মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
‘আহলুল হাদীছ’ অর্থ হাদীছের অনুসারী। ‘আহলুর রায়’ অর্থ রায়-এর অনুসারী। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে যারা জীবন সমস্যার সমাধান তালাশ করেন, তাঁদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়। পক্ষান্তরে... পূর্বসূরি কোন বিদ্বানের রচিত কোন ফিক্বহী উছূল বা ব্যবহারিক আইন সূত্রের ভিত্তিতে যারা জীবন সমস্যার সমাধান নেন, শাহ অলিউল্লাহর ভাষায় তাদেরকে ‘আহলুর রায়’ বলা হয়। আহলুর রায়গণ উদ্ভূত কোন সমস্যার সমাধান রাসূলের হাদীছ ও ছাহাবায়ে কেরামের আছারের মধ্যে তালাশ না করে পূর্ব যুগে কোন মুজতাহিদ ফক্বীহের গৃহীত কোন ফিক্বহী সিদ্ধান্ত বা ফিক্বহী মূলনীতির সঙ্গে সাদৃশ্য বিধানে চেষ্টা করে থাকেন এবং তার উপরে ক্বিয়াস বা উপমান পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বের করে থাকেন।[1] এভাবে প্রায় সকল বিষয়ে তিনি তাঁর অনুসরণীয় ইমাম বা ফক্বীহ-এর পরিকল্পিত ‘উছূলে ফিক্বহ’ বা ব্যবহারিক আইনসূত্রসমূহের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা ছহীহ হাদীছের উর্ধ্বে ব্যক্তির রায়কে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।
পক্ষান্তরে আহলুল হাদীছগণ সর্বাবস্থায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে সবার উর্ধ্বে স্থান দেন এবং যে কোন ব্যক্তির হাদীছ বিরোধী রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা রায়-এর ভিত্তিতে কুরআন-হাদীছ যাচাই করেন না। বরং কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে রায়কে যাচাই করেন। তাঁরা ‘অহি’-কে ‘রায়’ বা মানবিক জ্ঞান-এর উপরে অগ্রাধিকার দেন এবং ‘রায়’-কে ‘অহি’-র ব্যাখ্যাকারী বলে মনে করেন। কুরআন বা ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্ত নিজের বা নিজের অনুসরণীয় কোন ব্যক্তির রায় বা আইনসূত্রের পরিপন্থী হ’লে তাঁরা বিভিন্ন অজুহাতে হাদীছ প্রত্যাখ্যান করেন না; বরং হাদীছের সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে গ্রহণ করেন। আহলেহাদীছগণ ‘ইজতিহাদে’ বিশ্বাসী এবং তা সকল যুগের সকল যোগ্য আলেমের জন্য উন্মুক্ত বলে মনে করেন। তাঁরা ঐ ধরনের ইজতিহাদ বা রায় ও ক্বিয়াসে বিশ্বাসী, যা পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও ইজমায়ে ছাহাবার উপরে ভিত্তিশীল।
এ কারণে ইমাম মালেক, শাফেঈ, আহমাদ, ইসহাক্ব, ইমাম বুখারী প্রমুখ উম্মতের সেরা ফক্বীহ ও মুজতাহিগণকে ‘আহলুর রায়’ না বলে বরং ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়। পক্ষান্তরে হাদীছের সংগ্রহ কম থাকার কারণে নিজের রায় ও ক্বিয়াসের উপরে অধিক নির্ভরশীল হওয়ার ফলে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে ‘আহলুর রায়দের ইমাম’ বলা হয়ে থাকে। যেমন মরক্কোর জগদ্বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী আব্দুর রহমান ইবনু খলদূন (৭৩২-৮০২ হিঃ) বলেন,
‘(আহলেসুন্নাত বিদ্বানগণের মধ্যেও যুক্তিবাদের ঢেউ লাগে) ফলে তাদের মধ্যে ফিক্বহ শাস্ত্র ‘আহলুল হাদীছ’ ও ‘আহলুর রায়’ নামে দু’টি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হ’ল, রায় ও ক্বিয়াসপন্থীদের তরীক্বা। তারা হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। দ্বিতীয়টি হ’ল, হাদীছপন্থীদের বা আহলুল হাদীছদের তরীক্বা। তারা হ’লেন হেজাযের (মক্কা-মদীনার) অধিবাসী। ইরাকীদের মধ্যে হাদীছ খুবই কম ছিল... ফলে তারা ক্বিয়াস বেশী করেন ও এতে দক্ষতা অর্জন করেন। আর একারণেই তারা ‘আহলুর রায়’ বা রায়পন্থী নামে অভিহিত হয়েছেন। এই দলের নেতা ছিলেন আবু হানীফা, যাঁর নামে একটি মাযহাব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে’।[2] উল্লেখ্য যে, ইরাকেই সর্বপ্রথম হাদীছ জাল করা শুরু হয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইমাম ইবনু শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ) বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে এক বিঘত পরিমাণ একটি হাদীছ বের হয়ে ইরাক থেকে এক হাত পরিমাণ লম্বা হয়ে ফিরে আসে’। ইমাম মালেক ইরাককে ‘হাদীছ ভাঙ্গানোর কারখানা’ ( دَارُ الضَّرْبِ ) নামে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ একটি ছহীহ হাদীছের মধ্যে অসংখ্য যোগ-বিয়োগ করে তাকে ভাঙ্গিয়ে প্রচার করা হয়।[3] ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ছিলেন, ইরাকের কুফা নগরীর অধিবাসী এবং তাঁর প্রধান শিষ্যগণ ছিলেন সেখানকার। এজন্য তাঁর অনুসারীদেরকে হানাফী, কূফী, আহলুর রায়, আহলুল কূফা, আহলুল ইরাক্ব ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
তাক্বলীদে শাখ্ছী : তাক্বলীদ ( اَلتَّقْلِيْدُ ) ‘ক্বালাদাহ’ ( القَلاَدَةُ ) হ’তে গৃহীত। যার অর্থ ‘গলাবন্ধ’। তাক্বলীদ-এর আভিধানিক অর্থ : গলায় রশি বাঁধা। পারিভাষিক অর্থ : قُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা বিনা দলীলে মেনে নেওয়া’। পক্ষান্তরে ‘ইত্তেবা’র আভিধানিক অর্থ : পদাংক অনুসরণ করা। পারিভাষিক অর্থ : قُُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مَعَ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা দলীল সহ মেনে নেওয়া’। তাক্বলীদ হ’ল রায়-এর অনুরসণ এবং ইত্তেবা হ’ল দলীলের অনুসরণ। উল্লেখ্য যে, কোন আলেমের ছহীহ দলীল ভিত্তিক কোন কথাকে মেনে নেওয়ার নাম ‘তাক্বলীদ’ নয়, বরং তা হ’ল ‘ইত্তেবা’। অনুরূপভাবে কোন আলেমের দেওয়া ফৎওয়ার বিপরীতে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া গেলে উক্ত ফৎওয়া পরিত্যাগ করে ছহীহ দলীলের অনুসরণ করাকে বলা হয় ‘ইত্তেবা’। ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের যুগে তাক্বলীদের কোনরূপ নামগন্ধ ছিল না। বরং তাঁদের দলীল ভিত্তিক কথার অনুসরণকে অনেকে ‘তাক্বলীদ’ বলে ভুল বুঝিয়েছেন।
আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল ‘তাক্বলীদে শাখ্ছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। ২য় শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, إِعْلَمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوْا قَبْلَ الْمِائَةِ الرَّابِعَةِ غَيْرَ مُجْمَعِيْنَ عَلَى التَّقْلِيْدِ الْخَالِصِ لِمَذْهَبٍ وَّاحِدٍ بِعَيْنِهِ ، ‘জেনে রাখ হে পাঠক! ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের তাক্বলীদের উপরে সংঘবদ্ধ ছিল না’। .. কোন সমস্যা সৃষ্টি হ’লে লোকেরা যেকোন আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ ব্যাপারে কারু মাযহাব যাচাই করা হ’ত না।[4]
হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিঃ) তৃতীয় শতাব্দী হিজরীর শেষদিকের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই সময় ‘আহলুর রায়’ (হানাফী) ফক্বীহদের নেতৃস্থানীয় অনেক আলেম, মু‘তাযিলা, শী‘আ ও কালাম শাস্ত্রবিদ (দার্শনিক) গণের স্তম্ভ বিশেষ বহু পন্ডিত বর্তমান ছিলেন, যারা যুক্তিবাদের উপরে ভিত্তি করে চলতেন এবং নবীর হাদীছকে কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকায় সালাফে ছালেহীনের তরীক্বা এড়িয়ে চলতেন। এই সময় ফক্বীহদের মধ্যে তাক্বলীদ আত্মপ্রকাশ করে ও ইজতিহাদের অবক্ষয় শুরু হয়’।[5]
ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) বলেন, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হবার পরে ইসলামী খেলাফত এমন সব লোকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যারা শারঈ বিধানে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তারা সকল বিষয়ে ফক্বীহদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে বিভিন্ন সরকারী পদে তলব করা হ’তে থাকে। ফলে তখন লোকেরা ইল্ম শিখতে লাগল সম্মান ও প্রতিপত্তি হাছিলের মাধ্যম হিসাবে। মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ কেউ কালাম শাস্ত্রের উপরে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। সেখানে বহু কূটতর্কের অবতারণা করা হ’ল। এই সময় শাসকগণ হানাফী ও শাফেঈ ফিক্বহের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী হ’লেন। ফলে বিদ্বানগণ উক্ত দুই মাযহাবের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়সমূহের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন এবং বহু ঝগড়া ও অসংখ্য বই-পুস্তকাদি প্রণয়ন করেন। এইভাবে স্ব স্ব মাযহাবের পক্ষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্যসমূহ উদ্ধার করাকেই তারা তাদের মৌল উদ্দেশ্য হিসাবে গণ্য করেন। এই অবস্থা এখনও চলছে। আমরা জানি না ভবিষ্যতের লিখন কী আছে? (সংক্ষেপায়িত)। [6]
অতঃপর শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘(হে পাঠক!) বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলে তুমি মুসলমানদের দেখবে যে, তারা বিগত কোন একজন মুজতাহিদ বিদ্বানের মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি ঐ বিদ্বানের তাক্বলীদ হ’তে সে বেরিয়ে আসে, তাহ’লে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে ( كَأَنَّهُ نَبِىٌّ بُعِثَ إِلَيْهِ ) এবং যার অনুসরণ তার উপরে ফরয করা হয়েছে। অথচ ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না।[7]
আহলেহাদীছের ইস্তিদলালী পদ্ধতি : শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ইসলামী বিধান প্রণয়নে আহলেহাদীছ বিদ্বানদের অনুসৃত ‘ইস্তিদলালী পদ্ধতি’ বা দলীল গ্রহণের নীতিমালা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘(১) কোন বিষয়ে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ পেলে তাঁরা তাই গ্রহণ করেন। অন্যদিকে মুখ ফিরানোকে তাঁরা জায়েয মনে করেন না (২) কোন বিষয়ে কুরআনের কোন নির্দেশ অস্পষ্ট হ’লে সেক্ষেত্রে ‘সুন্নাহ’ ফায়ছালাকারী হবে। উক্ত হাদীছ সর্বত্র প্রচারিত থাকুক বা না থাকুক, তার উপরে ছাহাবীগণ বা ফক্বীহগণ আমল করুন বা না করুন। কোন বিষয়ে ‘হাদীছ’ পাওয়া গেলে তার বিপরীতে কোন ছাহাবীর ‘আছার’ কিংবা কোন মুজতাহিদের ‘ইজতিহাদ’ গ্রহণযোগ্য হবে না (৩) সার্বিক প্রচেষ্টার পরেও কোন বিষয়ে হাদীছ না পাওয়া গেলে আহলেহাদীছগণ ছাহাবী ও তাবেঈগণের যেকোন একটি জামা‘আতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেন। এক্ষেত্রে তাঁরা কোন একটি দল, শহর বা এলাকার অধিবাসীকে নির্দিষ্টভাবে অগ্রগণ্য মনে করেন না (৪) যদি কোন বিষয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন ও ফক্বীহগণ একমত হন, তবে তাকেই তাঁরা যথেষ্ট মনে করেন (৫) কিন্তু যদি সেখানে মতভেদ থাকে, তবে তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক বিদ্বান, পরহেযগার ও স্মৃতিধর তাঁর কথা অথবা তাঁদের মধ্যকার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কথাটি গ্রহণ করেন (৬) যখন কোন বিষয়ে সমশ্রেণীভুক্ত দু’টি বক্তব্য পাওয়া যায়, তখন সেক্ষেত্রে তাঁরা দু’টিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন (৭) কিন্তু যখন সেটিতেও ব্যর্থ হন, তখন তাঁরা কিতাব ও সুন্নাতের সাধারণ নির্দেশ ও ইঙ্গিতসমূহ এবং উদ্দেশ্যাবলী অনুধাবন করেন। অতঃপর উক্ত বিষয়ে তাঁরা প্রচলিত কোন উছূল বা ব্যবহারিক আইন সূত্রের অনুসরণ করেন না। বরং যে কথাটি তাঁরা উত্তমরূপে বুঝতে পারেন ও যা তাঁদের হৃদয়কে সুশীতল করে, তারই অনুসরণ করেন’।[8]
হানাফী মাযহাবের বিস্তৃতির কারণ : হানাফী মাযহাব সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। খলীফা মাহ্দী, হাদী ও হারূনুর রশীদের আমলে (১৫৮-১৯৩ হিঃ) ইমাম আবু হানীফার প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ) দেশের প্রধান বিচারপতি থাকার সুবাদে ইরাক, ইরান ও মধ্য তুর্কিস্তান সহ খেলাফতের সর্বত্র হানাফী মাযহাবের ফাতাওয়া ও সিদ্ধান্তসমূহ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) এদিকে ইঙ্গিত করে বলেন, فَكَانَ سَبَبًا لِظُهُوْرِ مَذْهَبِهِ ‘এটাই ছিল তাঁর মাযহাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ’।[9] আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী (১২৬৪-১৩০৪/১৮৪৮-৮৬) একথা সমর্থন করে বলেন, هُوَ اَوَّلُ مَنْ نَشَرَ عِلْمَ أَبِىْ حَنِيْفَةَ فِىْ أَقْطَارِ الْأَرْضِ وَ ثَبَتَ الْمَسَائِلَ ‘তিনিই প্রথম আবু হানীফার ইল্ম পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন ও তাঁর মাসআলাসমূহ প্রতিষ্ঠিত করেন’।[10]
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইসলাম এসেছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খলীফাদের আমলেই আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে। বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির পূর্বে আগত সেই ইসলাম ছিল হাদীছ ভিত্তিক নির্ভেজাল ইসলাম। নিঃসন্দেহে তাঁরা ছিলেন ‘আহলেহাদীছ’। পরবর্তী হানাফী মতাবলম্বী সেনাপতি ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খৃষ্টাব্দের সামরিক বিজয় ও তাঁর সাথে ও পরে আগত তুর্কী হানাফী আলেম ও মারেফতী ফকীরদের মাধ্যমে প্রচারিত হানাফী ও মারেফতী ইসলাম প্রধানতঃ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে প্রসার লাভ করে। যার অধিকাংশ আমল ছিল শিরক ও বিদ‘আতে ভরা। যদিও সেনারগাঁয়ের মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০খৃঃ) ও তার শিষ্যদের প্রচেষ্টায় আহলেহাদীছ আন্দোলন চালু থাকে। উল্লেখ্য যে, বোখারা (রাশিয়া) থেকে আগত এই স্বনামধন্য মুহাদ্দিছ-এর মাধ্যমেই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম বুখারী ও মুসলিমের দরস চালু হয়। তিনি সোনারগাঁয়ে দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ ছহীহায়েন-এর দরস দিয়েছিলেন। বলা চলে যে, প্রধানতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় এদেশে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সর্বাধিক প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে তুর্কী, মোগল, শী‘আ, পাঠান, আফগান প্রভৃতি দলের হাত বদল হয়ে যে ইসলাম এদেশে স্থিতি লাভ করে, তা হয়ে পড়ে শিরক, বিদ‘আত ও বিভিন্ন কুসংস্কারে ভরা জগাখিচুড়ী ইসলাম। বলা বাহুল্য যে, আজও সে অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নীতি : ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) তাঁর রায়-এর তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণ করতে তীব্রভাবে নিষেধ করে গিয়েছেন এবং ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যাবে, তখন সেটাই আমার মাযহাব’ বলে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়ে গিয়েছেন (দ্রঃ টীকা ৩)। সেকারণ আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী হানাফী (৮৯৮-৯৭৩ হিঃ) বলেন,
‘যদি (তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে) হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের স্বর্ণযুগে ইমাম আবু হানীফা বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তিনি সেগুলি গ্রহণ করতেন ও যত ক্বিয়াসী ফৎওয়া দিয়েছেন সবই বাদ দিতেন এবং তাঁর মাযহাবেও ক্বিয়াস কম হ’ত, যেমন অন্যদের মাযহাবে কম হয়েছে। .... যে কথা বলা হয়ে থাকে যে, ইমাম আবু হানীফা ক্বিয়াসকে দলীলের উপরে স্থান দিতেন, এটা তাঁর মুক্বাল্লিদগণের কথা মাত্র। যারা ইমামের ক্বিয়াসের উপরে আমল করাকে অপরিহার্য গণ্য করেছেন এবং হাদীছকে পরিত্যাগ করেছেন যা ইমামের মৃত্যুর পরে ছহীহ প্রমাণিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম দায়ী নন, বরং দায়ী তার অন্ধ অনুসারীবৃন্দ’।[11]
ফলকথা আহলুল হাদীছগণের বিপরীতে আহলুর রায়গণের ক্বিয়াস স্ব স্ব মাযহাবী বিদ্বানদের রচিত ব্যবহারিক আইনসূত্রসমূহ বা উছূলে ফিক্বহের উপরে ভিত্তিশীল, হাদীছের উপরে নয়।
মুজতাহিদগণের বিভক্তি :
হিজরী ষষ্ঠ শতকের খ্যাতনামা বিদ্বান আবুল ফাৎহ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী (৪৭৯-৫৪৮ হিঃ) বলেন,
‘উম্মতের মুজতাহিদ ইমামগণ দু’ভাগে বিভক্ত, তৃতীয় কোন ভাগে নয়। আছহাবুল হাদীছ ও আছহাবুর রায় (আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়)। আহলুল হাদীছগণ হেজায (মক্কা-মদীনা)-এর অধিবাসী। তাঁদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ এ জন্য বলা হয় যে, তাঁদের সার্বিক লক্ষ্য নিয়োজিত থাকে হাদীছ সংগ্রহের প্রতি এবং তাঁরা সমস্ত আদেশ-নিষেধের ভিত্তি রাখেন (কুরআন-হাদীছের) দলীল সমূহের উপরে। হাদীছ বা আছার পেলে তাঁরা কোন প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ক্বিয়াসের দিকে ফিরে তাকান না...। পক্ষান্তরে আহলুর রায়গণ হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। তাঁরা আবু হানীফা নু‘মান ইবনু ছাবিত (৮০-১৫০ হিঃ)-এর অনুসারী। তাঁদেরকে ‘আহলুর রায়’ এ জন্য বলা হয়ে থাকে যে, তাঁদের অধিকতর লক্ষ্য থাকে ক্বিয়াসের কারণ অনুসন্ধানের প্রতি ও কুরআন-হাদীছের আহকাম হ’তে সৃষ্ট মর্মার্থের প্রতি এবং তার উপরেই তাঁরা উদ্ভূত ঘটনাসমূহের ভিত্তি স্থাপন করেন। কখনো কখনো তাঁরা ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছের উপরে প্রকাশ্য ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন’।[12]
আহলুল হাদীছের নীতির সপক্ষে মত প্রকাশ করতে গিয়ে হিজরী পঞ্চম শতকের ইউরোপীয় বিদ্বান স্পেনের মুহাম্মাদ আলী ইবনু হায্ম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন-এর প্রথম হ’তে শেষ পর্যন্ত সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বা ইজমা এই যে, তাঁদের কোন একজন ব্যক্তির সকল কথার প্রতি কর্ণপাত করা চলবে না। অতএব ঐ ব্যক্তি জেনে রাখুক, যে ব্যক্তি আবু হানীফার সকল কথা গ্রহণ করেছে, কিংবা মালেক, শাফেঈ বা আহমাদের সকল কথাকে গ্রহণ করেছে। তাঁদের কোন কথা ছাড়েনি বা অন্যের কথার প্রতি দৃকপাত করেনি, কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ-নিষেধের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করেনি, ঐ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ইজমায়ে উম্মতের বিরোধিতা করেছে। এ নীতির অনুসারী কোন লোক ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের তিনটি প্রশংসিত যুগে ছিল না। ঐ ব্যক্তি মুমিনদের গৃহীত পথের বাইরে গিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঐ অবস্থা হ’তে পানাহ দিন’।[13]
এক্ষণে আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে আমরা আল্লাহ-প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান নেব? না মানব রচিত ফিক্বহের ভিত্তিতে সমাধান নেব। আমরা বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈকে অগ্রাধিকার দেব? নাকি পরবর্তীতে সৃষ্ট একটি নির্দিষ্ট মাযহাবী ফিক্বহগ্রন্থ কুদূরী, শরহে বেকায়া, হেদায়াহ, আলমগীরীকে অগ্রাধিকার দেব। আমরা কি হাদীছপন্থী হব, নাকি রায়পন্থী হব? জানা আবশ্যক যে, নবীদের আগমন শেষ হয়ে গেছে, অহি-র অবতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু যুগে যুগে ‘রায়’-এর পরিবর্তন ঘটেছে, আজও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। বর্তমানে মুসলিম তরুণ সমাজ ক্রমেই বিজাতীয়দের রায়ের অনুসারী হয়ে পড়ছে। ফলে নানা মুণীর নানা মতে মুসলিম সমাজ আজ শতধা বিভক্ত। বিশৃংখল এই বিরাট উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ ও কল্যাণমুখী করার একটাই মাত্র পথ। সেটা হ’ল, সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে ফিরে চলা। পবিত্র কুরাআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালার সম্মুখে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। যুগ যুগ ধরে আহলেহাদীছ আন্দোলন এই কল্যাণ লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়ে এসেছে, আজও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ।
[1]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো: ১৩২২ হিঃ)১/১২৯ পৃঃ; বিস্তারিত জানার জন্য ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ শীর্ষক আলোচনা দ্রষ্টব: ঐ, ১১৮-১২২।
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।