HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
ফিরক্বা নাজিয়াহ
লেখকঃ ফিরক্বা নাজিয়াহ
ফিরক্বা নাজিয়াহ
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ৪৪
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০১৩ খ্রিঃ
২য় সংস্করণ : জুন ২০১৩ খ্রিঃ
নির্ধারিত মূল্য : ২৫ (পঁচিশ) টাকা মাত্র।
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ৪৪
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০১৩ খ্রিঃ
২য় সংস্করণ : জুন ২০১৩ খ্রিঃ
নির্ধারিত মূল্য : ২৫ (পঁচিশ) টাকা মাত্র।
সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। সে হিসাবে মানবজাতি পরস্পরের ভাই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও অবিশ্বাস এবং তাঁর নাযিলকৃত বিধানসমূহ মানা ও না মানার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে মুমিন ও কাফিরের বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। যারা মুমিন তারা ইহকালে সফল ও পরকালে জান্নাত লাভে ধন্য হবে। পক্ষান্তরে যারা কাফের, তারা ইহকালে ব্যর্থ ও পরকালে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধীভূত হবে। কিন্তু ঈমান আনার পরেও শয়তানী ধোঁকায় পড়ে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় নানা বিভেদ। ফলে নূহ (আঃ)-এর যুগেই মানবজাতির মধ্যে শিরকের উদ্ভব ঘটে। অবশেষে তারা সবাই আললাহর গযবে প্লাবনে ডুবে ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে নূহের কিশতীতে উদ্ধার পাওয়া স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার ও মুত্তাক্বী লোকদের ঔরসে মানব বংশ নতুনভাবে শুরু হলেও তারা পুনরায় শিরকে লিপ্ত হয়। মানুষকে এই ভ্রষ্টতা থেকে ফিরাতে যুগে যুগে আল্লাহর পক্ষ থেকে বহু নবী ও রাসূল প্রেরিত হন। যেসব মানুষ নবীগণের যথার্থ অনুসারী হয়েছেন, তারাই ছিলেন স্ব স্ব যুগে নাজী ফিরক্বা। পৃথিবীতে চারজন কিতাবধারী শ্রেষ্ঠ রাসূলের মধ্যে মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর অনুসারী হ’ল ইহূদী ও নাছারাগণ। সংখ্যার বিচারে ও নিকটতম উম্মত হিসাবে তাদের অধঃপতনকে দৃষ্টান্ত হিসাবে হাদীছে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইহূদীরা ৭১ ফের্কা, নাছারারা ৭২ ফের্কা ও সবশেষ উম্মত মুসলমানেরা ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে শুরুতেই জান্নাতী হবে যে দলটি, তাদেরকেই বলা হয় ফিরক্বা নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। প্রত্যেক মুমিন এই দলভুক্ত হবার আকাংখা পোষণ করে এবং প্রত্যেকে নিজেকে এই দলভুক্ত বলে দাবী করে। ৭৩ ফের্কার সবাই ‘মুসলিম’। কিন্তু আমরা কেবল ‘মুসলিম’ হ’তে চাই না, বরং নাজী ফের্কাভুক্ত হ’তে চাই। সেই ফের্কাভুক্ত হ’তে গেলে তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া অবশ্যই যরূরী। অত্র বইটি আমাদেরকে সেদিকেই পথ দেখাবে ইনশাআল্লাহ।
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله وحده والصلاة والسلام على من لا نبي بعده وعلى آله وصحبه ومن تبعهم بإحسان إلي يوم الدين وبعد :
আমরা মুসলমান। আমরা মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানে বিশ্বাস করি। সেখানে আল্লাহর নিকটে আমাদের সারা জীবনের কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। পরকালে আমরা সকলেই জান্নাতের আকাংখী। কিন্তু সেটা নির্ভর করে দুনিয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথে যথাযথভাবে চলার উপরে। এধরনের মানুষের সংখ্যা সঙ্গতকারণেই সর্বদা কম হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের নাম বলে যাননি। কেবল বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় বলে গেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান তা জানে না। নিম্নে আমরা সেগুলি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। যাতে সকলে আমরা সেদিকে আগ্রহী হই এবং পার্থিব জীবনে ফিরক্বা নাজিয়াহর অন্তর্ভুক্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারি।
ইহূদীরা ৭১ ফের্কা, নাছারারা ৭২ ফের্কা ও সবশেষ উম্মত মুসলমানেরা ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে শুরুতেই জান্নাতী হবে যে দলটি, তাদেরকেই বলা হয় ফিরক্বা নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। প্রত্যেক মুমিন এই দলভুক্ত হবার আকাংখা পোষণ করে এবং প্রত্যেকে নিজেকে এই দলভুক্ত বলে দাবী করে। ৭৩ ফের্কার সবাই ‘মুসলিম’। কিন্তু আমরা কেবল ‘মুসলিম’ হ’তে চাই না, বরং নাজী ফের্কাভুক্ত হ’তে চাই। সেই ফের্কাভুক্ত হ’তে গেলে তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া অবশ্যই যরূরী। অত্র বইটি আমাদেরকে সেদিকেই পথ দেখাবে ইনশাআল্লাহ।
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله وحده والصلاة والسلام على من لا نبي بعده وعلى آله وصحبه ومن تبعهم بإحسان إلي يوم الدين وبعد :
আমরা মুসলমান। আমরা মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানে বিশ্বাস করি। সেখানে আল্লাহর নিকটে আমাদের সারা জীবনের কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। পরকালে আমরা সকলেই জান্নাতের আকাংখী। কিন্তু সেটা নির্ভর করে দুনিয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথে যথাযথভাবে চলার উপরে। এধরনের মানুষের সংখ্যা সঙ্গতকারণেই সর্বদা কম হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের নাম বলে যাননি। কেবল বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় বলে গেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান তা জানে না। নিম্নে আমরা সেগুলি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। যাতে সকলে আমরা সেদিকে আগ্রহী হই এবং পার্থিব জীবনে ফিরক্বা নাজিয়াহর অন্তর্ভুক্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারি।
وَعَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِيْ مَا أَتَى عَلَى بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلاَنِيَةً لَكَانَ فِيْ أُمَّتِيْ مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ وَإِنَّ بَنِي إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوْا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ- وَفِيْ رِوَايَةِ أَحْمَدَ وَأَبِيْ دَاؤدَ عَنْ مُعَاوِيَةَ : ثِنْتَانِ وَسَبْعُوْنَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَهِيَ الْجَمَاعَةُ، وَإِنَّهُ سَيَخْرُجُ فِيْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ تَتَجَارَى بِهِمْ تِلْكَ الْأَهْوَاءُ كَمَا يَتَجَارَى الْكَلْبُ بِصَاحِبِهِ لاَ يَبْقَى مِنْهُ عِرْقٌ وَلاَ مَفْصِلٌ إِلاَّ دَخَلَهُ -
অনুবাদ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আমার উম্মতের উপরে তেমন অবস্থা আসবে, যেমন এসেছিল বনু ইস্রাঈলের উপরে এক জোড়া জুতার পরস্পরে সমান হওয়ার ন্যায়। এমনকি তাদের মধ্যে যদি কেউ এমনও থাকে, যে তার মায়ের সাথে প্রকাশ্যে যেনা করেছে, তাহ’লেও আমার উম্মতের মধ্যে তেমন লোকও পাওয়া যাবে যে এমন কাজ করবে। আর বনু ইস্রাঈল ৭২ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে, একটি দল ব্যতীত। তারা বললেন, সেটি কোন দল হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যারা আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি, তার উপরে টিকে থাকবে’। -
অতঃপর আহমাদ ও আবুদাঊদ হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, ৭২ দল জাহান্নামী হবে ও একটি দল জান্নাতী হবে। আর তারা হ’ল, আল-জামা‘আত। আর আমার উম্মতের মধ্যে সত্বর এমন একদল লোক বের হবে, যাদের মধ্যে প্রবৃত্তিপরায়ণতা এমনভাবে প্রবহমাণ হবে, যেভাবে কুকুরের বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির সারা দেহে সঞ্চারিত হয়। কোন একটি শিরা বা জোড়া বাকী থাকে না যেখানে উক্ত বিষ প্রবেশ করে না।[2]
সনদ : আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন। তিরমিযী ‘হাসান’ বলেছেন বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে। হাকেম বিভিন্ন বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন, هذه أسانيد تقام بها الحجة في تصحيح هذا الحديث ‘এই সকল সনদ হাদীছটি ছহীহ হওয়ার পক্ষে দলীল হিসাবে দন্ডায়মান’।[3] ছাহেবে মির‘আত উক্ত মর্মের ১০টি হাদীছ উল্লেখ করেছেন ‘শাওয়াহেদ’ হিসাবে। অতঃপর তিনি বলেন, এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছ সমূহের কোনটি ‘ছহীহ’ কোনটি ‘হাসান’ ও কোনটি ‘যঈফ’। অতএব افةراق الأمة -এর হাদীছ নিঃসন্দেহে ‘ছহীহ’ ( صحيح من غير شك )।[4]
সারমর্ম : মুসলিম উম্মাহ অসংখ্য দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে একটি মাত্র দল শুরু থেকেই জান্নাতী হবে।
হাদীছের ব্যাখ্যা : হাদীছটি ‘ইফতিরাকুল উম্মাহ’ ( افةراق الأمة ) নামে প্রসিদ্ধ। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী লুকিয়ে রয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে মুসলিম উম্মাহর আক্বীদাগত বিভক্তি ও সামাজিক ভাঙনচিত্র যেমন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তেমনি তা থেকে নিষ্কৃতির পথও বাৎলে দেওয়া হয়েছে। এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, যত দলই সৃষ্টি হউক না কেন, একটি দলই মাত্র শুরুতে জান্নাতী হবে, যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদা ও আমলের যথার্থ অনুসারী হবে।
( لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِيْ مَا أَتَى عَلَى بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ ) ‘নিশ্চয়ই আমার উম্মতের উপরে তেমন অবস্থা আসবে, যেমন অবস্থা এসেছিল বনু ইস্রাঈলের উপরে এক জোড়া জুতার পরস্পরে সমান হওয়ার ন্যায়’।
لَيَأْتِيَنَّ ‘অবশ্যই আসবে’ অর্থ ‘আপতিত হবে’। এখানে أَتَي ক্রিয়াটির পরে عَلَى অব্যয়টি এসে তাকে ‘সকর্মক’ করেছে। যার সঠিক তাৎপর্য দাঁড়াবে الغلبة المؤدة إلي الهلاك ‘ঐরূপ বিজয় যা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়’। যেমন আল্লাহ বলেন, وَفِيْ عَادٍ إِذْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الرِّيْحَ الْعَقِيْمَ، مَا تَذَرُ مِنْ شَيْءٍ أَتَتْ عَلَيْهِ إِلاَّ جَعَلَتْهُ كَالرَّمِيْمِ - ‘আর নিদর্শন রয়েছে ‘আদ-এর কাহিনীতে, যখন আমরা তাদের উপরে প্রেরণ করেছিলাম অশুভ বায়ু’। ‘এই বায়ু যার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, তাকেই সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল’ (যারিয়াত ৫১/৪১-৪২)। একই ক্রিয়াপদ অত্র হাদীছে ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বনু ইস্রাঈলের উপরে দলাদলির যে গযব আপতিত হয়েছিল, একই ধরনের গযব আমার উম্মতের উপরে আপতিত হবে। ‘এক জোড়া জুতার পরস্পরে সমান হওয়ার ন্যায়’ বাক্যটি আনা হয়েছে দুই উম্মতের অবস্থার সামঞ্জস্য বুঝাবার জন্য।
[1]. নিবন্ধটি মাসিক ‘আত-তাহরীক’ (রাজশাহী) ১৬ বর্ষ ১ম সংখ্যা অক্টোবর’১২-তে ‘দরসে হাদীছ’ কলামে প্রকাশিত হয়। ২য় সংস্করণে কিছুটা সংযোজনসহ প্রকাশিত হ’ল।
[2]. তিরমিযী হা/২৬৪১, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; আবুদাঊদ হা/৪৫৯৬-৯৭; আহমাদ হা/১৬৯৭৯; মিশকাত হা/১৭১-১৭২; আলবানী, ছহীহাহ হা/১৩৪৮, ২০৩, ১৪৯২।
[3]. হাকেম ১/১২৮।
[4]. মির‘আত ১/২৭৬-৭৭।
অনুবাদ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আমার উম্মতের উপরে তেমন অবস্থা আসবে, যেমন এসেছিল বনু ইস্রাঈলের উপরে এক জোড়া জুতার পরস্পরে সমান হওয়ার ন্যায়। এমনকি তাদের মধ্যে যদি কেউ এমনও থাকে, যে তার মায়ের সাথে প্রকাশ্যে যেনা করেছে, তাহ’লেও আমার উম্মতের মধ্যে তেমন লোকও পাওয়া যাবে যে এমন কাজ করবে। আর বনু ইস্রাঈল ৭২ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে, একটি দল ব্যতীত। তারা বললেন, সেটি কোন দল হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যারা আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি, তার উপরে টিকে থাকবে’। -
অতঃপর আহমাদ ও আবুদাঊদ হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, ৭২ দল জাহান্নামী হবে ও একটি দল জান্নাতী হবে। আর তারা হ’ল, আল-জামা‘আত। আর আমার উম্মতের মধ্যে সত্বর এমন একদল লোক বের হবে, যাদের মধ্যে প্রবৃত্তিপরায়ণতা এমনভাবে প্রবহমাণ হবে, যেভাবে কুকুরের বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির সারা দেহে সঞ্চারিত হয়। কোন একটি শিরা বা জোড়া বাকী থাকে না যেখানে উক্ত বিষ প্রবেশ করে না।[2]
সনদ : আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন। তিরমিযী ‘হাসান’ বলেছেন বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’-এর কারণে। হাকেম বিভিন্ন বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন, هذه أسانيد تقام بها الحجة في تصحيح هذا الحديث ‘এই সকল সনদ হাদীছটি ছহীহ হওয়ার পক্ষে দলীল হিসাবে দন্ডায়মান’।[3] ছাহেবে মির‘আত উক্ত মর্মের ১০টি হাদীছ উল্লেখ করেছেন ‘শাওয়াহেদ’ হিসাবে। অতঃপর তিনি বলেন, এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছ সমূহের কোনটি ‘ছহীহ’ কোনটি ‘হাসান’ ও কোনটি ‘যঈফ’। অতএব افةراق الأمة -এর হাদীছ নিঃসন্দেহে ‘ছহীহ’ ( صحيح من غير شك )।[4]
সারমর্ম : মুসলিম উম্মাহ অসংখ্য দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে একটি মাত্র দল শুরু থেকেই জান্নাতী হবে।
হাদীছের ব্যাখ্যা : হাদীছটি ‘ইফতিরাকুল উম্মাহ’ ( افةراق الأمة ) নামে প্রসিদ্ধ। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী লুকিয়ে রয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে মুসলিম উম্মাহর আক্বীদাগত বিভক্তি ও সামাজিক ভাঙনচিত্র যেমন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তেমনি তা থেকে নিষ্কৃতির পথও বাৎলে দেওয়া হয়েছে। এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, যত দলই সৃষ্টি হউক না কেন, একটি দলই মাত্র শুরুতে জান্নাতী হবে, যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদা ও আমলের যথার্থ অনুসারী হবে।
( لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِيْ مَا أَتَى عَلَى بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ ) ‘নিশ্চয়ই আমার উম্মতের উপরে তেমন অবস্থা আসবে, যেমন অবস্থা এসেছিল বনু ইস্রাঈলের উপরে এক জোড়া জুতার পরস্পরে সমান হওয়ার ন্যায়’।
لَيَأْتِيَنَّ ‘অবশ্যই আসবে’ অর্থ ‘আপতিত হবে’। এখানে أَتَي ক্রিয়াটির পরে عَلَى অব্যয়টি এসে তাকে ‘সকর্মক’ করেছে। যার সঠিক তাৎপর্য দাঁড়াবে الغلبة المؤدة إلي الهلاك ‘ঐরূপ বিজয় যা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়’। যেমন আল্লাহ বলেন, وَفِيْ عَادٍ إِذْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الرِّيْحَ الْعَقِيْمَ، مَا تَذَرُ مِنْ شَيْءٍ أَتَتْ عَلَيْهِ إِلاَّ جَعَلَتْهُ كَالرَّمِيْمِ - ‘আর নিদর্শন রয়েছে ‘আদ-এর কাহিনীতে, যখন আমরা তাদের উপরে প্রেরণ করেছিলাম অশুভ বায়ু’। ‘এই বায়ু যার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, তাকেই সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল’ (যারিয়াত ৫১/৪১-৪২)। একই ক্রিয়াপদ অত্র হাদীছে ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বনু ইস্রাঈলের উপরে দলাদলির যে গযব আপতিত হয়েছিল, একই ধরনের গযব আমার উম্মতের উপরে আপতিত হবে। ‘এক জোড়া জুতার পরস্পরে সমান হওয়ার ন্যায়’ বাক্যটি আনা হয়েছে দুই উম্মতের অবস্থার সামঞ্জস্য বুঝাবার জন্য।
[1]. নিবন্ধটি মাসিক ‘আত-তাহরীক’ (রাজশাহী) ১৬ বর্ষ ১ম সংখ্যা অক্টোবর’১২-তে ‘দরসে হাদীছ’ কলামে প্রকাশিত হয়। ২য় সংস্করণে কিছুটা সংযোজনসহ প্রকাশিত হ’ল।
[2]. তিরমিযী হা/২৬৪১, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; আবুদাঊদ হা/৪৫৯৬-৯৭; আহমাদ হা/১৬৯৭৯; মিশকাত হা/১৭১-১৭২; আলবানী, ছহীহাহ হা/১৩৪৮, ২০৩, ১৪৯২।
[3]. হাকেম ১/১২৮।
[4]. মির‘আত ১/২৭৬-৭৭।
যেমন (১) ধর্মীয় ক্ষেত্রে : আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে মুক্তি পাওয়া ইহূদী সম্প্রদায় স্বচক্ষে তাদের জানী দুশমন ফেরাঊনকে সদলবলে সাগরে ডুবে মরতে দেখার পরেও সিরিয়ার পথে কিছুদূর এসে এক স্থানে মূর্তিপূজারীদের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে নবী মূসা (আঃ)-এর কাছে তারা আবদার করল, اجْعَل لَّنَا إِلَـهاً كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ‘আমাদের একজন উপাস্য ঠিক করে দিন, যেমন ওদের বহু উপাস্য রয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/১৩৮; নবীদের কাহিনী ২/৭১)। একই অবস্থা আমরা দেখতে পাই মক্কা বিজয়ের মাত্র ১৯দিন পরে হোনায়েন যুদ্ধে যাওয়ার পথে যাতু আনওয়াত্ব ( ذات أنواط ) নামক বটবৃক্ষের ন্যায় একটি বিশাল বৃক্ষের পাশ দিয়ে রাসূল (ছাঃ) যখন অতিক্রম করেন। ঐ বৃক্ষে কাফেররা তরবারি ঝুলিয়ে রাখতো ও তার মাধ্যমে বরকত ও বিজয় কামনা করত। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ওদের যেমন যাতু আনওয়াত্ব আছে আমাদের তেমনি একটি যাতু আনওয়াত্ব ঠিক করে দিন। তখন রাসূল (ছাঃ) বিস্মিত হয়ে বললেন, সুবহানাল্লাহ! এটাতো তেমন কথা হ’ল যেমন মূসার কওম তাঁকে বলেছিল, ‘আমাদের একজন উপাস্য ঠিক করে দিন, যেমন ওদের বহু উপাস্য রয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/১৩৮)। শুনে রাখ, যার হাতে আমার জীবন নিহিত তার কসম করে বলছি, لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিসমূহের অনুসরণ করবে’।[1]
এখানে ‘তারা বলল’ অর্থ, মক্কা বিজয়ের পর সদ্য নওমুসলিম কিছু লোক বলল। ‘পূর্ববর্তীদের’ বলতে পূর্ববর্তী কিতাবধারী উম্মত ইহূদী-নাছারাদের বুঝানো হয়েছে। বস্ত্ততঃ বিগত উম্মতের এই শিরকী আক্বীদা মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও স্থানপূজা, কবরপূজা, ছবি ও প্রতিকৃতিপূজা প্রভৃতির আকারে চালু হয়েছে।
(২) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে : ইহূদী-নাছারাদের চালু করা জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি বাতিল মতবাদ সমূহ মুসলমানরা খুশী মনে গ্রহণ করেছে। অথচ জাতীয়তাবাদ মানুষকে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল প্রভৃতি সংকীর্ণ গন্ডীতে বিভক্ত করে ও মানবজাতিকে ভাই ভাই হওয়ার বদলে পরস্পরে শত্রুতে পরিণত করে। তুর্কী ও আরব জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে ইহূদীরা মুসলমানদের সর্বশেষ রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক ওছমানীয় খেলাফতকে ধ্বংস করেছিল। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে খুব সহজে অখন্ড পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছিল। এখন আবার পাহাড়ী জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে বাংলাদেশের এক দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে। অথচ ইসলামী জাতীয়তা হ’ল বিশ্বজনীন। সেখানে আল্লাহভীরু সৎ এবং আল্লাহদ্রোহী পাপিষ্ঠ ব্যতীত মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। সেখানে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের পার্থক্যকে মর্যাদা দেওয়া হলেও তাকে বিচারের মানদন্ড হিসাবে গণ্য করা হয়নি। বরং সকল মানুষকে এক আদমের সন্তান হিসাবে ইসলামী খেলাফতের অধীনে সমঅধিকার প্রদান করা হয়েছে।
ইহূদী-নাছারাদের চালান করা আরেকটি মারণাস্ত্র হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। যা প্রথমে মুসলমানকে ঈমানের গন্ডীমুক্ত করে। অতঃপর গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের দাসত্বে আবদ্ধ করে। সেই সাথে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলাদলি ও হানাহানিতে গণতান্ত্রিক সমাজ এখন জ্বলন্ত হুতাশনে পরিণত হয়েছে। অমনিভাবে ইহূদী-নাছারাদের চালু করা আইন ও দন্ডবিধিসমূহ মুসলিম দেশসমূহে ও তাদের আদালত সমূহে চালু রয়েছে এবং তার ভিত্তিতে মুসলমানের জেল-ফাঁস হচ্ছে। জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক ঘোষণা দিয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। যা পরিষ্কার ভাবে শিরক। ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’ এই বিধান চালু করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ট দলের মনগড়া আইনে দেশ শাসন করা হচ্ছে এবং আল্লাহর আইন তথা অহীর বিধানকে কার্যতঃ অস্বীকার করা হচ্ছে, যা স্পষ্ট শিরক।
(৩) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে : বিশ্বসেরা কুসীদজীবী ইহূদীদের সূদ-ঘুষের পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানবতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ হিসাবে সকলের নিকট স্বীকৃত হলেও মুসলমান নেতাদের মাধ্যমেই তা মুসলিম দেশসমূহে আইনসিদ্ধ রয়েছে। যা সমাজে গাছতলা ও পাঁচতলার অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। আল্লাহ সূদকে হারাম করেছেন। কিন্তু মুসলিম নেতারা তা কার্যতঃ হালাল করেছেন। যা আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল (বাক্বারাহ ২/২৭৯)। অথচ ইসলামী অর্থনীতিতে হালাল-হারামের কঠোর অনুসৃতির ফলে সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার কায়েম হয় এবং ধনী-গরীবের অমানবিক বৈষম্য দূরীভুত হয়।
(৪) শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে : সমাজ জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনকি খাদ্যে-পোষাকে ও আচার-আচরণে, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমরা ইহূদী-নাছারাদের অন্ধ অনুকরণ করে থাকি।
এমনিভাবে মুসলিম উম্মাহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে ইহূদী-নাছারাদের অনুসারী হয়ে গেছে। যাকে অত্র হাদীছে ‘এক জোড়া জুতার পারস্পরিক সামঞ্জস্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
[1]. তিরমিযী হা/২১৮০; মিশকাত হা/৫৪০৮ ‘ফিতান’ অধ্যায়।
এখানে ‘তারা বলল’ অর্থ, মক্কা বিজয়ের পর সদ্য নওমুসলিম কিছু লোক বলল। ‘পূর্ববর্তীদের’ বলতে পূর্ববর্তী কিতাবধারী উম্মত ইহূদী-নাছারাদের বুঝানো হয়েছে। বস্ত্ততঃ বিগত উম্মতের এই শিরকী আক্বীদা মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও স্থানপূজা, কবরপূজা, ছবি ও প্রতিকৃতিপূজা প্রভৃতির আকারে চালু হয়েছে।
(২) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে : ইহূদী-নাছারাদের চালু করা জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি বাতিল মতবাদ সমূহ মুসলমানরা খুশী মনে গ্রহণ করেছে। অথচ জাতীয়তাবাদ মানুষকে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল প্রভৃতি সংকীর্ণ গন্ডীতে বিভক্ত করে ও মানবজাতিকে ভাই ভাই হওয়ার বদলে পরস্পরে শত্রুতে পরিণত করে। তুর্কী ও আরব জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে ইহূদীরা মুসলমানদের সর্বশেষ রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক ওছমানীয় খেলাফতকে ধ্বংস করেছিল। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে খুব সহজে অখন্ড পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছিল। এখন আবার পাহাড়ী জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে বাংলাদেশের এক দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে। অথচ ইসলামী জাতীয়তা হ’ল বিশ্বজনীন। সেখানে আল্লাহভীরু সৎ এবং আল্লাহদ্রোহী পাপিষ্ঠ ব্যতীত মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। সেখানে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের পার্থক্যকে মর্যাদা দেওয়া হলেও তাকে বিচারের মানদন্ড হিসাবে গণ্য করা হয়নি। বরং সকল মানুষকে এক আদমের সন্তান হিসাবে ইসলামী খেলাফতের অধীনে সমঅধিকার প্রদান করা হয়েছে।
ইহূদী-নাছারাদের চালান করা আরেকটি মারণাস্ত্র হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। যা প্রথমে মুসলমানকে ঈমানের গন্ডীমুক্ত করে। অতঃপর গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের দাসত্বে আবদ্ধ করে। সেই সাথে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলাদলি ও হানাহানিতে গণতান্ত্রিক সমাজ এখন জ্বলন্ত হুতাশনে পরিণত হয়েছে। অমনিভাবে ইহূদী-নাছারাদের চালু করা আইন ও দন্ডবিধিসমূহ মুসলিম দেশসমূহে ও তাদের আদালত সমূহে চালু রয়েছে এবং তার ভিত্তিতে মুসলমানের জেল-ফাঁস হচ্ছে। জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক ঘোষণা দিয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। যা পরিষ্কার ভাবে শিরক। ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’ এই বিধান চালু করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ট দলের মনগড়া আইনে দেশ শাসন করা হচ্ছে এবং আল্লাহর আইন তথা অহীর বিধানকে কার্যতঃ অস্বীকার করা হচ্ছে, যা স্পষ্ট শিরক।
(৩) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে : বিশ্বসেরা কুসীদজীবী ইহূদীদের সূদ-ঘুষের পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানবতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ হিসাবে সকলের নিকট স্বীকৃত হলেও মুসলমান নেতাদের মাধ্যমেই তা মুসলিম দেশসমূহে আইনসিদ্ধ রয়েছে। যা সমাজে গাছতলা ও পাঁচতলার অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। আল্লাহ সূদকে হারাম করেছেন। কিন্তু মুসলিম নেতারা তা কার্যতঃ হালাল করেছেন। যা আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল (বাক্বারাহ ২/২৭৯)। অথচ ইসলামী অর্থনীতিতে হালাল-হারামের কঠোর অনুসৃতির ফলে সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার কায়েম হয় এবং ধনী-গরীবের অমানবিক বৈষম্য দূরীভুত হয়।
(৪) শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে : সমাজ জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনকি খাদ্যে-পোষাকে ও আচার-আচরণে, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমরা ইহূদী-নাছারাদের অন্ধ অনুকরণ করে থাকি।
এমনিভাবে মুসলিম উম্মাহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে ইহূদী-নাছারাদের অনুসারী হয়ে গেছে। যাকে অত্র হাদীছে ‘এক জোড়া জুতার পারস্পরিক সামঞ্জস্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
[1]. তিরমিযী হা/২১৮০; মিশকাত হা/৫৪০৮ ‘ফিতান’ অধ্যায়।
দলবিভক্তির একটি মন্দ দিক আছে। যা অত্র হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। যা জাতির জন্য অভিশাপ স্বরূপ। বনু ইস্রাঈলগণ তাওহীদের দাবীদার হওয়া সত্ত্বেও শিরকী বিশ্বাস ও হঠকারী আচরণের ফলে তারা অভিশপ্ত হয়েছে ও দলে দলে বিভক্ত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর অবস্থা যেন তেমনটি না হয়, সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাবধান করে গেছেন। ভবিষ্যতে এরূপ হতে পারে, সেজন্য উম্মতকে সতর্ক করে গেছেন। যেন তারা দলাদলি ও হিংসা-হানাহানিতে লিপ্ত না হয়।
কিন্তু মুসলিম উম্মাহ উক্ত সতর্কবাণী উপেক্ষা করে। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পূর্বোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী হযরত ওছমান (রাঃ)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের প্রাক্কাল থেকেই কার্যকর হতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর রাজনৈতিক দলাদলিকে যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ করতে গিয়ে সৃষ্টি হয় উছূলী বিভক্তি। এভাবে দলাদলির শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছে হযরত আলী (রাঃ)-কে এবং তৎপুত্র হযরত হোসায়েন, আশারায়ে মুবাশশারাহর সদস্য হযরত যোবায়ের, হযরত তালহা এবং পরে হযরত আব্দুল্লাহ বিন যোবায়ের (রাঃ) প্রমুখ খ্যাতনামা ছাহাবীগণকে। এরপর উমাইয়া শাসনামলে তাদের বিরোধী গণ্য করে খ্যাতনামা তাবেঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব, মুহাম্মাদ ‘নফসে যাকিইয়াহ’ (পবিত্রাত্মা) সহ শত শত বিদ্বান সরকারী নির্যাতন ও সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। বনু ইস্রাঈল তাদের হাযার হাযার নবীকে হত্যা করেছে। মুসলমানরা উম্মতের উপরোক্ত সেরা ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করেছে, যারা ছিলেন উম্মতের নক্ষত্রতুল্য। এরপর হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত দলের পন্ডিতবর্গ প্রাণান্ত কোশেশ করে যাচ্ছেন কুরআন-হাদীছের শব্দ বা মর্ম পরিবর্তন কিংবা সেখানে কিছু যোগ-বিয়োগ করার জন্য। কিন্তু আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের আপোষহীন ভূমিকার কারণে তারা সর্ব যুগে ব্যর্থ হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন, ভবিষ্যতেও হবেন এবং সেটা হ’তেই হবে। কেননা আল্লাহ স্বয়ং কুরআন ও হাদীছের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন (হিজর ১৫/৯; ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)। তথাপি বিদ‘আতী আলেমদের এই অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে ও থাকবে, যা ইহূদী-নাছারাদের তাওরাত-ইঞ্জীল বিকৃতির চেষ্টার সাথে অনেকটা তুলনীয়।
দল বিভক্তির অন্য দিকটি হ’ল আশীর্বাদ স্বরূপ। যা জাতির জন্য কল্যাণময়। যেমন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর মক্কার কুরায়েশরা যখন তাওহীদ বিচ্যুত হয়ে শিরকে নিমজ্জিত হয়েছিল ও কা‘বাগৃহকে মূর্তিগৃহে পরিণত করেছিল, তখন তাদেরই সন্তান মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাদেরকে শিরক থেকে তাওহীদের পথে ফিরে আসার আহবান জানান। ফলে তাদের শিরকী জামা‘আত বিভক্ত হয় এবং আবুবকর, আলী, ওছমান, ইবনু মাসঊদ, ওমর, হামযাহ প্রমুখের মত তাওহীদপন্থী বিশ্বসেরা মানুষের একটি দল সৃষ্টি হয়। এই দল ছিল মানবতার জন্য আশীর্বাদ স্বরপ। এরাই ছিলেন তখন ফের্কা নাজিয়াহ। যদিও আবু জাহলদের দৃষ্টিতে এরা ছিলেন ‘জামা‘আত বিভক্তকারী’ ও সমাজে অনৈক্য সৃষ্টিকারী। যুগে যুগে এরূপ ঘটবে এবং বাতিল থেকে হক পৃথক হয়ে যাবে। আর এটা আল্লাহরই বিধান। যেমন তিনি বলেন, مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ ‘আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমরা যে অবস্থায় রয়েছ সে অবস্থার উপর মুমিনদের ছেড়ে দিবেন যতক্ষণ না নাপাককে পাক থেকে (অর্থাৎ শিরককে তাওহীদ থেকে) পৃথক করেন’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)। বস্ত্ততঃ উক্ত বিধানের ধারাবাহিকতায় মুসলমানদের বাতিল ফের্কাসমূহ থেকে নাজী ফের্কা সর্বদা পৃথক হয়ে যাবে।
আলোচ্য হাদীছটি পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যা বলা যায়। যেখানে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُوْلَـئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ - ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না (অর্থাৎ ইহূদী-নাছারাদের মত হয়ো না), যারা তাদের নিকটে (আল্লাহর) স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও নিজেরা ফের্কায় ফের্কায় বিভক্ত হয়ে গেছে এবং পরস্পরে মতবিরোধ করেছে। বস্ত্ততঃ তাদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ দলাদলিকে দুনিয়াবী শাস্তির স্বাদ আস্বাদন হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَى أَن يَّبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَاباً مِّنْ فَوْقِكُمْ أَوْ مِنْ تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعاً وَيُذِيْقَ بَعْضَكُمْ بَأْسَ بَعْضٍ انْظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ - ‘(হে নবী!) তুমি বলে দাও, তিনি এ ব্যাপারে ক্ষমতাবান যে, তিনি তোমাদের উপরে কোন আযাব উপর থেকে বা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে প্রেরণ করবেন অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে ও উপদলে বিভক্ত করে সবাইকে মুখোমুখি করে দিবেন এবং পরস্পরকে আক্রমণের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। দেখ কিভাবে আমরা আয়াত সমূহ ব্যাখ্যা করে দিচ্ছি, যাতে তারা হৃদয়ঙ্গম করে’ (আন‘আম ৬/৬৫)।
( حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلاَنِيَةً لَكَانَ فِيْ أُمَّتِيْ مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ ) ‘এমনকি তাদের মধ্যে যদি কেউ এমনও থাকে, যে তার মায়ের সাথে প্রকাশ্যে যেনা করেছে, তাহ’লেও আমার উম্মতের মধ্যে তেমন লোকও পাওয়া যাবে, যে এমন কাজ করবে’। একথার মাধ্যমে একটি চূড়ান্ত অসম্ভব বিষয়কে উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হয়েছে বিগত অভিশপ্ত উম্মত বনু ইস্রাঈলের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করার জন্য। এখানে ‘মা’ বলতে ‘পিতার স্ত্রী’ বুঝানো হয়েছে, নিজের গর্ভধারিণী মা নয়। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, অভিশপ্ত ইহূদী ও পথভ্রষ্ট খ্রিষ্টানদের ন্যায় অবস্থা মুসলমানদেরও হবে।
( وَإِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً ) ‘আর বনু ইস্রাঈল ৭২টি ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল’। হযরত ‘আওফ বিন মালেক (রাঃ) হ’তে ইবনু মাজাহ বর্ণিত অপর হাদীছে এসেছে, ইহূদীরা ৭১টি ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল। সবাই জাহান্নামী ছিল এবং একটি মাত্র ফের্কা জান্নাতী ছিল। নাছারাগণ ৭২টি ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল। সবাই জাহান্নামী ছিল, একটি মাত্র ফের্কা জান্নাতী ছিল’।[1] একই মর্মে হাদীছ এসেছে হযরত আনাস, আবু হুরায়রা, আবু উমামাহ, আবুদ্দারদা, ওয়াছেলা ইবনুল আসক্বা‘ ও ইবনু মাসঊদ (রাঃ) সহ অন্যান্য ছাহাবী হ’তে।[2]
( مِلَّةٌ ) ‘মিল্লাত’ অর্থ তরীকা বা পথ-পন্থা। কিন্তু প্রায়োগিক অর্থ হ’ল ‘আহলে মিল্লাত’ বা তরীকার অনুসারী একটি দল। অর্থাৎ كل فعل وقول اجتمع عليه جماعة حقا كان أو باطلا ‘হক হেŠক বা বাতিল হৌক, মিল্লাত বলা হয় ঐসব কাজ ও কথাকে, যার উপরে একদল লোক একত্রিত হয়’। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এখানে ইহূদী-নাছারাদের আবিষ্কৃত বিভিন্ন তরীকা ও রীতি-পদ্ধতিকে ‘মিল্লাত’ বলে অভিহিত করেছেন বিস্তৃত অর্থে। কেননা তাদের এইসব তরীকার অনুসারী বিরাট বিরাট দল মওজুদ ছিল। যেমন এখনকার খ্রিষ্টান বিশ্ব রোমান ক্যাথলিক, প্রটেষ্ট্যান্ট ও অর্থডক্স নামে বড় বড় তিনটি দলে বিভক্ত।
‘মিল্লাত’-এর পারিভাষিক অর্থ হ’ল : مَا شَرَعَ اللهُ لِعِبَادِهِ عَلَى أَلْسِنَةِ أَنْبِيَاءِهِ لِيَتَوَصَّلُوْا بِهِ إِلىَ قُرْبَتِهِ ‘ঐ সকল বিধি-বিধান, যা আল্লাহ স্বীয় নবীগণের যবানে স্বীয় বান্দাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। যার মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলে সমর্থ হয়’। এর দ্বারা পূর্ববর্তী ও বর্তমান সকল এলাহী শরী‘আতকে বুঝানো হয়। পরবর্তীতে এই শব্দটি বিস্তৃত অর্থে ভাল ও মন্দ সকল দলকে বুঝানো হয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে, الْكُفْرُ مِلَّةٌ وَاحِدَةٌ ‘কাফের সবাই এক দলভুক্ত’। অর্থাৎ আল্লাহ্কে অস্বীকারের মূল প্রশ্নে কাফের সবাই এক দলভুক্ত। অনুরূপভাবে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝের বাইরে আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যকার ভ্রান্ত ও বিদ‘আতী ফের্কাগুলি সবাই মূলতঃ এক দলভুক্ত। যেমন বলা হয়, أَهْلُ الْبِدْعِ مِلَّةٌ وَاحِدَةٌ ‘বিদ‘আতী সবাই এক দলভুক্ত’।
( وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَى ثَلاَثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً ) ‘আর আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে’। এখানে ‘উম্মত’ বলতে أمة الإجابة অর্থাৎ ইসলাম কবুলকারী উম্মত বুঝানো হয়েছে أمة الدعوة নয়। অর্থাৎ ইসলাম কবুল করুক বা না করুক শেষনবী (ছাঃ)-এর আগমনের পর থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষ তাঁর উম্মত। যারা তাঁর দাওয়াত কবুল করে, তারা ‘মুসলিম’ ( أمة الإجابة )। আর যারা ইসলাম কবুল করেনি, তারাও তাঁর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত ( أمة الدعوة )। যাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া মুসলিম উম্মাহর প্রধান দায়িত্ব (আলে ইমরান ৩/১১০)। অতএব একই ক্বিবলার অনুসারী ৭৩ ফের্কাভুক্ত সকল মুসলমান একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। যদিও এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা তাকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। যেমন ঈমানের ৬টি স্তম্ভের* কোন একটিতে মিথ্যারোপ করা, অস্বীকার করা, সন্দেহ করা, এড়িয়ে চলা; আল্লাহ, রাসূল, কুরআন প্রভৃতি বিষয়ে ব্যঙ্গ করা, কটূক্তি করা ইত্যাদি।
[1]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২।
[2]. মির‘আত ১/২৭৬-৭৭।
কিন্তু মুসলিম উম্মাহ উক্ত সতর্কবাণী উপেক্ষা করে। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পূর্বোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী হযরত ওছমান (রাঃ)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের প্রাক্কাল থেকেই কার্যকর হতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর রাজনৈতিক দলাদলিকে যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ করতে গিয়ে সৃষ্টি হয় উছূলী বিভক্তি। এভাবে দলাদলির শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছে হযরত আলী (রাঃ)-কে এবং তৎপুত্র হযরত হোসায়েন, আশারায়ে মুবাশশারাহর সদস্য হযরত যোবায়ের, হযরত তালহা এবং পরে হযরত আব্দুল্লাহ বিন যোবায়ের (রাঃ) প্রমুখ খ্যাতনামা ছাহাবীগণকে। এরপর উমাইয়া শাসনামলে তাদের বিরোধী গণ্য করে খ্যাতনামা তাবেঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব, মুহাম্মাদ ‘নফসে যাকিইয়াহ’ (পবিত্রাত্মা) সহ শত শত বিদ্বান সরকারী নির্যাতন ও সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। বনু ইস্রাঈল তাদের হাযার হাযার নবীকে হত্যা করেছে। মুসলমানরা উম্মতের উপরোক্ত সেরা ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করেছে, যারা ছিলেন উম্মতের নক্ষত্রতুল্য। এরপর হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত দলের পন্ডিতবর্গ প্রাণান্ত কোশেশ করে যাচ্ছেন কুরআন-হাদীছের শব্দ বা মর্ম পরিবর্তন কিংবা সেখানে কিছু যোগ-বিয়োগ করার জন্য। কিন্তু আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের আপোষহীন ভূমিকার কারণে তারা সর্ব যুগে ব্যর্থ হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন, ভবিষ্যতেও হবেন এবং সেটা হ’তেই হবে। কেননা আল্লাহ স্বয়ং কুরআন ও হাদীছের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন (হিজর ১৫/৯; ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)। তথাপি বিদ‘আতী আলেমদের এই অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে ও থাকবে, যা ইহূদী-নাছারাদের তাওরাত-ইঞ্জীল বিকৃতির চেষ্টার সাথে অনেকটা তুলনীয়।
দল বিভক্তির অন্য দিকটি হ’ল আশীর্বাদ স্বরূপ। যা জাতির জন্য কল্যাণময়। যেমন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর মক্কার কুরায়েশরা যখন তাওহীদ বিচ্যুত হয়ে শিরকে নিমজ্জিত হয়েছিল ও কা‘বাগৃহকে মূর্তিগৃহে পরিণত করেছিল, তখন তাদেরই সন্তান মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাদেরকে শিরক থেকে তাওহীদের পথে ফিরে আসার আহবান জানান। ফলে তাদের শিরকী জামা‘আত বিভক্ত হয় এবং আবুবকর, আলী, ওছমান, ইবনু মাসঊদ, ওমর, হামযাহ প্রমুখের মত তাওহীদপন্থী বিশ্বসেরা মানুষের একটি দল সৃষ্টি হয়। এই দল ছিল মানবতার জন্য আশীর্বাদ স্বরপ। এরাই ছিলেন তখন ফের্কা নাজিয়াহ। যদিও আবু জাহলদের দৃষ্টিতে এরা ছিলেন ‘জামা‘আত বিভক্তকারী’ ও সমাজে অনৈক্য সৃষ্টিকারী। যুগে যুগে এরূপ ঘটবে এবং বাতিল থেকে হক পৃথক হয়ে যাবে। আর এটা আল্লাহরই বিধান। যেমন তিনি বলেন, مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ ‘আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমরা যে অবস্থায় রয়েছ সে অবস্থার উপর মুমিনদের ছেড়ে দিবেন যতক্ষণ না নাপাককে পাক থেকে (অর্থাৎ শিরককে তাওহীদ থেকে) পৃথক করেন’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)। বস্ত্ততঃ উক্ত বিধানের ধারাবাহিকতায় মুসলমানদের বাতিল ফের্কাসমূহ থেকে নাজী ফের্কা সর্বদা পৃথক হয়ে যাবে।
আলোচ্য হাদীছটি পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যা বলা যায়। যেখানে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُوْلَـئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ - ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না (অর্থাৎ ইহূদী-নাছারাদের মত হয়ো না), যারা তাদের নিকটে (আল্লাহর) স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও নিজেরা ফের্কায় ফের্কায় বিভক্ত হয়ে গেছে এবং পরস্পরে মতবিরোধ করেছে। বস্ত্ততঃ তাদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ দলাদলিকে দুনিয়াবী শাস্তির স্বাদ আস্বাদন হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَى أَن يَّبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَاباً مِّنْ فَوْقِكُمْ أَوْ مِنْ تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعاً وَيُذِيْقَ بَعْضَكُمْ بَأْسَ بَعْضٍ انْظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ - ‘(হে নবী!) তুমি বলে দাও, তিনি এ ব্যাপারে ক্ষমতাবান যে, তিনি তোমাদের উপরে কোন আযাব উপর থেকে বা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে প্রেরণ করবেন অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে ও উপদলে বিভক্ত করে সবাইকে মুখোমুখি করে দিবেন এবং পরস্পরকে আক্রমণের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। দেখ কিভাবে আমরা আয়াত সমূহ ব্যাখ্যা করে দিচ্ছি, যাতে তারা হৃদয়ঙ্গম করে’ (আন‘আম ৬/৬৫)।
( حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلاَنِيَةً لَكَانَ فِيْ أُمَّتِيْ مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ ) ‘এমনকি তাদের মধ্যে যদি কেউ এমনও থাকে, যে তার মায়ের সাথে প্রকাশ্যে যেনা করেছে, তাহ’লেও আমার উম্মতের মধ্যে তেমন লোকও পাওয়া যাবে, যে এমন কাজ করবে’। একথার মাধ্যমে একটি চূড়ান্ত অসম্ভব বিষয়কে উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হয়েছে বিগত অভিশপ্ত উম্মত বনু ইস্রাঈলের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করার জন্য। এখানে ‘মা’ বলতে ‘পিতার স্ত্রী’ বুঝানো হয়েছে, নিজের গর্ভধারিণী মা নয়। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, অভিশপ্ত ইহূদী ও পথভ্রষ্ট খ্রিষ্টানদের ন্যায় অবস্থা মুসলমানদেরও হবে।
( وَإِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً ) ‘আর বনু ইস্রাঈল ৭২টি ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল’। হযরত ‘আওফ বিন মালেক (রাঃ) হ’তে ইবনু মাজাহ বর্ণিত অপর হাদীছে এসেছে, ইহূদীরা ৭১টি ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল। সবাই জাহান্নামী ছিল এবং একটি মাত্র ফের্কা জান্নাতী ছিল। নাছারাগণ ৭২টি ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল। সবাই জাহান্নামী ছিল, একটি মাত্র ফের্কা জান্নাতী ছিল’।[1] একই মর্মে হাদীছ এসেছে হযরত আনাস, আবু হুরায়রা, আবু উমামাহ, আবুদ্দারদা, ওয়াছেলা ইবনুল আসক্বা‘ ও ইবনু মাসঊদ (রাঃ) সহ অন্যান্য ছাহাবী হ’তে।[2]
( مِلَّةٌ ) ‘মিল্লাত’ অর্থ তরীকা বা পথ-পন্থা। কিন্তু প্রায়োগিক অর্থ হ’ল ‘আহলে মিল্লাত’ বা তরীকার অনুসারী একটি দল। অর্থাৎ كل فعل وقول اجتمع عليه جماعة حقا كان أو باطلا ‘হক হেŠক বা বাতিল হৌক, মিল্লাত বলা হয় ঐসব কাজ ও কথাকে, যার উপরে একদল লোক একত্রিত হয়’। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এখানে ইহূদী-নাছারাদের আবিষ্কৃত বিভিন্ন তরীকা ও রীতি-পদ্ধতিকে ‘মিল্লাত’ বলে অভিহিত করেছেন বিস্তৃত অর্থে। কেননা তাদের এইসব তরীকার অনুসারী বিরাট বিরাট দল মওজুদ ছিল। যেমন এখনকার খ্রিষ্টান বিশ্ব রোমান ক্যাথলিক, প্রটেষ্ট্যান্ট ও অর্থডক্স নামে বড় বড় তিনটি দলে বিভক্ত।
‘মিল্লাত’-এর পারিভাষিক অর্থ হ’ল : مَا شَرَعَ اللهُ لِعِبَادِهِ عَلَى أَلْسِنَةِ أَنْبِيَاءِهِ لِيَتَوَصَّلُوْا بِهِ إِلىَ قُرْبَتِهِ ‘ঐ সকল বিধি-বিধান, যা আল্লাহ স্বীয় নবীগণের যবানে স্বীয় বান্দাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। যার মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলে সমর্থ হয়’। এর দ্বারা পূর্ববর্তী ও বর্তমান সকল এলাহী শরী‘আতকে বুঝানো হয়। পরবর্তীতে এই শব্দটি বিস্তৃত অর্থে ভাল ও মন্দ সকল দলকে বুঝানো হয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে, الْكُفْرُ مِلَّةٌ وَاحِدَةٌ ‘কাফের সবাই এক দলভুক্ত’। অর্থাৎ আল্লাহ্কে অস্বীকারের মূল প্রশ্নে কাফের সবাই এক দলভুক্ত। অনুরূপভাবে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝের বাইরে আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যকার ভ্রান্ত ও বিদ‘আতী ফের্কাগুলি সবাই মূলতঃ এক দলভুক্ত। যেমন বলা হয়, أَهْلُ الْبِدْعِ مِلَّةٌ وَاحِدَةٌ ‘বিদ‘আতী সবাই এক দলভুক্ত’।
( وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَى ثَلاَثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً ) ‘আর আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে’। এখানে ‘উম্মত’ বলতে أمة الإجابة অর্থাৎ ইসলাম কবুলকারী উম্মত বুঝানো হয়েছে أمة الدعوة নয়। অর্থাৎ ইসলাম কবুল করুক বা না করুক শেষনবী (ছাঃ)-এর আগমনের পর থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষ তাঁর উম্মত। যারা তাঁর দাওয়াত কবুল করে, তারা ‘মুসলিম’ ( أمة الإجابة )। আর যারা ইসলাম কবুল করেনি, তারাও তাঁর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত ( أمة الدعوة )। যাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া মুসলিম উম্মাহর প্রধান দায়িত্ব (আলে ইমরান ৩/১১০)। অতএব একই ক্বিবলার অনুসারী ৭৩ ফের্কাভুক্ত সকল মুসলমান একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। যদিও এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা তাকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। যেমন ঈমানের ৬টি স্তম্ভের* কোন একটিতে মিথ্যারোপ করা, অস্বীকার করা, সন্দেহ করা, এড়িয়ে চলা; আল্লাহ, রাসূল, কুরআন প্রভৃতি বিষয়ে ব্যঙ্গ করা, কটূক্তি করা ইত্যাদি।
[1]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২।
[2]. মির‘আত ১/২৭৬-৭৭।
ফের্কাবন্দীর অর্থ ‘আক্বীদাগত বিভক্তির কারণে সৃষ্ট দলাদলি’ ( افتراق الأمة بافتراق العقائد )। আলোচ্য হাদীছে افةراق الأمة বা উম্মতের ফের্কাবন্দী বলতে ছাহাবা, তাবেঈন ও আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীনের সুধারণা প্রসূত ব্যাখ্যাগত মতপার্থক্য কিংবা শরী‘আতের ব্যবহারিক শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে পার্থক্যকে বুঝানো হয়নি। অথবা দুনিয়াবী কোন বিষয়ে বিরোধ ও বিভক্তিকে বুঝানো হয়নি। বরং বিভিন্ন শিরকী ও বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমলের উদ্ভব ঘটিয়ে তার ভিত্তিতে সৃষ্ট দলসমূহকে বুঝানো হয়েছে। যারা প্রত্যেকে নিজেকে সঠিক বলে দাবী করে ও অন্যকে কাফির-ফাসিক ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে। যাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কহীনতা, শত্রুতা এমনকি হানাহানির অবস্থা বিরাজ করে। ৩৭ হিজরীর পর থেকে যার উদ্ভব ঘটে খারেজী ও শী‘আ নামে এবং প্রথম শতাব্দী হিজরীর শেষ দিকে উদ্ভব হয় ক্বাদারিয়া, জাবরিয়া, মুরজিয়া, অতঃপর মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত দলসমূহের। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
(১) আল্লাহর উপরে (২) তাঁর ফিরিশতাগণের উপরে (৩) আল্লাহ প্রেরিত কিতাব সমূহের উপরে (৪) রাসূলগণের উপরে (৫) বিচার দিবসের উপরে এবং (৬) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করা (মুসলিম, মিশকাত হা/২)।
উল্লেখ্য যে, দুনিয়াবী বিষয়ে পারস্পরিক মতপার্থক্য ও বিভক্তি তখনই গোনাহের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হবে, যখন তা আক্বীদাগত ও দ্বীনী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। যেমন হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যকার পারস্পরিক রাজনৈতিক মতবিরোধ ও পরিণামে যুদ্ধ-বিগ্রহ-কে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আ মতবাদ, যা একেবারেই ভ্রান্ত।
বস্ত্ততঃ বৈষয়িক মতভেদের কারণে দ্বীনী বিভক্তি সৃষ্টি করা ইহূদী-নাছারাদের স্বভাব। যা মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। তাই দেখা যায়, বৈষয়িক বিবাদ বা রাজনৈতিক মতভেদকে কেন্দ্র করে মুসলমানেরা নানা দলে ও মযহাবে বিভক্ত হচ্ছে এবং মসজিদ-ঈদগাহ পৃথক করছে। যা আল্লাহর কাছে আদৌ গৃহীত হবে না। প্রকৃত মুমিন যারা, তারা এসব থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহ বলেন, كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِيْنَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيْمَا اخْتَلَفُوْا فِيْهِ وَمَا اخْتَلَفَ فِيْهِ إِلاَّ الَّذِيْنَ أُوْتُوْهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ فَهَدَى اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا لِمَا اخْتَلَفُوْا فِيْهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ وَاللهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ . ‘মানবজাতি সকলে একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে প্রেরণ করলেন জান্নাতের সুসংবাদ দাতা ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী রূপে। আর তিনি তাদের সাথে সত্যসহ কিতাব নাযিল করলেন, যাতে তা তাদের মতভেদের বিষয়গুলি সমাধান করে দেয়। অথচ যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন সমূহ এসে যাওয়ার পরেও তারা আল্লাহর কিতাবে মতভেদ ঘটালো পরস্পরে হঠকারিতা বশতঃ। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে ঈমানদারগণকে এ ব্যাপারে সত্যের দিকে পথপ্রদর্শন করলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২১৩)।
এতে দেখা যাচ্ছে যে, পারস্পরিক হিংসা-অহংকার এবং যিদ ও হঠকারিতাই হ’ল ফের্কাবন্দীর মূল কারণ। অহংকার কাকে বলে সে বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ ‘অহংকার হ’ল সত্যকে দম্ভের সাথে পরিত্যাগ করা ও মানুষকে হেয় এবং তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[1] বস্ত্ততঃ ইহূদী-নাছারারা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য জেনেও তাঁকে মানেনি (বাক্বারাহ ২/১৪৬) কেবল বিদ্বেষ বশতঃ। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্য থেকে ঈমানদার একটি দলকে ইসলামের প্রতি হেদায়াত দান করেছিলেন এবং তারা ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়েছিল। যেমন আব্দুল্লাহ বিন সালাম, আদী বিন হাতেম, বাদশাহ নাজাশী প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের অনুসারীগণ। এরাই ছিলেন আহলে কিতাবদের মধ্যে নাজী ফের্কা।
নেককার মানুষ কখনোই বিভক্তি চায় না। দুষ্টু নেতারাই সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে যিদ ও অহংকার বশে। অথচ দোষ চাপায় হকপন্থী সৎলোকদের উপরে। এমতাবস্থায় নাজী ফের্কার লোকেরা হক-এর উপর দৃঢ় থাকে এবং অন্যদের বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘অনন্তর যদি তারা বিশ্বাস স্থাপন করে যেরূপ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তাহ’লে তারা সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে তারা যিদ-এর মধ্যে রয়েছে। অতএব তাদের ব্যাপারে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন’ (বাক্বারাহ ২/১৩৭)। এতে পরিষ্কার যে, নাজী ফের্কা কখনো বাতিলের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে যাবে না। তারা সর্বদা নিজ আক্বীদা ও বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থাকবে।
ব্যবহারিক শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে বিভিন্ন মাযহাবী পার্থক্য মূলতঃ দোষণীয় নয়। কিন্তু এটা দোষণীয় এবং কবীরা গোনাহের পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখনই, যখন তার কারণে তাক্বলীদ[2] সৃষ্টি হয় এবং নিজের মাযহাবের বাইরের কোন ছহীহ হাদীছকে অগ্রাহ্য বা এড়িয়ে যাওয়া হয়। সাথে সাথে তার ভিত্তিতে উম্মত বিভক্ত হয় ও পারস্পরিক দলাদলি ও হিংসা-হানাহানিতে লিপ্ত হয়। নিঃসন্দেহে এটাও ফের্কাবন্দী, যা থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন (আন‘আম ৬/১৫৯)।
( ثَلاَثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً ) ‘৭৩ ফের্কা’। এর তাৎপর্য বিষয়ে বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এর সংখ্যা কি ৭৩-য়ে সীমায়িত, না কি এর অর্থ অগণিত? কেউ বলেছেন, এর অর্থ অগণিত। কেননা বিদ‘আতী দল ও উপদলের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার সংখ্যা গণনা করাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে। কেউ বলেছেন যে, সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাক, তার সংখ্যা ৭৩-এর মধ্যেই সীমায়িত হ’তে হবে। এ বিষয়ে বিদ্বানগণ বিদ‘আতী ফের্কা সমূহের সংখ্যা গণনা করেছেন। যেমন কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, উছূল বা মূলনীতির দিক দিয়ে সকল বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত ফের্কা ৪টি মূল দলে বিভক্ত : খারেজী, শী‘আ, ক্বাদারিয়া ও মুর্জিয়া। প্রত্যেকটি দল ১৮টি করে উপদলে বিভক্ত হয়ে মোট ৭২টি দল হয়েছে। বাকী ১টি দল হ’ল নাজী ফের্কা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’। আব্দুল করীম শাহরাস্তানীও অনুরূপ চারটি মূল দলে বিভক্ত করেছেন। কোন কোন বিদ্বান উপরোক্ত চারটি দলের সাথে আরও চারটি যোগ করে মোট ৮টি মূল দল বলেছেন। বাকী ৪টি হ’ল মু‘তাযিলা, মুশাবিবহা, জাবরিয়া ও নাজ্জারিয়া। কেউ বলেছেন, মূল দল হ’ল ৬টি : হারূরিয়া (খারেজী), ক্বাদারিয়া, জাহমিয়া, মুর্জিয়া, রাফেযাহ (শী‘আ), জাবরিয়া। তবে শেষের ৮টি ও ৬টি প্রথম ৪টির মতই। তাই উত্তম হবে ভ্রান্ত দল সমূহের সংখ্যা নির্দিষ্ট না করা। যার সবগুলি নাজী ফের্কার আক্বীদা ও আমলের বিরোধী। ভ্রান্ত ফের্কাগুলির বিস্তৃত আক্বীদা জানার জন্য ইবনু হযমের আল-ফিছাল, শাহরাস্তানীর আল-মিলাল, আব্দুল ক্বাহের বাগদাদীর উছূলুদ্দীন এবং আল-ফারকু বায়নাল ফিরাক্ব, আব্দুল কাদের জীলানীর কিতাবুল গুনিয়াহ, শাত্বেবীর আল-ই‘তিছাম প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
তবে আবু ইসহাক শাত্বেবী, আবুবকর তারতূশী, ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী প্রমুখের চিন্তাধারা এই যে, ফের্কায়ে নাজিয়াহর বিপরীতে ভ্রান্ত দল সমূহের এই সংখ্যাকে ৭২-এর মধ্যে সীমায়িত করা যুক্তিসংগত নয়। কেননা ক্বিয়ামত পর্যন্ত ভ্রান্ত দল ও উপদলের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। শাত্বেবী বলেন, ভ্রান্ত দলসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক- যাদের সম্পর্কে হাদীছে সাবধান করা হয়েছে। যেমন- খারেজী, মুর্জিয়া, ক্বাদারিয়া প্রভৃতি। দুই- যাদের সম্পর্কে হাদীছে নাম করে কিছু বলা হয়নি। অথচ এরাই হ’ল হাদীছের ভাষায় قُلُوبُهُمْ قُلُوبُ الشَّيَاطِينِ فِى جُثْمَانِ إِنْسٍ অর্থাৎ ‘মানবরূপী শয়তান’।[3] যারা বিভিন্ন যুক্তি ও জৌলুসের মাধ্যমে সরল-সিধা মুমিনকে পথভ্রষ্ট করে।
এদের কতগুলি নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেগুলিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। সংক্ষিপ্ত ( إجمالي ) ও বিস্তারিত ( تفصيلي )। প্রথমটির মৌলিক নিদর্শন হ’ল তিনটি। যথা- (ক) বিভেদ সৃষ্টি করা ( الفُرقة )। যার মাধ্যমে তারা পরস্পরে বিদ্বেষ, শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত করে, যা ধর্মীয় ও সামাজিক ঐক্য ধ্বংসের কারণ হয়। (খ) ‘মুহকাম’ (স্পষ্ট) আয়াত সমূহ বাদ দিয়ে কুরআনের ‘মুতাশাবিহ’ (অস্পষ্ট) আয়াত সমূহের পিছে পড়ে থাকা। (গ) প্রবৃত্তির অনুসরণ করা এবং নিজস্ব রায়কে শারঈ দলীল সমূহের উপরে অগ্রাধিকার দেয়া। অতঃপর প্রত্যেক ভ্রান্ত ব্যক্তি বা দলের বিস্তারিত নিদর্শন সমূহ ( علاماة ةفصيلية ) কুরআন ও সুন্নাহর দলীল সমূহের প্রতি দৃকপাত করলে যেকোন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আলেম তাদেরকে সহজে চিহ্নিত করতে পারবেন’।[4]
আমরা মনে করি যে, ৭১, ৭২ ও ৭৩ বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরবীয় বাকরীতি অনুযায়ী ‘আধিক্য এবং আধিক্যের পরিমাণ’ বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে চেয়েছেন যে, ক্বিয়ামত যতই ঘনিয়ে আসবে, উম্মতের ভাঙন, পদস্খলন ও ফের্কাবন্দী ততই বৃদ্ধি পাবে। অতএব অগ্রগামী উম্মত হিসাবে ইহূদীরা ৭১ দলে, পরবর্তী উম্মত হিসাবে নাছারাগণ ৭২ দলে এবং তার পরবর্তী ও সর্বশেষ উম্মত হিসাবে মুসলিম উম্মাহ ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। অর্থাৎ তাদের ভাঙন ও অধঃপতন বিগত সকল উম্মতের চাইতে বেশী হবে। এভাবে সারা পৃথিবীতে যখন একজন তাওহীদপন্থী মুমিনও অবশিষ্ট থাকবে না, তখনই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।[5]
( كُلُّهُمْ فِي النَّارِ ) ‘তাদের সবাই জাহান্নামে যাবে’। অর্থাৎ كلهم يستحقون الدخول في النار من أجل اختلاف العقائد ‘সবাই জাহান্নামে প্রবেশের হকদার হবে ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পন্ন হওয়ার কারণে’। অতঃপর যাদের আক্বীদা কুফরীর পর্যায়ভুক্ত ছিল, তারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী হবে (নিসা ৪/১৬৮-৬৯)। তাছাড়া ‘যে ব্যক্তি শিরক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (মায়েদাহ ৫/৭২)। একইভাবে কপটবিশ্বাসী মুনাফিকরাও কাফিরদের সাথে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী হবে (তওবা ৯/৬৮)। পক্ষান্তরে যাদের আক্বীদা ঐরূপ নিম্নপর্যায়ভুক্ত ছিল না, তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা না করলে জাহান্নামে যাবে। আর ক্ষমা করলে মুক্তি পাবে। কেননা ‘আল্লাহ শিরক ব্যতীত অন্য সকল গোনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করতে পারেন’ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)। তবে শেষোক্ত পর্যায়ের জাহান্নামীরা তাদের খালেছ ঈমানের কারণে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আতের ফলে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে অবশেষে মুক্তি পাবে ও জান্নাতে যাবে।[6]
( إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً ) ‘একটি দল ব্যতীত’। অর্থাৎ এরা শুরুতেই জান্নাতে যাবে। এখানে مِلَّةً -এর শেষ অক্ষরে দু’যবর হয়েছে দু’যের-এর স্থলে। যাকে منصوب بنزع خافض বলা হয়ে থাকে। কেননা এটি আসলে ছিল إِلاَّ أَهْلُ مِلَّةٍ وَاحِدَةٍ ‘একটি তরীকার অনুসারী দল ব্যতীত’। অর্থাৎ এই দলের লোকেরা ছহীহ আক্বীদার অনুসারী হবে। কেননা জান্নাত লাভের জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদাই হ’ল প্রধানতম শর্ত।
শাত্বেবী বলেন, إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً বলার মাধ্যমে একটি বিষয় প্রতিভাত হয়েছে যে, إن الحق واحد لا يختلف ‘হক একটাই হয়। একাধিক নয়’। হাদীছে জাহান্নামী দলসমূহের বিপরীতে একটিমাত্র জান্নাতী দলের উল্লেখ করার মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে, হাযারো দাবী করলেও ভ্রান্ত দলগুলি কখনোই হকপন্থী নয়। হক মাত্র একটি দলের সাথেই রয়েছে। إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً বলার মাধ্যমে একথাও ফুটে উঠেছে যে, অন্যান্য দলের ভ্রান্ত আক্বীদা ও আমলের ফায়ছালাকারী হ’ল এই একটি দল। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ ‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে ঝগড়া কর, তাহ’লে সে বিষয়টিকে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে’ (নিসা ৪/৫৯)। অতএব কুরআন ও সুন্নাহর (প্রকাশ্য অর্থের) অনুসারীদের জন্য কোনরূপ ফের্কা সৃষ্টির অবকাশ নেই’।
( قَالُوْا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ ) ‘তারা বললেন, সেই দল কোনটি হে আল্লাহর রাসূল?’ অর্থাৎ সেই মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি?
( قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ ) ‘তিনি বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যে তরীকার উপরে আছি, তার উপরে যারা দৃঢ় থাকবে’। হাকেম বর্ণিত ‘হাসান’ সনদে এসেছে, مَا أَنَا عَلَيْهِ الْيَوْمَ وَأَصْحَابِي ‘আজকের দিনে আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি’।[7] এর অর্থ, أهل تلك الملة الواحدة من كان على ما أنا عليه وأصحابي من الاعتقاد والقول والعمل - ‘উক্ত মুক্তিপ্রাপ্ত দলভুক্ত লোক তারাই হবে, যারা আমার ও আমার ছাহাবীগণের বিশ্বাস, কথা ও কর্মের উপরে দৃঢ় থাকবে’। এর দ্বারা প্রতিভাত হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং ছাহাবায়ে কেরামের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহর বুঝ হাছিল করা ও সেমতে জীবন পরিচালনা করাটাই নাজী ফের্কার লোকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কেননা ছাহাবীগণ সরাসরি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে দ্বীন শিখেছেন এবং দ্বীন সম্পর্কে তারাই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় চাক্ষুষ জ্ঞান লাভ করেছেন। হাদীছে দলের নাম করা হয়নি। বরং তাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। আর এটাই আরবদের বাকরীতি ছিল। কেননা আমলটাই বড় কথা, আমলকারী নয়।
এক্ষণে যে সকল মুমিন নর-নারী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত তথা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী সার্বিক জীবন পরিচালনায় ব্রতী হবেন, তারাই হবেন মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা আল্লাহর রহমতে শুরুতেই জান্নাতে যাবেন। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ হ’ল সরল পথ। এতদ্ব্যতীত ইজমা-ক্বিয়াস ইত্যাদি সেখান থেকে নির্গত বিষয়। তা কখনোই মূল নয় বা ভ্রান্তির আশংকামুক্ত নয়। আর ‘ইজমা’ বলতে কেবল ছাহাবায়ে কেরামের ইজমা-কে বুঝায়। কেননা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, مَنِ ادَّعَي الْإِجْمَاعَ ( بَعْدَ الصَّحَابَةِ ) فَهُوَ كَاذِبٌ ‘(ছাহাবীগণের পরে) যে ব্যক্তি (উম্মতের) ইজমা-এর দাবী করে, সে মিথ্যাবাদী’।[8] নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রহঃ) মাযহাবী আলেমদের যত্রতত্র ইজমা-র দাবী সম্পর্কে তীব্র মন্তব্য করে বলেন, هذه مفسدة عظيمة ‘এটি ভয়ংকর ফাসাদ সৃষ্টিকারী বিষয়’।[9]
[1]. মুসলিম হা/৯১, মিশকাত হা/৫১০৮ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়-২৫, ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ-২০।
[2]. শারঈ বিষয়ে বিনা দলীলে কারু কোন কথার অন্ধ অনুসরণকে তাক্বলীদ বলা হয়। পক্ষান্তরে দলীলের অনুসরণকে ইত্তেবা বলা হয়। ইসলামে তাক্বলীদ নিষিদ্ধ ও ইত্তেবা অপরিহার্য।
[3]. বুখারী, মুসলিম হা/১৮৪৭; মিশকাত হা/৫৩৮২।
[4]. মির‘আত ১/২৭৩।
[5]. মুসলিম হা/১৪৮; মিশকাত হা/৫৫১৬ ‘ফিতান’ অধ্যায়-২৭ অনুচ্ছেদ-৭; আহমাদ হা/১৩১৬০।
[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭২-৮৭ ‘কিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮ ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ-৪।
[7]. হাকেম হা/৪৪৪, ১/১২৯ পৃঃ; ‘মতন নিরাপদ’ যঈফাহ হা/১০৩৫-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য ৩/১২৬ পৃঃ; তিরমিযী হা/২৬৪১; মিশকাত হা/১৭১।
[8]. মির‘আত ১/২৭৯-৮০।
[9]. ছহীহ মুসলিম-এর ভাষ্যগ্রন্থ আস-সিরাজুল ওয়াহহাজ ১/৩ পৃঃ।
(১) আল্লাহর উপরে (২) তাঁর ফিরিশতাগণের উপরে (৩) আল্লাহ প্রেরিত কিতাব সমূহের উপরে (৪) রাসূলগণের উপরে (৫) বিচার দিবসের উপরে এবং (৬) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করা (মুসলিম, মিশকাত হা/২)।
উল্লেখ্য যে, দুনিয়াবী বিষয়ে পারস্পরিক মতপার্থক্য ও বিভক্তি তখনই গোনাহের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হবে, যখন তা আক্বীদাগত ও দ্বীনী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। যেমন হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যকার পারস্পরিক রাজনৈতিক মতবিরোধ ও পরিণামে যুদ্ধ-বিগ্রহ-কে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আ মতবাদ, যা একেবারেই ভ্রান্ত।
বস্ত্ততঃ বৈষয়িক মতভেদের কারণে দ্বীনী বিভক্তি সৃষ্টি করা ইহূদী-নাছারাদের স্বভাব। যা মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। তাই দেখা যায়, বৈষয়িক বিবাদ বা রাজনৈতিক মতভেদকে কেন্দ্র করে মুসলমানেরা নানা দলে ও মযহাবে বিভক্ত হচ্ছে এবং মসজিদ-ঈদগাহ পৃথক করছে। যা আল্লাহর কাছে আদৌ গৃহীত হবে না। প্রকৃত মুমিন যারা, তারা এসব থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহ বলেন, كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِيْنَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيْمَا اخْتَلَفُوْا فِيْهِ وَمَا اخْتَلَفَ فِيْهِ إِلاَّ الَّذِيْنَ أُوْتُوْهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ فَهَدَى اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا لِمَا اخْتَلَفُوْا فِيْهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ وَاللهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ . ‘মানবজাতি সকলে একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে প্রেরণ করলেন জান্নাতের সুসংবাদ দাতা ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী রূপে। আর তিনি তাদের সাথে সত্যসহ কিতাব নাযিল করলেন, যাতে তা তাদের মতভেদের বিষয়গুলি সমাধান করে দেয়। অথচ যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন সমূহ এসে যাওয়ার পরেও তারা আল্লাহর কিতাবে মতভেদ ঘটালো পরস্পরে হঠকারিতা বশতঃ। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে ঈমানদারগণকে এ ব্যাপারে সত্যের দিকে পথপ্রদর্শন করলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২১৩)।
এতে দেখা যাচ্ছে যে, পারস্পরিক হিংসা-অহংকার এবং যিদ ও হঠকারিতাই হ’ল ফের্কাবন্দীর মূল কারণ। অহংকার কাকে বলে সে বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ ‘অহংকার হ’ল সত্যকে দম্ভের সাথে পরিত্যাগ করা ও মানুষকে হেয় এবং তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[1] বস্ত্ততঃ ইহূদী-নাছারারা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য জেনেও তাঁকে মানেনি (বাক্বারাহ ২/১৪৬) কেবল বিদ্বেষ বশতঃ। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্য থেকে ঈমানদার একটি দলকে ইসলামের প্রতি হেদায়াত দান করেছিলেন এবং তারা ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়েছিল। যেমন আব্দুল্লাহ বিন সালাম, আদী বিন হাতেম, বাদশাহ নাজাশী প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের অনুসারীগণ। এরাই ছিলেন আহলে কিতাবদের মধ্যে নাজী ফের্কা।
নেককার মানুষ কখনোই বিভক্তি চায় না। দুষ্টু নেতারাই সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে যিদ ও অহংকার বশে। অথচ দোষ চাপায় হকপন্থী সৎলোকদের উপরে। এমতাবস্থায় নাজী ফের্কার লোকেরা হক-এর উপর দৃঢ় থাকে এবং অন্যদের বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘অনন্তর যদি তারা বিশ্বাস স্থাপন করে যেরূপ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তাহ’লে তারা সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে তারা যিদ-এর মধ্যে রয়েছে। অতএব তাদের ব্যাপারে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন’ (বাক্বারাহ ২/১৩৭)। এতে পরিষ্কার যে, নাজী ফের্কা কখনো বাতিলের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে যাবে না। তারা সর্বদা নিজ আক্বীদা ও বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থাকবে।
ব্যবহারিক শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে বিভিন্ন মাযহাবী পার্থক্য মূলতঃ দোষণীয় নয়। কিন্তু এটা দোষণীয় এবং কবীরা গোনাহের পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখনই, যখন তার কারণে তাক্বলীদ[2] সৃষ্টি হয় এবং নিজের মাযহাবের বাইরের কোন ছহীহ হাদীছকে অগ্রাহ্য বা এড়িয়ে যাওয়া হয়। সাথে সাথে তার ভিত্তিতে উম্মত বিভক্ত হয় ও পারস্পরিক দলাদলি ও হিংসা-হানাহানিতে লিপ্ত হয়। নিঃসন্দেহে এটাও ফের্কাবন্দী, যা থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন (আন‘আম ৬/১৫৯)।
( ثَلاَثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً ) ‘৭৩ ফের্কা’। এর তাৎপর্য বিষয়ে বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এর সংখ্যা কি ৭৩-য়ে সীমায়িত, না কি এর অর্থ অগণিত? কেউ বলেছেন, এর অর্থ অগণিত। কেননা বিদ‘আতী দল ও উপদলের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার সংখ্যা গণনা করাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে। কেউ বলেছেন যে, সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাক, তার সংখ্যা ৭৩-এর মধ্যেই সীমায়িত হ’তে হবে। এ বিষয়ে বিদ্বানগণ বিদ‘আতী ফের্কা সমূহের সংখ্যা গণনা করেছেন। যেমন কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, উছূল বা মূলনীতির দিক দিয়ে সকল বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত ফের্কা ৪টি মূল দলে বিভক্ত : খারেজী, শী‘আ, ক্বাদারিয়া ও মুর্জিয়া। প্রত্যেকটি দল ১৮টি করে উপদলে বিভক্ত হয়ে মোট ৭২টি দল হয়েছে। বাকী ১টি দল হ’ল নাজী ফের্কা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’। আব্দুল করীম শাহরাস্তানীও অনুরূপ চারটি মূল দলে বিভক্ত করেছেন। কোন কোন বিদ্বান উপরোক্ত চারটি দলের সাথে আরও চারটি যোগ করে মোট ৮টি মূল দল বলেছেন। বাকী ৪টি হ’ল মু‘তাযিলা, মুশাবিবহা, জাবরিয়া ও নাজ্জারিয়া। কেউ বলেছেন, মূল দল হ’ল ৬টি : হারূরিয়া (খারেজী), ক্বাদারিয়া, জাহমিয়া, মুর্জিয়া, রাফেযাহ (শী‘আ), জাবরিয়া। তবে শেষের ৮টি ও ৬টি প্রথম ৪টির মতই। তাই উত্তম হবে ভ্রান্ত দল সমূহের সংখ্যা নির্দিষ্ট না করা। যার সবগুলি নাজী ফের্কার আক্বীদা ও আমলের বিরোধী। ভ্রান্ত ফের্কাগুলির বিস্তৃত আক্বীদা জানার জন্য ইবনু হযমের আল-ফিছাল, শাহরাস্তানীর আল-মিলাল, আব্দুল ক্বাহের বাগদাদীর উছূলুদ্দীন এবং আল-ফারকু বায়নাল ফিরাক্ব, আব্দুল কাদের জীলানীর কিতাবুল গুনিয়াহ, শাত্বেবীর আল-ই‘তিছাম প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
তবে আবু ইসহাক শাত্বেবী, আবুবকর তারতূশী, ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী প্রমুখের চিন্তাধারা এই যে, ফের্কায়ে নাজিয়াহর বিপরীতে ভ্রান্ত দল সমূহের এই সংখ্যাকে ৭২-এর মধ্যে সীমায়িত করা যুক্তিসংগত নয়। কেননা ক্বিয়ামত পর্যন্ত ভ্রান্ত দল ও উপদলের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। শাত্বেবী বলেন, ভ্রান্ত দলসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক- যাদের সম্পর্কে হাদীছে সাবধান করা হয়েছে। যেমন- খারেজী, মুর্জিয়া, ক্বাদারিয়া প্রভৃতি। দুই- যাদের সম্পর্কে হাদীছে নাম করে কিছু বলা হয়নি। অথচ এরাই হ’ল হাদীছের ভাষায় قُلُوبُهُمْ قُلُوبُ الشَّيَاطِينِ فِى جُثْمَانِ إِنْسٍ অর্থাৎ ‘মানবরূপী শয়তান’।[3] যারা বিভিন্ন যুক্তি ও জৌলুসের মাধ্যমে সরল-সিধা মুমিনকে পথভ্রষ্ট করে।
এদের কতগুলি নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেগুলিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। সংক্ষিপ্ত ( إجمالي ) ও বিস্তারিত ( تفصيلي )। প্রথমটির মৌলিক নিদর্শন হ’ল তিনটি। যথা- (ক) বিভেদ সৃষ্টি করা ( الفُرقة )। যার মাধ্যমে তারা পরস্পরে বিদ্বেষ, শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত করে, যা ধর্মীয় ও সামাজিক ঐক্য ধ্বংসের কারণ হয়। (খ) ‘মুহকাম’ (স্পষ্ট) আয়াত সমূহ বাদ দিয়ে কুরআনের ‘মুতাশাবিহ’ (অস্পষ্ট) আয়াত সমূহের পিছে পড়ে থাকা। (গ) প্রবৃত্তির অনুসরণ করা এবং নিজস্ব রায়কে শারঈ দলীল সমূহের উপরে অগ্রাধিকার দেয়া। অতঃপর প্রত্যেক ভ্রান্ত ব্যক্তি বা দলের বিস্তারিত নিদর্শন সমূহ ( علاماة ةفصيلية ) কুরআন ও সুন্নাহর দলীল সমূহের প্রতি দৃকপাত করলে যেকোন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আলেম তাদেরকে সহজে চিহ্নিত করতে পারবেন’।[4]
আমরা মনে করি যে, ৭১, ৭২ ও ৭৩ বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরবীয় বাকরীতি অনুযায়ী ‘আধিক্য এবং আধিক্যের পরিমাণ’ বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে চেয়েছেন যে, ক্বিয়ামত যতই ঘনিয়ে আসবে, উম্মতের ভাঙন, পদস্খলন ও ফের্কাবন্দী ততই বৃদ্ধি পাবে। অতএব অগ্রগামী উম্মত হিসাবে ইহূদীরা ৭১ দলে, পরবর্তী উম্মত হিসাবে নাছারাগণ ৭২ দলে এবং তার পরবর্তী ও সর্বশেষ উম্মত হিসাবে মুসলিম উম্মাহ ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। অর্থাৎ তাদের ভাঙন ও অধঃপতন বিগত সকল উম্মতের চাইতে বেশী হবে। এভাবে সারা পৃথিবীতে যখন একজন তাওহীদপন্থী মুমিনও অবশিষ্ট থাকবে না, তখনই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।[5]
( كُلُّهُمْ فِي النَّارِ ) ‘তাদের সবাই জাহান্নামে যাবে’। অর্থাৎ كلهم يستحقون الدخول في النار من أجل اختلاف العقائد ‘সবাই জাহান্নামে প্রবেশের হকদার হবে ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পন্ন হওয়ার কারণে’। অতঃপর যাদের আক্বীদা কুফরীর পর্যায়ভুক্ত ছিল, তারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী হবে (নিসা ৪/১৬৮-৬৯)। তাছাড়া ‘যে ব্যক্তি শিরক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (মায়েদাহ ৫/৭২)। একইভাবে কপটবিশ্বাসী মুনাফিকরাও কাফিরদের সাথে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী হবে (তওবা ৯/৬৮)। পক্ষান্তরে যাদের আক্বীদা ঐরূপ নিম্নপর্যায়ভুক্ত ছিল না, তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা না করলে জাহান্নামে যাবে। আর ক্ষমা করলে মুক্তি পাবে। কেননা ‘আল্লাহ শিরক ব্যতীত অন্য সকল গোনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করতে পারেন’ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)। তবে শেষোক্ত পর্যায়ের জাহান্নামীরা তাদের খালেছ ঈমানের কারণে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আতের ফলে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে অবশেষে মুক্তি পাবে ও জান্নাতে যাবে।[6]
( إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً ) ‘একটি দল ব্যতীত’। অর্থাৎ এরা শুরুতেই জান্নাতে যাবে। এখানে مِلَّةً -এর শেষ অক্ষরে দু’যবর হয়েছে দু’যের-এর স্থলে। যাকে منصوب بنزع خافض বলা হয়ে থাকে। কেননা এটি আসলে ছিল إِلاَّ أَهْلُ مِلَّةٍ وَاحِدَةٍ ‘একটি তরীকার অনুসারী দল ব্যতীত’। অর্থাৎ এই দলের লোকেরা ছহীহ আক্বীদার অনুসারী হবে। কেননা জান্নাত লাভের জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদাই হ’ল প্রধানতম শর্ত।
শাত্বেবী বলেন, إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً বলার মাধ্যমে একটি বিষয় প্রতিভাত হয়েছে যে, إن الحق واحد لا يختلف ‘হক একটাই হয়। একাধিক নয়’। হাদীছে জাহান্নামী দলসমূহের বিপরীতে একটিমাত্র জান্নাতী দলের উল্লেখ করার মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে, হাযারো দাবী করলেও ভ্রান্ত দলগুলি কখনোই হকপন্থী নয়। হক মাত্র একটি দলের সাথেই রয়েছে। إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً বলার মাধ্যমে একথাও ফুটে উঠেছে যে, অন্যান্য দলের ভ্রান্ত আক্বীদা ও আমলের ফায়ছালাকারী হ’ল এই একটি দল। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ ‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে ঝগড়া কর, তাহ’লে সে বিষয়টিকে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে’ (নিসা ৪/৫৯)। অতএব কুরআন ও সুন্নাহর (প্রকাশ্য অর্থের) অনুসারীদের জন্য কোনরূপ ফের্কা সৃষ্টির অবকাশ নেই’।
( قَالُوْا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ ) ‘তারা বললেন, সেই দল কোনটি হে আল্লাহর রাসূল?’ অর্থাৎ সেই মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি?
( قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ ) ‘তিনি বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যে তরীকার উপরে আছি, তার উপরে যারা দৃঢ় থাকবে’। হাকেম বর্ণিত ‘হাসান’ সনদে এসেছে, مَا أَنَا عَلَيْهِ الْيَوْمَ وَأَصْحَابِي ‘আজকের দিনে আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি’।[7] এর অর্থ, أهل تلك الملة الواحدة من كان على ما أنا عليه وأصحابي من الاعتقاد والقول والعمل - ‘উক্ত মুক্তিপ্রাপ্ত দলভুক্ত লোক তারাই হবে, যারা আমার ও আমার ছাহাবীগণের বিশ্বাস, কথা ও কর্মের উপরে দৃঢ় থাকবে’। এর দ্বারা প্রতিভাত হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং ছাহাবায়ে কেরামের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহর বুঝ হাছিল করা ও সেমতে জীবন পরিচালনা করাটাই নাজী ফের্কার লোকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কেননা ছাহাবীগণ সরাসরি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে দ্বীন শিখেছেন এবং দ্বীন সম্পর্কে তারাই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় চাক্ষুষ জ্ঞান লাভ করেছেন। হাদীছে দলের নাম করা হয়নি। বরং তাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। আর এটাই আরবদের বাকরীতি ছিল। কেননা আমলটাই বড় কথা, আমলকারী নয়।
এক্ষণে যে সকল মুমিন নর-নারী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত তথা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী সার্বিক জীবন পরিচালনায় ব্রতী হবেন, তারাই হবেন মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা আল্লাহর রহমতে শুরুতেই জান্নাতে যাবেন। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ হ’ল সরল পথ। এতদ্ব্যতীত ইজমা-ক্বিয়াস ইত্যাদি সেখান থেকে নির্গত বিষয়। তা কখনোই মূল নয় বা ভ্রান্তির আশংকামুক্ত নয়। আর ‘ইজমা’ বলতে কেবল ছাহাবায়ে কেরামের ইজমা-কে বুঝায়। কেননা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, مَنِ ادَّعَي الْإِجْمَاعَ ( بَعْدَ الصَّحَابَةِ ) فَهُوَ كَاذِبٌ ‘(ছাহাবীগণের পরে) যে ব্যক্তি (উম্মতের) ইজমা-এর দাবী করে, সে মিথ্যাবাদী’।[8] নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রহঃ) মাযহাবী আলেমদের যত্রতত্র ইজমা-র দাবী সম্পর্কে তীব্র মন্তব্য করে বলেন, هذه مفسدة عظيمة ‘এটি ভয়ংকর ফাসাদ সৃষ্টিকারী বিষয়’।[9]
[1]. মুসলিম হা/৯১, মিশকাত হা/৫১০৮ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়-২৫, ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ-২০।
[2]. শারঈ বিষয়ে বিনা দলীলে কারু কোন কথার অন্ধ অনুসরণকে তাক্বলীদ বলা হয়। পক্ষান্তরে দলীলের অনুসরণকে ইত্তেবা বলা হয়। ইসলামে তাক্বলীদ নিষিদ্ধ ও ইত্তেবা অপরিহার্য।
[3]. বুখারী, মুসলিম হা/১৮৪৭; মিশকাত হা/৫৩৮২।
[4]. মির‘আত ১/২৭৩।
[5]. মুসলিম হা/১৪৮; মিশকাত হা/৫৫১৬ ‘ফিতান’ অধ্যায়-২৭ অনুচ্ছেদ-৭; আহমাদ হা/১৩১৬০।
[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭২-৮৭ ‘কিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮ ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ-৪।
[7]. হাকেম হা/৪৪৪, ১/১২৯ পৃঃ; ‘মতন নিরাপদ’ যঈফাহ হা/১০৩৫-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য ৩/১২৬ পৃঃ; তিরমিযী হা/২৬৪১; মিশকাত হা/১৭১।
[8]. মির‘আত ১/২৭৯-৮০।
[9]. ছহীহ মুসলিম-এর ভাষ্যগ্রন্থ আস-সিরাজুল ওয়াহহাজ ১/৩ পৃঃ।
এর জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে তিনটি বক্তব্য এসেছে। এক - مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ ‘যার উপরে আমি ও আমার ছাহাবীগণ আছি’। অর্থাৎ এখানে কেবল তরীকা ও বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। দুই - وَهِيَ الْجَمَاعَةُ ‘সেটি হ’ল জামা‘আত’।[1] যার অর্থ جماعة الصحابة ‘ছাহাবীগণের জামা‘আত’। প্রশস্ত অর্থে, الموافقون لجماعة الصحابة والآخذون بعقائدهم والمتمسكون بطريقتهم ‘ছাহাবীগণের জামা‘আতের অনুগামী, তাঁদের আক্বীদাসমূহের ধারণকারী এবং তাঁদের তরীকার সনিষ্ঠ অনুসারী’। তিন - السَّوَادُ الأَعْظَمُ ‘বড় দল’।[2] অর্থাৎ বড় দল ব্যতীত ছোট দল সব জাহান্নামী হবে। অথচ সংখ্যায় বড় দল হওয়ার কোন গুরুত্ব ইসলামে নেই। কেননা আল্লাহ বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ ‘যদি তুমি অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করো, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। কেননা ওরা কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)। সে কারণ ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন مَنِ السَّوَادُ الْأَعْظَمُ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ ‘বড় দল কোনটি হে আল্লাহর রাসূল’? জবাবে তিনি বললেন, مَنْ كَانَ عَلىَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ ‘যে ব্যক্তি আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি, তার অনুসারী হবে’।[3] অর্থাৎ এখানে ‘বড়’ সংখ্যায় নয়, বরং মর্যাদায় বড়। কেননা আল্লাহ বলেন, وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ ‘আমার কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা কম হবে’ (সাবা ৩৪/১৩)। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, বর্ণিত তিনটি বক্তব্যের সারমর্ম একটাই। আর তা হ’ল, যে দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদা ও আমলের এবং তাঁদের গৃহীত তরীকা ও রীতি-পদ্ধতির অনুসারী হবে, সে দল হ’ল ফের্কায়ে নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল।
নিঃসন্দেহে তারা হ’লেন ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ’ অর্থাৎ যথার্থভাবেই নবীর সুন্নাত ও ছাহাবীগণের জামা‘আতের অনুসারী ব্যক্তি বা দল। এ বিষয়ে বিদ্বানগণের কিছু বক্তব্য নিম্নে উদ্ধৃত হ’ল।-
[1]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; আহমাদ আবুদাঊদ হা/৪৫৯৭; মিশকাত হা/১৭২।
[2]. মুসনাদে আবী ইয়া‘লা হা/৩৯৪৪, আলবানী সনদ যঈফ; মিশকাত হা/১৭৪।
[3]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৬৫৯ সনদ যঈফ; সৈয়ূত্বী, জাম‘উল জাওয়ামে‘ হা/৫৬৯।
নিঃসন্দেহে তারা হ’লেন ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ’ অর্থাৎ যথার্থভাবেই নবীর সুন্নাত ও ছাহাবীগণের জামা‘আতের অনুসারী ব্যক্তি বা দল। এ বিষয়ে বিদ্বানগণের কিছু বক্তব্য নিম্নে উদ্ধৃত হ’ল।-
[1]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; আহমাদ আবুদাঊদ হা/৪৫৯৭; মিশকাত হা/১৭২।
[2]. মুসনাদে আবী ইয়া‘লা হা/৩৯৪৪, আলবানী সনদ যঈফ; মিশকাত হা/১৭৪।
[3]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৬৫৯ সনদ যঈফ; সৈয়ূত্বী, জাম‘উল জাওয়ামে‘ হা/৫৬৯।
(১) হিজরী পঞ্চম শতকের মুজাদ্দিদ ইমাম আবু মুহাম্মাদ আলী ইবনু হাযম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হিঃ) বলেন,
وَأَهْلُ السُّنَّةِ الَّذِيْنَ نَذْكُرُهُمْ أَهْلَ الْحَقِّ وَمَنْ عَدَاهُمْ فَأَهْلُ الْبَاطِلِ فَإِنَّهُمُ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَ كُلُّ مَنْ سَلَكَ نَهْجَهُمْ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِيْنَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ ثُمَّ أَهْلُ الْحِدِيْثِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْفُقَهَاءِ جَيْلاً فَجَيْلاً إِلىَ يَوْمِنَا هذَا وَمَنِ اقْتَدَى بِهِمْ مِنَ الْعَوَامِ فِىْ شَرْقِ الْأَرْضِ وَغَرْبِهَا رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ –
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত- যাদেরকে আমরা হকপন্থী ও তাদের বিরোধীদের বাতিলপন্থী বলেছি, তাঁরা হ’লেন (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত এবং (ঙ) প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন’।[1]
(২) ‘বড় পীর’ বলে খ্যাত শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (৪৯১-৫৬১ হিঃ) বলেন,
وَأَمَّا الْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ فَهِيَ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ قَالَ : وَأَهْلُ السُّنَّةِ لاَ إِسْمٌ لَهُمْ إِلاَّ إِسْمٌ وَّاحِدٌ وَّهُوَ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ –
‘অতঃপর ফের্কা নাজিয়া হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’।[2]
(৩) শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ/১৭০৩-১৭৬২ খৃঃ) বলেন,
اَلْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ هُمُ الآخِذُوْنَ فِي الْعَقِيْدَةِ وَالْعَمَلِ جَمِيْعًا بِمَا ظَهَرَ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَجَرَي عَلَيْهِ جُمْهُوْرُ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ، وَإِن اخْتلفُوا فِيمَا بَينَهُمْ فِيمَا لَم يَشْتَهِرْ فيه نَصٌّ، ولاَ ظَهَرَ مِن الصَّحَابَة اتِّفَاقٌ عَلَيْهِ اسْتِدْلاَلاً مِنْهُم بِبَعْضِ مَا هُنَالِكَ أَو تَفْسِيرًا لِمُجْمَلِهِ- وَغيرُ النَّاجِيةِ كلُّ فِرْقَةٍ اِنْتَحَلَتْ عَقِيدةً خِلاَفَ عَقِيْدَةِ السَّلَف أَو عَمَلاً دُونَ أَعْمَالِهِمْ -
‘ফের্কা নাজিয়াহ তারাই যারা আক্বীদা ও আমলের সকল বিষয়ে কিতাব ও সুন্নাতের প্রকাশ্য অর্থের এবং যার উপরে জমহূর ছাহাবা ও তাবেঈনের আমল জারি আছে, তার অনুসারী। যদিও তাঁদের মধ্যে মতভেদ থাকে যেসব বিষয়ে কোন দলীল প্রসিদ্ধি লাভ করেনি এবং ছাহাবীগণের মধ্যে ঐক্যমত প্রকাশিত হয়নি, তাঁদের থেকে দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে অথবা সংক্ষিপ্ত বিষয় ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। পক্ষান্তরে নাজী ফের্কা নয় ঐসব দল, যারা সালাফী আক্বীদা অথবা আমলের বিপরীত আক্বীদা বা আমল গ্রহণ করে’।[3] এ বক্তব্যে পরিষ্কার যে, তারা আহলুল হাদীছ।
[1]. আলী ইবনু হাযম আন্দালুসী, কিতাবুল ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল (বৈরূত : মাকতাবা খাইয়াত্ব ১৩২১/১৯০৩) শাহরাস্তানীর ‘মিলাল’ সহ ২/১১৩ পৃঃ; কিতাবুল ফিছাল (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৪২০/১৯৯৯) ১/৩৭১ পৃঃ ‘ইসলামী ফের্কাসমূহ’ অধ্যায়।
[2]. আব্দুল ক্বাদির জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসর : ১৩৪৬ হিঃ) ১/৯০ পৃঃ।
[3]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ (কায়রো : দারুত তুরাছ; ১৩৫৫হিঃ/১৯৩৬ খৃঃ) ১/১৭০ পৃঃ।
وَأَهْلُ السُّنَّةِ الَّذِيْنَ نَذْكُرُهُمْ أَهْلَ الْحَقِّ وَمَنْ عَدَاهُمْ فَأَهْلُ الْبَاطِلِ فَإِنَّهُمُ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَ كُلُّ مَنْ سَلَكَ نَهْجَهُمْ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِيْنَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ ثُمَّ أَهْلُ الْحِدِيْثِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْفُقَهَاءِ جَيْلاً فَجَيْلاً إِلىَ يَوْمِنَا هذَا وَمَنِ اقْتَدَى بِهِمْ مِنَ الْعَوَامِ فِىْ شَرْقِ الْأَرْضِ وَغَرْبِهَا رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ –
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত- যাদেরকে আমরা হকপন্থী ও তাদের বিরোধীদের বাতিলপন্থী বলেছি, তাঁরা হ’লেন (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত এবং (ঙ) প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন’।[1]
(২) ‘বড় পীর’ বলে খ্যাত শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (৪৯১-৫৬১ হিঃ) বলেন,
وَأَمَّا الْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ فَهِيَ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ قَالَ : وَأَهْلُ السُّنَّةِ لاَ إِسْمٌ لَهُمْ إِلاَّ إِسْمٌ وَّاحِدٌ وَّهُوَ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ –
‘অতঃপর ফের্কা নাজিয়া হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’।[2]
(৩) শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ/১৭০৩-১৭৬২ খৃঃ) বলেন,
اَلْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ هُمُ الآخِذُوْنَ فِي الْعَقِيْدَةِ وَالْعَمَلِ جَمِيْعًا بِمَا ظَهَرَ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَجَرَي عَلَيْهِ جُمْهُوْرُ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ، وَإِن اخْتلفُوا فِيمَا بَينَهُمْ فِيمَا لَم يَشْتَهِرْ فيه نَصٌّ، ولاَ ظَهَرَ مِن الصَّحَابَة اتِّفَاقٌ عَلَيْهِ اسْتِدْلاَلاً مِنْهُم بِبَعْضِ مَا هُنَالِكَ أَو تَفْسِيرًا لِمُجْمَلِهِ- وَغيرُ النَّاجِيةِ كلُّ فِرْقَةٍ اِنْتَحَلَتْ عَقِيدةً خِلاَفَ عَقِيْدَةِ السَّلَف أَو عَمَلاً دُونَ أَعْمَالِهِمْ -
‘ফের্কা নাজিয়াহ তারাই যারা আক্বীদা ও আমলের সকল বিষয়ে কিতাব ও সুন্নাতের প্রকাশ্য অর্থের এবং যার উপরে জমহূর ছাহাবা ও তাবেঈনের আমল জারি আছে, তার অনুসারী। যদিও তাঁদের মধ্যে মতভেদ থাকে যেসব বিষয়ে কোন দলীল প্রসিদ্ধি লাভ করেনি এবং ছাহাবীগণের মধ্যে ঐক্যমত প্রকাশিত হয়নি, তাঁদের থেকে দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে অথবা সংক্ষিপ্ত বিষয় ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। পক্ষান্তরে নাজী ফের্কা নয় ঐসব দল, যারা সালাফী আক্বীদা অথবা আমলের বিপরীত আক্বীদা বা আমল গ্রহণ করে’।[3] এ বক্তব্যে পরিষ্কার যে, তারা আহলুল হাদীছ।
[1]. আলী ইবনু হাযম আন্দালুসী, কিতাবুল ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল (বৈরূত : মাকতাবা খাইয়াত্ব ১৩২১/১৯০৩) শাহরাস্তানীর ‘মিলাল’ সহ ২/১১৩ পৃঃ; কিতাবুল ফিছাল (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৪২০/১৯৯৯) ১/৩৭১ পৃঃ ‘ইসলামী ফের্কাসমূহ’ অধ্যায়।
[2]. আব্দুল ক্বাদির জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসর : ১৩৪৬ হিঃ) ১/৯০ পৃঃ।
[3]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ (কায়রো : দারুত তুরাছ; ১৩৫৫হিঃ/১৯৩৬ খৃঃ) ১/১৭০ পৃঃ।
‘আহলুল হাদীছ’ অর্থ হাদীছের অনুসারী। পারিভাষিক অর্থে, ছহীহ হাদীছের অনুসারী’। তিনি মুহাদ্দিছ বিদ্বান হ’তে পারেন কিংবা ছহীহ হাদীছের অনুসারী সাধারণ ব্যক্তিও হ’তে পারেন। উক্ত দলের সাথে বিদ‘আতী দল সমূহের আক্বীদাগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন আহলেসুন্নাত বা আহলেহাদীছের নিকট ‘ঈমান’-এর পারিভাষিক অর্থ হ’ল, اَلْإِيْمَانُ هُوَ التَّصْدِيْقُ بِالْجَنَانِ وَالْإِقْرَارُ بِاللِّسَانِ وَالْعَمَلُ بِالْأَرْكَانِ، يَزِيْدُ بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَّةِ، اَلْإِيْمَانُ هُوَ الْأَصْلُ وَالْعَمَلُ هُوَ الْفَرْعُ - ‘হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম হ’ল ঈমান। যা আনুগত্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ও গোনাহে হরাসপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বাস ও স্বীকৃতি হ’ল মূল এবং কর্ম হ’ল শাখা।’ যা না থাকলে পূর্ণ মুমিন বা ইনসানে কামেল হওয়া যায় না।
এর বিপরীতে প্রধান দু’টি বিদ‘আতী দল হ’ল খারেজী ও মুর্জিয়া। খারেজীগণ বিশ্বাস, স্বীকৃতি ও কর্ম তিনটিকেই ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। ফলে তাদের মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তাদের রক্ত হালাল’। যুগে যুগে সকল চরমপন্থী ভ্রান্ত মুসলমান এই মতের অনুসারী। এরাই হযরত আলী (রাঃ)-কে কাফের বলেছিল ও তাঁর রক্ত হালাল মনে করে তাঁকে হত্যা করেছিল। অপর দু’জন ছাহাবী হযরত আমর ইবনুল ‘আছ ও হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) এদের হত্যা তালিকায় ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
পক্ষান্তরে মুর্জিয়াগণ কেবল বিশ্বাস অথবা স্বীকৃতিকে ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। যার কোন হরাস-বৃদ্ধি নেই। তাদের মতে আমল ঈমানের অংশ নয়। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এই মত পোষণ করেন। সে কারণ তাঁকে ও তাঁর অনুসারী ‘হানাফী’ দলকে শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী, আব্দুল করীম শাহরাস্তানী ও অন্যান্য বিদ্বানগণ মুর্জিয়া ফের্কার ১২টি উপদলের অন্যতম হিসাবে গণ্য করেছেন।[1] তাদের নিকট কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন। আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমান ও একজন ফাসেক-এর ঈমান সমান। ঈমানের দিক দিয়ে পরস্পরে কোন তারতম্য নেই’।[2] আমলের ব্যাপারে সকল যুগের শৈথিল্যবাদী ভ্রান্ত মুসলমানরা এই আক্বীদার অনুসারী। আর সঙ্গত কারণেই সকল যুগে এই দলের সংখ্যা বেশী।
খারেজী ও মুর্জিয়া দুই চরমপন্থী ও শৈথিল্যবাদী মতবাদের মধ্যবর্তী হ’ল আহলেহাদীছের ঈমান। যাদের নিকট বিশ্বাস ও স্বীকৃতি হল মূল এবং কর্ম হ’ল শাখা। অতএব কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের নিকট কাফের নয় কিংবা পূর্ণ মুমিন নয়, বরং ফাসেক অর্থাৎ গোনাহগার মুমিন। কবীরা গোনাহ থেকে খালেছ তওবা করলে সে পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে। এমনকি তওবা না করে মারা গেলেও সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। বস্ত্ততঃ এটাই হ’ল কুরআন ও সুন্নাহর অনুকূলে।
মোটকথা ফের্কা নাজিয়াহ তারাই যারা বিশ্বাস ও কর্মে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের অনুসারী হবে এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের যথার্থ আমলকারী হবে। সাথে সাথে জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে সেই অনুযায়ী ঢেলে সাজাবার জন্য চূড়ান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আর এটার জন্য কোন রং, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল বা গোত্র শর্ত নয়। বরং নিরপেক্ষভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সনিষ্ঠ অনুসারী হওয়াটাই শর্ত। তারা পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে যেকোন সুন্নী দলের মধ্যে থাকতে পারেন।
[1]. কিতাবুল গুনিয়াহ (মিসর : ১৩৪৬ হিঃ) ১/৯০ পৃঃ; কিতাবুল মিলাল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/১৪৬ পৃঃ; হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (বোম্বাই : তাবি) পৃঃ ৩৬-৩৯।
[2]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনু তায়মিয়াহ ৬/৪৭৯ পৃঃ।
এর বিপরীতে প্রধান দু’টি বিদ‘আতী দল হ’ল খারেজী ও মুর্জিয়া। খারেজীগণ বিশ্বাস, স্বীকৃতি ও কর্ম তিনটিকেই ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। ফলে তাদের মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তাদের রক্ত হালাল’। যুগে যুগে সকল চরমপন্থী ভ্রান্ত মুসলমান এই মতের অনুসারী। এরাই হযরত আলী (রাঃ)-কে কাফের বলেছিল ও তাঁর রক্ত হালাল মনে করে তাঁকে হত্যা করেছিল। অপর দু’জন ছাহাবী হযরত আমর ইবনুল ‘আছ ও হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) এদের হত্যা তালিকায় ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
পক্ষান্তরে মুর্জিয়াগণ কেবল বিশ্বাস অথবা স্বীকৃতিকে ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। যার কোন হরাস-বৃদ্ধি নেই। তাদের মতে আমল ঈমানের অংশ নয়। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এই মত পোষণ করেন। সে কারণ তাঁকে ও তাঁর অনুসারী ‘হানাফী’ দলকে শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী, আব্দুল করীম শাহরাস্তানী ও অন্যান্য বিদ্বানগণ মুর্জিয়া ফের্কার ১২টি উপদলের অন্যতম হিসাবে গণ্য করেছেন।[1] তাদের নিকট কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন। আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমান ও একজন ফাসেক-এর ঈমান সমান। ঈমানের দিক দিয়ে পরস্পরে কোন তারতম্য নেই’।[2] আমলের ব্যাপারে সকল যুগের শৈথিল্যবাদী ভ্রান্ত মুসলমানরা এই আক্বীদার অনুসারী। আর সঙ্গত কারণেই সকল যুগে এই দলের সংখ্যা বেশী।
খারেজী ও মুর্জিয়া দুই চরমপন্থী ও শৈথিল্যবাদী মতবাদের মধ্যবর্তী হ’ল আহলেহাদীছের ঈমান। যাদের নিকট বিশ্বাস ও স্বীকৃতি হল মূল এবং কর্ম হ’ল শাখা। অতএব কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের নিকট কাফের নয় কিংবা পূর্ণ মুমিন নয়, বরং ফাসেক অর্থাৎ গোনাহগার মুমিন। কবীরা গোনাহ থেকে খালেছ তওবা করলে সে পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে। এমনকি তওবা না করে মারা গেলেও সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। বস্ত্ততঃ এটাই হ’ল কুরআন ও সুন্নাহর অনুকূলে।
মোটকথা ফের্কা নাজিয়াহ তারাই যারা বিশ্বাস ও কর্মে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের অনুসারী হবে এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের যথার্থ আমলকারী হবে। সাথে সাথে জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে সেই অনুযায়ী ঢেলে সাজাবার জন্য চূড়ান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আর এটার জন্য কোন রং, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল বা গোত্র শর্ত নয়। বরং নিরপেক্ষভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সনিষ্ঠ অনুসারী হওয়াটাই শর্ত। তারা পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে যেকোন সুন্নী দলের মধ্যে থাকতে পারেন।
[1]. কিতাবুল গুনিয়াহ (মিসর : ১৩৪৬ হিঃ) ১/৯০ পৃঃ; কিতাবুল মিলাল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/১৪৬ পৃঃ; হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (বোম্বাই : তাবি) পৃঃ ৩৬-৩৯।
[2]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনু তায়মিয়াহ ৬/৪৭৯ পৃঃ।
১. তাঁরা সংস্কারক হবেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ، قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنِ الْغُرَبَاءُ قَالَ : الَّذِيْنَ يُصْلِحُوْنَ مَا أَفْسَدَ النَّاسُ - ‘ইসলাম নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। সত্বর সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। অতএব সুসংবাদ হ’ল সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য। যারা আমার পরে লোকেরা (ইসলামের) যে বিষয়গুলি ধ্বংস করে, সেগুলিকে পুনঃ সংস্কার করে’।[1]
২. আক্বীদার ক্ষেত্রে তারা সর্বদা মধ্যপন্থী হবেন এবং কখনোই চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী হবেন না।
আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا - ‘এভাবে আমরা তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত করেছি। যেন তোমরা মানবজাতির উপরে সাক্ষী হ’তে পার এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হ’তে পারেন’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)।
তারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে কাফের ও তার রক্তকে হালাল বলেন না বা তাকে পূর্ণ মুমিন বলেন না। আমলে ও আচরণে সর্বদা মধ্যপন্থী থেকে তারা আল্লাহর নৈকট্য তালাশ করেন। তারা নবীগণের তরীকা অনুযায়ী মানুষের আক্বীদা ও আমলের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধনে রত থাকেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীদের তারা ভালবাসেন না এবং আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর ভালোবাসার ঊর্ধ্বে তারা অন্য কারু ভালোবাসাকে হৃদয়ে স্থান দেন না।[2] তারা কেবল আল্লাহর জন্য মানুষকে ভালবাসেন ও আল্লাহর জন্যই মানুষের সাথে বিদ্বেষ করেন।[3]
৩. আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তারা সর্বদা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসারী হবেন এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত ব্যাখ্যা করবেন।
এক্ষেত্রে তারা রায়পন্থীদের কোন ধারণা ও কল্পনার অনুসারী হবেন না। যেমন (১) আল্লাহ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)। এর সরলার্থ হ’ল, আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে। কিন্তু তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তাঁর কান আছে ও চোখ আছে। কিন্তু তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি নিরাকার কোন শূন্য সত্তা নন। আল্লাহ বলেন, بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ ‘বরং তাঁর দু’টি হাত প্রসারিত’ (মায়েদাহ ৫/৬৪)। তিনি বলেন, خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ‘আমি আমার দু’হাত দিয়ে (মানুষকে) সৃষ্টি করেছি’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। এগুলির অর্থ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই বুঝতে হবে। ভ্রান্ত ফের্কা জাহমিয়া ও অতি যুক্তিবাদী মু‘তাযিলা এবং তাদের অনুসারীদের মতে আল্লাহ সকল প্রকার গুণাবলী হ’তে মুক্ত। তারা ‘আল্লাহর হাত’ অর্থ করেন তাঁর কুদরত ও নে‘মত, ‘চেহারা’ অর্থ করেন তাঁর সত্তা বা ছওয়াব ইত্যাদি। অথচ সঠিক আক্বীদা এই যে, আল্লাহ অবশ্যই নাম ও গুণযুক্ত সত্তা। তবে তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি শোনেন ও দেখেন। কিন্তু সেটা কিভাবে, তা জানা যাবে না। কেননা তাঁর সত্তা ও গুণাবলী বান্দার সত্তা ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। ভিডিও ক্যামেরা মানুষের কথা ও ছবি ধারণ করে। তার কান ও চোখ আছে। কিন্তু তা অন্যের সাথে তুলনীয় নয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহে আল্লাহর হাত, আঙ্গুল, পায়ের নলা, চেহারা, চক্ষু, কথা বলা, আরশে অবস্থান, নিম্ন আকাশে অবতরণ, ক্বিয়ামতের দিন মুমিনদের দর্শন দান ইত্যাদি অনেক বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার ধরন মানুষের অজানা। আবার এসবের অর্থ বুঝার জন্য আল্লাহর উপর ন্যস্ত করাও যাবে না। অতএব এসবই প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করতে হবে কোনরূপ পরিবর্তন, শূন্যকরণ, প্রকৃতি নির্ধারণ, তুলনাকরণ বা আল্লাহর উপরে ন্যস্তকরণ ( من غير تحريف وتعطيل وتكييف وتمثيل وتفويض ) ছাড়াই।
(২) আল্লাহ বলেন, الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর সমুন্নীত’ (ত্বোয়াহা ২০/৫)। এখানে اسْتَوَى -এর অর্থ আমাদের জানা। কিন্তু কিভাবে আল্লাহ আরশে অবস্থান করেন, সেটা আমাদের অজানা। এক্ষেত্রে কেবল প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করতে হবে। কোনরূপ দূরতম ব্যাখ্যা বা কল্পনা করা যাবে না। ইমাম মালেক (রহঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, اَلْإِسْتِوَاءُ مَعْلُوْمٌ وَالْكَيْفُ مَجْهُولٌ وَالْإِيْمَانُ بِهِ وَاجِبٌ وَالسُّؤَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ ‘আরশের উপর সমুন্নীত কথাটির অর্থ সুবিদিত। কিন্তু কিভাবে সমুন্নীত সেটা অবিদিত। অতএব এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ‘আত’।[4]
(৩) আল্লাহ বলেন, وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ ‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন, যেখানেই তোমরা থাক না কেন’ (হাদীদ ৫৭/৪)। তিনি বলেন, وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ ‘আমরা তার গর্দানের প্রধান শিরার চাইতেও নিকটবর্তী থাকি’ (ক্বাফ ৫০/১৬)। তিনি মূসা ও হারূণকে বলেন, إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি সবকিছু দেখছি ও শুনছি’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৬)। তিনি সাথে আছেন, কথাটি পরিষ্কার। এর অর্থ বুঝার জন্য আল্লাহর উপরে ন্যস্ত করার প্রয়োজন নেই। কেননা আরবরা যা বুঝে, সেই ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে। কিন্তু কিভাবে তিনি বান্দার সঙ্গে থাকেন, সে বিষয়ে এরূপ কাল্পনিক কথা বলা যাবে না যে, তাঁর আরশ বান্দার কলবে থাকে বা বান্দা আল্লাহর সত্তার অংশ কিংবা আত্মায় আত্মায় মিলিত হয়ে পরমাত্মায় লীন হয়ে ফানা ফিল্লাহ হয়ে যাবে, তিনি নিরাকার ও নির্গূণ সত্তা, তিনি সর্বত্র বিরাজমান ইত্যাদি। কেননা তিনি আরশে থাকেন, যা সাত আসমানের উপরে সমুন্নীত, যা বিভিন্ন আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। অতএব এর অর্থ হ’ল এই যে, আল্লাহ স্বীয় ইলমের মাধ্যমে বান্দার সাথে থাকেন। তাঁর জ্ঞান ও শক্তি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সবকিছুর উপরে ক্ষমতাশালী। তিনি বান্দার সব কথা শোনেন ও দেখেন। তিনি বান্দার হেফাযত করেন ও তাকে সাহায্য করেন।
ফলাফল : উপরোক্ত বিশ্বাসের ফলাফল এই হবে যে, মানুষ যখন জানবে, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি সর্বদা আরশে অবস্থান করেন, তখন বান্দা সর্বদা কেবল তাঁরই মুখাপেক্ষী থাকবে। কেবল তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। বান্দা যখন জানবে যে, আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নামসমূহ রয়েছে (আ‘রাফ ৭/১৮০), তখন সেইসব গুণবাচক নামেই বান্দা আল্লাহকে ডাকবে ও তাঁর সাহায্য চেয়ে নিশ্চিন্ত হবে। উদাহরণ স্বরূপ সে যখন জানবে যে, আল্লাহ একমাত্র রূযীদাতা, তখন সে রূযী নিয়ে চিন্তিত হবে না। যখন সে জানবে যে, আল্লাহ তার সব কথা শুনছেন ও সব কাজ দেখছেন, তখন সে অন্যায় কাজে ভীত হবে এবং নেকীর কাজে উৎসাহী হবে। যখন সে জানবে যে, আল্লাহ হায়াত ও মউতের মালিক, তিনি সন্তানদাতা, রোগ ও আরোগ্যদাতা এবং তিনিই বিপদহন্তা, তখন সে এসব বিষয় নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তায় ভুগবে না। যখন মানুষ জানবে যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান, তখন সে পাপ করে হতাশ হবে না। বরং অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ভালো হওয়ার চেষ্টা করবে। এভাবে মানুষ যখন আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জানবে, তখন সে সঠিকভাবে তার জীবনকে গড়ে তুলবে। নইলে যে কোন সময়ে তার পদস্খলন ঘটবে। আত্মগ্লানিতে সে ভেঙ্গে পড়বে। বস্ত্ততঃ অধিকাংশ বাতিল ফের্কার জন্ম হয়েছে তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের অভাবে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন- আমীন!
৪. তারা জামা‘আতবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেন এবং কখনোই উদ্ধত ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হন না।
আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালবাসেন ঐসব লোকদের, যারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে সারিবদ্ধভাবে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়’ (ছফ ৬১/৪)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَرَادَ بُحْبُوحَةَ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمِ الْجَمَاعَةَ ‘যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামা‘আতকে অপরিহার্য করে নেয়’।[5]
হযরত উমামাহ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,
اِتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ وَصَلُّوْا خَمْسَكُمْ وَصُوْمُوْا شَهْرَكُمْ وَأَدُّوْا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ وَأَطِيْعُوْا ذَا أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوْا جَنَّةَ رَبِّكُمْ -
(১) ‘তোমরা তোমাদের প্রভু আল্লাহকে ভয় কর (২) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর (৩) রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর (৪) তোমাদের সম্পদের যাকাত প্রদান কর এবং (৫) আমীরের আনুগত্য কর; তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ কর’।[6] অত্র হাদীছে আমীরের আনুগত্যকে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ইত্যাদি ফরয ইবাদতের সাথে যুক্ত করে বলা হয়েছে এবং একে জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইসলামী সংগঠনের স্তম্ভ হল ৪টি : আমীর, মামূর, বায়‘আত ও এত্বা‘আত।[7] বায়‘আত হ’ল আমীরের নিকট আল্লাহর নামে আল্লাহর বিধান মানার অঙ্গীকার গ্রহণের নাম। যা ব্যতীত ইসলামী সংগঠন হয় না। আল্লাহ বলেন, وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولاً ‘তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (ইসরা ১৭/৩৪)। বস্ত্ততঃ বায়‘আতবিহীন আনুগত্য সাধারণ সমর্থনের ন্যায়। জামা‘আতবদ্ধ জীবনে যার কোন দায়বদ্ধতা নেই। অতঃপর চতুর্থটি অর্থাৎ আনুগত্য না থাকলে বাকীগুলি মূল্যহীন হবে। কেননা অঙ্গীকার ও আনুগত্যহীন সংগঠন ইসলামে কাম্য নয়।
আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘আখেরাতের ঐ গৃহ আমরা নির্ধারিত করেছি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে উদ্ধত হয় না ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম রয়েছে কেবল মুত্তাকীদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
৫. তারা কুফর ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ও শক্তিশালী থাকেন এবং নিজেদের মধ্যে সর্বদা রহমদিল ও আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন।
আল্লাহ বলেন, مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُوْنَ فَضْلاً مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا سِيْمَاهُمْ فِيْ وُجُوْهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُوْدِ، ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং যারা তার সাথী, তারা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও নিজেদের মধ্যে সহমর্মী। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে সর্বদা রুকূকারী ও সিজদাকারী দেখতে পাবে। তাদের কপালে সিজদার চিহ্ন থাকবে’ (ফাৎহ ৪৮/২৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ ‘তুমি জান্নাতের সুসংবাদ দাও বিনীতদের জন্য’ (হজ্জ ২২/৩৪)।
তিনি আরও বলেন, وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لاَ تَعْلَمُونَهُمُ اللهُ يَعْلَمُهُمْ ‘তোমরা অবিশ্বাসীদের মুকাবিলায় যথাসাধ্য শক্তি ও সদা প্রস্ত্তত অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখো। যদ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের ভীত করবে এবং এছাড়াও অন্যদের, যাদেরকে তোমরা জানোনা। কিন্তু আল্লাহ জানেন’ (আনফাল ৮/৬০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ ‘শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চাইতে উত্তম ও আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় দুর্বল মুমিনের চাইতে’।[8] আর এটি কেবল দৈহিক শক্তি নয়। বরং মানসিক ও সাংগঠনিক শক্তিই বড় শক্তি। সেই সাথে থাকবে যুগোপযোগী বৈষয়িক শক্তি।
৬. তাঁরা যেকোন মূল্যে সুন্নাতকে আঁকড়ে থাকেন ও বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকেন।
হযরত ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘তোমরা আমার ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে ধারণ কর। তোমরা সেগুলি কঠিনভাবে আঁকড়ে ধর এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর। আর তোমরা ধর্মের নামে নতুন সৃষ্টি করা হ’তে বিরত থাক। কেননা প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।[9]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ زَمَانَ صَبْرٍ لِلْمُتَمَسِّكِ فِيْهِ أَجْرُ خَمْسِيْنَ شَهِيْدًا مِّنْكُمْ ‘তোমাদের পরে এমন একটা কঠিন সময় আসছে, যখন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে’।[10]
৭. তারা সর্বাবস্থায় সমবেতভাবে হাবলুল্লাহকে ধারণ করে থাকেন এবং কখনোই সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হন না। কেউ তাদেরকে ছেড়ে গেলে সে অবস্থায় তারা আল্লাহর উপর ভরসা করেন ও তাঁর গায়েবী মদদ কামনা করেন।
আল্লাহ বলেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا وَّلاَ تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করো এবং তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
হযরত নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ ‘জামা‘আতবদ্ধ জীবন হ’ল রহমত এবং বিচ্ছিন্ন জীবন হ’ল আযাব’।[11] তিনি বলেন, يَدُ اللهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ، ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত থাকে। আর শয়তান তার সাথে থাকে যে জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।[12]
‘হাবলুল্লাহ’ হ’ল কুরআন ও তার ব্যাখ্যা হাদীছ। যতক্ষণ কোন সংগঠনে এদু’টির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে এবং তা যথার্থভাবে অনুসৃত হবে, ততক্ষণ উক্ত সংগঠনের সাথে জামা‘আতবদ্ধ থাকা ফরয। যেমন হযরত উম্মুল হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا ‘যদি তোমাদের উপর একজন নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামকেও আমীর নিযুক্ত করা হয়, যদি তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তাহ’লে তোমরা তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর’।[13] হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمَنْ يُطِعْ الْأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِي وَمَنْ يَعْصِ الْأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِي وَإِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ وَعَدَلَ فَإِنَّ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ . ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল। আমীর হলেন ঢাল স্বরূপ। যার পিছনে থেকে লড়াই করা হয় ও যার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা হয়। যদি তিনি আল্লাহভীতির আদেশ দেন ও ন্যায় বিচার করেন, তাহ’লে এর বিনিময়ে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। আর যদি বিপরীত কিছু বলেন, তাহ’লে তার পাপ তার উপরেই বর্তাবে’।[14] তিনি বলেন, ‘তোমরা সাধ্যমত আমীরের কথা শোন ও মান্য কর’। ‘যদি আমীরের কোন বিষয় অপসন্দনীয় মনে কর, তাহ’লে তাতে ছবর কর। কেননা যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত বেরিয়ে গেল ও মৃত্যু বরণ করল, সে জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যু বরণ করল’।[15]
এই আমীর নাজী ফের্কার আমীর হ’তে পারেন কিংবা দেশের শাসক হ’তে পারেন। সাংগঠনিক আমীর ইসলামী ‘হুদূদ’ বা দন্ডবিধি জারি করতে পারেন না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আমীর সেটা করেন। উভয় অবস্থায় বায়‘আত ও আনুগত্য অপরিহার্য। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল, অথচ তার গর্দানে আমীরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত নেই, সে জাহেলী মৃত্যু বরণ করল’।[16] এটি কেবল খেলাফতে রাশেদাহ পর্যন্ত সীমায়িত নয়। বরং সকল যুগে রাষ্ট্রীয় বায়‘আত ও সাংগঠনিক বায়‘আত দু’টিই হ’তে পারে। কারণ বায়‘আত বা আনুগত্যের অঙ্গীকার না থাকলে রাষ্ট্র বা সংগঠনের প্রতি কোনরূপ দায়বদ্ধতা থাকে না। আর বায়‘আতবিহীন আনুগত্য সাধারণ সমর্থনের ন্যায়, যা তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না। এই বায়‘আত না থাকলে বা ভঙ্গ করলে কেউ কাফির হবে না বটে, কিন্তু সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। যাকে এখানে ‘জাহেলিয়াত’ বলা হয়েছে (মিরক্বাত)। যা আল্লাহর কাম্য নয়।
লোকেরা ছেড়ে গেলেও এবং পরিস্থিতি বিরূপ হলেও যারা হাবলুল্লাহকে মযবুতভাবে ধারণ করে থাকেন। এমতাবস্থায় তারা আল্লাহর গায়েবী মদদ পেয়ে থাকেন।
যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ ‘যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর উক্ত কথার উপর দৃঢ় থাকে, তাদের উপর ফেরেশতাগণ অবতীর্ণ হয় এই বলে যে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তান্বিত হয়ো না। তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০)।
নাজী ফের্কা থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং হক-বাতিল না বুঝে কোন দলে যোগ দেয়া বা নতুন দল গড়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً وَمَنْ قَاتَلَ تَحْتَ رَايَةٍ عُمِّيَّةٍ يَغْضَبُ لِعَصَبَةٍ أَوْ يَدْعُو إِلَى عَصَبَةٍ أَوْ يَنْصُرُ عَصَبَةً فَقُتِلَ فَقِتْلَةٌ جَاهِلِيَّةٌ ‘যে ব্যক্তি আনুগত্য হ’তে বেরিয়ে যায় ও জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, অতঃপর মারা যায়, সে জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করে। আর যে ব্যক্তি এমন পতাকাতলে যুদ্ধ করে, যার হক ও বাতিল হওয়া সম্পর্কে তার স্পষ্ট জ্ঞান নেই। বরং সে দলীয় প্রেরণায় ক্রুদ্ধ হয়, দলীয় প্রেরণায় লোকদের আহবান করে ও দলীয় প্রেরণায় মানুষকে সাহায্য করে, অতঃপর নিহত হয়। এমতাবস্থায় সে জাহেলিয়াতের উপর নিহত হয়।... [17]
যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয় ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالاً مَعَ أَثْقَالِهِمْ وَلَيُسْأَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ ‘তারা নিজেদের পাপভার বহন করবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে অন্যদের পাপের বোঝা। আর তারা যেসব মিথ্যা উদ্ভাবন করে সে বিষয়ে কিয়ামত দিবসে অবশ্যই তাদের প্রশ্ন করা হবে’ (আনকাবূত ২৯/১৩)।
[1]. আহমাদ হা/১৬৭৩৬; মিশকাত হা/১৫৯, ১৭০; ছহীহাহ হা/১২৭৩।
[2]. মুজাদালাহ ৫৮/২২; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৭; বুখারী হা/৬৬৩২।
[3]. ত্বাবারাণী কাবীর, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৯৮; মিশকাত হা/৫০১৪।
[4]. শাহরাস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল ১/৯৩ পৃঃ।
[5]. তিরমিযী হা/২১৬৫।
[6]. তিরমিযী হা/৬১৬, আহমাদ হা/২২২১৫; মিশকাত হা/৫৭১; ছহীহাহ হা/৮৬৭।
[7]. দ্রঃ সূরা তওবা ১১১ আয়াত যা মক্কায় বায়‘আতে কুবরা উপলক্ষে নাযিল হয়েছিল (ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত; ইক্বামতে দ্বীন পৃঃ ১৪-১৬; সূরা ফাৎহ ৪৮/১০, ১৮ আয়াত)।
[8]. মুসলিম হা/২৬৬৪; মিশকাত হা/৫২৯৮।
[9]. আহমাদ, আবুদাঊদ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১৬৫।
[10]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০২৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২৩৪।
[11]. আহমাদ হা/১৮৪৭২; ছহীহাহ হা/৬৬৭।
[12]. নাসাঈ হা/৪০২০; তিরমিযী হা/২১৬৬; মিশকাত হা/১৭৩।
[13]. মুসলিম হা/১৮৩৮, মিশকাত হা/৩৬৬২ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[14]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬১ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[15]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬৭-৬৮।
[16]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৭৪।
[17]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬৯, ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ، قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنِ الْغُرَبَاءُ قَالَ : الَّذِيْنَ يُصْلِحُوْنَ مَا أَفْسَدَ النَّاسُ - ‘ইসলাম নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। সত্বর সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। অতএব সুসংবাদ হ’ল সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য। যারা আমার পরে লোকেরা (ইসলামের) যে বিষয়গুলি ধ্বংস করে, সেগুলিকে পুনঃ সংস্কার করে’।[1]
২. আক্বীদার ক্ষেত্রে তারা সর্বদা মধ্যপন্থী হবেন এবং কখনোই চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী হবেন না।
আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا - ‘এভাবে আমরা তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত করেছি। যেন তোমরা মানবজাতির উপরে সাক্ষী হ’তে পার এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হ’তে পারেন’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)।
তারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে কাফের ও তার রক্তকে হালাল বলেন না বা তাকে পূর্ণ মুমিন বলেন না। আমলে ও আচরণে সর্বদা মধ্যপন্থী থেকে তারা আল্লাহর নৈকট্য তালাশ করেন। তারা নবীগণের তরীকা অনুযায়ী মানুষের আক্বীদা ও আমলের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধনে রত থাকেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীদের তারা ভালবাসেন না এবং আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর ভালোবাসার ঊর্ধ্বে তারা অন্য কারু ভালোবাসাকে হৃদয়ে স্থান দেন না।[2] তারা কেবল আল্লাহর জন্য মানুষকে ভালবাসেন ও আল্লাহর জন্যই মানুষের সাথে বিদ্বেষ করেন।[3]
৩. আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তারা সর্বদা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসারী হবেন এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত ব্যাখ্যা করবেন।
এক্ষেত্রে তারা রায়পন্থীদের কোন ধারণা ও কল্পনার অনুসারী হবেন না। যেমন (১) আল্লাহ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)। এর সরলার্থ হ’ল, আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে। কিন্তু তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তাঁর কান আছে ও চোখ আছে। কিন্তু তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি নিরাকার কোন শূন্য সত্তা নন। আল্লাহ বলেন, بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ ‘বরং তাঁর দু’টি হাত প্রসারিত’ (মায়েদাহ ৫/৬৪)। তিনি বলেন, خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ‘আমি আমার দু’হাত দিয়ে (মানুষকে) সৃষ্টি করেছি’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। এগুলির অর্থ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই বুঝতে হবে। ভ্রান্ত ফের্কা জাহমিয়া ও অতি যুক্তিবাদী মু‘তাযিলা এবং তাদের অনুসারীদের মতে আল্লাহ সকল প্রকার গুণাবলী হ’তে মুক্ত। তারা ‘আল্লাহর হাত’ অর্থ করেন তাঁর কুদরত ও নে‘মত, ‘চেহারা’ অর্থ করেন তাঁর সত্তা বা ছওয়াব ইত্যাদি। অথচ সঠিক আক্বীদা এই যে, আল্লাহ অবশ্যই নাম ও গুণযুক্ত সত্তা। তবে তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি শোনেন ও দেখেন। কিন্তু সেটা কিভাবে, তা জানা যাবে না। কেননা তাঁর সত্তা ও গুণাবলী বান্দার সত্তা ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। ভিডিও ক্যামেরা মানুষের কথা ও ছবি ধারণ করে। তার কান ও চোখ আছে। কিন্তু তা অন্যের সাথে তুলনীয় নয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহে আল্লাহর হাত, আঙ্গুল, পায়ের নলা, চেহারা, চক্ষু, কথা বলা, আরশে অবস্থান, নিম্ন আকাশে অবতরণ, ক্বিয়ামতের দিন মুমিনদের দর্শন দান ইত্যাদি অনেক বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার ধরন মানুষের অজানা। আবার এসবের অর্থ বুঝার জন্য আল্লাহর উপর ন্যস্ত করাও যাবে না। অতএব এসবই প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করতে হবে কোনরূপ পরিবর্তন, শূন্যকরণ, প্রকৃতি নির্ধারণ, তুলনাকরণ বা আল্লাহর উপরে ন্যস্তকরণ ( من غير تحريف وتعطيل وتكييف وتمثيل وتفويض ) ছাড়াই।
(২) আল্লাহ বলেন, الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর সমুন্নীত’ (ত্বোয়াহা ২০/৫)। এখানে اسْتَوَى -এর অর্থ আমাদের জানা। কিন্তু কিভাবে আল্লাহ আরশে অবস্থান করেন, সেটা আমাদের অজানা। এক্ষেত্রে কেবল প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করতে হবে। কোনরূপ দূরতম ব্যাখ্যা বা কল্পনা করা যাবে না। ইমাম মালেক (রহঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, اَلْإِسْتِوَاءُ مَعْلُوْمٌ وَالْكَيْفُ مَجْهُولٌ وَالْإِيْمَانُ بِهِ وَاجِبٌ وَالسُّؤَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ ‘আরশের উপর সমুন্নীত কথাটির অর্থ সুবিদিত। কিন্তু কিভাবে সমুন্নীত সেটা অবিদিত। অতএব এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ‘আত’।[4]
(৩) আল্লাহ বলেন, وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ ‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন, যেখানেই তোমরা থাক না কেন’ (হাদীদ ৫৭/৪)। তিনি বলেন, وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ ‘আমরা তার গর্দানের প্রধান শিরার চাইতেও নিকটবর্তী থাকি’ (ক্বাফ ৫০/১৬)। তিনি মূসা ও হারূণকে বলেন, إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি সবকিছু দেখছি ও শুনছি’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৬)। তিনি সাথে আছেন, কথাটি পরিষ্কার। এর অর্থ বুঝার জন্য আল্লাহর উপরে ন্যস্ত করার প্রয়োজন নেই। কেননা আরবরা যা বুঝে, সেই ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে। কিন্তু কিভাবে তিনি বান্দার সঙ্গে থাকেন, সে বিষয়ে এরূপ কাল্পনিক কথা বলা যাবে না যে, তাঁর আরশ বান্দার কলবে থাকে বা বান্দা আল্লাহর সত্তার অংশ কিংবা আত্মায় আত্মায় মিলিত হয়ে পরমাত্মায় লীন হয়ে ফানা ফিল্লাহ হয়ে যাবে, তিনি নিরাকার ও নির্গূণ সত্তা, তিনি সর্বত্র বিরাজমান ইত্যাদি। কেননা তিনি আরশে থাকেন, যা সাত আসমানের উপরে সমুন্নীত, যা বিভিন্ন আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। অতএব এর অর্থ হ’ল এই যে, আল্লাহ স্বীয় ইলমের মাধ্যমে বান্দার সাথে থাকেন। তাঁর জ্ঞান ও শক্তি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সবকিছুর উপরে ক্ষমতাশালী। তিনি বান্দার সব কথা শোনেন ও দেখেন। তিনি বান্দার হেফাযত করেন ও তাকে সাহায্য করেন।
ফলাফল : উপরোক্ত বিশ্বাসের ফলাফল এই হবে যে, মানুষ যখন জানবে, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি সর্বদা আরশে অবস্থান করেন, তখন বান্দা সর্বদা কেবল তাঁরই মুখাপেক্ষী থাকবে। কেবল তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। বান্দা যখন জানবে যে, আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নামসমূহ রয়েছে (আ‘রাফ ৭/১৮০), তখন সেইসব গুণবাচক নামেই বান্দা আল্লাহকে ডাকবে ও তাঁর সাহায্য চেয়ে নিশ্চিন্ত হবে। উদাহরণ স্বরূপ সে যখন জানবে যে, আল্লাহ একমাত্র রূযীদাতা, তখন সে রূযী নিয়ে চিন্তিত হবে না। যখন সে জানবে যে, আল্লাহ তার সব কথা শুনছেন ও সব কাজ দেখছেন, তখন সে অন্যায় কাজে ভীত হবে এবং নেকীর কাজে উৎসাহী হবে। যখন সে জানবে যে, আল্লাহ হায়াত ও মউতের মালিক, তিনি সন্তানদাতা, রোগ ও আরোগ্যদাতা এবং তিনিই বিপদহন্তা, তখন সে এসব বিষয় নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তায় ভুগবে না। যখন মানুষ জানবে যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান, তখন সে পাপ করে হতাশ হবে না। বরং অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ভালো হওয়ার চেষ্টা করবে। এভাবে মানুষ যখন আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জানবে, তখন সে সঠিকভাবে তার জীবনকে গড়ে তুলবে। নইলে যে কোন সময়ে তার পদস্খলন ঘটবে। আত্মগ্লানিতে সে ভেঙ্গে পড়বে। বস্ত্ততঃ অধিকাংশ বাতিল ফের্কার জন্ম হয়েছে তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের অভাবে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন- আমীন!
৪. তারা জামা‘আতবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেন এবং কখনোই উদ্ধত ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হন না।
আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালবাসেন ঐসব লোকদের, যারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে সারিবদ্ধভাবে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়’ (ছফ ৬১/৪)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَرَادَ بُحْبُوحَةَ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمِ الْجَمَاعَةَ ‘যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামা‘আতকে অপরিহার্য করে নেয়’।[5]
হযরত উমামাহ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,
اِتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ وَصَلُّوْا خَمْسَكُمْ وَصُوْمُوْا شَهْرَكُمْ وَأَدُّوْا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ وَأَطِيْعُوْا ذَا أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوْا جَنَّةَ رَبِّكُمْ -
(১) ‘তোমরা তোমাদের প্রভু আল্লাহকে ভয় কর (২) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর (৩) রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর (৪) তোমাদের সম্পদের যাকাত প্রদান কর এবং (৫) আমীরের আনুগত্য কর; তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ কর’।[6] অত্র হাদীছে আমীরের আনুগত্যকে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ইত্যাদি ফরয ইবাদতের সাথে যুক্ত করে বলা হয়েছে এবং একে জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইসলামী সংগঠনের স্তম্ভ হল ৪টি : আমীর, মামূর, বায়‘আত ও এত্বা‘আত।[7] বায়‘আত হ’ল আমীরের নিকট আল্লাহর নামে আল্লাহর বিধান মানার অঙ্গীকার গ্রহণের নাম। যা ব্যতীত ইসলামী সংগঠন হয় না। আল্লাহ বলেন, وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولاً ‘তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (ইসরা ১৭/৩৪)। বস্ত্ততঃ বায়‘আতবিহীন আনুগত্য সাধারণ সমর্থনের ন্যায়। জামা‘আতবদ্ধ জীবনে যার কোন দায়বদ্ধতা নেই। অতঃপর চতুর্থটি অর্থাৎ আনুগত্য না থাকলে বাকীগুলি মূল্যহীন হবে। কেননা অঙ্গীকার ও আনুগত্যহীন সংগঠন ইসলামে কাম্য নয়।
আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘আখেরাতের ঐ গৃহ আমরা নির্ধারিত করেছি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে উদ্ধত হয় না ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম রয়েছে কেবল মুত্তাকীদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
৫. তারা কুফর ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ও শক্তিশালী থাকেন এবং নিজেদের মধ্যে সর্বদা রহমদিল ও আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন।
আল্লাহ বলেন, مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُوْنَ فَضْلاً مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا سِيْمَاهُمْ فِيْ وُجُوْهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُوْدِ، ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং যারা তার সাথী, তারা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও নিজেদের মধ্যে সহমর্মী। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে সর্বদা রুকূকারী ও সিজদাকারী দেখতে পাবে। তাদের কপালে সিজদার চিহ্ন থাকবে’ (ফাৎহ ৪৮/২৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ ‘তুমি জান্নাতের সুসংবাদ দাও বিনীতদের জন্য’ (হজ্জ ২২/৩৪)।
তিনি আরও বলেন, وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لاَ تَعْلَمُونَهُمُ اللهُ يَعْلَمُهُمْ ‘তোমরা অবিশ্বাসীদের মুকাবিলায় যথাসাধ্য শক্তি ও সদা প্রস্ত্তত অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখো। যদ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের ভীত করবে এবং এছাড়াও অন্যদের, যাদেরকে তোমরা জানোনা। কিন্তু আল্লাহ জানেন’ (আনফাল ৮/৬০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ ‘শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চাইতে উত্তম ও আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় দুর্বল মুমিনের চাইতে’।[8] আর এটি কেবল দৈহিক শক্তি নয়। বরং মানসিক ও সাংগঠনিক শক্তিই বড় শক্তি। সেই সাথে থাকবে যুগোপযোগী বৈষয়িক শক্তি।
৬. তাঁরা যেকোন মূল্যে সুন্নাতকে আঁকড়ে থাকেন ও বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকেন।
হযরত ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘তোমরা আমার ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে ধারণ কর। তোমরা সেগুলি কঠিনভাবে আঁকড়ে ধর এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর। আর তোমরা ধর্মের নামে নতুন সৃষ্টি করা হ’তে বিরত থাক। কেননা প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।[9]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ زَمَانَ صَبْرٍ لِلْمُتَمَسِّكِ فِيْهِ أَجْرُ خَمْسِيْنَ شَهِيْدًا مِّنْكُمْ ‘তোমাদের পরে এমন একটা কঠিন সময় আসছে, যখন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে’।[10]
৭. তারা সর্বাবস্থায় সমবেতভাবে হাবলুল্লাহকে ধারণ করে থাকেন এবং কখনোই সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হন না। কেউ তাদেরকে ছেড়ে গেলে সে অবস্থায় তারা আল্লাহর উপর ভরসা করেন ও তাঁর গায়েবী মদদ কামনা করেন।
আল্লাহ বলেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا وَّلاَ تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করো এবং তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
হযরত নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ ‘জামা‘আতবদ্ধ জীবন হ’ল রহমত এবং বিচ্ছিন্ন জীবন হ’ল আযাব’।[11] তিনি বলেন, يَدُ اللهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ، ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত থাকে। আর শয়তান তার সাথে থাকে যে জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।[12]
‘হাবলুল্লাহ’ হ’ল কুরআন ও তার ব্যাখ্যা হাদীছ। যতক্ষণ কোন সংগঠনে এদু’টির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে এবং তা যথার্থভাবে অনুসৃত হবে, ততক্ষণ উক্ত সংগঠনের সাথে জামা‘আতবদ্ধ থাকা ফরয। যেমন হযরত উম্মুল হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا ‘যদি তোমাদের উপর একজন নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামকেও আমীর নিযুক্ত করা হয়, যদি তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তাহ’লে তোমরা তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর’।[13] হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمَنْ يُطِعْ الْأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِي وَمَنْ يَعْصِ الْأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِي وَإِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ وَعَدَلَ فَإِنَّ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ . ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল। আমীর হলেন ঢাল স্বরূপ। যার পিছনে থেকে লড়াই করা হয় ও যার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা হয়। যদি তিনি আল্লাহভীতির আদেশ দেন ও ন্যায় বিচার করেন, তাহ’লে এর বিনিময়ে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। আর যদি বিপরীত কিছু বলেন, তাহ’লে তার পাপ তার উপরেই বর্তাবে’।[14] তিনি বলেন, ‘তোমরা সাধ্যমত আমীরের কথা শোন ও মান্য কর’। ‘যদি আমীরের কোন বিষয় অপসন্দনীয় মনে কর, তাহ’লে তাতে ছবর কর। কেননা যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত বেরিয়ে গেল ও মৃত্যু বরণ করল, সে জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যু বরণ করল’।[15]
এই আমীর নাজী ফের্কার আমীর হ’তে পারেন কিংবা দেশের শাসক হ’তে পারেন। সাংগঠনিক আমীর ইসলামী ‘হুদূদ’ বা দন্ডবিধি জারি করতে পারেন না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আমীর সেটা করেন। উভয় অবস্থায় বায়‘আত ও আনুগত্য অপরিহার্য। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল, অথচ তার গর্দানে আমীরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত নেই, সে জাহেলী মৃত্যু বরণ করল’।[16] এটি কেবল খেলাফতে রাশেদাহ পর্যন্ত সীমায়িত নয়। বরং সকল যুগে রাষ্ট্রীয় বায়‘আত ও সাংগঠনিক বায়‘আত দু’টিই হ’তে পারে। কারণ বায়‘আত বা আনুগত্যের অঙ্গীকার না থাকলে রাষ্ট্র বা সংগঠনের প্রতি কোনরূপ দায়বদ্ধতা থাকে না। আর বায়‘আতবিহীন আনুগত্য সাধারণ সমর্থনের ন্যায়, যা তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না। এই বায়‘আত না থাকলে বা ভঙ্গ করলে কেউ কাফির হবে না বটে, কিন্তু সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। যাকে এখানে ‘জাহেলিয়াত’ বলা হয়েছে (মিরক্বাত)। যা আল্লাহর কাম্য নয়।
লোকেরা ছেড়ে গেলেও এবং পরিস্থিতি বিরূপ হলেও যারা হাবলুল্লাহকে মযবুতভাবে ধারণ করে থাকেন। এমতাবস্থায় তারা আল্লাহর গায়েবী মদদ পেয়ে থাকেন।
যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ ‘যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর উক্ত কথার উপর দৃঢ় থাকে, তাদের উপর ফেরেশতাগণ অবতীর্ণ হয় এই বলে যে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তান্বিত হয়ো না। তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০)।
নাজী ফের্কা থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং হক-বাতিল না বুঝে কোন দলে যোগ দেয়া বা নতুন দল গড়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً وَمَنْ قَاتَلَ تَحْتَ رَايَةٍ عُمِّيَّةٍ يَغْضَبُ لِعَصَبَةٍ أَوْ يَدْعُو إِلَى عَصَبَةٍ أَوْ يَنْصُرُ عَصَبَةً فَقُتِلَ فَقِتْلَةٌ جَاهِلِيَّةٌ ‘যে ব্যক্তি আনুগত্য হ’তে বেরিয়ে যায় ও জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, অতঃপর মারা যায়, সে জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করে। আর যে ব্যক্তি এমন পতাকাতলে যুদ্ধ করে, যার হক ও বাতিল হওয়া সম্পর্কে তার স্পষ্ট জ্ঞান নেই। বরং সে দলীয় প্রেরণায় ক্রুদ্ধ হয়, দলীয় প্রেরণায় লোকদের আহবান করে ও দলীয় প্রেরণায় মানুষকে সাহায্য করে, অতঃপর নিহত হয়। এমতাবস্থায় সে জাহেলিয়াতের উপর নিহত হয়।... [17]
যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয় ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالاً مَعَ أَثْقَالِهِمْ وَلَيُسْأَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ ‘তারা নিজেদের পাপভার বহন করবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে অন্যদের পাপের বোঝা। আর তারা যেসব মিথ্যা উদ্ভাবন করে সে বিষয়ে কিয়ামত দিবসে অবশ্যই তাদের প্রশ্ন করা হবে’ (আনকাবূত ২৯/১৩)।
[1]. আহমাদ হা/১৬৭৩৬; মিশকাত হা/১৫৯, ১৭০; ছহীহাহ হা/১২৭৩।
[2]. মুজাদালাহ ৫৮/২২; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৭; বুখারী হা/৬৬৩২।
[3]. ত্বাবারাণী কাবীর, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৯৮; মিশকাত হা/৫০১৪।
[4]. শাহরাস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল ১/৯৩ পৃঃ।
[5]. তিরমিযী হা/২১৬৫।
[6]. তিরমিযী হা/৬১৬, আহমাদ হা/২২২১৫; মিশকাত হা/৫৭১; ছহীহাহ হা/৮৬৭।
[7]. দ্রঃ সূরা তওবা ১১১ আয়াত যা মক্কায় বায়‘আতে কুবরা উপলক্ষে নাযিল হয়েছিল (ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত; ইক্বামতে দ্বীন পৃঃ ১৪-১৬; সূরা ফাৎহ ৪৮/১০, ১৮ আয়াত)।
[8]. মুসলিম হা/২৬৬৪; মিশকাত হা/৫২৯৮।
[9]. আহমাদ, আবুদাঊদ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১৬৫।
[10]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০২৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২৩৪।
[11]. আহমাদ হা/১৮৪৭২; ছহীহাহ হা/৬৬৭।
[12]. নাসাঈ হা/৪০২০; তিরমিযী হা/২১৬৬; মিশকাত হা/১৭৩।
[13]. মুসলিম হা/১৮৩৮, মিশকাত হা/৩৬৬২ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[14]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬১ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[15]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬৭-৬৮।
[16]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৭৪।
[17]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬৯, ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
পূর্বোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নাজী ফের্কা হ’ল মাত্র একটি :
ছাহাবায়ে কেরাম ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ। আল্লাহ বলেন, وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ‘ঈমান আনয়নে অগ্রবর্তী মুহাজির ও আনছারগণ এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে, আল্লাহ তাদের উপর খুশী হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর খুশী হয়েছে’ (তওবা ৯/১০০)।
হযরত ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, خَيْرُ أُمَّتِى قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ‘আমার উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’ল আমার যুগের লোক (অর্থাৎ ছাহাবীগণের যুগ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবেঈগণের যুগ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবে তাবেঈগণের যুগ)’।[1]
অতঃপর তাদের পরবর্তী সকল যুগে ‘আহলেহাদীছ’গণ। যারা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের ব্যাখ্যা করেন ও সার্বিক জীবনে তার অনুসারী থাকেন। ক্বিয়ামতের প্রাক্কাল অবধি এই দলের অস্তিত্ব থাকবে। যেমন হযরত ছওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَ هُمْ كَذَالِكَ ، رواه مسلم -
‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[2]
অন্য বর্ণনায় এসেছে لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ ‘তাদের বিরোধিতাকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[3] ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ عَلَى مَنْ نَاوَأَهُمْ حَتَّى يُقَاتِلَ آخِرُهُمُ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হক-এর উপর লড়াই করবে। তারা তাদের শত্রুদের উপর বিজয়ী থাকবে। তাদের শেষ দলটি দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’।[4]
উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, إِنْ لَّمْ يَكُوْنُوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ فَلاَ أَدْرِىْ مَنْ هُمْ؟ ‘তারা যদি ‘আহলেহাদীছ’ না হয়, তাহ’লে আমি জানি না তারা কারা’?[5]
বিদ‘আতীদের বিপরীতে তারা সর্বদা ‘আহলুল হাদীছ’ নামে পরিচিত হবেন। ছাহাবায়ে কেরাম ‘আহলুল হাদীছ’ নামে পরিচিত ছিলেন। ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মুসলিম যুবকদের ‘মারহাবা’ জানিয়ে বলতেন فَإِنَّكُمْ خُلُوْفُنَا وَأَهْلُ الْحَدِيْثِ بَعْدَنَا ‘তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও তোমরাই আমাদের পরবর্তী আহলুল হাদীছ’।[6] খ্যাতনামা তাবেঈ ইমাম শা‘বী (২২-১০৪ হিঃ) ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলতেন।[7] আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, তারা হলেন আহলুল হাদীছ’।[8] আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সকল প্রসিদ্ধ ইমাম, বিশেষ করে চার ইমামের প্রত্যেকে ছহীহ হাদীছকে তাদের মাযহাব হিসাবে ঘোষণা করে বলেছেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهبُنَا ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমাদের মাযহাব’।[9] অতএব সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী জীবন পরিচালনাকারী ব্যক্তিই মাত্র ‘আহলুল হাদীছ’ বলে অভিহিত হবেন। অন্য কেউ নয়।
আহলেহাদীছের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহের কারণে তাদের প্রশংসায় (১) ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ فِي كُلِّ زَمَانٍ كَالسَّحَابَةِ فِي زَمَانِهِمْ প্রত্যেক যামানায় আহলেহাদীছগণ হলেন সেই যামানার জন্য মেঘ সদৃশ।’ (২) তিনি বলতেন, إِذَا رَأَيْتُ صَاحِبَ حَدِيْثٍ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَياًّ ‘আমি যখন কোন আহলুল হাদীছকে দেখি, তখন যেন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর কোন ছাহাবীকে জীবন্ত দেখি’।[10]
(৩) ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) বলেন, لَوْلاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لاَنْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ يِعْنِىْ أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ - ‘আহলেহাদীছ জামা‘আত যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’।[11]
(৪) ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ فِىْ أَهْلِ الْإِسْلاَمِ كَأَهْلِ الْإِسْلاَمِ فِىْ أَهْلِ الْمِلَلِ ‘মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আহলেহাদীছের মর্যাদা অনুরূপ, যেমন সকল জাতির মধ্যে মুসলমানদের মর্যাদা’।[12]
উল্লেখ্য যে, যারা উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহ থেকে বিচ্যুত হয়, তারা আহলুল হাদীছ বা আহলুস সুন্নাহ নয়। মুখে যত দাবীই তারা করুক না কেন। যেমন কুরায়েশরা নিজেদেরকে ‘আহলুল্লাহ’ (আল্লাহওয়ালা) বলে দাবী করলেও তারা তা ছিলনা। বরং প্রকৃত আহলুল্লাহ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সাথী মুসলমানগণ। যদিও মক্কার মুশরিক নেতারা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘ছাবেঈ’ (ধর্মত্যাগী) ও ‘জামা‘আত বিভক্তকারী’ বলত।[13] যুগে যুগে বাতিলপন্থীরা এভাবেই হকপন্থীদের গালি দিবে।
পৃথিবীর সকল প্রান্তের সকল ‘আহলেহাদীছ’ একই ফেরক্বা নাজিয়াহর অন্তর্ভুক্ত। সাংগঠনিক শৃংখলার স্বার্থে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ‘আমীর’ থাকতে পারেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তারা সবাই একই ফের্কাভুক্ত। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির ঐক্য থাকলে বর্তমান বিশ্বে একই ইমারতের অধীনে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ পরিচালিত হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই কিছু বিদ‘আতী দল যার নমুনা কায়েম করেছে।
[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬০০০-০১ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. ছহীহ মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায়-৩৩, অনুচ্ছেদ-৫৩, হা/১৯২০; অত্র হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ ঐ, দেউবন্দ ছাপা শরহ নববী ২/১৪৩ পৃঃ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১ ‘ইল্ম’ অধ্যায় ও হা/৭৩১১-এর ভাষ্য ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা।
[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬২৭৬; আবুদাঊদ হা/৪২৫২।
[4]. আবুদাঊদ হা/২৪৮৪; মিশকাত হা/৩৮১৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[5]. তিরমিযী হা/২১৯২; মিশকাত হা/৬২৮৩-এর ব্যাখ্যা; ফাৎহুল বারী ১৩/৩০৬ পৃঃ, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা; খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ১৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০।
[6]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ১২; হাকেম ১/৮৮ পৃঃ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮০।
[7]. যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৮৩ পৃঃ।
[8]. তিরমিযী হা/২১৯২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭০২; মিশকাত হা/৬২৮৩।
[9]. শা‘রানী, কিতাবুল মীযান (দিল্লী : ১২৮৬ হিঃ) ১/৭৩ পৃঃ।
[10]. কিতাবুল মীযান ১/৬৫-৬৬; খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৬।
[11]. শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৯।
[12]. ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ (বৈরূতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ২/১৭৯ পৃঃ।
[13]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/২৬৭; আহমাদ হা/১৬০৬৯।
ছাহাবায়ে কেরাম ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ। আল্লাহ বলেন, وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ‘ঈমান আনয়নে অগ্রবর্তী মুহাজির ও আনছারগণ এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে, আল্লাহ তাদের উপর খুশী হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর খুশী হয়েছে’ (তওবা ৯/১০০)।
হযরত ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, خَيْرُ أُمَّتِى قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ‘আমার উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’ল আমার যুগের লোক (অর্থাৎ ছাহাবীগণের যুগ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবেঈগণের যুগ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবে তাবেঈগণের যুগ)’।[1]
অতঃপর তাদের পরবর্তী সকল যুগে ‘আহলেহাদীছ’গণ। যারা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের ব্যাখ্যা করেন ও সার্বিক জীবনে তার অনুসারী থাকেন। ক্বিয়ামতের প্রাক্কাল অবধি এই দলের অস্তিত্ব থাকবে। যেমন হযরত ছওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَ هُمْ كَذَالِكَ ، رواه مسلم -
‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[2]
অন্য বর্ণনায় এসেছে لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ ‘তাদের বিরোধিতাকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[3] ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ عَلَى مَنْ نَاوَأَهُمْ حَتَّى يُقَاتِلَ آخِرُهُمُ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হক-এর উপর লড়াই করবে। তারা তাদের শত্রুদের উপর বিজয়ী থাকবে। তাদের শেষ দলটি দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’।[4]
উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, إِنْ لَّمْ يَكُوْنُوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ فَلاَ أَدْرِىْ مَنْ هُمْ؟ ‘তারা যদি ‘আহলেহাদীছ’ না হয়, তাহ’লে আমি জানি না তারা কারা’?[5]
বিদ‘আতীদের বিপরীতে তারা সর্বদা ‘আহলুল হাদীছ’ নামে পরিচিত হবেন। ছাহাবায়ে কেরাম ‘আহলুল হাদীছ’ নামে পরিচিত ছিলেন। ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মুসলিম যুবকদের ‘মারহাবা’ জানিয়ে বলতেন فَإِنَّكُمْ خُلُوْفُنَا وَأَهْلُ الْحَدِيْثِ بَعْدَنَا ‘তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও তোমরাই আমাদের পরবর্তী আহলুল হাদীছ’।[6] খ্যাতনামা তাবেঈ ইমাম শা‘বী (২২-১০৪ হিঃ) ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলতেন।[7] আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, তারা হলেন আহলুল হাদীছ’।[8] আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সকল প্রসিদ্ধ ইমাম, বিশেষ করে চার ইমামের প্রত্যেকে ছহীহ হাদীছকে তাদের মাযহাব হিসাবে ঘোষণা করে বলেছেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهبُنَا ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমাদের মাযহাব’।[9] অতএব সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী জীবন পরিচালনাকারী ব্যক্তিই মাত্র ‘আহলুল হাদীছ’ বলে অভিহিত হবেন। অন্য কেউ নয়।
আহলেহাদীছের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহের কারণে তাদের প্রশংসায় (১) ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ فِي كُلِّ زَمَانٍ كَالسَّحَابَةِ فِي زَمَانِهِمْ প্রত্যেক যামানায় আহলেহাদীছগণ হলেন সেই যামানার জন্য মেঘ সদৃশ।’ (২) তিনি বলতেন, إِذَا رَأَيْتُ صَاحِبَ حَدِيْثٍ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَياًّ ‘আমি যখন কোন আহলুল হাদীছকে দেখি, তখন যেন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর কোন ছাহাবীকে জীবন্ত দেখি’।[10]
(৩) ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) বলেন, لَوْلاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لاَنْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ يِعْنِىْ أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ - ‘আহলেহাদীছ জামা‘আত যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’।[11]
(৪) ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ فِىْ أَهْلِ الْإِسْلاَمِ كَأَهْلِ الْإِسْلاَمِ فِىْ أَهْلِ الْمِلَلِ ‘মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আহলেহাদীছের মর্যাদা অনুরূপ, যেমন সকল জাতির মধ্যে মুসলমানদের মর্যাদা’।[12]
উল্লেখ্য যে, যারা উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহ থেকে বিচ্যুত হয়, তারা আহলুল হাদীছ বা আহলুস সুন্নাহ নয়। মুখে যত দাবীই তারা করুক না কেন। যেমন কুরায়েশরা নিজেদেরকে ‘আহলুল্লাহ’ (আল্লাহওয়ালা) বলে দাবী করলেও তারা তা ছিলনা। বরং প্রকৃত আহলুল্লাহ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সাথী মুসলমানগণ। যদিও মক্কার মুশরিক নেতারা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘ছাবেঈ’ (ধর্মত্যাগী) ও ‘জামা‘আত বিভক্তকারী’ বলত।[13] যুগে যুগে বাতিলপন্থীরা এভাবেই হকপন্থীদের গালি দিবে।
পৃথিবীর সকল প্রান্তের সকল ‘আহলেহাদীছ’ একই ফেরক্বা নাজিয়াহর অন্তর্ভুক্ত। সাংগঠনিক শৃংখলার স্বার্থে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ‘আমীর’ থাকতে পারেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তারা সবাই একই ফের্কাভুক্ত। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির ঐক্য থাকলে বর্তমান বিশ্বে একই ইমারতের অধীনে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ পরিচালিত হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই কিছু বিদ‘আতী দল যার নমুনা কায়েম করেছে।
[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬০০০-০১ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. ছহীহ মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায়-৩৩, অনুচ্ছেদ-৫৩, হা/১৯২০; অত্র হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ ঐ, দেউবন্দ ছাপা শরহ নববী ২/১৪৩ পৃঃ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১ ‘ইল্ম’ অধ্যায় ও হা/৭৩১১-এর ভাষ্য ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা।
[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬২৭৬; আবুদাঊদ হা/৪২৫২।
[4]. আবুদাঊদ হা/২৪৮৪; মিশকাত হা/৩৮১৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[5]. তিরমিযী হা/২১৯২; মিশকাত হা/৬২৮৩-এর ব্যাখ্যা; ফাৎহুল বারী ১৩/৩০৬ পৃঃ, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা; খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ১৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০।
[6]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ১২; হাকেম ১/৮৮ পৃঃ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮০।
[7]. যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৮৩ পৃঃ।
[8]. তিরমিযী হা/২১৯২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭০২; মিশকাত হা/৬২৮৩।
[9]. শা‘রানী, কিতাবুল মীযান (দিল্লী : ১২৮৬ হিঃ) ১/৭৩ পৃঃ।
[10]. কিতাবুল মীযান ১/৬৫-৬৬; খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৬।
[11]. শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৯।
[12]. ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ (বৈরূতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ২/১৭৯ পৃঃ।
[13]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/২৬৭; আহমাদ হা/১৬০৬৯।
ফায়েদা : (ক) মিশকাতুল মাছাবীহ-এর আরবী ভাষ্যগ্রন্থ মিরক্বাতুল মাফাতীহ-এর স্বনামধন্য লেখক মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ) مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ -এর ব্যাখ্যায় বলেন, فَلاَ شَكَّ وَلاَ رَيْبَ أَنَّهُمْ هُمْ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ، وَقِيلَ : ... فَإِنَّ ذَلِكَ يُعْرَفُ بِالْإِجْمَاعِ، فَمَا أَجْمَعَ عَلَيْهِ عُلَمَاءُ الْإِسْلاَمِ فَهُوَ حَقٌّ وَمَا عَدَاهُ فَهُوَ بَاطِلٌ ‘নিঃসন্দেহে তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। বলা হয়েছে যে, ... সেটা চেনা যাবে ইজমা-এর মাধ্যমে। অতএব যে বিষয়ের উপরে ওলামায়ে ইসলামের ইজমা বা ঐক্যমত হয়েছে, সেটাই হক। আর যা তার বাইরে তা বাতিল’।[1]
উপরোক্ত বক্তব্য অবশ্যই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কেননা বিদ‘আতী আলেমরাও নিজেদেরকে ওলামায়ে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবী করেন এবং নিজেদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বলেন। বরং সকল যুগে এদের সংখ্যাই বেশী। অথচ বিদ‘আতীরা কখনোই আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত নন।
অতঃপর ছাহেবে মিরক্বাত বলেন,
وَالْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ هُمْ أَهْلُ السُّنَّةِ الْبَيْضَاءِ الْمُحَمَّدِيَّةِ وَالطَّرِيقَةِ النَّقِيَّةِ الْأَحْمَدِيَّةِ، وَلَهَا ظَاهِرٌ سُمِّيَ بِالشَّرِيعَةِ شِرْعَةً لِلْعَامَّةِ، وَبَاطِنٌ سُمِّيَ بِالطَّرِيقَةِ مِنْهَاجًا لِلْخَاصَّةِ وَخُلاَصَةٌ خُصَّتْ بِاسْمِ الْحَقِيقَةِ مِعْرَاجًا لِأَخَصِّ الْخَاصَّةِ، فَالْأَوَّلُ نَصِيبُ الْأَبْدَانِ مِنَ الْخِدْمَةِ، وَالثَّانِي نَصِيبُ الْقُلُوبِ مِنَ الْعِلْمِ وَالْمَعْرِفَةِ، وَالثَّالِثُ نَصِيبُ الْأَرْوَاحِ مِنَ الْمُشَاهَدَةِ وَالرُّؤْيَةِ . قَالَ الْقُشَيْرِيُّ : وَالشَّرِيعَةُ أَمْرٌ بِالْتِزَامِ الْعُبُودِيَّةِ وَالْحَقِيقَةُ مُشَاهَدَةُ الرُّبُوبِيَّةِ، فَكُلُّ شَرِيعَةٍ غَيْرُ مُؤَيَّدَةٍ بِالْحَقِيقَةِ فَغَيْرُ مَقْبُولٍ، وَكُلُّ حَقِيقَةٍ غَيْرُ مُقَيَّدَةٍ بِالشَّرِيعَةِ فَغَيْرُ مَحْصُولٍ . فَالشَّرِيعَةُ قِيَامٌ بِمَا أُمِرَ وَالْحَقِيقَةُ شُهُودٌ لِمَا قُضِيَ وَقُدِّرَ وَأُخْفِيَ وَأُظْهِرَ - ( مرقاة ১/২৪৮)-
‘ফের্কায়ে নাজিয়াহ হ’ল আহলে সুন্নাত দল। যারা স্বচ্ছ মুহাম্মাদী সুন্নাত ও পরিচ্ছন্ন আহমাদী তরীকার অনুসারী। যার একটি বাহ্যিক দিক আছে। যার নাম ‘শরী‘আত’। যা সাধারণ মানুষের জন্য প্রদত্ত বিধান। তার একটি বাতেনী দিক আছে, যার নাম ‘তরীকত’, যা খাছ লোকদের জন্য প্রদত্ত পন্থা। আর একটি সারবস্ত্ত রয়েছে যার নাম ‘হাকীকত’। যা হ’ল খাছ লোকদের মধ্যকার খাছ ব্যক্তিগণের জন্য মি‘রাজ সদৃশ। এক্ষণে প্রথমটি হ’ল দেহের অংশ, যা তার ক্রিয়াকর্মের দ্বারা অর্জিত হয়। দ্বিতীয়টি হ’ল কলবের অংশ, যা ইলম ও মা‘রেফাত তথা জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে অর্জিত হয়। তৃতীয়টি হ’ল রূহের অংশ, যা মুশাহাদাহ বা চাক্ষুষ দর্শনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। কুশায়রী বলেন, শরী‘আত হ’ল উবূদিয়াত অর্থাৎ আল্লাহর দাসত্বকে কবুল করে নেওয়ার বিষয়। হাকীকত হ’ল রুবূবিয়াতকে দর্শনের বিষয়। এক্ষণে প্রত্যেক শরী‘আত যা হাকীকত দ্বারা শক্তিকৃত নয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপভাবে প্রত্যেক হাকীকত যা শরী‘আতের বিধানযুক্ত নয়, তা ফলবলহীন। অতএব শরী‘আত হ’ল আদিষ্ট বিষয় পালন করার নাম এবং হাকীকত হ’ল ক্বাযা ও ক্বদর তথা তাকদীরে নির্ধারিত গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় সমূহ চাক্ষুষ দর্শনের নাম’।[2]
উপরোক্ত বক্তব্যগুলি স্রেফ ধারণা নির্ভর ও কাল্পনিক ব্যাখ্যা মাত্র, যা কোন দলীলের উপর ভিত্তিশীল নয়। কেননা হাদীছে জিব্রীলে ইহসান-এর ব্যাখ্যায় অত্যন্ত সহজ ও সুন্দরভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে এমন বিশ্বাস নিয়ে ইবাদত কর যে তিনি তোমাকে দেখছেন’।[3] এর দ্বারা রাসূল (ছাঃ) একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, তোমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে ও পূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে ইবাদতে রত হও যে আল্লাহ তোমার সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। অতএব ভীত-সন্ত্রস্ত ও শ্রদ্ধাভরা আকুতি নিয়ে হে মুছল্লী! তুমি ছালাতে মনোনিবেশ কর। এই মনোনিবেশ সাধারণ-অসাধারণ সকল মুছল্লীর মধ্যে যাতে সমানভাবে সৃষ্টি হয়, সেদিকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যদিও সবার জন্য সর্বাবস্থায় তা সম্ভব হয় না। আর এর ফলেই আল্লাহর নিকটে মুছল্লীদের স্তরভেদ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ইহসান-এর এই স্তর হাছিল করার জন্য ছালাত ব্যতীত পৃথক কোন মা‘রেফতী তরীকা বা পদ্ধতি রাসূল (ছাঃ) চালু করে যাননি। যা ছাহাবী ও তাবেঈগণের স্বর্ণযুগের পর ভ্রষ্টতার যুগে কথিত ছূফী ও পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে সমাজে চালু হয়েছে এবং যা বর্তমানে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া ও মুজদ্দেদিয়া নামে প্রধান চারটি তরীকায় বিভক্ত। অতঃপর তা আরও বিভক্ত হয়ে উপমহাদেশে অন্যূন দু’শো তরীকার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে মাযহাবের নামে, তরীকার নামে, দেহতত্ত্বের নামে উপমহাদেশের বিশেষ করে হানাফী সমাজ অসংখ্য ভাগে বিভক্ত ও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। প্রত্যেক মুরীদ তার তরীকার পীর নিয়েই সন্তুষ্ট। আর এইসব তরীকার পীরের সংখ্যা শুধু বাংলাদেশেই ১৯৮১ সালের সরকারী হিসাব মতে ২,৯৮,০০০। যা বর্তমানে আরও বেড়েছে। এইসব পীরগণ আল্লাহ ও বান্দার মাঝে অসীলা হিসাবে পূজিত হচ্ছেন। এমনকি তদের নামে কুমীর, কচ্ছপ, কবুতর, গজাল মাছ ইত্যাদিও পূজিত হচ্ছে। মৃত্যুর পরে তাদের কবরের উপরে নির্মিত কারুকার্যখচিত সমাধিসৌধে কুরআনের বিশেষ একটি আয়াত লিখে ভক্তদের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে এভাবে যে, আউলিয়াগণ মরেন না। আয়াতটি হ’ল, أَلاَ إِنَّ أَوْلِيْاء اللهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ - ‘মনে রেখ যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)। আল্লাহ স্বীয় রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বলছেন, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারাও (অর্থাৎ পূর্বের নবীরাও) মৃত্যুবরণ করেছে’ (যুমার ৩৯/৩০)। অন্যদিকে সকল মৃত ব্যক্তির জন্য সাধারণ রীতি হিসাবে আল্লাহ বলেন, وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘আর তাদের সম্মুখে বারযাখ অর্থাৎ পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। ফলে বারযাখী জগতের লোকেরা পার্থিব জগতের কারু কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারেন না। যেমন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুর পর হযরত ওমর, ওছমান, আলী ও হুসায়েন (রাঃ)-এর কোন উপকার করতে পারেন নি বা তাদের হত্যাকারীদের ঠেকাতে পারেন নি।
এক্ষণে আল্লাহর বন্ধু কারা? সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, اللهُ وَلِيُّ الَّذِيْنَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ ‘আল্লাহ হ’লেন বিশ্বাসীদের অলী বা অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হ’তে আলোর পথে নিয়ে যান। আর যারা অবিশ্বাসী, শয়তান তাদের অলী বা অভিভাবক। সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। ওরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, প্রকৃত মুমিন যারা, তারাই আল্লাহর অলী। যারা নিজেরা অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে আসে এবং অন্যকে আলোর পথে ডাকে। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথে আহবান করে। আল্লাহ তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলেন, نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ ‘আমরা তোমাদের অভিভাবক তোমাদের পার্থিব জীবনে এবং আখেরাতে। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমরা দাবী করবে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩১)। তিনি সাবধান করে বলেন, أَفَحَسِبَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا أَنْ يَتَّخِذُوا عِبَادِي مِنْ دُوْنِي أَوْلِيَاءَ إِنَّا أَعْتَدْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِيْنَ نُزُلاً ‘অবিশ্বাসীরা কি ভেবেছে তারা আমাকে বাদ দিয়ে আমার বান্দাদের অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করবে? আমরা অবিশ্বাসীদের আপ্যায়নের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (কাহফ ১৮/১০২)।
অতএব মৃতব্যক্তি কখনোই জীবিত নন। তিনি কারু ‘অলি’ বা অভিভাবক নন। তিনি তার নিজের বা অন্যের কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারেন না। তিনি কাউকে দেখতে পান না বা কারু কথা শুনতে পান না। যারা এটাতে বিশ্বাসী, তারা শিরকে ডুবে আছে। তারা কখনোই আল্লাহর অলী নয়। বরং নিঃসন্দেহে শয়তানের অলী। এরা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যকে পথভ্রষ্ট করে। এরা মহাপাপী। খালেছ তওবা ব্যতীত এদের পাপের কোন ক্ষমা নেই।
বিগত যুগের কোন কোন ছূফী তো নিজেকেই ‘আল্লাহ’ বলেছেন। যেমন মেহমানের ডাকে ঘরে অবস্থানকারী আবু ইয়াযীদ বিসত্বামী ওরফে বায়েযীদ বোস্তামী (১৮৮-২৬১/৮০৪-৮৭৫ খৃঃ) বলেন, لَيْسَ فِي الْبَيْتِ أَحَدٌ إِلاَّ اللهُ ‘ঘরের মধ্যে কেউ নেই আল্লাহ ব্যতীত’।[4] একই আক্বীদার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে চালু হয়েছে, ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’। অর্থাৎ সৃষ্টি সবাই স্রষ্টার অংশ। এরা আহমাদ ও আহাদ-এর মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পান না একটা মীম-এর পর্দা ব্যতীত। এসব পীরদের কবর মহাসমারোহে পূজিত হচ্ছে তাদের ভক্তদের মাধ্যমে। মৃত পীরকে খুশী করার জন্য এরা তাদের জান-মাল উৎসর্গ করছে। তার অসীলাতেই তারা পরকালে মুক্তি কামনা করছে (ইউনুস ১০/১৮; যুমার ৩৯/৩)। ওদিকে আবার ছালাত-ছিয়াম-হজ্জ-ওমরাহ সবই পালন করছে। এটাই যদি হয় বাস্তবতা, তাহ’লে জাহেলী আরবের মূর্তিপূজারীদের সাথে উপমহাদেশের এইসব কবরপূজারীদের আক্বীদার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
ওদিকে রাজনৈতিক নেতারা কিছু ইট ও রড-সিমেন্ট দিয়ে একটা স্তম্ভ খাড়া করে বা প্রতিকৃতি বানিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করছেন। যেকোন উপলক্ষ্যে সেখানে গিয়ে নীরবতা পালন করছেন বা নেতার কবরে গিয়ে ফুল দিচ্ছেন ও ‘ফাতেহা’ পাঠ করছেন। ভাবখানা এই, যেন কবরস্থ নেতা বা নেতার ছবি ও প্রতিকৃতি সবই শুনছেন ও দেখছেন। অথচ এসবের পিছনে কোন যুক্তিও নেই, ধর্মও নেই, স্রেফ মূর্তিপূজারীদের অনুকরণ ব্যতীত। তাদের বানানো এইসব সৌধ, মিনার ও স্তম্ভগুলি এখন মসজিদের চাইতে পবিত্র স্থান বলে পূজিত হচ্ছে। অথচ যত লোক যতদিন যাবত এসবে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে, তত লোকের তত পরিমাণ পাপের বোঝা ক্বিয়ামতের দিন ঐ লোকদের উপরে চাপানো হবে, যারা এগুলি প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন আল্লাহ বলেন, لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلاَ سَاءَ مَا يَزِرُونَ ‘ফলে ক্বিয়ামত দিবসে তারা পূর্ণমাত্রায় তাদের পাপভার বহন করবে এবং তাদেরও পাপভার বহন করবে যাদেরকে ওরা অজ্ঞতাবশে পথভ্রষ্ট করেছে। দেখো, তারা যা বহন করে, তা কতই না নিকৃষ্ট’ (নাহল ১৬/২৫)। পৃথিবীতে কাবীল প্রথমে মানুষ খুন করায় পরবর্তীতে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ অন্যায়ভাবে খুন হবে, সকলের পাপের একটি অংশ কাবীলের আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে।[5]
যদি সুন্নী বিদ্বানগণ শরী‘আত, তরীকত, হাকীকত, মা‘রেফাত এভাবে ইসলামকে বিভক্ত করে জনগণের সামনে পেশ না করতেন, তাহ’লে এর সুযোগ নিয়ে ইবলীস পৃথক পৃথক তরীকা ও খানকাহ খুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারত না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা করেননি, তা থেকে সুধারণা বশেও কোন কাজ করলে শয়তান ঐ সুযোগে মুমিনের যে কতবড় সর্বনাশ করে, কবরপূজারী এইসব পথভ্রষ্ট তথাকথিত সুন্নী মুসলমানেরা তার বড় প্রমাণ। অতএব ছাহেবে মিরক্বাত বর্ণিত ‘ওলামায়ে ইসলাম’-এর সঠিক অর্থ হবে - علماء أهل السنة الصحيحة ‘ছহীহ সুন্নাহর অনুসারী আলেমগণ’। নিঃসন্দেহে তারা ‘আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম’ ব্যতীত আর কেউ নন।
(খ) একইভাবে বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফের সম্মানিত অনুবাদক ‘ছাহাবীগণ এবং হাদীছ ও ফিক্বহের ইমামগণ আহলে সুন্নাতের আক্বীদার অনুসারী ছিলেন’ বলার পরে একই বাক্যে বলেছেন, ‘দুনিয়ার সমস্ত ছূফী ওলীগণও এই আকীদাই পোষণ করিয়া গিয়াছেন’।[6] অথচ ছূফী-ওলী এই পরিভাষাগুলি সৃষ্টি হয়েছে স্বর্ণযুগ গত হয়ে যাবার পরে ভ্রষ্টতার যুগে। যার মূল নিহিত রয়েছে ইরানের অনৈসলামী যুগের অদ্বৈতবাদী কুফরী দর্শনের মধ্যে। যাদের দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক ও অদ্বৈত সত্তা এবং সৃষ্টি স্রষ্টার অংশ মাত্র। ইসলাম এই দর্শনের ঘোর প্রতিবাদ করে বলেছে যে, ‘আল্লাহ এক। তিনি মুখাপেক্ষীহীন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি কারু জন্মিত নন। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই’ (ইখলাছ ১১২/১-৪)। মাননীয় অনুবাদকের কথিত ছূফী-ওলীদের মর্যাদা নিঃসন্দেহে ছাহাবীগণের উপরে নয় বা তাদের সম মানের নয়। অথচ আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কেবল ছাহাবীগণের আক্বীদা ও আমলের অনুসারী, অন্যদের নয়।
অতঃপর মাননীয় অনুবাদক লিখেছেন, হাদীছে ফের্কা বলিতে আকীদা ও বিশ্বাসগত দলকেই বুঝাইয়াছে। কারণ আকীদা বা বিশ্বাসই হইল ইছলামের মূল। সুতরাং হানাফী, শাফেঈ প্রভৃতি ইহার অন্তর্গত নহে। ইহাদের সকলের আকীদাই এক। ইহারা সকলেই আহলুছ ছুন্নাতে ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত। ইহাদের এখতেলাফ শুধু ওজু, নামাজ প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ’।[7]
কথাটি যত হালকাভাবে বলা হয়েছে, বিষয়টি তত হালকা নয়। কেননা খুঁটিনাটি ইখতেলাফ অতক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য, যতক্ষণ সেখানে ছহীহ হাদীছের সমাধান না পাওয়া যায়। পেয়ে গেলে সেটাই মেনে নিতে হবে। আর তখন কোন ইখতেলাফ থাকবে না। কিন্তু সেটা পাওয়ার পরেও যদি যিদ করা হয়, তখন সেটা তাক্বলীদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রদত্ত বিধান বাদ দিয়ে অন্যের বিধান মান্য করা হবে। যা ‘শিরক ফির-রিসালাত’-এর পর্যায়ভুক্ত এবং যা নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ কাজের পরিণামেই মুসলিম উম্মাহ তাদের ‘খেলাফত’ হারিয়েছে। আজও সমাজে সর্বত্র ধর্মীয় হানাহানি মূলতঃ এই তাক্বলীদী যিদ ও মাযহাবী হঠকারিতার কারণেই বিদ্যমান রয়েছে।
অতএব যুক্তির নিরিখে মাননীয় অনুবাদকের উপরোক্ত বক্তব্য অনেকটা সঠিক হ’লেও বাস্তবতা বহুলাংশে ভিন্ন। কেননা (ক) উপমহাদেশের কবরপূজারী মুসলমানেরা অধিকাংশ হানাফী মাযহাবভুক্ত। অথচ কবরপূজা পরিষ্কারভাবে শিরক। এতদ্ব্যতীত আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কেও তাদের অনেকের আক্বীদা ভ্রান্তিপূর্ণ। যেমন (খ) অধিকাংশ হানাফী আলেম বলেন, ‘আল্লাহ নিরাকার। তিনি সর্বত্র বিরাজমান’। অথচ এগুলি আহলে সুন্নাতের আক্বীদা বহির্ভূত। কেননা সঠিক আক্বীদা হ’ল এই যে, আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে, যা তাঁর উপযুক্ত এবং যা কারু সাথে তুলনীয় নয় (শূরা ৪২/১১)। তাঁর সত্তা সপ্তাকাশের উপরে আরশে সমুন্নীত (ত্বোয়াহা ২০/৫-৬)। তাঁর ইল্ম ও কুদরত তথা জ্ঞান ও শক্তি সর্বত্র বিরাজিত (বাক্বারাহ ২/২৫৫)।
(গ) অনেক হানাফী ওলামা-মাশায়েখ বলেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ) মানুষ নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন নূরের নবী। তারা বলেন, আল্লাহর নূরে মুহাম্মাদ পয়দা, মুহাম্মাদের নূরে সারা জাহান পয়দা’। অথচ মুহাম্মাদ (ছাঃ) নূরের তৈরী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অন্যান্য মানুষের ন্যায় মাটির মানুষ (কাহফ ১৮/১১০)। তিনি সাধারণ মানুষের ন্যায় খানা-পিনা করতেন। বিয়ে-শাদী করেছিলেন। সন্তানের পিতা হয়েছিলেন। অথচ ‘নূর’ হলে তিনি এসব হতে মুক্ত থাকতেন। (ঘ) অধিকাংশ হানাফী আলেমের নিকটে চার মাযহাব মান্য করা ফরয এবং মাযহাবী তাক্বলীদ করা ফরয। আর চার ইমামের পরে ইজতিহাদের দুয়ার বন্ধ। (ঙ) অনেকের নিকটে পীর ধরা ফরয। যার কোন পীর নেই, শয়তান তার পীর’। অথচ এগুলি আহলে সুন্নাতের আক্বীদাভুক্ত নয়। অতএব ‘শুধু ওজু, নামাজ প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে এখতেলাফ সীমাবদ্ধ’ বলে আত্মতুষ্টি লাভের কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া ওযূ ও ছালাত কখনোই খুঁটিনাটি বিষয় নয়। বরং ছালাত হ’ল সর্বপ্রধান ইবাদত, ক্বিয়ামতের দিন যার প্রথম হিসাব নেওয়া হবে। ছালাতের হিসাব সুষ্ঠু হ’লে বাকী সবকিছুর হিসাব সুষ্ঠু হবে। নইলে সব বরবাদ হবে।[8]
অতএব আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী বিবাদীয় সকল বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। আর সুন্নাহ হ’তে হবে ছহীহ সুন্নাহ। কোন যঈফ বা জাল হাদীছ নয়। সুতরাং তারাই হবে সত্যিকারের আহলে সুন্নাত, যারা নিজেদের মনগড়া শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ থেকে খালেছভাবে তওবা করে সর্বাবস্থায় ছহীহ হাদীছমুখী হবে। নইলে মুখে ‘সুন্নী’ বলে কাজের বেলায় শিরক ও বিদ‘আতের বাজার গরম করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিদর্শন নয়।
অতএব افةراق الأمة বা উম্মতের বিভক্তি রোধের একটাই পথ খোলা রয়েছে। আর তা হ’ল, الرجوع إلي الكةاب والسنة الصحيحة অর্থাৎ তাক্বলীদী গোঁড়ামী পরিহার করে নিরপেক্ষ ও খোলা মন নিয়ে সর্বাবস্থায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যাওয়া এবং খোলাফায়ে রাশেদীন, ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের বুঝ হাছিল করা। কারু কোন বিষয় জানা না থাকলে বিজ্ঞ ও মুত্তাক্বী আলেমের নিকট থেকে তিনি জেনে নিবেন দলীলের ভিত্তিতে, রায়-এর ভিত্তিতে নয়। মনে রাখা আবশ্যক যে, দ্বীন সম্পূর্ণ হয়েছে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়। অতএব রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে যা দ্বীন ছিল না, এ যুগে তা দ্বীন নয়। যতই তার গায়ে দ্বীনের লেবাস পরানো হৌক না কেন।
[1]. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাত শরহ মিশকাত (দিল্লী : তাবি) ১/২৪৮ পৃঃ।
[2]. মিরক্বাত ১/২৪৮ পৃঃ।
[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২।
[4]. আব্দুর রহমান, আন-নাক্বশাবান্দিায়া (রিয়ায : দার ত্বাইয়িবাহ, ১৪০৯/১৯৮৮), পৃঃ ৭৭।
[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২১১ ‘ইলম’ অধ্যায়।
[6]. নূর মোহাম্মদ আ‘জমী, বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১৯৮৬), হা/১৬৩ (৩১)-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য, ১/১৮১ পৃঃ।
[7]. পূর্বোক্ত, ১/১৮২ পৃঃ।
[8]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব, ছহীহাহ হা/১৩৫৮; আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৩৩০।
উপরোক্ত বক্তব্য অবশ্যই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কেননা বিদ‘আতী আলেমরাও নিজেদেরকে ওলামায়ে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবী করেন এবং নিজেদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বলেন। বরং সকল যুগে এদের সংখ্যাই বেশী। অথচ বিদ‘আতীরা কখনোই আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত নন।
অতঃপর ছাহেবে মিরক্বাত বলেন,
وَالْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ هُمْ أَهْلُ السُّنَّةِ الْبَيْضَاءِ الْمُحَمَّدِيَّةِ وَالطَّرِيقَةِ النَّقِيَّةِ الْأَحْمَدِيَّةِ، وَلَهَا ظَاهِرٌ سُمِّيَ بِالشَّرِيعَةِ شِرْعَةً لِلْعَامَّةِ، وَبَاطِنٌ سُمِّيَ بِالطَّرِيقَةِ مِنْهَاجًا لِلْخَاصَّةِ وَخُلاَصَةٌ خُصَّتْ بِاسْمِ الْحَقِيقَةِ مِعْرَاجًا لِأَخَصِّ الْخَاصَّةِ، فَالْأَوَّلُ نَصِيبُ الْأَبْدَانِ مِنَ الْخِدْمَةِ، وَالثَّانِي نَصِيبُ الْقُلُوبِ مِنَ الْعِلْمِ وَالْمَعْرِفَةِ، وَالثَّالِثُ نَصِيبُ الْأَرْوَاحِ مِنَ الْمُشَاهَدَةِ وَالرُّؤْيَةِ . قَالَ الْقُشَيْرِيُّ : وَالشَّرِيعَةُ أَمْرٌ بِالْتِزَامِ الْعُبُودِيَّةِ وَالْحَقِيقَةُ مُشَاهَدَةُ الرُّبُوبِيَّةِ، فَكُلُّ شَرِيعَةٍ غَيْرُ مُؤَيَّدَةٍ بِالْحَقِيقَةِ فَغَيْرُ مَقْبُولٍ، وَكُلُّ حَقِيقَةٍ غَيْرُ مُقَيَّدَةٍ بِالشَّرِيعَةِ فَغَيْرُ مَحْصُولٍ . فَالشَّرِيعَةُ قِيَامٌ بِمَا أُمِرَ وَالْحَقِيقَةُ شُهُودٌ لِمَا قُضِيَ وَقُدِّرَ وَأُخْفِيَ وَأُظْهِرَ - ( مرقاة ১/২৪৮)-
‘ফের্কায়ে নাজিয়াহ হ’ল আহলে সুন্নাত দল। যারা স্বচ্ছ মুহাম্মাদী সুন্নাত ও পরিচ্ছন্ন আহমাদী তরীকার অনুসারী। যার একটি বাহ্যিক দিক আছে। যার নাম ‘শরী‘আত’। যা সাধারণ মানুষের জন্য প্রদত্ত বিধান। তার একটি বাতেনী দিক আছে, যার নাম ‘তরীকত’, যা খাছ লোকদের জন্য প্রদত্ত পন্থা। আর একটি সারবস্ত্ত রয়েছে যার নাম ‘হাকীকত’। যা হ’ল খাছ লোকদের মধ্যকার খাছ ব্যক্তিগণের জন্য মি‘রাজ সদৃশ। এক্ষণে প্রথমটি হ’ল দেহের অংশ, যা তার ক্রিয়াকর্মের দ্বারা অর্জিত হয়। দ্বিতীয়টি হ’ল কলবের অংশ, যা ইলম ও মা‘রেফাত তথা জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে অর্জিত হয়। তৃতীয়টি হ’ল রূহের অংশ, যা মুশাহাদাহ বা চাক্ষুষ দর্শনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। কুশায়রী বলেন, শরী‘আত হ’ল উবূদিয়াত অর্থাৎ আল্লাহর দাসত্বকে কবুল করে নেওয়ার বিষয়। হাকীকত হ’ল রুবূবিয়াতকে দর্শনের বিষয়। এক্ষণে প্রত্যেক শরী‘আত যা হাকীকত দ্বারা শক্তিকৃত নয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপভাবে প্রত্যেক হাকীকত যা শরী‘আতের বিধানযুক্ত নয়, তা ফলবলহীন। অতএব শরী‘আত হ’ল আদিষ্ট বিষয় পালন করার নাম এবং হাকীকত হ’ল ক্বাযা ও ক্বদর তথা তাকদীরে নির্ধারিত গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় সমূহ চাক্ষুষ দর্শনের নাম’।[2]
উপরোক্ত বক্তব্যগুলি স্রেফ ধারণা নির্ভর ও কাল্পনিক ব্যাখ্যা মাত্র, যা কোন দলীলের উপর ভিত্তিশীল নয়। কেননা হাদীছে জিব্রীলে ইহসান-এর ব্যাখ্যায় অত্যন্ত সহজ ও সুন্দরভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে এমন বিশ্বাস নিয়ে ইবাদত কর যে তিনি তোমাকে দেখছেন’।[3] এর দ্বারা রাসূল (ছাঃ) একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, তোমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে ও পূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে ইবাদতে রত হও যে আল্লাহ তোমার সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। অতএব ভীত-সন্ত্রস্ত ও শ্রদ্ধাভরা আকুতি নিয়ে হে মুছল্লী! তুমি ছালাতে মনোনিবেশ কর। এই মনোনিবেশ সাধারণ-অসাধারণ সকল মুছল্লীর মধ্যে যাতে সমানভাবে সৃষ্টি হয়, সেদিকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যদিও সবার জন্য সর্বাবস্থায় তা সম্ভব হয় না। আর এর ফলেই আল্লাহর নিকটে মুছল্লীদের স্তরভেদ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ইহসান-এর এই স্তর হাছিল করার জন্য ছালাত ব্যতীত পৃথক কোন মা‘রেফতী তরীকা বা পদ্ধতি রাসূল (ছাঃ) চালু করে যাননি। যা ছাহাবী ও তাবেঈগণের স্বর্ণযুগের পর ভ্রষ্টতার যুগে কথিত ছূফী ও পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে সমাজে চালু হয়েছে এবং যা বর্তমানে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া ও মুজদ্দেদিয়া নামে প্রধান চারটি তরীকায় বিভক্ত। অতঃপর তা আরও বিভক্ত হয়ে উপমহাদেশে অন্যূন দু’শো তরীকার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে মাযহাবের নামে, তরীকার নামে, দেহতত্ত্বের নামে উপমহাদেশের বিশেষ করে হানাফী সমাজ অসংখ্য ভাগে বিভক্ত ও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। প্রত্যেক মুরীদ তার তরীকার পীর নিয়েই সন্তুষ্ট। আর এইসব তরীকার পীরের সংখ্যা শুধু বাংলাদেশেই ১৯৮১ সালের সরকারী হিসাব মতে ২,৯৮,০০০। যা বর্তমানে আরও বেড়েছে। এইসব পীরগণ আল্লাহ ও বান্দার মাঝে অসীলা হিসাবে পূজিত হচ্ছেন। এমনকি তদের নামে কুমীর, কচ্ছপ, কবুতর, গজাল মাছ ইত্যাদিও পূজিত হচ্ছে। মৃত্যুর পরে তাদের কবরের উপরে নির্মিত কারুকার্যখচিত সমাধিসৌধে কুরআনের বিশেষ একটি আয়াত লিখে ভক্তদের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে এভাবে যে, আউলিয়াগণ মরেন না। আয়াতটি হ’ল, أَلاَ إِنَّ أَوْلِيْاء اللهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ - ‘মনে রেখ যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)। আল্লাহ স্বীয় রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বলছেন, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারাও (অর্থাৎ পূর্বের নবীরাও) মৃত্যুবরণ করেছে’ (যুমার ৩৯/৩০)। অন্যদিকে সকল মৃত ব্যক্তির জন্য সাধারণ রীতি হিসাবে আল্লাহ বলেন, وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘আর তাদের সম্মুখে বারযাখ অর্থাৎ পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। ফলে বারযাখী জগতের লোকেরা পার্থিব জগতের কারু কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারেন না। যেমন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুর পর হযরত ওমর, ওছমান, আলী ও হুসায়েন (রাঃ)-এর কোন উপকার করতে পারেন নি বা তাদের হত্যাকারীদের ঠেকাতে পারেন নি।
এক্ষণে আল্লাহর বন্ধু কারা? সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, اللهُ وَلِيُّ الَّذِيْنَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ ‘আল্লাহ হ’লেন বিশ্বাসীদের অলী বা অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হ’তে আলোর পথে নিয়ে যান। আর যারা অবিশ্বাসী, শয়তান তাদের অলী বা অভিভাবক। সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। ওরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, প্রকৃত মুমিন যারা, তারাই আল্লাহর অলী। যারা নিজেরা অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে আসে এবং অন্যকে আলোর পথে ডাকে। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথে আহবান করে। আল্লাহ তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলেন, نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ ‘আমরা তোমাদের অভিভাবক তোমাদের পার্থিব জীবনে এবং আখেরাতে। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমরা দাবী করবে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩১)। তিনি সাবধান করে বলেন, أَفَحَسِبَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا أَنْ يَتَّخِذُوا عِبَادِي مِنْ دُوْنِي أَوْلِيَاءَ إِنَّا أَعْتَدْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِيْنَ نُزُلاً ‘অবিশ্বাসীরা কি ভেবেছে তারা আমাকে বাদ দিয়ে আমার বান্দাদের অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করবে? আমরা অবিশ্বাসীদের আপ্যায়নের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (কাহফ ১৮/১০২)।
অতএব মৃতব্যক্তি কখনোই জীবিত নন। তিনি কারু ‘অলি’ বা অভিভাবক নন। তিনি তার নিজের বা অন্যের কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারেন না। তিনি কাউকে দেখতে পান না বা কারু কথা শুনতে পান না। যারা এটাতে বিশ্বাসী, তারা শিরকে ডুবে আছে। তারা কখনোই আল্লাহর অলী নয়। বরং নিঃসন্দেহে শয়তানের অলী। এরা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যকে পথভ্রষ্ট করে। এরা মহাপাপী। খালেছ তওবা ব্যতীত এদের পাপের কোন ক্ষমা নেই।
বিগত যুগের কোন কোন ছূফী তো নিজেকেই ‘আল্লাহ’ বলেছেন। যেমন মেহমানের ডাকে ঘরে অবস্থানকারী আবু ইয়াযীদ বিসত্বামী ওরফে বায়েযীদ বোস্তামী (১৮৮-২৬১/৮০৪-৮৭৫ খৃঃ) বলেন, لَيْسَ فِي الْبَيْتِ أَحَدٌ إِلاَّ اللهُ ‘ঘরের মধ্যে কেউ নেই আল্লাহ ব্যতীত’।[4] একই আক্বীদার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে চালু হয়েছে, ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’। অর্থাৎ সৃষ্টি সবাই স্রষ্টার অংশ। এরা আহমাদ ও আহাদ-এর মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পান না একটা মীম-এর পর্দা ব্যতীত। এসব পীরদের কবর মহাসমারোহে পূজিত হচ্ছে তাদের ভক্তদের মাধ্যমে। মৃত পীরকে খুশী করার জন্য এরা তাদের জান-মাল উৎসর্গ করছে। তার অসীলাতেই তারা পরকালে মুক্তি কামনা করছে (ইউনুস ১০/১৮; যুমার ৩৯/৩)। ওদিকে আবার ছালাত-ছিয়াম-হজ্জ-ওমরাহ সবই পালন করছে। এটাই যদি হয় বাস্তবতা, তাহ’লে জাহেলী আরবের মূর্তিপূজারীদের সাথে উপমহাদেশের এইসব কবরপূজারীদের আক্বীদার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
ওদিকে রাজনৈতিক নেতারা কিছু ইট ও রড-সিমেন্ট দিয়ে একটা স্তম্ভ খাড়া করে বা প্রতিকৃতি বানিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করছেন। যেকোন উপলক্ষ্যে সেখানে গিয়ে নীরবতা পালন করছেন বা নেতার কবরে গিয়ে ফুল দিচ্ছেন ও ‘ফাতেহা’ পাঠ করছেন। ভাবখানা এই, যেন কবরস্থ নেতা বা নেতার ছবি ও প্রতিকৃতি সবই শুনছেন ও দেখছেন। অথচ এসবের পিছনে কোন যুক্তিও নেই, ধর্মও নেই, স্রেফ মূর্তিপূজারীদের অনুকরণ ব্যতীত। তাদের বানানো এইসব সৌধ, মিনার ও স্তম্ভগুলি এখন মসজিদের চাইতে পবিত্র স্থান বলে পূজিত হচ্ছে। অথচ যত লোক যতদিন যাবত এসবে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে, তত লোকের তত পরিমাণ পাপের বোঝা ক্বিয়ামতের দিন ঐ লোকদের উপরে চাপানো হবে, যারা এগুলি প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন আল্লাহ বলেন, لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلاَ سَاءَ مَا يَزِرُونَ ‘ফলে ক্বিয়ামত দিবসে তারা পূর্ণমাত্রায় তাদের পাপভার বহন করবে এবং তাদেরও পাপভার বহন করবে যাদেরকে ওরা অজ্ঞতাবশে পথভ্রষ্ট করেছে। দেখো, তারা যা বহন করে, তা কতই না নিকৃষ্ট’ (নাহল ১৬/২৫)। পৃথিবীতে কাবীল প্রথমে মানুষ খুন করায় পরবর্তীতে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ অন্যায়ভাবে খুন হবে, সকলের পাপের একটি অংশ কাবীলের আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে।[5]
যদি সুন্নী বিদ্বানগণ শরী‘আত, তরীকত, হাকীকত, মা‘রেফাত এভাবে ইসলামকে বিভক্ত করে জনগণের সামনে পেশ না করতেন, তাহ’লে এর সুযোগ নিয়ে ইবলীস পৃথক পৃথক তরীকা ও খানকাহ খুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারত না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা করেননি, তা থেকে সুধারণা বশেও কোন কাজ করলে শয়তান ঐ সুযোগে মুমিনের যে কতবড় সর্বনাশ করে, কবরপূজারী এইসব পথভ্রষ্ট তথাকথিত সুন্নী মুসলমানেরা তার বড় প্রমাণ। অতএব ছাহেবে মিরক্বাত বর্ণিত ‘ওলামায়ে ইসলাম’-এর সঠিক অর্থ হবে - علماء أهل السنة الصحيحة ‘ছহীহ সুন্নাহর অনুসারী আলেমগণ’। নিঃসন্দেহে তারা ‘আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম’ ব্যতীত আর কেউ নন।
(খ) একইভাবে বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফের সম্মানিত অনুবাদক ‘ছাহাবীগণ এবং হাদীছ ও ফিক্বহের ইমামগণ আহলে সুন্নাতের আক্বীদার অনুসারী ছিলেন’ বলার পরে একই বাক্যে বলেছেন, ‘দুনিয়ার সমস্ত ছূফী ওলীগণও এই আকীদাই পোষণ করিয়া গিয়াছেন’।[6] অথচ ছূফী-ওলী এই পরিভাষাগুলি সৃষ্টি হয়েছে স্বর্ণযুগ গত হয়ে যাবার পরে ভ্রষ্টতার যুগে। যার মূল নিহিত রয়েছে ইরানের অনৈসলামী যুগের অদ্বৈতবাদী কুফরী দর্শনের মধ্যে। যাদের দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক ও অদ্বৈত সত্তা এবং সৃষ্টি স্রষ্টার অংশ মাত্র। ইসলাম এই দর্শনের ঘোর প্রতিবাদ করে বলেছে যে, ‘আল্লাহ এক। তিনি মুখাপেক্ষীহীন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি কারু জন্মিত নন। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই’ (ইখলাছ ১১২/১-৪)। মাননীয় অনুবাদকের কথিত ছূফী-ওলীদের মর্যাদা নিঃসন্দেহে ছাহাবীগণের উপরে নয় বা তাদের সম মানের নয়। অথচ আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কেবল ছাহাবীগণের আক্বীদা ও আমলের অনুসারী, অন্যদের নয়।
অতঃপর মাননীয় অনুবাদক লিখেছেন, হাদীছে ফের্কা বলিতে আকীদা ও বিশ্বাসগত দলকেই বুঝাইয়াছে। কারণ আকীদা বা বিশ্বাসই হইল ইছলামের মূল। সুতরাং হানাফী, শাফেঈ প্রভৃতি ইহার অন্তর্গত নহে। ইহাদের সকলের আকীদাই এক। ইহারা সকলেই আহলুছ ছুন্নাতে ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত। ইহাদের এখতেলাফ শুধু ওজু, নামাজ প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ’।[7]
কথাটি যত হালকাভাবে বলা হয়েছে, বিষয়টি তত হালকা নয়। কেননা খুঁটিনাটি ইখতেলাফ অতক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য, যতক্ষণ সেখানে ছহীহ হাদীছের সমাধান না পাওয়া যায়। পেয়ে গেলে সেটাই মেনে নিতে হবে। আর তখন কোন ইখতেলাফ থাকবে না। কিন্তু সেটা পাওয়ার পরেও যদি যিদ করা হয়, তখন সেটা তাক্বলীদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রদত্ত বিধান বাদ দিয়ে অন্যের বিধান মান্য করা হবে। যা ‘শিরক ফির-রিসালাত’-এর পর্যায়ভুক্ত এবং যা নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ কাজের পরিণামেই মুসলিম উম্মাহ তাদের ‘খেলাফত’ হারিয়েছে। আজও সমাজে সর্বত্র ধর্মীয় হানাহানি মূলতঃ এই তাক্বলীদী যিদ ও মাযহাবী হঠকারিতার কারণেই বিদ্যমান রয়েছে।
অতএব যুক্তির নিরিখে মাননীয় অনুবাদকের উপরোক্ত বক্তব্য অনেকটা সঠিক হ’লেও বাস্তবতা বহুলাংশে ভিন্ন। কেননা (ক) উপমহাদেশের কবরপূজারী মুসলমানেরা অধিকাংশ হানাফী মাযহাবভুক্ত। অথচ কবরপূজা পরিষ্কারভাবে শিরক। এতদ্ব্যতীত আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কেও তাদের অনেকের আক্বীদা ভ্রান্তিপূর্ণ। যেমন (খ) অধিকাংশ হানাফী আলেম বলেন, ‘আল্লাহ নিরাকার। তিনি সর্বত্র বিরাজমান’। অথচ এগুলি আহলে সুন্নাতের আক্বীদা বহির্ভূত। কেননা সঠিক আক্বীদা হ’ল এই যে, আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে, যা তাঁর উপযুক্ত এবং যা কারু সাথে তুলনীয় নয় (শূরা ৪২/১১)। তাঁর সত্তা সপ্তাকাশের উপরে আরশে সমুন্নীত (ত্বোয়াহা ২০/৫-৬)। তাঁর ইল্ম ও কুদরত তথা জ্ঞান ও শক্তি সর্বত্র বিরাজিত (বাক্বারাহ ২/২৫৫)।
(গ) অনেক হানাফী ওলামা-মাশায়েখ বলেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ) মানুষ নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন নূরের নবী। তারা বলেন, আল্লাহর নূরে মুহাম্মাদ পয়দা, মুহাম্মাদের নূরে সারা জাহান পয়দা’। অথচ মুহাম্মাদ (ছাঃ) নূরের তৈরী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অন্যান্য মানুষের ন্যায় মাটির মানুষ (কাহফ ১৮/১১০)। তিনি সাধারণ মানুষের ন্যায় খানা-পিনা করতেন। বিয়ে-শাদী করেছিলেন। সন্তানের পিতা হয়েছিলেন। অথচ ‘নূর’ হলে তিনি এসব হতে মুক্ত থাকতেন। (ঘ) অধিকাংশ হানাফী আলেমের নিকটে চার মাযহাব মান্য করা ফরয এবং মাযহাবী তাক্বলীদ করা ফরয। আর চার ইমামের পরে ইজতিহাদের দুয়ার বন্ধ। (ঙ) অনেকের নিকটে পীর ধরা ফরয। যার কোন পীর নেই, শয়তান তার পীর’। অথচ এগুলি আহলে সুন্নাতের আক্বীদাভুক্ত নয়। অতএব ‘শুধু ওজু, নামাজ প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে এখতেলাফ সীমাবদ্ধ’ বলে আত্মতুষ্টি লাভের কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া ওযূ ও ছালাত কখনোই খুঁটিনাটি বিষয় নয়। বরং ছালাত হ’ল সর্বপ্রধান ইবাদত, ক্বিয়ামতের দিন যার প্রথম হিসাব নেওয়া হবে। ছালাতের হিসাব সুষ্ঠু হ’লে বাকী সবকিছুর হিসাব সুষ্ঠু হবে। নইলে সব বরবাদ হবে।[8]
অতএব আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী বিবাদীয় সকল বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। আর সুন্নাহ হ’তে হবে ছহীহ সুন্নাহ। কোন যঈফ বা জাল হাদীছ নয়। সুতরাং তারাই হবে সত্যিকারের আহলে সুন্নাত, যারা নিজেদের মনগড়া শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ থেকে খালেছভাবে তওবা করে সর্বাবস্থায় ছহীহ হাদীছমুখী হবে। নইলে মুখে ‘সুন্নী’ বলে কাজের বেলায় শিরক ও বিদ‘আতের বাজার গরম করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিদর্শন নয়।
অতএব افةراق الأمة বা উম্মতের বিভক্তি রোধের একটাই পথ খোলা রয়েছে। আর তা হ’ল, الرجوع إلي الكةاب والسنة الصحيحة অর্থাৎ তাক্বলীদী গোঁড়ামী পরিহার করে নিরপেক্ষ ও খোলা মন নিয়ে সর্বাবস্থায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যাওয়া এবং খোলাফায়ে রাশেদীন, ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের বুঝ হাছিল করা। কারু কোন বিষয় জানা না থাকলে বিজ্ঞ ও মুত্তাক্বী আলেমের নিকট থেকে তিনি জেনে নিবেন দলীলের ভিত্তিতে, রায়-এর ভিত্তিতে নয়। মনে রাখা আবশ্যক যে, দ্বীন সম্পূর্ণ হয়েছে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়। অতএব রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে যা দ্বীন ছিল না, এ যুগে তা দ্বীন নয়। যতই তার গায়ে দ্বীনের লেবাস পরানো হৌক না কেন।
[1]. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাত শরহ মিশকাত (দিল্লী : তাবি) ১/২৪৮ পৃঃ।
[2]. মিরক্বাত ১/২৪৮ পৃঃ।
[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২।
[4]. আব্দুর রহমান, আন-নাক্বশাবান্দিায়া (রিয়ায : দার ত্বাইয়িবাহ, ১৪০৯/১৯৮৮), পৃঃ ৭৭।
[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২১১ ‘ইলম’ অধ্যায়।
[6]. নূর মোহাম্মদ আ‘জমী, বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১৯৮৬), হা/১৬৩ (৩১)-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য, ১/১৮১ পৃঃ।
[7]. পূর্বোক্ত, ১/১৮২ পৃঃ।
[8]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব, ছহীহাহ হা/১৩৫৮; আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৩৩০।
( وفي رواية لأحمد وأبي داؤد عن معاوية .... وَهِيَ الْجَمَاعَةُ ) ‘আহমাদ ও আবুদাঊদে হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘সেটি হ’ল জামা‘আত’ অর্থাৎ ছাহাবীগণের জামা‘আত ( جماعة الصحابة ) এবং তাঁদের আক্বীদা, আমল ও রীতি-পদ্ধতির সনিষ্ঠ অনুসারী ব্যক্তি বা দল’। তারাই হ’লেন নাজী ফের্কা। যে বিষয়ে সূরা তওবা ১০০ আয়াতে ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
অতএব পৃথিবীর সকল প্রান্তের সকল ‘আহলেহাদীছ’ একই জামা‘আতভুক্ত। এমনকি যদি তিনি কোন স্থানে একাকীও থাকেন। যেমন খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-এর কাছে রাসূল (ছাঃ) বর্ণিত ‘আল-জামা‘আত’ অর্থ কি- একথা জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, اَلْجَمَاعَةُ مَا وَافَقَ الْحَقَّ وَإِنْ كُنْتَ وَحْدَكَ ‘হক-এর অনুগামী দলই জামা‘আত, যদিও তুমি একাকী হও’।[1]
ফায়েদা : ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, أي أهلُ العلم والفقه الذين اجتمعوا على اتباع آثاره عليه الصلاة والسلام في النقير والقطمير ولم يبتدعوا بالتحريف والتغيير ‘উক্ত জামা‘আত হ’ল, আলিম ও ফিক্বহবিদগণ। যারা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ সমূহের অনুসরণের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং কোনরূপ (শাব্দিক বা মর্মগত) পরিবর্তনের বিদ‘আত সৃষ্টি করেননি’। এরপরে তিনি সুফিয়ান ছাওরীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন যে, لو أن فقيها على رأس جبل لكان هو الجماعة ‘যদি একজন ফক্বীহ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করেন, তাহ’লে তিনিই একটি জামা‘আত’।[2]
এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে পাঠকের দৃষ্টিকে ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আত ও মুহাদ্দিছ ফক্বীহগণ থেকে মাযহাবী ফক্বীহমুখী করা হয়েছে, যা উম্মতের ঐক্যের জন্য অতীব বিপজ্জনক। কেননা মাযহাবী ফক্বীহদের মতভেদের শেষ নেই এবং এইসব ফক্বীহদের অনৈক্যের কারণেই উম্মতের ঐক্য অনেকাংশে বিনষ্ট হয়েছে।
পক্ষান্তরে মিশকাতের অন্যতম আরবী ভাষ্যগ্রন্থ মির‘আতুল মাফাতীহ-এর লেখক মুহাদ্দিছ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২২-১৪১৪ হিঃ/১৯০৪-১৯৯৪ খৃঃ) বলেন, وهم أهلُ السنة والجماعة، أي أصحابُ الحديث الذين اجتمعوا على اتباع آثاره صلى الله عليه وسلم في جميع الأحوال، واتفقوا على الأخذ بتعامل الصحابة وإجماعهم، ولم يبتدعوا بالتحريف والتغيير، ولم يبدلوا بالآراء الفاسدة ‘তারা হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত অর্থাৎ আহলুল হাদীছ। যারা সর্বাবস্থায় রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুসরণ করেন এবং যারা ছাহাবীগণের আচার-আচরণ ও ইজমা গ্রহণের ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন। যারা শব্দ বা মর্ম পরিবর্তনের বিদ‘আতে লিপ্ত হন না কিংবা নিজেদের বাতিল রায়সমূহ দ্বারা তা পরিবর্তন করেন না’।[3]
[1]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশ্ক্ব, সনদ ছহীহ; হাশিয়া মিশকাত আলবানী, হা/১৭৩।
[2]. মিরক্বাত ১/২৪৮-৪৯।
[3]. মির‘আত ১/২৭৮।
অতএব পৃথিবীর সকল প্রান্তের সকল ‘আহলেহাদীছ’ একই জামা‘আতভুক্ত। এমনকি যদি তিনি কোন স্থানে একাকীও থাকেন। যেমন খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-এর কাছে রাসূল (ছাঃ) বর্ণিত ‘আল-জামা‘আত’ অর্থ কি- একথা জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, اَلْجَمَاعَةُ مَا وَافَقَ الْحَقَّ وَإِنْ كُنْتَ وَحْدَكَ ‘হক-এর অনুগামী দলই জামা‘আত, যদিও তুমি একাকী হও’।[1]
ফায়েদা : ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, أي أهلُ العلم والفقه الذين اجتمعوا على اتباع آثاره عليه الصلاة والسلام في النقير والقطمير ولم يبتدعوا بالتحريف والتغيير ‘উক্ত জামা‘আত হ’ল, আলিম ও ফিক্বহবিদগণ। যারা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ সমূহের অনুসরণের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং কোনরূপ (শাব্দিক বা মর্মগত) পরিবর্তনের বিদ‘আত সৃষ্টি করেননি’। এরপরে তিনি সুফিয়ান ছাওরীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন যে, لو أن فقيها على رأس جبل لكان هو الجماعة ‘যদি একজন ফক্বীহ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করেন, তাহ’লে তিনিই একটি জামা‘আত’।[2]
এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে পাঠকের দৃষ্টিকে ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আত ও মুহাদ্দিছ ফক্বীহগণ থেকে মাযহাবী ফক্বীহমুখী করা হয়েছে, যা উম্মতের ঐক্যের জন্য অতীব বিপজ্জনক। কেননা মাযহাবী ফক্বীহদের মতভেদের শেষ নেই এবং এইসব ফক্বীহদের অনৈক্যের কারণেই উম্মতের ঐক্য অনেকাংশে বিনষ্ট হয়েছে।
পক্ষান্তরে মিশকাতের অন্যতম আরবী ভাষ্যগ্রন্থ মির‘আতুল মাফাতীহ-এর লেখক মুহাদ্দিছ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২২-১৪১৪ হিঃ/১৯০৪-১৯৯৪ খৃঃ) বলেন, وهم أهلُ السنة والجماعة، أي أصحابُ الحديث الذين اجتمعوا على اتباع آثاره صلى الله عليه وسلم في جميع الأحوال، واتفقوا على الأخذ بتعامل الصحابة وإجماعهم، ولم يبتدعوا بالتحريف والتغيير، ولم يبدلوا بالآراء الفاسدة ‘তারা হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত অর্থাৎ আহলুল হাদীছ। যারা সর্বাবস্থায় রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুসরণ করেন এবং যারা ছাহাবীগণের আচার-আচরণ ও ইজমা গ্রহণের ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন। যারা শব্দ বা মর্ম পরিবর্তনের বিদ‘আতে লিপ্ত হন না কিংবা নিজেদের বাতিল রায়সমূহ দ্বারা তা পরিবর্তন করেন না’।[3]
[1]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশ্ক্ব, সনদ ছহীহ; হাশিয়া মিশকাত আলবানী, হা/১৭৩।
[2]. মিরক্বাত ১/২৪৮-৪৯।
[3]. মির‘আত ১/২৭৮।
( وَإِنَّهُ سَيَخْرُجُ فِيْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ تَتَجَارَى بِهِمْ تِلْكَ الْأَهْوَاءُ كَمَا يَتَجَارَى الْكَلْبُ بِصَاحِبِهِ لاَ يَبْقَى مِنْهُ عِرْقٌ وَلاَ مَفْصِلٌ إِلاَّ دَخَلَهُ ) ‘আর আমার উম্মতের মধ্যে সত্বর এমন একদল লোক বের হবে, যাদের মধ্যে প্রবৃত্তি পরায়ণতা এমনভাবে প্রবহমাণ হবে, যেভাবে কুকুরের বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির সারা দেহে সঞ্চারিত হয়। কোন একটি শিরা বা জোড়া বাকী থাকে না, যেখানে উক্ত বিষ প্রবেশ করে না’।
এখানে افةراق الأمة বা উম্মতের বিভক্তির সর্বপ্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রবৃত্তিপরায়ণতাকে এবং তাকে কুকুরের বিষের সাথে তুলনা করা হয়েছে। لأن هوى الرجل هو الذي يحمله على الابتداع في العقيدة والقول والعمل ‘কেননা প্রবৃত্তিপরায়ণতা মানুষকে বিশ্বাস, কথা ও কর্মের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টিতে প্ররোচনা দিয়ে থাকে’।
অত্র হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, সত্বর একদল লোক বের হবে, যারা হীন প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হবে এবং তারাই মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে। এই লোকগুলি নিঃসন্দেহে ধর্মনেতা বা সমাজনেতা হবেন। যাদের কথা মানুষ শোনে ও যাদেরকে মানুষ অনুসরণ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই ভন্ডনবী[1] এবং তাঁর মৃত্যুর কিছুকালের মধ্যেই মুরতাদ ও যাকাত অস্বীকারকারীদের ফিৎনা শুরু হয় ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের মাধ্যমে। অতঃপর খারেজী, শী‘আ, মুরজিয়া, ক্বাদারিয়া, জাবরিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত দলসমূহের উদ্ভব ঘটে বড় বড় ধর্মনেতাদের মাধ্যমে। পরবর্তীতে মু‘তাযিলা মতবাদ আববাসীয় খলীফা মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক বিল্লাহ প্রমুখ খলীফাদের (১৯৮-২৩২ হিঃ) স্কন্ধে সওয়ার হয়ে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) প্রমুখ আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপরে অত্যাচারের বিভীষিকা চালায়। তবুও শুরু থেকেই ছাহাবা, তাবেঈন এবং আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের দৃঢ় ভূমিকার ফলে ভ্রান্ত দলসমূহের অপতৎপরতায় ভাটা পড়ে। যদিও তাদের মতবাদের বিষাক্ত ধারা এখনো অনেক মুসলিম ও সুন্নী বিদ্বানের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। যা সাধারণ মানুষকে অনেক সময় বিভ্রান্ত করে।
কুরআন ও সুন্নাহর উপরে নিজের জ্ঞান ও যুক্তিবাদকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেই বলা হয় প্রবৃত্তিপরায়ণতা ( تحكيم العقل علي النصوص )। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُوْنُ عَلَيْهِ وَكِيْلاً ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে, যে তার প্রবৃত্তিকে তার উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে? (ফুরক্বান ২৫/৪৩; জাছিয়াহ ৪৫/২৩)। যখন তাদের সামনে কুরআন-হাদীছের বিধান শুনানো হয়, তখন তারা দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও নিজের প্রবৃত্তির উপরে যিদ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا وَلَّى مُسْتَكْبِرًا كَأَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ ‘যখন তার সামনে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে দম্ভের সাথে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে তা শুনতেই পায়নি, যেন ওর দু’কান বধির। অতএব ওকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও’ (লোকমান ৩১/৭)।
কেবল মুসলমানদের নয়, বরং মানবজাতির দলে দলে বিভক্তির কারণ হিসাবে আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে মানুষের হঠকারিতাকেই দায়ী করা হয়েছে (বাক্বারাহ ২/২১৩)।
[1]. ১০ম হিজরীতে ইয়ামামাহর নেতা মুসায়লামা কাযযাব এবং ইয়ামনের নেতা আসওয়াদ ‘আনাসী নবুঅতের দাবী করে। শেষোক্ত ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাতের একদিন পূর্বে নিহত হয় এবং প্রথমোক্ত ব্যক্তি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১২ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে সংঘটিত ইয়ামামাহর যুদ্ধে নিহত হয় (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪৫২-৫৩)।
এখানে افةراق الأمة বা উম্মতের বিভক্তির সর্বপ্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রবৃত্তিপরায়ণতাকে এবং তাকে কুকুরের বিষের সাথে তুলনা করা হয়েছে। لأن هوى الرجل هو الذي يحمله على الابتداع في العقيدة والقول والعمل ‘কেননা প্রবৃত্তিপরায়ণতা মানুষকে বিশ্বাস, কথা ও কর্মের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টিতে প্ররোচনা দিয়ে থাকে’।
অত্র হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, সত্বর একদল লোক বের হবে, যারা হীন প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হবে এবং তারাই মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে। এই লোকগুলি নিঃসন্দেহে ধর্মনেতা বা সমাজনেতা হবেন। যাদের কথা মানুষ শোনে ও যাদেরকে মানুষ অনুসরণ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই ভন্ডনবী[1] এবং তাঁর মৃত্যুর কিছুকালের মধ্যেই মুরতাদ ও যাকাত অস্বীকারকারীদের ফিৎনা শুরু হয় ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের মাধ্যমে। অতঃপর খারেজী, শী‘আ, মুরজিয়া, ক্বাদারিয়া, জাবরিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত দলসমূহের উদ্ভব ঘটে বড় বড় ধর্মনেতাদের মাধ্যমে। পরবর্তীতে মু‘তাযিলা মতবাদ আববাসীয় খলীফা মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক বিল্লাহ প্রমুখ খলীফাদের (১৯৮-২৩২ হিঃ) স্কন্ধে সওয়ার হয়ে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) প্রমুখ আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপরে অত্যাচারের বিভীষিকা চালায়। তবুও শুরু থেকেই ছাহাবা, তাবেঈন এবং আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের দৃঢ় ভূমিকার ফলে ভ্রান্ত দলসমূহের অপতৎপরতায় ভাটা পড়ে। যদিও তাদের মতবাদের বিষাক্ত ধারা এখনো অনেক মুসলিম ও সুন্নী বিদ্বানের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। যা সাধারণ মানুষকে অনেক সময় বিভ্রান্ত করে।
কুরআন ও সুন্নাহর উপরে নিজের জ্ঞান ও যুক্তিবাদকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেই বলা হয় প্রবৃত্তিপরায়ণতা ( تحكيم العقل علي النصوص )। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُوْنُ عَلَيْهِ وَكِيْلاً ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে, যে তার প্রবৃত্তিকে তার উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে? (ফুরক্বান ২৫/৪৩; জাছিয়াহ ৪৫/২৩)। যখন তাদের সামনে কুরআন-হাদীছের বিধান শুনানো হয়, তখন তারা দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও নিজের প্রবৃত্তির উপরে যিদ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا وَلَّى مُسْتَكْبِرًا كَأَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ ‘যখন তার সামনে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে দম্ভের সাথে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে তা শুনতেই পায়নি, যেন ওর দু’কান বধির। অতএব ওকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও’ (লোকমান ৩১/৭)।
কেবল মুসলমানদের নয়, বরং মানবজাতির দলে দলে বিভক্তির কারণ হিসাবে আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে মানুষের হঠকারিতাকেই দায়ী করা হয়েছে (বাক্বারাহ ২/২১৩)।
[1]. ১০ম হিজরীতে ইয়ামামাহর নেতা মুসায়লামা কাযযাব এবং ইয়ামনের নেতা আসওয়াদ ‘আনাসী নবুঅতের দাবী করে। শেষোক্ত ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাতের একদিন পূর্বে নিহত হয় এবং প্রথমোক্ত ব্যক্তি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১২ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে সংঘটিত ইয়ামামাহর যুদ্ধে নিহত হয় (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪৫২-৫৩)।
প্রবৃত্তিপরায়ণতার বিষ মানুষের আক্বীদা ও আমলে যে শিরক ও বিদ‘আত সমূহ সৃষ্টি করে, তাকে অত্র হাদীছে কুকুরের বিষের সঙ্গে তুলনা করার সম্ভাব্য কারণ সমূহ নিম্নরূপ :
এক- কুকুরের বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির সারা দেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তার কোন শিরা-উপশিরা বাকী থাকে না। অনুরূপভাবে শিরক ও বিদ‘আত মানুষকে এমনভাবে প্রলুব্ধ করে যে, মানুষ তার প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট হয় এবং তা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। কারণ এর পিছনে সর্বদা শয়তানের সুঁড়সুড়ি থাকে।
এজন্যই দেখা যায়, অনেক নিরীহ গরীব মুসলমান ফরয ছালাত ও ছিয়াম পালন করে না। কিন্তু একমাত্র সম্বল গাছটি বিক্রি করে হ’লেও বছর শেষে পীরের কবরে বার্ষিক ওরসে নযর-নেয়ায নিয়ে হাযির হবে। অথবা বাড়ীতে একবার মৌলভী ডেকে এনে মীলাদ অনুষ্ঠান করে। শা‘বান মাসে অন্য কোন ছিয়াম পালন না করলেও এমনকি রামাযানের ফরয ছিয়াম বাদ গেলেও শবেবরাতের ছিয়াম ও ছালাত সে আদায় করবে এবং হালুয়া-রুটি খাবে যেকোনভাবেই হৌক।
দুই- কুকুরের বিষদুষ্ট ব্যক্তি ‘পানি আতংক’ রোগে আক্রান্ত হয়। সে পানি পান করতে গেলেই তাতে কুকুর দেখে ও গলায় কাঁটা বিঁধে। ফলে এক সময় সে পানি বিহনে মারা যায়। অনুরূপভাবে বিদ‘আতী তার বিদ‘আতের মধ্যেই জান্নাত তালাশ করে। অথচ তার ফল হয় শূন্য। তাকে অবশেষে জাহান্নামী হতে হয়।
তিন- কুকুরের বিষ যেমন দেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, বিদ‘আতীর যুক্তিবাদ তেমনি মানুষকে দ্রুত বিভ্রান্ত করে। কিছু না পারলেও তাকে অন্ততঃ সন্দেহের মধ্যে নিক্ষেপ করে। ফলে সে বিদ‘আতে লিপ্ত না হ’লেও অনেক সময় ফরয পালন করা থেকে পিছিয়ে আসে। যেমন অনেক বিদ‘আতী বলেন, কল্ব ছাফ হওয়াটাই বড় কথা। অতএব যিকিরের মাধ্যমে কল্বকে তাযা রাখাটাই মূল কাজ। ছালাত-ছিয়াম এগুলি বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই যুক্তিবাদের ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, অনেক মুসলমানের কাছে ছালাত ও ছিয়াম এখন ঐচ্ছিক বা লোক দেখানো বিষয়ে পরিণত হয়েছে। চাকুরী জীবনে তারা তাদের বস্কে যতটা ভয় করে, আল্লাহকে তার দশ ভাগের একভাগও ভয় করে কি-না সন্দেহ। ফলে দেখা যায় অধিকাংশ নিয়মিত মুছল্লী অফিসে বা ডিউটিতে থাকাকালে বস-এর ভয়ে ছালাত আদায় করেন না। কারণ তাদের কলব ছাফ আছে।
চার- কুকুর যেমন হেদায়াত হয় না। বিদ‘আতী তেমনি হেদায়াত পায় না। কেননা সে মনে করে যে, সে নেকীর কাজ করছে। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالاً- الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا - ‘তুমি বল, আমি কি তোমাদের নিকট ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের বিষয়ে খবর দিব’? ‘দুনিয়াবী জীবনে যাদের আমল বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ধারণা করে যে, তারা সৎকর্ম করছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)। অতএব চোর-গুন্ডাদের তওবা করে ভাল হবার সম্ভাবনা থাকলেও বিদ‘আতীর সে সুযোগ হয় না বললেই চলে নিতান্ত আল্লাহর বিশেষ রহমত ছাড়া।
পাঁচ- আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বিদ‘আতকে অন্য কিছুর সাথে তুলনা না করে কুকুরের বিষের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে বিদ‘আতীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। ক্বিয়ামতের দিন হাউয কাওছারের পেয়ালা তিনি এদেরকে দিবেন না। বরং ঘৃণাভরে বলবেন, سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِى ‘দূর হও দূর হও যারা আমার পরে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছ’।[1] সেকারণ সালাফে ছালেহীন বিদ্বানগণ বিদ‘আতীদের সাথে উঠা-বসা, সালাম-কালাম, খানা-পিনা ইত্যাদি হ’তে বিরত থাকতেন ও সকলকে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। কারণ এরা যেমন ইসলামকে বিকৃত করে, তেমনি মুসলিম ঐক্যকে ভেঙ্গে টুকরা-টুকরা করে। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন- আমীন!
[1]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭১ ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ।
এক- কুকুরের বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির সারা দেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তার কোন শিরা-উপশিরা বাকী থাকে না। অনুরূপভাবে শিরক ও বিদ‘আত মানুষকে এমনভাবে প্রলুব্ধ করে যে, মানুষ তার প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট হয় এবং তা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। কারণ এর পিছনে সর্বদা শয়তানের সুঁড়সুড়ি থাকে।
এজন্যই দেখা যায়, অনেক নিরীহ গরীব মুসলমান ফরয ছালাত ও ছিয়াম পালন করে না। কিন্তু একমাত্র সম্বল গাছটি বিক্রি করে হ’লেও বছর শেষে পীরের কবরে বার্ষিক ওরসে নযর-নেয়ায নিয়ে হাযির হবে। অথবা বাড়ীতে একবার মৌলভী ডেকে এনে মীলাদ অনুষ্ঠান করে। শা‘বান মাসে অন্য কোন ছিয়াম পালন না করলেও এমনকি রামাযানের ফরয ছিয়াম বাদ গেলেও শবেবরাতের ছিয়াম ও ছালাত সে আদায় করবে এবং হালুয়া-রুটি খাবে যেকোনভাবেই হৌক।
দুই- কুকুরের বিষদুষ্ট ব্যক্তি ‘পানি আতংক’ রোগে আক্রান্ত হয়। সে পানি পান করতে গেলেই তাতে কুকুর দেখে ও গলায় কাঁটা বিঁধে। ফলে এক সময় সে পানি বিহনে মারা যায়। অনুরূপভাবে বিদ‘আতী তার বিদ‘আতের মধ্যেই জান্নাত তালাশ করে। অথচ তার ফল হয় শূন্য। তাকে অবশেষে জাহান্নামী হতে হয়।
তিন- কুকুরের বিষ যেমন দেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, বিদ‘আতীর যুক্তিবাদ তেমনি মানুষকে দ্রুত বিভ্রান্ত করে। কিছু না পারলেও তাকে অন্ততঃ সন্দেহের মধ্যে নিক্ষেপ করে। ফলে সে বিদ‘আতে লিপ্ত না হ’লেও অনেক সময় ফরয পালন করা থেকে পিছিয়ে আসে। যেমন অনেক বিদ‘আতী বলেন, কল্ব ছাফ হওয়াটাই বড় কথা। অতএব যিকিরের মাধ্যমে কল্বকে তাযা রাখাটাই মূল কাজ। ছালাত-ছিয়াম এগুলি বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই যুক্তিবাদের ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, অনেক মুসলমানের কাছে ছালাত ও ছিয়াম এখন ঐচ্ছিক বা লোক দেখানো বিষয়ে পরিণত হয়েছে। চাকুরী জীবনে তারা তাদের বস্কে যতটা ভয় করে, আল্লাহকে তার দশ ভাগের একভাগও ভয় করে কি-না সন্দেহ। ফলে দেখা যায় অধিকাংশ নিয়মিত মুছল্লী অফিসে বা ডিউটিতে থাকাকালে বস-এর ভয়ে ছালাত আদায় করেন না। কারণ তাদের কলব ছাফ আছে।
চার- কুকুর যেমন হেদায়াত হয় না। বিদ‘আতী তেমনি হেদায়াত পায় না। কেননা সে মনে করে যে, সে নেকীর কাজ করছে। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالاً- الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا - ‘তুমি বল, আমি কি তোমাদের নিকট ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের বিষয়ে খবর দিব’? ‘দুনিয়াবী জীবনে যাদের আমল বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ধারণা করে যে, তারা সৎকর্ম করছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)। অতএব চোর-গুন্ডাদের তওবা করে ভাল হবার সম্ভাবনা থাকলেও বিদ‘আতীর সে সুযোগ হয় না বললেই চলে নিতান্ত আল্লাহর বিশেষ রহমত ছাড়া।
পাঁচ- আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বিদ‘আতকে অন্য কিছুর সাথে তুলনা না করে কুকুরের বিষের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে বিদ‘আতীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। ক্বিয়ামতের দিন হাউয কাওছারের পেয়ালা তিনি এদেরকে দিবেন না। বরং ঘৃণাভরে বলবেন, سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِى ‘দূর হও দূর হও যারা আমার পরে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছ’।[1] সেকারণ সালাফে ছালেহীন বিদ্বানগণ বিদ‘আতীদের সাথে উঠা-বসা, সালাম-কালাম, খানা-পিনা ইত্যাদি হ’তে বিরত থাকতেন ও সকলকে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। কারণ এরা যেমন ইসলামকে বিকৃত করে, তেমনি মুসলিম ঐক্যকে ভেঙ্গে টুকরা-টুকরা করে। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন- আমীন!
[1]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭১ ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ।
দুনিয়ায় শক্তির বড়াই দেখালেও কিয়ামতের দিন বাতিলপন্থীদের অবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ لِلرَّحْمَنِ وَكَانَ يَوْمًا عَلَى الْكَافِرِينَ عَسِيرًا (26) وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً (27) يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيلاً (28) لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً (29) وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا (30)- ‘সেদিন যথার্থ কর্তৃত্ব থাকবে দয়াময়ের হাতে এবং কাফিরদের জন্য দিনটি হবে বড়ই কঠিন’ (ফুরক্বান ২৫/২৬)। ‘সেদিন যালেম তার দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি আমি (দুনিয়াতে) রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম’ (২৭)। ‘হায় কি দুর্ভোগ! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’ (২৮)। ‘আমার নিকট উপদেশ (কুরআন) এসে যাওয়ার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বাস্তবিকই শয়তান মানুষের জন্য মহা প্রতারক’ (২৯)। ‘সেদিন রাসূল বলবেন, হে আমার পালনকর্তা! আমার কওম এই কুরআনকে পরিত্যাগ করেছিল’ (ফুরক্বান ২৫/৩০)।
তাদের সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولاَ (66) وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلاَ (67) رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا (68)- ‘সেদিন তাদের মুখমন্ডল আগুনে ওলট-পালট করে ঝলসানো হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! যদি আমরা আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম’ (আহযাব ৩৩/৬৬)। ‘তারা আরও বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের মেনে চলতাম। অতঃপর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল’ (৬৭)। ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা অভিশাপ দিন’ (আহযাব ৩৩/৬৮)।
তাদের সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولاَ (66) وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلاَ (67) رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا (68)- ‘সেদিন তাদের মুখমন্ডল আগুনে ওলট-পালট করে ঝলসানো হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! যদি আমরা আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম’ (আহযাব ৩৩/৬৬)। ‘তারা আরও বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের মেনে চলতাম। অতঃপর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল’ (৬৭)। ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা অভিশাপ দিন’ (আহযাব ৩৩/৬৮)।
অনেকে ভাবেন, তার দল আদর্শচ্যুত হলেও কিংবা সেখানে আক্বীদা ও আমল পরিশুদ্ধির কোন প্রচেষ্টা না থাকলেও ঐদল ছেড়ে কোন ছহীহ-শুদ্ধ দলে যাওয়া যাবে না কিংবা অনুরূপ কোন জামা‘আত গঠন করা যাবে না। আবার কেউ ছহীহ-শুদ্ধ আক্বীদা সম্পন্ন দল থেকে খোঁড়া অজুহাতে বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল গড়েন ও ভাঙেন। সেই সাথে কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করেন ও মানুষকে ধোঁকা দেন। অনেকে শিরক ও বিদ‘আতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেও নিজেকে সুন্নী বা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এমনকি ‘আহলেহাদীছ’ দাবী করেন। কেউ কুরআনে বর্ণিত ‘মুসলেমীন’ (হজ্জ ৭৮) ও হাদীছে বর্ণিত ‘জামা‘আতুল মুসলেমীন’[1]-এর অর্থ না বুঝে ঐ নামে দল গড়ে নিজেদেরকেই মাত্র ইসলামী জামা‘আত বা মুসলিম জামা‘আত দাবী করেন ও অন্যদেরকে কাফের ধারণা করেন। কেউ আল্লাহর হুকুম ‘আক্বীমুদ্দীন’ (শূরা ১৩; তোমরা তাওহীদ কায়েম কর)-এর অর্থ ‘হুকুমত কায়েম কর’ বলেন এবং তাদের রাজনৈতিক দলে যোগ না দিলে তাকে নবীযুগের ইহূদীদের ন্যায় কাফের গণ্য করেন। কেউ কুরআনে বর্ণিত ‘উখরিজাত লিন্নাস’ (আলে ইমরান ১১০; যাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য) ও ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ (ছফ ১১; আল্লাহর রাস্তায়)-এর কদর্থ করে মানুষকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন ও দিনের পর দিন দেশে-বিদেশে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাচ্ছেন। সেই সাথে শুনাচ্ছেন কোটি কোটি নেকী ও ফযীলতের মিথ্যা বয়ান। কেউ ভিত্তিহীন কাহিনী ও জাল-যঈফের প্রচারকেই তাবলীগ ভাবেন ও ছহীহ হাদীছের তাবলীগকে ফিৎনা মনে করেন। কেউ ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’-এর অপব্যাখ্যা করে তাদের দৃষ্টিতে কবীরা গোনাহগার মুসলিম নেতাদের হত্যা করার মধ্যেই জান্নাত তালাশ করেন।
অথচ বাস্তবতা এই যে, প্রায় সকলেই যেকোন মূল্যে নিজেদের ভুলের উপর টিকে থাকেন। সঠিক বিষয়ের দিকে ফিরে যেতে চান না। কেউ বলেন, ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’। কিন্তু সঠিক বিষয়টির দিকে নিজেরাও যান না, অন্যকেও যেতে দেন না। এভাবেই শয়তান সর্বদা মানুষকে ধোঁকায় ফেলে রাখে। যাতে সে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে না পারে। এভাবে তারা দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলেছে। এই সব হঠকারী ও বিদ‘আতপন্থী দলসমূহের ব্যাপারে সাবধান করে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعاً لَّسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ - ‘নিশ্চয়ই যারা তাদের দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং বিভিন্ন দলে ও উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বিষয়টি কেবল আল্লাহর উপরে ন্যস্ত। অতঃপর তিনিই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানিয়ে দিবেন’ (আন‘আম ৬/১৫৯)। তারা তাদের দল নিয়েই খুশী থাকে এবং শয়তান তাদেরকে ধোঁকায় ডুবিয়ে রাখে, যাতে তারা সঠিক পথ খুঁজে না পায়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ- فَذَرْهُمْ فِي غَمْرَتِهِمْ حَتَّى حِينٍ - ‘তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করেছে। আর প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে খুশী’। ‘অতএব কিছুকাল তাদেরকে তাদের বিভ্রান্তির মধ্যে থাকতে দাও’ (মুমিনূন ২৩/৫৩-৫৪)।
উপরে বর্ণিত অজুহাতগুলি মূলতঃ ভুল চিন্তা ও অন্তরের রোগ হ’তে উদ্ভূত। কেননা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে কোন জনপদে কোন সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে সব ছেড়ে উক্ত আন্দোলনে যোগদান করাই হ’ল মানুষের দ্বীনী কর্তব্য। কিন্তু নিকৃষ্ট প্রবৃত্তিপরায়ণতা ও হীন দুনিয়াবী স্বার্থে প্রচলিত প্রথা ও বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে যুগে যুগে নবীদের বিরোধিতা করা হয়েছে। একইভাবে আজও পৃথিবীর যে প্রান্তে সঠিকভাবে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ চলছে, সেখানে বিরোধীরা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে বাধাগ্রস্ত ও বিনষ্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিদ‘আতপন্থী ও হঠকারীরা চিরকাল এটি করবে। কিন্তু জান্নাতপিয়াসী মুমিনগণ ঠিকই ছুটে আসবেন এখানে আল্লাহর বিশেষ রহমতে। আল্লাহ আমাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে ‘মুক্তিপ্রাপ্ত দলে’র অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!
[1]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩৮২ ‘ফিতান’ অধ্যায়।
অথচ বাস্তবতা এই যে, প্রায় সকলেই যেকোন মূল্যে নিজেদের ভুলের উপর টিকে থাকেন। সঠিক বিষয়ের দিকে ফিরে যেতে চান না। কেউ বলেন, ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’। কিন্তু সঠিক বিষয়টির দিকে নিজেরাও যান না, অন্যকেও যেতে দেন না। এভাবেই শয়তান সর্বদা মানুষকে ধোঁকায় ফেলে রাখে। যাতে সে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে না পারে। এভাবে তারা দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলেছে। এই সব হঠকারী ও বিদ‘আতপন্থী দলসমূহের ব্যাপারে সাবধান করে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعاً لَّسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ - ‘নিশ্চয়ই যারা তাদের দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং বিভিন্ন দলে ও উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বিষয়টি কেবল আল্লাহর উপরে ন্যস্ত। অতঃপর তিনিই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানিয়ে দিবেন’ (আন‘আম ৬/১৫৯)। তারা তাদের দল নিয়েই খুশী থাকে এবং শয়তান তাদেরকে ধোঁকায় ডুবিয়ে রাখে, যাতে তারা সঠিক পথ খুঁজে না পায়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ- فَذَرْهُمْ فِي غَمْرَتِهِمْ حَتَّى حِينٍ - ‘তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করেছে। আর প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে খুশী’। ‘অতএব কিছুকাল তাদেরকে তাদের বিভ্রান্তির মধ্যে থাকতে দাও’ (মুমিনূন ২৩/৫৩-৫৪)।
উপরে বর্ণিত অজুহাতগুলি মূলতঃ ভুল চিন্তা ও অন্তরের রোগ হ’তে উদ্ভূত। কেননা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে কোন জনপদে কোন সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে সব ছেড়ে উক্ত আন্দোলনে যোগদান করাই হ’ল মানুষের দ্বীনী কর্তব্য। কিন্তু নিকৃষ্ট প্রবৃত্তিপরায়ণতা ও হীন দুনিয়াবী স্বার্থে প্রচলিত প্রথা ও বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে যুগে যুগে নবীদের বিরোধিতা করা হয়েছে। একইভাবে আজও পৃথিবীর যে প্রান্তে সঠিকভাবে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ চলছে, সেখানে বিরোধীরা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে বাধাগ্রস্ত ও বিনষ্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিদ‘আতপন্থী ও হঠকারীরা চিরকাল এটি করবে। কিন্তু জান্নাতপিয়াসী মুমিনগণ ঠিকই ছুটে আসবেন এখানে আল্লাহর বিশেষ রহমতে। আল্লাহ আমাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে ‘মুক্তিপ্রাপ্ত দলে’র অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!
[1]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩৮২ ‘ফিতান’ অধ্যায়।
১. তারা আক্বীদা, ইবাদত ও আচরণে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের নীতির উপর দৃঢ় থাকেন এবং সর্বদা ছহীহ হাদীছের উপর আমল করেন। তারা মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করেন এবং আপোষে মহববতের সম্পর্ক অটুট রাখেন।
২. তারা সকল বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যান এবং সালাফে ছালেহীন ও মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের মাসলাক অনুসরণে যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দেন।
৩. তারা ব্যাখ্যাগত মতভেদ-কে লঘু করে দেখেন এবং কখনোই তাকে দলীয় বিভক্তিতে পরিণত করেন না।
যেমন খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরেই জিব্রীল (আঃ) বললেন দ্রুত বনু কুরায়যার বিরুদ্ধে অভিযানে বের হবার জন্য। তখন রাসূল (ছাঃ) সবাইকে নির্দেশ দিলেন বনু কুরায়যায় পৌছে আছর পড়ার জন্য। ইতিমধ্যে আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে কেউ মদীনা থেকেই আছর পড়ে বের হলেন। কেউ বনু কুরায়যায় পৌঁছে ওয়াক্ত শেষে আছর পড়লেন। বুঝের এই ভিন্নতার কারণে রাসূল (ছাঃ) কাউকে তিরষ্কার করলেন না। কেননা কেউ এই নির্দেশকে প্রকাশ্য অর্থে বুঝেছিলেন, কেউ একে দ্রুত যাওয়ার অর্থে নিয়েছিলেন। উভয়ে সঠিক ছিলেন।
বস্ত্ততঃ ব্যাখ্যাগত মতভেদের কারণে কেউ ফিরক্বা নাজিয়াহ থেকে বের হবে না। যতক্ষণ না সেখানে যিদ, অহংকার ও দলাদলি সৃষ্টি হয়। কিন্তু আক্বীদাগত বিভ্রান্তি হ’লে বেরিয়ে যাবে। তাই তার ব্যবহারিক আচরণ যতই সুন্দর হৌক না কেন? এমতাবস্থায় নাজী ফের্কা থেকে কেউ বেরিয়ে গেলে তার বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে এবং নিজেকে সত্যের উপর দৃঢ় রাখতে হবে।
৪. তারা সর্বদা উত্তম মুমিন হওয়ার জন্য চেষ্টিত থাকেন এবং এজন্য সর্বদা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না ও তাকে হীন মনে করবে না। ‘আল্লাহভীতি এখানে’- একথা বলে রাসূল (ছাঃ) তিনবার নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন। অতঃপর তিনি বলেন, কোন ব্যক্তির মন্দ কাজের জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার কোন মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। আর এক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের উপর হারাম হ’ল তার রক্ত, তার মাল ও তার ইযযত’।[1] সে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী হবে’।[2]
[1]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ।
[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫০৭৫ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ১৯ অনুচ্ছেদ।
২. তারা সকল বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যান এবং সালাফে ছালেহীন ও মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের মাসলাক অনুসরণে যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দেন।
৩. তারা ব্যাখ্যাগত মতভেদ-কে লঘু করে দেখেন এবং কখনোই তাকে দলীয় বিভক্তিতে পরিণত করেন না।
যেমন খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরেই জিব্রীল (আঃ) বললেন দ্রুত বনু কুরায়যার বিরুদ্ধে অভিযানে বের হবার জন্য। তখন রাসূল (ছাঃ) সবাইকে নির্দেশ দিলেন বনু কুরায়যায় পৌছে আছর পড়ার জন্য। ইতিমধ্যে আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে কেউ মদীনা থেকেই আছর পড়ে বের হলেন। কেউ বনু কুরায়যায় পৌঁছে ওয়াক্ত শেষে আছর পড়লেন। বুঝের এই ভিন্নতার কারণে রাসূল (ছাঃ) কাউকে তিরষ্কার করলেন না। কেননা কেউ এই নির্দেশকে প্রকাশ্য অর্থে বুঝেছিলেন, কেউ একে দ্রুত যাওয়ার অর্থে নিয়েছিলেন। উভয়ে সঠিক ছিলেন।
বস্ত্ততঃ ব্যাখ্যাগত মতভেদের কারণে কেউ ফিরক্বা নাজিয়াহ থেকে বের হবে না। যতক্ষণ না সেখানে যিদ, অহংকার ও দলাদলি সৃষ্টি হয়। কিন্তু আক্বীদাগত বিভ্রান্তি হ’লে বেরিয়ে যাবে। তাই তার ব্যবহারিক আচরণ যতই সুন্দর হৌক না কেন? এমতাবস্থায় নাজী ফের্কা থেকে কেউ বেরিয়ে গেলে তার বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে এবং নিজেকে সত্যের উপর দৃঢ় রাখতে হবে।
৪. তারা সর্বদা উত্তম মুমিন হওয়ার জন্য চেষ্টিত থাকেন এবং এজন্য সর্বদা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না ও তাকে হীন মনে করবে না। ‘আল্লাহভীতি এখানে’- একথা বলে রাসূল (ছাঃ) তিনবার নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন। অতঃপর তিনি বলেন, কোন ব্যক্তির মন্দ কাজের জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার কোন মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। আর এক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের উপর হারাম হ’ল তার রক্ত, তার মাল ও তার ইযযত’।[1] সে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী হবে’।[2]
[1]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ।
[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫০৭৫ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ১৯ অনুচ্ছেদ।
৭২ ফের্কার অন্তর্ভুক্ত সবাইকে সাধারণভাবে মুসলমানই বলতে হবে। তাদের ব্যাপারে সুধারণা রাখতে হবে। তাদের জন্য হেদায়াত প্রার্থনা করতে হবে ও তাদেরকে সর্বদা সঠিক পথের দাওয়াত দিতে হবে। সেই সাথে নিজেকে সর্বদা নাজী ফের্কার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে হবে। এখানেও সর্বদা স্তরগত পার্থক্য থাকবে। তাই একান্তভাবে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে, যেন তিনি আমাকে ও আমার সাথীদেরকে তাঁর অধিকতর নৈকট্যশীল বান্দা হবার তাওফীক দান করেন এবং জান্নাতুল ফিরদৌসের অধিকারী করেন- আমীন!
أَهْلُ الْحَدِيْثِ هُمْ أَهْلُ النَّبِيْ + وَإِنْ لَمْ يَصْحَبُوْا نَفْسَهْ أَنْفَاسُهُ صَحِبُوْا
‘আহলেহাদীছগণ তো নবী করীম (ছাঃ)-এর পরিবার।
যদি তারা স্বয়ং সাথী নাও হন, তবুও তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস তাদের সাথী’।
سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك -
اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب -
أَهْلُ الْحَدِيْثِ هُمْ أَهْلُ النَّبِيْ + وَإِنْ لَمْ يَصْحَبُوْا نَفْسَهْ أَنْفَاسُهُ صَحِبُوْا
‘আহলেহাদীছগণ তো নবী করীম (ছাঃ)-এর পরিবার।
যদি তারা স্বয়ং সাথী নাও হন, তবুও তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস তাদের সাথী’।
سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك -
اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب -
১. বর্ণিত হাদীছে ফিরক্বা নাজিয়াহ বলতে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দলকে বুঝানো হয়েছে।
২. ৭৩ ফেরক্বার মধ্যে একটি মাত্র দল শুরু থেকেই জান্নাতী হবে। যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের আক্বীদা ও আমলের যথার্থ অনুসারী হবে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ‘হক মাত্র একটাই হয়, একাধিক নয়’।
৩. নাজী ফের্কা হ’ল প্রথম যুগে ছাহাবী, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণের দল এবং তার পরে সর্বযুগে আহলেহাদীছের দল।
৪. তাদের বৈশিষ্ট্য হ’ল সাতটি :
(১) তারা সংস্কারক হবেন (২) আক্বীদার ক্ষেত্রে সর্বদা মধ্যপন্থী হবেন এবং কখনোই চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী হবেন না (৩) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তারা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসারী হবেন এবং তারা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত ব্যাখ্যা করেন (৪) তারা জামা‘আতবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেন এবং কখনোই উদ্ধত ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হন না (৫) তারা কুফর ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ও শক্তিশালী থাকেন এবং নিজেদের মধ্যে সর্বদা রহমদিল ও আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন (৬) তাঁরা যেকোন মূল্যে সুন্নাতকে আঁকড়ে থাকেন ও বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকেন (৭) তারা সর্বাবস্থায় সমবেতভাবে হাবলুল্লাহকে ধারণ করে থাকেন এবং কখনোই সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হন না। কেউ তাদেরকে ছেড়ে গেলে সে অবস্থায় তারা আল্লাহর উপর ভরসা করেন ও তাঁর গায়েবী মদদ কামনা করেন।
৫. ফের্কাবন্দীর প্রধান কারণ হ’ল প্রবৃত্তিপরায়ণতা। রাসূল (ছাঃ) যাকে কুকুরের বিষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যা দ্রুত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে ও রোগীকে মেরে ফেলে। প্রবৃত্তিপূজা তেমনি দ্রুত সমাজকে ভেঙ্গে বিনষ্ট করে দেয়।
কুরআন ও হাদীছের উপরে নিজের যুক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেই প্রবৃত্তিপূজা বলা হয়, যাকে কুরআনে ‘উপাস্য’ বলে অভিহিত করা হয়েছে (ফুরক্বান ২৫/৪৩)।
৬. ফিরক্বা নাজিয়াহর নিদর্শন ৪টি :
(১) তারা আক্বীদা, ইবাদত ও আচরণে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের নীতির উপর দৃঢ় থাকেন এবং সর্বদা ছহীহ হাদীছের উপর আমল করেন। তারা মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করেন এবং আপোষে মহববতের সম্পর্ক অটুট রাখেন।
(২) তারা সকল বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যান এবং সালাফে ছালেহীন ও মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের মাসলাক অনুসরণে যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দেন।
(৩) তারা ব্যাখ্যাগত মতভেদ-কে লঘু করে দেখেন এবং কখনোই তাকে দলীয় বিভক্তিতে পরিণত করেন না।
(৪) তারা সর্বদা উত্তম মুমিন হওয়ার জন্য চেষ্টিত থাকেন এবং এজন্য সর্বদা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন।
২. ৭৩ ফেরক্বার মধ্যে একটি মাত্র দল শুরু থেকেই জান্নাতী হবে। যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের আক্বীদা ও আমলের যথার্থ অনুসারী হবে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ‘হক মাত্র একটাই হয়, একাধিক নয়’।
৩. নাজী ফের্কা হ’ল প্রথম যুগে ছাহাবী, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণের দল এবং তার পরে সর্বযুগে আহলেহাদীছের দল।
৪. তাদের বৈশিষ্ট্য হ’ল সাতটি :
(১) তারা সংস্কারক হবেন (২) আক্বীদার ক্ষেত্রে সর্বদা মধ্যপন্থী হবেন এবং কখনোই চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী হবেন না (৩) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তারা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসারী হবেন এবং তারা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত ব্যাখ্যা করেন (৪) তারা জামা‘আতবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেন এবং কখনোই উদ্ধত ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হন না (৫) তারা কুফর ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ও শক্তিশালী থাকেন এবং নিজেদের মধ্যে সর্বদা রহমদিল ও আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন (৬) তাঁরা যেকোন মূল্যে সুন্নাতকে আঁকড়ে থাকেন ও বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকেন (৭) তারা সর্বাবস্থায় সমবেতভাবে হাবলুল্লাহকে ধারণ করে থাকেন এবং কখনোই সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হন না। কেউ তাদেরকে ছেড়ে গেলে সে অবস্থায় তারা আল্লাহর উপর ভরসা করেন ও তাঁর গায়েবী মদদ কামনা করেন।
৫. ফের্কাবন্দীর প্রধান কারণ হ’ল প্রবৃত্তিপরায়ণতা। রাসূল (ছাঃ) যাকে কুকুরের বিষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যা দ্রুত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে ও রোগীকে মেরে ফেলে। প্রবৃত্তিপূজা তেমনি দ্রুত সমাজকে ভেঙ্গে বিনষ্ট করে দেয়।
কুরআন ও হাদীছের উপরে নিজের যুক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেই প্রবৃত্তিপূজা বলা হয়, যাকে কুরআনে ‘উপাস্য’ বলে অভিহিত করা হয়েছে (ফুরক্বান ২৫/৪৩)।
৬. ফিরক্বা নাজিয়াহর নিদর্শন ৪টি :
(১) তারা আক্বীদা, ইবাদত ও আচরণে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের নীতির উপর দৃঢ় থাকেন এবং সর্বদা ছহীহ হাদীছের উপর আমল করেন। তারা মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করেন এবং আপোষে মহববতের সম্পর্ক অটুট রাখেন।
(২) তারা সকল বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যান এবং সালাফে ছালেহীন ও মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের মাসলাক অনুসরণে যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দেন।
(৩) তারা ব্যাখ্যাগত মতভেদ-কে লঘু করে দেখেন এবং কখনোই তাকে দলীয় বিভক্তিতে পরিণত করেন না।
(৪) তারা সর্বদা উত্তম মুমিন হওয়ার জন্য চেষ্টিত থাকেন এবং এজন্য সর্বদা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন