মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
অর্থনীতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর দশ দফা
লেখকঃ শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
১২
যাকাতের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্যে
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/476/12
যাকাতের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্যে হচ্ছে ইসলামী সমাজ হতে দরিদ্রতা দূর করা। দারিদ্র মানবতার পয়লা নম্বরের দুশমন। ক্ষেত্রবিশেষে তা কুফরী পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। যে কোন সমাজ ও দেশের এটা সবচেয়ে জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতির সৃষ্টি হয়। দারিদ্রতার ফলে। পরিণামে দেখা দেয় সামাজিক সংঘাত। বহু সময়ে রাজনৈতিক অভ্যূত্থান পর্যন্ত ঘটে। অধিকাংশ অপরাধই সচরাচর ঘটে দরিদ্রতার জন্য। এ সমস্যাগুলির প্রতিবিধান করার জন্যে যাকাত ইসলামের অন্যতম মূখ্য হাতিয়ার। যে আট শ্রেণীর লোকের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, যাকাত লাভের ফলে তাদের দিনগুলি আনন্দ ও নিরাপত্তার হতে পারে। যাকাত যথাযথভাবে আদায় ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হলে, আজকের দিনেও এর মাধ্যমে দারিদ্র দূর করা সম্ভব।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের লোকদের মধ্যে যখন যাকাতের অর্থসামগ্রী বন্টন করে দেওয়া হয় তখন শুধু যে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তাই নয়, বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। দরিদ্র ও দুর্গত লোকদের ক্রয় ক্ষমতা থাকে না। বেকারত্ব তাদের নিত্যসঙ্গী। যাকাত প্রাপ্তির ফলে তাদের হাতে অর্থাগম হলে বাজারে কার্যকর চাহিদার সৃষ্টি হয়। এরই ফলে দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নতুন প্রেরনার সৃষ্টি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নির্মাণের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় অনুকূল পরিবেশ। ফলশ্রুতিতে প্রচলিত সামাজিক শ্রেণীসমূহের মধ্যে আয়গত পার্থক্যও হ্রাস পেতে থাকে।
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে বায়তুল মালেরও প্রতিষ্ঠা করেন। বায়তুলমাল বলতে সরকারের অর্থ সম্বন্ধীয় কর্মকান্ড বুঝায় না। বরং বিভিন্ন উৎস হতে অর্জিত ও রাষ্ট্রের কোষাগারে জমাকৃত ধন-সম্পদকেই বায়তুলমাল বলা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকেরই এতে সম্মিলিত মালিকানা রয়েছে। প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা রাজকীয় ধনাগারের সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালে সঞ্চিত ধন-সম্পদের উপর জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে আপামর জনসাধরণের সাধারণ অধিকার স্বীকৃত। রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে একজন লোকও যেন মৌলিক মানবিক প্রয়াজন হতে বঞ্চিত না হয় তার ব্যবস্থা করা বায়তুলমালের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।
প্রত্যেক নাগরিকই তা প্রয়োজনীয় পরিমাণ ন্যূনতম অর্থ বা সম্পদ বায়তুলমাল হতে গ্রহণ করতে পারে। সাধ্যানুসারে পরিশ্রম করেও যদি জীবিকার অভাব পূরণ না হয় বা সমাজের স্বচ্ছল লোকজন তাদের দরিদ্র আত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশীদের প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করার পরও মৌলিক প্রয়োজন অপূর্ণ থেকে যায় তবেই মাত্র বায়তুলমাল হতে সাহায্য গ্রহণ করা যাবে । ইসলামে এভাবেই সমস্ত নাগরিকই জন্যে আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করা হয়েছে । পৃথিবীর ইতিহাসে এ ব্যবস্থা শুধু প্রথমই নয়, মৌলিকও।ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বায়তুলমালের অর্থ সংস্থানের উৎসগুলি নিন্মরূপ :১। অর্থ সম্পদ ও গবাদি পশুর যাকাত২। সদাকাতুল ফিতর৩। কাফফারাহ৪। ওশর৫। খারাজ৬। গণীমতের মাল ও ফাই৭। জিজিয়া৮। খনিজ সম্পদের আয়৯। নদী ও সমুদ্র হতে প্রাপ্ত সম্পদের এক-পঞ্চামাংশ১০। ইজারা ও কেরায়ার অর্থ ১১। মালিক ও উত্তরাধিকারহীন সম্পদ১২। আমদানী ও রফতানী শুল্ক১৩। রাষ্ট্রের মালিকানা ও কর্তৃত্বধীন জমি, বন ব্যবসায় ও শিল্পের মুনাফা১৪। শরীয়াহ মোতাবেক আরোপিত কর এবং১৫। বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের অনুদান ও উপটৌকন।
বায়তুলমালের আয় বৃদ্ধির জন্যে উল্লেখিত উৎসসমূহকে অবশ্যই পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। এসমস্ত উৎস হতে যথাযথ ভাবে অর্থাগম নিশ্চিত করা এবং সুষ্ঠ বন্টনের উদ্দেশ্যে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পদাংকে অনুসরণ করে মহান খুলাফায়ে রাশিদীনের (রা) আমলেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ যাকাতের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
যে সমস্ত খাতে বায়তুলমালের অর্থ ব্যয়ের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে সেগুলি হচ্ছে :১। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার কর্মচারীদের বেতন২। বন্দী ও কয়েদীদের ভরণ-পোষণ৩। লা-ওয়ারিশ শিশুদের প্রতিপালন৪। অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা৫। করযে হাসানা প্রদান এবং৬। সামাজিক কল্যাণ
রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারী কর্মচারীদের বেতন :
ইসলামী রাষ্ট্রের তাঁর বেতন বায়তুল মাল হতেই নেবেন। তবে এর পরিমাণ হবে তাঁর প্রয়োজন ও সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য অনুসারে সাধারণ প্রচলিত হারের সমান। এ ক্ষেত্রে হযরত উমর ফারুক (রা) এর বক্তব্য বিশেষ প্রণীধানযোগ্য। তিনি বলেন-
তোমাদের সামগ্রিক ধনসম্পদ ইয়াতীমের ধনসম্পদের সমতূল্য এবাং আমি যেন ইয়াতীমের মালেরই রক্ষাণবেক্ষণকারী। অতএব আমি যদি ধনী হই-তবে আমি বায়তুলমাল হতে কিছুই গ্রহণ করব না। আর যদি দরিদ্র ও অভাবী হই, তবে অপরিহার্য পরিমাণ কিংবা সাধারণ প্রচলিত মানের বেতনই আমি গ্রহণ করব।
(আবু ইউসূফ-কিতাবুল খারাজ)
অথচ আজ বিশ্বের মুসলিম দেশসমূহেরই রাষ্ট্রপ্রধানদের বার্ষিক বেতন ও বিভিন্ন এলাউন্সের পরিমাণ সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এক বিরাট অংশ। রাষ্ট্রপ্রধানগণ বেতন ছাড়াও নানা ধরনের এলাউন্স ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এত বেশী পেয়ে থাকেন যে তার হিসেব করলে দেশের সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে পার্থক্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০,০০০:১।
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় সরকারী কর্মচারীদের জন্যে ভরণ-পোষণের দায়িত্বপালনক্ষম বেতন নীতির কথা বলা হয়েছে। নিন্মপদ বা সাধারণ কর্মচারীদের ন্যূনতম প্রয়োজন অপূর্ণ রেখে উচ্চপদস্থ অফিসারদের বিলাস-ব্যাসনের ব্যবস্থার অনুমতি ইসলাম দেয়নি। বেতন নির্ধারণ সম্পর্কে উমর ফারুক (রা) এর গৃহীত নীতি এ প্রসঙ্গে সবিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। সে নীতিতে মূখ্য বিচার্য বিষয় ছিল একজন ব্যক্তি-১। ইসলামের জন্যে কি পরিমাণ দু:খ ভোগ করেছে।২। ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কতখানি অগ্রসর হয়েছে৩। ইসলাম প্রতিষ্ঠার কতখানি কষ্ট স্বীকার করেছে৪। ইসলামী জীবন যাপনের জন্যে প্রকৃত প্রয়োজন কতখানি এবং৫। কতজন লোকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত রয়েছে।
বন্দী ও কয়েদীদের ভরণ-পোষণ : অত্যাধুনিক এই সভ্য যুগেও বন্দী ও কয়েদীদের সঙ্গে যে অমানুষিক আচরণ করা হয়ে থাকে তা কারো অবিদিত নয়। এদের ন্যূন্যতম প্রয়োজনও মেটানো হয় না। বরং নির্মম ও নির্দয় ব্যবহারের শিকার হয়ে থাকে তারা। ক্ষুৎপিপাসায়, বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায় বন্দীরা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা বন্দী শিবিরগুলিতে সোভিয়েত রাশিয়ার লেবার ক্যাম্প ও আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধবন্দীদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ এর প্রকৃষ্ট নজীর।
যুদ্ধবন্দী ও বিভিন্ন অপরাধে কয়েদীদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাবার জন্যে ইসলামী সরকার বাধ্য। রাসূলে করীম সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বন্দী ও কয়েদীদের সঙ্গে যে অপূর্ব সুন্দর ব্যবহার করেছেন দুনিয়ার ইতিহাসে তার নজীর বিরল। মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে যখন এই নীতি অনুসৃত হতো তখন পাশাপাশি রোমান ও বাইজেন্টাইন শাসকবর্গ তাদের যুদ্ধবন্দী ও কয়েদীদের সঙ্গে যে ব্যবহার করতো তা ছিল নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক।
লা-ওয়ারিশ শিশুদের প্রতিপালন : ইয়াতীম, অনাথ ও লা-ওয়ারিশ শিশুদের লালন পালন করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য। মনে রাখা দরকার, যে সমাজে ইয়াতীমের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ ছিল সাধারণ ঘটনা সেই সমাজেই রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিপ্লবী চেতনার ফলে লা-ওয়ারিশ শিশুরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়েছিল। তাদের লালন-পালন ও জীবিকার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতেই ন্যস্ত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-যে বেক্তি কোন দায়ভার রেখে যাবে তা বহন করা করা আমার কর্তব্য।(আবু দাউদ)
বায়তুল মাল হতেই এই দায়ভার বহনের বিধান করা হয়েছিল। অমুসলিমদের লা-ওয়ারিশ সন্তানদের সম্পর্কেও এই একই নীতি অনুসৃত হতো।
অমুলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান : ইসলামের সামাজিক নিরাপত্তা শুধুমাত্র মুসলিম নাগরিকদের জন্যেই নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ভাষা-লিঙ্গ নির্বিশেষে আবাল বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই এর অন্তর্ভূক্ত। বিধর্মীরা অক্ষম অবস্থায় জিজিয়া দেবে না, বরং রাষ্ট্র তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে বায়তুল মাল হতে।
করযে হাসানা প্রদান :আইয়ামে জাহেলিয়া বা তার পূর্ববর্তী যুগে বিনা প্রতিদানে ঋণ দেবার রীতি চালু ছিল না। বরং সুদই ছিল লেনদেনের ভিত্তি। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রীতির মূলোচ্ছেদ করেন এবং বিনা সুদে ঋণ বা করযে হাসানা দেবার রীতি চালু করেন। বিশ্বে প্রচলিত আর কোনও ধরনের অর্থনীতিতে এই ব্যবস্থা পূর্বেও ছিল না, আজও নেই।
সামাজিক কল্যাণ : সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন হতে পারে এমন সব কাজে বায়তুলমাল হতেই অর্থ ব্যয় করার বিধান রয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই অর্থেই জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের উদ্দেশ্যে কাজ করা হতো। সরাইখানা নির্মাণ, শিক্ষাবিস্তার, পানির নহর খনন প্রভৃতি তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য। এ যুগেও শিক্ষার সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বিস্তার, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ পদ্ধতির ব্যাপক সম্প্রসারণ, পথিকদের সুবিধার ব্যবস্থা সবই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিনামূল্যে নির্দিষ্ট একটা স্তর পর্যন্ত শিক্ষাদান, রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট ও সেতু নির্মাণ, দিঘী-পুকুর খনন সবই সমাজকল্যাণের আওয়াভুক্ত। মুসাফিরখানা স্থাপন, ভিক্ষাবৃত্তির উচ্ছেদ, গরমৌসূমে কাজের বিনিময়ে খাদ্যের যোগান, পুষ্টিহীনতা দূর, শ্রমিক কল্যাণ প্রভৃতিও সরকারের দায়িত্ব। এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে বায়তুল মালের অর্থ ও সম্পদ হবে সবচেয়ে বড় সহায়ক।
কোন নাগরিক যখন দারিদ্র হয়ে পড়বে, বৃদ্ধ হয়ে উপার্জন ক্ষমতা হারাবে তখন তার যাবতীয় প্রয়োজন মেটাবার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রের উপর নাগরিকদের এই অধিকার ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক। রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর খুলাফায়ে রাশেদীনও (রা) এই দাবী পূরণে যত্নবান ছিলেন।
বিশ্বের ইতিহাসে মানবতার বন্ধু রাহমাতুল্লিল আলামীনই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম মানবিক শ্রমনীতির প্রবর্তন করেন। তাঁর পূর্বে কোন দেশ বা অর্থনীতিতেই শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়াস গ্রহীত হয়নি। এমনকি পরেও কোন দেশ বা মতবাদে সমতুল্য কোন নীতি গৃহীত হয়নি। আজ হতে চৌদ্দশত বছর পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবর্তিত শ্রমনীতি আজও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শ্রমনীতি। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অনুসৃত শ্রমনীতি মানবিক নয়, ইনসাফভিত্তিক তো নয়ই। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক, শ্রমিকদের সঙ্গে ব্যবহার, তাদর বেতন ও মৌলিক প্রয়োজন পূরণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে রাসূলে করীমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত পথ ও হাদীসসমূহ থেকেই ইসলামের বৈপ্লবিক ও মানবিক শ্রমনীতির সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে। মজুরদের অধিকার সম্বন্ধে তিনি বলেন-
তারা তোমাদের ভাই! আল্লাহ তাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করেছেন। কাজেই আল্লাহ যাদের উপর এরূপ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন তাদের কর্তব্য হলো তারা যে রকম খাবার খাবে তাদেরকেও সেরকম খাবার দেবে, তারা যা পরিধান করবে তাদেরকে তা পরাবার ব্যবস্থা করবে। যে কাজ করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ও সাধ্যতীত তা করার জন্যে তাদেরকে কখনও বাধ্য করবে না। যদি সে কাজ তাদের দিয়েই করাতে হয় তা হলে সে জন্যে তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য অবশ্যই করতে হবে।(বুখারী)
অন্যত্র রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রমিকদের সম্পর্কে বলেছেন, শ্রমিককে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না, যা তাদেরকে অক্ষম ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেবে।(তিরমিযী)
তাদের উপর ততখানি চাপ দেওয়া যেতে পারে, যতখানি তাদের সামর্থ্যে কুলায়। সাধ্যাতীত কোন কাজের নির্দেশ কিছুতেই দেওয়া যেতে পারে না।(মুয়াত্তা, মুসলিম)
মজুরদের বেতন, উৎপাদিত পণ্যে তাদের অংশ ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন-মজুরের মজুরী তার গায়ের ঘাম শুকাবার পূর্বেই পরিশোধ কর।(ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)
মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর। কারণ, আল্লাহ মজুরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যেতে পারে না।(মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল)
উপরোক্ত হাদীসসমূহ হতে যেসব মূলনীতি পাওয়া যায় সেগুলোই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবর্তিত মানবিক শ্রমনীতি। সংক্ষেপে এগুলো হচ্ছে-
১। উদ্যোক্তা বা শিল্প মালিক মজুর-শ্রমিককে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করবে। সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে এ ক্ষেত্রেও সে রকম সম্পর্ক থাকবে।
২। অন্ন বস্ত্র-বাসস্থান প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রমিক ও মালিক উভয়ের মান সমান হবে। মালিক যা খাবে ও পরবে শ্রমিককেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
৩। সময় ও কাজ উভয় দিক দিয়েই শ্রমিকদের সাধ্যমতো দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, তার বেশী নয়। শ্রমিককে এত বেশী কাজ দেওয়া উচিৎ হবে না যাতে সে ক্লান্ত ও পীড়িত হয়ে পড়ে। এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাকে শ্রম দিতে বাধ্য করা যাবে না, যার ফলে সে অক্ষম হয়ে পড়ে। শ্রমিকের কাজের সময় নির্দিষ্ট হতে হবে এবং বিশ্রামের সুযোগ থাকতে হবে।
৪। যে শ্রমিকের পক্ষে একটি কাজ করা অসাধ্য তা সম্পন্ন হবে না এমন কথা ইসলাম বলে না। বরং সে ক্ষেত্রে আরও বেশী সময় দিয়ে বা বেশী শ্রমিক নিয়োগ করে তা সম্পন্ন করা যেতে পারে।
৫। শ্রমিকদের বেতন শুধুমাত্র তাদের জীবন রক্ষার জন্যে যথেষ্ট হলে হবে না। তাদের স্বাস্থ্য, শক্তি ও সজীবতা রক্ষার জন্যে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ভিত্তিতেই বেতন নির্ধারণ করতে হবে।
৬। উৎপন্ন দ্রব্যের অংশবিশেষ বা লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশও শ্রমিকদের দান করতে হবে।
৭। শ্রমিকদের কাজে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে তাদের প্রতি অমানুষিক আচরণ বা নির্যাতন করা চলবে না। বরং যথাযথ সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে।
৮। চুক্তিমত কাজ শেষ হলে অথবা নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে শ্রমিককে দ্রুত মজুরী বা বেতন পরিশোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে কোন ওজর-আপত্তি বা গাফলতি করা চলবে ন।
৯। পেশা বা কাজ নির্বাচন করার ও মজুরীর পরিমাণ বা হার নির্ধারণ সম্পর্কেও দর-দস্তর করার পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার শ্রমিকের রয়েছে। বিশেষ কোন কাজে বা মজুরীর বিশেষ কোন পরিমাণের বিনিময়ে কাজ করতে জবরদস্তি করা যাবে না।
১০। কোন অবস্থাতেই মজুরদের অসহায় করে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। তারা অক্ষম ও বৃদ্ধ হয়ে পড়লে পেনশন বা ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বায়তুল মালের তহবিল ব্যবহৃত হতে পারে।
উপরে বর্ণিত নীতিমালার আলোকে দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, ইসলাম মজুরের যে মর্যাদা ও অধিকার স্বীকৃত হয়েছে এবং শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে যে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাতে শ্রমিক-মালিক দ্বন্ধ ও সংঘাতের কোন সুযোগ থাকে না। দুইয়ের সম্মিলিত চেষ্টা ও আন্তরিকতা পূর্ণ সহযোগিতার ফলে শিল্পের ক্রমাগত উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি হওয়াই স্বাভাবিক। সর্বোপরি মুমিন মুসলমান শিল্প-মালিক ও উদ্যোক্তরা ঈমানের তাগিদে পরকালের কঠিন শাস্তি হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যেই এই শ্রমনীতি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। অন্য কোন ধরনের অর্থনীতিতে যা প্রত্যাশা করা একেবারেই অসম্ভব। দুনিয়ার মজুদুর এক হও শ্লোগানসর্বস্ব সমাজতন্ত্রের বাধ্যতামূলক শ্রমদান যেমন এখানে অনুপুস্থিত, তেমনি পুঁজিবাদী মালিকের অবমাননাকর শর্ত ও লাগামহীন শোষণও নেই। শ্রমিক ও মালিক পরস্পর ভাই-এই বিপ্লবাত্মক ঘোষণাই ইসলামী শ্রম। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাস্তবায়নে পূর্ব পর্যন্ত আব ভূখন্ডে ভূমি রাজস্বের কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অবস্থার পরিবর্তন সাধন করেন। সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের জন্যে তিনি একটি নির্দিষ্ট হারে ওশর নির্ধারণ করেছিলেন। কৃষি কাজের উপযুক্ততার দিক থেকে জমির দুটি শ্রেণী রয়েছে-সেচবিহীন ও সেচযুক্ত। প্রথমোক্ত ভূমি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বৃষ্টির পানিতেই সিক্ত হয়। অন্যটিতে মানুষ কায়িক শ্রম, পশুশ্রম বা যন্ত্রের সাহায্যে জলসেচ করে কৃষি কাজের উপর উপযুক্ত করে নেয়। এই উভয় ধরনের জমির ওশরের ব্যাপারে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তা নিন্মরূপ-
মুসলমানদের নিকট থেকে ওশর (এক-দশমাংশ) আদায় করবে। এই পরিমাণ ফসল ঐসব জমি হতে গ্রহণ করা হবে যা বৃষ্টি বা ঝর্ণার (স্বাভাবিক) পানিতে সিক্ত হয়। কিন্তু যেসব জমিতে স্বতন্ত্রভাবে পানি সেচ করতে হয় সেসব হতে এক-বিংশতি অংশ (নিসফে ওশর) আদায় করতে হবে।(তারীখ-ই-তাবারী, ফতুহুল বুলদান)
এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হচ্ছে যে, প্রতিটি মুসলিম তার জমিতে বছরে যা কিছু উৎপন্ন হোক না কেন তা থেকে ওশর অর্থাৎ এক-দশমাংশ এবং ক্ষেত্র বিশেষ ওশরের অর্ধেক অর্থাৎ এক বিংশতি অংশ বায়তুল মালে জমা দেবে। অবশ্য নিসাব পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হলে তবেই ওশর আদায় করতে হবে। ওশরের কয়েকটি অনন্য বৈশীষ্ট্য রয়েছে নীচে সেগুলি উল্লেখ করা গেল।
প্রথমত:
ওশর কখনই এবং কোন অবস্থাতেই রহিত করা যাবে না। এর হারও চিরকালের জন্যে নির্দিষ্ট। এ থেকে কোন অবস্থাতেই কাউকে অব্যহতি দেওয়া যেতে পারে না। তবে কোন মৌসুমে কোন ফসল নিসাব পরিমাণের কম উৎপন্ন হলে তার ওশর আদায় করতে হবে না।
দ্বিতীয়ত:
ওশর আদায় করতে হবে প্রতিটি ফসল হতেই। অর্থাৎ যেসব জমিতে বছরে দুটি বা তিনটি ফসল হবে সেই ফসলের প্রত্যেকটি হতেই ওশর আদায় করতে হবে। এর ফলে বায়তুল মালের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, পরোক্ষভাবে জাতি ও দেশেরই খেদমত করা হবে।
তৃতীয়ত :
ওশর আদায় করতে হবে ফসলের দ্বারাই। এ ব্যবস্থা কৃষক বা ভূমি মালিকের জন্যে খুবই অনুকূল। কারণ, ফসল কমই হোক আর বেশীই হোক, তা থেকে নির্দিষ্ট অংশ পরিশোধ করতে কৃষকের অসুবিধার সম্ভবনা নেই। তাছাড়া নগদ টাকা যদি ওশর দিতে হয় তাহলে কৃষকের অসুবিধা হওয়ার সম্ভবনা থাকে। ফসলের দাম কখনই নির্দিষ্ট থাকে না। কোন বছর যদি বিশেষ কোন ফসল বেশী পরিমান উৎপন্ন হয় বা অন্য কোন নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে মূল্য হ্রাস পায় তাহলে নির্দিষ্ট ওশর পরিশোধ করার জন্যে কৃষক অধিক পরিমাণে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হবে। এতে কৃষকের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী নানা ধরনের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ইউরোপ, বিশেষত: ইংল্যান্ডে এই সেদিনও ভূমিদাসদের দ্বারা জমি চাষ করানো হতো। সাধারণ রায়তদের উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকের বেশী জমিদার ও চার্চের নামে আদায় করা হতো। ভূমির মালিকানা মুষ্টিমেয় পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর পর শিল্প বিপ্লবের ফলে জমির উৎপাদন যখন বহুগুন বৃদ্ধি পায়, তখন বড় বড় শিল্পপতিরা হাজার হাজার একর জমি সস্তায় কিনে একই সঙ্গে ভূস্বামী হয়ে বসে। উপরন্ত নব্য জমিদাররা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমি হয় কিনে নেয় অথবা শক্তির দ্বারা চাষীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে। ফলে বেকার ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সমাজতন্ত্রে ভূমিস্বত্ব নীতিতে জমির ব্যক্তি মালিকানা শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, বরং ব্যক্তিকে জমি হতে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সমস্ত জমি রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানায় আনা হয়েছে। এ জন্য লক্ষ লক্ষ লোককে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। লেবার ক্যাম্প ও বন্দী শিবিরে পাঠানো হয়েছে আরও বহু লক্ষকে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার ভূস্বামীকে। তবেই জমি রাষ্ট্রয়ত্বকরণ করা সম্ভব হয়েছিল। উপরন্ত কৃষকদের এই রাষ্ট্রীয় ও যৌথ খামারে কাজ করতে গায়েব জোরে বাধ্য করা হয়েছে। বিনিময়ে অনেক সময় তাদের ভরণ-পোষণের উপযুক্ত ন্যূন্যতম পারিশ্রমিকও জোটেনি।
এই উভয় প্রকার ভূমিব্যবস্থাই বঞ্চনামূলক ও স্বভাববিরোধী। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজ ও জাতি বঞ্চিত ; সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি মানুষ শুধু বঞ্চিত হয়, বরং শোষিত ও নিপীড়িত। এই অবস্থা যেন আদৌ সৃষ্টি না হয় সেজন্য চৌদ্দশত বছর পূর্বেই রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিস্বত্ব নীতি ঘোষণা করেছিলেন। আব্বাসীয় খিলাফত পর্যন্ত সে নীতি অনুসারে ভূমির বিলি-বন্টন ও মালিকানা নির্ধারিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চূড়ান্ত ফায়সালা করে দিয়েছেন, জমি জায়গা সব কিছুই আল্লাহর। মানুষ তাঁরই দাস। অতএব যে ব্যক্তি অনাবাদী জমি চাষ উপযোগী ও উৎপাদনক্ষম করে তুলবে তার মালিকানা লাভে সেই-ই অগ্রাধিকার পাবে।(আবু দাউদ)ইসলাম ভূমিস্বত্ব নীতি অনুযায়ী জমির মালিকানা লাভ ও ভোগদখলের দৃষ্টিতে জমিকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। সে গুলি হচ্ছে-
১। আবাদী ও মালিকানাধীন জমি। মালিকের বৈধ অনুমতি ব্যতীত এই জমি অপর কেউ ব্যবহার বা কোন অংশ দখল করতে পারবে না।
২। কারো মালিকানাভূক্ত হওয়া সত্বেও পতিত আবাদ অযোগ্য জমি। এই জমিতে বসবাস নেই, কৃষিকাজ হয় না, ফলমূলের চাষ হয় না। এই শ্রেণীর জমিও মালিকেরই অধিকারভুক্ত থাকবে।
৩। জনগণের সাধারণ কল্যাণের জন্যে নির্দিষ্ট জমি। কবরস্থান, মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, স্কুল-কলেজ, চারণ ভূমি ইত্যাদি সর্বসাধারণের জন্যে নির্দিষ্ট জমি এই শ্রেণীর আওতাভূক্ত।
৪। অনাবাদী ও পরিত্যক্ত জমি যার কোন মালিক নেই বা কেউ ভোগ-দখলও করছে না। এ ধরনের জমির বিলি-বন্টন সম্পর্কে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।অনাবাদি, অনুর্বর, মালিকহীন ও উত্তরাধীকারহীন জমি-জায়গা এবং যে জমিতে কেউ চাষাবাদ ও ফসল ফলানোর কাজ করে না তা ইসলামী রাষ্ট্রের উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ব্যপারে সকল মুসলমানদের সাধারণ ও নির্বিশেষ অধিকার স্বীকার ও সর্বসাধারণের কল্যাণ সাধনই নীতি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।(আবু ইউসুফ-কিতাবুল খারাজ)
ইসলামে মাত্র একপ্রকার ভূমিস্বত্বই স্বীকৃত-রাষ্ট্রের সঙ্গে ভূমি মালিকের সরাসরি সম্পর্ক। জমিদার তালুকদার মানবদার প্রমুখ মধ্যস্বত্বভোগীর কোন স্থান ইসলামে নেই। সে কারণে শোষণও নেই। উপরন্ত ওশর (ক্ষেত্রে বিশেষে ওশরের অর্ধেক) ও খারাজ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় জমির মালিক বা কৃষকদের উপর ইনসাফ ও ইহসান করা হয়েছে।জমি পতিত রাখাকে ইসলাম সমর্থন করেনি, সে জমি রাষ্ট্রের হোক আর ব্যক্তিরই হোক। জমির মালিক যদি বৃদ্ধ, পংগু, শিশু বা স্ত্রীলোক হয় অথবা চাষাবাদ করতে অনিচ্ছুক বা অসমর্থ হয় তবে অন্যের দ্বারা জমি চাষ করাতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ হচ্ছে-
যার অতিরিক্ত জমি রয়েছে সে তা হয় নিজে চাষ করবে, অন্যথায় তার কোন ভাইয়ের দ্বারা চাষ করাবে অথবা তাকে চাষ করতে হবে।(ইবনে মাজাহ)
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
সেই জমি নিজেরা চাষ কর কিংবা অন্যদের চাষ করাও।(মুসলিম)
উপরে বর্ণিত হাদীস দুটির আলোকেই উমর ফারুক (রা) হযরত বিলাল ইবনুল হারেস (রা) এর নিকট হতে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদত্ত জমির যে পরিমাণ তাঁর চাষের সাধ্যাতীত ছিল তা ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং মুসলিম কৃষকদের মধ্যে পুনর্বন্টন করে দিয়েছিলেন।
বর্তমান সময়ে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনবার জন্যে এক দিকে কিছু দেশ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ফসলের দাম কমে যাওয়ার ভয়ে কোন কোন দেশে হাজার হাজার একর জমি ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত রাখা হচ্ছে। তাই সামগ্রিকভাবে পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে বিশ্ব খাদ্যের অনটন লেগেই রয়েছে। সুতরাং জমি যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত রাখা যাবে না তেমনি সমস্ত পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে হবে। ইসলামের দাবীই তাই। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পতিত জমি শুধু ব্যক্তিকে চাষ করতেই বলা হয়নি, উৎসাহ দেবার জন্যে ঐ জমিতে তার মালিকানাও স্বীকার করা হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
যে লোক পোড়ো ও অনাবাদী জমি আবাদ ও চাষযোগ্য করে নেবে সে তার মালিক হবে।(আবু দাউদ)
ইচ্ছাকৃতভাবে জমি অনাবাদী রাখার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। বরং জমি চাষের জন্যে এতদূর হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোন আবাদী জমি পর পর তিন বছর চাষ না করলে তা রাষ্ট্রের দখলে চলে যাবে। রাষ্ট্রই তা পুনরায় কৃষকদের মধ্যে বিলি-বন্টন করে দেবে।
উন্নত কৃষি ব্যবস্থার মূখ্য শর্ত হিসেবেই উন্নত ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন হওয়া দরকার। এ জন্যে ইসলামের সেই প্রারম্ভিক যুগে বিশ্ব মানবতার কল্যাণকামী ও শান্তির পথিকৃৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল তা আজও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিধান। মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কোন কিছু দিক দিকেই এর সমকক্ষ ও সমতূল্য কোন বিধানই আজকের পৃথিবীর নেই।
উত্তরাধিকার আইন
শুধু আরব ভূখন্ডেই নয়, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বে ভূমির উত্তরাধিকার আইন ছিল অস্বাভাবিক। তখন পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র সন্তানই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্ব লাভ করতো। বঞ্চিত হতো পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। এছাড়া সমাজে যৌথ পরিবার প্রথা চালু ছিল। এ প্রথার মূল বক্তব্য হচ্ছে সম্পত্তি গোটা পরিবারের হাতেই থাকবে। পরিবারের বাইরে তা যাবে না। ফলে মেয়ারা বিয়ের পর পিতার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হতো। উপরন্ত সম্পত্তির কর্তৃত্ব বা ব্যবস্থাপনার ভার জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তানের হাতেই ন্যস্ত থাকত। এই দুটি নীতিই হিন্দু, খ্রীষ্টান ও ইহুদী ধর্মে অনুসৃত হয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে। সম্পত্তি যেন বিভক্ত না হয় তার প্রতি সব ধর্মের ছিল তীক্ষ্ম নজর। কারণ সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেলে পুঁজির পাহাড় গড়ে উঠবে না, গড়ে উঠবে না বিশেষ একটি ধনিক শ্রেণী যারা অর্থবলেই সমাজের প্রভুত্ব লাভ করে। এরাই নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে অত্যাচার, অবিচার, অনাচার ও নানা ধরণের সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে।
উত্তরাধীকারিত্বের ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অধিকারের স্বীকৃত প্রদান ও প্রতিষ্ঠা ছিল রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যন্য অবদান। ইসলাম-পূর্ব যুগে সাধারণভাবে সম্পত্তিতে নারীদের কোন অধিকার ছিল না। ক্ষেত্রেবিশেষ অনুকম্পাবশত: কাউকে কিছু দিলেও তা ছিল নিতান্তই দয়ার দান, অধিকার নয়। কিন্তু কখনোই কন্যারা পিতারা বা স্ত্রীরা স্বামীর সম্পত্তির মালিকানা বা উত্তরাধিকারত্ব লাভ করতো না। বরং নারীরা নিজেরাই ছিল পন্যসামগ্রীর মতো। এই অবস্থার অবসান ও প্রতিনিধিদের জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল কুরআনে সূরা আন নিসার দুটি দীর্ঘ আয়াতে সম্পত্তির ওয়ারিশ বা উত্তরাধীকারিনী হিসেবে নারীদের অংশ নির্দিষ্ট করে দিলেন। সেই প্রথম পৃথিবীতে মাতা, ভগ্নি স্ত্রী ও কন্যা হিসেবে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও অংশ স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হলো। এ বিধান ছিল সম্পত্তির এককেন্দ্রীকরণ বা পুঞ্জিভূতকরণ নিরোধের এক মোক্ষম ব্যবস্থা। অধিকন্তু মানুষের খেয়াল-খুশীর উপর সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়নি।
ইসলাম নারীকে দুই দিয়ে সম্পত্তিতে অংশীদারত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রথমত : পিতার দিক হতে, দ্বিতীয়ত: স্বামীর দিক হতে। পিতার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার বর্তাবে। একইভাবে স্বামীর মৃত্যুর পর তার সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। উপরন্ত স্ত্রী তার দেনমোহরও পাবে। এভাবেই পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে যুগপৎ উত্তরাধিকাত্ব প্রদান করা হয়েছে নারীকে। যদি কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয় তাহলে ইদ্দৎ পালনের সময়ে ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করতে হবে। স্বামীকেই। তা ছাড়া স্বামী মারা গেলে তখনও তারই বাড়ীতে নূন্যতম এক বছর স্ত্রীর বসাবাসের হক রয়েছে, যদি তার মধ্যে স্ত্রী পুনরায় বিবাহ না করে। ঐ সময়ের খরচও স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তিই হতেই বহন করা হবে।
প্রসঙ্গত : স্মরণীয় যে, ইসলামের এই কালজয়ী, যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ যখন গৃহীত হয়েছিল নারী তখন বিবেচিত হতো সাধারণ পন্যের মতো। কন্যাসন্তান জন্ম ছিল অপরাধের শামিল। তাদেরকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হত। ইসলাম পূর্ববর্তী কোন সমাজেই নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকারের স্বীকৃতি ছিল না।
পুঁজিবাদী সামাজে উইল করে কোন বিত্তশালী মানুষ যেকোন কাজে তার সমুদয় সম্পত্তি দান করে যেতে পারে। বিশেষ করে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শেষ নির্দেশ বা অসিয়তের সামাজিক ও আইনগত মূল্য খুব বেশী। এর সুযোগ নিয়ে মানুষ মৃত্যুর পূর্বে তার সর্বস্ব দান করে যায় ইচ্ছামতো যে কাউকে, ক্ষেত্রবিশেষ কুকুর, বিড়াল বা পাখীর জন্য। এর পরিমাণ লক্ষ লক্ষ ডলার হয়ে থাকে। এমনও নজীর রয়েছে যে একাদিকে পুত্র-কন্যা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পথে পথে ঘোরে, অপরদিকে কুকুর-বিড়ালের জন্যে সম্পত্তি উইল করে যায়। ইসলামে অসিয়ত করর ব্যাপারে ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দিক নির্দেশনা রয়েছে। কোন ব্যক্তি অসিয়ত করতে পারে তার সম্পত্তির সর্বোচ্চ এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত, তার বেশী নয়। করলেও তা ইসলামী আইনে সিদ্ধ হবে না। এই অসিয়তও কার্যকর হবে মৃতের যদি কোন ঋণ বা কর্জ ও কাফফারা থেকে তবে তা পরিশোধের পর।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্যে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। অন্যসব অর্থনৈতিক বিবেচনাকে সামাজিক সুবিচার ও মূলনীতির আলোকেই বিচার-বিশ্লেষণ ও গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিচার ব্যহত হতে পারে এমন কোন অর্থনৈতিক নিয়ম বা নীতি কার্যকর করতে বা থাকতে দেওয়া কিছুতেই সঙ্গত হতে পারে না। এই উদ্দেশ্যেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রেকে অবশ্যই মারুফ বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা এবং মুনকার বা দুর্নীতির প্রতিরোধ করতে হবে। অর্থনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে সমস্ত উপায়ে সুবিচারমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলে। আর দুর্নীতি প্রতিরোধের অর্থ হচ্ছে সব ধরণের অর্থনৈতিক জুলুম ও শোষণের পথ বন্ধ করা।
সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও জুলুমের অবসানের জন্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সব আইন রচনা করতে পারে। এজন্যে প্রয়োজনীয় আইনগত ক্ষমতা আল্লাহ তাআলা আল কুরাআনেই প্রদান করেছেন। ইসলামী সরকার আইন প্রয়োগ করে অবৈধ উপার্জণের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিতে পারে, পারে সব ধরনের অনাচারের উচ্ছেদ করতে। এই উপায়েই রাষ্ট্র সুদ, ঘুষ, মুনাফাখোরী, মজুতদারী, চোরাচালান,কালোবাজারী, পরদ্রব্য আত্মসাৎ, সব ধরনের জুয়া, হারাম সামগ্রীর উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রচলিত সব ধরনের অসাধুতা সমূলে উৎপাদন করতে পারে। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপেই মাধ্যমেই যাকাত আদায় ও বিলি-বন্টন, বায়তুল মালের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা, উত্তরাধিকা বা মীরাসী আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন, ইসলামী শ্রমনীতির রূপদান প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণ সম্ভব।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তখন তাঁর সামনে কোন মডেল ছিল না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে মডেল তৈরীতে সাহায্য করলেন জীবরীল এর মাধ্যমে নির্দেশ পাঠিয়ে। সেই আলোকে তিনি গড়ে তুললেন নতুন এক সমাজ কাঠামো, অর্থনীতি ছিল যার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। তিনি ঠিক করে দিলেন অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অবশ্যই নজরদারী করতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। আবার প্রয়োজন পূর্ণ সহযোগিতা নিয়েও এগিয়ে আসতে হবে।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে এমন কতগুলি বিষয় রয়েছে যা ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া উত্তম, কিন্তু তার লাগাম রাষ্ট্রের হাতে থাকাই বাঞ্চনীয়। যেমন উৎপাদন, বন্টন ও বিনিয়োগ। এগুলির যথাযথ তত্ত্বাবধান না হলে সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে, মুষ্টিমেয় লোকেই সকল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্গতির অন্ত রইবে না। মূলত : এই দৃষ্টিকোণ হতেই মানবতার অকৃতিম দরদী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উৎপাদের পাশাপাশি তা থেকে গরীবদের হক আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, ইয়াতীমদের যত্ন নিতে বলেছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে পৃথক দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কৃষি জমি অনাবদী ফেলে রাখার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন।
আলোচ্য প্রসঙ্গে যে বিশেষ ক্ষেত্রেগুলিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তার কারণ ও ফলাফল পর্যালোচনা করা দরকার। সেগুলি হচ্ছে-১। উপার্জন২। কৃষি৩। শিল্প ও শ্রমিক এবং৪। ব্যবসা-বাণিজ্য
উপার্জন : ইসলামী রাষ্ট্র অবশ্যই ব্যক্তির উপার্জনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। উপার্জনের পথ ও পদ্ধতি হালাল বা বৈধ হতে হবে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সমস্ত সম্পদ ইসলামী সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেবে। কেননা সব অবৈধ পন্থাই হচ্ছে হারাম বা মুনকার এবং মুনকার নির্মূল করা ইসলামী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সরকার সুদ, ঘুষ, জুয়া,কালোবাজারী, মজুতদারী, চোরাকারবারী ইত্যাদি সকল হারাম উপায়ে উপার্জনের পথ রুদ্ধ করে দেবে। সরকার এজন্যে আইনের কঠোর ও ত্বরিৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অপরদিকে যদি অন্যের জমি, সম্পত্তি বা অর্থে কেউ জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে আত্মসাৎ করে থাকে তবে তা উদ্ধার করে প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেবে। তা সম্ভব না হলে ঐ ধন-সম্পদ বায়তুলমালে জমা হবে। এমনকি কোন শাসনকর্তা বা সরকারী কর্মচারী পদের সুযোগ নিয়ে বিত্ত-সম্পত্তি করলে তাও সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। যদি এ কাজ না করা হয়, তবে সমাজে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার অব্যাহত থাকবে। পরিণামে তা রাষ্ট্র ও সমাজের অকল্যাণ ও মারাত্মক দুর্গতি ডেকে আনবে।
কৃষি : কৃষির স্বার্থে বর্গাচাষের শর্ত ও পদ্ধতির কারণে কৃষক যেন অত্যাচারিত না হয় সে বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবিশেষ সতর্ক থাকতে বলেছেন। উপরন্তু জমি যেন অনাবাদী ও পতিত পড়ে না থাকে সে ব্যবস্থা করা সকরকারেই দায়িত্ব। জমির উৎপাদন ক্ষমতা, পরিমাণ ও গুণাগুণের ভিত্তিতে খারাজ নির্ধারণ করা হবে। ট্যাক্স জনগণের জন্যে দুর্বিষহ ভারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিনা তাও যাচাই করে দেখতে হবে সরকারকেই। কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে কৃষককে সাহায্য করা দরকার। কৃষিপণ্যের বাজার, মূল্য ও সরবরাহের উপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে তেমনি কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায়সঙ্গত দাম হতে বঞ্চিত হবে। তাছাড়া মূল্য বেড়ে গিয়ে জনগণের ও অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
সরকারের অপর অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে মীরাস বা উত্তরাধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করা। বিশেষত :ইয়াতীম ও স্ত্রীলোক এই বিধানের সুফল পাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। বর্তমানে সমাজে ন্যায্য প্রাপ্য হতে ওয়ারিশরা প্রায়ই বঞ্চিত হয়। সৎভাই-বোনেরা বিতাড়িত হয়। এর কারণ মীরাসী আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব। এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। পক্ষপাতহীন শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই এই দুর্নীতি দমনে করা সম্ভব। অসিয়ত ও ওয়াকফকৃত জমি যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সরকারকেই।
শ্রমিক : রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশের প্রেক্ষিতে একথা বুঝতে বাকী থাকার কথা নয় যে, ইসলামী সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় নিশ্চিত করা। তাদের উপর যাতে জুলুম না হতে পারে তার যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শ্রমিকদের মজুরী যেন তাদের জীবন-যাপনের জন্যে উপযুক্ত হয় তা দেখাও সরকারে দায়িত্ব। শ্রমিকদের জন্য সরকার একটা নিন্মতম মজুরী নির্ধারণ করে দেবে। শিল্পমালিকেরা এই মজুরী দিতে বাধ্য থাকবে। বাস্তবতার আলোকেই সরকার শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধা দানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন করবে। শ্রমিকদের নায্য অধিকার সংরক্ষণ, বাসস্থান, চিকিৎসা, বোনাস ইত্যাদির সুবিধাও এই আইনে থাকবে। এসব আইনের উদ্দেশ্যে হবে শ্রমিকদের সত্যিকার স্বার্থ রক্ষা করা।
ব্যবসা-বাণিজ্য : ব্যবসায়ের সব অবৈধ ও অন্যায় পথ এবং প্রতারণামূলক কাজ নিষিদ্ধ করাই শুধু ইসলামী সরকারের দায়িত্ব নয় বরং তা যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তাও দেখা কর্তব্য। ইহতিকার অর্থাৎ অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুদ রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। ওজনে কারচুপিও তাই। এ সমস্তই প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। না হলে জনসাধারণ ক্রমাগত ঠকতে থাকবে। এর প্রতিবিধানের জন্যে হিসবাহ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কায়েম হয়েছিল। এ থেকেই উপলব্ধি করা যায় সমাজকে তথা মানব চরিত্রকে কত গভীলভাবে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাঝে মাঝে বাজার পরিদর্শনে যেতেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে দোকানদারদের কার্যক্রম লক্ষ্য করতেন। এ থেকেই বোঝা যায় বাজার ব্যবস্থার উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে। পরবর্তীকালে আমীরুল মুমিনীন উমর (রা) একাজ করতেন। এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে বাজার যেন স্বাভাবিক নিয়মে চলে। মজুতদারী, মুনাফাখারী, ওজনে কারচুপি, ভেজাল দেওয়া, নকল করা প্রভৃতি বাজারে অনুপ্রবেশের সুযোগ না পায়। পন্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ চলাচলের উপর বিধি-নিষেধও সম্ভবপর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ তুলে নিতে হবে। কারণ, খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অবাধ চলাচলের উপর বাধা-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলেই কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয় ও দুর্নীতির পথ প্রশস্ত হয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক করার জন্যে সরকারকে সুষ্ঠু ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
যে কোন উত্তম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচায়ক হচ্ছে তার সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্যে গৃহীত ব্যবস্থা। প্রচলিত সমস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শে এজন্যেই সমাজকল্যাণের কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সে সবের কোনটিই ইসলামের সমকক্ষ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামেই জনকল্যাণের জন্যে সর্বপ্রথম সর্বাত্মক জোর ও সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে শুধু আল-কুরআনে ও হাদীস শরীফে যে নির্দেশ রয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে গোটা সমাজব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হওয়া সম্ভবপর। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আপন আপন মর্জি-মাফিক যতটুকু করতে ইচ্ছুক ততটুকুই মাত্র জনসাধারণ পেতে পারে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রে একদলীয় সরকারের নিজস্ব নীতি ও প্রয়োজন অনুসারে জনকল্যাণমূলক নীতি গৃহীত হয়ে থাকে। এর কোনটিই পূর্ণাংগ ও সুষ্ঠ হতে পারে না।
জনকল্যাণের জন্যে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ছাড়াও ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। ব্যক্তিকেও নিজস্ব সামর্থ ও যোগ্যতা অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তির ধন-সম্পত্তিতে অন্যেরও হক বা অধিকার রয়েছে। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-
উপরের আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, কোন ব্যক্তির উপার্জিত অর্থে তার নিজের ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের অন্যান্য অভাবগ্রস্তদের অধিকার রয়েছে। কোন ব্যক্তি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয় এবং তার আত্মীয়দের মধ্যে কেউ প্রয়োজনের চেয়ে কম উপার্জন করে তাহলে সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ আত্মীয়কে সাহায্য করা তার সামাজিক দায়িত্ব। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ এমন না থাকলে প্রতিবেশী বা পরিচিতদের মধ্যে অভাবগ্রস্ত বা প্রয়োজন পূরণে অক্ষম ব্যক্তিকে সাহায্য করা ঐ ব্যক্তির পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। এমন ব্যাপকভাবে প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নির্দেশ পৃথিবীর আর কোন ধর্মে বা মতাদর্শে ইসলামের পূর্বেও দেওয়া হয়নি, পরেও না। বস্তুত: এই নির্দেশের মধ্যে পারষ্পরিক সাহায্য, সহযোগিতা ও সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব অনুভূতির প্রেরণা রয়েছে।
জনকল্যাণমূলক কাজের উদ্দেশ্যে ও সমাজের সাধারণ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের জন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন- যাকাত ও বায়তুলমাল। যাকাত কারা দেবে, কিভাবে তা আদায় হবে এবং কারা যাকাতের হকদার সে সম্পর্কে ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে বায়তুল মাল সৃষ্টির উদ্দেশ্য, এর অর্থের উৎস ও ব্যয়ের খাত প্রভৃতি সম্বন্ধেও বলা হয়েছে। ইসলামী সমাজে বায়তুলমাল ও যাকাত একযোগে যে বিপুল সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে এবং দু:স্থ, দারিদ্রপীড়িত, অক্ষম, বৃদ্ধ, পঙ্গু, বিধবা ও ইয়াতীম শিশুদের যে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে তা আর কোনভাবেই সম্ভব নয়। ইসলাম পূর্ব যুগের কোন সমাজে তা ছিল না, এখনও নেই।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসন লোক ঢোকানোর জন্যে সমস্যার সাময়িক উপশম করতে পারে বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ সাধন হয় না। স্বেচ্ছায় মানুষ যখন কোন কাজে সাড়া দেয় এবং অংশ গ্রহণ করে তখন যে দুর্বার শক্তির সৃষ্টি হয় তার মুখে কোন বাধাই যেমন বাধা নয়, তেমনি কোন কাজই কঠিন নয়। যাকাত ও বায়তুলমাল ছাড়াও মীরাসী আইনের প্রয়োগ, মানবিক শ্রমনীতির প্রবর্তন, সম্পত্তিতে নারীরা অধিকারের প্রতিষ্ঠা, করযে হাসানার বিধান এবং উপার্জন ভোগ-বন্টন প্রভৃতি ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য নির্দেশ একদিকে বহু সামাজিক অনাচারের পথ যেমন চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ও জনসাধারণের দীর্ঘ মেয়াদী কল্যাণ ও উন্নয়নের পথ সুগম করেছে। বস্তুত : উপরোক্ত বিষয়গুলির সমষ্টিফলই হচ্ছে একটি সুখী, অভাবমুক্ত ও সমৃদ্ধশালী সমাজ। আইয়ামে জাহেলিয়াত ও তার পূর্ববর্তী সমাজ ব্যবস্থাসমূহ হতে ক্রমে ক্রমে যে পংকিলতা ও অনাচার অর্থনীতিতে সংক্রমিত হয়েছিল সেসব দূর করার জন্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশিত পথে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাজ করে গেছেন। তাঁর সে পথ অনুসরণ করেছেন মহান খুলাফায়ে রাশেদীন (রা)। ফলে অর্থনীতিতে সূচিত হয়েছিল বিপ্লব। প্রয়োগ ও সাফল্যে সৃষ্টি হয়েছিল উন্নয়নের গতিবেগ। তারই সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে এক সুখী ও সমৃদ্ধশালী, সাহিত্য-শিল্পকলা ও বিজ্ঞানে উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল।
উপরের আলোচনা হতে একথা পরিস্কার হয়ে গেছে যে মানবতার বন্ধু, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী এবং সফলতম সমাজ সংস্কারক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র দশ বছরের প্রচেষ্টায় সমকালীন অর্থনীতিতে এমন পরিবর্তন এনেছিলেন যা ছিল এক কথায় অনন্য। তিনি অর্থনীতিতে এমন পরিবর্তন এনেছিলেন যা ছিল অশ্রুতপূর্ব। এই কর্মসূচীর মাধ্যমেই মাধ্যমেই তিনি একদিকে অত্যাচার ও শোষণের পথ রুদ্ধ করেছিলেন। দাসভিত্তিক অর্থনীতির মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছেন, বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন উৎখাত করেছেন, অবৈধ পথে উপার্জনের মাধ্যমে বিপুল বিত্তের মালিক হয়ে সাধারণ লোকের উপর ছড়ি ঘোরাবার পথ রুদ্ধ করেছেন, সুদের মত ঘৃণ্য প্রথার মাধ্যমে জোঁকের মত সমাজদেহ হতে জীবনীশকক্তি শুষে নেবার পথ ধ্বংস করেছেন। এরই পাশাপাশি যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিটি নাগরিকের আর্থিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করে আপামর জনসাধারণের জীবনে যে স্বস্তি ও নিরাপত্তা বিধান করেছেন সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে তার তূল্য কোন নজীর নেই।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবী মুসা (আ) আল্লাহর সংগে তুর পাহাড়ে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাঁর কাছ থেকে দশ দফা নির্দেশ পেয়েছিলেন। খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে এই দশ দফা নির্দেশ বা Ten Commandments এর উল্লেখ রয়েছে। এরপর দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় নানা জনে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ-প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা ধরণের কর্মসূচী দিয়েছেন, সমাজ জীবনে কোন না কোন দিকের সংস্কার বা উন্নয়নের জন্য দিয়েছেন নানা দফা বা দিক নির্দেশনামূলক প্রস্তাব। পৃথিবীর বহু রাজনীতিবীদ, সমাজ সংস্কারক, অর্থনীতিবিদ তাদের প্রস্তাবিত দফার সাফল্য জীবদ্দশায় দেখে যাওয়া দুরে থাক সেসবের বাস্তবায়ন পর্যন্ত করে যেতে পারেননি। কিন্তু আল্লাহর হাবীব ছিলেন পৃথিবীর সকল কালের সকল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সফল রাষ্ট্রনেতাও সমাজ সংস্কারক। তিনি যে দশ দফা কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়নও করে দেখিয়েছেন। এখানেই তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তাঁর অসাধারণ সাফল্য।
বিশ্বের বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষ তাঁর গৃহীত অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে যে শোষণমুক্ত নবজীবন লাভ করেছিল, have nots আর have দের যের দূরতিক্রম্য ব্যবধান অপসারিত হয়েছিল, রাষ্ট্রেরই পক্ষপুটে অসহায়দের আশ্রয়ের যে অভাবিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর আর কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেই তার কোন নজীর নেই। পরিতাপের বিষয় আজকের মুসলমান আত্মভোলা, নিজেদের ইতিহাস বিস্মৃত। সে বিজাতীয় জীবনাদর্শ ও কর্মকৌশল আকঁড়ে ধরে ভুল পথে উন্নতি লাভের চেষ্টা করছে। ফলে না তার ইহজাগতিক উন্নতি হচ্ছে, না তার আখিরাতের জীবনের কল্যাণ হচ্ছে। এই অবস্থা হতে পরিমাণ পেতে হলে নিজেদের স্বকীয়তা নিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে, সামনে এগুবার জন্যে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশ দফা অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তার পক্ষে সম্ভব ইহজাগতিক কল্যাণ একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদশিত জীবন ব্যবস্তা অনুসরণেই তার মুক্তি এই বোধ-বিশ্বাসে তাকে উজ্জীবিত হতে হবে। তবেই ইহকালীন সাফল্যের সাথে নিশ্চিত হবে তার পারলৌকিক মুক্তি।
সমাপ্ত
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/476/12
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।