HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কালেমার মর্মকথা

লেখকঃ মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম বিন আলী আ‏হমাদ

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কালেমার মর্মকথা

মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম বিন আলী আ‏হমাদ

ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

অবতরণিকা:
বর্তমান পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ মুসলমান হলেও প্রকৃত মুসলমান ও ঈমানদারের সংখ্যা উপরোল্লেখিত অংঙ্কের যে বহুগুন নীচে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ অনেক লোক নামধাম দিয়ে ইসলাম ও ঈমানের দাবি করলেও প্রকৃত অর্থে তারা শিরকের বেড়াজাল থেকে নিজদের মুক্ত করতে পারেনি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَ مَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَ هُم مُشْرِكُوْنَ

‘‘অনেক মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করলেও তারা কিন্তু মুশ্রিক।’’ [সূরা ইউসূফ : ১০৬]

অনেক মানুষ তাদের জীবনে কোন এক সময় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এ কালেমার মৌখিক স্বীকৃতি দান করেই নিজকে খাঁটি ঈমানদার মনে করে, যদিও তার কাজ-কর্ম ঈমান আকবীদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী হয়। এর কারণ হলো ঐ ব্যক্তিরা কেন আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, অথবা তাদের নিকট ঈমান কি দাবি করে এবং কি কাজ করলে ঈমানের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে এ সম্পর্কে তাদের মোটেই ধারণা নেই।

গণেশ নামে কোন ব্যক্তি একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করার পরেও কালি পূঁজা করে বলে অথবা লক্ষ্মীর নিকট কল্যাণ কামনা করে বলে তাকে মুশ্রিক বলা হয়। আবার আবদুল্লাহ্ নামক কোন ব্যক্তি আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করার পর যদি গোর পূজা বা পীর পূজা করে অথবা খাজাকে সেজদা করে বা মৃত ব্যক্তির নিকট কল্যাণ কামনা করে তাহলে গনেশের মধ্যে ও এ আব্দুল্লার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? মূলত: এদের দুজনের নামে পার্থক্য থাকলেও উভয়ের কর্ম এবং পথ কিন্তু একটিই। দ্বিতীয় ব্যক্তি তার জীবনের কোন এক সময় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এ কালেমা সাক্ষ্য দান করে থাকলেও তা ছিল একান্তই গতানুগতিক। তাই সে তাওহীদের পথকে পরিহার করে ঘুরপাক খাচ্ছে শিরকের অন্ধকার গলিতে। অন্তত মুসলমানদের জীবনে এমনটি যেন না ঘটে এ দৃষ্টিকে সামনে রেখে লেখক এই পুস্তিকাটিতে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ এর অর্থ এবং এর দাবি ইত্যাদি প্রসঙ্গে তথ্য ভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। নির্ভেজাল ইসলামী আক্বীদাহ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য বইটিকে মাইল ফলক হিসাবে ধরা যায়।

বইটির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলা ভাষায় বইটি অনুবাদ করার জন্য আমি প্রয়াসী হই। যথা সময়ে অনুবাদের কাজ শেষ করতে পেরে আমি আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। বইটি পড়ে একজন পাঠকও যদি সঠিক ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারেন তাহলে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে বলে মনে করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে খাঁটি ঈমানদার হয়ে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করার তাওফীক দান করুন। (আমীন )

মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম বিন আলী আ‏হমাদ

কালেমার মর্মকথা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁরই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁরই নিকট তওবা করি। আমাদেরকে সমস্ত বিপর্যয় ও কুকীর্তি হতে রক্ষা করার জন্য তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে হিদায়েত দান করেন তার কোন পথভ্রষ্টকারী নেই, আর যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোন পথ প্রদর্শনকারী নেই।

অতঃপর আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর পক্ষ হতে কিয়ামত পর্যন্ত সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল, আহ্লে বাইত এবং সমস্ত সাহাবীদের উপর। ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের উপরও, যারা অনুসরণ করেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এবং আঁকড়ে ধরেছেন তাঁর সুন্নাহকে।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর জিকির করার জন্য আদেশ করেছেন এবং তিনি তাঁর জিকিরকারীদের প্রশংসা করেছেন ও তাদের জন্য পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন। তিনি আমাদেরকে সাধারণভাবে সর্বাবস্থায় তাঁর জিকির করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আবার বিভিন্ন ইবাদত সম্পন্ন করার পর তাঁর জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন।

তিনি বলেন,

فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلاَةَ فَاذْكُرُواْ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِكُمْ

‘‘অতঃপর তোমরা যখন নামাজ সমাপ্ত কর তখন দন্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর জিকির কর।’’ [সূরা আন্ নিসা : ১০৩]

আল্লাহ আরো বলেন,

فَإِذَا قَضَيْتُم مَّنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُواْ اللّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا

‘‘আর যখন তোমরা হজের যাবতীয় অনুষ্ঠান সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহর জিকির করবে, যেমন করে স্মরণ করতে তোমাদের পিতৃপুরুষদেরকে, বরং তার চেয়েও বেশি স্মরণ করবে।’’ [সূরা আল বাক্বারা : ২০০]

বিশেষ করে হজব্রত পালনের সময় তাঁর জিকির করার জন্য বলেন,

فَإِذَا أَفَضْتُم مِّنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُواْ اللّهَ عِندَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ

‘‘অতঃপর যখন আরাফাত থেকে তোমরা ফিরে আসবে তখন (মুযদালাফায়) মাশআরে হারাম এর নিকট আল্লাহর জিকির কর।’’ [সূরা আল বাক্বারা : ২০০]

তিনি আরো বলেন,

وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الأنْعَامِ

‘‘এবং তারা যেন নির্দিষ্ট দিনগুলিতে আল্লাহ তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তুর মধ্য থেকে যে সমস্ত রিয্ক দিয়েছেন তার উপর আল্লাহর নাম জিকির করে।’’ [সূরা আল-হাজ্জ, ২৮]

তিনি আরো বলেন,

{ وَاذْكُرُواْ اللّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍ }

‘‘আর এই নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েক দিনে আল্লাহর জিকির কর।’’ (সূরা আল বাক্বারাহ, ২০৩)

এছাড়া আল্লাহর জিকিরের লক্ষ্যে তিনি নামাজ প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي

‘‘আমার জিকিরের জন্য নামাজ প্রতিষ্ঠিত কর।’’ (সূরা ত্বাহা, ১৪)

রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাশরীকের দিনগুলো হচ্ছে পানাহার এবং আল্লাহর জিকিরের জন্য। (সহীহ মুসলিম)

আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلاً

‘‘হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে বেশি বেশি করে জিকির কর এবং সকাল সন্ধ্যা তাঁর তাসবীহ পাঠ কর।’’ (সূরা আহযাব, ৪১ - ৪২)

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, সবচেয়ে উত্তম জিকির হলো,

لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ

অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন মাবুদ নেই, তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সবচেয়ে উত্তম দুআ আরাফাত দিবসের দুআ এবং সবচেয়ে উত্তম কথা যা আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছেন, তা হলো :

لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، لَهُ الـمُـلْكُ وَ لَهُ الحَمْدُ وَ هُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ

অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন মাবুদ নেই, তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব একমাত্র তাঁরই জন্য এবং প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

আল্লাহর জিকিরসমূহের মধ্যে: " لاَ إِلهَ إِلاَّ الله এই মহামূল্যবান বাণীর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা এবং এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্ন হুকুম আহকামের। আর এই কালেমার রয়েছে এক বিশেষ অর্থ ও উদ্দেশ্য এবং কয়েকটি শর্ত, ফলে এ কালেমাকে গতানুগতিক মুখে উচ্চারণ করাই ঈমানের জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্যই আমি আমার লেখার বিষয়বস্ত্ত হিসাবে এ বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছি এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাকে এবং আপনাদেরকে এই মহান কালেমার ভাবাবেগ ও মর্মার্থ অনুধাবন করত: এর দাবি অনুযায়ী তাঁর সমস্ত কাজ করার তাওফীক দান করেন এবং আমাদেরকে ঐ সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন যাঁরা এই কালেমাকে সঠিক অর্থে বুঝতে পেরেছেন।

প্রিয় পাঠক! এ কালেমার ব্যাখ্যা দানকালে আমি নিম্নের বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করব :

মানুষের জীবনে এ কালেমার মর্যাদা

ফজিলত

ব্যাকরণিক ব্যাখ্যা

স্তম্ভ বা রোকনসমূহ

শর্তাবলি

অর্থ এবং দাবি

কখন মানুষ এ কালেমা পাঠে উপকৃত হবে আর কখন উপকৃত হবে না

আমাদের সার্বিক জীবনে এর প্রভাব কি ?

এবার আল্লাহর সাহায্য কামনা করে কালেমা " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে এখন আমি আলোচনা শুরু করছি।

ব্যক্তি জীবনে কালেমা" لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর গুরুত্ব ও মর্যাদা :
এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বাণী যা মুসলমানগণ তাদের আজান, ইকামাত, বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করে থাকে। এটি এমন এক কালেমা যার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আসমান-জমিন, সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত মাখলুকাত। আর এর প্রচারের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে পাঠিয়েছেন অসংখ্য রাসূল এবং নাযিল করেছেন আসমানি কিতাবসমূহ, প্রণয়ন করেছেন অসংখ্য বিধান। প্রতিষ্ঠিত করেছেন তুলাদন্ড (মিযান) এবং ব্যবস্থা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবের, তৈরি করেছেন জান্নাত এবং জাহান্নাম। এই কালেমাকে স্বীকার করা এবং অস্বীকার করার মাধ্যমে মানব সম্প্রদায় ঈমানদার এবং কাফির এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। অতএব সৃষ্টি জগতে মানুষের কর্ম, কর্মের ফলাফল, পুরস্কার অথবা শাস্তি সব কিছুরই উৎস হচ্ছে এই কালেমা। এরই জন্য উৎপত্তি হয়েছে সৃষ্টিকুলের, এ সত্যের ভিত্তিতেই পরকালীন জিজ্ঞাসাবাদ এবং এর ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হবে সওয়াব ও শাস্তি। এই কালেমার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলমানদের কেবলা এবং এ হলো মুসলমানদের জাতি সত্তার ভিত্তি-প্রস্তর এবং এর প্রতিষ্ঠার জন্য খাপ থেকে খোলা হয়েছে জিহাদের তরবারি।

বান্দার উপর এটাই হচ্ছে আল্লাহর অধিকার, এটাই ইসলামের মূল বক্তব্য ও শান্তির আবাসের (জান্নাতের) চাবিকাঠি এবং পূর্বাপর সকলই জিজ্ঞাসিত হবে এই কালেমা সম্পর্কে।

আল্লাহ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কার ইবাদত করেছ? নবীদের ডাকে কতটুকু সাড়া দিয়েছ? এই দুই প্রশ্নের উত্তর দেয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তি তার দুটো পা সামান্যতম নাড়াতে পারবে না। আর প্রথম প্রশ্নের সঠিক উত্তর হবে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ -কে ভালো ভাবে জেনে-বুঝে এর স্বীকৃতি দান করা এবং এর দাবি অনুযায়ী কাজ করা। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর সঠিক হবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসাবে মেনে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে। আর এ কালেমাই হচ্ছে কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। এ হচ্ছে আল্লাহ ভীতির কালেমা ও মজবুত হাতল।

এবং এ কালেমাই নবী ইব্রাহীম আলাইহিস্সালাম ‘‘অক্ষয় বাণীরূপে রেখে গেলেন তাঁর পরবর্তীতে তাঁর সন্তানদের জন্য, যেন তারা ফিরে আসে এ পথে’’। ১.

এই সেই কালেমা যার সাক্ষ্য আল্লাহ তাআলা স্বয়ং নিজেই নিজের জন্য দিয়েছেন, আরো দিয়েছেন ফিরিশতাগণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণ। আল্লাহ তাআলা বলেন :

شَهِدَ اللّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ الْعِلْمِ قَآئِمَاً بِالْقِسْطِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন, নিশ্চয় তিনি ছাড়া আর কোন সত্য মাবুদ নেই এবং ফিরেশতাগণ ও ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছে যে, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’ (সূরা আলে ইমরান : ১৮ )

এ কালেমাই ইখলাছের বা সত্যনিষ্ঠার বাণী। এটাই সত্যের সাক্ষ্য ও তার দাওয়াত এবং শিরক এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার বাণী এবং এ জন্যই সমস্ত জগতের সৃষ্টি।২.

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ

‘‘আমি জ্বীন ও ইনসানকে শুধু আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’’ (সূরা আয্যারিয়াত-৫৬)

এই কালেমা প্রচারের জন্য আল্লাহ সমস্ত রাসূল এবং আসমানি কিতাবসমূহ প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন :

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدُونِ

‘‘আমরা তোমার পূর্বে যে রাসূলই প্রেরণ করেছি তাঁর নিকট এই প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই, অতএব তোমরা আমারই ইবাদত কর।’’ (সূরা আল্ আম্বিয়া, আয়াত ২৫)

আল্লাহ আরো বলেন :

يُنَزِّلُ الْمَلآئِكَةَ بِالْرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَى مَن يَشَاء مِنْ عِبَادِهِ أَنْ أَنذِرُواْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَاْ فَاتَّقُونِ

‘‘তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে রুহ (ওহী) সহ ফিরিশতা প্রেরণ করেন এই বলে যে, তোমরা সতর্ক কর যে, আমি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, অতএব তোমরা আমাকেই ভয় কর।’’ (সূরা আন্নাহাল, আয়াত -২)

ইবনে উইয়াইনা বলেন, ‘বান্দার উপর আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রধান এবং বড় নেয়ামত হলো তিনি তাদেরকে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " তাঁর এই একাত্ববাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার পিপাসা কাতর তৃষ্ণার্ত একজন মানুষের নিকট ঠান্ডা পানির যে মূল্য আখেরাতে জান্নাতবাসীদের জন্য এ কালেমা তদ্রুপ।’’ এবং যে ব্যক্তি এ কালেমার স্বীকৃতি দান করল সে তার সম্পদ এবং জীবনের নিরাপত্তা গ্রহণ করল। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করল সে তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করল না। ১.

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর স্বীকৃতি দান করল এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব উপাস্যকে অস্বীকার করল তার ধন-সম্পদ ও জীবন নিরাপদ হল এবং তার কৃতকর্মের হিসাব আল্লাহর উপর বর্তাল।’ (সহীহ মুসলিম)

একজন কাফেরকে ইসলামের প্রতি আহবানের জন্য প্রথম এই কালেমার স্বীকৃতি চাওয়া হয়। নবী সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুআজ (রা:)-কে ইয়ামানে ইসলামের দাওয়াতের জন্য পাঠান তখন তাঁকে বলেন, ‘তুমি আহলে কিতাবের নিকট যাচ্ছ, অতএব সর্ব প্রথম তাদেরকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর সাক্ষ্য দান করার জন্য আহবান করবে। (সহীহ মুসলিম )

প্রিয় পাঠকগণ! এবার চিন্তা করুন, দ্বীনের দৃষ্টিতে এ কালেমার স্থান কোন পর্যায়ে এবং এর গুরুত্ব কতখানি। এজন্যই বান্দার প্রথম কাজ হলো এ কালেমার স্বীকৃতি দান করা; কেননা এ হলো সমস্ত কর্মের মূল ভিত্তি।

" لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর ফজিলত।
এ কালেমার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে এবং আল্লাহর নিকট এর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :

যে ব্যক্তি সত্য-সত্যিই কায়মনোবাক্যে এ কালেমা পাঠ করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি মিছেমিছি এ কালেমা পাঠ করবে তা দুনিয়াতে তার জীবন ও সম্পদের হেফাজত করবে বটে, তবে তাকে এর হিসাব আল্লাহর নিকট দিতে হবে।

এটি একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য, হাতেগোনা কয়েকটি বর্ণ এবং শব্দের সমারোহ মাত্র, উচ্চারণেও অতি সহজ কিন্তু কেয়ামতের দিন পাল্লায় হবে অনেক ভারী।

ইবনে হিববান এবং আল হাকেম আবু সাইদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মূসা (আঃ) একদা আল্লাহ তাআলাকে বললেন, ‘হে রব, আমাকে এমন একটি বিষয় শিক্ষা দান করুন যা দ্বারা আমি আপনাকে স্মরণ করব এবং আপনাকে আহবান করব।’ আল্লাহ বললেন, ‘হে মুসা বলো, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মাবুদ নেই।’ মুসা (আঃ) বললেন, ‘এতো আপনার সকল বান্দাই বলে থাকে।’ আল্লাহ বললেন, ‘হে মুসা, আমি ব্যতীত সপ্তাকাশ ও এর মাঝে অবস্থানকারী সকল কিছু এবং সপ্ত জমিন যদি এক পাল্লায় রাখা হয় আর " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এক পাল্লায় রাখা হয় তা হলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর পাল্লা ভারী হবে।

(হাকেম বলেন, হাদীসটি সহীহ)। ১. অতএব এ হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া গেল যে," لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " হলো সবচেয়ে উত্তম জিকির।

আব্দুল্লাহ বিন ওমর হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সব চেয়ে উত্তম দোআ আরাফাত দিবসের দোআ এবং সবচেয়ে উত্তম কথা যা আমি এবং আমার পূর্ববতী নবীগণ বলেছেন, তা হলো :

( لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، لَهُ الـمُـلْكُ وَ لَهُ الحَمْدُ وَ هُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ )

অর্থাৎ, ‘‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকার মাবুদ নেই, তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব একমাত্র তাঁরই জন্য এবং প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য, তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।’’ (তিরমিযি, কিতাবুদ দাওয়া, হাদীস নং-২৩২৪)

এ কালেমা যে সমস্ত কিছু হতে গুরুত্বপূর্ণ ও ভারী তার আরেকটি প্রমাণ হলো, আবদুল্লাহ বিন আমর হতে অপর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আমার উম্মতের এক ব্যক্তিকে সকল মানুষের সামনে ডাকা হবে, তার সামনে নিরানববইটি (পাপের) পুস্তক রাখা হবে এবং একেকটি পুস্তকের পরিধি হবে চক্ষু দৃষ্টির সীমারেখার সমান। এর পর তাকে বলা হবে, এই পুস্তকে যা কিছু লিপিবদ্ধ হয়েছে তা কি তুমি অস্বীকার কর? উত্তরে ঐ ব্যক্তি বলবে, হে রব আমি তা অস্বীকার করি না। তারপর বলা হবে, এর জন্য তোমার কোন আপত্তি আছে কিনা? অথবা এর পরিবর্তে তোমার কোন নেক কাজ আছে কিনা? তখন সে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বলবে, না তাও নেই। অতঃপর বলা হবে, আমার নিকট তোমার কিছু পুণ্যের কাজ আছে এবং তোমার উপর কোন প্রকার অত্যাচার করা হবে না, অতঃপর তার জন্য একখানা কার্ড বের করা হবে তাতে লেখা থাকবে,

" أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُهُ "

অর্থাৎ, ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য মা’বুদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’ তখন ঐ ব্যক্তি বিস্ময়ের সাথে বলবে, ‘হে আমার রব, এই কার্ড খানা কি নিরানববইটি পুস্তকের সমতুল্য হবে?’ তখন বলা হবে, ‘তোমার উপর কোন প্রকার অত্যাচার করা হবে না। এরপর ঐ নিরানববইটি পুস্তক এক পাল্লায় রাখা হবে এবং ঐ কার্ড খানা এক পাল্লায় রাখা হবে তখন ঐ পুস্তকগুলোর ওজন কার্ড খানার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য হবে এবং কার্ডের পাল্লা ভারী হবে। (আত তিরমিযি, হাদিস নং ২৬৪১। আল হাকেম ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫-৬)

এ মহামূল্যবান কালেমার আরো ফযিলত সম্পর্কে হাফেজ ইবনে রজব তাঁর ‘কালেমাতুল ইখলাছ’ নামক গ্রন্থে দলিল প্রমাণ সহকারে বলেন, এই কালেমা হবে জান্নাতের মূল্য, কোন ব্যক্তি জীবনের শেষ মূহুর্তে ও এ কালেমা পাঠ করে ইন্তেকাল করলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটাই জাহান্নাম থেকে মুক্তির একমাত্র পথ এবং আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমা পাওয়ার একমাত্র সম্বল। সমস্ত পুণ্য কাজগুলোর মধ্যে এ কালেমাই শ্রেষ্ঠ। এটি পাপ পঙ্কিলতাকে দূর করে, হৃদয় মনে ঈমানের বিষয়গুলোকে সজীব করে। স্ত্তপকৃত পাপ রাশির উপর এ কালেমা ভারী হবে। আল্লাহকে পাওয়ার পথে যতসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সব কিছুকে এ কালেমা ছিনণ-ভিন্ন করে আল্লাহর নিকট পৌঁছে দেবে। এ কালেমার স্বীকৃতি দানকারীকে আল্লাহ সত্যায়িত করবেন। নবীদের কথার মধ্যে উত্তম কথা হলো এটাই। সব চেয়ে উত্তম জিকির এটাই। এটি যেমনি উত্তম কথা তেমনি এর ফলাফল হবে অনেক বেশি। এটি গোলাম আজাদ করার সমতুল্য। শয়তান থেকে রক্ষা কবচ। কবর ও হাশরের বিভীষিকাময় অবস্থার নিরাপত্তা দানকারী। কবর থেকে দন্ডায়মান হওয়ার পর এ কালেমার মাধ্যমেই মুমিনরা চি ‎‎‎‎ হ্নত হবে।

এর ফজিলতের মধ্যে আরো হচ্ছে, এই কালেমার স্বীকৃতি দানকারীর জন্য জান্নাতের আটটি দ্বার খুলে দেয়া হবে এবং সে ইচ্ছা মত যে কোন দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। এ কালেমার সাক্ষ্য দানকারী এর দাবি অনুযায়ী পূর্ণভাবে কাজ না করার ফলে এবং বিভিন্ন অপরাধের ফল স্বরূপ জাহান্নামে প্রবেশ করলেও অবশ্যই কোন এক সময় জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে।

ইবনে রজব (রহ) তাঁর বইতে এই কালেমার এ সব ফজিলতের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন এবং এর দলিল প্রমাণাদি পেশ করেছেন।১.

কালেমার ব্যাকরণগত আলোচনা, এর স্তম্ভ ও শর্তসমূহ।
এ কালেমার ব্যাকরণগত আলোচনা :

অনেক সময় অনেক বাক্যের অর্থ বুঝা নির্ভর করে তার ব্যাকরণগত আলোচনার উপর। এ জন্য ওলামায়ে কেরাম " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এই বাক্যের ব্যাকরণগত আলোচনার প্রতি তাঁদের দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন এবং তারা বলেছেন যে, এই বাক্যে " لا " শব্দটি নাফিয়া লিল জিনস এবং" إِله " (ইলাহ) এর ইসম, মাবনি আলাল ফাতহ্। আর " حق " এর খবরটি এখানে ঊহ্য, অর্থাৎ কোন হক বা সত্য ইলাহ নেই। " إِلاَّ اللهُ " ইসতেস্না খবরে মারফু " حق " হতে। অর্থাৎ, আল্লাহ ব্যতীত হক বা সত্য ইলাহ বলতে কেউ নেই। " إِلهَ " অর্থ ‘‘মাবুদ’’ আর তিনি হচ্ছেন ঐ সত্তা যে সত্তার প্রতি কল্যাণের আশায় এবং অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্য হৃদয়ের আসক্তি সৃষ্টি হয় এবং মন তার উপাসনা করে। এখানে কেউ যদি মনে করে যে, উক্ত খবরটি হচ্ছে ‘‘মাউজুদুন’’ বা ‘‘মা’বুদুন’’ অথবা এ ধরনের কোন শব্দ তা হলে এটা হবে অত্যন্ত ভুল। কারণ আল্লাহ ব্যতীত অনেক মা’বুদ রয়েছে যেমন মূর্তি, মাজার ইত্যাদি। তবে আল্লাহ হচ্ছেন সত্য মাবুদ, আর তিনি ব্যতীত অন্য যত মাবুদ রয়েছে বা অন্যদের যে ইবাদত করা হয় তা হচ্ছে অসত্য ও ভ্রান্ত। আর এটাই হচ্ছে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর না সূচক এবং হাঁ সূচক এই দুই স্তম্ভের মূল দাবি।

" لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এই কালেমার দুটি স্তম্ভ বা রুকন। এই কালেমার দুটি স্তম্ভ বা রুকন আছে, একটি হলো না বাচক আর অপরটি হলো হাঁ বাচক।
না বাচক কথাটির অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করা। আর হাঁ বাচক কথাটির অর্থ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহই সত্য মাবুদ। আর মুশরিকগন আল্লাহ ব্যতীত যে সব মাবুদের উপাসনা করে তার সবগুলো মিথ্যা এবং বানোয়াট মাবুদ। আল্লাহ তাআলা বলেন,

ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ

‘‘এটা এ জন্য যে, আল্লাহ-ই প্রকৃত সত্য, আর তিনি ব্যতীত যাদেরকে তারা ডাকে সে সব কিছুই বাতিল।’’(আল হাজ্ব-৬২ )

ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা ইলাহ বা মাবুদ’ এ কথার চেয়ে ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই’ এই বাক্যটি আল্লাহর উলুহিয়াত প্রতিষ্ঠার জন্য অধিকতর মজবুত দলীল। কেননা; ‘আল্লাহ ইলাহ’ একথা দ্বারা অন্যসব যত ভ্রান্ত ইলাহ রয়েছে তাদের উলুহিয়াতকে অস্বীকার করা হয় না। আর ‘আললাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই’ এ কথাটি উলুহিয়্যাতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং অন্য সকল বাতিল ইলাহকে অস্বীকার করে। কিছু লোক চরম ভুল বশত: বলে থাকে যে, ‘ইলাহ’ অর্থ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি ক্ষমতাবান।

আশ-শেখ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ তাঁর কিতাবুত তাওহীদে এর ব্যাখ্যায় বলেন, কেউ যদি মনে করে ‘ইলাহ এবং উলুহিয়্যাতের’ অর্থ হলো, নব সৃষ্টিতে পূর্ণ মাত্রায় ক্ষমতাশালী অথবা এ ধরনের অন্য কোন অর্থ, তখন উত্তরে এ ব্যক্তিকে কি বলা হবে ?

মূলত: এই প্রশ্নের উত্তরের দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমত: এটা একটা উদ্ভট, অজ্ঞতা প্রসূত কথা। এ ধরনের কথা বিদআ’তী ব্যক্তিরাই বলে থাকে। কোন বিজ্ঞ আলেম বা আরবী ভাষাবিদ ‘ইলাহ’ শব্দের এ ধরনের অর্থ করেছেন বলে কেউ বলতে পারবে না। বরং তাঁরা এ শব্দের ঐ অর্থই করেছেন যা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। অতএব, এ ধরনের ব্যাখ্যা ভুল বলে প্রমাণিত হলো।

দ্বিতীয় : ক্ষণিকের জন্য এ অর্থকে মেনে নিলেও এমনিতেই ‘সত্য ইলাহ’ যিনি হবেন তাঁর জন্য সৃষ্টি করার গুণাবলি একান্তই অপরিহার্য। অতএব ‘ইলাহ’ হওয়ার জন্য সৃষ্টি করার সার্বিক যোগ্যতা থাকা তো অঙ্গাঙ্গিভাবেই তার সাথে জড়িত। আর যে কোন কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম সে তো ‘ইলাহ’ হতে পারে না, যদিও তাকে ইলাহ রূপে কেউ অভিহিত করে থাকে। এ জন্য ‘আল্লাহ নব সৃষ্টিতে ক্ষমতাশালী’ এটুকু বিশ্বাস কোন ব্যক্তির ইসলামের গন্ডিতে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট নয় এবং এতটুকু কথা কিয়ামতের দিন জান্নাত লাভের জন্যও যথেষ্ট নয়। আর যদি এতটুকু বিশ্বাসই যথেষ্ট হতো তাহলে আরবের কাফিররাও মুসলমান বলে বিবেচিত হতো। তাই এ যুগের কোন লেখক যদি ‘ইলাহ’ শব্দের এ অর্থ করে থাকেন তা হলে তাকে ভ্রান্ত বলতে হবে এবং কুরআন হাদীসের জ্ঞানগর্ভ দলিল দ্বারা এর প্রতিবাদ করা একান্ত প্রয়োজন। ১.

" لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর শর্তসমূহ :
এই পবিত্র কালেমা মুখে বলাতে কোনই উপকারে আসবে না যে পর্যন্ত এর সাতটি শর্ত২. পূর্ণ করা না হবে।

প্রথম শর্ত : এ কালেমার না বাচক এবং হাঁ বাচক দুটি অংশের অর্থ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অর্থ এবং উদ্দেশ্য না বুঝে শুধুমাত্র মুখে এ কালেমা উচ্চারণ করার মধ্যে কোন লাভ নেই। কেননা সে ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি এ কালেমার মর্মের উপর ঈমান আনতে পারবে না। আর তখন এ ব্যক্তির উদাহরণ হবে ঐ লোকের মত যে লোক এমন এক অপরিচিত ভাষায় কথা বলা শুরু করল যে ভাষা সম্পর্কে তার সামান্যতম জ্ঞান নেই।

দ্বিতীয় শর্ত : ইয়াকীন বা দৃঢ় প্রত্যয়। অর্থাৎ, এ কালেমার মাধ্যমে যে কথার স্বীকৃতি দান করা হলো তাতে সামান্যতম সন্দেহ পোষণ করা চলবে না।

তৃতীয় শর্ত : ঐ ইখলাছ যা " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর দাবি অনুযায়ী ঐ ব্যক্তিকে শিরক্ থেকে মুক্ত রাখবে।

চতুর্থ শর্ত : এই কালেমা পাঠকারীকে সত্যের পরাকাষ্ঠা হতে হবে, যে সত্য তাকে মুনাফিকী আচরণ থেকে বিরত রাখবে। মুনাফিকরাও " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এ কালেমা মুখে মুখে উচ্চারণ করে থাকে, কিন্তু এর নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে তারা পূর্ণ বিশ্বাসী নয়।

পঞ্চম শর্ত : ভালোবাসা। অর্থাৎ, মোনাফেকী আচরণ বাদ দিয়ে এই কালেমাকে সানন্দ চিত্তে গ্রহণ করতে হবে ও ভালোবাসতে হবে।

ষষ্ঠ শর্ত : এই কালেমার দাবি অনুযায়ী নিজকে পরিচালনা করা। অর্থাৎ, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সমস্ত ফরজ ওয়াজিব কাজগুলো আঞ্জাম দেয়া।

সপ্তম শর্ত : আন্তরিক ভাবে এ কালেমাকে গ্রহণ করা এবং এরপর দ্বীনের কোন কাজকে প্রত্যাখ্যান করা থেকে নিজকে বিরত রাখা। অর্থাৎ, আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন করতে হবে এবং তাঁর নিষিদ্ধ সব কাজ পরিহার করতে হবে।১.

এই শর্তগুলো ওলামায়ে কেরাম চয়ন করেছেন কোরআন হাদীসের আলোকেই, অতএব এ কালেমাকে শুধু মুখে উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট এমন ধারণা ঠিক নয়।

" لاَ إِلهَ إِلاَّ الله এর অর্থ ও দাবি।
পূর্ববর্তী আলোচনা হতে এ কালেমার অর্থ ও এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে এ কথা স্পষ্ট হলো যে, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর অর্থ হচ্ছে : সত্য এবং হক মাবুদ বলতে যে ইলাহকে বুঝায় তিনি হলেন একমাত্র আল্লাহ যার কোন শরীক নেই এবং তিনিই ইবাদতের অধিকারী। তিনি ব্যতীত যত মাবুদ আছে সব মিথ্যা ও বাতিল। তাই তারা কোন ধরনের ইবাদত পাওয়ার যোগ্য নয়। এজন্য অধিকাংশ সময় আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের আদেশের সাথে সাথে তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা আল্লাহর ইবাদতের সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করা হলে ঐ ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, { وَاعْبُدُواْ اللّهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئًا } অর্থাৎ, ‘‘এবং তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর আর তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করো না’’। (আন নিসা-৩৬)

আল্লাহ আরো বলেন,

فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىَ لاَ انفِصَامَ لَهَا وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘‘অতঃপর যে তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে সে ব্যক্তি সুদৃঢ় হাতল ধারণ করল যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন।’’(সূরা আল বাকারাহ-২৫৬)

তিনি আরো বলেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولاً أَنِ اعْبُدُواْ اللّهَ وَاجْتَنِبُواْ الطَّاغُوتَ

‘‘আর নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এজন্য যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে পরিহার কর।’’ (আন্ নাহাল-৩৬)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি বলল, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করল ঐ ব্যক্তি আমার নিকট থেকে তার জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা লাভ করল।’ (সহীহ্ মুসলিম, কিতাবুল ঈমাম হাদীস-নং ২৩)

প্রত্যেক রাসূলই তাঁর জাতিকে বলেছেন,

اعْبُدُواْ اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই।’’ (সূরা আল আয়রাফ, ৫৯)

এতদ ব্যতীত এ সম্পর্কে আরো প্রমানাদি রয়েছে।

ইবনে রজব বলেন, কালেমার এই অর্থ বাস্তবায়িত হবে তখন, যখন বান্দাহ " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর স্বীকৃতি দান করার পর এটা প্রমাণ করবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ নেই এবং মাবুদ হওয়ার একমাত্র যোগ্য ঐ সত্তা যাকে ভয়-ভীতি, বিনয়, ভালোবাসা, আশা-ভরসা সহকারে আনুগত্য করা হয়। যার নিকট প্রার্থনা করা হয়, যার সমীপে দু‘আ করা হয় এবং যার অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা হয় এবং এ সমস্ত কাজ আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য নিবেদন করা বৈধ নয়। এ জন্য রাসূল সা. যখন মক্কার কাফেরদেরকে বললেন, তোমরা বলো,

" لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ "

উত্তরে তারা বলল,

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

‘‘সে কি সমস্ত ইলাহকে এক ইলাহতে পরিণত করেছে? নিশ্চয় এ তো অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়’’। (সূরা সাদ -৫)

এর অর্থ হলো তারা বুঝতে পারল যে, এ কালেমার স্বীকৃতি মানেই এখন হতে মূর্তি পূজা বাতিল করা হলো এবং ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করা হলো। আর তারা কখনও এমনটি কামনা করে না। তাই এখানেই প্রমাণিত হলো যে, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর অর্থ এবং এর দাবি হচ্ছে ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুর ইবাদত পরিহার করা।

এজন্য কোন ব্যক্তি যখন বলে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " তখন সে এ ঘোষণাই প্রদান করে যে, ইবাদতের একমাত্র অধিকারী আল্লাহ তা‘আলাই এবং তিনি ব্যতীত অন্য কিছুর ইবাদত যেমন, কবর পূজা, পীর পূজা ইত্যাদি সমস্ত কিছু বাতিল। এর মাধ্যমে গোর পূজারি ও অন্যান্যরা, যারা মনে করে যে, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর অর্থ হচ্ছে এই বলে স্বীকৃতি দেয়া যে, ‘আল্লাহ আছেন, অথবা তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি কোন কিছু উদ্ভাবন করতে সক্ষম’, তাদের এই সমস্ত মতবাদ ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হলো।

আবার অনেকে মনে করে যে, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর অর্থ হলো সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য এবং এটাই এর একমাত্র অর্থ। যে ব্যক্তি এতটুকু ধারণা পোষণ করবে, সে সত্যিকার অর্থে তার জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করল। এরপর যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পূজা-অর্চনা করা হয় বা মৃত ব্যক্তিদের বিষয়ে বিশ্বাস করা হয় যে, তাদের নামে মান্নত, কোরবানী ও ভেট প্রধান করার মাধ্যমে তাদের নৈকট্য লাভ করা সম্ভব বা তাদের কবরের চার পাশে ঘুরে তাওয়াফ করাতে কিংবা তাদের কবরের মাটিকে বরকতময় মনে করাতে কোন অসুবিধা নেই এবং এতে কিছু আসে যায় না। এ লোকেরা অনুধাবন করতে পারেনি যে এদের মত এ ধরনের আক্বীদাহ বিশ্বাস তৎকালীন মক্কার কাফেরগণও পোষণ করত। তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র উদ্ভাবক। এবং তারা অন্যান্য দেব- দেবীর ইবাদত শুধুমাত্র এজন্যই করত যে, তারাই তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার খুব নিকটবর্তী করে দেবে।

তা ছাড়া তারা মনে করত না যে, ঐ সমস্ত দেব-দেবী সৃষ্টি করতে অথবা রিজিক দান করতে পারে। অতএব সার্বভৌমত্ব আল্লাহর জন্য এবং এটাই ‘লা ইলাহা ইললাল্লাহ’এর প্রকৃত অর্থ বা একমাত্র অর্থ এমনটি নয়। বরং ‘সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্য’ কথাটি এ কালেমার অর্থের একটি অংশ মাত্র। পূর্ণ অর্থ নয়। কেননা কেউ যদি এক দিকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে যেমন, আইন আদালত বা বিচার বিভাগ ইত্যাদিতে শরীয়তের হুকুম প্রতিষ্ঠা করে অন্য দিকে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে তাহলে এর কোন মূল্যই হবে না। আর যদি " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর অর্থ এটাই হতো যেমনটি ঐ সমস্ত লোক ধারণা করে তাহলে মক্কার মুশরিকদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন দ্বন্দ্বই থাকত না। তিনি তাদেরকে যদি শুধুমাত্র এতটুকু আহবানই করতেন যে, তোমরা এ মর্মে স্বীকৃতি প্রদান কর যে, আল্লাহ তা‘আলা উদ্ভাবন করতে সক্ষম। অথবা আল্লাহ বলতে একজন কেউ আছেন, অথবা তোমরা ধন-সম্পদ এবং অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে শরীয়াত অনুযায়ী ফয়সালা কর। এর সাথে সাথে তিনি যদি তাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার কথা বলা থেকে বিরত থাকতেন তাহলে কালবিলম্ব না করে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহবানে সাড়া দিত। কিন্তু তারা আরবী ভাষী হওয়ার কারণে বুঝতে পেরেছিল যে, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর স্বীকৃতি দেয়ার অর্থই হচ্ছে সমস্ত দেব-দেবীকে অস্বীকার করা। তারা আরো বুঝেছিল যে, এই কালেমা শুধু এমন কতগুলো শব্দের সমারোহ নয় যে, এর কোন অর্থ নেই বরং এসব কিছু বুঝার কারণেই তারা এর স্বীকৃতি দান থেকে বিরত থাকল এবং বলল,

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

‘‘সে কি সমস্ত ইলাহগুলোকে এক ইলাহতে পরিণত করল? নিশ্চয় এ তো অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়।’’ তাদের সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন,

إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ

‘‘তাদেরকে যখন বলা হতো, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই তখন তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত এবং বলত, আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের সকল উপাস্যকে পরিত্যাগ করব?’’ (সূরা আস্সা্ফফাত-৩৫-৩৬)

অতএব তারা বুঝল যে, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর মানেই হচ্ছে সমস্ত কিছুর ইবাদত ছেড়ে দিয়ে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করা। তারা যদি এক দিকে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলত অন্যদিকে দেব-দেবীর ইবাদতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকত তা হলে এটা হত স্ববিরোধিতা। অথচ এমন স্ববিরোধিতা থেকে তারা নিজদেরকে বিরত রেখেছে। কিন্তু আজকের কবর পূজারিরা এই জঘন্যতম স্ববিরোধিতা থেকে নিজদেরকে বিরত রাখছে না। তারা একদিকে বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অন্য দিকে মৃত ব্যক্তি এবং মাজারভিত্তিক ইবাদতের মাধ্যমে এ কালেমার বিরোধিতা করে থাকে। অতএব ধ্বংস ঐ সকল ব্যক্তির জন্য যাদের চেয়ে আবু জাহ্ল ও আবু লাহাব ছিল কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন।

সংক্ষিপ্ত কথা হলো এই যে, যে ব্যক্তি কালেমার অর্থ জেনে বুঝে কালেমার দাবি অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে এর স্বীকৃতি দান করল এবং প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় নিজকে শিরক থেকে বিরত রেখে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতকে নির্ধারণ করল, সে ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে মুসলমান। আর যে এই কালেমার মর্মার্থকে বিশ্বাস না করে এমনিতে প্রকাশ্যভাবে এর স্বীকৃতি দান করল এবং এর দাবি অনুযায়ী গতানুগতিক ভাবে কাজ করল সে ব্যক্তি মূলত: মুনাফিক। আর যে মুখে এ কালেমা বলল এবং শিরক এর মাধ্যমে এর বিপরীত কাজ করল সে প্রকৃত অর্থে স্ববিরোধী মুশরিক। এ জন্য এ কালেমা উচ্চারণের সাথে সাথে অবশ্যই এর অর্থ জানতে হবে আর তখনই এর দাবি অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হবে। আল্লাহ বলেন,

إِلاَّ مَن شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

‘‘তবে যারা জেনে-বুঝে সত্যের সাক্ষ্য দিল তারা ব্যতীত (অন্যরা সুপারিশের অধিকারী হবে না)’’ (আয্যুখরুফ, ৮৬)

অতএব এ কালেমার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এর দাবি অনুযায়ী একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকল কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করা।

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর আরো অন্যতম দাবি হলো ইবাদত, মো’আমালাত (লেন-দেন) হালাল-হারাম, সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধানকে মেনে নেয়া এবং অন্য সব কিছুকে পরিত্যাগ করা। আল্লাহ বলেন,

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاء شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ

‘‘তাদের কি এমন কোন শরীক দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান রচনা করবে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি’’। (সূরা আশ্ শুরা, ২১)

এ থেকে বুঝা গেল অবশ্যই ইবাদত, লেন-দেন এবং মানুষের মধ্যে বিতর্কিত বিষয়সমূহ ফয়সালা করতে আল্লাহর বিধানকে মেনে নিতে হবে এবং এর বিপরীত মানব রচিত সকল বিধানকে ত্যাগ করতে হবে। এ অর্থ থেকে আরো বুঝা গেল যে, সমস্ত বেদ‘আত ও কুসংস্কার যা জিন ও মানব-রূপী শয়তান রচনা করে, তাও পরিত্যাগ করতে হবে। আর যে এগুলোকে গ্রহণ করবে সে মুশরিক বলে গণ্য হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاء شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ

‘‘তাদের কি এমন শরীক দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান রচনা করবে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি।’’ (সূরা আশ্ শুরা, ২১) আল্লাহ আরো বলেন,

وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

‘‘যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর তা হলে নিশ্চয়ই তোমরা মুশরিক।’’ (সূরা আল আনআম-১২১) আল্লাহ আরো বলেন,

اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللّهِ

‘‘আল্লাহ ব্যতীত তারা তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতদেরকে প্রভু রূপে গ্রহণ করেছে।’’ (সূরা আত্তাওবাহ, ৩১)

সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আদী ইবনে হাতেম আত্ত্বায়ীর সামনে উল্লেখিত আয়াত পাঠ করেন তখন আদী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরাতো আমাদের পীর-পুরোহিতদের কখনো ইবাদত করিনি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ যে সমস্ত জিনিস হারাম করেছেন তোমাদের পীর-পুরোহিতরা তা হালাল করেছে। আর আল্লাহ যে সমস্ত জিনিস হালাল করেছেন তাকে তারা হারাম বা অবৈধ করেছে, তোমরা কি এক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করতে না? আদী বললেন, ‘হাঁ, এতে আমরা তাদের অনুসরণ করতাম।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম বললেন, এটাই তাদের ইবাদত।

শায়খ আবদুর রহমান বিন হাসান বলেন, অন্যায় কাজে তাদের আনুগত্য করার জন্যই এটা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের ইবাদত হয়ে গেল এবং এরই মাধ্যমে পীর পুরোহিতদের তারা নিজেদের রব বা প্রভু হিসাবে গ্রহণ করল। আর এ হলো আমাদের বর্তমান জাতির অবস্থা এবং এটা এক প্রকার বড় শিরক যার মাধ্যমে আল্লাহকে অস্বীকার করা হয় যে, একত্ববাদের অর্থ বহন করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাক্ষ্য। অতএব এখানে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, এই কালেমার অর্থ ঐ সমস্ত বিষয়কে নিষেধ বা পরিহার করার কারণে ইখলাছের বাণীও তাকে নিষেধ করে।

এভাবে মানব রচিত আইনকে ত্যাগ করা ওয়াজিব। কেননা, বিচার ফয়সালাতে কোরআন ও হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন করা ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন,

فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ

‘‘তারপর তোমরা যদি কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড় তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর।’’ (আন্ নিসা-৫৯) আল্লাহ আরো বলেন,

وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِن شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبِّي

‘‘তোমরা যে বিষয়ই মতভেদ কর তার ফয়সালা আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে। আর তিনি আমার রব।’’ (আশ্ শুরা, ১০)

যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ফয়সালা করবে না তার বিষয়ে আল্লাহর ফয়সালা হলো এই যে, সে কাফের অথবা যালেম অথবা ফাসেক এবং সে ঈমানদার থাকবে না। আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী যে ব্যক্তি ফয়সালা না করবে সে ঐ পর্যায়ের কাফের হবে যখন সে শরীয়ত বিরোধী ফায়সালা দেয়াকে জায়েয মনে করবে। অথবা মনে করবে যে, তার ফয়সালা আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালা থেকে অধিক উত্তম বা অধিক গ্রহণীয়। এমন ধারণা পোষণ করা হবে তাওহীদ পরিপন্থী, কুফুরী ও শিরক এবং তা " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এই কালেমার অর্থের একেবারে বিরোধী।

আর যদি শরীয়ত বিরোধী ফয়সালা দানকে মোবাহ বা বৈধ মনে না করে, বরং এ অনুযায়ী ফয়সালা দানকে ওয়াজিব মনে করে কিন্তু পার্থিব লালসার বশবর্তী হয়ে নিজের মনগড়া আইন দিয়ে ফয়সালা করে তবে এটা ছোট শিরক ও ছোট কুফরীর পর্যায়ে পড়বে। তবে এটাও " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর অর্থের পরিপন্থী। অতএব " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, এ কালেমাই মুসলমানদের জীবনকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং পরিচালনা করবে তাদের সমস্ত ইবাদত-বন্দেগী এবং সমস্ত কাজ কর্মকে। এই কালেমা শুধু কতগুলো শব্দের সমারোহ নয় যে, না বুঝে একে সকাল সন্ধ্যার তাসবীহ হিসাবে শুধু বরকতের জন্য পাঠ করবে আর এর দাবি অনুযায়ী কাজ করা থেকে বিরত থাকবে অথবা এর নির্দেশিত পথে চলবে না। মূলত: অনেকেই একে শুধু গতানুগতিকভাবে মুখে উচ্চারণ করে থাকে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস ও কর্ম এর পরিপন্থী।

" " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর আরো দাবি হলো আল্লাহর যত গুণবাচক নাম ও তাঁর নিজ সত্তার যে সমস্ত নাম আছে, যেগুলোকে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন অথবা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, সে সব গুণাবলিকে বিশ্বাস করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلِلّهِ الأَسْمَاء الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُواْ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَآئِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ

‘‘আল্লাহর জন্য রয়েছে সবচেয়ে উত্তম নামসমূহ, কাজেই সে সকল নাম ধরেই তাঁকে ডাক আর তাদেরকে বর্জন কর যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল অবশ্যই পাবে।’’ (সূরা আল‘আরাফ-১৮০)

ফাতহুল মজীদ কিতাবের লেখক বলেন, আরবদের ভাষায় প্রকৃত ( إِلْحَاد ) ইল্হাদ বলতে বুঝায়, সঠিক পথ পরিহার করে বক্র পথ অনুসরণ করা এবং বক্রতার দিকে ঝুঁকে পড়ে পথভ্রষ্ট হওয়া।

আল্লাহর সমস্ত নাম এবং গুণবাচক নামের মধ্যেই তাঁর পরিচয় এবং কামালিয়াত ফুটে উঠে বান্দার নিকট। লেখক আরো বলেন, অতএব আল্লাহর নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করা মানে ঐ সমস্ত নামকে অস্বীকার করা, অথবা ঐ সমস্ত নামের অর্থকে অস্বীকার বা অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক মনে করা, অথবা অপ-ব্যাখ্যার মাধ্যমে এর সঠিক অর্থকে পরিবর্তন করে দেয়া। অথবা আল্লাহর ঐ সমস্ত নাম দ্বারা তাঁর মাখলুকাতকে বিশেষিত করা। যেমন ওহদাতুল ওয়াজুদ পন্থীরা স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে এক করে সৃষ্টির ভাল-মন্দ অনেক কিছুকেই আল্লাহর নামে বিশেষিত করেছে।১.

অতএব যে ব্যক্তি মু’তাযিলা সম্প্রদায় বা জাহমিয়া ও আশায়েরাদের অনুরূপ আল্লাহর নামসমূহের ও গুণাবলির অপ-ব্যাখ্যা করল, অথবা সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ও অর্থ-সারশূন্য মনে করল, অথবা সেগুলোর অর্থ বোধগম্য নয় বলে মনে করল এবং এসব নাম ও গুণাবলির সুমহান অর্থের উপর বিশ্বাস আনল না সে মূলত আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে বক্রতার পথ অবলম্বন করল এবং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর অর্থ ও উদ্দেশ্যেরই বিরোধিতা করল। কেন না ‘ইলাহ’ হলেন তিনি, যাকে তার নাম ও সিফাতের মাধ্যমে ডাকা হয় এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করা হয়।

আল্লাহ বলেন,

( فَادْعُوْهُ بِهَا ) 

‘‘ঐ সমস্ত নামের মাধ্যমে তাঁকে ডাক।’’ আর যার কোন নাম বা সিফাত নেই সে কীভাবে ‘ইলাহ’ বা উপাস্য হতে পারে এবং কিসের মাধ্যমে তাকে ডাকা হবে?

ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, শরীয়াতের বিভিন্ন হুকুম আহ্কামের বিষয়ে মানুষ বিতর্কে লিপ্ত হলেও সিফাত সংক্রান্ত আয়াতসমূহে বা এ সম্পর্কে যে সংবাদ এসেছে তাতে কেউ বিতর্কে লিপ্ত হয়নি। বরং সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, আল্লাহর এ সকল আসমায়ে হুসনা এবং সিফাতের প্রকৃত অর্থ বুঝার পর ঠিক যেভাবে তা বর্ণিত হয়েছে, কোন অপ-ব্যাখ্যা ছাড়া তা ঐ ভাবেই মেনে নিতে হবে এবং স্বীকৃতি দান করতে হবে। এখানে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহর আসমায়ে হুসনা এবং সিফাতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তাওহীদ ও রেসালাতকে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করার এটাই মূল উৎস এবং তাওহীদের স্বীকৃতির জন্য এ সমস্ত আসমায়ে হুসনার স্বীকৃতি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্যই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যাতে কোন প্রকার সংশয়ের অবকাশ না থাকে।

হুকুম আহকামের আয়াতগুলো বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ ব্যতীত সবার জন্য বুঝে উঠা একটু কঠিন কাজ, কিন্তু আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত আয়াত সমূহের সাধারণ অর্থ সব মানুষই বুঝতে পারে। অর্থাৎ, তাঁর সত্তা ও আকৃতি বুঝা ব্যতীত আসল অর্থ সকলেই বুঝতে পারে।

লেখক আরো বলেন, এটি এমন একটি বিষয় যা সহজাত প্রবৃত্তি, সুস্থ মস্তিষ্ক এবং আসমানি কিতাবসমূহের মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় যে, যার মধ্যে পূর্ণতা অর্জনের সমস্ত গুণাবলি থাকে না সে কিছুতেই ইলাহ বা মা’বুদ, উদ্ভাবক ও প্রতিপালক হতে পারে না। সে হবে নিন্দিত ক্রটিপূর্ণ ও অপরিপক্ব এবং পূর্বাপর কোন অবস্থায় সে প্রশংসিত হতে পারে না। সর্বাবস্থায় প্রশংসিত হবেন তিনিই যাঁর মধ্যে কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জনের সমস্ত গুণাবলি বিদ্যমান থাকে। এ জন্যই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পূর্বের মনিষীগণ আল্লাহর সিফাত সম্পর্কে- যেমন, তিনি সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে, তাঁর কথোপকথন ইত্যাদি বিষয়ে- যে সমস্ত বই পুস্ত্তক রচনা করেছেন সে সকল বইয়ের নামকরণ করেছেন ‘‘আত্তাওহীদ’’ নামে। কারণ এ সমস্ত গুণাবলিকে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করা এবং এর সাথে কুফরী করার অর্থ হলো সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করা এবং তাঁকে না মানা। আর আল্লাহর একত্ববাদের অর্থ হচ্ছে তার সমস্ত কামালিয়াতের সিফাতকে মেনে নেয়া। সমস্ত দোষত্রুটি ও অন্য কিছুর সাথে তুলনীয় হওয়া থেকে তাঁকে পবিত্র মনে করা।

১০
একজন ব্যক্তির জন্য কখন " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর স্বীকৃতি ফলদায়ক হবে আর কখন এর স্বীকৃতি নিষ্ফল হবে ?
আমরা পূর্বেই বলেছি যে, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর স্বীকৃতির সাথে এর অর্থ বুঝা এবং এর দাবি অনুযায়ী কাজ করাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু কোরআন হাদীসে এমন কিছু উদ্ধৃতি আছে যা থেকে সন্দেহের উদ্ভব হয় যে, শুধুমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট। মূলত: কিছু লোক এ ধারণাই পোষণ করে। অতএব সত্য সন্ধানীদের জন্য এ সন্দেহের নিরসন করে দেয়া একান্তই প্রয়োজন মনে করি।

ইতবান (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুনকে হারাম করে দেবেন (বুখারী ১১ খন্ড ২০৬ পৃ: মুসলিম: ৩৩ নং)

এই হাদীসের আলোচনায় শেখ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ বলেন, মনে রাখবেন অনেক হাদীসের বাহ্যিক অর্থ দেখলে মনে হবে যে, কোন ব্যক্তি তাওহীদ এবং রেসালাতের শুধুমাত্র সাক্ষ্য দান করলেই জাহান্নামের জন্য সে হারাম হয়ে যাবে যেমনটি উপরোল্লেখিত হাদীসে বলা হয়েছে। এমনিভাবে আনাছ (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীসেও এসেছে তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুআজ (রা:) একবার সাওয়ারীর পিঠে আরোহণ করে কোথাও যাচেছন এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআজকে ডাকলেন। তিনি বললেন, লাববাইকা ওয়া সায়াদাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে মুআজ, যে বান্দাই এ সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেবেন। (বুখারী ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৯৯)

ইমাম মুসলিম উবাদাহ (রা:) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ এবং তাঁর রাসূল, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেবেন।’ (সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ২২৮ - ২২৯)

এছাড়া অনেকগুলো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি তাওহীদ ও রেসালাতের স্বীকৃতি দান করবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তবে জাহান্নাম তার জন্য হারাম করা হবে এমন কোন উল্লেখ তাতে নেই।

তাবুক যুদ্ধকালের একটি ঘটনা। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। আর সংশয়হীনভাবে এই কালেমা পাঠকারী আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় মিলিত হবে যে, জান্নাত ও তার মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।

লেখক আরো বলেন, শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এবং অন্যান্য প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তা অত্যন্ত চমৎকার।

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, এ সমস্ত হাদীসের অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ কালেমা পাঠ করে এর উপর মৃত্যুবরণ করবে - যেভাবে নির্দিষ্ট সীমা রেখায় বর্ণিত হয়েছ - এবং এই কালেমাকে সংশয়হীনভাবে একেবারে নিরেট আল্লাহর ভালোবাসায় হৃদয়-মন থেকে এর স্বীকৃতি দেবে সেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেননা প্রকৃত তাওহীদ হচ্ছে সার্বিকভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা এবং আকৃষ্ট হওয়া। আর ইখলাছ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঐ আকর্ষণের নাম, যে আকর্ষণ বা আবেগের ফলে আল্লাহর নিকট বান্দা সমস্ত পাপের জন্য খালেছ তওবা করবে এবং যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে তবেই জান্নাত লাভ করতে পারবে। কারণ অসংখ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসবে যদি তার মধ্যে অণু পরিমাণও ঈমান বিদ্যমান থাকে। এছাড়া অসংখ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, অনেক লোক ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরেও জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। অনেকগুলো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, বনি আদম সিজদা করার ফলে যে চি‎হ্ন পড়ে ঐ চিহ্নকে জাহান্নাম কখনো স্পর্শ করতে পারবে না।

এতে বুঝা গেল ঐ ব্যক্তিরা নামাজ পড়ত এবং আল্লাহর জন্য সিজদা করত। আর অনেকগুলো হাদীসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং এই সাক্ষ্য দান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্যিকার মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তার উপর জাহান্নামকে হারাম করা হবে। তবে একথা এমনিতে মুখে উচ্চারণ করলে হবে না, এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু নির্দিষ্ট কাজ যা অবশ্যই করণীয়। অধিকাংশ লোক মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করলেও তারা জানে না ইখলাছ এবং ইয়াকীন বা দৃঢ় প্রত্যয় বলতে কি বুঝায়। আর যে ব্যক্তি এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত থাকবে না, মৃত্যুর সময় এ কারণে তার ফিতনার সম্মুখীন হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং ঐ সময় হয়তো তার মাঝে এবং কালেমার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। অনেক লোক এ কালেমা অনুকরণমূলক বা সামাজিক প্রথা অনুযায়ী পাঠ করে। অথচ তাদের সাথে ঐকান্তিকভাবে ঈমানের কোন সম্পর্কই থাকে না। আর মৃত্যুর সময়ও কবরে ফিতনার সম্মুখীন যারা হবে তাদের অধিকাংশই এই শ্রেণির মানুষ।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এ ধরনের লোকদের কবরে প্রশ্ন করার পর উত্তরে বলবে, ‘মানুষকে এভাবে একটা কিছু বলতে শুনেছি এবং আমিও তাদের মত বুলি আওড়িয়েছি মাত্র’। তাদের অধিকাংশ কাজ কর্ম এবং আমল তাদের পূর্বসূরিদের অনুকরণেই হয়ে থাকে। আর এ কারণে তাদের জন্য আল্লাহর এ বাণীই শোভা পায়।

إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِم مُّهْتَدُونَ

‘‘আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের এই পথের পথিক হিসাবে পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছি।’’ (সূরা আয্যুখরুফ-২৩)

এই দীর্ঘ আলোচনার পর বলা যায় যে, এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে কোন প্রকার বিরোধিতা নেই। অতএব কোন ব্যক্তি যদি পূর্ণ ইখলাছ এবং ইয়াকীনের সাথে এ কালেমা পাঠ করে থাকে তা হলে কোন মতেই সে কোন পাপ কাজের উপর অবিচলিত থাকতে পারে না। কারণ তার বিশুদ্ধ ইসলাম বা সততার কারণে আল্লাহর ভালোবাসা তার নিকট সকল কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান পাবে। অতএব এ কালেমা পাঠ করার পর আল্লাহর হারামকৃত বস্ত্তর প্রতি তার হৃদয়ের মধ্যে কোন প্রকার আগ্রহ বা ইচ্ছা থাকবে না এবং আল্লাহ যা আদেশ করেছেন সে সম্পর্কে তার মনের মাঝে কোন প্রকার দ্বিধা- সংকোচ বা ঘৃণা থাকবে না। আর এ ধরনের ব্যক্তির জন্যই জাহান্নাম হারাম হবে, যদিও তার নিকট হতে এর পূর্বে কিছু গুনাহ হয়ে থাকে। কারণ তার এ ঈমান, ইখলাছ, ভালোবাসা এবং ইয়াকীনই তার সমস্ত পাপকে এভাবে মুছে দেবে যেভাবে দিনের আলো রাতের অন্ধকারকে দূরীভূত করে দেয়। ১.

শেখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহ.) বলেন, এই প্রসঙ্গে তাদের আরেকটি সংশয় এই যে তারা বলে, উসামা (রা:) এক ব্যক্তিকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরেও হত্যা করার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ কাজকে নিন্দা করেছেন এবং উসামা (রা:) কে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘তুমি কি তাকে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলার পর হত্যা করেছ?’

এ ধরনের আরো হাদীস আছে যাতে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠকারীর নিরাপত্তা সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ থেকে এ সকল মূর্খরা বলতে চায় যে, কোন ব্যক্তি এ কালেমা পড়ার পর যা ইচ্ছা করতে পারে কিন্তু এ কারণে আর কখনো কাফের হয়ে যাবে না এবং তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য এটাই যথেষ্ট। এ সমস্ত অজ্ঞদের বলতে হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদীদের সাথে জিহাদ করেছেন এবং তাদের বন্দী করেছেন অথচ তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এ কথাকে স্বীকার করত। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ হানিফা গোত্রের সাথে জিহাদ করেছেন অথচ তারা স্বীকার করত যে, আল্লাহ এক এবং মুহাম্মাদ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এবং তারা নামাজ পড়ত ও ইসলামের দাবিদার ছিল। এভাবে আলী (রা:) যাদেরকে জ্বালিয়ে মেরেছিলেন তাদের কথাও উল্লেখ করা যায়।

এ সমস্ত অজ্ঞরা এ বিষয় স্বীকৃতি দান করে যে, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পর পুনরুত্থানকে অবিশ্বাস করবে, সে কাফের ও মুরতাদ হয়ে যাবে এবং মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হবে। এছাড়া যে ব্যক্তি ইসলামের স্তম্ভগুলোর কোন একটিকে অস্বীকার করবে তাকে কাফের বলা হবে এবং মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হবে, যদিও সে মুখে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এ কালেমা উচ্চারণ করে থাকে।

তা হলে বিষয়টা কেমন হলো? আংশিক দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বক্রতার পথ গ্রহণ করলে যদি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা কোন উপকারে না আসে তা হলে রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত দীনের মূল বিষয় তাওহীদের সাথে কুফরী করার পর কীভাবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শুধু মুখে উচ্চারণ করাটা তার উপকার সাধন করতে পারে? মূলত আল্লাহ দ্রোহীরা এই সমস্ত হাদীসের অর্থ বুঝতে পারেনি।১.

উসামা (রা:) এর হাদীসের ব্যাখ্যায় তিনি আরো বলেন, উসামা (রা:) ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন এই মনে করে যে, ঐ ব্যক্তি মুসলমান হওয়ার দাবি করেছে শুধু তার জীবন ও সম্পদ রক্ষার ভয়ে। আর ইসলামের নীতি হচ্ছে কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে ঐ পর্যন্ত তার ধন-সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে যে পর্যন্ত ইসলামের পরিপন্থী কোন কাজ সে না করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا ضَرَبْتُمْ فِي سَبِيلِ اللّهِ فَتَبَيَّنُواْ

‘‘হে ঈমানদারগণ তোমরা যখন আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য বের হও তখন যাচাই করে নিও।’’ (সূরা আন্ নিসা-৯৪)

এই আয়াতের অর্থ হলো এই যে, কোন ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের পর ঐ পর্যন্ত তার জীবনের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে যে পর্যন্ত ইসলাম পরিপন্থী কোন কাজ তার নিকট থেকে প্রকাশ না পায়। আর যদি এর বিপরীত কোন কাজ করা হয় তাহলে তাকে হত্যা করা যাবে। কেননা আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিরূপণ কর। আর যদি তাই না হতো তাহলে এখানে { فَتَبَيَّنُواْ } অর্থাৎ, যাচাই কর, এ শব্দের কোন মূল্যই থাকে না। এভাবে অন্যান্য হাদীসসমূহ যার আলোচনা পূর্বে বর্ণনা করেছি অর্থাৎ, যে ব্যক্তি ইসলাম এবং তাওহীদের স্বীকৃতি দান করল এবং এরপর ইসলাম পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত থাকল তার জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা ওয়াজিব। আর একথার দলীল হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামাকে বললেন, তুমি কি তাকে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " বলার পর হত্যা করেছ?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘আমি মানুষের সাথে জিহাদ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য মাবুদ নেই।’ আবার তিনিই খারেজীদের সম্পর্কে বলেন, ‘তোমরা যেখানেই তাদের দেখা পাও সেখানেই তাদেরকে হত্যা কর, আমি যদি তাদেরকে পেতাম তাহলে আদ জাতির হত্যার মত তাদেরকে হত্যা করতাম।’ অথচ এরাই ছিল তখনকার সময় সবচেয়ে বেশি আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনাকারী। এমন কি সাহাবায়ে কেরাম এ দিক থেকে এ সমস্ত লোকদের তুলনায় নিজদেরকে খুব খাট মনে করতেন, যদিও তারা সাহাবায়ে কেরামদের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করত। এদের নিকট থেকে ইসলাম বহির্ভূত কাজ প্রকাশ পাওয়ায় এদের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা বা এর প্রচার করা এবং ইবাদত করা ও মুখে ইসলামের দাবি করা কোন কিছুই তাদের কাজে আসল না। এভাবে ইয়াহুদীদের সাথে যুদ্ধ করা এবং সাহাবাদের ‘বনু হানিফা’ গোত্রের সাথে যুদ্ধ করার বিষয়গুলোও এখানে উল্লেখ যোগ্য।

এ প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে রজব তাঁর ‘কালেমাতুল ইখলাছ’ নামক গ্রন্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি মানুষের সাথে জিহাদ করার জন্য যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্যিকার মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ এর ব্যাখ্যায় বলেন, উমার এবং একদল সাহাবা বুঝে ছিলেন যে, যে ব্যক্তি শুধুমাত্র তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দান করবে একমাত্র এর উপর নির্ভর করে তাদের দুনিয়াবী শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এ জন্যই তাঁরা যাকাত প্রদান করতে যারা অস্বীকার করেছে তাদের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছেন এবং আবু বকর (রা:) বলেছিলেন যে, ঐ পর্যন্ত তাদেরকে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি দেয়া যাবে না যে পর্যন্ত তারা যাকাত প্রদানে স্বীকৃতি না দেবে। কেননা; রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যারা ‘তাওহীদ ও রিসালাতের’ সাক্ষ্য দেবে তারা আমার নিকট থেকে তাদের জীবনকে হেফাজত করবে তবে কোন অপরাধের কারণে ইসলামি দন্ডে মৃত্যুদন্ডের উপযুক্ত হলে তা প্রয়োগ করা হবে এবং তাদের হিসাবের দায়িত্ব আল্লাহর উপর বর্তাবে।’’

লেখক আরো বলেন, যাকাত হচ্ছে সম্পদের হক এবং আবুবকর (রা:) এটাই বুঝে ছিলেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে ইবনে উমার, আনাস ও অন্যান্য অনেক সাহাবা (রা:) বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ‘‘আমি মানুষের সাথে জিহাদ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলবে, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল এবং নামাজ প্রতিষ্ঠিত করবে ও যাকাত প্রদান করবে।’’ আল্লাহ তা‘আলার বাণীগুলোও এ অর্থই বহন করে। তিনি বলেন,

فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمْ

‘‘তারা যদি তওবা করে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দান করে তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও।’’ (সূরা আত তাওবা, আয়াত ৫) আল্লাহ আরো বলেন,

فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ

‘‘তারা যদি তাওবা করে নামাজ কায়েম করে ও যাকাত দান করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।’’ (সূরা আত তাওবা, আয়াত ১১) এ থেকে প্রমাণিত হলো যে, কোন ব্যক্তির সাথে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব ঐ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হবে না যে পর্যন্ত না সে তাওহীদের স্বীকৃতির সাথে সাথে সমস্ত ফরজ ওয়াজিব আদায় করবে। আর শিরক থেকে তওবা করা ঐ পর্যন্ত প্রমাণিত হবে না, যে পর্যন্ত তাওহীদের উপর অবিচল না থাকবে।

আবু বকর (রা:) যখন সাহাবাদের জন্য এটাই নির্ধারণ করলেন তখন তাঁরা এ রায়ের প্রতি ফিরে আসলেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তই সঠিক মনে করলেন। এতে বুঝা গেল যে, দুনিয়ার শাস্তি থেকে শুধুমাত্র এই কালেমা পাঠ করলেই রেহাই পাওয়া যাবে না বরং ইসলামের কোন বিধান লঙ্ঘন করলে দুনিয়াতে যেমন শাস্তি ভোগ করতে হবে, তেমনি আখেরাতেও শাস্তি ভোগ করতে হবে।

লেখক আরো বলেন,১. আলেমদের মধ্যে অন্য একটি দল বলেন, এই সমস্ত হাদীসের অর্থ হচ্ছে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " মুখে উচ্চারণ করা জান্নাতে প্রবেশ এবং জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটা প্রধান উপকরণ এবং এর দাবি মাত্র। আর এ দাবির ফলাফল সিদ্ধি হবে শুধুমাত্র তখনই যখন প্রয়োজনীয় শর্তগুলো আদায় করা হবে এবং এর প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা হবে। আর ঐ লক্ষ্যে পেঁŠছার শর্তগুলো যদি অনুপস্থিত থাকে, অথবা এর পরিপন্থী কোন কাজ পাওয়া যায়, তাহলে এ কালেমা পাঠ করা এবং এর লক্ষ্যে পৌঁছার মাঝে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।

হাসান আল বসরী এবং ওয়াহাব বিন মোনাববিহ্ও এই মতই ব্যক্তি করেছেন এবং এ মতই হলো অধিক স্পষ্ট। হাসান আল বসরী (রহ.) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, ফারাজদাক নামক কবি তার স্ত্রীকে দাফন করার সময় হাসান আল বসরী বলেন, এ দিনের - কিয়ামতের - জন্য কি প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেছ? উত্তরে ফারাজদাক বললেন, সত্ত্বর বৎসর যাবৎ কালেমা " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর যে স্বীকৃতি দিয়ে আসছি সেটাই আমার সম্বল। হাসান আল বসরী বললেন, বেশ উত্তম প্রস্ত্ততি! কিন্তু এই কালেমার কতগুলো শর্ত রয়েছে তা কি তুমি জান? তুমি অবশ্যই সতী-সাধ্বী নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে কবিতা লেখা থেকে নিজকে বিরত রাখবে। হাসান আল বসরীকে প্রশ্ন করা হলো, কিছু সংখ্যক মানুষ বলে থাকে যে, যে ব্যক্তি বলবে, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি বলবে, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এবং এর ফরজ ওয়াজিব আদায় করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এক ব্যক্তি ওয়াহাব বিন মোনাব্বিহকে বললেন,‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ কি বেহেস্তের কুঞ্জি ?

তিনি বললেন, হাঁ, তবে প্রত্যেক চাবির মধ্যে দাঁত (কাটা) থাকে তুমি যে চাবি নিয়ে আসবে তাতে যদি দাঁত থাকে তবেই তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খোলা হবে, নইলে না। লেখক বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই কালেমা পাঠ করলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে এর দাবি অনুযায়ী কাজ করা হোক বা নাই হোক অথবা যারা মনে করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বললেই আর কখনো তাদেরকে কাফের বলা যাবে না, চাই মাজার পূজা ও পীর পূজার মাধ্যমে যত বড় শিরকের চর্চাই তারা করুক না কেন, তাদের কথা ঠিক নয়। এ সমস্ত শিরক মিশ্রিত কর্মকান্ড যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর একেবারেই পরিপন্থী এ সন্দেহের অবসান করার জন্য আমি আহলে ইলমদের কথা থেকে যতটুকু এখানে উপস্থাপন করেছি তাই যথেষ্ট বলে মনে করি।

যারা কোরআন ও হাদীসের সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি সমূহকে বিশদ ব্যাখ্যা দ্বারা না বুঝে ভাসা- ভাসা অর্থ গ্রহণ করে এবং এরপর এটাকে তাদের পক্ষের দলিল হিসাবে প্রমাণ করে, আর বিস্তারিত ব্যাখ্যাকারী উদ্ধৃতিসমূহকে উপেক্ষা করে, এটা হচ্ছে মূলত: পথ ভ্রষ্টকারীদের কাজ। এদের অবস্থা হলো ঐ সমস্ত লোকদের মত যারা কোরআনের কিছু অংশে বিশ্বাস করে আর কিছু অংশের সাথে কুফরি করে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

هُوَ الَّذِيَ أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ في قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاء الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاء تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ اللّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلاَّ أُوْلُواْ الألْبَابِ رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لاَّ رَيْبَ فِيهِ إِنَّ اللّهَ لاَ يُخْلِفُ الْمِيعَادَ

‘‘তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন এতে কিছু সংখ্যক আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলো কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো অস্পষ্ট। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে তারা ফিতনা বিস্তার ও অস্পষ্ট আয়াতগুলোর অপ-ব্যাখ্যার অনুসরণ করে। মূলত সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে, আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের পালন-কর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। জ্ঞানী লোকেরা ছাড়া অন্য কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না। হে আমাদের পালন-কর্তা! তুমি আমাদের সরল পথ প্রদর্শনের পর আমাদের অন্তরকে সত্য লঙ্ঘনে প্রবৃত্ত করো না এবং তোমার নিকট থেকে অনুগ্রহ দান কর, তুমিই সব কিছুর দাতা। হে আমাদের পালন-কর্তা! তুমি একদিন মানব জাতিকে অবশ্যই একত্রিত করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’’ (সূরা আলে ইমরান-৭-৯)

হে আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন, সত্যকে সত্য হিসাবে গ্রহণ করতে এবং মিথ্যাকে পরিহার করতে।

১১
" لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর প্রভাব
সত্য এবং নিষ্ঠার সাথে এ মহান কালেমা পাঠ করলে এবং এর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দাবি অনুযায়ী আমল করলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এ কালেমার এক বিশেষ সুফল প্রতিফলিত হবে। তম্মধ্যে নিকটবর্তী বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য:

(ক) এই কালেমা মুসলমানদের মধ্যে একতা সৃষ্টি করে। আর এর ফল স্বরূপ তারা আল্লাহর বলে বলীয়ান হয়ে বিজয় সূচিত করতে পারে আল্লাহ দ্রোহীদের উপর। কেননা তখন তারা একই দীনের অনুসারী এবং একই আকীদায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللّهِ جَمِيعًا وَلاَ تَفَرَّقُواْ

‘‘এবং তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর, আর তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’’ (সূরা আলে ইমরান-১০৩) আল্লাহ আরো বলেন:

وَإِن يُرِيدُواْ أَن يَخْدَعُوكَ فَإِنَّ حَسْبَكَ اللّهُ هُوَ الَّذِيَ أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِ وَبِالْمُؤْمِنِينَ وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ لَوْ أَنفَقْتَ مَا فِي الأَرْضِ جَمِيعاً مَّا أَلَّفَتْ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ وَلَكِنَّ اللّهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ إِنَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘‘তিনিই তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন আপন সাহায্যে ও মুমিনদের দিয়ে। আর তিনি প্রীতি সঞ্চার করেছেন তাদের অন্তরে। যমীনের সকল সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মনে পারস্পরিক প্রীতি সঞ্চার করেছেন, নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়।’’ (সূরা আল আনফাল-৬২-৬৩)

ইসলামী আকীদায় যদি অনৈক্য সৃষ্টি হয় তাহলে তা থেকে পরস্পরের মধ্যে বিভক্তি এবং ঝগড়া কলহের জন্ম নেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمْ وَكَانُواْ شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ

‘‘নিশ্চয়ই যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড বিখন্ড করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই।’’ (সূরা আল আনআম-১৫৯) আল্লাহ আরো বলেন:

فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُم بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ

‘‘অতঃপর তারা তাদের কাজকে বহুধা বিভক্ত করে দিয়েছে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত।’’ (সূরা আল ম’মিনূন -৫৩)

অতএব মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে তাওহীদ ও ঈমানী আকীদার বন্ধনে একত্রিত হওয়া। আর এটাই " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর একমাত্র অর্থ। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে আরবদের অবস্থা এবং তাদের পরবর্তী অবস্থা বিবেচনা করলেই একথা সুস্পষ্ট বুঝা যাবে।

খ ) " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এই কালেমার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সমাজের মধ্যে ফিরে আসে শান্তি আর নিরাপত্তার গ্যারানিট। কেননা; এ ধরনের ঈমানের ফলে ঐ সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিই আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা গ্রহণ করে, আর যা হারাম করেছেন তাকে পরিহার করে। আর সকল মানুষ ফিরে আসে সীমা-লঙ্ঘন, অত্যাচার আর শক্রতার পথ থেকে। একে অপরের প্রতি বাড়িয়ে দেয় সহানুভূতি, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের হাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ

‘‘নিশ্চয়ই মুমিনরা একে অপরের ভাই।’’ (সূরা আল হুজুরাত, ১০ )

আর এই বাণীর অনুসরণে একে অপরকে জড়িয়ে নেয় প্রীতি আর ভালোবাসার জালে। এর বাস্তব নিদর্শন হলো আরবদের অবস্থা। তারা এ কালেমার ছায়াতলে একত্রিত হওয়ার পূর্বে একে অপরের চরম দুশমন ছিল। হত্যা, লুণ্ঠন আর রাহাজানির জন্য তারা গর্ববোধ করত। আর যখন তারা " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর ঝান্ডাতলে একত্রিত হলো তখন গড়ে উঠল তাদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সীসাঢালা প্রাচীর।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاء عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاء بَيْنَهُمْ

‘‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথিরা হলেন কাফেরদের উপর কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল।’’ (সূরা আল-ফাত্হ, ২৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

وَاذْكُرُواْ نِعْمَةَ اللّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاء فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا

‘‘আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শক্র ছিলে অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছ।’’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)

(গ) এ কালেমার বন্ধনে একত্রিত হয়ে মুসলমানগণ লাভ করবে খেলাফতের দায়িত্ব এবং নেতৃত্ব দান করবে এ পৃথিবীর, আর তারা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে মোকাবিলা করবে সকল ষড়যন্ত্র ও বিভিন্ন মতবাদের। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُم فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

‘‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে যে দ্বীনকে তিনি পছন্দ করেছেন তাদের জন্য এবং ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করে এবং আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক করে না।’’ (আন্ নুর-৫৫)

এখানে এই মহান সফলতা অর্জনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র তাঁর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার শর্তারোপ করেছেন আর এটাই হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর দাবি ও অর্থ।

ঘ) যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" এর স্বীকৃতি দান করবে এবং এর দাবি অনুযায়ী আমল করবে তার হৃদয়ের মধ্যে খুঁজে পাবে এক অনাবিল প্রশান্তি। কেননা সে এক প্রতিপালকের ইবাদাত করে এবং তিনি কি চান এবং কিসে তিনি রাজি হবেন সে অনুপাতে কাজ করে এবং যে কাজে তিনি নারাজ হবেন তা থেকে বিরত থাকে। আর যে ব্যক্তি বহু দেব-দেবীর পূজা করে তার হৃদয়ে এমন প্রশান্তি আসতে পারে না, কারণ ঐ সমস্ত উপাস্যদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য হবে ভিন্ন ভিন্ন এবং প্রত্যেকে চাবে তাকে ভিন্ন ভাবে পরিচালনা করার জন্য। আল্লাহ বলেন,

أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ

‘‘পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভাল না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ ?’’ (সূরা ইউসুফ-৩৯)

আল্লাহ আরো বলেন,

ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا رَّجُلًا فِيهِ شُرَكَاء مُتَشَاكِسُونَ وَرَجُلًا سَلَمًا لِّرَجُلٍ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا

‘‘আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন, কোন একজন লোকের উপর পরস্পর বিরোধী কয়েকজন মালিক রয়েছে আরেক ব্যক্তির প্রভু মাত্র একজন তাদের উভয়ের উদাহরণ কি সমান?’’ (সূরা আয্ যুমার-২৯)

ইমাম ইব্নুল কাইয়েম রহ. বলেন, এখানে আল্লাহ একজন মুশরিক ও একজন একত্ববাদে বিশ্বাসী ব্যক্তির অবস্থা বুঝাবার জন্য এই উদাহরণ দিয়েছেন। একজন মুশরিকের অবস্থা হচ্ছে এমন একজন দাস বা চাকরের মত যার উপর কর্তৃত্ব রয়েছে একত্রে কয়েকজন মালিকের। আর ঐ সমস্ত মালিকরা হচ্ছে পরস্পর বিরোধী, তাদের সম্পর্ক হচ্ছে দা-কুমড়োর সম্পর্ক, একজন অপর জনের চির শক্র। আর আয়াতে বর্ণিত (মোতাশাকেছ) এর অর্থ হলো, ‘‘যে ব্যক্তির চরিত্র অত্যন্ত খারাপ।’’ আর মুশরিক যেহেতু বিভিন্ন উপাস্যের পূজা করে সেহেতু তার উপমা দেয়া হয়েছে ঐ দাস বা চাকরের সাথে, যার মালিক হচ্ছে একত্রে কয়েকজন ব্যক্তি যাদের প্রত্যেকই তার খেদমত পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে এসব মালিকদের সবার সন্তুষ্টি অর্জন করা অসম্ভব। আর যে ব্যক্তি শুধু এক আল্লাহর ইবাদত করে তার উদাহরণ হচ্ছে ঐ চাকরের মত যে শুধু একজন মালিকের অধীনস্থ। সে তার মালিকের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত থাকে এবং তার মনস্ত্তষ্টির পথ সে জানে।

তাই এ চাকরের জন্য বহু মালিকের অত্যাচার ও নিপীড়নের ভয় থাকে না। শুধু তাই নয়, নিজের মনিবের প্রীতি, ভালোবাসা, দয়া ও করুণা নিয়ে অত্যন্ত নিরাপদে সে তার নিকট বসবাস করে। এখন প্রশ্ন হলো এ দু’জন চাকরের অবস্থা কি এক?

(ঙ) এই কালেমা র অনুসারীরা দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান ও সুমহান মর্যাদা লাভ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

حُنَفَاء لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِينَ بِهِ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاء فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ

‘‘যে আল্লাহর দিকে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর সাথে শরীক না করে এবং যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দুরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’’ (আল হাজ্জ-৩১)

এই আয়াতের অর্থ থেকে বুঝা-গেল যে, তাওহীদ হচ্ছে সুমহান উচ্চ-মর্যাদা সম্পন্ন এবং শিরক হচ্ছে নীচ, হীন।

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ঈমান এবং তাওহীদের সুমহান মর্যাদার কারণে এর উদাহরণ দেয়া হয়েছে সুমহান আকাশের সাথে আর ঐ আকাশ হচ্ছে তার ঊর্ধ্বলোকে উঠার সিঁড়ি এবং তাতেই সে অবতরণ করবে। আর ঈমান ও তাওহীদ পরিত্যাগকারীর উদাহরণ দেয়া হয়েছে আকাশ থেকে জমিনের অতল গহবরে পড়ে যাওয়ার সাথে যার ফলে তার হৃদয় মন হয়ে যাবে সংকুচিত, আর সে অনুভব করবে আঘাতের পর আঘাত এবং যে পাখি তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে ও ছিন্ন-ভিন্ন করে দেবে। ঐ পাখির উদাহরণ দিয়ে বুঝান হয়েছে এমন শয়তানদের, যারা তার সহযোগী হবে এবং তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য অস্থির ও বিব্রত করতে থাকবে। আর যে বাতাস তাকে দূরবর্তী সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করবে তা হলো তার মনের কামনা বাসনা, যা তাকে আকাশ থেকে মাটির অতল গহবরে নিক্ষেপ করতে প্রলুব্ধ করবে। ১.

(চ) এ কালেমা তার জীবন সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা দান করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমি আদিষ্ট হয়েছি মানুষের সাথে জিহাদ করার জন্য যে পর্যন্ত না তারা বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আর যখন তারা এ স্বীকৃতি দান করবে তখন আমার নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদকে নিরাপদ করবে। তবে তার - ইসলামের - কোন হক বা অধিকার লঙ্ঘন হলে-তা আর নিরাপদ থাকবে না।’’

এখানে তার অধিকার বলতে বুঝান হয়েছে তারা যখন এ কালেমার স্বীকৃতি এবং দাবি অনুযায়ী কাজ করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখবে, অর্থাৎ তাওহীদের উপর অবিচল থাকবে না, ইবাদতকে শিরক মুক্ত করবে না ও ইসলামের প্রধান প্রধান কাজগুলো আদায় করবে না, তখন ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর স্বীকৃতি তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দান করবে না বরং এজন্য তাদের জীবন নাশ করা হবে, যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ করেছেন।

এছাড়া ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইবাদত, মোয়ামালাত, চরিত্র গঠন, আচার অনুষ্ঠান সবকিছুকেই প্রভাবিত করবে এ কালেমা।

পরিশেষে আল্লাহর তাওফীক কামনা করি, আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদের উপর এবং তাঁর আহাল ও সাহাবায়ে কেরামদের উপরেও।

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন