HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
উৎসাহ উদ্দিপনা মূলক গল্প
লেখকঃ QuranerAlo Desk
বিয়ের ২১ বছর পর আমার স্ত্রী আমাকে বলল অন্য একজন মহিলাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে ও খেতে নিয়ে যেতে। সে বলল, “আমি তোমাকে ভালবাসি, কিন্তু আমি জানি এই মহিলাটিও তোমাকে ভালবাসেন এবং তিনি তোমার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতেও ভালবাসবেন।”
আমার স্ত্রী যার সাথে আমাকে বাইরে যেতে বলছিল, তিনি ছিলেন আমার মা, যিনি ১৯ বছর আগে বিধবা হয়ে গেছেন; কিন্তু আমার কাজের চাপ আর তিন সন্তানের দায়িত্বের কারনে শুধু কোন উপলক্ষ হলেই তার সাথে আমার দেখা হওয়া সম্ভব হত।
সেই রাতে আমি মাকে ফোন করে একসাথে বাইরে বেড়াতে ও খেতে যাওয়ার আমন্ত্রন জানালাম। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কি ব্যপার বাবা, তুমি ভাল আছ তো?’
আমার মা হলেন এমন একজন মানুষ যিনি গভীর রাতে ফোন কল বা আকস্মিক দাওয়াতকে কোন দুঃসংবাদ বলে আগাম আশঙ্কা করেন। মায়ের প্রশ্নে আমি বললাম, ‘ভাবছি তোমার সাথে কিছু ভাল সময় কাটাবো মা। শুধু তুমি আর আমি।’ তিনি এক মুহূর্ত ভাবলেন, তারপর বললেন, “এমন হলে আমার খুবই ভাল লাগবে বাবা।”
কাজ শেষে সেদিন যখন ড্রাইভ করে মাকে তুলে নিতে গেলাম, কিছুটা নার্ভাস বোধ করছিলাম। যখন সেখানে পৌঁছলাম, খেয়াল করলাম, তিনিও যেন এভাবে দেখা করার জন্য কিছুটা নার্ভাস। তিনি রেডি হয়ে দরজার কাছেই অপেক্ষা করছিলেন। তার চেহারা ছিল দ্যুতিময় হাসি। গাড়িতে উঠতে উঠতে তিনি বললেন, ‘আমি আমার বন্ধুদের বলেছি যে আমি আমার ছেলের সাথে বেড়াতে যাচ্ছি; তারা শুনে খুবই খুশী হয়েছে। আমাদের সাক্ষাতের বর্ণনা শোনার জন্য তারা অধীর ভাবে অপেক্ষা করছে।’
আমরা যে রেস্তোরাঁয় গেলাম, সেটা খুব দামী না হলেও বেশ ভাল আর আরামদায়ক ছিল। আমার মা আমার বাহু ধরে ছিলেন, যেন তিনি একজন ‘ফার্স্ট লেডী’। বসার পরে আমাকেই মেনু পড়ে শোনাতে হল। তিনি শুধু বড় লেখা পড়তে পারতেন। অর্ধেক পড়ে শোনানোর পর মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি তাকিয়ে শুধু আমাকে দেখছেন। তার ঠোঁটে এক নস্টালজিক হাসি। তিনি বললেন, ‘তুমি যখন ছোট ছিলে, আমাকে মেনু পড়ে শোনাতে হত।’ আমি বললাম, ‘এখন তাহলে সময় এসেছে যেন তুমি আরাম কর আর আমাকে সুযোগ দাও তোমার সেই কষ্টের প্রতিদান কিছুটা হলেও দেওয়ার।’
খেতে খেতে আমরা সাধারন নিত্যনৈমিত্তিক কথা বার্তা বললাম- বিশেষ কিছু না, জীবনের নতুন নতুন ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী একজন আরেকজনকে জানালাম। আমরা অনেকক্ষন গল্প করলাম। পরে যখন মাকে তার বাসায় নামিয়ে দিচ্ছিলাম, তিনি বললেন- “আমি তোমার সাথে আবার বেড়াতে যাব, কিন্তু দাওয়াতটা আমি দেব।” আমি রাজী হলাম।
যখন ঘরে ফিরলাম, আমার স্ত্রী প্রশ্ন করল, ‘তোমার সাক্ষাত কেমন কাটল?’ জবাব দিলাম, ‘ভীষণ ভাল, আমি যেমন ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক ভাল।’
কিছুদিন পর আমার মা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটলো যে তার জন্য আমার কোন কিচ্ছু করার সুযোগও হল না। কিছুদিন পর একটা খাম আসলো আমার কাছে। ভেতরে একটা সেই রেস্তোরাঁর রিসিট যেখানে মাকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। সাথে একটি ছোট্ট চিঠি, তাতে লেখা-
‘আমি এই বিলটি অগ্রিম আদায় করে দিয়েছি, জানিনা তোমার সাথে আবার সেখানে যেতে পারতাম কিনা; যাইহোক আমি দুই জনের খাবারের দাম দিয়ে দিয়েছি- একটা তোমার আরেকটা তোমার স্ত্রীর জন্য। তুমি কখনও বুঝবে না সেই রাতটি আমার জন্য কত বিশেষ ছিল। তোমাকে অনেক ভালবাসি বাবা।’
সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম, সময়মত ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলতে পারা এবং প্রিয় মানুষগুলোকে কিছুটা একান্ত সময় দেওয়া কতটা জরুরী। জীবনে নিজের পরিবারের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। তাদেরকে তাদের প্রাপ্য সময়টুকু দিন, কারন এগুলো কখনও ‘পরে কোন এক সময়’ এর জন্য ফেলে রাখা যায় না।
আল্লাহ যেন আমাদের সবার মাদেরকে যারা জীবিত আছেন এবং মারা গেছেন, তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে তাদের জন্য দয়া, ধৈর্য এবং ভালবাসা দান করেন। “রব্বির হামহুমা কামা রব্বায়া-নি সগীরা”
“মায়ের সাথে থাক, কারন জান্নাত তাঁরই পদতলে” (ইবনে মাজাহ, সুনান, হাদিস নং ২৭৭১)
আমার স্ত্রী যার সাথে আমাকে বাইরে যেতে বলছিল, তিনি ছিলেন আমার মা, যিনি ১৯ বছর আগে বিধবা হয়ে গেছেন; কিন্তু আমার কাজের চাপ আর তিন সন্তানের দায়িত্বের কারনে শুধু কোন উপলক্ষ হলেই তার সাথে আমার দেখা হওয়া সম্ভব হত।
সেই রাতে আমি মাকে ফোন করে একসাথে বাইরে বেড়াতে ও খেতে যাওয়ার আমন্ত্রন জানালাম। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কি ব্যপার বাবা, তুমি ভাল আছ তো?’
আমার মা হলেন এমন একজন মানুষ যিনি গভীর রাতে ফোন কল বা আকস্মিক দাওয়াতকে কোন দুঃসংবাদ বলে আগাম আশঙ্কা করেন। মায়ের প্রশ্নে আমি বললাম, ‘ভাবছি তোমার সাথে কিছু ভাল সময় কাটাবো মা। শুধু তুমি আর আমি।’ তিনি এক মুহূর্ত ভাবলেন, তারপর বললেন, “এমন হলে আমার খুবই ভাল লাগবে বাবা।”
কাজ শেষে সেদিন যখন ড্রাইভ করে মাকে তুলে নিতে গেলাম, কিছুটা নার্ভাস বোধ করছিলাম। যখন সেখানে পৌঁছলাম, খেয়াল করলাম, তিনিও যেন এভাবে দেখা করার জন্য কিছুটা নার্ভাস। তিনি রেডি হয়ে দরজার কাছেই অপেক্ষা করছিলেন। তার চেহারা ছিল দ্যুতিময় হাসি। গাড়িতে উঠতে উঠতে তিনি বললেন, ‘আমি আমার বন্ধুদের বলেছি যে আমি আমার ছেলের সাথে বেড়াতে যাচ্ছি; তারা শুনে খুবই খুশী হয়েছে। আমাদের সাক্ষাতের বর্ণনা শোনার জন্য তারা অধীর ভাবে অপেক্ষা করছে।’
আমরা যে রেস্তোরাঁয় গেলাম, সেটা খুব দামী না হলেও বেশ ভাল আর আরামদায়ক ছিল। আমার মা আমার বাহু ধরে ছিলেন, যেন তিনি একজন ‘ফার্স্ট লেডী’। বসার পরে আমাকেই মেনু পড়ে শোনাতে হল। তিনি শুধু বড় লেখা পড়তে পারতেন। অর্ধেক পড়ে শোনানোর পর মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি তাকিয়ে শুধু আমাকে দেখছেন। তার ঠোঁটে এক নস্টালজিক হাসি। তিনি বললেন, ‘তুমি যখন ছোট ছিলে, আমাকে মেনু পড়ে শোনাতে হত।’ আমি বললাম, ‘এখন তাহলে সময় এসেছে যেন তুমি আরাম কর আর আমাকে সুযোগ দাও তোমার সেই কষ্টের প্রতিদান কিছুটা হলেও দেওয়ার।’
খেতে খেতে আমরা সাধারন নিত্যনৈমিত্তিক কথা বার্তা বললাম- বিশেষ কিছু না, জীবনের নতুন নতুন ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী একজন আরেকজনকে জানালাম। আমরা অনেকক্ষন গল্প করলাম। পরে যখন মাকে তার বাসায় নামিয়ে দিচ্ছিলাম, তিনি বললেন- “আমি তোমার সাথে আবার বেড়াতে যাব, কিন্তু দাওয়াতটা আমি দেব।” আমি রাজী হলাম।
যখন ঘরে ফিরলাম, আমার স্ত্রী প্রশ্ন করল, ‘তোমার সাক্ষাত কেমন কাটল?’ জবাব দিলাম, ‘ভীষণ ভাল, আমি যেমন ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক ভাল।’
কিছুদিন পর আমার মা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটলো যে তার জন্য আমার কোন কিচ্ছু করার সুযোগও হল না। কিছুদিন পর একটা খাম আসলো আমার কাছে। ভেতরে একটা সেই রেস্তোরাঁর রিসিট যেখানে মাকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। সাথে একটি ছোট্ট চিঠি, তাতে লেখা-
‘আমি এই বিলটি অগ্রিম আদায় করে দিয়েছি, জানিনা তোমার সাথে আবার সেখানে যেতে পারতাম কিনা; যাইহোক আমি দুই জনের খাবারের দাম দিয়ে দিয়েছি- একটা তোমার আরেকটা তোমার স্ত্রীর জন্য। তুমি কখনও বুঝবে না সেই রাতটি আমার জন্য কত বিশেষ ছিল। তোমাকে অনেক ভালবাসি বাবা।’
সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম, সময়মত ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলতে পারা এবং প্রিয় মানুষগুলোকে কিছুটা একান্ত সময় দেওয়া কতটা জরুরী। জীবনে নিজের পরিবারের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। তাদেরকে তাদের প্রাপ্য সময়টুকু দিন, কারন এগুলো কখনও ‘পরে কোন এক সময়’ এর জন্য ফেলে রাখা যায় না।
আল্লাহ যেন আমাদের সবার মাদেরকে যারা জীবিত আছেন এবং মারা গেছেন, তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে তাদের জন্য দয়া, ধৈর্য এবং ভালবাসা দান করেন। “রব্বির হামহুমা কামা রব্বায়া-নি সগীরা”
“মায়ের সাথে থাক, কারন জান্নাত তাঁরই পদতলে” (ইবনে মাজাহ, সুনান, হাদিস নং ২৭৭১)
শিকারি ও বুদ্ধিমান পাখি
একবার এক শিকারি ছোট্ট একটি পাখি ধরে ফেলল। পাখিটি খুব বুদ্ধিমান ছিল। পাখিটি শিকারির খুব প্রশংসা করতে লাগল যে, তুমি এতবড় শিকারি! জীবনে অনেক বাঘ মেরেছ, অনেক ভাল্লুক মেরেছ, এই করেছ, সেই করেছ। আমি একটা ছোট্ট পাখি, আমার ওজন ১০০ গ্রামও না, আমাকে খেয়ে তুমি কী করবে? আমাকে খেলে তো তোমার পেটের একটা কোনাও ভরবে না। তার চেয়ে বরং আমাকে ছেড়ে দাও। তোমাকে এমন তিনটি মূল্যবান বাণী শোনাব যা তোমার সারাজীবন কাজে লাগবে।
এমনভাবে সে কথাবার্তা বলছিল যে শিকারির মন গলে গেল। কারণ তেল পেতে সবাই পছন্দ করে। আরেকজনকে গলানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তেল। সে ভেবে দেখল, ঠিকই তো। এত ছোট পাখি খেয়ে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে শুনি, পাখিটা কী বলতে চায়। হয়তো এতে আমার লাভ বেশি হবে। শিকারি রাজি হওয়ায় পাখিটি বলল, আমি প্রথম বাক্যটি বলব তোমার হাতের ওপর বসে, দ্বিতীয় বাক্যটি বলব এই গাছের ডালে বসে, তৃতীয় বাক্যটি বলবো গাছের মগডালে বসে। শিকারি বললো, ঠিক আছে।
পাখি বলল, ‘কখনো অলীক কল্পনা কর না, যা অবাস্তব সেটা কখনো বিশ্বাস কর না’। শিকারি বলল, খুব ঠিক কথা। সত্যিই তাই। কখনো অবাস্তব কথায় বিশ্বাস করতে নেই। পাখি বলল, এবার আমাকে গাছের ডালে যেতে দাও। আমি দ্বিতীয় বাক্যটি বলব। শিকারি ছেড়ে দিল। গাছের ডালে উঠে পাখি বলল, ‘যা হাতছাড়া হয়ে গেল তা নিয়ে কখনো আফসোস কর না।’ শিকারি বললো, এটাও ঠিক। যা আর আমার নেই, তা নিয়ে আফসোস করা তো বোকামি। পাখি এবার মগডালে উঠল।
শিকারি বলল, এবার তৃতীয় উপদেশটি বল। পাখি বলল, তৃতীয়টি বলার আগে দেখে নিই, আগের দুটি উপদেশের শিক্ষা তোমার জীবনে কাজে লাগিয়েছ কি না। পাখিটি বলল, আমার পেটে আছে ২০০ গ্রাম ওজনের একটি মুক্তো। শুনে শিকারি খুব আফসোস শুরু করলো। হায় হায়! এ কী করলাম আমি! এভাবে হাতছাড়া করলাম ধনী হওয়ার এত সহজ সুযোগ! বলেই পাখিকে ধরার ব্যর্থ চেষ্টায় ওপরের দিকে লাফাতে লাগল।
কিন্তু পাখি তো তখন মগডালে। সে হাসল। বলল, দেখ, আমি আগেই বলেছিলাম, অবাস্তব কথা কখনো বিশ্বাস কর না। আমার ওজনই ১০০ গ্রাম। আমার ভেতরে ২০০ গ্রামের মুক্তো থাকবে কীভাবে? বলেছিলাম, যা হাতছাড়া হয়ে গেল তা নিয়ে কখনো আফসোস কর না। কিন্তু তুমি তা-ই করছ। তোমাকে আর কোনো উপদেশ দেয়া অর্থহীন। কারণ অধিকাংশ মানুষের মতো তুমিও উপদেশ কান দিয়ে শুনেছ। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নাও নি। তোমার মতো বোকা ও লোভীদের কারণেই প্রতারকরা প্রতারণা করার সুযোগ পায়।
(সংগৃহীত)
একবার এক শিকারি ছোট্ট একটি পাখি ধরে ফেলল। পাখিটি খুব বুদ্ধিমান ছিল। পাখিটি শিকারির খুব প্রশংসা করতে লাগল যে, তুমি এতবড় শিকারি! জীবনে অনেক বাঘ মেরেছ, অনেক ভাল্লুক মেরেছ, এই করেছ, সেই করেছ। আমি একটা ছোট্ট পাখি, আমার ওজন ১০০ গ্রামও না, আমাকে খেয়ে তুমি কী করবে? আমাকে খেলে তো তোমার পেটের একটা কোনাও ভরবে না। তার চেয়ে বরং আমাকে ছেড়ে দাও। তোমাকে এমন তিনটি মূল্যবান বাণী শোনাব যা তোমার সারাজীবন কাজে লাগবে।
এমনভাবে সে কথাবার্তা বলছিল যে শিকারির মন গলে গেল। কারণ তেল পেতে সবাই পছন্দ করে। আরেকজনকে গলানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তেল। সে ভেবে দেখল, ঠিকই তো। এত ছোট পাখি খেয়ে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে শুনি, পাখিটা কী বলতে চায়। হয়তো এতে আমার লাভ বেশি হবে। শিকারি রাজি হওয়ায় পাখিটি বলল, আমি প্রথম বাক্যটি বলব তোমার হাতের ওপর বসে, দ্বিতীয় বাক্যটি বলব এই গাছের ডালে বসে, তৃতীয় বাক্যটি বলবো গাছের মগডালে বসে। শিকারি বললো, ঠিক আছে।
পাখি বলল, ‘কখনো অলীক কল্পনা কর না, যা অবাস্তব সেটা কখনো বিশ্বাস কর না’। শিকারি বলল, খুব ঠিক কথা। সত্যিই তাই। কখনো অবাস্তব কথায় বিশ্বাস করতে নেই। পাখি বলল, এবার আমাকে গাছের ডালে যেতে দাও। আমি দ্বিতীয় বাক্যটি বলব। শিকারি ছেড়ে দিল। গাছের ডালে উঠে পাখি বলল, ‘যা হাতছাড়া হয়ে গেল তা নিয়ে কখনো আফসোস কর না।’ শিকারি বললো, এটাও ঠিক। যা আর আমার নেই, তা নিয়ে আফসোস করা তো বোকামি। পাখি এবার মগডালে উঠল।
শিকারি বলল, এবার তৃতীয় উপদেশটি বল। পাখি বলল, তৃতীয়টি বলার আগে দেখে নিই, আগের দুটি উপদেশের শিক্ষা তোমার জীবনে কাজে লাগিয়েছ কি না। পাখিটি বলল, আমার পেটে আছে ২০০ গ্রাম ওজনের একটি মুক্তো। শুনে শিকারি খুব আফসোস শুরু করলো। হায় হায়! এ কী করলাম আমি! এভাবে হাতছাড়া করলাম ধনী হওয়ার এত সহজ সুযোগ! বলেই পাখিকে ধরার ব্যর্থ চেষ্টায় ওপরের দিকে লাফাতে লাগল।
কিন্তু পাখি তো তখন মগডালে। সে হাসল। বলল, দেখ, আমি আগেই বলেছিলাম, অবাস্তব কথা কখনো বিশ্বাস কর না। আমার ওজনই ১০০ গ্রাম। আমার ভেতরে ২০০ গ্রামের মুক্তো থাকবে কীভাবে? বলেছিলাম, যা হাতছাড়া হয়ে গেল তা নিয়ে কখনো আফসোস কর না। কিন্তু তুমি তা-ই করছ। তোমাকে আর কোনো উপদেশ দেয়া অর্থহীন। কারণ অধিকাংশ মানুষের মতো তুমিও উপদেশ কান দিয়ে শুনেছ। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নাও নি। তোমার মতো বোকা ও লোভীদের কারণেই প্রতারকরা প্রতারণা করার সুযোগ পায়।
(সংগৃহীত)
সম্রাট ক্রমশ বৃদ্ধ হয়ে পড়ছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, তাঁর একজন উত্তরসূরী দরকার। নিজের কোনো সহকারী বা সন্তানকে বাছাই না করে তিনি আলাদা কিছু করার কথা ভাবছেন। তাই তিনি একদিন রাজ্যের সকল তরুণদের একসঙ্গে ডেকে পাঠালেন। সবাইকে বললেন, “রাজ্যের শাসনকার্য থেকে সরে যাওয়ার সময় হয়েছে আমার। কাজেই নতুন একজন সম্রাট নির্বাচন করারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমি তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনীত করবো।”সম্রাটের কথা শুনে তরুণরা সব হতবাক! কিন্তু সম্রাট বলতে থাকলেন, “আজকে আমি প্রত্যেককে একটি করে বীজ দেবো। এক বিশেষ ধরণের বীজ। আমি চাই, সবাই বীজটি বপন করে, তাতে সেচ দেবে এবং বীজ থেকে যা উৎপন্ন হয়, তা-ই নিয়ে আজ থেকে একবছর পর আবার এখানে ফিরে আসবে। তোমাদের চারাগাছগুলোর মধ্য থেকে আমি যার চারাটিকে পছন্দ করব, সেই হবে পরবর্তী সম্রাট!”
সেদিন আবদুল্লাহ নামে একটি ছেলে সেখানে উপস্থিত ছিল। অন্যদের মতো সেও একটি বীজ পেলো। বাড়ি গিয়ে সে তার মাকে অতি উৎসাহের সাথে পুরো ঘটনাটি খুলে বলল। সব শুনে ছেলেকে মা একটি টব এবং বীজ বপনের জন্য মাটি দিয়ে সাহায্য করলেন। আবদুল্লাহ তার বীজটি বপন করে যত্নের সাথে পানি দিয়ে পরিচর্যা করতে লাগল। প্রতিদিন টবে পানি দিয়ে সে আগ্রহভরে দেখে কোনো চারা গজিয়েছে কিনা। প্রায় সপ্তাহ তিনেক পর, অন্যান্য তরুণদেরকে তাদের বীজ থেকে গজানো চারা নিয়ে কথা বলতে শোনা গেল।আবদুল্লাহ তার বপন করা বীজটি বারবার দেখতে থাকল। কিন্তু চারা গজানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। এমনি করে ৩ সপ্তাহ, ৪ সপ্তাহ, ৫ সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। কোনোকিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না। ততদিনে অন্যরা তাদের চারাগাছ নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছে । অথচ আবদুল্লার বীজ থেকে কোনো চারাই গজায়নি তখনও। ফলে আবদুল্লার মধ্যে একটা ব্যর্থতাবোধ দেখা দিলো। ছয়মাস পেরিয়ে গেলেও লিংয়ের বীজ থেকে কোনো চারা গজালো না। সে বুঝতে পারল বীজটাকে সে নষ্টই করেছে।
সবার চারাগাছ বড় হয়ে গেল কিন্তু আবদুল্লার চারাগাছের কোন খবর নেই। আবদুল্লাহ তার বন্ধুদের কিছু বলল না। শুধু অপেক্ষায় থাকল কখন তার বীজটি থেকে চারা জন্মাবে।দেখতে দেখতে একটি বছর পেরিয়ে গেল। রাজ্যের সকল তরুণরা তাদের চারা নিয়ে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হলো। আবদুল্লাহ তার মাকে বলল, সে খালি টব নিয়ে যাবে না। সততার সাথে বাস্তবতাকে স্বীকার করতে গিয়ে তার অনেক কষ্ট হলো। তবুও ঘটনার প্রতি সৎ থেকে মায়ের কথা অনুযায়ী খালি টব নিয়েই সে রাজ দরবারে উপস্থিত হলো। উপস্থিত হয়ে আবদুল্লাহ অন্য তরুণদের হরেক রংয়ের চারাগাছ দেখে সে বিস্মিত হলো। আকার এবং আকৃতিতেও চারাগুলো বেশ বাহারি আর চমৎকার দেখাচ্ছিল। আবদুল্লাহ দরবারের মেঝেতে খালি টব রাখতেই অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়ল। কয়েকজন তার প্রতি সমবেদনা দেখাতে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, “আরে, চেষ্টা তো আর কম করনি!”
সম্রাট আসলেন, তরুণদের স্বাগত জানালেন এবং কক্ষ পরিদর্শন করলেন। আবদুল্লাহ কেবল পেছনে লুকানোর চেষ্টা করলো। “তোমরা কি চমৎকার চারাগাছ এবং ফুল ফলিয়েছ!” সম্রাট বললেন, “আজ তোমাদের একজনকে পরবর্তী সম্রাট হিসেবে নিয়োগ দেবো।” হঠাৎ করে সম্রাট কক্ষের পেছনে আবদুল্লাহ-কে খালি একটা টবসহ লক্ষ্য করলেন। তাকে সামনে নিয়ে আসার জন্য সম্রাট প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন। আবদুল্লাহ ভয় পেয়ে গেল এবং ভাবল, “সম্রাট জেনে গেছে আমি ব্যর্থ। আমাকে আজ হয়তো মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া হবে!”
আবদুল্লাহ সামনে আসার পর সম্রাট তার নাম জানতে চাইলেন । সে জবাব দিলো, “আমার নাম আবদুল্লাহ।” তরুণরা সবাই হাসতে লাগল এবং তাকে নিয়ে মজা করতে লাগল। সম্রাট সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তিনি আবদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, “তোমাদের নতুন সম্রাটকে দেখে নাও! তার নাম আবদুল্লাহ।” আবদুল্লার কোনোকিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। চারাগাছ তো দূরের কথা, তার বীজটি অঙ্কুরিতই হয়নি। সে কীভাবে নতুন সম্রাট হবে? সম্রাট বলেই গেলেন, “আজ থেকে একবছর আগে এখানে উপস্থিত সবাইকে একটি করে বীজ দিয়েছিলাম। আমি তোমাদেরকে বীজটি বপন করে, পানি দিতে বলেছিলাম এবং একবছর পর আমার কাছে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। আসলে আমি তোমাদের সবাইকে গরম পানিতে সিদ্ধ করা বীজ দিয়েছিলাম যেগুলো থেকে চারা গজানো সম্ভব ছিল না। আবদুল্লাহ ব্যতীত তোমরা সবাই আমাকে দেখানোর জন্য চারা, গাছ এবং ফুল নিয়ে এসেছ। যখন বুঝতে পেরেছ যে, বীজটি গজাবে না, তখন তোমরা আমার দেওয়া বীজটির বদলে অন্যকোনো বীজ বপন করেছিলে। একমাত্র আবদুল্লাহ হচ্ছে সেই তরুণ যে সততা ও সাহসের সাথে আমার দেওয়া সেই বীজসহ খালি টব নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। অতএব, সেই হবে নতুন সম্রাট!”
যদি সততা বপন করেন, ফলবে বিশ্বাস।
যদি সদ্গুণ বপন করেন, জুটবে বন্ধু।
যদি বিনয় বপন করেন, ফলবে মহত্ত্ব।
যদি অধ্যবসায় বপন করেন, আসবে বিজয়।
যদি বিবেচনাবোধ বপন করেন, ফলবে সম্প্রীতি।
যদি কঠোর পরিশ্রম বপন করেন, ফলবে সাফল্য।
যদি ক্ষমাশীলতা বপন করেন, ফলবে মীমাংসা।
যদি স্পষ্টবাদীতা বপন করেন, জন্ম নেবে অন্তরঙ্গতা।
যদি ধৈর্য বপন করেন, ফলবে উন্নতি।
যদি আস্থা-বিশ্বাস বপন করেন, সম্ভব হবে অলৌকিক কিছু।
পক্ষান্তরে,
যদি অসততা বপন করেন, ফলবে অবিশ্বাস।
যদি স্বার্থপরতা বপন করেন, ফলবে সঙ্গীহীনতা।
যদি অহংকার বপন করেন, জুটবে ধ্বংস।
যদি পরশ্রীকাতরতা বপন করেন, জন্ম নেবে সমস্যা।
যদি অলসতা বপন করেন, ফলবে স্থবিরতা।
যদি তিক্ততা বপন করেন, ফলবে জনবিচ্ছিন্নতা।
যদি লোভ বপন করেন, ফলবে কেবলই ক্ষতি।
যদি পরচর্চা বপন করেন, জন্ম নেবে শত্রু।
যদি দুশ্চিন্তা বপন করেন, ফলবে কপালের ভাঁজ।
যদি পাপ বপন করেন, ফলবে অপরাধ।
তাই যা বপন করছেন, সে ব্যাপারে সতর্ক হোন। কারন আজকে যা বপন করবেন তা-ই নির্ধারণ করবে আপনার আগামীর অর্জন। আজকের ছেটানো বীজ আপনার আগামীর জীবনকে হয় ভালো নয়তো আরও মন্দের দিকে নিয়ে যাবে — এই জীবন হতে পারে আপনার নিজের কিংবা আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরের। হ্যাঁ, কোনো একদিন, কোনো না কোনো একভাবে আপনাকে আপনার বীজের ফসল ভোগ করতেই হবে। আপনি আজকে যে ইচ্ছা বা পছন্দ বপন করেছেন, আজকে আপনার যা করতে ভালো লাগে, তার মূল্য আপনাকেই পরিশোধ করতে হবে — করতেই হবে।।
সেদিন আবদুল্লাহ নামে একটি ছেলে সেখানে উপস্থিত ছিল। অন্যদের মতো সেও একটি বীজ পেলো। বাড়ি গিয়ে সে তার মাকে অতি উৎসাহের সাথে পুরো ঘটনাটি খুলে বলল। সব শুনে ছেলেকে মা একটি টব এবং বীজ বপনের জন্য মাটি দিয়ে সাহায্য করলেন। আবদুল্লাহ তার বীজটি বপন করে যত্নের সাথে পানি দিয়ে পরিচর্যা করতে লাগল। প্রতিদিন টবে পানি দিয়ে সে আগ্রহভরে দেখে কোনো চারা গজিয়েছে কিনা। প্রায় সপ্তাহ তিনেক পর, অন্যান্য তরুণদেরকে তাদের বীজ থেকে গজানো চারা নিয়ে কথা বলতে শোনা গেল।আবদুল্লাহ তার বপন করা বীজটি বারবার দেখতে থাকল। কিন্তু চারা গজানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। এমনি করে ৩ সপ্তাহ, ৪ সপ্তাহ, ৫ সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। কোনোকিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না। ততদিনে অন্যরা তাদের চারাগাছ নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছে । অথচ আবদুল্লার বীজ থেকে কোনো চারাই গজায়নি তখনও। ফলে আবদুল্লার মধ্যে একটা ব্যর্থতাবোধ দেখা দিলো। ছয়মাস পেরিয়ে গেলেও লিংয়ের বীজ থেকে কোনো চারা গজালো না। সে বুঝতে পারল বীজটাকে সে নষ্টই করেছে।
সবার চারাগাছ বড় হয়ে গেল কিন্তু আবদুল্লার চারাগাছের কোন খবর নেই। আবদুল্লাহ তার বন্ধুদের কিছু বলল না। শুধু অপেক্ষায় থাকল কখন তার বীজটি থেকে চারা জন্মাবে।দেখতে দেখতে একটি বছর পেরিয়ে গেল। রাজ্যের সকল তরুণরা তাদের চারা নিয়ে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হলো। আবদুল্লাহ তার মাকে বলল, সে খালি টব নিয়ে যাবে না। সততার সাথে বাস্তবতাকে স্বীকার করতে গিয়ে তার অনেক কষ্ট হলো। তবুও ঘটনার প্রতি সৎ থেকে মায়ের কথা অনুযায়ী খালি টব নিয়েই সে রাজ দরবারে উপস্থিত হলো। উপস্থিত হয়ে আবদুল্লাহ অন্য তরুণদের হরেক রংয়ের চারাগাছ দেখে সে বিস্মিত হলো। আকার এবং আকৃতিতেও চারাগুলো বেশ বাহারি আর চমৎকার দেখাচ্ছিল। আবদুল্লাহ দরবারের মেঝেতে খালি টব রাখতেই অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়ল। কয়েকজন তার প্রতি সমবেদনা দেখাতে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, “আরে, চেষ্টা তো আর কম করনি!”
সম্রাট আসলেন, তরুণদের স্বাগত জানালেন এবং কক্ষ পরিদর্শন করলেন। আবদুল্লাহ কেবল পেছনে লুকানোর চেষ্টা করলো। “তোমরা কি চমৎকার চারাগাছ এবং ফুল ফলিয়েছ!” সম্রাট বললেন, “আজ তোমাদের একজনকে পরবর্তী সম্রাট হিসেবে নিয়োগ দেবো।” হঠাৎ করে সম্রাট কক্ষের পেছনে আবদুল্লাহ-কে খালি একটা টবসহ লক্ষ্য করলেন। তাকে সামনে নিয়ে আসার জন্য সম্রাট প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন। আবদুল্লাহ ভয় পেয়ে গেল এবং ভাবল, “সম্রাট জেনে গেছে আমি ব্যর্থ। আমাকে আজ হয়তো মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া হবে!”
আবদুল্লাহ সামনে আসার পর সম্রাট তার নাম জানতে চাইলেন । সে জবাব দিলো, “আমার নাম আবদুল্লাহ।” তরুণরা সবাই হাসতে লাগল এবং তাকে নিয়ে মজা করতে লাগল। সম্রাট সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তিনি আবদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, “তোমাদের নতুন সম্রাটকে দেখে নাও! তার নাম আবদুল্লাহ।” আবদুল্লার কোনোকিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। চারাগাছ তো দূরের কথা, তার বীজটি অঙ্কুরিতই হয়নি। সে কীভাবে নতুন সম্রাট হবে? সম্রাট বলেই গেলেন, “আজ থেকে একবছর আগে এখানে উপস্থিত সবাইকে একটি করে বীজ দিয়েছিলাম। আমি তোমাদেরকে বীজটি বপন করে, পানি দিতে বলেছিলাম এবং একবছর পর আমার কাছে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। আসলে আমি তোমাদের সবাইকে গরম পানিতে সিদ্ধ করা বীজ দিয়েছিলাম যেগুলো থেকে চারা গজানো সম্ভব ছিল না। আবদুল্লাহ ব্যতীত তোমরা সবাই আমাকে দেখানোর জন্য চারা, গাছ এবং ফুল নিয়ে এসেছ। যখন বুঝতে পেরেছ যে, বীজটি গজাবে না, তখন তোমরা আমার দেওয়া বীজটির বদলে অন্যকোনো বীজ বপন করেছিলে। একমাত্র আবদুল্লাহ হচ্ছে সেই তরুণ যে সততা ও সাহসের সাথে আমার দেওয়া সেই বীজসহ খালি টব নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। অতএব, সেই হবে নতুন সম্রাট!”
যদি সততা বপন করেন, ফলবে বিশ্বাস।
যদি সদ্গুণ বপন করেন, জুটবে বন্ধু।
যদি বিনয় বপন করেন, ফলবে মহত্ত্ব।
যদি অধ্যবসায় বপন করেন, আসবে বিজয়।
যদি বিবেচনাবোধ বপন করেন, ফলবে সম্প্রীতি।
যদি কঠোর পরিশ্রম বপন করেন, ফলবে সাফল্য।
যদি ক্ষমাশীলতা বপন করেন, ফলবে মীমাংসা।
যদি স্পষ্টবাদীতা বপন করেন, জন্ম নেবে অন্তরঙ্গতা।
যদি ধৈর্য বপন করেন, ফলবে উন্নতি।
যদি আস্থা-বিশ্বাস বপন করেন, সম্ভব হবে অলৌকিক কিছু।
পক্ষান্তরে,
যদি অসততা বপন করেন, ফলবে অবিশ্বাস।
যদি স্বার্থপরতা বপন করেন, ফলবে সঙ্গীহীনতা।
যদি অহংকার বপন করেন, জুটবে ধ্বংস।
যদি পরশ্রীকাতরতা বপন করেন, জন্ম নেবে সমস্যা।
যদি অলসতা বপন করেন, ফলবে স্থবিরতা।
যদি তিক্ততা বপন করেন, ফলবে জনবিচ্ছিন্নতা।
যদি লোভ বপন করেন, ফলবে কেবলই ক্ষতি।
যদি পরচর্চা বপন করেন, জন্ম নেবে শত্রু।
যদি দুশ্চিন্তা বপন করেন, ফলবে কপালের ভাঁজ।
যদি পাপ বপন করেন, ফলবে অপরাধ।
তাই যা বপন করছেন, সে ব্যাপারে সতর্ক হোন। কারন আজকে যা বপন করবেন তা-ই নির্ধারণ করবে আপনার আগামীর অর্জন। আজকের ছেটানো বীজ আপনার আগামীর জীবনকে হয় ভালো নয়তো আরও মন্দের দিকে নিয়ে যাবে — এই জীবন হতে পারে আপনার নিজের কিংবা আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরের। হ্যাঁ, কোনো একদিন, কোনো না কোনো একভাবে আপনাকে আপনার বীজের ফসল ভোগ করতেই হবে। আপনি আজকে যে ইচ্ছা বা পছন্দ বপন করেছেন, আজকে আপনার যা করতে ভালো লাগে, তার মূল্য আপনাকেই পরিশোধ করতে হবে — করতেই হবে।।
ভারতীয় হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ বঙ্কে লাল, বয়স মাত্র ১৮ বছর, কিন্তু ধর্মীয় বিষয় আশয়ে তার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। একান্ত আগ্রহ থেকে তিনি নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করলেন। এবং এক পর্যায়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি, ধর্মীয় জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে তিনি মদীনায় গমন করেন। সেখানে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং হাদীস শাস্ত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে মিশরের কায়রোতে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেন। আস্তে আস্তে একজন হাদিস বিশারদে পরিণত হন।
তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতায় যোগ দেন এবং দিনে দিনে হাদিস শাস্ত্রের পাণ্ডিত্য লাভ করেন। এই সময়ে হাদিসের মূল্যবান কিছু বইও তিনি লিখেন করেন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি মসজিদের নববীতে দারস দেওয়ার দায়িত্ব পান। দ্বীনি জ্ঞান চর্চার পরিমণ্ডলে এই দায়িত্বকে অত্যন্ত সম্মানজনক মনে করা হয়।
বঙ্কে লালই আজকের শায়খ জিয়াউর রহমান আজমী। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘আল জামি আল হাদিসিস সহীহিস শামিল’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কিতাবটি বিগত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে একমাত্র কিতাব বলা যায়, যেখানে শুধুমাত্র সহীহ হাদিসগুলোকেই স্থান দেয়া হয়েছে এবং এতে একটি হাদিসও পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। ১৬ হাজার হাদিস সংবলিত এই কিতাবটির সংকলনে ১৫ বছর ব্যয় করেছেন জিয়াউর রহমান আজমী। ২০ খণ্ডের এই কিতাবটির বিনির্মাণে ২০০ টি হাদিসের কিতাবের সহায়তা নিয়েছেন তিনি।
তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে অারেকটি হচ্ছে হিন্দি ভাষায় ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ এবং ‘কম্পারেটিভ স্টাডি অন জুদাইজম, ক্রিশ্চিয়ানিটি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান রিলিজিওনস’। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘দি জাজমেন্ট অফ দি প্রফেট’। ইসলাম গ্রহণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘গঙ্গা টু জমজম’।
বঙ্কে লাল (জিয়াউর রহমান আজমী) ১৯৪৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার বিলার্যগঞ্জ গ্রামে এক হিন্দু বাক্ষ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় হাকিম আইয়ুব নামের এক আলেমের সাহচর্যে তিনি ইসলামের সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতায় যোগ দেন এবং দিনে দিনে হাদিস শাস্ত্রের পাণ্ডিত্য লাভ করেন। এই সময়ে হাদিসের মূল্যবান কিছু বইও তিনি লিখেন করেন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি মসজিদের নববীতে দারস দেওয়ার দায়িত্ব পান। দ্বীনি জ্ঞান চর্চার পরিমণ্ডলে এই দায়িত্বকে অত্যন্ত সম্মানজনক মনে করা হয়।
বঙ্কে লালই আজকের শায়খ জিয়াউর রহমান আজমী। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘আল জামি আল হাদিসিস সহীহিস শামিল’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কিতাবটি বিগত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে একমাত্র কিতাব বলা যায়, যেখানে শুধুমাত্র সহীহ হাদিসগুলোকেই স্থান দেয়া হয়েছে এবং এতে একটি হাদিসও পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। ১৬ হাজার হাদিস সংবলিত এই কিতাবটির সংকলনে ১৫ বছর ব্যয় করেছেন জিয়াউর রহমান আজমী। ২০ খণ্ডের এই কিতাবটির বিনির্মাণে ২০০ টি হাদিসের কিতাবের সহায়তা নিয়েছেন তিনি।
তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে অারেকটি হচ্ছে হিন্দি ভাষায় ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ এবং ‘কম্পারেটিভ স্টাডি অন জুদাইজম, ক্রিশ্চিয়ানিটি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান রিলিজিওনস’। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘দি জাজমেন্ট অফ দি প্রফেট’। ইসলাম গ্রহণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘গঙ্গা টু জমজম’।
বঙ্কে লাল (জিয়াউর রহমান আজমী) ১৯৪৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার বিলার্যগঞ্জ গ্রামে এক হিন্দু বাক্ষ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় হাকিম আইয়ুব নামের এক আলেমের সাহচর্যে তিনি ইসলামের সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম।
আমি এবং আপনি .. তিনি এবং সে .. অমুক এবং তমুক .. আমরা প্রত্যেকে এই জীবনে কিছু না কিছু করি …. হতে পারে আপনি এখন রুজি-রোজগারের তল্লাশে ব্যস্ত আছেন। কিংবা খাওয়ার টেবিলে রুচিসম্পন্ন খাদ্য ভক্ষণ করছেন। কিংবা নরম বিছানায় মধুর ঘুমে আচ্ছন্ন আছেন। কিংবা সুস্বাস্থের উদ্দেশ্যে ব্যায়াম করছেন। কিংবা সমুদ্র সৈকতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগের মাধ্যমে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাচ্ছেন। কিংবা কোন মসজিদে নামায আদায় করছেন। কিংবা কুরআনের কিছু অংশ পড়ছেন। কিংবা আল্লাহর যিক্র করছেন। এর বিপরীতও হতে পারে!
হতে পারে প্রেম ভালবাসার হৈচৈ পূর্ণ গান শুনছেন ! কিংবা টেলিভিশনে অর্ধ নগ্ন নর্তকীদের দেখছেন ! কিংবা অন্য কিছু মন্দ কাজ করছেন .. হতে পারে ! যাই হোক না কেন , এসব কাজ আপনি করতে পারেন নাও করতে পারেন, অনুশীলন করতে পারেন আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন। আপনি, কেবল আপনিই শুরু এবং শেষ সিদ্ধান্তের মালিক।
তাই আপনি সানন্দে কাজে যেতে পারেন কিংবা নাও যেতে পারেন! খেতে পারেন কিংবা নাও খেতে পারেন ! অনুরূপ আপনার পুরো ইচ্ছাধীনে যে, আপনি নামায পড়তে পারেন আবার নাও পড়তে পারেন ! আল্লাহকে স্মরণ করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন ! নিকৃষ্ট কাজসমূহ করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন ! বর্ণিত প্রত্যেক বিষয়ের মালিক আপনি , আপনি এসব ব্যাপারে স্বাধীন । আপনি এসব কাজ করতেও পারেন নাও পারেন।
কিন্তু .. শুধু একটি কাজ এমন আছে , যা হবেই হবে। এ বিষয়টি কিন্তু আগের চেয়ে ভিন্ন .. এটি করা এবং না করার স্বাধীনতা আপনার নেই ! বরং অবশ্যই এটা ঘটবে, আপনি তাতে সন্তুষ্ট থাকুন কিংবা অসন্তুষ্ট , চান বা না চান ! সেই অটল সত্যটি হচ্ছে যে, আপনাকে মরতে হবে !!
অত:পর অবশ্যই আপনাকে এক নতুন বাসস্থান এবং ভিন্ন জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আপনার সেই নতুন বাসস্থানটি একটি সংকীর্ণ গর্ত ছাড়া কিছুই হবে না যা, কেবল আপনার দেহটাকে কোনরূপে সেখানে রাখা সম্ভব হবে । তাছাড়া জানালা বিহীন, আলো বিহীন, এই স্থানটি কতই না অন্ধকার হবে! শুধু এতটুকুই নয় বরং উপর থেকে আপনার আপন লোক-জন , আত্মীয়-স্বজনরা নিষ্ঠুরের মত মাটি চাপিয়ে দিবে । আর অজানা অচেনা লোকের মত আপনাকে সেখানে একা ফেলে রেখে নিজ নিজ বাড়ী ফিরবে। যেন আপনি তাদের কেউই নন। আপনি আর্তনাদ ও চিৎকার করে যদি তাদের ডাকতেও থাকেন, তারা শুনতে পাবে না। আপনি শত চেষ্টা করলেও কাফনে জোড়ানো শরীরটাকে খুলে উঠে বসতে পারবেন না। সেই ঘরে প্রচণ্ড গরমে ফ্যান বা এসির ব্যবস্থা থাকবে না ! এমনকি বাইরের একটু বাতাসও প্রবেশ করতে পারবে না। আর না দারুণ ঠাণ্ডার দিনে লেপ-কাঁথার ব্যবস্থা থাকবে! আপনার আশে পাশে হবে বিশ্রী কদাকার পোকা-মাকড় যারা আপনার কাফনকে কুরে কুরে খেয়ে আপনার নরম গোশত-মাংস আঁচড়ে আঁচড়ে খাবে।
এসবের পরেও আপনি জানেন না যে, আপনার সেই নতুন জীবনটা কেমন হবে? আপনি সৌভাগ্যবান হবেন না দুর্ভাগ্যবান! এটা আপনার সৎকাজের উপর নির্ভর করবে যা আপনি এর পূর্বের জীবনে করে ছিলেন। অবশ্যই এটা ভয়ংকর ব্যাপার।
তবে যেহেতু আপনি এই কথাগুলো পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন তার মানে আপনার হাতে নেক আমল করার এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ আছে। তাই আসুন সুযোগ কাজে লাগাই। কারণ এই জীবন তো কয় দিনের মাত্র। তার পর হয়ত: লোকেরা বলবে: অমুক মারা গেছে .. দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে .. ( আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুক ).. দু-চার দিন হয়ত লোকেরা আপনার মৃত্যুতে আফসোস করবে। তার পর ভুলে যাবে।
তাই আসুন, এমন কাজ করি যা আল্লাহ পছন্দ করেন। যেন আপনার নতুন গৃহের জীবনটা সৌভাগ্যের হয়। আল্লাহর কসম! কারণ সেটাই আসল জীবন। যদি সৌভাগ্যবান হন তবে চিরকাল সৌভাগ্যবান থাকবেন। আর সতর্ক থাকুন যেন দুর্ভাগ্যবানদের মধ্যে গণ্য না হন। কারণ সেটি সর্বনাশা !
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
মৃত ব্যক্তিকে যখন কবর দেওয়া হয়, তখন কাল বর্ণ ও নীল বর্ণ দুইজন ফেরেশতা আসে। একজনের নাম মুনকার অপর জনের নাম নাকীর। তারা মৃত ব্যক্তিকে কে জিজ্ঞেসকরবে : এই লোকটির সম্পর্কে (পৃথিবীতে) তুমি কি বলেছিলে? সে বলবে: ইনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। দুই ফেরেশতা বলবে : আমরা জানি যা তুমি বলেছিলে। অত:পর তার কবর দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৭০ গজ সম্প্রসারিত করে তা আলোয় আলোকিত করে দেওয়া হবে। তার পর বলা হবে : ঘুমিয়ে পড়। সে বলবে: আমার পরিবারের কাছে গিয়ে তাদের এ খবর দিতে চাই। ফেরেশতা বলবে: বাসর ঘরের সদ্য বিবাহিত বরের মত ঘুমাও যাকে তার একান্ত আপন জনই ঘুম থেকে জাগাবে। সে এই অবস্থাতেই থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ তাকে পুনরুত্থান না করেন। আর যদি মৃত ব্যক্তি মুনাফেক হয় তাহলে সে বলবে: লোকেরা যা বলত আমিও তাই বলতাম আসলে কি তা জানি না। ফেরেশতা বলবে : আমরা জানতাম যা তুমি বলতে। অত:পর মাটিকে আদেশ করা হবে : জোড়া লেগে যাও। মাটি মিলে যাবে। যার কারণে মৃতের পাঁজরের হাড় চাপে এদিক ওদিক হয়ে যাবে। এই ভাবে তার শাস্তি হতে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ তাঁকে পুনরায় না ওঠান।
[হাদীস হাসান, সহীহুল জামে নং ৭২৪]
আমি এবং আপনি .. তিনি এবং সে .. অমুক এবং তমুক .. আমরা প্রত্যেকে এই জীবনে কিছু না কিছু করি …. হতে পারে আপনি এখন রুজি-রোজগারের তল্লাশে ব্যস্ত আছেন। কিংবা খাওয়ার টেবিলে রুচিসম্পন্ন খাদ্য ভক্ষণ করছেন। কিংবা নরম বিছানায় মধুর ঘুমে আচ্ছন্ন আছেন। কিংবা সুস্বাস্থের উদ্দেশ্যে ব্যায়াম করছেন। কিংবা সমুদ্র সৈকতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগের মাধ্যমে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাচ্ছেন। কিংবা কোন মসজিদে নামায আদায় করছেন। কিংবা কুরআনের কিছু অংশ পড়ছেন। কিংবা আল্লাহর যিক্র করছেন। এর বিপরীতও হতে পারে!
হতে পারে প্রেম ভালবাসার হৈচৈ পূর্ণ গান শুনছেন ! কিংবা টেলিভিশনে অর্ধ নগ্ন নর্তকীদের দেখছেন ! কিংবা অন্য কিছু মন্দ কাজ করছেন .. হতে পারে ! যাই হোক না কেন , এসব কাজ আপনি করতে পারেন নাও করতে পারেন, অনুশীলন করতে পারেন আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন। আপনি, কেবল আপনিই শুরু এবং শেষ সিদ্ধান্তের মালিক।
তাই আপনি সানন্দে কাজে যেতে পারেন কিংবা নাও যেতে পারেন! খেতে পারেন কিংবা নাও খেতে পারেন ! অনুরূপ আপনার পুরো ইচ্ছাধীনে যে, আপনি নামায পড়তে পারেন আবার নাও পড়তে পারেন ! আল্লাহকে স্মরণ করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন ! নিকৃষ্ট কাজসমূহ করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন ! বর্ণিত প্রত্যেক বিষয়ের মালিক আপনি , আপনি এসব ব্যাপারে স্বাধীন । আপনি এসব কাজ করতেও পারেন নাও পারেন।
কিন্তু .. শুধু একটি কাজ এমন আছে , যা হবেই হবে। এ বিষয়টি কিন্তু আগের চেয়ে ভিন্ন .. এটি করা এবং না করার স্বাধীনতা আপনার নেই ! বরং অবশ্যই এটা ঘটবে, আপনি তাতে সন্তুষ্ট থাকুন কিংবা অসন্তুষ্ট , চান বা না চান ! সেই অটল সত্যটি হচ্ছে যে, আপনাকে মরতে হবে !!
অত:পর অবশ্যই আপনাকে এক নতুন বাসস্থান এবং ভিন্ন জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আপনার সেই নতুন বাসস্থানটি একটি সংকীর্ণ গর্ত ছাড়া কিছুই হবে না যা, কেবল আপনার দেহটাকে কোনরূপে সেখানে রাখা সম্ভব হবে । তাছাড়া জানালা বিহীন, আলো বিহীন, এই স্থানটি কতই না অন্ধকার হবে! শুধু এতটুকুই নয় বরং উপর থেকে আপনার আপন লোক-জন , আত্মীয়-স্বজনরা নিষ্ঠুরের মত মাটি চাপিয়ে দিবে । আর অজানা অচেনা লোকের মত আপনাকে সেখানে একা ফেলে রেখে নিজ নিজ বাড়ী ফিরবে। যেন আপনি তাদের কেউই নন। আপনি আর্তনাদ ও চিৎকার করে যদি তাদের ডাকতেও থাকেন, তারা শুনতে পাবে না। আপনি শত চেষ্টা করলেও কাফনে জোড়ানো শরীরটাকে খুলে উঠে বসতে পারবেন না। সেই ঘরে প্রচণ্ড গরমে ফ্যান বা এসির ব্যবস্থা থাকবে না ! এমনকি বাইরের একটু বাতাসও প্রবেশ করতে পারবে না। আর না দারুণ ঠাণ্ডার দিনে লেপ-কাঁথার ব্যবস্থা থাকবে! আপনার আশে পাশে হবে বিশ্রী কদাকার পোকা-মাকড় যারা আপনার কাফনকে কুরে কুরে খেয়ে আপনার নরম গোশত-মাংস আঁচড়ে আঁচড়ে খাবে।
এসবের পরেও আপনি জানেন না যে, আপনার সেই নতুন জীবনটা কেমন হবে? আপনি সৌভাগ্যবান হবেন না দুর্ভাগ্যবান! এটা আপনার সৎকাজের উপর নির্ভর করবে যা আপনি এর পূর্বের জীবনে করে ছিলেন। অবশ্যই এটা ভয়ংকর ব্যাপার।
তবে যেহেতু আপনি এই কথাগুলো পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন তার মানে আপনার হাতে নেক আমল করার এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ আছে। তাই আসুন সুযোগ কাজে লাগাই। কারণ এই জীবন তো কয় দিনের মাত্র। তার পর হয়ত: লোকেরা বলবে: অমুক মারা গেছে .. দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে .. ( আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুক ).. দু-চার দিন হয়ত লোকেরা আপনার মৃত্যুতে আফসোস করবে। তার পর ভুলে যাবে।
তাই আসুন, এমন কাজ করি যা আল্লাহ পছন্দ করেন। যেন আপনার নতুন গৃহের জীবনটা সৌভাগ্যের হয়। আল্লাহর কসম! কারণ সেটাই আসল জীবন। যদি সৌভাগ্যবান হন তবে চিরকাল সৌভাগ্যবান থাকবেন। আর সতর্ক থাকুন যেন দুর্ভাগ্যবানদের মধ্যে গণ্য না হন। কারণ সেটি সর্বনাশা !
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
মৃত ব্যক্তিকে যখন কবর দেওয়া হয়, তখন কাল বর্ণ ও নীল বর্ণ দুইজন ফেরেশতা আসে। একজনের নাম মুনকার অপর জনের নাম নাকীর। তারা মৃত ব্যক্তিকে কে জিজ্ঞেসকরবে : এই লোকটির সম্পর্কে (পৃথিবীতে) তুমি কি বলেছিলে? সে বলবে: ইনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। দুই ফেরেশতা বলবে : আমরা জানি যা তুমি বলেছিলে। অত:পর তার কবর দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৭০ গজ সম্প্রসারিত করে তা আলোয় আলোকিত করে দেওয়া হবে। তার পর বলা হবে : ঘুমিয়ে পড়। সে বলবে: আমার পরিবারের কাছে গিয়ে তাদের এ খবর দিতে চাই। ফেরেশতা বলবে: বাসর ঘরের সদ্য বিবাহিত বরের মত ঘুমাও যাকে তার একান্ত আপন জনই ঘুম থেকে জাগাবে। সে এই অবস্থাতেই থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ তাকে পুনরুত্থান না করেন। আর যদি মৃত ব্যক্তি মুনাফেক হয় তাহলে সে বলবে: লোকেরা যা বলত আমিও তাই বলতাম আসলে কি তা জানি না। ফেরেশতা বলবে : আমরা জানতাম যা তুমি বলতে। অত:পর মাটিকে আদেশ করা হবে : জোড়া লেগে যাও। মাটি মিলে যাবে। যার কারণে মৃতের পাঁজরের হাড় চাপে এদিক ওদিক হয়ে যাবে। এই ভাবে তার শাস্তি হতে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ তাঁকে পুনরায় না ওঠান।
[হাদীস হাসান, সহীহুল জামে নং ৭২৪]
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
দুটি নিয়ামত এমন আছে, যে দুটোতে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হল সুস্থতা আর অবসর। (সহীহ বুখারী ৫৯৭০, ইফা)
এটি একটি সচিত্র সত্যি ঘটনা যা আপনার জীবন, আপনার চিন্তা ধারা ও জীবনের উদ্দেশ্য বদলে দিতে পারে।
ঘটনাটি বাহরাইনের ইব্রাহিম নাসের নামের এক যুবকের। সে জন্মগতভাবেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত, শুধু তার আঙ্গুল ও মাথা নাড়াতে সক্ষম। এমনকি তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের জন্যও তাকে যন্ত্রপাতির সাহায্য নিতে হয়।
এই যুবকটির একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল একদিন শেইখ নাবীল আল আওদির সাথে দেখা করার। এইজন্য ইব্রাহীমের বাবা শেইখের সাথে ফোনে আলাপ করলেন ইব্রাহীমের সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
ইনি শেইখ নাবীল। ইব্রাহীম শেইখ নাবীলকে তার ঘরের দরজা খুলে ঢুকতে দেখে কি ভীষণ খুশী হয়ে গেল! আমরা তার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ তার চেহারাতেই দেখতে পাবো কারণ সে কথা বলে বোঝাতেও অক্ষম।
শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের ঘরে ঢোকার মুহূর্ত।
আর এটি হল শেইখ নাবিলকে দেখে ইব্রাহীমের অভিব্যক্তি।
লক্ষ্য করুন ইব্রাহীমের গলায় শ্বাস নেওয়ার যন্ত্রটি। সে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতেও অক্ষম।
শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের কপালে চুমু খাচ্ছেন
ইব্রাহীম তার বাবা, চাচা ও শেইখ নাবীলের সাথে।
এভাবে শেইখ নাবীল আর ইব্রাহীম আলাপ করলেন ইন্টারনেটে ইসলামের দাওয়াত এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার ব্যপারে। তারা কিছু ঘটনাও আলোচনা করলেন।
এবং তাদের আলাপচারিতার মাঝে শেইখ নাবীল ইব্রাহীমকে একটি প্রশ্ন করলেন। যে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ইব্রাহীম কেঁদে ফেললেন, তার গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল।
ইব্রাহীম না কেঁদে পারলেন না যখন তার কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি মনে পড়ল।
শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের চোখের পানি মুছে দিচ্ছেন।
আপনি কি জানেন কি ছিল সেই প্রশ্ন যা ইব্রাহীমকে কাঁদিয়ে দিল?
শেইখ জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আচ্ছা ইব্রাহীম, আল্লাহ যদি তোমাকে সুস্থ করতেন…তাহলে তুমি কি করতে?
আর তখন ইব্রাহীম এমনভাবে কাঁদলেন যা শেইখ, ইব্রাহীমের বাবা, তার চাচা এবং ঘরের প্রত্যেককে কাঁদিয়ে দিল…এমন কি ক্যামেরাম্যানকেও।
তার উত্তর ছিলঃ আল্লাহর শপথ, আমি তাহলে আনন্দের সাথে মসজিদে যেয়ে আমার নামাজ পড়তাম। আমি আমার সুস্বাস্থ্যের নেয়ামত এমন প্রতিটি কাজে ব্যবহার করতাম যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারে।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কর্মশক্তি ও সুস্বাস্থ্যের নেয়ামত দিয়ে রহমত করেছেন।
কিন্তু আমরা মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়ি না !!! অথচ আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটার অথবা টিভির সামনে বসে সময় কাটিয়ে দেই।
“এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার আছে অন্তঃকরণ অথবা যে শ্রবণ করে একাগ্রচিত্তে।” (সূরা ক্বাফঃ ৩৭)
আল্লাহ যেন আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন আর সেই পথে আমাদের দৃঢ় রাখেন। আমীন।
দুটি নিয়ামত এমন আছে, যে দুটোতে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হল সুস্থতা আর অবসর। (সহীহ বুখারী ৫৯৭০, ইফা)
এটি একটি সচিত্র সত্যি ঘটনা যা আপনার জীবন, আপনার চিন্তা ধারা ও জীবনের উদ্দেশ্য বদলে দিতে পারে।
ঘটনাটি বাহরাইনের ইব্রাহিম নাসের নামের এক যুবকের। সে জন্মগতভাবেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত, শুধু তার আঙ্গুল ও মাথা নাড়াতে সক্ষম। এমনকি তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের জন্যও তাকে যন্ত্রপাতির সাহায্য নিতে হয়।
এই যুবকটির একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল একদিন শেইখ নাবীল আল আওদির সাথে দেখা করার। এইজন্য ইব্রাহীমের বাবা শেইখের সাথে ফোনে আলাপ করলেন ইব্রাহীমের সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
ইনি শেইখ নাবীল। ইব্রাহীম শেইখ নাবীলকে তার ঘরের দরজা খুলে ঢুকতে দেখে কি ভীষণ খুশী হয়ে গেল! আমরা তার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ তার চেহারাতেই দেখতে পাবো কারণ সে কথা বলে বোঝাতেও অক্ষম।
শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের ঘরে ঢোকার মুহূর্ত।
আর এটি হল শেইখ নাবিলকে দেখে ইব্রাহীমের অভিব্যক্তি।
লক্ষ্য করুন ইব্রাহীমের গলায় শ্বাস নেওয়ার যন্ত্রটি। সে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতেও অক্ষম।
শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের কপালে চুমু খাচ্ছেন
ইব্রাহীম তার বাবা, চাচা ও শেইখ নাবীলের সাথে।
এভাবে শেইখ নাবীল আর ইব্রাহীম আলাপ করলেন ইন্টারনেটে ইসলামের দাওয়াত এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার ব্যপারে। তারা কিছু ঘটনাও আলোচনা করলেন।
এবং তাদের আলাপচারিতার মাঝে শেইখ নাবীল ইব্রাহীমকে একটি প্রশ্ন করলেন। যে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ইব্রাহীম কেঁদে ফেললেন, তার গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল।
ইব্রাহীম না কেঁদে পারলেন না যখন তার কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি মনে পড়ল।
শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের চোখের পানি মুছে দিচ্ছেন।
আপনি কি জানেন কি ছিল সেই প্রশ্ন যা ইব্রাহীমকে কাঁদিয়ে দিল?
শেইখ জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আচ্ছা ইব্রাহীম, আল্লাহ যদি তোমাকে সুস্থ করতেন…তাহলে তুমি কি করতে?
আর তখন ইব্রাহীম এমনভাবে কাঁদলেন যা শেইখ, ইব্রাহীমের বাবা, তার চাচা এবং ঘরের প্রত্যেককে কাঁদিয়ে দিল…এমন কি ক্যামেরাম্যানকেও।
তার উত্তর ছিলঃ আল্লাহর শপথ, আমি তাহলে আনন্দের সাথে মসজিদে যেয়ে আমার নামাজ পড়তাম। আমি আমার সুস্বাস্থ্যের নেয়ামত এমন প্রতিটি কাজে ব্যবহার করতাম যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারে।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কর্মশক্তি ও সুস্বাস্থ্যের নেয়ামত দিয়ে রহমত করেছেন।
কিন্তু আমরা মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়ি না !!! অথচ আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটার অথবা টিভির সামনে বসে সময় কাটিয়ে দেই।
“এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার আছে অন্তঃকরণ অথবা যে শ্রবণ করে একাগ্রচিত্তে।” (সূরা ক্বাফঃ ৩৭)
আল্লাহ যেন আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন আর সেই পথে আমাদের দৃঢ় রাখেন। আমীন।
ঠিক কত বছর বয়সে দাস হিসেবে বিক্রির জন্য আবীসিনিয়া থেকে মক্কায় আনা হয়েছিল তাকে তা আমাদের জানা নেই। জানা নেই কে তার মা, কে তার বাবা, বা কি তার বংশ পরিচয়। সেই সময় তার মত অনেককেই বিভিন্ন জায়গা থকে ধরে আনা হত দাস দাসী হিসেবে মক্কার বাজারে বিক্রির জন্য। আর নিষ্ঠুর মনিবদের কাছে বিক্রি হত যারা তাদের জন্য অপেক্ষা করত নির্মম অত্যাচার আর অমানবিক আচরণ। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটা হত তা কিন্তু নয়; এদের মাঝে অনেক সৌভাগ্যবানও ছিল, যাদের মনিবেরা ছিল অনেক ভাল আর দয়াবান।
আবীসিনিয় কিশোরী বারাকাহ ছিল সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। কারণ তার মনিব ছিল আব্দুল মুতালিবের ছেলে আব্দুল্লাহ্। যিনি ছিলেন মক্কার সুদর্শন আর দয়াবান যুবকদের একজন। বারাকাহ ছিল আব্দুল্লাহ্র গৃহে একমাত্র কাজের লোক যে কিনা আমিনার সাথে আব্দুল্লাহর বিয়ের পর তাদের পারিবারিক কাজে সাহায্য সহযোগিতা করত।
বারাকাহর ভাষ্যমতে, বিয়ের দুই সপ্তাহ হতে না হতেই পিতা আব্দুল মুতালিবের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবসার কাজে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়েছিল সদ্যবিবাহিত আব্দুল্লাহকে। ব্যাপারটাতে নববধূ আমিনা খুব হতাশ হয়ে বললঃ
“কি আশ্চর্য! ক আশ্চর্য! হাতের মেহেন্দির রঙ পর্যন্ত (মুছে) যায়নি এখনো আমার, এই অবস্থায় একজন নববধূকে একা রেখে তার স্বামী সিরিয়া যায় কি করে??”
আব্দুল্লাহ্র এই প্রস্থান ছিল আমিনার জন্য খুবই হৃদয়বিদারক। আর সেই কষ্টে বধূ আমিনা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল। বারাকাহ বললঃ “তিনি চলে যাওয়ার পর আমি যখন দেখলাম তাঁর স্ত্রী বেহুঁশ হয়ে পরে আছে, ভয়ে আর কষ্টে আমি যখন অনেক জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম, তখন তিনি চোখ খুললেন হঠাৎ আর তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছিল তখন। কান্না চেপে তিনি বললেনঃ “আমাকে একটু বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আস বারাকাহ।”
“এর পর সেই কষ্টে অনেকদিন শয্যাশায়ী ছিলেন আমিনা। তার পর থেকে কারো সাথেই কথা বলতেন না তিনি আর। এমন কি সেসময় তার শ্বশুর বৃদ্ধ আব্দুল মুতালিব ছাড়া তাকে আর যারা দেখতে আসতেন তাদের দিকে তাকাতেন পর্যন্ত না। ‘ আব্দুল্লাহ সিরিয়া যাবার দুইমাস পর আমিনা এক ভোরে ডাকলেন আমাকে হঠাৎ। তাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল সেই সময়।
তিনি বল্লেনঃ “বারাকাহ, আমি না অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি আজ।”
“নিশ্চয় ভাল কিছু, তাই না ?” জিজ্ঞাস করলাম আমি।
তিনি বললেন, “আমি দেখলাম আমার তলপেট থেকে আশ্চর্য একটা আলো বের হয়ে মক্কার আশেপাশের সমস্ত পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা সবকিছুই আলোকিত করে দিল হঠাৎ।”
“আপনি কি সন্তান–সম্ভবা?” আমি জিজ্ঞাস করলাম।
তিনি বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু অন্য সন্তান–সম্ভাবা মহিলাদের মত কোন ব্যথা, কষ্ট বা অসুস্থতা অনুভব করছিনা আমি”।
আমি বললাম, “নিশ্চয় আপনি এমন একটা সন্তান জন্ম দিবেন যে সবার জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে”।
যতদিন আব্দুল্লাহ দূরে ছিল, আমিনা বেশ বিষণ্ণ ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে ছিল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বারাকাহ প্রায়সময় তার পাশে থেকে বিভিন্ন গালগল্প করতেন এবং বিভিন্ন কথাবার্তা বলে তাকে হাসিখুশি উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করতেন সবসময়। কিন্তু তিনি আরও বেশি বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন যখন একদিন শ্বশুর আব্দুল মুতালিব এসে বললেন, তাদের সবাইকে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে হবে, কারণ ইয়েমেনের তৎকালীন শাসক আব্রাহাহ তার শক্তিশালী দলবল নিয়ে মক্কা আক্রমণ করতে আসছিল। তখন আমিনা তাকে বললেন, তিনি এতই দুর্বল আর বিষণ্ণ যে তার পক্ষে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া সম্ভব না। আমিনা আরও বললেন যে আব্রাহাহ কখনোই মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না আর পবিত্র কাবা গৃহ ধ্বংস করতে পারবেনা। কেননা, স্বয়ং আল্লাহ্ ওটাকে রক্ষা করবেন। কথাটা শুনে শ্বশুর আব্দুল মুতালিব বেশ রাগান্বিত হয়ে পরলেন; কিন্তু পুত্রবধূ আমিনাকে বেশ নির্ভীক দেখাচ্ছিল এব্যাপারে। তার চোখে মুখে বিন্দুমাত্র ভয়ের লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। আর আমিনার কথাই সত্যি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। আমিনার কথামত মক্কায় প্রবেশের পূর্বেই আব্রাহাহ তার হস্তী-বাহিনীসহ পরাজিত আর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা বারাকাহ আমিনার পাশে থাকত। তার ভাষ্যমতে, “ আমি তার পায়ের কাছে ঘুমাতাম আর তার ঘুমের মাঝে স্বামীর জন্য তার বিলাপ আর কান্না শুনতে পেতাম নিয়মিত। মাঝে মাঝে তার কান্নার শব্দে আমার ঘুম পর্যন্ত ভেঙ্গে যেত, তখন আমি বিছানা থেকে উঠে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম”।
ইতিমধ্যে সিরিয়া যাওয়া বণিকদের অনেকেই ফিরে এসেছে এবং তাদের পরিবার-পরিজন তাদের আনন্দের সহিত অভ্যর্থনা দিল। কিন্তু আব্দুল্লাহর কোন খবর জানা গেল না। বারাকাহগোপনে আব্দুল্লাহর খবর নেওয়ার জন্য আব্দুল মুতালিবের বাসায় গেল, কিন্তু কোন খবর পেল না। শুনলে কষ্ট পাবে ভেবে বারাকাহ আমিনাকে খবরটা জানাল না। ইতিমধ্যে সিরিয়া যাত্রী বণিকদের সবাই ফিরে এলো, শুধু মাত্র আব্দুল্লাহ ছাড়া!
পরে ইয়াত্রিব থেকে যখন আব্দুলাহ’র মৃত্যুর খবর আসল বারাকাহ তখন আব্দুল মুতালিবের ঘরেই ছিল। বারাকাহ বললঃ “মক্কার সবচাইতে সুদর্শন যুবক, কুরাইশদের গর্ব আব্দুল্লাহ, যার ফেরার জন্য এত অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম আমরা সবাই, সেই আব্দুল্লাহ ফিরবে না কখনোই আর। খবরটা শুনা মাত্রই জোরে একটা চিৎকার দিলাম আমি আর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আমিনার কাছে ছুটে গেলাম আমি।
দুঃসংবাদটা শোনামাত্রই অজ্ঞান হয়ে গেল আমিনা। এই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার পাশেই ছিলাম আমি। আমিনার ঘরে আমি ছাড়া আর কেউই ছিল না তখন। এইভাবে আসমান জমিন আলোকিত করে মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্ম পর্যন্ত দিবারাত্রি সর্বক্ষণ আমিনার সেবায় নিয়োজিত ছিলাম আমি”। মুহাম্মদ (সঃ) যখন জন্মগ্রহণ করেছিল বারাকাহ সর্বপ্রথম তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। তারপর দাদা আব্দুল মুতালিব এসে ক্বাবায় নিয়ে গেল তাকে, সেখানে সমগ্র মক্কাবাসী উৎসবের মাধ্যমে বরন করে নিলো তাকে। এরপর মুহাম্মদ(সঃ) কে যখন সুস্বাস্থ্যকর উত্তম পরিবেশে লালনপালনের জন্য হালিমার সাথে ‘বাদিয়াতে’ (মরুভূমি) পাঠানো হয়েছিল বেশ কয়েক বছরের জন্য। তখনও বারাকাহ আমিনার সাথে থেকে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করত। পাঁচ বছর বয়সে মুহাম্মদ(সঃ) কে যখন মক্কায় ফিরিয়ে আনা হল তখন মা আমিনা ও বারাকাহ তাকে পরম আনন্দে গ্রহণ করে নিলো। আর মুহাম্মদ(সঃ) এর বয়স যখন ছয় তখন মা আমিনা তার স্বামীর কবর যিয়ারতের মনস্থির করল। শ্বশুর আব্দুল মুতালিব আর বারাকাহ দুজনেই তাকে নিরুৎসাহিত করতে চাইল এব্যাপারে। কিন্তু কোনভাবেই নিরুৎসাহিত করা গেল না আমিনাকে। সুতরাং একদিন সকালে বড় একটি উটে চড়ে সিরিয়া-গামী মরুযাত্রীদের সাথে আমিনা বারাকাহ ও শিশু মুহাম্মদ (সঃ) কে সাথে নিয়ে ইয়াত্রিবের উদ্দ্যশ্যে রওনা দিল। ব্যাপারটা জানলে শিশু মুহাম্মদ(সঃ) মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরতে পারে তাই তারা যে তার বাবার কবর যিয়ারত করতে যাচ্ছিল সেটা মুহাম্মদ(সঃ) কে জানানো হয়নি তখন”।
তাদের কাফেলাতি বেশ দ্রুতই আগাচ্ছিল। বারাকাহ আমিনাকে অন্ততপক্ষে তার সন্তানের স্বার্থে হলেও শান্ত থাকতে বলছিল বারবার। আর এদিকে শিশু মুহাম্মদ(সঃ) যাত্রার প্রায় পুরো সময় জুড়েই বারাকার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল।
ইয়াত্রিব পৌছাতে প্রায় দশদিনের মত লেগেছিল তাদের। প্রতিদিন আব্দুল্লাহর কবরে যাবার সময় আমিনা শিশু মুহাম্মদ(সঃ) কে তার বানু নাজ্জার গোত্রীয় ভাইদের কাছে রেখে যেতেন। এভাবে প্রায় কয়েক সপ্তাহ যাবত প্রতিদিন আমিনা আব্দুল্লাহর কবরে যেতেন। এসময় আমিনা আরও বেশি শোকার্ত হয়ে পড়েছিল।
এরপর মক্কা ফেরার পথে আমিনা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ল হঠাৎ। মক্কা আর ইয়াত্রিবের মাঝামাঝি আল-আবওয়া নামক একটা জায়গায় যাত্রা-বিরতি করতে বাধ্য হল তারা। আমিনার অবস্থা আরও বেশি খারাপ হতে লাগল। এক অমাবস্যার রাতে, তার জ্বর মারাত্মক রকম বেড়ে গেল। এমন সময় আমিনা বারাকাহকে কাছে ডেকে কান্না-বিজড়িত কণ্ঠে কানে কানে বললেনঃ “বারাকাহ, আমি তো আর বেশিক্ষণ বাঁচব না। আমি আমার সন্তান মুহাম্মদ (সঃ) কে তোমার দায়িত্বে দিয়ে গেলাম। পেটে থাকা অবস্থায় বাবাকে হারিয়েছে সে। আর এখন তার চোখের সামনেই তার মাকে হারাতে যাচ্ছে সে। তার মা হয়েই থেকো তুমি, বারাকাহ। কখনোই ছেড়ে যেওনা তাকে তুমি”।
“কথাটা শোনামাত্র হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল আমার, কান্না আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি। আমার কান্না দেখে শিশু মুহাম্মদ(সঃ)ও কাঁদা শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে; জড়িয়ে ধরল তাকে গলায়। আমিনা শেষবারের মত আর্তনাদ করে উঠল একবার। তারপর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তার… সারাজীবনের জন্যই নীরব হয়ে গেল সে”।
বারাকার কান্না থামল না আর। কাঁদতেই থাকল সে অঝোর ধারায়। ধূধূ মরুর বুকে নিজ হাতেই কবর খুঁড়ল সে। আর নিজ হাতেই প্রিয় আমিনাকে দাফন করল সে। বারাকার চোখের জলে ভিজল আমিনার কবর। মা-বাবা হারানো এতিম শিশু মুহাম্মদ(সঃ) কে নিয়ে দাফন শেষে মক্কায় তার দাদা আব্দুল মুতালিবের কাছে ফিরল সে। শিশু মুহাম্মদ (সঃ) কে দেখাশুনা করবার জন্য সেও তাদের সাথে থেকে গেল। এর দুই বছর পর দাদা আব্দুল মুতালিবও যখন মারা গেল তখন সে চাচা আবু তালিবের বাসায় শিশু মুহাম্মদ(সঃ) দেখাশুনা করতে লাগল। এভাবে মুহাম্মদ(সঃ) বড় হওয়া এবং খাদিজার সাথে তার বিয়ে পর্যন্ত আমাদের প্রিয় নবীর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন বারাকাহ।
খাদিজার সাথে বিয়ের পর মুহাম্মদ(সঃ) একদিন বারাকাহকে ডেকে বললেন, “ইয়া উম্মাহ! ( বারাকাহকে তিনি ‘মা’ বলেই সম্বোধন করতেন সবসময়) এখন তো বিবাহিত আমি, আর বিয়েই করেননি আপনি এখনো…কেউ যদি এখন বিয়ে করতে চায় আপনাকে…?” বারাকাহ মুহাম্মদ(সঃ) এর দিকে এক পলক তাকাল আর বলল, “তোমাকে ছেড়ে কখনোই যাবনা আমি। মা কি তার ছেলেকে ছেড়ে যেতে পারে কখনো?” মুহাম্মদ(সঃ) মৃদু হাসলেন আর বারাকাহর কপালে চুমু খেলেন। আর স্ত্রী খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ দেখ, এটাই হল বারাকাহ। আমার নিজের মায়ের পরে ইনিই আমার মা, আমার পরিবার”।
তখন খাদিজা বলল, “বারাকাহ, আপনি আপনার যৌবন বিসর্জন দিয়েছেন আপনার প্রিয় মুহাম্মদ(সঃ) এর জন্য। সে আপনার প্রতি তার দায়িত্ব সম্পাদন করতে চাচ্ছে। তাই আমার আর আপনার প্রিয় মুহাম্মদ(সঃ) এর স্বার্থে বৃদ্ধ হয়ে যাবার আগেই এই বিয়েতে রাজি হয়ে যান আপনি”।
বারাকাহ বলল, “কে আমাকে বিয়ে করবে, খাদিজা?” “ ওই যে… ইয়াত্রিবের খাযরায গোত্রের উবাইদ ঈবনে যায়েদ আমাদের কাছে এসেছিল আপনার বিয়ের ব্যাপারে। দয়া করে না বলবেন না ”।
বারাকাহ রাজি হয়ে গেল। বিয়ের পর উবাইদ ঈবনে যায়েদের সাথে ইয়াত্রিব চলে গেল সে। সেখানে তাদের সন্তান ও হয়েছিল একটি। যার নাম ছিল আইমান। এরপর থেকে লোকে তাকে ‘উম্মে আইমান’ অর্থাৎ আইমানের মা বলেই ডাকত।
তার বিয়ে অবশ্য বেশিদিন ঠেকেনি। হঠাৎ স্বামী মারা গেল তার। আবার সে মক্কায় ফিরে এলো, তার ‘ছেলে’ মুহাম্মদ (সঃ) এর কাছে। তখন মুহাম্মদ(সঃ) ও খাদিজার সাথে আলী বিন আবু তালিব, খাদিজার প্রথম স্বামীর কন্যা হিন্দ, আর যায়েদ বিন হারিথাহও থাকত।
যায়েদ ছিল আরবের কাল্ব গোত্রের লোক। যাকে তার ছেলেবেলায় মক্কায় দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। তখন খাদিজার ভাইপো কিনে নিয়েছিল তাকে খাদিজার সেবা করার জন্য। খাদিজার গৃহে যায়েদ মুহাম্মদ(সঃ) এর সংস্পর্শে আসার পর তার সেবায় নিয়োজিত করল নিজেকে সে। তাদের দুজনের সম্পর্ক ছিল বাবা-ছেলের মতই। সম্পর্কটা এতই সুন্দর ছিল যে যায়েদের বাবা যখন তার ছেলে খোঁজে মক্কায় আসল একদিন তখন মুহাম্মদ(সঃ) যায়েদকে বললেন, তুমি স্বাধীন, ইচ্ছা হলে আমার সাথে থাকতে পার তুমি অথবা তোমার বাবার সাথে চলে যেতে পার। তখন যায়েদ তার বাবাকে বললঃ
“উনাকে [মুহাম্মদ(সঃ) কে] ছেড়ে কখনোই যাবনা আমি। একজন বাবা তার সন্তানকে আদর করেন যেভাবে তার চেয়েও বেশি আদর করেছেন তিনি আমাকে। তিনি এত ভালবাসতেন আমাকে যে একদিনের জন্যও মনে হয়নি আমার যে আমি তার চাকর। তিনি হল সৃষ্টির সেরা মানব। তাকে ছেড়ে কি করে আমি আপনার সাথে যাব?…তাকে ছেড়ে কখনোই যাব না আমি!”
মুহাম্মদ(সঃ) পরে প্রকাশ্যে মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন যায়েদকে। কিন্তু তারপরও যায়েদ উনাকে ছেড়ে যায়নি। বরং তার সাথে থেকে তার সেবায় আরও বেশি মনোনিবেশ করেছিল সে।
পরে মুহাম্মদ(সঃ) যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হলেন, তাতে প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারীদের মধ্যে যায়েদ এবং বারাকাহ ছিল অন্যতম। প্রথম মুসলিম হিসেবে কুরাইশদের অমানুষিক নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছিল তাদের।
নবী করিম(সঃ) এর ইসলাম প্রচারের মিশনে তাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সেসময় ইসলামের বিরুদ্ধে মুশরিকদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা সম্পর্কে গোপনে তথ্য সংগ্রহের জন্য নিজেদের জীবন পর্যন্ত বাজি রেখেছিল তারা।
এক রাতে মুশরিকরা যখন আল-আরকাম [যে গৃহে নবী করিম(সঃ) তার সাহাবীদের ইসলামের শিক্ষা দিতেন] যাবার পথ অবরোধ করে বসল, বারাকাহ সেই অবরোধের মধ্যেই তার জীবন বাজি রেখে খাদিজার পাঠানো গোপন বার্তা নিয়ে আল-আরকামে নবী(সঃ) এর কাছে এসে হাজির হয়েছিলেন। যখন তিনি মুহাম্মদ(সঃ) এর কাছে এসে খবরটা জানালেন, তখন নবী করিম(সঃ) মৃদু হেসে বললেনঃ
“আপনি অনেক ভাগ্যবতী, উম্মে আইমান। নিঃসন্দেহে জান্নাতের অধিবাসী হবেন আপনি”। উম্মে আইমান সেখান থেকে চলে যাবার পর নবী করিম(সঃ) তার সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের মাঝে কেউ যদি জান্নাতি কোন মহিলাকে বিয়ে করবার ইচ্ছা পোষণ কর তবে তার উচিত উম্মে আইমানকে বিয়ে করা”।
এই কথা শুনার পর সব সাহাবীরাই নীরব হয়ে গেলেন হঠাৎ। কোন সাড়া পাওয়া গেল না কারো কাছ থেকে। কেননা উম্মে আইমান না ছিলেন সুন্দরী না ছিলেন আকর্ষণীয়। বয়স ইতিমধ্যেই পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়ে গেছে তার, দেখতেও বৃদ্ধ বৃদ্ধ লাগত তাকে। কিন্তু যায়েদ ইবনে হারিথাহ এগিয়ে এসে বললঃ
“হে আল্লাহ্র নবী, আমিই বিয়ে করব উম্মে আইমান কে। আল্লাহ্র কসম, সুন্দরী রূপবতী মহিলাদের চাইতে তিনিই উত্তম”।
এরপর যথারীতি বিয়ে হয়ে গেল তাদের দুজনের। একটা সন্তানও জন্ম নিয়েছিল তাদের সংসারে। তার নাম ছিল ঊসামা। উসামাকে নিজের সন্তানের মতই ভালবাসতেন নবী করিম(সঃ)। তিনি প্রায়সময়ই খেলাধুলা করতেন তার সাথে,আদর করতেন তাকে চুমু দিয়ে আর খাইয়ে দিতেন তাকে নিজ হাতে। একারণে মুসলিমরা ‘প্রিয় নবীর প্রিয় সন্তান’ হিসেবেই জানত তাকে। অল্প বয়স থেকেই উসামা নিজেকে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করেন। পরে নবী করিম(সঃ) ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন তার উপর।
পরে নবী করিম(সঃ) যখন ইয়াত্রিবে (মদীনায়) হিজরত করলেন তখন তিনি উম্মে আইমান কে রেখে গিয়েছিলেন মক্কায় তার ঘরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেখাশুনা করবার জন্য। পরবর্তীতে উম্মে আইমান একা একায় ‘পুত্র’ মুহাম্মদ(সঃ) এর কাছে মদীনায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। উঁচু পর্বত আর উত্তপ্ত বালি আর মরুঝড় পাড়ি দিয়ে এই কঠিন দীর্ঘ পথ অতিক্রমের কাজটি একা পায়ে হেটেই সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত মদীনায় যখন পৌঁছালেন তিনি তখন তার মুখমণ্ডল ও শরীর ছিল ধুলো আবৃত, ফোসকা পড়ে পা গিয়েছিল ছিঁড়ে আর ফুলে। এত কিছুর পরও তার সেই কঠিন যাত্রাটিকে একমাত্র সম্ভব করে তুলেছিল ‘পুত্র’ মুহাম্মদ(সঃ) এর প্রতি তার অপরিসীম মমতা ও ভালবাসা।
হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে বিস্ময়ে নবী করীম(সঃ) বললেন , “ইয়া উম্মে আইমান! ইয়া উম্মি! ( ও উম্মে আইমান! ও আমার মা!) নিঃসন্দেহে আপনি জান্নাতবাসী”। তারপর পরম মমতায় তার চোখ মুখে নিজের কোমলখানা হাত বুলিয়ে, পা টিপে দিয়ে, কাঁদে দুহাত রেখে আদর করে দিলেন তাকে তিনি।
উম্মে আইমান মদীনায় গিয়েও ইসলামের সেবায় পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করেন নিজেকে তিনি। উহুদের যুদ্ধে তৃষ্ণার্তদের মাঝে পানি বিতরণ করেন তিনি এবং আহত সৈনিকদের সেবা শুশ্রূষা করেন। খাইবার ও হুনাইনের মত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযানেও নবী করিম(সঃ) এর পাশে ছিলেন তিনি।
রসূল (সঃ) এর প্রিয় সাহাবী বারাকাহর পুত্র আইমান হিজরি অষ্টম বর্ষে হুনাইনের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তার স্বামী যায়েদও মুতাহ’র যুদ্ধে শহীদ হন। ইতিমধ্যে বারাকাহর বয়স সত্তরের কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। বার্ধক্যের কারণে বেশীরভাগ সময় ঘরে বসেই কাটাতে হত তার। আবু বকর আর উমর কে সাথে নিয়ে নবী করিম(সঃ) প্রায়সময় তাকে দেখতে যেতেন এবং জিজ্ঞাস করতেন, “ইয়া উম্মি! (ও আমার মা!) কেমন আছেন আপনি?” প্রত্যুত্তরে তিনি বলতেন, “ হে আল্লাহ্র নবী, ইসলাম যতক্ষণ ভাল, আমিও ভাল ততক্ষণ”।
নবী করিম(সঃ) এর ইন্তেকালের পর প্রায়সময়ই কাঁদতে দেখা যেত বারাকাহকে। তাকে যখন একবার জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, “কেন কাঁদছেন এত আপনি?” তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, নবী(সঃ) যে ইন্তেকাল করবেন তা আমি জানতাম, কিন্তু আমি একারণে কাঁদি যে তার মৃত্যুর পর আমাদের প্রতি আল্লাহ্র ওহী নাযিল হবেনা কখনোই আর”।
বারাকাহই হল একমাত্র ব্যক্তি/ মহিলা যে কিনা মুহাম্মদ(সঃ) এর জন্ম থেকে শুরু করে ইন্তেকাল পর্যন্ত পাশে ছিলেন তার। মুহাম্মদ(সঃ) এর পরিবারের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও শ্রম দিয়ে গেছেন সারাজীবন তিনি। নিয়োজিত ছিলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ(সঃ) এর সেবায়। সর্বোপরি ইসলামের ক্রান্তি-লগ্নে, ইসলামের আবির্ভাবের সময়ে ইসলামের প্রতি তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। পরবর্তীতে হযরত উসমানের খিলাফতের সময় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
যদিও কিনা তার বংশ পরিচয় নিয়ে নিশ্চিত হতে পারিনি আজও আমরা, সে যে জান্নাতের অধিবাসী হবে সে ব্যাপারে পুরাপুরি নিশ্চিত আজ আমরা। আল্লাহ্ এভাবেই সৎকাজের প্রতিদান দেন!!
ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খাইরান!
আবীসিনিয় কিশোরী বারাকাহ ছিল সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। কারণ তার মনিব ছিল আব্দুল মুতালিবের ছেলে আব্দুল্লাহ্। যিনি ছিলেন মক্কার সুদর্শন আর দয়াবান যুবকদের একজন। বারাকাহ ছিল আব্দুল্লাহ্র গৃহে একমাত্র কাজের লোক যে কিনা আমিনার সাথে আব্দুল্লাহর বিয়ের পর তাদের পারিবারিক কাজে সাহায্য সহযোগিতা করত।
বারাকাহর ভাষ্যমতে, বিয়ের দুই সপ্তাহ হতে না হতেই পিতা আব্দুল মুতালিবের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবসার কাজে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়েছিল সদ্যবিবাহিত আব্দুল্লাহকে। ব্যাপারটাতে নববধূ আমিনা খুব হতাশ হয়ে বললঃ
“কি আশ্চর্য! ক আশ্চর্য! হাতের মেহেন্দির রঙ পর্যন্ত (মুছে) যায়নি এখনো আমার, এই অবস্থায় একজন নববধূকে একা রেখে তার স্বামী সিরিয়া যায় কি করে??”
আব্দুল্লাহ্র এই প্রস্থান ছিল আমিনার জন্য খুবই হৃদয়বিদারক। আর সেই কষ্টে বধূ আমিনা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল। বারাকাহ বললঃ “তিনি চলে যাওয়ার পর আমি যখন দেখলাম তাঁর স্ত্রী বেহুঁশ হয়ে পরে আছে, ভয়ে আর কষ্টে আমি যখন অনেক জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম, তখন তিনি চোখ খুললেন হঠাৎ আর তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছিল তখন। কান্না চেপে তিনি বললেনঃ “আমাকে একটু বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আস বারাকাহ।”
“এর পর সেই কষ্টে অনেকদিন শয্যাশায়ী ছিলেন আমিনা। তার পর থেকে কারো সাথেই কথা বলতেন না তিনি আর। এমন কি সেসময় তার শ্বশুর বৃদ্ধ আব্দুল মুতালিব ছাড়া তাকে আর যারা দেখতে আসতেন তাদের দিকে তাকাতেন পর্যন্ত না। ‘ আব্দুল্লাহ সিরিয়া যাবার দুইমাস পর আমিনা এক ভোরে ডাকলেন আমাকে হঠাৎ। তাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল সেই সময়।
তিনি বল্লেনঃ “বারাকাহ, আমি না অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি আজ।”
“নিশ্চয় ভাল কিছু, তাই না ?” জিজ্ঞাস করলাম আমি।
তিনি বললেন, “আমি দেখলাম আমার তলপেট থেকে আশ্চর্য একটা আলো বের হয়ে মক্কার আশেপাশের সমস্ত পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা সবকিছুই আলোকিত করে দিল হঠাৎ।”
“আপনি কি সন্তান–সম্ভবা?” আমি জিজ্ঞাস করলাম।
তিনি বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু অন্য সন্তান–সম্ভাবা মহিলাদের মত কোন ব্যথা, কষ্ট বা অসুস্থতা অনুভব করছিনা আমি”।
আমি বললাম, “নিশ্চয় আপনি এমন একটা সন্তান জন্ম দিবেন যে সবার জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে”।
যতদিন আব্দুল্লাহ দূরে ছিল, আমিনা বেশ বিষণ্ণ ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে ছিল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বারাকাহ প্রায়সময় তার পাশে থেকে বিভিন্ন গালগল্প করতেন এবং বিভিন্ন কথাবার্তা বলে তাকে হাসিখুশি উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করতেন সবসময়। কিন্তু তিনি আরও বেশি বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন যখন একদিন শ্বশুর আব্দুল মুতালিব এসে বললেন, তাদের সবাইকে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে হবে, কারণ ইয়েমেনের তৎকালীন শাসক আব্রাহাহ তার শক্তিশালী দলবল নিয়ে মক্কা আক্রমণ করতে আসছিল। তখন আমিনা তাকে বললেন, তিনি এতই দুর্বল আর বিষণ্ণ যে তার পক্ষে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া সম্ভব না। আমিনা আরও বললেন যে আব্রাহাহ কখনোই মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না আর পবিত্র কাবা গৃহ ধ্বংস করতে পারবেনা। কেননা, স্বয়ং আল্লাহ্ ওটাকে রক্ষা করবেন। কথাটা শুনে শ্বশুর আব্দুল মুতালিব বেশ রাগান্বিত হয়ে পরলেন; কিন্তু পুত্রবধূ আমিনাকে বেশ নির্ভীক দেখাচ্ছিল এব্যাপারে। তার চোখে মুখে বিন্দুমাত্র ভয়ের লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। আর আমিনার কথাই সত্যি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। আমিনার কথামত মক্কায় প্রবেশের পূর্বেই আব্রাহাহ তার হস্তী-বাহিনীসহ পরাজিত আর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা বারাকাহ আমিনার পাশে থাকত। তার ভাষ্যমতে, “ আমি তার পায়ের কাছে ঘুমাতাম আর তার ঘুমের মাঝে স্বামীর জন্য তার বিলাপ আর কান্না শুনতে পেতাম নিয়মিত। মাঝে মাঝে তার কান্নার শব্দে আমার ঘুম পর্যন্ত ভেঙ্গে যেত, তখন আমি বিছানা থেকে উঠে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম”।
ইতিমধ্যে সিরিয়া যাওয়া বণিকদের অনেকেই ফিরে এসেছে এবং তাদের পরিবার-পরিজন তাদের আনন্দের সহিত অভ্যর্থনা দিল। কিন্তু আব্দুল্লাহর কোন খবর জানা গেল না। বারাকাহগোপনে আব্দুল্লাহর খবর নেওয়ার জন্য আব্দুল মুতালিবের বাসায় গেল, কিন্তু কোন খবর পেল না। শুনলে কষ্ট পাবে ভেবে বারাকাহ আমিনাকে খবরটা জানাল না। ইতিমধ্যে সিরিয়া যাত্রী বণিকদের সবাই ফিরে এলো, শুধু মাত্র আব্দুল্লাহ ছাড়া!
পরে ইয়াত্রিব থেকে যখন আব্দুলাহ’র মৃত্যুর খবর আসল বারাকাহ তখন আব্দুল মুতালিবের ঘরেই ছিল। বারাকাহ বললঃ “মক্কার সবচাইতে সুদর্শন যুবক, কুরাইশদের গর্ব আব্দুল্লাহ, যার ফেরার জন্য এত অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম আমরা সবাই, সেই আব্দুল্লাহ ফিরবে না কখনোই আর। খবরটা শুনা মাত্রই জোরে একটা চিৎকার দিলাম আমি আর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আমিনার কাছে ছুটে গেলাম আমি।
দুঃসংবাদটা শোনামাত্রই অজ্ঞান হয়ে গেল আমিনা। এই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার পাশেই ছিলাম আমি। আমিনার ঘরে আমি ছাড়া আর কেউই ছিল না তখন। এইভাবে আসমান জমিন আলোকিত করে মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্ম পর্যন্ত দিবারাত্রি সর্বক্ষণ আমিনার সেবায় নিয়োজিত ছিলাম আমি”। মুহাম্মদ (সঃ) যখন জন্মগ্রহণ করেছিল বারাকাহ সর্বপ্রথম তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। তারপর দাদা আব্দুল মুতালিব এসে ক্বাবায় নিয়ে গেল তাকে, সেখানে সমগ্র মক্কাবাসী উৎসবের মাধ্যমে বরন করে নিলো তাকে। এরপর মুহাম্মদ(সঃ) কে যখন সুস্বাস্থ্যকর উত্তম পরিবেশে লালনপালনের জন্য হালিমার সাথে ‘বাদিয়াতে’ (মরুভূমি) পাঠানো হয়েছিল বেশ কয়েক বছরের জন্য। তখনও বারাকাহ আমিনার সাথে থেকে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করত। পাঁচ বছর বয়সে মুহাম্মদ(সঃ) কে যখন মক্কায় ফিরিয়ে আনা হল তখন মা আমিনা ও বারাকাহ তাকে পরম আনন্দে গ্রহণ করে নিলো। আর মুহাম্মদ(সঃ) এর বয়স যখন ছয় তখন মা আমিনা তার স্বামীর কবর যিয়ারতের মনস্থির করল। শ্বশুর আব্দুল মুতালিব আর বারাকাহ দুজনেই তাকে নিরুৎসাহিত করতে চাইল এব্যাপারে। কিন্তু কোনভাবেই নিরুৎসাহিত করা গেল না আমিনাকে। সুতরাং একদিন সকালে বড় একটি উটে চড়ে সিরিয়া-গামী মরুযাত্রীদের সাথে আমিনা বারাকাহ ও শিশু মুহাম্মদ (সঃ) কে সাথে নিয়ে ইয়াত্রিবের উদ্দ্যশ্যে রওনা দিল। ব্যাপারটা জানলে শিশু মুহাম্মদ(সঃ) মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরতে পারে তাই তারা যে তার বাবার কবর যিয়ারত করতে যাচ্ছিল সেটা মুহাম্মদ(সঃ) কে জানানো হয়নি তখন”।
তাদের কাফেলাতি বেশ দ্রুতই আগাচ্ছিল। বারাকাহ আমিনাকে অন্ততপক্ষে তার সন্তানের স্বার্থে হলেও শান্ত থাকতে বলছিল বারবার। আর এদিকে শিশু মুহাম্মদ(সঃ) যাত্রার প্রায় পুরো সময় জুড়েই বারাকার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল।
ইয়াত্রিব পৌছাতে প্রায় দশদিনের মত লেগেছিল তাদের। প্রতিদিন আব্দুল্লাহর কবরে যাবার সময় আমিনা শিশু মুহাম্মদ(সঃ) কে তার বানু নাজ্জার গোত্রীয় ভাইদের কাছে রেখে যেতেন। এভাবে প্রায় কয়েক সপ্তাহ যাবত প্রতিদিন আমিনা আব্দুল্লাহর কবরে যেতেন। এসময় আমিনা আরও বেশি শোকার্ত হয়ে পড়েছিল।
এরপর মক্কা ফেরার পথে আমিনা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ল হঠাৎ। মক্কা আর ইয়াত্রিবের মাঝামাঝি আল-আবওয়া নামক একটা জায়গায় যাত্রা-বিরতি করতে বাধ্য হল তারা। আমিনার অবস্থা আরও বেশি খারাপ হতে লাগল। এক অমাবস্যার রাতে, তার জ্বর মারাত্মক রকম বেড়ে গেল। এমন সময় আমিনা বারাকাহকে কাছে ডেকে কান্না-বিজড়িত কণ্ঠে কানে কানে বললেনঃ “বারাকাহ, আমি তো আর বেশিক্ষণ বাঁচব না। আমি আমার সন্তান মুহাম্মদ (সঃ) কে তোমার দায়িত্বে দিয়ে গেলাম। পেটে থাকা অবস্থায় বাবাকে হারিয়েছে সে। আর এখন তার চোখের সামনেই তার মাকে হারাতে যাচ্ছে সে। তার মা হয়েই থেকো তুমি, বারাকাহ। কখনোই ছেড়ে যেওনা তাকে তুমি”।
“কথাটা শোনামাত্র হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল আমার, কান্না আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি। আমার কান্না দেখে শিশু মুহাম্মদ(সঃ)ও কাঁদা শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে; জড়িয়ে ধরল তাকে গলায়। আমিনা শেষবারের মত আর্তনাদ করে উঠল একবার। তারপর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তার… সারাজীবনের জন্যই নীরব হয়ে গেল সে”।
বারাকার কান্না থামল না আর। কাঁদতেই থাকল সে অঝোর ধারায়। ধূধূ মরুর বুকে নিজ হাতেই কবর খুঁড়ল সে। আর নিজ হাতেই প্রিয় আমিনাকে দাফন করল সে। বারাকার চোখের জলে ভিজল আমিনার কবর। মা-বাবা হারানো এতিম শিশু মুহাম্মদ(সঃ) কে নিয়ে দাফন শেষে মক্কায় তার দাদা আব্দুল মুতালিবের কাছে ফিরল সে। শিশু মুহাম্মদ (সঃ) কে দেখাশুনা করবার জন্য সেও তাদের সাথে থেকে গেল। এর দুই বছর পর দাদা আব্দুল মুতালিবও যখন মারা গেল তখন সে চাচা আবু তালিবের বাসায় শিশু মুহাম্মদ(সঃ) দেখাশুনা করতে লাগল। এভাবে মুহাম্মদ(সঃ) বড় হওয়া এবং খাদিজার সাথে তার বিয়ে পর্যন্ত আমাদের প্রিয় নবীর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন বারাকাহ।
খাদিজার সাথে বিয়ের পর মুহাম্মদ(সঃ) একদিন বারাকাহকে ডেকে বললেন, “ইয়া উম্মাহ! ( বারাকাহকে তিনি ‘মা’ বলেই সম্বোধন করতেন সবসময়) এখন তো বিবাহিত আমি, আর বিয়েই করেননি আপনি এখনো…কেউ যদি এখন বিয়ে করতে চায় আপনাকে…?” বারাকাহ মুহাম্মদ(সঃ) এর দিকে এক পলক তাকাল আর বলল, “তোমাকে ছেড়ে কখনোই যাবনা আমি। মা কি তার ছেলেকে ছেড়ে যেতে পারে কখনো?” মুহাম্মদ(সঃ) মৃদু হাসলেন আর বারাকাহর কপালে চুমু খেলেন। আর স্ত্রী খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ দেখ, এটাই হল বারাকাহ। আমার নিজের মায়ের পরে ইনিই আমার মা, আমার পরিবার”।
তখন খাদিজা বলল, “বারাকাহ, আপনি আপনার যৌবন বিসর্জন দিয়েছেন আপনার প্রিয় মুহাম্মদ(সঃ) এর জন্য। সে আপনার প্রতি তার দায়িত্ব সম্পাদন করতে চাচ্ছে। তাই আমার আর আপনার প্রিয় মুহাম্মদ(সঃ) এর স্বার্থে বৃদ্ধ হয়ে যাবার আগেই এই বিয়েতে রাজি হয়ে যান আপনি”।
বারাকাহ বলল, “কে আমাকে বিয়ে করবে, খাদিজা?” “ ওই যে… ইয়াত্রিবের খাযরায গোত্রের উবাইদ ঈবনে যায়েদ আমাদের কাছে এসেছিল আপনার বিয়ের ব্যাপারে। দয়া করে না বলবেন না ”।
বারাকাহ রাজি হয়ে গেল। বিয়ের পর উবাইদ ঈবনে যায়েদের সাথে ইয়াত্রিব চলে গেল সে। সেখানে তাদের সন্তান ও হয়েছিল একটি। যার নাম ছিল আইমান। এরপর থেকে লোকে তাকে ‘উম্মে আইমান’ অর্থাৎ আইমানের মা বলেই ডাকত।
তার বিয়ে অবশ্য বেশিদিন ঠেকেনি। হঠাৎ স্বামী মারা গেল তার। আবার সে মক্কায় ফিরে এলো, তার ‘ছেলে’ মুহাম্মদ (সঃ) এর কাছে। তখন মুহাম্মদ(সঃ) ও খাদিজার সাথে আলী বিন আবু তালিব, খাদিজার প্রথম স্বামীর কন্যা হিন্দ, আর যায়েদ বিন হারিথাহও থাকত।
যায়েদ ছিল আরবের কাল্ব গোত্রের লোক। যাকে তার ছেলেবেলায় মক্কায় দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। তখন খাদিজার ভাইপো কিনে নিয়েছিল তাকে খাদিজার সেবা করার জন্য। খাদিজার গৃহে যায়েদ মুহাম্মদ(সঃ) এর সংস্পর্শে আসার পর তার সেবায় নিয়োজিত করল নিজেকে সে। তাদের দুজনের সম্পর্ক ছিল বাবা-ছেলের মতই। সম্পর্কটা এতই সুন্দর ছিল যে যায়েদের বাবা যখন তার ছেলে খোঁজে মক্কায় আসল একদিন তখন মুহাম্মদ(সঃ) যায়েদকে বললেন, তুমি স্বাধীন, ইচ্ছা হলে আমার সাথে থাকতে পার তুমি অথবা তোমার বাবার সাথে চলে যেতে পার। তখন যায়েদ তার বাবাকে বললঃ
“উনাকে [মুহাম্মদ(সঃ) কে] ছেড়ে কখনোই যাবনা আমি। একজন বাবা তার সন্তানকে আদর করেন যেভাবে তার চেয়েও বেশি আদর করেছেন তিনি আমাকে। তিনি এত ভালবাসতেন আমাকে যে একদিনের জন্যও মনে হয়নি আমার যে আমি তার চাকর। তিনি হল সৃষ্টির সেরা মানব। তাকে ছেড়ে কি করে আমি আপনার সাথে যাব?…তাকে ছেড়ে কখনোই যাব না আমি!”
মুহাম্মদ(সঃ) পরে প্রকাশ্যে মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন যায়েদকে। কিন্তু তারপরও যায়েদ উনাকে ছেড়ে যায়নি। বরং তার সাথে থেকে তার সেবায় আরও বেশি মনোনিবেশ করেছিল সে।
পরে মুহাম্মদ(সঃ) যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হলেন, তাতে প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারীদের মধ্যে যায়েদ এবং বারাকাহ ছিল অন্যতম। প্রথম মুসলিম হিসেবে কুরাইশদের অমানুষিক নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছিল তাদের।
নবী করিম(সঃ) এর ইসলাম প্রচারের মিশনে তাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সেসময় ইসলামের বিরুদ্ধে মুশরিকদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা সম্পর্কে গোপনে তথ্য সংগ্রহের জন্য নিজেদের জীবন পর্যন্ত বাজি রেখেছিল তারা।
এক রাতে মুশরিকরা যখন আল-আরকাম [যে গৃহে নবী করিম(সঃ) তার সাহাবীদের ইসলামের শিক্ষা দিতেন] যাবার পথ অবরোধ করে বসল, বারাকাহ সেই অবরোধের মধ্যেই তার জীবন বাজি রেখে খাদিজার পাঠানো গোপন বার্তা নিয়ে আল-আরকামে নবী(সঃ) এর কাছে এসে হাজির হয়েছিলেন। যখন তিনি মুহাম্মদ(সঃ) এর কাছে এসে খবরটা জানালেন, তখন নবী করিম(সঃ) মৃদু হেসে বললেনঃ
“আপনি অনেক ভাগ্যবতী, উম্মে আইমান। নিঃসন্দেহে জান্নাতের অধিবাসী হবেন আপনি”। উম্মে আইমান সেখান থেকে চলে যাবার পর নবী করিম(সঃ) তার সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের মাঝে কেউ যদি জান্নাতি কোন মহিলাকে বিয়ে করবার ইচ্ছা পোষণ কর তবে তার উচিত উম্মে আইমানকে বিয়ে করা”।
এই কথা শুনার পর সব সাহাবীরাই নীরব হয়ে গেলেন হঠাৎ। কোন সাড়া পাওয়া গেল না কারো কাছ থেকে। কেননা উম্মে আইমান না ছিলেন সুন্দরী না ছিলেন আকর্ষণীয়। বয়স ইতিমধ্যেই পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়ে গেছে তার, দেখতেও বৃদ্ধ বৃদ্ধ লাগত তাকে। কিন্তু যায়েদ ইবনে হারিথাহ এগিয়ে এসে বললঃ
“হে আল্লাহ্র নবী, আমিই বিয়ে করব উম্মে আইমান কে। আল্লাহ্র কসম, সুন্দরী রূপবতী মহিলাদের চাইতে তিনিই উত্তম”।
এরপর যথারীতি বিয়ে হয়ে গেল তাদের দুজনের। একটা সন্তানও জন্ম নিয়েছিল তাদের সংসারে। তার নাম ছিল ঊসামা। উসামাকে নিজের সন্তানের মতই ভালবাসতেন নবী করিম(সঃ)। তিনি প্রায়সময়ই খেলাধুলা করতেন তার সাথে,আদর করতেন তাকে চুমু দিয়ে আর খাইয়ে দিতেন তাকে নিজ হাতে। একারণে মুসলিমরা ‘প্রিয় নবীর প্রিয় সন্তান’ হিসেবেই জানত তাকে। অল্প বয়স থেকেই উসামা নিজেকে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করেন। পরে নবী করিম(সঃ) ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন তার উপর।
পরে নবী করিম(সঃ) যখন ইয়াত্রিবে (মদীনায়) হিজরত করলেন তখন তিনি উম্মে আইমান কে রেখে গিয়েছিলেন মক্কায় তার ঘরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেখাশুনা করবার জন্য। পরবর্তীতে উম্মে আইমান একা একায় ‘পুত্র’ মুহাম্মদ(সঃ) এর কাছে মদীনায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। উঁচু পর্বত আর উত্তপ্ত বালি আর মরুঝড় পাড়ি দিয়ে এই কঠিন দীর্ঘ পথ অতিক্রমের কাজটি একা পায়ে হেটেই সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত মদীনায় যখন পৌঁছালেন তিনি তখন তার মুখমণ্ডল ও শরীর ছিল ধুলো আবৃত, ফোসকা পড়ে পা গিয়েছিল ছিঁড়ে আর ফুলে। এত কিছুর পরও তার সেই কঠিন যাত্রাটিকে একমাত্র সম্ভব করে তুলেছিল ‘পুত্র’ মুহাম্মদ(সঃ) এর প্রতি তার অপরিসীম মমতা ও ভালবাসা।
হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে বিস্ময়ে নবী করীম(সঃ) বললেন , “ইয়া উম্মে আইমান! ইয়া উম্মি! ( ও উম্মে আইমান! ও আমার মা!) নিঃসন্দেহে আপনি জান্নাতবাসী”। তারপর পরম মমতায় তার চোখ মুখে নিজের কোমলখানা হাত বুলিয়ে, পা টিপে দিয়ে, কাঁদে দুহাত রেখে আদর করে দিলেন তাকে তিনি।
উম্মে আইমান মদীনায় গিয়েও ইসলামের সেবায় পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করেন নিজেকে তিনি। উহুদের যুদ্ধে তৃষ্ণার্তদের মাঝে পানি বিতরণ করেন তিনি এবং আহত সৈনিকদের সেবা শুশ্রূষা করেন। খাইবার ও হুনাইনের মত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযানেও নবী করিম(সঃ) এর পাশে ছিলেন তিনি।
রসূল (সঃ) এর প্রিয় সাহাবী বারাকাহর পুত্র আইমান হিজরি অষ্টম বর্ষে হুনাইনের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তার স্বামী যায়েদও মুতাহ’র যুদ্ধে শহীদ হন। ইতিমধ্যে বারাকাহর বয়স সত্তরের কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। বার্ধক্যের কারণে বেশীরভাগ সময় ঘরে বসেই কাটাতে হত তার। আবু বকর আর উমর কে সাথে নিয়ে নবী করিম(সঃ) প্রায়সময় তাকে দেখতে যেতেন এবং জিজ্ঞাস করতেন, “ইয়া উম্মি! (ও আমার মা!) কেমন আছেন আপনি?” প্রত্যুত্তরে তিনি বলতেন, “ হে আল্লাহ্র নবী, ইসলাম যতক্ষণ ভাল, আমিও ভাল ততক্ষণ”।
নবী করিম(সঃ) এর ইন্তেকালের পর প্রায়সময়ই কাঁদতে দেখা যেত বারাকাহকে। তাকে যখন একবার জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, “কেন কাঁদছেন এত আপনি?” তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, নবী(সঃ) যে ইন্তেকাল করবেন তা আমি জানতাম, কিন্তু আমি একারণে কাঁদি যে তার মৃত্যুর পর আমাদের প্রতি আল্লাহ্র ওহী নাযিল হবেনা কখনোই আর”।
বারাকাহই হল একমাত্র ব্যক্তি/ মহিলা যে কিনা মুহাম্মদ(সঃ) এর জন্ম থেকে শুরু করে ইন্তেকাল পর্যন্ত পাশে ছিলেন তার। মুহাম্মদ(সঃ) এর পরিবারের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও শ্রম দিয়ে গেছেন সারাজীবন তিনি। নিয়োজিত ছিলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ(সঃ) এর সেবায়। সর্বোপরি ইসলামের ক্রান্তি-লগ্নে, ইসলামের আবির্ভাবের সময়ে ইসলামের প্রতি তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। পরবর্তীতে হযরত উসমানের খিলাফতের সময় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
যদিও কিনা তার বংশ পরিচয় নিয়ে নিশ্চিত হতে পারিনি আজও আমরা, সে যে জান্নাতের অধিবাসী হবে সে ব্যাপারে পুরাপুরি নিশ্চিত আজ আমরা। আল্লাহ্ এভাবেই সৎকাজের প্রতিদান দেন!!
ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খাইরান!
লেখকঃ আবু হামযা
‘তারবিয়াহ’ একটি আরবি শব্দ যার ভাষাগত অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি করা, জন্মানো, উন্নতি ইত্যাদি। প্রচলিত অর্থে, তারবিয়াহ’ মানে হচ্ছে মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে উন্নত করা ও প্রশিক্ষণ দান । তাকওয়া, ইলম অর্জন, অন্যদের ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দান এগুলো সবই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তারবিয়াহ’র অন্তর্ভুক্ত তবুও কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মুসলিমদের মানসিকতা উন্নয়ন কিংবা ‘তারবিয়াহ’র বিষয়টি হয়তো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে কিংবা সচেতনভাবে বাদ দেয়া হচ্ছে। এমন একটি ভুলে যাওয়া বিষয় হচ্ছে, কিভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর অনুসারীদের মাঝে একটি বিজয়ী মন মানসিকতা রেখে গিয়েছিলেন, তাদের মাঝে তিনি এই বিজয়ী মানসিকতার লালন ও বৃদ্ধি শিখিয়েছেন। বর্তমান সময়ের মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিজয়ী মানসিকতা কিংবা এর লালন, বৃদ্ধি করা এগুলো নেই, অনুপস্থিত।
সারা দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের আজ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা: নির্যাতন, নিপীড়নের এক অভিন্ন চিত্র সবখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ কারণে এই কঠিন সময়ে এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় যে, মুসলিমদের সেই বিজয়ী মন মানসিকতা আর নেই, বরং তাদেরকে গ্রাস করেছে একটি বিপরীত পরাজিত ক্ষমাপ্রার্থী মানসিকতা। আর এটা যুলুম নির্যাতনের একটি সহজাত ও অনিবার্য ফলাফল। যত বেশি আপনি যুলুম নির্যাতনের ভিকটিম হবেন, তত বেশি আপনার মাঝে তৈরি হবে ভিকটিম মানসিকতা বা পরাজিত মানসিকতা, ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব, কিছু হলেই আপনি ভাবতে শুরু করবেন কিভাবে নিজেকে যুলুমের হাত থেকে রক্ষা করবেন, কুফফারদের থেকে নিজের পিঠ বাঁচাতে কি অজুহাত প্রদর্শন করবেন -এই মানসিকতা। এই পরাজিত অজুহাত প্রদর্শনকারী ক্ষমাপ্রার্থী মানসিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হচ্ছে, নিজের অবস্থানের উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা, তা থেকে উত্তরণে অপারগতা প্রকাশ করা এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা । অতিরিক্ত রয়েছে হতাশা ও নিষ্কর্ম মনোভাব এর জন্মলাভ।
এটা সেই পরাজিত মানসিকতা যা উম্মাহকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে: এবং সমাজ বা আমাদের পরিবেশকে বর্তমান শোচনীয় অবস্থা থেকে উন্নত করে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলদারদের থেকে আমাদের মুসলিম ভূমিকে মুক্ত করা, ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা, দীন কায়েম করা কিংবা চূড়ান্ত লক্ষ্য জান্নাতুল ফিরদাউস অর্জন – এগুলোর পথে বড় বাধা আমাদের পরাজিত মানসিকতা।
অনাকাংক্ষিতভাবে, এই পরাজিত মানসিকতা নিজেই একটি অভিশাপ:
যত বেশি আপনি অজুহাত প্রদর্শনকারী পরাজিত মানসিকতার অধিকারী হবেন, এটা আপনাকে আরও পেঁচিয়ে ধরবে, এরপর তা আরও বাড়তে থাকবে, এটা থেকে কোন মুক্তি নেই, চক্রাকারে কেবল আপনাকে নিচের দিকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যাবে। যারা সত্যিকারের ভিকটিম, তাদের সমবেদনা প্রাপ্য; কিন্তু অধিকাংশ সময়েই যারা নিজেরা পরাজিত মানসিকতার শিকার তাদের দুরবস্থার জন্য সমব্যথা অনুভব করাটাও কঠিন। এমনকি তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে কারণ তারা এমনভাবে কথা বলে, আচরণ করে বা বিশ্বাস করে যে, যেন তারা একটি ক্রমিক ক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে !
অথচ আমরা যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের দিকে মনোযোগী হই, আমরা দেখতে পাই যে তিনি এবং তাঁর সাথীরা সম্মুখীন হয়েছিল এরচেয়েও অনেক কঠিন অত্যাচার-নির্যাতনের। এত কিছুর পরেও তারা নিজেদের মানসিকতার পরাজয় ঘটতে দেননি। বরং, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মাঝে যে মানসিকতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন ও লালন করেছিলেন তাতে তাঁরা শিখেছিলেন ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন যে তারাই সেই সকল লোক যারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করছেন আর জীবন ব্যবস্থা বা সিস্টেম হিসেবে ইসলাম চূড়ান্তভাবে বিজয় ও সফলতা লাভ করবে। তাদের প্রতি হুমকি আর যুলুম যত বেশি কঠিন হতো, তাঁরা তাদের মন মানসিকতাকে তার চেয়েও বেশি ইতিবাচক করে নিতেন।
উদাহরণস্বরূপ, খাববাব ইবন আল-আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবীরা একবার আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে তাদের উপর চলমান অত্যাচার নির্যাতনের কথা তুলে ধরে অনুযোগ অভিযোগ পেশ করলেন। তাঁরা চাইলেন, তিনি যেন তাদের জন্য মুশরিকদের বিরুদ্ধে দুয়া করেন ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। হতে, “…আমি একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি তাঁর নিজের চাদরকে বালিশ বানিয়ে কা’বা গৃহের ছায়ার বসে বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন। আমরা মুশরিকদের পক্ষ থেকে কঠিন নির্যাতন ভোগ করছিলাম। তাই আমি বললাম, আপনি কি (আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তার)জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন না? তখন তিনি উঠে বসলেন এবং তাঁর চেহারা রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদারদের মধ্যে কারো কারো শরীরের হাড় পর্যন্ত সমস্ত মাংস ও শিরা উপশিরাগুলি লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে বের করে ফেলা হত। কিন্তু এসব নির্যাতনও তাদেরকে দীন থেকে বিমুখ করতে পারতো না। তাঁদের মধ্যে কারো মাথার মধ্যবর্তী স্থানে করাত স্থাপন করে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হত। কিন্তু এ নির্যাতনও তাঁদেরকে তাঁদের দীন থেকে ফিরাতে পারতো না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই এ দীনকে পরিপূর্ণ করবেন,ফলে একজন উষ্ট্রারোহী সান’আ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সে ভয় করবে না”। রাবী (র) আরো অতিরিক্ত বর্ণনা করেন “এবং তার মেষ পালের উপর নেকড়ে বাঘের আক্রমণে সে ভয় করবে না”। ( বুখারী ৩৫৭৩ ৬ষ্ঠ খণ্ড)
এরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কারণ ছিল এই যে: তিনি সাহাবাদেরকে আশ্বস্ত করলেন যে, তাদের উপর চলমান নিপীড়ন তো কেবল স্বল্প একটি সময়ের জন্য আর অচিরেই ইসলাম হবে বিজয়ী। তিনি সাহাবাদেরকে তাদের নিজেদের অবস্থার উপর দুঃখ অনুভব, সমবেদনা করতে নিষেধ করে দিলেন, বরং তাদের কষ্টকে তুলনা করলেন পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা ঈমান আনার কারণে যে কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন সেই অবস্থার সাথে যেন তারা এই অত্যাচার নিপীড়নকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন, আর এটাও জানিয়ে আশ্বস্ত করলেন যে, চূড়ান্ত বিজয় হবে ইসলামের।
মদীনার পথে হিজরতকালে, একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। আল্লাহর নবীকে ধরিয়ে দিলে ১০০ উট পুরষ্কার দেয়া হবে, এ লোভে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্ধান করতে এক ব্যক্তি বের হল, সে সুরাকা বিন মালিক। একসময় সে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হল। এই ভয়াবহ বিপদের মুহুর্তে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উলটো সুরাকা বিন মালিকের জন্য একটি নিরাপত্তা পত্র লিখে দিলেন ! বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি বিপদের কারণ ব্যক্তিকে নিরাপত্তা পত্র লিখে দিয়েছিলেন ! তদুপরি তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরাকাকে একটি সোনার বালা উপহার দিতেও রাজি হলেন, তাও কিনা পারস্য সম্রাটের রাজকোষ হতে! আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও সুরাকার অবস্থান হতে চিন্তা করলে, জীবন রক্ষার্থে উটের পিঠে চড়ে আপন জন্মভূমি হতে নির্বাসিত একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এরকম কিছু লাভ করা শুধ অচিন্তনীয় নয়, বরং এক নিশ্চিত অসম্ভব ব্যাপার। অথচ, এরকম এক বিপর্যস্ত সময়ে এহেন সুমহান প্রতিশ্রুতি প্রদান শুধু আবু বকর সিদ্দিকের নিরাপদে মদীনায় গমনের আত্মবিশ্বাসকেই বৃদ্ধি করলো না বরং ইসলাম যে বিজয় লাভ করবে তার প্রতিও বিশ্বাস বৃদ্ধি হল। আর অবশ্যই, যখন পারস্য বিজয় হয়েছিল, সেই সোনার বালা ও খসরুর (পারস্য সম্রাট) মুকুট আনা হল হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট, তিনি সুরাকা ইবন মালিককে ডেকে পাঠালেন ও সেই রাজপোশাক পরিধান করিয়ে দিলেন।
এমনকি জিহাদে রণাঙ্গনের কঠিন সময়েও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে উজ্জীবিত করার একটি আশ্চর্য সক্ষমতা ছিল, এমনকি যদি মনে হতো অনিবার্য পরাজয় সামনে তবুও তিনি তা করতে পারতেন। উহুদ যুদ্ধের কথা স্মরণ করুন, যেখানে কিছু মুসলিম তীরন্দাজের ভুল ও আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ অমান্য করার কারণে মুসলিমদের মাঝে ব্যাপক বিশৃংখলা দেখা দিল, যার ফলে অনেক মুসলিম শহীদ হলেন, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও মারাত্মক আহত হলেন। এমনি একটি পরিস্থিতিতে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুসলিমেরা যুদ্ধের শেষে উহুদ পাহাড়ের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, কুফফারদের কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বিজয়ের উদযাপনসূচক ভংগীতে বলে উঠল, “হুবাল (আরবদের মূর্তি) এর জয় হোক”। এটা ছিল বিজয়ের উদযাপনের ভংগীতে বলা এবং মুসলিমদের প্রতি একটি বিদ্রুপ, যারা ময়দানের আকস্মিক পট পরিবর্তনের কারণে দুর্বলতা অনুভব করছিলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন?সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি জবাব দিব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, আল্লাহ তায়ালা মহান এবং সর্ব শক্তিমান। মুসলিমদের পক্ষে জবাব দিচ্ছিলেন, হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু। একথা শুনে আবু সুফিয়ান উচ্চস্বরে বললো, আমাদের জন্যে ওযযা আছে, তোমাদের ওযযা নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি জবাব দিব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, ‘আল্লাহু মাওলানা ওয়া-লা মাওলা লাকুম’- “আল্লাহ তায়ালা আমাদের অভিভাবক, আর তোমাদের কোন অভিভাবক নেই”।
এরপর আবু সুফিয়ান যে উক্তিটি করেছিল তা থেকে বোঝা যায় যে, মুসলিমদের ইতিবাচক মনোভাব দেখে সে আশ্চর্য হয়েছিল এবং সে বুঝতে পারল যে কথায় সে নীচু হয়ে যাচ্ছে, তাই সে কথার লড়াইয়ে সমতা আনার জন্য বলল, “দিনের বদলা দিন। তোমাদের জন্য বদর ছিল, আর আমাদের জন্য উহুদ…আজ বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের দিন। যুদ্ধ হচ্ছে একটা বালতি”। হযরত উমার আবু সুফিয়ানের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে বললেন, “ না, সমান নয়। আমাদের যারা নিহত হয়েছেন, তারা জান্নাতে রয়েছেন আর তোমাদের যারা নিহত হয়েছে, তারা জাহান্নামে রয়েছে”। মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল চাঙ্গা করতে এই কথাগুলো দারুণ কার্যকরী ভূমিকা রাখল আর তারা ঘোষণা করলেন, বিজয় হয়েছে মুসলিমদেরই, ময়দানে কি হয়েছে তাতে কিছুই আসে যায় না।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল ফাঁকা বুলি আওড়ানো মানুষ ছিলেন না।
উহুদের বিপর্যয়ের পরদিনের ঘটনা দেখুন, যখন অধিকাংশ মুসলিম ক্লান্ত ও আহত, তিনি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যারা লড়াই করেছিলেন তাদের সবাইকে আদেশ দিলেন যে তাঁরা তাদের লৌহবর্ম পড়ে নেয় ও হামরা আল-আসাদ পর্যন্ত যেন কুফফারদের সাথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে তাড়া করে যায়। এটি ছিল এমন একটি সময়, যখন সাহাবাগণ শারিরীক ও মানসিক উভয় দিক থেকে চরমভাবে পরিশ্রান্ত ছিলেন, আহত মন ও দেহ, ব্যথায় অনেকে কাতরাচ্ছেন; এমন পরিস্থিতিতে এ ধরণের আদেশ কেবলমাত্র সেই নেতার কাছ থেকেই আসতে পারে যিনি দূরদর্শী ও অত্যন্ত কুশলী। কুরাইশরা, মক্কায় ফেরার পথে, তারাও চিন্তা করল মদীনায় ফিরে বাকি মুসলিমদের একেবারে চিরদিনের জন্য বিদায় করে দিতে কেননা এখন তারা দুর্বল, এমন সময়ে উলটো তারাই খবর পেল যে, হামরা আল-আসাদের দিকে মুসলিমরা রওনা দিয়েছে, এরপর তারা তড়িঘড়ি করে মক্কার পথে ছুটে পালাল ও আক্রমণের যাবতীয় কল্পনা মন থেকে বিদায় করে দিল। মুসলিমরা হামরা আল-আসাদে তিনি দিন পর্যন্ত অবস্থান করলেন মদীনায় ফেরত আসার পূর্বে; এবারে সমস্ত বাহিনী একেবারে চাঙ্গা ও খোশ মেজাজে ফিরে এলেন, বিজয়ের উদযাপনের আমেজ মন-মেজাজে চলে এল। সপ্তাহ খানেক আগের শারিরীক পরাজয়- বদলে গেল বিজয়ে।
আমাদের জন্যে আরও উদাহরণ হয়েছে খন্দকের যুদ্ধে:
যখন মদীনার মুসলিমদের ঘিরে ফেলেছিল ১০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল শক্তিশালী বাহিনী, যাদের মধ্যে ছিল কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র। মুসলিমদের ছিল মাত্র ৩০০০ জন, উপরন্তু এত বড় বাহিনী তাঁরা কখনো দেখেননি। তখন মদীনায় ছিল দুর্ভিক্ষ, তারা পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধা দূর করার চেষ্টা করতেন, আর চরম বৈরী আবহাওয়ার মাঝে নিজেদের রক্ষার্থে একটানা কাজ করে চললেন ও পরিখা খনন করলেন। যদি এই অবস্থা যথেষ্ট ভীতিকর বলে প্রতীয়মান না হয়, তবে জেনে রাখুন সেই কঠিন পরিস্থিতিতে খবর এল, মদীনার ভেতরকার ইহুদীরা মুসলিমদের সাথে চুক্তি ভংগ করেছে ও শহরের পিছন দিক থেকে আক্রমণের রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তদুপরি, মুনাফিকরা মুসলিমদের সাথে এই কষ্টকর সংগ্রাম ত্যাগ করল ও আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিদ্রুপ,কটাক্ষ করা শুরু করল। মুসলিমরা এত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুর’আনে এ অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন “…এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কন্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে”।
(আহযাব ১০)
এটা ছিল এক প্রাণান্তকর পরিস্থিতি: অথচ তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সুসংবাদ দিলেন যে, তারা বিরাট শক্তিধর তৎকালীন ‘সুপার পাওয়ার’ পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য বিজয় করবেন, আর বাকি আরব্য উপদ্বীপ তো বিজয় হবেই। এতে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পেল ও চূড়ান্ত বিজয়ের সংবাদে আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। আল্লাহ বর্ণণা করছেন, এরপর কিভাবে তারা সেই সম্মিলিত কুফফার সেনাবাহিনীর দিকে ফিরে তাকালো ও আল্লাহকে স্মরণ করলো, তিনি বলেন, “যখন মুমিনরা শক্রবাহিনীকে দেখল, তখন বলল, আল্লাহ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্নসমর্পণই বৃদ্ধি পেল”।(আহযাব ২২)
মানসিকতার পরিবর্তনের প্রভাব ছিল ব্যাপক: এবং এটা ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশ। তিনি আদেশ করেছিলেন যেন তারা পরাজিত ভিকটিম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। যদি তারা পরাজিত মানসিকতার অধিকারী হতেন, হীনমন হয়ে থাকতেন, তারা সেই সুবিশাল শত্রুবাহিনীর সামনে নিঃশেষ হয়ে যেতেন। অথচ, ইতিহাস সাক্ষী, এবারও তারাই বিজয়ী হলেন।
সীরাহ(জীবনী)গ্রন্থগুলো এমন ঘটনার বর্ণনায় ভরপুর:
যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাহিনীকে কৌশলগত কারণে মদীনার দিকে পিছু হটে নিয়ে এলেন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মুতার সেই ময়দানে রোমান সৈন্যদের সংখ্যাধিক্যের কাছে মুসলিমদের ক্ষুদ্র বাহিনীর সৈন্যসংখ্যার কোন তুলনাই হয় না। ফিরতি পথে, অনেকে খালিদ বিন ওয়ালিদকে‘ইয়া ফাররার’ (হে পলায়নকারী) বলে বিদ্রুপ করছিলেন। এই কথাগুলো খালিদকে মনোবল হারা করে দিতে পারতো, এমনকি তা মুসলিম সেনাবাহিনীর মাঝেও দুর্বলতা ছড়িয়ে দিতে পারতো, অথচ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে চাঙ্গা করে দিলেন ও শত্রুদের বিদ্রুপাত্মক কথাকে পালটে দিলেন, তিনি তাদের আদেশ করলেন যেন তারা বলেন, ‘ইয়া কাররার’(হে অগ্রগামী)। এতে তারা বুঝতে পারলেন, কৌশলগত কারণে পিছু হটা আর পলায়ন করা এক নয়। এটা খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাহস শক্তি বৃদ্ধি করল আর তাঁরা এতে এরপর ডজনখানেক যুদ্ধে রোমান ও পারস্য বাহিনীকে পরাভূত করলেন।
বিজয়ী মানসিকতা লালন করা ও তা ধরে রাখা, বৃদ্ধি করা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে:
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পরেও সাহাবীরা জিহাদ চালিয়ে গেলেন ও ইসলামের বিজয় আনতে লাগলেন। উদাহরণ দেখুন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন উসামা বিন যায়িদ(রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর বাহিনীকে ফিরিয়ে আনতে অস্বীকার করেছিলেন তখন তিনি কি বলেছিলেন? অথচ সেই বাহিনী প্রেরণের দিনকয়েক পরেই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করেন। এত বড় মানসিক আঘাত ও দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরবের গোত্রগুলো পরিকল্পনা করছিল মদীনা আক্রমণের, একারণে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই পরিস্থিতিতে বাহিনী প্রেরণ করা উচিত হবে না। আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিলেন, “যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরে কুকুর টেনে নিয়ে যাও তারপরও আমি এই বাহিনী প্রেরণ করবো, আর যদি মদীনায় আমি ছাড়া আর কেউ নাও থাকে তারপরও আমি এই বাহিনী পাঠাব কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দিয়েছেন”!
তিনি কিছুতেই সেই বাহিনীকে ফেরত আনতে চাননি, যারা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশে বের হয়েছিলেন। আর যখন উসামার বাহিনী সামনে এগিয়ে চলল, শত্রুভাবাপন্ন আরব গোত্রগুলো লা-জওয়াব হয়ে গেল, তারা ভেবে পেল না, আল্লাহর নবীর মৃত্যুর মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে কিভাবে এই বাহিনী জিহাদের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এটা সাক্ষ্য দেয়, বিপদের মুখে অবিচল ও অটল থাকার এই মানসিকতার কারণে শত্রুদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি হল ও তারা মদীনা আক্রমণের যাবতীয় কল্পনা বাদ দিল। সাহাবারা অনুধাবন করেছিলেন, মুসলিম হিসেবে যদি টিকে থাকতে হয়, যদি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে হয় তাহলে তাদেরকে অতিক্রম করতে হবে নানা রকম ফিতনা ও পরীক্ষা, সম্মুখীন হতে হবে যুলুম,নির্যাতন ও যন্ত্রণার। কিন্তু তারা জানতেন, দুনিয়া কিংবা আখিরাতে চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই। তারা আরও জানতেন যে, ইসলামের বিজয় হবেই সেটা তাদের জীবদ্দশাতে না হলেও পরবর্তী সময়ে হবে। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি যিনি আমাদেরকে কুর’আন ও হাদীসের বহু স্থানে অবগত করেছেন যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চলমান লড়াইয়ে মুসলিমরাই হবে চূড়ান্ত বিজয়ী আর ইসলাম টিকে থাকবে।
আমাদের অবশ্যই উচিত হল এই পরাজিত ভিকটিম মানসিকতা পরিত্যাগ করা, যাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমাদের দৈনন্দিন দুঃখ দুর্দশার কারণে, এগুলো ঝেড়ে ফেলে আমাদের উচিত একিন তথা দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়া কারণ বিজয় মুমিন ও মুসলিমদেরই। ফলে আমরা আমাদের বর্তমান অপমানজনক অবস্থা থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হব ইনশা আল্লাহ, অথচ আজ আমরা যুলুম ও বাতিলের মোকাবিলা করতে গিয়ে অন্যদের সাহায্য ও সমবেদনার দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি। যদি আমাদের মত করে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমও নিজেদেরকে খোলসের ভেতর গুটিয়ে নিতেন, নিজেদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব পোষণ করতেন, নিজেদের উপর চাপ অনুভব করতেন কিংবা অন্যদের কাছে সাহায্যের আবেদন করতেন, তাহলে আজ আমরা যেভাবে তাদের নাম ও খ্যাতির কথা জানি তা জানতাম না, এটা নিশ্চিত। একমাত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মত ও পথে, তাঁর দেখানো পদ্ধতিতেই সর্বোত্তম উদাহরণ রয়েছে আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে, আমরা কি পারি না নিজেদের সম্মান ও মর্যাদাকে সেই পদ্ধতিতেই উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে ?
আমরা কি পারি না নিজেদেরকে সেই সুনিশ্চিত বিজয়ের অংশ করতে, যার আগমন নিয়ে কোন সন্দেহ নেই?
‘তারবিয়াহ’ একটি আরবি শব্দ যার ভাষাগত অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি করা, জন্মানো, উন্নতি ইত্যাদি। প্রচলিত অর্থে, তারবিয়াহ’ মানে হচ্ছে মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে উন্নত করা ও প্রশিক্ষণ দান । তাকওয়া, ইলম অর্জন, অন্যদের ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দান এগুলো সবই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তারবিয়াহ’র অন্তর্ভুক্ত তবুও কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মুসলিমদের মানসিকতা উন্নয়ন কিংবা ‘তারবিয়াহ’র বিষয়টি হয়তো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে কিংবা সচেতনভাবে বাদ দেয়া হচ্ছে। এমন একটি ভুলে যাওয়া বিষয় হচ্ছে, কিভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর অনুসারীদের মাঝে একটি বিজয়ী মন মানসিকতা রেখে গিয়েছিলেন, তাদের মাঝে তিনি এই বিজয়ী মানসিকতার লালন ও বৃদ্ধি শিখিয়েছেন। বর্তমান সময়ের মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিজয়ী মানসিকতা কিংবা এর লালন, বৃদ্ধি করা এগুলো নেই, অনুপস্থিত।
সারা দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের আজ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা: নির্যাতন, নিপীড়নের এক অভিন্ন চিত্র সবখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ কারণে এই কঠিন সময়ে এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় যে, মুসলিমদের সেই বিজয়ী মন মানসিকতা আর নেই, বরং তাদেরকে গ্রাস করেছে একটি বিপরীত পরাজিত ক্ষমাপ্রার্থী মানসিকতা। আর এটা যুলুম নির্যাতনের একটি সহজাত ও অনিবার্য ফলাফল। যত বেশি আপনি যুলুম নির্যাতনের ভিকটিম হবেন, তত বেশি আপনার মাঝে তৈরি হবে ভিকটিম মানসিকতা বা পরাজিত মানসিকতা, ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব, কিছু হলেই আপনি ভাবতে শুরু করবেন কিভাবে নিজেকে যুলুমের হাত থেকে রক্ষা করবেন, কুফফারদের থেকে নিজের পিঠ বাঁচাতে কি অজুহাত প্রদর্শন করবেন -এই মানসিকতা। এই পরাজিত অজুহাত প্রদর্শনকারী ক্ষমাপ্রার্থী মানসিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হচ্ছে, নিজের অবস্থানের উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা, তা থেকে উত্তরণে অপারগতা প্রকাশ করা এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা । অতিরিক্ত রয়েছে হতাশা ও নিষ্কর্ম মনোভাব এর জন্মলাভ।
এটা সেই পরাজিত মানসিকতা যা উম্মাহকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে: এবং সমাজ বা আমাদের পরিবেশকে বর্তমান শোচনীয় অবস্থা থেকে উন্নত করে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলদারদের থেকে আমাদের মুসলিম ভূমিকে মুক্ত করা, ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা, দীন কায়েম করা কিংবা চূড়ান্ত লক্ষ্য জান্নাতুল ফিরদাউস অর্জন – এগুলোর পথে বড় বাধা আমাদের পরাজিত মানসিকতা।
অনাকাংক্ষিতভাবে, এই পরাজিত মানসিকতা নিজেই একটি অভিশাপ:
যত বেশি আপনি অজুহাত প্রদর্শনকারী পরাজিত মানসিকতার অধিকারী হবেন, এটা আপনাকে আরও পেঁচিয়ে ধরবে, এরপর তা আরও বাড়তে থাকবে, এটা থেকে কোন মুক্তি নেই, চক্রাকারে কেবল আপনাকে নিচের দিকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যাবে। যারা সত্যিকারের ভিকটিম, তাদের সমবেদনা প্রাপ্য; কিন্তু অধিকাংশ সময়েই যারা নিজেরা পরাজিত মানসিকতার শিকার তাদের দুরবস্থার জন্য সমব্যথা অনুভব করাটাও কঠিন। এমনকি তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে কারণ তারা এমনভাবে কথা বলে, আচরণ করে বা বিশ্বাস করে যে, যেন তারা একটি ক্রমিক ক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে !
অথচ আমরা যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের দিকে মনোযোগী হই, আমরা দেখতে পাই যে তিনি এবং তাঁর সাথীরা সম্মুখীন হয়েছিল এরচেয়েও অনেক কঠিন অত্যাচার-নির্যাতনের। এত কিছুর পরেও তারা নিজেদের মানসিকতার পরাজয় ঘটতে দেননি। বরং, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মাঝে যে মানসিকতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন ও লালন করেছিলেন তাতে তাঁরা শিখেছিলেন ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন যে তারাই সেই সকল লোক যারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করছেন আর জীবন ব্যবস্থা বা সিস্টেম হিসেবে ইসলাম চূড়ান্তভাবে বিজয় ও সফলতা লাভ করবে। তাদের প্রতি হুমকি আর যুলুম যত বেশি কঠিন হতো, তাঁরা তাদের মন মানসিকতাকে তার চেয়েও বেশি ইতিবাচক করে নিতেন।
উদাহরণস্বরূপ, খাববাব ইবন আল-আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবীরা একবার আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে তাদের উপর চলমান অত্যাচার নির্যাতনের কথা তুলে ধরে অনুযোগ অভিযোগ পেশ করলেন। তাঁরা চাইলেন, তিনি যেন তাদের জন্য মুশরিকদের বিরুদ্ধে দুয়া করেন ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। হতে, “…আমি একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি তাঁর নিজের চাদরকে বালিশ বানিয়ে কা’বা গৃহের ছায়ার বসে বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন। আমরা মুশরিকদের পক্ষ থেকে কঠিন নির্যাতন ভোগ করছিলাম। তাই আমি বললাম, আপনি কি (আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তার)জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন না? তখন তিনি উঠে বসলেন এবং তাঁর চেহারা রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদারদের মধ্যে কারো কারো শরীরের হাড় পর্যন্ত সমস্ত মাংস ও শিরা উপশিরাগুলি লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে বের করে ফেলা হত। কিন্তু এসব নির্যাতনও তাদেরকে দীন থেকে বিমুখ করতে পারতো না। তাঁদের মধ্যে কারো মাথার মধ্যবর্তী স্থানে করাত স্থাপন করে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হত। কিন্তু এ নির্যাতনও তাঁদেরকে তাঁদের দীন থেকে ফিরাতে পারতো না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই এ দীনকে পরিপূর্ণ করবেন,ফলে একজন উষ্ট্রারোহী সান’আ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সে ভয় করবে না”। রাবী (র) আরো অতিরিক্ত বর্ণনা করেন “এবং তার মেষ পালের উপর নেকড়ে বাঘের আক্রমণে সে ভয় করবে না”। ( বুখারী ৩৫৭৩ ৬ষ্ঠ খণ্ড)
এরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কারণ ছিল এই যে: তিনি সাহাবাদেরকে আশ্বস্ত করলেন যে, তাদের উপর চলমান নিপীড়ন তো কেবল স্বল্প একটি সময়ের জন্য আর অচিরেই ইসলাম হবে বিজয়ী। তিনি সাহাবাদেরকে তাদের নিজেদের অবস্থার উপর দুঃখ অনুভব, সমবেদনা করতে নিষেধ করে দিলেন, বরং তাদের কষ্টকে তুলনা করলেন পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা ঈমান আনার কারণে যে কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন সেই অবস্থার সাথে যেন তারা এই অত্যাচার নিপীড়নকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন, আর এটাও জানিয়ে আশ্বস্ত করলেন যে, চূড়ান্ত বিজয় হবে ইসলামের।
মদীনার পথে হিজরতকালে, একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। আল্লাহর নবীকে ধরিয়ে দিলে ১০০ উট পুরষ্কার দেয়া হবে, এ লোভে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্ধান করতে এক ব্যক্তি বের হল, সে সুরাকা বিন মালিক। একসময় সে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হল। এই ভয়াবহ বিপদের মুহুর্তে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উলটো সুরাকা বিন মালিকের জন্য একটি নিরাপত্তা পত্র লিখে দিলেন ! বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি বিপদের কারণ ব্যক্তিকে নিরাপত্তা পত্র লিখে দিয়েছিলেন ! তদুপরি তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরাকাকে একটি সোনার বালা উপহার দিতেও রাজি হলেন, তাও কিনা পারস্য সম্রাটের রাজকোষ হতে! আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও সুরাকার অবস্থান হতে চিন্তা করলে, জীবন রক্ষার্থে উটের পিঠে চড়ে আপন জন্মভূমি হতে নির্বাসিত একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এরকম কিছু লাভ করা শুধ অচিন্তনীয় নয়, বরং এক নিশ্চিত অসম্ভব ব্যাপার। অথচ, এরকম এক বিপর্যস্ত সময়ে এহেন সুমহান প্রতিশ্রুতি প্রদান শুধু আবু বকর সিদ্দিকের নিরাপদে মদীনায় গমনের আত্মবিশ্বাসকেই বৃদ্ধি করলো না বরং ইসলাম যে বিজয় লাভ করবে তার প্রতিও বিশ্বাস বৃদ্ধি হল। আর অবশ্যই, যখন পারস্য বিজয় হয়েছিল, সেই সোনার বালা ও খসরুর (পারস্য সম্রাট) মুকুট আনা হল হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট, তিনি সুরাকা ইবন মালিককে ডেকে পাঠালেন ও সেই রাজপোশাক পরিধান করিয়ে দিলেন।
এমনকি জিহাদে রণাঙ্গনের কঠিন সময়েও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে উজ্জীবিত করার একটি আশ্চর্য সক্ষমতা ছিল, এমনকি যদি মনে হতো অনিবার্য পরাজয় সামনে তবুও তিনি তা করতে পারতেন। উহুদ যুদ্ধের কথা স্মরণ করুন, যেখানে কিছু মুসলিম তীরন্দাজের ভুল ও আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ অমান্য করার কারণে মুসলিমদের মাঝে ব্যাপক বিশৃংখলা দেখা দিল, যার ফলে অনেক মুসলিম শহীদ হলেন, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও মারাত্মক আহত হলেন। এমনি একটি পরিস্থিতিতে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুসলিমেরা যুদ্ধের শেষে উহুদ পাহাড়ের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, কুফফারদের কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বিজয়ের উদযাপনসূচক ভংগীতে বলে উঠল, “হুবাল (আরবদের মূর্তি) এর জয় হোক”। এটা ছিল বিজয়ের উদযাপনের ভংগীতে বলা এবং মুসলিমদের প্রতি একটি বিদ্রুপ, যারা ময়দানের আকস্মিক পট পরিবর্তনের কারণে দুর্বলতা অনুভব করছিলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন?সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি জবাব দিব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, আল্লাহ তায়ালা মহান এবং সর্ব শক্তিমান। মুসলিমদের পক্ষে জবাব দিচ্ছিলেন, হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু। একথা শুনে আবু সুফিয়ান উচ্চস্বরে বললো, আমাদের জন্যে ওযযা আছে, তোমাদের ওযযা নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি জবাব দিব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, ‘আল্লাহু মাওলানা ওয়া-লা মাওলা লাকুম’- “আল্লাহ তায়ালা আমাদের অভিভাবক, আর তোমাদের কোন অভিভাবক নেই”।
এরপর আবু সুফিয়ান যে উক্তিটি করেছিল তা থেকে বোঝা যায় যে, মুসলিমদের ইতিবাচক মনোভাব দেখে সে আশ্চর্য হয়েছিল এবং সে বুঝতে পারল যে কথায় সে নীচু হয়ে যাচ্ছে, তাই সে কথার লড়াইয়ে সমতা আনার জন্য বলল, “দিনের বদলা দিন। তোমাদের জন্য বদর ছিল, আর আমাদের জন্য উহুদ…আজ বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের দিন। যুদ্ধ হচ্ছে একটা বালতি”। হযরত উমার আবু সুফিয়ানের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে বললেন, “ না, সমান নয়। আমাদের যারা নিহত হয়েছেন, তারা জান্নাতে রয়েছেন আর তোমাদের যারা নিহত হয়েছে, তারা জাহান্নামে রয়েছে”। মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল চাঙ্গা করতে এই কথাগুলো দারুণ কার্যকরী ভূমিকা রাখল আর তারা ঘোষণা করলেন, বিজয় হয়েছে মুসলিমদেরই, ময়দানে কি হয়েছে তাতে কিছুই আসে যায় না।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল ফাঁকা বুলি আওড়ানো মানুষ ছিলেন না।
উহুদের বিপর্যয়ের পরদিনের ঘটনা দেখুন, যখন অধিকাংশ মুসলিম ক্লান্ত ও আহত, তিনি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যারা লড়াই করেছিলেন তাদের সবাইকে আদেশ দিলেন যে তাঁরা তাদের লৌহবর্ম পড়ে নেয় ও হামরা আল-আসাদ পর্যন্ত যেন কুফফারদের সাথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে তাড়া করে যায়। এটি ছিল এমন একটি সময়, যখন সাহাবাগণ শারিরীক ও মানসিক উভয় দিক থেকে চরমভাবে পরিশ্রান্ত ছিলেন, আহত মন ও দেহ, ব্যথায় অনেকে কাতরাচ্ছেন; এমন পরিস্থিতিতে এ ধরণের আদেশ কেবলমাত্র সেই নেতার কাছ থেকেই আসতে পারে যিনি দূরদর্শী ও অত্যন্ত কুশলী। কুরাইশরা, মক্কায় ফেরার পথে, তারাও চিন্তা করল মদীনায় ফিরে বাকি মুসলিমদের একেবারে চিরদিনের জন্য বিদায় করে দিতে কেননা এখন তারা দুর্বল, এমন সময়ে উলটো তারাই খবর পেল যে, হামরা আল-আসাদের দিকে মুসলিমরা রওনা দিয়েছে, এরপর তারা তড়িঘড়ি করে মক্কার পথে ছুটে পালাল ও আক্রমণের যাবতীয় কল্পনা মন থেকে বিদায় করে দিল। মুসলিমরা হামরা আল-আসাদে তিনি দিন পর্যন্ত অবস্থান করলেন মদীনায় ফেরত আসার পূর্বে; এবারে সমস্ত বাহিনী একেবারে চাঙ্গা ও খোশ মেজাজে ফিরে এলেন, বিজয়ের উদযাপনের আমেজ মন-মেজাজে চলে এল। সপ্তাহ খানেক আগের শারিরীক পরাজয়- বদলে গেল বিজয়ে।
আমাদের জন্যে আরও উদাহরণ হয়েছে খন্দকের যুদ্ধে:
যখন মদীনার মুসলিমদের ঘিরে ফেলেছিল ১০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল শক্তিশালী বাহিনী, যাদের মধ্যে ছিল কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র। মুসলিমদের ছিল মাত্র ৩০০০ জন, উপরন্তু এত বড় বাহিনী তাঁরা কখনো দেখেননি। তখন মদীনায় ছিল দুর্ভিক্ষ, তারা পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধা দূর করার চেষ্টা করতেন, আর চরম বৈরী আবহাওয়ার মাঝে নিজেদের রক্ষার্থে একটানা কাজ করে চললেন ও পরিখা খনন করলেন। যদি এই অবস্থা যথেষ্ট ভীতিকর বলে প্রতীয়মান না হয়, তবে জেনে রাখুন সেই কঠিন পরিস্থিতিতে খবর এল, মদীনার ভেতরকার ইহুদীরা মুসলিমদের সাথে চুক্তি ভংগ করেছে ও শহরের পিছন দিক থেকে আক্রমণের রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তদুপরি, মুনাফিকরা মুসলিমদের সাথে এই কষ্টকর সংগ্রাম ত্যাগ করল ও আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিদ্রুপ,কটাক্ষ করা শুরু করল। মুসলিমরা এত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুর’আনে এ অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন “…এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কন্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে”।
(আহযাব ১০)
এটা ছিল এক প্রাণান্তকর পরিস্থিতি: অথচ তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সুসংবাদ দিলেন যে, তারা বিরাট শক্তিধর তৎকালীন ‘সুপার পাওয়ার’ পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য বিজয় করবেন, আর বাকি আরব্য উপদ্বীপ তো বিজয় হবেই। এতে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পেল ও চূড়ান্ত বিজয়ের সংবাদে আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। আল্লাহ বর্ণণা করছেন, এরপর কিভাবে তারা সেই সম্মিলিত কুফফার সেনাবাহিনীর দিকে ফিরে তাকালো ও আল্লাহকে স্মরণ করলো, তিনি বলেন, “যখন মুমিনরা শক্রবাহিনীকে দেখল, তখন বলল, আল্লাহ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্নসমর্পণই বৃদ্ধি পেল”।(আহযাব ২২)
মানসিকতার পরিবর্তনের প্রভাব ছিল ব্যাপক: এবং এটা ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশ। তিনি আদেশ করেছিলেন যেন তারা পরাজিত ভিকটিম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। যদি তারা পরাজিত মানসিকতার অধিকারী হতেন, হীনমন হয়ে থাকতেন, তারা সেই সুবিশাল শত্রুবাহিনীর সামনে নিঃশেষ হয়ে যেতেন। অথচ, ইতিহাস সাক্ষী, এবারও তারাই বিজয়ী হলেন।
সীরাহ(জীবনী)গ্রন্থগুলো এমন ঘটনার বর্ণনায় ভরপুর:
যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাহিনীকে কৌশলগত কারণে মদীনার দিকে পিছু হটে নিয়ে এলেন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মুতার সেই ময়দানে রোমান সৈন্যদের সংখ্যাধিক্যের কাছে মুসলিমদের ক্ষুদ্র বাহিনীর সৈন্যসংখ্যার কোন তুলনাই হয় না। ফিরতি পথে, অনেকে খালিদ বিন ওয়ালিদকে‘ইয়া ফাররার’ (হে পলায়নকারী) বলে বিদ্রুপ করছিলেন। এই কথাগুলো খালিদকে মনোবল হারা করে দিতে পারতো, এমনকি তা মুসলিম সেনাবাহিনীর মাঝেও দুর্বলতা ছড়িয়ে দিতে পারতো, অথচ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে চাঙ্গা করে দিলেন ও শত্রুদের বিদ্রুপাত্মক কথাকে পালটে দিলেন, তিনি তাদের আদেশ করলেন যেন তারা বলেন, ‘ইয়া কাররার’(হে অগ্রগামী)। এতে তারা বুঝতে পারলেন, কৌশলগত কারণে পিছু হটা আর পলায়ন করা এক নয়। এটা খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাহস শক্তি বৃদ্ধি করল আর তাঁরা এতে এরপর ডজনখানেক যুদ্ধে রোমান ও পারস্য বাহিনীকে পরাভূত করলেন।
বিজয়ী মানসিকতা লালন করা ও তা ধরে রাখা, বৃদ্ধি করা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে:
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পরেও সাহাবীরা জিহাদ চালিয়ে গেলেন ও ইসলামের বিজয় আনতে লাগলেন। উদাহরণ দেখুন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন উসামা বিন যায়িদ(রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর বাহিনীকে ফিরিয়ে আনতে অস্বীকার করেছিলেন তখন তিনি কি বলেছিলেন? অথচ সেই বাহিনী প্রেরণের দিনকয়েক পরেই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করেন। এত বড় মানসিক আঘাত ও দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরবের গোত্রগুলো পরিকল্পনা করছিল মদীনা আক্রমণের, একারণে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই পরিস্থিতিতে বাহিনী প্রেরণ করা উচিত হবে না। আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিলেন, “যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরে কুকুর টেনে নিয়ে যাও তারপরও আমি এই বাহিনী প্রেরণ করবো, আর যদি মদীনায় আমি ছাড়া আর কেউ নাও থাকে তারপরও আমি এই বাহিনী পাঠাব কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দিয়েছেন”!
তিনি কিছুতেই সেই বাহিনীকে ফেরত আনতে চাননি, যারা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশে বের হয়েছিলেন। আর যখন উসামার বাহিনী সামনে এগিয়ে চলল, শত্রুভাবাপন্ন আরব গোত্রগুলো লা-জওয়াব হয়ে গেল, তারা ভেবে পেল না, আল্লাহর নবীর মৃত্যুর মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে কিভাবে এই বাহিনী জিহাদের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এটা সাক্ষ্য দেয়, বিপদের মুখে অবিচল ও অটল থাকার এই মানসিকতার কারণে শত্রুদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি হল ও তারা মদীনা আক্রমণের যাবতীয় কল্পনা বাদ দিল। সাহাবারা অনুধাবন করেছিলেন, মুসলিম হিসেবে যদি টিকে থাকতে হয়, যদি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে হয় তাহলে তাদেরকে অতিক্রম করতে হবে নানা রকম ফিতনা ও পরীক্ষা, সম্মুখীন হতে হবে যুলুম,নির্যাতন ও যন্ত্রণার। কিন্তু তারা জানতেন, দুনিয়া কিংবা আখিরাতে চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই। তারা আরও জানতেন যে, ইসলামের বিজয় হবেই সেটা তাদের জীবদ্দশাতে না হলেও পরবর্তী সময়ে হবে। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি যিনি আমাদেরকে কুর’আন ও হাদীসের বহু স্থানে অবগত করেছেন যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চলমান লড়াইয়ে মুসলিমরাই হবে চূড়ান্ত বিজয়ী আর ইসলাম টিকে থাকবে।
আমাদের অবশ্যই উচিত হল এই পরাজিত ভিকটিম মানসিকতা পরিত্যাগ করা, যাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমাদের দৈনন্দিন দুঃখ দুর্দশার কারণে, এগুলো ঝেড়ে ফেলে আমাদের উচিত একিন তথা দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়া কারণ বিজয় মুমিন ও মুসলিমদেরই। ফলে আমরা আমাদের বর্তমান অপমানজনক অবস্থা থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হব ইনশা আল্লাহ, অথচ আজ আমরা যুলুম ও বাতিলের মোকাবিলা করতে গিয়ে অন্যদের সাহায্য ও সমবেদনার দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি। যদি আমাদের মত করে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমও নিজেদেরকে খোলসের ভেতর গুটিয়ে নিতেন, নিজেদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব পোষণ করতেন, নিজেদের উপর চাপ অনুভব করতেন কিংবা অন্যদের কাছে সাহায্যের আবেদন করতেন, তাহলে আজ আমরা যেভাবে তাদের নাম ও খ্যাতির কথা জানি তা জানতাম না, এটা নিশ্চিত। একমাত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মত ও পথে, তাঁর দেখানো পদ্ধতিতেই সর্বোত্তম উদাহরণ রয়েছে আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে, আমরা কি পারি না নিজেদের সম্মান ও মর্যাদাকে সেই পদ্ধতিতেই উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে ?
আমরা কি পারি না নিজেদেরকে সেই সুনিশ্চিত বিজয়ের অংশ করতে, যার আগমন নিয়ে কোন সন্দেহ নেই?
লেখিকাঃ রেহনুমা বিনত আনিস
কোণাচোখে তারিককে পাশের টেবিলে আরাম করে বসতে দেখে জামিল দ্রুত গলা নামিয়ে বলে, ‘শুনুন, আপনি কিন্তু কিছুতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেননা’।
ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে যায় ফারজানা। সে লোকটাকে চেনেনা, জানেনা, কোন সালাম নেই, সম্ভাষন নেই, হুট করে এই আচমকা অনুরোধ! তারিকের দিকে জামিলের চোরা চাহনি, ফিসফিস কথা বলার ভঙ্গি আর এই অদ্ভুত প্রস্তাব- সব মিলিয়ে কিম্ভুত এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ হাসি পেয়ে যায় ওর। হাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে সে স্মিত হেসে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম’।
এবার নিজের অভদ্র আচরন স্মরন করে জামিল নিজেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, লজ্জা লজ্জা চেহারায় টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’।
‘আমার নাম ফারজানা’।
‘জ্বি, তারিক ভাই এইমাত্র বললেন। আমি জামিল’।
‘আপনার মত আমিও আসলে এখন বিয়ে করতে উৎসাহী নই। কিন্তু আমি যদি এই মূহূর্তে উঠে চলে যাই তাহলে বিয়ে করবনা বললে ভাইয়া কিছুতেই কনভিন্সড হবেনা। সুতরাং, আমাদের মনে হয় কিছুক্ষণ অন্তত কথা বলার অভিনয় করা উচিত’।
জামিল বুঝতে পারল কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু সে কি বলবে? ওর তো এটুকুই শুধু বলার ছিল!
ফারজানাই এগিয়ে এলো, ‘আচ্ছা, আপনি বিয়ে করতে না চাইলে দেখা করতে চাইলেন কেন? আপনি তো মেয়ে না যে কেউ আপনাকে জোর করে বাধ্য করতে পারবে!’
জামিল ওর দিকে তাকালে দেখতে পেত ওর চোখের তারায় কৌতুক, কিন্তু টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকায় সে ফারজানার কথায় দুষ্টুমির ভাবটা ধরতে পারলনা। খুব অপরাধী, মাটির সাথে মিশে যেতে পারলে বাঁচে এমন চেহারা করে আমতা আমতা করে বলতে লাগল, ‘আসলে আমার বাবামা ভাইবোন কেউ নেই। চাচা চাচীর কাছে মানুষ। এখন শহরে থাকি বলে তাঁদের সাথেও তেমন যোগাযোগ হয়না। একা থাকি বলে তাঁদের চিন্তার অন্ত নেই। চাচা তাঁর এক বন্ধুকে বললেন আমার জন্য মেয়ে দেখতে। আমার নিজের কোন কুলকিনারা নেই, সাধারন একটা পেটেভাতে চাকরী করি, ছোট্ট একটা দু’কামরার ঘরে ভাড়া থাকি- এই জীবনে কাউকে জড়িয়ে কষ্টে ফেলে লাভ আছে? কিন্তু চাচা চাচী কিছুতেই বুঝতে চান না। চাচার এক বন্ধু আপনার ভাইকে চেনেন। ওঁরা আমাকে এমনভাবে ধরলেন যে মেয়ে না দেখে কোন সিদ্ধান্তই তারা শুনবেন না। তাই আপনাকে কষ্ট দিতে হোল। আপনাকে এখানে আসতে বাধ্য করা হয়ে থাকলে সেজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। প্লীজ আমাকে মাফ করে দেবেন’।
জামিলের হাবভাবে এবার ফারজানা কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারলনা, খিক করে একটু হাসি দিয়েই মুখে হাত চেপে ধরল। এবার জামিল থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কি এমন কিছু বলেছি যা আপনার অস্বাভাবিক মনে হয়েছে?’ ফারজানা হাসি সংযত করার চেষ্টা করে বলে, ‘নাহ, তবে আপনার চেহারায় কেমন যেন একটা চোর চোর মার্কা দুঃখী দুঃখী ভাব আছে, হি হি…’
‘চোর চোর?’, কনফিউজড হয়ে যায় জামিল।
‘জ্বি, আদিব, আমার ভাইয়ের ছেলেটা বিস্কিট চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে যেমন চেহারা বানায় আপনার চেহারাটা ঠিক তেমন লাগছে, হি হি হি…’
এবার জামিলও হেসে ফেলে।
‘আচ্ছা, আপনি কি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন?’
অপ্রত্যাশিত প্রসঙ্গ পরিবর্তনে আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় জামিল, শুধু উত্তর দিতে পারে, ‘জ্বি’।
‘আপনি কি লেখাপড়া করতে পছন্দ করেন? যেমন কুর’আন হাদিস পড়া, গল্পের বই পড়া, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ইত্যাদি?’
‘জ্বি, নিয়মিত পড়ি’।
‘আপনি কি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন?’
‘জ্বি’, কথাবার্তা যে কোনদিকে যাচ্ছে কিছুই ঠাহর করতে পারেনা জামিল।
‘আপনি কি বিশ্বাস করেন যে সৃষ্টিকর্তা আপনাকে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আপনাকে সেই উদ্দেশ্যের কাছে পৌঁছে দেবেন?’
‘জ্বি’।
‘তাহলে আপনার কি মনে হয় আপনার কথায় এই বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়? নাকি আপনার মন বিশ্বাসের কথা বললেও মুখ অবিশ্বাসের সাক্ষ্য দেয়?’
বাক্যালাপ এখানে এসে ঠেকবে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি জামিল। কিন্তু এই অপরিচিত মেয়েটি তাকে এমন এক রূঢ় সত্যের সম্মুখীন করে দিয়েছে যা সে কখনো ভেবেও দেখেনি। সময় তাকে এমন এক ব্যাক্তিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছে যে বিশ্বাসের কথা বলে অথচ নিরাশায় ভোগে, যে আত্মীয়তার জন্য হাহাকার করে অথচ আত্মীয়তার বন্ধনের মূল্যায়ন করতে পারেনা, যে আল্লাহর ওপর নির্ভরতার কথা বলে অথচ কারো দায়িত্ব নেয়ার জন্য নিজেকে নির্ভরযোগ্য মনে করেনা। হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন জবাব দিতে পারেনা সে।
ওদিকে তারিক উঠে দাঁড়ায়, ফারজানাও সালাম দিয়ে ভাইকে অনুসরন করে। তারিক আর ফারজানাকে বিদায় দিয়ে আবার রেস্টুরেন্টের বে-আরাম চেয়ারটাতে বসে ভাবতে থাকে জামিল, মেয়েটা তাকে কি বলে গেল?
দু’ঘন্টা পর, ফারজানার বাসায়ঃ
‘অ্যাই বলনা ছেলেটা দেখতে কেমন ছিল?’
‘সত্যি ভাবী, আমি খেয়াল করিনি। খুব বেশি খারাপ হলে হয়ত খেয়াল করতাম’।
‘তাহলে আমার যে ননদিনি এতদিন বিয়ে করতে রাজী হয়নি সে কি দেখে একঘণ্টায় বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেল?’
‘ওহ, তুমি এটা জানতে চাও? বললেই তো হত!’, চোখ টিপে হেসে ফেলে ফারজানা।
‘জ্বি ফারজু বিবি, এটাই জানতে চাই’, গালে হাত দিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করেন ভাবী।
‘শোন তাহলে- লোকটাকে দেখে মনে হোল আমি এই লোকটার জীবনে কিছু একটা অবদান রাখতে পারব, তার বিশ্বাসকে পূর্ণতা দান করতে সাহায্য করতে পারব, তার সাথী হতে পারব। অধিকাংশ পুরুষ বিয়ে করার সময় কাজের মেয়ে খোঁজে। ভাবী, আমার ঘরের কাজ আমি করব, তাতে আপত্তির কি আছে? কিন্তু সেটাই যদি বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় সেটা আমি মেনে নিতে পারিনা’।
‘তা তো ঠিক আছে ফারজু বিবি। কিন্তু তোমার ভাইয়া বলল ছেলেটাকে দেখে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী মনে হয়নি, আমি ভাবছি তুমি তার জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে তা সে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিনা’, চিন্তিত মনে হয় ভাবীকে।
‘ভাবী, লোকটাকে দেখে মনে হোল খুব সরল আর লাজুক প্রকৃতির কিন্তু বোকা না। উনি নানা কারণে জীবনের প্রতি আশাহত কিন্ত এই আশা জাগিয়ে তোলার মত বিশ্বাস ওনার মনের কোণে কোথাও অবশিষ্ট আছে’।
‘তাহলে আশা করি তুমি তার সেই ভঙ্গুর আশালতায় কোথাও দোলা দিতে পেরেছ’, ফারজানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান ভাবী। বাপমা মরা এই মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মত করেই বড় করেছে তিনি। কোনদিন ওর বিশ্বাসে এতটুকু চির ধরতে দেননি। এই আশার উজ্জ্বল প্রদীপ, এই বাতিঘর যদি সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কোন নাবিককে পথ দেখাতে পারে, পারে আরেকটি ঘরকে আলোকিত করতে, তবে এর চেয়ে বেশি আর কি সাফল্য আশা করতে পারেন তিনি?
তিনদিন পর, নদীর ধারেঃ
‘মেয়েটা যে তোর জন্য perfect তা কি এখন তোর মাথায় ঢুকেছে না আরো সময় লাগবে?’, রোদের জন্য ভ্রূ কুঁচকে জামিলের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে কামাল। জামিলের মুখটা ভারী উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, ওটা কি রোদের আলো না আশার?
‘হিসেব করছি রে দোস্ত। কথায় কথায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবে, বাচ্চাদের মত আবদার করে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে এমন বৌয়ের ভীতি থেকেই বিয়ে করতে অনীহা বোধ করতাম। কিন্তু এই মেয়েটা প্র্যাক্টিকাল, সেন্সিবল, স্মার্ট, বুদ্ধিমতি এবং ঠিক আমার মত পরিস্থিতিতে বড় হয়েও ওর বিশ্বাসটা অত্যন্ত মজবুত। আমার জীবনের এক বিরাট সত্য সে আমাকে কি অবলীলায় বুঝিয়ে দিল মনে একটুও কষ্ট না দিয়ে! এই সাহচর্য আমার প্রয়োজন, ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস দিয়ে দুঃখগুলোকে দেখা বন্ধ করার জন্য ওর হাসির জোয়ার আমার জীবনে দরকার, সবচেয়ে বড় কথা ওর বিশ্বাসের শক্ত খুঁটিটা হতে পারে আমার জীবনের সে অবলম্বন যা আমি এতদিন খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি’।
‘তাহলে তুই দেরি করছিস কিসের জন্য?’
‘মেয়েটা যে বলল সে বিয়ে করতে আগ্রহী না!’
‘তুই জিজ্ঞেস করেছিলি, কেন?’
‘নাহ’।
‘গাধা কোথাকার! জিজ্ঞেস করবিনা?’, ঈষৎ বিরক্ত হয় কামাল, পরক্ষণেই আবার আশাবাদী হয়ে ওঠে, ‘যাক, সে বুদ্ধিমতি মেয়ে, ঠিকই বুঝতে পারবে তোর জীবনে সে ফ্রেন্ড, গাইড অ্যান্ড ফিলোসফার হয়ে বিরাজ করতে পারবে। একজন বুদ্ধিমতি মেয়ের জন্য এটাই বড় প্রাপ্তি’।
‘কিন্তু ওর আমাকে পছন্দ হোল কি’না কিভাবে জানব?’
‘ওরে দোস্ত, ওর পরিবারের সাথে কথা বল, নাহলে জানবি কি করে?’
‘ওঁরা যদি না করে দেয়?’
‘হ্যাঁও তো বলতে পারে। তুই আগেই নিরাশ হলে মেয়েটা তোকে শেখালটা কি?’
মাথা নাড়ে জামিল, আজই কথা বলতে হবে।
‘তা মেয়েটা দেখতে কেমন রে?’
‘খেয়াল করিনি তো!’, নিজেই অবাক হয় জামিল, ‘কিন্তু খুব বেশি খারাপ না মনে হয়, তাহলে হয়ত খেয়াল করতাম’।
খুশি হয় কামাল, ‘যারা মানুষের অন্তর দেখে পছন্দ করে তারাই মেয়ে দেখে এসে বলতে পারে চেহারা খেয়াল করেনি। এই বিয়ে হলে তুই ঠকবি না দোস্ত’।
উঠে দাঁড়ায় দু’জনে, আনন্দের আতিশয্যে হঠাৎ স্লোগান ছাড়ে কামাল, ‘জামিল তুই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোর সাথে’।
হো হো করে হেসে ফেলে দু’জনে।
ছয়মাস পরঃ
‘আজকে তোমার নতুন চাকরী, এত সুন্দর জামাকাপড় পরেছ অথচ চুলটা আঁচড়াওনি। একটু গেলাম রান্নাঘরে আর ব্যাস, তোমার ফাঁকিঝুঁকি শুরু! তোমাকে নিয়ে আমি কি করি বলত?’, ব্যাস্তসমস্ত হয়ে পাশের রুম থেকে চিরুনী হাতে দৌড়ে আসে ফারজানা।
টেবিলে ঠান্ডা হতে দিয়ে যাওয়া খাবারগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে ভরতে ভরতে জামিল বলে, ‘আমি চুল আঁচড়ালে সকাবেলা আমার মাথায় তোমার হাতের স্পর্শ নিয়ে বেরোব কি করে বলত? তুমি সকালে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলে আমার সারাদিন মাথা ঠান্ডা থাকে, একদম যেন তিব্বত কদুর তেলের বিজ্ঞাপনের মত!’
‘হি হি হি’, ওকে হাসতে দেখে জামিলের হাসিটাও ঠোঁটের একপাশ থেকে পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জামিলকে শেষপর্যন্ত হাসতে শেখাতে পেরেছে ফারজানা, ওর দুষ্টুমিগুলো এখন সে কিছু কিছু বোঝে, নিজেও দুষ্টুমি করতে শুরু করেছে দেখে বেশ উৎফুল্ল হয় সে।
‘যাবার পথে চাচা চাচীকে ফোন করে জানিয়ো নতুন চাকরিতে যাচ্ছ’।
‘ওঁরা জানেন তো’।
‘তাতে কি হয়েছে? ফোন করে জানাও, খুশি হবেন। আর বিকালে ফিরলে চাচীর জন্য শাড়ি কিনব যেন আগামী বৃহস্পতিবার নিয়ে যেতে পারি। আগামী মাসে বেতন পেলে চাচাকে পাঞ্জাবী কিনে দেব’।
‘আর তুমি কি কিনবে?’
‘বাহ, তোমার মতন এমন একটা চমৎকার গিফট থাকতে আমার আর কি লাগবে?’
মনে মনে একই কথা ভাবে জামিল, কিন্তু ওর মত সাবলীলভাবে বলতে পারেনা। বেহেস্তের টুকরোর মত বৌটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
‘তুমি কি চাও তোমার নতুন অফিসে প্রথমদিন লেট হোক?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জুতো পায়ে দিতে দিতে আবার ফারজানার দিকে তাকায় জামিল।
‘যাআআআও’, বলে হাতে টিফিন ক্যারিয়ারটা হাতে গুঁজে দিয়ে দরজা খুলে ওকে প্রায় ঠেলে বের করে দেয় ফারজানা।
শেষ একবার পেছন ফিরে তাকালে ফারজানা মিষ্টি হেসে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম’।
এই স্বর্গীয় সম্ভাষন কানে নিয়েই প্রতিদিন পৃথিবীর বন্ধুর পথে যাত্রা শুরু হয় জামিলের, সে স্মিত হেসে জবাব দেয়, ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’।
এখনো রিক্সা পেতে দেরী হয়, বাসে ভিড় ঠেলে উঠতে কষ্ট হয়, অফিসে ঝামেলা হয়, দোকানে দরদাম নিয়ে মন কষাকষি হয়, দু’কামরার ঘরটাতে চাপাচাপি হয়, কোন কোনদিন ভাল তরকারীও থাকেনা। তবু কেন যেন পৃথিবীটাকে আর আগের মত জটিল মনে হয়না। দিনের শেষে ওর জীবনে আছে এমন এক সাথী যে ওর সুখদুঃখ সব সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেয়, যে ওর কষ্টগুলোকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে, যে ওর বিশ্বাসকে এক আলোর তৈরী মিনারের মত উচ্চকিত করে তোলে। হাসি পায় এই ভেবে যে এই দুই শ্রেষ্ঠ বন্ধুর প্রথম বাক্যালাপ ছিল, ‘আপনি কিন্তু কিছুতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেননা’!
শুধুমাত্র বাস্তব জীবনে ইসলাম চর্চাকারী অবিবাহিত মুসলিম ছেলেমেয়েদেরকে আল্লাহ্ভীরু জীবন সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে পেতে সহায়তা করাই “পিওর ম্যাট্রিমনি” ওয়েবসাইটের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন – HTTPS://WWW.QURANERALO.COM/PUREMATRIMONY/
কোণাচোখে তারিককে পাশের টেবিলে আরাম করে বসতে দেখে জামিল দ্রুত গলা নামিয়ে বলে, ‘শুনুন, আপনি কিন্তু কিছুতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেননা’।
ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে যায় ফারজানা। সে লোকটাকে চেনেনা, জানেনা, কোন সালাম নেই, সম্ভাষন নেই, হুট করে এই আচমকা অনুরোধ! তারিকের দিকে জামিলের চোরা চাহনি, ফিসফিস কথা বলার ভঙ্গি আর এই অদ্ভুত প্রস্তাব- সব মিলিয়ে কিম্ভুত এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ হাসি পেয়ে যায় ওর। হাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে সে স্মিত হেসে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম’।
এবার নিজের অভদ্র আচরন স্মরন করে জামিল নিজেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, লজ্জা লজ্জা চেহারায় টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’।
‘আমার নাম ফারজানা’।
‘জ্বি, তারিক ভাই এইমাত্র বললেন। আমি জামিল’।
‘আপনার মত আমিও আসলে এখন বিয়ে করতে উৎসাহী নই। কিন্তু আমি যদি এই মূহূর্তে উঠে চলে যাই তাহলে বিয়ে করবনা বললে ভাইয়া কিছুতেই কনভিন্সড হবেনা। সুতরাং, আমাদের মনে হয় কিছুক্ষণ অন্তত কথা বলার অভিনয় করা উচিত’।
জামিল বুঝতে পারল কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু সে কি বলবে? ওর তো এটুকুই শুধু বলার ছিল!
ফারজানাই এগিয়ে এলো, ‘আচ্ছা, আপনি বিয়ে করতে না চাইলে দেখা করতে চাইলেন কেন? আপনি তো মেয়ে না যে কেউ আপনাকে জোর করে বাধ্য করতে পারবে!’
জামিল ওর দিকে তাকালে দেখতে পেত ওর চোখের তারায় কৌতুক, কিন্তু টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকায় সে ফারজানার কথায় দুষ্টুমির ভাবটা ধরতে পারলনা। খুব অপরাধী, মাটির সাথে মিশে যেতে পারলে বাঁচে এমন চেহারা করে আমতা আমতা করে বলতে লাগল, ‘আসলে আমার বাবামা ভাইবোন কেউ নেই। চাচা চাচীর কাছে মানুষ। এখন শহরে থাকি বলে তাঁদের সাথেও তেমন যোগাযোগ হয়না। একা থাকি বলে তাঁদের চিন্তার অন্ত নেই। চাচা তাঁর এক বন্ধুকে বললেন আমার জন্য মেয়ে দেখতে। আমার নিজের কোন কুলকিনারা নেই, সাধারন একটা পেটেভাতে চাকরী করি, ছোট্ট একটা দু’কামরার ঘরে ভাড়া থাকি- এই জীবনে কাউকে জড়িয়ে কষ্টে ফেলে লাভ আছে? কিন্তু চাচা চাচী কিছুতেই বুঝতে চান না। চাচার এক বন্ধু আপনার ভাইকে চেনেন। ওঁরা আমাকে এমনভাবে ধরলেন যে মেয়ে না দেখে কোন সিদ্ধান্তই তারা শুনবেন না। তাই আপনাকে কষ্ট দিতে হোল। আপনাকে এখানে আসতে বাধ্য করা হয়ে থাকলে সেজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। প্লীজ আমাকে মাফ করে দেবেন’।
জামিলের হাবভাবে এবার ফারজানা কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারলনা, খিক করে একটু হাসি দিয়েই মুখে হাত চেপে ধরল। এবার জামিল থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কি এমন কিছু বলেছি যা আপনার অস্বাভাবিক মনে হয়েছে?’ ফারজানা হাসি সংযত করার চেষ্টা করে বলে, ‘নাহ, তবে আপনার চেহারায় কেমন যেন একটা চোর চোর মার্কা দুঃখী দুঃখী ভাব আছে, হি হি…’
‘চোর চোর?’, কনফিউজড হয়ে যায় জামিল।
‘জ্বি, আদিব, আমার ভাইয়ের ছেলেটা বিস্কিট চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে যেমন চেহারা বানায় আপনার চেহারাটা ঠিক তেমন লাগছে, হি হি হি…’
এবার জামিলও হেসে ফেলে।
‘আচ্ছা, আপনি কি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন?’
অপ্রত্যাশিত প্রসঙ্গ পরিবর্তনে আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় জামিল, শুধু উত্তর দিতে পারে, ‘জ্বি’।
‘আপনি কি লেখাপড়া করতে পছন্দ করেন? যেমন কুর’আন হাদিস পড়া, গল্পের বই পড়া, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ইত্যাদি?’
‘জ্বি, নিয়মিত পড়ি’।
‘আপনি কি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন?’
‘জ্বি’, কথাবার্তা যে কোনদিকে যাচ্ছে কিছুই ঠাহর করতে পারেনা জামিল।
‘আপনি কি বিশ্বাস করেন যে সৃষ্টিকর্তা আপনাকে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আপনাকে সেই উদ্দেশ্যের কাছে পৌঁছে দেবেন?’
‘জ্বি’।
‘তাহলে আপনার কি মনে হয় আপনার কথায় এই বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়? নাকি আপনার মন বিশ্বাসের কথা বললেও মুখ অবিশ্বাসের সাক্ষ্য দেয়?’
বাক্যালাপ এখানে এসে ঠেকবে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি জামিল। কিন্তু এই অপরিচিত মেয়েটি তাকে এমন এক রূঢ় সত্যের সম্মুখীন করে দিয়েছে যা সে কখনো ভেবেও দেখেনি। সময় তাকে এমন এক ব্যাক্তিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছে যে বিশ্বাসের কথা বলে অথচ নিরাশায় ভোগে, যে আত্মীয়তার জন্য হাহাকার করে অথচ আত্মীয়তার বন্ধনের মূল্যায়ন করতে পারেনা, যে আল্লাহর ওপর নির্ভরতার কথা বলে অথচ কারো দায়িত্ব নেয়ার জন্য নিজেকে নির্ভরযোগ্য মনে করেনা। হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন জবাব দিতে পারেনা সে।
ওদিকে তারিক উঠে দাঁড়ায়, ফারজানাও সালাম দিয়ে ভাইকে অনুসরন করে। তারিক আর ফারজানাকে বিদায় দিয়ে আবার রেস্টুরেন্টের বে-আরাম চেয়ারটাতে বসে ভাবতে থাকে জামিল, মেয়েটা তাকে কি বলে গেল?
দু’ঘন্টা পর, ফারজানার বাসায়ঃ
‘অ্যাই বলনা ছেলেটা দেখতে কেমন ছিল?’
‘সত্যি ভাবী, আমি খেয়াল করিনি। খুব বেশি খারাপ হলে হয়ত খেয়াল করতাম’।
‘তাহলে আমার যে ননদিনি এতদিন বিয়ে করতে রাজী হয়নি সে কি দেখে একঘণ্টায় বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেল?’
‘ওহ, তুমি এটা জানতে চাও? বললেই তো হত!’, চোখ টিপে হেসে ফেলে ফারজানা।
‘জ্বি ফারজু বিবি, এটাই জানতে চাই’, গালে হাত দিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করেন ভাবী।
‘শোন তাহলে- লোকটাকে দেখে মনে হোল আমি এই লোকটার জীবনে কিছু একটা অবদান রাখতে পারব, তার বিশ্বাসকে পূর্ণতা দান করতে সাহায্য করতে পারব, তার সাথী হতে পারব। অধিকাংশ পুরুষ বিয়ে করার সময় কাজের মেয়ে খোঁজে। ভাবী, আমার ঘরের কাজ আমি করব, তাতে আপত্তির কি আছে? কিন্তু সেটাই যদি বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় সেটা আমি মেনে নিতে পারিনা’।
‘তা তো ঠিক আছে ফারজু বিবি। কিন্তু তোমার ভাইয়া বলল ছেলেটাকে দেখে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী মনে হয়নি, আমি ভাবছি তুমি তার জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে তা সে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিনা’, চিন্তিত মনে হয় ভাবীকে।
‘ভাবী, লোকটাকে দেখে মনে হোল খুব সরল আর লাজুক প্রকৃতির কিন্তু বোকা না। উনি নানা কারণে জীবনের প্রতি আশাহত কিন্ত এই আশা জাগিয়ে তোলার মত বিশ্বাস ওনার মনের কোণে কোথাও অবশিষ্ট আছে’।
‘তাহলে আশা করি তুমি তার সেই ভঙ্গুর আশালতায় কোথাও দোলা দিতে পেরেছ’, ফারজানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান ভাবী। বাপমা মরা এই মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মত করেই বড় করেছে তিনি। কোনদিন ওর বিশ্বাসে এতটুকু চির ধরতে দেননি। এই আশার উজ্জ্বল প্রদীপ, এই বাতিঘর যদি সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কোন নাবিককে পথ দেখাতে পারে, পারে আরেকটি ঘরকে আলোকিত করতে, তবে এর চেয়ে বেশি আর কি সাফল্য আশা করতে পারেন তিনি?
তিনদিন পর, নদীর ধারেঃ
‘মেয়েটা যে তোর জন্য perfect তা কি এখন তোর মাথায় ঢুকেছে না আরো সময় লাগবে?’, রোদের জন্য ভ্রূ কুঁচকে জামিলের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে কামাল। জামিলের মুখটা ভারী উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, ওটা কি রোদের আলো না আশার?
‘হিসেব করছি রে দোস্ত। কথায় কথায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবে, বাচ্চাদের মত আবদার করে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে এমন বৌয়ের ভীতি থেকেই বিয়ে করতে অনীহা বোধ করতাম। কিন্তু এই মেয়েটা প্র্যাক্টিকাল, সেন্সিবল, স্মার্ট, বুদ্ধিমতি এবং ঠিক আমার মত পরিস্থিতিতে বড় হয়েও ওর বিশ্বাসটা অত্যন্ত মজবুত। আমার জীবনের এক বিরাট সত্য সে আমাকে কি অবলীলায় বুঝিয়ে দিল মনে একটুও কষ্ট না দিয়ে! এই সাহচর্য আমার প্রয়োজন, ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস দিয়ে দুঃখগুলোকে দেখা বন্ধ করার জন্য ওর হাসির জোয়ার আমার জীবনে দরকার, সবচেয়ে বড় কথা ওর বিশ্বাসের শক্ত খুঁটিটা হতে পারে আমার জীবনের সে অবলম্বন যা আমি এতদিন খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি’।
‘তাহলে তুই দেরি করছিস কিসের জন্য?’
‘মেয়েটা যে বলল সে বিয়ে করতে আগ্রহী না!’
‘তুই জিজ্ঞেস করেছিলি, কেন?’
‘নাহ’।
‘গাধা কোথাকার! জিজ্ঞেস করবিনা?’, ঈষৎ বিরক্ত হয় কামাল, পরক্ষণেই আবার আশাবাদী হয়ে ওঠে, ‘যাক, সে বুদ্ধিমতি মেয়ে, ঠিকই বুঝতে পারবে তোর জীবনে সে ফ্রেন্ড, গাইড অ্যান্ড ফিলোসফার হয়ে বিরাজ করতে পারবে। একজন বুদ্ধিমতি মেয়ের জন্য এটাই বড় প্রাপ্তি’।
‘কিন্তু ওর আমাকে পছন্দ হোল কি’না কিভাবে জানব?’
‘ওরে দোস্ত, ওর পরিবারের সাথে কথা বল, নাহলে জানবি কি করে?’
‘ওঁরা যদি না করে দেয়?’
‘হ্যাঁও তো বলতে পারে। তুই আগেই নিরাশ হলে মেয়েটা তোকে শেখালটা কি?’
মাথা নাড়ে জামিল, আজই কথা বলতে হবে।
‘তা মেয়েটা দেখতে কেমন রে?’
‘খেয়াল করিনি তো!’, নিজেই অবাক হয় জামিল, ‘কিন্তু খুব বেশি খারাপ না মনে হয়, তাহলে হয়ত খেয়াল করতাম’।
খুশি হয় কামাল, ‘যারা মানুষের অন্তর দেখে পছন্দ করে তারাই মেয়ে দেখে এসে বলতে পারে চেহারা খেয়াল করেনি। এই বিয়ে হলে তুই ঠকবি না দোস্ত’।
উঠে দাঁড়ায় দু’জনে, আনন্দের আতিশয্যে হঠাৎ স্লোগান ছাড়ে কামাল, ‘জামিল তুই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোর সাথে’।
হো হো করে হেসে ফেলে দু’জনে।
ছয়মাস পরঃ
‘আজকে তোমার নতুন চাকরী, এত সুন্দর জামাকাপড় পরেছ অথচ চুলটা আঁচড়াওনি। একটু গেলাম রান্নাঘরে আর ব্যাস, তোমার ফাঁকিঝুঁকি শুরু! তোমাকে নিয়ে আমি কি করি বলত?’, ব্যাস্তসমস্ত হয়ে পাশের রুম থেকে চিরুনী হাতে দৌড়ে আসে ফারজানা।
টেবিলে ঠান্ডা হতে দিয়ে যাওয়া খাবারগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে ভরতে ভরতে জামিল বলে, ‘আমি চুল আঁচড়ালে সকাবেলা আমার মাথায় তোমার হাতের স্পর্শ নিয়ে বেরোব কি করে বলত? তুমি সকালে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলে আমার সারাদিন মাথা ঠান্ডা থাকে, একদম যেন তিব্বত কদুর তেলের বিজ্ঞাপনের মত!’
‘হি হি হি’, ওকে হাসতে দেখে জামিলের হাসিটাও ঠোঁটের একপাশ থেকে পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জামিলকে শেষপর্যন্ত হাসতে শেখাতে পেরেছে ফারজানা, ওর দুষ্টুমিগুলো এখন সে কিছু কিছু বোঝে, নিজেও দুষ্টুমি করতে শুরু করেছে দেখে বেশ উৎফুল্ল হয় সে।
‘যাবার পথে চাচা চাচীকে ফোন করে জানিয়ো নতুন চাকরিতে যাচ্ছ’।
‘ওঁরা জানেন তো’।
‘তাতে কি হয়েছে? ফোন করে জানাও, খুশি হবেন। আর বিকালে ফিরলে চাচীর জন্য শাড়ি কিনব যেন আগামী বৃহস্পতিবার নিয়ে যেতে পারি। আগামী মাসে বেতন পেলে চাচাকে পাঞ্জাবী কিনে দেব’।
‘আর তুমি কি কিনবে?’
‘বাহ, তোমার মতন এমন একটা চমৎকার গিফট থাকতে আমার আর কি লাগবে?’
মনে মনে একই কথা ভাবে জামিল, কিন্তু ওর মত সাবলীলভাবে বলতে পারেনা। বেহেস্তের টুকরোর মত বৌটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
‘তুমি কি চাও তোমার নতুন অফিসে প্রথমদিন লেট হোক?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জুতো পায়ে দিতে দিতে আবার ফারজানার দিকে তাকায় জামিল।
‘যাআআআও’, বলে হাতে টিফিন ক্যারিয়ারটা হাতে গুঁজে দিয়ে দরজা খুলে ওকে প্রায় ঠেলে বের করে দেয় ফারজানা।
শেষ একবার পেছন ফিরে তাকালে ফারজানা মিষ্টি হেসে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম’।
এই স্বর্গীয় সম্ভাষন কানে নিয়েই প্রতিদিন পৃথিবীর বন্ধুর পথে যাত্রা শুরু হয় জামিলের, সে স্মিত হেসে জবাব দেয়, ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’।
এখনো রিক্সা পেতে দেরী হয়, বাসে ভিড় ঠেলে উঠতে কষ্ট হয়, অফিসে ঝামেলা হয়, দোকানে দরদাম নিয়ে মন কষাকষি হয়, দু’কামরার ঘরটাতে চাপাচাপি হয়, কোন কোনদিন ভাল তরকারীও থাকেনা। তবু কেন যেন পৃথিবীটাকে আর আগের মত জটিল মনে হয়না। দিনের শেষে ওর জীবনে আছে এমন এক সাথী যে ওর সুখদুঃখ সব সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেয়, যে ওর কষ্টগুলোকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে, যে ওর বিশ্বাসকে এক আলোর তৈরী মিনারের মত উচ্চকিত করে তোলে। হাসি পায় এই ভেবে যে এই দুই শ্রেষ্ঠ বন্ধুর প্রথম বাক্যালাপ ছিল, ‘আপনি কিন্তু কিছুতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেননা’!
শুধুমাত্র বাস্তব জীবনে ইসলাম চর্চাকারী অবিবাহিত মুসলিম ছেলেমেয়েদেরকে আল্লাহ্ভীরু জীবন সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে পেতে সহায়তা করাই “পিওর ম্যাট্রিমনি” ওয়েবসাইটের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন – HTTPS://WWW.QURANERALO.COM/PUREMATRIMONY/
লিখেছেনঃ সাইফ
নিজেকে করার কিছু প্রশ্ন , যদি পারেন তো জবাব দিন , না পারলে আল্লাহর দিকে ফিরে আসুনঃ
১/ আপনি শুধু জুমআ’র নামাজই পড়েন কেন? আপনাকে কি আল্লাহ্ শুধু জুমার দিনেই আলো, বাতাস, পানি খাবার দিয়ে থাকেন? শনিবার দেন না? রবি, সোম, মঙ্গল সব দিনই তো দেন, সবদিন পরিপূর্ণ আল্লাহর নেয়মত ভোগ করেন, কিন্তু আল্লাহ্কে শুধু একদিনই স্মরণ করেন। এবার বলুন আপনি কি ঠিক পথে আছেন? এটা কি স্পষ্টত অপরাধ নয়? জবাব দিন , না হলে ফিরে আসুন।
২/ আপনি কি মনে করেন ইসলাম শুধু মসজিদ , মাদ্রাসায় , ইমাম, আলেমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ? সবার জন্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কি ইসলাম নয়? তাহলে আমাদের প্রিয় নবীর জীবনের প্রতিটি অংশই কেন ইসলাম জড়িত, কিংবা সাহাবীরা/৪ খলিফা কেনইবা ইসলামিক জীবন যাপন করেছেন? এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছেন না? জবাব দিন, না হলে ফিরে আসুন।
৩/ আপনি জানেন নামাজ পড়া ফরজ, আপনি এও জানেন নামাজ না পড়লে জাহান্নামে যেতে হবে, আপনার এটাও জানা আছে যে জাহান্নাম অত্যন্ত ভয়াবহ, দুনিয়ার কোন শাস্তিই জাহান্নামের ধারে কাছেও নেই, তবু কেন আপনি পড়ছেন না? আপনি কি জেনে বুঝে নিকৃষ্ট জায়গায় , ভয়াবহ শাস্তির জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন না? কেউ যদি জেনে বুঝে শাস্তি পেতে চায়, অথচ সে ইচ্ছা করলে শাস্তির বদলে চির সুখের স্থান পেতে পারে তাকে আপনি কি বলবেন ? চরম দুর্ভাগা বলবেন না? জবাব দিন , না হলে ফিরে আসুন।
৪/ আপনি তো জানেন জান্নাতে আরাম আয়েশের অভাব নেই। ইচ্ছা মত ভাল ভাল খাবার, পরমা সুন্দরী জান্নাতি হুর, যা যা ইছে করে সব পাওয়া যাবে জান্নাতে গেলে। দুনিয়ায় মানুষ কদিন বাঁচে? ৮০/১০০ বছর?আর আখিরাতের জীবন তো অনন্ত অসীম। আপনি এই ৮০-১০০ বছর আরামে কাটিয়ে দিতে চান আর অনন্ত জীবন ছেড়ে দিতে চান? এর থেকে বোকামি আর কি হতে পারে?
৫/ আপনি সবই মানেন সবই বোঝেন, কিন্তু অলসতা কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে পালন করেন না, কি করে আশা করেন জান্নাত পাওয়ার। অনেকে বলেন ভাই আমি তো জাহান্নামী, তাদেরকে বলতে ইচ্ছে করে ভাই জাহান্নামকে আপনি কি মনে করেন? সাধারন জেলখানা ? তাহলে শুনুন
নু’মান ইবনে বাশীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ
“কেয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্যে সবচাইতে লঘু শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির শাস্তি হবে এই যে, তার দুই পায়ের তালুর নিচে আগুনের দু’টি অংগার রাখা হবে এবং তাতে তার মস্তিষ্ক সিদ্ধ হতে থাকবে। সে মনে করবে, তার চাইতে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি আর কেউ হয়নি। অথচ সে-ই জাহান্নামীদের মধ্যে সবচাইতে হালকা শাস্তিপ্রাপ্ত।”
[ বুখারী: ৬৫৬২ , মুসলিম: ২১৩ ]
জবাব দিন , নাহলে ফিরে আসুন। যারা ফিরে আসবে এই মুহূর্ত থেকে তাদের জন্য আল্লাহ্ সুসংবাদ দিয়েছেন,
“আর যারা খারাপ কাজ করে, তারপরে তওবা করে নেয় এবং ঈমান নিয়ে আসে, তবে নিশ্চয়ই তোমার রব এরপরও ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।” [ সূরা আ’রাফ ১৫৩]
“তারা কি দেখে না,তারা প্রতি বছর একবার কিংবা দুবার বিপদগ্রস্ত হয়? এরপরও তারা তওবা করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না।” [ সূরা তাওবা ১২৬]
“সুতরাং তারা কি আল্লাহর নিকট তওবা করবে না? এবং তার নিকট ক্ষমা চাইবে না? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।” [সূরা মায়েদা ৭৪]
যারা ভাবে এখন পাপ করি পরে সময়মত তওবা করে নেব, তাদের সাধারণতঃ কোনদিনই তওবা করার সৌভাগ্য পাবে না।
আল্লাহ্ বলেন,
“আর এমন লোকদের জন্য কোন ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকেঃ আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।” [সূরা নিসা ১৮]
তাই আমার ভাই ও বোনেরা ফিরে আসুন , এখনই, এখনই এবং এখনই। তওবা করে ফিরে আসুন। আল্লাহর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করুন।
নিজেকে করার কিছু প্রশ্ন , যদি পারেন তো জবাব দিন , না পারলে আল্লাহর দিকে ফিরে আসুনঃ
১/ আপনি শুধু জুমআ’র নামাজই পড়েন কেন? আপনাকে কি আল্লাহ্ শুধু জুমার দিনেই আলো, বাতাস, পানি খাবার দিয়ে থাকেন? শনিবার দেন না? রবি, সোম, মঙ্গল সব দিনই তো দেন, সবদিন পরিপূর্ণ আল্লাহর নেয়মত ভোগ করেন, কিন্তু আল্লাহ্কে শুধু একদিনই স্মরণ করেন। এবার বলুন আপনি কি ঠিক পথে আছেন? এটা কি স্পষ্টত অপরাধ নয়? জবাব দিন , না হলে ফিরে আসুন।
২/ আপনি কি মনে করেন ইসলাম শুধু মসজিদ , মাদ্রাসায় , ইমাম, আলেমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ? সবার জন্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কি ইসলাম নয়? তাহলে আমাদের প্রিয় নবীর জীবনের প্রতিটি অংশই কেন ইসলাম জড়িত, কিংবা সাহাবীরা/৪ খলিফা কেনইবা ইসলামিক জীবন যাপন করেছেন? এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছেন না? জবাব দিন, না হলে ফিরে আসুন।
৩/ আপনি জানেন নামাজ পড়া ফরজ, আপনি এও জানেন নামাজ না পড়লে জাহান্নামে যেতে হবে, আপনার এটাও জানা আছে যে জাহান্নাম অত্যন্ত ভয়াবহ, দুনিয়ার কোন শাস্তিই জাহান্নামের ধারে কাছেও নেই, তবু কেন আপনি পড়ছেন না? আপনি কি জেনে বুঝে নিকৃষ্ট জায়গায় , ভয়াবহ শাস্তির জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন না? কেউ যদি জেনে বুঝে শাস্তি পেতে চায়, অথচ সে ইচ্ছা করলে শাস্তির বদলে চির সুখের স্থান পেতে পারে তাকে আপনি কি বলবেন ? চরম দুর্ভাগা বলবেন না? জবাব দিন , না হলে ফিরে আসুন।
৪/ আপনি তো জানেন জান্নাতে আরাম আয়েশের অভাব নেই। ইচ্ছা মত ভাল ভাল খাবার, পরমা সুন্দরী জান্নাতি হুর, যা যা ইছে করে সব পাওয়া যাবে জান্নাতে গেলে। দুনিয়ায় মানুষ কদিন বাঁচে? ৮০/১০০ বছর?আর আখিরাতের জীবন তো অনন্ত অসীম। আপনি এই ৮০-১০০ বছর আরামে কাটিয়ে দিতে চান আর অনন্ত জীবন ছেড়ে দিতে চান? এর থেকে বোকামি আর কি হতে পারে?
৫/ আপনি সবই মানেন সবই বোঝেন, কিন্তু অলসতা কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে পালন করেন না, কি করে আশা করেন জান্নাত পাওয়ার। অনেকে বলেন ভাই আমি তো জাহান্নামী, তাদেরকে বলতে ইচ্ছে করে ভাই জাহান্নামকে আপনি কি মনে করেন? সাধারন জেলখানা ? তাহলে শুনুন
নু’মান ইবনে বাশীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ
“কেয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্যে সবচাইতে লঘু শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির শাস্তি হবে এই যে, তার দুই পায়ের তালুর নিচে আগুনের দু’টি অংগার রাখা হবে এবং তাতে তার মস্তিষ্ক সিদ্ধ হতে থাকবে। সে মনে করবে, তার চাইতে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি আর কেউ হয়নি। অথচ সে-ই জাহান্নামীদের মধ্যে সবচাইতে হালকা শাস্তিপ্রাপ্ত।”
[ বুখারী: ৬৫৬২ , মুসলিম: ২১৩ ]
জবাব দিন , নাহলে ফিরে আসুন। যারা ফিরে আসবে এই মুহূর্ত থেকে তাদের জন্য আল্লাহ্ সুসংবাদ দিয়েছেন,
“আর যারা খারাপ কাজ করে, তারপরে তওবা করে নেয় এবং ঈমান নিয়ে আসে, তবে নিশ্চয়ই তোমার রব এরপরও ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।” [ সূরা আ’রাফ ১৫৩]
“তারা কি দেখে না,তারা প্রতি বছর একবার কিংবা দুবার বিপদগ্রস্ত হয়? এরপরও তারা তওবা করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না।” [ সূরা তাওবা ১২৬]
“সুতরাং তারা কি আল্লাহর নিকট তওবা করবে না? এবং তার নিকট ক্ষমা চাইবে না? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।” [সূরা মায়েদা ৭৪]
যারা ভাবে এখন পাপ করি পরে সময়মত তওবা করে নেব, তাদের সাধারণতঃ কোনদিনই তওবা করার সৌভাগ্য পাবে না।
আল্লাহ্ বলেন,
“আর এমন লোকদের জন্য কোন ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকেঃ আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।” [সূরা নিসা ১৮]
তাই আমার ভাই ও বোনেরা ফিরে আসুন , এখনই, এখনই এবং এখনই। তওবা করে ফিরে আসুন। আল্লাহর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করুন।
আজ আমি আপনাদের সাথে আমার হিজাব শুরু করার আগের ও পরের জীবনের কথা শুনাতে চাই। আমি ২০ বছর বয়সী একজন মুসলিম মেয়ে যার জন্ম আরব উপসাগরীয় এলাকায়-ইসলামের আদি জন্মভূমিতে।আমি বিশ্বাস করতাম হিজাব তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।যদিও আমার মা হিজাব পড়তেন, তিনি আমাকে বা আমার বোনকে তা পড়ার ব্যাপারে জোর করেন নি। তিনি মনে করতেন কাজটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করা উচিত, নতুবা তার আওতার বাইরে চলে গেলেই আমরা হিজাব পড়া ছেড়ে দিব। আমি মনে করি ধারণাটা কিছু মাত্রায় সঠিক।
অথবা আমরা যখন বড় হব তখন হিজাব পড়াটাকে আমাদের কাছে খুব কঠিন মনে হবে। কারণ সারাজীবন ধরে একটি বিষয়ে অভ্যস্ত হওয়া আর তারপর হঠাৎ করে সেটা বদলে ফেলা খুব কঠিন। মন পরিবর্তন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। যাই হোক, নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে আমি খুবই ভালবাসতাম যেহেতু আমি দেখতে খুবই আকর্ষণীয় ছিলাম।আর এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন অংশ।আমি দামী দামী জামা-কাপড় কিনতে, সেগুলো দিয়ে নিজেকে সাজাতে খুবই পছন্দ করতাম। সবাই যখন আমার দিকে তাকাত এবং বিশেষভাবে চিহ্নিত করত, ব্যাপারটা আমি চরমভাবে উপভোগ করতাম। আমি ভালবাসতাম প্রশংসা শুনতে –বাহ মেয়েটাতো দারুণ সুন্দরী।
আমার মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ হবার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য আমি আমেরিকাতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেখানে আমি একটি বিষয় লক্ষ করলাম যা আগে কখনও দেখিনি। তা হল মুসলিম সমাজ এবং সম্প্রদায়। এ এক অসাধারণ সমাজ আদর্শ মুসলিমদের নিয়ে যারা ইসলাম পালন করছে আমি যেভাবে অভ্যস্ত তার তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রায়। আরব উপসাগরীয় এলাকার মুসলিমরা জন্মগতভাবে মুসলিম। তাদের কোন প্রশ্ন করতে হয়না কারণ সব কিছুই খুব সুস্পষ্ট। আমাদের নিজেদের ঈমান নিয়ে এবং কিভাবে আল্লাহতে বিশ্বাস করতে হবে এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হয় নি কারণ আমরা বেড়েই উঠেছি মুসলিম হিসেবে এবং আমাদের চারপাশের সবাই ছিল মুসলিম। প্রকৃত ইসলামের স্বরূপ কেমন এটা এবং সব ধরণের ধর্মাবলম্বী সম্বলিত একটি মিশ্র সমাজে বাস করার অনুভূতি কেমন সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই ছিল না। আমি উপলব্ধি করলাম উপসাগরীয় লোকজন বিশুদ্ধ ধর্ম পালন করত না, যা করত তা হল ধর্ম এবং সংস্কৃতির এক ধরণের মিশ্রণ।আমি আবিষ্কার করলাম-অনেক কিছু, যাকে আমি ইসলামিক বলে মনে করতাম, আসলে সাংস্কৃতিক বিশ্বাস এবং সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চরম ভুল!আমি জানলাম যে বিশুদ্ধ ইসলাম সেটা না যার মাঝে আমরা বেড়ে উঠেছি বরং তা ছিল অর্থহীণ বিষয়ে পূর্ণ যা বহুদিন ধরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ। বিশুদ্ধ ইসলামের শিক্ষার উৎস শুধুই ক্বুরআন ও সুন্নাহ।
যখন আমেরিকার লোকজন জানতে পারল যে আমি মুসলিম, তখন তারা সবসময় ইসলামের ব্যাপারে আমাকে নানা ধরণের প্রশ্ন করত। অধিকাংশ সময়েই আমি তাদের সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না। ফলে আমি বিভিন্ন ইসলামী বই এবং ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করা শুরু করলাম-বিশুদ্ধ ইসলাম জানার আশায়। আমার অবস্থা ছিল এমন ব্যক্তির মত যে কখনও ইসলামের কথা আগে শোনেনি। আমি অনেক কিছু জানতে পারলাম যা আমি আগে জানতাম না।আমি মসজিদে যাওয়া শুরু করলাম এবং প্রচুর ভাই বোনদের সাথে ইসলামিক বিষয়ে কথা বলা ও আলোচনায় অংশ নিতে লাগলাম। আমি শপথ করে বলতে পারি যে আমার নিজের দেশে আমি কখনও কোন মসজিদে যাই নি এবং সেটার কথা চিন্তাও করিনি। যদিও আমার দেশে হাজার হাজার মসজিদ ছিল।আমি ছাড়া মসজিদের সমস্ত বোনরা হিজাব করত।আমি বাদে আর সবাই ছিল আমেরিকান। তারা আমার ব্যাপারে খুবই উদার ছিল আর সেজন্য আমি তাদের খুবই সম্মান করি। আমি এটা নিয়ে সবসময়ের জন্য ভাবা শুরু করলাম এবং আমার হিজাব পড়া নিয়ে প্রচুর স্বপ্ন দেখতে লাগ্লাম।আমি হঠাৎ এক অচেনা অনুভূতির সম্মুখীন হতে লাগলাম- আর তা হল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে তা উপভোগ করার বদলে আমার বিতৃষ্ণা বোধ হতে থাকল। আমার নিজেকে একটা ছবির মত মনে হত যার কোন ব্রেন বা হৃদয় বলতে কিছু নেই। পরিশেষে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হিজাব শুরু করলাম। এটা আমার জীবনের নেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। জীবনে প্রথমবারের মত আমি অনুভব করলাম যে আমি একজন দৃঢ় চিত্তের মানুষ।আমি যা বিশ্বাস করি সে অনুযায়ী কাজ করি।চারপাশের মানুষ আমার ব্যাপারে কি বলল বা আমার দিকে কিভাবে তাকাল, আমি তা গ্রাহ্য করি না।
হিজাব পড়ার পর প্রথম দিনটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর। আমি এত সুখী আর উদার জীবনে আর কখনও বোধ করি নি যেমনটি করেছিলাম সেদিন। আর বন্ধু এবং আত্মীয় স্বজনদের জন্য অবিশ্বাস্য ছিল যে আমি আসলেও এটা করতে পারব এবং প্রত্যেকে বলেছিল যে আমার এটা বেশী দিন স্থায়ী হবে না। সম্ভবত তাদের এই অনুমান অনেকগুলো কারণের মাঝে একটি যা আজও আমাকে হিজাব পড়া অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। আমার নিজের সাথে এজন্য যুদ্ধ চালাতে হয়েছে। আমার আমি সবসময়ই দুনিয়ার এই জীবনটাকে খুব ভালবাসে এবং তাকে সর্বোত্তমরূপে ভোগ করতে চায়। কিন্তু তখন সময় এসেছিল তাকে থামানোর এবং আমি তা করেছিলাম।কিছুদিন পর থেকে সবাই আমাকে সম্মানের চোখে দেখা শুরু করল যেভাবে তারা আগে কখনও দেখেনি। সবাই আমাকে চরমভাবে বিশ্বাস করা শুরু করল এই কারণে যে তারা জানত আমি একজন ধার্মিক ব্যক্তি। কি তাদের মাঝে এই ধারণার জন্ম দিল? -হিজাব।
আমি এখন যে কোন জায়গায় যেতে পারি এবং কেউ আমার দিকে এমনভাবে তাকায় না যে আমি একটা ছবি বা প্রাণহীণ পুতুল।তবে আমি এখনও সুন্দর করে পোশাক পড়ি এবং সাজগোজ করি, যখন আমি শুধু আমার বোনদের মাঝে থাকি আর দেখা গেল সেটা আরও বেশি মজা- নির্মল বিনোদন।
আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ হিজাব বাধ্যতামূলক করেছেন আমাদের সাহায্য করার জন্য, আমাদের জীবনকে সহজতর করার জন্য। এটা নারী ও পুরুষের মাঝে সম্মানজনক সেতুবন্ধনের সাহায্য করে। তাছাড়াও এটা হল নিজের সৌন্দর্য শুধু নিজের কাছে এবং যাদের কাছে আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন শুধু তাদের কাছেই তুলে ধরার ব্যাপার।এটা অন্য সকল ধর্মের মত একটি চিহ্ন বা স্মারক যে আমি একজন মুসলিম। যেমন ইহুদীরা তাদের মাথার উপর একটা ছোট কাপ পড়ে আর খ্রিস্টানরা পরে ক্রস।তাদের কেউই জনসম্মুখে এটা পড়তে লজ্জিত বোধ করে না। কোন মানুষ এব্যাপারে খারাপ ধারণাও পোষণ করে না।
একটা মেয়ে হিজাব পড়ে যেন এটা তাকে ভুল বা হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়া থেকে বাঁচায়। যে মেয়েটা হিজাব পড়ে সে এমন দৃঢ়চিত্ত হয় যে, যে কোন কিছু করতে পারে এবং জীবনের পথে যে কোন সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে। তোমার চারপাশের সবাই তোমাকে বিশ্বাস করবে কারণ তুমি নিজেকে বিশ্বাস কর। তুমি কি জান না যে তোমার বাহ্যিক দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ? তুমি কি জান না তা খুব মূল্যবান? তুমি যে সুন্দর এটা বলার জন্য তোমার কাউকে প্রয়োজন নেই, কারণ তুমি তা জান। আর তোমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকার জন্যও তোমার কাউকে দরকার নেই যেন তুমি একটা সুন্দর ছবি না চিত্রকর্ম, কারণ তুমি একজন মানুষ।
অথবা আমরা যখন বড় হব তখন হিজাব পড়াটাকে আমাদের কাছে খুব কঠিন মনে হবে। কারণ সারাজীবন ধরে একটি বিষয়ে অভ্যস্ত হওয়া আর তারপর হঠাৎ করে সেটা বদলে ফেলা খুব কঠিন। মন পরিবর্তন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। যাই হোক, নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে আমি খুবই ভালবাসতাম যেহেতু আমি দেখতে খুবই আকর্ষণীয় ছিলাম।আর এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন অংশ।আমি দামী দামী জামা-কাপড় কিনতে, সেগুলো দিয়ে নিজেকে সাজাতে খুবই পছন্দ করতাম। সবাই যখন আমার দিকে তাকাত এবং বিশেষভাবে চিহ্নিত করত, ব্যাপারটা আমি চরমভাবে উপভোগ করতাম। আমি ভালবাসতাম প্রশংসা শুনতে –বাহ মেয়েটাতো দারুণ সুন্দরী।
আমার মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ হবার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য আমি আমেরিকাতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেখানে আমি একটি বিষয় লক্ষ করলাম যা আগে কখনও দেখিনি। তা হল মুসলিম সমাজ এবং সম্প্রদায়। এ এক অসাধারণ সমাজ আদর্শ মুসলিমদের নিয়ে যারা ইসলাম পালন করছে আমি যেভাবে অভ্যস্ত তার তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রায়। আরব উপসাগরীয় এলাকার মুসলিমরা জন্মগতভাবে মুসলিম। তাদের কোন প্রশ্ন করতে হয়না কারণ সব কিছুই খুব সুস্পষ্ট। আমাদের নিজেদের ঈমান নিয়ে এবং কিভাবে আল্লাহতে বিশ্বাস করতে হবে এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হয় নি কারণ আমরা বেড়েই উঠেছি মুসলিম হিসেবে এবং আমাদের চারপাশের সবাই ছিল মুসলিম। প্রকৃত ইসলামের স্বরূপ কেমন এটা এবং সব ধরণের ধর্মাবলম্বী সম্বলিত একটি মিশ্র সমাজে বাস করার অনুভূতি কেমন সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই ছিল না। আমি উপলব্ধি করলাম উপসাগরীয় লোকজন বিশুদ্ধ ধর্ম পালন করত না, যা করত তা হল ধর্ম এবং সংস্কৃতির এক ধরণের মিশ্রণ।আমি আবিষ্কার করলাম-অনেক কিছু, যাকে আমি ইসলামিক বলে মনে করতাম, আসলে সাংস্কৃতিক বিশ্বাস এবং সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চরম ভুল!আমি জানলাম যে বিশুদ্ধ ইসলাম সেটা না যার মাঝে আমরা বেড়ে উঠেছি বরং তা ছিল অর্থহীণ বিষয়ে পূর্ণ যা বহুদিন ধরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ। বিশুদ্ধ ইসলামের শিক্ষার উৎস শুধুই ক্বুরআন ও সুন্নাহ।
যখন আমেরিকার লোকজন জানতে পারল যে আমি মুসলিম, তখন তারা সবসময় ইসলামের ব্যাপারে আমাকে নানা ধরণের প্রশ্ন করত। অধিকাংশ সময়েই আমি তাদের সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না। ফলে আমি বিভিন্ন ইসলামী বই এবং ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করা শুরু করলাম-বিশুদ্ধ ইসলাম জানার আশায়। আমার অবস্থা ছিল এমন ব্যক্তির মত যে কখনও ইসলামের কথা আগে শোনেনি। আমি অনেক কিছু জানতে পারলাম যা আমি আগে জানতাম না।আমি মসজিদে যাওয়া শুরু করলাম এবং প্রচুর ভাই বোনদের সাথে ইসলামিক বিষয়ে কথা বলা ও আলোচনায় অংশ নিতে লাগলাম। আমি শপথ করে বলতে পারি যে আমার নিজের দেশে আমি কখনও কোন মসজিদে যাই নি এবং সেটার কথা চিন্তাও করিনি। যদিও আমার দেশে হাজার হাজার মসজিদ ছিল।আমি ছাড়া মসজিদের সমস্ত বোনরা হিজাব করত।আমি বাদে আর সবাই ছিল আমেরিকান। তারা আমার ব্যাপারে খুবই উদার ছিল আর সেজন্য আমি তাদের খুবই সম্মান করি। আমি এটা নিয়ে সবসময়ের জন্য ভাবা শুরু করলাম এবং আমার হিজাব পড়া নিয়ে প্রচুর স্বপ্ন দেখতে লাগ্লাম।আমি হঠাৎ এক অচেনা অনুভূতির সম্মুখীন হতে লাগলাম- আর তা হল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে তা উপভোগ করার বদলে আমার বিতৃষ্ণা বোধ হতে থাকল। আমার নিজেকে একটা ছবির মত মনে হত যার কোন ব্রেন বা হৃদয় বলতে কিছু নেই। পরিশেষে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হিজাব শুরু করলাম। এটা আমার জীবনের নেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। জীবনে প্রথমবারের মত আমি অনুভব করলাম যে আমি একজন দৃঢ় চিত্তের মানুষ।আমি যা বিশ্বাস করি সে অনুযায়ী কাজ করি।চারপাশের মানুষ আমার ব্যাপারে কি বলল বা আমার দিকে কিভাবে তাকাল, আমি তা গ্রাহ্য করি না।
হিজাব পড়ার পর প্রথম দিনটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর। আমি এত সুখী আর উদার জীবনে আর কখনও বোধ করি নি যেমনটি করেছিলাম সেদিন। আর বন্ধু এবং আত্মীয় স্বজনদের জন্য অবিশ্বাস্য ছিল যে আমি আসলেও এটা করতে পারব এবং প্রত্যেকে বলেছিল যে আমার এটা বেশী দিন স্থায়ী হবে না। সম্ভবত তাদের এই অনুমান অনেকগুলো কারণের মাঝে একটি যা আজও আমাকে হিজাব পড়া অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। আমার নিজের সাথে এজন্য যুদ্ধ চালাতে হয়েছে। আমার আমি সবসময়ই দুনিয়ার এই জীবনটাকে খুব ভালবাসে এবং তাকে সর্বোত্তমরূপে ভোগ করতে চায়। কিন্তু তখন সময় এসেছিল তাকে থামানোর এবং আমি তা করেছিলাম।কিছুদিন পর থেকে সবাই আমাকে সম্মানের চোখে দেখা শুরু করল যেভাবে তারা আগে কখনও দেখেনি। সবাই আমাকে চরমভাবে বিশ্বাস করা শুরু করল এই কারণে যে তারা জানত আমি একজন ধার্মিক ব্যক্তি। কি তাদের মাঝে এই ধারণার জন্ম দিল? -হিজাব।
আমি এখন যে কোন জায়গায় যেতে পারি এবং কেউ আমার দিকে এমনভাবে তাকায় না যে আমি একটা ছবি বা প্রাণহীণ পুতুল।তবে আমি এখনও সুন্দর করে পোশাক পড়ি এবং সাজগোজ করি, যখন আমি শুধু আমার বোনদের মাঝে থাকি আর দেখা গেল সেটা আরও বেশি মজা- নির্মল বিনোদন।
আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ হিজাব বাধ্যতামূলক করেছেন আমাদের সাহায্য করার জন্য, আমাদের জীবনকে সহজতর করার জন্য। এটা নারী ও পুরুষের মাঝে সম্মানজনক সেতুবন্ধনের সাহায্য করে। তাছাড়াও এটা হল নিজের সৌন্দর্য শুধু নিজের কাছে এবং যাদের কাছে আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন শুধু তাদের কাছেই তুলে ধরার ব্যাপার।এটা অন্য সকল ধর্মের মত একটি চিহ্ন বা স্মারক যে আমি একজন মুসলিম। যেমন ইহুদীরা তাদের মাথার উপর একটা ছোট কাপ পড়ে আর খ্রিস্টানরা পরে ক্রস।তাদের কেউই জনসম্মুখে এটা পড়তে লজ্জিত বোধ করে না। কোন মানুষ এব্যাপারে খারাপ ধারণাও পোষণ করে না।
একটা মেয়ে হিজাব পড়ে যেন এটা তাকে ভুল বা হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়া থেকে বাঁচায়। যে মেয়েটা হিজাব পড়ে সে এমন দৃঢ়চিত্ত হয় যে, যে কোন কিছু করতে পারে এবং জীবনের পথে যে কোন সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে। তোমার চারপাশের সবাই তোমাকে বিশ্বাস করবে কারণ তুমি নিজেকে বিশ্বাস কর। তুমি কি জান না যে তোমার বাহ্যিক দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ? তুমি কি জান না তা খুব মূল্যবান? তুমি যে সুন্দর এটা বলার জন্য তোমার কাউকে প্রয়োজন নেই, কারণ তুমি তা জান। আর তোমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকার জন্যও তোমার কাউকে দরকার নেই যেন তুমি একটা সুন্দর ছবি না চিত্রকর্ম, কারণ তুমি একজন মানুষ।
ঈমানদার যুবক ও আছহাবুল উখদূদের কাহিনী
হযরত সুহায়েব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে জে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ বহুকাল পূর্বে একজন রাজা ছিলেন। সেই রাজার ছিল একজন যাদুকর। ঐ যাদুকর বৃদ্ধ হ’লে একদিন সে রাজাকে বলল, ‘আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি এবং আমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। সুতরাং আমার নিকট একটি ছেলে পাঠান, যাকে আমি ভালভাবে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব’। বাদশাহ তার নিকট একটি বালককে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বালকটি যাদুকরের নিকট যে পথ দিয়ে যাতায়াত করত, সে পথে ছিল এক সন্ন্যাসীর আস্তানা। সন্ন্যাসী ঐখানে বসে কখনো ইবাদাত করতেন, আবার কখনো লোকদের নিকট ওয়াজ-নসিহাত করতেন। বালকটিও পথের পাসে দাঁড়িয়ে তার ওয়াজ নসীহত শুনত। ফলে যাদুকরের নিকট পৌছাতে বালকটির দেরী হ’ত বলে যাদুকর তাকে প্রহার করত। বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট এ কথা জানালে তিনি বালককে শিখিয়ে দেন যে, তুমি যদি যাদুকর কে ভয় কর তাহ’লে বলবে, বাড়ীর লোকজন আমাকে পাঠাতে বিলম্ব করেছে এবং বাড়ীর লোকজনকে ভয় পেলে বলবে, যাদুকরই আমাকে ছুটি দিতে বিলম্ব করেছে।
বালকটি এভাবে একদিকে যাদু বিদ্যা অন্যদিকে ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষা করতে লাগলো। একদিন পথে সে দেখল, একটি বৃহদাকার প্রাণী মানুষের চলাচলের পথ রোধ করে বসে আছে। বালকটি ভাবল, আজ পরীক্ষা করে দেখব যে আল্লাহর কাছে যাদুকরের ধর্ম শ্রেষ্ঠ, না সন্ন্যাসীর ধর্ম শ্রেষ্ঠ ? অতঃপর সে একটি পাথর নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ্! যাদুকরের কার্যকলাপ অপেক্ষা সন্ন্যাসীর কার্যকলাপ যদি তোমার নিকট অধিকতর প্রিয় হয়, তবে এই প্রাণীটিকে এই পাথরের আঘাতে মেরে ফেল। যেন লোকজন যাতায়াত করতে পারে’। এই বলে প্রাণীটিকে লক্ষ্য করে সে পাথরটি ছুঁড়ে মারল এবং প্রাণীটি মারা গেল ও লোক চলাচল শুরু হ’ল। এরপর বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট গিয়ে তাকে ঘটনাটি জানালে তিনি তাকে বললেন, ‘বৎস! তুমি এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছ। তোমার প্রকৃত স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি। শীঘ্রই তোমাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও তাহ’লে যেন আমার কথা প্রকাশ করে দিও না’।
তারপ বালকটির দো‘আয় জন্মান্ধ ব্যক্তি দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেতে লাগলো , কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নিরাময় হ’তে লাগল এবং লোকজন অন্যান্য রোগ হ’তেও আরোগ্য লাভ করতে লাগল।
এদিকে রাজার একজন সহচর অন্ধ হয়েছিল। সে বহু উপঢৌকনসহ বালকটির নিকট গিয়ে বলল, ‘তুমি যদি আমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দাও, তাহ’লে এ সবই তোমার’। বালকটি বলল, ‘আমিতো কাউকে আরোগ্য করতে পারি না । বরং রোগ ভাল করেন আল্লাহ্। অতএব আপনি যদি আল্লাহ্ প্রতি ঈমান আনেন, তাহ’লে আমি আপনার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহ্ নিকটে দো‘আ করতে পারি। তাতে তিনি হয়ত আপনাকে আরোগ্য দান করতে পারেন’। ফলে লোকটি আল্লাহ্ প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহ্ তাকে আরোগ্য দান করলেন।
পূর্বের ন্যায় তিনি রাজার নিকটে গিয়ে বসলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল’? সে বলল, ‘আমার রব’। রাজা বললেন, আমি ছাড়া তোমার রব আছে কি’? সে বলল, ‘আমার ও আপনার উভয়ের রব আল্লাহ্’। এতে রাজা তাকে ধরে তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে সে বালকটির নাম প্রকাশ করে দিল। অতঃপর বালকটিকে রাজদরবারে আনা হ’ল। রাজা তাকে বললেন, ‘বৎস! আমি জানতে পারলাম যে, তুমি তোমার যাদুর গুণে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত লোকদের রোগ নিরাময় করছ এবং অন্যান্য কঠিন রোগও নিরাময় করে চলেছ। বালকটি বলল, আমি কাউকে রোগ মুক্ত করি না। রোগ মুক্ত করেন আল্লাহ্’। তখন রাজা তাকে পাকড়াও করে তার উপর উৎপীড়ন চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সে সন্ন্যাসীর কথা প্রকাশ করে দিল। তখন সন্ন্যাসীকে ধরে আনা হ’ল এবং তাঁকে বলা হ’ল, তুমি তোমার ধর্ম পরিত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন রাজার আদেশক্রমে করাত নিয়ে আসা হ’লে তিনি তা তার মাথার মাঝখানে বসালেন এবং তাঁর মাথা ও শরীর চিরে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললেন। তারপর রাজার সহচরকে আনা হ’ল এবং তাকেও তার ধর্ম ত্যাগ করতে বলা হ’ল। কিন্তু সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকেও করাত দিয়ে চিরে দ্বিখণ্ডিত করা হ’ল।
তারপর বালকটিকে হাযির করে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হ’ল। বালকটিও নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করল। তখন রাজা তাকে তার লোকজনের নিকট দিয়ে বললেন, ‘তোমরা একে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আরোহণ করতে থাক। যখন তোমরা পাহাড়ের উচ্চশৃঙ্গে পৌঁছবে, তখন তাকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলবে। সে যদি অস্বীকার করে, তাহ’লে তোমরা তাকে সেখান থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিবে’। তারা বালকটিকে নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলে বালকটি দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ্! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের কাছ থেকে রক্ষা কর’। তৎক্ষণাৎ পাহাড়টি কম্পিত হয়ে উঠল এবং তারা নীচে পড়ে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকট এসে উপস্থিত হ’ল। রাজা তখন তাকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গীদের কি হ’ল’? তখন সে বলল, আল্লাহ্ই আমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
তারপর রাজা তাকে তার একদল লোকের নিকট সোপর্দ করে আদেশ দিলেন, ‘একে একটি বড় নৌকায় উঠিয়ে নদীর মাঝখানে নিয়ে যাও। যদি সে নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে, তো ভাল। নচেৎ তাকে নদীতে নিক্ষেপ কর’। তারা বালকটিকে নিয়ে মাঝ নদীতে পৌঁছলে বালকটি পূর্বের ন্যায় দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ্! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের হাত থেকে রক্ষা কর’। এতে নৌকা ভীষণভাবে কাত হয়ে পড়ল। ফলে রাজার লোকজন নদীতে ডুবে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্ত দেহে) রাজার নিকটে আসলে রাজা তাকে বললেন, তোমার সঙ্গীদের কি অবস্থা? সে বলল, আল্লাহ্ই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এরপর সে রাজাকে বলল, ‘আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আমাকে কোনভাবেই হত্যা করতে পারবেন না। যতক্ষণ না আমি যা বলব, আপনি তা করবেন। রাজা বললেন, ‘সেটা কি’? বালকটি বলল, ‘আপনি একটি বিস্তীর্ণ মাঠে সকল লোককে হাযির করুন এবং সেই মাঠে খেজুরের একটি গুঁড়ি পুঁতে তার উপরিভাগে আমাকে বেঁধে রাখুন। তারপর আমার তূণীর হ’তে একটি তীর নিয়ে ধনুকে সংযোজিত করুন। তারপর ( بسم الله الرحمن الرحيم ) “বালকটির রব আল্লাহ্ নামে” বলে আমার দিকে তীরটি নিক্ষেপ করুন।
আপনি যদি এ পন্থা অবলম্বন করেন, তবেই আমাকে হত্যা করতে পারবেন। বালকের কথামত এক বিস্তীর্ণ মাঠে রাজা সকল লোককে সমবেত করলেন এবং বালকটিকে একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপরে বাঁধলেন। তারপর রাজা বালকটির তূণীর হ’তে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মধ্যভাগে সংযোজিত করলেন। তারপর বলে বালকটির দিকে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরটি বালকের চোখ ও কানের মধ্যভাগে বিদ্ধ হ’ল। বালকটি এক হাতে তীর-বিদ্ধ স্থানটি চেপে ধরল। অতঃপর সে মারা গেল।
এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনগণ বলে উঠল, ‘আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম’। তারপর রাজার লোকজন তাঁর নিকট গিয়ে বলল, ‘আপনি যা আশঙ্কা করছিলেন তাই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল। সব লোক বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনল’। তখন রাজা রাস্তা গুলির চৌমাথায় প্রকাণ্ড গর্ত খনন করার নির্দেশ দিলেন। তার কথা মতো গর্ত খনন করে তাতে আগুন প্রজ্বলিত করা হ’ল। তারপর রাজা হুকুম দিলেন, ‘যে ব্যক্তি বালকের ধর্ম পরিত্যাগ করবে না, তাকে ঐ আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মার। অথবা তাকে বলবে, তুমি এই আগুনে ঝাঁপ দাও। রাজার লোকেরা তার হুকম পালন করতে লাগল। ইতিমধ্যে একজন রমণীকে তার শিশুসন্তান সহ উপস্থিত করা হ’ল। রমণীটি আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্ততঃ করতে থাকলে শিশুটি বলে উঠল, ‘মা ছবর অবলম্বন করে আগুনে প্রবেশ করুন। কেননা আপনি হক পথে আছেন’।
পবিত্র কুরআনের সূরা বুরূজে এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংস হয়েছিল গর্ত ওয়ালারা- ইন্ধন পূর্ণ যে গর্তে ছিল অগ্নি, যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল। তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু একারণে যে, তারা বিশ্বাস করত পরাক্রমশালী ও প্রশংসা আল্লাহর’ (বুরূজ ৪-৮)।
[ছহীহ মুসলিম হা/৩০০৫ ‘যুহদ ও রক্বাক্ব’ অধ্যায়, অনুচেছদ-১৭, ছুহাইব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আহমাদ হা/২৩৯৭৬]।
বিস্তারিত পড়ুনঃ তাফসীর ইবনে কাসির, ১৮ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৫-১২২।
শিক্ষা :
১. প্রত্যেকটি আদম সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে।
২. মুমিন বান্দা সর্বদা আল্লাহ্কে স্মরণ করবে ও কায়মনোবাক্যে তাঁর নিকট দো‘আ করবে।
৩. রোগমুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ্; কোন পীর-ফকীর বা সাধু-সন্ন্যাসী নয়।
৪. আল্লাহ্ পথের নির্ভীক সৈনিকেরা বাতিলের সামনে কখনো মাথা নত করে না।
৫. মুমিন দুনিয়াবি জীবনে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এর মাধ্যমে
আল্লাহ্ তার ঈমানের মজবুতি পরখ করেন।
৬. হক্বের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
৭. সুরা আল-বুরুজে আল্লাহ এমন একটা জাতির কথা বর্ণনা করেছেন, ঈমান আনার কারণে যাদেরকে আগুনের গর্তে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। একটা মুসলিম উম্মাহর সবগুলো মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো অথচ আল্লাহ এই ঘটনাকে “এটাই হলো সুস্পষ্ট বিজয়” বলেছেন।
এ শত্রুতা এবং শাস্তির কারণ শুধু এটাই ছিল জে, তারা পরাক্রমশালী ও প্রশংসনীয় আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা’আলাই সর্বশক্তিমান। তাঁর আশ্রয়ে আশ্রিত লোকেরা কখনো ধ্বংস হয় মা, ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যদি তিনি কখনো নিজের বিশেষ বান্দাদেরকে কাফিরদের দ্বারা কষ্টও দিয়ে থাকেন, সেটাও বিশেষ কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য এবং তার রহস্য কারো জানা না থাকতেও পারে। কিন্তু সেটা একটা প্রছন্ন ও বিশেষ অন্তর্নিহিত রহমত ও ফজিলতের ব্যাপার বৈ কিছু নয়।
আমাদের দুনিয়ার জীবনের বিবেচনায় অবাক হওয়ার মতো কথা, কিন্তু মুসলিমদের চূড়ান্ত বিজয় হলো জান্নাত। সমস্ত মুসলিমদেরকেও যদি হত্যা করা হয় বা আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় তবু সেই বিজয়ের সামান্যতম ক্ষতি হবেনা। কিন্তু কথা হচ্ছে আমরা যেনো আমাদের ইসলামকে ধরে রাখতে পারি, আমাদের কাছে মৃত্যু চলে আসা পর্যন্ত।
আল্লাহ আমাদের সকলকেই ঈমানের সহিত মৃত্যুবরণ করার মহাসোওভাগ্য দান করুন। আমিন।
হযরত সুহায়েব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে জে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ বহুকাল পূর্বে একজন রাজা ছিলেন। সেই রাজার ছিল একজন যাদুকর। ঐ যাদুকর বৃদ্ধ হ’লে একদিন সে রাজাকে বলল, ‘আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি এবং আমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। সুতরাং আমার নিকট একটি ছেলে পাঠান, যাকে আমি ভালভাবে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব’। বাদশাহ তার নিকট একটি বালককে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বালকটি যাদুকরের নিকট যে পথ দিয়ে যাতায়াত করত, সে পথে ছিল এক সন্ন্যাসীর আস্তানা। সন্ন্যাসী ঐখানে বসে কখনো ইবাদাত করতেন, আবার কখনো লোকদের নিকট ওয়াজ-নসিহাত করতেন। বালকটিও পথের পাসে দাঁড়িয়ে তার ওয়াজ নসীহত শুনত। ফলে যাদুকরের নিকট পৌছাতে বালকটির দেরী হ’ত বলে যাদুকর তাকে প্রহার করত। বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট এ কথা জানালে তিনি বালককে শিখিয়ে দেন যে, তুমি যদি যাদুকর কে ভয় কর তাহ’লে বলবে, বাড়ীর লোকজন আমাকে পাঠাতে বিলম্ব করেছে এবং বাড়ীর লোকজনকে ভয় পেলে বলবে, যাদুকরই আমাকে ছুটি দিতে বিলম্ব করেছে।
বালকটি এভাবে একদিকে যাদু বিদ্যা অন্যদিকে ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষা করতে লাগলো। একদিন পথে সে দেখল, একটি বৃহদাকার প্রাণী মানুষের চলাচলের পথ রোধ করে বসে আছে। বালকটি ভাবল, আজ পরীক্ষা করে দেখব যে আল্লাহর কাছে যাদুকরের ধর্ম শ্রেষ্ঠ, না সন্ন্যাসীর ধর্ম শ্রেষ্ঠ ? অতঃপর সে একটি পাথর নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ্! যাদুকরের কার্যকলাপ অপেক্ষা সন্ন্যাসীর কার্যকলাপ যদি তোমার নিকট অধিকতর প্রিয় হয়, তবে এই প্রাণীটিকে এই পাথরের আঘাতে মেরে ফেল। যেন লোকজন যাতায়াত করতে পারে’। এই বলে প্রাণীটিকে লক্ষ্য করে সে পাথরটি ছুঁড়ে মারল এবং প্রাণীটি মারা গেল ও লোক চলাচল শুরু হ’ল। এরপর বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট গিয়ে তাকে ঘটনাটি জানালে তিনি তাকে বললেন, ‘বৎস! তুমি এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছ। তোমার প্রকৃত স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি। শীঘ্রই তোমাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও তাহ’লে যেন আমার কথা প্রকাশ করে দিও না’।
তারপ বালকটির দো‘আয় জন্মান্ধ ব্যক্তি দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেতে লাগলো , কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নিরাময় হ’তে লাগল এবং লোকজন অন্যান্য রোগ হ’তেও আরোগ্য লাভ করতে লাগল।
এদিকে রাজার একজন সহচর অন্ধ হয়েছিল। সে বহু উপঢৌকনসহ বালকটির নিকট গিয়ে বলল, ‘তুমি যদি আমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দাও, তাহ’লে এ সবই তোমার’। বালকটি বলল, ‘আমিতো কাউকে আরোগ্য করতে পারি না । বরং রোগ ভাল করেন আল্লাহ্। অতএব আপনি যদি আল্লাহ্ প্রতি ঈমান আনেন, তাহ’লে আমি আপনার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহ্ নিকটে দো‘আ করতে পারি। তাতে তিনি হয়ত আপনাকে আরোগ্য দান করতে পারেন’। ফলে লোকটি আল্লাহ্ প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহ্ তাকে আরোগ্য দান করলেন।
পূর্বের ন্যায় তিনি রাজার নিকটে গিয়ে বসলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল’? সে বলল, ‘আমার রব’। রাজা বললেন, আমি ছাড়া তোমার রব আছে কি’? সে বলল, ‘আমার ও আপনার উভয়ের রব আল্লাহ্’। এতে রাজা তাকে ধরে তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে সে বালকটির নাম প্রকাশ করে দিল। অতঃপর বালকটিকে রাজদরবারে আনা হ’ল। রাজা তাকে বললেন, ‘বৎস! আমি জানতে পারলাম যে, তুমি তোমার যাদুর গুণে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত লোকদের রোগ নিরাময় করছ এবং অন্যান্য কঠিন রোগও নিরাময় করে চলেছ। বালকটি বলল, আমি কাউকে রোগ মুক্ত করি না। রোগ মুক্ত করেন আল্লাহ্’। তখন রাজা তাকে পাকড়াও করে তার উপর উৎপীড়ন চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সে সন্ন্যাসীর কথা প্রকাশ করে দিল। তখন সন্ন্যাসীকে ধরে আনা হ’ল এবং তাঁকে বলা হ’ল, তুমি তোমার ধর্ম পরিত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন রাজার আদেশক্রমে করাত নিয়ে আসা হ’লে তিনি তা তার মাথার মাঝখানে বসালেন এবং তাঁর মাথা ও শরীর চিরে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললেন। তারপর রাজার সহচরকে আনা হ’ল এবং তাকেও তার ধর্ম ত্যাগ করতে বলা হ’ল। কিন্তু সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকেও করাত দিয়ে চিরে দ্বিখণ্ডিত করা হ’ল।
তারপর বালকটিকে হাযির করে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হ’ল। বালকটিও নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করল। তখন রাজা তাকে তার লোকজনের নিকট দিয়ে বললেন, ‘তোমরা একে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আরোহণ করতে থাক। যখন তোমরা পাহাড়ের উচ্চশৃঙ্গে পৌঁছবে, তখন তাকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলবে। সে যদি অস্বীকার করে, তাহ’লে তোমরা তাকে সেখান থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিবে’। তারা বালকটিকে নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলে বালকটি দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ্! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের কাছ থেকে রক্ষা কর’। তৎক্ষণাৎ পাহাড়টি কম্পিত হয়ে উঠল এবং তারা নীচে পড়ে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকট এসে উপস্থিত হ’ল। রাজা তখন তাকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গীদের কি হ’ল’? তখন সে বলল, আল্লাহ্ই আমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
তারপর রাজা তাকে তার একদল লোকের নিকট সোপর্দ করে আদেশ দিলেন, ‘একে একটি বড় নৌকায় উঠিয়ে নদীর মাঝখানে নিয়ে যাও। যদি সে নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে, তো ভাল। নচেৎ তাকে নদীতে নিক্ষেপ কর’। তারা বালকটিকে নিয়ে মাঝ নদীতে পৌঁছলে বালকটি পূর্বের ন্যায় দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ্! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের হাত থেকে রক্ষা কর’। এতে নৌকা ভীষণভাবে কাত হয়ে পড়ল। ফলে রাজার লোকজন নদীতে ডুবে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্ত দেহে) রাজার নিকটে আসলে রাজা তাকে বললেন, তোমার সঙ্গীদের কি অবস্থা? সে বলল, আল্লাহ্ই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এরপর সে রাজাকে বলল, ‘আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আমাকে কোনভাবেই হত্যা করতে পারবেন না। যতক্ষণ না আমি যা বলব, আপনি তা করবেন। রাজা বললেন, ‘সেটা কি’? বালকটি বলল, ‘আপনি একটি বিস্তীর্ণ মাঠে সকল লোককে হাযির করুন এবং সেই মাঠে খেজুরের একটি গুঁড়ি পুঁতে তার উপরিভাগে আমাকে বেঁধে রাখুন। তারপর আমার তূণীর হ’তে একটি তীর নিয়ে ধনুকে সংযোজিত করুন। তারপর ( بسم الله الرحمن الرحيم ) “বালকটির রব আল্লাহ্ নামে” বলে আমার দিকে তীরটি নিক্ষেপ করুন।
আপনি যদি এ পন্থা অবলম্বন করেন, তবেই আমাকে হত্যা করতে পারবেন। বালকের কথামত এক বিস্তীর্ণ মাঠে রাজা সকল লোককে সমবেত করলেন এবং বালকটিকে একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপরে বাঁধলেন। তারপর রাজা বালকটির তূণীর হ’তে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মধ্যভাগে সংযোজিত করলেন। তারপর বলে বালকটির দিকে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরটি বালকের চোখ ও কানের মধ্যভাগে বিদ্ধ হ’ল। বালকটি এক হাতে তীর-বিদ্ধ স্থানটি চেপে ধরল। অতঃপর সে মারা গেল।
এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনগণ বলে উঠল, ‘আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম’। তারপর রাজার লোকজন তাঁর নিকট গিয়ে বলল, ‘আপনি যা আশঙ্কা করছিলেন তাই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল। সব লোক বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনল’। তখন রাজা রাস্তা গুলির চৌমাথায় প্রকাণ্ড গর্ত খনন করার নির্দেশ দিলেন। তার কথা মতো গর্ত খনন করে তাতে আগুন প্রজ্বলিত করা হ’ল। তারপর রাজা হুকুম দিলেন, ‘যে ব্যক্তি বালকের ধর্ম পরিত্যাগ করবে না, তাকে ঐ আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মার। অথবা তাকে বলবে, তুমি এই আগুনে ঝাঁপ দাও। রাজার লোকেরা তার হুকম পালন করতে লাগল। ইতিমধ্যে একজন রমণীকে তার শিশুসন্তান সহ উপস্থিত করা হ’ল। রমণীটি আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্ততঃ করতে থাকলে শিশুটি বলে উঠল, ‘মা ছবর অবলম্বন করে আগুনে প্রবেশ করুন। কেননা আপনি হক পথে আছেন’।
পবিত্র কুরআনের সূরা বুরূজে এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংস হয়েছিল গর্ত ওয়ালারা- ইন্ধন পূর্ণ যে গর্তে ছিল অগ্নি, যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল। তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু একারণে যে, তারা বিশ্বাস করত পরাক্রমশালী ও প্রশংসা আল্লাহর’ (বুরূজ ৪-৮)।
[ছহীহ মুসলিম হা/৩০০৫ ‘যুহদ ও রক্বাক্ব’ অধ্যায়, অনুচেছদ-১৭, ছুহাইব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আহমাদ হা/২৩৯৭৬]।
বিস্তারিত পড়ুনঃ তাফসীর ইবনে কাসির, ১৮ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৫-১২২।
শিক্ষা :
১. প্রত্যেকটি আদম সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে।
২. মুমিন বান্দা সর্বদা আল্লাহ্কে স্মরণ করবে ও কায়মনোবাক্যে তাঁর নিকট দো‘আ করবে।
৩. রোগমুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ্; কোন পীর-ফকীর বা সাধু-সন্ন্যাসী নয়।
৪. আল্লাহ্ পথের নির্ভীক সৈনিকেরা বাতিলের সামনে কখনো মাথা নত করে না।
৫. মুমিন দুনিয়াবি জীবনে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এর মাধ্যমে
আল্লাহ্ তার ঈমানের মজবুতি পরখ করেন।
৬. হক্বের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
৭. সুরা আল-বুরুজে আল্লাহ এমন একটা জাতির কথা বর্ণনা করেছেন, ঈমান আনার কারণে যাদেরকে আগুনের গর্তে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। একটা মুসলিম উম্মাহর সবগুলো মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো অথচ আল্লাহ এই ঘটনাকে “এটাই হলো সুস্পষ্ট বিজয়” বলেছেন।
এ শত্রুতা এবং শাস্তির কারণ শুধু এটাই ছিল জে, তারা পরাক্রমশালী ও প্রশংসনীয় আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা’আলাই সর্বশক্তিমান। তাঁর আশ্রয়ে আশ্রিত লোকেরা কখনো ধ্বংস হয় মা, ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যদি তিনি কখনো নিজের বিশেষ বান্দাদেরকে কাফিরদের দ্বারা কষ্টও দিয়ে থাকেন, সেটাও বিশেষ কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য এবং তার রহস্য কারো জানা না থাকতেও পারে। কিন্তু সেটা একটা প্রছন্ন ও বিশেষ অন্তর্নিহিত রহমত ও ফজিলতের ব্যাপার বৈ কিছু নয়।
আমাদের দুনিয়ার জীবনের বিবেচনায় অবাক হওয়ার মতো কথা, কিন্তু মুসলিমদের চূড়ান্ত বিজয় হলো জান্নাত। সমস্ত মুসলিমদেরকেও যদি হত্যা করা হয় বা আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় তবু সেই বিজয়ের সামান্যতম ক্ষতি হবেনা। কিন্তু কথা হচ্ছে আমরা যেনো আমাদের ইসলামকে ধরে রাখতে পারি, আমাদের কাছে মৃত্যু চলে আসা পর্যন্ত।
আল্লাহ আমাদের সকলকেই ঈমানের সহিত মৃত্যুবরণ করার মহাসোওভাগ্য দান করুন। আমিন।
আবূ নাজীহ আমর ইবনু আবাসাহ আস-সুলামী (রা:) বলেন, জাহেলী যুগ আমি ধারণা করতাম যে, লোকেরা পথভ্রষ্টতার উপর রয়েছে এবং এরা কোন ধর্মেই নেই। আর ওরা প্রতিমা পূজা করছে। অতঃপর আমি এক ব্যক্তির ব্যাপারে শুনলাম যে, তিনি মক্কায় অনেক আশ্চর্য খবর বলছেন। সুতরাং আমি আমার সওয়ারীর উপর বসে তাঁর কাছে এসে দেখলাম যে, তিনি আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ)।
তিনি গোপনে (ইসলাম প্রচার করছেন), আর তাঁর সম্প্রদায় (মুশরিকরা) তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহার করছে। সুতরাং আমি বিচক্ষণতার সাথে কাজ করলাম। আমি মক্কায় তাঁর কাছে পরামর্শ করলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আপনি কে?
তিনি বললেন, ‘আমি নবী’।
আমি বললাম, নবী কি?
তিনি বললেন, ‘মহান আল্লাহ্ আমাকে প্রেরণ করেছেন।
আমি বললাম, তিনি কি দিয়ে প্রেরণ করেছেন?
তিনি বললেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা,মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা, আল্লাহ্কে একক উপাস্য মানা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার নির্দেশ দিয়ে।
আমি বললাম, এ কাজে আপনার সঙ্গে কে আছে?
তিনি বললেন, ‘একজন স্বাধীন এবং একজন কৃতদাস। তিনি বলেন, তার প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তার মধ্যে তখন তাঁর সঙ্গে আবূ বকর ও বেলাল (রা:) ছিলেন।
আমি বললাম, ‘আমিও আপনার অনুগত।
তিনি বললেন, ‘তুমি এখন এ কাজ কোন অবস্থাতেই করতে পারবে না। তুমি কি আমার অবস্থা ও লোকদের অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না? অতএব তুমি (এখন) বাড়ি ফিরে যাও। অতঃপর যখন তুমি আমার জয়ী ও শক্তিশালী হওয়ার সংবাদ পাবে, তখন আমার কাছে এস।
সুতরাং আমি আমার পরিবার-পরিজনের নিকট চলে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় চলে এলেন। আর আমি পরিবারের সদস্যদের সাথেই ছিলাম। অতঃপর আমি খবরাখবর নিতে আরম্ভ করলাম এবং যখন তিনি মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি (তাঁর ব্যাপারে) লোকদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। অবশেষে আমার নিকট মদীনার কিছু লোক এলো।
আমি বললাম, ঐ লোকটার অবস্থা কি, যিনি (মক্কা ত্যাগ করে) মদীনায় এসেছেন?
তারা বলল, লোকেরা তাঁর দিকে দ্রুত ধাবমান। তাঁর সম্প্রদায় তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হয়নি।
অতঃপর আমি মদীনায় এসে তাঁর খিদমতে হাযির হলাম। তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ)! আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তো ঐ ব্যক্তি, যে মক্কায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলে।
আমি বললাম, হ্যাঁ। হে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ)! আল্লাহ্ তাআলা আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা আমার অজানা, তা আমাকে বলুন? আমাকে ছালাত সম্পর্কে বলুন।
তিনি বললেন, তুমি ফজরের ছালাত পড়। তারপর সূর্য এক বল্লম পরিমাণ উঁচু হওয়া পর্যন্ত বিরত থাক। কারণ তা শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যভাগে উদিত হয় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং সে সময় কাফেররা তাকে সিজদা করে। পুনরায় তুমি ছালাত আদায় কর। কেননা ছালাতে ফেরেশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন, যতক্ষণ না ছায়া বল্লমের সমান হয়ে যায়। অতঃপর ছালাত থেকে বিরত হও। কেননা তখন জাহান্নামের আগুন উস্কানো হয়। অতঃপর যখন ছায়া বাড়তে আরম্ভ করে, তখন ছালাত আদায় কর। কেননা এ ছালাতে ফেরেশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন। পরিশেষে তুমি আছরের ছালাত আদায় কর। অতঃপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছালাত আদায় করা থেকে বিরত থাক। কেননা সূর্য শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যে অস্ত যায় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং তখন কাফেররা তাকে সিজদা করে।
পুনরায় আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র নবী (সাঃ)! আপনি আমাকে ওযূ সম্পর্কে বলুন?
তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ পানি নিয়ে (হাত ধোয়ার পর) কুলি করবে এবং নাকে পানি নিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করবে, তার চেহারা, তার মুখ এবং নাকের গুনাহসমূহ ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন আল্লাহ্র আদেশ অনুযায়ী তার চেহারা ধৌত করে, তখন তার চেহারার পাপরাশি তার দাড়ির শেষ প্রান্তের পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার হাত দু’খানি কনুই পর্যন্ত ধৌত করে, তখন তার হাতের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন তার মাথা মাসাহ করে, তখন তার মাথার পাপরাশি চুলের ডগার পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার পা দু’খানি গিট পর্যন্ত ধৌত করে, তখন তার পায়ের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যদি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করে, আল্লাহ্র প্রশংসা ও তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে, যার তিনি যোগ্য এবং অন্তরকে আল্লাহ্ তাআলার জন্য খালি করে, তাহলে সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে বেরিয়ে আসে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।
তারপর আমর ইবনু আবাসাহ (রা:) এ হাদীছটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ছাহাবী আবূ উমামা (রা:)-এর নিকট বর্ণনা করলেন।
আবূ উমামাহ (রা:) তাঁকে বললেন, ‘হে আমর ইবনু আবাসাহ! তুমি যা বলছ, তা চিন্তা করে বল! একবার ওযূ করলেই কি এই ব্যক্তিকে এতটা মর্যাদা দেওয়া হবে? আমর বললেন, হে আবূ উমামাহ! আমার বয়স ঢের হয়েছে, আমার হাড় দুর্বল হয়ে গেছে এবং আমার মৃত্যুও নিকটবর্তী। (ফলে এ অবস্থায়) আল্লাহ্ তাআলা অথবা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি মিথ্যারোপ করার কি প্রয়োজন আছে? যদি আমি এটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট থেকে একবার, দুবার, তিনবার এমনকি সাতবার পর্যন্ত না শুনতাম, তাহলে কখনোই তা বর্ণনা করতাম না। কিন্তু আমি তার নিকট এর চেয়েও অধিকবার শুনেছি’ (মুসলিম হা/৮৩২, ‘মুসাফিরের ছালাত’অধ্যায়)।
শিক্ষা:
১. দ্বীনী বিষয় জানার জন্য আগ্রহ থাকতে হবে।
২. পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আউয়াল ওয়াক্তে আদায় করতে হবে।
৩. ওযূর মাধ্যমে বান্দা তার পাপরাশি মোচন করে নিতে পারে।
তিনি গোপনে (ইসলাম প্রচার করছেন), আর তাঁর সম্প্রদায় (মুশরিকরা) তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহার করছে। সুতরাং আমি বিচক্ষণতার সাথে কাজ করলাম। আমি মক্কায় তাঁর কাছে পরামর্শ করলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আপনি কে?
তিনি বললেন, ‘আমি নবী’।
আমি বললাম, নবী কি?
তিনি বললেন, ‘মহান আল্লাহ্ আমাকে প্রেরণ করেছেন।
আমি বললাম, তিনি কি দিয়ে প্রেরণ করেছেন?
তিনি বললেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা,মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা, আল্লাহ্কে একক উপাস্য মানা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার নির্দেশ দিয়ে।
আমি বললাম, এ কাজে আপনার সঙ্গে কে আছে?
তিনি বললেন, ‘একজন স্বাধীন এবং একজন কৃতদাস। তিনি বলেন, তার প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তার মধ্যে তখন তাঁর সঙ্গে আবূ বকর ও বেলাল (রা:) ছিলেন।
আমি বললাম, ‘আমিও আপনার অনুগত।
তিনি বললেন, ‘তুমি এখন এ কাজ কোন অবস্থাতেই করতে পারবে না। তুমি কি আমার অবস্থা ও লোকদের অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না? অতএব তুমি (এখন) বাড়ি ফিরে যাও। অতঃপর যখন তুমি আমার জয়ী ও শক্তিশালী হওয়ার সংবাদ পাবে, তখন আমার কাছে এস।
সুতরাং আমি আমার পরিবার-পরিজনের নিকট চলে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় চলে এলেন। আর আমি পরিবারের সদস্যদের সাথেই ছিলাম। অতঃপর আমি খবরাখবর নিতে আরম্ভ করলাম এবং যখন তিনি মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি (তাঁর ব্যাপারে) লোকদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। অবশেষে আমার নিকট মদীনার কিছু লোক এলো।
আমি বললাম, ঐ লোকটার অবস্থা কি, যিনি (মক্কা ত্যাগ করে) মদীনায় এসেছেন?
তারা বলল, লোকেরা তাঁর দিকে দ্রুত ধাবমান। তাঁর সম্প্রদায় তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হয়নি।
অতঃপর আমি মদীনায় এসে তাঁর খিদমতে হাযির হলাম। তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ)! আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তো ঐ ব্যক্তি, যে মক্কায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলে।
আমি বললাম, হ্যাঁ। হে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ)! আল্লাহ্ তাআলা আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা আমার অজানা, তা আমাকে বলুন? আমাকে ছালাত সম্পর্কে বলুন।
তিনি বললেন, তুমি ফজরের ছালাত পড়। তারপর সূর্য এক বল্লম পরিমাণ উঁচু হওয়া পর্যন্ত বিরত থাক। কারণ তা শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যভাগে উদিত হয় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং সে সময় কাফেররা তাকে সিজদা করে। পুনরায় তুমি ছালাত আদায় কর। কেননা ছালাতে ফেরেশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন, যতক্ষণ না ছায়া বল্লমের সমান হয়ে যায়। অতঃপর ছালাত থেকে বিরত হও। কেননা তখন জাহান্নামের আগুন উস্কানো হয়। অতঃপর যখন ছায়া বাড়তে আরম্ভ করে, তখন ছালাত আদায় কর। কেননা এ ছালাতে ফেরেশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন। পরিশেষে তুমি আছরের ছালাত আদায় কর। অতঃপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছালাত আদায় করা থেকে বিরত থাক। কেননা সূর্য শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যে অস্ত যায় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং তখন কাফেররা তাকে সিজদা করে।
পুনরায় আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র নবী (সাঃ)! আপনি আমাকে ওযূ সম্পর্কে বলুন?
তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ পানি নিয়ে (হাত ধোয়ার পর) কুলি করবে এবং নাকে পানি নিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করবে, তার চেহারা, তার মুখ এবং নাকের গুনাহসমূহ ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন আল্লাহ্র আদেশ অনুযায়ী তার চেহারা ধৌত করে, তখন তার চেহারার পাপরাশি তার দাড়ির শেষ প্রান্তের পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার হাত দু’খানি কনুই পর্যন্ত ধৌত করে, তখন তার হাতের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন তার মাথা মাসাহ করে, তখন তার মাথার পাপরাশি চুলের ডগার পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার পা দু’খানি গিট পর্যন্ত ধৌত করে, তখন তার পায়ের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যদি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করে, আল্লাহ্র প্রশংসা ও তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে, যার তিনি যোগ্য এবং অন্তরকে আল্লাহ্ তাআলার জন্য খালি করে, তাহলে সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে বেরিয়ে আসে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।
তারপর আমর ইবনু আবাসাহ (রা:) এ হাদীছটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ছাহাবী আবূ উমামা (রা:)-এর নিকট বর্ণনা করলেন।
আবূ উমামাহ (রা:) তাঁকে বললেন, ‘হে আমর ইবনু আবাসাহ! তুমি যা বলছ, তা চিন্তা করে বল! একবার ওযূ করলেই কি এই ব্যক্তিকে এতটা মর্যাদা দেওয়া হবে? আমর বললেন, হে আবূ উমামাহ! আমার বয়স ঢের হয়েছে, আমার হাড় দুর্বল হয়ে গেছে এবং আমার মৃত্যুও নিকটবর্তী। (ফলে এ অবস্থায়) আল্লাহ্ তাআলা অথবা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি মিথ্যারোপ করার কি প্রয়োজন আছে? যদি আমি এটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট থেকে একবার, দুবার, তিনবার এমনকি সাতবার পর্যন্ত না শুনতাম, তাহলে কখনোই তা বর্ণনা করতাম না। কিন্তু আমি তার নিকট এর চেয়েও অধিকবার শুনেছি’ (মুসলিম হা/৮৩২, ‘মুসাফিরের ছালাত’অধ্যায়)।
শিক্ষা:
১. দ্বীনী বিষয় জানার জন্য আগ্রহ থাকতে হবে।
২. পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আউয়াল ওয়াক্তে আদায় করতে হবে।
৩. ওযূর মাধ্যমে বান্দা তার পাপরাশি মোচন করে নিতে পারে।
পিতার সাথে বিরোধ
শায়খ আলবানী কট্টর হানাফী পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আলবেনীয় ও সার্বীয় আলেমদের মধ্যে হানাফী ফিকহ সম্পর্কে সবচেয়ে বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম। তাঁর নিকটে সবাই ফৎওয়া নিতে আসত। কিন্তু শায়খ আলবানী শুরু থেকেই ছিলেন ভিন্ন মানসিকতার। বিশেষতঃ কুরআন-হাদীছের গভীরভাবে অধ্যয়ন করার পর তাঁর নিকটে সমকালীন বিভ্রান্তি ও ভুল-ত্রুটিসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুঁজে পান কুরআন-হাদীছের সাথে বহু মাসআলা-মাসায়েলের যোজন যোজন দূরের ব্যবধান। বিভিন্ন মসজিদে তখন হানাফী এবং শাফেঈদের দু’টি করে জামা‘আত হ’ত। হানাফী জামা‘আতের পর শাফেঈদের জামা‘আত হ’ত। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সিরিয়ায় একজন শাফেঈ শাসক ক্ষমতাসীন হন এবং তিনি হানাফীদের পূর্বে শাফেঈদের ছালাত আদায় করার নির্দেশ জারী করেন। এমতাবস্থায় শায়খ আলবানী দ্বিতীয় জামা‘আতে ছালাত আদায়ের কোন দলীল না পেয়ে শাফেঈদের সাথে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা শুরু করলেন। একদিন হানাফীদের ইমাম শায়খ বুরহানী হজ্জের সফরে গমনের কারণে শায়খ আলবানীর পিতাকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। পরিস্থিতি এমন হ’ল যে, শায়খ আলবানী প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করছেন, আর তাঁর পিতা দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করছেন। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ল, যেদিন তাঁর পিতা তার ব্যক্তিগত সফরে যাওয়ার কারণে উপলক্ষে আলবানীকে দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। স্পষ্টভাষী আলবানী স্বীয় পিতাকে বললেন, এ বিষয়ে আপনি আমার মতামত জানেন যে, আমি প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করি। এমতাবস্থায় স্বীয় মত বিরোধী কাজ করা আমার জন্য খুবই কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধ তীব্রতর হ’ল। অতঃপর একদিন পিতা তাকে গৃহকোণে ডেকে বললেন, তাহ’লে এটাই কি সত্য যে, তুমি তোমার মাযহাব পরিত্যাগ করেছ? ক্রোধান্বিত পিতার কণ্ঠ ঊঁচু হ’তে লাগল। একপর্যায়ে বললেন, হয় তোমাকে একমত হ’তে হবে, অন্যথায় পৃথক হ’তে হবে। শায়খ আলবানী পিতার নিকট থেকে তিনদিন সময় চেয়ে নিলেন। অবশেষে মাত্র ২৫ সিরীয় লিরা হাতে নিয়ে পিতৃগৃহ থেকে বিদায় নিলেন পরবর্তীকালের বিশ্ববিশ্রুত এই মুহাদ্দিছ। তখন তাঁর বয়স সবেমাত্র কুড়ি অতিক্রম করেছিল। সেই বয়সেই তিনি الروض النضير في ترتيب وتخريج معجم الطبراني الصغير নামক একটি তাখরীজ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যদিও তা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।
পেশাজীবী আলবানী
শায়খ আলবানীর পিতা জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘড়ি মেরামত করতেন। আলবানী পিতার দোকানে কাজ করেই একাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি বলতেন, ঘড়ি মেরামতের কাজই আমাকে সূক্ষ্মতা শিখিয়েছে। পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর পড়াশুনার পাশাপাশি কর্মজীবনের শুরুতে দু’বছর কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। অতঃপর কাজটি কষ্টসাধ্য হওয়ায় তিনি পুরাতন গৃহ সংস্কারের পেশা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আবার ঘড়ি মেরামতের পেশায় ফিরে গেলেন। তাঁর নিজস্ব ঘড়ির দোকান ছিল। তিনি বলতেন, আল্লাহ্র অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে প্রথম যৌবনেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখার তাওফীক্ব দান করেছিলেন। এটা এমন একটি স্বাধীন পেশা, যা ইলমে হাদীছে বুৎপত্তি অর্জনে আমার জন্য বাধা হ’ত না। আমি মঙ্গলবার ও শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন মাত্র তিন ঘণ্টা এর পিছনে ব্যয় করি। এই পরিমাণ কাজ করাই আমার ও আমার পরিবারের প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল। অর্থাৎ এর বেশী আর প্রয়োজন নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) এ দো‘আই করতেন যে, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারের জন্য এমন রিযিক দান কর যা পরিমিত। অর্থাৎ প্রয়োজনের কম নয় বা বেশীও নয় (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।
দারিদ্রক্লিষ্ট আলবানী
প্রথম জীবনে শায়খ আলবানীকে চরম দারিদ্রের মুকাবিলা করতে হয়েছিল। শায়খ মাশহূর হাসান বলেন, শায়খ আলবানী আমাকে সিলসিলা যঈফাহ ছাপাখানায় যাওয়ার পূর্বে এর সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি তাঁর নিকট থেকে পঞ্চম খন্ডের পান্ডুলিপি গ্রহণ করে যখন ব্যাগ থেকে বের করলাম, দেখলাম তিনি পঞ্চম খন্ডটি চিনি, চাল প্রভৃতির প্যাকেটসহ মানুষের ফেলে দেয়া লাল রঙের পরিত্যক্ত কাগজে লিখেছেন! অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললাম। শায়খ আমার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, দেখ আমার কাছে তখন ভাল কাগজ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না (ইসতামে‘ ইলাইহে মিন কালামিশ শায়খ আবী ওবায়দা, অডিও রেকর্ড থেকে সংগৃহীত)।
তার আরেক ছাত্র আবু মু‘আবিয়া বৈরূতীর ভাষায় তিনি দারিদ্রের কারণে কাগজ ক্রয় করতে না পেরে রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে নিতেন এবং তাতেই তাঁর অমূল্য লেখনীর প্রকাশ ঘটাতেন। একদিন তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘সস্তা হওয়ার কারণে আমি পরিত্যক্ত কাগজ কেজি দরে ক্রয় করতাম’ (শায়বানী, হায়াতুল আলবানী ১/৪৩)।
বইয়ের পোকা আলবানী
তিনি হাদীছের মুদ্রিত গ্রন্থাবলী ও দুর্লভ পান্ডুলিপি অধ্যয়নের জন্য দামেশকের সুপ্রাচীন যাহেরিয়া লাইব্রেরীতে প্রত্যেক দিন ৬/৮ ঘণ্টা নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। কখনো কখনো ১২ ঘণ্টা অবধি চলত নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। অনেক সময় লাইব্রেরীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যয়নে কেটে যেত। কর্তৃপক্ষ তাঁর পড়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি কক্ষ বরাদ্দ করেন এবং সার্বক্ষণিক উপকৃত হওয়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি চাবি তাঁকে প্রদান করেন। তিনি ইবনু আবিদ দুনয়ার ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপির বিনষ্ট হয়ে যাওয়া একটি পৃষ্ঠা উদ্ধারের জন্য উক্ত লাইব্রেরীর প্রায় ১০ হাযার পান্ডুলিপি অধ্যয়ন করেন (মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ ২৩-২৫ পৃঃ)।
জহূরী জহর চেনে
হজ্জের মওসুম। শায়খ আলবানী হজ্জে গিয়েছেন। এদিকে মিশকাতের প্রসিদ্ধ আরবী ভাষ্য ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’-এর লেখক স্বনামধন্য সালাফী বিদ্বান ভারতগুরু শায়খ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীও হজ্জে গিয়েছেন। ইন্ডিয়ার আহলেহাদীছ নেতা শায়খ মুখতার আহমাদ নাদভী মিনাতে শায়খ আলবানীর তাঁবুতে আল্লামা মুবারকপুরীকে নিয়ে গেলেন। কেবল নামটি বলার অপেক্ষা। আর যাবেন কোথায়! শায়খ আলবানী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। যেন কতদিনের স্বপ্ন আজ স্বার্থক হ’ল। শায়খ মুখতার বলেন, ইসলামী দুনিয়ার দুই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছের সেই মহামিলন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের সেদিন আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
বিনয়-নম্রতার মূর্ত প্রতীক
(১) শায়খ আলবানীর প্রিয় ছাত্র শায়খ আলী হালাবী বলেন, একদিন আমি শায়খকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনার মৃত্যুর পর আমরা ইলমে হাদীছে কার উপর নির্ভর করব? তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল হও। আমি কামনা করি তোমরা আলবানীর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।
(২) মিসরীয় আলেম শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী তাঁর উস্তাদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি ভুলতে পারি না সেদিনের কথা যেদিন আমি উস্তাদ আলবানীকে আমার তাখরীজকৃত ইমাম আবুদাঊদ রচিত البعث নামক বইটি উপহার দিলাম। তিনি যখন বইয়ের কভারে خرج أحاديثه الشيخ الحويني السلفي লেখা দেখলেন, তখন বিস্মিত হয়ে الشيخ শব্দের দিকে ইশারা করে বললেন, এটা কেন? আমি ওযর পেশ করে বললাম, শায়খ! এটা আমার কাজ নয় বরং প্রকাশকের ভুল। কিন্তু তিনি আমার ওযর গ্রহণ করলেন না। আললাহর কসম! আমি মোটেও কষ্ট পাইনি। বরং এরপর থেকে আমি তাঁকে ভিন্ন মাত্রায় শ্রদ্ধা করতে লাগলাম এবং আমার হৃদয়ে তিনি যেন একটি বিশেষ স্থানে আসীন হ’লেন। কারণ হাদীছ শাস্ত্রের অবিসংবাদিত ইমাম হিসাবে যাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া, তিনি যে নিজেই স্বীয় গ্রন্থে কেবল নাম ব্যতীত কিছুই লিখতেন না! (আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী, বাযালুল ইহসান বিতাকরীবি সুনান নাসাঈ)।
(৩) শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী বলেন, একদিন আমরা কয়েকজন তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি নিজেই দরজা খুললেন এবং সহাস্যবদনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই তাঁর বাড়ীর বাগানে গিয়ে বসলাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে তাঁর সাথে নাশতা করতে বাধ্য করলেন। তিনি নিজে হাতে খাবার এনে আমাদের খাওয়াচ্ছিলেন। আমি উঠে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি ধমক দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমি বিব্রতভাবে বললাম, শায়খ! আমি বসে থাকব আর আপনি আমার খেদমত করবেন, এটা তো আমার জন্য খুবই অভদ্রতার পরিচয়। উত্তরে শায়খ আলবানী মনের রাখার মত যে কথাটি বললেন, ‘দেখ, الامتثال هو الأدب، بل هو خير من الأدب ‘রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করাই হ’ল ভদ্রতা। বরং ভদ্রতার চাইতেও উত্তম’ (বাদরুত তামাম ফী তারজামাতিশ শায়খ আল-ইমাম)।
নিজের দোষ-ত্রুটি শিকারে দ্ব্যর্থহীন
একদিন জনৈক ছাত্র শায়খ আলবানীর একটি ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার জন্য দো‘আ করে বললেন, এর জন্য আল্লাহ তোমাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের পারস্পরিক মহববতকে এমন মহববতে পরিণত করুন, যা পরস্পরকে উপদেশ প্রদান এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়। কেননা অনেক মানুষ অপরকে বলে থাকে যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। কিন্তু যখনই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে কোন দোষ-ক্রটি করে ফেলে, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেয় ও তার মর্যাদাহানি করে। এটা কখনোই ‘আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা’র নিদর্শন নয়। বরং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়া হবে তখনই তা প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব বলে গণ্য হবে। সুতরাং যখন তুমি আমার কোন ভুল-ক্রটি দেখবে, তখন অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দিবে (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, আলবানীর বক্তব্যের অডিও রেকর্ড ৮২/৩:৭)। তিনি বলতেন, السَّعيد من وُعظ بغيره সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ/পরামর্শ প্রাপ্ত হয়।
তিন মনীষীর মহামিলন
শায়খ আলবানী জীবনের শেষ হজব্রত পালনকালে মিনায় অবস্থান করছেন। সেখানে তিনিসহ আরো রয়েছেন শায়খ বিন বায এবং শায়খ উছায়মীন। তাদের উপস্থিতিতে বিরাট মজলিসে প্রশ্নোত্তর বৈঠক শুরু হ’ল। সভাপতি হিসাবে শায়খ বিন বায প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য হাদীছ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর শায়খ আলবানীকে, ফিক্বহী প্রশ্নের উত্তর শায়খ উছায়মীনকে এবং আক্বীদাগত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের দায়িত্ব নিজেই নিলেন। অতঃপর যোহরের সময় হ’ল। শায়খ বিন বায শায়খ আলবানীকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আজ আপনি ছালাতে আমাদের ইমামতি করবেন, আপনি আমাদের ইমাম। শায়খ আলবানী অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, না না শায়খ, বরং আপনাকেই ইমামতি করতে হবে, আপনি আমাদের শায়খ। শায়খ বিন বায বললেন, আমরা কুরআনের ক্ষেত্রে সকলেই সমান হ’তে পারি। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের মাঝে সর্বাধিক অবগত। সুতরাং আপনিই ইমামতি করুন। অবশেষে শায়খ আলবানী ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, হে শায়খ! আমি কি রাসূল (ছাঃ)-এর ন্যায় ছালাত আদায় করব, না সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করব? শায়খ বিন বায বললেন, রাসূল (ছাঃ)-এর অনুরূপ ছালাত আদায় করুন এবং আমাদেরকে শিখিয়ে দিন কিভাবে রাসূল (ছাঃ) ছালাত আদায় করতেন।
গাড়িচালক আলবানী
শায়খ আলবানী একদিন নিজের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। জনৈক ছাত্র তাঁর গাড়িতে উঠলো। শায়খ আলবানী তখন দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ছাত্রটি ভয় পেয়ে তাঁকে বলল, শায়খ! গাড়ির গতি ধীর করুন। শায়খ বিন বায বলেছেন, জোরে গাড়ি চালানো নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল। উত্তরে শায়খ আলবানী বললেন, এই ফৎওয়া গাড়ি চালনায় অদক্ষদের জন্য, আমার জন্য নয়। ছাত্রটি বলল, আমি কি আপনার এই কথাটি শায়খ বিন বাযকে শোনাবো? তিনি বললেন, হ্যা, তাঁকে বল। পরে ছাত্রটি একথা শায়খ বিন বাযকে জানালে তিনি হাসতে লাগলেন এবং বললেন, তাঁকে বল এই ফৎওয়া তাদের জন্য যাদের এ্যাকসিডেন্ট করে রক্তপণ দেয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি (সঊদী আরবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তাই যাদের একবার এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারা এমনিতেই সাবধানে গাড়ি চালায়) (তরজমাতুস সাদহান লিশ শায়খ বিন বায)।
খেলাধুলায় আলবানী
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ (মৃত্যু ১৪৩২হিঃ) বলেন, মদীনায় অনেক বিখ্যাত আলেম-ওলামার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে শায়খ আলবানী ছিলেন আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমরা একত্রে বহুবার সফর করেছি। তিনি একাধারে আমার উস্তাদ এবং বন্ধু ছিলেন। যে বিষয়েই তাঁর সাথে কথা বলা হোক না কেন, তিনি হাদীছ দিয়ে কথা বলতেন এবং সনদের শুদ্ধাশুদ্ধি উল্লেখ করতেন। কুরআন থেকে তিনি এমনভাবে দলীল দিতেন যেন কুরআন তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। একবার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে আমরা মাঠে নামলাম। ছাত্ররা ফুটবল খেলছিল। শায়খ আলবানীও নিজের পোষাক পরিহিত অবস্থাতেই মাঝে মাঝে তাদের সাথে খেলছিলেন। আমি বললাম, আপনি করছেন কি? আপনি ফুটবল খেলছেন, অথচ আপনি আলবানী! উত্তরে তিনি বললেন, أتقوى بها على الطاعة وهي لا تلهيني عن ذكر ربي ‘এর দ্বারা আমি আল্লাহ্র আনুগত্যে শক্তি অর্জন করছি। আর এটি আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ থেকে উদাসীন করছে না।’
সৃজনশীল কারিগর
শায়খ আলবানী ইলমে হাদীছে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নির্মাণেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন-
(১) অধ্যাপক মাহমূদ রেযা বলেন, একবার শায়খ আলবানী আমাকে তাঁর গৃহের ছাদে নিয়ে গিয়ে স্বীয় উদ্ভাবিত একটি যন্ত্র দেখালেন, যা সূর্যের কিরণে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গরম হ’ত। সালফার, আলকাতরা ইত্যাদি পদার্থের মিশ্রণে নির্মিত এই জটিল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রটি শীতকালে তাঁর ঘরের উষ্ণতা ধরে রাখত (মুহাম্মাদ রেযা মুরাদ, মাসিক আদ-দাওয়াহ, ১৮১৮ সংখ্যা, শা‘বান ১৪২০ হিঃ)।
(২) তিনি সূর্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছালাতের সঠিক সময় নির্ণয়কারী একটি ঘড়ি নির্মাণ করেন। তবে তাঁর বাড়িতে ভ্রমণকারীরা সবচেয়ে বিস্মিত হ’ত তাঁর স্বনির্মিত লিফটটি দেখে, যার মাধ্যমে তিনি উপর তলায় উঠতেন। স্থুল স্বাস্থ্যের কারণে উপরে পায়ে হেঁটে উঠতে তাঁর কষ্ট হ’ত। তাঁর এই লিফটটির সাথে একটি ডায়নামা সদৃশ যন্ত্র যুক্ত করা ছিল। সুইচ টিপ দিলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠা-নামা করত। এছাড়া তিনি বই-পত্র রাখার জন্য একটি ঘূর্ণায়মান র্যাক তৈরী করেছিলেন, যেখানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় বইসমূহ রাখতেন। বিশেষতঃ জারাহ-তা‘দীল এবং রিজাল শাস্ত্রের বইগুলো তিনি এই র্যাকে রাখতেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। এমনকি স্বীয় সন্তান মুহাম্মাদের প্রসবকার্যে তিনি একাই স্ত্রীকে সাহায্য করেছিলেন (ইছাম হাদী, আলবানী কামা ‘আরাফতুহু ১০৪ পৃঃ)।
(৩) বৈদ্যুতিক কাজসহ গাড়ি মেরামতেও তাঁর দক্ষতা ছিল আশ্চর্য ধরনের। একাধিক দাওয়াতী সফরে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাঁকে নিজেই তা মেরামত করতে দেখা গেছে। তাঁর ছাত্র শায়খ আদনান স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একবার তিনি শায়খ আলবানীর সাথে রেডিও কিনতে গিয়েছিলেন। আলবানী দোকানীকে রেডিও সম্পর্কে দক্ষ বিশেষজ্ঞের মত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন। যেমন, রেডিও তরঙ্গ কয়টি? কয়টি ব্যাটারী প্রয়োজন হয়? পাওয়ার কত? কোন দেশে তৈরী ইত্যাদি। তিনি শায়খকে বললেন, এগুলিতো রেডিওর খুব সূক্ষ্ম বিষয়, আপনি বোঝেন কিভাবে? আলবানী বললেন, তুমি কি মনে করেছ, আমাদেরকে কেবল ইলমে হাদীছের ক্ষেত্রেই সূক্ষ্মতা অবলম্বন করতে হবে? না, বরং সর্বক্ষেত্রেই এ নীতি প্রযোজ্য। আমরা কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রেই তাক্বলীদকে অস্বীকার করি না। বরং যে কোন বিষয়েই অন্যের তাক্বলীদকে অস্বীকার করি।
(৪) অনুরূপভাবে ইয়ারমূক বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিক্বহ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারূক সামেরাঈ স্মৃতিচারণ করে বলেন, শায়খ আলবানীর সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি বাড়িতে হাঁস-মুরগী, কবুতর ইত্যাদি পালন করতেন। একবার তিনি সপরিবারে ওমরা করতে যাবেন। দুই সপ্তাহ বাড়ি খালি থাকবে। কিন্তু এসব প্রাণীর খাদ্য-পানীয়ের সংস্থান কিভাবে হবে? তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর যথারীতি নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি একটি চমৎকার যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন, যা প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য এবং পানীয় প্রত্যেক খাঁচায় ঢেলে দেবে। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগল। সফর থেকে ফিরে এসে দেখলেন সব পশু-পাখি সুন্দরভাবে খেয়ে-দেয়ে বেঁচে আছে। কোন সমস্যা হয়নি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটিই হয়েছে।
(৫) ড. আব্দুল আযীয সাদহান লিখেছেন, শায়খ আলবানীর বাসায় অনেক পাখি ছিল। পাখিদের বাসা ছিল তাঁর বারান্দা থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে। তাই প্রতিদিন পাখির খাবার ব্যবস্থা করতে তিনি বারান্দা থেকে একটি পাইপ লাগিয়ে দেন। যার অপর মুখটি ছিল পাখির বাসা পর্যন্ত দীর্ঘ। তিনি প্রতিদিন ঐ পাইপটি পাখিদের খাবার দিয়ে ভরে রাখতেন। ফলে অপর মুখ থেকে পাখিরা যখনই কিছু খাবার খেত, তখনই পাইপের মুখে বাকি খাবার অল্প অল্প করে নেমে আসত। ফলে বার বার খাবার দেয়ার পরিশ্রম করতে হত না। এভাবে তাঁর সবকিছুতেই ছিল সৃষ্টিশীলতার ছাপ (ইমাম আলবানী দুরূস ওয়া মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১১১ পৃঃ)।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব
একদিন শায়খ সাম‘আনী শায়খ আলবানীকে তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি চমৎকার এক উদাহরণ পেশ করে বললেন, এই জামা‘আতের মত ইখলাছপূর্ণ এবং আমলসমৃদ্ধ কোন জামা‘আত আজ পর্যন্ত আমার নযরে পড়েনি। কিন্তু তাদের অবস্থা হ’ল ঐ অতি উৎসাহী কুর্দী ব্যক্তির মত, যে ইসলাম প্রচারের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর সামনে একজন ইহুদীকে পেয়ে খঞ্জর উঁচিয়ে বলল, তোমার জন্য ধ্বংস, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে আত্মসমর্পণ করে বলল, ঠিক আছে ইসলাম গ্রহণ করব। এখন বল, কি বলে আমি ইসলাম গ্রহণ করব? কিংকর্তব্যবিমূঢ় কুর্দী তখন বলল, হায় হায় এটা তো আমার জানা নেই! (অর্থাৎ তারা দ্বীনের তাবলীগ করে বটে; কিন্তু দ্বীন সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান নেই)।
প্রচারবিমুখতা
১৯৮৪ সালে সঊদী আরব সফরকালে তাঁর এক সঊদী সাথী তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন এবং এটাও বললেন, আপনার আগমনে সেখানে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি হবে ইনশাআল্লাহ। একথা শুনে আলবানী বেঁকে বসলেন এবং বারংবার নিবেদন সত্ত্বেও কোনক্রমে রাযী হলেন না। বাসায় ফিরে আসলে তার এক সাথী দাওয়াত কবুল না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, إني أخشي علي نفسي الفةنة আমি আমার উপর ফিতনার আশংকা করছি (অর্থাৎ এতে আমার মধ্যে আত্মগর্বের সৃষ্টি হতে পারে)।
একবার তিনি গাড়িতে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি তাকে চিনতে পেরে ছুটে এসে বলল, আপনিই কি শায়খ আলবানী? একথা শুনে আলবানী কেঁদে ফেললেন। পরে তাঁকে কাঁদার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ينبغي للمرء أن يجاهد نفسه وأن لا يغتربإشارة الناس إليه ‘প্রত্যেক মানুষেরই উচিৎ আত্মপরিশুদ্ধির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা এবং তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও কৌতুহলের কারণে আত্মপ্রবঞ্চিত না হওয়া (ড. আব্দুল আযীয সাদহান, ইমাম আলবানী দুরূস মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১২৬ পৃঃ)।
আধুনিক যুগের ইলমে হাদীছের এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যময় কর্মকান্ড সত্যিই বিস্ময়কর বৈকি!
কারাজীবনে আলবানী
শায়খ আলবানীকে বিনা অপরাধে সন্দেহের বশে কয়েকজন আলেমের সাথে কারান্তরীণ হতে হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে তিনি সিরিয়ার বিখ্যাত কেল‘আ কারাগারে কয়েকমাসের জন্য বন্দী ছিলেন। এই কারাগারেই একসময় বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (১২৬৩-১৩২৮ইং)।
আলবানী বাইরের ন্যায় কারাভ্যন্তরেও দ্বীনের দাওয়াত দেন এবং তাকলীদ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের প্রতি সকলকে দাওয়াত দেন। তিনি ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)-এর পরে সর্বপ্রথম কেল‘আ কারাগারে একত্রে জুম‘আর ছালাত চালু করেন। মুক্তির কিছুদিন পরই তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং প্রায় আট মাস কারাবাস করেন। এসময় তিনি মুনযেরী কর্তৃক সংকলিত মুখতাছার ছহীহ মুসলিমের তাহকীক সম্পন্ন করেন।
শায়খ আলবানী কট্টর হানাফী পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আলবেনীয় ও সার্বীয় আলেমদের মধ্যে হানাফী ফিকহ সম্পর্কে সবচেয়ে বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম। তাঁর নিকটে সবাই ফৎওয়া নিতে আসত। কিন্তু শায়খ আলবানী শুরু থেকেই ছিলেন ভিন্ন মানসিকতার। বিশেষতঃ কুরআন-হাদীছের গভীরভাবে অধ্যয়ন করার পর তাঁর নিকটে সমকালীন বিভ্রান্তি ও ভুল-ত্রুটিসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুঁজে পান কুরআন-হাদীছের সাথে বহু মাসআলা-মাসায়েলের যোজন যোজন দূরের ব্যবধান। বিভিন্ন মসজিদে তখন হানাফী এবং শাফেঈদের দু’টি করে জামা‘আত হ’ত। হানাফী জামা‘আতের পর শাফেঈদের জামা‘আত হ’ত। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সিরিয়ায় একজন শাফেঈ শাসক ক্ষমতাসীন হন এবং তিনি হানাফীদের পূর্বে শাফেঈদের ছালাত আদায় করার নির্দেশ জারী করেন। এমতাবস্থায় শায়খ আলবানী দ্বিতীয় জামা‘আতে ছালাত আদায়ের কোন দলীল না পেয়ে শাফেঈদের সাথে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা শুরু করলেন। একদিন হানাফীদের ইমাম শায়খ বুরহানী হজ্জের সফরে গমনের কারণে শায়খ আলবানীর পিতাকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। পরিস্থিতি এমন হ’ল যে, শায়খ আলবানী প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করছেন, আর তাঁর পিতা দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করছেন। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ল, যেদিন তাঁর পিতা তার ব্যক্তিগত সফরে যাওয়ার কারণে উপলক্ষে আলবানীকে দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। স্পষ্টভাষী আলবানী স্বীয় পিতাকে বললেন, এ বিষয়ে আপনি আমার মতামত জানেন যে, আমি প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করি। এমতাবস্থায় স্বীয় মত বিরোধী কাজ করা আমার জন্য খুবই কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধ তীব্রতর হ’ল। অতঃপর একদিন পিতা তাকে গৃহকোণে ডেকে বললেন, তাহ’লে এটাই কি সত্য যে, তুমি তোমার মাযহাব পরিত্যাগ করেছ? ক্রোধান্বিত পিতার কণ্ঠ ঊঁচু হ’তে লাগল। একপর্যায়ে বললেন, হয় তোমাকে একমত হ’তে হবে, অন্যথায় পৃথক হ’তে হবে। শায়খ আলবানী পিতার নিকট থেকে তিনদিন সময় চেয়ে নিলেন। অবশেষে মাত্র ২৫ সিরীয় লিরা হাতে নিয়ে পিতৃগৃহ থেকে বিদায় নিলেন পরবর্তীকালের বিশ্ববিশ্রুত এই মুহাদ্দিছ। তখন তাঁর বয়স সবেমাত্র কুড়ি অতিক্রম করেছিল। সেই বয়সেই তিনি الروض النضير في ترتيب وتخريج معجم الطبراني الصغير নামক একটি তাখরীজ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যদিও তা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।
পেশাজীবী আলবানী
শায়খ আলবানীর পিতা জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘড়ি মেরামত করতেন। আলবানী পিতার দোকানে কাজ করেই একাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি বলতেন, ঘড়ি মেরামতের কাজই আমাকে সূক্ষ্মতা শিখিয়েছে। পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর পড়াশুনার পাশাপাশি কর্মজীবনের শুরুতে দু’বছর কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। অতঃপর কাজটি কষ্টসাধ্য হওয়ায় তিনি পুরাতন গৃহ সংস্কারের পেশা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আবার ঘড়ি মেরামতের পেশায় ফিরে গেলেন। তাঁর নিজস্ব ঘড়ির দোকান ছিল। তিনি বলতেন, আল্লাহ্র অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে প্রথম যৌবনেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখার তাওফীক্ব দান করেছিলেন। এটা এমন একটি স্বাধীন পেশা, যা ইলমে হাদীছে বুৎপত্তি অর্জনে আমার জন্য বাধা হ’ত না। আমি মঙ্গলবার ও শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন মাত্র তিন ঘণ্টা এর পিছনে ব্যয় করি। এই পরিমাণ কাজ করাই আমার ও আমার পরিবারের প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল। অর্থাৎ এর বেশী আর প্রয়োজন নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) এ দো‘আই করতেন যে, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারের জন্য এমন রিযিক দান কর যা পরিমিত। অর্থাৎ প্রয়োজনের কম নয় বা বেশীও নয় (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।
দারিদ্রক্লিষ্ট আলবানী
প্রথম জীবনে শায়খ আলবানীকে চরম দারিদ্রের মুকাবিলা করতে হয়েছিল। শায়খ মাশহূর হাসান বলেন, শায়খ আলবানী আমাকে সিলসিলা যঈফাহ ছাপাখানায় যাওয়ার পূর্বে এর সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি তাঁর নিকট থেকে পঞ্চম খন্ডের পান্ডুলিপি গ্রহণ করে যখন ব্যাগ থেকে বের করলাম, দেখলাম তিনি পঞ্চম খন্ডটি চিনি, চাল প্রভৃতির প্যাকেটসহ মানুষের ফেলে দেয়া লাল রঙের পরিত্যক্ত কাগজে লিখেছেন! অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললাম। শায়খ আমার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, দেখ আমার কাছে তখন ভাল কাগজ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না (ইসতামে‘ ইলাইহে মিন কালামিশ শায়খ আবী ওবায়দা, অডিও রেকর্ড থেকে সংগৃহীত)।
তার আরেক ছাত্র আবু মু‘আবিয়া বৈরূতীর ভাষায় তিনি দারিদ্রের কারণে কাগজ ক্রয় করতে না পেরে রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে নিতেন এবং তাতেই তাঁর অমূল্য লেখনীর প্রকাশ ঘটাতেন। একদিন তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘সস্তা হওয়ার কারণে আমি পরিত্যক্ত কাগজ কেজি দরে ক্রয় করতাম’ (শায়বানী, হায়াতুল আলবানী ১/৪৩)।
বইয়ের পোকা আলবানী
তিনি হাদীছের মুদ্রিত গ্রন্থাবলী ও দুর্লভ পান্ডুলিপি অধ্যয়নের জন্য দামেশকের সুপ্রাচীন যাহেরিয়া লাইব্রেরীতে প্রত্যেক দিন ৬/৮ ঘণ্টা নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। কখনো কখনো ১২ ঘণ্টা অবধি চলত নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। অনেক সময় লাইব্রেরীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যয়নে কেটে যেত। কর্তৃপক্ষ তাঁর পড়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি কক্ষ বরাদ্দ করেন এবং সার্বক্ষণিক উপকৃত হওয়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি চাবি তাঁকে প্রদান করেন। তিনি ইবনু আবিদ দুনয়ার ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপির বিনষ্ট হয়ে যাওয়া একটি পৃষ্ঠা উদ্ধারের জন্য উক্ত লাইব্রেরীর প্রায় ১০ হাযার পান্ডুলিপি অধ্যয়ন করেন (মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ ২৩-২৫ পৃঃ)।
জহূরী জহর চেনে
হজ্জের মওসুম। শায়খ আলবানী হজ্জে গিয়েছেন। এদিকে মিশকাতের প্রসিদ্ধ আরবী ভাষ্য ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’-এর লেখক স্বনামধন্য সালাফী বিদ্বান ভারতগুরু শায়খ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীও হজ্জে গিয়েছেন। ইন্ডিয়ার আহলেহাদীছ নেতা শায়খ মুখতার আহমাদ নাদভী মিনাতে শায়খ আলবানীর তাঁবুতে আল্লামা মুবারকপুরীকে নিয়ে গেলেন। কেবল নামটি বলার অপেক্ষা। আর যাবেন কোথায়! শায়খ আলবানী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। যেন কতদিনের স্বপ্ন আজ স্বার্থক হ’ল। শায়খ মুখতার বলেন, ইসলামী দুনিয়ার দুই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছের সেই মহামিলন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের সেদিন আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
বিনয়-নম্রতার মূর্ত প্রতীক
(১) শায়খ আলবানীর প্রিয় ছাত্র শায়খ আলী হালাবী বলেন, একদিন আমি শায়খকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনার মৃত্যুর পর আমরা ইলমে হাদীছে কার উপর নির্ভর করব? তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল হও। আমি কামনা করি তোমরা আলবানীর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।
(২) মিসরীয় আলেম শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী তাঁর উস্তাদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি ভুলতে পারি না সেদিনের কথা যেদিন আমি উস্তাদ আলবানীকে আমার তাখরীজকৃত ইমাম আবুদাঊদ রচিত البعث নামক বইটি উপহার দিলাম। তিনি যখন বইয়ের কভারে خرج أحاديثه الشيخ الحويني السلفي লেখা দেখলেন, তখন বিস্মিত হয়ে الشيخ শব্দের দিকে ইশারা করে বললেন, এটা কেন? আমি ওযর পেশ করে বললাম, শায়খ! এটা আমার কাজ নয় বরং প্রকাশকের ভুল। কিন্তু তিনি আমার ওযর গ্রহণ করলেন না। আললাহর কসম! আমি মোটেও কষ্ট পাইনি। বরং এরপর থেকে আমি তাঁকে ভিন্ন মাত্রায় শ্রদ্ধা করতে লাগলাম এবং আমার হৃদয়ে তিনি যেন একটি বিশেষ স্থানে আসীন হ’লেন। কারণ হাদীছ শাস্ত্রের অবিসংবাদিত ইমাম হিসাবে যাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া, তিনি যে নিজেই স্বীয় গ্রন্থে কেবল নাম ব্যতীত কিছুই লিখতেন না! (আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী, বাযালুল ইহসান বিতাকরীবি সুনান নাসাঈ)।
(৩) শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী বলেন, একদিন আমরা কয়েকজন তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি নিজেই দরজা খুললেন এবং সহাস্যবদনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই তাঁর বাড়ীর বাগানে গিয়ে বসলাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে তাঁর সাথে নাশতা করতে বাধ্য করলেন। তিনি নিজে হাতে খাবার এনে আমাদের খাওয়াচ্ছিলেন। আমি উঠে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি ধমক দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমি বিব্রতভাবে বললাম, শায়খ! আমি বসে থাকব আর আপনি আমার খেদমত করবেন, এটা তো আমার জন্য খুবই অভদ্রতার পরিচয়। উত্তরে শায়খ আলবানী মনের রাখার মত যে কথাটি বললেন, ‘দেখ, الامتثال هو الأدب، بل هو خير من الأدب ‘রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করাই হ’ল ভদ্রতা। বরং ভদ্রতার চাইতেও উত্তম’ (বাদরুত তামাম ফী তারজামাতিশ শায়খ আল-ইমাম)।
নিজের দোষ-ত্রুটি শিকারে দ্ব্যর্থহীন
একদিন জনৈক ছাত্র শায়খ আলবানীর একটি ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার জন্য দো‘আ করে বললেন, এর জন্য আল্লাহ তোমাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের পারস্পরিক মহববতকে এমন মহববতে পরিণত করুন, যা পরস্পরকে উপদেশ প্রদান এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়। কেননা অনেক মানুষ অপরকে বলে থাকে যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। কিন্তু যখনই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে কোন দোষ-ক্রটি করে ফেলে, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেয় ও তার মর্যাদাহানি করে। এটা কখনোই ‘আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা’র নিদর্শন নয়। বরং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়া হবে তখনই তা প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব বলে গণ্য হবে। সুতরাং যখন তুমি আমার কোন ভুল-ক্রটি দেখবে, তখন অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দিবে (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, আলবানীর বক্তব্যের অডিও রেকর্ড ৮২/৩:৭)। তিনি বলতেন, السَّعيد من وُعظ بغيره সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ/পরামর্শ প্রাপ্ত হয়।
তিন মনীষীর মহামিলন
শায়খ আলবানী জীবনের শেষ হজব্রত পালনকালে মিনায় অবস্থান করছেন। সেখানে তিনিসহ আরো রয়েছেন শায়খ বিন বায এবং শায়খ উছায়মীন। তাদের উপস্থিতিতে বিরাট মজলিসে প্রশ্নোত্তর বৈঠক শুরু হ’ল। সভাপতি হিসাবে শায়খ বিন বায প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য হাদীছ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর শায়খ আলবানীকে, ফিক্বহী প্রশ্নের উত্তর শায়খ উছায়মীনকে এবং আক্বীদাগত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের দায়িত্ব নিজেই নিলেন। অতঃপর যোহরের সময় হ’ল। শায়খ বিন বায শায়খ আলবানীকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আজ আপনি ছালাতে আমাদের ইমামতি করবেন, আপনি আমাদের ইমাম। শায়খ আলবানী অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, না না শায়খ, বরং আপনাকেই ইমামতি করতে হবে, আপনি আমাদের শায়খ। শায়খ বিন বায বললেন, আমরা কুরআনের ক্ষেত্রে সকলেই সমান হ’তে পারি। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের মাঝে সর্বাধিক অবগত। সুতরাং আপনিই ইমামতি করুন। অবশেষে শায়খ আলবানী ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, হে শায়খ! আমি কি রাসূল (ছাঃ)-এর ন্যায় ছালাত আদায় করব, না সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করব? শায়খ বিন বায বললেন, রাসূল (ছাঃ)-এর অনুরূপ ছালাত আদায় করুন এবং আমাদেরকে শিখিয়ে দিন কিভাবে রাসূল (ছাঃ) ছালাত আদায় করতেন।
গাড়িচালক আলবানী
শায়খ আলবানী একদিন নিজের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। জনৈক ছাত্র তাঁর গাড়িতে উঠলো। শায়খ আলবানী তখন দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ছাত্রটি ভয় পেয়ে তাঁকে বলল, শায়খ! গাড়ির গতি ধীর করুন। শায়খ বিন বায বলেছেন, জোরে গাড়ি চালানো নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল। উত্তরে শায়খ আলবানী বললেন, এই ফৎওয়া গাড়ি চালনায় অদক্ষদের জন্য, আমার জন্য নয়। ছাত্রটি বলল, আমি কি আপনার এই কথাটি শায়খ বিন বাযকে শোনাবো? তিনি বললেন, হ্যা, তাঁকে বল। পরে ছাত্রটি একথা শায়খ বিন বাযকে জানালে তিনি হাসতে লাগলেন এবং বললেন, তাঁকে বল এই ফৎওয়া তাদের জন্য যাদের এ্যাকসিডেন্ট করে রক্তপণ দেয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি (সঊদী আরবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তাই যাদের একবার এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারা এমনিতেই সাবধানে গাড়ি চালায়) (তরজমাতুস সাদহান লিশ শায়খ বিন বায)।
খেলাধুলায় আলবানী
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ (মৃত্যু ১৪৩২হিঃ) বলেন, মদীনায় অনেক বিখ্যাত আলেম-ওলামার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে শায়খ আলবানী ছিলেন আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমরা একত্রে বহুবার সফর করেছি। তিনি একাধারে আমার উস্তাদ এবং বন্ধু ছিলেন। যে বিষয়েই তাঁর সাথে কথা বলা হোক না কেন, তিনি হাদীছ দিয়ে কথা বলতেন এবং সনদের শুদ্ধাশুদ্ধি উল্লেখ করতেন। কুরআন থেকে তিনি এমনভাবে দলীল দিতেন যেন কুরআন তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। একবার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে আমরা মাঠে নামলাম। ছাত্ররা ফুটবল খেলছিল। শায়খ আলবানীও নিজের পোষাক পরিহিত অবস্থাতেই মাঝে মাঝে তাদের সাথে খেলছিলেন। আমি বললাম, আপনি করছেন কি? আপনি ফুটবল খেলছেন, অথচ আপনি আলবানী! উত্তরে তিনি বললেন, أتقوى بها على الطاعة وهي لا تلهيني عن ذكر ربي ‘এর দ্বারা আমি আল্লাহ্র আনুগত্যে শক্তি অর্জন করছি। আর এটি আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ থেকে উদাসীন করছে না।’
সৃজনশীল কারিগর
শায়খ আলবানী ইলমে হাদীছে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নির্মাণেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন-
(১) অধ্যাপক মাহমূদ রেযা বলেন, একবার শায়খ আলবানী আমাকে তাঁর গৃহের ছাদে নিয়ে গিয়ে স্বীয় উদ্ভাবিত একটি যন্ত্র দেখালেন, যা সূর্যের কিরণে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গরম হ’ত। সালফার, আলকাতরা ইত্যাদি পদার্থের মিশ্রণে নির্মিত এই জটিল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রটি শীতকালে তাঁর ঘরের উষ্ণতা ধরে রাখত (মুহাম্মাদ রেযা মুরাদ, মাসিক আদ-দাওয়াহ, ১৮১৮ সংখ্যা, শা‘বান ১৪২০ হিঃ)।
(২) তিনি সূর্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছালাতের সঠিক সময় নির্ণয়কারী একটি ঘড়ি নির্মাণ করেন। তবে তাঁর বাড়িতে ভ্রমণকারীরা সবচেয়ে বিস্মিত হ’ত তাঁর স্বনির্মিত লিফটটি দেখে, যার মাধ্যমে তিনি উপর তলায় উঠতেন। স্থুল স্বাস্থ্যের কারণে উপরে পায়ে হেঁটে উঠতে তাঁর কষ্ট হ’ত। তাঁর এই লিফটটির সাথে একটি ডায়নামা সদৃশ যন্ত্র যুক্ত করা ছিল। সুইচ টিপ দিলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠা-নামা করত। এছাড়া তিনি বই-পত্র রাখার জন্য একটি ঘূর্ণায়মান র্যাক তৈরী করেছিলেন, যেখানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় বইসমূহ রাখতেন। বিশেষতঃ জারাহ-তা‘দীল এবং রিজাল শাস্ত্রের বইগুলো তিনি এই র্যাকে রাখতেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। এমনকি স্বীয় সন্তান মুহাম্মাদের প্রসবকার্যে তিনি একাই স্ত্রীকে সাহায্য করেছিলেন (ইছাম হাদী, আলবানী কামা ‘আরাফতুহু ১০৪ পৃঃ)।
(৩) বৈদ্যুতিক কাজসহ গাড়ি মেরামতেও তাঁর দক্ষতা ছিল আশ্চর্য ধরনের। একাধিক দাওয়াতী সফরে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাঁকে নিজেই তা মেরামত করতে দেখা গেছে। তাঁর ছাত্র শায়খ আদনান স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একবার তিনি শায়খ আলবানীর সাথে রেডিও কিনতে গিয়েছিলেন। আলবানী দোকানীকে রেডিও সম্পর্কে দক্ষ বিশেষজ্ঞের মত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন। যেমন, রেডিও তরঙ্গ কয়টি? কয়টি ব্যাটারী প্রয়োজন হয়? পাওয়ার কত? কোন দেশে তৈরী ইত্যাদি। তিনি শায়খকে বললেন, এগুলিতো রেডিওর খুব সূক্ষ্ম বিষয়, আপনি বোঝেন কিভাবে? আলবানী বললেন, তুমি কি মনে করেছ, আমাদেরকে কেবল ইলমে হাদীছের ক্ষেত্রেই সূক্ষ্মতা অবলম্বন করতে হবে? না, বরং সর্বক্ষেত্রেই এ নীতি প্রযোজ্য। আমরা কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রেই তাক্বলীদকে অস্বীকার করি না। বরং যে কোন বিষয়েই অন্যের তাক্বলীদকে অস্বীকার করি।
(৪) অনুরূপভাবে ইয়ারমূক বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিক্বহ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারূক সামেরাঈ স্মৃতিচারণ করে বলেন, শায়খ আলবানীর সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি বাড়িতে হাঁস-মুরগী, কবুতর ইত্যাদি পালন করতেন। একবার তিনি সপরিবারে ওমরা করতে যাবেন। দুই সপ্তাহ বাড়ি খালি থাকবে। কিন্তু এসব প্রাণীর খাদ্য-পানীয়ের সংস্থান কিভাবে হবে? তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর যথারীতি নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি একটি চমৎকার যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন, যা প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য এবং পানীয় প্রত্যেক খাঁচায় ঢেলে দেবে। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগল। সফর থেকে ফিরে এসে দেখলেন সব পশু-পাখি সুন্দরভাবে খেয়ে-দেয়ে বেঁচে আছে। কোন সমস্যা হয়নি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটিই হয়েছে।
(৫) ড. আব্দুল আযীয সাদহান লিখেছেন, শায়খ আলবানীর বাসায় অনেক পাখি ছিল। পাখিদের বাসা ছিল তাঁর বারান্দা থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে। তাই প্রতিদিন পাখির খাবার ব্যবস্থা করতে তিনি বারান্দা থেকে একটি পাইপ লাগিয়ে দেন। যার অপর মুখটি ছিল পাখির বাসা পর্যন্ত দীর্ঘ। তিনি প্রতিদিন ঐ পাইপটি পাখিদের খাবার দিয়ে ভরে রাখতেন। ফলে অপর মুখ থেকে পাখিরা যখনই কিছু খাবার খেত, তখনই পাইপের মুখে বাকি খাবার অল্প অল্প করে নেমে আসত। ফলে বার বার খাবার দেয়ার পরিশ্রম করতে হত না। এভাবে তাঁর সবকিছুতেই ছিল সৃষ্টিশীলতার ছাপ (ইমাম আলবানী দুরূস ওয়া মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১১১ পৃঃ)।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব
একদিন শায়খ সাম‘আনী শায়খ আলবানীকে তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি চমৎকার এক উদাহরণ পেশ করে বললেন, এই জামা‘আতের মত ইখলাছপূর্ণ এবং আমলসমৃদ্ধ কোন জামা‘আত আজ পর্যন্ত আমার নযরে পড়েনি। কিন্তু তাদের অবস্থা হ’ল ঐ অতি উৎসাহী কুর্দী ব্যক্তির মত, যে ইসলাম প্রচারের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর সামনে একজন ইহুদীকে পেয়ে খঞ্জর উঁচিয়ে বলল, তোমার জন্য ধ্বংস, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে আত্মসমর্পণ করে বলল, ঠিক আছে ইসলাম গ্রহণ করব। এখন বল, কি বলে আমি ইসলাম গ্রহণ করব? কিংকর্তব্যবিমূঢ় কুর্দী তখন বলল, হায় হায় এটা তো আমার জানা নেই! (অর্থাৎ তারা দ্বীনের তাবলীগ করে বটে; কিন্তু দ্বীন সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান নেই)।
প্রচারবিমুখতা
১৯৮৪ সালে সঊদী আরব সফরকালে তাঁর এক সঊদী সাথী তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন এবং এটাও বললেন, আপনার আগমনে সেখানে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি হবে ইনশাআল্লাহ। একথা শুনে আলবানী বেঁকে বসলেন এবং বারংবার নিবেদন সত্ত্বেও কোনক্রমে রাযী হলেন না। বাসায় ফিরে আসলে তার এক সাথী দাওয়াত কবুল না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, إني أخشي علي نفسي الفةنة আমি আমার উপর ফিতনার আশংকা করছি (অর্থাৎ এতে আমার মধ্যে আত্মগর্বের সৃষ্টি হতে পারে)।
একবার তিনি গাড়িতে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি তাকে চিনতে পেরে ছুটে এসে বলল, আপনিই কি শায়খ আলবানী? একথা শুনে আলবানী কেঁদে ফেললেন। পরে তাঁকে কাঁদার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ينبغي للمرء أن يجاهد نفسه وأن لا يغتربإشارة الناس إليه ‘প্রত্যেক মানুষেরই উচিৎ আত্মপরিশুদ্ধির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা এবং তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও কৌতুহলের কারণে আত্মপ্রবঞ্চিত না হওয়া (ড. আব্দুল আযীয সাদহান, ইমাম আলবানী দুরূস মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১২৬ পৃঃ)।
আধুনিক যুগের ইলমে হাদীছের এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যময় কর্মকান্ড সত্যিই বিস্ময়কর বৈকি!
কারাজীবনে আলবানী
শায়খ আলবানীকে বিনা অপরাধে সন্দেহের বশে কয়েকজন আলেমের সাথে কারান্তরীণ হতে হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে তিনি সিরিয়ার বিখ্যাত কেল‘আ কারাগারে কয়েকমাসের জন্য বন্দী ছিলেন। এই কারাগারেই একসময় বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (১২৬৩-১৩২৮ইং)।
আলবানী বাইরের ন্যায় কারাভ্যন্তরেও দ্বীনের দাওয়াত দেন এবং তাকলীদ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের প্রতি সকলকে দাওয়াত দেন। তিনি ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)-এর পরে সর্বপ্রথম কেল‘আ কারাগারে একত্রে জুম‘আর ছালাত চালু করেন। মুক্তির কিছুদিন পরই তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং প্রায় আট মাস কারাবাস করেন। এসময় তিনি মুনযেরী কর্তৃক সংকলিত মুখতাছার ছহীহ মুসলিমের তাহকীক সম্পন্ন করেন।
আবু হুরায়রা (রা:) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসূল (সাঃ) নাজদের দিকে কিছু অশ্বারোহী (সৈন্য) পাঠালেন। তারা বনী হানীফা গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে ধরে আনল। তার নাম ছুমামাহ বিন উছাল।সে ইয়ামামাবাসীদের সরদার। তারা তাকে মসজিদে নববীর একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখল।
রাসূল (সাঃ) তার কাছে আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে ছুমামাহ! তুমি কি মনে করছ’? সে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার ধারণা ভালই। যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন, তাহ’লে অবশ্যই আপনি একজন খুনীকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি অনুগ্রহ করেন, তাহ’লে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপরই অনুগ্রহ করবেন। আর যদি আপনি মাল চান, তাহ’লে যা ইচ্ছা চাইতে পারেন, তা আদায় করা হবে’। তার কথা শুনে রাসূল (সাঃ) তাকে (সেদিনের মত তার নিজের অবস্থার উপর) ছেড়ে দিলেন।
অতঃপর পরের দিন নবী করীম (সাঃ) তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে ছুমামাহ! তোমার কি মনে হচ্ছে’? সে জবাবে বলল, ‘তাই মনে হচ্ছে, যা আমি আপনাকে পূর্বেই বলেছি। যদি আপনি আমার প্রতি মেহেরবানী করেন, তাহ’লে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপর মেহেরবানী করবেন। আর যদি আপনি হত্যা করেন, তাহ’লে একজন খুনী লোককে হত্যা করবেন। আর যদি মাল-সম্পদ চান, তাহ’লে যা ইচ্ছা চাইতে পারেন, তা দেয়া হবে’।
রাসূল (সাঃ) আজও তাকে (নিজের অবস্থার উপর) ছেড়ে দিলেন। এভাবে রাসূল (সাঃ) তৃতীয় দিনে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে ছুমামাহ! তোমার কি মনে হচ্ছে’? জওয়াবে সে বলল, ‘আমার তাই মনে হচ্ছে, যা আমি পূর্বেই আপনাকে বলেছি।যদি আপনি আমার প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেন, তাহ’লে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপরই অনুকম্পা করবেন। আর যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন, তাহ’লে একজন খুনীকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি মাল-সম্পদ চান, তাহ’লে যতটা ইচ্ছা চাইতে পারেন, তা দেয়া হবে’।
অতঃপর রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তোমরা ছুমামাহকে ছেড়ে দাও’! (তাকে ছেড়ে দেওয়া হ’ল)।
অতঃপর সে মসজিদের নিকটবর্তী একটি খেজুর বাগানে গিয়ে গোসল করল। অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করে বলে উঠল:
‘আশহাদু আললা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আনণা মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু’।
‘হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ্ কসম! পৃথিবীর বুকে আপনার চেহারা অপেক্ষা আর কারও চেহারা আমার নিকট অধিক ঘৃণ্য ছিল না। কিন্তু এখন আপনার চেহারা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয় হয়ে গেছে।আল্লাহ্ কসম! (ইতিপূর্বে) আপনার দ্বীন অপেক্ষা অধিক অপ্রিয় দ্বীন আমার কাছে আর কোনটিই ছিল না। কিন্তু এখন আপনার দ্বীনই আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় হয়ে গেছে। আল্লাহ্ কসম! (এর আগে) আপনার শহরের চেয়ে অধিক ঘৃণ্য শহর আর কোনটিই আমার কাছে ছিল না।কিন্তু এখন আপনার শহরটিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়ে গেছে।আপনার অশ্বারোহীরা আমাকে এমন অবস্থায় ধরে এনেছে, যখন আমি ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। এখন আপনি আমাকে কি করতে হুকুম দিচ্ছেন?
রাসূল (সাঃ) তাকে সুসংবাদ শুনালেন এবং ওমরাহ পালনের আদেশ করলেন।এরপর যখন তিনি মক্কায় পৌছলেন, তখন জনৈক ব্যক্তি তাকে বলল, তুমি না কি বেদ্বীন হয়ে গেছ? তিনি জওয়াবে বললেন, ‘তা হবে কেন; বরং আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছি।আর আল্লাহ্ কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অনুমতি ছাড়া তোমাদের কাছে ইয়ামামা হ’তে আর একটি গমের দানাও আসবে না’
(বুখারী হা/৪৬২, মুসলিম হা/১৭৬৪, আলবানী, মিশকাত হা/৩৯৬৪, ‘জিহাদ’অধ্যায়, ‘যুদ্ধবন্দীদের বিধান’অনুচেছদ) ।
শিক্ষা:
উত্তম আচরণ ও ক্ষমার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। এজন্যই বলা হয়, ক্ষমাই উত্তম প্রতিশোধ। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘মন্দকে ভাল দ্বারা মোকাবেলা কর, ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবে’ (হা-মীম সাজদাহ ৩৪) ।
রাসূল (সাঃ) তার কাছে আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে ছুমামাহ! তুমি কি মনে করছ’? সে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার ধারণা ভালই। যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন, তাহ’লে অবশ্যই আপনি একজন খুনীকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি অনুগ্রহ করেন, তাহ’লে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপরই অনুগ্রহ করবেন। আর যদি আপনি মাল চান, তাহ’লে যা ইচ্ছা চাইতে পারেন, তা আদায় করা হবে’। তার কথা শুনে রাসূল (সাঃ) তাকে (সেদিনের মত তার নিজের অবস্থার উপর) ছেড়ে দিলেন।
অতঃপর পরের দিন নবী করীম (সাঃ) তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে ছুমামাহ! তোমার কি মনে হচ্ছে’? সে জবাবে বলল, ‘তাই মনে হচ্ছে, যা আমি আপনাকে পূর্বেই বলেছি। যদি আপনি আমার প্রতি মেহেরবানী করেন, তাহ’লে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপর মেহেরবানী করবেন। আর যদি আপনি হত্যা করেন, তাহ’লে একজন খুনী লোককে হত্যা করবেন। আর যদি মাল-সম্পদ চান, তাহ’লে যা ইচ্ছা চাইতে পারেন, তা দেয়া হবে’।
রাসূল (সাঃ) আজও তাকে (নিজের অবস্থার উপর) ছেড়ে দিলেন। এভাবে রাসূল (সাঃ) তৃতীয় দিনে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে ছুমামাহ! তোমার কি মনে হচ্ছে’? জওয়াবে সে বলল, ‘আমার তাই মনে হচ্ছে, যা আমি পূর্বেই আপনাকে বলেছি।যদি আপনি আমার প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেন, তাহ’লে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপরই অনুকম্পা করবেন। আর যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন, তাহ’লে একজন খুনীকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি মাল-সম্পদ চান, তাহ’লে যতটা ইচ্ছা চাইতে পারেন, তা দেয়া হবে’।
অতঃপর রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তোমরা ছুমামাহকে ছেড়ে দাও’! (তাকে ছেড়ে দেওয়া হ’ল)।
অতঃপর সে মসজিদের নিকটবর্তী একটি খেজুর বাগানে গিয়ে গোসল করল। অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করে বলে উঠল:
‘আশহাদু আললা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আনণা মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু’।
‘হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ্ কসম! পৃথিবীর বুকে আপনার চেহারা অপেক্ষা আর কারও চেহারা আমার নিকট অধিক ঘৃণ্য ছিল না। কিন্তু এখন আপনার চেহারা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয় হয়ে গেছে।আল্লাহ্ কসম! (ইতিপূর্বে) আপনার দ্বীন অপেক্ষা অধিক অপ্রিয় দ্বীন আমার কাছে আর কোনটিই ছিল না। কিন্তু এখন আপনার দ্বীনই আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় হয়ে গেছে। আল্লাহ্ কসম! (এর আগে) আপনার শহরের চেয়ে অধিক ঘৃণ্য শহর আর কোনটিই আমার কাছে ছিল না।কিন্তু এখন আপনার শহরটিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়ে গেছে।আপনার অশ্বারোহীরা আমাকে এমন অবস্থায় ধরে এনেছে, যখন আমি ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। এখন আপনি আমাকে কি করতে হুকুম দিচ্ছেন?
রাসূল (সাঃ) তাকে সুসংবাদ শুনালেন এবং ওমরাহ পালনের আদেশ করলেন।এরপর যখন তিনি মক্কায় পৌছলেন, তখন জনৈক ব্যক্তি তাকে বলল, তুমি না কি বেদ্বীন হয়ে গেছ? তিনি জওয়াবে বললেন, ‘তা হবে কেন; বরং আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছি।আর আল্লাহ্ কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অনুমতি ছাড়া তোমাদের কাছে ইয়ামামা হ’তে আর একটি গমের দানাও আসবে না’
(বুখারী হা/৪৬২, মুসলিম হা/১৭৬৪, আলবানী, মিশকাত হা/৩৯৬৪, ‘জিহাদ’অধ্যায়, ‘যুদ্ধবন্দীদের বিধান’অনুচেছদ) ।
শিক্ষা:
উত্তম আচরণ ও ক্ষমার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। এজন্যই বলা হয়, ক্ষমাই উত্তম প্রতিশোধ। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘মন্দকে ভাল দ্বারা মোকাবেলা কর, ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবে’ (হা-মীম সাজদাহ ৩৪) ।
মহিলাটি নিঃশব্দে ট্রেনে উঠে পড়ল; যদি তার চোখে চোখ না পড়ে যেত, আমি বুঝতেও পারতাম না যে তার চোখ ছলছল করছিল। যেকোনো মুহূর্তে সেই অশ্রু যেন ঝরে পড়বে। আমি তার পায়ের দিকে তাকালাম, দেখলাম খালি পা, এক জোড়া জুতা তার হাতে। কোলে কম্বলে মোড়ানো একটি ছোট শিশু; শিশুটি কোন শব্দ করছেনা। মহিলাটি যাত্রীদের কাছে এসে নিচুস্বরে কি যেন বলছিল, কিন্তু তার কথা ফেরিওয়ালার কণ্ঠ ঢেকে দিচ্ছিল। মহিলাটি ট্রেনের এক পাশে আমার কাছাকাছি আসলো। তার পুরনো ব্যবহৃত ক্ষয়ে যাওয়া জুতা জোড়ার দিকে লজ্জিতভাবে তাকিয়ে আস্তে বলল, ‘কারও কি এটা লাগবে? কেউ কি আমার কাছ থেকে জুতা তা কিনবেন?’ সবাই বিব্রতভাবে না করে দিল, কেউ বুঝে পেল না কেনই বা কেউ ব্যাবহার করা, পুরনো, ক্ষয় হয়ে যাওয়া জুতা কিনবে। অন্য একজন মহিলা ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে তাকে দান করতে চাইল। কিন্তু মহিলাটি এমন কিছু গ্রহন করতে অস্বীকার করল; তার ঘুমন্ত শিশুর হাতের মধ্যে দেওয়ার পরও সে তা ফিরিয়ে দিল। সে তখন জুবুথুবু হয়ে পরাজিতের মত ট্রেনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
মহিলাটি তার মুখ এমনভাবে নীচু করে রাখল যেন অন্য যাত্রীরা তার চোখ থেকে গড়িয়ে পরা অশ্রু দেখতে না পায়। তখন একজন মহিলা তার কাছে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল, ‘আমি তোমার কাছ থেকে জুতা জোড়াটা কিনব।’ তখন জুতা হাতে সেই মহিলাটি আশান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিনবেন, তাইতো? আপনি কিনে নেবেন? দান না তো, আমি কিন্তু ভিক্ষা চাচ্ছি না।’ অন্য মহিলাটি তখন হেসে মাথা ঝাকাল, তারপর বড় একটি নোট তার হাতে গুজে দিয়ে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে চলে গেল।
এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দেখে সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় কুরআনের একটি আয়াত ঘুরতে লাগলোঃ
“যারা আল্লাহর পথে অবরুদ্ধ রয়েছে বলে ভূপৃষ্ঠে গমনাগমনে অপারগ সেই সব দরিদ্রদের জন্য ব্যায় কর; (ভিক্ষা হতে) নিবৃত থাকার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অবস্থাপন্ন মনে করে, তুমি তাদেরকে তাদের লক্ষণের দ্বারা চিনতে পার, তারা লোকের নিকট ব্যাকুলভাবে যাচ্ঞা (ভিক্ষা করে না) করে না এবং তোমরা শুদ্ধ সম্পদ হতে যা ব্যায় কর বস্তুতঃ সে সমস্ত বিষয় আল্লাহ সম্যকরূপে অবগত।” [সূরা বাকারাঃ ২৭৩]
আমি জানিনা এই মহিলার ঘটনা কি, টাকাটা তার কেন দরকার, অথবা টাকাটা দিয়ে সে কি করবে; আমি যা জানি তা হল তার চোখে যন্ত্রণার চিহ্ন, তার কাধে যেন অনেক ভারী বোঝার ভার। এই আয়াতটি আমি আগে বহুবার পড়েছি, এই আয়াত নিয়ে বহু আলোচনা শুনেছি, কিন্তু কখনও এই আয়াতের ওজন বুঝিনি; আজ বুঝলাম যখন আমার চোখের সামনে আয়াতটিকে এভাবে জলজ্যান্ত ঘটে যেতে দেখলাম।
আবারও আমার মাথায় নানান কথা ঘুরতে থাকল, এবার হাদিসের কথা। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, একজন লোক এসে রাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করল, আমি কি আমার উট বেঁধে রাখব আর তারপর আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখব, নাকি উটকে খোলা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখব? উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘তাকে বেঁধে রাখ, এবং সেই সাথে আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখো।’ [তিরমিযী]
মহিলাটির জন্য হাল ছেড়ে দেওয়াই সহজ ছিল, যদি সে এইটা ভাবত যে তার কাছে বিক্রি করার মতও কিছু নেই, কাজেই এমন কোন উপায় নেই যাতে সে কিছু টাকা পেতে পারে। তা সত্ত্বেও সে এই হাদিসটি বাস্তবায়িত করে দেখাল। তার কাছে যাই অকিঞ্চিৎকর ছিল তাই সম্বল করল, যেটা আসলে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে মুল্যহীন ছিল। সে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখল, এবং এমন মুল্য পেল যা সে দর কষাকষি করে কখনই পেতে পারত না। যেমন, আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা’আলা বলেনঃ
“…যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ সহজ করে দিবেন। আর তাকে তার ধারনাতীত উৎস হতে দান করবেন রিজিক; যে ব্যাক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, আল্লাহ তার ইচ্ছা পুরন করবেনই, আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।” [সূরা তালাকঃ ২-৩]
ট্রেনের মধ্যে নিজস্ব ব্যাক্তিগত সমস্যা সমাধানে ব্যাস্ত এক অচেনা মহিলা আমাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কত গভীর শিক্ষা দিয়ে গেল। সেই মহিলার হাতে খুব সামান্য কিছুই ছিল, কিন্তু আমি এটা বলতে পারি, তার অন্তর পরিপূর্ণ ছিল। তার কাছ থেকেই আমারা বুঝতে পারি, সব কিছু দেওয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহর- তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী দেন, আমাদের আশা অনুযায়ী নয়। আমরা যদিও ভাবি, কোন পরিস্থিতিতে আমাদের হয়তো তেমন কিছুই করার নেই, আমাদের আবার ভেবে দেখা উচিত। কারণ আল্লাহ আমাদের সেই সামান্য পুঁজিই আমাদের আশাতীত হারে বহুগুনে বাড়িয়ে দিতে পারেন। এবং সবশেষে আমরা সেই সব অভাবী মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করব যাদের কথা আল্লাহ বলেছেন, তাদের অন্তরের সেই ব্যাখ্যাতীত সৌন্দর্যের কথা ভাবব যেমন এই মহিলাটি দেখিয়েছেন।
মহিলাটি তার মুখ এমনভাবে নীচু করে রাখল যেন অন্য যাত্রীরা তার চোখ থেকে গড়িয়ে পরা অশ্রু দেখতে না পায়। তখন একজন মহিলা তার কাছে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল, ‘আমি তোমার কাছ থেকে জুতা জোড়াটা কিনব।’ তখন জুতা হাতে সেই মহিলাটি আশান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিনবেন, তাইতো? আপনি কিনে নেবেন? দান না তো, আমি কিন্তু ভিক্ষা চাচ্ছি না।’ অন্য মহিলাটি তখন হেসে মাথা ঝাকাল, তারপর বড় একটি নোট তার হাতে গুজে দিয়ে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে চলে গেল।
এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দেখে সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় কুরআনের একটি আয়াত ঘুরতে লাগলোঃ
“যারা আল্লাহর পথে অবরুদ্ধ রয়েছে বলে ভূপৃষ্ঠে গমনাগমনে অপারগ সেই সব দরিদ্রদের জন্য ব্যায় কর; (ভিক্ষা হতে) নিবৃত থাকার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অবস্থাপন্ন মনে করে, তুমি তাদেরকে তাদের লক্ষণের দ্বারা চিনতে পার, তারা লোকের নিকট ব্যাকুলভাবে যাচ্ঞা (ভিক্ষা করে না) করে না এবং তোমরা শুদ্ধ সম্পদ হতে যা ব্যায় কর বস্তুতঃ সে সমস্ত বিষয় আল্লাহ সম্যকরূপে অবগত।” [সূরা বাকারাঃ ২৭৩]
আমি জানিনা এই মহিলার ঘটনা কি, টাকাটা তার কেন দরকার, অথবা টাকাটা দিয়ে সে কি করবে; আমি যা জানি তা হল তার চোখে যন্ত্রণার চিহ্ন, তার কাধে যেন অনেক ভারী বোঝার ভার। এই আয়াতটি আমি আগে বহুবার পড়েছি, এই আয়াত নিয়ে বহু আলোচনা শুনেছি, কিন্তু কখনও এই আয়াতের ওজন বুঝিনি; আজ বুঝলাম যখন আমার চোখের সামনে আয়াতটিকে এভাবে জলজ্যান্ত ঘটে যেতে দেখলাম।
আবারও আমার মাথায় নানান কথা ঘুরতে থাকল, এবার হাদিসের কথা। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, একজন লোক এসে রাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করল, আমি কি আমার উট বেঁধে রাখব আর তারপর আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখব, নাকি উটকে খোলা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখব? উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘তাকে বেঁধে রাখ, এবং সেই সাথে আল্লাহর উপর তাওাক্কুল রাখো।’ [তিরমিযী]
মহিলাটির জন্য হাল ছেড়ে দেওয়াই সহজ ছিল, যদি সে এইটা ভাবত যে তার কাছে বিক্রি করার মতও কিছু নেই, কাজেই এমন কোন উপায় নেই যাতে সে কিছু টাকা পেতে পারে। তা সত্ত্বেও সে এই হাদিসটি বাস্তবায়িত করে দেখাল। তার কাছে যাই অকিঞ্চিৎকর ছিল তাই সম্বল করল, যেটা আসলে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে মুল্যহীন ছিল। সে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখল, এবং এমন মুল্য পেল যা সে দর কষাকষি করে কখনই পেতে পারত না। যেমন, আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা’আলা বলেনঃ
“…যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ সহজ করে দিবেন। আর তাকে তার ধারনাতীত উৎস হতে দান করবেন রিজিক; যে ব্যাক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, আল্লাহ তার ইচ্ছা পুরন করবেনই, আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।” [সূরা তালাকঃ ২-৩]
ট্রেনের মধ্যে নিজস্ব ব্যাক্তিগত সমস্যা সমাধানে ব্যাস্ত এক অচেনা মহিলা আমাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কত গভীর শিক্ষা দিয়ে গেল। সেই মহিলার হাতে খুব সামান্য কিছুই ছিল, কিন্তু আমি এটা বলতে পারি, তার অন্তর পরিপূর্ণ ছিল। তার কাছ থেকেই আমারা বুঝতে পারি, সব কিছু দেওয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহর- তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী দেন, আমাদের আশা অনুযায়ী নয়। আমরা যদিও ভাবি, কোন পরিস্থিতিতে আমাদের হয়তো তেমন কিছুই করার নেই, আমাদের আবার ভেবে দেখা উচিত। কারণ আল্লাহ আমাদের সেই সামান্য পুঁজিই আমাদের আশাতীত হারে বহুগুনে বাড়িয়ে দিতে পারেন। এবং সবশেষে আমরা সেই সব অভাবী মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করব যাদের কথা আল্লাহ বলেছেন, তাদের অন্তরের সেই ব্যাখ্যাতীত সৌন্দর্যের কথা ভাবব যেমন এই মহিলাটি দেখিয়েছেন।
মৎকার একটি দিন। ড্রাইভার স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে রাস্তা ধরে চলেছেন গন্তব্যের পানে। প্রথম কয়েকটি স্টপেজ ভালমতই পার হয়ে গেল। কেউ নামলো কেউ আবার উঠল। সবকিছুই ঠিকঠাক যাচ্ছিল।
তারপর হল কি! পরবর্তী স্টপেজে ছয় ফুট আট ইঞ্চি লম্বা, সুঠাম দেহী এক কুস্তিগীর উঠল গাড়ীতে। গাড়ীতে উঠে ড্রাইভারের দিয়ে কড়া নজরে তাকিয়ে বলল, “পালোয়ান কখনো ভাড়া দেয় না।” তারপর গিয়ে বসল গাড়ির পেছনের এক সিটে।
এ ফাঁকে বাস ড্রাইভারের দৈহিক বর্ণনাটাও দিয়ে রাখি। ড্রাইভার প্রায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা,হালকা পাতলা গড়ন, আচার আচরণে মোটামুটি নম্র টাইপের। পালোয়ানের আচরণ ড্রাইভারের ভাল না লাগলেও পালোয়ানের সাথে ড্রাইভার কোন তর্ক-বিতর্কে জড়াতে যায়নি।
পরের দিনও ঐ একই ঘটনা-সেই পালোয়ান আবার গাড়িতে উঠল এবং গতদিনের মত ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সিটে বসে পড়ল। পরের দিনও ঐ একই কাহিনী। তারপরের দিনও তাই।
পালোয়ান বাসভাড়া না দিয়ে প্রতিদিন সুবিধা নিচ্ছে। বিষয়টি রীতিমত বাস ড্রাইভারের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠল। এমনকি তার ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ড্রাইভার এবার অন্য পন্থা অবলম্বনের মনস্থির করল। সিদ্ধান্ত নিল পালোয়ানকে সায়েস্তা করার জন্যে বডি বিল্ডিং করবে। কারাতে,জুডো যা আছে প্রয়োজনে সব শিখবে। পরিকল্পনা মাফিক এক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে ভর্তিও হল।
সময়টা গ্রীষ্মের শেষের দিক। প্রশিক্ষন নিয়ে ড্রাইভার নিজেই এবার পালোয়ান হয়ে উঠেছে। নিজের শক্তি-সামর্থ্যের ব্যাপারে সে এখন সন্তুষ্ট।
পরের এক সোমবার পালোয়ান বাসে উঠে পূর্বের ভঙ্গিমায় বলল, “পালোয়ান কখনো ভাড়া দেয় না।” আর অমনি ড্রাইভার লাফিয়ে উঠে গলা ফাটিয়ে বলে উঠল, “কেন ভাড়া দিস না???!!!”
হতভম্ব হয়ে পালোয়ান এবার জবাব দিল, “আমার বিনামুল্যে বাস ভ্রমনের পাস আছে।”
গল্পের নৈতিক শিক্ষা
গল্পের নৈতিক শিক্ষা একেবারে পরিষ্কার যা আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এবং দৈনন্দিন চলাফেরায় অবহেলা করে আমরা এড়িয়ে যাই।
ঘটনা থেকে জানা গেল যে পুরো ঘটনা না জেনে হঠকারীতার পরিচয় দিয়ে কোন বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
একজন মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাই সম্পর্কে উত্তম ধারণা পোষণ করবে এবং তাকে সন্দেহের সুবিধা দেবে (কোন কারণে সন্দেহ করতে হলে তাকে ভাল জেনে পরবর্তী অনুসন্ধানে অগ্রসর হবে)। সম্ভব হলে তাকে তার অবস্থান বা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেবে যেন সন্দেহের কোন কারণ থাকলে তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
“অনুমান করা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ অনুমান হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা। আর বেঁচে থাকো অন্যের দোষ খোঁজা থেকে, এবং অন্যের উপর গোয়েন্দাগিরি করা থেকে, বেঁচে থাকো (মন্দ কাজে) প্রতিযোগিতা করা থেকে, বেঁচে থাক অপরের হিংসা করা থেকে, অপরকে ঘৃণা করা থেকে এবং একে অপরকে পরিহার করা থেকে; এমনভাবে থাকো যেন তোমরা পরস্পর ভাই এবং আল্লাহ্র দাস”। [আল-বুখারী; খণ্ড ৮, অধ্যায় ৭৩, হাদীস নং ৯২]
অন্যের কথাকে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যাখ্যা করাটা হলো মু’মিনদের অন্যতম গুণ। ‘উমার (রা) বলেন,
“তোমার বিশ্বাসী ভাইয়ের কোনো কথাকে খারাপ অর্থে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভালো অর্থে নেওয়ার সুযোগ থাকে।”
একইভাবে ইসলামিক বিশেষজ্ঞগণের মত হল, যদি কাউকে সন্দেহ করার কোন কারণ থাকেও, তবুও মানুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সন্দেহকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়।
পরিশেষে,কোন ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করার সময় উক্ত ব্যক্তির চারিত্রিক সকল দিক বিবেচনা করা এবং হঠকারীতা পরিহার করা উচিৎ। কারো উপর মিথ্যারোপ করা থেকে বেঁচে থাকার জন্য তার ব্যাপারে পুরো বিষয়টা পরিষ্কারভাবে জেনে নেয়া উচিত।
তারপর হল কি! পরবর্তী স্টপেজে ছয় ফুট আট ইঞ্চি লম্বা, সুঠাম দেহী এক কুস্তিগীর উঠল গাড়ীতে। গাড়ীতে উঠে ড্রাইভারের দিয়ে কড়া নজরে তাকিয়ে বলল, “পালোয়ান কখনো ভাড়া দেয় না।” তারপর গিয়ে বসল গাড়ির পেছনের এক সিটে।
এ ফাঁকে বাস ড্রাইভারের দৈহিক বর্ণনাটাও দিয়ে রাখি। ড্রাইভার প্রায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা,হালকা পাতলা গড়ন, আচার আচরণে মোটামুটি নম্র টাইপের। পালোয়ানের আচরণ ড্রাইভারের ভাল না লাগলেও পালোয়ানের সাথে ড্রাইভার কোন তর্ক-বিতর্কে জড়াতে যায়নি।
পরের দিনও ঐ একই ঘটনা-সেই পালোয়ান আবার গাড়িতে উঠল এবং গতদিনের মত ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সিটে বসে পড়ল। পরের দিনও ঐ একই কাহিনী। তারপরের দিনও তাই।
পালোয়ান বাসভাড়া না দিয়ে প্রতিদিন সুবিধা নিচ্ছে। বিষয়টি রীতিমত বাস ড্রাইভারের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠল। এমনকি তার ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ড্রাইভার এবার অন্য পন্থা অবলম্বনের মনস্থির করল। সিদ্ধান্ত নিল পালোয়ানকে সায়েস্তা করার জন্যে বডি বিল্ডিং করবে। কারাতে,জুডো যা আছে প্রয়োজনে সব শিখবে। পরিকল্পনা মাফিক এক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে ভর্তিও হল।
সময়টা গ্রীষ্মের শেষের দিক। প্রশিক্ষন নিয়ে ড্রাইভার নিজেই এবার পালোয়ান হয়ে উঠেছে। নিজের শক্তি-সামর্থ্যের ব্যাপারে সে এখন সন্তুষ্ট।
পরের এক সোমবার পালোয়ান বাসে উঠে পূর্বের ভঙ্গিমায় বলল, “পালোয়ান কখনো ভাড়া দেয় না।” আর অমনি ড্রাইভার লাফিয়ে উঠে গলা ফাটিয়ে বলে উঠল, “কেন ভাড়া দিস না???!!!”
হতভম্ব হয়ে পালোয়ান এবার জবাব দিল, “আমার বিনামুল্যে বাস ভ্রমনের পাস আছে।”
গল্পের নৈতিক শিক্ষা
গল্পের নৈতিক শিক্ষা একেবারে পরিষ্কার যা আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এবং দৈনন্দিন চলাফেরায় অবহেলা করে আমরা এড়িয়ে যাই।
ঘটনা থেকে জানা গেল যে পুরো ঘটনা না জেনে হঠকারীতার পরিচয় দিয়ে কোন বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
একজন মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাই সম্পর্কে উত্তম ধারণা পোষণ করবে এবং তাকে সন্দেহের সুবিধা দেবে (কোন কারণে সন্দেহ করতে হলে তাকে ভাল জেনে পরবর্তী অনুসন্ধানে অগ্রসর হবে)। সম্ভব হলে তাকে তার অবস্থান বা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেবে যেন সন্দেহের কোন কারণ থাকলে তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
“অনুমান করা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ অনুমান হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা। আর বেঁচে থাকো অন্যের দোষ খোঁজা থেকে, এবং অন্যের উপর গোয়েন্দাগিরি করা থেকে, বেঁচে থাকো (মন্দ কাজে) প্রতিযোগিতা করা থেকে, বেঁচে থাক অপরের হিংসা করা থেকে, অপরকে ঘৃণা করা থেকে এবং একে অপরকে পরিহার করা থেকে; এমনভাবে থাকো যেন তোমরা পরস্পর ভাই এবং আল্লাহ্র দাস”। [আল-বুখারী; খণ্ড ৮, অধ্যায় ৭৩, হাদীস নং ৯২]
অন্যের কথাকে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যাখ্যা করাটা হলো মু’মিনদের অন্যতম গুণ। ‘উমার (রা) বলেন,
“তোমার বিশ্বাসী ভাইয়ের কোনো কথাকে খারাপ অর্থে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভালো অর্থে নেওয়ার সুযোগ থাকে।”
একইভাবে ইসলামিক বিশেষজ্ঞগণের মত হল, যদি কাউকে সন্দেহ করার কোন কারণ থাকেও, তবুও মানুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সন্দেহকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়।
পরিশেষে,কোন ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করার সময় উক্ত ব্যক্তির চারিত্রিক সকল দিক বিবেচনা করা এবং হঠকারীতা পরিহার করা উচিৎ। কারো উপর মিথ্যারোপ করা থেকে বেঁচে থাকার জন্য তার ব্যাপারে পুরো বিষয়টা পরিষ্কারভাবে জেনে নেয়া উচিত।
আমার মা। মাকে আমি ভালোবাসি। আমার জন্য কত কষ্টই না তুমি করেছ মা। মনে পড়ে এক রাতের ঘটনা। তখন আমি ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। আমার কি জ্বরটাই না হল সে রাতে। সারাটা রাত আমি জ্বরে কাতরাচ্ছিলাম। ঘরে জ্বরের ঔষধ ছিল না। দোকান পাটও অত রাতে বন্ধ হয়ে গেছে। মা আমার মাথা ধুইয়ে দিলেন। সারাটা রাত আমার সাথে জেগে রইলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর যে কোন ব্যাক্তিরই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসার কথা। অথচ মায়ের চোখ থেকে ঘুম যে ছুটে কোথায় গেল। কি যেন একটা উৎকন্ঠা মায়ের মুখকে এতটুকু করে দিয়েছিল। এমন কত রাত যে মা আমার না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তার কি হিসেব আছে। আমি যখন কোলে ছিলাম । যে বয়সের স্মৃতি আমার একটুও মনে নেই। কতবার যে ক্ষুধায় কেদে উঠেছি। মা আমার ঠিকই বুঝে যেতেন। সেই মাকে আমি কিই বা দিতে পেড়েছি।
এই বেশীদিন আগের ঘটনা নয়। এক রাতে হঠাৎ জেগে দেখি মা আমার জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে কাঁদছেন। একজন মা তার সন্তান ও পরিবার ছাড়া কার জন্যই বা দোয়া করতে পারে। ভেবে আমার চোখেও জল এসে গিয়েছিল।
মা আমাকে মাঝে মাঝে বকা দেন। আমি যখন পড়ায়ে ফাকি দেই বা যখন একটু বেশী দুষ্টুমি করি। সহসা কিছুটা মন খারাপ হয় কিন্তু আমি জানি মা আমার ভালর জন্যই তিনি বকেন। আমাকে পড়তে বলেন সে তো আমার ভবিষ্যতের জন্যই। নি:স্বার্থ মা আমার।
আমার বাবা ছোটখাটো মুদি দোকানে চাকরি করেন। বাবা যা আয় করেন তা দিয়ে আমাদের সংসার কোন রকম চলে । কিন্তু মা-বাবা কখনই আমাদের কখনই তা বুঝতে দেন না। জানি কিভাবে মা এতকিছু সামলান। মা সবসময়ই আমাদের খাবার নিশ্চিত করে তারপর খেতেন। মাকে দেখে মনে হত তিনি আমাদের মতই ভাল খাচ্ছেন। কিন্তু তিনি কি কিছু লুকাচ্ছেন। একদিন বাবা একটি ছোট মাছ এনেছিল। মা মাছটি বেশ মজা করে রেধেছিলেন। কিন্তু সেদিন কোন কারণে মাছের টুকরো কম পড়েছিল। কিন্তু মা আমাদের সেটা বুঝতেই দেননি। দেখি, লুকিয়ে তিনি শুধু আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। মা তুমি এত ভাল কেন? কেন তুমি আমাদের জন্য এত কষ্ট কর?
গত কয়েক মাস ধরে মা হঠাৎ শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথমদিকে আমরা লক্ষ্যই করিনি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে দেখছি মার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি কিছু খেতে পারছেন না। যাই খাচ্ছেন বমি করে ফেলে দিচ্ছেন। বাবাকে বললাম । বাবা মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার মাকে দেখে বলেছে গ্রামে তার চিকিৎসা হবে না। মাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে গেছেন। আমাকে আর আমার ছোট বোনকে ফুফুর কাছে রেখে গেছেন। হে পরওয়াদিগার তুমি মাকে ভাল করে দাও।
আজ আমাদের ওয়ার্ডে এডমিশন। সকাল থেকেই ডিউটি করছি। আজকে মহিলা ওয়ার্ডে ডিউটি। এখন বাজে দুপুর বারোটা। মানিকগঞ্জ থেকে একটি রোগী এসেছে। রোগীটির ক্যাকেক্সিয়া। সে রক্তশূণ্য। কয়েকদিন ধরে বমি ও ক্ষুধামন্দার হিস্ট্রি দিচ্ছে। পেট ফুলে আছে। কতগুলো প্রশ্ন করে জানা গেল গত কয়েক মাসে তার বেশ ওজন কমেছে। অবশ্য রোগীকে দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে। আমরা টিবি সাসপেক্ট করলাম। রোগীকে ভর্তি দিলাম।
রোগীর হাসবেন্ডটা বেশ ভালো। সে তার স্ত্রীর পাশে নিয়মিত থাকছে। আমরা যে পরীক্ষানীরিক্ষা করতে বলছি করিয়ে আনছে। অবশ্য গরীব হওয়ায় কিছু পরীক্ষানীরিক্ষা ফ্রি করে দিতে হয়েছে। ওয়ার্ডে নতুন ইন্টার্ণরা এসেছে। একজন ইন্টার্ণ রোগীটির পেটে জমে যাওয়া পানি বেড় করে দিয়েছে। এতে রোগীটির নাকি বেশ ভাল লাগছে। কিন্তু এভাবে তো বেশী পানি বের করাও যাবে না। পানি বের করে আমরা পরীক্ষা করতে বাইরে পাঠিয়েছি। হাসপাতালের রিপো্র্ট ভালো না। তাই বাইরে পাঠাতে হল। রিপোর্টে টিবি ধরা পড়েনি। তাহলে কি ম্যালিগন্যান্সি? ক্লিনিক্যালী কোন ম্যাস তো পাওয়া যাচ্ছে না।
সিটি স্ক্যান করতে হবে। তিন হাজার টাকা লাগবে। কিন্তুর রোগীর লোকেরা জোগাড় করতে পারছে না। এদিকে রোগীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। স্যারকে বলে সিটি স্ক্যানটা ফ্রি করে, রোগীর হাজবেন্ডকে দিয়ে ডেট আনতে পাঠালাম। সে এসে বলল মেশিন নাকি নষ্ট ঠিক করতে সময় লাগবে। তাহলে? এখন তো বাইরে থেকে স্ক্যান করিয়ে আনতে হবে। আবার রোগ ধরা ছাড়া সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাও দেয়া যাচ্ছে না। রোগীর লোককে বলা হয়েছে যে করেই হোক টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু সে টাকা জোগাড় করতে পারছে না।
প্রতিদিনের মত আজকে সকালেও ফলো আপ দিচ্ছি। কি ব্যাপার রোগীর এ অবস্থা কেন? তার চোখ বড় হয়ে আছে। মুখের এক কোণা দিয়ে রক্ত পড়ছে। সে একদমই কথা বলতে পারছে না। আমি নাড়ি দেখলাম। পালস্ খুবই ফিইবল। স্যালাইন বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু যেখানেই স্যালাইন দি্চ্ছি ফুলে যাচ্ছে। ভেইনগুলো কলাপস করে যাচ্ছে।
“সিস্টার আসুনতো এর একটি ক্যানুলা করতে হবে।খুবই জরুরী”।
দুজনে মিলে পায়ে হাতে চেষ্টা করলাম ক্যানুলা করতে পারলাম না। এর সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার করতে হবে। এনেসথেসিওলোজীতে খবর পাঠিয়েছি। একজন ইন্টার্ণ গেছে। সে ক্যাথেটারের প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট নিয়ে এসেছে। রোগীর লোককে কিছু টাকা দিয়ে আমরা ক্যাথেটার আনতে পাঠাবো। এর মধ্যে রোগীকে ট্রলিতে করে ওটিতে পাঠাতে হবে।
ওয়ার্ডবয় ট্রলি জোগাড় করল। রোগী খুব ধীরে বুক টান করে প্রশ্বাস নিচ্ছে। এটা ভাল লক্ষণ নয়। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে মানুষ সাধারণত এরকম প্রশ্বাস নেয়। তাকে ধরে ট্রলিতে উঠালাম। দ্রুত ওটিতে নেয়া দরকার।
“কি ব্যাপার আপনারা জিনিসপত্র এনেছেন। এতক্ষণ লাগছে কেন?”
“স্যার আর ওটিতে নিতে হইব না। থাক…. স্যার আপনারা অনেক কষ্ট করছেন”।
ট্রলিতে উঠানোর পরপরই মহিলাটি বড় একটি নি:শ্বাসের মাধ্যমে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। আমরা রোগটি পুরোপুরি ধরার আগেই রোগী ইহজীবন সাঙ্গ করল। আমরা কিছু করতে পারলাম না।
স্যারের রাউন্ড চলছে। রোগীর স্বামী দেখি আমাকে ডাকছে।
“কি গাড়ি যোগাড় করতে পেরেছেন?”
“স্যার গাড়ি যোগাড় হইছে, তয় স্যার আর পাঁচশোটা টাকা দিতে পারবেন? আমার কাছে এই পাঁচশ ছাড়া আর নাই। গাড়ির জন্য একহাজার লাগবো। আর পাঁচশোটা টাকা দিলে তিথির মা’র লাশটা বাড়ি লইয়া যাইতে পারতাম”।
সিএ কে বলে ফান্ড থেকে টাকাটা যোগাড় করে দিলাম। লোকটা অনেক কষ্টে নিজের চোখের পানি ধরে রাখছিল। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। চোখে পানি চলে আসল। দ্রুত সরে গিয়ে নিজেকে সামলালাম।
অনেকদিন হল মা ঢাকায় গেছে। নিশ্চয়ই মা পুরো সুস্থ হয়েই ঢাকা থেকে ফিরবে। মাকে দেখে কতই না ভাল লাগবে। এবার মা আসলে মায়ের সব কথা শুনবো । আর কখনও দুষ্টুমি করব না। মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করব। মা তুমি দেখ এবার আমি প্রথম হবই । আমি বড় হয়ে মা তোমার জন্য রোজ রোজ মাছ নিয়ে আসব। তোমাকে কোন কষ্টই করতে দিব না। তুমিই যতই বল আমি তোমাকে আর দু:খী দেখতে চাই না।
দুরের রাস্তায় একটা মাইক্রো দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি মা চলে এসেছে? একি বাবার মুখ এরকম শুকনো কেন? কি হয়েছে? বাবা, মা কোথায়? গাড়ীর জানালার ভিতর দিয়ে দেখি, সাদা কাফনের কাপড় পড়ে প্রিয় মা আমার চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে
সমাপ্ত
এই বেশীদিন আগের ঘটনা নয়। এক রাতে হঠাৎ জেগে দেখি মা আমার জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে কাঁদছেন। একজন মা তার সন্তান ও পরিবার ছাড়া কার জন্যই বা দোয়া করতে পারে। ভেবে আমার চোখেও জল এসে গিয়েছিল।
মা আমাকে মাঝে মাঝে বকা দেন। আমি যখন পড়ায়ে ফাকি দেই বা যখন একটু বেশী দুষ্টুমি করি। সহসা কিছুটা মন খারাপ হয় কিন্তু আমি জানি মা আমার ভালর জন্যই তিনি বকেন। আমাকে পড়তে বলেন সে তো আমার ভবিষ্যতের জন্যই। নি:স্বার্থ মা আমার।
আমার বাবা ছোটখাটো মুদি দোকানে চাকরি করেন। বাবা যা আয় করেন তা দিয়ে আমাদের সংসার কোন রকম চলে । কিন্তু মা-বাবা কখনই আমাদের কখনই তা বুঝতে দেন না। জানি কিভাবে মা এতকিছু সামলান। মা সবসময়ই আমাদের খাবার নিশ্চিত করে তারপর খেতেন। মাকে দেখে মনে হত তিনি আমাদের মতই ভাল খাচ্ছেন। কিন্তু তিনি কি কিছু লুকাচ্ছেন। একদিন বাবা একটি ছোট মাছ এনেছিল। মা মাছটি বেশ মজা করে রেধেছিলেন। কিন্তু সেদিন কোন কারণে মাছের টুকরো কম পড়েছিল। কিন্তু মা আমাদের সেটা বুঝতেই দেননি। দেখি, লুকিয়ে তিনি শুধু আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। মা তুমি এত ভাল কেন? কেন তুমি আমাদের জন্য এত কষ্ট কর?
গত কয়েক মাস ধরে মা হঠাৎ শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথমদিকে আমরা লক্ষ্যই করিনি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে দেখছি মার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি কিছু খেতে পারছেন না। যাই খাচ্ছেন বমি করে ফেলে দিচ্ছেন। বাবাকে বললাম । বাবা মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার মাকে দেখে বলেছে গ্রামে তার চিকিৎসা হবে না। মাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে গেছেন। আমাকে আর আমার ছোট বোনকে ফুফুর কাছে রেখে গেছেন। হে পরওয়াদিগার তুমি মাকে ভাল করে দাও।
আজ আমাদের ওয়ার্ডে এডমিশন। সকাল থেকেই ডিউটি করছি। আজকে মহিলা ওয়ার্ডে ডিউটি। এখন বাজে দুপুর বারোটা। মানিকগঞ্জ থেকে একটি রোগী এসেছে। রোগীটির ক্যাকেক্সিয়া। সে রক্তশূণ্য। কয়েকদিন ধরে বমি ও ক্ষুধামন্দার হিস্ট্রি দিচ্ছে। পেট ফুলে আছে। কতগুলো প্রশ্ন করে জানা গেল গত কয়েক মাসে তার বেশ ওজন কমেছে। অবশ্য রোগীকে দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে। আমরা টিবি সাসপেক্ট করলাম। রোগীকে ভর্তি দিলাম।
রোগীর হাসবেন্ডটা বেশ ভালো। সে তার স্ত্রীর পাশে নিয়মিত থাকছে। আমরা যে পরীক্ষানীরিক্ষা করতে বলছি করিয়ে আনছে। অবশ্য গরীব হওয়ায় কিছু পরীক্ষানীরিক্ষা ফ্রি করে দিতে হয়েছে। ওয়ার্ডে নতুন ইন্টার্ণরা এসেছে। একজন ইন্টার্ণ রোগীটির পেটে জমে যাওয়া পানি বেড় করে দিয়েছে। এতে রোগীটির নাকি বেশ ভাল লাগছে। কিন্তু এভাবে তো বেশী পানি বের করাও যাবে না। পানি বের করে আমরা পরীক্ষা করতে বাইরে পাঠিয়েছি। হাসপাতালের রিপো্র্ট ভালো না। তাই বাইরে পাঠাতে হল। রিপোর্টে টিবি ধরা পড়েনি। তাহলে কি ম্যালিগন্যান্সি? ক্লিনিক্যালী কোন ম্যাস তো পাওয়া যাচ্ছে না।
সিটি স্ক্যান করতে হবে। তিন হাজার টাকা লাগবে। কিন্তুর রোগীর লোকেরা জোগাড় করতে পারছে না। এদিকে রোগীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। স্যারকে বলে সিটি স্ক্যানটা ফ্রি করে, রোগীর হাজবেন্ডকে দিয়ে ডেট আনতে পাঠালাম। সে এসে বলল মেশিন নাকি নষ্ট ঠিক করতে সময় লাগবে। তাহলে? এখন তো বাইরে থেকে স্ক্যান করিয়ে আনতে হবে। আবার রোগ ধরা ছাড়া সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাও দেয়া যাচ্ছে না। রোগীর লোককে বলা হয়েছে যে করেই হোক টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু সে টাকা জোগাড় করতে পারছে না।
প্রতিদিনের মত আজকে সকালেও ফলো আপ দিচ্ছি। কি ব্যাপার রোগীর এ অবস্থা কেন? তার চোখ বড় হয়ে আছে। মুখের এক কোণা দিয়ে রক্ত পড়ছে। সে একদমই কথা বলতে পারছে না। আমি নাড়ি দেখলাম। পালস্ খুবই ফিইবল। স্যালাইন বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু যেখানেই স্যালাইন দি্চ্ছি ফুলে যাচ্ছে। ভেইনগুলো কলাপস করে যাচ্ছে।
“সিস্টার আসুনতো এর একটি ক্যানুলা করতে হবে।খুবই জরুরী”।
দুজনে মিলে পায়ে হাতে চেষ্টা করলাম ক্যানুলা করতে পারলাম না। এর সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার করতে হবে। এনেসথেসিওলোজীতে খবর পাঠিয়েছি। একজন ইন্টার্ণ গেছে। সে ক্যাথেটারের প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট নিয়ে এসেছে। রোগীর লোককে কিছু টাকা দিয়ে আমরা ক্যাথেটার আনতে পাঠাবো। এর মধ্যে রোগীকে ট্রলিতে করে ওটিতে পাঠাতে হবে।
ওয়ার্ডবয় ট্রলি জোগাড় করল। রোগী খুব ধীরে বুক টান করে প্রশ্বাস নিচ্ছে। এটা ভাল লক্ষণ নয়। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে মানুষ সাধারণত এরকম প্রশ্বাস নেয়। তাকে ধরে ট্রলিতে উঠালাম। দ্রুত ওটিতে নেয়া দরকার।
“কি ব্যাপার আপনারা জিনিসপত্র এনেছেন। এতক্ষণ লাগছে কেন?”
“স্যার আর ওটিতে নিতে হইব না। থাক…. স্যার আপনারা অনেক কষ্ট করছেন”।
ট্রলিতে উঠানোর পরপরই মহিলাটি বড় একটি নি:শ্বাসের মাধ্যমে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। আমরা রোগটি পুরোপুরি ধরার আগেই রোগী ইহজীবন সাঙ্গ করল। আমরা কিছু করতে পারলাম না।
স্যারের রাউন্ড চলছে। রোগীর স্বামী দেখি আমাকে ডাকছে।
“কি গাড়ি যোগাড় করতে পেরেছেন?”
“স্যার গাড়ি যোগাড় হইছে, তয় স্যার আর পাঁচশোটা টাকা দিতে পারবেন? আমার কাছে এই পাঁচশ ছাড়া আর নাই। গাড়ির জন্য একহাজার লাগবো। আর পাঁচশোটা টাকা দিলে তিথির মা’র লাশটা বাড়ি লইয়া যাইতে পারতাম”।
সিএ কে বলে ফান্ড থেকে টাকাটা যোগাড় করে দিলাম। লোকটা অনেক কষ্টে নিজের চোখের পানি ধরে রাখছিল। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। চোখে পানি চলে আসল। দ্রুত সরে গিয়ে নিজেকে সামলালাম।
অনেকদিন হল মা ঢাকায় গেছে। নিশ্চয়ই মা পুরো সুস্থ হয়েই ঢাকা থেকে ফিরবে। মাকে দেখে কতই না ভাল লাগবে। এবার মা আসলে মায়ের সব কথা শুনবো । আর কখনও দুষ্টুমি করব না। মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করব। মা তুমি দেখ এবার আমি প্রথম হবই । আমি বড় হয়ে মা তোমার জন্য রোজ রোজ মাছ নিয়ে আসব। তোমাকে কোন কষ্টই করতে দিব না। তুমিই যতই বল আমি তোমাকে আর দু:খী দেখতে চাই না।
দুরের রাস্তায় একটা মাইক্রো দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি মা চলে এসেছে? একি বাবার মুখ এরকম শুকনো কেন? কি হয়েছে? বাবা, মা কোথায়? গাড়ীর জানালার ভিতর দিয়ে দেখি, সাদা কাফনের কাপড় পড়ে প্রিয় মা আমার চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে
সমাপ্ত
নাম তার আব্দুল ওয়াহ্হাব। আমেরিকান এক মুসলমান। কয়েকদিন পূর্বে বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলেছেন এক ষোড়শী যুবতীকে। যুবতীর নাম রাইহানা। যুবতী বেশ সুন্দরী। অনিন্দ্য সুন্দরী। ওর বাইরের রূপটা যে কোনো পুরুষকে মুগ্ধ করলেও ভিতরটা তার ঘোর অন্ধকারে ঢাকা। কারণ ইসলামের আলো এখনো তার অন্তর জগতে প্রবেশ করেনি। কালেমায়ে শাহদাত পড়ে মুসলমান হয়নি। ধর্মে ছিল সে খৃস্টান। আর এ অবস্থায়ই নববধূ হয়ে চলে আসে জনাব আব্দুল ওয়াহ্হাবের স্ত্রী হয়ে।
রাইহানা ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেবকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মোকাবেলা করতে হয়েছে মারাত্মক পরিস্থিতির। পাঠকবৃন্দ! চলুন, জনাব আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেবের মুখ থেকেই তাদের কাহিনীটা হৃদয়ঙ্গম করি। সেই সাথে নিজেরা শিক্ষা গ্রহণ করে তদানুযায়ী নিজেদের জীবনকে ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করি।
জনাব আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব বলেন, রাইহানাকে বিয়ে করার সময় আমি ছিলাম নামে মুসলমান। ইসলামী বিধি-বিধান পালনের কোনো গুরুত্ব আমার মধ্যে ছিল না। তাই সেগুলো রীতিমত পালনও করতাম না। এমনকি কোনো খৃস্টান মেয়ের সাথে কোনো মুসলমান ছেলের বিয়ে সহীহ হয় না একথাটিও আমার জানা ছিল না। রাইহানার অবস্থাও ছিল আমার মতো। সেও তার ধর্মের প্রতি আন্তরিক ছিল না। বরং বলা যায়, ধর্ম কিংবা ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের ব্যাপারে তার কোনো মনোযোগই ছিল না। আমি অবশ্য মাঝে মধ্যে মসজিদে যেতাম। নামাজ পড়তাম। কিন্তু সে কখনো চার্চে যেতো না।
কিছুদিন পর আমাদের একটা সন্তান হলো। তখন আমি সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় বিভোর হলাম। ভাবলাম, আমি ও আমার স্ত্রী যদি একই ধর্মের অনুসারী না হতে পারি, তবে সন্তান বড় হয়ে কোন্ ধর্মের অনুসারী হবে। তাই আমি রাইহানাকে মসজিদে যাওয়ার দাওয়াত দিলাম। কিন্তু আমার দাওয়াত সে স্পষ্ট ভাষায় কেবল অস্বীকারই করল না, উল্টো চার্চে যেতে শুরু করল। এমনকি এটি একটি অলিখিত নিয়মই হয়ে গেল যে, তাকে আমি যখনই মসজিদে যাওয়ার কথা বলি তখনই সে চার্চে ছুটে যায়।
এবার আমার বোধদোয় হলো। আমি ভাবলাম, আমি মুসলমান, আমার স্ত্রী খৃস্টান। হায়, এ আমাদের কেমন জিন্দেগী? মুসলমানের ঘরে খৃস্টান বউ! তাছাড়া এতদিন তো অবস্থাটা এমন ছিল যে, সে চার্চে যেত না। কিন্তু এখন? এখন তো সে চার্চেও যায়!
আমি বিষয়টি নিয়ে খুব ফিকির করলাম। তাকে মুসলমান বানানোর জন্য কী কৌশল অবলম্বন করা যায়, এ নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলাম। অবশেষে তাকে এই প্রস্তাব দিলাম যে, চলো এক রবিবারে আমরা উভয়ে চার্চে যাবো, আর আরেক রবিবারে যাব মসজিদে। সে খানিকটা চিন্তা করে আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল। এই প্রস্তাব দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমি চাছিলাম যে কোনোভাবে ইসলামের পরিচয় তার সামনে প্রকাশিত হোক। সে ইসলামের কাছে আসুক।
আমি যখন আমার স্ত্রীকে মুসলমান বানানোর ফিকির করছিলাম তখন আমার মাঝেও আত্ম সচেতনতা সৃষ্টি হলো। আমি মনে মনে নিজকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, আমি কেমন ঈমানদার যে, মুসলমান হয়েও ইসলামী বিধি-বিধান ঠিকমত পালন করি না? ইসলামের রঙে রঙিন হই না? তাছাড়া আমি নিজে ইসলাম পালন না করে, আরেকজনকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তা কতটুকুই বা কার্যকর হবে? না, আমাকে আর এভাবে চললে হবে না। আমাকে পুরোপুরি মুসলমান হতে হবে। আমলদার হতে হবে। ইসলামের যাবতীয় বিধান একশ ভাগ পালন করতে হবে। তখন হয়তো আমার স্ত্রীকে আর ইসলাম গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করতে হবে না। কারণ সে যখন তার স্বামীর মধ্যে ইসলামের অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করবে, অতি সহজে তখন ইসলামের প্রকৃতরূপ তার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে। ফলে তখন সে নিজেই ইসলামের প্রতি আগ্রহী হবে এবং আল্লাহ চাহেত ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়ও নিবে।
যে কথা সে কাজ। সেদিন থেকে আমি আমার জীবন বদলাতে শুরু করলাম। আলেম-উলামাদের সান্নিধ্যে যেতে লাগলাম। একান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে লাগলাম, ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান। প্রত্যেক কথা ও কাজে অনুসরণ করতে লাগলাম, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি সুন্নত। ঘরে বাইরে সকল ক্ষেত্রে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে লাগলাম। মোট কথা ইসলামী আচার-আচরণে রাঙিয়ে তুললাম আমার জীবনের প্রতিটি অঙ্গন।
আমি যখন ধর্মের প্রতিটি বিধান একান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম, তখন আমি মনের মধ্যে এমন এক প্রশান্তি অনুভব করলাম, যা কেবল অনুভব করা যায়, অন্যকে বলে বুঝানো যায় না। আর সে প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল রাইহানার কোমল হৃদয়কেও। দেখা গেল, কিছুদিনের মধ্যেই সে ইসলামী আচার-আচরণ ও সভ্যতার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে। দুর্বল হয়ে পড়ে ইসলামের প্রতি। তাছাড়া ঘরে ইসলামী পরিবেশ, আর মসজিদ থেকে ইসলাম সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা শ্রবন এ দুই বস্তু ইসলামের প্রতি তার দুর্বলতা ও আগ্রহকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলে। ফলে বেশিদিন আমাকে অপো করতে হয়নি। ইসলামের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে একদিন সে কালিমায়ে শাহাদত পড়ে মুসলমান যায়। আলহামদুলিল্লাহ।
আরো খুশি ও শুকরিয়ার ব্যাপার হলো, ইসলাম গ্রহণের পর রাইহানা আশ্চর্য রকমভাবে বদলে যায়। মুসলমান হয়ে ইসলামকে সে গ্রহণ করে প্রাণখুলে, পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও ভালোবাসার সাথে। সে তার জীবনের প্রতিটি কাজকে ইসলামের রঙে রঙিন করে তুলতে প্রয়াসী হয়ে ওঠে। পর্দা করতে শুরু করে। তাও আবার অসম্পূর্ণ পর্দা নয়। অর্থাৎ মুখ কিংবা চোখ বের করা ‘ফ্যাশনী পর্দা’ নয়। রাইহানা প্রায়ই বলে, মুসলমানের ঘরে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম নারীরা কেন পর্দা করে না? আর করলেও কেন পুরোপুরি করে না? কেন তারা ইসলামী কায়দায় মাথা ঢাকে না?। কেন তারা শরীরটা ঢেকে সৌন্দর্যের উৎস ‘মুখখানা’ খোলা রাখে? তাদের কি কোনো অনুভূতি নেই? তারা কি বুঝে না যে, মুখ কিংবা চোখ খোলা রেখে পর্দা করলে পর্দার বিধান সম্পূর্ণরূপে পালিত হয় না? তবে কি তারা আল্লাহকে ভয় করে না? তাদের কি চিন্তা নেই যে, উত্তমরূপে পর্দার বিধান পালন না করলে মৃত্যুর পর কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে তাদেরকে? এমনকি দুনিয়াতেও সম্মুখীন হতে পারে নানাবিধ পেরেশানীর? তাছাড়া ইসলামী পোষাক তো নারীর ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে তোলে। তার মর্যাদাকে বিকশিত করে। আহা! ওরা না বুঝেই অন্যদের রঙ চড়াতে চাচ্ছে নিজেদের গায়ে!
ইসলামের প্রতি রাইহানার বিশ্বাস ছিল পরম শাণিত। ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামী শিক্ষার প্রতি তার ঝোঁক অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। সে এখন অন্য ধর্মের কোনো বই-পুস্তক পড়ে না। বরং ইসলাম ধর্ম বিষয়ক বই-পুস্তক এনে দেওয়ার জন্য আমাকে সে বারবার অনুরোধ জানাতে থাকে। আমিও সানন্দে দেশের বিভিন্ন নামকরা লাইব্রেরীগুলো খোঁজে ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে নামকরা লেখকদের লেখা বই-পুস্তক কিনে ওর হাতে তুলে দেই। এসব বই হাতে পেয়ে রাইহানা যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি দারুণ পুলকিত হই আমিও। কারণ, আমি তো এমনটিই চাচ্ছিলাম। বড় কথা হলো, ইসলাম সম্পর্কে রাইহানা যা-ই জানতো, যা-ই শিখতো তার উপরই সে আমল শুরু করে দিত। আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতো আপনার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। আপনার পরশ পেয়েই আমি এ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছি। আল্লাহ পাক আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
সন্তানের ব্যাপারে রাইহানার বক্তব্য ছিল অসম্ভব স্বচ্ছ। সে তার সন্তানকে ইসলামী স্কুলেই পড়াবে এ যেন তার কঠিন প্রতিজ্ঞা। তার কথা হলো ইসলামী শিক্ষা ছাড়া কেউ পরিপূর্ণ মুসলমান হতে পারে না। সে প্রায়ই বলত, পার্থিব শিায় কোনো ঘাটতি থাকলে সেটা পরবর্তিকালে পুষিয়ে নেওয়া যায় কিন্তু ধর্মীয় শিায় কোনো ঘাটতি থাকলে সেটা আর পুষিয়ে নেওয়া যায় না।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব ও রাইহানার দাম্পত্য জীবন আজ পরম আনন্দের, পরম সুখের। ইসলামের স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় তারা লাভ করে অপূর্ব প্রশান্তি। ইসলাম ধর্ম জানা ও মানার মধ্যে যে এত শান্তি আছে, এত সুখ আছে তা যদি তারা আরো আগে জানতো, আরো আগে বুঝতো, তবে শান্তি-সুখের এই সুন্দরতম জীবনকে আরো আগেই তারা গ্রহণ করত।
হে আল্লাহ! ওরা যে কথাটি বুঝতে পেরেছিল, দাম্পত্য জীবনের কয়েকটি বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর সে কথাটি আমাদেরকে বুঝার এবং সে অনুপাতে জীবন যাপন করার তাওফীক দাও আজই এখন থেকেই। আমীন।
রাইহানা ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেবকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মোকাবেলা করতে হয়েছে মারাত্মক পরিস্থিতির। পাঠকবৃন্দ! চলুন, জনাব আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেবের মুখ থেকেই তাদের কাহিনীটা হৃদয়ঙ্গম করি। সেই সাথে নিজেরা শিক্ষা গ্রহণ করে তদানুযায়ী নিজেদের জীবনকে ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করি।
জনাব আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব বলেন, রাইহানাকে বিয়ে করার সময় আমি ছিলাম নামে মুসলমান। ইসলামী বিধি-বিধান পালনের কোনো গুরুত্ব আমার মধ্যে ছিল না। তাই সেগুলো রীতিমত পালনও করতাম না। এমনকি কোনো খৃস্টান মেয়ের সাথে কোনো মুসলমান ছেলের বিয়ে সহীহ হয় না একথাটিও আমার জানা ছিল না। রাইহানার অবস্থাও ছিল আমার মতো। সেও তার ধর্মের প্রতি আন্তরিক ছিল না। বরং বলা যায়, ধর্ম কিংবা ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের ব্যাপারে তার কোনো মনোযোগই ছিল না। আমি অবশ্য মাঝে মধ্যে মসজিদে যেতাম। নামাজ পড়তাম। কিন্তু সে কখনো চার্চে যেতো না।
কিছুদিন পর আমাদের একটা সন্তান হলো। তখন আমি সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় বিভোর হলাম। ভাবলাম, আমি ও আমার স্ত্রী যদি একই ধর্মের অনুসারী না হতে পারি, তবে সন্তান বড় হয়ে কোন্ ধর্মের অনুসারী হবে। তাই আমি রাইহানাকে মসজিদে যাওয়ার দাওয়াত দিলাম। কিন্তু আমার দাওয়াত সে স্পষ্ট ভাষায় কেবল অস্বীকারই করল না, উল্টো চার্চে যেতে শুরু করল। এমনকি এটি একটি অলিখিত নিয়মই হয়ে গেল যে, তাকে আমি যখনই মসজিদে যাওয়ার কথা বলি তখনই সে চার্চে ছুটে যায়।
এবার আমার বোধদোয় হলো। আমি ভাবলাম, আমি মুসলমান, আমার স্ত্রী খৃস্টান। হায়, এ আমাদের কেমন জিন্দেগী? মুসলমানের ঘরে খৃস্টান বউ! তাছাড়া এতদিন তো অবস্থাটা এমন ছিল যে, সে চার্চে যেত না। কিন্তু এখন? এখন তো সে চার্চেও যায়!
আমি বিষয়টি নিয়ে খুব ফিকির করলাম। তাকে মুসলমান বানানোর জন্য কী কৌশল অবলম্বন করা যায়, এ নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলাম। অবশেষে তাকে এই প্রস্তাব দিলাম যে, চলো এক রবিবারে আমরা উভয়ে চার্চে যাবো, আর আরেক রবিবারে যাব মসজিদে। সে খানিকটা চিন্তা করে আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল। এই প্রস্তাব দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমি চাছিলাম যে কোনোভাবে ইসলামের পরিচয় তার সামনে প্রকাশিত হোক। সে ইসলামের কাছে আসুক।
আমি যখন আমার স্ত্রীকে মুসলমান বানানোর ফিকির করছিলাম তখন আমার মাঝেও আত্ম সচেতনতা সৃষ্টি হলো। আমি মনে মনে নিজকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, আমি কেমন ঈমানদার যে, মুসলমান হয়েও ইসলামী বিধি-বিধান ঠিকমত পালন করি না? ইসলামের রঙে রঙিন হই না? তাছাড়া আমি নিজে ইসলাম পালন না করে, আরেকজনকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তা কতটুকুই বা কার্যকর হবে? না, আমাকে আর এভাবে চললে হবে না। আমাকে পুরোপুরি মুসলমান হতে হবে। আমলদার হতে হবে। ইসলামের যাবতীয় বিধান একশ ভাগ পালন করতে হবে। তখন হয়তো আমার স্ত্রীকে আর ইসলাম গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করতে হবে না। কারণ সে যখন তার স্বামীর মধ্যে ইসলামের অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করবে, অতি সহজে তখন ইসলামের প্রকৃতরূপ তার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে। ফলে তখন সে নিজেই ইসলামের প্রতি আগ্রহী হবে এবং আল্লাহ চাহেত ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়ও নিবে।
যে কথা সে কাজ। সেদিন থেকে আমি আমার জীবন বদলাতে শুরু করলাম। আলেম-উলামাদের সান্নিধ্যে যেতে লাগলাম। একান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে লাগলাম, ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান। প্রত্যেক কথা ও কাজে অনুসরণ করতে লাগলাম, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি সুন্নত। ঘরে বাইরে সকল ক্ষেত্রে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে লাগলাম। মোট কথা ইসলামী আচার-আচরণে রাঙিয়ে তুললাম আমার জীবনের প্রতিটি অঙ্গন।
আমি যখন ধর্মের প্রতিটি বিধান একান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম, তখন আমি মনের মধ্যে এমন এক প্রশান্তি অনুভব করলাম, যা কেবল অনুভব করা যায়, অন্যকে বলে বুঝানো যায় না। আর সে প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল রাইহানার কোমল হৃদয়কেও। দেখা গেল, কিছুদিনের মধ্যেই সে ইসলামী আচার-আচরণ ও সভ্যতার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে। দুর্বল হয়ে পড়ে ইসলামের প্রতি। তাছাড়া ঘরে ইসলামী পরিবেশ, আর মসজিদ থেকে ইসলাম সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা শ্রবন এ দুই বস্তু ইসলামের প্রতি তার দুর্বলতা ও আগ্রহকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলে। ফলে বেশিদিন আমাকে অপো করতে হয়নি। ইসলামের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে একদিন সে কালিমায়ে শাহাদত পড়ে মুসলমান যায়। আলহামদুলিল্লাহ।
আরো খুশি ও শুকরিয়ার ব্যাপার হলো, ইসলাম গ্রহণের পর রাইহানা আশ্চর্য রকমভাবে বদলে যায়। মুসলমান হয়ে ইসলামকে সে গ্রহণ করে প্রাণখুলে, পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও ভালোবাসার সাথে। সে তার জীবনের প্রতিটি কাজকে ইসলামের রঙে রঙিন করে তুলতে প্রয়াসী হয়ে ওঠে। পর্দা করতে শুরু করে। তাও আবার অসম্পূর্ণ পর্দা নয়। অর্থাৎ মুখ কিংবা চোখ বের করা ‘ফ্যাশনী পর্দা’ নয়। রাইহানা প্রায়ই বলে, মুসলমানের ঘরে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম নারীরা কেন পর্দা করে না? আর করলেও কেন পুরোপুরি করে না? কেন তারা ইসলামী কায়দায় মাথা ঢাকে না?। কেন তারা শরীরটা ঢেকে সৌন্দর্যের উৎস ‘মুখখানা’ খোলা রাখে? তাদের কি কোনো অনুভূতি নেই? তারা কি বুঝে না যে, মুখ কিংবা চোখ খোলা রেখে পর্দা করলে পর্দার বিধান সম্পূর্ণরূপে পালিত হয় না? তবে কি তারা আল্লাহকে ভয় করে না? তাদের কি চিন্তা নেই যে, উত্তমরূপে পর্দার বিধান পালন না করলে মৃত্যুর পর কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে তাদেরকে? এমনকি দুনিয়াতেও সম্মুখীন হতে পারে নানাবিধ পেরেশানীর? তাছাড়া ইসলামী পোষাক তো নারীর ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে তোলে। তার মর্যাদাকে বিকশিত করে। আহা! ওরা না বুঝেই অন্যদের রঙ চড়াতে চাচ্ছে নিজেদের গায়ে!
ইসলামের প্রতি রাইহানার বিশ্বাস ছিল পরম শাণিত। ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামী শিক্ষার প্রতি তার ঝোঁক অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। সে এখন অন্য ধর্মের কোনো বই-পুস্তক পড়ে না। বরং ইসলাম ধর্ম বিষয়ক বই-পুস্তক এনে দেওয়ার জন্য আমাকে সে বারবার অনুরোধ জানাতে থাকে। আমিও সানন্দে দেশের বিভিন্ন নামকরা লাইব্রেরীগুলো খোঁজে ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে নামকরা লেখকদের লেখা বই-পুস্তক কিনে ওর হাতে তুলে দেই। এসব বই হাতে পেয়ে রাইহানা যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি দারুণ পুলকিত হই আমিও। কারণ, আমি তো এমনটিই চাচ্ছিলাম। বড় কথা হলো, ইসলাম সম্পর্কে রাইহানা যা-ই জানতো, যা-ই শিখতো তার উপরই সে আমল শুরু করে দিত। আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতো আপনার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। আপনার পরশ পেয়েই আমি এ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছি। আল্লাহ পাক আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
সন্তানের ব্যাপারে রাইহানার বক্তব্য ছিল অসম্ভব স্বচ্ছ। সে তার সন্তানকে ইসলামী স্কুলেই পড়াবে এ যেন তার কঠিন প্রতিজ্ঞা। তার কথা হলো ইসলামী শিক্ষা ছাড়া কেউ পরিপূর্ণ মুসলমান হতে পারে না। সে প্রায়ই বলত, পার্থিব শিায় কোনো ঘাটতি থাকলে সেটা পরবর্তিকালে পুষিয়ে নেওয়া যায় কিন্তু ধর্মীয় শিায় কোনো ঘাটতি থাকলে সেটা আর পুষিয়ে নেওয়া যায় না।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব ও রাইহানার দাম্পত্য জীবন আজ পরম আনন্দের, পরম সুখের। ইসলামের স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় তারা লাভ করে অপূর্ব প্রশান্তি। ইসলাম ধর্ম জানা ও মানার মধ্যে যে এত শান্তি আছে, এত সুখ আছে তা যদি তারা আরো আগে জানতো, আরো আগে বুঝতো, তবে শান্তি-সুখের এই সুন্দরতম জীবনকে আরো আগেই তারা গ্রহণ করত।
হে আল্লাহ! ওরা যে কথাটি বুঝতে পেরেছিল, দাম্পত্য জীবনের কয়েকটি বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর সে কথাটি আমাদেরকে বুঝার এবং সে অনুপাতে জীবন যাপন করার তাওফীক দাও আজই এখন থেকেই। আমীন।
কাযী শুরাইহ বিন হারেছ আল-কিন্দী ইসলামের ইতিহাসে ন্যায়পরায়ণতা, বুদ্ধিমত্তা ও অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী এক অনন্যসাধারণ বিচারপতি ছিলেন। তিনি একাধারে ওমর, ওছমান, আলী এবং মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৬০ বছর যাবৎ বিচারকার্য পরিচালনার পর ৭৮ হিজরী সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার নিরপেক্ষ বিচারের দীপ্তিমান ইতিহাস সর্বকালেই মানবজাতিকে প্রেরণা জুগিয়ে থাকে। নিম্নে তার দু’টি ঘটনা বিবৃত হ’ল-
[১] ইসলামের ২য় খলীফা ওমর (রাঃ) একদা এক ব্যক্তির নিকট থেকে ভালভাবে দেখেশুনে একটি ঘোড়া ক্রয় করলেন। অতঃপর ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে স্বীয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর ঘোড়াটি অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে লাগল।
ওমর (রাঃ) কালবিলম্ব না করে সরাসরি বিক্রেতার নিকটে ফিরে এলেন এবং তাকে বললেন, তুমি তোমার ঘোড়া ফিরিয়ে নাও, এটা ত্রুটিযুক্ত।
বিক্রেতা বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি ঘোড়াটি ফেরত নিব না, কেননা আপনি তা সুস্থ ও সবল অবস্থাতেই আমার নিকট থেকে ক্রয় করেছেন।
ওমর (রাঃ) বললেন, ঠিক আছে, তাহ’লে তোমার মাঝে ও আমার মাঝে একজন বিচারক নির্ধারণ করা হোক।
বিক্রেতা বললেন, ঠিক আছে, কাযী শুরাইহ আমাদের মাঝে ফায়ছালা করবেন।
ঘটনার বর্ণনাকারী শা‘বী বলেন, তারা উভয়েই শুরাইহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন এবং তার নিকটে পৌঁছে তাকে প্রকৃত ঘটনা বিবৃত করলেন। কাযী শুরাইহ ঘোড়ার মালিকের অভিযোগ শ্রবণ করে ওমর (রাঃ)-কে বললেন, আপনি কি ঘোড়াটিকে সবল ও সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন? ওমর (রাঃ) বললেন, জি হ্যাঁ। বুদ্ধিমত্তা ও ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক কাযী শুরাইহ ঘোষণা করলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি যা ক্রয় করেছেন তা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হৌন অথবা যে অবস্থায় ঘোড়াটিকে গ্রহণ করেছিলেন সে অবস্থায় ফেরত প্রদান করুন। হতচকিত খলীফা মুগ্ধ দৃষ্টিতে কাযী শুরাইহের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ! এটাই তো ন্যায়বিচার। হে বিচারপতি! আপনি কুফায় গমন করুন। আমি আপনাকে কুফার প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দান করলাম। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়াহ ৯/২৫)
[২] ৪র্থ খলীফা আলী (রাঃ) একদিন বাজারে গিয়ে দেখেন, জনৈক খৃষ্টান লোক একটা লোহার বর্ম বিক্রি করছে। আলী (রাঃ) তৎক্ষণাৎ বর্মটি চিনে ফেললেন এবং বললেন, এ বর্ম তো আমার। চল, আদালতে তোমার ও আমার মধ্যে ফায়ছালা হবে। সেসময় ঐ আদালতের বিচারক ছিলেন কাযী শুরাইহ। তিনি যখন আমীরুল মুমিনীনকে আসতে দেখলেন, তখন তাঁর বসার স্থান থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং আলী (রাঃ)-কে নিজ স্থানে বসিয়ে তিনি তাঁর পাশে বসলেন।
আলী (রাঃ) বিচারপতি শুরাইহকে বললেন, এই ব্যক্তির সাথে আমার বিরোধ মিটিয়ে দিন। শুরাইহ বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আপনার বক্তব্য কি? আলী বললেন, এই বর্মটি আমার। অনেক দিন হ’ল এটি হারিয়ে গেছে। আমি তা বিক্রয় করিনি, দানও করিনি।
শুরাইহ বললেন, ওহে খৃষ্টান! আমীরুল মুমিনীন যা বলছেন, সে ব্যাপারে তুমি কী বলতে চাও? সে বলল, আমি আমীরুল মুমিনীনকে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করছি না, তবে বর্মটি আমারই। শুরাইহ বললেন, বর্মটিতো এই ব্যক্তির দখলে রয়েছে। কোন প্রমাণ ছাড়া তার কাছ থেকে সেটা নেয়া যাবে বলে আমি মনে করি না। আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে কি?
আলী (রাঃ) হেসে ফেললেন এবং বললেন, শুরাইহ ঠিকই বলেছেন। আমার নিকট তো কোন প্রমাণ নেই। নিরুপায় শুরাইহ খৃষ্টানের পক্ষেই রায় দিলেন এবং সে বর্মটি গ্রহণ করে রওয়ানা হ’ল। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে সে আবার ফিরে এল এবং বলল, আমি সাক্ষী দিচ্ছি যে, এটাই নবীদের বিধান ও শিক্ষা। আমীরুল মুমিনীন নিজের দাবী বিচারকের সামনে পেশ করেছেন, আর বিচারক তার বিপক্ষে রায় দিচ্ছেন। আল্লাহ্র কসম, হে আমীরুল মুমিনীন! এটা আপনারই বর্ম। আমি এটা আপনার কাছে বিক্রয় করেছিলাম। পরে তা আপনার মেটে রঙের উটটির উপর থেকে ছিটকে পড়ে গেলে আমি ওটা তুলে নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল।
আলী (রাঃ) বললেন, তুমি যখন মুসলমান হয়ে গেলে, তখন এ বর্ম এখন থেকে তোমার। অতঃপর আলী (রাঃ) তাকে ভাল দেখে একটা ঘোড়াও উপহার দিলেন এবং তাতে চড়িয়ে তাকে বিদায় দিলেন।
ইমাম শা‘বী বলেন, আমি পরবর্তীকালে এই নওমুসলমানকে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে দেখেছি। অপর বর্ণনায় শা‘বী বলেন, আলী (রাঃ) এছাড়া তার জন্য দু’হাযার দিরহাম ভাতাও নির্ধারণ করে দেন। অবশেষে এই ব্যক্তি ছিফফীনের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে লড়াই করে শহীদ হন। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ১০/১৩৬ হা/২০২৫২, ১০/১৩৬; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ৮/৫)
শিক্ষা:
[1] ন্যায়বিচার মানবতাকে সমুন্নত করে।
[2] আল্লাহর আইনের সামনে রাজা-প্রজা সকলে সমান।
[3] ক্ষমাশীল আচরণ দিয়ে মানব হৃদয় জয় করা যায়।
[4] বিচারপতিকে বিচক্ষণ, মহৎ ও সৎসাহসী হ’তে হয়।
[5] ইসলামী খেলাফতে মুসলিম-অমুসলিম সকলের নাগরিক অধিকার সমান।
[১] ইসলামের ২য় খলীফা ওমর (রাঃ) একদা এক ব্যক্তির নিকট থেকে ভালভাবে দেখেশুনে একটি ঘোড়া ক্রয় করলেন। অতঃপর ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে স্বীয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর ঘোড়াটি অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে লাগল।
ওমর (রাঃ) কালবিলম্ব না করে সরাসরি বিক্রেতার নিকটে ফিরে এলেন এবং তাকে বললেন, তুমি তোমার ঘোড়া ফিরিয়ে নাও, এটা ত্রুটিযুক্ত।
বিক্রেতা বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি ঘোড়াটি ফেরত নিব না, কেননা আপনি তা সুস্থ ও সবল অবস্থাতেই আমার নিকট থেকে ক্রয় করেছেন।
ওমর (রাঃ) বললেন, ঠিক আছে, তাহ’লে তোমার মাঝে ও আমার মাঝে একজন বিচারক নির্ধারণ করা হোক।
বিক্রেতা বললেন, ঠিক আছে, কাযী শুরাইহ আমাদের মাঝে ফায়ছালা করবেন।
ঘটনার বর্ণনাকারী শা‘বী বলেন, তারা উভয়েই শুরাইহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন এবং তার নিকটে পৌঁছে তাকে প্রকৃত ঘটনা বিবৃত করলেন। কাযী শুরাইহ ঘোড়ার মালিকের অভিযোগ শ্রবণ করে ওমর (রাঃ)-কে বললেন, আপনি কি ঘোড়াটিকে সবল ও সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন? ওমর (রাঃ) বললেন, জি হ্যাঁ। বুদ্ধিমত্তা ও ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক কাযী শুরাইহ ঘোষণা করলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি যা ক্রয় করেছেন তা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হৌন অথবা যে অবস্থায় ঘোড়াটিকে গ্রহণ করেছিলেন সে অবস্থায় ফেরত প্রদান করুন। হতচকিত খলীফা মুগ্ধ দৃষ্টিতে কাযী শুরাইহের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ! এটাই তো ন্যায়বিচার। হে বিচারপতি! আপনি কুফায় গমন করুন। আমি আপনাকে কুফার প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দান করলাম। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়াহ ৯/২৫)
[২] ৪র্থ খলীফা আলী (রাঃ) একদিন বাজারে গিয়ে দেখেন, জনৈক খৃষ্টান লোক একটা লোহার বর্ম বিক্রি করছে। আলী (রাঃ) তৎক্ষণাৎ বর্মটি চিনে ফেললেন এবং বললেন, এ বর্ম তো আমার। চল, আদালতে তোমার ও আমার মধ্যে ফায়ছালা হবে। সেসময় ঐ আদালতের বিচারক ছিলেন কাযী শুরাইহ। তিনি যখন আমীরুল মুমিনীনকে আসতে দেখলেন, তখন তাঁর বসার স্থান থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং আলী (রাঃ)-কে নিজ স্থানে বসিয়ে তিনি তাঁর পাশে বসলেন।
আলী (রাঃ) বিচারপতি শুরাইহকে বললেন, এই ব্যক্তির সাথে আমার বিরোধ মিটিয়ে দিন। শুরাইহ বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আপনার বক্তব্য কি? আলী বললেন, এই বর্মটি আমার। অনেক দিন হ’ল এটি হারিয়ে গেছে। আমি তা বিক্রয় করিনি, দানও করিনি।
শুরাইহ বললেন, ওহে খৃষ্টান! আমীরুল মুমিনীন যা বলছেন, সে ব্যাপারে তুমি কী বলতে চাও? সে বলল, আমি আমীরুল মুমিনীনকে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করছি না, তবে বর্মটি আমারই। শুরাইহ বললেন, বর্মটিতো এই ব্যক্তির দখলে রয়েছে। কোন প্রমাণ ছাড়া তার কাছ থেকে সেটা নেয়া যাবে বলে আমি মনে করি না। আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে কি?
আলী (রাঃ) হেসে ফেললেন এবং বললেন, শুরাইহ ঠিকই বলেছেন। আমার নিকট তো কোন প্রমাণ নেই। নিরুপায় শুরাইহ খৃষ্টানের পক্ষেই রায় দিলেন এবং সে বর্মটি গ্রহণ করে রওয়ানা হ’ল। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে সে আবার ফিরে এল এবং বলল, আমি সাক্ষী দিচ্ছি যে, এটাই নবীদের বিধান ও শিক্ষা। আমীরুল মুমিনীন নিজের দাবী বিচারকের সামনে পেশ করেছেন, আর বিচারক তার বিপক্ষে রায় দিচ্ছেন। আল্লাহ্র কসম, হে আমীরুল মুমিনীন! এটা আপনারই বর্ম। আমি এটা আপনার কাছে বিক্রয় করেছিলাম। পরে তা আপনার মেটে রঙের উটটির উপর থেকে ছিটকে পড়ে গেলে আমি ওটা তুলে নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল।
আলী (রাঃ) বললেন, তুমি যখন মুসলমান হয়ে গেলে, তখন এ বর্ম এখন থেকে তোমার। অতঃপর আলী (রাঃ) তাকে ভাল দেখে একটা ঘোড়াও উপহার দিলেন এবং তাতে চড়িয়ে তাকে বিদায় দিলেন।
ইমাম শা‘বী বলেন, আমি পরবর্তীকালে এই নওমুসলমানকে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে দেখেছি। অপর বর্ণনায় শা‘বী বলেন, আলী (রাঃ) এছাড়া তার জন্য দু’হাযার দিরহাম ভাতাও নির্ধারণ করে দেন। অবশেষে এই ব্যক্তি ছিফফীনের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে লড়াই করে শহীদ হন। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ১০/১৩৬ হা/২০২৫২, ১০/১৩৬; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ৮/৫)
শিক্ষা:
[1] ন্যায়বিচার মানবতাকে সমুন্নত করে।
[2] আল্লাহর আইনের সামনে রাজা-প্রজা সকলে সমান।
[3] ক্ষমাশীল আচরণ দিয়ে মানব হৃদয় জয় করা যায়।
[4] বিচারপতিকে বিচক্ষণ, মহৎ ও সৎসাহসী হ’তে হয়।
[5] ইসলামী খেলাফতে মুসলিম-অমুসলিম সকলের নাগরিক অধিকার সমান।
সুখ হচ্ছে এমন একটি জিনিস যার সন্ধানে আজকে আমরা সবাই বেরিয়েছি। কে আছে এমন যে সুখী হতে চায় না কিংবা একটি সুন্দর জীবন কামনা করে না? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সুন্দর জীবন বলতে আসলে কি বোঝায়?
কিছু মানুষ আছে এমন, যারা তাদের জীবনকে ঘৃণা করে ! তারা সর্বদাই মনমরা ও হতাশায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। অপরদিকে, কিছু মানুষ এমনও আছে যারা তাদের জীবনকে উপভোগ করে, তারা সব সময় হাসি খুশি আর সুখে থাকে। কিন্তু এমন হয় কেন? আর সুখের কারণ কি?
আমরা অনেকেই একথা জানি, পরকালের জীবনে সুন্দর জীবন পাওয়া যাবে জান্নাতে। কিন্তু এই দুনিয়ার জীবনের কি হবে? আসুন জেনে নিই, যিনি আমাদেরকে এই দুনিয়ার জীবন দান করেছেন তিনি,
সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সুন্দর জীবন লাভের ব্যাপারে কি বলছেন –
“যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন (হায়াতে তাইয়েবা) দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত”। [ সূরা নাহল ৯৭]
এই জীবনে আমরা যা কিছুই করি না কেন সবকিছুই হয়তো আপনার পক্ষে একটি দলীল প্রমাণ হবে নয়তো আপনার বিপক্ষে একটি দলীল প্রমাণ হবে। প্রতিটি আলাদা মুহুর্ত, সেকেণ্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ আর মাস যা আমরা অতিক্রান্ত করে চলেছি, যা আমাদের জীবন থেকে চলে যাচ্ছে তা হয়তো আমাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আরও নিকটবর্তী করে দিবে অথবা বিপরীতভাবে তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে আপনাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
যখন একজন মানুষ সকালে জেগে উঠে, সে কি ভেবে দেখে না? একটু আগে তার দেহ ছিল নিথর, ঘুমন্ত ! তাকে কেউ ডাকলেও সে শুনতে পায়নি, হতে পারে তার সামনে কেউ বসে ছিল, সে দেখতে পায়নি, সারা রাত ঘুমন্ত মনে সে কি চিন্তা করেছে তা সে নিজেও জানে না।
কে সেই সত্তা যে আবার তাকে জাগ্রত করল ! ফিরিয়ে দিল দৃষ্টিশক্তি, কে ফিরিয়ে দিল শ্রবণ শক্তি, কিংবা রুহ? কে সেই সত্তা যিনি আপনাকে সুস্থ সুন্দর স্বাস্থ্য দান করেছেন যখন অনেকেই নানা শারিরীক সমস্যায় কষ্ট ভোগ করছে! আল্লাহ আমাদের এত বেশি নিয়ামত দান করে থাকেন যে আমরা তাকে ভালো না বেসে পারি না, আল্লাহ আমাদেরকে খাদ্য দান করেন, তাজা ফল, টাটকা সুস্বাদু মাংস, পানীয়, খাবার জল, সূর্যের আলো আরও কত কি !
আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।
–“যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু”। সূরা নাহল ১৮
দেখুন কি চমৎকার ভাষায় আল্লাহ বলছেনঃ
“তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডল সৃজন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জন্যে ফলের রিযিক উৎপন্ন করেছেন এবং নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন, যাতে তাঁর আদেশে সমুদ্রে চলা ফেরা করে এবং নদ-নদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন।
এবং তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন সূর্যকে এবং চন্দ্রকে সর্বদা এক নিয়মে এবং রাত্রি ও দিবাকে তোমাদের কাজে লাগিয়েছেন।
যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ”। [ইবরাহীম ৩২-৩৪]
আল্লাহ আমাদের কাছে কি চান ? আল্লাহ চান আমরা যেন সেই কাজগুলো সুচারুভাবে সম্পাদন করি যা আমাদের জন্য করা অপরিহার্য আর সেই কিছু সামান্য কাজ থেকে দূরে থাকি যা তিনি নিষেধ করেছেন। যদি কেউ এমন ধারণা করে থাকে যে, আল্লাহর আনুগত্য করে কিংবা তাঁর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা করলে তার জীবন কঠিন হয়ে যাবে, দুঃখ দুর্দশা চলে আসবে, সুখ শান্তি চলে যাবে- এগুলো ভুল। বরং এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর সম্পর্কে মন্দ ধারণা করছে। আল্লাহ বলেন,
“আপনাকে ক্লেশ দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করিনি।” [ত্বহা ২]
সুখের সন্ধানে হন্যে হয়ে ছুটে চলেছেন আপনি। অথচ জানেন কি,
আপনি শুধুমাত্র তখনই ‘লাইফ এনজয়’ করতে পারবেন যখন আপনি আপনার অবশ্য পালনীয় কাজগুলো সম্পূর্ণ করবেন। আল্লাহর আনুগত্য ব্যতীত এমন কোন মহৌষধ নেই যা আপনার অন্তরকে পরিষ্কার করে দিবে, কিংবা তাকে তাইয়েব (সুন্দর) করে দিবে। একজন মানুষ, হতে পারে সে দুনিয়ার যত ভোগ করার সামগ্রী, উপাদান, উপায় আছে সে ভোগ করল, কিন্তু আল্লাহর আনুগত্যের চেয়ে অধিক ‘এনজয়েবল’ আর কিছুই নেই, ফলে আপনি নিষিদ্ধ কাজ থেকেও বেঁচে থাকতে পারবেন।
আপনি তখনই ‘লাইফ এনজয়’ করতে পারবেন যখন আপনি পালন করবেন যা আল্লাহ আপনাকে করতে আদেশ করেছেনঃ দাওয়াহ, জিহাদ, আমর বিল মারুফ ওয়া নাহিয়ানিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ), কুর’আন তিলাওয়াত, সালাত আদায় ইত্যাদি। আপনি উপভোগ করবেন সেই সকল সাথীদের সাহচর্য যারা সঠিক মানহাজ (কর্মপদ্ধতি) এর উপর আছে, দীন নিয়ে পড়ালেখা করছে, মানুষকেও শিখাচ্ছে এমনকি আল্লাহর জন্যে তারা অর্থ ব্যয় করছে।
আপনি আপনার মুখ দিয়ে কিছু বলবেন কিংবা আপনার দেহ দ্বারা কোন কাজ করবেন, একটু থামুন, নিজেকে প্রশ্ন করুন, যিনি আপনাকে এই দেহ, জীবন দান করেছেন তিনি কি আপনার ইচ্ছার কাজটি করার অনুমতি দিয়েছেন? আমার কি তাঁর অনুমতি রয়েছে?
আপনি যাই করেন না কেন, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হওয়া উচিত যেন কাজটি আপনাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে তোলে, মেয়র, জেলা প্রশাসক, এম পি, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর নৈকট্য লাভ করা উদ্দেশ্য নয়। বরং সকল কাজের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল মালিকুল মুলক (বাদশাহদের যিনি বাদশাহ) এর সন্তুষ্টি। আপনি যদি আপনার জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহকে মেনে না চলেন, আপনি কিছুতেই একটি সুন্দর জীবন লাভ করতে পারেন না। কোনদিন আপনি সুখী হতে পারবেন না। আপনি সব সময় সংশয়, সন্দেহের উপর থাকবেন, সব সময় দোটানায় ভুগবেন দ্বিধাদ্বন্দে ভুগবেন, চিন্তিত আর পেরেশানীর উপর থাকবেন। দেখা যাবে, সারা জীবন আপনি সুখ নামক সোনার হরিণের পিছনে ছুটতেই ব্যয় করবেন কিন্তু সুখ পাবেন না, জীবন হবে শোচনীয়। আপনার অবস্থা হবে অনেকটা এরকম, ‘আমার যা ছিল তা হারিয়ে গেল, যা নেই তার ক্ষোভে’।
একারণেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“ যে আত্মসমর্পণ (ইসলাম গ্রহণ) করলো, যাকে প্রয়োজন পরিমাণ রিযিক দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যে সম্পদ দিয়েছেন এর উপর পরিতৃপ্ত হওয়ারও শক্তি দিয়েছেন, সেই (জীবনে) সফলতা লাভ করেছে” – [মুসলিম ২২৯৫]
আপনি আল্লাহর যত নিকটবর্তী হবেন, আপনি তত বেশি ‘লাইফ এনজয়’ করতে পারবেন।
আপনি যদি এক রাকা’আত সালাত আদায় করেন, এর সবগুলো রুকন ও শর্ত পূরণ করে, তাহলে যে শান্তি-তৃপ্তি আপনি পাবেন তা অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে পাওয়া যাবে না। সারা দুনিয়ার সমস্ত অর্থ সম্পদ দিয়েও সুখ কেনা যায় না।
কাজেই নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি সেই কাজগুলো করছেন যা করার জন্য আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেছেন? আপনি কি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন? হালাল খাবার, পোশাক পরিচ্ছদের বিধি নিষেধ মেনে চলা, দাওয়াহর কাজে সময় দেয়া, খিলাফা প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করা, জিহাদ সমর্থন করা (যদি এর থেকে ভালো আর কিছু করতে আপনি সক্ষম না হন), দখলদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, পিতামাতার আনুগত্য করা, হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা এগুলো করেন কি?
না কি এর মধ্য থেকে যেগুলো আপনার ভালো লাগে সেগুলো করেন আর যা করতে কষ্ট হয় সেগুলো বর্জন করেন?
আসুন একটু জেনে নিই, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথে বাধাগুলো কি কি ?
(১) -শয়তানঃ
মানুষ কিংবা জিনদের মধ্যে যারা শয়তান তাদের থেকে দূরে থাকুন, তাদের এড়িয়ে চলুন।
তারা কেবল আপনাকে বিপদগ্রস্ত আর হতাশ করতে পারে, আর পারে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। মানুষদের মধ্যে যারা শয়তান তাদের মধ্যে আছে অবিশ্বাসী কুফফার, আর তাদের দাওয়াহ’র মাধ্যম হচ্ছে যা আপনি প্রতিদিন দেখছেন টেলিভিশনে, স্যাটেলাইট চ্যানেলে, কিংবা যা‘শুনছেন সবসময়’ রেডিওতে, তারা আসলে তাই করছে যা করার জন্য আপনার প্রয়োজন ছিল কিছু অসৎ বন্ধুর সাহচর্যের। আপনি আপনার বাসায় ব্যক্তিগত সময় কাটাচ্ছেন রেডিও, টিভি গান সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে; মূলত শয়তানেরা আপনার একাকি ব্যক্তিগত সময়টাতেও ঠিক সেভাবেই কাজ করছে যেভাবে একটা অসৎ বন্ধু আহবান জানায় খারাপ কাজের দিকে। খারাপ বন্ধুরা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায় হাল ফ্যাশনের কথা, তথাকথিত তারকা সেলিব্রেটীদের কথা, তাদের অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার কথা, গান বাজনা-কনসার্টের কথা যেখানে মাদকাসক্ত‘তারকা’রা মাদকবিরোধী উৎসব করে, হয়তো কখনো তারা আপনাকে অনলাইনে লিংকও পাঠাতে পারে, আর এভাবেই তারা আপনাকে খারাপ কাজের জন্যে উত্তেজিত করে থাকে।
একটু ভেবে দেখবেন কি, কতগুলো খারাপ কাজ আপনি আপনার নিজের প্রবৃত্তির তাড়না থেকে করেছেন আর কতগুলো খারাপ কাজ করেছেন অসৎ সঙ্গের কারণে? এই খারাপ সংগীরা আপনাকে কখনো মনে করিয়ে দেবে না, আপনার সালাত আদায় হয়েছে কিনা! দাওয়াহর কাজ করা কিংবা নিজেদের মধ্যে যারা দীনের পথে আসতে চাচ্ছে তাদের একটা সার্কেল গঠন করা দূরে থাক ! একারণেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
-:
“কার সাথে বন্ধুত্ব করছো তা যাচাই করে নিবে, কেননা মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত”
কিছু মানুষ এমন আছে, যারা মানুষ কিন্তু শয়তানের মত। এরা তারাই, যারা আপনাকে মানব রচিত কুফরী মতবাদের দিকে (উদারতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,গণতন্ত্র,স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি) আহবান করে, ভোট দানের জন্য উৎসাহিত করে, ভোট দানের নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে তারা আইন পরিষদ-সংসদ গঠন করে, যেখানে মূল কাজ হল আল্লাহর আইন বাতিল করে নিজেদের মনগড়া মানব রচিত আইন তৈরি করা ও এভাবে তারা আল্লাহর জন্য সংরক্ষিত আসনে মানুষকে বসায়। তাদের রচিত জীবন বিধান আর মতবাদ কখনো স্থায়ী কিছু দিতে পারে না, বরং সদা পরিবর্তনশীল, সৃষ্টি করে নিত্য নতুন সমস্যা। তাদের মনগড়া সিস্টেমে তারা নিজেরাই একের পর এক সংশোধনী আনে আর যুগোপযুগী করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তারা নিজেরা যেমন বিভ্রান্ত, আপনিও তাদের সিস্টেম দ্বারা বিভ্রান্ত,
অথচ আপনি স্বপ্ন দেখছেন একটি সুখী সমৃদ্ধ জীবনের ! আপনি বেরিয়েছিলেন সুখের সন্ধানে !
তারা হচ্ছে মানুষের মধ্যে শয়তান। তারা আপনাকে আরও ভুল পথে চালিত করতে পারে, আপনাকে উৎসাহিত করতে পারে তাগুতের গোলামী করার জন্য, বলতে পারে আপনি পুলিশ-প্রশাসনে যোগ দিচ্ছেন না কেন, কিংবা তাদের গোয়েন্দাবাহিনী, সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করতে পারে, যারা কুফফার তাগুতের আনুগত্যে আপনি তাদের অধিক অগ্রগামী পাবেন।
অপরদিকে জিনদের মধ্যে যারা শয়তান তাদের কাজ হচ্ছে আপনার কানে কানে ওয়াসওয়াসা কুমন্ত্রণা দেয়া, ভুল কাজে আপনাকে উৎসাহিত করা। এই শয়তানেরা বলে থাকে, “…আরে, জীবনটাকে সহজভাবে নাও ! . . . এইগুলা করার জন্যে সামনে বহু দিন পড়ে আছে। দীন শিক্ষা করা, দাওয়াতের কাজ …করার জন্য জীবনটাকে নষ্ট করো না,
সময়ের মূল্য আছে !…এইগুলা করলে কি তোমার পেটে ভাত আসবে? লাইফ এনজয় করো…জীবনে অনেক কিছু করার আছে, অনেক কিছু দেখার আছে…দুনিয়া কা মজা লে লো…তোমার সামনে তো সারা জীবন পড়ে আছে…”
আফসোস ! আপনি বেরিয়েছেন সুখের সন্ধানে ।
(২) শাহাওয়াতঃ
আমাদের প্রবৃত্তি, কামনা বাসনা আমাদেরকে ভুলিয়ে রাখে দায়িত্ব কর্তব্যগুলো থেকে,
এমনকি এক সময় তা আর কখনো করা হয়ে উঠে না।
“তারা স্বীয় ধর্মকে তামাশা ও খেলা বানিয়ে নিয়েছিল এবং পার্থিব জীবন তাদের কে ধোঁকায় ফেলে রেখেছিল।
অতএব, আমি আজকে তাদেরকে ভুলে যাব; যেমন তারা এ দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল এবং
যেমন তারা আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করত”। [সূরা আরাফ ৭]
আল্লাহ আপনাকে বসবাসের জন্য একটি সুন্দর বাসগৃহ দান করেছেন, আরামদায়ক শয্যা, বিছানা-বালিশ-তোষক কি আরামদায়ক ব্যবস্থা ! কিন্তু যখন আপনার মৃত্যু হয়ে যাবে তখন সেখানে থাকবে না কোন তোষক, বালিশ বরং উলটো সম্মুখীন হতে হবে প্রশ্নের-জিজ্ঞাসাবাদের, পেতে হবে শাস্তি যদি আপনি আল্লাহর সাথে অবাধ্যতা করে থাকেন। যারা কাফির, অবিশ্বাস করেছে তারা ইচ্ছা করবে, আফসোস করবে যদি তারা আবার কোনভাবে দুনিয়াতে ফেরত আসতে পারতো !
আল্লাহ বলছেন :
“যখন তাদের কারও কাছে মৃত্যু আসে, তখন সে বলেঃ হে আমার পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে ) প্রেরণ করুন। যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি। কখনই নয়, এ তো তার (মুখের) একটি কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে বারযাখ (বাধা,পর্দা) আছে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত” । সূরা মুমিনুন ৯৯-১০০
(৩) আল্লাহ সম্পর্কে অশোভন ধারণা করাঃ
আপনি বেরিয়েছেন সুখের সন্ধানে। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না, কারণ আল্লাহ সম্পর্কে আপনার মনে বহু মন্দ ধারণা করা এবং তাঁর সম্পর্কে নানাবিধ সন্দেহ । যখন আপনি লোকদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করেন, দাওয়াহ, সালাহ, অন্যান্য ভালো কা্জের দিকে আহবান করেন, কিছু লোক তখন জবাবে বলে থাকে, “…আরে, আমাকে আমার মত থাকতে দাও…আমি চাই না এগুলো মানতে গিয়ে আমার জীবনকে কঠিন করতে। আমি ‘লাইফটাকে ইনজয়’ করতে চাই…”
যারা আল্লাহ সম্পর্কে সন্দেহে পতিত আছে আর আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ নিয়ামতের প্রশংসা শুকরিয়া আদায় করে না
তারা কিভাবে একটি শান্তিপূর্ণ, সুখী সুন্দর জীবন লাভ করতে পারে?
আল্লাহ এদের সম্পর্কে বলেন :
“ তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি”। জুমার ৬৭
যেসব অবিশ্বাসীরা মনে করছে যে, যদি তারা ইসলাম মেনে চলা শুরু করে তাহলে তাদের জীবন কঠিন হয়ে যাবে তারা আসলে আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করছে, তারা একটি ভুল দৃষ্টিভংগীর উপর রয়েছে। কাজেই এই বাধাগুলো দূর করার জন্য আপনাকে এর বিপরীত কাজগুলো করতে হবে।
শয়তান থেকে দূরে থাকুন, আল্লাহ আর রাহমানের দিকে আসুন, নিজের প্রবৃত্তি কামনা বাসনার আনুগত্য-গোলামী পরিহার করে কুর’আন ও সুন্নাহর অনুসরণ করুন, আর পরিশেষে আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করুন।
ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে জীবন সংকীর্ণ হবে না, বরং প্রসারিত হবে।
ইসলাম মানুষের জীবনকে সংকীর্ণ করে দেয়ার জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। এসেছে মানুষকে মুক্তি দিতে অসংখ্য উপাস্যের গোলামী থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর আনুগত্যের দিকে নিয়ে যেতে, এসেছে আপনার বুকে জমানো কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে, নিয়ে এসেছে সেই হারিয়ে যাওয়া সুখের সন্ধান।
সাহাবী সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন পারস্য সম্রাটের সেনাপতি রুস্তমের নিকট দূত প্রেরণ করেছিলেন, তিনি অসাধারণ ভাষায় দুনিয়াপূজারী পারস্য সম্রাটদের সমস্ত লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করলেন। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে যে অসাধারণ ভাষায় ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেছিলেন তা ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ তাঁর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে জমা করেছন, এভাবেঃ
“শোন, হে সিপাহশালার ! তাঁর সকল বান্দাদের মধ্য থেকে আল্লাহ আমাদের উত্থান ঘটিয়েছেন এ কারণে যেন তিনি যাদের ইচ্ছে করেনতাদেরকে যেন আমরা মানুষের দাসত্ব থেকে বের করে আল্লাহর দাসত্বে নিয়ে আসতে পারি; যেন তাদেরকে দুনিয়ার জীবনেরসঙ্কীর্ণতা থেকে বের করে এর প্রশস্ততার দিকে নিয়ে আসতে পারি; যেন তাদেরকে মুক্ত করতে পারি অসংখ্য দীনের [ধর্ম,মতবাদ, পথ, আদর্শ] জুলুম থেকে এবং নিয়ে আসতে পারি এক ইসলামের ন্যায় ও সুবিচারের দিকে।” (দ্র আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ)
কাজেই সুখের সন্ধানে যদি আমরা বেরিয়ে থাকি তাহলে আমাদের জন্য করণীয় হচ্ছে, সকল মিথ্যা মতবাদ আর বাতিল মূর্তি, মাবূদদের বর্জন করে আকাশ ও পৃথিবীর সমান প্রশস্ত ইসলামের দিকে যাত্রা শুরু করা। আল্লাহ বলছেন,
“তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও যমীন, যা তৈরী করা হয়েছে পরহেযগারদের জন্য”। আলে ইমরান ১৩৩
মানুষদের মধ্যে যারা শয়তান, তাদের সাথে সাথে থাকার বদলে মুসলিমদের সাথে থাকুন, মুসলিম জামায়াত এর সাথে থাকুন। সেই সমস্ত মুসলিমদের সাথে থাকুন যারা উলামা আর মুজাহিদিনদের সাহায্য সমর্থন করে। এমন কারণে লোকদের সাথে থাকবেন না যে তাদের খ্যাতি, যশ কিংবা অর্থ আপনাকে আকর্ষণ করে।
যখনই কোন অপরাধ কিংবা গুনাহের কাজ করে ফেলবেন কিংবা ভুল করে বসবেন – ভাবুন, চিন্তা করুন। অধিকাংশ ভুল কিংবা গুনাহের পিছনে মূল কারণ কি ছিল? দেখা যায়, অসৎ সংগ, মানুষ কিংবা জিনদের মধ্যে যারা শয়তান তাদের কারণেই আপনি অনেক ভুল করেছেন।
-কাজেই, সুখের সন্ধানে যেহেতু আপনি আছেন, আপনার জন্য উচিত হবে এমন লোকদের সাহচর্য ত্যাগ করে সালেহীন(সৎ কর্মশীল) লোকদের সাথে সম্পর্ক বন্ধুত্ব গড়ে তোলা।
আপনার এমন প্রচেষ্টা কি বৃথা যাবে? এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
“আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কাজ গুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদেরকে কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব”। [ সূরা আনকাবুত ৭]
এবং তিনি আরও বলছেন,
“যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকাজ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করব”। [ সূরা আনকাবুত ৯]
যদি আপনার মনে কারও সম্পর্কে অশোভন, বাজে ধারণা থাকে তাহলে সে ধারণা থাকা উচিত কুফফার, মুশরিক, ফাসিকদের জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কিংবা আমলকারী মুসলিমদের সম্পর্কে কিংবা ইসলাম সম্পর্কে
আমাদের মন্দ ধারণা করা উচিত নয়।
আল্লাহ বলছেন :
“বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। [সূরা জুমার ৫৩]
কিছু মানুষ আছে এমন, যারা তাদের জীবনকে ঘৃণা করে ! তারা সর্বদাই মনমরা ও হতাশায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। অপরদিকে, কিছু মানুষ এমনও আছে যারা তাদের জীবনকে উপভোগ করে, তারা সব সময় হাসি খুশি আর সুখে থাকে। কিন্তু এমন হয় কেন? আর সুখের কারণ কি?
আমরা অনেকেই একথা জানি, পরকালের জীবনে সুন্দর জীবন পাওয়া যাবে জান্নাতে। কিন্তু এই দুনিয়ার জীবনের কি হবে? আসুন জেনে নিই, যিনি আমাদেরকে এই দুনিয়ার জীবন দান করেছেন তিনি,
সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সুন্দর জীবন লাভের ব্যাপারে কি বলছেন –
“যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন (হায়াতে তাইয়েবা) দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত”। [ সূরা নাহল ৯৭]
এই জীবনে আমরা যা কিছুই করি না কেন সবকিছুই হয়তো আপনার পক্ষে একটি দলীল প্রমাণ হবে নয়তো আপনার বিপক্ষে একটি দলীল প্রমাণ হবে। প্রতিটি আলাদা মুহুর্ত, সেকেণ্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ আর মাস যা আমরা অতিক্রান্ত করে চলেছি, যা আমাদের জীবন থেকে চলে যাচ্ছে তা হয়তো আমাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আরও নিকটবর্তী করে দিবে অথবা বিপরীতভাবে তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে আপনাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
যখন একজন মানুষ সকালে জেগে উঠে, সে কি ভেবে দেখে না? একটু আগে তার দেহ ছিল নিথর, ঘুমন্ত ! তাকে কেউ ডাকলেও সে শুনতে পায়নি, হতে পারে তার সামনে কেউ বসে ছিল, সে দেখতে পায়নি, সারা রাত ঘুমন্ত মনে সে কি চিন্তা করেছে তা সে নিজেও জানে না।
কে সেই সত্তা যে আবার তাকে জাগ্রত করল ! ফিরিয়ে দিল দৃষ্টিশক্তি, কে ফিরিয়ে দিল শ্রবণ শক্তি, কিংবা রুহ? কে সেই সত্তা যিনি আপনাকে সুস্থ সুন্দর স্বাস্থ্য দান করেছেন যখন অনেকেই নানা শারিরীক সমস্যায় কষ্ট ভোগ করছে! আল্লাহ আমাদের এত বেশি নিয়ামত দান করে থাকেন যে আমরা তাকে ভালো না বেসে পারি না, আল্লাহ আমাদেরকে খাদ্য দান করেন, তাজা ফল, টাটকা সুস্বাদু মাংস, পানীয়, খাবার জল, সূর্যের আলো আরও কত কি !
আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।
–“যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু”। সূরা নাহল ১৮
দেখুন কি চমৎকার ভাষায় আল্লাহ বলছেনঃ
“তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডল সৃজন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জন্যে ফলের রিযিক উৎপন্ন করেছেন এবং নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন, যাতে তাঁর আদেশে সমুদ্রে চলা ফেরা করে এবং নদ-নদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন।
এবং তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন সূর্যকে এবং চন্দ্রকে সর্বদা এক নিয়মে এবং রাত্রি ও দিবাকে তোমাদের কাজে লাগিয়েছেন।
যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ”। [ইবরাহীম ৩২-৩৪]
আল্লাহ আমাদের কাছে কি চান ? আল্লাহ চান আমরা যেন সেই কাজগুলো সুচারুভাবে সম্পাদন করি যা আমাদের জন্য করা অপরিহার্য আর সেই কিছু সামান্য কাজ থেকে দূরে থাকি যা তিনি নিষেধ করেছেন। যদি কেউ এমন ধারণা করে থাকে যে, আল্লাহর আনুগত্য করে কিংবা তাঁর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা করলে তার জীবন কঠিন হয়ে যাবে, দুঃখ দুর্দশা চলে আসবে, সুখ শান্তি চলে যাবে- এগুলো ভুল। বরং এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর সম্পর্কে মন্দ ধারণা করছে। আল্লাহ বলেন,
“আপনাকে ক্লেশ দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করিনি।” [ত্বহা ২]
সুখের সন্ধানে হন্যে হয়ে ছুটে চলেছেন আপনি। অথচ জানেন কি,
আপনি শুধুমাত্র তখনই ‘লাইফ এনজয়’ করতে পারবেন যখন আপনি আপনার অবশ্য পালনীয় কাজগুলো সম্পূর্ণ করবেন। আল্লাহর আনুগত্য ব্যতীত এমন কোন মহৌষধ নেই যা আপনার অন্তরকে পরিষ্কার করে দিবে, কিংবা তাকে তাইয়েব (সুন্দর) করে দিবে। একজন মানুষ, হতে পারে সে দুনিয়ার যত ভোগ করার সামগ্রী, উপাদান, উপায় আছে সে ভোগ করল, কিন্তু আল্লাহর আনুগত্যের চেয়ে অধিক ‘এনজয়েবল’ আর কিছুই নেই, ফলে আপনি নিষিদ্ধ কাজ থেকেও বেঁচে থাকতে পারবেন।
আপনি তখনই ‘লাইফ এনজয়’ করতে পারবেন যখন আপনি পালন করবেন যা আল্লাহ আপনাকে করতে আদেশ করেছেনঃ দাওয়াহ, জিহাদ, আমর বিল মারুফ ওয়া নাহিয়ানিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ), কুর’আন তিলাওয়াত, সালাত আদায় ইত্যাদি। আপনি উপভোগ করবেন সেই সকল সাথীদের সাহচর্য যারা সঠিক মানহাজ (কর্মপদ্ধতি) এর উপর আছে, দীন নিয়ে পড়ালেখা করছে, মানুষকেও শিখাচ্ছে এমনকি আল্লাহর জন্যে তারা অর্থ ব্যয় করছে।
আপনি আপনার মুখ দিয়ে কিছু বলবেন কিংবা আপনার দেহ দ্বারা কোন কাজ করবেন, একটু থামুন, নিজেকে প্রশ্ন করুন, যিনি আপনাকে এই দেহ, জীবন দান করেছেন তিনি কি আপনার ইচ্ছার কাজটি করার অনুমতি দিয়েছেন? আমার কি তাঁর অনুমতি রয়েছে?
আপনি যাই করেন না কেন, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হওয়া উচিত যেন কাজটি আপনাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে তোলে, মেয়র, জেলা প্রশাসক, এম পি, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর নৈকট্য লাভ করা উদ্দেশ্য নয়। বরং সকল কাজের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল মালিকুল মুলক (বাদশাহদের যিনি বাদশাহ) এর সন্তুষ্টি। আপনি যদি আপনার জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহকে মেনে না চলেন, আপনি কিছুতেই একটি সুন্দর জীবন লাভ করতে পারেন না। কোনদিন আপনি সুখী হতে পারবেন না। আপনি সব সময় সংশয়, সন্দেহের উপর থাকবেন, সব সময় দোটানায় ভুগবেন দ্বিধাদ্বন্দে ভুগবেন, চিন্তিত আর পেরেশানীর উপর থাকবেন। দেখা যাবে, সারা জীবন আপনি সুখ নামক সোনার হরিণের পিছনে ছুটতেই ব্যয় করবেন কিন্তু সুখ পাবেন না, জীবন হবে শোচনীয়। আপনার অবস্থা হবে অনেকটা এরকম, ‘আমার যা ছিল তা হারিয়ে গেল, যা নেই তার ক্ষোভে’।
একারণেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“ যে আত্মসমর্পণ (ইসলাম গ্রহণ) করলো, যাকে প্রয়োজন পরিমাণ রিযিক দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যে সম্পদ দিয়েছেন এর উপর পরিতৃপ্ত হওয়ারও শক্তি দিয়েছেন, সেই (জীবনে) সফলতা লাভ করেছে” – [মুসলিম ২২৯৫]
আপনি আল্লাহর যত নিকটবর্তী হবেন, আপনি তত বেশি ‘লাইফ এনজয়’ করতে পারবেন।
আপনি যদি এক রাকা’আত সালাত আদায় করেন, এর সবগুলো রুকন ও শর্ত পূরণ করে, তাহলে যে শান্তি-তৃপ্তি আপনি পাবেন তা অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে পাওয়া যাবে না। সারা দুনিয়ার সমস্ত অর্থ সম্পদ দিয়েও সুখ কেনা যায় না।
কাজেই নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি সেই কাজগুলো করছেন যা করার জন্য আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেছেন? আপনি কি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন? হালাল খাবার, পোশাক পরিচ্ছদের বিধি নিষেধ মেনে চলা, দাওয়াহর কাজে সময় দেয়া, খিলাফা প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করা, জিহাদ সমর্থন করা (যদি এর থেকে ভালো আর কিছু করতে আপনি সক্ষম না হন), দখলদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, পিতামাতার আনুগত্য করা, হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা এগুলো করেন কি?
না কি এর মধ্য থেকে যেগুলো আপনার ভালো লাগে সেগুলো করেন আর যা করতে কষ্ট হয় সেগুলো বর্জন করেন?
আসুন একটু জেনে নিই, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথে বাধাগুলো কি কি ?
(১) -শয়তানঃ
মানুষ কিংবা জিনদের মধ্যে যারা শয়তান তাদের থেকে দূরে থাকুন, তাদের এড়িয়ে চলুন।
তারা কেবল আপনাকে বিপদগ্রস্ত আর হতাশ করতে পারে, আর পারে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। মানুষদের মধ্যে যারা শয়তান তাদের মধ্যে আছে অবিশ্বাসী কুফফার, আর তাদের দাওয়াহ’র মাধ্যম হচ্ছে যা আপনি প্রতিদিন দেখছেন টেলিভিশনে, স্যাটেলাইট চ্যানেলে, কিংবা যা‘শুনছেন সবসময়’ রেডিওতে, তারা আসলে তাই করছে যা করার জন্য আপনার প্রয়োজন ছিল কিছু অসৎ বন্ধুর সাহচর্যের। আপনি আপনার বাসায় ব্যক্তিগত সময় কাটাচ্ছেন রেডিও, টিভি গান সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে; মূলত শয়তানেরা আপনার একাকি ব্যক্তিগত সময়টাতেও ঠিক সেভাবেই কাজ করছে যেভাবে একটা অসৎ বন্ধু আহবান জানায় খারাপ কাজের দিকে। খারাপ বন্ধুরা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায় হাল ফ্যাশনের কথা, তথাকথিত তারকা সেলিব্রেটীদের কথা, তাদের অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার কথা, গান বাজনা-কনসার্টের কথা যেখানে মাদকাসক্ত‘তারকা’রা মাদকবিরোধী উৎসব করে, হয়তো কখনো তারা আপনাকে অনলাইনে লিংকও পাঠাতে পারে, আর এভাবেই তারা আপনাকে খারাপ কাজের জন্যে উত্তেজিত করে থাকে।
একটু ভেবে দেখবেন কি, কতগুলো খারাপ কাজ আপনি আপনার নিজের প্রবৃত্তির তাড়না থেকে করেছেন আর কতগুলো খারাপ কাজ করেছেন অসৎ সঙ্গের কারণে? এই খারাপ সংগীরা আপনাকে কখনো মনে করিয়ে দেবে না, আপনার সালাত আদায় হয়েছে কিনা! দাওয়াহর কাজ করা কিংবা নিজেদের মধ্যে যারা দীনের পথে আসতে চাচ্ছে তাদের একটা সার্কেল গঠন করা দূরে থাক ! একারণেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
-:
“কার সাথে বন্ধুত্ব করছো তা যাচাই করে নিবে, কেননা মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত”
কিছু মানুষ এমন আছে, যারা মানুষ কিন্তু শয়তানের মত। এরা তারাই, যারা আপনাকে মানব রচিত কুফরী মতবাদের দিকে (উদারতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,গণতন্ত্র,স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি) আহবান করে, ভোট দানের জন্য উৎসাহিত করে, ভোট দানের নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে তারা আইন পরিষদ-সংসদ গঠন করে, যেখানে মূল কাজ হল আল্লাহর আইন বাতিল করে নিজেদের মনগড়া মানব রচিত আইন তৈরি করা ও এভাবে তারা আল্লাহর জন্য সংরক্ষিত আসনে মানুষকে বসায়। তাদের রচিত জীবন বিধান আর মতবাদ কখনো স্থায়ী কিছু দিতে পারে না, বরং সদা পরিবর্তনশীল, সৃষ্টি করে নিত্য নতুন সমস্যা। তাদের মনগড়া সিস্টেমে তারা নিজেরাই একের পর এক সংশোধনী আনে আর যুগোপযুগী করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তারা নিজেরা যেমন বিভ্রান্ত, আপনিও তাদের সিস্টেম দ্বারা বিভ্রান্ত,
অথচ আপনি স্বপ্ন দেখছেন একটি সুখী সমৃদ্ধ জীবনের ! আপনি বেরিয়েছিলেন সুখের সন্ধানে !
তারা হচ্ছে মানুষের মধ্যে শয়তান। তারা আপনাকে আরও ভুল পথে চালিত করতে পারে, আপনাকে উৎসাহিত করতে পারে তাগুতের গোলামী করার জন্য, বলতে পারে আপনি পুলিশ-প্রশাসনে যোগ দিচ্ছেন না কেন, কিংবা তাদের গোয়েন্দাবাহিনী, সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করতে পারে, যারা কুফফার তাগুতের আনুগত্যে আপনি তাদের অধিক অগ্রগামী পাবেন।
অপরদিকে জিনদের মধ্যে যারা শয়তান তাদের কাজ হচ্ছে আপনার কানে কানে ওয়াসওয়াসা কুমন্ত্রণা দেয়া, ভুল কাজে আপনাকে উৎসাহিত করা। এই শয়তানেরা বলে থাকে, “…আরে, জীবনটাকে সহজভাবে নাও ! . . . এইগুলা করার জন্যে সামনে বহু দিন পড়ে আছে। দীন শিক্ষা করা, দাওয়াতের কাজ …করার জন্য জীবনটাকে নষ্ট করো না,
সময়ের মূল্য আছে !…এইগুলা করলে কি তোমার পেটে ভাত আসবে? লাইফ এনজয় করো…জীবনে অনেক কিছু করার আছে, অনেক কিছু দেখার আছে…দুনিয়া কা মজা লে লো…তোমার সামনে তো সারা জীবন পড়ে আছে…”
আফসোস ! আপনি বেরিয়েছেন সুখের সন্ধানে ।
(২) শাহাওয়াতঃ
আমাদের প্রবৃত্তি, কামনা বাসনা আমাদেরকে ভুলিয়ে রাখে দায়িত্ব কর্তব্যগুলো থেকে,
এমনকি এক সময় তা আর কখনো করা হয়ে উঠে না।
“তারা স্বীয় ধর্মকে তামাশা ও খেলা বানিয়ে নিয়েছিল এবং পার্থিব জীবন তাদের কে ধোঁকায় ফেলে রেখেছিল।
অতএব, আমি আজকে তাদেরকে ভুলে যাব; যেমন তারা এ দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল এবং
যেমন তারা আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করত”। [সূরা আরাফ ৭]
আল্লাহ আপনাকে বসবাসের জন্য একটি সুন্দর বাসগৃহ দান করেছেন, আরামদায়ক শয্যা, বিছানা-বালিশ-তোষক কি আরামদায়ক ব্যবস্থা ! কিন্তু যখন আপনার মৃত্যু হয়ে যাবে তখন সেখানে থাকবে না কোন তোষক, বালিশ বরং উলটো সম্মুখীন হতে হবে প্রশ্নের-জিজ্ঞাসাবাদের, পেতে হবে শাস্তি যদি আপনি আল্লাহর সাথে অবাধ্যতা করে থাকেন। যারা কাফির, অবিশ্বাস করেছে তারা ইচ্ছা করবে, আফসোস করবে যদি তারা আবার কোনভাবে দুনিয়াতে ফেরত আসতে পারতো !
আল্লাহ বলছেন :
“যখন তাদের কারও কাছে মৃত্যু আসে, তখন সে বলেঃ হে আমার পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে ) প্রেরণ করুন। যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি। কখনই নয়, এ তো তার (মুখের) একটি কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে বারযাখ (বাধা,পর্দা) আছে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত” । সূরা মুমিনুন ৯৯-১০০
(৩) আল্লাহ সম্পর্কে অশোভন ধারণা করাঃ
আপনি বেরিয়েছেন সুখের সন্ধানে। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না, কারণ আল্লাহ সম্পর্কে আপনার মনে বহু মন্দ ধারণা করা এবং তাঁর সম্পর্কে নানাবিধ সন্দেহ । যখন আপনি লোকদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করেন, দাওয়াহ, সালাহ, অন্যান্য ভালো কা্জের দিকে আহবান করেন, কিছু লোক তখন জবাবে বলে থাকে, “…আরে, আমাকে আমার মত থাকতে দাও…আমি চাই না এগুলো মানতে গিয়ে আমার জীবনকে কঠিন করতে। আমি ‘লাইফটাকে ইনজয়’ করতে চাই…”
যারা আল্লাহ সম্পর্কে সন্দেহে পতিত আছে আর আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ নিয়ামতের প্রশংসা শুকরিয়া আদায় করে না
তারা কিভাবে একটি শান্তিপূর্ণ, সুখী সুন্দর জীবন লাভ করতে পারে?
আল্লাহ এদের সম্পর্কে বলেন :
“ তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি”। জুমার ৬৭
যেসব অবিশ্বাসীরা মনে করছে যে, যদি তারা ইসলাম মেনে চলা শুরু করে তাহলে তাদের জীবন কঠিন হয়ে যাবে তারা আসলে আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করছে, তারা একটি ভুল দৃষ্টিভংগীর উপর রয়েছে। কাজেই এই বাধাগুলো দূর করার জন্য আপনাকে এর বিপরীত কাজগুলো করতে হবে।
শয়তান থেকে দূরে থাকুন, আল্লাহ আর রাহমানের দিকে আসুন, নিজের প্রবৃত্তি কামনা বাসনার আনুগত্য-গোলামী পরিহার করে কুর’আন ও সুন্নাহর অনুসরণ করুন, আর পরিশেষে আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করুন।
ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে জীবন সংকীর্ণ হবে না, বরং প্রসারিত হবে।
ইসলাম মানুষের জীবনকে সংকীর্ণ করে দেয়ার জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। এসেছে মানুষকে মুক্তি দিতে অসংখ্য উপাস্যের গোলামী থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর আনুগত্যের দিকে নিয়ে যেতে, এসেছে আপনার বুকে জমানো কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে, নিয়ে এসেছে সেই হারিয়ে যাওয়া সুখের সন্ধান।
সাহাবী সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন পারস্য সম্রাটের সেনাপতি রুস্তমের নিকট দূত প্রেরণ করেছিলেন, তিনি অসাধারণ ভাষায় দুনিয়াপূজারী পারস্য সম্রাটদের সমস্ত লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করলেন। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে যে অসাধারণ ভাষায় ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেছিলেন তা ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ তাঁর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে জমা করেছন, এভাবেঃ
“শোন, হে সিপাহশালার ! তাঁর সকল বান্দাদের মধ্য থেকে আল্লাহ আমাদের উত্থান ঘটিয়েছেন এ কারণে যেন তিনি যাদের ইচ্ছে করেনতাদেরকে যেন আমরা মানুষের দাসত্ব থেকে বের করে আল্লাহর দাসত্বে নিয়ে আসতে পারি; যেন তাদেরকে দুনিয়ার জীবনেরসঙ্কীর্ণতা থেকে বের করে এর প্রশস্ততার দিকে নিয়ে আসতে পারি; যেন তাদেরকে মুক্ত করতে পারি অসংখ্য দীনের [ধর্ম,মতবাদ, পথ, আদর্শ] জুলুম থেকে এবং নিয়ে আসতে পারি এক ইসলামের ন্যায় ও সুবিচারের দিকে।” (দ্র আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ)
কাজেই সুখের সন্ধানে যদি আমরা বেরিয়ে থাকি তাহলে আমাদের জন্য করণীয় হচ্ছে, সকল মিথ্যা মতবাদ আর বাতিল মূর্তি, মাবূদদের বর্জন করে আকাশ ও পৃথিবীর সমান প্রশস্ত ইসলামের দিকে যাত্রা শুরু করা। আল্লাহ বলছেন,
“তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও যমীন, যা তৈরী করা হয়েছে পরহেযগারদের জন্য”। আলে ইমরান ১৩৩
মানুষদের মধ্যে যারা শয়তান, তাদের সাথে সাথে থাকার বদলে মুসলিমদের সাথে থাকুন, মুসলিম জামায়াত এর সাথে থাকুন। সেই সমস্ত মুসলিমদের সাথে থাকুন যারা উলামা আর মুজাহিদিনদের সাহায্য সমর্থন করে। এমন কারণে লোকদের সাথে থাকবেন না যে তাদের খ্যাতি, যশ কিংবা অর্থ আপনাকে আকর্ষণ করে।
যখনই কোন অপরাধ কিংবা গুনাহের কাজ করে ফেলবেন কিংবা ভুল করে বসবেন – ভাবুন, চিন্তা করুন। অধিকাংশ ভুল কিংবা গুনাহের পিছনে মূল কারণ কি ছিল? দেখা যায়, অসৎ সংগ, মানুষ কিংবা জিনদের মধ্যে যারা শয়তান তাদের কারণেই আপনি অনেক ভুল করেছেন।
-কাজেই, সুখের সন্ধানে যেহেতু আপনি আছেন, আপনার জন্য উচিত হবে এমন লোকদের সাহচর্য ত্যাগ করে সালেহীন(সৎ কর্মশীল) লোকদের সাথে সম্পর্ক বন্ধুত্ব গড়ে তোলা।
আপনার এমন প্রচেষ্টা কি বৃথা যাবে? এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
“আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কাজ গুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদেরকে কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব”। [ সূরা আনকাবুত ৭]
এবং তিনি আরও বলছেন,
“যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকাজ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করব”। [ সূরা আনকাবুত ৯]
যদি আপনার মনে কারও সম্পর্কে অশোভন, বাজে ধারণা থাকে তাহলে সে ধারণা থাকা উচিত কুফফার, মুশরিক, ফাসিকদের জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কিংবা আমলকারী মুসলিমদের সম্পর্কে কিংবা ইসলাম সম্পর্কে
আমাদের মন্দ ধারণা করা উচিত নয়।
আল্লাহ বলছেন :
“বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। [সূরা জুমার ৫৩]
ঘটনাটি রাশেদ নামের এক ব্যক্তির। তিনি যেমনটি বলছিলেন…
আমার স্ত্রী যখন প্রথম সন্তানের মা হলো, তখন আমার বয়স তিরিশের বেশি হবে না। আজও আমার সেই রাতটার কথা মনে আছে।
প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সেদিনও সারারাত বন্ধুদের সাথে বাড়ির বাইরে ছিলাম। সারাটা রাত কেটেছিল যতসব নিরর্থক আর অসার কথাবার্তা, পরনিন্দা, পরচর্চা এবং লোকজনকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা আর মজা করে। সবাইকে হাসানোর কাজটা মুলত আমিই করছিলাম। আমি অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছিলাম আর তাই শুনে বন্ধুরা সব হেসেই খোশ হচ্ছিল। মনে আছে, সেই রাতে আমি ওদের অনেক হাসিয়ে ছিলাম। মানুষের কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি খুব ভাল নকল করতে পারি আমি । যাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করি ওর মত কণ্ঠ করে কথা বলতে থাকি। ওর হেনস্তা না হওয়া পর্যন্ত আর ছাড়াছাড়ি নেই। আমার ঠাট্টা মশকরার ছোবল থেকে রেহাই পায় না কেউই, এমনকি আমার বন্ধুরাও না। এর থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। আমার মনে আছে, সেদিন রাতে বাজারে ভিক্ষা করতে দেখা এক অন্ধ ফকিরকে নিয়েও মশকরা করেছিলাম আমি। তারচেয়েও খারাপ কাজটি করেছিলাম আমার নিজের পা’টা ওনার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে আর তাতে বেচারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। কী করবেন বুঝতে না পেরে অন্ধদৃষ্টি নিয়ে বেচারি চারপাশে শুধু মুখ ফেরাচ্ছিলেন।
আমি যথারীতি দেরি করে বাড়ি ফিরে দেখলাম আমার স্ত্রী আমার বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। ওর অবস্থা তখন ভয়ানক।
আমাকে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, “রাশেদ… কোথায় ছিলে তুমি?”
“চাঁদের দেশে গিয়েছিলাম বুঝি?” ব্যঙ্গোক্তি করে বললাম, “কোথায় থাকব আবার, বন্ধুদের সাথে ছিলাম।”
ওকে খুবই অবসন্ন দেখাচ্ছিল। চোখের দু’ফোটা অশ্রু গোপন করে ও বলল, “রাশেদ, আমি আর পারছিনা। মনে হয় খুব শীঘ্রই আমাদের সন্তান আসছে।” এবার দু’ফোটা অশ্রু ওর গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে।
মনে হলো আমি আমার স্ত্রীকে অবহেলা করেছি। আমার উচিৎ ছিল আমার স্ত্রীর সেবা-শশ্রুষা করা। রাতের পর রাত বাইরে কাটিয়ে দেওয়া আমার মোটেই উচিৎ হয়নি, বিশেষ করে যখন ওর গর্ভের নবম মাস চলছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম; ও ডেলিভারি রুমে চলে গেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাথায় আর যন্ত্রণায় কাতর হয়ে থাকল।
আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি মানব জীবনে দুনিয়াবি নানান পরীক্ষা আর পার্থিব দুঃখকষ্ট নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। বললেন, আল্লাহ্ আমাদের জন্য যা কিছু নির্ধারণ করেছেন তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট এবং পরিতৃপ্ত থাকা উচিৎ।
এরপর বললেন, “আপনার ছেলের চোখে গুরুতর রকমের বিকলাঙ্গতা রয়েছে এবং মনে হচ্ছে ওর দৃষ্টিশক্তি নেই।”
অনেক চেষ্টায় অশ্রু সংবরণ করতে করতে মস্তকটা আমার অবনত হয়ে পড়ল… মনে পড়ল বাজারের ঐ অন্ধ ফকিরটার কথা যাকে হুমড়ি খেয়ে ফেলে দিয়ে অন্যদের ফুর্তির খোরাক যোগাচ্ছিলাম।
সুবহানআল্লাহ্ ! আপনি তা-ই পাবেন, যা আপনি অন্যকে দিয়েছেন! কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ভাবতে থাকলাম… বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। মনে পড়ল আমার স্ত্রী আর সন্তানের কথা। ডাক্তারকে তার সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ছুটে গেলাম ওদের দেখবার জন্য। আমার স্ত্রী কিন্তু মোটেই দুঃখিত নয়। ও আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্ধারিত সিদ্ধান্তে বিশ্বাসী… আর তাতেই সন্তুষ্ট। কতবার ও আমাকে বলত মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা না করার জন্য! সে বলতেই থাকত, “পরের নিন্দা করো না…” যাইহোক, আমরা হাসপাতাল থেকে চলে এলাম; সালেম’ও এলো আমাদের সাথে।
বাস্তবে, আমি আমার সন্তানের প্রতি খুব বেশি মনযোগ দিতাম না। এমন ভাব করতাম যেন, ও বাড়িতে নেই। যখন ও জোরে জোরে কাঁদত, তখন আমি ওখান থেকে চলে গিয়ে শোয়ার ঘরে ঘুমাতাম। আমার স্ত্রী ওর অনেক যত্ন করত, ওকে অনেক ভালোবাসতো। আর আমার ব্যাপারে বললে, আমি ওকে অপছন্দ করতাম না, তবে ভালোবাসতেও পারতাম না।
সালেম আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। ও হামাগুড়ি দিতে শিখল; তবে ওর হামাগুড়ি দেওয়াটা ছিল অদ্ভুত ধরনের। বয়স যখন প্রায় একবছর, তখন ও হাঁটতে চেষ্টা করতে লাগল; তখনই ওর পঙ্গুত্ব আমাদের কাছে ধরা পড়ল। এবার ওকে আমার কাছে আরো বড় ধরনের বোঝা মনে হতে লাগল।
সালেমের পর আমাদের উমার এবং খালেদ নামে আরও দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে। কয়েক বছর চলে গেল, সালেম বড় হয়ে উঠল; ওর ভাইয়েরাও বড় হয়ে উঠল। আমার বাড়িতে থাকতে ভালো লাগত না, আমি সবসময় বাড়ির বাইরে বন্ধুদের সাথে থাকতাম… বাস্তবে, আমি ছিলাম তাদের (বন্ধুদের) হাতে একটা খেলনা [দরকার লাগলেই ওরা আমাকে ফুর্তির জন্য ব্যবহার করত]।
আমার সংশোধনের ব্যাপারে আমার স্ত্রী কখনই হাল ছেড়ে দেয়নি। ও সবসময়ই আমার হেদায়াতের জন্য দো’আ করত। আমার লাগামহীন বেপরোয়া আচরণে ও কখনোই রাগ করত না। তবে সালেমের প্রতি আমার অবহেলা কিংবা ওর অন্য ভাইদের প্রতি আমার বেখেয়ালী ভাব দেখলে ও খুব মন খারাপ করত। সালেম বড় হয়ে উঠল। সাথে সাথে আমার দুঃশ্চিন্তাও বাড়লো। আমার স্ত্রী ওকে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে বলল; তবে কথাটি আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পেল না।
কীভাবে যে বছরগুলো কেটে গেল টেরই পেলাম না। আমার প্রতিটা দিনই কাটত একই ভাবে। খাওয়া, ঘুমানো, কাজ করা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। একদিন শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠলাম বেলা ১১ টায়। ওই দিন আগেই ওঠা হলো। একটা দাওয়াত ছিল; তাই কাপড়-চোপড় পড়ে, গায়ে খুশবু লাগিয়ে বের হচ্ছিলাম। কেবল শোবার ঘরটা পেরিয়েছি.. অমনি সালেমের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়ালাম — ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে!! শিশু অবস্থার পর এই প্রথম ওকে কাঁদতে দেখলাম। বিশটা বছর পেরিয়ে গেছে, আমি ওর দিকে নজর দিইনি। এবারও পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলাম, পারলাম না…ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম যখন ওর মাকে ও ডাকছিল। ওর দিকে ফিরে আরেকটু কাছে গেলাম।
“সালেম! কাঁদছ কেন?” আমি জিজ্ঞাস করলাম।
আমার কণ্ঠ শুনে ওর কান্না থেমে গেল। আমি ওর খুব কাছাকাছি আছি টের পেয়ে ছোট্ট দু’খানা হাত দিয়ে চারপাশ হাতড়াতে লাগল। কী হয়েছে ওর? বুঝতে পারলাম ও আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে! যেন বলছে, “এতোদিনে তোমার সময় হয়েছে আমাকে খেয়াল করার? বিগত দশ বছর কোথায় ছিলে?” ও সরে যেতে থাকল। ওর পেছন পেছন আমি ওর ঘর পর্যন্ত গেলাম। প্রথমে বলতে চায়নি ও কেন কাঁদছিল। আমি একটু নরম হওয়ার চেষ্টা করলাম… সালেম বলতে লাগল কেন ও কাঁদছিল। আমি শুনছিলাম আর আমার ভেতর কাঁপছিল।
আপনারা কি জানেন, ও কেন কাঁদছিল?! ওর ভাই উমার — যে ওকে মসজিদে নিয়ে যায় — তখনও বাড়ি ফেরেনি। আজ জুম’আর দিন; সালেমর ভয়, ও প্রথম কাতারে হয়তো জায়গা পাবে না। ও উমার’কে ডেকেছে… ওর মাকেও ডেকেছে… কারও কোনো সাড়া নেই — এজন্যই সে কাঁদছে। ওর পাথর চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর পরের কথাগুলো আমার আর প্রাণে সইলো না।
মুখের উপর হাত রেখে ওকে থামালাম আর জিজ্ঞেস করলাম, “সালেম, তুমি কি এ জন্যই কাঁদছ?”
ও বলল, “হ্যাঁ।”
আমি বন্ধুদের কথা ভুলে গেলাম, পার্টির কথাও আর মনে থাকল না।
আমি ওকে বললাম, “দুঃখ পেয়ো না, সালেম। তুমি কি জানো, আজ তোমাকে কে মসজিদে নিয়ে যাবে?”
“নিশ্চয় উমার”, সে বলল, “…কিন্তু ও তো এখনও আসেনি।”
“না”, আমি বললাম, “আজ আমিই তোমাকে নিয়ে যাব।”
সালেম হতভম্ভ হয়ে গেল… ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও ভাবল, আমি ওর সাথে ঠাট্টা করছি। চোখে পানি এসে গেল; আবার কাঁদতে লাগল ও। নিজ হাত দিয়ে চোখের পানি ফোঁটা মুছে দিয়ে ওর হাত ধরলাম। চাইলাম গাড়িতে করেই ওকে মসজিদে নিয়ে যাব। কিন্তু ও রাজি হলো না। বলল, “মসজিদ তো কাছেই… আমি হেঁটে যেতে চাই।” হ্যাঁ, আল্লাহ্র কসম, ও আমাকে একথাই বলল।
মনে পড়ে না কবে শেষবারের মতো মসজিদে প্রবেশ করেছিলাম। তবে জীবন থেকে অবহেলায় হারিয়ে দেওয়া বিগত বছরগুলোর কথা পড়তেই মনের ভেতর ভয় আর অনুতাপের উদয় হলো। মসজিদ মুসল্লিতে ভরা। তারপরও আমি সালেমর জন্য প্রথম কাতারে একটু জায়গা খুঁজে নিলাম। একসাথেই জুম ‘আর খুৎবা শুনলাম; ও আমার পাশেই সালাত আদায় করল। সত্যি বলতে, আমিই ওর পাশে সালাত আদায় করলাম, ও আমার পাশে নয়।
সালাত সমাপ্ত হলে সালেম আমার কাছে একখানা কোরআন চাইল। আমি তো অবাক! ভাবলাম ও কী করে পড়বে, ও তো দেখতে পায় না। বলতে গেলে ওর কথায় কানই দিলাম না। কিন্তু কষ্ট পেতে পারে এই ভয়ে তাকে একখানা কুর’আন ধরিয়ে দিলাম। ও আমাকে সূরা আল-কাহ্ফ খুলে দিতে বলল। আমি পাতা উল্টাতে লাগলাম। খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সূচীপত্র দেখতে থাকলাম। ও কুর’আন খানা আমার কাছ থেকে নিয়ে ওর সামনে রেখে চোখ বন্ধ করেই সূরাটি তেলাওয়াত করতে শুরু করল… সুবহানাল্লাহ! গোটা সূরা’টাই ওর মুখস্ত।
নিজের কথা ভেবে খুবই লজ্জিত হলাম। আমিও একখানা কুর’আন তুলে নিলাম…বুঝতে পারলাম সারা শরীর আমার কাঁপছে… পড়া শুরু করলাম… পড়তেই থাকলাম। আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলাম। তাঁর কাছে প্রার্থনা করলাম, “ইয়া আল্লাহ্ ! আমাকে সহজ সরল পথ দেখাও।” আর সইতে পারলাম না… ছোট বাচ্চার মতো কেঁদে ফেললাম। মসজিদে তখনও অনেক লোক সুন্নাত আদায় করছেন। তাদের উপস্থিতি আমাকে একটু বিব্রত করল, আমি অশ্রু সংবরণ করলাম। আমার কান্না তখন চাপা দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিয়েছে। শুধু টের পেলাম, একখানা কচি হাত আমার মুখখানা ছুঁতে চাইছে আর আমার ভেজা চোখ দু’টো মুছে দিচ্ছে। হ্যাঁ, ও আমার সালেম! আমি ওকে বুকে টেনে নিলাম… ওর দিকে তাকিয়ে নিজেকে বললাম… অন্ধ তো আমিই, অন্ধ তুমি না। আমি অন্ধ না হলে কি আর ওসব পথভ্রষ্টদের পেছনে ছুটে বেড়াই, যারা আমাকে জাহান্নামের আগুনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে?
সালাত শেষ করে আমরা বাড়ি ফিরলাম। আমার স্ত্রী সালেমের জন্য অত্যন্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর দুঃশ্চিন্তা অশ্রু (আনন্দের) হয়ে ঝরল যখন দেখল আমিও সালেমের সাথে জুম’আর সালাত আদায় করেছি।
সেদিনের পর থেকে আমি আর কখনো মসজিদে জামা’আতের সাথে সালাত বাদ দিইনি। আমি আমার খারাপ বন্ধুদের ত্যাগ করেছি। বন্ধু করেছি মসজিদের ওই সৎনিষ্ঠ লোকগুলোকে। তাদের সাথে আমিও পেয়েছি ঈমানের অমৃত স্বাদ। কী আমাকে আমার জীবন সম্পর্কে ভুলিয়ে রেখেছিল তাও তাদের থেকে জেনেছি, শিখেছি। বিত্র সালাতের পরে যে দীনি আলোচনা হতো আমি তাও কখনো আর বাদ দিতাম না। মাসে পুরো কুর’আন কয়েকবার করে পড়ে শেষ করতে থাকলাম। মানুষের কুৎসা রটিয়ে আর ঠাট্টা তামাশা করে নিজের যে জিহ্বা টাকে কলুষিত করেছিলাম, তা এখন সদায় আল্লাহ্র স্মরণে সিক্ত রাখলাম যাতে আল্লাহ্ আমাকে মাফ করে দেন।
একদিন আমার কিছু দ্বীনি, ধার্মিক বন্ধুরা মিলে দূরে এক জায়গায় দা’ওয়াতের কাজে যাওয়ার মনস্থির করল। তাদের সাথে যাওয়ার ব্যাপারে আমার একটু অনাগ্রহ ছিল। আমি ইস্তেখারাহ সালাত আদায় করলাম, আমার স্ত্রীর সাথেও পরামর্শ করলাম। ভেবেছিলাম ও নিষেধ করবে যেতে… কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা! কারন এতোদিন পাপের কারনে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, অথচ ভুলেও ওকে একবার জিজ্ঞেস করিনি। আজ যখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও ভীষণ আনন্দিত হলো, এমনকি আমাকে উৎসাহিতও করল। আমি সালেমের কাছে গেলাম, বললাম আমি সফরে যাচ্ছি। শুনে ওর পাথর চোখদুটো ছলছল করে উঠল, আর কচি বাহুতে আমাকে জড়িয়ে নিলো…
বাড়ির বাইরে থাকলাম প্রায় সাড়ে তিন মাস। এই সময়টাতে যখনই সুযোগ পেয়েছি আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানদের সাথে ফোনে কথা বলেছি। ওদের জন্য আমার খুব খারাপ লাগত… কি খারাপই না লাগত সালেমের জন্য!! ওর কণ্ঠটা শোনার ভীষণ ইচ্ছা জাগত… শুধু ওর সাথেই কথা হয়নি সফরের ঐ সময়টায়। ফোন করলেই শুনতাম হয় স্কুলে নয়তো মসজিদে আছে। যতবারই বলতাম ওর কথা আমার ভীষণ মনে পড়ে, ওর জন্য আমার মন খারাপ করে, ততবারই আমার স্ত্রী খুশিতে হাসত। কিন্তু শেষবার ও হাসেনি। ওর কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন আলাদা ছিল শেষবার। ওকে বললাম, “সালেমকে আমার সালাম দিও”, ও শুধু বলল, “ইনশাআল্লাহ্,” তারপর চুপ হয়ে গেল।
অবশেষে বাড়ি ফিরলাম। দরজায় করাঘাত করে দাঁড়িয়ে আছি সালেম এসে আমার দরজাটা খুলে দেবে এই আশায়। কিন্তু আশ্চর্য হলাম আমার প্রায় চার বছরের ছেলে খালেদকে দেখে। ওকে কোলে তুলে নিতেই ও নালিশের সুরে বলে উঠল, “বাবা! বাবা!”। বাড়িতে ঢুকতেই কেন জানি না, ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় চাইলাম…আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম… ওর চেহারাটা কেমন যেন লাগছে। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভান করছে ও। ভালো করে তাকিয়ে বললাম, “কি হয়েছে তোমার?” ও বলল, “কিছু নাহ।” হঠাৎ সালেমের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, “সালেম কোথায়?” ওর মাথাটা নিচু হয়ে গেল; কোন উত্তর দিলনা ও। ও কাঁদছে…
“সালেম! কোথায় আমার সালেম?” আমি চিৎকার করে উঠলাম।
ঠিক তখনই আমার ছোট ছেলে খালেদ ওর শিশু সুলভ ভাষায় বলে উঠল,
“বাবা… থালেম জান্নাতে তলে গেতে… আল্লাহ্র কাথে…” (সালেম জান্নাতে চলে গেছে… আল্লাহ্র কাছে…)
আমার স্ত্রী আর সইতে পারল না। ও কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরে জানলাম, আমি আসার দুই সপ্তাহ আগে সালেমের জ্বর হয়েছিল। আমার স্ত্রী ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। জ্বর আস্তে আস্তে ভয়ানক রূপ ধারন করল…অবশেষে জ্বর ছেড়ে গেল… সাথে আমার সালেমের প্রাণ পাখিটাও…
আর তাই, যদি দুনিয়া সমান বিপদ আসে আপনার উপর, যদি তা বইবার সাধ্য না থাকে, তো আল্লাহ্কে ডাকুন, “ইয়া আল্লাহ্!” যদি পথ হারিয়ে ফেলেন কিংবা যদি পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়, যদি পাল ছিঁড়ে যায়, যদি আশার প্রদীপ নিভে যায়, তো আল্লাহ্কে ডাকুন, “ইয়া আল্লাহ্!।”
আল্লাহ্ চেয়েছিলেন সন্তানের মৃত্যুর আগেই পিতাকে সন্তানের মাধ্যমে হেদায়াত দান করতে। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন কতই না দয়ালু!
“অনেক মহান কর্ম নিয়্যতের কারনে তুচ্ছ হয়ে যায়, আবার অনেক নগণ্য কর্ম নিয়্যত গুণে মহান হয়ে ওঠে…”
(আবদুল্লাহ ইবন মুবারাক)
আমার স্ত্রী যখন প্রথম সন্তানের মা হলো, তখন আমার বয়স তিরিশের বেশি হবে না। আজও আমার সেই রাতটার কথা মনে আছে।
প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সেদিনও সারারাত বন্ধুদের সাথে বাড়ির বাইরে ছিলাম। সারাটা রাত কেটেছিল যতসব নিরর্থক আর অসার কথাবার্তা, পরনিন্দা, পরচর্চা এবং লোকজনকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা আর মজা করে। সবাইকে হাসানোর কাজটা মুলত আমিই করছিলাম। আমি অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছিলাম আর তাই শুনে বন্ধুরা সব হেসেই খোশ হচ্ছিল। মনে আছে, সেই রাতে আমি ওদের অনেক হাসিয়ে ছিলাম। মানুষের কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি খুব ভাল নকল করতে পারি আমি । যাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করি ওর মত কণ্ঠ করে কথা বলতে থাকি। ওর হেনস্তা না হওয়া পর্যন্ত আর ছাড়াছাড়ি নেই। আমার ঠাট্টা মশকরার ছোবল থেকে রেহাই পায় না কেউই, এমনকি আমার বন্ধুরাও না। এর থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। আমার মনে আছে, সেদিন রাতে বাজারে ভিক্ষা করতে দেখা এক অন্ধ ফকিরকে নিয়েও মশকরা করেছিলাম আমি। তারচেয়েও খারাপ কাজটি করেছিলাম আমার নিজের পা’টা ওনার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে আর তাতে বেচারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। কী করবেন বুঝতে না পেরে অন্ধদৃষ্টি নিয়ে বেচারি চারপাশে শুধু মুখ ফেরাচ্ছিলেন।
আমি যথারীতি দেরি করে বাড়ি ফিরে দেখলাম আমার স্ত্রী আমার বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। ওর অবস্থা তখন ভয়ানক।
আমাকে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, “রাশেদ… কোথায় ছিলে তুমি?”
“চাঁদের দেশে গিয়েছিলাম বুঝি?” ব্যঙ্গোক্তি করে বললাম, “কোথায় থাকব আবার, বন্ধুদের সাথে ছিলাম।”
ওকে খুবই অবসন্ন দেখাচ্ছিল। চোখের দু’ফোটা অশ্রু গোপন করে ও বলল, “রাশেদ, আমি আর পারছিনা। মনে হয় খুব শীঘ্রই আমাদের সন্তান আসছে।” এবার দু’ফোটা অশ্রু ওর গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে।
মনে হলো আমি আমার স্ত্রীকে অবহেলা করেছি। আমার উচিৎ ছিল আমার স্ত্রীর সেবা-শশ্রুষা করা। রাতের পর রাত বাইরে কাটিয়ে দেওয়া আমার মোটেই উচিৎ হয়নি, বিশেষ করে যখন ওর গর্ভের নবম মাস চলছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম; ও ডেলিভারি রুমে চলে গেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাথায় আর যন্ত্রণায় কাতর হয়ে থাকল।
আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি মানব জীবনে দুনিয়াবি নানান পরীক্ষা আর পার্থিব দুঃখকষ্ট নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। বললেন, আল্লাহ্ আমাদের জন্য যা কিছু নির্ধারণ করেছেন তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট এবং পরিতৃপ্ত থাকা উচিৎ।
এরপর বললেন, “আপনার ছেলের চোখে গুরুতর রকমের বিকলাঙ্গতা রয়েছে এবং মনে হচ্ছে ওর দৃষ্টিশক্তি নেই।”
অনেক চেষ্টায় অশ্রু সংবরণ করতে করতে মস্তকটা আমার অবনত হয়ে পড়ল… মনে পড়ল বাজারের ঐ অন্ধ ফকিরটার কথা যাকে হুমড়ি খেয়ে ফেলে দিয়ে অন্যদের ফুর্তির খোরাক যোগাচ্ছিলাম।
সুবহানআল্লাহ্ ! আপনি তা-ই পাবেন, যা আপনি অন্যকে দিয়েছেন! কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ভাবতে থাকলাম… বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। মনে পড়ল আমার স্ত্রী আর সন্তানের কথা। ডাক্তারকে তার সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ছুটে গেলাম ওদের দেখবার জন্য। আমার স্ত্রী কিন্তু মোটেই দুঃখিত নয়। ও আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্ধারিত সিদ্ধান্তে বিশ্বাসী… আর তাতেই সন্তুষ্ট। কতবার ও আমাকে বলত মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা না করার জন্য! সে বলতেই থাকত, “পরের নিন্দা করো না…” যাইহোক, আমরা হাসপাতাল থেকে চলে এলাম; সালেম’ও এলো আমাদের সাথে।
বাস্তবে, আমি আমার সন্তানের প্রতি খুব বেশি মনযোগ দিতাম না। এমন ভাব করতাম যেন, ও বাড়িতে নেই। যখন ও জোরে জোরে কাঁদত, তখন আমি ওখান থেকে চলে গিয়ে শোয়ার ঘরে ঘুমাতাম। আমার স্ত্রী ওর অনেক যত্ন করত, ওকে অনেক ভালোবাসতো। আর আমার ব্যাপারে বললে, আমি ওকে অপছন্দ করতাম না, তবে ভালোবাসতেও পারতাম না।
সালেম আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। ও হামাগুড়ি দিতে শিখল; তবে ওর হামাগুড়ি দেওয়াটা ছিল অদ্ভুত ধরনের। বয়স যখন প্রায় একবছর, তখন ও হাঁটতে চেষ্টা করতে লাগল; তখনই ওর পঙ্গুত্ব আমাদের কাছে ধরা পড়ল। এবার ওকে আমার কাছে আরো বড় ধরনের বোঝা মনে হতে লাগল।
সালেমের পর আমাদের উমার এবং খালেদ নামে আরও দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে। কয়েক বছর চলে গেল, সালেম বড় হয়ে উঠল; ওর ভাইয়েরাও বড় হয়ে উঠল। আমার বাড়িতে থাকতে ভালো লাগত না, আমি সবসময় বাড়ির বাইরে বন্ধুদের সাথে থাকতাম… বাস্তবে, আমি ছিলাম তাদের (বন্ধুদের) হাতে একটা খেলনা [দরকার লাগলেই ওরা আমাকে ফুর্তির জন্য ব্যবহার করত]।
আমার সংশোধনের ব্যাপারে আমার স্ত্রী কখনই হাল ছেড়ে দেয়নি। ও সবসময়ই আমার হেদায়াতের জন্য দো’আ করত। আমার লাগামহীন বেপরোয়া আচরণে ও কখনোই রাগ করত না। তবে সালেমের প্রতি আমার অবহেলা কিংবা ওর অন্য ভাইদের প্রতি আমার বেখেয়ালী ভাব দেখলে ও খুব মন খারাপ করত। সালেম বড় হয়ে উঠল। সাথে সাথে আমার দুঃশ্চিন্তাও বাড়লো। আমার স্ত্রী ওকে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে বলল; তবে কথাটি আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পেল না।
কীভাবে যে বছরগুলো কেটে গেল টেরই পেলাম না। আমার প্রতিটা দিনই কাটত একই ভাবে। খাওয়া, ঘুমানো, কাজ করা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। একদিন শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠলাম বেলা ১১ টায়। ওই দিন আগেই ওঠা হলো। একটা দাওয়াত ছিল; তাই কাপড়-চোপড় পড়ে, গায়ে খুশবু লাগিয়ে বের হচ্ছিলাম। কেবল শোবার ঘরটা পেরিয়েছি.. অমনি সালেমের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়ালাম — ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে!! শিশু অবস্থার পর এই প্রথম ওকে কাঁদতে দেখলাম। বিশটা বছর পেরিয়ে গেছে, আমি ওর দিকে নজর দিইনি। এবারও পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলাম, পারলাম না…ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম যখন ওর মাকে ও ডাকছিল। ওর দিকে ফিরে আরেকটু কাছে গেলাম।
“সালেম! কাঁদছ কেন?” আমি জিজ্ঞাস করলাম।
আমার কণ্ঠ শুনে ওর কান্না থেমে গেল। আমি ওর খুব কাছাকাছি আছি টের পেয়ে ছোট্ট দু’খানা হাত দিয়ে চারপাশ হাতড়াতে লাগল। কী হয়েছে ওর? বুঝতে পারলাম ও আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে! যেন বলছে, “এতোদিনে তোমার সময় হয়েছে আমাকে খেয়াল করার? বিগত দশ বছর কোথায় ছিলে?” ও সরে যেতে থাকল। ওর পেছন পেছন আমি ওর ঘর পর্যন্ত গেলাম। প্রথমে বলতে চায়নি ও কেন কাঁদছিল। আমি একটু নরম হওয়ার চেষ্টা করলাম… সালেম বলতে লাগল কেন ও কাঁদছিল। আমি শুনছিলাম আর আমার ভেতর কাঁপছিল।
আপনারা কি জানেন, ও কেন কাঁদছিল?! ওর ভাই উমার — যে ওকে মসজিদে নিয়ে যায় — তখনও বাড়ি ফেরেনি। আজ জুম’আর দিন; সালেমর ভয়, ও প্রথম কাতারে হয়তো জায়গা পাবে না। ও উমার’কে ডেকেছে… ওর মাকেও ডেকেছে… কারও কোনো সাড়া নেই — এজন্যই সে কাঁদছে। ওর পাথর চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর পরের কথাগুলো আমার আর প্রাণে সইলো না।
মুখের উপর হাত রেখে ওকে থামালাম আর জিজ্ঞেস করলাম, “সালেম, তুমি কি এ জন্যই কাঁদছ?”
ও বলল, “হ্যাঁ।”
আমি বন্ধুদের কথা ভুলে গেলাম, পার্টির কথাও আর মনে থাকল না।
আমি ওকে বললাম, “দুঃখ পেয়ো না, সালেম। তুমি কি জানো, আজ তোমাকে কে মসজিদে নিয়ে যাবে?”
“নিশ্চয় উমার”, সে বলল, “…কিন্তু ও তো এখনও আসেনি।”
“না”, আমি বললাম, “আজ আমিই তোমাকে নিয়ে যাব।”
সালেম হতভম্ভ হয়ে গেল… ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও ভাবল, আমি ওর সাথে ঠাট্টা করছি। চোখে পানি এসে গেল; আবার কাঁদতে লাগল ও। নিজ হাত দিয়ে চোখের পানি ফোঁটা মুছে দিয়ে ওর হাত ধরলাম। চাইলাম গাড়িতে করেই ওকে মসজিদে নিয়ে যাব। কিন্তু ও রাজি হলো না। বলল, “মসজিদ তো কাছেই… আমি হেঁটে যেতে চাই।” হ্যাঁ, আল্লাহ্র কসম, ও আমাকে একথাই বলল।
মনে পড়ে না কবে শেষবারের মতো মসজিদে প্রবেশ করেছিলাম। তবে জীবন থেকে অবহেলায় হারিয়ে দেওয়া বিগত বছরগুলোর কথা পড়তেই মনের ভেতর ভয় আর অনুতাপের উদয় হলো। মসজিদ মুসল্লিতে ভরা। তারপরও আমি সালেমর জন্য প্রথম কাতারে একটু জায়গা খুঁজে নিলাম। একসাথেই জুম ‘আর খুৎবা শুনলাম; ও আমার পাশেই সালাত আদায় করল। সত্যি বলতে, আমিই ওর পাশে সালাত আদায় করলাম, ও আমার পাশে নয়।
সালাত সমাপ্ত হলে সালেম আমার কাছে একখানা কোরআন চাইল। আমি তো অবাক! ভাবলাম ও কী করে পড়বে, ও তো দেখতে পায় না। বলতে গেলে ওর কথায় কানই দিলাম না। কিন্তু কষ্ট পেতে পারে এই ভয়ে তাকে একখানা কুর’আন ধরিয়ে দিলাম। ও আমাকে সূরা আল-কাহ্ফ খুলে দিতে বলল। আমি পাতা উল্টাতে লাগলাম। খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সূচীপত্র দেখতে থাকলাম। ও কুর’আন খানা আমার কাছ থেকে নিয়ে ওর সামনে রেখে চোখ বন্ধ করেই সূরাটি তেলাওয়াত করতে শুরু করল… সুবহানাল্লাহ! গোটা সূরা’টাই ওর মুখস্ত।
নিজের কথা ভেবে খুবই লজ্জিত হলাম। আমিও একখানা কুর’আন তুলে নিলাম…বুঝতে পারলাম সারা শরীর আমার কাঁপছে… পড়া শুরু করলাম… পড়তেই থাকলাম। আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলাম। তাঁর কাছে প্রার্থনা করলাম, “ইয়া আল্লাহ্ ! আমাকে সহজ সরল পথ দেখাও।” আর সইতে পারলাম না… ছোট বাচ্চার মতো কেঁদে ফেললাম। মসজিদে তখনও অনেক লোক সুন্নাত আদায় করছেন। তাদের উপস্থিতি আমাকে একটু বিব্রত করল, আমি অশ্রু সংবরণ করলাম। আমার কান্না তখন চাপা দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিয়েছে। শুধু টের পেলাম, একখানা কচি হাত আমার মুখখানা ছুঁতে চাইছে আর আমার ভেজা চোখ দু’টো মুছে দিচ্ছে। হ্যাঁ, ও আমার সালেম! আমি ওকে বুকে টেনে নিলাম… ওর দিকে তাকিয়ে নিজেকে বললাম… অন্ধ তো আমিই, অন্ধ তুমি না। আমি অন্ধ না হলে কি আর ওসব পথভ্রষ্টদের পেছনে ছুটে বেড়াই, যারা আমাকে জাহান্নামের আগুনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে?
সালাত শেষ করে আমরা বাড়ি ফিরলাম। আমার স্ত্রী সালেমের জন্য অত্যন্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর দুঃশ্চিন্তা অশ্রু (আনন্দের) হয়ে ঝরল যখন দেখল আমিও সালেমের সাথে জুম’আর সালাত আদায় করেছি।
সেদিনের পর থেকে আমি আর কখনো মসজিদে জামা’আতের সাথে সালাত বাদ দিইনি। আমি আমার খারাপ বন্ধুদের ত্যাগ করেছি। বন্ধু করেছি মসজিদের ওই সৎনিষ্ঠ লোকগুলোকে। তাদের সাথে আমিও পেয়েছি ঈমানের অমৃত স্বাদ। কী আমাকে আমার জীবন সম্পর্কে ভুলিয়ে রেখেছিল তাও তাদের থেকে জেনেছি, শিখেছি। বিত্র সালাতের পরে যে দীনি আলোচনা হতো আমি তাও কখনো আর বাদ দিতাম না। মাসে পুরো কুর’আন কয়েকবার করে পড়ে শেষ করতে থাকলাম। মানুষের কুৎসা রটিয়ে আর ঠাট্টা তামাশা করে নিজের যে জিহ্বা টাকে কলুষিত করেছিলাম, তা এখন সদায় আল্লাহ্র স্মরণে সিক্ত রাখলাম যাতে আল্লাহ্ আমাকে মাফ করে দেন।
একদিন আমার কিছু দ্বীনি, ধার্মিক বন্ধুরা মিলে দূরে এক জায়গায় দা’ওয়াতের কাজে যাওয়ার মনস্থির করল। তাদের সাথে যাওয়ার ব্যাপারে আমার একটু অনাগ্রহ ছিল। আমি ইস্তেখারাহ সালাত আদায় করলাম, আমার স্ত্রীর সাথেও পরামর্শ করলাম। ভেবেছিলাম ও নিষেধ করবে যেতে… কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা! কারন এতোদিন পাপের কারনে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, অথচ ভুলেও ওকে একবার জিজ্ঞেস করিনি। আজ যখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও ভীষণ আনন্দিত হলো, এমনকি আমাকে উৎসাহিতও করল। আমি সালেমের কাছে গেলাম, বললাম আমি সফরে যাচ্ছি। শুনে ওর পাথর চোখদুটো ছলছল করে উঠল, আর কচি বাহুতে আমাকে জড়িয়ে নিলো…
বাড়ির বাইরে থাকলাম প্রায় সাড়ে তিন মাস। এই সময়টাতে যখনই সুযোগ পেয়েছি আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানদের সাথে ফোনে কথা বলেছি। ওদের জন্য আমার খুব খারাপ লাগত… কি খারাপই না লাগত সালেমের জন্য!! ওর কণ্ঠটা শোনার ভীষণ ইচ্ছা জাগত… শুধু ওর সাথেই কথা হয়নি সফরের ঐ সময়টায়। ফোন করলেই শুনতাম হয় স্কুলে নয়তো মসজিদে আছে। যতবারই বলতাম ওর কথা আমার ভীষণ মনে পড়ে, ওর জন্য আমার মন খারাপ করে, ততবারই আমার স্ত্রী খুশিতে হাসত। কিন্তু শেষবার ও হাসেনি। ওর কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন আলাদা ছিল শেষবার। ওকে বললাম, “সালেমকে আমার সালাম দিও”, ও শুধু বলল, “ইনশাআল্লাহ্,” তারপর চুপ হয়ে গেল।
অবশেষে বাড়ি ফিরলাম। দরজায় করাঘাত করে দাঁড়িয়ে আছি সালেম এসে আমার দরজাটা খুলে দেবে এই আশায়। কিন্তু আশ্চর্য হলাম আমার প্রায় চার বছরের ছেলে খালেদকে দেখে। ওকে কোলে তুলে নিতেই ও নালিশের সুরে বলে উঠল, “বাবা! বাবা!”। বাড়িতে ঢুকতেই কেন জানি না, ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় চাইলাম…আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম… ওর চেহারাটা কেমন যেন লাগছে। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভান করছে ও। ভালো করে তাকিয়ে বললাম, “কি হয়েছে তোমার?” ও বলল, “কিছু নাহ।” হঠাৎ সালেমের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, “সালেম কোথায়?” ওর মাথাটা নিচু হয়ে গেল; কোন উত্তর দিলনা ও। ও কাঁদছে…
“সালেম! কোথায় আমার সালেম?” আমি চিৎকার করে উঠলাম।
ঠিক তখনই আমার ছোট ছেলে খালেদ ওর শিশু সুলভ ভাষায় বলে উঠল,
“বাবা… থালেম জান্নাতে তলে গেতে… আল্লাহ্র কাথে…” (সালেম জান্নাতে চলে গেছে… আল্লাহ্র কাছে…)
আমার স্ত্রী আর সইতে পারল না। ও কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরে জানলাম, আমি আসার দুই সপ্তাহ আগে সালেমের জ্বর হয়েছিল। আমার স্ত্রী ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। জ্বর আস্তে আস্তে ভয়ানক রূপ ধারন করল…অবশেষে জ্বর ছেড়ে গেল… সাথে আমার সালেমের প্রাণ পাখিটাও…
আর তাই, যদি দুনিয়া সমান বিপদ আসে আপনার উপর, যদি তা বইবার সাধ্য না থাকে, তো আল্লাহ্কে ডাকুন, “ইয়া আল্লাহ্!” যদি পথ হারিয়ে ফেলেন কিংবা যদি পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়, যদি পাল ছিঁড়ে যায়, যদি আশার প্রদীপ নিভে যায়, তো আল্লাহ্কে ডাকুন, “ইয়া আল্লাহ্!।”
আল্লাহ্ চেয়েছিলেন সন্তানের মৃত্যুর আগেই পিতাকে সন্তানের মাধ্যমে হেদায়াত দান করতে। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন কতই না দয়ালু!
“অনেক মহান কর্ম নিয়্যতের কারনে তুচ্ছ হয়ে যায়, আবার অনেক নগণ্য কর্ম নিয়্যত গুণে মহান হয়ে ওঠে…”
(আবদুল্লাহ ইবন মুবারাক)
আজকে একটা সম্ভাব্য প্রেমের ধ্বংস দেখতে পেলাম !!
অফিস থেকে ফিরছিলাম, রিকসা থেকে যেখানে নামলাম, সেখানে অচেনা দু’টো ছেলে আর একটা মেয়ে দাঁড়ানো, একটা রিকসা দাঁড়ানো পাশে। সেই মেয়েটার বান্ধবীকে সম্ভবত একটা’ ছেলে ‘লাইক’ করে, সেই কথাটা বন্ধুটা মেয়েটাকে বলছিল বলে বুঝলাম। মেয়েটা কিছু একটা উত্তর দিলো। পরে শুনলাম বন্ধুটি মেয়েটিকে বলল, ”ও কি ফ্রেন্ডশিপ টাইপের রিলেশনও করবেনা?”। মেয়েটা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল, “তোমরা রাগ কইরো না, ঠিকাছে? ভালো থাইকোওও, বাআআই!! ” (একটু সুর করে)
বেচারা প্রেমিক ছেলেটা কষ্টে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ানো। সারাদিন কাজের চাপে সময় কাটানোর পর দিনশেষে এই কষ্ট পাওয়ার ঘটনা দেখে আমিও স্তব্ধ। বন্ধুটি সেই রোমিও প্রেমিককে ঠেলে রিকশায় তোলা পর্যন্ত ওদের দেখলাম। রিকসা রওনা হবার পর আমিও একটু বিষণ্ণ মন নিয়ে হাঁটা ধরলাম। এরকম করে দেখা অনেক দৃশ্য মনে পড়ে গেলো। এমন কত প্রেমের শুরু-শেষ দেখলাম এইটুকু জীবনেই!
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘোরা স্কুল-কলেজের এই ছেলে মেয়েগুলোর জীবনে প্রেম একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। এটা আজ থেকে দশ বছর আগে ছিল না। বিলবোর্ড, মিউজিক ভিডিও, নাটক-সিরিয়াল, শাহরুখ খান-শাহেদ কাপুর, কারিনা-প্রিয়াঙ্কা-রনবীরদের সিনেমা দেখে প্রেম করাটাকে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় কাজ বানিয়ে ফেলেছে। তাই যেকোনো মেয়ে দেখলেই তাদের নিজেদের রোমিও বানাতে ইচ্ছে হয়। আমার ভাইবোনদের কাছে শুনতে পাই, কলেজে বা ভার্সিটিতে ক্লাসের কোন মেয়ে (যে কিনা প্রেম করেনা) পেলেই সবাই তাকে ‘অফার’ দিয়ে বসে। এই আতঙ্কে অনেক মেয়ে নিজেকে ‘ইন এ রিলেশনশিপ’ দেখিয়ে থাকে!!
স্বভাবগতভাবে কোমল আর কিছুটা ‘ভদ্র’ ছেলেরা দুঃখ পায় এবং ছ্যাঁকা খেয়ে অনেক কাজে অমনোযোগী হয়ে যায়। আমার অনেক বন্ধুরা সেই সময়েই সিগারেট ধরে “দুইডা টান” দিয়েছিলো আর সেখান থেকেই জীবনের মতন শুরু হয়ে যায়।
অন্যদিকে, যেসব ছেলের স্বভাবে ছোট থেকেই কোমলতা বর্জিত হয়ে গেছে, ছোটবেলা থেকেই যারা প্রয়োজনীয় পারিবারিক শিক্ষা কম পেয়ে বড় হয়েছে, তারা প্রেম করতে না চাওয়া সেই মেয়ের পিছু ছাড়েই না। মেয়েটা এই অফারকে ফিরিয়ে দিলেও ‘প্রেমের নেশায় কাতর’ নাছোড়বান্দা ছেলেটা ক্রমাগতভাবে ফোনে, ক্লাসে, রাস্তায়, ফেসবুকে মেয়েটিকে ফলো করার চেষ্টা করতে থাকে। আসলে এটাকে ‘বিরক্ত’ করা বলাটাই সঠিক হবে। এই বিরক্ত করার স্কেল যেসব ছেলে যত বেশি নোংরা আর পশু তাদের কাছে ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়। আর বখে যাওয়া ছেলেরা তখন “জোর করে” ভালোবাসা আদায়ে অনেক মেয়েরই ক্ষতি করতে চায় — যা কিনা স্বাভাবিক প্রাণীজ গুণাবলী। এই প্রাণী থেকে মানুষ হতে চেষ্টা করতে হয়।
আর সমাজের আধুনিকা ইয়ো-টাইপের মেয়ে অথবা পরিস্থিতির শিকারে পড়ে মেয়েরা এই অফার গ্রহণ করে, প্রেম খেলা শুরু হয়। স্কুল কলেজের বাইরে রাস্তার উপরে, ফাস্ট-ফুডের দোকানে, বাসের কাউন্টারের সামনে, কোন পার্কে বা বসুন্ধরা সিটিতে তাদের একসাথে দেখা যায়। প্রচুর ফোনালাপ শুরু হয় — কী খেয়েছ, তুমি কী পছন্দ করো, তোমার স্বপ্ন কী, তুমি কোথায় বেড়াতে যেতে চাও, তোমার কোন রঙ পছন্দ — এইসব বলে এফএনএফ নাম্বারের ব্যাপক উসুল করা হয়। জীবনের সমস্ত কথা এক দুই সপ্তাহেই বলা শেষ হয়ে যায়। তারপর ছেলেটা যদি উত্তম চরিত্রের না হয়, আর কোন একটা আদিম চাওয়া পূরণ করতে চাইলে তা না দেয়ায় মেয়েটা পুনরায় আবার দোষী হয় এবং এতকিছুর পরেও ছেলেটা তার উপরে খেপে যায়। মেয়েটা এমন অবস্থায় পেছানোর চেষ্টা করে কিন্তু অনেক দিনের অনেক অন্তরঙ্গতায় বাধা পড়ে সেখানেই আটকে যায়। স্মৃতিরা বাঁধা হয়ে যায়। শুরু হয় “প্রেমের নাম বেদনা” টাইপের অবস্থা।
আবার, কোন একদিন তৃতীয় কোন ছেলের বা মেয়ের আগমন হয়, ঝগড়া আর ভুল বোঝাবোঝির শুরু। অথবা কেউ একজন ছেলে বন্ধু-মেয়েবন্ধুর স্বাধীনতা চায়, অপরজন তাকে আপন করে চায় আবার শুরু হয় যুদ্ধ। আবারো এই সম্পর্ক ভাঙ্গনের পথে যায়, একসময় আবারো পিছনে লাগা স্টেজ। দুইজন তাদের সম্ভাব্য সকল বন্ধু মহলে অপরের নামে খারাপ কথা বলতে থাকে, যাকে গীবত বলা যায়। এখানে প্রতিহিংসার আগমন হয়। ক্রোধের আগমন হয়।
এইরকম আরও বহু ধাপ পেরিয়ে বাবা-মা পর্যন্ত এসে আবার থেমে যায় প্রেমের স্রোত। তখন ডানে বামে শোনা যায় — প্রেম করলে অনেক অসাধ্য সাধন করতে হয়। এই জায়গায় কানপড়া পাওয়া যায় “ভালো কিছু পেতে হলে কিছু তো ত্যাগ হবেই”।অবশেষে এই প্রেম নামের ভালো কিছুর জন্য সারাজীবন সবকিছুতে সাথে থাকা বাবা-মা, ভাই-বোনের যাবতীয় অপছন্দ উপেক্ষা করে, রাগারাগি আর গালাগালির পরে হয়তবা তারা একসাথে হয়। কিন্তু বিয়ের পরের জীবন? সে এক ইতিহাস। সেইটা অন্যরকম আলোচনার বিষয়।
অনেকে আবার ‘সেই একজন’ কে না পেয়ে ভগ্ন হৃদয়ে চোখের পানি ঝরাতে থাকে। তাকে পাওয়ার জন্য শুরু হয় প্রার্থনা। হয়ত তাকে চেনাই হয়নি ঠিকমতন, কিন্তু এই মোহগ্রস্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা তারা। ছেলে হোক, মেয়ে হোক… এমন ঘটনা অজস্র।
উপরের কোন ঘটনা জীবনে নেই — এমন ছেলে বা মেয়ে খুব বেশি না মনে হয়। বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড কি আমাদেরই এই সমাজে ছিল পনের-বিশ বছর আগে? তখন কি আমাদের বড় ভাই-বোনেরা থাকতে পারেননি? আর সমাজের ওই রক্ষণশীলতা ছিল বলেই এত হাজার রকমের আতংক, ভয়ে নীল হয়ে থাকতে হতো না সমাজের মেয়েদের, মায়েদের, বাবাদের।
আফসোস!! আমাদের জীবন, আমাদের অনুভূতি, আমাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা, আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য এখন আমরা ছেড়ে দিয়েছি কিছু মোবাইল অপারেটর আর কর্পোরেট কোম্পানিদের বিজ্ঞাপনের কাছে, মুভি আর সিরিয়ালের কাছে।বলিউডের কেথ্রিজি, কুচ কুচ হোতা হ্যায়, মোহাব্বাতেইন, জাব উই মিট দেখে প্রেমিক-প্রেমিকা পাবার এবং হবার যেই আকাঙ্ক্ষাতে আমার ভাইবোনদের হৃদয় দোলে সেই নায়ক-নায়িকা, ক্যামেরা ম্যান-প্রস্ততকারক, প্রযোজক সবাই এ থেকে কেবল মুনাফাই অর্জন করেন। আর সেই ব্যবসা সফলতা থেকেই তাদের এমন সিনেমা বানানোর হিড়িক পড়ে। সেই সিনেমায় সত্য কতখানি, তার প্রভাব কতখানি আমাদের সমাজে সেই হিসেব কেইবা রাখে? ভুক্তভোগী যারা, সাবধানতা তাদের থেকেই তো আগে আসা উচিত, তাই নয় কি?
অথচ এই প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে আমরা প্রেমাক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণা দিই আমাদের মা কে। আমাদের দুঃখিনী মা ক’বার গিয়েছেন তিনি এদেশেরই মাধবকুণ্ড ঝর্ণার কাছে? ক’বার গিয়েছেন তিনি কেএফসি আর ফ্যান্টাসি কিংডমে? তার কী একটা জীবন কেবলই আমাদের জন্য ভাত আর তরকারি রান্নার জন্য? আমাদের শরীরের খবর নেয়ার জন্য? কেন এই কাজ করবেন তারা? ছোটবেলা কত শত রাত আমরা এই মা-কে ঘুমাতে দিইনি — কেন এই মায়েদের অশান্তি দিয়ে এই ভালোবাসা বাসি? কেন হয়ত আমার কারণে অন্য আরেকটা ছেলে বা মেয়ের মা-বাবাকে অশান্তি দেয়া? পরিবারের শান্তি কেন আমরা নষ্ট করতে চাই?
ভালোবাসা মানে কী তবে? ভোগ করা?
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটাকে অগ্রাহ্য করলেই কেন ওই মেয়েটা শত্রু হয়ে যায়? তার মানে কি সেই মেয়ের কিছুটা সময়, তার কণ্ঠের অনুরণন, তার কিছু দৃষ্টিকে, তার সহজাত সম্পদগুলোকে ভোগ করতে না পেরেই আমি তাকে ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা করতে শুরু করলাম? কী হাস্যকর রকমের সস্তা ব্যাপার, তাইনা? যাকে ভালোবাসি, তাকে না পেলেও তো আমার ভালোবাসা থাকারই কথা তাইনা? এই স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হতে পারলে সেদিন নিজেকে মুক্ত করা যাবে পশুত্ব থেকে।
ক’দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ক্লাসমেট ছেলেটা তার প্রেমিকাকে ছুরি দিয়ে গেঁথে খুন করে ফেলার ঘটনাতে কি এই ভয়ংকর জিনিসগুলোই পরিষ্কার করে দেয় না? মানবীয় গুণাবলী যেখানে হারিয়ে যায়, তখন প্রেমের নামে এই সাময়িক মোহ কেটে যেতে কেবলই একটা মূহুর্ত লাগে!
প্রিয় ভাইয়ারা, জীবনটাকে জটিল করতে, পাপময় করতে, রাগ-ক্ষোভ-হতাশার স্ফুরণ ঘটাতে কেন তোমরা ফিরে ফিরে রোমিও, মজনু, ফরহাদ হতে চাও? তুমি সেই মেয়েটিকেই খুঁজো, যার মতন একটা কন্যা সন্তান পেলে তুমি খুশি হবে জীবনে। কিংবা এমন মেয়ে খুঁজো যাকে তুমি তোমার সন্তানদের মা হিসেবে চাও! মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট থেকে দূরে রেখে ঘরের আলো নিভিয়ে নিজেকে একটুখানি সময় দাও। তারপর নিজের আত্মাকে জিজ্ঞেস করো তো এই একটা দেহ, প্রাণ, সে কি শুধুই কোন নারীর পেছনে ছোটার জন্য? তোমার ভাইবোন, মা-বাবার কষ্টার্জিত জীবন, রাস্তার পাশের কষ্টে থাকা মানুষগুলো কি কখনই তোমাকে ভাবায় না? যেদিন তুমি হবে সুন্দর চরিত্রের উদার প্রাণের ছেলে, দেখবে তোমার চাইতেও চমৎকার একজন তোমারই জন্য অপেক্ষা করবে এই জীবনের বাকিটা সময়, অনন্তকালের অসীম সময়ে সঙ্গ দিতে। চোখকে সংযত করা উচিত, কেননা এই নির্লজ্জ অবাধ্য দৃষ্টি অনেক বোনদেরকে কষ্ট দেয়, অশান্তি দেয়। হতে পারে সে আমাদেরই কারো মা-বোন। আর আখিরাতে আল্লাহর হিসেব তো হবে খুবই কঠিন!
আচ্ছা আপু, এই রূপ-সৌন্দর্য-যৌবন কতদিন থাকে জানো তো? সর্বোচ্চ ১৫-২০ বছর। তারপর? এই শরীর ভেঙ্গে যাবে, চামড়া কুঁচকে যাবে। তখন কে দেখবে তোমাকে? তুমি বরং এমন ছেলেকেই খুঁজো, যার মতন ছেলে গর্ভে পেলে তুমি খুশি হবে। কিংবা এমন ছেলে খুঁজো যাকে তুমি তোমার সন্তানদের বাবা হিসেবে চাও। তথাকথিত দারুণ স্মার্ট ছেলের আক্রমণাত্মক, ড্যাম কেয়ার আর “ম্যানলি” আচরণে মুগ্ধ হয়ে, তার প্রতি অনেক মেয়েরা মুগ্ধ বলে তাকে নিজের জীবনে চাইলে — মনে রেখো আপু, সে যদি তোমার হয়ও কখনো, তখনো সে এমনই থাকবে। সেদিন তার এই আক্রমণের আচরণের খারাপ দিকগুলো তুমি ভোগ করবে প্রতিদিন, প্রতি বেলা। আসলে, কোমল আর ধৈর্য্যশীল ছেলেরা বোধকরি সবচাইতে ভালো ছেলে। সংসার জীবনে প্রাপ্য সম্মান পাওয়াটা ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে বেশি প্রয়োজনীয়।মনে রাখা উচিত, এই জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, আবার তার কাছেই আমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে। পৃথিবীতে এসেছিলাম তখনো একা, যাবোও একা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবসময়েই সাথে আছেন। মন অস্থির হলে, চঞ্চল হলে, একা লাগলে — আল্লাহকে স্মরণ করতে হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন:
“… জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়… ” [সুরা আর রা’দঃ ২৮]
এই জগতে কত আত্মার প্রশান্তি আছে! কী অপার ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে আমাদেরই চারপাশে। আমাদের প্রিয়তম জনকে ভালবাসলে, সবসময়ে স্মরণ করে সমস্ত জীবনটা কতটা সুন্দর হতে পারে — সেটা যারা চেষ্টা করে তারাই পায়! আল্লাহই আমাদের আপনজন, তিনিই সবকিছুর মালিক।
যারা অবিবাহিত, তাদের প্রয়োজন নিজেদের সংযত করা। দরকার আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দুয়া করা, যেই সুন্দর দুয়া পবিত্র কুরআনুল কারীমেই আমরা শিখেছি। আল্লাহর কাছে আমাদের এমন একজন জীবনসঙ্গী চাওয়া উচিত, যাকে দেখলে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়, যার সাথে আমরা দুনিয়াতে একসাথে থাকবো, আখিরাতেও আল্লাহর দেয়া জান্নাতে একসাথে থাকতে পারবো, চিরসবুজ, চির যুবা হয়ে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন আর তার ভালোবাসায় সিক্ত স্নিগ্ধ-শান্ত-মিষ্ট হৃদয় ধারণ করার তাওফিক দান করুন। সেই সুন্দর দু’আ হল– “রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্কুররাতা আ’ইয়ুনিন ওয়া জা’আলনা লিল মুত্তাক্কিনা ইমামা।”
“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” [সূরা ফুরক্কানঃ ৭৪]
অফিস থেকে ফিরছিলাম, রিকসা থেকে যেখানে নামলাম, সেখানে অচেনা দু’টো ছেলে আর একটা মেয়ে দাঁড়ানো, একটা রিকসা দাঁড়ানো পাশে। সেই মেয়েটার বান্ধবীকে সম্ভবত একটা’ ছেলে ‘লাইক’ করে, সেই কথাটা বন্ধুটা মেয়েটাকে বলছিল বলে বুঝলাম। মেয়েটা কিছু একটা উত্তর দিলো। পরে শুনলাম বন্ধুটি মেয়েটিকে বলল, ”ও কি ফ্রেন্ডশিপ টাইপের রিলেশনও করবেনা?”। মেয়েটা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল, “তোমরা রাগ কইরো না, ঠিকাছে? ভালো থাইকোওও, বাআআই!! ” (একটু সুর করে)
বেচারা প্রেমিক ছেলেটা কষ্টে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ানো। সারাদিন কাজের চাপে সময় কাটানোর পর দিনশেষে এই কষ্ট পাওয়ার ঘটনা দেখে আমিও স্তব্ধ। বন্ধুটি সেই রোমিও প্রেমিককে ঠেলে রিকশায় তোলা পর্যন্ত ওদের দেখলাম। রিকসা রওনা হবার পর আমিও একটু বিষণ্ণ মন নিয়ে হাঁটা ধরলাম। এরকম করে দেখা অনেক দৃশ্য মনে পড়ে গেলো। এমন কত প্রেমের শুরু-শেষ দেখলাম এইটুকু জীবনেই!
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘোরা স্কুল-কলেজের এই ছেলে মেয়েগুলোর জীবনে প্রেম একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। এটা আজ থেকে দশ বছর আগে ছিল না। বিলবোর্ড, মিউজিক ভিডিও, নাটক-সিরিয়াল, শাহরুখ খান-শাহেদ কাপুর, কারিনা-প্রিয়াঙ্কা-রনবীরদের সিনেমা দেখে প্রেম করাটাকে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় কাজ বানিয়ে ফেলেছে। তাই যেকোনো মেয়ে দেখলেই তাদের নিজেদের রোমিও বানাতে ইচ্ছে হয়। আমার ভাইবোনদের কাছে শুনতে পাই, কলেজে বা ভার্সিটিতে ক্লাসের কোন মেয়ে (যে কিনা প্রেম করেনা) পেলেই সবাই তাকে ‘অফার’ দিয়ে বসে। এই আতঙ্কে অনেক মেয়ে নিজেকে ‘ইন এ রিলেশনশিপ’ দেখিয়ে থাকে!!
স্বভাবগতভাবে কোমল আর কিছুটা ‘ভদ্র’ ছেলেরা দুঃখ পায় এবং ছ্যাঁকা খেয়ে অনেক কাজে অমনোযোগী হয়ে যায়। আমার অনেক বন্ধুরা সেই সময়েই সিগারেট ধরে “দুইডা টান” দিয়েছিলো আর সেখান থেকেই জীবনের মতন শুরু হয়ে যায়।
অন্যদিকে, যেসব ছেলের স্বভাবে ছোট থেকেই কোমলতা বর্জিত হয়ে গেছে, ছোটবেলা থেকেই যারা প্রয়োজনীয় পারিবারিক শিক্ষা কম পেয়ে বড় হয়েছে, তারা প্রেম করতে না চাওয়া সেই মেয়ের পিছু ছাড়েই না। মেয়েটা এই অফারকে ফিরিয়ে দিলেও ‘প্রেমের নেশায় কাতর’ নাছোড়বান্দা ছেলেটা ক্রমাগতভাবে ফোনে, ক্লাসে, রাস্তায়, ফেসবুকে মেয়েটিকে ফলো করার চেষ্টা করতে থাকে। আসলে এটাকে ‘বিরক্ত’ করা বলাটাই সঠিক হবে। এই বিরক্ত করার স্কেল যেসব ছেলে যত বেশি নোংরা আর পশু তাদের কাছে ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়। আর বখে যাওয়া ছেলেরা তখন “জোর করে” ভালোবাসা আদায়ে অনেক মেয়েরই ক্ষতি করতে চায় — যা কিনা স্বাভাবিক প্রাণীজ গুণাবলী। এই প্রাণী থেকে মানুষ হতে চেষ্টা করতে হয়।
আর সমাজের আধুনিকা ইয়ো-টাইপের মেয়ে অথবা পরিস্থিতির শিকারে পড়ে মেয়েরা এই অফার গ্রহণ করে, প্রেম খেলা শুরু হয়। স্কুল কলেজের বাইরে রাস্তার উপরে, ফাস্ট-ফুডের দোকানে, বাসের কাউন্টারের সামনে, কোন পার্কে বা বসুন্ধরা সিটিতে তাদের একসাথে দেখা যায়। প্রচুর ফোনালাপ শুরু হয় — কী খেয়েছ, তুমি কী পছন্দ করো, তোমার স্বপ্ন কী, তুমি কোথায় বেড়াতে যেতে চাও, তোমার কোন রঙ পছন্দ — এইসব বলে এফএনএফ নাম্বারের ব্যাপক উসুল করা হয়। জীবনের সমস্ত কথা এক দুই সপ্তাহেই বলা শেষ হয়ে যায়। তারপর ছেলেটা যদি উত্তম চরিত্রের না হয়, আর কোন একটা আদিম চাওয়া পূরণ করতে চাইলে তা না দেয়ায় মেয়েটা পুনরায় আবার দোষী হয় এবং এতকিছুর পরেও ছেলেটা তার উপরে খেপে যায়। মেয়েটা এমন অবস্থায় পেছানোর চেষ্টা করে কিন্তু অনেক দিনের অনেক অন্তরঙ্গতায় বাধা পড়ে সেখানেই আটকে যায়। স্মৃতিরা বাঁধা হয়ে যায়। শুরু হয় “প্রেমের নাম বেদনা” টাইপের অবস্থা।
আবার, কোন একদিন তৃতীয় কোন ছেলের বা মেয়ের আগমন হয়, ঝগড়া আর ভুল বোঝাবোঝির শুরু। অথবা কেউ একজন ছেলে বন্ধু-মেয়েবন্ধুর স্বাধীনতা চায়, অপরজন তাকে আপন করে চায় আবার শুরু হয় যুদ্ধ। আবারো এই সম্পর্ক ভাঙ্গনের পথে যায়, একসময় আবারো পিছনে লাগা স্টেজ। দুইজন তাদের সম্ভাব্য সকল বন্ধু মহলে অপরের নামে খারাপ কথা বলতে থাকে, যাকে গীবত বলা যায়। এখানে প্রতিহিংসার আগমন হয়। ক্রোধের আগমন হয়।
এইরকম আরও বহু ধাপ পেরিয়ে বাবা-মা পর্যন্ত এসে আবার থেমে যায় প্রেমের স্রোত। তখন ডানে বামে শোনা যায় — প্রেম করলে অনেক অসাধ্য সাধন করতে হয়। এই জায়গায় কানপড়া পাওয়া যায় “ভালো কিছু পেতে হলে কিছু তো ত্যাগ হবেই”।অবশেষে এই প্রেম নামের ভালো কিছুর জন্য সারাজীবন সবকিছুতে সাথে থাকা বাবা-মা, ভাই-বোনের যাবতীয় অপছন্দ উপেক্ষা করে, রাগারাগি আর গালাগালির পরে হয়তবা তারা একসাথে হয়। কিন্তু বিয়ের পরের জীবন? সে এক ইতিহাস। সেইটা অন্যরকম আলোচনার বিষয়।
অনেকে আবার ‘সেই একজন’ কে না পেয়ে ভগ্ন হৃদয়ে চোখের পানি ঝরাতে থাকে। তাকে পাওয়ার জন্য শুরু হয় প্রার্থনা। হয়ত তাকে চেনাই হয়নি ঠিকমতন, কিন্তু এই মোহগ্রস্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা তারা। ছেলে হোক, মেয়ে হোক… এমন ঘটনা অজস্র।
উপরের কোন ঘটনা জীবনে নেই — এমন ছেলে বা মেয়ে খুব বেশি না মনে হয়। বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড কি আমাদেরই এই সমাজে ছিল পনের-বিশ বছর আগে? তখন কি আমাদের বড় ভাই-বোনেরা থাকতে পারেননি? আর সমাজের ওই রক্ষণশীলতা ছিল বলেই এত হাজার রকমের আতংক, ভয়ে নীল হয়ে থাকতে হতো না সমাজের মেয়েদের, মায়েদের, বাবাদের।
আফসোস!! আমাদের জীবন, আমাদের অনুভূতি, আমাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা, আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য এখন আমরা ছেড়ে দিয়েছি কিছু মোবাইল অপারেটর আর কর্পোরেট কোম্পানিদের বিজ্ঞাপনের কাছে, মুভি আর সিরিয়ালের কাছে।বলিউডের কেথ্রিজি, কুচ কুচ হোতা হ্যায়, মোহাব্বাতেইন, জাব উই মিট দেখে প্রেমিক-প্রেমিকা পাবার এবং হবার যেই আকাঙ্ক্ষাতে আমার ভাইবোনদের হৃদয় দোলে সেই নায়ক-নায়িকা, ক্যামেরা ম্যান-প্রস্ততকারক, প্রযোজক সবাই এ থেকে কেবল মুনাফাই অর্জন করেন। আর সেই ব্যবসা সফলতা থেকেই তাদের এমন সিনেমা বানানোর হিড়িক পড়ে। সেই সিনেমায় সত্য কতখানি, তার প্রভাব কতখানি আমাদের সমাজে সেই হিসেব কেইবা রাখে? ভুক্তভোগী যারা, সাবধানতা তাদের থেকেই তো আগে আসা উচিত, তাই নয় কি?
অথচ এই প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে আমরা প্রেমাক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণা দিই আমাদের মা কে। আমাদের দুঃখিনী মা ক’বার গিয়েছেন তিনি এদেশেরই মাধবকুণ্ড ঝর্ণার কাছে? ক’বার গিয়েছেন তিনি কেএফসি আর ফ্যান্টাসি কিংডমে? তার কী একটা জীবন কেবলই আমাদের জন্য ভাত আর তরকারি রান্নার জন্য? আমাদের শরীরের খবর নেয়ার জন্য? কেন এই কাজ করবেন তারা? ছোটবেলা কত শত রাত আমরা এই মা-কে ঘুমাতে দিইনি — কেন এই মায়েদের অশান্তি দিয়ে এই ভালোবাসা বাসি? কেন হয়ত আমার কারণে অন্য আরেকটা ছেলে বা মেয়ের মা-বাবাকে অশান্তি দেয়া? পরিবারের শান্তি কেন আমরা নষ্ট করতে চাই?
ভালোবাসা মানে কী তবে? ভোগ করা?
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটাকে অগ্রাহ্য করলেই কেন ওই মেয়েটা শত্রু হয়ে যায়? তার মানে কি সেই মেয়ের কিছুটা সময়, তার কণ্ঠের অনুরণন, তার কিছু দৃষ্টিকে, তার সহজাত সম্পদগুলোকে ভোগ করতে না পেরেই আমি তাকে ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা করতে শুরু করলাম? কী হাস্যকর রকমের সস্তা ব্যাপার, তাইনা? যাকে ভালোবাসি, তাকে না পেলেও তো আমার ভালোবাসা থাকারই কথা তাইনা? এই স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হতে পারলে সেদিন নিজেকে মুক্ত করা যাবে পশুত্ব থেকে।
ক’দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ক্লাসমেট ছেলেটা তার প্রেমিকাকে ছুরি দিয়ে গেঁথে খুন করে ফেলার ঘটনাতে কি এই ভয়ংকর জিনিসগুলোই পরিষ্কার করে দেয় না? মানবীয় গুণাবলী যেখানে হারিয়ে যায়, তখন প্রেমের নামে এই সাময়িক মোহ কেটে যেতে কেবলই একটা মূহুর্ত লাগে!
প্রিয় ভাইয়ারা, জীবনটাকে জটিল করতে, পাপময় করতে, রাগ-ক্ষোভ-হতাশার স্ফুরণ ঘটাতে কেন তোমরা ফিরে ফিরে রোমিও, মজনু, ফরহাদ হতে চাও? তুমি সেই মেয়েটিকেই খুঁজো, যার মতন একটা কন্যা সন্তান পেলে তুমি খুশি হবে জীবনে। কিংবা এমন মেয়ে খুঁজো যাকে তুমি তোমার সন্তানদের মা হিসেবে চাও! মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট থেকে দূরে রেখে ঘরের আলো নিভিয়ে নিজেকে একটুখানি সময় দাও। তারপর নিজের আত্মাকে জিজ্ঞেস করো তো এই একটা দেহ, প্রাণ, সে কি শুধুই কোন নারীর পেছনে ছোটার জন্য? তোমার ভাইবোন, মা-বাবার কষ্টার্জিত জীবন, রাস্তার পাশের কষ্টে থাকা মানুষগুলো কি কখনই তোমাকে ভাবায় না? যেদিন তুমি হবে সুন্দর চরিত্রের উদার প্রাণের ছেলে, দেখবে তোমার চাইতেও চমৎকার একজন তোমারই জন্য অপেক্ষা করবে এই জীবনের বাকিটা সময়, অনন্তকালের অসীম সময়ে সঙ্গ দিতে। চোখকে সংযত করা উচিত, কেননা এই নির্লজ্জ অবাধ্য দৃষ্টি অনেক বোনদেরকে কষ্ট দেয়, অশান্তি দেয়। হতে পারে সে আমাদেরই কারো মা-বোন। আর আখিরাতে আল্লাহর হিসেব তো হবে খুবই কঠিন!
আচ্ছা আপু, এই রূপ-সৌন্দর্য-যৌবন কতদিন থাকে জানো তো? সর্বোচ্চ ১৫-২০ বছর। তারপর? এই শরীর ভেঙ্গে যাবে, চামড়া কুঁচকে যাবে। তখন কে দেখবে তোমাকে? তুমি বরং এমন ছেলেকেই খুঁজো, যার মতন ছেলে গর্ভে পেলে তুমি খুশি হবে। কিংবা এমন ছেলে খুঁজো যাকে তুমি তোমার সন্তানদের বাবা হিসেবে চাও। তথাকথিত দারুণ স্মার্ট ছেলের আক্রমণাত্মক, ড্যাম কেয়ার আর “ম্যানলি” আচরণে মুগ্ধ হয়ে, তার প্রতি অনেক মেয়েরা মুগ্ধ বলে তাকে নিজের জীবনে চাইলে — মনে রেখো আপু, সে যদি তোমার হয়ও কখনো, তখনো সে এমনই থাকবে। সেদিন তার এই আক্রমণের আচরণের খারাপ দিকগুলো তুমি ভোগ করবে প্রতিদিন, প্রতি বেলা। আসলে, কোমল আর ধৈর্য্যশীল ছেলেরা বোধকরি সবচাইতে ভালো ছেলে। সংসার জীবনে প্রাপ্য সম্মান পাওয়াটা ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে বেশি প্রয়োজনীয়।মনে রাখা উচিত, এই জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, আবার তার কাছেই আমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে। পৃথিবীতে এসেছিলাম তখনো একা, যাবোও একা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবসময়েই সাথে আছেন। মন অস্থির হলে, চঞ্চল হলে, একা লাগলে — আল্লাহকে স্মরণ করতে হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন:
“… জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়… ” [সুরা আর রা’দঃ ২৮]
এই জগতে কত আত্মার প্রশান্তি আছে! কী অপার ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে আমাদেরই চারপাশে। আমাদের প্রিয়তম জনকে ভালবাসলে, সবসময়ে স্মরণ করে সমস্ত জীবনটা কতটা সুন্দর হতে পারে — সেটা যারা চেষ্টা করে তারাই পায়! আল্লাহই আমাদের আপনজন, তিনিই সবকিছুর মালিক।
যারা অবিবাহিত, তাদের প্রয়োজন নিজেদের সংযত করা। দরকার আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দুয়া করা, যেই সুন্দর দুয়া পবিত্র কুরআনুল কারীমেই আমরা শিখেছি। আল্লাহর কাছে আমাদের এমন একজন জীবনসঙ্গী চাওয়া উচিত, যাকে দেখলে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়, যার সাথে আমরা দুনিয়াতে একসাথে থাকবো, আখিরাতেও আল্লাহর দেয়া জান্নাতে একসাথে থাকতে পারবো, চিরসবুজ, চির যুবা হয়ে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন আর তার ভালোবাসায় সিক্ত স্নিগ্ধ-শান্ত-মিষ্ট হৃদয় ধারণ করার তাওফিক দান করুন। সেই সুন্দর দু’আ হল– “রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্কুররাতা আ’ইয়ুনিন ওয়া জা’আলনা লিল মুত্তাক্কিনা ইমামা।”
“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” [সূরা ফুরক্কানঃ ৭৪]
ফিলিপাইনের জাতীয় সাঁতার দলের প্রশিক্ষক, ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানের ওপর ডিগ্রি নেয়া ক্যাপ্টেন আব্দুল কারীম এরসিনাস নিজের ইসলাম গ্রহণের গল্প তুলে ধরেন এভাবে-
আল্লাহর অসংখ্য প্রশংসা যে, (এরসিনাস) খ্রিস্টান পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে তিনি আমাকে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সৌভাগ্যে ভূষিত করেছেন। আমার জন্ম ও শিক্ষা রাজধানী ম্যানিলার এক খ্রিস্টান পরিবেশে। এখানে কোনো মুসলিম নেই। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলগুলোতেই মুসলিমদের অবস্থান সীমিত। বাল্যকালে আমার পরিবার চাইতো গির্জায় আমি বেশি বেশি সময় দেই। বাবা যখন আমাকে গির্জায় নিয়ে যাবার সুযোগ করতে পারছিলেন না, তখন আমার বয়সে বড় এক ভাই এলেন। তিনি রোজ আমাকে গির্জায় নিয়ে যেতেন।
আমি যখন যৌবনে পা রাখলাম, গির্জায় যেতে কোনো আগ্রহ বোধ করছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নিজ ধর্ম খ্রিস্টবাদ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম। এ সম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনা শুরু করলাম। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পেলাম, খ্রিস্ট ধর্মে ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্টসহ নানা বিভক্তি। আমার বিস্ময় বেড়ে গেল যখন দেখলাম ধর্মমতে ব্যাপক বিভক্তি থাকলেও তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে ঈমান না আনার বেলায় এরা সব একাট্টা।
শিক্ষা জীবন শেষে সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে আমি সৌদি আরব গেলাম। এই প্রথম আমার মুসলিমদের সংস্পর্শে আসা। আগেই বলেছি ফিলিপাইনে থাকতে আমি কোনো মুসলিমের সঙ্গ পাইনি। ফিলিপাইনের মুসলিমরা তাদের অঞ্চলগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকেন। আমরা তাদের সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাই না। সরকারি প্রচার মাধ্যম যা প্রচার করে অগত্যা আমাদেরকে তা-ই বিশ্বাস করতে হয়। মিডিয়া দেশের জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করে, দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিমদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যেসব সংঘর্ষ হয় তা রাজনৈতিক। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা মুসলমানদের একটি উগ্রগোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরে। যারা কেবল তাদের দেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায়। পেতে চায় তাদের রাজনৈতিক অধিকার। আল্লাহর অসংখ্য শুকরিয়া যে, আজ আমি যাদের একজনে পরিণত হয়েছি সেই মুসলিম ভাইদের কারও দিকে কখনো অস্ত্র তাক করিনি।
আমি সৌদি আরবে যাওয়ার পরেই কেবল মুসলিম সম্পর্কে জানতে পারি। তাদের অবস্থা, আচার ও আকীদা (বিশ্বাস) সম্পর্কে অবহিত হই। আমি যাদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিতাম তাদের মধ্যে এক বালক ছিল। বয়স তার অনূর্ধ্ব তেরো। ক্ষুদে এই মুসলিমের চলাফেরা ও কাজকর্মে লক্ষ্য করতাম দারুণ এক নিয়মানুবর্তিতা। ওর স্বভাব শান্ত। জীবন যাপন সুশৃঙ্খল। আমাকে দেয়া প্রতিশ্রুতির অন্যথা করে না সে কখনো। যথাসময়ে সালাত আদায়ে তার চেষ্টা দেখার মতো। অবসরের সিংহভাগ সময়ই কাটত তার নিবিষ্টমনে কুরআন তেলাওয়াতে।
মুসলিম বালকটির ছিল তীক্ষ্ন মেধা আর বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। আমি তার কর্মকাণ্ডের প্রতি লক্ষ্য করছি, তার সঙ্গ আমাকে আনন্দ দিচ্ছে- এতটুকু বুঝতে পেরেই সে আমার সামনে একগাদা ইংরেজিতে অনূদিত ইসলাম ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বই উপস্থাপন করল। ইংরেজি অনুবাদসহ কুরআন শরীফের একটি কপিও দিল। সঙ্গে সে এও বলল, ‘আপনি এসব পড়লেই আমার সুবিন্যস্ত জীবন যাপনের রহস্য উদ্ধার করতে পারবেন।’
এই প্রথম ইসলাম সম্পর্কে জানার অভিজ্ঞতা। যত পড়লাম আমার সামনে একে একে অজানা জগত উদ্ভাসিত হতে লাগল। আমি বা আমার মতো অন্য কেউ এ জগতের সন্ধান পাননি। এসব পড়ে আমি খুব প্রভাবিত হলাম। বিশেষ করে যখন কুরআন শরীফের তরজমা পড়লাম। এ কিতাবে যে একক স্রষ্টার কথা বলা হয়েছে, তা আমার চিন্তার সঙ্গে মিলে গেল। এ চিন্তায় আমি খুব তৃপ্তি ও স্বস্থি বোধ করলাম। এরপর আমি প্রবলভাবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। এমনকি আমি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার আগেই নিজের নতুন নামও (আব্দুল করীম) ঠিক করে ফেললাম। আসলে ইসলামের সঙ্গে আমার এই পরিচয়ের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহের পর এই বালকটির প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ। এই পরিচয়ের পরই শুরু হয় হেদায়েতের পথে আমার অভিযাত্রা।
আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন দেখতে লাগলাম আমার সহকর্মীদের সময়মতো সালাত আদায়ের দৃশ্য। আমার কর্মক্ষেত্রেই ছিল মসজিদ। আমি পর্যবেক্ষণ করতাম তাদের সালাত। কী বিস্ময়কর তন্ময়তায় তারা নামাজে নিমগ্ন হত! সবাই একসঙ্গে রুকু করছে, সিজদা করছে! একই ইমামের পেছনে সবাই কত শৃঙ্খলা ও গুরুত্বের সঙ্গে সালাত আদায় করছে! আমার কর্মস্থলের বন্ধুরাও অনুদারতা দেখাননি। তারা আমাকে জেদ্দায় রাখা এই বালকটির মতই সহযোগিতা করেছেন। যথেষ্ট যত্ন-আত্তি করেছেন। তারা যখন আমার ইসলাম সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা, ইসলাম নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা এবং সালাতের ব্যাপারে অনন্ত কৌতূহল লক্ষ্য করলেন, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু কিতাব পড়তে দিলেন।
তাদের দেয়া গ্রন্থগুলোর মধ্যে ছিল পাদ্রীদের সঙ্গে আহমদ দিদাতের সংলাপের বই। আমি অনেক শুনেছি, মুসলমানরা অন্যদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে। সৌদি আরবে আসার এগে থেকেই আমার মাথায় এই চিত্র আকাঁ ছিল। কিন্তু এখানে এসে আমি এ ধরনের কোনো আচরণ দেখলাম না। সিজওয়ার্টের সঙ্গে আহমদ দিদাতের বিতর্ক অনুষ্ঠানের বই আমার মনে অনেক গভীর প্রভাব সৃষ্টি করল। এই লোকটির ব্যাপারে আমি যার পর নাই বিস্মিত। কিভাবে তিনি একেরপর এক প্রমাণ উপস্থাপন করেন! একটির পিঠে আরেকটি যুক্তি তুলে ধরেন! বর্ণনা আর যুক্তি কোনোটির অভাব নেই তাতে! প্রতিটি আসর পাঠে আমি হেসে মরি আর সিজওয়ার্ট পরাজিত বিষণ্ন হতে থাকে। তার প্রতিক্রিয়া ছিল অতৃপ্ত মানুষের নির্ভুল প্রতিক্রিয়া। তার অবস্থান যে ভ্রান্তির পক্ষে, মুসলমানদের আগে তা খ্রিস্টানও বুঝতে পারছিল।
এক পর্যায়ে আমি আহমদ দিদাতের কাছে চিঠি লিখলাম। এতে আমি তার যুক্তির শাণিত অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অসাধারণ ক্ষমতার প্রশংসা করলাম। তার কাছে এ ধরনের অসত্য থেকে সত্য উন্মোচনকারী বিতর্ক ও সংলাপের বেশি বেশি বই চাইলাম।
এখন আমি খ্রিস্টান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। এতদুদ্দেশে আমার সহকর্মীদের কাছে এ জন্য আমার করণীয় কী তা জানতে চাইলাম। আর সেদিনই আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর ওপর, তাঁর রাসূলের ওপর এবং শেষ দিবসের ওপর। বিশ্বাস স্থাপন করলাম জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কেও। সে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি। আমি নিজের অপরিমেয় সৌভাগ্য অনুভব করলাম। আজ অনুগত মুসলিম হিসেবে জীবন যাপন করি। আমি সালাত আদায়ে মসজিদে যাই। সেখানে সিজদাবনত হয়ে এক অপার্থিব তৃপ্তি ও সুখ বোধ করি। জীবন যাপনেও তেমনি অপূর্ব প্রশান্তির আস্বাদ পাই। আমার অতীত জীবন ছিল বিশৃঙ্খলা আর উদ্দেশ্যহীন হট্টগোলে পূর্ণ। আল্লাহ আমাকে সে অবস্থার বদলে আজ আলো, শৃঙ্খলা, সচ্চরিত্র ও মূল্যবোধের জীবন দান করেছেন। সত্যিই আমি মুসলিম ভাইদের সঙ্গ পেয়ে সৌভাগ্যবান। সন্দেহ নেই ইসলাম অনেক মহান ধর্ম। এর সঙ্গে জড়িয়ে ধন্য আমার জীবন।
আল্লাহর অসংখ্য প্রশংসা যে, (এরসিনাস) খ্রিস্টান পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে তিনি আমাকে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সৌভাগ্যে ভূষিত করেছেন। আমার জন্ম ও শিক্ষা রাজধানী ম্যানিলার এক খ্রিস্টান পরিবেশে। এখানে কোনো মুসলিম নেই। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলগুলোতেই মুসলিমদের অবস্থান সীমিত। বাল্যকালে আমার পরিবার চাইতো গির্জায় আমি বেশি বেশি সময় দেই। বাবা যখন আমাকে গির্জায় নিয়ে যাবার সুযোগ করতে পারছিলেন না, তখন আমার বয়সে বড় এক ভাই এলেন। তিনি রোজ আমাকে গির্জায় নিয়ে যেতেন।
আমি যখন যৌবনে পা রাখলাম, গির্জায় যেতে কোনো আগ্রহ বোধ করছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নিজ ধর্ম খ্রিস্টবাদ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম। এ সম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনা শুরু করলাম। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পেলাম, খ্রিস্ট ধর্মে ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্টসহ নানা বিভক্তি। আমার বিস্ময় বেড়ে গেল যখন দেখলাম ধর্মমতে ব্যাপক বিভক্তি থাকলেও তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে ঈমান না আনার বেলায় এরা সব একাট্টা।
শিক্ষা জীবন শেষে সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে আমি সৌদি আরব গেলাম। এই প্রথম আমার মুসলিমদের সংস্পর্শে আসা। আগেই বলেছি ফিলিপাইনে থাকতে আমি কোনো মুসলিমের সঙ্গ পাইনি। ফিলিপাইনের মুসলিমরা তাদের অঞ্চলগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকেন। আমরা তাদের সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাই না। সরকারি প্রচার মাধ্যম যা প্রচার করে অগত্যা আমাদেরকে তা-ই বিশ্বাস করতে হয়। মিডিয়া দেশের জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করে, দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিমদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যেসব সংঘর্ষ হয় তা রাজনৈতিক। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা মুসলমানদের একটি উগ্রগোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরে। যারা কেবল তাদের দেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায়। পেতে চায় তাদের রাজনৈতিক অধিকার। আল্লাহর অসংখ্য শুকরিয়া যে, আজ আমি যাদের একজনে পরিণত হয়েছি সেই মুসলিম ভাইদের কারও দিকে কখনো অস্ত্র তাক করিনি।
আমি সৌদি আরবে যাওয়ার পরেই কেবল মুসলিম সম্পর্কে জানতে পারি। তাদের অবস্থা, আচার ও আকীদা (বিশ্বাস) সম্পর্কে অবহিত হই। আমি যাদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিতাম তাদের মধ্যে এক বালক ছিল। বয়স তার অনূর্ধ্ব তেরো। ক্ষুদে এই মুসলিমের চলাফেরা ও কাজকর্মে লক্ষ্য করতাম দারুণ এক নিয়মানুবর্তিতা। ওর স্বভাব শান্ত। জীবন যাপন সুশৃঙ্খল। আমাকে দেয়া প্রতিশ্রুতির অন্যথা করে না সে কখনো। যথাসময়ে সালাত আদায়ে তার চেষ্টা দেখার মতো। অবসরের সিংহভাগ সময়ই কাটত তার নিবিষ্টমনে কুরআন তেলাওয়াতে।
মুসলিম বালকটির ছিল তীক্ষ্ন মেধা আর বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। আমি তার কর্মকাণ্ডের প্রতি লক্ষ্য করছি, তার সঙ্গ আমাকে আনন্দ দিচ্ছে- এতটুকু বুঝতে পেরেই সে আমার সামনে একগাদা ইংরেজিতে অনূদিত ইসলাম ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বই উপস্থাপন করল। ইংরেজি অনুবাদসহ কুরআন শরীফের একটি কপিও দিল। সঙ্গে সে এও বলল, ‘আপনি এসব পড়লেই আমার সুবিন্যস্ত জীবন যাপনের রহস্য উদ্ধার করতে পারবেন।’
এই প্রথম ইসলাম সম্পর্কে জানার অভিজ্ঞতা। যত পড়লাম আমার সামনে একে একে অজানা জগত উদ্ভাসিত হতে লাগল। আমি বা আমার মতো অন্য কেউ এ জগতের সন্ধান পাননি। এসব পড়ে আমি খুব প্রভাবিত হলাম। বিশেষ করে যখন কুরআন শরীফের তরজমা পড়লাম। এ কিতাবে যে একক স্রষ্টার কথা বলা হয়েছে, তা আমার চিন্তার সঙ্গে মিলে গেল। এ চিন্তায় আমি খুব তৃপ্তি ও স্বস্থি বোধ করলাম। এরপর আমি প্রবলভাবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। এমনকি আমি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার আগেই নিজের নতুন নামও (আব্দুল করীম) ঠিক করে ফেললাম। আসলে ইসলামের সঙ্গে আমার এই পরিচয়ের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহের পর এই বালকটির প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ। এই পরিচয়ের পরই শুরু হয় হেদায়েতের পথে আমার অভিযাত্রা।
আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন দেখতে লাগলাম আমার সহকর্মীদের সময়মতো সালাত আদায়ের দৃশ্য। আমার কর্মক্ষেত্রেই ছিল মসজিদ। আমি পর্যবেক্ষণ করতাম তাদের সালাত। কী বিস্ময়কর তন্ময়তায় তারা নামাজে নিমগ্ন হত! সবাই একসঙ্গে রুকু করছে, সিজদা করছে! একই ইমামের পেছনে সবাই কত শৃঙ্খলা ও গুরুত্বের সঙ্গে সালাত আদায় করছে! আমার কর্মস্থলের বন্ধুরাও অনুদারতা দেখাননি। তারা আমাকে জেদ্দায় রাখা এই বালকটির মতই সহযোগিতা করেছেন। যথেষ্ট যত্ন-আত্তি করেছেন। তারা যখন আমার ইসলাম সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা, ইসলাম নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা এবং সালাতের ব্যাপারে অনন্ত কৌতূহল লক্ষ্য করলেন, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু কিতাব পড়তে দিলেন।
তাদের দেয়া গ্রন্থগুলোর মধ্যে ছিল পাদ্রীদের সঙ্গে আহমদ দিদাতের সংলাপের বই। আমি অনেক শুনেছি, মুসলমানরা অন্যদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে। সৌদি আরবে আসার এগে থেকেই আমার মাথায় এই চিত্র আকাঁ ছিল। কিন্তু এখানে এসে আমি এ ধরনের কোনো আচরণ দেখলাম না। সিজওয়ার্টের সঙ্গে আহমদ দিদাতের বিতর্ক অনুষ্ঠানের বই আমার মনে অনেক গভীর প্রভাব সৃষ্টি করল। এই লোকটির ব্যাপারে আমি যার পর নাই বিস্মিত। কিভাবে তিনি একেরপর এক প্রমাণ উপস্থাপন করেন! একটির পিঠে আরেকটি যুক্তি তুলে ধরেন! বর্ণনা আর যুক্তি কোনোটির অভাব নেই তাতে! প্রতিটি আসর পাঠে আমি হেসে মরি আর সিজওয়ার্ট পরাজিত বিষণ্ন হতে থাকে। তার প্রতিক্রিয়া ছিল অতৃপ্ত মানুষের নির্ভুল প্রতিক্রিয়া। তার অবস্থান যে ভ্রান্তির পক্ষে, মুসলমানদের আগে তা খ্রিস্টানও বুঝতে পারছিল।
এক পর্যায়ে আমি আহমদ দিদাতের কাছে চিঠি লিখলাম। এতে আমি তার যুক্তির শাণিত অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অসাধারণ ক্ষমতার প্রশংসা করলাম। তার কাছে এ ধরনের অসত্য থেকে সত্য উন্মোচনকারী বিতর্ক ও সংলাপের বেশি বেশি বই চাইলাম।
এখন আমি খ্রিস্টান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। এতদুদ্দেশে আমার সহকর্মীদের কাছে এ জন্য আমার করণীয় কী তা জানতে চাইলাম। আর সেদিনই আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর ওপর, তাঁর রাসূলের ওপর এবং শেষ দিবসের ওপর। বিশ্বাস স্থাপন করলাম জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কেও। সে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি। আমি নিজের অপরিমেয় সৌভাগ্য অনুভব করলাম। আজ অনুগত মুসলিম হিসেবে জীবন যাপন করি। আমি সালাত আদায়ে মসজিদে যাই। সেখানে সিজদাবনত হয়ে এক অপার্থিব তৃপ্তি ও সুখ বোধ করি। জীবন যাপনেও তেমনি অপূর্ব প্রশান্তির আস্বাদ পাই। আমার অতীত জীবন ছিল বিশৃঙ্খলা আর উদ্দেশ্যহীন হট্টগোলে পূর্ণ। আল্লাহ আমাকে সে অবস্থার বদলে আজ আলো, শৃঙ্খলা, সচ্চরিত্র ও মূল্যবোধের জীবন দান করেছেন। সত্যিই আমি মুসলিম ভাইদের সঙ্গ পেয়ে সৌভাগ্যবান। সন্দেহ নেই ইসলাম অনেক মহান ধর্ম। এর সঙ্গে জড়িয়ে ধন্য আমার জীবন।
আপনার চিরচেনা এক কাপ চা কে এখন থেকে আপনি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখবেন…
একজন যুবতী মহিলা একদিন তার মায়ের কাছে গিয়ে নিজের জীবন সম্পর্কে বলতে লাগলো যে তার জীবন তার জন্য কত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বুঝে উঠতে পারছিল না কিভাবে সে সবকিছু সামলাবে, হতাশায় তার সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। সে সংগ্রাম করে করে ক্লান্ত। মনে হচ্ছিল যেন, একটা সমস্যা শেষ হতে না হতেই আরেকটা সমস্যা এসে হাজির হয়ে যাচ্ছে।
তার মা তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। তিনি তখন তিনটি পানি ভরা পাত্র তিনটি চুলায় গনগনে আগুনের উপর বসিয়ে দিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাত্রগুলোর পানি ফুটতে লাগলো। প্রথম পাত্রটির ভিতর তিনি গাজর রাখলেন, দ্বিতীয়টিতে ডিম রাখলেন, আর শেষ পাত্রটিতে কিছু চা পাতা ছেড়ে দিলেন। একটি কোথাও না বলে তিনি সেগুলোকে সিদ্ধ হতে সময়
প্রায় বিশ মিনিট পর তিনি সবগুলো চুলার আগুন নিভিয়ে দিলেন। তারপর গাজর উঠিয়ে একটি বাটিতে রাখলেন; ডিম তুলে আরেকটি বাটিতে রাখলেন। সবশেষে চা ঢেলে কাপে রাখলেন।
মেয়ের দিকে ঘুরে তার মা প্রশ্ন করলেন, ‘বল তো, তুমি কি দেখলে?’
সে উত্তর দিল, ‘গাজর, ডিম আর চা’
তার মা তখন তাকে কাছে নিয়ে এসে গাজরটি হাত দিয়ে ধরে দেখতে বললেন। সে ধরে অনুভব করল যে গাজরটি নরম হয়ে গেছে।
তারপর তার মা বললেন ডিম নিয়ে ভেঙ্গে দেখতে। ডিমের খোসা খুলে সে দেখল ডিমের ভিতরে সিদ্ধ হয়ে শক্ত হয়ে গেছে।
সবশেষে, মা তার মেয়েকে চায়ে চুমুক দিতে বললেন।
তার মেয়ে তখন চায়ে চুমুক দিয়ে এর ঘ্রান নিয়ে হাসল।
মেয়ে তখন মা কে প্রশ্ন করল, “এতে কি বোঝা গেল মা?”
তার মা তখন ব্যখ্যা করলেন, এই প্রত্যেকটি জিনিস একই রকম পরিস্থিতির মুখমুখি হয়েছেঃ ফুটন্ত পানি। কিন্তু একেকটির প্রতিক্রিয়া হল একেকরকম।
গাজরটি ছিল মজবুত, শক্ত, অনমনীয়। কিন্তু, ফুটন্ত পানির মধ্যে থেকে তা হয়ে গেল নরম ও দুর্বল।
ডিমটি ছিল নাজুক, ভঙ্গুর। এটির পাতলা বহিরাবরন এর ভেতরের তরল অংশটির সংরক্ষন করছিল। কিন্তু ফুটন্ত পানির তাপ এর ভেতরকে শক্ত করে ফেলল।
চায়ের বৈশিষ্ট্য ছিল সবচেয়ে ভিন্ন। ফুটন্ত পানিতে ছড়িয়ে গিয়ে এটি পানিকেই বদলে ফেলল।
মা তার মেয়েকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এর কোনটির মতো?’
‘যখন প্রতিকূলতা আপনার দরজায় কড়া নাড়ে, আপনি কিভাবে সাড়া দেন? গাজরের মতো, ডিমের মতো, নাকি চায়ের মতো?’
ভেবে দেখুনঃ আমি কিসের মতো?
আমি কি সেই গাজরের মতো যে কিনা দেখতে মজবুত, অনমনীয়; কিন্তু কষ্টে ও প্রতিকূলতায় আমি কি নুয়ে পড়ি আর দুর্বল হয়ে যাই এবং শক্তিহীন হয়ে পড়ি?
আমি কি সেই ডিমের মতো যার অন্তর প্রথমে নমনীয় থাকে, পরে তাপে-কষ্টে পরিবর্তিত হয়ে যায়? আমি কি চঞ্চল মনের অধিকারী ছিলাম…কিন্তু কারও মৃত্যু, কোন সম্পর্কের ছেদ, কোন আর্থিক দৈন্যতা অথবা অন্য কোন পরীক্ষায় আমি শক্ত ও কঠোর হয়ে গেছি?
নাকি আমি চায়ের মতো? যা গরম পানিটিকেই বদলে দেয়, সেই পরিস্থিতিকেই বদলে ফেলে যা কষ্ট দিতে এসেছিল। চায়ের বেলায়, পানি যখন গরম হয়ে যায়, চা তখন তার সুঘ্রান ও স্বাদ আশেপাশে ছড়িয়ে দেয়। আপনি যদি চায়ের মতো হয়ে থাকেন, তাহলে যখন আপনার চারপাশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, আপনার তখন আরও উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং আপনার জন্য চারপাশের পরিস্থিতি আপনার পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
যখন অন্ধকার আচ্ছন্ন করে ফেলে আর বড় বড় পরীক্ষা আসে, আপনি কি আত্মোন্নয়নে আরেকটু এগিয়ে যান? আপনি কিভাবে প্রতিকূলতাকে সামলান?
আপনি কি গাজর, ডিম না চায়ের মতো?
এমন নয় যে সুখী মানুষদের সবকিছু সেরা অবস্থায় থাকে; তারা তাদের চলার পথে যার মুখোমুখি হয় তারই ভালটুকু গ্রহন করে এগিয়ে যেতে পারে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য কিছু অতীত ভুলে যেতে হয়; যদি অতীতের ব্যর্থতার গ্লানি, হৃদয়ের ক্ষত কাটিয়ে না উঠতে পারেন আপনি জীবনে সামনে এগোতে পারবেন না।
আপনি যখন জন্মেছিলেন, আপনি কাঁদছিলেন আর আপনার আশেপাশের সবাই হাসছিল। জীবনে এমন ভাবে বাঁচুন, যেন জীবনের শেষ মুহূর্তে আপনি হাসতে পারেন আর আপনার জন্য সবাই কাঁদে।
আপনি হয়তো এই কথাগুলো তাদেরকে জানাতে চাইবেন, যারা আপনার প্রিয় (যেমনটি আমি করেছি); যারা কোন না কোনভাবে আপনার জীবনকে ছুঁয়ে গেছে; যারা আপনার মুখে হাসি ফুটিয়েছে যখন তা আপনার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিল; যারা আপনাকে কোন কিছুর ভাল দিকটি দেখিয়েছেন যখন আপনি হতাশায় ছিলেন; যাদের বন্ধুত্ব আপনার কাছে খুবই মুল্যবান; যারা আপনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
একজন বয়স্ক মানুষকে বদলানোর চেয়ে একটি শিশুকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা সহজ…
আমরা যেন সবাই সেই চায়ের গুনটি অর্জন করতে পারি।
ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য জাযাকাল্লাহ খায়ের।
একজন যুবতী মহিলা একদিন তার মায়ের কাছে গিয়ে নিজের জীবন সম্পর্কে বলতে লাগলো যে তার জীবন তার জন্য কত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বুঝে উঠতে পারছিল না কিভাবে সে সবকিছু সামলাবে, হতাশায় তার সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। সে সংগ্রাম করে করে ক্লান্ত। মনে হচ্ছিল যেন, একটা সমস্যা শেষ হতে না হতেই আরেকটা সমস্যা এসে হাজির হয়ে যাচ্ছে।
তার মা তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। তিনি তখন তিনটি পানি ভরা পাত্র তিনটি চুলায় গনগনে আগুনের উপর বসিয়ে দিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাত্রগুলোর পানি ফুটতে লাগলো। প্রথম পাত্রটির ভিতর তিনি গাজর রাখলেন, দ্বিতীয়টিতে ডিম রাখলেন, আর শেষ পাত্রটিতে কিছু চা পাতা ছেড়ে দিলেন। একটি কোথাও না বলে তিনি সেগুলোকে সিদ্ধ হতে সময়
প্রায় বিশ মিনিট পর তিনি সবগুলো চুলার আগুন নিভিয়ে দিলেন। তারপর গাজর উঠিয়ে একটি বাটিতে রাখলেন; ডিম তুলে আরেকটি বাটিতে রাখলেন। সবশেষে চা ঢেলে কাপে রাখলেন।
মেয়ের দিকে ঘুরে তার মা প্রশ্ন করলেন, ‘বল তো, তুমি কি দেখলে?’
সে উত্তর দিল, ‘গাজর, ডিম আর চা’
তার মা তখন তাকে কাছে নিয়ে এসে গাজরটি হাত দিয়ে ধরে দেখতে বললেন। সে ধরে অনুভব করল যে গাজরটি নরম হয়ে গেছে।
তারপর তার মা বললেন ডিম নিয়ে ভেঙ্গে দেখতে। ডিমের খোসা খুলে সে দেখল ডিমের ভিতরে সিদ্ধ হয়ে শক্ত হয়ে গেছে।
সবশেষে, মা তার মেয়েকে চায়ে চুমুক দিতে বললেন।
তার মেয়ে তখন চায়ে চুমুক দিয়ে এর ঘ্রান নিয়ে হাসল।
মেয়ে তখন মা কে প্রশ্ন করল, “এতে কি বোঝা গেল মা?”
তার মা তখন ব্যখ্যা করলেন, এই প্রত্যেকটি জিনিস একই রকম পরিস্থিতির মুখমুখি হয়েছেঃ ফুটন্ত পানি। কিন্তু একেকটির প্রতিক্রিয়া হল একেকরকম।
গাজরটি ছিল মজবুত, শক্ত, অনমনীয়। কিন্তু, ফুটন্ত পানির মধ্যে থেকে তা হয়ে গেল নরম ও দুর্বল।
ডিমটি ছিল নাজুক, ভঙ্গুর। এটির পাতলা বহিরাবরন এর ভেতরের তরল অংশটির সংরক্ষন করছিল। কিন্তু ফুটন্ত পানির তাপ এর ভেতরকে শক্ত করে ফেলল।
চায়ের বৈশিষ্ট্য ছিল সবচেয়ে ভিন্ন। ফুটন্ত পানিতে ছড়িয়ে গিয়ে এটি পানিকেই বদলে ফেলল।
মা তার মেয়েকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এর কোনটির মতো?’
‘যখন প্রতিকূলতা আপনার দরজায় কড়া নাড়ে, আপনি কিভাবে সাড়া দেন? গাজরের মতো, ডিমের মতো, নাকি চায়ের মতো?’
ভেবে দেখুনঃ আমি কিসের মতো?
আমি কি সেই গাজরের মতো যে কিনা দেখতে মজবুত, অনমনীয়; কিন্তু কষ্টে ও প্রতিকূলতায় আমি কি নুয়ে পড়ি আর দুর্বল হয়ে যাই এবং শক্তিহীন হয়ে পড়ি?
আমি কি সেই ডিমের মতো যার অন্তর প্রথমে নমনীয় থাকে, পরে তাপে-কষ্টে পরিবর্তিত হয়ে যায়? আমি কি চঞ্চল মনের অধিকারী ছিলাম…কিন্তু কারও মৃত্যু, কোন সম্পর্কের ছেদ, কোন আর্থিক দৈন্যতা অথবা অন্য কোন পরীক্ষায় আমি শক্ত ও কঠোর হয়ে গেছি?
নাকি আমি চায়ের মতো? যা গরম পানিটিকেই বদলে দেয়, সেই পরিস্থিতিকেই বদলে ফেলে যা কষ্ট দিতে এসেছিল। চায়ের বেলায়, পানি যখন গরম হয়ে যায়, চা তখন তার সুঘ্রান ও স্বাদ আশেপাশে ছড়িয়ে দেয়। আপনি যদি চায়ের মতো হয়ে থাকেন, তাহলে যখন আপনার চারপাশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, আপনার তখন আরও উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং আপনার জন্য চারপাশের পরিস্থিতি আপনার পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
যখন অন্ধকার আচ্ছন্ন করে ফেলে আর বড় বড় পরীক্ষা আসে, আপনি কি আত্মোন্নয়নে আরেকটু এগিয়ে যান? আপনি কিভাবে প্রতিকূলতাকে সামলান?
আপনি কি গাজর, ডিম না চায়ের মতো?
এমন নয় যে সুখী মানুষদের সবকিছু সেরা অবস্থায় থাকে; তারা তাদের চলার পথে যার মুখোমুখি হয় তারই ভালটুকু গ্রহন করে এগিয়ে যেতে পারে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য কিছু অতীত ভুলে যেতে হয়; যদি অতীতের ব্যর্থতার গ্লানি, হৃদয়ের ক্ষত কাটিয়ে না উঠতে পারেন আপনি জীবনে সামনে এগোতে পারবেন না।
আপনি যখন জন্মেছিলেন, আপনি কাঁদছিলেন আর আপনার আশেপাশের সবাই হাসছিল। জীবনে এমন ভাবে বাঁচুন, যেন জীবনের শেষ মুহূর্তে আপনি হাসতে পারেন আর আপনার জন্য সবাই কাঁদে।
আপনি হয়তো এই কথাগুলো তাদেরকে জানাতে চাইবেন, যারা আপনার প্রিয় (যেমনটি আমি করেছি); যারা কোন না কোনভাবে আপনার জীবনকে ছুঁয়ে গেছে; যারা আপনার মুখে হাসি ফুটিয়েছে যখন তা আপনার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিল; যারা আপনাকে কোন কিছুর ভাল দিকটি দেখিয়েছেন যখন আপনি হতাশায় ছিলেন; যাদের বন্ধুত্ব আপনার কাছে খুবই মুল্যবান; যারা আপনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
একজন বয়স্ক মানুষকে বদলানোর চেয়ে একটি শিশুকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা সহজ…
আমরা যেন সবাই সেই চায়ের গুনটি অর্জন করতে পারি।
ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য জাযাকাল্লাহ খায়ের।
অনেকেই আমার কাছে আমার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে জানতে চান এবং আমি তাদেরকে খুব সংক্ষেপেই আমার ঘটনাটা বলে থাকি। কিন্তু আজ আমি আপনাদের সাথে আমার কাহিনীর পুরোটাই শেয়ার করতে চাই কিভাবে আমি এই সত্য ও সুন্দরের ধর্ম ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় গ্রহণ করলাম।
প্রায় আট বছর আগের কথা বলছি; হঠাৎ একদিন এক অদ্ভুত রকমের স্বপ্ন দেখলাম; বিশ্বাস করুন, একেবারেই অদ্ভুত এক স্বপ্ন; স্বপ্নটা কোনভাবেই মেলাতে পারছিলাম না। স্বপ্নটা কতটা অদ্ভুত তা গল্পের বাকিটা পড়লেই বুঝতে পারবেন…
ঘটনার প্রথম সূত্রপাত ২০০২ সালেঃ
আ্যকাউনটিং বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য কিছুদিন আগেই আমাকে নিজ শহর ছেড়ে পাশের উপশহরে আসতে হয়েছে। নতুন জায়গা, আশপাশের মানুষরা সব অপরিচিত, নতুন পড়াশোনা-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল স্কুলের প্রথমদিনটার কথা। প্রথম যেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম সেদিনও ঠিক এমনটাই মনে হয়েছিল।
.
কলেজের প্রথম দিন; প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছে প্রায় পনেরো মিনিট হল। দেখলাম মেয়েটি ক্লাসে প্রবেশ করল। হয়ত এমনিতেই খুব বেশী মনোযোগ দিতাম না ওর দিকে কিন্তু দিলাম কারন আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে ওর মতো কাউকে দেখিনি কখনো। আর যদিও বা দুই একজনকে দেখা যায় তাদের দিকে মানুষের দৃষ্টি থাকে ঘৃণা আর অবজ্ঞার। মেয়েটির নাম ফাতিমা; লেবাননের মেয়ে; ইসলামি হিজাবে আপদমস্তক ঢাকা।
একটু পরেই শুরু হবে দ্বিতীয় ক্লাস; ক্লাসে ঢুকতেই ফাতিমার দিকে চোখ পড়ল। কেন জানিনা ওর দিকে তাকাতেই মনে হল ও আমার অনেক দিনের পরিচিত কেউ। ওকে জিজ্ঞাস করলাম, “তোমার পাশে বসতে পারি?”…সেই যে শুরু বন্ধুত্বের, আলহামদুলিল্লাহ্, এতো বছর পরেও আমরা একে অপরের বন্ধু। পুরো কলেজ লাইফে আমরা ছিলাম একেবারে আত্মার আত্মীয়। আমাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা দেখে শিক্ষকরা বলাবলি করতেন আমরা সম্ভবত দু’বোন।
কলেজের ঐ বছরগুলোতে আমি নিজে একজন খ্রিষ্টান হওয়া সত্ত্বেও ফাতিমার ধর্মের (ইসলাম) ব্যাপারে ছিলাম চরম আগ্রহী। সেও যতটুকু জানত আমার সাথে শেয়ার করত। দেখতাম ইসলাম সম্পর্কে কথা বলার সময় তার চোখ দুটো কেমন স্পৃহায় ছলছল করে উঠত। আর এই ব্যাপারটি আমাকে খুব নাড়া দিত। কারণ আমিও একটা ধর্মের অনুসারী অথচ আমার মাঝে ঐ ধরনের কোন বিষয় কাজ করতনা। এমনকি মাঝে মাঝে আমরা আন্তঃধর্ম বিতর্কের আয়োজন করতাম যেখানে আমি কথা বলতে গিয়ে প্রায় রেগে যেতাম যখন দেখতাম নিজের ধর্মের অনেক বিষয়ই আমার জানা নেই বা তার করা কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিনা। তবে ফাতিমার প্রতি ছিল আমার অগাদ শ্রদ্ধাবোধ। আমার এখনও মনে আছে আমি ভাবতাম কি করে ফাতিমা দিনে পাঁচ পাঁচবার করে সালাত আদায়ের জন্য ওজু করত, গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরেও নিজেকে হিজাব পরে ঢেকে রাখত, রমজান মাসে সারাদিন না খেয়ে রোজা রাখত এমন আরো অনেক বিষয়। অথচ নিজেকে একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান বলে ভাবলেও অনন্ত রবিবার করেও চার্চে যাওয়া হয়ে উঠত না আমার।
আমরা দু’জন দুই ধর্মের হলেও আমাদের জীবন যাত্রার অন্যান্য বিষয়গুলো ছিল একই ধরনের। আমি কখনই ছেলেদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতাম না। আর সত্যি কথা বলতে কি, এসব ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই আমার একধরনের লজ্জাবোধ কাজ করে। তবে যে ব্যাপারটি ফাতিমার জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল তা হল আমি কখনই খোলামেলা পোশাক পরতাম না যেটা ফাতিমা আর আমার ভিতর সাদৃশ্যগুলোর অন্যতম। একদিন ফাতিমা আর আমি কলেজের ভিতর দিয়ে হেঁটে দুপুরের খাবারে জন্য আমাদের একটা নির্ধারিত জায়গায় যাচ্ছিলাম। আমরা প্রায় ওখানেই খাই। কিন্তু আজ যখন ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন একটি ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। জায়গাটার দিকে ভালো করে খেয়াল করতেই মনে পড়ল সেই অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা যেটা একবছর আগে কলেজে ভর্তির শুরুতেই দেখেছিলাম।
মনে পড়ে গেল আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম আমি যেন একটা হিজাব পরা মেয়েকে আমার ডান পাশে নিয়ে কোথাও হেঁটে যাচ্ছি। আর জায়গাটা ঠিক আজকের এই জায়গা। অন্য কেউ হলে হয়ত স্বপ্নে কি দেখল বা দেখেছিল তা নিয়ে মাথা ঘামাতো না। কিন্তু স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার এমন অসম্ভব মিল দেখে আমি একেবারেই হতবাক হয়ে গেলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি আর হাঁটতে পারছিলাম না। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমি ফাতিমাকে বললাম, “কি আশ্চর্য! এটা কি করে সম্ভব!! আমি তো এটা স্বপ্নে দেখেছি!!” এমন তো নয় যে ফাতিমার আগে আমার মুসলিম কোন বন্ধু ছিল বা আমি কোনভাবে কাউকে চিনতাম। তাহলে না হয় বলতাম তাদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি আর তাই হয়ত স্বপ্নে দেখেছি। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেও কখনো আমি এই কলেজে প্রবেশ করিনি। অথচ হুবহু আমাদের খাওয়ার সে জায়গাটায় স্বপ্নে দেখেছি। এই বিষয়টিই আমার কাছে বেশী আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল। যাই হোক, অনেকেই হয়ত বলবেন এই আর এমনকি, স্বপ্ন নিয়ে কে আর এতো মাথা ঘামায়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ঐ স্বপ্ন ছিল আমার জন্য আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট হেদায়াতের নিদর্শন এবং ফাতিমা আর আমার বন্ধুত্ব হল তাঁরই ইচ্ছার প্রতিফলন। ফাতিমার মাধ্যমেই আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন আমাকে ইসলামের সাথে পরিচিত করালেন।
সেদিনের পর থেকে এক অজ্ঞাত কারনে ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ বহুগুণে বাড়তে থাকে। আমি ফাতিমাকে ইসলাম বিষয়ে অনেক অনেক প্রশ্ন করতে থাকি। লক্ষ্য করি, নিজ ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস ও আস্থা ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। আমার নীতি হল আমি যদি কোন বিষয়ে একবার সন্দেহ পোষণ করি এবং নিজেকে প্রশ্ন করে সন্দেহের কোন জবাব না পাই তাহলে ধরে নিই যে আমার সন্দেহ বাস্তব এবং আমার বিশ্বাসে গোলমাল আছে।
আমার সকল সন্দেহের অবসান হল যেদিন ফাতিমা আমাকে আহমেদ দিদাত (রাহিমাহুল্লাহ্) এর সাথে খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের বিতর্কের কয়েকটি ডিভিডি দিল। দিনটি ছিল সত্যিই আমার জীবনকে বদলে দেয়ার দিন। বিতর্কগুলো দেখার পর আমার অন্তর চক্ষু দিয়ে উপলব্ধি করলাম এতোদিন যে ধর্মকে পুঁজি করে বেঁচে আছি তা আসলে সত্য নয়। আমি দেখলাম কোন একজন খ্রিষ্টান পণ্ডিতও আমার তথাকথিত ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহগুলোর সত্য উত্তর দিতে পারেনি। তাহলে আমি কি করে নিজে নিজে আমার সন্দেহ দূর করতে পারি? আমি সত্যিই হতবাক হয়ে গেলাম!! বিশ্বাস করুন, একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। ফাতিমার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ কেঁদে ফেললাম। আর কাঁদতে কাঁদতেই বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমার বারবার মনে হতে লাগল, “সর্বনাশ!! আমি এতদিন কী করেছি!!”
আমি তখন আমার সাবেক বয়ফ্রেন্ডের সাথে থাকতাম। সেও নিজেকে একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান বলে মনে করত। আমার ভেঙ্গেপড়া দেখে ও আমাকে সান্তনা দিতে লাগল। ও আসলে বোঝাতে চাচ্ছিল যে ফাতিমা ইসলামের ব্যাপারে আমার মগজধোলাই করার চেষ্টা করছে। প্রথমে শুনে আমারও খানিকটা তাই মনে হল। পরের দিন ফাতিমার কাছে গিয়ে বললাম যে আমি আর ধর্ম নিয়ে তার সাথে কোন কথা বলতে চাই না। উত্তরে ফাতিমা যা বলল তা খুবই সহজ!! কি বলল জানেন? ও বলল, “তোমার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া আমার কর্তব্য ছিল। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। ইসলাম মানবে কি না মানবে সেটা নিতান্তই তোমার ব্যাপার। শেষ বিচারের দিন তুমি আমাকে এই বলে দোষ দিতে পারবে না যে আমি তোমাকে ইসলামের দাওয়াত দেয়নি।”
বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। আমি আর ফাতিমা এখনও আগের মতোই ভাল বন্ধু। ইতোমধ্যেই আমি ফাতিমার পরিবারের সাথে অনেক বেশী সময় কাটাতে শুরু করেছি। ফলে ইসলাম সম্পর্কেও আমার জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। তাদের সাথে থাকতেও আমার ভাল লাগে। তাদের ওখানে নেই কোন মদ্যপানের আসর বা কোনরকম হারাম কাজকর্ম। এখনও মনে হয় ঐ সময়টা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আটটি বছর আমি আমার বিশ্বাসের চড়াই-উৎরাই দেখলাম। মনে হল যেন আল্লাহ্ আমাকে ইসলামের সঠিক পথ দেখানোর আগেই অন্যান্য মিথ্যা পথগুলো ভালভাবে চিনিয়ে দিলেন।
ইসলামে আসার আগে আমার প্রথম পর্যায়টা ছিল অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। কোন ধর্মই আমার ছিল না তখন, না খ্রিশ্চিয়ানিটি না ইসলাম। আমি প্রথমে কোনটাই জানতাম না ফলে মানতামও না।
আমার দ্বিতীয় পর্যায়টা ছিল বিদ্রোহপূর্ণ। আপনজন কারোর কথাতেই আমি কর্ণপাত করতাম না। সকলকে ত্যাগ করে মত্ত ছিলাম শয়তানি কর্মকাণ্ডে।
২০০৮ সালটি ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে ভয়াবহ। চরম ভুগেছি ঐ বছর। নিজের সাথে লড়েছি। জর্জরিত থেকেছি হাজারো সমস্যায়। যেন জীবন গিয়ে সর্বনাশের অতল গহীনে ঠেকেছিল। ঐ বছরই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় আমার সাত বছরের প্রেমিকের সাথে। সবখানেই আঘাত আর আঘাত। ভাল সব বন্ধুরা পর হয়ে যেতে থাকে, এসে জুটে যতসব খারাপের দল। পরিবারের একজন মানুষের সাথেও ভাল ব্যবহার করতে পারছিলাম না। আর ঐ সময়টাতেই আমি ফাতিমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতাম। নিজের কাছেই নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমি চাইনি ফাতিমা আমাকে ঐ অবস্থায় দেখা দুঃখ পাক।
হঠাৎ মনে হল, “এসবের মানে কি? কেন এই অপরাধ বোধ? আমি কেন ফাতিমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি? সে তো আমরা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু; আমি যা করছি তা ভুল হলে কেন তা করছি?” এমন হাজারো প্রশ্ন মনে উদয় হতে লাগল। আমি তখনও জানতাম আমি যা করছিলাম তা আল্লাহ্ পছন্দ করেন না এবং আমি ওসব কাজ বন্ধ না করলে নির্ঘাত জাহান্নামে যেতে হবে। এসব ভাবতাম এবং লজ্জিত হতাম। ফাতিমার মাধ্যমেই আমার ইসলামের সাথে যোগসূত্র। তার ওসীলায় ইসলামকে সত্য বলে জানার সুযোগ হয়েছে। তাই আমার কাছে মনে হল আমি আসলে ফাতিমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি না বরং আল্লাহ্র কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছি যা অসম্ভব।
শেষ পর্যায়টা ছিল আমার জন্য অনেকটা সতর্ক সংকেতের মত। শেষবার দেখা হল আরেকজন মুসলিমের সাথে; তার সাথে দেখা হওয়াটাই বলতে গেলে আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মত ঘটনা। সে আমাকে অনেকটা জোর করেই খারাপ কাজগুলো থেকে বাধা দিতে শুরু করল। শুনে অবাক লাগতে পারে কিন্তু সত্যি হল আমি ঐ সময়টাতে কারোর কোন কথাই শুনতাম না। আর তাই হয়ত বাধ্য হয়েই সে আমার উপর জোর খাটাতে শুরু করল। আলহামদুলিল্লাহ্, সে সময়মত আমার জীবনে হাজির হয়েছিল। আমি তখন যে মানসিক অবস্থার মধ্যে ছিলাম তাতে মনে হয়না যে কোন খ্রিষ্টান, বা ইহুদী এমনকি কোন নাস্তিক আমার ঐ মানসিক খট্কা দূর করতে পারত।
ফাতিমার দেয়া ডিভিডিগুলো দেখার দিন থেকেই আমি জানতাম আমি ইসলাম গ্রহণ করব। শুধু একটা শেষ ধাক্কা বাকি ছিল। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। তিনি আট বছর আগে আমাকে একটি হিজাব পরা মেয়েকে (যে পরে হল আমার বেস্ট ফ্রেইন্ড) স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে ইসলাম সত্য। তিনি আমাকে দেখিয়েছেন স্রষ্টায় বিশ্বাস না করার কি কষ্ট; তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিষিদ্ধ জীবন যাপন কতটা যন্ত্রণাদায়ক; অবশেষে তিনি আমাকে ইসলাম উপহার দিয়ে দেখিয়েছেন মানব জীবনে প্রকৃত সুখ কোথায়।
অবশেষে আমি ২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারি সাক্ষ্য দেয় যে, “আল্লাহ্ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) তাঁর দাস এবং বার্তাবাহক।” এই সাক্ষ্য দেয়ার সময় আমার সত্যিকারের বন্ধু ফাতিমা ও তার বাবা আমার পাশেই ছিলেন।
আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহ্ আমাকে মুলসিম হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।
প্রায় আট বছর আগের কথা বলছি; হঠাৎ একদিন এক অদ্ভুত রকমের স্বপ্ন দেখলাম; বিশ্বাস করুন, একেবারেই অদ্ভুত এক স্বপ্ন; স্বপ্নটা কোনভাবেই মেলাতে পারছিলাম না। স্বপ্নটা কতটা অদ্ভুত তা গল্পের বাকিটা পড়লেই বুঝতে পারবেন…
ঘটনার প্রথম সূত্রপাত ২০০২ সালেঃ
আ্যকাউনটিং বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য কিছুদিন আগেই আমাকে নিজ শহর ছেড়ে পাশের উপশহরে আসতে হয়েছে। নতুন জায়গা, আশপাশের মানুষরা সব অপরিচিত, নতুন পড়াশোনা-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল স্কুলের প্রথমদিনটার কথা। প্রথম যেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম সেদিনও ঠিক এমনটাই মনে হয়েছিল।
.
কলেজের প্রথম দিন; প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছে প্রায় পনেরো মিনিট হল। দেখলাম মেয়েটি ক্লাসে প্রবেশ করল। হয়ত এমনিতেই খুব বেশী মনোযোগ দিতাম না ওর দিকে কিন্তু দিলাম কারন আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে ওর মতো কাউকে দেখিনি কখনো। আর যদিও বা দুই একজনকে দেখা যায় তাদের দিকে মানুষের দৃষ্টি থাকে ঘৃণা আর অবজ্ঞার। মেয়েটির নাম ফাতিমা; লেবাননের মেয়ে; ইসলামি হিজাবে আপদমস্তক ঢাকা।
একটু পরেই শুরু হবে দ্বিতীয় ক্লাস; ক্লাসে ঢুকতেই ফাতিমার দিকে চোখ পড়ল। কেন জানিনা ওর দিকে তাকাতেই মনে হল ও আমার অনেক দিনের পরিচিত কেউ। ওকে জিজ্ঞাস করলাম, “তোমার পাশে বসতে পারি?”…সেই যে শুরু বন্ধুত্বের, আলহামদুলিল্লাহ্, এতো বছর পরেও আমরা একে অপরের বন্ধু। পুরো কলেজ লাইফে আমরা ছিলাম একেবারে আত্মার আত্মীয়। আমাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা দেখে শিক্ষকরা বলাবলি করতেন আমরা সম্ভবত দু’বোন।
কলেজের ঐ বছরগুলোতে আমি নিজে একজন খ্রিষ্টান হওয়া সত্ত্বেও ফাতিমার ধর্মের (ইসলাম) ব্যাপারে ছিলাম চরম আগ্রহী। সেও যতটুকু জানত আমার সাথে শেয়ার করত। দেখতাম ইসলাম সম্পর্কে কথা বলার সময় তার চোখ দুটো কেমন স্পৃহায় ছলছল করে উঠত। আর এই ব্যাপারটি আমাকে খুব নাড়া দিত। কারণ আমিও একটা ধর্মের অনুসারী অথচ আমার মাঝে ঐ ধরনের কোন বিষয় কাজ করতনা। এমনকি মাঝে মাঝে আমরা আন্তঃধর্ম বিতর্কের আয়োজন করতাম যেখানে আমি কথা বলতে গিয়ে প্রায় রেগে যেতাম যখন দেখতাম নিজের ধর্মের অনেক বিষয়ই আমার জানা নেই বা তার করা কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিনা। তবে ফাতিমার প্রতি ছিল আমার অগাদ শ্রদ্ধাবোধ। আমার এখনও মনে আছে আমি ভাবতাম কি করে ফাতিমা দিনে পাঁচ পাঁচবার করে সালাত আদায়ের জন্য ওজু করত, গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরেও নিজেকে হিজাব পরে ঢেকে রাখত, রমজান মাসে সারাদিন না খেয়ে রোজা রাখত এমন আরো অনেক বিষয়। অথচ নিজেকে একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান বলে ভাবলেও অনন্ত রবিবার করেও চার্চে যাওয়া হয়ে উঠত না আমার।
আমরা দু’জন দুই ধর্মের হলেও আমাদের জীবন যাত্রার অন্যান্য বিষয়গুলো ছিল একই ধরনের। আমি কখনই ছেলেদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতাম না। আর সত্যি কথা বলতে কি, এসব ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই আমার একধরনের লজ্জাবোধ কাজ করে। তবে যে ব্যাপারটি ফাতিমার জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল তা হল আমি কখনই খোলামেলা পোশাক পরতাম না যেটা ফাতিমা আর আমার ভিতর সাদৃশ্যগুলোর অন্যতম। একদিন ফাতিমা আর আমি কলেজের ভিতর দিয়ে হেঁটে দুপুরের খাবারে জন্য আমাদের একটা নির্ধারিত জায়গায় যাচ্ছিলাম। আমরা প্রায় ওখানেই খাই। কিন্তু আজ যখন ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন একটি ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। জায়গাটার দিকে ভালো করে খেয়াল করতেই মনে পড়ল সেই অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা যেটা একবছর আগে কলেজে ভর্তির শুরুতেই দেখেছিলাম।
মনে পড়ে গেল আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম আমি যেন একটা হিজাব পরা মেয়েকে আমার ডান পাশে নিয়ে কোথাও হেঁটে যাচ্ছি। আর জায়গাটা ঠিক আজকের এই জায়গা। অন্য কেউ হলে হয়ত স্বপ্নে কি দেখল বা দেখেছিল তা নিয়ে মাথা ঘামাতো না। কিন্তু স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার এমন অসম্ভব মিল দেখে আমি একেবারেই হতবাক হয়ে গেলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি আর হাঁটতে পারছিলাম না। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমি ফাতিমাকে বললাম, “কি আশ্চর্য! এটা কি করে সম্ভব!! আমি তো এটা স্বপ্নে দেখেছি!!” এমন তো নয় যে ফাতিমার আগে আমার মুসলিম কোন বন্ধু ছিল বা আমি কোনভাবে কাউকে চিনতাম। তাহলে না হয় বলতাম তাদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি আর তাই হয়ত স্বপ্নে দেখেছি। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেও কখনো আমি এই কলেজে প্রবেশ করিনি। অথচ হুবহু আমাদের খাওয়ার সে জায়গাটায় স্বপ্নে দেখেছি। এই বিষয়টিই আমার কাছে বেশী আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল। যাই হোক, অনেকেই হয়ত বলবেন এই আর এমনকি, স্বপ্ন নিয়ে কে আর এতো মাথা ঘামায়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ঐ স্বপ্ন ছিল আমার জন্য আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট হেদায়াতের নিদর্শন এবং ফাতিমা আর আমার বন্ধুত্ব হল তাঁরই ইচ্ছার প্রতিফলন। ফাতিমার মাধ্যমেই আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন আমাকে ইসলামের সাথে পরিচিত করালেন।
সেদিনের পর থেকে এক অজ্ঞাত কারনে ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ বহুগুণে বাড়তে থাকে। আমি ফাতিমাকে ইসলাম বিষয়ে অনেক অনেক প্রশ্ন করতে থাকি। লক্ষ্য করি, নিজ ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস ও আস্থা ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। আমার নীতি হল আমি যদি কোন বিষয়ে একবার সন্দেহ পোষণ করি এবং নিজেকে প্রশ্ন করে সন্দেহের কোন জবাব না পাই তাহলে ধরে নিই যে আমার সন্দেহ বাস্তব এবং আমার বিশ্বাসে গোলমাল আছে।
আমার সকল সন্দেহের অবসান হল যেদিন ফাতিমা আমাকে আহমেদ দিদাত (রাহিমাহুল্লাহ্) এর সাথে খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের বিতর্কের কয়েকটি ডিভিডি দিল। দিনটি ছিল সত্যিই আমার জীবনকে বদলে দেয়ার দিন। বিতর্কগুলো দেখার পর আমার অন্তর চক্ষু দিয়ে উপলব্ধি করলাম এতোদিন যে ধর্মকে পুঁজি করে বেঁচে আছি তা আসলে সত্য নয়। আমি দেখলাম কোন একজন খ্রিষ্টান পণ্ডিতও আমার তথাকথিত ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহগুলোর সত্য উত্তর দিতে পারেনি। তাহলে আমি কি করে নিজে নিজে আমার সন্দেহ দূর করতে পারি? আমি সত্যিই হতবাক হয়ে গেলাম!! বিশ্বাস করুন, একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। ফাতিমার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ কেঁদে ফেললাম। আর কাঁদতে কাঁদতেই বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমার বারবার মনে হতে লাগল, “সর্বনাশ!! আমি এতদিন কী করেছি!!”
আমি তখন আমার সাবেক বয়ফ্রেন্ডের সাথে থাকতাম। সেও নিজেকে একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান বলে মনে করত। আমার ভেঙ্গেপড়া দেখে ও আমাকে সান্তনা দিতে লাগল। ও আসলে বোঝাতে চাচ্ছিল যে ফাতিমা ইসলামের ব্যাপারে আমার মগজধোলাই করার চেষ্টা করছে। প্রথমে শুনে আমারও খানিকটা তাই মনে হল। পরের দিন ফাতিমার কাছে গিয়ে বললাম যে আমি আর ধর্ম নিয়ে তার সাথে কোন কথা বলতে চাই না। উত্তরে ফাতিমা যা বলল তা খুবই সহজ!! কি বলল জানেন? ও বলল, “তোমার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া আমার কর্তব্য ছিল। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। ইসলাম মানবে কি না মানবে সেটা নিতান্তই তোমার ব্যাপার। শেষ বিচারের দিন তুমি আমাকে এই বলে দোষ দিতে পারবে না যে আমি তোমাকে ইসলামের দাওয়াত দেয়নি।”
বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। আমি আর ফাতিমা এখনও আগের মতোই ভাল বন্ধু। ইতোমধ্যেই আমি ফাতিমার পরিবারের সাথে অনেক বেশী সময় কাটাতে শুরু করেছি। ফলে ইসলাম সম্পর্কেও আমার জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। তাদের সাথে থাকতেও আমার ভাল লাগে। তাদের ওখানে নেই কোন মদ্যপানের আসর বা কোনরকম হারাম কাজকর্ম। এখনও মনে হয় ঐ সময়টা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আটটি বছর আমি আমার বিশ্বাসের চড়াই-উৎরাই দেখলাম। মনে হল যেন আল্লাহ্ আমাকে ইসলামের সঠিক পথ দেখানোর আগেই অন্যান্য মিথ্যা পথগুলো ভালভাবে চিনিয়ে দিলেন।
ইসলামে আসার আগে আমার প্রথম পর্যায়টা ছিল অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। কোন ধর্মই আমার ছিল না তখন, না খ্রিশ্চিয়ানিটি না ইসলাম। আমি প্রথমে কোনটাই জানতাম না ফলে মানতামও না।
আমার দ্বিতীয় পর্যায়টা ছিল বিদ্রোহপূর্ণ। আপনজন কারোর কথাতেই আমি কর্ণপাত করতাম না। সকলকে ত্যাগ করে মত্ত ছিলাম শয়তানি কর্মকাণ্ডে।
২০০৮ সালটি ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে ভয়াবহ। চরম ভুগেছি ঐ বছর। নিজের সাথে লড়েছি। জর্জরিত থেকেছি হাজারো সমস্যায়। যেন জীবন গিয়ে সর্বনাশের অতল গহীনে ঠেকেছিল। ঐ বছরই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় আমার সাত বছরের প্রেমিকের সাথে। সবখানেই আঘাত আর আঘাত। ভাল সব বন্ধুরা পর হয়ে যেতে থাকে, এসে জুটে যতসব খারাপের দল। পরিবারের একজন মানুষের সাথেও ভাল ব্যবহার করতে পারছিলাম না। আর ঐ সময়টাতেই আমি ফাতিমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতাম। নিজের কাছেই নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমি চাইনি ফাতিমা আমাকে ঐ অবস্থায় দেখা দুঃখ পাক।
হঠাৎ মনে হল, “এসবের মানে কি? কেন এই অপরাধ বোধ? আমি কেন ফাতিমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি? সে তো আমরা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু; আমি যা করছি তা ভুল হলে কেন তা করছি?” এমন হাজারো প্রশ্ন মনে উদয় হতে লাগল। আমি তখনও জানতাম আমি যা করছিলাম তা আল্লাহ্ পছন্দ করেন না এবং আমি ওসব কাজ বন্ধ না করলে নির্ঘাত জাহান্নামে যেতে হবে। এসব ভাবতাম এবং লজ্জিত হতাম। ফাতিমার মাধ্যমেই আমার ইসলামের সাথে যোগসূত্র। তার ওসীলায় ইসলামকে সত্য বলে জানার সুযোগ হয়েছে। তাই আমার কাছে মনে হল আমি আসলে ফাতিমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি না বরং আল্লাহ্র কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছি যা অসম্ভব।
শেষ পর্যায়টা ছিল আমার জন্য অনেকটা সতর্ক সংকেতের মত। শেষবার দেখা হল আরেকজন মুসলিমের সাথে; তার সাথে দেখা হওয়াটাই বলতে গেলে আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মত ঘটনা। সে আমাকে অনেকটা জোর করেই খারাপ কাজগুলো থেকে বাধা দিতে শুরু করল। শুনে অবাক লাগতে পারে কিন্তু সত্যি হল আমি ঐ সময়টাতে কারোর কোন কথাই শুনতাম না। আর তাই হয়ত বাধ্য হয়েই সে আমার উপর জোর খাটাতে শুরু করল। আলহামদুলিল্লাহ্, সে সময়মত আমার জীবনে হাজির হয়েছিল। আমি তখন যে মানসিক অবস্থার মধ্যে ছিলাম তাতে মনে হয়না যে কোন খ্রিষ্টান, বা ইহুদী এমনকি কোন নাস্তিক আমার ঐ মানসিক খট্কা দূর করতে পারত।
ফাতিমার দেয়া ডিভিডিগুলো দেখার দিন থেকেই আমি জানতাম আমি ইসলাম গ্রহণ করব। শুধু একটা শেষ ধাক্কা বাকি ছিল। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। তিনি আট বছর আগে আমাকে একটি হিজাব পরা মেয়েকে (যে পরে হল আমার বেস্ট ফ্রেইন্ড) স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে ইসলাম সত্য। তিনি আমাকে দেখিয়েছেন স্রষ্টায় বিশ্বাস না করার কি কষ্ট; তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিষিদ্ধ জীবন যাপন কতটা যন্ত্রণাদায়ক; অবশেষে তিনি আমাকে ইসলাম উপহার দিয়ে দেখিয়েছেন মানব জীবনে প্রকৃত সুখ কোথায়।
অবশেষে আমি ২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারি সাক্ষ্য দেয় যে, “আল্লাহ্ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) তাঁর দাস এবং বার্তাবাহক।” এই সাক্ষ্য দেয়ার সময় আমার সত্যিকারের বন্ধু ফাতিমা ও তার বাবা আমার পাশেই ছিলেন।
আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহ্ আমাকে মুলসিম হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।
লেখিকাঃ মুসাম্মাৎ শারমীন আখতার
প্রখ্যাত ছাহাবী আবু নাজীহ আমর ইবনু আবাসাহ আস-সুলামী ইসলামের প্রাথমিক যুগেই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেকে ধন্য করে ছিলেন। মাক্কী জীবনেই রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন গোপনে ইসলামের দাওয়াত দেন, সে সময় তিনি মক্কায় এসে রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কিছু প্রশ্ন করে নিশ্চিত হন যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহ্র রাসূল, তখন তিনি ইসলাম কবুল করেন। রাসূলের নিকট থেকে দ্বীন সম্পর্কে শিক্ষা নিয়ে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী নিজ এলাকায় চলে যান। অতঃপর রাসূল মদীনায় হিজরত করলে তিনিও মদীনায় রাসূলের খেদমতে হাযির হন। এ ঘটনা সম্পর্কেই নিম্নের হাদীছ।-
আবু নাজীহ আমর ইবনু আবাসাহ আস-সুলামী (রাঃ) বলেন, জাহেলী যুগ থেকেই আমি ধারণা করতাম যে, লোকেরা পথভ্রষ্টতার উপর রয়েছে এবং এরা কোন ধর্মেই নেই, আর ওরা প্রতিমা পূজা করছে। অতঃপর আমি এক ব্যক্তির ব্যাপারে শুনলাম যে, তিনি মক্কায় অনেক আশ্চর্য খবর বলছেন। সুতরাং আমি আমার সওয়ারীর উপর বসে তাঁর কাছে এসে দেখলাম যে, তিনি আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)। তিনি গোপনে (ইসলাম প্রচার করছেন), আর তাঁর সম্প্রদায় (মুশরিকরা) তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহার করছে। সুতরাং আমি বিচক্ষণতার সাথে কাজ করলাম।
আমি মক্কায় তাঁর কাছে প্রবেশ করলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আপনি কে? তিনি বললেন, ‘আমি নবী’। আমি বললাম, নবী কি? তিনি বললেন, ‘আমাকে মহান আল্লাহ্ প্রেরণ করেছেন’। আমি বলাম, কি নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করেছেন? তিনি বললেন, ‘জ্ঞাতিবন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা, মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা, আলাহ্কে একক উপাস্য মানা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার নির্দেশ দিয়ে’। আমি বললাম, এ কাজে আপনার সঙ্গে কে আছে? তিনি বললেন, ‘একজন স্বাধীন এবং একজন কৃতদাস’। তখন তাঁর সঙ্গে আবু বকর ও বিলাল (রাঃ) ছিলেন। আমি বললাম, আমিও আপনার অনুগত। তিনি বললেন, ‘তুমি এখন এ কাজ কোন অবস্থাতেই করতে পারবে না। তুমি কি আমার অবস্থা ও লোকেদের অবস্থা দেখতে পাও না? অতএব তুমি (এখন) বাড়ি ফিরে যাও। অতঃপর যখন তুমি আমার জয়ী ও শক্তিশালী হওয়ার সংবাদ পাবে, তখন আমার কাছে এসো’।
সুতরাং আমি আমার পরিবার-পরিজনের নিকট চলে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় চলে এলেন। আর আমি স্বপরিবারেই ছিলাম। অতঃপর আমি খবরাখবর নিতে আরম্ভ করলাম এবং যখন তিনি মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি (তাঁর ব্যাপারে) লোকেদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। অবশেষে আমার পরিবারের কিছু লোক মদীনায় এল। আমি বললাম, ঐ লোকটার অবস্থা কি, যিনি (মক্কা ত্যাগ করে) মদীনায় এসেছেন? তারা বলল, লোকেরা তাঁর দিকে ধাবমান। তাঁর সম্প্রদায় তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হয়নি।
অতঃপর আমি মদীনায় এসে তাঁর খিদমতে হাযির হ’লাম। তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তো ঐ ব্যক্তি, যে মক্কায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলে’। আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা আমার অজানা, তা আমাকে বলুন? আমাকে ছালাত সম্পর্কে বলুন? তিনি বললেন, ‘তুমি ফজরের ছালাত পড়। তারপর সূর্য এক বলম বরাবর উঁচু হওয়া পর্যন্ত বিরত থাকো। কারণ তা শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যভাগে উদিত হয় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং সে সময় কাফেররা তাকে সিজদা করে। পুনরায় তুমি ছালাত আদায় কর। কেননা ছালাতে ফিরিশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন, যতক্ষণ না ছায়া বলমের সমান হয়ে যায়। অতঃপর ছালাত থেকে বিরত হও। কেননা তখন জাহান্নামের আগুন উস্কানো হয়। অতঃপর যখন ছায়া বাড়তে আরম্ভ করে, তখন ছালাত আদায় কর। কেননা এ ছালাতে ফিরিশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন। পরিশেষে তুমি আছরের ছালাত আদায় কর। অতঃপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছালাত আদায় করা থেকে বিরত থাকো। কেননা সূর্য শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যে অস্ত যায় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং তখন কাফেররা তাকে সিজদা করে’।
পুনরায় আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র নবী (ছাঃ)! আপনি আমাকে ওযূ সম্পর্কে বলুন? তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ পানি নিয়ে (হাত ধোয়ার পর) কুলি করবে এবং নাকে পানি নিয়ে ঝেড়ে পরিস্কার করবে, তার চেহারা, তার মুখ এবং নাকের গুনাহসমূহ ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন আল্লাহ্র আদেশ অনুযায়ী তার চেহারা ধৌত করে, তখন তার চেহারার পাপরাশি তার দাড়ির শেষ প্রান্তের পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার হাত দু’খানি কনুই পর্যন্ত ধোয়, তখন তার হাতের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন তার মাথা মাসাহ করে, তখন তার মাথার পাপরাশি চুলের ডগার পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার পা দু’খানি গাঁট পর্যন্ত ধৌত করে, তখন তার পায়ের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যদি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করে, আল্লাহ্র প্রশংসা ও তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে, যার তিনি যোগ্য এবং অন্তরকে আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য খালি করে, তাহ’লে সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে বেরিয়ে আসে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।
.
তারপর আমর ইবনে আবাসাহ (রাঃ) এ হাদীছটি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবী আবু উমামা (রাঃ)-এর নিকট বর্ণনা করলেন। আবু উমামাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আমর ইবনে আবাসাহ! তুমি যা বলছ, তা চিন্তা করে বল! একবার ওযূ করলেই কি এই ব্যক্তিকে এতটা মর্যাদা দেওয়া হবে? আমর বললেন, হে আবূ উমামাহ! আমার বয়স ঢের হয়েছে, আমার হাড় দুর্বল হয়ে গেছে এবং আমার মৃত্যুও নিকটবর্তী। (ফলে এ অবস্থায়) আল্লাহ্ তা‘আলা অথবা রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার কি প্রয়োজন আছে? যদি আমি এটি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট থেকে একবার, দু’বার, তিনবার এমনকি সাতবার পর্যন্ত না শুনতাম, তাহ’লে কখনই তা বর্ণনা করতাম না। কিন্তু আমি তাঁর নিকট এর চেয়েও অধিকবার শুনেছি’
(মুসলিম হা/৮৩২; নাসাঈ হা/১৪৭, ৫৭২, ৫৮৪; ইবনু মাজাহ হা/২৮৩, ১২৫১, ১৩৫৪; আহমাদ হা/১৬৫৬৬, ১৬৫৭১, ১৬৫৭৮, ১৬৫৮০, ১৮৯৪০)।
আমর ইবনু আবাসাহ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ ও তাঁর দ্বীনি ইলম অর্জনের প্রতি আগ্রহ-স্পৃহা ছিল অতুলনীয়। আমাদেরকেও তাঁর মত দ্বীনি শিক্ষার্জনে আগ্রহী ও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। আল্লাহ্ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন!
প্রখ্যাত ছাহাবী আবু নাজীহ আমর ইবনু আবাসাহ আস-সুলামী ইসলামের প্রাথমিক যুগেই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেকে ধন্য করে ছিলেন। মাক্কী জীবনেই রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন গোপনে ইসলামের দাওয়াত দেন, সে সময় তিনি মক্কায় এসে রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কিছু প্রশ্ন করে নিশ্চিত হন যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহ্র রাসূল, তখন তিনি ইসলাম কবুল করেন। রাসূলের নিকট থেকে দ্বীন সম্পর্কে শিক্ষা নিয়ে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী নিজ এলাকায় চলে যান। অতঃপর রাসূল মদীনায় হিজরত করলে তিনিও মদীনায় রাসূলের খেদমতে হাযির হন। এ ঘটনা সম্পর্কেই নিম্নের হাদীছ।-
আবু নাজীহ আমর ইবনু আবাসাহ আস-সুলামী (রাঃ) বলেন, জাহেলী যুগ থেকেই আমি ধারণা করতাম যে, লোকেরা পথভ্রষ্টতার উপর রয়েছে এবং এরা কোন ধর্মেই নেই, আর ওরা প্রতিমা পূজা করছে। অতঃপর আমি এক ব্যক্তির ব্যাপারে শুনলাম যে, তিনি মক্কায় অনেক আশ্চর্য খবর বলছেন। সুতরাং আমি আমার সওয়ারীর উপর বসে তাঁর কাছে এসে দেখলাম যে, তিনি আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)। তিনি গোপনে (ইসলাম প্রচার করছেন), আর তাঁর সম্প্রদায় (মুশরিকরা) তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহার করছে। সুতরাং আমি বিচক্ষণতার সাথে কাজ করলাম।
আমি মক্কায় তাঁর কাছে প্রবেশ করলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আপনি কে? তিনি বললেন, ‘আমি নবী’। আমি বললাম, নবী কি? তিনি বললেন, ‘আমাকে মহান আল্লাহ্ প্রেরণ করেছেন’। আমি বলাম, কি নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করেছেন? তিনি বললেন, ‘জ্ঞাতিবন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা, মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা, আলাহ্কে একক উপাস্য মানা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার নির্দেশ দিয়ে’। আমি বললাম, এ কাজে আপনার সঙ্গে কে আছে? তিনি বললেন, ‘একজন স্বাধীন এবং একজন কৃতদাস’। তখন তাঁর সঙ্গে আবু বকর ও বিলাল (রাঃ) ছিলেন। আমি বললাম, আমিও আপনার অনুগত। তিনি বললেন, ‘তুমি এখন এ কাজ কোন অবস্থাতেই করতে পারবে না। তুমি কি আমার অবস্থা ও লোকেদের অবস্থা দেখতে পাও না? অতএব তুমি (এখন) বাড়ি ফিরে যাও। অতঃপর যখন তুমি আমার জয়ী ও শক্তিশালী হওয়ার সংবাদ পাবে, তখন আমার কাছে এসো’।
সুতরাং আমি আমার পরিবার-পরিজনের নিকট চলে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় চলে এলেন। আর আমি স্বপরিবারেই ছিলাম। অতঃপর আমি খবরাখবর নিতে আরম্ভ করলাম এবং যখন তিনি মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি (তাঁর ব্যাপারে) লোকেদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। অবশেষে আমার পরিবারের কিছু লোক মদীনায় এল। আমি বললাম, ঐ লোকটার অবস্থা কি, যিনি (মক্কা ত্যাগ করে) মদীনায় এসেছেন? তারা বলল, লোকেরা তাঁর দিকে ধাবমান। তাঁর সম্প্রদায় তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হয়নি।
অতঃপর আমি মদীনায় এসে তাঁর খিদমতে হাযির হ’লাম। তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তো ঐ ব্যক্তি, যে মক্কায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলে’। আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা আমার অজানা, তা আমাকে বলুন? আমাকে ছালাত সম্পর্কে বলুন? তিনি বললেন, ‘তুমি ফজরের ছালাত পড়। তারপর সূর্য এক বলম বরাবর উঁচু হওয়া পর্যন্ত বিরত থাকো। কারণ তা শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যভাগে উদিত হয় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং সে সময় কাফেররা তাকে সিজদা করে। পুনরায় তুমি ছালাত আদায় কর। কেননা ছালাতে ফিরিশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন, যতক্ষণ না ছায়া বলমের সমান হয়ে যায়। অতঃপর ছালাত থেকে বিরত হও। কেননা তখন জাহান্নামের আগুন উস্কানো হয়। অতঃপর যখন ছায়া বাড়তে আরম্ভ করে, তখন ছালাত আদায় কর। কেননা এ ছালাতে ফিরিশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন। পরিশেষে তুমি আছরের ছালাত আদায় কর। অতঃপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছালাত আদায় করা থেকে বিরত থাকো। কেননা সূর্য শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যে অস্ত যায় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং তখন কাফেররা তাকে সিজদা করে’।
পুনরায় আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র নবী (ছাঃ)! আপনি আমাকে ওযূ সম্পর্কে বলুন? তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ পানি নিয়ে (হাত ধোয়ার পর) কুলি করবে এবং নাকে পানি নিয়ে ঝেড়ে পরিস্কার করবে, তার চেহারা, তার মুখ এবং নাকের গুনাহসমূহ ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন আল্লাহ্র আদেশ অনুযায়ী তার চেহারা ধৌত করে, তখন তার চেহারার পাপরাশি তার দাড়ির শেষ প্রান্তের পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার হাত দু’খানি কনুই পর্যন্ত ধোয়, তখন তার হাতের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন তার মাথা মাসাহ করে, তখন তার মাথার পাপরাশি চুলের ডগার পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার পা দু’খানি গাঁট পর্যন্ত ধৌত করে, তখন তার পায়ের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যদি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করে, আল্লাহ্র প্রশংসা ও তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে, যার তিনি যোগ্য এবং অন্তরকে আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য খালি করে, তাহ’লে সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে বেরিয়ে আসে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।
.
তারপর আমর ইবনে আবাসাহ (রাঃ) এ হাদীছটি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবী আবু উমামা (রাঃ)-এর নিকট বর্ণনা করলেন। আবু উমামাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আমর ইবনে আবাসাহ! তুমি যা বলছ, তা চিন্তা করে বল! একবার ওযূ করলেই কি এই ব্যক্তিকে এতটা মর্যাদা দেওয়া হবে? আমর বললেন, হে আবূ উমামাহ! আমার বয়স ঢের হয়েছে, আমার হাড় দুর্বল হয়ে গেছে এবং আমার মৃত্যুও নিকটবর্তী। (ফলে এ অবস্থায়) আল্লাহ্ তা‘আলা অথবা রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার কি প্রয়োজন আছে? যদি আমি এটি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট থেকে একবার, দু’বার, তিনবার এমনকি সাতবার পর্যন্ত না শুনতাম, তাহ’লে কখনই তা বর্ণনা করতাম না। কিন্তু আমি তাঁর নিকট এর চেয়েও অধিকবার শুনেছি’
(মুসলিম হা/৮৩২; নাসাঈ হা/১৪৭, ৫৭২, ৫৮৪; ইবনু মাজাহ হা/২৮৩, ১২৫১, ১৩৫৪; আহমাদ হা/১৬৫৬৬, ১৬৫৭১, ১৬৫৭৮, ১৬৫৮০, ১৮৯৪০)।
আমর ইবনু আবাসাহ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ ও তাঁর দ্বীনি ইলম অর্জনের প্রতি আগ্রহ-স্পৃহা ছিল অতুলনীয়। আমাদেরকেও তাঁর মত দ্বীনি শিক্ষার্জনে আগ্রহী ও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। আল্লাহ্ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন!
আমরা একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের একটা সময় অতিক্রম করছি এখন। সময়টা কঠিন যাচ্ছে। এমন কঠিন সময় হয়ত যুগে যুগেই নির্দিষ্ট বিরতি পর পর আসে। যুগের বিচার করলে আমাদের চলে না। আজ থেকে মাত্র ১০০ বছর আগে এই পৃথিবীতেই ঘটে গিয়েছিলো নারকীয় বিশ্বযুদ্ধ। হানাহানি-খাদ্যমন্দা-ক্ষমতা দখলের লড়াইতে ডুবে ছিলো সমগ্র বিশ্ব। অনেকেই অনেক অর্জন করেছে, তারপর বছর বিশ যেতে না যেতেই আবার আরো বড় ভয়ংকর সময় — সেই ক্ষমতা খাটানোর যুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকিকে বিষাক্ত করে দিয়ে লক্ষ লক্ষ প্রাণনাশ করে দিয়ে আমেরিকান জাতিগোষ্ঠী বিশ্বকে কব্জা করেছে আপন কৌশলে। অথচ তার দুইশ বছর আগেও ব্রিটিশ সূর্য ডুবতো না কোথাও। এমন আরো অজস্র চোখ দিয়ে দেখা যাবে “সময়”গুলো। আরেকটু উপরে উঠি? যখন সভ্যতাগুলো হারিয়ে গেলো। ফারাওদের মিশর, মেগাস্থিনিস, ব্যাবিলন, ইনকা, মায়া, পাল সাম্রাজ্য, সেনদের রাজত্ব, অটোমান এম্পায়ার -অমন শত শত সভ্যতা পাওয়া যাবে হয়ত যদি হিসেব করি এই সৃষ্টির শুরু থেকে। কিন্তু তাদের অমন হিসেব করে আমাদের লাভ নেই। সভ্যতা টেকে কয়েকশত বছর। আমরা বাঁচি খুব বেশি হলে অর্ধশত বছর।
আমরা বাস করছি বিদ্যুত সভ্যতায়। মাত্র দু’তিনশ বছর আগে উদ্ভাবিত বিদ্যুত দিয়ে গত পঞ্চাশ বছরে প্রযুক্তিতে উন্নত হয়েই মাটিতে আমাদের আর পা পড়েনা। আমরা বুর্জ আল আরব বানাই, আমরা বানাই পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, মনোহারি সিয়ার্স টাওয়ার, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, আইফেল টাওয়ার। আমরা দম্ভে আর বড়ত্বে গলা ফুলিয়ে দিই। অথচ প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চে যখন কয়েকটা হিমালয় ডুবে যাবে শুনি — মনে হয়না ওই উঁচু হিমালয়, আর অমন গভীর খানা-খন্দটা কে তৈরি করলো! প্রকৃতি নামের শব্দটা দিয়ে লেখকমহল চালিয়ে দেন অগভীর চিন্তার পাঠকদের মনকে বাঁকিয়ে দেবার জন্য — আমরাও সন্তুষ্ট হই। কিন্তু অমন পিরামিড বানালেন যারা, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর বা পিসার হেলানো মিনার যারা বানালেন — তারা কোথায় চলে গেলেন? মরে গেলেন তো কেন আর কোন চিহ্নই রইলো না তাদের? কত বেশি দুর্বল সেই সভ্যতার এই ধারক ও বাহকদল — কতনা ক্ষণস্থায়ী এই বিপুল দম্ভযজ্ঞ, সৃষ্টিযজ্ঞ আর ক্ষমতাযজ্ঞ!
এসব সভ্যতা আসবে যাবে। একসময় ‘আদ জাতি ছিলো, সামূদ জাতি ছিলো। দম্ভে আর জুলুমে তারা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো সবাইকে। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচাইতে ক্ষমতাধর জাতিকেও আল্লাহ এক মূহুর্তেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। কওমে লূতের মাঝে “সমকামিতা” প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিলো, তারা শুনেনি তাদের নবীর বলা কথাগুলো– মাটিচাপা পড়ে, প্রকট শব্দে কানে তালা লেগে সমস্ত জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। পবিত্র কুরআনে এই পৃথিবী আর নভোমন্ডলসহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেই দিয়েছেন– তিনি অনেক জাতিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন তাদের “কাজের জন্য”। তিনি জানিয়েছেন আমাদের মাঝে কেউ যদি তার দাসত্ব না করে, আল্লাহ তাদের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে সেখানে আরেকটা জাতিই সৃষ্টি করে দিতে পারেন — নিঃসন্দেহে এটা তার জন্য কোন ব্যাপারই না। কিন্তু আমরা যখন সেই কোন একটি জাতিস্বত্ত্বার অংশ — তখন সেটা আমাদের জন্য “ব্যাপার”। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য ব্যাপার। আমাদের একটা জীবন একবারের জন্যই। এই আত্মা, এই দেহ আর জীবন — একবারের জন্যই। আমরা নিশ্চয়ই অবলীলায় ভেসে দিতে পারিনা আমাদের জীবন — আমরা অবশ্যই চাইনা একটা নিশ্চিত ভয়ংকর পরিণতি। এমন উদ্দেশ্যহীন বর্বর লোভী, জালিম আর কামুক সমাজ তৈরি করে যে জাতি– তার অংশ হওয়ায় আমাদের ভালো কাজের অ্যাকাউন্টে অনেক কিছু জমা থাকলেও — সেই পুরো ব্যাঙ্কটাই মহান অধিপতি করে দিবেন “সিলড”। তাইতো খেয়ে দেয়ে, ঘুমিয়ে, চাকুরি করে দিন অতিক্রম করার পরেও মহান সর্বশক্তিমানের দাসত্বের কতখানি আমরা প্রত্যেকে/পরিবারসহ/ এই পুরো জাতি মিলে করছি তা চিন্তা করার দায় থেকে যায় সবারই। নইলে একদম শেষে সকল প্রাপ্তিই হয়ত মাল্টিপ্লাইড হবে শূণ্য দিয়ে,
(ধনসম্পদX প্রতিপত্তি X সম্মান X যশ X জ্ঞান) X শূণ্য = শূণ্য [ভিখিরী]।
এখন চিন্তা করার বিষয় রয়ে যায় — আমরা কি হাশরের ময়দানের বিশাল প্রান্তরে ভিখিরি বেশে দাঁড়াতে চাই?
আমি চাকুরি করি একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক “আধুনিক প্রজন্মের” তরুণ। আমাদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলে আলাপ। প্রায়ই টপিক আসে “গার্লফ্রেন্ড-বিয়ে-মেয়ে”। একদিন সহসা লম্বা চওড়া আলাপ হলো– আমি শ্রোতা টাইপের। কিছু কিছু আলাপে সবার প্রবেশের ফাঁকফোকর থাকে না। তাই ওয়েস্টিন, রুচিতা বার, ভুত, রেস্তোরা, পিজা হাট, কেএফসি গুলশান ধানমন্ডির কিছু কিছু প্লেসের রঙ্গিন আলাপ চলতে থাকলে অন্য কাজে মন দিলাম। এলো বিয়ের আলাপ। প্রশ্ন আমার দিকে। কেন প্রেম করিনা — এ নিয়ে কিছুক্ষণ হাসি তামাশা। ইদানিং ছেলে মহলে একটা কথা খুব শুনি — “লাভ ম্যারেজ মানে নিজের গার্লফ্রেন্ড, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ মানে অন্যের গার্লফ্রেন্ড”। আমি এই প্রসঙ্গেও কথা বলিনা, শুধু স্মিত একটা হাসি উপহার দিই ওদের। একজন অভিজ্ঞতা বলছিলেন নিজ জীবনের — কীভাবে তিনি স্কুলগামী একটা মেয়ের সাথে প্রেম করেছিলেন, কতবার চাকুরিজীবী বাবা মায়ের সেই মেয়েরটির বাসাতেই শয্যাগমন করেছেন, কীভাবে মেয়েটা রিলেশন ব্রেক করে *আপ* রিলেশনে চলে গেলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হই। তারপর একজন বলতে শুরু করলো তাদের ভার্সিটিতে[ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে] কীভাবে ক্লাসের মধ্যেও ছেলে-মেয়ে আদিম আনন্দের স্বাদ নিতো। অমন কমপক্ষে ১০-১২টা গল্প। সত্য-মিথ্যা জানিনা, আমি স্তব্ধ হয়ে শুনি। বরফশীতল হয়ে জমে যাওয়া দেহে রক্তসঞ্চালনের চেষ্টা করতে থাকি।
আমার দিকে তাকিয়ে একজন কলিগ বলতে থাকে — “তুমি এই জেনারেশনে এমন কোন মেয়ে আশা করতে পারো না বিয়ে করতে গিয়ে, যে *ইউজড* না”! তার পরপরই আবার বলে “টাকা-পয়সা না থাকলে বউ *বাঁধতে* পারবা না, তোমাকে অনেক টাকা থাকতে হবে, নইলে বউ আপনার অফিসে থাকার সময়ে পাশের বাড়ির ছেলেটার সাথে ফোনে কথা বলবে, তারপর… “।
আমি আর সহ্য করতে পারিনি, শক্ত গলায় বলে উঠেছিলাম — “দুঃখিত আমি একমত না। এই সমাজে আমার মতন দুর্বল আত্মার একটা ছেলেও যখন এমন ভয়াবহতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে, এমন কেউ আমার জন্য আছেই যে আমার মতন করেই আমার মতন কারো জন্য অপেক্ষা করছে। সমস্ত মেয়েদের এক করে দিলে হবেনা কেননা আমি আমার বোনদের মতন অনেক মুসলিমাহ বোনদের চিনি যারা অসম্ভব সুন্দর অন্তকরণকে ধারণ করে”। যাদের চোখে পৃথিবী কেবলই কেনাকাটা, গয়নাগাটি, সাজগোজ আর গাড়ি-বাড়ির না। তাদের কাছে এই জীবনটার একটা আলাদা অর্থ আছে। তাদের কাছে ব্র্যাডপিট-নিকোল কিডম্যান, শাহরুখ-গৌরি, প্রভা-রাজিবরা দাম্পত্য জীবনের আইকন না। তাদের কাছে আইডল হলো ফাতিমা, আয়িশা, আসিয়া, খাদিজা নামের কিছু পবিত্র আত্মা। মুসলিম যারা, তাদের আইডল তথা আদর্শ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যার জীবনে দারিদ্র ছিলো আগাগোড়া বন্ধু। আরবের ইসলামী রাস্ট্রের এই নেতা বিয়ের অনেকগুলো বছর পরেও মোহরানা আদায় করতে না পারায় স্ত্রী আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কে নিজ বাড়িতে তুলে নেয়ার সুযোগ করতে পারেননি। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন জরুরি ফান্ডে দান করতে কিছু জিনিস নিয়ে যাবার পর তাকে প্রশ্ন করা হলো বাড়িতে কি রেখে এসেছেন — তিনি উত্তর দিয়েছিলেন আল্লাহ ও তার রাসূলকে। কারণ তার ঘর ছিলো শূণ্য! এমনই ছিলেন তারা, আর তাদের সহধর্মিনীগণ ছিলেন অমনই। কই, তারা তো *বউ বাঁধতে* বাড়ি-গাড়ি-ঐশ্বর্যে মুড়িয়ে রাখতেন না (যদিও তা করার সুযোগ তাদের ছিলো)।
সেই আদর্শের বলে দাস যায়িদ বিন হারিসা সন্তান পেতেন উসামা বিন যায়িদদের মতন। যাকে নবীজী (সা) মাত্র উনিশ বছর বয়েসে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন, যার নেতৃত্বে অনেক প্রবীণ সাহাবাও তাগুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন– স্থাপন করে গেছেন অনুপম দৃষ্টান্ত। তাদের ছোটো একটা বাহিনীর কাছে প্রবল প্রতাপশালী রোমান সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। আমার আইডল তো সেই ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম, যিনি একজন অতিথি ছাড়া খেতেই বসতেন না। আমাদের আইডল হলেন আইয়ুব আলাইহিস সালাম — যার দেহের কোন ইঞ্চি বাকি ছিলো না রোগ থেকে, তবু তিনি ছিলেন প্রশান্ত আত্মায় তার মনীবের কৃতজ্ঞ দাস।
আমি সেই দ্বীনকেই জীবনবিধান হিসেবে মানি — যা সৃষ্টির শুরুতেও ছিলো, যা থাকবে বিশ্বজগত ধ্বংস অবধি। আমি সেই নৌকায় উঠতে পারি বা না পারি, এই দ্বীন ইসলামই বিজয়ীদের আরোহণের যান — যা নিয়ে যাবে সফলতার মঞ্জিলে। *বউ বাঁধতে* টাকা কামানোর আইডিয়ায় মগ্ন থেকে, ক্রমাগত অন্যের সাথে নিজেকে বড় করার টেক্কা দিতে দিতে, নিজেকে খুউল আর ইয়ো স্মার্ট বানানোর নেশাময়তায় ইনভলভ করতে শেখায়না আমার এই দ্বীন। আমাদের আমাদের সমস্ত ভালোবাসা আল্লাহর জন্যই। সেই ভালোবাসায় সিক্ত আমি যেখানেই যাই, জীবনের প্রয়োজন সামলে ঘরে ফিরে যাবো প্রিয়জনের কাছে — আবেগ আর ভালোবাসা ভাগাভাগি করতে। আমরা বিয়ের আয়োজনে কেবল আল্লাহর স্মরণে একটা দোয়া করতে উন্মুখ থাকি — যেন আমাদের নতুন এই বন্ধন তার দাসত্বের জন্যই হয়। যেন দুজনের এই বন্ধন পৃথিবীর জীবন ছাপিয়ে কবর, হাশর, পুলসিরাত, মীযান পেরিয়ে জান্নাতেও অটুট থাকে। যেন দু’জন এই নতুন ভালোবাসার গ্ল্যামার নিয়ে থাকি অনন্তকাল, যেমন ছিলেন আমাদের আইডলেরা। আমরা জানি আমাদের ভালোবাসা নশ্বর নয় — আমাদের ভালোবাসা হলো আল্লাহর প্রতি আমাদের ভালোবাসার আলোকে উদ্ভাসিত। আমাদের বিশ্বাসের কমতি হবেনা কখনই। আমাদের সম্মানের ঘাটতি হবেনা কখনই। আমরা সবসময় নিজেদের শোধরাতে শিখি। তাই আমাদের ভুল বুঝাবুঝি রবে না বেশিক্ষণ। আমাদের মৃত্যুবধি আমরা নিজেদের উন্নত করি আত্মিকভাবে। আমরা কখনই হারিয়ে যাইনা সময়ের নষ্টদের দখলে যাওয়া প্রচারণার কাছে, আমরা কখনই হারিয়ে যাইনা প্রাচূর্যের প্রতিযোগিতায় মোহাচ্ছন্ন হওয়া গাফেলদের উঁচু উঁচু অট্টালিকা মতন অহংকার দেখে। আমরা জানি, আমরা মানুষকে, মানবতার জন্য নিজেদের বিলাই লোক দেখাতে না– কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবার আশায়। আমরা খুব ভালো করে জানি, আমাদের প্রতিটি মূহুর্তের কাজ ও মনের চিন্তা-অনুভূতিরা রেকর্ডিং হচ্ছে — যার কিছুই গোপন থাকবে না, তা থেকে রক্ষা পাবো না আমরা কেউই। মরুর বুকে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতিকে আলোয় উদ্ভাসিত করেছিলো যেই দ্বীনের পূর্ণাবয়ব আমরা সেই সে দ্বীনের অনুসারী। মুশরিক সর্দার আবু জাহলের ছেলে ইকরিমা জীবনভোর মুসলিমদের বিরোধিতা করেছিলেন, হিন্দা হত্যা করেছিলেন তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় চাচা হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। অথচ পরে তারা যখন অনুতপ্ত হয়ে তারা নবীজীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন– পেয়েছিলেন, হয়েছিলেন রাদিয়াল্লাহু আনহুম, আনহুমা। আর দ্বীনকে গ্রহণ করে নেয়ার পর তাদের জীবন ও চরিত্রও ছিলো অন্যরকম সুন্দর। এই উদার ভালোবাসাময় সুন্দরতম দ্বীন ইসলাম হলো আমাদের আদর্শ! এই সুন্দরতম জীবনবিধান আমাদের সম্পদ।
আমাদের সামনে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো, রাস্তার বিলবোর্ডগুলো, পত্রিকা-ম্যাগাজিনগুলো যতই হতাশা প্রচার করুন না কেন, প্রাচূর্যের নেশায় চুর হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীরা যতই ভয়াবহ সমাজ তৈরি করুক না কেন, আত্মিক মুক্তির জ্ঞানে মূর্খ শাসকদল আমাদের যতই শোষণ করে ছিবড়ে করে দিক না কেন, আমরা জানি আমাদের অন্তরের আলোতেই আমরা মুছে দেবো এই অন্ধকারের নোংরামি, কদর্যতা। আমাদের কর্মের আলোতে, অন্তরের ভালোবাসায় সিক্ত হবে অভাবীরা, মজলুমেরা, মানবতা। রূপালী আর সোনালী পর্দার প্রচারণায় পণ্য হওয়া থেকে মুক্তি পেয়ে সম্মানিত হবেন আমাদের মা-বোনেরা এই দ্বীনেই স্পর্শেই। আমরা তো হতাশ নই! আমরা নোংরা মনের লোকের নোংরা কথায় দুঃখের সাগরে ভেসে হতাশ হয়ে “আনইউজড” মেয়ে খুঁজতে প্রেম করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়িনা। আমরা প্রতিদিন সালাতের পরে, ইবাদাতের পরে হাত দুটি তুলে দোয়া করি, “রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াযিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্কুররাতা আ’ইয়ুনিন ওয়া জা’আলনা লিল মুত্তাক্কিনা ইমামা”। যার অর্থঃ
“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” [সূরা ফুরক্কানঃ ৭৪]
আমরা জানি, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সমস্ত দোয়া কবুল করেন এবং দোয়ায় ভাগ্য ফিরায়। তাইতো এই ভয়ংকর সময়েও আমরা স্বপ্ন দেখি সুন্দরের, প্রশান্ত আত্মার। এই স্বপ্ন কোন ক্ষুদ্র স্বপ্ন নয়– স্বপ্নের সুতোর এই প্রান্তে মালা গাঁথছি যখন, অন্য প্রান্তেও তখন আমাদের হয়ে মালা গেঁথে যাচ্ছে জান্নাতে, যেখানে শান্তিই শান্তি। আমাদের কাজই তো তৈরি করে দেয় আমাদের ভবিষ্যত, যে ভবিষ্যত অনন্ত কালের। যা সুন্দর কর্মের মানুষদের জন্য অনন্ত সুন্দর, অনন্ত শান্তির, সুখস্বপ্নের!
আমরা বাস করছি বিদ্যুত সভ্যতায়। মাত্র দু’তিনশ বছর আগে উদ্ভাবিত বিদ্যুত দিয়ে গত পঞ্চাশ বছরে প্রযুক্তিতে উন্নত হয়েই মাটিতে আমাদের আর পা পড়েনা। আমরা বুর্জ আল আরব বানাই, আমরা বানাই পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, মনোহারি সিয়ার্স টাওয়ার, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, আইফেল টাওয়ার। আমরা দম্ভে আর বড়ত্বে গলা ফুলিয়ে দিই। অথচ প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চে যখন কয়েকটা হিমালয় ডুবে যাবে শুনি — মনে হয়না ওই উঁচু হিমালয়, আর অমন গভীর খানা-খন্দটা কে তৈরি করলো! প্রকৃতি নামের শব্দটা দিয়ে লেখকমহল চালিয়ে দেন অগভীর চিন্তার পাঠকদের মনকে বাঁকিয়ে দেবার জন্য — আমরাও সন্তুষ্ট হই। কিন্তু অমন পিরামিড বানালেন যারা, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর বা পিসার হেলানো মিনার যারা বানালেন — তারা কোথায় চলে গেলেন? মরে গেলেন তো কেন আর কোন চিহ্নই রইলো না তাদের? কত বেশি দুর্বল সেই সভ্যতার এই ধারক ও বাহকদল — কতনা ক্ষণস্থায়ী এই বিপুল দম্ভযজ্ঞ, সৃষ্টিযজ্ঞ আর ক্ষমতাযজ্ঞ!
এসব সভ্যতা আসবে যাবে। একসময় ‘আদ জাতি ছিলো, সামূদ জাতি ছিলো। দম্ভে আর জুলুমে তারা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো সবাইকে। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচাইতে ক্ষমতাধর জাতিকেও আল্লাহ এক মূহুর্তেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। কওমে লূতের মাঝে “সমকামিতা” প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিলো, তারা শুনেনি তাদের নবীর বলা কথাগুলো– মাটিচাপা পড়ে, প্রকট শব্দে কানে তালা লেগে সমস্ত জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। পবিত্র কুরআনে এই পৃথিবী আর নভোমন্ডলসহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেই দিয়েছেন– তিনি অনেক জাতিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন তাদের “কাজের জন্য”। তিনি জানিয়েছেন আমাদের মাঝে কেউ যদি তার দাসত্ব না করে, আল্লাহ তাদের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে সেখানে আরেকটা জাতিই সৃষ্টি করে দিতে পারেন — নিঃসন্দেহে এটা তার জন্য কোন ব্যাপারই না। কিন্তু আমরা যখন সেই কোন একটি জাতিস্বত্ত্বার অংশ — তখন সেটা আমাদের জন্য “ব্যাপার”। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য ব্যাপার। আমাদের একটা জীবন একবারের জন্যই। এই আত্মা, এই দেহ আর জীবন — একবারের জন্যই। আমরা নিশ্চয়ই অবলীলায় ভেসে দিতে পারিনা আমাদের জীবন — আমরা অবশ্যই চাইনা একটা নিশ্চিত ভয়ংকর পরিণতি। এমন উদ্দেশ্যহীন বর্বর লোভী, জালিম আর কামুক সমাজ তৈরি করে যে জাতি– তার অংশ হওয়ায় আমাদের ভালো কাজের অ্যাকাউন্টে অনেক কিছু জমা থাকলেও — সেই পুরো ব্যাঙ্কটাই মহান অধিপতি করে দিবেন “সিলড”। তাইতো খেয়ে দেয়ে, ঘুমিয়ে, চাকুরি করে দিন অতিক্রম করার পরেও মহান সর্বশক্তিমানের দাসত্বের কতখানি আমরা প্রত্যেকে/পরিবারসহ/ এই পুরো জাতি মিলে করছি তা চিন্তা করার দায় থেকে যায় সবারই। নইলে একদম শেষে সকল প্রাপ্তিই হয়ত মাল্টিপ্লাইড হবে শূণ্য দিয়ে,
(ধনসম্পদX প্রতিপত্তি X সম্মান X যশ X জ্ঞান) X শূণ্য = শূণ্য [ভিখিরী]।
এখন চিন্তা করার বিষয় রয়ে যায় — আমরা কি হাশরের ময়দানের বিশাল প্রান্তরে ভিখিরি বেশে দাঁড়াতে চাই?
আমি চাকুরি করি একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক “আধুনিক প্রজন্মের” তরুণ। আমাদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলে আলাপ। প্রায়ই টপিক আসে “গার্লফ্রেন্ড-বিয়ে-মেয়ে”। একদিন সহসা লম্বা চওড়া আলাপ হলো– আমি শ্রোতা টাইপের। কিছু কিছু আলাপে সবার প্রবেশের ফাঁকফোকর থাকে না। তাই ওয়েস্টিন, রুচিতা বার, ভুত, রেস্তোরা, পিজা হাট, কেএফসি গুলশান ধানমন্ডির কিছু কিছু প্লেসের রঙ্গিন আলাপ চলতে থাকলে অন্য কাজে মন দিলাম। এলো বিয়ের আলাপ। প্রশ্ন আমার দিকে। কেন প্রেম করিনা — এ নিয়ে কিছুক্ষণ হাসি তামাশা। ইদানিং ছেলে মহলে একটা কথা খুব শুনি — “লাভ ম্যারেজ মানে নিজের গার্লফ্রেন্ড, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ মানে অন্যের গার্লফ্রেন্ড”। আমি এই প্রসঙ্গেও কথা বলিনা, শুধু স্মিত একটা হাসি উপহার দিই ওদের। একজন অভিজ্ঞতা বলছিলেন নিজ জীবনের — কীভাবে তিনি স্কুলগামী একটা মেয়ের সাথে প্রেম করেছিলেন, কতবার চাকুরিজীবী বাবা মায়ের সেই মেয়েরটির বাসাতেই শয্যাগমন করেছেন, কীভাবে মেয়েটা রিলেশন ব্রেক করে *আপ* রিলেশনে চলে গেলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হই। তারপর একজন বলতে শুরু করলো তাদের ভার্সিটিতে[ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে] কীভাবে ক্লাসের মধ্যেও ছেলে-মেয়ে আদিম আনন্দের স্বাদ নিতো। অমন কমপক্ষে ১০-১২টা গল্প। সত্য-মিথ্যা জানিনা, আমি স্তব্ধ হয়ে শুনি। বরফশীতল হয়ে জমে যাওয়া দেহে রক্তসঞ্চালনের চেষ্টা করতে থাকি।
আমার দিকে তাকিয়ে একজন কলিগ বলতে থাকে — “তুমি এই জেনারেশনে এমন কোন মেয়ে আশা করতে পারো না বিয়ে করতে গিয়ে, যে *ইউজড* না”! তার পরপরই আবার বলে “টাকা-পয়সা না থাকলে বউ *বাঁধতে* পারবা না, তোমাকে অনেক টাকা থাকতে হবে, নইলে বউ আপনার অফিসে থাকার সময়ে পাশের বাড়ির ছেলেটার সাথে ফোনে কথা বলবে, তারপর… “।
আমি আর সহ্য করতে পারিনি, শক্ত গলায় বলে উঠেছিলাম — “দুঃখিত আমি একমত না। এই সমাজে আমার মতন দুর্বল আত্মার একটা ছেলেও যখন এমন ভয়াবহতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে, এমন কেউ আমার জন্য আছেই যে আমার মতন করেই আমার মতন কারো জন্য অপেক্ষা করছে। সমস্ত মেয়েদের এক করে দিলে হবেনা কেননা আমি আমার বোনদের মতন অনেক মুসলিমাহ বোনদের চিনি যারা অসম্ভব সুন্দর অন্তকরণকে ধারণ করে”। যাদের চোখে পৃথিবী কেবলই কেনাকাটা, গয়নাগাটি, সাজগোজ আর গাড়ি-বাড়ির না। তাদের কাছে এই জীবনটার একটা আলাদা অর্থ আছে। তাদের কাছে ব্র্যাডপিট-নিকোল কিডম্যান, শাহরুখ-গৌরি, প্রভা-রাজিবরা দাম্পত্য জীবনের আইকন না। তাদের কাছে আইডল হলো ফাতিমা, আয়িশা, আসিয়া, খাদিজা নামের কিছু পবিত্র আত্মা। মুসলিম যারা, তাদের আইডল তথা আদর্শ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যার জীবনে দারিদ্র ছিলো আগাগোড়া বন্ধু। আরবের ইসলামী রাস্ট্রের এই নেতা বিয়ের অনেকগুলো বছর পরেও মোহরানা আদায় করতে না পারায় স্ত্রী আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কে নিজ বাড়িতে তুলে নেয়ার সুযোগ করতে পারেননি। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন জরুরি ফান্ডে দান করতে কিছু জিনিস নিয়ে যাবার পর তাকে প্রশ্ন করা হলো বাড়িতে কি রেখে এসেছেন — তিনি উত্তর দিয়েছিলেন আল্লাহ ও তার রাসূলকে। কারণ তার ঘর ছিলো শূণ্য! এমনই ছিলেন তারা, আর তাদের সহধর্মিনীগণ ছিলেন অমনই। কই, তারা তো *বউ বাঁধতে* বাড়ি-গাড়ি-ঐশ্বর্যে মুড়িয়ে রাখতেন না (যদিও তা করার সুযোগ তাদের ছিলো)।
সেই আদর্শের বলে দাস যায়িদ বিন হারিসা সন্তান পেতেন উসামা বিন যায়িদদের মতন। যাকে নবীজী (সা) মাত্র উনিশ বছর বয়েসে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন, যার নেতৃত্বে অনেক প্রবীণ সাহাবাও তাগুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন– স্থাপন করে গেছেন অনুপম দৃষ্টান্ত। তাদের ছোটো একটা বাহিনীর কাছে প্রবল প্রতাপশালী রোমান সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। আমার আইডল তো সেই ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম, যিনি একজন অতিথি ছাড়া খেতেই বসতেন না। আমাদের আইডল হলেন আইয়ুব আলাইহিস সালাম — যার দেহের কোন ইঞ্চি বাকি ছিলো না রোগ থেকে, তবু তিনি ছিলেন প্রশান্ত আত্মায় তার মনীবের কৃতজ্ঞ দাস।
আমি সেই দ্বীনকেই জীবনবিধান হিসেবে মানি — যা সৃষ্টির শুরুতেও ছিলো, যা থাকবে বিশ্বজগত ধ্বংস অবধি। আমি সেই নৌকায় উঠতে পারি বা না পারি, এই দ্বীন ইসলামই বিজয়ীদের আরোহণের যান — যা নিয়ে যাবে সফলতার মঞ্জিলে। *বউ বাঁধতে* টাকা কামানোর আইডিয়ায় মগ্ন থেকে, ক্রমাগত অন্যের সাথে নিজেকে বড় করার টেক্কা দিতে দিতে, নিজেকে খুউল আর ইয়ো স্মার্ট বানানোর নেশাময়তায় ইনভলভ করতে শেখায়না আমার এই দ্বীন। আমাদের আমাদের সমস্ত ভালোবাসা আল্লাহর জন্যই। সেই ভালোবাসায় সিক্ত আমি যেখানেই যাই, জীবনের প্রয়োজন সামলে ঘরে ফিরে যাবো প্রিয়জনের কাছে — আবেগ আর ভালোবাসা ভাগাভাগি করতে। আমরা বিয়ের আয়োজনে কেবল আল্লাহর স্মরণে একটা দোয়া করতে উন্মুখ থাকি — যেন আমাদের নতুন এই বন্ধন তার দাসত্বের জন্যই হয়। যেন দুজনের এই বন্ধন পৃথিবীর জীবন ছাপিয়ে কবর, হাশর, পুলসিরাত, মীযান পেরিয়ে জান্নাতেও অটুট থাকে। যেন দু’জন এই নতুন ভালোবাসার গ্ল্যামার নিয়ে থাকি অনন্তকাল, যেমন ছিলেন আমাদের আইডলেরা। আমরা জানি আমাদের ভালোবাসা নশ্বর নয় — আমাদের ভালোবাসা হলো আল্লাহর প্রতি আমাদের ভালোবাসার আলোকে উদ্ভাসিত। আমাদের বিশ্বাসের কমতি হবেনা কখনই। আমাদের সম্মানের ঘাটতি হবেনা কখনই। আমরা সবসময় নিজেদের শোধরাতে শিখি। তাই আমাদের ভুল বুঝাবুঝি রবে না বেশিক্ষণ। আমাদের মৃত্যুবধি আমরা নিজেদের উন্নত করি আত্মিকভাবে। আমরা কখনই হারিয়ে যাইনা সময়ের নষ্টদের দখলে যাওয়া প্রচারণার কাছে, আমরা কখনই হারিয়ে যাইনা প্রাচূর্যের প্রতিযোগিতায় মোহাচ্ছন্ন হওয়া গাফেলদের উঁচু উঁচু অট্টালিকা মতন অহংকার দেখে। আমরা জানি, আমরা মানুষকে, মানবতার জন্য নিজেদের বিলাই লোক দেখাতে না– কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবার আশায়। আমরা খুব ভালো করে জানি, আমাদের প্রতিটি মূহুর্তের কাজ ও মনের চিন্তা-অনুভূতিরা রেকর্ডিং হচ্ছে — যার কিছুই গোপন থাকবে না, তা থেকে রক্ষা পাবো না আমরা কেউই। মরুর বুকে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতিকে আলোয় উদ্ভাসিত করেছিলো যেই দ্বীনের পূর্ণাবয়ব আমরা সেই সে দ্বীনের অনুসারী। মুশরিক সর্দার আবু জাহলের ছেলে ইকরিমা জীবনভোর মুসলিমদের বিরোধিতা করেছিলেন, হিন্দা হত্যা করেছিলেন তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় চাচা হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। অথচ পরে তারা যখন অনুতপ্ত হয়ে তারা নবীজীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন– পেয়েছিলেন, হয়েছিলেন রাদিয়াল্লাহু আনহুম, আনহুমা। আর দ্বীনকে গ্রহণ করে নেয়ার পর তাদের জীবন ও চরিত্রও ছিলো অন্যরকম সুন্দর। এই উদার ভালোবাসাময় সুন্দরতম দ্বীন ইসলাম হলো আমাদের আদর্শ! এই সুন্দরতম জীবনবিধান আমাদের সম্পদ।
আমাদের সামনে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো, রাস্তার বিলবোর্ডগুলো, পত্রিকা-ম্যাগাজিনগুলো যতই হতাশা প্রচার করুন না কেন, প্রাচূর্যের নেশায় চুর হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীরা যতই ভয়াবহ সমাজ তৈরি করুক না কেন, আত্মিক মুক্তির জ্ঞানে মূর্খ শাসকদল আমাদের যতই শোষণ করে ছিবড়ে করে দিক না কেন, আমরা জানি আমাদের অন্তরের আলোতেই আমরা মুছে দেবো এই অন্ধকারের নোংরামি, কদর্যতা। আমাদের কর্মের আলোতে, অন্তরের ভালোবাসায় সিক্ত হবে অভাবীরা, মজলুমেরা, মানবতা। রূপালী আর সোনালী পর্দার প্রচারণায় পণ্য হওয়া থেকে মুক্তি পেয়ে সম্মানিত হবেন আমাদের মা-বোনেরা এই দ্বীনেই স্পর্শেই। আমরা তো হতাশ নই! আমরা নোংরা মনের লোকের নোংরা কথায় দুঃখের সাগরে ভেসে হতাশ হয়ে “আনইউজড” মেয়ে খুঁজতে প্রেম করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়িনা। আমরা প্রতিদিন সালাতের পরে, ইবাদাতের পরে হাত দুটি তুলে দোয়া করি, “রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াযিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্কুররাতা আ’ইয়ুনিন ওয়া জা’আলনা লিল মুত্তাক্কিনা ইমামা”। যার অর্থঃ
“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” [সূরা ফুরক্কানঃ ৭৪]
আমরা জানি, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সমস্ত দোয়া কবুল করেন এবং দোয়ায় ভাগ্য ফিরায়। তাইতো এই ভয়ংকর সময়েও আমরা স্বপ্ন দেখি সুন্দরের, প্রশান্ত আত্মার। এই স্বপ্ন কোন ক্ষুদ্র স্বপ্ন নয়– স্বপ্নের সুতোর এই প্রান্তে মালা গাঁথছি যখন, অন্য প্রান্তেও তখন আমাদের হয়ে মালা গেঁথে যাচ্ছে জান্নাতে, যেখানে শান্তিই শান্তি। আমাদের কাজই তো তৈরি করে দেয় আমাদের ভবিষ্যত, যে ভবিষ্যত অনন্ত কালের। যা সুন্দর কর্মের মানুষদের জন্য অনন্ত সুন্দর, অনন্ত শান্তির, সুখস্বপ্নের!
ফারজানা তান্নী
আজ বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এলাম।
মনটা একটু খারাপ লাগছে বটে! কিন্তু ভালোও লাগছে এই ভেবে যে একটা কাজ ভালোভাবে শেষ করতে পারলাম। বাবার প্রতি দায়িত্বও শেষ হলো। সংসারটা এবার নতুন করে গুছিয়ে নেব। বাবার ঘরটা গেস্টরুম বানাতে হবে। বাসায় একটা গেস্টরুম ছিল না বলে লুনার কত অভিযোগ—বাসায় গেস্ট এলে ওর নাকি মানসম্মান চলে যায়। ঠিকই তো বলেছে, গেস্টরুম একটা প্রয়োজন বৈকি! বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর বুদ্ধিটাও তার। আমারও যে মত ছিল না, তা নয়। বাবারও বোধ হয় এটাই ইচ্ছা ছিল। কারণ, তিনি আমাদের মতামতের কোনো বিরোধিতা করেননি। তা ছাড়া মায়ের মৃত্যুর পর বাবা খুবই নিঃসঙ্গ ছিলেন। আমি ও লুনা—দুজনই চাকরিজীবী, অফিসে যাই। বাবাকে কে সময় দেবে? ওখানে গিয়ে বাবা নিশ্চয়ই ভালো থাকবেন। সমবয়সী অনেককে পাবেন সঙ্গী হিসেবে। নাহ্, কাজটা ভালোই করেছি। আমার সব স্বপ্ন আমার পরিবারকে ঘিরে। লুনাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আমাদের দুজনের সংসারে অনাবিল আনন্দ বয়ে এনেছে আমাদের সোনার টুকরো ছেলে। তাকে পেয়ে আমার জীবনটা সত্যিই অন্য রকম হয়ে গেল। আমার সব মনোযোগ এখন স্ত্রী-পুত্রের দিকে। বাবা-মাকে দেখার সময় কই?
যেদিন মা মারা গেলেন, সেদিন একটু অপরাধবোধ মনে জেগেছিল। মনে হয়েছিল, আমার অবহেলার জন্যই কি মা চলে গেলেন? মা স্ট্রোক করেছিলেন। হয়তো ভেতরে ভেতরে আরও অসুখ দানা বেঁধেছিল, কিন্তু মুখ ফুটে কখনো কাউকে কিছু বলেননি তিনি। মাকে দেখতে তো সুস্থই দেখাত, তাই কখনো তাঁকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।
বাবার বিষয়-সম্পত্তি তেমন ছিল না। তবে আমাদের একটা ছিমছাম একতলা বাড়ি ছিল। ছোটবেলা থেকে সেখানে বড় হয়েছি বলেই হয়তো বাড়িটা ভালোই মনে হতো। কিন্তু লুনা আধুনিক মেয়ে, ওর বাড়িটা পছন্দ হতো না মোটেই। বলত, পুরোনো, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। পরে ভেবে দেখলাম, কথাটা তো ও ভুল বলেনি! আমি তখন সবেমাত্র চাকরিতে ঢুকেছি। অন্যখানে বাসা নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য আমার হয়ে ওঠেনি। তাই লুনার পরামর্শে বাবাকে বোঝালাম, এই বাড়িটা জমিসহ বিক্রি করে দিলেই মোটামুটি হালফ্যাশনের একটা ফ্ল্যাট কিনেও কিছু টাকা ব্যাংকে রাখা যাবে। আমার বাবা এই প্রস্তাবে রাজি হননি। শেষে আমি রাগ করে লুনাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার হুমকি দিলাম, যদিও জানি, এ আমার সামর্থ্যের বাইরে। লুনা তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ সময় ওর বাড়তি কিছু যত্নআত্তি প্রয়োজন। এ অবস্থায় আমার সাহায্যে এগিয়ে এলেন মা। তিনি বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করালেন। অবশেষে বাবা রাজিও হলেন, কিন্তু আমার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতেন না আর। সেই থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল আমার।
নতুন ফ্ল্যাটটা বাবা-মা আমার নামে দিতে চাইলেন, কিন্তু আমার অনুরোধে বাবা ফ্ল্যাটটা তাঁর নাতির নামে উইল করে দেন। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে এই কাজটি করেছিলাম। যেদিন নতুন ফ্ল্যাটে আমরা শিফট করলাম, সেদিন লুনার আনন্দ যেন বাঁধ মানছিল না। আমারও ভালো লাগছিল ওর হাসিমুখ দেখে। আমাদের ছেলের বয়স তখন চার বছর, ওকেও একটা আলাদা ঘর দেওয়া হলো। ছেলের ঘরটি ছবির মতো করে সাজাল লুনা। শুধু ছেলের ঘরই নয়, পুরো বাসাটাই সুন্দর করে সাজাল সে। ফ্ল্যাট কেনার পর যে টাকা বেঁচে ছিল, এর অনেকটাই ব্যয় করা হলো ঘর সাজানোর কাজে। শুধু বদলাল না বাবা-মায়ের ঘরটি—সেই আগেকার খাট, ঘুণে ধরা চেয়ার-টেবিল, আলমারি—ঠিক আগের বাড়ির ঘরটির মতো। এই ঘরটি সাজাতে দেননি মা। তিনি বলেছিলেন, থাকুক কিছু স্মৃতি। আমি কিছু মনে করিনি, কিন্তু লুনার মনে খেদ ছিল খুব। মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সেই কবে, বাবাকেও আজ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলাম, সেই সঙ্গে বাধামুক্ত হলো লুনার ঘর সাজানোর পথটা।
পরিশিষ্ট
এতক্ষণ নিজের লেখা ডায়েরির কয়েকটি পাতা পড়ছিলেন আবীর চৌধুরী। তাঁর চোখের কোণে পানি। এখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর। পাঁচ বছর আগে লুনা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর তাঁর আদরের ছেলে আনন্দ চৌধুরী আজ সকালে তাঁকে রেখে গেল বৃদ্ধাশ্রমে।
আজ বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এলাম।
মনটা একটু খারাপ লাগছে বটে! কিন্তু ভালোও লাগছে এই ভেবে যে একটা কাজ ভালোভাবে শেষ করতে পারলাম। বাবার প্রতি দায়িত্বও শেষ হলো। সংসারটা এবার নতুন করে গুছিয়ে নেব। বাবার ঘরটা গেস্টরুম বানাতে হবে। বাসায় একটা গেস্টরুম ছিল না বলে লুনার কত অভিযোগ—বাসায় গেস্ট এলে ওর নাকি মানসম্মান চলে যায়। ঠিকই তো বলেছে, গেস্টরুম একটা প্রয়োজন বৈকি! বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর বুদ্ধিটাও তার। আমারও যে মত ছিল না, তা নয়। বাবারও বোধ হয় এটাই ইচ্ছা ছিল। কারণ, তিনি আমাদের মতামতের কোনো বিরোধিতা করেননি। তা ছাড়া মায়ের মৃত্যুর পর বাবা খুবই নিঃসঙ্গ ছিলেন। আমি ও লুনা—দুজনই চাকরিজীবী, অফিসে যাই। বাবাকে কে সময় দেবে? ওখানে গিয়ে বাবা নিশ্চয়ই ভালো থাকবেন। সমবয়সী অনেককে পাবেন সঙ্গী হিসেবে। নাহ্, কাজটা ভালোই করেছি। আমার সব স্বপ্ন আমার পরিবারকে ঘিরে। লুনাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আমাদের দুজনের সংসারে অনাবিল আনন্দ বয়ে এনেছে আমাদের সোনার টুকরো ছেলে। তাকে পেয়ে আমার জীবনটা সত্যিই অন্য রকম হয়ে গেল। আমার সব মনোযোগ এখন স্ত্রী-পুত্রের দিকে। বাবা-মাকে দেখার সময় কই?
যেদিন মা মারা গেলেন, সেদিন একটু অপরাধবোধ মনে জেগেছিল। মনে হয়েছিল, আমার অবহেলার জন্যই কি মা চলে গেলেন? মা স্ট্রোক করেছিলেন। হয়তো ভেতরে ভেতরে আরও অসুখ দানা বেঁধেছিল, কিন্তু মুখ ফুটে কখনো কাউকে কিছু বলেননি তিনি। মাকে দেখতে তো সুস্থই দেখাত, তাই কখনো তাঁকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।
বাবার বিষয়-সম্পত্তি তেমন ছিল না। তবে আমাদের একটা ছিমছাম একতলা বাড়ি ছিল। ছোটবেলা থেকে সেখানে বড় হয়েছি বলেই হয়তো বাড়িটা ভালোই মনে হতো। কিন্তু লুনা আধুনিক মেয়ে, ওর বাড়িটা পছন্দ হতো না মোটেই। বলত, পুরোনো, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। পরে ভেবে দেখলাম, কথাটা তো ও ভুল বলেনি! আমি তখন সবেমাত্র চাকরিতে ঢুকেছি। অন্যখানে বাসা নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য আমার হয়ে ওঠেনি। তাই লুনার পরামর্শে বাবাকে বোঝালাম, এই বাড়িটা জমিসহ বিক্রি করে দিলেই মোটামুটি হালফ্যাশনের একটা ফ্ল্যাট কিনেও কিছু টাকা ব্যাংকে রাখা যাবে। আমার বাবা এই প্রস্তাবে রাজি হননি। শেষে আমি রাগ করে লুনাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার হুমকি দিলাম, যদিও জানি, এ আমার সামর্থ্যের বাইরে। লুনা তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ সময় ওর বাড়তি কিছু যত্নআত্তি প্রয়োজন। এ অবস্থায় আমার সাহায্যে এগিয়ে এলেন মা। তিনি বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করালেন। অবশেষে বাবা রাজিও হলেন, কিন্তু আমার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতেন না আর। সেই থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল আমার।
নতুন ফ্ল্যাটটা বাবা-মা আমার নামে দিতে চাইলেন, কিন্তু আমার অনুরোধে বাবা ফ্ল্যাটটা তাঁর নাতির নামে উইল করে দেন। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে এই কাজটি করেছিলাম। যেদিন নতুন ফ্ল্যাটে আমরা শিফট করলাম, সেদিন লুনার আনন্দ যেন বাঁধ মানছিল না। আমারও ভালো লাগছিল ওর হাসিমুখ দেখে। আমাদের ছেলের বয়স তখন চার বছর, ওকেও একটা আলাদা ঘর দেওয়া হলো। ছেলের ঘরটি ছবির মতো করে সাজাল লুনা। শুধু ছেলের ঘরই নয়, পুরো বাসাটাই সুন্দর করে সাজাল সে। ফ্ল্যাট কেনার পর যে টাকা বেঁচে ছিল, এর অনেকটাই ব্যয় করা হলো ঘর সাজানোর কাজে। শুধু বদলাল না বাবা-মায়ের ঘরটি—সেই আগেকার খাট, ঘুণে ধরা চেয়ার-টেবিল, আলমারি—ঠিক আগের বাড়ির ঘরটির মতো। এই ঘরটি সাজাতে দেননি মা। তিনি বলেছিলেন, থাকুক কিছু স্মৃতি। আমি কিছু মনে করিনি, কিন্তু লুনার মনে খেদ ছিল খুব। মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সেই কবে, বাবাকেও আজ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলাম, সেই সঙ্গে বাধামুক্ত হলো লুনার ঘর সাজানোর পথটা।
পরিশিষ্ট
এতক্ষণ নিজের লেখা ডায়েরির কয়েকটি পাতা পড়ছিলেন আবীর চৌধুরী। তাঁর চোখের কোণে পানি। এখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর। পাঁচ বছর আগে লুনা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর তাঁর আদরের ছেলে আনন্দ চৌধুরী আজ সকালে তাঁকে রেখে গেল বৃদ্ধাশ্রমে।
“তুমি কি মনে করেছ যে, গুহা ও রকিমের অধিবাসীরা ছিল আমার আয়াতসমূহের এক বিস্ময়? যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল, অতঃপর বলল, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার পক্ষ থেকে রহমত দিন এবং আমাদের জন্য আমাদের কর্মকাণ্ড সঠিক করে দিন।’ ফলে আমি গুহায় তাদের কান বন্ধ করে দিলাম অনেক বছরের জন্য।বিতর্ককারীরা বলবে, ‘তারা ছিল তিনজন, চতুর্থ হল তাদের কুকুর।’ আর কতক বলবে, ‘তারা ছিল পাঁচজন, ষষ্ঠ হল তাদের কুকুর।’ এসবই অজানা বিষয়ে অনুমান করে। আর কেউ কেউ বলবে, ‘তারা ছিল সাতজন; অষ্টম হল তাদের কুকুর।” [কাহফ, ১৮ : ০৯,১২,২২]
কুরআন মাজিদের টিকাকারদের মতে, এই আয়াতে একদল যুবকের কথা উল্লিখিত হয়েছে, যারা এক রোমান রাজার উৎপীড়ন থেকে নিজেদের ঈমান ও জীবন রক্ষার জন্য পাহাড়ের একটি গর্তে আশ্রয় নিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে গুহার ভেতর প্রায় তিনশ বছর ঘুমিয়ে রেখেছিলেন। যখন তারা ঘুম থেকে জাগ্রত হল, তাদের একজন সাথীকে একটি মুদ্রা দিয়ে খাবার কিনে আনার জন্য পাঠাল। যখন সে শহরে প্রবেশ করল, দেখতে পেল পুরো শহর সম্পূর্ণরূপে বদলে গেছে। দোকানী এত প্রাচীন মুদ্রা দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল। সে মনে করল, এই যুবক কোনো ধরনের
ধনভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছে এবং সে এই মুদ্রার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইল। যুবকটি এমন বিপত্তির মুখে পড়ে আরও অধিক বিস্মিত হল।বিষয়টি শেষ পর্যন্ত রাজ দরবার পর্যন্ত গড়াল। রাজা যুবকটির কাহিনী শুনে বিস্মিত হলেন। অতঃপর তার সভাসদদের সঙ্গে নিয়ে সেই গুহার কাছে গেলেন এবং যুবকদেরকে তাদের জন্য দুআ করতে বললেন। পরবর্তীতে তারা সেই একই গুহার মধ্যেই বসবাস করতে লাগল এবং মৃত্যু বরণকরল। ‘গিবন’ তার ‘রোমান সম্রাজ্যের উত্থান-পতন’ (অধ্যায় ৩৩) নামক গ্রন্থে এই ঘটনার আরও কিছু বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তার মতে, এই ঘটনাটি সংঘটিত হয় রোম সম্রাট ‘ডিসাস’ এর রাজত্বকালে ২৪৯-২৫১ খৃস্টাব্দে। যুবকরা অতঃপর জাগ্রত হয়েছিল রোমান সম্রাট থিউডুসাস এর রাজত্বকালে। যার শাসনকাল ছিল ৪০৭ থেকে ৪৫০ খৃস্টাব্দ।
কিছুদিন পূর্বে আমি জর্ডানে এক স্থান ভ্রমণ করি, যাকে অধিকাংশ লোক আসহাবে কাহফের গুহা বলে ধারণা করে থাকে। এটি রাজধানী শহর আম্মানের বহিরপার্শ্বে অবস্থিত। পুরো এলাকাটি খুব এবড়ো-থেবড়ো, পিঙ্গলবর্ণ পাহাড়ময়। একটি পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি সুপ্ত গুহা, যার রয়েছে একটি বড় কক্ষ। আমি কক্ষটিতে প্রবেশ করলাম। পাথরে খোদিত সাতটি গর্ত দেখতে পেলাম। প্রতিটি গর্তের ভেতর একটি করে প্রকোষ্ঠ, যাতে একেকটি মানব কঙ্কাল। সেখানে অন্য একটি গর্ত আছে,যাতে আছে কুকুরের কঙ্কাল। স্মর্তব্য, এসব লোকের ব্যাপারে ন্যূনতম জ্ঞান অর্জন কিংবা জানার জন্য মুহাম্মদ সা.-এর কাছে কোনো মাধ্যম কিংবা উৎস ছিল না এবং বাস্তবতা হল, তা এখনো মাটির নিচে একটি গুহায় চাপা পড়ে আছে। এটি কুরআনের মুজিজা যে, তা ঐতিহাসিকদের বর্ণনা বা নৃবিজ্ঞানীদেরআবিষ্কারের শত শত বছর পূর্বের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে।
গুহাবাসীদের কর্ণকুহর বন্ধ করে দেয়া
“ফলে আমি (আল্লাহ) গুহায় তাদের কান (শ্রবণশক্তি) বন্ধ করে দিলাম বহু বছরের জন্য (যাতে তারা গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন হয়)।” [কাহফ ১৮ : ১১]
এই আয়াতে সেসব যুবকের কথা উল্লেখিত হয়েছে যারা গুহার ভেতর ঘুমিয়ে ছিল তিনশত বছর। লক্ষ্য করলে বিস্মিত হতে হয় যে, এই আয়াতে কুরআন মাজিদ শ্রবণ ব্যতীত সেসব যুবকের অন্য কোনো শরীরবৃত্তের বর্ণনা দেয় নি। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছে, সকল সংবেদনশীল অঙ্গের মধ্যে কেবল কানই, এমন কি, ঘুমের মধ্যেও সক্রিয় থাকে। এ কারণেই ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার জন্য আমাদের শাব্দিক সংকেত প্রয়োজন হয়।যেহেতু, আল্লাহ তাআলা এসব লোককে দীর্ঘদিনের জন্য নিদ্রিত রাখতে ইচ্ছা করলেন, তিনি তাদের শ্রবণেন্দ্রীয়কেও বন্ধ করে দিলেন। নিশ্চিতভাবে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চৌদ্দশ বছর পূর্বে ঘুমের শরীরবৃত্তীয় বিদ্যা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।
গুহাবাসীদের পার্শ্ব পরিবর্তন
“তুমি তাদের মনে করতে জাগ্রত, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত। আমি তাদেরকে পার্শ পরিবর্তন করাচ্ছি ডানে ও বামে এবং তাদের কুকুরটি আঙিনায় তার সামনের দু’পা বাড়িয়ে আছে।” [কাহফ, ১৮: ১৮]
এই আয়াতটি গুহার যুবকদের ঘুমানোর ধরন সম্পর্কিত। এই আয়াত বলে, যদিও তারা তিনশ বছরের অধিককাল ঘুমিয়েছিল, আল্লাহ তাআলা তাদের ডানে ও বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতেন। এই আয়াতটি এভাবে সেসব লোকদের জন্য একটি বিশেষ স্বাস্থ্য-নিয়মের নির্দেশনা দেয় যারা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিছানায় শুয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এ ধরনের লোকদের উপদেশ দেয়া হয়েছে বিছানায় তাদের অবস্থান নিয়ত পরিবর্তন করতে।অন্যথায় পরিণামে তারা বিভিনড়ব স্বাস্থ্য-সমস্যায় পতিত হবে। যেমন- রক্ত সঞ্চালনজনিত জটিলতা, ত্বকের পঁচন, শরীরের নিমড়বাংশে রক্তের চাপ ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কে এসব যুবকের ঘুমানোর ধরন বর্ণনার ক্ষেত্রে এমন যথার্থ ভাষা ব্যবহার করতে পারেন?
মুলঃ আল-কুর’আনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য
কুরআন মাজিদের টিকাকারদের মতে, এই আয়াতে একদল যুবকের কথা উল্লিখিত হয়েছে, যারা এক রোমান রাজার উৎপীড়ন থেকে নিজেদের ঈমান ও জীবন রক্ষার জন্য পাহাড়ের একটি গর্তে আশ্রয় নিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে গুহার ভেতর প্রায় তিনশ বছর ঘুমিয়ে রেখেছিলেন। যখন তারা ঘুম থেকে জাগ্রত হল, তাদের একজন সাথীকে একটি মুদ্রা দিয়ে খাবার কিনে আনার জন্য পাঠাল। যখন সে শহরে প্রবেশ করল, দেখতে পেল পুরো শহর সম্পূর্ণরূপে বদলে গেছে। দোকানী এত প্রাচীন মুদ্রা দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল। সে মনে করল, এই যুবক কোনো ধরনের
ধনভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছে এবং সে এই মুদ্রার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইল। যুবকটি এমন বিপত্তির মুখে পড়ে আরও অধিক বিস্মিত হল।বিষয়টি শেষ পর্যন্ত রাজ দরবার পর্যন্ত গড়াল। রাজা যুবকটির কাহিনী শুনে বিস্মিত হলেন। অতঃপর তার সভাসদদের সঙ্গে নিয়ে সেই গুহার কাছে গেলেন এবং যুবকদেরকে তাদের জন্য দুআ করতে বললেন। পরবর্তীতে তারা সেই একই গুহার মধ্যেই বসবাস করতে লাগল এবং মৃত্যু বরণকরল। ‘গিবন’ তার ‘রোমান সম্রাজ্যের উত্থান-পতন’ (অধ্যায় ৩৩) নামক গ্রন্থে এই ঘটনার আরও কিছু বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তার মতে, এই ঘটনাটি সংঘটিত হয় রোম সম্রাট ‘ডিসাস’ এর রাজত্বকালে ২৪৯-২৫১ খৃস্টাব্দে। যুবকরা অতঃপর জাগ্রত হয়েছিল রোমান সম্রাট থিউডুসাস এর রাজত্বকালে। যার শাসনকাল ছিল ৪০৭ থেকে ৪৫০ খৃস্টাব্দ।
কিছুদিন পূর্বে আমি জর্ডানে এক স্থান ভ্রমণ করি, যাকে অধিকাংশ লোক আসহাবে কাহফের গুহা বলে ধারণা করে থাকে। এটি রাজধানী শহর আম্মানের বহিরপার্শ্বে অবস্থিত। পুরো এলাকাটি খুব এবড়ো-থেবড়ো, পিঙ্গলবর্ণ পাহাড়ময়। একটি পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি সুপ্ত গুহা, যার রয়েছে একটি বড় কক্ষ। আমি কক্ষটিতে প্রবেশ করলাম। পাথরে খোদিত সাতটি গর্ত দেখতে পেলাম। প্রতিটি গর্তের ভেতর একটি করে প্রকোষ্ঠ, যাতে একেকটি মানব কঙ্কাল। সেখানে অন্য একটি গর্ত আছে,যাতে আছে কুকুরের কঙ্কাল। স্মর্তব্য, এসব লোকের ব্যাপারে ন্যূনতম জ্ঞান অর্জন কিংবা জানার জন্য মুহাম্মদ সা.-এর কাছে কোনো মাধ্যম কিংবা উৎস ছিল না এবং বাস্তবতা হল, তা এখনো মাটির নিচে একটি গুহায় চাপা পড়ে আছে। এটি কুরআনের মুজিজা যে, তা ঐতিহাসিকদের বর্ণনা বা নৃবিজ্ঞানীদেরআবিষ্কারের শত শত বছর পূর্বের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে।
গুহাবাসীদের কর্ণকুহর বন্ধ করে দেয়া
“ফলে আমি (আল্লাহ) গুহায় তাদের কান (শ্রবণশক্তি) বন্ধ করে দিলাম বহু বছরের জন্য (যাতে তারা গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন হয়)।” [কাহফ ১৮ : ১১]
এই আয়াতে সেসব যুবকের কথা উল্লেখিত হয়েছে যারা গুহার ভেতর ঘুমিয়ে ছিল তিনশত বছর। লক্ষ্য করলে বিস্মিত হতে হয় যে, এই আয়াতে কুরআন মাজিদ শ্রবণ ব্যতীত সেসব যুবকের অন্য কোনো শরীরবৃত্তের বর্ণনা দেয় নি। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছে, সকল সংবেদনশীল অঙ্গের মধ্যে কেবল কানই, এমন কি, ঘুমের মধ্যেও সক্রিয় থাকে। এ কারণেই ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার জন্য আমাদের শাব্দিক সংকেত প্রয়োজন হয়।যেহেতু, আল্লাহ তাআলা এসব লোককে দীর্ঘদিনের জন্য নিদ্রিত রাখতে ইচ্ছা করলেন, তিনি তাদের শ্রবণেন্দ্রীয়কেও বন্ধ করে দিলেন। নিশ্চিতভাবে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চৌদ্দশ বছর পূর্বে ঘুমের শরীরবৃত্তীয় বিদ্যা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।
গুহাবাসীদের পার্শ্ব পরিবর্তন
“তুমি তাদের মনে করতে জাগ্রত, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত। আমি তাদেরকে পার্শ পরিবর্তন করাচ্ছি ডানে ও বামে এবং তাদের কুকুরটি আঙিনায় তার সামনের দু’পা বাড়িয়ে আছে।” [কাহফ, ১৮: ১৮]
এই আয়াতটি গুহার যুবকদের ঘুমানোর ধরন সম্পর্কিত। এই আয়াত বলে, যদিও তারা তিনশ বছরের অধিককাল ঘুমিয়েছিল, আল্লাহ তাআলা তাদের ডানে ও বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতেন। এই আয়াতটি এভাবে সেসব লোকদের জন্য একটি বিশেষ স্বাস্থ্য-নিয়মের নির্দেশনা দেয় যারা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিছানায় শুয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এ ধরনের লোকদের উপদেশ দেয়া হয়েছে বিছানায় তাদের অবস্থান নিয়ত পরিবর্তন করতে।অন্যথায় পরিণামে তারা বিভিনড়ব স্বাস্থ্য-সমস্যায় পতিত হবে। যেমন- রক্ত সঞ্চালনজনিত জটিলতা, ত্বকের পঁচন, শরীরের নিমড়বাংশে রক্তের চাপ ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কে এসব যুবকের ঘুমানোর ধরন বর্ণনার ক্ষেত্রে এমন যথার্থ ভাষা ব্যবহার করতে পারেন?
মুলঃ আল-কুর’আনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন