HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

হজ্জ ও ওমরাহ

লেখকঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
হজ্জ ও ওমরাহ

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ

নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,

হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ১০

ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,

মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০

১ম প্রকাশ : জুলাই ২০১১ খৃঃ

৪র্থ সংস্করণ : মে ২০১৩ খ্রিঃ

নির্ধারিত মূল্য : ৩০ (ত্রিশ) টাকা মাত্র।

ভূমিকা (المقدمة)
হজ্জ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। সামর্থ্যবান মুমিনের জন্য যত দ্রুত সম্ভব ইসলামের এই রুকন আদায় করা ফরয। হজ্জ মুমিনকে যেমন আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয়, তেমনি তার আত্মিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঙ্গে সঙ্গে হজ্জ মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী মহাজাতিতে পরিণত হ’তে উদ্বুদ্ধ করে।

উল্লেখ্য যে, কোন নেক আমলই কবুল হয় না তিনটি শর্ত পূরণ করা ব্যতীত। (১) ছহীহ আক্বীদা (২) ছহীহ তরীকবা ও (৩) ইখলাছে নিয়ত। অতএব শিরকবিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের খালেছ নিয়তে ও পরকালীন মুক্তির স্বার্থে ছহীহ হাদীছ মোতাবেক ছহীহ তরীক্বায় হজ্জ করলেই কেবল তা আল্লাহর নিকট কবুল হবার সম্ভাবনা থাকবে।

সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা আমাদের সাধ্যমত ছহীহ হাদীছ মোতাবেক সংক্ষেপে পুস্তিকাটি প্রণয়ন করার চেষ্টা করেছি। বিনিময় স্রেফ আল্লাহর নিকটেই কামনা করি এবং আল্লাহর মেহমানদের নিকটে চাই প্রাণখোলা দো‘আ। ভুল-ত্রুটির জন্য সর্বদা ক্ষমাপ্রার্থী। বিনীত-

হজ্জ ও ওমরাহ
হজ্জ-এর সংজ্ঞা ( معنى الحج ) :

‘হজ্জ’-এর আভিধানিক অর্থ: সংকল্প করা ( القصد )। পারিভাষিক অর্থ: আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে শরী‘আত নির্ধারিত ক্রিয়া-পদ্ধতি সহকারে মক্কায় গিয়ে বায়তুল্লাহ যেয়ারত করার সংকল্প করা।

ওমরাহ-এর সংজ্ঞা ( معنى العمرة ) :

‘ওমরাহ’-এর আভিধানিক অর্থ : আবাদ স্থানে যাওয়ার সংকল্প করা ( الاعتمار ) , যিয়ারত করা। পারিভাষিক অর্থ: আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে বছরের যেকোন সময় শরী‘আত নির্ধারিত ক্রিয়া-পদ্ধতি সহকারে মক্কায় গিয়ে বায়তুল্লাহ যেয়ারত করার সংকল্প করা।

হজ্জ-এর সময়কাল ( أشهر الحج ) :

হজ্জের জন্য নির্দিষ্ট তিনটি মাস হ’ল শাওয়াল, যুলক্বা‘দাহ ও যুলহিজ্জাহ । এ মাসগুলির মধ্যেই যেকোন সময় হজ্জের ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হয় এবং ৯ই যিলহাজ্জ তারিখে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হয়। ৯ তারিখে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান না করলে হজ্জ হবে না। পক্ষান্তরে ‘ওমরাহ’ করা সুন্নাত এবং বছরের যেকোন সময় তা করা চলে।[1]

হুকুম ( حكم الحج والعمرة ) :

নিরাপদ ও সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুমিনের জন্য জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয।[2]অধিকবার হজ্জ বা ওমরাহ করা নফল বা অতিরিক্ত বিষয়’।[3]বারবার নফল হজ্জ ও ওমরাহ করার চাইতে গরীব নিকটাত্মীয়দের মধ্যে উক্ত অর্থ বিতরণ করা এবং অন্যান্য দ্বীনী কাজে ছাদাক্বা করা উত্তম।

৯ম অথবা ১০ম হিজরীতে হজ্জ ফরয হয়। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) এ মতকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে জমহূর বিদ্বানগণের মতে ৬ষ্ঠ হিজরীতে হজ্জের হুকুম নাযিল হয় এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ১০ম হিজরীতে জীবনে একবার ও শেষবার সপরিবারে হজ্জ করেন।[4] তিনি জীবনে মোট ৪ বার ওমরাহ করেন।[5]

ফযীলত ( فضائل الحج والعمرة ) :

مَنْ حَجَّ للهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمٍ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ، متفق عليه -

১.রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্জ হ’তে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল’।[6]

اَلْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِّمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ، متفق عليه -

২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত সময়ের (ছগীরা গোনাহ সমূহের) কাফফারা স্বরূপ। আর কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়’।[7]

কবুল হজ্জের নিদর্শন ( علامات الحج المبرور ) :

‘হাজ্জে মাবরূর’ বা কবুল হজ্জ বলতে ঐ হজ্জকে বুঝায়, (ক) যে হজ্জে কোন গোনাহ করা হয়নি এবং যে হজ্জের আরকান-আহকাম সবকিছু (ছহীহ সুনণাহ মোতাবেক) পরিপূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে। (খ) হজ্জ থেকে ফিরে আসার পর পূর্বের চাইতে উত্তম হওয়া এবং পূর্বের গোনাহে পুনরায় লিপ্ত না হওয়া’।[8] আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন, ... سَتَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ ، فَسَيَسْأَلُكُمْ عَنْ أَعْمَالِكُمْ ، أَلاَ فَلاَ تَرْجِعُوا بَعْدِى ضُلاَّلاً، Ô †হ লোকসকল! সত্বর তোমরা তোমাদের প্রভুর সঙ্গে মিলিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। অতএব সাবধান! তোমরা আজকের দিনের পর যেন পুনরায় পথভ্রষ্ট হয়ো না।[9]

৩.রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘ইসলাম, হিজরত এবং হজ্জ মুমিনের বিগত দিনের সকল গুনাহ ধ্বসিয়ে দেয়’।[10]

৪.তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা হজ্জ ও ওমরাহর মধ্যে পারম্পর্য বজায় রাখো (অর্থাৎ সাথে সাথে কর)। কেননা এ দু’টি মুমিনের দরিদ্রতা ও গোনাহ সমূহ দূর করে দেয়, যেমন স্বর্ণকারের আগুনের হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা ছাফ করে দেয়...’।[11]তিনি আরও বলেন, ওমরাহ সর্বদা হজ্জের মধ্যে প্রবেশ করবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত’।[12]সম্ভবত: সে কারণেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় ছাহাবীগণকে প্রথমে ওমরাহ সেরে পরে হজ্জ করার অর্থাৎ ‘তামাত্তু হজ্জ’ করার তাকীদ দিয়েছেন এবং না করলে ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।[13]

৫.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, إِنَّ عُمْرَة فِىْ رَمَضَانَ تَعْدِلُ حَجَّةً، ‘নিশ্চয়ই রামাযান মাসের ওমরাহ একটি হজ্জের সমান।[14] অন্য বর্ণনায় এসেছে, إنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَانَ تَقْضِىْ حَجَّةً مَّعِىْ ‘রামাযান মাসে ওমরা করা আমার সাথে হজ্জ করার ন্যায়’।[15]

৬.হযরত আয়েশা(রাযিয়াল্লা-হু ‘আনহা) একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মহিলাদের উপরে ‘জিহাদ’ আছে কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ আছে। তবে সেখানে যুদ্ধ নেই। সেটি হ’ল হজ্জ ও ওমরাহ’।[16] তিনি বলেন, ‘বড়, ছোট, দুর্বল ও মহিলা সকলের জন্য জিহাদ হ’ল: হজ্জ ও ওমরাহ’।[17] তিনি বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ আমল হ’ল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনা। অতঃপর শ্রেষ্ঠ হ’ল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। অতঃপর শ্রেষ্ঠ হ’ল কবুল হজ্জ’।[18]

৭. তিনি বলেন, وَفْدُ اللهِ ثَلاَثَةٌ : الغَازِى وَالْحَاجُّ وَالْمُعْتَمِرُ ‘আল্লাহর মেহমান হ’ল তিনটি দল: আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধকারী, হজ্জকারী ও ওমরাহকারী’।[19]

৮.রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ ‘শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল আরাফা দিবসের দো‘আ...’।[20] তিনি বলেন, ‘আরাফার দিন ব্যতীত অন্য কোন দিন আল্লাহ এত অধিক পরিমাণ লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন না। ঐদিন আল্লাহ নিকটবর্তী হন। অতঃপর আরাফাহ ময়দানের হাজীদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন ও বলেন, দেখ ঐ লোকেরা কি চায়’?[21] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘ওরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ ওদের ডেকেছেন তাই ওরা এসেছে। এখন ওরা চাইবে, আর আল্লাহ তা দিয়ে দিবেন’।[22]

৯. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জ, ওমরাহ কিংবা জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হ’ল এবং রাস্তায় মৃত্যুবরণ করল, আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ নেকী লিখে দিবেন’।[23]

১০.হাজারে আসওয়াদ ও ত্বাওয়াফ( الحجر الأسود والطواف ) :রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রুক্নে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্পর্শ করবে, তার সমস্ত গোনাহ ঝরে পড়বে’।[24] তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর সাতটি ত্বাওয়াফ করবে ও শেষে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, সে যেন একটি গোলাম আযাদ করল’। ‘এই সময় প্রতি পদক্ষেপে একটি করে গোনাহ ঝরে পড়ে ও একটি করে নেকী লেখা হয়’।[25] তিনি বলেন, ‘ত্বাওয়াফ হ’ল ছালাতের ন্যায়। তবে এই সময় প্রয়োজনে যৎসামান্য নেকীর কথা বলা যাবে’।[26]

তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন হাজারে আসওয়াদকে উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তার দু’টি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখবে ও একটি যবান থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং ঐ ব্যক্তির জন্য সাক্ষ্য দিবে, যে ব্যক্তি খালেছ অন্তরে তাকে স্পর্শ করেছে’।[27]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘হাজারে আসওয়াদ’ প্রথমে দুধ বা বরফের চেয়েও সাদা ও মসৃণ অবস্থায় জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর বনু আদমের পাপ সমূহ তাকে কালো করে দেয়’।[28]

² মনে রাখা উচিত যে, পাথরের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। আমরা কেবলমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের উপর আমল করব। যেমন ওমর ফারূক (রাঃ) উক্ত পাথরে চুমু দেওয়ার সময় বলেছিলেন,

إِنِّىْ لَأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ مَا تَنْفَعُ وَلاَ تَضُرُّ، وَلَوْلاَ أَنِّيْ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عليه وسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ، متفق عليه -

‘আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারো না। তবে আমি যদি আল্লাহর রাসূলকে না দেখতাম তোমাকে চুমু দিতে, তাহ’লে আমি তোমাকে চুমু দিতাম না’।[29]ওমর ফারূক (রাঃ) উক্ত পাথরে চুমু খেয়েছেন ও কেঁদেছেন’।[30]

১১. যমযম পানি ( ماء زمزم ):ত্বাওয়াফ শেষে দু’রাক‘আত ছালাত অন্তে মাত্বাফ থেকে বেরিয়ে পাশেই যমযম কুয়া এলাকায় প্রবেশ করবে এবং সেখানে যমযমের পানি বিসমিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে পান করবে ও কিছুটা মাথায় দিবে।[31] যমযম পানি পান করার সময় ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত বিশেষ দো‘আ পাঠের প্রচলিত হাদীছটি যঈফ।[32] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُماءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ، فِيْهِ طَعَامٌ مِِّنَ الطُّعْمِ وَشِفَاءٌ مِّنَ السُّقْمِ ‘ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হ’ল যমযমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ হ’তে আরোগ্য’।[33] অন্য বর্ণনায় এসেছে إِنَّهَا مُبَارَكَةٌ ‘এটি বরকত মন্ডিত’।[34] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এই পানি কোন রোগ থেকে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে পান করলে তোমাকে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন’।[35] বস্ত্ততঃ যমযম হ’ল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে সৃষ্ট এক অলৌকিক কুয়া। যা শিশু ইসমাঈল ও তার মা হাজেরার জীবন রক্ষার্থে এবং পরবর্তীতে মক্কার আবাদ ও শেষনবী (ছাঃ)-এর আগমন স্থল হিসাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছিল।[36]

১২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘অন্যত্র ছালাত আদায়ের চেয়ে আমার মসজিদে ছালাত আদায় করা এক হাযার গুণ উত্তম এবং মসজিদুল হারামে ছালাত আদায় করা একলক্ষ গুণ উত্তম’।[37]

১৩.রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ উটের পিঠে বসে কংকর মারার সময় বলেন, خُذُوا عَنِّى مَناسِكَكُمْ ‘হে জনগণ! তোমরা আমার কাছ থেকে হজ্জের নিয়ম-কানূন শিখে নাও। কেননা আমি জানিনা, এ বছরের পরে আমি আর হজ্জ করতে পারব কি-না।[38] অতএব হজ্জের প্রতিটি অনুষ্ঠান সঠিকভাবে খুবই সম্মান ও নিবেদিতপ্রাণ হয়ে সম্পাদন করা কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম সেভাবেই হজ্জ ও ওমরাহ পালন করতেন।

দ্রুত হজ্জ সম্পাদন করা ( التعجيل في الحج ):রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَرَادَ الْحَجَّ فَلْيَتَعَجَّلْ ‘যে ব্যক্তি হজ্জের সংকল্প করে, সে যেন দ্রুত সেটা সম্পাদন করে’।[39]যাদের উপরে হজ্জ ফরয হওয়া সত্ত্বেও দেরী করেন, তারা হাদীছটি লক্ষ্য করুন।

বদলী হজ্জ ( الحج البدل ) :কেউ অন্যের পক্ষ হ’তে বদলী হজ্জ করতে চাইলে তাকে প্রথমে নিজের হজ্জ করতে হবে।[40]যার উপর হজ্জ ফরয হয়েছে, কিন্তু রোগ বা অতি বার্ধক্যের কারণে নিরাশ হয়ে গেছেন, তাঁর পক্ষে বা মৃতব্যক্তির পক্ষে বদলী হজ্জ করা যাবে। নারী পুরুষের পক্ষে অথবা পুরুষ নারীর পক্ষে বদলী হজ্জ করতে পারেন। বদলী ওমরাহর কোন দলীল পাওয়া যায় না। ওমরাহ ফরয নয়। তাই নফল হজ্জ বা নফল ওমরাহর কোন বদলী হয় না।

শিশুর হজ্জ ( حج الصبى ) :শিশু হজ্জ করলে তার হজ্জ হবে ও তার পিতা নেকী পাবেন। কিন্তু ঐ শিশুর উপর থেকে হজ্জের ফরযিয়াত বিলুপ্ত হবে না। বড় হয়ে সামর্থ্যবান হ’লে পুনরায় তাকে নিজের হজ্জ করতে হবে।

অন্যের খরচে হজ্জ ( الحج بنفقة الغير ) :

অন্যের খরচে ও ব্যবস্থাপনায় হজ্জ করা যাবে এবং এর ফলে তার উপর হজ্জের ফরযিয়াত বিলুপ্ত হবে। যিনি হজ্জ করাবেন, তিনি এই বিরাট সৎকর্মের নেকী পাবেন এবং হজ্জকারী তার হজ্জের নেকী পাবেন।

[1]. সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো: দারুল ফাৎহ ৫ম সংস্করণ ১৪১২/১৯৯২), পৃঃ ১/৪৬২, ৫৪০।

[2]. আলে ইমরান ৩/৯৭; আবুদাঊদ হা/১৭২১।

[3]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, আহমাদ, আলবানী মিশকাত হা/২৫২০।

[4]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৪২, ৪৪৪।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫১৮; চারটি ওমরাহ : (১) ৬ষ্ঠ হিজরীতে হোদায়বিয়ার ওমরাহ ( عمرة الحديبية ) , যা পূর্ণ না হওয়ায় তিনি সন্ধি করে ফিরে যান (২) ৭ম হিজরীতে গত বছরের সন্ধি মতে ওমরাহ ( عمرة القضاء ) আদায় (৩) ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় ও হোনায়েন যুদ্ধের পর গণীমত বণ্টন শেষে জি‘ইর্রা-নাহ হ’তে ওমরাহ ( عمرة الجعرّانة ) আদায় এবং (৪) সবশেষে ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের সাথে একত্রিতভাবে ওমরাহ আদায়। সবগুলিই তিনি করেছিলেন যুলক্বা‘দাহ মাসে’। উক্ত হিসাবে দেখা যায় যে, তিনি পৃথক ও স্বতন্ত্রভাবে কেবল দু’টি ওমরাহ করেছেন। একটি ৭ম হিজরীতে এবং অন্যটি ৮ম হিজরীতে। সম্ভবতঃ একারণেই ছাহাবী বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর হজ্জের পূর্বে দু’টি ওমরাহ করেছেন যুলক্বা‘দাহ মাসে’ (বুখারী, মিশকাত হা/২৫১৯)।

[6]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৭।

[7]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৫০৮।

[8]. ফৎহুল বারী ৩/৪৪৬; হা/১৫১৯-এর ব্যাখ্যা।

[9]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৫৯।

[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৮।

[11].তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/২৫২৪।

[12]. আবুদাঊদ হা/১৭৮৪, ৮৭, ৮৮, ৯০।

[13]. আবুদাঊদ হা/১৭৮৫, ৮৭।

[14]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৯।

[15]. বুখারী হা/১৮৬৩; মুসলিম হা/৩০৩৯।

[16]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৫৩৪।

[17]. ছহীহ নাসাঈ হা/২৪৬৩।

[18]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৬।

[19]. নাসাঈ, মিশকাত হা/২৫৩৭।

[20]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৫৯৮; ছাহীহাহ হা/১৫০৩।

[21]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৯৪।

[22]. ইবনু মাজাহ হা/২৮৯৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮২০।

[23]. বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৫৩৯; ছহীহাহ হা/২৫৫৩।

[24]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৭২৯; ছহীহ নাসাঈ হা/২৭৩২।

[25]. তিরমিযী ও অন্যান্য, মিশকাত হা/২৫৮০।

[26].তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/২৫৭৬; ইরওয়া হা/১১০২।

[27]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, দারেমী, মিশকাত হা/২৫৭৮।

[28]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৫৭৭; ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৭৩৩।

[29]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৮৯।

[30]. বায়হাক্বী ৫/৭৪ পৃঃ, সনদ জাইয়িদ।

[31]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪২৬৮; আহমাদ (কায়রো, তাবি) হা/১৫২৮০ সনদ ছহীহ, আরনাঊত্ব; ক্বাহত্বানী পৃঃ ৯৩।

[32]. ইরওয়া ৪/৩৩২-৩৩ পৃঃ হা/১১২৬-এর আলোচনা দ্রঃ।

[33]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৩৯১২; ছহীহাহ হা/১০৫৬।

[34]. আহমাদ, মুসলিম; ছহীহাহ হা/১০৫৬।

[35]. দারাকুৎনী, হাকেম, ছহীহ তারগীব হা/১১৬৪।

[36]. ছহীহ বুখারী হা/৩৩৬৪; দ্রঃ লেখক প্রণীত ‘নবীদের কাহিনী’ ১/১৩৪-৩৫ পৃঃ।

‘যমযম’ ( زمزم ) : ১৮ ফুট দৈর্ঘ, ১৪ ফুট প্রস্থ ও অন্যূন ৫ ফুট গভীরতার এই ছোট্ট কুয়াটি অত্যাশ্চর্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। বিগত প্রায় চার হাযার বছরের অধিককাল ধরে এই কুয়া থেকে দৈনিক হাযার হাযার গ্যালন পানি মানুষ পান করছে ও সুস্থতা লাভ করছে। কিন্তু কখনোই পানি কম হ’তে দেখা যায়নি বা নষ্ট হয়নি। বিজ্ঞানীরা বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশেষে এ পানির অলৌকিকত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের ল্যাবরেটরী রিপোর্ট এই যে, এ পানিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম সল্টের আধিক্যের কারণেই পানকারী হাজীদের ক্লান্তি দূর হয়। অধিকহারে ফ্লোরাইড থাকার কারণে এ পানিতে কোন শেওলা ধরে না বা পোকা জন্মে না’। অথচ দেড় হাযার বছর আগেই নিরক্ষর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এ পানির উচ্চগুণ ও মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণনা করে গেছেন(দ্রঃ মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী ৪/৭ সংখ্যা, এপ্রিল ২০০১, পৃঃ ১৭-১৮)।

[37]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ, ইরওয়া হা/১১২৯।

[38].মুসলিম, নাসাঈ, আবুদাঊদ প্রভৃতি; ইরওয়া হা/১০৭৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৮২।

[39]. আবুদাঊদ, দারেমী, মিশকাত হা/২৫২৩।

[40]. আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৫২৯।

সফরের পূর্বে করণীয় (الأعمال قبل السفر)
১. (ক) নিজের হালাল মাল থেকে হজ্জ করা (খ) ঋণসমূহ পরিশোধ করা (গ) শরীকদের অংশ বুঝে দেওয়া (ঘ) পরিবারের জন্য অছিয়ত করা বা অছিয়তনামা লিপিবদ্ধ করা ও তাদের প্রতি তাক্বওয়ার উপদেশ দেওয়া (ঙ) খালেছ অন্তরে তওবা করা।

২. সফরের পূর্বে হাজী ছাহেবগণ যাতায়াত ব্যবস্থা ও মক্কা-মিনা-আরাফা-মুযদালিফা প্রভৃতি অবস্থান সম্পর্কে এবং হজ্জের আরকান-আহকাম ও যাবতীয় নিয়ম-কানূন ভালভাবে জেনে নিবেন। বিশেষ করে সফরের দো‘আ, ইহরামের দো‘আ ও ‘তালবিয়াহ’ ভালভাবে মুখস্ত করবেন। এতদ্ব্যতীত ইহরাম বাঁধা, ছালাত জমা ও ক্বছর করা, তায়াম্মুম করা, মোযা মাসাহ করা ইত্যাদি বিষয়গুলির বাস্তব প্রশিক্ষণ নিবেন।

তার জন্য বড় উপদেশ হ’ল এই যে, তাকে সফরের পক্ষকাল পূর্ব থেকে প্রতিদিন সকালে অন্ততঃ ৩ কিঃ মিঃ দ্রুত হেঁটে অথবা বাড়ীতে যোগ ব্যায়াম করে নিজেকে শক্ত ও কষ্টসহিষ্ণু করে নিতে হবে। যা সফরে তাকে বাড়তি শক্তি যোগাবে।

৩. সফরের জন্য যোগ্য, জ্ঞানী, নেককার ও সচেতন সাথী তালাশ করা। একাকী সফর করতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন।[1] সফরে তিন জন থাকলেও একজনকে ‘আমীর’ নিয়োগ করবেন।[2] সকলে সর্বাবস্থায় একত্রে থাকবেন ও একত্রে সব কাজ করবেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সফর অবস্থায় বিচ্ছিন্ন থাকা শয়তানী কাজ’।[3]

সফরের আদব ( آداب السفر ) :

১. বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় পড়বেন-

بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ وَلاَحَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ َبِاللهِ -

উচ্চারণ: বিসমিল্লা-হি তাওয়াক্কাল্তু ‘আলাল্লা-হি ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ’।

অর্থ: ‘আল্লাহর নামে (বের হচ্ছি), তাঁর উপরে ভরসা করছি। নেই কোন ক্ষমতা, নেই কোন শক্তি আল্লাহ ব্যতীত’।[4]

২. নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সকলের নিকট থেকে বিনম্রচিত্তে বিদায় নিবেন এবং পরস্পরের উদ্দেশ্যে নিম্নের দো‘আটি পাঠ করবেন,

أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِينَكُم وَأَمَانَتَكُمْ وَخَوَاتِيْمَ أَعْمَالِكُمْ -

উচ্চারণ: ‘আস্তাউদি‘উল্লা-হা দীনাকুম ওয়া আমা-নাতাকুম ওয়া খাওয়া-তীমা আ‘মা-লিকুম’।

অর্থ: ‘আমি আপনার দ্বীন, আপনার আমানত সমূহ ও আপনাদের শেষ আমল সমূহকে আল্লাহর যিম্মায় ন্যস্ত করলাম’।[5] এখানে ‘আমানতসমূহ’ অর্থ ‘ন্যস্ত দায়িত্ব সমূহ’ এবং ‘শেষ আমল’ অর্থ ‘মৃত্যুকালীন সুন্দর আমল ( حسن الخاةمة ) ’ (মিরক্বাত)।

‘কুম’ সর্বনামটি বহুবচনে এবং সম্মানী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তবে একবচনে ‘কুম’-এর স্থলে ‘কা’ বলা যাবে। পরস্পরে ডান হাত ধরে দো‘আটি পাঠ করে পরস্পরকে বিদায় দিবেন।[6]

৩. বিদায় দানকারীগণ তার জন্য উপরের দো‘আটি ছাড়াও নিম্নের দো‘আটিও পাঠ করবে-

زَوَّدَكَ اللهُ التَّقْوَى وَغَفَرَ ذَنْبَكَ وَيَسَّرَ لَكَ الْخَيْرَ حَيْثُ مَا كُنْتَ -

উচ্চারণ: যাউয়াদাকাল্লা-হুত্ তাক্বওয়া ওয়া গাফারা যাম্বাকা ওয়া ইয়াস্সারা লাকাল খায়রা হায়ছু মা কুন্তা’।

অর্থ: ‘আল্লাহ আপনাকে তাক্বওয়ার পুঁজি দান করুন! আপনার গোনাহ মাফ করুন এবং আপনি যেখানেই থাকুন আপনার জন্য কল্যাণকে সহজ করে দিন’।[7]

৪. অতঃপর গাড়ী বা বিমানের সিঁড়িতে পা দিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’, উঠার সময় ‘আল্লাহু আকবর’ এবং সীটে বসে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবেন। অতঃপর নামার সময় ‘সুবহা-নাল্লাহ’ বলবেন।[8]

পরিবহন চলতে শুরু করলে তিনবার আল্লাহু আকবর বলে নিম্নের দো‘আটি পাঠ করবেন-

سُبْحَانَ الَّذِىْ سَخَّرَلَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِيْنَ، وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ- اَللّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِىْ سَفَرِنَا هذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى، اَللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هذَا وَاطْوِ لَنَا بُعْدَهُ، اَللّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِى السَّفَرِ وَالْخَلِيْفَةُ فى الْأَهْلِ وَالْمَالِ، اَللّهُمَّ إِنِّىْ أَعُوْذُبِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوْءِ الْمُنْقَلَبِ فِى الْمَالِ وَالْأَهْلِ، رواه مسلم -

উচ্চারণ: সুবহা-নাল্লাযী সাখখারা লানা হা-যা ওয়া মা কুন্না লাহূ মুক্বরেনীনা; ওয়া ইন্না ইলা রব্বিনা লামুনক্বালিবূন। আল্লা-হুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফী সাফারিনা হা-যাল বির্রা ওয়াত তাক্বওয়া ওয়া মিনাল ‘আমালে মা তারযা; আল্লা-হুম্মা হাওভিন ‘আলাইনা সাফারানা হা-যা ওয়াত্বভে লানা বু‘দাহূ, আল্লা-হুম্মা আনতাছ ছা-হিবু ফিস সাফারি ওয়াল খালীফাতু ফিল আহ্লি ওয়াল মা-লি। আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন ওয়া‘ছা-ইস সাফারি ওয়া কাআ-বাতিল মানযারি ওয়া সূইল মুনক্বালাবি ফিল মা-লি ওয়াল আহ্লি’।

অর্থ: আল্লাহ সবার বড় (৩ বার)। ‘মহা পবিত্র সেই সত্তা যিনি এই বাহনকে আমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন। অথচ আমরা একে অনুগত করার ক্ষমতা রাখি না’। ‘আর আমরা সবাই আমাদের প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী’ (যুখরুফ ৪৩/১৩-১৪)। হে আল্লাহ! আমরা তোমার নিকটে আমাদের এই সফরে কল্যাণ ও তাক্বওয়া এবং এমন কাজ প্রার্থনা করি, যা তুমি পসন্দ কর। হে আল্লাহ! আমাদের উপরে এই সফরকে সহজ করে দাও এবং এর দূরত্ব কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তুমি এই সফরে আমাদের একমাত্র সাথী এবং আমাদের পরিবারে ও মাল-সম্পদে তুমি আমাদের একমাত্র প্রতিনিধি। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে পানাহ চাই সফরের কষ্ট ও খারাব দৃশ্য হ’তে এবং আমাদের মাল-সম্পদে ও পরিবারের নিকটে মন্দ প্রত্যাবর্তন হ’তে’।[9]

৫. গন্তব্যস্থলে অবতরণ করে পড়বেন-

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ -

উচ্চারণ: আ‘ঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মা-তি মিন শার্রি মা খালাক্ব’।

অর্থ: আল্লাহর সৃষ্টবস্ত্ত সমূহের অনিষ্টকারিতা হ’তে আমি তাঁর পূর্ণ কালেমা সমূহের মাধ্যমে পানাহ চাচ্ছি’।[10]

৬. বায়তুল্লাহ থেকে বেরিয়ে দেশে ফেরার সময় তিনবার ‘আল্লা-হু আকবার’ বলবেন। অতঃপর নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়বেন-

لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَشَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، آيِبُوْنَ تَائِبُوْنَ عَابِدُوْنَ سَاجِدُوْنَ لِرَبِّنَا حَامِدُوْنَ، صَدَقَ اللهُ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ، متفق عليه -

উচ্চারণ : লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু; লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লে শাইয়িন ক্বাদীর; আ-য়িবূনা তা-ইবূনা ‘আ-বিদূনা সা-জিদূনা লি রবিবনা হা-মিদূনা; ছাদাক্বাল্লা-হু ওয়া‘দাহু ওয়া নাছারা ‘আবদাহু ওয়া হাযামাল আহযা-বা ওয়াহদাহু।

অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সমস্ত রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা এবং তিনিই সকল বস্ত্তর উপরে ক্ষমতাবান। আমরা সফর হ’তে প্রত্যাবর্তন করছি তওবাকারী হিসাবে, ইবাদতকারী হিসাবে, সিজদাকারী হিসাবে এবং আমাদের প্রভুর জন্য প্রশংসাকারী হিসাবে। আল্লাহ সত্যে পরিণত করেছেন তাঁর প্রতিশ্রুতিকে, জয়ী করেছেন তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)-কে এবং পরাজিত করেছেন একাই সম্মিলিত (কুফরী) শক্তিকে’।[11]

৭. নিজ গৃহে প্রবেশকালীন দো‘আ : প্রথমে ‘বিসমিল্লাহ’ বলবেন। অতঃপর গৃহবাসীর উদ্দেশ্যে সালাম দিবেন।[12]

[1]. বুখারী ফৎহ সহ হা/২৯৯৮; ৬/১৬০।

[2]. আবূদাঊদ হা/২৬০৮; ঐ ছহীহ, হা/২২৭২।

[3]. আবুদাঊদ হা/২২৮৮; মিশকাত হা/৩৯১৪।

[4]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২৪৪৩।

[5]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/২২৬৬, ২২৬৫; মিশকাত হা/২৪৩৬।

[6]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৪৩৫।

[7]. ছহীহ তিরমিযী হা/২৭৩৯; মিশকাত হা/২৪৩৭।

[8]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৪৩৪; বুখারী, মিশকাত হা/২৪৫৩।

[9]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৪২০।

[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৪২২।

[11]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৪২৫।

[12]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৬১; নূর ২৪/৬১।

হজ্জের প্রকারভেদ (أنواع الحج)
হজ্জ তিন প্রকার। তামাত্তু, ক্বিরান ও ইফরাদ। এর মধ্যে ‘তামাত্তু’ সর্বোত্তম। যদিও মুশরিকরা একে হজ্জের পবিত্রতা বিরোধী বলে মনে করত এবং হীন কাজ ভাবতো।

(১) হজ্জে তামাত্তু ( الحج التمتع ) : হজ্জের মাসে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ ও ছাফা-মারওয়ার সাঈ শেষে মাথা মুন্ডন করে বা চুল ছেঁটে হালাল হওয়ার মাধ্যমে প্রথমে ওমরাহর কাজ সম্পন্ন করা। অতঃপর ৮ই যিলহজ্জ তারিখে স্বীয় অবস্থানস্থল হ’তে হজ্জের ইহরাম বেঁধে পূর্বাহ্নে মিনায় গমন করা। অতঃপর ৯ই যিলহাজ্জ আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান ও মুযদালিফায় রাত্রি যাপন শেষে ১০ই যিলহাজ্জ সকালে মিনায় প্রত্যাবর্তন করে বড় জামরায় ৭টি কংকর মেরে কুরবানী ও মাথা মুন্ডন শেষে প্রাথমিক হালাল হওয়া। অতঃপর মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ ও সাঈ শেষে পূর্ণ হালাল হওয়া। অতঃপর মিনায় ফিরে সেখানে অবস্থান করে ১১, ১২, ১৩ তিনদিন তিন জামরায় প্রতিদিন ৩´৭=২১টি করে কংকর নিক্ষেপ শেষে মক্কায় ফিরে বিদায়ী ত্বাওয়াফ সেরে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া।

² উল্লেখ্য যে, তামাত্তু হজ্জ কেবলমাত্র হারাম বা মীক্বাতের বাইরের লোকদের জন্য, ভিতরকার লোকদের জন্য নয় (বাক্বারাহ ২/১৯৬)।

(২) হজ্জে ক্বিরান ( الحج القِرَان ) : এটি দু’ভাবে হ’তে পারে- (ক) একই সাথে ওমরাহ ও হজ্জের ইহরাম বাঁধা (খ) প্রথমে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে অতঃপর ওমরাহর ত্বাওয়াফ শুরুর পূর্বে হজ্জের নিয়ত ওমরাহর সঙ্গে শামিল করা।

এই হজ্জের নিয়তকারীগণ যথারীতি ত্বাওয়াফ ও সাঈ শেষে আরাফা-মুযদালিফায় হজ্জের মূল আনুষ্ঠানিকতা সমূহ সেরে মিনায় এসে বড় জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করে কুরবানী ও মাথা মুন্ডন শেষে প্রাথমিক হালাল হবেন। অতঃপর মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ শেষে পূর্ণ হালাল হবেন। অতঃপর মিনায় ফিরে গিয়ে তিনদিন সেখানে অবস্থান করে কংকর মেরে মক্কায় এসে বিদায়ী ত্বাওয়াফ শেষে বাড়ী ফিরবেন।

বিদায় হজ্জে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজে ক্বিরান হজ্জ করেছিলেন। কিন্তু যাদের সঙ্গে কুরবানী ছিল না, তাদেরকে তিনি তামাত্তু হজ্জ করার আদেশ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, এখন যেটা বুঝছি সেটা আগে বুঝতে পারলে আমি কুরবানী সাথে আনতাম না। বরং তোমাদের সাথে ওমরাহ করে হালাল হয়ে যেতাম (অর্থাৎ তামাত্তু হজ্জ করতাম)।[1]

যদি ক্বিরান হজ্জকারীগণ ত্বাওয়াফ ও সাঈ শেষে মাথার চুল ছেঁটে হালাল হয়ে যান, তবে সেটা ‘ওমরাহ’ হবে এবং তিনি তখন ‘তামাত্তু’ হজ্জ করবেন।

(৩) হজ্জে ইফরাদ ( الحج الإفراد ) : শুধু হজ্জের নিয়তে ইহরাম বাঁধা এবং যথারীতি ত্বাওয়াফ, সাঈ ও হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা সমূহ শেষ করে হালাল হওয়া।

হজ্জে ক্বিরান ও ইফরাদের একই নিয়ম। পার্থক্য শুধু এই যে, হজ্জে ক্বিরানে ‘হাদ্ই’ বা পশু কুরবানী প্রয়োজন হবে। কিন্তু হজ্জে ইফরাদে কুরবানীর প্রয়োজন নেই।

হজ্জ-এর রুকন সমূহ ( أركان الحج )৪টি :

(১) ইহরাম বাঁধা (২) আরাফা ময়দানে অবস্থান করা (৩) ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করা (৪) ছাফা-মারওয়ায় সাঈ করা।

হজ্জ-এর ওয়াজিব সমূহ ( واجبات الحج ) ৭টি :

(১) মীক্বাত হ’তে ইহরাম বাঁধা (২) আরাফা ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা (৩) মুযদালিফায় রাত্রি যাপন করা (৪) আইয়ামে তাশরীক্বের রাত্রিগুলি মিনায় অতিবাহিত করা (৫) ১০ তারিখে জামরাতুল আক্বাবায় ও ১১, ১২, ১৩ তারিখে তিন জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা (৬) মাথা মুন্ডন করা অথবা সমস্ত মাথার চুল ছোট করা (৭) বিদায়ী ত্বাওয়াফ করা।

ফিদ্ইয়া ( الفدية ) :

‘রুকন’ তরক করলে হজ্জ বিনষ্ট হয়। ‘ওয়াজিব’ তরক করলে ‘ফিদ্ইয়া’ ওয়াজিব হয়। এজন্য একটি বকরী কুরবানী দিবে অথবা ৬ জন মিসকীনকে তিন ছা‘ খাদ্য দিবে অথবা তিনটি ছিয়াম পালন করবে’।[2] পক্ষান্তরে তামাত্তু হজ্জের হাদ্ই বা কুরবানী তরক করলে তাকে ১০টি ছিয়াম পালন করতে হয়। ৩টি হজ্জের মধ্যে এবং ৭টি বাড়ী ফিরে’ (বাক্বারাহ ১৯৬)। আইয়ামে তাশরীক্ব অর্থাৎ ১১,১২,১৩ই যিলহাজ্জ তারিখে সাধারণভাবে ছিয়াম নিষিদ্ধ হ’লেও এসময় ফিদইয়ার তিনটি ছিয়াম রাখা যায়।[3]

[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫ ‘বিদায় হজ্জ’ অনুচ্ছেদ।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৮৮; ইরওয়া হা/১১০০, ৪/২৯৯; ক্বাহত্বানী পৃঃ ৬৪-৬৫।

[3]. বুখারী হা/১৯৯৭-৯৮ আয়েশা ও ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে।

ওমরাহর রুকন (أركان العمرة)
ওমরাহর রুকন ( أركان العمرة ) ৩টি :

ইহরাম বাঁধা, ত্বাওয়াফ করা ও সাঈ করা।

ওমরাহর ওয়াজিব ( واجباة العمرة ) ২টি : মীক্বাত হ’তে ইহরাম বাঁধা এবং মাথা মুন্ডন করা অথবা মাথার সমস্ত চুল ছোট করা।

উল্লেখ্য যে, অনেক হাজী ছাহেব মাসজিদুল হারাম হ’তে ৬ কিঃমিঃ উত্তরে ‘মসজিদে আয়েশা’ বা তান‘ঈম মসজিদ থেকে, আবার কেউ ১৬ কিঃমিঃ পূর্বে জি‘ইর্রা-নাহ মসজিদ হ’তে ইহরাম বেঁধে বার বার ওমরাহ করে থাকেন। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কাজ। এ দুই মসজিদের পৃথক কোন গুরুত্ব নেই। এসব স্থান থেকে মক্কায় বসবাসকারীগণ ওমরাহর জন্য ইহরাম বেঁধে থাকেন, মক্কার বাইরের লোকেরা নন।

মীক্বাত (مواقيت الحج)
মীক্বাত ( مواقيت الحج ) : ইহরাম বাঁধার স্থানকে ‘মীক্বাত’ বলা হয়। মীক্বাত পাঁচটি :(১) মদীনা বাসীদের জন্য ‘যুল হুলাইফা’ যা মদীনা থেকে প্রায় ১০ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে এবং মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে ৪৫০ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত (২) শাম বা সিরিয়া বাসীদের জন্য ‘জুহ্ফা’ যা মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে ১৮৩ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত। বর্তমানে এর নিকটবর্তী ‘রাবেগ’ নামক স্থান থেকে ইহরাম বাঁধা হয় (৩) ইরাক বাসীদের জন্য ‘যাতু ‘ইর্ক্ব’ যা মক্কা থেকে সোজা উত্তরে ৯৪ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত (৪) নাজ্দ বাসীদের জন্য ‘ক্বারনুল মানাযিল’ যা মক্কা থেকে উত্তর-পূর্বে ৭৫ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত। যাকে এখন ‘আস-সায়লুল কাবীর’ বলা হয় (৫) পাক-ভারত উপমহাদেশ ও ইয়ামন বাসীদের জন্য ইয়ালামলাম পাহাড়। যা মক্কা থেকে সোজা দক্ষিণে ৯২ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত। যার নিকটবর্তী ‘আস-সা‘দিয়াহ’ থেকে এখন ইহরাম বাঁধা হচ্ছে। জেদ্দা হ’তে উত্তরে মক্কা অভিমুখী আল-লাইছ সড়কে অবস্থিত এই স্থানে বর্তমানে ‘মীক্বাত মসজিদ’ স্থাপিত হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, মক্কা থেকে জেদ্দা ৭৩ কিঃমিঃ দক্ষিণে এবং নিকটবর্তী ‘ইয়ালামলাম’ মীক্বাতের মধ্যে অবস্থিত। তাই এখানকার অধিবাসীগণ এখান থেকেই ইহরাম বাঁধবেন।

‘যারা এইসব মীক্বাত এলাকার অধিবাসী অথবা যারা এগুলি অতিক্রম করেন, তারা হজ্জ বা ওমরাহর জন্য এসব স্থান থেকে ইহরাম বাঁধবেন। কিন্তু যারা এসব মীক্বাত-এর অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে বসবাস করেন, তারা স্ব স্ব অবস্থান থেকে ইহরাম বাঁধবেন। একইভাবে মক্কাবাসীগণ মক্কা থেকে ইহরাম বাঁধবেন’।[1]

জ্ঞাতব্য : (১) মক্কায় অবস্থানকারীগণ হজ্জের ইহরাম স্ব স্ব অবস্থান থেকে বাঁধবেন। কিন্তু ওমরাহর ইহরাম বাঁধার জন্য তাঁরা হারাম এলাকার বাইরে যাবেন ও সেখান থেকে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে আসবেন। এজন্য সবচেয়ে নিকটবর্তী হ’ল ৬ কিঃমিঃ উত্তরে ‘তান‘ঈম’ এলাকা। বিদায় হজ্জের সময় ওমরাহর ইহরাম বাঁধার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আয়েশা (রাঃ)-কে তার ভাই আব্দুর রহমানের সাথে এখানে পাঠিয়েছিলেন।[2]

(২) মদীনা থেকে মক্কায় হজ্জ বা ওমরাহর জন্য আসতে গেলে মদীনা হ’তে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ‘যুল হুলাইফা’ থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। স্থানটি বর্তমানে মসজিদ ও গোসলখানা দ্বারা সুশোভিত। ‘হুলাইফা’ বনু জাশাম গোত্রের একটি কুয়ার নাম। অথচ এটি বিদ‘আতীদের মাধ্যমে ‘আবইয়ারে আলী’ বা ‘আবারে আলী’ অর্থাৎ আলীর কুয়া সমূহ নামে পরিচিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, আলী (রাঃ) জিন হত্যা করে উক্ত কুয়ায় নিক্ষেপ করেছিলেন।[3] এগুলি অতিভক্তদের ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী মাত্র।

(৩) যদি কেউ ভুলক্রমে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মীক্বাত অতিক্রম করেন ও অন্যত্রে ইহরাম বাঁধেন, তাতে তিনি মাফ পাবেন। কিন্তু আলস্য বশে করলে তার উপর ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি বকরী কুরবানী ওয়াজিব হবে। যা তিনি মক্কায় গিয়ে যবহ করে ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করে দিবেন। যদি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে মীক্বাত অতিক্রম করেন, তাহ’লে তাকে ফিরে এসে পুনরায় মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে।

(৪) যদি কোন বিমান বা পরিবহন তাকে মীক্বাতের সংকেত দিবে না বলে আশংকা হয়, তাহ’লে বিমানে ওঠার আগেও ইহরাম বাঁধতে পারবেন। তবে এযুগে সময়ের হিসাব জানা খুবই সহজ। অতএব ঢাকা থেকে জেদ্দায় বিমান অবতরণের আধা ঘণ্টা আগে বিমানেই ইহরাম বেঁধে নিবেন।

(৫) যদি অন্য উদ্দেশ্যে কেউ মক্কায় এসে থাকেন, অতঃপর হজ্জ বা ওমরাহ করতে চান, তাহ’লে হারামের বাইরে তান‘ঈম বা জি‘ইর্রানাহ প্রভৃতি এলাকায় গিয়ে তিনি ইহরাম বেঁধে আসবেন।

ইহরাম বাঁধার নিয়ম ( طريقة الإحرام ) :

(১) ইহরামের পূর্বে ওযূ বা গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম। তবে শর্ত নয়। মহিলাগণ নাপাক অবস্থাতেও ইহরাম বাঁধতে পারবেন (২) পুরুষদের জন্য সাদা সেলাই বিহীন লুঙ্গী ও চাদর পরিধান করা। মহিলাদের জন্য যেকোন ধরনের শালীন পোষাক পরিধান করা, যা পুরুষদের পোষাকের সদৃশ নয়। (৩) দেহে সুগন্ধি ব্যবহার করা। তবে পোষাকে নয়।

যে কোন ফরয ছালাতের পরে কিংবা ‘তাহিইয়াতুল ওযূ’ দু’রাক‘আত নফল ছালাতের পরে ইহরাম বাঁধা চলে। তবে ইহরাম বাঁধার সাথে ছালাতের কোন সম্পর্ক নেই।[4]

المحرمات في حالة الإحرام

ইহরামের পর নিষিদ্ধ বিষয় সমূহ

হজ্জ ও ওমরাহর ইহরাম ছালাতে তাকবীরে তাহরীমার ন্যায়। ফলে ইহরাম বাঁধার পর মুহরিমের জন্য অনেকগুলি বিষয় নিষিদ্ধ থাকে। যেমন (১) সুগন্ধি ব্যবহার করা (২) স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের জন্যই মাথার চুল এবং যে কোন উপায়ে শরীরের যে কোন স্থানের পশম উঠানো ও হাত-পায়ের নখ কাটা (৩) পশু-পক্ষী বা যেকোন প্রাণী শিকার করা। এমনকি শিকার ধরতে ইশারা-ইঙ্গিতে সহযোগিতা করা। তবে ক্ষতিকর জীবজন্তু যেমন সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর, ক্ষ্যাপা কুকুর, মশা, উকুন ইত্যাদি মারার অনুমতি রয়েছে[5] (৪) যাবতীয় যৌনাচার, বিবাহের প্রস্তাব, বিবাহের আক্বদ বা যৌন আলোচনা করা (৫) পুরুষের জন্য পাগড়ী, টুপী ও রুমাল ব্যবহার করা। তবে প্রচন্ড গরমে ছায়ার জন্য বা বৃষ্টিতে ছাতা বা ঐরূপ কিছু ব্যবহার করায় দোষ নেই (৬) পুরুষের জন্য কোন প্রকারের সেলাই করা কাপড় যেমন জুববা, পাঞ্জাবী, শার্ট, গেঞ্জি, মোযা ইত্যাদি পরিধান করা। তবে তালি লাগানো ইহরামের কাপড় পরায় দোষ নেই (৭) মহিলাদের জন্য মুখাচ্ছাদন ও হাত মোযা ব্যবহার করা। তবে পর পুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব (৮) ঝগড়া-বিবাদ করা এবং শরী‘আত বিরোধী কোন বাজে কথা বলা ও বাজে কাজ করা।

উপরোক্ত কাজগুলির মধ্যে কেবল যৌনমিলনের ফলেই ইহরাম বাতিল হবে। বাকীগুলির জন্য ইহরাম বাতিল হবে না। তবে ফিদইয়া ওয়াজিব হবে। অবশ্য যদি ভুলে কিংবা অজ্ঞতাবশে কিংবা বাধ্যগত কারণে অথবা ঘুম অবস্থায় কেউ কিছু করে ফেলে, তাতে কোন গোনাহ নেই বা ফিদ্ইয়া নেই।

² উপরোক্ত নিষিদ্ধ বিষয় সমূহের উদ্দেশ্য হ’ল মুহরিমকে দুনিয়াবী সাজ-সজ্জা থেকে মুক্ত হ’য়ে পুরাপুরি আল্লাহমুখী করা। পুরুষের জন্য সেলাই বিহীন কাপড় পরিধানের উদ্দেশ্য হ’ল সকল জৌলুস ও প্রদর্শনী থেকে মুক্ত হ’য়ে আল্লাহর জন্য খালেছ ও নিবেদিতপ্রাণ হওয়া।

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫১৬, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে। মীক্বাত-এর উদ্দেশ্য: হজ্জে আগত দূরদেশীগণ যাতে দূরের সফর থেকে এসে মীক্বাত থেকে ইহরাম বেঁধে নতুন উদ্যম নিয়ে মক্কায় উপস্থিত হ’তে পারেন। তবে মদীনাবাসীদের জন্য মীক্বাত সবচেয়ে দূরে হবার কারণ সম্ভবতঃ এই যে, ইসলাম গ্রহণে এবং তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় মদীনাবাসীদের আগ্রহ, অবদান ও মর্যাদা সবার উপরে। এটি শেষনবী (ছাঃ)-এর হিজরতের স্থান ও প্রথম জনপদ যারা ঈমান এনেছিল। ক্বিয়ামতের পূর্বে সারা বিশ্ব থেকে ঈমান গুটিয়ে মদীনায় আশ্রয় নিবে। তাদের ঈমানী জাযবা অন্য সবার চেয়ে বেশী ছিল এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ। তাই তাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় দূর থেকে মক্কায় আসা কষ্টকর হবে না।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৫৬, ২৬৬৭।

[3]. মিরক্বাত ৫/২৬৯ পৃঃ।

[4]. শায়খ আবদুল্লাহ বিন জাসের, আহকামুল হজ্জ (রিয়াদ: ৩য় সংস্করণ ১৪১২/১৯৯২) পৃঃ ৭০-৭৫।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৯৮-৯৯।

ওমরাহ ও তামাত্তু হজ্জের নিয়মাবলী ও প্রয়োজনীয় দো‘আ সমূহ
১. ওমরাহ ও তামাত্তু হজ্জ ( العمرة والحج التمتع ) :

বাংলাদেশী হাজীগণ সাধারণতঃ তামাত্তু হজ্জ করে থাকেন। ঢাকা হ’তে জেদ্দা পৌঁছতে বিমানে সাধারণতঃ সাড়ে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে। তামাত্তু হাজীগণ জেদ্দা অবতরণের অন্ততঃ আধা ঘন্টা পূর্বে বিমানের দেওয়া মীক্বাত বরাবর পৌঁছবার ঘোষণা ও সবুজ সংকেত দানের পরপরই ওযূ শেষে ওমরাহর জন্য ইহরামের কাপড় পরিধান করে (১) নিম্নোক্ত দো‘আ পড়বেন, لَبَّيْكَ عُمْرَةً ‘লাববায়েক ‘ওমরাতান’ (আমি ওমরাহর জন্য হাযির)। অতঃপর ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করতে থাকবেন। অথবা (২) أَللّهُمَّ لَبَّيْكَ عُمْرَةً ‘আল্লা-হুম্মা লাববায়েক ওমরাতান’ (হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর জন্য হাযির)। অথবা (৩) لَبَّيْكَ أَللَّهُمَّ عُمْرَةً مُتَمَتِّعًا بِهَا إِلَى الْحَجَّ فَيَسِّرْهَا لِىْ وَتَقَبَّلْهَا مِنِّىْ ‘লাববায়েক আললা-হুম্মা ‘ওমরাতাম মুতামাত্তি‘আন বিহা ইলাল হাজ্জি; ফাইয়াসসিরহা লী ওয়া তাক্বাববালহা মিন্নী’।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর জন্য হাযির, হজ্জের উদ্দেশ্যে উপকার লাভকারী হিসাবে। অতএব তুমি আমার জন্য ওমরাহকে সহজ করে দাও এবং আমার পক্ষ হ’তে তা কবুল করে নাও’।

(৪) যারা একই ইহরামে ওমরাহ ও হজ্জ দু’টিই করবেন, তারা বলবেন, لَبَّيْكَ أَللَّهُمَّ عُمْرَةً وَحَجَّا ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা ‘ওমরাতান ওয়া হাজ্জান’। (৫) যারা কেবলমাত্র হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন, তারা বলবেন لَبَّيْكَ أَللَّهُمَّ حَجَّا ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা হাজ্জান’।

(৬) কিন্তু যারা পথিমধ্যে অসুখের কারণে বা অন্য কোন কারণে হজ্জ আদায় করতে পারবেন না বলে আশংকা করবেন, তারা ‘লাববায়েক ওমরাতান’ অথবা ‘লাববায়েক হাজ্জান’ বলার পর নিম্নোক্ত শর্তাধীন দো‘আ পড়বেন-

فَإِنْ حَبَسَنِىْ حَابِسٌ فَمَحَلِّيْ حَيْثُ حَـــــتَنِىْ ‘ফাইন হাবাসানী হা-বিসুন, ফা মাহাল্লী হায়ছু হাবাসতানী’।

অর্থ: ‘যদি (আমার হজ্জ বা ওমরাহ পালনে) কোন কিছু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহ’লে যেখানে তুমি আমাকে বাধা দিবে (হে আল্লাহ!), সেখানেই আমার হালাল হওয়ার স্থান হবে’।[1]

(৭) যারা কারু পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ করবেন, তারা তাদের মুওয়াক্কিল পুরুষ হ’লে মনে মনে তার নিয়ত করে বলবেন, لَبَّيْكَ عَنْ فُلاَنٍ ‘লাববায়েক ‘আন ফুলান’ (অমুকের পক্ষ হ’তে আমি হাযির)। আর মহিলা হ’লে বলবেন, ‘লাববায়েক ‘আন ফুলা-নাহ’। যদি ‘আন ফুলান বা ফুলা-নাহ বলতে ভুলে যান, তাতেও অসুবিধা নেই। নিয়তের উপরেই আমল কবুল হবে ইনশাআল্লাহ।

(৮) সঙ্গে নাবালক ছেলে বা মেয়ে থাকলে (তাদেরকে ওযূ করিয়ে ইহরাম বাঁধিয়ে) তাদের পক্ষ থেকে তাদের অভিভাবক মনে মনে তাদের নিয়ত করে উপরোক্ত দো‘আ পড়বেন।[2]

(৯) যদি কেউ ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করতেও ভুলে যান, তাহ’লে তিনি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইবেন এবং ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করবেন। এজন্য তাকে কোন ফিদ্ইয়া দিতে হবে না।

(১০) বাংলাদেশী হাজীগণ যদি মদীনা হয়ে মক্কায় যান, তাহ’লে মদীনায় নেমে ‘যুল-হুলাইফা’ থেকে ইহরাম বাঁধবেন, তার আগে নয়। কেননা জেদ্দা হয়ে তিনি মদীনায় এসেছেন সাধারণ মুসাফির হিসাবে মসজিদে নববীতে ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে, হজ্জের উদ্দেশ্যে নয়। আর মসজিদে নববীতে ছালাত আদায় করা হজ্জের কোন অংশ নয়।

২. তালবিয়াহ ( الةلبية ) :

ইহরাম বাঁধার পর থেকে মাসজিদুল হারামে পৌঁছা পর্যন্ত ইহরামের কারণে নিষিদ্ধ বস্ত্ত সমূহ হ’তে বিরত থাকবেন এবং হালাল হওয়ার আগ পর্যন্ত সর্বদা সরবে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়বেন, যাকে ‘তালবিয়াহ’ বলা হয়। পুরুষগণ সরবে[3] ও মহিলাগণ নিম্নস্বরে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করবেন।-

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَشَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَشَرِيْكَ لَكَ -

উচ্চারণ: ‘লাববাইকা আল্লা-হুম্মা লাববায়েক, লাববাইকা লা শারীকা লাকা লাববায়েক; ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক; লা শারীকা লাক’।

অর্থ: ‘আমি হাযির হে আল্লাহ আমি হাযির। আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাযির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সাম্রাজ্য সবই তোমার; তোমার কোন শরীক নেই’।

উল্লেখ্য যে, জাহেলী যুগে আরবরা ত্বাওয়াফ কালে নিম্নোক্ত শিরকী তালবিয়াহ পাঠ করত।- লাববাইকা লা শারীকা লাকা, ইল্লা শারীকান হুয়া লাক; তামলিকুহু ওয়া মা মালাক’ (আমি হাযির; তোমার কোন শরীক নেই, কেবল ঐ শরীক যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং যা কিছুর সে মালিক’)। মুশরিকরা ‘লাববাইকা লা শারীকা লাকা’ বলার পর রাসূল (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে ক্বাদ ক্বাদ (থামো থামো, আর বেড়োনা) বলতেন।[4] বস্ত্তত: ইসলাম এসে উক্ত শিরকী তালবিয়াহ পরিবর্তন করে পূর্বে বর্ণিত নির্ভেজাল তাওহীদ ভিত্তিক তালবিয়াহ প্রবর্তন করে। যার অতিরিক্ত কোন শব্দ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেননি’।[5]

‘তালবিয়া’ পাঠ শেষে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত কামনা করে এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য ছহীহ হাদীছে বর্ণিত দো‘আ সমূহ পাঠ করা যাবে। যেমন ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল জান্নাহ, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিনান্না-র’ (হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে জান্নাত প্রার্থনা করছি ও জাহান্নাম থেকে পানাহ চাচ্ছি)।[6] অথবা বলবে ‘রবেব ক্বিনী ‘আযা-বাকা ইয়াওমা তাব‘আছু ‘ইবা-দাকা’। ‘হে আমার প্রতিপালক! তোমার আযাব হ’তে আমাকে বাঁচাও! যেদিন তোমার বান্দাদের তুমি পুনরুত্থান ঘটাবে’।[7]

নিয়ত ( النية ) : মনে মনে ওমরাহ বা হজ্জের সংকল্প করা ও তালবিয়াহ পাঠ করাই যথেষ্ট। মুখে ‘নাওয়াইতুল ওমরাতা’ বা ‘নাওয়াইতুল হাজ্জা’ বলা বিদ‘আত।[8] উল্লেখ্য যে, হজ্জ বা ওমরাহর জন্য ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করা ব্যতীত অন্য কোন ইবাদতের জন্য মুখে নিয়ত পাঠের কোন দলীল নেই।

ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কোন মুসলমান যখন ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করে, তখন তার ডাইনে-বামে, পূর্বে-পশ্চিমে তার ধ্বনির শেষ সীমা পর্যন্ত কংকর, গাছ ও মাটির ঢেলা সবকিছু তার সাথে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করে’।[9] ত্বীবী বলেন, অর্থাৎ যমীনে যা কিছু আছে, সবই তার তালবিয়াহর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।

৩. মাসজিদুল হারামে প্রবেশের দো‘আ : কা‘বা গৃহ দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র ইচ্ছা করলে দু’হাত উঁচু করে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে যেকোন দো‘আ অথবা নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়া যায়, যা ওমর (রাঃ) পড়েছিলেন। اَللُّهُمَّ اَنْتَ السَّلاَمُ وَمِنْكَ السَّلاَمُ فَحَيِّنَا رَبَّنَا بِالسَّلاَمِ - ফাহাইয়েনা রববানা বিস সালাম’ শান্তির সাথে বাঁচিয়ে রাখো!’)।[10] অতঃপর মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করার সময় প্রথমে ডান পা রেখে নিম্নের দো‘আটি পড়বেন।-

اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وسَلِّمْ، اَللَّهُمَّ افْتَحْ لِىْ أَبْوَابَ رَحَمَتِكَ -

(১) আল্লা-হুম্মা ছাল্লে ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া সাল্লেম; আল্লা-হুম্মাফতাহলী আবওয়াবা রহমাতিকা’ (হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ-এর উপর অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষণ কর। হে আল্লাহ তুমি আমার জন্য তোমার অনুগ্রহের দরজা সমূহ খুলে দাও!’)।[11]

(২) অথবা বলবেন,

أَعُوْذُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيْمِ وَبِسُلْطَانِهِ الْقَدِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ -

আ‘ঊযু বিল্লা-হিল ‘আযীম, ওয়া বিওয়াজহিহিল কারীম, ওয়া বিসুলত্বা-নিহিল ক্বাদীমি মিনাশ শায়ত্বা-নির রজীম’ (‘আমি মহীয়ান ও গরীয়ান আল্লাহ এবং তাঁর মহান চেহারা ও চিরন্তন কর্তৃত্বের আশ্রয় প্রার্থনা করছি বিতাড়িত শয়তান হ’তে’।

এই দো‘আ পাঠ করলে শয়তান বলে, লোকটি সারা দিন আমার থেকে নিরাপদ হয়ে গেল’।[12] দু’টি দো‘আ একত্রে পড়ায় কোন দোষ নেই। বস্ত্ততঃ এ দো‘আ মসজিদে নববীসহ যেকোন মসজিদে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

মসজিদ থেকে বের হওয়ার দো‘আ:

প্রথমে বাম পা রেখে বলবেন, اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَ سَلِّمْ، اَللَّهُمَّ إِنِّى أَسْئَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ ‘আল্লা-হুম্মা ছাল্লে ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া সাল্লেম; আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা মিন ফাযলিকা’ (হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ-এর উপর অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষণ কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি’)।

(২) অথবা বলবেন, اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَ سَلِّمْ، اَللَّهُمَّ اعْصِمْنِىْ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمَ ‘আল্লা-হুম্মা ছাল্লে ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া সাল্লেম; আল্লা-হুম্মা‘ছিমনী মিনাশ শায়ত্বা-নির রজীম’ নিরাপদ রাখো’)।[13] ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

৪. ত্বাওয়াফ ( الطواف ) :

‘ত্বাওয়াফ’ অর্থ প্রদক্ষিণ করা। পারিভাষিক অর্থে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ করাকে ত্বাওয়াফ বলে। অন্য কোন গৃহ প্রদক্ষিণ করাকে ত্বাওয়াফ বলা সিদ্ধ নয়। হাজারে আসওয়াদের নিকটবর্তী বনু শায়বাহ গেইট দিয়ে অথবা অন্য যেকোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ওযূ অবস্থায় সোজা মাত্বাফে গিয়ে কা‘বার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত ‘হাজারে আসওয়াদ’ (কালো পাথর) বরাবর সবুজ বাতির নীচ থেকে কা‘বা গৃহকে বামে রেখে ত্বাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) শুরু করবেন। একে ‘ত্বাওয়াফে কুদূম’ বা আগমনী ত্বাওয়াফ বলে।

উল্লেখ্য যে, ত্বাওয়াফ হ’ল ছালাতের ন্যায়। এসময় চুপে চুপে দো‘আসমূহ পড়তে হয়। তবে এখানে বাধ্যগত অবস্থায় কল্যাণকর সামান্য কথা বলার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন।[14] ওযূ অবস্থায় ত্বাওয়াফ শুরু করতে হবে। তবে মাঝখানে ওযূ টুটে গেলে এবং ভিড়ের কারণে ওযূ করা কষ্টকর হ’লে ঐ অবস্থায় ত্বাওয়াফ শেষ করবেন।[15] পুনরায় ক্বাযা করতে হবে না। এরূপ অবস্থায় শেষের দু’রাক‘আত নফল ছালাত পুনরায় ওযূ করে হারামের যেকোন স্থানে পড়ে নিবেন। ত্বাওয়াফের মধ্যে মেয়েদের ঋতু শুরু হ’লে ত্বাওয়াফ ছেড়ে দিবেন এবং বাকী অন্যান্য কাজসমূহ করবেন। উল্লেখ্য যে, সাঈর জন্য ওযূ শর্ত নয়, তবে মুস্তাহাব।

এই ত্বাওয়াফের সময় পুরুষেরা ‘ইযত্বিবা’ করবেন। অর্থাৎ ডান বগলের নীচ দিয়ে ইহরামের কাপড় বাম কাঁধের উপরে উঠিয়ে রাখবেন ও ডান কাঁধ খোলা রাখবেন। তবে অন্যান্য ত্বাওয়াফ যেমন ত্বাওয়াফে ইফাযাহ, ত্বাওয়াফে বিদা‘ ইত্যাদির সময় এবং ছালাতের সময় সহ অন্য সকল অবস্থায় মুহরিম তার উভয় কাঁধ ঢেকে রাখবেন। হাজারে আসওয়াদ থেকে প্রতিটি ত্বাওয়াফ শুরু হবে ও সেখানে এসেই শেষ হবে।

ত্বাওয়াফের শুরুতে ‘হাজারে আসওয়াদ’-এর দিকে হাত ইশারা করে বলবেন, بِِسْـمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবর’ (আল্লাহর নামে শুরু করছি এবং আল্লাহ সবার বড়)। অথবা শুধু ‘আল্লাহু আকবর’ বলবেন।[16] এভাবে যখনই হাজারে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছবেন, তখনই ডান হাতে ইশারা দিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলবেন। ভিড় কম থাকার সুযোগ নেই। তবুও সুযোগ পেলে অন্ততঃ ত্বাওয়াফের শুরুতে এবং শেষে ‘হাজারে আসওয়াদ’ চুম্বন করার সুন্নাত আদায় করবেন।

মোট ৭টি ত্বাওয়াফ হবে। প্রথম তিনটি ত্বাওয়াফে ‘রমল’[17] বা একটু জোরে চলতে হবে এবং শেষের চার ত্বাওয়াফে স্বাভাবিক গতিতে চলবেন। মহিলাগণ সর্বদা স্বাভাবিক গতিতে চলবেন।[18]

অতঃপর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত ‘রুকনে ইয়ামানী’ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘হাজারে আসওয়াদ’ পর্যন্ত দক্ষিণ দেওয়াল এলাকায় পৌঁছে প্রতি ত্বাওয়াফে এই দো‘আ পড়বেন-

رَبَّنَا آتِنَا فِى الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِى الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ -

উচ্চারণ: ‘রববা-না আ-তিনা ফিদ্দুন্ইয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আ-খিরাতে হাসানাতাঁও ওয়া ক্বিনা ‘আযা-বান্না-র’।

অর্থ: ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ দাও ও আখিরাতে মঙ্গল দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হ’তে রক্ষা কর’।[19] এ সময় ডান হাত দিয়ে ‘রুক্নে ইয়ামানী’ স্পর্শ করবেন ও বলবেন بٍسْـمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ ‘বিসমিল্লা-হি, ওয়াল্লা-হু আকবর’। তবে চুমু দিবেন না। ভিড়ের জন্য সম্ভব না হ’লে স্পর্শ করারও দরকার নেই বা ওদিকে ইশারা করে ‘আল্লাহু আকবর’ বলারও প্রয়োজন নেই। কেবল ‘রববানা আ-তিনা...’ দো‘আটি পড়ে চলে যাবেন। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অধিকাংশ সময় অত্র দো‘আটি পাঠ করতেন। উল্লেখ্য যে, রববানা-এর স্থলে আল্লা-হুম্মা আ-তিনা কিংবা আল্লা-হুম্মা রববানা আ-তিনা বললে সিজদাতেও এ দো‘আ পড়া যাবে। এতদ্ব্যতীত ছালাত, সাঈ, আরাফা, মুযদালিফা সর্বত্র সর্বদা এ দো‘আ পড়া যাবে। এটি একটি সারগর্ভ ও সর্বাত্মক দো‘আ। যা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর সবকিছুকে শামিল করে এবং যা সর্বাবস্থায় পড়া যায়।

উল্লেখ্য যে, কা‘বার উত্তর পার্শ্বে স্বল্প উচ্চ দেওয়াল ঘেরা ‘হাত্বীম’-এর বাহির দিয়ে ত্বাওয়াফ করতে হবে। ভিতর দিয়ে গেলে ঐ ত্বাওয়াফ বাতিল হবে ও পুনরায় আরেকটি ত্বাওয়াফ করতে হবে। কেননা ‘হাত্বীম’[20] অংশটি মূল কা‘বার অন্তর্ভুক্ত। যাকে বাদ দিলে কা‘বা বাদ পড়ে যাবে। 

ত্বাওয়াফ শেষের ছালাত : সাত ত্বাওয়াফ শেষে মাক্বামে ইবরাহীমের[21] পিছনে বা ভিড়ের কারণে অসম্ভব হ’লে হারাম শরীফের যেকোন স্থানে হালকাভাবে নীরবে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করবেন। এই সময় ডান কাঁধ ঢেকে নিবেন। (ক) এই ছালাত নিষিদ্ধ তিন সময়েও পড়া যাবে (খ) যদি বাধ্যগত কোন শারঈ কারণে বা ভুলবশতঃ এই ছালাত আদায় না করে কেউ বেরিয়ে আসেন, তাতে কোন দোষ হবে না। কারণ এটি ওয়াজিব নয় (গ) এখানে সুৎরা ছাড়াই ছালাত জায়েয। তবে মুছল্লীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব। মুছল্লীর সিজদার স্থান হ’তে একটি বকরী যাওয়ার মত দুরত্বের বাহির দিয়ে অতিক্রম করা যাবে।[22] (ঘ) উক্ত ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা শেষে প্রথম রাক‘আতে ‘সূরা কাফেরূন’ ও দ্বিতীয় রাক‘আতে ‘সূরা ইখলাছ’ পাঠ করবেন। তবে অন্য সূরাও পাঠ করা যাবে। (ঙ) ত্বাওয়াফ ও সাঈ-তে সংখ্যা গণনায় কম হয়েছে বলে নিশ্চিত ধারণা হ’লে বাকীটা পূর্ণ করে নিবেন। ধারণা অনিশ্চিত হ’লে বা গণনায় বেশী হ’লে কোন দোষ নেই।

ছালাত শেষে সম্ভব হ’লে হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করবেন। অতঃপর নিকটেই পূর্ব-দক্ষিণে ‘যমযম’ এলাকায় প্রবেশ করে সেখান থেকে পানি পান করে পাশেই ‘ছাফা’ পাহাড়ে উঠে যাবেন।

৫. সাঈ ( السعى ) :

সাঈ অর্থ দৌড়ানো। পারিভাষিক অর্থে, হজ্জ বা ওমরাহর উদ্দেশ্যে ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ানোকে সাঈ বলা হয়। ত্বাওয়াফ শেষে ছাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাতবার সাঈ করবেন।[23] দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী দুই সবুজ দাগের মধ্যে একটু জোরে দৌড়াবেন। তবে মহিলাগণ স্বাভাবিক গতিতে চলবেন।

‘সাঈ’ অর্থ দৌঁড়ানো। তৃষ্ণার্ত মা হাজেরা শিশু ইসমাঈলের ও নিজের পানি পানের জন্য মানুষের সন্ধানে পাগলপারা হয়ে ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ে উঠে দেখতে চেয়েছিলেন কোন ব্যবসায়ী কাফেলার সন্ধান মেলে কি-না। সেই কষ্টকর ও করুণ স্মৃতি মনে রেখেই এ সাঈ করতে হয়।

(১) ত্বাওয়াফ শেষে ছাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হয়ে বলবেন, আমরা শুরু করছি সেখান থেকে যা দিয়ে আল্লাহ শুরু করেছেন। অতঃপর নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করবেন - إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللهَ شَاكِرٌ عَلِيْمٌ ‘ইন্নাছ ছাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শা‘আ-ইরিল্লা-হ। ফামান হাজ্জাল বাইতা আবি‘তামারা ফালা জুনা-হা ‘আলাইহি আইঁ ইয়াত্ত্বাউওয়াফা বিহিমা। ওয়ামান তাত্বাউওয়া‘আ খায়রান, ফাইন্নাল্লা-হা শা-কেরুন ‘আলীম’। (নিশ্চয়ই ছাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। অতএব যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর হজ্জ অথবা ওমরা করবে, তার জন্য এদু’টি পাহাড় প্রদক্ষিণ করায় দোষ নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সৎকর্ম করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার যথার্থ মূল্যায়নকারী ও তার সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (বাক্বারাহ ২/১৫৮)।

(২) অতঃপর ছাফা পাহাড়ে উঠে কা‘বার দিকে দেখবেন ও সেদিকে তাকিয়ে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ বলবেন ও তিনবার আল্লাহু আকবর বলবেন। দেয়াল বা পিলার সমূহের কারণে কা‘বা দেখায় সমস্যা হ’লেও সেদিকে তাকাবেন ও দেখতে চেষ্টা করবেন। দেখতে পেলে সুন্নাতের অনুসরণ হ’ল। না পেলেও কোন দোষ নেই। অতঃপর কা‘বা-র দিকে মুখ করে দু’হাত উঠিয়ে তিনবার নিম্নের দো‘আটি পাঠ করবেন ও অন্যান্য দো‘আ করবেন।-

لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَشَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِِىْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٌ- لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَشَرِيْكَ لَهُ، أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ -

উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহূ, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু; ইউহয়ী ওয়া ইউমীতু, ওয়াহুয়া ‘আলা কুল্লে শাইয়িন ক্বাদীর। লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহূ লা শারীকা লাহূ, আনজাযা ওয়া‘দাহূ ওয়া নাছারা ‘আবদাহূ, ওয়া হাযামাল আহ্যা-বা ওয়াহদাহূ’।

অর্থ: ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সকল রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সকল প্রশংসা। তিনিই বাঁচান ও তিনিই মারেন এবং তিনি সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশালী’। ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন ও স্বীয় বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রু দলকে ধ্বংস করেছেন’।[24]

(৩) ছাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত এক সাঈ, মারওয়া থেকে ছাফা পর্যন্ত আরেক সাঈ। এমনিভাবে ছাফা থেকে সাঈ শুরু হ’য়ে মারওয়াতে গিয়ে সপ্তম সাঈ শেষ হবে ও সেখান থেকে ডান দিকে বেরিয়ে পাশেই সেলুনে গিয়ে মাথা মুন্ডন করবেন অথবা সমস্ত চুল ছেটে খাটো করবেন।

(৪) মহিলাগণ তাদের চুলের বেণী হ’তে অঙ্গুলীর অগ্রভাগ সমান অল্প কিছু চুল কেটে ফেলবেন।

(৫) ওমরাহর পরে হজ্জের সময় নিকটবর্তী হ’লে চুল খাটো করাই ভাল। পরে হজ্জের সময় মাথা মুন্ডন করবেন। এরপর হালাল হয়ে যাবেন ও ইহরাম খুলে স্বাভাবিক পোষাক পরবেন।

(৬) তবে সাঈ-র সময় মহিলাদের দৌড়াতে হয় না সম্ভবতঃ তাদের পর্দার কারণে ও স্বাস্থ্যগত কারণে।

(৭) প্রতিবার ছাফা ও মারওয়াতে উঠে কা‘বামুখী হয়ে পূর্বের ন্যায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও তিনবার আল্লাহু আকবার বলবেন ও হাত উঠিয়ে পূর্বের দো‘আটি পাঠ করবেন।

(৮) ত্বাওয়াফ ও সাঈ অবস্থায় নির্দিষ্ট কোন দো‘আ নেই। বরং যার যা দো‘আ মুখস্ত আছে, তাই নীরবে পড়বেন। অবশ্যই তা ছহীহ হাদীছে বর্ণিত দো‘আ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বান্দা তার প্রভুর নিকটে তার মনের সকল কথা নিবেদন করবেন। আল্লাহ তার বান্দার হৃদয়ের খবর রাখেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) এই সময় পড়েছেন : رَبِّ اغْفِرْ وَ ارْحَمْ وَأَنْتَ الْأَعَزُّ الْأَكْرَمُ ‘রবিবগফির ওয়ারহাম ওয়া আনতাল আ‘আযযুল আকরাম’ (হে প্রভু! আমাকে ক্ষমা কর ও দয়া কর। আর তুমিই সর্বোচ্চ সম্মানিত ও সবচেয়ে দয়ালু)।[25]

(৯) তাছাড়া এই সময় অধিকহারে ‘সুবহা-নাল্লাহ’ ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ পড়বেন বা কুরআন তেলাওয়াত করবেন।

(১০) সাঈ-র জন্য ওযূ বা পবিত্রতা শর্ত নয়, তবে মুস্তাহাব।[26]

জ্ঞাতব্য : (ক) সাঈ-র মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকী সাঈগুলি ট্রলিতে করায় দোষ নেই (খ) ত্বাওয়াফ ও সাঈ-র সময় একজন দলনেতা বই বের করে জোরে জোরে পড়তে থাকেন ও তার সাথীরা পিছে পিছে সরবে তা উচ্চারণ করতে থাকে। এ প্রথাটি বিদ‘আত। এটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। অর্থ না বুঝে এভাবে সমস্বরে ও উচ্চৈঃস্বরে দো‘আ পাঠ করার মধ্যে যেমন খুশূ-খুযূ থাকে না, তেমনি তা নিজ হৃদয়ে কোনরূপ রেখাপাত করে না। ফলে এভাবে তোতাপাখির বুলি আওড়ানোর মধ্যে কোনরূপ নেকী লাভ হবে না। উপরন্তু অন্যের নীরব দো‘আ ও খুশূ-খুযূ-তে বিঘ্ন সৃষ্টি করার দায়ে নিঃসন্দেহে তাকে গোনাহগার হ’তে হবে।

(গ) ত্বাওয়াফের পরেই সাঈ করার নিয়ম। কিন্তু যদি কেউ ত্বাওয়াফে ইফাযাহর পূর্বেই অজ্ঞতাবশে বা ভুলক্রমে সাঈ করেন, তাতে কোন দোষ হবে না।

মহিলাদের জ্ঞাতব্য ( معلومات النساء ) :

(১) মহিলাগণ মাহরাম সঙ্গী ব্যতীত কোন গায়ের মাহরাম ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে হজ্জ বা ওমরাহ করতে পারবেন না।[27]

মাহরাম হ’ল রক্ত সম্পর্কীয় ৭ জন : (১) পিতা-দাদা (২) পুত্র-পৌত্র ও অধঃস্তন (৩) ভ্রাতা (৪) ভ্রাতুষ্পুত্র ও অধঃস্তন (৫) ভগিনীপুত্র ও অধঃস্তন (৬) চাচা (৭) মামু। এতদ্ব্যতীত দুগ্ধ সম্পর্কীয়গণ।

বিবাহ সম্পর্কীয় ৪ জন : (১) স্বামীর পুত্র বা পৌত্র (২) স্বামীর পিতা বা দাদা (৩) জামাতা, পৌত্রী-জামাতা, নাতিন জামাতা (৪) মাতার স্বামী বা দাদী-নানীর স্বামী।

(২) ঋতুবতী ও নেফাসওয়ালী মহিলাগণ ত্বাওয়াফ (ও ছালাত) ব্যতীত হজ্জ ও ওমরাহর সবকিছু পালন করবেন।[28] (৩) যদি ওমরাহর ইহরাম বাঁধার সময়ে বা পরে নাপাকী শুরু হয় এবং ৮ তারিখের পূর্বে পাক না হয়, তাহ’লে ঐ অবস্থায় নিজ অবস্থানস্থল থেকে হজ্জের ইহরাম বাঁধবেন এবং তিনি তখন ওমরাহ ও হজ্জ মিলিতভাবে ক্বিরান হজ্জকারিনী হবেন। (৪) পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তিনি ত্বাওয়াফ ব্যতীত সাঈ, ওকূফে আরাফা, মুযদালিফা, মিনায় কংকর মারা, বিভিন্ন দো‘আ-দরূদ পড়া, কুরবানী করা, চুলের মাথা কাটা ইত্যাদি হজ্জের বাকী সব অনুষ্ঠান পালন করবেন। (৫) নাপাক থাকলে বিদায়ী ত্বাওয়াফ ছাড়াই দেশে ফিরবেন।

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১১।

[2]. ক্বাহত্বানী, পৃঃ ৫২-৫৫।

[3]. মুওয়াত্ত্বা, তিরমিযী প্রভৃতি, মিশকাত হা/২৫৪৯।

[4]. মুসলিম, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/২৫৫৪ ‘ইহরাম ও তালবিয়াহ’ অনুচ্ছেদ।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৪১ ‘ইহরাম ও তালবিয়াহ’ অনুচ্ছেদ।

[6]. আবূদাঊদ হা/৭৯৩; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৮৬৫।

[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৯৪৭ ‘তাশাহহুদে দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-১৭।

[8]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৬৪ পৃঃ।

[9]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৫৫০।

[10]. বায়হাক্বী ৫/৭৩; আলবানী, মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল ‘ওমরাহ পৃঃ ২০।

[11]. হাকেম ১/২১৮; আবুদাঊদ হা/৪৬৫; ইবনু মাজাহ হা/৭৭২-৭৩; ছহীহাহ হা/২৪৭৮।

[12]. আবুদাঊদ হা/৪৬৬; মিশকাত হা/৭৪৯।

[13]. ইবনু মাজাহ হা/৭৭৩; ছহীহাহ হা/২৪৭৮।

[14]. তিরমিযী ও অন্যান্য; মিশকাত হা/২৫৭৬; ইরওয়া হা/১২১; ত্বাওয়াফের তাৎপর্য : ‘বায়তুল্লাহ’ প্রদক্ষিণ বা ত্বাওয়াফের তাৎপর্য সম্ভবতঃ নিম্নের বিষয়গুলিই হ’তে পারে। যেমন (১) এটাই পৃথিবীতে আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম গৃহ (আলে ইমরান ৩/৯৬)। (২) এটি পৃথিবীর নাভিস্থল এবং ঘুর্ণায়মান লাটিমের কেন্দ্রের মত। (৩) প্রত্যেক ছোট বস্ত্ত বড় বস্ত্তকে কেন্দ্র করে ঘোরে। যেমন চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এমনিভাবে সৃষ্টিজগতের সবকিছু তার সৃষ্টিকর্তার দিকে আবর্তিত হচ্ছে। আবর্তন কেন্দ্র সর্বদা এক ও অবিভাজ্য। আর তিনিই আল্লাহ, যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব চরাচরের ধারক। কা‘বা আল্লাহর গৃহ। এটি তাঁর একত্বের প্রতীক। বান্দাকে তাই তিনি এ গৃহ প্রদক্ষিণ করার নির্দেশ দিয়েছেন (হজ্জ ২২/২৯)। এটি আল্লাহর প্রতি বান্দার মুখাপেক্ষীতার ও দাসত্ব প্রকাশের অনন্য নিদর্শন। বলা বাহুল্য, এ গৃহ ব্যতীত অন্য কোন গৃহ প্রদক্ষিণের নির্দেশ আল্লাহ কাউকে দেননি (৪) ঘড়ির কাঁটার অনুকূলে সকল কাজ ডান দিক থেকে বামে করতে বলা হ’লেও কা‘বা প্রদক্ষিণ বাম থেকে ডাইনে করতে হয়। কারণ পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি প্রকৃতির সবকিছু এমনকি দেহের রক্ত প্রবাহ বাম থেকে ডাইনে আবর্তিত হয়। আল্লাহর গৃহের ত্বাওয়াফ কালে তাই পুরা প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে আমরা ত্বাওয়াফ করি এবং সকলের সাথে আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি ও তাঁর বড়ত্ব ঘোষণা করি। তাই এটি ফিৎরত বা স্বভাবধর্ম অনুযায়ী করা হয়। যার উপরে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন (রূম ৩০/৩০)। (৫) মানুষের হৃৎপিন্ড বুকের বাম দিকে থাকে। কা‘বাকে বামে রেখে ডাইনে প্রদক্ষিণের ফলে কা‘বার প্রতি হৃদয়ের অধিক আকর্ষণ ও নৈকট্য অনুভূত হয়, যা স্বভাবধর্মের অনুকূলে। (৬) হাজীগণ আল্লাহর মেহমান। তাই মেযবানের কাছে আগমন ও বিদায় তাঁর গৃহ থেকেই হওয়া স্বাভাবিক। ত্বাওয়াফে কুদূম ও ত্বাওয়াফে বিদা‘ সে উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে। বস্ত্ততঃ (৭) ত্বাওয়াফের মাধ্যমে পৃথিবী ও সৌরজগতের অবিরত ঘুর্ণনের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা নিরক্ষর নবীর নবুঅতের একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ বটে \

[15]. উছায়মীন, শারহুল মুমতে‘ ৭/৩০০; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৬/২১১-১৩।

[16]. বায়হাক্বী ৫/৭৯ পৃঃ।

[17]. ‘রমল’ ( الرمل ) করার কারণ এই যে, আগের বছর ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে ওমরাহ করতে এসে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী পরের বছর ৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে ওমরাহ আদায়ের দিন কাফেররা দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত মুসলমানদের ত্বাওয়াফের প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ ইঙ্গিত করে বলেছিল যে, ‘ইয়াছরিবের জ্বর এদের দুর্বল করে দিয়েছে’। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তখন শক্তি প্রদর্শনের জন্য মুসলমানদের প্রতি দ্রুত চলার আদেশ দেন’। ওমর (রাঃ) বলেন, ডান কাঁধ খুলে ত্বাওয়াফের কারণও ছিল সেটাই’ (মিরক্বাত ৫/৩১৪)। বস্ত্ততঃ এর দ্বারা দ্বীন প্রতিষ্ঠায় ছাহাবায়ে কেরামের কষ্টকর খিদমতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় এবং জানিয়ে দেওয়া হয় যে, আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মুসলমান কোন যুগেই দুর্বল নয়। তাছাড়া এর মধ্যে অন্য কল্যাণও রয়েছে যে, প্রথম দিকে যে শক্তি থাকে, শেষের দিকে তা থাকে না। তাই প্রথমে যদি দ্রুত না চলা হয়, তাহ’লে সাত ত্বাওয়াফ শেষ করতে ক্লান্তিকর দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন পড়ে। কেননা এমনিতেই এতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যায় \

[18]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৬৬।

[19]. বাক্বারাহ ২/২০১; ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৬৬৬; মিশকাত হা/২৫৮১; বুখারী হা/৪৫২২, ৬৩৮৯; মিশকাত হা/২৪৮৭।

[20] . কা‘বা ও হাত্বীম : ‘হাত্বীম’ ( الحطيم ) হ’ল কা‘বা গৃহের মূল ভিতের উত্তর দিকের পরিত্যক্ত অংশের নাম। যা একটি স্বল্প উচ্চ অর্ধ গোলাকার প্রাচীর দ্বারা চিহ্নিত করা আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নবুঅত লাভের পাঁচ বছর পূর্বে তাঁর ৩৫ বছর বয়স কালে কুরায়েশ নেতাগণ বন্যার তোড়ে ধ্বসে পড়ার উপক্রম বহু বছরের প্রাচীন ইবরাহীমী কা‘বাকে ভেঙ্গে নতুনভাবে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তারা তাদের পবিত্র উপার্জন দ্বারা এক এক গোত্র এক এক অংশ নির্মাণের দায়িত্ব ভাগ করে নেন। কিন্তু উত্তরাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনু ‘আদী বিন কা‘ব বিন লুওয়াই তাদের হালাল অর্থের ঘাটতি থাকায় ব্যর্থ হয়। ফলে ঐ অংশের প্রায় ৬ হাত জায়গা বাদ রেখেই দেওয়াল নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়। এতে ইবরাহীমী কা‘বার ঐ অংশটুকু বাদ পড়ে যায়। যা ‘হাত্বীম’ বা পরিত্যক্ত নামে আজও ঐভাবে আছে। এই সময় ‘হাজারে আসওয়াদ’ রাখা নিয়ে গোত্রগুলির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের উপক্রম হ’লে

[21]. মাক্বামে ইবরাহীম : কা‘বার পূর্ব-উত্তর পার্শ্বে পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর দাঁড়ানোর স্থানকে ‘মাক্বামে ইবরাহীম’ বলা হয়। আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, وَاتَّخِذُوْا مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيْمَ مُصَلًّى ‘তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর স্থানকে ছালাতের স্থান বানাও’ (বাক্বারাহ ২/১২৫)। এখানে দাঁড়ানো ইমামের পিছনে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল নির্বিশেষে সকল মুসলিম একত্রে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেন। মাক্বামে ইবরাহীম তাই বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র। অথচ চার মাযহাবের তাক্বলীদপন্থী আলেম ও তাদের অনুসারীদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে তৎকালীন মিসরের বুরজী মামলূক সুলতান ফারজ বিন বারকূকের নির্দেশে ৮০১ হিজরী সনে (১৪০৬ খৃঃ) কা‘বা গৃহের চারপাশে চারটি মুছাল্লা কায়েম করা হয়, যা মাযহাবী বিভক্তিকে স্থায়ী রূপ দেয়। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে বর্তমান সঊদী শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আযীয আলে সঊদ ১৩৪৩ হিজরী সনে (১৯২৭ খৃঃ) উক্ত চার মুছাল্লার বিদ‘আত উৎখাত করেন এবং ৫৪২ বছর পরে মুসলমানগণ পুনরায় মাক্বামে ইবরাহীমে এক ইমামের পিছনে ঐক্যবদ্ধভাবে ছালাত আদায়ের সুযোগ লাভে ধন্য হয়। যা আজও অব্যাহত আছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

[22]. বুখারী হা/৪৯৬; মুসলিম হা/১১৩৪।

[23]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৫৭; ছাফা পাহাড় : কা‘বা গৃহের পূর্ব-দক্ষিণে ‘ছাফা পাহাড়’ অবস্থিত। সেখান থেকে সোজা উত্তর দিকে প্রায় অর্ধ কিঃ মিঃ (৪৫০ মিঃ) দূরে ‘মারওয়া পাহাড়’ অবস্থিত। উভয় পাহাড়ে সাতবার সাঈ-তে ৩.১৫ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করতে হয়।

[24]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫; আবুদাঊদ হা/১৮৭২।

[25]. বায়হাক্বী ৫/৯৫ পৃঃ।

[26]. ফাতাওয়া ইবনু বায ৫/২৬৪ পৃঃ।

[27] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫১৩, ২৫১৫।

[28]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৭২।

হজ্জ-এর নিয়মাবলী (مناسك الحج)
(১) মিনায় গমন ( الذهاب إلى منى ) :

তামাত্তু হজ্জ পালনকারীগণ যিনি ইতিপূর্বে ওমরাহ পালন শেষে ইহরাম খুলে ফেলেছেন ও হালাল হয়ে গেছেন, তিনি ৮ই যিলহাজ্জ সকালে স্বীয় অবস্থানস্থল হ’তে ওযূ-গোসল সেরে সুগন্ধি মেখে হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন ও নিম্নোক্ত দো‘আ পাঠ করবেন - لَبَّيْكَ اَللَّهُمَّ حَجًّا ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা হাজ্জান’ (হে আল্লাহ! আমি হজ্জের উদ্দেশ্যে তোমার দরবারে হাযির)। অতঃপর ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করতে করতে কা‘বা থেকে প্রায় ৮ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে মিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন ও যোহরের পূর্বেই সেখানে পৌঁছে যাবেন।

অতঃপর সেখানে রাত্রি যাপন করবেন ও জমা না করে শুধু ক্বছরের সাথে প্রতি ওয়াক্ত ছালাত পৃথক পৃথকভাবে মসজিদে খায়েফে আদায় করবেন। তবে জামা‘আতে ইমাম পূর্ণ পড়লে তিনিও পূর্ণ পড়বেন। ‘ক্বছর’ অর্থ, চার রাক‘আত বিশিষ্ট ফরয ছালাতগুলি দু’রাক‘আত পড়া। সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সুন্নাত সমূহ পড়তেন না।[1] তবে ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ও বিতর ছাড়তেন না।[2] এই সময় সিজদায় ও শেষ বৈঠকে ইচ্ছামত হৃদয় ঢেলে দিয়ে দো‘আ করবেন। তবে রুকু ও সিজদায় কুরআনী দো‘আগুলি পড়বেন না।

উল্লেখ্য যে, মক্কার পরে মিনা হ’ল হাজী ছাহেবদের দ্বিতীয় আবাসস্থল। যেখানে তাঁদেরকে আরাফা ও মুযদালিফা সেরে এসে আইয়ামে তাশরীক্বের তিন দিন কংকর মারার জন্য অবস্থান করতে হয়। ৯ তারিখে হজ্জ সেরে ১০ই যিলহাজ্জ সকালে মিনায় ফিরে কংকর মেরে প্রাথমিক হালাল হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে।

(২) আরাফা ময়দানে অবস্থান ( الوقوف بعرفة ) :

এটিই হ’ল হজ্জের প্রধান অনুষ্ঠান। এটি পালন না করলে হজ্জ হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْحَجُّ عَرَفَةُ ‘হজ্জ হ’ল আরাফাহ’।[3] ৯ই যিলহাজ্জ সূর্যোদয়ের পর মিনা হ’তে ধীরস্থিরভাবে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করতে করতে ১৪.৪ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে আরাফা ময়দান অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং ময়দানের চিহ্নিত সীমানার মধ্যে সুবিধামত স্থানে অবস্থান নিবেন।[4] যেখানে তিনি যোহর হ’তে মাগরিব পর্যন্ত অবস্থান করবেন। আরাফাতে পৌঁছে সূর্য ঢলার পরে ইমাম বা তাঁর প্রতিনিধি কর্তৃক হজ্জের সুন্নাতী খুৎবা হয়ে থাকে। যা শোনা যরূরী। অতঃপর যোহর ও আছরের ছালাত এক আযান ও দুই ইক্বামতে ২+২=৪ রাক‘আত জমা ও ক্বছর সহ মূল জামা‘আতের সাথে আদায় করবেন। সম্ভব না হ’লে নিজেরা পৃথক জামা‘আতে নিজ নিজ তাঁবুতে জমা ও ক্বছর করবেন।

আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে হৃদয়ের গভীরে ফেলে আসা স্মৃতিচারণ করতে হবে যে, এ ময়দানেই একদিন আমরা মানবজাতি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সম্মুখে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, আপনিই আমাদের প্রতিপালক। যাকে ‘আহ্দে আলাস্ত্ত’ বলা হয়। অতএব সার্বিক জীবনে আমরা আল্লাহরই দাসত্ব করব এবং শয়তানের দাসত্ব থেকে বিরত থাকব। এই দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এখানে অবস্থানকালে সর্বদা দো‘আ-দরূদ ও তাসবীহ-তেলাওয়াতে রত থাকবেন এবং ক্বিবলামুখী হ’য়ে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে আল্লাহর নিকটে কায়মনোচিত্তে প্রার্থনায় রত থাকবেন। যেন আল্লাহ তাকে জাহান্নাম হ’তে মুক্তদাসদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আরাফার দিন আল্লাহ সর্বাধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম হ’তে মুক্তি দান করে থাকেন এবং তিনি নিকটবর্তী হন ও ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করে বলেন, দেখ ওরা কি চায়? (মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি নিম্ন আকাশে নেমে আসেন ও ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা সাক্ষী থাক আমি ওদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম’।[5] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল আরাফার দো‘আ...’।[6] আরাফার ময়দানে অবস্থান করে তওবা-ইস্তিগফার, যিকর ও তাসবীহ সহ আল্লাহর নিকটে হৃদয়-মন ঢেলে দো‘আ করাটাই হ’ল হজ্জের মূল কাজ। এ সময় ছহীহ হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন দো‘আ পড়বেন ও কুরআন তেলাওয়াতে রত থাকবেন। আরাফার জন্য নির্দিষ্ট কোন দো‘আ নেই।

উল্লেখ্য যে, ৯ই যিলহাজ্জ হাজীগণ ছিয়াম পালন করবেন না। তবে যারা হাজী নন, তাদের জন্য আরাফার দিন ছিয়াম পালন করা অত্যন্ত নেকীর কাজ। এতে বিগত এক বছরের ও আগামী এক বছরের গোনাহ মাফ হয়’।[7] এর দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানকারী মুসলিম নর-নারীগণ হজ্জের বিশ্ব সম্মেলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। যা মুসলিম ঐক্য ও সংহতির প্রতি গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করে।

৯ই যিলহাজ্জ পূর্বাহ্ন হ’তে ১০ই যিলহাজ্জ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আরাফার ময়দানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেই কিংবা ময়দানের উপর দিয়ে হজ্জের নিয়তে হেঁটে গেলেও আরাফায় অবস্থানের ফরয আদায় হয়ে যাবে।

(৩) মুযদালিফায় রাত্রিযাপন ( البيات في مزدلفة ) :

৯ই যিলহাজ্জ সুর্যাস্তের পর আরাফা ময়দান হ’তে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ ও তওবা-ইস্তিগফার করতে করতে ধীরে-সুস্থে প্রায় ৯ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিমে মুযদালিফা অভিমুখে রওয়ানা হবেন। কোন অবস্থাতেই সূর্যাস্তের পূর্বে রওয়ানা হওয়া যাবে না। রওয়ানা দিলে পুনরায় ফিরে আসতে হবে ও সূর্যাস্তের পরে যাত্রা করতে হবে। যদি ফিরে না আসেন, তাহ’লে তার উপরে কাফফারা স্বরূপ ফিদ্ইয়া ওয়াজিব হবে।

মুযদালিফায় পৌঁছে ‘জমা তাখীর’ করবেন। অর্থাৎ মাগরিব পিছিয়ে এশার সাথে জমা করবেন। এক আযান ও দুই এক্বামতে জমা ও ক্বছর অর্থাৎ মাগরিব তিন রাক‘আত ও এশা দু’রাক‘আত জমা করে পড়বেন। যরূরী কোন কারণে জমা ও ক্বছরের মাঝে বিরতি ঘটে গেলে তাতে কোন দোষ নেই। দুই ছালাতের মাঝে বা এশার ছালাতের পরে আর কোন ছালাত নেই। এরপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলেন।[8] এতে বুঝা যায় যে, তিনি এই রাতে বিতর বা তাহাজ্জুদ পড়েননি। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে আউয়াল ওয়াক্তে ফজর পড়ে ‘আল-মাশ‘আরুল হারামে’ (অর্থাৎ মুযদালিফা মসজিদে) গিয়ে অথবা নিজ অবস্থানে বসে দীর্ঘক্ষণ ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ-ইস্তিগফারে রত থাকবেন। তারপর ভালভাবে ফর্সা হওয়ার পর সূর্যোদয়ের পূর্বেই মিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন।

দুর্বল ও মহিলাদের নিয়ে অর্ধরাত্রির পরেও রওয়ানা দেওয়া জায়েয আছে। তার পূর্বে রওয়ানা হওয়া জায়েয নয়। রওয়ানা দিলে ফিরে আসতে হবে। নইলে কাফফারা স্বরূপ ফিদ্ইয়া দিতে হবে।

উল্লেখ্য যে, অর্ধরাত্রির পরে নিয়ত সহকারে মুযদালিফার উপর দিয়ে চলে গেলেও সেখানে অবস্থানের ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। মুযদালিফা হ’তে মিনায় রওয়ানা হওয়ার সময় সেখান থেকে অথবা চলার পথে রাস্তার পাশ থেকে ছোলার চেয়ে একটু বড় সাতটি ছোট্ট পাথর বা কংকর কুড়িয়ে নিবেন। যা মিনায় গিয়ে সকালে জামরাতুল আক্বাবাহ বা ‘বড় জামরায়’ মারার সময় ব্যবহার করবেন।

এ সময় বিশেষ ধরনের কংকর কুড়ানোর জন্য মুযদালিফা পাহাড়ে উঠে টর্চ লাইট মেরে লোকদের যে কঠিন প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যায়, সেটা স্রেফ বিদ‘আতী আক্বীদার ফলশ্রুতি মাত্র।

মুযদালিফায় গিয়ে মূল কাজ হ’ল : মাগরিব-এশা একত্রে জমা করার পর ঘুমিয়ে যাওয়া। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে আউয়াল ওয়াক্তে ফজর পড়ে ক্বিবলামুখী হয়ে কায়মনোচিত্তে দো‘আয় মশগূল হওয়া। রাতে এই বিশ্রামের কারণ যাতে পরদিন কুরবানী ও কংকর মারার কষ্ট সহজ হয়। আরাফা ময়দানের ন্যায় এখানেও কোন নির্দিষ্ট দো‘আ নেই।

(৪) মিনায় প্রত্যাবর্তন ( الرجوع إلى منى ) :

১০ই যিলহাজ্জ ফজরের ছালাত আদায়ের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে মুযদালিফা থেকে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করতে করতে রওয়ানা হয়ে মুযদালিফার শেষ প্রান্ত ও মিনার সীমান্তবর্তী ‘মুহাসসির’ উপত্যকায় একটু জোরে চলবেন।[9] অতঃপর প্রায় ৫ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিমে মিনা পৌঁছে সূর্যোদয়ের পর প্রথমে ‘জামরাতুল আক্বাবাহ’ যা মক্কার নিকটবর্তী, সেই বড় জামরাকে লক্ষ্য করে মক্কা বাম দিকে ও মিনা ডান দিকে রেখে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করবেন। এরপর থেকে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ বন্ধ করবেন এবং ইহরাম খুলে হালাল হ’তে পারবেন, যদিও মাথা মুন্ডন ও কুরবানী বাকী থাকে। কোন কারণে পূর্বাহ্নে কংকর নিক্ষেপে ব্যর্থ হ’লে অপরাহ্নে কিংবা সূর্যাস্তের পূর্বে কংকর মারবেন। উল্লেখ্য যে, দুর্বল ও মহিলাগণ যদি সূর্যোদয়ের পূর্বে মিনায় পৌঁছে যান, তাহ’লে তারা সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। অতঃপর কংকর মারবেন।

প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় ডান হাত উঁচু করে বলবেন, الله اكبر ‘আল্লা-হু আকবর’ (আল্লাহ সবার বড়)। এভাবে সাতবার তাকবীর দিয়ে সাতটি কংকর মারবেন। এই তাকবীর ধ্বনি শয়তানের বিরুদ্ধে মুমিনের পক্ষ থেকে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা এবং ঈদের তাকবীরের ন্যায় ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। কংকর হাউজে পড়লেই হবে। পিলারের গায়ে লাগা শর্ত নয়।[10]

অতঃপর তাকবীর ধ্বনির সময় নিয়ত এটাই থাকবে যে, আমি আমার সার্বিক জীবনে শয়তান ও শয়তানী বিধানকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও আল্লাহর বিধানকে ঊর্ধ্বে রাখব। বস্ত্ততঃ হজ্জের পর থেকে আমৃত্যু ত্বাগূতের বিরুদ্ধে আল্লাহর বিধানকে অগ্রাধিকার দেবার সংগ্রামে টিকে থাকতে পারলেই হজ্জ সার্থক হবে ইনশাআল্লাহ।

মিনায় পৌঁছেই দুপুরের আগে বা পরে যথাশীঘ্র কংকর মেরে কুরবানী করবেন। অতঃপর পুরুষগণ মাথা মুন্ডন করবেন অথবা সমস্ত চুল খাটো করে ছাঁটবেন। মহিলাগণ কেবল চুলের অগ্রভাগ সামান্য কেটে ফেলবেন। অতঃপর ইহরাম খুলে হালাল হয়ে যাবেন ও সাধারণ পোষাক পরিধান করবেন। তবে এটা হবে প্রাথমিক হালাল বা ‘তাহাল্লুলে আউয়াল’। এই হালালের ফলে স্ত্রী মিলন ব্যতীত সবকিছু সাধারণ অবস্থার ন্যায় করা যাবে। এরপরই মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করলে পুরা হালাল হওয়া যাবে। এসময় ‘রমল’ করার প্রয়োজন নেই। ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’-কে ‘ত্বাওয়াফে যিয়ারত’ও বলা হয়। এটি হজ্জের অন্যতম রুকন। যা না করলে হজ্জ বিনষ্ট হয়। সেকারণ রাত্রিতে হ’লেও ১০ই যিলহাজ্জ তারিখেই এটা সম্পন্ন করা উচিত। নইলে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যে অর্থাৎ ১১, ১২, ১৩ই যিলহাজ্জের মধ্যে সম্পন্ন করা উত্তম।[11]

উল্লেখ্য যে, যিলহাজ্জ মাসের পুরাটাই হজ্জের মাস সমূহের অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ মাসের মধ্যেই ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু যদি কোন কারণ বশতঃ এ মাস অতিক্রান্ত হয়ে যায়, তবে তার হজ্জ হয়ে যাবে। তবে কাফফারা স্বরূপ ফিদ্ইয়া দিতে হবে। ঋতুর আশংকাকারী মহিলাগণ এ সময় ঔষধ ব্যবহারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে ঋতুরোধ করে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ সেরে নিতে পারেন।[12]

‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ শেষে সেদিনই মিনায় ফিরে এসে রাত্রিযাপন করবেন।

মিনায় ৪টি কাজ :

১০ই যিলহাজ্জ সকালে মুযদালিফা থেকে মিনায় পৌঁছে মোট চারটি কাজ পর্যায়ক্রমে করতে হয়। (১) বড় জামরায় কংকর মারা (২) কুরবানী করা (৩) মাথা মুন্ডন করা অথবা সমস্ত চুল ছোট করা। টাকমাথা যাদের তারাও মাথায় ক্ষুর দিবেন। এসময় সকলের জন্য গোফ ছাঁটা ও নখ কাটা মুস্তাহাব।[13] (৪) মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করা। তবে এ কাজগুলির কোনটি আগপিছ হয়ে গেলে তাতে কোন দোষ নেই। যেমন কেউ কংকর মারার আগেই ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করল অথবা আগেই মাথা মুন্ডন করল ও পরে কুরবানী করল এবং শেষে কংকর মারল, তাতে কোন দোষ নেই। উল্লেখ্য যে, কুরবানী মিনা ছাড়া মক্কাতে এসেও করা যায়। কেননা মক্কা, মিনা, মুযদালিফা, আযীযিয়াহ সবই হারামের অন্তর্ভুক্ত। তবে আরাফাত নয়।

তামাত্তু হাজীগণ ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করার পর সাঈ করবেন। অতঃপর পূর্ণ হালাল হবেন। এর কারণ এই যে, প্রথম ত্বাওয়াফ ও সাঈ ছিল ওমরাহর জন্য। কিন্তু এবারেরটা হ’ল হজ্জের জন্য। ক্বিরান ও ইফরাদ হাজীগণ শুরুতে মক্কায় এসে ‘ত্বাওয়াফে কুদূম’-এর সময় সাঈ করে থাকলে এখন আর সাঈ করতে হবে না। কেবল ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করেই হালাল হয়ে যাবেন।

কুরবানী ( الأضحية ) : আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে কুরবানী দেওয়ার ও পুত্রের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় তা বরণ করে নেওয়ার অনন্য আত্মোৎসর্গের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত হ’তে প্রেরিত দুম্বার ‘মহান কুরবানী’র পুণ্যময় স্মৃতিকে ধারণ করেই কুরবানী অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। যাতে মুসলমান সর্বদা দুনিয়াবী মহববতের উপরে আল্লাহর মহববতকে স্থান দিতে পারে। প্রায় চার হাযার বছর পূর্বে এই দিনে এই মিনা প্রান্তরেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। (ক) কুরবানী তাই মিনা সহ ‘হারাম’ এলাকার মধ্যেই করতে হয়, বাইরে নয়। যদি কেউ ‘হারাম’ এলাকার বাইরে আরাফাতের ময়দান বা অন্যত্র কুরবানী করেন, তবে তাকে হারামে এসে পুনরায় কুরবানী দিতে হবে। সামর্থ্য না থাকলে ফিদ্ইয়া স্বরূপ হজ্জের মধ্যে ৩টি ও বাড়ী ফিরে ৭টি মোট ১০টি ছিয়াম পালন করতে হবে। (খ) হাজী ছাহেব সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে মিনার বাজার থেকে নিজের কুরবানীর পশু খরিদ করে কসাইখানায় যবহ করে গোশত কুটাবাছা করে নিয়ে আসতে পারেন।

কুরবানীর পশু সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও ত্রুটিমুক্ত হ’তে হবে। কুরবানী করার সময় উট হ’লে দাঁড়ানো অবস্থায় ‘হলকূমে’ অর্থাৎ কণ্ঠনালীর গোড়ায় অস্ত্রাঘাত করে রক্ত ছুটিয়ে দিবেন, যাকে ‘নহর’ করা বলা হয়। আর গরু বা দুম্বা-বকরী হ’লে দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে বামকাতে ফেলে ক্বিবলামুখী হয়ে তীক্ষ্ণধার অস্ত্র দিয়ে দ্রুত ‘যবহ’ করবেন। তবে ক্বিবলামুখী হ’তে ভুলে গেলেও ইনশাআল্লাহ কোন দোষ বর্তাবে না। নহর বা যবহ কালে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়বেন-

بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ، اَللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ، اَللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّى -

‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার; আল্লা-হুম্মা মিন্কা ওয়া লাকা, আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী’।

অর্থ: ‘আল্লাহর নামে কুরবানী করছি। আল্লাহ সবার বড়। হে আল্লাহ! এটি তোমারই তরফ হ’তে প্রাপ্ত ও তোমারই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। হে আল্লাহ! তুমি এটি আমার পক্ষ থেকে কবুল কর’। অন্য কোন পুরুষের পক্ষ থেকে হ’লে বলবেন ‘মিন ফুলা-ন’ এবং মহিলার পক্ষ থেকে হ’লে বলবেন ‘মিন ফুলা-নাহ’।[14] জন প্রতি একটি করে বকরী বা দুম্বা ও সাত জনে মিলে একটি গরু অথবা সাত বা দশজনে একটি উট কুরবানী দিতে পারেন।[15] মেয়েরাও যবহ বা নহর করতে পারেন।

জানা আবশ্যক যে, নিজে কুরবানী করে পশুটিকে ফেলে রেখে আসা জায়েয নয়। বরং এতে গোনাহগার হ’তে হবে। কেননা কুরবানীর পশু আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবহ করা হয় এবং তা অত্যন্ত

সম্মানিত। অতএব তাকে যত্নের সাথে কুটাবাছা করতে হবে, নিজে খেতে হবে, অন্যকে দিতে হবে এবং ফকীর-মিসকীনের মধ্যে অবশ্যই বিতরণ করতে হবে। নিজে না পারলে বিশ্বস্ত কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকে কুরবানী বাবদ নির্ধারিত টাকা জমা দিলে হাজী ছাহেবের পক্ষে তারাই অর্থাৎ সঊদী সরকার উক্ত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সরকার অনুমোদিত সংস্থা সমূহের লোকেরা উক্ত হাজীর নামে মিনা প্রান্তরেই সরকারী কসাইখানায় গিয়ে যবহ বা নহর করে থাকে। অতঃপর এগুলো মেশিনের সাহায্যে ছাফ করে আস্ত বা টুকরা করে ফ্রিজে রেখে মোটা পলিথিনে মুড়িয়ে বিভিন্ন দেশে গরীবদের মাঝে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ সমূহের সরকারের নিকটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

অতএব মিনা প্রান্তরে মসজিদে খায়েফ-এর নিকটবর্তী সেলুন এলাকার সামনে বা অন্যত্রে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যাংক কাউন্টারে কুরবানী বা হাদ্ই বাবদ নির্ধারিত ‘রিয়াল’ জমা দিয়ে রসিদ নিলেই কুরবানীর দায়িত্ব শেষ হ’ল বলে বুঝতে হবে। কুরবানী শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোন প্রয়োজন নেই।

(গ) কুরবানীর পশু কেনার সামর্থ্য না থাকলে তার পরিবর্তে দশটি ছিয়াম পালন করতে হবে। তিনটি হজ্জের মধ্যে (৯ই যিলহাজ্জের পূর্বে অথবা ১০ই যিলহাজ্জের পরে) এবং বাকী সাতটি বাড়ী ফিরে (বাক্বারাহ ২/১৯৬)। ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন ও পরবর্তী আইয়ামে তাশরীক্বের তিনদিন সকলের জন্য ছিয়াম পালন নিষিদ্ধ।[16] তবে ফিদ্ইয়ার তিনটি ছিয়াম এ তিনদিন রাখা যায়।[17]

(ঘ) উল্লেখ্য যে, ১০ই যিলহাজ্জ তাকবীর সহ কংকর নিক্ষেপ করা ঈদুল আযহার তাকবীর ও ছালাতের স্থলাভিষিক্ত। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদায় হজ্জের এদিন কংকর নিক্ষেপের পর সকলের উদ্দেশ্যে খুৎবা দিয়েছেন। যেমন তিনি মদীনায় থাকা অবস্থায় ঈদের ছালাতের পর খুৎবা দিতেন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীন মিনাতে ঈদুল আযহার ছালাত আদায় করেননি, সেহেতু তা আদায় করা হয় না। তবে (ঙ) এ দিন বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপ শেষে ঈদের তাকবীর ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহ আকবর, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু; আল্লা-হু আকবর, আল্লা-হু আকবর, ওয়া লিল্লা-হিল হাম্দ’ (আল্লাহ সবার বড়, আল্লাহ সবার বড়। নেই কোন উপাস্য আল্লাহ ব্যতীত। আল্লাহ সবার বড়, আল্লাহ সবার বড়, আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা) বারবার পড়া উচিত।

মিনায় অবস্থান ( المبيت بمنى ) : ১১, ১২, ১৩ই যিলহাজ্জ আইয়ামে তাশরীক্ব-এর তিনদিন মিনায় রাত্রি যাপন করা ওয়াজিব। এ সময় পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সাথে মসজিদে খায়েফে আদায় করা উত্তম। ছালাত ক্বছর করা ও পূর্ণ পড়া দু’টিই জায়েয।[18] ইমাম যেভাবে পড়েন, সেভাবেই পড়তে হবে।[19] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সময় প্রতি রাতে কা‘বা যেয়ারত করতেন ও ত্বাওয়াফ করে ফিরে আসতেন। প্রথম রাতে মিনায় থেকে শেষ রাতেও মক্কা যাওয়া যায়। মিনায় রাত্রি যাপন না করলে তাকে ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে। ৮ই যিলহাজ্জ দুপুর হ’তে ১৩ই যিলহাজ্জ মাগরিব পর্যন্ত গড়ে ৫ দিন মিনায় ও মুযদালিফায় অবস্থান করতে হয়। অবশ্য ১২ তারিখ সন্ধ্যার পূর্বেও মিনা থেকে মক্কায় ফিরে আসা জায়েয আছে। অনেকে মিনায় না থেকে মক্কায় এসে রাত্রি যাপন করেন ও দিনের বেলায় মিনায় গিয়ে কংকর মারেন। বাধ্যগত শারঈ ওযর ব্যতীত এটি করা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয। যদি কেউ এটা করেন, তবে তাকে ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে।

কংকর নিক্ষেপ ( رمى الجمار ) :মিনায় ৪দিনে মোট ৭০টি কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন সকালে বড় জামরায় ৭টি। অতঃপর ১১, ১২, ১৩ই যিলহাজ্জ প্রতিদিন দুপুরে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার পর হ’তে সন্ধ্যার মধ্যে তিনটি জামরায় ৩´৭=২১টি করে মোট ৬৩টি। বাধ্যগত অবস্থায় রাতেও কংকর নিক্ষেপ করা যায়। ছোলার চাইতে একটু বড় যেকোন কংকর হ’লেই চলবে এবং তা যেখান থেকে খুশী কুড়িয়ে নেওয়া যায়। তবে ১০ তারিখে বড় জামরায় মারার জন্য প্রথম সাতটি কংকর মুযদালিফা থেকে বা মিনায় ফেরার সময় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া মুস্তাহাব। ‘মুযদালিফা পাহাড় থেকে বিশেষ সাইজ ও গুণ সম্পন্ন কংকর সংগ্রহ করতে হবে’ বলে যে ধারণা প্রচার করা হয়ে থাকে, তা নিছক ভিত্তিহীন।

কংকর মারার আদব ( من آداب الرمى ) :

(ক) ১১, ১২, ১৩ তারিখে প্রথমে ‘জামরা ছুগরা’ (ছোট) যা মসজিদে খায়ফের নিকটবর্তী, তারপর ‘উস্তা’ (মধ্যম) ও সবশেষে ‘কুবরা’ (বড়)-তে কংকর মারতে হবে। যদি কেউ সূর্য পশ্চিমে ঢলার পূর্বে কংকর মারে কিংবা নিয়মের ব্যতিক্রম করে আগে ‘বড়’ পরে ‘মধ্যম’ ও শেষে ‘ছোট’ জামরায় কংকর মারে, তবে তাকে ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে।

(খ) পূর্ণ শালীনতা ও ভদ্রতার সাথে ‘জামরা’-র উঁচু পিলার বেষ্টিত হাউজের কাছাকাছি পৌঁছে তার মধ্যে কংকর নিক্ষেপ করবেন। প্রতিবারে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ডান হাত উঁচু করে সাতবারে সাতটি কংকর মারবেন। খেয়াল রাখতে হবে হাউজের মধ্যে পড়ল কি-না। নইলে পুনরায় মেরে সাতটি সংখ্যা পূরণ করতে হবে।

(গ) কংকর গণনায় ভুল হ’লে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে দু’একটা পড়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে, তাতে কোন দোষ হবে না। কিন্তু সবগুলি হারিয়ে গেলে পুনরায় কংকর সংগ্রহ করে এনে মারতে হবে। নইলে ফিদ্ইয়া দিতে হবে।

(ঘ) ছোট ও মধ্যম জামরায় কংকর মেরে প্রতিবারে একটু দূরে সরে গিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে হয়। অতঃপর বড় জামরায় কংকর মারার পর আর দাঁড়াতে হয় না বা দো‘আও করতে হয় না।

(ঙ) এই সময় হুড়াহুড়ি করা, ঝগড়া করা, জোরে কথা বলা, কারু গায়ে আঘাত করা, হাউজে জুতা-স্যান্ডেল নিক্ষেপ করা, কারু উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়া, পা দাবানো ইত্যাদি কষ্টদায়ক যাবতীয় ক্রিয়া-কলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। শয়তান মারার নামে এগুলি আরেক ধরনের শয়তানী কাজ মাত্র। হজ্জের পবিত্র অনুষ্ঠান সমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এগুলি পালন করতে এসে যাবতীয় বিদ‘আত থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। নইলে হজ্জের নেকী হ’তে মাহরূম হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাবে।

(চ) সক্ষম পুরুষ বা মহিলার পক্ষ হ’তে অন্যকে কংকর মারার দায়িত্ব দেওয়া জায়েয নয়। যার কংকর তাকেই মারতে হবে।

(ছ) নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত অন্য সময়ে কংকর মারার ক্বাযা আদায় করার নিয়ম নেই।

(জ) তবে যদি কেউ শারঈ ওযর বশতঃ সন্ধ্যার সময়সীমার মধ্যে কংকর মারতে ব্যর্থ হন, তাহ’লে বাধ্যগত অবস্থায় তিনি সূর্যাস্তের পর হ’তে ফজরের আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কংকর মারতে পারেন।

(ঝ) বদলী হজ্জের জন্য কিংবা প্রচন্ড ভিড়ের কারণে দুর্বল, রোগী বা অপারগ মহিলা হাজীর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হ’লে প্রথমে নিজের জন্য সাতটি কংকর মারবেন। পরে দায়িত্ব দানকারী মুওয়াক্কিল-এর নিয়তে তার পক্ষে সাতটি কংকর মারবেন।

(ঞ) ১২ই যিলহাজ্জ কংকর মারার পর হজ্জের কাজ শেষ করতে চাইলে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ত্যাগ করে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হবেন। যদি রওয়ানা অবস্থায় ভিড়ের কারণে মিনাতেই সূর্য ডুবে যায়, তাতেও কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি রওয়ানা হবার পূর্বেই মিনাতে সূর্য অস্ত যায়, তাহ’লে থেকে যেতে হবে ও পরদিন দুপুরে সূর্য ঢলার পর আগের দিনের ন্যায় যথারীতি তিন জামরায় ২১টি কংকর মেরে রওয়ানা হ’তে হবে। ১২ তারিখে আগেভাগে চলে যাওয়ার চাইতে ১৩ তারিখে দেরী করে যাওয়াই উত্তম। কেননা এতেই সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ হয়।

(ট) বাধ্যগত শারঈ ওযর থাকলে মিনায় রাত্রিযাপন না করে ১১-১২ দু’দিনের কংকর যেকোন একদিনে একসাথে মেরে মক্কায় ফেরা যাবে।[20]

(৫) বিদায়ী ত্বাওয়াফ ( طواف الوداع ):

ঋতুবতী ও নেফাস ওয়ালী মহিলা ব্যতীত কোন হাজী বিদায়ী ত্বাওয়াফ ছাড়া মক্কা ত্যাগ করতে পারবেন না।[21] যদি কেউ সেটা করেন, তাহ’লে তাকে ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে। অতএব মিনার ইবাদত সমূহ শেষ করে মক্কায় ফিরে এসে হাজীগণ বায়তুল্লাহর বিদায়ী ত্বাওয়াফ করবেন। এ সময় সাঈ করার প্রয়োজন নেই।

তবে যদি ইতিপূর্বে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ না করে থাকেন, তাহ’লে তামাত্তু হাজীগণ ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ ও সাঈ করে পূর্ণ হালাল হয়ে দেশে রওয়ানা হবেন। তখন তাকে আর পৃথকভাবে ‘বিদায়ী ত্বাওয়াফ’ করতে হবে না। পক্ষান্তরে ক্বিরান ও ইফরাদ হাজীগণ শুরুতে মক্কায় এসে ত্বাওয়াফে কুদূম-এর সময় সাঈ করে থাকলে এখন আর তাকে সাঈ করতে হবে না। কেবল ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করেই হালাল হয়ে দেশে রওয়ানা হবেন। অনুরূপভাবে ঋতুবতী বা নেফাস ওয়ালী মহিলাগণ বিদায়ী ত্বাওয়াফ ছাড়াই বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় হবার দো‘আ পাঠ করবেন, যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে (‘সফরের আদব’ দো‘আ-৬ দ্রঃ)।

তিনটি হজ্জের সময়কাল ( ميعاد الأنساك الثلاثة ) :

তিনটি হজ্জের মধ্যে তামাত্তু হজ্জের জন্য সময় লাগে একটু বেশী এবং এতে কষ্টও কিছুটা বেশী। কেননা তাকে প্রথমে ওমরাহর ত্বাওয়াফ ও সাঈ করতে হয়। পরে নতুন ভাবে হজ্জের ইহরাম বেঁধে হজ্জ শেষে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ ও সাঈ করতে হয়। ফলে গড়ে দু’টি বা তিনটি ত্বাওয়াফ ও দু’টি সাঈ করতে হয়। অবশ্য এতে তার নেকীও বেশী হয়।

এর পরের সংক্ষিপ্ত হজ্জ হ’ল ক্বিরান ও ইফরাদ। এতে গড়ে দু’টি ত্বাওয়াফ ও একটি সাঈ করতে হয়। সর্বসাকুল্যে ৮ই যিলহাজ্জ থেকে ১২ বা ১৩ই যিলহাজ্জ পর্যন্ত ৫ বা ৬ দিনে এই হজ্জ সমাপ্ত হয়। উল্লেখ্য যে, বিদায়ী ত্বাওয়াফের পর সফরের গোছগাছ ব্যতীত অন্য কারণে দেরী হ’লে তাকে পুনরায় বিদায়ী ত্বাওয়াফ করতে হবে। বিদায়ের সময় বায়তুল্লাহকে সম্মান দেখাবার জন্য পিছন দিকে হেঁটে বের হওয়া নিকৃষ্টতম বিদ‘আতী কাজ। বরং অন্যান্য মসজিদের ন্যায় স্বাভাবিকভাবে মুখ ফিরিয়ে দো‘আ পড়তে পড়তে বেরিয়ে আসতে হবে।

কিবরান ও ইফরাদ হাজীদের করণীয় :

( أعمال القارن والمفرد )

‘ক্বিরান’ অর্থাৎ যারা ওমরাহ ও হজ্জ একই নিয়তে ও একই ইহরামে আদায় করেন এবং ‘ইফরাদ’ অর্থাৎ যারা স্রেফ হজ্জ-এর নিয়তে ইহরাম বাঁধেন, তাঁরা তামাত্তু হাজীদের ন্যায় মক্কায় গিয়ে প্রথমে বায়তুল্লাহতে ‘ত্বাওয়াফে কুদূম’ বা আগমনী ত্বাওয়াফ সম্পাদন করবেন ও ত্বাওয়াফ শেষে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করবেন। অতঃপর ইচ্ছা করলে সাঈ করবেন অথবা রেখে দিবেন। যা তিনি হজ্জ শেষে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করার পর সম্পাদন করবেন। আর যদি ত্বাওয়াফে কুদূমের পরেই সাঈ করেন, তাহ’লে তাকে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ শেষে পুনরায় সাঈ করতে হবে না। অর্থাৎ শুরুতে একবার সাঈ করলে শেষে আর সাঈ প্রয়োজন হবে না। তবে তাকে ত্বাওয়াফে কুদূমের পর থেকে ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন হালাল হওয়া পর্যন্ত ইহরামের পোষাকে থাকতে হবে। ‘ক্বিরান’ হজ্জের জন্য কুরবানী ওয়াজিব হবে। কিন্তু ‘ইফরাদ’ হজ্জের জন্য কুরবানী প্রয়োজন নেই।

হজ্জ শেষে মক্কায় ফিরে করণীয় :

( الأعمال في مكة بعد الفراغ من الحج )

হজ্জের সব কাজ সেরে মক্কায় ফিরে দেশে ফেরার জন্য বিদায়ী ত্বাওয়াফের আগ পর্যন্ত মাসজিদুল হারামে যত খুশি ছালাতে এবং দিনে-রাতে যত খুশি ত্বাওয়াফে সময় কাটাবেন। কেননা বায়তুল্লাহর ছালাতে অন্য স্থানের চাইতে এক লক্ষ গুণ বেশী নেকী রয়েছে[22] এবং বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফে প্রতি পদক্ষেপে একটি করে গুনাহ ঝরে পড়ে ও একটি করে নেকী লেখা হয়।[23] এই সময় সর্বদা তেলাওয়াত ও ইবাদতে রত থাকা এবং তাক্বওয়া বৃদ্ধি পায় এমন কিতাব সমূহ পাঠের মধ্যে মনোনিবেশ করা উত্তম। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক ইলমী মজলিসে যোগদান করা ও গভীর মনোযোগের সাথে উক্ত আলোচনা শ্রবণ করা নিঃসন্দেহে নেকীর কাজ।

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৩৮।

[2]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ ৩/৪৫৭ পৃঃ।

[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৭১৪।

[4]. ওকূফে আরাফাহ : আরাফার ময়দানে অবস্থানের প্রধান কারণ হ’ল বান্দাকে একথা মনে করিয়ে দেওয়া যে, সৃষ্টির সূচনায় এই উপত্যকায় প্রথম ‘আহ্দে আলাস্ত্ত’-র শপথ অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেদিন আল্লাহ আদমের পিঠ থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল বনু আদমকে পিপীলিকার অবয়বে সৃষ্টি করে তাদের জিজ্ঞেস করেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? জওয়াবে সেদিন আমরা সবাই বলেছিলাম, হ্যাঁ’ (আ‘রাফ ১৭২; আহমাদ, মিশকাত হা/১২১)। সেদিনের সেই তাওহীদের স্বীকৃতি ও বিশ্ব মানব সম্মেলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য আরাফার ময়দানে অবস্থান করাকে হজ্জের প্রধান অনুষ্ঠান হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বিশ্বের সকল প্রান্তের মুমিন-মুসলমান একত্রিত হয় ও আল্লাহর ইবাদতে রত হয়।

[5]. রাযীন, বাযযার, ত্বাবারাণী, ছহীহ আত-তারগীব হা/১১৫৪-৫৫।

[6]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৫৯৮; ছহীহাহ হা/১৫০৩।

[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪।

[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫।

[9]. ওয়াদিয়ে মুহাসসির : ‘মুহাস্সির’ ( المحسِّر ) অর্থ ‘অক্ষমকারী’। এই উপত্যকায় আবরাহার হাতী ‘মাহমূদ’ অক্ষম হয়ে বসে পড়েছিল। মক্কার দিকে এগোতে পারেনি। অল্প দূরে আরাফাত সন্নিহিত মক্কার নিকটবর্তী ‘মুগাম্মাস’ নামক স্থানে এসে আবরাহার পথপ্রদর্শক ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের আবু রেগাল মৃত্যুবরণ করেছিল। এভাবে আবরাহা বাহিনী এ এলাকাতেই আল্লাহর অদৃশ্য বাধার মাধ্যমে আটকে যায় এবং পরে আল্লাহ প্রেরিত পক্ষীবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাই এটি একটি গযবের এলাকা হওয়ার কারণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটি দ্রুত অতিক্রম করেন (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৬১)। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ কা‘বা গৃহকে اَلْبَيْتُ الْعَتِيْقُ বা ‘মুক্ত গৃহ’ বলেছেন (হজ্জ ২২/২৯)। কাফেরদের অধিকার থেকে যা সর্বদা মুক্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ। দ্বিতীয় : ৫০০´৪৫=২২,৫০০ বর্গ হাতের এই স্থানটি একটি নিন্দিত এলাকা। আভিজাত্যগর্বী কুরায়েশ নেতারা নিজেদেরকে অতি ধার্মিক ‘আহলুল্লাহ’ তথা আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা দাবী করে হজ্জের সময় আরাফার বদলে এখানে অবস্থান করত এবং নিজ নিজ বংশের ও বাপ-দাদাদের গৌরব বর্ণনা করত। কেননা মুযদালিফা হ’ল হারামের ভিতরে এবং আরাফাত হ’ল বাইরে। তারা সাধারণ লোকদের সাথে আরাফার ময়দানে অবস্থান করাকে হীনকর মনে করত। এর প্রতিবাদ স্বরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্থানটি দ্রুত অতিক্রম করেন (শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/১৬৬)।

[10]. জামরাতুল ‘আক্বাবাহ : হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে এখানেই শয়তান প্রথমে ধোঁকা দিয়েছিল। পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানীর জন্য মক্কা থেকে প্রায় ৮ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে মিনা প্রান্তরে নিয়ে যাওয়ার পথে বর্তমানে যে তিন স্থানে কংকর মারতে হয়, ঐ তিন স্থানে ইবলীস তিনবার ইবরাহীম (আঃ)-কে পুত্র কুরবানী থেকে বিরত রাখার জন্য ধোঁকা দিয়েছিল। আর তিনবারই ইবরাহীম (আঃ) শয়তানের প্রতি ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন’ (আহমাদ হা/২৭০৭, ২৭৯৫; সনদ ছহীহ)। সেই স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য এবং শয়তানের প্রতারণার বিরুদ্ধে মুমিনকে বাস্তবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এ বিষয়টিকে হজ্জ অনুষ্ঠানের আবশ্যিক বিষয় সমূহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (নবীদের কাহিনী ১/১৩৮ পৃঃ)। মনে রাখতে হবে যে, পিলারটি শয়তান নয়। আর শয়তান মারা লক্ষ্য নয়। বরং লক্ষ্য হবে ইবরাহীমী সুন্নাত পালন করা এবং ইবরাহীমের ন্যায় দৃঢ় ঈমান লাভ করা ও শয়তানের বিরুদ্ধে সর্বদা সতর্ক থাকা।

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, ইবরাহীম (আঃ) যেমন এখানেই প্রথম ইবলীসকে পাথর মেরে তাড়িয়ে ছিলেন, তেমনি এখানেই ইবরাহীমের শ্রেষ্ঠ সন্তান মানবকুল শিরোমণি শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ১৩ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুমে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী গভীর রজনীতে মানবরূপী শয়তানদের বিরুদ্ধে আল্লাহর অবিমিশ্র তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক বায়‘আত গ্রহণ করেন। ঐ রাতের ঐ বায়‘আত ও আক্বীদার বিপ্লব পরবর্তীতে আরব ভূখন্ডে যেমন সমাজ বিপ্লব সৃষ্টি করে, তেমনি তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি সবকিছুতে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। বর্তমানের বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ সে রাতে ইয়াছরিবের ৭৫ জন ঈমানদার নারী-পুরুষের গৃহীত ‘বায়‘আতে কুবরা’-র মাধ্যমে সূচিত সমাজ বিপ্লবের সোনালী ফসল মাত্র \

[11]. মাথা মুন্ডন ও ত্বাওয়াফে ইফাযাহ : মাথা মুন্ডনের তাৎপর্য হ’ল হারাম থেকে হালাল হওয়া এবং ইহরামের কারণে যা কিছু নিষিদ্ধ ছিল, তা সিদ্ধ হওয়া। অতঃপর ত্বাওয়াফে ইফাযাহর তাৎপর্য হ’ল, ৮ তারিখে মক্কা থেকে ইহরাম বেঁধে বিদায় নিয়ে এসে হজ্জ সমাধা করে পুনরায় আল্লাহর ঘরে ফিরে যাওয়া। অতঃপর পূর্ণ হালাল হওয়া।

[12]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৫৩৭-৩৮।

[13]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৫৩৬।

[14]. বায়হাক্বী ৯/২৮৬-৮৭।

[15]. মুসলিম ‘হজ্জ’ অধ্যায় হা/১৩১৮; মিশকাত হা/১৪৫৮; তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৪৬৯ ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।

[16]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৮-৫০।

[17]. বুখারী হা/১৯৯৭-৯৮ আয়েশা ও ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে।

[18]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৪৭।

[19]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৩৯।

[20]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৬৭৭; তুহফা হা/৯৬২।

[21]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৬৮।

[22]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ হা/১৪০৬; সনদ ছহীহ।

[23]. তিরমিযী হা/৯৫৯, মিশকাত হা/২৫৮০।

১০
যরূরী দো‘আ সমূহ (الأدعية الضرورية )
দো‘আর ফযীলত : আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘মুসলমান যখন অন্য কোন মুসলমানের জন্য দো‘আ করে, যার মধ্যে কোনরূপ গোনাহ বা আত্মীয়তা ছিন্ন করার কথা থাকে না, আল্লাহ উক্ত দো‘আর বিনিময়ে তাকে তিনটির যেকোন একটি দান করে থাকেন : (১) তার দো‘আ দ্রুত কবুল করেন অথবা (২) তার প্রতিদান আখেরাতে প্রদান করার জন্য রেখে দেন অথবা (৩) তার থেকে অনুরূপ আরেকটি কষ্ট দূর করে দেন। একথা শুনে ছাহাবীগণ বললেন, তাহ’লে আমরা বেশী বেশী দো‘আ করব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ আরও বেশী দো‘আ কবুলকারী’।[1] অত্র হাদীছে বর্ণিত উপরোক্ত শর্তটির সাথে অন্যান্য ছহীহ হাদীছে বর্ণিত আরও তিনটি শর্ত রয়েছে। যথা : (১) দো‘আকারীর খাদ্য, পানীয় ও পোষাক পবিত্র হওয়া (অর্থাৎ হারাম না হওয়া) (২) দো‘আ কবুল হওয়ার জন্য ব্যস্ত না হওয়া (৩) উদাসীনভাবে দো‘আ না করা এবং দো‘আ কবুলের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদী থাকা’।[2]

দো‘আ কবুলের স্থান ও সময় : আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব’।[3] এতে বুঝা যায় যে, যে কোন স্থানে যে কোন সময় যে কোন ভাষায় আল্লাহকে ডাকলে তিনি সাড়া দিবেন। তবে ছালাতের মধ্যে আরবী ব্যতীত অন্য ভাষায় দো‘আ করা যাবে না। দো‘আর জন্য হাদীছে বিশেষ কিছু স্থান ও সময়ের ব্যাপারে তাকীদ এসেছে, যেগুলি সংক্ষেপে বর্ণিত হ’ল :

(১) কুরআনী দো‘আ ব্যতিরেকে হাদীছে বর্ণিত দো‘আ সমূহের মাধ্যমে সিজদায় দো‘আ করা (২) শেষ বৈঠকে তাশাহ্হুদ ও সালামের মধ্যবর্তী সময়ে (৩) জুম‘আর দিনে ইমামের মিম্বরে বসা হ’তে সালাম ফিরানো পর্যন্ত সময়কালে (৪) রাত্রির নফল ছালাতে (৫) ছিয়াম অবস্থায় (৬) রামাযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ বেজোড় রাত্রিগুলিতে (৭) ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ে উঠে বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দু’হাত উঠিয়ে (৮) হজ্জের সময় আরাফা ময়দানে দু’হাত উঠিয়ে (৯) মাশ‘আরুল হারাম অর্থাৎ মুযদালিফা মসজিদে অথবা বাইরে স্বীয় অবস্থান স্থলে ১০ই যিলহাজ্জ ফজরের ছালাতের পর হ’তে সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত (১০) ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহাজ্জ তারিখে মিনায় ১ম ও ২য় জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর একটু দূরে সরে গিয়ে দু’হাত উঠিয়ে (১১) কা‘বাগৃহের ত্বাওয়াফের সময় রুকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে। (১২) ‘কারু পিছনে খালেছ মনে দো‘আ করলে, সে দো‘আ কবুল হয়। সেখানে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকেন। যখনই ঐ ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য দো‘আ করে, তখনই উক্ত ফেরেশতা ‘আমীন’ বলেন এবং বলেন তোমার জন্যও অনুরূপ হৌক’।[4] এতদ্ব্যতীত অন্যান্য আরও কিছু স্থানে ও সময়ে।

আরাফা, মুযদালিফা ও অন্যান্য স্থানে পঠিতব্য দো‘আ সমূহ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল আরাফার দো‘আ। আর আমি ও আমার পূর্বেকার নবীগণ শ্রেষ্ঠ যে দো‘আ করেছেন, তা হ’ল,

- لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ، لاَشَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ، يُحْيِىْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرً -

(১) উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহূ লা শারীকা লাহূ; লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, বিইয়াদিহিল খাইরু, ইউহ্য়ী ওয়া ইউমীতু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লে শাইয়িন ক্বাদীর।

অর্থ: ‘আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সকল রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সকল প্রশংসা। তাঁর হাতেই রয়েছে সকল কল্যাণ। তিনিই বাঁচান ও তিনিই মারেন। তিনি সব কিছুর উপরে ক্ষমতাবান’। ত্বাবারাণীর বর্ণনায় দো‘আটি আরাফার দিন সন্ধ্যায় পড়ার কথা এসেছে।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি মাগরিব ও ফজরের ছালাতের শেষে সালাম ফিরানোর পরপরই উক্ত দো‘আ দশবার পড়বে, সে ব্যক্তির জন্য প্রতি বারের বিনিময়ে ১০টি নেকী লেখা হবে, ১০টি গোনাহ মুছে দেওয়া হবে এবং তার মর্যাদার স্তর ১০টি করে উন্নীত করা হবে। এতদ্ব্যতীত এটি তার জন্য মন্দ কাজ হ’তে রক্ষাকবচ হবে ও বিতাড়িত শয়তান হ’তে সে নিরাপদ থাকবে এবং কোন পাপ তাকে স্পর্শ করবে না (অর্থাৎ তাকে ধ্বংস করতে পারবে না) শিরক ব্যতীত। অতঃপর সে ব্যক্তি হবে সকলের চাইতে উত্তম আমলকারী’।[6]

- سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلّهِ وَلآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أِكْبَرُ -

(২) উচ্চারণ: সুবহা-নাল্লা-হি ওয়ালহামদুলিল্লা-হি অলা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার।

অর্থ: আল্লাহ পবিত্র। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ সবার চেয়ে বড়’।[7]

- اَللَّهُمَّ إِنِّىْ اَسْئَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِىْ دِيْنِىْ وَ دُنْيَاىَ وَاَهْلِىْ وَ مَالِىْ -

(৩) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল ‘আফওয়া ওয়াল ‘আ-ফিয়াতা ফী দ্বীনী ওয়া দুন্ইয়া-য়া ওয়া আহ্লী ওয়া মা-লী।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি আমার দ্বীন ও দুনিয়ায়, আমার পরিবারে ও বিষয়-সম্পদে তোমার ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি’।[8]

- اَللَّهُمَّ إِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَ غَلَبَةِ الرِّجَالِ -

(৪) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়াল ‘আজযি ওয়াল কাসালি, ওয়াল জুবনি ওয়াল বুখ্লি, ওয়া যালা‘ইদ দায়নি ওয়া গালাবাতির রিজা-লি।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ হ’তে, অক্ষমতা ও অলসতা হ’তে, ভীরুতা ও কৃপণতা হ’তে এবং ঋণের বোঝা ও মানুষের যবরদস্তি হ’তে’।[9]

- اَللَّهُمَّ إِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْجُبْنِ وَ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ وَ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ اَرْذَلِ الْعُمُرِ وَ اَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا وَعَذَابِ الْقَبَرِ -

(৫) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিনাল জুব্নে, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিনাল বুখ্লে, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন আরযালিল ‘উমুরে, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন ফিৎনাতিদ্দুন্ইয়া ওয়া ‘আযা-বিল ক্বাব্রে।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! (১) আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি ভীরুতা হ’তে (২) আশ্রয় প্রার্থনা করছি কৃপণতা হ’তে (৩) আশ্রয় প্রার্থনা করছি জ্বরাজীর্ণ বয়স হ’তে এবং (৪) আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুনিয়ার ফিৎনা হ’তে ও (৫) কবরের আযাব হ’তে’।[10]

- اَللَّهُمَّ إِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ مِنْ زَوَالِ نِعْمَتِكَ وَتَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ وَفُجَاءَةِ نِقْمَتِكَ وَجَمِيْعِ سَخَطِكَ -

(৬) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন যাওয়া-লি নি‘মাতিকা, ওয়া তাহাউভুলি ‘আ-ফিয়াতিকা, ওয়া ফুজা-আতি নিক্বমাতিকা, ওয়া জামী‘ই সাখাত্বিকা।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি আমার থেকে তোমার নে‘মত চলে যাওয়া হ’তে, তোমার দেওয়া সুস্থতার পরিবর্তন হ’তে, তোমার শাস্তির আকস্মিক আক্রমণ হ’তে এবং তোমার যাবতীয় অসন্তুষ্টি হ’তে।[11]

- رَبِّ اَعِنِّىْ وَلاَتُعِنْ عَلَىَّ وَانْصُرْنِىْ وَلاَتَنْصُرْ عَلَىَّ وَاهْدِنِىْ وَيَسِّرِ الْهُدَى لِىْ -

(৭) উচ্চারণ: রবিব আ‘ইন্নী অলা তু‘ইন ‘আলাইয়া, ওয়ানছুরনী অলা তানছুর ‘আলাইয়া, ওয়াহদিনী ওয়া ইয়াসসিরিল হুদা লী।

অর্থ: ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সহায়তা দাও এবং আমার বিরুদ্ধে সহায়তা করো না। আমাকে সাহায্য কর এবং আমার বিরুদ্ধে সাহায্য করো না। আমাকে হেদায়াত দাও এবং আমার জন্য হেদায়াতকে সহজ করে দাও’।[12]

- اَللَّهُمَّ إِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ مِنْ جَهْدِ الْبَلاَءِ وَدَرَكِ الشَّقَاءِ وَ سُوْءِ الْقَضَاءِ وَ شَمَاتَةِ الْأَعْدَاءِ -

(৮) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন জাহদিল বালা-ই, ওয়া দারাকিশ শাক্বা-ই, ওয়া সূইল ক্বাযা-ই, ওয়া শামা-তাতিল আ‘দা-ই।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি অক্ষমকারী বিপদের কষ্ট হ’তে, দুর্ভাগ্যের আক্রমণ হ’তে, মন্দ ফায়ছালা হ’তে এবং শত্রুর হাসি হ’তে’।[13]

- يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِىْ عَلَى دِيْنِكَ، اَللَّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلُوْبِ صَرِّفْ قُلُوْبَنَا عَلَى طَاعَتِكَ -

(৯) উচ্চারণ: ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলূবি ছাবিবত ক্বালবী ‘আলা দীনিকা; আল্লা-হুম্মা মুছার্রিফাল ক্বুলূবি ছার্রিফ ক্বুলূবানা ‘আলা ত্বোয়া-‘আতিকা।

অর্থ: হে হৃদয় সমূহের পরিবর্তনকারী! আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের উপর দৃঢ় রাখো’। ‘হে অন্তর সমূহের রূপান্তরকারী! আমাদের অন্তর সমূহকে তোমার আনুগত্যের দিকে ফিরিয়ে দাও’।[14]

১০ - اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ -

(১০) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা ‘আফুববুন তোহেববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। তুমি ক্ষমা করতে ভালবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা কর’। বিশেষ করে লায়লাতুল ক্বদরে এটা পড়ার জন্য ‘আয়েশা (রাঃ)-কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দো‘আটি শিক্ষা দিয়েছিলেন’।[15]

১১ - اَللَّهُمَّ إِنِّىْ أَسْأَلُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى -

(১১) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল হুদা ওয়াততুক্বা ওয়াল ‘আফা-ফা ওয়াল গিনা।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট সুপথের নির্দেশনা, পরহেযগারিতা, চারিত্রিক পবিত্রতা এবং সচ্ছলতা প্রার্থনা করছি’।[16]

(১২) সাইয়িদুল ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দো‘আ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এই দো‘আ পাঠ করবে, দিবসে পাঠ করে রাতে মারা গেলে কিংবা রাতে পাঠ করে দিবসে মারা গেলে, সে জান্নাতী হবে’ (বুখারী)।-

১২ - اَللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّىْ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِىْ وَ أَنَا عَبْدُكَ وَ أَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَ وَعْدِكَ مَااسْتَطَعْتُ، أَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ وَ أَبُوْءُ بِذَنْبِىْ فَاغْفِرْلِىْ، فَإِنَّهُ لاَيَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ -

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা আনতা রববী লা ইলা-হা ইল্লা আনতা খালাক্বতানী, ওয়া আনা ‘আবদুকা ওয়া আনা ‘আলা ‘আহদিকা ওয়া ওয়া‘দিকা মাস্তাত্বা‘তু। আ‘ঊযুবিকা মিন শার্রি মা ছানা‘তু। আবূউ লাকা বিনি‘মাতিকা ‘আলাইয়া, ওয়া আবূউ বিযাম্বী, ফাগফিরলী। ফাইন্নাহূ লা ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা আনতা।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক। তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ এবং আমি তোমার দাস। আমি তোমার নিকটে কৃত অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির উপরে সাধ্যমত দৃঢ় আছি। আমি আমার কৃতকর্মগুলির অনিষ্টকারিতা হ’তে তোমার পানাহ চাচ্ছি। আমার উপরে তোমার অনুগ্রহ স্বীকার করছি এবং আমি আমার পাপসমূহ স্বীকার করছি। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর। কেননা তুমি ব্যতীত ক্ষমা করার কেউ নেই’।[17]

১৩ - سُبْحَانَ اللهِ، اَلْحَمْدُ لِلَّهِ، اَللهُ أَكْبَرُ، لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَه لاَشَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَ هُوَ عَلَى كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٌ -

(১৩) উচ্চারণ: সুবহা-নাল্লা-হি (৩৩ বার), আলহামদুলিল্লা-হি (৩৩ বার), আল্লা-হু আকবার (৩৩ বার), লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহূ লা শারীকা লাহূ, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লে শাইয়িন ক্বাদীর (১ বার)। অথবা আল্লা-হু আকবার (৩৪ বার)।

অর্থ: মহা পবিত্র আল্লাহ। যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। নেই কোন উপাস্য আল্লাহ ব্যতীত; তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সমস্ত রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা। তিনি সকল বস্ত্তর উপরে ক্ষমতাশালী’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এই দো‘আ পাঠকারী নিরাশ হবে না’। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি প্রতি ফরয ছালাত শেষে এই দো‘আ পাঠ করবে, তার সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে। যদিও তা সাগরের ফেনা সমতুল্য হয়’।[18]

১৪ - سُبْحَانَ اللهِ وَ بِحَمْدِهِ ، سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْمِ -

(১৪) উচ্চারণ: সুবহা-নাল্লা-হে ওয়া বিহামদিহী, সুবহানাল্লা-হিল ‘আযীম। অথবা সকালে ও সন্ধ্যায় ১০০ বার করে ‘সুবহা-নাল্লা-হে ওয়া বেহামদিহী’ পড়বেন।

অর্থ: মহাপবিত্র আল্লাহ এবং সকল প্রশংসা তাঁর জন্য। মহাপবিত্র আল্লাহ, যিনি মহান’। এই দো‘আ পাঠের ফলে তার সকল গোনাহ ঝরে যাবে। যদিও তা সাগরের ফেনা সমতুল্য হয়’।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, কালেমা দু’টি উচ্চারণে খুবই হালকা, মীযানের পাল্লায় খুবই ভারী, কিন্তু আল্লাহর নিকটে খুবই প্রিয়’।[19] ইমাম বুখারী (রহঃ) এই দো‘আর হাদীছটি বর্ণনার মাধ্যমে ছহীহ বুখারী শেষ করেছেন।

(১৫) আয়াতুল কুরসী :

১৫ - اَللهُ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّوْمُ، لآ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَّلاَ نَوْمٌ، لَهُ مَا فِى السَّمَاوَاتِ وَمَا فِى الْأَرْضِ، مَنْ ذَا الَّذِىْ يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ، يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ وَ مَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيْطُوْنَ بِشَيْئٍ مِّنْ عِلْمِه إِلاَّبِمَا شَآءَ، وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ، وَلاَيَئُودُهُ حِفْظُهُمَا، وَهُوَ الْعَلِىُّ الْعَظِيْمُ -

উচ্চারণ: আল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূম; লা তা’খুযুহু সেনাতুঁ ওয়ালা নাঊম; লাহূ মা ফিস্ সামা-ওয়াতে ওয়ামা ফিল আরয। মান যাল্লাযী ইয়াশ্ফা‘উ ‘ইন্দাহূ ইল্লা বি ইযনিহ; ইয়া‘লামু মা বায়না আয়দীহিম ওয়া মা খালফাহুম, ওয়া লা ইউহীত্বূনা বিশাইয়িম্ মিন ‘ইলমিহী ইল্লা বিমা শা-আ; ওয়াসে‘আ কুরসিইয়ুহুস্ সামা-ওয়া-তে ওয়াল আরযা, ওয়া লা ইয়াউদুহূ হিফযুহুমা, ওয়াহুওয়াল ‘আলিইয়ুল ‘আযীম (বাক্বারাহ ২/২৫৫)।

অর্থ : আল্লাহ তিনি, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব চরাচরের ধারক। কোনরূপ তন্দ্রা ও নিন্দ্রা তাঁকে স্পর্শ করে না। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবকিছু তাঁরই মালিকানাধীন। তাঁর অনুমতি ব্যতীত এমন কে আছে যে তাঁর নিকটে সুফারিশ করতে পারে? তাদের সম্মুখে ও পিছনে যা কিছু আছে সবকিছুই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসমুদ্র হ’তে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, কেবল যতটুকু তিনি দিতে ইচ্ছা করেন। তাঁর কুরসী সমগ্র আসমান ও যমীন পরিবেষ্টন করে আছে। আর এতদুভয়ের তত্ত্বাবধান তাঁকে মোটেই শ্রান্ত করে না। তিনি সর্বোচ্চ ও মহীয়ান’।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, প্রত্যেক ফরয ছালাত শেষে ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠকারীর জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য আর কোন বাধা থাকে না মৃত্যু ব্যতীত’ (নাসাঈ)। শয়নকালে পাঠ করলে সকাল পর্যন্ত তার হেফাযতের জন্য একজন ফেরেশতা পাহারায় নিযুক্ত থাকে। যাতে শয়তান তার নিকটবর্তী হ’তে না পারে’।[20]

(১৬) ঋণ মুক্তির দো‘আ :

১৬ - أَللَّهُمَّ اكْفِنِىْ بِحَلاَلِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَأَغْنِنِىْ بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ -

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাকফিনী বেহালা-লেকা ‘আন হারা-মেকা ওয়া আগ্নিনী বেফাযলেকা ‘আম্মান সেওয়া-কা।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হারাম ব্যতীত হালাল দ্বারা যথেষ্ট কর এবং তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে অন্যদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন কর’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এই দো‘আ পাঠের দ্বারা পাহাড় পরিমাণ ঋণ থাকলেও আল্লাহ তার ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করে দেন’।[21]

(১৭) বিপদ ও সংকটকালে দো‘আ :

১৭ - يَا حَىُّ يَا قَيُّوْمُ بِرَحْمَتِكَ اَسْتَغِيْثُ -

উচ্চারণ : ইয়া হাইয়ু ইয়া ক্বাইয়ূমু বেরহমাতিকা আস্তাগীছ।

অর্থ : হে চিরঞ্জীব! হে বিশ্ব চরাচরের ধারক! আমি তোমার রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি’। আনাস (রাঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর কোন কাজ কঠিন হয়ে দেখা দিত, তখন তিনি এ দো‘আটি পড়তেন’।[22]

অথবা দো‘আয়ে ইউনুস :

لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّىْ كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ -

উচ্চারণ : লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নী কুন্তু মিনায যোয়ালেমীন’ (আম্বিয়া ২১/৮৭)।

অর্থ: তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তুমি মহা পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মাছের পেটে ইউনুস এই দো‘আ পড়ে আল্লাহকে ডেকেছিলেন (এবং মুক্তি পেয়েছিলেন)। এক্ষণে যদি কোন মুসলিম কোন বিপদে পড়ে এ দো‘আ পাঠ করে, আল্লাহ তা কবুল করবেন’।[23]

(১৮) তওবার দো‘আ :

১৮ - اَسْتَغْفِرُ اللهَ الّذِىْ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّوْمُ وَ أَتُوْبُ إِلَيْهِ -

উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহে’।

অর্থ: ‘আমি আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব চরাচরের ধারক এবং আমি তাঁর দিকে ফিরে যাচ্ছি বা তওবা করছি’। এই দো‘আ পড়লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন, যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়নকারী হয়।[24] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, হে জনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর। কেননা আমি তাঁর নিকট দৈনিক একশ’ বার করে তওবা করি’।[25]

(১৯) জান্নাত প্রার্থনা ও জাহান্নাম থেকে বাঁচার দো‘আ :

১৯ - اَللَّهُمَّ أَدْخِلْنِى الْجَنَّةَ وَأَجِرْنِىْ مِنَ النَّارِ -

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা আদখিলনিল জান্নাতা ওয়া আজিরনী মিনান্না-র (৩ বার)।

অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাও এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ দাও’। এই দো‘আ পড়লে জান্নাত বলে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে জান্নাতে দাও। অন্যদিকে জাহান্নাম বলে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও![26]



زيارة المسجد النبوي r

মসজিদে নববীর যিয়ারত

এটি হজ্জ বা ওমরাহর কোন অংশ নয়। এটা না করলে হজ্জের নেকীর কোন ঘাটতি হয় না। তবে হজ্জের আগে বা পরে মসজিদে নববীর যিয়ারত এবং সেখানে ছালাত আদায়ের অশেষ নেকী হাছিলের উদ্দেশ্যে মদীনায় গমন করা যায়। শুধু মাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করা জায়েয নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,

لاَ تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلاَّ إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ : مَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْمَسْجِدِ الْأَقْصَى وَ مَسْجِدِىْ هَذَا، متفق عليه -

‘তিনটি মসজিদ ব্যতীত (নেকীর উদ্দেশ্যে) সফর করা যাবে না; মাসজিদুল হারাম, মাসজিদুল আক্বছা ও আমার এই মসজিদ’।[27] মসজিদে নববীতে একবার ছালাত আদায় বায়তুল্লাহ ছাড়া অন্য মসজিদে এক হাযার ছালাতের চাইতে উত্তম।[28]

এখানে তাঁর মসজিদের কথা বলা হয়েছে, কবরের কথা নয়। সাধারণভাবে যেকোন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যেয়ারত করা যাবে। কিন্তু কেবল উক্ত উদ্দেশ্যে ঘর হ’তে বের হওয়া এবং সফর করা নিষিদ্ধ। ‘যে ব্যক্তি আমার কবর যেয়ারত করবে, তার জন্য আমার শাফা‘আত ওয়াজিব হবে’ বা ‘আমি তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন সাক্ষী হব’ ইত্যাদি মর্মে যে সমস্ত হাদীছ বলা হয়ে থাকে, তার সবগুলিই জাল ও বাজে ( كلها واهية )।[29]

² মসজিদে নববীতে প্রবেশ ও বের হওয়ার দো‘আ এবং মাসজিদুল হারামে প্রবেশ ও বের হওয়ার দো‘আ একই। অতএব সেখানে দেখে নিন।

মসজিদে নববীতে প্রবেশের পর দু’রাক‘আত ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ ছালাত আদায় করবেন। তবে জামা‘আত চলতে থাকলে কোনরূপ নফল বা সুন্নাত না পড়ে সরাসরি জামা‘আতে যোগ দিবেন। সময় পেলে ইচ্ছামত নফল ছালাত আদায় করা যাবে। এটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাসগৃহ (বর্তমানে কবর) ও মিম্বরের মধ্যবর্তী ‘রওযা’র মধ্যে পড়াই উত্তম। এ স্থানটিকে হাদীছে ‘রওযাতুল জান্নাহ’ বা জান্নাতের বাগিচা বলা হয়েছে।[30] স্থানটি সবুজ রংয়ের খাম্বা দ্বারা বেষ্টিত।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কবর যেয়ারত :

‘রওযাতুল জান্নাহ’ থেকে একটু সামনে এগিয়ে বামে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে প্রথমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কবর বরাবর গিয়ে এভাবে সালাম দিবেন-

اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَ بَرَكَاتُهُ -

(১) উচ্চারণ: আসসালা-মু ‘আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ ওয়া রহমাতুল্লা-হে ওয়া বারাকা-তুহু।

অর্থ: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর শান্তিবর্ষিত হউক এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত সমূহ নাযিল হউক’!!

অতঃপর একটু এগিয়ে আবুবকর (রাঃ)-এর কবর বরাবর গিয়ে তাঁর উপর সালাম প্রদান করবেন।-

اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا أَبَابَكْرٍ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَ بَرَكَاتُهُ -

(২) উচ্চারণ: আসসালা-মু ‘আলায়কা ইয়া আবা বাকরিন ওয়া রহমাতুল্লা-হে ওয়া বারাকা-তুহু।

অর্থ: ‘হে আবুবকর! আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হউক এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত সমূহ নাযিল হউক’!!

অতঃপর একটু এগিয়ে ওমর (রাঃ)-এর কবর বরাবর গিয়ে তাঁর উপরে সালাম প্রদান করবেন।-

اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا عُمَرُ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَ بَرَكَاتُهُ -

(৩) উচ্চারণ: আসসালা-মু ‘আলায়কা ইয়া ‘ওমারো ওয়া রহমাতুল্লা-হে ওয়া বারাকা-তুহু।

অর্থ: ‘হে ওমর! আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হউক এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত সমূহ নাযিল হউক’!![31]

বাক্বী‘ গোরস্থান যিয়ারত : মসজিদে নববীর পূর্বদিকে ‘বাক্বী‘উল গারক্বাদ’ কবরস্থান যিয়ারত করা সুন্নাত। এখানে বহু ছাহাবী, তাবেঈ ও মুসলিম বিদ্বানমন্ডলীর কবর রয়েছে। তবে কবরের কোন চিহ্ন নেই এবং চিহ্ন তালাশ করাও উচিত নয়। এ সময় কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে দু’হাত তুলে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়বেন-

السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ وَأَتَاكُمْ مَا تُوعَدُونَ غَدًا مُؤَجَّلُونَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لاَحِقُونَ اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لأَهْلِ بَقِيعِ الْغَرْقَدِ -

উচ্চারণ: আসসালা-মু ‘আলায়কুম দারা ক্বাওমিন মু’মিনীন, ওয়া আতা-কুম মা তূ‘আদূনা গাদান মুআজ্জালূনা; ওয়া ইন্না ইনশা-আল্লা-হু বিকুম লা-হেকূন; আল্লা-হুম্মাগফির লিআহলি বাক্বী‘ইল গারক্বাদ।

অর্থ: কবরবাসী মুমিনগণ! আপনাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! আগামীকাল (ক্বিয়ামতের দিন) আপনারা লাভ করবেন যা আপনাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আর আমরাও আল্লাহ চাহেন তো সত্বর আপনাদের সাথে মিলিত হ’তে যাচ্ছি। হে আল্লাহ! আপনি ‘বাক্বী‘উল গারক্বাদ’-এর অধিবাসীদের ক্ষমা করুন’।[32]

অথবা নিম্নের দো‘আটি পড়বেন, যা শোহাদায়ে ওহোদ সহ সকল কবরস্থানে পড়া যায়।-

اَلسَّلاَمُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ، وَإِنَّا إِنْ شَآءَ اللهُ بِكُمْ لَلاَحِقُوْنَ، نَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ -

উচ্চারণ: আসসালা-মু ‘আলা আহলিদ্দিয়া-রি মিনাল মু’মিনীনা ওয়াল মুসলিমীনা; ওয়া ইন্না ইনশা-আল্লা-হু বিকুম লালা-হেকূন; নাসআলুল্লা-হা লানা ওয়া লাকুমুল ‘আ-ফিয়াতা’।

অর্থ: মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীগণ! আপনাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! আর আমরাও আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই আপনাদের সাথে মিলিত হ’তে যাচ্ছি। আমাদের ও আপনাদের জন্য আমরা আল্লাহর নিকটে কল্যাণ প্রার্থনা করছি’।[33]

[1]. আহমাদ, মিশকাত হা/২২৫৯ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়।

[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৫৯, ২২২৭; তিরমিযী, আহমাদ, মিশকাত হা/২২৪১।

[3]. গাফের/মুমিন ৪০/৬০।

[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/২২২৮, ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯।

[5]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৫৯৮; ত্বাবারাণী, ছহীহাহ হা/১৫০৩।

[6]. আহমাদ, মিশকাত হা/৯৭৫, সনদ হাসান।

[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/২২৯৫।

[8]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৩৯৭।

[9]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৪৫৮।

[10]. বুখারী, মিশকাত হা/৯৬৪।

[11]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৪৬১।

[12]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৪৮৮।

[13]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৪৫৭।

[14]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১০২; মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯।

[15]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২০৯১।

[16]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৪৮৪।

[17]. বুখারী, মিশকাত হা/২৩৩৫।

[18]. মুসলিম, মিশকাত হা/৯৬৬, ৯৬৭।

[19]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২২৯৬-৯৮।

[20]. বুখারী, নাসাঈ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৭২; মুসলিম, বুখারী, মিশকাত হা/২১২২-২৩।

[21]. তিরমিযী, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৪৪৯।

[22]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৪৫৪।

[23]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২২৯২।

[24]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৩৫৩; ছহীহাহ হা/২৭২৭।

[25]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৩২৫।

[26]. তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/২৪৭৮।

[27]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৯৩; আহমাদ, সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৭-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[28]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৯২।

[29]. আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ ওয়াল মওযূ‘আহ হা/৪৭,২০৩, ১০২১; ইরওয়াউল গালীল হা/১১২৭-২৮ প্রভৃতি।

[30]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৯৪।

[31]. বায়হাক্বী হা/১০০৫১, ৫/২৪৫; আলবানী, মানাসিকুল হাজ্জ পৃঃ ৬১ টীকা ১৩১; আল-মিনহাজ্জ লিল মু‘তামির ওয়াল হাজ্জ (রিয়াদ : ২য় সংস্করণ ১৪১৫ হিঃ), পৃঃ ১০৯।

[32]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৬৬।

[33]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৬৪।

১১
এক নযরে হজ্জ
(১) ‘মীক্বাত’ থেকে ইহরাম বেঁধে সরবে ‘তালবিয়াহ’ পড়তে পড়তে কা‘বা গৃহে পৌঁছবেন।

(২) কা‘বাকে বামে রেখে ‘হাজারে আসওয়াদ’ হ’তে ত্বাওয়াফ শুরু করবেন ও সেখানে এসে সাত ত্বাওয়াফ সমাপ্ত করবেন। ‘রুক্নে ইয়ামানী’ ও ‘হাজারে আসওয়াদ’-এর মধ্যে ‘রববানা আ-তিনা ফিদ্দুন্ইয়া ...’ (পৃঃ ৬৬) পড়বেন।

(৩) ত্বাওয়াফ শেষে মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে অথবা হারামের যে কোন স্থানে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করবেন। অতঃপর যমযমের পানি পান করবেন।

(৪) এরপর প্রথমে ‘ছাফা’ পাহাড়ে উঠে কা‘বার দিকে মুখ করে লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ ও তিনবার আল্লাহু আকবার বলবেন এবং দু’হাত তুলে তিন বার ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু... ওয়াহদাহূ... ওয়া হাযামাল আহ্যা-বা ওয়াহদাহূ’ (পৃঃ ৭৫-৭৬) দো‘আটি পড়ে ‘মারওয়া’র দিকে ‘সাঈ’ শুরু করবেন। অল্প দূরে গিয়ে দুই সবুজ চিহ্নের মধ্যে কিছুটা দ্রুত চলবেন। তবে মহিলাগণ স্বাভাবিক গতিতে চলবেন। ‘ছাফা’ হ’তে ‘মারওয়া’ পর্যন্ত একবার ‘সাঈ’ ধরা হবে। এইভাবে সপ্তম বারে ‘মারওয়ায়’ গিয়ে ‘সাঈ’ শেষ হবে।

(৫) ‘সাঈ’ শেষে মারওয়া থেকে বেরিয়ে মাথা মুন্ডন করবেন অথবা সব চুল ছোট করবেন। মহিলাগণ চুলের অগ্রভাগ থেকে এক আঙ্গুলের মাথা পরিমাণ সামান্য চুল ছাঁটবেন।

(৬) ‘হজ্জে তামাত্তু’ সম্পাদনকারী প্রথমে ওমরাহ শেষ করে হালাল হয়ে সাধারণ কাপড় পরিধান করবেন। কিন্তু ‘হজ্জে ইফরাদ’ ও ‘ক্বিরান’ সম্পাদনকারীগণ হজ্জ শেষে হালাল হওয়া পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থেকে যাবেন।

(৭) ৮ই যুলহিজ্জার দিন মক্কায় স্বীয় আবাসস্থল হ’তে গোসল করে ও খোশবু লাগিয়ে হজ্জের ইহরাম বেঁধে ‘লাববায়েক...’ বলতে বলতে মিনার দিকে রওয়ানা হবেন।

(৮) মিনায় পৌঁছে সেখানে যোহর, আছর, মাগরিব, এশা ও ফজরের ছালাত পৃথক পৃথকভাবে নির্দিষ্ট ওয়াক্তে ‘ক্বছর’ সহ আদায় করবেন। দুই ওয়াক্তের ছালাত একত্রে জমা করবেন না।

(৯) ৯ তারিখে সূর্যোদয়ের পর ধীরস্থিরভাবে ‘তালবিয়া’ ও ‘তাকবীর’ বলতে বলতে আরাফা ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করবেন। অতঃপর সেখানে গিয়ে আরাফার সীমানার মধ্যে অবস্থান করে ক্বিবলামুখী হয়ে দু’হাত তুলে দো‘আ ও যিকর-আযকারে রত হবেন। অতঃপর সূর্য পশ্চিমে ঢলার পরে হজ্জের খুৎবা শ্রবণ শেষে যোহর ও আছরের ছালাত ক্বছর সহ এক আযান ও দুই ইক্বামতে ‘জমা তাক্বদীম’ করে আদায় করবেন এবং পুনরায় দো‘আ, যিকর-আযকার ও তেলাওয়াতে রত হবেন।

অতঃপর সূর্যাস্তের পর আরাফা ময়দানে হ’তে মুযদালেফার দিকে রওয়ানা হবেন এবং সেখানে পৌঁছে মাগরিবের তিন রাক‘আত ও এশার দু’রাক‘আত ছালাত ক্বছর সহ এক আযান ও দুই ইক্বামতে এশার আউয়াল ওয়াক্তে ‘জমা তাখীর’ করে আদায় করবেন এবং ঘুমিয়ে যাবেন। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে আউয়াল ওয়াক্তে ফজরের ছালাত আদায় করে ক্বিবলামুখী হয়ে যিকর-আযকারে লিপ্ত হবেন ও হৃদয় ঢেলে দিয়ে দো‘আয় রত হবেন। অতঃপর ভালভাবে ফর্সা হ’লে সূর্যোদয়ের আগেই মিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন। এ সময় মুযদালিফা হ’তে ৭টি কংকর সংগ্রহ করে সাথে নিবেন।

(১০) মিনায় পৌঁছে সূর্যোদয়ের পর ‘জামরাতুল আক্বাবা’য় অর্থাৎ বড় জামরায় গিয়ে ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবেন ও প্রতিবারে ‘আল্লাহু আকবার’ বলবেন। কংকর মারা হ’লে কুরবানী করবেন। অতঃপর মাথা মুন্ডন করবেন অথবা ছোট করে সমস্ত মাথার চুল ছাঁটবেন। তবে এতে আগপিছ হ’লে দোষ নেই।

(১১) এরপর ইহরাম খুলে ‘প্রাথমিক হালাল’ হয়ে সাধারণ কাপড় পরিধান করবেন। প্রাথমিক হালাল হওয়ার পর স্ত্রী মিলন ব্যতীত বাকী সব কাজ সাধারণভাবে করা যাবে।

(১২) অতঃপর মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ সেরে তামাত্তু হাজীগণ ছাফা-মারওয়া সাঈ করবেন। কিন্তু ক্বিরান ও ইফরাদ হাজীগণ শুরুতে মক্কায় পৌঁছে সাঈ সহ ‘ত্বাওয়াফে কুদূম’ করে থাকলে শেষে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ্’র পর আর সাঈ করবেন না। এই ত্বাওয়াফ শেষে হাজীগণ পূর্ণ হালাল হবেন।

(১৩) ত্বাওয়াফে ইফাযাহ শেষে হাজীগণ মিনায় ফিরে আসবেন ও সেখানে রাত্রিযাপন করবেন। অতঃপর ১১, ১২ ও ১৩ তারিখে প্রতিদিন অপরাহ্নে তিন জামরায় ৩´৭=২১টি করে কংকর নিক্ষেপ করবেন।

(১৪) ১১ তারিখ দুপুরে সূর্য ঢলার পর ২১টি কংকর সাথে নিয়ে প্রথমে ছোট জামরায় ৭টি, তারপর মধ্য জামরায় ৭টি ও সবশেষে বড় জামরায় (জামরাতুল আক্বাবাহ) ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবেন এবং প্রতিবার নিক্ষেপের সময় ‘আল্লাহু আকবার’ বলবেন। ১ম ও ২য় জামরায় কংকর নিক্ষেপ শেষে একটু দূরে গিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দু’হাত উঠিয়ে প্রাণ খুলে দো‘আ করবেন।

(১৫) ১২ তারিখে কংকর মারার পর সূর্যাস্তের পূর্বেই যদি কেউ মক্কায় ফিরতে চান, তবে ফিরতে পারেন। কিন্তু যদি ১২ তারিখে রওয়ানা হওয়ার পূর্বেই সূর্য মিনায় ডুবে যায়, তাহ’লে তাকে সেখানে অবস্থান করে ১৩ তারিখে কংকর মেরে আসতে হবে। বাধ্যগত শারঈ ওযর থাকলে ১১, ১২ দু’দিনের যেকোন একদিনে একসাথে কংকর মেরে মক্কায় ফেরা যাবে।

(১৬) সবশেষে মক্কায় ফিরে ‘ত্বাওয়াফে বিদা’ বা বিদায়ী ত্বাওয়াফ করতে হবে। তবে ঋতুবতী ও নেফাসওয়ালী মেয়েদের জন্য এটা মাফ। ‘ত্বাওয়াফে বিদা‘র মাধ্যমে হজ্জ সমাপ্ত হবে ইনশাআল্লাহ।[1]

১২
হজ্জ পালনকালে কতিপয় ত্রুটি-বিচ্যুতি
মক্কায় : (১) অনেক হাজী ছাহেব ত্বাওয়াফ শেষের দু’রাক‘আত ছালাত দীর্ঘ করেন। অতঃপর ছালাত শেষে বসে দীর্ঘ মুনাজাতে লিপ্ত হন। এটি একেবারেই সুন্নাত বিরোধী কাজ। বরং মাত্বাফে সুযোগ না পেলে মাসজিদুল হারামের যেকোন স্থানে সংক্ষিপ্তভাবে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেই তিনি বেরিয়ে আসবেন।

(২) অনেকে মনে করেন মাসজিদুল হারামে প্রবেশের পর প্রথমে দু’রাক‘আত তাহিইয়াতুল মাসজিদ পড়ে মাত্বাফে যেতে হবে। এটা ভুল। বরং তিনি মনে করলে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে ওযূ করে সোজা মাত্বাফে গিয়ে ত্বাওয়াফ শেষে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করবেন। এটাই তাহিইয়াতুল মাসজিদের জন্য যথেষ্ট হবে। (৩) অনেকে ত্বাওয়াফ, সাঈ, ফরয ছালাত, সুন্নাত ও নফল ছালাত প্রতিটির জন্য পৃথক পৃথক নিয়ত মুখে পাঠ করেন। অথচ নিয়ত হ’ল হৃদয়ের সংকল্প। এটা মুখে বলা বিদ‘আত (৪) অনেকে অধিক নেকী ও দো‘আ কবুলের আশায় হাজারে আসওয়াদ, রুকনে ইয়ামানী, কা‘বার দরজা প্রভৃতি স্থানে মুখ-বুক লাগিয়ে উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করেন। অথচ ঐদিকে কেবল ইশারা করাই যথেষ্ট। তাছাড়া সুযোগ না পেলে হাজারে আসওয়াদে চুমু দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এতদ্ব্যতীত (৫) কা‘বা গৃহকে বা হাজারে আসওয়াদকে স্পর্শ করতে না পারলে কা‘বা গৃহের দেওয়ালে জায়নামায, রুমাল ইত্যাদি ছুঁড়ে দিয়ে সেটিতে বার বার চুমু খাওয়া (৬) বিদায়ী ত্বাওয়াফ শেষ করে ফেরার সময় কা‘বা গৃহের দিকে মুখ করে পিছন দিকে হেঁটে আসা (৭) ‘মসজিদে তান‘ঈম’ থেকে এহরাম বেঁধে বার বার বিভিন্ন জনের নামে ওমরাহ করা ও সবশেষে পুরুষদের মাথার দু’এক জায়গা থেকে সামান্য চুল কাটা (৮) দৌড়ে ও দল বেঁধে ত্বাওয়াফ করা এবং উচ্চৈঃস্বরে ও সমস্বরে দো‘আ পড়া (৯) মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে পুরুষের সারিতে ছালাত আদায় করা (১০) তামাত্তু হাজীদের ৮ তারিখে মিনা রওয়ানার পূর্বে ত্বাওয়াফ ও সাঈ করা (১১) যমযমের নিকট দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা (১২) ছাফা পাহাড়ের মাথায় ওঠা, সেখানে অযথা ভিড় করা ও কুরআন তেলাওয়াত করা (১৩) রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ না করে চুমু খাওয়া (১৪) নামে নামে ত্বাওয়াফ করা। যেমন- মায়ের নামে, ছেলের নামে ইত্যাদি (১৫) যমযমের পানিতে নিজের কাফনের কাপড় ধোয়া (১৬) মুছল্লীদের সারির ভিতরে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করা (১৭) ত্বাওয়াফ শেষের দু’রাক‘আত ছালাতের জন্য মাত্বাফে বসে পড়া ইত্যাদি।

মিনায় : (১) আইয়ামে তাশরীক্বে দুপুরে সূর্য ঢলার আগেই কংকর মারা (২) জামরাতুল আক্বাবায় কংকর মারার সময় অযথা মানুষকে ধাক্কা দেওয়া ও শক্তি প্রয়োগ করা (৩) কংকরের বদলে জুতা-স্যান্ডেল, ছাতা ইত্যাদি নিক্ষেপ করা (৪) কুরবানী কবুল হওয়া সম্পর্কে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নামে কুরবানী করা (৫) ওযর ছাড়াই সূর্যোদয়ের পূর্বে আরাফা ময়দানে গমন করা (৬) পুরুষের সম্পূর্ণ মাথা না মুড়িয়ে দু’এক জায়গা থেকে সামান্য চুল কাটা ইত্যাদি।

আরাফায় : (১) মসজিদে নামিরার ক্বিবলার দিকে চিহ্নিত অংশে অবস্থান করা, যা ‘আরাফা’র সীমানার বাইরে। এখানে যদি কেউ সূর্যাস্ত পর্যন্ত বসে থাকে, তাহ’লে তার হজ্জ বিনষ্ট হবে (২) বরকত মনে করে ‘জাবালে রহমত’-এর নিকটে অবস্থান নেওয়ার জন্য হুড়াহুড়ি করা ও সেখানে উঠে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা (৩) নিম্নস্বরে ‘তালবিয়া’ পাঠ করা (৪) জাবালে রহমতের বিভিন্ন অংশ থেকে পলিথিনের ব্যাগে মাটি সংগ্রহ করা ও তাতে সিজদা দিয়ে ছালাত আদায় করা (৫) ৯ তারিখে সূর্যাস্তের পূর্বে ‘আরাফা’ ময়দান ত্যাগ করা (৬) ‘মসজিদে নামিরা’তে এক আযানে ও দুই ইক্বামতে যোহর ও আছরের ছালাত আদায়কে সন্দেহ মনে করা ইত্যাদি।

মুযদালিফায় : (১) মুযদালেফার সীমানা মনে করে বাইরে অবস্থান করা ও সেখানে ছালাত আদায় করা (২) মধ্যরাতের আগে মুযদালিফার সীমানা ত্যাগ করে মিনায় প্রবেশ করা (৩) কোন ওযর ছাড়াই ফজর না পড়ে মুযদালিফা ত্যাগ করা ইত্যাদি।

মদীনায় : (১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বিদ‘আতী দরূদ পাঠ করা এবং সালাম পেশ ও কান্নাকাটি করে তাঁর নিকটে মনোবাঞ্ছা পেশ করা। দেওয়ালে হাত বুলানো ও ছবি তোলা (২) ‘আলী মসজিদ, আবুবকর মসজিদ ইত্যাদিতে বরকত মনে করে ছালাত আদায় করা (৩) মসজিদে নববীর খুঁটিকে ‘হান্না খুঁটি’, ‘আয়েশা খুঁটি’ ইত্যাদি মনে করে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করা ও এসবের অসীলায় দো‘আ করা (৪) মসজিদে নববীতে ৪০ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা ইত্যাদি।

১৩
প্রসিদ্ধ স্থান সমূহ(الأماكن الشهيرة)
মক্কায়( في مكة ):

১.বায়তুল্লাহ :পবিত্র কা‘বা গৃহকে ‘বায়তুল্লাহ’ বা আল্লাহর ঘর বলা হয়। বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম ইবাদতগাহ পবিত্র কা‘বা গৃহের চারপাশ ঘিরে তৈরী হয়েছে বিশালায়তন হারাম শরীফ। বর্তমান (২০১১ খৃঃ) আয়তন তিন লক্ষ ছাপ্পান্ন হাযার বর্গমিটার বা ৮৮.২ একর। সেখানে একত্রে ১০ লাখ মুছল্লীর ছালাত আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে হজ্জের মৌসুমে এ সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখে পৌঁছে যায়। কা‘বা চত্বরে ও আঙিনায় দেওয়া সাদা পুরু মার্বেল পাথর প্রচন্ড রৌদ্রে ঠান্ডা থাকে, যা সঊদী সরকারের নিজস্ব কারখানায় প্রস্ত্ততকৃত। মদীনা হ’তে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কারখানাটি বর্তমান বিশ্বে সেরা পাথর তৈরীর কারখানা হিসাবে বিবেচিত।

২.জাবালুন নূর :অর্থ জ্যোতির পাহাড়। এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ১২Í৫১/৪Í৭ বর্গফুট ‘হেরা গুহা’য় প্রথম ‘অহি’ নাযিল হয়। গৃহীত মতে তারিখটি ছিল সোমবার ২১শে রামাযান দিবাগত রাতে মোতাবেক ১০ই আগষ্ট ৬১০ খৃষ্টাব্দ।[1]হাদীছে যাকে ‘গারে হেরা’ বলা হয়েছে।[2]বায়তুল্লাহ থেকে ৬ কিঃমিঃ উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এ পাহাড়টি মক্কার ট্যাক্সিওয়ালাদের নিকটে ‘জাবালুন নূর’ নামে পরিচিত। সকালে বা বিকালে পাহাড়ে ওঠা চলে। রাতে ওঠা নিষিদ্ধ। এখানে ‘অহি’ নাযিলের সূত্রপাত হ’লেও এর পৃথক কোন ধর্মীয় গুরুত্ব নেই। এটাকে পবিত্র স্থান হিসাবে গণ্য করার কোন প্রমাণ কুরআন-হাদীছ ও ছাহাবায়ে কেরামের আমল-আচরণে পাওয়া যায় না। যদিও বিদ‘আতীরা এখানে এসে অনেকে ছালাত আদায় করে ও কান্নাকাটি করে থাকে। এখানকার নুড়ি-কংকর বরকত মনে করে বাড়ীতে নিয়ে যায়।

৩. গারে ছাওর : অর্থ, ছওর গুহা। বায়তুল্লাহর দক্ষিণ-পূর্বে ৩ কিঃমিঃ দূরে ‘ছওর’ পাহাড় অবস্থিত। আল্লাহর হুকুমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রিয় সাথী আবুবকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে গভীর রাতে কাফের নেতাদের হত্যা বেষ্টনী ভেদ করে ইয়াছরিবে হিজরতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পিছু ধাওয়াকারী কাফেরদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাঁরা রাতেই ছাওর গিরিগুহায় আশ্রয় নেন।[3]পুরস্কার লোভী রক্ত পিপাসু কাফেররা গুহা মুখে গিয়েও ফিরে যায় এবং আল্লাহর রহমতে তাঁরা রক্ষা পান। তবে বর্তমানে যেটাকে ‘গারে ছাওর’ বলা হচ্ছে, সেটা সেই গুহা কি-না, এ বিষয়ে অনেকে সন্দেহ করেন। হেরা গুহার ন্যায় ছাওর গুহারও কোন ধর্মীয় গুরুত্ব নেই। যদিও এখানে রয়েছে বিদ‘আতীদের ব্যাপক আনাগোনা।

৪.জি‘ইর্রা-নাহ মসজিদ :এটি মাসজিদুল হারাম থেকে ১৬ কিঃমিঃ পূর্বে হোনায়েন-এর পথে জি‘ইর্রা-নাহ উপত্যকায় অবস্থিত। এখানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ৮ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে হোনায়েন যুদ্ধের গণীমত বণ্টন করেছিলেন। অতঃপর এখান থেকেই রাতের বেলা মক্কায় এসে ওমরাহ করে রওয়ানা হন এবং ২৪শে যুলক্বা‘দাহ মদীনায় পৌঁছেন।[4]

৫.তান‘ঈম মসজিদ :মসজিদুল হারাম থেকে ৬ কিঃমিঃ উত্তরে মক্কা-মদীনা সড়কে (আল-হিজরাহ রোডে) অবস্থিত এ মসজিদটি ‘মসজিদে আয়েশা’ নামে পরিচিত। বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্ত্রী আয়েশাকে তার ভাই আব্দুর রহমানের সাথে হারামের বাইরে এখান থেকে ওমরাহর ইহরাম বাঁধার জন্য পাঠিয়েছিলেন।[5]মসজিদটি ইসলামী শিল্পনৈপুণ্যের এক অনুপম নিদর্শন। অত্র দু’টি মসজিদ হারাম এলাকার বাইরে অবস্থিত। যেখান থেকে মক্কাবাসীগণ ওমরাহর জন্য ইহরাম বেঁধে থাকেন। বর্তমানে ভিনদেশী হাজীদের অনেকে ‘আয়েশা মসজিদ’ থেকে বারবার ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন ওমরাহর ইহরাম বেঁধে থাকেন। যা একেবারেই ভিত্তিহীন ও বিদ‘আতী কাজ।

মদীনায়( في المدينة ):

১.মসজিদে নববী:আঙ্গিনা সহ বর্তমান (২০০০ খৃঃ) আয়তন ৩,০৫,০০০ (তিন লক্ষ পাঁচ হাযার) বর্গমিটার। যেখানে হজ্জ মওসুমে ১০ লাখ হাজী একত্রে ছালাত আদায় করেন। বর্তমানে পুরা আঙিনা ছাতাবেষ্টিত করা হয়েছে। যা প্রতিদিন সময়মত খোলা ও বন্ধ করা হয়।

২.ফাহ্দ কুরআন কমপ্লেক্স :পবিত্র কুরআনের মুদ্রণ, অনুবাদ ও ক্যাসেট প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত এই কমপ্লেক্স ‘মুজাম্মা‘ মালেক ফাহ্দ’ নামে পরিচিত। ২,৫০,০০০ বর্গমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই বিশাল কমপ্লেক্স ১৪০৫/১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১১ মিলিয়ন (এক কোটি দশ লক্ষ) কপি কুরআন শরীফ। এযাবৎ (২০১১) তের কোটি ষাট লাখ কপি মুছহাফ মুদ্রিত ও বিতরিত হয়েছে এবং বাংলা, উর্দূ, ইংরেজী ও চীনা সহ অন্যূন ৫০টি ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

৩.ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় :মসজিদে নববী থেকে পশ্চিমে অন্যূন ৫ কিলোমিটার দূরে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশালায়তন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে (২০১১) ১৬০ টিরও বেশী দেশের পনের হাযারের অধিক ছাত্র পড়াশুনা করে।

৪.মসজিদে ক্বোবা :মসজিদে নববী থেকে ২ কিঃমিঃ দক্ষিণে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনার ‘প্রথম মসজিদ’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি শনিবারে সওয়ারীতে বা পদব্রজে এখানে এসে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন’। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি বাড়ী থেকে ওযূ করে এখানে এসে ছালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তি একটি ওমরাহ করার সমান নেকী পাবে।[6]

৫.মসজিদে যুল-ক্বিবলাতায়েন :মসজিদে নববীর পূর্বদিকে অনতিদূরে অবস্থিত অত্র ‘বনু সালামাহ’ মসজিদে যোহরের ছালাতরত অবস্থায় আয়াত নাযিল হওয়ার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর বিপরীতে কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায় শুরু করেন। এ জন্য একে ‘দুই ক্বিবলার মসজিদ’ বলা হয়(কুরতুবী)। উল্লেখ্য যে, হিজরতের পর থেকে প্রায় ১৭ মাস রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহর হুকুমে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে ফিরে ছালাত আদায় করেছিলেন(ইবনু কাছীর)।

৬. সাব‘আ মাসাজিদ :সাতটি মসজিদ বলা হ’লেও প্রকৃত প্রস্তাবে ৬টি মসজিদ রয়েছে। (১) মসজিদুল ‘ফাত্হ’। সম্মিলিত আরব শক্তির বিরুদ্ধে ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত ‘আহযাব যুদ্ধে’ অবিস্মরণীয় বিজয় লাভের স্মৃতি হিসাবে উমাইয়া খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৯৯-১০১ হিঃ) উক্ত মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন (২) মসজিদে ‘আবুবকর’ (৩) মসজিদে ‘ওমর’ (৪) মসজিদে ‘আলী’ (৫) মসজিদে ‘ফাতেমা’ (৬) মসজিদে ‘সালমান ফারেসী (রাঃ)’। কেউ কেউ মসজিদে ক্বিবলাতায়েন-কে উক্ত ৭ মসজিদের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। এই সকল মসজিদের পৃথক কোন ধর্মীয় গুরুত্ব নেই। যদিও অনেকে এই সব মসজিদে ছালাত আদায়ের জন্য খুবই উদগ্রীব থাকেন।

৭.বাক্বী‘উল গারক্বাদ :মসজিদে নববী থেকে বেরিয়ে পূর্ব-দক্ষিণে পাকা প্রাচীর বেষ্টিত প্রায় এক মাইল ব্যাসার্ধের এই বিশাল কবরস্থানটি অবস্থিত। যেখানে হযরত ওছমান গণী (রাঃ), হযরত ফাতেমা (রাঃ) সহ অসংখ্য ছাহাবী, তাবেঈ, ইমাম-মুজতাহিদ, শহীদ, গাযী ও ওলামায়ে কেরামের কবর রয়েছে। যদিও কোথাও কবরের কোন চিহ্ন নেই। বর্তমানে এটি মদীনা পৌর এলাকার কবরস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

‘গারক্বাদ’ নামক অত্র স্থানটি জনৈক ইহুদীর খেজুর বাগান ছিল এবং বৃক্ষশোভিত সমতলভূমি হওয়ায় এটিকে ‘বাক্বী‘ বলা হ’ত। এখানে হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর কবর থাকায় শী‘আরা এর নাম দিয়েছে ‘জান্নাতুল বাক্বী‘। যা বলা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। ‘ফাতেমার কবুতর’ মনে করে বিদ‘আতীরা এখানে কবুতরের জন্য দৈনিক শত শত প্যাকেট গম ছড়িয়ে দেয়। যেখানে পৃথিবীতে মানুষের খাবার জোটে না, সেখানে মানুষের খাদ্য পাখিকে খাওয়ানো নিঃসন্দেহে অপচয় ও গোনাহের কাজ। সেই সাথে বিদ‘আতের গুনাহ তো আছেই।

৮. শোহাদায়ে ওহোদ কবরস্থান :মসজিদে নববী থেকে ৩ কিঃ মিঃ উত্তরে ওহোদ যুদ্ধের স্মৃতিধন্য স্বল্প উঁচু প্রাচীরঘেরা এই কবরস্থানে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয় চাচা হামযাহ (রাঃ) সহ ৭০ জন শহীদ ছাহাবীকে দাফন করা হয়। যদিও কবরের কোন চিহ্ন নেই। তাঁদের উদ্দেশ্যে সালাম দেওয়া সাধারণভাবে কবর যিয়ারতের ন্যায় জায়েয রয়েছে। কিন্তু নেকী মনে করে কেবলমাত্র ঐ স্থানের উদ্দেশ্যে গমন করা জায়েয নয়। বর্তমানে এখানে ‘শোহাদা মার্কেট’ গড়ে উঠেছে।

আল্লাহ সকল মুমিনকে হজ্জে গমন করার এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর তরীকা মোতাবেক হজ্জ সম্পাদন করার তাওফীক দান করুন- আমীন!!



কতগুলি উপদেশ ( بعض النصائح للحاج ):

হজ্জের সকল অনুষ্ঠান ধীরে-সুস্থে ও বিনয়ের সাথে করবেন। সর্বদা ধৈর্য ধারণ করবেন।

‘তালবিয়াহ’ ব্যতীত অন্য সকল দো‘আ নিম্নস্বরে ও কাকুতি সহকারে পড়বেন। বিতর্ক ও ঝগড়া এড়িয়ে চলবেন। হুড়াহুড়ি করবেন না। হাত ও যবান দ্বারা কাউকে কষ্ট দিবেন না। সর্বদা হাসিমুখে থাকবেন।

ধর্ম পালনে বাড়াবাড়ি করবেন না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা ধর্মে বাড়াবাড়ি করোনা। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগুলি ধ্বংস হয়েছে ধর্মে বাড়াবাড়ি করার কারণে’।[7]তাই বলে শৈথিল্যবাদী হবেন না। শৈথিল্যবাদীরা ইসলামের দুশমন। সর্বদা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করুন।[8]

সকল ইবাদত ইত্তেবায়ে সুন্নাতের উপর ভিত্তিশীল। অতএব ছহীহ হাদীছের বাইরে কোন ইবাদত করবেন না।

(ক) হজ্জ থেকে ফেরাকে নতুন জীবন লাভ মনে করুন (খ) এখন থেকে বেশী করে নফল ইবাদত শুরু করুন (গ) যাবতীয় শিরক-বিদ‘আত ও হারাম কাজ বর্জন করুন। কারণ শিরক করলে তার উপর আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করে দেন(মায়েদাহ ৭২)(ঘ) কম কথা বলুন ও নেকীর কাজে প্রতিযোগিতা করুন (ঙ) সর্বদা তওবা-ইস্তিগফার করুন ও নিজেকে পরপারে যাত্রার জন্য প্রস্ত্তত করুন।

মনে রাখবেন, কবুল হজ্জের লক্ষণ হ’ল- পূর্বের চেয়ে উত্তম হওয়া এবং গোনাহে লিপ্ত না হওয়া। অতএব ছোট গোনাহ থেকে বিরত থাকুন। কেননা ছোট গোনাহ বারবার করলে তা কবীরা গুনাহে পরিণত হয়, যা তওবা ব্যতীত মাফ হয় না।আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন! আমীন!!

œপথনির্দেশ

কা‘বা হ’তে- (১) জেদ্দা ৭৩ কিঃমিঃ দক্ষিণে (২) ইয়ালামলাম ৯২ কিঃমিঃ দক্ষিণে (৩) মদীনা ৪৬০ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিমে (৪) মিনা ৮ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে (৫) ও আরাফাত ২২.৪ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে। আর (৬) মিনা হ’তে আরাফাত ১৪.৪ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে (৭) আরাফাত হ’তে মুযদালেফা ৯ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিমে (৮) মুযদালেফা হ’তে মিনা ৫ কিঃমিঃ উত্তরে (৯) কা‘বা হ’তে হেরা পাহাড় ৬ কিঃমিঃ উত্তর-পূর্বে (১০) ছওর পাহাড় ৩ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে। (১১) যমযম কা‘বা গৃহের দক্ষিণ-পূর্বে (১২) ছাফা ও মারওয়া কা‘বার পূর্বে দক্ষিণ হ’তে উত্তরে প্রায় অর্ধ কিঃমিঃ (৪৫০ মিটার)। সাত সাঈ-তে মোট ৩.১৫ কিঃমিঃ (১৩) জেদ্দা হ’তে মদীনা ৪৪০ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিমে (১৪) মদীনা হ’তে বদর প্রান্তর ১৪৫ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পশ্চিমে \

১. মক্কার হারামের চতুঃসীমা :উত্তরে তান‘ঈম (৬ কিঃমিঃ), উত্তর-পূর্বে নাখলা উপত্যকা (১৪ কিঃমিঃ), দক্ষিণে আযাহ (১২ কিঃমিঃ), পূর্বে জি‘ইর্রা-নাহ (১৬ কিঃমিঃ), পশ্চিমে হোদায়বিয়াহ (১৫ কিঃমিঃ)।

২. মদীনার হারামের চতুঃসীমা :৩ কিঃমিঃ উত্তরে ওহোদ পাহাড় ও ১০ কিঃমিঃ দক্ষিণে যুল হুলাইফা পাহাড়ের মধ্যবর্তী ১২ মাইল এলাকা।

উল্লেখ্য যে, মক্কা ও মদীনা ব্যতীত পৃথিবীর কোথাও ‘হারাম’ এলাকা নেই। এমনকি বায়তুল মুক্বাদ্দাসও নয়। এ দুই হারামের সম্মান বজায় রাখা ওয়াজিব। ‘এখানে কোন অস্ত্র বহন করা যাবে না। এমনকি গাছের পাতাও ছেঁড়া যাবে না গবাদিপশুর খাদ্যের কারণে ব্যতীত’।[9]



سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لآ إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك، اللهم اغفرلي ولوالدىَّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب -



[1]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম পৃঃ ৬৬।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত, হা/৫৮৪১ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায়।

[3]. ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মোতাবেক ৬২২ খৃষ্টাব্দের ১২/১৩ সেপ্টেম্বর, আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৬৩-৬৪।

[4]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪২২।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত, হা/২৫৫৬।

[6]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৭২; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৯৫; আহমাদ, ছাহীহাহ হা/৩৪৪৬।

[7]. আহমাদ, নাসাঈ, ছহীহুল জামে‘ হা/২৬৮০।

[8]. বুখারী, মিশকাত হা/১২৪৬।

[9]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/২৭১৫, ২৭৩২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৮৯-৯১।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন