HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার

লেখকঃ মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম

ইসলামী সমাজে মজুরদের মর্যাদা ও অধিকার
বুখারী শরীফের একটি হাদীসে মজুর ও চাকরদের অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট আলোকপাত করা হইয়াছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ বকর (রা) কে সম্বোধন করিয়া একদা মজুর দাসদের সম্পর্কে বলিয়াছেন:

هُمْ اَخْوَ اَنُكُمْ جَعَلَهُمُ اللهُ تَحْتَ اَيْدِ يْكُمْ ـ فَمَنْ جَعَلَ اللهُ اَخَاهُ تَحْتَ يَدِه فَلْيُعْمَهُ مِمَّا يَأكُلُ يُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبِسُ وَلاَ يُكَلّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ مَانُغْلِبُهُ فَاِنْ كَلِّفُهُ مَا يُغْلِيُعِنْهُ عَلَيْهِ ـ ( رواه البخاري )

যাহারা তোমাদের কাজ করিয়া জীবিকা উপার্জন করে সেই মজুর ও দাস তোমাদের ভাই-আল্লাহ তাহাদিগকে তোমাদের অধীন করিয়া দিয়াছেন। কাজেই যাহার কাছে এইরূপ লোক রহিয়াছে, তাহাকে যেন সে তাহাই খাইতে দেয় যাহা সে নিজে আহার করে; আর তাহাকে যেন তাহাই পরিতে দেয়, যাহা সে নিজে পরিধান করে। তাহার সাধ্যশক্তির অতীতে কোন কাজের চাপ যেন তাহাকে না দেয়। দিলে সে কাজ সমাধা করিবার ব্যাপারে যেন তাহাকে উপযুক্ত সাহায্য ও সহযোগিতা দান করে।

আমাদের কারখানার মালিকগণ যদি খাঁটি খাঁটি মুসলিম হইয়া বিশ্বনবীর এই আদেশ অনুসারে কাজ করিতে শুরু করিয়া, পক্ষান্তরে মজুর কৃষকগণ যদি মার্কস-লেলিনের ফাঁকা বুলির মোহ ত্যাগ করিয়া ইসলাম প্রদত্ত অধিকার আদায়-করিবার জন্য সঠিক ইসলামী পন্থায় আন্দোলন করে, তাহা হইলে শ্রেণী-বিদ্বেষ ও শ্রেণী-সংগ্রাম এবং অমানুষিকভাবে স্বার্থের টানা-হেঁচড়া শোষণ ও পীড়ন নিমেষে বন্ধ হইয়া যাইতে পারে এবং রক্তপাত ও বিদ্রোহ বিপ্লব ব্যতিরেকেই সমস্যার সমাধান হইতে পারে। উল্লিখিত হাদীস হইতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা প্রমাণিত হয়। পণ্যোৎপাদনের ব্যাপারে মজুর ও মূলধনীদের জন্য ইহা ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার একটি মূলনীতি বিশেষ:

১. মজুর ও পুঁজিদার যে কাজ করে এবং মজুরদের দ্বারা যে কাজ করায়-ইহারা উভয়ই ভাই বলিয়া মনে করিবে। দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যে সম্পর্কে ইহাদের মধ্যেও ঠিক তাহাই হইবে। বিশ্বনবীর ইহাই আন্তরিক বাসনা এবং ইসলামের দৃষ্টিতে ইহাই সুষ্ঠ মানবিক আদর্শ।

এই ব্যাপারে মূলনীতি হিসাবে যদি এইটুকু কথাই বলা হইত এবং সকলে মিলিয়া এই অনুসারে কাজ করিত তাহা হইলেও সকল প্রকার সমস্যার উৎসমুখ বন্ধ হইতে পারিত। কারখানা মালিক কারখানা শ্রমিককে যদি নিজের ভাই বলিয়া মনে করে, তাহা হইলে আর কোন সমস্যাই থাকিতে পারে না। শ্রমিক ও মজুরের যাবতীয় দু:খকষ্ট দূর করা এবং সর্বোতভাবে তাহার সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করাই তখন কারখানা মালিকের কর্তব্য হইবে। কিন্তু বিশ্বনবীর এই কথা এই অস্পষ্টতার মধ্যে শেষ হইয়া যায় নাই, তিনি আরো স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিয়াছেন।

২. অন্তত খাওয়া-পরা-থাকা প্রভৃতি বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণ করা পর্যন্ত মজুর ও মালিকদের আর্থিক অবস্থা একেবারে সমান-স্তরের হইতে হইবে। মালিক নিজ যা খাইবে, তাহাই মজুর ও শ্রমিককে খাইতে দিবে, যাহা নিজে পরিধান করিবে মজুরকেও তাহাই পরিধান করিবার ব্যবস্থা করিয়া দিবে। কেবল গার্হস্থ্য পর্যায়ের শ্রমিক-মজুরদের সম্পর্কেও ইসলামের ইহা বিধান। এই আদেশ হইতে মজুরে পারিশ্রমিক নির্ধারণের ব্যাপারে ইসলামের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিও নি:সন্দেহে জানিতে পারা যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই আদেশকে মালিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর ছাড়িয়া দেওয়া কোনক্রমেই ঠিক হইবে না; বরং ইসলামী হুকুমত আইনের সাহায্যে এইরূপ আচরণকে প্রত্যেক মালিক ও মূলধনীর পক্ষে অবশ্য করণীয় ও বাধ্যতামূলক করিয়া দিবে। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন: لِلْمُلُوْكِ طَعَامُهُ وَكَسْوَتُهُ بِالْمَعْرُوْفِ ـ মজুর-শ্রমিক ও ভৃত্যদের যথারীতি খাদ্য ও পোষাক দিতে হইবে।

উল্লিখিত হাদীস হইতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায় যে, ইসলামী হুকুমতের অধীন প্রত্যেক মজুর ও শ্রমিককে মালিকের সমান স্তরের খাওয়া-পরা-থাকা প্রভৃতি বুনিয়াদী প্রয়োজন পূরণ করিবার পরিমাণ অনুপাতে পারিশ্রমিক অবশ্যই দিতে হইবে। বর্তমান সময় মজুরির হার যদি এতটুকু পরিমাণও বৃদ্ধি করিয়া দেওয়া হয় এবং মালিক ও মূলধনী মালিকদের মানের খাওয়া-পরা-থাকা ইত্যাদি শ্রমিক ও শ্রমিকের সন্তানরাও লাভ করিতে থাকে, তাহা হইলে তথায় শোষণ বলিতে কিছুরই অস্তিত্ব থাকিতে পারে না, থাকিতে পারে না কোন শ্রেণী বিদ্বেষ। শ্রেণী-বৈষম্যের তৈল খনিতে আগুন লাগাইয়া মারত্মক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করাও কাহারো পক্ষে সম্ভব হয় না।

৩. সময় ও কাজের কঠোরতা-উভয় দিক দিয়াই মজুরকে সক্ষম ও সামর্থ করিয়া রাখিতে হইবে। এমন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাজে নিযুক্ত রাখা বা এমন কোন কাজের বোঝা মজুরের মাথায় চাপাইয়া দেওয়া যাইবে না, যাহা করিতে সে একেবারেই অসমর্থ কিংবা যাহা করিলে সে ক্লান্ত হইয়া পড়িবে বা তাহার স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া যাইতে পারে:

وَلاَيُكَلِّفُ مِنَ الْعَمَلِ اِلاًّ مَايُطْيِقُ ـ মজুরদের সাধ্যের অতীত কোন কাজকরিতে তাহাদিগকে বাধ্য করিবে না।

বিশ্বনবীর এই ছোট কথাটি মজুর-শ্রমিকদের জন্য চিরন্তন রক্ষাকবচ। বর্তমান যুগে মজুরদের কাজের সময়ের পরিমাণ এবং কাজের স্বরূপ নির্ধারণ শ্রমিকদের এই দুইটি প্রধান ও বুনিয়াদী সমস্যার সমাধান এই ছোট বাণীটির ভিত্তিতেই অতি সুন্দরভাবে করা যাইতে পারে। সহজ কথায় বলিতে গেলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কাজের গুরুত্ব অনুপাতে সাধারণভাবে যে কয় ঘন্টা শ্রম করা সম্ভব ঠিক তত ঘন্টাই মজুরদের নিকট হইতে কাজ লওয়া যাইবে এবং ততটুকু সময়ের কাজের বিনিময়ে তাহাকে পূর্ণ একটি দিনের বুনিয়াদী প্রয়োজন পূরণ করিবার সমান মজুরি দিতে হইবে।

৪. এমন কোন কঠিন কাজ যদি এসে পড়ে বা সমাধা করা মজুরের পক্ষে নানা কারণে দু:সাধ্য, যথা-কারখানার বর্তমান মজুর সমাধার জন্য যথেষ্ট শারীরিক শক্তি মজুরের নাই, এমতাবস্থায় সে কাজটি অসম্পূর্ণ রাখা হইবে এবং সামগ্রিক প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন এইভাবে বন্ধ করিয়া দিয়া কারখানা অচল করে দেওয়া হইবে-তাহা মোটেই সমীচীন নহে। পক্ষান্তরে মজুরদের শক্তি থাকুক তাহাদের দ্বারা সে কাজ অবশ্যই জোর করিয়া করান হইবে বা তা করিতে তাহাদিগকে বাধ্য করা হইবে-ইহাও হইতে পারে না। এহেন অবস্থায় ইসলামের নির্দেশ এই যে, বর্তমান মজুরদিগকে সেই কাজে নিযুক্ত করিয়া দিয়া, সেইকাজ সমাধার জন্য যথেষ্ট জনশক্তি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির শক্তি অথবা সময়-সুযোগের শক্তি দিয়ে তাহাদিগকে সাহায্য করিতে হইবে। হাদীসে উল্লিখিত فَاَعْيِنُوْهُمْ শব্দটির অর্থ এই নয় যে, এহেন অবস্থায় মালিক বা মূলধন নিজেই মজুরদের সঙ্গে কাজে নামিয়া পড়িবে। কারণ তা সব সময় সম্ভব ও সহজ হয় না এবং একজন বা দুইজনের শারীরিক সাহায্য সেই কাজ সমাধার জন্য যথেষ্ট না-ও হইতে পারে। আর তাহার প্রয়োজনও কিছু নেই। বরং বর্তমান মজুরদের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া কাজের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করিলেই যথেষ্ট হয়। মজুরদের শক্তি বৃদ্ধি করিবার একাধিক উপায় হইতে পারে;আর তাহা প্রয়োজন অনুপাতেই করিতে হইবে। প্রয়োজন হইলে মজুরের সংখ্যা বাড়াইয়া দিতে হইবে। সেই জন্য আবশ্যক হইলে মজুরির হারও বৃদ্ধি করিতে হইবে। এক কথায় উপস্থিত কাজ সম্পন্ন করিতে যথাসম্ভব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করিতে হইবে। যেমন দেশ ও জাতির প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন বন্ধ বা ব্যবহৃত না হয়, কারখানা-মালিকের কাজেরও যেন সমাধা হয়, মজুরদের উপর সাধ্যাতীত কোন কাজেরও যেন চাপ না পড়ে। ইসলামে শ্রমিকদের যাবতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য ইহাই প্রধানতম মূলনীতি।

বর্তমান যুগে কারখানা-মালিক ও মজুর-শ্রমিক এবং পুঁজি ও শ্রমের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বৈষম্যের যে আকাশ ছোঁয়া তুফান জাগিয়া উঠিয়াছে, এই হাদীসের ভিত্তিতে তাহার সুন্দর ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অবসান সাধন করা অতীব সহজ।

ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় ইহা মোটেই মন ভোলানো প্রস্তাব কিংবা ‘খেয়ালী স্বর্গ’ বিশেষ নয়। ইহা একটি বাস্তব কর্মাদর্শ। ইহার ভিত্তিতে মানবেতিহাসে এক সোনালী অধ্যায়ে সমাজের যাবতীয় আর্থিক সমস্যার সমাধান করা হইয়াছিল। বাস্তবক্ষেত্রে তদনুযায়ী কাজ করিয়া একটি যুগের মানুষের জীবনকে সুখ-শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী করিয়া তোলা হইয়াছিল। ফলে তৎকালে শ্রম-মজুরি এবং শ্রমিক মূলধনীদের পরস্পরের মধ্যে কোনরূপ বৈষম্য, শ্রেণী-সংগ্রাম ও শ্রেণী-বিদ্বেষ সৃষ্টি হইতে পারে নাই। উপরোল্লিখিত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন আবুযার গিফারী (রা)। তিনি বলিয়াছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখে এই পবিত্র বাণীটি ঠিক সেই সময় শুনিয়াছেন, যখন তিনি ও তাঁহার ভৃত্য ঠিক একইরূপ পোশাক পরিহিত ছিলেন। তাঁহাকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করা হইলে উত্তরে তিনি এই হাদীসটি ইরশাদ করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা শুনিয়া বলিয়াছিলেন; তোমরা মধ্যে এখনও কি জাহিলী যুগের বদ-অভ্যাস বর্তমান আছে? অর্থাৎ ভৃত্যকে ভর্ৎসনা করা জাহিলী স্বভাব-বিশেষ, ইসলাম তা বরদাশত করে না। অত:পর প্রতিটি ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষা করাই আবু যারের আজীবনের কার্যসূচীতে পরিণত হইয়াছিল। ওমর ফারুক (রা) এর বায়তুল মাকদাস সফরকালে উষ্ট্র চালনার কাজে ভৃত্যের সাথে আধাআধি ভাগ করিয়া লওয়ার ঘটনা এক ঐতিহাসিক ব্যাপার। তিনি মদীনার চতুর্দিকে রাত নিশিথে ঘুরিয়া বেড়াইতেন এবং যেখানে কোন মজুর-দাসকে কোন কঠিন কাজে নিযুক্ত দেখিতে পাইতেন তাহাকে তাহা হইতে মুক্তি দিতেন এবং কাহাকেও তাহার ন্যায়সংগত মজুরি কম পাইতে দেখিলে তাহার মজুরি বৃদ্ধি করিয়া প্রয়োজন পরিমাণ দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়া দিতেন।

শ্রমিক-মজুরদের প্রতি বর্তমান যুগের পুঁজিদার ও কারখানা-মালিকদের আচরণ শোষণ ও উৎপীড়নমূলক সন্দেহ নাই। তাহারা মজুর-শ্রমিককে খাটাইয়া নির্দিষ্ট কাজ তিল তিল করিয়া সম্পূর্ণ করিয়া লয়, অথচ শ্রমিকদেরকে যথেষ্ট পরিমাণ মজুরি আদৌ দেয় না। আর দিলেও নানা কৌশলে ও ফাঁদ-প্রতারণায় জড়াইয়া উহার অধিকাংশ কাটিয়া-ছাটিয়া রাখিয়া দেয়। তাহার পরও যে সামান্য পরিমাণ বেতন বা মজুরি প্রাপ্য হয় তাহাও যথা সময় আদায় করিতে কুন্ঠিত হয় এবং অফিসের নিয়মতান্ত্রিকতা অভাব-পীড়নে তাহাদিগকে অতিষ্ট করিয়া তোলা হয়। একদিকে গরীব ও মজুরদের শিশু-সন্তান ক্ষুধা-তৃষ্ণায়, দু:সহ-জ্বালায়, শীত-গ্রীষ্মের, রোগ-দু:খের দু:সহ চাপে জর্জরিত হইয়া ওষ্ঠাগত প্রাণ। অপরদিকে আকাশচুম্বি বিরাট প্রাসাদের উপর তলায় বিদ্যুত-পাখার হিমশীতল মলয়-হিল্লোল মজুর-দেহের শোণিত বর্ণের লাল-পানি পানের রুদ্রদর্পিত হুঙ্কার-এখন দিতে পারিব না। এক সপ্তাহ পরে বেতন পাইবে ইত্যাদি।

পুঁজিদার আর মালিকদের এবম্বিধ আচরণ ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অন্যায়-অনাচারমূলক এবং ইহা মজুরদের প্রতি তাহাদের অমানুষিক জুলুম, সন্দেহ নাই। ইসলামের শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মানবতার এই দু:খ মর্মে মর্মে অনুভব করিতে পারিয়াছিলেন। দু:খী মানবতার আহাজারী তাঁহার হৃদয়-মনকে বিষায়িত করিয়া তুলিয়াছিল। ব্যথিতের প্রতি সহানুভূতিই ছিল তাঁহার জীবনের অন্যতম ব্রত। তাই তিনি জলদ-গম্ভীর স্বরে ইরশাদ করিয়াছিলেন:

আল্লাহ পাক ইরশাদ করিয়াছেন যে, কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি কঠিন অভিযোগ উপস্থাপিত করিব-যে ব্যক্তি আমার জন্য কাহাকেও কিছু দান করিবার ওয়াদা করিয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিল, কোন মুক্ত স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করিয়া পুরাপুরি কাজ আদায় করিয়া লইল, কিন্তু তাহার মজুরি দিল না-ইহারাই সেই তিন জন।

অন্য হাদীসে বলা হইয়াছে: “ধনীর সামর্থ থাকা সত্ত্বেও পরের ‘হক’ আদায় করিতে অকারণ বিলম্ব করা জুলুম”।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট ভাষায় আদেশ করিয়াছেন:

اُعْطُوْا الاَجِيْرَ اجْرَهُ قَبْلَ اَنْ يُّجِفً رِيْقُهُ ـ

মজুরকে তাহার ঘাম শুল্ক হওয়ার পূর্বেই মজুরি শোধ করিয়া দাও।

অর্থাৎ মজুরি শোধ করিতে অকারণ কিছুমাত্র বিলম্ব করা সঙ্গত নয়। এই ব্যাপারে কোনরূপ টাল-বাহানা করা এবং কোনরূপ ধোঁকা বা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া পরিষ্কার জুলুম এবং সকল প্রকার জুলুম শোষণের উৎস চিরতরে বন্ধ করিয়া দেওয়াই ইসলামী হুকুমতের কর্তব্য। এই জন্য রাষ্ট্র যথাযোগ্য আইন রচনা করিয়া পুঁজিদার ও কারখানা মালিককে নির্দিষ্ট সময়ে এবং পুরোপুরিভাবে শ্রমিকের বেতন আদায় করিতে বাধ্য করিতে পারিবে। বর্তমান কালের শ্রমিক-মজুরদের জীবনে দু:খ-দারিদ্রের যে অমানিশা নামিয়াছে, ইসলামী হুকুমতে তাহার চির অবসান হইবে, তাহাতে কোনরূপ সন্দেহ থাকিতে পারে না।

একটি হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে:

اِنَّ رَسُوْلٌ اللهِ نَهى عَنِ اسْتَجَارَةِ اِلاجِيْرِ حَتّى يُبَيِنُ لَهُ اَجرُهُ ـ

মজুরের বেতন নির্দিষ্ট না করিয়া তাহাকে কাজে নিযুক্ত করিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কার ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন।

এ যুগের পুঁজিদার ও কারখানা-মালিকগণ গরীব দুস্থ ও দারিদ্র নিপীড়িত মজুরদের প্রতি যে ধোঁকা ও প্রতারণামূলক আচরণ করিয়া থাকে, তাহাদিগকে শোষণ করিবার জন্য নিত্য নূতন উপায় উদ্ভাবন করিয়া থাকে, মজুরি নির্ধারিত না করিয়া তাহাদিগকে কাজ করিতে বাধ্য করিয়া এবং কাজ আদায় করিবার পর সামান্য কিছু দিয়ে তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দেয়-বর্তমান বিপর্যস্ত সমাজে এই ধরণের দুর্নীতি এবং জুলুম-পীড়নের কোনই অন্ত নাই। কিন্ত ইসলামী সমাজে ইহার বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকিতে পারিবে না। সেখানে মজুরির পরিমাণ অজ্ঞাত ও অনির্দিষ্ট রাখিয়া কাজ করা কিংবা করান মাত্রই জায়েয নয় বরং কাজ-কাজের স্বরূপ এবং উহার মজুরি-পূর্বেই সুনির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। মুজরি নির্ধারিত না করিয়া কাজ করিলে সেই ধরনের কাজে যাহা মজুরি সাধারণত দেওয়া হয়, তাহাই আদায় করিতে হইবে। মালিক নিজের ইচ্ছামত মজুরির কোন পরিমাণ নির্ধারিত করিতে পারিবে না-করিলে মজুর বা শ্রমিক তা কবুল করিতে বাধ্য হইবে না। কাজের স্বরূপ অনুসারে মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারে প্রয়োজন হইলে ইসলামী হুকুমত সরাসরি হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে এবং এক সুসমঞ্জস্য ও সুবিচারপূর্ণ হার নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়ার পূর্ণ অধিকার তাহার রহিয়াছে।

শ্রকিকদের অজ্ঞতা ও অসহায়তায় সুযোগ লইয়া শিল্পপতি ও পুঁজিদারগণ তাহাদের উপর যাতে কোনরূপ অত্যাচার করিতে না পারে কোনরূপ শোষণ পীড়ন করিতে না পারে, ইসলামী রাষ্ট্র তাহার নিখুঁত ব্যবস্থা করিবে।

ইসলামী শিল্প-ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মজুরের অধিকার সম্পর্কে একটি হাদীস সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিতেছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করিয়াছেন:

মজুরকে তাহার কাজ হইতে অংশ দান কর। কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যাইতে পারে না।

এই হাদীসের দৃষ্টিতে প্রমাণিত হইতেছে যে, মজুরের নির্ধারিত বেতন যা মজুরি আদায়ের পরও মূল কারখানায় যাহা মুনাফা হইবে তাহা হইতেও মজুরকে অংশ দিতে হইবে। এই সম্পর্কে ইসলামী অর্থনীতিতে যদিও সুস্পষ্ট কোন নির্দেশ পাওয়া যায় না, কিন্তু তবুও নিম্মলিখিত হাদীসটি এই ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন:

إذا صنع لأحدكم خادمه طعامه ثم جاءه به ، وفقد ولى حره ودخانه ، فلقعده معه . فليأكل . فإن كان الطعام مشفوها قليلا ، فليضع في يده منه أكلة أو أكلتين

তোমরা ভৃত্য যদি তোমার অন্ন প্রস্তুত করে এবং তাহা লইয়া তোমার নিকট আসে- যাহা রান্না করিবার সময় আগুনের তাপ এবং ধুম্র তাহাকে অনেক কষ্ট দিয়াছে-তখন তাহাকে তোমার সাথে বসাইয়া খাওয়াইবে। খানা যদি শুষ্ক রান্না হইয়া থাকে, তবে তাহা হইতে তাহার হাতে এক মুঠি বা দুই মুঠি অবশ্যই তুলিয়া দিবে। (মুসলিম)

এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, শ্রমিক শ্রমের সাহায্যে মালিকের কাঁচামাল বা মূলধন খাটাইয়া যাহা উৎপন্ন করিবে, তাহা হইতে তাহাকে নির্দিষ্ট হারে বেতন দেওয়ার পরও আসল মুনাফা হইতে তাহাকে কিছু না কিছু অংশ দিতে হইবে। হাদীসে উল্লিখিত ঘরের বাবুর্চি আর কারখানার শ্রমিকের মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নাই। একজন বাবুর্চি খাদ্য পাকাইবার কাজে যেভাবে মনোযোগ দিতে হয়, দেহ ও চিন্তা শক্তিকে যেভাবে নির্দিষ্ট এক কাজের জন্য নিয়োজিত করিতে হয়, কম-বেশি প্রায় তদ্রুপই কারখানার একজন মজুরকেও খাটিতে হয়। কাজেই এক হাদীস অনুসারে নির্বিশেষে সকল শ্রমিকই কারখানায় উৎপন্ন দ্রব্য হইতে অংশ পাইতে পারিবে। যে মিলে কাপড় তৈরী হয়, প্রত্যেক শ্রমিককে তাহার পরিবারবর্গের জন্য বৎসরে এক বা একাধিক বার কাপড় দেওয়া যাইতে পারে। ইহা নির্দিষ্ট বেতনের মধ্যে গণ্য হইবে না। কারণ প্রায়ই দেখা যায়, কোন মিলে শ্রমিক সকাল-সন্ধ্যা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করিয়া থানকে থান কাপড় বুনে অথচ তাহার নিজের বা তাহার পরিবারের লোকদের পরিধানে হয়ত ছিন্নবস্ত্রটুকুরও অস্তিত্ব নাই। এই হাদীস অনুসারে ইসলামী সামাজে যে শ্রমনীতি কায়েম করা হইবে তাহাতে এই অবাঞ্চিত পরিস্থিতির অবকাশ থাকিতে পারিবে না। খাদ্য প্রস্তুতকারী পাচকের অভুক্ত থাকা যে ইসলাম বরদাশত করিতে পারে না, কারণ খাদ্য প্রস্তুত করিবার ব্যাপারে মালিক শুধু দ্রব্যসামগ্রী দিয়াই রেহাই পাইয়া যায়, কিন্তু উহা প্রস্তুত করিতে গিয়া আগুনের উত্তাপ ও ধোঁয়ার জ্বালা পাচককেই ভুগিতে হয়। তাহা হইলে যে কারখানায় মজুর শ্রমিকগণ প্রাণান্তকর পরিশ্রম করিয়া হাজার হাজার থান কাপড় বুনল, সে বা তাহার পরিবারবর্গ কাপড়ের অভাবে উলঙ্গ থাকিবে, আর ওদিকে কারখানা-মালিক তাহার কুকুরকে পর্যন্ত মখমলে মূল্যবান বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া রাখিবে, এমন অবিচার ও অসাম্য ব্যবস্থা ইসলাম কিছুতেই সমর্থন করিতে পারে না। একথা প্রমাণ করিতে খুব বেশি যুক্তির আবশ্যক করে না।

ইসলাম মজুর-শ্রমিকদের এই সব অধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হইয়াছে। এ সম্পর্কে আরও কয়েকটি হাদীস পাওয়া যায়, যেসবের উপর ভিত্তি করিয়া আধুনিক সমস্যা ও প্রয়োজন অনুপাতে এই সম্পর্কীয় একটি পরিপূর্ণ ও বিস্তারিত বিধান রচনা করা যাইতে পারে। সম্প্রতি আমাদের বক্তব্য শুধু এতটুকু যে, বর্তমান সময় মজুর-শ্রমিকদের এই আকাশ ছোঁয়া জটিল সমস্যাসমূহের সুষ্ঠু ও সুবিচারপূর্ণ সমাধান করিতে পারে একমাত্র ইসলাম। মালিক-মজুরের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী সংগ্রাম অতি সহজেই বন্ধ হইতে পারে? তিক্ততার পরিবর্তে তথায় মধুর সহযোগিতা ও সহানুভূতিমূলক সম্পর্কের সৃষ্টি হইতে পারে।

অতএব অনতিবিলম্বে ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা এবং ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী মালিক ও মজুরের যাবতীয় সমস্যা সমাধান করা একান্তই কর্তব্য। আর সেই জন্য সরকার ও কারখানা মালিকগণের তথা সমগ্র দেশবাসীরই প্রাণপণ চেষ্টা করা বাঞ্চনীয়।

(প্রবন্ধটি ১৯৫১ সালের ৫ই জুলাই ঈদ সংখ্যা দৈনিক ‘আজাদে’ প্রকাশিত হয়)

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন