HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
তওহীদের তত্ত্বকথা
লেখকঃ সানাউল্লাহ বিন নজির আহমদ
এক বাক্যে বলা যায়, বর্তমান যুগে জীবনের সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষার শিকার তাওহীদ। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে সর্বনিম্ন সাধারণ নাগরিক, অফিস আদালতের কর্মকর্তা থেকে পথে ঘাটের ছিন্নমূল মানুষ, জ্ঞানী কিংবা মূর্খ সবার নিকট অবহেলার বিষয় এ তওহীদ। শুধু আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, তাঁরই ইবাদত করা, কারো নিকট প্রার্থনা না করা- এটাই তওহীদের মূল উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে এমন বিষয়-বস্ত্ত কমই আছে, যা এ তওহীদের ন্যায় উদাসীনতার শিকার। অথচ এটাই হচ্ছে ইসলামের মূল ভিত্তি। এর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ঈমান নামক বৃক্ষটি। সমসাময়িক আলেম সমাজ, ওয়ায়েজ, সকলেই এবাদতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, গুনাহের প্রতি ঘৃণা এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু আলেম আছেন, যারা তওহীদের আলোচনা করেন, বক্তৃতা দেন ও লেখেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। অথচ এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল।
কুরআনুল করীম গভীর মনোযোগ সহ অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, এর প্রতিটি আয়াত আল্লাহর নিকট প্রার্থনার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। উদাহরণ স্বরূপ :
১. ইরশাদ হচ্ছে :
وَاسْأَلُوا اللَّهَ مِنْ فَضْلِهِ ﴿النساء :32﴾
‘‘তোমরা আল্লাহর নিকট তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর।’’ [নিসা : ৩২]
তিনি দয়ালু, তার কৃপা অসীম, রহমত অশেষ। অতএব, তোমরা তাঁর কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা কর, তিনি তোমাদের উপর অনুগ্রহ করবেন।
২. আললাহ অতি নিকটে, তিনি প্রার্থনা শ্রবণ করেন, কবুল করার ওয়াদা করেছেন ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখকরে তাঁর নিকট প্রার্থনার তালীম দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে :
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ﴿البقرة :186﴾
‘‘আর আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, বস্ত্তত, নিশ্চয় আমি নিকটেই রয়েছি। যারা প্রার্থনা করে তাদের প্রার্থনা কবুল করি, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে।’’ [বাক্বারা : ১৮৬]
অতএব সকলের উচিত তার কাছে দু‘আ করা। তিনি অতি নিকটে, দু‘আ কবুল করেন।
৩. যারা অহংকার করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে না, স্বীয় অভাব-অভিযোগ তার সামনে পেশ করে না, তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে- ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তওহীদের তালিম। ইরশাদ হচ্ছে :
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ﴿المؤمن / غافر :60﴾
‘‘তোমাদের রব বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। যারা অহংকার করে আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তারা অচিরেই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে দাখিল হবে।’’ [গাফের : ৬০]
অতএব সকলের কর্তব্য তার নিকট প্রার্থনা করা।
৪. একমাত্র আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, অন্য কারো নিকট প্রার্থনা না করা- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তওহীদের তালীম। ইরশাদ হচ্ছে :
إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقًا فَابْتَغُوا عِنْدَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ ﴿العنكبوت :17﴾
‘‘নিশ্চয় তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে প্রতিমার পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। নিশ্চয় আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। সুতরাং আল্লাহর কাছে রিযিক অনুসন্ধান কর, তার এবাদত কর এবং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তার কাছে-ই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’’ [আনকাবুত : ১৭]
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴿الملك :1﴾
‘‘বরকতময় তিনি যার হাতে রাজত্ব। এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।’’ [মূলক : ১]
الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا ﴿2﴾ وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آَلِهَةً لَا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ وَلَا يَمْلِكُونَ لِأَنْفُسِهِمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا وَلَا يَمْلِكُونَ مَوْتًا وَلَا حَيَاةً وَلَا نُشُورًا ﴿3﴾
‘‘যার রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব। তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি। রাজত্বে তাঁর কোন অংশীদার নেই। আর তিনি প্রত্যেক বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে। তারা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে যারা কিছুই সৃষ্টি করে না বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়, এবং নিজেদের ক্ষতি ও উপকারের ক্ষমতা রাখে না। এবং জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপরও কোন ক্ষমতা রাখে না। [ফুরকান : ২-৩]
সুতরাং তারা কোনভাবেই প্রার্থনার যোগ্য হতে পারে না।
৫. যারা মানুষের নিকট প্রার্থনা হতে বিরত থাকে আর আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে। তাদের সমর্থন ও প্রশংসার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তওহীদের তালিম।
ইরশাদ হচ্ছে :
لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا ﴿البقرة :273﴾
‘‘( দান-খয়রাত) ঐ সকল দরিদ্র লোকের জন্য যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে, জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র চলাফেরা করতে সক্ষম নয়। অজ্ঞ লোকেরা না চাওয়ার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে, তোমরা তাদেরকে তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি মিনতি করে ভিক্ষা চায়না।’’ [বাকারা : ২৭৩]
সুতরাং তাদের গুন অর্জন করা এবং মানুষের নিকট প্রার্থনা পরিহার করা।
এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে আরো অনেক আয়াত রয়েছে। যা বিভিন্ন পন্থায়, নানান পদ্ধতিতে মানবজাতিকে তালিম দিয়েছে, তোমরা আল্লাহকে ডাক, তার কাছে প্রার্থনা কর। একমাত্র তিনিই প্রার্থনার উপযুক্ত।
হাদীস গ্রন্থাবলিতেও এ বিষয়টি খুব সূক্ষ্ম ও সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ :
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের কাছে যাঞ্চনা করার অশুভ পরিণতি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, বরং এর প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে :
ما يزال الرجل يسأل الناس حتى يأتي يوم القيامة وليس في وجهه مزعة لحم . رواه البخاري في الزكاة، باب : من سأل الناس تكثرا، ورواه مسلم أيضا .
‘‘যে ব্যক্তি মানুষের নিকট ভিক্ষা করে বেড়ায়, সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উপনীত হবে যে, তার চেহারায় একটি গোস্তের টুকরাও নেই।’’ [বুখারী ও মুসলিম]
সুতরাং মানুষের কাছে ভিক্ষা করা, নিজের উপর অভিশাপ ডেকে আনারই নামান্তর।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন, যাতে কেউ ভিক্ষার জন্য মানুষের দ্বারস্থ না হয়।
ইরশাদ হচ্ছে :
لأن يأخذ أحدكم حبله ثم يغدو فيحتطب، فيبيع فيأكل ويتصدق خير له من أن يسأل الناس . رواه البخاري في الزكاة .
‘‘তোমাদের কেউ সকালে রশি নিয়ে বের হয়ে লা-কড়ি সংগ্রহ করা অত:পর তা বিক্রি করে আহার করা এবং সদকা করা মানুষের নিকট হাত পেতে ভিক্ষা করার চেয়ে অনেক উত্তম।’’ [বুখারী]
৩. যে ব্যক্তি মানুষের কাছে হাত পাতা হতে বিরত থাকবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য প্রতিদান স্বরূপ জান্নাতের সুসংবাদ দান করেছেন। সাওবান রা. বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
من تكفل لي أن لايسأل الناس شيئا فأتكفل له بالجنة؟ فقلت : أنا، فكان لايسأل أحداً شيئاً . رواه أبوداود في زكاة الفطر .
কে আমাকে এই নিশ্চয়তা দেবে যে, সে মানুষের কাছে মোটেও হাত পাতবে না ফলে আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব ? তখন আমি বললাম, ‘আমি’। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর তিনি কারো কাছে কোন কিছুর জন্য হাত পাতেননি।’’ [আবু দাউদ]
৪. ভিক্ষাবৃত্তির শিকড় উৎপাটনের জন্য তাঁর আগ্রহ এমন পর্যায়ে ছিল যে, তিনি এ জন্য সাহাবাদের থেকে বায়আত পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন।
‘আউফ বিন মালেক আশজা‘য়ী রা. বলেন, আমরা নয়, আট কিংবা সাত জনের মত লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম, তিনি বললেন :
ألا تبايعون؟
‘‘তোমরা কেন আমার বায়আত গ্রহণ করছ না?’’ সাহাবী বলেন, অথচ আমরা ইতোমধ্যে বায়আত গ্রহণ করেছি। তাই, আমরা বললাম হে আললাহর রাসূল, (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমরা তো আপনার বায়আত গ্রহণ করেছি। পুনরায় বললেন, তোমরা কেন আল্লাহর রাসূলের বায়আত গ্রহণ করছ না? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমরা তো আপনার বায়আত গ্রহণ করেছি। পুনরায় বললেন : তোমরা কেন আল্লাহর রাসূলের বায়আত গ্রহণ করছ না? অতঃপর আমরা হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং বললাম: আমরা তো আপনার বায়আত গ্রহণ করেছি। অতএব এখন কীসের উপর বায়আত গ্রহণ করব? তিনি বললেন : শুধু এর উপর যে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে, তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে ও তাঁর আনুগত্য করবে। একটি কথা খুব ক্ষীণ আওয়াজে বললেন, ‘মানুষের কাছে কোন জিনিস চাইবে না’’ বর্ণনাকারী বলেন : আমি সে মজলিসে উপস্থিত কতিপয় ব্যক্তিকে দেখেছি, তাদের কারো হাত ফসকে চাবুক পড়ে গেলেও উঠিয়ে দেয়ার জন্য অন্য কাউকে অনুরোধ করতেন না।’’ [মুসলিম]
৫. তাওহীদের এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে ছোট বাচ্চাদেরও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব যত্ন সহাকরে শিক্ষা দিতেন। যেমন তিনি সাত বছরের বাচ্চাদের নামাযের হুকুম করতেন। লক্ষ্য করুন ইবনে আববাসকে কীভাবে তাওহীদ শিক্ষা দিচ্ছেন। অথচ তখনও সে ছোট ছেলে মাত্র।
يا غلام ! إني أعلمك كلمات : احفظ الله يحفظك، احفظ الله تجده تجاهك، إذا سألت فاسأل الله، وإذا استعنت فاستعن بالله .
‘‘হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিক্ষা দিচ্ছি, তুমি আল্লাহকে হেফাজত কর (তাঁর বিধিনিষেধ মান্য কর) আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। যখন চাইবে, একমাত্র আল্লাহর নিকটই চাইবে। আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করবে।
আরো গুরুত্ব সহকারে বোঝাচ্ছেন :
واعلم أن الأمة لو اجتمعت على أن ينفوك بشيء لم ينفعوك إلا بشيء قد كتبه الله لك، وإن اجتمعوا على أن يضروك بشيء لم يضروك إلا بشيء قد كتبه عليك، رفعت الأقلام، وجفت الصحف . رواه الترمذي في صفة القيامة .
‘‘জেনে রাখ, সমস্ত মানুষ একত্রিত হয়ে যদি তোমার কোন উপকার করতে চায়, কোন উপকার করতে পারবে না। তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর তারা সকলে একত্রিত হয়ে যদি তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং কিতাব শুকিয়ে গেছে।’’ [তিরমিযী]
৬. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি মুহূর্তকে তাওহীদের মূলনীতি শিক্ষার দেয়ার জন্য গনিমত মনে করতেন। গায়রুল্লাহর নিকট যাঞ্চনা করার চেয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রার্থনা করার উপকারিতা বর্ণনা করতেন। তিনি বলেন:
من نزلت به فاقة فأنزلها بالناس لم تسد فاقته، ومن نزلت به فاقة فأنزلها بالله فيوشك الله له برزق عاجل أو آجل . رواه الترمذي في الزهد .
‘‘যার উপর অভাব আপতিত হল, আর সে তা মানুষের সামনে তুলে ধরল, তার অভাব কখনো মোচন হবে না। আর যে ব্যক্তির উপর অভাব দেখা দিল, আর সে তা আল্লাহ তা‘আলার সামনে তুলে ধরল, খুবই সম্ভব আল্লাহ তার জন্য শীঘ্র প্রদত্ত কিংবা বিলম্বে প্রদত্ত রিযিকের ব্যবস্থা করবেন।’’ [তিরমিযী]
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, কয়েকজন আনসার সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কিছু চাইল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রদান করলেন। তারা পুনরায় চাইল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দিলেন। তারা আবারও চাইল তিনি আবারও দিলেন।এক সময় তার কাছে যা ছিল, সব নিঃশেষ হয়ে গেল। অতঃপর বললেন :
ما يكون عندي من خير فلن أدخره عنكم، ومن يستعفف يعفه الله، ومن يستغن يغنه الله، ومن يتصبر يصبره الله، وما أعطي أحد عطاء خيرا وأوسع من الصبر . رواه البخاري في الزكاة .
‘‘আমার নিকট কোন মাল-সম্পদ থাকলে এমন হয় না যে,আমি তোমাদের না দিয়ে জমা করে রাখি। তবে যে পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন। আর যে অমুখাপেক্ষী হতে চায় আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করে দেন। যে ধৈর্যধারণ করতে চায়, আল্লাহ তাকে ধৈর্যধারণ করার তওফীক দেন। ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও বিশাল পুরস্কার কাউকে প্রদান করা হয়নি।’’ [বুখারী]
সাহাবায়ে কেরাম রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপদেশ হতে খুব ভাল করেই উপকৃত হয়েছেন। ফলে তাওহীদের এ মূলনীতি তাদের হৃদয়ে বদ্ধ-মূল হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা কারো কাছে কোন জিনিস প্রার্থনা করতেন না। যেমন এ নিবন্ধে উল্লেখিত আউফ ও সওবান হতে বর্ণিত হাদীসে বিবৃত হয়েছে।
একদা হাকীম বিন হিযাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে কিছু প্রার্থনা করলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দান করেন। সে পুনরায় যাঞ্চনা করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে পুনরায় দান করেন।সে আবারও চাইলে রাসূলুল্লাহ তাকে আবারও দান করেন। অতঃপর বললেন :
يا حكيم ! إن هذا المال خضرة حلوة، فمن أخذه بسخاوة نفس بورك له فيه، ومن أخذه بإشراف نفس، لم يبارك له فيه، كالذي يأكل ولايشبع . اليد العليا خير من اليد السفلى .
‘‘হে হাকীম, এ সম্পদ হল সবুজ সুমিষ্ট। যে একে মনের বদান্যতা গ্রহণ করবে, সেটি তার জন্য বরকতময় হবে। আর যে একে মনের লালসা নিয়ে গ্রহণ করবে, তার জন্য বরকতময় হবে না। ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে খায় কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না। উপরের হাত নীচের হাতের তুলনায় উত্তম।
অর্থাৎ দানশীলের হাত দান গ্রহণকারীর হাতের চেয়ে উত্তম। হাকীম বলেন :আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, ঐ সত্তার কসম, যে আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত আপনার পর আর কারো নিকট কোন জিনিসের জন্য শরণাপন্ন হব না। আবু বকর রা. হাকীমকে বায়তুলমাল হতে অনুদান নেয়ার জন্য ডেকে পাঠালেন, তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর ওমর রা. তাকে দেয়ার জন্য ডেকে পাঠালেন, তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। অত:পর ওমর রা. বলেন :
إني أشهدكم يا معشر المسلمين على حكيم، أني أعرض عليه حقه من هذا الفيء فيأبى أن يأخذه . رواه البخاري في الزكاة .
‘‘হে মুসলিম জাতি, আমি তোমাদেরকে হাকীমের ব্যাপারে সাক্ষ্য রাখছি, আমি এ ফায় (সন্ধি সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ) হতে তার প্রাপ্য পেশ করছি, আর সে তা প্রত্যাখ্যান করছে।’’ [বুখারী]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর হাকীম মৃত্যু পর্যন্ত কোন মানুষের দ্বারস্থ হননি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথায় ও কাজে বাস্তবায়ন না করে সাহাবাদেরকে কোন বিষয়ে নির্দেশ দিতেন না। এ জন্য তার নির্দেশ তাদের অন্তকরণে ও আচার ব্যবহারে গভীরভাবে প্রভাব সৃষ্টি করত। হিজরতের সময় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরোহণের জন্য একটি উট পেশ করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মূল্য বিহীন গ্রহণ কতে অস্বীকার করেন। [বুখারী]
এভাবেই সাহাবায়ে কেরাম এক স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করা এবং সৃষ্টি জীবের নিকট প্রার্থনা না করার দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছেন। এমনকি রাসূলের নিকটও তারা পার্থিব কোন জিনিস প্রার্থনা করতেন না। তারা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করতেন। সর্ব প্রথম তাঁরই শরণাপন্ন হতেন।
পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে যখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহার পবিত্রতা ও নির্দোষিতা প্রমাণিত হল, তখন তার মা তাকে বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যাও, কৃতজ্ঞতা সহ তার সকাশে উপস্থিত হও। তিনি বললেন :
والله لا أقوم إليه . ولا أحمد إلا الله، هو الذي أنزل براءتي . رواه مسلم في كتاب التوبة
‘‘আল্লাহর কসম, আমি তাঁর নিকট যাব না।এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসা করব না। তিনিই আমার নিরপরাধ হওয়া বিষয়ে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।’’ [মুসলিম]
কা’ব ইবনে মালেকের তাওবা কবুলের আয়াত অবতীর্ণ হলে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেন :
أمن عندك أم من عند الله؟ قال : بل من عند الله . رواه مسلم في التوبة
‘‘এটি আপনার পক্ষ হতে, না আল্লাহর পক্ষ হতে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; বরং আল্লাহর পক্ষ হতে।’’ [মুসলিম]
এ প্রশ্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগান্বিত হননি। তার ও আয়েশার অবস্থানকে বেয়াদবী জ্ঞান করেননি। তিনিই তাদের এ নীতির উপর লালন করেছেন।
তাছাড়া এখানে বেয়াদবীরও কিছু ছিল না। বরং এটা ছিল আল্লাহ তাআলার সাথে পরিপূর্ণ শিষ্টচার প্রদর্শন। কারণ, কারো পক্ষেই আল্লাহর হকের উপর অন্য কারো হকের অগ্রাধিকার দেয়া উচিত নয়। যদিও তিনি নবী হন।
শীর্ষস্থানীয় সাহাবাদের নীতি ছিল, তারা নিজেদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কোন কিছুই প্রার্থনা করতেন না। এ ছিল পার্থিব বিষয়ের ব্যাপারে। আর ধর্মীয় ব্যাপারে তারা তাঁর নিজের পক্ষ থেকে বলার অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁর সামনে কেউ অগ্রণী হয়ে কথা বলতেন না। তাদের আদবের এমন অবস্থা ছিল যে, মাত্র চৌদ্দটি প্রশ্ন ব্যতীত তারা কোন প্রশ্নই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে করেনি। আর সবকটি প্রশ্ন-ই কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে। উদাহরণত : আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ ... ﴿البقرة :215﴾
‘‘তারা তোমার কাছে জিজ্ঞেস করবে, তারা কি সদকা করবে?...’’ [বাকারা : ২১০]
তবে হ্যাঁ, যে সকল সাহাবা পরিপূর্ণ রূপে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহচর্য গ্রহণ করতে পারেননি, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পার্থিব জিনিসও প্রার্থনা করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে সহনশীলতা প্রদর্শন করতেন, তাদের শিক্ষা দিতেন। ভাল এবং উত্তম জিনিসের দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন।
উসমান বিন হানীফ হতে বর্ণিত : দৃষ্টিহীন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসেন। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আমার সুস্থতার জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন। নবীজী বললেন :
إن شئت دعوت لك، وإن شئت صبرت فهو خير لك .
‘‘তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দু‘আ করে দিব। আবার ইচ্ছা হলে ধৈর্যও ধারণ করতে পার।আর ধৈর্যই তোমার জন্য উত্তম।’’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দু‘টি জিনিসের একটি বেছে নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সাথে সাথে ধৈর্য ধারণ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। আর ধৈর্যকে এভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, দু‘আর বিপরীতে তার জন্য ধৈর্য ধারণ করাই উত্তম। তা সত্ত্বেও সে বলেছে আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে ভাল করে ওজু করার নির্দেশ দিলেন। এবং দু‘রাকাত সালাত আদায় করতে বললেন। অতঃপর এভাবে দু‘আ করতে বললেন।
اللهم إني أسألك وأتوجه إليك بنبيك محمد نبي الرحمة، يا محمد إني توجهت بك إلى ربي في حاجتي هذه، لتقضى لي . اللهم فشفعه فيّ . رواه الترمذي في الدعوات .
‘‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি এবং আপনার নবী, রহমতের নবী, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। হে মুহাম্মদ! আমি আপনার মাধ্যমে আমার এ প্রয়োজন আমার প্রভুর নিকট তুলে ধরেছি, যাতে আমার প্রয়োজন পূর্ণ হয়। হে আল্লাহ! আমার দু‘আর ব্যাপারে আপনি তার সুপারিশ কবুল করুন।’’ [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এবং শুধু তার নিকটই আবেদন নিবেদন জানাতে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু যখন সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দু‘আর জন্য পীড়াপীড়ি করেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে এমন জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন, যার মধ্যে তার কল্যাণ নিহিত রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় দু‘আর সাথে তাকেও দু‘আর করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এর শিক্ষা। তাকে আল্লাহর শরণাপন্ন হতে বলেছেন। যাতে সে কারো দু‘আকে যথেষ্ট মনে না করে, যদিও সে দু‘আকারী একজন রাসূল হন।
আরেকটি ঘটনা:
মৃগী রোগাক্রান্ত জনৈকা মহিলা আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যেত। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দু‘আর জন্য আবেদন জানাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন :
إن شئت صبرت ولك الجنة، وإن شئت دعوت الله أن يعافيك . رواه البخاري في المرضى .
‘‘তুমি চাইলে ধৈর্যধারণ করতে পার, বিনিময়ে জান্নাত পাবে। আর যদি চাও, সুস্থতার জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করে দেই।’’ [বুখারী]
এটাও পূর্বের মত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দু‘আ বা ধৈর্যের যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। সাথে সাথে ধৈর্যধারণ ও আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ, এটাই তার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দু‘আর তুলনায় বেশি উত্তম। এ ধরনের দৃষ্টান্ত আরো অনেক আছে।
উপরোক্ত ঘটনাসমূহের প্রত্যেকটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের অন্তরসমূহ আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন। যে কোন প্রসঙ্গে তাদেরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট প্রার্থনা না করার দীক্ষা দিয়েছেন। কারণ, এটি ঈমান ও দ্বীনের মৌলিক একটি অধ্যায়, এ ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব প্রদান করাই হচ্ছে আল্লাহর বিধান।
এতক্ষণ আমরা লক্ষ্য করলাম যে, মানুষের অন্তরে এ মূলনীতিটি বদ্ধ মূল করতে শরীয়ত কি পরিমাণ গুরুত্ব আরোপ করেছে। কুরআন হাদীসের একজন গবেষক, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নবীগণের জীবন চরিতের একজন পর্যালোচক খুব সহজেই এ মূলনীতি সম্পর্কে অবগত হতে পারেন যে,
أصل التوحيد سؤال الله وأصل الشرك سؤال غير الله تعالى .
‘‘তাওহীদের মূল আবেদন আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, আর শিরকের মূল আবেদন গায়রুল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।’’
এ মহৎ নীতিটি সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে হৃদয়ংগম করেছিলেন বিধায় তাদের ভিতর পার্থিব স্বার্থকে কেন্দ্র করে পরস্পর ঝগড়া-ফ্যাসাদ, হানা-হানি,মারামারি ইত্যাদি সংঘটিত হয়নি। সকল চাওয়া-পাওয়াকে তারা এক আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে ছিলেন। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাললাম এর ওফাতের পরও তাদের ঈমানের ভিতর ক্ষুদ্রতম ফাটল পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের পরপরই তাঁর প্রথম ছাত্র আবু বকর রা. উপস্থিত সকল জনতার সামনে বক্তৃতার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বলেন :
أما بعد : من كان منكم يعبد محمدا، فإن محمدا قد مات، ومن كان منكم يعبد الله فإن الله حي لا يموت .
‘‘...তোমাদের যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইবাদত করতে, মুহাম্মাদ নিশ্চিত মারা গেছেন, আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে, আল্লাহ চিরঞ্জীব, মৃত্যু বরণ করেন না।’’
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ ﴿آل عمران :144﴾
‘‘আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ তো নয়। তার পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। অতএব যদি সে মৃত্যু বরণ করে অথবা নিহত হয়, তবে কি তোমরা পশ্চাতে ফিরে যাবে? বস্ত্তত: কেউ যদি পশ্চাতে ফিরে যায়, তাতে আল্লাহর সামান্য ক্ষতিও হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।’’ [আলে ইমরান : ১৪৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদত এবং সব বিষয়ে তার নিকট প্রার্থনা করার জন্য দীক্ষা প্রদান করতেন। হাদীসে এসেছে:
ليسأل أحدكم ربه في حاجاته كلها، حتى شسع نعله إذا انقطع . رواه الترمذي من حديث أنس .
‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই যেন নিজেদের প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস স্বীয় রবের নিকট প্রার্থনা করে, এমনকি জুতার ফিতাও যদি ছিঁড়ে যায়’’ [তিরমিযী]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের সময় সাহাবাদের অন্তরসমূহ সে আল্লাহর সাথেই সম্পৃক্ত ছিল, যিনি চিরঞ্জীব, কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না। ফলে তার মৃত্যুর পর কঠিনভাবে ধৈর্য ধারণ করেন এবং দ্বীনের দায়িত্ব হাতে নিয়ে দৃঢ়পদে দন্ডায়মান হন। যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এ দীক্ষায় দীক্ষিত না করতেন, তবে তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর প্রচারিত দ্বীনও নিঃশেষ হয়ে যেত। ইসলাম কখনো এ মর্যাদায় উন্নীত হত না।
সাহাবায়ে কেরাম সারাজীবন আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব, তাঁর উপর পূর্ণ আস্থা এবং প্রতিটি ছোট বড় জিনিসের ব্যাপারে তার নিকট প্রার্থনা করার বিধানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তারা এমন আস্থা, ত্যাগ, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার নমুনা পেশ করেছেন, ইতিহাস যার উদাহরণ পেশ করতে অপরাগ, অক্ষম।
সেনাপতি আবু উবাইদা রা. ইয়ারমুকের যুদ্ধের বছর কাফেরদের মোকাবেলায় সাহায্য চেয়ে ওমর রা. এর নিকট পত্র লিখেন। তিনি লিখেন যে, তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য গোটা শত্রু বাহিনী এক যুগে অবতীর্ণ হয়েছে, যাদের মোকাবেলা করার শক্তি আমাদের নেই। তার পত্র পৌঁছা মাত্র উপস্থিত সকলে কেঁদে ফেলেন, যাদের মধ্যে আব্দুর রহমান বিন আউফও ছিলেন। তিনি ওমর রা. কে আরো সৈন্যবাহিনী নিয়ে বের হতে পরামর্শ দিলেন। ওমর রা. ভেবে দেখলেন, এটা অসম্ভব। অতএব আবু উবাইদাহ রা. এর নিকট পত্র লিখলেন :
مهما ينزل بامرئ مسلم من شدة، فينزلها بالله، يجعل الله له فرجا ومخرجا، فإذا جاءك كتابي هذا فاستعن بالله وقاتلهم . رواه مالك في المؤطأ في الجهاد .
‘‘মুসলিম জাতির সামনে যখন কোন মুসীবত অবতীর্ণ হয়, আর সে তা আল্লাহ তাআলার নিকট পেশ করে, আল্লাহ তার জন্য মুক্তি ও নাজাতের ব্যবস্থা করে দেন। যখন তোমার নিকট আমার এ পত্র পৌঁছোবে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাদের সাথে জেহাদে অবতীর্ণ হবে।’’ [মুয়াত্তা ইমাম মালেক]
অবশ্য ওমর রা. এর অবস্থানকে অনেকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়াই গণ্য করবে। কিন্তু ওমর রা. জানতেন যে, সাহায্য একমাত্র আল্লাহ তাআলারই পক্ষ হতে। তার অন্তরও এ দীক্ষায় দীক্ষিত ছিল। আবু উবাইদাহ রা. প্রেরিত পত্র পেয়েও তিনি এ বিশ্বাস থেকে সামান্যও বিচ্যুত হননি। জানতেন, আল্লাহ তাআলার সাহায্যই সবার উপরে। বিধায় তিনি যা বলেছেন পূর্ণ আস্থা আর দৃঢ় ঈমান থেকেই বলেছেন।
এযাবৎ আমরা আলোচিত বিষয়ে শরীয়তের উৎস ও সাহাবাদের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছি। এখন আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করার উপকারিতা এবং সৃষ্টি জীবের নিকট যাচ্ঞা করার অপকারিতা সম্পর্কে আলোকপাত করব। যার মাধ্যমে আমরা পূর্বে বর্ণিত মূল নীতির সত্যতা এবং শরীয়ত কর্তৃক আনীত বিধানের সাথে এর সামঞ্জস্যতা জোরালো ও দৃঢ় ভাবে প্রমাণ করব।
যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করার অভ্যাস গড়ে তুলবে, সে দু’টি বড় নেয়ামত লাভে ধন্য হবে।
প্রথমত : আল্লাহর সাথে মোনাজাতের স্বাদ।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহ তাআলার মহববত।
মোনাজাত প্রসঙ্গ : মানুষের প্রয়োজনের শেষ নেই, সমস্যার অন্ত নেই। তাই সে যদি সব সময় আল্লাহর শরণাপন্ন হয়, তার নিকট প্রার্থনা করে, তার কাছেই স্বীয় অভাব অভিযোগ তুলে ধরে, তার অন্তর আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাবে। আল্লাহর পরিচয়ের নতুন দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত হবে। তার সামনে আস্তে আস্তে আল্লাহর রহমত, করুণা ও ঈমানের সে সব অধ্যায়সমূহ খুলে যাবে, যা সে জানতো না। আরো অর্জিত হবে ঈমানের স্বাদ, মুনাজাতের তৃপ্তি ও অন্তকরণের প্রশান্তি। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে না, সে আল্লাহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আল্লাহর সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়, মাখলুকের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। যা মুসীবত, নিপীড়ন, কষ্ট ও মানুষিক ব্যাধি ভিন্ন কিছুই নয়। আব্দুল্লাহ বিন আউন এর বাণী :
ذكرالناس داء، وذكر الله دواء . سير أعلام النبلاء 6/369 ، قال الذهبي عقبه : إي والله ! فالعجب منا ومن جهلنا، كيف ندع الدواء، ونقتحم الداء، قال الله – تعالى -: فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ ﴿البقرة :152﴾ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ ﴿العنكبوت :45﴾ وذكر ابن القيم في الوابل الصيب (99) عن مكحول قوله : ذكر الله شفاء، وذكر الناس داء .
‘‘মানুষের যিকির হচ্ছে ব্যাধি আর আল্লাহর যিকির হচ্ছে ঔষধ। আল্লামা যাহাবী রহ. এর পশ্চাতে বলেন : আল্লাহর শপথ! আশ্চর্য হচ্ছে আমাদের উপর ও আমাদের মূর্খতার উপর। আমরা কীভাবে ঔষধ প্রত্যাখ্যান করছি আর ব্যাধি গ্রহণ করছি। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব।’ [বাকারা : ১৫২]
তিনি আরো বলেন : ‘আল্লাহর জিকিরই হচ্ছে সব চেয়ে বড় জিনিস।’ [আনকাবুত : ৪৫] ইবনুল কাইয়্যিম রহ. উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর স্মরণ রোগ মুক্তি ও মানুষের স্মরণ ব্যাধি।’’ [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা]
হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলার সাথে এ ধরনের সম্পর্ক, তার প্রতি গভীর মনোযোগ মানব হৃদয়ে প্রশান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়। যেমন আল্লাহর এক বান্দা স্বীয় উপলব্ধি ব্যক্ত করে বলেছেন :
إنه ليكون لي إلى الله حاجة، فأدعوه، فيفتح لي من لذيذ معرفته، وحلاوة مناجاته، ما لاأحب معه أن يعجل قضاء حاجتي، خشية أن تنصرف نفسي عن ذلك، لأن النفس لا تريد إلا حظها، فإذا قضت انصرفت . مجموع الفتاوى 10/333
‘‘আমার যখন কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, আমি আল্লাহকে আহবান করি, তার দরবারে হাজিরা দেই, ফলে তাঁর সাথে মোনাজাতের স্বাদ, তাঁর সাথে কথোপকথনের মিষ্টতার দ্বার আমার জন্য খুলে যায়। যার বিপরীতে আমার প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে যাওয়াটাও পছন্দের মনে করি না, পাছে আমার একাগ্রতা দূর হয়ে যায়। কারণ, নফস্ খুবই আরাম প্রিয়। যখন উদ্দেশ্য সফল হবে, আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। [মাজমাউল ফাতাওয়া]
আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন :
فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا ﴿النساء :19﴾
‘‘সম্ভবত তোমরা এমন এক বস্ত্তকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’’ [নিসা : ১৯]
আল্লাহ তাআলার মহববত প্রসঙ্গ : মানুষ যখন গায়রুল্লাহকে বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করে, আর আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন, তখন সে আল্লাহ তাআলাকে অন্যভাবে চিনতে পারে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা মানুষের মঙ্গলজনক সব দু‘আই কবুল করেন। তিনি বান্দার জন্য কল্যাণকর কোন দু‘আ ব্যর্থ হতে দেন না। অধিকন্তু সে আরো উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ তাআলা কত সুন্দরভাবে তাকে মূল্যায়ন করছেন। দু‘আর ফলে কখনো তার প্রার্থিত বস্ত্ত প্রদান করবেন, কখনো তার উপর থেকে বালা-মুসীবত দূর করে দেবেন আবার কখনো আখেরাতের পুঁজি হিসেবে এ দু‘আর সওয়াব তার জন্য জমা করে রাখবেন। হাদীস শরীফে আছে, প্রার্থনাকারীকে তিনটি জিনিসের যে কোন একটি অবশ্যই প্রদান করা হয়।
إما أن يعجل له بالإجابة، وإما أن يصرف عنه من السوء مثلها، وإما أن يدخر له . رواه الترمذي في الدعوات، باب : انتظار الفرج، وباب : ماجاء أن دعوة المسلم مستجابة، وفي الموطأ، في القرآن، باب ماجاء في الدعاء .
‘‘হয়তো সাথে সাথে তার দু‘আ কবুল করা হয়। অথবা দু‘আ কবুলের বিপরীতে তার থেকে মুসীবত দূর করে দেয়া হয়। অথবা দু‘আর সওয়াব আখেরাতে তার জন্য জমা করে রাখা হয়।’’ [তিরমিযী]
দু‘আর এ মহান ও নিশ্চিত পুরস্কারের ফলে মানব হৃদয়ে আল্লাহর মহববত ও ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। এর দ্বারা তার নিকট আল্লাহ তাআলার দয়া, মহানুভবতা, দানশীলতা, স্নেহশীলতা, ক্ষমা ও রিযিক প্রদানের বিষয়টি স্পষ্ট করে ফুটে উঠে। আর স্বাভাবিকভাবেই মানুষ অনুগ্রহকারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করা স্বীয় অভ্যাসে পরিণত করবে, সে নিত্য নতুন আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যক্ষ করবে। মানুষ তথা সৃষ্টি জীবের নিকট প্রার্থনা করলে এর কিঞ্চিৎও অর্জিত হয় না বরং তার মধ্যে রয়েছে অনেক অনিষ্ট, অপমান ও কষ্ট। যেমন :
প্রথমত : মানুষের কাছে প্রার্থনা অন্তরে আঁধার ও কালিমার জন্ম দেয়। কারণ, তার নিকট কিছু চাওয়ার অর্থ হল, যালেম-জাহুল তথা অত্যাচারী-অজ্ঞ সত্তার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। আর যে ব্যক্তি যালেম-জাহুলের সাথে সম্পর্ক করবে তার অন্তরে আঁধার ও মূর্খতারই সৃষ্টি হবে।
দ্বিতীয়ত : তারা যদি তার ডাকে সাড়াও দেয়, তবুও তাদের সাথে মহববত, বিনয় ও আনুগত্যের সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার সম্পর্কের সাথে চিড় ধরায়।
তৃতীয়ত : প্রার্থনাকারী সর্বদা অনুগ্রহকারীর কৃতজ্ঞতার বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়ায়, তার বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এটা এক ধরনের দাসত্ব, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সমীচীন নয়।
চতুর্থত : কারো থেকে অনুদান গ্রহণকারীর জন্য জরুরি, সে অনুদানের প্রতিদান দেয়া। প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হলে কার্যত গোলামে পরিণত হতে বাধ্য হয়। এমনি পরিস্থিতির শিকার জনৈক ব্যক্তি বলেছেন :
ما وضعت يدي في قصعة أحد إلا ذللت له . الفتاوى 1/98
‘‘আমি যখনই কারো পাত্রে আমার হাত রেখেছি, তখন বাধ্য হয়েই তার বশ্যতা মেনে নিয়েছি।’’ [মাজমাউল ফাতাওয়া]
অন্য এক ব্যক্তি বলেছেন :
احتج إلى من شئت تكن أسيره، واستغن عمن شئت تكن نظيره، وأحسن إلى من شئت تكن أميره . الفتاوى 1/39
‘‘তুমি-ই সিদ্ধান্ত নাও কি করবে? যদি কারো মুখাপেক্ষী হও, তার গোলামে পরিণত হবে। আর যদি তুমি নিজেকে তুষ্ট কিংবা অভাব মুক্ত মনে কর, সবার বরাবর হয়ে যাবে। আর যদি কারো প্রতি দয়া কর, তার আমীরে পরিণত হবে।’’ [মাজমাউল ফাতাওয়া]
অনেক সময় তাদের প্রতিদান দেয়ার সুযোগ হলেও, দ্বীনকে বিসর্জন দিতে হয়, দ্বীনের আনুষঙ্গিক বিষয়বস্ত্ত পরিত্যাগ করতে হয়। আবার এতটুকু ক্ষতি ছাড়া তাদের প্রতিদান দিতে সক্ষম হলেও, এ সময়টুকু আল্লাহ হতে দূরে সরে থাকার ক্ষতিই কম কীসের? বরং এ সময় যদি আল্লাহর নিকট রিযিক চাওয়া হত, তার নিকট প্রার্থনা করা হত, তবেই তো অনেক ভাল ছিল।
পঞ্চতম : আমাদের বর্ণিত ক্ষতির সম্ভাবনা তখন, যখন তারা প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করবে। আর তারা যদি তার আবেদন নাকচ করে দেয়, তবে সৃষ্টি হবে অবিশ্বাস, ঝগড়া, বিচ্ছিন্নতা, পরস্পর হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি। পিছনে দেখা গেছে কারো অভাব পূরণ না করার ফলে, অনেক শত্রুতার জন্ম হয়েছে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, সুসম্পর্ক নষ্ট হয়েছে ইত্যাদি।
ষষ্ঠত : মানুষের নিকট প্রার্থনা করার অর্থ মানুষকে মানুষের দাসে রূপান্তরিত করা। আর এটাই মানব জাতির সবচেয়ে বড় অধঃপতন। পক্ষান্তরে ইসলাম মানুষের দাসত্ব বিলুপ্ত ও কুফরের শাখা প্রশাখা রুদ্ধ করার জন্য আগমন করেছে। এ জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন : স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মধ্যস্থতার ধারণা রহিত করেছে। সরাসরি তার নিকট প্রার্থনা জানাতে নির্দেশ দিয়েছে। প্রধানত দু’টি কারণে মধ্যস্থতা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে।
প্রথমত : দাসত্ব এবং ইবাদত যাতে একমাত্র আল্লাহর তাআলার জন্যই সংরক্ষিত থাকে।
দ্বিতীয়ত : মানুষ যাতে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও কবুলিয়তের মুহূর্ত হতে বঞ্চিত না হয়। এর সামান্য ব্যাখ্যা নিম্নে তুলে ধরা হল :
মানুষ বিগলিত হৃদয় ও বিনয়াবনত দু’টি অবস্থায় হয়ে থাকে।
এক : গুনাহ করার পর।
দুই : প্রয়োজনের মুহূর্তে।
গুনাহ পরবর্তী হালত : গুনাহ সংঘটিত হওয়ার পর কৃতকর্মের অনুশোচনা, নফসের হীনতা, আল্লাহর ভয় ও লজ্জার অনুভূতি তাকে ব্যাকুল-বিহবল ও আবিষ্ট করে তুলে। এ মুহূর্তটি আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন ও তার নিকট ক্ষমা ভিক্ষার সফল মোক্ষম সময়। কারণ, আল্লাহ তার বান্দার ভগ্ন হৃদয়, বশ্যতা ও বিনম্রতাকে খুব পছন্দ করেন। অহমিকা, অহংকার ইত্যাদিকে অপছন্দ করেন। যে আল্লাহর নিকট ভগ্ন হৃদয় ও নম্রতা নিয়ে উপস্থিত হবে, আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন। সুতরাং বান্দার উচিত গুনাহের পর লজ্জা ও ভগ্নতার মুহূর্তগুলোকে আল্লাহ তাআলার নিকট গুনাহ মার্জনার প্রার্থনায় লিপ্ত হওয়া।
এ দিকে শয়তান ওৎপেতে থাকে দু‘আ কবুলের এ মুহূর্তটি লুফে নেয়ার জন্য। যাতে সে এ সময় আল্লাহর দরবারে দু‘আ না করে এবং তার দু‘আও কবুল না হয়। সে তাকে প্ররোচিত করে শিক্ষা দেয়, তুমি গুনাহ্গার তোমার দু‘আ কবুল হবে না ইত্যাদি। এ ফন্দির মাধ্যমেই সে পূর্বেকার লোকদের মুশরিক বানিয়েছিল। তাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়েছে যে, আল্লাহ গুনাহ্গারদের দু‘আ কবুল করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত নেককার পবিত্র আত্মাদের মাধ্যমে তওবা না করা হয়। তারা শয়তানের ফাঁদে পা দিল। ফলে তারা ক্ষমা, কবুলিয়ত ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মুহূর্ত হতে বঞ্চিত হল। তারা গায়রুল্লাহর শরণাপন্ন হয়ে, তাদের মাধ্যম বানিয়ে এবং তাদের নিকট সুপারিশ ও শাফায়াতের অন্তরালে শিরকের ভিতর লিপ্ত হল।
তাদের এক দল এখনও মাজার ও আউলিয়াদের বেলায়েতের নামে ইবাদত করে। তাদেরকে আল্লাহ ও সৃষ্টির মাঝে মাধ্যম হিসেবে জ্ঞান করে, যা হুবহু মুশরিকদের কর্ম কান্ড সদৃশ,আল্লাহ তাআলা যাদের কর্ম অপছন্দ করেন, যাদেরকে কাফের বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ ﴿يونس :18﴾
‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্যের উপাসনা করে, যারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে না। তারা বলে এরা তো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী মাত্র। তুমি বল, তোমরা কি আল্লাকে এমন বিষয় অবহিত করছ, আসমান ও যমীনরে মাঝে যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন? তিনি পুত পবিত্র ও মহান সে সমস্ত থেকে যাকে তোমরা শরীক করছ।’’ [ইউনুস : ১৮]
বান্দা যত গুনাহ করুক আল্লাহ তাআলা তার প্রার্থনা কবুল করেন।
আল্লাহ তাআলা কি ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করেননি যে একশত মানুষ হত্যা করেছিল? [বুখারী]
আল্লাহ তাআলা কি ঐ ব্যভিচারিণীকে ক্ষমা করেননি যে তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়েছিল? হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা তার সেবার মূল্যায়ন করেছেন, তাকে মাফ করে দিয়েছেন। [মুসলিম]
তিনি বলেছেন :
يا ابن آدم ! إنك ما دعوتني ورجوتني غفرت لك على ما كان منك ولا أبالي . يا ابن آدم ! لو بلغت ذنوبك عنان السماء، ثم استغفرتني غفرت لك ولا أبالي . يا ابن آدم ! لو أتيتني بقراب الأرض خطايا، ثم لقيتني لا تشرك بي شيئا لقيتك بقرابها مغفرة . رواه الترمذي في الدعوات .
‘‘হে বনী আদম! যত বড় গুনাহই তোমাহতে প্রকাশ পেয়েছে , তুমি যদি আমাকে আহবান কর, আমার উপর আশায় বুক বাধ, আমি তোমাকে মাফ করে দিব, এতে আমি সামান্য মাত্র পরওয়া করি না। হে বনী আদম! যদি তোমরা গুনাহ উর্ধ্বগগন পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতঃপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব, এতে আমি কোন পরওয়া করি না। হে বনী আদম! তুমি যদি আমার কাছে দুনিয়ার সমান গুনাহ নিয়ে আস, অতঃপর আমার সাথে কাউকে শরীক না করে সাক্ষাৎ কর, আমি তোমার কাছে দুনিয়ার সমান ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হব।’’ [তিরমিযী]
এ গুলো হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশনা এবং বান্দাদের উদ্বুদ্ধ করণ, যাতে তারা দুনিয়া এবং আখেরাতের সমূহ প্রয়োজন একমাত্র তাঁর নিকট-ই প্রার্থনা করে এবং শিরকের দ্বার বদ্ধ রাখে।
প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া : মানুষ সর্বস্ব দিয়ে সে ব্যক্তির বশ্যতা শিকার করে যে, তার প্রয়োজন পূর্ণ করে। যে বান্দা আল্লাহ তাআলার প্রার্থনা পরিত্যাগ করে, অন্য কারো প্রার্থনায় মনোযোগী হল, সে মারাত্মক ভুল করল। সে এমন ব্যক্তির দ্বারস্থ হল যে এর উপযুক্ত নয়। এর বিপরীতে উপযুক্ত সত্তাকে সে পরিত্যাগ করল।
আল্লাহ তাআলার ধন-ভান্ডার পরিপূর্ণ, যা কখনো নিঃশেষ হবে না। আল্লাহ তাআলা হিসাব ছাড়া রিযিক প্রদান করেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য :
(১) কবুল হওয়ার পূর্ণ বিশ্বাস রেখে আল্লাহ তাআলাকে ডাকা এবং তাঁর প্রতি আস্থা রাখা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
ادعوا الله وأنتم موقنون بالإجابة . رواه الترمذي في الدعوات . السلسلة الصحيحة 594.
‘‘তোমরা কবুল হবে এরূপ বিশ্বাস রেখে আল্লাহ তাঅলাকে ডাক , প্রার্থনা কর।’’ [তিরমিযী]
(২) বিনয় ও নম্রতা নিয়ে আল্লাহ তাআলাকে অনুচ্চ-স্বরে আহবান করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :
ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ﴿الأعراف :55﴾
‘‘তোমরা তোমাদের রবকে ডাক, বিনীত হয়ে এবং সংগোপনে। তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’’ [আরাফ : ৫৫]
(৩) পূর্ণ আস্থা এবং দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহকে আহবান করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
إذا دعا أحدكم فليعزم المسألة، ولا يقل : اللهم إن شئت فأعطني . فإن الله لا مستكره له . رواه البخاري في الدعوات . باب ليعزم المسألة فإن الله لا مكره له .
‘‘যখন তোমাদের কেউ প্রার্থনা করে, সে যেন প্রার্থিত বিষয় কবুল হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করে। এ রকম বলবে না, হে আল্লাহ, তোমার ইচ্ছা হলে আমাকে প্রদান কর। কারণ, আল্লাহর উপর শক্তি প্রয়োগ করবে এমন কেউ নেই।’’ [বুখারী]
(৪) কবুল হওয়া নিয়ে তাড়াহুড়ো না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
يستجاب للعبد مالم يدع بإثم أو قطيعة رحم، ما لم يستعجل، قيل با رسول الله ! ما الاستعجال؟ قال : يقول : قد دعوت فلم أر يستجاب لي، فيستحسر عند ذلك، ويدع الدعاء . رواه مسلم في الذكر والدعاء , باب : بيان أنه يستجاب للداعي ما لم يستعجل .
‘‘বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত গুনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নতার দু‘আ না করে, তার দু‘আ কবুল হতে থাকে যদি তাড়াহুড়ো না করে। বলা হল : হে আল্লাহর রাসূল, তাড়াহুড়ো কি? তিনি বললেন : প্রার্থনাকারীর এমন মন্তব্য করা যে, আমি দু‘আ করেছি কিন্তু আমার দু‘আ কবুল হতে দেখিনি। তখন সে পরিশ্রান্ত হয়ে যায়, আর দু‘আ করা পরিত্যাগ করে দেয়।’’ [মুসলিম]
কুরআনুল করীম গভীর মনোযোগ সহ অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, এর প্রতিটি আয়াত আল্লাহর নিকট প্রার্থনার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। উদাহরণ স্বরূপ :
১. ইরশাদ হচ্ছে :
وَاسْأَلُوا اللَّهَ مِنْ فَضْلِهِ ﴿النساء :32﴾
‘‘তোমরা আল্লাহর নিকট তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর।’’ [নিসা : ৩২]
তিনি দয়ালু, তার কৃপা অসীম, রহমত অশেষ। অতএব, তোমরা তাঁর কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা কর, তিনি তোমাদের উপর অনুগ্রহ করবেন।
২. আললাহ অতি নিকটে, তিনি প্রার্থনা শ্রবণ করেন, কবুল করার ওয়াদা করেছেন ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখকরে তাঁর নিকট প্রার্থনার তালীম দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে :
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ﴿البقرة :186﴾
‘‘আর আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, বস্ত্তত, নিশ্চয় আমি নিকটেই রয়েছি। যারা প্রার্থনা করে তাদের প্রার্থনা কবুল করি, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে।’’ [বাক্বারা : ১৮৬]
অতএব সকলের উচিত তার কাছে দু‘আ করা। তিনি অতি নিকটে, দু‘আ কবুল করেন।
৩. যারা অহংকার করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে না, স্বীয় অভাব-অভিযোগ তার সামনে পেশ করে না, তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে- ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তওহীদের তালিম। ইরশাদ হচ্ছে :
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ﴿المؤمن / غافر :60﴾
‘‘তোমাদের রব বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। যারা অহংকার করে আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তারা অচিরেই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে দাখিল হবে।’’ [গাফের : ৬০]
অতএব সকলের কর্তব্য তার নিকট প্রার্থনা করা।
৪. একমাত্র আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, অন্য কারো নিকট প্রার্থনা না করা- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তওহীদের তালীম। ইরশাদ হচ্ছে :
إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقًا فَابْتَغُوا عِنْدَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ ﴿العنكبوت :17﴾
‘‘নিশ্চয় তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে প্রতিমার পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। নিশ্চয় আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। সুতরাং আল্লাহর কাছে রিযিক অনুসন্ধান কর, তার এবাদত কর এবং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তার কাছে-ই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’’ [আনকাবুত : ১৭]
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴿الملك :1﴾
‘‘বরকতময় তিনি যার হাতে রাজত্ব। এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।’’ [মূলক : ১]
الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا ﴿2﴾ وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آَلِهَةً لَا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ وَلَا يَمْلِكُونَ لِأَنْفُسِهِمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا وَلَا يَمْلِكُونَ مَوْتًا وَلَا حَيَاةً وَلَا نُشُورًا ﴿3﴾
‘‘যার রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব। তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি। রাজত্বে তাঁর কোন অংশীদার নেই। আর তিনি প্রত্যেক বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে। তারা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে যারা কিছুই সৃষ্টি করে না বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়, এবং নিজেদের ক্ষতি ও উপকারের ক্ষমতা রাখে না। এবং জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপরও কোন ক্ষমতা রাখে না। [ফুরকান : ২-৩]
সুতরাং তারা কোনভাবেই প্রার্থনার যোগ্য হতে পারে না।
৫. যারা মানুষের নিকট প্রার্থনা হতে বিরত থাকে আর আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে। তাদের সমর্থন ও প্রশংসার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তওহীদের তালিম।
ইরশাদ হচ্ছে :
لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا ﴿البقرة :273﴾
‘‘( দান-খয়রাত) ঐ সকল দরিদ্র লোকের জন্য যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে, জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র চলাফেরা করতে সক্ষম নয়। অজ্ঞ লোকেরা না চাওয়ার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে, তোমরা তাদেরকে তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি মিনতি করে ভিক্ষা চায়না।’’ [বাকারা : ২৭৩]
সুতরাং তাদের গুন অর্জন করা এবং মানুষের নিকট প্রার্থনা পরিহার করা।
এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে আরো অনেক আয়াত রয়েছে। যা বিভিন্ন পন্থায়, নানান পদ্ধতিতে মানবজাতিকে তালিম দিয়েছে, তোমরা আল্লাহকে ডাক, তার কাছে প্রার্থনা কর। একমাত্র তিনিই প্রার্থনার উপযুক্ত।
হাদীস গ্রন্থাবলিতেও এ বিষয়টি খুব সূক্ষ্ম ও সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ :
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের কাছে যাঞ্চনা করার অশুভ পরিণতি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, বরং এর প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে :
ما يزال الرجل يسأل الناس حتى يأتي يوم القيامة وليس في وجهه مزعة لحم . رواه البخاري في الزكاة، باب : من سأل الناس تكثرا، ورواه مسلم أيضا .
‘‘যে ব্যক্তি মানুষের নিকট ভিক্ষা করে বেড়ায়, সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উপনীত হবে যে, তার চেহারায় একটি গোস্তের টুকরাও নেই।’’ [বুখারী ও মুসলিম]
সুতরাং মানুষের কাছে ভিক্ষা করা, নিজের উপর অভিশাপ ডেকে আনারই নামান্তর।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন, যাতে কেউ ভিক্ষার জন্য মানুষের দ্বারস্থ না হয়।
ইরশাদ হচ্ছে :
لأن يأخذ أحدكم حبله ثم يغدو فيحتطب، فيبيع فيأكل ويتصدق خير له من أن يسأل الناس . رواه البخاري في الزكاة .
‘‘তোমাদের কেউ সকালে রশি নিয়ে বের হয়ে লা-কড়ি সংগ্রহ করা অত:পর তা বিক্রি করে আহার করা এবং সদকা করা মানুষের নিকট হাত পেতে ভিক্ষা করার চেয়ে অনেক উত্তম।’’ [বুখারী]
৩. যে ব্যক্তি মানুষের কাছে হাত পাতা হতে বিরত থাকবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য প্রতিদান স্বরূপ জান্নাতের সুসংবাদ দান করেছেন। সাওবান রা. বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
من تكفل لي أن لايسأل الناس شيئا فأتكفل له بالجنة؟ فقلت : أنا، فكان لايسأل أحداً شيئاً . رواه أبوداود في زكاة الفطر .
কে আমাকে এই নিশ্চয়তা দেবে যে, সে মানুষের কাছে মোটেও হাত পাতবে না ফলে আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব ? তখন আমি বললাম, ‘আমি’। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর তিনি কারো কাছে কোন কিছুর জন্য হাত পাতেননি।’’ [আবু দাউদ]
৪. ভিক্ষাবৃত্তির শিকড় উৎপাটনের জন্য তাঁর আগ্রহ এমন পর্যায়ে ছিল যে, তিনি এ জন্য সাহাবাদের থেকে বায়আত পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন।
‘আউফ বিন মালেক আশজা‘য়ী রা. বলেন, আমরা নয়, আট কিংবা সাত জনের মত লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম, তিনি বললেন :
ألا تبايعون؟
‘‘তোমরা কেন আমার বায়আত গ্রহণ করছ না?’’ সাহাবী বলেন, অথচ আমরা ইতোমধ্যে বায়আত গ্রহণ করেছি। তাই, আমরা বললাম হে আললাহর রাসূল, (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমরা তো আপনার বায়আত গ্রহণ করেছি। পুনরায় বললেন, তোমরা কেন আল্লাহর রাসূলের বায়আত গ্রহণ করছ না? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমরা তো আপনার বায়আত গ্রহণ করেছি। পুনরায় বললেন : তোমরা কেন আল্লাহর রাসূলের বায়আত গ্রহণ করছ না? অতঃপর আমরা হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং বললাম: আমরা তো আপনার বায়আত গ্রহণ করেছি। অতএব এখন কীসের উপর বায়আত গ্রহণ করব? তিনি বললেন : শুধু এর উপর যে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে, তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে ও তাঁর আনুগত্য করবে। একটি কথা খুব ক্ষীণ আওয়াজে বললেন, ‘মানুষের কাছে কোন জিনিস চাইবে না’’ বর্ণনাকারী বলেন : আমি সে মজলিসে উপস্থিত কতিপয় ব্যক্তিকে দেখেছি, তাদের কারো হাত ফসকে চাবুক পড়ে গেলেও উঠিয়ে দেয়ার জন্য অন্য কাউকে অনুরোধ করতেন না।’’ [মুসলিম]
৫. তাওহীদের এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে ছোট বাচ্চাদেরও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব যত্ন সহাকরে শিক্ষা দিতেন। যেমন তিনি সাত বছরের বাচ্চাদের নামাযের হুকুম করতেন। লক্ষ্য করুন ইবনে আববাসকে কীভাবে তাওহীদ শিক্ষা দিচ্ছেন। অথচ তখনও সে ছোট ছেলে মাত্র।
يا غلام ! إني أعلمك كلمات : احفظ الله يحفظك، احفظ الله تجده تجاهك، إذا سألت فاسأل الله، وإذا استعنت فاستعن بالله .
‘‘হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিক্ষা দিচ্ছি, তুমি আল্লাহকে হেফাজত কর (তাঁর বিধিনিষেধ মান্য কর) আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। যখন চাইবে, একমাত্র আল্লাহর নিকটই চাইবে। আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করবে।
আরো গুরুত্ব সহকারে বোঝাচ্ছেন :
واعلم أن الأمة لو اجتمعت على أن ينفوك بشيء لم ينفعوك إلا بشيء قد كتبه الله لك، وإن اجتمعوا على أن يضروك بشيء لم يضروك إلا بشيء قد كتبه عليك، رفعت الأقلام، وجفت الصحف . رواه الترمذي في صفة القيامة .
‘‘জেনে রাখ, সমস্ত মানুষ একত্রিত হয়ে যদি তোমার কোন উপকার করতে চায়, কোন উপকার করতে পারবে না। তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর তারা সকলে একত্রিত হয়ে যদি তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং কিতাব শুকিয়ে গেছে।’’ [তিরমিযী]
৬. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি মুহূর্তকে তাওহীদের মূলনীতি শিক্ষার দেয়ার জন্য গনিমত মনে করতেন। গায়রুল্লাহর নিকট যাঞ্চনা করার চেয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রার্থনা করার উপকারিতা বর্ণনা করতেন। তিনি বলেন:
من نزلت به فاقة فأنزلها بالناس لم تسد فاقته، ومن نزلت به فاقة فأنزلها بالله فيوشك الله له برزق عاجل أو آجل . رواه الترمذي في الزهد .
‘‘যার উপর অভাব আপতিত হল, আর সে তা মানুষের সামনে তুলে ধরল, তার অভাব কখনো মোচন হবে না। আর যে ব্যক্তির উপর অভাব দেখা দিল, আর সে তা আল্লাহ তা‘আলার সামনে তুলে ধরল, খুবই সম্ভব আল্লাহ তার জন্য শীঘ্র প্রদত্ত কিংবা বিলম্বে প্রদত্ত রিযিকের ব্যবস্থা করবেন।’’ [তিরমিযী]
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, কয়েকজন আনসার সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কিছু চাইল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রদান করলেন। তারা পুনরায় চাইল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দিলেন। তারা আবারও চাইল তিনি আবারও দিলেন।এক সময় তার কাছে যা ছিল, সব নিঃশেষ হয়ে গেল। অতঃপর বললেন :
ما يكون عندي من خير فلن أدخره عنكم، ومن يستعفف يعفه الله، ومن يستغن يغنه الله، ومن يتصبر يصبره الله، وما أعطي أحد عطاء خيرا وأوسع من الصبر . رواه البخاري في الزكاة .
‘‘আমার নিকট কোন মাল-সম্পদ থাকলে এমন হয় না যে,আমি তোমাদের না দিয়ে জমা করে রাখি। তবে যে পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন। আর যে অমুখাপেক্ষী হতে চায় আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করে দেন। যে ধৈর্যধারণ করতে চায়, আল্লাহ তাকে ধৈর্যধারণ করার তওফীক দেন। ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও বিশাল পুরস্কার কাউকে প্রদান করা হয়নি।’’ [বুখারী]
সাহাবায়ে কেরাম রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপদেশ হতে খুব ভাল করেই উপকৃত হয়েছেন। ফলে তাওহীদের এ মূলনীতি তাদের হৃদয়ে বদ্ধ-মূল হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা কারো কাছে কোন জিনিস প্রার্থনা করতেন না। যেমন এ নিবন্ধে উল্লেখিত আউফ ও সওবান হতে বর্ণিত হাদীসে বিবৃত হয়েছে।
একদা হাকীম বিন হিযাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে কিছু প্রার্থনা করলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দান করেন। সে পুনরায় যাঞ্চনা করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে পুনরায় দান করেন।সে আবারও চাইলে রাসূলুল্লাহ তাকে আবারও দান করেন। অতঃপর বললেন :
يا حكيم ! إن هذا المال خضرة حلوة، فمن أخذه بسخاوة نفس بورك له فيه، ومن أخذه بإشراف نفس، لم يبارك له فيه، كالذي يأكل ولايشبع . اليد العليا خير من اليد السفلى .
‘‘হে হাকীম, এ সম্পদ হল সবুজ সুমিষ্ট। যে একে মনের বদান্যতা গ্রহণ করবে, সেটি তার জন্য বরকতময় হবে। আর যে একে মনের লালসা নিয়ে গ্রহণ করবে, তার জন্য বরকতময় হবে না। ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে খায় কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না। উপরের হাত নীচের হাতের তুলনায় উত্তম।
অর্থাৎ দানশীলের হাত দান গ্রহণকারীর হাতের চেয়ে উত্তম। হাকীম বলেন :আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, ঐ সত্তার কসম, যে আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত আপনার পর আর কারো নিকট কোন জিনিসের জন্য শরণাপন্ন হব না। আবু বকর রা. হাকীমকে বায়তুলমাল হতে অনুদান নেয়ার জন্য ডেকে পাঠালেন, তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর ওমর রা. তাকে দেয়ার জন্য ডেকে পাঠালেন, তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। অত:পর ওমর রা. বলেন :
إني أشهدكم يا معشر المسلمين على حكيم، أني أعرض عليه حقه من هذا الفيء فيأبى أن يأخذه . رواه البخاري في الزكاة .
‘‘হে মুসলিম জাতি, আমি তোমাদেরকে হাকীমের ব্যাপারে সাক্ষ্য রাখছি, আমি এ ফায় (সন্ধি সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ) হতে তার প্রাপ্য পেশ করছি, আর সে তা প্রত্যাখ্যান করছে।’’ [বুখারী]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর হাকীম মৃত্যু পর্যন্ত কোন মানুষের দ্বারস্থ হননি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথায় ও কাজে বাস্তবায়ন না করে সাহাবাদেরকে কোন বিষয়ে নির্দেশ দিতেন না। এ জন্য তার নির্দেশ তাদের অন্তকরণে ও আচার ব্যবহারে গভীরভাবে প্রভাব সৃষ্টি করত। হিজরতের সময় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরোহণের জন্য একটি উট পেশ করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মূল্য বিহীন গ্রহণ কতে অস্বীকার করেন। [বুখারী]
এভাবেই সাহাবায়ে কেরাম এক স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করা এবং সৃষ্টি জীবের নিকট প্রার্থনা না করার দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছেন। এমনকি রাসূলের নিকটও তারা পার্থিব কোন জিনিস প্রার্থনা করতেন না। তারা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করতেন। সর্ব প্রথম তাঁরই শরণাপন্ন হতেন।
পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে যখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহার পবিত্রতা ও নির্দোষিতা প্রমাণিত হল, তখন তার মা তাকে বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যাও, কৃতজ্ঞতা সহ তার সকাশে উপস্থিত হও। তিনি বললেন :
والله لا أقوم إليه . ولا أحمد إلا الله، هو الذي أنزل براءتي . رواه مسلم في كتاب التوبة
‘‘আল্লাহর কসম, আমি তাঁর নিকট যাব না।এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসা করব না। তিনিই আমার নিরপরাধ হওয়া বিষয়ে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।’’ [মুসলিম]
কা’ব ইবনে মালেকের তাওবা কবুলের আয়াত অবতীর্ণ হলে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেন :
أمن عندك أم من عند الله؟ قال : بل من عند الله . رواه مسلم في التوبة
‘‘এটি আপনার পক্ষ হতে, না আল্লাহর পক্ষ হতে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; বরং আল্লাহর পক্ষ হতে।’’ [মুসলিম]
এ প্রশ্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগান্বিত হননি। তার ও আয়েশার অবস্থানকে বেয়াদবী জ্ঞান করেননি। তিনিই তাদের এ নীতির উপর লালন করেছেন।
তাছাড়া এখানে বেয়াদবীরও কিছু ছিল না। বরং এটা ছিল আল্লাহ তাআলার সাথে পরিপূর্ণ শিষ্টচার প্রদর্শন। কারণ, কারো পক্ষেই আল্লাহর হকের উপর অন্য কারো হকের অগ্রাধিকার দেয়া উচিত নয়। যদিও তিনি নবী হন।
শীর্ষস্থানীয় সাহাবাদের নীতি ছিল, তারা নিজেদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কোন কিছুই প্রার্থনা করতেন না। এ ছিল পার্থিব বিষয়ের ব্যাপারে। আর ধর্মীয় ব্যাপারে তারা তাঁর নিজের পক্ষ থেকে বলার অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁর সামনে কেউ অগ্রণী হয়ে কথা বলতেন না। তাদের আদবের এমন অবস্থা ছিল যে, মাত্র চৌদ্দটি প্রশ্ন ব্যতীত তারা কোন প্রশ্নই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে করেনি। আর সবকটি প্রশ্ন-ই কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে। উদাহরণত : আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ ... ﴿البقرة :215﴾
‘‘তারা তোমার কাছে জিজ্ঞেস করবে, তারা কি সদকা করবে?...’’ [বাকারা : ২১০]
তবে হ্যাঁ, যে সকল সাহাবা পরিপূর্ণ রূপে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহচর্য গ্রহণ করতে পারেননি, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পার্থিব জিনিসও প্রার্থনা করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে সহনশীলতা প্রদর্শন করতেন, তাদের শিক্ষা দিতেন। ভাল এবং উত্তম জিনিসের দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন।
উসমান বিন হানীফ হতে বর্ণিত : দৃষ্টিহীন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসেন। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আমার সুস্থতার জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন। নবীজী বললেন :
إن شئت دعوت لك، وإن شئت صبرت فهو خير لك .
‘‘তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দু‘আ করে দিব। আবার ইচ্ছা হলে ধৈর্যও ধারণ করতে পার।আর ধৈর্যই তোমার জন্য উত্তম।’’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দু‘টি জিনিসের একটি বেছে নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সাথে সাথে ধৈর্য ধারণ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। আর ধৈর্যকে এভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, দু‘আর বিপরীতে তার জন্য ধৈর্য ধারণ করাই উত্তম। তা সত্ত্বেও সে বলেছে আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে ভাল করে ওজু করার নির্দেশ দিলেন। এবং দু‘রাকাত সালাত আদায় করতে বললেন। অতঃপর এভাবে দু‘আ করতে বললেন।
اللهم إني أسألك وأتوجه إليك بنبيك محمد نبي الرحمة، يا محمد إني توجهت بك إلى ربي في حاجتي هذه، لتقضى لي . اللهم فشفعه فيّ . رواه الترمذي في الدعوات .
‘‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি এবং আপনার নবী, রহমতের নবী, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। হে মুহাম্মদ! আমি আপনার মাধ্যমে আমার এ প্রয়োজন আমার প্রভুর নিকট তুলে ধরেছি, যাতে আমার প্রয়োজন পূর্ণ হয়। হে আল্লাহ! আমার দু‘আর ব্যাপারে আপনি তার সুপারিশ কবুল করুন।’’ [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এবং শুধু তার নিকটই আবেদন নিবেদন জানাতে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু যখন সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দু‘আর জন্য পীড়াপীড়ি করেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাকে এমন জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন, যার মধ্যে তার কল্যাণ নিহিত রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় দু‘আর সাথে তাকেও দু‘আর করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এর শিক্ষা। তাকে আল্লাহর শরণাপন্ন হতে বলেছেন। যাতে সে কারো দু‘আকে যথেষ্ট মনে না করে, যদিও সে দু‘আকারী একজন রাসূল হন।
আরেকটি ঘটনা:
মৃগী রোগাক্রান্ত জনৈকা মহিলা আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যেত। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দু‘আর জন্য আবেদন জানাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন :
إن شئت صبرت ولك الجنة، وإن شئت دعوت الله أن يعافيك . رواه البخاري في المرضى .
‘‘তুমি চাইলে ধৈর্যধারণ করতে পার, বিনিময়ে জান্নাত পাবে। আর যদি চাও, সুস্থতার জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করে দেই।’’ [বুখারী]
এটাও পূর্বের মত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দু‘আ বা ধৈর্যের যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। সাথে সাথে ধৈর্যধারণ ও আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ, এটাই তার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দু‘আর তুলনায় বেশি উত্তম। এ ধরনের দৃষ্টান্ত আরো অনেক আছে।
উপরোক্ত ঘটনাসমূহের প্রত্যেকটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের অন্তরসমূহ আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন। যে কোন প্রসঙ্গে তাদেরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট প্রার্থনা না করার দীক্ষা দিয়েছেন। কারণ, এটি ঈমান ও দ্বীনের মৌলিক একটি অধ্যায়, এ ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব প্রদান করাই হচ্ছে আল্লাহর বিধান।
এতক্ষণ আমরা লক্ষ্য করলাম যে, মানুষের অন্তরে এ মূলনীতিটি বদ্ধ মূল করতে শরীয়ত কি পরিমাণ গুরুত্ব আরোপ করেছে। কুরআন হাদীসের একজন গবেষক, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নবীগণের জীবন চরিতের একজন পর্যালোচক খুব সহজেই এ মূলনীতি সম্পর্কে অবগত হতে পারেন যে,
أصل التوحيد سؤال الله وأصل الشرك سؤال غير الله تعالى .
‘‘তাওহীদের মূল আবেদন আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, আর শিরকের মূল আবেদন গায়রুল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।’’
এ মহৎ নীতিটি সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে হৃদয়ংগম করেছিলেন বিধায় তাদের ভিতর পার্থিব স্বার্থকে কেন্দ্র করে পরস্পর ঝগড়া-ফ্যাসাদ, হানা-হানি,মারামারি ইত্যাদি সংঘটিত হয়নি। সকল চাওয়া-পাওয়াকে তারা এক আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে ছিলেন। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাললাম এর ওফাতের পরও তাদের ঈমানের ভিতর ক্ষুদ্রতম ফাটল পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের পরপরই তাঁর প্রথম ছাত্র আবু বকর রা. উপস্থিত সকল জনতার সামনে বক্তৃতার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বলেন :
أما بعد : من كان منكم يعبد محمدا، فإن محمدا قد مات، ومن كان منكم يعبد الله فإن الله حي لا يموت .
‘‘...তোমাদের যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইবাদত করতে, মুহাম্মাদ নিশ্চিত মারা গেছেন, আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে, আল্লাহ চিরঞ্জীব, মৃত্যু বরণ করেন না।’’
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ ﴿آل عمران :144﴾
‘‘আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ তো নয়। তার পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। অতএব যদি সে মৃত্যু বরণ করে অথবা নিহত হয়, তবে কি তোমরা পশ্চাতে ফিরে যাবে? বস্ত্তত: কেউ যদি পশ্চাতে ফিরে যায়, তাতে আল্লাহর সামান্য ক্ষতিও হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।’’ [আলে ইমরান : ১৪৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদত এবং সব বিষয়ে তার নিকট প্রার্থনা করার জন্য দীক্ষা প্রদান করতেন। হাদীসে এসেছে:
ليسأل أحدكم ربه في حاجاته كلها، حتى شسع نعله إذا انقطع . رواه الترمذي من حديث أنس .
‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই যেন নিজেদের প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস স্বীয় রবের নিকট প্রার্থনা করে, এমনকি জুতার ফিতাও যদি ছিঁড়ে যায়’’ [তিরমিযী]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের সময় সাহাবাদের অন্তরসমূহ সে আল্লাহর সাথেই সম্পৃক্ত ছিল, যিনি চিরঞ্জীব, কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না। ফলে তার মৃত্যুর পর কঠিনভাবে ধৈর্য ধারণ করেন এবং দ্বীনের দায়িত্ব হাতে নিয়ে দৃঢ়পদে দন্ডায়মান হন। যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এ দীক্ষায় দীক্ষিত না করতেন, তবে তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর প্রচারিত দ্বীনও নিঃশেষ হয়ে যেত। ইসলাম কখনো এ মর্যাদায় উন্নীত হত না।
সাহাবায়ে কেরাম সারাজীবন আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব, তাঁর উপর পূর্ণ আস্থা এবং প্রতিটি ছোট বড় জিনিসের ব্যাপারে তার নিকট প্রার্থনা করার বিধানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তারা এমন আস্থা, ত্যাগ, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার নমুনা পেশ করেছেন, ইতিহাস যার উদাহরণ পেশ করতে অপরাগ, অক্ষম।
সেনাপতি আবু উবাইদা রা. ইয়ারমুকের যুদ্ধের বছর কাফেরদের মোকাবেলায় সাহায্য চেয়ে ওমর রা. এর নিকট পত্র লিখেন। তিনি লিখেন যে, তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য গোটা শত্রু বাহিনী এক যুগে অবতীর্ণ হয়েছে, যাদের মোকাবেলা করার শক্তি আমাদের নেই। তার পত্র পৌঁছা মাত্র উপস্থিত সকলে কেঁদে ফেলেন, যাদের মধ্যে আব্দুর রহমান বিন আউফও ছিলেন। তিনি ওমর রা. কে আরো সৈন্যবাহিনী নিয়ে বের হতে পরামর্শ দিলেন। ওমর রা. ভেবে দেখলেন, এটা অসম্ভব। অতএব আবু উবাইদাহ রা. এর নিকট পত্র লিখলেন :
مهما ينزل بامرئ مسلم من شدة، فينزلها بالله، يجعل الله له فرجا ومخرجا، فإذا جاءك كتابي هذا فاستعن بالله وقاتلهم . رواه مالك في المؤطأ في الجهاد .
‘‘মুসলিম জাতির সামনে যখন কোন মুসীবত অবতীর্ণ হয়, আর সে তা আল্লাহ তাআলার নিকট পেশ করে, আল্লাহ তার জন্য মুক্তি ও নাজাতের ব্যবস্থা করে দেন। যখন তোমার নিকট আমার এ পত্র পৌঁছোবে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাদের সাথে জেহাদে অবতীর্ণ হবে।’’ [মুয়াত্তা ইমাম মালেক]
অবশ্য ওমর রা. এর অবস্থানকে অনেকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়াই গণ্য করবে। কিন্তু ওমর রা. জানতেন যে, সাহায্য একমাত্র আল্লাহ তাআলারই পক্ষ হতে। তার অন্তরও এ দীক্ষায় দীক্ষিত ছিল। আবু উবাইদাহ রা. প্রেরিত পত্র পেয়েও তিনি এ বিশ্বাস থেকে সামান্যও বিচ্যুত হননি। জানতেন, আল্লাহ তাআলার সাহায্যই সবার উপরে। বিধায় তিনি যা বলেছেন পূর্ণ আস্থা আর দৃঢ় ঈমান থেকেই বলেছেন।
এযাবৎ আমরা আলোচিত বিষয়ে শরীয়তের উৎস ও সাহাবাদের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছি। এখন আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করার উপকারিতা এবং সৃষ্টি জীবের নিকট যাচ্ঞা করার অপকারিতা সম্পর্কে আলোকপাত করব। যার মাধ্যমে আমরা পূর্বে বর্ণিত মূল নীতির সত্যতা এবং শরীয়ত কর্তৃক আনীত বিধানের সাথে এর সামঞ্জস্যতা জোরালো ও দৃঢ় ভাবে প্রমাণ করব।
যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করার অভ্যাস গড়ে তুলবে, সে দু’টি বড় নেয়ামত লাভে ধন্য হবে।
প্রথমত : আল্লাহর সাথে মোনাজাতের স্বাদ।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহ তাআলার মহববত।
মোনাজাত প্রসঙ্গ : মানুষের প্রয়োজনের শেষ নেই, সমস্যার অন্ত নেই। তাই সে যদি সব সময় আল্লাহর শরণাপন্ন হয়, তার নিকট প্রার্থনা করে, তার কাছেই স্বীয় অভাব অভিযোগ তুলে ধরে, তার অন্তর আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাবে। আল্লাহর পরিচয়ের নতুন দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত হবে। তার সামনে আস্তে আস্তে আল্লাহর রহমত, করুণা ও ঈমানের সে সব অধ্যায়সমূহ খুলে যাবে, যা সে জানতো না। আরো অর্জিত হবে ঈমানের স্বাদ, মুনাজাতের তৃপ্তি ও অন্তকরণের প্রশান্তি। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে না, সে আল্লাহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আল্লাহর সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়, মাখলুকের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। যা মুসীবত, নিপীড়ন, কষ্ট ও মানুষিক ব্যাধি ভিন্ন কিছুই নয়। আব্দুল্লাহ বিন আউন এর বাণী :
ذكرالناس داء، وذكر الله دواء . سير أعلام النبلاء 6/369 ، قال الذهبي عقبه : إي والله ! فالعجب منا ومن جهلنا، كيف ندع الدواء، ونقتحم الداء، قال الله – تعالى -: فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ ﴿البقرة :152﴾ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ ﴿العنكبوت :45﴾ وذكر ابن القيم في الوابل الصيب (99) عن مكحول قوله : ذكر الله شفاء، وذكر الناس داء .
‘‘মানুষের যিকির হচ্ছে ব্যাধি আর আল্লাহর যিকির হচ্ছে ঔষধ। আল্লামা যাহাবী রহ. এর পশ্চাতে বলেন : আল্লাহর শপথ! আশ্চর্য হচ্ছে আমাদের উপর ও আমাদের মূর্খতার উপর। আমরা কীভাবে ঔষধ প্রত্যাখ্যান করছি আর ব্যাধি গ্রহণ করছি। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব।’ [বাকারা : ১৫২]
তিনি আরো বলেন : ‘আল্লাহর জিকিরই হচ্ছে সব চেয়ে বড় জিনিস।’ [আনকাবুত : ৪৫] ইবনুল কাইয়্যিম রহ. উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর স্মরণ রোগ মুক্তি ও মানুষের স্মরণ ব্যাধি।’’ [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা]
হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলার সাথে এ ধরনের সম্পর্ক, তার প্রতি গভীর মনোযোগ মানব হৃদয়ে প্রশান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়। যেমন আল্লাহর এক বান্দা স্বীয় উপলব্ধি ব্যক্ত করে বলেছেন :
إنه ليكون لي إلى الله حاجة، فأدعوه، فيفتح لي من لذيذ معرفته، وحلاوة مناجاته، ما لاأحب معه أن يعجل قضاء حاجتي، خشية أن تنصرف نفسي عن ذلك، لأن النفس لا تريد إلا حظها، فإذا قضت انصرفت . مجموع الفتاوى 10/333
‘‘আমার যখন কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, আমি আল্লাহকে আহবান করি, তার দরবারে হাজিরা দেই, ফলে তাঁর সাথে মোনাজাতের স্বাদ, তাঁর সাথে কথোপকথনের মিষ্টতার দ্বার আমার জন্য খুলে যায়। যার বিপরীতে আমার প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে যাওয়াটাও পছন্দের মনে করি না, পাছে আমার একাগ্রতা দূর হয়ে যায়। কারণ, নফস্ খুবই আরাম প্রিয়। যখন উদ্দেশ্য সফল হবে, আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। [মাজমাউল ফাতাওয়া]
আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন :
فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا ﴿النساء :19﴾
‘‘সম্ভবত তোমরা এমন এক বস্ত্তকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’’ [নিসা : ১৯]
আল্লাহ তাআলার মহববত প্রসঙ্গ : মানুষ যখন গায়রুল্লাহকে বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করে, আর আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন, তখন সে আল্লাহ তাআলাকে অন্যভাবে চিনতে পারে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা মানুষের মঙ্গলজনক সব দু‘আই কবুল করেন। তিনি বান্দার জন্য কল্যাণকর কোন দু‘আ ব্যর্থ হতে দেন না। অধিকন্তু সে আরো উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ তাআলা কত সুন্দরভাবে তাকে মূল্যায়ন করছেন। দু‘আর ফলে কখনো তার প্রার্থিত বস্ত্ত প্রদান করবেন, কখনো তার উপর থেকে বালা-মুসীবত দূর করে দেবেন আবার কখনো আখেরাতের পুঁজি হিসেবে এ দু‘আর সওয়াব তার জন্য জমা করে রাখবেন। হাদীস শরীফে আছে, প্রার্থনাকারীকে তিনটি জিনিসের যে কোন একটি অবশ্যই প্রদান করা হয়।
إما أن يعجل له بالإجابة، وإما أن يصرف عنه من السوء مثلها، وإما أن يدخر له . رواه الترمذي في الدعوات، باب : انتظار الفرج، وباب : ماجاء أن دعوة المسلم مستجابة، وفي الموطأ، في القرآن، باب ماجاء في الدعاء .
‘‘হয়তো সাথে সাথে তার দু‘আ কবুল করা হয়। অথবা দু‘আ কবুলের বিপরীতে তার থেকে মুসীবত দূর করে দেয়া হয়। অথবা দু‘আর সওয়াব আখেরাতে তার জন্য জমা করে রাখা হয়।’’ [তিরমিযী]
দু‘আর এ মহান ও নিশ্চিত পুরস্কারের ফলে মানব হৃদয়ে আল্লাহর মহববত ও ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। এর দ্বারা তার নিকট আল্লাহ তাআলার দয়া, মহানুভবতা, দানশীলতা, স্নেহশীলতা, ক্ষমা ও রিযিক প্রদানের বিষয়টি স্পষ্ট করে ফুটে উঠে। আর স্বাভাবিকভাবেই মানুষ অনুগ্রহকারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করা স্বীয় অভ্যাসে পরিণত করবে, সে নিত্য নতুন আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যক্ষ করবে। মানুষ তথা সৃষ্টি জীবের নিকট প্রার্থনা করলে এর কিঞ্চিৎও অর্জিত হয় না বরং তার মধ্যে রয়েছে অনেক অনিষ্ট, অপমান ও কষ্ট। যেমন :
প্রথমত : মানুষের কাছে প্রার্থনা অন্তরে আঁধার ও কালিমার জন্ম দেয়। কারণ, তার নিকট কিছু চাওয়ার অর্থ হল, যালেম-জাহুল তথা অত্যাচারী-অজ্ঞ সত্তার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। আর যে ব্যক্তি যালেম-জাহুলের সাথে সম্পর্ক করবে তার অন্তরে আঁধার ও মূর্খতারই সৃষ্টি হবে।
দ্বিতীয়ত : তারা যদি তার ডাকে সাড়াও দেয়, তবুও তাদের সাথে মহববত, বিনয় ও আনুগত্যের সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার সম্পর্কের সাথে চিড় ধরায়।
তৃতীয়ত : প্রার্থনাকারী সর্বদা অনুগ্রহকারীর কৃতজ্ঞতার বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়ায়, তার বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এটা এক ধরনের দাসত্ব, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সমীচীন নয়।
চতুর্থত : কারো থেকে অনুদান গ্রহণকারীর জন্য জরুরি, সে অনুদানের প্রতিদান দেয়া। প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হলে কার্যত গোলামে পরিণত হতে বাধ্য হয়। এমনি পরিস্থিতির শিকার জনৈক ব্যক্তি বলেছেন :
ما وضعت يدي في قصعة أحد إلا ذللت له . الفتاوى 1/98
‘‘আমি যখনই কারো পাত্রে আমার হাত রেখেছি, তখন বাধ্য হয়েই তার বশ্যতা মেনে নিয়েছি।’’ [মাজমাউল ফাতাওয়া]
অন্য এক ব্যক্তি বলেছেন :
احتج إلى من شئت تكن أسيره، واستغن عمن شئت تكن نظيره، وأحسن إلى من شئت تكن أميره . الفتاوى 1/39
‘‘তুমি-ই সিদ্ধান্ত নাও কি করবে? যদি কারো মুখাপেক্ষী হও, তার গোলামে পরিণত হবে। আর যদি তুমি নিজেকে তুষ্ট কিংবা অভাব মুক্ত মনে কর, সবার বরাবর হয়ে যাবে। আর যদি কারো প্রতি দয়া কর, তার আমীরে পরিণত হবে।’’ [মাজমাউল ফাতাওয়া]
অনেক সময় তাদের প্রতিদান দেয়ার সুযোগ হলেও, দ্বীনকে বিসর্জন দিতে হয়, দ্বীনের আনুষঙ্গিক বিষয়বস্ত্ত পরিত্যাগ করতে হয়। আবার এতটুকু ক্ষতি ছাড়া তাদের প্রতিদান দিতে সক্ষম হলেও, এ সময়টুকু আল্লাহ হতে দূরে সরে থাকার ক্ষতিই কম কীসের? বরং এ সময় যদি আল্লাহর নিকট রিযিক চাওয়া হত, তার নিকট প্রার্থনা করা হত, তবেই তো অনেক ভাল ছিল।
পঞ্চতম : আমাদের বর্ণিত ক্ষতির সম্ভাবনা তখন, যখন তারা প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করবে। আর তারা যদি তার আবেদন নাকচ করে দেয়, তবে সৃষ্টি হবে অবিশ্বাস, ঝগড়া, বিচ্ছিন্নতা, পরস্পর হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি। পিছনে দেখা গেছে কারো অভাব পূরণ না করার ফলে, অনেক শত্রুতার জন্ম হয়েছে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, সুসম্পর্ক নষ্ট হয়েছে ইত্যাদি।
ষষ্ঠত : মানুষের নিকট প্রার্থনা করার অর্থ মানুষকে মানুষের দাসে রূপান্তরিত করা। আর এটাই মানব জাতির সবচেয়ে বড় অধঃপতন। পক্ষান্তরে ইসলাম মানুষের দাসত্ব বিলুপ্ত ও কুফরের শাখা প্রশাখা রুদ্ধ করার জন্য আগমন করেছে। এ জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন : স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মধ্যস্থতার ধারণা রহিত করেছে। সরাসরি তার নিকট প্রার্থনা জানাতে নির্দেশ দিয়েছে। প্রধানত দু’টি কারণে মধ্যস্থতা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে।
প্রথমত : দাসত্ব এবং ইবাদত যাতে একমাত্র আল্লাহর তাআলার জন্যই সংরক্ষিত থাকে।
দ্বিতীয়ত : মানুষ যাতে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও কবুলিয়তের মুহূর্ত হতে বঞ্চিত না হয়। এর সামান্য ব্যাখ্যা নিম্নে তুলে ধরা হল :
মানুষ বিগলিত হৃদয় ও বিনয়াবনত দু’টি অবস্থায় হয়ে থাকে।
এক : গুনাহ করার পর।
দুই : প্রয়োজনের মুহূর্তে।
গুনাহ পরবর্তী হালত : গুনাহ সংঘটিত হওয়ার পর কৃতকর্মের অনুশোচনা, নফসের হীনতা, আল্লাহর ভয় ও লজ্জার অনুভূতি তাকে ব্যাকুল-বিহবল ও আবিষ্ট করে তুলে। এ মুহূর্তটি আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন ও তার নিকট ক্ষমা ভিক্ষার সফল মোক্ষম সময়। কারণ, আল্লাহ তার বান্দার ভগ্ন হৃদয়, বশ্যতা ও বিনম্রতাকে খুব পছন্দ করেন। অহমিকা, অহংকার ইত্যাদিকে অপছন্দ করেন। যে আল্লাহর নিকট ভগ্ন হৃদয় ও নম্রতা নিয়ে উপস্থিত হবে, আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন। সুতরাং বান্দার উচিত গুনাহের পর লজ্জা ও ভগ্নতার মুহূর্তগুলোকে আল্লাহ তাআলার নিকট গুনাহ মার্জনার প্রার্থনায় লিপ্ত হওয়া।
এ দিকে শয়তান ওৎপেতে থাকে দু‘আ কবুলের এ মুহূর্তটি লুফে নেয়ার জন্য। যাতে সে এ সময় আল্লাহর দরবারে দু‘আ না করে এবং তার দু‘আও কবুল না হয়। সে তাকে প্ররোচিত করে শিক্ষা দেয়, তুমি গুনাহ্গার তোমার দু‘আ কবুল হবে না ইত্যাদি। এ ফন্দির মাধ্যমেই সে পূর্বেকার লোকদের মুশরিক বানিয়েছিল। তাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়েছে যে, আল্লাহ গুনাহ্গারদের দু‘আ কবুল করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত নেককার পবিত্র আত্মাদের মাধ্যমে তওবা না করা হয়। তারা শয়তানের ফাঁদে পা দিল। ফলে তারা ক্ষমা, কবুলিয়ত ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মুহূর্ত হতে বঞ্চিত হল। তারা গায়রুল্লাহর শরণাপন্ন হয়ে, তাদের মাধ্যম বানিয়ে এবং তাদের নিকট সুপারিশ ও শাফায়াতের অন্তরালে শিরকের ভিতর লিপ্ত হল।
তাদের এক দল এখনও মাজার ও আউলিয়াদের বেলায়েতের নামে ইবাদত করে। তাদেরকে আল্লাহ ও সৃষ্টির মাঝে মাধ্যম হিসেবে জ্ঞান করে, যা হুবহু মুশরিকদের কর্ম কান্ড সদৃশ,আল্লাহ তাআলা যাদের কর্ম অপছন্দ করেন, যাদেরকে কাফের বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ ﴿يونس :18﴾
‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্যের উপাসনা করে, যারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে না। তারা বলে এরা তো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী মাত্র। তুমি বল, তোমরা কি আল্লাকে এমন বিষয় অবহিত করছ, আসমান ও যমীনরে মাঝে যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন? তিনি পুত পবিত্র ও মহান সে সমস্ত থেকে যাকে তোমরা শরীক করছ।’’ [ইউনুস : ১৮]
বান্দা যত গুনাহ করুক আল্লাহ তাআলা তার প্রার্থনা কবুল করেন।
আল্লাহ তাআলা কি ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করেননি যে একশত মানুষ হত্যা করেছিল? [বুখারী]
আল্লাহ তাআলা কি ঐ ব্যভিচারিণীকে ক্ষমা করেননি যে তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়েছিল? হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা তার সেবার মূল্যায়ন করেছেন, তাকে মাফ করে দিয়েছেন। [মুসলিম]
তিনি বলেছেন :
يا ابن آدم ! إنك ما دعوتني ورجوتني غفرت لك على ما كان منك ولا أبالي . يا ابن آدم ! لو بلغت ذنوبك عنان السماء، ثم استغفرتني غفرت لك ولا أبالي . يا ابن آدم ! لو أتيتني بقراب الأرض خطايا، ثم لقيتني لا تشرك بي شيئا لقيتك بقرابها مغفرة . رواه الترمذي في الدعوات .
‘‘হে বনী আদম! যত বড় গুনাহই তোমাহতে প্রকাশ পেয়েছে , তুমি যদি আমাকে আহবান কর, আমার উপর আশায় বুক বাধ, আমি তোমাকে মাফ করে দিব, এতে আমি সামান্য মাত্র পরওয়া করি না। হে বনী আদম! যদি তোমরা গুনাহ উর্ধ্বগগন পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতঃপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব, এতে আমি কোন পরওয়া করি না। হে বনী আদম! তুমি যদি আমার কাছে দুনিয়ার সমান গুনাহ নিয়ে আস, অতঃপর আমার সাথে কাউকে শরীক না করে সাক্ষাৎ কর, আমি তোমার কাছে দুনিয়ার সমান ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হব।’’ [তিরমিযী]
এ গুলো হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশনা এবং বান্দাদের উদ্বুদ্ধ করণ, যাতে তারা দুনিয়া এবং আখেরাতের সমূহ প্রয়োজন একমাত্র তাঁর নিকট-ই প্রার্থনা করে এবং শিরকের দ্বার বদ্ধ রাখে।
প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া : মানুষ সর্বস্ব দিয়ে সে ব্যক্তির বশ্যতা শিকার করে যে, তার প্রয়োজন পূর্ণ করে। যে বান্দা আল্লাহ তাআলার প্রার্থনা পরিত্যাগ করে, অন্য কারো প্রার্থনায় মনোযোগী হল, সে মারাত্মক ভুল করল। সে এমন ব্যক্তির দ্বারস্থ হল যে এর উপযুক্ত নয়। এর বিপরীতে উপযুক্ত সত্তাকে সে পরিত্যাগ করল।
আল্লাহ তাআলার ধন-ভান্ডার পরিপূর্ণ, যা কখনো নিঃশেষ হবে না। আল্লাহ তাআলা হিসাব ছাড়া রিযিক প্রদান করেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য :
(১) কবুল হওয়ার পূর্ণ বিশ্বাস রেখে আল্লাহ তাআলাকে ডাকা এবং তাঁর প্রতি আস্থা রাখা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
ادعوا الله وأنتم موقنون بالإجابة . رواه الترمذي في الدعوات . السلسلة الصحيحة 594.
‘‘তোমরা কবুল হবে এরূপ বিশ্বাস রেখে আল্লাহ তাঅলাকে ডাক , প্রার্থনা কর।’’ [তিরমিযী]
(২) বিনয় ও নম্রতা নিয়ে আল্লাহ তাআলাকে অনুচ্চ-স্বরে আহবান করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :
ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ﴿الأعراف :55﴾
‘‘তোমরা তোমাদের রবকে ডাক, বিনীত হয়ে এবং সংগোপনে। তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’’ [আরাফ : ৫৫]
(৩) পূর্ণ আস্থা এবং দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহকে আহবান করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
إذا دعا أحدكم فليعزم المسألة، ولا يقل : اللهم إن شئت فأعطني . فإن الله لا مستكره له . رواه البخاري في الدعوات . باب ليعزم المسألة فإن الله لا مكره له .
‘‘যখন তোমাদের কেউ প্রার্থনা করে, সে যেন প্রার্থিত বিষয় কবুল হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করে। এ রকম বলবে না, হে আল্লাহ, তোমার ইচ্ছা হলে আমাকে প্রদান কর। কারণ, আল্লাহর উপর শক্তি প্রয়োগ করবে এমন কেউ নেই।’’ [বুখারী]
(৪) কবুল হওয়া নিয়ে তাড়াহুড়ো না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
يستجاب للعبد مالم يدع بإثم أو قطيعة رحم، ما لم يستعجل، قيل با رسول الله ! ما الاستعجال؟ قال : يقول : قد دعوت فلم أر يستجاب لي، فيستحسر عند ذلك، ويدع الدعاء . رواه مسلم في الذكر والدعاء , باب : بيان أنه يستجاب للداعي ما لم يستعجل .
‘‘বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত গুনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নতার দু‘আ না করে, তার দু‘আ কবুল হতে থাকে যদি তাড়াহুড়ো না করে। বলা হল : হে আল্লাহর রাসূল, তাড়াহুড়ো কি? তিনি বললেন : প্রার্থনাকারীর এমন মন্তব্য করা যে, আমি দু‘আ করেছি কিন্তু আমার দু‘আ কবুল হতে দেখিনি। তখন সে পরিশ্রান্ত হয়ে যায়, আর দু‘আ করা পরিত্যাগ করে দেয়।’’ [মুসলিম]
আমরা যদি তাওহীদের এ শিক্ষার উপর আমল করি, তবে আমরা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে পুরস্কৃত হব। লক্ষ্য করব তিনি আমাদের বিভিন্নভাবে সম্মানিত করছেন। আল্লাহ স্বীয় বান্দার আহবানে খুশি হন। মানুষ অন্যের যাঞ্চনায় বিরক্তি বোধ করে। কারণ, সে নিজের কমতি, ঘাটতি ও দৈন্যতা সম্পর্কে খুব ভাল করে জ্ঞান রাখে।
ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন : ‘‘তুমি যে বিষয়ে আল্লাহর শরণাপন্ন, আল্লাহ সে বিষয়ে অভাবশূন্য। তুমি যে বিষয়ে মানুষের শরণাপন্ন, মানুষ সে বিষয়ে মুখাপেক্ষী। এতদ্ব্যতীত তারা তোমার উপকার-অপকার বুঝারও ক্ষমতা রাখে না। অধিকন্তু তারা নিজেদের কল্যাণ ও জরুরত সম্পর্কেও অজ্ঞ। অতএব যে নিজের ভাল মন্দের জ্ঞান রাখে না, সে অন্যের ভাল মন্দের জ্ঞান কীভাবে রাখবে?’’ [মাজমূউল ফাতাওয়া]
মানুষ যত বেশি আল্লাহর নিকট প্রার্থনার অভ্যাস গড়ে তুলবে, তত বেশি তাদের ঈমান ও তাওহীদের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত হতে থাকবে, সীরকের দ্বার সমূহ রুদ্ধ হতে থাকবে।
মানুষ যত বেশি মাখলুকের নিকট প্রার্থনা করার অভ্যাস গড়ে তুলবে, তত বেশি তার নিকট শিরকের দ্বারসমূহ খুলতে থাকবে, তওহীদের দ্বারসমূহ রুদ্ধ হতে থাকবে। সুতরাং আমাদের নিকট স্পষ্ট হল যে, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা তাওহীদের অংশ, যেমন মানুষের নিকট প্রার্থনা শিরকের অংশ। এটি অনন্য বৈশিষ্ট্য মন্ডিত ইসলামের একটি মূলনীতিও বটে। এর উপর উলামায়ে ইসলামের বিশেষ দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয়েছে। তারা এর উপর ভিত্তিকরে অনেক ফিকহী মাসআলার ভিত নির্মাণ করেছেন।
যেমন তারা বলেছেন, কারো দান দাক্ষিণ্যে হজ্জ ফরয হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তি ভ্রমণ ব্যয় ও যানবাহন খরচে অক্ষম, তার হজ্জ সম্পাদন করার জন্য অনুদান গ্রহণ করা জরুরি নয়। যদিও এটা তার ফরয হজ্জ হয়। যেন সে মানুষের করুণা মুক্ত থাকতে পারে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন:
فإن كان قادرا على تحصيله بصنعة أو هبة أو وصية أو مسألة أو أخذ من صدقة أو بيت المال لم يجب عليه ذلك . شرح العمدة 1/131
‘‘যে ব্যক্তি কোন পেশা, অনুদান, ওসিয়ত, ভিক্ষা, সদকা অথবা রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অনুদান গ্রহণ করে হজ্জের সক্ষম হয়, তার উপর হজ্জ ফরয নয়।’’ [শারহুল উমদাহ]
তদ্রুপ অনুদান গ্রহণ করা জরুরি নয় ঐ ব্যক্তির জন্য যে, সালাতে সতর ঢাকতে সক্ষম নয়। যদিও সতর ঢাকা সালাতের শর্ত।
রাউদুল মুরবি’ গ্রন্থে আছে : যদি কেউ তাকে আচ্ছাদন ধার দেয়, তবে তা কবুল করা জরুরি। কারণ, সে চাওয়ার ন্যায় ঘৃণ্য কাজ করা ছাড়াই লজ্জাস্থান ঢাকার কাপড় পেয়ে গেছে। এটা অনুদান গ্রহণের বিপরীত। তবে তার নিজ ইচ্ছায় কারো থেকে ধার চাওয়া জরুরি নয়।’’ [শারহুল উমদাহ]
পূর্বের আলোচনার উপর ভিত্তি করে ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন :
سؤال الخلق في الأصل محرم، لكنه أبيح للضرورة، وتركه توكلا على الله-تعالى- أفضل . الفتاوى 1/181
‘‘ মাখলুকের নিকট চাওয়া ও প্রার্থনা করা মূলত: হারাম। বিশেষ প্রয়োজনে তা বৈধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে তা পরিহার করা উত্তম।’’ [মাজমাউল ফাতাওয়া]
এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি যে মাখলুকের নিকট চাওয়া হারাম। তবে যেহেতু কিছু প্রয়োজন আছে যা পরস্পর চাওয়া-পাওয়া ছাড়া পূর্ণ হয় না, তাই এটা আল্লাহ বৈধ রেখেছেন। যাতে আপোশ সহযোগিতা, মহববত ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়। তবে এ শর্তে যে, সীমা-লঙ্ঘন করা যাবে না এবং এটাকে অভ্যাসে পরিণত করা যাবে না। অর্থাৎ ভাল-মন্দ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বিবেচনা ব্যতিরেকে প্রত্যেক জিনিস প্রার্থনা করা যাবে না। আর যখন বাধ্য হয়ে প্রার্থনা করবে, তখন জরুরি হবে সে অনুপাতে প্রতিদান দেয়া। বরং তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দিতে চেষ্টা করা। যদি অক্ষমতার কারণে প্রতিদান দিতে সক্ষম না হয়, তবে তার জন্য দু‘আ করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
من صنع إليكم معروفا فكافئوه، فإن لم تجدوا ما تكافئونه به فادعوا له، حتى تروا أنكم قد كافأتموه . رواه أبوداود في الزكاة، باب : عطية من سأل الله .
‘‘যে তোমাকে কোন উপকার করল, তাকে তার প্রতিদান প্রদান কর। যদি তুমি তাকে বিনিময় দিতে অপারগ হও, তবে তার জন্য খুব দু‘আ কর, যতক্ষণ না তোমার মন বলবে, তুমি তার ঋণ শোধ করে দিয়েছ।’’ [আবুদাউদ]
দুঃখ জনক ভাবে অবহেলিত, স্পর্শকাতর ও নাজাতের অত্র বিষয়টি সম্পর্কে এ উপস্থাপনার পর আমাদের সামনে আর কোন অজুহাত বাকি রইল নাযার দোহাই দিয়ে আমরা এ শিক্ষা পরিত্যাগ করব কিংবা অন্য কোন পথ অবলম্বন করব।
অতএব আমরা আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদের এ শিক্ষা ও নীতির উপর লালন করব। অন্য সবাইকে এর জন্য আহবান করব। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করব, মাখলুক তথা সৃষ্টি জীবের নিকট প্রার্থনা পরিহার করব।
আমার বিশ্বাস : আমরা যদি পঠন-পাঠন, দাওয়াত ও অন্তঃকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে এ শিক্ষা গ্রহণ করি। প্রত্যেক সুযোগ ও প্রতি জলসায় এর আলোচনা করি, যেমনটি ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র অভ্যাস, তবে আমরা লক্ষ্য করব যে, এ পার্থিব জগতের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ছোট সমস্যা কিংবা বড় , ছোট গুনাহ কিংবা বড় গুনাহ, সগিরা কিংবা কবিরা কিংবা শিরক সহ সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি নিঃশেষ হবে আমাদের বিচ্যুতিসমূহ ও নিরসন হবে ভ্রান্তিগুলোর। আমাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সুন্দর ও মসৃণ হবে। যেমন সুন্দর ছিল সাহবায়ে কেরাম ও নেককার লোকদের জীবন। সুতরাং আমাদের প্রয়োজন প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রত্যেক মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ এ মূলনীতিটি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা।
সমাপ্ত
ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন : ‘‘তুমি যে বিষয়ে আল্লাহর শরণাপন্ন, আল্লাহ সে বিষয়ে অভাবশূন্য। তুমি যে বিষয়ে মানুষের শরণাপন্ন, মানুষ সে বিষয়ে মুখাপেক্ষী। এতদ্ব্যতীত তারা তোমার উপকার-অপকার বুঝারও ক্ষমতা রাখে না। অধিকন্তু তারা নিজেদের কল্যাণ ও জরুরত সম্পর্কেও অজ্ঞ। অতএব যে নিজের ভাল মন্দের জ্ঞান রাখে না, সে অন্যের ভাল মন্দের জ্ঞান কীভাবে রাখবে?’’ [মাজমূউল ফাতাওয়া]
মানুষ যত বেশি আল্লাহর নিকট প্রার্থনার অভ্যাস গড়ে তুলবে, তত বেশি তাদের ঈমান ও তাওহীদের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত হতে থাকবে, সীরকের দ্বার সমূহ রুদ্ধ হতে থাকবে।
মানুষ যত বেশি মাখলুকের নিকট প্রার্থনা করার অভ্যাস গড়ে তুলবে, তত বেশি তার নিকট শিরকের দ্বারসমূহ খুলতে থাকবে, তওহীদের দ্বারসমূহ রুদ্ধ হতে থাকবে। সুতরাং আমাদের নিকট স্পষ্ট হল যে, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা তাওহীদের অংশ, যেমন মানুষের নিকট প্রার্থনা শিরকের অংশ। এটি অনন্য বৈশিষ্ট্য মন্ডিত ইসলামের একটি মূলনীতিও বটে। এর উপর উলামায়ে ইসলামের বিশেষ দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয়েছে। তারা এর উপর ভিত্তিকরে অনেক ফিকহী মাসআলার ভিত নির্মাণ করেছেন।
যেমন তারা বলেছেন, কারো দান দাক্ষিণ্যে হজ্জ ফরয হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তি ভ্রমণ ব্যয় ও যানবাহন খরচে অক্ষম, তার হজ্জ সম্পাদন করার জন্য অনুদান গ্রহণ করা জরুরি নয়। যদিও এটা তার ফরয হজ্জ হয়। যেন সে মানুষের করুণা মুক্ত থাকতে পারে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন:
فإن كان قادرا على تحصيله بصنعة أو هبة أو وصية أو مسألة أو أخذ من صدقة أو بيت المال لم يجب عليه ذلك . شرح العمدة 1/131
‘‘যে ব্যক্তি কোন পেশা, অনুদান, ওসিয়ত, ভিক্ষা, সদকা অথবা রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অনুদান গ্রহণ করে হজ্জের সক্ষম হয়, তার উপর হজ্জ ফরয নয়।’’ [শারহুল উমদাহ]
তদ্রুপ অনুদান গ্রহণ করা জরুরি নয় ঐ ব্যক্তির জন্য যে, সালাতে সতর ঢাকতে সক্ষম নয়। যদিও সতর ঢাকা সালাতের শর্ত।
রাউদুল মুরবি’ গ্রন্থে আছে : যদি কেউ তাকে আচ্ছাদন ধার দেয়, তবে তা কবুল করা জরুরি। কারণ, সে চাওয়ার ন্যায় ঘৃণ্য কাজ করা ছাড়াই লজ্জাস্থান ঢাকার কাপড় পেয়ে গেছে। এটা অনুদান গ্রহণের বিপরীত। তবে তার নিজ ইচ্ছায় কারো থেকে ধার চাওয়া জরুরি নয়।’’ [শারহুল উমদাহ]
পূর্বের আলোচনার উপর ভিত্তি করে ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন :
سؤال الخلق في الأصل محرم، لكنه أبيح للضرورة، وتركه توكلا على الله-تعالى- أفضل . الفتاوى 1/181
‘‘ মাখলুকের নিকট চাওয়া ও প্রার্থনা করা মূলত: হারাম। বিশেষ প্রয়োজনে তা বৈধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে তা পরিহার করা উত্তম।’’ [মাজমাউল ফাতাওয়া]
এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি যে মাখলুকের নিকট চাওয়া হারাম। তবে যেহেতু কিছু প্রয়োজন আছে যা পরস্পর চাওয়া-পাওয়া ছাড়া পূর্ণ হয় না, তাই এটা আল্লাহ বৈধ রেখেছেন। যাতে আপোশ সহযোগিতা, মহববত ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়। তবে এ শর্তে যে, সীমা-লঙ্ঘন করা যাবে না এবং এটাকে অভ্যাসে পরিণত করা যাবে না। অর্থাৎ ভাল-মন্দ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বিবেচনা ব্যতিরেকে প্রত্যেক জিনিস প্রার্থনা করা যাবে না। আর যখন বাধ্য হয়ে প্রার্থনা করবে, তখন জরুরি হবে সে অনুপাতে প্রতিদান দেয়া। বরং তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দিতে চেষ্টা করা। যদি অক্ষমতার কারণে প্রতিদান দিতে সক্ষম না হয়, তবে তার জন্য দু‘আ করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
من صنع إليكم معروفا فكافئوه، فإن لم تجدوا ما تكافئونه به فادعوا له، حتى تروا أنكم قد كافأتموه . رواه أبوداود في الزكاة، باب : عطية من سأل الله .
‘‘যে তোমাকে কোন উপকার করল, তাকে তার প্রতিদান প্রদান কর। যদি তুমি তাকে বিনিময় দিতে অপারগ হও, তবে তার জন্য খুব দু‘আ কর, যতক্ষণ না তোমার মন বলবে, তুমি তার ঋণ শোধ করে দিয়েছ।’’ [আবুদাউদ]
দুঃখ জনক ভাবে অবহেলিত, স্পর্শকাতর ও নাজাতের অত্র বিষয়টি সম্পর্কে এ উপস্থাপনার পর আমাদের সামনে আর কোন অজুহাত বাকি রইল নাযার দোহাই দিয়ে আমরা এ শিক্ষা পরিত্যাগ করব কিংবা অন্য কোন পথ অবলম্বন করব।
অতএব আমরা আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদের এ শিক্ষা ও নীতির উপর লালন করব। অন্য সবাইকে এর জন্য আহবান করব। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করব, মাখলুক তথা সৃষ্টি জীবের নিকট প্রার্থনা পরিহার করব।
আমার বিশ্বাস : আমরা যদি পঠন-পাঠন, দাওয়াত ও অন্তঃকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে এ শিক্ষা গ্রহণ করি। প্রত্যেক সুযোগ ও প্রতি জলসায় এর আলোচনা করি, যেমনটি ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র অভ্যাস, তবে আমরা লক্ষ্য করব যে, এ পার্থিব জগতের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ছোট সমস্যা কিংবা বড় , ছোট গুনাহ কিংবা বড় গুনাহ, সগিরা কিংবা কবিরা কিংবা শিরক সহ সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি নিঃশেষ হবে আমাদের বিচ্যুতিসমূহ ও নিরসন হবে ভ্রান্তিগুলোর। আমাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সুন্দর ও মসৃণ হবে। যেমন সুন্দর ছিল সাহবায়ে কেরাম ও নেককার লোকদের জীবন। সুতরাং আমাদের প্রয়োজন প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রত্যেক মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ এ মূলনীতিটি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা।
সমাপ্ত
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন