HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

বিদ‘আত হ’তে সাবধান

লেখকঃ শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
বিদ‘আত হ’তে সাবধান

মূল : শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ

নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,

হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ৩৩

ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,

মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০

১ম প্রকাশ : জুলাই ২০১১ খৃঃ

নির্ধারিত মূল্য : ১৮ (আঠারো) টাকা মাত্র।

অনুবাদকের আরয
كلمة المترجم

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ’৭৬ (আরবী)-তে ছাত্র থাকা কালীন সময়ে একদিন বিকালে প্রিয় শিক্ষক ড. মুস্তাফিজুর রহমান স্যারের (পরবর্তীতে ভিসি, ই.বি. কুষ্টিয়া) ফুলার রোডের বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারের বাসায় গেলে তিনি আমাকে সদ্য প্রকাশিত এই বইটি [প্রকাশক : মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (১৩৯৬/১৯৭৬ খৃ:)] পড়তে দেন এবং অনুবাদ করতে বলেন। বইটি আমি ২০.১২.১৯৭৬ ইং তারিখে গ্রহণ করি এবং ২৮.১২.১৯৭৬ ইং তারিখে অনুবাদ শেষ করে স্যারের বাসায় নিয়ে যাই। স্যার খুবই খুশী হন এবং দো‘আ করেন। পরবর্তীতে বইয়ের চতুর্থ বিষয়টি ‘একটি বহুল প্রচলিত অছিয়তনামা’ (মদীনার শায়খ আহমাদ বর্ণিত) শিরোনামে ঢাকার সাপ্তাহিক আরাফাত ২০ বর্ষ ১২, ১৩, ১৪ পরপর তিন সংখ্যায় ১৯৭৭ সালের ১৬, ২৩ ও ৩০শে ডিসেম্বর তারিখে প্রকাশিত হয়। বাকীগুলি খাতায় বন্দী হয়ে পড়ে থাকে।

জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে পান্ডুলিপিটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সম্প্রতি ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’ গবেষণা বিভাগের উদ্যোগে পুরানো দিনের লেখাগুলি বন্দীত্ব কাটিয়ে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। এজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। অনুবাদ করেছিলাম সাধু ভাষায়। গবেষণা বিভাগ আমার অনুমতিক্রমে তা চলতি ভাষায় পরিবর্তন করেছে। এজন্য তাদেরকে ধন্যবাদ রইল। অতঃপর পুরা লেখাটি নতুনভাবে দেখার পর মুদ্রণের অনুমতি দিয়েছি। যে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে এটি সম্ভব হয়েছে, সেই মহান প্রজ্ঞাময় ও দয়াময়ের প্রতি রইল আমার হৃদয় উজাড় করা প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা। যাঁর অমূল্য লেখনী আমরা অনুবাদ ও প্রকাশ করছি, তিনি আজ সকলের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এই অনুবাদের মাধ্যমে ও তা পঠন ও পাঠনের মাধ্যমে যত মানুষ উপকৃত হবেন ও বাতিল ছেড়ে হক-এর অনুসারী হবেন, সকলের নেক আমলের ছওয়াব মরহূম লেখকের আমলনামায় ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ হিসাবে যুক্ত হৌক, এই দো‘আ করি। সাথে সাথে অনুবাদক, প্রকাশক ও সহযোগী সকলের জন্য বইটি পরকালীন মুক্তির অসীলা হৌক- মহান আল্লাহর নিকটে একান্তভাবে সেই প্রার্থনা করি- আমীন!

বিনীত

অনুবাদক ও পরিচালক

হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

লেখকের সংক্ষিপ্ত জীবনী (مختصر حياة المؤلف)
নাম : আব্দুল আযীয, পিতা : আব্দুল্লাহ। ঊর্ধ্বতন ৪র্থ পিতামহ ‘বায’-এর নামানুসারে তিনি ‘বিন বায’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১২ই যিলহাজ্জ ১৩৩০ হিঃ মোতাবেক ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৯ সালের ১৩ই মে বৃহস্পতিবার ভোর রাত ৩-টায় ত্বায়েফের এক হাসপাতালে ৮৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শুক্রবার বাদ জুম‘আ পবিত্র কা‘বা চত্বরে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সঊদী বাদশাহ সহ লক্ষ লক্ষ শোকবিহবল মুছল্লী উক্ত জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। মৃত্যুর ৩ ঘণ্টা আগেও রাত ১২-টা পর্যন্ত তিনি সুস্থ ছিলেন ও সকলের সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলেন।

শিক্ষা জীবন : তিনি বাল্যকালেই পবিত্র কুরআন হেফয করেন। অতঃপর রিয়াদের শ্রেষ্ঠ বিদ্বানগণের নিকট শিক্ষা লাভ করেন ও শরী‘আতের বিভিন্ন শাখায় গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৬ বছর বয়সে তাঁর চোখের অসুখ দেখা দেয় এবং মাত্র ২০ বছর বয়সে দৃষ্টি শক্তি সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু প্রখর মেধাশক্তির কারণে লেখাপড়ায় কোন সমস্যা হয়নি। তিনি ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিম কয়েকবার খতম করেছেন। এতদ্ব্যতীত কুতুবে সিত্তাহর অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থ এবং মুসনাদে আহমাদ ও দারেমীর বেশীর ভাগ অংশ অধ্যয়ন করেন। তিনি বুখারী শরীফের হাফেয ছিলেন বলে যে কথা প্রচলিত আছে, তা ঠিক নয়। তবে ছহীহ বুখারীর উপর তাঁর দখল এমন ছিল যে, আলোচনায় মনে হ’ত যেন সমস্ত বুখারী শরীফ তাঁর নখদর্পণে।

কর্ম জীবন : ১৩৫৭ হিজরীতে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি রিয়াদের আল-খারজ এলাকার বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং ১৩৭১ হিজরী পর্যন্ত ১৪ বছর উক্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি রিয়াদ আল-মা‘হাদ আল-ইলমীতে একবছর ও পরে শরী‘আহ কলেজে ৭ বছর অধ্যাপনা করেন। ১৩৮৩ হিজরীতে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর ১ম ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন এবং ১৩৯০ হিজরীতে চ্যান্সেলর হন। তিনি হজ্জ-এর ময়দানে খুৎবা দিতেন ও ইমামতি করতেন। ১৩৯৫ হিজরীতে তিনি রিয়াদের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা-র প্রধান নিযুক্ত হন। ১৪১৪ হিজরীতে তিনি সঊদী আরবের ‘মুফতী আম’ বা গ্রান্ড মুফতী হিসাবে বরিত হন। এটাই ছিল সেদেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় পদ। এজন্য বাদশাহ তাঁকে سماحة الوالد বা ‘বুযর্গ পিতা’ বলে ডাকতেন। কখনও রাজ দরবারে আহবান করলে বাদশাহ তাঁকে নিজের পাশে বসাতেন। তাঁর পরামর্শ সেদেশের সরকার ও মজলিসে শূরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করত।

লেখনী : তাঁর রচিত ও প্রকাশিত ছোট-বড় অন্যূন ২১টি বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ কলেবরের হ’ল তাঁর মূল্যবান টীকা সম্বলিত ছহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থ ফাৎহুল বারী যা ১৩ খন্ডে সমাপ্ত এবং তাঁর নিজস্ব ফৎওয়া সংকলন, যা ৮ খন্ডে সমাপ্ত। এছাড়া রয়েছে হজ্জ ও ওমরাহ নির্দেশিকা, বিদ‘আত হ’তে সাবধান, আল্লাহর পথে দাওয়াতের গুরুত্ব ও দাঈ-র চরিত্র, ছহীহ আক্বীদা ও তার বিপরীত আক্বীদা, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের উপর আমলের অপরিহার্যতা, আল্লাহর বিধান সমূহ বাস্তবায়ন করা ও তার বিপরীত বিধান সমূহ পরিত্যাগ করা, ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব: তাঁর দাওয়াত ও চরিত্র, সফর ও হিজাবের বিধান, ছালাত বিষয়ে (একত্রে) তিনটি পুস্তিকা, কুরআন ও রাসূল (ছাঃ)-এর সমালোচনাকারীদের বিষয়ে ইসলামের বিধান, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট সাহায্যপ্রার্থীর বিষয়ে শরী‘আতের বিধান, জাদুকর ও গনৎকারদের সত্যতা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার অপরিহার্যতা ও বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকা, আরব জাতীয়তাবাদের সমালোচনা ইত্যাদি। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দান করুন- আমীন! -অনুবাদক

মীলাদুন্নবী (ছাঃ)-এর অনুষ্ঠান
( حكم الاحتفال بمولد النبى )

অতঃপর আমার নিকট রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্ম উপলক্ষে মীলাদ অনুষ্ঠান করা, তাতে ক্বিয়াম করা, রাসূলকে সালাম দেওয়া এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক যে সকল ব্যাপার সাধারণতঃ মীলাদ মাহফিলে করা হয়ে থাকে সে সম্পর্কে বহুবার প্রশ্ন এসেছে।

এর জওয়াবে কেবল এতটুকুই বলা যেতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং অন্য কারু জন্ম উপলক্ষে কোনরূপ অনুষ্ঠান করা শরী‘আতে জায়েয নয়। কেননা তা হ’ল শরী‘আতের মধ্যে নবোদ্ভূত বিষয় সমূহের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে তা করেননি, তার খুলাফায়ে রাশেদীনও করেননি এবং রাসূলের অন্যান্য ছাহাবী ও তাবেঈগণও তা কখনোই করেননি। অথচ তাঁরাই ছিলেন সুন্নাতে নববী সম্পর্কে দুনিয়ার সকল মানুষের চাইতে বেশী ওয়াকিফহাল, রাসূলের মহববতে সর্বাগ্রগণ্য এবং তাঁর সুন্নাত ও শরী‘আতের একনিষ্ঠ অনুসারী।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ - ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[1] অন্য হাদীছে বলা হয়েছে,

عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ مِنْ بَعْدِيْ، تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ- رواه أحمد وأبوداؤد والترمذي وابن ماجه -

‘তোমাদের উপর পালনীয় হ’ল আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত। তোমরা তা কঠিনভাবে আঁকড়ে ধর এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর। আর ধর্মের নামে নতুন সৃষ্টি হ’তে সাবধান! নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত ও প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[2] উপরোক্ত হাদীছ দু’টিতে বিদ‘আতের প্রবর্তন ও তার অনুসরণের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।

আল্লাহ রববুল আলামীন বলেছেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا - ( الحشر 7)- ‘আর রাসূল তোমাদের নিকট যা নিয়ে আসেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ - ( النور 63)- ‘যারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদেশ-নিষেধের বিরোধিতা করে তারা যেন এ বিষয়ে ভয় করে যে, তাদেরকে (দুনিয়াবী জীবনে) গ্রেফতার করবে নানাবিধ ফিৎনা এবং (পরকালীন জীবনে) গ্রেফতার করবে মর্মান্তিক আযাব’ (নূর ২৪/৬৩)। তিনি বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا - ( الأحزاب 21)- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতকে কামনা করে এবং আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)। তিনি বলেন,

وَالسَّابِقُوْنَ الْأَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهَاجِرِيْنَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِيْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِإِحْسَانٍ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَدًا، ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ - ( الةوبة ১০০)-

‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী এবং যারা পরবর্তীতে নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর আল্লাহ তাদের জন্য এমন উদ্যান সমূহ প্রস্ত্তত করে রেখেছেন। যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহান সফলতা’ (তওবা ৯/১০০)। তিনি বলেন, اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا - ( المائدة 3)- ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য আমার প্রদত্ত দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। এই মর্মে আরও বহু আয়াত রয়েছে।

অতঃপর এই সকল জন্ম দিবস সমূহের প্রবর্তন হ’তে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনকে উম্মতের জন্য পূর্ণাঙ্গ করে দেননি এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-ও উম্মতের জন্য করণীয় অনেক কিছু পুণ্যপন্থা আমাদেরকে বাৎলে দিয়ে যাননি, যার জন্য পরবর্তীকালে কিছু ব্যক্তি আল্লাহ প্রদত্ত শরী‘আতের মধ্যে তাঁর অনুমতি ছাড়াই পুণ্যের নামে নতুন কিছু অনুষ্ঠানের উদ্ভব ঘটিয়ে ভেবে নিলেন যে, এর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা সম্ভব হবে।

নিঃসন্দেহে এর মধ্যে বিরাট গুনাহ নিহিত রয়েছে এবং এটা স্বয়ং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শামিল। অথচ মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ এবং এই নে‘মতকে সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। আর মহান রাসূল (ছাঃ) উক্ত দ্বীনকে তাঁর উম্মতের নিকট পুরাপুরিভাবেই পৌঁছে দিয়েছেন। মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার ও জাহান্নাম হ’তে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন পথ-পন্থাই তিনি বলতে বাকী রেখে যাননি। যেমন ছহীহ হাদীছে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন যে,

مَا بَعَثَ اللهُ مِنْ نَبِىٍّ إِلاَّ كَانَ حَقًّا عَلَيْهِ أَنْ يَّدُلَّ أُمَّتَهُ عَلَى خَيْرِ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ وَيُنْذِرَهُمْ شَرَّ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ - ‘প্রত্যেক নবীর উপর এটি অপরিহার্য করা হয়েছে যে, তিনি তাঁর উম্মতের নিকট আল্লাহর নিকট হ’তে আনীত যাবতীয় পুণ্যপথসমূহ বাৎলিয়ে দিবেন এবং তাদেরকে যাবতীয় অন্যায় পথ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিবেন’।[3] অতঃপর এটা সকলের জানা বিষয় যে, আমাদের নবী (ছাঃ) দুনিয়ার সেরা নবী ও শেষনবী। তাই দ্বীনের সকল কথা উম্মতের নিকট পৌঁছানোর ব্যাপারে ও উপদেশ দানের ব্যাপারে তিনি সবার ঊর্ধ্বে।

এক্ষণে যদি মীলাদ অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হ’ত, যদ্বারা আল্লাহ খুশী হন, তাহ’লে নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এই ব্যাপারটি তাঁর উম্মতের নিকট বলে যেতেন অথবা তিনি নিজ জীবনে করে যেতেন কিংবা তাঁর ছাহাবীগণ করতেন। কিন্তু এরূপ কোন কিছুই যখন ঘটেনি তখন বুঝতে হবে যে, এটা ইসলামের মধ্যকার কিছুই নয় বরং তা সেই বিদ‘আত সমূহের অন্তর্ভুক্ত, যে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উম্মতকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে গিয়েছেন। যা পূর্বোক্ত দু’টি হাদীছ ছাড়াও উক্ত মর্মের বহু হাদীছে তিনি বলেছেন। এতদ্ব্যতীত জুম‘আর খুৎবায় তিনি বলতেন, أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَخَيْرَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ وَشَرَّ الْأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ، رواه مسلم - ‘সর্বোত্তম হাদীছ হ’ল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত এবং সবচাইতে নিকৃষ্ট কর্ম হ’ল শরী‘আতের মধ্যে নতুন নতুন অনুষ্ঠানের উদ্ভব ঘটানো। আর প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[4] এ প্রসঙ্গে অসংখ্য আয়াত ও হাদীছ রয়েছে। আলেমদের একটি বিরাট দল পূর্বোক্ত দলীল সমূহ ও অন্যান্য দলীলাদির প্রতি আমল করে প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠানের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছেন ও তার পরিণতি সম্পর্কে উম্মতকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।

পরবর্তীকালে কিছু বিদ্বান এটাকে জায়েয রেখেছেন, যদি তার মধ্যে ধর্মীয় নীতি বিরোধী কোন অপকর্ম না হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রশংসায় অতি বাড়াবাড়ি, নারী-পুরুষের সম্মিলন, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার ইত্যাদি। তারা ধারণা করেন যে, মীলাদ হ’ল একটি ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ (উত্তম বিদ‘আত)। অথচ শরী‘আতের মূলনীতি ( القائدة الشرعية ) আমাদেরকে আমাদের বিতর্কিত বিষয় সমূহের মীমাংসার জন্য আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতের প্রতি ধাবিত হ’তে বলে। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে,

يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَّأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً - ( النساء 59)- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর আমার রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদ কর, তাহ’লে বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা সত্যিকারভাবে আল্লাহ ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাসী হও। আর এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيْهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللهِ - ( الشوري ১০)- ‘আর তোমরা যেসব বিষয়ে মতভেদ কর, তার ফায়ছালা তো কেবল আল্লাহর নিকট’ (শূরা ৪২/১০)।

(এবারে আসুন মাননীয় পাঠক!) মীলাদ মাহফিলের এই বিতর্কিত মাসআলাটি নিয়ে আমরা প্রথমে আল্লাহর কিতাবের শরণাপন্ন হই। সেখানে আমাদেরকে রাসূলের প্রতিটি নির্দেশের অনুসরণ ও নিষেধ হ’তে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে এবং এটাও দেখছি যে, আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে এই উম্মতের জন্য পূর্ণ করে দিয়েছেন। অথচ উক্ত মীলাদ মাহফিল রাসূলের আনীত সেই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয় যে দ্বীনকে আল্লাহ আমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন এবং যে ব্যাপারে আমাদেরকে রাসূলের অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আসুন রাসূলের সুন্নাতের দিকে। সেখানে দেখছি যে, না রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা কখনও করেছেন, না কাউকে করার হুকুম দিয়েছেন, না তাঁর ছাহাবীগণ তা করেছেন। অতএব আমরা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারি যে, তা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং নবোদ্ভূত বিষয় সমূহের অন্যতম এবং তা হ’ল ইহুদী ও খৃষ্টানদের ধর্মীয় উৎসবসমূহের অনুকরণ মাত্র।

উপরোক্ত আলোচনা হ’তে যার সামান্যতম বোধশক্তি ও সত্যপ্রীতি এবং নিরপেক্ষ অনুসন্ধিৎসা রয়েছে, তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন যে, প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠান ইসলামী শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং তা হ’ল বিদ‘আত সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যা হ’তে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে পূর্বেই সতর্ক করে দিয়েছেন। সুতরাং বিভিন্ন প্রান্তের বহু সংখ্যক লোক উক্ত মাহফিলের অনুষ্ঠান করে বলে কোন জ্ঞানী লোকের পক্ষে তা দ্বারা ধোঁকা খাওয়া উচিত নয়। কেননা সংখ্যাধিক্য দ্বারা সত্য নির্ধারিত হয় না বরং সত্য নির্ধারিত হয় কেবলমাত্র মযবুত শারঈ দলীল সমূহ দ্বারা। যেমন (সে যুগের সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইহুদী-নাছারারা বলত, لَنْ يَّدْخُلَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ كَانَ هُوْدًا أَوْ نَصَارَى تِلْكَ أَمَانِيُّهُمْ قُلْ هَاتُوْا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ- البقرة 111)- ‘ইহুদী ও নাছারা ব্যতীত কেউই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (আল্লাহ বলেন) এটা ছিল তাদের একটা (অন্ধ) ধারণা মাত্র; (হে নবী!) তুমি বল যে, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহ’লে দলীল পেশ কর’ (বাক্বারাহ ২/১১১)। আল্লাহ বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ، ( الأنعام 116)- ‘হে নবী! তুমি যদি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের অনুসরণ কর, তাহ’লে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে ...’ (আন‘আম ৬/১১৬)।

অতঃপর প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠান সমূহ বিদ‘আত হওয়া ছাড়াও এসবের অধিকাংশ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম হ’তে মুক্ত নয়। যেমন নারী-পুরুষের সম্মিলন, বিভিন্ন গান-গযল ও বাদ্যযন্ত্রের আমদানী, জ্ঞান লোপকারী পানীয় সমূহ (মদ, তাড়ি, গাঁজা ইত্যাদি) পরিবেশন ইত্যাদি। এতদ্ব্যতীত তার মধ্যে সবচাইতে মারাত্মক ও বড় শিরক ( الشرك الأكبر ) হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রশংসায় অতিরঞ্জিত করা এবং অলি-আউলিয়াদের প্রতি অযথা ভক্তির আতিশয্য প্রদর্শন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আহবান করা ও তাঁর নিকট আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করা এবং এই বিশ্বাস রাখা যে, তিনি ‘গায়েব’-এর খবর জানেন প্রভৃতি নানা ধরনের কুফরী কর্মসমূহ লোকেরা মীলাদের মাহফিলে এবং অন্যান্য অলি-আউলিয়াদের স্মৃতি উৎসবে (ওরসে) করে থাকে।

অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِى الدِّيْنِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِى الدِّيْنِ، رواه ابن ماجه - ‘তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা হ’তে বিরত থাক। কেননা এই বাড়াবাড়িই তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদেরকে (ইহুদী-নাছারাকে) ধ্বংস করেছে’।[5] তিনি আরও বলেন, لاَ تَطِرُوْنِىْ كَمَا أَطَرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ، متفق عليه - ‘তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি কর না, যেমন বাড়াবাড়ি করেছে খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারিয়ামকে নিয়ে। আমি শুধুমাত্র তাঁর একজন বান্দা। অতএব তোমরা আমাকে বল, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[6]

বিস্ময় ও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বহুলোক খুব খুশীর সাথে ও যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করে এই সব বিদ‘আতী মজলিসে যোগ দিতে আসে এবং তার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে। অথচ তারা সাপ্তাহিক জুম‘আ ও দৈনন্দিন ফরয ছালাতের জামা‘আত সমূহ হ’তে পিছিয়ে থাকে এবং এ সকল ব্যাপারে মোটেই মাথা ঘামায় না। এমনকি সে একবারও মনে করে না যে, সে একটা মহা অন্যায় কাজ করে চলেছে। নিঃসন্দেহে এটা তাদের দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক এবং (শরী‘আতের ব্যাপারে) অন্তর্দৃষ্টির অভাব ও রকমারি পাপাচার ও গুনাহের কাজে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে তাদের অন্তরে যে মরিচা ধরে গেছে, এই সকল অপকর্ম তারই বাস্তব ফলশ্রুতি। আমরা আমাদের জন্য ও সকল মুসলমানের জন্য আল্লাহর নিকটে এসব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

‘মীলাদ’ সমর্থক লোকদের মধ্যে কিছু লোক এমন ধারণা রাখে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং মীলাদের মাহফিলে হাযির হন এবং সেজন্য তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্মানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে (ক্বিয়াম করে) সালাম জানায় (যেমন, ইয়া নবী সালামু আলায়কা)। এটাই হ’ল সবচাইতে চরম মূর্খতা ও ভিত্তিহীন কর্ম। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বিয়ামতের পূর্বে কবর থেকে বাইরে আসতে পারেন না। পারেন না কোন মানুষের সাথে মিলিত হ’তে কিংবা তাদের কোন মজলিসে যোগদান করতে। তিনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত কবরেই থাকবেন এবং তাঁর পবিত্র রূহ তাঁর প্রতিপালকের নিকট মহা সম্মানিত ‘ইল্লীঈনে’ থাকবে। যেমন সূরায়ে মুমিনূনে এ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, ثُمَّ إِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ- ثُمَّ إِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ - ( المؤمنون ১৫-১৬) ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই মৃত্যুমুখে পতিত হবে’। ‘অতঃপর তোমরা ক্বিয়ামত দিবসে অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে’ (মুমিনূন ২৩/১৫-১৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

أَنَا أَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ-رواه مسلم ‘ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আমারই কবর বিদীর্ণ হবে এবং আমিই প্রথম শাফা‘আত করব ও আমারই শাফা‘আত সর্বপ্রথম কবুল করা হবে’।[7] অতএব তাঁর উপরেই বর্ষিত হেŠক তাঁর প্রতিপালকের সর্বোত্তম অনুগ্রহ ও শান্তি!

উপরোক্ত আয়াতে কারীমা ও হাদীছ ছাড়াও এই মর্মে অন্যান্য বহু আয়াত ও হাদীছ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সহ দুনিয়ার সমস্ত মৃতব্যক্তি কেবলমাত্র ক্বিয়ামতের দিন কবর হ’তে উঠবেন; এর পূর্বে নয়। এ ব্যাপারে মুসলিম জাহানের সমস্ত আলেমই একমত, কারু কোন দ্বিমত নেই। অতএব প্রত্যেক মুসলমানকে এই সকল বিদ‘আত হ’তে সতর্ক থাকা প্রয়োজন এবং কিছু সংখ্যক মূর্খ ও তাদের অনুগামীরা যেসকল বিদ‘আত ও কল্পিত ধর্মানুষ্ঠান সমূহ আবিষ্কার করেছে, যার সপক্ষে আল্লাহ রববুল আলামীন কোন দলীল অবতীর্ণ করেননি- ঐ সকল অপকর্ম হ’তে সকলের সাবধান থাকা উচিত।

والله المسةعان وعليه الةكلان ولا حول ولا قوة إلا بالله -

অতঃপর অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষিত হৌক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর। আর এটা হ’ল আল্লাহর নৈকট্য লাভের উৎকৃষ্ট উপায় এবং সৎকর্ম সমূহের অন্যতম। যেমন আল্লাহ বলেছেন যে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতা মন্ডলী নবীর প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। অতএব হে বিশ্বাসীগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ কর’ (আহযাব ৩৩/৫৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত নাযিল করেন’।[8] এটি সকল অবস্থায় পড়তে হয় এবং বিশেষভাবে তাকীদ হ’ল সকল ছালাতের শেষে পড়া। বরং সকল বিদ্বানের নিকট ওয়াজিব হ’ল প্রত্যেক ছালাতের শেষ বৈঠকে দরূদ পাঠ করা। অনেক স্থানে এটি পাঠ করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। যেমন আযানের পরে ও রাসূলের নাম বলার সময় এবং জুম‘আর দিনে ও রাতে। যে বিষয়ে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, তিনি আমাদেরকে ও সকল মুসলমানকে দ্বীন বুঝার ও তার উপরে দৃঢ় থাকার তাওফীক দান করুন এবং সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার ও বিদ‘আত হ’তে সাবধান থাকার বিষয়ে সকলের প্রতি অনুগ্রহ করুন! কেননা তিনি সর্বপ্রদাতা ও দয়াবান।

وصلى الله وسلم على نبينا محمد وآله وصحبه -

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০ ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ-৫।

[2]. আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৬৫ ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫।

[3]. মুসলিম হা/১৮৪৪, ‘ইমারত’ অধ্যায়-৩৩, وجوب الوفاء ببيعة الخلفاء الأول فالأول অনুচ্ছেদ-১০।

[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১ ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ-৫।

[5]. ইবনু মাজাহ হা/৩০২৯ ‘মানাসিক (হজ্জ)’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৬৩।

[6]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৮৯৭ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, ‘পারস্পরিক গর্ব’ অনুচ্ছেদ-১৩।

[7]. মুসলিম হা/২২৭৮, মিশকাত হা/৫৭৪১ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘নবীকুল শিরোমণির মর্যাদা সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১।

[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৯২১ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘নবীর উপর দরূদ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৬।

শবে মি‘রাজ
( حكم الاحتفال بليلة الإسراء والمعراج )

الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه -

অতঃপর আমরা এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে, মি‘রাজের পবিত্র ঘটনা আল্লাহর মহান নিদর্শন সমূহের অন্যতম, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রিসালাতের সত্যতার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ এবং আল্লাহর দরবারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উচ্চতম মর্যাদার প্রতীক। সাথে সাথে এটি আল্লাহ রববুল আলামীনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা ও সৃষ্টিকুলের উপর তাঁর নিরংকুশ একাধিপত্যের দলীলও বটে। আল্লাহ বলেন,

سُبْحَانَ الَّذِيْ أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِيْ بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّه هُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ - ( الإسراء 1)- ‘মহাপবিত্র সেই সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দা (মুহাম্মাদ)-কে (কা‘বার) মসজিদুল হারাম হ’তে (যেরুজালেমের) মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছেন- যে মসজিদের চতুস্পার্শ্বকে আমরা বরকতমন্ডিত করেছি, যাতে আমরা আমাদের কিছু নিদর্শন তাকে দেখাতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা (ইস্রা/বনু ইসরাঈল ১৭/১)। এতদ্ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে অবিরতধারায় বহু বর্ণনা এসেছে যে, তাঁকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হ’ল এবং আকাশের দরজা সমূহ তাঁর জন্য উন্মুক্ত করা হ’ল। তিনি সপ্তম আকাশ অতিক্রম করলেন। অতঃপর আল্লাহ রববুল আলামীন তাঁর সাথে কথা বললেন ও পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করে দিলেন। আল্লাহ প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বারংবার কাতর অনুরোধে অবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয করা হয়। অতএব ফরয হিসাবে তা পাঁচ ওয়াক্ত হ’লেও পুণ্যের হিসাবে তা পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমান।[1] কেননা (আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী) প্রতিটি পুণ্যকর্ম তার দশগুণ ছওয়াবের সমতুল্য (আন‘আম ৬/১৬০)। অতএব সেই মহান সৃষ্টিকর্তার অসংখ্য নে‘মতের জন্য যাবতীয় প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা।

অতঃপর (মাননীয় পাঠকবর্গ জেনে রাখুন!) শবে মি‘রাজের সঠিক তারিখ সম্পর্কে ছহীহ হাদীছ সমূহে কোন বর্ণনা নেই। এ সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়ে থাকে, তার কোনটিই হাদীছবিশারদ পন্ডিতগণের নিকট রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে সঠিকভাবে প্রমাণিত নয়। তাছাড়া শবে মি‘রাজের নির্দিষ্ট তারিখটি মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়ার মধ্যেও আল্লাহর একটি সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য নিহিত রয়েছে।

অতঃপর যদি তার একটি নির্দিষ্ট তারিখ প্রমাণও করা যায়, তবুও সেই উপলক্ষে কোনরূপ নির্দিষ্ট ইবাদত বা কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা মুসলমানদের জন্য জায়েয হবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তদীয় ছাহাবীগণ এজন্য নির্দিষ্টভাবে কোন অনুষ্ঠান বা ইবাদত করেননি। যদি এই রাত উপলক্ষে কোনরূপ অনুষ্ঠান করা শরী‘আতসম্মত হ’ত, তাহ’লে নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা স্বীয় উম্মতকে বলে যেতেন অথবা নিজে করে যেতেন এবং যদি এজন্য কোন অনুষ্ঠান তিনি করতেন, তাহ’লে নিশ্চয়ই তা সকলে জানতে পারত ও প্রচারিত হ’ত এবং ছাহাবায়ে কেরাম সেটা আমাদের জন্য বর্ণনা করে যেতেন। কেননা তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কৃত ও বর্ণিত প্রতিটি বস্ত্ত যা উম্মতের জন্য প্রয়োজনীয়, সবকিছুই আমাদেরকে বলে গেছেন। দ্বীন পালনের ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কোনরূপ অবহেলা ছিল না; বরং তাঁরাই ছিলেন প্রতিটি সৎকর্মের ব্যাপারে সর্বাগ্রগণ্য। সুতরাং যদি শবে মি‘রাজ উদযাপন কোন ধর্মীয় কাজ হ’ত, তাহ’লে তাঁরাই সর্বাগ্রে তা করতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন মানুষের জন্য সর্বোত্তম উপদেশদাতা এবং তিনি তদীয় রিসালাতকে পরিপূর্ণভাবে মানুষের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়ে স্বীয় পবিত্র আমানত ও দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। এক্ষণে যদি উক্ত রাত্রিকে সম্মান করা ও এতদুপলক্ষে কোনরূপ অনুষ্ঠান করা ইসলামী শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত হ’ত, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনোই তা হ’তে উদাসীন থাকতেন না এবং তা গোপন করতেন না। যখন এই ধরনের কিছুই ঘটেনি, তখন বুঝা গেল যে, শবে মি‘রাজ উদযাপন ও উক্ত রাত্রির জন্য সম্মান প্রদর্শন করা ইসলামের অন্তর্ভুক্ত কোন বিষয় নয়।

আল্লাহ রববুল আলামীন উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য তাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন ও এই নে‘মতকে সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন এবং সাথে সাথে তাঁর অনুমতি ছাড়াই ধর্মের নামে চালুকৃত যাবতীয় অনুষ্ঠানাদিকে অগ্রাহ্য করেছেন। যেমন সূরায়ে মায়েদায় ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম ও ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। অতঃপর সূরায়ে শূরায় ধমকি প্রদান করে বলা হয়েছে,

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوْا لَهُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ - ( الشوري 21)- ‘তাদের জন্য কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন শরীক রয়েছে, যারা তাদের জন্য আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকেই দ্বীনের মধ্যে বিভিন্ন বিধান সমূহ প্রবর্তন করেছে? যদি (কিবয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করার) পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকত, তাহ’লে তাদের ব্যাপারে সিন্ধান্ত হয়েই যেত। নিশ্চয়ই যালেমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (শূরা ৪২/২১)।

বিদ‘আত ও তার স্পষ্ট ভ্রষ্টতা সম্পর্কে স্বীয় উম্মতকে সাবধান করে ছহীহ হাদীছ সমূহে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। যেমন বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন যে, ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[2] মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ - ‘যে ব্যক্তি এমন কাজ করল যাতে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[3] ছহীহ মুসলিমে জাবের (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জুম‘আর খুৎবায় বলতেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ হাদীছ (বাণী) হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হচ্ছে মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্ট কর্ম হচ্ছে শরী‘আতের মধ্যে নতুন বস্ত্তর উদ্ভব ঘটানো। কেননা (ধর্মের নামে) প্রতিটি নবোদ্ভূত বস্ত্তই হ’ল বিদ‘আত এবং প্রতিটি বিদ‘আতই হ’ল ভ্রষ্টতা’। এতদ্ব্যতীত নাসাঈ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ প্রভৃতি সুনানের কিতাব সমূহে ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত হয়েছে যে,

وَعَظَنَا رَسُوْلُ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلم مَوْعِظَةً بَلِيْغَةً وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ فَقُلْنَا : يَا رَسُوْلَ اللهِ كَأَنَّ هٰذه مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا قَالَ : أُوْصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدًا حَبَشِيًّا، فَإِنَّهُ مَنْ يَّعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِيْ فَسَيَرَي اخْتِلاَفًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ، تَمَسَّكُوْا بِهَا وَ عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَ مُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ -

‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে একটি মর্মস্পর্শী ভাষণ প্রদান করলেন। যাতে আমাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হ’ল এবং চক্ষু হ’তে অশ্রু প্রবাহিত হ’তে লাগল। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে এটিই আপনার বিদায়ী ভাষণ। অতএব আমাদেরকে অন্তিম উপদেশ প্রদান করুন! তখন তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে অছিয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং তোমাদের নেতার আনুগত্য করার জন্য- সেই নেতা যদি একজন হাবশী ক্রীতদাসও হন। কেননা তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে, তারা বহুবিধ মতানৈক্য দেখতে পাবে। এমতাবস্থায় তোমরা আমার ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করবে। তোমরা তা মযবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। সাবধান! শরী‘আতের মধ্যে নতুন বিষয়ের প্রচলন ঘটানো হ’তে বিরত থাকবে। কেননা প্রতিটি নবোদ্ভূত বস্ত্তই হ’ল বিদ‘আত। আর প্রতিটি বিদ‘আতই হ’ল ভ্রষ্টতা’।[4]

উক্ত মর্মে আরও বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ছাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের পুণ্যবান পূর্বসুরী তথা সালাফে ছালেহীন যাবতীয় রকমের বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকার জন্য হুঁশিয়ার করে গেছেন। তা কেবলমাত্র এ কারণে যে, এর ফলে দ্বীন ও শরী‘আতের মধ্যে বাড়াবাড়ি করা হয়, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি। এটি আল্লাহর দুশমন ইহুদী-খৃষ্টানদের স্ব স্ব ধর্মে বাড়াবাড়ি ও বিভিন্ন ধরনের বিদ‘আত সৃষ্টির ন্যায়, যার অনুমতি আল্লাহ তাদের দেননি। আর সবচাইতে বড় কথা হ’ল যে, এই সমস্ত নতুন নতুন ধর্মানুষ্ঠান তথা বিদ‘আত প্রচলনের ফলে অপরিহার্য রূপে ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে ত্রুটি প্রমাণিত হয় এবং তা যে পরিপূর্ণ ছিল না, এই মিথ্যারোপ করা হয়। এর মধ্যে যে কি নিদারুণ বিভ্রান্তি ও নিকৃষ্টতম অনাচার এবং দ্বীনের পূর্ণতা বিষয়ে আল্লাহর ঘোষণার (মায়েদাহ ৩) এবং বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ সমূহের স্পষ্ট বিরোধিতা রয়েছে, তা সকলেরই জানা।

আমি আশা করি উপরোল্লিখিত প্রমাণ সমূহ শবে মি‘রাজ উপলক্ষে প্রচলিত বিদ‘আতী অনুষ্ঠানের অসারতা প্রতিপন্ন করার জন্য যেকোন সত্যসন্ধানী ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হবে। প্রকৃত কথা হ’ল, ইসলামী দ্বীনের সাথে উক্ত অনুষ্ঠানের সামান্যতম সম্পর্ক নেই।

আল্লাহ রববুল আলামীন যেহেতু মুসলমানদের জন্য পারস্পরিক উপদেশ প্রদান অপরিহার্য করেছেন এবং তাঁর প্রদত্ত দ্বীনের ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দান করেছেন ও ইলম গোপন করা হারাম করে দিয়েছেন- সেহেতু আমি আমার মুসলমান ভাইদেরকে উক্ত বিদ‘আত সম্পর্কে হুঁশিয়ার করা প্রয়োজন বোধ করছি। যা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি কেউ কেউ একে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে নিয়েছে।

আল্লাহর নিকট প্রার্থনা তিনি যেন মুসলিম জাতির এই দৈন্যদশা দূরীভূত করেন এবং তাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান দান করেন! এবং আমাদেরকে ও সকলকে মযবুতভাবে সত্যকে আঁকড়ে ধরার ও তার উপরে দৃঢ় থাকার এবং সত্যের বিরোধী সকল বস্ত্ত হ’তে বিরত থাকার তাওফীক দান করেন। কেননা তিনিই দ্বীনের অভিভাবক এবং এর উপর ক্ষমতাশালী। আমীন!

وصلى الله وسلم وبارك على عبده ورسوله نبينا محمد آله وصحبه -

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৭ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ-৬ ।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।

[3]. মুসলিম হা/১৭১৮, ‘বিচার সমূহ’ অধ্যায়-৩০, نقض الأحكام الباطلة ورد محدثات الأمور অনুচ্ছেদ-৮।

[4]. আহমাদ, হাকেম, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৫।

শবেবরাত
( حكم الاحتفال بليلة النصف من شعبان )

আল্লাহ রববুল আলামীন সূরায়ে মায়েদায় এরশাদ করেছেন যে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে একমাত্র জীবন বিধান হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৫/৩)। সূরা শূরায় তিনি বলেন, ‘তাদের জন্য কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন শরীক রয়েছে, যারা তাদের জন্য আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকেই দ্বীনের মধ্যে বিভিন্ন বিধান সমূহ প্রবর্তন করেছে’ (শূরা ৪২/২১)। বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন যে, ‘দ্বীনের মধ্যেকার যাবতীয় নবোদ্ভূত বস্ত্তই প্রত্যাখ্যাত’।[1] ছহীহ মুসলিমে জাবের (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জুম‘আর খুৎবায় বলতেন, ‘সবচাইতে নিকৃষ্ট কর্ম হচ্ছে শরী‘আতের মধ্যে নতুন নতুন বস্ত্তর উদ্ভব ঘটানো। কেননা (ধর্মের নামে) প্রতিটি নবোদ্ভূত বস্ত্তই হ’ল ভ্রষ্টতা’।[2]

এমনিতরো অন্যান্য আয়াত ও হাদীছ দ্বারা একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন এবং এই নে‘মতকে সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর রাসূলকে উঠিয়ে নেননি যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি কুরআনকে মানুষের নিকট পুরাপুরিভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং স্বীয় কথা ও কর্ম দ্বারা শরী‘আতের প্রতিটি হুকুম-আহকাম উম্মতের জন্য বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে গেছেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্পষ্ট ভাষায় এরশাদ করেছেন যে, যে সকল কথা ও ধর্মানুষ্ঠান তাঁর পরবর্তীকালে লোকেরা নতুনভাবে আবিষ্কার করবে এবং ঐ সমস্ত কপোলকল্পিত অনুষ্ঠান সমূহকে শরী‘আতের সাথে সম্পর্কিত করবে, তার সমস্তই বিদ‘আত এবং তার যাবতীয় গুনাহ ঐ বিদ‘আতের আবিষ্কারকারীদের উপর বর্তাবে- তাদের উদ্দেশ্য হাযারো ভাল হেŠক না কেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরোক্ত আদেশের প্রকৃত তাৎপর্য ছাহাবায়ে কেরাম ও প্রাথমিক যুগের হকপন্থী আলেমগণ যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে তাঁরা যেকোন রকমের বিদ‘আতকে ইনকার করেছেন এবং তা হ’তে সাবধান করেছেন। ফলে বহু আলেম সুন্নাতের মাহাত্ম্য ও বিদ‘আতের অসারতা প্রমাণ করে বিভিন্ন গ্রন্থাবলীও লিপিবদ্ধ করেছেন। যেমন ইবনু ওয়ায্যাহ, তুরতূশী, আবু শামাহ প্রমুখ বিদ্বানগণ।

বর্তমানে প্রচলিত বিদ‘আত সমূহের মধ্যে একটি হ’ল শা‘বান মাসের মধ্যভাগে ‘শবেবরাত’ উদযাপন এবং ঐদিন ছিয়াম পালন করা, যা কিছুসংখ্যক লোক ধর্মের নামে নতুনভাবে চালু করেছে। অথচ শরী‘আতে এর সপক্ষে নির্ভরযোগ্য কোন দলীল নেই। কেননা শবেবরাতের ফযীলত বর্ণনায় যে সকল যঈফ হাদীছ পেশ করা হয়ে থাকে, তার কোনটির উপরেই নির্ভর করা চলে না। অতঃপর ঐ রাতের বিশেষ ছালাতের বিশেষ বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়ে থাকে তা একেবারেই বানোয়াট। বহু বিদগ্ধ মনীষী এ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছেন যাঁদের কিছু উক্তি পরে আসবে ইনশাআল্লাহ।

সিরিয়ার (শামের) ও অন্যান্য স্থানের কতিপয় পূর্ববর্তী বিদ্বান থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং অধিকাংশ (জমহূর) ওলামায়ে কেরাম যার উপরে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, তা এই যে, শবেবরাত উদযাপন একটি বিদ‘আতী প্রথা এবং এর ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত সমস্ত হাদীছই যঈফ ও কিছু কিছু নিজেদের তৈরী জাল হাদীছ। এ বিষয়ে সাবধান করে মনীষী হাফেয ইবনু রজব (রহঃ) স্বীয় ‘লাত্বায়েফুল মা‘আরিফ’ ( لطائف المعارف ) ও অন্যান্য কিতাবে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। যঈফ হাদীছের উপরে অনেক সময় ঐ সকল ইবাদতের ব্যাপারে আমল করা যেতে পারে, যার মূল ভিত্তি ছহীহ দলীল সমূহ দ্বারা প্রমাণিত। অথচ শবেবরাত অনুষ্ঠানের কোনরূপ সঠিক ভিত্তিই নেই, যে তার জন্য যঈফ হাদীছের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।

হাদীছ গ্রহণের উপরোক্ত মূলনীতি বর্ণনা করেছেন মহামতি ইমাম শায়খুল ইসলাম আবুল আববাস আহমাদ ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ)। অতঃপর হে পাঠক! আমি আপনার জন্য শবেবরাতের এই মাসআলা সম্পর্কে কয়েকজন মনীষীর মতামত উদ্ধৃত করব যা এ বিষয়ে একটি দলীল হিসাবে প্রতিপন্ন হবে।

সকল বিদ্বান এ বিষয়ে একমত যে, যেকোন মাসআলার জন্য আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। অতঃপর কুরআন ও সুন্নাহ অথবা তার যেকোন একটি আমাদেরকে যে হুকুম করবে, তা অবশ্য পালনীয় রূপে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে কুরআন ও সুন্নাহ যে সকল বস্ত্তর বিরোধিতা করবে তা অবশ্যই বর্জন করতে হবে। আর যে সকল ধর্মানুষ্ঠান কুরআন ও সুন্নাহতে স্থান পায়নি, তা সবই বিদ‘আত হবে এবং তা পালন করা কখনোই জায়েয হবে না- তার প্রতি মানুষকে আহবান করা ও তাকে স্বাগত জানানো তো দূরের কথা।

যেমন সূরা নিসায় আল্লাহ রববুল আলামীন বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوْا اللهَ وَأَطِيْعُوْا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَّأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً - ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর আমার রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদ কর, তাহ’লে বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা সত্যিকারভাবে আল্লাহ ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাসী হও। আর এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)। তিনি বলেন, وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللهِ ... ‘আর তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন, তার ফায়ছালা তো আল্লাহর কাছে’... (শূরা ৪২/১০)। সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ - ‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে তিনি তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ সমূহ মাফ করবেন’ (আলে ইমরান ৩/৩১)। সূরা নিসায় আরো কঠোর ভাষায় তিনি বলেন, فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا - ‘(হে মুহাম্মাদ!) তোমার প্রভুর শপথ! তারা কখনোই মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের বিবাদীয় বিষয়সমূহে তোমাকে একমাত্র সমাধানকারী হিসাবে গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমার দেয়া ফায়ছালা সম্পর্কে তাদের মনে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ থাকবে না এবং তারা অবনতচিত্তে তা মেনে নিবে’(নিসা ৪/৬৫)।

উপরোক্ত মর্মে আরও বহু আয়াত রয়েছে। যেগুলির প্রতিটিই এ বিষয়ে এক একটি স্পষ্ট দলীল যে, প্রত্যেক বিতর্কিত মাসআলার সমাধানের জন্য কিতাব ও সুন্নাতের দিকে ধাবিত হ’তে হবে এবং তার দেওয়া সমাধান অবশ্যই সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে হবে। কেননা এটাই হ’ল ঈমানের মূল দাবী এবং বান্দার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গল পরিণতির চাবিকাঠি।

হাফেয ইবনু রজব (রহঃ) তদীয় لطائف المعارف কিতাবে উপরোক্ত দলীল সমূহ উদ্ধৃত করার পর বলেছেন, ‘সিরিয়ার (শামের) খালেদ ইবনে মা‘দান, মাকহূল, লোকমান বিন ‘আমের প্রমুখ তাবেঈগণ শবেবরাতকে বেশ সম্মানের চোখে দেখতেন এবং ঐ রাত্রিতে বেশী বেশী ইবাদত-বন্দেগী করতেন। তাদের দেখেই লোকেরা উক্ত রাত্রির অধিক ফযীলত ও সম্মান কল্পনা করে নিয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, এবিষয়ে তাদের নিকট ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহ পৌঁছেছিল। অতঃপর যখন এই প্রথা চারিদিকে বিস্তৃত হয়ে পড়ল, তখন কেউ তা গ্রহণ করল এবং ঐ রাত্রির সম্মানের ব্যাপারে একমত হ’ল। যেমন বছরাবাসীদের একদল আবেদ ও অন্যান্যরা। কিন্তু মক্কা-মদীনা তথা হেজাযের অধিকাংশ আলেম ওটাকে প্রত্যাখ্যান করেন। যেমন আত্বা, ইবনু আবী মুলায়কাহ প্রমুখ। আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম মালেক ও তাঁর সঙ্গীরা ছাড়াও মদীনার সকল ফক্বীহ এ ব্যাপারে একমত যে, আলোচ্য শবেবরাত বস্ত্তটি সর্বৈব বিদ‘আত।

সিরিয়ার আলেমগণ ঐ রাত্রি জাগরণের ধরন বিষয়ে দু’প্রকার মত পোষণ করেছেন। ১ম : ঐ রাত্রিতে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে মসজিদে জাগরণ করা মুস্তাহাব। যেমন খালেদ বিন মা‘দান, লোকমান বিন ‘আমের প্রমুখ আলেমগণ ঐ রাত্রিতে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে, আতর-সুরমা মেখে সারা রাত্রি মসজিদে ইবাদত করতেন। ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ্ এ ব্যাপারে উক্ত মত পোষণ করেন। তিনি বলেন যে, ঐ রাত্রিতে মসজিদে সম্মিলিতভাবে রাত্রি জাগরণ করা বিদ‘আত নয়। হারব আল-কিরমানী তদীয় ‘মাসায়েল’-বইয়ে এই সকল বিষয় উল্লেখ করেছেন।

২য় মত হ’ল : ঐ রাত্রিতে দলবদ্ধভাবে মসজিদে ছালাত, দো‘আ ও গল্প-গুজবের জন্য গমন করা মাকরূহ। অবশ্য একাকী যদি কেউ মসজিদে গিয়ে ইবাদত করে, তবে মাকরূহ হবে না। এটি হ’ল সিরিয়াবাসীদের ইমাম, আলেম ও ফক্বীহ আওযাঈর মত। ইনশাআল্লাহ এটাই সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী।

‘শবেবরাত’ সম্পর্কে ইমাম আহমাদের কোন মতামত জানা যায়নি। তবে উক্ত রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে তাঁর দুই ঈদের রাত্রিতে ইবাদত করা সম্পর্কে প্রদত্ত দু’টি মতামত থেকে ‘তাখরীজ’ (মাসআলা বের করা) হয়ে থাকে। একটি হ’ল দুই ঈদের রাত্রিতে দলবদ্ধ হয়ে মসজিদে ইবাদত করা মুস্তাহাব নয়। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ কেউই তা করেননি। অন্যটি হ’ল তা করা মুস্তাহাব। যেহেতু আব্দুর রহমান বিন ইয়াযীদ ইবনুল আসওয়াদ নামক জনৈক তাবেঈ তা করেছেন। অনুরূপভাবে ১৫ই শা‘বানের রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিংবা তাঁর ছাহাবীগণের কোনরূপ উক্তি বা আমল প্রমাণিত হয়নি। বরং সিরিয়ার কিছু সংখ্যক তাবেঈ ও তাদের সমর্থক কতিপয় ফক্বীহদের আমলই কেবল এ বিষয়ে পরিদৃষ্ট হয়’। হাফেয ইবনু রজবের আলোচনার সংক্ষেপ এখানেই শেষ হ’ল।

উপরোক্ত আলোচনা হ’তে স্পষ্ট প্রমাণিত হ’ল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবায়ে কেরামের তরফ হ’তে ‘শবেবরাত’ সম্পর্কে কোন কিছুই প্রমাণিত হয়নি। ইমাম আওযাঈ যে ঐ রাত্রিতে একাকী ইবাদত করা মুস্তাহাব বলেছেন এবং হাফেয ইবনু রজব যা সমর্থন করেছেন- তা নিতান্তই অপরিচিত ও দুর্বল। কেননা যে সকল বস্ত্ত শরী‘আতের স্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়, আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে তার প্রচলন ঘটানোর অনুমতি কোন মুসলমানের নেই। চাই সে একাকী করুক কিংবা দলবদ্ধ হয়ে করুক, চাই গোপনে করুক কিংবা প্রকাশ্যে করুক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ এ বিষয়ে সকলের উপরেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন কাজ করবে যা আমরা করিনি, তা প্রত্যাখ্যাত’।[3] এমনিতরো অন্যান্য যে সকল হাদীছে বিদ‘আতের অসারতা ও তা হ’তে বিরত থাকার ব্যাপারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।

ইমাম আবুবকর তুরতূশী (রহঃ) তদীয় الحوادث والبدع নামক কিতাবে লিখেছেন যে, ইবনু অয্যাহ যায়েদ ইবনে আসলাম প্রমুখাৎ বর্ণনা করেন যে, আমরা আমাদের কোন উস্তায ও ফক্বীহকে ১৫ই শা‘বানের প্রতি কোনরূপ গুরুত্ব দিতে দেখিনি। তাঁরা মাকহূলের বর্ণনার প্রতিও দৃকপাত করতেন না এবং অন্যান্য রাত্রির তুলনায় উক্ত রাত্রির কোন ফযীলত আছে বলে তাঁরা মনে করতেন না’। ইবনু আবী মুলায়কাহকে একদা বলা হ’ল যে, যিয়াদ নুমায়রী নামক জনৈক ব্যক্তি বলেন যে, শবেবরাতের ফযীলত শবেক্বদরের ন্যায়’। এর উত্তরে ইবনু আবী মুলায়কাহ বললেন, যদি আমি তা শুনতাম এবং তখন আমার হাতে লাঠি থাকত, তাহ’লে আমি তাকে অবশ্যই পিটাতাম’। উল্লেখ্য যে, যিয়াদ ছিল একজন গল্পকার।

আল্লামা শওকানী (রহঃ) الفوائد المجموعة নামক কিতাবে বলেন, শবেবরাতের নামে নিম্নোক্ত হাদীছটি ‘মওযূ’ (জাল)। যেমন (রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন), ‘হে আলী! যে ব্যক্তি মধ্য শা‘বানের রাত্রিতে ১০০ রাক‘আত ছালাত পড়বে এবং তার প্রত্যেক রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা ও তৎসহ সূরায়ে ইখলাছ দশবার করে পড়বে, আল্লাহ তার সকল প্রয়োজন পূর্ণ করে দিবেন’। উক্ত হাদীছের শব্দগুলি- যাতে উক্ত ছালাত আদায়কারীর জন্য বিরাট ছওয়াবের কথা বলা হয়েছে, ঐ শব্দগুলিই এটির ‘মওযূ’ হওয়া সম্পর্কে কারু মনে কোনরূপ সন্দেহ বাকী রাখেনি। তাছাড়া তার সনদের সকল ব্যক্তিই মাজহূল বা অজ্ঞাত।

‘মুখতাছার’ নামক কিতাবে তিনি বলেন যে, ১৫ই শা‘বানের রাত্রিতে বিশেষ ছালাত আদায় করার হাদীছ ‘বাতিল’ এবং ইবনু মাজাহ-তে আলী (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত হাদীছ যাতে বলা হয়েছে যে, إِذَا كَانَ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُوْمُوْا لَيْلَهَا وَصُوْمُوْا نَهَارَهَا ‘মধ্য শা‘বান আসলে তোমরা রাতে ইবাদত কর ও দিনে ছিয়াম পালন কর’- তা ‘যঈফ’।[4] اللآلي কিতাবে তিনি বলেন, দায়লামী ও অন্যরা যে মধ্য শা‘বানের প্রতি রাক‘আতে ১০ বার সূরা ইখলাছ সহ ১০০ রাক‘আত ছালাত ও তার পাহাড় প্রমাণ ছওয়াবের হাদীছ বর্ণনা করে থাকেন তা ‘মওযূ’। তিনটি সূত্রে বর্ণিত তার সকল রাবীর প্রত্যেকেই অজ্ঞাত ও দুর্বল। তিনি বলেন, এমনিভাবে প্রতি রাক‘আতে ৩০ বার সূরা ইখলাছ সহ ১২ রাক‘আত বা ১৪ রাক‘আত ছালাতের যে সকল হাদীছ বলা হয়ে থাকে তা সবই ‘মওযূ’ বা জাল।

(ইমাম শাওকানী বলেন) এই সমস্ত জাল হাদীছ দ্বারা একদল ফক্বীহ ধোঁকা খেয়েছেন। যেমন এহইয়াউ উলূমিদ্দীন -এর লেখক ইমাম গাযযালী (রহঃ) ও অন্যান্য ফক্বীহগণ। এমনিভাবে একদল তাফসীরকারও প্রতারিত হয়েছেন। অতঃপর এই রাতের অর্থাৎ মধ্য শা‘বানের রাত্রির বিশেষ ছালাত সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রে যতগুলি বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে- সবগুলিই বাতিল ও মওযূ। অবশ্য এর দ্বারা তিরমিযীর আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত রেওয়ায়াত বাতিল হয় না। যেখানে বলা হয়েছে যে, ‘মধ্য শা‘বানের রাত্রিতে আল্লাহ নিম্ন আকাশে নেমে আসেন এবং বনু কলবের ছাগলের পশম সমতুল্য বান্দার অসংখ্য অপরাধ ক্ষমা করেন’। কেননা এখানে কথা হ’ল, এই রাতের বানোয়াট ছালাত সম্পর্কে। যদিও এই হাদীছের মধ্যে যথেষ্ট দুর্বলতা ও সনদের মধ্যে ছিন্নসূত্রিতা ( انقطاع ) রয়েছে। এমনিভাবে পূর্ববর্ণিত আলী (রাঃ) প্রমুখাৎ হাদীছও বাতিল হয় না, যেখানে উক্ত দিবসে ছিয়াম ও রাত্রিতে ইবাদত করতে বলা হয়েছে, যদিও ওটাও যঈফ। আমরা ইতিপূর্বে তার আলোচনা করেছি। কেননা এখানে কথা হ’ল উক্ত রাত্রির জন্য আবিষ্কৃত ছালাত সম্পর্কে। উপরোক্ত হাদীছ দু’টির কোনটিতেই এই তথাকথিত ছালাত সম্পর্কে বলা হয়নি।

হাফেয ইরাক্বী বলেন, শবেবরাতের ছালাত সম্পর্কিত হাদীছ রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে তৈরী করা হয়েছে এবং এর দ্বারা তাঁর উপর মিথ্যারোপ করা হয়েছে। ইমাম নববী (রহঃ) স্বীয় المجموع কিতাবে বলেন, ‘ছালাতুর রাগায়েব’ নামে প্রসিদ্ধ যে ১২ রাক‘আত ছালাত রজব মাসের প্রথম জুম‘আর রাত্রিতে মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে পড়া হয়ে থাকে এবং মধ্য শা‘বানের রাত্রিতে যে ১০০ রাক‘আত ছালাত চালু করা হয়েছে- এই দুই ধরনের ছালাতই অতীব নিন্দনীয় বিদ‘আত ( بدعتان منكرتان )। আবু তালেব মাক্কীর (মৃ ৩৮৬ হিঃ) ‘কূতুল কুলূব’ ( قوت القلوب ) ও ইমাম গাযালীর (৪৫০-৫০৫ হিঃ) ‘এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন’ ( إحياء علوم الدين ) কিতাবে তার উল্লেখ দেখে এবং এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীছ দেখে কেউ যেন ধোঁকায় না পড়েন। এমনিভাবে কিছু সংখ্যক আলেম যাঁরা উক্ত বিষয়ে সন্দেহের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন হয়েছেন এবং উক্ত ছালাতদ্বয়ের মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে কিছু পৃষ্ঠা প্রণয়ন করেছেন, তাঁদের ঐসব দেখে কেউ যেন প্রতারিত না হন। কেননা তারা প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে ভুল করেছেন ( غالط فى ذلك ) ’।

উপরোক্ত ছালাত দু’টির অসারতা সম্পর্কে ইমাম আবু মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান বিন ইসমাঈল মাক্বদেসী একটি মূল্যবান কিতাব রচনা করেছেন। সেখানে তিনি সুন্দরভাবে ও সর্বোত্তম পদ্ধতিতে এর রদ করেছেন। এর বিরুদ্ধে এগুলি ছাড়াও আরও বহু মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করা যেত। কিন্তু তাতে আলোচনা দীর্ঘ হবে।

আশা করি ইতিপূর্বে আমরা যেসমস্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছি, তা-ই যেকোন সত্যসন্ধানীর জন্য যথেষ্ট হবে এবং যেসমস্ত আয়াত ও হাদীছ এবং বিদ্বানগণের উক্তি সমূহ উদ্ধৃত হয়েছে, তা যেকোন সত্যান্বেষী ব্যক্তিকে পরিষ্কারভাবে বলে দিবে যে, ১৫ই শা‘বানের রাত্রিতে বিশেষ ছালাত পড়া ও অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান করা এবং ঐ দিবসে খাছ করে ছিয়াম রাখা অধিকাংশ বিদ্বানের নিকট নিন্দনীয় বিদ‘আত ( بدعة منكرة )। পূত-পবিত্র শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই। বরং তা ছাহাবীগণের পরবর্তী যুগের আবিষ্কৃত বিদ‘আত সমূহের অন্যতম।

প্রত্যেক সত্যসন্ধ পাঠকের জন্য আল্লাহ রববুল ‘আলামীনের সেই যুগান্তকারী ঘোষণাই যথেষ্ট, যা সূরা মায়েদায় এরশাদ হয়েছে যে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। অতঃপর রাসূলে কারীমের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- ‘যে ব্যক্তি শরী‘আতের মধ্যে এমন কিছুর উদ্ভব ঘটায় যা তাতে ছিল না, তা প্রত্যাখ্যাত’[5] এবং উক্ত মর্মের অন্যান্য হাদীছ সমূহ।

ছহীহ মুসলিমের একটি হাদীছে আবু হুরায়রাহ (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, لاَ تَخْتَصُّوْا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللَّيَالِىْ وَلاَ تَخُصُّوْا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الْأَيَّامِ إِلاَّ أَنْ يَّكُوْنَ فِىْ صَوْمٍ يَصُوْمُهُ أَحَدُكُمْ - ‘তোমরা অন্যান্য রাত্রির তুলনায় জুম‘আর রাত্রিকে সারাক্ষণ জেগে ইবাদতের জন্য এবং অন্যান্য দিবসের তুলনায় জুম‘আর দিবসকে ছিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়ো না। অবশ্য যদি কারু (মানত বা) অন্য ছিয়ামের মধ্যে তা এসে পড়ে সে কথা স্বতন্ত্র’।[6]

এক্ষণে যদি কোন রাত্রিকে কোন খাছ ইবাদত অনুষ্ঠান দ্বারা নির্দিষ্ট করা জায়েয হ’ত, তাহ’লে জুম‘আর রাত্রিই তার জন্য সর্বোত্তম হ’ত। কেননা জুম‘আর দিবসই হ’ল অন্যান্য সকল দিবসের তুলনায় শ্রেষ্ঠ- যা বিভিন্ন ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সেই পবিত্র জুম‘আর রাত্রিকেও সারাক্ষণ জেগে থেকে বিশেষভাবে ইবাদতের জন্য খাছ করে নিতে সাবধান করে দিলেন, তখন অন্যান্য রাত্রির অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং কোন ছহীহ শারঈ প্রমাণ ব্যতীত কোন রাত্রিকে কোন বিশেষ ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া কখনোই জায়েয হ’তে পারে না।

অতঃপর শবেক্বদরে এবং রামাযানের রাত্রি সমূহে জেগে থেকে কষ্ট করে ইবাদত করা শরী‘আতে অনুমোদিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর জন্য স্বীয় উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন এবং নিজে তা করেছেন। যেমন ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ - ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের রাত্রি জেগে ইবাদতে রত হ’ল, আল্লাহ তার পূর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দেন এবং যে ব্যক্তি শবেক্বদরে ঐ একই উদ্দেশ্যে রাত্রি জেগে ইবাদতে রত হ’ল, আল্লাহ তারও পূর্বেকার সকল গোনাহ মাফ করে দেন’।[7] এক্ষণে যদি শবেবরাত, শবে মি‘রাজ ও রজব মাসের প্রথম জুম‘আর রাত্রিকে কোনরূপ ইবাদত বা আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা নির্দিষ্ট করা জায়েয হ’ত, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিশ্চয়ই তা উম্মতকে বলে যেতেন অথবা নিজে করতেন। আর সত্যিকার যদি এমন কিছু থাকত, তবে ছাহাবায়ে কেরাম নিশ্চয়ই তা আমাদেরকে বর্ণনা করতেন; কখনোই গোপন করতেন না। কেননা নবীগণের পরে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ মানুষ। আল্লাহ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট এবং তিনিও তাদেরকে সন্তুষ্ট করেছেন।

অতঃপর হে পাঠক! আপনি কিছুক্ষণ পূর্বেই বিভিন্ন বিদ্বানের আলোচনায় স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিংবা তাঁর ছাহাবীগণের নিকট হ’তে রজব মাসের প্রথম জুম‘আর রাত্রির ফযীলত সম্পর্কে অথবা মধ্য শা‘বানের রাত্রির ফযীলত সম্পর্কে কিছুই প্রমাণিত হয়নি। অতএব এটা পরিষ্কার যে, উক্ত দুই রাত্রিতে কোনরূপ অনুষ্ঠান করা এবং ঐ রাত্রিকে কোনরূপ ইবাদতের জন্য খাছ করা ইসলামের মধ্যে একটি নবোদ্ভূত ও নিন্দনীয় বিদ‘আত ছাড়া কিছুই নয়। এমনিভাবে ২৭শে রজবের রাত্রিতেও কোনরূপ খাছ ইবাদত ও আচার-অনুষ্ঠান পালন করা পূর্বে বর্ণিত দলীল সমূহের আলোকে নিঃসন্দেহে নাজায়েয- যে রাত্রিকে লোকেরা ‘শবে মি‘রাজ’ বলে বিশ্বাস করে নিয়েছে। কেননা বিদ্বানগণের নিকট সঠিক কথা এই যে, শবে মি‘রাজের নির্দিষ্ট তারিখ কেউই জানতে পারেননি। অতএব যে ব্যক্তি ওটাকে ২৭শে রজব বলেছেন, সেটা বাতিল কথা। ছহীহ হাদীছ সমূহে যার কোন ভিত্তি নেই। জনৈক কবি কত সুন্দরই না বলেছেন-

وَخَيْرُ الْأُمُوْرِ السَّالِفَاتُ عَلَى الْهُدٰى # وَشَرُّ الْأُمُوْرِ الْمُحْدَثَاتُ الْبَدَائِعِ

অর্থ : ‘উত্তম আমল হ’ল পূর্ববর্তীদের হেদায়াতসমৃদ্ধ আমল সমূহ। আর নিকৃষ্ট আমল হ’ল ধর্মের নামে নবোদ্ভূত আমল সমূহ’।

আল্লাহর নিকট প্রার্থনা- তিনি যেন সুন্নাতকে কঠিনভাবে ধারণ করার ও তার উপর দৃঢ় থাকার এবং সুন্নাত বিরোধী যাবতীয় কর্ম সম্পর্কে সাবধান থাকার জন্য আমাদেরকে ও সকল মুসলমানকে তাওফীক্ব দান করেন! তিনিই একমাত্র দাতা ও দয়ালু। অতঃপর যাবতীয় দরূদ ও সালাম বর্ষিত হৌক আল্লাহর বান্দা ও রাসূল আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গ ও ছাহাবায়ে কেরামের উপর। আমীন!!

وصلى الله وسلم على عبده ورسوله نبينا محمد وعلي آله وصحبه أجمعين -

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।

[2]. মুসলিম হা/১৭১৮, ‘বিচার সমূহ’ অধ্যায়-৩০, অনুচ্ছেদ-৮।

[3]. মুত্তাফাক্ব ‘‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।

[4]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৮, মিশকাত হা/১৩০৮ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭, ( سنده ضعيف جدا أو موضوع قاله الألباني رحـ ) ।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।

[6]. মুসলিম হা/২৬৮৪ (১৪৮), ‘ছিয়াম’ অধ্যায়-১৩, অনুচ্ছেদ-২৪; ঐ, মিশকাত হা/২০৫২ ‘ছওম’ অধ্যায়-৭, ‘ঐচ্ছিক ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬।

[7]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৮ ‘ছওম’ অধ্যায়-৭।

মদীনার হারাম শরীফের খাদেম শায়খ আহমদ মারফত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নামে মিথ্যা স্বপ্ন ও অছিয়ত সম্বলিত বিজ্ঞাপন সম্পর্কে
( تكذيب الرؤيا والوصية المزعومة من الشيخ أحمد خادم الحجرة النبوية )

আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায-এর পক্ষ থেকে সচেতন মুসলমানদের প্রতি (আল্লাহ আমাদেরকে ও তাদেরকে মূর্খ ও নীচুমনা লোকদের মিথ্যা অপবাদ সমূহের অনিষ্টকারিতা হ’তে রক্ষা করুন-আমীন!)।

আসসালামু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লা-হি ওয়া বারাকা-তুহু!

অতঃপর সম্প্রতি আমাকে মদীনার হারাম শরীফের খাদেম শায়খ আহমাদের নামে প্রচারিত নিম্ন শিরোনামযুক্ত একটি বিজ্ঞাপন সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। শিরোনামটি হ’ল - هذه وصية من المدينة المنورة عن الشيخ أحمد خادم الحرم النبوي الشريف ‘এটি মদীনা মুনাউওয়ারাহর হারাম শরীফের খাদেম শায়খ আহমাদের তরফ হ’তে প্রচারিত অছিয়ত’।

যেখানে বলা হয়েছে যে, ‘আমি জুম‘আর রাত্রিতে জেগে কুরআন মজীদ পড়ছিলাম। অতঃপর আল্লাহর কল্যাণময় নামসমূহ (আল-আসমাউল হুসনা) তেলাওয়াতের পর যখন আমি নিদ্রা যাওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলাম, এমন সময় হঠাৎ আমি কনকোজ্জ্বল চেহারার অধিকারী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখলাম। যিনি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মহিমাময় আয়াত ও আহকাম সমূহের বাহক, বিশ্বমানবের শান্তিদূত এবং আমাদের নেতা। অতঃপর বললেন, হে শায়খ আহমাদ! বললাম, আমি হাযির, হে আল্লাহর রাসূল! হে সৃষ্টিকুলের সেরা সম্মানিত!! তিনি তখন বললেন, ‘আমি লোকদের নানাবিধ অপকর্মে দারুণভাবে লজ্জিত। তাতে আমি আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সম্মুখে মুখ দেখাতে পারছি না। কেননা গত এক জুম‘আ হ’তে পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত এক সপ্তাহে ১,৬০,০০০ (এক লক্ষ ষাট হাযার) লোক বেদ্বীন অবস্থায় মারা গেছে। অতঃপর তিনি মানুষের বিভিন্ন পাপকর্মের কথা ব্যক্ত করলেন, যাতে তারা লিপ্ত আছে, অতঃপর বললেন,

‘এই অছিয়ত লোকদের জন্য আল্লাহর তরফ হ’তে রহমত স্বরূপ’। এরপরে তিনি ক্বিয়ামতের কিছু কিছু আলামত বর্ণনা করে বলেন, হে শায়খ আহমাদ! তুমি লোকদেরকে এই অছিয়ত সম্পর্কে জানিয়ে দাও। কেননা এটি লওহে মাহফূয থেকে তাক্বদীরের কলম দ্বারা লিখিত। যে ব্যক্তি তা ছাপিয়ে শহর হ’তে শহরান্তরে ও এলাকা হ’তে এলাকান্তরে প্রচার করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। কিন্তু যে ব্যক্তি তা ছাপাবে না ও প্রচার করবে না, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য আমার শাফা‘আত হারাম হবে। যদি কোন দরিদ্র ব্যক্তি তা ছাপায়, তাহ’লে সে ধনী হবে। কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ছাপালে আল্লাহ তাকে ঋণমুক্ত করবেন। যদি তার কোন বিশেষ গুনাহ থাকে, তবে আল্লাহ এই অছিয়তনামার বরকতে তাকে ও তার মাতা-পিতাকে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহর যে বান্দা এটা ছাপাবে না, ইহকাল ও পরকালে তার চেহারা কালিমালিপ্ত হবে’। অতঃপর তিনি মহান আল্লাহর নামে তিনবার কসম করে বললেন, এটাই হ’ল প্রকৃত সত্য ( هذه حقيقة )। যদি আমি এতে মিথ্যাবাদী হই, তাহ’লে (ক্বিয়ামতের দিন) বেদ্বীন অবস্থায় দুনিয়া থেকে বের হব। যে ব্যক্তি উপরোক্ত অছিয়তের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে জাহান্নামের শাস্তি হ’তে পরিত্রাণ পাবে। আর যে ব্যক্তি তা মিথ্যা মনে করবে, সে কাফের হবে’।

এটাই হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নামে মিথ্যারোপিত তথাকথিত অছিয়তনামার সার-সংক্ষেপ।

আমরা বিগত কয়েক বছর যাবৎ এই মিথ্যা অছিয়তনামার কথা বহুবার শুনেছি, যা ইতিমধ্যে লোকসমাজে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত এই সকল অছিয়ত সমূহের মধ্যে কিছু শাব্দিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন প্রথম দিকে প্রকাশিত মিথ্যা অছিয়তনামায় বলা হয় যে, শায়খ আহমাদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ঘুমের মধ্যে দেখে সেই অবস্থায়ই অছিয়ত প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য শেষ অছিয়তনামায়- যার বিবরণ আমরা উপরে দিয়েছি, সেখানে হে পাঠক! আপনি দেখেছেন যে, এই মিথ্যারোপকারী ব্যক্তিটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিদ্রাবস্থায় দেখেনি; বরং নিদ্রা যাবার প্রাক্কালে জাগ্রত অবস্থায় দেখেছে। এই মিথ্যা অছিয়তনামার মধ্যে তাই কপট দুরভিসন্ধি রয়েছে। অতএব এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা ও স্পষ্ট বাতিল দাবী। আমি অনতিবিলম্বে আপনাদেরকে এ বিষয়ে অবহিত করব ইনশাআল্লাহ।

বিগত কয়েক বছরে আমি লোকদেরকে বহুবার হুঁশিয়ার করেছি যে, এটি একটি প্রকাশ্য মিথ্যা ও স্পষ্ট বাতিল জিনিস। অতঃপর যখন উক্ত অছিয়তনামার এই শেষ সংস্করণ সম্পর্কে আমাকে অবহিত করা হ’ল, তখন আমি এ বিষয়ে লিখতে মনস্থ করলাম যাতে এই মিথ্যার অসারতা ও উক্ত মিথ্যাবাদীর অসম দুঃসাহস জনসাধারণ্যে প্রকাশ হয়ে পড়ে। কোন সুস্থ বিবেক ও সামান্য বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের মধ্যেও যে এই বাতিল জিনিসটি প্রসার লাভ করবে, এর আমি কল্পনাও করিনি। কিন্তু আমার বহু বন্ধু আমাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন যে, এটা লোকসমাজে ব্যাপকহারে প্রসার লাভ করেছেএবং লোকেরা তা একের পর এক প্রচার করছে এবং অনেকেই তা সত্য বলে বিশ্বাস করেছে। এই একমাত্র কারণেই আমি আমার সাথীদের সাহায্য নিয়ে[1] এ বিষয়ে লিখে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিলাম, যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে এই মিথ্যা অপবাদে কেউ বিভ্রান্ত না হন।

এ বিষয়ে সামান্য চিন্তা করলেই যেকোন বিদ্বান, ঈমানদার, সুস্থস্বভাব ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিই স্বীকার করবেন যে, এটি বিভিন্ন কারণে মিথ্যা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে একটি অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়।

আমি আলোচ্য শায়খ আহমাদের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নিকটে এই তথাকথিত অছিয়ত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন যে, ওটা প্রকৃতপক্ষে শায়খ আহমাদের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা অপবাদ মাত্র। যিনি নিজেই এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তাছাড়া আলোচ্য শায়খ আহমাদ বহু আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

এক্ষণে যদি আমরা ধরে নেই যে, সত্যসত্যই উক্ত শায়খ আহমাদ কিংবা তার চাইতে বুযর্গ কেউ ধারণা করেছেন যে, তিনি নিদ্রা অথবা জাগ্রত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখেছেন এবং এই সমস্ত অছিয়ত করেছেন, তাহ’লে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানব যে, তিনি মিথ্যাবাদী অথবা যে তাকে এমন অছিয়ত করেছে সে হ’ল ইবলীস, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নন। আমাদের এই বিশ্বাস কয়েকটি কারণে। যেমন-

১ম কারণ : মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জাগ্রত অবস্থায় কখনোই দেখা যাবে না। কিছুসংখ্যক মূর্খ ছূফী যে ধারণা করে থাকে যে, তারা জাগ্রত অবস্থায় নবীকে দেখেছে কিংবা তিনি মীলাদের মাহফিলে বা অনুরূপ মজলিস সমূহে হাযির হয়ে থাকেন- তা ভুল, নিকৃষ্টতম ভুল। তারা চূড়ান্ত ধোঁকার জালে আবেষ্টিত হয়েছে এবং মহাভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়েছে। তারা আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত ও বিদ্বানমন্ডলীর ইজমা তথা সম্মিলিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। কেননা মৃত ব্যক্তিগণ কেবলমাত্র ক্বিয়ামতের দিনই স্ব স্ব কবর হ’তে বের হবেন, তার পূর্বে নয়। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ثُمَّ إِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ- ثُمَّ إِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ - ‘অতঃপর তোমাদের সবারই মৃত্যু হবে। অতঃপর তোমরা সবাই ক্বিয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হবে’ (মুমিনূন ২৩/১৫-১৬)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ রববুল আলামীন স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, মৃতদের পুনরুত্থান কেবলমাত্র ক্বিয়ামতের দিন হবে- তার পূর্বে নয়। এক্ষণে যে ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে বলবে, সে প্রকাশ্য মিথ্যাবাদী অথবা মোহাচ্ছন্ন ভ্রান্ত। সে সেই সত্য উপলব্ধি করতে পারেনি, যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন পূর্ববর্তী সালাফে ছালেহীন এবং মহান ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের অনুসারীগণ।

২য় কারণ : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় জীবদ্দশায় কিংবা জীবনাবসানকালে হক্ব ও ন্যায়ের বিরোধী কিছু বলেননি। অথচ আলোচ্য অছিয়ত অনেকগুলি কারণে তাঁর আনীত শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধী। প্রথমতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে নিদ্রাবস্থায় দেখা দিয়েছেন। যে ব্যক্তি তাঁকে নিদ্রাবস্থায় দেখেছে সে দেখেছে। কেননা শয়তান কখনও তাঁর চেহারার অনুকরণ করতে পারে না। যেমন ছহীহ হাদীছ সমূহে এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বড় কথা হ’ল, যিনি তাঁকে দেখেছেন সেই ব্যক্তির ঈমানদারী, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধীশক্তি, দ্বীনদারী ও আমানতদারী সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হ’তে হবে। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখেছেন, না অন্য কাউকে দেখেছেন, সে বিষয়েও তাকে নিশ্চিত হ’তে হবে।

(এ বিষয়ে হাদীছ বাছাইয়ের পদ্ধতি হ’ল) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় বর্ণিত এমন কোন হাদীছ যদি আমরা পাই যা বিশ্বস্ত সনদে প্রমাণিত নয়- তখন তার উপরে আস্থা স্থাপন করা যাবে না এবং তা দ্বারা কোন প্রমাণও উপস্থাপন করা যাবে না। অথবা যদি বিশ্বস্ত সূত্রে প্রমাণিত কোন হাদীছ পাওয়া যায়। কিন্তু অবস্থা হ’ল যে, উক্ত রেওয়ায়াত তার চেয়ে অধিক বিশ্বস্ত রেওয়ায়াতের বিরোধী এবং উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানেরও কোন পথ নেই, তখন একটিকে ‘মানসূখ’ মানতে হবে- যার উপর আমল করা যাবে না এবং অপরটিকে ‘নাসেখ’ মানতে হবে- যার উপর আমল করতে হবে। কিন্তু যেক্ষেত্রে উক্ত ‘নাসেখ-মানসূখের’ ধারাও প্রযোজ্য নয়, অধিকন্তু উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানেরও কোন উপায় নেই, সে ক্ষেত্রে নিয়ম হ’ল উক্ত রেওয়ায়াত দু’টির মধ্যে যেটির রাবী (বর্ণনাকারী) তুলনামূলকভাবে কম ধীশক্তিসম্পন্ন ও কম বিচক্ষণ, সেটিকে বাদ দিতে হবে। আর তখন এই ‘বিরল’ (শায্) রেওয়ায়াতটির উপর আমল করা যাবে না।

এক্ষণে উপরোক্ত নিয়ম হৃদয়ঙ্গম করার পর এই অছিয়তনামাকে কি বলা যেতে পারে, যার বর্ণনাকারী ব্যক্তিটিকে কেউ চেনে না, যে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে তা বর্ণনা করছে। কেউ সেই ব্যক্তিটির ন্যায়নিষ্ঠা ও সত্যপরায়ণতা সম্পর্কে খবর রাখে না। এমতাবস্থায় যদি উক্ত অছিয়তটি শরী‘আত বিরোধী নাও হ’ত, তবুও তার দিকে দৃকপাত করা জায়েয হ’ত না। তাহ’লে উক্ত অছিয়তনামার অবস্থা কি হবে যা বহু বাতিল ও বাজে কথায় ভরা, যা মহান রাসূলের বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা অপবাদ এবং দ্বীনের মধ্যে একটা নতুন নিয়মের প্রবর্তন, যার অধিকার আল্লাহ কাউকে দেননি? অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, مَنْ قَالَ عَلَىَّ مَا لَمْ أَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি আমার নামে এমন কথা বলল, যা আমি বলিনি, সে ব্যক্তি জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নিল’।[2] অথচ এই অছিয়তনামার মালিক মিথ্যুক ব্যক্তিটি মহান রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে এমন সব কথা বলেছে, যা তিনি বলেননি এবং তাঁর উপরে সে একটি জাজ্জ্বল্যমান ডাহা মিথ্যা আরোপ করেছে। অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরোক্ত দুঃসংবাদের কত বড়ইনা হক্বদার সে, যদি না সে এখুনি তওবা করে এবং পাল্টা ইশতেহার ছেপে প্রচার করে দেয় এই মর্মে যে, সে উক্ত অছিয়তনামা দ্বারা মহান রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর অযথা মিথ্যারোপ করেছে। কেননা যদি কেউ ধর্মের নামে কোন বাতিল বস্ত্ত লোক সমাজে ছড়িয়ে দেয়, তখন তার তওবা শুদ্ধ হয় না, যতক্ষণ না সে তার অসারতা লোকদের মাঝে ভালভাবে প্রচার করে দেয়। যাতে সকলে জানতে পারে যে, সে তার পূর্বে কৃত মিথ্যা হ’তে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং নিজেকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছে।

কেননা আল্লাহ রববুল ‘আলামীন এরশাদ করেছেন,

إِنَّ الَّذِيْنَ يَكْتُمُوْنَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدٰى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُوْلَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللهُ وَيَلْعَنُهُمُ الْلاَّعِنُونَ- إِلاَّ الَّذِيْنَ تَابُوْا وَأَصْلَحُوْا وَبَيَّنُوْا فَأُوْلَئِكَ أَتُوْبُ عَلَيْهِمْ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ - ‘যে সমস্ত লোক আমাদের নাযিলকৃত স্পষ্ট আয়াত ও হেদায়াত সমূহ গোপন করে, লোকদের জন্য কুরআনের মধ্যে সেগুলি বিস্তারিত বর্ণনা করে দেওয়ার পর, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর অভিসম্পাত এবং অভিসম্পাত সকল অভিসম্পাতকারীর। অবশ্য যদি কেউ তওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে ও তা প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করে, তাহ’লে আমি তাদের তওবা কবুল করব এবং আমিই একমাত্র তওবা কবুলকারী ও দয়ালু’ (বাক্বারাহ ২/১৫৯-৬০)।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ রববুল ‘আলামীন স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন সত্য গোপন করে, তবে তার তওবা শুদ্ধ হবে না নিজেকে সংশোধন ও প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রেরণের মাধ্যমে তদীয় দ্বীন ও শ্রেষ্ঠতম নে‘মত ইসলামকে পূর্ণতা দান করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট অহীকৃত যাবতীয় বস্ত্তই ছিল সেই পূর্ণাঙ্গ শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ তাঁর রূহ ক্ববয করেননি যতক্ষণ না দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে ও তা পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করে দিলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)।

এক্ষণে উক্ত মিথ্যুক অছিয়তকারী হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়ে মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে এবং মুসলমানদের মধ্যে একটি নতুন দ্বীনের প্রচলন ঘটাতে যাচ্ছে, যার অনুসরণের উপরই নাকি নির্ভর করছে জান্নাত লাভ করা। আর যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে না সে ব্যক্তি জান্নাত লাভ হ’তে বঞ্চিত হবে। এমনকি উক্ত ব্যক্তি মনে করেছে যে, তার এই তথাকথিত অছিয়ত কুরআনের চেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন। কেননা তার কথামতে যে ব্যক্তি উক্ত অছিয়তনামা ছাপিয়ে এক শহর হ’তে অন্য শহরে কিংবা এক মহল্লা হ’তে অন্য মহল্লায় প্রচার করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা ছাপাবে না এবং প্রচার করবে না তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন নবীর শাফা‘আত হারাম হবে।’

এটি হ’ল সবচাইতে নিকৃষ্ট মিথ্যা এবং উক্ত অছিয়ত মিথ্যা হবার স্পষ্ট দলীল। এটি উক্ত মিথ্যাবাদীর নির্লজ্জতা ও মিথ্যাবাদিতার চরম দুঃসাহসের পরিচয়ও বটে। কেননা যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ শিখে শহর হ’তে শহরান্তরে, মহল্লা হ’তে মহল্লান্তরে প্রচার করে, তার জন্যও অনুরূপ মর্যাদা নেই, যদি না সে কুরআনের হুকুম অনুযায়ী আমল করে। তাহ’লে কেমন করে উক্ত মিথ্যা অপবাদের লেখক ও প্রচারক অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী হ’তে পারে? পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ লিখেনি এবং তা শহর হ’তে শহরান্তরে প্রচারও করেনি, সে ব্যক্তি রাসূলের শাফা‘আত হ’তে বঞ্চিত হবে না, যদি সে খাঁটি মুমিন হয় এবং শরী‘আতের অনুসারী হয়। তাই এই একটিমাত্র মিথ্যা দাবীই উক্ত অছিয়তনামার অসারতা, এর প্রকাশকের মিথ্যাবাদিতা, নির্লজ্জতা, মূর্খতা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনীত দ্বীন ও হেদায়াত সম্পর্কিত জ্ঞান হ’তে চরম অজ্ঞতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

এই অছিয়তের মধ্যে উপরোল্লেখিত বস্ত্ত ছাড়াও আর যা কিছু রয়েছে সবকিছুই তার অসারতা এবং মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ বহন করে। যদি ঐ ব্যক্তি হাযার বারও কসম করে বলে কিংবা নিজের জন্য সবচেয়ে বড় আযাব ও সবচেয়ে বড় শাস্তি গ্রহণের দাবী করে বলে যে সে সত্যবাদী, তবুও সে সত্যবাদী নয়, কখনোই ঐ বস্ত্ত সঠিক নয়। বরং আল্লাহর কসম! পুনরায় আল্লাহর কসম! এটি সবচেয়ে বড় মিথ্যা ও নিকৃষ্টতম বাতিল বস্ত্ত। আমরা আল্লাহকে এবং সকল ফেরেশতামন্ডলীকে- যাঁরা আমাদের সাথে সর্বদা রয়েছেন এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐ সকল ব্যক্তিকে, যাঁরা এই লেখা সম্পর্কে অবহিত হবেন, সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, উক্ত অছিয়তনামাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে আনীত অপবাদ বৈ কিছুই নয়- এই সাক্ষ্য নিয়ে আমরা ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে মুলাক্বাত করব। আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে যথাযথভাবে লাঞ্ছিত করুন, যে ব্যক্তি এই মিথ্যাচার করেছে এবং যে ব্যক্তি এর উপর আমল করেছে।

উপরের কারণগুলি ব্যতীত আরও কতকগুলি বস্ত্ত এটির অসারতা প্রমাণ করে। যেমন (১) এতে বলা হয়েছে যে, ‘এক জুম‘আ হ’তে অন্য জুম‘আ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৬০ হাযার ব্যক্তি বেদ্বীন অবস্থায় মারা গেছে’ এটি একটি মিথ্যা দাবী। কেননা এটি গায়েবী ইলমের ব্যাপার। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ‘অহি’ নাযিল হওয়ার পথ বন্ধ হয়েছে। এমনকি তিনি স্বীয় জীবদ্দশায়ও ‘গায়েব’ (ভবিষ্যৎ) জানতেন না, তাহ’লে মৃত্যুর পরে কেমন করে গায়েব জানলেন? যেমন আল্লাহ বলেছেন,

قُلْ لاَ يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلاَّ اللهُ - ‘হে মুহাম্মাদ! তুমি বলে দাও যে, আসমান ও যমীনের কেউই ‘গায়েব’ জানে না একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত’ (নমল ২৭/৬৫)। এমনিভাবে ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন যে, إِنَّ أُنَاسًا مِنْ أَصْحَابِى يُؤْخَذُ بِهِمْ ذَاتَ الشِّمَالِ فَأَقُوْلُ أَصْحَابِى أَصْحَابِى فَيَقُولُ ، إِنَّهُمْ لَمْ يَزَالُوا مُرْتَدِّيْنَ عَلَى أَعْقَابِهِمْ مُنْذُ فَارَقْتَهُمْ . فَأَقُولُ كَمَا قَالَ الْعَبْدُ الصَّالِحُ : وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيْدًا مَا دُمْتُ فِيْهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِيْ كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيْبَ عَلَيْهِمْ وَأَنْتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيْدٌ - ‘ক্বিয়ামতের দিন ‘হাউয কাওছার’ হ’তে আমার বহু লোককে বাম সারির লোকদের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি ফরিয়াদ করে বলব, হে আল্লাহ! এরা তো আমারই সঙ্গী ছিল। তখন আমাকে বলা হবে, তুমি জানো না, এরা তোমার মৃত্যুর পরে কত বিদ‘আতের উদ্ভব ঘটিয়েছিল’। তখন আমি সেই নেককার বান্দার (ঈসা) ন্যায় বলব, ‘আমি তাদের উপর সাক্ষ্য ছিলাম যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর যখন হে আল্লাহ! তুমি আমার ওফাৎ ঘটালে তখন তুমিই তাদের একমাত্র পাহারাদার হ’লে। আর তুমিই সকল বস্ত্তর প্রত্যক্ষ সাক্ষী’ (মায়েদাহ ৫/১১৭)। [3]

(২) এতে বলা হয়েছে- ‘কোন ফকীর ব্যক্তি তা লিখে প্রচার করলে সে ধনী হবে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি প্রচার করলে আল্লাহ তাকে ঋণমুক্ত করবেন, কোন পাপী তা করলে তার এবং তার মাতা-পিতাকে এই অছিয়তনামার বরকতে আল্লাহ ক্ষমা করবেন’। এটি উক্ত বেহায়া মিথ্যাবাদীর চরম মিথ্যাবাদিতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। কেননা যেখানে পবিত্র কুরআন কেবল লিখে প্রচার করলে অনুরূপ তিনটি পুণ্য লাভ করা যায় না, সেখানে একটা বাজে অছিয়তনামা লিখে প্রচার করলে কিভাবে অনুরূপ ছওয়াব লাভ করা যেতে পারে? এই খবীছ এর দ্বারা কেবল মানুষের মনে মোহজাল সৃষ্টি করতে চায় এবং তাদেরকে উক্ত অছিয়তে কল্পিত বিরাট ছওয়াবের খোয়াড়ে আবদ্ধ করতে চায়। যাতে লোকেরা তা ছাপিয়ে প্রচার করে এবং যাতে লোকেরা যাবতীয় শারঈ পথ-পন্থা ছেড়ে এই কল্পিত অছিয়তনামাকেই ধনী হবার, ঋণমুক্ত হবার ও পাপমুক্ত হবার একমাত্র ‘মাধ্যম’ ( موصلة ) হিসাবে মনে করে। আল্লাহ আমাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন লজ্জিত হবার এই সকল পথ-পন্থা হ’তে এবং প্রবৃত্তিপরায়ণতা ও শয়তানের তাবেদারী হ’তে রক্ষা করুন!

(৩) এতে বলা হয়েছে- ‘যারা তা ছাপাবে না আল্লাহ তাদের মুখমন্ডলকে দুনিয়া ও আখেরাতে কালিমালিপ্ত করবেন’। এটিও একটি ডাহা মিথ্যা কথা এবং উক্ত অছিয়তনামার অসারতার অন্যতম দলীল। কেননা জ্ঞান এটা কিভাবে সমর্থন করতে পারে যে, হিজরী চতুর্দশ শতকের একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির তথাকথিত অছিয়তনামা- যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যারোপ করা হয়েছে- তা যদি কেউ ছাপিয়ে প্রচার না করে তাহ’লে ইহকাল ও পরকালে তার চেহারা কালিমালিপ্ত হবে এবং ছাপালে গরীবেরা ধনী হবে, ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত ব্যক্তি ঋণমুক্ত হবে, হাযারো পাপে ডুবে থাকা ব্যক্তি পাপমুক্ত হবে? সুবহানাল্লাহ! এটি একটি বড় অপবাদ। তাছাড়া যাবতীয় শারঈ প্রমাণ এবং বাস্তবতা এর অসারতা ও উক্ত মিথ্যুকের দুঃসাহস ও নির্লজ্জতা প্রমাণ করে। কেননা এমন অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা তা লিখে প্রচার করেননি। অথচ তাদের চেহারা কালিমালিপ্ত হয়নি। পক্ষান্তরে এখানেই বহুলোক রয়েছে, যারা উক্ত অছিয়তনামা বহুবার লিখে প্রচার করেছে। অথচ তারা ঋণমুক্ত হয়নি, বা তাদের দারিদ্র্যও বিদূরিত হয়নি। আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই সকল প্রকারের বিভ্রান্তি হ’তে ও এই সকল পাপের মরিচা হ’তে।

এই ধরনের গুণাবলী ও উত্তম পুরস্কার সমূহ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের লেখক কোন মহান ব্যক্তির জন্যও পবিত্র শরী‘আতে বিধৃত হয়নি। অথচ তা কেমন করে একজন মিথ্যা অছিয়তনামা লেখকের জন্য হ’তে পারে, যা বিভিন্ন বাজে উক্তি ও কুফরী বাক্য সমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ? সুবহানাল্লাহ! লোকটা মিথ্যা বলায় কতই না দুঃসাহস দেখিয়েছে!

(৪) এতে বলা হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি উক্ত অছিয়তে বিশ্বাস স্থাপন করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামের শাস্তি হ’তে মুক্তি পাবে এবং যে ব্যক্তি ওটাকে মিথ্যা মনে করবে সে কাফের হবে’।

উক্ত মিথ্যাবাদীর জন্য এটা অন্যতম দুঃসাহস যে, সে সমস্ত লোককে তার এই মিথ্যা বানোয়াট জিনিসের উপর বিশ্বাস স্থাপন করার আহবান জানাচ্ছে এবং ধারণা করছে যে, এর ফলে লোকেরা জাহান্নামের শাস্তি হ’তে পরিত্রাণ পাবে। আর যে ব্যক্তি তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, সে ব্যক্তি কাফের হবে। আল্লাহর কসম! এই মিথ্যুকটি আল্লাহর উপর একটি চরম মিথ্যারোপ করেছে এবং আল্লাহর কসম! সে সত্যের বিপরীত কথা বলেছে। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ব্যক্তি অবশ্যই কাফের হবার যোগ্য। কিন্তু ঐ ব্যক্তি কখনোই নন, যিনি ওটাকে মিথ্যা মনে করেন। কেননা ওটা প্রতারণা, বাতিল ও মিথ্যা। ওতে সত্যের কোন ভিত্তিই নেই।

আমরা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, এটি একটি ডাহা মিথ্যা ও তার উদ্গাতা ব্যক্তিটি চরম মিথ্যুক। সে এর দ্বারা লোকদের মধ্যে এমন বস্ত্তর প্রচলন ঘটাতে চায়, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি। সে মুসলমানদের দ্বীনের মধ্যে এমন বস্ত্তর অনুপ্রবেশ ঘটাতে চায়, যা তার মধ্যে নেই। অথচ আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে উম্মতের জন্য পরিপূর্ণতা দান করেছেন এই মিথ্যা প্রচারণার চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেই।

অতএব হে পাঠক, হে ভাইয়েরা সাবধান! আপনারা এই সকল মিথ্যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা হ’তে এবং আমাদের মধ্যে তার প্রচলন করা হ’তে বিরত থাকুন! কেননা সত্যের একটা জ্যোতি রয়েছে, যা কোন সত্যসন্ধানীর উপর সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে না। অতএব আপনারা দলীল সহকারে সত্য সন্ধানে ব্রতী হেŠন এবং যে সকল বিষয় আপনাদের নিকট দুর্বোধ্য ঠেকে সে সকল বিষয়ে বিদ্বানদের নিকট জিজ্ঞাসা করুন। সাবধান! কোন মিথ্যাবাদীর বাহ্যিক কসম খাওয়ায় ধোঁকায় পড়বেন না। মনে রাখবেন অভিশপ্ত ইবলীসও আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়াকে কসম দিয়ে বলেছিল যে, সে তাঁদের জন্য সত্যিকারের উপদেশদাতা। অথচ সেই ছিল সেরা খেয়ানতকারী ও সেরা মিথ্যাবাদী। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা আ‘রাফে আল্লাহ রববুল আলামীন এরশাদ করেছেন, - وَقَاسَمَهُمَا إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِيْنَ ‘ইবলীস তাদের দু’জনকে কসম দিয়ে বলল যে, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য অন্যতম উপদেশদাতা মাত্র’ (আ‘রাফ ৭/২১)।

সুতরাং আপনারা ইবলীস ও তার সাঙ্গপাঙ্গ এই সব মিথ্যুকদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকুন! জানি না শয়তান ও তার শিখন্ডীদের নিকট মানুষকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করার জন্য কত রকমের মিথ্যা ঈমানদারীর বাহানা, শঠতাপূর্ণ ওয়াদা সমূহ ও মিথ্যার চাকচিক্যে ঢাকা বাক্যসমূহ রয়েছে। আল্লাহ আমাকে ও আপনাদেরকে এবং সকল মুসলমানকে শয়তানদের কুহক হ’তে, পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তদের বিভ্রান্তি হ’তে এবং আল্লাহর শত্রু বাতিলপন্থীদের সৃষ্ট সন্দেহ-দ্বন্দ্ব হ’তে রক্ষা করুন! যারা আল্লাহর নূরকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় এবং মুসলমানদের নিকট তাদের দ্বীনকে সন্দেহপূর্ণ করে তুলতে চায়। অথচ আল্লাহ স্বীয় নূরের পূর্ণ বিকাশ চান এবং তাঁর মনোনীত দ্বীনের তিনিই স্বয়ং সাহায্যকারী। যদিও আল্লাহর চির দুশমন ইবলীস ও তার সাঙ্গপাঙ্গ কাফির ও নাস্তিকের দল তা অপসন্দ করে।

অতঃপর বিভিন্ন শরী‘আত বিরোধী কাজকর্মের প্রসার ঘটা সম্পর্কে উক্ত মিথ্যুক ব্যক্তি যা উল্লেখ করেছে, তা বাস্তব বিষয়। কুরআনুল কারীম ও পবিত্র সুন্নাহ এ সম্পর্কে আমাদেরকে কঠিন হুঁশিয়ারী প্রদান করেছে। এ দু’টির মধ্যেই হেদায়াত নিহিত রয়েছে এবং এ বিষয়ে এ দু’টিই আমাদের জন্য যথেষ্ট। দো‘আ করি আল্লাহ যেন মুসলমানদের অবস্থার সংশোধন করেন এবং তাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের অনুসরণ ও তার উপর দৃঢ় থাকার তাওফীক দান করেন। সাথে সাথে তারা যেন যাবতীয় গোনাহ হ’তে তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। কেননা তিনিই একমাত্র তওবা কবুলকারী, দয়ালু ও সকল কিছুর উপর একক ক্ষমতাবান।

অতঃপর ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ সম্পর্কে ঐ ব্যক্তি যে সকল কথার উল্লেখ করেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছ সমূহ সেই সকল আলামত সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা করেছে। কুরআনুল কারীম তার কিছু কিছুর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। এক্ষণে যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের পূর্ব নিদর্শনাদি সম্পর্কে অবহিত হ’তে চায়, সে তা হাদীছের কিতাব সমূহে ও ঈমানদার বিদ্বানমন্ডলীর লেখনীর মধ্যে অবশ্যই পাবে। এর জন্য এই সকল মিথ্যুকদের কল্পকথার আশ্রয় নিতে হবে না, যা সন্দেহের তমিশ্রাযুক্ত এবং হক ও বাতিলের জগাখিচুড়ী মাত্র।

حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الوَكِيلُ، وَلاَ حَولَ وَلاَ قُوَّةَ إلاَّ بِاللهِ الْعَلِيِّ الْعَظِيْمِ،

وَالْحَمْدُ ِللهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، وصَلَّى اللهُ وَسَلَّمَ عَلَى عَبْدِهِ وَرَسُولِهِ الصَّادِقِ الأَمِينِ، وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ وَأَتْبَاعِهِ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّينِ -

আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতইনা সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক। নেই কোন শক্তি, নেই কোন সামর্থ্য, সেই মহামহিমের সাহায্য ব্যতীত। অতএব বিশ্বচরাচরের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্যই যাবতীয় প্রশংসা এবং তাঁর বান্দা ও রাসূল, চিরসত্যের ঝান্ডাবাহী আল-আমীন মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গ ও ছাহাবায়ে কেরাম এবং প্রলয় ঊষার উদয়কাল পর্যন্ত তাঁর দয়ায় আগত তাঁর সকল অনুসারীর প্রতি চিরশান্তির ফল্গুধারা বর্ষিত হৌক! আমীন!

[1]. প্রকাশ থাকে যে, মাননীয় লেখক একজন অন্ধ ব্যক্তি- অনুবাদক।

[2]. বুখারী হা/১০৯ ‘ইলম’ অধ্যায়-৩, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে মিথ্যারোপের পাপ’ অনুচ্ছেদ-৩৮।

[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৩৫ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থাসমূহ ও সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়-২৮ ‘হাশর’ অনুচ্ছেদ-২।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন