HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম

লেখকঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর নিমিত্ত। সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয়তম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, তাঁর পরিজন, সহচর, আল্লাহর সকল নবী-রাসূল ও প্রকৃত অনুসারীদের জন্য।

১৯৭৮ খৃস্টাব্দে আমেরিকার কলরাডো (Colorado) রাষ্ট্রের কলরাডো স্প্রীংস (Colorado springs) শহরে (north American conference on muslim evangelization): ‘মুসলিমদের খৃস্টান বানানো বিষয়ে উত্তর আমেরিকান সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে মিশনারিগণ পরবর্তী অর্ধশতকের মধ্যে বাংলাদেশ-সহ এশিয়ার কয়েকটি মুসলিম দেশকে খৃস্টান-প্রধান দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা নেন। তারা প্রচার-পদ্ধতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদেরকে মুসলিম, ঈসায়ী তরীকার মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়া, ধর্মান্তরিতদের নামায-রোযা, ঈদ-মীলাদ বহাল রাখতে বলা.. ইত্যাদি। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সহস্রাধিক প্রচারক একনিষ্ঠভাবে কর্ম করে চলেছেন। ৫০ বৎসর আগে বাংলাদেশে কয়েক হাজার খৃস্টান ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লক্ষ মুসলিম খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়।

প্রত্যেকেরই অধিকার আছে নিজ ধর্ম প্রচার করার। কিন্তু অন্যদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা বা নিজের বিশ্বাস গোপন করে প্রতারণা করা আপত্তিকর। সকল সম্প্রদায়ের ন্যায় খৃস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ভাল মানুষ রয়েছেন, কুরআনে তাঁদের প্রশংসা করা হয়েছে (মায়িদা: ৮২)। কিন্তু খৃস্টধর্মের প্রাণপুরুষ সাধু পল মিথ্যার মাধ্যমে ধর্মপ্রচার পূণ্যকর্ম বলে গণ্য করেছেন। তিনি বলেন: "For if the truth of God hath more abounded through my lie unto his glory; why yet am I also judged as a sinner?" কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি ঈশ্বরের সত্য তাঁহার গৌরবার্থে উপচিয়া পড়ে, তবে আমিও বা এখন পাপী বলিয়া আর বিচারিত হইতেছি কেন?” (রোমান ৩/৭)। এজন্য মিথ্যাচার অনেক প্রচারকের মূলনীতিতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বত্র ঈসায়ী প্রচারকগণ যা বলছেন তার মধ্যে রয়েছে: তাওরাত-ইঞ্জিল না পালন করে কোনো মুসলিম মুক্তি পাবে না। আমরা নাসারা-খৃস্টান নই; আমরা মুসলিম, আমরা ঈসায়ী মুসলিম। আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মান্য করি, কুরআন ও সকল ধর্মগ্রন্থ মান্য করি। শুধু ঈসায়ী তরীকা গ্রহণ করি। শুধু ভক্তির জন্য ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বলি। আমরা বাইবেল মানি না; বরং কিতাবুল মোকাদ্দস মানি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু আরবদের সতর্ক করতে এসেছিলেন, আর ঈসা মাসীহ বিশ্বের পাপীদের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন। ঈসা মাসীহ যেহেতু আবার আসবেন; কাজেই তার উপর ঈমান এনে আগেই প্রস্তুতি নেওয়া ভাল। ঈসা মাসীহ জীবিত কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত; জীবিতের কাছেই যেতে হবে। ঈসা মাসীহ জীবিতকে মৃত করেছেন কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করেন নি; কাজেই ঈসা মাসীহই বড়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ খুন করেছেন; কাজেই তিনি শান্তির দুত নন; ঈসা মাসীহ শান্তির দূত! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপী, কাজেই তিনি কিয়ামতে শাফা‘আত করতে পারবেন না; ঈসা মাসীহ নিষ্পাপ, তিনিই শাফা‘আত করবেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃদ্ধ বয়সে কিশোরী মেয়ে বিবাহ করেন, কাজেই তাঁর চরিত্র ভাল ছিল না। (নাঊযু বিল্লাহ!) .... এ জাতীয় আরো অনেক নোংরা কথা।

এ সকল কথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে এবং মুসলিমদের আহত করছে। বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও তথ্যভিত্তিক আলোচনায় রূপান্তরিত না করলে যে কোনো সময় হানাহানির রূপ নিতে পারে। কারণ, বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক করতে অক্ষম হলে মানুষ আবেগ তাড়িত হয়ে শক্তির আশ্রয় নিতে পারে। এজন্য এ পুস্তিকাটির রচনা। যেমন সমাজের আলিম, তালিবুল ইলম এবং সাধারণ যে কোনো মুসলিম কুরআন, হাদীস ও তাওরাত-ইঞ্জিল-এর আলোকে ঈসায়ী প্রচারকদের সাথে তথ্যভিত্তিক ও জ্ঞানবৃত্তিক আলোচনা করতে পারেন।

অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। আল্লাহ বলেন: “আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না।” (আন‘আম: ১০৮)। “তোমরা উত্তম ও সৌজন্যময় পন্থা ব্যতীত কিতাবীগণের (ইয়াহূদী-খৃস্টানগণের) সাথে বিতর্ক করো না, তবে তাদের সাথে করতে পার যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘন করে।” (আনকাবূত: ৪৬)। সারা বিশ্বে ঈসায়ী পোপ, পাদরি ও পণ্ডিতগণ ঘৃণ্য সিনেমা, কার্টুন, প্রচারণা ও বইপুস্তক লিখে এবং প্রচারকগণ মাঠে ময়দানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে নোংরা কথা বলে মুসলিমদের অনুভূতিকে আহত করছেন। কিন্তু কুরআনের নির্দেশে আমরা আমাদের মারাত্মকভাবে আহত অনুভূতিকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ এবং খৃস্টান পণ্ডিতদের বক্তব্যের আলোকেই প্রচারকদের বক্তব্য পর্যালোচনা করেছি।

খৃস্টানগণ এতদিন ঈশ্বর, ভাববাদী, যীশু খৃস্ট ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন। বর্তমানে আল্লাহ, নবী, ঈসা মাসীহ, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। আমি উভয় প্রকারের পরিভাষা ব্যবহার করেছি। বাংলা বাইবেলের কেরির অনুবাদই মূল ইংরেজির নিকটবর্তী, কিন্তু ভাষা দুর্বোধ্য। মুসলমানী অনুবাদগুলিতে মূলত মুসলিমদের ধর্মান্তর করার দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে। ফলে অনেক স্থানেই মূল অর্থ বিকৃত হয়েছে। এজন্য ইংরেজি বাইবেল সামনে রেখে মূলত কেরির বাংলা বাইবেল এবং প্রয়োজনে কিতাবুল মোকাদ্দস ও অন্যান্য বাংলা অনুবাদের সাহায্য গ্রহণ করেছি এবং প্রয়োজনে তুলনার জন্য ইংরেজি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি।

গ্রীক biblion, ল্যাটিন biblia ও ইংরেজি bible শব্দটির অর্থ গ্রন্থাবলি বা গ্রন্থমালা। মূল গ্রীক বাইবেল বা ক্যাথলিক বাইবেলের পুস্তকের সংখ্যা ৭৩টি। প্রটেস্ট্যান্ট খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার: Martin Luther (১৫২৯ খৃ) ৭টি পূর্ণ বইকে জাল বলে বাতিল করেন। বাকি বইগুলি থেকেও অনেক অধ্যায় ও আয়াত জাল বলে বাতিল করেন। এজন্য প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে বইয়ের সংখ্যা ৬৬টি। ক্যাথলিক বাইবেল বাংলায় ‘পবিত্র বাইবেল: জুবিলী বাইবেল’ নামে অনূদিত এবং বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী ১৯৯৯, ২০০৬ কর্তৃক প্রকাশিত। প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলটি ‘পবিত্র বাইবেল’ নামে প্রথম উইলিয়াম কেরি কর্তৃক অনূদিত ও বিভিন্ন সময়ে পরিমার্জিত ও বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি (বি. বি. এস.) কর্তৃক প্রকাশিত। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি সর্বশেষ বাইবেলকে ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ নামে প্রকাশ করেন। এতে বাইবেলের বইগুলির নামও পরিবর্তন করা হয়। এজন্য এখানে বাইবেলের বইগুলির নামের তালিকা এ পুস্তিকার শেষে দেওয়া হলো।

ত্রিত্ববাদী আকীদা, খৃস্টান প্রচারকদের সীমালঙ্ঘন এবং কিতাবুল মোকাদ্দসের বিকৃতি বুঝাতে তাদের অনেক কুফরী আকীদা বা বক্তব্য উদ্ধৃত করতে বাধ্য হয়েছি। লেখার সময় মুখে বারবার (নাউযূ বিল্লাহ) বললেও সর্বত্র লিখতে পরিনি। পাঠক এগুলি পাঠের সময় অবশ্যই বারংবার নাউযূ বিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ বলে হৃদয়কে পবিত্র করবেন।

বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গবেষণা সহজ হয়েছে। খৃস্টধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন নাম ও শব্দের ইংরেজি বানান অনেক সময় বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করেছি, যেন আগ্রহী পাঠক এ সকল শব্দ ইংরেজিতে লিখে সার্চ করে খৃস্টান লেখকদের বক্তব্য থেকেই আমাদের উপস্থাপিত তথ্যের বিশুদ্ধতা ও এ বিষয়ক অন্যান্য তথ্য জানতে পারেন।

আল্লাহর মহান রাসূল ঈসা (আ)-এর বিরুদ্ধে এবং রাহমাতুল্লিল আলামীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে অশোভন নিন্দামূলক (blasphemous) অপপ্রচারের প্রতিরোধে এ সামান্য প্রচেষ্টাকে মহান আল্লাহ আমার, আমার পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান, সকল পাঠক ও দীনের সকল প্রচারকের নাজাতের উপকরণ হিসেবে কবুল করুন। আমীন!

১. ঈসা মাসীহের ধর্মে মিথ্যার অনুপ্রবেশ: ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন
খৃস্টধর্মে মিথ্যার অনুপ্রবেশের বড় প্রমাণ ২৫শে ডিসেম্বরকে বড়দিন (ক্রিসমাস : Christmas) বা ঈসা মাসীহের জন্মদিন বলে বিশ্বাস, প্রচার ও উদযাপন করা। অথচ ঈসা মাসীহ ২৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছেন- কথাটি যেমন শতভাগ অসত্য, তেমনি এ দিবসটি পালন করা ঈসা মাসীহের শিক্ষা— এ কথাও শতভাগ অসত্য। এ দুটি মহা অসত্য-ই এখন “ঈসায়ী তরীকা”-য় পরিণত হয়েছে।

খৃস্টধর্মের সর্বোচ্চ গুরু পোপ বেনিডিক্ট ১৬ (Benedict XVI) স্বয়ং “Jesus of Nazareth: The Infance Narratives” নামে একটি পুস্তক রচনা করেছেন, যাতে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ২৫ শে ডিসেম্বর ঈসা মাসীহের জন্মদিন হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। পাঠক ইন্টারনেটে পোপের নাম বা বইটির নাম দিয়ে সার্চ করলেই বইটি পেয়ে যাবেন।

এ মিথ্যার সাথে সংযুক্ত হয়েছে “বিদ‘আত” বা উদ্ভাবন। ঈসা মাসীহের জন্ম যে দিনই হোক না কেন, দিনটি উদযাপন করার কোনোরূপ নির্দেশনা ইঞ্জিলে নেই। খৃস্টান গবেষকগণ একমত যে, যীশুর পরের ৩০০ বৎসর পর্যন্ত কোনো খৃস্টান কখনোই যীশুর জন্মদিন পালন করেন নি। ঈসা মাসীহ নিজে এবং পরবর্তী ৩০০ বৎসরের খৃস্টানরা যা পালন করলেন না সেটিকে “ঈসায়ী তরীকা” বা “খৃস্টধর্ম” নামে প্রতিষ্ঠা করা হলো। মাইক্রোসফট এনকার্টায় ক্রিসমাস আর্টিকেলের বক্তব্য:

Historians are unsure exactly when Christians first began celebrating the Nativity of Christ. However, most scholars believe that Christmas originated in the 4th century as a Christian substitute for pagan celebrations of the winter solstice. “ঠিক কবে থেকে যীশুর জন্মদিন উদযাপনের জন্য খৃস্টানগণ ক্রিসমাস পালন শুরু করেন সে বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ নিশ্চিত নন। তবে অধিকাংশ গবেষক বিশ্বাস করেন যে, পৌত্তলিক শীতকালীন উত্তরায়ণ উৎসবের বিকল্প হিসেবে ৪র্থ শতকে ক্রিসমাস পালনের আয়োজন করা হয়।”

পাঠক যে কোনো ইনসাইক্লোপিডিয়া বা ইন্টারনেটে Origin of Christmas বা ক্রিসমাসের উৎপত্তি বিষয়ে পাঠ করলে দেখবেন যে, মূলত রোমান-গ্রীকদের দলে ভেড়ানোর জন্যই খৃস্টান ধর্মগুরুগণ এ উৎসবটির উদ্ভাবন করেন। গ্রীক-রোমান পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারীরা ডিসেম্বরের শেষে ফসলের দেবতা Saturn এবং আলোর দেবতা Mithra-এর পূজা উপলক্ষ্যে ব্যাপক উৎসব করত। পাদরিগণ পৌত্তলিকদেরকে ধর্মে ভিড়ানোর জন্য এ সময়ে ক্রিসমাস উৎসব চালু করেন। তারা বলতে চান, আমরাও তো তোমাদের মতই একই ধর্মের মানুষ এবং একই উৎসব করি। যেমন মুসলিমদেরকে তারা বলেন: ‘আমরাও মুসলিম, ঈসায়ী মুসলিম!

বড়দিনের আরেকটি জালিয়াতি “সান্তা ক্লজ” (Santa Claus)। সারা বিশ্বে খৃস্টানগণ বিশ্বাস ও প্রচার করেন যে, ক্রিসমাস-রাত্রিতে সান্তা ক্লজ প্রত্যেক খৃস্টান বাড়িতে যেয়ে ক্রিসমাসের দোয়া-উপহার রেখে আসেন। বিশেষত “ভাল” ছেলেমেয়েদের পায়ের মোজার মধ্যে উপহার রেখে আসেন! যুগযুগ ধরে এ মিথ্যাটি খৃস্টানগণ জেনেশুনেই বলেন। এ পুরো কাহিনীই বানোয়াট।

সম্মানিত পাঠক, ঈসায়ী প্রচারককে বলুন: যে মিথ্যা কথাটি ব্যবসা, সমাজ বা রাজনীতিতে বললে ফৌজদারি অপরাধ ও শাস্তি হতো, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর মিথ্যা আপনারা ধর্মের নামে বলছেন!! আপনি যে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ প্রচার করছেন সে গ্রন্থেও তো মিথ্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে: “তোমরা চুরি করিও না এবং আপন আপন স্বজাতীয়কে বঞ্চনা করিও না, ও মিথ্যা বলিও না।” (লেবীয় ১৯/১১)। আপনার ইঞ্জিলের শেষ বইয়েও বলা হয়েছে যে, মিথ্যার শাস্তি অনন্ত জাহান্নাম: “কিন্তু জ্বলন্ত আগুন ও গন্ধকের হ্রদের মধ্যে থাকাই হবে ভীতু, বেঈমান, ঘৃণার যোগ্য, খুনী, জেনাকারী, জাদুকর, মূর্তিপূজাকারী এবং সব মিথ্যাবাদীদের শেষ দশা। এটাই হল দ্বিতীয় মৃত্যু।” (প্রকাশিত বাক্য/কালাম ২১/৮)। আসুন না আমার সত্য বলি!

২. ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ বনাম ‘তওরাত-যাবূর-ইঞ্জিল’ কিতাব
আমরা দেখেছি যে, তিনটি দাবির উপর ঈসায়ী প্রচারণার ভিত্তি: (১) প্রচলিত কিতাবুল মোকাদ্দসকে ‘প্রকৃত তাওরাত-ইঞ্জিল’ বলে দাবি করা, (২) প্রচলিত খৃস্টধর্মকে ঈসা মাসীহের প্রকৃত ধর্ম বলে দাবি করা এবং (৩) খৃস্টধর্মকে বিশ্বধর্ম বলে দাবি করা। প্রথম দাবির অসারতা অনুধাবন করতে নিম্নের বিষয়গুলি অনুধাবন করুন:

২. ১. বাইবেলের ‘নতুন নিয়ম’-কে ‘ইঞ্জিল’ নামকরণ
বাংলাদেশে খৃস্টান প্রচারকগণ “ইঞ্জিল শরীফ” নামের একটি পুস্তক প্রচার করেন। ইঞ্জিল শব্দটির ইংরেজি ইভানজেল (evangel)। শব্দটি প্রাচীন গ্রীক (euaggelion/euaggelos) থেকে গৃহীত। এর অর্থ সুসংবাদ। ইংরেজিতে একে গসপেল (gospel)-ও বলা হয়। খৃস্টান বাইবেলের দ্বিতীয় অংশ “নতুন নিয়ম” (the New Testament)-এর মধ্যে মোট ২৭টি পুস্তক বিদ্যমান। এগুলির মধ্যে মাত্র ৪টি পুস্তককে খৃস্টানগণ “ইঞ্জিল” বলে দাবি করেছেন। এছাড়া বাকি ২৩টি পুস্তককে বিগত ২ হাজার বৎসরে কোনো একজন খৃস্টানও ‘ইঞ্জিল’ বলে দাবি করেন নি। মুসলিমদের সরল বিশ্বাসকে পুজি করে তাদেরকে ধর্মান্তর করার জন্য খৃস্টান প্রচারকগণ ২৭ গ্রন্থের এ পুস্তককে “ইঞ্জিল শরীফ” বলে চালাচ্ছেন। জেনে শুনেই তাঁরা এ মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:

(১) ইংরেজী ভাষায় এ গ্রন্থটির নাম (the New Testament)। আরবী ভাষায় এটির নাম ( العهد الجديد ), যার অর্থ নতুন নিয়ম বা নতুন সন্ধি। বিশ্বের কোনো ভাষাতেই খৃস্টানগণ এটির নাম ‘ইঞ্জিল’ বলে দাবি করেন নি। শুধু সরল মুসলিমদের প্রতারণা করার জন্য বর্তমানে কোনো কোনো মুসলিম দেশে এ বইটিকে “ইঞ্জিল” বলে চালাচ্ছেন তাঁরা। আগ্রহী পাঠক একটু কষ্ট করে যে কোনো ইংরেজি অভিধানে বা ইন্টারনেটে evangel লিখে সার্চ করলেই বিষয়টি জানতে পারবেন।

(২) ২৭টি বইয়ের মধ্যে মাত্র চারটি বইকে খৃস্টানগণ ইঞ্জিল বলে দাবি করেছেন। মূল গ্রীক বা ইংরেজি বাইবেলে এগুলির নাম নিম্নরূপ:

(১) The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Matthew/ The Gospel According To St. Matthew: সাধু মথির মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল

(২) The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Mark/ The Gospel According To St. Mark: সাধু মার্কের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল

(১) The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Luke/ The Gospel According To St. Luke: সাধু লূকের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল

(১) The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. John/ The Gospel According To St. John: সাধু যোহনের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল

পাঠক, নাম থেকেই সহজেই বুঝতে পারছেন যে, এ চারটি পুস্তকও মূলত ইঞ্জিল নয়, বিভিন্ন মানুষের মতে এগুলি ইঞ্জিল বলে কথিত। ঈসা (আ) একটি ইঞ্জিল প্রচার করেছিলেন বলে সকলেই জানত। তবে কারো কাছেই এর কোনো কপি ছিল না। তাঁর তিরোধানের কয়েকশত বৎসর পরে অনেক মানুষ ‘ইঞ্জিল’ লিখে প্রচার করেন যে, এটি ঈসা (আ) এর ইঞ্জিল। এজন্য এগুলির এরূপ নামকরণ করা হয়: ‘অমুকের মতানুসারে এটি ইঞ্জিল’, সঠিক ইঞ্জিল কোনটি তা কেউ জানেন না।

২. ২. “মতানুসারে ইঞ্জিল”-কে “ঈসা নবীর প্রকৃত ইঞ্জিল” বলা
আমরা দেখলাম যে, “ইঞ্জিল শরীফ” নামের পুস্তকটি কখনোই ইঞ্জিল নয়। ২৭টির মধ্যে মাত্র চারটি পুস্তক “মতানুসারে ইঞ্জিল” বলে দাবি করেছেন খৃস্টানগণ।

এ সকল ‘মতানুসারে ইঞ্জিলের’ সাথে ‘ঈসা মাসীহের ইঞ্জিলের’ মুল পার্থক্য ঈসা (আ)-এর উপর নাযিলকৃত মূল ইঞ্জিলটি ছিল আল্লাহর কালাম। আর প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’ চারটির মধ্যে আল্লাহর কোনো কালাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এগুলির মধ্যে ঈসা মাসীহের বক্তব্যও কম। এগুলি মূলত তাঁর জীবনীগ্রন্থ। এগুলির মধ্যে ঈসা মাসীহ বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের গালগল্প সংকলন করা হয়েছে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এরূপ প্রায় অর্ধশত “মতানুসারে ইঞ্জিল” তৃতীয় শতকের খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এগুলির মধ্য থেকে সাধু পলের অনুসারী ত্রিত্ববাদী খৃস্টানগণ কোনোরূপ সুস্পষ্ট সনদ, ভিত্তি বা যুক্তি ছাড়া, শুধু নিজেদের পছন্দের উপর নির্ভর করে এ চারটিকে বাছাই করেন।

খৃস্টান পণ্ডিতদের লেখা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার biblical literature-এর বক্তব্য: As far as the New Testament is concerned, there could be no Bible without a church that created it; yet conversely, having been nurtured by the content of the writings themselves, the church selected the canon. ... Indeed, until c. AD 150, Christians could produce writings either anonymously or pseudonymously—i.e., using the name of some acknowledged important biblical or apostolic figure. The practice was not believed to be either a trick or fraud. ...

“নতুন নিয়মের বিষয়টি হলো যদি চার্চ (ধর্মগুরুদের মণ্ডলী) বাইবেল তৈরি না করত তাহলে কোনো বাইবেলই থাকতো না। অপরদিকে লিখনিগুলির বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে চার্চই বাইবেলের বইগুলি বাছাই করেছে। ... প্রকৃত বিষয় হলো, ১৫০ খৃস্টাব্দের দিকে যে কোনো খৃস্টান নাম প্রকাশ না করে, অথবা কোনো প্রসিদ্ধ বাইবেলীয় ব্যক্তিত্ব বা যীশুর শিষ্যদের নামে বই লিখতে পারত। এরূপ কর্মকে ছলচাতুরি বা প্রতারণা বলে গণ্য করা হতো না! ...”

কি ভয়ঙ্কর কথা! ১০০/১৫০ বৎসর পরে যে কোনো খৃস্টান সম্পূর্ণ মিথ্যাভাবে একটি বই লিখে প্রচার করছে, এটি লূক লিখিত ইঞ্জিল, এটি পিতর লিখিত ইঞ্জিল... এভাবে যীশুর শিষ্যদের বা সাধুদের নামে যে যা পারছে লিখে প্রচার করছে। এরূপ কর্মকে উক্ত ধার্মিক লেখক বা সমাজের অন্য কোনো ধার্মিক খৃস্টান কেউই অন্যায় বা পাপ বলে গণ্য করছেন না! এগুলি সমাজে এভাবে ইঞ্জিল নামে প্রসিদ্ধ হওয়ার আরো ১৫০ বৎসর পর এরূপ ধার্মিক খৃস্টানগণ “যীশুর শিষ্যদের নামে ১৫০ বৎসর পরে অজ্ঞাত ধার্মিক মানুষদের লেখা” অর্ধশত ইঞ্জিল থেকে শুধু বিষয়বস্তুর দিকে তাকিয়ে, বিষয়বস্তুগুলি নিজেদের পছন্দমত কিনা তা দেখে, ৪টি ইঞ্জিল বেছে নিয়ে “নতুন নিয়ম”-এর অন্তর্ভুক্ত করলেন।

মাইক্রোসফট এনকার্টায় Bible আর্টিকেলের বক্তব্য: The 27 books of  the New Testament are only a fraction of the literary production of the Christian communities in their first three centuries. ... As many as 50 Gospels were in circulation during this time. “খৃস্টান সম্প্রদায়গুলি প্রথম তিন শতকে যে সকল ধর্মগ্রন্থ লিখেছিল তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি হলো নতুন নিয়মের ২৭টি বই। তখন ৫০টির মত ইঞ্জিল তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।”

২. ৩. তিন ইঞ্জিল বনাম চার ইঞ্জিল
আমরা জানলাম যে, প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল চারটি’ ২য় শতকের কতিপয় খৃস্টানের পরনামে (pseudonymously) লেখা বই। এগুলির মধ্যে বৈপরিত্যের শেষ নেই। এ চারটির মধ্যে প্রথম তিনটিকে খৃস্টান পণ্ডিত ও ধর্মগুরুগণ Synoptic Gospels বা ‘একমতীয় ইঞ্জিল’ বলে আখ্যায়িত করেন। চতুর্থ যোহন বা ইউহোন্নার মতানুসারে ইঞ্জিলটিকে ব্যতিক্রম বলে গণ্য করেন। প্রথম তিনটির সাথে চতুর্থটির বৈপরীত্য আরো বেশি। খৃস্টান গবেষকগণ প্রায় সকলেই একমত যে, মথি, মার্ক ও লূকের সুসমাচারের উৎস মূল একটি সংক্ষিপ্ত ‘ইঞ্জিল’। হারিয়ে যাওয়া এই মূল ইঞ্জিলটিকে খৃস্টান গবেষকগণ ‘কিউ’ (Q) বলে অভিহিত করেন। জার্মান Quelle শব্দের অর্থ source বা উৎস। যেহেতু এতে শুধু যীশুর বচন সংকলন করা হয়েছিল এজন্য গবেষকগণ একে Logia বলে অভিহিত করেন। (The New Encyclopedia Britannica, 15th Ed, V-10, Jesus Christ, p 146) চতুর্থ ‘মতানুসারে ইঞ্জিলের’ উৎস, ভিত্তি, প্রেক্ষাপট ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খৃস্টান গবেষকদের মত ও ভিন্নমত জানতে যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়াতে “বাইবেল” বিষয়ক প্রবন্ধ অধ্যয়ন করতে পারেন।

২. ৪. ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল কোন্ ভাষায় নাযিল হয়েছিল?
ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল এবং এ সকল ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’-এর মধ্যে অন্যতম পার্থক্য ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল ছিল (Hebrew-Aramaic) হিব্রু-আরামিক ভাষায়। কিন্তু প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’-গুলি গ্রীক ভাষায় লেখা। সাধু পলের অনুসারীরা যীশুর পরে ১০০ বৎসরের মধ্যেই তাঁর আসল হিব্রু ইঞ্জিল গুম করে দেন।

খৃস্টান প্রচারকগণ “বাংলা”-য় ‘ইঞ্জিল শরীফ’ প্রচার করেন। আপনি তাকে বলুন: আপনার হাতের ইঞ্জিলটি তো বাংলায় লেখা! ঈসা মাসীহ কি বাঙালী ছিলেন? তা না হলে তিনি কোন্ ভাষায় কথা বলতেন? খৃস্টান প্রচারক স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ঈসা মাসীহ হিব্রু-আরামিক ভাষায় কথা বলতেন। আপনি তাকে বলুন: হিব্রু ইঞ্জিল কোথায়? যীশুর তিরোধানের পর থেকে ৫০০ বৎসরের মধ্যে লেখা একটি হিব্রু ইঞ্জিল যদি আপনি দেখাতে পারেন তবে আপনার ইঞ্জিল সত্য বলে মেনে নেব।

তারা বলেন, ইঞ্জিল গ্রীক ভাষায় লেখা হয়েছিল। কী উদ্ভট কথা! যীশু, তাঁর শিষ্যগণ এবং ফিলিস্তিনের মানুষের মাতৃভাষা এবং ধর্মীয় ভাষা ছিল হিব্রু। তবে সে সময়ে গ্রীকরা ফিলিস্তিন দখল করেছিল। ইয়াহূদীগণ বিজাতীয় ভাষা ঘৃণা করতেন এবং করেন। যীশু কি তাঁর নিজের ও জনগণের মাতৃভাষা ও ধর্মীয়ভাষা বাদ দিয়ে দখলদারদের অপরিচিত ও ঘৃণিত ভাষায় ইঞ্জিল প্রচার করতেন? যীশুর শিষ্যরা কি তাদের মাতৃভাষা ও ধর্মীয়ভাষা বাদ দিয়ে দখলদারদের ভাষায় ইঞ্জিল লিখবেন? কেউ যদি বলে রবীন্দ্র বা নজরুল সাহিত্য ইংরেজিতে রচিত তবে তাকে আপনি কী বলবেন?

বস্তুত এ সকল বেনামী ইঞ্জিলের লেখকগণ অ-ইয়াহূদী রোমান ছিলেন। তাঁরা হিব্রু ভাষা জানতেন না। যীশু হিব্রু ভাষায় ইস্রায়েল বংশের মানুষদের মধ্যে ইঞ্জিল প্রচার করেন। তিনি অ-হিব্রু বা অ-ইয়াহূদীদের কাছে ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেন। সাধু পল দাবি করেন যে, যীশু তাকে পয়গম্বর বানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের খৃস্টানগণ তাঁর দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তখন তিনি দাবি করেন যে, যীশু তাঁকে অ-ইস্রায়েলীয়দের জন্য পয়গম্বর বানিয়েছেন। এভাবে তিনি গ্রীকভাষী মানুষদের মধ্যে তার বানোয়াট ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তিনি বারংবার বলেন, তাঁর নিজের ইঞ্জিল ছাড়া অন্য কোনো ইঞ্জিল, অর্থাৎ যীশুর ইঞ্জিল যদি কেউ প্রচার করে তবে সে অভিশপ্ত (গালাতীয় ১/৬, ৮-৯; ২-করিন্থীয় ১১/৪)। এভাবে ক্রমান্বয়ে তাঁর অনুসারী ত্রিত্ববাদী খৃস্টানগণ (Pauline Christaians) প্রাধান্য লাভ করে এবং একত্ববাদী হিব্রু খৃস্টানগণ (Judeo Christaians) কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সাধু পলের অনুসারী গ্রীক-ভাষী খৃস্টানগণ যীশু খৃস্টের ১০০/১৫০ বৎসর পরে “পবিত্র সাধুদের নামে” নিজেদের মনগড়া ইঞ্জিল লিখতে থাকেন। তাঁরা সমাজে ঈসা মাসীহের নামে প্রচলিত সত্য, মিথ্যা ও নিজের মনগড়া কথা লিখে ‘অমুকের লেখা ইঞ্জিল’ নামে প্রচার করেন।

২. ৫. পবিত্র আত্মার রচনা
খৃস্টান প্রচারকগণ দাবি করেন, পবিত্র আত্মা বা পাক রুহের তত্ত্বাবধানে ‘ইঞ্জিল’ লেখা হয়। এটিও ভিত্তিহীন দাবি ছাড়া কিছুই নয়। নতুন নিয়মে যীশু খৃস্টের শিষ্যদের পত্রে আমরা দেখি যে, তারা পবিত্র আত্মার মাধ্যমে কিছু জানতে পারলে তা উল্লেখ করতেন। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফগুলির কোথাও লেখা নেই যে, এগুলি পবিত্র আত্মার মাধ্যমে লেখা। বরং লূক তার ইঞ্জিলের শুরুতে খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন যে, অনেকেই বিশ্বাসের ভিত্তিতে অনেক ইঞ্জিল লিখেছেন এবং তিনিও শোনা কথার উপর ভিত্তি করে সঠিক কথাগুলি লেখার চেষ্টা করেছেন। (লূক ১/১-৪)।

সর্বোপরি ইঞ্জিলগুলির মধ্যে এত বৈপরীত্য রয়েছে যে, পাক রূহ তো দূরের কথা কোনো নাপাক মানুষও এরূপ পরস্পর বিরোধী কথা লিখতে পারে না। পাঠক যদি প্রচলিত চারটি “মতানুসারে ইঞ্জিল” তুলনা করে অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখবেন যে, চারটি ইঞ্জিলেই যীশু খৃস্টের জীবনের একই ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি ঘটনা চার ইঞ্জিলে পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

১০
২. ৬. কিতাবুল মোকাদ্দস ও ইঞ্জিলের বিকৃতির মজার মজার প্রমাণ
একটি ডকুমেন্ট বা দলিলের মধ্যে যদি সুস্পষ্ট স্ববিরোধী বা সর্বজনবিদিত সত্যের বিপরীত কিছু তথ্য থাকে, তবে অন্য কোনো বিচার ছাড়াই বিচারক তাকে জাল বলে গণ্য করেন। কিতাবুল মোকাদ্দস-এর মধ্যে বিদ্যমান এরূপ কিছু তথ্য দেখুন:

১১
২. ৬. ১. নবীর কিতাবে তাঁরই মৃত্যু ও কবরের গল্প
আমরা জানি যে, তাওরাত মূসা (আ)-এর উপর অবতীর্ণ। অথচ প্রচলিত তাওরাতের দ্বিতীয় বিবরণের ৩৪ অধ্যায়ে মূসা (আ)-এর মৃত্যু, দাফন, কবর. তার উম্মাতের ত্রিশ দিন শোক পালন এবং যুগের আবর্তনের মূসার কবরটি হারিয়ে যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। আর ইঞ্জিলের বিষয় তো আরো অদ্ভূত। আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ ঈসা (আ)-এর উপর ইঞ্জিল নাযিল করেন। ঈসা মাসীহ জীবদ্দশায় ইঞ্জিল প্রচার করেছেন (মথি ৪/২৩, ৯/৩৫, ১১/১৫; মার্ক ১/১৪, ১৫, ৮/৩৫; মার্ক ১০/২৯; লূক ৯/৬)। কিন্তু প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির সবগুলিতেই ঈসা মাসীহের মৃত্যু, কবর, কবর থেকে বের হওয়া... ইত্যাদি বিবরণ বিদ্যমান। পাঠক কি মনে করেন, আল্লাহ মূসার (আ) কিতাবে তার মৃত্যু ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলি এবং ঈসার (আ) কিতাবে তার মৃত্যু ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলির বিবরণ নাযিল করেছিলেন?

১২
২. ৬. ২. কার অজ্ঞতায় এ বিভ্রাট? পবিত্র আত্মার না বেনামি লেখকের?
(ক) ৩, ৫ ও ১০-এর বিভ্রাট

বনী ইস্রায়েলের মূল পিতা ইসরায়েল (ইয়াকুব আ)-এর ১২ পুত্রের একপুত্র বিন্যামীন (বিন্ইয়ামীন)। তাঁর পুত্রগণের বিষয়ে সাংঘর্ষিক বর্ণনা লক্ষ্য করুন:

১-বংশাবলি ৭/৬: “বিন্যামীনের সন্তান- বেলা, বেখর ও যিদীয়েল, তিন জন।”

পক্ষান্তরে ১-বংশাবলি ৮/১: “বিন্যামীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বেলা, দ্বিতীয় অস্বেল, তৃতীয় অহর্হ, চতুর্থ নোহা ও পঞ্চম রাফা।”

কিন্তু আদিপুস্তক ৪৬/২১: “বিন্যামীনের পুত্র বেলা, বেখর, অস্বেল, গেরা, নামন, এহী, রোশ, মুপ্পীম, হুপ্পীম ও অর্দ।”

বিন্যামিনের সন্তান সংখ্যা প্রথম বক্তব্যে তিনজন এবং দ্বিতীয় বক্তব্যে পাঁচজন। তাদের নামের বর্ণনাও পরস্পর বিরোধী, শুধু বেলার নামটি উভয় শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাকিদের নাম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর তৃতীয় শ্লোকে বিন্যামীনের সন্তান সংখ্যা দশজন। নামগুলিও আলাদা। তৃতীয় শ্লোকের নামগুলির সাথে প্রথম শ্লোকের সাথে দুজনের নামের এবং দ্বিতীয় শ্লোকের দুজনের নামের মিল আছে। আর তিনটি শ্লোকের মিল আছে একমাত্র “বেলা” নামটি উল্লেখের ক্ষেত্রে।

(খ) মাত্র তিন লক্ষের হেরফের!

দায়ূদের নির্দেশে তাঁর সেনাপতি যোয়াব লোকসংখ্যা গণনা করেন। এ বিষয়ে শমূয়েলের দ্বিতীয় পুস্তকের ২৪ অধ্যায়ের ৯ম শ্লোকটি নিম্নরূপ: “পরে যোয়াব গণিত লোকেদের সংখ্যা রাজার কাছে দিলেন; ইস্রায়েলে খড়্গ-ধারী আট লক্ষ বলবান লোক ছিল; আর যিহূদার পাঁচ লক্ষ লোক ছিল।”

অপর দিকে বংশাবলি প্রথম খন্ডের ২১ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোক নিম্নরূপ: “আর যোয়াব গণিত লোকদের সংখ্যা দায়ূদের কাছে দিলেন। সমস্ত ইস্রায়েলের এগার লক্ষ খড়্গধারী লোক, ও যিহূদার চারি লক্ষ সত্তর সহস্র খড়্গধারী লোক ছিল।”

প্রথম বর্ণনায় ইস্রায়েলের যোদ্ধাসংখ্যা ৮ লক্ষ এবং যিহূদার ৫ লক্ষ। আর দ্বিতীয় বর্ণনামতে ১১ লক্ষ ও ৪ লক্ষ ৭০ হাজার। উভয় বর্ণনার মধ্যে বৈপরীত্যের পরিমাণ দেখুন! ইস্রায়েলের জনসংখ্যা বর্ণনায় মাত্র ৩ লক্ষের কমবেশি এবং যিহূদার জনসংখ্যার বর্ণনায় ত্রিশ হাজারের কমবেশি। পবিত্র আত্মার কারসাজি?!

(গ) ভুলটি কার? যীশুর? পবিত্র আত্মার? না বেনামি লেখকের?

মার্ক লিখেছেন ২/২৫-২৬: “তিনি (যীশু) তাহাদিগকে (ইয়াহূদী ফরীশীগণকে) কহিলেন, দায়ূদ ও তাঁহার সঙ্গীরা খাদ্যের অভাবে ক্ষুধিত হইলে তিনি যাহা করিয়াছিলেন, তাহা কি তোমরা কখনো পাঠ কর নাই? তিনি ত অবিয়াথর মহাযাজকের সময়ে ঈশ্বরের গৃহে প্রবেশ করিয়া, যে দর্শন-রুটী যাজকবর্গ ব্যতিরেকে আর কাহারও ভোজন করা বিধেয় নয়, তাহাই ভোজন করিয়াছিলেন, এবং সঙ্গিগণকেও দিয়াছিলেন।”

১ শমূয়েল ২১ ও ২২ অধ্যায় থেকে প্রমাণিত যে, এ কথাটি ভুল। কারণ ‘দর্শন-রুটী’ ভোজন করার সময় দায়ূদ ‘একা’ ছিলেন, তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। কাজেই ‘ও তাঁহার সঙ্গীরা’ এবং ‘সঙ্গিগণকেও দিয়াছিলেন’ দুটি কথাই ভুল। এছাড়া এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট মহাযাজকের নাম ছিল ‘অহীমেলক’। ‘অবিয়াথর’ এ সময়ে যাজক ছিলেন না। অর্থাৎ যীশু অথবা পবিত্র আত্মা কিতাবুল মোকাদ্দস জানতেন না!

অন্যত্র ঈসা মাসীহ বলেছেন: “আর স্বর্গে কেহ উঠে নাই; কেবল যিনি স্বর্গ হইতে নামিয়াছেন, সেই মনুষ্যপুত্র, যিনি স্বর্গে থাকেন।” (যোহন ৩/১৩) তাওরাতের ভাষ্যে এ কথাটি ভুল। কারণ হনোক (Enoch: ইদরীস) এবং এলিয় (Eli'jah: আল-ইয়াসা’) উভয়ে স্বর্গে গমন করেছেন (আদিপুস্তক ৫/২৩-২৪; ২ রাজাবলি ২/১-১১।) অর্থাৎ যীশু বা ইঞ্জিল লেখক পবিত্র(!) আত্মা ‘আল্লাহর কালাম’ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন।

যীশুর পিতামাতা তাঁকে নিয়ে মিসর থেকে ফিলিস্তিনে ফিরে নাসরৎ নামক শহরে বসবাস করতে থাকেন। এ বিষয়ে মথি বলেন: “এবং নাসরৎ নামক নগরে গিয়া বসতি করিলেন; যেন ভাববাদিগণের দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হয় যে, তিনি নসরতীয় বলিয়া আখ্যাত হইবেন।” (মথি ২/২৩) ইঞ্জিলের এ কথাটি অসত্য; কোনো ভাববাদীর কোনো পুস্তকেই এ কথা নেই। কিন্তু পবিত্র আত্মা তা জানতেন না!

ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা ৩০ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে যীশুকে ইয়াহূদীদের কাছে ধরিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে মথি বলেন ২৭/৯: “তখন যিরমিয় ভাববাদী দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হইল, ‘আর তাহারা সেই ত্রিশ রৌপ্যমুদ্রা লইল।” কথাটি অসত্য। এ বাক্যটি বা এ অর্থে কোনো বাক্য যিরমিয় ভাববাদীর পুস্তকের কোথাও নেই।

যীশুর বংশাবলি-পত্রে লূক লিখেছেন (৩/২৭): “ইনি যোহানার পুত্র, ইনি রীষার পুত্র, ইনি সরুববাবিলের পুত্র, ইনি শল্টীয়েলের পুত্র ইনি নেরির পুত্র”।

পুরাতন নিয়ম থেকে প্রমাণিত যে এখানে তিনটি অসত্য তথ্য রয়েছে: প্রথমত: “রীষা সরুববাবিলের পুত্র” কথাটি অসত্য। মথি লিখেছেন (১/১২-১৩) “সরুববাবিলের পুত্র অবীহূদ।” লূক ও মথি দুজনের কথাই অসত্য। কারণ ১ বংশাবলি ৩/১৯-এ রয়েছে যে, সরুববাবিলের ৫টি পুত্র ছিল, তাদের মধ্যে (রীষা) বা (অবীহূদ) নামে কোনো পুত্র ছিল না। দ্বিতীয়ত: সরুববাবিল শল্টীয়েলের পুত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন পদায়ের পুত্র। হ্যাঁ, তিনি শল্টীয়েলের ভাতিজা ছিলেন। (১ বংশাবলি ৩/১৭-১৮) তৃতীয়ত: শল্টীয়েলের পিতার নাম নেরি ছিল না। তার পিতার নাম ছিল যিকনিয় (যিহোয়াখীন)। (১ বংশাবলি ৩/১৭ ও মথি ১/১২)

(ঘ) যীশুর পিতার দুজন পিতা!

আমরা দেখেছি যে, প্রচলিত ইঞ্জিল আল্লাহর কালাম নয়। এর মধ্যে আল্লাহর কোনো বাণী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর মূল বিষয় যীশু খৃস্ট। অথচ যীশু খৃস্টের পরিচয়েও ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য! এক ব্যক্তির দুজন পিতা!!

মথি এবং লূক উভয়ে যীশুর বংশ তালিকা প্রদান করেছেন (মথি: ১/১-১৬ ও লূক: ৩/২৩-৩৮)। যদি কেউ উভয় তালিকার তুলনা করেন তাহলে উভয়ের মধ্যে অনেক বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা দেখতে পাবেন, যেগুলির মধ্যে রয়েছে:

যীশুর দাদার নাম: মথি বলেন: যাকোব কিন্তু লূক বলেন: এলি। দু পিতার একপুত্র!

মথি থেকে জানা যায় যে, যীশু দায়ূদের পুত্র শলোমনের বংশধর। লূক থেকে জানা যায় যে, যীশু দায়ূদের পুত্র নাথন-এর বংশধর।

মথির ভাষ্যে দায়ূদ থেকে ব্যবিলনের নির্বাসন পর্যন্ত যীশুর পূর্বপুরুষগণ সকলেই সুপ্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন। লূকের বর্ণনায় দায়ূদ ও নাথন বাদে যীশুর পুর্বপুরুষগণের মধ্যে কেউই রাজা বা কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন না।

মথির বিবরণ অনুযায়ী দায়ূদ থেকে যীশু পর্যন্ত উভয়ের মাঝে ২৬ প্রজন্ম। আর লূকের বর্ণনা অনুযায়ী উভয়ের মাঝে ৪১ প্রজন্ম।

মথি বলেন (১/১৭): “এভাবে ইব্রাহিম থেকে দাউদ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; ব্যাবিলনে বন্দী হবার পর থেকে মসীহ্ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ।”

এখানে দুটি সুনিশ্চিত ও প্রমাণিত অসত্য তথ্য বিদ্যমান:

প্রথমত, এখানে বলা হলো: যীশুর বংশতালিকা তিন অংশে বিভক্ত, প্রত্যেক অংশে ১৪ পুরুষ, তাহলে মোট ৪২ পুরুষ। এ কথাটি সুস্পষ্ট ভুল। মথির ১/১-১৭-র বংশ তালিকায় যীশু থেকে আবরাহাম পর্যন্ত ৪২ পুরুষ নয়, বরং ৪১ পুরুষের উল্লেখ রয়েছে। যে কোনো পাঠক গণনা করলেই তা জানতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, মথির বক্তব্য: “দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ”- মারাত্মক ভুল। ১ বংশাবলির ১ম অধ্যায় থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, এ পর্যায়ে ১৮ পুরুষ ছিল, ১৪ পুরুষ নয়। আরো লক্ষণীয় যে, বংশাবলি ও মথি- বাইবেলের দু স্থানেই স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী ব্যক্তি পরবর্তী ব্যক্তির জনক। মথি তালিকার বিভিন্ন স্থান থেকে চার পুরুষ ফেলে দেওয়া সত্ত্বেও লিখেছেন যে, পূর্ববতী ব্যক্তি পরের ব্যক্তির সরাসরি জনক। তিনি এতেও ক্ষান্ত হন নি। উপরন্তু এদের মাঝে যে আর কেউ ছিল না নিশ্চিত করতে এ পর্যায়ে সর্বমোট ১৪ পুরুষ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন।

এজন্য প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ কার্ডিনাল জন হেনরী নিউম্যান (১৮০১-১৮৯০) আফসোস করে বলেন, “খৃস্টধর্মে একথা বিশ্বাস করা জরুরী যে, তিনে এক হয় বা তিন ও এক একই সংখ্যা। কিন্তু এখন একথাও বিশ্বাস করা জরুরী হয়ে গেল যে, ১৪ এবং ১৮ একই সংখ্যা; কারণ পবিত্র গ্রন্থে কোনো ভুল থাকার সম্ভাবনা নেই!”

আমরা তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে পারি, ৪১ ও ৪২ একই সংখ্যা!

১৩
২. ৬. ৩. মহান আল্লাহ সম্পর্কে অপবিত্র কথাবার্তা
‘কিতাবুল মোকাদ্দস’-এ আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় নবীগণের বিষয়ে অনেক ঘৃণ্য কথা বিদ্যমান। বাইবেলের ভাষ্যে স্রষ্টা অনেক কিছুই দেখতে বা শুনতে পারেন না। কেউ গাছের আড়ালে গেলে তাকে দেখতে পান না; বরং তাকে ডেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হন যে, তুমি কোথায়? (আদিপুস্তক ৩/৯)। দূরের মানুষদের অবস্থা দেখতে তাকে নিচে নেমে আসতে হয় (আদিপুস্তক ১১/৫)। পৃথিবীর মানুষদের চিৎকার তাঁর কানে পৌঁছালেও তাদের কর্ম তিনি দেখতে পান না (আদিপুস্তক ১৮/২০-২১)। স্রষ্টা না বুঝে কাজ করেন এবং পরে অনুশোচনা করেন। মানুষ সৃষ্টি করার পর যখন মানুষেরা পাপ করতে থাকে তখন তিনি মানুষ সৃষ্টি করে ভুল করেছেন ভেবে আফসোস করেন এবং মনের ব্যথ্যায় কষ্ট পেতে থাকেন। (আদিপুস্তক ৬/৬-৭)। তিনিই তালূত বা শৌলকে ইয়াহূদীদের রাজা বানান এবং তাকে ‘মাসীহ’ হিসেবে অভিষিক্ত করেন। রাজা হয়ে এ ‘মাসীহ’ যে অন্যায় করবে তা তিনি বুঝতে পারেন নি! রাজা হওয়ার পরে তালূত অন্যায় করলে খোদা অনুশোচনায় ভেঙ্গে পড়েন! (১ শমূয়েল ১৫/১১, ৩৫)

কিতাবুল মোকাদ্দসের ভাষ্যে আল্লাহ বিনা অপরাধে শাস্তি দেন! তিনি মানুষের পাপের অপরাধে নিরপরাধ পশু-পাখীকে ধ্বংস করেন (আদিপুস্তক ৬/৬-৭)। তিনি ইয়াহূদীদেরকে তিন নির্দেশ দেন, ইয়াহূদীদের চেয়েও বড় ৭ টি জাতির সকল নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর লক্ষলক্ষ মানুষকে নির্দয়ভাবে গণহত্যা করতে (দ্বিতীয় বিবরণ ৭/২-১৬)। অনুরূপভাবে শমরীয়দের গণহত্যা করতে, বিশেষভাবে ‘শিশুদেরকে আছড়াইয়া খণ্ড খণ্ড’ করতে এবং ‘গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের উদর বিদীর্ণ’ করতে নির্দেশ প্রদান করেন (হোশেয় ১৩/১৬)।

বাইবেলের বর্ণনায় দেখা যায় যে, স্রষ্টা অপরাধীর অপরাধের জন্য নিরপরাধকে শাস্তি দেন। পিতার অপরাধের কারণে ৪ পুরুষ পর্যন্ত বংশধরগণ শাস্তি পাবে বলে বিধান দিয়েছেন। (যাত্রাপুস্তক ৩৪/৭) এমনকি ৯/১০ পুরুষ আগের পূর্বপুরুষের অপরাধের কারণে ৪০০ বৎসর পরের উত্তরপুরুষদের প্রতিটি মানুষকে এবং সকল সম্পদকে নির্দয়ভাবে ধ্বংস করতে নির্দেশ দেন। এমনকি “স্ত্রী ও পুরুষ, বালক-বালিকা ও স্তন্যপায়ী শিশু, গরু ও মেষ, উষ্ট্র ও গর্দভ সকলকেই বধ” করতে নির্দেশ দেন। (১ শমূয়েল ১৫/১-৩)

অন্য গল্পে নূহ (আ) মদপান করে মাতাল হয়ে উলঙ্গ হন (নাঊযু বিল্লাহ)। তাঁর ছোট ছেলে হাম হঠাৎ পিতাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলেন। মাতলামি কাটার পর বিষয়টি জেনে নূহ (আ) ক্রুদ্ধ হয়ে হামের ছেলে কনানকে অভিশাপ দেন এবং ঈশ্বর সে অভিশাপ বাস্তবায়নও করেন!!!! (আদিপুস্তক ৯/১৮-২৫)

মাতাল হয়ে উলঙ্গ হওয়ায় নূহের কোনো অপরাধ হলো না কিন্তু অসতর্কভাবে তা দেখে ফেলায় হামের অপরাধ হলো! ভয়ঙ্কর বিষয় হলো অপরাধ করলো হাম কিন্তু অভিশাপ ও শাস্তি পেল হামের এক ছেলে কনান!! অপরাধী হামের চারটি পুত্র ছিল: কূশ, মিসর, পূট ও কনান। (আদিপুস্তক ১০/৬) তাদের মধ্য থেকে শাস্তির জন্য শুধু কনানকে বেছে নেওয়ার কারণটিই বা কী?

অনুরূপ আরেকটি উদ্ভট গল্প! ইসহাক নবীর দুই ছেলে: বড় ছেলে এযৌ ও ছোটে ছেলে ইয়াকুব। ইসহাক তার বড় ছেলে এযৌকে ভালবাসতেন। বৃদ্ধ বয়সে ইসহাক অন্ধ হয়ে যান। তিনি আল্লাহর বিধান মত বড় ছেলে এযৌকে আশীর্বাদ করে “গদ্দীনশীন” করতে চান। কিন্তু ইয়াকূব প্রতারণা করে এযৌ-এর বেশ ধরে পিতার কাছে এসে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলে ইসহাক না বুঝে এযৌ মনে করে তাকে আশীর্বাদ করেন। (আদিপুস্তক ২৭ অধ্যায়) মজার কথা, ইসহাক অন্ধ হওয়ার কারণে এযৌ ভেবে ইয়াকুবকে আশীর্বাদ করলেন এবং ঈশ্বরও অন্ধের মতই তা কবুল করে নিলেন! প্রতারককে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, ঈশ্বর ঘোষণা দিলেন, কোনো অপরাধ ছাড়াই তিনি এযৌকে ঘৃণা করলেন, শাস্তি দিলেন এবং অপরাধী প্রতারক ইয়াকূবকে প্রেম করলেন (মালাখি ১ম অধ্যায়: ২-৩)

আরেকটি গল্পে আল্লাহ সারা রাত ধরে ইয়াকুবের (আ) সাথে রেসলিং বা মল্লযুদ্ধ করেন!! শেষ রাতে ইয়াকুব তাকে ছেড়ে দেন!! এজন্য ইয়াকূবের নাম হলো “ইস্রায়েল” অর্থাৎ আল্লাহর সাথে মল্লযুদ্ধকারী!!! (আদিপুস্তক ৩২/২৪-৩০)

১৪
২. ৬. ৪. নবীগণ, ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ-এর ব্যভিচার-ধর্ষণ ও হত্যা!
কিতাবুল মোকাদ্দসের বর্ণনায় নবী-রাসূলগণ ও তাদের সন্তানগণ ছিলেন ব্যভিচারী ও ধর্ষক (আদিপুস্তক: ১৯: ৩৩-৩৮, ৩৫: ২২; ৩৮: ১৫-১৮, ২৭-৩০..), মদ্যপ (আদিপুস্তক ৯/২০), মিথ্যাবাদী (যাত্রাপুস্তক ৩/১৭-১৮, ৫/৩, ১১/২, ১২/৩৫; ১ শমূয়েল ১৬/১-৪), তাঁরা মানুষের মল ও গোবিষ্ঠা ভক্ষণ করতেন (যিহিষ্কেল ৪/৪-১৫), উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করতেন (যিশাইয় ২০/২-৪), মদপান করে উলঙ্গ হতেন (আদিপুস্তক ৯/২০), মূর্তিপূজা করতেন (যাত্রাপুস্তক ৩২ : ১-৩৫; ১ রাজাবলি ১১ : ১-১৩)... .... ইত্যাদি।

যে পাপের কথা চিন্তা করলেও গা শিউরে উঠে এবং যে পাপ করতে পাপীও রাজি হয় না সে পাপও নবীগণ ও তাদের সন্তানগণ করতেন বলে বাইবেলে বলা হয়েছে। যেমন নিজের কন্যাদের সাথে ব্যভিচার করা (আদিপুস্তক ১৯/৩৩-৩৮), পিতার স্ত্রীকে ধর্ষণ করা (আদিপুস্তক ৩৫/২২), নিজের বোনকে ধর্ষণ করা (২ শমূয়েল ১৩/১১-১৪), সকল মানুষের সামনে নিজের পিতার স্ত্রীগণকে গণধর্ষণ করা (২ শমুয়েল ১৬/২২), নিজের পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচার করা (আদিপুস্তক ৩৮/১৫-১৮, ২৭-৩০) ইত্যাদি।

এত পাপাচারের পরেও ঈশ্বর তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন নি। বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে জারজ সন্তানদের প্রতি ঈশ্বরের মায়া মনে হয় একটু বেশিই। ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ ‘দায়ূদ’ এবং ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ ঈসা: দুজনই জারজ সন্তানের বংশধর। (দ্বিতীয় বিবরণ: ২: ১৭-১৯ এবং ২০: ১৩-১৬, মথি: ১: ১-৩)।

ইয়াহূদী-খৃস্টানদের প্রাণপুরুষ দাউদ (আ)। দাউদের বংশধর হওয়া যীশুখৃস্টের শ্রেষ্ঠ গৌরব। বাইবেলের ভাষ্যে দায়ূদ ঈশ্বরের প্রথমপুত্র, ঔরসজাত পুত্র ও ঈশ্বরের মাসীহ বা খৃস্ট। “সদাপ্রভু আমাকে কহিলেন, তুমি আমার পুত্র, অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি” (যাবুর ২/৭) “আমার দাস দায়ূদকেই পাইয়াছি, আমার পবিত্র তৈলে তাহাকে অভিষিক্ত করিয়াছি (with my holy oil have I anointed him)।...সে আমাকে ডাকিয়া বলিবে, তুমি আমার পিতা, আমার ঈশ্বর। আবার আমি তাহাকে প্রথমজাত (my firstborn) করিব ..।” (যাবূর ৮৯/২০-২৭)

এ দায়ূদ (আ)-কেও বাইবেলে ব্যভিচারী ও ধর্ষক বলে চিত্রিত করা হয়েছে। উরিয়া নামে দাউদের এক প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধরত ছিলেন। দায়ূদ উরিয়ার স্ত্রীকে এক নজর দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। মহিলা এ ধর্ষণে গর্ভবতী হয়ে যান। দায়ূদ সেনাপতিকে চিঠি লিখে কৌশলে উরিয়াকে হত্যা করান এবং উক্ত মহিলাকে বিবাহ করেন। (২ শমূয়েল: ১১/১৪: ১৭)

ধর্ষণ ও হত্যা একত্রে! একজন মহাপাপীও এমন করবেন না। একজন পাপী বয়স্ক মানুষ, যার অর্ধশতাধিক স্ত্রী বিদ্যমান, তিনি একজন মহিলাকে একনজর দেখেই তাকে ধর্ষণ করতে ব্যস্ত হবেন এবং তাঁর স্বামীকে হত্যা করবেন?

তাওরাতে বিধান ব্যভিচারীকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে। কিন্তু তাওরাতের ঈশ্বর অপরাধীর চেহারা দেখে বিচার করেন বলে মনে হয়। সম্ভবত দায়ূদ যেহেতু ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ, সেহেতু ঈশ্বর দাউদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিলেন দায়ূদের বৈধ স্ত্রীদেরকে। তিনি দায়ূদকে বলেন, তুমি যেহেতু ব্যভিচার ও হত্যায় লিপ্ত হলে, সেহেতু তোমার সামনে তোমার স্ত্রীদের গণধর্ষণের ব্যবস্থা করব। কী অদ্ভুত বিচার ব্যবস্থা!! একটি পাপের শাস্তি হিসেবে আরেকটি পাপের ব্যবস্থা ও ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে নিরপরাধকে ধর্ষণের ব্যবস্থা করা!! (২ শমূয়েল ১২: ১১-১২)। ইঞ্জিলের বর্ণনা অনুসারে ঈসা মাসীহও ভয়ঙ্কর সব পাপ ও অশোভন কর্মে লিপ্ত হতেন। আমরা “নবীগণের পাপ ও পাপীর শাফা‘আত” প্রসঙ্গে তা আলোচনা করব।

এরূপ অগণিত স্ববিরোধী এবং অপবিত্র বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, কিতাবুল মোকাদ্দস পুরোটাই জাল অথবা এর মধ্যে অনেক জালিয়াতি বিদ্যমান। কুরআন দ্বিতীয় বিষয়টিই নিশ্চিত করে। কুরআন বলে যে, ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ তিনভাবে তাওরাত-ইঞ্জিল নষ্ট করে: (ক) ভুলে যাওয়া (খ) বিকৃত করা (মায়িদা: ১৩, ১৪ ও ৪১), ও (গ) জাল কথা ও বই সংযোজন করা (বাকারা ৭৯ আল-ইমরান ৭৮)। এ সকল বিকৃতি ও জালিয়াতির পাশাপাশি এগুলির মধ্যে কিছু কিছু ভালোকথা বিদ্যমান। তবে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো পথ নেই। এজন্য আল্লাহ কুরআনকে যাচাইয়ের মানদণ্ড করেছেন এবং এগুলির মূল শিক্ষা কুরআনের মধ্যে উদ্ধৃত ও সংরক্ষিত করেছেন। (সূরা ৫-মায়িদা: ৪৮)। আর গত ২০০ বৎসর যাবৎ ইউরোপ-আমেরিকার ইয়াহূদী-খৃস্টান গবেষকগণ এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করেছেন।

১৫
২. ৭. বিকৃতির ধারাবাহিকতা
বিকৃতি ও জালিয়াতির ধারা কুরআন নাযিলের পরেও অব্যাহত আছে। আপনি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বিগত ২০০ বৎসরের বাইবেলগুলি একত্রে অধ্যয়ন করলেই দেখবেন যে, প্রত্যেক সংস্করণেই অনেক পরিবর্তন। ভাষার পরিবর্তন নয়, বরং তথ্যের পরিবর্তন, বিকৃতি, এমনকি অনেক আয়াত বা শ্লোক পর্যন্ত বাদ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস-এর সময়ে ১৬১১ খৃস্টাব্দে ইংরেজি ভাষায় ‘বাইবেলের’ বিশুদ্ধ অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। এটিই অন্যান্য ভাষার কিতাবুল মোকাদ্দসের মূল ভিত্তি। এটি কিং জেমস ভার্শন (King James Version: KJV) এবং অথোরাইযড ভার্শন (Authorised Version: AV) নামে পরিচিত। ১৯৫২ খৃস্টাব্দে আমেরিকার ৩২ জন খৃস্টান ধর্মগুরু একত্রিত হয়ে কিং জেমস বাইবেলের ভুলভ্রান্তিদূর করে রিভাইযড স্টান্ডার্ড র্ভাশন (Revised Standerd Version)। এখানে এ দুটি সংস্করণের মধ্যে বিদ্যমান বৈপরীত্য ও প্রমাণিত কয়েকটি বিকৃতি উল্লেখ করছি।

১৬
২. ৭. ১. ইঞ্জিল থেকে ইচ্ছাকৃত বিয়োজন
যীশু তার শিষ্যদেরকে কিয়ামত সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করেন বলে মথি, মার্ক ও লূক উল্লেখ করেছেন। মথির বর্ণনা অনুসারে এ প্রসঙ্গে যীশু বলেন: (মথি ২৪/৩৪-৩৬) “(৩৪) আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, এই কালের লোকদের লোপ হইবে না, যে পর্যন্ত না এ সমস্ত সিদ্ধ হয়। (৩৫) আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না। (৩৬) কিন্তু সেই দিনের ও সেই দণ্ডের কথা কেহই জানে না, স্বর্গের দূতগণও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।” এ হলো অথোরাইযড ভার্শন বা কিং জেমস ভার্শন (AV/ KJV)-এর ভাষ্য (But of that day and hour knoweth no man, no, not the angels of heaven, but my Father only.)

আধুনিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, এখানে তিনটি শব্দ বাদ দেওয়া হয়েছিল। শব্দগুলি নিম্নরূপ (neither the Son): “পুত্রও জানেন না”। রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্সন (RSV)-এ শব্দগুলি সংযোজন করা হয়েছে। সংযোজিত বাক্যাংশটুকু-সহ শ্লোকটির অর্থ হচ্ছে: “কিন্তু সেই দিনের বা সেই দণ্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না, স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।”

এ কথা-সহ এ শ্লোকটি প্রমাণ করে যে, যীশু বা যীশুর মধ্যে বিদ্যমান “পুত্র” সত্ত্বা ঈশ্বর ছিলেন না। এমনকি কিয়ামত কখন হবে সে জ্ঞানও তাঁর ছিল না। যীশুকে ঈশ্বর বলে যারা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য কথাটি মেনে নেওয়া অসম্ভব। এজন্য বাইবেল লেখকগণ এ বাক্যাংশটুকু মুছে দিয়েছিলেন। আরো মজার ব্যাপার হলো লূকের বাইবেল থেকে এ শ্লোকটি পুরোই ফেলে দেওয়া হয়েছে। লূক ২১/৩২-৩৪ নিম্নরূপ: “(৩২) আমি তোমাদেরকে সত্য বলিতেছি, যে পর্যন্ত সমস্ত সিদ্ধ না হইবে সেই পর্যন্ত এই কালের লোকদের লোপ হইবে না। (৩৩) আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না। (৩৪) কিন্তু আপনাদের বিষয়ে সাবধান থাকিও, পাছে ভোগপীড়ায় ও মত্ততায় এবং জীবিকার চিন্তায় তোমাদের হৃদয় ভারগ্রস্ত হয়, আর সেই দিন হঠাৎ ফাঁদের ন্যায় তোমাদের উপর আসিয়া পড়ে।”

১৭
২. ৭. ২. ইঞ্জিলের মধ্যে ইচ্ছাকৃত সংযোজন
কিং জেমস ভার্শন অনুসারে যোহনের প্রথম পত্রের ৫/৭-৮ নিম্নরূপ: “কারণ স্বর্গে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহারা সাক্ষ্য সংরক্ষণ করেন: পিতা, বাক্য ও পবিত্র আত্মা; এবং তাঁহারা তিন একই। এবং পৃথিবীতে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহারা সাক্ষ্য প্রদান করেন: আত্মা, জল ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই। (For there are three that bear record in heaven, the Father, the Word, and the Holy Ghost; and the three are one. And there are three that bear witness in earth, the spirit, and the water, and the blood: and these three agree in one.)।”

এভাবে সহস্রাধিক বৎসর বাইবেল পাঠ করা হয়েছে। এখন খৃস্টান পণ্ডিতগণ একমত যে, একথাগুলি ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সংযোজিত। এখানে মূল কথা ছিল “তিনজন সাক্ষী রয়েছেন: আত্মা, জল ও রক্ত, এবং এ তিনজনের সাক্ষ্য একই।” ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বাইবেল লেখকগণ অতিরিক্ত কথাগুলি সংযোজন করেন। রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনের ভাষ্য নিম্নরূপ: There are three witnesses , the Spirit, the water and the blood; and these three agree." “বস্তুত তিনে সাক্ষ্য দিতেছেন, আত্মা, জল, ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই।”

১৮
২. ৭. ৩. ইঞ্জিলের মধ্যে ইচ্ছাকৃত বিকৃতি
প্রেরিত ৩/১৩ কিং জেমস ভার্শনে নিম্নরূপ: (The God of Abraham, and of Isaac, and of Jacob, the God of our fathers, hath glorified his Son Jesus...) অব্রাহামের, ইসহাকের ও যাকোবের ঈশ্বর, আমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর আপনার (নিজের) পুত্র যীশুকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন...”

কিন্তু রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনে কথাটি নিম্নরূপ: (.... hath glorified his servant Jesus...) অব্রাহামের, ইসহাকের ও যাকোবের ঈশ্বর, আমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর আপনার বান্দা (নিজের গোলাম) যীশুকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন...”

অর্থাৎ ঈসা মাসীহ আল্লাহর বান্দা ছিলেন এ কথাটি গোপন করতে ‘বান্দা’ শব্দটি ‘পুত্র’ বানানো হয়েছিল। একইরূপ জালিয়াতি দেখুন প্রেরিত ৪/২৭। সেখানেও (thy holy servant Jesus: RSV) “তোমার পবিত্র দাস যীশু” কথাটি বিকৃত করে (thy holy child Jesus: KJV) “তোমার পবিত্র পুত্র যীশু" বানানো হয়েছিল।

১৯
২. ৮. কুরআন দিয়ে ইঞ্জিলের বিশুদ্ধতা দাবি
খৃস্টান ধর্মগুরুগণ উপরের তথ্যগুলি গোপন করে মুসলিমদেরকে ধোঁকা দিতে কুরআনের আয়াতের আংশিক বিকৃত অর্থ দিয়ে দাবি করেন যে, প্রচলিত তাওরাত-ইঞ্জিল সঠিক। এরূপ দুটি বিষয় উল্লেখ করছি।

আল্লাহ বলেন: “জেনে রাখ! আল্লাহ্‌র বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না; যারা ঈমান আনে ও তাক্ওয়া অবলম্বন করে। তাদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখিরাতে, আল্লাহ্‌র বাক্যাবলির কোনো পরিবর্তন নেই; ওটাই মহাসাফল্য। (সূরা ১০-ইউনূস: ৬২-৬৪)।

এখানে আল্লাহ বলেছেন যে, আল্লাহর বন্ধুদের সুসংবাদ ও সাফল্যের বিষয়ে আল্লাহর বাক্য, বাণী বা বিধান কেউ রদ্দ বা পরিবর্তন করতে বা আল্লাহর বন্ধুদের ব্যর্থ করতে পারবে না। খৃস্টান প্রচারকগণ সকল কথা বাদ দিয়ে (লা তাবদীলা লিকালিমাতিল্লাহ) ‘আল্লাহর বাক্যবালির পরিবর্তন নেই’ কথাটি দিয়ে দাবি করেন যে, তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি আল্লাহর কালাম, সেহেতু কেউ তা পরিবর্তন করতে পারবে না। অতএব প্রচলিত তাওরাত-ইঞ্জিল আদি ও অকৃত্রিম আল্লাহর কালাম!

পাঠক হয়ত প্রতারণা ধরতে পারছেন না। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:

(ক) এখানে আল্লাহর কালেমা বা বাক্যের কথা বলা হয়েছে, আল্লাহর কিতাবের কথা বলা হয় নি। আল্লাহ যে কথা বলেন তা আল্লাহর বাক্য বা কালেমা। আর আল্লাহর কালামের লিখিত রূপ ‘কিতাব’। এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহর বাক্য বা কথা পরিবর্তন হয় না; কারণ আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। কিন্তু আল্লাহর কালামের লিখিত গ্রন্থ বিকৃত হয় না তা কখনোই আল্লাহ বলেন নি। বরং তিনি বারংবার বলেছেন যে, ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ আল্লাহর কালামের লিখিত রূপ পরিবর্তন করেছে, অনেক কালাম ভুলে গিয়েছে বা হারিয়ে ফেলেছে এবং অনেক জাল বই লিখে আল্লাহর নামে চালিয়েছে। (২-বাকারা ৭৯, ৪-আল ইমরান: ৭৮, ৫-মায়িদা ১৩, ১৪, ৪১)

(খ) কিতাবুল মোকাদ্দস প্রমাণ করে যে, আল্লাহ কালামের পরিবর্তন হয়, হারিয়ে যায় এবং জালিয়াতি করা হয়। বর্তমান প্রচলিত ‘কিতাবুল মোকাদ্দসের মধ্যে কয়েক ডজন আল্লাহর কিতাবের নাম আছে যেগুলির অস্তিত্ব দুনিয়াতে নেই। যেমন: (১) ‘সদাপ্রভুর যুদ্ধপুস্তক’ (গণনা পুস্তক ২১/১৪), (২) ‘যাশের পুস্তক (যিহোশূয় ১০/১৩), (৩) শলোমন রচিত ‘এক হাজার পাঁচটি গীত’, (৪) শলোমন রচিত ‘প্রাণী জগতের ইতিবৃত্ত’, (৫) শলোমন রচিত ‘তিন হাজার প্রবাদ বাক্য’ (১ রাজাবলি ৪/৩২-৩৩), (৬) শমূয়েল ভাববাদীর রাজনীতির পুস্তক (১ শময়েল ১০/২৫), (৭) শমূয়েল দর্শকের পুস্তক, (৮) নাথন ভাববাদীর পুস্তক, (৯) গাদ দর্শকের পুস্তক (১ রাজাবলি ২৯/২৩), (১০) শময়িয় ভাববাদীর পুস্তক, (১১) ইদ্দো দর্শকের পুস্তক (২ বংশাবলি ১২/১৫), (১২) অহীয় ভাববাদীর ভাববানী, (১৩) ইদ্দো দর্শকের দর্শন (২ বংশাবলি ৯/২৯), (১৪) হনানির পুত্র যেহুর পুস্তক (২ বংশাবলি ২০/৩৪), (১৫) যিশাইয় ভাববাদী রচিত উষিয় রাজার আদ্যোপান্ত ইতিহাস (২ বংশাবলি ২৬/২২), (১৬) যিশাইয় ভাববাদীর দর্শন-পুস্তক হিষ্কিয় রাজার ইতিহাস সম্বলিত (২ বংশাবলি ৩২/৩২), (১৭) যিরমিয় ভাববাদী রচিত যোশিয় রাজার বিলাপগীত (২ বংশাবলি ৩৫/ ২৫), (১৮) বংশাবলি পুস্তক (নহিমিয় ১২/২৩), (১৯) মোশির ‘নিয়মপুস্তক’ (যাত্রাপুস্তক ২৪/৭) এবং (২০) শলোমনের বৃত্তান্ত-পুস্তক (১ রাজাবলি ১১/৭)।

কিতাবুল মোকাদ্দস বলছে যে, এগুলি সবই আল্লাহর কিতাব। ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ স্বীকার করতে বাধ্য যে, কিতাবগুলি তাদের কাছে নেই। আপনি খৃস্টান প্রচারককে বলুন: ২০টি আস্ত কিতাব যদি হারিয়ে যেতে পারে তাহলে বিদ্যমান কিতাবগুলির কয়েক হাজার আয়াত হারানো বা বিকৃত হওয়া অসম্ভব হবে কেন?

(গ) কিতাবুল মোকাদ্দস প্রমাণ করে যে আল্লাহর কিতাবের জালিয়াতি হয়। ক্যাথলিকদের কিতাবুল মোকাদ্দসে বইয়ের সংখ্যা ৭৩; কিন্তু প্রটেস্ট্যান্টদের কিতাবুল মোকাদ্দসে বইয়ের সংখ্যা ৬৬। ৭টি বই-ই বেশি কম। উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান বইগুলির মধ্যেও আয়াত ও অধ্যায়ে অনেক বৈপরীত্য। আবার প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের কিং জেমস ভার্শন ও রিভাইযবড স্টান্ডার্ড ভার্শনের মধ্যে শতশত আয়াত ও হাজার হাজার শব্দের পার্থক্য। একটি সঠিক হলে অন্যটিকে জাল। অথবা সবগুলিই জাল।

(ঘ) কিতাবুল মোকাদ্দসে বারংবার আল্লাহর কিতাবের জালিয়াতির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ভণ্ড নবীগণ বা ভণ্ড শিষ্যগণ আল্লাহর বা মাসীহের নামে জাল কথা প্রচার করবে (মথি ৭/১৫, ২৪/১১, ২৪/২৪, মার্ক ১৩/২২)। সাধু পল লিখেছেন: “আমার আশ্চর্য বোধ হইতেছে যে, খৃস্টের অনুগ্রহে যিনি তোমাদিগকে আহ্বান করিয়াছেন, তোমরা এত শীঘ্র তাঁহা হইতে অন্যবিধ ইঞ্জিলের (unto another gospel) দিকে ফিরিয়া যাইতেছ।” (গালাতীয় ১/৬। আরো দেখুন: ২ করিন্থীয় ১১/৪, গালাতীয় ১/৮-৯) খৃস্টান প্রচারককে বলুন, আল্লাহর নামে যদি জাল কথা বলা ও জাল ইঞ্জিল লেখা অসম্ভব হয় তাহলে ভণ্ড নবী, ভণ্ড খৃস্ট ও জাল ইঞ্জিল কিভাবে হলো?

(ঙ) খৃস্টান প্রচারককে বলুন, সত্যই তো পরিবর্তন ও বৈপরীত্য তো আল্লাহর বিশুদ্ধ কালামের মধ্যে থাকে না। তবে আল্লাহর নামে জাল করা শয়তানী কালামের মধ্যে পরিবর্তন ও স্ববিরোধিতা থাকে। প্রচলিত কিতাবুল মোকাদ্দসের মধ্যে বিদ্যমান স্ববিরোধিতাই প্রমাণ করে যে, তা আল্লাহর কালাম নয়।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন: “আমি বনী ইস্রাঈলকে উৎকৃষ্ট আবাসভূমিতে বসবাস করালাম এবং আমি ওদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দিলাম, তারপর ওদের কাছে জ্ঞান আসলে ওরা বিভেদ সৃষ্টি করল। ওরা যে বিষয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল আপনার প্রতিপালক অবশ্যই তাদের মধ্যে কিয়ামতের দিনে ওটার ফয়সালা করে দেবেন। আমি আপনার প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে যদি আপনার সন্দেহ থাকে তবে আপনার আগের কিতাব যারা পাঠ করে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন; আপনার প্রতিপালকের কাছ থেকে আপনার কাছে সত্য এসেছে। আপনি কখনো সন্দেহপ্রবণদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না, এবং যারা আল্লাহ্‌র নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছে আপনি কখনো তাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না, তাহলে আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” (সূরা ১০-ইউনুস ৯৩-৯৫)

মিশনারিগণ প্রথম ও শেষ বাদ দিয়ে মাঝের অংশটুকু উল্লেখ করে বলেন, কুরআনের বিষয়ে সন্দেহ হলে বাইবেল থেকে সত্য জানতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, কিতাবুল মোকাদ্দস সত্য এবং তা পালন করা জরুরী!

সম্মানিত পাঠক, এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে আল্লাহ প্রত্যেক কুরআন পাঠকারীকে সম্বোধন করে বললেন যে, বনী ইসরাঈল বিষয়ক তথ্যগুলির বিষয়ে কারো সন্দেহ হলে পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলি থেকে যাচাই করতে পার। মহান আল্লাহ কোনো জাতিকে অনুগ্রহসিক্ত করার পরেও যদি তারা অবাধ্য হয় এবং মতভেদ ও হানাহানি করে তবে তাদের কিরূপ শাস্তি হবে তা মুসলিমদের জানা প্রয়োজন, যেন তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামত পাওয়ার পরে অবাধ্যতা ও হানাহানিতে লিপ্ত না হয়। আর এ বিষয়ে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ একটি বিশ্বকোষ! আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে কত প্রকারের নিয়ামত দিয়েছেন, নিয়ামত পাওয়ার পরেও কতভাবে তারা আল্লাহর কিতাবে অবিশ্বাস, কিতাব প্রত্যাখ্যান, সন্দেহ, শির্ক, কুফর, মুর্তিপূজা, পাপাচার ও হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে এবং এর শাস্তিতে কত প্রকারের গযব আল্লাহ তাদের দিয়েছেন তা বিস্তারিত এ গ্রন্থে সংকলিত। এজন্য আল্লাহ বললেন যে, হে কুরআনের পাঠক, যদি তোমার মনে পূর্ববর্তী জাতিদের পরিণতির বিষয়ে কোনো সন্দেহ আগমন করে তবে তুমি পূর্ববর্তী কিতাবগুলি যারা পাঠ করে তাদেরকে প্রশ্ন করলেই জানবে যে, এ বিষয়ে কুরআনের তথ্য নির্ভুল।

সম্মানিত পাঠক, যে কোনো গবেষক যদি বিশ্বসৃষ্টি, পূর্ববর্তী জাতিগণের ইতিহাস ও পরিণতি সম্পর্কে কুরআন মাজীদ অধ্যয়ন করেন এবং বাইবেলের সাথে তা তুলনা করেন তবে নিশ্চিত হবেন যে, কুরআন সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহর কিতাব। ডা. মরিস বুকাইলি (Dr. Maurice Bucaile) রচিত (The Bible, the Qur'an and the Science ) বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ বইটি পড়লেই তা জানা যায়।

২০
২.৯. কুরআন অবিকৃত অথচ তাওরাত-ইঞ্জিল বিকৃত কিভাবে?
খৃস্টীয় প্রচারকগণ বলেন, কুরআন যেমন লাখলাখ মানুষ পড়ে, বিকৃত করা যায় না, তেমনি তাওরাত-ইঞ্জিলও বিকৃত করা সম্ভব ছিল না। কথাগুলি একেবারে ভিত্তিহীন। কারণ সর্বশেষ ওহী হিসেবে আল্লাহ কুরআনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলির ক্ষেত্রে করেন নি। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:

(ক) কুরআন মূলতই লিখিত বই নয় বরং অগণিত মানুষের মুখস্থ বই। অবতরণের শুরু থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণ তা মুখস্থ করেছেন। প্রতি সপ্তাহে, মাসে ও বৎসরে তাহাজ্জুদে, তারাবীহে ও তিলাওয়াতে অগণিতবার খতম করেছেন। সকল যুগেই একই অবস্থা। কুরআনের লিখিতরূপ শুধু সহায়ক মাত্র। পক্ষান্তরে তাওরাত-ইঞ্জিল কখনোই মুখস্থ করা হয়নি এবং মুখস্থ করা সম্ভবও নয়।

(খ) কুরআন প্রথম অবতরণ থেকেই প্রতিটি মুমিনের প্রতিদিনের পাঠ্য বই। প্রতিদিন নিজের নামাযে, জামাতে নামাযে ও সাধারণভাবে প্রত্যেক মুমিন তা তিলাওয়াত করেন বা শুনেন। পক্ষান্তরে তাওরাত-ইঞ্জিল কখনোই সাধারণ মানুষের পাঠ্য বই ছিল না। বরং কতিপয় “ধর্মগুরু” বা “পুরোহিত” বছরে দু-একটি অনুষ্ঠানে বা প্রয়োজনে তা পড়তেন। সাধারণ মানুষের জন্য বাইবেল পাঠ নিষিদ্ধ ছিল। কয়েকশত বৎসর আগেও “বাইবেল” পাঠ করলে আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো।

(গ) মূসা (আ) তাওরাতের একটি মাত্র কপি ‘নিয়ম সিন্দুকের” মধ্যে রেখে গিয়েছেন, প্রতি সাত বৎসর পরপর তা পড়ার জন্য। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর শতবৎসরের মধ্যেই ইয়াহূদীরা তাঁর ধর্ম ত্যাগ করে শির্ক কুফরে লিপ্ত হয়। এভাবে তাওরাতের পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। শতশত বৎসর পরে লোকমুখের প্রচলনে তা লেখা হয়।

(ঘ) যীশুর শিষ্যগণ তাঁর ইঞ্জিল লিখেন নি। কারণ তিনি তাঁদেরকে বলেছিলেন যে, তাঁরা জীবিত থাকতেই কিয়ামত হবে (১৬/২৭-২৮)। শিষ্যগণ এ কথাই বিশ্বাস ও প্রচার করতেন যে, তাঁরা জীবিত থাকতেই কিয়ামত হবে (১ থিষলনীকীয় ৪/১৫-১৭; ১ করিন্থীয় ১৫/৫১-৫২) এজন্য আল্লাহর কালাম লিখতে নিষেধ করা হয়েছে: “আর তিনি আমাকে কহিলেন, তুমি এ গ্রন্থের ভাববাণীর বচন সকল মুদ্রাঙ্কিত করিও না (লিখিও না); কেননা সময় সন্নিকট।” (প্রকাশিত বাক্য ২২/১০-১১)

(ঙ) খৃস্টান গবেষকগণ একমত যে, যীশুর তিরোধানের পরে দুইশত বৎসরের মধ্যে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির কোনো নামও কোথাও পাওয়া যায় না। এ সময়ে খৃস্টানগণ অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বিভিন্ন দেশে খৃস্টধর্ম প্রচার করেছেন, কিন্তু কেউই যীশুর ইঞ্জিলের কোনো লিখিত রূপ সংরক্ষণ করেন নি। প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে খৃস্টান চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিশপ নিযুক্ত হয়েছে। এ সকল বিশপের অনেক চিঠি ও বই এখনো সংরক্ষিত আছে। কিন্তু সেগুলোতে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির কোনো নামও উল্লেখ নেই। ২০০ বৎসর পর্যন্ত কোনো চার্চে কোনো ইঞ্জিল শরীফ সংরক্ষিত রাখা বা পঠিত হওয়া তো দূরের কথা এগুলির কোনো উল্লেখই পাওয়া যায় না। অর্থাৎ মথি, মার্ক, লূক ও যোহনের লেখা ইঞ্জিল নামে কোনো পুস্তক যে পৃথিবীতে বিদ্যমান এ কথাটিই ২০০ বছর পর্যন্ত কেউ জানত না। এটি কোনো বিতর্কিত তথ্য নয়, বরং সকল খৃস্টান কর্তৃক স্বীকৃত সত্য।

(চ) এরপর সমাজে অগণিত ইঞ্জিল প্রকাশ পেতে থাকে। যাজকগণ এ সকল ইঞ্জিলের মধ্য থেকে তাঁদের পছন্দসই ইঞ্জিলগুলোকে ‘সঠিক’ (canonical) এবং বাকি ইঞ্জিলগুলোকে “সন্দেহজনক” (non-canonical/ Apocryphal) বলে দাবী করেন। কোনটি সঠিক এবং কোনটি সন্দেহজনক তা নিয়েও তাদের মতভেদের অন্ত নেই। আবার “সঠিক” ইঞ্জিলগুলির পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যেও অগণিত বৈপরীত্য বিদ্যমান।

(ছ) খৃস্টান প্রচারকগণ বলতে চান যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের ৩০ বৎসর পরে উসমান (রা) কুরআন সংকলন করেন। ত্রিশ বৎসরে বিকৃতির সম্ভাবনা ছিল! যাদের ধর্মগ্রন্থ ৩০০ বৎসর পরে সংকলিত তারা ত্রিশ বৎসর নিয়ে চিন্তা করেন! তাদের এ কথা পুরোটাই মিথ্যা। আমরা আগেই বলেছি, কুরআন মূলত মুখস্থ বই। প্রায় সকল মুসলিম তা মুখস্থ রাখতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়েই সাহাবীগণ তা লিখেও রাখতেন। ১১ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পরের বৎসর ১২ হিজরীতে আবূ বকর (রা) কুরআনের লিখিত পাণ্ডুলিপি সংকলন করে রাখেন। যখন ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিসর বিভিন্ন দেশের অগণিত মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন তখন নতুন মুসলিমদের জন্য লিখিত কুরআনের প্রয়োজন হতো। অনেকে নিজের ইচ্ছামত কারো মুখে শুনে কুরআন লিখতে শুরু করেন। এতে ভুল পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এজন্য ২৩ হিজরী সালে, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের ১২ বৎসরের মাথায় উসমান (রা) খলীফা হওয়ার পরে আবূ বকর (রা)-এর পাণ্ডুলিপিটিকে কয়েকটি কপি করে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র প্রেরণ করেন।

(জ) খৃস্টানগণ বলেন, উসমানের (রা) সময়ে কুরআনের এক কপি রেখে অন্যান্য কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়; কাজেই কুরআনের বিকৃতির সম্ভাবনা আছে। আপনি বলুন, বর্তমানে যদি কুরআনের সবকপি পুড়িয়ে ফেলা হয় তাহলে কি কুরআন বিকৃত হবে? না হাফিযগণ অবিকৃতভাবেই তা তিলাওয়াত করবেন? বর্তমান সময়ের চেয়ে সাহাবীদের যুগে কুরআন মুখস্থ করার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। হাজার হাজার হাফিয সাহাবী-তাবিয়ী মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে ছিলেন। আরবী লিখনপদ্ধতির ভুলে যেন লিখিত কুরআনের মধ্যে কোনো ভুল ঢুকে না পড়ে এজন্য উসমান (রা) আবূ বকর (রা)-এর সংকলিত পাণ্ডুলিপিটির কয়েকটি কপি সর্বত্র প্রেরণ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, এ পাণ্ডুলিপির সাথে যে সকল লিখিত কুরআনের মিল হবে না, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে, যেন অ-হাফিয সাধারণ মুসলিম ভুল পড়া থেকে রক্ষা পান।

২১
৩. প্রচলিত ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’-এর আলোকে প্রচলিত ‘ঈসায়ীধর্ম’
সম্মানিত পাঠক, ঈসায়ী প্রচারকদের দ্বিতীয় দাবিও ভিত্তিহীন অসত্য ছাড়া কিছুই নয়। প্রচলিত তাওরাত-ইঞ্জিল প্রমাণ করে যে, ঈসায়ী বা খৃস্টধর্ম ঈসা মাসীহের ধর্ম নয়, বরং তা সাধু পলের উদ্ভাবিত একটি ধর্ম। নিম্নের বিষয়গুলি অনুধাবন করুন।

২২
৩. ১. সাধু পলের উদ্ভাবিত ধর্মকে ‘ঈসায়ীধর্ম’ বলা
পাঠক, আপনি হয়ত জানেন না! বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠিত অসত্য সাধু পল-এর বানানো ধর্মকে “ঈসায়ী” ধর্ম বা “খৃস্টধর্ম” নামকরণ। প্রচলিত খৃস্টধর্মের সাথে প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিলের’ মধ্যে বিদ্যমান ঈসা মাসীহের কথা ও কর্মের সাথে কোনো মিল নেই। সাধু পলের উদ্ভাবিত ঈসায়ী ধর্মের মূল ভিত্তি (১) ত্রিত্ববাদ, (২) যীশুর ঈশ্বরত্ব, (৩) আদমের পাপে সকল মানুষের জাহান্নামী হওয়া, (৪) তাওবা সত্ত্বেও মানুষদের ক্ষমা করায় আল্লাহর অক্ষমতা, (৫) মানুষদের মুক্তির জন্য আল্লাহর নিজ পুত্রকে কুরবানী করতে বাধ্য হওয়া, (৬) যীশুর ক্রুশে মরে অভিশপ্ত হওয়া, (৭) যীশুর নরকভোগ করা, (৮) শরীয়তের বিধিবিধান বাতিল হওয়া।... প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যেও এ সকল বিষয়ে ঈসা মাসীহের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই বরং বিপরীত বক্তব্য রয়েছে।

২৩
৩. ২. সাধু পল ও তাঁর পয়গম্বর হওয়ার কাহিনী
সাধু পলের (Paul) মূল নাম সৌল (Saul)। তিনি বর্তমান তুরস্কের তারসূস (Tarsus) বা সাইলেশিয়ায় (Cilicia) জন্মগ্রহণ করেন (প্রেরিত ২১/৩৯, ২২/৩)। তিনি জাতিতে রোমান (প্রেরিত: ২২/২৮, ১৬/৩৭-৩৮, ২৩/২৭), মাতৃভাষা গ্রীক (প্রেরিত: ৯/২৯) এবং ধর্মে ইয়াহূদী ছিলেন। (রোমীয় ১১/১-২; করিন্থীয় ১১/২২; ফিলিপীয় ৩/৫)। ধর্মে ইয়াহূদী হলেও ইয়াহূদী ধর্ম ও ধর্মশাস্ত্রের সাথে তাঁর পরিচয় ছিল সামান্যই (রোমীয় ৭/৯; গালাতীয় ১৫/১); তবে তিনি গ্রীক-রোমান ধর্ম ও দর্শনে ব্যাপক অভিজ্ঞ ছিলেন (এনকার্টা: পল)। সাধু পল যীশুর সমসাময়িক ছিলেন, তবে যীশুর জীবদ্দশায় তিনি তাঁকে কখনো দেখেন নি (১ করিন্থীয় ৯/১, ১৫/৮)।

যীশুর তিরোধানের পর তিনি তাঁর অনুসারীদের হত্যা ও নির্যাতন করতেন (প্রেরিত: ৭/৫৮, ৮/৩, ৯/১-২; (২২/৪-৫ ও ২৬/৯-১১); গালাতীয়: ১/১৩)। এরপর তিনি যীশুর অনুসারী হওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি দাবি করেন যীশু তাকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন এবং তাকে শিষ্যত্ব প্রদান করেন। এরূপ হঠাৎ ধর্মান্তরের দাবি ছিল যে, সাধু পল দ্রুত ফিলিস্তিনে এসে হাওয়ারিদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং তাঁদের নিকট থেকে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল শরীফ শ্রবণ ও অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু তিনি তা না করে তাদের থেকে দূরে থাকেন (গালাতীয় ১/১৬-১৭)। তিনি ইঞ্জিল শরীফ সম্পর্কে কিছুই শিক্ষা না করেই শুধু একবার একটু আলো দেখা ও কথা শোনাকেই তার পয়গম্বরীর জন্য যথেষ্ট বলে গণ্য করেন। তিনি ধর্ম, শরীয়ত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে হাওয়ারিদের সাথে কোনোরূপ পরামর্শ না করে নিজেকে তাদের চেয়েও বড় ও সরাসরি ঈসা মাসীহের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত শিষ্য বলে দাবি করতে থাকেন। হাওয়ারীদের কারো মতেরই কোনো দাম নেই বলে ঘোষণা করতে থাকেন (গালাতীয় ১/১১-১২, ১৫, ২/৬, ১-করিন্থীয় ৩/১০, ৪/১৫, ৯/১, ১১/৫-৬)।

ঈসা মাসীহ জীবদ্দশায় ইঞ্জিল প্রচার করেছেন (মথি ৪/২৩, ৯/৩৫, ১১/১৫; মার্ক ১/১৪, ১৫, ৮/৩৫; মার্ক ১০/২৯; লূক ৯/৬...)। সাধু পল কখনোই তাঁর বা শিষ্যদের থেকে ইঞ্জিল শুনেন নি বা শিক্ষা করেন নি। অথচ তিনি নিজেই ইঞ্জিলের রচয়িতা বলে প্রচার করতেন এবং বলতেন: (my gospel) “আমার ইঞ্জিল” (রোমীয় ২/১৬, ১৬/২৫; ২ তিমথীয় ২/৮)। তিনি বারংবার ঘোষণা দেন যে, তাঁর নিজের ইঞ্জিল ছাড়া অন্য কোনো ইঞ্জিল, অর্থাৎ ঈসা মাসীহের মূল ইঞ্জিল যদি কেউ প্রচার করে তবে সে অভিশপ্ত (গালাতীয় ১/৬, ৮-৯; ২-করিন্থীয় ১১/৪)।

সর্বাবস্থায় তাঁর যীশুর শিষ্য হওয়ার কাহিনীটি “প্রেরিত” নামক পুস্তকে ৯, ২২ ও ২৬ অধ্যায়ে তিন স্থানে তিনভাবে দেওয়া হয়েছে। ৯/৩-৭-এর বক্তব্য: “তখন হঠাৎ আকাশ হইতে আলোক তাঁহার চারিদিকে চমকিয়া উঠিল। তাহাতে তিনি ভূমিতে পড়িয়া শুনিলেন, তাঁহার প্রতি এই বাণী হইতেছে: শৌল, শৌল, কেন আমাকে তাড়না করিতেছ? ... কিন্তু উঠ, নগরে প্রবেশ কর, তোমাকে কি করিতে হইবে, তাহা বলা যাইবে। আর তাহার সহপথিকেরা অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহারা ঐ বাণী শুনিল বটে, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইল না (hearing a voice, but seeing no man)।

পক্ষান্তরে ২২/৬-১০-এর ভাষ্য: “হঠাৎ আকাশ হইতে মহা আলো আমার চারিদিকে চমকিয়া উঠিল। তাহাতে আমি ভূমিতে পড়িয়া গেলাম ও শুনিলাম, এক বাণী আমাকে বলিতেছে, শৌল, শৌল, কেন আমাকে তাড়না করিতেছ?... আর যাহারা আমার সঙ্গে ছিল, তাহারা সেই আলো দেখিতে পাইল বটে, কিন্তু যিনি আমার সহিত কথা কহিতেছিলেন, তাঁহার বাণী শুনিতে পাইল না (And they that were with me saw indeed the light, and were afraid; but they heard not the voice of him that spake to me) প্রভু আমাকে কহিলেন, উঠিয়া দামেশকে যাও, তোমাকে যাহা যাহা করিতে হইবে বলিয়া নিরূপিত আছে, সে সমস্ত সেখানেই তোমাকে বলা যাইবে।”

জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বর্ণনায় কি কোনো সাধারণ সুস্থ মানুষ এত স্ববিরোধী কথা বলতে পারে? প্রথম বর্ণনায় সহ-পথিকরা কথা শুনলো কিন্তু আলো দেখল না; আর দ্বিতীয় বর্ণনায় ঠিক তার উল্টো কথা: তারা আলো দেখল কিন্তু কথা শুনলো না!!! এ কি সাধু পলের স্ববিরোধী কথা? না ‘পাক রুহের’ অজ্ঞতার ফল?!

আরেকটি বিষয় দেখুন! উপরের দুস্থানে বলা হয়েছে যে, পলের কী করণীয় সে বিষয়ে যীশু তাকে কোনো নির্দেশ দিলেন না; শুধু বললেন, দামেশকে যাও, সেখানেই সব বলা হবে। অথচ ২৬ অধ্যায়ের ১৬-১৮ শ্লোকে বলা হয়েছে যে, সাধু পলের দায়িত্ব ও করণীয় বিস্তারিত সেখানেই তাকে জানানো হয়েছিল?

এ সকল স্ববিরোধী বক্তব্যের মধ্যে কোনটি সত্য? নাকি সবই মিথ্যা? আমরা জানি না। তবে আমরা দেখেছি যে, সাধু পল স্বস্বীকৃত মিথ্যাবাদী। তিনি জোর গলায় বলেছেন যে, ঈশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মিথ্যা বললে অসুবিধা নেই। তিনি যে বহুরূপী তা তিনি অন্যত্রও স্বীকার করেছেন (দেখুন: ১ করিন্থীয় ১৯-২১)।

তার এ সকল কথা সবই হয়ত মিথ্যা। ঈসা মাসীহের শিক্ষা বিনষ্ট করাকেই তিনি ঈশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধি বলে বিশ্বাস করতেন। এজন্যই তিনি তাঁর অনুসারীদের হত্যা ও নির্যাতন করতেন (প্রেরিত ২৬/৯-১১)। তিনি দেখলেন যে, হত্যা ও নির্যাতন করে যীশুর শিক্ষার বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না; কাজেই শিষ্য সেজে তা বিনষ্ট করতে হবে।

লক্ষণীয় যে, সাধু পল দাবি করেন যে, যীশু তাঁকে বলেছিলেন: “তোমার নিজের লোকদের (ইহুদীদের) এবং অ-ইয়াহূদীদের হাত থেকে আমি তোমাকে রক্ষা করব।” (প্রেরিত ২৬/১৭)। কিন্তু বাস্তবে এ ওয়াদা কার্যকর হয় নি। সাধু পলকে যীশু রক্ষা করেন নি; বরং তিনি নিহত হয়েছেন। ৬২ খৃস্টাব্দের দিকে রোমান সরকার তাকে বন্দী করে এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। (Microsoft® Encarta® 2008: Paul) এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, তিনি মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড নবী ছিলেন। কারণ, আমরা দেখব যে, ভণ্ড নবীর পরিণতি হত্যা বা অপমৃত্যু বলে কিতাবুল মোকাদ্দসে বলা হয়েছে।

বাহ্যত সাধু পল ও তাঁর অনুসারীদের সম্পর্কেই ঈসা মাসীহ বলেন: “ভণ্ড নবীদের বিষয়ে সাবধান হও। তারা তোমাদের কাছে ভেড়ার চেহারায় আসে, অথচ ভিতরে তারা রাক্ষুসে নেকড়ে বাঘের মত। তাদের জীবনে যে ফল দেখা যায় তা দিয়েই তোমরা তাদের চিনতে পারবে। ... যারা আমাকে ‘প্রভু প্রভু’ বলে তারা প্রত্যেকে যে বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে তা নয়। কিন্তু আমার বেহেশতী পিতার ইচ্ছা যে পালন করে সে-ই ঢুকতে পারবে। সেই দিন অনেকে আমাকে বলবে, ‘প্রভু প্রভু, তোমার নামে কি আমরা নবী হিসাবে কথা বলি নি? তোমার নামে কি ভূত ছাড়াই নি? তোমার নামে কি অনেক অলৌকিক কাজ করি নি? তখন আমি সোজাসুজিই তাদের বলব ‘আমি তোমাদের চিনি না। দুষ্টের দল! আমার কাছ থেকে তোমরা দূর হও।’ (মথি ৭/১৫-২৩)। তিনি আরো বলেন: “অনেক ভণ্ড মসীহ্ ও ভণ্ড নবী আসবে এবং ‘বড় বড় আশ্চর্য ও চিন্থ-কাজ করবে যাতে সম্ভব হলে আল্লাহ্‌র বাছাই করা বান্দাদেরও তাঁরা ঠকাতে পারে।” (মথি ২৪/২৪) যীশুকে প্রভু প্রভু বলেছেন, তাঁর নামে অলৌকিক কাজ ও চিন্থ-কাজ করেছেন এবং ‘আল্লাহর বাছাইকরা বান্দাদের’ অর্থাৎ যীশুর সাহাবী-শিষ্যদেরকেও ভুলাতে পেরেছেন এমন ব্যক্তি সাধু পল ছাড়া আর কাউকে আমরা দেখি না।

কেউ যদি ইঞ্জিলের ‘প্রেরিত’ পুস্তকটি ও পরবর্তী পত্রগুলি ভালোভাবে অধ্যয়ন করেন তবে ড. মরিস বুকাইলির নিম্নের বক্তব্যের সাথে অবশ্যই একমত হবেন:

Paul is the most controversial figure of Christianity, He was considered to be a traitor to Jesus’ thought by the latter’s family and by apostles who had stayed in Jerusalem in the circle around James. Paul created Christianity at the expense of those whom Jesus had gathered around him to spread his teachings”.

“পল খৃস্টধর্মের সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ঈসা মাসীহের পরিবার এবং শিষ্যগণ যেরুজালেমে (ঈসা মাসীহের ভাই) জেমসের (যাকোবের) চারিপাশে জমায়েত ছিলেন এবং তারা পলকে মাসীহের চিন্তা-চেতনার বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করতেন। ঈসা মাসীহ তাঁর শিক্ষা প্রচারের জন্য যাদেরকে জমায়েত করেছিলেন সাধু পল তাদের বিপরীতে একটি খৃস্টধর্ম তৈরি করেন।” (Dr. Maurice Bucaile, The Bible, the Qur'an and the Science, page 52)

২৪
৪. ঈসা মাসীহের ধর্ম ও সাধু পলের ধর্মের মধ্যে তুলনা ৪. ১. শরীয়ত পালন অথবা শরীয়ত লঙ্ঘন
ঈসায়ী ধর্ম ও পলীয় ধর্মের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য শরীয়ত পালন। ঈসা মাসীহ কঠোরভাবে শরীয়ত পালন করতেন, করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং শরীয়ত পালন ছাড়া মুক্তি পাওয়া যাবে না বলে প্রচার করেছেন। পক্ষান্তরে দ্রুত অধিক সংখ্যক মুরিদ যোগাড় করার লক্ষ্যে সাধু পল শরীয়ত বর্জন করতে উৎসাহ দেন এবং শরীয়ত পালনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে সকল পাপাচারের পথ উন্মুক্ত করে দেন। শরীয়তের বিরুদ্ধে তাঁর অনেক ঘৃণ্য বক্তব্য রয়েছে। ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান প্রেরিত পুস্তকটি এবং পরবর্তী পত্রগুলি পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, তাঁর এ সকল বক্তব্য হাওয়ারী ও প্রকৃত খৃস্টানদের (Judio Christians) মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ তৈরি করে। তাঁরা তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। তিনিও হাওয়ারীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও অপপ্রচার করতে থাকেন। ফিলিস্তিন ও পার্শবতী এলাকার শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে ভাল ফল না পেয়ে তিনি দ্রুত এশিয়া মাইনর ও ইউরোপের গ্রীক-রোমান পৌত্তলিকদের মধ্যে তাঁর শরীয়তমুক্ত মারফতী ধর্মের দাওয়াত দিতে থাকেন। হাওয়ারী ও শরীয়ত পালনকারী খৃস্টানদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণের জন্য তিনি অতিভক্তিমূলক অনেক নতুন নতুন আকীদা আবিষ্কার করেন। যেহেতু নতুন আকীদাও তাদের পুরাতন পৌত্তলিক আকীদার মতই এবং নতুন কোনো বিধিবিধান মানতে হবে না, শুধু বিশ্বাসই যথেষ্ট, সেহেতু দলে দলে মুর্খ ও পাপ-প্রেমিক মানুষেরা তার মুরিদ হতে লাগলেন।

‘ব্যবস্থা’ বা ‘শরীয়তের’ বিরুদ্ধে সাধু পলের দার্শনিক ও ‘মারফতী” বক্তব্য অনেক। মন শুদ্ধ হলেই হলো। নামায বা শরীয়ত তো বিশ্বাস ঠিক করার জন্য; বিশ্বাস ঠিক হলে আর কিছুই লাগে না। শরীয়তই পাপ করো না বলে পাপের কথা মনে করিয়ে দেয়; শরীয়ত তুলে দিলে আর পাপ থাকবে না!!! ইত্যাদি। সাধুর কয়েকটি বচন শুনুন:

“শরীয়ত পালনের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন না, বরং ঈসা মসীহের উপর ঈমানের জন্যই তা করেন। ... শরীয়ত পালন করবার ফলে কাউকেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে না।” (গালাতীয় ২/১৬) “ব্যবস্থার কার্য ব্যতিরেকে বিশ্বাস দ্বারাই মনুষ্য ধার্মিক গণিত হয়” (রোমীয় ৩/২৮। পুনশ্চ রোমীয় ১০/১০)। “ব্যবস্থা খৃস্টের কাছে আনিবার জন্য আমাদের স্কুল মাস্টার (our schoolmaster) যেন আমরা বিশ্বাস হেতু ধার্মিক গণিত হই।” (গালাতীয় ৩/২৪)। “শাস্ত্র সকলই পাপের অধীনতায় রুদ্ধ (the scripture hath concluded all under sin) (গালাতীয় ৩/২২)। “ব্যবস্থার কার্য দ্বারা কোন প্রাণী তাঁহার সাক্ষাতে ধার্মিক গণিত হইবে না; কেননা ব্যবস্থা দ্বারা পাপের জ্ঞান জন্মে” (রোমীয় ৩/২০)। “বাস্তবিক যাহারা ব্যবস্থার (শরীয়তের) ক্রিয়াবলম্বী, তাহারা সকলে শাপের অধীন।” (গালাতীয় ৩/১০-১৩)।

তাহলে শুধু মনের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকারোক্তি মুক্তির জন্য যথেষ্ট, শরীয়ত শুধু বিশ্বাস পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য। শরীয়ত সকলকে পাপের মধ্যে আবদ্ধ করে, শরীয়তই পাপের উৎস, শরীয়ত পালন করে কেউ ধার্মিক হতে পারে না; বরং পাপী ও অভিশপ্ত হয়। অর্থাৎ ঈসা মাসীহ -সহ সকল নবী ও তাঁদের অনুসারীরা পাপী ও অভিশপ্ত!

তিনি দাবি করেন যে, শরীয়তই সকল শত্রুতা ও হানাহানির কারণ এবং যীশু শরীয়ত বিলোপ করতে এসেছিলেন: “শত্রুতাকে, অর্থাৎ বিধিবদ্ধ আজ্ঞাকলারূপ ব্যবস্থাকে, নিজ মাংসে লুপ্ত করিয়াছেন (abolished in his flesh the enmity, even the law of commandments contained in ordinances)।” (ইফিষীয় ২/১৫)

বিধিবদ্ধ আজ্ঞা বা শরীয়ত কী? শির্ক করিও না, ব্যভিচার করিও না, হত্যা করিও না... । পলীয় খৃস্টধর্মে এগুলি মান্য করা পাপ ও অভিশাপ! তাহলে শির্ক করা, ব্যভিচার করা, হত্যা করা... ইত্যাদিই পাপ ও অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায়!

মাসীহের বক্তব্য সাধুর বচনের সাথে সাংঘর্ষিক। শুধু বিশ্বাসে মুক্তি মিলবে তা কখনোই মাসীহ বলেন নি। শত বিশ্বাস থাকলেও সামান্যতম শরীয়ত লঙ্ঘন করলে জান্নাত মিলবে না বলে তিনি প্রচার করেছেন। তিনি বলেন: “মনে করো না আমি তৌরাত কিতাব আর নবীদের কিতাব বাতিল করতে এসেছি। আমি সেগুলো বাতিল করতে আসি নি বরং পূর্ণ করতে এসেছি। ... মূসার শরীয়তের মধ্যে ছোট একটা হুকুমও যে কেউ অমান্য করে এবং লোককে তা অমান্য করতে শিক্ষা দেয় তাকে বেহেশতী রাজ্যে সবচেয়ে ছোট বলা হবে। কিন্তু যে কেউ শরীয়তের হুকুমগুলো পালন করে ও শিক্ষা দেয় তাকে বেহেশতী রাজ্যে বড় বলা হবে। আমি তোমাদের বলছি, আলেম ও ফরীশীদের ধার্মিকতার চেয়ে তোমাদের যদি বেশী কিছু না থাকে তবে তোমরা কোনমতেই বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে না।” (মথি ৫/১৭-২০)

সাধু পলের দাবি: যীশু শরীয়ত লোপ করতে এসেছিলেন। কিন্তু যীশু বললেন তিনি লোপ করতে নয়, পূর্ণ করতে এসেছিলেন। সাধু পল বললেন, শরীয়ত পালনকারী পাপী ও অভিশপ্ত। আর যীশু বললেন শরীয়তের ক্ষুদ্রতম বিধান লঙ্ঘনকারী পাপী ও অভিশপ্ত। খৃস্টান ভাইগণের প্রতি সবিনয় প্রশ্ন: আপনি কাকে বিশ্বাস ও মান্য করবেন?

মাসীহ বলেন: “যারা আমাকে ‘প্রভু প্রভু’ বলে তারা প্রত্যেকে যে বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে তা নয়। কিন্তু আমার বেহেশতী পিতার ইচ্ছা যে পালন করে সে-ই ঢুকতে পারবে। সেই দিন অনেকে আমাকে বলবে, ‘প্রভু প্রভু, তোমার নামে কি আমরা নবী হিসাবে কথা বলি নি? তোমার নামে কি ভূত ছাড়াই নি? তোমার নামে কি অনেক অলৌকিক কাজ করি নি? তখন আমি সোজাসুজিই তাদের বলব ‘আমি তোমাদের চিনি না। দুষ্টের দল! (হে অধর্মচারীরা: ye that work iniquity) আমার কাছ থেকে তোমরা দূর হও।’ (মথি ৭/২১-২৩)।

যারা তাকে ‘হে প্রভু হে প্রভু’ বলেন তারা অবশ্যই তাকে অন্তরে বিশ্বাস করেছেন এবং মুখে এভাবে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। উপরন্তু তার নামে পবিত্রআত্মার প্রেরণা লাভের দাবি করেছেন, ধর্মপ্রচার করেছেন এবং কারামতি দেখিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তারা জান্নাত লাভ করবেন না; কারণ শত বিশ্বাস ও অতিভক্তি সত্ত্বেও যদি আল্লাহর শরীয়ত পালন বা “ধর্মাচারণ” না থাকে তাহলে মুক্তি মিলবে না।

ঈসা মাসীহ বারংবার বলেছেন যে, আজ্ঞা, বিধান বা শরীয়ত পালনই জান্নাতের একমাত্র পথ। “যে কেহ আমার এই সকল বাক্য শুনিয়া পালন করে... বুদ্ধিমান..। আর যে কেহ আমার এই সকল বাক্য শুনিয়া পালন না করে.. নির্বোধ (মথি ৭/২৪, ২৬)। “এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাকে বলিল, ... অনন্ত (আখেরী) জীবন পাইবার জন্য আমি কিরূপ সৎকর্ম করিব? তিনি তাহাকে কহিলেন: ... তুমি যদি (আখেরী) জীবনে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা কর তবে আজ্ঞা সকল পালন কর (মথি ১৯/১৬-১৭; লূক ১৮/১৮-১৯)

সাধু পল যীশুর এ সকল বক্তব্য প্রচারকারীদেরকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করেছেন; কারণ তারা তার ইঞ্জিলের বিপরীত ইঞ্জিল প্রচার করেন (গালাতীয় ১/৮-৯)। এরপরও যীশুর অনেক বক্তব্য মানুষদের কাছে পৌঁছাত। এজন্য তিনি ও তাঁর অনুসারীরা অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেন। যেমন, তিনি ইয়াহূদীদের ভয়ে বা মানুষে বুঝবে না বলে এগুলি বলেছিলেন। এভাবেই তাঁরা ঈসা মাসীহকে বুঝাতে অক্ষম বা মুনাফিক হিসেবে চিত্রিত করেন (নাউযূ বিল্লাহ)। এমনকি সাধু পল যীশুর শিক্ষাকে প্রাথমিক, আদিম ও পূর্ণতার পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন: “(RSV: let us leave the elementrary doctrine (teachings) of Christ and go on to maturity): অতএব আইস, আমরা খৃস্টের আদিম-প্রাথমিক নীতিমালা (শিক্ষা) পশ্চাতে ফেলিয়া পরিপক্কতার দিকে ধাবিত হই।” (ইব্রীয় ৬/১, বাংলা অনুবাদে কারসাজি বিদ্যমান)

ঈসা মাসীহের শিক্ষা প্রাথমিক ও অপরিপক্ক! তাঁর শিক্ষা প্রাইমারি আর পলের শিক্ষা হাইস্কুল! অবশ্য ত্রিত্ববাদীদের জন্য মাসীহের শিক্ষাকে অপরিপক্ক বলা ছাড়া উপায়ও নেই। তাদের ধর্মের একটি আকীদাও মাসীহের শিক্ষার মধ্যে সুস্পষ্ট নেই। কাজেই তাকে অপূর্ণ এবং সাধু পলকে পূর্ণ বলা ছাড়া তাদের উপায় নেই।

২৫
৪.২. একত্ববাদ বনাম ত্রিত্ববাদ
আগেই বলেছি যে, প্রেরিত পুস্তকটি ও পরবর্তী পত্রগুলি থেকে জানা যায় যে, সাধু পলের এ মতবাদ হাওয়ারী এবং শরীয়ত পালনকারী খৃস্টানদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে। আত্মরক্ষার জন্য তিনি অতিভক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন। এতকাল সকলেই জানত যে বিশ্বাস ও শরীয়ত পালনের মাধ্যমেই মানুষ নাজাত পায়। এখন তিনি বলছেন শরীয়ত পালন মুক্তির পথে প্রতিবন্ধক। এটি প্রমাণের জন্য তিনি বললেন: যীশু তো আর সাধারণ কোনো নবী নন; যে তাকে হত্যা করাতে শুধু হত্যাকারীদের পাপ হয়েছে। বরং তিনি ঈশ্বর; তিনি ক্রুশে মরে সকলের পাপ মোচন করেছেন। কাজেই শরীয়ত পালনের আর প্রয়োজন নেই। তিনি প্রচার করতে থাকেন: “ব্যবস্থা (শরীয়ত) দ্বারা যদি ধার্মিকতা হয়, তাহা হইলে খৃস্ট অকারণে মরিলেন” (গালাতীয় ২/২১)। তিনি বলেন: “খৃস্ট যীশুতে জীবনের আত্মার যে ব্যবস্থা, তাহা আমাদেরকে পাপের ও মৃত্যুর ব্যবস্থা (শরীয়ত) হইতে মুক্ত করিয়াছে (রোমীয় ৮/২) অর্থাৎ শরীয়ত আছে বলেই পাপ এবং পাপ আছে বলেই অনন্ত মৃত্যু বা নরকবাস। যীশুতে বিশ্বাস করলে আর শরীয়ত থাকে না; আর শরীয়ত না থাকলে তো কোনো কিছুই আর পাপ বলে গণ্য হবে না।

সাধু পলের এ উদ্ভাবন সফল হয়েছিল। এ অতিভক্তির আকীদা তাকে ও তাঁর মতবাদকে চিরস্থায়ী করে; নইলে হাওয়ারী ও শরীয়তপন্থীদের প্রতিরোধে তার মতবাদ বিলুপ্ত হয়ে যেত। যেভাবে আমাদের সমাজে শরীয়ত-মুক্ত তরিকত-মারিফত পন্থীগণ সর্বদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ওলীগণের প্রতি অতিভক্তি প্রকাশ করেন এবং শরীয়ত-পন্থীদেরকে বেয়াদব বানিয়ে সাধারণ মানুষদের সমর্থন লাভ করেন ও টিকে থাকেন।

সাধু পলের উদ্ভাবিত ‘অতিভক্তির’ মূল বিষয় ত্রিত্ববাদ। মাসীহ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস এবং প্রচার করতেন। তিনি হিব্রু ভাষার রীতিতে ইয়াহূদী নবীগণ ও সকল ইয়াহূদীর মতই ‘রব্ব’ অর্থে আল্লাহকে পিতা বলতেন। তিনি সর্বদা বলেছেন, পিতাই একমাত্র ঈশ্বর। পিতার পাশাপাশি পুত্র ও পবিত্র আত্মাও ঈশ্বর-এ কথা ঘুণাক্ষরেও তিনি বলেন নি। পক্ষান্তরে সাধু পলের ধর্মের মূল বিশ্বাস যে, আল্লাহ তিনজন সম্পূর্ণ পৃথক ব্যক্তি। এরূপ জঘন্য কথা ঈসা মাসীহ কখনোই বলেন নি।

মার্ক ১২/২৮-৩৪: “একজন আলেম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তৌরাত শরীফের মধ্যে সবচেয়ে দরকারী হুকুম কোনটা’? জবাবে ঈসা বললেন, ‘সবচেয়ে দরকারী হুকুম হল, বনি-ইস্রাইলরা, শোন, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহকে মহব্বত করবে। তার পরের দরকারী হুকুম হল এই, ‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে’। এই দু‘টা হুকুমের চেয়ে বড় হুকুম আর কিছুই নেই”। তখন সেই আলেম বললেন, “... আপনি সত্যি কথাই বলেছেন যে, আল্লাহ্ এক এবং তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আর সমস্ত দিল, সমস্ত বুদ্ধি ও সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁকে মহববত করা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মত মহববত করা পশু ও অন্য সব কোরবানীর চেয়ে অনেক বেশী দরকারী”। ঈসা যখন দেখলেন সেই আলেমটি খুব বুদ্ধিমানের মত জবাব দিয়েছেন তখন তিনি তাঁকে বললেন “আল্লাহর রাজ্য থেকে আপনি বেশী দূরে নন”।

সাধু পলের অনুসারীরা বলেন, আল্লাহকে একমাত্র মাবূদ বলে বিশ্বাস করলেও নাজাত হবে না; বরং ত্রিত্বে, যীশুর ঈশ্বরত্বে ও যীশুর রক্তের মাধ্যমে পাপমোচনে বিশ্বাস করতে হবে। যদি ত্রিত্ববাদী এ আকীদা সঠিক হতো, তবে নিশ্চয়ই ভাববাদীগণের গ্রন্থে প্রথম আজ্ঞা হিসেবে সুস্পষ্টরূপে তা উল্লেখ করা হতো এবং যীশু বলতেন: ‘প্রথম আজ্ঞাটি এই, ‘ঈশ্বর প্রভু এক, যিনি তিনটি প্রকৃত ও সম্পূর্ণ পৃথক সত্তার সমন্বয় এবং আমিই ঈশ্বরের দ্বিতীয় ব্যক্তি ও ঈশ্বরের পুত্র।’ যেহেতু যীশু তা বলেন নি এবং কোনো নবীর পুস্তকে বা ইঞ্জিলেও তা বলা হয় নি, সেহেতু আমরা সুনিশ্চিতরূপে জানতে পারছি যে, সাধু পলের খৃস্টধর্ম একটি ভ্রান্ত মতবাদ।

আরো লক্ষণীয় যে, এ অধ্যাপক ত্রিত্বে বিশ্বাস করতেন না। উপরন্তু কেউ ত্রিত্বের কথা বললে বা যীশু নিজেকে ঈশ্বরের এক অংশ বলে দাবি করলে তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করতেন। অথচ যীশু সুস্পষ্ট উক্ত অধ্যাপককে জান্নাতী বললেন।

সাধু পলের অনুসারীরা বলেন, ইয়াহূদীদের ভয়ে বা মানুষেরা বুঝবে না বলে যীশু মিথ্যা বলেছিলেন! তাঁরা নিজেদের মিথ্যাচার বৈধ করতে তাঁকে অপারগ ও মুনাফিক রূপে চিত্রিত করেন। সত্য বুঝানোর ক্ষমতা ও সাহস পলের ছিল কিন্তু যীশুর ছিল না!

আল্লাহর কাছে মুনাজাতে যীশু বলেন: “আর ইহাই অনন্ত জীবন যে, তাহারা তোমাকে, একমাত্র সত্যময় ঈশ্বরকে এবং তুমি যাঁহাকে পাঠাইয়াছ, তাঁহাকে, যীশু খ্রীষ্টকে, জানিতে পায়। (And this is life eternal, that they might know thee the only true God, and Jesus Christ, whom thou hast sent.)” (যোহন ১৭/৩)

এ কথাটি তিনি একান্তে আল্লাহর সাথে বলেছেন; কাজেই ইয়াহূদীদের ভয়ে বা কেউ বুঝবে না বলে দাবি করার সুযোগ নেই। এখানেও তিনি বলছেন যে, জান্নাত লাভ করতে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই এবং ঈসা মাসীহ তাঁর প্রেরিত অর্থাৎ রাসূল। ঈশ্বরের ত্রিত্বে বিশ্বাস করা, আদি পাপ বা পাপ মোচনে বিশ্বাস করা ... ইত্যাদি কিছুই জান্নাত লাভের শর্ত নয়। একটিবারের জন্য গোপন মুনাজাতেও তিনি বললেন না যে, ‘ইহাই অনন্ত জীবন যে, তাহারা জানিবে তোমার সত্ত্বা তিনটি সম্পূর্ণ পৃথক সত্ত্বার সমন্বয় এবং ঈসা মাসীহ মনুষ্য ও ঈশ্বর বা মাংসে প্রকাশিত ঈশ্বর।’ পক্ষান্তরে পলীয় ধর্মের বিশ্বাস হলো কেউ যদি যীশুর উপরের কথাটি সর্বান্তকরণে ও আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করার কথা এক কোটি বার ঘোষণা করে, কিন্তু স্পষ্টভাবে ত্রিত্ববাদের ঘোষণা না দেয় তবে কাফির (heretic)। তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা (Inquisition) খৃস্টধর্মের সুপরিচিত বিধান।

২৬
৪. ৩. ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল অথবা আল্লাহর অবতার
উপরের বক্তব্যে ঈসা মাসীহ বললেন যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত, অর্থাৎ রাসূল। অন্যত্র তিনি বলেন: “আর পৃথিবীতে কাহাকেও ‘পিতা’ বলিয়া সম্বোধন করিও না, কারণ তোমাদের পিতা এক জন, তিনি সেই স্বর্গীয়। তোমরা ‘আচার্য’ বলিয়া সম্ভাষিত হইও না, কারণ তোমাদের আচার্য এক জন, তিনি খ্রীষ্ট।” (মথি ২৩/৯-১০)

এ কথারও একই অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই এবং ঈসা তাঁর রাসূল, যাকে একমাত্র আচার্য বা শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। অথচ পলীয় ধর্মে তাঁকে আচার্য, উস্তাদ বা রাসূল মানলে নাজাত তো দূরের কথা অনন্ত জাহান্নাম ছাড়া কিছুই মিলবে না। নাজাত লাভ করতে তাঁকে ঈশ্বরের অবতার ও মানবদেহধারী ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করতে হবে (যোহন ১/১, ১৪: ১ তিমথীয় ৩/১৬)।

উল্লেখ্য যে, প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে ঈসা মাসীহ বারংবার নিজেকে আল্লাহর নবী (prophet) বলে ঘোষণা করেছেন। (মার্ক ৬/৩-৬; লূক ১৩/৩৩)

২৭
৪. ৪. আল্লাহই একমাত্র পিতা? না সাধু পল একমাত্র পিতা?
ঈসা মাসীহ উপরের বক্তব্যে বলেছেন যে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে পিতা বলা যাবে না। কিন্তু সাধু পল বলেন, তিনিই উম্মাতের একমাত্র পিতা: “মসীহের বিষয়ে শিক্ষা দিবার লোক হয়ত তোমাদের অনেক হইতে পারে, কিন্তু পিতা তোমাদের অনেক নাই; আমিই সুখবরের মধ্য দিয়া মাসীহী জীবনে তোমাদের পিতা হইয়াছি। (have ye not many fathers: for in Christ Jesus I have begotten you through the gospel) (১-করিন্থীয় ৪/১৫)

২৮
৪. ৫. যীশু আল্লাহর বান্দা পুত্র? না ঈশ্বরত্বে আল্লাহর সমকক্ষ পুত্র?
আল্লাহকে পিতা বলা এবং বান্দাকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হিব্রু ভাষার রীতি। পিতা অর্থ জগৎপিতা বা প্রতিপালক। আর ‘ইবন’ বা পুত্র (son) অর্থ বান্দা। এজন্য কিতাবুল মোকাদ্দসে সকল আদম-সন্তানকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা “আল্লাহর পুত্র” বলা হয়েছে। (আদিপুস্তক ৬/২-৪; ইয়োব ৩৮/৭; গীতসংহিতা ৬৮/৫)। আবার অনেক স্থানে বিশেষ বান্দা হিসেবে সকল ইস্রায়েল-সন্তানকে “আল্লাহর পুত্র” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৪/১, ৩২/১৯; যিশাইয় ১/২, ৩০/১, ৬৩/৮; হোশেয় ১/১০)। বিশেষ করে আল্লাহর অনুগত বান্দাদেরকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হয়েছে: “যত লোক ঈশ্বরের আজ্ঞা দ্বারা চালিত হয়, তাহারাই ঈশ্বরের পুত্র।” (রোমীয় ৮/১৪)। বিপরীতে পাপী লোকদেরকে শয়তানের পুত্র বলা হয়েছে। (মথি ৫/৯, ৪৪, ৪৫; যোহন ৩/৮-১০, ৮/৪১-৪৪)। আবার খাস বান্দা হিসেবে ইয়াকূব (আ) এবং তাঁর পৌত্র ইফ্রিমিয়কে আল্লাহর প্রথমজাত পুত্র বা বড় ছেলে বলা হয়েছে। (যাত্রাপুস্তক ৪/২২ এবং যিরমিয় ৩১/৯)। দায়ূদ (আ)-কে আল্লাহর পুত্র, প্রথমজাত পুত্র ও ‘জন্ম-দেওয়া’ বা ‘ঔরসজাত’ পুত্র বলা হয়েছে (গীতসংহিতা ২/৭)।

হিব্রুভাষী ইয়াহূদীগণ জানতেন যে, ইবনুল্লাহ: ‘আল্লাহর পুত্র’ অর্থ আল্লাহর বান্দা এবং যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত তাকে তত প্রিয় বান্দা হিসেবে একমাত্র পুত্র, ঔরসজাত পুত্র ইত্যাদি বলা হয়েছে। এজন্যই তারা দাঊদ (আ)-কে ‘ইবনুল্লাহ’, আল্লাহ পুত্র, মাসীহুল্লাহ: আল্লাহর মাসীহ ও জন্মদেওয়া পুত্র বলার কারণে তাকে অলৌকিক সত্তা বলে দাবি করেন নি। বরং তাকে ‘আল্লাহর বান্দা দায়ূদ (Servant David) বলেই আখ্যায়িত করেছেন (২-শ্যমুয়েল ৩/১৮, ৭/৫, ৭/৮, ৭/২৬, ১-রাজাবলি ৩/৬, ৮/২৪, ৮/২৫, ৮/২৬, ১১/৩২, ১৪/৮, ২-রাজাবলি ১৯/৩৪, ২০/৬, ১-বংশাবলি ১৭/৭, ২-বংশাবলি ৬/১৫, ৬/১৬, ৬/১৭; গীতসংহিতা ১৩২/১০; যিশাইয় ৩৭/৩৫; যিহিষ্কেল ৩৪/২৩, ৩৪/২৪, ৩৭/২৫; লূক ১/৬৯; প্রেরিত ৪/২৫)।

ইয়াহূদীদের সাথে কথোপকথনে যীশু বলেন: “তোমাদের পিতার কার্য তোমরা করিতেছ। তাহারা তাঁহাকে কহিল, আমরা ব্যভিচারজাত নহি; আমাদের একমাত্র পিতা আছেন, তিনি ঈশ্বর। যীশু তাহাদিগকে কহিলেন, ঈশ্বর যদি তোমাদের পিতা হইতেন, তবে তোমরা আমাকে প্রেম করিতে ... তোমরা তোমাদের পিতা দিয়াবলের, এবং তোমাদের পিতার অভিলাষ সকল পালন করাই তোমাদের ইচ্ছা; ... কেননা সে মিথ্যাবাদী ও তাহার (মিথ্যাবাদীর) পিতা।” (যোহন ৮/৪১-৪২)

প্রচলিত ইঞ্জিলে ঈসা মাসীহ ঠিক এ অর্থেই নিজেকে আল্লাহর পুত্র এবং আল্লাহকে পিতা বলতেন। পাশাপাশি প্রচলিত চারটি ইঞ্জিলের মধ্যে শতশতবার তিনি নিজেকে মনুষ্যপুত্র (son of man) বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিতাবুল মোকাদ্দসে মনুষ্যপুত্র বলতে ‘মরণশীল মানুষ’ ও ‘আল্লাহর বান্দা’ বুঝানো হয়েছে। নবীগণকে বিশেষভাবে মানুষের পুত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যেন কেউ অলৌকিক কার্যাদি দেখে তাদেরকে ঈশ্বরের সাথে সম্পৃক্ত মনে না করে। বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর কখনোই মনুষ্যপুত্র নন, মনুষ্যপুত্র কখনো ঈশ্বর হতে পারে না এবং কোনো মনুষ্যপুত্রের কোনো ক্ষমতা নেই; সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। (গণনাপুস্তক ২৩/১৯; ইয়োব ২৫/৬; গীতসংহিতা ১৪৬/২-৫; যিশাইয় ৫১/১২-১৩)।

বাইবেলের বর্ণনানুসারে কবর থেকে বেরিয়ে মগ্দলীনী মরিয়মকে মাসীহ বলেন: “তুমি আমার ভ্রাতৃগণের কাছে গিয়া তাহাদিগকে বল, যিনি আমার পিতা ও তোমাদের পিতা এবং আমার ঈশ্বর ও তোমাদের ঈশ্বর, তাঁহার নিকটে আমি ঊর্ধ্বে যাইতেছি (I ascend unto my Father, and your Father; and to my God, and your God)।” (যোহন ২০/১৭) তাহলে শিষ্যগণ যে অর্থে ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র যীশুও ঠিক সে অর্থেই ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র। আবার আল্লাহ যে অর্থে অন্য সকল মানুষের মাবুদ, অবিকল সে অর্থেই তিনি ঈসা মাসীহেরও মাবুদ। এ তাঁর জীবনের শেষ শিক্ষা। কুরআন জানায় যে, ঈসা মাসীহ বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু (আল-ইমরান ৫১), “তোমরা আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু আল্লাহর ইবাদত কর... (মায়িদা ৭২ ও ১১৭), “নিশ্চয় আল্লাহ আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু, অতএব তোমরা তার ইবাদত কর” (মরিয়ম ৩৬ এবং যুখরুফ ৬৪)। এভাবেই কুরআন প্রকৃত ইঞ্জিল সংরক্ষণ করেছে।

আমরা দেখেছি যে, তিনি নিজেকে একজন রাসূল ও শিক্ষক হিসেবে প্রচার করেছেন। ঈশ্বরত্বে আল্লাহর সমকক্ষ বলে নিজেকে দাবি করা তো দূরের কথা কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা-ই তাঁর নেই বলে তিনি প্রচার করেছেন। কিয়ামত বিষয়ে তিনি বলেন: “কিন্তু সেই দিনের বা সেই দণ্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না; স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।” (মার্ক ১৩/৩২) অর্থাৎ অলৌকিক ঐশ্বরিক ক্ষমতা তো দূরের কথা, অলৌকিক জ্ঞানও তার নেই।

পিতার সমকক্ষ ঈশ্বরত্ব দাবি করা তো দূরের কথা নিজেকে ভালো বলতেও তিনি রাজি হন নি। এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করে, “হে সৎ গুরু (Good Master), অনন্ত জীবন পাইবার জন্য আমি কিরূপ সৎকর্ম করিব? তিনি তাহাকে কহিলেন, (Why callest thou me good? there is none good but one, that is, God: KJV/AV) আমাকে কেন সৎ (good) কহিতেছ? একজন ব্যতীত আর কেউই সৎ নন, তিনি ঈশ্বর।” (মথি ১৯/১৬-১৭: বাংলা বাইবেলের অনুবাদ অস্পষ্ট)

মাসীহের শিষ্যগণও আল্লাহর পুত্র বা ‘জাত (begotten জন্মদেওয়া) পুত্র’ বলতে আল্লাহর নেককার বান্দা বুঝিয়েছেন। যোহন বলেন: “যে কেহ বিশ্বাস করে যে, যীশুই সেই খ্রীষ্ট, সে ঈশ্বর হইতে জাত (born of God); এবং যে কেহ জন্মদাতাকে প্রেম করে; সে তাঁহা হইতে জাত ব্যক্তিকেও প্রেম করে (every one that loveth him that begat loveth him also that is begotten of him) ইহাতে আমরা জানিতে পারি যে, ঈশ্বরের সন্তানগণকে প্রেম করি, যখন ঈশ্বরকে প্রেম করি ও তাঁহার আজ্ঞা সকল পালন করি। ... আমরা জানি, যে কেহ ঈশ্বর হইতে জাত, সে পাপ করে না; কিন্তু যে ঈশ্বর হইতে জাত সে নিজেকে (আপনাকে) রক্ষা করে (he that is begotten of God keepeth himself) এবং সেই পাপাত্মা (শয়তান) তাহাকে স্পর্শ করে না।” (১- যোহন ৫/১-২ ও ১৮)

এ অর্থেই তাঁরা মাসীহকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন। মার্ক ১৫/৩৯: “সত্যই এ মানুষটি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন (this man was the Son of God)” এবং লূক ২৩/৪৭: সত্য, এই ব্যক্তি ধার্মিক ছিলেন (this was a righteous man)।”

যে অর্থে তাঁরা তাঁকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন, সে অর্থেই তাঁরা তাঁকে আল্লাহর বান্দা বলেছেন। পিতর বলেন: “অব্রাহামের, ইসহাকের ও যাকোবের ঈশ্বর, আমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর আপনার বান্দা যীশুকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন (glorified his servant Jesus)।” (প্রেরিত ৩/১৩)

অন্যত্র শিষ্যগণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় বলেন: “তুমি তোমার দাস (thy servant David) আমাদের পিতা দায়ূদের মুখ দিয়া... কেননা সত্যই তোমার পবিত্র দাস যীশু (thy servant Jesus)..।” (প্রেরিত ৪/২৪-২৭)।

এর বিপরীতে সাধু পল ‘আল্লাহর পুত্র’ কথাকে গ্রীক-রোমান পৌত্তলিকদের পরিভাষায় ব্যবহার করে আক্ষরিক অর্থে তাঁকে “আল্লাহর পুত্র” বলে দাবি করেন। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা যীশুকে আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর একজাত বা একমাত্র ঔরসজাত পুত্র (only begotten Son), পিতা আল্লাহর মতই পরিপূর্ণ আল্লাহ, আল্লাহর অবতার বা মানবরূপী আল্লাহ (God incarnate/ God in flesh) এবং আল্লাহর যাতের অংশ (of the same substance) বলে প্রচার করেন। (যোহন ১/১, ১৪, ১৮ ৩/১৬, ৩/১৮; ইব্রীয় ১১/১৭, কলসীয় ১/১৬, ২/৯; ফিলিপীয় ২/৬, ১-তিমথীয় ৩/১৬)।

এভাবে সাধু পল ও তাঁর অনুসারিগণ ঈসা মাসীহের তাওহীদী দীনকে ত্রিত্ববাদী শির্কী ধর্মে পরিণত করেন। এ কথা মুসলিমদের বানানো কথা নয়। যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া বা ইন্টারনেটে খৃস্টান গবেষকদের লেখা পড়লেই আপনি এ সত্য জানতে পারবেন। মাইক্রোসফট এনকার্টা (Microsoft ® Encarta ® 2008, article (God)) থেকে একটি মাত্র উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

Christianity began as a Jewish sect and thus took over the Hebrew God, the Jewish Scriptures eventually becoming, for Christians, the Old Testament. During his ministry, Jesus Christ was probably understood as a prophet of God, but by the end of the 1st century Christians had come to view him as a divine being in his own right, and this created tension with the monotheistic tradition of Judaism. The solution of the problem was the development of the doctrine of the triune God, or Trinity, which, although it is suggested in the New Testament, was not fully formulated until the 4th century.

“খৃস্টধর্ম ইয়াহূদী ধর্মের একটি ফির্কা হিসেবেই যাত্রা শুরু করে। কাজেই ঈশ্বর বা আল্লাহর বিষয়ে ইয়াহূদীদের বিশ্বাস নিয়েই তার শুরু। ক্রমান্বয়ে ইয়াহূদীদের ধর্মগ্রন্থ খৃস্টানদের নিকট ‘পুরাতন নিয়ম’ বলে গণ্য হয়। যীশু খৃস্ট তার জীবদ্দশাতে আল্লাহর একজন নবী বলেই স্বীকৃত বা গৃহীত হয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু প্রথম শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে খৃস্টানগণ তাঁর বিষয়ে মনে করতে লাগলেন যে, তিনি নিজেই একজন ঐশ্বরিক সত্ত্বা। এ ধারণা ইয়াহূদী ধর্মের একত্ববাদ-এর সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য ত্রিত্ববাদ বা তিন ব্যক্তির ঈশ্বর মতবাদের উৎপত্তি ঘটে। যদিও নতুন নিয়মের মধ্যে এ মতের কিছু ধারণা আছে, তবে ত্রিত্ববাদ মতটি ৪র্থ খৃস্টীয় শতকের আগে পূর্ণরূপ লাভ করে নি।”

এভাবে ঈসা মাসীহের একত্ববাদী ধর্ম একশত বৎসরের মাথায় ত্রিত্ববাদী শির্কী ধর্মে পরিণত হলো, শুধু ঈসা মাসীহের “ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব” কল্পনা করার কারণে। আর এ কল্পনার মূল কারণ ছিল হিব্রু ভাষার সম্মানসূচক “ঈশ্বরের পুত্র” পরিভাষাটির অর্থ গ্রীক ভাষায় ‘আক্ষরিক’ অর্থে ব্যবহার করা।

এ মহা ধ্বংসের জন্য দায়ী ছিলেন সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা। যীশু বলেছেন যে, তিনি শুধু ইস্রায়েল বংশের নবী হিসেবে প্রেরিত। তাদের জন্য “ঈশ্বরের পুত্র” পরিভাষাটির ব্যবহারে কোনো অসুবিধা ছিল না। এজন্য তিনি অ-ইস্রায়েলীদের কাছে তাঁর ধর্ম প্রচার করতে কঠিনভাবে নিষেধ করেন। (মথি ৭/৬, ১০/৫-৮; ১৫/২২-২৮) কিন্তু সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা নিজেরা গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যীশুর ঈশ্বরত্ব দাবি করতে থাকেন এবং এ ধর্মকে এশিয়া মাইনর ও ইউরোপের রোমান অঞ্চলে প্রচার করেন। এ সকল এলাকার মানুষেরা ঈশ্বরের পুত্র পরিভাষাকে আক্ষরিক অর্থেই বুঝতো এবং তাদের দেবদেবীদেরকে ঈশ্বরের পুত্র বা কন্যা হিসেবেই পূজা করত। তারা ঈসা মাসীহকেও এ অর্থেই বুঝে। এভাবে ১০০ বৎসরের মধ্যে ঈসা মাসীহের ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য বিশ্বধর্ম ইসলামে “আল্লাহর প্রিয়পাত্র” হিসেবেও কাউকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলতে নিষেধ করা হয়েছে। (৫-মায়িদা ১৮ আয়াত)।

২৯
৪. ৬. জালিয়াতি ও অপব্যাখ্যা
সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা এ শির্কী বিশ্বাস প্রমাণের জন্য জালিয়াতি ও অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেন। আমরা দেখেছি, কিভাবে তাঁরা বান্দার স্থানে পুত্র লিখে, কিছু কথা মুছে এবং কিছু কথা যোগ করে ত্রিত্ব ও যীশুর ঈশ্বরত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।

আমরা জেনেছি যে, ‘মতানুসারে ইঞ্জিলগুলিও’ পলীয় ধর্মের প্রাধান্য লাভের পর তাঁর অনুসারীদের দ্বারা গ্রীক ভাষায় সংকলিত ‘বেনামী’ ইঞ্জিল। এরপরও এ সকল ইঞ্জিলের মধ্যে ঈসা মাসীহের আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর বান্দা হওয়ার পক্ষে, ঈশ্বর বা ঈশ্বরের সমতুল্য না হওয়ার পক্ষে অগণিত প্রমাণ বিদ্যমান। উপরে আমরা সামান্য কিছু উল্লেখ করলাম। এর বিপরীতে প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিলগুলি’-র মধ্যে যীশুর ঈশ্বরত্বের পক্ষে তাঁর একটিও সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। তবে চতুর্থ ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান তাঁর কিছু কথাকে ত্রিত্ববাদীরা তার ঈশ্বরত্বের প্রতি ‘ইঙ্গিত’ বলে প্রচার করেন। এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:

প্রথমত: মহান আল্লাহ সকল মানুষের প্রেমময় স্রষ্টা। দুনিয়ায় যে যেমনই হোক না কেন সকলেই যেন সহজে মুক্তির পথ বুঝতে ও মানতে পারে এজন্য তিনি নবী-রাসূল প্রেরণ করেন। যে বিশ্বাসের উপর মানুষের মুক্তি নির্ভর করে সে বিশ্বাস যদি ধর্ম প্রচারক বুদ্ধিমান-নির্বোধ প্রত্যেক মানুষের সহজে বুঝার মত সহজবোধ্য ও দ্ব্যর্থহীনভাবে না বলেন তাহলে বুঝতে হবে যে, তিনি ভণ্ড প্রচারক। তিনি মানুষকে সত্যের সন্ধান দেন নি; বরং সত্যকে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য করেছেন। ঈমান ও নাজাতের বিষয় ছাড়া অন্যান্য উপদেশের ক্ষেত্রে হয়ত কোনো নবী-রাসূল অলঙ্কার-এর আশ্রয় নিতে পারেন; কিন্তু মুক্তির দিশাকে তিনি অস্পষ্ট করতে পারেন না।

দ্বিতীয়ত: কোনো মহাপুরুষের কোনো কথা যদি তার সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীত হয় তাহলে তা জাল বলে গণ্য হবে অথবা তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে মাসীহ মানুষের মুক্তির যে মূলমন্ত্র বারংবার উল্লেখ করেছেন, তা হলো ‘আল্লাহর প্রকৃত ও ব্যাখ্যাবিহীন একত্বে বিশ্বাস করা’। কিতাবুল মোকাদ্দসেও তাই বলা হয়েছে। কাজেই এ কথার উল্টা কোনো কথা যদি পাওয়া যায় তবে তাকে এ সুস্পষ্ট মূলনীতির ভিত্তিতেই ব্যাখ্যা করতে হবে।

তৃতীয়ত: চতুর্থ ইঞ্জিল বা যোহনের ইঞ্জিলের বিষয়ে আমরা দেখেছি যে, গ্রন্থটি মূলতই জাল। এর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে খৃস্টান পণ্ডিতদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। তবে তারা সকলেই একমত যে, এ গ্রন্থটি আলঙ্কারিক গ্রীকভাষায় লেখা এবং এতে ব্যাপকভাবে রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই এগুলির ব্যাখ্যা অন্য তিন ইঞ্জিলের সুস্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে করতে হবে।

চতুর্থত: সবচেয়ে বড় কথা, পলীয় খৃস্টানগণ যীশুর যে বক্তব্যগুলি তাঁর ‘ঈশ্বরত্বের ইঙ্গিত’ বলে প্রচার করেন, ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশুর অন্যান্য বক্তব্য প্রমাণ করে যে, সেগুলো অন্য বিষয়ের ইঙ্গিত। ত্রিত্ববাদীদের প্রমাণগুলি দেখুন:

(১) “তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, তোমরা অধঃস্থানের, আমি ঊর্ধ্বস্থানের; তোমরা এ জগতের, আমি এ জগতের নহি।” (যোহন ৮/২৩)। পলীয়গণ প্রচার করেন যে, এখানে যীশু তাঁর ঈশ্বরত্বের প্রতি “ইঙ্গিত” করেছেন। অথচ যীশু ঠিক একই কথা শিষ্যদেরকেও বলেছেন: “তোমরা যদি জগতের হইতে, তবে জগৎ আপনার নিজস্ব বলিয়া ভালোবাসিত; কিন্তু তোমরা ত জগতের নহ..” (যোহন ১৫/১৯)। “আমি তাহাদিগকে তোমার বাক্য দিয়াছি; আর জগৎ তাহাদিগকে দ্বেষ করিয়াছে, কারণ তাহারা জগতের নয়, যেমন আমিও জগতের নই। ... তাহারা জগতের নয়, যেমন আমিও জগতের নই।” (যোহন ১৭/১৪-১৬)

প্রথম বক্তব্য যদি যীশুর ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হয় তবে পরের দুটি বক্তব্য প্রমাণ করে যে, ঈশ্বর দুই বা তিনজন নন; বরং অন্তত ১৪/১৫ জন!

(২) যীশু বলেন: “আমি ও পিতা, আমরা এক (I and my Father are one)।” (যোহন ১০/৩০)। খৃস্টানগণ দাবি করেন, এ কথাটি তাঁর ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করে। অথচ যীশু ঠিক একই কথা বলেছেন শিষ্যদের বিষয়ে। তিনি বলেন: “যেন তাহারা সকলে এক হয়; পিতঃ, যেমন তুমি আমাতে ও আমি তোমাতে, তেমনি তাহারাও যেন আমাদের মধ্যে এক থাকে (That they all may be one; as thou, Father, art in me, and I in thee, that they also may be one in us)... আর তুমি আমাকে যে মহিমা দিয়াছ, তাহা আমি তাহাদিগকে দিয়াছি; যেন তাহারা এক হয়, যেমন আমরা এক (that they may be one, even as we are one); আমি তাহাদের মধ্যে ও তুমি আমাতে, যেন তাহারা একের মধ্যে পরিপূর্ণতা লাভ করে (যেন তাহারা সিদ্ধ হইয়া এক হয়) (I in them, and thou in me, that they may be made perfect in one)।” (যোহন: ১৭/২১-২৩)

তাহলে কি প্রমাণিত হলো যে, যীশুকে যে ঈশ্বরত্ব প্রদান করেছিলেন পিতা ঈশ্বর সে ঈশ্বরত্ব তিনি শিষ্যদেরকে প্রদান করলেন এবং পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর ও শিষ্য ঈশ্বরগণ সকলে মিলে ১৫ ঈশ্বর!

(৩) যীশু বলেন: “যে আমাকে দেখিয়াছে, সে পিতাকে দেখিয়াছে; তুমি কেমন করিয়া বলিতেছ, পিতাকে আমাদের দেখাউন? ... আমি পিতাতে আছি এবং পিতা আমাতে আছেন আমি তোমাদিগকে যে সকল কথা বলি, তাহা আপনা হইতে বলি না; কিন্তু পিতা আমাতে থাকিয়া আপনার কার্য সকল সাধন করেন।” (যোহন ১৪/৯-১০)। পলীয় খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, এটি তাঁর ঈশ্বরত্বের প্রমাণ; কারণ তিনি বলেছেন যে, তাঁকে দেখলেই পিতাকে দেখা হয় এবং পিতা তার মধ্যে রয়েছেন। মজা হলো, তিনি শিষ্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন: “সেই দিন তোমরা জানিবে যে, আমি আমার পিতাতে আছি, ও তোমরা আমাতে আছ, এবং আমি তোমাদের মধ্যে আছি।” (যোহন ১৪/২০)। আরো বলেন: “পিতঃ, যেমন তুমি আমাতে ও আমি তোমাতে, তেমনি তাহারাও যেন আমাদের মধ্যে থাকে (that they also may be one in us)।” (যোহন ১৭/২১)

তাহলে কি প্রমাণিত হলো যে, শিষ্যগণও ঈশ্বর ছিলেন? উপরন্তু প্রচলিত ইঞ্জিলে বলা হয়েছে, সকলের মধ্যেই ঈশ্বর বসত করেন (১-করিন্থীয় ৬/১৯-২০; ২-করিন্থীয় ৬/১৬; ইফিষীয় ৪/৬)। তাহলে কি সকলেই ঈশ্বর?

বাইবেলে মানুষদেরকে god বলা হয়েছে। যাত্রাপুস্তক ৭/১: “সদাপ্রভু মোশিকে কহিলেন, দেখ, আমি ফরৌনের (ফেরাউনের) কাছে তোমাকে একজন আল্লাহ করিয়া (I have made thee a god to Pharaoh: বাংলায় “ঈশ্বর স্বরূপ”, “আল্লাহর মত”) নিযুক্ত করিলাম; আর তোমার ভ্রাতা হারোণ (হারুন) তোমার ভাববাদী (নবী) হইবে”। (গীতসংহিতা/যাবূর ৮২/৬: (I have said, Ye are gods; and all of you are children of the Most High): আমি বলেছিলাম: তোমরা আল্লাহ, তোমরা সবাই আল্লাহ তা‘আলার সন্তান” (কিতাবুল মোকাদ্দসে: তোমরা যেন আল্লাহ’: ‘যেন’ শব্দটি সংযোজিত) । শুধু আল্লাহর পুত্র নয়, মূসা (আ) এবং সকল মানুষই আল্লাহ! এগুলি কি আক্ষরিক অর্থে বুঝতে হবে? না কিতাবুল মোকাদ্দসের অন্যান্য বক্তব্যের আলোকে বুঝতে হবে?

ঈসা মাসীহের উপরের কথাও তাঁর ও নবীগণের সুস্পষ্ট কথার আলোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। কিতাবুল মোকাদ্দস বারংবার বলেছে যে, ঈশ্বরকে দেখা যায় না; যা দেখা যায় তা ঈশ্বর নয়; তিনি কারো মধ্যে থাকেন না; তিনি কারো মত নয়; তিনি এক, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। কাজেই উপরের কথাগুলি এ মূলনীতির আলোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। বস্তুত, কারো মধ্যে আল্লাহর অবস্থান, কারো সাথে আল্লাহর এক হওয়া, কাউকে দেখলে আল্লাহকে দেখা ইত্যাদির অর্থ তার সাথে আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা, প্রেম, তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্যে আল্লহর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা ইত্যাদি।

মজার বিষয় হলো ত্রিত্ববাদী পলীয় খৃস্টানগণও এগুলি বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করেন না। তারা কখনোই বিশ্বাস করেন না যে পিতা ঈশ্বর ও পুত্র ঈশ্বর এক বা যীশুর দেহ দেখলে প্রকৃতই পিতা ঈশ্বরকে দেখা হয়। বরং তারা বিশ্বাস করেন পিতা পুত্র নন এবং পুত্রও পিতা নন; তারা উভয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুজন ব্যক্তি। এরপরও তাঁরা এ সকল কথাকে দলীল হিসেবে পেশ করেন।

৩০
৪. ৭. অলৌকিক কর্ম
পলীয়গণ যীশুর অলৌকিক কর্মগুলোকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বা ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। যেমন, পিতা ব্যতিরেকে জন্ম ও মৃতকে জীবিত করা। বাইবেলের আলোকে এগুলি অলৌকিক ক্ষম

তা বা ঈশ্বরত্বের প্রমাণ নয়। আদম পিতামাতা ব্যতিরেকে জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আ)-এর সমসাময়িক যাজক মল্কীষেদক (Melchisedec) পিতামাতা ব্যতিরেকেই জন্ম গ্রহণ করেন (ইব্রীয় ৭/১-৩)। মৃতকে জীবিত করাও যীশুর কোনো বিশেষত্ব নয়। ইঞ্জিলের বর্ণনানুসারে যীশু মাত্র তিন ব্যক্তিকে জীবিত করেছিলেন। পক্ষান্তরে যিহিষ্কেল ভাববাদী হাজার হাজার মৃত মানুষকে জীবিত করেন (যিহিষ্কেল ৩৭/১-১৪)। মৃতকে জীবিত করা যদি ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হয় তবে যিহিষ্কেল ভাববাদীই ঈশ্বর হওয়ার অধিকতর যোগ্যতা রাখেন। এছাড়া এলিয় (Elijah) একটি মৃত শিশুকে পুনর্জীবিত করেন (১ রাজাবলি ১৭/১৭-২৪)। ইলীশায় (Elisha) একজন মৃত বালককে পুনর্জীবিত করেন (২ রাজাবলি ৪/৮-৩৭)। ইলীশায় কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করেন (২ রাজাবলির ৫/১-১৪)। মূসার (আ) অলৌকিক কার্যাদি প্রসিদ্ধ। অলৌকিক কার্য ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হলে এরা সকলেই ঈশ্বর বলে গণ্য হতেন।

৩১
৪. ৮. পিতা-পুত্র পরিভাষা
খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, ঈসা মাসীহ আল্লাহকে পিতা বলেছেন এবং নিজেকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন, কাজেই তিনি প্রকৃতই আল্লাহর পুত্র। আল্লাহকে পিতা বলা এবং মানুষকে পুত্র বলার প্রকৃত অর্থ আমরা উপরে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, আল্লাহকে পিতা বললে বা কাউকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা আল্লাহর পুত্র বললে যদি তার ঈশ্বরত্ব প্রমাণিত হয় তাহলে হাওয়ারীগণ, সকল ধার্মিক মানুষ, বরং বিশ্বের সকল মানুষই ‘ইবনুল্লাহ’ ও ‘আল্লাহ’ বলে প্রমাণিত হবে!! এখানে আরো কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:

প্রথমত: কিতাবুল মোকাদ্দস প্রমাণ করে যে, পুত্র হিসেবে ঈসা মাসীহ অতি সাধারণ পুত্র। তার কোনো বিশেষত্বের কথা বলা হয় নি। পক্ষান্তরে ইয়াকূব (আ), তাঁর পৌত্র ইফ্রমিয় ও দায়ূদ (আ)-কে “আল্লাহর প্রথমজাত পুত্র” (firstborn) বলা হয়েছে (যাত্রাপুস্তক ৪/২২, যিরমিয় ৩১/৯, গীতসংহিতা ৮৯/২৭) তাহলে কী ইয়াকূব (আ), ইফ্রিমিয় ও দায়ূদ (আ) ঈসা মাসীহের চেয়েও বড় ঈশ্বর!

দ্বিতীয়ত: দায়ূদকে (আ) আল্লাহ বলেন: “(Thou art my Son; this day have I begotten thee) তুমি আমার পুত্র, অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি।” (গীতসংহিতা ২/৭)। ইংরেজি (beget) অর্থ পিতা কর্তৃক সন্তান জন্ম দেওয়া, অর্থাৎ ঔরসে জন্ম দেওয়া। বাইবেলে অসংখ্যবার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন (Abraham begat Isaac) ইবরাহীম ইসহাককে জন্ম দিলেন। দায়ূদ নবীকে আল্লাহ তার পুত্র বানিয়েই ক্ষান্ত হন নি; উপরন্তু তিনি জানালেন যে, দায়ূদ তার জন্ম দেওয়া বা ঔরসজাত (begotten) সন্তান। দায়ূদ মানবসন্তান হয়ে জন্মলাভের প্রায় ৫০ বৎসর পরে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে জন্মলাভ করলেন! এরূপ কোনো বৈশিষ্ট্য যীশুর বিষয়ে বলা হয় নি। তাহলে প্রমাণ হলো যে, দায়ূদ যীশুর চেয়ে অনেক বড় ঈশ্বর!

তৃতীয়ত: পলীয়গণ যীশুকে আল্লাহর একমাত্র ‘জন্মদেওয়া’ বা ঔরসজাত: ‘একজাত’ পুত্র (only begotten Son of God) বলে প্রচার করেন। সাধু পল ও তার অনুসারীরা চতুর্থ ইঞ্জিলে ও একটি পত্রে এ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, তবে যীশুর বক্তব্যে ঢুকাতে পারেন নি ( যোহন ১/১৮, ৩/১৬, ৩/১৮; ১-যোহন ৪/৯)।

কথাটি অসত্য। বাইবেল অনুসারে যীশু নন; বরং দায়ূদই আল্লাহর ‘একজাত’ বা একমাত্র জন্ম দেওয়া পুত্র। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে মাসীহ কোথাও বলেন নি যে, তিনি ‘আল্লাহর জন্ম দেওয়া পুত্র (begotten Son)’। যদি তা থাকতো তবে আমরা বলতাম: দায়ূদ আল্লাহর প্রথম এবং যীশু দ্বিতীয় ‘জন্ম-দেওয়া’ পুত্র। কিন্তু তা নেই!

চতুর্থত: তাঁরা দাবি করেন, আল্লাহ যখন দায়ূদ (আ)-কে বলেন: ‘অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি” তখন তিনি দায়ূদকে বুঝান নি, ঈসা মাসীহকে বুঝিয়েছেন, কারণ তিনি দায়ূদের সন্তান বা দায়ূদের বংশধর!!!

কী উদ্ভট কথা! ইঞ্জিলে আল্লাহ যীশুকে যে মর্যাদার কথা বলেছেন কেউ যদি বলেন যে, কথাটি যীশুর জন্য নয়; বরং ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য, কারণ তিনি যীশুর বংশের, অথবা বারাক ওবামার জন্য, কারণ তিনি যীশুর অনুসারী- তাহলে আপনি তাকে কী বলবেন? পাগলের সাথে কি বিতর্ক হয়?

আর যীশু দায়ূদের সন্তানই বা কিভাবে? পিতার দিক থেকে? না মাতার দিক থেকে? মরিয়মের স্বামী ইউসূফ দায়ূদের বংশধর ছিলেন। তবে ইঞ্জিল স্পষ্টত বলেছে যে, যীশু কোনোভাবেই ইউসুফের সন্তান নন। তার দেহে ইউসুফের রক্ত নেই। আর তার মাতা মরিয়ম দায়ূদের বংশধর ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। বরং চতুর্থ শতকের শ্রেষ্ঠ খৃস্টান ধর্মগুরু অগাস্টিন (St. Augustine: 354-430) লিখেছেন যে, তার যুগে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয়েছে যে, মরিয়ম লেবির বংশধর। (ইযহারুল হক্ক: বঙ্গানুবাদ ১/১৬৪) ইয়াকূব (আ)-এর ১২ ছেলের একজন লেবি এবং অন্যজন যিহূদা। দায়ূদ যিহূদার বংশধর। আর মরিয়ম লেবির বংশধর। কাজেই যীশুর দায়ূদ-বংশের হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

পঞ্চমত: ‘আজ আমি তোমাকে জন্ম দিলাম’ কথাটির উদ্দেশ্য যদি মাসীহ হন তাহলে ত্রিত্ববাদী খৃস্টধর্ম বাতিল হয়ে যায়। কারণ এতে প্রমাণিত হয় যে, দায়ূদের শাসনামলে খৃস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে পুত্র ঈশ্বরের জন্ম! অথচ ত্রিত্ববাদীদের বিশ্বাস লক্ষ কোটি বৎসর পূর্বে পুত্র ঈশ্বরের জন্ম! তিনি পিতারই মত অনাদি।

ষষ্ঠত: সম্মানিত পাঠক, এ অনুচ্ছেদের শুরুতে আমরা বলেছি যে, ঈসা মাসীহের ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করতে পলের অনুসারিগণ জালিয়াতির আশ্রয় নিতেন। এরূপ জালিয়াতির একটি প্রমাণ, বিগত প্রায় দু হাজার বৎসর যাবৎ নতুন নিয়মের যত স্থানে (only begotten Son) লেখা ছিল ১৯৫২ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনে সকল স্থান থেকে (begotten) শব্দটি ফেলে দিয়ে (only Son) লেখা হয়েছে; কারণ নতুন নিয়মের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলিতে এ শব্দটি নেই। ইংরেজি KJV ও RSV দুটি সংস্করণে যোহন ১/১৮, ৩/১৬, ৩/১৮; ১-যোহন ৪/৯ মিলিয়ে দেখলেই পাঠক তা জানতে পারবেন।

সপ্তমত: ঈসা মাসীহ আল্লাহর একমাত্র পুত্র (only Son) একথা বিশ্বাস করতে হলে পুরো কিতাবুল মোকাদ্দস ও ঈসা মাসীহকে মিথ্যাবাদী বলে বিশ্বাস করা জরুরী। কারণ আমরা দেখেছি যে, কিতাবুল মোকাদ্দসে ও ইঞ্জিল শরীফে আল্লাহর আরো লক্ষ কোটি পুত্র ও কন্যার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

৩২
৪. ৯. পবিত্র আত্মার ঈশ্বরত্ব
পবিত্র আত্মা: পাক রূহ (Holy Spirit), পবিত্র ভূত (Holy Ghost), ঈশ্বরের আত্মা (Spirit of God/ Spirit of the LORD) শব্দগুলি বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মে অনেক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও একে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঈশ্বরের তিন ব্যক্তির এক ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করা হয় নি। বরং কখনো মানুষ, কখনো নবী, কখনো ফিরিশতা এবং কখনো আল্লাহর প্রেরণা বুঝানো হয়েছে। যেমন: “সদাপ্রভু কহিলেন, আমার আত্মা মনুষ্যদের মধ্যে নিত্য অধিষ্ঠান করিবে না; কারণ সেও তো মাংস মাত্র (My Spirit shall not always strive with man, for that he also is flesh) পরন্তু তাহাদের সময় এক শত বিংশতি বৎসর হইবে। (আদিপুস্তক ৬/৩) এখানে আল্লাহর আত্মা বলতে সুস্পষ্টত আল্লাহর সৃষ্ট মানবাত্মা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর রূহ বা মানবাত্মা অমর হবে না; বরং সীমিত বৎসর- ১২০ বৎসর!- আয়ু লাভ করবে।

অন্যত্র আল্লাহ মৃতদেরকে জীবন দান প্রসঙ্গে বলেন: “আর আমি তোমাদের মধ্যে আপন আত্মা দিব (And shall put my spirit in you)।” (যিহিষ্কেল ৩৭/১৪)। এখানেও “আল্লাহর রূহ” বলতে ‘মানবীয় আত্মা’ বা জীবন বুঝানো হয়েছে।

প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির মধ্যে বিদ্যমান ঈসা মাসীহের বক্তব্যে পবিত্র আত্মা ও পবিত্র ভূতের কথা কয়েকবার এসেছে। কোথাও তিনি তাকে আল্লাহ বা আল্লাহর তিন ব্যক্তির একব্যক্তি বলে উল্লেখ করেন নি। বরং বাহ্যত তিনি তাঁকে আল্লাহর ওহীর বাহক হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন: “আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, মনুষ্যদের সকল পাপ ও নিন্দার ক্ষমা হইবে, কিন্তু পবিত্র আত্মার নিন্দার ক্ষমা হইবে না। আর যে কেহ মনুষ্যপুত্রের (ঈসা মাসীহের) বিরুদ্ধে কোনো কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে, কিন্তু যে কেহ পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে না, ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।” (মথি ১২/৩১-৩২)

এখানে পবিত্র আত্মা অর্থ ওহীর বাহক। পবিত্র আত্মার মাধ্যমেই নবীগণ ওহী লাভ করেন। এজন্য যীশু বললেন, যদি কেউ সত্য নবীর ওহী লাভের দাবি অবিশ্বাস করে অথবা ওহীর নামে মিথ্যা বলে তবে দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এজন্যই বাইবেলের বিধান: ওহীর নামে মিথ্যা বললে দুনিয়াতেই নিহত হতে হবে।

সাধু পলই সর্বপ্রথম পবিত্র আত্মা বা ঈশ্বরের আত্মা বলতে পৃথক ঐশ্বরিক সত্ত্বা ও স্বয়ং সম্পূর্ণ ঈশ্বর বলে দাবি করেন। (রোমীয় ৮/২)

৩৩
৪. ১০. আদিপাপ ও প্রায়শ্চিত্তবাদ (Original Sin & Atonement)
সাধু পল উদ্ভাবিত ধর্মের অন্যতম বিশ্বাস আদিপাপ ও প্রায়শ্চিত্ত, যার মূল কথা:

“আদম নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে মহাপাপ করেন। এজন্য কিয়ামত পর্যন্ত সকল আদমসন্তানের শাস্তি ও অনন্ত মৃত্যু পাওনা হয়। ‘পিতার অপরাধে সকল সন্তানের নরক-গমনের’ এ “দয়াময়” ব্যবস্থায় দয়াময় স্রষ্টা অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন। বিনা রক্তপাতে মানুষকে ক্ষমা করতে অক্ষম হয়ে তিনি নিজের পুত্রকে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, পাপের জন্য পাপী নিজের বা পাপীর সন্তানগণ রক্তপাত করলে হবে না! বরং নিরপরাধ-নিষ্পাপ কাউকে ধরে কুরবানি দিতে হবে। এজন্য স্রষ্টা নিজের আপন পুত্রকে কুরবানি হিসেবে পৃথিবীতে পাঠান। তিনি ক্রুশে মরে অভিশপ্ত হয়ে নরকে প্রবেশ করেন। তিনদিন নরক ভোগ করেন এবং শয়তানের হাত থেকে নরকের চাবি কেড়ে নিয়ে মানুষদেরকে চিরতরে মুক্ত করে দেন। এখন মানুষ যত পাপই করুক না কেন যীশুর ঈশ্বরত্বে ও কুরবানীতে বিশ্বাস করলেই নরক থেকে চিরমুক্তি!”

চিন্তা করুন! আল্লাহ একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দিবেন! পাপী ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করতে পারবেন না! পাপী বা তার সন্তানগণ কাফ্‌ফারা-কুরবানী দিলে হবে না, পাপীর অপরাধে নিষ্পাপকে কুরবানী দিতে হবে! একজন খৃস্টান লেখক লিখেছেন:

"No heathen tribe has conceived so grotesque an idea, involving as it does the assumption, that man was born with a hereditary stain uopn him, and that this stain (for wihch he was not personally responsible) was to be atoned for, and that the creator of all things had to sacrifice His only begotten son to neutralise this mysterious curse."

“কোনো নাস্তিক জংলী উপজাতিও এরূপ উদ্ভট বিশ্বাস পোষণ করে না যে, মানুষ বংশগতভাবে পাপের কলঙ্ক নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং এ কলঙ্ক, যার জন্য সে নিজে কোনোরূপ দায়ী নয়, তার জন্য কাফ্‌ফারা দিতে হবে এবং এ রহস্যময় অভিশাপকে অকার্যকর করতে সকল কিছুর স্রষ্টা নিজের একমাত্র ঔরসজাত সন্তানকে কুরবানী দিতে বাধ্য হলেন।” (Ahmed Deedat, The Choice, Volume 2, page 165.)

ইঞ্জিলের মাসীহ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রেফতারের আগের রাতে মাটিতে মাথা ঠুকে কেঁদেছিলেন ও প্রার্থনা করেছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি চিৎকার করে বলেন: “আল্লাহ তুমি কেন আমাকে পরিত্যাগ করলে!” (মথি ২৬/৩৬-৪৬, ২৭/৪৬)। অপরাধীর মুক্তির জন্য একজন অনিচ্ছুক নিরাপরাধীকে জোর করে হত্যা করতে হবে!

এ আকীদার সবচেয়ে বড় দিক ঈশ্বরের মহানুভবতা! শাস্তির ক্ষেত্রে অকৃপণ ও মহানুভব হলেও মুক্তির ক্ষেত্রে কৃপণ! (নাঊযু বিল্লাহ) আদমের পাপের কারণে শাস্তি পেতে কোনো মানুষের কোনো বিশ্বাস বা স্বীকারোক্তির প্রয়োজন নেই। ফ্রি শাস্তি! তবে যীশুর ত্যাগের কারণে মুক্তিটা ফ্রি নয়! বরং বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তি লাগবে!

সাধু পলের ভাষায়: “একটা পাপের মধ্য দিয়া যেমন সমস্ত মানুষকেই আজাব পাইবার যোগ্য বলিয়া ধরা হইয়াছে, তেমনি একটি ন্যায্য কাজের মধ্য দিয়া সমস্ত মানুষকেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করিবার ব্যবস্থাও করা হইয়াছে। যেমন একজন মানুষের অবাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেকেই পাপী হইয়াছিল, তেমনি একজন মানুষের বাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেকেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করা যাইবে।” (রোমীয় ৫/১৭-১৮)... “রক্তসেচন (রক্তপাত) না হইলে পাপমোচন হয় না।” (ইব্রীয়: ৯/২২) পুনশ্চ: (রোমীয় ৪/২৫, ৫/১২, ১৪, ১০/৯; গালাতীয় ৩/১০-১৩; ইফিষীয় ১/৭; করিন্থীয় ১৫/২১-২২)।

এ উদ্ভট আকীদার দুটি বিষয়ই ভিত্তিহীন অসত্য (১) একের পাপে অন্যের শাস্তি ও একের ত্যাগে অন্যের মুক্তি এবং (২) রক্তপাত ছাড়া পাপমুক্তি হয় না।

কিতাবুল মোকাদ্দসের বিধান: “প্রত্যেক জন আপন আপন অপরাধ প্রযুক্ত মরিবে” (যিরমিয় ৩১/৩০)। “যে প্রাণী পাপ করে সে-ই মরিবে।” (যিহিষ্কেল ১৮/৪)। পুনশ্চ: দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১৬, ২-রাজাবলি ১৪/৬; ২-বংশাবলি ২৫/৪।

যিহিস্কেল ১৮/১৯-২৩: “তবুও তোমরা বলছ, ‘বাবার দোষের জন্য কেন ছেলে শাস্তি পাবে না?’ সেই ছেলে তো ন্যায় ও ঠিক কাজ করেছে এবং আমার সমস্ত নিয়ম কানুন যত্নের সংগে পালন করেছে, তাই সে নিশ্চয়ই বাঁচবে। যে গুনাহ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে। কিন্তু একজন দুষ্ট লোক তার সব গুনাহ থেকে ফিরে আমার সব নিয়ম-কানুন পালন করে আর ন্যায় ও ঠিক কাজ করে তবে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে, মরবে না। সে যেসব অন্যায় করেছে তা আমি আর মনে রাখব না। সে যেসব সৎ কাজ করেছে তার জন্যই সে বাঁচবে। দুষ্ট লোকের মরণে কি আমি খুশী হই? বরং সে যখন কুপথ থেকে ফিরে বাঁচে তখনই আমি খুশী হই।

এতে প্রমাণ হয় (১) একের পাপে যেমন অন্যের শাস্তি এবং একের ত্যাগে অন্যের মুক্তির দাবি শতভাগ মিথ্যা এবং আল্লাহর নামে বে-ইনসাফির অপবাদ, (২) পাপীর মুক্তির জন্য কাফ্‌ফারা বা রক্তপাত নিষ্প্রয়োজন; তাওবা ও ধর্মপালনই যথেষ্ঠ। আর এটিই তো আল্লাহর ইনসাফ, দয়া ও মমতার প্রকাশ।

এভাবে বাইবেলে আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, পাপীর মুক্তির জন্য তিনি কাফ্‌ফারা বা কুরবানী চান না; বরং পাপীর ঈমান, তওবা ও নেক কর্ম চান: “আমি বিশ্বস্ততা চাই, পশু-কোরবানী নয়: পোড়ানো-কোরবানীর চেয়ে আমি চাই যেন মানুষ সত্যিকারভাবে আল্লাহ্‌কে চেনে। (হোশেয় ৬/৬। মথি ৯/১৩ ও ১২/৭)

ইঞ্জিলে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস, সকল মনপ্রাণ দিয়ে তাঁকে ভালবাসা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মত ভালবাসা- সকল কাফ্‌ফারার চেয়ে অধিক শক্তিশালী এবং এরূপ বিশ্বাস ও কর্ম থাকলেই সে জান্নাতী (মার্ক ১২/৩২-৩৪)

যীশু বলেন: “মনুষ্যদের সকল পাপ ও নিন্দার ক্ষমা হইবে, কিন্তু পবিত্র আত্মার নিন্দার ক্ষমা হইবে না। আর যে কেহ মনুষ্যপুত্রের (যীশুর) বিরুদ্ধে কোনো কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে, কিন্তু যে কেহ পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে না, ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।” (মথি ১২/৩১-৩৩)।

সাধু পলের মতবাদ সত্য হলে ঈসা মাসীহের কথা মিথ্যা বলতেই হবে! কারণ মাসীহ বলছেন যে, পাপ ক্ষমার জন্য অন্য কোনো বিষয় ধর্তব্য নয়, শুধু পাপের বড়ত্ব ও ভয়ঙ্করত্বই বিবেচ্য; এজন্য পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে অপরাধ, অর্থাৎ ওহীর নামে জালিয়াতি, কোনো সত্য নবীর প্রতি অবিশ্বাস বা শির্ক-কুফর-এর পাপ ক্ষমা করা হবে না, অন্যান্য পাপ ক্ষমা করা হবে। এর বিপরীতে সাধু পল বলছেন, পাপের গভীরতা বা বড়ত্ব বিবেচ্য নয়; বরং কাফ্‌ফারা তত্বে পাপীর বিশ্বাসই বিবেচ্য। কাফ্‌ফারা ছাড়া কোনো পাপই ক্ষমা হবে না। আর যীশুর রক্তে কাফ্‌ফারা তত্ত্বে বিশ্বাস করলে পবিত্র আত্মার নিন্দা-সহ সকল পাপই ক্ষমা হবে।

ইঞ্জিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষেরা কয়েকজন শিশুকে ঈসা মাসীহের নিকট দো‘আর জন্য নিয়ে আসে। কিন্তু শিশুদের তাঁর নিকট আনয়নকে অন্যায় মনে করে শিষ্যগণ লোকগুলির উপর রাগ করেন। এতে মাসীহ অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন: “শিশুদেরকে আমার নিকট আসিতে দেও, বারণ করিও না; কেননা ঈশ্বরের রাজ্য এই মত লোকদেরই (for of such is the kingdom of God/ kingdom of heaven.। (মার্ক ১০/১৪) আরো দেখুন: মথি ১৯/১৪; লূক ১৮/১৬

তাহলে ঈসায়ী আকীদায় আদিপাপ বলে কিছুই নেই। কোনো মানুষই পাপ নিয়ে জন্মায় না বরং নিষ্পাপ জন্মগ্রহণ করে। বড় হয়ে মানুষ পাপ করে। কাজেই কেউ যদি বড় হয়ে করা পাপগুলি বর্জন করে শিশুদের মত হতে পারে তবে জান্নাত পাবে। পক্ষান্তরে পলীয় আকীদায় প্রত্যেক মানুষই আদিপাপ নিয়ে জন্মায়; শুধু পিতা-পুত্র-পবিত্র বিশ্বাসের মাধ্যমে মুক্তি পায়। এ বিশ্বাস ছাড়া পাপ বর্জন করে শিশুর মত হলেও কোনো লাভ নেই; আর এ বিশ্বাস থাকলে পাপ করলেও তেমন অসুবিধা নেই!

৩৪
৪. ১১. মধ্যস্থ না সরাসরি
বিশ্বের সকল মুশরিক সম্প্রদায়ের শির্কের মূল ভিত্তি আল্লাহর দয়া বা ক্ষমা লাভ করতে মধ্যস্থ গ্রহণ প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করা। তারা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম কিছু বান্দাকে বিশেষ ক্ষমতা বা মধ্যস্থতার ক্ষমতা দিয়েছেন। এদের মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর রহমত পাওয়া যায় না। যেমন রাজার নিকট যেতে প্রজাদের রাজার প্রিয়ভাজন খাদিমদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়। আর এ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই তারা দেবতা, মুর্তি, সেন্ট ইত্যাদির পূজা করেন বা তাদের কাছে ধর্ণা দেন।

আসমানী গ্রন্থগুলির শিক্ষা: আল্লাহর দীন, ইবাদত ও কল্যাণ লাভের পদ্ধতি জানতে নবী-রাসূল ও আলিমগণের সহায়তা লাগে। তবে তাঁকে ডাকতে, প্রার্থনা করতে, তাঁর করুণা, সান্নিধ্য বা মুক্তি লাভ করতে কোনো মধ্যস্থতা লাগে না। কারণ তিনি মহারাজার মত প্রজা থেকে দূরে নন, প্রজা বিষয়ে অজ্ঞ নন এবং প্রজার প্রতি কঠোর নন। বরং তিনি মমতাময়, সর্বজ্ঞ এবং বান্দার সবচেয়ে নিকটবর্তী। এ বিষয়ে মাসীহ বলেন: “তোমাদের পিতার কাছে চাইবার আগেই তিনি জানেন তোমাদের কি দরকার” (মথি ৬/৮) “চাও, তোমাদের দেওয়া হবে, খোঁজ কর, পাবে, দরজায় আঘাত দাও, তোমাদের জন্য খোলা হবে।” (মথি ৭/৭)

কিতাবুল মোকাদ্দসের নবীদের গ্রন্থগুলিতে এবং প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান ঈসা মাসীহের বাণীতে কোথাও এ মধ্যস্থতার আকীদার বিন্দুমাত্র স্থান নেই। মধ্যস্থ (mediator) শব্দটি আপনি সাধু পলের পত্র ছাড়া কিতাবুল মোকাদ্দসের কোথাও পাবেন না। সাধু পল গ্রীক-রোমান পৌত্তলিকদের “মধ্যস্থ” বিশ্বাসকে ভিত্তি করে ঈসা মাসীহকে মধ্যস্থ বলে প্রচার করেন। তিনি বলেন: “কারণ একমাত্র ঈশ্বর আছেন; ঈশ্বরের ও মনুষ্যদের মধ্যে একমাত্র মধ্যস্থও আছেন; তিনি মনুষ্য খৃস্ট যীশু।” (১-তিমথীয় ২/৫-৬) এভাবে তিনি সর্বত্র মধ্যস্থ (mediator)-এর প্রয়োজনীয়তা এবং যীশুই মধ্যস্থ বলে প্রচার করতে থাকেন। দেখুন: গালাতীয় ৩/১৯, ২০; ইব্রীয় ৮/৬, ৯/১৫, ১২/২৪)

৩৫
৫. পলীয় ত্রিত্ববাদ (Trinity)-এর প্রকৃতি ৫. ১. ঈসায়ী ধর্মের কালেমা কী?
আমরা দেখলাম, পলীয় খৃস্টধর্মে শরীয়ত, ইবাদত ইত্যাদির গুরুত্ব নেই। যাজকগণ ধর্মকর্মের সব কিছুতেই ছাড় দিতে প্রস্তুত। তবে একটি বিষয়ে তাঁরা বিন্দু মাত্র ছাড় দিতে রাজি হন নি; তা হলো ত্রিত্ববাদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের একটি শব্দ নিয়ে সামান্য দ্বিধা করলেই তাকে অভিশাপ দেওয়া থেকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা! এ বিশ্বাসটি এত অযৌক্তিক ও উদ্ভট যে, খৃস্টান প্রচারকগণ নতুন খৃস্টানদেরকে তা খুলে বলেন না। এখানে আমি খৃস্টধর্মের মূল কালেমা, বিশ্বাসের সাক্ষ্য বা নাইসীন ক্রীড (Nicene creed) হুবহু্ উল্লেখ করছি:

We believe in one God, the Father Almighty, Maker of all thing, visible and invisible; and in one Lord Jesus Christ, the Son of God, the only begotten of the Father, that is, of the substance of the Father; God of God, light of light, true God of true God; begotten, not made, consubstantial with the Father, by whom all things were made, both in heaven and in earth; who for us men, and for our salvation, descended, was incarnate, and was made man, and suffered, and rose again the third day: he ascended into heaven, and shall come to judge the living and the dead; And in the Holy Spirit. But the holy catholic and apostolic Church of God anathematizes those who affirm that there was a time when the Son was not, or that he was not before he was begotten, or that he was made of things not existing: or who say, that the Son of God was of any other substance or essence, or created, or liable to change or conversion.

“আমরা বিশ্বাস করি এক ঈশ্বরে, সর্বশক্তিমান পিতা, সকল কিছুর স্রষ্টা, দৃশ্য ও অদৃশ্য; এবং একজন প্রভু যীশু খৃস্টে, ঈশ্বরের পুত্র & পিতার একমাত্র জন্ম-দেওয়া (ঔরসজাত) পুত্র (only begotten Son), অর্থাৎ পিতারই যাত বা সত্ত্বা থেকে, ঈশ্বর থেকে ঈশ্বর, আলো থেকে আলো, সত্য ঈশ্বর থেকে সত্য ঈশ্বর, জন্ম দেওয়া (begotten: ঔরসজাত), সৃস্ট নয়; পিতার সাথে মূলগত-সারবস্তুতে এক; যার দ্বারা সকল কিছু সৃষ্ট; আসমানে ও যমিনে, যিনি আমাদের মানুষদের জন্য এবং আমাদের পরিত্রানের জন্য অবতরণ করেন, দেহ ধারণ করেন, তাকে মানুষ বানানো হয়, তিনি দুঃখভোগ করেন, এবং তৃতীয় দিনে পুনরায় উত্থান করেন। তিনি স্বর্গে উঠেন, এবং জীবিত ও মৃতদের বিচার করতে আবার আগমন করবেন। এবং পবিত্র আত্মায়। কিন্তু পবিত্র মহাসম্মেলন ও শিষ্যদের অনুসারী মণ্ডলী অভিশাপ দিচ্ছে তাদেরকে যারা দাবি করে যে, পুত্র অনাদি নন- এক সময় ছিল যখন পুত্র বিদ্যমান ছিলেন না, অথবা তাঁকে জন্ম দেওযার আগে তাঁর অস্তিত্ব ছিল না, অথবা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে অনাদি কোনো বস্তু দ্বারা; অথবা যারা বলে যে ঈশ্বরের পুত্র অন্য কোনো বস্তু বা সারবস্তুর; অথবা তিনি সৃষ্ট, অথবা তিনি পরিবর্তন বা রূপান্তর যোগ্য।" (A Historical View of the Council of Nice, p 44) পাঠক, প্রয়োজনে the creed লিখে ইন্টারনেটে সার্চ করুন।

সম্মানিত পাঠক, নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:

(ক) একটি ধর্মের মূলবিশ্বাস সে ধর্মের ধর্মগ্রন্থের কোথাও নেই! আমাদের ঈমানের কালিমা কুরআনে এবং হাদীসে শতশতবার বলা হয়েছে। আর খৃস্টধর্মের ঈমানের এ সুবৃহৎ কালিমাটির কোনো অস্তিত্ব ‘কিতাবুল মোকাদ্দসে’ নেই। পাপ, পুন্য ও শরীয়ত পালন সম্পর্কে মাসীহ কত কথা বলেছেন! শিষ্যগণ না বুঝলে আবার বুঝিয়েছেন। বর্তমান ঈসায়ী ধর্মে এসব কথা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়! বরং পাপ ও অভিশাপের উৎস! অথচ যে বিশ্বাসের উপর মুক্তি নির্ভর করছে তা তিনি বুঝালেন না!

(খ) এ বিশ্বাসের মূল বিষয় আল্লাহ বা পিতা নন; পুত্র বা যীশু। পিতার প্রতি ঈমানের বিষয়টি কয়েক শব্দে শেষ! বাকি সব কথা শুধু পুত্রকে নিয়ে! পুত্রকে জন্ম-দেওয়া (begotten) ও ‘পিতার যাত বা সত্ত্বা (substance of the Father) থেকে’ বলে বিশ্বাস করতেই হবে; না-হলে অভিশাপ থেকে আগুনে মৃত্যু! ঈসা (আ)-কে আল্লাহর পুত্র, তবে জন্ম-দেওয়া (begotten) বা ‘যাত থেকে’ নয়; বরং ‘মাখলূক (made) পুত্র’ বলে বিশ্বাস করার কারণে ৩য়-৪র্থ শতকের প্রসিদ্ধ খৃস্টান ধর্মগুরু আরিয়ূস (Arius) এবং তাঁর অনুসারীগণ (Arians) কি ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তা জানতে পাঠক উপরের শব্দ দুটি দিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করতে পারেন।

(গ) আমরা দেখলাম যে, এ ঘৃণ্য শির্কী শব্দটি প্রচলিত ইঞ্জিল থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। খৃস্টান ধর্মগুরু ও বাইবেল বিশেষজ্ঞগণ বাইবেলের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে এ ঘৃণ্য শব্দটির অস্তিত্ব না পেয়ে তা ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ শব্দটির উচ্ছেদের সাথে সাথে ত্রিত্ববাদের উচ্ছেদ জরুরী ছিল; কিন্তু ধর্মগুরুগণ তা করেন নি। কারণ ইঞ্জিলে কি আছে বা নেই তা তাদের বিবেচ্য নয়; তাদের ত্রিত্ববাদী গুরুগণ কি বলেছেন, সেটিই বড় বিষয়। এজন্যই আল্লাহ বলেন: “বলুন, ‘হে কিতাবীগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না; এবং যে সম্প্রদায় ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না।”’ (৫-মায়িদা: ৭৭)

৩৬
৫. ২. ত্রিত্ববাদের ব্যাখ্যা
ত্রিত্ববাদ বা (Trinity) অর্থ (the unity of Father, Son, and Holy Spirit as three persons in one Godhead): এক ঈশ্বরত্বের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা এই তিন ব্যক্তির মিলন। এর ব্যাখ্যায় ঈসায়ী ধর্মগুরুগণ বলেন:

There is exactly one God. There are three really distinct Persons - Father, Son, and Holy Spirit. Each of the Persons is God. The Father is God. The Son is God. The Holy Spirit is God. The Father is not the Son. The Son is not the Holy Spirit. The Father is not the Holy Spirit

(http://www.bbc.co.uk/religion/religions/christianity/beliefs/trinity_1.shtml)

“একজন ঈশ্বর বিদ্যমান, সম্পূর্ণ পৃথক তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিদ্যমান: পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। তিনজনের প্রত্যেক ব্যক্তিই ঈশ্বর: পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর, পবিত্রআত্মা ঈশ্বর। পিতা পুত্র নন, পুত্র পবিত্র আত্মা নন, পিতা পবিত্র আত্মা নন।”

কিভাবে সম্পূর্ণ তিনজন পৃথক ব্যক্তি একজন হলেন তা কখনোই ত্রিত্ববাদীরা বুঝতে বা বুঝাতে পারেন নি। হয়ত খৃস্টান প্রচারক আপনাকে বলবেন, যেমন মাংস, অস্থি ও রক্ত তিন বস্তু দিয়ে মানব দেহ; তেমনি পিতা-পুত্র-পবিত্রআত্মার সমন্বয়ে আল্লাহ! সম্ভবত তিনি জানেনও না যে, এ কথা বলার সাথে সাথে ত্রিত্ববাদী বিশ্বাস অনুসারে তিনি কাফির হয়ে গিয়েছেন! কারণ ত্রিত্ববাদে পিতা-পুত্র-পবিত্র আত্মা এক ঈশ্বরের তিন অঙ্গ বা অংশ নন; বরং প্রত্যেকে পৃথক ঈশ্বর! আচ্ছা বলুন তো মাংস, অস্থি ও রক্তকে কি বলা যায় প্রত্যেকেই পৃথক মানুষ! সম্পূর্ণ পৃথক সত্ত্বা?!

ত্রিত্ববাদ বিষয়ে বিবিসির খৃস্টধর্ম বিষয়ক ওয়েবসাইটের ভাষ্য:

The Trinity is a controversial doctrine; many Christians admit they don't understand it, while many more Christians don't understand it but think they do. .... The doctrine of the Trinity is one of the most difficult ideas in Christianity, but it's fundamental to Christians ... This idea that three persons add up to one individual seems like nonsense. And logically, it is. (www.bbc.co.uk/religion/religions/christianity/beliefs/trinity_1.shtml)

“ত্রিত্ববাদ একটি বিতর্কিত মতবাদ; অনেক খৃস্টানই স্বীকার করেন যে, তারা তা বুঝেন না। অন্যান্য অধিকাংশ খৃস্টান তা বুঝেন বলে ধারণা করেন, তবে প্রকৃতপক্ষে তারা তা বুঝেন না। .. ত্রিত্ববাদী বিশ্বাস খৃস্টধর্মের সবচেয়ে কঠিন বিশ্বাসগুলির অন্যতম; যদিও খৃস্টানদের জন্য এটি মূল বিষয়। তিনজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে একক ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছেন-এরূপ ধারণা ননসেন্স বা নির্বোধ প্রলাপ বলেই প্রতীয়মান হয়। আর যুক্তির বিচারে তা নির্বোধ প্রলাপই বটে।”

আর এ ‘ননসেন্স’ নিয়েই বিগত দু হাজার বৎসর ধরে খৃস্টানদের যত দলাদলি ও খুনোখুনি। ‘অবতারবাদ’ বা মানুষরূপে ঈশ্বরের (God incarnate) বিশ্বাস হিন্দুধর্মেও রয়েছে। হিন্দুরা খুবই সহজভাবে কৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতার (God incarnate) বলে বিশ্বাস করেন। এর ব্যাখ্যা চাইলে তারা অতি সহজে বলবেন যে, ঈশ্বর মানুষ রূপে এসেছিলেন.... ইত্যাদি। খৃস্টানগণ যীশুকে ঈশ্বরের অবতার (God incarnate) বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু আল্লাহর একত্ব, ঈসা মাসীহের প্রেরিতত্ব (রাসূলত্ব) ও মনুষ্যত্ব বিষয়ক কিতাবুল মোকাদ্দসের এবং ঈসা মাসীহের অগণিত সুস্পষ্ট বক্তব্য বাতিল করে ‘ত্রিত্ববাদ’ প্রমাণ করতে যেয়ে তারা গলদঘর্ম হয়ে পড়েন।

‘তিনে এক’-এর ‘ননসেন্স’ ছাড়াও আরো সমস্যা আছে। পলীয় ধর্মে যে নতুন দুজন ঈশ্বর আবিষ্কার করা হলো তাদের প্রকৃতি নিয়ে তাঁদের সমস্যার অন্ত নেই। পুত্র ঈশ্বরের প্রকৃতি: মানুষ যীশুর সাথে পুত্র ঈশ্বরের সমন্বয় কিভাবে? মানুষ যীশু কিভাবে এবং কখন থেকে ঈশ্বর ও ঈশ্বরের পুত্র? জন্ম থেকে না পরবর্তী কোনো সময়ে? তাঁর মধ্যে কয়টি সত্ত্বা বিদ্যমান ছিল? একটি? না দুটি? তৃতীয় ঈশ্বর ‘পবিত্র আত্মা’র উৎস কী? প্রথম ঈশ্বর না প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় ঈশ্বর? প্রকৃতপক্ষে কেউ এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। ফলে একজনের ব্যাখ্যার সাথে অন্যজনের ব্যাখ্যা মিলে না। খৃস্টধর্মের অগণিত দল উপদল ও যুদ্ধ বিগ্রহ মূলত এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই। আগ্রহী পাঠক যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া বা ইন্টারনেটে নিম্নের বিষয়গুলি দেখুন:

Chalcedon, Council of; Syrian Orthodox Patriarchate of Antioch, Nestorius; Nestorian, Monarchianism; Paul Of Samosata, Trinitarian heresies, Modalism, Tritheism, Partialism, Adoptionism, Arianism, The Filioque fracas, Schism...

কোনোভাবে এ সকল ‘ননসেন্স আকীদা’ বুঝাতে না পেরে তারা এখন বলেন: (the Trinity of Persons being conceived as an irrational truth found in revelation) তিন ব্যক্তির ঐক্য আল্লাহর কিতাবে বিদ্যমান একটি অযৌক্তিক সত্য। অর্থাৎ বিষয়টি অযৌক্তিক, তবে যেহেতু আল্লাহর কিতাবে বিদ্যমান তাই বিশ্বাস করি।

তাদের এ কথাটি অসত্য। খৃস্টানগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, ত্রিত্ববাদের কথা বাইবেলে কোথাও বলা হয় নি। (Trinity) শব্দটিতো দূরের কথা, এ আকীদায় যা বলা হয় সে বিষয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসে, ইঞ্জিল শরীফে, শিষ্যদের পত্রে কোথাও পরিষ্কার কিছু নেই। নিজেরাই বলছেন, এ বিষয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসে স্পষ্ট কিছুই নেই। আবার বলছেন, কিতাবে আছে বলে বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করি!

তাঁরা বলেন, এ বিষয়ক কিছু ইঙ্গিত বাইবেলে বিদ্যমান। আমরা আগেই বলেছি যে, বুদ্ধিমান-নির্বোধ সকল মানুষের জন্য বিশ্বাসের বিষয়টি পরিষ্কার করতেই নবী-রাসূলগণ আগমন করেন। কাজেই যে বিশ্বাসের উপর মুক্তি নির্ভর করে সে বিশ্বাস কখনো ইঙ্গিত হতে পারে না। সর্বোপরি, কিতাবুল মোকাদ্দসের সুস্পষ্ট ও ব্যাখ্যাতীত বক্তব্যের বিপরীতে ইঙ্গিত নামের অপব্যাখ্যাকে কিতাবের শিক্ষা বলা যায় না।

৩৭
৫. ৩. ত্রিত্ববাদের উপকারিতা
এ বিশ্বাসের লাভ কী? এ বিষয়ে বিবিসির খৃস্টধর্ম বিষয়ক ওয়েবসাইটের ভাষ্য:

Absolutely nothing worthwhile for the practical life can be made out of the doctrine of the Trinity taken literally. (Immanuel Kant, Der Streit der Fakultätencite) ...the doctrine of the Trinity so easily appears to be an intellectual puzzle with no relevance to the faith of most Christians. Karen Kilby. Until quite recently, many theologians thought that the doctrine of the Trinity was pretty pointless. And the churches themselves disagree about the content of the doctrine... And yet somehow it remains at the heart of the Christian faith ..... (www.bbc.co.uk/religion/religions/christianity/beliefs/trinity_1.shtml)

“ইম্মানুলে কান্ট বলেন: ‘বাস্তব জীবনের কল্যাণকর সামান্য কোনো কিছুই ত্রিত্ববাদী আকীদা থেকে অর্জন করা যায় না।’ কারেন কিলবি বলেন: ‘খুব সহজেই বুঝা যায় যে, ত্রিত্ববাদী আকীদাটি একটি বুদ্ধির গোলকধাঁধা, অধিকাংশ খৃস্টানের বাস্তব জীবনে এর কোনো কার্যকরিতা নেই।’ একেবারে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক খৃস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ বিশ্বাস করেন যে, ত্রিত্ববাদী আকীদা একেবারে অন্তসারশূণ্য। আর খৃস্টান চার্চগুলিও এ বিশ্বাসের বিষয়বস্তুগুলির বিষয়ে একমত নয়।... এরপরও এ আকীদাটিই খৃস্টধর্মের মূল বিষয়।”

৩৮
৬. খৃস্টধর্ম বংশীয়-গোত্রীয় ধর্ম না সর্বজনীন ধর্ম
আমরা দেখলাম যে, প্রচলিত কিতাবুল মোকাদ্দসের বিশুদ্ধতা নেই। আর এ বিকৃতিপূর্ণ কিতাব প্রমাণ করে যে, প্রচলিত ঈসায়ী ধর্ম ঈসা মাসীহের ধর্ম নয়। এরপরও যদি প্রকৃত ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ বিদ্যমান থাকত এবং মাসীহের ধর্ম অবিকল বিদ্যমান থাকত তবুও কোনো বাঙালী-ভারতীয় এ ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তি পেত না।

একটি ধর্ম যে শুধু কোনো বংশের জন্য হতে পারে তা বাংলাদেশের মুসলিমগণ বুঝতে পারেন না। এজন্য খৃস্টান প্রচারকগণ তাদের বলেন, যারা খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন সকলেই ইস্রায়েল বংশ! এত বড় মিথ্যা কথা তারা নির্বিকারেই বলেন। বাইবেলের ভাষায় বিশ্বের মানুষ দু ভাগে বিভক্ত: (১) ইস্রায়েল (ইয়াকূব আ)-এর ১২ পুত্রের বংশধর। এদেরকে আল্লাহর সন্তান, আল্লাহর প্রজা, ও আল্লাহর বাছাইকৃত প্রজা (children, people, chosen people of God) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (২) অন্যান্য সকল বংশ, রক্ত, বর্ণ ও দেশের সকল আদম সন্তান। এদেরকে পরজাতি (nations)- ‘অ-ইয়াহূদী’, আরবীতে উম্মী, উমামী, যাদের কাছে নবী আসে নি- বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাঙালী, ভারতীয়, আরব, চীনা... সকলেই পরজাতি।

কিতাবুল মোকাদ্দস সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, তা কেবল ইস্রায়েল বংশীয়দের মুক্তি ও পরিত্রাণের জন্য। এখানে মুক্তি, রহমত, বরকত, ঈমান, সততা বা নেককর্মের বিষয়ে যত বক্তব্য রয়েছে তা শুধু ইস্রায়েল বংশীয়দের জন্য। অন্য কোনো বংশের মানুষদের জন্য এ দাওয়াত নয়। ইঞ্জিলের বক্তব্য: “এই বারো জনকে যীশু প্রেরণ করিলেন, আর তাঁহাদিগকে এই আদেশ দিলেন- তোমরা পরজাতিগণের (Gentiles) পথে যাইও না এবং শমরীয়দের কোন নগরে প্রবেশ করিও না; বরং ইস্রায়েল-কুলের হারানো মেষগণের কাছে যাও। আর তোমরা যাইতে যাইতে এই কথা প্রচার কর, ‘স্বর্গ-রাজ্য সন্নিকট হইল”’ (মথি ১০/৫-৮)

এখানে অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় ঈসা মাসীহ বলেছেন যে, তার ধর্ম সার্বজনীন নয়। ‘পরজাতি’ অর্থাৎ অ-ইস্রায়েলীয় কোনো মানুষকে তার ধর্মে দীক্ষা দেওয়া যাবে না। এমনকি শমরীয়গণ যারা মূলত ইস্রায়েলীয়, কিন্তু অ-ইস্রায়েলীয়দের সাথে বিবাহ-শাদী করে অন্যবংশে মিশে ছিল তাদেরকেও তাঁর ধর্মে দীক্ষা প্রদান করা যাবে না। কেবল “বিশুদ্ধ ইস্রায়েল বংশীয়দের” মধ্যেই তার ধর্মের প্রচার সীমাবদ্ধ থাকবে। খৃস্টধর্মের স্বর্গরাজ্যের সকল সুসংবাদ কেবলমাত্র তাঁদের জন্য।

ঈসা মাসীহ কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন: “পবিত্র বস্তু কুকুরদিগকে দিও না, এবং তোমাদের মুক্তা শূকরদের সম্মুখে ফেলিও না; পাছে তাহারা পা দিয়া তাহা দলায় এবং ফিরিয়া তোমাদিগকে আক্রমণ করে।” (মথি ৭/৬।)

অর্থাৎ ইস্রায়েলের ১২ গোত্রের মানুষ ছাড়া সকলেই কুকুর ও শূকর-তূল্য। কাজেই কোনো পবিত্র বস্তু তাদেরকে দেওয়া যাবে না। ধর্মের দীক্ষা তো দূরের কথা, চিকিৎসা বা ঝাড়-ফুঁকও তাদের দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে ইঞ্জিল শরীফের বক্তব্য: “আর দেখ, ঐ অঞ্চলের এক জন কনানীয় স্ত্রীলোক আসিয়া এই বলিয়া চেঁচাইতে লাগিল, হে প্রভু, দায়ূদ-সন্তান, আমার প্রতি দয়া করুন, আমার কন্যাটি ভূতগস্ত হইয়া অত্যন্ত ক্লেশ পাইতেছে। কিন্তু তিনি তাহাকে কিছুই উত্তর দিলেন না। তখন তাঁহার শিষ্যেরা নিকটে আসিয়া তাঁহাকে নিবেদন করিলেন, ইহাকে বিদায় করুন, কেননা এ আমাদের পিছনে পিছনে চেঁচাইতেছে। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, ইস্রায়েল-কুলের হারানো মেষ ছাড়া আর কাহারও নিকটে আমি প্রেরিত হই নাই (I am not sent but unto the lost sheep of the house of Israel)। কিন্তু স্ত্রীলোকটি আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল, প্রভু, আমার উপকার করুন। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, সন্তানদের খাদ্য লইয়া কুকুরদের কাছে ফেলিয়া দেওয়া ভাল নয় (It is not meet to take the children's bread and to cast it to dogs)।” (মথি ১৫/২২-২৮)

অন্যত্র বলা হয়েছে: “তখনই একজন স্ত্রীলোক, যাহার একটি মেয়ে ছিল, আর তাহাকে অশুচি আত্মায় পাইয়াছিল, তাঁহার বিষয় শুনিতে পাইয়া আসিয়া তাঁহার চরণে পড়িল। স্ত্রীলোকটি গ্রীক, জাতিতে সুর-ফৈনীকী। সে তাঁহাকে বিনতি করিতে লাগিল, যেন তিনি তাহার কন্যার ভূত ছাড়াইয়া দেন। তিনি তাহাকে কহিলেন, প্রথমে সন্তানরা তৃপ্ত হউক, কেননা সন্তানদের খাদ্য লইয়া কুকুরদের কাছে ফেলিয়া দেওয়া ভাল নয়। কিন্তু স্ত্রীলোকটি উত্তর করিয়া তাঁহাকে কহিল, হাঁ, প্রভু, আর কুকুরেরাও মেজের নিচে ছেলেদের খাদ্যের গুঁড়াগাঁড়া খায়। তখন তিনি তাহাকে বলিলেন, এই বাক্য প্রযুক্ত চলিয়া যাও, তোমার কন্যার ভূত ছাড়িয়া গিয়াছে।” (মার্ক ৭/২৫-২৯)

এখানে ঈসা মাসীহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দুটি বিষয় জানিয়েছেন:

প্রথমত: তাঁকে পৃথিবীর সকল মানুষের মুক্তির জন্য প্রেরণ করা হয় নি। তাঁকে কেবল ইস্রায়েল বংশের মুক্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁর ইঞ্জিলে পরিত্রাণ, মুক্তি, স্বর্গ-রাজ্য ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে তা সবই শুধু ইস্রায়েল বংশের মানুষদের জন্য। অন্য কোনো বংশের মানুষের জন্য নয়।

দ্বিতীয়ত: ইস্রায়েল বংশের সন্তানগণ ঈশ্বরের সন্তান। অ-ইস্রায়েলীয় মানুষ কুকুর বৈ কিছুই নয়। সন্তানের খাদ্য যেমন কুকুরকে দেওয়া ঠিক নয়, তেমনি অ-ইস্রায়েলীয় কোনো মানুষকে ঈসা মাসীহের দো‘আ দেওয়াও ঠিক নয়।

খৃস্টান প্রচারকগণ বলেন: যীশু কবর থেকে পুনরুত্থানের পর শিষ্যদেরকে বলেন: “তোমারা সমুদয় জগতে যাও, সমস্ত সৃষ্টির নিকটে সুসমাচার প্রচার কর।” (মার্ক ১৬/১৫-১৬)। “অতএব তোমরা গিয়া সমুদয় জাতিকে শিষ্য কর; পিতার ও পুত্রের ও পবিত্র আত্মার নামে তাহাদিগকে বাপ্তাইজ (স্নান করাও: দীক্ষা দাও) কর। আমি তোমাদিগকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিয়াছি সেই সমস্ত পালন করিতে তাহাদিগকে শিক্ষা দেও।” (মথি ২৮/১৯)। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, খৃস্টধর্ম বিশ্বধর্ম।

বাইবেলের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য বক্তব্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এ কথাগুলি ঈসা মাসীহ বলেন নি, বরং তাঁর নামে পরবর্তীকালে সংযোজিত। কারণ:

(ক) বাইবেলের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলিতে মার্কের ইঞ্জিলের ১৬ অধ্যায়ের শেষে এ কথাগুলি নেই। রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনের মথির ইঞ্জিলের শেষে নিম্নের টীকা লেখা হয়েছে: (some of the most ancient authorities bring the book to a close at the end of verse 8) “সবচেয়ে প্রাচীন ইঞ্জিলগুলির কয়েকটিতে এ ইঞ্জিলটির ১৬ অধ্যায়ের ৮ আয়াতেই সমাপ্ত হয়েছে।” এতে প্রমাণ হয় যে, সকল জাতির কাছে প্রচারের নির্দেশনাবলি সবই পরবর্তী সংযোজন।

(খ) মাসীহ প্রেরিতদেরকে বলেন: “কেননা আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, ইস্রায়েলের সকল নগরে তোমাদের কার্য শেষ হইবে না, যে পর্যন্ত মনুষ্যপুত্র না আইসেন (Ye shall not have gone over the cities of Israel, till the Son of man be come.) (মথি ১০/২৩) তাহলে ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে প্রচার কার্য শেষ হওয়ার আগেই কিয়ামত হবে এবং তাঁর পুনরাগমন হবে। কাজেই ইস্রায়েলীয়গণ ছাড়া অন্যান্য জাতিকে দাওয়াত দেওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না।

(গ) ঈসা মাসীহের স্বর্গারোহনের অনেক পরে অ-ইস্রায়েলী মানুষদের এক জমায়েতে ঈসা মাসীহের প্রধান খলীফা ‘পিতর’ বলেন: আপনারা ত জানেন যে, একজন ইয়াহূদীর পক্ষে একজন অ-ইয়াহূদীর সংগে মিলামিশা করা বা তাহার সংগে দেখা করা আমাদের শরীয়তের বিরুদ্ধে। কিন্তু খোদা আমাকে দেখাইয়া দিয়াছেন, কাহাকেও নাপাক বা অপবিত্র বলা আমার উচিত নয়।..” (প্রেরিত ১০/২৮)

এ কথা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, যীশুর শিষ্যগণ নিজেদেরকে ইয়াহূদী শরীয়তের অনুসারী বলেই বিশ্বাস করতেন এবং অ-ইয়াহূদীদের দাওয়াত দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের সাথে মেলামেশা ও কথাবার্তাকেও শরীয়ত বিরোধী বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তাকে বুঝিয়েছেন যে, কাউকে অপবিত্র মনে করতে হয় না; মাসীহ বা আল্লাহ তাকে অন্যদের কাছে গমন করতে নির্দেশ দিয়েছেন- সেকথা তিনি বলেন নি। কাজেই সকল জাতির কাছে যাওয়া নির্দেশটি জাল।

(ঘ) সাধু পল মাসীহের নতুন নিয়ম সম্পর্কে লিখেছেন: “প্রভু কহেন, এমন সময় আসিতেছে, যখন আমি ইস্রায়েল-কুলের সহিত এবং যিহূদা-কুলের সহিত এক নূতন নিয়ম সম্পন্ন করিব... কিন্তু সেই সময়ের পরে আমি ইস্রায়েল কুলের সহিত এই নিয়ম স্থির করিব..।” (ইব্রীয় ৮/৮)। এতে প্রমাণ হয় যে, সাধু পলও জানতেন যে, নতুন নিয়ম বা ইঞ্জিল শরীফ শুধু ইস্রায়েল বংশ ও ইয়াহূদীদের জন্য।

(ঙ) সাধু পল ‘শিষ্য’ হওয়ার কয়েক বৎসর পর ঈসা মাসীহের শিষ্যদের বা হাওয়ারিদের সাথে সাক্ষাত করেন। তাদের বিষয়ে তিনি লিখেছেন: “তাহারা দেখিলেন ইয়াহূদীদের নিকট সুখবর প্রচার করিবার ভার যেমন পিতরের উপর দেওয়া হইয়াছিল, তেমনি অ-ইয়াহূদীদের নিকট সুখবর প্রচার করিবার ভার খোদা আমার উপর দিয়াছেন।” (গালাতীয় ২/৭) এ কথাটিও নিশ্চিত করে যে, ঈসা মাসীহ পিতর-সহ তাঁর ১১ শিষ্যকে ইয়াহূদী ছাড়া আর কারো কাছে প্রচারের দায়িত্ব দেন নি। সাধু পলই সর্বপ্রথম দাবি করেন যে, তাঁকে অ-ইয়াহূদীদের কাছে প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈসায়ী ধর্ম সকল জাতির কাছে প্রচার করার নির্দেশটি জাল। এরপরও যদি আমরা ধরে নিই যে, তিনি তা বলেছেন তবে এর অর্থ হবে “তোমরা ইস্রায়েল বংশের ১২ জাতির সকল মানুষের কাছে প্রচার করতে যাও”।

অন্য কারো কাছে প্রচার করবে বা করবে না- তা উল্লেখ না করে তিনি যদি বলতেন: ‘তোমরা ইস্রায়েল বংশের কাছে প্রচার কর’ তাহলে আমরা ধারণা করতাম যে, তিনি প্রথমে ইস্রায়েলীদের এবং পরে সমস্ত বিশ্বকে দাওয়াত দিতে বলেন। কিন্তু বলেছেন: “আমি ইস্রাইল বংশ ছাড়া কারো জন্যই প্রেরিত হই নি”, “তোমরা ইস্রাইল বংশ ছাড়া কারো কাছেই যেও না”। এরপর যদি আমরা বলি যে, বিশ্বের সকলকে দাওয়াত দিতে বলেছেন- তাহলে তাঁকে স্ববিরোধিতায় অভিযুক্ত করা হবে।

তাঁর এ কথার আরেকটি অর্থ হতেও পারে। তিনি বলেছেন, আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছি যে, অ-ইস্রায়েলীগণ শূকর ও কুকুর, তাদেরকে দীক্ষা বা দো‘আ দেওয়া যাবে না, তবে যদি কোনো অ-ইস্রায়েলীয় নিজেকে “উচ্ছিষ্ট-খেকো কুকুর” বলে স্বীকার ও বিশ্বাস করে তাকে দো‘আ ও দীক্ষা দেওয়া যাবে। এ সকল শিক্ষা তোমরা বিশ্বের সকল মানুষের কাছে বলবে। কোনো অ-ইস্রায়েলীয় যদি নিজেকে ‘উচ্ছিষ্ট-খেকো কুকুর’ বলে বিশ্বাস ও স্বীকার করে এবং তাওহীদ ও শরীয়ত পালন বিষয়ক আমার সকল আজ্ঞা পালন করে তবে সেও মুক্তি পাবে।

বস্তুত, ইসলামই একমাত্র বিশ্বধর্ম এবং একমাত্র ধর্ম যা কখনোই বংশ, রক্ত, ভাষা বা বর্ণ দিয়ে মানুষকে বিচার করেনি। আমরা পরে তা আলোচনা করব, ইন-শাআল্লাহ।

৩৯
৭. খৃস্টান প্রচারকদের কয়েকটি অসত্যকথন ৭. ১. ঈসায়ী মুসলিম, ঈসায়ী তরীকা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কুরআন মান্য করা
খৃস্টান প্রচারকগণ বলেন: আমরা মুসলিম, ঈসায়ী মুসলিম। আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ঈসা (আ) সকলকে মান্য করি। আমরা কুরআনও মানি ইঞ্জিল বা কিতাবুল মোকাদ্দসও মানি। আমরা সকল নবীকেই ভক্তি করি। তবে আমরা তরীকাটা শুধু ঈসা মাসীহ থেকে গ্রহণ করি। যারা বিকৃত কিতাবুল মোকাদ্দাসের বর্ণনামত সকল নবীকে পাপী, ব্যভিচারী, ধর্ষক, মদ্যপ বা খুনি বলে বিশ্বাস করেন, যারা কুরআন টয়লেটে ফেলেন, আগুনে পুড়ান, গণতান্ত্রিক দেশে কুরআন নিষিদ্ধ করার জন্য রাজনীতি করেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য মিথ্যা কার্টুন ও সিনেমা তৈরি করে প্রচার করেন, তাঁরাই বলেন যে, আমরা সকল নবীকে ভক্তি করি অথবা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কুরআন মানি! তাঁরা মুসলিমদের বলেন, যারা কুরআন পোড়ায়, নবীকে নিয়ে সিনেমা বানায় আমরা সে খৃস্টান নই; আমরা ঈসায়ী মুসলিম! একজন মানুষ এত ভয়ঙ্কর মিথ্যাবাদী-প্রতারক হতে পারে! আপনি বলুন: ‘ঐ সব খৃস্টান এবং আপনাদের মধ্যে পার্থক্য কী? আকীদার পাথক্য? কর্মের পার্থক্য? ধর্মগ্রন্থের পার্থক্য? ইংরেজিতে আপনাদের পরিচয় কি লিখেন: (Jesuit Muslim) না (Christian)?

দীর্ঘ গবেষণা করে তাঁরা দেখেছেন যে, বাংলাদেশের মুসলিম ধর্ম পরিবর্তন করেন না; তবে সহজেই “তরীকা” পরিবর্তন করেন। এজন্য প্রতারণামূলকভাবে তাঁরা খৃস্টধর্মকে ধর্ম না বলে তরীকা বলতে এবং ধর্মগ্রহণকে “তরীকাবন্দী’ বলতে শুরু করেছেন। তাঁরা বলেন, মুসলিম এত প্রকারের তরীকা গ্রহণ করতে পারে, তাতে মুসলিমরা আপত্তি করে না, তাহলে ঈসায়ী তরীকা নিলে সমস্যা কী?

তাদের কথাগুলি যে মহামিথ্যা তা যে কোনো সচেতন মুসলিম জানেন। কিন্তু গ্রামগঞ্জের সরল মুসলিমগণ প্রতারিত হন। এজন্য নিম্নের বিষয়গুলি বুঝতে হবে:

(ক) আমরা দেখলাম, ‘ঈসায়ীগণ’ ঈসা মাসীহের আকীদা বা আমল কিছুই মানেন না। আমরা দেখব যে, তাঁরা কিতাবুল মোকাদ্দসের একটি বিধানও মানেন না।

(খ) যিনি একাধিক নবী মানার দাবি করেন তিনি মিথ্যাবাদী অথবা পাগল এবং তার ধর্ম জারজ ধর্ম। সকল নবীকে সম্মান করতে হয়; কিন্তু দুজনকে একত্রে মান্য করা যায় না। একসাথে দুজন নবীর উম্মাত হওয়া সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। একাধিক নবী মানার দাবি করার অর্থ কাউকে না মানা। কারণ প্রত্যেক নবীরই কিছু না কিছু নিয়ম রয়েছে যা অন্য নবীর নিকট নেই বা অন্য নবীর কাছে তার বিপরীত কিছু শরীয়ত রয়েছে। কারণ প্রতি যুগের জন্য সে যুগের উপযোগী কিছু বিশেষত্ব সহকারে শরীয়ত দেওয়া হয়।

(গ) আমরা দেখেছি, ঈসা মাসীহ বলেছেন, আল্লাহ ছাড়া কাউকে পিতা এবং ঈসা ছাড়া কাউকে আচার্য মানা যাবে না। কাজেই যে ব্যক্তি বলেন, তিনি ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়কেই আচার্য মানেন তিনি মাসীহের এ কথা অবিশ্বাস করলেন।

(ঘ) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ অর্থও একই: আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই এবং তাঁর ইবাদতের তরীকা একমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করতে হবে। মুসলিমরা আলেমদের কাছে গিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরীকা শিখেন।

(ঙ) আল্লাহ বলেন: “বল, ’তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ্ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (আল-ইমরান: ৩১)। অর্থাৎ আল্লাহর ভালবাসা ও নাজাত পেতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরীকায় চলতে হবে। তাঁর তরীকার বাইরে অন্য কোনো নবীর তরীকায় নাজাত থাকতে পারে বলে মনে করাও কুফরী।

(চ) আল্লাহ বলেন: “কিন্তু না, আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না, যতক্ষন পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের মধ্যকার সকল বিতর্ক-সমস্যার বিচার-সিদ্ধান্তের ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; তারপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং আন্তরিকভাবে তা মেনে নেয়।” (সূরা আন-নিসা ৬৫)। কাজেই তাঁর নির্দেশ মানার পরেও যদি অন্য কোনো আচার্যের শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন, উচিত বা সম্ভব বলে বিশ্বাস থাকে তাহলেও সে মুসলিম বলে গণ্য হবে না।

(ছ) একই সাথে দুজনকে মানার একমাত্র পথ পরবর্তীকে মানা। পূর্ববর্তী সকল প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা এমপিকে সম্মান করতে হয়, কিন্তু দুজনকে একত্রে মানা যায় না। কেবল সর্বশেষকেই মান্য করতে হয়। এজন্য দুজনকে মানতে চাইলে অবশ্যই ঈসা মাসীহের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই মানতে হবে।

(জ) আপনি যদি যীশু-সহ সকল নবী-রাসূলকে ভালবাসতে চান তাহলে কিতাবুল মুকাদ্দাসকে পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ ‘কিতাবুল মুকাদ্দাস’ নবীগণকে মহাপাপী বলে চিত্রিত করেছে এবং চোর-ডাকাত বলে ঘৃণা করতে শিক্ষা দেয়। কিতাবুল মুকাদ্দাসের ভাষায় ঈসা মাসীহ পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণকে চোর-ডাকাত এবং নিজেকে দরজা বলে আখ্যায়িত করে বলেন: “আমিই মেষদের দ্বার। যাহারা আমার পূর্বে আসিয়াছিল তাহার সকলে চোর ও দস্যু; কিন্তু মেষেরা তাহাদের রব শুনে নাই।” (যোহন ১০/৭-৮) একমাত্র কুরআনেই সকল নবীকে সম্মান করা হয়েছে এবং তাঁদের সঠিক পবিত্র জীবন তুলে ধরা হয়েছে। আর এজন্যই খৃস্টানগণ নবীদের নামে অশালীন সিনেমা কার্টুন প্রকাশ করেন; কখনোই মুসলিমগণ তা করেন না।

৪০
৭. ২. কুরআন মানি, হাদীস মানি না
ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন, আমরা কুরআন মানি, হাদীস মানি না। আমরা দেখলাম যে, আল্লাহর প্রেম ও মুক্তিলাভের জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘অনুসরণ করতে হবে (আলে-ইমরান: ৩১), অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগি ও সকল বিষয়ে তাঁর পদ্ধতি মানতে হবে। কুরআনে মূল নির্দেশ থাকলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে এগুলো পালন করতেন তা হাদীসে বিদ্যমান। কাজেই হাদীস বাদ দিয়ে কেউ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুবহু অনুসরণ করার এ কুরআনী নির্দেশ মানতে পারে না। মানবতাকে নাজাতের পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্যই খৃস্টান প্রচারকগণ হাদীস না মানার কথা বলেন। আপনি তাঁকে বলুন:

(ক) কুরআন মানলে আপনাকে নিম্নের বিষয়গুলি বিশ্বাস করতে হবে:

(১) প্রচলিত তাওরাত-ইঞ্জিলের মধ্যে অগণিত জালিয়াতি বিদ্যমান (বাকারা ৭৯, আল-ইমরান ৭৮, মায়িদা: ১৩, ১৪ ও ৪১)।

(২) প্রচলিত খৃস্টধর্মের বিশ্বাসগুলি প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে নেই; বরং তা কতিপয় ধর্মগুরুর উদ্ভাবিত বিদ‘আত ও শির্ক (মায়িদা: ৭৭)।

(৩) যারা ঈসাকে (আ) মানুষরূপী আল্লাহ বা আল্লাহর সত্যিকার পুত্র বলে বিশ্বাস করেন এবং ত্রিত্বে বিশ্বাস করে তারা কাফির (মায়িদা ১৭, ৭২, ৭৩)।

(৪) ঈসা মাসীহ ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেন নি। (নিসা: ১৫৭)।

(৫) কেউ অন্যের পাপের জন্য দায়ী হয় না এবং কেউ অন্যের পাপ বহন করতে পারে না; বরং প্রত্যেকেই নিজের পাপের জন্য দায়ী (আন‘আম: ১৬৪, বনী ইসরাঈল: ১৫, ফাতির: ১৮, যুমার: ৭, নাজম: ৩৮)

(৬) ঈসা মাসীহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন (সাফ্ফ: ৬)।

(খ) যে ব্যক্তি কুরআন মানার দাবি করে আবার বলে যে, হাদীস মানি না তিনি মূলতই কুরআন মানেন না। মহান আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শুধু কুরআন প্রদান করেন নি; বরং কিতাব এবং প্রজ্ঞা দুটি বিষয় তাঁর উপর নাযিল করেন। (বাকারা ১২৯, ১৫১, ২৩১; আল-ইমরান ১৬৪, নিসা, ১১৩; আহযাব ৩৪; জুমুআহ ২ আয়াত) কিতাব আক্ষরিকভাবে কুরআন হিসেবে সংকলিত। আর হিকমাহ বা প্রজ্ঞা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ভাষায় উম্মাতকে জানান, যা হাদীস হিসেবে সংকলিত। কাজেই যিনি কুরআন নির্দেশিত হিকমাহ বা হাদীস মানেন না তার কুরআন মানার দাবি অসত্য।

(গ) প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে আল্লাহর কালাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এতে ঈসা মাসীহের কিছু কথা, তাঁর কয়েকজন শিষ্য, শিষ্যের শিষ্য ও অন্যান্য মানুষদের কথাবার্তা সংকলিত। অর্থাৎ ‘ইঞ্জিল’ নামক গ্রন্থটি যীশু, তাঁর কয়েকজন সাহাবী ও তাবিয়ীর হাদীসের সংকলন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস ও ঈসার (আ) হাদীসের মধ্যে পার্থক্য হলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি হাদীসের সনদ বিদ্যমান এবং হাদীসগুলি প্রথম থেকেই লেখা শুরু হয়ে পরবর্তী ২০০ বৎসরের মধ্যে গ্রন্থাকারে সংকলিত। পক্ষান্তরে ইঞ্জিল নামক মাসীহী হাদীস-এর কোনোরূপ কোনো সনদ নেই এবং ৩০০ বৎসরের পরে সংকলিত। অতএব, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ঈসা (আ) উভয়কে মানার দাবি করেন, অথচ ঈসার (আ) হাদীস মানেন কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস মানেন না- তার দাবিটি অবশ্যই মিথ্যা।

(ঘ) তাঁরা বলেন: “হাদীস যদি ওহী হয় তা হলে হাদীসের এত প্রকার কেন? তাতে জাল ও মওজু কেন?” আপনি বলুন: কিতাবুল মোকাদ্দাস যদি ওহী হয় তাহলে এত প্রকার কিতাবুল মুকাদ্দাস কেন? ক্যাথলিক কিতাবে বইয়ের সংখ্যা ৭৩; কিন্তু প্রটেস্ট্যান্ট কিতাবুল মোকাদ্দসে বইয়ের সংখ্যা ৬৬। উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান বইগুলির মধ্যেও আয়াত ও অধ্যায়ে অনেক বৈপরীত্য। জাল-মাওযু যাচাই করা যদি খারাপ হয় তাহলে খৃস্টানদের কিতাবুল মুকাদ্দাসের এত শতশত জাল (non-canonical/ Apocryphal) ইঞ্জিল কেন? ইন্টারনেটে গসপেল (ইঞ্জিল) এবং (Apocrypha) লিখে সার্চ দিলেই দেখবেন কিতাবুল মোকাদ্দসের জাল-মাউযূ কাকে বলে! ইংরেজি না জানলে বাংলা জুবিলী বাইবেল, কেরি বাইবেল, কিতাবুল মোকাদ্দাস ও ইঞ্জিল শরীফ মিলিয়ে দেখলেই বুঝবেন বৈপরীত্য কাকে বলে!

[(ঙ) তাছাড়া ঈসা আলাইহিস সালামের হাদীসের শুদ্ধ ও অশুদ্ধতা যাচাইয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি খৃস্টানদের কাছে নেই। সেখানে সেগুলোর বর্ণনাকারীদের নেই কোনো গ্রহণযোগ্য জীবন-চরিত; যা দেখে গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী ও অগ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী নির্ধারণ করা যাবে, পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমূহের শুদ্ধাশুদ্ধ যাচাইয়ের রয়েছে সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি। সেগুলোর বর্ণনাকারীদের পূর্ণাঙ্গ জীবন-বৃত্তান্ত সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেগুলোর উপর ভিত্তি করে সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞ আলেমগণ খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকে অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা থেকে পৃথক করতে পারেন। এ বিষয়টিকে অনেক ইনসাফের অধিকারী প্রাচ্যবিদও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। সুতরাং হাদীস না মানার কোনো যৌক্তিক কারণ কেউ দেখাতে পারবে না। কারণ কোনো বিষয়ে জাল ও দুর্বল বর্ণনা থাকলেই সেখানকার বিশুদ্ধ বর্ণনাও নেওয়া যাবে না এমন কথা দুনিয়ার কোনো বিবেকবানও বলবে না। যদি এটা বলা হয় তবে দুনিয়ার কোনো কর্মকাণ্ডই সঠিকভাবে পরিচালিত হবে না। কারণ সকল কিছুরই পক্ষে-বিপক্ষে কথা আছে, তারপরও মানুষ বিশুদ্ধতাকে যাচাই করে দুনিয়ার বিধি-বিধান পরিচালনা করছে। [দু ব্রাকেটের মাঝখানের অংশ সম্পাদক কর্তৃক সংযোজিত।]]

৪১
৮. কুরআনে তাওরাত ইঞ্জিল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ
ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন: কুরআন বলেছে সকল কিতাব বিশ্বাস করতে হবে, কাজেই সকল কিতাবের বিধান মানতে হবে। আপনি তাকে বলুন, বিশ্বাস করার অর্থ বিধান পালন নয়। পূর্ববর্তী নবীগণ এবং গ্রন্থগুলো যে সত্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল তা বিশ্বাস করতে কুরআন নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন সেগুলোকে পালন করতে নির্দেশ দেয় নি; বরং বারংবার উল্লেখ করেছে যে, সেগুলোকে তাদের অনুসারিগণ বিকৃত করেছে; এজন্য আল্লাহ তাওরাত-ইঞ্জিলের প্রয়োজনীয় বিধানগুলি কুরআনের মধ্যে সন্নিবেশিত করে কুরআনকে সংরক্ষক বানিয়েছেন (মায়িদা ৪৮)। এখন কুরআন পালনের মাধ্যমেই শুধু তাওরাত-ইঞ্জিল পালন-প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আমরা পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপ্রধানদের বিষয়ে বিশ্বাস করি যে, তারা দেশের বৈধ রাষ্টপ্রধান ছিলেন, কিন্তু তাদের নির্দেশ মান্য করি না; বরং সর্বশেষ রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ মান্য করি। পূর্ববর্তী সংবিধানগুলোকে বৈধ সংবিধান ছিল বলে বিশ্বাস করি, কিন্তু সর্বশেষ সংবিধান পালন করি; কারণ পূর্ববর্তী সংবিধানগুলি মৌলিক বিষয় সর্বশেষ সংবিধানে সংরক্ষিত।

ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ দাবি করতেন যে, তারা তাওরাত-ইঞ্জিল পালন করেন। আল্লাহ তাদেরকে বলেন, আল্লাহ সর্বশেষ যে কিতাব তাদের জন্য নাযিল করেছেন তা পালন না করা পর্যন্ত তাদের মুক্তি নেই। আল্লাহ বলেন: “বলুন, ‘হে কিতাবীগণ! (১) তাওরাত, (২) ইন্জীল ও (৩) ‘যা তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তা’ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত তোমাদের কোন ভিত্তিই নেই...” (৫-মায়িদা ৬৮)। আল্লাহ জানালেন যে, ইয়াহূদী-খৃস্টানদেরকে নাজাতের জন্য কুরআন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এ আয়াতকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে খৃস্টানগণ বলেন যে, মুসলিমদেরকে নাজাতের জন্য তাওরাত-ইঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করতে হবে! তারা আয়াতের প্রথম (আপনি বলুন, হে কিতাবীগণ) কথাটুকু এবং শেষ (ও যা তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ) কথাগুলি গোপন করেন।

খৃস্টান প্রচারককে বলুন: আল্লাহ এ নির্দেশ কাদেরকে দিতে বললেন। তিনি হয়ত বলবেন: কুরআনের নির্দেশ তো সকল মুসলিমের জন্য। কথাটি ডাহা মিথ্যা! কুরআনে আল্লাহ কাফিরদেরকে নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন (বলুন, হে কাফিরগণ...)। কখনো ইয়াহূদী-খৃস্টানদেরকে নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন: (বলুন, হে কিতাবীগণ...)। এ সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তাঁর মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য; কিন্তু কাফির, ইয়াহূদী, খৃস্টান বা কাফিরদেরকে যা বলেছেন তা মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ মুসলিমদের দায়িত্ব ইয়াহূদী-খৃস্টানদেরকে বলা: তোমরা তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআন কায়েম না করা পর্যন্ত নাজাত পাবে না।

৪২
৯. হে কিতাবীগণ, তাওরাত ও ইঞ্জিল কায়েম করুন
আমরা দেখেছি যে, বহুবিধ বিকৃতিসহ বাইবেলের মধ্যে মূল ওহীর কিছু বিষয় বিদ্যমান, যেমন: (ক) আল্লাহর একত্ববাদ ও ১০ আজ্ঞা, (খ) শরীয়তের বিধিবিধান, (গ) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুবুওয়াত বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী। কয়েকটি বিধান দেখুন:

৪৩
৯. ১. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুবুওয়াতের বিশ্বাস
অনেক বিকৃতির পরেও তাওরাত-ইঞ্জিলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়ক সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যমান। তাওরাত ও ইঞ্জিল থেকে একটি করে ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করছি।

৪৪
৯. ১. ১. তাওরাতের একটি ভবিষ্যদ্বাণী
“তখন সদাপ্রভু আমাকে কহিলেন, উহারা ভালই বলিয়াছে। আমি উহাদের জন্য উহাদের ভ্রাতৃগণের মধ্য হইতে তোমার সদৃশ এক ভাববাদী (Prophet) উৎপন্ন করিব, ও তাঁহার মুখে আমার বাক্য দিব; আর আমি তাঁহাকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিব, তাহা তিনি উহাদিগকে বলিবেন। আর আমার নামে তিনি আমার যে সকল বাক্য বলিবেন, তাহাতে যে কেহ কর্ণপাত না করিবে, তাহার কাছে আমি প্রতিশোধ লইব। কিন্তু আমি যে বাক্য বলিতে আজ্ঞা করি নাই, আমার নামে যে কোন ভাববাদী দুঃসাহসপূর্বক তাহা বলে, কিমবা অন্য দেবতাদের নামে যে কেহ কথা বলে, সেই ভাববাদীকে মরিতে হইবে। আর তুমি যদি মনে মনে বল, সদাপ্রভু যে বাক্য বলেন নাই, তাহা আমরা কি প্রকারে জানিব? [তবে শুন,] কোন ভাববাদী সদাপ্রভুর নামে কথা কহিলে যদি সেই বাক্য পরে সিদ্ধ না হয়, ও তাহার ফল উপস্থিত না হয়, তবে সেই বাক্য সদাপ্রভু বলেন নাই; ঐ ভাববাদী দুঃসাহসপূর্বক তাহা বলিয়াছে, তুমি তাহা হইতে উদ্বিগ্ন হইও না।” (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৭-২২)

এ ভবিষ্যদ্বাণীটি সুনিশ্চিতভাবেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিষয়ে বলা হয়েছে। কারণ তিনি ছিলেন বনী ইসরাঈলের ভ্রাতৃগণ বনী ইসমাঈল বা ইসমাঈলের বংশধর। তিনি মূসা (আ)-এর মতই নবী ছিলেন। আল্লাহ তাঁর মুখে তাঁর কালাম অর্থাৎ কুরআন প্রদান করেন। যারা কুরআন মান্য করবে না তাদের জন্য শাস্তিরও ব্যবস্থা করেন। সকল দিক থেকে ভবিষ্যদ্বাণীটি একমাত্র তাঁর জন্যই প্রযোজ্য।

খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, কথাটি যীশুর বিষয়ে বলা হয়েছে। বড় অদ্ভুৎ ও উদ্ভট দাবি! যীশুই ঈশ্বর এবং তিনিই “ঈশ্বরের প্রেরিত নবী”। একই ব্যক্তি নিজেই আল্লাহ এবং নিজেই নিজের কাছে ওহী পাঠান!!! সর্বোপরি, কিতাবু মোকাদ্দাস প্রমাণ করে যে, যীশু কখনোই এ ‘প্রতিশ্রুত নবী’ বা ভাববাদী হতে পারেন না, কারণ:

(ক) প্রতিশ্রুত নবী ও প্রতিশ্রুত মাসীহ দুজন ভিন্ন মানুষ হবেন। যোহনের সুসমাচারের ১ম অধ্যায়ে রয়েছে: “১৯ আর যোহনের সাক্ষ্য এই, যখন যিহূদিগণ কয়েক জন যাজক ও লেবীয়কে দিয়া যিরূশালেম হইতে তাঁহার কাছে এই কথা জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইল, আপনি কে? ২০ তখন তিনি স্বীকার করিলেন, অস্বীকার করিলেন না; তিনি স্বীকার করিলেন যে, আমি সেই খ্রীষ্ট নই। ২১ তাহারা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তবে কি? আপনি কি এলিয় (Elias)? তিনি বলিলেন, আমি নই। আপনি কি সেই নবী (that prophet)? তিনি উত্তর করিলেন, না।... ২৫ আর তাহারা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি যদি সেই খ্রীষ্ট নহেন, এলিয়ও নহেন, সেই ভাববাদীও নহেন, তবে বাপ্তাইজ করিতেছেন কেন?”

এখানে আমরা দেখছি যে, ইস্রায়েলীয়গণ জানতেন যে, প্রতিশ্রুত মাসীহ ও প্রতিশ্রুত নবী দু ব্যক্তি হবেন। যোহন কোন্ ব্যক্তি তা তারা জানতে চান। ইঞ্জিলে অন্যত্র রয়েছে: “সেই সকল কথা শুনিয়া লোকসমূহের মধ্যে কেহ কেহ বলিল, ইনি সত্যই সেই ভাববাদী (this is the Prophet)। আর কেহ কেহ বলিল, ইনি সেই খ্রীষ্ট (This is the Christ)।” যোহন ৭/৪০-৪১। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়, তাঁরা যীশুর আগমনের সময়েও প্রতিশ্রুত ‘নবীর’ আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন এবং তারা জানতেন যে, প্রতিশ্রুত নবী আসবেন এবং তিনি প্রতিশ্রুত মসীহ নন; বরং ভিন্ন মানুষ।

(খ) প্রতিশ্রুত নবী মূসা (আ)-এর সদৃশ হবেন। এখানে বলা হয়েছে “তোমার সদৃশ (like unto thee)”। যীশু কখনোই মূসা (আ)-এর মত ছিলেন না। মুহাম্মাদ নিঃসন্দেহে সামগ্রিকভাবে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূসা (আ)-এর সদৃশ। এখানে সামান্য কয়েকটি দিক উল্লেখ করছি: (১) তাঁরা উভয়ে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, (২) পিতা ও মাতার সন্তান, (৩) বিবাহিত ও সন্তান-সন্ততির পিতা, (৪) উভয়ের ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধিবিধান রয়েছে, (৫) জিহাদ বা যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, (৬) ইবাদতের সময় পবিত্রতা অর্জনের বিধান রয়েছে, (৭) হালাল-হারাম ও পাক-নাপাকের ব্যবস্থা উভয়ের শরীয়তে একইভাবে বিদ্যমান, (৮) বিচার, শাস্তি, ব্যভিচারের শাস্তি ইত্যাদি উভয়ের শরীয়তে বিদ্যমান, (৯) উভয়েই এগুলি প্রয়োগ করতে সক্ষম ছিলেন, (১০) উভয়েই ত্রিত্ববাদ মুক্ত বিশুদ্ধ তাওহীদ বা একত্ববাদের শিক্ষা ও নির্দেশ দিয়েছেন, (১১) তাঁরা উভয়েই তাঁদের উম্মাতকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁদেরকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল (ঈশ্বরের ভাববাদী ও ঈশ্বরের দাস) বলতে। তাঁদেরকে ঈশ্বরের পুত্র বা ঈশ্বর (নাঊযু বিল্লাহ!) বলতে নির্দেশ দেন নি; (১২) উভয়েই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন, (১৩) তাঁরা কেউ অনুসারীদের জন্য শাপগ্রস্ত হন নি; (১৪) তাঁরা উভয়েই মত নিজ জাতির মধ্যে সম্মানিত নেতা ছিলেন, যাকে সকলেই মান্য করেছেন এবং তাঁর আদেশ ও নিষেধ পালন করেছেন।

তাঁদের উভয়ের জীবন ও ধর্ম-ব্যবস্থা (শরীয়ত) তুলনা করলে এরূপ আরো অনেক সাদৃশ্য ও মিল আমরা দেখতে পাই। এ সকল কোনো বিষয়েই ঈসা মাসীহের সাথে মূসার (আ) কোনো মিল নেই। তিনি কোনোভাবেই মূসার সদৃশ ছিলেন না। বাহ্যিকভাবে তাকে একজন মানুষ এবং ইয়াহূদী বংশের মানুষ হিসেবে মূসার সদৃশ বলা যেতে পারে। তবে এরূপ সদৃশ তো ইস্রায়েল বংশের সকল মানুষই ছিলেন। এরূপ বিষয়কে সদৃশ বলে গণ্য করলে পুরো ভবিষ্যদ্বাণীই বাতিল হয়ে যায়। সর্বোপরি খৃস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে তিনি মানুষের দেহ ধারণ করলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে মানুষ ছিলেন না, বরং ঈশ্বর ছিলেন; কাজেই এ দুটি বিষয়ের মিলও প্রকৃত মিল নয়; কাজেই কোনোভাবেই ঈসা মাসীহ মূসা (আ)-এর সদৃশ নবী হতে পারেন না।

(গ) তাঁর মুখে আল্লাহর কালামের আক্ষরিক প্রকাশ হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছে: “তাঁহার মুখে আমার বাক্য দিব; আর আমি তাঁহাকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিব, তাহা তিনি উহাদিগকে বলিবেন।” এ কথাটি একমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ একমাত্র কুরআনই আক্ষরিক আল্লাহর বাক্য; আল্লাহ যা বলেছেন তাই এর মধ্যে আছে। এর মধ্যে আল্লাহর বাক্য ছাড়া অন্য কিছুই নেই। বিশ্বে কুরআন ছাড়া কোনো আক্ষরিক ওহীর গ্রন্থ নেই। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে “আল্লাহর বাক্য” নেই বললেই চলে। এমনকি এর মধ্যে মাসীহের বাক্যও সামান্য।

(ঘ) তাঁর অপমৃত্যু হবে না, বরং স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছে, আল্লাহ যে কথা বলেন নি, সে কথা যদি কোনো নবী-দাবিদার আল্লাহর নামে বলে তবে তাকে মরতে হবে, অর্থাৎ তিনি নিহত হবেন বা তার অপমৃত্যু হবে। মুহাম্মাদ () যদি সত্য নবী না হতেন তবে তিনি অবশ্যই নিহত হতেন। কিন্তু তিনি নিহত হন নি। তাঁকে হত্যা বা গুপ্ত হত্যা করতে কাফিরগণ প্রানান্ত চেষ্টা করেছেন। উপরন্তু তিনি নিজে বহুবার যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করেছেন, একাকী যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, কিন্তু তাঁর শত্রুরা তাঁকে হত্যা করতে সক্ষম হয় নি। পক্ষান্তরে খৃস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে যীশু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এজন্য যদি কেউ দাবি করেন যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীটি যীশুর বিষয়ে কথিত, তবে তাতে প্রমাণিত হবে যে, তিনি আল্লাহর নামে মিথ্যা বলেছিলেন। নাঊযু বিল্লাহ!

(ঙ) তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সফল হবে। এখানে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো নবী আল্লাহর নামে মনগড়া কিছু বলেন, তবে তার ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাত্র দুটি বিষয় দেখুন:

(১) চারিদিকে শত্রু পরিবেষ্ঠিত অবস্থাতেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, তিনি নিহত হবেন না। আল্লাহ বলেছেন: “আল্লাহ তোমাকে মানুষ হতে রক্ষা করবেন” (৫- মায়িদা, ৬৭ আয়াত)। এ ভবিষ্যদ্বাণী আক্ষরিকভাবে সত্য হয়েছে।

(২) কুরআনের মাধ্যমে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, কুরআনের মত একটি গ্রন্থ কেউ কখনো রচনা করতে সক্ষম হবে না। এ ভবিষ্যদ্বাণীও সফল হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ উন্মুক্ত। খৃস্টানগণ দাবি করেন কুরআনের মত একটি বই লেখা সম্ভব। আমাদের দাবি, আপনারা একটি বই লিখে দিন। অর্থ ও তথ্য বিচার পরে হবে। যদি কেউ সে বইটির ভাষা ও অর্থ না জেনেও কুরআনের মত দু/তিন বছরে তা মুখস্থ করতে পারে তবে প্রমাণিত হবে যে, অর্থ ও তথ্য যাই হোক না কেন, শব্দ ও বাক্যে তা কুরআনের মত হয়েছে। খৃস্টানগণ কি এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন?

পক্ষান্তরে ইঞ্জিলের ভাষ্য অনুসারে যীশুর ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তিনি ইউনুস নবীর মত তিনদিন তিনরাত্রি মাটির গর্ভে থাকবেন (মথি ১২/৩৯-৪০), কিন্তু তা থাকেন নি। তিনি তিনদিন তিনরাত নয়; বরং এক দিন দুই রাত ছিলেন। উপরন্তু ইউনুস নবীর মত থাকতে পারেন নি। ইউনুস নবী জীবিত অবস্থায় মাছের পেটে ছিলেন, কিন্তু ইঞ্জিলের যীশু মৃত অবস্থায় ছিলেন। (মথি ২৭/৪৫-৬১; মার্ক ১৫/৩৩-৪৭; লূক ২৩/৪৪-৫৬; যোহন ১৯/২৫-৪২; ২০/১-১৮। আরো দেখুন: মথি ২৮/১-১০; মার্ক ১৬/১-১১; লূক ২৪/১-১২।)

এছাড়া তিনি বলেছিলেন যে, তার কিছু শিষ্যের জীবদ্দশাতেই কিয়ামত হবে এবং তিনি ফিরে আসবেন। একথাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। (মথি ১৬/২৭-২৮, ১ থিষলনীকীয় ৪/১৫-১৭, ১ করিন্থীয় ১৫/৫১-৫২, প্রকাশিত বাক্য ২২/১০-১১)

৪৫
৯. ১. ২. ইঞ্জিলের একটি ভবিষ্যদ্বাণী
“তথাপি আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল, কারণ আমি না গেলে, সেই সহায় (ফারাক্লীত/ the Comforter/the Counselor) তোমাদের নিকটে আসিবেন না [এ শব্দটি পরবর্তীতে অনুবাদ করে বলা হয়েছে। পূর্ববর্তী কোনো কোনো আরবী সংস্করণে এর পরিবর্তে ‘মাদমাদ’ শব্দটি লেখা হয়েছে। তা মুহাম্মাদ শব্দের বেশি কাছাকাছি শব্দ। তারা সেটাকে তখনি বিকৃত করেছিল। তারপর যখন তারা বুঝতে পারল, এটা দ্বারা অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপিত হবে যে এটা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী, তখন তারা শব্দটিকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে নেয়। এ ব্যাপারে আরও জানার জন্য দেখুন, ড. যিয়াউর রহমান আল-আ‘যামী প্রণীত দিরাসাতুন ফিল ইয়াহূদিয়্যাহ ওয়াল মাসীহীয়্যা, ও ড. সাউদ ইবন আবদুল আযীয আল-খালাফ প্রণীত দিরাসাতুন ফিল ইয়াহূদিয়্যাহ ওয়ান নাসরানিয়্যাহ [সম্পাদক]]; কিনতু আমি যদি যাই, তবে তোমাদের নিকটে তাঁহাকে পাঠাইয়া দিব। .... পরন্তু তিনি, সত্যের আত্মা (the Spirit of truth), যখন আসিবেন, তখন পথ দেখাইয়া তোমাদিগকে সমস্ত সত্যে লইয়া যাইবেন; কারণ তিনি আপনা হইতে কিছু বলিবেন না, কিনতু যাহা যাহা শুনেন, তাহাই বলিবেন, এবং আগামী ঘটনাও তোমাদিগকে জানাইবেন।...” (যোহন ১৬/৭-১৩)

এখানে যীশু সুস্পষ্টত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের কথা জানালেন। খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, এখানে ‘পাক রূহের’ কথা বলা হয়েছে। অথচ আমরা প্রচলিত ইঞ্জিলে দেখছি যে, যীশুর পৃথিবীতে থাকা অবস্থাতেই পাক রুহ বারবার এসেছেন। কাজেই যীশু না গেলে তিনি আসবেন না কথাটি কখনোই পাক রুহের জন্য প্রযোজ্য নয়। আর খৃস্টানদের বিশ্বাসে পাক রুহ তো নিজেই আল্লাহ; কাজেই ‘তিনি নিজের থেকে কিছুই বলবেন না; যা শুনবেন তা-ই বলবেন’ বলার কোনোই অর্থ নেই। উপরন্তু যীশু বলেছেন যে, তার উপাধি হবে সত্যের আত্মা অর্থাৎ আল-আমীন ও আস-সাদিক। এজন্য এ ভবিষ্যদ্বাণী নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে। বার্নাবাস লিখিত ইঞ্জিলে তিনি বারংবার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম উল্লেখ করেছেন। (বার্নাবাসের ইঞ্জিল (The Gospel of Barnabas) ১১২, ১৩৬, ১৬৩ ও ২২০ অধ্যায়।)

প্রচলিত কিতাবুল মোকাদ্দসের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এরূপ আরো অনেক সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী এখনো বিদ্যমান। ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ যদি এগুলি প্রতিষ্ঠা করতেন তবে তাঁরা এবং মানব সভ্যতা রক্ষা পেত।

৪৬
৯. ২. শির্ক-কুফর-এর শাস্তি
কিতাবুল মোকাদ্দসে শির্ক-কুফর-এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যদি কোনো ব্যক্তি কোনোভাবে মূর্তি, ছবি বা প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠা করে, শির্ক করে বা শির্কের প্ররোচনা দেয় তাহলে তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করতে হবে। কোনো নবী অনেক মু‘জিযা দেখানোর পর কোনোভাবে শির্কের প্ররোচনা দিলে তাকেও প্রস্তরাঘাতে হত্যা করতে হবে। কোনোরূপ করুণা দেখানো যাবে না। যদি কোনো জনপদবাসী কোনোরূপ শির্কে নিপতিত হলে সে গ্রামের বা নগরের সকল মানুষকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে এবং সে গ্রামের সকল জীব-জানোয়ার পশুও হত্যা করতে হবে। গ্রামের সকল সম্পদ ও দ্রব্যাদি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে তাওবারও কোনো সুযোগ নেই। (যাত্রাপুস্তক ২২/২০, ৩২/২৮, দ্বিতীয় বিবরণ ১৩/১-১৬, ১৭/২-৭, ১ রাজাবলী ১৮/৪০)

৪৭
৯. ৩. ব্যভিচারের শাস্তি
বাইবেলে ব্যভিচারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। (লেবীয়: ২০/১০-১৭) এমনকি পরনারীর প্রতি দৃষ্টিপাতকেও ঈসা মাসীহ ব্যভিচার বলে গণ্য করেছেন এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার চোখ তুলে ফেলে দিতে বলেছেন। তিনি বলেন: “যে কেহ কোনো স্ত্রীলোকের প্রতি কামভাবে দৃষ্টিপাত করে, সে তখনই মনে মনে তাহার সহিত ব্যভিচার করিল। আর তোমার দক্ষিণ চক্ষু যদি তোমার বিঘ্ন জন্মায় তবে তাহা উপড়াইয়া দূরে ফেলিয়া দেও; কেননা সমস্ত শরীর নরকে নিক্ষিপ্ত হওয়া অপেক্ষা বরং একটি অঙ্গের নাশ হওয়া তোমার পক্ষে ভাল।” (মথি ৫/২৮-২৯)

যদি খৃস্টান বিশ্ব তাওহীদ ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করতো, শির্ক-ব্যভিচারের শাস্তি প্রতিষ্ঠা করতো তাহলে মানব সভ্যতা বর্তমানের ভয়ঙ্কর অবক্ষয়ের মধ্যে পড়তো না।

যদি কেউ আপনাকে বলে যে, কুরআন তাওরাত-ইঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছে, আপনি তাকে বলুন: হ্যা, কুরআন ইয়াহূদী-খৃস্টানদেরকে তাওরাত-ইঞ্জিল এবং কুরআনের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে। “ঈসা মাসীহ পাপ বহন করবেন” বলে ধোঁকা দিয়ে শির্ক ও ব্যভিচার প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয় নি। আপনাদের দেশগুলিতে যদি না-ও পারেন তবে অন্তত চার্চগুলিতে তাওরাত-ইঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করুন। খৃস্টান চার্চগুলিতে পাদরিগণ যত ব্যভিচার ও ধর্ষণ করেন তা বিশ্বের আর কোনো ধর্মের ধর্মালয়ে ঘটে না। (ইন্টারনেটে দেখুন: Catholic sex abuse cases)। এ সকল পাদরিকে তাওরাত নির্দেশিত শাস্তি প্রদান করুন। সকল খৃস্টান চার্চে ঈসা মাসীহ, তাঁর মাতা মরিয়ম ও অন্যান্য অগণিত মানুষের প্রতিমা বিদ্যমান। এগুলি ধ্বংস করুন, যারা এগুলি বানিয়েছে বা এগুলিতে ভক্তি মানত-উৎসর্গ করতে উৎসাহ দিয়েছে তাদের সকলকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করুন। এরপর আমাদের কাছে তাওরাত-ইঞ্জিল নিয়ে আসুন।

৪৮
৯. ৪. কিতাবুল মোকাদ্দসের একটি সহজ নির্দেশ প্রতিষ্ঠা করুন
সম্মানিত পাঠক, ঈসায়ীগণ কেতাবুল মোকাদ্দসের একটি বিধানও মানেন না। শুধু দু-চারটি কথাকে বিকৃত করে সাধু পলের ত্রিত্ববাদী আকীদা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। ঈসাসী প্রচারককে তৌরাত শরীফের লেবীয় পুস্তকের ১৫ অধ্যায়টি পড়তে বলুন। পুরুষ ও নারীর নাপাকির অদ্ভুৎ সব বিধান! আপনি বলুন: আপনি বা কোনো খৃস্টান কি এ বিধানগুলি মানেন? তৌরাতের কোন্ বিধানটি আপনারা প্রতিষ্ঠা করেন?

তৌরাতের সহজ একটি মৌখিক বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে দাওয়াত দিন। তাওরাত বলে: “যে ব্যক্তি কোনো ক্ষোদিত বা ছাঁচে ঢালা প্রতিমা- সদাপ্রভুর ঘৃণিত বস্তু- শিল্পকরের হস্ত নির্মিত বস্তু নির্মাণ করিয়া গোপনে স্থাপন করে সে শাপগ্রস্ত (অভিশপ্ত)। তখন সমস্ত লোক উত্তর করিয়া বলিবে: আমেন” সকল ব্যভিচারী শাপগ্রস্ত... “যে কেহ এই ব্যবস্থার কথাসকল পালন করিবার জন্য সেই সকল অটল না রাখে, সে শাপগ্রস্ত। তখন সমস্ত লোক বলিবে: আমেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ২৭/১৫, ২০-২৩, ২৬)

খৃস্টান প্রচারককে বলুন, আসুন এ বিধানটি কায়েম করে দো‘আ করি: যে সকল পাদরি, পোপ ও বিশপ যীশু, মেরি ও অন্যান্য মানুষের ক্ষোদিত, ছাঁচে ঢালা বা শিল্পীর আঁকা মূর্তি, প্রতিকৃতি বা ছবি তৈরি করে চার্চে ও সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাওরাতের বিধান প্রতিষ্ঠায় অটল থাকেন নি বরং ঈসা মাসীহ পাপ বহন করবেন বলে প্রতারণা করে সকল প্রকারের পাপাচার ও ব্যভিচার প্রশ্রয় দিয়েছেন, মানব সমাজকে এবং চার্চগুলোকে ব্যভিচারের আখড়া বানিয়েছেন, তারা সকলেই আল্লাহর অনন্ত লা‘নত ও অভিশাপে অভিশপ্ত হোক! আমীন!! খৃস্টান প্রচারক যদি ‘আমীন’ বলতে দ্বিধা করেন তাহলে বুঝবেন যে, তিনি কিতাবুল মোকাদ্দসে বিশ্বাস করেন না।

৪৯
১০. হানাহানির ধর্ম বনাম ভালবাসার ধর্ম
খৃস্টান প্রচারকগণ বলেন, ইসলাম হানাহানির ধর্ম ও খৃস্টধর্ম ভালবাসার ধর্ম! কি ভয়ঙ্কর মিথ্যা! যে ধর্মের পোপ-পাদরিগণ প্রায় ২ হাজার বছরে ধর্মের নামে কয়েক কোটি মানুষকে জেলে দিয়ে, জবাই করে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন তারা তাদের ধর্মকে শান্তির ধর্ম বলে দাবি করেন! খৃস্টান প্রচারকগণ বাংলাদেশে এসে খুবই ভাল ব্যবহার করেন। আর এটিই স্বাভাবিক। সন্তান যখন চকলেট খেতে চায় তখন বাবা-মা আপত্তি বা রাগ করেন। আর ছেলেধরা খুবই আদর করে তাকে চকলেট খেতে দেয়। বাবা-মার চেয়েও বেশি দরদ ছেলেধরার! ঠিক এমনই দরদ মিশনারিদের! খৃস্টান ধর্মগুরুদের নির্যাতন, গণহত্যা, ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরের প্রকৃত চরিত্র জানতে যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া বা ইন্টারনেটে নিম্নের বিষয়গুলি দেখুন:

Christian Persecutions, DEMOLISH THEM, Theodosian Code, Christian advocacy of persecution, heresy, heretics, The Protestant theory of persecution, Moriscos, Relegious War, Crusade, Christian terrorism, Religious discrimination against Neopagans, European colonization of the Americas, Persecution of Ancient Greek religion, History of the Jews in Spain, Christianization of Scandinavia, Baptism of Poland, Christianization of Kievan Rus', Persecution of Muslims, Persecution of Atheists, Christianization, Conquistador, Santería, Inquisition, Waldensians, Lollardy, Cathari, Ku Klux Klan, New Christian Public Worship Regulation Act 1874, genocide, holocaust, Massacre of Saint Bartholomew's Day,..। খৃস্টান লেখকদের লেখা থেকে আপনি জানবেন, কি ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার, অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে খৃস্টধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

৫০
১১. ইসলামের জিহাদ বনাম খৃস্টধর্মের জিহাদ
খৃস্টান প্রচারকগণ আমাদের বুঝাতে চান যে, ইসলামেই শুধু জিহাদ আছে! অথচ বাইবেল, বেদ, গীতা ও সকল ধর্মগ্রন্থেই জিহাদ বা যুদ্ধ বিদ্যমান। ইসলামে রাষ্ট্র ও নাগরিক ও ধর্মের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যই জিহাদের বিধান। কিতাল বা জিহাদ বৈধ হওয়ার প্রথম শর্ত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “রাষ্টপ্রধান ঢাল, যাকে সামনে রেখে যুদ্ধ পরিচালিত হবে” (বুখারী ও মুসলিম)। দ্বিতীয় শর্ত রাষ্ট্র বা মুসলিমের নিরাপত্তা। আল্লাহ বলেন: “যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে” (সূরা ২২-হজ্জ ৩৯)। তৃতীয় শর্ত সন্ধি ও শান্তির সুযোগ গ্রহণ। আল্লাহ বলেন: “আর যদি তারা সন্ধির প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তবে তুমিও তার প্রতি ঝুঁকে পড়, আর আল্লাহর উপর নির্ভর কর, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ” (সূরা ৮-আনফাল: ৬২)। চতুর্থ শর্ত: শুধু যোদ্ধা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত। আল্লাহ বলেন: “তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের সাথে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে। কিন্তু সীমালঙ্ঘন করবে না, আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না” (সূরা ২-বাকারা: ১৯০)।

যুদ্ধের ময়দানেও ধর্মযাজক, নারী, শিশু বা কোনো অযোদ্ধাকে আক্রমণ নিষেধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যুদ্ধে তোমরা প্রতারণা বা ধোঁকার আশ্রয় নেবে না, চুক্তিভঙ্গ করবে না, কোনো মানুষ বা প্রাণীর মৃতদেহ বিকৃত করবে না বা অসম্মান করবে না, কোনো শিশু-কিশোরকে হত্যা করবে না, কোনো মহিলাকে হত্যা করবে না, কোনো গীর্জাবাসী, সন্ন্যাসী বা ধর্মযাজককে হত্যা করবে না, কোনো বৃদ্ধকে হত্যা করবে না, কোনো অসুস্থ মানুষকে হত্যা করবে না, কোনো বাড়িঘর ধ্বংস করবে না, খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া গরু, উট বা কোনো প্রাণী বধ করবে না, যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাছ কাটবে না...। তোমরা দয়া ও কল্যাণ করবে, কারণ আল্লাহ দয়াকারী- কল্যাণকারীদেরকে ভালবাসেন” (বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৯/৯০)।

কিতাবুল মোকাদ্দসের জিহাদের চিত্র ভিন্ন। শুধু যুদ্ধের ময়দানেই নয়, যুদ্ধবন্দী, নিরস্ত্র নারী, পুরুষ, শিশু ও অবলা প্রাণী নির্বিচারে হত্যা করতে (গণনা পুস্তক ৩১/১৭-১৮; দ্বিতীয় বিবরণ ২০/১৩-১৬; ১ শমূয়েল ২৭/৮-৯), বিধর্মীদের উপাসনালয় ভেঙ্গে ফেলতে (যাত্রাপুস্তক ২৩/২৩-২৪; যাত্রপুস্তক ৩৪/১২-১৩), সরলপ্রাণ বিধর্মীদেরকে খানাপিনার নামে ডেকে নিয়ে হত্যা করতে (১ রাজাবলি ১৮/৪০; ২ রাজাবলি ১০/১৮-২৮), নিরস্ত্র বন্দীদেরকে জবাই করতে বা পুড়িয়ে মারতে (২ শমূয়েল ১২/২৯-৩১) নির্দেশনা প্রদান করেছে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’।

অযোদ্ধা ও যুদ্ধবন্দী নারী, পুরুষ ও শিশুদের নির্বিচারে ও গণহারে হত্যার বিষয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসের বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যুদ্ধবন্দীদের কত বেশি কষ্ট দিয়ে হত্যা করা যায় সে বিষয়েও আগ্রহ লক্ষণীয়। লোহার মইয়ের নিচে রেখে, লোহার কুড়ালির নিচে রেখে এবং ইটের পাঁজার মধ্যে ঢুকিয়ে বা অনুরূপভাবে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা দিয়ে নিরস্ত্র মানুষদেরকে হত্যার নির্দেশনা বাইবেলে প্রচুর। এগুলি থেকে মনে হয়, বাইবেলের জিহাদ বা যুদ্ধ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য নয়, এমনকি অন্যের দেশ দখলের জন্যও যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ মূলত হত্যা ও ধ্বংসের মাধ্যমে আনন্দলাভের জন্য। ইঞ্জিল শরীফে এ সকল কর্মের বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে (নতুন নিয়ম, ইব্রীয় ১১/৩২-৩৪)।

বাইবেলে যুদ্ধ, হত্যা ও প্রতিশোধের ক্ষেত্রে কোনোরূপ নৈতিকার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয় নি। ইসলামে যুদ্ধের জন্য গোপনীয়তা ও শত্রুপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য কৌশল অবলম্বন বৈধ করেছে। কিন্তু চুক্তিভঙ্গ করা, প্রবঞ্চনা করা, নিরস্ত্রকে আক্রমন করা, অযোদ্ধা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা, আহতদের হত্যা করা, মৃতদেহ অপমান করা ইত্যাদি কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এরূপ সকল কর্মই বাইবেলীয় জিহাদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই।

ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন: আমরাই শান্তি চাই ও প্রতিষ্ঠা করি? কেননা ঈসা কোনো যুদ্ধ করেনি। আর মুহাম্মাদ (সা) অনেক যুদ্ধ করে মানুষ হত্যা করেছে, তাই তিনি শান্তি ও ভালবাসার নবী হতে পারেন না। (নাঊযু বিল্লাহ!)

সম্মানিত পাঠক, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি ও ভালবাসা প্রতিষ্ঠার জন্যই জিহাদ করেছেন। রাষ্ট্র থাকলেই যুদ্ধের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে যুদ্ধকে যথাসম্ভব কম ধ্বংসাত্মক করতে হবে এবং অযোদ্ধা লক্ষ্য থেকে দূরে রাখতে হবে। ইসলামে এ কাজটি সর্বোত্তমভাবে করা হয়েছে তাত্ত্বিকভাবে এবং প্রায়োগিকভাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব কম প্রাণহানি ঘটাতে। শুধু জুলুম বা আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য বাধ্য হয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং তার সারাজীবনের সকল যুদ্ধে মুসলিম ও কাফির মিলে সর্বমোট প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। যে দেশে প্রতি মাসেই শতশত মানুষ খুন হতো, সে দেশে মাত্র সহস্র মানুষের জীবনের বিনিময়ে সকল হানাহানি রোধ করে তিনি বিশ্বব্যাপী চিরস্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পক্ষান্তরে বাইবেলের একেক যুদ্ধেই হাজার হাজার “কাফির” হত্যার গৌরবময় বিবরণ লেখা হয়েছে। মহাভারত, গীতা বা রামায়ণের যুদ্ধেরও কাছাকাছি অবস্থা।

আমরা মুসলিমগণ বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত ঈসা (আ)-ও শান্তির নবী ছিলেন। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফ প্রমাণ করে তিনি অশান্তির নবী ছিলেন। ইঞ্জিলে তিনি বলেন: “মনে করিও না যে, আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে আসিয়াছি; শান্তি দিতে আসি নাই, কিন্তু খড়্গ দিতে আসিয়াছি (I came not to send peace but a sword)। কেননা আমি পিতার সহিত পুত্রের, মাতার সহিত কন্যার এবং শ্বাশুড়ির সহিত বধূর বিচ্ছেদ জন্মাইতে আসিয়াছি।” (মথি ১০/৩৪-৩৫)

ইঞ্জিলের যীশু যুদ্ধ করার সুযোগ পান নি, তবে তাঁর রাজত্বের বিরোধীদের গণহত্যা করতে তাঁর নির্দেশ দেখুন: "But those mine enemies, which would not that I should reign over them, bring hither, and slay them before me", “পরন্তু আমার এই যে শত্রুগণ ইচ্ছা করে নাই যে, আমি তাহাদের উপরে রাজত্ব করি, তাহাদিগকে এই স্থানে আন, আর আমার সাক্ষাতে বধ কর।” (লূক ১৯/২৭)

শুধু রাজত্ব অপছন্দ করার কারণে ধরে এনে জবাই!! তাও আবার নিজের সামনে! জবাই-এর সময় কিভাবে মানুষ ছটফট করে তা দেখতে? মানুষের রক্ত দেখে মন ঠান্ডা করতে? এরূপ ভয়ঙ্কর নির্দেশ কী কোনো মানুষ প্রদান করতে পারেন?

ঈসায়ী প্রচারকগণ মুসলিমদেরকে বলেন: “ইসলাম যদি সঠিক হয় তাহলে মুসলিমদের মধ্যে এত দল কেন?” সরল মুসলিমগণ না জানলেও, খৃস্টানগণ ভালভাবেই জানেন যে, খৃস্টানদের দলাদলির কাছে মুসলিমদের দলাদলি কিছুই নয়। পাঠক “ত্রিত্ববাদের ব্যাখ্যা” অনুচ্ছেদে এবং উপরের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আর্টিকেলগুলি ইন্টারনেটে পড়লেই বুঝতে পারবেন যে, মুসলিম, ইয়াহূদী, বিধর্মী ও খৃ্স্টধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ (Crusades) ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা (Inquisition)-ই নয়, খৃস্টানগণ নিজেদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ-মারামারি করে অন্তত কয়েক কোটি খৃস্টান নিহত হয়েছেন। অগণিত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিককে সামান্য মতভেদের কারণে হত্যা করেছেন। কিতাবুল মোকাদ্দস ও ইঞ্জিলের জিহাদ ও শত্রু হত্যা বিষয়ক উপরের নির্দেশনাগুলির তাঁরা ঠিকমতই পালন করেছেন। এজন্যই নোবেল বিজয়ী প্রসিদ্ধ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell: ১৮৭২-১৯৭০) বলেন:

"You find as you look around the world that every single bit of progress in human feeling, every improvement in the criminal law, every step towards the diminution of war, every step towards better treatment of coloured races, or every mitigation of slavery, every moral progress that there has been in the world, has been consistently opposed by the organized Churches of the world. I say quite deliberately that the Christian religion, as organized in the churches, has been and still is the principal enemy of moral progress in the world." (Bertrand Russell, Why I am not a Christian, pp 20-21, quoted from Dr. Abdul Hamid Qadri, Dimensions of Christianity, pp 40-41.)

“বিশ্বের চারিদিকে তাকালে আপনি দেখবেন যে, বিশ্বের যেখানেই মানবীয় অনুভবের যে কোনো ক্ষুদ্রতম অগ্রগতি, অপরাধ-আইনের যে কোনো উন্নয়ন, যুদ্ধ হ্রাসে যে কোনো পদক্ষেপ, কাল বা অ-সাদা বর্ণের মানুষদের সাথে উন্নততর আচরণের ক্ষেত্রে যে কোনো পদক্ষেপ, দাসপ্রথা বিলুপ্তির যে কোনো প্রচেষ্টা এবং নৈতিক উন্নয়ন যে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তারই বিরোধিতা করেছে খৃস্টীয় চার্চ নিরবিচ্ছিন্নভাবে। আমি পরিপূর্ণ সতর্কতা ও সুচিন্তিতভাবে বলছি যে, চার্চ পরিচালিত খৃস্টধর্মই বিশ্বের নৈতিক উন্নয়নের প্রধান শত্রু ছিল এবং এখনো আছে।”

বর্তমানেও উচ্চশিক্ষিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘উদার’ খৃস্টানদের মধ্যে আমরা যে সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পাই সেরূপ সাম্প্রদায়িকতা আমরা মুর্খ কোনো মুসলিম জঙ্গির মধ্যেও দেখতে পাই না। শান্তি ও ভালবাসার প্রচারক খৃস্টানগণ, অন্য ধর্মের পবিত্র ব্যক্তি বা গ্রন্থের অবমাননা, হত্যা ও জোরপূর্বক ধর্মান্তর ছাড়া কিছুই বুঝেন না। কুরআন পোড়ানো, টয়লেটে ফেলা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য সিনেমা-কার্টুন বানানো ইত্যাদি খৃস্টান পাদরি ও পণ্ডিতদের সুপরিচিত কর্ম।

আমেরিকার প্রসিদ্ধ ও প্রভাবশালী সাংবাদিক ও লেখিকা অ্যান কালটার (Ann Coulter) জঙ্গিবাদ দমনের জন্য সকল মুসলিম দেশ দখল করে মুসলিমদেরকে জোরপূর্বক খৃস্টধর্মে দীক্ষিত করার দাবি জানিয়ে লিখেন: "we should invade their countries, kill their leaders and convert them to Christianity." “আমাদের উচিত তাদের দেশগুলি আক্রমন করা, তাদের নেতাদেরকে হত্যা করা এবং ধর্মান্তরিত করে তাদেরকে খৃস্টান বানানো।” (The Wisdom of Ann Coulter, The Independent (Dhaka), 8/9/2006, p 12.) এরূপ দাবী খৃস্টান পণ্ডিতগণ পাশ্চাত্যের মিডিয়ায় প্রতিদিন করছেন।

অথচ মুসলিম অন্য মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার বা কাউকে জোর পূর্বক ধর্মান্তরিত করার কথা চিন্তাও করেন না। আমরা দেখছি যে, সবচেয়ে সহিংস মুসলিম সন্ত্রাসীও অন্যের ধর্মকে অবমাননা করার চেষ্টা করছে না বা অন্য ধর্মের মানুষকে জবরদস্তি করে মুসলিম বানানোর আহবান করছে না। শান্তি ও ভালবাসার প্রচারক! ঈসায়ী পাদরিগণ কুরআন পোড়াচ্ছেন, টয়লেটে ফেলছেন! মুসলিমদের নবীকে () নিয়ে ঘৃণ্য কার্টুন ও সিনেমা তৈরি করছেন। সারা বিশ্বের মুসলিমগণ এ ঘৃণ্য বর্বরতার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁরা মার্কিন বা ডেনিশ পতাকায় অথবা এ সব দেশের রাজনীতিবিদদের কুশপুত্তলিকায় অগ্নিসংযোগ করেছেন। কিন্তু কখনোই কোনো মুসলিম খৃস্টানদের পবিত্র ব্যক্তি বা গ্রন্থের অবমাননা করেন নি বা করতে বলেন নি।

৫১
১২. সহজ ধর্ম বনাম কঠিন ধর্ম
ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন: ইসলাম কঠিন এবং খৃস্টধর্ম সহজ। লক্ষ্য করুন:

(ক) সরল মানুষকে প্রতারণা করার এটি বড় অস্ত্র। এ অস্ত্র দিয়ে সাধু পল ঈসা মাসীহের ধর্ম নষ্ট করেন। শুধু বিশ্বাসেই মুক্তি, কোনো কর্মই জরুরী নয়। ব্যভিচার, নরহত্যা, দুর্নীতি, মাদকতা ইত্যাদি যত পাপই কর না কেন যীশু তোমাকে ত্রাণ করবেন। বিশ্ব মানবতাকে ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে বড় প্রতারণা কী হতে পারে? বর্তমান বিশ্বে মানবতার অধঃপতন, নৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, স্বার্থপরতা, মাদকতা ও হিংস্রতার প্রসারের মূল কারণ সাধু পলের এ ধর্ম। এজন্য খৃস্টান সমাজের মানুষ হৃদয়ের পবিত্রতা হারিয়ে অবক্ষয়ের গভীরে নিমজ্জিত হয়েছেন। খৃস্টান পাদরীগণ কর্তৃক খৃস্টান চার্চগুলির মধ্যে যে পরিমাণ ব্যভিচার, ধর্ষণ, শিশুধর্ষণ ইত্যাদি ভয়ঙ্কর পাপ সংঘটিত হয়, বিশ্বের অন্য কোনো ধর্মের ধর্মগৃহে এর শতভাগের একভাগ পাপাচারেরও নযির নেই। আগ্রহী পাঠক ইন্টারনেটে sex abuse, sex abuse of catholic church, catholic celibacy ইত্যাদি সার্চ করুন।

(খ) পাশ্চাত্যের অনেক উচ্চশিক্ষিত খৃস্টান ‘সহজধর্ম’ ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করছেন, কারণ, খৃস্টান ধর্মে আল্লাহর যিকর, গুণগান, আখিরাত-মুখিতা ইত্যাদি কিছুই নেই। কালেভদ্রে চার্চে গিয়ে যে প্রার্থনা করা হয় তাও দুনিয়া মুখি। আর আল্লাহর মর্যাদা ও গুণগান ও আল্লাহর যিকর ছাড়া কখনোই মানুষের হৃদয় প্রশান্তি পায় না। পাঠক ইন্টারনেটে revertmuslims.com ভিযিট করুন।

(গ) প্রচলিত ঈসায়ী ধর্ম সহজ নয়। মানুষের বানানো ধর্ম যা হয়। একদিক সহজ করতে যেয়ে অন্যদিক কঠিন হয়ে গেছে। এ ধর্মে হারামকে হালাল করা হয়েছে কিন্তু হালালকে হারাম বানানো হয়েছে। এ ধর্মের নির্দেশ হলো পাপ করলে সরাসরি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া যাবে না, বরং পাপের কথা পাদরির কাছে বলতে হবে। নিজে বিবাহ না করে চিরকুমার বা চিরকুমারী থাকা এবং মেয়েদেরকে বিবাহ না দিয়ে চিরকুমারী রাখাই উত্তম (মথি ১৯/৯-১২, ১ করিন্থীয় ৭/১-৪০)। ঈশ্বরের জন্য পিতামাতা, স্ত্রী-পরিজন ত্যাগ করা প্রয়োজন; তাতে শতগুণ পিতামাতা স্ত্রীপরিজন পাওয়া যাবে! (মথি ১৯/২৯, মার্ক ১০/২৯-৩০, লুক ১৮/২৯-৩০)। এ ধর্মের বিধানে কোনো ধনী জান্নাতে যেতে পারবে না। (মথি ১৯/২৩-২৪)।

(ঘ) এ ধর্মের সবচেয়ে কঠিন হলো বিশ্বাস। প্রচারকগণ বলেন: শুধু যীশুকে বিশ্বাস করলেই মুক্তি। তবে কিভাবে তাঁকে বিশ্বাস করতে হবে তা সত্যিকার অর্থে কেউ বলতে পারে না। আমরা দেখেছি, খৃস্টান পণ্ডিতগণ স্বীকার করেছেন যে, ত্রিত্ববাদ একটি ননসেন্স বা নির্বোধ প্রলাপ; কেউই তা বুঝেন না। ত্রিত্বের স্বরূপ কী? পিতার সাথে পুত্রের সম্পর্ক কী? যীশু কিভাবে ও কখন থেকে ঈশ্বর? জন্ম থেকে না মানুষ হিসেবে জন্মের পরে? তার মধ্যে একটি ব্যক্তিত্ব বা দুটি ব্যক্তিত্ব? তৃতীয় ঈশ্বরের উৎস কী? ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিগত ২ হাজার বছরে অন্তত দু কোটি খৃস্টান মারামারি করে খুন হয়েছেন। ত্রিত্ববাদ বিষয়ক ও খৃস্টধর্মের হানাহানি বিষয়ক আলোচনায় যে আর্টিকেলগুলি উল্লেখ করেছি ইন্টারনেটে সেগুলো অধ্যয়ন করলেই পাঠক বুঝবেন, খৃস্টধর্মের “ঈমান” কত ভয়ানক দুর্বোধ্য ও কঠিন।

(ঙ) খৃস্টধর্মের সহজ ঈমানটুকুও কেউ অর্জন করতে পারে না। যীশু বলেন: “যাহারা বিশ্বাস করে, এই চিহ্নগুলি তাহাদের অনুবর্তী হইবে; তাহারা আমার নামে ভূত ছাড়াইবে, তাহারা নূতন নূতন ভাষায় কথা কহিবে, তাহারা সর্প তুলিবে এবং প্রাণনাশক কিছু পান করিলেও তাহাতে কোন মতে তাহাদের হানি হইবে না; তাহারা পীড়িতদের উপরে হস্তার্পণ করিবে, আর তাহারা সুস্থ হইবে” (মার্ক ১৬/১৭-১৮)। তিনি বলেন: “আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, যদি তোমাদের একটি সরিষা-দানার ন্যায় বিশ্বাস থাকে, তবে তোমরা এই পর্বতকে বলিবে ‘এখান হইতে ঐখানে সরিয়া যাও, আর ইহা সরিয়া যাইবে; এবং তোমাদের অসাধ্য কিছুই থাকিবে না।” (মথি ১৭/২০-২১)

ঈসায়ী প্রচারককে প্রশ্ন করুন: আপনার সহজ ধর্মের সহজ ঈমানটুকু কি আপনি অর্জন করতে পেরেছেন? তাহলে বিষপান করুন। শরিষা পরিমাণ ঈমানও কি অর্জন করতে পেরেছেন? তবে পাহাড় নয় আপনার টেবিলটিকে সরে যেতে বলুন! যদি তা না সরে তবে আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে, আপনার ‘সরিষা-দানার পরিমাণও’ ঈমান নেই। আপনি যাকে ঈমান বলে মনে করছেন তা ঈমানই নয়; এতে মুক্তি মিলবে না।

৫২
১৩. পাপীদের নাজাত কিভাবে?
‘সবাইকে ভক্তি করার’ কথা মুখে বললেও, ঈসায়ী প্রচারকগণের প্রথম লক্ষ্য ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঘৃণা ও অভক্তি’ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। তাঁরা কখনো বলেন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপীদের মুক্তির জন্য আগমন করেন নি, বরং মানুষদেরকে সতর্ক করতে এসেছিলেন (নাউযূ বিল্লাহ)। কখনো বলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মাত হয়ে জান্নাত পেতে মুত্তাকী হতে হয়। পক্ষান্তরে যীশুর উম্মাত হলে মহাপাপী হলেও ক্ষতি নেই।

প্রথমত: আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল নবী-রাসূলই পাপীদের মুক্তির জন্য আগমন করেন। তবে প্রচলিত ইঞ্জিল থেকে প্রমাণিত হয় যে, যীশু মানুষদের জাহান্নামী করতে এসেছিলেন (নাঊযু বিল্লাহ)। নিম্নের বিষয়গুলি দেখুন:

(ক) যীশুর গ্রেফতারের পর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের ঘটনা প্রসঙ্গে লূক বলেন: ঈসাকে দেখে হেরোদ (ফিলিস্তিনের রাজা Herod Antipas) খুব খুশি হলেন। তিনি ঈসার সমন্ধে অনেক কথা শুনেছিলেন, তাই তিনি অনেক দিন ধরে তাঁকে দেখতে চাইছিলেন। হেরোদ আশা করেছিলেন ঈসা তাকে কোনো কেরামতী কাজ করে দেখাবেন। তিনি ঈসাকে অনেক প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ঈসা কোন কথারই জবাব দিলেন না। প্রধান ইমামেরা এবং আলেমেরা সেখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ঈসাকে দোষ দিতে লাগলেন। তখন হেরোদ ঈসাকে অপমান ও ঠাট্রা করলেন, আর তাঁর সৈন্যরাও তাই করল। ,,,(লুক ২৩/৮-১১)

এখানে যীশু রাজা হেরোদের আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ সত্ত্বেও কোনো মু‘জিযা দেখালেন না। ইতোপূর্বে দেখিয়েছেন অথবা ভবিষ্যতে দেখাবেন- তাও বললেন না। তিনি যদি এরূপ কিছু করতেন তাহলে রাজা হেরোদ-সহ সকল ইয়াহূদী ও সকল মানুষ বিশ্বাস অর্জন করে নাজাত লাভ করত। এরপর তিনি প্রয়োজনে ক্রুশে উঠে মৃত্যুবরণ করতেন। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না; ফলে এ সকল মানুষ এবং কিয়ামত পর্যন্ত ইয়াহূদী জাতি সকলেই অবিশ্বাসের কারণে নরকবাসী হয়ে গেল।

(খ) ক্রুশারোহণ প্রসঙ্গে মথি বলেন: “যে সব লোক সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল তারা মাথা নেড়ে ঈসাকে ঠাট্রা করে বলল, “তুমি না বায়তুল-মোকাদ্দস ভেংগে আবার তিন দিনের মধ্যে তৈরী করতে পার! তাহলে এখন নিজেকে রক্ষা কর। যদি তুমি ইবনুল্লাহ হও তবে ক্রুশ থেকে নেমে এস”। প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরা এবং বৃদ্ধ নেতারাও তাঁকে ঠাট্রা করে বললেন, ‘ও অন্যদের রক্ষা করত, নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। ও তো ইসরাইলের বাদশাহ্! & এখন ক্রুশ থেকে ও নেমে আসুক। তাহলে আমরা ওর উপর ঈমান আনব। ও আল্লাহর উপর ভরসা করে, এখন আল্লাহ যদি ওর উপর খুশি থাকেন তবে ওকে তিনি উদ্ধার করুন। ও তো নিজেকে ইবনুল্লাহ বলত। যে ডাকাতের তাঁর সংগে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল তারাও সেই একই কথা বলে তাঁকে টিট্কারি দিল। (মথি ২৭/৩৯-৪৩)

এ সময়ে তো তাঁর দায়িত্ব ছিল যে, বিশ্ববাসীকে জান্নাতের প্রকৃত বিশ্বাস জানিয়ে দিতে অন্তত একবার ক্রুশ থেকে নেমে আসবেন। এরপর আবার ক্রুশে উঠে জীবনত্যাগ করবেন। তাহলে এসকল মানুষ ও সকল ইয়াহূদী মুক্তি পেত!

(গ) মথি ১২/৩৮-৪০: “কয়েকজন আলেম ও ফরীশী ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আমরা আপনার কাছ থেকে একটা চিহ্ন দেখতে চাই।” ঈসা তাঁদের বললেন, “এই কালের দুষ্ট ও বেঈমান লোকেরা চিহ্নের খোঁজ করে, কিন্তু ইউনুস নবীর চিহ্ন ছাড়া আর কোন চিহ্নই তাদের দেখানো হবে না। ইউনুস যেমন সেই মাছের পেটে তিন দিন ও তিন রাত ছিলেন ইবনে আদম তেমনি তিন দিন ও তিন রাত মাটির নীচে থাকবেন।”

যীশু তাঁদেরকে একটি চিহ্ন দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন যা তিনি তাদেরকে দেখান নি। তিনি মাটির নিচে তিন দিন তিন রাত থাকেন নি, বরং দুই রাত ও এক দিন ছিলেন (যোহন ২০/১-১৮; মথি ২৮/১-১০; মার্ক ১৬/১-১১; লূক ২৪/১-১২)। সর্বোপরি, যীশু তাঁর প্রতিশ্রুতি মত পৃথিবীর গর্ভ থেকে পুনরুত্থানের চিহ্নটি অধ্যাপক ও ফরীশীদেরকে দেখান নি। যীশু পুনরুত্থানের পর নিজেকে এদের সামনে বা অন্য কোনো ইয়াহূদীর সামনে একটিবারের জন্যও প্রকাশ করেন নি। এজন্যই ইয়াহূদীরা যীশুর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করেন না। যদি যীশু পাপীদের মুক্তির জন্যই এসে থাকতেন তাহলে তো তিনি পুনরুত্থানের পরে অধ্যাপক ও ফরীশীদেরকে দেখা দিয়ে তাদের সকলের, সকল ইয়াহূদী এবং বিশ্বের সকল মানুষের মুক্তির ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু তিনি তো তা করলেন না।

দ্বিতীয়ত: সকল নবী-রাসূলই পাপীদের জন্য আগমন করেন। তবে আমরা দেখেছি যে, ঈসা মাসীহ শুধু ইসরায়েল বংশের পাপীদের নাজাতের পথ দেখাবেন। অন্য কোনো দেশের, বর্ণের, বংশের বা ধর্মের মানুষ তাঁর উম্মাত হয়ে বা তাঁর মত অনুসরণ করে নাজাত পাবে না। (মথি ৭/৬, ১০/৫-৮; ১৫/২২-২৮) পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা বিশ্বের সকল যুগের সকল মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। বিশ্বের যে কোনো যুগ, দেশ, জাতি, বর্ণ বা ধর্মের পাপী মানুষ তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করলে মুক্তি, নাজাত ও সফলতা লাভ করবেন। কুরআন কারীমের এ কথা বারংবার ঘোষণা করা হয়েছে। (আ‘রাফ: ১৫৮; ফুরকান: ১, আম্বিয়া: ১০৭, সাবা: ২৮)

তৃতীয়ত: আমরা দেখেছি, ঈসা মাসীহের মাধ্যমে পাপমোচন তত্ত্বটি ভিত্তিহীন মিথ্যা। যীশু পাপীদের পাপ বহন করবেন না “যে প্রাণী পাপ করে, সেই মরিবে; পিতার অপরাধ পুত্র বহন করিবে না, ও পুত্রের অপরাধ পিতা বহন করিবে না; ধার্মিকের ধার্মিকতা তাহার উপর বর্তিবে ও দুষ্টের দুষ্টতা তাহার উপর বর্তিবে।” (যিহিষ্কেল ১৮/২০) “কিন্তু জ্বলন্ত আগুন ও গন্ধকের হ্রদের মধ্যে থাকাই হবে ভীতু, বেঈমান, ঘৃণার যোগ্য, খুনী, জেনাকারী, জাদুকর, মূর্তিপূজাকারী এবং সব মিথ্যাবাদীদের শেষ দশা। এটাই হল দ্বিতীয় মৃত্যু।” (প্রকাশিত বাক্য/কালাম ২১/৮)

যদি মাসীহ পাপ বহন করবেন তবে ছোট বড় সকল পাপের জন্য চিরস্থায়ী নরক কেন? তিনি আরো বলেন: “যে কেউ কোন স্ত্রীলোকের দিকে কামনার চোখে তাকায় সে তখনই মনে মনে তার সংগে জেনা করল। তোমার ডান চোখ যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা উপড়ে দূরে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর দোজখে যাওয়ার চেয়ে বরং তার একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল। (মথি ৫/২৮-২৯)

তিনি সুস্পষ্ট বললেন যে, চক্ষু না তুললে পুরো দেহ জাহান্নামে পুড়বে। তিনি যদি পরনারীর প্রতি দৃষ্টিপাতের পাপও বহন করতে না পারেন তাহলে কোন্ পাপ বহন করবেন? খৃস্টান প্রচারক হয়ত বলবেন যে, তিনি মানুষদেরকে বুঝানোর জন্য এ সব কথা বলেছেন, মূলত তিনি সকল পাপ বহন করবেন। তাঁরা নিজেদের বিভ্রান্তি প্রচার করতে যীশুকে সত্য বুঝাতে অক্ষম বা মুনাফিক বলে চিত্রিত করেন। বস্তুত, তিনি কোনো পাপীর পাপই বহন করবেন না; তবে ইসরায়েল বংশের শির্কমুক্ত ঈমানদার পাপীদের পাপ ক্ষমার জন্য তিনি সুপারিশ করবেন। (সূরা মায়িদা: ৭২)

চতুর্থত: পাপমোচন থিওরির ভিত্তিতে প্রটেস্ট্যান্ট খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার: Martin Luther (১৪৮২-১৫২৯ খৃ) বলেন: “তোমরা শুধু বিশ্বাস কর। আর সুনিশ্চিতরূপে জেনে রাখ যে, এতেই তোমাদের মুক্তি লাভ হবে। মুক্তির জন্য কোনো উপবাসের কষ্ট করতে হবে না, সৎ থাকার কষ্ট করতে হবে না, পাপের স্বীকারোক্তির কষ্ট করতে হবে না, কোনোরূপ সৎকর্ম পালনের কষ্ট করতে হবে না। খৃস্টের জন্য যেমন সুনিশ্চিত মুক্তি, তোমাদের জন্যও ঠিক তেমনি সুনিশ্চিত মুক্তি, যাতে কোনোরূপ সন্দেহ নেই। তোমরা পাপ কর। পরিপূর্ণ সাহসিকতার সাথে পাপ করতে থাক এবং শুধু বিশ্বাস কর। শুধু বিশ্বাসই তোমাদেরকে মুক্তি প্রদান করবে, যদিও তোমরা প্রতিদিন এক হাজার বার ব্যভিচার বা হত্যার মত পাপে লিপ্ত হও। তোমরা শুধু বিশ্বাস কর। আমি তোমাদেরকে বলছি, শুধু বিশ্বাসই তোমাদেরকে মুক্তি দিবে।” (ক্যাথলিক হেরাল্ড, ভলিউম ৯, পৃষ্ঠা ২৭৭) এজন্যই আমরা দেখি যে, মিথ্যা, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, মদপান, ব্যভিচার, ধর্ষণ ইত্যাদি পাপ খৃস্টান চার্চ ও পাদরিদের নিয়মিত কর্ম। এমনকি হিটলারের মত ঠান্ডা মাথায় গ্যাস চেম্বারে কয়েক লক্ষ মানুষ হত্যা করলেও কোনো সমস্যা নেই। যীশু সকলের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে বসে রয়েছেন! সাধু পলের এ বিশ্বাস পাপীকে পাপ মুক্ত করে না, বরং পাপীকে মহাপাপীতে পরিণত করে।

পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগতের প্রতিটি পাপীকে অতি সহজে পাপ মুক্ত হয়ে দুনিয়ায় আল্লাহর প্রিয়ভাজন বা ওলী হওয়ার এবং আখিরাতে জান্নাত পাওয়ার সহজ পথ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তাওবার শিক্ষা দিয়েছেন। পাপ যত মহাপাপই হোক না কেন, যে কোনো পাপী বান্দা একান্তই নিজের মনের মধ্যে অনুশোচনা ও ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে পরিপূর্ণ ক্ষমা ও নাজাত লাভ করতে পারেন।

সম্মানিত পাঠক, মনে করুন, একটি ছেলে প্রায়ই মায়ের অবাধ্য হয়। এরপর যখনই মনটা নরম হয় মায়ের কাছে যেয়ে মাকে জাড়িয়ে ধরে, ক্ষমা চায়। তখন মা আদর করেন ও দোআ করেন। প্রায়ই এমন ঘটে। মায়ের আরেক ছেলে। প্রায়ই মায়ের অবাধ্যতা করে। সে জানে তার বড়ভাই তার জন্য মায়ের কাছে সুপারিশ করবেন। কাজেই সে মায়ের সান্নিধ্যে কখনোই যায় না, অথবা যখনই মনটা নরম হয় তখন বড়ভাইকে মায়ের কাছে তার জন্য সুপারিশ করতে অনুরোধ করে। বলুন তো কোন্ সন্তান সত্যিকার মাতৃপ্রেম ও মায়ের স্নেহ লাভ করবে?

সম্মানিত পাঠক, প্রতি মুহূর্তেই আমরা পাপ করি। যখনই মনটা একটু নরম হয় তখনই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়াই হলো পাপ মোচনের সঠিক পথ। পাপের মাধ্যমে আল্লাহর থেকে আমরা যতটুকু দূরে যাই, আল্লাহর যিকর ও তাওবার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর অনেক বেশি ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভ করি। ইসলামের শিক্ষা হলো, মহান আল্লাহ মায়ের চেয়েও অনেক প্রিয়, অনেক আপন। প্রতিটি মানুষকে তিনি সন্তানের চেয়েও অনেক বেশি ভালবাসেন। দীন শিক্ষার জন্য মানুষের উস্তাদ বা আলিমের প্রয়োজন। কিন্তু মহান আল্লাহর কাছে দো‘আ করতে বা তাওবা করতে পাপীকে কারো কাছে যেতে হবে না। কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা বা আলিম-ইমামের কাছেও তাকে যেতে হবে না। নিজের স্থানে থেকে নিজের মনের আবেগ ও অনুশোচনা দিয়ে প্রতিটি মানুষ সরাসরি মহান আল্লাহকে ডাকবে, পাপ করলে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে পাপী বান্দা আল্লাহর প্রিয়মত ওলীতে পরিণত হয়।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যীশু বা অন্য কাউকে আল্লাহ ও তার মাঝে মধ্যস্থ বলে মনে করে, অথবা কেউ তাকে ত্রাণ করবে বলে বিশ্বাস করে সে উক্ত মধ্যস্থের উপর নির্ভরতার কারণে পাপ ত্যাগ করতে পারে না, কখনো প্রার্থনার আবেগ হলে মূলত উক্ত মধ্যস্থের কথাই তার হৃদয়ে জাগে। এভাবে তার হৃদয় আল্লাহর যিকর থেকে বঞ্চিত হয়, ক্রমান্বয়ে পাপ তার হৃদয়কে অন্ধকার করে তাকে চির জাহান্নামী করে।

৫৩
১৪. তাওরাত-ইঞ্জিলের বিধান রহিত হওয়া প্রসঙ্গ
ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন, আল্লাহর বিধান তো রহিত হয় না। কারণ আল্লাহর বিধান রহিত হওয়ার অর্থ আগের বিধানটি আল্লাহ না বুঝে দিয়েছিলেন। এরূপ তো চিন্তা করা যায় না। এজন্য তাওরাত-ইঞ্জিলও মানতে হবে। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:

প্রথমত, যারা কিতাবুল মোকাদ্দসকে আল্লাহর কিতাব বলে বিশ্বাস করে তাদের এ কথা বলার সুযোগ নেই। কারণ, আমরা দেখেছি যে, কিতাবুল মোকাদ্দসের ‘খোদা’ অনেক কাজই না বুঝে করেন এবং পরে আফসোস করেন [এগুলো তাদের গ্রন্থের কথা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। লেখক বা কোনো মুসলিমই এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে না। [সম্পাদক]]।

দ্বিতীয়ত, তাওরাত-ইঞ্জিল পাওয়া গেলে তো তা মানতে হবে। আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, প্রচলিত কিতাবুল মোকাদ্দস থেকে অনেক গ্রন্থ হারিয়ে গিয়েছে, অনেক কিছু সংযোজিত হয়েছে এবং বিকৃত হয়েছে। এগুলির মূল শিক্ষা ও বিধান কুরআনে সংরক্ষিত।

তৃতীয়ত, আল্লাহর বিধান যে রহিত হয় তার অগণিত নমুনা কিতাবুল মোকাদ্দসে বিদ্যমান। এ গ্রন্থের বর্ণনানুসারে সামান্য কয়েকটি নমুনা দেখুন:

(ক) আদম (আ)-এর শরীয়তে ভাই-বোনের বিবাহ বৈধ ছিল। ইবরাহীম (আ)-এর স্ত্রী সারা তার বৈমাত্রেয় বোন ছিলেন। (আদিপুস্তক ২০/১২)। কিন্তু মূসা (আ)-এর শরীয়তে আপন ভগ্নি, বৈমাত্রেয় ভগ্নি ও বৈপিত্রেয় ভগ্নি সকল প্রকারের ভগ্নিকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ। এইরূপ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ স্বামী-স্ত্রী উভয়কে হত্যা করা অত্যাবশ্যক। (লেবীয় ১৮/৯, ২০/১৭, দ্বিতীয় বিবরণ ২৭/২২)।

(খ) নূহ (আ)-এর শরীয়তে সকল প্রাণী ভক্ষণ বৈধ ছিল (আদিপুস্তক ৯/৩)। কিন্তু মূসা (আ)-এর শরীয়তে এ বৈধতা রহিত করে অধিকাংশ প্রাণী হারাম করা হয় (লেবীয় ১১/৪-৮; দ্বিতীয় বিবরণ১৪/৭-৮)

(গ) ইবরাহীম (আ)-এর শরীয়তে দু বোনকে একত্রে বিবাহ বৈধ ছিল। ইয়াকূব (আ) লেয়া ও রাহেল দু বোনকে বিবাহ করেন (আদিপুস্তক ২৯/১৫-৩৫)। মূসা (আ)-এর শরীয়তে দু বোনকে একত্রে বিবাহের বৈধতা “রহিত” হয়। (লেবীয় ১৮/১৮)

(ঘ) মূসা (আ)-এর শরীয়তে যে কোনো কারণে স্বামীর জন্য স্ত্রীকে তালাক দেওয়া বৈধ ছিল এবং তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিবাহ করাও অন্য পুরুষের জন্য বৈধ ছিল (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১-২)। কিন্তু ঈসা (আ)-এর শরীয়তে একমাত্র ব্যভিচারের অপরাধ ছাড়া কোনো স্বামী তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে না এবং অন্য কোনো ব্যক্তি সে পরিত্যাক্তা স্ত্রীকে বিবাহ করতে পারবে না। এইরূপ বিবাহ ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। (মথি ৫/৩১-৩২ ও ১৯/৩-৯)

চতুর্থত: পরবর্তী বিধান বা কিতাবের কারণে পূর্ববর্তী বিধান পরিবর্তিত, রহিত বা বাতিল হওয়ার বিষয়ে খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু পল লিখেছেন: “যখন ইমামের পদ বদলানো হয় তখন শরীয়তও বদলাবার দরকার হয় ((ইব্রীয়/ইবরানী ৭/১২) এভাবে বারংবার সাধু পল লিখেছেন যে, নতুন কিতাব ও নতুন ইমাম যখন আগমন করেন তখন পুরাতন শরীয়ত লুপ্ত ও রহিত হয়। (ইব্রীয়/ইবরানী ৭/১৮, ৮/৭, ১৩, ১০/৯) এ সকল বক্তব্য প্রমাণ করে যে, পরবর্তী বিধান দ্বারা পূর্ববর্তী বিধান রহিত হওয়াই নিয়ম। সাধু পলের নেতৃত্বে খৃস্টানগণ মূসার শরীয়তের সব কিছুই রহিত করে দেন। কাজেই পলের ধর্মের অনুসারীদের জন্য আল্লাহর বিধান রহিত হওয়া অস্বীকার করা প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।

৫৪
১৫. মৃতকে জীবিত করা ও অলৌকিক কর্মকাণ্ড
মিশনারিগণ বলেন: যীশু মৃতকে জীবিত করেছেন কাজেই তাঁর মর্যাদা বেশি।

প্রথমত: খৃস্টান প্রচারককে বলুন, আপনি কি আপনার নবীর মু‘জিযা প্রমাণ করতে পারবেন? আমি আমার নবীর মু‘জিযা প্রমাণ করতে পারব। ঈসা মাসীহ শুধু তার যুগের নবী ছিলেন। এজন্য আল্লাহ তাঁকে ক্ষণস্থায়ী মু‘জিযা প্রদান করেন। তিনি মৃতকে জীবিত করেছিলেন এ কথা বিশ্বাস করা হয়, প্রমাণ করা যায় না। কোনো খৃস্টান মৃতকে জীবিত করে দেখাতে পারেন না। পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সকল যুগের জন্য বিশ্বনবী; সেজন্য আল্লাহ তাকে অন্যান্য অগণিত মহান মু‘জিযার পাশাপাশি তাঁর শ্রে্ষ্ঠ মু‘জিযা দিয়েছেন কুরআন। সকল যুগেই কুরআনের মু‘জিযা প্রকাশিত। যে কোনো মুসলিমের জন্য তা প্রমাণ করা সম্ভব। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বাদ দিলেও যে কোনো মুসলিম দু-তিন বৎসরে কুরআন মুখস্থ করে এর অলৌকিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন; কিন্তু কোনো খৃস্টান কি ২০ বা ২০০ বছরে ইঞ্জিল শরীফ মুখস্থ করতে [মুখস্থ করা তো দূরে থাক, সেটার মূল কপিই তো প্রমাণ করতে পারবে না। [সম্পাদক]] বা কুরআনের মত একটি গ্রন্থ লিখে দিতে পারবেন?

দ্বিতীয়ত, মৃতকে জীবিত করা যদি মর্যাদার মাপকাঠি হয় তাহলে খৃস্টানদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, যিহিষ্কেল নবী ঈসা মাসীহের চেয়ে হাজারগুণ বেশি মর্যাদাবান। কারণ, ইঞ্জিলের উল্টোপাল্টা বর্ণনা সত্য ধরলে যীশু মাত্র তিনজন মৃতকে জীবিত করেন। অথচ যিহিষ্কেল ভাববাদী হাজার হাজার মৃত মানুষকে জীবিত করেন (যিহিষ্কেল ৩৭/১-১৪)। এছাড়া এলিয় নবী (Elijah) একটি মৃত শিশুকে পুনর্জীবিত করেন (১ রাজাবলির ১৭/১৭-২৪)। ইলীশায় (Elisha) নবী একজন মৃত বালককে পুনর্জীবিত করেন (২ রাজাবলির ৪/৮-৩৭)। তাহলে খৃস্টান প্রচারকদের স্বীকার করতে হবে যে, এলিয় এবং ইলীশায় নবীর মর্যাদা ইবরাহীম, মূসা, দায়ূদ ও যীশুর ১২ শিষ্যের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

তৃতীয়ত: বস্তুত, নবীগণ দুচারজন মৃতকে জীবিত করতে আসেন না। তাঁরা আসেন মৃত হৃদয়কে ঈমান দ্বারা জীবিত করতে। বাইবেলের ভাষ্যানুসারে যীশু ২/৩ জন মৃতকে জীবিত করলেও তিনি মানুষদেরকে ঈমানদার বানাতে পারেন নি। খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, যীশুর বারো জন প্রেরিত শিষ্যের মর্যাদা মোশি ও অন্য সকল ইস্রায়েলীয় নবী-রাসূলের চেয়ে বেশি। যীশু তাদেরকে নুবুওয়াত প্রদান করেন, মৃতকে জীবিত করা সহ সকল অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন এবং তারা পাক রূহ বা পবিত্র আত্মায় পরিপূর্ণ হন। ইঞ্জিলের বর্ণনানুসারে এ মহান নবীগণকেও ঈসা মাসীহ ঈমান শিক্ষা দিতে পারেন নি। তাঁদের ঈমানের হাল-হাকীকত দেখুন!

(ক) পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগের রাতে যীশু অত্যন্ত ভীত, দুঃখার্ত ও ব্যাকুল ছিলেন। তিনি শিষ্যদেরকে বলেন: আমার প্রাণ মারাত্মক (মরণ পর্যন্ত) দুঃখার্ত, তোমরা এখানে থাক এবং আমার সাথে জেগে থাক। পরে তিনি কিঞ্চিত অগ্রসর হয়ে উবুড় হয়ে (সাজদা করে) প্রার্থনা করেন (সালাত আদায় করেন)। পরে তিনি শিষ্যদের নিকটে এসে দেখেন যে, তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তিনি পিতরকে বললেন, এ কি? এক ঘণ্টাও কি আমার সঙ্গে জেগে থাকতে তোমাদের শক্তি হল না? জেগে থাক ও প্রার্থনা কর। এরপর তিনি দ্বিতীয় বার গিয়ে আবার প্রার্থনা করলেন। পরে তিনি আবার এসে দেখেন যে, তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। (মথি ২৬/৩৬-৪৬)।

ঈমানের কোনো নমুনা কি এখানে দেখা যায়? পৃথিবীর সাধারণ পাপী মানুষদের দিকে তাকান। যদি তাদের কোনো নেতা বা কোনো আপনজন অত্যন্ত দুঃখার্ত ও অস্থির থাকেন, অথবা অসুস্থ থাকেন তবে তারা সে রাতে ঘুমাতে পারেন না। জগতের সবচেয়ে পাপী মানুষটিও এরূপ অবস্থায় ঘুমাতে পারবেন না।

(খ) এরপর যখন ইয়াহূদীরা যীশুকে গ্রেফতার করল তখন এ মহা-মর্যাদাবান শিষ্যগণ যীশুকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছিলেন (মথি ২৬/৫৬)।

(গ) ১২ শিষ্যের একজন ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা (Judas Iscar'i-ot)। পাকরূহে পরিপূর্ণ (মথি ১০/১-৮) এ শিষ্যের বিষয়ে যোহন উল্লেখ করেছেন যে, তিনি চোর ছিলেন (যোহন ১২/৪-৬)। সর্বোপরি তিনি ৩০ টাকার বিনিময়ে যীশুকে হত্যার জন্য ইয়াহূদীদের হাতে তুলে দেন। (মথি ২৬ ও ২৭ অধ্যায়)

(ঘ) দ্বিতীয় শিষ্য পিতর। ঈসায়ীগণের বিশ্বাস অনুসারে তিনিই ছিলেন যীশুর স্থলাভিষিক্ত ও প্রেরিতগণের প্রধান। অন্য শিষ্যদের মতই তিনি যীশুকে দুঃখার্ত ও ব্যাকুল দেখেও শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন এবং তাঁকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যান। তবে অন্যদের চেয়েও অতিরিক্ত একটি কর্ম করে তিনি অতিরিক্ত মর্যাদা লাভ করেন। যখন উপস্থিত জনতার কেউ কেউ পিতরকে চিনতে পেরে বলে যে, এ ব্যক্তি গ্রেফতারকৃত যীশুর সাথীদের একজন, তখন তিনি যীশুকে গালি দিয়ে বারংবার শপথ করে বলতে থাকেন যে, তিনি যীশুকে চিনেনই না! (মথি ২৬/৬৯-৭৫; মার্ক ১৪/৬৬-৭২; লূক ২২/৫৫-৬২; যোহন ১৮/১৬-১৮ ও ২৫-২৭)।

ইঞ্জিলের বর্ণনায় এ হলো যীশুর ঈমান শেখানোর অবস্থা। পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের লক্ষাধিক বর্বর মৃত হৃদয়ের মানুষের মৃত হৃদয়কে জীবিত করে অনন্ত জীবন দান করেন, যারা সাধারণ একজন মানুষের জীবন রক্ষার জন্যও নিজেদের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

চতুর্থত: অলৌকিক কার্যে মর্যাদা বৃদ্ধি হয় না। ইঞ্জিলে বলা হয়েছে যে, ভণ্ডগণ ও দাজ্জালও এভাবে মহা-অলৌকিক কাজ করবে (মথি ২৪/২৪, ২ থিষলনীকীয় ২/৯)। নবীগণের প্রকৃত মর্যাদা মানব সমাজকে অবক্ষয় থেকে রক্ষা করায়। বাইবেলের যীশু এ বিষয়ে কিছুই করেন নি। তিনি মানুষদেরকে হেদায়াত করতে পারেন নি। সমাজ থেকে জুলুম, নিপীড়ন, অনাচার বা দুর্নীতি উঠাতে পারেন নি। নতুন কোনো বিশ্বাস বা নৈতিকতার প্রসার তিনি করতে পারেন নি।

খৃস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে তিনি শুধু এসেছেন, ক্রুশে জীবন দিয়ে মানুষদের পাপক্ষয় করে চলে গিয়েছেন। উপরন্তু মানুষদের জাহান্নামী করার ব্যবস্থা করেছেন। কারণ, খৃস্টানদের দাবি অনুযায়ী, মানুষকে জান্নাতী হতে হলে তাঁর ঈশ্বরত্বে, প্রায়শ্চিত্বে ও পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু সবগুলি বিষয়ই তিনি গোপন করে গিয়েছেন। তার ঈশ্বরত্বের কথা স্পষ্ট করে বলেন নি। প্রকাশ্যে মু‘জিযা না দেখিয়ে গোপন করেছেন। অন্তত কবর থেকে বেরোনোর পরে যেরুজালেমে একটু দেখা দিলে সকলেই বিশ্বাস করে জান্নাতী হতে পারত। শতমুখে প্রচারিত হলে বিশ্বের সকল মানুষ বিশ্বাস করত। তিনি তাও করেন নি। গোপনেই চলে গেছেন। আমরা দেখেছি যে, এজন্যই খৃস্টানগণ আজ পর্যন্ত তাদের ‘ঈমান’ কী তা ঠিক করতে পারেন নি। ফলে একে অপরকে জাহান্নামী বলেছেন ও কোটি কোটি খৃস্টান মারামারি করে মরেছেন।

পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতার ক্রান্তিলগ্নে এসেছেন, নতুন বিশ্বাস ও নৈতিকতায় মানব জাতিকে উজ্জীবিত করেছেন, সমাজ থেকে জুলুম, দুর্নীতি, মাদকতা, অনাচার ও অবিচার উৎখাত করেছেন এবং বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রদান করেছেন।

৫৫
১৬. ঈসা (আ) জীবিত ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত?
খৃস্টান প্রচারকগণ বলেন: যীশু জীবিত কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত, কাজেই যীশুর মর্যাদা বেশি। এক্ষেত্রে খৃস্টানদের মানতে হবে যে, যীশুর চেয়ে বেশি মর্যাদা ইদরিস ও এলিয় নবীর; কারণ, বাইবেলের বর্ণনানুসারে তারা স্বশরীরে অমর হয়ে জান্নাতে গিয়েছেন। (আদিপুস্তক ৫/২৩-২৪; ২ রাজাবলি ২/১-১১) পক্ষান্তরে ঈসা মাসীহকে ক্রুশে মরে অভিশপ্ত হয়ে তিন দিন নরকভোগের পর জান্নাতে যেতে হয়েছে। সর্বোচ্চ মর্যাদা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর, কারণ আল্লাহ তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে নিয়ে যান মি‘রাজের মাধ্যমে। আমরা বিশ্বাস করি যে, ঈসা (আ)-কে আল্লাহ ক্রুশে মৃত্যুর লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে জীবিত তুলে নেন। কিন্তু ইঞ্জিলের বর্ণনায় ও খৃস্টানদের বিশ্বাসে তিনি মৃত। মৃত্যুর পরে তিনি জীবন পেয়েছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও মৃত্যুর পরে বারযাখী জীবন পেয়েছেন। পার্থক্য হলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “সর্বোচ্চ ভালোবাসার পাত্র প্রিয় বন্ধুর সান্নিধ্য চাই” বলতে বলতে ভালোবাসার আবেগে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। আর যীশু অসহায়ের মত চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মরেছেন। তাঁর সাথে ক্রুশবিদ্ধ ডাকাতগুলিও মরার সময় এভাবে কাঁদে নি। (মথি ২৭/৩৮-৫১; মার্ক ১৫/২৭-৩৮)

৫৬
১৭. নবীগণের পাপ ও পাপীর শাফা‘আত
সবাইকে মানি বলে প্রতারণা করে দলে ভেড়ানোর পর ঈসায়ী প্রচারকদের প্রথম কর্ম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অভক্তি তার হৃদয়ে রোপণ করেন। এ সকল ঘৃণ্য কথাগুলির মধ্যে তারা বলেন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপী (নাঊযু বিল্লাহ!) তিনি শাফা‘আত করতে পারবেন না; মাসীহ নিষ্পাপ কাজেই তিনি শাফা‘আত করবেন। লক্ষ্য করুন:

প্রথমত: এক পাপী অন্য পাপীর শাফা‘আত করতে পারবেন না- কথাটি মহা মিথ্যা। খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, মূসা, হারূন ও অন্যান্য সকল নবী পাপী (নাঊযু বিল্লাহ); কিন্তু আল্লাহ তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেন। ইস্রায়েলীয়গণ গোবৎস পূজা করলে আল্লাহ তাদের সকলকেই ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন মূসা (আ) তাদের জন্য সুপারিশ করেন এবং আল্লাহ সুপারিশ গ্রহণ করেন। (যাত্রাপুস্তক ৩২/৭-১৪) আরো কয়েকবার ইস্রায়েলীয়গণ মহাপাপে লিপ্ত হলে আল্লাহ সকলকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে মূসা (আ) ও হারূন (আ)-এর শাফাআতে তাদের ক্ষমা করে দেন (গণনা পুস্তক ১৬ এবং ২১ অধ্যায়: ১৬/২০-২৪ ও ৪১-৫০; ২১/৪-৯)।

দ্বিতীয়ত: ঈসা মাসীহ নিষ্পাপ কথাটিও ইঞ্জিলের আলোকে অসত্য। আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ঈসা মাসীহ ও অন্যান্য সকল নবী-রাসূল নিষ্পাপ ছিলেন। কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দস বা প্রচলিত ইঞ্জিলকে আল্লাহর কালাম বলে বিশ্বাস করলে বিশ্বাস করতে হবে যে, ঈসা মাসীহ মহাপাপী ছিলেন। কারণ, তিনি মানুষদেরকে গালিগালাজ করতেন (মথি ১৬/২৩, ২৩/১৩-৩৩), অন্য বংশ বা ধর্মের মানুষদেরকে শূকর ও কুকুর বলে বিশ্বাস করতেন ও এরূপ সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দিয়েছেন (মথি ৭/৬; ১৫/২২-২৮, মার্ক ৭/২৫-২৯), পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদেরকে চোর-ডাকাত বলতেন (যোহন ১০/৭-৮), নিরপরাধ মানুষদেরকে অভিশাপ দিতেন (মথি ২৩/৩৫-৩৬), অকারণে হত্যা করতেন (মথি ২১/১৮-২১, মার্ক ৫/১০-১৪; ১১/১২-২২), অবিশ্বাসীদেরকে নির্বিচারে ধরে ধরে তাঁর সামনে জবাই করার নির্দেশ দিতেন (লূক ১৯/২৭), মিথ্যা ওয়াদা ও ভবিষ্যদ্বাণী করতেন (মথি ১৬/২৭-২৮: ১৯/২৮: মার্ক ২/২৫-২৬, ১১/২৩, ১৬/১৭-১৮: লূক ১৮/২৯-৩০, যোহন ৩/১৩), মদ পান করে মাতাল হতেন (লূক ৭/৩৪-৫০, যোহন ১৩/৪-৫), বেশ্যা মেয়েদেরকে তাঁকে স্পর্শ করতে ও চুম্বন করতে দিতেন (লূক ৭/৩৪-৫০, ৮/১-৩, যোহন ১১/১-৫)। তিনি নিজের মায়ের সাথে ভয়ঙ্কর বেয়াদবি করেছেন। একদিন তাঁর মা তাঁকে বলেন যে, তাদের দ্রাক্ষারস (মদ) নেই। তখন “যীশু তাহাকে কহিলেন, হে নারি, আমার সঙ্গে তোমার বিষয় কী? (Woman, what have I to do with thee?) (যোহন ২/৪) এভাবে বারংবার তিনি মাকে “ওহে নারি” (Woman) বলে সম্বোধন করেছেন (যোহন ১৯/২৬); তাঁকে সাক্ষাৎ দানে অস্বীকার করেছেন ও তুচ্ছ করেছেন। (মথি ১২/৪৬-৫০; মার্ক ৩/৩১-৩৫; লূক ৮/১৯-২১)। এগুলি পাপ না হলে পাপ কী?

তৃতীয়ত: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপী কথাটিও কুরআন, হাদীস ও বাস্তবতার আলোকে মহা মিথ্যা কথা। খৃস্টান প্রচারকগণ কুরআন বা হাদীস থেকে একটি তথ্যও পেশ করতে পারবেন না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুক সময়ে অমুক পাপ করেছিলেন। কোনো কিছু না পেয়ে তারা বলেন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৫ বৎসর বয়য়ে ১০ বৎসরের কিশোরীকে বিবাহ করেছিলেন, কাজেই তাঁর চরিত্র ভাল ছিল না! (নাউযূ বিল্লাহ) এ হলো তাদের ‘সব নবীকে ভক্তি করার’ চিত্র! আপনি বলুন: স্বেচ্ছায় দুজনের বৈধ বিবাহ কি পাপ? না বেশ্যা মেয়েদের সাথে জড়াজড়ি, তাঁদের নিয়ে একত্রে ভ্রমন ও রাত্রিযাপন, মদ খেয়ে কাপড় খোলা ইত্যাদি পাপ? আমাদের বিশ্বাসে নবীগণ নিষ্পাপ, তবে আপনাদের ইঞ্জিল অনুসারে ঈসা মাসীহ এগুলি করেছেন।

চতুর্থত: কুরআনে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করেছেন। (সূরা ফাতহ ১-২ আয়াত) আরো বলা হয়েছে যে, হে নবী আপনি আপনার ও মুমিন নারী-পুরুষদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। (সূরা মুমিন ৫৫ আয়াত ও সূরা মুহাম্মাদ ১৯ আয়াত)। এছাড়া বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মাদ () আল্লাহর কাছে নিজের পাপের জন্য ক্ষমা চাইতেন। এ থেকে তারা বলতে চান যে তিনি পাপী ছিলেন (নাঊযূ বিল্লাহ)।

“ক্ষমা” অর্থ পাপে লিপ্ত হওয়ার পরে ক্ষমা করাই শুধু নয়। কাউকে পাপ থেকে রক্ষা করাকেও ক্ষমা করা বলা হয়। কুরআন-হাদীস থেকে প্রমাণিত যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোনো পাপে লিপ্ত হন নি। বিরোধীরাও প্রমাণ করতে পারবেন না যে, তিনি অমুক সময়ে অমুক কর্ম করেছেন যা তাঁর জন্য পাপ বলে গণ্য। এতে প্রমাণিত হয় যে, “তোমার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পাপ ক্ষমা করা হয়েছে” অর্থ তোমাকে পূর্বে ও পরে পাপের কলঙ্কে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।

পঞ্চমত: দো‘আর শুরুতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম উল্লেখ করলে দো‘আ কবুল হওয়ার নিশ্চয়তা বাড়ে। এজন্যই মহান আল্লাহ তাঁকে উম্মাতের জন্য ক্ষমা চাওয়ার আগে তার নিজের নাম উল্লেখ করতে শিখিয়েছেন। যেন উম্মাতের সকলেই ক্ষমা লাভ করতে পারেন।

ষষ্ঠত: আল্লাহর প্রিয় মানুষেরা সাধারণ ত্রুটিবিচ্যুতিকেও পাপ বলে গণ্য করেন। আল্লাহর যিকর থেকে বিরত থাকা, মনের মধ্যে সামান্যতম মানবীয় চিন্তার উদ্রেক, কারো উপর সামান্য রাগ করা, দুটি বৈধ বিষয়ের মধ্যে উত্তমটিকে বাদ দিয়ে অনুত্তম বৈধ বিষয় গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়কেও তারা পাপ বলে গণ্য করে ক্ষমা প্রার্থনায় ব্যস্ত হন। প্রকৃতপক্ষে এগুলি কোনো পাপই নয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পর্যায়ের ক্ষমা প্রার্থনা করতেন এবং উম্মাতকে এভাবে ক্ষমা প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ ক্ষমা প্রার্থনা মহান আল্লাহর অন্যতম যিকর। মুমিন যখন সামান্যতম অমনোযোগিতার জন্যও আল্লাহর কাছে বিনয়ী হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তখন তাঁর হৃদয় আল্লাহর রহমত, বরকত ও প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ হয় এবং পবিত্র থেকে পবিত্রতর হয়। একে প্রকৃত পাপের স্বীকারোক্তি বলে দাবি করলে ঈসা মাসীহকে দ্বিতীয়বার আবার মহাপাপী বলতে হবে:

(ক) এক ব্যক্তি ঈসা মাসীহকে সৎ গুরু বা ভাল শিক্ষক (Good Master) বলে সম্বোধন করে। তিনি বলেন: “Why callest thou me good? there is none good but one, that is, God” অর্থাৎ: আমাকে সৎ কেন বলিতেছ? এক জন ব্যতিরেকে সৎ আর কেহ নাই, তিনি ঈশ্বর। (মার্ক ১০/১৭-১৮ ও লূক ১৮/১৮-১৯)। এ কথাকে আক্ষরিক গ্রহণ করে কি আমরা বলব যে, মাসীহ অসৎ ছিলেন?

(খ) ইয়াইয়া (আ) পাপমোচনের জন্য তাওবার বাপ্তাইজ করেন। যীশু তাঁর কাছে বাপ্তাইজ হন। (মার্ক ১/৪-৯, লূক ৩/৩) এতে কি যীশু পাপী ছিলেন প্রমাণ হয়?

(গ) ঈসা মাসীহ বেশি বেশি প্রার্থনা করতেন (মথি ৪/২, মার্ক ১/৩৫, লূক ৫/১৬, ৬/১২)। তাঁর শেখানো প্রার্থনা: “আর আমাদের অপরাধ সকল ক্ষমা কর, যেমন আমরাও আপন আপন অপরাধীদিগকে ক্ষমা করিয়াছি (forgive us our debts, as we forgive our debtors)(মথি ৬/১২-১৩)। এ থেকে কি আমরা প্রমাণ করব যে, তিনি অনেক পাপ করতেন বলে বেশি বেশি প্রার্থনা করতেন?

(ঘ) ইঞ্জিলের ভাষ্যে যীশু বলেন: “ঈশ্বর আমার, ঈশ্বর আমার, তুমি কেন আমায় পরিত্যাগ করিয়াছ? (My God, my God, why hast thou forsaken me?)” (মথি ২৭/৪৬)। এতে কি প্রমাণ হয় যে, তিনি আল্লাহ পরিত্যক্ত মহাপাপী ছিলেন?

৭০ বার ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গ: মুনাফিকদের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: “আপনি ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন অথবা ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করুন একই কথা; আপনি সত্তর বার ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ্ ওদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না। এটা এ জন্যে যে, ওরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে। আল্লাহ্ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।” (সূরা ৯-তাওবা: ৮০)

এ আয়াতে আল্লাহ সুস্পষ্ট বলেছেন যে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস আনেনি, কুফুরি করেছে, তাদের জন্য যেন রাসূলুল্লাহ ক্ষমা না চান। ঈসায়ী প্রচারকগণ সবটুকু না বলে শুধু বলেন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৭০ বার ক্ষমা চাইলেও আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। আপনি তাঁকে নিম্নের বিষয়গুলি বলুন:

(ক) এ আয়াত থেকে জানা যায়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেঈমানদের জন্য দো‘আ করবেন না। তবে ঈমানদার পাপীদের জন্য দো‘আ করবেন এবং সে দো‘আ তাঁদের মুক্তি দিবে (৪-নিসা: ৬৪; ৯-তাওবা: ৯৯, ১০৩) কিন্তু ইঞ্জিল থেকে জানা যায় যে, যীশু তাঁর ঈমানদার ও কারামতধারী পাদরি ও প্রচারকদের জন্যও শাফায়াত করতে পারবেন না। তিনি বলেন: “যারা আমাকে ‘প্রভু প্রভু’ বলে তারা প্রত্যেকে যে বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে তা নয়। কিন্তু আমার বেহেশতী পিতার ইচ্ছা যে পালন করে সে-ই ঢুকতে পারবে। সেই দিন অনেকে আমাকে বলবে, ‘প্রভু প্রভু, তোমার নামে কি আমরা নবী হিসাবে কথা বলি নি? তোমার নামে কি ভূত ছাড়াই নি? তোমার নামে কি অনেক অলৌকিক কাজ করি নি? তখন আমি সোজাসুজিই তাদের বলব ‘আমি তোমাদের চিনি না। দুষ্টের দল! আমার কাছ থেকে তোমরা দূর হও।’ (মথি ৭/১৫-২৩)

(খ) তাঁর দু শিষ্যের মা তাঁর কাছে দাবি করেন যে, তার দুই ছেলে যেন তাঁর রাজ্যে তাঁর দুপাশে বসার অধিকার পায়। তিনি উত্তরে বলেন যে, তাঁর পাশে বসানোর ক্ষমতাও তাঁর নেই; বরং সকল ক্ষমতা আল্লাহর তিনি যাকে বসাবেন সেই বসবে: “যাহাদের জন্য আমার পিতা কর্তৃক স্থান প্রস্তুত করা হইয়াছে, তাহাদের ভিন্ন আর কাহাকেও আমার দক্ষিণ পার্শ্বে ও বাম পার্শ্বে বসিতে দিতে আমার অধিকার নাই।” (মথি ২০/২০-২৩) এভাবে প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফ প্রমাণ করে যে, কারো জন্য কোনো সুপারিশ, দো‘আ বা শাফা‘আত করার অধিকার-ই ঈসা মাসীহের নেই।

(গ) আমরা বিশ্বাস করি যে, অন্যান্য নবী-রাসূলদের মত ঈসা (আ) ইস্রায়েল বংশের পাপী ঈমানদারদের জন্য সুপারিশ করবেন; সুপারিশ কবুল করা একান্তই আল্লাহর ইচ্ছা। তবে সাধু পল প্রতিষ্ঠিত ধর্মে ঈসা মাসীহের সুপারিশ ক্ষমতা খুবই সীমিত! কোনো ব্যক্তির খাৎনা বা মুসলমানি হলে মাসীহ আর তার কোনো উপকারই করতে পারবেন না! বরং তার জন্য তখন শরীয়ত পুরোপুরি মানা জরুরী হয়ে যাবে। আর শরীয়ত পালন অর্থই পাপ, অভিশাপ ও জাহান্নাম। ফলে খাতনাকৃত ব্যক্তির জন্য যীশুর প্রতি বিশ্বাস অর্থহীন! সাধু পল বলেন (if ye be circumcised, Christ shall profit you nothing) যদি তোমাদের খাৎনা করানো হয় তবে খৃস্ট তোমাদের কোনোই উপকার করবেন না।” (গালাতীয় ৫/২)

খৃস্টান প্রচারকগণ বলেন: কুরআনে কোথাও নেই যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপীদের শাফায়াত করবেন। কী ভয়ঙ্কর মিথ্যা! আল্লাহ বলেন: “যখন তারা নিজেদের প্রতি যুলুম করে তখন তারা আপনার কাছে আসলে ও আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং রাসুলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইলে তারা অবশ্যই আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালুরূপে পাবে।” (সূরা ৩-নিসা: ৬৪) কাজেই দুনিয়াতে যে কোনো পাপী যদি ক্ষমাপ্রার্থনার চেতনা-সহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফাআাত প্রার্থনা করে এবং তিনি শাফা‘আত করেন তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। আর আখেরাতে তার সুপারিশের বিষয়টি বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত [অর্থাৎ দুনিয়াতে রাসূলের জীবদ্দশায় অপরাধ করে রাসূলের কাছে আসলে তিনি তাদের জন্য সুপারিশ করতেন, এটা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। আর আখেরাতে তিনি যে সুপারিশ করবেন এ ব্যাপারটি কোনো মুসলিম অস্বীকার করতে পারে না। তবে আখেরাতে সকল সুপারিশের অধিকারী হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলা। তিনি সুপারিশ করার জন্য যার জন্য ও যাকে ইলহাম করবেন তখন কেবল তিনিই সুপারিশ করবেন। [সম্পাদক]]।

৫৭
১৮. বিশ্বনবী ও বিশ্বধর্ম
ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন: ইঞ্জিল অর্থ সুসংবাদ। ঈসা মাসীহ মানবকুলের জন্য সুসংবাদ প্রচার করেছেন। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু আরবদের ভয় প্রদর্শনকারী! তিনি মক্কা ও পার্শবর্তী এলাকার জন্য এবং যাদের পিতৃপুরুষগণকে সতর্ক করা হয় নি তাদের সতর্ক করতে প্রেরিত। (নাউযূ বিল্লাহ!) মিথ্যাচারগুলি লক্ষ্য করুন:

(১) নবীগণের দায়িত্ব সুসংবাদ দেওয়া ও ভয় প্রদর্শন। কাজেই কেউ যদি শুধু সুসংবাদ প্রচার করেন তবে তিনি নুবুওয়াতের অর্ধেক দায়িত্ব পালন করেছেন। যে স্কুলে ছাত্রদেরকে শুধুই পাস করার সুসংবাদ শোনানো হয়, ফেল করার ভয় প্রদর্শন করা না হয় সে স্কুলে কেউ সন্তান ভর্তি করবেন না। যে দেশ বা সমাজে আইনের শাসনের ভয় না দেখিয়ে সবাইকে শুধু সর্বপ্রকার শাস্তি থকে পরিত্রানের সুসংবাদ শোনানো হয় সে দেশে কোনো মানুষ বাস করতে পারেন না।

(২) ভয়প্রদর্শনও সুসংবাদ। এজন্য ইঞ্জিলেও মাসীহ ভয় প্রদর্শন করেছেন। কোনো ধনী ব্যক্তি জান্নাতে ঢুকবে না, পরনারীর দিকে তাকালে চক্ষু তুলতে হবে ইত্যাদিও বলেছেন। তবে তাঁর সুসংবাদ ও ভয় প্রদর্শন সবই ইস্রায়েলীয়দের জন্য।

(৩) আল্লাহ বলেছেন: “আমি এ কল্যাণময় কিতাব নাযিল করেছি যা তার আগের সব কিতাবের সমর্থক এবং যা দ্বারা আপনি মক্কা ও তার চারপাশের মানুষদেরকে সতর্ক করেন।” (৬-আন‘আম ৯২। ৪২-শূরা: ৭)। আল্লাহ আরো বলেন: “যেন আপনি সতর্ক করেন সেসব সম্প্রদায়কে যাদের কাছে আপনার আগে কোন সতর্ককারী আসেনি” (২৮-কাসাস: ৪৬; ৩২-সাজদা: ৩। ৩৬-ইয়াসীন: ৬)। ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বনবী ছিলেন না। অথচ শুধু এ কথাগুলিই প্রমাণ করে যে, তিনি অসাম্প্রদায়িক বিশ্বনবী ছিলেন।

(৪) আমরা দেখেছি যে, মাসীহ বলেছেন: তিনি ইসরায়েল বংশের সন্তানগণ ছাড়া কারো জন্যই প্রেরিত হন নি, অন্যান্য বংশের ও জাতির মানুষেরা শূকর ও কুকুর; কাজেই তাদেরকে তাঁর দীন প্রদান করা যাবে না; দো‘আও করা যাবে না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম এ সাম্প্রদায়িকতার ইতি টানলেন। সম্প্রদায় বা বংশের কারণে কাউকে শূকর-কুকুর বলা তো দূরের কথা আল্লাহ একথাও বলেন নি যে, তুমি ‘ঈসমাঈল বংশ’ বা ‘আরব’ ছাড়া কাউকে দীক্ষা দিবে না। বরং বললেন, কোনোরূপ গোত্র, বংশ বা সম্প্রদায় বিবেচনা না করে যারাই “সতর্ককারী” বা সত্য নবীর সঠিক দীন থেকে বঞ্চিত সকলকেই জান্নাতের পথ দেখাবে। মক্কা ও তৎপার্শবর্তী অঞ্চলের সকল ধর্মের, বর্ণের, বংশের ও গোত্রের মানুষকে জান্নাতের পথের দাওয়াত দিবে।’

(৫) মক্কা ও তৎপার্শবর্তী এলাকা থেকে বিশ্বধর্ম শুরু করার কারণ বিশ্বের একমাত্র এ অঞ্চলেই সকল ধর্ম, রক্ত ও বর্ণের মানুষ বাস করতেন। তৎকালীন সময়ে চীন, ভারত, আফ্রিকা, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে মূলত একই বংশ বা বর্ণের মানুষ বাস করত। কোনো সর্বজনীন দাওয়াতও এ সকল দেশে শুরু করলে তা সাম্প্রদায়িক বা আঞ্চলিক হওয়ার ভয় ছিল। পাঠক মানচিত্রে দৃষ্টি দিলে দেখবেন যে, মক্কা পৃথিবীর কেন্দ্র। একমাত্র এখান থেকেই পৃথিবীর স্থলভাগের সকল অংশ প্রায় সমান। উপরন্তু সে সময়েই মক্কা ও তৎপার্শ্ববর্তী সিরিয়া, ইয়ামান, পারস্য, রোম, মিসর ইত্যাদি দেশে সকল বংশের, বর্ণের ও ধর্মের মানুষ বসবাস করত। এজন্য ইসলামকে সত্যিকার বিশ্বজনীন করার জন্য আল্লাহ এ বিশ্বজনীন দাওয়াতকে মক্কা থেকে শুরু করেন।

(৬) এ বিশ্বজনীনতা বারংবার নিশ্চিত করা হয়েছে কুরআনে। আল্লাহ বলেন: “আমি তো আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী ও ভয়প্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি” (৩৪-সাবা: ২৮); “বল: হে মানবজাতি, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল” (৭-আ’রাফ: ১৫৮); “তিনিই মহিমাময় যিনি তাঁর বান্দার উপরে ফুরকান নাযিল করেছেন, যেন তিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী হন” (২৫- ফুরকান: ১); “নিশ্চয় আমি আপনাকে সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত-স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (২১-আম্বিয়া: ১০৭)। কিতাবুল মোকাদ্দসে মানবজাতিকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল: (১) ইসরায়েল বংশ এবং (২) অন্যান্য বংশ বা ‘পরজাতি’ ও উম্মী। বিভক্তির দেওয়াল যে ভাঙ্গা হলো তা বুঝাতে মাঝে মাঝে দু অংশের জন্যই যে ইসলামী বিধান এক আল্লাহ তা স্পষ্ট করেছেন। একস্থানে আল্লাহ বলেন: “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও ‘উম্মী’গণকে বলুন, ‘তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ?’...” (৩-আল-ইমরান ২০)।

(৭) সর্বোপরি একমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যেই সকল মানুষের জীবন্ত আদর্শ বিদ্যমান এবং তাঁর আদর্শ সংরক্ষিত। ব্যক্তিগত, দাম্পত্য, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বাণিজ্যিক সকল প্রকারের সমস্যায় ও অবস্থায় বিশ্বের যে কোনো মানুষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে প্রায়োগিক আদর্শ দেখতে পান। কিন্তু ঈসা মাসীহের আদর্শ সংরক্ষিত হয় নি। তাঁর সাধারণ কিছু শিক্ষা বিদ্যমান; কিন্তু প্রায়োগিক কোনো আদর্শ সংরক্ষিত নয়। খৃস্টান প্রচারকগণ তাকে ত্যাগের আদর্শ বলে প্রচার করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, তিনি মানবতার মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফে তার জীবনদানের যে বিবরণ লেখা হয়েছে তাকে কোনোভাবেই ‘আদর্শ আত্মত্যাগ’ বলে বিবেচনা করা যায় না। জীবন দানের ভয়ে হাউমাউ করে মাথা ঠুকে ক্রন্দন, মৃত্যুর পূর্বে সমবেত মানুষদেরকে মুক্তির পথ এবং অলৌকিক চিহ্ন না দেখিয়ে নীরব থাকা, ক্রুশের উপর চিৎকার করে আল্লাহকে দোষারোপ করা ইত্যাদি কর্ম যদি কোনো মানুষ করেন তবে আমরা তাকে আদর্শ আত্মত্যাগী বলতে পারি না।

অনুরূপভাবে অবিবাহিত জীবন যাপন করা, বিবাহকে নিরুৎসাহিত করা, পিতামাতা-স্ত্রীপুত্র পরিত্যাগ করতে উৎসাহ দেওয়া, কথাবার্তায় গালিগালাজ করা, অভিশাপ দেওয়া, নিজের মা-কে ‘ওহে মহিলা’ বলা, মাকে ‘কে আমার মা?’ বলা, তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করা, বেশ্যা মহিলাদেরকে চুমু খাওয়ার সুযোগ দেওয়া ইত্যাদিকে কোনোভাবেই আদর্শ বলে বিবেচনা করা যায় না। অন্য কোনো মানুষ যদি এরূপ করেন তবে কেউ তাকে আদর্শস্থানীয় বলে বিবেচনা করবেন না।

(৮) আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি, ঈসা (আ) এসকল কর্ম করেন নি। তবে প্রচলিত ইঞ্জিলে এরকমই রয়েছে। এজন্য আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর আদর্শ সংরক্ষিত হয় নি। তিনি বিশ্বনবী ছিলেন না, শুধু ইস্রায়েল বংশের মানুষদেরকে সত্যের দিশা দিতে আগমন করেছিলেন। তাঁর অনুসারীরা তাঁর আদর্শ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। বিশ্বের সকল মানুষই ‘সতর্ককারী’র বা সত্যনবীর সত্য আদর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। এজন্য আল্লাহ সকলের জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করেন।

৫৮
১৯. ঈসা মাসীহের পুনরাগমন
মুসলিমগণ বিশ্বাস করেন যে, কিয়ামতের পূর্বে ঈসা মাসীহ পুনরায় আগমন করবেন। ঈসায়ী প্রচারকগণ এ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের ধর্মান্তর করার জন্য বলেন: তিনি যেহেতু আসবেন, কাজেই তার প্রতি বিশ্বাস এনে প্রস্তুত হওয়াই ভাল!

সুপ্রিয় পাঠক, আপনি খৃস্টান প্রচারককে বলুন, তিনি তো আসবেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মাত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতে এবং তাঁর বিরুদ্ধে তোমাদের মিথ্যাচারগুলি বাতিল করতে। কাজেই তোমাদের উচিৎ তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার থেকে তাওবা করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মাত হওয়া। তিনি হয়ত বলবেন: এ কথা কোথায় আছে? আপনি বলুন, যেখানে তার পুনরাগমনের কথা আছে সেখানেই একথা আছে।

আপনি ঈসায়ী প্রচারককে জিজ্ঞাসা করুন: আপনি কোন্ পুনরাগমনে বিশ্বাস করেন? হাদীসে উল্লেখিত না ইঞ্জিলে উল্লেখিত পুনরাগমনে? যদি হাদীসে বর্ণিত পুনরাগমনে বিশ্বাস করেন তবে উপরের বিষয়গুলি বিশ্বাস করতে হবে। আর যদি ইঞ্জিলে উল্লেখিত পুনরাগমনে বিশ্বাস করেন তবে আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে, আপনার বিশ্বাস মিথ্যা। কারণ ইঞ্জিলে বারংবার বলা হয়েছে যে, যীশুর যুগের মানুষদের এবং তার কোনো কোনো শিষ্যের মৃত্যুর আগেই তিনি পুনরাগমন করবেন। (মথি ১০/২৩, ১৬/২৭-২৮; ১ থিষলনীকীয় ৪/১৫-১৭: ১ করিন্থীয় ১৫/৫১-৫২: প্রকাশিত বাক্য ২২/১০-১১)। আর এ ভবিষ্যদ্বাণী নিশ্চিতরূপে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

আল্লাহ বলেন: “তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি; কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল। .... এটা নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি, বরং আল্লাহ্ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং কিয়ামতের দিন তিনি তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন।” (৩-নিসা: ১৫৯)। তাহলে প্রত্যেক কেতাবী: ইয়াহূদী-খৃস্টানই তার মৃত্যুর পূর্বে ঈসা মাসীহের ক্রশবিদ্ধ হয়ে অভিশপ্ত হওয়ার ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিভ্রান্তি জানতে পারবে। আর এজন্যই ঈসা মাসীহ আবার আসবেন।

৫৯
২০. একটি আবেদন
ঈসায়ী প্রচারকগণের মিথ্যাচার অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু ধর্ম প্রচারে তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করতে হবে। আমরা কি কুরআন-হাদীসের নির্দেশ মত দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করছি? আল্লাহর দীন সহজ, কিন্তু না জেনে আমরা তাকে কঠিন করে ফেলেছি। ফলে সাধারণ মানুষ ইসলাম থেকে বিমুখ হচ্ছেন, তাঁদের ঈমান দুর্বল হচ্ছে এবং সহজেই তাঁরা মুরতাদ হয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেক দীনদার পাঠকের প্রতি আবেদন, আড্ডায় ও চায়ের দোকানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জাবর না কেটে প্রতিদিন বা অন্তত প্রতি সপ্তাহে হাটে, বাজারে, চায়ের দোকানে, খেলার মাঠে ধর্মবিমুখ মুসলিমদের সাথে ২০/২৫ মিনিট বসে দীনের কথা বলুন। যতটুকু জানেন ততটুকুই বলুন। তাহলে আল্লাহ আপনার মধ্যে ঈমান, মহব্বত ও জ্ঞান বাড়িয়ে দিবেন। আল্লাহর দীন যে সকল মানুষের জন্যই সহজ তা প্রচার করুন।

কুরআন-হাদীস থেকে আমরা জানি, মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজ কর্ম আল্লাহর প্রিয় হওয়া। কারণ:

(১) সকল কাজে সফলতার জন্য যোগ্যতার প্রয়োজন। আল্লাহর ওলী হতে কোনো যোগ্যতা লাগে না। তিনি যাকে যতটুকু দিয়েছেন সেটুকুর ভিতরে তাঁকে ডাকলেই তিনি সন্তুষ্ট হন। কারী সাহেবের সুন্দর তিলাওয়াতে তিনি যেমন খুশি, একজন মুর্খ বা বোবা মানুষের অস্পষ্ট দো‘আ-তিলাওয়াতেও তিনি তেমনি খুশি হন।

(২) মানুষকে খুশি করা কঠিন, মহান আল্লাহকে খুশি করা খুবই সহজ; বান্দা তাঁর দিকে হেঁটে এগোলে তিনি তার দিকে দৌড়ে আসেন।

(৩) দুনিয়ার মানুষকে খুশি রাখা কঠিন, কিন্তু মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখা খুবই সহজ। তিনি শত পাপ ও অবাধ্যতার পরেও বান্দার তাওবার জন্য অপেক্ষা করেন। হারানো উটের মালিক উট ফিরে পেয়ে যত খুশি হন মহান আল্লাহ পাপী বান্দার তাওবায় তার চেয়েও বেশি খুশি হন।

(৪) মানুষ মনের কথা জানে না, তাই প্রিয়তম মানুষও সন্দেহ করেন। কিন্তু মহান আল্লাহ মনের কথা জানেন, কাজেই বান্দা সাধ্যমত যতটুকু আমল করে তাতেই আল্লাহ খুশি হন।

আল্লাহর ওলী হতে শুধু ঈমান ও তাকওয়া জরুরী (সূরা ১০- ইউনুস: ৬২ আয়াত)। অর্থাৎ একমাত্র মহান আল্লাহর ইবাদত করব এবং একমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরীকাতেই তা করব। আমাদের উচিত এবিশ্বাসকে অন্তরের গভীরে অবিচলভাবে গেঁথে নিয়ে সাধ্যমত আল্লাহর হুকুম মানার চেষ্টা করা এবং ভুল-ভ্রান্তি ও পাপের জন্য সর্বদা একান্ত গোপনে আল্লাহর কাছে নিজের ভাষায় আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া।

নামায আল্লাহর প্রিয়তম এবং মানুষের জন্য সহজতম ইবাদত। সাধ্যের মধ্যে ওযু বা তায়াম্মুম করে, দাঁড়িয়ে বা বসে, সূরা-দো‘আ না জানলে দাঁড়িয়ে, বসে ও রুকু-সাজদায় কয়েকবার ‘আল্লাহু আকবার’ বললেও মুমিনের সালাত আদায় হবে এবং সালাতের মধ্যে ও পরে দো‘আ করলে আল্লাহ তা কবুল করবেন।

সালাত আদায় ও সাধ্যমত আল্লাহর হুকুম পালনের পাশাপাশি সর্বদা পিতামাতার খেদমত, মানুষকে সাহায্য করা এবং সর্বদা আল্লাহর তাসবীহ-তাহলীল ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য দরুদ-সালাম পাঠ করে মানুষ সহজেই আল্লাহর ওলী হওয়ার মর্যাদা লাভ করতে পারেন।

দাওয়াতের পাশাপাশি সকলকে বলুন, আজকাল কিছু মানুষ আমাদের নবীর বিরুদ্ধে কথা বলছে। তিনি শাফা‘আত করবেন না, তিনি গোনাহগারের নাজাতের জন্য নন ... ইত্যাদি কথা তারা বলছে। আপনারা কেউ তাদের এ কথা শুনে কেউ নীরব থাকলে ভয়ঙ্কর পাপী হবেন এবং ঈমান নষ্ট হতে পারে। এজন্য তাকে আদব ও ভদ্রতার সাথে দীনের দাওয়াত দিবেন এবং আলেমদের কাছে নিয়ে যাবেন।

কোনো মুসলিম ভাই বা বোন যদি মুরতাদ বা “ঈসায়ী” হয়ে যায় তাহলে তাকে ভালবেসে হাত-পা ধরে ইসলামের দাওয়াত দিন। তাকে বলুন, তুমি কেন ইসলাম ত্যাগ করছ তা আমাদেরকে বল। তুমি কেন রাহমাতুল্লিল আলামীনকে ছেড়ে অপরিচিত প্রতারকদের কাছে যাচ্ছ? তুমি আমাদের ভাই। আমরা আলিমদের সংবাদ দিচ্ছি, আমাদেরকে বুঝিয়ে পরাজিত করে ধর্মত্যাগ কর। সবাই মিলে অবিরত তাকে দাওয়াত দিতে থাকুন। যতক্ষণ না কোনো ধর্মত্যাগী মুরতাদ তাওবা করে ফিরে আসেন ততক্ষণ তার সাথে সকল প্রকার সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন রাখুন। তাদের সাথে কোনো রকম সম্পর্ক রাখলে তাদের পাপে পাপী হতে হবে।

ঈসায়ী প্রচারকদের চ্যালেঞ্জ করুন। আমরা কোনা মারামারি-হানাহানি চাই না। আমরা তাদের সাথে আন্তরিক পরিবেশে সকল প্রকার বিতর্ক বা আলোচনা করতে প্রস্তুত। তাঁদেরকে মিথ্যাচার পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত প্রদান করুন।

মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল খৃস্টান প্রচারকদের জন্য ধর্মান্তকরণকে অত্যন্ত সহজ করেছে। মুসলিমগণ ছোটখাট মতভেদ নিয়ে এমন ভয়ঙ্কর দলাদলি ও শত্রুতায় লিপ্ত যে, চোখের সামনে মুসলিম ভাইবোনগণ মুরতাদ হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অনেক সময় অবস্থা এরূপ যে, মুসলিম খৃস্টান হয় হোক, তবে আমার মত বা আমার দলের কোনো ক্ষতি না হলেই হলো! মুসলিম খৃস্টান হলে কষ্ট লাগে না, কিন্তু অন্য কোনো মুসলিম দল বা মতের অনুসরণ করলে কষ্ট লাগে!! নিজের দলের কেউ অন্য দলে চলে গেলে কষ্ট লাগে। কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মাত মুরতাদ হয়ে অন্য ধর্মে চলে গেলে এবং তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলে কষ্ট লাগছে না! এটি কি ঈমানের দুর্বলতার লক্ষণ নয়? কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ ও তাঁর মহান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কিভাবে মুখ দেখাব? কি জবাব দেব? একটু কি ভাবতে হবে না? মতভেদ ও দলাদলি তো থাকবেই। তবে ঈমান রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সকলকেই সচেতন ও একত্রিত হতে হবে।

কোনো মুসলিম ঈসায়ী হয়েছেন, অথবা ইঞ্জিল শরীফ বিতরণ করছেন, বলে কোনোভাবে জানতে পারলে তাকে দাওয়াত দিন। অন্তত সমাজের আলিম ও ইমামগণকে তা জানান। মহান আল্লাহ ইসলামের এ মহববতের জন্য আপনাকে পুরস্কার দিবেন।

মহান আল্লাহর মহান রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবী ও অনুসারীদের উপর সালাত ও সালাম। প্রথমে ও শেষে সর্বদা ও সর্বত্র সকল প্রশংসা আল্লাহরই নিমিত্ত।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন