HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতা

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়

ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতা

লেখক : মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
সনেদহ নেই, ধর্মাচারব্রতী আচরণ ও ধর্মপরায়ণতা মানব গোষ্ঠীর এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস। দুর্বল-সবল, জ্ঞানী-মূর্খ, সংস্কৃতিবান-সংস্কৃতিহীন, সভ্য-অসভ্য,- মোটকথা, সমাজের সকল শ্রেণিই এই একমাত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাসের অধিকারী। মানুষের এ সাধারণ মৌলিক অভ্যাসটি প্রোথিত আছে তার আত্ম-প্রকৃতির গভীরে। তার অনুভূতির ব্যাপক সীমান্ত জুড়ে তা এমন শক্ত মৃত্তিকায় শিকড়ায়িত হয়ে আছে যে, শত চেষ্টা সাধনা ও পরিশ্রম ব্যায় সত্ত্বেও তাকে উপড়ে ফেলা, কিংবা স্মৃতি থেকে আমূল ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব নয় কারো পক্ষে। ধর্মপরায়ণতা ও ধর্মাচারব্রতী আচরণ—আর্নেষ্ট রেনান [ফ্রান্সের গবেষক। ফেব্রুয়ারি ১৮২৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ২ অক্টোবর ১৮৯২। তার রচিত ‘যিশু চরিত’ পৃথিবী ব্যাপী খ্রিস্টজগতে প্রচন্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করে। কারণ, তাতে তিনি যিশু খ্রিস্টকে একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি মর্যাদা দেননি। তার উল্লেখযোগ্য রচনা ‘খ্রিস্ট ধর্মের উৎস ইতিহাস’। যিশু চরিতকে মনে করা হয় এ গ্রন্থেরই প্রথম অংশ। ‘বনী ইসরাঈলের ইতিহাস’-ও তার বিশেষ একটি রচনা। সূত্র―Lexicon Universal Encyclopedia খন্ড―১৬, পৃষ্ঠা―১৫৭৮।]-এর ভাষ্যমতে―মানুষের এমন এক অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য, যাকে মুছে ফেলা যায় না কখনো। মানুষ আত্মা দিয়ে ভালোবাসে এবং তা বজায় থাকে কামনা বেয়ে―এমন অনেক অভ্যাস মুছে ফেলা যাবে সত্য, কিন্তু ধর্ম-প্রীতি থেকে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না কখনো। [সূত্র আব্দুল্লাহ দারায ألدين بحوث ممهدة لدراسة تاريخ الأديان পৃষ্ঠা―৮২৮৩।]

তবে, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ তার গভীরে প্রোথিত এই অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রতিনিয়ত মুখোমুখী হয় কঠিন এক মানসিক পীড়ন ও দ্বন্দ্বের। মানুষের আত্মপ্রকৃতিতে ধর্ম-প্রীতি যখন এমন কঠিন শক্তিশালী স্থানে অবস্থিত, তখন আধুনিক মানসিকতা- সম্পন্ন মানুষ সহজে আবিষ্কার করে যে, পৃথিবীর তাবৎ অকাট ধারণা এর সামনে সর্বার্থে ম্রিয়মাণ, তাতে সম্মতি প্রদান ও মেনে নেয়া হাস্যকর। খ্রিস্টবাদ, ইহুদীবাদ, হিন্দুবাদ এগুলোর কিছুই তার কাছে এই মূলনীতির পৃথক বলে অনুভূত হয় না। খ্রিস্টবাদ তার কাছে অনুভূত হয় কিছু ধাঁধাময় অধ্রুব সত্য হিসেবে। কারণ, তাতে আরোপিত হয়েছে এমন কিছু জটিলতা, চূড়ান্ত মেধাবীও যাকে বিশ্লিষ্ট ও স্বচ্ছতায় তুলে আনতে সক্ষম হন না। ফলশ্রুতিতে তাতে সন্তোষ লাভ সম্ভব হয় না কারো পক্ষেই। ইহুদীবাদ প্রণয়ন করেছে এক অদ্ভুত আইন ; এই ধর্মে স্রষ্টার করুণা, নেয়ামত ও জান্নাত সব কিছুই নির্দিষ্ট বিশেষ এক গোষ্ঠীর জন্য। আর উভয় ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ পুরাতন সুসমাচার বা নতুন সুসমাচার, শাস্ত্রীয় বিচারে দেখা যায় যার বহুলাংশই উদ্ভট ও ভ্রান্তিতে ভরা। [মুসলিম গবেষক ডক্টর মরিস বুকাইলী তার রচনা ‘পবিত্র কুরআন, বাইবেল ও বিজ্ঞান’-এ এ দ্বান্দ্বিকতা অত্যন্ত বিশদভাবে উপস্থাপন করেছেন।] যে ভ্রান্তির সামনে আধুনিক মনোভাবাপন্ন মানুষ নিজেকে অসহায় ও প্রতারিত ভাবতে বাধ্য হন নিদারুণভাবে। তার সামনে তখন খোলা থাকে দুটো পথ―হয়ত খ্রিস্টবাদ ও তার প্রণীত কাল্পনিক সমস্ত পুরাণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তাকে অস্বীকার করতে হয় সূর্যের আলোর মত স্পষ্ট ও প্রামাণ্য সত্যগুলোকে।

সুতরাং, এই সূত্রে তাকে অস্বীকার করে নিতে হয় মাথার উপর সূর্যের জাজ্বল্যমান আলোকিত উপস্থিতি। একজন আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এর তুলনায় অধিক অসহায়ত্ব ও যন্ত্রণার বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। এর ফলে তাকে মুখোমুখী হতে হয় এক তিক্ত মানসিক বিক্ষেপের, অনিঃশেষ মনোজাগতিক পীড়নের, [হল্যান্ডের বংশোদ্ভুত মি. ওয়েজিনরেম―ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর ফায়সাল মুহাম্মাদ নাম গ্রহণ করেন―ইসলামের শীতল ছায়াতলে আসার পর তার কঠিন মানসিক পীড়ন ও কাতরতার বর্ণনা করে বলেন―আমি ইতিপূর্বে ছিলাম এক প্রচন্ড মানসিক পীড়নে আক্রান্ত, এ এমন এক পীড়ন, ইউরোপের যুবসমাজের অধিকাংশ যাতে ভুগে থাকেন। এ মানসিক পীড়নের অভিজ্ঞতা অল্পবিস্তর সকলের রয়েছে। আমি হল্যান্ডের ক্যাথলিক গির্জার সদস্য ছিলাম। আমার এমন পর্যাপ্ত সাহস ছিল না যে, আমি নিজেকে শাব্দিক অর্থে খ্রিস্টান বলে ঘোষণা করব। একদিকে আমাকে আমার আদি ও পৌরাণিক বিশ্বাসগুলো প্রচন্ডভাবে আকর্ষণ করছিল, আর আমার দিকে খ্রিস্টবাদের ধারণাগুলোর টানাপোড়েন ছিল অত্যন্ত কঠিন। একজন খ্রিস্টান হিসাবে আমাকে মানতে হত যে কতগুলো অপবিশ্বাস তা আমাকে আহত করছিল ভীষণভাবে। সূত্র―আরাফাত কামেল ‘ইসলাম গ্রহণকারী কয়েকজন নারী পুরুষ’। ৫ম ভাগ―পৃষ্ঠা―৩৫।] কিংবা তাকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস পোষণ করতে হয় পবিত্র গ্রন্থ ও তাতে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের প্রতি। এভাবে তার মাঝে উদ্ভব ঘটে প্রথমে নাস্তিকতার, যা প্রাথমিকভাবে থাকে অপ্রকাশিত, এবং এক সময় প্রকাশ পায় হিংস্রভাবে।

দ্বিতীয়ত তার কাছে জীবনকে মনে হতে থাকে অর্থহীন, [সূত্র American becoming muslim থেকে প্রকাশিত ভিডিও সিডি।] প্রাপ্তিশূন্য, যার নিরন্তর ঘানি টানার কোন ফলাফল নেই। সবই শূন্য। এখানেও দেখা দেয় সেই একই মানসিক যন্ত্রণা ও পীড়ন। [সূত্র―ওয়াহিদুদ্দীন খান الدين الكامل পৃষ্ঠা―৩২৭, প্রকাশক الرسالة للإعلام الدولي বার্ট্রান্ড রাসেলের আত্মজীবনী থেকে অনুবাদকৃত অংশ, পৃষ্ঠা―৭২৭।] এ স্তরে মানুষ আশ্রয় নেয় বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবিদ্যার, তার বিশ্বাস হয়, একমাত্র এটিই তাকে তৃপ্ত করতে পারবে, প্রশম করতে পারবে তার যন্ত্রণার। কিন্তু বাস্তবতা হল, বিজ্ঞানের মাধ্যমে সে তার ধর্ম-প্রীতিকে যতই দমন করতে চাক, তা বাড়ে বৈ কমে না। [সূত্র আব্দুল্লাহ দারায الدين পৃষ্ঠা―৯৪।] কারণ, মানুষ তার সর্বসত্ত্বা দিয়ে প্রয়াসী বস্ত্তর স্বরূপ ও সারবত্তা উদ্ঘাটনে, বস্ত্তর ব্যবহারিক গুনাগুন নয়, তার কাম্য বস্ত্তর পরম সত্যকে উপলব্ধি করা।

কিন্তু বিজ্ঞান তাকে ব্যবহারিক গুনাগুন বা কাঠামোগত আকৃতি সম্পর্কেই ধারণা দিতে পারে। যে সমস্ত অবোধ্য প্রশ্ন মানুষকে নিয়ত পীড়িত করে চলে, তাহল, পৃথিবীর সৃষ্টি-লীলার আরম্ভ কীভাবে? কী পরিণতির দিকে পৃথিবী সদা ধাবমান, বিজ্ঞান এ সকল প্রশ্নের উত্তর নয়, তাকে জ্ঞাত করে বরং প্রকৃত সত্যে উপনীত করার কিছু মাধ্যম সম্পর্কে। মানুষ তলিয়ে দেখতে আগ্রহী বস্ত্তরাজির প্রকৃতির অনন্ততা, আর বিজ্ঞান তাকে জানায় বস্ত্তর বাহ্যিক সত্য সম্বন্ধে। মানুষের মন যখন প্রাণিত হয় গোলাপের ঘ্রাণের অপূর্বতার উৎস সন্ধানে, তখন বিজ্ঞান তাকে তৃপ্ত করতে পারে না, কারণ বিজ্ঞানের আছে গোলাপের আকৃতি-প্রকৃতি বর্ণনার শক্তি, তবে গোলাপ সুবাসিত হওয়ার পশ্চাৎগত দর্শন কী এ-বিষয়ে জ্ঞান দিতে বিজ্ঞান নিতান্তই অসহায়। মানুষ উদগ্রীব যদিও তার বুদ্ধি-আত্মা-হৃদয় ইত্যাদির সত্য জানতে, কিন্তু বিজ্ঞান তাকে জানায় দৈহিক কাঠামোর খুঁটিনাটি কলাকৌশল। মোটকথা, বিজ্ঞান অথর্ব তাকে মহা সত্যের ধারণা দিতে। মানুষ আগ্রহী স্রষ্টা সম্পর্কে জানতে, বিজ্ঞান অপারগ এখানেও; কেননা তার জ্ঞানের বলয় সৃষ্টিজগতের সীমানা পেরিয়ে স্রষ্টা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে অপ্রস্ত্তত। সৃষ্টিই তার জন্য মূখ্য, মহা-সত্য গৌণ। [সূত্র―ওয়াহিদুদ্দীন খান― الدين الكامل পৃষ্ঠা―৩৩১-৩৩২।]

বিজ্ঞানের ব্যাপারে যখন মানুষ আশাহত হয়ে পড়ে, নিবৃত্ত হয় না তার আত্মিক পিপাসা, তখন তাকে গ্রাস করে নেয় এক অবর্ণনীয় বিপর্যস্ততা, বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তার চিন্তা-কর্ম ও মানসিকতা। সে যাপন করে এক দোদুল্যমান সময়কাল। অবাধ্য হয়ে উঠে সে পূর্বপুরুষের অনুকরণে : কারণ সেটা তার কাছে বিজ্ঞান শাসিত সমাজে এক প্রকার অন্ধতা বলে অনুমিত। এবং বিজ্ঞানের প্রহেলিকায় পড়ে স্পষ্ট ও দিনের আলোর মত স্বচ্ছ অনেক সত্যকে সে অস্বীকারও করতে পারে না। কারণ, এতে তার স্বাভাবিক বুদ্ধি বিদ্রোহ করে। সুতরাং, এমন শোচনীয় অবস্থায় বুদ্ধিকে সে নিয়োজিত করতে চায় পৈতৃক বিশ্বাসের অন্ধ অনুকরণে। কিন্তু এ উভয় অবস্থার কোনটিই তার জন্য নয় স্থায়ী সমাধান। [সূত্র―ভিডিও সিডি। তাতে আছে, প্রোফেসর জেফ্রী লিংক যখন প্রচন্ড নাস্তিকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ হচ্ছিলেন, তখন কখনো কখনো তার মনে এই অনুভূতি জাগ্রত হত যে, তিনি খ্রিস্টবাদে প্রত্যাবর্তন করবেন। কিন্তু এ অনুভূতি সত্ত্বেও তার বুদ্ধি ও সজ্ঞান অনুভূতি এটা কখনো মেনে নিতে পারছিল না, কারণ, খ্রিস্টবাদ বিশ্বাস ও বর্ণনায় ছিল এক উদ্ভট কল্পকথায় পরিপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক বিচারে তাতে ছিল দ্বন্দ্বের সুস্পষ্ট আভাস।] জার্মান দার্শনিক ওসওয়েল্ড স্পেলার [ওসওয়েল্ড স্পেংলার (১৮৯০-১৯৩৬) জার্মান দার্শনিক। তার মতামত এই যে, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা মৃত্যুমুখে ক্রম ধাবমান। সূত্র মুনীর বা’লাবাক্কী, معجم أعلام ملحق قاموس المورد إنجليزي عربي পৃষ্ঠা―৮০।] ও হার্বার্ট জর্জ ওয়েলস [হার্বার্ট জর্জ ওয়েলস (Herbert george wells) (১৮৬৬-১৯৪৬) ইংরেজ লেখক, কথা সাহিত্যিক। জ্ঞানধর্মী উপন্যাস রচনায় তাকে অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়। সূত্র―প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা―৮৮।] এই দোদুল্যমানতা ও অস্থিরতাকে চিত্রিত করেছেন অত্যন্ত চমৎকার ও সুচারুরূপে। তাদের ভাষ্য―‘এ অবস্থায় মানুষ না পারে বেরোতে, অথবা অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে; আর না পারে তার চারপাশে আবর্তিত হতে।’ [সূত্র―কোলিন ওয়েলসন। ‘সভ্যতার পতন’, আরবি অনুবাদ আনীস জাকী হাসান, পৃ. ১৩৬-১৩৭ বৈরুত। ১৯৮৭।]

আধুনিক মনোভাবাপন্ন মানুষ মানসিক দ্বন্দ্বের এ চূড়ান্ত পেষণে নিজেকে অসহায় ও ইচ্ছাশূন্য হিসেবে আবিষ্কার করে। সৃষ্টির অনর্থতা ও লক্ষ্যহীনতা ব্যতীত তার সামনে ভিন্ন কোন পথ খোলা থাকে না। বিশ্বাসের সমস্ত পথই তার জন্য হয়ে পড়ে রুদ্ধ। যে অন্ত সত্তার ধর্মপরায়ণতা তাকে মুখোমুখী এনে দাঁড় করিয়েছিল কিছু মৌলিক প্রশ্নের, তার মনে হয়, সেগুলোর সমাধান ইহজীবনে কখনো সম্ভব নয়। মানুষের মানসিক স্তরের ব্যাখ্যায় বার্ট্রান্ড রাসেলের উক্তি―‘পাশ্চাত্যের তাবৎ দার্শনিক স্পষ্ট ভাষ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন, এ জাতীয় প্রশ্নে বুদ্ধি ও বুদ্ধিজাত ভাবনা কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এর সমাধানকল্পে বুদ্ধি সততই শক্তিহীন। যদিও প্রশ্নগুলোর সমাধান মানব জাতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে, এ স্বীকৃতি সত্ত্বেও তাদের জন্য যেটা দুঃখজনক, তা হল, মানব বুদ্ধির আশ্রয় ব্যতীত অন্য কোনভাবে এগুলোর উত্তর হতে পারে কিনা তা তারা ভেবে দেখেননি বা স্বীকার করেননি যে ভিন্ন পথের মাধ্যমে আমরা এ মহান সত্যগুলোর পরদা উন্মোচন করতে পারি। [ওয়াহিদুদ্দীন খান, الدين الكامل পৃষ্ঠা―৩৩২, বার্ট্রান্ড রাসেল রচিত A history or western philosophy থেকে অনুবাদকৃত, পৃ. ৭৮৯।]

এ প্রসঙ্গে ভিন্ন একটি আলোচনা উপস্থাপনযোগ্য। মুসলিম ধর্মতাত্তিকদের বুদ্ধিবাদী একটি অংশ-অর্থাৎ মুতাযিলা সম্প্রদায় মনে করে, বুদ্ধিই মানুষের জন্য ঐশী বাণীবাহক বা রাসূল। এবং বুদ্ধির মাধ্যমেই মানুষের তাবৎ স্বরূপ সন্ধানী প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধি ব্যতীত অন্য কোন ঐশী বাণী না এলেও সত্য প্রাপ্তিতে আদৌ কোন ব্যাঘাত ঘটবে না। [সূত্র―আল্লামা যামাখশারী, আল কাশ্শাফ, খন্ড―২, পৃ. ৪৪১, বৈরুত, দারুল মারেফা।] দর্শনের ইতিহাসের দীর্ঘকালীন পরম্পরা মুতাযিলাদের এ দাবিকে ভ্রান্ত ও হাস্যকর বলে প্রমাণিত করে। বার্ট্রান্ড রাসেলের উল্লেখিত উক্তিতেই স্পষ্ট, মুতাযিলাদের এ মতামত পাশ্চাত্যের দার্শনিক সমাজের চিন্তার সম্পূর্ণ বিরোধী। গবেষণা ও আবিষ্কারের বিপুলতা ও সম্ভাবনার প্রাচুর্যের কারণে তাদের প্রতি আমাদের আস্থা থাকাটাই স্বাভাবিক। মুসলিম স্পেনের খ্যাতিমান দার্শনিক ইবনে তোফাইল রচিত ‘হাই ইবনে য়াকজান’ চরিত্রটি একটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মাত্র। যাতে কাজ করেছে ইবনে তোফাইলের উদ্ভাবনী ও কল্পনা বিলাসী প্রতিভা। [দার্শনিক উপন্যাস, নায়ক হাই বিন য়াকযান। উপন্যাসের সার বক্তব্য হাই বিন য়াকযানের মা তার ভাইয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করে, কারণ, তার ভাই তাকে যথার্থ পাত্র না পাওয়ার কারণে বিয়ে দিতে চায়নি, তাই তার ব্যাপার তার মা ভীত ছিল। হাইকে তার মা এই ভয়ে সাগরে ভাসিয়ে দেয়। সাগরের ঢেউ তাকে এমন এক দ্বীপে এনে উপস্থিত করল, যা ছিল জন-মানব শূন্য। এক হরিণী তাকে তুলে নিল, এবং অন্যান্য বন্য হিংস্র প্রাণী হতে তাকে বাঁচিয়ে তুলল। এমন বিজন দ্বীপেই হাই কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উপনীত হল, এবং জীবনের ক্ষুদ্র হতে বড়, সমস্ত গূঢ় তত্ত্ব উদ্ঘাটনেই সে সক্ষম হল। এমনকি, এক সময় নিকটবর্তী দ্বীপের অধিবাসীদেরকে সে সত্যের পথে দাওয়াত দিতে লাগল। তার বন্ধু আসালাম যার মাধ্যমে সে উক্ত দ্বীপ হতে স্থানান্তরিত হয়ে পার্শ্ববর্তী দ্বীপে পৌঁছেছিল, তাকে জ্ঞাত করল যে, তার উদ্ঘাটিত সত্যই সে মহান সত্য, যা নিয়ে নবী-রাসূলগণ পৃথিবীতে আগমন করেছেন।] ইবনে তোফাইল [মুহাম্মাদ ইবনে তোফাইল পাশ্চাত্যের পাঁচ মুসলিম দার্শনিকের অন্যতম। (?―১১৭৯) তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ―দর্শনের রহস্য, হাই বিন য়াকযান, আত্মা। সূত্র―ওমর রেজা معجم المؤلفين খন্ড―১০, পৃ. ১০৪।] তাতে নির্মাণ করেছেন যে দার্শনিক তত্ত্বটির, যদি ইসলাম ধর্মাবলম্বনে তিনি বিশ্বাসী না হতেন, তবে কোনভাবেই সেটি তার পক্ষে সম্ভব হত না। এটি যে তার শুধুই কল্পনা তার বড় ও জ্বলন্ত প্রমাণ, মানব সমাজের দৈনন্দিন বাস্তবতায় এর কোন নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই না। ইবনে তোফাইল ও মুতাযিলাদের এ দার্শনিক চিন্তার খন্ডনে আমি দার্শনিকদের যাবতীয় তত্ত্ব-প্রমাণ এখানে টেনে আনার কোন প্রয়োজন বোধ করছি না। ওয়েল ডিওরান্ট রচিত দর্শনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দর্শনের গল্প’-এর ভাষ্য গ্রহণ করে নিলে এর সমাধান সহজ হয়ে যায় অনেকাংশে। যার কোন ঐশী বাণীর প্রাপ্তি নেই, তার ব্যাপারে মানবিক বোধ-বুদ্ধি ও বিজ্ঞান সর্বশেষ যেটুকু সহায়তা করতে পারে, তাহল, তাকে উন্নীত করতে পারে হানীফ এর স্তরে, যেখানে মানুষ পৈতৃক বিশ্বাসের শৃঙ্খল ছিন্ন করে একেশ্বরবাদী বিশ্বাসের স্পর্শ পায় মাত্র। কিন্তু, তাকে নিয়ে স্রষ্টার কী ইচ্ছা? স্রষ্টা কেন এ বিশাল মহা জগৎ সৃষ্টি করলেন? কী হতে পারে তার ও এ মহা জগতের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি-এগুলোর কোন সমাধানই তার অর্জন হয় না। প্রাক ইসলামী যুগেও মানুষের একটি শ্রেণি হানীফদের স্তরে উন্নীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাদের শীর্ষে নিঃসন্দেহে অবস্থান করছেন যায়েদ ইবন আমর ইবনে নৌফেল ইবনে আব্দুল উজ্জা, [যায়েদ বিন আমর বিন নোফেল বিন আব্দুল উজ্জা বিন রাবাছ বিন আব্দুল্লাহ। জাহেলী যুগেও সে এবাদত করত, সে ইবরাহীম আ. এর ধর্মের অনুরাগী। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন সে এক স্বয়ং সম্পূর্ণ উম্মত হিসেবে উত্থিত হবে। সূত্র―ইবনুল আসীর। أسد الغابة في معرفة الصحابة খন্ড―২, পৃ. ২৯৫।] যিনি পৈতৃক বিশ্বাসের সীমাকে অতিক্রম করে এই বিশ্বাসে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। কিন্তু কীভাবে সেই উপাস্য এক আল্লাহর উপাসনায় রত হতে হবে সেটি তার জানা ছিল না।

সুতরাং, ইতিহাসে যেমন পাওয়া যায়, তিনি বেড়িয়ে পড়লেন আরব উপদ্বীপ ও সিরিয়া পরিব্রাজনে। স্রষ্টার উপাসনার কোন পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যায় কিনা সেই খোঁজে। কিন্তু তা কোন ভাবেই হবার ছিল না। তিনি খুঁজে পেলেন না কিছুই, তার প্রাত্যহিক প্রার্থনা ছিল এই - ‘হে স্রষ্টা, আমি যদি তোমাকে উপাসনা করার উত্তম পন্থার সন্ধান পেতাম, তবে, অবশ্যই তোমার উপাসনায় রত হতাম। কিন্তু আমি পাইনি। এই বলে তিনি তার আরোহণের উষ্ট্রীর উপর সেজদায় রত হতেন।’ [সূত্র―ইবনে কাসীর, البداية والنهاية খন্ড―২, পৃ. ২৩৭, বৈরুত, মাকতাবাতুল মাআরেফ, ১৯৬৬।] আধুনিক পৃথিবীতে যখন আমরা মুসলমানের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব হিসেবে ঐশী বাণীকে মানুষের কাছে যথার্থভাবে পৌঁছে দিতে পারছি না, তখন দেখতে পাচ্ছি মানুষের সেই আদিম হাহাকার আবার প্রত্যাবর্তন করছে। এঙ্গেলস [ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস (Friedrich engels) জন্ম ২৮ নভেম্বর ১৮২০, মৃত্যু ৫ আগস্ট ১৮৯৫। মার্ক্সবাদী বিপ্লবী দর্শন প্রসারে তিনি ছিলেন কার্ল মার্কসের অন্যতম সঙ্গী। মার্ক্সের ভাববাদ ও বস্ত্তবাদের প্রতিষ্ঠায় এঙ্গেলসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মার্কস রচিত পুঁজির (Daskapital) দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড তার হাতেই সমাপ্ত। তার অন্য একটি রচনা ‘ব্রিটেনে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা’। সূত্র― Lexicon universal encyclopedia খন্ড―৭, পৃ. ১৭৬।] যখন প্রশ্নের ঘূর্ণি পাকে আবদ্ধ হয়ে নিদারুণ ক্রন্দনে ভাসিয়ে দেন সকলকে, তখন আমাদের ব্যথিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এঙ্গেলসের ভাষ্যে - ‘আমি প্রতিনিয়ত প্রার্থনায় রত হচ্ছি, এই কামনায় আমার জীবন অতিবাহিত হচ্ছে যে, সত্য তার পূর্ণ আলোক নিয়ে আমার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক। যেদিন থেকে সংশয়ের তীর আমার আত্মার কোমল প্রকোষ্ঠগুলোয় হানা দিয়েছে, সেদিন থেকে আমার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নিদারুণ প্রার্থনা। আমি তোমাদের বিশ্বাসগুলো মেনে নিতে পারছি না। আমার আত্মা কান্নার জলে সিক্ত। আমি লিখছি, আর আমার অন্তর ব্যথিত, চোখ অশ্রুবর্ষণে রত। তবে, আমি অনুভব করছি, ঈশ্বরের কৃপা হতে আমি বঞ্চিত নই। কামনা করি, আমি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যাব, যার দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় আমি কাতর। আমি আমার জীবনের শপথ করে বলছি, আমার এ গভীর আবেগ ও গবেষণা পবিত্র আত্মারই দান। আমি প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি এই অনীহা কোন ভাবেই ত্যাগ করতে পারব না, যদিও বাইবেল তাকে শতবার মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। [ يتحدى الإسلام ওয়াহিদুদ্দীন খান, আরবী অনুবাদ, জফরুল ইসলাম খান। পৃ. ২৪৪, কায়রো।]

এঙ্গেলস যখন আর্তনাদ করে বলে উঠেন,―‘আমি তোমাদের এইসব বিশ্বাসকে মেনে নিতে পারব না’―তখন মূলত: তা করে থাকেন এমন কিছু বিভ্রান্ত অস্বচ্ছ ধর্ম ও তার সমাজকে লক্ষ্য করে, দীর্ঘ একটি সময় অতিক্রান্তের পরও যেখানে ইসলামের প্রকৃত বাণী যথার্থভাবে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়নি। এর প্রতি আদিষ্টরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন চরমভাবে। দাওয়াতকে পৌঁছে না দেয়ার ফলেই তাদের মাঝে জন্ম দিয়েছে এই ধারণা যে, ধর্ম হল এক অপ-বিশ্বাস ; কিছু পৌরাণিক অপ-বিশ্বাস ও কল্পকথা, এর আড়ালে নেই কোন জোড়াল সত্যের আশ্বাস। কোলিন ওয়েলসনের ভাষ্য : ধর্মের যেই মৌলিক উপাদানটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে সমাজ-সভ্যতা ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ, তা মূলত: একরাশ পৌরাণিক কাহিনি, অপ-বিশ্বাসের সমষ্টি, তাতে সত্যের লেশমাত্র নেই। [কোলিন ওয়েলসন, সভ্যতার পতন, পৃ. ১৫৭-১৫৮।]

যখন তারা ধর্মের এমন সততা হীনতার কারণে পিছু হটে যান ধর্ম ও ধর্মপরায়ণতা থেকে, তখন কিন্তু ধর্মের মহা সত্য তাদের আত্মা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় না। তাদের আত্মার অগ্নি নির্বাপিত হওয়ার জন্য সতত অস্থির, চঞ্চল হয়ে থাকে। কারণ, এর শেকড় মানবীয় স্বভাবের গভীরে প্রোথিত।

মানুষ সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে স্রষ্টার যে অপরিমেয় করুণা, তার দাবি মোতাবেক, মানুষের আত্মার গভীরের এ অগ্নি ও পিপাসা নিবারণের কোন ব্যবস্থা অবশ্যই থাকবে। সুতরাং, মানুষের কাছে সত্যের মহান বাণী পৌঁছে দেয়ারও পন্থা তিনি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যে বাণী তার আত্মার প্রয়োজন পূরণে সহায়তা দেবে, তাকে জ্ঞাত করাবে তার ভবিষ্যৎ, অনাগত সুসময় কিংবা ভয়ংকর পরিস্থিতি সম্পর্কে। মানুষের জন্য মানুষের মাঝ থেকে স্রষ্টার ইচ্ছা অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়েছে পুণ্যবান, মহাত্মা কিছু ব্যক্তিকে, যারা তার আয়াত সমূহকে সৃষ্টিকুলের কাছে পৌঁছে দেবেন পরম দায়িত্বশীলতার সাথে এবং যারা সম্বোধিত হবেন নবী ও রাসূল হিসেবে।

এই নবী বা রাসূলদের জন্য অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ছিল, তারা মানুষের কাছে স্রষ্টার অমোঘ বিধান, অহী পৌঁছে দেবেন স্পষ্টভাবে। তাতে সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ থাকবে না কিছুমাত্র। তাদের সামনে উন্মোচিত হবে জীবন চলার অন্ধকার পথগুলো। আল্লাহর ইচ্ছা, তার সন্তুষ্টি তাদের দৃষ্টির সরল রেখায় ভেসে উঠবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে উচ্চারিত এ সংক্রান্ত স্পষ্ট বর্ণনা, কঠোর উক্তি এর সাবলীল প্রমাণ বহন করছে। কুরআনে এসেছে―

يُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ بِالرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ أَنْ أَنْذِرُوا أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاتَّقُونِ .

অর্থাৎ―তিনি স্বীয় নির্দেশে বান্দাদের মাঝে যার কাছে ইচ্ছা, নির্দেশসহ ফেরেশতাদের এই মর্মে অবতীর্ণ করেন যে, হুঁশিয়ার করে দাও, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। অতএব, আমাকে ভয় কর। [সূরা আন নাহল―আয়াত―২] অপর স্থানে বর্ণিত হয়েছে―

إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ أَنْ أَنْذِرْ قَوْمَكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ .

অর্থাৎ―আমি নূহকে প্রেরণ করেছি তার জাতির কাছে, এই আদেশে যে, কঠিন শাস্তি আসার পূর্বেই তুমি তোমার জাতিকে সতর্ক করে দাও। [সূরা নূহ, আয়াত―১] আরো এসেছে―

يَاأَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ ﴿১﴾ قُمْ فَأَنْذِرْ ﴿২﴾.

অর্থাৎ―হে চাদরাবৃত, উঠুন, সতর্ক করুন। [সূরা―আল মুদ্দাসসির―আয়াত-১-২] অন্য এক স্থানে উল্লেখিত হয়েছে―

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ .

অর্থাৎ―আপনি আহবান করুন আপনার প্রভুর পথে প্রজ্ঞা, ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে। আর তাদের সাথে বিতর্ক করুন সুশীল পন্থায়। [সূরা―আন নাহল, আয়াত―১২৫]

يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ ﴿৬৭﴾

হে রাসূল, আপনি পৌঁছে দিন যা আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার নিকট অবতীর্ণ হয়েছে। আর আপনি যদি তা পালন না করেন, তবে, আপনি তার বাণী পৌঁছালেন না, একমাত্র আল্লাহ আপনাকে মানুষের হাত থেকে রক্ষা করবেন। আল্লাহ অবিশ্বাসী জাতিকে পথ প্রদর্শন করেন না। [সূরা―আল মায়েদা, আয়াত―৬৭]

আল্লাহ তাআলার করুণা আদিতে, যখন এমনই পরিব্যাপ্ত ছিল যে, তার সিদ্ধান্ত ছিল [( وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ ) সূরা ফাতির―২৪] তিনি সকল জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ করবেন, তাদেরকে সত্য সন্ধানের ব্যবস্থা করবেন। তখন এটা কোনভাবেই বোধগম্য নয় যে, কেয়ামত অবধি আগত শত-সহস্র কোটি মানব সন্তানকে তার করুণা হতে তিনি বঞ্চিত করবেন। তাদেরকে সত্য বাণী পৌঁছে দেয়ার কোন ব্যবস্থা নেবেন না। মূলত: বর্তমানের দাওয়াতী ব্যবস্থা সংক্রান্ত আমাদের প্রস্তাবনা ও আলোচনা দ্বিতীয় এই দিকটিকে কেন্দ্র করে। সুতরাং, তার করুণার দাবি অনুসারে, পৃথিবীর শেষ সময়গুলোর জন্য দাওয়াতের কিংবা সত্যের বাণী পৌঁছে দেয়ার এ মহান দায়িত্ব অর্পণ করলেন পুরো উম্মতকে―যাদের তিনি মানব গোষ্ঠীর মধ্য হতে বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন। [( ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِينَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا ) সূরা ফাতির―৩২] কারণ, সর্বজ্ঞাতা হিসেবে তিনি জ্ঞাত ছিলেন, শেষ যুগে মানব গোষ্ঠী রূপ নিবে অসংখ্য সদস্য নিয়ে এক বিশাল মানব গোষ্ঠীতে। তাদের জন্য প্রয়োজন দেখা দেবে হাজার হাজার দায়ীর। সে দায়ীদের মাধ্যমে পুরো মানব গোষ্ঠীর সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে আল্লাহর ইচ্ছা, তার সন্তুষ্টি। কুরআনে আল্লাহ তাআলা অবশ্য পালনীয় এক নির্দেশে ঘোষণা করেছেন―

قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿১০৮﴾.

অর্থাৎ―আপনি বলে দিন এই আমার পথ আমি আল্লাহর পথে আহবান করছি প্রজ্ঞাশ্রিত বিবেচনা নিয়ে―আমি ও আমার অনুসারীরা। আল্লাহ পবিত্র, আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই। [সূরা ইউসুফ―আয়াত ১০৮]

ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এবং তাদের অনুসারীদের মতানুসারে, কুরআনের আয়াত ও তার নির্দেশনার বিধান হল, যে ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ নাযিল হবে, তাতে যদি তাকে বিশিষ্ট না করা হয়, তবে তা সমানভাবে পুরো উম্মতের উপর অর্পিত বলে গণ্য হবে। [সূত্র আল আমাদী, الأحكام في أصول الأحكام সম্পাদনা ডক্টর সাইয়েদ জামীল। খন্ড―২, পৃ. ২৭৯, বৈরুত, দারুল কিতাবিল আরাবী ১৯৮৬] উল্লেখিত আয়াত ও এ জাতীয় কোরআনিক নির্দেশের ব্যাপারে ব্যাপক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেই নির্দেশগুলো, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবশ্য পালনীয় হিসেবে নাযিল হয়েছে, তা সন্নিবেশ করে নিচ্ছে এই উম্মতের প্রতিটি সদস্যকে। রাসূল যেমন আদিষ্ট ছিলেন, তেমনি আদিষ্ট উম্মতের উচ্চ থেকে নিম্নের প্রতিটি সদস্য। পবিত্র কুরআনে এমনকি কিছু কিছু আয়াত রয়েছে, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ নয়, স্পষ্টভাবেই যা প্রমাণ করে সকলের জন্য দাওয়াতী কর্মের এ অবশ্য পালনীয়তার। ইমাম আবু যাহরা উল্লেখিত আয়াতটির ব্যাপারে বলেন, তা প্রমাণ করে তিনটি বিষয়ের :―

সমগ্র মানবগোষ্ঠীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া মুমিনদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের অন্যতম শর্ত। তা ব্যতীত অনুসরণ সাব্যস্ত হবে না। যে দায়ী নয়, প্রকারান্তরে সে রাসূলের অনুসারীও নয়।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুরূপ উম্মতের জন্য আল্লাহর রেসালাত পৌঁছে দেয়া মুমিনদের জন্য অবশ্য পালনীয়। প্রকৃত বিশ্বস্ত ও মুমিনরা কখনো তা পরিত্যাগ করতে পারে না।

ইঙ্গিতে আয়াতটি প্রমাণ করছে, পূর্ণ স্বচ্ছতায় দাওয়াত উপস্থাপিত হবে। রুক্ষতা বা ঘৃণার সাথে নয়, তা পালন করতে হবে, সহনশীলতা ও বিনম্রতার সাথে। [সূত্র মুহাম্মাদ আবু যাহরা الدعوة إلى الإسلام পৃ. ২৪]

এমনিভাবে ভিন্ন দু’টি আয়াত এখানে উপস্থাপনযোগ্য, যা দাওয়াত সংক্রান্ত ভিন্ন দু’টি বিষয় সাব্যস্ত করছে। প্রথমত: পৃথিবীর তাবৎ মানুষের উপর এটি প্রমাণ করার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে যে, মানুষের কাছে দাওয়াত ও দাওয়াত পৌঁছানোর সাক্ষ্য প্রমাণ করার জন্য এই উম্মতকে পুরো মানবজাতি হতে পৃথক করে নির্বাচন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের আয়াতটি হল―

وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ .

অর্থাৎ―তোমরা আল্লাহর পথে যথাযথ শ্রম ব্যয় কর। তিনিই তোমাদেরকে নির্বাচন করেছেন এবং তোমাদের উপর দীনের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেননি। তোমরা তোমাদের আদি পিতা ইবরাহীমের ধর্মে অটল থাক। তিনিই তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলমান হিসেবে। পূর্বেও এবং এই কুরআনেও, যাতে সাক্ষ্যদাতা হন রাসূল তোমাদের উপর এবং তোমরা সমগ্র মানব মন্ডলীর উপর। [সূরা হজ―আয়াত―৭৮] [এখানে সাক্ষ্য বা ‘শাহাদত’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে মানুষকে আল্লাহর দীনের প্রতি আহবান জানাব, দাওয়াতের যাবতীয় শর্ত ও অনুষঙ্গকে সামনে রেখে। এ দাওয়াতে কেউ কেউ সাড়া দিয়ে ঈমান আনয়ন করবে, আল্লাহর বিচারালয়ে আমরা তার ব্যাপারে সততার সাক্ষ্য প্রদান করব যে, সে দাওয়াতে সাড়া দিয়েছে এবং সে অনুযায়ী আমলও করেছে। আর যে অস্বীকার করবে, তার ব্যাপারে আমাদের সাক্ষ্য হবে সে দাওয়াতকে অস্বীকার করে দম্ভ প্রদর্শন করেছে। কুরআনের একটি আয়াতে শাহাদতের এই অর্থের প্রমাণ পাওয়া যায়। وَنُفِخَ فِي الصُّورِ ذَلِكَ يَوْمُ الْوَعِيدِ ﴿২০﴾ وَجَاءَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَعَهَا سَائِقٌ وَشَهِيدٌ ﴿২১﴾ অর্থাৎ আর শিঙায় ফুৎকার দেয়া হবে, সেটিই হবে প্রতিশ্রুতির দিন। প্রতিটি আত্মা উপস্থিত হবে, সাথে থাকবে পাহারাদার ও সাক্ষী। (সূরা কাফ : আয়াত : ২০-২১। এখানে পাহারাদার বা কুরআনের ভাসায় سائق এর অর্থ হল, ঐ সমস্ত ফেরেশতারা, যারা তাকে আল্লাহর দরবারে এনে উপস্থিত করবে। আর সাক্ষী হল, যে মানুষ ও মানুষের কর্মের ব্যাপারে আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্য প্রদান করবে। বিশিষ্ট তাফসীর বিশারদ মুজাহিদ, কাতাদা এবং ইবনে যায়েদ উক্ত আয়াতের এমনই ব্যাখ্যা করেছেন। (সূত্র―ইবনে কাসীর, খন্ড―৪, পৃ. ২৪১) কুরআনের অন্য এক আয়াতেও এ সাক্ষ্যের প্রসঙ্গটি এসেছে وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أُولَئِكَ يُعْرَضُونَ عَلَى رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الْأَشْهَادُ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى رَبِّهِمْ أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ ( سورة هود -১৮) অর্থাৎ―যে আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তার তুলনায় অধিক জালিম আর কে হতে পারে? তাদেরকে তাদের প্রভুর দরবারে উপস্থিত করা হবে, সাক্ষীরা বলবে, এরাই তাদের প্রভুর ব্যাপারে মিথ্যা আরোপ করেছিল। শুনে রাখ, আল্লাহর অভিশাপ জালিমদের উপর। কোন কোন তাফসীর বিশারদ এই মন্তব্য করেছেন, উভয় আয়াতে সাক্ষী দ্বারা উদ্দেশ্য ফেরেশতারা। কিন্তু আমি মনে করি, এমত সঠিক ও নির্ভুল নয়। কারণ, এ ব্যাপারে অন্যান্য অনেক আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ বহন করছে, কেয়ামতের দিন সাক্ষীগণ মানুষদেরই অন্তর্ভুক্ত হবেন। কুরআনের একস্থানে এসেছে― فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًاا তখন কেমন হবে, যখন প্রতিটি উম্মত হতে আমি একজন করে সাক্ষী উপস্থিত করব, আর আপনাকে উপস্থিত করব সকলের উপর সাক্ষী হিসেবে? (সূরা নিসা-৪১)]

দ্বিতীয় একটি আয়াত প্রমাণ করে, রাসূলের উম্মত আল্লাহ তাআলা ও তার বান্দাদের সাথে সংযোগ সেতু। তারা আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছে দেবে, এবং কেয়ামতের দিন এই দাওয়াত পৌঁছানোর ব্যাপারে স্রষ্টার দরবারে সাক্ষ্য প্রদান করবে, কুরআনে এসেছে―

وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا .

অর্থাৎ, এমনিভাবে তোমাদের মধ্যবর্তী উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষ্যদাতা হও, আর রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা হন। [সূরা বাকারা―আয়াত―১৪৩]

ইমাম আবু যাহরা এ প্রসঙ্গে লেখেন―আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে মানুষের জন্য সাক্ষীরূপে নির্ধারণ করেছেন। আর রাসূলকে সাক্ষী করেছেন তাদের জন্য। তাদের এই শাহাদত বা সাক্ষ্যদানের দায়িত্ব দাবি করে যে, তারা মানুষকে সত্যের প্রতি আহবান জানাবে, এবং তাদের ঈমান ও কুফরির ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে। রাসূল এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন যে, তারা তার শরীয়তকে স্পষ্ট করে বর্ণনা করে দিয়েছে, এবং রেসালাতকে মানুষের জন্য উন্মোচিত করে দিয়েছে। [মুহাম্মাদ আবু যাহরা, ألدعوة إلى الإسلام পৃ. ২৪]

আরবী ভাষার ব্যাপারে সামান্যতম সম্পর্ক রাখেন, এমন ব্যক্তির কাছেও এটি স্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলার সম্বোধন لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ উম্মতের তাবৎ সদস্যকে খেতাব করে উল্লেখ হয়েছে, এবং এ খেতাব অনুজ্ঞার ভাষ্যে উচ্চারিত হয়েছে, যা ঐচ্ছিক নয়, বরং অর্পন করে অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব। মুহাম্মাদ আবু যাহরা আরো লেখেন―আমরা যখন সাহাবী, তাবেয়ী ও তাদের ধর্মচার্চা নিয়ে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করব, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, পূর্ণাঙ্গ ইসলাম ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো এবং ঈমানের স্বরূপ যাদের কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট ছিল, তারা অবশ্যই অপরকে ইসলাম ও ঈমান শিক্ষা দানে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতেন। তাদের দাওয়াতের লক্ষ্য ছিল হয় মুশরিক, কিংবা আত্মীয়-পড়শিরা। মূলত : দাওয়াত সে সময় থেকেই মুসলমানদের জন্য এক সার্বজনীন দায়িত্ব । [মুহাম্মাদ আবু যাহরা, ألدعوة إلى الإسلام পৃ. ৩৪]

আমি মনে করি, তাদের কাছে দাওয়াত এমন সার্বজনীনতা লাভ করেছিল এই কারণে যে, তাদের উপর অর্পিত এই অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব সম্পর্কে তারা ছিলেন পূর্ণ সজাগ। তাদের কর্মই এ ব্যাপারে স্বীকৃতি দেয় যে, এটা ছিল তাদের নিকট ‘ওয়াজিবে আইনি’ বা প্রত্যেকের উপর অর্পিত অবশ্য পালনীয় বিধান।

তবে, এ বিষয়টি অবশ্য প্রণিধানযোগ্য, দাওয়াত যদিও প্রতিটি মুসলিমের উপর অবশ্য পালনীয় বিধান―পরিভাষায় আমরা যাকে বলি ‘ওয়াজিবে আইনী’ কিন্তু তা এ অর্থ বহন করে না যে, পৃথিবীব্যাপী মুসলমানদের সকলে তাদের পরিবার-পরিজন, সহায়-সম্বল, কাজ-কর্ম পরিত্যাগ করে দাওয়াতী আমল পালনের জন্য সর্বস্থানে ছড়িয়ে পড়বে, তাদের জীবনের একমাত্র কর্ম হবে দাওয়াত প্রদান। বরং, প্রত্যেকে অবস্থা ও অবস্থান অনুসারে জীবনের সাথে সমান্তরালভাবে দাওয়াতী দায়িত্ব পালন করে যাবে। ইসলাম কুরআনে স্বীকৃতি দিয়েছে যে, আল্লাহ বান্দাকে তার সাধ্যাতীত বিষয়ে বাধ্য করেন না। দাওয়াত প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজে আইন―এ বিষয়টি উল্লেখের পর তাই ইমাম মুহাম্মাদ আবদুহ লিখেন―হ্যাঁ, উম্মত লাভ করেছে যে মহান সত্যের সন্ধান, তার দিকে অপরকে আহবান করা ফরজ। কিন্তু তা এই দাবি করে না যে, প্রতিটি ব্যক্তি একই সাথে সর্বদা এই কাজে ব্যস্ত থাকবে। কেননা, এটি হবে একটি অবাস্তব ও অসাধ্য দাবি। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব যেটুকু, তাহল, মুসলমান

সর্বদা দাওয়াতকে―অন্তত চিন্তায়, আপন লক্ষ্য ও ধ্যান-জ্ঞান বানিয়ে রাখবে। যখনই দাওয়াতের উপযোগী ব্যক্তির সাথে মিলন বা সাক্ষাৎ ঘটবে, তখনি তাকে সত্যের পথে আহবান জানাবে। এর জন্য সমাজ

সংসার ত্যাগের প্রয়োজন নেই। একটি শ্রেণি যথাযথ প্রস্ত্ততি নিয়ে ও কাজটি সর্বদা আঞ্জাম দিয়ে যাবে। অন্যান্য সকলে সময় ও সুযোগ অনুসারে এর সাথে জড়িত হয়ে স্বীয়

দায়িত্ব পালনে তৎপর হবে। এটি অনেকটা হজের অনুরূপ। তা ফরজে আইন, তবে কেবল তার ওপরই যার শক্তি সামর্থ্য রয়েছে । [মুহাম্মাদ রশীদ রেজা, তাফসীর আল মানার, খন্ড―৪, পৃষ্ঠা, ২৯, মিশর―১৯৭৩]

তবে, এ আলোচনা প্রসঙ্গে আমি ভুলে যাচ্ছি না, দাওয়াতের ব্যাপারে মুসলমানদের মাঝে বর্তমানে যে ধারণাটি ব্যাপক প্রচলিত, তাহল, দাওয়াত ফরজে আইন নয় ; ফরজে কেফায়া। এটি নিরেট ভুল ও বিভ্রান্ত ধারণা। কারণ, যে সমস্ত শরয়ী প্রমাণের উপর ভিত্তি করে এ মতামতটি প্রতিষ্ঠিত আমি দেখেছি তা অনির্ভরযোগ্য, ও অপ্রামাণ্য। বিনাবাক্যে তা মেনে নেয়া যায় না। এ ব্যাপারে উক্ত মতামতের অনুসারীদের পক্ষ থেকে দু’টি আয়াত প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তাহল―

কুরআনে এসেছে―

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ .

তোমাদের মধ্য হতে একটি দল অবশ্যই থাকবে, যারা কল্যাণের দিকে আহবান জানাবে, অকল্যাণে বাধা প্রদান করবে, আর তারাই হবে সফল। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত―১০৪]

আয়াতটিকে তারা এভাবে বিশ্লেষণ করেন যে, উক্ত আয়াতে ব্যবহৃত من শব্দটি অংশবাচক, [সূত্র―যামাখশারী, আল কাশশাফ, খন্ড―১, পৃ. ৪৫২] যা একটি বৃহৎ বস্ত্তর অংশ বিশেষকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুতরাং তাদের নিকট আয়াতের অর্থ হলো তোমাদের সমষ্টি থেকে নির্দিষ্ট একটি দল এ দায়িত্ব পালনে তৎপর হবে। আমার বক্তব্য হল, من শব্দটির এ অর্থ তাফসীর বিশারদদের নিকট সর্বসম্মত নয়। কোন কোন মুফাসসির এ মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, এখানে من শব্দটি স্পষ্ট বাচক অর্থে ব্যবহৃত। কোন বিষয়কে দৃঢ়করণের জন্য বাক্যে আনীত। [প্রাগুক্ত] এ ভিত্তিতে আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায়―তোমরা এমন একটি দলে পরিণত হও, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, সৎকাজে আদেশ করবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আয়াতটির অর্থ বা উদ্দেশ্য সর্বসম্মত নয়, বরং ধারণা প্রসূত। উভয় অর্থই এখানে সম্ভাব্য, যার ফলে কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, শরয়ী মূলনীতি হল―

إذا تطرق الاحتمال بطل الاستدلال .

যার মর্মার্থ হল, সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে প্রমাণ কখনো অকাট্য হয় না। এখানেও আমরা উক্ত সম্ভাব্যতার সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। দুটি সম্ভাবনার উভয়টি গ্রহণযোগ্য। কোনটিকে অগ্রাধিকার প্রদানের কোন প্রমাণ আমাদের সম্মুখে নেই। বিধায় বাধ্য হয়ে উভয়টিই আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হচ্ছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভিন্ন কোন ‘নস’ বা শরয়ী প্রমাণের দ্বারস্থ হতে হবে। যার প্রামাণ্যতা হবে স্বীকৃত ও সুস্পষ্ট। [সূত্র―মুহাম্মাদ আল-আমাদী, الأحكام في أصول الأحكام খন্ড, ৪, পৃ. ২৬০] আমরা ইতিপূর্বে এ জাতীয় সুস্পষ্ট ও প্রামাণ্য কুরআনের একাধিক আয়াত উল্লেখ করে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছি যে, দাওয়াত ফরজে কেফায়া নয়, ফরজে আইন।

২. কুরআনে এসেছে―

وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ .

আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া উচিত নয়। তাই তাদের প্রতিটি দলের একটি অংশ কেন বের হল না, যাতে দীনের জ্ঞান লাভ করতে পারে, এবং সতর্ক করতে পারে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে? যেন তারা রক্ষা পায়? [সূরা তাওবা, আয়াত―১২২]

এ আয়াত দ্বারাও অনেকে দাওয়াতকে ফরজে কেফায়া হিসেবে সাব্যস্ত করেন। তাদের বক্তব্য হল, আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াতে নির্দেশ প্রদান করেছেন যে, প্রতিটি দল থেকে একটি অংশ দীনের ব্যাপারে গভীর জ্ঞান অন্বেষণের জন্য বেরিয়ে পড়বে এবং তাদের জাতি যখন প্রত্যাবর্তন করবে তখন তাদেরকে দীনের ব্যাপারে সতর্ক করবে জ্ঞানের দ্বারা। যারা দাওয়াতকে মনে করেন ফরজে কেফায়া হিসেবে, হয়তো তাদের নিকট কুরআনের এই আয়াতটিই অধিক প্রামাণ্য ও তাদের মতামত সাব্যস্ত করণের অনুকূল। তবে, আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার কারণ, অবস্থান, এমনিভাবে, আয়াতে ব্যবহৃত الطائفة-الفرقة শব্দ-দ্বয়ের উল্লেখ এ দাবির ভিন্ন প্রমাণ বহন করছে। ইমাম তবারী এ আয়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতামত উল্লেখ করেছেন যার কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি―

১. আয়াতে বর্ণিত দলটি দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মরু-বাসী একটি দল, যাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে ইসলামের দাওয়াত ও শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন, অতঃপর তখন এই আয়াত নাযিল হল―

مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ .

মদীনাবাসী ও তার পার্শ্ববর্তী মরুবাসীদের উচিত হয়নি যে, তারা রাসূলের সঙ্গ ত্যাগ করে পিছনে থেকে যাবে। [সূরা তাওবা, আয়াত―১২০] ―তখন সকলে মরু অঞ্চল থেকে চলে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হল। তাদের ভয় হচ্ছিল যে, হয়তো মরু অঞ্চলে থেকে যাওয়ার কারণে তারা রাসূলের সঙ্গ ত্যাগকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে, যাদের ব্যাপারে আয়াতে নির্দেশ করা হয়েছে। তাই আল্লাহ তাআলা তাদের অপরাগতা উল্লেখ করে নাযিল করলেন― وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً । এবং তাদের সকলের দাওয়াত ছেড়ে মরু অঞ্চল থেকে চলে আসাটা পছন্দ করলেন না। [আততাবারী, جامع البيان عن تأويل آي القرآن খন্ড―১৪, পৃ. ৪৫৫, দারুল মাআরেফ, মিশর]

২. وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً আয়াত প্রসঙ্গে মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের একটি দল আরবের মরু অঞ্চলে গেলেন তারা সেখানে আপ্যায়ন পেয়ে সুখী ছিলেন। তারা তথাকার অধিবাসীদেরকে কল্যাণের দিকে, ইসলামের দিকে আহবান জানালেন। কিন্তু অধিবাসীরা তাদের লক্ষ্য করে বলল, তোমরা কি তোমাদের সাথিদের কথা বিস্মৃত হয়ে এখানে মজে গেলে আমাদের নিয়ে? তাদের এ কথা শুনে তাদের মনে আঘাত লাগল এবং একযোগে সকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে ফিরে আসলেন। মানুষকে দাওয়াত প্রদানের এ সুযোগ ত্যাগ করার কারণে আল্লাহ তাআলা কুরআনে নাযিল করলেন― فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ অর্থাৎ―তাদের একটি দল কেন দাওয়াতের জন্য বেরিয়ে পড়ে না? মূলত এই আয়াতটি দাওয়াতের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে নাযিল হয়েছে। [প্রাগুক্ত]

৩. উক্ত আয়াত সম্পর্কে ইবনে আববাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আরবের প্রতিটি এলাকা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে একটি দল আগমন করত এবং দীনের ব্যাপারে তাদের প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে জেনে নিত। তার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করত। রাসূলের কাছে তাদের আবেদন ছিল―আমাদের কর্মের ব্যাপারে আপনার আদেশ আমাদের জানিয়ে দিন। এবং আমরা আমাদের জাতির কাছে প্রত্যাবর্তন করে তাদের কী বিষয়ে জানাব, আমাদের বলে দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যের আদেশ দিতেন এবং তাদের জাতিকে সালাত, যাকাত, ইত্যাদি শরীয়তের অবশ্য পালনীয় বিধান সম্পর্কে জানাতে বলতেন। তারা তাদের জাতির কাছে প্রত্যাবর্তন করে ঘোষণা করতেন―যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা নিশ্চয় আমাদের দলভুক্ত। এবং তারা তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক করে দিতেন। [প্রাগুক্ত―পৃষ্ঠা―৫৬৯]

উক্ত আয়াত সংক্রান্ত এ তিনটি বর্ণনা থেকে আমরা যে সারকথায় উপনীত হই, তাহল, আয়াতটিতে সম্বোধন করা হচ্ছে সাহাবীদের একটি দলকে, যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধি হিসেবে রাসূলের দরবারে এসে উপস্থিত হতেন। তারা প্রথমে ঈমান এনে দীনের ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করে তাদের জাতির কাছে ফিরে যেতেন এবং তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত প্রদান করতেন। [আমার মনে হয়, তা ছিল প্রতিনিধি আগমনের বছরে, যে বছর প্রতিটি গোত্র ও এলাকা হতে একটি করে প্রতিনিধি দল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আগমন করে। তারা তার দরবারে এসে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করত এবং স্ব গোত্রের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকেও ইসলামের ছায়াতলে আসার আমন্ত্রণ জানাত। সময়টি ছিল গাযওয়ায়ে তাবুকের সমসাময়িক। সূত্র―ইবনে কাসীর الســـيرة النبوية খন্ড―২, পৃ. ২৯৮] মূলত: তাদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেছেন। তাদেরকে এতে নির্দেশ দিয়েছেন নিজ এলাকায় ফিরে যেতে এবং দাওয়াত অব্যাহত রাখতে।

সুতরাং, আয়াতের সম্বোধন মূলত : দাওয়াতের দায়িত্ব দৃঢ়তার সাথে পালন ও অব্যাহত রাখার সম্বোধন। দুর্যোগ ও প্রতিযোগ যতই থাকুক, মুসলমানকে অবশ্যই ইসলামের প্রচারমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে যে কোন মূল্যে।

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন