রেলভীদের গায়েব সম্পর্কিত আক্বীদার ব্যাপারে ৩০-এর অধিক এবং কাদিয়ানীদের ভন্ড নবী গোলাম আহমাদকে রাসূল (ছাঃ)-এর উপর প্রাধান্য দেয়া সম্পর্কে ২০-এর অধিক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।[28]
৬. কখনো কখনো বাতিল ফিরকাগুলির মতামত ও আক্বীদা উল্লেখের ক্ষেত্রে দীর্ঘ উদ্ধৃতি (এক থেকে তিন বা তারও বেশী পৃষ্ঠা) পেশ করেছেন।[29]
৭. আল্লামা যহীর বাতিল ফিরকাগুলির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। সেজন্য যেকোন ফিরকার উপর বই লেখার পূর্বে তাদের সম্পর্কে সাধ্যানুযায়ী যতগুলি সম্ভব বইপত্র সংগ্রহ করতেন, বিভিন্ন দেশ সফর করতেন এবং এজন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতেন। যাতে তাদের বই থেকেই তাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সত্যকে মানুষের সামনে উদ্ভাসিত করা যায় এবং বাতিলপন্থীরা তার দলীল ও যুক্তির সামনে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়।
একবার তিনি ধর্মতত্ত্বের উপর বই সংগ্রহের জন্য রিয়াদ অতঃপর কায়রোর বইমেলায় যান। কায়রোতে গিয়ে তিনি শুনেন যে, ইসমাঈলী আলেম আল-মাগরেবী লিখিত ‘আল-মাজালিস ওয়াল মুসায়ারাত’ ( المجالس و المسايرات ) নামক তিউনেসীয় ছাপা বইটি বইমেলায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু মেলায় গিয়ে দেখেন, বইটির সব কপি ফুরিয়ে গেছে। ফলে সেটি সংগ্রহের জন্য তিনি তিউনিসিয়ায় গিয়ে বইটির প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করেন।[30]
তিনি ‘আশ-শী‘আ ওয়াত তাশাইয়ু‘ গ্রন্থে ২৫৯টি, ‘আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত’ গ্রন্থে ২৩০টি, ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’ গ্রন্থে ৮৮টি, ‘আর-রাদ্দুল কাফী’ গ্রন্থে ২৫৯টি, ‘আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন’ গ্রন্থে ৮৪টি, ‘আল-ইসমাঈলিয়াহ’ গ্রন্থে ১৬৯টি, ‘আত-তাছাউওফ আল-মানশা ওয়াল মাছাদির’ গ্রন্থে ৩৫৬টি, ‘দিরাসাত ফিত তাছাউওফ’ গ্রন্থে ৩৫৪টি, ‘আল-বাবিয়া’ গ্রন্থে ১৭৪টি, ‘আল-বাহাইয়া’ গ্রন্থে ২১৭টি, ‘আল-কাদিয়ানিয়াহ’ গ্রন্থে ১৫০টি ও ‘আল-ব্রেলভিয়া’ গ্রন্থে ১৮৫টি গ্রন্থ তথ্যসূত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন।[31] মক্কার উম্মুল ক্বোরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘শায়খ ইহসান ইলাহী যহীর মানহাজুহু ওয়া জুহূদুহু ফী তাক্বরীরিল আক্বীদা ওয়ার রাদ্দি আলাল ফিরাক্বিল মুখালিফাহ’ শিরোনামে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনকারী ড. আলী বিন মূসা আয-যাহরানী বলেন, وعند جمعي لمراجع الشيخ ومصادره في جميع كتبه وجدتها بلغت ألفين وخمسمائة وخمسة وعشرين مرجعا ومصدرا . ‘শায়খের সকল বইয়ের তথ্যসূত্র একত্রিত করে আমি সর্বমোট সংখ্যা পেয়েছি ২ হাযার ৫২৫টি’।[32]
৮. তিনি বাতিল ফিরকাগুলোর আক্বীদা-বিশ্বাসকে অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শের আক্বীদা-বিশ্বাসের সাথে তুলনা করেছেন। যেমন শী‘আদের ‘বেলায়াত’ সম্পর্কিত আক্বীদাকে ইহূদীদের সাথে, ছূফীদের বিভিন্ন আক্বীদাকে শী‘আ, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের সাথে, ইসমাঈলিয়াদের আল্লাহর পিতৃত্ব সম্পর্কিত আক্বীদাকে খৃষ্টানদের সাথে এবং শী‘আ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদার মধ্যে (বিশেষ করে ছাহাবীদের ব্যাপারে) তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।[33]
৯. ভ্রান্ত ফিরকাগুলোর মতামত খন্ডনের সময় তাদের যে সকল ব্যক্তি প্রসিদ্ধ, মধ্যপন্থী ও সাধারণের কাছে বিশ্বস্ত বলে পরিচিত তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এজন্য তিনি ‘আত-তাছাউওফ’ গ্রন্থে চরমপন্থী ছূফী মনছূর হাল্লাজ (মৃঃ ৩০৯) ও তার অনুসারীদের কোন বর্ণনাই উদ্ধৃত করেননি।[34]
১০. গালি-গালাজ না করে বাতিল ফিরকাগুলোর মুখোশ উন্মোচনের সময় বাহাছ-মুনাযারার শিষ্টাচার বজায় রেখেছেন এবং তাদেরকে বাতিল মত ও পথ ছেড়ে হকের পথে ফিরে আসার জন্য আহবান জানিয়েছেন। যেমন- ‘আল-কাদিয়ানিয়াহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, وراعية في الكةاب كله أن لا أخرج عن أسلوب البحث وآداب المناظرة . ‘গোটা বইয়ে আমি বাহাছ-মুনাযারার স্টাইল ও শিষ্টাচার থেকে বহির্গত না হওয়ার প্রতি খেয়াল রেখেছি’।[35] উক্ত গ্রন্থে ‘গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ’ শীর্ষক আলোচনায় তার প্রত্যেকটি ভবিষ্যদ্বাণী যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল তা বর্ণনা করার পর উপসংহারে এসে আল্লামা যহীর বলেন, فها هي الحقائق . والله نسأل أن يريهم الحق حقا ويرزقهم اتباعه، ويريهم الباطل باطلا ويرزقهم اجتنابه، وهو نعم المولى ونعم النصير ... ‘এগুলোই হল বাস্তবতা। আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন তাদেরকে হককে হক হিসাবে দেখিয়ে তার অনুসরণের এবং বাতিলকে বাতিল হিসাবে দেখিয়ে তা থেকে বিরত থাকার তৌফিক দেন। তিনিই উত্তম অভিভাবক ও সাহায্যকারী’।[36]
১১. প্রতিপক্ষের পরস্পর বিপরীতমুখী বর্ণনা উল্লেখ করে তাদেরকে কুপোকাত করেছেন। যেমন শী‘আ আলেম তূসী লিখিত ‘কিতাবুল গায়বাহ’তে বলা হয়েছে যে, তাদের প্রতীক্ষিত মাহদী মুহাম্মাদ বিন হাসান আল-আসকারী শেষ যামানায় মক্কায় আবির্ভূত হবেন এবং কা‘বাগৃহের নিকট জিবরীল (আঃ) তার হাতে বায়‘আত গ্রহণ করবেন। এরপর তিনি শী‘আ বিদ্বান আরবিলীর ‘কাশফুল গুম্মাহ’ গ্রন্থ থেকে বর্ণনা পেশ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, রাসূল (ছাঃ)-এর অন্তিম সময়ে জিবরীল এসে তাঁকে বললেন, আজকেই আমার দুনিয়ায় অবতরণের শেষ দিন।[37] এ দু’টি বর্ণনা পরস্পর বিরোধী। একটিতে তাদের কথিত মাহদীর নিকট জিবরীলের আগমনের কথা বলা হচ্ছে, আর অন্যটিতে তা নাকচ করা হচ্ছে। এভাবে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার মধ্যে তারা নিজেরাই আটকা পড়েছে।
১২. আল্লামা যহীর পূর্ববর্তী আলেম ও গবেষক এবং কখনও কখনও প্রাচ্যবিদদের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছেন। যেমন ছূফীদের জ্ঞানার্জন থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ইবনুল জাওযী (মৃঃ ৫৯৭ হিঃ)-এর মত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, وكان أصل تلبيسه عليهم أنه صدهم عن العلم وأراهم أن المقصود العمل . فلما أطفأ مصباح العلم عندهم تخبطوا في الظلمات - ‘ছূফীদের মধ্যে ইবলীসের সংশয় সৃষ্টির মূল বিষয় ছিল তাদেরকে জ্ঞানার্জন থেকে বিরত রাখা এবং আমল করাই মুখ্য উদ্দেশ্য একথা বুঝানো। যখন সে তাদের নিকট জ্ঞানের আলো নিভিয়ে দিল, তখন তারা অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে লাগল’।[38] প্রাচ্যবিদদের মধ্যে গোল্ডযিহের, নিকলসন, ব্রকলম্যান, ডোজি, মিলার, ভন হ্যামার প্রমুখের বক্তব্য ‘বাইরের সাক্ষ্য’ ( شهاداة خارجية ) হিসাবে উল্লেখ করেছেন।[39]
১৩. তিনি সূক্ষ্ম ও যথার্থভাবে বাতিল ফিরকাগুলোর মতামত পর্যালোচনার পর তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্য মত উল্লেখ করেছেন। যেমন- শী‘আদের ‘আহলুল বায়েত’ সম্পর্কিত আক্বীদার ভ্রান্তি নিরসনে তিনি ‘আহল’ ও ‘বায়েত’ শব্দ দু’টির অর্থ সম্পর্কে ভাষাবিদ, মুফাসসির ও গবেষকদের মতামত উল্লেখ ও পর্যালোচনার পর বলেছেন, فالحاصل أن المراد من أهل بيت النبى أصلا وحقيقة أزواجه عليه الصلاة والسلام، ويدخل في الأهل أولاده وأعمامه وأبنائهم أيضا تجاوزا . ‘মোদ্দাকথা, নবী পরিবার দ্বারা মূলত ও প্রকৃতঅর্থে রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণকে বুঝানো হয়েছে। তাঁর সন্তান-সন্ততি, চাচারা ও তাদের সন্তানগণও বৃহত্তর অর্থে নবী পরিবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে’।[40] উল্লেখ্য যে, শী‘আরা আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন (রাঃ) এবং তাদের বংশধরদেরকেই শুধুমাত্র আহলে বায়েত বা নবী পরিবার বলে থাকে।[41]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৮।
[2]. ১৮৯৩ সালে আব্দুল্লাহ আছেম নামে এক খৃষ্টান অমৃতসরে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ বিতর্কে তারা কেউই বিজয়ী হতে পারেনি এবং কোন ফলাফলে পৌঁছতে পারেনি। ফলে নিজের লজ্জা ঢাকবার জন্য গোলাম আহমাদ ১৮৯৩ সালের ৫ জুন ঘোষণা করে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়েছে যে, পনের মাস তথা ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আব্দুল্লাহ আছেম মারা যাবে। কিন্তু ঐদিন সে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ না করার ফলে ভন্ডনবী গোলাম আহমাদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। আব্দুল্লাহ আছেম এরপরেও অনেক দিন বেঁচেছিলেন। যহীর তাঁর বিতর্কে এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। দ্র. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ১৬৩-১৬৭।
[3]. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ৭-৮।
[4]. ঐ, পৃঃ ৮-৯।
[5]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত পৃঃ ২১৭।
[6]. ‘আল-আরাবিয়াহ’, সঊদী আরব, সংখ্যা ৮৭, রবীউল আখের, ১৪০৫ হিঃ, পৃঃ ৯১।
[7]. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ৯-১০।
[8]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৬-৪৭।
[9]. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ৭।
[10]. ইহসান ইলাহী যহীর, আল-ব্রেলভিয়া আক্বাইদ ওয়া তারীখ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ১১।
[11]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫০।
[12]. ঐ, পৃঃ ৪৮।
[13]. ইহসান ইলাহী যহীর, আল-ইসমাঈলিয়াহ তারীখ ওয়া আক্বাইদ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১৪০৬ হিঃ), পৃঃ ২৮-২৯।
[14]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৫।
[15]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ৭।
[16]. ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ২৪তম সংস্করণ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ১৫।
[17]. ইহসান ইলাহী যহীর, আত-তাছাওউফ আল-মানশা ওয়াল মাছাদির (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১৪০৬ হিঃ), পৃঃ ৫০।
[18]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ১১।
[19]. আল-ইসমাঈলিয়াহ, পৃঃ ২৭।
[20]. ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ৫ম সংস্করণ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৩ খৃঃ), পৃঃ ৬৭-৬৮।
[21]. দ্রঃ আল-ইসমাঈলিয়াহ, পৃঃ ২৭৩।
[22]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ৮৫-৮৬।
[23]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।
[24]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ১২৬-২৭।
[25]. আত-তাছাউওফ, পৃঃ ৬২।
[26]. ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ৪৬।
[27]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ১১০।
[28]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৩-৩০৪।
[29]. দ্র. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ১৭৭-১৮২; আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন, পৃঃ ৫৭-৫৮।
[30]. ‘আল-জুনদী আল-মুসলিম’, সংখ্যা ৪৮, ১৪০৮ হিঃ, পৃঃ ১৮; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২।
[31]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০০-৩০২।
[32]. ঐ, পৃঃ ৩০২।
[33]. বিস্তারিত আলোচনা দ্রঃ ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৪৫-৭৫।
[34]. আত-তাছাউওফ, পৃঃ ৯, ১১।
[35]. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ১২।
[36]. ঐ, পৃঃ ১৯৮।
[37]. বিস্তারিত দ্রঃ ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আ ওয়াত তাশাইয়ু ফিরাক ওয়া তারীখ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১০ম সংস্করণ, ১৪১৫ হিঃ), পৃঃ ৩৬১-৩৭৪।
[38]. ইহসান ইলাহী যহীর, দিরাসাত ফিত তাছাওউফ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৯ হিঃ), পৃঃ ১৩১; ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস (বৈরূত : মুআস্সাসাতুত তারীখ আল-আরাবী, তাবি), পৃঃ ১৭৪।
[39]. আশ-শী‘আ ওয়াত তাশাইয়ু, পৃঃ ১১৬; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১৮-১৯।
[40]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ১৯।
[41]. ঐ, পৃঃ ২০।
ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর মধ্যে এসব ফিরকা সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। তখন তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিয়ে বাহাইয়া, কাদিয়ানী ও খৃষ্টানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন তাদের বক্তব্য শোনার জন্য ও তাদের সাথে বাহাছ করার জন্য। শিয়ালকোটে একবার তাঁকে কাদিয়ানী মুবাল্লিগের সাথে মুনাযারার জন্য আহবান জানানো হলে তিনি তাদের প্রস্তাবে সম্মত হন। তবে শর্ত হ’ল- গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর বই তাঁকে পড়ার জন্য ধার দিতে হবে। কাদিয়ানীরা এ শর্তে রাযী হয়ে তাকে ‘আনজামে আছেম’, ‘ইযালাতুল আওহাম’, ‘দুর্রে ছামীন’, ‘হাক্বীক্বাতে অহী’, ‘সাফীনায়ে নূহ’-এই পাঁচটি বই পড়তে দেয়। প্রথম ও তৃতীয় বইটি তিনি এক রাতে পড়ে শেষ করেন। অন্য বইগুলোও দুই/তিন দিনে পড়ে শেষ করেন। নির্ধারিত দিনে কয়েকজন বন্ধুসহ কাদিয়ানী মসজিদে উপস্থিত হন। সেখানে বিতর্কের বিষয় নির্ধারিত হয় ‘গোলাম আহমাদের ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ’। কারণ সে তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে মিথ্যা নবুঅতের মানদন্ড হিসাবে পেশ করেছিল। তিনি বিতর্কে বলেন, গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, আব্দুল্লাহ আছেম ১৫ মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করবে।[2] কিন্তু সে এ সময়ের মধ্যে মরেনি। কাজেই তোমাদের কথিত ভন্ড নবীর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক না হওয়ায় সে যে মিথ্যা নবুঅতের দাবীদার তা প্রমাণিত হল। কারণ নবীদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সঠিক হয়। যহীরের এ যুক্তিতে কাদিয়ানী মুবাল্লিগের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তিনি জবাব দেয়ার চেষ্টা করে যহীরের অকাট্য দলীলের কাছে ব্যর্থ হয়ে নতি স্বীকার করেন এবং বলেন, আমি তার্কিক নই। ‘রাবওয়া’ থেকে কাদিয়ানী তার্কিক আসলে আমি তোমাদেরকে তার সাথে বাহাছের জন্য ডাকব। এভাবে সেখান থেকে যহীর ও তার বন্ধুরা বিজয়ী বেশে ফিরে আসেন এবং কাদিয়ানীদের আরো কিছু বই পড়ার জন্য ধার নিয়ে আসেন। আল্লামা যহীর বলেন, وهكذا بدأة أدرس هذا المذهب بدون أية واسطة . ‘এভাবে কোন মাধ্যম ছাড়াই আমি এই ফিরকা সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে শুরু করি’।[3]
এ ঘটনার পর আল্লামা যহীর ও তাঁর বন্ধুরা বাহাঈদের মাহফিল, খৃষ্টানদের ইনস্টিটিউটসমূহ এবং কাদিয়ানীদের কেন্দ্রসমূহে যাতায়াতের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। এমনকি তিনি কাদিয়ানীদের কেন্দ্র ‘রাবওয়া’তে গিয়েও তাদের সাথে বিতর্ক করে বিজয়ী হন।[4] পরবর্তীতে তিনি প্রত্যেক সপ্তাহের বৃহস্পতিবার শিয়ালকোটে যেতেন এবং কাদিয়ানী সেন্টারে গিয়ে তাদের সাথে বিতর্ক করতেন ও তাদের বইপত্র সংগ্রহ করে আনতেন।[5]
মাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনা করার সময় একদিন তিনি বাহাঈদের একটি সভার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বক্তারা আক্বীদা সম্পর্কিত একটি বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি সেই সভায় গিয়ে তাদের বক্তব্য শুনেন। ইতিপূর্বে তাদের সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না। তিনি ৮ দিন ঐ সভায় গিয়ে তাদের বক্তব্য শুনে তাদের আক্বীদা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে অবগত হন এবং জনগণকে এ বিষয়ে সজাগ করেন। ফলে সেই সভা বন্ধ করে দেয়া হয়।[6]
দেশে লেখাপড়া শেষ করার পর আল্লামা যহীর উচ্চশিক্ষার জন্য মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে ধর্মতত্ত্বে শিক্ষকদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা লক্ষ্য করে তিনি এ বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সেখানে অধ্যয়নকালে القاديانية عملية للاستعمار শিরোনামে আরবীতে প্রথম তাঁর একটি প্রবন্ধ দামেশকের ‘হাযারাতুল ইসলাম’ পত্রিকার ১৩৮৬ হিজরীর তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিদ্বানমহলে সাড়া পড়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকবৃন্দ তাঁকে কাদিয়ানীদের সম্পর্কে এ জাতীয় প্রবন্ধ লেখার জন্য উৎসাহিত করেন। ফলে তিনি আরবীতে এ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা অব্যাহত রাখেন।[7]
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে তিনি দ্বীনের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি বক্তৃতা জগতে সুদৃঢ়ভাবে পদচারণা অব্যাহত রাখেন এবং বিভিন্ন বাতিল ফিরকার ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস জনসমক্ষে তুলে ধরা তাঁর বক্তব্যের অবিচ্ছেদ্য উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য বক্তব্যের প্রয়োজনে তাঁকে এ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা করতে হয় বলে মাহবূব জাবেদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন।[8]
ধর্মতত্ত্বের উপর বক্তৃতা দেয়া ও লেখালেখির জন্য প্রচুর পড়াশুনার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে বাতিল ফিরকাগুলির আক্বীদা বিশ্লেষণ এবং দলীল ও যুক্তিভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সেগুলির দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য। আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের মধ্যে এই গুণ পুরা মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তিনি ছাত্র জীবনেই কাদিয়ানীদের সম্পর্কে বইপত্র পড়া শুরু করেন। যেমন ‘আল-কাদিয়ানিয়াহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন, فدرست هذه الحركة أثناء دراستي في المدارس الشرعية، بواسطة كتب شيخ الإسلام العلامة ثناء الله الأمرتسري، وإمام عصره الشيخ محمد إبراهيم السيالكوتي، وشيخنا الجليل العلامة المحدث الحافظ محمد جوندلوي، وغيرهم من العلماء . ‘ইসলামিয়া মাদরাসাগুলিতে পড়াশুনা করার সময় শায়খুল ইসলাম আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, স্বীয় যুগের ইমাম শায়খ মুহাম্মাদ ইবরাহীম শিয়ালকোটী, আমাদের সম্মানিত শায়খ আল্লামা মুহাদ্দিছ হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলবী ও অন্যান্য আলেমদের বইপত্রের বদৌলতে আমি এই আন্দোলন সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছিলাম’।[9] তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে পরিশ্রমকে মোটেই ভয় পেতেন না। ‘আল-ব্রেলভিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থটি লেখার জন্য তিনি তিন শতাধিক বই অধ্যয়ন করেন।[10]
এক লাখ গ্রন্থ সম্বলিত তাঁর একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল। নানাবিধ কর্মব্যস্ততার মাঝে তিনি যখনই সময় পেতেন তখনই এই লাইব্রেরীতে বসে জ্ঞানসমুদ্রের মণি-মাণিক্য আহরণে মশগুল হয়ে যেতেন। মাহবূব জাবেদকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি যখনই অবসর পাই, তখনই সেই সময়টুকু আমার বাড়ির লাইব্রেরীতে কাটাই। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে বিভিন্ন ফিরকার উপর পৃথিবীর যেকোন বড় লাইব্রেরীর চেয়ে বেশী বই আছে। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে হাযার হাযার বই মওজুদ রয়েছে। এগুলি সবই আমি অধ্যয়ন করেছি। আপনি এটা জেনে আশ্চর্য হবেন যে, আমি ৩/৪ ঘণ্টা ঘুমাই। সারাজীবন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ ঘণ্টার বেশী আমি কখনো ঘুমাইনি। যখন পৃথিবী ঘুমের সাগরে ডুবে থাকে, তখন আমি আমার লাইব্রেরীতে অবস্থান করি। আমি আমার বিবিধ কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কাগজ-কলমের সাথে যোগসূত্র বজায় রেখে আসছি’।[11]
কাদিয়ানী, শী‘আ, বাহাইয়া, বাবিয়া, ব্রেলভী, ইসমাঈলিয়া, ছূফী প্রভৃতি ভ্রান্ত ফিরকাগুলোর আক্বীদা জনসম্মুখে তুলে ধরে ইসলামের নির্মল রূপ প্রকাশ করাই তাঁর ধর্মতত্ত্ব গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল। কাউকে সন্তুষ্ট, ক্রুদ্ধ অথবা নিছক গবেষণার জন্য তাঁর লেখালেখি পরিচালিত হয়নি। তিনি বলেছেন, ‘আমি কঠোর পরিশ্রম করে বিভিন্ন ফিরকার উপর প্রামাণ্য বইপত্র লেখার চেষ্টা করেছি। ধর্মতত্ত্বের উপর বই লিখে আমি ইসলামের খিদমত করেছি; বিভেদ সৃষ্টি করিনি। ভ্রান্ত ফিরকাগুলোর আক্বীদা বর্ণনা করেছি মাত্র। মানুষকে রাসূল (ছাঃ) আনীত ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করার এবং ইসলামকে স্রেফ কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে দেখার জন্য উৎসাহ যুগিয়েছি’।[12] তিনি ‘আল-ইসমাঈলিয়াহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হককে বাতিল থেকে, সঠিককে বেঠিক থেকে, হেদায়াতকে পথভ্রষ্টতা থেকে, ইসলামকে কুফরী থেকে পৃথক করা এবং মানুষকে বক্র পথ, শয়তানী আদর্শ ও মানুষের মতামত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া শ্বেত-শুভ্র-নিষ্কলঙ্ক পথের দিশা প্রদান করে ইসলামের পবিত্রতার প্রতিরক্ষা-ই বাতিল ফিরকাসমূহ সম্পর্কে কলমী জিহাদ চালানোর পিছনে আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। যেমন তিনি বলেন,
فهذا هو الهدف، وهذه هي الحقيقة من البحث والكتابة في الفرق الضالة، المنحرفة، والطوائف الباغية الخارجة على الإسلام ممن كتبنا عنهم حتى اليوم .
‘পথভ্রষ্ট, ভ্রান্ত ও ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া বিদ্রোহী দলগুলির যাদের সম্পর্কে অদ্যাবধি আমরা গবেষণা করেছি ও লিখেছি, তার উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা এটিই’।[13]
এক্ষণে প্রশ্ন হল, তিনি তাঁর মাতৃভাষা উর্দূ বাদ দিয়ে আরবীতে কেন ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত বই লিখলেন তাঁর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাহবূব জাবেদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি ধর্মতত্ত্বের উপর বেশী বই লিখেছি। এই বইগুলি গোটা মুসলিম বিশ্বে পড়ানো হোক সে উদ্দেশ্য ছিল। এজন্য আমি আমার এই বইগুলি আরবীতে লিখেছি’।[14] আরবীতে বই লেখার আর একটা কারণ হল- এসব বাতিল ফিরকাগুলির আক্বীদা-বিশ্বাসধারী বিভিন্ন ফিরকা মুসলিম দেশগুলিতে বিভিন্ন নামে বিদ্যমান আছে। ‘আল-ব্রেলভিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন,
إنها جديدة من حيث النشأة والإسم، ومن فرق شبه القارة من حيث التكوين والهيئة، ولكنها قديمة من حيث الأفكار والعقائد، ومن الفرق المنتشرة الكثيرة في العالم الإسلامي بأسماء مختلفة وصور متنوعة من الخرافيين وأهل البدع، لذلك أردت أن أكتب عنهم في اللغة العربية كما كتبت عن الفئات الضالة المنحرفة الأخرى .
‘নাম ও উদ্ভব এবং গঠন ও আকৃতির দিক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ফিরকাগুলির মধ্যে এটা নতুন। কিন্তু চিন্তাধারা ও আক্বীদা এবং মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন নাম ও আকৃতিতে বিস্তৃত বহু বিদ‘আতী ও কুসংস্কারপন্থী ফিরকার দিক থেকে এটা পুরাতন। এজন্য আমি এদের সস্পর্কে আরবীতে লিখতে মনস্থ করেছি, যেমনভাবে অন্যান্য পথভ্রষ্ট ভ্রান্ত ফিরকাগুলো সম্পর্কে লিখেছি’।[15]
ধর্মতত্ত্ব গবেষণায় তাঁর মানহাজ বা পদ্ধতি ছিল ভিন্ন স্টাইলের। তিনি যেই ফিরকার উপর বই লিখতেন সেই ফিরকার লিখিত বই-পত্র থেকেই তাদের ইতিহাস ও আক্বীদা-বিশ্বাস বর্ণনা করতেন। ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন,
وقد التزمنا في هذا الكتاب أن لا نذكر شيئا من الشيعة إلا من كتبهم، وبعباراتهم أنفسهم، مع ذكر الكتاب، والمجلد، والصفحة، والطبعة، بحول الله وقوته .
‘আমরা এই গ্রন্থে এ নীতি অবলম্বন করেছি যে, শী‘আদের থেকে আমরা যা কিছুই উল্লেখ করব আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিতে তা তাদের বই-পুস্তক থেকেই নাম, খন্ড, পৃষ্ঠা ও ছাপা সহ তাদের উদ্ধৃতি দিয়েই উল্লেখ করব’।[16] এ পদ্ধতি কঠিন, কণ্টকাকীর্ণ ও দুর্গম হলেও এটাই ধর্মতত্ত্ব গবেষণার ‘সঠিক পদ্ধতি’ ( الطريقة الصحيحة المسةقيمة ) বলে তিনি মনে করেন।[17] এজন্য তিনি আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাওয়ার ব্যাপারেও দৃঢ় বিশ্বাসী।[18]
২. আল্লামা যহীর বাতিল ফিরকাগুলোর আক্বীদা-বিশ্বাস বর্ণনার ক্ষেত্রে পূর্ণ আমানতদারিতার পরিচয় দিয়েছেন। যে শব্দে ও বাক্যে তাদের বইগুলোতে সেগুলো উদ্ধৃত হয়েছে তিনি কোন প্রকার কমবেশী করা ছাড়াই তা হুবহু উল্লেখ করেছেন। ‘আল-ইসমাঈলিয়াহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন,
إن مدار الاستشهاد والاستدلال ليست إلا على كتب القوم أنفسهم بالأمانة العلمية ونقل العبارات الكاملة بدون تحريف وتبديل وتغيير التي بها امتازت كتبنا ومؤلفاتنا بفضل من الله وتوفيقه -
‘ইলমী আমানত এবং কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিকৃতি ছাড়াই পূর্ণ বর্ণনা উদ্ধৃত করার মাধ্যমে গোষ্ঠীটির নিজেদের গ্রন্থাবলীই যুক্তি-প্রমাণের কেন্দ্রবিন্দু। আল্লাহর অনুকম্পায় আমাদের সকল গ্রন্থই এ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত’।[19] যেমন ‘আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন’ গ্রন্থে কুরআনের বিকৃতি সাধন সম্পর্কে শী‘আ মুহাদ্দিছ নেয়ামাতুল্লাহ জাযায়েরীর (জন্ম : ১০৫০ হিঃ) লিখিত ‘আল-আনওয়ারুন নু‘মানিয়া’ (২/৩৫৭) গ্রন্থ থেকে হুবহু উদ্ধৃতি পেশ করেছেন।[20]
৩. তিনি বাতিল ফিরকাগুলোর মত খন্ডনের ক্ষেত্রে কুরআন, হাদীছ ও সালাফে ছালেহীনের বুঝের উপর নির্ভর করেছেন। ভ্রান্ত ফিরকা ইসমাঈলিয়ারা মনে করে যে, ‘আল্লাহর কোন নাম ও গুণাবলী নেই’। আল্লামা যহীর তাদের এই ভ্রান্ত মত খন্ডন করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, এটি কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফে ছালেহীনের মানহাজের খেলাফ। কুরআন-সুন্নাহ প্রমাণ করে যে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলী রয়েছে। এর প্রমাণে তিনি কুরআন মাজীদের ৩৫টি আয়াত উদ্ধৃত করেছেন।[21] ব্রেলভীদের আক্বীদা- ‘নবী, রাসূল ও অলী-আওলিয়া অদৃশ্যের খবর জানেন’-এর খন্ডনে নামল ৬৫, ফাতির ৩৮, হুজুরাত ১৮, হূদ ১২৩, ইউনুস ২০, আন‘আম ৫৯, লোকমান ৩৪ মোট ৭টি আয়াত পেশ করেছেন।[22] অনুরূপভাবে ঈদে মীলাদুন্নবী সম্পর্কে ব্রেলভীদের মত খন্ডন করতে গিয়ে একে ‘বিদ‘আত’ বলে আখ্যা দেন এবং এর প্রমাণে مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ . ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’[23] হাদীছটি উল্লেখ করেছেন।[24] তাছাড়া ছূফীদের বৈবাহিক জীবনে অনীহার খন্ডনে কুরআন ও হাদীছ থেকে দলীল উল্লেখের পর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। মহামতি ইমাম বলেন, ليس العزوبة من أمر الإسلام في شيء . ‘চিরকুমার থাকা ইসলামী শরী‘আতের কোন বিধানই নয়’।[25]
৪. শক্তিশালী যুক্তির মাধ্যমে তিনি বাতিল ফিরকাগুলির মতামত খন্ডন করেছেন। শী‘আ ইমাম মুহাম্মাদ বিন বাকির আল-মাজলেসী (১০৩৭-১১১১ হিঃ) তাঁর ‘হায়াতুল কুলূব’ গ্রন্থে (২/৬৪০) উল্লেখ করেছেন যে, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আবূ যর গিফারী, মিক্বদাদ বিন আসওয়াদ ও সালমান ফারেসী- এই তিনজন ব্যতীত সবাই মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল’ (নাঊযুবিল্লাহ)। আল্লামা যহীর শক্তিশালী যুক্তির অবতারণা করে তার এ ভ্রান্ত মত খন্ডন করে বলেন,
ولسائل أن يسأل هؤلاء الأشقياء وأين ذهب أهل بيت النبى بما فيهم عباس عم النبى، وابن عباس ابن عمه، وعقيل أخ لعلى، وحتى على نفسه، والحسنان سبطا رسول الله؟
‘এই হতভাগ্যদেরকে কোন প্রশ্নকারীর জিজ্ঞেস করা উচিত, তাহলে রাসূল (ছাঃ)-এর আহলে বায়েত বা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত তাঁর চাচা আববাস, চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আববাস, আলী (রাঃ)-এর ভাই আক্বীল এমনকি খোদ আলী এবং রাসূল (ছাঃ)-এর নাতিদ্বয় হাসান ও হুসাইন তখন কোথায় গিয়েছিলেন’?[26]
অনুরূপভাবে ব্রেলভীদের আক্বীদা- ‘রাসূল (ছাঃ) সর্বত্র হাযির ও সবকিছু দেখেন’-এর খন্ডনে সূরা ফাতহ-এর ১৮নং আয়াত উল্লেখ করেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তো মুমিনগণের উপর সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা গাছের নিচে তোমার নিকট বায়‘আত করল’। এরপর তিনি এত্থেকে যুক্তিসিদ্ধ দলীল সাব্যস্ত করে বলেন,
فكان هذا في الحديبية في العام السادس بعد الهجرة حيث لم يكن فى المدينة كما لم يكن في مكة ولم يكن في الحديبية موجودا قبله ولم يبقى فيها بعد رجوعه إلى المدينة .
‘হিজরতের পরে ষষ্ঠ বর্ষে হুদায়বিয়াতে এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। তখন তিনি যেমন মদীনায় ছিলেন না, তেমনি মক্কাতেও ছিলেন না। আর ইতিপূর্বে তিনি হুদায়বিয়াতে উপস্থিত ছিলেন না এবং সেখান থেকে মদীনায় ফিরে আসার পর সেখানেও অবস্থান করেননি’।[27]
৫. একটি মাসআলায় বাতিল ফিরকাগুলোর বই থেকে একাধিক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যাতে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ-সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ না থাকে। তাঁর সকল গ্রন্থেই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন- শী‘আদের ইমাম মাহদী সম্পর্কে বিশ্বাস সম্পর্কে ৬৯টি, ইসমাঈলিয়াদের আল্লাহ সম্পর্কে বিশ্বাস সম্পর্কে ৭৬টি, ছূফীদের সন্ন্যাসব্রত সম্পর্কে ১৪৬টি, ব্রেলভীদের গায়েব সম্পর্কিত আক্বীদার ব্যাপারে ৩০-এর অধিক এবং কাদিয়ানীদের ভন্ড নবী গোলাম আহমাদকে রাসূল (ছাঃ)-এর উপর প্রাধান্য দেয়া সম্পর্কে ২০-এর অধিক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।[28]
৬. কখনো কখনো বাতিল ফিরকাগুলির মতামত ও আক্বীদা উল্লেখের ক্ষেত্রে দীর্ঘ উদ্ধৃতি (এক থেকে তিন বা তারও বেশী পৃষ্ঠা) পেশ করেছেন।[29]
৭. আল্লামা যহীর বাতিল ফিরকাগুলির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। সেজন্য যেকোন ফিরকার উপর বই লেখার পূর্বে তাদের সম্পর্কে সাধ্যানুযায়ী যতগুলি সম্ভব বইপত্র সংগ্রহ করতেন, বিভিন্ন দেশ সফর করতেন এবং এজন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতেন। যাতে তাদের বই থেকেই তাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সত্যকে মানুষের সামনে উদ্ভাসিত করা যায় এবং বাতিলপন্থীরা তার দলীল ও যুক্তির সামনে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়।
একবার তিনি ধর্মতত্ত্বের উপর বই সংগ্রহের জন্য রিয়াদ অতঃপর কায়রোর বইমেলায় যান। কায়রোতে গিয়ে তিনি শুনেন যে, ইসমাঈলী আলেম আল-মাগরেবী লিখিত ‘আল-মাজালিস ওয়াল মুসায়ারাত’ ( المجالس و المسايرات ) নামক তিউনেসীয় ছাপা বইটি বইমেলায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু মেলায় গিয়ে দেখেন, বইটির সব কপি ফুরিয়ে গেছে। ফলে সেটি সংগ্রহের জন্য তিনি তিউনিসিয়ায় গিয়ে বইটির প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করেন।[30]
তিনি ‘আশ-শী‘আ ওয়াত তাশাইয়ু‘ গ্রন্থে ২৫৯টি, ‘আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত’ গ্রন্থে ২৩০টি, ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’ গ্রন্থে ৮৮টি, ‘আর-রাদ্দুল কাফী’ গ্রন্থে ২৫৯টি, ‘আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন’ গ্রন্থে ৮৪টি, ‘আল-ইসমাঈলিয়াহ’ গ্রন্থে ১৬৯টি, ‘আত-তাছাউওফ আল-মানশা ওয়াল মাছাদির’ গ্রন্থে ৩৫৬টি, ‘দিরাসাত ফিত তাছাউওফ’ গ্রন্থে ৩৫৪টি, ‘আল-বাবিয়া’ গ্রন্থে ১৭৪টি, ‘আল-বাহাইয়া’ গ্রন্থে ২১৭টি, ‘আল-কাদিয়ানিয়াহ’ গ্রন্থে ১৫০টি ও ‘আল-ব্রেলভিয়া’ গ্রন্থে ১৮৫টি গ্রন্থ তথ্যসূত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন।[31] মক্কার উম্মুল ক্বোরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘শায়খ ইহসান ইলাহী যহীর মানহাজুহু ওয়া জুহূদুহু ফী তাক্বরীরিল আক্বীদা ওয়ার রাদ্দি আলাল ফিরাক্বিল মুখালিফাহ’ শিরোনামে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনকারী ড. আলী বিন মূসা আয-যাহরানী বলেন, وعند جمعي لمراجع الشيخ ومصادره في جميع كتبه وجدتها بلغت ألفين وخمسمائة وخمسة وعشرين مرجعا ومصدرا . ‘শায়খের সকল বইয়ের তথ্যসূত্র একত্রিত করে আমি সর্বমোট সংখ্যা পেয়েছি ২ হাযার ৫২৫টি’।[32]
৮. তিনি বাতিল ফিরকাগুলোর আক্বীদা-বিশ্বাসকে অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শের আক্বীদা-বিশ্বাসের সাথে তুলনা করেছেন। যেমন শী‘আদের ‘বেলায়াত’ সম্পর্কিত আক্বীদাকে ইহূদীদের সাথে, ছূফীদের বিভিন্ন আক্বীদাকে শী‘আ, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের সাথে, ইসমাঈলিয়াদের আল্লাহর পিতৃত্ব সম্পর্কিত আক্বীদাকে খৃষ্টানদের সাথে এবং শী‘আ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদার মধ্যে (বিশেষ করে ছাহাবীদের ব্যাপারে) তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।[33]
৯. ভ্রান্ত ফিরকাগুলোর মতামত খন্ডনের সময় তাদের যে সকল ব্যক্তি প্রসিদ্ধ, মধ্যপন্থী ও সাধারণের কাছে বিশ্বস্ত বলে পরিচিত তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এজন্য তিনি ‘আত-তাছাউওফ’ গ্রন্থে চরমপন্থী ছূফী মনছূর হাল্লাজ (মৃঃ ৩০৯) ও তার অনুসারীদের কোন বর্ণনাই উদ্ধৃত করেননি।[34]
১০. গালি-গালাজ না করে বাতিল ফিরকাগুলোর মুখোশ উন্মোচনের সময় বাহাছ-মুনাযারার শিষ্টাচার বজায় রেখেছেন এবং তাদেরকে বাতিল মত ও পথ ছেড়ে হকের পথে ফিরে আসার জন্য আহবান জানিয়েছেন। যেমন- ‘আল-কাদিয়ানিয়াহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, وراعية في الكةاب كله أن لا أخرج عن أسلوب البحث وآداب المناظرة . ‘গোটা বইয়ে আমি বাহাছ-মুনাযারার স্টাইল ও শিষ্টাচার থেকে বহির্গত না হওয়ার প্রতি খেয়াল রেখেছি’।[35] উক্ত গ্রন্থে ‘গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ’ শীর্ষক আলোচনায় তার প্রত্যেকটি ভবিষ্যদ্বাণী যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল তা বর্ণনা করার পর উপসংহারে এসে আল্লামা যহীর বলেন, فها هي الحقائق . والله نسأل أن يريهم الحق حقا ويرزقهم اتباعه، ويريهم الباطل باطلا ويرزقهم اجتنابه، وهو نعم المولى ونعم النصير ... ‘এগুলোই হল বাস্তবতা। আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন তাদেরকে হককে হক হিসাবে দেখিয়ে তার অনুসরণের এবং বাতিলকে বাতিল হিসাবে দেখিয়ে তা থেকে বিরত থাকার তৌফিক দেন। তিনিই উত্তম অভিভাবক ও সাহায্যকারী’।[36]
১১. প্রতিপক্ষের পরস্পর বিপরীতমুখী বর্ণনা উল্লেখ করে তাদেরকে কুপোকাত করেছেন। যেমন শী‘আ আলেম তূসী লিখিত ‘কিতাবুল গায়বাহ’তে বলা হয়েছে যে, তাদের প্রতীক্ষিত মাহদী মুহাম্মাদ বিন হাসান আল-আসকারী শেষ যামানায় মক্কায় আবির্ভূত হবেন এবং কা‘বাগৃহের নিকট জিবরীল (আঃ) তার হাতে বায়‘আত গ্রহণ করবেন। এরপর তিনি শী‘আ বিদ্বান আরবিলীর ‘কাশফুল গুম্মাহ’ গ্রন্থ থেকে বর্ণনা পেশ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, রাসূল (ছাঃ)-এর অন্তিম সময়ে জিবরীল এসে তাঁকে বললেন, আজকেই আমার দুনিয়ায় অবতরণের শেষ দিন।[37] এ দু’টি বর্ণনা পরস্পর বিরোধী। একটিতে তাদের কথিত মাহদীর নিকট জিবরীলের আগমনের কথা বলা হচ্ছে, আর অন্যটিতে তা নাকচ করা হচ্ছে। এভাবে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার মধ্যে তারা নিজেরাই আটকা পড়েছে।
১২. আল্লামা যহীর পূর্ববর্তী আলেম ও গবেষক এবং কখনও কখনও প্রাচ্যবিদদের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছেন। যেমন ছূফীদের জ্ঞানার্জন থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ইবনুল জাওযী (মৃঃ ৫৯৭ হিঃ)-এর মত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, وكان أصل تلبيسه عليهم أنه صدهم عن العلم وأراهم أن المقصود العمل . فلما أطفأ مصباح العلم عندهم تخبطوا في الظلمات - ‘ছূফীদের মধ্যে ইবলীসের সংশয় সৃষ্টির মূল বিষয় ছিল তাদেরকে জ্ঞানার্জন থেকে বিরত রাখা এবং আমল করাই মুখ্য উদ্দেশ্য একথা বুঝানো। যখন সে তাদের নিকট জ্ঞানের আলো নিভিয়ে দিল, তখন তারা অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে লাগল’।[38] প্রাচ্যবিদদের মধ্যে গোল্ডযিহের, নিকলসন, ব্রকলম্যান, ডোজি, মিলার, ভন হ্যামার প্রমুখের বক্তব্য ‘বাইরের সাক্ষ্য’ ( شهاداة خارجية ) হিসাবে উল্লেখ করেছেন।[39]
১৩. তিনি সূক্ষ্ম ও যথার্থভাবে বাতিল ফিরকাগুলোর মতামত পর্যালোচনার পর তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্য মত উল্লেখ করেছেন। যেমন- শী‘আদের ‘আহলুল বায়েত’ সম্পর্কিত আক্বীদার ভ্রান্তি নিরসনে তিনি ‘আহল’ ও ‘বায়েত’ শব্দ দু’টির অর্থ সম্পর্কে ভাষাবিদ, মুফাসসির ও গবেষকদের মতামত উল্লেখ ও পর্যালোচনার পর বলেছেন, فالحاصل أن المراد من أهل بيت النبى أصلا وحقيقة أزواجه عليه الصلاة والسلام، ويدخل في الأهل أولاده وأعمامه وأبنائهم أيضا تجاوزا . ‘মোদ্দাকথা, নবী পরিবার দ্বারা মূলত ও প্রকৃতঅর্থে রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণকে বুঝানো হয়েছে। তাঁর সন্তান-সন্ততি, চাচারা ও তাদের সন্তানগণও বৃহত্তর অর্থে নবী পরিবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে’।[40] উল্লেখ্য যে, শী‘আরা আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন (রাঃ) এবং তাদের বংশধরদেরকেই শুধুমাত্র আহলে বায়েত বা নবী পরিবার বলে থাকে।[41]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৮।
[2]. ১৮৯৩ সালে আব্দুল্লাহ আছেম নামে এক খৃষ্টান অমৃতসরে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ বিতর্কে তারা কেউই বিজয়ী হতে পারেনি এবং কোন ফলাফলে পৌঁছতে পারেনি। ফলে নিজের লজ্জা ঢাকবার জন্য গোলাম আহমাদ ১৮৯৩ সালের ৫ জুন ঘোষণা করে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়েছে যে, পনের মাস তথা ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আব্দুল্লাহ আছেম মারা যাবে। কিন্তু ঐদিন সে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ না করার ফলে ভন্ডনবী গোলাম আহমাদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। আব্দুল্লাহ আছেম এরপরেও অনেক দিন বেঁচেছিলেন। যহীর তাঁর বিতর্কে এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। দ্র. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ১৬৩-১৬৭।
[3]. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ৭-৮।
[4]. ঐ, পৃঃ ৮-৯।
[5]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত পৃঃ ২১৭।
[6]. ‘আল-আরাবিয়াহ’, সঊদী আরব, সংখ্যা ৮৭, রবীউল আখের, ১৪০৫ হিঃ, পৃঃ ৯১।
[7]. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ৯-১০।
[8]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৬-৪৭।
[9]. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ৭।
[10]. ইহসান ইলাহী যহীর, আল-ব্রেলভিয়া আক্বাইদ ওয়া তারীখ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ১১।
[11]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫০।
[12]. ঐ, পৃঃ ৪৮।
[13]. ইহসান ইলাহী যহীর, আল-ইসমাঈলিয়াহ তারীখ ওয়া আক্বাইদ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১৪০৬ হিঃ), পৃঃ ২৮-২৯।
[14]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৫।
[15]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ৭।
[16]. ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ২৪তম সংস্করণ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ১৫।
[17]. ইহসান ইলাহী যহীর, আত-তাছাওউফ আল-মানশা ওয়াল মাছাদির (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১৪০৬ হিঃ), পৃঃ ৫০।
[18]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ১১।
[19]. আল-ইসমাঈলিয়াহ, পৃঃ ২৭।
[20]. ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ৫ম সংস্করণ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৩ খৃঃ), পৃঃ ৬৭-৬৮।
[21]. দ্রঃ আল-ইসমাঈলিয়াহ, পৃঃ ২৭৩।
[22]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ৮৫-৮৬।
[23]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।
[24]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ১২৬-২৭।
[25]. আত-তাছাউওফ, পৃঃ ৬২।
[26]. ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ৪৬।
[27]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ১১০।
[28]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৩-৩০৪।
[29]. দ্র. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ১৭৭-১৮২; আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন, পৃঃ ৫৭-৫৮।
[30]. ‘আল-জুনদী আল-মুসলিম’, সংখ্যা ৪৮, ১৪০৮ হিঃ, পৃঃ ১৮; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২।
[31]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০০-৩০২।
[32]. ঐ, পৃঃ ৩০২।
[33]. বিস্তারিত আলোচনা দ্রঃ ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৪৫-৭৫।
[34]. আত-তাছাউওফ, পৃঃ ৯, ১১।
[35]. আল-কাদিয়ানিয়াহ, পৃঃ ১২।
[36]. ঐ, পৃঃ ১৯৮।
[37]. বিস্তারিত দ্রঃ ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আ ওয়াত তাশাইয়ু ফিরাক ওয়া তারীখ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১০ম সংস্করণ, ১৪১৫ হিঃ), পৃঃ ৩৬১-৩৭৪।
[38]. ইহসান ইলাহী যহীর, দিরাসাত ফিত তাছাওউফ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৯ হিঃ), পৃঃ ১৩১; ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস (বৈরূত : মুআস্সাসাতুত তারীখ আল-আরাবী, তাবি), পৃঃ ১৭৪।
[39]. আশ-শী‘আ ওয়াত তাশাইয়ু, পৃঃ ১১৬; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১৮-১৯।
[40]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ১৯।
[41]. ঐ, পৃঃ ২০।
১৯৮৭ সালের ২৩শে মার্চ সোমবার লাহোরের কেল্লা লছমনসিং ফোয়ারা চক রাভী পার্কে ‘আহলেহাদীছ ইয়ুথ ফোর্স’ লছমনসিং এলাকার উদ্যোগে এক বিরাট ইসলামী জালসায় আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর তদানীন্তন পাকিস্তানের দুর্দশা ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বক্তৃতা করছিলেন। হামদ ও ছানার পর তিনি তাঁর বক্তব্যের প্রথমদিকে বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমাদের দেশ কঠিন দুঃসময় অতিক্রম করছে। একথা শুধু পাকিস্তানের বেলায়ই প্রযোজ্য নয়; বরং গোটা মুসলিম বিশ্ব বর্তমানে যে দুঃসন্ধিক্ষণের সম্মুখীন হয়েছে, তা কখনো মুসলিম বিশ্বে আপতিত হয়নি। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা অনেক। চৌদ্দশ বছরের মুসলিম ইতিহাসে বর্তমানের ন্যায় এতো জনসংখ্যা কখনো ছিল না। বর্তমানে মুসলিম জনসংখ্যা ১২০ কোটির বেশি। এখন পৃথিবীতে ৪৫টির বেশি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। এর পাশাপাশি বর্তমানে মুসলমানদের কাছে এত সম্পদ রয়েছে যার কল্পনাই করা যায় না। ... ধন-সম্পদ, জনসংখ্যা এবং রাষ্ট্র সত্ত্বেও মুসলমানদের উপর লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে’ (বাক্বারাহ ৬১)। আজ মুসলমানরা যতটা লাঞ্ছিত-অপমানিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, দুর্বল, অসহায়, পরাভূত-নির্যাতিত, ততটা বিশ্বের ইতিহাসে কখনো ছিল না। আমরা কখনো কি একথা চিন্তা করেছি যে, আমাদের সংখ্যা ও সম্পদ সবচেয়ে বেশি এবং রাষ্ট্র অসংখ্য হওয়া সত্ত্বেও আমরা কেন সীমাহীন লাঞ্ছনার শিকার। আসলে এর কারণ কি? কেন এমনটা হল’? এরপর তিনি তাঁর বক্তৃতায় জেনারেল যিয়াউল হকের কঠোর সমালোচনা করেন। কারণ তিনি ভারত সফরে গিয়ে সোনিয়া গান্ধীর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে করমর্দন করেছিলেন। এভাবে বক্তব্যের এক পর্যায়ে আল্লামা ইকবালের কবিতা-
كافر ہے تو شمشير پہ كرتا ہے بهروسا
مؤمن ہے تو بے تيغ بهى ( لڑتا ہے سپاهى )
এ পর্যন্ত বলা মাত্রই রাত ১১-টা ২০ মিনিটের দিকে একটি শক্তিশালী টাইমবোমা বিস্ফোরিত হয়। তখন তিনি মাত্র ২০/২২ মিনিট বক্তৃতা করেছেন।[1]
বোমাটি স্টেজের নিচে পেতে রাখা ছিল। এর পূর্বে একটি ফুলদানি মঞ্চে রাখার জন্য জালসার পিছন থেকে পাঠানো হয়েছিল, যেটিতে শক্তিশালী রাসায়নিক দ্রব্য ছিল।
বোমা বিস্ফোরণের পর সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। লোকজনের আর্তচিৎকারে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। সবাই প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। ৯ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন ১১৪ জন। আহত ও নিহতদের রক্তে ময়দান রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। আশপাশের কয়েকটি বাড়ি ও বিল্ডিংও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’-এর ডেপুটি সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা হাবীবুর রহমান ইয়াযদানী (১৯৪৭-১৯৮৭), মাওলানা আব্দুল খালেক কুদ্দূসী (১৯৩৯-১৯৮৭), ‘আহলেহাদীছ ইয়ুথ ফোর্স’ প্রধান মাওলানা মুহাম্মাদ খান নাজীব, মাওলানা মুহাম্মাদ শফীক খান, জালসার সভাপতি ইহসানুল হক, নাঈম বাদশাহ, রানা যুবায়ের, ফারূক রানা, মুহাম্মাদ আসলাম, মুহাম্মাদ আলম, আব্দুস সালাম, সেলীম ফারূকী প্রমুখ। বোমা বিস্ফোরণের পর আল্লামা যহীর ২০/৩০ মিটার দূরে ছিটকে পড়েন। কিন্তু তখনও তিনি জ্ঞান হারাননি। তাঁকে মারাত্মক আহত অবস্থায় লাহোরের কেন্দ্রীয় মিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে পাঁচদিন ইন্টেনসিভ কেয়ারে (নিবিড় পর্যবেক্ষণে) চিকিৎসাধীন থাকেন।[2]
[1]. ‘শহীদে মিল্লাত কা আখেরী পয়গাম’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৭০-৮১; বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৩-১৪।
[2]. মুহাম্মাদ ছায়েম, শুহাদাউদ দাওয়াহ আল-ইসলামিয়াহ ফিল ক্বারনিল ইশরীন (কায়রো : দারুল ফাযীলাহ, ১৯৯২), পৃঃ ১৬৬-৬৭; মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর : আল-জিহাদু ওয়াল ইলমু মিনাল হায়াতি ইলাল মামাত (কুয়েত : ১৪০৭ হিঃ), পৃঃ ১৮-২০; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৩-১৪; ‘আদ-দাওয়াহ’, সঊদী আরব, সংখ্যা ১১১৫, ৯ নভেম্বর ১৯৮৭, পৃঃ ৩১।
كافر ہے تو شمشير پہ كرتا ہے بهروسا
مؤمن ہے تو بے تيغ بهى ( لڑتا ہے سپاهى )
এ পর্যন্ত বলা মাত্রই রাত ১১-টা ২০ মিনিটের দিকে একটি শক্তিশালী টাইমবোমা বিস্ফোরিত হয়। তখন তিনি মাত্র ২০/২২ মিনিট বক্তৃতা করেছেন।[1]
বোমাটি স্টেজের নিচে পেতে রাখা ছিল। এর পূর্বে একটি ফুলদানি মঞ্চে রাখার জন্য জালসার পিছন থেকে পাঠানো হয়েছিল, যেটিতে শক্তিশালী রাসায়নিক দ্রব্য ছিল।
বোমা বিস্ফোরণের পর সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। লোকজনের আর্তচিৎকারে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। সবাই প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। ৯ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন ১১৪ জন। আহত ও নিহতদের রক্তে ময়দান রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। আশপাশের কয়েকটি বাড়ি ও বিল্ডিংও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’-এর ডেপুটি সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা হাবীবুর রহমান ইয়াযদানী (১৯৪৭-১৯৮৭), মাওলানা আব্দুল খালেক কুদ্দূসী (১৯৩৯-১৯৮৭), ‘আহলেহাদীছ ইয়ুথ ফোর্স’ প্রধান মাওলানা মুহাম্মাদ খান নাজীব, মাওলানা মুহাম্মাদ শফীক খান, জালসার সভাপতি ইহসানুল হক, নাঈম বাদশাহ, রানা যুবায়ের, ফারূক রানা, মুহাম্মাদ আসলাম, মুহাম্মাদ আলম, আব্দুস সালাম, সেলীম ফারূকী প্রমুখ। বোমা বিস্ফোরণের পর আল্লামা যহীর ২০/৩০ মিটার দূরে ছিটকে পড়েন। কিন্তু তখনও তিনি জ্ঞান হারাননি। তাঁকে মারাত্মক আহত অবস্থায় লাহোরের কেন্দ্রীয় মিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে পাঁচদিন ইন্টেনসিভ কেয়ারে (নিবিড় পর্যবেক্ষণে) চিকিৎসাধীন থাকেন।[2]
[1]. ‘শহীদে মিল্লাত কা আখেরী পয়গাম’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৭০-৮১; বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৩-১৪।
[2]. মুহাম্মাদ ছায়েম, শুহাদাউদ দাওয়াহ আল-ইসলামিয়াহ ফিল ক্বারনিল ইশরীন (কায়রো : দারুল ফাযীলাহ, ১৯৯২), পৃঃ ১৬৬-৬৭; মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর : আল-জিহাদু ওয়াল ইলমু মিনাল হায়াতি ইলাল মামাত (কুয়েত : ১৪০৭ হিঃ), পৃঃ ১৮-২০; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৩-১৪; ‘আদ-দাওয়াহ’, সঊদী আরব, সংখ্যা ১১১৫, ৯ নভেম্বর ১৯৮৭, পৃঃ ৩১।
তাঁর আহত হওয়ার খবর জানতে পেরে শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বাদশাহ ফাহ্দকে সঊদীতে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন। ২৯শে মার্চ ভোর পৌনে পাঁচটার সময় সঊদী এয়ারলাইন্স যোগে তাঁকে সঊদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তান ত্যাগের পূর্বে বিমানবন্দরে আল্লামা যহীর বলেছিলেন, ‘সঊদীতে চিকিৎসা নেয়ার পর আরো জোরেশোরে ইসলামের খেদমত করব’। সঊদীতে পৌঁছার পর তাঁকে রিয়াদের বাদশাহ ফয়ছাল সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তাররা তাঁকে পা কেটে ফেলার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি সম্মত হননি।
রিয়াদে জানাযা শেষে সামরিক বিমানযোগে তাঁর লাশ ঐদিন বিকাল পৌনে চারটার দিকে মদীনা বিমানবন্দরে পৌঁছে। সেখান থেকে মসজিদে নববীতে নিয়ে যাওয়া হয়। মসজিদে নববীর ইমাম শায়খ আব্দুল্লাহ আয-যাহিমের ইমামতিতে মসজিদে নববীতে তাঁর দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে তাঁকে মদীনার ‘বাক্বী’ কবরস্থানে দাফন করা হয়। এভাবে সত্যিকারের নবীপ্রেমিক ও মদীনাপ্রেমিক আল্লামা যহীরের দো‘আও কবুল হয়। তিনি প্রতিনিয়তই এ দো‘আ করতেন, اَللَّهُمَّ ارْزُقْنِيْ شَهَادَةً فِيْ سَبِيْلِكَ وَاجْعَلْ مَوْتِيْ فِيْ بَلَدِ رَسُوْلِكَ . ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার পথে শহীদ করো এবং তোমার নবীর দেশে আমার মৃত্যু লিখে রেখ’।[1]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৪-১৫; বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১৪২; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬-৬৯; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৪-১৫; বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১৪২; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬-৬৯; শাহাদত, মার্চ ২০০৮, পৃঃ ২৩।
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর কাদিয়ানী, শী‘আ, ব্রেলভী প্রভৃতি বাতিল ফিরকাগুলোর বিরুদ্ধে ছিলেন মূর্তিমান চ্যালেঞ্জ। তিনি এদের বিরুদ্ধে দলীলভিত্তিক বইপত্র লিখে ও অগ্নিঝরা বক্তৃতা প্রদান করে তাদের স্বরূপ বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচন করেছিলেন। স্বভাবতই তারা তাঁর ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিল। তারা তাঁকে পত্রযোগে ও টেলিফোনে একাধিকবার প্রাণ নাশের হুমকি দিয়েছিল। মাওলানা আতাউর রহমান শেখুপুরী ৩/৪/১৪২১ হিজরীতে আল্লামা যহীরের উপর পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনকারী ড. যাহরানীকে জানান, একদিন এক ব্যক্তি আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরকে দেওয়ার জন্য একটি পত্র আমাকে দেয়। তাতে লেখা ছিল, ‘আমরা অচিরেই আপনাকে হত্যা করব’। ইরানী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনী ঘোষণা করেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি ইহসান ইলাহী যহীরের মাথা কেটে আনতে পারবে তাকে ২ লাখ ডলার পুরস্কার দেয়া হবে’। অনেকে ঘোষণা করেছিল, ‘যে ইহসান ইলাহী যহীরকে হত্যা করতে পারবে সে শহীদ’। শত্রুরা তাঁকে হুমকি প্রদান করে এমনটিও বলেছিল যে, ‘আপনি যখন রাস্তায় হাঁটবেন, তখন আমরা আপনার ওপর দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ করব’। তিনি অনেকবার মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন। শত্রুরা তাঁকে উদ্দেশ্য করে একবার গুলিও চালিয়েছিল। আমেরিকায় একবার তিনি প্রায় নিহত হতেই বসেছিলেন।[1]
বাতিলপন্থীদের এতো হুমকি-ধমকি ও প্রাণ নাশের তর্জন-গর্জন সত্ত্বেও তিনি ছিলেন বেপরোয়া। এসবকে তিনি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে সর্বদা নির্ভয়ে চলতেন। ভয় করতেন স্রেফ আল্লাহকে; পৃথিবীর অন্য কাউকেই নয়। তিনি তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় সূরা তওবার ৫১ (‘হে নবী আপনি বলুন! আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছবে না’) ও সূরা আ‘রাফের ৩৪ আয়াত (‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একটি মেয়াদ রয়েছে। যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে, তখন তারা না এক মুহূর্ত পিছে যেতে পারবে, আর না এগিয়ে আসতে পারবে’) প্রায়ই পেশ করতেন। তিনি ইবনে আববাস (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটিও উল্লেখ করতেন,
وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَّنْفَعُوْكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوْكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ لَكَ، وَلَوِ اجْتَمَعُوْا عَلَى أَنْ يَّضُرُّوْكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوْكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ .
‘জেনে রেখ! যদি সমস্ত মাখলূক একত্রিত হয়ে তোমার কোন উপকার করতে চায়, তবুও আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যতটুকু লিখে রেখেছেন সেটুকু ছাড়া তারা তোমার কোন উপকার করতে পারবে না। অনুরূপভাবে তারা যদি সমবেতভাবে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, তাহলেও আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যতটুকু লিখে রেখেছেন সেটুকু ছাড়া কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[2]
আল্লামা যহীর সঊদীতে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে বলেছিলেন, ‘আমি বিভিন্ন ফিরকার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছিলাম এবং আমার সমালোচনা তাদের মনঃপীড়ার কারণ হচ্ছিল। তারা এর সাথে জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ হচ্ছে’।[3]
কুয়েতের ‘আল-মুজতামা’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘বাতিল ফিরকাগুলোর মত খন্ডন ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার স্বরূপ উন্মোচনে তিনি অত্যন্ত দৃঢ় ছিলেন। তাঁর বই-পুস্তক ও বক্তৃতায় কঠোর খন্ডন পদ্ধতির কারণে এই সমস্ত ভ্রান্ত ফিরকা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। কাদিয়ানীরা ইতিপূর্বে পাকিস্তানে বেশ কয়েকজন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমকে গুম ও খুন করে। ব্রেলভীদের সাথেও তাঁর কঠিন শত্রুতা ছিল।[4] ড. আব্দুল আযীয আল-ক্বারী বলেন, ويبدو أن أسلوبه كان شديد النكاية بالرافضة إلى درجة أنهم آثروا قتله . ‘তাঁর খন্ডন পদ্ধতি রাফেযীদের (চরমপন্থী শী‘আ) এতটাই অন্তর্জ্বালার কারণ ছিল যে, তারা তাঁকে হত্যা করতে মনস্থির করে’।[5]
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ও ‘রাবেতা আলমে ইসলামী’র সাবেক সহ-সেক্রেটারী শায়খ মুহাম্মাদ বিন নাছের আল-‘আবূদী বলেন,
قتل الشيخ بعد تخطيط وبعد محاولة من المبتدعة، ومن المنحرفين عن الإسلام، وربما كانت وراءهم أيادي كبيرة تعمل على قتل الشيخ لأنه كان سيفا مصلتا على أعداء الإسلام الذين يحبون أن يغمدوا هذا السيف .
‘বিদ‘আতী ও ইসলাম থেকে বিচ্যুতদের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় শায়খকে হত্যা করা হয়। হয়ত তাদের পিছনে বড় কোন হাত থাকতে পারে, যারা তাঁকে হত্যার ব্যাপারে ইন্ধন যোগায়। কেননা ইসলামের শত্রুদের জন্য তিনি ছিলেন চকচকে ধারালো তরবারির ন্যায়। যারা এই তরবারিকে কোষবদ্ধ (নিহত) করতে চাচ্ছিল’।[6]
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৪।
[2]. তিরমিযী হা/২৫১৬, অধ্যায়-৩৫, অনুচ্ছেদ-৫৯; মিশকাত হা/৫৩০২ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর উপর ভরসা ও ছবর’ অনুচ্ছেদ, হাদীছ ছহীহ।
[3]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১৪২।
[4]. ‘আল-মুজতামা’, কুয়েত, সংখ্যা ৮১২, বর্ষ ১৩, ৯ শা‘বান ১৪০৭ হিজরী।
[5]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৫।
[6]. ঐ, পৃঃ ৬৯-৭০।
বাতিলপন্থীদের এতো হুমকি-ধমকি ও প্রাণ নাশের তর্জন-গর্জন সত্ত্বেও তিনি ছিলেন বেপরোয়া। এসবকে তিনি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে সর্বদা নির্ভয়ে চলতেন। ভয় করতেন স্রেফ আল্লাহকে; পৃথিবীর অন্য কাউকেই নয়। তিনি তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় সূরা তওবার ৫১ (‘হে নবী আপনি বলুন! আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছবে না’) ও সূরা আ‘রাফের ৩৪ আয়াত (‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একটি মেয়াদ রয়েছে। যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে, তখন তারা না এক মুহূর্ত পিছে যেতে পারবে, আর না এগিয়ে আসতে পারবে’) প্রায়ই পেশ করতেন। তিনি ইবনে আববাস (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটিও উল্লেখ করতেন,
وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَّنْفَعُوْكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوْكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ لَكَ، وَلَوِ اجْتَمَعُوْا عَلَى أَنْ يَّضُرُّوْكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوْكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ .
‘জেনে রেখ! যদি সমস্ত মাখলূক একত্রিত হয়ে তোমার কোন উপকার করতে চায়, তবুও আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যতটুকু লিখে রেখেছেন সেটুকু ছাড়া তারা তোমার কোন উপকার করতে পারবে না। অনুরূপভাবে তারা যদি সমবেতভাবে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, তাহলেও আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যতটুকু লিখে রেখেছেন সেটুকু ছাড়া কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[2]
আল্লামা যহীর সঊদীতে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে বলেছিলেন, ‘আমি বিভিন্ন ফিরকার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছিলাম এবং আমার সমালোচনা তাদের মনঃপীড়ার কারণ হচ্ছিল। তারা এর সাথে জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ হচ্ছে’।[3]
কুয়েতের ‘আল-মুজতামা’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘বাতিল ফিরকাগুলোর মত খন্ডন ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার স্বরূপ উন্মোচনে তিনি অত্যন্ত দৃঢ় ছিলেন। তাঁর বই-পুস্তক ও বক্তৃতায় কঠোর খন্ডন পদ্ধতির কারণে এই সমস্ত ভ্রান্ত ফিরকা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। কাদিয়ানীরা ইতিপূর্বে পাকিস্তানে বেশ কয়েকজন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমকে গুম ও খুন করে। ব্রেলভীদের সাথেও তাঁর কঠিন শত্রুতা ছিল।[4] ড. আব্দুল আযীয আল-ক্বারী বলেন, ويبدو أن أسلوبه كان شديد النكاية بالرافضة إلى درجة أنهم آثروا قتله . ‘তাঁর খন্ডন পদ্ধতি রাফেযীদের (চরমপন্থী শী‘আ) এতটাই অন্তর্জ্বালার কারণ ছিল যে, তারা তাঁকে হত্যা করতে মনস্থির করে’।[5]
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ও ‘রাবেতা আলমে ইসলামী’র সাবেক সহ-সেক্রেটারী শায়খ মুহাম্মাদ বিন নাছের আল-‘আবূদী বলেন,
قتل الشيخ بعد تخطيط وبعد محاولة من المبتدعة، ومن المنحرفين عن الإسلام، وربما كانت وراءهم أيادي كبيرة تعمل على قتل الشيخ لأنه كان سيفا مصلتا على أعداء الإسلام الذين يحبون أن يغمدوا هذا السيف .
‘বিদ‘আতী ও ইসলাম থেকে বিচ্যুতদের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় শায়খকে হত্যা করা হয়। হয়ত তাদের পিছনে বড় কোন হাত থাকতে পারে, যারা তাঁকে হত্যার ব্যাপারে ইন্ধন যোগায়। কেননা ইসলামের শত্রুদের জন্য তিনি ছিলেন চকচকে ধারালো তরবারির ন্যায়। যারা এই তরবারিকে কোষবদ্ধ (নিহত) করতে চাচ্ছিল’।[6]
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৪।
[2]. তিরমিযী হা/২৫১৬, অধ্যায়-৩৫, অনুচ্ছেদ-৫৯; মিশকাত হা/৫৩০২ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর উপর ভরসা ও ছবর’ অনুচ্ছেদ, হাদীছ ছহীহ।
[3]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১৪২।
[4]. ‘আল-মুজতামা’, কুয়েত, সংখ্যা ৮১২, বর্ষ ১৩, ৯ শা‘বান ১৪০৭ হিজরী।
[5]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৫।
[6]. ঐ, পৃঃ ৬৯-৭০।
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের ৩ ছেলে ও ৫ মেয়ে ছিল। তিন ছেলেই দাওয়াতী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত আছেন। বড় ছেলে ইবতিসাম ইলাহী যহীর ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’-এর সেক্রেটারী জেনারেল, ‘আল-ইখওয়াহ’ মাসিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ও ‘কুরআন-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে’র প্রধান নির্বাহী। ১৯৮৭ সালে লাহোরের ক্রিসেন্ট মডেল স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক ও ১৯৮৯ সালে লাহোর সরকারী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (এফএসসি) পাশ করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি কুরআন মাজীদ হিফয করেন। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বি.এ ছাড়াও তিনি গণযোগাযোগ, ইংরেজী, ইসলামিক স্টাডিজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আরবী, ব্যবসায় প্রশাসন, কম্পিউটার সায়েন্স, ইতিহাস ও মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন। তিনি মোট ১১টি বিষয়ে মাস্টার্স করে পাকিস্তানে এক বিরল রেকর্ড স্থাপন করেন। তিনি এযাবৎ এক হাযারের অধিক জালসা, সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগদান করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত www.quran-o-sunnah.com ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ৭ হাযারের অধিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এটি উর্দূ ভাষার অন্যতম বড় একটি ইসলামী ওয়েবসাইট। প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ লোক এটি ভিজিট করে। তাছাড়া তাঁর সম্পাদনায় ‘আল-ইখওয়াহ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা ৮ বছর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, যার সার্কুলেশন সংখ্যা ৫ হাযার কপির বেশি। পাকিস্তান টেলিভিশন, জিয়ো নিউজ, এক্সপ্রেস নিউজ, দুনিয়া নিউজ, রয়েল নিউজ, দ্বীন নিউজ, হাম টিভি, ডিএম টিভি (ইংল্যান্ড) প্রভৃতি টিভি চ্যানেলে তিনি তিনশ’র অধিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। সঊদী আরব, ইরাক, মিসর, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, ইতালী প্রভৃতি দেশে তিনি দাওয়াতী সফর করেন এবং বড় বড় সেমিনারে বক্তব্য প্রদান করেন। লন্ডন, ব্রাডফোর্ড, স্টক অন ট্রেন্ট এবং কোপেনহেগেনে ইংরেজীতে জুম‘আর খুৎবা দিয়েছেন। তিনি উর্দূ ও ইংরেজীতে ভাল বক্তব্য দিতে পারেন। আরবীও বুঝেন। ছবর, অদৃশ্যে বিশ্বাস ও কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিভিন্ন বিষয়ের সমাধান সম্পর্কে তাঁর ৩টি বই রয়েছে।
মেঝ ছেলে মু‘তাছিম ইলাহী যহীরও কুরআনের হাফেয। তিনি দুই বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনিও ভাল বক্তা। আর ছোট ছেলে হেশাম ইলাহী যহীর মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ। তিনিও কুরআনের হাফেয ও বক্তা। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি পাঁচ বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সম্ভবত তিনিই একমাত্র পাকিস্তানী যিনি এত অল্প বয়সে ৫ বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেছেন। তিনি তিনটি গ্রন্থও প্রণয়ন করেছেন।[1]
[1]. আল্লামা যহীরের বড় ছেলে ইবতিসাম ও ছোট ছেলে হেশামের সাথে যোগাযোগ করলে তারা ২২শে জুলাই ২০১১ শুক্রবারে এক ই-মেইল বার্তায় আমাদের এসব তথ্য জানান। আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন!-লেখক।
মেঝ ছেলে মু‘তাছিম ইলাহী যহীরও কুরআনের হাফেয। তিনি দুই বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনিও ভাল বক্তা। আর ছোট ছেলে হেশাম ইলাহী যহীর মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ। তিনিও কুরআনের হাফেয ও বক্তা। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি পাঁচ বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সম্ভবত তিনিই একমাত্র পাকিস্তানী যিনি এত অল্প বয়সে ৫ বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেছেন। তিনি তিনটি গ্রন্থও প্রণয়ন করেছেন।[1]
[1]. আল্লামা যহীরের বড় ছেলে ইবতিসাম ও ছোট ছেলে হেশামের সাথে যোগাযোগ করলে তারা ২২শে জুলাই ২০১১ শুক্রবারে এক ই-মেইল বার্তায় আমাদের এসব তথ্য জানান। আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন!-লেখক।
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর মাত্র ৪২ বছর এ পৃথিবীর ক্ষণিকের নীড়ে বেঁচেছিলেন। কিন্তু সময়ের সদ্ব্যবহারের কারণে নানাবিধ ব্যস্ততা সত্ত্বেও এত অল্প সময়ে তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। শায়খ মুহাম্মাদ নাছের আল-উবূদী যথার্থই বলেছেন, ولقد أنةج في سنواة قليلة مالم ينةجه غيره في سنواة كثيرة . ‘তিনি অল্প কয়েক বছরে যা রচনা করেছেন, অনেক বছরেও তা অন্যরা করতে পারেনি’।[1] তিনি সর্বমোট ১৮টি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। তন্মধ্যে ১৪টি আরবী ভাষায় ও ৪টি উর্দূ ভাষায়।[2]
১. আল-কাদিয়ানিয়াহ দিরাসাহ ওয়া তাহলীল ( القاديانية دراسات وتحليل ) : মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে দামেশকের ‘হাযারাতুল ইসলাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত ১০টি প্রবন্ধের সমাহার এ গ্রন্থটি। আল্লামা যহীর বলেন, تركت المقالات كلها على حالها كما كتبت ولم أغير فيها ولم أبدل، فلذلك يرى القارئ المقدمات البسيطة قبل كل مقال للدخول في أصل الموضوع . ‘প্রবন্ধগুলো যেভাবে লিখেছিলাম সেভাবেই সেগুলোকে রেখে দিয়েছি। তাতে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন করিনি। তাই মূল বিষয়ে প্রবেশের জন্য পাঠক প্রত্যেকটি প্রবন্ধের শুরুতে সামান্য বিস্তৃত লক্ষ্য করবেন’।[3] ১ম প্রবন্ধে কাদিয়ানীদের উত্থানে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের ভূমিকা। ২য় প্রবন্ধে মুসলমানদের সম্পর্কে কাদিয়ানীদের আক্বীদা, ইসরাঈল কর্তৃক কাদিয়ানীদের সহযোগিতা এবং ইসরাঈলে কাদিয়ানী কেন্দ্র সম্পর্কে। ৩য় প্রবন্ধে বিভিন্ন নবী ও ছাহাবীগণ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। ৪র্থ প্রবন্ধে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর রাসূল (ছাঃ)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দাবী ও তার অসারতা। ৫ম প্রবন্ধে আল্লাহ, খতমে নবুঅত, জিবরীল, কুরআন, হজ্জ, জিহাদ প্রভৃতি সম্পর্কে তাদের আক্বীদা। ৬ষ্ঠ প্রবন্ধে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর জীবনী। ৭ম প্রবন্ধে তার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ। ৮ম প্রবন্ধে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে তাদের আক্বীদা, ৯ম প্রবন্ধে কাদিয়ানীদের নেতা ও তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী সম্পর্কে এবং ১০ম প্রবন্ধে খতমে নবুঅত সম্পর্কে তাদের আক্বীদা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আরবীতে এটির ৩০টি ও ইংরেজীতে ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
২. আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ ( الشيعة والسنة ) : তিন অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ গ্রন্থটি প্রথম ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৪ সালে এটির ২৪তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত এটির ৩৩তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ বিন সাবার ফিতনা, খুলাফায়ে রাশেদীন, উম্মাহাতুল মুমিনীন সহ অন্যান্য ছাহাবীগণ সম্পর্কে শী‘আদের ভ্রান্ত ধারণা, অপবাদ, তাদেরকে কাফের আখ্যাদান প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে শী‘আদের কুরআন পরিবর্তন ও ইমামতের গুরুত্ব এবং তৃতীয় অধ্যায়ে তাদের ভ্রান্ত ‘তাক্বিয়া’ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ইংরেজী, ফার্সী, তুর্কী, তামিল, ইন্দোনেশীয়, থাইল্যান্ডী, মালয়েশীয় প্রভৃতি ভাষায় এটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আরবী ভাষায় এর প্রকাশ সংখ্যা ১০ লাখ কপিতে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করে মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী বলেন, وللمرة الأولى في ةاريخ الةأليف في الملل والنحل يؤلف كةاب بهذا الةفصيل الذي لم يسبق إليه . لا نظير له في المؤلفاة الحديثة . ‘ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী সম্পর্কে গ্রন্থ রচনার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ ধরনের বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত অভূতপূর্ব গ্রন্থ লেখা হয়। আধুনিক রচনাবলীতে এর নযীর নেই’।[4]
৩. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত ( الشيعت وأهل البيت ) : এ গ্রন্থে শী‘আদের আহলে বায়তের প্রতি মেকি ভালবাসার মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে। যেমন গ্রন্থটির ভূমিকায় আল্লামা যহীর বলেন,
فأولا وأصلا كتبنا هذا الكتاب لأولئك المخدوعين المغترين، الغير العارفين حقيقة القوم وأصل معتقداتهم كى يدركوا الحق، ويرجعوا إلى الصواب إن وفقهم الله لذلك، ويعرفوا أن أهل البيت- نعم- وحتى أهل بيت علي رضى الله عنهم أجمعين لا يوافقون القوم ولا يقولون بمقالتهم، بل هم على طرف والقوم على طرف آخر، وكل ذلك من كتب القوم وبعباراتهم هم أنفسهم .
‘যারা শী‘আদের প্রকৃতি ও তাদের মৌলিক বিশ্বাস সমূহ সম্পর্কে অনবহিত সে সকল প্রতারিত ব্যক্তিদের জন্যই আমরা মূলত এই বইটি লিখেছি। যাতে তারা যেন প্রকৃত বিষয়টি জানতে পারে এবং যদি আল্লাহ তাদের তাওফীক দেন তাহলে যেন তারা সত্যের দিকে ফিরে আসে। আর তারা এটাও জানতে পারে যে, আহলে বায়েত এমনকি খোদ আলী (রাঃ)-এর পরিবার-পরিজনও শী‘আ জাতির সাথে একমত নয় এবং তারা যা বলে তারা তা বলে না। বরং তারা একপ্রান্তে আর শী‘আরা আরেক প্রান্তে। এ সকল কিছু শী‘আদের বইপত্র ও তাদের উদ্ধৃতি দিয়েই উল্লেখ করা হয়েছে’।[5]
চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ গ্রন্থের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩১৬। প্রথম অধ্যায়ে শী‘আ ও আহলে বায়েত শব্দের বিশ্লেষণ এবং ইমামদের ব্যাপারে তাদের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে কুরআন মাজীদে ছাহাবীগণের প্রশংসা, ছাহাবীগণ সম্পর্কে আলী (রাঃ)-এর দৃষ্টিভঙ্গি, খুলাফায়ে রাশেদীন সম্পর্কে শী‘আদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে মুত‘আ বিবাহ সম্পর্কে এবং চতুর্থ অধ্যায়ে রাসূল (ছাঃ), তাঁর সন্তান-সন্ততি ও ছাহাবীগণ সম্পর্কে তাদের বাজে মন্তব্য সমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে। উর্দূ, ইংরেজী, তুর্কী প্রভৃতি ভাষায় এটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শায়বানী এ গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেছেন, فمن كان في بيةه هذا الكةاب فقد عرف حقيقة ادعائهم حب آل بية النبي صلى الله عليه وسلم الذي هو في الحقيقة طعن لهم وإهانة . ‘যার গৃহে এই বইটি থাকবে সে নবী (ছাঃ)-এর পরিবারকে তাদের ভালবাসার দাবির প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে। যা আসলে আহলে বায়তের প্রতি অপবাদ ও লাঞ্ছনার শামিল’।[6]
৪. আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন ( الشيعة والقرآن ) : আল্লামা মুহিববুদ্দীন আল-খতীব মিসরী (১৩০৩-১৩৮৯ হিঃ) الخطوط العريضة নামে শী‘আদের বিরুদ্ধে একটি বই লিখেন। এ বইয়ে তিনি প্রমাণ করেন যে, শী‘আরা কুরআন পরিবর্তন করেছে। এর জবাবে একজন শী‘আ আলেম مع الخطيب فى خطوطه العريضة নামে একটি বই লিখে দাবী করেন যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট কুরআন যেমন অবিকৃত, তেমনি শী‘আদের নিকটও। আল্লামা যহীর সেই শী‘আ আলেমের দাবীর অসারতা ও খতীবের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে ৩৫২ পৃষ্ঠা সম্বলিত উক্ত বইটি রচনা করেন। যেমন তিনি বলেছেন, وأثبةنا فيه صدق ما قاله الخطيب لا بالكلام والعواطف، بل بالأدلة القاطعة، والبراهين الساطعة، والنصوص الثابةة، والعباراة الصريحة، والرواياة الجلية والقطعية حيث الثبوة والنسبة . ‘আমরা এতে খতীবের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করেছি কথা ও আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়; বরং অকাট্য দলীল-প্রমাণ, প্রমাণিত নছ, সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি এবং অকাট্য বর্ণনা সমূহ দ্বারা’।[7] পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এটি অনূদিত ও একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে।
৫. আল-ব্রেলভিয়া আক্বাইদ ওয়া তারীখ ( البريلوية عقائد وتاريخ ) : ভারতীয় উপমহাদেশের বিদ‘আতী ও কবরপূজারী ব্রেলভী ফিরক্বা সম্পর্কে এটি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থের সুবাদে আরব বিশ্বের জনগণ প্রথমবারের মতো এই ভ্রান্ত ফিরক্বা সম্পর্কে অবগত হয়। পাঁচটি অধ্যায় সম্বলিত এ গ্রন্থের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৪। প্রথম অধ্যায়ে এ মতবাদের ইতিহাস ও এর প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ রেযা খানের জীবনী, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ব্রেলভীদের আক্বীদা-বিশ্বাস, তৃতীয় অধ্যায়ে তাদের শিক্ষা, চতুর্থ অধ্যায়ে মুসলমানদের মধ্যে যারা তাদের আক্বীদা বিরোধী তাদেরকে কাফের আখ্যাদান ও তাদের বিভিন্ন বিদ‘আতী আমল এবং পঞ্চম অধ্যায়ে তাদের বিভিন্ন আজগুবি কেচ্ছা-কাহিনী আলোচনা করা হয়েছে।
এছাড়া তাঁর রচিত অন্য গ্রন্থগুলি হচ্ছে-
৬. আশ-শী‘আ ওয়াত তাশাইয়ু‘ ( الشيعة والتشيع ) ৭. আল-ইসমাঈলিয়াহ : তারীখ ওয়া আক্বাইদ ( الإسماعيلية تاريخ وعقائد ) ৮. আল-বাবিয়া আরয ওয়া নাক্বদ ( البابية عرض ونقد ) ৯. আল-বাহাইয়া : নাক্বদ ওয়া তাহলীল ( البهائية نقد وتحليل ) ১০. আর-রাদ্দুল কাফী আলা মুগালাতাতিদ দুকতূর আলী আব্দুল ওয়াহিদ ওয়াফী ফী কিতাবিহি বায়নাশ শী‘আ ওয়া আহলিস সুন্নাহ ১১. দিরাসাত ফিত-তাছাউওফ ( دراسات في التصوف ) ১২. ‘সুকূতে ঢাকা’ (ঢাকার পতন) (উর্দূ) ১৩. আত-তুরুকুল মাশহূরাহ ফী শিবহিল কার্রাহ আল-হিন্দিয়া (অপ্রকাশিত) ( الطرق المشهورة في شبه القارة الهندية ) ১৪. আত-তাছাউওফ আল-মানশাউ ওয়াল মাছাদির ( التصوف المنشأ والمصادر ) ১৫. কুফর ওয়া ইসলাম (উর্দূ) ১৬. ইমাম ইবনু তায়মিয়ার ‘কিতাবুল অসীলা’-এর উর্দূ অনুবাদ ১৭. সফরে হিজায (উর্দূ) ১৮. আন-নাছরানিয়াহ (অপ্রকাশিত)।
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯।
[2]. ঐ, পৃঃ ১৩৪-৩৫।
[3]. আল-কাদিয়ানিয়াহ পৃঃ ১৩।
[4]. শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর, পৃঃ ৫।
[5]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ৮।
[6]. শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর, পৃঃ ৬।
[7]. আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন, পৃঃ ৭
১. আল-কাদিয়ানিয়াহ দিরাসাহ ওয়া তাহলীল ( القاديانية دراسات وتحليل ) : মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে দামেশকের ‘হাযারাতুল ইসলাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত ১০টি প্রবন্ধের সমাহার এ গ্রন্থটি। আল্লামা যহীর বলেন, تركت المقالات كلها على حالها كما كتبت ولم أغير فيها ولم أبدل، فلذلك يرى القارئ المقدمات البسيطة قبل كل مقال للدخول في أصل الموضوع . ‘প্রবন্ধগুলো যেভাবে লিখেছিলাম সেভাবেই সেগুলোকে রেখে দিয়েছি। তাতে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন করিনি। তাই মূল বিষয়ে প্রবেশের জন্য পাঠক প্রত্যেকটি প্রবন্ধের শুরুতে সামান্য বিস্তৃত লক্ষ্য করবেন’।[3] ১ম প্রবন্ধে কাদিয়ানীদের উত্থানে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের ভূমিকা। ২য় প্রবন্ধে মুসলমানদের সম্পর্কে কাদিয়ানীদের আক্বীদা, ইসরাঈল কর্তৃক কাদিয়ানীদের সহযোগিতা এবং ইসরাঈলে কাদিয়ানী কেন্দ্র সম্পর্কে। ৩য় প্রবন্ধে বিভিন্ন নবী ও ছাহাবীগণ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। ৪র্থ প্রবন্ধে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর রাসূল (ছাঃ)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দাবী ও তার অসারতা। ৫ম প্রবন্ধে আল্লাহ, খতমে নবুঅত, জিবরীল, কুরআন, হজ্জ, জিহাদ প্রভৃতি সম্পর্কে তাদের আক্বীদা। ৬ষ্ঠ প্রবন্ধে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর জীবনী। ৭ম প্রবন্ধে তার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ। ৮ম প্রবন্ধে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে তাদের আক্বীদা, ৯ম প্রবন্ধে কাদিয়ানীদের নেতা ও তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী সম্পর্কে এবং ১০ম প্রবন্ধে খতমে নবুঅত সম্পর্কে তাদের আক্বীদা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আরবীতে এটির ৩০টি ও ইংরেজীতে ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
২. আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ ( الشيعة والسنة ) : তিন অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ গ্রন্থটি প্রথম ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৪ সালে এটির ২৪তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত এটির ৩৩তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ বিন সাবার ফিতনা, খুলাফায়ে রাশেদীন, উম্মাহাতুল মুমিনীন সহ অন্যান্য ছাহাবীগণ সম্পর্কে শী‘আদের ভ্রান্ত ধারণা, অপবাদ, তাদেরকে কাফের আখ্যাদান প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে শী‘আদের কুরআন পরিবর্তন ও ইমামতের গুরুত্ব এবং তৃতীয় অধ্যায়ে তাদের ভ্রান্ত ‘তাক্বিয়া’ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ইংরেজী, ফার্সী, তুর্কী, তামিল, ইন্দোনেশীয়, থাইল্যান্ডী, মালয়েশীয় প্রভৃতি ভাষায় এটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আরবী ভাষায় এর প্রকাশ সংখ্যা ১০ লাখ কপিতে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করে মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী বলেন, وللمرة الأولى في ةاريخ الةأليف في الملل والنحل يؤلف كةاب بهذا الةفصيل الذي لم يسبق إليه . لا نظير له في المؤلفاة الحديثة . ‘ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী সম্পর্কে গ্রন্থ রচনার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ ধরনের বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত অভূতপূর্ব গ্রন্থ লেখা হয়। আধুনিক রচনাবলীতে এর নযীর নেই’।[4]
৩. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত ( الشيعت وأهل البيت ) : এ গ্রন্থে শী‘আদের আহলে বায়তের প্রতি মেকি ভালবাসার মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে। যেমন গ্রন্থটির ভূমিকায় আল্লামা যহীর বলেন,
فأولا وأصلا كتبنا هذا الكتاب لأولئك المخدوعين المغترين، الغير العارفين حقيقة القوم وأصل معتقداتهم كى يدركوا الحق، ويرجعوا إلى الصواب إن وفقهم الله لذلك، ويعرفوا أن أهل البيت- نعم- وحتى أهل بيت علي رضى الله عنهم أجمعين لا يوافقون القوم ولا يقولون بمقالتهم، بل هم على طرف والقوم على طرف آخر، وكل ذلك من كتب القوم وبعباراتهم هم أنفسهم .
‘যারা শী‘আদের প্রকৃতি ও তাদের মৌলিক বিশ্বাস সমূহ সম্পর্কে অনবহিত সে সকল প্রতারিত ব্যক্তিদের জন্যই আমরা মূলত এই বইটি লিখেছি। যাতে তারা যেন প্রকৃত বিষয়টি জানতে পারে এবং যদি আল্লাহ তাদের তাওফীক দেন তাহলে যেন তারা সত্যের দিকে ফিরে আসে। আর তারা এটাও জানতে পারে যে, আহলে বায়েত এমনকি খোদ আলী (রাঃ)-এর পরিবার-পরিজনও শী‘আ জাতির সাথে একমত নয় এবং তারা যা বলে তারা তা বলে না। বরং তারা একপ্রান্তে আর শী‘আরা আরেক প্রান্তে। এ সকল কিছু শী‘আদের বইপত্র ও তাদের উদ্ধৃতি দিয়েই উল্লেখ করা হয়েছে’।[5]
চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ গ্রন্থের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩১৬। প্রথম অধ্যায়ে শী‘আ ও আহলে বায়েত শব্দের বিশ্লেষণ এবং ইমামদের ব্যাপারে তাদের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে কুরআন মাজীদে ছাহাবীগণের প্রশংসা, ছাহাবীগণ সম্পর্কে আলী (রাঃ)-এর দৃষ্টিভঙ্গি, খুলাফায়ে রাশেদীন সম্পর্কে শী‘আদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে মুত‘আ বিবাহ সম্পর্কে এবং চতুর্থ অধ্যায়ে রাসূল (ছাঃ), তাঁর সন্তান-সন্ততি ও ছাহাবীগণ সম্পর্কে তাদের বাজে মন্তব্য সমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে। উর্দূ, ইংরেজী, তুর্কী প্রভৃতি ভাষায় এটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শায়বানী এ গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেছেন, فمن كان في بيةه هذا الكةاب فقد عرف حقيقة ادعائهم حب آل بية النبي صلى الله عليه وسلم الذي هو في الحقيقة طعن لهم وإهانة . ‘যার গৃহে এই বইটি থাকবে সে নবী (ছাঃ)-এর পরিবারকে তাদের ভালবাসার দাবির প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে। যা আসলে আহলে বায়তের প্রতি অপবাদ ও লাঞ্ছনার শামিল’।[6]
৪. আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন ( الشيعة والقرآن ) : আল্লামা মুহিববুদ্দীন আল-খতীব মিসরী (১৩০৩-১৩৮৯ হিঃ) الخطوط العريضة নামে শী‘আদের বিরুদ্ধে একটি বই লিখেন। এ বইয়ে তিনি প্রমাণ করেন যে, শী‘আরা কুরআন পরিবর্তন করেছে। এর জবাবে একজন শী‘আ আলেম مع الخطيب فى خطوطه العريضة নামে একটি বই লিখে দাবী করেন যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট কুরআন যেমন অবিকৃত, তেমনি শী‘আদের নিকটও। আল্লামা যহীর সেই শী‘আ আলেমের দাবীর অসারতা ও খতীবের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে ৩৫২ পৃষ্ঠা সম্বলিত উক্ত বইটি রচনা করেন। যেমন তিনি বলেছেন, وأثبةنا فيه صدق ما قاله الخطيب لا بالكلام والعواطف، بل بالأدلة القاطعة، والبراهين الساطعة، والنصوص الثابةة، والعباراة الصريحة، والرواياة الجلية والقطعية حيث الثبوة والنسبة . ‘আমরা এতে খতীবের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করেছি কথা ও আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়; বরং অকাট্য দলীল-প্রমাণ, প্রমাণিত নছ, সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি এবং অকাট্য বর্ণনা সমূহ দ্বারা’।[7] পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এটি অনূদিত ও একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে।
৫. আল-ব্রেলভিয়া আক্বাইদ ওয়া তারীখ ( البريلوية عقائد وتاريخ ) : ভারতীয় উপমহাদেশের বিদ‘আতী ও কবরপূজারী ব্রেলভী ফিরক্বা সম্পর্কে এটি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থের সুবাদে আরব বিশ্বের জনগণ প্রথমবারের মতো এই ভ্রান্ত ফিরক্বা সম্পর্কে অবগত হয়। পাঁচটি অধ্যায় সম্বলিত এ গ্রন্থের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৪। প্রথম অধ্যায়ে এ মতবাদের ইতিহাস ও এর প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ রেযা খানের জীবনী, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ব্রেলভীদের আক্বীদা-বিশ্বাস, তৃতীয় অধ্যায়ে তাদের শিক্ষা, চতুর্থ অধ্যায়ে মুসলমানদের মধ্যে যারা তাদের আক্বীদা বিরোধী তাদেরকে কাফের আখ্যাদান ও তাদের বিভিন্ন বিদ‘আতী আমল এবং পঞ্চম অধ্যায়ে তাদের বিভিন্ন আজগুবি কেচ্ছা-কাহিনী আলোচনা করা হয়েছে।
এছাড়া তাঁর রচিত অন্য গ্রন্থগুলি হচ্ছে-
৬. আশ-শী‘আ ওয়াত তাশাইয়ু‘ ( الشيعة والتشيع ) ৭. আল-ইসমাঈলিয়াহ : তারীখ ওয়া আক্বাইদ ( الإسماعيلية تاريخ وعقائد ) ৮. আল-বাবিয়া আরয ওয়া নাক্বদ ( البابية عرض ونقد ) ৯. আল-বাহাইয়া : নাক্বদ ওয়া তাহলীল ( البهائية نقد وتحليل ) ১০. আর-রাদ্দুল কাফী আলা মুগালাতাতিদ দুকতূর আলী আব্দুল ওয়াহিদ ওয়াফী ফী কিতাবিহি বায়নাশ শী‘আ ওয়া আহলিস সুন্নাহ ১১. দিরাসাত ফিত-তাছাউওফ ( دراسات في التصوف ) ১২. ‘সুকূতে ঢাকা’ (ঢাকার পতন) (উর্দূ) ১৩. আত-তুরুকুল মাশহূরাহ ফী শিবহিল কার্রাহ আল-হিন্দিয়া (অপ্রকাশিত) ( الطرق المشهورة في شبه القارة الهندية ) ১৪. আত-তাছাউওফ আল-মানশাউ ওয়াল মাছাদির ( التصوف المنشأ والمصادر ) ১৫. কুফর ওয়া ইসলাম (উর্দূ) ১৬. ইমাম ইবনু তায়মিয়ার ‘কিতাবুল অসীলা’-এর উর্দূ অনুবাদ ১৭. সফরে হিজায (উর্দূ) ১৮. আন-নাছরানিয়াহ (অপ্রকাশিত)।
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯।
[2]. ঐ, পৃঃ ১৩৪-৩৫।
[3]. আল-কাদিয়ানিয়াহ পৃঃ ১৩।
[4]. শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর, পৃঃ ৫।
[5]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ৮।
[6]. শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর, পৃঃ ৬।
[7]. আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন, পৃঃ ৭
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর আধুনিক বিশ্বের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মতাত্ত্বিক ছিলেন। বিভিন্ন বাতিল ফিরকার উপর লিখিত তাঁর গ্রন্থগুলোকে এ বিষয়ের মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলো পাঠসূচীভুক্ত রয়েছে। আল্লামা যহীর বলেন, ‘আমি ধর্মতত্ত্বের উপর বই লিখে গোটা মুসলিম বিশ্বে আমার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করেছি। আমার বইগুলো বিশ্বের প্রত্যেক ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্যসূচীভুক্ত রয়েছে এবং অনেক দেশে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য লিখিত অভিসন্দর্ভসমূহে ঐসব বইয়ের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। আমার রাত্রিদিনের অধ্যয়ন ও গবেষণার ফসল এগুলি’।[1] তিনি বলেন, ‘আমার বইগুলো মুসলিম বিদ্বানদের জন্য ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক সাহিত্যের অভাব পূরণ করেছে’।[2] তিনি আরো বলেন, ‘মোদ্দাকথা, ধর্মতত্ত্বের উপর আমার লেখা গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে একটি পরিমন্ডল সৃষ্টি হয়েছে’।[3]
মুহাম্মাদ ছায়েম বলেন, وإنها في مجال الأبحاث العلمية لتعتبر من أهم مراجع الدارسين للفرق والملل والنحل . ‘বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী সম্পর্কে গবেষণাকারীদের জন্য গবেষণা পরিমন্ডলে এ গ্রন্থগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে’।[4]
আল্লামা যহীরের প্রত্যেকটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ ৩০ হাযার কপি বের হত। তাঁর ‘আল-ব্রেলভিয়া’ বইটির ৩০ হাযার কপি মাত্র ১৫ দিনে নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে এক বছরে এই বইটি ৯ বার প্রকাশ করতে হয়। এতেও চাহিদা পূরণ না হলে দামেশক ও সঊদী আরব থেকেও এটি প্রকাশ করা হয়। তাঁর এই বইটি প্রকাশের পর সঊদী আরব ও মিসরে উক্ত ভ্রান্ত ফিরকা সম্পর্কে অনেক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।[5] তাঁর অধিকাংশ বই পৃথিবীর বিভিন্ন জীবন্ত ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
সাবেক জনপ্রিয় সঊদী বাদশাহ ফয়ছাল এক শাহী ফরমানে তাঁর নিজ খরচে আল্লামা যহীরের বইপত্র ক্রয় করে সঊদী আরবের সকল লাইব্রেরী, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এবং অন্য এক ফরমানে সেগুলো ছেপে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন লাইব্রেরীতে বিতরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।[6]
তাঁর বইগুলোর বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার কারণ সম্পর্কে তদীয় শিক্ষক মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর শায়খ আতিয়াহ সালিম (১৯২৭-৯৯) বলেন,
إن كتاباته كلها اتسمت بالرزانة والاعتدال ومدعمة بالأدلة وصدق المقال . وأهم ما فيها أن يستدل لها من كتب أهلها مما لا يدع مجالا للشك فيما يكتب عنهم . ولا مطعن فيها يفرده من مصادرهم حتى أصبحت كتبه في تلك الفرق مصادر ومراجع للدارسين ومناهل للباحثين .
‘তাঁর রচনাবলী গাম্ভীর্য ও সুসামঞ্জস্যের বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এবং দলীল ও সত্যকথন দ্বারা মযবুতকৃত। এসব গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হ’ল ঐসব ফিরকার নিজেদের রচিত বইপত্র থেকে প্রমাণ পেশ, যা তাদের সম্পর্কে তিনি যা লিখেন তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না এবং তাদের সূত্রসমূহ থেকে তিনি যেসব উদ্ধৃতি দেন তাতে দোষারোপেরও কিছু থাকে না। এভাবে তাঁর গ্রন্থগুলো ঐ সকল ফিরকার ব্যাপারে পাঠক ও গবেষকদের জন্য উৎস ও ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে’।[7]
শায়খ মুহাম্মাদ নাছের আল-উবূদী বলেন, واتسمت كتبه بقوة الحجة والمنطق . ‘তাঁর গ্রন্থগুলো দলীল ও যুক্তির শক্তিতে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত’।[8]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫০।
[2]. ঐ, পৃঃ ৪৭।
[3]. ঐ, পৃঃ ৪৯।
[4]. শুহাদাউদ দাওয়াহ, পৃঃ ১৬৫।
[5]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৯-৫০।
[6]. শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর, পৃঃ ১৪; ‘আল-মাজাল্লাতুল আরাবিয়াহ’, সংখ্যা ৪৮, ১৪০৮ হিঃ, পৃঃ ৯১; শুহাদাউদ দাওয়াহ, পৃঃ ১৬৫।
[7]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ৩।
[8]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯।
মুহাম্মাদ ছায়েম বলেন, وإنها في مجال الأبحاث العلمية لتعتبر من أهم مراجع الدارسين للفرق والملل والنحل . ‘বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী সম্পর্কে গবেষণাকারীদের জন্য গবেষণা পরিমন্ডলে এ গ্রন্থগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে’।[4]
আল্লামা যহীরের প্রত্যেকটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ ৩০ হাযার কপি বের হত। তাঁর ‘আল-ব্রেলভিয়া’ বইটির ৩০ হাযার কপি মাত্র ১৫ দিনে নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে এক বছরে এই বইটি ৯ বার প্রকাশ করতে হয়। এতেও চাহিদা পূরণ না হলে দামেশক ও সঊদী আরব থেকেও এটি প্রকাশ করা হয়। তাঁর এই বইটি প্রকাশের পর সঊদী আরব ও মিসরে উক্ত ভ্রান্ত ফিরকা সম্পর্কে অনেক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।[5] তাঁর অধিকাংশ বই পৃথিবীর বিভিন্ন জীবন্ত ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
সাবেক জনপ্রিয় সঊদী বাদশাহ ফয়ছাল এক শাহী ফরমানে তাঁর নিজ খরচে আল্লামা যহীরের বইপত্র ক্রয় করে সঊদী আরবের সকল লাইব্রেরী, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এবং অন্য এক ফরমানে সেগুলো ছেপে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন লাইব্রেরীতে বিতরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।[6]
তাঁর বইগুলোর বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার কারণ সম্পর্কে তদীয় শিক্ষক মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর শায়খ আতিয়াহ সালিম (১৯২৭-৯৯) বলেন,
إن كتاباته كلها اتسمت بالرزانة والاعتدال ومدعمة بالأدلة وصدق المقال . وأهم ما فيها أن يستدل لها من كتب أهلها مما لا يدع مجالا للشك فيما يكتب عنهم . ولا مطعن فيها يفرده من مصادرهم حتى أصبحت كتبه في تلك الفرق مصادر ومراجع للدارسين ومناهل للباحثين .
‘তাঁর রচনাবলী গাম্ভীর্য ও সুসামঞ্জস্যের বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এবং দলীল ও সত্যকথন দ্বারা মযবুতকৃত। এসব গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হ’ল ঐসব ফিরকার নিজেদের রচিত বইপত্র থেকে প্রমাণ পেশ, যা তাদের সম্পর্কে তিনি যা লিখেন তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না এবং তাদের সূত্রসমূহ থেকে তিনি যেসব উদ্ধৃতি দেন তাতে দোষারোপেরও কিছু থাকে না। এভাবে তাঁর গ্রন্থগুলো ঐ সকল ফিরকার ব্যাপারে পাঠক ও গবেষকদের জন্য উৎস ও ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে’।[7]
শায়খ মুহাম্মাদ নাছের আল-উবূদী বলেন, واتسمت كتبه بقوة الحجة والمنطق . ‘তাঁর গ্রন্থগুলো দলীল ও যুক্তির শক্তিতে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত’।[8]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫০।
[2]. ঐ, পৃঃ ৪৭।
[3]. ঐ, পৃঃ ৪৯।
[4]. শুহাদাউদ দাওয়াহ, পৃঃ ১৬৫।
[5]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৪৯-৫০।
[6]. শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর, পৃঃ ১৪; ‘আল-মাজাল্লাতুল আরাবিয়াহ’, সংখ্যা ৪৮, ১৪০৮ হিঃ, পৃঃ ৯১; শুহাদাউদ দাওয়াহ, পৃঃ ১৬৫।
[7]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ৩।
[8]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯।
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর প্রচন্ড সাহসী ছিলেন। মক্কার হারামের ইমাম ও সঊদী সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ সদস্য শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সুবাইল বলেন, إنه كان شجاعا، وجريئا، وصريحا، ولا يكتم ما في نفسه ولا تأخذه في الله لومة لائم . ‘তিনি বীর, দুঃসাহসী ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। তিনি মনের কথা গোপন রাখতেন না এবং আল্লাহর পথে কোন নিন্দুকের নিন্দা তাকে গ্রাস করত না’।[1] তিনি যেটাকে হক মনে করতেন সেটা প্রকাশে কোন দ্বিধা-সংকোচ বা ভয় কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। নিম্নে তাঁর সাহসিকতার কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করা হল-
১. আল্লামা যহীর যখন কোন বাতিল ফিরকা সম্পর্কে কোন বই লিখতেন, তখন প্রসিদ্ধ ওলামায়ে কেরামকে তার কপি পাঠাতেন। এমনকি শী‘আ ও অন্যান্য ভ্রান্ত ফিরকার লোকদের কাছেও নাম-ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর সহ বইপত্র পাঠাতেন। পক্ষান্তরে শী‘আরা তাঁর বিরুদ্ধে বই লিখত। কিন্তু কখনো তার কাছে সেসবের কপি পাঠাত না। উপরন্তু ঐসব বইয়ে লেখকের ছদ্মনাম ব্যবহার করত। যেমন- আল্লামা যহীরের ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’ বইটি প্রকাশিত হলে শী‘আদের গুমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে শী‘আ মহলে রীতিমতো ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। জনৈক শী‘আ এর উত্তরে ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ ফিল মীযান’ নামে একটি বই লিখে ‘সীন-খা’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে।[2] নিঃসন্দেহে এটি আল্লামা যহীরের সাহসিকতা ও শী‘আদের ভীরুতা-কাপুরুষতার দলীল বৈ-কি!
২. মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন নূরুদ্দীন ‘ইতর নামে একজন কট্টর হানাফী শিক্ষক ‘মুছতালাহুল হাদীছ’ (হাদীছের পরিভাষা) পড়াতেন। তিনি এ বিষয়টি পড়ানোর সময় তাতে মাতুরীদী আক্বীদা ঢুকিয়ে দিতেন। আল্লামা যহীর আদব ও সম্মান বজায় রেখে তাঁর যুক্তি খন্ডন করতেন। পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার ভয় কখনো তাঁকে পেয়ে বসেনি। বরং এক্ষেত্রে তিনি যেটাকে সঠিক মনে করতেন তা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঐ শিক্ষকের সামনে পেশ করতেন।[3]
৩. ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. যাকির হুসাইন মদীনা মুনাউওয়ারায় গেলে তাঁকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আল্লামা যহীর তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারী শায়খ নাছের আল-উবূদীকে এসে বললেন, আপনি জানেন যে, ইনি ভারতের প্রেসিডেন্ট। যে দেশটি মুসলমানদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে কাশ্মীরকে কেড়ে নেয়ার জন্য যবরদস্তি করছে। অথচ তারা জানে যে, কাশ্মীরীরা ভারতের সাথে একীভূত হতে চায় না। একথা শুনে শায়খ উবূদী বললেন, তুমি কি করতে চাচ্ছ? তখন তিনি বলেন, আমরা একটি প্রতিনিধি দল গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর সমালোচনা করব এবং হিন্দুরা মুসলমানদের উপর কি নির্যাতন চালিয়েছে তা বিবৃত করব। শায়খ উবূদী তাঁর আবেগ ও আগ্রহের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন যে, উনাকে আমাদের সম্মান করা উচিত। কারণ আমরা জানি, তাঁর এ পদ সম্মানসূচক; নির্বাহী নয়। রাজনৈতিক নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কিন্তু যহীর যেন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলেন না। কারণ তিনি প্রচন্ড আবেগ নিয়ে শায়খ উবূদীর কাছে এসেছিলেন। দ্বীনের প্রতি তাঁর আগ্রহ, মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও সাহসিকতার জ্বলন্ত সাক্ষী এ ঘটনাটি।[4]
৪. আল্লামা যহীর বাতিল ফিরক্বাগুলোর কেন্দ্রে ও তাদের মাহফিলে গিয়ে মুনাযারা করতেন নির্ভয়ে-নিঃশঙ্কচিত্তে। ১৯৬৫ সালে ইরাকের সামার্রায় এক রেফাঈ ছূফী নেতার সাথে তাঁর মুনাযারা হয়। ঐ ছূফী নেতার দাবী ছিল, সে কারামতের অধিকারী। অস্ত্র তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। আল্লামা যহীর এর উত্তরে বিতর্কসভায় বলেছিলেন, যদি অস্ত্র, বর্শা ও চাকু আপনাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে, তাহলে আপনারা কেন যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন না? গুলী ও অন্যান্য জিনিস যাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না, সেসব লোকের ইরাকের বড্ড প্রয়োজন। তিনি সেখানে ঐ রেফাঈ ছূফী নেতাকে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছিলেন, আপনি আমার হাতে একটা রিভলভার দিন। আমি গুলী ছুঁড়ে দেখিয়ে দিচ্ছি, ওটা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারে কি-না। একথা বলার পর ঐ ভন্ড ছূফী পালাতে দিশা পায়নি।[5] একইভাবে তিনি ইরাকের কাযেমিয়াতে গিয়েও শী‘আদের সাথে বিতর্ক করেন।[6]
৫. পাকিস্তানে বাতিল ফিরকাগুলো কর্তৃক আহলেহাদীছদের নিকট থেকে অপদখলকৃত মসজিদগুলো তিনি পুনরুদ্ধার করতেন।[7]
[1]. ঐ, পৃঃ ৫০।
[2]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ৪; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৩।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৮।
[4]. ঐ, পৃঃ ৫৮-৫৯।
[5]. দিরাসাত ফিত-তাছাউওফ, পৃঃ ২৩২।
[6]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৮।
[7]. ঐ, পৃঃ ৫৮
১. আল্লামা যহীর যখন কোন বাতিল ফিরকা সম্পর্কে কোন বই লিখতেন, তখন প্রসিদ্ধ ওলামায়ে কেরামকে তার কপি পাঠাতেন। এমনকি শী‘আ ও অন্যান্য ভ্রান্ত ফিরকার লোকদের কাছেও নাম-ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর সহ বইপত্র পাঠাতেন। পক্ষান্তরে শী‘আরা তাঁর বিরুদ্ধে বই লিখত। কিন্তু কখনো তার কাছে সেসবের কপি পাঠাত না। উপরন্তু ঐসব বইয়ে লেখকের ছদ্মনাম ব্যবহার করত। যেমন- আল্লামা যহীরের ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’ বইটি প্রকাশিত হলে শী‘আদের গুমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে শী‘আ মহলে রীতিমতো ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। জনৈক শী‘আ এর উত্তরে ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ ফিল মীযান’ নামে একটি বই লিখে ‘সীন-খা’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে।[2] নিঃসন্দেহে এটি আল্লামা যহীরের সাহসিকতা ও শী‘আদের ভীরুতা-কাপুরুষতার দলীল বৈ-কি!
২. মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন নূরুদ্দীন ‘ইতর নামে একজন কট্টর হানাফী শিক্ষক ‘মুছতালাহুল হাদীছ’ (হাদীছের পরিভাষা) পড়াতেন। তিনি এ বিষয়টি পড়ানোর সময় তাতে মাতুরীদী আক্বীদা ঢুকিয়ে দিতেন। আল্লামা যহীর আদব ও সম্মান বজায় রেখে তাঁর যুক্তি খন্ডন করতেন। পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার ভয় কখনো তাঁকে পেয়ে বসেনি। বরং এক্ষেত্রে তিনি যেটাকে সঠিক মনে করতেন তা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঐ শিক্ষকের সামনে পেশ করতেন।[3]
৩. ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. যাকির হুসাইন মদীনা মুনাউওয়ারায় গেলে তাঁকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আল্লামা যহীর তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারী শায়খ নাছের আল-উবূদীকে এসে বললেন, আপনি জানেন যে, ইনি ভারতের প্রেসিডেন্ট। যে দেশটি মুসলমানদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে কাশ্মীরকে কেড়ে নেয়ার জন্য যবরদস্তি করছে। অথচ তারা জানে যে, কাশ্মীরীরা ভারতের সাথে একীভূত হতে চায় না। একথা শুনে শায়খ উবূদী বললেন, তুমি কি করতে চাচ্ছ? তখন তিনি বলেন, আমরা একটি প্রতিনিধি দল গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর সমালোচনা করব এবং হিন্দুরা মুসলমানদের উপর কি নির্যাতন চালিয়েছে তা বিবৃত করব। শায়খ উবূদী তাঁর আবেগ ও আগ্রহের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন যে, উনাকে আমাদের সম্মান করা উচিত। কারণ আমরা জানি, তাঁর এ পদ সম্মানসূচক; নির্বাহী নয়। রাজনৈতিক নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কিন্তু যহীর যেন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলেন না। কারণ তিনি প্রচন্ড আবেগ নিয়ে শায়খ উবূদীর কাছে এসেছিলেন। দ্বীনের প্রতি তাঁর আগ্রহ, মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও সাহসিকতার জ্বলন্ত সাক্ষী এ ঘটনাটি।[4]
৪. আল্লামা যহীর বাতিল ফিরক্বাগুলোর কেন্দ্রে ও তাদের মাহফিলে গিয়ে মুনাযারা করতেন নির্ভয়ে-নিঃশঙ্কচিত্তে। ১৯৬৫ সালে ইরাকের সামার্রায় এক রেফাঈ ছূফী নেতার সাথে তাঁর মুনাযারা হয়। ঐ ছূফী নেতার দাবী ছিল, সে কারামতের অধিকারী। অস্ত্র তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। আল্লামা যহীর এর উত্তরে বিতর্কসভায় বলেছিলেন, যদি অস্ত্র, বর্শা ও চাকু আপনাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে, তাহলে আপনারা কেন যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন না? গুলী ও অন্যান্য জিনিস যাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না, সেসব লোকের ইরাকের বড্ড প্রয়োজন। তিনি সেখানে ঐ রেফাঈ ছূফী নেতাকে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছিলেন, আপনি আমার হাতে একটা রিভলভার দিন। আমি গুলী ছুঁড়ে দেখিয়ে দিচ্ছি, ওটা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারে কি-না। একথা বলার পর ঐ ভন্ড ছূফী পালাতে দিশা পায়নি।[5] একইভাবে তিনি ইরাকের কাযেমিয়াতে গিয়েও শী‘আদের সাথে বিতর্ক করেন।[6]
৫. পাকিস্তানে বাতিল ফিরকাগুলো কর্তৃক আহলেহাদীছদের নিকট থেকে অপদখলকৃত মসজিদগুলো তিনি পুনরুদ্ধার করতেন।[7]
[1]. ঐ, পৃঃ ৫০।
[2]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ৪; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৩।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৮।
[4]. ঐ, পৃঃ ৫৮-৫৯।
[5]. দিরাসাত ফিত-তাছাউওফ, পৃঃ ২৩২।
[6]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৮।
[7]. ঐ, পৃঃ ৫৮
আল্লামা যহীর উর্দূ ভাষায় যেমন অনর্গল অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতে পারতেন, তেমনি আরবী ভাষাতেও পারতেন। একবার সঊদী বাদশাহ ফয়ছাল পাকিস্তান সফরে আসেন। তখন আল্লামা যহীর মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি বাদশাহর সামনে দাঁড়িয়ে আরবীতে বক্তৃতা প্রদান করেন। বাদশাহ তাঁর বিশুদ্ধভাষিতা ও বক্তব্যের স্টাইল দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁর নাম জিজ্ঞেস করেন। তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে বাদশাহকে নিজের পরিচয় দেন।[1]
[1]. ঐ, পৃঃ ২১৬।
[1]. ঐ, পৃঃ ২১৬।
১. ইসমাঈলী শী‘আদের নেতা করীম আগা খান (জন্ম : ১৯৩৬) আল্লামা যহীরকে ব্রিটেন সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং সেখানে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বীয় প্রতিনিধিকে প্রাইভেট বিমানসহ করাচীতে পাঠান। উদ্দেশ্য ছিল যহীরের সাথে সাক্ষাত করে ইসমাঈলীদের সম্পর্কে বই না লেখার জন্য তাঁকে রাযী করানো। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অগত্যা আগা খান আল্লামা যহীরকে প্রেরিত এক পত্রে বলেন, ‘মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আপনার লেখালেখি করা উচিত; তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য নয়’। জবাবে আল্লামা যহীর তাকে লেখেন, ‘হ্যাঁ, শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং তাঁদের শিক্ষার প্রতি ঈমান আনয়নকারী মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। খতমে নবুঅতকে অস্বীকারকারী কাফের এবং রিসালাতে মুহাম্মাদীকে অস্বীকারকারীদের সাথে মুসলমানদের ঐক্যের জন্য নয়’।[1]
২. একবার একজন বড় শী‘আ আলেম ইমাম খোমেনীর (১৩১৮-১৪০৯ হিঃ) প্রতিনিধি হিসাবে আল্লামা যহীরের সাথে তাঁর বাড়িতে দেখা করে তাঁর ‘আল-বাবিয়া’ ও ‘আল-বাহাইয়া’ বই দু’টি সম্পর্কে ইমাম খোমেনীর মুগ্ধতার বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁকে ইরান সফরের আমন্ত্রণ জানান। আল্লামা যহীর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমার জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে দিবে’? তখন সেই শী‘আ আলেম তাঁকে বলেন, আমি আপনার জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রদান করব এবং আপনি পাকিস্তানে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এখানে আপনার অনুসারীদের কাছে অবস্থান করব। আল্লামা যহীর তখন বলেন, ‘কে জানে যে, হয়ত আপনি খোমেনীর ক্রোধভাজন’। অতঃপর আল্লামা যহীর তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনাদের কোন বই-ই ছাহাবীগণকে গালি দেয়া থেকে মুক্ত নয় কেন’? এ প্রশ্ন করে তিনি খোমেনীর প্রতিনিধিকে হতচকিত করে দিয়ে ‘অছূলুল আখয়ার ইলা উছূলিল আখবার’ গ্রন্থটি হাতে নেন। ঐ শী‘আ আলেম তখন বলেন, এ বইয়ের কোথায় ছাহাবীগণকে গালি দেয়া হয়েছে দেখান? আল্লামা যহীর বইটির ১৬৮ পৃষ্ঠা খুলেন যেখানে লেখা ছিল, ‘আমরা (শী‘আরা) এদেরকে (ছাহাবীগণকে) গালিগালাজ করে ও তাদের সাথে এবং তাদেরকে যারা ভালবাসে তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করি’। অতঃপর সেই শী‘আ আলেম তাঁকে খোমেনীর একটি পত্র হস্তান্তর করেন এবং সাক্ষাৎ শেষ হওয়ার ও যহীর পত্রটি পড়ে দেখার পূর্বেই জিজ্ঞেস করেন, খোমেনীর ব্যাপারে আপনার মতামত কি? জবাবে আল্লামা যহীর বলেন, আল্লাহর কাছে দো‘আ করছি তিনি যেন তাকে দীর্ঘজীবি করেন। তাঁর কথা শেষ না হতেই ঐ শী‘আ আলেম বললেন, আপনি আমাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করুন। তখন তিনি বললেন, আমাকে কথা শেষ করতে দিন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি তাকে দীর্ঘজীবি করুন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দিন। যতক্ষণ না তিনি ধ্বংস হন এবং মুসলমানদেরকে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেন। একথা শুনে ঐ শী‘আ আলেম বলেন, এ কেমন শত্রুতা! অতঃপর মিটিং সমাপ্ত হয়।[2]
৩. একদা ওমানের মিড্ল ইস্ট ব্যাংকের প্রধান আল্লামা যহীরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বলেন, শী‘আদের সম্পর্কে লেখালেখি ছেড়ে দিন, আমি আপনার জন্য দুই মিলিয়ন (২০ লাখ) রিয়াল ব্যয়ে আহলেহাদীছের জন্য একটি মারকায বা কেন্দ্র নির্মাণ করে দিব।[3]
৪. একবার ইরানের প্রেসিডেন্ট খামেনীর দূত আল্লামা যহীরের বাড়িতে এসে তাঁকে বলেন, শী‘আদের সম্পর্কে লেখালেখি বাদ দিন। জবাবে তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের বইগুলো পুড়িয়ে ফেলুন, আমি আপনাদের সম্পর্কে লেখালেখি ছেড়ে দিব।[4]
৫. ১৯৮০ সালে আল্লামা যহীর হজ্জ করতে গেলে মক্কায় শী‘আদের কয়েকজন বড় মাপের আলেম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’-এর মতো বই লেখা উচিত নয়। তখন তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আপনারা ঠিকই বলেছেন। তবে আপনারা আমাকে বলুন, আমার বইয়ে এমন কোন কথা কি উল্লেখ করা হয়েছে যা আপনাদের বইয়ে নেই’? তখন তারা বলল, হ্যাঁ, সবই আমাদের বইয়ে আছে। তবে বিষয়গুলোকে এভাবে উত্থাপন করা ঠিক নয়। তখন তিনি বলেন, আপনারা কি বলতে চাচ্ছেন? আল্লামা যহীর তাদের কথা শুনার কারণে তারা আনন্দে বাগবাগ হয়ে বলল, উক্ত বইটি বাযেয়াফ্ত করে পুড়িয়ে ফেলুন। দ্বিতীয়বার তা প্রকাশ করবেন না। তিনি বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। তবে একটি শর্তে? শর্তটি উল্লেখ করার পূর্বেই তারা আনন্দে বলা শুরু করল, যে কোন শর্তে আমরা রাযী আছি। এরপর আল্লামা যহীর বললেন, আপনাদের যেসকল বই থেকে আমি ঐসব অসত্য কল্পকাহিনী উল্লেখ করেছি সেগুলো সব বাযেয়াফ্ত করুন এবং জ্বালিয়ে দিন, যাতে বাস্তবিকই এর পরে মতদ্বৈততার আর কোন অবকাশ না থাকে এবং আমার পরে ঐসব বই থেকে আর কেউ উদ্ধৃতি দিতে না পারে। আমরা চিরতরে মতদ্বৈততার মূলোৎপাটন করতে চাই। এরপর তারা বলল, আপনি জানেন যে, ওগুলো বিভিন্ন বইয়ের পৃষ্ঠাসমূহে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সবার হাতের নাগালে ছিল না। কিন্তু আপনি ঐগুলো একটা বইয়ের মধ্যে জমা করেছেন এবং মুসলিম ঐক্য ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন। এর জবাবে আল্লামা যহীর দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ, আমি গ্রন্থ রচনা করে এই সকল আক্বীদাকে সবার হাতের নাগালে নিয়ে এসেছি। অথচ ইতিপূর্বে একটি জাতিই (শী‘আ) সেগুলো অবগত ছিল, আর অন্যরা সে সম্পর্কে বেখবর ছিল। আমি এজন্য উক্ত গ্রন্থটি রচনা করেছি যেন উভয় পক্ষই সুস্পষ্ট দলীল ও সম্যক অবগতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এবং কোন এক পক্ষই যেন শুধু ধোঁকা না খায়। যাতে একদিক থেকে নয়; বরং উভয় দিক থেকেই প্রকৃত ঐক্য অর্জিত হয়। পক্ষান্তরে আমরা আপনাদেরকে ও আপনাদের বড় বড় নেতাদেরকে সম্মান করব আর আপনারা আমাদের সাথে এবং এই উম্মতের পূর্বসূরী, এর কল্যাণকামী, এর মর্যাদার রূপকার, এর কালেমাকে সমুন্নতকারী মর্দে মুজাহিদদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবেন। অথবা আমরা আপনাদের কথা বিশ্বাস করব এবং আমাদের মনের কথা খুলে বলব আর আপনারা ‘তাক্বিয়া’ নীতি অবলম্বন করে যা প্রকাশ করবেন তার বিপরীত চিন্তা-চেতনা সংগোপনে লালন করবেন, তা কখনই হ’তে পারে না। তবে হ্যাঁ, যদি আমার ঐ বইয়ে এমন কিছু পাওয়া যায় যা আপনাদের বইয়ে নেই এবং আমি যদি এমন কোন কিছুকে আপনাদের দিকে সম্পর্কিত করে থাকি যা আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাহলে এর জন্য আমি দায়বদ্ধ। আপনাদের ও অন্যদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যিনি এটা প্রমাণ করতে পারবেন। আরব ও অনারবের কোন ব্যক্তিই এমনটি প্রমাণ করার দুঃসাহস দেখায়নি।[5]
[1]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zaheer, p. 32.
[2]. Ibid, P. 32-33.
[3]. Ibid, P. 79.
[4]. Ibid.
[5]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ৫-৬।
২. একবার একজন বড় শী‘আ আলেম ইমাম খোমেনীর (১৩১৮-১৪০৯ হিঃ) প্রতিনিধি হিসাবে আল্লামা যহীরের সাথে তাঁর বাড়িতে দেখা করে তাঁর ‘আল-বাবিয়া’ ও ‘আল-বাহাইয়া’ বই দু’টি সম্পর্কে ইমাম খোমেনীর মুগ্ধতার বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁকে ইরান সফরের আমন্ত্রণ জানান। আল্লামা যহীর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমার জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে দিবে’? তখন সেই শী‘আ আলেম তাঁকে বলেন, আমি আপনার জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রদান করব এবং আপনি পাকিস্তানে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এখানে আপনার অনুসারীদের কাছে অবস্থান করব। আল্লামা যহীর তখন বলেন, ‘কে জানে যে, হয়ত আপনি খোমেনীর ক্রোধভাজন’। অতঃপর আল্লামা যহীর তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনাদের কোন বই-ই ছাহাবীগণকে গালি দেয়া থেকে মুক্ত নয় কেন’? এ প্রশ্ন করে তিনি খোমেনীর প্রতিনিধিকে হতচকিত করে দিয়ে ‘অছূলুল আখয়ার ইলা উছূলিল আখবার’ গ্রন্থটি হাতে নেন। ঐ শী‘আ আলেম তখন বলেন, এ বইয়ের কোথায় ছাহাবীগণকে গালি দেয়া হয়েছে দেখান? আল্লামা যহীর বইটির ১৬৮ পৃষ্ঠা খুলেন যেখানে লেখা ছিল, ‘আমরা (শী‘আরা) এদেরকে (ছাহাবীগণকে) গালিগালাজ করে ও তাদের সাথে এবং তাদেরকে যারা ভালবাসে তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করি’। অতঃপর সেই শী‘আ আলেম তাঁকে খোমেনীর একটি পত্র হস্তান্তর করেন এবং সাক্ষাৎ শেষ হওয়ার ও যহীর পত্রটি পড়ে দেখার পূর্বেই জিজ্ঞেস করেন, খোমেনীর ব্যাপারে আপনার মতামত কি? জবাবে আল্লামা যহীর বলেন, আল্লাহর কাছে দো‘আ করছি তিনি যেন তাকে দীর্ঘজীবি করেন। তাঁর কথা শেষ না হতেই ঐ শী‘আ আলেম বললেন, আপনি আমাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করুন। তখন তিনি বললেন, আমাকে কথা শেষ করতে দিন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি তাকে দীর্ঘজীবি করুন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দিন। যতক্ষণ না তিনি ধ্বংস হন এবং মুসলমানদেরকে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেন। একথা শুনে ঐ শী‘আ আলেম বলেন, এ কেমন শত্রুতা! অতঃপর মিটিং সমাপ্ত হয়।[2]
৩. একদা ওমানের মিড্ল ইস্ট ব্যাংকের প্রধান আল্লামা যহীরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বলেন, শী‘আদের সম্পর্কে লেখালেখি ছেড়ে দিন, আমি আপনার জন্য দুই মিলিয়ন (২০ লাখ) রিয়াল ব্যয়ে আহলেহাদীছের জন্য একটি মারকায বা কেন্দ্র নির্মাণ করে দিব।[3]
৪. একবার ইরানের প্রেসিডেন্ট খামেনীর দূত আল্লামা যহীরের বাড়িতে এসে তাঁকে বলেন, শী‘আদের সম্পর্কে লেখালেখি বাদ দিন। জবাবে তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের বইগুলো পুড়িয়ে ফেলুন, আমি আপনাদের সম্পর্কে লেখালেখি ছেড়ে দিব।[4]
৫. ১৯৮০ সালে আল্লামা যহীর হজ্জ করতে গেলে মক্কায় শী‘আদের কয়েকজন বড় মাপের আলেম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’-এর মতো বই লেখা উচিত নয়। তখন তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আপনারা ঠিকই বলেছেন। তবে আপনারা আমাকে বলুন, আমার বইয়ে এমন কোন কথা কি উল্লেখ করা হয়েছে যা আপনাদের বইয়ে নেই’? তখন তারা বলল, হ্যাঁ, সবই আমাদের বইয়ে আছে। তবে বিষয়গুলোকে এভাবে উত্থাপন করা ঠিক নয়। তখন তিনি বলেন, আপনারা কি বলতে চাচ্ছেন? আল্লামা যহীর তাদের কথা শুনার কারণে তারা আনন্দে বাগবাগ হয়ে বলল, উক্ত বইটি বাযেয়াফ্ত করে পুড়িয়ে ফেলুন। দ্বিতীয়বার তা প্রকাশ করবেন না। তিনি বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। তবে একটি শর্তে? শর্তটি উল্লেখ করার পূর্বেই তারা আনন্দে বলা শুরু করল, যে কোন শর্তে আমরা রাযী আছি। এরপর আল্লামা যহীর বললেন, আপনাদের যেসকল বই থেকে আমি ঐসব অসত্য কল্পকাহিনী উল্লেখ করেছি সেগুলো সব বাযেয়াফ্ত করুন এবং জ্বালিয়ে দিন, যাতে বাস্তবিকই এর পরে মতদ্বৈততার আর কোন অবকাশ না থাকে এবং আমার পরে ঐসব বই থেকে আর কেউ উদ্ধৃতি দিতে না পারে। আমরা চিরতরে মতদ্বৈততার মূলোৎপাটন করতে চাই। এরপর তারা বলল, আপনি জানেন যে, ওগুলো বিভিন্ন বইয়ের পৃষ্ঠাসমূহে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সবার হাতের নাগালে ছিল না। কিন্তু আপনি ঐগুলো একটা বইয়ের মধ্যে জমা করেছেন এবং মুসলিম ঐক্য ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন। এর জবাবে আল্লামা যহীর দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ, আমি গ্রন্থ রচনা করে এই সকল আক্বীদাকে সবার হাতের নাগালে নিয়ে এসেছি। অথচ ইতিপূর্বে একটি জাতিই (শী‘আ) সেগুলো অবগত ছিল, আর অন্যরা সে সম্পর্কে বেখবর ছিল। আমি এজন্য উক্ত গ্রন্থটি রচনা করেছি যেন উভয় পক্ষই সুস্পষ্ট দলীল ও সম্যক অবগতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এবং কোন এক পক্ষই যেন শুধু ধোঁকা না খায়। যাতে একদিক থেকে নয়; বরং উভয় দিক থেকেই প্রকৃত ঐক্য অর্জিত হয়। পক্ষান্তরে আমরা আপনাদেরকে ও আপনাদের বড় বড় নেতাদেরকে সম্মান করব আর আপনারা আমাদের সাথে এবং এই উম্মতের পূর্বসূরী, এর কল্যাণকামী, এর মর্যাদার রূপকার, এর কালেমাকে সমুন্নতকারী মর্দে মুজাহিদদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবেন। অথবা আমরা আপনাদের কথা বিশ্বাস করব এবং আমাদের মনের কথা খুলে বলব আর আপনারা ‘তাক্বিয়া’ নীতি অবলম্বন করে যা প্রকাশ করবেন তার বিপরীত চিন্তা-চেতনা সংগোপনে লালন করবেন, তা কখনই হ’তে পারে না। তবে হ্যাঁ, যদি আমার ঐ বইয়ে এমন কিছু পাওয়া যায় যা আপনাদের বইয়ে নেই এবং আমি যদি এমন কোন কিছুকে আপনাদের দিকে সম্পর্কিত করে থাকি যা আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাহলে এর জন্য আমি দায়বদ্ধ। আপনাদের ও অন্যদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যিনি এটা প্রমাণ করতে পারবেন। আরব ও অনারবের কোন ব্যক্তিই এমনটি প্রমাণ করার দুঃসাহস দেখায়নি।[5]
[1]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zaheer, p. 32.
[2]. Ibid, P. 32-33.
[3]. Ibid, P. 79.
[4]. Ibid.
[5]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ৫-৬।
যারা পাকিস্তানে ‘হানাফী-জা‘ফরী’ ও অন্যান্য ফিক্বহী মাযহাব বাস্তবায়নের দাবী করে তাদের সাথে লাহোর ট্র্যাজেডির মাত্র একদিন পূর্বে (৮৭-র ২২শে মার্চ) আল্লামা যহীর এক সংলাপে অংশগ্রহণ করেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, ‘আমরা কুরআন-সুন্নাহর বিকল্প হিসাবে কোন কিছুকে গ্রহণ করি না’। সাড়ে ৬ ঘণ্টার দীর্ঘ আলোচনায় তিনি কুরআন-সুন্নাহ থেকে দলীল পেশ করতে থাকেন এবং এ দু’টিকে আঁকড়ে ধরার আহবান জানান। পরের দিন বিচারকরা ঘোষণা করেন যে, ‘আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর ও তার জামা‘আতই হকের উপরে আছেন’।[1] ফালিল্লাহিল হামদ।
[1]. ‘আল-ইস্তিজাবাহ’, সংখ্যা ১১, ১৪০৭ হিঃ, বর্ষ ২, পৃঃ ৩৫।
[1]. ‘আল-ইস্তিজাবাহ’, সংখ্যা ১১, ১৪০৭ হিঃ, বর্ষ ২, পৃঃ ৩৫।
তিনি নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালীর উপরে পিএইচ.ডি করার জন্য পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের সাথে একাডেমিক বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে পিএইচ.ডি সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অনারারী ডক্টরেট ডিগ্রীও দিয়েছিল।[1]
[1]. ১৫/৪/১৪১৯ হিজরীতে ড. যাহরানীর সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইহসান ইলাহী যহীরের ভাই আবেদ ইলাহী যহীর এ তথ্য দিয়েছিলেন। তবে তখন তিনি ডিগ্রী প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম স্মরণ করতে পারেননি। দ্রঃ ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৯-৯০।
[1]. ১৫/৪/১৪১৯ হিজরীতে ড. যাহরানীর সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইহসান ইলাহী যহীরের ভাই আবেদ ইলাহী যহীর এ তথ্য দিয়েছিলেন। তবে তখন তিনি ডিগ্রী প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম স্মরণ করতে পারেননি। দ্রঃ ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৯-৯০।
আল্লামা যহীর অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচ্ছল ছিলেন। আমদানী-রফতানী ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। কাপড়ের ফ্যাক্টরি ও প্রকাশনা সংস্থাও ছিল।[1] তিনি অত্যন্ত দামী জামা, জুতা ও চশমা পরিধান করতেন। এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি সূরা যোহার ১১ আয়াত (‘তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা জানিয়ে দাও’) দ্বারা জবাব দিতেন। তিনি মনে করতেন যে, দ্বীনের দাঈদের সচ্ছল হওয়া উচিত, যাতে তাদেরকে কারো মুখাপেক্ষী না হতে হয় এবং তারা নির্দ্বিধায় হক কথা বলতে পারেন। উল্লেখ্য যে, তিনি লাহোরের প্রাচীনতম ও প্রথম আহলেহাদীছ জামে মসজিদ ‘চীনাওয়ালী’তে বিনা বেতনে খতীবের দায়িত্ব পালন করতেন।[2]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২১।
[2]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬২, ২১৭।
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১২১।
[2]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬২, ২১৭।
আল্লামা যহীর পিতা-মাতার প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। তিনি তাদের সাথে সর্বদা সদ্ব্যবহার করতেন, তাদের হকের প্রতি খেয়াল রাখতেন এবং বিভিন্ন বক্তৃতা-ভাষণেও তাদের অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করতেন। তিনি লাহোরে বসবাস করতেন। আর তাঁর পিতা-মাতা থাকতেন গুজরানওয়ালায়। ইসলামাবাদে তাঁকে প্রায়ই যেতে হত। ব্যস্ততা যতই থাক না কেন তিনি যখনই গুজরানওয়ালার পাশ দিয়ে যেতেন, তখন আববা-আম্মার সাথে সাক্ষাৎ করে যেতেন। একবার তাঁর আববা হাজী যহূর ইলাহী অসুস্থ হলে তিনি তাঁকে চিকিৎসা করানোর জন্য লাহোরে নিয়ে আসেন। পিতা তাঁকে বলেন, ‘ইহসান! আমি যখন লাহোরে যাব তখন যেন তুমি নিজেকে বড় নেতা ও আলেমে দ্বীন মনে না কর। বরং তুমি আমার কাছে সেই ছোট্টবেলার ইহসান। তুমি ছোটবেলায় যেমন আমার নির্দেশাবলী শুনতে, তেমনি এখনও আমার নির্দেশ মেনে চলবে। এশার পরে দেরি না করে দ্রুত বাড়ি ফিরবে। জেনে রাখ! তুমি যহূর ইলাহীর কাছে যেহেতু ছোট, সেহেতু তিনি তোমাকে আদেশ করবেন। দশদিন আল্লামা যহীরের পিতা তাঁর বাড়িতে অবস্থানকালে প্রত্যেকদিন তিনি পিতার নির্দেশ মতো এশার পরপরই বাড়িতে ফিরেছেন।[1]
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬১-৬২।
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬১-৬২।
ছোটবেলা থেকেই আল্লামা যহীর ছালাতের প্রতি যত্নবান ছিলেন। তিনি অত্যন্ত মুত্তাক্বী-পরহেযগার ছিলেন। নিয়মিত তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করতেন। বিভিন্ন দাওয়াতী প্রোগ্রাম শেষে গভীর রাতে বাড়িতে ফিরলেও তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করেই তবে ঘুমাতেন। তিনি অত্যধিক নফল ছিয়াম পালন করতেন এবং আল্লাহর কাছে কাতরকণ্ঠে প্রার্থনা করতেন। কোন সমস্যায় পড়লেই কাউকে কিছু না জানিয়ে ওমরা পালনে চলে যেতেন।[1]
[1]. ঐ, পৃঃ ৬২।
[1]. ঐ, পৃঃ ৬২।
আদর্শ মানুষ হিসাবে আল্লামা যহীরের চরিত্রে নানামুখী গুণের সম্মিলন ঘটেছিল। তিনি অত্যন্ত দানশীল, নম্র ও ভদ্র ছিলেন। আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয়, গরীব-দুঃখী ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তিনি সর্বদা সামনের সারিতে থাকতেন। অসংখ্য মসজিদ নির্মাণে তিনি নিজে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা ও ক্ষমাশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। কারো চাটুকারিতা ও মোসাহেবি করা ছিল তাঁর চিরাচরিত স্বভাববিরুদ্ধ। যতবড় ব্যক্তিই হোক না কেন তাকে ভয় করতেন না। বরং তার মধ্যে খারাপ কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশ করতেন।
তিনি মিশুক, রসিক ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। দ্রুত রেগে যেতেন। তাঁর মধ্যে কিছুটা কঠোরতা ছিল। তবে বক্তব্য প্রদানের সময় তাঁর অন্তর নরম হয়ে যেত। শ্রোতাদেরকে কাঁদাতেন ও তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতেন। একবার এক মজলিসে রাফেযীদের আক্বীদা ও ছাহাবীগণকে তাদের গালি-গালাজ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। প্রতীক্ষিত মাহদী সম্পর্কে রাফেযীদের আক্বীদা হল, তাদের কল্পিত ইমাম মাহদী যখন আবির্ভূত হবেন, তখন ইফকের ঘটনার জন্য তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে বেত্রাঘাত করবেন ও তাঁর ওপর হদ জারি করবেন। একথা বলার পর আল্লামা যহীর ছাহাবায়ে কেরাম ও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি ভালবাসায় অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকেন।[1]
ব্যক্তিগতভাবে তিনি কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করতেন না। যাদের সাথে তাঁর বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে মতভেদ ছিল, তাদের সাথেও তিনি সদাচরণ করতেন। কখনো কারো গীবত, চোগলখুরী ও অকল্যাণ করতেন না।[2]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৮; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৯, ৬১।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৮।
তিনি মিশুক, রসিক ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। দ্রুত রেগে যেতেন। তাঁর মধ্যে কিছুটা কঠোরতা ছিল। তবে বক্তব্য প্রদানের সময় তাঁর অন্তর নরম হয়ে যেত। শ্রোতাদেরকে কাঁদাতেন ও তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতেন। একবার এক মজলিসে রাফেযীদের আক্বীদা ও ছাহাবীগণকে তাদের গালি-গালাজ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। প্রতীক্ষিত মাহদী সম্পর্কে রাফেযীদের আক্বীদা হল, তাদের কল্পিত ইমাম মাহদী যখন আবির্ভূত হবেন, তখন ইফকের ঘটনার জন্য তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে বেত্রাঘাত করবেন ও তাঁর ওপর হদ জারি করবেন। একথা বলার পর আল্লামা যহীর ছাহাবায়ে কেরাম ও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি ভালবাসায় অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকেন।[1]
ব্যক্তিগতভাবে তিনি কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করতেন না। যাদের সাথে তাঁর বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে মতভেদ ছিল, তাদের সাথেও তিনি সদাচরণ করতেন। কখনো কারো গীবত, চোগলখুরী ও অকল্যাণ করতেন না।[2]
[1]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৮; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৯, ৬১।
[2]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ১১৮।
মুসলিম ঐক্য : মুসলিম ঐক্য সম্পর্কে আল্লামা যহীর বলেন, ‘ইসলামী দলসমূহ এবং মাযহাবী গোষ্ঠীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন স্রেফ কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ। কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণই যাবতীয় মতপার্থক্য অবসানের মাধ্যম হতে পারে। যদি সব দল ঈমানদারির সাথে নিজেদের মাযহাবী গোঁড়ামী ছেড়ে এবং দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের মাসআলাগুলোকে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী ফায়ছালা করে এবং যে মাসআলা ঐ দু’টির বিপরীত হবে সেটা ছেড়ে দেয়, তাহলে এভাবে ঐক্য হতে পারে’।[1]
তিনি ‘আল-ব্রেলভিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় এ সম্পর্কে আরো বলেন,
ان الاتحاد والاتفاق لايتأتى دون الاتفاق والاتحاد في العقائد والأفكار وإن الوحدت لا تتحقق مادام الآراء والمعتقدات لم تتوحد لأن الاتحاد والوحدت عبارت عن الاتفاق في المبدأ والوجهت . فعلينا جميعا أن نتحد ونتفق بالرجوع إلى كتاب الله وسنت رسوله صلى الله عليه وسلم وبتصحيح العقائد في ضوئهما ونترك العصبيات والتمسك بأقوال الرجال والتتبع طرق الصوفيت والخرافات .
‘আক্বীদা ও চিন্তাধারার ঐক্য ছাড়া কোন ঐক্য সম্ভব নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত চিন্তাধারা ও আক্বীদার ঐক্য না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত (প্রকৃত) ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। কেননা ঐক্যের অর্থই হল মূলনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির ঐক্য। কাজেই আমাদের সবার উচিত কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন। এর আলোকে আক্বীদা সংশোধন, মাযহাবী গোঁড়ামি ও ব্যক্তির মতামত পরিহার এবং ছূফী ও কুসংস্কারবাদীদের পথ ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়া’।[2]
ইজতিহাদ : কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে ছাহাবার মধ্যে স্পষ্ট পাওয়া যায় না এমন বিষয়ে শারঈ হুকুম নির্ধারণের জন্য সার্বিক অনুসন্ধান প্রচেষ্টা নিয়োজিত করাকে ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় ইজতিহাদ বলে। কিয়ামত পর্যন্ত সকল যোগ্য আলেমের জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু ইসলামে ইজতিহাদের প্রবক্তাই নই; বরং আমি একথাও বলি যে, এদেশে ইজতিহাদের স্বাধীনতা থাকা উচিত। তবে এক্ষেত্রে আমি বল্গাহীন স্বাধীনতার পক্ষে নই। এক্ষেত্রে এমন স্বাধীনতা থাকাও উচিত নয় যা কুফরী এবং ফাসেকী ও ফিতনা-ফ্যাসাদের দরজা উন্মুক্ত করে দিবে’।[3]
দেশে কোন ফিকহ চলবে : এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা কোন ফিকহের-ই বাস্তবায়ন চাই না। কেননা লোকেরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় কোন নির্দিষ্ট ফিকহ বাস্তবায়নের জন্য জীবন উৎসর্গ করেনি। ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং এখানে স্রেফ কুরআন ও সুন্নাহর ইসলাম বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। কুরআন ও সুন্নাহ এমন দু’টি জিনিস যার উপর সকল শ্রেণী ও রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত হতে পারে’।[4]
[1]. ঐ, পৃঃ ৬২।
[2]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ১১।
[3]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৬১।
[4]. ঐ, পৃঃ ৫৯।
তিনি ‘আল-ব্রেলভিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় এ সম্পর্কে আরো বলেন,
ان الاتحاد والاتفاق لايتأتى دون الاتفاق والاتحاد في العقائد والأفكار وإن الوحدت لا تتحقق مادام الآراء والمعتقدات لم تتوحد لأن الاتحاد والوحدت عبارت عن الاتفاق في المبدأ والوجهت . فعلينا جميعا أن نتحد ونتفق بالرجوع إلى كتاب الله وسنت رسوله صلى الله عليه وسلم وبتصحيح العقائد في ضوئهما ونترك العصبيات والتمسك بأقوال الرجال والتتبع طرق الصوفيت والخرافات .
‘আক্বীদা ও চিন্তাধারার ঐক্য ছাড়া কোন ঐক্য সম্ভব নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত চিন্তাধারা ও আক্বীদার ঐক্য না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত (প্রকৃত) ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। কেননা ঐক্যের অর্থই হল মূলনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির ঐক্য। কাজেই আমাদের সবার উচিত কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন। এর আলোকে আক্বীদা সংশোধন, মাযহাবী গোঁড়ামি ও ব্যক্তির মতামত পরিহার এবং ছূফী ও কুসংস্কারবাদীদের পথ ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়া’।[2]
ইজতিহাদ : কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে ছাহাবার মধ্যে স্পষ্ট পাওয়া যায় না এমন বিষয়ে শারঈ হুকুম নির্ধারণের জন্য সার্বিক অনুসন্ধান প্রচেষ্টা নিয়োজিত করাকে ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় ইজতিহাদ বলে। কিয়ামত পর্যন্ত সকল যোগ্য আলেমের জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু ইসলামে ইজতিহাদের প্রবক্তাই নই; বরং আমি একথাও বলি যে, এদেশে ইজতিহাদের স্বাধীনতা থাকা উচিত। তবে এক্ষেত্রে আমি বল্গাহীন স্বাধীনতার পক্ষে নই। এক্ষেত্রে এমন স্বাধীনতা থাকাও উচিত নয় যা কুফরী এবং ফাসেকী ও ফিতনা-ফ্যাসাদের দরজা উন্মুক্ত করে দিবে’।[3]
দেশে কোন ফিকহ চলবে : এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা কোন ফিকহের-ই বাস্তবায়ন চাই না। কেননা লোকেরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় কোন নির্দিষ্ট ফিকহ বাস্তবায়নের জন্য জীবন উৎসর্গ করেনি। ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং এখানে স্রেফ কুরআন ও সুন্নাহর ইসলাম বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। কুরআন ও সুন্নাহ এমন দু’টি জিনিস যার উপর সকল শ্রেণী ও রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত হতে পারে’।[4]
[1]. ঐ, পৃঃ ৬২।
[2]. আল-ব্রেলভিয়া, পৃঃ ১১।
[3]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৬১।
[4]. ঐ, পৃঃ ৫৯।
১. সাবেক সঊদী গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বলেন, الشيخ إحسان إلهي ظهير رحمه الله معروف لدينا، وهو حسن العقيدة، وقد قرأت بعض كتبه فسرني ما تضمنته من النصح لله ولعباده والرد على خصوم الإسلام . ‘শায়খ ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) আমাদের নিকট সুপরিচিত। তাঁর আক্বীদা ভাল। আমি তাঁর কতিপয় গ্রন্থ পড়েছি। আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের জন্য তাতে যে নছীহত এবং ইসলামের শত্রুদের জবাব রয়েছে, তা আমাকে আনন্দিত করেছে’। তিনি বলেন, نعم الرجل وجهوده طيبة في الدعوة إلى الله . ‘তিনি অত্যন্ত ভাল ব্যক্তি। আর আল্লাহর পথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়’। তিনি আরো বলেন, له مآثر جميلة، ومؤلفاة طيبة نافعة . ‘তাঁর চমৎকার কীর্তি ও উপকারী ভাল বইপত্র রয়েছে’।
২. শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-জিবরীন বলেন, كرس الشيخ رحمه الله جهوده في الرد على المبتدعة والذب عن السنة ونصرها . ‘শায়খ যহীর (রহঃ) বিদ‘আতীদের মত খন্ডন এবং হাদীছের প্রতিরক্ষা ও সহযোগিতায় তাঁর প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিলেন’।
৩. মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ বলেন, وله جهود طيبة في الرد على أهل البدع وكشف باطلهم، وله مؤلفات كثيرة في ذلك . ‘বিদ‘আতীদের মতামত খন্ডন ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার স্বরূপ উন্মোচনে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। এ বিষয়ে তাঁর অনেক বই-পুস্তকও রয়েছে’।
৪. মক্কার হারামের ইমাম শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সুবাইল বলেন, فضيلة الشيخ إحسان إلهي ظهير عالم جليل وداعية بصير من علماء أهل السنة والجماعة في باكستان ومن الدعاة المشهورين هناك . ‘মাননীয় শায়খ ইহসান ইলাহী যহীর পাকিস্তানের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সম্মানিত আলেম এবং সেখানকার দূরদর্শী ও খ্যাতিমান দাঈ’। তিনি আরো বলেন, ويتمتع بقوة في الحجة وشدة في التأثير في خطبه ومواعظه . ‘তিনি দলীল-প্রমাণের বলিষ্ঠতা এবং তাঁর বক্তৃতা ও ওয়ায-নছীহতে প্রচন্ড প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন’।[1]
৫. সঊদী সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ সদস্য শায়েখ ছালেহ বিন মুহাম্মাদ আল-লিহীদান বলেন, وليس بخاف أنه رحمه الله قد أسهم بقلمه وخطابته في مجال مكافحة البدع والمبتدعة أيما إسهام، وكان لحماسه واندفاعه في دفاعه عن العقيدة أثره في بلاد الباكستان وغيرها . ‘এটা সুস্পষ্ট যে, তিনি (রহঃ) তাঁর লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে বিদ‘আত ও বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কঠিনভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আক্বীদার প্রতিরক্ষায় তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রভাব পাকিস্তান ও অন্যত্র ছিল’।[2] তিনি আরো বলেন, فقد كان مجاهدا بلسانه وقلمه - ‘তিনি তাঁর বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে একজন মুজাহিদ ছিলেন’।
৬. শায়খ আব্দুর রহমান আল-বাররাক বলেন, اشةهر بجهاده للرافضة . ‘তিনি রাফেযীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন’।
৭. শায়খ আব্দুল্লাহ আল-গুনায়মান বলেন, قلَّ أن يوجد مثله في شجاعةه في مواجهة الباطل ورده بالأدلة المقنعة . ‘বাতিলের প্রতিরোধ ও যথোপযুক্ত দলীল দ্বারা তার জবাবদানের ক্ষেত্রে তাঁর মতো দুঃসাহসী ব্যক্তি খুব কমই পাওয়া যায়’।
৮. ড. অছিউল্লাহ মুহাম্মাদ আববাস বলেন, وله جهود جبارة في ةوجيه الشباب إلى العقيدة السلفية . ‘যুবকদেরকে সালাফী আক্বীদার দিকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ছিল’।
৯. মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রফেসর শায়খ রবী বিন হাদী আল-মাদখালী বলেন, عرفةه مجاهدا في ميدان العقيدة . ‘আক্বীদার ময়দানে আমি তাঁকে একজন মুজাহিদ হিসাবে জেনেছি’।
১০. শায়খ আব্দুল আযীয আল-ক্বারী বলেন, إنه كان مقاتلا من الطراز الأول، لا بالسنان ولكن بالفكر والتعلم واللسان . ‘তিনি প্রথম শ্রেণীর যোদ্ধা ছিলেন। তবে বর্শা তথা অস্ত্রের মাধ্যমে নয়; বরং গবেষণা, শিক্ষাদান ও বক্তৃতার মাধ্যমে’।
১১. শায়খ মুহাম্মাদ বিন নাছির আল-উবূদী বলেন, لقد عاش الشيخ إحسان إلهي حميدا ومضى شهيدا إن شاء الله . ‘শায়খ ইহসান ইলাহী প্রশংসিত ব্যক্তিরূপে বেঁচে ছিলেন এবং ইনশাআল্লাহ শহীদ হয়েই (পরপারে) চলে গেছেন’।
১২. ড. মারযূক বিন হাইয়াস আয-যাহরানী বলেন, كان عالما ذكيا فذًّا شجاعا، حسن الأخلاق، يقول رأيه ولا يهاب العواقب . ‘তিনি অত্যন্ত মেধাবী, অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সাহসী ও চরিত্রবান আলেম ছিলেন। পরিণামের ভয় না করে তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করতেন’।[3]
১৩. জীবনীকার মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী বলেন, كان شجاعا في قوله الحق، باحثا عن الحقيقة، ناصحا لأمته . ‘তিনি হক কথা বলায় সাহসী, সত্যানুসন্ধানী এবং তাঁর জাতির হিতাকাঙ্খী ছিলেন’।[4]
১৪. ড. আলী বিন মূসা আয-যাহরানী বলেন, كان صاحب خلق، وورع، وكرم، قوي الإيمان، شديد التمسك بدينه قوي في الصدع بالحق . ‘তিনি চরিত্রবান, আল্লাহভীরু, দানশীল, সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারী, দ্বীনকে কঠিনভাবে ধারণকারী এবং হক কথা প্রচারে নির্ভীক ছিলেন’।[5]
১৫. পশ্চিম বঙ্গের ড. লোকমান সালাফী বলেন, هو الخطيب المسقع العظيم الذي لم يعرف له مثيل في تاريخ باكستان، وقد شهد له بالعظمة في هذا الشأن القاصي، والداني، والصديق، والعدو . ‘তিনি অনলবর্ষী বাগ্মী, পাকিস্তানের ইতিহাসে যার সমতুল্য কেউ দৃষ্টিগোচর হয়নি। এক্ষেত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে নিকটবর্তী-দূরবর্তী এবং শত্রু-মিত্র সবাই সাক্ষ্য প্রদান করেছেন’।[6] তিনি আরো বলেন, هو الكاتب البارع الفذ الذي قمع بقلمه السيال قصور الباطل، وهدم بنيان الفرق الباطلة هدما ليس بعده هدم . ‘তিনি সেই শ্রেষ্ঠ ও অনন্য লেখক, যিনি তাঁর গতিশীল লেখনীর মাধ্যমে বাতিলের রাজপ্রাসাদকে চূর্ণ করেছিলেন এবং বাতিল ফিরকাগুলোর ভিত্তিগুলোকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন’।[7]
১৬. ওআইসি তাঁর সম্পর্কে বলেছে, وقد أوقف حياةه ووقةه وماله على الدفاع عن العقيدة الإسلامية . ‘ইসলামী আক্বীদার প্রতিরক্ষায় তিনি তাঁর জীবন, সময় ও সম্পদ ওয়াক্ফ করে ছিলেন’।[8]
১৭. ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জমঈয়তে আহলেহাদীছের শুববান বিভাগের সাবেক পরিচালক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের তদানীন্তন সহকারী অধ্যাপক (বর্তমানে প্রফেসর ও আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ) মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব আল্লামা যহীরের মৃত্যুতে লাহোরে একটি শোকবার্তা পাঠান। যেটি ‘মুমতায ডাইজেস্ট’ বিশেষ সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর ’৮৭-তে ‘মাকতূবে বাংলাদেশ : আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর কি শাহাদত পর ইযহারে গাম’ (বাংলাদেশের চিঠি : আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের শাহাদতে শোক প্রকাশ) শিরোনামে প্রকাশিত হয়। উক্ত শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান-এর সেক্রেটারী জেনারেল আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের শাহাদতে আমরা সবাই আন্তরিকভাবে ব্যথিত-মর্মাহত। বাংলাদেশের আহলেহাদীছ ছাত্র ও যুবকদের পক্ষ থেকে আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি। আল্লাহ পাক মরহূম আল্লামাকে স্বীয় খাছ রহমত ও মাগফিরাতে সম্মানিত করুন এবং তাঁর উত্তরাধিকারী ও আত্মীয়-স্বজনকে পরম ধৈর্যধারণের ক্ষমতা দান করুন। আমীন!
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর ছিলেন তাঁর সময়ের অতুলনীয় বাগ্মী, লেখক, সংগঠক, আলেমে দ্বীন ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের নির্ভীক মুজাহিদ। মুশরিক, বিদ‘আতী ও দ্বীন বিকৃতকারীদের বুকে কম্পন সৃষ্টিকারী, নির্ভীক সত্যভাষী আল্লামা যহীরের মৃত্যু এভাবে হওয়াটাই মর্যাদাকর ছিল। জিহাদের ময়দানের সেনাপতিকে খ্যাতির শীর্ষে চমকানো অবস্থায় মহান প্রভু তাকে স্বীয় রহমতের ছায়াতলে টেনে নিলেন।
আল্লামা যহীর কি চলে গেছেন? শত্রুরা তাকে মেরে ফেলেছে? কখনোই না। আল-কাদিয়ানিয়াহ, আল-বাহাইয়াহ, আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন, আল-ব্রেলভিয়া এবং তাঁর অন্যান্য মূল্যবান গ্রন্থাবলী, সংবাদপত্র, তাঁর তর্জুমানুল হাদীছ, জমঈয়তে আহলেহাদীছ সবই তাঁর জীবন্ত কীর্তি।
ফেব্রুয়ারী ’৮৫-এর ঢাকা কনফারেন্সে তাঁর অগ্নিঝরা ভাষণ তো আমরা এখনো শুনতে পাচ্ছি। বাংলাদেশে আগামী সফরে তিনি বাংলায় ভাষণ দিবেন বলে ওয়াদা করে গেছেন। আর আমরা আহলেহাদীছ যুবসংঘের পক্ষ থেকে তাঁকে সেদিন ‘শেরে পাকিস্তান’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করব বলে দৃঢ় সংকল্প নিয়েছিলাম। এখন মৃত্যুর পরে কি তাঁকে আমরা উক্ত লকব দিতে পারি না?
এরূপ অতুলনীয় নেতার মৃত্যুতে পাকিস্তানীদের এবং বিশেষ করে আহলেহাদীছ জামা‘আত ও জমঈয়তের যে অপরিসীম ক্ষতি সাধিত হয়েছে, আল্লাহ পাক তাঁর খাছ রহমতে তার উত্তম বিনিময় দান করুন! আমীন’!![9]
২৪.০৯.২০১১ তারিখে লেখককে দেওয়া এক লিখিত তথ্যে তিনি বলেন, ‘যহীর আমার সাময়িককালের বন্ধু ছিলেন। প্রথমে কলমী, পরে সরাসরি। আমি তাঁকে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমায় বক্তা হিসাবে দাওয়াতনামা পাঠিয়েছিলাম। তিনি তা কবুল করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই তিনি শাহাদাত লাভ করেন।
১৯৮৫ সালে ঢাকায় জমঈয়ত কনফারেন্সে তাঁকে আনার মূল ভূমিকায় ছিলাম আমি। কেন জানিনা ডক্টর ছাহেব তাঁকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই তাঁকে মাত্র ১৫ মিনিট সময় দেন বক্তৃতার জন্য। যার জন্য হাযারো মানুষের আগমন, যার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে হাযারো শ্রোতা, তাঁর জন্য এত সংক্ষিপ্ত সময় নির্ধারণ কেউই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু সভাপতির আদেশ শিরোধার্য। আমার বিরূপ মনোভাব বুঝতে পেরে যহীর মাইকের কাছে যাওয়ার আগে আমার হাতে হাত রেখে বললেন, ‘দিল খারাব না কী জিয়ে’ (মন খারাব করবেন না)। তারপর মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে হামদ ও ছানা শেষে ভাষণ শুরুর এক পর্যায়ে ঝলসে উঠে বললেন, ছদরে জালসা মুঝে পন্দ্রা মিনিট টাইম দিয়ে হ্যাঁয়। ওহ নেহী জানতে হ্যাঁয় কে যহীর কো গরম হোনে কে লিয়ে পন্দ্রা মিনিট লাগতা হ্যায়’ (সভাপতি ছাহেব আমাকে ১৫ মিনিট সময় দিয়েছেন। উনি জানেন না যে, যহীরের গরম হ’তেই ১৫ মিনিট সময় লাগে)। এতেই শ্রোতারা সব গরম হয়ে উঠলো। ওদিকে যহীরের বক্তৃতায় আগুনের ফুলকি বের হতে লাগলো। শুরু হ’ল আহলেহাদীছের সত্যতার উপরে একের পর এক কোটেশন টানা ও তার আবেগঘন ব্যাখ্যা। অগ্নিঝরা ভাষণ, অপূর্ব বাকভঙ্গি, যুক্তি আর চ্যালেঞ্জের দাপট, সব মিলে পুরা সম্মেলনটাই হয়ে গেল যহীরময়। সভাপতি ছাহেবও অপলক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন এই তরুণ পাকিস্তানী সিংহের প্রতি। ১৫ মিনিট পেরিয়ে কখন যে সময় ঘণ্টার কাছাকাছি চলে গেছে, কারুরই খেয়াল নেই। যহীর এবার শেষ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন- ‘বিদ‘আতী লোগো! আগার আহলেহাদীছ কা এক মাসআলা ভী তোম ছহীহ হাদীছ কে খেলাফ দেখানা সেকো তো লে আও। তোমহারে লিয়ে যহীর হাফতা ভর হোটেল মে ইন্তেযার করে গা’ (বিদ‘আতীরা শোনো। যদি তোমরা আহলেহাদীছের একটি মাসআলাও ছহীহ হাদীছের খেলাফ দেখাতে পারো, তবে নিয়ে আস। তোমাদের জন্য যহীর হোটেলে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করবে)।
সমস্ত সম্মেলন মুহুর্মুহু তাকবীর ধ্বনিতে ফেটে পড়ল। দক্ষ শিল্পীর মত যহীর এবার দপ করে নিভে গেলেন ও ভাষণ শেষ করে পিছন ফিরে আমার হাত ধরে মঞ্চ থেকে নেমে এসে সোজা একটানে হোটেল শেরাটন। সেখানে এসে চলল বহুক্ষণ তার সরস আলাপচারিতা। সেই সাথে রাগ-ক্ষোভ অনেক কিছু। পাকিস্তান জমঈয়তের নেতাদের সাথে বাংলাদেশ জমঈয়তের নেতার মনোভঙ্গি ও আচরণের সাথে তিনি অনেক মিল খুঁজে পেলেন এবং আমাকে হিম্মত নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে উৎসাহ দিলেন। তার তেজস্বিতা, ওজস্বিনী ভাষণ, খোলামেলা আলাপচারিতা ও এক দিনের বন্ধুসুলভ আচরণ আমি আজও ভুলতে পারি না। শত্রুর বোমা তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে। কিন্তু ঢাকায় তার ঐতিহাসিক ভাষণের অগ্নিঝরা কণ্ঠ আজও আমাদের কানে ভাসছে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নছীব করুন- আমীন!’
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৩-৯৭।
[2]. ইহসান ইলাহী যহীর, দিরাসাত ফিত-তাছাওউফ, পৃঃ ৫, শায়খ লিহীদান লিখিত ভূমিকা দ্রঃ।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৯-১০৩, ১০৫-১০৬।
[4]. শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর, পৃঃ ২।
[5]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯।
[6]. ‘আল-ইস্তিজাবাহ’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৩-৩৪; ‘আদ-দাওয়াহ’, সংখ্যা ১০৮৭, ১৫/৮/১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৪০-৪১।
[7]. ‘আল-ইস্তিজাবাহ’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ।
[8]. ‘আর-রিসালাহ আল-ইসলামিয়্যাহ’, সংখ্যা ২০২, বর্ষ ২০, শা‘বান ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ১২৯।
[9]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, (লাহোর : সেপ্টেম্বর ১৯৮৭), পৃঃ ১২৩।
২. শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-জিবরীন বলেন, كرس الشيخ رحمه الله جهوده في الرد على المبتدعة والذب عن السنة ونصرها . ‘শায়খ যহীর (রহঃ) বিদ‘আতীদের মত খন্ডন এবং হাদীছের প্রতিরক্ষা ও সহযোগিতায় তাঁর প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিলেন’।
৩. মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ বলেন, وله جهود طيبة في الرد على أهل البدع وكشف باطلهم، وله مؤلفات كثيرة في ذلك . ‘বিদ‘আতীদের মতামত খন্ডন ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার স্বরূপ উন্মোচনে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। এ বিষয়ে তাঁর অনেক বই-পুস্তকও রয়েছে’।
৪. মক্কার হারামের ইমাম শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সুবাইল বলেন, فضيلة الشيخ إحسان إلهي ظهير عالم جليل وداعية بصير من علماء أهل السنة والجماعة في باكستان ومن الدعاة المشهورين هناك . ‘মাননীয় শায়খ ইহসান ইলাহী যহীর পাকিস্তানের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সম্মানিত আলেম এবং সেখানকার দূরদর্শী ও খ্যাতিমান দাঈ’। তিনি আরো বলেন, ويتمتع بقوة في الحجة وشدة في التأثير في خطبه ومواعظه . ‘তিনি দলীল-প্রমাণের বলিষ্ঠতা এবং তাঁর বক্তৃতা ও ওয়ায-নছীহতে প্রচন্ড প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন’।[1]
৫. সঊদী সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ সদস্য শায়েখ ছালেহ বিন মুহাম্মাদ আল-লিহীদান বলেন, وليس بخاف أنه رحمه الله قد أسهم بقلمه وخطابته في مجال مكافحة البدع والمبتدعة أيما إسهام، وكان لحماسه واندفاعه في دفاعه عن العقيدة أثره في بلاد الباكستان وغيرها . ‘এটা সুস্পষ্ট যে, তিনি (রহঃ) তাঁর লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে বিদ‘আত ও বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কঠিনভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আক্বীদার প্রতিরক্ষায় তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রভাব পাকিস্তান ও অন্যত্র ছিল’।[2] তিনি আরো বলেন, فقد كان مجاهدا بلسانه وقلمه - ‘তিনি তাঁর বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে একজন মুজাহিদ ছিলেন’।
৬. শায়খ আব্দুর রহমান আল-বাররাক বলেন, اشةهر بجهاده للرافضة . ‘তিনি রাফেযীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন’।
৭. শায়খ আব্দুল্লাহ আল-গুনায়মান বলেন, قلَّ أن يوجد مثله في شجاعةه في مواجهة الباطل ورده بالأدلة المقنعة . ‘বাতিলের প্রতিরোধ ও যথোপযুক্ত দলীল দ্বারা তার জবাবদানের ক্ষেত্রে তাঁর মতো দুঃসাহসী ব্যক্তি খুব কমই পাওয়া যায়’।
৮. ড. অছিউল্লাহ মুহাম্মাদ আববাস বলেন, وله جهود جبارة في ةوجيه الشباب إلى العقيدة السلفية . ‘যুবকদেরকে সালাফী আক্বীদার দিকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ছিল’।
৯. মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রফেসর শায়খ রবী বিন হাদী আল-মাদখালী বলেন, عرفةه مجاهدا في ميدان العقيدة . ‘আক্বীদার ময়দানে আমি তাঁকে একজন মুজাহিদ হিসাবে জেনেছি’।
১০. শায়খ আব্দুল আযীয আল-ক্বারী বলেন, إنه كان مقاتلا من الطراز الأول، لا بالسنان ولكن بالفكر والتعلم واللسان . ‘তিনি প্রথম শ্রেণীর যোদ্ধা ছিলেন। তবে বর্শা তথা অস্ত্রের মাধ্যমে নয়; বরং গবেষণা, শিক্ষাদান ও বক্তৃতার মাধ্যমে’।
১১. শায়খ মুহাম্মাদ বিন নাছির আল-উবূদী বলেন, لقد عاش الشيخ إحسان إلهي حميدا ومضى شهيدا إن شاء الله . ‘শায়খ ইহসান ইলাহী প্রশংসিত ব্যক্তিরূপে বেঁচে ছিলেন এবং ইনশাআল্লাহ শহীদ হয়েই (পরপারে) চলে গেছেন’।
১২. ড. মারযূক বিন হাইয়াস আয-যাহরানী বলেন, كان عالما ذكيا فذًّا شجاعا، حسن الأخلاق، يقول رأيه ولا يهاب العواقب . ‘তিনি অত্যন্ত মেধাবী, অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সাহসী ও চরিত্রবান আলেম ছিলেন। পরিণামের ভয় না করে তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করতেন’।[3]
১৩. জীবনীকার মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী বলেন, كان شجاعا في قوله الحق، باحثا عن الحقيقة، ناصحا لأمته . ‘তিনি হক কথা বলায় সাহসী, সত্যানুসন্ধানী এবং তাঁর জাতির হিতাকাঙ্খী ছিলেন’।[4]
১৪. ড. আলী বিন মূসা আয-যাহরানী বলেন, كان صاحب خلق، وورع، وكرم، قوي الإيمان، شديد التمسك بدينه قوي في الصدع بالحق . ‘তিনি চরিত্রবান, আল্লাহভীরু, দানশীল, সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারী, দ্বীনকে কঠিনভাবে ধারণকারী এবং হক কথা প্রচারে নির্ভীক ছিলেন’।[5]
১৫. পশ্চিম বঙ্গের ড. লোকমান সালাফী বলেন, هو الخطيب المسقع العظيم الذي لم يعرف له مثيل في تاريخ باكستان، وقد شهد له بالعظمة في هذا الشأن القاصي، والداني، والصديق، والعدو . ‘তিনি অনলবর্ষী বাগ্মী, পাকিস্তানের ইতিহাসে যার সমতুল্য কেউ দৃষ্টিগোচর হয়নি। এক্ষেত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে নিকটবর্তী-দূরবর্তী এবং শত্রু-মিত্র সবাই সাক্ষ্য প্রদান করেছেন’।[6] তিনি আরো বলেন, هو الكاتب البارع الفذ الذي قمع بقلمه السيال قصور الباطل، وهدم بنيان الفرق الباطلة هدما ليس بعده هدم . ‘তিনি সেই শ্রেষ্ঠ ও অনন্য লেখক, যিনি তাঁর গতিশীল লেখনীর মাধ্যমে বাতিলের রাজপ্রাসাদকে চূর্ণ করেছিলেন এবং বাতিল ফিরকাগুলোর ভিত্তিগুলোকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন’।[7]
১৬. ওআইসি তাঁর সম্পর্কে বলেছে, وقد أوقف حياةه ووقةه وماله على الدفاع عن العقيدة الإسلامية . ‘ইসলামী আক্বীদার প্রতিরক্ষায় তিনি তাঁর জীবন, সময় ও সম্পদ ওয়াক্ফ করে ছিলেন’।[8]
১৭. ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জমঈয়তে আহলেহাদীছের শুববান বিভাগের সাবেক পরিচালক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের তদানীন্তন সহকারী অধ্যাপক (বর্তমানে প্রফেসর ও আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ) মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব আল্লামা যহীরের মৃত্যুতে লাহোরে একটি শোকবার্তা পাঠান। যেটি ‘মুমতায ডাইজেস্ট’ বিশেষ সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর ’৮৭-তে ‘মাকতূবে বাংলাদেশ : আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর কি শাহাদত পর ইযহারে গাম’ (বাংলাদেশের চিঠি : আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের শাহাদতে শোক প্রকাশ) শিরোনামে প্রকাশিত হয়। উক্ত শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান-এর সেক্রেটারী জেনারেল আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের শাহাদতে আমরা সবাই আন্তরিকভাবে ব্যথিত-মর্মাহত। বাংলাদেশের আহলেহাদীছ ছাত্র ও যুবকদের পক্ষ থেকে আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি। আল্লাহ পাক মরহূম আল্লামাকে স্বীয় খাছ রহমত ও মাগফিরাতে সম্মানিত করুন এবং তাঁর উত্তরাধিকারী ও আত্মীয়-স্বজনকে পরম ধৈর্যধারণের ক্ষমতা দান করুন। আমীন!
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর ছিলেন তাঁর সময়ের অতুলনীয় বাগ্মী, লেখক, সংগঠক, আলেমে দ্বীন ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের নির্ভীক মুজাহিদ। মুশরিক, বিদ‘আতী ও দ্বীন বিকৃতকারীদের বুকে কম্পন সৃষ্টিকারী, নির্ভীক সত্যভাষী আল্লামা যহীরের মৃত্যু এভাবে হওয়াটাই মর্যাদাকর ছিল। জিহাদের ময়দানের সেনাপতিকে খ্যাতির শীর্ষে চমকানো অবস্থায় মহান প্রভু তাকে স্বীয় রহমতের ছায়াতলে টেনে নিলেন।
আল্লামা যহীর কি চলে গেছেন? শত্রুরা তাকে মেরে ফেলেছে? কখনোই না। আল-কাদিয়ানিয়াহ, আল-বাহাইয়াহ, আশ-শী‘আ ওয়াল কুরআন, আল-ব্রেলভিয়া এবং তাঁর অন্যান্য মূল্যবান গ্রন্থাবলী, সংবাদপত্র, তাঁর তর্জুমানুল হাদীছ, জমঈয়তে আহলেহাদীছ সবই তাঁর জীবন্ত কীর্তি।
ফেব্রুয়ারী ’৮৫-এর ঢাকা কনফারেন্সে তাঁর অগ্নিঝরা ভাষণ তো আমরা এখনো শুনতে পাচ্ছি। বাংলাদেশে আগামী সফরে তিনি বাংলায় ভাষণ দিবেন বলে ওয়াদা করে গেছেন। আর আমরা আহলেহাদীছ যুবসংঘের পক্ষ থেকে তাঁকে সেদিন ‘শেরে পাকিস্তান’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করব বলে দৃঢ় সংকল্প নিয়েছিলাম। এখন মৃত্যুর পরে কি তাঁকে আমরা উক্ত লকব দিতে পারি না?
এরূপ অতুলনীয় নেতার মৃত্যুতে পাকিস্তানীদের এবং বিশেষ করে আহলেহাদীছ জামা‘আত ও জমঈয়তের যে অপরিসীম ক্ষতি সাধিত হয়েছে, আল্লাহ পাক তাঁর খাছ রহমতে তার উত্তম বিনিময় দান করুন! আমীন’!![9]
২৪.০৯.২০১১ তারিখে লেখককে দেওয়া এক লিখিত তথ্যে তিনি বলেন, ‘যহীর আমার সাময়িককালের বন্ধু ছিলেন। প্রথমে কলমী, পরে সরাসরি। আমি তাঁকে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমায় বক্তা হিসাবে দাওয়াতনামা পাঠিয়েছিলাম। তিনি তা কবুল করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই তিনি শাহাদাত লাভ করেন।
১৯৮৫ সালে ঢাকায় জমঈয়ত কনফারেন্সে তাঁকে আনার মূল ভূমিকায় ছিলাম আমি। কেন জানিনা ডক্টর ছাহেব তাঁকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই তাঁকে মাত্র ১৫ মিনিট সময় দেন বক্তৃতার জন্য। যার জন্য হাযারো মানুষের আগমন, যার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে হাযারো শ্রোতা, তাঁর জন্য এত সংক্ষিপ্ত সময় নির্ধারণ কেউই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু সভাপতির আদেশ শিরোধার্য। আমার বিরূপ মনোভাব বুঝতে পেরে যহীর মাইকের কাছে যাওয়ার আগে আমার হাতে হাত রেখে বললেন, ‘দিল খারাব না কী জিয়ে’ (মন খারাব করবেন না)। তারপর মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে হামদ ও ছানা শেষে ভাষণ শুরুর এক পর্যায়ে ঝলসে উঠে বললেন, ছদরে জালসা মুঝে পন্দ্রা মিনিট টাইম দিয়ে হ্যাঁয়। ওহ নেহী জানতে হ্যাঁয় কে যহীর কো গরম হোনে কে লিয়ে পন্দ্রা মিনিট লাগতা হ্যায়’ (সভাপতি ছাহেব আমাকে ১৫ মিনিট সময় দিয়েছেন। উনি জানেন না যে, যহীরের গরম হ’তেই ১৫ মিনিট সময় লাগে)। এতেই শ্রোতারা সব গরম হয়ে উঠলো। ওদিকে যহীরের বক্তৃতায় আগুনের ফুলকি বের হতে লাগলো। শুরু হ’ল আহলেহাদীছের সত্যতার উপরে একের পর এক কোটেশন টানা ও তার আবেগঘন ব্যাখ্যা। অগ্নিঝরা ভাষণ, অপূর্ব বাকভঙ্গি, যুক্তি আর চ্যালেঞ্জের দাপট, সব মিলে পুরা সম্মেলনটাই হয়ে গেল যহীরময়। সভাপতি ছাহেবও অপলক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন এই তরুণ পাকিস্তানী সিংহের প্রতি। ১৫ মিনিট পেরিয়ে কখন যে সময় ঘণ্টার কাছাকাছি চলে গেছে, কারুরই খেয়াল নেই। যহীর এবার শেষ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন- ‘বিদ‘আতী লোগো! আগার আহলেহাদীছ কা এক মাসআলা ভী তোম ছহীহ হাদীছ কে খেলাফ দেখানা সেকো তো লে আও। তোমহারে লিয়ে যহীর হাফতা ভর হোটেল মে ইন্তেযার করে গা’ (বিদ‘আতীরা শোনো। যদি তোমরা আহলেহাদীছের একটি মাসআলাও ছহীহ হাদীছের খেলাফ দেখাতে পারো, তবে নিয়ে আস। তোমাদের জন্য যহীর হোটেলে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করবে)।
সমস্ত সম্মেলন মুহুর্মুহু তাকবীর ধ্বনিতে ফেটে পড়ল। দক্ষ শিল্পীর মত যহীর এবার দপ করে নিভে গেলেন ও ভাষণ শেষ করে পিছন ফিরে আমার হাত ধরে মঞ্চ থেকে নেমে এসে সোজা একটানে হোটেল শেরাটন। সেখানে এসে চলল বহুক্ষণ তার সরস আলাপচারিতা। সেই সাথে রাগ-ক্ষোভ অনেক কিছু। পাকিস্তান জমঈয়তের নেতাদের সাথে বাংলাদেশ জমঈয়তের নেতার মনোভঙ্গি ও আচরণের সাথে তিনি অনেক মিল খুঁজে পেলেন এবং আমাকে হিম্মত নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে উৎসাহ দিলেন। তার তেজস্বিতা, ওজস্বিনী ভাষণ, খোলামেলা আলাপচারিতা ও এক দিনের বন্ধুসুলভ আচরণ আমি আজও ভুলতে পারি না। শত্রুর বোমা তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে। কিন্তু ঢাকায় তার ঐতিহাসিক ভাষণের অগ্নিঝরা কণ্ঠ আজও আমাদের কানে ভাসছে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নছীব করুন- আমীন!’
[1]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৩-৯৭।
[2]. ইহসান ইলাহী যহীর, দিরাসাত ফিত-তাছাওউফ, পৃঃ ৫, শায়খ লিহীদান লিখিত ভূমিকা দ্রঃ।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৯-১০৩, ১০৫-১০৬।
[4]. শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর, পৃঃ ২।
[5]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯।
[6]. ‘আল-ইস্তিজাবাহ’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৩-৩৪; ‘আদ-দাওয়াহ’, সংখ্যা ১০৮৭, ১৫/৮/১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৪০-৪১।
[7]. ‘আল-ইস্তিজাবাহ’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ।
[8]. ‘আর-রিসালাহ আল-ইসলামিয়্যাহ’, সংখ্যা ২০২, বর্ষ ২০, শা‘বান ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ১২৯।
[9]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, (লাহোর : সেপ্টেম্বর ১৯৮৭), পৃঃ ১২৩।
পরিশেষে বলা যায়, আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) বিংশ শতকে আল্লাহর পথে দাওয়াতের ময়দানে নিয়োজিত এক নিবেদিতপ্রাণ অকুতোভয় সিপাহসালার ছিলেন। পাকিস্তানে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ঝান্ডা উড্ডীন করার দৃপ্ত শপথ নিয়ে তিনি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অগ্নিঝরা বক্তৃতা, ক্ষুরধার লেখনী ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ঘুমন্ত আহলেহাদীছ জামা‘আতকে অল্প সময়ের মধ্যেই জাগিয়ে তুলে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মোপলব্ধির বীজ বপন করতে সক্ষম হন।
শী‘আ, কাদিয়ানী, ব্রেলভী, বাহাইয়া, বাবিয়া প্রভৃতি বাতিল ফিরকাগুলো ইসলামের শ্বেত-শুভ্র রূপকে কালিমালিপ্ত করার যে অপপ্রয়াস চালাচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে আল্লামা যহীর গবেষণালব্ধ বই-পত্র লিখে বিশ্বের কাছে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। এসব পথভ্রষ্ট ফিরকার আক্বীদা-বিশ্বাস তাদের লিখিত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে শক্তিশালী দলীল ও যুক্তির আলোকে এমনভাবে খন্ডন করতেন যে, তারা তার মুকাবিলা করার দুঃসাহস দেখাত না। তাঁর বই-পুস্তক পড়ে এসব ফিরকার অনেকেই তওবা করে সঠিক পথে ফিরে এসেছেন। ফালিল্লাহিল হামদ।
‘খতীবে মিল্লাত’ ‘খতীবে কওম’ রূপে বরিত আল্লামা যহীর ছিলেন সময়ের সেরা বাগ্মী। তাঁর অগ্নিঝরা বক্তৃতা হকপিয়াসীদের মনে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলো প্রজ্বলিত করত, আর বাতিলপন্থীদের বুকে থরথর কম্পন সৃষ্টি করত। তাঁর বলিষ্ঠ চ্যালেঞ্জের কাছে বিদ‘আতী, কবরপূজারী ও পথভ্রষ্ট ফিরকার লোকজন ছিল অসহায়-নিরুপায়। আল্লাহর পথে দাওয়াতে অন্তঃপ্রাণ এই বিরল আহলেহাদীছ প্রতিভা খ্যাতির শীর্ষে দেদীপ্যমান থাকা অবস্থায় কুচক্রীদের বোমার আঘাতে মাত্র ৪২ বছর বয়সে ১৯৮৭ সালের ৩০ মার্চ দপ করে নিভে যান। মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর রহমতের বারিধারায় সিক্ত করুন এবং জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দিয়ে সম্মানিত করুন! আমীন!!
সূচীপত্র
বইসমূহ
পরবর্তী পৃষ্ঠা
শী‘আ, কাদিয়ানী, ব্রেলভী, বাহাইয়া, বাবিয়া প্রভৃতি বাতিল ফিরকাগুলো ইসলামের শ্বেত-শুভ্র রূপকে কালিমালিপ্ত করার যে অপপ্রয়াস চালাচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে আল্লামা যহীর গবেষণালব্ধ বই-পত্র লিখে বিশ্বের কাছে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। এসব পথভ্রষ্ট ফিরকার আক্বীদা-বিশ্বাস তাদের লিখিত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে শক্তিশালী দলীল ও যুক্তির আলোকে এমনভাবে খন্ডন করতেন যে, তারা তার মুকাবিলা করার দুঃসাহস দেখাত না। তাঁর বই-পুস্তক পড়ে এসব ফিরকার অনেকেই তওবা করে সঠিক পথে ফিরে এসেছেন। ফালিল্লাহিল হামদ।
‘খতীবে মিল্লাত’ ‘খতীবে কওম’ রূপে বরিত আল্লামা যহীর ছিলেন সময়ের সেরা বাগ্মী। তাঁর অগ্নিঝরা বক্তৃতা হকপিয়াসীদের মনে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলো প্রজ্বলিত করত, আর বাতিলপন্থীদের বুকে থরথর কম্পন সৃষ্টি করত। তাঁর বলিষ্ঠ চ্যালেঞ্জের কাছে বিদ‘আতী, কবরপূজারী ও পথভ্রষ্ট ফিরকার লোকজন ছিল অসহায়-নিরুপায়। আল্লাহর পথে দাওয়াতে অন্তঃপ্রাণ এই বিরল আহলেহাদীছ প্রতিভা খ্যাতির শীর্ষে দেদীপ্যমান থাকা অবস্থায় কুচক্রীদের বোমার আঘাতে মাত্র ৪২ বছর বয়সে ১৯৮৭ সালের ৩০ মার্চ দপ করে নিভে যান। মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর রহমতের বারিধারায় সিক্ত করুন এবং জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দিয়ে সম্মানিত করুন! আমীন!!
সূচীপত্র
বইসমূহ
পরবর্তী পৃষ্ঠা
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন