HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আক্বীদায়ে মোহাম্মদী বা মাযহাবে আহলেহাদীছ

লেখকঃ মাওলানা আহমাদ আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
আক্বীদায়ে মোহাম্মদী বা মাযহাবে আহলেহাদীছ

মাওলানা আহমাদ আলী

প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ

নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,

হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ৩১

ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,

মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০

১ম প্রকাশ : ১৩৫৯ বাংলা

২য় প্রকাশ : ২০১১ ইং (হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

নির্ধারিত মূল্য : ১০ (দশ) টাকা মাত্র।

প্রকাশকের কথা
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও তার অঙ্গ সংগঠন সমূহের সকল মৌলিক বই সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সংস্থা ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ কর্তৃক প্রকাশিত হবে মর্মে ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মতে ইতিপূর্বে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র পক্ষ হ’তে প্রকাশিত অত্র বইটি বর্তমানে হা.ফা.বা.-এর পক্ষ হ’তে প্রকাশিত হ’ল। নিম্নে তাদের লিখিত পূর্বের ভূমিকাটি পুনর্মুদ্রিত হ’ল :

‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র মাননীয় প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের মরহূম আববাজান বিশেষতঃ দক্ষিণ বাংলায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের অগ্রসৈনিক, লেখনী, বক্তৃতা, সাংগঠনিক প্রতিভায় ভাস্বর, আজীবন শিক্ষাব্রতী, অগণিত মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, অসংখ্য ছাত্রের আদর্শ শিক্ষক, উদার ও মহানুভব চরিত্রের অধিকারী, বহু গ্রন্থ প্রণেতা বিশেষতঃ ‘বঙ্গানুবাদ খুৎবা’-র খ্যাতনামা লেখক ও সংকলক জনাব মাওলানা আহমাদ আলীর অন্যতম অবদান হ’ল ‘আক্বীদায়ে মোহাম্মাদী বা মাযহাবে আহলেহাদীছ’।

বইটি আকারে ছোট হ’লেও গুরুত্বে অপরিসীম। এর রচনাভঙ্গি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য। আহলেহাদীছ আক্বীদার উপরে যুক্তিগ্রাহ্য ও মধুর ভাষায় লিখিত এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি যেকোন নিরপেক্ষ পাঠকের হৃদয় আকর্ষণ করে। বাংলাদেশে নিযুক্ত (তৎকালীন) সঊদী মাব‘ঊছ শায়খ আব্দুল মতীন সালাফী বইটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে এসে যত বই পড়েছি, তার মধ্যে মরহূম মাওলানা আহমাদ আলীর ‘আক্বীদায়ে মোহাম্মাদী’ই আমার অন্তর জয় করেছে’। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঢাকা-র প্রাক্তন ডি.জি. ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রবীণ প্রফেসর জনাব ডঃ মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান ১৯৬১ সালে কৃত স্বীয় পিএইচ-ডি থিসিসে ‘আক্বীদায়ে মোহাম্মাদী’-কে তাঁহার অন্যতম রেফারেন্স বই হিসাবে গ্রহণ করেন (History of the Faraidi Movement P. 41)। মরহূম মাওলানার জীবনীকার খুলনার শেখ আখতার হোসেন বলেন, ‘মাওলানা আহমাদ আলী ছিলেন একজন সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সমাজ সেবক ও সুবক্তা। তাঁর চিন্তাধারা ছিল মানব সেবা। ... তাঁর লেখা প্রবন্ধ ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের’। (‘সাহিত্যিক মাওলানা আহমাদ আলী’ লেখকের কথা)। বলা বাহুল্য বইটি ইতিমধ্যে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কর্মী সিলেবাসভুক্ত হয়েছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

বহুদিন যাবৎ বইটি বাজারে অপ্রাপ্য থাকায় আমরা বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। আল্লাহপাক মরহূম মাওলানাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের এই ক্ষুদ্র খিদমতটুকু কবুল করুন- আমীন!!

কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ।

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على رسوله الكريم، وعلى آله وصحبه أجمعين ومن تبعهم بإحسان إلي يوم الدين، أما بعد :

আক্বীদায়ে মোহাম্মাদী বা মাযহাবে আহলেহাদীছ
আক্বীদা বিষয়ে :

মোহাম্মাদী বা আহলেহাদীছগণের আক্বীদা বা ধর্মবিশ্বাস হইল ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই কালেমায়ে শাহাদাত মানুষ যতক্ষণ না বলিবে, ততক্ষণ সে মুসলমান হইবে না। পবিত্রতাময় আল্লাহ স্বীয় যাত ও ছেফাতে একেবারেই একক ও অতুলনীয়। তিনি চিরদিন আছেন ও থাকিবেন। তিনি সকলেরই স্রষ্টা, প্রভু, প্রতিপালক ও রুযীদাতা। তিনি সপ্ত আকাশের উপরে স্বীয় আরশের উপর সমাসীন। পবিত্র কুরআনে ও ছহীহ হাদীছে যেখানে যেভাবে তাঁহার ছেফাত বা গুণাবলী বর্ণিত হইয়াছে, তাহা ক্ষুণ্ণ অথবা রঞ্জিত না করিয়া, ঠিক সেই ভাবেই তাহার উপর আহলেহাদীছগণ ঈমান রাখেন। আর্থিক এবাদত হউক বা শারীরিক, মৌখিক হউক বা মানসিক, সকল প্রকারের এবাদত সেই পবিত্র একক যাত পাকের জন্যই হওয়া উচিৎ। সেই আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদত করিলে বা অন্যের মধ্যে এলাহী ছেফাত স্বীকার করিলে মোশরেক হইতে হয়, আর মোশরেক চির জাহান্নামী। আল্লাহ পাকের পবিত্র কুরআন গায়ের মাখলূক- ‘সৃষ্ট নহে’ যাহা তিনি বিশ্বস্ত ফেরেশতা হযরত জিবরাঈলের মধ্যবর্তিতায় শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করিয়াছেন। তিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও সত্য রাসূল। তিনি জিন ও ইনসান সকলের জন্য রাসূল হইয়া আসিয়াছেন। উক্ত রেসালাত বা নবুঅত আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) হইতে শুরু হইয়া মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর উপর সমাপ্ত হইয়াছে। হযরতের পরে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন পয়গম্বর বা নবী হইবেন না। হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষ পয়গম্বর বলিয়া স্বীকার না করিয়া, তাঁহার পরে অন্য কাহাকেও নবী বলিয়া স্বীকার করিলে কাফের হইতে হয়, আহলেহাদীছগণ ইহা দৃঢ়তার সহিত বিশ্বাস করেন। হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) সমগ্র আদম সন্তান হইতে উত্তম এবং সমস্ত পয়গম্বর হইতে শ্রেষ্ঠ ও তাঁহাদের সরদার। তাঁহার শাফা‘আত সত্য। শেষ বিচারের দিনে সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ শাফা‘আত তাঁহারই হইবে। তাঁহার সম্বন্ধে কোন প্রকার বে-আদবী, অসভ্যাচরণ, কটুক্তি, গালি-গালাজ ও লা‘ন-তা‘ন করিলে ধর্মদ্রোহী বা কাফের হইতে হয়, ইহাও তাহারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। কোন মানুষ বা উম্মতের কোন ব্যক্তি যতই আবেদ, যতই সাধক, যতই সংসার বিরাগী আর যত বড়ই আলেম বা ফকীহ হউন না কেন, নবুঅত বা পয়গম্বরীর মর্যাদা পাইতে পারেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত মানব অন্তরে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি জগতের সমস্ত বস্ত্তর মহববত হইতে রাসূল (ছাঃ)-এর মহববত অধিক পরিমাণে না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সে প্রকৃত ঈমানদার হইতে পারে না। রাসূলে আক্বদাস (ছাঃ)-কে শুধু মহাগুরু বা পরম শ্রদ্ধেয় বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাতুল্য ভক্তি-শ্রদ্ধা করিলেই যথেষ্ট হইল, ইহা তাহারা কদাচ স্বীকার করেন না। তাঁহার মু‘জেযা স্বরূপ চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়া, পর্বতমালা, বৃক্ষরাজি, বন্য জন্তু ইত্যাদি কর্তৃক তাঁহার নবুঅতের সাক্ষ্যদান করা, সমস্তই বরহক। রাসূলে আক্বদাস (ছাঃ)-কে আল্লাহ একই রাত্রিতে সশরীরে জাগ্রতাবস্থায় পবিত্র মক্কা হইতে বায়তুল মুকাদ্দাস, অতঃপর তথা হইতে সপ্ত আকাশ পরিভ্রমণ অন্তে সেই রাত্রিতেই মক্কায় স্বীয় অবস্থান স্থলে পৌঁছাইয়াছিলেন, এ বিশ্বাস তাহাদের রহিয়াছে। রাসূল (ছাঃ)-এর উপর অধিক হারে দরূদ পাঠ করা উচিৎ। যে ব্যক্তি তাঁহার পবিত্র নাম উচ্চারণ করিয়া বা শুনিয়া দরূদ পড়ে না, সে হতভাগ্য বখিল। হাশরের ময়দানে রাসূল (ছাঃ) সর্বাগ্রে উঠিবেন এবং সকলের পূর্বে তাঁহার জন্যই বেহেশতের দ্বার উন্মুক্ত করা হইবে। মহা সম্মানিত ‘হাউয কাওছার’ তাঁহাকেই দেওয়া হইবে। তাঁহার আদেশ ও আচরণ তাঁহার উম্মতের জন্য একান্তই পালনীয়। আল্লাহর পক্ষ হইতে অহী না আসা পর্যন্ত রাসূল (ছাঃ) শরী‘আতের কোন আদেশ প্রদান করিতেন না। তিনি শারঈ ভুল-ভ্রান্তি হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং সকল পাপ হইতে নিষ্কলঙ্ক ছিলেন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে অমান্য বা অস্বীকার করিলে কাফের হইতে হয়।

শরী‘আতে সন্দেহহীন ও অকাট্য দলীল কেবল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। শ্রদ্ধেয় ইমাম ও ফকীহগণ ও মহাপ্রাণ মোহাদ্দিছগণের প্রত্যেক আদেশ ও অভিমত, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুকূলে হইলে তাহা অবশ্যই গ্রহণীয় ও পালনীয়, অন্যথায় নহে। সকল পয়গম্বর (আঃ) ও তাঁহাদের মু‘জেযা ও কেতাব সমস্তই বরহক। পয়গম্বরগণের দেহ মোবারক মাটিতে খায় না, পূর্বাপর সমভাবেই রহিয়া যায়। বেহেশত, দোযখ, আযাব, ছওয়াব, লওহে-মাহফূয, কলম, কেয়ামত, ছূর, মীযান, নামায়ে আমল, ফেরেশতা, হূর ও গেলমান ইত্যাদি সমস্তই বরহক। আহলে বায়েত বা হযরতের পরিবারবর্গের ও ছাহাবায়ে কেরামের প্রতি মহববত ঈমানেরই অন্তর্ভুক্ত। ইহাদের প্রতি বিদ্বেষ ভাব, বিশেষতঃ খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রতি বিদ্বেষ বা হিংসা পোষণ করা কুফরীর লক্ষণ। শ্রদ্ধেয় আউলিয়াগণের কারামত বরহক এবং তাহাদিগকে যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা একান্ত কর্তব্য। কিন্তু তাঁহাদিগকে অভাব মোচনকারী, বিপদহন্তা, রোগ আরোগ্যদাতা, দুঃখ-দৈন্য নিবারণকারী ইত্যাদি বলিয়া আহলেহাদীছগণ কদাচ মনে করেন না বা তাহাদিগকে এমন গুণে গুণান্বিতও করেন না, যে গুণ বা যে ছেফত তাঁহারা আল্লাহর প্রতি আরোপ করিয়া থাকেন। তাহাদের উদ্দেশ্যে এমন কোন এবাদতও করেন না, যাহা তাহারা আল্লাহর জন্য করিয়া থাকেন। উহা শারীরিক, আর্থিক অথবা বাচনিক যাহাই হউক না কেন।

মহামতি ইমাম, ফকীহ ও মহাপ্রাণ মোহাদ্দেছগণের প্রতি হীনতা আরোপ ও হিংসা পোষণ এবং প্রলাপোক্তি কদাচ কোন মুসলিমের জন্য শোভনীয় নহে। বিশেষতঃ সর্বজনমান্য পরম ভক্তিভাজন ইমাম চতুষ্টয়ের প্রতি শত্রুতা পোষণ, ঘৃণার সহিত তাঁহাদের নাম উচ্চারণ ইত্যাদি নিতান্ত মূর্খতা ও চরম অভদ্রতা বলিয়াই তাঁহারা মনে করেন। আহলেহাদীছগণ ইহাদিগকে ও অন্যান্য বোযর্গদিগকেও অন্তরের সহিত চিরদিন সম্মান প্রদর্শন ও আন্তরিক শ্রদ্ধা-ভক্তি করিয়া থাকেন। শরী‘আতের যে সমস্ত বিষয় আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ হইতে অর্থাৎ কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী তাঁহাদের নিকট পৌঁছিয়াছে, তাহা তাঁহারা সাদরে গ্রহণপূর্বক সনিষ্ঠ পালন করিয়া থাকেন। তবে যাহার যে কথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিপরীত দৃষ্ট হয়, কেবল সেই কথাটি তাঁহারা স্বীকার করিতে বা মানিয়া লইতে রাযী নহেন। কোন একজন ইমামের শরী‘আত সংক্রান্ত আদেশ কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিপরীত হইলেও নতশিরে মানিয়া লইতে হইবে, এমন আকীদা তাঁহারা কদাচ পোষণ করেন না। বরং এরূপ তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণকে তাঁহারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিপরীত বলিয়া মনে করিয়া থাকেন। দুনিয়ার মধ্যে এমন কোন মহাজ্ঞানী জন্মগ্রহণ করেন নাই বা করিবেনও না, যাঁহার প্রত্যেকটি কথা নিঃসন্দেহে নিঃসংকোচে বিনা দ্বিধায় ফরয বা ওয়াজেব বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে, একমাত্র সরওয়ারে কায়েনাত হযরত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত। কেবলমাত্র তাঁহারই পবিত্র আমল অভ্রান্ত, যাহা নিঃসন্দেহে অনুসরণ ও অনুকরণ পূর্বক মানুষ নাজাতের পথ মুক্ত করিতে পারে- আহলেহাদীছগণ এরূপ সুদৃঢ় ‘আকীদা’ পোষণ করিয়া থাকেন। প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত এমন কেহই নাই, শরী‘আত সম্বন্ধে যাঁহার ভুল-ভ্রান্তি হয় নাই বা হইতে পারে না। মুহাম্মাদীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর মাতৃভূমি পবিত্র মক্কা ও কর্মভূমি পবিত্র মদীনাকে ‘হারাম’ বলিয়া মনে করেন। তাঁহারা খেলাফতকে[1] তাঁহার বংশেই সীমাবদ্ধ মনে করেন।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পর সমগ্র উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম মানুষ প্রথম খলীফা হযরত আবুবকর (রাঃ), তাঁহার পরে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারূক (রাঃ), তৎপর তৃতীয় খলীফা যুননূরায়েন- হযরত ওছমান (রাঃ), অতঃপর চতুর্থ খলীফা ‘আল্লাহর সিংহ’ হযরত আলী (রাঃ), আহলেহাদীছগণ ইহা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। আহলে বায়তের শত্রুদিগকে তাঁহারা আল্লাহর শত্রু মনে করেন। ইমাম মাহদী (আঃ)-এর ইমামত তাহারা বরহক মনে করেন। হযরত ঈসা (আঃ)-কে জীবিত আসমানে উঠানো হইয়াছে এবং অদ্যাবধি জীবিত অবস্থায় আছেন বলিয়া তাহারা বিশ্বাস করেন। তিনি কেয়ামতের প্রাক্কালে আসমান হইতে অবতরণ পূর্বক দাজ্জালকে হত্যা করিয়া দুনিয়াতে ইসলাম বিস্তার করিবেন এবং প্রিয় হযরতের সুন্নতের উপর সভক্তি আমল করিতে থাকিবেন এবং যথা সময় মৃত্যুর কবলে পড়িয়া এন্তেকাল ফরমাইবেন, এ বিশ্বাস তাহাদের আছে। মোতা‘কে তাঁহারা যেনার ন্যায় সকল অবস্থায় হারাম মনে করিয়া থাকেন। মোওয়াহহেদ ও সুন্নত অনুসারী মুসলমানগণ কবীরা গোনাহ বশতঃ চিরদিন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করিবেন না, বরং রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত ক্রমে কোন না কোন দিন মুক্ত হইয়া বেহেশতে অবশ্যই যাইবেন। মোশরেক ও কাফেরের উপর যে বেহেশত হারাম, এ বিশ্বাস তাঁহারা রাখেন। কবর যেয়ারত করা, মৃত ব্যক্তিদের জন্য দো‘আ করা এবং তাহাদের কথা স্মরণ করিয়া নিজেদের মরণ ও পরিণামকে স্মরণ করা, তাহারা সুন্নত বলিয়া জানেন। তবে কবরের উপর সেজদা করা, কবরস্থ ব্যক্তির নিকটে মনোবাঞ্ছা পূরণার্থে কামনা করা, মানত করা, নযর চড়ানো ও তাওয়াফ করা ইত্যাদি সমস্তই এবাদতের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া তাহারা এই সবকে ‘শিরক’ বলিয়া মনে করেন; উক্ত কবরস্থ ব্যক্তি পীর, পয়গম্বর, শহীদ যিনিই হউন না কেন। উপরোক্ত এবাদতগুলি অথবা অন্য যে কোন এবাদত, যাহা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট, তাহা অন্যের জন্য করাকে তাঁহারা শিরক বলিয়া জানেন। ছদকা-খয়রাত অথবা অন্য কোন পুণ্যের কাজ মৃত ব্যক্তির নামে করিলে তিনি তাহা প্রাপ্ত হন, তবে সেই পুণ্যের কাজগুলি সুন্নত অনুযায়ী হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। রাসূল (ছাঃ)-এর গুণাবলী ও আওছাফে হামীদাহ জনসমাজে বর্ণনা করা মহাপুণ্যের কাজ সন্দেহ নাই। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং উহার নিয়ম-পদ্ধতি যেভাবে শিখাইয়াছেন, ঠিক সেই ভাবেই হওয়া উচিৎ। শরী‘আতের কোন মাসআলা কুরআন বা হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত না হইয়া থাকিলে এজমায়ে ছাহাবার অনুসরণ করা উচিৎ এবং ইহাতে মীমাংসিত না হইয়া থাকিলে যেকোন মোহাদ্দেছ, ফকীহ বা ইমামের সুচিন্তিত অভিমতের উপর তাঁহারা আমল করিয়া থাকেন। কিন্তু সকল ব্যাপারে কেবলমাত্র একজন মোহাদ্দেছ বা মোজতাহেদ বা ইমামেরই অনুসরণ করিতে হইবে, এমন আকীদা তাঁহারা কদাচ পোষণ করেন না। বরং যে মোহাদ্দেছ বা মোজতাহেদ বা ইমামের কথা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অধিকতর নিকটবর্তী, তাঁহার কথার উপরেই তাহারা আমল করেন। আবার উক্ত মাসআলা কুরআন বা হাদীছ হইতে যখনই পাওয়া যায়, তখনই তাহারা উক্ত ইমামের কথা পরিহার করেন। কুরআন বা হাদীছ মওজুদ থাকিতে কোন রায় বা কেয়াসের উপর আমল করা অথবা কুরআন ও হাদীছের খেলাফ কোন মাসআলার উপর আঁকড়ে থাকা তাহারা অন্যায় বলিয়া মনে করেন। তাহারা নিজেদের রায় বা কেয়াসের উপর আমল করার চাইতে সালাফে ছালেহীনের অনুসরণ করাই উত্তম মনে করেন।

যে সমস্ত কেতাবে বিনা সনদে বা প্রমাণহীন অবস্থায় শরী‘আতের কথা বর্ণিত হইয়াছে, ইহা তাহারা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। তাহারা শুধু ছেহাহ সেত্তার হাদীছগুলিই আমলের যোগ্য মনে করেন না বরং ঐ সমস্ত হাদীছগুলিকেও আমলের যোগ্য মনে করেন, যাহা মোহাদ্দেছগণের নিকটে ‘ছহীহ’ বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। আকীদা, কওল ও ফে‘ল-এর সমষ্টিকে তাহারা ‘ঈমান’ বলিয়া থাকেন। তাহাদের মতে ঈমান কম ও বেশী হইতে পারে। তাহারা সঊদী আরবের শায়খ মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব নাজদী ছাহেবের কদাচ মোক্বাল্লেদ নহেন। এমনিভাবে দিল্লীর মিয়াঁ ছাহেব বা ভূপালের নওয়াব ছাহেব অথবা অন্য কোন জীবিত বা মৃত বিদ্বানের তাহারা কদাচ মোক্বাল্লেদ নহেন। তাহারা মদীনা শরীফের যেয়ারত করিয়া থাকেন এবং মসজিদে নববীর এক রাক‘আত ছালাতকে অন্য স্থানের হাযার রাক‘আত ছালাতের তুল্য মনে করিয়া থাকেন। তাহারা প্রত্যেক সৎ-অসৎ মুসলমানের পশ্চাতে ছালাত আদায় করা এবং তাহাদের জানাযায় যোগদান করা জায়েয মনে করেন।

ইসলামের আরকান পাঁচটি- আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের প্রতি ঈমান আনা, দিবারাত্রি পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা, রামাযান মাসের ছিয়াম রাখা, মাল থাকিলে যথারীতি যাকাত আদায় করা, সামর্থ্য থাকিলে জীবনে একবার হজ্জ করা। তাহাদের মাযহাব ইসলাম, তাহারা মুসলিম বা মুসলমান। জগতের কোন মানুষের দিকে তাহারা মনসূব না হইয়া সরওয়ারে দোজাহান হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ছাঃ)-এর দিকে মনসূব হইয়া নিজদিগকে ‘মুহাম্মাদী’ বলিয়া থাকেন। কাহারো কাজের বা মতের পয়রবী বা অনুসরণের দিক দিয়া যেহেতু তাহারা কেবল কুরআন ও হাদীছকেই নিঃসন্দেহে অনুসরণের যোগ্য মনে করিয়া থাকেন এবং কুরআনকেও যেহেতু কুরআনের বহু স্থানে ‘হাদীছ’ বলা হইয়াছে, সে কারণ তাহারা নিজদিগকে আহলেহাদীছও বলিয়া থাকেন, ইহাই হইতেছে তাহাদের আকীদাগত সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

[1]. এর দ্বারা খিলাফতে রাশেদাহ-ক ে বুঝানো হয়েছে। -প্রকাশক।

উপক্রমণিকা
কথিত আছে, ‘কাজীর গরু তাঁর পুঁথিতে, গোয়ালে নহে’। আমাদের অবস্থাও যেন সেইরূপ মনে হয়। আমাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন ও হাদীছ দেখিলে মনে হয় বিশ্বের মুসলমান সমষ্টিগত ভাবে মাত্র একটি দল। বলিতে কি, খায়রুল কুরূনের সেই সনাতন যুগে ছিল ঠিক তাই। তৎপর আমাদের শ্রদ্ধেয় মনীষীগণের মধ্যে আক্বীদায় বা ধর্ম বিশ্বাসে মতভেদ হইতে থাকায় প্রথমতঃ আমরা দেখিতে পাই, মুসলমানগণ মোটামুটি দশ ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়ে। যথা: আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত, খারেজী, শী‘আহ, মো‘তাযেলা, মুরজিয়াহ, মোশাবেবহা, জাহমিয়া, যেরারীয়াহ, নাজ্জারীয়াহ, কেলাবীয়াহ। প্রথম দল ব্যতীত অবশিষ্ট দলগুলি প্রায় প্রত্যেকেই বহুবিধ দলে বিভক্ত হয়। খারেজী পনর ভাগে, শী‘আহ তিন ভাগে, রাফেযী চৌদ্দ ভাগে,[1] মুরজিয়াহ বারো ভাগে, মোশাবেবহা তিন ভাগে ইত্যাদি। উপরোক্ত বর্ণনায় মনে হয় মুসলমানগণ যেন চিরদিনই বিভাগপ্রিয়! সেই জন্যই তো আল্লাহ স্বীয় পবিত্র কুরআনে বজ্রনিনাদে ‘ওয়ালা তাফাররাকু’- ‘তোমরা দলে দলে বিভক্ত হইওনা’ বাক্যের দ্বারা আমাদের এই আচরণের ঘোর প্রতিবাদ করিয়াছেন। এখন বর্ণিত প্রথম দল আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আতের কথা। ইহারাই নাজী ফেরকা নামে পরিচিত। আমাদের প্রিয় নবী (ছাঃ) ইহাদিগের পথকেই ‘মা আনা আলাইহে ওয়া আছহাবী’ এই আখ্যায় আখ্যায়িত করিয়াছেন। ইহাদের মাত্র একটি দল। ইহাদিগকেই ইসলামের স্বর্ণযুগে ‘আছহাবুল হাদীছ’ বা ‘আহলেহাদীছ’ বলিয়া সম্মানিত করা হইয়াছে। অবশিষ্ট নয়টি দল প্রিয় হযরতের (ছাঃ) উক্তি মতে ৭২ ফেরকার অন্তর্গত। এহেন সত্য সনাতন আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত দল কালের কুটিল চক্রে অক্ষত দেহে থাকিতে পারিল না। কালে কালে তাহাতেও ভাঙ্গন ধরিল। উক্ত সুন্নী দলের মহামান্য ইমাম ও ফকীহগণের আক্বীদা ও ধর্মবিশ্বাস প্রায় অভিন্ন হইলেও শাখায়-প্রশাখায় আসিয়া সামান্য সামান্য বিষয় লইয়া তাহাদের মধ্যে মতভেদ হইতে থাকায় ও তাহাদের সেই সুচিন্তিত অভিমতগুলি লিখিতভাবে প্রকাশ পাওয়ায়, জনসাধারণ যে যাঁহার নিকটের ও যাঁহার ভক্ত, তাঁহার প্রাধান্য ও মর্যাদা রক্ষার্থে তাঁহার দিকে সভক্তি নিজকে সম্বন্ধ করতঃ সমাজে নূতন ভাবে নিজ পরিচয় প্রদান করিল। যেমন শ্রদ্ধেয় বড় ইমাম হযরত আবু হানীফা (রঃ)-এর একজন প্রিয় শিষ্য ও একান্ত অনুরক্ত স্বীয় মোর্শেদ বা ওস্তাদের সুচিন্তিত অভিমতগুলি অতি ভক্তি বশতঃ অভ্রান্ত মনে করিয়া সাদরে গ্রহণ পূর্বক সমাজে সগর্বে প্রকাশ করিলেন যে, আমি ‘হানাফী’। অতঃপর নিজ দলের পুষ্টি সাধনে তিনি তৎপর হইলেন। আর একজন ঐরূপে একজন বিশিষ্ট ইমামের ভক্ত ও অনুরক্ত হইয়া নিজেকে ‘শাফেঈ’ নামে আখ্যায়িত করতঃ তাহার প্রাধান্য রক্ষার্থে আপ্রাণ চেষ্টা তো করিলেনই, উপরন্তু স্বদলের পুষ্টি সাধনে যত্নবান হইলেন। এইরূপে মালেকী ও হাম্বলী সকলেই সকলের ভক্তিভাজন ইমাম লইয়া যেমন তুষ্ট, তেমনি তাহাদের প্রাধান্য ও গৌরব রক্ষার জন্য ও তাহাদের দলের পুষ্টি সাধনে সততই ব্যতিব্যস্ত রহিলেন। কেহ কাহারো ইমামের যেমন ধার ধারিল না, তেমনি কোন দলের পরোয়াও করিল না।

এক্ষণে ইহারা সেই আদি আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত তথা আহলেহাদীছ দল হইতে ক্রমাগত বহির্গত হইয়া আসিতে থাকায়, উক্ত আদি দলটি যেমন সংখ্যা লঘিষ্ঠ ও দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিল, এই নবগঠিত দলগুলিও তেমনি শনৈঃ শনৈঃ পরিপুষ্ট হইতে লাগিল। এই নবগঠিত দলগুলির কোন কোন কার্যে তাহাদের সহানুভূতি না থাকায় বরং বিরোধিতা করায় বিশেষ করিয়া এই নব দলগুলির কোন দলে যোগদান না করায়, শুধু যে ইহাদের বিরাগভাজন হইলেন তাহা নহে, বরং ইহাদের পক্ষ হইতে অন্যায় ও অসংগত ভাবে ‘লা-মাযহাবী’ উপাধিও লাভ করিলেন। তাই দুনিয়ার লোক বিচার-বিবেচনা না করিয়া উক্ত গরিষ্ঠ দলগুলির সুরে সুর মিলাইয়া আদি আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত তথা আছহাবুল হাদীছ বা আহলেহাদীছ দলটিকে গায়ের জোরে অন্যায় ভাবে ‘লা-মাযহাবী’ বলিয়া ফেলিলেন ও আজ পর্যন্ত বলিয়া চলিয়াছেন।

প্রিয় বিচক্ষণ পাঠক! আমরা কিন্তু স্পষ্টই উপরে দেখিয়া আসিয়াছি যে, উক্ত আছহাবুল হাদীছ দল হইতেই এই নবগঠিত দলগুলি বাহির হইয়া আসার দরুন, উহা ক্ষুদ্র ও লঘিষ্ঠ হইয়া পড়িলেও কদাচ লা-মাযহাবী নহেন। বরং উহারাই হইতেছেন খাঁটি, আদি, অখন্ড ও অবিভক্ত আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত বা ‘আহলেহাদীছ’ দল। অতঃপর উপরোক্ত দল চতুষ্টয় যখন নিজ নিজ অনুসরণীয় ইমামগণের দিকে সম্বন্ধ করিয়া নিজদিগকে নূতন ভাবে হানাফী, শাফেঈ ইত্যাদি নামে অভিহিত করিতে লাগিলেন, নিরূপায় হইয়া উক্ত আদি ও লঘিষ্ঠ দলটিও আবশ্যক বোধে নিজেদের অতি গৌরবের পরম মোক্তাদা সরওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (ছাঃ)-এর দিকে সভক্তি সম্বন্ধ করতঃ নিজদিগকে ‘মুহাম্মাদী’ বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে বাধ্য হইলেন। তাহারা একমাত্র কুরআন ও হাদীছের অনুসারী হিসাবে যেমন পূর্বেও আছহাবুল হাদীছ বা আহলেহাদীছ- এই গৌরবান্বিত নামে অভিহিত ছিলেন, আজও সেই গৌরব রক্ষার্থে নানা লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্য দিয়াও নিজদিগকে ‘আহলেহাদীছ’ বলিয়া পরিচয় দিয়া আসিতেছেন।

এক্ষণে আমি ইহাদের আক্বীদা বা ধর্ম বিশ্বাস যে কি, তাহার সঠিক পরিচয় দিবার মানসে ‘মাযহাবে আহলেহাদীছ’ নামে এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাখানা আমার সহৃদয় পাঠক-পাঠিকার খেদমতে উপহার প্রদান করিতেছি। ইহা পাঠে তাহারা দেখিবেন যে, ইহাদের আক্বীদা আর অধুনা আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আতের দাবীদার উপরোক্ত নবদল চতুষ্টয়ের আক্বীদা প্রায় অভিন্ন। আর ইহারা হইতেছেন সত্যসত্যই সেই কুরূনে ছালাছার অখন্ড ও অবিভক্ত আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত আছহাবুল হাদীছ দল এবং প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের একান্ত অনুরক্ত মুসলমান। উপরোক্ত দল চতুষ্টয় এই অখন্ড দল হইতেই বহির্গত হইয়া, নূতন নামে পরিচিত হইয়াছেন ভিন্ন অন্য কিছুই নহেন।

অতঃপর যে সমস্ত মহাপ্রাণ মহাজনগণের অনুপ্রেরণায় এই পুস্তিকা প্রকাশে সামর্থ্য লাভ করিয়াছি, তাহাদের প্রতি আমার হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশের শ্রদ্ধাপূর্ণ অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি। এক্ষণে নগণ্য লেখকের এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাখানি বাংলাভাষী মুসলমানের ঘরে ঘরে প্রিয় ভাই-বোনের হস্তে দেখিতে পাইলে এবং ইহা পাঠে তাহাদের ভ্রান্ত ধারণার নিরসন হইলে, আমার সকল শ্রম সফল হইল মনে করিব।

হে আল্লাহ[2]! অযোগ্যের এই অকিঞ্চিৎকর খেদমতটুকু গ্রহণপূর্বক তাহার ও তদীয় পরলোকগত পিতা-মাতার নাজাতের পথ মুক্ত করুন- আমীন! বিনীত গ্রন্থকার

[1]. রাফেযীরাও মূলতঃ শী‘আ দলভুক্ত। -প্রকাশক

[2]. মাননীয় লেখক সে যুগের প্রচলন অনুযায়ী অনেক স্থানে ‘খোদা’ ও ‘নামায’ লিখেছেন। আমরা তার বদলে ‘আল্লাহ’ ও ‘ছালাত’ লিখলাম। -প্রকাশক।

তুলনামূলক আলোচনা
আসুন পাঠক! আমরা এইবার মুহাম্মাদী বা আহলেহাদীছগণের উপরোক্ত আকীদা সমূহ লইয়া আমাদের আকীদার সহিত তুলনামূলক বিচার করিয়া দেখি। যদি তাহাদের ও আমাদের আকীদা একই হয়, তবে বাস্তবিকই গায়ের জোরে তাহাদিগকে আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত হইতে বিতাড়িত করা অথবা মুখের বলে নির্মমভাবে তাহাদের প্রতি নানাবিধ অশ্রাব্য কটুক্তি প্রয়োগ করা অথবা লেখনীর সাহায্যে নিছক অমূলক যা-তা লিখিয়া সমাজে প্রচার করতঃ তাহাদের প্রতি জনসাধারণের মনে একটা ঘৃণার ভাব আনয়ন করা, কদাচ বিচার সম্মত হইবে না। আর যদি আমাদের ও তাহাদের আকীদা সর্বতোভাবে এক না হইয়া দুই একটা বিষয়ের মধ্যে দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়, তাহা হইলেও আমরা তাহাদিগকে আমাদের দল হইতে ন্যায়তঃ বাহির করিয়া দিতে পারি না। যেহেতু আমাদের এই দল চতুষ্টয়ের মনীষীগণের মধ্যেও বহুবিধ বিষয়ে বহু মতভেদ স্বচক্ষে দেখিয়াও আমরা সকলকে সমভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়া আসিতেছি। কাহাকেও আমরা স্বদল হইতে বিতাড়িত করিতেছি না। কাজেই তাঁহাদিগকেও আমরা ন্যায়তঃ কোন প্রকারে আমাদের এই স্বেচ্ছাকৃত নব রচিত ও নব কথিত মনগড়া আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত হইতে কদাচ বিতাড়িত করিতে পারি না। ইহা ব্যতীত উক্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ দল হইতেই যখন সত্যসত্যই আমাদের উৎপত্তি এবং বলিতে কি আমাদের শ্রদ্ধেয় মোক্তাদা বা ইমামগণ ও তাঁহাদের পূর্বপুরুষগণ সকলেই যখন ঐ ক্ষুদ্র ও লঘিষ্ঠ দলেরই অন্তর্ভুক্ত, তখন তাহাদের প্রতি কোন প্রকারের অভদ্রতা, অনাচার বা অবিচার আমাদের পক্ষে কদাচ সঙ্গত বা বৈধ হইতে পারে না। বিশেষতঃ এই বিংশ শতাব্দীর যুগে, যে যুগে প্রত্যেক জাতি অন্য জাতিকে কলাকৌশলে ও নানাবিধ প্রলোভনে স্বদলে আনয়ন পূর্বক স্বীয় গৌরব ও স্বদলের পুষ্টিসাধনে আদাজল খাইয়া লাগিয়া গিয়াছে। যে যুগে আদম শুমারীর গুরুত্বের উপর জাতির গুরুত্ব নির্ভর করিতেছে, যে যুগে সংখ্যালঘুর স্থান সোনার বাংলার বুকে হইবে কিনা, মাতা-ভগিনীর ইযযৎ-আবরু রক্ষা করতঃ স্বাধীনভাবে স্বীয় ঈমান-আমান ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করিয়া চলা সম্ভবপর হইবে কি-না সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ, সেই যুগে আমরা সত্যসত্যই সেই আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত দলভুক্ত, পবিত্র কুরআন ও হাদীছের প্রকৃত বাহক, আল্লাহ ও রাসূলের একান্ত অনুগত একটি মুসলিম দলকে আমাদের দল হইতে বিতাড়িত করিবার জন্য সততই ব্যতিব্যস্ত। ইহা হইতে জাতির জন্য বড় অভিশাপ আর কি হইতে পারে?

প্রিয় পাঠক! এতক্ষণ আমরা মোহাম্মাদীগণের আকীদা বা ধর্ম বিশ্বাস কিরূপ তাহারই পরিচয় দিয়াছি। উহা পাঠে আমরা বিশেষভাবে জ্ঞাত হইয়াছি যে, আহলেহাদীছগণ সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র দল হইলেও আকীদাগতভাবে তাহারা সত্য সত্যই প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কথিত সেই নাজী ফেরকা আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত দল ব্যতীত আর কিছুই নহে।

আমল বিষয়ে
এখন আমি আহলেহাদীছগণের ‘আমালিয়াত’ অর্থাৎ ব্যবহারগত কার্যকলাপ সম্বন্ধেও সংক্ষেপে কিছু পরিচয় দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হইবে না মনে করিয়া ছালাত সংক্রান্ত দুই চারিটি মাসআলার পরিচয় দিয়া এই অধ্যায়ের উপসংহার করিব বলিয়া স্থির করিয়াছি। যেহেতু ছালাতই মুসলমানের নাজাতের পথ মুক্ত করিতে পারে। আর আমাদের অন্তরের গুপ্ত ও দুষিত মনোভাবটা প্রায়ই প্রকাশ পায় এই ছালাত পড়িবার সময়ই। অথচ আমাদের ছালাত আল্লাহর প্রিয় হইতেছে কি-না সে বিচার না করিয়া মোহাম্মাদীগণের ছালাত কেমন হইতেছে না হইতেছে তাহা লইয়াই আমাদের যত মাথা ব্যথা।

আসুন পাঠক! আমরা এ সম্বন্ধে একবার ধীর-স্থিরভাবে আলোচনা করিয়া দেখি। তাহার পূর্বে আমি আপনাদের খেদমতে আমাদের অতীব গৌরব ও অশেষ ভক্তিভাজন ছাহাবীগণের সেই স্বর্ণযুগের একটি সত্য ঘটনা উপহার দিয়াই উক্ত আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি, যাহা দ্বারা মোহাম্মাদীগণের ছালাতের সনাতন পদ্ধতি জনসাধারণের মধ্যে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হইয়া উঠিবে। ঘটনাটি নিম্নরূপ :

(১) দশ জন ছাহাবায়ে কেরামের একটি পবিত্র মাহফিল, তন্মধ্যের আবু হোমায়েদ সা‘এদী (রাঃ) নামক ছাহাবী বলিতেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত কেমন ছিল তা আপনাদের হইতে আমিই ভাল জানি। ইহা শ্রবণে একজন জালীলুল কদর ছাহাবী বলিয়া উঠিলেন, আপনি এরূপ দাবী করিতে পারেন কেমন করিয়া? অথচ আপনি না আমাদের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করিয়াছেন না আমাদের হইতে অধিক হযরতের সংসর্গ লাভ করিয়াছেন? আচ্ছা বলুনতো! আমাদের প্রিয় হযরত কিভাবে ছালাত পড়াইতেন। এতদশ্রবণে হযরত হোমায়েদ (রাঃ) তখন প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাতের বাস্তব চিত্র দেখাইতে লাগিলেন এবং উক্ত ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) উহা নীরবে ও সাগ্রহে দেখিয়া যাইতে লাগিলেন। চলুন পাঠক! আমরাও উক্ত পবিত্র মাহফিলে যোগদান করতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত ছালাত নীরবে দেখিয়া লই এবং বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়া যাই যে, সেই স্বর্ণযুগের একজন নিষ্কাম সাধক, প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাঠশালার সত্যসেবী ছাত্র, প্রিয় হযরতের শিখানো আল্লাহপ্রিয় ছালাতের কিরূপ চিত্র অংকন করিতেছেন।

ঐ দেখুন পাঠক! হযরত হোমায়েদ (রাঃ) ছালাত শুরু করিবার কালে প্রথম তাকবীর বলিবার সময়, রুকূতে যাইবার সময় ও রুকূ হইতে মাথা উঠাইবার সময় এবং দুই রাক‘আত সমাপ্তির পর তৃতীয় রাক‘আতের জন্য দাঁড়াইবার সময় ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করিতেছেন এবং এক রাক‘আতের পর দ্বিতীয় রাক‘আতের জন্য দাঁড়াইবার পূর্বে স্বল্প সময় বসিয়া লইতেছেন অর্থাৎ জালসায়ে এস্তেরাহাত করিতেছেন এবং শেষ রাক‘আত যাহাতে সালাম ফিরাইতে হয়, নিজের বাম পা ডান পায়ের নিম্ন দিয়া ডান পার্শ্বে বাহির করিয়া দিয়া বাম নিতম্বের উপর সুস্থির ভাবে বসিতেছেন এবং শাহাদাত অঙ্গুলি দিয়া ইশারা করিয়া যাইতেছেন। ইহা দর্শনে বুযর্গ ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) সকলেই হোমায়েদ (রাঃ)-এর প্রদর্শিত ছালাত সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করতঃ বলিতেছেন, ‘ছদাকতা’ আপনি সত্যই বলিয়াছেন। প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সদাসর্বদা এইভাবেই ছালাত আদায় করিতেন।[1]

মোহাম্মাদী আহলেহাদীছগণ ঠিক এইভাবেই চিরদিন নিজেদের ছালাত সম্পন্ন করিয়া আসিতেছেন। যাহা আমরা দেখিলাম। অন্ততঃ দশজন আমাদের প্রিয় হযরতের পাঠশালায় সনাতন শিক্ষার নিষ্কাম ছাত্র বিনা বাক্য ব্যয়ে এবং নিঃসংশয়ে সমর্থন করিতেছেন। এই বর্ণনায় আমরা স্পষ্টই বুঝিলাম যে, মোহাম্মাদীগণ মনগড়া যা-তা একটা পন্থা অবলম্বন পূর্বক তাহাদের ছালাত আদায় করিতেছেন না, বরং হযরত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শিখান সেই স্বর্ণযুগের জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ছাহাবায়ে কেরামের সনাতন পদ্ধতি অবলম্বনে নিজেদের ছালাত সুসম্পন্ন করিয়া আসিতেছেন। যদিও এই বিংশ শতাব্দীতে আমাদের ন্যায় হাদীছ অনভিজ্ঞ দুর্বল ঈমানদার মুসলমানের নিকটে এরূপ ছালাত নিতান্ত অপ্রিয়।

(২) ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) প্রমুখাৎ ছহীহ সনদে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় দক্ষিণ হস্ত বাম হস্তের উপর রাখিয়া বুকের উপর বাঁধিয়া ছালাত পড়িতেন।[2] মোহাম্মাদীগণও প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এই আচরণ সভক্তি বক্ষে ধারণ পূর্বক ঠিক এইরূপেই বুকে হাত বাঁধিয়া ছালাত পড়িয়া থাকেন। (৩) আহমাদ, তিরমিযী প্রভৃতিতে ওবাদা বিন ছামেত (রাঃ) হইতে ‘হাসান’ সনদে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মোক্তাদিগণকে বলিতেছেন যে, ‘তোমরা ইমামের পশ্চাতে সূরায়ে ফাতেহা ব্যতীত আর কিছুই পড়িবে না। কেননা যে ব্যক্তি উহা পড়িবে না, তাহার ছালাত হইবে না’।[3] মোহাম্মাদীগণ অত্র হাদীছ অবলম্বনে ইমামের পশ্চাতে সকল সময় সূরায়ে ফাতেহা পাঠ করিয়া থাকেন।

(৪) বোখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, দারেমী, ইবনে মাজা প্রভৃতিতে হযরত আবু হুরায়রা ও হযরত ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় ছালাতে উচ্চকণ্ঠে ‘আমীন’ বলিতেন এবং স্বীয় ছাহাবীগণকে ‘আমীন’ বলিবার নির্দেশ দিতেন।[4] তাঁহার এই নির্দেশ পালনার্থে ও প্রিয় রাসূল (ছাঃ)-এর আমলের অনুসরণ পূর্বক মোহাম্মাদীগণ কোন দ্বিধা না করিয়া ঠিক ঐরূপ উচ্চকণ্ঠে ‘আমীন’ বলিয়া থাকেন।

(৫) ছহীহ বুখারী সহ ছেহাহ সেত্তার অধিকাংশ গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হইতে ছহীহ সনদে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ছালাত শুরু করিতেন এবং রুকুতে যাইতেন, রুকু হইতে মাথা উঠাইতেন ও তৃতীয় রাক‘আতে উঠিয়া দাঁড়াইতেন, তখন রাফ‘উল ইয়াদায়েন করিতেন।[5] মোহাম্মাদীগণও ঠিক ঐরূপে স্বীয় ছালাতে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করিয়া থাকেন।

প্রিয় পাঠক! আহলেহাদীছগণের ছালাতের মাসআলা কয়টি যাহা বর্ণিত হইল- আসুন উহা লইয়াও আমরা একবার স্থির ভাবে আলোচনা করিয়া দেখি। আমরা দেখিলাম যে, তাহারা ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করেন, বুকের উপর হাত বাঁধেন, ইমামের পশ্চাতে সূরায়ে ফাতেহা পাঠ করিয়া থাকেন। এখন দেখিতে হইবে যে, এইগুলি তাহারা ন্যায় করিতেছেন, না অন্যায়। যদি ন্যায় হয়, তবে তো আমাদের বলিবার কিছুই নাই। আর যদি আমরা উহা করিনা এবং আমাদের চক্ষে ভাল লাগেনা বলিয়াই অন্যায় বলি, তবে আমাদিগকে ঈমান ও জ্ঞানচক্ষু দিয়া দেখিতে হইবে যে, বাস্তবিক উহা অন্যায় কি-না। আমরা দেখিলাম, আমাদের প্রিয় রাসূল (ছাঃ) উপরোক্ত নিয়মেই আমৃত্যু ছালাত পড়িয়া গিয়াছেন এবং স্বীয় ভক্তপ্রাণ ছাহাবীদিগকেও ঠিক ঐরূপে ছালাত পড়িবার অছিয়ত করিয়া গিয়াছেন। যদি তাহাতে আমরা সন্তুষ্ট হইতে না পারি, তবে আমরা ইচ্ছা করিলে দেখিতে পাইব যে, আমাদের মাথার মণি প্রাতঃস্মরণীয় ও স্বনামখ্যাত ইমাম চতুষ্টয়ের মধ্যে অধিকাংশ ইমাম উপরোক্ত নিয়মে ছালাত পড়িয়া গিয়াছেন ও তাঁহাদের অনুসারী ও অনুগামীগণও তাঁহাদের নির্দেশমতে ঠিক ঐভাবেই আজ পর্যন্ত ছালাত পড়িয়া আসিতেছেন। তাহাতেও যদি সন্তুষ্ট হইতে না পারি, তবে আসুন আমাদের হানাফী মাযহাবের সর্বজনমান্য বিশ্বস্ত কেতাবগুলি একবার আলোচনা করিয়া দেখি।

ঐ দেখুন! আমাদের প্রসিদ্ধ কেতাব দোররে মোখতারের ১ম খন্ড ৫৬ পৃষ্ঠায় লিখিত

আছে যে, ‘কোন হানাফী মুছল্লী যদি শাফেঈ মুছল্লীর ন্যায় সশব্দে আমীন বলিয়া, রাফ‘উল ইয়াদায়েন করিয়া ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতেহা পড়িয়া স্বীয় ছালাত সম্পন্ন করেন এবং কোন শাফেঈ মুছল্লী যদি হানাফী মুছল্লীর ন্যায় স্বীয় ছালাত সমাধা করেন, তবে কাহাকেও বাধা দেওয়া যাইবে না। উভয়ের ছালাত শরী‘আত মতে সঙ্গত ও মকবুল হইবে’। প্রিয় পাঠক! বিচার করুন, ছালাতের মধ্যকার উক্ত কার্যগুলি যথা: রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা, সশব্দে আমীন বলা ইত্যাদি যদি অন্যায় ও শরী‘আত বিগর্হিত হইত, তবে উক্ত হানাফী মুছল্লীর ছালাত মকবুল হইল কেমন করিয়া?

অতএব প্রমাণিত হইল যে, উক্ত কার্যগুলি অন্যায় বা দোষের নহে। সুতরাং মোহাম্মাদীরা ঐ কাজগুলি মোটেই অন্যায় করিতেছেন না। আর যদি অন্যায় বলা হয়, তবে আমাদের মাযহাবী দলের অধিকাংশ শ্রদ্ধেয় ইমামকেও ইহার জন্য দোষী হইতে হইবে সর্বাগ্রে (না‘ঊযুবিল্লাহে মিন যালেক)। যেহেতু তাঁহারাও উহা প্রিয় রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নত জ্ঞানে সাদরে গ্রহণ পূর্বক সশ্রদ্ধ আমল করতঃ পুণ্যভাজন তো হইয়াছেনই, উপরন্তু কেয়ামতের দিন ইনশাআল্লাহ প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শুভাশীষ অবশ্যই প্রাপ্ত হইবেন। ইহা ব্যতীত তাপসকুলতিলক হযরত বড়পীর ছাহেব স্বীয় প্রসিদ্ধ ‘গুণিয়াতুত ত্বালেবীন’ গ্রন্থে সশব্দে আমীন, রাফ‘উল ইয়াদায়েন, সূরা ফাতেহা পাঠ ইত্যাদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রিয় সুন্নত বলিয়া সপ্রমাণ করিতেছেন। সুতরাং সর্বতোভাবে প্রমাণিত হইল যে, মোহাম্মাদীগণের ছালাতের মধ্যকার বর্ণিত কার্যগুলি মোটেও দোষের নহে। বরং উহাতে প্রিয় নবী (ছাঃ)-এর প্রিয় সুন্নতগুলি যথাযথভাবে পালিত হয়। এ সম্বন্ধে সবিস্তার সদলীল জানিবার বাসনা থাকিলে মৎপ্রণীত ‘আল-মাসায়েলুল আরবা‘আহ’ নামক পুস্তক খানা পাঠ করিতে অনুরোধ রইল।[6]

প্রিয় পাঠক! যে কার্য ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হইল, শ্রদ্ধেয় ইমামগণ যাহা সমর্থন ও পুণ্যের কার্য বলিয়া সভক্তি আমলও করিলেন, ছূফিয়ানে কেরামের অগ্রণী সর্বশ্রেষ্ঠ তাপস হযরত বড়পীর ছাহেবও যাহা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রিয় সুন্নত বলিয়া সাক্ষ্য দান করিতেছেন, জানিনা কোন বিদ্যাবুদ্ধি ও কোন গুণ-গরিমা লইয়া আমরা সেই কার্যের দোষ অনুসন্ধান করিতে যাই। ইহাতে আমাদেরই অজ্ঞতার ও শরী‘আত অনভিজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া হয় না কি? আর জানি না ইহা লইয়া আমাদের এত মাথাব্যথা, এত মারামারি-কাটাকাটি কেন? ইহাতে তো কাহারো স্বার্থে এতটুকুও ব্যাঘাত ঘটেনা। ইহাতো নিছক আল্লাহর কাজ। আল্লাহ তুষ্ট হইলেই সব মিটিয়া গেল। এখন আল্লাহ তুষ্ট হইবেন কি-না তাহা প্রিয় রাসূল (ছাঃ) ভালই জানিতেন। আর জানিতেন বলিয়াই তো তিনি উপরোক্ত কার্যগুলি নিজে করিয়াছেন এবং স্বীয় ছাহাবীগণকে শিখাইয়া গিয়াছেন। আমরা মাঝখানে অনধিকার চর্চা করিয়া, অপ্রিয় বাক-বিতন্ডা ও আত্মবিরোধের সৃষ্টি করিতে যাই কেন? বাস্তবিক ইহা আমাদের ন্যায় আল্লাহভক্ত সমাজের পক্ষে মোটেও শোভনীয় নহে।

[1]. বুখারী হা/৮২৮; আবুদাঊদ হা/৯৬৩; তিরমিযী হা/৩০৪; ইবনু মাজাহ হা/১০৬১; মিশকাত হা/৭৯২, ৮০১ ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০।

[2]. বুলূগুল মারাম হা/২৭৫; আবুদাঊদ হা/৭৫৫; মুসনাদে আহমাদ হা/১৮৮৮৬; মিশকাত হা/৭৯৭ ইত্যাদি।

[3]. আহমাদ হা/২২৭৯৮; তিরমিযী হা/৩১১; ঐ, মিশকাত হা/৮৫৪ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।

[4]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২৫, তিরমিযী, আবুদাঊদ, দারেমী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৮৪৫ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।

[5]. বুখারী হা/৭৩৯, আবুদাঊদ হা/৭৪১; ঐ, মিশকাত হা/৭৯৪ ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০।

[6]. উক্ত চারটি মাসআলা চারটি বই আকারে পরে প্রকাশিত হয়। যথাক্রমে (১) সূরা ফাতেহা পাঠের সমস্যা সমাধান (১ম প্রকাশ ১৩৬৪ বাং)। (২) সশব্দে আমীন সমস্যা সমাধান (১৩৬৫ বাং)। (৩ ও ৪) রাফ‘উল ইয়াদায়েন ও বুকের উপর হাত সমস্যা সমাধান (১৩৬৯ বাং)। -প্রকাশক।

সারকথা
আসুন পাঠক! আমরা আহলেহাদীছগণের আকীদা ও আমলগুলি, যাহা উপরে বর্ণিত হইয়াছে, সংক্ষেপে পুনরালোচনা করিয়া বিদায় গ্রহণ করি। আহলেহাদীছগণের আকীদা, আমাদের মাযহাবী দল চতুষ্টয়ের আকীদার সহিত মিলাইয়া, সতর্কতার সহিত তুলনা মূলক বিচার করিয়া আমরা প্রায়ই অভিন্ন পাইয়াছি এবং সেই স্বর্ণযুগের আছহাবুল হাদীছ বা আহলেহাদীছ দল হইতেই যে আমাদের এই আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আতের দাবীদার দল চতুষ্টয় উৎপন্ন হইয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে, নিরপেক্ষ বিচারের খাতিরে ইহা আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য হইতেছি এবং জুযয়ী মাসআলাতেও তাহাদের কার্যকলাপ আমরা যেরূপ পাইয়াছি, তাহাও আমরা স্থিরভাবে আলোচনা করিয়া দেখিয়াছি যে, আমাদের মাযহাবী দলের অধিকাংশ শ্রদ্ধেয় ইমাম ও আমাদের হানাফী মাযহাবের অধিকাংশ মনীষীগণ এমন কি ছূফিয়ানে কেরামও তাহা সমর্থন ও সর্বান্তঃকরণে পালন করিয়াছেন। এমতাবস্থায় তাহাদিগকে অন্যায়ভাবে লা-মাযহাবী, ওয়াহহাবী ইত্যাদি বলিয়া বিদ্রুপ করা, তাহাদের প্রতি ঘৃণার ভাব পোষণ করা, তাহাদের ছালাত দেখিয়া নাসিকা কুঞ্চিত করা, তাহাদের পশ্চাতে ছালাত না পড়া, অজ্ঞাতভাবে ছালাতে যোগ দিয়া পরে আহলেহাদীছ ইমাম জানিতে পারিয়া আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করতঃ জামা‘আত পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাওয়া ও ছালাত দোহরাইয়া পড়া, এমন কি নিষ্ঠুরভাবে তাহাদিগকে আল্লাহর ঘর মসজিদ হইতে বিতাড়িত করা ইত্যাদি গর্হিত কার্যগুলি আমাদের ন্যায় আহলে-সুন্নত ওয়াল-জমা‘আতের দাবীদার ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পক্ষে কদাচ শোভনীয় হইবে না।

অতএব আমাদের অন্তর হইতে এই দূষিত ও ঘৃণিত মনোভাব গুলি চিরদিনের জন্য বিদূরিত করতঃ সংখ্যালঘিষ্ঠ দল হইলেও তাহারা সেই স্বর্ণযুগের আদি ও অখন্ড সত্য সনাতন আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত বা আছহাবুল হাদীছ দল বিধায়, তাহাদিগকে সর্বান্তঃকরণে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও তাহারাই আমাদের আদিপুরুষ ও অতি আপনার দরদী জন মনে করিয়া অকৃত্রিম ভালবাসা ও সৌহার্দ্য প্রদান করিলে, সরওয়ারে দোজাহান হযরত মুহাম্মাদ মোছতফা (ছাঃ)-এর চির আশীর্বাদ ভাজন তো হইবই, উপরন্তু এই শতধা বিভক্তির যুগে আল্লাহর নির্দেশ মতে তাহাদিগকে অমিয় ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ করতঃ আমাদের অতীত গৌরব অখন্ড ও অপ্রতিহত মুসলিম বাহিনীর পুনর্গঠন করিলে যে আল্লাহর অফুরন্ত রহমত লাভ করিতে পারিব, ইহাই আমার ব্যথিত প্রাণের করুণ আর্তনাদ ও আকুল আহবান। আর ইহাই আমার সহৃদয় ও দরদী পাঠক-পাঠিকাকে সশ্রদ্ধ উপহার দিয়া আজিকার মত বিদায় গ্রহণ করিলাম। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।

سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لآ إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك، اللهم اغفرلي ولوالدى وللمؤمنين يوم يقوم الحساب -

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন