HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন
লেখকঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ১২
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম সংস্করণ : জুলাই ১৯৭৯
২য় সংস্করণ : আগষ্ট ১৯৮৯
৩য় সংস্করণ : জানুয়ারী ১৯৯৪
৪র্থ সংস্করণ : সেপ্টেম্বর ২০০২
৫ম সংস্করণ : জানুয়ারী ২০০৫
নির্ধারিত মূল্য : ২১ (একুশ) টাকা মাত্র।
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ১২
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম সংস্করণ : জুলাই ১৯৭৯
২য় সংস্করণ : আগষ্ট ১৯৮৯
৩য় সংস্করণ : জানুয়ারী ১৯৯৪
৪র্থ সংস্করণ : সেপ্টেম্বর ২০০২
৫ম সংস্করণ : জানুয়ারী ২০০৫
নির্ধারিত মূল্য : ২১ (একুশ) টাকা মাত্র।
বিশ্বে যতগুলি ইসলামী আন্দোলন রয়েছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং নির্ভেজাল হ’ল ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’। দুনিয়ার মানুষকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্মমূলে জমায়েত করার জন্য ছাহাবায়ে কেরামের যুগ হ’তে চলে আসা নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনের নামই হ’ল ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’। এ আন্দোলনের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এর ভিত্তি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ। বাংলাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ক্ষেত্রে অত্র বইখানি ১৯৭৯ সালে ১ম প্রকাশের পর হ’তেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সম্মানিত লেখক বিরাট একটি বিষয়কে সংক্ষেপে ও সাবলীল ভঙ্গিতে এবং সহজ-সরল ভাব ও ভাষার মাধ্যমে জনগণের সন্মুখে তুলে ধরার অসাধ্য সাধন করেছেন। তিনি পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ’ শিরোনামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হ’তে সম্মানজনক পিএইচ. ডি. (Ph.D) ডিগ্রী লাভ করেছেন। অত্যন্ত তথ্যবহুল ও গবেষণা সমৃদ্ধ এ অভিসন্দর্ভটি ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ ১৯৯৬ সালে গ্রন্থাকারে (৫৩৮ পৃঃ) প্রকাশ করার গৌরব অর্জন করেছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?’ বইয়ের স্বত্বাধিকারী ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ আমাদেরকে বইটি প্রকাশের অনুমতি প্রদান করায় আমরা তাদেরকে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’-এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং উক্ত সংগঠনের উত্তরোত্তর অগ্রগতি কামনা করছি। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যেও সম্মানিত লেখক বইটির ৪র্থ সংস্করণ একবার দেখে দিয়েছেন ও বেশ কিছু তথ্য সংযোজনের কষ্ট স্বীকার করেছেন, সে জন্য তাঁকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। সাথে সাথে তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। এছাড়াও অত্র সংস্করণ প্রকাশে বিভিন্নভাবে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলের জন্য মহান আল্লাহর নিকটে খাছ দো‘আ করছি।
প্রায় তিন বছর পূর্বে বইটির স্টক শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আর্থিক সংকট ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্নমুখী সমস্যা থাকার কারণে পুনরায় ছাপা সম্ভব হয়নি। তবুও অবশেষে আমরা এই মূল্যবান বইটির ৪র্থ সংস্করণ পাঠক-পাঠিকার খেদমতে পেশ করতে পেরে মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
এ বইটির মাধ্যমে বিদগ্ধ পাঠক-পাঠিকাদের নিকটে আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি হ’লে এবং সাথে সাথে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রতরভাবে অনুভূত হ’লে আমাদের শ্রম সার্থক হবে বলে মনে করব। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সকলকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সার্বিক জীবন পরিচালনার তাওফীক্ব দাও। আমীন!
বিনীত
অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল লত
সচিব
হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?’ বইয়ের স্বত্বাধিকারী ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ আমাদেরকে বইটি প্রকাশের অনুমতি প্রদান করায় আমরা তাদেরকে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’-এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং উক্ত সংগঠনের উত্তরোত্তর অগ্রগতি কামনা করছি। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যেও সম্মানিত লেখক বইটির ৪র্থ সংস্করণ একবার দেখে দিয়েছেন ও বেশ কিছু তথ্য সংযোজনের কষ্ট স্বীকার করেছেন, সে জন্য তাঁকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। সাথে সাথে তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। এছাড়াও অত্র সংস্করণ প্রকাশে বিভিন্নভাবে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলের জন্য মহান আল্লাহর নিকটে খাছ দো‘আ করছি।
প্রায় তিন বছর পূর্বে বইটির স্টক শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আর্থিক সংকট ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্নমুখী সমস্যা থাকার কারণে পুনরায় ছাপা সম্ভব হয়নি। তবুও অবশেষে আমরা এই মূল্যবান বইটির ৪র্থ সংস্করণ পাঠক-পাঠিকার খেদমতে পেশ করতে পেরে মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
এ বইটির মাধ্যমে বিদগ্ধ পাঠক-পাঠিকাদের নিকটে আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি হ’লে এবং সাথে সাথে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রতরভাবে অনুভূত হ’লে আমাদের শ্রম সার্থক হবে বলে মনে করব। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সকলকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সার্বিক জীবন পরিচালনার তাওফীক্ব দাও। আমীন!
বিনীত
অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল লত
সচিব
হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
অন্যান্য সকল বস্ত্তর ন্যায় কালক্রমে ইসলামেও যথেষ্ট ভেজালের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এসব থেকে ইসলামকে মুক্ত করে মুসলিম মিল্লাতকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর মূল আদর্শের দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ছাহাবায়ে কেরাম ও তৎকালীন হক্বপন্থী মুসলমানগণ যে আন্দোলন শুরু করেন, সেটাই ‘আহলুল হাদীছ’ বা আহলেহাদীছ আন্দোলন নামে ইতিহাসে পরিচিত। এ আন্দোলনের মর্মবাণী একটাই- মানুষকে নির্ভেজাল ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত দেওয়া এবং ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করা। এ আন্দোলন ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই চলে আসছে। ইনশাআল্লাহ ক্বিয়ামত পর্যন্ত চলবে।
এ প্রসঙ্গে পাক-ভারত উপমহাদেশে আহলেহাদীছের নেতৃত্বে পরিচালিত জিহাদ আন্দোলনের বীর সিপাহ্সালার সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী, শাহ ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা বেলায়েত আলী, মাওলানা এনায়েত আলী, সৈয়দ নিছার আলী তিতুমীর, হাজী শরী‘আতুল্লাহ্ প্রমুখের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
বাংলার সচেতন যুব সমাজের কাছে ইসলামের নির্ভেজাল রূপ তুলে ধরার যে দায়িত্ব নিয়ে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ তাদের অগ্রযাত্রা শুরু করেছে, আমি তাদের এ প্রচেষ্টাকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। আল্লাহ তাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন-আমীন!
অতঃপর আমি এতদ্বারা ঘোষণা করছি যে, শুধুমাত্র পরকালীন স্বার্থেই আমি আমার ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন’ বইটি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় কমিটিকে দান করলাম। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ যতদিন তার সাংগঠনিক ঐক্য ও কার্যক্রম বজায় রাখবে, ততদিন যাবত এ বইয়ের পূর্ণ স্বত্বাধিকারী তারাই থাকবে।
পরিশেষে এ বই দ্বারা পাঠকের মন হ’তে যদি আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে অহেতুক ধাঁধা দূর হয় এবং নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসরণের প্রতি কারো মনে তাকীদ সৃষ্টি হয়, তবেই আমার এ শ্রম সার্থক বলে মনে করব।
ইতি-
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাং ৫ই জুলাই ১৯৭৯
সাং বুলারাটি
পোঃ আলীপুর, যেলাঃ খুলনা
(বর্তমানে যেলাঃ সাতক্ষীরা)।
এ প্রসঙ্গে পাক-ভারত উপমহাদেশে আহলেহাদীছের নেতৃত্বে পরিচালিত জিহাদ আন্দোলনের বীর সিপাহ্সালার সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী, শাহ ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা বেলায়েত আলী, মাওলানা এনায়েত আলী, সৈয়দ নিছার আলী তিতুমীর, হাজী শরী‘আতুল্লাহ্ প্রমুখের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
বাংলার সচেতন যুব সমাজের কাছে ইসলামের নির্ভেজাল রূপ তুলে ধরার যে দায়িত্ব নিয়ে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ তাদের অগ্রযাত্রা শুরু করেছে, আমি তাদের এ প্রচেষ্টাকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। আল্লাহ তাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন-আমীন!
অতঃপর আমি এতদ্বারা ঘোষণা করছি যে, শুধুমাত্র পরকালীন স্বার্থেই আমি আমার ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন’ বইটি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় কমিটিকে দান করলাম। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ যতদিন তার সাংগঠনিক ঐক্য ও কার্যক্রম বজায় রাখবে, ততদিন যাবত এ বইয়ের পূর্ণ স্বত্বাধিকারী তারাই থাকবে।
পরিশেষে এ বই দ্বারা পাঠকের মন হ’তে যদি আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে অহেতুক ধাঁধা দূর হয় এবং নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসরণের প্রতি কারো মনে তাকীদ সৃষ্টি হয়, তবেই আমার এ শ্রম সার্থক বলে মনে করব।
ইতি-
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাং ৫ই জুলাই ১৯৭৯
সাং বুলারাটি
পোঃ আলীপুর, যেলাঃ খুলনা
(বর্তমানে যেলাঃ সাতক্ষীরা)।
ফারসী সম্বন্ধ পদে ‘আহলেহাদীছ’ এবং আরবী সম্বন্ধ পদে ‘আহলুল হাদীছ’-এর আভিধানিক অর্থ : হাদীছের অনুসারী। পারিভাষিক অর্থ : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসারী। যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে নিঃশর্তভাবে মেনে নিবেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবায়ে কেরামের তরীক্বা অনুযায়ী নিজের সার্বিক জীবন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন, কেবলমাত্র তিনিই এ নামে অভিহিত হবেন।
ছাহাবায়ে কেরাম হ’লেন জামা‘আতে আহলেহাদীছের প্রথম সারির সম্মানিত দল, যাঁরা এ নামে অভিহিত হ’তেন। যেমন- (১) প্রখ্যাত ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) (মৃঃ ৭৪হিঃ) কোন মুসলিম যুবককে দেখলে খুশী হয়ে বলতেন,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّهُ كَانَ إِذَا رَأَى الشَّبَابَ قَالَ : مَرْحَبًا بِوَصِيَّةِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ نُوَسِّعَ لَكُمْ فِي الْمَجْلِسِ وَأَنْ نُفَهِّمَكُمُ الْحَدِيثَ فَإِنَّكُمْ خُلُوْفُنَا وَأَهْلُ الْحَدِيْثِ بَعْدَنَا -
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অছিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাকে ‘মারহাবা’ জানাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীছ বুঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও পরবর্তী ‘আহলেহাদীছ’।[1]
(১) খ্যাতনামা তাবেঈ ইমাম শা‘বী (২২-১০৪হিঃ) ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলতেন। যেমন একদা তিনি বলেন,
لَوِ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِيْ مَا اسْتَدْبَرْتُ مَا حَدَّثْتُ إِلاَّ مَا أَجْمَعَ عَلَيْهِ أَهْلُ الْحَدِيْثِ -
‘এখন যেসব ঘটছে, তা আগে জানলে আমি কোন হাদীছ বর্ণনা করতাম না, কেবল ঐ হাদীছ ব্যতীত, যার উপরে ‘আহলুল হাদীছ’ অর্থাৎ ছাহাবায়ে কেরাম একমত হয়েছেন’।[2]
(৩) ছাহাবায়ে কেরামের শিষ্যমন্ডলী তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন সকলে ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। ইবনু নাদীম (মৃঃ ৩৭০ হিঃ) তাঁর ‘কিতাবুল ফিহরিস্ত’ গ্রন্থে, ইমাম খত্বীব বাগদাদী (৩৯২-৪৬৩ হিঃ) স্বীয় ‘তারীখু বাগদাদ’ দ্বাদশ ও চতুর্দশ খন্ডে এবং ইমাম হেবাতুল্লাহ লালকাঈ (মৃঃ ৪১৮ হিঃ) স্বীয় ‘শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদ ...’ গ্রন্থে ছাহাবায়ে কেরাম হ’তে শুরু করে তাঁর যুগ পর্যন্ত তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম ও নেতৃবৃন্দের নামের বিরাট তালিকা দিয়েছেন। এতদ্ব্যতীত ‘আহলেহাদীছ-এর মর্যাদা’ শীর্ষক ‘শারফু আছহাবিল হাদীছ’ নামে ইমাম খত্বীব বাগদাদীর একটি পৃথক বইও রয়েছে।
(৪) ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ), ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ), ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ), ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) সকলেই ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। স্বীয় যুগে হাদীছ তেমন সংগৃহীত না হওয়ার ফলে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) অধিকহারে রায় ও ক্বিয়াসের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে তাঁকে إِمَامُ أَهْلِ الرَّأْىِ বা ‘আহলুর রায়দের ইমাম’ বলা হয়ে থাকে। তিনি নিজে কোন কেতাব লিখে যাননি। বরং শিষ্যদের অছিয়ত করে গিয়েছেন এই বলে যে, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘ইযা ছাহ্হাল হাদীছু ফাহুয়া মাযহাবী’ অর্থাৎ ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।[3]
(৫) একবার তিনি তাঁর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ)-কে বলেন, لاَ تَرْوِ عَنِّي شَيْئًا فَإِنِّىْ وَاللهِ مَا أَدْرِىْ مُخْطِئٌ أَنَا أَمْ مُصِيْبٌ؟ ‘তুমি আমার পক্ষ হ’তে কোন মাসআলা বর্ণনা কর না। আল্লাহর ক্বসম! আমি জানি না নিজ সিদ্ধান্তে আমি বেঠিক না সঠিক’।[4]
(৬) আরেকবার তিনি তাকে তাঁর বক্তব্য লিখতে দেখে ধমক দিয়ে বলেন,
وَيْكَ يَا يَعْقُوْبُ ! لاَ تَكْتُبْ كُلَّ مَا تَسْمَعُهُ مِنِّى فَإِنِّي قَدْ أَرَى الرَّأْيَ الْيَوْمَفَأَتْرُكُهُ غَدًا، وَ أَرَى الرَّأْىَ غَدًا وَ أَتْرُكُهُ بَعْدَ غَدٍ -
‘সাবধান হে ইয়াকূব (আবু ইউসুফ)! আমার নিকট থেকে যা-ই শোন, তাই-ই লিখে নিয়ো না। কেননা আমি আজকে যে রায় দেই, কালকে তা পরিত্যাগ করি; কাল যে রায় দেই, পরদিন তা প্রত্যাহার করি’।[5]
চার ইমামের সকলেই তাঁদের তাক্বলীদ তথা দ্বীনী বিষয়ে অন্ধ অনুসরণ বর্জন করে ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করার জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।[6] এ জন্য তাঁরা সবাই নিঃসন্দেহে ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। কিন্তু তাঁদের অনুসারী মুক্বাল্লিদগণ ইমামদের নির্দেশ উপেক্ষা করে পরবর্তীতে ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে তা এড়িয়ে গিয়ে স্ব স্ব মাযহাবী বিদ্বানদের রায় ও তাঁদের রচিত ফিক্বহ ও ফৎওয়াসমূহের অন্ধ অনুসারী হয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে এক ইমামের নামে অসংখ্য আলেমের রায়পন্থী ‘আহলুর রায়’ বনে গেছেন। এ জন্য অনুসারীগণ দায়ী হ’লেও ইমামগণ দায়ী নন। সেকারণ খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান আবদুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী (৮৯৮-৯৭৩ হিঃ) বলেন, فَالْإِمَامُ مَعْذُوْرٌ وَ أَتْبَاعُهُ غَيْرُ مَعْذُورِيْنَ ‘ইমামের ওযর আছে, কিন্তু অনুসারীদের জন্য কোন ওযর নেই’।[7]
ইমামদের ওযর আছে এজন্য যে, তাঁরা যে অনেক হাদীছ জানতেন না, সেকথা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে গেছেন ও পরবর্তীতে ছহীহ হাদীছ পেলে তা অনুসরণের জন্য সবাইকে তাকীদ দিয়ে বলে গিয়েছেন। কিন্তু অনুসারীদের কোন ওযর নেই এ কারণে যে, তারা ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ করেনি ও তার উপরে আমল করেনি। বরং তাদের মধ্যে এই অন্ধ বিশ্বাস দানা বেঁধে আছে যে, তাদের অনুসরণীয় ইমাম বা পীর সবকিছু জানেন। তাঁর ভুল হবার সম্ভাবনা নেই। এমনকি তাঁর ভুল হ’তে পারে, এমনটি চিন্তা করাও বে-আদবী। সেকারণ তাঁরা যেকোনভাবেই হৌক, ইমামের রায় বা মাযহাবী ফৎওয়াকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এমনকি এজন্য ছহীহ হাদীছকে বাদ দিতে হ’লেও কুছ পরওয়া নেই।
অথচ ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) স্বীয় ‘কিতাবুল মানখূলে’ বলেন যে, أَنَّهُمَا خَالَفَا أَبَا حَنِيْفَةَ فِىْ ثُلُثَىْ مَذْهَبِهِ ‘ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ) তাঁদের উস্তাদ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মাযহাবের দুই-তৃতীয়াংশের বিরোধিতা করেছেন’।[8] এতদ্ব্যতীত চার ইমামের নামে প্রচলিত ফৎওয়াসমূহ ও বিশেষ করে হানাফী ফিক্বহে বর্ণিত ক্বিয়াসী ফৎওয়াসমূহের সবটুকু অথবা অধিকাংশ ফৎওয়াই ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নয় বলে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী সহ বহু বিদ্বান মন্তব্য করেছেন।[9] শুধু ফিক্বহী বা ব্যবহারিক বিষয়েই নয় বরং উছূলে ফিক্বহ বা ব্যবহারিক আইন সূত্রসমূহেও উক্ত শিষ্যদ্বয় ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর বিরোধিতা করেছেন।[10] অতএব ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এবং অন্যান্য ইমামদের যেসব মাযহাব বর্তমানে চালু আছে, তার অধিকাংশ পরবর্তী যুগে দলীয় আলেমদের সৃষ্টি।
নিরপেক্ষভাবে হাদীছ অনুসরণের কারণে ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ), ইমাম মুসলিম (২০৪-২৬১ হিঃ), ইমাম নাসাঈ (২১৫-৩০৩ হিঃ), ইমাম আবু দাঊদ (২০২-২৭৫ হিঃ), ইমাম তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হিঃ), ইমাম ইবনু মাজাহ (২০৯-২৭৩ হিঃ), ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (১৬১-২৩৪ হিঃ), ইমাম ইসহাক্ব ইবনে রাহ্ওয়াইহ (১৬৬-২৩৮ হিঃ), ইমাম আবুবকর ইবনু আবী শায়বা (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), ইমাম দারেমী (১৮১-২৫৫ হিঃ), ইমাম আবু যুর‘আ রাযী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ), ইমাম ইবনু খুযায়মা (২২৩-৩১১ হিঃ), ইমাম দারাকুতনী (৩০৫-৩৮৫ হিঃ), ইমাম হাকেম (৩২১-৪০৫ হিঃ), ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮ হিঃ), ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বাগাভী (৪৩৬-৫১৬ হিঃ) প্রমুখ হাদীছ শাস্ত্রের জগদ্বিখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দেছীনে কেরাম এবং তাঁদের শিষ্যবর্গ ও অনুসারীবৃন্দ সকলেই ‘আহলুল হাদীছ’ ছিলেন।
[1]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ (লাহোর : রিপন প্রেস, তারিখ বিহীন), পৃঃ ১২; হাকেম একে ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। -আল-মুস্তাদরাক ১/৮৮ পৃঃ; আলবানী, সিলসিলা ছহীহা হা/২৮০।
[2]. শামসুদ্দীন যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৮৩ পৃঃ।
[3]. ইবনু আবেদীন, শামী হাশিয়া রাদ্দুল মুহতার (বৈরুত : দারুল ফিক্র ১৩৯৯/১৯৭৯) ১/৬৭ পৃঃ; আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী : ১২৮৬ হিঃ) ১/৩০ পৃঃ।
[4]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ ১৩/৪০২ পৃঃ।
[5]. প্রাগুক্ত; থিসিস পৃঃ ১৭৯, টীকা ৪৮।
[6]. আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী: ১২৮৬ হিঃ) ১/৬০।
[7]. প্রাগুক্ত ১/৭৩ পৃঃ।
[8]. শারহু বেকায়াহ-এর মুক্বাদ্দামাহ (দিল্লী ছাপা ১৩২৭) পৃঃ ২৮, শেষ লাইন; ঐ, দেউবন্দ ছাপা, তাবি, পৃঃ ৮।
[9]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো: ১৩৫৫ হিঃ) ১/১৬০; ছালেহ ফুল্লানী, ঈক্বাযু হিমাম পৃঃ ৯৯; ‘তালবীহ’-এর বরাতে মোল্লা মুঈন সিন্ধী, দিরাসাতুল লাবীব (লাহোর: ১২৮৪ হিঃ) পৃঃ ১৮৩, ২৯০, ২৯১; আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী, নাফে’ কাবীর পৃঃ ১৩ প্রভৃতি; দ্রঃ থিসিস পৃঃ ১৮০, টীকা ৫৯, ৬০।
[10]. ( فَإِنَّهُمَا يُخَالِفَانِ أُصُوْلَ صَاحِبِهِمَا ) সুবকী, ‘ত্বাবাক্বাতুশ শাফেঈয়াহ কুবরা’ (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/২৪৩ পৃঃ।
ছাহাবায়ে কেরাম হ’লেন জামা‘আতে আহলেহাদীছের প্রথম সারির সম্মানিত দল, যাঁরা এ নামে অভিহিত হ’তেন। যেমন- (১) প্রখ্যাত ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) (মৃঃ ৭৪হিঃ) কোন মুসলিম যুবককে দেখলে খুশী হয়ে বলতেন,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّهُ كَانَ إِذَا رَأَى الشَّبَابَ قَالَ : مَرْحَبًا بِوَصِيَّةِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ نُوَسِّعَ لَكُمْ فِي الْمَجْلِسِ وَأَنْ نُفَهِّمَكُمُ الْحَدِيثَ فَإِنَّكُمْ خُلُوْفُنَا وَأَهْلُ الْحَدِيْثِ بَعْدَنَا -
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অছিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাকে ‘মারহাবা’ জানাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীছ বুঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও পরবর্তী ‘আহলেহাদীছ’।[1]
(১) খ্যাতনামা তাবেঈ ইমাম শা‘বী (২২-১০৪হিঃ) ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলতেন। যেমন একদা তিনি বলেন,
لَوِ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِيْ مَا اسْتَدْبَرْتُ مَا حَدَّثْتُ إِلاَّ مَا أَجْمَعَ عَلَيْهِ أَهْلُ الْحَدِيْثِ -
‘এখন যেসব ঘটছে, তা আগে জানলে আমি কোন হাদীছ বর্ণনা করতাম না, কেবল ঐ হাদীছ ব্যতীত, যার উপরে ‘আহলুল হাদীছ’ অর্থাৎ ছাহাবায়ে কেরাম একমত হয়েছেন’।[2]
(৩) ছাহাবায়ে কেরামের শিষ্যমন্ডলী তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন সকলে ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। ইবনু নাদীম (মৃঃ ৩৭০ হিঃ) তাঁর ‘কিতাবুল ফিহরিস্ত’ গ্রন্থে, ইমাম খত্বীব বাগদাদী (৩৯২-৪৬৩ হিঃ) স্বীয় ‘তারীখু বাগদাদ’ দ্বাদশ ও চতুর্দশ খন্ডে এবং ইমাম হেবাতুল্লাহ লালকাঈ (মৃঃ ৪১৮ হিঃ) স্বীয় ‘শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদ ...’ গ্রন্থে ছাহাবায়ে কেরাম হ’তে শুরু করে তাঁর যুগ পর্যন্ত তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম ও নেতৃবৃন্দের নামের বিরাট তালিকা দিয়েছেন। এতদ্ব্যতীত ‘আহলেহাদীছ-এর মর্যাদা’ শীর্ষক ‘শারফু আছহাবিল হাদীছ’ নামে ইমাম খত্বীব বাগদাদীর একটি পৃথক বইও রয়েছে।
(৪) ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ), ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ), ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ), ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) সকলেই ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। স্বীয় যুগে হাদীছ তেমন সংগৃহীত না হওয়ার ফলে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) অধিকহারে রায় ও ক্বিয়াসের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে তাঁকে إِمَامُ أَهْلِ الرَّأْىِ বা ‘আহলুর রায়দের ইমাম’ বলা হয়ে থাকে। তিনি নিজে কোন কেতাব লিখে যাননি। বরং শিষ্যদের অছিয়ত করে গিয়েছেন এই বলে যে, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘ইযা ছাহ্হাল হাদীছু ফাহুয়া মাযহাবী’ অর্থাৎ ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।[3]
(৫) একবার তিনি তাঁর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ)-কে বলেন, لاَ تَرْوِ عَنِّي شَيْئًا فَإِنِّىْ وَاللهِ مَا أَدْرِىْ مُخْطِئٌ أَنَا أَمْ مُصِيْبٌ؟ ‘তুমি আমার পক্ষ হ’তে কোন মাসআলা বর্ণনা কর না। আল্লাহর ক্বসম! আমি জানি না নিজ সিদ্ধান্তে আমি বেঠিক না সঠিক’।[4]
(৬) আরেকবার তিনি তাকে তাঁর বক্তব্য লিখতে দেখে ধমক দিয়ে বলেন,
وَيْكَ يَا يَعْقُوْبُ ! لاَ تَكْتُبْ كُلَّ مَا تَسْمَعُهُ مِنِّى فَإِنِّي قَدْ أَرَى الرَّأْيَ الْيَوْمَفَأَتْرُكُهُ غَدًا، وَ أَرَى الرَّأْىَ غَدًا وَ أَتْرُكُهُ بَعْدَ غَدٍ -
‘সাবধান হে ইয়াকূব (আবু ইউসুফ)! আমার নিকট থেকে যা-ই শোন, তাই-ই লিখে নিয়ো না। কেননা আমি আজকে যে রায় দেই, কালকে তা পরিত্যাগ করি; কাল যে রায় দেই, পরদিন তা প্রত্যাহার করি’।[5]
চার ইমামের সকলেই তাঁদের তাক্বলীদ তথা দ্বীনী বিষয়ে অন্ধ অনুসরণ বর্জন করে ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করার জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।[6] এ জন্য তাঁরা সবাই নিঃসন্দেহে ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। কিন্তু তাঁদের অনুসারী মুক্বাল্লিদগণ ইমামদের নির্দেশ উপেক্ষা করে পরবর্তীতে ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে তা এড়িয়ে গিয়ে স্ব স্ব মাযহাবী বিদ্বানদের রায় ও তাঁদের রচিত ফিক্বহ ও ফৎওয়াসমূহের অন্ধ অনুসারী হয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে এক ইমামের নামে অসংখ্য আলেমের রায়পন্থী ‘আহলুর রায়’ বনে গেছেন। এ জন্য অনুসারীগণ দায়ী হ’লেও ইমামগণ দায়ী নন। সেকারণ খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান আবদুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী (৮৯৮-৯৭৩ হিঃ) বলেন, فَالْإِمَامُ مَعْذُوْرٌ وَ أَتْبَاعُهُ غَيْرُ مَعْذُورِيْنَ ‘ইমামের ওযর আছে, কিন্তু অনুসারীদের জন্য কোন ওযর নেই’।[7]
ইমামদের ওযর আছে এজন্য যে, তাঁরা যে অনেক হাদীছ জানতেন না, সেকথা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে গেছেন ও পরবর্তীতে ছহীহ হাদীছ পেলে তা অনুসরণের জন্য সবাইকে তাকীদ দিয়ে বলে গিয়েছেন। কিন্তু অনুসারীদের কোন ওযর নেই এ কারণে যে, তারা ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ করেনি ও তার উপরে আমল করেনি। বরং তাদের মধ্যে এই অন্ধ বিশ্বাস দানা বেঁধে আছে যে, তাদের অনুসরণীয় ইমাম বা পীর সবকিছু জানেন। তাঁর ভুল হবার সম্ভাবনা নেই। এমনকি তাঁর ভুল হ’তে পারে, এমনটি চিন্তা করাও বে-আদবী। সেকারণ তাঁরা যেকোনভাবেই হৌক, ইমামের রায় বা মাযহাবী ফৎওয়াকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এমনকি এজন্য ছহীহ হাদীছকে বাদ দিতে হ’লেও কুছ পরওয়া নেই।
অথচ ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) স্বীয় ‘কিতাবুল মানখূলে’ বলেন যে, أَنَّهُمَا خَالَفَا أَبَا حَنِيْفَةَ فِىْ ثُلُثَىْ مَذْهَبِهِ ‘ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ) তাঁদের উস্তাদ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মাযহাবের দুই-তৃতীয়াংশের বিরোধিতা করেছেন’।[8] এতদ্ব্যতীত চার ইমামের নামে প্রচলিত ফৎওয়াসমূহ ও বিশেষ করে হানাফী ফিক্বহে বর্ণিত ক্বিয়াসী ফৎওয়াসমূহের সবটুকু অথবা অধিকাংশ ফৎওয়াই ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নয় বলে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী সহ বহু বিদ্বান মন্তব্য করেছেন।[9] শুধু ফিক্বহী বা ব্যবহারিক বিষয়েই নয় বরং উছূলে ফিক্বহ বা ব্যবহারিক আইন সূত্রসমূহেও উক্ত শিষ্যদ্বয় ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর বিরোধিতা করেছেন।[10] অতএব ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এবং অন্যান্য ইমামদের যেসব মাযহাব বর্তমানে চালু আছে, তার অধিকাংশ পরবর্তী যুগে দলীয় আলেমদের সৃষ্টি।
নিরপেক্ষভাবে হাদীছ অনুসরণের কারণে ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ), ইমাম মুসলিম (২০৪-২৬১ হিঃ), ইমাম নাসাঈ (২১৫-৩০৩ হিঃ), ইমাম আবু দাঊদ (২০২-২৭৫ হিঃ), ইমাম তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হিঃ), ইমাম ইবনু মাজাহ (২০৯-২৭৩ হিঃ), ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (১৬১-২৩৪ হিঃ), ইমাম ইসহাক্ব ইবনে রাহ্ওয়াইহ (১৬৬-২৩৮ হিঃ), ইমাম আবুবকর ইবনু আবী শায়বা (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), ইমাম দারেমী (১৮১-২৫৫ হিঃ), ইমাম আবু যুর‘আ রাযী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ), ইমাম ইবনু খুযায়মা (২২৩-৩১১ হিঃ), ইমাম দারাকুতনী (৩০৫-৩৮৫ হিঃ), ইমাম হাকেম (৩২১-৪০৫ হিঃ), ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮ হিঃ), ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বাগাভী (৪৩৬-৫১৬ হিঃ) প্রমুখ হাদীছ শাস্ত্রের জগদ্বিখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দেছীনে কেরাম এবং তাঁদের শিষ্যবর্গ ও অনুসারীবৃন্দ সকলেই ‘আহলুল হাদীছ’ ছিলেন।
[1]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ (লাহোর : রিপন প্রেস, তারিখ বিহীন), পৃঃ ১২; হাকেম একে ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। -আল-মুস্তাদরাক ১/৮৮ পৃঃ; আলবানী, সিলসিলা ছহীহা হা/২৮০।
[2]. শামসুদ্দীন যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৮৩ পৃঃ।
[3]. ইবনু আবেদীন, শামী হাশিয়া রাদ্দুল মুহতার (বৈরুত : দারুল ফিক্র ১৩৯৯/১৯৭৯) ১/৬৭ পৃঃ; আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী : ১২৮৬ হিঃ) ১/৩০ পৃঃ।
[4]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ ১৩/৪০২ পৃঃ।
[5]. প্রাগুক্ত; থিসিস পৃঃ ১৭৯, টীকা ৪৮।
[6]. আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী: ১২৮৬ হিঃ) ১/৬০।
[7]. প্রাগুক্ত ১/৭৩ পৃঃ।
[8]. শারহু বেকায়াহ-এর মুক্বাদ্দামাহ (দিল্লী ছাপা ১৩২৭) পৃঃ ২৮, শেষ লাইন; ঐ, দেউবন্দ ছাপা, তাবি, পৃঃ ৮।
[9]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো: ১৩৫৫ হিঃ) ১/১৬০; ছালেহ ফুল্লানী, ঈক্বাযু হিমাম পৃঃ ৯৯; ‘তালবীহ’-এর বরাতে মোল্লা মুঈন সিন্ধী, দিরাসাতুল লাবীব (লাহোর: ১২৮৪ হিঃ) পৃঃ ১৮৩, ২৯০, ২৯১; আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী, নাফে’ কাবীর পৃঃ ১৩ প্রভৃতি; দ্রঃ থিসিস পৃঃ ১৮০, টীকা ৫৯, ৬০।
[10]. ( فَإِنَّهُمَا يُخَالِفَانِ أُصُوْلَ صَاحِبِهِمَا ) সুবকী, ‘ত্বাবাক্বাতুশ শাফেঈয়াহ কুবরা’ (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/২৪৩ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত এবং ছাহাবী ও তাবেঈগণের জামা‘আতের অনুসারী ব্যক্তিকে ‘আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ বলা হয়। এক্ষণে আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচয় দিতে গিয়ে স্পেনের বিশ্বখ্যাত মনীষী হিজরী পঞ্চম শতকের ইমাম আবু মুহাম্মাদ আলী ইবনু আহমাদ ইবনু হায্ম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) বলেন,
وَأَهْلُ السُّنَّةِ الَّذِيْنَ نَذْكُرُهُمْ أَهْلَ الْحَقِّ وَ مَنْ عَدَاهُمْ فَأَهْلُ الْبَاطِلِ فَإِنَّهُمُ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَ كُلُّ مَنْ سَلَكَ نَهْجَهُمْ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِيْنَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ ثُمَّ أَهْلُ الْحَدِيْثِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْفُقَهَاءِ جِيْلاً فَجِيْلاً إِلَى يَوْمِنَا هذَا وَ مَنِ اقْتَدَى بِهِمْ مِنَ الْعَوَامِ فِى شَرْقِ الْأَرْضِ وَ غَرْبِهَا رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ -
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত- যাদেরকে আমরা হক্বপন্থী ও তাদের বিরোধী পক্ষকে বাতিলপন্থী বলেছি, তাঁরা হ’লেন (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত (ঙ) এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন।[1]
এর দ্বারা বুঝা গেল যে, ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম, মুহাদ্দেছীন ও হাদীছপন্থী ফকীহগণই কেবল আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বা ‘আহলুল হাদীছ’ ছিলেন না, বরং তাঁদের তরীক্বার অনুসারী ‘আম জনসাধারণও ‘আহলুল হাদীছ’ নামে সকল যুগে কথিত হ’তেন বা আজও হয়ে থাকেন। আল্লাহ পাক বলেন, وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُوْنَ بِالْحَقِّ وَ بِهِ يَعْدِلُوْنَ ‘আমার সৃষ্টির (মানুষের) মধ্যে একটি দল আছে, যারা হক্ব পথে চলে ও সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে’ (আ‘রাফ ১৮১)। অন্যত্র তিনি বলেন, قَلِيْلٌ مِنْ عِبَادِىَ الشَّكُوْرُ ‘আমার কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা কম’ (সাবা ১৩)।
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রত্যেক নবীর উম্মতের মধ্যে হক্বপন্থী একদল উম্মত চিরদিন ছিলেন, আজও আছেন; যদিও তারা সংখ্যায় কম হবেন। এমনকি কোন কোন নবীকে তার উম্মতের মধ্যে একজন মাত্র ব্যক্তি সত্য বলে বিশ্বাস করবেন।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের উম্মত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন,
عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَالِكَ، رَوَاهُ مُسْلِمٌ -
(লা তাযা-লু ত্বা-য়েফাতুম মিন উম্মাতী যা-হিরীনা ‘আলাল হাক্বক্বে, লা ইয়াযুররুহুম মান খাযালাহুম, হাত্তা ইয়া’তিয়া আমরুল্লা-হি ওয়াহুম কাযা-লিকা’)
অর্থ : ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[3] অর্থাৎ নিতান্ত অল্প সংখ্যক হ’লেও ক্বিয়ামত পূর্বকাল পর্যন্ত হক্বপন্থী দলের অস্তিত্ব থাকবে এবং তাঁরাই হবেন সত্যিকার অর্থে বিজয়ী দল। উল্লেখ্য যে, হাদীছে বিজয়ী দল বলতে আখেরাতে বিজয়ী বুঝানো হয়েছে, দুনিয়াবী বিজয় নয়। নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) কেউই দুনিয়াবী দিক দিয়ে বিজয়ী ছিলেন না। তথাপি তাঁরাই ছিলেন প্রকৃত বিজয়ী, হক্বপন্থী ও বিশ্ব মানবতার আদর্শ পুরুষ।
এক্ষণে ‘হক্ব’ কোথায় পাওয়া যাবে? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا -
‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন ‘হক্ব’ তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে আসে। অতঃপর যে চায় সেটা বিশ্বাস করুক, যে চায় সেটা অবিশ্বাস করুক। আমরা সীমা লংঘনকারীদের জন্য জাহান্নাম তৈরী করে রেখেছি...’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)।
উক্ত আয়াতের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, মানুষের চিন্তাপ্রসূত কোন ইযম, মাযহাব, মতবাদ বা তরীক্বা কখনই চূড়ান্ত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। এ সত্য পাওয়া যাবে কেবলমাত্র আল্লাহ প্রেরিত ‘অহি’র মধ্যে, যা সংরক্ষিত আছে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছসমূহের মধ্যে। এদিকে ইঙ্গিত করেই ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, فَلَيْسَ لِلْعَقْلِ حُكْمٌ فِى حُسْنِ الْأَشْيَاءِ وَ قُبْحِهَا ‘কোন বস্ত্তর চূড়ান্ত ভাল ও মন্দ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দানের ক্ষমতা ‘জ্ঞান’-এর নেই’।[4] তাই সবকিছুর বিনিময়ে যারা সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী থাকবেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী কেবল তারাই হবেন উম্মতের হক্বপন্থী ‘নাজী’ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِى مَا أَتَى عَلَى بَنِى إِسْرَائِيلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ ... وَإِنَّ بَنِى إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِى عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِى النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَ فِىْ رِوَايَةٍ لِّلْحَاكِمِ فِىْ مُسْتَدْرَكِهِ : مَا أَنَا عَلَيْهِ الْيَوْمَ وَ أَصْحَابِىْ، وَحَسَّنَهُمَا الْأَلْبَانِىُّ -
‘বনু ইসরাঈলদের (ইহুদী-নাছারাদের) যেমন অবস্থা হয়েছিল, আমার উম্মতেরও ঠিক তেমন অবস্থা হবে। যেমন এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার ঠিক সমান হয়। ... বনু ইসরাঈলগণ ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের সব দলই জাহান্নামে যাবে একটি দল ব্যতীত। ছহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সে দল কোন্টি? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি, তার উপরে যে দল থাকবে’। হাকেম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ‘আমি ও আমার ছাহাবীগণ আজকের দিনে যার উপরে আছি’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَهِىَ الْجَمَاعَةُ ‘সেটি হ’ল জামা‘আত’।[6] উক্ত জামা‘আত বলতে কী বুঝায় এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, اَلْجَمَاعَةُ مَا وَافَقَ الْحَقَّ وَإِنْ كُنْتَ وَحْدَكَ ‘হক্ব’-এর অনুসারী দলই হ’ল জামা‘আত, যদিও তুমি একাকী হও’।[7] এক্ষণে সেই হক্বপন্থী জামা‘আত বা ‘নাজী’ দল কোন্টি, সে সম্পর্কে বিগত ওলামায়ে দ্বীন ও সালাফে ছালেহীনের অভিমত শ্রবণ করব।
[1]. আলী ইবনু হাযম, কিতাবুল ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল (বৈরুত: মাকাতাবা খাইয়াত্ব ১৩২১/১৯০৩) শহরস্তানীর ‘মিলাল’ সহ ২/১১৩ পৃ: কিতাবুল ফিছাল (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৪২০/১৯৯৯) ১/৩৭১ পৃঃ ‘ইসলামী ফের্কাসমূহ’ অধ্যায়।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৪ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।
[3]. ছহীহ মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায় ৩৩, অনুচ্ছেদ ৫৩, হা/১৯২০; অত্র হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ ঐ, দেউবন্দ ছাপা শরহ নববী ২/১৪৩ পৃঃ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১ ‘ইল্ম’ অধ্যায় ও হা/৭৩১১-এর ভাষ্য ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা।
[4]. শাহ অলিউল্লাহ, আল-‘আক্বীদাতুল হাসানাহ (দিল্লী ছাপা: ১৩০৪ হিঃ/১৮৮৪ খৃঃ) পৃঃ ৫; থিসিস পৃঃ ১১৩ টীকা ১১ (ক)।
[5]. সনদ হাসান, আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/২১২৯; ঐ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩৪৮; হাকেম ১/১২৯ পৃঃ; আলবানী, মিশকাত হা/১৭১ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[6]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৭২ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[7]. ইবনু ‘আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব, সনদ ছহীহ, আলবানী মিশকাত হা/১৭৩-এর টীকা নং ৫ দ্রষ্টব্য।
وَأَهْلُ السُّنَّةِ الَّذِيْنَ نَذْكُرُهُمْ أَهْلَ الْحَقِّ وَ مَنْ عَدَاهُمْ فَأَهْلُ الْبَاطِلِ فَإِنَّهُمُ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَ كُلُّ مَنْ سَلَكَ نَهْجَهُمْ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِيْنَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ ثُمَّ أَهْلُ الْحَدِيْثِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْفُقَهَاءِ جِيْلاً فَجِيْلاً إِلَى يَوْمِنَا هذَا وَ مَنِ اقْتَدَى بِهِمْ مِنَ الْعَوَامِ فِى شَرْقِ الْأَرْضِ وَ غَرْبِهَا رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ -
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত- যাদেরকে আমরা হক্বপন্থী ও তাদের বিরোধী পক্ষকে বাতিলপন্থী বলেছি, তাঁরা হ’লেন (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত (ঙ) এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন।[1]
এর দ্বারা বুঝা গেল যে, ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম, মুহাদ্দেছীন ও হাদীছপন্থী ফকীহগণই কেবল আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বা ‘আহলুল হাদীছ’ ছিলেন না, বরং তাঁদের তরীক্বার অনুসারী ‘আম জনসাধারণও ‘আহলুল হাদীছ’ নামে সকল যুগে কথিত হ’তেন বা আজও হয়ে থাকেন। আল্লাহ পাক বলেন, وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُوْنَ بِالْحَقِّ وَ بِهِ يَعْدِلُوْنَ ‘আমার সৃষ্টির (মানুষের) মধ্যে একটি দল আছে, যারা হক্ব পথে চলে ও সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে’ (আ‘রাফ ১৮১)। অন্যত্র তিনি বলেন, قَلِيْلٌ مِنْ عِبَادِىَ الشَّكُوْرُ ‘আমার কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা কম’ (সাবা ১৩)।
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রত্যেক নবীর উম্মতের মধ্যে হক্বপন্থী একদল উম্মত চিরদিন ছিলেন, আজও আছেন; যদিও তারা সংখ্যায় কম হবেন। এমনকি কোন কোন নবীকে তার উম্মতের মধ্যে একজন মাত্র ব্যক্তি সত্য বলে বিশ্বাস করবেন।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের উম্মত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন,
عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَالِكَ، رَوَاهُ مُسْلِمٌ -
(লা তাযা-লু ত্বা-য়েফাতুম মিন উম্মাতী যা-হিরীনা ‘আলাল হাক্বক্বে, লা ইয়াযুররুহুম মান খাযালাহুম, হাত্তা ইয়া’তিয়া আমরুল্লা-হি ওয়াহুম কাযা-লিকা’)
অর্থ : ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[3] অর্থাৎ নিতান্ত অল্প সংখ্যক হ’লেও ক্বিয়ামত পূর্বকাল পর্যন্ত হক্বপন্থী দলের অস্তিত্ব থাকবে এবং তাঁরাই হবেন সত্যিকার অর্থে বিজয়ী দল। উল্লেখ্য যে, হাদীছে বিজয়ী দল বলতে আখেরাতে বিজয়ী বুঝানো হয়েছে, দুনিয়াবী বিজয় নয়। নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) কেউই দুনিয়াবী দিক দিয়ে বিজয়ী ছিলেন না। তথাপি তাঁরাই ছিলেন প্রকৃত বিজয়ী, হক্বপন্থী ও বিশ্ব মানবতার আদর্শ পুরুষ।
এক্ষণে ‘হক্ব’ কোথায় পাওয়া যাবে? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا -
‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন ‘হক্ব’ তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে আসে। অতঃপর যে চায় সেটা বিশ্বাস করুক, যে চায় সেটা অবিশ্বাস করুক। আমরা সীমা লংঘনকারীদের জন্য জাহান্নাম তৈরী করে রেখেছি...’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)।
উক্ত আয়াতের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, মানুষের চিন্তাপ্রসূত কোন ইযম, মাযহাব, মতবাদ বা তরীক্বা কখনই চূড়ান্ত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। এ সত্য পাওয়া যাবে কেবলমাত্র আল্লাহ প্রেরিত ‘অহি’র মধ্যে, যা সংরক্ষিত আছে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছসমূহের মধ্যে। এদিকে ইঙ্গিত করেই ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, فَلَيْسَ لِلْعَقْلِ حُكْمٌ فِى حُسْنِ الْأَشْيَاءِ وَ قُبْحِهَا ‘কোন বস্ত্তর চূড়ান্ত ভাল ও মন্দ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দানের ক্ষমতা ‘জ্ঞান’-এর নেই’।[4] তাই সবকিছুর বিনিময়ে যারা সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী থাকবেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী কেবল তারাই হবেন উম্মতের হক্বপন্থী ‘নাজী’ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِى مَا أَتَى عَلَى بَنِى إِسْرَائِيلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ ... وَإِنَّ بَنِى إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِى عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِى النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَ فِىْ رِوَايَةٍ لِّلْحَاكِمِ فِىْ مُسْتَدْرَكِهِ : مَا أَنَا عَلَيْهِ الْيَوْمَ وَ أَصْحَابِىْ، وَحَسَّنَهُمَا الْأَلْبَانِىُّ -
‘বনু ইসরাঈলদের (ইহুদী-নাছারাদের) যেমন অবস্থা হয়েছিল, আমার উম্মতেরও ঠিক তেমন অবস্থা হবে। যেমন এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার ঠিক সমান হয়। ... বনু ইসরাঈলগণ ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের সব দলই জাহান্নামে যাবে একটি দল ব্যতীত। ছহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সে দল কোন্টি? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি, তার উপরে যে দল থাকবে’। হাকেম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ‘আমি ও আমার ছাহাবীগণ আজকের দিনে যার উপরে আছি’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَهِىَ الْجَمَاعَةُ ‘সেটি হ’ল জামা‘আত’।[6] উক্ত জামা‘আত বলতে কী বুঝায় এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, اَلْجَمَاعَةُ مَا وَافَقَ الْحَقَّ وَإِنْ كُنْتَ وَحْدَكَ ‘হক্ব’-এর অনুসারী দলই হ’ল জামা‘আত, যদিও তুমি একাকী হও’।[7] এক্ষণে সেই হক্বপন্থী জামা‘আত বা ‘নাজী’ দল কোন্টি, সে সম্পর্কে বিগত ওলামায়ে দ্বীন ও সালাফে ছালেহীনের অভিমত শ্রবণ করব।
[1]. আলী ইবনু হাযম, কিতাবুল ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল (বৈরুত: মাকাতাবা খাইয়াত্ব ১৩২১/১৯০৩) শহরস্তানীর ‘মিলাল’ সহ ২/১১৩ পৃ: কিতাবুল ফিছাল (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৪২০/১৯৯৯) ১/৩৭১ পৃঃ ‘ইসলামী ফের্কাসমূহ’ অধ্যায়।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৪ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।
[3]. ছহীহ মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায় ৩৩, অনুচ্ছেদ ৫৩, হা/১৯২০; অত্র হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ ঐ, দেউবন্দ ছাপা শরহ নববী ২/১৪৩ পৃঃ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১ ‘ইল্ম’ অধ্যায় ও হা/৭৩১১-এর ভাষ্য ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা।
[4]. শাহ অলিউল্লাহ, আল-‘আক্বীদাতুল হাসানাহ (দিল্লী ছাপা: ১৩০৪ হিঃ/১৮৮৪ খৃঃ) পৃঃ ৫; থিসিস পৃঃ ১১৩ টীকা ১১ (ক)।
[5]. সনদ হাসান, আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/২১২৯; ঐ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩৪৮; হাকেম ১/১২৯ পৃঃ; আলবানী, মিশকাত হা/১৭১ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[6]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৭২ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[7]. ইবনু ‘আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব, সনদ ছহীহ, আলবানী মিশকাত হা/১৭৩-এর টীকা নং ৫ দ্রষ্টব্য।
১. ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ)-এর উস্তাদ আলী ইবনুল মাদীনী (১৬১-২৩৪ হিঃ) বলেন,
هُمْ أَهْلُ الْحَدِيْثِ وَالَّذِيْنَ يَتَعَاهَدُوْنَ مَذَاهِبَ الرَّسُوْلِ وَ يَذُبُّوْنَ عَنِ الْعِلْمِ، وَ لَوْلاَ هُمْ لَمْ نَجِدْ عَنِ الْمُعْتَزِلَةِ وَالرَّافِضَةِ وَالْجَهْمِيَّةِ وَأَهْلِ الْإِرْجَاءِ وَالرَّأْىِ شَيْئًا مِّنَ السُّنَنِ، فَقَدْ جَعَلَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ الطَّائِفَةَ الْمَنْصُوْرَةَ حُرَّاسَ الدِّيْنِ وَ صَرَفَ عَنْهُمْ كَيْدَ الْمُعَانِدِيْنَ لِتَمَسُّكِهِمْ بِالشَّرْعِ الْمَتِيْنِ وَاقْتِفَائِهِمْ آثَارَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ ... اُوْلَئِكَ حِزْبُ اللهِ أَلاَ إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ -
‘উক্ত দল হ’ল ‘আহলুল হাদীছ জামা‘আত’। যারা রাসূলের বিধানসমূহের হেফাযত করে ও তাঁর ইল্ম কুরআন ও হাদীছের পক্ষে প্রতিরোধ করে। নইলে মু‘তাযিলা, রাফেযী (শী‘আ), জাহমিয়া, মুরজিয়া ও আহলুর রায়দের নিকট থেকে আমরা সুন্নাতের কিছুই আশা করতে পারি না। বিশ্বপ্রভু এই বিজয়ী দলকে দ্বীনের পাহারাদার হিসাবে নিযুক্ত করেছেন এবং ছাহাবা ও তাবেঈনের সনিষ্ঠ অনুসারী হবার কারণে তাদেরকে হঠকারীদের চক্রান্তসমূহ হ’তে রক্ষা করেছেন। .. এরাই হ’লেন আল্লাহর সেনাবাহিনী। নিশ্চয়ই আল্লাহর সেনাদলই হ’ল সফলকাম’ (শারফ ৫)।
২. ইয়াযীদ ইবনে হারূণ (১১৮-২১৭ হিঃ) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (১৬৪-২৪১হিঃ) বলেন, إِنْ لَّمْ يَكُوْنُوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ فَلاَ أَدْرِىْ مَنْ هُمْ ؟ ‘তাঁরা যদি আহলেহাদীছ না হন, তবে আমি জানি না তারা কারা’।[1] ইমাম বুখারীও এবিষয়ে দৃঢ়মত ব্যক্ত করেছেন’। ক্বাযী আয়ায বলেন, أَرَادَ أَحْمَدُ أَهْلَ السُّنَّةِ وَمَنْ يَّعْتَقِدُ مَذْهَبَ أَهْلِ الْحَدِيْثِ ‘ইমাম আহমাদ (রহঃ) একথা দ্বারা আহলে সুন্নাত এবং যারা আহলুল হাদীছ-এর মাযহাব অনুসরণ করে, তাদেরকে বুঝিয়েছেন’।[2] ইমাম আহমাদ (রহঃ) আরও বলেন, لَيْسَ قَوْمٌ عِنْدِىْ خَيْراً مِّنْ أَهْلِ الْحَدِيْثِ، لاَ يَعْرِفُوْنَ إِلاَّ الْحَدِيْثَ ‘আহলেহাদীছের চেয়ে উত্তম কোন দল আমার কাছে নেই। তারা হাদীছ ছাড়া অন্য কিছু চেনে না’।[3]
৩. ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ) বলেন,
إِذَا رَأَيْتُ رَجُلاً مِّنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَيًّا -
‘যখন আমি কোন আহলেহাদীছকে দেখি, তখন আমি যেন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জীবন্ত দেখি’ (শারফ ২৬)।
৪. খ্যাতনামা তাবেঈ আব্দুল্লাহ বইনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) বলেন,
هُمْ عِنْدِىْ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ قَالَ : أَثْبَتُ النَّاسِ عَلَى الصِّرَاطِ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ -
‘নাজী দল হ’ল আহলেহাদীছ জামা‘আত’।... লোকদের মধ্যে তারাই ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর উপর সর্বাপেক্ষা দৃঢ়’ (শারফ ১৫, ৩৩)।
৫. ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ) একদা তাঁর দরবার সন্মুখে কতিপয় আহলেহাদীছকে দেখে উল্লসিত হয়ে বলেন, مَا عَلَى الْأَرْضِ خَيْرٌ مِّنْكُمْ ‘ভূপৃষ্ঠে আপনাদের চেয়ে উত্তম আর কেউ নেই’ (শারফ ২৮)।
৬. আহমাদ ইবনু সারীহ বলতেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الْفُقَهَاءِ لِاِعْتِنَائِهِمْ بِضَبْطِ الْأُصُوْلِ - ‘দলীলের উপরে কায়েম থাকার কারণে আহলেহাদীছগণের মর্যাদা ফক্বীহগণের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে।[4]
৭. ইমাম আবুদাঊদ (২০২-২৭৫ হিঃ) বলেন, لَوْلاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لَانْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ يَعْنِىْ أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ - ‘আহলেহাদীছ জামা‘আত যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’ (শারফ ২৯ পৃঃ)।
৮. ওছমান ইবনু আবী শায়বা একদা কয়েকজন আহলেহাদীছকে হয়রান অবস্থায় দেখে মন্তব্য করেন যে, إنَّ فَاسِقَهُمْ خَيْرٌ مِنْ عَابِدِ غَيْرِهِمْ ‘আহলেহাদীছের একজন ফাসিক্ব ব্যক্তি অন্য দলের একজন আবিদের চেয়েও উত্তম’ (শারফ ২৭ পৃঃ)।
৯. খলীফা হারূনুর রশীদ (মৃঃ ১৯৩ হিঃ) বলতেন,
طَلَبْتُ أَرْبَعَةً فَوَجَدْتُهَا فِىْ أَرْبَعَةٍ : طَلَبْتُ الْكُفْرَ فَوَجَدْتُّهُ فِى الْجَهْمِيَّةِ وَ طَلَبْتُ الْكَلاَمَ وَ الشَّغَبَ فَوَجَدْتُّهُ فِى الْمُعْتَزِلَةِ وَطَلَبْتُ الْكِذْبَ فَوَجَدْتُّهُ عِنْدَ الرَّافِضَةِ وَ طَلَبْتُ الْحَقَّ فَوَجَدْتُّهُ مَعَ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ -
‘আমি মুসলমানদের চারটি দলের মধ্যে চারটি বস্ত্ত পেয়েছি : (ক) কুফরী সন্ধান করে পেয়েছি ‘জাহমিয়া’ (অদৃষ্টবাদী)-দের মধ্যে (খ) কূটতর্ক ও ঝগড়া পেয়েছি মু‘তাযিলাদের মধ্যে (গ) মিথ্যা খুঁজেছি ও সেটি পেয়েছি ‘রাফেযী’ (শী‘আ)-দের মধ্যে (ঘ) আমি ‘হক্ব’ খুঁজেছি এবং তা পেয়েছি ‘আহলেহাদীছ’দের মধ্যে’ (শারফ ৩১ পৃঃ)।
১০. ‘বড় পীর’ বলে খ্যাত শায়খ আবুদর ক্বাদির জীলানী আল-বাগদাদী (৪৭০-৫৬১ হিঃ) ‘নাজী’ দল হিসাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বর্ণনা দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে বিদ‘আতীদের ক্রোধ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
إِعْلَمْ أَنَّ لِأَهْلِ الْبِدْعِ عَلاَمَاتٌ يُعْرَفُوْنَ بِهَا، فَعَلاَمَةُ أَهْلِ الْبِدْعَةِ الْوَقِيْعَةُ فِىْ أَهْلِ الْأَثَرِ ... وَ كُلُّ ذَلِكَ عَصَبِيَّةٌ وَّغِيَاظٌ لِأَهْلِ السُّنَّةِ، وَلاَ إِسْمَ لَهُمْ إِلاَّ إِسْمٌ وَّاحِدٌ وَ هُوَ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ -
‘জেনে রাখ যে, বিদ‘আতীদের কিছু নিদর্শন রয়েছে, যা দেখে তাদের চেনা যায়। বিদ‘আতীদের লক্ষণ হ’ল আহলেহাদীছদের গালি দেওয়া ও বিভিন্ন বাজে নামে তাদেরকে সম্বোধন করা। এগুলি সুন্নাতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় গোঁড়ামী ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন কিছুই নয়। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’। বিদ‘আতীদের এই সব গালি প্রকৃত অর্থে আহলেহাদীছদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন মক্কার কাফিরদের জাদুকর, কবি, পাগল, মাথা খারাপ, গায়েবজান্তা প্রভৃতি গালি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য প্রযোজ্য ছিল না’।[5]
১১. আহমাদ ইবনু সিনান আল-ক্বাত্বান (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) বলেন,
لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ إِلاَّ وَ هُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ، فَإِذَا ابْتَدَعَ الرَّجُلُ نَزَعَتْ حَلاَوَةُ الْحَدِيْثِ مِنْ قَلْبِهِ -
‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। যখন কোন ব্যক্তি বিদ‘আত করে, তখন তার অন্তর থেকে হাদীছের স্বাদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়’।[6]
১২. ইমাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন,
مِنَ الْمَعْلُوْمِ لِكُلِّ مَنْ لَهُ خِبْرَةٌ أَنَّ أَهْلَ الْحَدِيْثِ مِنْ أَعْظَمِ النَّاسِ بَحْثًا عَنْ أَقْوَالِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ وَ طَلَبًا لِّعِلْمِهَا وَ أَرْغَبِ النَّاسِ فِى اِتِّبَاعِهَا وَ أَبْعَدِ النَّاسِ عَنِ اتِّبَاعِ هَوًى يُخَالِفُهَا ... فَهُمْ فِىْ أَهْلِ الْإِسْلاَمِ كَأَهْلِ الْإِسْلاَمِ فِىْ أَهْلِ الْمِلَلِ -
‘যার কিছুটা অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার এটা জানা কথা যে, আহলেহাদীছগণ হ’লেন, মুসলমানদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীসমূহের ও তাঁর ইল্মের অধিক সন্ধানী ও সে সবের অনুসরণের প্রতি অধিক আগ্রহশীল এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ হ’তে সর্বাধিক দূরে অবস্থানকারী, যার বিরোধিতা সে করে থাকে।... মুসলমানদের মধ্যে তাদের অবস্থান এমন মর্যাদাপূর্ণ, যেমন সকল জাতির মধ্যে মুসলমানদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান’।[7]
১৩. ছহীহ মুসলিম-এর শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু শারফ নববী আশ-শামী (৬৩১-৬৭৬ হিঃ) বলেন, ‘এই ফের্কা মুমিনদের মধ্যকার বীর মুজাহিদ, ফক্বীহ, মুহাদ্দিছ, যাহিদ (দুনিয়া থেকে নির্লিপ্ত ইবাদতকারী), নেকীর কাজের আদেশ দানকারী ও অন্যায় কাজের নিষেধকারী বিভিন্ন পর্যায়ের মুমিন হ’তে পারেন, যারা আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠা দান করে থাকেন। এদের সবাইকে একস্থানে জমায়েত থাকা আবশ্যক নয়। বরং তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকতে পারেন’।[8]
১৪. হাফেয ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) يَوْمَ نَدْعُوْا كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ ‘যেদিন আমরা ডাকব প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা সহ’ (ইসরা ৭১) আয়াতের ব্যাখ্যায় স্বীয় জগদ্বিখ্যাত তাফসীরে বিগত একজন মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, هَذَا أَكْبَرُ شَرَفٍ لِأَصْحَابِ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ إِمَامَهُمْ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ ‘আহলেহাদীছদের জন্য এটাই সর্বোচ্চ মর্যাদা যে, তাদের একমাত্র ইমাম হ’লেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’।[9]
নিঃসন্দেহে এই উচ্চ মর্যাদা ক্বিয়ামতের দিন কেবল তাদের জন্যই হবে, যারা দুনিয়াবী জীবনে সকল দিক ও বিভাগে যেকোন মূল্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপরে কায়েম থেকেছেন এবং অন্য কোন মতবাদ বা রায় ও ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দেননি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে রাসূলের দেওয়া উপাধিধন্য সত্যিকারের ‘আহলেহাদীছ’ হওয়ার তাওফীক দাও ও তাদের দলভুক্ত করে নাও- আমীন!!
[1]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৬২৮৩ -এর ব্যাখ্যা; ফাৎহুল বারী ১৩/৩০৬, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা; সিলসিলা ছাহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা; শারফ ১৫।
[2]. ফাৎহুল বারী ‘ইলম’ অধ্যায় ১/১৯৮ হা/৭১-এর ব্যাখ্যা।
[3]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৭।
[4]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী: ১২৮৬ হিঃ) ১/৬২ পৃঃ।
[5]. আব্দুল ক্বাদির জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসর: ১৩৪৬ হিঃ ১/৯০ পৃঃ।
[6]. আব্দুর রহমান ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ (কুয়েত: দারুস সালাফিইয়াহ ১৪০৪ হিঃ), পৃঃ ১০২।
[7]. আহমাদ ইবনু তাইমিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ২/১৭৯ পৃঃ।
[8]. মুসলিম শরহ নববী (দেউবন্দ ছাপা) ২/১৪৩পৃঃ ফাৎহুল বারী ১/১৯৮ হা/৭১-এর ব্যাখ্যা, ‘ইল্ম’ অধ্যায়।
[9]. ইবনু কাছীর, তাফসীর (বৈরূত: ১৪০৮/১৯৮৮) সূরা বণী ইসরাঈল ৭১ আয়াতের ব্যাখ্যা, ৩/৫৬ পৃঃ।
هُمْ أَهْلُ الْحَدِيْثِ وَالَّذِيْنَ يَتَعَاهَدُوْنَ مَذَاهِبَ الرَّسُوْلِ وَ يَذُبُّوْنَ عَنِ الْعِلْمِ، وَ لَوْلاَ هُمْ لَمْ نَجِدْ عَنِ الْمُعْتَزِلَةِ وَالرَّافِضَةِ وَالْجَهْمِيَّةِ وَأَهْلِ الْإِرْجَاءِ وَالرَّأْىِ شَيْئًا مِّنَ السُّنَنِ، فَقَدْ جَعَلَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ الطَّائِفَةَ الْمَنْصُوْرَةَ حُرَّاسَ الدِّيْنِ وَ صَرَفَ عَنْهُمْ كَيْدَ الْمُعَانِدِيْنَ لِتَمَسُّكِهِمْ بِالشَّرْعِ الْمَتِيْنِ وَاقْتِفَائِهِمْ آثَارَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ ... اُوْلَئِكَ حِزْبُ اللهِ أَلاَ إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ -
‘উক্ত দল হ’ল ‘আহলুল হাদীছ জামা‘আত’। যারা রাসূলের বিধানসমূহের হেফাযত করে ও তাঁর ইল্ম কুরআন ও হাদীছের পক্ষে প্রতিরোধ করে। নইলে মু‘তাযিলা, রাফেযী (শী‘আ), জাহমিয়া, মুরজিয়া ও আহলুর রায়দের নিকট থেকে আমরা সুন্নাতের কিছুই আশা করতে পারি না। বিশ্বপ্রভু এই বিজয়ী দলকে দ্বীনের পাহারাদার হিসাবে নিযুক্ত করেছেন এবং ছাহাবা ও তাবেঈনের সনিষ্ঠ অনুসারী হবার কারণে তাদেরকে হঠকারীদের চক্রান্তসমূহ হ’তে রক্ষা করেছেন। .. এরাই হ’লেন আল্লাহর সেনাবাহিনী। নিশ্চয়ই আল্লাহর সেনাদলই হ’ল সফলকাম’ (শারফ ৫)।
২. ইয়াযীদ ইবনে হারূণ (১১৮-২১৭ হিঃ) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (১৬৪-২৪১হিঃ) বলেন, إِنْ لَّمْ يَكُوْنُوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ فَلاَ أَدْرِىْ مَنْ هُمْ ؟ ‘তাঁরা যদি আহলেহাদীছ না হন, তবে আমি জানি না তারা কারা’।[1] ইমাম বুখারীও এবিষয়ে দৃঢ়মত ব্যক্ত করেছেন’। ক্বাযী আয়ায বলেন, أَرَادَ أَحْمَدُ أَهْلَ السُّنَّةِ وَمَنْ يَّعْتَقِدُ مَذْهَبَ أَهْلِ الْحَدِيْثِ ‘ইমাম আহমাদ (রহঃ) একথা দ্বারা আহলে সুন্নাত এবং যারা আহলুল হাদীছ-এর মাযহাব অনুসরণ করে, তাদেরকে বুঝিয়েছেন’।[2] ইমাম আহমাদ (রহঃ) আরও বলেন, لَيْسَ قَوْمٌ عِنْدِىْ خَيْراً مِّنْ أَهْلِ الْحَدِيْثِ، لاَ يَعْرِفُوْنَ إِلاَّ الْحَدِيْثَ ‘আহলেহাদীছের চেয়ে উত্তম কোন দল আমার কাছে নেই। তারা হাদীছ ছাড়া অন্য কিছু চেনে না’।[3]
৩. ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ) বলেন,
إِذَا رَأَيْتُ رَجُلاً مِّنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَيًّا -
‘যখন আমি কোন আহলেহাদীছকে দেখি, তখন আমি যেন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জীবন্ত দেখি’ (শারফ ২৬)।
৪. খ্যাতনামা তাবেঈ আব্দুল্লাহ বইনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) বলেন,
هُمْ عِنْدِىْ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ قَالَ : أَثْبَتُ النَّاسِ عَلَى الصِّرَاطِ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ -
‘নাজী দল হ’ল আহলেহাদীছ জামা‘আত’।... লোকদের মধ্যে তারাই ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর উপর সর্বাপেক্ষা দৃঢ়’ (শারফ ১৫, ৩৩)।
৫. ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ) একদা তাঁর দরবার সন্মুখে কতিপয় আহলেহাদীছকে দেখে উল্লসিত হয়ে বলেন, مَا عَلَى الْأَرْضِ خَيْرٌ مِّنْكُمْ ‘ভূপৃষ্ঠে আপনাদের চেয়ে উত্তম আর কেউ নেই’ (শারফ ২৮)।
৬. আহমাদ ইবনু সারীহ বলতেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الْفُقَهَاءِ لِاِعْتِنَائِهِمْ بِضَبْطِ الْأُصُوْلِ - ‘দলীলের উপরে কায়েম থাকার কারণে আহলেহাদীছগণের মর্যাদা ফক্বীহগণের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে।[4]
৭. ইমাম আবুদাঊদ (২০২-২৭৫ হিঃ) বলেন, لَوْلاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لَانْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ يَعْنِىْ أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ - ‘আহলেহাদীছ জামা‘আত যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’ (শারফ ২৯ পৃঃ)।
৮. ওছমান ইবনু আবী শায়বা একদা কয়েকজন আহলেহাদীছকে হয়রান অবস্থায় দেখে মন্তব্য করেন যে, إنَّ فَاسِقَهُمْ خَيْرٌ مِنْ عَابِدِ غَيْرِهِمْ ‘আহলেহাদীছের একজন ফাসিক্ব ব্যক্তি অন্য দলের একজন আবিদের চেয়েও উত্তম’ (শারফ ২৭ পৃঃ)।
৯. খলীফা হারূনুর রশীদ (মৃঃ ১৯৩ হিঃ) বলতেন,
طَلَبْتُ أَرْبَعَةً فَوَجَدْتُهَا فِىْ أَرْبَعَةٍ : طَلَبْتُ الْكُفْرَ فَوَجَدْتُّهُ فِى الْجَهْمِيَّةِ وَ طَلَبْتُ الْكَلاَمَ وَ الشَّغَبَ فَوَجَدْتُّهُ فِى الْمُعْتَزِلَةِ وَطَلَبْتُ الْكِذْبَ فَوَجَدْتُّهُ عِنْدَ الرَّافِضَةِ وَ طَلَبْتُ الْحَقَّ فَوَجَدْتُّهُ مَعَ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ -
‘আমি মুসলমানদের চারটি দলের মধ্যে চারটি বস্ত্ত পেয়েছি : (ক) কুফরী সন্ধান করে পেয়েছি ‘জাহমিয়া’ (অদৃষ্টবাদী)-দের মধ্যে (খ) কূটতর্ক ও ঝগড়া পেয়েছি মু‘তাযিলাদের মধ্যে (গ) মিথ্যা খুঁজেছি ও সেটি পেয়েছি ‘রাফেযী’ (শী‘আ)-দের মধ্যে (ঘ) আমি ‘হক্ব’ খুঁজেছি এবং তা পেয়েছি ‘আহলেহাদীছ’দের মধ্যে’ (শারফ ৩১ পৃঃ)।
১০. ‘বড় পীর’ বলে খ্যাত শায়খ আবুদর ক্বাদির জীলানী আল-বাগদাদী (৪৭০-৫৬১ হিঃ) ‘নাজী’ দল হিসাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বর্ণনা দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে বিদ‘আতীদের ক্রোধ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
إِعْلَمْ أَنَّ لِأَهْلِ الْبِدْعِ عَلاَمَاتٌ يُعْرَفُوْنَ بِهَا، فَعَلاَمَةُ أَهْلِ الْبِدْعَةِ الْوَقِيْعَةُ فِىْ أَهْلِ الْأَثَرِ ... وَ كُلُّ ذَلِكَ عَصَبِيَّةٌ وَّغِيَاظٌ لِأَهْلِ السُّنَّةِ، وَلاَ إِسْمَ لَهُمْ إِلاَّ إِسْمٌ وَّاحِدٌ وَ هُوَ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ -
‘জেনে রাখ যে, বিদ‘আতীদের কিছু নিদর্শন রয়েছে, যা দেখে তাদের চেনা যায়। বিদ‘আতীদের লক্ষণ হ’ল আহলেহাদীছদের গালি দেওয়া ও বিভিন্ন বাজে নামে তাদেরকে সম্বোধন করা। এগুলি সুন্নাতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় গোঁড়ামী ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন কিছুই নয়। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’। বিদ‘আতীদের এই সব গালি প্রকৃত অর্থে আহলেহাদীছদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন মক্কার কাফিরদের জাদুকর, কবি, পাগল, মাথা খারাপ, গায়েবজান্তা প্রভৃতি গালি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য প্রযোজ্য ছিল না’।[5]
১১. আহমাদ ইবনু সিনান আল-ক্বাত্বান (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) বলেন,
لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ إِلاَّ وَ هُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ، فَإِذَا ابْتَدَعَ الرَّجُلُ نَزَعَتْ حَلاَوَةُ الْحَدِيْثِ مِنْ قَلْبِهِ -
‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। যখন কোন ব্যক্তি বিদ‘আত করে, তখন তার অন্তর থেকে হাদীছের স্বাদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়’।[6]
১২. ইমাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন,
مِنَ الْمَعْلُوْمِ لِكُلِّ مَنْ لَهُ خِبْرَةٌ أَنَّ أَهْلَ الْحَدِيْثِ مِنْ أَعْظَمِ النَّاسِ بَحْثًا عَنْ أَقْوَالِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ وَ طَلَبًا لِّعِلْمِهَا وَ أَرْغَبِ النَّاسِ فِى اِتِّبَاعِهَا وَ أَبْعَدِ النَّاسِ عَنِ اتِّبَاعِ هَوًى يُخَالِفُهَا ... فَهُمْ فِىْ أَهْلِ الْإِسْلاَمِ كَأَهْلِ الْإِسْلاَمِ فِىْ أَهْلِ الْمِلَلِ -
‘যার কিছুটা অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার এটা জানা কথা যে, আহলেহাদীছগণ হ’লেন, মুসলমানদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীসমূহের ও তাঁর ইল্মের অধিক সন্ধানী ও সে সবের অনুসরণের প্রতি অধিক আগ্রহশীল এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ হ’তে সর্বাধিক দূরে অবস্থানকারী, যার বিরোধিতা সে করে থাকে।... মুসলমানদের মধ্যে তাদের অবস্থান এমন মর্যাদাপূর্ণ, যেমন সকল জাতির মধ্যে মুসলমানদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান’।[7]
১৩. ছহীহ মুসলিম-এর শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু শারফ নববী আশ-শামী (৬৩১-৬৭৬ হিঃ) বলেন, ‘এই ফের্কা মুমিনদের মধ্যকার বীর মুজাহিদ, ফক্বীহ, মুহাদ্দিছ, যাহিদ (দুনিয়া থেকে নির্লিপ্ত ইবাদতকারী), নেকীর কাজের আদেশ দানকারী ও অন্যায় কাজের নিষেধকারী বিভিন্ন পর্যায়ের মুমিন হ’তে পারেন, যারা আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠা দান করে থাকেন। এদের সবাইকে একস্থানে জমায়েত থাকা আবশ্যক নয়। বরং তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকতে পারেন’।[8]
১৪. হাফেয ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) يَوْمَ نَدْعُوْا كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ ‘যেদিন আমরা ডাকব প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা সহ’ (ইসরা ৭১) আয়াতের ব্যাখ্যায় স্বীয় জগদ্বিখ্যাত তাফসীরে বিগত একজন মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, هَذَا أَكْبَرُ شَرَفٍ لِأَصْحَابِ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ إِمَامَهُمْ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ ‘আহলেহাদীছদের জন্য এটাই সর্বোচ্চ মর্যাদা যে, তাদের একমাত্র ইমাম হ’লেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’।[9]
নিঃসন্দেহে এই উচ্চ মর্যাদা ক্বিয়ামতের দিন কেবল তাদের জন্যই হবে, যারা দুনিয়াবী জীবনে সকল দিক ও বিভাগে যেকোন মূল্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপরে কায়েম থেকেছেন এবং অন্য কোন মতবাদ বা রায় ও ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দেননি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে রাসূলের দেওয়া উপাধিধন্য সত্যিকারের ‘আহলেহাদীছ’ হওয়ার তাওফীক দাও ও তাদের দলভুক্ত করে নাও- আমীন!!
[1]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৬২৮৩ -এর ব্যাখ্যা; ফাৎহুল বারী ১৩/৩০৬, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা; সিলসিলা ছাহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা; শারফ ১৫।
[2]. ফাৎহুল বারী ‘ইলম’ অধ্যায় ১/১৯৮ হা/৭১-এর ব্যাখ্যা।
[3]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৭।
[4]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী: ১২৮৬ হিঃ) ১/৬২ পৃঃ।
[5]. আব্দুল ক্বাদির জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসর: ১৩৪৬ হিঃ ১/৯০ পৃঃ।
[6]. আব্দুর রহমান ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ (কুয়েত: দারুস সালাফিইয়াহ ১৪০৪ হিঃ), পৃঃ ১০২।
[7]. আহমাদ ইবনু তাইমিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ২/১৭৯ পৃঃ।
[8]. মুসলিম শরহ নববী (দেউবন্দ ছাপা) ২/১৪৩পৃঃ ফাৎহুল বারী ১/১৯৮ হা/৭১-এর ব্যাখ্যা, ‘ইল্ম’ অধ্যায়।
[9]. ইবনু কাছীর, তাফসীর (বৈরূত: ১৪০৮/১৯৮৮) সূরা বণী ইসরাঈল ৭১ আয়াতের ব্যাখ্যা, ৩/৫৬ পৃঃ।
আহলেহাদীছদের বাহ্যিক নিদর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম আব্দুর রহমান ছাবূনী (৩৭২-৪৪৯ হিঃ) বলেন, (১) কম হউক বেশী হউক সকল প্রকারের মাদকদ্রব্য ব্যবহার হ’তে তারা বিরত থাকেন (২) ফরয ছালাতসমূহ আউয়াল ওয়াক্তে আদায়ের জন্য তারা সদা ব্যস্ত থাকেন (৩) ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পড়াকে তারা ওয়াজিব মনে করেন (৪) ছালাতের মধ্যে রুকূ-সুজূদ, ক্বিয়াম-কু‘ঊদ ইত্যাদি আরকানকে ধীরে-সুস্থে শান্তির সঙ্গে আদায় করাকে তারা অপরিহার্য বলেন এবং এতদ্ব্যতীত ছালাত শুদ্ধ হয় না বলে তারা মনে করেন (৫) তারা সকল কাজে নবী (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের কঠোর অনুসারী হয়ে থাকেন (৬) বিদ‘আতীদেরকে তারা ঘৃণা করেন। তারা বিদ‘আতীদের সঙ্গে উঠাবসা করেন না বা তাদের সঙ্গে দ্বীনের ব্যাপারে অহেতুক ঝগড়া করেন না। তাদের থেকে সর্বদা কান বন্ধ রাখেন, যাতে তাদের বাতিল যুক্তিসমূহ অন্তরে ধোঁকা সৃষ্টি করতে না পারে’।[1]
আমরা বলি, আহলেহাদীছের সর্বাপেক্ষা বড় নিদর্শন হ’ল এই যে, তারা হ’লেন আক্বীদার ক্ষেত্রে শিরকের বিরুদ্ধে আপোষহীন তাওহীদবাদী এবং আমলের ক্ষেত্রে বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে সুন্নাতপন্থী। তবে এখানে বলা আবশ্যক যে, আহলেহাদীছ হওয়ার জন্য যেমন আহলেহাদীছ বাপের সন্তান হওয়া শর্ত নয়। তেমনি রক্ত, বর্ণ, ভাষা বা অঞ্চলেরও কোন ভেদাভেদ নেই। বরং যেকোন মুসলমান নিঃশর্তভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্ত মেনে নিলে ও সেই অনুযায়ী নিজের সার্বিক জীবন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হ’লেই কেবল তিনি ‘আহলেহাদীছ’ নামে অভিহিত হবেন। নিঃসন্দেহে আহলেহাদীছ-এর প্রকৃত পরিচয় তার নির্ভেজাল আক্বীদা ও আমলের মধ্যে নিহিত। তার পিতৃ পরিচয়, বিদ্যা-বুদ্ধি, অর্থ-সম্পদ বা সামাজিক পদ মর্যাদার মধ্যে নয়।
[1]. আব্দুর রহমান ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ৯৯-১০০।
আমরা বলি, আহলেহাদীছের সর্বাপেক্ষা বড় নিদর্শন হ’ল এই যে, তারা হ’লেন আক্বীদার ক্ষেত্রে শিরকের বিরুদ্ধে আপোষহীন তাওহীদবাদী এবং আমলের ক্ষেত্রে বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে সুন্নাতপন্থী। তবে এখানে বলা আবশ্যক যে, আহলেহাদীছ হওয়ার জন্য যেমন আহলেহাদীছ বাপের সন্তান হওয়া শর্ত নয়। তেমনি রক্ত, বর্ণ, ভাষা বা অঞ্চলেরও কোন ভেদাভেদ নেই। বরং যেকোন মুসলমান নিঃশর্তভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্ত মেনে নিলে ও সেই অনুযায়ী নিজের সার্বিক জীবন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হ’লেই কেবল তিনি ‘আহলেহাদীছ’ নামে অভিহিত হবেন। নিঃসন্দেহে আহলেহাদীছ-এর প্রকৃত পরিচয় তার নির্ভেজাল আক্বীদা ও আমলের মধ্যে নিহিত। তার পিতৃ পরিচয়, বিদ্যা-বুদ্ধি, অর্থ-সম্পদ বা সামাজিক পদ মর্যাদার মধ্যে নয়।
[1]. আব্দুর রহমান ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ৯৯-১০০।
‘আহলুল হাদীছ’ অর্থ হাদীছের অনুসারী। ‘আহলুর রায়’ অর্থ রায়-এর অনুসারী। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে যারা জীবন সমস্যার সমাধান তালাশ করেন, তাঁদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়। পক্ষান্তরে... পূর্বসূরি কোন বিদ্বানের রচিত কোন ফিক্বহী উছূল বা ব্যবহারিক আইন সূত্রের ভিত্তিতে যারা জীবন সমস্যার সমাধান নেন, শাহ অলিউল্লাহর ভাষায় তাদেরকে ‘আহলুর রায়’ বলা হয়। আহলুর রায়গণ উদ্ভূত কোন সমস্যার সমাধান রাসূলের হাদীছ ও ছাহাবায়ে কেরামের আছারের মধ্যে তালাশ না করে পূর্ব যুগে কোন মুজতাহিদ ফক্বীহের গৃহীত কোন ফিক্বহী সিদ্ধান্ত বা ফিক্বহী মূলনীতির সঙ্গে সাদৃশ্য বিধানে চেষ্টা করে থাকেন এবং তার উপরে ক্বিয়াস বা উপমান পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বের করে থাকেন।[1] এভাবে প্রায় সকল বিষয়ে তিনি তাঁর অনুসরণীয় ইমাম বা ফক্বীহ-এর পরিকল্পিত ‘উছূলে ফিক্বহ’ বা ব্যবহারিক আইনসূত্রসমূহের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা ছহীহ হাদীছের উর্ধ্বে ব্যক্তির রায়কে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।
পক্ষান্তরে আহলুল হাদীছগণ সর্বাবস্থায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে সবার উর্ধ্বে স্থান দেন এবং যে কোন ব্যক্তির হাদীছ বিরোধী রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা রায়-এর ভিত্তিতে কুরআন-হাদীছ যাচাই করেন না। বরং কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে রায়কে যাচাই করেন। তাঁরা ‘অহি’-কে ‘রায়’ বা মানবিক জ্ঞান-এর উপরে অগ্রাধিকার দেন এবং ‘রায়’-কে ‘অহি’-র ব্যাখ্যাকারী বলে মনে করেন। কুরআন বা ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্ত নিজের বা নিজের অনুসরণীয় কোন ব্যক্তির রায় বা আইনসূত্রের পরিপন্থী হ’লে তাঁরা বিভিন্ন অজুহাতে হাদীছ প্রত্যাখ্যান করেন না; বরং হাদীছের সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে গ্রহণ করেন। আহলেহাদীছগণ ‘ইজতিহাদে’ বিশ্বাসী এবং তা সকল যুগের সকল যোগ্য আলেমের জন্য উন্মুক্ত বলে মনে করেন। তাঁরা ঐ ধরনের ইজতিহাদ বা রায় ও ক্বিয়াসে বিশ্বাসী, যা পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও ইজমায়ে ছাহাবার উপরে ভিত্তিশীল।
এ কারণে ইমাম মালেক, শাফেঈ, আহমাদ, ইসহাক্ব, ইমাম বুখারী প্রমুখ উম্মতের সেরা ফক্বীহ ও মুজতাহিগণকে ‘আহলুর রায়’ না বলে বরং ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়। পক্ষান্তরে হাদীছের সংগ্রহ কম থাকার কারণে নিজের রায় ও ক্বিয়াসের উপরে অধিক নির্ভরশীল হওয়ার ফলে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে ‘আহলুর রায়দের ইমাম’ বলা হয়ে থাকে। যেমন মরক্কোর জগদ্বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী আব্দুর রহমান ইবনু খলদূন (৭৩২-৮০২ হিঃ) বলেন,
وَانْقَسَمَ الْفِقْهُ فِيْهِمْ إِلَى طَرِيْقَتَيْنِ، طَرِيْقَةُ أَهْلِ الرَّأْىِ وَالْقِيَاسِ وَ هُمْ أَهْلُ الْعِرَاقِ وَ طَرِيْقَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ وَ هُمْ أَهْلُ الْحِجَازِ وَ كَانَ الْحَدِيْثُ قَلِيْلاً فِىْ أَهْلِ الْعِرَاقِ ... فَاسْتَكْثَرُوْا مِنَ الْقِيَاسِ وَ مَهَرُوْا فِيْهِ، فَلِذَالِكَ قِيْلَ أَهْلُ الرَّأْىِ وَ مُقَدَّمُ جَمَاعَتِهِمُ الَّذِىْ اسْتَقَرَّ الْمَذْْهَبُ فِيْهِ وَ فِىْ أَصْحَابِهِ أَبُوْ حَنِيْفَةَ -
‘(আহলেসুন্নাত বিদ্বানগণের মধ্যেও যুক্তিবাদের ঢেউ লাগে) ফলে তাদের মধ্যে ফিক্বহ শাস্ত্র ‘আহলুল হাদীছ’ ও ‘আহলুর রায়’ নামে দু’টি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হ’ল, রায় ও ক্বিয়াসপন্থীদের তরীক্বা। তারা হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। দ্বিতীয়টি হ’ল, হাদীছপন্থীদের বা আহলুল হাদীছদের তরীক্বা। তারা হ’লেন হেজাযের (মক্কা-মদীনার) অধিবাসী। ইরাকীদের মধ্যে হাদীছ খুবই কম ছিল... ফলে তারা ক্বিয়াস বেশী করেন ও এতে দক্ষতা অর্জন করেন। আর একারণেই তারা ‘আহলুর রায়’ বা রায়পন্থী নামে অভিহিত হয়েছেন। এই দলের নেতা ছিলেন আবু হানীফা, যাঁর নামে একটি মাযহাব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে’।[2] উল্লেখ্য যে, ইরাকেই সর্বপ্রথম হাদীছ জাল করা শুরু হয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইমাম ইবনু শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ) বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে এক বিঘত পরিমাণ একটি হাদীছ বের হয়ে ইরাক থেকে এক হাত পরিমাণ লম্বা হয়ে ফিরে আসে’। ইমাম মালেক ইরাককে ‘হাদীছ ভাঙ্গানোর কারখানা’ ( دَارُ الضَّرْبِ ) নামে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ একটি ছহীহ হাদীছের মধ্যে অসংখ্য যোগ-বিয়োগ করে তাকে ভাঙ্গিয়ে প্রচার করা হয়।[3] ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ছিলেন, ইরাকের কুফা নগরীর অধিবাসী এবং তাঁর প্রধান শিষ্যগণ ছিলেন সেখানকার। এজন্য তাঁর অনুসারীদেরকে হানাফী, কূফী, আহলুর রায়, আহলুল কূফা, আহলুল ইরাক্ব ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
তাক্বলীদে শাখ্ছী : তাক্বলীদ ( اَلتَّقْلِيْدُ ) ‘ক্বালাদাহ’ ( القَلاَدَةُ ) হ’তে গৃহীত। যার অর্থ ‘গলাবন্ধ’। তাক্বলীদ-এর আভিধানিক অর্থ : গলায় রশি বাঁধা। পারিভাষিক অর্থ : قُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা বিনা দলীলে মেনে নেওয়া’। পক্ষান্তরে ‘ইত্তেবা’র আভিধানিক অর্থ : পদাংক অনুসরণ করা। পারিভাষিক অর্থ : قُُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مَعَ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা দলীল সহ মেনে নেওয়া’। তাক্বলীদ হ’ল রায়-এর অনুরসণ এবং ইত্তেবা হ’ল দলীলের অনুসরণ। উল্লেখ্য যে, কোন আলেমের ছহীহ দলীল ভিত্তিক কোন কথাকে মেনে নেওয়ার নাম ‘তাক্বলীদ’ নয়, বরং তা হ’ল ‘ইত্তেবা’। অনুরূপভাবে কোন আলেমের দেওয়া ফৎওয়ার বিপরীতে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া গেলে উক্ত ফৎওয়া পরিত্যাগ করে ছহীহ দলীলের অনুসরণ করাকে বলা হয় ‘ইত্তেবা’। ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের যুগে তাক্বলীদের কোনরূপ নামগন্ধ ছিল না। বরং তাঁদের দলীল ভিত্তিক কথার অনুসরণকে অনেকে ‘তাক্বলীদ’ বলে ভুল বুঝিয়েছেন।
আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল ‘তাক্বলীদে শাখ্ছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। ২য় শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, إِعْلَمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوْا قَبْلَ الْمِائَةِ الرَّابِعَةِ غَيْرَ مُجْمَعِيْنَ عَلَى التَّقْلِيْدِ الْخَالِصِ لِمَذْهَبٍ وَّاحِدٍ بِعَيْنِهِ ، ‘জেনে রাখ হে পাঠক! ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের তাক্বলীদের উপরে সংঘবদ্ধ ছিল না’। .. কোন সমস্যা সৃষ্টি হ’লে লোকেরা যেকোন আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ ব্যাপারে কারু মাযহাব যাচাই করা হ’ত না।[4]
হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিঃ) তৃতীয় শতাব্দী হিজরীর শেষদিকের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই সময় ‘আহলুর রায়’ (হানাফী) ফক্বীহদের নেতৃস্থানীয় অনেক আলেম, মু‘তাযিলা, শী‘আ ও কালাম শাস্ত্রবিদ (দার্শনিক) গণের স্তম্ভ বিশেষ বহু পন্ডিত বর্তমান ছিলেন, যারা যুক্তিবাদের উপরে ভিত্তি করে চলতেন এবং নবীর হাদীছকে কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকায় সালাফে ছালেহীনের তরীক্বা এড়িয়ে চলতেন। এই সময় ফক্বীহদের মধ্যে তাক্বলীদ আত্মপ্রকাশ করে ও ইজতিহাদের অবক্ষয় শুরু হয়’।[5]
ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) বলেন, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হবার পরে ইসলামী খেলাফত এমন সব লোকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যারা শারঈ বিধানে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তারা সকল বিষয়ে ফক্বীহদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে বিভিন্ন সরকারী পদে তলব করা হ’তে থাকে। ফলে তখন লোকেরা ইল্ম শিখতে লাগল সম্মান ও প্রতিপত্তি হাছিলের মাধ্যম হিসাবে। মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ কেউ কালাম শাস্ত্রের উপরে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। সেখানে বহু কূটতর্কের অবতারণা করা হ’ল। এই সময় শাসকগণ হানাফী ও শাফেঈ ফিক্বহের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী হ’লেন। ফলে বিদ্বানগণ উক্ত দুই মাযহাবের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়সমূহের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন এবং বহু ঝগড়া ও অসংখ্য বই-পুস্তকাদি প্রণয়ন করেন। এইভাবে স্ব স্ব মাযহাবের পক্ষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্যসমূহ উদ্ধার করাকেই তারা তাদের মৌল উদ্দেশ্য হিসাবে গণ্য করেন। এই অবস্থা এখনও চলছে। আমরা জানি না ভবিষ্যতের লিখন কী আছে? (সংক্ষেপায়িত)। [6]
অতঃপর শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘(হে পাঠক!) বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলে তুমি মুসলমানদের দেখবে যে, তারা বিগত কোন একজন মুজতাহিদ বিদ্বানের মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি ঐ বিদ্বানের তাক্বলীদ হ’তে সে বেরিয়ে আসে, তাহ’লে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে ( كَأَنَّهُ نَبِىٌّ بُعِثَ إِلَيْهِ ) এবং যার অনুসরণ তার উপরে ফরয করা হয়েছে। অথচ ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না।[7]
আহলেহাদীছের ইস্তিদলালী পদ্ধতি : শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ইসলামী বিধান প্রণয়নে আহলেহাদীছ বিদ্বানদের অনুসৃত ‘ইস্তিদলালী পদ্ধতি’ বা দলীল গ্রহণের নীতিমালা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘(১) কোন বিষয়ে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ পেলে তাঁরা তাই গ্রহণ করেন। অন্যদিকে মুখ ফিরানোকে তাঁরা জায়েয মনে করেন না (২) কোন বিষয়ে কুরআনের কোন নির্দেশ অস্পষ্ট হ’লে সেক্ষেত্রে ‘সুন্নাহ’ ফায়ছালাকারী হবে। উক্ত হাদীছ সর্বত্র প্রচারিত থাকুক বা না থাকুক, তার উপরে ছাহাবীগণ বা ফক্বীহগণ আমল করুন বা না করুন। কোন বিষয়ে ‘হাদীছ’ পাওয়া গেলে তার বিপরীতে কোন ছাহাবীর ‘আছার’ কিংবা কোন মুজতাহিদের ‘ইজতিহাদ’ গ্রহণযোগ্য হবে না (৩) সার্বিক প্রচেষ্টার পরেও কোন বিষয়ে হাদীছ না পাওয়া গেলে আহলেহাদীছগণ ছাহাবী ও তাবেঈগণের যেকোন একটি জামা‘আতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেন। এক্ষেত্রে তাঁরা কোন একটি দল, শহর বা এলাকার অধিবাসীকে নির্দিষ্টভাবে অগ্রগণ্য মনে করেন না (৪) যদি কোন বিষয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন ও ফক্বীহগণ একমত হন, তবে তাকেই তাঁরা যথেষ্ট মনে করেন (৫) কিন্তু যদি সেখানে মতভেদ থাকে, তবে তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক বিদ্বান, পরহেযগার ও স্মৃতিধর তাঁর কথা অথবা তাঁদের মধ্যকার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কথাটি গ্রহণ করেন (৬) যখন কোন বিষয়ে সমশ্রেণীভুক্ত দু’টি বক্তব্য পাওয়া যায়, তখন সেক্ষেত্রে তাঁরা দু’টিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন (৭) কিন্তু যখন সেটিতেও ব্যর্থ হন, তখন তাঁরা কিতাব ও সুন্নাতের সাধারণ নির্দেশ ও ইঙ্গিতসমূহ এবং উদ্দেশ্যাবলী অনুধাবন করেন। অতঃপর উক্ত বিষয়ে তাঁরা প্রচলিত কোন উছূল বা ব্যবহারিক আইন সূত্রের অনুসরণ করেন না। বরং যে কথাটি তাঁরা উত্তমরূপে বুঝতে পারেন ও যা তাঁদের হৃদয়কে সুশীতল করে, তারই অনুসরণ করেন’।[8]
হানাফী মাযহাবের বিস্তৃতির কারণ : হানাফী মাযহাব সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। খলীফা মাহ্দী, হাদী ও হারূনুর রশীদের আমলে (১৫৮-১৯৩ হিঃ) ইমাম আবু হানীফার প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ) দেশের প্রধান বিচারপতি থাকার সুবাদে ইরাক, ইরান ও মধ্য তুর্কিস্তান সহ খেলাফতের সর্বত্র হানাফী মাযহাবের ফাতাওয়া ও সিদ্ধান্তসমূহ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) এদিকে ইঙ্গিত করে বলেন, فَكَانَ سَبَبًا لِظُهُوْرِ مَذْهَبِهِ ‘এটাই ছিল তাঁর মাযহাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ’।[9] আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী (১২৬৪-১৩০৪/১৮৪৮-৮৬) একথা সমর্থন করে বলেন, هُوَ اَوَّلُ مَنْ نَشَرَ عِلْمَ أَبِىْ حَنِيْفَةَ فِىْ أَقْطَارِ الْأَرْضِ وَ ثَبَتَ الْمَسَائِلَ ‘তিনিই প্রথম আবু হানীফার ইল্ম পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন ও তাঁর মাসআলাসমূহ প্রতিষ্ঠিত করেন’।[10]
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইসলাম এসেছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খলীফাদের আমলেই আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে। বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির পূর্বে আগত সেই ইসলাম ছিল হাদীছ ভিত্তিক নির্ভেজাল ইসলাম। নিঃসন্দেহে তাঁরা ছিলেন ‘আহলেহাদীছ’। পরবর্তী হানাফী মতাবলম্বী সেনাপতি ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খৃষ্টাব্দের সামরিক বিজয় ও তাঁর সাথে ও পরে আগত তুর্কী হানাফী আলেম ও মারেফতী ফকীরদের মাধ্যমে প্রচারিত হানাফী ও মারেফতী ইসলাম প্রধানতঃ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে প্রসার লাভ করে। যার অধিকাংশ আমল ছিল শিরক ও বিদ‘আতে ভরা। যদিও সেনারগাঁয়ের মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০খৃঃ) ও তার শিষ্যদের প্রচেষ্টায় আহলেহাদীছ আন্দোলন চালু থাকে। উল্লেখ্য যে, বোখারা (রাশিয়া) থেকে আগত এই স্বনামধন্য মুহাদ্দিছ-এর মাধ্যমেই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম বুখারী ও মুসলিমের দরস চালু হয়। তিনি সোনারগাঁয়ে দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ ছহীহায়েন-এর দরস দিয়েছিলেন। বলা চলে যে, প্রধানতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় এদেশে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সর্বাধিক প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে তুর্কী, মোগল, শী‘আ, পাঠান, আফগান প্রভৃতি দলের হাত বদল হয়ে যে ইসলাম এদেশে স্থিতি লাভ করে, তা হয়ে পড়ে শিরক, বিদ‘আত ও বিভিন্ন কুসংস্কারে ভরা জগাখিচুড়ী ইসলাম। বলা বাহুল্য যে, আজও সে অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নীতি : ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) তাঁর রায়-এর তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণ করতে তীব্রভাবে নিষেধ করে গিয়েছেন এবং ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যাবে, তখন সেটাই আমার মাযহাব’ বলে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়ে গিয়েছেন (দ্রঃ টীকা ৩)। সেকারণ আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী হানাফী (৮৯৮-৯৭৩ হিঃ) বলেন,
إِنَّهُ لَوْ عَاشَ حَتَّى دُوِّنَتْ أَحَادِيْثُ الشَّرِيْعَةِ .... لَأَخَذَ بِهَا وَ تَرَكَ كُلَّ قِيَاسٍ كَانَ قَاسَهُ وَ كَانَ الْقِيَاسُ قَلَّ فِيْ مَذْهَبِهِ كَمَا قَلَّ فِيْ مَذْهَبِ غَيْرِهِ ...
‘যদি (তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে) হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের স্বর্ণযুগে ইমাম আবু হানীফা বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তিনি সেগুলি গ্রহণ করতেন ও যত ক্বিয়াসী ফৎওয়া দিয়েছেন সবই বাদ দিতেন এবং তাঁর মাযহাবেও ক্বিয়াস কম হ’ত, যেমন অন্যদের মাযহাবে কম হয়েছে। .... যে কথা বলা হয়ে থাকে যে, ইমাম আবু হানীফা ক্বিয়াসকে দলীলের উপরে স্থান দিতেন, এটা তাঁর মুক্বাল্লিদগণের কথা মাত্র। যারা ইমামের ক্বিয়াসের উপরে আমল করাকে অপরিহার্য গণ্য করেছেন এবং হাদীছকে পরিত্যাগ করেছেন যা ইমামের মৃত্যুর পরে ছহীহ প্রমাণিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম দায়ী নন, বরং দায়ী তার অন্ধ অনুসারীবৃন্দ’।[11]
ফলকথা আহলুল হাদীছগণের বিপরীতে আহলুর রায়গণের ক্বিয়াস স্ব স্ব মাযহাবী বিদ্বানদের রচিত ব্যবহারিক আইনসূত্রসমূহ বা উছূলে ফিক্বহের উপরে ভিত্তিশীল, হাদীছের উপরে নয়।
মুজতাহিদগণের বিভক্তি :
হিজরী ষষ্ঠ শতকের খ্যাতনামা বিদ্বান আবুল ফাৎহ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী (৪৭৯-৫৪৮ হিঃ) বলেন,
ثُمَّ الْمُجْتَهِدُوْنَ مِنْ أَئِمَّةِ الْأُمَّةِ مَحْصُوْرُوْنَ فِيْ صِنْفَيْنِ لاَ يَعْدُوَانِ إِلَى ثَالِثٍ : أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ، أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ هُمْ أَهْلُ الْحِجَازِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ عِنَايَتَهُمْ بِتَحْصِيْلِ الْأَحَادِيْثِ وَ نَقْلِ الْأَخْبَارِ وَ بِنَاءِ الْأَحْكَامِ عَلَى النُّصُوْصِ وَ لاَيَرْجِعُوْنَ إِلَى الْقِيَاسِ الْجَلِىِّ وَ الْخَفِىِّ مَا وَجَدُوْا خَبَرًا أََوْ أَثَرًا ... وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ وَهُمْ أَهْلُ الْعِرَاقِ هُمْ أَصْحَابُ أَبِىْ حَنِيْفَةَ النُّعْمَانِ بْنِ الثَّابِتِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوا أَصْحَابَ الرَّأْىِ لِأَنَّ أَكْثَرَ عِنَايَتِهِمْ بِتَحْصِيْلِ وَجْهِ الْقِيَاسِ وَالْمَعْنَى الْمُسْتَنْبَطِ مِنَ الْأَحْكَامِ وَ بِنَاءِ الْحَوَادِثِ عَلَيْهَا وَ رُبَّمَا يُقَدِّمُوْنَ الْقِيَاسَ الْجَلِىَّ عَلَى آحَادِ الْأَخْبَارِ -
‘উম্মতের মুজতাহিদ ইমামগণ দু’ভাগে বিভক্ত, তৃতীয় কোন ভাগে নয়। আছহাবুল হাদীছ ও আছহাবুর রায় (আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়)। আহলুল হাদীছগণ হেজায (মক্কা-মদীনা)-এর অধিবাসী। তাঁদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ এ জন্য বলা হয় যে, তাঁদের সার্বিক লক্ষ্য নিয়োজিত থাকে হাদীছ সংগ্রহের প্রতি এবং তাঁরা সমস্ত আদেশ-নিষেধের ভিত্তি রাখেন (কুরআন-হাদীছের) দলীল সমূহের উপরে। হাদীছ বা আছার পেলে তাঁরা কোন প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ক্বিয়াসের দিকে ফিরে তাকান না...। পক্ষান্তরে আহলুর রায়গণ হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। তাঁরা আবু হানীফা নু‘মান ইবনু ছাবিত (৮০-১৫০ হিঃ)-এর অনুসারী। তাঁদেরকে ‘আহলুর রায়’ এ জন্য বলা হয়ে থাকে যে, তাঁদের অধিকতর লক্ষ্য থাকে ক্বিয়াসের কারণ অনুসন্ধানের প্রতি ও কুরআন-হাদীছের আহকাম হ’তে সৃষ্ট মর্মার্থের প্রতি এবং তার উপরেই তাঁরা উদ্ভূত ঘটনাসমূহের ভিত্তি স্থাপন করেন। কখনো কখনো তাঁরা ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছের উপরে প্রকাশ্য ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন’।[12]
আহলুল হাদীছের নীতির সপক্ষে মত প্রকাশ করতে গিয়ে হিজরী পঞ্চম শতকের ইউরোপীয় বিদ্বান স্পেনের মুহাম্মাদ আলী ইবনু হায্ম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন-এর প্রথম হ’তে শেষ পর্যন্ত সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বা ইজমা এই যে, তাঁদের কোন একজন ব্যক্তির সকল কথার প্রতি কর্ণপাত করা চলবে না। অতএব ঐ ব্যক্তি জেনে রাখুক, যে ব্যক্তি আবু হানীফার সকল কথা গ্রহণ করেছে, কিংবা মালেক, শাফেঈ বা আহমাদের সকল কথাকে গ্রহণ করেছে। তাঁদের কোন কথা ছাড়েনি বা অন্যের কথার প্রতি দৃকপাত করেনি, কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ-নিষেধের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করেনি, ঐ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ইজমায়ে উম্মতের বিরোধিতা করেছে। এ নীতির অনুসারী কোন লোক ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের তিনটি প্রশংসিত যুগে ছিল না। ঐ ব্যক্তি মুমিনদের গৃহীত পথের বাইরে গিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঐ অবস্থা হ’তে পানাহ দিন’।[13]
এক্ষণে আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে আমরা আল্লাহ-প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান নেব? না মানব রচিত ফিক্বহের ভিত্তিতে সমাধান নেব। আমরা বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈকে অগ্রাধিকার দেব? নাকি পরবর্তীতে সৃষ্ট একটি নির্দিষ্ট মাযহাবী ফিক্বহগ্রন্থ কুদূরী, শরহে বেকায়া, হেদায়াহ, আলমগীরীকে অগ্রাধিকার দেব। আমরা কি হাদীছপন্থী হব, নাকি রায়পন্থী হব? জানা আবশ্যক যে, নবীদের আগমন শেষ হয়ে গেছে, অহি-র অবতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু যুগে যুগে ‘রায়’-এর পরিবর্তন ঘটেছে, আজও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। বর্তমানে মুসলিম তরুণ সমাজ ক্রমেই বিজাতীয়দের রায়ের অনুসারী হয়ে পড়ছে। ফলে নানা মুণীর নানা মতে মুসলিম সমাজ আজ শতধা বিভক্ত। বিশৃংখল এই বিরাট উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ ও কল্যাণমুখী করার একটাই মাত্র পথ। সেটা হ’ল, সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে ফিরে চলা। পবিত্র কুরাআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালার সম্মুখে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। যুগ যুগ ধরে আহলেহাদীছ আন্দোলন এই কল্যাণ লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়ে এসেছে, আজও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ।
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো: ১৩২২ হিঃ)১/১২৯ পৃঃ; বিস্তারিত জানার জন্য ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ শীর্ষক আলোচনা দ্রষ্টব: ঐ, ১১৮-১২২।
[2]. আব্দুর রহমান ইবনু খালদূন, তারীখ (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুল আ‘লামী, তাবি), মুক্বাদ্দামা ১/৪৪৬।
[3]. ড. মুছতফা সাবাঈ, আস-সুন্নাহ (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৪র্থ সংস্করণ ১৪০৫/১৯৮৫), পৃঃ ৭৯।
[4]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫২-৫৩ ‘চতুর্থ শতাব্দী ও তার পরের লোকদের অবস্থা বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।
[5]. যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরূত : ছাপা, তাবি) ২/২৬৭পৃঃ।
[6]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫৩ পৃঃ।
[7]. শাহ অলিউল্লাহ, তাফহীমাতে ইলাহিয়াহ (ইউ,পি, বিজনৌর ১৩৫৫/১৯৩৬) ১/১৫১ পৃঃ।
[8]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো : দারুত তুরাছ, ১ম সংস্করণ ১৩৫৫/১৯৩৬), ১/১৪৯ পৃঃ, ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ অনুচ্ছেদ।
[9]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৪৬ ‘ফক্বীহদের মাযহাবী পার্থক্যের কারণ সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[10]. মুক্বাদ্দামা শারহু বেক্বায়াহ (দেউবন্দ ছাপা: তাবি) পৃঃ ৩৮।
[11]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী ছাপা : ১২৮৬ হিঃ) ১/৭৩ পৃঃ।
[12]. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী, কিতাবুল মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ২০৬-২০৭ পৃঃ।
[13]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (মিসরী ছাপা ১৩২২ হিঃ) ১/১২৩-১২৪ পৃঃ।
পক্ষান্তরে আহলুল হাদীছগণ সর্বাবস্থায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে সবার উর্ধ্বে স্থান দেন এবং যে কোন ব্যক্তির হাদীছ বিরোধী রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা রায়-এর ভিত্তিতে কুরআন-হাদীছ যাচাই করেন না। বরং কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে রায়কে যাচাই করেন। তাঁরা ‘অহি’-কে ‘রায়’ বা মানবিক জ্ঞান-এর উপরে অগ্রাধিকার দেন এবং ‘রায়’-কে ‘অহি’-র ব্যাখ্যাকারী বলে মনে করেন। কুরআন বা ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্ত নিজের বা নিজের অনুসরণীয় কোন ব্যক্তির রায় বা আইনসূত্রের পরিপন্থী হ’লে তাঁরা বিভিন্ন অজুহাতে হাদীছ প্রত্যাখ্যান করেন না; বরং হাদীছের সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে গ্রহণ করেন। আহলেহাদীছগণ ‘ইজতিহাদে’ বিশ্বাসী এবং তা সকল যুগের সকল যোগ্য আলেমের জন্য উন্মুক্ত বলে মনে করেন। তাঁরা ঐ ধরনের ইজতিহাদ বা রায় ও ক্বিয়াসে বিশ্বাসী, যা পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও ইজমায়ে ছাহাবার উপরে ভিত্তিশীল।
এ কারণে ইমাম মালেক, শাফেঈ, আহমাদ, ইসহাক্ব, ইমাম বুখারী প্রমুখ উম্মতের সেরা ফক্বীহ ও মুজতাহিগণকে ‘আহলুর রায়’ না বলে বরং ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়। পক্ষান্তরে হাদীছের সংগ্রহ কম থাকার কারণে নিজের রায় ও ক্বিয়াসের উপরে অধিক নির্ভরশীল হওয়ার ফলে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে ‘আহলুর রায়দের ইমাম’ বলা হয়ে থাকে। যেমন মরক্কোর জগদ্বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী আব্দুর রহমান ইবনু খলদূন (৭৩২-৮০২ হিঃ) বলেন,
وَانْقَسَمَ الْفِقْهُ فِيْهِمْ إِلَى طَرِيْقَتَيْنِ، طَرِيْقَةُ أَهْلِ الرَّأْىِ وَالْقِيَاسِ وَ هُمْ أَهْلُ الْعِرَاقِ وَ طَرِيْقَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ وَ هُمْ أَهْلُ الْحِجَازِ وَ كَانَ الْحَدِيْثُ قَلِيْلاً فِىْ أَهْلِ الْعِرَاقِ ... فَاسْتَكْثَرُوْا مِنَ الْقِيَاسِ وَ مَهَرُوْا فِيْهِ، فَلِذَالِكَ قِيْلَ أَهْلُ الرَّأْىِ وَ مُقَدَّمُ جَمَاعَتِهِمُ الَّذِىْ اسْتَقَرَّ الْمَذْْهَبُ فِيْهِ وَ فِىْ أَصْحَابِهِ أَبُوْ حَنِيْفَةَ -
‘(আহলেসুন্নাত বিদ্বানগণের মধ্যেও যুক্তিবাদের ঢেউ লাগে) ফলে তাদের মধ্যে ফিক্বহ শাস্ত্র ‘আহলুল হাদীছ’ ও ‘আহলুর রায়’ নামে দু’টি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হ’ল, রায় ও ক্বিয়াসপন্থীদের তরীক্বা। তারা হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। দ্বিতীয়টি হ’ল, হাদীছপন্থীদের বা আহলুল হাদীছদের তরীক্বা। তারা হ’লেন হেজাযের (মক্কা-মদীনার) অধিবাসী। ইরাকীদের মধ্যে হাদীছ খুবই কম ছিল... ফলে তারা ক্বিয়াস বেশী করেন ও এতে দক্ষতা অর্জন করেন। আর একারণেই তারা ‘আহলুর রায়’ বা রায়পন্থী নামে অভিহিত হয়েছেন। এই দলের নেতা ছিলেন আবু হানীফা, যাঁর নামে একটি মাযহাব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে’।[2] উল্লেখ্য যে, ইরাকেই সর্বপ্রথম হাদীছ জাল করা শুরু হয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইমাম ইবনু শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ) বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে এক বিঘত পরিমাণ একটি হাদীছ বের হয়ে ইরাক থেকে এক হাত পরিমাণ লম্বা হয়ে ফিরে আসে’। ইমাম মালেক ইরাককে ‘হাদীছ ভাঙ্গানোর কারখানা’ ( دَارُ الضَّرْبِ ) নামে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ একটি ছহীহ হাদীছের মধ্যে অসংখ্য যোগ-বিয়োগ করে তাকে ভাঙ্গিয়ে প্রচার করা হয়।[3] ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ছিলেন, ইরাকের কুফা নগরীর অধিবাসী এবং তাঁর প্রধান শিষ্যগণ ছিলেন সেখানকার। এজন্য তাঁর অনুসারীদেরকে হানাফী, কূফী, আহলুর রায়, আহলুল কূফা, আহলুল ইরাক্ব ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
তাক্বলীদে শাখ্ছী : তাক্বলীদ ( اَلتَّقْلِيْدُ ) ‘ক্বালাদাহ’ ( القَلاَدَةُ ) হ’তে গৃহীত। যার অর্থ ‘গলাবন্ধ’। তাক্বলীদ-এর আভিধানিক অর্থ : গলায় রশি বাঁধা। পারিভাষিক অর্থ : قُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা বিনা দলীলে মেনে নেওয়া’। পক্ষান্তরে ‘ইত্তেবা’র আভিধানিক অর্থ : পদাংক অনুসরণ করা। পারিভাষিক অর্থ : قُُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مَعَ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা দলীল সহ মেনে নেওয়া’। তাক্বলীদ হ’ল রায়-এর অনুরসণ এবং ইত্তেবা হ’ল দলীলের অনুসরণ। উল্লেখ্য যে, কোন আলেমের ছহীহ দলীল ভিত্তিক কোন কথাকে মেনে নেওয়ার নাম ‘তাক্বলীদ’ নয়, বরং তা হ’ল ‘ইত্তেবা’। অনুরূপভাবে কোন আলেমের দেওয়া ফৎওয়ার বিপরীতে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া গেলে উক্ত ফৎওয়া পরিত্যাগ করে ছহীহ দলীলের অনুসরণ করাকে বলা হয় ‘ইত্তেবা’। ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের যুগে তাক্বলীদের কোনরূপ নামগন্ধ ছিল না। বরং তাঁদের দলীল ভিত্তিক কথার অনুসরণকে অনেকে ‘তাক্বলীদ’ বলে ভুল বুঝিয়েছেন।
আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল ‘তাক্বলীদে শাখ্ছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। ২য় শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, إِعْلَمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوْا قَبْلَ الْمِائَةِ الرَّابِعَةِ غَيْرَ مُجْمَعِيْنَ عَلَى التَّقْلِيْدِ الْخَالِصِ لِمَذْهَبٍ وَّاحِدٍ بِعَيْنِهِ ، ‘জেনে রাখ হে পাঠক! ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের তাক্বলীদের উপরে সংঘবদ্ধ ছিল না’। .. কোন সমস্যা সৃষ্টি হ’লে লোকেরা যেকোন আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ ব্যাপারে কারু মাযহাব যাচাই করা হ’ত না।[4]
হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিঃ) তৃতীয় শতাব্দী হিজরীর শেষদিকের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই সময় ‘আহলুর রায়’ (হানাফী) ফক্বীহদের নেতৃস্থানীয় অনেক আলেম, মু‘তাযিলা, শী‘আ ও কালাম শাস্ত্রবিদ (দার্শনিক) গণের স্তম্ভ বিশেষ বহু পন্ডিত বর্তমান ছিলেন, যারা যুক্তিবাদের উপরে ভিত্তি করে চলতেন এবং নবীর হাদীছকে কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকায় সালাফে ছালেহীনের তরীক্বা এড়িয়ে চলতেন। এই সময় ফক্বীহদের মধ্যে তাক্বলীদ আত্মপ্রকাশ করে ও ইজতিহাদের অবক্ষয় শুরু হয়’।[5]
ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) বলেন, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হবার পরে ইসলামী খেলাফত এমন সব লোকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যারা শারঈ বিধানে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তারা সকল বিষয়ে ফক্বীহদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে বিভিন্ন সরকারী পদে তলব করা হ’তে থাকে। ফলে তখন লোকেরা ইল্ম শিখতে লাগল সম্মান ও প্রতিপত্তি হাছিলের মাধ্যম হিসাবে। মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ কেউ কালাম শাস্ত্রের উপরে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। সেখানে বহু কূটতর্কের অবতারণা করা হ’ল। এই সময় শাসকগণ হানাফী ও শাফেঈ ফিক্বহের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী হ’লেন। ফলে বিদ্বানগণ উক্ত দুই মাযহাবের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়সমূহের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন এবং বহু ঝগড়া ও অসংখ্য বই-পুস্তকাদি প্রণয়ন করেন। এইভাবে স্ব স্ব মাযহাবের পক্ষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্যসমূহ উদ্ধার করাকেই তারা তাদের মৌল উদ্দেশ্য হিসাবে গণ্য করেন। এই অবস্থা এখনও চলছে। আমরা জানি না ভবিষ্যতের লিখন কী আছে? (সংক্ষেপায়িত)। [6]
অতঃপর শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘(হে পাঠক!) বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলে তুমি মুসলমানদের দেখবে যে, তারা বিগত কোন একজন মুজতাহিদ বিদ্বানের মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি ঐ বিদ্বানের তাক্বলীদ হ’তে সে বেরিয়ে আসে, তাহ’লে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে ( كَأَنَّهُ نَبِىٌّ بُعِثَ إِلَيْهِ ) এবং যার অনুসরণ তার উপরে ফরয করা হয়েছে। অথচ ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না।[7]
আহলেহাদীছের ইস্তিদলালী পদ্ধতি : শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ইসলামী বিধান প্রণয়নে আহলেহাদীছ বিদ্বানদের অনুসৃত ‘ইস্তিদলালী পদ্ধতি’ বা দলীল গ্রহণের নীতিমালা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘(১) কোন বিষয়ে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ পেলে তাঁরা তাই গ্রহণ করেন। অন্যদিকে মুখ ফিরানোকে তাঁরা জায়েয মনে করেন না (২) কোন বিষয়ে কুরআনের কোন নির্দেশ অস্পষ্ট হ’লে সেক্ষেত্রে ‘সুন্নাহ’ ফায়ছালাকারী হবে। উক্ত হাদীছ সর্বত্র প্রচারিত থাকুক বা না থাকুক, তার উপরে ছাহাবীগণ বা ফক্বীহগণ আমল করুন বা না করুন। কোন বিষয়ে ‘হাদীছ’ পাওয়া গেলে তার বিপরীতে কোন ছাহাবীর ‘আছার’ কিংবা কোন মুজতাহিদের ‘ইজতিহাদ’ গ্রহণযোগ্য হবে না (৩) সার্বিক প্রচেষ্টার পরেও কোন বিষয়ে হাদীছ না পাওয়া গেলে আহলেহাদীছগণ ছাহাবী ও তাবেঈগণের যেকোন একটি জামা‘আতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেন। এক্ষেত্রে তাঁরা কোন একটি দল, শহর বা এলাকার অধিবাসীকে নির্দিষ্টভাবে অগ্রগণ্য মনে করেন না (৪) যদি কোন বিষয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন ও ফক্বীহগণ একমত হন, তবে তাকেই তাঁরা যথেষ্ট মনে করেন (৫) কিন্তু যদি সেখানে মতভেদ থাকে, তবে তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক বিদ্বান, পরহেযগার ও স্মৃতিধর তাঁর কথা অথবা তাঁদের মধ্যকার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কথাটি গ্রহণ করেন (৬) যখন কোন বিষয়ে সমশ্রেণীভুক্ত দু’টি বক্তব্য পাওয়া যায়, তখন সেক্ষেত্রে তাঁরা দু’টিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন (৭) কিন্তু যখন সেটিতেও ব্যর্থ হন, তখন তাঁরা কিতাব ও সুন্নাতের সাধারণ নির্দেশ ও ইঙ্গিতসমূহ এবং উদ্দেশ্যাবলী অনুধাবন করেন। অতঃপর উক্ত বিষয়ে তাঁরা প্রচলিত কোন উছূল বা ব্যবহারিক আইন সূত্রের অনুসরণ করেন না। বরং যে কথাটি তাঁরা উত্তমরূপে বুঝতে পারেন ও যা তাঁদের হৃদয়কে সুশীতল করে, তারই অনুসরণ করেন’।[8]
হানাফী মাযহাবের বিস্তৃতির কারণ : হানাফী মাযহাব সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। খলীফা মাহ্দী, হাদী ও হারূনুর রশীদের আমলে (১৫৮-১৯৩ হিঃ) ইমাম আবু হানীফার প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ) দেশের প্রধান বিচারপতি থাকার সুবাদে ইরাক, ইরান ও মধ্য তুর্কিস্তান সহ খেলাফতের সর্বত্র হানাফী মাযহাবের ফাতাওয়া ও সিদ্ধান্তসমূহ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) এদিকে ইঙ্গিত করে বলেন, فَكَانَ سَبَبًا لِظُهُوْرِ مَذْهَبِهِ ‘এটাই ছিল তাঁর মাযহাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ’।[9] আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী (১২৬৪-১৩০৪/১৮৪৮-৮৬) একথা সমর্থন করে বলেন, هُوَ اَوَّلُ مَنْ نَشَرَ عِلْمَ أَبِىْ حَنِيْفَةَ فِىْ أَقْطَارِ الْأَرْضِ وَ ثَبَتَ الْمَسَائِلَ ‘তিনিই প্রথম আবু হানীফার ইল্ম পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন ও তাঁর মাসআলাসমূহ প্রতিষ্ঠিত করেন’।[10]
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইসলাম এসেছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খলীফাদের আমলেই আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে। বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির পূর্বে আগত সেই ইসলাম ছিল হাদীছ ভিত্তিক নির্ভেজাল ইসলাম। নিঃসন্দেহে তাঁরা ছিলেন ‘আহলেহাদীছ’। পরবর্তী হানাফী মতাবলম্বী সেনাপতি ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খৃষ্টাব্দের সামরিক বিজয় ও তাঁর সাথে ও পরে আগত তুর্কী হানাফী আলেম ও মারেফতী ফকীরদের মাধ্যমে প্রচারিত হানাফী ও মারেফতী ইসলাম প্রধানতঃ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে প্রসার লাভ করে। যার অধিকাংশ আমল ছিল শিরক ও বিদ‘আতে ভরা। যদিও সেনারগাঁয়ের মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০খৃঃ) ও তার শিষ্যদের প্রচেষ্টায় আহলেহাদীছ আন্দোলন চালু থাকে। উল্লেখ্য যে, বোখারা (রাশিয়া) থেকে আগত এই স্বনামধন্য মুহাদ্দিছ-এর মাধ্যমেই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম বুখারী ও মুসলিমের দরস চালু হয়। তিনি সোনারগাঁয়ে দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ ছহীহায়েন-এর দরস দিয়েছিলেন। বলা চলে যে, প্রধানতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় এদেশে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সর্বাধিক প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে তুর্কী, মোগল, শী‘আ, পাঠান, আফগান প্রভৃতি দলের হাত বদল হয়ে যে ইসলাম এদেশে স্থিতি লাভ করে, তা হয়ে পড়ে শিরক, বিদ‘আত ও বিভিন্ন কুসংস্কারে ভরা জগাখিচুড়ী ইসলাম। বলা বাহুল্য যে, আজও সে অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নীতি : ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) তাঁর রায়-এর তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণ করতে তীব্রভাবে নিষেধ করে গিয়েছেন এবং ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যাবে, তখন সেটাই আমার মাযহাব’ বলে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়ে গিয়েছেন (দ্রঃ টীকা ৩)। সেকারণ আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী হানাফী (৮৯৮-৯৭৩ হিঃ) বলেন,
إِنَّهُ لَوْ عَاشَ حَتَّى دُوِّنَتْ أَحَادِيْثُ الشَّرِيْعَةِ .... لَأَخَذَ بِهَا وَ تَرَكَ كُلَّ قِيَاسٍ كَانَ قَاسَهُ وَ كَانَ الْقِيَاسُ قَلَّ فِيْ مَذْهَبِهِ كَمَا قَلَّ فِيْ مَذْهَبِ غَيْرِهِ ...
‘যদি (তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে) হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের স্বর্ণযুগে ইমাম আবু হানীফা বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তিনি সেগুলি গ্রহণ করতেন ও যত ক্বিয়াসী ফৎওয়া দিয়েছেন সবই বাদ দিতেন এবং তাঁর মাযহাবেও ক্বিয়াস কম হ’ত, যেমন অন্যদের মাযহাবে কম হয়েছে। .... যে কথা বলা হয়ে থাকে যে, ইমাম আবু হানীফা ক্বিয়াসকে দলীলের উপরে স্থান দিতেন, এটা তাঁর মুক্বাল্লিদগণের কথা মাত্র। যারা ইমামের ক্বিয়াসের উপরে আমল করাকে অপরিহার্য গণ্য করেছেন এবং হাদীছকে পরিত্যাগ করেছেন যা ইমামের মৃত্যুর পরে ছহীহ প্রমাণিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম দায়ী নন, বরং দায়ী তার অন্ধ অনুসারীবৃন্দ’।[11]
ফলকথা আহলুল হাদীছগণের বিপরীতে আহলুর রায়গণের ক্বিয়াস স্ব স্ব মাযহাবী বিদ্বানদের রচিত ব্যবহারিক আইনসূত্রসমূহ বা উছূলে ফিক্বহের উপরে ভিত্তিশীল, হাদীছের উপরে নয়।
মুজতাহিদগণের বিভক্তি :
হিজরী ষষ্ঠ শতকের খ্যাতনামা বিদ্বান আবুল ফাৎহ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী (৪৭৯-৫৪৮ হিঃ) বলেন,
ثُمَّ الْمُجْتَهِدُوْنَ مِنْ أَئِمَّةِ الْأُمَّةِ مَحْصُوْرُوْنَ فِيْ صِنْفَيْنِ لاَ يَعْدُوَانِ إِلَى ثَالِثٍ : أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ، أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ هُمْ أَهْلُ الْحِجَازِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ عِنَايَتَهُمْ بِتَحْصِيْلِ الْأَحَادِيْثِ وَ نَقْلِ الْأَخْبَارِ وَ بِنَاءِ الْأَحْكَامِ عَلَى النُّصُوْصِ وَ لاَيَرْجِعُوْنَ إِلَى الْقِيَاسِ الْجَلِىِّ وَ الْخَفِىِّ مَا وَجَدُوْا خَبَرًا أََوْ أَثَرًا ... وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ وَهُمْ أَهْلُ الْعِرَاقِ هُمْ أَصْحَابُ أَبِىْ حَنِيْفَةَ النُّعْمَانِ بْنِ الثَّابِتِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوا أَصْحَابَ الرَّأْىِ لِأَنَّ أَكْثَرَ عِنَايَتِهِمْ بِتَحْصِيْلِ وَجْهِ الْقِيَاسِ وَالْمَعْنَى الْمُسْتَنْبَطِ مِنَ الْأَحْكَامِ وَ بِنَاءِ الْحَوَادِثِ عَلَيْهَا وَ رُبَّمَا يُقَدِّمُوْنَ الْقِيَاسَ الْجَلِىَّ عَلَى آحَادِ الْأَخْبَارِ -
‘উম্মতের মুজতাহিদ ইমামগণ দু’ভাগে বিভক্ত, তৃতীয় কোন ভাগে নয়। আছহাবুল হাদীছ ও আছহাবুর রায় (আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়)। আহলুল হাদীছগণ হেজায (মক্কা-মদীনা)-এর অধিবাসী। তাঁদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ এ জন্য বলা হয় যে, তাঁদের সার্বিক লক্ষ্য নিয়োজিত থাকে হাদীছ সংগ্রহের প্রতি এবং তাঁরা সমস্ত আদেশ-নিষেধের ভিত্তি রাখেন (কুরআন-হাদীছের) দলীল সমূহের উপরে। হাদীছ বা আছার পেলে তাঁরা কোন প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ক্বিয়াসের দিকে ফিরে তাকান না...। পক্ষান্তরে আহলুর রায়গণ হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। তাঁরা আবু হানীফা নু‘মান ইবনু ছাবিত (৮০-১৫০ হিঃ)-এর অনুসারী। তাঁদেরকে ‘আহলুর রায়’ এ জন্য বলা হয়ে থাকে যে, তাঁদের অধিকতর লক্ষ্য থাকে ক্বিয়াসের কারণ অনুসন্ধানের প্রতি ও কুরআন-হাদীছের আহকাম হ’তে সৃষ্ট মর্মার্থের প্রতি এবং তার উপরেই তাঁরা উদ্ভূত ঘটনাসমূহের ভিত্তি স্থাপন করেন। কখনো কখনো তাঁরা ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছের উপরে প্রকাশ্য ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন’।[12]
আহলুল হাদীছের নীতির সপক্ষে মত প্রকাশ করতে গিয়ে হিজরী পঞ্চম শতকের ইউরোপীয় বিদ্বান স্পেনের মুহাম্মাদ আলী ইবনু হায্ম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন-এর প্রথম হ’তে শেষ পর্যন্ত সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বা ইজমা এই যে, তাঁদের কোন একজন ব্যক্তির সকল কথার প্রতি কর্ণপাত করা চলবে না। অতএব ঐ ব্যক্তি জেনে রাখুক, যে ব্যক্তি আবু হানীফার সকল কথা গ্রহণ করেছে, কিংবা মালেক, শাফেঈ বা আহমাদের সকল কথাকে গ্রহণ করেছে। তাঁদের কোন কথা ছাড়েনি বা অন্যের কথার প্রতি দৃকপাত করেনি, কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ-নিষেধের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করেনি, ঐ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ইজমায়ে উম্মতের বিরোধিতা করেছে। এ নীতির অনুসারী কোন লোক ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের তিনটি প্রশংসিত যুগে ছিল না। ঐ ব্যক্তি মুমিনদের গৃহীত পথের বাইরে গিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঐ অবস্থা হ’তে পানাহ দিন’।[13]
এক্ষণে আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে আমরা আল্লাহ-প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান নেব? না মানব রচিত ফিক্বহের ভিত্তিতে সমাধান নেব। আমরা বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈকে অগ্রাধিকার দেব? নাকি পরবর্তীতে সৃষ্ট একটি নির্দিষ্ট মাযহাবী ফিক্বহগ্রন্থ কুদূরী, শরহে বেকায়া, হেদায়াহ, আলমগীরীকে অগ্রাধিকার দেব। আমরা কি হাদীছপন্থী হব, নাকি রায়পন্থী হব? জানা আবশ্যক যে, নবীদের আগমন শেষ হয়ে গেছে, অহি-র অবতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু যুগে যুগে ‘রায়’-এর পরিবর্তন ঘটেছে, আজও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। বর্তমানে মুসলিম তরুণ সমাজ ক্রমেই বিজাতীয়দের রায়ের অনুসারী হয়ে পড়ছে। ফলে নানা মুণীর নানা মতে মুসলিম সমাজ আজ শতধা বিভক্ত। বিশৃংখল এই বিরাট উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ ও কল্যাণমুখী করার একটাই মাত্র পথ। সেটা হ’ল, সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে ফিরে চলা। পবিত্র কুরাআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালার সম্মুখে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। যুগ যুগ ধরে আহলেহাদীছ আন্দোলন এই কল্যাণ লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়ে এসেছে, আজও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ।
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো: ১৩২২ হিঃ)১/১২৯ পৃঃ; বিস্তারিত জানার জন্য ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ শীর্ষক আলোচনা দ্রষ্টব: ঐ, ১১৮-১২২।
[2]. আব্দুর রহমান ইবনু খালদূন, তারীখ (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুল আ‘লামী, তাবি), মুক্বাদ্দামা ১/৪৪৬।
[3]. ড. মুছতফা সাবাঈ, আস-সুন্নাহ (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৪র্থ সংস্করণ ১৪০৫/১৯৮৫), পৃঃ ৭৯।
[4]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫২-৫৩ ‘চতুর্থ শতাব্দী ও তার পরের লোকদের অবস্থা বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।
[5]. যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরূত : ছাপা, তাবি) ২/২৬৭পৃঃ।
[6]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫৩ পৃঃ।
[7]. শাহ অলিউল্লাহ, তাফহীমাতে ইলাহিয়াহ (ইউ,পি, বিজনৌর ১৩৫৫/১৯৩৬) ১/১৫১ পৃঃ।
[8]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো : দারুত তুরাছ, ১ম সংস্করণ ১৩৫৫/১৯৩৬), ১/১৪৯ পৃঃ, ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ অনুচ্ছেদ।
[9]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৪৬ ‘ফক্বীহদের মাযহাবী পার্থক্যের কারণ সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[10]. মুক্বাদ্দামা শারহু বেক্বায়াহ (দেউবন্দ ছাপা: তাবি) পৃঃ ৩৮।
[11]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী ছাপা : ১২৮৬ হিঃ) ১/৭৩ পৃঃ।
[12]. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী, কিতাবুল মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ২০৬-২০৭ পৃঃ।
[13]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (মিসরী ছাপা ১৩২২ হিঃ) ১/১২৩-১২৪ পৃঃ।
তাক্বলীদ ( اَلتَّقْلِيْدُ ) ‘ক্বালাদাহ’ ( القَلاَدَةُ ) হ’তে গৃহীত। যার অর্থ ‘গলাবন্ধ’। তাক্বলীদ-এর আভিধানিক অর্থ : গলায় রশি বাঁধা। পারিভাষিক অর্থ : قُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা বিনা দলীলে মেনে নেওয়া’। পক্ষান্তরে ‘ইত্তেবা’র আভিধানিক অর্থ : পদাংক অনুসরণ করা। পারিভাষিক অর্থ : قُُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مَعَ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা দলীল সহ মেনে নেওয়া’। তাক্বলীদ হ’ল রায়-এর অনুরসণ এবং ইত্তেবা হ’ল দলীলের অনুসরণ। উল্লেখ্য যে, কোন আলেমের ছহীহ দলীল ভিত্তিক কোন কথাকে মেনে নেওয়ার নাম ‘তাক্বলীদ’ নয়, বরং তা হ’ল ‘ইত্তেবা’। অনুরূপভাবে কোন আলেমের দেওয়া ফৎওয়ার বিপরীতে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া গেলে উক্ত ফৎওয়া পরিত্যাগ করে ছহীহ দলীলের অনুসরণ করাকে বলা হয় ‘ইত্তেবা’। ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের যুগে তাক্বলীদের কোনরূপ নামগন্ধ ছিল না। বরং তাঁদের দলীল ভিত্তিক কথার অনুসরণকে অনেকে ‘তাক্বলীদ’ বলে ভুল বুঝিয়েছেন।
আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল ‘তাক্বলীদে শাখ্ছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। ২য় শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, إِعْلَمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوْا قَبْلَ الْمِائَةِ الرَّابِعَةِ غَيْرَ مُجْمَعِيْنَ عَلَى التَّقْلِيْدِ الْخَالِصِ لِمَذْهَبٍ وَّاحِدٍ بِعَيْنِهِ ، ‘জেনে রাখ হে পাঠক! ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের তাক্বলীদের উপরে সংঘবদ্ধ ছিল না’। .. কোন সমস্যা সৃষ্টি হ’লে লোকেরা যেকোন আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ ব্যাপারে কারু মাযহাব যাচাই করা হ’ত না।[1]
হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিঃ) তৃতীয় শতাব্দী হিজরীর শেষদিকের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই সময় ‘আহলুর রায়’ (হানাফী) ফক্বীহদের নেতৃস্থানীয় অনেক আলেম, মু‘তাযিলা, শী‘আ ও কালাম শাস্ত্রবিদ (দার্শনিক) গণের স্তম্ভ বিশেষ বহু পন্ডিত বর্তমান ছিলেন, যারা যুক্তিবাদের উপরে ভিত্তি করে চলতেন এবং নবীর হাদীছকে কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকায় সালাফে ছালেহীনের তরীক্বা এড়িয়ে চলতেন। এই সময় ফক্বীহদের মধ্যে তাক্বলীদ আত্মপ্রকাশ করে ও ইজতিহাদের অবক্ষয় শুরু হয়’।[2]
ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) বলেন, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হবার পরে ইসলামী খেলাফত এমন সব লোকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যারা শারঈ বিধানে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তারা সকল বিষয়ে ফক্বীহদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে বিভিন্ন সরকারী পদে তলব করা হ’তে থাকে। ফলে তখন লোকেরা ইল্ম শিখতে লাগল সম্মান ও প্রতিপত্তি হাছিলের মাধ্যম হিসাবে। মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ কেউ কালাম শাস্ত্রের উপরে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। সেখানে বহু কূটতর্কের অবতারণা করা হ’ল। এই সময় শাসকগণ হানাফী ও শাফেঈ ফিক্বহের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী হ’লেন। ফলে বিদ্বানগণ উক্ত দুই মাযহাবের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়সমূহের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন এবং বহু ঝগড়া ও অসংখ্য বই-পুস্তকাদি প্রণয়ন করেন। এইভাবে স্ব স্ব মাযহাবের পক্ষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্যসমূহ উদ্ধার করাকেই তারা তাদের মৌল উদ্দেশ্য হিসাবে গণ্য করেন। এই অবস্থা এখনও চলছে। আমরা জানি না ভবিষ্যতের লিখন কী আছে? (সংক্ষেপায়িত)। [3]
অতঃপর শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘(হে পাঠক!) বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলে তুমি মুসলমানদের দেখবে যে, তারা বিগত কোন একজন মুজতাহিদ বিদ্বানের মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি ঐ বিদ্বানের তাক্বলীদ হ’তে সে বেরিয়ে আসে, তাহ’লে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে ( كَأَنَّهُ نَبِىٌّ بُعِثَ إِلَيْهِ ) এবং যার অনুসরণ তার উপরে ফরয করা হয়েছে। অথচ ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না।[4]
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫২-৫৩ ‘চতুর্থ শতাব্দী ও তার পরের লোকদের অবস্থা বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরূত : ছাপা, তাবি) ২/২৬৭পৃঃ।
[3]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫৩ পৃঃ।
[4]. শাহ অলিউল্লাহ, তাফহীমাতে ইলাহিয়াহ (ইউ,পি, বিজনৌর ১৩৫৫/১৯৩৬) ১/১৫১ পৃঃ।
আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল ‘তাক্বলীদে শাখ্ছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। ২য় শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, إِعْلَمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوْا قَبْلَ الْمِائَةِ الرَّابِعَةِ غَيْرَ مُجْمَعِيْنَ عَلَى التَّقْلِيْدِ الْخَالِصِ لِمَذْهَبٍ وَّاحِدٍ بِعَيْنِهِ ، ‘জেনে রাখ হে পাঠক! ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের তাক্বলীদের উপরে সংঘবদ্ধ ছিল না’। .. কোন সমস্যা সৃষ্টি হ’লে লোকেরা যেকোন আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ ব্যাপারে কারু মাযহাব যাচাই করা হ’ত না।[1]
হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিঃ) তৃতীয় শতাব্দী হিজরীর শেষদিকের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই সময় ‘আহলুর রায়’ (হানাফী) ফক্বীহদের নেতৃস্থানীয় অনেক আলেম, মু‘তাযিলা, শী‘আ ও কালাম শাস্ত্রবিদ (দার্শনিক) গণের স্তম্ভ বিশেষ বহু পন্ডিত বর্তমান ছিলেন, যারা যুক্তিবাদের উপরে ভিত্তি করে চলতেন এবং নবীর হাদীছকে কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকায় সালাফে ছালেহীনের তরীক্বা এড়িয়ে চলতেন। এই সময় ফক্বীহদের মধ্যে তাক্বলীদ আত্মপ্রকাশ করে ও ইজতিহাদের অবক্ষয় শুরু হয়’।[2]
ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) বলেন, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হবার পরে ইসলামী খেলাফত এমন সব লোকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যারা শারঈ বিধানে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তারা সকল বিষয়ে ফক্বীহদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে বিভিন্ন সরকারী পদে তলব করা হ’তে থাকে। ফলে তখন লোকেরা ইল্ম শিখতে লাগল সম্মান ও প্রতিপত্তি হাছিলের মাধ্যম হিসাবে। মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ কেউ কালাম শাস্ত্রের উপরে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। সেখানে বহু কূটতর্কের অবতারণা করা হ’ল। এই সময় শাসকগণ হানাফী ও শাফেঈ ফিক্বহের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী হ’লেন। ফলে বিদ্বানগণ উক্ত দুই মাযহাবের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়সমূহের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন এবং বহু ঝগড়া ও অসংখ্য বই-পুস্তকাদি প্রণয়ন করেন। এইভাবে স্ব স্ব মাযহাবের পক্ষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্যসমূহ উদ্ধার করাকেই তারা তাদের মৌল উদ্দেশ্য হিসাবে গণ্য করেন। এই অবস্থা এখনও চলছে। আমরা জানি না ভবিষ্যতের লিখন কী আছে? (সংক্ষেপায়িত)। [3]
অতঃপর শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘(হে পাঠক!) বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলে তুমি মুসলমানদের দেখবে যে, তারা বিগত কোন একজন মুজতাহিদ বিদ্বানের মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি ঐ বিদ্বানের তাক্বলীদ হ’তে সে বেরিয়ে আসে, তাহ’লে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে ( كَأَنَّهُ نَبِىٌّ بُعِثَ إِلَيْهِ ) এবং যার অনুসরণ তার উপরে ফরয করা হয়েছে। অথচ ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না।[4]
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫২-৫৩ ‘চতুর্থ শতাব্দী ও তার পরের লোকদের অবস্থা বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরূত : ছাপা, তাবি) ২/২৬৭পৃঃ।
[3]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫৩ পৃঃ।
[4]. শাহ অলিউল্লাহ, তাফহীমাতে ইলাহিয়াহ (ইউ,পি, বিজনৌর ১৩৫৫/১৯৩৬) ১/১৫১ পৃঃ।
শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ইসলামী বিধান প্রণয়নে আহলেহাদীছ বিদ্বানদের অনুসৃত ‘ইস্তিদলালী পদ্ধতি’ বা দলীল গ্রহণের নীতিমালা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘(১) কোন বিষয়ে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ পেলে তাঁরা তাই গ্রহণ করেন। অন্যদিকে মুখ ফিরানোকে তাঁরা জায়েয মনে করেন না (২) কোন বিষয়ে কুরআনের কোন নির্দেশ অস্পষ্ট হ’লে সেক্ষেত্রে ‘সুন্নাহ’ ফায়ছালাকারী হবে। উক্ত হাদীছ সর্বত্র প্রচারিত থাকুক বা না থাকুক, তার উপরে ছাহাবীগণ বা ফক্বীহগণ আমল করুন বা না করুন। কোন বিষয়ে ‘হাদীছ’ পাওয়া গেলে তার বিপরীতে কোন ছাহাবীর ‘আছার’ কিংবা কোন মুজতাহিদের ‘ইজতিহাদ’ গ্রহণযোগ্য হবে না (৩) সার্বিক প্রচেষ্টার পরেও কোন বিষয়ে হাদীছ না পাওয়া গেলে আহলেহাদীছগণ ছাহাবী ও তাবেঈগণের যেকোন একটি জামা‘আতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেন। এক্ষেত্রে তাঁরা কোন একটি দল, শহর বা এলাকার অধিবাসীকে নির্দিষ্টভাবে অগ্রগণ্য মনে করেন না (৪) যদি কোন বিষয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন ও ফক্বীহগণ একমত হন, তবে তাকেই তাঁরা যথেষ্ট মনে করেন (৫) কিন্তু যদি সেখানে মতভেদ থাকে, তবে তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক বিদ্বান, পরহেযগার ও স্মৃতিধর তাঁর কথা অথবা তাঁদের মধ্যকার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কথাটি গ্রহণ করেন (৬) যখন কোন বিষয়ে সমশ্রেণীভুক্ত দু’টি বক্তব্য পাওয়া যায়, তখন সেক্ষেত্রে তাঁরা দু’টিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন (৭) কিন্তু যখন সেটিতেও ব্যর্থ হন, তখন তাঁরা কিতাব ও সুন্নাতের সাধারণ নির্দেশ ও ইঙ্গিতসমূহ এবং উদ্দেশ্যাবলী অনুধাবন করেন। অতঃপর উক্ত বিষয়ে তাঁরা প্রচলিত কোন উছূল বা ব্যবহারিক আইন সূত্রের অনুসরণ করেন না। বরং যে কথাটি তাঁরা উত্তমরূপে বুঝতে পারেন ও যা তাঁদের হৃদয়কে সুশীতল করে, তারই অনুসরণ করেন’।[1]
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো : দারুত তুরাছ, ১ম সংস্করণ ১৩৫৫/১৯৩৬), ১/১৪৯ পৃঃ, ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ অনুচ্ছেদ।
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো : দারুত তুরাছ, ১ম সংস্করণ ১৩৫৫/১৯৩৬), ১/১৪৯ পৃঃ, ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ অনুচ্ছেদ।
হানাফী মাযহাব সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। খলীফা মাহ্দী, হাদী ও হারূনুর রশীদের আমলে (১৫৮-১৯৩ হিঃ) ইমাম আবু হানীফার প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ) দেশের প্রধান বিচারপতি থাকার সুবাদে ইরাক, ইরান ও মধ্য তুর্কিস্তান সহ খেলাফতের সর্বত্র হানাফী মাযহাবের ফাতাওয়া ও সিদ্ধান্তসমূহ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) এদিকে ইঙ্গিত করে বলেন, فَكَانَ سَبَبًا لِظُهُوْرِ مَذْهَبِهِ ‘এটাই ছিল তাঁর মাযহাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ’।[1] আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী (১২৬৪-১৩০৪/১৮৪৮-৮৬) একথা সমর্থন করে বলেন, هُوَ اَوَّلُ مَنْ نَشَرَ عِلْمَ أَبِىْ حَنِيْفَةَ فِىْ أَقْطَارِ الْأَرْضِ وَ ثَبَتَ الْمَسَائِلَ ‘তিনিই প্রথম আবু হানীফার ইল্ম পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন ও তাঁর মাসআলাসমূহ প্রতিষ্ঠিত করেন’।[2]
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইসলাম এসেছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খলীফাদের আমলেই আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে। বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির পূর্বে আগত সেই ইসলাম ছিল হাদীছ ভিত্তিক নির্ভেজাল ইসলাম। নিঃসন্দেহে তাঁরা ছিলেন ‘আহলেহাদীছ’। পরবর্তী হানাফী মতাবলম্বী সেনাপতি ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খৃষ্টাব্দের সামরিক বিজয় ও তাঁর সাথে ও পরে আগত তুর্কী হানাফী আলেম ও মারেফতী ফকীরদের মাধ্যমে প্রচারিত হানাফী ও মারেফতী ইসলাম প্রধানতঃ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে প্রসার লাভ করে। যার অধিকাংশ আমল ছিল শিরক ও বিদ‘আতে ভরা। যদিও সেনারগাঁয়ের মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০খৃঃ) ও তার শিষ্যদের প্রচেষ্টায় আহলেহাদীছ আন্দোলন চালু থাকে। উল্লেখ্য যে, বোখারা (রাশিয়া) থেকে আগত এই স্বনামধন্য মুহাদ্দিছ-এর মাধ্যমেই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম বুখারী ও মুসলিমের দরস চালু হয়। তিনি সোনারগাঁয়ে দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ ছহীহায়েন-এর দরস দিয়েছিলেন। বলা চলে যে, প্রধানতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় এদেশে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সর্বাধিক প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে তুর্কী, মোগল, শী‘আ, পাঠান, আফগান প্রভৃতি দলের হাত বদল হয়ে যে ইসলাম এদেশে স্থিতি লাভ করে, তা হয়ে পড়ে শিরক, বিদ‘আত ও বিভিন্ন কুসংস্কারে ভরা জগাখিচুড়ী ইসলাম। বলা বাহুল্য যে, আজও সে অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৪৬ ‘ফক্বীহদের মাযহাবী পার্থক্যের কারণ সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[2]. মুক্বাদ্দামা শারহু বেক্বায়াহ (দেউবন্দ ছাপা: তাবি) পৃঃ ৩৮।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইসলাম এসেছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খলীফাদের আমলেই আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে। বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির পূর্বে আগত সেই ইসলাম ছিল হাদীছ ভিত্তিক নির্ভেজাল ইসলাম। নিঃসন্দেহে তাঁরা ছিলেন ‘আহলেহাদীছ’। পরবর্তী হানাফী মতাবলম্বী সেনাপতি ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খৃষ্টাব্দের সামরিক বিজয় ও তাঁর সাথে ও পরে আগত তুর্কী হানাফী আলেম ও মারেফতী ফকীরদের মাধ্যমে প্রচারিত হানাফী ও মারেফতী ইসলাম প্রধানতঃ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে প্রসার লাভ করে। যার অধিকাংশ আমল ছিল শিরক ও বিদ‘আতে ভরা। যদিও সেনারগাঁয়ের মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০খৃঃ) ও তার শিষ্যদের প্রচেষ্টায় আহলেহাদীছ আন্দোলন চালু থাকে। উল্লেখ্য যে, বোখারা (রাশিয়া) থেকে আগত এই স্বনামধন্য মুহাদ্দিছ-এর মাধ্যমেই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম বুখারী ও মুসলিমের দরস চালু হয়। তিনি সোনারগাঁয়ে দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ ছহীহায়েন-এর দরস দিয়েছিলেন। বলা চলে যে, প্রধানতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় এদেশে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সর্বাধিক প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে তুর্কী, মোগল, শী‘আ, পাঠান, আফগান প্রভৃতি দলের হাত বদল হয়ে যে ইসলাম এদেশে স্থিতি লাভ করে, তা হয়ে পড়ে শিরক, বিদ‘আত ও বিভিন্ন কুসংস্কারে ভরা জগাখিচুড়ী ইসলাম। বলা বাহুল্য যে, আজও সে অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৪৬ ‘ফক্বীহদের মাযহাবী পার্থক্যের কারণ সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[2]. মুক্বাদ্দামা শারহু বেক্বায়াহ (দেউবন্দ ছাপা: তাবি) পৃঃ ৩৮।
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) তাঁর রায়-এর তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণ করতে তীব্রভাবে নিষেধ করে গিয়েছেন এবং ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যাবে, তখন সেটাই আমার মাযহাব’ বলে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়ে গিয়েছেন (দ্রঃ টীকা ৩)। সেকারণ আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী হানাফী (৮৯৮-৯৭৩ হিঃ) বলেন,
إِنَّهُ لَوْ عَاشَ حَتَّى دُوِّنَتْ أَحَادِيْثُ الشَّرِيْعَةِ .... لَأَخَذَ بِهَا وَ تَرَكَ كُلَّ قِيَاسٍ كَانَ قَاسَهُ وَ كَانَ الْقِيَاسُ قَلَّ فِيْ مَذْهَبِهِ كَمَا قَلَّ فِيْ مَذْهَبِ غَيْرِهِ ...
‘যদি (তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে) হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের স্বর্ণযুগে ইমাম আবু হানীফা বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তিনি সেগুলি গ্রহণ করতেন ও যত ক্বিয়াসী ফৎওয়া দিয়েছেন সবই বাদ দিতেন এবং তাঁর মাযহাবেও ক্বিয়াস কম হ’ত, যেমন অন্যদের মাযহাবে কম হয়েছে। .... যে কথা বলা হয়ে থাকে যে, ইমাম আবু হানীফা ক্বিয়াসকে দলীলের উপরে স্থান দিতেন, এটা তাঁর মুক্বাল্লিদগণের কথা মাত্র। যারা ইমামের ক্বিয়াসের উপরে আমল করাকে অপরিহার্য গণ্য করেছেন এবং হাদীছকে পরিত্যাগ করেছেন যা ইমামের মৃত্যুর পরে ছহীহ প্রমাণিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম দায়ী নন, বরং দায়ী তার অন্ধ অনুসারীবৃন্দ’।[1]
ফলকথা আহলুল হাদীছগণের বিপরীতে আহলুর রায়গণের ক্বিয়াস স্ব স্ব মাযহাবী বিদ্বানদের রচিত ব্যবহারিক আইনসূত্রসমূহ বা উছূলে ফিক্বহের উপরে ভিত্তিশীল, হাদীছের উপরে নয়।
[1]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী ছাপা : ১২৮৬ হিঃ) ১/৭৩ পৃঃ।
إِنَّهُ لَوْ عَاشَ حَتَّى دُوِّنَتْ أَحَادِيْثُ الشَّرِيْعَةِ .... لَأَخَذَ بِهَا وَ تَرَكَ كُلَّ قِيَاسٍ كَانَ قَاسَهُ وَ كَانَ الْقِيَاسُ قَلَّ فِيْ مَذْهَبِهِ كَمَا قَلَّ فِيْ مَذْهَبِ غَيْرِهِ ...
‘যদি (তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে) হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের স্বর্ণযুগে ইমাম আবু হানীফা বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তিনি সেগুলি গ্রহণ করতেন ও যত ক্বিয়াসী ফৎওয়া দিয়েছেন সবই বাদ দিতেন এবং তাঁর মাযহাবেও ক্বিয়াস কম হ’ত, যেমন অন্যদের মাযহাবে কম হয়েছে। .... যে কথা বলা হয়ে থাকে যে, ইমাম আবু হানীফা ক্বিয়াসকে দলীলের উপরে স্থান দিতেন, এটা তাঁর মুক্বাল্লিদগণের কথা মাত্র। যারা ইমামের ক্বিয়াসের উপরে আমল করাকে অপরিহার্য গণ্য করেছেন এবং হাদীছকে পরিত্যাগ করেছেন যা ইমামের মৃত্যুর পরে ছহীহ প্রমাণিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম দায়ী নন, বরং দায়ী তার অন্ধ অনুসারীবৃন্দ’।[1]
ফলকথা আহলুল হাদীছগণের বিপরীতে আহলুর রায়গণের ক্বিয়াস স্ব স্ব মাযহাবী বিদ্বানদের রচিত ব্যবহারিক আইনসূত্রসমূহ বা উছূলে ফিক্বহের উপরে ভিত্তিশীল, হাদীছের উপরে নয়।
[1]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী ছাপা : ১২৮৬ হিঃ) ১/৭৩ পৃঃ।
হিজরী ষষ্ঠ শতকের খ্যাতনামা বিদ্বান আবুল ফাৎহ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী (৪৭৯-৫৪৮ হিঃ) বলেন,
ثُمَّ الْمُجْتَهِدُوْنَ مِنْ أَئِمَّةِ الْأُمَّةِ مَحْصُوْرُوْنَ فِيْ صِنْفَيْنِ لاَ يَعْدُوَانِ إِلَى ثَالِثٍ : أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ، أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ هُمْ أَهْلُ الْحِجَازِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ عِنَايَتَهُمْ بِتَحْصِيْلِ الْأَحَادِيْثِ وَ نَقْلِ الْأَخْبَارِ وَ بِنَاءِ الْأَحْكَامِ عَلَى النُّصُوْصِ وَ لاَيَرْجِعُوْنَ إِلَى الْقِيَاسِ الْجَلِىِّ وَ الْخَفِىِّ مَا وَجَدُوْا خَبَرًا أََوْ أَثَرًا ... وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ وَهُمْ أَهْلُ الْعِرَاقِ هُمْ أَصْحَابُ أَبِىْ حَنِيْفَةَ النُّعْمَانِ بْنِ الثَّابِتِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوا أَصْحَابَ الرَّأْىِ لِأَنَّ أَكْثَرَ عِنَايَتِهِمْ بِتَحْصِيْلِ وَجْهِ الْقِيَاسِ وَالْمَعْنَى الْمُسْتَنْبَطِ مِنَ الْأَحْكَامِ وَ بِنَاءِ الْحَوَادِثِ عَلَيْهَا وَ رُبَّمَا يُقَدِّمُوْنَ الْقِيَاسَ الْجَلِىَّ عَلَى آحَادِ الْأَخْبَارِ -
‘উম্মতের মুজতাহিদ ইমামগণ দু’ভাগে বিভক্ত, তৃতীয় কোন ভাগে নয়। আছহাবুল হাদীছ ও আছহাবুর রায় (আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়)। আহলুল হাদীছগণ হেজায (মক্কা-মদীনা)-এর অধিবাসী। তাঁদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ এ জন্য বলা হয় যে, তাঁদের সার্বিক লক্ষ্য নিয়োজিত থাকে হাদীছ সংগ্রহের প্রতি এবং তাঁরা সমস্ত আদেশ-নিষেধের ভিত্তি রাখেন (কুরআন-হাদীছের) দলীল সমূহের উপরে। হাদীছ বা আছার পেলে তাঁরা কোন প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ক্বিয়াসের দিকে ফিরে তাকান না...। পক্ষান্তরে আহলুর রায়গণ হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। তাঁরা আবু হানীফা নু‘মান ইবনু ছাবিত (৮০-১৫০ হিঃ)-এর অনুসারী। তাঁদেরকে ‘আহলুর রায়’ এ জন্য বলা হয়ে থাকে যে, তাঁদের অধিকতর লক্ষ্য থাকে ক্বিয়াসের কারণ অনুসন্ধানের প্রতি ও কুরআন-হাদীছের আহকাম হ’তে সৃষ্ট মর্মার্থের প্রতি এবং তার উপরেই তাঁরা উদ্ভূত ঘটনাসমূহের ভিত্তি স্থাপন করেন। কখনো কখনো তাঁরা ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছের উপরে প্রকাশ্য ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন’।[1]
আহলুল হাদীছের নীতির সপক্ষে মত প্রকাশ করতে গিয়ে হিজরী পঞ্চম শতকের ইউরোপীয় বিদ্বান স্পেনের মুহাম্মাদ আলী ইবনু হায্ম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন-এর প্রথম হ’তে শেষ পর্যন্ত সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বা ইজমা এই যে, তাঁদের কোন একজন ব্যক্তির সকল কথার প্রতি কর্ণপাত করা চলবে না। অতএব ঐ ব্যক্তি জেনে রাখুক, যে ব্যক্তি আবু হানীফার সকল কথা গ্রহণ করেছে, কিংবা মালেক, শাফেঈ বা আহমাদের সকল কথাকে গ্রহণ করেছে। তাঁদের কোন কথা ছাড়েনি বা অন্যের কথার প্রতি দৃকপাত করেনি, কুরআন ও সুন্নাহ্র আদেশ-নিষেধের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করেনি, ঐ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ইজমায়ে উম্মতের বিরোধিতা করেছে। এ নীতির অনুসারী কোন লোক ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের তিনটি প্রশংসিত যুগে ছিল না। ঐ ব্যক্তি মুমিনদের গৃহীত পথের বাইরে গিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঐ অবস্থা হ’তে পানাহ দিন’।[2]
এক্ষণে আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে আমরা আল্লাহ-প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান নেব? না মানব রচিত ফিক্বহের ভিত্তিতে সমাধান নেব। আমরা বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈকে অগ্রাধিকার দেব? নাকি পরবর্তীতে সৃষ্ট একটি নির্দিষ্ট মাযহাবী ফিক্বহগ্রন্থ কুদূরী, শরহে বেকায়া, হেদায়াহ, আলমগীরীকে অগ্রাধিকার দেব। আমরা কি হাদীছপন্থী হব, নাকি রায়পন্থী হব? জানা আবশ্যক যে, নবীদের আগমন শেষ হয়ে গেছে, অহি-র অবতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু যুগে যুগে ‘রায়’-এর পরিবর্তন ঘটেছে, আজও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। বর্তমানে মুসলিম তরুণ সমাজ ক্রমেই বিজাতীয়দের রায়ের অনুসারী হয়ে পড়ছে। ফলে নানা মুণীর নানা মতে মুসলিম সমাজ আজ শতধা বিভক্ত। বিশৃংখল এই বিরাট উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ ও কল্যাণমুখী করার একটাই মাত্র পথ। সেটা হ’ল, সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্র দিকে ফিরে চলা। পবিত্র কুরাআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালার সম্মুখে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। যুগ যুগ ধরে আহলেহাদীছ আন্দোলন এই কল্যাণ লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়ে এসেছে, আজও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ।
[1]. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী, কিতাবুল মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ২০৬-২০৭ পৃঃ।
[2]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (মিসরী ছাপা ১৩২২ হিঃ) ১/১২৩-১২৪ পৃঃ।
ثُمَّ الْمُجْتَهِدُوْنَ مِنْ أَئِمَّةِ الْأُمَّةِ مَحْصُوْرُوْنَ فِيْ صِنْفَيْنِ لاَ يَعْدُوَانِ إِلَى ثَالِثٍ : أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ، أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ هُمْ أَهْلُ الْحِجَازِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ عِنَايَتَهُمْ بِتَحْصِيْلِ الْأَحَادِيْثِ وَ نَقْلِ الْأَخْبَارِ وَ بِنَاءِ الْأَحْكَامِ عَلَى النُّصُوْصِ وَ لاَيَرْجِعُوْنَ إِلَى الْقِيَاسِ الْجَلِىِّ وَ الْخَفِىِّ مَا وَجَدُوْا خَبَرًا أََوْ أَثَرًا ... وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ وَهُمْ أَهْلُ الْعِرَاقِ هُمْ أَصْحَابُ أَبِىْ حَنِيْفَةَ النُّعْمَانِ بْنِ الثَّابِتِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوا أَصْحَابَ الرَّأْىِ لِأَنَّ أَكْثَرَ عِنَايَتِهِمْ بِتَحْصِيْلِ وَجْهِ الْقِيَاسِ وَالْمَعْنَى الْمُسْتَنْبَطِ مِنَ الْأَحْكَامِ وَ بِنَاءِ الْحَوَادِثِ عَلَيْهَا وَ رُبَّمَا يُقَدِّمُوْنَ الْقِيَاسَ الْجَلِىَّ عَلَى آحَادِ الْأَخْبَارِ -
‘উম্মতের মুজতাহিদ ইমামগণ দু’ভাগে বিভক্ত, তৃতীয় কোন ভাগে নয়। আছহাবুল হাদীছ ও আছহাবুর রায় (আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়)। আহলুল হাদীছগণ হেজায (মক্কা-মদীনা)-এর অধিবাসী। তাঁদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ এ জন্য বলা হয় যে, তাঁদের সার্বিক লক্ষ্য নিয়োজিত থাকে হাদীছ সংগ্রহের প্রতি এবং তাঁরা সমস্ত আদেশ-নিষেধের ভিত্তি রাখেন (কুরআন-হাদীছের) দলীল সমূহের উপরে। হাদীছ বা আছার পেলে তাঁরা কোন প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ক্বিয়াসের দিকে ফিরে তাকান না...। পক্ষান্তরে আহলুর রায়গণ হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। তাঁরা আবু হানীফা নু‘মান ইবনু ছাবিত (৮০-১৫০ হিঃ)-এর অনুসারী। তাঁদেরকে ‘আহলুর রায়’ এ জন্য বলা হয়ে থাকে যে, তাঁদের অধিকতর লক্ষ্য থাকে ক্বিয়াসের কারণ অনুসন্ধানের প্রতি ও কুরআন-হাদীছের আহকাম হ’তে সৃষ্ট মর্মার্থের প্রতি এবং তার উপরেই তাঁরা উদ্ভূত ঘটনাসমূহের ভিত্তি স্থাপন করেন। কখনো কখনো তাঁরা ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছের উপরে প্রকাশ্য ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন’।[1]
আহলুল হাদীছের নীতির সপক্ষে মত প্রকাশ করতে গিয়ে হিজরী পঞ্চম শতকের ইউরোপীয় বিদ্বান স্পেনের মুহাম্মাদ আলী ইবনু হায্ম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন-এর প্রথম হ’তে শেষ পর্যন্ত সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বা ইজমা এই যে, তাঁদের কোন একজন ব্যক্তির সকল কথার প্রতি কর্ণপাত করা চলবে না। অতএব ঐ ব্যক্তি জেনে রাখুক, যে ব্যক্তি আবু হানীফার সকল কথা গ্রহণ করেছে, কিংবা মালেক, শাফেঈ বা আহমাদের সকল কথাকে গ্রহণ করেছে। তাঁদের কোন কথা ছাড়েনি বা অন্যের কথার প্রতি দৃকপাত করেনি, কুরআন ও সুন্নাহ্র আদেশ-নিষেধের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করেনি, ঐ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ইজমায়ে উম্মতের বিরোধিতা করেছে। এ নীতির অনুসারী কোন লোক ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের তিনটি প্রশংসিত যুগে ছিল না। ঐ ব্যক্তি মুমিনদের গৃহীত পথের বাইরে গিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঐ অবস্থা হ’তে পানাহ দিন’।[2]
এক্ষণে আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে আমরা আল্লাহ-প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান নেব? না মানব রচিত ফিক্বহের ভিত্তিতে সমাধান নেব। আমরা বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈকে অগ্রাধিকার দেব? নাকি পরবর্তীতে সৃষ্ট একটি নির্দিষ্ট মাযহাবী ফিক্বহগ্রন্থ কুদূরী, শরহে বেকায়া, হেদায়াহ, আলমগীরীকে অগ্রাধিকার দেব। আমরা কি হাদীছপন্থী হব, নাকি রায়পন্থী হব? জানা আবশ্যক যে, নবীদের আগমন শেষ হয়ে গেছে, অহি-র অবতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু যুগে যুগে ‘রায়’-এর পরিবর্তন ঘটেছে, আজও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। বর্তমানে মুসলিম তরুণ সমাজ ক্রমেই বিজাতীয়দের রায়ের অনুসারী হয়ে পড়ছে। ফলে নানা মুণীর নানা মতে মুসলিম সমাজ আজ শতধা বিভক্ত। বিশৃংখল এই বিরাট উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ ও কল্যাণমুখী করার একটাই মাত্র পথ। সেটা হ’ল, সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্র দিকে ফিরে চলা। পবিত্র কুরাআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালার সম্মুখে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। যুগ যুগ ধরে আহলেহাদীছ আন্দোলন এই কল্যাণ লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়ে এসেছে, আজও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ।
[1]. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী, কিতাবুল মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ২০৬-২০৭ পৃঃ।
[2]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (মিসরী ছাপা ১৩২২ হিঃ) ১/১২৩-১২৪ পৃঃ।
ছাহাবী ও তাবেঈগণ প্রথম যুগের আহলেহাদীছ ছিলেন। তাঁদের হাতে বিজিত ও তাঁদের মাধ্যমে প্রচারিত তৎকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার মুসলিমগণ সকলেই ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। ৩৭ হিজরীর পর থেকে বিদ‘আতীদের উদ্ভব হ’তে থাকলে তাদের বিপরীতে আহলুল হাদীছগণ স্বতন্ত্র নামে ও অনন্য বৈশিষ্ট্যে পরিচালিত হ’তে থাকেন। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে তাক্বলীদ ভিত্তিক বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির ফলে তৎকালীন পৃথিবীর মুসলিম অঞ্চলসমূহে আহলুল হাদীছের পাশাপাশি বিভিন্ন মাযহাবী দলেরও সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন প্রখ্যাত মুসলিম ভূ-পর্যটক শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাক্বদেসী চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর মাঝামাঝি নাগাদ পৃথিবীর মুসলিম এলাকাসমূহ পরিভ্রমণে বের হন। তৎকালীন বিশ্বের আহলেহাদীছ অধ্যুষিত এলাকাসমূহের কিছু কিছু তথ্য তিনি স্বীয় ‘আহসানুত তাক্বাসীম ফী মা‘রিফাতিল আক্বালীম’ নামক ভ্রমণ গ্রন্থে বিবৃত করেছেন। তিনি বলেন, ‘হেজায তথা মক্কা-মদীনার এলাকায় আহলে সুন্নাত (পৃঃ ৯৬) এবং আববাসীয় রাজধানী বাগদাদের অধিকাংশ ফক্বীহ ও বিচারপতি হানাফী ছিলেন (পৃঃ ১২৭)। উমাইয়াদের রাজধানী দামেশক ও সিরিয়ার লোকদের সমস্ত আমল আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরেই ( وَالْعَمَلُ كَانَ فِيْهِ عَلَى مَذْهَبِ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ ) আছে। এখানে মু‘তাযিলাদের স্থান নেই। মালেকী বা দাঊদীও নেই’ (পৃঃ ১৭৯-৮০)।
অতঃপর মাক্বদেসী ৩৭৫ হিজরীতে ভারতে তৎকালীন ইসলামী রাজধানী সিন্ধুর মানছূরায় আসেন। মানছূরা (করাচী) সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সেখানকার অধিকাংশ (মুসলিম) অধিবাসী আহলেহাদীছ’ ( أَكْثَرُهُمْ أَصْحَابُ حَدِيْثٍ )। ক্বাযী আবু মুহাম্মাদ মানছূরী নামে সেখানে দাঊদী মাযহাবের একজন ইমাম আছেন। তাঁর লিখিত অনেক মূল্যবান কেতাব রয়েছে। মুলতানের অধিবাসীরা শী‘আ মতাবলম্বী। প্রত্যেক শহরেই কিছু কিছু হানাফী ফক্বীহ রয়েছেন। এখানে মালেকী বা মু‘তাযেলী কেউ নেই, হাম্বলীও নেই’।[1]
মাক্বদেসীর অর্ধশত বছর পরে ঐতিহাসিক আবু মানছূর আব্দুল ক্বাহির বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯) তৎকালীন পৃথিবীতে আহলেহাদীছদের অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেন,
ثُغُوْرُ الرُّوْمِ وَالْجَزِيْرَةِ وَ ثُغُوْرُ الشَّامِ وَ ثُغُوْرُ آذَرْبَيْجَانَ وَبَابِ الْأَبْوَابِ كُلُّهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَ كَذَالِكَ ثُغُوْرُ أَفْرِيْقِيَّةَ وَ أَنْدَلُسَ وَ كُلُّ ثِغَرِ وَرَاءِ بَحْرِ الْمَغْرِبِ أَهْلُهُ مِنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ وَ كَذَالِكَ ثُغُوْرُ الْيَمَنِ عَلَى سَاحِلِ الزَّنْجِ ، وَأَمَّا ثُغُوْرُ أَهْلِ مَا وَرَاءِ النَّهْرِ فِيْ وُجُوْهِ التُّرْكِ وَ الصِّيْنِ فَهُمْ فَرِيْقَانِ : إِمَّا شَافِعِيَّةٌ وَإِمَّا مِنْ أَصْحَابِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ -
‘রূম সীমান্ত, আলজিরিয়া, সিরিয়া, আযারবাইজান, বাবুল আবওয়াব (মধ্য তুর্কিস্তান) প্রভৃতি এলাকার সকল মুসলিম অধিবাসী ‘আহলেহাদীছ’ মাযহাবের উপরে ছিলেন। এমনিভাবে আফ্রিকা, স্পেন ও পশ্চিম সাগরের পশ্চাদবর্তী দেশসমূহের সকল মুসলমান ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। একইভাবে আবিসিনিয়ার উপকূলবর্তী ইয়ামনের সকল অধিবাসী ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। তবে তুরস্ক ও চীন অভিমুখী মধ্য তুর্কিস্তান সীমান্তের অধিকারীদের মধ্যে দু’টি দল ছিল : একদল শাফেঈ ও একদল আবু হানীফার অনুসারী’।[2]
মাক্বদেসী ও আবদুল ক্বাহির বাগদাদীর উপরোক্ত বর্ণনা হ’তে প্রমাণিত হয় যে, বাগদাদী খেলাফতের স্কন্ধে সওয়ার হয়ে ‘আহলুর রায়’ ও মু‘তাযিলাদের চরম রাজনৈতিক ও মাযহাবী নির্যাতন সত্ত্বেও পঞ্চম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত খোদ মক্কা-মদীনা ও সিরিয়া সহ ইউরোপ, আফ্রিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, নিকটপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং সুদূর সিন্ধু পর্যন্ত আহলেহাদীছ জনগণের সংখ্যাধিক্য বজায় ছিল, যা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার বৈ কি!
৩৭৫ হিজরীর কিছু পরে মানছূরার শাসন ক্ষমতা ইসমাঈলী শী‘আদের হাতে চলে যায়। অন্যদিকে ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খৃষ্টাব্দ থেকে দিল্লীতে ও বাংলাদেশে শুরু হয় ‘আহলুর রায়’ হানাফী শাসন। তখন থেকেই কখনও গযনভী, কখনও আফগানী, কখনও তুর্কীদের দ্বারা উপমহাদেশ শাসিত হয় এবং মূল আরবীয় শাসনের অবসান ঘটে। ফলে একদিকে রাজনৈতিক অনুদারতা, অন্যদিকে তাক্বলীদপন্থী আলেমদের সংকীর্ণতা, জনসাধারণের অজ্ঞতা ও আহলেহাদীছ আলেমদের স্বল্পতার কারণে আহলেহাদীছ আন্দোলন ভারতবর্ষে ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে। দ্বাদশ শতাব্দীতে এসে আল্লাহ পাকের খাছ মেহেরবাণীতে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ)-এর শাণিত যুক্তি ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে নিরপেক্ষভাবে হাদীছ অনুসরণের জায্বা সৃষ্টি হয় এবং তাঁর পরে তদীয় পুত্রগণ ও মুজাহিদ পৌত্র শাহ ইসমাঈল শহীদ (১১৯৩-১২৪৬ হিঃ)-এর সূচিত ‘জিহাদ আন্দোলন’ এর মাধ্যমে সারা ভারতে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, যা আহলেহাদীছ আন্দোলনে জোয়ার সৃষ্টি করে। পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে বসবাসরত প্রায় ছয় কোটি আহলেহাদীছ জনগণ সেই বিপ্লবেরই ফসল। যাদের রক্তে-মাংসে, অস্থি-মজ্জায় বালাকোট, বাঁশের কেল্লা, মুল্কা, সিত্তানা, আম্বালা, চামারকান্দ, আসমাস্ত ও আন্দামানের রক্তাক্ত স্মৃতিসমূহ, জেল-যুলুম, ফাঁসি, সম্পত্তি বাযেয়াফত, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ও কালাপানির অবর্ণনীয় নির্যাতন, গাযী, শহীদী রক্তের অমলিন ছাপসমূহ আজও ভাস্বর হয়ে আছে। যুলুম ও নির্যাতনের আগুনে পোড়া নিখাদ তাওহীদবাদী ‘জামা‘আতে আহলেহাদীছ’ তাই চিরকালীন জিহাদী উত্তরাধিকারের নাম। যেকোন মূল্যের বিনিময়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখার চিরন্তন শহীদী কাফেলার নাম। মহান আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ - ‘তোমরা হীনবল হয়ো না, দুঃখিত হয়ো না, ঈমানদার হ’লে তোমরাই শ্রেষ্ঠ’ (আলে ইমরান ১৩৯)।
[1]. শামসুদ্দীন আল-মাক্বদেসী, আহসানুত তাক্বাসীম ২য় সংস্করণ (লন্ডন: ই, জে, ব্রীল ১৯০৬) পৃঃ ৪৮১।
[2]. আব্দুল ক্বাহির বাগদাদী, কিতাবুল উছূলিদ্দীন (ইস্তাম্বুল: দাওলাহ প্রেস ১৩৪৬/১৯২৮) ১/৩১৭ পৃঃ।
অতঃপর মাক্বদেসী ৩৭৫ হিজরীতে ভারতে তৎকালীন ইসলামী রাজধানী সিন্ধুর মানছূরায় আসেন। মানছূরা (করাচী) সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সেখানকার অধিকাংশ (মুসলিম) অধিবাসী আহলেহাদীছ’ ( أَكْثَرُهُمْ أَصْحَابُ حَدِيْثٍ )। ক্বাযী আবু মুহাম্মাদ মানছূরী নামে সেখানে দাঊদী মাযহাবের একজন ইমাম আছেন। তাঁর লিখিত অনেক মূল্যবান কেতাব রয়েছে। মুলতানের অধিবাসীরা শী‘আ মতাবলম্বী। প্রত্যেক শহরেই কিছু কিছু হানাফী ফক্বীহ রয়েছেন। এখানে মালেকী বা মু‘তাযেলী কেউ নেই, হাম্বলীও নেই’।[1]
মাক্বদেসীর অর্ধশত বছর পরে ঐতিহাসিক আবু মানছূর আব্দুল ক্বাহির বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯) তৎকালীন পৃথিবীতে আহলেহাদীছদের অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেন,
ثُغُوْرُ الرُّوْمِ وَالْجَزِيْرَةِ وَ ثُغُوْرُ الشَّامِ وَ ثُغُوْرُ آذَرْبَيْجَانَ وَبَابِ الْأَبْوَابِ كُلُّهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَ كَذَالِكَ ثُغُوْرُ أَفْرِيْقِيَّةَ وَ أَنْدَلُسَ وَ كُلُّ ثِغَرِ وَرَاءِ بَحْرِ الْمَغْرِبِ أَهْلُهُ مِنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ وَ كَذَالِكَ ثُغُوْرُ الْيَمَنِ عَلَى سَاحِلِ الزَّنْجِ ، وَأَمَّا ثُغُوْرُ أَهْلِ مَا وَرَاءِ النَّهْرِ فِيْ وُجُوْهِ التُّرْكِ وَ الصِّيْنِ فَهُمْ فَرِيْقَانِ : إِمَّا شَافِعِيَّةٌ وَإِمَّا مِنْ أَصْحَابِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ -
‘রূম সীমান্ত, আলজিরিয়া, সিরিয়া, আযারবাইজান, বাবুল আবওয়াব (মধ্য তুর্কিস্তান) প্রভৃতি এলাকার সকল মুসলিম অধিবাসী ‘আহলেহাদীছ’ মাযহাবের উপরে ছিলেন। এমনিভাবে আফ্রিকা, স্পেন ও পশ্চিম সাগরের পশ্চাদবর্তী দেশসমূহের সকল মুসলমান ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। একইভাবে আবিসিনিয়ার উপকূলবর্তী ইয়ামনের সকল অধিবাসী ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। তবে তুরস্ক ও চীন অভিমুখী মধ্য তুর্কিস্তান সীমান্তের অধিকারীদের মধ্যে দু’টি দল ছিল : একদল শাফেঈ ও একদল আবু হানীফার অনুসারী’।[2]
মাক্বদেসী ও আবদুল ক্বাহির বাগদাদীর উপরোক্ত বর্ণনা হ’তে প্রমাণিত হয় যে, বাগদাদী খেলাফতের স্কন্ধে সওয়ার হয়ে ‘আহলুর রায়’ ও মু‘তাযিলাদের চরম রাজনৈতিক ও মাযহাবী নির্যাতন সত্ত্বেও পঞ্চম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত খোদ মক্কা-মদীনা ও সিরিয়া সহ ইউরোপ, আফ্রিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, নিকটপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং সুদূর সিন্ধু পর্যন্ত আহলেহাদীছ জনগণের সংখ্যাধিক্য বজায় ছিল, যা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার বৈ কি!
৩৭৫ হিজরীর কিছু পরে মানছূরার শাসন ক্ষমতা ইসমাঈলী শী‘আদের হাতে চলে যায়। অন্যদিকে ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খৃষ্টাব্দ থেকে দিল্লীতে ও বাংলাদেশে শুরু হয় ‘আহলুর রায়’ হানাফী শাসন। তখন থেকেই কখনও গযনভী, কখনও আফগানী, কখনও তুর্কীদের দ্বারা উপমহাদেশ শাসিত হয় এবং মূল আরবীয় শাসনের অবসান ঘটে। ফলে একদিকে রাজনৈতিক অনুদারতা, অন্যদিকে তাক্বলীদপন্থী আলেমদের সংকীর্ণতা, জনসাধারণের অজ্ঞতা ও আহলেহাদীছ আলেমদের স্বল্পতার কারণে আহলেহাদীছ আন্দোলন ভারতবর্ষে ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে। দ্বাদশ শতাব্দীতে এসে আল্লাহ পাকের খাছ মেহেরবাণীতে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ)-এর শাণিত যুক্তি ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে নিরপেক্ষভাবে হাদীছ অনুসরণের জায্বা সৃষ্টি হয় এবং তাঁর পরে তদীয় পুত্রগণ ও মুজাহিদ পৌত্র শাহ ইসমাঈল শহীদ (১১৯৩-১২৪৬ হিঃ)-এর সূচিত ‘জিহাদ আন্দোলন’ এর মাধ্যমে সারা ভারতে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, যা আহলেহাদীছ আন্দোলনে জোয়ার সৃষ্টি করে। পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে বসবাসরত প্রায় ছয় কোটি আহলেহাদীছ জনগণ সেই বিপ্লবেরই ফসল। যাদের রক্তে-মাংসে, অস্থি-মজ্জায় বালাকোট, বাঁশের কেল্লা, মুল্কা, সিত্তানা, আম্বালা, চামারকান্দ, আসমাস্ত ও আন্দামানের রক্তাক্ত স্মৃতিসমূহ, জেল-যুলুম, ফাঁসি, সম্পত্তি বাযেয়াফত, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ও কালাপানির অবর্ণনীয় নির্যাতন, গাযী, শহীদী রক্তের অমলিন ছাপসমূহ আজও ভাস্বর হয়ে আছে। যুলুম ও নির্যাতনের আগুনে পোড়া নিখাদ তাওহীদবাদী ‘জামা‘আতে আহলেহাদীছ’ তাই চিরকালীন জিহাদী উত্তরাধিকারের নাম। যেকোন মূল্যের বিনিময়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখার চিরন্তন শহীদী কাফেলার নাম। মহান আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ - ‘তোমরা হীনবল হয়ো না, দুঃখিত হয়ো না, ঈমানদার হ’লে তোমরাই শ্রেষ্ঠ’ (আলে ইমরান ১৩৯)।
[1]. শামসুদ্দীন আল-মাক্বদেসী, আহসানুত তাক্বাসীম ২য় সংস্করণ (লন্ডন: ই, জে, ব্রীল ১৯০৬) পৃঃ ৪৮১।
[2]. আব্দুল ক্বাহির বাগদাদী, কিতাবুল উছূলিদ্দীন (ইস্তাম্বুল: দাওলাহ প্রেস ১৩৪৬/১৯২৮) ১/৩১৭ পৃঃ।
আল্লাহ্র হুকুম ছিল, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا وَلاَ تَفَرَّقُوْا ‘ওয়া‘তাছিমূ বিহাবলিল্লা-হি জামী‘আঁও অলা তাফাররাক্বূ’। অর্থ: ‘তোমরা সকলে মিলে আল্লাহ্র রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর। (সাবধান)! দলে দলে বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ১০৩)। কিন্তু রাসূল (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকালের কিছুকাল পর হ’তেই মুসলমানরা আপোষে দলাদলি ও ফির্কাবন্দীতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়।
মুসলমানদের মধ্যে এই দল বিভক্তির কারণ ছিল মূলতঃ চারটি।
১. ইহুদী-খৃষ্টানদের প্ররোচনা। ২. রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্ব। ৩. বিভিন্ন বিজাতীয় প্রথা ও দর্শন চিন্তার অনুপ্রবেশ। ৪. শরী‘আতের ব্যাখ্যাগত মতভেদ।
প্রথমোক্ত কারণ হিসাবে আমরা দেখতে পাই যে, তৃতীয় খলীফা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের (২৩-৩৫ হিঃ) শেষ দিকে ইয়ামনের জনৈকা নিগ্রো মাতার গর্ভজাত ইহুদী সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা বাহ্যিকভাবে মুসলমান হয় (২) পরে তারই কূট চক্রজালে মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘সাবাঈ’ ও ‘ওছমানী’ দু’টি দলের সৃষ্টি হয়। অতঃপর বিদ্রোহী সাবাঈ দলের হাতেই মহান খলীফা ওছমান (রাঃ) নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীতে হযরত আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যেকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খারেজী ও শী‘আ দলের উদ্ভব ঘটে এবং চরমপন্থী খারেজীদের হাতে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ) শহীদ হন (৩) এই সময়ে পৃথবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মতাদর্শের লোক মুসলমান হ’তে থাকে। কিন্তু বংশ পরম্পরায় লালিত তাদের এতকালের অভ্যাস অনেকেই পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে বহু বিজাতীয় রসম-রেওয়াজ মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে। যা পরবর্তীতে সাধারণভাবে ইসলামী রীতি ও প্রথা হিসাবে চালু হয়ে যায় এবং এই সকল বিদ‘আতী রীতির অনুসারী ও বিরোধীগণ বিভিন্ন নামে অভিহিত হ’তে থাকেন। (৪) এমনিভাবে বিভিন্ন বিজাতীয় দর্শন চিন্তাও মুসলমানদের মাঝে ফের্কা সৃষ্টিতে বারি সিঞ্চন করে। যেমন উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আমলে (৬৫-৮৬ হিঃ) ইরাকের বছরা নগরে ‘সূসেন’ নামীয় জনৈক খৃষ্টান বাহ্যিকভাবে মুসলমান হয়ে পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যায়। তার প্ররোচনায় মা‘বাদ নামীয় জনৈক ব্যক্তি সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজে তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী ‘ক্বাদারিয়া’ মতবাদের জন্ম দেয়। পরে তার বিপরীতে সৃষ্টি হয় ‘জাবরিয়া’ নামে সম্পূর্ণ অদৃষ্টবাদী এক বিভ্রান্তিকর মতবাদ।
এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন দল ও মতসমূহ পরবর্তী কালে পৃথক পৃথক ‘মাযহাবে’ রূপ নেয়। এ সকল মাযহাবের অনুসারী দলের মধ্যে আবার বিভিন্ন তরীক্বা ও উপদল রয়েছে। ফলে ইসলামের মধ্যে ফের্কাবন্দীর ইতিহাস একটি দুঃখজনক অভিশাপ হিসাবে দিন দিন প্রলম্বিত হ’তে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উপরোক্ত সকল মাযহাব ও তরীক্বার অনুসারীরা তাদের গৃহীত ফৎওয়াসমূহ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ থেকেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। পবিত্র কুরআনের যে সকল আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যে সকল হাদীছ তাদের মাযহাবী সিদ্ধান্তের অনুকূলে হ’ত, সেগুলি তারা সানন্দে গ্রহণ করতেন। কিন্তু যেগুলি তার বিরোধী হ’ত, তারা সেগুলির পরোক্ষ ব্যাখ্যায় লিপ্ত হ’তেন কিংবা ‘মানসূখ’ বলে পরিত্যাগ করতেন। শী‘আরা তো রাজনৈতিক কারণে হযরত আলী (রাঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনায় তিন লাখ জাল হাদীছ বানিয়ে নিয়েছেন।[1] প্রচলিত কুরআন শরীফ, যা ‘মুছহাফে উছমানী’ নামে পরিচিত, তার বিপরীতে তাদের আবিষ্কৃত এর তিনগুণ বড় ‘মুছহাফে ফাতেমা’ নামক তথাকথিত কুরআন গ্রন্থে প্রচলিত কুরআন শরীফের একটি হরফও নেই বলে তারা দাবী করেন।[2] এমনিভাবে উমাইয়া, আববাসীয়, শী‘আ, হানাফী, শাফেঈ প্রভৃতি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলের লোকেরা নিজ নিজ দলের ও মাযহাবের পক্ষে ও অপর মাযহাবের বিপক্ষে যে কত জাল ও মিথ্যা হাদীছ রটনা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই।[3]
[1]. ড. মুছতফা সাবাঈ, আস-সুন্নাহ, পৃঃ ৮১।
[2]. ইহসান ইলাহী যাহীর, আশ-শী‘আহ ওয়াস সুন্নাহ (লাহোর : ইদারাহ তারজুমানুস সুন্নাহ, তাবি) পৃঃ ৮০-৮১।
[3]. দ্রঃ আস-সুন্নাহ পৃঃ ৭৮-৭৯; ইউসুফ জয়পুরী, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (বোম্বাই : তাবি, তাহক্বীক্ব : দাঊদ রায) দুর্রে মুখতার-এর বরাতে, পৃঃ ১৮৩-৮৫; থিসিস পৃঃ ১৮০-৮২ টীকা ৫৯-৬০ দ্রষ্টব্য।
মুসলমানদের মধ্যে এই দল বিভক্তির কারণ ছিল মূলতঃ চারটি।
১. ইহুদী-খৃষ্টানদের প্ররোচনা। ২. রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্ব। ৩. বিভিন্ন বিজাতীয় প্রথা ও দর্শন চিন্তার অনুপ্রবেশ। ৪. শরী‘আতের ব্যাখ্যাগত মতভেদ।
প্রথমোক্ত কারণ হিসাবে আমরা দেখতে পাই যে, তৃতীয় খলীফা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের (২৩-৩৫ হিঃ) শেষ দিকে ইয়ামনের জনৈকা নিগ্রো মাতার গর্ভজাত ইহুদী সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা বাহ্যিকভাবে মুসলমান হয় (২) পরে তারই কূট চক্রজালে মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘সাবাঈ’ ও ‘ওছমানী’ দু’টি দলের সৃষ্টি হয়। অতঃপর বিদ্রোহী সাবাঈ দলের হাতেই মহান খলীফা ওছমান (রাঃ) নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীতে হযরত আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যেকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খারেজী ও শী‘আ দলের উদ্ভব ঘটে এবং চরমপন্থী খারেজীদের হাতে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ) শহীদ হন (৩) এই সময়ে পৃথবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মতাদর্শের লোক মুসলমান হ’তে থাকে। কিন্তু বংশ পরম্পরায় লালিত তাদের এতকালের অভ্যাস অনেকেই পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে বহু বিজাতীয় রসম-রেওয়াজ মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে। যা পরবর্তীতে সাধারণভাবে ইসলামী রীতি ও প্রথা হিসাবে চালু হয়ে যায় এবং এই সকল বিদ‘আতী রীতির অনুসারী ও বিরোধীগণ বিভিন্ন নামে অভিহিত হ’তে থাকেন। (৪) এমনিভাবে বিভিন্ন বিজাতীয় দর্শন চিন্তাও মুসলমানদের মাঝে ফের্কা সৃষ্টিতে বারি সিঞ্চন করে। যেমন উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আমলে (৬৫-৮৬ হিঃ) ইরাকের বছরা নগরে ‘সূসেন’ নামীয় জনৈক খৃষ্টান বাহ্যিকভাবে মুসলমান হয়ে পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যায়। তার প্ররোচনায় মা‘বাদ নামীয় জনৈক ব্যক্তি সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজে তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী ‘ক্বাদারিয়া’ মতবাদের জন্ম দেয়। পরে তার বিপরীতে সৃষ্টি হয় ‘জাবরিয়া’ নামে সম্পূর্ণ অদৃষ্টবাদী এক বিভ্রান্তিকর মতবাদ।
এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন দল ও মতসমূহ পরবর্তী কালে পৃথক পৃথক ‘মাযহাবে’ রূপ নেয়। এ সকল মাযহাবের অনুসারী দলের মধ্যে আবার বিভিন্ন তরীক্বা ও উপদল রয়েছে। ফলে ইসলামের মধ্যে ফের্কাবন্দীর ইতিহাস একটি দুঃখজনক অভিশাপ হিসাবে দিন দিন প্রলম্বিত হ’তে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উপরোক্ত সকল মাযহাব ও তরীক্বার অনুসারীরা তাদের গৃহীত ফৎওয়াসমূহ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ থেকেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। পবিত্র কুরআনের যে সকল আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যে সকল হাদীছ তাদের মাযহাবী সিদ্ধান্তের অনুকূলে হ’ত, সেগুলি তারা সানন্দে গ্রহণ করতেন। কিন্তু যেগুলি তার বিরোধী হ’ত, তারা সেগুলির পরোক্ষ ব্যাখ্যায় লিপ্ত হ’তেন কিংবা ‘মানসূখ’ বলে পরিত্যাগ করতেন। শী‘আরা তো রাজনৈতিক কারণে হযরত আলী (রাঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনায় তিন লাখ জাল হাদীছ বানিয়ে নিয়েছেন।[1] প্রচলিত কুরআন শরীফ, যা ‘মুছহাফে উছমানী’ নামে পরিচিত, তার বিপরীতে তাদের আবিষ্কৃত এর তিনগুণ বড় ‘মুছহাফে ফাতেমা’ নামক তথাকথিত কুরআন গ্রন্থে প্রচলিত কুরআন শরীফের একটি হরফও নেই বলে তারা দাবী করেন।[2] এমনিভাবে উমাইয়া, আববাসীয়, শী‘আ, হানাফী, শাফেঈ প্রভৃতি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলের লোকেরা নিজ নিজ দলের ও মাযহাবের পক্ষে ও অপর মাযহাবের বিপক্ষে যে কত জাল ও মিথ্যা হাদীছ রটনা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই।[3]
[1]. ড. মুছতফা সাবাঈ, আস-সুন্নাহ, পৃঃ ৮১।
[2]. ইহসান ইলাহী যাহীর, আশ-শী‘আহ ওয়াস সুন্নাহ (লাহোর : ইদারাহ তারজুমানুস সুন্নাহ, তাবি) পৃঃ ৮০-৮১।
[3]. দ্রঃ আস-সুন্নাহ পৃঃ ৭৮-৭৯; ইউসুফ জয়পুরী, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (বোম্বাই : তাবি, তাহক্বীক্ব : দাঊদ রায) দুর্রে মুখতার-এর বরাতে, পৃঃ ১৮৩-৮৫; থিসিস পৃঃ ১৮০-৮২ টীকা ৫৯-৬০ দ্রষ্টব্য।
‘হাদীছ’ অর্থ বাণী এবং ‘সুন্নাহ’ অর্থ রীতি। পারিভাষিক অর্থে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিকে ‘হাদীছ’ বলা হয়। হাদীছ ও সুন্নাহ্র মধ্যে আভিধানিক অর্থে কিছু পার্থক্য থাকলেও পারিভাষিক ও প্রায়োগিক অর্থে কোন পার্থক্য নেই। কেননা উভয়ের বিষয়বস্ত্ত এক এবং সবকিছুই হাদীছের মাধ্যমে লিখিত রূপ লাভ করেছে। হাদীছ ও ফিক্বহে ‘আহলুস সুন্নাহ’ ও ‘আহলুল হাদীছ’ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে পরবর্তী যুগে ‘আহলুর রায়’-এর বিপরীতে ‘আহলুল হাদীছ’ নামটি বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করে।
৩৭ হিজরীর পর থেকেই ইসলামের স্বচ্ছ সলিলে কিছু কিছু ভেজাল মিশ্রিত হ’তে শুরু করেছিল। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের পবিত্র উদ্যোগ এসবের প্রসার রোধ করেছিল। তাঁরা এসব ফিৎনা হ’তে মুসলিম মিল্লাতকে মুক্ত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং বিদ‘আতপন্থীদের বিপরীতে নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাহ’ ও ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করেন। অতঃপর তাঁদের অনুসারী হক্বপন্থী মুসলমানরাও নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করেন। যেমন খ্যাতনামা তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হিঃ) বলেন,
لَمْ يَكُوْنُوْا يَسْأَلُوْنَ عَنِ الْإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ قَالُوْا سَمُّوْا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُوْخَذُ حَدِيْثُهُمْ وَ يُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدْعِ فَلاَ يُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ -
অর্থাৎ ‘লোকেরা ইতিপূর্বে কখনও হাদীছের সনদ বা সূত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না। কিন্তু যখন ফিৎনার যুগ এল, তখন লোকেরা বলতে লাগল আগে তোমরা বর্ণনাকারীদের পরিচয় বল। অতঃপর যদি দেখা যেত যে, বর্ণনাকারী ‘আহলে সুন্নাত’ দলভুক্ত, তাহ’লে তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত। কিন্তু ‘আহলে বিদ‘আত’ দলভুক্ত হ’লে তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না।[1] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) এজন্য বলেন,
وَمِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ مَذْهَبٌ قَدِيْمٌ مَعْرُوْفٌ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ اللهُ أَبَا حَنِيْفَةَ وَ مَالِكًا وَ الشَّافِعِىَّ وَ أَحْمَدَ، فَإِنَّهُ مَذْهَبُ الصَّحَابَةِ الَّذِيْنَ تَلَقَّوْهُ عَنْ نَبِيِّهِمْ -
‘আবু হানীফা, মালেক, শাফেঈ ও আহমাদের জন্মের বহু পূর্ব হ’তে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের প্রাচীন একটি মাযহাব সুপরিচিত ছিল। সেটি হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের মাযহাব, যাঁরা তাঁদের নবীর কাছ থেকে সরাসরি ইল্ম হাছিল করেছিলেন’।[2] ছহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে যে ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হ’ত, সেকথা আমরা ইতিপূর্বে ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী, ইমাম শা‘বী, ইবনু হাযম আন্দালুসী প্রমুখের বক্তব্যে অবহিত হয়েছি (দ্রঃ টীকা ১, ২, ১১)।
আহলেহাদীছগণ বিভিন্ন হাদীছের কিতাবে ও বিশ্বস্ত ফিক্বহ গ্রন্থসমূহে ‘আহলুল হাদীছ’, ‘আছহাবুল হাদীছ’, ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’, ‘আহলুল আছার’, ‘আহলুল হক্ব’ ‘মুহাদ্দেছীন’ প্রভৃতি নামে কথিত হয়েছেন। সালাফে ছালেহীনের[3] অনুসারী হিসাবে তাঁরা ‘সালাফী’ নামেও পরিচিত। আহলেহাদীছগণ মিসর, সূদান, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে ‘আনছারুস সুন্নাহ’, সউদী আরব, কুয়েত প্রভৃতি দেশে ‘সালাফী’, ইন্দোনেশিয়াতে ‘জামা‘আতে মুহাম্মাদিয়াহ’ এবং পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘মুহাম্মাদী’ ও ‘আহলেহাদীছ’ নামে পরিচিত। যদিও বিরোধীরা তাঁদেরকে লা-মাযহাবী, রাফাদানী, ওয়াহ্হাবী, গায়ের মুক্বাল্লিদ ইত্যাদি বাজে নামে অভিহিত করে থাকেন।
[1]. মুক্বাদামা মুসলিম: (বৈরুত: দরুল ফিক্র ১৪০৩/১৯৮৩) পৃঃ ১৫।
[2]. আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ, ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইল্মিয়াহ, তাবি, ১৩২২ হিঃ মিসরী ছাপা হ’তে ফটোকপিকৃত) ১/২৫৬ পৃঃ ।
[3]. ছাহাবা, তাবেঈন ও হাদীছপন্থী বিগত বিদ্বানগণকে ‘সালাফে ছালেহীন’ বলা হয়। -লেখক
৩৭ হিজরীর পর থেকেই ইসলামের স্বচ্ছ সলিলে কিছু কিছু ভেজাল মিশ্রিত হ’তে শুরু করেছিল। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের পবিত্র উদ্যোগ এসবের প্রসার রোধ করেছিল। তাঁরা এসব ফিৎনা হ’তে মুসলিম মিল্লাতকে মুক্ত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং বিদ‘আতপন্থীদের বিপরীতে নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাহ’ ও ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করেন। অতঃপর তাঁদের অনুসারী হক্বপন্থী মুসলমানরাও নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করেন। যেমন খ্যাতনামা তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হিঃ) বলেন,
لَمْ يَكُوْنُوْا يَسْأَلُوْنَ عَنِ الْإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ قَالُوْا سَمُّوْا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُوْخَذُ حَدِيْثُهُمْ وَ يُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدْعِ فَلاَ يُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ -
অর্থাৎ ‘লোকেরা ইতিপূর্বে কখনও হাদীছের সনদ বা সূত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না। কিন্তু যখন ফিৎনার যুগ এল, তখন লোকেরা বলতে লাগল আগে তোমরা বর্ণনাকারীদের পরিচয় বল। অতঃপর যদি দেখা যেত যে, বর্ণনাকারী ‘আহলে সুন্নাত’ দলভুক্ত, তাহ’লে তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত। কিন্তু ‘আহলে বিদ‘আত’ দলভুক্ত হ’লে তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না।[1] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) এজন্য বলেন,
وَمِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ مَذْهَبٌ قَدِيْمٌ مَعْرُوْفٌ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ اللهُ أَبَا حَنِيْفَةَ وَ مَالِكًا وَ الشَّافِعِىَّ وَ أَحْمَدَ، فَإِنَّهُ مَذْهَبُ الصَّحَابَةِ الَّذِيْنَ تَلَقَّوْهُ عَنْ نَبِيِّهِمْ -
‘আবু হানীফা, মালেক, শাফেঈ ও আহমাদের জন্মের বহু পূর্ব হ’তে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের প্রাচীন একটি মাযহাব সুপরিচিত ছিল। সেটি হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের মাযহাব, যাঁরা তাঁদের নবীর কাছ থেকে সরাসরি ইল্ম হাছিল করেছিলেন’।[2] ছহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে যে ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হ’ত, সেকথা আমরা ইতিপূর্বে ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী, ইমাম শা‘বী, ইবনু হাযম আন্দালুসী প্রমুখের বক্তব্যে অবহিত হয়েছি (দ্রঃ টীকা ১, ২, ১১)।
আহলেহাদীছগণ বিভিন্ন হাদীছের কিতাবে ও বিশ্বস্ত ফিক্বহ গ্রন্থসমূহে ‘আহলুল হাদীছ’, ‘আছহাবুল হাদীছ’, ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’, ‘আহলুল আছার’, ‘আহলুল হক্ব’ ‘মুহাদ্দেছীন’ প্রভৃতি নামে কথিত হয়েছেন। সালাফে ছালেহীনের[3] অনুসারী হিসাবে তাঁরা ‘সালাফী’ নামেও পরিচিত। আহলেহাদীছগণ মিসর, সূদান, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে ‘আনছারুস সুন্নাহ’, সউদী আরব, কুয়েত প্রভৃতি দেশে ‘সালাফী’, ইন্দোনেশিয়াতে ‘জামা‘আতে মুহাম্মাদিয়াহ’ এবং পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘মুহাম্মাদী’ ও ‘আহলেহাদীছ’ নামে পরিচিত। যদিও বিরোধীরা তাঁদেরকে লা-মাযহাবী, রাফাদানী, ওয়াহ্হাবী, গায়ের মুক্বাল্লিদ ইত্যাদি বাজে নামে অভিহিত করে থাকেন।
[1]. মুক্বাদামা মুসলিম: (বৈরুত: দরুল ফিক্র ১৪০৩/১৯৮৩) পৃঃ ১৫।
[2]. আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ, ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইল্মিয়াহ, তাবি, ১৩২২ হিঃ মিসরী ছাপা হ’তে ফটোকপিকৃত) ১/২৫৬ পৃঃ ।
[3]. ছাহাবা, তাবেঈন ও হাদীছপন্থী বিগত বিদ্বানগণকে ‘সালাফে ছালেহীন’ বলা হয়। -লেখক
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে অস্বীকার কিংবা সম্পূর্ণ অমান্য করে কেউ মুসলমান হ’তে পারেন না। তাই এক হিসাবে দুনিয়ার সকল মুসলমানই আহলেহাদীছ। কিন্তু একটু সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, মুসলমানদের মধ্যে এযাবৎ যতগুলো দল, মাযহাব ও তরীক্বার সৃষ্টি হয়েছে এবং আজও হচ্ছে, তার সবগুলোই কোন না কোন ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সেজন্য প্রত্যেক মাযহাবের পৃথক পৃথক ‘ফিক্বহ’ গ্রন্থ রচিত হয়েছে। প্রত্যেক মাযহাবের অনুসারীরা স্ব স্ব ফিক্বহের কিতাবসমূহ হ’তে ফৎওয়া সংগ্রহ করে থাকেন এবং সেগুলোকেই কার্যত অভ্রান্ত শরী‘আত ভেবে মান্য করে থাকেন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তার স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কোন নির্দেশ আছে কি-না, তা খুঁজে দেখার অবকাশ তাদের থাকে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের মনে এ অন্ধ বিশ্বাসই বদ্ধমূল থাকে যে, স্বীয় তরীক্বা বা মাযহাবী ফিক্বহের বরখেলাফ পবিত্র কুরআন বা ছহীহ হাদীছে কোন কথাই থাকতে পারে না।
সেটাও মন্দের ভাল ছিল যদি না অবস্থা আরও নিম্ন পর্যায়ে নেমে যেত। বর্তমানে কোন কোন আলেম ও পীর যেকোন কারণেই হোক মাঝে-মধ্যে এমনামন অভিনব ফৎওয়া জারি করে থাকেন, যার সাথে কুরআন-হাদীছ তো দূরের কথা, নিজ মাযহাবী ফিক্বহের কিতাবেরও কোন সম্পর্ক নেই। যেমন আমাদের সমাজে প্রচলিত পীরপূজা, কবরপূজা, মীলাদ-ক্বিয়াম, কুলখানী, চেহলাম, হায়াতুন্নবী, আল্লাহ নিরাকার, তিনি সর্বত্র বিরাজমান ইত্যাদি আক্বীদা ও আমলসমূহের পিছনে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) কিংবা তাঁর মাযহাবের শ্রেষ্ট কিতাবসমূহে কোনরূপ সমর্থন নেই। অথচ সরলবুদ্ধি জনসাধারণ অন্ধ বিশ্বাসে তাদের আলেমদের তাবেদারী করতে গিয়ে এগুলিকেই প্রকৃত ইসলামী অনুষ্ঠান বলে ধারণা করে। এভাবে তারা বিভিন্ন সময় নানাবিধ শিরক ও বিদ‘আতের শিকার হয়ে পড়ে। যার পরিণতি জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ ঐ ব্যক্তির সম্মুখে যদি কোন নিরপেক্ষ হক্বপন্থী আলেম রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন ছহীহ হাদীছ পেশ করে তার ভুল ধরিয়ে দিতে চান, তাহ’লে বেচারা ভীষণ ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং শেষ অস্ত্র হিসাবে নিজ বাপ-দাদা হ’তে শুরু করে বিগত যুগের ইমাম ও পীর-আউলিয়ার নাম নিয়ে যুক্তি দেখিয়ে বলে ‘তাঁরা কি বুঝতেন না?’ যদিও ঐ সকল বিগত ব্যক্তিদের তাক্বওয়া-পরহেযগারী ও কুরআন-হাদীছের পাবন্দী সম্পর্কে তার স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। অথচ ঐ ব্যক্তি একবারও ভাবে না যে, দ্বীন সম্পূর্ণরূপে ‘অহিয়ে এলাহীর’ উপরে নির্ভরশীল। এখানে কোন ব্যক্তির নিজস্ব রায় বা খেয়াল-খুশীর কোন অবকাশ নেই।
বলা বাহুল্য উপরোক্ত অজুহাতই ছিল সকল যুগের গোঁড়া সংস্কারবাদীদের মোক্ষম যুক্তি- যা যুগে যুগে সকল নবীকেই শুনানো হয়েছে। এই অন্ধ কুসংস্কারের বিরোধিতা করার কারণেই সমাজের বুকে জেঁকে বসা ক্বায়েমী স্বার্থবাদীরা নবীদেরকে অকথ্য নির্যাতন করেছে, প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে জীবন্ত নিক্ষেপ করেছে, সর্বস্বান্ত অবস্থায় দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। আজও তারা শেষনবীর সনিষ্ঠ অনুসারীদের উপরে একইভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
সেটাও মন্দের ভাল ছিল যদি না অবস্থা আরও নিম্ন পর্যায়ে নেমে যেত। বর্তমানে কোন কোন আলেম ও পীর যেকোন কারণেই হোক মাঝে-মধ্যে এমনামন অভিনব ফৎওয়া জারি করে থাকেন, যার সাথে কুরআন-হাদীছ তো দূরের কথা, নিজ মাযহাবী ফিক্বহের কিতাবেরও কোন সম্পর্ক নেই। যেমন আমাদের সমাজে প্রচলিত পীরপূজা, কবরপূজা, মীলাদ-ক্বিয়াম, কুলখানী, চেহলাম, হায়াতুন্নবী, আল্লাহ নিরাকার, তিনি সর্বত্র বিরাজমান ইত্যাদি আক্বীদা ও আমলসমূহের পিছনে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) কিংবা তাঁর মাযহাবের শ্রেষ্ট কিতাবসমূহে কোনরূপ সমর্থন নেই। অথচ সরলবুদ্ধি জনসাধারণ অন্ধ বিশ্বাসে তাদের আলেমদের তাবেদারী করতে গিয়ে এগুলিকেই প্রকৃত ইসলামী অনুষ্ঠান বলে ধারণা করে। এভাবে তারা বিভিন্ন সময় নানাবিধ শিরক ও বিদ‘আতের শিকার হয়ে পড়ে। যার পরিণতি জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ ঐ ব্যক্তির সম্মুখে যদি কোন নিরপেক্ষ হক্বপন্থী আলেম রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন ছহীহ হাদীছ পেশ করে তার ভুল ধরিয়ে দিতে চান, তাহ’লে বেচারা ভীষণ ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং শেষ অস্ত্র হিসাবে নিজ বাপ-দাদা হ’তে শুরু করে বিগত যুগের ইমাম ও পীর-আউলিয়ার নাম নিয়ে যুক্তি দেখিয়ে বলে ‘তাঁরা কি বুঝতেন না?’ যদিও ঐ সকল বিগত ব্যক্তিদের তাক্বওয়া-পরহেযগারী ও কুরআন-হাদীছের পাবন্দী সম্পর্কে তার স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। অথচ ঐ ব্যক্তি একবারও ভাবে না যে, দ্বীন সম্পূর্ণরূপে ‘অহিয়ে এলাহীর’ উপরে নির্ভরশীল। এখানে কোন ব্যক্তির নিজস্ব রায় বা খেয়াল-খুশীর কোন অবকাশ নেই।
বলা বাহুল্য উপরোক্ত অজুহাতই ছিল সকল যুগের গোঁড়া সংস্কারবাদীদের মোক্ষম যুক্তি- যা যুগে যুগে সকল নবীকেই শুনানো হয়েছে। এই অন্ধ কুসংস্কারের বিরোধিতা করার কারণেই সমাজের বুকে জেঁকে বসা ক্বায়েমী স্বার্থবাদীরা নবীদেরকে অকথ্য নির্যাতন করেছে, প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে জীবন্ত নিক্ষেপ করেছে, সর্বস্বান্ত অবস্থায় দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। আজও তারা শেষনবীর সনিষ্ঠ অনুসারীদের উপরে একইভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্ধ তাক্বলীদ ও রসম পূজার শেষ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। একদিকে থাকেন ভ্রান্তির আশংকাযুক্ত অনুসরণীয় ইমাম অথবা পীর। অন্যদিক থাকেন দোজাহানের অভ্রান্ত ইমাম, ইমামুল মুত্তাক্বীন ও ইমামুল মুরসালীন শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। একদিকে থাকে ধর্মের নামে প্রচলিত রসম-রেওয়াজ, অন্যদিকে থাকে শেষনবীর পবিত্র হেদায়াতসমূহ। আল্লাহ না করুন এটিই যদি কারো প্রকৃত অবস্থা হয়ে থাকে, তবে কোন্ আকাশ তাকে ছায়া দিবে, কোন্ যমীন তাকে আশ্রয় দিবে, কোন্ নবীর শাফা‘আত সে কামনা করবে?
তাক্বলীদের মায়াবন্ধনে পড়ে মানুষ ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কে কত বড় ইমাম বা কে কত বড় দলের অনুসারী, সেটাই এখন প্রধান বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাযহাবী তাক্বলীদের বাড়াবাড়ির পরিণামে হানাফী-শাফেঈ দ্বন্দ্বে ও শী‘আ মন্ত্রীর ষড়যন্ত্রে ৬৫৬ হিজরী মোতাবেক ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে হালাকু খাঁর আক্রমণে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়েছে। পরবর্তীতে মিসরের বাহরী মামলূক সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বারাসের আমলে (৬৫৮-৬৭৬/১২৬০-১২৭৭ খৃঃ) মিসরীয় রাজধানীতে সর্বপ্রথম চার মাযহাবের লোকদের জন্য পৃথক পৃথক ক্বাযী নিয়োগ করা হয়, যা ৬৬৪ হিজরী থেকে ইসলাম জগতের সর্বত্র চালু হয়ে যায়... এবং চার মাযহাবের বহির্ভূত কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হ’লেও তা অনুসরণ করা নিষিদ্ধ বলে গণ্য হয়’। বুরজী মামলূক সুলতান ফারজ বিন বারকূক-এর আমলে (৭৯১-৮১৫ হিঃ) ৮০১ হিজরী সনে মুক্বাল্লিদ আলেম ও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মুসিলম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র কা‘বা গৃহের চারপাশে চার মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক চার মুছাল্লা কায়েম করা হয়। এইভাবে তাক্বলীদের কু-প্রভাবে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি স্থায়ী রূপ ধারণ করে। ১৩৪৩ হিজরীতে বর্তমান সঊদী শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীয আলে-সঊদ উক্ত চার মুছাল্লা উৎখাত করেন। ফলে সকল মুসলমান বর্তমানে কুরআন-হাদীছের বিধান অনুযায়ী একই ইবরাহীমী মুছাল্লায় এক ইমামের পিছনে এক সাথে ছালাত আদায় করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে (থিসিস পৃঃ ৮৯)। ফালিল্লাহিল হামদ্।
জাতীয় তথা ধর্মীয় তাক্বলীদের দুনিয়াবী পরিণতি হিসাবে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার নামে আমরা ভাই ভাইয়ে দলে দলে বিভক্ত হয়েছি। বিজাতীয় তাক্বলীদের ফলে আমরা প্রগতির নামে ইহুদী-খৃষ্টান ও অনৈসলামী জোটের চালু করা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি কুফরী মতবাদের অন্ধ অনুসারী হয়েছি। ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পূজা করতে গিয়ে একক ‘ইসলামী খেলাফত’ ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৫৬টি দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছি। বহু দলীয় গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে একটি দেশকে ভিতর থেকে অনৈক্যে ও বিশৃংখলায় স্থায়ীভাবে দুর্বল করে রাখার অনৈসলামী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার ফলে বঙ্গভবন থেকে বস্তিঘর পর্যন্ত অনৈক্য ও অশান্তির আগুনে জ্বলছে। আমাদের জাতীয় ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ ‘ইসলামী খেলাফাত’ তথা মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বিধ্বস্ত হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এখন ইহুদী-খৃষ্টান-অমুসলিম অক্ষশক্তির গোলামে পরিণত হয়েছে। এককালের উমাইয়া খেলাফতের (৪১-১৩২হিঃ/৬৬১-৭৫০খৃঃ=৯০বৎসর) রাজধানী দামেশক, আববাসীয় খেলাফতের (১৩২-৬৫৬হিঃ/৭৫০-১২৫৮খৃঃ=৫০৯বৎসর) রাজধানী বাগদাদ, স্পেনীয় উমাইয়া খেলাফতের (৯২-৮৯৭হিঃ/৭১১-১৪৯২খৃঃ=৭৮১বৎসর) রাজধানী গ্রানাডা, তৎকালীন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ও ‘বিশ্বের বিস্ময়’ কর্ডোভা, সেভিল আজ ইতিহাসের বিষয়বস্ত্ত, ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনের (৩৫১-১২৭৩ হিঃ/৯৬২-১৮৫৭ খৃঃ= ৮৯৫বৎসর) কেন্দ্রস্থল গযনী (কাবুল ) ও দিল্লী আজ ইতিহাসের হারানো অধ্যায়। সর্বশেষ উছমানীয় খেলাফতের (৭০০-১৩৪২ হিঃ/১৩০০-১৯২৪খৃঃ=৬২৪বৎসর) রাজধানী ইস্তাম্বুল বা কনষ্টান্টিনোপল ও তুরস্ক আজ ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ বলে ইহুদী-খৃষ্টান জগতের হাসি-ঠাট্টার বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। ক্রুসেড বিজেতা সেনাপতি ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৬৪-৫৮৯ হিঃ/১১৬৯-১১৯৩ খৃঃ)-এর শাসিত মিসর এখন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের বন্ধু!
শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী মুসলমান আজ অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। কিন্তু কেন? কে এজন্য দায়ী? ইসলাম না মুসলমান? ঔষধ না রোগী? নিশ্চয়ই দোষ ঔষধের নয়। কেননা এ ঔষধ বহু পরীক্ষিত। তাছাড়া ইসলামের যথার্থতার প্রশংসায় তো অমুসলমানেরাই বেশী সোচ্চার। অতএব সে দোষ নিশ্চয়ই রোগীর যারা এর ব্যবহার জানে না। আমরা যারা ঔষধ তাকে রেখে কেবল ঔষধ ঔষধ তাসবীহ জপেছি, কিন্তু সেবন করে দেখিনি। অথবা সঠিক ব্যবহারবিধি শিখিনি। কিংবা অল্প শিখে বাকীটা অনুমান করে নিয়েছি কিংবা অন্য কিছু মিশিয়ে মনের মত করে ‘মিকশ্চার’ বানিয়েছি।
মোটকথা মুসলমানদের বর্তমান এই করুণ পরিণতি হেদায়াতের মূল উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মহান শিক্ষা হ’তে দূরে থাকারই ফল। আর একারণেই শাশ্বত জীবন বিধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের যুগোপযোগী সমাধান পেতে ব্যর্থ হয়ে আধুনিক শিক্ষিত যুবকেরা আজ ক্রমেই বিভিন্ন বস্ত্তবাদী দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার বিভিন্ন চেহারা দেখে তারা মূল ইসলামকেই সন্দেহ করছে। দরগাহ, খানক্বাহ ও হালক্বায়ে যিকরের জৌলুস দেখে অথবা বিলাসী রাজনীতির জাঁকজমকপূর্ণ মঞ্চে ও মিছিলে ইসলামের তেজিয়ান শ্লোগান শুনে তারা ইসলামকে ভুল বুঝছে। তাকে পুঁজিবাদের সমর্থক অথবা শোষণের হাতিয়ার ভাবছে। অথচ মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবু বকর (রাঃ), ওমর (রাঃ), ওছমান (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-এর রেখে যাওয়া ইসলাম কি এই? নিশ্চয়ই নয়। তা পেতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে বিজাতীয় মতবাদসমূহ এবং অবশ্যই ফিরে যেতে হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মূল শিক্ষার মর্মকেন্দ্রে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, আন্তরিকভাবে আমরা তা পেতে চাই কি?
তাক্বলীদের মায়াবন্ধনে পড়ে মানুষ ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কে কত বড় ইমাম বা কে কত বড় দলের অনুসারী, সেটাই এখন প্রধান বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাযহাবী তাক্বলীদের বাড়াবাড়ির পরিণামে হানাফী-শাফেঈ দ্বন্দ্বে ও শী‘আ মন্ত্রীর ষড়যন্ত্রে ৬৫৬ হিজরী মোতাবেক ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে হালাকু খাঁর আক্রমণে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়েছে। পরবর্তীতে মিসরের বাহরী মামলূক সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বারাসের আমলে (৬৫৮-৬৭৬/১২৬০-১২৭৭ খৃঃ) মিসরীয় রাজধানীতে সর্বপ্রথম চার মাযহাবের লোকদের জন্য পৃথক পৃথক ক্বাযী নিয়োগ করা হয়, যা ৬৬৪ হিজরী থেকে ইসলাম জগতের সর্বত্র চালু হয়ে যায়... এবং চার মাযহাবের বহির্ভূত কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হ’লেও তা অনুসরণ করা নিষিদ্ধ বলে গণ্য হয়’। বুরজী মামলূক সুলতান ফারজ বিন বারকূক-এর আমলে (৭৯১-৮১৫ হিঃ) ৮০১ হিজরী সনে মুক্বাল্লিদ আলেম ও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মুসিলম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র কা‘বা গৃহের চারপাশে চার মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক চার মুছাল্লা কায়েম করা হয়। এইভাবে তাক্বলীদের কু-প্রভাবে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি স্থায়ী রূপ ধারণ করে। ১৩৪৩ হিজরীতে বর্তমান সঊদী শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীয আলে-সঊদ উক্ত চার মুছাল্লা উৎখাত করেন। ফলে সকল মুসলমান বর্তমানে কুরআন-হাদীছের বিধান অনুযায়ী একই ইবরাহীমী মুছাল্লায় এক ইমামের পিছনে এক সাথে ছালাত আদায় করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে (থিসিস পৃঃ ৮৯)। ফালিল্লাহিল হামদ্।
জাতীয় তথা ধর্মীয় তাক্বলীদের দুনিয়াবী পরিণতি হিসাবে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার নামে আমরা ভাই ভাইয়ে দলে দলে বিভক্ত হয়েছি। বিজাতীয় তাক্বলীদের ফলে আমরা প্রগতির নামে ইহুদী-খৃষ্টান ও অনৈসলামী জোটের চালু করা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি কুফরী মতবাদের অন্ধ অনুসারী হয়েছি। ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পূজা করতে গিয়ে একক ‘ইসলামী খেলাফত’ ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৫৬টি দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছি। বহু দলীয় গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে একটি দেশকে ভিতর থেকে অনৈক্যে ও বিশৃংখলায় স্থায়ীভাবে দুর্বল করে রাখার অনৈসলামী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার ফলে বঙ্গভবন থেকে বস্তিঘর পর্যন্ত অনৈক্য ও অশান্তির আগুনে জ্বলছে। আমাদের জাতীয় ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ ‘ইসলামী খেলাফাত’ তথা মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বিধ্বস্ত হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এখন ইহুদী-খৃষ্টান-অমুসলিম অক্ষশক্তির গোলামে পরিণত হয়েছে। এককালের উমাইয়া খেলাফতের (৪১-১৩২হিঃ/৬৬১-৭৫০খৃঃ=৯০বৎসর) রাজধানী দামেশক, আববাসীয় খেলাফতের (১৩২-৬৫৬হিঃ/৭৫০-১২৫৮খৃঃ=৫০৯বৎসর) রাজধানী বাগদাদ, স্পেনীয় উমাইয়া খেলাফতের (৯২-৮৯৭হিঃ/৭১১-১৪৯২খৃঃ=৭৮১বৎসর) রাজধানী গ্রানাডা, তৎকালীন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ও ‘বিশ্বের বিস্ময়’ কর্ডোভা, সেভিল আজ ইতিহাসের বিষয়বস্ত্ত, ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনের (৩৫১-১২৭৩ হিঃ/৯৬২-১৮৫৭ খৃঃ= ৮৯৫বৎসর) কেন্দ্রস্থল গযনী (কাবুল ) ও দিল্লী আজ ইতিহাসের হারানো অধ্যায়। সর্বশেষ উছমানীয় খেলাফতের (৭০০-১৩৪২ হিঃ/১৩০০-১৯২৪খৃঃ=৬২৪বৎসর) রাজধানী ইস্তাম্বুল বা কনষ্টান্টিনোপল ও তুরস্ক আজ ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ বলে ইহুদী-খৃষ্টান জগতের হাসি-ঠাট্টার বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। ক্রুসেড বিজেতা সেনাপতি ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৬৪-৫৮৯ হিঃ/১১৬৯-১১৯৩ খৃঃ)-এর শাসিত মিসর এখন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের বন্ধু!
শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী মুসলমান আজ অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। কিন্তু কেন? কে এজন্য দায়ী? ইসলাম না মুসলমান? ঔষধ না রোগী? নিশ্চয়ই দোষ ঔষধের নয়। কেননা এ ঔষধ বহু পরীক্ষিত। তাছাড়া ইসলামের যথার্থতার প্রশংসায় তো অমুসলমানেরাই বেশী সোচ্চার। অতএব সে দোষ নিশ্চয়ই রোগীর যারা এর ব্যবহার জানে না। আমরা যারা ঔষধ তাকে রেখে কেবল ঔষধ ঔষধ তাসবীহ জপেছি, কিন্তু সেবন করে দেখিনি। অথবা সঠিক ব্যবহারবিধি শিখিনি। কিংবা অল্প শিখে বাকীটা অনুমান করে নিয়েছি কিংবা অন্য কিছু মিশিয়ে মনের মত করে ‘মিকশ্চার’ বানিয়েছি।
মোটকথা মুসলমানদের বর্তমান এই করুণ পরিণতি হেদায়াতের মূল উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মহান শিক্ষা হ’তে দূরে থাকারই ফল। আর একারণেই শাশ্বত জীবন বিধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের যুগোপযোগী সমাধান পেতে ব্যর্থ হয়ে আধুনিক শিক্ষিত যুবকেরা আজ ক্রমেই বিভিন্ন বস্ত্তবাদী দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার বিভিন্ন চেহারা দেখে তারা মূল ইসলামকেই সন্দেহ করছে। দরগাহ, খানক্বাহ ও হালক্বায়ে যিকরের জৌলুস দেখে অথবা বিলাসী রাজনীতির জাঁকজমকপূর্ণ মঞ্চে ও মিছিলে ইসলামের তেজিয়ান শ্লোগান শুনে তারা ইসলামকে ভুল বুঝছে। তাকে পুঁজিবাদের সমর্থক অথবা শোষণের হাতিয়ার ভাবছে। অথচ মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবু বকর (রাঃ), ওমর (রাঃ), ওছমান (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-এর রেখে যাওয়া ইসলাম কি এই? নিশ্চয়ই নয়। তা পেতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে বিজাতীয় মতবাদসমূহ এবং অবশ্যই ফিরে যেতে হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মূল শিক্ষার মর্মকেন্দ্রে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, আন্তরিকভাবে আমরা তা পেতে চাই কি?
এবারে ‘আহলেহাদীছ’ সম্পর্কে চিন্তা করুন। এটি প্রচলিত অর্থে কোন ব্যক্তি ভিত্তিক ‘মাযহাব’, মতবাদ বা ‘ইজম’-এর নাম নয়। বরং এটি একটি পথের নাম। যে পথ আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র পথ। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথ। এপথের শেষ ঠিকানা হ’ল জান্নাত। মানুষের আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক জীবনের সমস্ত হেদায়াত এপথেই মওজুদ রয়েছে। ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম ও সালাফে ছালেহীন সর্বদা এপথেই মানুষকে আহবান জানিয়ে গেছেন। আহলেহাদীছ তাই চরিত্রগত দিক দিয়ে একটি দা‘ওয়াত, একটি ‘আন্দোলন’ এর নাম। এ আন্দোলন ইসলামের নির্ভেজাল আদিরূপ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এ আন্দোলন দুনিয়ার সকল মানুষকে বিশেষ করে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বায় বিভক্ত শতধাবিচ্ছিন্ন মুসলিম উম্মাহকে সকল প্রকারের সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামী ছেড়ে এবং সকল দিক হ’তে মুখ ফিরিয়ে চিরশান্তির গ্যারান্টি আল্লাহর কিতাব ও শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতের মর্মকেন্দ্রে জমায়েত হবার আহবান জানায়। কিতাব ও সুন্নাতের অভ্রান্ত পথনির্দেশকে কেন্দ্র করেই এ আন্দোলন গতি লাভ করেছে। উম্মতের কোন ফক্বীহ, মুজতাহিদ, অলি-আউলিয়া, ইমাম বা চিন্তাবিদের দেওয়া কোন নিজস্ব চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলন গড়ে উঠেনি। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ব্যতীত এ আন্দোলনের কর্মীদের অন্য কোন ‘গাইড বুক’ নেই। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যতীত তাদের অন্য কোন অভ্রান্ত ইমাম নেই। ইসলাম ব্যতীত তাদের অন্য কোন ‘মাযহাব’ বা চলার পথ নেই। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোন ফিক্বহ গ্রন্থ নেই। প্রচলিত চার মাযহাবের ইমামকে তাঁরা যথাযোগ্য সম্মান করে থাকেন। কোনরূপ অন্ধভক্তি বা অন্ধবিদ্বেষের বশবর্তী না হয়ে বরং বিভিন্ন মাযহাবের যে সকল সিদ্ধান্ত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুকূলে হয় বা সর্বাধিক নিকটবর্তী হয়, তারা বিনা দ্বিধায় সম্পূর্ণ খোলা মনে তা গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু ভুল ও শুদ্ধ সবকিছু মিলিয়ে কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ বা তাক্বলীদ করাকে তারা অন্যায় ও অযৌক্তিক বলে মনে করেন।
তাদের মাঝে পুরোহিত তন্ত্রের কোন অবকাশ নেই। নেই পীরের ‘ফয়েয’ লাভের বা তাঁদের ‘অসীলায়’ মুক্তি পাবার অহেতুক কোন মাথাব্যথা। তাঁদের রোগমুক্তি অথবা মামলায় ডিগ্রী পাবার জন্য কোন ‘পীর বাবা’ কিংবা ‘সাধু বাবা’-র চরণ ধূলি নিতে হয় না। কোন আউলিয়ার কবরে মানত করতে হয় না। কারো ‘মুরীদ’ হওয়ার সনদও নিতে হয় না।
খালেছ তাওহীদে বিশ্বাসী আহলেহাদীছগণ দুঃখে ও বিপদে কেবলমাত্র আল্লাহরই সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাঁরই নিকটে আশ্রয় ভিক্ষা করেন। তাঁরই নিকটে কাঁদেন, তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য ছাদাক্বা করেন। ‘তাক্বদীরের’ ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস রেখে যথাসাধ্য ‘তদবীর’ করে চলেন। পরকালীন মুক্তির জন্য তারা শিরক ও বিদ‘আতমুক্ত এবং শরী‘আত অনুমোদিত নেক আমলকেই একমাত্র ‘অসীলা’ মনে করেন, যা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই খালেছ হয়ে থাকে। যে সকল কথায় ও কর্মে শিরক ও বিদ‘আতের সামান্যতম ছিটে-ফোঁটা রয়েছে, তা হ’তে তারা দূরে থাকেন। কোন মানুষকে ‘ইলমে গায়েব’ বা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বলে তারা বিশ্বাস করেন না। নবী ব্যতীত অন্য কাউকে তারা অভ্রান্ত বলে মনে করেন না। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নূরের সৃষ্টি বা ‘নূরনবী’ নয় বরং মাটির সৃষ্টি ‘মানুষ নবী’ বলে মনে করেন। তারা কোন মৃত ব্যক্তিকে নিজের জন্য বা অপরের জন্য কোনরূপ মঙ্গলামঙ্গলের অধিকারী বলে বিশ্বাস করেন না। এমনকি কোন জীবিত ব্যক্তিও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত অপরের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। কবরে সিজদা করা, সেখানে মানত করা, ফুল দেওয়া, বাতি দেওয়া, গেলাফ চড়ানো, গোসল করানো, নযর-নেয়ায পাঠানো, মোরগ বা খাসি যবেহ করে ‘হাজত’ দেওয়া, কবরবাসীর অসীলায় মুক্তি কামনা করা, তার নিকটে ফরিয়াদ পেশ করা ইত্যাদিকে তারা প্রকাশ্য শিরক মনে করেন। এমনিভাবে একই মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লাখো মীলাদের মাহফিলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রূহ মুবারক হাযির হওয়ার অলীক ধারণা ও তাঁর সম্মানে সকলে দাঁড়িয়ে (ক্বিয়াম করে) সালাম জানানোকে মানুষের মাঝে স্রষ্টার গুণ কল্পনার মতই ঘৃণ্যতম পাপ বলে মনে করেন। এমনিভাবে কোন মৃত মানুষের সম্মানে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা, নিজেদের বানানো স্মৃতিসৌধে বা শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, বিভিন্ন মানুষের তৈলচিত্র, ছবি, মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণ ও সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন ইত্যাদি সবকিছু জাহেলী যুগের ফেলে আসা অগ্নিপূজা ও মূর্তিপূজার জঘন্যতম শিরকী রীতি-নীতির আধুনিক রূপ বলে মনে করেন।
আহলেহাদীছগণ মনে প্রাণে একথা বিশ্বাস করেন যে, শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের কোন হুকুম গোপন করে যাননি। বরং বিশ্ব ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ মানুষ হিসাবে এবং ইসলামী চরিত্রের নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ রূপকার হিসাবে দীর্ঘ তেইশ বছরের নবুঅতী জীবনে স্বীয় কথায়, কর্মে ও আচরণে ইসলামী শরী‘আতের ভিতর-বাহির ও খুঁটি-নাটি সব কিছুই স্বীয় উম্মতের জন্য স্পষ্ট করে গিয়েছেন এবং ‘অহিয়ে এলাহীর’ সবটুকু উম্মতের নিকট পূর্ণ সততার সাথে যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। অতঃপর জীবন সায়াহ্নে বিদায় হজ্জে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত লক্ষাধিক ছাহাবীর নিকট হ’তে সাক্ষ্য নিয়ে আল্লাহর নিকট হ’তে সরাসরি ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার নিশ্চয়তাও লাভ করেছেন। অতএব আহলেহাদীছগণ মনে করেন যে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে ইসলামী জীবন বিধানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র লাভ করার পর নিজেদের আবিষ্কৃত হাক্বীক্বত, তরীক্বত ও মা‘রেফাত তত্ত্বের তথাকথিত সীনা ব-সীনা বাত্বেনী ইলমের তালাশে অযথা সময় নষ্ট করা ইসলামের সহজ-সরল ও পরিচ্ছন্ন জীবন বিধান হ’তে দূরে সরে যাওয়ারই নামান্তর। সঙ্গে সঙ্গে এটা শেষনবী (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শরী‘আত সংক্রান্ত আমানতদারীর ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করে, যা ঈমানের প্রকাশ্য বিরোধী।
আহলেহাদীছগণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শেষনবী হিসাবে বিশ্বাস করেন এবং এই বিশ্বাসকে ঈমানের অন্যতম প্রধান রুকন বা স্তম্ভ বলে মনে করেন। এই রুকনকে অস্বীকার বা অমান্যকারী কিংবা এতে সন্দেহ পোষণকারী ব্যক্তি কখনোই মুসলমান হ’তে পারে না। অতঃপর যেহেতু তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না, সেহেতু তাঁর অনুসারী বিশ্বের সকল মুসলমান একই মিল্লাতভুক্ত একটি মহাজাতি। যেখানে ফের্কাবন্দীর কোন অবকাশ নেই। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ মুসলিম মিল্লাতকে আপোষে সকল দলাদলি ভুলে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একক নেতৃত্বে শুধুমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ মহাজাতিতে পরিণত করতে চায়।
আহলেহাদীছগণ ইসলামের প্রথম চারজন খলীফাকে ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ (সঠিক পথের অনুসারী খলীফাগণ) বলে বিশ্বাস করেন। তাঁদের সহ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অপর যে কোন ছাহাবীর প্রতি সামান্যতম অসম্মান প্রদর্শন করাকে তারা ‘গুনাহে কাবীরা’ বলে মনে করেন। তারা মহানবী (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবারবর্গের প্রতি যেমন মনে-প্রাণে ভক্তি রাখেন, তেমনি মহররমের তা‘যিয়ার নামে হুসায়েন-পূজারও চরম বিরোধিতা করে থাকেন।
খালেছ সুন্নাতের অনুসারী আহলেহাদীছগণ কোন অবস্থাতেই বিদ‘আতের সাথে আপোষ করেন না। লৌকিকতার নামে, দেশাচারের নামে, বিদ‘আতে হাসানাহর নামে অথবা ‘হিকমতের’ দোহাই পেড়ে এরা কোন বিদ‘আতকে কখনই প্রশ্রয় দেন না। এদের নিকটে সবচাইতে সম্মানিত ঐ ব্যক্তি, যিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সকল প্রকারের শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীন ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং জীবনের বিনিময়ে হ’লেও তাওহীদ ও সুন্নাতের যথাযথ পায়রবী করে চলেন। বিপ্লবী আদর্শ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে আহলেহাদীছগণ ইসলামকে সর্বযুগীয় সমাধান বলে বিশ্বাস করেন এবং ইসলামের গতিশীল (Dynamic) হওয়ার স্বার্থেই ‘ইজতিহাদ’কে সকল যুগে অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং ‘তাক্বলীদে শাখছী’কে অবশ্য বর্জনীয় বলে মনে করেন।[1] তারা একথাই বলতে চান যে, ‘তাক্বলীদে শাখছী’ হ’ল মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অগ্রগতির মূলে সবচাইতে বড় বাধা। কেননা এর ফলে আমরা কেবল একজনের একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার অন্ধ অনুসরণ করি, যার মধ্যে ভুলের আশংকা পুরা মাত্রায় বিদ্যমান। অথচ উক্ত একই বিষয়ে আরও যে কিছু উন্নত চিন্তা অন্যের মধ্যে কিংবা আমার নিজের মধ্যেই থাকতে পারে, এই আত্মবিশ্বাস আমরা হারিয়ে ফেলি। তাক্বলীদের সাক্ষাৎ পরিণতিতে অবশেষে আমরা হয়তবা সারাটি জীবন ধরে একজনের দেওয়া একটি ভুলের অনুসরণ করে চলি। অথচ স্ব স্ব ইহকালীন ও পরকালীন স্বার্থেই তা পরিত্যাগ করে নিরপেক্ষভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে চলা মুক্তিকামী মুসলমানের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। বলা আবশ্যক যে, আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল দাবী চিরদিন এটাই।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ‘আহলেহাদীছ’-এর পরিচয় এবং এ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যাবলী সংক্ষেপে পরিবেশিত হয়েছে। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, দুনিয়ার সকল মুসলমান আহলেহাদীছ নন। কেননা অন্যেরা কেবল ঐ হাদীছগুলিই মানেন, যেগুলি তাদের অনুসরণীয় ইমাম বা আলেমদের গৃহীত মাযহাবের অনুকূলে হয়। কিন্তু আহলেহাদীছগণ নিরপেক্ষভাবে যেকোন ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে থাকেন। উপরের আলোচনায় একথাও প্রমাণিত হয় যে, আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল, ‘তাক্বলীদে শাখছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। এই তাক্বলীদ ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোন মাযহাব বা তরীক্বার হৌক কিংবা বৈষয়িক ক্ষেত্রে প্রগতির নামে বিজাতীয় কোন মতবাদের হৌক। ‘অহি’র বিধানের আনুগত্য ব্যতীত ধর্মীয় ও বৈষয়িক সকল ক্ষেত্রে সকল প্রকার তাক্বলীদ বর্জনযোগ্য। অতএব যাবতীয় মাযহাবী সংকীর্ণতা ও তাক্বলীদী গোঁড়ামী ছেড়ে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত মন নিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দেওয়া ফায়ছালার সম্মুখে আনুগত্যের মস্তক অবনতকারী ব্যক্তিই মাত্র ‘আহলেহাদীছ’। কিন্তু দুঃখের বিষয় মহান ছাহাবায়ে কেরাম ও মুহাদ্দেছীনে ইযামের উপাধিধন্য এই গৌরবময় নামে নিজেকে পরিচিত করতে অনেকেই আজ সংকোচ বোধ করে থাকেন।
অনেকে আহলেহাদীছকে হানাফী, শাফেঈ প্রভৃতি তাক্বলীদী ফের্কার প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা অনুরূপ একটি ফের্কা বলে মনে করেন। অথচ ঐগুলি নির্দিষ্ট একজন বিদ্বানের অথবা নির্দিষ্ট বিদ্বানের গৃহীত মাযহাবের অনুসারী দল মাত্র। পক্ষান্তরে ঐসব মাযহাবী ও তাক্বলীদী গন্ডী ভেঙ্গে যারা নিরপেক্ষভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী হন, তারাই কেবল ‘আহলেহাদীছ হ’তে পারেন। কেননা ‘আহলেহাদীছ’ অর্থাৎ ‘হাদীছের অনুসারী’ বললে কোন ব্যক্তির অনুসারী বুঝায় না। অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেমন বিশ্বনবী, তাঁর নিকটে প্রেরিত ‘অহি’ যেমন বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য, তেমনি সর্বশেষ ‘অহি’ ভিত্তিক আন্দোলন তথা ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ তেমনি দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিত।
পরিশেষে আমরা সবিনয় নিবেদন রাখতে চাই যে, যেভাবে নির্দিষ্ট ইমাম, মাযহাব, ফিক্বহ ও তরীক্বা রচনা করে লোকেরা বিভিন্ন দলীয় নামে বিভক্ত হয়েছেন, এ ধরনের কোন বৈশিষ্ট্য আহলেহাদীছদের মধ্যে কেউ দেখেছেন কি? অতএব ছাহাবায়ে কেরাম, আয়েম্মায়ে ইযাম ও মুহাদ্দেছীনকে যেমন কেউ কোন ব্যক্তি পূজারী ফের্কায় চিহ্নিত করতে পারেন না, তেমনি তাঁদেরই নামে নামাংকিত ও তাঁদেরই একনিষ্ঠ অনুসারী আহলেহাদীছগণকেও প্রচলিত অর্থে কোন ফের্কায় চিহ্নিত করা যায় না। তবে উদার ও অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার কারণে আহলেহাদীছগণ নিঃসন্দেহে একটি পৃথক জামা‘আতী সত্তা। যে বৈশিষ্ট্যের কারণে ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকেও ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়েছে।
[1]. ইজতিহাদ-এর আভিধানিক অর্থ : সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। পারিভাষিক অর্থ : ‘কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে ছাহাবার মধ্যে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না এমন বিষয়ে শারঈ বিধান নির্ধারণের জন্য নিয়মানুযায়ী সার্বিক অনুসন্ধান প্রচেষ্টা চালানো। -লেখক।
তাদের মাঝে পুরোহিত তন্ত্রের কোন অবকাশ নেই। নেই পীরের ‘ফয়েয’ লাভের বা তাঁদের ‘অসীলায়’ মুক্তি পাবার অহেতুক কোন মাথাব্যথা। তাঁদের রোগমুক্তি অথবা মামলায় ডিগ্রী পাবার জন্য কোন ‘পীর বাবা’ কিংবা ‘সাধু বাবা’-র চরণ ধূলি নিতে হয় না। কোন আউলিয়ার কবরে মানত করতে হয় না। কারো ‘মুরীদ’ হওয়ার সনদও নিতে হয় না।
খালেছ তাওহীদে বিশ্বাসী আহলেহাদীছগণ দুঃখে ও বিপদে কেবলমাত্র আল্লাহরই সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাঁরই নিকটে আশ্রয় ভিক্ষা করেন। তাঁরই নিকটে কাঁদেন, তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য ছাদাক্বা করেন। ‘তাক্বদীরের’ ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস রেখে যথাসাধ্য ‘তদবীর’ করে চলেন। পরকালীন মুক্তির জন্য তারা শিরক ও বিদ‘আতমুক্ত এবং শরী‘আত অনুমোদিত নেক আমলকেই একমাত্র ‘অসীলা’ মনে করেন, যা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই খালেছ হয়ে থাকে। যে সকল কথায় ও কর্মে শিরক ও বিদ‘আতের সামান্যতম ছিটে-ফোঁটা রয়েছে, তা হ’তে তারা দূরে থাকেন। কোন মানুষকে ‘ইলমে গায়েব’ বা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বলে তারা বিশ্বাস করেন না। নবী ব্যতীত অন্য কাউকে তারা অভ্রান্ত বলে মনে করেন না। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নূরের সৃষ্টি বা ‘নূরনবী’ নয় বরং মাটির সৃষ্টি ‘মানুষ নবী’ বলে মনে করেন। তারা কোন মৃত ব্যক্তিকে নিজের জন্য বা অপরের জন্য কোনরূপ মঙ্গলামঙ্গলের অধিকারী বলে বিশ্বাস করেন না। এমনকি কোন জীবিত ব্যক্তিও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত অপরের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। কবরে সিজদা করা, সেখানে মানত করা, ফুল দেওয়া, বাতি দেওয়া, গেলাফ চড়ানো, গোসল করানো, নযর-নেয়ায পাঠানো, মোরগ বা খাসি যবেহ করে ‘হাজত’ দেওয়া, কবরবাসীর অসীলায় মুক্তি কামনা করা, তার নিকটে ফরিয়াদ পেশ করা ইত্যাদিকে তারা প্রকাশ্য শিরক মনে করেন। এমনিভাবে একই মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লাখো মীলাদের মাহফিলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রূহ মুবারক হাযির হওয়ার অলীক ধারণা ও তাঁর সম্মানে সকলে দাঁড়িয়ে (ক্বিয়াম করে) সালাম জানানোকে মানুষের মাঝে স্রষ্টার গুণ কল্পনার মতই ঘৃণ্যতম পাপ বলে মনে করেন। এমনিভাবে কোন মৃত মানুষের সম্মানে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা, নিজেদের বানানো স্মৃতিসৌধে বা শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, বিভিন্ন মানুষের তৈলচিত্র, ছবি, মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণ ও সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন ইত্যাদি সবকিছু জাহেলী যুগের ফেলে আসা অগ্নিপূজা ও মূর্তিপূজার জঘন্যতম শিরকী রীতি-নীতির আধুনিক রূপ বলে মনে করেন।
আহলেহাদীছগণ মনে প্রাণে একথা বিশ্বাস করেন যে, শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের কোন হুকুম গোপন করে যাননি। বরং বিশ্ব ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ মানুষ হিসাবে এবং ইসলামী চরিত্রের নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ রূপকার হিসাবে দীর্ঘ তেইশ বছরের নবুঅতী জীবনে স্বীয় কথায়, কর্মে ও আচরণে ইসলামী শরী‘আতের ভিতর-বাহির ও খুঁটি-নাটি সব কিছুই স্বীয় উম্মতের জন্য স্পষ্ট করে গিয়েছেন এবং ‘অহিয়ে এলাহীর’ সবটুকু উম্মতের নিকট পূর্ণ সততার সাথে যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। অতঃপর জীবন সায়াহ্নে বিদায় হজ্জে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত লক্ষাধিক ছাহাবীর নিকট হ’তে সাক্ষ্য নিয়ে আল্লাহর নিকট হ’তে সরাসরি ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার নিশ্চয়তাও লাভ করেছেন। অতএব আহলেহাদীছগণ মনে করেন যে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে ইসলামী জীবন বিধানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র লাভ করার পর নিজেদের আবিষ্কৃত হাক্বীক্বত, তরীক্বত ও মা‘রেফাত তত্ত্বের তথাকথিত সীনা ব-সীনা বাত্বেনী ইলমের তালাশে অযথা সময় নষ্ট করা ইসলামের সহজ-সরল ও পরিচ্ছন্ন জীবন বিধান হ’তে দূরে সরে যাওয়ারই নামান্তর। সঙ্গে সঙ্গে এটা শেষনবী (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শরী‘আত সংক্রান্ত আমানতদারীর ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করে, যা ঈমানের প্রকাশ্য বিরোধী।
আহলেহাদীছগণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শেষনবী হিসাবে বিশ্বাস করেন এবং এই বিশ্বাসকে ঈমানের অন্যতম প্রধান রুকন বা স্তম্ভ বলে মনে করেন। এই রুকনকে অস্বীকার বা অমান্যকারী কিংবা এতে সন্দেহ পোষণকারী ব্যক্তি কখনোই মুসলমান হ’তে পারে না। অতঃপর যেহেতু তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না, সেহেতু তাঁর অনুসারী বিশ্বের সকল মুসলমান একই মিল্লাতভুক্ত একটি মহাজাতি। যেখানে ফের্কাবন্দীর কোন অবকাশ নেই। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ মুসলিম মিল্লাতকে আপোষে সকল দলাদলি ভুলে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একক নেতৃত্বে শুধুমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ মহাজাতিতে পরিণত করতে চায়।
আহলেহাদীছগণ ইসলামের প্রথম চারজন খলীফাকে ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ (সঠিক পথের অনুসারী খলীফাগণ) বলে বিশ্বাস করেন। তাঁদের সহ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অপর যে কোন ছাহাবীর প্রতি সামান্যতম অসম্মান প্রদর্শন করাকে তারা ‘গুনাহে কাবীরা’ বলে মনে করেন। তারা মহানবী (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবারবর্গের প্রতি যেমন মনে-প্রাণে ভক্তি রাখেন, তেমনি মহররমের তা‘যিয়ার নামে হুসায়েন-পূজারও চরম বিরোধিতা করে থাকেন।
খালেছ সুন্নাতের অনুসারী আহলেহাদীছগণ কোন অবস্থাতেই বিদ‘আতের সাথে আপোষ করেন না। লৌকিকতার নামে, দেশাচারের নামে, বিদ‘আতে হাসানাহর নামে অথবা ‘হিকমতের’ দোহাই পেড়ে এরা কোন বিদ‘আতকে কখনই প্রশ্রয় দেন না। এদের নিকটে সবচাইতে সম্মানিত ঐ ব্যক্তি, যিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সকল প্রকারের শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীন ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং জীবনের বিনিময়ে হ’লেও তাওহীদ ও সুন্নাতের যথাযথ পায়রবী করে চলেন। বিপ্লবী আদর্শ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে আহলেহাদীছগণ ইসলামকে সর্বযুগীয় সমাধান বলে বিশ্বাস করেন এবং ইসলামের গতিশীল (Dynamic) হওয়ার স্বার্থেই ‘ইজতিহাদ’কে সকল যুগে অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং ‘তাক্বলীদে শাখছী’কে অবশ্য বর্জনীয় বলে মনে করেন।[1] তারা একথাই বলতে চান যে, ‘তাক্বলীদে শাখছী’ হ’ল মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অগ্রগতির মূলে সবচাইতে বড় বাধা। কেননা এর ফলে আমরা কেবল একজনের একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার অন্ধ অনুসরণ করি, যার মধ্যে ভুলের আশংকা পুরা মাত্রায় বিদ্যমান। অথচ উক্ত একই বিষয়ে আরও যে কিছু উন্নত চিন্তা অন্যের মধ্যে কিংবা আমার নিজের মধ্যেই থাকতে পারে, এই আত্মবিশ্বাস আমরা হারিয়ে ফেলি। তাক্বলীদের সাক্ষাৎ পরিণতিতে অবশেষে আমরা হয়তবা সারাটি জীবন ধরে একজনের দেওয়া একটি ভুলের অনুসরণ করে চলি। অথচ স্ব স্ব ইহকালীন ও পরকালীন স্বার্থেই তা পরিত্যাগ করে নিরপেক্ষভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে চলা মুক্তিকামী মুসলমানের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। বলা আবশ্যক যে, আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল দাবী চিরদিন এটাই।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ‘আহলেহাদীছ’-এর পরিচয় এবং এ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যাবলী সংক্ষেপে পরিবেশিত হয়েছে। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, দুনিয়ার সকল মুসলমান আহলেহাদীছ নন। কেননা অন্যেরা কেবল ঐ হাদীছগুলিই মানেন, যেগুলি তাদের অনুসরণীয় ইমাম বা আলেমদের গৃহীত মাযহাবের অনুকূলে হয়। কিন্তু আহলেহাদীছগণ নিরপেক্ষভাবে যেকোন ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে থাকেন। উপরের আলোচনায় একথাও প্রমাণিত হয় যে, আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল, ‘তাক্বলীদে শাখছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। এই তাক্বলীদ ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোন মাযহাব বা তরীক্বার হৌক কিংবা বৈষয়িক ক্ষেত্রে প্রগতির নামে বিজাতীয় কোন মতবাদের হৌক। ‘অহি’র বিধানের আনুগত্য ব্যতীত ধর্মীয় ও বৈষয়িক সকল ক্ষেত্রে সকল প্রকার তাক্বলীদ বর্জনযোগ্য। অতএব যাবতীয় মাযহাবী সংকীর্ণতা ও তাক্বলীদী গোঁড়ামী ছেড়ে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত মন নিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দেওয়া ফায়ছালার সম্মুখে আনুগত্যের মস্তক অবনতকারী ব্যক্তিই মাত্র ‘আহলেহাদীছ’। কিন্তু দুঃখের বিষয় মহান ছাহাবায়ে কেরাম ও মুহাদ্দেছীনে ইযামের উপাধিধন্য এই গৌরবময় নামে নিজেকে পরিচিত করতে অনেকেই আজ সংকোচ বোধ করে থাকেন।
অনেকে আহলেহাদীছকে হানাফী, শাফেঈ প্রভৃতি তাক্বলীদী ফের্কার প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা অনুরূপ একটি ফের্কা বলে মনে করেন। অথচ ঐগুলি নির্দিষ্ট একজন বিদ্বানের অথবা নির্দিষ্ট বিদ্বানের গৃহীত মাযহাবের অনুসারী দল মাত্র। পক্ষান্তরে ঐসব মাযহাবী ও তাক্বলীদী গন্ডী ভেঙ্গে যারা নিরপেক্ষভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী হন, তারাই কেবল ‘আহলেহাদীছ হ’তে পারেন। কেননা ‘আহলেহাদীছ’ অর্থাৎ ‘হাদীছের অনুসারী’ বললে কোন ব্যক্তির অনুসারী বুঝায় না। অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেমন বিশ্বনবী, তাঁর নিকটে প্রেরিত ‘অহি’ যেমন বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য, তেমনি সর্বশেষ ‘অহি’ ভিত্তিক আন্দোলন তথা ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ তেমনি দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিত।
পরিশেষে আমরা সবিনয় নিবেদন রাখতে চাই যে, যেভাবে নির্দিষ্ট ইমাম, মাযহাব, ফিক্বহ ও তরীক্বা রচনা করে লোকেরা বিভিন্ন দলীয় নামে বিভক্ত হয়েছেন, এ ধরনের কোন বৈশিষ্ট্য আহলেহাদীছদের মধ্যে কেউ দেখেছেন কি? অতএব ছাহাবায়ে কেরাম, আয়েম্মায়ে ইযাম ও মুহাদ্দেছীনকে যেমন কেউ কোন ব্যক্তি পূজারী ফের্কায় চিহ্নিত করতে পারেন না, তেমনি তাঁদেরই নামে নামাংকিত ও তাঁদেরই একনিষ্ঠ অনুসারী আহলেহাদীছগণকেও প্রচলিত অর্থে কোন ফের্কায় চিহ্নিত করা যায় না। তবে উদার ও অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার কারণে আহলেহাদীছগণ নিঃসন্দেহে একটি পৃথক জামা‘আতী সত্তা। যে বৈশিষ্ট্যের কারণে ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকেও ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়েছে।
[1]. ইজতিহাদ-এর আভিধানিক অর্থ : সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। পারিভাষিক অর্থ : ‘কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে ছাহাবার মধ্যে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না এমন বিষয়ে শারঈ বিধান নির্ধারণের জন্য নিয়মানুযায়ী সার্বিক অনুসন্ধান প্রচেষ্টা চালানো। -লেখক।
ইসলামের মধ্যকার বিভিন্ন মাযহাব অপর মাযহাবে গৃহীত অনেক ছহীহ সিদ্ধান্ত, যার পক্ষে কিতাব ও সুন্নাতের ছহীহ দলীল রয়েছে, তাকে শুধুমাত্র নিজেদের তাক্বলীদী গোঁড়ামীর কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রত্যাখ্যান করেছে। অতঃপর নিজেদের এই অনুদারতা ঢাকবার জন্য অপর মাযহাবের গৃহীত ছহীহ হাদীছকে অস্বীকার করেছে অথবা ‘মানসূখ’ (হুকুম রহিত) বলে দাবী করেছে। কিংবা তার পরোক্ষ ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়েছে অথবা ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’ বলে সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেছে। এঁরা জাঁকজমকের সাথে ‘খতমে বুখারী’-র অনুষ্ঠান করেন, অথচ বুখারীর হাদীছ মানেন না। ছহীহ বুখারীর অনুবাদক হ’তে গর্ব অনুভব করেন, অথচ অনুবাদে কারচুপি করেন। আবার অযৌক্তিক টীকা-টিপ্পনীর ছুরি চালিয়ে স্বীয় মাযহাব বিরোধী ছহীহ হাদীছগুলিকে যবেহ করেন। এইসব তাক্বলীদী গোঁড়ামীর ক্যান্সারে আক্রান্ত লোকদের দ্বারাই ইসলামী ঐক্য ইসলামের নামেই ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেছে এবং তা এখন সামাজিকভাবে স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে।
এক্ষণে যদি কেউ সত্যিকার অর্থে ইসলামী ঐক্য চান এবং ইসলামের বিধান ও অনুশাসনসমূহ সঠিকভাবে পালন করে ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি কামনা করেন, তবে তাকে সর্বপ্রথম তাক্বলীদী বন্ধন ছিন্ন করে মাযহাবী ও দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করতে হবে। অতঃপর সম্পূর্ণ খোলা মনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সনিষ্ঠ অনুসারী হ’তে হবে। তা তার নিজ মাযহাবের, নিজ বংশের বা সমাজের এমনকি নিজ দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধেও যাক না কেন। এই কঠিন ঝুঁকি নিয়ে ‘হক্ব’ কবুল করতে পারলেই তবে জান্নাতের আশা করা যায়।
’৮০-এর দশকের প্রথম দিকে ( الاتحاد مع الاختلاف ) ‘মতপার্থক্য সহই ঐক্য’ নামক একটি নতুন ফর্মুলার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু প্রায় দু’ দশক (১৯৭৮-৯৮) ধরে চেষ্টা করেও তাতে কোন ফলোদয় হয়নি।[1] কারণ বৈষয়িক অনৈক্যের চাইতে ধর্মীয় অনৈক্য মানুষের মনে বেশী রেখাপাত করে। আর সেকারণেই শ্রেষ্ঠ ইবাদত ‘ছালাতের’ মধ্যে বুকে হাত বাঁধা বা নাভীর নীচে হাত বাঁধা, রুকূতে যাওয়া ও ওঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা বা না করা, ঈদায়নের ছালাতে ৬ তাকবীর না ১২ তাকবীর, জানাযার ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পড়তে হবে কি হবে না, ছালাত শেষে ইমাম-মুক্তাদী দু’হাত উঠিয়ে দলবদ্ধভাবে মুনাজাত (প্রার্থনা) করবে কি করবে না, জুম‘আর আযান একটা না দু’টা-ইত্যাকার ধর্মীয় পার্থক্য সমূহ ঘুচানো আজও সম্ভব হয়নি। অথচ এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহজ-সরল ঐক্য ফর্মুলা হ’ল: ছহীহ হাদীছ দ্বারা যেটি প্রমাণিত হবে, সেটি সকলে মেনে নিবেন ও বাকীটি ছেড়ে দিবেন। যদি দু’টিই ছহীহ হাদীছে থাকে, তবে সর্বাধিক ছহীহ আমলটি করবেন অথবা দু’টি আমলই সকলে সুযোগমত করবেন। নির্দিষ্ট কোন একটির উপরে গোঁড়ামী করবেন না। বলা বাহুল্য, এধরনের পার্থক্য ফিক্বহের অধিকাংশ বিষয়ে রয়েছে।
অনেকে বলেন, আমাদের মধ্যে আক্বীদায় কোন বিরোধ নেই। যত বিরোধ কেবল শাখা-প্রশাখায়। কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। বরং আমলের সাথে সাথে আক্বীদার ক্ষেত্রেও রয়েছে দুস্তর পার্থক্য। যেমন কেউ বলছেন, আল্লাহ নিরাকার, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। অথচ কুরআন বলছে, আল্লাহর আকার আছে (ছোয়াদ ৩৮/৭৫, মায়েদাহ ৫/৬৪ ইত্যাদি)। তবে তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই (শূরা ৪২/১১)। তিনি আসমানের উপরে আরশে সমাসীন (ত্বোহা ২০/৫ ইত্যাদি)। তবে তাঁর ইল্ম ও কুদরত সর্বত্র বিরাজমান (ত্বালাক্ব ৬৫/১২, বাক্বারাহ ২/১৪৮ প্রভৃতি)। কেউ বলছেন ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’। আমরা সবাই আল্লাহর সত্তার অংশ (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ কুরআন বলছে আল্লাহ সবকিছুরই স্রষ্টা। বাকী সবই তাঁর সৃষ্টি। স্রষ্টা এবং সৃষ্টি কখনই এক নয় (রা‘দ ১৩/১৬, নাহল ১৬/১৭ ইত্যাদি)। মূলতঃ এগুলি ইরানী ও হিন্দুয়ানী অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী দর্শন, যা মা‘রেফাতের নামে সূফীবাদী দর্শন হিসাবে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। কেউ বলেন, নবী-রাসূল ও পীর-আউলিয়া মরেন না, বরং ভূপৃষ্ঠ হ’তে ভূগর্ভে বা কবরে ইন্তেকাল বা স্থানান্তরিত হন মাত্র। তাঁরা কবরে যিন্দা থাকেন ও ভক্তদের ভালমন্দের ক্ষমতা রাখেন। অথচ আল্লাহ ব্যতীত ‘কেউ কারু ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না’ (মায়েদাহ ৫/৭৬ ইত্যাদি)। এমনকি কেউ কেউ ‘যিনদা পীর’ নামেও অভিহিত হয়েছেন। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘নবী-রাসূল সহ সকল মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকেন’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। চরম অদৃষ্টবাদী একদল লোক বলছেন, ‘কিছু হইতে কিছু হয় না, যা কিছু হয় আল্লাহ হইতে হয়’ আমরা সবাই পুতুল সদৃশ। অতএব ‘যেমনে নাচায় তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ’? তার বিপরীতে আরেকদল বলছেন, অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। ‘মানুষ নিজেই তার অদৃষ্টের স্রষ্টা’। অথচ আক্বীদা বিষয়ে সহজ-সরল ঐক্য ফর্মুলা হ’ল : আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত আয়াত ও ছহীহ হাদীছসমূহকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা এবং সকল বিষয়ে ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম ও মুহাদ্দেছীনের মাসলাক অনুযায়ী ফায়ছালা প্রদান করা।
এছাড়াও রয়েছে হাক্বীক্বাত, তরীক্বাত ও মা‘রেফাতের নামে চিশতিয়া, ক্বাদেরিয়া, মুজাদ্দেদিয়া ও নকশবন্দীয়া নামক প্রধান চারটি সূফীবাদী দলের উপদলসমূহ মিলে প্রায় দু’শ তরীক্বা। যাদের পরস্পরে আক্বীদা ও আমলে কোন মিল নেই। যার ফলে দেশে সৃষ্টি হয়েছে ১৯৮১ সালে সরকারী হিসাব মতে ২ লক্ষ ৯৮ হাযার পীর। প্রত্যেক পীরের রয়েছে হাযার হাযার মুরীদ। এক পীরের সাথে অন্য পীরের ও তাদের মুরীদদের রয়েছে আক্বীদা ও আমলের মাঝে বিরাট ফারাক। তাই ১৩ কোটি তাওহীদবাদী মুসলিমের অবস্থা এখন ঘুণে ধরা বাঁশের মত। যাতে কোন শক্তি নেই। আর এর একমাত্র কারণ হ’ল, বিভিন্ন শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী আমল। যেসবের প্রচলনকারী হ’লেন, প্রথমতঃ দেশের এক শ্রেণীর দুষ্টমতি আলেম, যারা দুনিয়াবী স্বার্থে এগুলির প্রচলন ও লালন করেন। দ্বিতীয়তঃ এক ধরনের সমাজনেতা, যারা এগুলিকে সহযোগিতা করেন ও পাহারা দেন। তৃতীয়তঃ এক ধরনে ধনী লোক, যারা তাদের অঢেল ধন-সম্পদ এসবের পিছনে ব্যয় করেন সহজে জান্নাত পাওয়ার ধোঁকায়। চতুর্থতঃ দেশের সরকার, যারা ধর্মের নামে এগুলিকে নিরাপত্তা দান করে থাকেন। সত্য কথা বলতে কি, এদেশের অধিকাংশ পীর ও ইসলামী নেতারা তাওহীদ-এর সঠিক ব্যাখ্যা জানেন না কিংবা সুন্নাত ও বিদ‘আতের পার্থক্য বুঝেন না। সেকারণ সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন শিরকী আক্বীদা যেমন তাওহীদের নামে পার পেয়ে যাচ্ছে, তেমনি প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ ‘বিদ‘আতে হাসানাহ্’র নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে যেন এখন আর শিরক ও বিদ‘আত বলে কিছুই নেই। যা আছে সবই তাওহীদ, সবই সুন্নাত, সবই ইসলাম। এসবের বিরোধিতাকারী আহলেহাদীছরাই আসলে বেদ্বীন ও লা-মাযহাবী। হা-শা ওয়া কাল্লা!
অতএব শিরক ও বিদ‘আতসমূহের ব্যাপারে মৌলিক ঐক্যমতে না এসে কেবলমাত্র ভোটের স্বার্থে সাময়িক ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ করলে তা কখনই টেকসই হবে না। বরং স্লাইস্ড পাউরুটির মত যেকোন সময়ে স্বার্থদুষ্ট পাতলা পর্দার ঐক্য ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে।
বলা আবশ্যক যে, ইসলামের শত্রুরা রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের চাইতে আক্বীদাগত বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকেই সর্বদা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মুসলিম পন্ডিত ইতিমধ্যেই তাদের আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যারা দেশের প্রচার মাধ্যমসমূহে, শিক্ষা কেন্দ্রে, অর্থনৈতিক উপায়-উপাদানসমূহে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশে অনুপ্রবেশ করে তাদের কপট উদ্দেশ্য সাধন করে চলেছেন। ঐক্য প্রয়াসী ইসলামী নেতৃবৃন্দকে তাই মূল আক্বীদাগত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য আমরা আহবান জানাই।
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ইসলামের মধ্যকার বিচ্ছিন্ন ফের্কাসমূহকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সর্বোচ্চ অধিকার নিঃশর্তভাবে মেনে নেওয়ার একটিমাত্র শর্তে ঐক্যবদ্ধ মহাজাতিতে পরিণত করতে চায়। মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ)-কে একাই একটি ‘উম্মত’ হিসাবে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে (নাহ্ল ১২০)। যদিও তাঁর যুগে তিনি কার্যতঃ একাকী ছিলেন এবং তাঁর পিতা ও নিজ গোত্র সহ সে যুগের প্রায় সকল মানুষ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
অতএব আজও যেকোন মূল্যে হক্ব-কে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং মনকে উদার রেখে সকলকে হক্ব-এর দিকে আহবান জানাতে হবে। সংখ্যায় কম হৌক বা বেশী হৌক হক্বপন্থী সেই লোকগুলিই হবেন আল্লাহর নিকটে সত্যিকারের ঐক্যবদ্ধ একটি জামা‘আত। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সেদিকেই জগদ্বাসীকে আহবান জানায় এবং হক্বপন্থী সেই জামা‘আতই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আল্লাহ্ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যিবাদীদের (হক্বপন্থীদের) সঙ্গে থাক’ (তাওবা ৯/১১৯)।
[1]. অধ্যাপক গোলাম আযম, ইসলামী ঐক্যমঞ্চ চাই (ঢাকা: জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগ, ফেব্রুয়ারী ২০০০) পুস্তক দ্রষ্টব্য।
এক্ষণে যদি কেউ সত্যিকার অর্থে ইসলামী ঐক্য চান এবং ইসলামের বিধান ও অনুশাসনসমূহ সঠিকভাবে পালন করে ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি কামনা করেন, তবে তাকে সর্বপ্রথম তাক্বলীদী বন্ধন ছিন্ন করে মাযহাবী ও দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করতে হবে। অতঃপর সম্পূর্ণ খোলা মনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সনিষ্ঠ অনুসারী হ’তে হবে। তা তার নিজ মাযহাবের, নিজ বংশের বা সমাজের এমনকি নিজ দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধেও যাক না কেন। এই কঠিন ঝুঁকি নিয়ে ‘হক্ব’ কবুল করতে পারলেই তবে জান্নাতের আশা করা যায়।
’৮০-এর দশকের প্রথম দিকে ( الاتحاد مع الاختلاف ) ‘মতপার্থক্য সহই ঐক্য’ নামক একটি নতুন ফর্মুলার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু প্রায় দু’ দশক (১৯৭৮-৯৮) ধরে চেষ্টা করেও তাতে কোন ফলোদয় হয়নি।[1] কারণ বৈষয়িক অনৈক্যের চাইতে ধর্মীয় অনৈক্য মানুষের মনে বেশী রেখাপাত করে। আর সেকারণেই শ্রেষ্ঠ ইবাদত ‘ছালাতের’ মধ্যে বুকে হাত বাঁধা বা নাভীর নীচে হাত বাঁধা, রুকূতে যাওয়া ও ওঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা বা না করা, ঈদায়নের ছালাতে ৬ তাকবীর না ১২ তাকবীর, জানাযার ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পড়তে হবে কি হবে না, ছালাত শেষে ইমাম-মুক্তাদী দু’হাত উঠিয়ে দলবদ্ধভাবে মুনাজাত (প্রার্থনা) করবে কি করবে না, জুম‘আর আযান একটা না দু’টা-ইত্যাকার ধর্মীয় পার্থক্য সমূহ ঘুচানো আজও সম্ভব হয়নি। অথচ এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহজ-সরল ঐক্য ফর্মুলা হ’ল: ছহীহ হাদীছ দ্বারা যেটি প্রমাণিত হবে, সেটি সকলে মেনে নিবেন ও বাকীটি ছেড়ে দিবেন। যদি দু’টিই ছহীহ হাদীছে থাকে, তবে সর্বাধিক ছহীহ আমলটি করবেন অথবা দু’টি আমলই সকলে সুযোগমত করবেন। নির্দিষ্ট কোন একটির উপরে গোঁড়ামী করবেন না। বলা বাহুল্য, এধরনের পার্থক্য ফিক্বহের অধিকাংশ বিষয়ে রয়েছে।
অনেকে বলেন, আমাদের মধ্যে আক্বীদায় কোন বিরোধ নেই। যত বিরোধ কেবল শাখা-প্রশাখায়। কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। বরং আমলের সাথে সাথে আক্বীদার ক্ষেত্রেও রয়েছে দুস্তর পার্থক্য। যেমন কেউ বলছেন, আল্লাহ নিরাকার, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। অথচ কুরআন বলছে, আল্লাহর আকার আছে (ছোয়াদ ৩৮/৭৫, মায়েদাহ ৫/৬৪ ইত্যাদি)। তবে তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই (শূরা ৪২/১১)। তিনি আসমানের উপরে আরশে সমাসীন (ত্বোহা ২০/৫ ইত্যাদি)। তবে তাঁর ইল্ম ও কুদরত সর্বত্র বিরাজমান (ত্বালাক্ব ৬৫/১২, বাক্বারাহ ২/১৪৮ প্রভৃতি)। কেউ বলছেন ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’। আমরা সবাই আল্লাহর সত্তার অংশ (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ কুরআন বলছে আল্লাহ সবকিছুরই স্রষ্টা। বাকী সবই তাঁর সৃষ্টি। স্রষ্টা এবং সৃষ্টি কখনই এক নয় (রা‘দ ১৩/১৬, নাহল ১৬/১৭ ইত্যাদি)। মূলতঃ এগুলি ইরানী ও হিন্দুয়ানী অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী দর্শন, যা মা‘রেফাতের নামে সূফীবাদী দর্শন হিসাবে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। কেউ বলেন, নবী-রাসূল ও পীর-আউলিয়া মরেন না, বরং ভূপৃষ্ঠ হ’তে ভূগর্ভে বা কবরে ইন্তেকাল বা স্থানান্তরিত হন মাত্র। তাঁরা কবরে যিন্দা থাকেন ও ভক্তদের ভালমন্দের ক্ষমতা রাখেন। অথচ আল্লাহ ব্যতীত ‘কেউ কারু ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না’ (মায়েদাহ ৫/৭৬ ইত্যাদি)। এমনকি কেউ কেউ ‘যিনদা পীর’ নামেও অভিহিত হয়েছেন। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘নবী-রাসূল সহ সকল মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকেন’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। চরম অদৃষ্টবাদী একদল লোক বলছেন, ‘কিছু হইতে কিছু হয় না, যা কিছু হয় আল্লাহ হইতে হয়’ আমরা সবাই পুতুল সদৃশ। অতএব ‘যেমনে নাচায় তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ’? তার বিপরীতে আরেকদল বলছেন, অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। ‘মানুষ নিজেই তার অদৃষ্টের স্রষ্টা’। অথচ আক্বীদা বিষয়ে সহজ-সরল ঐক্য ফর্মুলা হ’ল : আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত আয়াত ও ছহীহ হাদীছসমূহকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা এবং সকল বিষয়ে ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম ও মুহাদ্দেছীনের মাসলাক অনুযায়ী ফায়ছালা প্রদান করা।
এছাড়াও রয়েছে হাক্বীক্বাত, তরীক্বাত ও মা‘রেফাতের নামে চিশতিয়া, ক্বাদেরিয়া, মুজাদ্দেদিয়া ও নকশবন্দীয়া নামক প্রধান চারটি সূফীবাদী দলের উপদলসমূহ মিলে প্রায় দু’শ তরীক্বা। যাদের পরস্পরে আক্বীদা ও আমলে কোন মিল নেই। যার ফলে দেশে সৃষ্টি হয়েছে ১৯৮১ সালে সরকারী হিসাব মতে ২ লক্ষ ৯৮ হাযার পীর। প্রত্যেক পীরের রয়েছে হাযার হাযার মুরীদ। এক পীরের সাথে অন্য পীরের ও তাদের মুরীদদের রয়েছে আক্বীদা ও আমলের মাঝে বিরাট ফারাক। তাই ১৩ কোটি তাওহীদবাদী মুসলিমের অবস্থা এখন ঘুণে ধরা বাঁশের মত। যাতে কোন শক্তি নেই। আর এর একমাত্র কারণ হ’ল, বিভিন্ন শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী আমল। যেসবের প্রচলনকারী হ’লেন, প্রথমতঃ দেশের এক শ্রেণীর দুষ্টমতি আলেম, যারা দুনিয়াবী স্বার্থে এগুলির প্রচলন ও লালন করেন। দ্বিতীয়তঃ এক ধরনের সমাজনেতা, যারা এগুলিকে সহযোগিতা করেন ও পাহারা দেন। তৃতীয়তঃ এক ধরনে ধনী লোক, যারা তাদের অঢেল ধন-সম্পদ এসবের পিছনে ব্যয় করেন সহজে জান্নাত পাওয়ার ধোঁকায়। চতুর্থতঃ দেশের সরকার, যারা ধর্মের নামে এগুলিকে নিরাপত্তা দান করে থাকেন। সত্য কথা বলতে কি, এদেশের অধিকাংশ পীর ও ইসলামী নেতারা তাওহীদ-এর সঠিক ব্যাখ্যা জানেন না কিংবা সুন্নাত ও বিদ‘আতের পার্থক্য বুঝেন না। সেকারণ সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন শিরকী আক্বীদা যেমন তাওহীদের নামে পার পেয়ে যাচ্ছে, তেমনি প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ ‘বিদ‘আতে হাসানাহ্’র নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে যেন এখন আর শিরক ও বিদ‘আত বলে কিছুই নেই। যা আছে সবই তাওহীদ, সবই সুন্নাত, সবই ইসলাম। এসবের বিরোধিতাকারী আহলেহাদীছরাই আসলে বেদ্বীন ও লা-মাযহাবী। হা-শা ওয়া কাল্লা!
অতএব শিরক ও বিদ‘আতসমূহের ব্যাপারে মৌলিক ঐক্যমতে না এসে কেবলমাত্র ভোটের স্বার্থে সাময়িক ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ করলে তা কখনই টেকসই হবে না। বরং স্লাইস্ড পাউরুটির মত যেকোন সময়ে স্বার্থদুষ্ট পাতলা পর্দার ঐক্য ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে।
বলা আবশ্যক যে, ইসলামের শত্রুরা রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের চাইতে আক্বীদাগত বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকেই সর্বদা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মুসলিম পন্ডিত ইতিমধ্যেই তাদের আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যারা দেশের প্রচার মাধ্যমসমূহে, শিক্ষা কেন্দ্রে, অর্থনৈতিক উপায়-উপাদানসমূহে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশে অনুপ্রবেশ করে তাদের কপট উদ্দেশ্য সাধন করে চলেছেন। ঐক্য প্রয়াসী ইসলামী নেতৃবৃন্দকে তাই মূল আক্বীদাগত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য আমরা আহবান জানাই।
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ইসলামের মধ্যকার বিচ্ছিন্ন ফের্কাসমূহকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সর্বোচ্চ অধিকার নিঃশর্তভাবে মেনে নেওয়ার একটিমাত্র শর্তে ঐক্যবদ্ধ মহাজাতিতে পরিণত করতে চায়। মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ)-কে একাই একটি ‘উম্মত’ হিসাবে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে (নাহ্ল ১২০)। যদিও তাঁর যুগে তিনি কার্যতঃ একাকী ছিলেন এবং তাঁর পিতা ও নিজ গোত্র সহ সে যুগের প্রায় সকল মানুষ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
অতএব আজও যেকোন মূল্যে হক্ব-কে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং মনকে উদার রেখে সকলকে হক্ব-এর দিকে আহবান জানাতে হবে। সংখ্যায় কম হৌক বা বেশী হৌক হক্বপন্থী সেই লোকগুলিই হবেন আল্লাহর নিকটে সত্যিকারের ঐক্যবদ্ধ একটি জামা‘আত। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সেদিকেই জগদ্বাসীকে আহবান জানায় এবং হক্বপন্থী সেই জামা‘আতই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আল্লাহ্ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যিবাদীদের (হক্বপন্থীদের) সঙ্গে থাক’ (তাওবা ৯/১১৯)।
[1]. অধ্যাপক গোলাম আযম, ইসলামী ঐক্যমঞ্চ চাই (ঢাকা: জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগ, ফেব্রুয়ারী ২০০০) পুস্তক দ্রষ্টব্য।
আল্লাহর উদ্দেশ্যে আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করার যে আন্দোলন তাকেই সত্যিকারের ইসলামী আন্দোলন বলে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এর ভিত্তি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ। এর কাজ হ’ল কিতাব ও সুন্নাতের যথাযথ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। বস্ত্ততঃপক্ষে আহলেহাদীছ আন্দোলন ব্যতীত অন্য কোন ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য যথাযথভাবে বর্তমান নেই। আর সেকারণেই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বিশ্ব ইতিহাসের একমাত্র নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন।
ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে হয়েছে, আজও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের নামে এযাবত যতগুলো আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই অবশেষে সংকীর্ণ মাযহাবী রূপ ধারণ করেছে এবং তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও শাসন সংবিধানে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণের বদলে কোন একটি মাযহাবী মতবাদ চেপে বসেছে। যার পরিণতি অতীব ভয়াবহ হয়েছে। বিগত যুগে আববাসীয় খেলাফতকালে খলীফা মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক বিল্লাহ (১৯৮-২৩২ হিঃ) কর্তৃক মু‘তাযিলা মতবাদের নির্মম পৃষ্ঠপোষকতা, বর্তমানে ইরানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী হুকুমত তথা শী‘আ হুকুমত এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একটি বিশেষ ইসলামী দল কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ মাযহাবী (হানাফী) হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এরই প্রমাণ বহন করে।[1] যেকোন দলীয় নামের সাথে ‘ইসলাম’ শব্দটি জুড়ে দিলে তা দ্বারা অবশ্যই কিছু সস্তা জনপ্রিয়তা লাভ করা সম্ভব হয়। কিন্তু নিজেদের দলীয় অনুদারতা ঢাকবার জন্য যেরূপ ঢালাওভাবে সকলে ইসলামকে রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করছেন, তাতে ইসলামী আন্দোলন যেন গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে। কোন্ ইসলামের দলভুক্ত হ’লে সত্যিকারের ইসলামী জামা‘আতভুক্ত হ’লাম, তা বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
যে বৈশিষ্ট্যগত কারণে ছাহাবায়ে কেরাম স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করতেন, সেই একই কারণে নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনের ঝান্ডাবাহী আহলেহাদীছগণ সকল প্রকারের রাখ-ঢাক ছেড়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্কে স্ব স্ব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের পরিচালিত আন্দোলকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বলেছেন। তাতে সস্তা জনপিয়তা (Cheap popularity) অবশ্যই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু তবুও হক্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পূর্ণ খোলা মনে যিনিই নির্ভেজাল ইসলামের অনুসরণে ব্রতী হবেন, তিনিই এ আন্দোলনে শরীক হ’তে পারবেন।
মোদ্দাকথা কালেমা পাঠকারী যে কোন মুসলমান, তিনি যতই অনৈসলামী ভাবাপন্ন হৌন না কেন, তাকে যেমন ‘কাফের’ বলা যায় না, তেমনি ইসলামের নামে পরিচালিত কোন আন্দোলন, তার মধ্যে যতই শিরক ও বিদ‘আতের জগাখিচুড়ি থাকুক না কেন, সাধারণভাবে তাকে ইসলামী আন্দোলনই বলতে হয়। কিন্তু ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বলতে এসব ভেজালের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেননা ইসলামের নির্ভেজাল আদিরূপ প্রতিষ্ঠা করাই এ মহান আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য। অতএব সঙ্গত কারণেই এ আন্দোলনের কর্মীরা সকল প্রকারের শিরক-বিদ‘আত ও অনৈসলামী তৎপরতার বিরুদ্ধে হয়ে থাকেন আপোষহীন সংগ্রামী। তাই ‘সকলের মনরক্ষা নীতি’ অনুসরণে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের কোন সুযোগ না থাকার ফলে আহলেহাদীছের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় চিরদিনই কম। বরং বলা যেতে পারে যে, সংখ্যায় কম হওয়াটাই এদের গৌরব। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদত্ত সুসংবাদ কেবলমাত্র ঐ সকল মর্দে মুজাহিদের জন্যই নির্দিষ্ট, যারা বিরোধীদের ও দুশমনদের পরোয়া না করে দৃঢ়ভাবে হক্ব ও ন্যায়ের অনুসরণ করে চলেন (মুসলিম হা/১৯২৩)। তাছাড়া কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা চিরদিনই কম হয়ে থাকে (সাবা ৩৪/১৩)।
[1]. দ্রষ্টব্য: উর্দু সাপ্তাহিক আল-ইসলাম (লাহোর) ১৩ বর্ষ ২৩ সংখ্যা এবং বাংলা সাপ্তাহিক সোনার বাংলা (ঢাকা) ৩১শে জানুয়ারী ১৯৮৬ প্রশ্নোত্তরের আসর; অধ্যাপক গোলাম আযম, প্রশ্নোত্তর (ঢাকা: গ্রন্থমালঞ্চ ১৯৯৮) পৃঃ ১৮২।
ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে হয়েছে, আজও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের নামে এযাবত যতগুলো আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই অবশেষে সংকীর্ণ মাযহাবী রূপ ধারণ করেছে এবং তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও শাসন সংবিধানে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণের বদলে কোন একটি মাযহাবী মতবাদ চেপে বসেছে। যার পরিণতি অতীব ভয়াবহ হয়েছে। বিগত যুগে আববাসীয় খেলাফতকালে খলীফা মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক বিল্লাহ (১৯৮-২৩২ হিঃ) কর্তৃক মু‘তাযিলা মতবাদের নির্মম পৃষ্ঠপোষকতা, বর্তমানে ইরানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী হুকুমত তথা শী‘আ হুকুমত এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একটি বিশেষ ইসলামী দল কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ মাযহাবী (হানাফী) হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এরই প্রমাণ বহন করে।[1] যেকোন দলীয় নামের সাথে ‘ইসলাম’ শব্দটি জুড়ে দিলে তা দ্বারা অবশ্যই কিছু সস্তা জনপ্রিয়তা লাভ করা সম্ভব হয়। কিন্তু নিজেদের দলীয় অনুদারতা ঢাকবার জন্য যেরূপ ঢালাওভাবে সকলে ইসলামকে রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করছেন, তাতে ইসলামী আন্দোলন যেন গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে। কোন্ ইসলামের দলভুক্ত হ’লে সত্যিকারের ইসলামী জামা‘আতভুক্ত হ’লাম, তা বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
যে বৈশিষ্ট্যগত কারণে ছাহাবায়ে কেরাম স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করতেন, সেই একই কারণে নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনের ঝান্ডাবাহী আহলেহাদীছগণ সকল প্রকারের রাখ-ঢাক ছেড়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্কে স্ব স্ব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের পরিচালিত আন্দোলকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বলেছেন। তাতে সস্তা জনপিয়তা (Cheap popularity) অবশ্যই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু তবুও হক্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পূর্ণ খোলা মনে যিনিই নির্ভেজাল ইসলামের অনুসরণে ব্রতী হবেন, তিনিই এ আন্দোলনে শরীক হ’তে পারবেন।
মোদ্দাকথা কালেমা পাঠকারী যে কোন মুসলমান, তিনি যতই অনৈসলামী ভাবাপন্ন হৌন না কেন, তাকে যেমন ‘কাফের’ বলা যায় না, তেমনি ইসলামের নামে পরিচালিত কোন আন্দোলন, তার মধ্যে যতই শিরক ও বিদ‘আতের জগাখিচুড়ি থাকুক না কেন, সাধারণভাবে তাকে ইসলামী আন্দোলনই বলতে হয়। কিন্তু ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বলতে এসব ভেজালের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেননা ইসলামের নির্ভেজাল আদিরূপ প্রতিষ্ঠা করাই এ মহান আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য। অতএব সঙ্গত কারণেই এ আন্দোলনের কর্মীরা সকল প্রকারের শিরক-বিদ‘আত ও অনৈসলামী তৎপরতার বিরুদ্ধে হয়ে থাকেন আপোষহীন সংগ্রামী। তাই ‘সকলের মনরক্ষা নীতি’ অনুসরণে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের কোন সুযোগ না থাকার ফলে আহলেহাদীছের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় চিরদিনই কম। বরং বলা যেতে পারে যে, সংখ্যায় কম হওয়াটাই এদের গৌরব। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদত্ত সুসংবাদ কেবলমাত্র ঐ সকল মর্দে মুজাহিদের জন্যই নির্দিষ্ট, যারা বিরোধীদের ও দুশমনদের পরোয়া না করে দৃঢ়ভাবে হক্ব ও ন্যায়ের অনুসরণ করে চলেন (মুসলিম হা/১৯২৩)। তাছাড়া কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা চিরদিনই কম হয়ে থাকে (সাবা ৩৪/১৩)।
[1]. দ্রষ্টব্য: উর্দু সাপ্তাহিক আল-ইসলাম (লাহোর) ১৩ বর্ষ ২৩ সংখ্যা এবং বাংলা সাপ্তাহিক সোনার বাংলা (ঢাকা) ৩১শে জানুয়ারী ১৯৮৬ প্রশ্নোত্তরের আসর; অধ্যাপক গোলাম আযম, প্রশ্নোত্তর (ঢাকা: গ্রন্থমালঞ্চ ১৯৯৮) পৃঃ ১৮২।
ইসলামের স্বচ্ছ কিরণমালার উপরে অনৈসলামী চিন্তাধারার কালো মেঘ যুগে যুগে ঘনায়িত হয়েছে। কখনো সে আলো সম্পূর্ণ বাধামুক্ত পরিবেশে মানুষের মাঝে শান্তি ও কল্যাণ বয়ে এনেছে। কখনও বা জাহেলিয়াতের গাঢ় তমিশ্রায় মেঘে ঢাকা সূর্যের মত তার স্বচ্ছ কিরণ মানুষের নিকট আপন স্বরূপে প্রকাশ পেতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বুভুক্ষ মানবতা চিরদিন তা পাবার জন্য আকুলি-বিকুলি করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা যারা তার যথাযথ পরিবেশনার দায়িত্ব নিয়ে ‘মুসলিম’ হয়ে আল্লাহ্র নিকট শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসাবে প্রশংসা কুড়িয়েছিলাম। সাথে সাথে জগদ্ব্যাপী আমাদের উচ্চ সম্মান প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। সেই আমরাই ইসলামের সাথে সর্বাপেক্ষা বেশী গাদ্দারী করেছি। ইসলামের স্বচ্ছ সলিলে ভেজাল মিশ্রিত করেছি মনের মাধুরী মিশিয়ে তাকে মনের মত করে নিয়েছি। ফলে নিজেরা পেয়ে হারিয়েছি। অন্যকে দিতেও অপারগ হয়েছি।
বলতে কি ইসলামের প্রথম যুগ হ’তেই তার বিরুদ্ধে ভিতর ও বাহির সকল দিক থেকে হামলা পরিচালিত হয়েছে। বিভিন্ন অনৈসলামী চিন্তাধারা ও বিজাতীয় রসম-রেওয়াজসমূহকে ইসলামী লেবাস পরিয়ে মুসলিম সমাজে প্রচার ও প্রসার ঘটাবার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। যুগে যুগে বহু মুসলমান তার দ্বারা বিভ্রান্তও হয়েছে। রাসূলে করীম (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র যুগে মুনাফিকদের কপট আচরণ ও ছাহাবায়ে কেরামের স্বর্ণযুগে তাদের অপতৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকার নও-মুসলিমদের দ্বারা আমদানীকৃত শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী আমলসমূহের উদ্ভব আমাদেরকে উক্ত কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিদ‘আতী দলগুলি থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতে গিয়ে নির্ভেজাল ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী ছাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য হক্বপন্থী মুসলমানগণ সেই যুগে নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ হিসাবে পরিচিত করেছিলেন। তাঁরা মুসলিম সমাজকে যাবতীয় অনৈসলামী দর্শন ও সংস্কৃতি হ’তে বিমুক্ত রাখার জন্য জীবনপাত করে গেছেন। যুগে যুগে তাঁদের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। মুসলিম মিল্লাতকে কিতাব ও সুন্নাতের মূল ভিত্তির উপরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য নিজেদের সকল শ্রম নিয়োজিত করেছেন। সত্য কথা বলতে কি একমাত্র এঁদেরই নিঃস্বার্থ খিদমত ও আন্দোলনের ফলে বিদ‘আতপন্থীদের হাতে ইসলাম আজও সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হ’তে পারেনি। এঁদের ঘরে আজও তাওহীদ ও সুন্নাহ প্রাণবন্ত রয়েছে। ইনশাআল্লাহ ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা : শেষনবী (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের সময়ে পৃথিবীর যে করুণ অবস্থা ছিল, বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি তা থেকে কোন অংশে কম নয়। সে কারণে বিশ্বের বর্তমান বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে মানবতা যখন চরমভাবে মার খাচ্ছে, বস্ত্তবাদী দর্শনসমূহ তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে যখন ক্রমেই ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে এবং সারা বিশ্ব যখন একটি শান্তিময় আদর্শের সন্ধানে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে, সেই মুহূর্তে ইসলামের নির্ভেজাল আদিরূপ সকলের সম্মুখে তুলে ধরার মহান দায়িত্ব পালনের জন্য আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের যোগ্য অনুসারীগণকে তাই আজ তাদের চিরন্তন জিহাদী ঐতিহ্য স্মরণ করে চরম ত্যাগের প্রস্ত্ততি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে ও বিদেশে দা‘ওয়াত ও তাবলীগের জোয়ার বইয়ে দিয়ে মানুষকে মূল ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
পরিশেষে আমরা বিশ্বের প্রতিটি মুসলমান বিশেষ করে যুব সমাজকে অন্যান্য সকল দিক হ’তে মুখ ফিরিয়ে নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাতলে সমবেত হওয়ার এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী স্ব স্ব ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবন পরিচালনা করার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
বলতে কি ইসলামের প্রথম যুগ হ’তেই তার বিরুদ্ধে ভিতর ও বাহির সকল দিক থেকে হামলা পরিচালিত হয়েছে। বিভিন্ন অনৈসলামী চিন্তাধারা ও বিজাতীয় রসম-রেওয়াজসমূহকে ইসলামী লেবাস পরিয়ে মুসলিম সমাজে প্রচার ও প্রসার ঘটাবার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। যুগে যুগে বহু মুসলমান তার দ্বারা বিভ্রান্তও হয়েছে। রাসূলে করীম (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র যুগে মুনাফিকদের কপট আচরণ ও ছাহাবায়ে কেরামের স্বর্ণযুগে তাদের অপতৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকার নও-মুসলিমদের দ্বারা আমদানীকৃত শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী আমলসমূহের উদ্ভব আমাদেরকে উক্ত কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিদ‘আতী দলগুলি থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতে গিয়ে নির্ভেজাল ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী ছাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য হক্বপন্থী মুসলমানগণ সেই যুগে নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ হিসাবে পরিচিত করেছিলেন। তাঁরা মুসলিম সমাজকে যাবতীয় অনৈসলামী দর্শন ও সংস্কৃতি হ’তে বিমুক্ত রাখার জন্য জীবনপাত করে গেছেন। যুগে যুগে তাঁদের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। মুসলিম মিল্লাতকে কিতাব ও সুন্নাতের মূল ভিত্তির উপরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য নিজেদের সকল শ্রম নিয়োজিত করেছেন। সত্য কথা বলতে কি একমাত্র এঁদেরই নিঃস্বার্থ খিদমত ও আন্দোলনের ফলে বিদ‘আতপন্থীদের হাতে ইসলাম আজও সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হ’তে পারেনি। এঁদের ঘরে আজও তাওহীদ ও সুন্নাহ প্রাণবন্ত রয়েছে। ইনশাআল্লাহ ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা : শেষনবী (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের সময়ে পৃথিবীর যে করুণ অবস্থা ছিল, বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি তা থেকে কোন অংশে কম নয়। সে কারণে বিশ্বের বর্তমান বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে মানবতা যখন চরমভাবে মার খাচ্ছে, বস্ত্তবাদী দর্শনসমূহ তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে যখন ক্রমেই ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে এবং সারা বিশ্ব যখন একটি শান্তিময় আদর্শের সন্ধানে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে, সেই মুহূর্তে ইসলামের নির্ভেজাল আদিরূপ সকলের সম্মুখে তুলে ধরার মহান দায়িত্ব পালনের জন্য আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের যোগ্য অনুসারীগণকে তাই আজ তাদের চিরন্তন জিহাদী ঐতিহ্য স্মরণ করে চরম ত্যাগের প্রস্ত্ততি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে ও বিদেশে দা‘ওয়াত ও তাবলীগের জোয়ার বইয়ে দিয়ে মানুষকে মূল ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
পরিশেষে আমরা বিশ্বের প্রতিটি মুসলমান বিশেষ করে যুব সমাজকে অন্যান্য সকল দিক হ’তে মুখ ফিরিয়ে নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাতলে সমবেত হওয়ার এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী স্ব স্ব ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবন পরিচালনা করার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
আহলেহাদীছগণের পরিচয় দিতে গিয়ে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্বনামধন্য পন্ডিতগণ বলেন: AHL-I-HADEETH : The followers of the prophetic traditions, who profess to hold the same view as the early Ashab-al-hadith or Ahl-al-hadith (as opposed to Ahl-al-ray). They do not hold themselves bound by “Taqlid”.... But consider themselves free to seek guidance in matters of religious faith and practices from the authentic traditions which together with the Quran are in their view the only worthy guide for the true Muslims.
The Ahle-hadith try to go back to first principles and to restore the original simplicity and purity to faith and practices. Emphasis is accordingly laid in particular on the reassertion of `Twahid' and the denial of occult powers and knowledge of the hidden things (Ilm-al-ghayb) to any of his creatures. This involves a rejection of the miraculous powers of Saints and of the exaggerated veneration paid to them. They also make every effort to eradicate customs either to innovation (bid‘a) or to Hindu or non-Islamic systems.
In all these, their reformist programme bears a striking resemblance to that of the `Wahhabis' of Arabia and as a matter of fact their adversaries often nickname them Wahhabeis.
অর্থাৎ ‘আহলেহাদীছ’ বলতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছের অনুসারী দলকে বুঝায়। যারা প্রাথমিক যুগের আহলেহাদীছ বা আছহাবে হাদীছের ন্যায় মত পোষণ করে থাকেন (আহলুর রায়-এর বিপরীত)। যারা তাক্বলীদের বন্ধনকে স্বীকার করেন না...। বরং স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে থাকেন। যারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছকেই একজন প্রকৃত মুসলিমের জন্য যথার্থ পথপ্রদর্শক বা worthy guide বলে মনে করেন।
আহলেহাদীছগণ ইসলামের প্রাথমিক যুগের নীতিসমূহের দিকে ফিরে যেতে চান এবং আক্বীদা ও আমলের মৌলিক সরলতা ও স্বচ্ছতাকে পুনরুদ্ধার করতে প্রচেষ্টা চালান। তারা স্রষ্টার কোন সৃষ্টিকে অলৌকিক শক্তি অথবা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বলে স্বীকার করেন না। সে কারণে কোন আউলিয়া বা সাধু ব্যক্তির প্রতি তারা কোনরূপ অতিভক্তি প্রদর্শন করেন না। তারা মুসলিম সমাজে সৃষ্ট কোন বিদ‘আত (ধর্মের নামে সৃষ্ট কোন নতুন বস্ত্ত) কিংবা হিন্দুয়ানী প্রথা বা অন্য যে কোন অনৈসলামী রীত-নীতি সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। তাদের এই সংস্কারমূলক কার্যক্রমসমূহ আরবে ওয়াহ্হাবীদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সত্য বলতে কি তাদের বিরোধীরা এ কারণেই তাদেরকে কখনো কখনো ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে দুর্নাম করে থাকেন’।[1]
[1]. এনসাইক্লোপেডিয়া অফ ইসলাম, লাইডেন, ব্রীল ১৯৬০, ১/২৫৯ পৃঃ।
The Ahle-hadith try to go back to first principles and to restore the original simplicity and purity to faith and practices. Emphasis is accordingly laid in particular on the reassertion of `Twahid' and the denial of occult powers and knowledge of the hidden things (Ilm-al-ghayb) to any of his creatures. This involves a rejection of the miraculous powers of Saints and of the exaggerated veneration paid to them. They also make every effort to eradicate customs either to innovation (bid‘a) or to Hindu or non-Islamic systems.
In all these, their reformist programme bears a striking resemblance to that of the `Wahhabis' of Arabia and as a matter of fact their adversaries often nickname them Wahhabeis.
অর্থাৎ ‘আহলেহাদীছ’ বলতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছের অনুসারী দলকে বুঝায়। যারা প্রাথমিক যুগের আহলেহাদীছ বা আছহাবে হাদীছের ন্যায় মত পোষণ করে থাকেন (আহলুর রায়-এর বিপরীত)। যারা তাক্বলীদের বন্ধনকে স্বীকার করেন না...। বরং স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে থাকেন। যারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছকেই একজন প্রকৃত মুসলিমের জন্য যথার্থ পথপ্রদর্শক বা worthy guide বলে মনে করেন।
আহলেহাদীছগণ ইসলামের প্রাথমিক যুগের নীতিসমূহের দিকে ফিরে যেতে চান এবং আক্বীদা ও আমলের মৌলিক সরলতা ও স্বচ্ছতাকে পুনরুদ্ধার করতে প্রচেষ্টা চালান। তারা স্রষ্টার কোন সৃষ্টিকে অলৌকিক শক্তি অথবা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বলে স্বীকার করেন না। সে কারণে কোন আউলিয়া বা সাধু ব্যক্তির প্রতি তারা কোনরূপ অতিভক্তি প্রদর্শন করেন না। তারা মুসলিম সমাজে সৃষ্ট কোন বিদ‘আত (ধর্মের নামে সৃষ্ট কোন নতুন বস্ত্ত) কিংবা হিন্দুয়ানী প্রথা বা অন্য যে কোন অনৈসলামী রীত-নীতি সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। তাদের এই সংস্কারমূলক কার্যক্রমসমূহ আরবে ওয়াহ্হাবীদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সত্য বলতে কি তাদের বিরোধীরা এ কারণেই তাদেরকে কখনো কখনো ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে দুর্নাম করে থাকেন’।[1]
[1]. এনসাইক্লোপেডিয়া অফ ইসলাম, লাইডেন, ব্রীল ১৯৬০, ১/২৫৯ পৃঃ।
১নং প্রশ্ন : ইসলামী আন্দোলন না বলে আহলেহাদীছ আন্দোলন বলার পিছনে যুক্তি কী?
উত্তর : ইসলামী আন্দোলন একটি ব্যাপক অর্থবোধক পরিভাষা। শী‘আ, সুন্নী, শিরকী, বিদ‘আতী সকল মত ও পথের মুসলমান ইসলামী আন্দোলনের নামে যে কোন দলে শরীক হ’তে পারেন। কিন্তু ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ একটি বিশেষ অর্থবোধক পরিভাষা। যেখানে শিরক ও বিদ‘আত বর্জিত প্রকৃত তাওহীদপন্থী মুসলমানই কেবল অংশগ্রহণ করতে পারেন। দ্বিতীয়তঃ আহলেহাদীছ আন্দোলনে মানব রচিত মতবাদের অনুসারী রায়পন্থী কোন মুসলমানের অংশগ্রহণের অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী ব্যক্তিই কেবল আহলেহাদীছ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাই আহলেহাদীছ আন্দোলনকেই প্রকৃত প্রস্তাবে নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
২নং প্রশ্ন : সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বিপরীতে আহলেহাদীছ-এর নামে আন্দোলন চালানো বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরানোর নামান্তর নয় কি?
উত্তর : দেশে ঐক্যের শ্লোগান আছে। কিন্তু বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য বলে বাস্তবে কিছুই নেই। এর কারণ যারা ঐক্যের কথা বলেন, তারা বৃহত্তর ঐক্যের কোন গ্রহণযোগ্য ভিত্তি দিতে পারেননি। ফলে ইসলামী আন্দোলনের নামে এবং বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার নামে দেশে অসংখ্য ইসলামী দলের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে রাজনীতির নামে অসংখ্য দল ও উপদল। অথচ এগুলিকে কেউ ফাটল বলেন না। বরং বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে এগুলির প্রশংসাই করা হয়। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সকল দল মতের মুসলমানকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে নিঃশর্তভাবে মেনে নেওয়ার একটিমাত্র শর্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়েছে। তাই আহলেহাদীছ আন্দোলনকেই ‘বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের’ একমাত্র প্লাটফরম বলা যেতে পারে- যেখানে সুস্পষ্টভাবে মুসলিম ঐক্যের একটি সর্বজনগ্রাহ্য ভিত্তি পেশ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হ’ল এই যে, সংখ্যা কখনই সত্যের মাপকাঠি নয়। মুসলমানকে সংখ্যাপূজারী হ’তে পবিত্র কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে (আন‘আম ১১৬)। বরং স্যখ্যায় কম-বেশী যাই-ই হৌক, সর্বাবস্থায় হক্ব-এর অনুসরণে তাকে আপোষহীন থাকতে হয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকেই মুসলমানগণ অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র মানদন্ড বলে বিশ্বাস করেন। আহলেহাদীছ আন্দোলন সেই বিশ্বাসকেই বাস্তবায়িত করতে চায় মাত্র। অধিকাংশ লোক চিরকাল হক্ব-এর দা‘ওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আজও করবে। তাই বলে কি সংখ্যাগুরুর নিন্দাবাদের ভয়ে সংখ্যালঘু সত্যসেবীগণ হক্ব-এর দা‘ওয়াত পরিত্যাগ করে বাতিলের মিছিলে হারিয়ে যাবেন? অতএব বৃহত্তর ইস্যুতে বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়টি দেখার সাথে সাথে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী হক্বপন্থীদের সাথে জামা‘আতবদ্ধ হওয়ার (তাওবাহ ৯/১১৯) বিষয়টিও স্মরণে রাখতে হবে।
৩নং প্রশ্ন : আহলেহাদীছ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব কি? যদি না হয়, তাহ’লে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন গড়ার যে দাবী আহলেহাদীছগণ করে থাকেন, তা কিভাবে বাস্তবায়িত হবে?
উত্তর : কাউকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে। বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির পূর্বে পৃথিবীর সকল মুসলিম অঞ্চলে এমনকি ৩৭৫ হিজরী পর্যন্ত ভারতবর্ষের তৎকালীন ইসলামী রাজধানী সিন্ধুর মানছূরাহ্তেও আহলেহাদীছগণ রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৮ম ও ৯ম শতাব্দী হিজরীতে আহলেহাদীছগণ দক্ষিণ ভারতের গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যের শাসনদন্ড পরিচালনা করেছেন। পুনরায় যে আল্লাহ পাক তাদের হাতে সে ক্ষমতা দিবেন না, এই নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? স্মর্তব্য যে, আমাদের উপরে ফরয হ’ল, দ্বীনের দা‘ওয়াত দেওয়া এবং তাকে সর্বত্র বিজয়ী করার চেষ্টা করা। অবশ্য দা‘ওয়াত কবুল হ’লে তার বিনিময়ে আল্লাহপাক স্বীয় দ্বীনকে যেকোন উপায়ে শাসন ক্ষমতায় বসাতে পারেন।
৪নং প্রশ্ন : রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যতীত ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে প্রথমে রাষ্ট্র কায়েম করেন। অতঃপর ইসলাম কায়েম করেন।
উত্তর : কথাটি বাস্তবসম্মত নয়। ইসলাম মানুষের জন্য স্বভাবধর্ম। তা কখনোই রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে শর্তযুক্ত নয়। তবে তা নিঃসন্দেহে সহায়ক শক্তি। মুসলমান সর্বাবস্থায় সে চেষ্টা করে যাবে।
দ্বিতীয়তঃ রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যতীত কুরআন-হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়া অসম্ভব-এই ধারণাটাই বা সার্বিকভাবে কতটুকু বাস্তব সম্মত? ইসলামের ফৌজদারী ও অর্থনৈতিক আইনের কতগুলি মৌলিক ধারা যেমন খুনের বদলে খুন, চোরের হাত কাটা, ব্যভিচারীর দন্ড প্রদান, সূদী লেনদেন সরকারীভাবে বন্ধ করা প্রভৃতি বিষয়গুলি বাস্তবায়নের জন্য অবশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োজন। যে কোন মুসলিম শাসকই এগুলি করতে বাধ্য। না করলে তিনি এজন্য আল্লাহর নিকট দায়ী হবেন। সাধারণ মুসলমানগণ ও ইসলামী সংগঠনসমূহ শাসন কর্তৃপক্ষকে সংশোধনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন এবং নিজেরা সাধ্যমত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন যাপনের চেষ্টা করবেন। জনমত পক্ষে এনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী বিধান জারি করতে সচেষ্ট হবেন। সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম বিশ্বজনীন ধর্ম। ইসলামী রাষ্ট্র থাক বা না থাক, সংখ্যাগুরু হৌক বা সংখ্যালঘু হৌক সকল অবস্থায় সকল দেশে মুসলমানকে ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে। এজন্য সর্বত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক পূর্বশর্ত নয় এবং তা কখোনা সম্ভবও নয়। আল্লাহ পাক কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেননি (বাক্বারা ২৮৬)। তাছাড়া উচ্চাভিলাষী ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীকে আল্লাহ পসন্দ করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
তৃতীয়তঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’। পক্ষান্তরে ইসলামী রাজনীতিতে ‘আল্লাহ্ই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’। বাংলাদেশী রাজনীতিতে ‘দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ই চূড়ান্ত’। ইসলামী রাজনীতিতে ‘অহি’-র বিধানই চূড়ান্ত’। দুঃখের বিষয়, এদেশে যারা এমনকি ইসলামী আন্দোলনের নামে রাজনীতি করে থাকেন, তারাও বৃটিশ প্রবর্তিত গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’-এই মতবাদে বিশ্বাসী। আর সে কারণেই তারা সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করে থাকেন যে, ‘দেশে যে মাযহাবের লোকংখ্যা বেশী সে মাযহাব অনুযায়ী সেখানে শাসন ব্যবস্থা হওয়াই স্বাভাবিক’।[1] হক্ব-নাহক্ব কোন ব্যাপার নয়, সংখ্যায় বেশী হ’লেই হ’ল। অথচ আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম ইসলামের নামে অর্জিত সুন্নী প্রধান পাকিস্তানের পথম গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান হ’লেন শী‘আ এবং আইনমন্ত্রী যাফরুল্লাহ খান হ’লেন অমুসলিম ক্বাদিয়ানী। আল্লাহর ইচ্ছা তো এভাবেই কার্যকর হয়।
চতুর্থতঃ আজকাল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে জোট করাকে রাসূলের ‘হোদায়বিয়ার সন্ধি’-র সঙ্গে তুলনা করছেন, অথচ রাসূল (ছাঃ) সেদিন তাগূতী কোন বিধানের সঙ্গে আপোষ করেননি। কেবল নিজের নামের শেষে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে সন্ধি করেছিলেন। অথচ ইসলামী নেতাগণ সরকারের পার্টনার হয়ে অসংখ্য ত্বাগূতী বিধানের সাথে আপোষ করে ভবিষ্যতের জন্য ইসলামী আন্দোলনের পথকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছেন। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে তোহমত দেওয়া হচ্ছে মাত্র।
বলা বাহুল্য, প্রচলিত এই শিরকী রাজনীতির সঙ্গে আপোষ নয়; বরং জনমত পরিবর্তনের মাধ্যমে একে পরিবর্তন করাই হ’ল প্রকৃত অর্থে ইসলামী রাজনীতি।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের কর্মীগণ দু’টি বিষয়কে নিজেদের দায়িত্ব মনে করেন। ১ম : আল্লাহর পথে দা‘ওয়াতের মৌলিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট ওযর পেশ করা। ২য়ঃ হঠকারী বান্দাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর জন্য দলীল কায়েম করা, যেন ‘দাওয়াত পায়নি’ বলে আল্লাহর সম্মুখে তাদের কোনরূপ ওযর পেশ করার সুযোগ না থাকে।
আর দু’টি বিষয়কে তারা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে ছেড়ে দেন। তিনি চাইলে সে দু’টি তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত করবেন, চাইলে দেরীতে করবেন। একটি হ’ল, মানুষের হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়া। দ্বিতীয়টি হ’ল, তাঁর প্রেরিত দ্বীনকে পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। উক্ত দু’টি বিষয় অর্জনের জন্য ইসলাম প্রদত্ত সমাজ বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন অনুসরণে জনগণের আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনে সদা সচেষ্ট থাকা যরূরী কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। কারণ সরকার পরিবর্তনের চেয়ে নবীগণ সমাজ পরিবর্তনকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা নবীদের সেই তরীক্বায় চলতে চাই। কেননা সমাজ পরিবর্তন ব্যতীত সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর কোনভাবে সম্ভব হ’লেও তা সমাজে কোনরূপ স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় না। যেমন সক্ষম হয়নি ভারতে প্রায় সাড়ে ছয়শো বছরের মুসলিম শাসন এবং বাংলাদেশে ১৯০ বছরের খৃষ্টান ইংরেজ শাসন।
৫নং প্রশ্ন : ইসলামী আন্দোলনের নামে যতগুলি দল কাজ করছে, তারা সবাই ঠিক। অতএব যেকোন একটি দলে যোগ দিলেই তো চলে।
উত্তর : আমরা বিশ্বাস করি কোন ব্যাপারে ‘ঠিক’ একটাই হয়, একাধিক নয়। আমরা বিশ্বাস করি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালাই একমাত্র ঠিক, বাকী সবই বেঠিক। আহলেহাদীছ আন্দোলনের কর্মীদেরকে বিশুদ্ধ ইসলামী আন্দোলন থেকে সরিয়ে ভেজাল আন্দোলনসমূহে নেওয়ার জন্যই বর্তমানে ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’-এর ধোঁকা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।
৬নং প্রশ্ন : আহলেহাদীছ-এর রাজনৈতিক দর্শন কী?
উত্তর : সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সৃষ্টিকে পরিচালিত করা।
৭নং প্রশ্ন : আহলেহাদীছ-এর নিকটে দেশে আইন রচনার মূলনীতিসমূহ কী কী?
উত্তর : (১) আল্লাহ্কে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসাবে মেনে নেওয়া (২) আল্লাহর বিধানকে অভ্রান্ত সত্যের মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করা (৩) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে আইন রচনার মূল ভিত্তি হিসাবে গণ্য করা (৪) অস্পষ্ট বিষয়গুলিতে পবিত্র কুরআনে, ছহীহ হাদীছ ও ইজমায়ে ছাহাবার আলোকে ‘ইজতিহাদ’ করা (৫) মুহাদ্দেছীনের মাসলাক অনুসরণের উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান করা।
৮নং প্রশ্ন : ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
উত্তর : নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন করা। আক্বীদা ও আমলের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য।
৯নং প্রশ্ন : আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর কর্মপদ্ধতি কী?
উত্তর : আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর কর্মপদ্ধতি হ’ল দু’টি (১) আল্লাহর পথে দা‘ওয়াত (২) আল্লাহ বিরোধীদের সাথে জিহাদ। এই জিহাদ হবে জান, মাল, সময়, শ্রম, কথা, কলম ও সংগঠন তথা সর্বাত্মকভাবে বৈধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এক কথায় আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর কর্মপদ্ধতি হ’ল দু’টি : দা‘ওয়াত ও জিহাদ।
১০নং প্রশ্ন : ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ কেমন সমাজ চায়?
উত্তর : ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ চায় এমন একটি ইসলামী সমাজ যেখানে থাকবে না প্রগতির নামে কোন বিজাতীয় মতবাদ; থাকবে না ইসলামের নামে কোনরূপ মাযহাবী সংকীর্ণতাবাদ।
আল্লাহ পাক সকল মুসলিম ভাই-বোনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
[1]. দ্রষ্টব্য: সাপ্তাহিক সোনার বাংলা (ঢাকা) ৩১শে জানুয়ারী ১৯৮৬ প্রশ্নোত্তর আসর; অধ্যাপক গোলাম আযম, প্রশ্নোত্তর (ঢাকা: গ্রন্থমালঞ্চ ১৯৯৮) পৃঃ ১৮২।
উত্তর : ইসলামী আন্দোলন একটি ব্যাপক অর্থবোধক পরিভাষা। শী‘আ, সুন্নী, শিরকী, বিদ‘আতী সকল মত ও পথের মুসলমান ইসলামী আন্দোলনের নামে যে কোন দলে শরীক হ’তে পারেন। কিন্তু ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ একটি বিশেষ অর্থবোধক পরিভাষা। যেখানে শিরক ও বিদ‘আত বর্জিত প্রকৃত তাওহীদপন্থী মুসলমানই কেবল অংশগ্রহণ করতে পারেন। দ্বিতীয়তঃ আহলেহাদীছ আন্দোলনে মানব রচিত মতবাদের অনুসারী রায়পন্থী কোন মুসলমানের অংশগ্রহণের অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী ব্যক্তিই কেবল আহলেহাদীছ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাই আহলেহাদীছ আন্দোলনকেই প্রকৃত প্রস্তাবে নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
২নং প্রশ্ন : সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বিপরীতে আহলেহাদীছ-এর নামে আন্দোলন চালানো বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরানোর নামান্তর নয় কি?
উত্তর : দেশে ঐক্যের শ্লোগান আছে। কিন্তু বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য বলে বাস্তবে কিছুই নেই। এর কারণ যারা ঐক্যের কথা বলেন, তারা বৃহত্তর ঐক্যের কোন গ্রহণযোগ্য ভিত্তি দিতে পারেননি। ফলে ইসলামী আন্দোলনের নামে এবং বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার নামে দেশে অসংখ্য ইসলামী দলের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে রাজনীতির নামে অসংখ্য দল ও উপদল। অথচ এগুলিকে কেউ ফাটল বলেন না। বরং বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে এগুলির প্রশংসাই করা হয়। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সকল দল মতের মুসলমানকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে নিঃশর্তভাবে মেনে নেওয়ার একটিমাত্র শর্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়েছে। তাই আহলেহাদীছ আন্দোলনকেই ‘বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের’ একমাত্র প্লাটফরম বলা যেতে পারে- যেখানে সুস্পষ্টভাবে মুসলিম ঐক্যের একটি সর্বজনগ্রাহ্য ভিত্তি পেশ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হ’ল এই যে, সংখ্যা কখনই সত্যের মাপকাঠি নয়। মুসলমানকে সংখ্যাপূজারী হ’তে পবিত্র কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে (আন‘আম ১১৬)। বরং স্যখ্যায় কম-বেশী যাই-ই হৌক, সর্বাবস্থায় হক্ব-এর অনুসরণে তাকে আপোষহীন থাকতে হয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকেই মুসলমানগণ অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র মানদন্ড বলে বিশ্বাস করেন। আহলেহাদীছ আন্দোলন সেই বিশ্বাসকেই বাস্তবায়িত করতে চায় মাত্র। অধিকাংশ লোক চিরকাল হক্ব-এর দা‘ওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আজও করবে। তাই বলে কি সংখ্যাগুরুর নিন্দাবাদের ভয়ে সংখ্যালঘু সত্যসেবীগণ হক্ব-এর দা‘ওয়াত পরিত্যাগ করে বাতিলের মিছিলে হারিয়ে যাবেন? অতএব বৃহত্তর ইস্যুতে বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়টি দেখার সাথে সাথে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী হক্বপন্থীদের সাথে জামা‘আতবদ্ধ হওয়ার (তাওবাহ ৯/১১৯) বিষয়টিও স্মরণে রাখতে হবে।
৩নং প্রশ্ন : আহলেহাদীছ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব কি? যদি না হয়, তাহ’লে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন গড়ার যে দাবী আহলেহাদীছগণ করে থাকেন, তা কিভাবে বাস্তবায়িত হবে?
উত্তর : কাউকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে। বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির পূর্বে পৃথিবীর সকল মুসলিম অঞ্চলে এমনকি ৩৭৫ হিজরী পর্যন্ত ভারতবর্ষের তৎকালীন ইসলামী রাজধানী সিন্ধুর মানছূরাহ্তেও আহলেহাদীছগণ রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৮ম ও ৯ম শতাব্দী হিজরীতে আহলেহাদীছগণ দক্ষিণ ভারতের গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যের শাসনদন্ড পরিচালনা করেছেন। পুনরায় যে আল্লাহ পাক তাদের হাতে সে ক্ষমতা দিবেন না, এই নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? স্মর্তব্য যে, আমাদের উপরে ফরয হ’ল, দ্বীনের দা‘ওয়াত দেওয়া এবং তাকে সর্বত্র বিজয়ী করার চেষ্টা করা। অবশ্য দা‘ওয়াত কবুল হ’লে তার বিনিময়ে আল্লাহপাক স্বীয় দ্বীনকে যেকোন উপায়ে শাসন ক্ষমতায় বসাতে পারেন।
৪নং প্রশ্ন : রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যতীত ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে প্রথমে রাষ্ট্র কায়েম করেন। অতঃপর ইসলাম কায়েম করেন।
উত্তর : কথাটি বাস্তবসম্মত নয়। ইসলাম মানুষের জন্য স্বভাবধর্ম। তা কখনোই রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে শর্তযুক্ত নয়। তবে তা নিঃসন্দেহে সহায়ক শক্তি। মুসলমান সর্বাবস্থায় সে চেষ্টা করে যাবে।
দ্বিতীয়তঃ রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যতীত কুরআন-হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়া অসম্ভব-এই ধারণাটাই বা সার্বিকভাবে কতটুকু বাস্তব সম্মত? ইসলামের ফৌজদারী ও অর্থনৈতিক আইনের কতগুলি মৌলিক ধারা যেমন খুনের বদলে খুন, চোরের হাত কাটা, ব্যভিচারীর দন্ড প্রদান, সূদী লেনদেন সরকারীভাবে বন্ধ করা প্রভৃতি বিষয়গুলি বাস্তবায়নের জন্য অবশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োজন। যে কোন মুসলিম শাসকই এগুলি করতে বাধ্য। না করলে তিনি এজন্য আল্লাহর নিকট দায়ী হবেন। সাধারণ মুসলমানগণ ও ইসলামী সংগঠনসমূহ শাসন কর্তৃপক্ষকে সংশোধনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন এবং নিজেরা সাধ্যমত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন যাপনের চেষ্টা করবেন। জনমত পক্ষে এনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী বিধান জারি করতে সচেষ্ট হবেন। সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম বিশ্বজনীন ধর্ম। ইসলামী রাষ্ট্র থাক বা না থাক, সংখ্যাগুরু হৌক বা সংখ্যালঘু হৌক সকল অবস্থায় সকল দেশে মুসলমানকে ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে। এজন্য সর্বত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক পূর্বশর্ত নয় এবং তা কখোনা সম্ভবও নয়। আল্লাহ পাক কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেননি (বাক্বারা ২৮৬)। তাছাড়া উচ্চাভিলাষী ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীকে আল্লাহ পসন্দ করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
তৃতীয়তঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’। পক্ষান্তরে ইসলামী রাজনীতিতে ‘আল্লাহ্ই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’। বাংলাদেশী রাজনীতিতে ‘দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ই চূড়ান্ত’। ইসলামী রাজনীতিতে ‘অহি’-র বিধানই চূড়ান্ত’। দুঃখের বিষয়, এদেশে যারা এমনকি ইসলামী আন্দোলনের নামে রাজনীতি করে থাকেন, তারাও বৃটিশ প্রবর্তিত গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’-এই মতবাদে বিশ্বাসী। আর সে কারণেই তারা সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করে থাকেন যে, ‘দেশে যে মাযহাবের লোকংখ্যা বেশী সে মাযহাব অনুযায়ী সেখানে শাসন ব্যবস্থা হওয়াই স্বাভাবিক’।[1] হক্ব-নাহক্ব কোন ব্যাপার নয়, সংখ্যায় বেশী হ’লেই হ’ল। অথচ আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম ইসলামের নামে অর্জিত সুন্নী প্রধান পাকিস্তানের পথম গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান হ’লেন শী‘আ এবং আইনমন্ত্রী যাফরুল্লাহ খান হ’লেন অমুসলিম ক্বাদিয়ানী। আল্লাহর ইচ্ছা তো এভাবেই কার্যকর হয়।
চতুর্থতঃ আজকাল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে জোট করাকে রাসূলের ‘হোদায়বিয়ার সন্ধি’-র সঙ্গে তুলনা করছেন, অথচ রাসূল (ছাঃ) সেদিন তাগূতী কোন বিধানের সঙ্গে আপোষ করেননি। কেবল নিজের নামের শেষে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে সন্ধি করেছিলেন। অথচ ইসলামী নেতাগণ সরকারের পার্টনার হয়ে অসংখ্য ত্বাগূতী বিধানের সাথে আপোষ করে ভবিষ্যতের জন্য ইসলামী আন্দোলনের পথকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছেন। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে তোহমত দেওয়া হচ্ছে মাত্র।
বলা বাহুল্য, প্রচলিত এই শিরকী রাজনীতির সঙ্গে আপোষ নয়; বরং জনমত পরিবর্তনের মাধ্যমে একে পরিবর্তন করাই হ’ল প্রকৃত অর্থে ইসলামী রাজনীতি।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের কর্মীগণ দু’টি বিষয়কে নিজেদের দায়িত্ব মনে করেন। ১ম : আল্লাহর পথে দা‘ওয়াতের মৌলিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট ওযর পেশ করা। ২য়ঃ হঠকারী বান্দাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর জন্য দলীল কায়েম করা, যেন ‘দাওয়াত পায়নি’ বলে আল্লাহর সম্মুখে তাদের কোনরূপ ওযর পেশ করার সুযোগ না থাকে।
আর দু’টি বিষয়কে তারা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে ছেড়ে দেন। তিনি চাইলে সে দু’টি তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত করবেন, চাইলে দেরীতে করবেন। একটি হ’ল, মানুষের হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়া। দ্বিতীয়টি হ’ল, তাঁর প্রেরিত দ্বীনকে পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। উক্ত দু’টি বিষয় অর্জনের জন্য ইসলাম প্রদত্ত সমাজ বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন অনুসরণে জনগণের আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনে সদা সচেষ্ট থাকা যরূরী কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। কারণ সরকার পরিবর্তনের চেয়ে নবীগণ সমাজ পরিবর্তনকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা নবীদের সেই তরীক্বায় চলতে চাই। কেননা সমাজ পরিবর্তন ব্যতীত সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর কোনভাবে সম্ভব হ’লেও তা সমাজে কোনরূপ স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় না। যেমন সক্ষম হয়নি ভারতে প্রায় সাড়ে ছয়শো বছরের মুসলিম শাসন এবং বাংলাদেশে ১৯০ বছরের খৃষ্টান ইংরেজ শাসন।
৫নং প্রশ্ন : ইসলামী আন্দোলনের নামে যতগুলি দল কাজ করছে, তারা সবাই ঠিক। অতএব যেকোন একটি দলে যোগ দিলেই তো চলে।
উত্তর : আমরা বিশ্বাস করি কোন ব্যাপারে ‘ঠিক’ একটাই হয়, একাধিক নয়। আমরা বিশ্বাস করি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালাই একমাত্র ঠিক, বাকী সবই বেঠিক। আহলেহাদীছ আন্দোলনের কর্মীদেরকে বিশুদ্ধ ইসলামী আন্দোলন থেকে সরিয়ে ভেজাল আন্দোলনসমূহে নেওয়ার জন্যই বর্তমানে ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’-এর ধোঁকা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।
৬নং প্রশ্ন : আহলেহাদীছ-এর রাজনৈতিক দর্শন কী?
উত্তর : সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সৃষ্টিকে পরিচালিত করা।
৭নং প্রশ্ন : আহলেহাদীছ-এর নিকটে দেশে আইন রচনার মূলনীতিসমূহ কী কী?
উত্তর : (১) আল্লাহ্কে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসাবে মেনে নেওয়া (২) আল্লাহর বিধানকে অভ্রান্ত সত্যের মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করা (৩) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে আইন রচনার মূল ভিত্তি হিসাবে গণ্য করা (৪) অস্পষ্ট বিষয়গুলিতে পবিত্র কুরআনে, ছহীহ হাদীছ ও ইজমায়ে ছাহাবার আলোকে ‘ইজতিহাদ’ করা (৫) মুহাদ্দেছীনের মাসলাক অনুসরণের উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান করা।
৮নং প্রশ্ন : ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
উত্তর : নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন করা। আক্বীদা ও আমলের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য।
৯নং প্রশ্ন : আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর কর্মপদ্ধতি কী?
উত্তর : আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর কর্মপদ্ধতি হ’ল দু’টি (১) আল্লাহর পথে দা‘ওয়াত (২) আল্লাহ বিরোধীদের সাথে জিহাদ। এই জিহাদ হবে জান, মাল, সময়, শ্রম, কথা, কলম ও সংগঠন তথা সর্বাত্মকভাবে বৈধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এক কথায় আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর কর্মপদ্ধতি হ’ল দু’টি : দা‘ওয়াত ও জিহাদ।
১০নং প্রশ্ন : ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ কেমন সমাজ চায়?
উত্তর : ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ চায় এমন একটি ইসলামী সমাজ যেখানে থাকবে না প্রগতির নামে কোন বিজাতীয় মতবাদ; থাকবে না ইসলামের নামে কোনরূপ মাযহাবী সংকীর্ণতাবাদ।
আল্লাহ পাক সকল মুসলিম ভাই-বোনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
[1]. দ্রষ্টব্য: সাপ্তাহিক সোনার বাংলা (ঢাকা) ৩১শে জানুয়ারী ১৯৮৬ প্রশ্নোত্তর আসর; অধ্যাপক গোলাম আযম, প্রশ্নোত্তর (ঢাকা: গ্রন্থমালঞ্চ ১৯৯৮) পৃঃ ১৮২।
১. আহলেহাদীছ কে? ( أَهْلُ الْحَدِيْثِ مَنْ هُوَ؟ )
যিনি সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী।
اَلَّذِيْ يَتَّبِعُ الْقُرْآنَ وَالسُّنَّةَ الصَّحِيْحَةَ فِي جَمِيْعِ نَوَاحِي الْحَيَاةِ مِنْ غَيْرِ شَرْطٍ -
২. আহলেহাদীছ আন্দোলন কী? ( حَرَكَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مَا هِيَ؟ )
هَذِهِ حَرَكَةٌ إِسْلاَمِيَّةٌ خَالِصَةٌ مِنْ زَمَنِ الصَّحَابَةِ رَضِيَ الله ُعَنْهُمْ إِلَي يَوْمِنَا هَذَا الَّتِي تَدْعُو النَّاسَ إِلَي الْإِعْتِصَامِ بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ الصَّحِيْحَةِ -
ইহা দুনিয়ার মানুষকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্মমূলে জমায়েত করার জন্য ছাহাবায়ে কেরামের যুগ হ’তে চলে আসা নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনের নাম।
৩. আহলেহাদীছ আন্দোলন কেন? ( حَرَكَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ لِمَا هِيَ؟ )
حَرَكَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مُهِمَّةٌ جِدًّا لِإِهْدَاءِ النَّاسِ إِلَي الْحَقِّ الْخَالِصِ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ الصَّحِيْحَةِ وَلِإِرْتِدَادِهِمْ مِنَ الْمَذَاهِبِ وَالطُّرُقِ وَالْاَرَاءِ الْمُحْدَثَةِ -
নিজেদের রচিত অসংখ্য মাযহাব-মতবাদ, ইযম ও তরীক্বার বেড়াজালে আবেষ্টিত মানব সমাজকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রদর্শিত অভ্রান্ত সত্যের পথে পরিচালনার জন্যই আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজন।
৪. আমাদের আহবান ( دَعْوَتُنَا )
আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি!!
تَعَالَ نَبْنِ حَيَاتَنَا عَلَي ضُوْءِ الْكِتَابِ وَالْأَحَادِيْثِ الصَّحِيْحَةِ -
---০---
আমরা চাই এমন একটি ইসলামী সমাজ, যেখানে থাকবে না প্রগতির নামে কোন বিজাতীয় মতবাদ; থাকবে না ইসলামের নামে কোনরূপ মাযহাবী সংকীর্ণতাবাদ।
نَرْجُو أَنْ نُقِيْمَ الْمُجْتَمَعَ الْإِسْلاَمِيَّ الْخَالِصَ الَّذِيْ لاَ تَلْبِسُ مَعَهُ الْأَرَاءُ الْأَجْنَبِيَّةُ بِإِسْمِ الْعَصْرِيَّةِ وَ لاَ يَلْبِسُ مَعَهُ التَّعَصُّبُ الْمَذْهَبِيُّ الْمُرَوَّجُ بِإِسْمِ الْإِسْلاَمِ -
*******
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ، اَللَّهُمَّ اغْفِرْلِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ يَوْمَ يَقُوْمُ الْحِسَابُ -
সমাপ্ত
যিনি সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী।
اَلَّذِيْ يَتَّبِعُ الْقُرْآنَ وَالسُّنَّةَ الصَّحِيْحَةَ فِي جَمِيْعِ نَوَاحِي الْحَيَاةِ مِنْ غَيْرِ شَرْطٍ -
২. আহলেহাদীছ আন্দোলন কী? ( حَرَكَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مَا هِيَ؟ )
هَذِهِ حَرَكَةٌ إِسْلاَمِيَّةٌ خَالِصَةٌ مِنْ زَمَنِ الصَّحَابَةِ رَضِيَ الله ُعَنْهُمْ إِلَي يَوْمِنَا هَذَا الَّتِي تَدْعُو النَّاسَ إِلَي الْإِعْتِصَامِ بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ الصَّحِيْحَةِ -
ইহা দুনিয়ার মানুষকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্মমূলে জমায়েত করার জন্য ছাহাবায়ে কেরামের যুগ হ’তে চলে আসা নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনের নাম।
৩. আহলেহাদীছ আন্দোলন কেন? ( حَرَكَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ لِمَا هِيَ؟ )
حَرَكَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مُهِمَّةٌ جِدًّا لِإِهْدَاءِ النَّاسِ إِلَي الْحَقِّ الْخَالِصِ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ الصَّحِيْحَةِ وَلِإِرْتِدَادِهِمْ مِنَ الْمَذَاهِبِ وَالطُّرُقِ وَالْاَرَاءِ الْمُحْدَثَةِ -
নিজেদের রচিত অসংখ্য মাযহাব-মতবাদ, ইযম ও তরীক্বার বেড়াজালে আবেষ্টিত মানব সমাজকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রদর্শিত অভ্রান্ত সত্যের পথে পরিচালনার জন্যই আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজন।
৪. আমাদের আহবান ( دَعْوَتُنَا )
আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি!!
تَعَالَ نَبْنِ حَيَاتَنَا عَلَي ضُوْءِ الْكِتَابِ وَالْأَحَادِيْثِ الصَّحِيْحَةِ -
---০---
আমরা চাই এমন একটি ইসলামী সমাজ, যেখানে থাকবে না প্রগতির নামে কোন বিজাতীয় মতবাদ; থাকবে না ইসলামের নামে কোনরূপ মাযহাবী সংকীর্ণতাবাদ।
نَرْجُو أَنْ نُقِيْمَ الْمُجْتَمَعَ الْإِسْلاَمِيَّ الْخَالِصَ الَّذِيْ لاَ تَلْبِسُ مَعَهُ الْأَرَاءُ الْأَجْنَبِيَّةُ بِإِسْمِ الْعَصْرِيَّةِ وَ لاَ يَلْبِسُ مَعَهُ التَّعَصُّبُ الْمَذْهَبِيُّ الْمُرَوَّجُ بِإِسْمِ الْإِسْلاَمِ -
*******
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ، اَللَّهُمَّ اغْفِرْلِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ يَوْمَ يَقُوْمُ الْحِسَابُ -
সমাপ্ত
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন