HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কুরআন-হাদিসের আলোকে সুদের ক্ষতি-অপকার-কুপ্রভাব

লেখকঃ সায়ীদ বিন আলী বিন ওয়াহাফ আল-কাহতানি

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কুরআন-হাদিসের আলোকে সুদের ক্ষতি-অপকার-কুপ্রভাব

লেখক : সায়ীদ বিন আলী বিন ওয়াহাফ আল-কাহতানি

অনুবাদ : আলী হাসান তৈয়ব

সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

ভূমিকা
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সুদ, সুদের অপকারিতা ও তার ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে বেশি বেশি আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ যে সুদী কারবার করে সে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর কোনো মুসলমান এমনটি কল্পনাও করতে পারে না। তাই এ থেকে দূরে থাকতে প্রতিটি মুসলমানের জন্য সুদের বিধান ও তার প্রকার-প্রকরণ জানা অপরিহার্য।

এ গুরুত্ব বিবেচনা করেই আমি নিজের এবং আমার মতো জ্ঞানের দৈন্যতায় ভোগা মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য সুদের বিধানাবলির ওপর কুরআন-হাদিসের দলিলাদি একত্রিত করেছি। বর্ণনা করেছি ব্যক্তি ও সমাজের ওপর এর কুপ্রভাবের দিকগুলোও।

আমি প্রথমে ভূমিকা তারপর তিনটি পর্ব এবং সবশেষে উপসংহার তুলে ধরে বইটির বিন্যাস করেছি এভাবে-

প্রথম পর্ব : প্রাক ইসলামি যুগে সুদ। এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-

প্রথম অধ্যায় : রিবা বা সুদের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ।

দ্বিতীয় অধ্যায় : ইহুদি ধর্মে সুদ।

তৃতীয় অধ্যায় : জাহিলি যুগে সুদ।

দ্বিতীয় পর্ব : ইসলাম ধর্মে সুদের অবস্থান। এ পর্বে রয়েছে চারটি অধ্যায়। যথা-

প্রথম অধ্যায় : সুদ সম্পর্কে সতর্কিকরণ।

দ্বিতীয় অধ্যায় : রিবায়ে ফযল- (ক) রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য। (খ) এর বিধান এবং রিবার সকল প্রকার। এবং (গ) রিবা হারাম হওয়ার কারণ ও হিকমত।

তৃতীয় অধ্যায় : রিবায়ে নাসিয়া। (ক) সংজ্ঞা (খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য।

চতুর্থ অধ্যায় : বাইয়ে ইনা। (ক) সংজ্ঞা (খ) এর বিধান এবং তার নিন্দায় বর্ণিত কয়েকটি উদ্ধৃতি।

তৃতীয় পর্ব : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে। এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-

প্রথম অধ্যায় : ওজন বা পরিমাপ করে বিক্রি হয় না এমন জিনিস কম-বেশি করে বেচা-কেনা বৈধ।

দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইয়ে সরফ এবং তার বিধান।

তৃতীয় অধ্যায় : সন্দেহ থেকে দূরে থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করণ।

চতুর্থ পর্ব : সমকালীন রিবার কতিপয় মাসআলার ব্যাপারে ফতোয়া।

পঞ্চম পর্ব : সুদের ক্ষতি ও অপকারিতা এবং তার কুপ্রভাব।

উপসংহার : এতে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল।

প্রথম পর্ব: প্রাক ইসলামি যুগে সুদ
প্রথম অধ্যায় : ‘রিবা’ বা সুদের শাব্দিক ও শরয়ি অর্থ।

দ্বিতীয় অধ্যায় : ইহুদি ধর্মে সুদ।

তৃতীয় অধ্যায় : জাহিলি যুগে সুদ।

প্রথম অধ্যায় : ‘রিবা’ বা সুদের শাব্দিক ও শরয়ি অর্থ
‘রিবা’র আভিধানিক অর্থ : বৃদ্ধি করা। যেমন-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

(আরবি)

‘অতঃপর যখনই আমি তাতে পানি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও স্ফীত (বৃদ্ধি প্রাপ্ত) হয়।’ [. হজ : ০৫] আরও ইরশাদ করেন-

(আরবি)

‘একদল অপর দলের চেয়ে বড় হবে।’ [. নাহল : ৯২] অর্থাৎ অধিক সংখ্যক। যেমন বলা হয় অমুকে অমুকের চেয়ে বেশি লাভ করেছে। [. মুগনি : ৬/৫১]

রিবার আসল অর্থ বৃদ্ধি : তা মূলে নয়তো মূলের বিনিময়ের মাঝে। যেমন এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম। আবার প্রত্যেক হারাম ও নিষিদ্ধ ব্যবসাকেও রিবা বলা হয়। [. শরহুন নাবাবি আলা মুসলিম: ৮/১১, ফাতহুল বারি : ৪/৩১২]

রিবার শরয়ি বা পারিভাষিক অর্থ

নির্দিষ্ট কয়েকটি জিনিসে কম-বেশি করা। দুই ধরনের রিবার ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা প্রযোজ্য। যথা- রিবাল-ফযল ও রিবান-নাসিয়া।

দ্বিতীয় অধ্যায় : ইহুদি ধর্মে সুদ।
ইহুদিরা সেই আদিকাল থেকেই ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশল প্রিয় জাতি হিসেবে প্রসিদ্ধ। তারা তাদের কাছে প্রেরিত নবীর বিরুদ্ধে নানা কূটচাল চালত। তাদের সেসব কূটকৌশলের একটি ছিল সুদ খাওয়ার ব্যাপারে কৌশলের আশ্রয় নেয়া। অথচ তাদের নবী এ থেকে তাদের বারণ করেছেন। হারাম ঘোষণা করেছেন সুদ খাওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

(আরবি)

সুতরাং ইয়াহুদীদের যুলুমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।’ [. নিসা :১৬০-১৬১]

হাফেজ ইবনে কাসির রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তথা ইহুদিদের সুদ খেতে নিষেধ করেন, তারপরও তারা সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকেনি। এজন্য তারা নানা কৌশল গ্রহণ করল। বিষয়টিকে সন্দেহের বাতাবরণে ঢেকে ফেলল আর মানুষের সম্পদ খেতে লাগল অবৈধ পন্থায়।’ [. তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/৫৮৪]

ইহুদিরা সুদ হারাম ঘোষণাকারী বক্তব্যকেই বিকৃত করল। তারা সে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাঁড় করাল এভাবে, ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদ খাওয়া নিষেধ, তবে অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে ইহুদিদের সুদী কারবার করতে কোনো বারণ নেই। রাব নামক এক ইহুদি যাজক বলে, যখন কোনো খৃস্টানের দরকার পড়বে দিরহামের, ইহুদির উচিৎ হবে সর্বদিক থেকে এ সুযোগে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করা। তাকে আটকে ফেলা ব্যাপক লাভের বেড়াজালে। যাতে সে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়। এবং তার সম্পদের মালিকানা খর্ব হয় কিংবা তার সম্পদ এবং ঋণ সমান্তরাল হয়ে যায়। এভাবে ইহুদি খৃষ্টান ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব লাভ করবে অতপর বিচারকের সহযোগিতায় তার সম্পদের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হবে। [. উমর বিন সুলাইমান আল আশকার, সুদ ও মানব সমাজের ওপর তার কুপ্রভাব: ৩১]

সুতরাং আল্লাহর বাণীর আলোকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি তাওরাত গ্রন্থেই ইহুদিদের ওপর সুদ হারাম করেছেন। তারা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে এবং কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাঁর বাণীর বিকৃতি সাধন করেছে। তারা মনগড়া ব্যাখ্যা স্থির করেছে যে, হারাম শুধু ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদী লেনদেন করা অন্যথায় অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে সুদী কারবার করা হারাম নয়। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে তাদের ভৎর্সনা করেছেন। যেমনটি জানা গেল উপরের আয়াত থেকে।

তৃতীয় অধ্যায় : জাহিলি যুগে সুদ
জাহিলি যুগে সুদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এমনকি তারা তাদের ধারণা মতে এটাকে বিশাল লাভ হিসেবে গণ্য করত। ইমাম তাবারি রহ. তদীয় তাফসির গ্রন্থে ইমাম মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, জাহিলি যুগে তারা এমন ছিল যে, কারও ওপর কারও ঋণ থাকলে সে বলত, ‘আমি তোমার পাওনা অর্থ আরও পরে শোধ করব, বিনিময়ে এ পরিমাণ অর্থ পাবে। এতে সে সম্মত হয়ে যেত। [. জামেউল বায়ান ফি তাফসিরি আয়িল কুরআন : ৩/৬৭]

জাহিলি যুগের লোকদের অভ্যাস ছিল, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে জিজ্ঞেস করত, তুমি কি এখন ঋণ পরিশোধ করবে নাকি বেশি দেয়ার শর্তে আরও সময় নেবে ? ঋণ পরিশোধ না করলে তার ওপর বৃদ্ধির হার ধার্য করে দিত। আর ঠিক করে দিত নতুন মেয়াদ।

জাহিলি যুগে চক্রবৃদ্ধি সুদ যেমন ছিল নগদ অর্থে, গবাদি পশুর ওপরও তেমনি প্রচলিত ছিল বাৎসরিক সুদ। যদি কারও কাছে কারও ঋণের অতিরিক্ত পাওনা থাকত সে মেয়াদ পূর্ণ হওয়া মাত্র তার কাছে এসে বলত, ‘তুমি কি ঋণ শোধ করে দিবে নাকি অতিরিক্তসহ পরে দেবে ? যদি সে দিতে পারত দিয়ে দিত; নয়তো সে তার কাছে সেই উট দিত যা তার পাওনা উটের চেয়ে এক বছরের বড়। যদি তার পাওনা হত বিনতে মাখায বা এক বছরের উট সে দিত বিনতে লাবুন বা দুই বছরের উট। অতপর তার কাছে দ্বিতীয় বছর পাওনা চাইতে আসলে না দিতে পেরে হিক্কা দিত তৃতীয় বছরে। এ মেয়াদ শেষ হলে সে এলে তাকে জিযআ বা চার বছরের উট দিত। এভাবে ওপরে উঠতে উঠতে ঋণদাতা বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে যেত। অষ্টম বছরে তার কাছে এলে যখন সে তাও পরিশোধ না করতে পারত পরের বছর তাকে দ্বিগুণ দিত। সে বছর না দিতে পারলে তারও দ্বিগুণ দিত। যখন একশতটি হত তখন দুইশতটি দিতে হত। এ বছর দিতে না পারলে পরের বছর তাকে চারশ’টি দিতে হত। আল্লাহ তাআলা এদের কথাই বলেছেন কুরআনে কারিমে- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’ [. আলে ইমরান : ১৩০]

সুতরাং জানা গেল জাহিলি যুগে সুদকে ওই সব লাভের মধ্যে গণ্য করা হত সম্পদের মালিক যা ভোগ করে। এ ব্যাপারে সে অন্য ভাইয়ের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, সে লাভবান হল নাকি ক্ষতিগ্রস্ত ? সে গরিব হয়ে গেল নাকি ধনী ? দৃষ্টি শুধু এক দিকেই থাকে- বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া। এতে অন্য কেউ ধ্বংসের মুখে পড়লেও তা দেখার বিষয় নয়। তারা এমন করত তাদের অমানবিক আচরণ এবং নষ্ট চরিত্র বলেই। তাদেরকে যে চরিত্র দিয়ে পাঠানো হয়েছে তা বিকৃত হওয়ার ফলেই। এ জন্যই তাদের সমাজে কুকর্ম ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল। ছিল না সেখানে অন্যের সম্মান। ছোটরা বড়দের সম্মান দিত না। বড়রাও ছোটদের স্নেহ করত না। ধনীরাও দেখাত না গরিবদের প্রতি কোনো মমতা। সমাজের সবাই ছিল অনাচার ও হট্টগোলে দিশেহারা। আর সবচে’ আফসোসের বিষয় হলো, এ সুদ শুধু জাহিলি যুগেই সীমাবদ্ধ থাকে নি বরং ইসলামি সমাজ বলে দাবিদার পরিমন্ডলেও তা ঢুকে পড়েছে অনায়াসে- যারা দাবি করে যে তারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করেছে ! এ জন্য প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহর নির্দেশ পালন করা এবং সত্যিকারার্থেই তাঁর আইন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হওয়া। তবে যারা মুসলমান হিসেবে দাবি করার পরও সুদী কারবার করেন তাদেরকে বিনীত উপদেশ দান ও এ বিশাল অপরাধ থেকে সতর্ক করার সঙ্গে সঙ্গে এও বলব যে, চিন্তা করে দেখুন আপনারা কি প্রাক কুরআন নাজিল যুগে ফিরে যাননি ? প্রত্যাবর্তন করেননি কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমন পূর্ব কালের সেই নির্দয় অসভ্য সমাজে ?

দ্বিতীয় পর্ব: ইসলামে সুদের অবস্থান
এ পর্বে রয়েছে চারটি অধ্যায়। যথা-

প্রথম অধ্যায়: সুদ সম্পর্কে সতর্কিকরণ।

দ্বিতীয় অধ্যায়: রিবায়ে ফযল এবং- (ক) রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য। (খ) এর বিধান এবং রিবার সকল প্রকার। ও (গ) রিবা হারাম হওয়ার কারণ ও রহস্য।

তৃতীয় অধ্যায়: রিবায়ে নাসিয়া। এবং- (ক) সংজ্ঞা এবং (খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য।

চতুর্থ অধ্যায়: বাইয়ে ইনা। এবং- (ক) সংজ্ঞা এবং (খ) এর বিধান এবং তার নিন্দায় বর্ণিত কয়েকটি উদ্ধৃতি।

প্রথম অধ্যায় : সুদ সম্পর্কে সতর্কিকরণ
রিবা বা সুদ থেকে সতর্ক করে কুরআন ও সুন্নায় অনেক বক্তব্য এসেছে। আর কুরআন-সুন্নাহ যেহেতু শরিয়তের এমন প্রধান দুই উৎস যে, এ দুটোকে যে অবলম্বন করবে; এতদুভয়ের অনুসরণ ও আনুগত্য করবে, সে হবে কামিয়াব; চির সফল। যে মুখ ফিরিয়ে নিবে তার জন্য রয়েছে এক সংকুচিত জীবন তদুপরি কিয়ামতে তাকে উঠানো হবে অন্ধ হিসেবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে। [. বাকারা : ২৭৫]

আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না। [. বাকারা : ২৭৬]

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।’ [. বাকারা : ২৭৮-২৭৯]

ইবনে আববাস রা. বলেন, এটি শেষ আয়াত যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। [. ফাতহুল বারি : ৪/৩১৪]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’ [. আলে উমরান : ১৩০]

আল্লাহ তাআলা সুদ হারাম করেন আর ইহুদিরা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সুদ বৈধ করার চেষ্টা করে, সেদিকে ইঙ্গিত করে মহান বর বলেন- ‘আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।’ [. নিসা : ১৬১]

‘আর তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলতঃ আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে (তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত।’ [. রুম : ৩৯]

জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদদাতা, গ্রহীতা এবং এর লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন।’ [. মুসলিম : ৭৫৯৭]

সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘রাতে আমি দেখলাম, দু’জন লোক এসে আমার কাছে এলো। তারা আমাকে এক পবিত্র ভূমির দিকে নিয়ে গেল। আমরা চলছিলাম, সহসা এক রক্ত নদীর পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম যার মাঝে দন্ডায়মান এক ব্যক্তি। নদীর মাঝখানে এক ব্যক্তিকে দেখা গেল। সামনে তার পাথর। মাঝের লোকটি নদী পেরুনোর জন্য যেই সামনে অগ্রসর হয়, পাথর হাতে দাঁড়ানো ব্যক্তি অমনি তার মুখে পাথর মেরে তাকে পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে দেয়। এভাবে যখনই সে নদী পেরিয়ে আসতে চায়, লোকটি তখনই তার মুখে পাথর মেরে পেছনে ঠেলে দেয়। আমি বললাম, ব্যাপার কী ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বললেন, আমি যাকে নদীর মধ্যখানে দেখেছি সে সুদখোর।’ [. বুখারি : ২০৮৫, ফাতহুল বারি : ৪/৩১৩]

আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘ধ্বংসকারী সাতটি জিনিস থেকে বেঁচে থাক। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কী কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শিরক করা, যাদু করা, অনুমোদিত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের মাল ভক্ষণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং সতী সরলা মুমিনা নারীকে ব্যাভিচারের অপবাদ দেয়া।’ [. বুখারি : ২০১৫, মুসলিম : ৮৯]

ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সুদের অর্থ দিয়ে যা-ই বৃদ্ধি করুক না কেন অল্পই কিন্তু তার শেষ পরিণাম।’ [. ইবনে মাজা : ২২৭৯। আলবানি সহি জামে সগিরে ৫/১২০ বলেছেন, এটি সহি হাদিস।]

সালমান বিন আমর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বিদায় হজে আমি বলতে শুনেছি, তিনি বলেন- ‘মনে রেখ জাহিলি যুগের সকল সুদ ভিত্তিহীন। তোমাদের জন্য শুধুই মূলধন। তোমরা জুলুম করবেও না এবং সইবেও না।’ [. আবু দাউদ : ৩৩৩৪]

এ হাদিসে জাহিলি যুগের প্রচলিত রীতিগুলোকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে। যদি অমুসলিম ব্যক্তি তার ইসলাম পূর্ব সময়ে লাভ হিসেবে সুদের পাওনাদার হয়। অতপর সে অর্থ গ্রহণের আগেই ইসলামে প্রবেশ করে। তবে শুধু তার মালের মূল অংশ গ্রহণ করবে; লাভটুকু ছেড়ে দিবে। আর ইসলামের আগে এ ধরনের যে কারবারগুলো হয়েছে ইসলাম সে ব্যাপারে ক্ষমা ঘোষণা করেছে। সুতরাং তাদেরকে অতীত কারবার সম্পর্কে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। ইসলাম অতীত ক্ষমা করে দিয়েছে। কারণ, ইসলাম পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেয়। [. আওনুল মাবুদ বি শরহি সুনানে আবি দাউদ : ৯/১৮৩]

আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘এমন এক সময় উপস্থিত হবে যখন লোকেরা পরোয়া করবে না সম্পদ হালাল নাকি হারাম উপায়ে অর্জিত।’ [. বুখারি : ২০৮৩] নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সংবাদ দিয়েছেন মানুষকে সম্পদের ফিতনা থেকে বাঁচানোর জন্য। তিনি এমন সংবাদ দিয়েছেন যা তাঁর যুগে ছিল না। এ ধরনের ভবিষ্যৎবাণী তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণও বটে। [. ফাতহুল বারি : ৪/২৯৭]

আবি জুহায়ফা রা. তদীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘নবী সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্ত ও কুকুরের মূল্য নিতে এবং দাসীর উপার্জন গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। অভিশাপ দিয়েছেন উল্কি অঙ্কনকারী, উল্কি গ্রহণকারী এবং সুদ গ্রহীতা ও সুদদাতাকে। আরও অভিশাপ দিয়েছেন তিনি চিত্রাঙ্কনকারীকে।’ [. বুখারি : ২২২৮]

আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সুদের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। সর্বনিম্নটি হলো নিজের মায়ের সঙ্গে জেনা করার সমতুল্য। আর অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা সবচে’ নিকৃষ্ট সুদ। [. মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭]

ফেরেশতা কর্তৃক গোসল করার সৌভাগ্যধন্য হানযালা তনয় আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘জেনে বুঝে এক দিরহাম পরিমাণ সুদ খাওয়া ছত্রিশবার জেনা করার চেয়েও বড় অপরাধ। [. মুসনাদে আহমদ : ৫/২২৫]

ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যখন কোনো জনপদে সুদ ও ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে তখন তারা নিজেদের ওপর আল্লাহর আজাব বৈধ করে নেয়। [. মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭]

দ্বিতীয় অধ্যায় : রিবায়ে ফযল
রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় হাদিস-

আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমরা কমবেশি করে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করো না। হ্যা, সমান সমান বিক্রি করতে পার। তোমরা কমবেশি করে রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করো না। হ্যা, সমান সমান বিক্রি করতে পার। তোমরা এসব জিনিসে বাকির বিনিময়ে নগদে বিক্রি করো না।’ [. বুখারি : ২১৭৭, মুসলিম : ১৫৮৪]

উসমান বিন আফ্ফান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমরা এক দিনারের বিনিময়ে দুই দিনার অথবা এক দিরহাম দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করো না।’ [. মুসলিম : ১৫৮৫]

আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা -গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী।’ [. মুসলিম : ১৫৮৪]

উবাদা বিন সামেত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। তবে যখন এসব জিনিসের প্রকার পরিবর্তন করা হবে তো যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি করো। যখন তা হবে নগদ নগদ।’ [. মুসলিম : ১৫৯২]

মা’মার বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত যে, তিনি নিজ গোলামের হাতে এক সা পরিমাণ গম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যাও এটি বিক্রি করো এবং এর বিনিময়ে যব কিনে আনো। গোলাম চলে গেল এবং এক সা’ ও তার অতিরিক্ত কিছু নিল। যখন সে মা’মারের কাছে এসে এ সংবাদ দিল তখন তিনি বললেন, এমন করেছ কেন ? তুমি আবার বাজারে যাও। আর মনে রেখ কমবেশি করে নিবে না। কেননা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, খাবারের বদলে খাবার বিক্রি করতে হবে সমান সমান। তিনি বলেন, সেদিন আমাদের খাবার ছিল যব। তাকে বলা হলো, এটাতো একই জাতের খাদ্য নয়। তিনি বললেন, আমি এটাতেও সমান হওয়ার আশংকা করছি। [. মুসলিম : ১৫৮৭, শরহুন নাবাবি ১১/১৪]

এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ইমাম মালেক রহ. মনে করেন, গম এবং যব একই জাতের খাদ্য যাতে কম-বেশি করে কেনাবেচা বৈধ নয়। তবে জমহুর উলামার মত অন্যরকম। তারা বলেন, গম এক জাতীয় শস্য আর যব অন্য জাতের শস্য। সুতরাং এদুয়ের মাঝে কমবেশি করে কেনাবেচা জায়িয আছে, যখন তা হবে নগদে। যেমন- গমের বদলে চাল ক্রয় ইত্যাদি। জমহুরের দলিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর উক্তি- ‘যদি এসব জিনিসের মধ্যে জাত পরিবর্তন হয় তবে যেভাবে ইচ্ছে কেনাবেচা করতে পার- যখন তা হবে নগদ মূল্যে। [. মুসলিম : ১৫৮৭, দেখুন শরহুন নাবাবি : ১১/১৪]

তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর উক্তি ‘গমের বদলে যব বিক্রি করতে কোনো সমস্যা নেই এমনকি যব বেশি হলেও; যখন তা হবে নগদে। তবে বাকিতে হলে সেটা ভিন্ন কথা। [. সুনানে আবি দাউদ : ৩৩৪৯, আউনুল মাবুদ : ৩/১৯৮] আর মা’মার বর্ণিত হাদিসের উত্তরে বলা হবে, এতে মালেকের রহ. পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কারণ এতে তিনি স্পষ্ট বলেন নি যে, যব আর গম একই শ্রেণিভুক্ত শস্য। তদুপরি তিনি ভয় করেছেন- সেটা তার ব্যক্তিগত তাক্ওয়ার ব্যাপার। [. শরহুন নাবাবি : ১১/২০] এরপর আশা করা যায় আর কোনো শংসয় থাকবে না। যব এক স্বতন্ত্র জাত আর গম অন্য এক জাত। সুতরাং এ দুটির মাঝে কমবেশি করে কেনাবেচা বৈধ যখন তা হবে নগদে এবং বিক্রিত দ্রব্য হস্তান্তর হবে চলমান বৈঠক ভাঙ্গার আগেই।

সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব জানান, তাকে আবু হোরায়রা এবং আবু সাইদ রা.বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনি আদি আনসারির ভাইকে খায়বরের আমলা হিসেবে প্রেরণ করেন। একবার তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে ‘জানিব’ [. এক প্রকারের উন্নত জাতের খেজুর।] খেজুর নিয়ে আসেন। পয়গাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, খায়বরের সব খেজুরই কি এমন ? তিনি আরজ করলেন, জি না, হে আল্লাহর নবী, আমরা বরং এক সা’ ‘জানিব’ ক্রয় করি দুই সা’ ‘জামা’ [. এক ধরনের অনুন্নত জাতের খেজুর। কেউ ব্যাখ্যা করেছেন, কাঁচা-পাকা মিশ্রিত খেজুর।] খেজুরের বিনিময়ে। এতদশ্রবণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘তোমরা এমনটি করো না। বরং সমান সমান বিক্রি করো নয়তো মন্দ জাতের খেজুর বিক্রি করো তারপর সে মূল্য দিয়ে উন্নত জাতের খেজুর কেনো। এটাই ইনসাফের দাবি।’ [. মুসলিম : ১৫৯৩]

আবু সাইদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন বেলাল রা. কিছু ‘বারনি’ খেজুর নিয়ে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখে বললেন, কোত্থেকে নিয়ে এলে এসব ? বেলাল রা. উত্তর দিলেন, আমার কাছে কিছু খারাপ খেজুর ছিল। সেগুলো দুই সা’ দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর জন্য এর এক সা’ কিনেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হায়! একি করেছ ? এটাতো খাঁটি সুদ। তুমি আর এমন করেবে না। যখন কিনতে চাইবে, আলাদাভাবে আগে সেটা বিক্রি করবে। তারপর সেই মূল্য দিয়ে এটা কিনবে। [. বুখারি : ২২০২, মুসলিম : ১৫৯৪]

আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় ‘জামা’ খেজুর খেতাম। আর জামা হলো বিভিন্ন মানের মিশ্রিত খেজুর। আমরা সেসবের এক সা’ কিনতাম দুই সা’র বিনিময়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে যখন এ সংবাদ পৌঁছল তিনি বললেন, দুই সা’ খেজুরের বিনিময়ে এক সা’ খেজুর কেনা যাবে না, দুই সা’ গমের বিনিময়ে এক সা’ গম কেনা যাবে না এবং দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম কেনা যাবে না। [. মুসলিম : ১৫৯৫]

ফুযালা বিন উবাইদুল্লাহ আনসারি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খায়বরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে গনিমতের মাল উপস্থাপনকালে স্বর্ণ ও ছোট দানা খচিত একটি হার সামনে এলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হার থেকে স্বর্ণ আলাদা করার নির্দেশ দিলেন। অতপর তিনি তাদের বললেন, সমান সমান ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা না।’ [. মুসলিম : ১৫৯১, শরহুন নাবাবি : ১১/১৭]

ফুযালা রা. থেকে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, খায়বর বিজয়ের দিন আমি বারো দিরহামের বিনিময়ে একটি হার কিনলাম যাতে স্বর্ণ এবং ছোট দানা ছিল। পরে আমি সেগুলো আলাদা করে বারো দিরহামের বেশি পেলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে যখন এ বিবরণ শুনালাম তিনি বললেন, ‘স্বর্ণ ততক্ষণ পর্যন্ত বিক্রি করা উচিৎ নয় যাবৎ না তার থেকে অন্য জিনিস আলাদা করা হয়।’ [. মুসলিম : ১৫৯১, শরহুন নাবাবি : ১১/১৮]

এ হাদিস থেকে জানা গেল স্বর্ণের বিনিময়ে অন্য জিনিসসহ স্বর্ণ বেচাকেনা জায়িয নেই যতক্ষণ না অন্য জিনিস স্বর্ণ থেকে পৃথক করা হয়। পৃথক করে স্বর্ণের বদলে স্বর্ণ কিনতে হবে একদম সমান সমান। আর অন্য জিনিস যা দিয়ে ইচ্ছে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। তেমনি রুপাকেও রুপার বিনিময়ে অন্যবস্ত্ত সমেত বিক্রি করা জায়িয নেই, গম বিক্রি করা জায়িয নেই অন্য জিনিসসহ গমের বিনিময়ে এবং লবণ বিক্রি করা জায়িয নেই অন্যকিছুর সঙ্গে লবণের বিনিময়ে। এভাবে সুদ হয় এমন প্রত্যেক বস্ত্তই অন্য জিনিসসহ বিক্রি করা জায়িয নেই; যতক্ষণ না সেটাকে আলাদা করা হয়।

(খ) সুদের বিধান :

ইমাম নাববি রহ. বলেন, ‘সুদ হারামের ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত; যদিও এর সংজ্ঞা ও মূলনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। [. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯] আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ হারামের ক্ষেত্রে ছয়টি জিনিসের নাম নির্দিষ্ট করেছেন। সেগুলো হলো, সোনা, রুপা, গম, যব, খেজুর ও লবণ।

আসহাবে জাহিরি বলেছেন, এ ছয়টি জিনিসের বাইরে কোনো কিছুতে সুদ নেই। প্রমাণের ক্ষেত্রে তাদের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের সনাতন যে নীতি রয়েছে তারই ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত তাদের।

আসহাবে জাহিরি বাদে অন্যরা বলেছেন, সুদ এ ছয়টি জিনিসেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ ছয়টির কারণের মধ্যে যা যা অন্তর্ভুক্ত সবগুলোর হুকুম অভিন্ন। তবে তারা মতবিরোধ করেছেন এ ছয় ধরনের জিনিসে বিদ্যমান হারাম হওয়ার ইল্লত বা কারণ নিয়ে।

ইমাম শাফেয়ি রহ. মনে করেন, সোনা এবং রুপায় ‘ইল্লত’ হলো এদুয়ের মূল্যমান। তাই পরিমাপযোগ্য ও অন্যান্য জিনিস এ দুয়ের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হবে না ইল্লত অনুপস্থিত থাকার কারণে। আর বাকি চার জিনিসে ইল্লত হলো, এসবের খাদ্য জাতীয় হওয়া। এ জন্য প্রত্যেক খাদ্যদ্রব্যই সুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।

ইমাম মালেক রহ. সোনা ও রুপার ক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। তবে অবশিষ্ট চারটির ব্যাপারে বলেছেন এসবের মধ্যে ইল্লত হলো, এসবের সংরক্ষণ এবং খাবারযোগ্য হওয়া।

ইমাম আবু হানিফার রহ. মতে সোনা ও রুপার ইল্লত মওযুনি বা ওজনযোগ্য হওয়া আর বাকি চারটির ইল্লত মাকিলি বা (শস্যের) পরিমাপযোগ্য হওয়া। সুতরাং প্রত্যেক মাকিলি এবং মওযুনি বস্ত্ততেই সুদের এ বিধান প্রযোজ্য।

সাইদ বিন মুসাইয়াব এবং ইমাম আহমদ ও শাফেয়ির পুরাতন মতানুসারে চারটির ইল্লত হলো একই সঙ্গে ওজন ও খাদ্য জাতীয় হওয়া। [. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯]

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘সকল সাহাবি, তাবেয়ি এবং ইমাম চতুষ্টয় একমত যে, সোনা, রুপা, গম, যব, খেজুর এবং আঙ্গুর সমগোত্রের সামগ্রীর বিনিময়ে কেবল সমান সমান বিক্রি জায়িয। কেননা কমবেশি করা অবৈধ সম্পদ ভক্ষণের নামান্তর। [. ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া : ২০/৩৪৭, আশ শারহুল কাবির : ১২/১১, শরহুয যারাখশি : ৩/৪১৪]

উলামায়ে কিরাম একমত যে, রেবা জাতীয় দ্রব্যকে তার সমগোত্রীয় দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রি বৈধ নয় যখন এক তরফে বাকি থাকে। তারা আরও একমত যে, একই গোত্রভুক্ত দ্রব্যকে নগদে কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়। যেমন- সোনার বদলে সোনা বিক্রির সময়। তেমনি তারা একমত যে, একই জাতীয় দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রির সময় পণ্য হস্তগত করা পর্যন্ত ক্রয় মজলিস ত্যাগ করা বৈধ নয়। যেমন- সোনার বদলে সোনা, খেজুরের পরিবর্তে খেজুর অথবা অন্য জাতীয় তবে একই ইল্লত বিশিষ্ট জিনিস যেমন- সোনার বিনিময়ে রুপা এবং গমের বিনিময়ে যব। (এমন কেনাবেচার সময় হস্তগত হওয়ার আগে মজলিস ত্যাগ করা বৈধ নয়।) [. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯]

ইমাম ইবনে কুদামা সুদের বিধান সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটি কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমার দ্বারা প্রমাণিত হারাম। [. আল মুগনি : ৬/৫১]

সারকথা, সোনা এবং রুপায় সুদের হুকুম বর্তানোর কারণ এর মূল্যমান সমৃদ্ধ হওয়া আর বাকি চারটি এ জন্যে যে পরিমাপ, ওজন ও ভক্ষণযোগ্য। যেমন-গম, যব, চাল ইত্যাদি। আর যা ওজন, মাপ বা ভক্ষণ কোনো জাতীয়ই নয় তদুপরি বিক্রি হয় অন্য জাতীয় জিনিসের বিনিময়ে সেটাতে কোনো সুদ নেই। এমনটিই বলেছেন অধিকাংশ উলামা। যেমন-(আংটির) পাথর, (খেজুরের) বীচি ইত্যাদি।

সুদ হারাম হওয়ার কারণ এবং হিকমত :

মুমিন মাত্রেই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা এমন কিছুর নির্দেশ দেন না বা এমন কিছু থেকে বারণ করেন না যাতে কোনো না কোনো হিকমত বা নিগূঢ় রহস্য লুকায়িত থাকে নেই। আমরা যদি সে রহস্য জানতে পারি তাহলে তা আমাদের জন্য অতিরিক্ত অর্জন। যদি না জানি তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আমাদের কাম্য ও কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ ও রাসূল সা. যা করতে বলেন তা সম্পাদন করা আর যা বারণ করেন তা থেকে বিরত থাকা। সুদ হারাম হওয়ার পশ্চাতে যেসব কারণ ও হিকমত কার্যকর তার কয়েকটি এই -

সুদ এক ধরনের জুলুম আর আল্লাহ তাআলা জুলুম হারাম করেছেন।

অসুস্থ হৃদয়ের মালিকদের প্রতারণার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া।

সুদের মধ্যে প্রতারণা রয়েছে।

পণ্যের মান ধরে রাখা।

সুদ আল্লাহ প্রবর্তিত পদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। [. মুগনি লি ইবনে কুদামা : ৬/৫৩, নাইলুল আওতার : ৬/৩৪৬-৩৫৮]

১০
তৃতীয় অধ্যায়: রিবায়ে নাসিয়া
(ক) রিবায়ে নাসিয়ার সংজ্ঞা:

জাহিলি যুগে এমন প্রচলন ছিল, একজন অপরজনকে নির্দিষ্ট মেয়াদের ওপর অর্থ ঋণ দিত এ শর্তে যে, প্রতি মাসে তাকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। অথচ মূল অর্থ আপনাবস্থায় বহাল থাকবে (কমবে না)। যখন সে মেয়াদ পুরা হবে; ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছে মূল অর্থ ফেরত চাইবে। যদি সে পরিশোধ করতে অক্ষম হয়, তাহলে মেয়াদ পুনঃনির্ধারণ করে মাসিক প্রদেয় অর্থের পরিমাণও বাড়িয়ে দিবে। সুদের এ প্রকার যদিও ‘রিবাল ফযল’ এর সংজ্ঞায় পড়ে তথাপি তার নাম দেয়া হয়েছে নাসিয়া এ জন্য যে, এতে নাসিয়া বা বাকিই মূল উদ্দেশ্য।

ইবনে আববাস রা. রিবায়ে নাসিয়া ছাড়া অন্য কোনো প্রকারকে সুদ বলতেন না এ বলে যে, নাসিয়া-ই তখন সমাজে প্রচলিত ছিল। [. তাফসিরে মানার : ৪/১২৪]

অবশ্য একটু পরেই আমরা তাঁর এ মত প্রত্যাহার করে অন্যান্য সাহাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নাসিয়া, ফযল- সব রিবা হারামের পক্ষাবলম্বনের প্রমাণাদি তুলে ধরব। তারপর আর এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। (সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।)

(খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য :

রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে সমগ্র উম্মাহ একমত হলেও রিবায়ে ফযল সম্পর্কে ইবনে আববাস রা. এবং অন্যান্য সাহাবির মাঝে মতবিরোধ হয়। পরে তিনিও তাঁর মত থেকে ফিরে আসেন এবং সকল সাহাবির সঙ্গে রিবাল ফযল হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত হন। রিবান নাসিয়া হারাম হওয়াটা কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।

আবু সালেহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু সাইদ খুদরি রা. কে বলতে শুনলাম, ‘দিনার দিনারের বিনিময়ে এবং দিরহাম দিরহামের বিনিময়ে সমান সমান বিক্রি করতে হবে। যে কমবেশি করবে সে সুদ খাওয়ার অপরাধ করল। আমি তাঁকে বললাম, ইবনে আববাস রা. অন্য কথা বলছেন। তিনি (আবু সাইদ খুদরি রা.) বললেন, আমি ইবনে আববাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যা বলছেন তা কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর মুখ থেকে শুনেছেন নাকি কুরআনে পেয়েছেন ? তিনি উত্তর দিলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর মুখেও শুনি নাই বা কুরআনেও পাইনি। তবে উসামা বিন যায়েদ আমাকে বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘রিবা নাসিয়া বা বাকিতেই।’ [. মুসলিম : ১৫৯৬, শারহুন নাবাবি : ১১/২৫]

ইবনে আববাসের অপর বর্ণনায় রয়েছে, উসামা বিন যায়েদ আমাকে শুনিয়েছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সাবধান, নিশ্চয় সুদ হলো (নাসিয়া) বাকিতে।’ [. বুখারি : ২১৭৯ এবং ২১৭৯, ফাতহুল বারি : ৪/৩৮১]

ইমাম নাবাবি রহ. বলেন, ইবনে আববাস এবং ইবনে উমর রা. এর কথার ভিত্তি ছিল উসামা বিন যায়েদ রা. এর হাদিস ‘রিবা নাসিয়া বা বাকিতেই।’ অতপর তাঁরা উভয়ে নিজেদের মত থেকে ফিরে এসেছেন। তাদের কাছে যখন মুসলিম শরিফে বর্ণিত আবু সাইদ খুদরির রা. হাদিস পৌঁছে তখন তাঁরাও আলোচ্য বস্ত্তগুলোকে একই জাতীয় বস্ত্তর বিনিময়ে কমবেশি করে কেনাবেচা হারাম বলে মেনে নেন। ইমাম মুসলিম সংকলিত হাদিসগুলো থেকে বুঝা যায়, তাঁদের কাছে নাসিয়া বা বাকিতে ছাড়া নগদেও যে কমবেশি করে বিক্রি করা নিষেধ সে হাদিস পৌঁছেনি। যখন পৌঁছেছে তখন তাঁরা নিজেদের মত থেকে ফিরে এসেছেন।

আর উসামা বিন যায়েদের হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এসব হাদিস দ্বারা তার হাদিস মনসুখ (রহিত) হয়ে গেছে। আর মুসলিম উম্মাহ যেহেতু এ হাদিসের ওপর আমল করেন না তাই বুঝা যায় এটি মনসুখ হয়ে গেছে। [. শারহুন নাবাবি : ১১/২৫]

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেছেন, ‘উসামা রা. বর্ণিত হাদিসের শুদ্ধতার ব্যাপারে আলেমগণ একমত। তবে অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে এর সমন্বয় করতে গিয়ে তাঁরা দ্বিমত করেছেন। বলা হয়েছে, হাদিসটি মনসুখ অথচ সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে কখনো মনসুখ প্রমাণিত হয় না। আবার বলা হয়েছে, হাদিসে ‘ لاربا ’ বা ‘নাসিয়া ছাড়া বাকিতে রিবা নাই’ বলে বুঝানো হয়েছে নাসিয়ার চেয়ে কঠিন শাস্তিযোগ্য কোনো রিবা নেই। যেমন- আরবরা বলে, ‘জায়েদ ছাড়া শহরে কোনো জ্ঞানী নাই।’ অথচ সে শহরে অনেক বিদ্বান রয়েছেন। কারণ এমন বলার উদ্দেশ্য, এর চেয়ে বড় নেই সেটা বুঝানো; একেবারে নেই তা বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। দ্বিতীয়ত উসামা রা. এর হাদিস দ্বারা রিবায়ে ফযল হারাম না হওয়া বুঝা যায় পরোক্ষভাবে। পক্ষান্তরে আবু সাইদ খুদরির রা. হাদিসের বক্তব্য সুস্পষ্ট। [. ফাতহুল বারি : ৪/৩৮২]

উপরের আলোচনা দ্বারা আমাদের সামনে রিবায়ে নাসিয়া এবং রিবায়ে ফযল উভয়টার হারাম হওয়া প্রমাণিত হয়। সুতরাং কোনো প্রশ্ন বা সংশয়ের অবকাশ নেই।

১১
চতুর্থ অধ্যায় : বাইয়ে ইনা
(ক) বাইয়ে ইনা’র সংজ্ঞা :

কেউ তার কোনো পণ্য অপরের কাছে বাকিতে বিক্রি করে ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দিল। তারপর সে মূল্য পরিশোধের আগেই তার (ক্রেতার) কাছ থেকে বিক্রেতা ওই একই পণ্য নগদ মূল্যে কিনে নিল তার চেয়ে কম মূল্যে। [. আউনুল মাবুদ : ৯/৩৩৬]

যেমন- কেউ তার পণ্য অপর এক ব্যক্তির কাছে এক বছর সময় দিয়ে বাকিতে একশ’ টাকা মূল্যে বিক্রি করল। অতপর একই সময়ে বিক্রেতা তার সদ্য বেচা পণ্য ক্রেতার কাছ থেকে নগদ পঞ্চাশ টাকা মূল্যে কিনে নিল আর প্রথম ক্রেতার কাঁধে পুরো একশ টাকার ঋণ রয়ে গেল!

(খ) বাইয়ে ইনা’র নিন্দায় উচ্চারিত কিছু বক্তব্য :

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে ইরশাদ করতে শুনেছি, তিনি বলেন- ‘যখন তোমরা পরস্পর বাইয়ে ইনা’র লেনদেন করবে আর জিহাদ ছেড়ে দিয়ে বলদের লেজ ধরে সন্তুষ্ট থাকবে কৃষিকাজ নিয়ে, আল্লাহ তাআলা তখন তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন। আল্লাহ এ লাঞ্ছনা তুলে নিবেন না যতক্ষণ তোমরা তোমাদের দীনের দিকে ফিরে আসবে। [. আবু দাউদ : ৩৪৬২, আউনুল মাবুদ : ৯/৩৩৫] হাদিসটি আরও কয়েকভাবে বর্ণিত হয়েছে। [. দেখুন মুসনাদে ইমাম আহমদ : ২/৮৪]

মালেক বিন আনাস, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমদ এবং কতিপয় শাফেয়ি প্রমুখ উলামায়ে কিরাম বাইয়ে ইনা'কে অবৈধ বলেছেন।

ইমাম শাওকানি রহ. বলেন, ‘ইনা’র লেনদেন যারা করে তারা এর নাম দেয় ক্রয়চুক্তি। অথচ আক্দ পুরা হওয়ার আগে এমনটি করা যে সুস্পষ্ট রিবার অন্তর্ভুক্ত সে ব্যাপারে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে একমত। তারপর তারা এ চুক্তির নাম দেয় মোয়ামালা। আর একে রূপ দেয় বিক্রয় চুক্তির। অথচ মোটেও তাদের এ ইচ্ছে নেই। এ হচ্ছে তাদের হিলা-বাহানা আর আল্লাহর সঙ্গে নিষ্ফল প্রতারণা। বাইয়ে ইনা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি সবচে সহজ যে হিলা আবলম্বন করে তা হলো, সে তাকে (উদাহরণ স্বরূপ) এক টাকা কম এক হাজার টাকা কর্জ দেয়। অতপর তার কাছে এক দিরহাম মূল্যের এক টুকরো কাপড় বিক্রি করে পাঁচশ টাকায়।

এ ধরনের চালাকির মূলে কুঠারাঘাত করেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর বিখ্যাত সে হাদিস ‘নিশ্চয় প্রত্যেক কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ [. বুখারি : ০১, মুসলিম : ১৯০৭] কারণ সে চায় এক হাজার টাকা দিয়ে দেড় হাজার টাকা কামাতে। তার কর্জ দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো, অতিরিক্ত সুদ লাভ করা যেটাকে সে কাপড়ের মূল্য নাম দিয়ে হাসিল করতে চাইছে। প্রকৃতপক্ষে সে তাকে নগদ এক হাজার টাকা দিচ্ছে বাকিতে দেড় হাজার টাকার বিনিময়ে। আর কর্জ ও ক্রয়ের রূপ দিয়ে সে এ হারাম কাজ বৈধ করতে চাচ্ছে। আর এটা জানা কথা যে, এ ধরনের হিলা-বাহানা এর অবৈধতাকে রুখতে পারে না। সুদকে যেসব অকল্যাণের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাও দূর করতে পারে না। বরং তা বিভিন্নভাবে এর অপকারিতা বাড়িয়ে দেয়। [. নাইলুল আওতার : ৬/৩৬৩]

১২
তৃতীয় পর্ব: যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে।
এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-

প্রথম অধ্যায় : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে

দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইয়ে সরফ এবং তার বিধান।

তৃতীয় অধ্যায় : সন্দেহ থেকে দূরে থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করণ।

১৩
প্রথম অধ্যায় : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে
(ক) কম-বেশি করা জায়িয যখন ‘ইল্লত’ অনুপস্থিত থাকবে :

ইমাম নাববি রহ. বলেন, আলেমগণ একমত যে, রেবা জাতীয় পণ্যকে রেবা জাতীয় পণ্যের বিনিময়ে কমবেশি করে এবং বাকিতে বিক্রি করা বৈধ যদি উভয়ের ইল্লত ভিন্ন হয়। যেমন- গমের বিনিময়ে সোনা বিক্রি এবং যবের বদলে রুপা ইত্যাদি পরিমাপযোগ্য পণ্য বিক্রি। তেমনি জাত ভিন্ন হলে নগদে কমবেশি করে বেচা-কেনা জায়িয এ ব্যাপারেও তাঁরা একমত। যেমন- এক সা’ গমের বিনিময়ে দুই সা’ যব কেনা ইত্যাদি। [. শারহুন নাবাবি : ১১/০৯]

(খ) অপরিমাপযোগ্য জিনিসের মাঝে কমবেশি করে বিক্রি জায়িয :

ফিকাহবিদগণ প্রাণীকে প্রাণীর বদলে বাকিতে বিক্রির বৈধতা সম্পর্কে মতবিরোধ করেছেন। অধিকাংশ উলামার মতে, এটা বৈধ। তাদের দলিল আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা. এর হাদিস। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উটের পালের পিঠে আমাকে একটি সৈন্যদল পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। আমি লোকদের উটের পিঠে চড়ালাম। এক পর্যায়ে আমার উট শেষ হয়ে গেল। বাকি রয়ে গেল কয়েকজন- আমি তাদের বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি আমার পক্ষে কয়েকটি উট কেন সদকার উট দিয়ে আমি তা পরিশোধ করে দেব। যাতে এ দলটি পূর্ণ হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ রা. বলেন, তাঁর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা মত আমি একেকটি উট কিনতে থাকি দুটি তিনটি করে উটের বিনিময়ে। এমনকি দল পূর্ণ হয়ে গেল। তিনি বলেন, যখন সদকার উট বাটোয়ারা শুরু হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা পরিশোধ করে দিলেন। [. মুসনাদে আহমদ : ২/২১৬, আবু দাউদ : ৩৩৫৭]

জাবের রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একজন দাস এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে হিজরতের বাইয়াত করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টের পান নি যে সে একজন গোলাম। পরে দাসের মুনিব এসে তাকে চাইল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, একে আমার কাছে বিক্রি করে দাও। অতপর তিনি তাকে দুইজন হাবশি গোলামের বিনিময়ে কিনে নেন। পরবর্তীতে তিনি কাউকে বাইয়াত করতেন না যতক্ষণ না জিজ্ঞেস করেন (সে কারো দাস কি না)। [. মুসলিম : ১৬০২, শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯]

এ থেকে বুঝা যায়, দুই গোলামের বিনিময়ে এক গোলাম বিক্রি করা জায়িয আছে। চাই এদের মূল্য একই রকম হোক বা ভিন্ন। এটা নগদ হলে সবাই এর বৈধতার ব্যাপারে একমত। মানুষ ছাড়া অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রেও একই বিধান। [. শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯]

কেউ যদি এক গোলাম দুই গোলামের বিনিময়ে কিংবা এক উট দুই উটের বিনিময়ে বাকিতে বিক্রি করে তাহলে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুযায়ী তা বৈধ। এটাই ইমাম শাফেয়ি এবং জমহুরের মত। [. শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯]

উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুসারে বাকিতে বা কমবেশি করে প্রাণীর বদলে প্রাণী বিক্রি করা জায়িয। কয়েকজন সাহাবি এবং তাবেয়ির বক্তব্যও প্রমাণ করে এমনটি। ইমাম বুখারি রহ. তদীয় সহি বুখারিতে বলেন-

১-ইবনে উমর রা. একটি সাওয়ারি প্রাণী খরিদ করেছেন নিজের জিম্মায় চারটি উটের দায়িত্ব নেয়ার মাধ্যমে। যা তিনি দিয়ে দিয়েছেন রাবাযা নামক স্থানে।

২-রাফে বিন খাদিজ রা. দুই উটের বিনিময়ে এক উট কেনেন। তাকে একটি উট দেন আর বলেন, অপরটা তোমাকে কাল দেব ইনশাআল্লাহ।

৩-ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘এক উট কখনো দুই উটের চেয়ে উত্তম হয়।’

৪-ইবনে মুসাইয়াব বলেন, বাকিতে এক উটের মোকাবেলায় দুই উট কিংবা এক ছাগলের বিনিময়ে দুই ছাগল বেচায় কোনো সুদ নেই। [. চারটি হাদিসই দেখুন ফাতহুল বারি : ৪/৪১৯]

১৪
দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইয়ে সরফ এবং তার বিধান
(ক) মুরাতালা :

আরবি مراطلة শব্দটি رطل থেকে উদ্গত। যা مفاعلة এর মাসদার। পরিভাষায় মুরাতালা বলা হয় ওজনে সোনার বিনিময়ে সোনা কিংবা রুপার বিনিময়ে রুপা বিক্রি করাকে। [. শারহুয যারকানি আলা মুযাত্তা : ৩/২৮৪]

ইমাম মালেক রহ. বলেন, ‘আমাদের মতে তোলার হিসেবে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌঁপ্য বিক্রি করায় কোনো সমস্যা নেই। যেমন- কেউ নগদ মূল্যে দশ দিনারের বিনিময়ে দশ দিনার কিনল সেটাকে টাকা হিসেবে নয় স্বর্ণ হিসেবে পরিমাপ করে। এতে কোনো অসুবিধা নেই যদিও সংখ্যা কমবেশি হয়। এ ব্যাপারে দিরহামের হুকুমও অভিন্ন। [. মুয়াত্তা ইমাম মালেক : ২/৬৩৮]

এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এর সংখ্যা নয় ; ওজন। অতএব কারো কাছে যদি সোনার দশটি টুকরো থাকে এবং সে তা বিক্রি করে পাঁচ টুকরো সোনার বিনিময়ে। আর দশ টুকরো সোনা যদি ওজনে পাঁচ টুকরোর সমান হয় তাহলে তা বৈধ। ইমাম মালেক রহ. মুরাতালা বলে এটাই উদ্দেশ্য নিয়েছেন।

(খ) সরফ :

মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি লেনদেন পদ্ধতি সরফ। এদিকে সময় দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের লেনদেন পদ্ধতি। ইসলাম এ ব্যাপারে একেবারে উদাসীন নয়। তাই সরফ কোনটা বৈধ কোনটা বৈধ নয়- ইসলাম সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছে।

মালেক বিন আউস বিন হাদাসান রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি বললাম, কে আমার সঙ্গে দিরহাম দিয়ে বাইয়ে সরফ করবে ? তালহা বিন উবাইদুল্লাহ বললেন, (তিনি তখন উমর বিন খাত্তাবের রা. কাছে ছিলেন)- আমাদেরকে তোমার স্বর্ণ দেখাও। তারপর আমাদের গোলাম যখন আসবে তোমাকে তোমার রৌপ্য দিয়ে দিব। উমর বিন খাত্তাব রা. বললেন, খোদার দোহায় এমন করো না কখনো। তাকে রৌপ্য দাও নয়তো তার স্বর্ণ তাকে ফেরত দিয়ে দাও। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রুপা সোনার বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ; হ্যা যদি হাতে হাতে তথা নগদ বিক্রি করা হয়। গম গমের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ; হ্যা, যদি নগদ বিক্রি করা হয়, যব যবের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ হ্যা যদি নগদ বিক্রি করা হয় এবং খেজুর খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ হ্যা যদি নগদ বিক্রি করা হয়। [. বুখারি : ২১৭৪, মুসলিম : ১৫৮৬]

ইমাম নাববি রহ. বলেন, ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন, এ হাদিসের অর্থ- পণ্য এবং মূল্য হস্তগত হওয়া। সুতরাং এ হাদিস দ্বারা জানা গেল, সুদী পণ্যকে সুদী পণ্যের মোকাবেলায় বেচতে হলে শর্ত হলো, পণ্য এবং মূল্য উভয়টা নগদ হস্তগত হতে হবে- যখন উভয়ের ইল্লত অভিন্ন হবে। চাই উভয়ের জাত এক হোক যেমন- স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ কিংবা জাত ভিন্ন যেমন- রৌপ্যের বিনিময়ে স্বর্ণ সোনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইল্লত এক জাত ভিন্ন- এমন দুই সামগ্রীর লেনদেনের ব্যাপারেই উপরিউক্ত হাদিসে সতর্ক করেছেন।

আর তালহা বিন আব্দুল্লাহ রা. স্বর্ণ মালিকের সঙ্গে সরফ করতে চেয়েছিলেন। অভিপ্রায় ছিল তিনি স্বর্ণ নিবেন আর রৌপ্য দিবেন পরে খাদেম এলে। এমন করেছিলেন তিনি অন্যান্য বিক্রয় চুক্তির মতো এটাকে হালাল মনে করে। তখনো তিনি মাসআলা জানতেন না যে এটা অবৈধ। সেহেতু উমর রা. তাঁর কাছে হাদিসটি পৌঁছে দেন। ফলে তিনি সরফের এ চুক্তি বাতিল করে দেন। [. শরহুন নাবাবি : ১১/১৩]

সুফিয়ান বিন উয়ায়না আমর বিন মিনহাল থেকে বর্ণনা করেন, একদা আমার এক ভাগীদার আগামী মৌসুম বা হজ পর্যন্ত সময় দিয়ে বাকিতে রুপা বিক্রি করল। আমার কাছে আগমন করে সে এ কথা বললে আমি তাকে বললাম, এটা অবৈধ কাজ। সে বলল, আমি এটা বাজারে বিক্রি করলাম কেউ তো আমাকে বারণ করল না। এ কথা শুনে আমি বারা বিন আযেবের রা. কাছে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় তাশরিফ আনলেন, আমাদের মাঝে তখন এমন বিক্রয় চুক্তির প্রচলন ছিল। তিনি আমাদের বললেন, ‘যেটা নগদ হবে সেটায় সমস্যা নেই আর যা বাকিতে হবে সেটা সুদ।’ তুমি যায়েদ বিন আরকাম রা. এর কাছে যাও। কারণ তিনি আমার চেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। (সুতরাং তিনি এ ব্যাপারে ভালো জানবেন।) আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি একই উত্তর দিলেন। [. বুখারি : ২১৮০, মুসলিম : ১৫৮৯]

ইমাম বুখারি রহ. বলেন, (এ অধ্যায় নগদ মূল্যে সোনা দিয়ে রুপা কেনা সম্পর্কে) তারপর তিনি আবু বাকরা রা. এর হাদিস উল্লেখ করেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুপার বিনিময়ে রুপা এবং সোনার বিনিময়ে সোনা বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। হ্যা যদি সমান সমান হয় তাহলে বৈধ। এবং তিনি আমাদেরকে যেভাবে ইচ্ছে সোনার বিনিময়ে রুপা এবং রুপার বিনিময়ে সোনা কেনার অনুমতি দিয়েছেন। [. বুখারি : ২১৮২]

ইমাম বুখারি বারা বিন আযেব এবং যায়েদ বিন আরকাম থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকিতে স্বর্ণ দিয়ে রৌঁপ্য কিনতে নিষেধ করেছেন। [. বুখারি : ২১৮১, যারকানি, শরহুল মুয়াত্তা : ৩/২৮২]

উপরের হাদিসগুলো দ্বারা আমরা বুঝলাম-

সোনার বিনিময়ে সোনা বাইয়ে সরফ হিসেবে বিক্রি করা বৈধ। শর্ত হলো, সমান সমান এবং নগদ নগদ হতে হবে।

সোনার বিনিময়ে রুপা এবং রুপার বিনিময়ে সোনা বেচা জায়িয। শর্ত হলো, তা হতে হবে নগদ। আর কমবেশি করা, যেমন ওজনে সোনা বেশি হওয়া বা রুপা বেশি হওয়া- তো এতে কোনো সমস্যা নেই। শর্ত শুধু এই যে, সেটা হতে হবে সরফ চলাকালেই একেবারে হাতে হাতে।

সোনার বিনিময়ে সোনা বা সোনার বিনিময়ে রুপা কেনা বা বেচা বাকিতে কোনোটাই বৈধ নয়। সুতরাং কেউ যদি সোনার বিনিময়ে সোনা খরিদ করতে চায় আর একজন সোনা হস্তান্তর করে অন্যজন বাকি রাখে তাহলে তা কিছুতেই বৈধ হবে না। কারণ এ চুক্তিতে পণ্য এবং মূল্য হস্তান্তর করার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে।

১৫
তৃতীয় অধ্যায় : সন্দেহ থেকে দূরে থাকতে উৎসাহ দান
মুসলমান মাত্রেই চায় শরিয়তের বিষয়গুলো দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে। তাই সে ওয়াজিবগুলো পালন করে। হারাম এবং মাকরুহ বিষয়গুলো বর্জন করে। সচেষ্ট থাকে মুস্তাহাব কাজগুলো বেশি বেশি করতে। মুবাহ কাজগুলোর মধ্যে নিজ অবস্থা ও প্রয়োজন অনুপাতে কোনোটা করে আবার কোনোটা ছাড়ে। আর দূরে থাকে অস্পষ্ট এবং শংকাপূর্ণ কাজ থেকে। কারণ সে জানে অস্পষ্ট কাজগুলোই সুস্পষ্ট হারাম কাজে লিপ্ত করে।

নুমান বিন বাশির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বলতে শুনেছি (এ কথা বলে তিনি আঙ্গুল দিয়ে নিজ কানের দিকে ইঙ্গিত করেন; অর্থাৎ নিজ কানে শুনেছি।)- ‘নিশ্চয় হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট; এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে অস্পষ্ট বিষয়াবলি- যা অধিকাংশ লোকই জানে না। সুতরাং যে অস্পষ্ট বিষয়াবলি থেকে দূরে থাকবে তা তার সম্মান ও দীনদারি উভয়ের জন্য কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে। পক্ষান্তরে যে এতে পতিত হবে সে হারামে লিপ্ত হবে। যেমন- রাখাল সংরক্ষিত এলাকা থেকে সভয়ে দূরে থাকে যাতে সে এতে ঢুকে না পড়ে। মনে রেখ প্রত্যেক রাজারই কিছু সংরক্ষিত স্থান থাকে আরও মনে রেখ আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা (যার সীমানা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ) হলো, তাঁর হারাম ঘোষিত বিষয়গুলি। তোমরা মনে রেখ, নিশ্চয় (মানুষের) শরীরে একটি মাংসপিন্ড আছে। সেটা যদি সুস্থ থাকে তাহলে সারা দেহ সুস্থ আর সেটা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। মনে রেখ সেটা হলো কলব বা আত্মা।’ [. বুখারি : ৫২, মুসলিম : ১৫৯৯]

ইমাম নাববি রহ. বলেন, ‘এ হাদিসের সীমাহীন গুরুত্ব ও অপরিসীম তাৎপর্যের ব্যাপারে আলেমগণ একমত। এটি সে হাদিসসমূহের অন্যতম যেগুলোর ওপর শরিয়তের ভিত্তি। একদল আলেম বলেছেন, হাদিসটি ইসলামের এক তৃতীয়াংশ। অপর দুই তৃতীয়াংশের একটি ‘নিশ্চয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল’ [. বুখারি : ০১, মুসলিম : ১৯০৭] এবং মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য হলো, সে অনর্থক কাজ পরিহার করবে শীর্ষক হাদিস। [. মুয়াত্তা মালেক : ৩/৯০৩]

ইমাম আবু দাউদ রহ. বলেন, পুরো ইসলাম চারটি হাদিসকে ঘিরে আবর্তিত। উল্লেখিত তিনটি এবং ‘তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে নিজের জন্য যা করে’ [. বুখারি : ১৩, মুসলিম : ৪৫] শীর্ষক হাদিস। কেউ বলেছেন, চতুর্থ হাদিসটি হলো, তুমি দুনিয়ার ব্যাপারে বিরাগ হও আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন আর মানুষের হাতে যা রয়েছে তা থেকে বিরাগ হও লোকে তোমাকে ভালোবাসবে। [. ইবনে মাজাহ : ৪১০২, ইমাম নাববি বলেন, ইবনে মাজা র. এ হাদিসটি হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। শরহুন নাববি ১১/২৮]

উলামায়ে কিরাম বলেন, (নুমান বিন বাশির রা. বর্ণিত) হাদিসটি অবর্ণনীয় গুরুত্বের দাবিদার এ জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতে বস্ত্র, আহার্য ও পানীয়সহ মৌলিক সবকিছু সংশোধন করার কথা বলেছেন। তাগিদ দিয়েছেন অস্পষ্ট বিষয় থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকার প্রতি। কারণ তা ধার্মিকতা ও সম্মান রক্ষায় সহায়ক। সতর্ক করেছেন সন্দেহে পতিত হওয়া থেকে। উপরন্তু বিষয়টাকে স্পষ্ট করেছেন সংরক্ষিত স্থানের চমৎকার এক দৃষ্টান্ত পেশ করে। অবশেষে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিও উল্লেখ করেছেন। আর সেটা হলো, আত্মার প্রতি লক্ষ্য রাখা। তাঁর কথা, আত্মা শুদ্ধ থাকলে সারা দেহ ঠিক এর ব্যতিক্রম হলে পুরো দেহে সমস্যা দেখা দিবে।

তবে পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উক্তি ‘হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট’ এর অর্থ, - বিষয় মোট তিন প্রকার।

(ক) সুস্পষ্ট হালাল- যা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না; যে কেউ বুঝতে পারে। যেমন- রুটি, মধু ইত্যাদি।

(খ) সুস্পষ্ট হারাম- যা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না; যে কেউ বুঝতে পারে। যেমন- মদ, শূকর ইত্যাদি।

(গ) মুশ্তাবিহাত অর্থাৎ যার হালাল হওয়া বা হারাম হওয়া কোনোটাই স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ লোকই এর হুকুম বুঝতে পারে না। শুধু উলামায়ে কিরাম কিয়াস, নস বা অন্য কোনোভাবে তার হুকুম জানেন। [. শরহুন নাববি : ১১/২৮]

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর প্রিয় কাজগুলো করার এবং অপ্রিয় কাজগুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দেন। আমিন।

১৬
চতুর্থ পর্ব: সমকালীন রিবা সংক্রান্ত কতিপয় মাসআলার ব্যাপারে ফতোয়া প্রথম মাসআলা : শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগুজে মুদ্রা এবং তার বিধান
এ মাসআলা সম্পর্কে সৌদি মুফতি বোর্ডের লিখিত ফতোয়া প্রকাশ করা হয়েছে। নিম্নে হুবহু তার অনুবাদ তুলে ধরা হলো-

হামদ ও সালাতের পর, সৌদি মুফতি বোর্ড বরাবর উপস্থাপিত ‘শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগজের টাকা ও তার বিধান’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করেছেন। তারা পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

প্রথমত. যেহেতু সোনা-রুপাই টাকার মূল এবং আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুসারে সোনা-রুপায় তাদের মূল্যমানই সুদের ইল্লত আর ফকিহদের মতানুসারে উৎস এক হওয়া সত্ত্বেও সোনা-রুপাতেই মূল্যমানতা সীমাবদ্ধ নয় তাই। এবং যেহেতু টাকাই বর্তমানে মূল্য হিসেবে প্রচলন পেয়েছে, লেনদেনের বেলায় স্থান দখল করেছে সোনা-রুপার, এমনকি এ দিয়ে লেনদেন চলে, মানুষ এটা অর্জন ও সঞ্চয় করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে অথচ নিছক কাগজ হিসেবে তার কোনো মূল্য নেই; মূল্য তার অতিরিক্ত কারণে সেটা হলো, এর দ্বারা আস্থা অর্জন করা এবং লেনদেনের সময় বিনিময় মাধ্যম স্থির হওয়া আর এটাই মূল্যযোগ্য হওয়ার উদ্দেশ্য- এতসব কারণে মুফতি বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কাগজের টাকা একধরনের স্বতন্ত্র মুদ্রা যার বিধান সোনা-রুপার বিধানের অনুরূপ। সুতরাং এতে জাকাত ওয়াজিব হবে এবং এর ওপর সোনা-রুপার মতো সুদের উভয় প্রকার তথা ফযল ও নাসিয়া খাটবে। এককথায় কাগজের টাকা শরিয়তের সকল লেনদেনের ক্ষেত্রে সোনা-রুপার অনুরূপ হবে।

দ্বিতীয়ত. সোনা-রুপা ও অন্যান্য মুদ্রার মতো কাগজকেও স্বতন্ত্র মুদ্রা হিসেবে ধরা হবে। তেমনি কাগজের নোটকেও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে। এটা হবে দেশ ও প্রকাশ-প্রচলন স্থানের ভিন্নতা বিচার করে। অর্থাৎ সৌদি টাকা এক শ্রেণী আর মার্কিনি টাকা আরেক শ্রেণী। এভাবে প্রত্যেক দেশের টাকা মুদ্রার একেক স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে গণ্য হবে। আর সে অনুযায়ী সোনা-রুপা ও অন্যান্য মূল্যের মতো কাগজের মুদ্রা বা নোটের ওপরও সুদের বিধান খাটানো হবে।

আর এসবই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো দাবি করে :

(ক) কেবল নগদ ছাড়া বাকিতে কোনোভাবে কাগজের নোট একটার বদলে একটা কিংবা মুদ্রার অন্য কোনো প্রকার যেমন- সোনা,রুপা ইত্যাদির মোকাবেলায় বিক্রি করা বৈধ নয়। অতএব উদারণত, সৌদি রিয়াল অন্য কোনো দেশের কাগজের টাকার মোকাবেলায় কমবেশি করে হস্তগত না করে বাকিতে বিক্রি করা বৈধ নয়।

(খ) একই (দেশের) ধরনের কাগজের মুদ্রার একটার মোকাবেলায় অন্যটা কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়; চাই তা নগদে হোক বা বাকিতে। সুতরাং কাগজের সৌদি দশ রিয়াল কাগুজের এগারো রিয়ালের বিনিময়ে বিক্রি করা বাকিতে বা নগদে কোনোটাই বৈধ নয়।

(গ) দুই ধরনের দুই কাগজের মুদ্রা একটার বিনিময়ে আরেকটা বিক্রি করা বৈধ। যদি তা হয় হাতে হাতে। সুতরাং পাকিস্তানি রুপি দিয়ে সৌদি রিয়াল ক্রয় করা জায়িয। চাই তা সোনার হোক বা রুপার, কম হোক বা বেশি। তেমনি এক মার্কিন ডলার সৌদি তিন রিয়াল কিংবা তার কম বা বেশি দিয়ে বিক্রি করা এবং সৌদি রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে সৌদি কাগুজে মুদ্রা কমবেশি করে বিক্রি করা জায়িয। যদি তা হয় নগদে। কারণ এটাকে এক জাতীয় মুদ্রার বিনিময়ে আরেক জাতীয় মুদ্রা বিক্রি হিসেবে গণ্য করা হবে। আর বাস্তবতা এবং মূল্য ভিন্ন হলে শুধু নাম এক হওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।

তৃতীয়ত. সোনা-রুপার মতো কাগুজে মুদ্রার ওপরও জাকাত ফরজ হবে যখন স্বর্ণ বা রৌপ্য কোনোটার নেসাব পরিমাণ টাকা হবে। অথবা নেসাব পূর্ণ হবে অন্য কোনো মূল্য বা ব্যবসায়িক পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে।

চতুর্থত. কাগজের মুদ্রাকে বাইয়ে সলম এবং অংশীদারি কারবারগুলোতে মূলধন বানানো যাবে। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৭৯-৩৮০, সৌদি শীর্ষ আলেমদের গবেষণা অভিসন্দর্ভ : ১/৩০-৫৮]

১৭
দ্বিতীয় মাসআলা : তৃতীয় হিলার বিধান
প্রশ্ন: আমার কয়েক বস্তা চাল আছে সেটাকে আমরা গুদাম হিসেবে ধরি। আমার কাছে লোক এসে বাজার মূল্যে তা কিনল। তারপর সে আবার অন্য একজনের কাছে বাকিতে বিক্রি করল। চাল যখন ঋণগ্রহীতার হাতে পৌঁছল আমি তার কাছে গিয়ে আমার থেকে কেনা মূল্যের চেয়ে এক রিয়াল কমে কিনলাম। এবার আমার হাতে চাল আসার পর লোক এলো এবং আমার কাছ থেকে কিনল। এভাবে পণ্য একই স্থানে থাকল কিন্তু তা একেরপর এক বিক্রি হতে থাকল। এমন করলে কি গুনাহ হবে? জানিয়ে কৃতার্থ করবেন।

উত্তর: এটি মূলত সুদের ওপর হিলা। এমন রিবা যার মধ্যে নাসিয়া এবং ফযল উভয়ই বিদ্যমান। এটা এভাবে যে ঋণদাতা এর মাধ্যমে উদাহরণ স্বরূপ দশ টাকা দিয়ে বারো টাকা উপার্জন করতে চাচ্ছে।

১৮
তৃতীয় মাসআলা : পণ্য সস্থানে রেখে বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়
প্রশ্ন: পণ্য সস্থানে রেখে বাকিতে তার কেনা-বেচা অব্যাহত রাখার বিধান কী? বর্তমানকালে এ ধরনের বাকি লেনদেন ব্যাপক প্রচলন পেয়েছে।

উত্তর: মুমিনের জন্য কোনো পণ্য নগদে বা বাকিতে বিক্রি করা ততক্ষণ বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে এর মালিক হয় এবং পণ্য তার হাতে আসে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাকিম বিন হাযাম রা. কে বলেছেন- ‘যা তোমার কাছে নেই তা বিক্রি করতে পার না।’ [. আবু দাউদ : ৩৫০৩, তিরমিযি : ১২৩২, নাসায়ি : ২৮৯] অন্যত্র বলেছেন- ‘যা তোমার হাতে নেই তা তুমি ঋণ হিসেবে কাউকে দিতে পারে না কিংবা বেচতেও পার না কারো কাছে।’ [আবু দাউদ : ৩৫০৪, তিরমিযি : ১২৩৪, নাসায়ি : ৪৬১১] ঠিক তেমনি যে জিনিস কেনা হলো তাও সে বিক্রি করতে পারবে না, যতক্ষণ জিনিসটি তার হস্তগত হয়। কেননা ইমাম আহমদ ও আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, যায়েদ বিন সাবেত রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদ্য কেনা পণ্য নিজ বাহনে ব্যক্তিগত হেফাজতে না নেয়া পর্যন্ত বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। [. আবু দাউদ : ৩৪৯৯]

তেমনি ইমাম বুখারি তাঁর সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর যুগে মানুষকে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে দেখেছি। দেখেছি তাদের শাস্তি দেয়া হতো যদি পণ্য নিজ বাহনে (সংরক্ষণে) না নিয়ে বিক্রি করত। [. বৃখারি : ২১৩১] এ দু’টি ছাড়াও এ ব্যাপারে আরও অনেক হাদিস রয়েছে। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৩-৩৮৪]

১৯
চতুর্থ মাসআলা : নোট বদল
প্রশ্ন: আমি এক নির্দিষ্ট ব্যক্তি থেকে চল্লিশ হাজার সৌদি রিয়ালের বিনিময়ে দশ হাজার আমেরিকান ডলার কিনেছি। এ চল্লিশ হাজার রিয়াল শোধ করব মাসিক কিস্তিতে। প্রতি কিস্তি এক হাজার রিয়াল। এখন আমি সে ডলারগুলো বাজারে নিয়ে সাইত্রিশ হাজার পাঁচশ রিয়াল দিয়ে বেচতে চাচ্ছি। এটা কি আমার জন্য বৈধ হবে? উল্লেখ্য যে, আমার এ টাকার খুব প্রয়োজন।

উত্তর: আপনার প্রশ্নের উত্তর, না। এমনটি করা হারাম। কেননা নোট বদলের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের বিনিময় হস্তগত না করা পর্যন্ত আলাদা হওয়া হারাম। আর প্রশ্নে বর্ণিত সুরতে দ্বিতীয় বিনিময় তথা ডলারের মূল্য পরিশোধ করা হয়নি। সুতরাং এ সুরত বাতিল ও প্রত্যাহারযোগ্য। এখন যা হবার তা যেহেতু হয়েই গেছে তাই যে ডলার নিয়েছে তার জন্য অত্যাবশ্যক হলো, ডলার ফেরত দেয়া এবং প্রথম চুক্তির ওপর নির্ভর না করা। কারণ তা অবশ্য বাতিলযোগ্য। আর এটা প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- প্রত্যেক শর্ত যা আল্লাহর কিতাবে নেই তা অবশ্য প্রত্যাহারযোগ্য যদিও তা একশ বার করা হোক না কেন। আল্লাহর ফয়সালাই সঠিক এবং আল্লাহর শর্তই অধিক মজবুত। [. বুখারি : ৪৫৬ , ফতোয়া : সৌদি শীর্ষ আলেমদের ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৬]

২০
পঞ্চম মাসআলা : ব্যবহৃত স্বর্ণ দিয়ে (অব্যবহৃত) নতুন স্বর্ণ ক্রয়
প্রশ্ন: এক লোক অলঙ্কারাদি ক্রয়-বিক্রয় করে। একজন তার কাছে এলো কিছু ব্যবহৃত স্বর্ণ নিয়ে। সে ওই স্বর্ণ তার থেকে কিনে নিল। মূল্য নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। তারপর সে সময় ও সে স্থানে মূল্য পরিশোধের আগেই পুরাতন স্বর্ণ বিক্রেতার কাছে নতুন স্বর্ণ বিক্রি করল। এর দামও নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। এরপর যতটুকু বাকি থাকল তা পরিশোধ করবে টাকা দিয়ে। জানতে চাই- এটা কি জায়িয নাকি আগে প্রথম ক্রয়-চুক্তির টাকা বিক্রেতার কাছে পুরোটা দিয়ে দিতে হবে তারপর বিক্রেতা যে নতুন স্বর্ণ কিনেছে তার মূল্য ওই টাকা বা অন্য কোনো টাকা থেকে পরিশোধ করতে হবে?

উত্তর: এসব ক্ষেত্রে ওয়াজিব হলো প্রথমে ব্যবহৃত স্বর্ণ হস্তান্তর করা। তারপর বিক্রেতা যখন মূল্য হাতে পাবে তখন তার ইচ্ছা। চাইলে যার কাছে পুরাতন স্বর্ণ বিক্রি করেছে তার কাছ থেকে অথবা চাইলে অন্যের কাছ থেকে নতুন স্বর্ণ কিনবে। এখন সে যদি তার কাছ থেকেই নতুন স্বর্ণ কেনে তাহলে তার জন্য উভয় সুযোগ রয়েছে। চাইলে নতুন স্বর্ণের মূল্য হিসেবে তার টাকাই তাকে ফেরত দিবে অথবা অন্য টাকা দিবে। এমন করার উদ্দেশ্য যাতে মুসলমান সুদী দ্রব্যের ভালোর বদলে কমবেশি করে মন্দটা বিক্রি করার মতো হারাম কাজে লিপ্ত না হয়।

ইমাম বুখারি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে খায়বরের গভর্নর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। একবার তিনি তাঁর দরবারে জানিব নামক উৎকৃষ্ট জাতের খেজুর নিয়ে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন খায়বরের সব খেজুরই এমন কি-না। তিনি উত্তর দেন, না। আমরা এ খেজুরের এক সা’ কিনি সাধারণ খেজুর দুই সা’ দিয়ে আর এর দুই সা’ নেই সাধারণ খেজুরের তিন সা’ দিয়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এমন করো না; বরং সাধারণ (জানিব) খেজুর কেনো দিরহাম দিয়ে তারপর সে দিরহামের বিনিময়ে জানিব কেনো। [. বুখারি : ২২০১, মুসলিম : ১৫৯৪]

কারণ এ ধরনের ক্রয়-চুক্তিতে লেন-দেন ক্লিয়ার করণ যদিও একই সময়ে একই স্থানে হয় কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ‘সোনার বদলে কমবেশি করে সোনা বিক্রি’রই রূপ পরিগ্রহ করে। যা সুস্পষ্ট হারাম।

ইমাম মুসলিম রহ. উবাদা বিন সাবেত রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। তবে যখন এসব জিনিসের প্রকার পরিবর্তন করা হবে তো যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি করো অবশ্য যখন সেটা হতে হবে নগদ নগদ। আবু সাইদ খুদরির এক রেওয়াতে আছে, যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা -গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৯ আর হাদিসদ্বয়ের প্রাগুক্ত।]

প্রশ্ন: আমি স্বর্ণ-বিক্রেতার কাছে কিছু পুরাতন স্বর্ণ নিয়ে গেলাম। স্বর্ণ-বিক্রেতা সেসব ওজন করে বললেন, এর দাম হবে ১৫০০ রিয়াল। তার কাছে ১৫০০ রিয়াল মূল্যে স্বর্ণগুলো বিক্রি করে আমি একই ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু নুতন স্বর্ণ কিনলাম- যার দাম ১৮০০ রিয়াল। এখন জানতে চাচ্ছি, আমার জন্য কি জায়িয হবে যে আমি তাকে শুধু ৩০০ রিয়াল দিয়ে দিব? নাকি প্রথমে ১৫০০ রিয়াল হস্তগত করব তারপর একসাথে ১৮০০ রিয়াল তাকে দিব?

উত্তর: নগদ মূল্যে হাতে হাতে সমান দামে ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা জায়িয নেই যদিও ভালো-মন্দ হিসেবে তার প্রকার বদলানো হোক না কেন- এ কথা হাদিসে বারবার বলা হয়েছে দ্ব্যর্থহীনভাবে। বৈধ উপায় হলো- যে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ কিনতে ইচ্ছুক সে প্রথমে তার কাছে যে স্বর্ণ আছে তা রুপা বা কাগজের মুদ্রা দিয়ে সে বিক্রি করবে তারপর সে মুদ্রা বা রুপা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ কিনবে। তবে যদি সোনা-রুপা বিক্রি করা হয় কাগজের মুদ্রা বৈ অন্য কিছু দিয়ে যেমন- পরিবহন সামগ্রী কিংবা চিনি ইত্যাদির বিনিময়ে তবে চুক্তির উভয় মাধ্যম তথা পণ্য ও মূল্য হস্তগত করার আগেই ক্রেতা-বিক্রেতা মজলিস ত্যাগ করায় কোনো সমস্যা নেই। কারণ স্বর্ণ, রৌপ্য ও কাগজের মুদ্রা এবং এসব এবং এ ধরনের বস্ত্তর মাঝে রিবা বা সুদের বিধান প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য যে, বিক্রি চুক্তি যখন বাকিতে হবে তখন পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা জরুরি। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে।’ [. বাকারা : ২৮২, ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫২]

২১
ষষ্ঠ মাসআলা : বাকিতে স্বর্ণ বা রৌপ্য বিক্রি
প্রশ্ন: এক ব্যক্তি আমার কাছ থেকে একটি সোনার গহনা নিয়েছে। অলঙ্কারটির দাম এক হাজার রিয়াল। আমি তাকে বললাম, এটা নগদ ছাড়া বিক্রি করা বৈধ হবে না। সে বলল, তুমি আমাকে এক হাজার রিয়াল কর্জ দাও। আমি তাকে কর্জ দিলাম আর সে ওই রিয়ালই আমাকে গহনার মূল্য হিসেবে দিল। এমন করা বৈধ হবে কি?

উত্তর: না বৈধ হবে না। কারণ এটিও সুকৌশলে সুদী কারবার। উপরন্তু এতে দুই আকদ একত্রিত হচ্ছে। একটি বাকির আকদ অপরটি বিক্রির আকদ। আর এমনটিও নিষিদ্ধ। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৯০]

প্রশ্ন: আমার কাছে এক ব্যক্তি স্বর্ণালঙ্কার কিনতে আসল। তার পছন্দকৃত অলঙ্কারটি ওজন করে দেখা গেল তার কাছে যত টাকা আছে তা এর মূল্য হিসেবে যথেষ্ট নয়। এখন জানা কথা যে, তার কাছে স্বর্ণালঙ্কারটি বিক্রি করা এবং সেটা তার হাতে তুলে দেয়া বৈধ হবে না। কিন্তু সে যদি ধরুন প্রভাতে আমার কাছে এসে থাকে এবং বলে, অলঙ্কারটি আপনার কাছেই রাখুন আমি আসরের সময় এসে পুরা টাকা নিয়ে উপস্থিত হয়ে তবেই আপনার কাছ থেকে নিব।

জিজ্ঞাস্য হলো, এমতাবস্থায় আমার জন্য কি বিকালে তার টাকা পাবার এমন নিশ্চয়তার ওপর ভিত্তি করে এ অলঙ্কার তার ব্যাগে দিয়ে দেয়া বৈধ হবে? নাকি আমার কর্তব্য তার এ চুক্তিকে নিরর্থক মনে করা। তারপর সে যদি উপস্থিত হয় তখন সে অন্যান্য ক্রেতার মতো তার সঙ্গে নতুন ক্রয় চুক্তি কার্যকর করা? নয়তো আমাদের মাঝে কোনো চুক্তি নেই বলে মনে করব।

উত্তর: তার কথা মতো এ বিক্রয় চুক্তি কার্যকর করার সুযোগ নেই। যাবৎ না সে সম্পূর্ণ মূল্য নিয়ে উপস্থিত হয়। এভাবেই আপরি রিবায়ে নাসিয়া বা বাকি বিক্রির সুদ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। সুতরাং আপনি স্বর্ণালঙ্কারটি নিজের কাছেই রাখবেন। অতপর সে যখন সম্পূর্ণ মূল্য নিয়ে আপনার কাছে আসবে তখন আপনার উভয়ে নতুন এক ক্রয় চুক্তি করবেন যে চুক্তিতে উভয় মাধ্যম উপস্থিত বৈঠকেই সম্পন্ন হবে। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫৩]

২২
সপ্তম মাসআলা : ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে অংশগ্রহণ
প্রশ্ন: আমি একজন কুয়েতি নাগরিক। আমাদের দেশে বিভিন্ন কৃষি ও বাণিজ্যিক কোম্পানি রয়েছে। রয়েছে ব্যাংক, বীমা ও পেট্রোল কোম্পানি। এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য এসব কোম্পানির পার্টনার হওয়ার অনুমতি রয়েছে। জানতে ইচ্ছুক এসব কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডার হওয়া যাবে কি-না।

উত্তর: সবার জন্য এসব কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করা বৈধ যদি সে কোম্পানি সুদী কারবার না করে। যদি সুদী লেনদেন করে তাহলে জায়িয হবে না। কারণ কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার মাধ্যমে সুদের হারাম হওয়া প্রমাণিত। তেমনিভাবে মানুষের জন্য বাণিজ্যিক বীমা কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করাও বৈধ নয়। কারণ বীমা চুক্তিগুলো প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে পরিপূর্ণ। আর যেসব চুক্তি প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে ভরা ইসলামের দৃষ্টিতে তার সবই হারাম। [. ইসলামি ফাতাওয়া সংকলন : ২/৩৯০]

২৩
অষ্টম মাসআলা : সুদী ব্যাংকে লেনদেন
এ ব্যাপারে ইসলামি ফিকাহ বোর্ডের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়েছে নিম্নে যা হুবহু তুলে দেয়া হলো- ইসলামি ফিকাহ বোর্ড পবিত্র মক্কাস্থ রাবেতা আলমে ইসলামি’র বিল্ডিংয়ে সাত দিনব্যাপী (১২-২৯ রজব ১৪০৬ হিঃ) অনুষ্ঠিত তার নবম বৈঠকে ভেবে দেখেছে যে, সুদী ব্যাংক ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব ব্যাংকে মানুষের লেনদেন। অথচ তাদের কাছে এসব ব্যাংকের বিকল্প নেই বললেই চলে।

বৈঠকে এই ভয়ঙ্কর সমস্যা নিয়ে সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সারগর্ভ আলোচনা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে শোনা হয়। তাদের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, আধুনিক অর্থনীতির গবেষণা এ কথা সপ্রমাণ করেছে যে, সুদই বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি এবং শান্তি-সমৃদ্ধির পথে সবচে’ বড় হুমকি। বিশ্বের অনেক সমস্যার আড়ালেই রয়েছে এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। চৌদ্দশ বছর আগেই ইসলামে হারাম ঘোষিত এই বিষাক্ত জীবাণু সমাজ থেকে নির্মূল করা ছাড়া বিশ্বশান্তি অধরাই থেকে যাবে চিরদিন। আর সুদ নির্মূলে সবচে’ কার্যকর পদক্ষেপ হলো, সুদ ও শরিয়ত অননুমোদিত লেনদেন মুক্ত ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। নিম্নে বৈঠকের উলেখযোগ্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হলো।

প্রথমত. প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত সুদী লেনদেন সর্বোতভাবে পরিহার করা। এবং সুদী কারবারে যে কোনো রকম সহযোগিতা থেকে বিরত থাকা।

দ্বিতীয়ত. সুদী ব্যাংকগুলোর উত্তম বিকল্প হিসেবে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি মুসলিম দেশ এবং বিশ্বের সকল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকায় ইসলামি ব্যাংকের প্রসার ঘটাতে হবে। এভাবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি অর্থনীতির বাস্তব রূপায়নে এসব ব্যাংক এক শক্তিশালী নেটওয়ার্কে পরিণত হবে।

তৃতীয়ত. প্রতিটি মুসলমানের জন্য দেশে-বিদেশে যেখানেই ইসলামি ব্যাংক বিদ্যমান সেখানে সুদী ব্যাংকে লেনদেন করা হারাম। কারণ ইসলামি ব্যাংকের মতো বিকল্পের বর্তমানে তার জন্য সুদী ব্যাংকে কারবার করার কোনো অজুহাত বাকি থাকে না। তার ওপর ওয়াজিব অপবিত্র পথ বর্জন করে পবিত্র পথে আসা এবং হারামের স্থলে হালাল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা।

চতুর্থত. এ বৈঠক মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান ও সুদী ব্যাংকসমূহের কর্ণধারদের প্রতি সুদের মতো পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে।

পঞ্চমত. সুদের লাভের পথে আহরিত সকল সম্পদই শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম। কোনো মুসলিমের (আমানতকারী) জন্যই তা নিজের বা পরিবারস্থ লোকদের প্রতি এ টাকা ব্যয় করা বৈধ নয়। বরং উটিৎ হলো, এ টাকা সাধারণ জনকল্যাণ মূলক কাজে যেমন- মাদরাসা, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণে ব্যয় করা। তবে এ টাকা খরচ করার সময় দান-সদকার নিয়ত করা যাবে না। বরং নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়ার নিয়ত করতে হবে।

আবার কোনো অবস্থাতেই সুদী ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত লভ্যাংশ বিদেশি ব্যাংকগুলোর জন্য ফেলে রাখা যাবে না। এতে গুনাহ বা অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ বিদেশি ব্যাংকগুলো এ টাকা খৃস্টান মিশনারি বা ইহুদি প্রতিষ্ঠনগুলোয় ব্যয় করে। এবং শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের এসব টাকা মুসলমানদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং তাদের সন্তানদের ঈমান হরণের পেছনে ব্যয় হয়।

২৪
নবম মাসআলা : সুদী ব্যাংকে লেনদেন বা চাকুরি
নিচের প্রশ্নগুলোর ইসলামি জবাব প্রত্যাশা করছি।

যে ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা রেখেছে বছরান্তে সে কি এর লভ্যাংশ গ্রহণ করতে পারবে ?

অতিরিক্ত লাভ দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদের ওপর ঋণগ্রহীতার লভ্যাংশ ভোগ করে না ?

যে ওইসব ব্যাংকে টাকা আমানত রাখে কিন্তু লভ্যাংশ ভোগ করে না ?

ওই সব ব্যাংকে চাকুরীরত কর্মকর্তা চাই সে পরিচালক বা অন্য কেউ ?

ওই ভূ-স্বামী যে এসব ব্যাংকে তার ভূমি লিজ দেয় ?

উত্তর: লাভের ওপর ব্যাংককে লাভের ওপর ঋণ বা আমানত দেয়া কোনোটাই জায়িয নেই। কারণ এ দুটোই সুস্পষ্ট সুদ। ব্যাংক ছাড়া অন্য কোথাও লাভের ওপর অর্থ আমানত রাখা জায়িয নেই। এভাবে লাভের ওপর কাউকে কর্জ দেয়াও জায়িয নেই। কারণ এর সবই উলামায়ে কেরামের সর্ব সম্মতিক্রমে হারাম। ইরশাদ হয়েছে-‘আল্লাহ বেচাকেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। [. বাকারা : ২৭৫]

আরও ইরশাদ হয়েছে- আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। [. বাকারা : ২৭৬] অন্যত্র ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।’ [. বাকারা : ২৭৮] এসবের পর আল্লাহ তাআলা বলেন, আর যদি সে অসচ্ছল হয়, তাহলে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তার অবকাশ রয়েছে। [. বাকারা : ২৮০] এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাকে সতর্ক করে বলছেন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে ঋণের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা বৈধ নয়। বরং কর্তব্য হলো বেচারাকে তার সুবিধামত ঋণ পরিশোধের অবকাশ দেয়া। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহ যাতে সে জুলুম ও নিপীড়ন থেকে বাচতে পারে।

তবে লভ্যাংশ ভোগ না করে শুধু আমানত রাখায় কোনো অসুবিধা নেই যতক্ষণ সুদী ব্যাংকের বিকল্প না পাওয়া যায়। আর সুদী ব্যাংকে চাকুরি করা চাই পরিচালক হিসেবে হোক আর হিসাব রক্ষক, রেজিস্ট্রার বা অন্য যে পদেই হোক বৈধ নয়। কারণ ইরশাদ হয়েছে- সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। [. মায়িদা : ০২]

২৫
দশম মাসআলা : সুদী ব্যাংকে বীমা করা
প্রশ্ন: যার কাছে টাকা আছে এবং সে তা কোনো ব্যাংকে জমা রাখে আমানত হিসেবে যাতে সে অর্থ সুরক্ষিত থাকে আবার বছরান্তে তার লাভও পাওয়া যায়। এটা কি বৈধ?

উত্তর: সুদী ব্যাংকে বীমা করা জায়িয নেই যদিও তাতে লভ্যাংশ ভোগ না করে। কারণ এর দ্বারা পাপ এবং অন্যায় কাজে সাহায্য করা হয়। আর আল্লাহ তাআলা অন্যায় কাজে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ করেছেন। তবে যদি টাকা রাখার মতো অন্য কোনো ব্যাংক না পাওয়া যায় তাহলে অপারগতা বশত এমন ব্যাংকে টাকা রাখলে কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ। ইরশাদ হয়েছে- অথচ তিনি তোমাদের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, যা তোমাদের উপর হারাম করেছেন। তবে যার প্রতি তোমরা বাধ্য হয়েছে। [. আনআম: ১১৯] অতএব টাকা রাখার জন্য যখন কোনো ইসলামি কায়দায় পরিচালিত ব্যাংক অথবা নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে- যেখানে অন্যায়ে সহযোগিতা দানের অপরাধ হবে না তখন সুদী ব্যাংকে টাকা রাখা জায়িয হবে না। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৯৭]

২৬
একাদশ মাসআলা : ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়
প্রশ্ন: এভাবে ব্যাংকের শেয়ার কেনার হুকুম কী যে কিছুদিন পর তা এক হাজার টাকা থেকে উন্নীত হয়ে ১৩০০ টাকা হয়ে যাবে। এটা কী সুদ বলে গণ্য হবে?

উত্তর: ব্যাংকের শেয়ার কেনাবেচা করা জায়িয নেই। কারণ এটা হস্তগত করা এবং সমতা রক্ষার শর্ত পুরণ না করে মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা বেচার শামিল- যা হারাম। দ্বিতীয়ত এটা সুদী প্রতিষ্ঠান যেখানে কোনো রূপ সাহায্য করা বৈধ নয়। কারণ ইরশাদ হয়েছে- ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।’ [. মায়িদা : ০২] এবং এ জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি সুদদাতা, গ্রহীতা, সুদের লেখক এবং সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন। আখ্যায়িত করেছেন এদের সকলকে সমান অপরাধী বলে। [. মুসলিম : ১৫৯৭]

তবে আপনি এবং সকল মুসলমানের প্রতি আমার অনুরোধ, যে কোনো মূল্যে সব ধরণের সুদী লেনদেন থেকে বিরত থাকুন। আর অতীত লেনদেনের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করুন। কারণ সুদী লেনদেন করার অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। আল্লাহর গোস্বা ও আজাবকে অবধারিত করা। তিনি যেমন ইরশাদ করেছেন- ‘যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।

আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না। [. বাকারা : ২৭৫-২৭৬] তিনি আরও ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও।’ [. বাকারা : ২৭৮-২৭৯] আর এ সম্পর্কে হাদিস তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৯৯-৪০০]

২৭
দ্বাদশ মাসআলা : সুদী প্রতিষ্ঠানে চাকুরি
প্রশ্ন: সুদী প্রতিষ্ঠানে কি নিরাপত্তারক্ষী বা ড্রাইভার হিসেবে চাকুরি করা যাবে ?

উত্তর: কোনো সুদী প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করা বৈধ নয় চাই তা দারোয়ান-ড্রাইভার যে হিসেবেই হোক না কেন। কারণ সুদী প্রতিষ্ঠানের যে কোনো দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়া মানেই তাদের হারাম কাজে সম্মতি জানানো। কেননা যে কোনো কিছু ঘৃণা করে তার স্বার্থে সে কাজ করতে পারে না। সুতরাং সে যখন সুদী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে তার অর্থ এতে তার সমর্থন আছে। আর হারাম কাজে সমর্থন দেয়াও গুনাহ। আর যে সরাসরি হিসাব রক্ষণ, রেজিস্ট্রি, আমানত গ্রহণ বা এ ধরণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অবতীর্ণ তার চাকুরি তো সন্দেহাতীতভাবে হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি সুদদাতা, গ্রহীতা, সুদের লেখক এবং সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন। আখ্যায়িত করেছেন এদের সকলকে সমান অপরাধী বলে। [. প্রাগুক্ত : ২/৪০১]

২৮
ত্রয়োদশ মাসআলা : সুদী ব্যাংকের লাভ
প্রশ্ন: কিছু কিছু ব্যাংক তাদের কাছে টাকা আমানত রাখলে তার ওপর লাভ দিয়ে থাকে। আমরা জানি না লাভগুলো সুদ না-কি লাভ যা গ্রহণ করা বৈধ?

উত্তর: প্রথমত. ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের গচ্ছিত টাকার ওপর যে লাভ দেয় তাকে সুদ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ টাকা ভোগ করা বৈধ নয়। তার কর্তব্য সুদী ব্যাংকে টাকা রাখার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং মূল টাকা লাভসহ প্রত্যাহার করে নেয়া। তারপর মূল এমাউন্ট সংরক্ষণ করবে আর লভ্যাংশটুকু গরিব-মিসকিন এবং জনহিতকর খাতে ব্যয় করা। দ্বিতীয়ত. সুদী কারবার করে না এমন ক্ষেত্র খুঁজে বের করবে। হোক না সেটা দোকান বা অন্য কিছু। সেখানে টাকা রাখবে ব্যবসায় খাটানোর জন্য কিংবা অলাভজনক আমানত হিসেবে। [. প্রাগুক্ত : ২/৪০৪]

২৯
চতুর্দশ মাসআলা : বার্ষিক লাভের ওপর ব্যাংকের ঋণ দান
প্রশ্ন: ব্যাংকের সাথে লেনদেন করা কি সুদ নাকি অবৈধ? অনেক নাগরিকই তো ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়।

উত্তর: মুসলমানের জন্য সোনা, রুপা বা কাগজের মুদ্রা কর্জ নেয়া এ হিসেবে তার চেয়ে পরিশোধ করবে হারাম। চাই ঋণদাতা ব্যাংক হোক বা অন্য কেউ। কারণ এটা সুদ- যা অন্যতম কবিরা গুনাহ। যে ব্যাংক এ কাজ করে সেটা সুদী ব্যাংক। [. প্রাগুক্ত : ২/৪১২]

৩০
পঞ্চদশ মাসআলা : একরকম মুদ্রা নিয়ে অন্যরকম মুদ্রা দিয়ে পরিশোধ করা
প্রশ্ন: আমাকে এক ভাই দুই হাজার তিউনিসি মুদ্রা কর্জ দিলেন। চুক্তিপত্র লেখার সময় টাকার অঙ্ক উল্লেখ করা হলো জার্মানি মুদ্রায়। তারপর ঋণের মেয়াদ তথা বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা গেল জার্মানি মুদ্রার মান বেড়ে গেছে। ফলে আমি যখন চুক্তিনামায় উল্লেখিত পরিমাণ টাকা পরিশোধ করলাম, দেখা গেল তাকে তিনশ তিউনিসি মুদ্রা বেশি দেয়া হয়েছে। এখন জিজ্ঞাস্য হলো, আমার ঋণদাতার জন্য এ অতিরিক্ত টাকা নেয়া বৈধ হবে কি? নাকি তা সুদ বলে গণ্য হবে? প্রকাশ থাকে যে, সে চায় আমি জার্মানি মুদ্রায় তার প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করি। যেন সে জার্মানি থেকে গাড়ি কিনতে পারে।

উত্তর: ঋণদাতার জন্য আপনাকে যত টাকা কর্জ দিয়েছে অর্থাৎ দুই হাজার তিউনিসি মুদ্রা-এর অতিরিক্ত নেয়া বৈধ হবে না। তবে আপনি যদি উদারতা দেখিয়ে একটু বেশি দেন সেটা ভিন্ন কথা। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-‘লোকদের মধ্যে সেই উত্তম যে তাদের মাঝে ঋণ পরিশোধের বেলায় উত্তম।’ হাদিসটি এভাবে মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে। [. মুসলিম : ১৬০০] বুখারিতে এসেছে এভাবে- ‘সর্বোত্তম লোকদের মধ্যে অন্যতম সেই ব্যক্তি যে ভালোভাবে কর্জ আদায় করে।’ [. বুখারি : ২৩০৬]

আর উল্লেখিত চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। এর কোনো মূল্য নেই। আমলও করা হবে না সে অনুযায়ী। কারণ এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ চুক্তি। শরিয়তের অসংখ্য দলিল প্রমাণ করে যে, কর্জ নেয়া টাকা তার অনুরূপ পরিমাণ দিয়েই পরিশোধ করতে হয়। তবে যদি ঋণগ্রহীতা উপকারের বদলা হিসেবে কিছু বেশি দেয় তাহলে সেটা উল্লেখিত হাদিসের কারণে বৈধ হবে। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৪১৪]

প্রশ্ন: আমার এক মিশর প্রবাসী আত্মীয় আমার কাছে ২৫০০ মিশরি পাউন্ড কর্জ চাইলেন। আমি তার উদ্দেশে ২০০০ ডলার পাঠালাম- যা বিক্রি করে তিনি ২৪৯০ মিশরি পাউন্ড পেলেন। তখন আমরা পরিশোধের ধরন বা তারিখ কোনোটাই উল্লেখ করিনি। ইদানীং তিনি আমার প্রাপ্য পরিশোধ করতে চাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হলো, আমি কি তার থেকে ২৪৯০ মিশরি পাউন্ড নিব- যা বর্তমানে ১৮০০ ডলার সম পরিমাণ না-কি ২০০০ ডলার- যা তাকে ২৮০০ মিশরি পাউন্ড দিয়ে কিনতে হবে?

উত্তর: তার জন্য ওয়াজিব যত ডলার সে কর্জ নিয়েছে তা-ই পরিশোধ করা। কারণ এটাই মূল এমাউন্ট যা সে কর্জ নিয়েছে। তবে উভয়ে একমত হয়ে যদি আপনি পাউন্ড নিতে রাজি হন তাহলে কোনো সমস্যা নেই। ইবনে উমর রা. বলেন, ‘আমরা বকি’ নামক স্থানে দিরহাম দিয়ে উট বিক্রি করতাম পরে আবার দিরহামের বদলে দিনার গ্রহণ করতাম। তেমনি দিনার দিয়ে উট বিক্রি করতাম তারপর দিরহাম গ্রহণ করতাম। এতদশ্রবণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘যতক্ষণ তোমরা (চুক্তির স্থান থেকে) আলাদা না হবে ততক্ষণ বিক্রিত উট তার মূল্য দিয়ে (সেটা যা-ই হোক না কেন) বিক্রি করায় কোনো সমস্যা নেই। [. আবু দাউদ : ৩৩৪৫, নাসায়ি : ৫০-৫২] আলোচ্য মাসআলায় মুদ্রা বিক্রি করা হচ্ছে ভিন্ন জাতের মুদ্রা দিয়ে যা ঠিক স্বর্ণ দিয়ে রৌপ্য বিক্রির মতো।

সুতরাং আপনারা যখন একমত যে তিনি আপনাকে ডলারের পরিবর্তে মিশরি পাউন্ড দিবেন এ শর্তে যে একমত হওয়ার সময়ের চেয়ে বেশি মূল্য নিবেন না তাহলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। অতএব আজ যদি ২০০০ ডলারের মূল্য হয় ২৮০০ পাউন্ড তাহলে আপনি ৩০০০ পাউন্ড নিতে পারবেন না। হ্যা শুধু ২৮০০ পাউন্ড নিতে পারবেন আবার শুধু ২০০০ ডলারও নিতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি হয়তো আজকের দরে নিবেন নয়তো তার চেয়ে কমে। এককথায় বেশি নিতে পারবেন না। বেশি নিলে সেটা আপনার দায়িত্ব বহির্ভূত লাভ বলে গণ্য হবে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দায় বহির্ভূত লাভ গ্রহণ থেকে বারণ করেছেন। তবে যদি কম নেন তাহলে ধরা হবে যে, আপনি কিছু নিয়েছেন আর বাকিটা ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর এতে কোনো সমস্যা নেই। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৪১৪-৪১৫]

৩১
ষষ্ঠদশ মাসআলা : এমন কর্জ যা লাভ টেনে আনে
প্রশ্ন: একব্যক্তি একজনের কাছ থেকে কিছু অর্থ ঋণ নিয়েছে। তবে ঋণদাতা শর্ত দিয়েছে এর জন্য তার কাছে একটি ধানী জমি বন্ধক রাখতে হবে। সে ওই জমি চাষাবাদ করবে আর উৎপাদিত ফসলের পুরোটা বা অর্ধেক নিয়ে নিবে। বাকি অর্ধেক নিবে জমির মালিক। যতদিন এ ব্যক্তি তার ঋণ পুরোপুরি শোধ না করতে পারবে ঋণদাতা এ জমি ভোগ করবে। প্রশ্ন হলো এমন করা তার জন্য জায়িয হবে কি? এ ধরনের শর্তযুক্ত ঋণের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?

উত্তর: কর্জ হলো অন্যের প্রতি দয়া ও সহমর্মিতার পরিচায়ক লেনদেনের অন্যতম। ইসলাম এমন লেনদেনর বহুল প্রচার কামনা করে। কেননা কর্জ দ্বারা অন্যের উপকার ও তার ওপর অনুগ্রহ করা হয়। আর আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- তোমরা অনুগ্রহ করো আল অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন। [. বাকারা : ১৯৫] সুতরাং ঋণ দেয়া মুস্তাহাব ও প্রশংসনীয় কাজ আর ঋণ নেয়া মুবাহ ও বৈধ কাজ।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি এক ব্যক্তি থেকে একটি বাচ্চা উট ধার নিয়েছেন এবং তার চেয়ে উত্তমটা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর কর্জ দেয়া যেহেতু অনুগ্রহ ও দয়াপূর্ণ চুক্তি তাই এটাকে লাভ ও বিনিময় চুক্তি তথা নিছক পার্থিব লাভ আহরণের উপায়ে পরিণত করা বৈধ নয়। কারণ এমন করার দ্বারা একটা পুণ্যকর্মকে ভোগসর্বস্ব ব্যবসায়িক লেনদেনে পরিণত করা হয়। এ জন্যই আপনি এ দুই কথার মধ্যে পার্থক্য পাবেন যে বলল, আমি তোমাকে এই দিনারের বিনিময়ে এই দিনার এক বছরের জন্য বাকিতে দিলাম অথবা আমি তোমার কাছে এতগুলো দিনারের বদলে এতগুলো দিনার বিক্রি করলাম। অতপর হস্তগত না করেই দু’জন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ উভয় অবস্থায়ই হারাম হবে। কিন্তু যদি তাকে এক দিনার কর্জা দেয় আর সে তা শোধ করে এক মাস বা এক বছর পরে তাহলে সেটা বৈধ। অথচ এখানেও ঋণদাতা বিনিময়টা এক বছর পরে বা তার আগে-পিছে গ্রহণ করছে। এটা এ জন্য যে এখানে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও দয়ার দিকটিই প্রাধান্য পাচ্ছে।

আর এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, আপনার জিজ্ঞাস্য ক্ষেত্রে ঋণদাতা যেহেতু নিছক জাগতিক লাভের শর্ত করেছে সুতরাং এটা কর্জার উপকারী মনোভাব থেকে বেরিয়ে গেছে। অতএব এ সুরত হারাম। এছাড়া ফিকাহবিদদের স্বীকৃত মূলনীতি তো আছেই যে, ‘প্রত্যেক ওই কর্জ যা লাভ টেনে আনে তা সুদ।’ সুতরাং বুঝা গেল, কর্জদাতার জন্য বৈধ হবে না যে তিনি কর্জগ্রহীতার ওপর তার জমি অর্পণের শর্ত করবেন যা চাষাবাদ করে তিনি ভোগ করবেন। এমনকি যদি ঋণগ্রহীতা এক ভাগ দেয় তাও বৈধ হবে না। কারণ এটা সুস্পষ্টভাবে কর্জ দিয়ে লাভ নেয়ার শামিল যা কর্জের মতো একটি সুন্দর সহমর্মিতা মূলক লেনদেনকে বস্ত্ত ও সার্থ সর্বস্ব লেনদেনে পরিণত করে। [. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৪১৫-৪১৬]

৩২
সপ্তদশ মাসআলা : ব্যাবসায়িক বীমা এবং ব্যাংক গ্যারান্টি
প্রশ্ন: আমরা এমন সমস্যায় আছি যে ব্যাংকের সাথে কারবার না করে উপায় নাই। ব্যাপার হলো, আমরা একটি ব্যাংককে ঠিকাদার নিযুক্ত করেছি; যেটির নাম ‘সুন্দর ব্যবস্থাপনা ঠিকাদারি ব্যাংক (অর্থাৎ ব্যাংকটি চুক্তির ধারা অনুযায়ী সুন্দরভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের জামিন হয়।) এখন আমরা সবিস্ময়ে জানছি, তারা যে জামিননামা পেশ করে তার বিনিময়ে মূল্য নেয়। এদিকে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ফিকহের কিতাব রয়েছে যেগুলো থেকে জানা যায়, জিম্মাদারি বা গ্যারান্টি একধরনের স্বেচ্ছাসেবা। এরপর আমরা প্রজেক্টি স্থগিত করেছি বিষয়টি সম্পর্কে শরয়ি প্রমাণাদিসহ বিস্তারিত জানার জন্য। জিজ্ঞাস্য হলো, জামিন বা গ্যারান্টার হওয়ার বিনিময়ে মূল্য নেয়া কি জায়িজ ?

তেমনি ব্যবসায়িক পণ্যের বীমা, জীবন বীমা এবং এ ধরনের চুক্তির ব্যাপারে শরিয়তের বক্তব্য কী আমাদের জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর: প্রথমত. যে আপনাদের কোনো চুক্তি বাস্তবায়নে জামিন হয়েয়ে তার জন্য যে নির্ধারিত এমাউন্টের বেশি লাভের ওপর জামিন হওয়া জায়িজ নেই। কারণ সে মুনাফা নিবে তা সুদী মুনাফা যা হারাম। দ্বিতীয়ত. ব্যাবসায়িক বীমা হারাম। নিম্নের কারণগুলোর ভিত্তিতে।

ব্যবসায়িক বীমা চুক্তি এক ধরনের অনিশ্চিত মুয়ামালা যাতে আছে নির্জলা প্রতারণা। কারণ বীমাকারী চুক্তির সময় জানতে পারে না কত টাকা তাকে দেয়া হবে। তাই দেখা যায় বীমাকারী হয়তো এক বা দুই কিস্তি দিয়েছে মাত্র; অমনি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। তখন সে বীমা কোম্পানি কর্তৃক ধার্যকৃত এমাউন্টের মালিক হয়। আবার কারো বেলায় দেখা যায় দুর্ঘটনা ঘটেই না। তখন সে সব কিস্তি পরিশোধ করেও কিছুই পায় না। আর কোম্পানিও নিশ্চিত করে জানতে পারে না প্রত্যেক চুক্তির বেলায় কত পাবে আর কত দিবে। কারণ সহি হাদিসে ধোঁকা-প্রতারণামূলক ব্যবসা বৈধ নয়। [. মুসলিম : ১৫১৩]

ব্যবসায়িক বীমা এক ধরনের জুয়া। কারণ এতে ‘আর্থিক লেনদেনে শংকা’ রয়েছে, রয়েছে কোনো অপরাধ বা ভূমিকা ছাড়া ক্ষতি পূরণ এবং বিপরীতে কিছু ছাড়া মুনাফা বা বিনিময় ছাড়া প্রতিদান। দেখা যায় বীমাকারী মাত্র এক কিস্তি দিয়েছে ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে দুর্ঘটনা তখন বীমা কোম্পানি এর দায় বহন করে। আবার কারো বেলায় দুর্ঘটনা ঘটেই না। অথচ কোম্পানি তারপরও কোনো বিনিময় ছাড়াই সমুদয় কিস্তি গ্রহণ করে। এসবের সাথে সাথে যখন তাতে অজ্ঞতা যোগ হয় তখন তা হয়ে যায় পুরোমাত্রায় জুয়া। ফলে তখন এটি কুরআনে বর্ণিত ‘মাইসির’ এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা- বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ [. মায়িদা : ৯০]

ব্যবসায়িক বীমায় নাসিয়া ও ফযল উভয় ধরনের সুদ রয়েছে। কারণ কোম্পানি যখন বীমাকারী বা তার উত্তরাধীকারীদের জমা দেয়া টাকার অতিরিক্ত দিবে তখন তা রিবায়ে ফযল বা অতিরিক্ত নেয়ার মাধ্যমে সুদ হবে। এদিকে কোম্পানি যেহেতু চুক্তির পরে শোধ করে তাই তা রিবায়ে নাসিয়া বা বাকি দেয়ার মাধ্যমে সুদ হবে। আর যদি মুনাফা না দিয়ে সমান দেয় তবুও তা হবে রিবায়ে নাসিয়া বলে গণ্য হবে। আর উভয় অবস্থায়ই হারাম।

ব্যবসায়িক বীমা এক ধরনের বাজি। যার উভয় তরফেই রয়েছে অজ্ঞতা, প্রতারণা এবং জুয়া। আর ইসলামে বাজি সম্পূর্ণ হারাম। কেবল ওইসব ক্ষেত্রে যেখানে ইসলামের কলম বা কথা দ্বারা ইসলামের বিজয় সাধন উদ্দেশ্য হয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাজি বৈধতা তিন ক্ষেত্রেই সীমিত রেখেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, .....

বীমা চুক্তিতে বিনিময় ছাড়া অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা হয় বলে তা আল্লাহর বাণী ‘হে মুমিনগণ তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।’ [.]- এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে হারাম হবে।

ব্যবসায়িক বীমায় শরিয়ত যেটার ওপর মানুষকে বাধ্য করেনি সেটাতে বাধ্য করা হয়। কারণ কোম্পানি দুর্ঘটনা ঘটায় না; এর পেছনে তার কোনো হাতও থাকে না। কোম্পানি শুধু দুর্ঘটনার ক্ষতি বহনের গ্যারান্টি দিয়ে বীমাকারীর কাছ থেকে নির্ধারিত এমাউন্ট নিয়েছে। কোম্পানি বীমাকারীর জন্য এতটুকু শ্রম দেয়নি। সুতরাং এটা হারাম হবে। [. সৌদি শীর্ষ আলেমদের ফতোয়া সংকলন : ফতোয়া : ৩২৪৯]

এ কথা আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, জীবন বীমা ও বাণিজ্যিক বীমা নিম্নোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে অবৈধ-

১. বীমার মধ্যে সুদ রয়েছে। কারণ কোনো কোনো বীমায় লাভ দেয়া হয়। যেমন- জীবন বীমা। এতে কোম্পানি বীমাকারীকে তার সঞ্চিত পরিমাণের চেয়ে বেশি সুদসহ দেয়া হয়। বীমাকারী দেয় কম অথচ পায় তার চেয়ে বেশি।

২. বীমা মানুষকে অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ ভোগে বাধ্য করে।

৩. বীমায় জুয়া রয়েছে। কারণ এটি ঝুঁকির ওপর কৃত চুক্তি- যা কখনো ঘটে; কখনো ঘটে না। সুতরাং এটি একধরনের জুয়া।

৪. বীমায় ধোঁকা-প্রতারণা ও অজ্ঞতা রয়েছে।

৫. বীমা চুক্তিকারীদ্বয়ের মাঝে অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। কারণ যখন দুর্ঘটনা ঘটবে তখন উভয়পক্ষ চাইবে ক্ষতির দায়দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপাবে। এতে করে ঝগড়া-বিবাদ এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে।

৬. বীমা এমন কোনো ব্যবস্থা নয় যা ছাড়া চলবে না। কারণ বীমার এ কাজের জন্য ইসলাম বিভিন্ন উপলক্ষে দান-সদকার নিয়ম প্রবর্তন করেছে। এবং গরিব-মিসকিন ও ঋণগ্রস্থদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে জাকাত ওয়াজিব করেছে। এ ছাড়াও ইসলামি রাষ্ট্র তার সকল প্রজার দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করে। [. ড. উমর বিন আব্দুল আজিজ, ইসলামি দৃষ্টিকোণে সুদ এবং অর্থনৈতিক লেনদেন। পৃষ্ঠা : ৪২৫]

৩৩
পঞ্চম পর্ব: সুদের ক্ষতি-অপকারিতা-কুপ্রভাব
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সুদের রয়েছে অনেক বড় বড় অপকারিতা এবং মারাত্মক শাস্তি। ইসলাম মানুষকে যা-ই করতে বলে তার মাঝে তার সৌভাগ্য এবং দুনিয়া-আখিরাতের সম্মান নিহিত থাকে। তেমনি ইসলাম এমন জিনিস থেকেই বারণ করে যার মাঝে তার দুর্ভাগ্য এবং উভয় জগতের ক্ষতি রয়েছে। হ্যা, সুদেরও আছে অনেক অকল্যাণকর দিক। তার মধ্য হতে কয়েকটি। যেমন-

সুদের আত্মিক-চারিত্রিক ক্ষতি : সুদ ভক্ষণেচ্ছা যাদের রয়েছে তাদের চরিত্র নিয়ে ভাবলেই বুঝা যায় এর ক্ষতি কতটুকু। কারণ, সমাজে আমরা তাদেরকেই সুদী কারবার করতে দেখি যাদের অন্তরে কৃপণতা, নির্দয়তা, অর্থলিপ্সা এবং বস্ত্ত লোলুপতা প্রভৃতি বদগুণ স্থান করে নিয়েছে।

সুদের সামাজিক ক্ষতি : যে সমাজে সুদী লেনদেন হয় সেটা ভ্রষ্ট, অন্তসার শূন্য সমাজ। যেখানে একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে না। কেউ কারো সামান্য উপকার করে না স্বার্থ ছাড়া। এ সমাজের বিত্তশালীরা নিঃস্বদের ঘৃণা করে। বলাবাহুল্য যে, এমন সমাজে কখনো ঐক্য-স্থিতি টিকে থাকতে পারে না। এর সদস্যরা অনৈক্য ও অশান্তির দিকে ঝুঁকে থাকে সদা সর্বদা।

সুদের অর্থনৈতিক ক্ষতি : সুদ সমাজ জীবনের সকল লেনদেনের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্ক রাখে। কারণ সমাজের সবাই কমবেশি কর্জ দেয়া-নেয়া করে।

আর কর্জ কয়েক প্রকার : যথা-

(ক) এমন কর্জ যেটা অভাবী শ্রেণী তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের অভিপ্রায়ে গ্রহণ করে। ঋণের এই সনাতনী ধারাকে অবলম্বন করেই সুদী কারবার সবচে বেশি প্রসারতা লাভ করেছে। এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই সুদী ব্যবসা যার রাহুগ্রাস থেকে খুব কম সংখ্যক দেশই নিরাপদ আছে। যে ব্যক্তিই এ সুদী চক্রের কব্জায় একবার এসেছে আমৃত্যু সে এর নাগপাশ থেকে মুক্তি পায় না।

(খ) এমন কর্জ যেটা ব্যবসায়ী, নির্মাতা এবং ভূ-স্বামীগণ গ্রহণ করে থাকে তাদের সফল প্রকল্পগুলোয় কাজে লাগানোর জন্য।

(গ) এমন ঋণ যা কোনো দেশ অন্য দেশের অর্থবাজার থেকে গ্রহণ করে থাকে তার প্রয়োজন মেটাবার নিমিত্তে।

ঋণের সবগুলো প্রকারই সমাজের প্রভুত দুর্দশা ও অকল্যাণ বয়ে আনে। চাই ঋণ নেয়া হোক ব্যবসা বা কারখানার জন্য, চাই ঋণ গ্রহণ করুক গরিব রাষ্ট্র ধনী রাষ্ট্রের কাছ থেকে। কারণ সবগুলোই এমন ব্যাপক অনিষ্ট ডেকে আনে যা থেকে ওই সমাজ বা রাষ্ট্র সহজে পরিত্রাণ পায় না। এটা হচ্ছে শুধু ইসলামি পদ্ধতির অনুসরণ না করার ফলেই। যে ইসলাম মানুষকে সব রকম কল্যাণের দিকে আহবান জানায়। নির্দেশ দেয় গরিব, মিসকিন ও অভাবীদের প্রতি দয়া, অনুগ্রহ ও সহমর্মিতা দেখাতে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।’ [. মায়িদা : ০২] তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন মুসলমানদের পরস্পর দয়া, সহানুভূতি দেখাতে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকতে। তিনি ইরশাদ করেন- ‘মুসলমান মুসলমানের জন্য প্রাচীরের মতো যার এক অংশ অপর অংশের সঙ্গে বাঁধা আছে। এ বলে তিনি তাঁর এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখালেন। [. বুখারি : ৪৮১, মুসলিম : ২৫৮৫] তিনি আরও বলেন, পরস্পর ভালোবাসা, সৌহার্দ্য এবং একতার দিক দিয়ে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়। যখন তার কোনো অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন তার সব অঙ্গই জ্বর বা জাগরণের মাধ্যমে সাড়া দেয়। [. বুখারি : ৬০১১, মুসলিম : ২৫৮৬]

সুতরাং বুঝা গেল, বিপদ থেকে বাঁচতে হলে, কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিৎ করতে হলে ইসলাম ও ইসলামি আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।

সুদ মানুষের কর্ম-শক্তিকে অকার্যকর বানিয়ে দেয়। কেননা সুদ থেকে যখন চাহিদা মেটাতে পারে সুদী কারবারি তখন বেকারত্ব ওপরই সন্তুষ্ট থাকে।

ইসলামি সমাজগুলো পর্যন্ত সুদের দাবানল থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না।

মানুষের কাছে অলস বেকার টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অর্থনীতি বিকৃত ও ভ্রান্ত পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

মুসলমানদের সম্পদ তাদের শত্রুদের হাতে চলে যাচ্ছে। এটা মুসলমানদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক ব্যাপার। কারণ তারা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ কাফেরদের ব্যাংকগুলোয় জমা রাখছে। এর দ্বারা তারা যেমন আমাদের বিরুদ্ধে আমাদেরই টাকা নিয়ে শক্তিশালী হচ্ছে তেমনি সে টাকা দিয়ে আমাদেরকেই দুর্বল বানানোর চেষ্টা করছে। তাছাড়া তাদের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখার কারণে মুসলমানরা উপকরণ সল্পতারও শিকার হচ্ছে।

সুদ আল্লাহর দুশমন অভিশপ্ত ইহুদিদের স্বভাব-আমল। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।’ [. নিসা : ১৬১]

সুদ বর্বরযুগের লোকদের স্বভাব। যে সুদী কারবার করে যে বর্বরদের গুণে গুণান্বিত হয়।

সুদখোরকে কিয়ামতের দিন পাগল হিসেবে পুনরুত্থিত করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘ যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’ [. বাকারা : ২৭৫]

আল্লাহ তাআলা সুদের মাধ্যমে আহরিত সম্পদ ধ্বংস ও নির্মূল করেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না।’ [. বাকারা : ২৭৬] ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সুদ যদিও সম্পদ বাড়ায় কিন্তু শেষ পরিণামে তা কমায়। [. মুসনাদে আহমদ : ৪২৪]

সুদী কারবার বান্দাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।’ [. বাকারা : ২৭৮-২৭৯]

সুদ ভক্ষণ খোদাভীতি, তাকওয়া শূন্যতা এবং দুর্বলতার প্রমাণ বহণ করে। যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থ ও হতভাগ্য মানুষে পরিণত করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও। আর তোমরা আগুনকে ভয় কর, যা কাফিরদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।’ [. আলে ইমরান : ১৩০-১৩২]

সুদ খেলে মানুষ লালত ও অভিশাপের ভাগী হয়। দূরে চলে যায় আল্লাহর রহমত থেকে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সুদদাতা, গ্রহীতা, সুদ-চুক্তির লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন।’ তিনি বলেছেন, ‘তারা সবাই সমান অপরাধী।’ [. মুসলিম : ১৫৯৭]

সুদখোরকে মৃত্যুর পর রক্তের নদীতে সাঁতরানোর শাস্তি দেয়া হবে। সে সাঁতরাবে আর তাকে পাথর ছুড়ে নদীর মাঝখানে পৌঁছে দেয়া হবে। সামুরা রা. থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসের শেষে বলা হয়েছে ‘আমি যাকে নদীর মাঝে দেখেছি সে হলো সুদখোর। [. বুখারি : ২০৮৫]

সুদ মানুষকে মারাত্মকভাবে ধ্বংসকারী বিষয়গুলোর অন্যতম। আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘ধ্বংসকারী সাতটি জিনিস থেকে বেঁচে থাক। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কী কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শিরক করা, যাদু করা, অনুমোদিত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের মাল ভক্ষণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং মুমিনা সরলা সতী নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া। [. বুখারি : ২৬১৫, মুসলিম : ৮৯]

সুদ খাওয়া শাস্তি ও ধ্বংসের কারণ হয়। ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যখন এলাকায় সুদ ও ব্যভিচার প্রকাশ পাবে তখন বুঝতে হবে তারা নিজেদের ওপর আল্লাহর শাস্তি হালাল করে নিয়েছে।’ [. মুসতাদরাকে হাকেম : ২/৩৭]

নিকৃষ্টতম কাজের মধ্যে তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে এই সুদের। যেমন-আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সুদের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। সর্বনিম্নটি হলো নিজের মায়ের সঙ্গে জেনা করার মতো। আর অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা সবচে’ নিকৃষ্ট সুদ। [. মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭]

সুদ খাওয়ার অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরুদ্ধাচারণ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘অতএব যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে।’ [. নূর : ৬৩] ‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক আযাব।’ [. নিসা : ১৪] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন- ‘আর আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। [. আহযাব : ৩৬] আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাতে তারা চিরস্থায়ী হবে।’ [. জিন : ২৩]

সুদখোরকে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে যদি সে তওবা না করে। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’ [. বাকারা : ২৭৫]

আল্লাহ তাআলা সুদের অর্থ দিয়ে সদকা করলে সেটা গ্রহণ করেন না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘আল্লাহ তাআলা পবিত্র তিনি শুধু পবিত্র মালই গ্রহণ করেন।’ [. মুসলিম : ১০১৪]

সুদখোরের দুআ কবুল হয় না। আবু হোরায়রা রা. বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই ব্যক্তির কথা বলেন, যে প্রায়শই দীর্ঘ ভ্রমণে থাকে। তার কেশ এলোমেলো আর বেশ আলুথালু। আকাশ পানে হাত প্রসারিত করে সে বলে, হে রব, হে রব, অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং ভরণপোষণও হারাম তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এর দুআ কীভাবে কবুল হবে? (তার দুআ কবুল করা হয় না।)

সুদ খেলে অন্তর কঠোর হয় এবং তাতে মরচে পড়ে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘কখনো নয়, বরং তারা যা অর্জন করত তা-ই তাদের অন্তরসমুহকে ঢেকে দিয়েছে।’ [. মুতাফ্ফিফিন : ১৪] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমরা জেনে নাও নিশ্চয় দেহের মধ্যে একটি মাংসপিন্ড আছে যদি তা ঠিক তাহলে সারা দেহ সুস্থ, যখন তা অসুস্থ হয় সারা দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে। [. বুখারি : ৫২, মুসলিম : ১৫৯৯]

সুদ খাওয়া হালাল রিজিক থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘সুতরাং ইয়াহূদীদের যুলমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।’ [. নিসা : ১৬০-১৬১]

সুদ খাওয়া জুলুম বা অন্যায় আর সকল জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর তমসা ডেকে আনবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘আর যালিমরা যা করছে, আল্লাহকে তুমি সে বিষয়ে মোটেই গাফেল মনে করো না, আল্লাহ তো তাদের অবকাশ দিচ্ছেন, ঐ দিন পর্যন্ত যে দিন চোখ পলকহীন তাকিয়ে থাকবে। তারা মাথা তুলে দৌড়াতে থাকবে, তাদের দৃষ্টি নিজদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে শূন্য।’ [. ইবরাহিম : ৪২-৪৩]

সুদখোর কল্যাণ আহরণের যাবতীয় উপলক্ষ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাই সে উত্তম ঋণ দেয় না, অভাবীর প্রতি লক্ষ্য করে না এবং দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তির কষ্ট দূর করে না। কারণ তার পক্ষে বোধগম্য স্বার্থ ছাড়া অর্থ নিয়োগ কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ আল্লাহ তাআলা যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে সাহায্য করে এবং তার বিপদ দূর করে তার ফজিলত বলে দিয়েছেন। হাদিসগ্রন্থগুলোয় এসেছে-

আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় তার মুমিন ভাইয়ের বিপদ দূর করবে আল্লাহ তাআলা তার বিপদ দূর করবেন দুনিয়া ও আখিরাতে। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে ছাড় দিবে আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়া-আখিরাতে ছাড় দিবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে আল্লাহ তাআলা উভয় জগতে তার দোষ গোপন করবেন। আর বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্যে থাকেন। [. মুসলিম : ২৬৯৯]

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- মুসলমান মুসলমানের ভাই- তার ওপর জুলুম করে না; তাকে একাকী ছেড়েও দেয় না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের কষ্ট লাঘব করবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার কষ্ট লাঘব করবেন। আর যে তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। [. বুখারি : ২৪৪২, মুসলিম : ২৫৮০]

তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি অভাবী লোককে সুযোগ দিবে অথবা তার প্রাপ্য মাফ করে দিবে আল্লাহ তাআলা তাকে নিজ ছায়াতলে স্থান দিবেন। [. মুসলিম : ৩০০৬]

সুদ মানুষের সৌহার্দ্য-সহানুভূতির চেতনাকে গলা টিপে হত্যা করে। কারণ ঋণী ব্যক্তির সকল সম্পদ হাতছাড়া হতে দেখেও সুদখোরের অন্তরে মায়া জাগে না। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘দয়া-মায়া তার অন্তর থেকেই ছিনিয়ে নেয়া হয় যে হতভাগার দলে যোগ দিয়েছে।’ [. আবু দাউদ : ৪৯৪২, তিনমিযি : ১৯২৩] তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ তার ওপর দয়া দেখান না যে মানুষকে দয়া করে না।’ [. বুখারি : ৭৩৭৬, মুসলিম : ২৩১৯] অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘দয়াকারীদের ওপর দয়াবান-রহমান দয়া করেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া করো; আসমানবাসী তোমাদের ওপর দয়া করবেন। [. আবু দাউদ : ১৯৪১, তিরমিযি : ৯২৪]

সুদ ব্যক্তি এবং দলের মাঝে হিংসা ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। অনৈক্য এবং বিশৃংখলা উস্কে দেয়। [. তাওযিহুল আহকাম ফি বুলুগিল মারাম : ৪/০৭]

সুদ মানুষকে এমন সব কাজে উদ্বৃদ্ধ করে যার ফলাফল তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে।

এ ছাড়াও সুদের অনেক ক্ষতি রয়েছে যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। তবে আমাদের জন্য এতটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা সেটাই হারাম করেন যার মাঝে শুধু অনিষ্ট ও অকল্যাণই রয়েছে। যার লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। পরিশেষে আমি নিজের এবং সকল মুসলমানের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রত্যাশা করছি।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন