HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

জিহাদ ও ক্বিতাল

লেখকঃ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
জিহাদ ও ক্বিতাল

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

প্রকাশক : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,

হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ৪৫

ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,

মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০

১ম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০১৩ খ্রিঃ

২য় সংস্করণ : সেপ্টেম্বর ২০১৩ খ্রিঃ

নির্ধারিত মূল্য : ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) টাকা মাত্র।

ভূমিকা
ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম। যার সকল বিধান মানুষের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে নির্ধারিত। পক্ষান্তরে শয়তানী বিধান সর্বত্র অন্যায় ও অশান্তির বিস্তৃতি ঘটিয়ে থাকে। যা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে হটিয়ে জাহান্নামের পথে নিতে চায়। সেকারণ আল্লাহ মুসলমানকে ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’-এর দায়িত্ব প্রদান করেছেন এবং তাকে শয়তানের বিরুদ্ধে সর্বদা জিহাদে লিপ্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। জিহাদ ও সন্ত্রাস দু’টি বিপরীতধর্মী বিষয়। জিহাদ হয় মানব কল্যাণের জন্য এবং সন্ত্রাস হয় শয়তানী অপকর্মের জন্য। জিহাদ হ’ল ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এই ইবাদতকেই শয়তান সবচেয়ে বেশী ভয় পায়। সেকারণ নানা কৌশলে শয়তান মুসলমানের জিহাদী জাযবাকে ধ্বংস করতে চায়। বর্তমান যুগে ইসলামী জিহাদকে ‘জঙ্গীবাদ’ হিসাবে চিহ্নিত করাটাও শয়তানী তৎপরতার একটি অংশ মাত্র। একটি পরাশক্তি তার প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক পরাশক্তিকে আফগানিস্তান থেকে হটানোর জন্য অঢেল অর্থ ব্যয় করে ও আধুনিক অস্ত্রের যোগান দিয়ে গত শতাব্দীর শেষদিকে জিহাদের নামে ‘তালেবান’ সৃষ্টি করে। পরে উদ্দেশ্য হাছিল হয়ে গেলে তাদেরকে সন্ত্রাসী জঙ্গীদল বলে আখ্যায়িত করে। একই পলিসি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হচ্ছে। তাদের টার্গেটকৃত মুসলিম রাষ্ট্রটিকে জঙ্গীরাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে তাদের স্বার্থ হাছিলের কপট উদ্দেশ্যে পরাশক্তিগুলি এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে বলে সরকারের অভিজ্ঞ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের প্রকাশিত মন্তব্যে জানা যায়।

বর্তমানে স্টিং অপারেশনের নামে তারা নিজেদের দেশে মুসলিম তরুণদের পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে বন্ধু বেশে তাদেরকে সেদেশের বিভিন্ন স্থাপনায় ভুয়া বোমাবাজিতে লিপ্ত করছে। অতঃপর তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করছে। বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, মুসলিম মানেই জঙ্গী।

এছাড়া তাদের চক্রান্তের অসহায় শিকার হচ্ছে বিভিন্ন মুসলিম দেশের স্বল্পবুদ্ধি তরুণ সমাজ। অনেক সময় বিদেশীরা তাদের এদেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে এদেরকে ধর্মের নামে জিহাদ ও ক্বিতালে উসকে দেয়। অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে লালন করে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলে। অতঃপর তাদেরই অদৃশ্য ইঙ্গিতে এরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এবং মিডিয়ার সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়। আসল হোতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরপর দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে বিদেশী আধিপত্যবাদীরা তাদের অন্যায় স্বার্থ হাছিল করে। অন্যদিকে তারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে মুসলিম ঐক্য ভেঙ্গে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে ও একে অপরের শত্রু বানিয়ে দিচ্ছে।

গণতন্ত্রী ও জঙ্গী উভয় দলের লক্ষ্য ক্ষমতা দখল করা। অথচ ঐ লক্ষ্যটাই ইসলামে নিষিদ্ধ। দুনিয়াবী লক্ষ্যে কোন কাজই আল্লাহর নিকটে গ্রহণীয় নয়। ক্ষমতা ও নেতৃত্ব আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মত। তা চেয়ে নেবার বা আদায় করে নেবার বিষয় নয়। এর মধ্যে প্রতারণা বা যবরদস্তির কোন অবকাশ নেই। অথচ উক্ত কারণেই সর্বত্র নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে হানাহানি চলছে। এবিষয়ে ইসলামের নিজস্ব নীতি-আদর্শ ও রীতি-পদ্ধতি রয়েছে। সেটি যথার্থভাবে অনুসরণ করলে নেতৃত্বের কোন্দল ও ক্ষমতার লড়াই থেকে জাতি রক্ষা পাবে ইনশাআল্লাহ।

ইসলামে শৈথিল্যবাদ ও চরমপন্থা কোনটারই অবকাশ নেই। আল্লাহ বলেন, আমরা তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত করেছি। যাতে তোমরা মানবজাতির উপরে (ক্বিয়ামতের দিন) সাক্ষী হ’তে পার এবং রাসূলও তোমাদের উপর সাক্ষী হন’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)। সাক্ষ্যদাতা উম্মত সর্বদা মধ্যপন্থী হয়ে থাকে। আর এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে মুসলিম উম্মাহর ‘শ্রেষ্ঠ জাতি’ হওয়ার চাবিকাঠি (আলে ইমরান ৩/১১০)। কিন্তু কিছু মানুষ ক্ষমতা দখলকেই ‘বড় ইবাদত’ এবং ‘সব ফরযের বড় ফরয’ বলে থাকেন। যেভাবেই হৌক ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য। সেকারণ চরমপন্থাকে তারা অধিক পসন্দ করেন। এদের কারণে ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে জঙ্গীবাদী ধর্ম হিসাবে অপপ্রচারের সুযোগ পেয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা উক্ত ধারণা অপনোদনের চেষ্টা করব। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!

বিনীত

লেখক।

প্রকাশকের নিবেদন
পবিত্র কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত ‘জিহাদ’ ও ‘ক্বিতাল’ শব্দ দু’টিকে বর্তমানে ইসলামের নামে জঙ্গীবাদী তৎপরতার পক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ ‘জিহাদ’ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকে। জিহাদ সর্বদা শান্তি ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। কিন্তু কিছু মানুষ জিহাদের সঠিক তাৎপর্য বুঝতে না পেরে ইসলামের নামে হরতাল, সহিংসতা ও বোমাবাজি করছে। ফলে ইসলামের শান্তিময় রূপ বিনষ্ট হচ্ছে, যা বিরোধী প্রচারণায় বারি সিঞ্চন করছে। আলোচ্য প্রবন্ধে জিহাদের সঠিক তাৎপর্য উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ভুল ধারণা অপনোদনের চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রবন্ধটি প্রথম মাসিক আত-তাহরীক (রাজশাহী) ৫ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ডিসেম্বর ২০০১ ‘দরসে কুরআন’ কলামে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারী’১৩-তে তা বই আকারে বের হয়। ২য় সংস্করণে কিছু নতুন তথ্যাবলী সংযোজিত হয়েছে। ফলে বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে।

অত্র বইটির সাথে মাননীয় লেখকের ‘ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি’ এবং ‘ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন’ বই দু’টি পাঠ করার অনুরোধ রইল।

সচিব

হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

১ম ভাগ জিহাদ ও ক্বিতাল
‘জিহাদ’ অর্থ, আল্লাহর পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো’ এবং ‘ক্বিতাল’ অর্থ আল্লাহর পথে কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা’। জিহাদ হ’ল ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া। পঞ্চস্তম্ভের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু চূড়া বা ছাদ না থাকলে তাকে পূর্ণাঙ্গ গৃহ বলা যায় না। চূড়াহীন গৃহের যে তুলনা, জিহাদবিহীন ইসলামের সেই তুলনা। জিহাদেই জীবন, জিহাদেই সম্মান ও মর্যাদা। জিহাদবিহীন মুমিন মর্যাদাহীন ব্যক্তির ন্যায়। জিহাদের মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়। আল্লাহর জন্য মুসলমানের প্রতিটি কর্ম যেমন ইবাদত, আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠায় মুসলমানের প্রতিটি সংগ্রামই তেমনি জিহাদ। দ্বীনের বিজয় জিহাদের উপরেই নির্ভরশীল। জিহাদ হ’ল মুমিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্যের অন্যতম মানদন্ড। আল্লাহ বলেন, যারা ঈমানদার তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে। আর যারা কাফির, তারা যুদ্ধ করে ত্বাগূতের পথে। অতএব তোমরা শয়তানের বন্ধুদের সাথে যুদ্ধ কর। নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল সদা দুর্বল’ (নিসা ৪/৭৬)।

বস্ত্ততঃ মুমিন তার জীবনপথের প্রতিটি পদক্ষেপ ও চিন্তা-চেতনায় শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। শয়তানী সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে মুমিনের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। তাই সর্বদা তাকে জিহাদী চেতনা নিয়েই পথ চলতে হয়। কোন অবস্থাতেই সে বাতিলের ফাঁদে পা দেয় না বা তার সঙ্গে আপোষ করতে পারে না। কেননা শয়তান মুমিনের প্রকাশ্য দুশমন। বাতিলের সমাজে বসবাস করেও নবীগণ কখনো বাতিলের সঙ্গে আপোষ করেননি। তাদেরকে নিরন্তর যুদ্ধ করতে হয়েছে মূলতঃ সমাজের লালিত আক্বীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, যা কখনো কখনো সশস্ত্র মুকাবিলায় রূপ নিয়েছে। একই নীতি-কৌশল সকল যুগে প্রযোজ্য।

চেতনাহীন মানুষ প্রাণহীন লাশের ন্যায়। ইসলামের শত্রুরা তাই মুসলমানের জিহাদী চেতনাকে বিনাশ করার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। এযুগেও তা অব্যাহত রয়েছে। তারা ইসলামকে চূড়াহীন একটা পাঁচখুঁটির চালাঘর বানানোর জন্য তাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ময়দান থেকে হটানোর উদ্দেশ্যে যুগে যুগে নানা থিওরী প্রবর্তন করেছে। এভাবে সুকৌশলে তারা সর্বত্র একদল বশংবদ ‘নেতা’ বানিয়েছে এবং চূড়ার কর্তৃত্ব সর্বদা নিজেদের হাতে রেখে দিয়েছে। ফলে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর প্রেরিত মঙ্গলময় জীবন বিধান প্রায় সকল ক্ষেত্রে পদদলিত হচেছ। আর মানবতা ইসলামের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এজন্যই আল্লাহ মুমিনের উপর জিহাদকে ফরয করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

وَجَاهِدُوْا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ ‘আর তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে যথার্থভাবে; তিনি তোমাদের মনোনীত করেছেন’ (হজ্জ ২২/৭৮)। অন্যত্র তিনি বলেন,

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ -

‘তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে। অথচ তা তোমাদের জন্য কষ্টকর। বহু বিষয় এমন রয়েছে, যা তোমরা অপসন্দ কর। অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার বহু বিষয় এমন রয়েছে, যা তোমরা পসন্দ কর। অথচ তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। বস্ত্ততঃ আল্লাহ (পরিণাম সম্পর্কে) অধিক জানেন, কিন্তু তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)। অত্র আয়াতের মাধ্যমে যুদ্ধকারী মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয় (কুরতুবী)। যা ২য় হিজরীতে নাযিল হয়।[1]

শাব্দিক ব্যাখ্যা :

(১) كُتِبَ (কুতিবা) অর্থ ‘লিখিত হয়েছে’। কুরআনী পরিভাষায় এর অর্থ : فُرِضَ وَأُثْبِتَ ‘ফরয করা হয়েছে’ বা ‘নির্ধারিত হয়েছে’। যেমন كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ ‘তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)। كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى ‘তোমাদের উপরে হত্যার বদলে হত্যাকে ফরয করা হয়েছে’ (বাক্বারাহ ২/১৭৮)।

(২) الْقِتَالُ (ক্বিতাল) অর্থ, (ক) ‘পরস্পরে যুদ্ধ করা’। বাবে মুফা‘আলাহর অন্যতম মাছদার। (খ) ‘প্রতিরোধ করা’। যেমন মুছল্লীর সম্মুখ দিয়ে গমনকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ হাদীছে বলা হয়েছে فَلْيُقَاتِلْهُ فَإِنَّهُ شَيْطَانٌ ‘তার উচিৎ ওকে সজোরে রুখে দেয়া। কেননা ওটা শয়তান’।[2] (গ) ‘লা‘নত করা’। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে, قَاتَلَهُمُ اللهُ أَنَّى يُؤْفَكُوْنَ ‘আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন, ওরা কোন্ পথে চলেছে? (তওবাহ ৯/৩০)। (ঘ) ‘বিস্মিত হওয়া ও প্রশংসা করা’। যেমন বলা হয়ে থাকে قَاتَلَهُ اللهُ مَا أَفْصَحَهُ ‘আল্লাহ ওকে ধ্বংস করুন, কতই না শুদ্ধভাষী সে’।

(৩) كُرْهٌ (কুরহুন) অর্থ, ‘কষ্ট’। ইবনু ‘আরাফাহ বলেন, الْكُرْهُ الْمَشَقَّةُ والْكَرْهُ بالفتح مَا أُكْرِهْتَ عَلَيْهِ ‘আল-কুরহু’ অর্থ, কষ্ট এবং ‘আল-কারহু’ অর্থ, যা তোমার উপর চাপানো হয়’। ইমাম কুরতুবী (৬১০-৬৭১ হিঃ/১২১৪-১২৭৩) বলেন, هذا هو الاختيار এটাই পসন্দনীয়। তবে দু’টি শব্দ একই অর্থে আসাটাও সিদ্ধ’ (কুরতুবী)। জমহূর বিদ্বানগণ এর অর্থ করেছেন, الكُرهُ الطَّبِيْعِىُّ وَالْمَشَقَّةُ ‘স্বভাবগত অপসন্দ ও কষ্ট’। এটি সন্তুষ্টি ও সমর্থনের বিরোধী নয় বা কষ্ট সহ্য করার আগ্রহের বিপরীত নয়। কেননা জিহাদের বিষয়টি আল্লাহর নির্দেশাবলীর অন্তর্ভুক্ত এবং এর মধ্যেই রয়েছে দ্বীনের হেফাযতের গ্যারান্টি’।[3] যা কোন মুমিন কখনো অপসন্দ করতে পারেনা।

ইকরিমা বলেন, ‘(কষ্টকর বিষয় হওয়ার কারণে) মুসলমানরা এটাকে অপসন্দ করে। কিন্তু পরে পসন্দ করে এবং বলে যে, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। কেননা আল্লাহর হুকুম মানতে গেলে কষ্ট করতেই হবে। কিন্তু যখন এর অধিক ছওয়াবের কথা জানা যায়, তখন তার পাশে যাবতীয় কষ্টকে হীন মনে হয়’ (কুরতুবী)।

সৈয়দ রশীদ রিযা (১৮৬৫-১৯৩৫ খৃঃ) বলেন, কেউ কেউ জিহাদকে কঠিন বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অথচ মুমিনগণ এটাকে কিভাবে অপসন্দ করতে পারে? যে বিষয়টি আল্লাহ তাদের উপরে ফরয করেছেন এবং এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের সৌভাগ্য। তবে হ্যাঁ, এটি স্বভাবগত অপসন্দের বিষয়াবলীর মধ্যে গণ্য হ’তে পারে, যার মধ্যে তার জন্য উপকার ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যেমন তিক্ত ঔষধ সেবন, ইনজেকশন গ্রহণ ইত্যাদি। তাছাড়া ছাহাবীগণ যুদ্ধ-বিগ্রহকে স্বভাবগতভাবেও অপসন্দ করতেন না। কেননা তাঁরা এতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এ বিষয়টি খেয়াল করেছিলেন যে, মদীনায় তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন মুহাজির এবং সংখ্যায় অল্প। মুশরিকদের মুকাবিলায় দুনিয়াবী শক্তির ভারসাম্যহীনতার কারণে তাঁরা যে মুছীবত প্রাপ্ত হয়েছেন এবং যে হক-এর প্রতি তাঁরা মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছেন ও যার সামাজিক প্রতিষ্ঠা তাঁরা কামনা করছেন, সেটুকু অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। এতদ্ব্যতীত তাঁদের নিকটে আরেকটি চিন্তার বিষয় ছিল সেটি হ’ল, তাঁরা ছিলেন শান্তি ও মানবকল্যাণের আকাংখী। সশস্ত্র যুদ্ধ হ’লে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে এবং এতে লোকদের সামগ্রিকভাবে ইসলামে প্রবেশে বাধার সৃষ্টি হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমিই মাত্র জানি, তোমরা জানো না’। অর্থাৎ শান্তির অবস্থায় সকল মানুষ ইসলামে প্রবেশ করবে- এরূপ ধারণা বাতিল। কেননা লোকদের মধ্যে বহু দুষ্ট চরিত্রের লোক রয়েছে। তাদেরকে সমাজদেহ থেকে উৎখাত করা সুস্থ দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করার শামিল। অতএব এই যুদ্ধ বা জিহাদ তোমাদের জন্য নিঃসন্দেহে কল্যাণকর’।[4]

আয়াতের ব্যাখ্যা :

ইতিপূর্বে মক্কায় জিহাদের অনুমতি ছিল না। পরে সেখান থেকে হিজরতকালে জিহাদের অনুমতির আয়াত নাযিল হয় সূরা হজ্জ ৩৯ আয়াতের মাধ্যমে।[5] অতঃপর ২য় হিজরী সনে মদীনায় অবতীর্ণ সূরা বাক্বারাহ ২১৬ আয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদের উপরে প্রথম ‘জিহাদ’ ফরয করা হয়।[6] অত্র আয়াতে ‘ক্বিতাল’ শব্দ বলা হ’লেও সূরা তাওবাহ ৪১ আয়াতে ‘জিহাদ’ শব্দ উল্লেখিত হয়েছে।[7] যার মাধ্যমে সাময়িকভাবে শুধু ক্বিতাল বা ‘যুদ্ধ’ নয়, বরং মুশরিক ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে জান-মাল দিয়ে সর্বদা ‘জিহাদ’ বা সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানানো হয়েছে।

‘জিহাদ’ শব্দটি ব্যাপক প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং ‘ক্বিতাল’ শব্দটি বিশেষভাবে ‘সশস্ত্র যুদ্ধ’ হিসাবে গণ্য হয়। ‘জিহাদ’ শান্তি ও যুদ্ধ সকল অবস্থায় প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে ‘ক্বিতাল’ কেবল যুদ্ধাবস্থায় প্রযোজ্য। ‘জিহাদ’ বললে দু’টিই বুঝায়। ‘ক্বিতাল’ বললে স্রেফ ‘যুদ্ধ’ বুঝায়। যদিও দু’টি শব্দ অনেক সময় সমার্থক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে ইসলামী পরিভাষায় ‘জিহাদ’ শব্দটিই অধিক প্রচলিত ও অধিক গ্রহণীয়।

‘জিহাদ’ جُهْدٌ ‘জুহদুন’ ধাতু হ’তে উৎপন্ন। যার অর্থ, কষ্ট ও চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। جَاهَدَ يُجَاهِدُ مُجَاهَدَةً وَجِهَادًا إِذَا اسْتَفْرَغَ وُسْعَهُ وَبَذَلَ طَاقَتَهُ وَتَحَمَّلَ الْمَشَاقَّ فِىْ مُقَاتَلَةِ الْعَدُوِّ وَمُدَافَعَتِهِ - অর্থাৎ যখন কেউ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে ও তাকে প্রতিরোধের জন্য তার সকল ক্ষমতা ও শক্তি ব্যয় করে এবং কষ্টসমূহ সহ্য করে, তাকে আভিধানিক অর্থে ‘জিহাদ’ বলে’।[8] ইসলামী পরিভাষায় ‘জিহাদ’ অর্থ : আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য বাতিলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো’। ‘জিহাদ’ শব্দটি পারিভাষিক অর্থেই অধিক প্রচলিত। মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন, ‘জিহাদ’ অর্থ ‘কাফেরদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো অথবা মাল দ্বারা, পরামর্শ দ্বারা, দলবৃদ্ধি দ্বারা কিংবা অন্য যেকোন পন্থায় কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতা করা’। তিনি বলেন, জিহাদ হ’ল ‘ফরযে কিফায়াহ’। কেউ সেটা করলে অন্যের উপর থেকে দায়িত্ব নেমে যায়’।[9]

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, الْجِهَادُ شَرْعًا بَذْلُ الْجُهْدِ فِي قِتَالِ الْكُفَّارِ وَيُطْلَقُ أَيْضًا عَلَى مُجَاهَدَةِ النَّفْسِ وَالشَّيْطَانِ وَالْفُسَّاقِ ‘শারঈ পরিভাষায় জিহাদ হ’ল, কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করা। এর দ্বারা নফস, শয়তান ও ফাসিকদের বিরুদ্ধে জিহাদকেও বুঝানো হয়’।[10]

[1]. সৈয়দ মুহাম্মাদ রশীদ রেযা, মুখতাছার তাফসীরুল মানার (বৈরূত : ১ম সংস্করণ ১৪০৪/১৯৮৪) ১/১৮৬ পৃঃ।

[2]. ইবনু মাজাহ হা/৯৫৪, নাসাঈ হা/৪৮৬২; বুখারী, মিশকাত হা/৭৭৭।

[3]. সৈয়দ রশীদ রেযা, মুখতাছার তাফসীরুল মানার ১/১৮৬।

[4]. সৈয়দ রশীদ রেযা, মুখতাছার তাফসীরুল মানার ১/১৮৬-১৮৭ পৃঃ (সার-সংক্ষেপ)।

[5]. أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُوْنَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيْرٌ -হজ্জ ২২/৩৯।

[6]. তিরমিযী হা/৩১৭১, নাসাঈ হা/৩০৮৫; মুখতাছার তাফসীরুল মানার ১/১৮৬।

[7]. তওবাহ ৪১ আয়াত; انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالاً وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ -

[8]. সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো : দারুল ফাৎহ, ৫ম সংস্করণ ১৪১২/১৯৯২) ৩/৮৬।

[9]. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাত শরহ মিশকাত (মুলতান : ইশ‘আতুল মা‘আরেফ, ১৩৮৬/১৯৬৬) ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৭/২৬৪ পৃঃ। الْجِهَادُ : بِكَسْرِ أَوَّلِهِ، وَهُوَ لُغَةً الْمَشَقَّةُ، وَشَرْعًا بَذْلُ الْمَجْهُودِ فِي قِتَالِ الْكُفَّارِ مُبَاشَرَةً، أَوْ مُعَاوَنَةً بِالْمَالِ، أَوْ بِالرَّأْيِ، أَوْ بِتَكْثِيرِ السَّوَادِ، أَوْ غَيْرِ ذَلِكَ -

[10]. আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শরহ ছহীহুল বুখারী (কায়রো : ১৪০৭/১৯২৭) ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৬/৫ পৃঃ।

জিহাদের উদ্দেশ্য
(১) জিহাদ হবে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য ও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। যেমন আল্লাহ বলেন, وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا ‘তিনি স্বীয় রাসূলকে সাহায্য করেন এমন বাহিনী দ্বারা যাদেরকে তোমরা দেখোনি। তিনি কাফিরদের ঝান্ডাকে অবনমিত করেন ও আল্লাহর ঝান্ডাকে সমুন্নত করেন’ (তওবাহ ৯/৪০)।

হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, কোন ব্যক্তি যুদ্ধ করে গণীমত লাভের জন্য, কেউ যুদ্ধ করে নাম-যশের জন্য, কেউ যুদ্ধ করে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য। এক্ষণে কোন্ ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে? জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللهِ هِىَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِى سَبِيلِ اللهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য লড়াই করে, সেই-ই মাত্র আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে’।[1] আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَكَفَى بِاللهِ شَهِيدًا - ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি স্বীয় রাসূলকে হেদায়াত ও সত্যদ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপরে তাকে বিজয়ী করতে পারেন। আর (এ ব্যাপারে) সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (ফাৎহ ৪৮/২৮)। অর্থাৎ ইসলাম যে সকল দ্বীনের উপরে বিজয়ী, সে বিষয়ে আল্লাহই বড় সাক্ষী। কারণ অন্যেরা তা স্বীকার করে না বা করবেও না। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ ‘যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে’ (তওবাহ ৯/৩৩, ছফ ৬১/৯)। তিনি বলেন, يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ ‘তারা আল্লাহর নূরকে (শরী‘আতকে) ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহ স্বীয় নূরকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন, যদিও কাফিররা তা অপসন্দ করে’ (ছফ ৬১/৮; তওবাহ ৯/৩২)।

উপরোক্ত আয়াতসমূহে একথা পরিষ্কার যে, যারা ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনের সর্বত্র ইসলামী শরী‘আতকে কবুল করে না, বরং তাকে অপসন্দ করে, তারা কাফির ও মুশরিকদের অনুসারী এবং তারা ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দিতে চায়। যদিও তারা তাতে নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে।

(২) ইসলামে ‘জিহাদ’ স্রেফ আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে, দুনিয়ার জন্য নয়। আল্লাহ বলেন, وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ ‘তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে সত্যিকারের জিহাদ। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন’ (হজ্জ ২২/৭৮)।

(ক) ৭ম হিজরীতে খায়বর যুদ্ধে ইহূদীদের সবচাইতে মযবুত ‘নায়েম’ দুর্গ জয়ের পূর্বে ঝান্ডা হাতে দেওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেনাপতি আলী (রাঃ)-কে বলেন, যুদ্ধ শুরুর পূর্বে প্রতিপক্ষ যোদ্ধাদের প্রতি ইসলামের দাওয়াত দাও। কেননা فَوَاللهِ لَأَنْ يَّهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ ‘যদি তোমার দ্বারা আল্লাহ একজন ব্যক্তিকেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের (কুরবানীর) চাইতে উত্তম হবে’।[2]

এতে বুঝা যায় যে, স্রেফ যুদ্ধবিজয় ইসলামী জিহাদের লক্ষ্য নয়। বরং মানুষ আল্লাহর বিধানের অনুগত হৌক এটাই হ’ল কাম্য। যদি নিয়তের মধ্যে খুলূছিয়াত না থাকে, বরং ব্যক্তিস্বার্থ বা অন্য কোন দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিল করা উদ্দেশ্য হয়, তাহ’লে আল্লাহর দরবারে সেটা জিহাদ হিসাবে কবুল হবে না।

(খ) আল্লাহ বলেন, فَاعْبُدِ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ ‘অতএব তুমি আল্লাহর ইবাদত কর তাঁর প্রতি খালেছ আনুগত্য সহকারে’ (যুমার ৩৯/২)। যুদ্ধাবস্থায় মৃত্যু হ’লেও ত্রুটিপূর্ণ নিয়তের কারণে ঐ ব্যক্তি শহীদের মর্যাদা হ’তে বঞ্চিত হবে। আবার শহীদ হওয়ার খালেছ নিয়তের কারণে বিছানায় মৃত্যুবরণ করেও অনেকে শহীদের মর্যাদা পাবেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে এবং হযরত আবুবকর (রাঃ), হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ) প্রমুখ। উক্ত মর্মে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। কেননা ‘নিয়ত’ হ’ল আমলের রূহ স্বরূপ। নিয়তহীন আমল লক্ষ্যহীন পথিকের ন্যায়। আল্লাহর কাছে ঐ আমলের কোন মূল্য নেই।

(গ) হযরত আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ আমল কবুল করেন না, যা তার জন্য খালেছ না হয় এবং যা স্রেফ তাঁর চেহারা অন্বেষণের লক্ষ্যে না হয়’।[3]

(ঘ) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রথম বিচার হবে (কপট) শহীদের। আল্লাহ তাকে (দুনিয়ায় প্রদত্ত) নে‘মত সমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে বলা হবে, তুমি ঐসব নে‘মতের বিনিময়ে দুনিয়ায় কি কাজ করেছ? সে বলবে, আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য লড়াই করেছি ও অবশেষে শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এজন্য যুদ্ধ করেছিলে যেন তোমাকে ‘বীর’ ( جَرِئٌ ) বলা হয়। আর তা তোমাকে বলা হয়েছে। অতঃপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড়মুখী করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর আলেমদের, অতঃপর (লোক দেখানো) দানশীলদের একই অবস্থা হবে’।[4]

(ঙ) সাহল বিন হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে খালেছ অন্তরে শাহাদাত কামনা করে, আল্লাহ তাকে শহীদগণের স্তরে পৌঁছে দেন, যদিও সে বিছানায় মৃত্যুবরণ করে’।[5]

(চ) একদা এক খুৎবায় ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, কেউ যুদ্ধে নিহত হ’লে বা মারা গেলে তোমরা বলে থাক যে, ‘অমুক লোক শহীদ হয়ে গেছে’। তোমরা এরূপ বলো না। বরং ঐরূপ বল যেরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, مَنْ قُتِلَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ وَمَنْ مَاتَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হ’ল সে ব্যক্তি শহীদ এবং যে আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু বরণ করল সে ব্যক্তি শহীদ’।[6]

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৮১৪ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬০৮০; ফাৎহুল বারী হা/৪২১০।

[3]. আবুদাঊদ, নাসাঈ হা/৩১৪০।

[4]. মুসলিম হা/১৯০৫, মিশকাত হা/২০৫ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[5]. মুসলিম হা/১৯০৯, মিশকাত হা/৩৮০৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[6]. আহমাদ হা/২৮৫, ১০৭৭২; ইবনু মাজাহ হা/২৯১০; মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১১।

জিহাদের ফযীলত
(১) আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيْكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ- تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَتُجَاهِدُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ - ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসার কথা বলে দেব না, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হ’তে মুক্তি দেবে? তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমাদের মাল ও জান দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ’ (ছফ ৬১/১০-১১)।

(২) তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা লড়াই করে আল্লাহর রাস্তায়। অতঃপর তারা মারে ও মরে’ (তওবাহ ৯/১১১)।

(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ فِى الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِى سَبِيلِ اللهِ، مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ ، فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللهَ فَاسْأَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ، فَإِنَّهُ أَوْسَطُ الْجَنَّةِ وَأَعْلَى الْجَنَّةِ، أُرَاهُ فَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ، وَمِنْهُ تَفَجَّرَ أَنْهَارُ الْجَنَّةِ ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীদের জন্য আল্লাহ জান্নাতে একশতটি স্তর প্রস্ত্তত করে রেখেছেন। প্রতিটি স্তরের দূরত্ব আসমান ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের ন্যায়। অতএব যখন তোমরা প্রার্থনা করবে, তখন ‘ফেরদৌস’ প্রার্থনা করবে। কেননা এটিই হ’ল জান্নাতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ স্তর। এর উপরেই আমাকে আল্লাহর আরশ দেখানো হয়েছে। আর এখান থেকেই জান্নাতের নদীসমূহ প্রবাহিত হয়েছে’।[1]

(৪) তিনি বলেন مَا اغْبَرَّتْ قَدَمَا عَبْدٍ فِى سَبِيلِ اللهِ فَتَمَسَّهُ النَّارُ ‘যার পদযুগল আল্লাহর রাস্তায় ধূলি ধূসরিত হয়েছে, তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না’।[2] ‘পদযুগল ধূলি ধূসরিত হওয়া’ অর্থ, দেহ-মন সবকিছু আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা। যেমন অন্যত্র (৫) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَغَدْوَةٌ فِى سَبِيلِ اللهِ أَوْ رَوْحَةٌ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا ‘আল্লাহর রাস্তায় একটি সকাল ও একটি সন্ধ্যা ব্যয় করা, দুনিয়া ও তার মধ্যকার সকল কিছু হ’তে উত্তম’।[3]

(৬) তিনি বলেন, الْقَتْلُ فِى سَبِيلِ اللهِ يُكَفِّرُ كُلَّ شَىْءٍ إِلاَّ الدَّيْنَ ‘আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়া সকল পাপকে মোচন করে ঋণ ব্যতীত।[4]

(৭) তিনি বলেন, لاَ يُكْلَمُ أَحَدٌ فِى سَبِيلِ اللهِ- وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَنْ يُكْلَمُ فِى سَبِيلِهِ- إِلاَّ جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَجُرْحُهُ يَثْعَبُ، اللَّوْنُ لَوْنُ دَمٍ وَالرِّيحُ رِيحُ مِسْكٍ ‘কেউ আল্লাহর রাস্তায় আহত হ’লে, আর আল্লাহ ভালো জানেন কে তার রাস্তায় আহত হয়েছে, ক্বিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় আসবে যে, তার ক্ষতস্থান হ’তে রক্ত ঝরতে থাকবে। যার রং হবে রক্তের ন্যায়, কিন্তু সুগন্ধি হবে মিশকের ন্যায়’।[5]

(৮) রাসূল (ছাঃ) বলেন, কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করার পর তাকে পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ দেওয়া হলেও পুনরায় সে দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে না, শহীদ ব্যতীত। তাদের উচ্চ মর্যাদা দেখে সে দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে, যাতে সে দশবার শহীদ হ’তে পারে।[6]

(৯) আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَحْسِبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِى سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত ধারণা করো না; বরং তারা জীবিত। তারা তাদের প্রতিপালক হ’তে জীবিকাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তাদের আত্মাসমূহ সবুজ বর্ণের পাখির মধ্যে রক্ষিত হয় এবং তাদের জন্য আল্লাহর আরশের নীচে ফানুস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তারা জান্নাতে যথেচ্ছ বিচরণ করে। পরে তারা আবার ঐসমস্ত ফানুসের দিকে ফিরে আসে। তখন তাদের রব তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, তোমরা কি আরো কিছু চাও? উত্তরে তারা বলে, আমরা আর কিসের আকাংখা করব? আমরা তো জান্নাতের যেখানে খুশী বিচরণ করছি। আল্লাহ তাদেরকে এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করলে তারা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা চাই যে, আমাদের আত্মাগুলিকে পুনরায় আমাদের দেহের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। যেন আমরা পুনরায় আপনার রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হ’তে পারি। অতঃপর যখন আল্লাহ দেখবেন যে তাদের আর কিছু প্রয়োজন নেই, তখন তাদের ছেড়ে দিবেন’।[7]

(১০) তিনি বলেন, আল্লাহর নিকটে শহীদদের জন্য ৬টি বিশেষ পুরস্কার রয়েছে (ক) শহীদের রক্তের প্রথম ফোঁটা যমীনে পড়তেই তাকে মাফ করে দেওয়া হয় এবং জান বের হওয়ার প্রাক্কালেই তাকে জান্নাতের ঠিকানা দেখানো হয় (খ) তাকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করা হয় (গ) ক্বিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা হ’তে তাকে নিরাপদ রাখা হয় (ঘ) সেদিন তার মাথায় সম্মানের মুকুট পরানো হবে। যার একটি মুক্তা দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সবকিছু হতে উত্তম (ঙ) তাকে ৭২ জন সুন্দর চক্ষুবিশিষ্ট হূরের সাথে বিয়ে দেওয়া হবে এবং (চ) ৭০ জন নিকটাত্মীয়ের জন্য তার সুফারিশ কবুল করা হবে।[8]

(১১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, كُلُّ مَيِّتٍ يُخْتَمُ عَلَى عَمَلِهِ إِلاَّ الَّذِى مَاتَ مُرَابِطًا فِى سَبِيْلِ اللهِ فَإِنَّهُ يُنْمَى لَهُ عَمَلُهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَيَأْمَنُ مِنْ فِتْنَةِ الْقَبْرِ ‘প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির আমল বন্ধ হয়ে যায় কেবল ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় পাহারারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। তার নেকী ক্বিয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ঐ ব্যক্তি কবরের পরীক্ষা হ’তে নিরাপদ থাকে’।[9] এই নেকী ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরী সৈনিক যেমন পাবেন, ইসলাম বিরোধী আক্বীদা ও আমল প্রতিরোধে নিহত বা মৃত ব্যক্তিও তেমনি পাবেন।

[1]. বুখারী, মিশকাত হা/৩৭৮৭; ফাৎহুল বারী হা/২৭৯০ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৪ অনুচ্ছেদ।

[2]. বুখারী, মিশকাত হা/৩৭৯৪ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৭৯২ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[4]. মুসলিম হা/১৮৮৬, মিশকাত হা/৩৮০৬।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৮০২ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[6]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৮০৩।

[7]. মুসলিম হা/১৮৮৭; মিশকাত হা/৩৮০৪।

[8]. তিরমিযী হা/১৬৬৩, ইবনু মাজাহ হা/২৭৯৯, মিশকাত হা/৩৮৩৪।

[9]. তিরমিযী হা/১৬২১; মিশকাত হা/৩৮২৩।

শহীদগণ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে মুসলমান (১) তার দ্বীনের জন্য নিহত হ’ল, সে শহীদ (২) যে তার জীবন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (৩) যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (৪) যে ব্যক্তি তার পরিবার রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ।[1]

তিনি বলেন, (৫) যে ব্যক্তি মহামারীতে মারা যায়, সে শহীদ, (৬) যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় (কলেরা, ডায়রিয়া) মারা যায়, সে শহীদ, (৭) যে ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়, সে শহীদ’।[2] তিনি আরও বলেন, (৮) যে ব্যক্তি মযলূম অবস্থায় নিহত হয়, সে শহীদ’।[3] (৯) যে ব্যক্তি তার ন্যায্য অধিকার রক্ষায় নিহত হয়, সে শহীদ’।[4]

রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তি ছাড়াও আরও সাত জন ‘শহীদ’ রয়েছে। তারা হ’ল : (১) মহামারীতে মৃত (মুমিন) ব্যক্তি (২) পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি (৩) ‘যাতুল জাম্ব’ নামক কঠিন রোগে মৃত ব্যক্তি[5] (৪) (কলেরা বা অনুরূপ) পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি (৫) আগুনে পুড়ে মৃত ব্যক্তি (৬) ধ্বসে চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি ও (৭) গর্ভাবস্থায় মৃত মহিলা’।[6] উল্লেখ্য যে, ঐ সকল মুমিন ব্যক্তি আখেরাতে শহীদের নেকী পাবেন। যদিও দুনিয়াতে তাদের গোসল ও জানাযা করা হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে নিহত শহীদের গোসল নেই। তিনি ঐ অবস্থায় ক্বিয়ামতের দিন উঠবেন।[7]

শহীদগণ তিন শ্রেণীর : (১) যারা দুনিয়া ও আখেরাতে শহীদ। এঁরা হ’লেন, কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত মুমিন ব্যক্তি (২) আখেরাতে শহীদ। তারা হ’লেন উপরে বর্ণিত অন্যান্য শহীদগণ (৩) দুনিয়াতে শহীদ, আখেরাতে নয়। তারা হ’ল, যুদ্ধের ময়দানে গণীমতের মাল আত্মসাৎকারী অথবা জিহাদ থেকে পলাতক অবস্থায় নিহত ব্যক্তি’।[8] অর্থাৎ লোক দেখানো কপট শহীদ।

পরস্পরে মারামারি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ মানুষ ও পশু-পক্ষী সকল প্রাণীর স্বভাবগত বিষয়। স্ব স্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য মানুষ পরস্পরে যুদ্ধ করে। ধর্মীয় স্বার্থে হ’লে তখন সেটা ‘ধর্মযুদ্ধে’ পরিণত হয়। সেকারণ প্রত্যেক ধর্মেই যুদ্ধ একটি স্বীকৃত বিধান। ইসলাম আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ দ্বীন। যা সকল মানুষের কল্যাণে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন সহ সকল মানবরচিত ধর্ম এবং ইহূদী-নাছারা সহ পূর্ববর্তী সকল এলাহী ধর্ম, যা এখন মানসূখ বা হুকুমরহিত হিসাবে গণ্য; এসব ধর্ম রক্ষার জন্য লড়াই করাকে ‘জিহাদ’ বলা হবে না। বরং ঐসব ধর্মের অনুসারীদের হামলা থেকে ইসলামকে রক্ষা করার লড়াইকে ‘জিহাদ’ বলা হবে। ইসলামে জিহাদ বা যুদ্ধবিধান সম্পূর্ণরূপে দ্বীনের নিরিখে রচিত। এই বিধান সর্বব্যাপী ও সার্বজনীনভাবে কল্যাণময়। স্থান-কাল ও পাত্র বিবেচনায় এই বিধানের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগবিধি রয়েছে। নিম্নের আলোচনায় তা স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।

[1]. তিরমিযী হা/১৪২১, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৫২৯ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়।

[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১১; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪৪৯।

[3]. আহমাদ হা/২৭৮০, ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪৪৭।

[4]. মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৬৭৭৫; সনদ হাসান।

[5]. এটি সে যুগে একটি কঠিন মরণব্যাধি হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল। নামটি স্ত্রীলিঙ্গ হওয়ায় রোগটি মেয়েদের মধ্যেই অধিকহারে হ’ত বলে ধারণা করা হয়। যেসব গর্ভবর্তী মেয়েদের পেটে বাচ্চা মারা যায় এবং সেকারণে মাও মারা যায়, ঐ মেয়েকে যাতুল জাম্ব-এর রোগিনী বলা হয়। ইবনু হাজার বলেন, এটিই প্রসিদ্ধ (ফাৎহুল বারী হা/২৮২৯-এর ব্যাখ্যা, ৬/৫১ পৃঃ)।

[6]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৫৬১, সনদ ছহীহ।

[7]. বুখারী হা/৪০৭৯; মিশকাত হা/১৬৬৫; মির‘আত হা/১৬৭৯, ৫/৪০০ পৃঃ।

[8]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৯১।

ইসলামে জিহাদ বিধান
মাক্কী জীবনে : দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুঅতী জীবনের প্রথম ১৩ বছর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় অবস্থান করেন। এই সময় তাঁকে সশস্ত্র জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বরং তাঁকে প্রতিকূল পরিবেশে প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের পথে আহবানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁর সম্প্রদায় যখন তাঁর আহবানের মধ্যে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রীতি ও সংস্কৃতির বিরোধী বক্তব্য দেখতে পেল, তখন তাঁর বিরুদ্ধে তারা খড়গহস্ত হয়ে উঠলো এবং তাঁর উপরে নানাবিধ নির্যাতন শুরু করে দিল।

এই সময় রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হয়, اُدْعُ اِلىَ سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِى هِىَ اَحْسَنُ ‘তুমি আহবান কর মানুষকে তোমার প্রভুর পথে প্রজ্ঞার সাথে ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সর্বাধিক সুন্দর পন্থায়’ (নাহ্ল ১৬/১২৫)। বলা হয়, اِدْفَعْ بِالَّتِىْ هِىَ اَحْسَنُ السَيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُوْنَ ‘তুমি মন্দকে ভাল দ্বারা প্রতিরোধ কর। তারা যা বলে আমরা সে বিষয়ে ভালভাবে অবগত’ (মুমিনূন ২৩/৯৬)। বলা হ’ল, فَاِذَا الَّذِىْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِىٌّ حَمِيْمٌ ‘তাহ’লে তোমার শত্রুর অবস্থা এমন দাঁড়াবে, যেন সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)।

মাক্কী জীবনে মন্দকে মন্দ দ্বারা বা অস্ত্রকে অস্ত্র দ্বারা মুকাবিলা করার নির্দেশ আল্লাহপাক স্বীয় রাসূলকে দেননি। এই সময় তাঁকে কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা বাতিলপন্থী মন্দশক্তিকে মুকাবিলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُوْلُوْنَ وَمَا أَنْتَ عَلَيْهِمْ بِجَبَّارٍ فَذَكِّرْ بِالْقُرْآنِ مَنْ يَخَافُ وَعِيْدِ ‘আমরা ভালভাবে অবগত আছি যা তারা বলে। কিন্তু তুমি তাদের উপর যবরদস্তিকারী নও। অতএব তুমি কুরআন দ্বারা উপদেশ দাও যে ব্যক্তি আমার শাস্তিকে ভয় করে’ (ক্বাফ ৫০/৪৫)। অতঃপর এটাকেই ‘বড় জিহাদ’ হিসাবে উল্লেখ করে বলা হ’ল, فَلاَ تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَجَاهِدْ هُمْ بِهِ جِهَادًا كَبِيْرًا ‘তুমি কাফিরদের আনুগত্য করো না। বরং তাদের বিরুদ্ধে কুরআন দ্বারা বড় জিহাদে অবতীর্ণ হও’ (ফুরক্বান ২৫/৫২)।

কুরআন ও কুরআনের বাহক রাসূল ও তাঁর অনুসারীদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে কাফেররা মানসিক পীড়ন করতে থাকলে আল্লাহ বলেন, وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ‘যখন তুমি তাদেরকে আমাদের আয়াত সমূহে ত্রুটি সন্ধানে লিপ্ত দেখবে, তখন তুমি তাদের থেকে সরে যাবে। যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়’ (আন‘আম ৬/৬৮)। আরও বলা হয়েছে, فَذَرْهُمْ يَخُوضُوا وَيَلْعَبُوا حَتَّى يُلاَقُوا يَوْمَهُمُ الَّذِي يُوعَدُونَ ‘তাদেরকে ছিদ্রান্বেষণ ও খেল-তামাশায় ছেড়ে দাও সেই দিবসের (ক্বিয়ামতের) সম্মুখীন হওয়া পর্যন্ত, যে দিবসের ওয়াদা তাদেরকে করা হয়েছে’ (যুখরুফ ৪৩/৮৩, মা‘আরিজ ৭০/৪২)। বলা হয়, فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ ‘তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর’। ‘বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমরাই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)।

মাক্কী যিন্দেগীতে সাধারণ মুসলমানদের সামাজিক জীবন ও চলাফেরা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلاَمًا ‘দয়াময় আল্লাহর সত্যিকারের বান্দা তারাই যারা ভূপৃষ্ঠে বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা যখন তাদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে ‘সালাম’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩)। এই সময় কাফেরদের ক্ষমা করার উপদেশ দিয়ে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيلَ ‘তুমি তাদেরকে সুন্দরভাবে ক্ষমা করে দাও’ (হিজর ১৫/৮৫)। সাধারণ মুসলমানদেরও একইরূপ পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, قُلْ لِلَّذِينَ آمَنُوا يَغْفِرُوا لِلَّذِينَ لاَ يَرْجُونَ أَيَّامَ اللهِ ‘তুমি মুমিনদের বল, তারা যেন ঐসব লোকদের ক্ষমা করে দেয়, যারা আল্লাহর দিবস সমূহ (অর্থাৎ তাঁর শাস্তি বা অনুগ্রহ কোনটাই) কামনা করে না’ (জাছিয়াহ ৪৫/১৪)। উপরে বর্ণিত আয়াতগুলির সবই মাক্কী। এইভাবে সূরা হজ্জ ৩৯ আয়াত নাযিলের পূর্ব পর্যন্ত ৭০-এর অধিক আয়াতে মাক্কী জীবনে যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল’।[1]

[1]. মুফতী মুহাম্মাদ শাফী, তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন (সংক্ষেপায়িত), বঙ্গানুবাদ : মহিউদ্দীন খান (মদীনা : ১৪১৩/১৯৯৩) পৃঃ ৯০৩।

মাদানী জীবনে
উপরের আলোচনায় মাক্কী জীবনে জিহাদের প্রকৃতি ফুটে উঠেছে। প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে সেখানে দ্বীনের দাওয়াতকে খুবই ধৈর্য ও দূরদর্শিতার সাথে জনগণের নিকটে পেশ করতে হয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যখন কুফরী শক্তি ঈমানদারগণকে বরদাশত করতে পারলো না, বরং তাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেল এবং অবশেষে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করল, তখন আল্লাহর নির্দেশে তিনি মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হন (আনফাল ৮/৩০)। যেখানে পূর্ব থেকেই অন্ততঃ ৭৫ জন নারী-পুরুষ তাঁর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেছিলেন ও তাঁর জানমালের নিরাপত্তা দানে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন। তাছাড়া মুছ‘আব বিন ‘ওমায়ের (রাঃ) সেখানে পূর্ব থেকেই দ্বীনের প্রচারে লিপ্ত ছিলেন ও ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে রেখেছিলেন। যে কারণে মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিপুলভাবে সমাদৃত হন এবং জনসমর্থন ও শক্তি অর্জনে সমর্থ হন। ফলে এখানে যখন ২য় হিজরীতে মক্কার কাফেররা এসে হামলা চালায়, তখন আর তাঁকে পূর্বের মাক্কী জীবনের ন্যায় ছবর ও ক্ষমা করার কথা না বলে বরং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) প্রমুখাৎ হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর উক্তি বর্ণিত হয়েছে যে, যে রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, সে রাতে আবুবকর (রাঃ) দুঃখ করে বলেছিলেন, أَخْرَجُوْا نَبِيَّهُمْ لَيَهْلِكُنَّ ‘তারা তাদের নবীকে বের করে দিল। এখন অবশ্যই তারা ধ্বংস হবে’। এ সময় সূরা হজ্জ-এর ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয়, أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ- الَّذِيْنَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلاَّ أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللهُ وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيْهَا اسْمُ اللهِ كَثِيْرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম’ (৩৯)। ‘যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা ‘আল্লাহ’। যদি আল্লাহ মানবজাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে নাছারাদের বিশেষ উপাসনালয়, সাধারণ উপাসনালয়, ইহূদীদের উপাসনালয় ও মুসলমানদের মসজিদসমূহ, যে সকল স্থানে আল্লাহর নাম অধিকহারে স্মরণ করা হয়, সবই বিধ্বস্ত হয়ে যেত। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী’ (হজ্জ ৩৯-৪০)।[1]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ‘তোমরা যুদ্ধ কর আল্লাহর রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তবে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)।[2]

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (৭০০-৭৭৪ হিঃ) বলেন, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর এবং তাতে সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্ত্তকে সিদ্ধ করো না। যেমন বুরাইদাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন সেনাদল প্রেরণ করতেন, তখন বলতেন, اغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا وَلاَ تَغُلُّوا وَلاَ تَغْدِرُوا وَلاَ تُمَثِّلُوا وَلاَ تَقْتُلُوا الْوِلْدَانَ وَلاَ أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ - ‘তোমরা আল্লাহর নামে তাঁর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’।[3] ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, এক যুদ্ধে এক মহিলাকে নিহত দেখতে পেয়ে রাসূল (ছাঃ) দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং নারী ও শিশুদের থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেন।[4]

উপরে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর মাক্কী ও মাদানী জীবন পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। তবে সেটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কখনো নিরস্ত্র হবে, কখনো সশস্ত্র হবে। নিরস্ত্র জিহাদ মূলতঃ প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত ও হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার মাধ্যমে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে সশস্ত্র জিহাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত সামর্থ্য, বৈধ কর্তৃপক্ষ এবং স্রেফ আল্লাহর ওয়াস্তে নির্দেশ দানকারী আমীরের প্রয়োজন হবে। নইলে ছবর করতে হবে এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।

[1]. তিরমিযী হা/৩১৭১; নাসাঈ হা/৩০৮৫; আহমাদ হা/১৮৬৫; হাকেম হা/২৩৭৬।

[2]. তাফসীর কুরতুবী ২/৩৪৭, শাওকানী, তাফসীর ফাৎহুল ক্বাদীর ১/১৯০।

[3]. মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮; মিশকাত হা/৩৯২৯।

[4]. বুখারী হা/৩০১৫।

১০
মুসলিমদের মধ্যে পরস্পরে যুদ্ধ
মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ ‘সকল মুসলমানের পরস্পরের জন্য তিনটি বস্ত্ত হারাম। তার রক্ত, তার মাল ও তার ইযযত’।[1] কিন্তু এরপরেও মুসলমান বিভিন্ন কারণে পরস্পরের যুদ্ধ করে থাকে। এতে অত্যাচারী পক্ষ কবীরা গোনাহগার হ’লেও সে ইসলামের গন্ডী থেকে বহিস্কৃত হয় না। উমাইয়া যুগে খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান (৬৫-৮৬ হিঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ)-এর মধ্যে ৭৩ হিজরীতে যখন মক্কায় যুদ্ধ হয়, তখন লোকদের প্রশ্নের উত্তরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, يَمْنَعُنِى أَنَّ اللهَ حَرَّمَ دَمَ أَخِى ‘আমাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছে এ বিষয়টি যে, আল্লাহ আমার উপর আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন’। লোকেরা বলল, আল্লাহ কি বলেননি, وَقَاتِلُوْهُمْ حَتَّى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ ِللهِ ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না ফিৎনা অবশিষ্ট থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)। জবাবে তিনি বলেন, قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ، وَكَانَ الدِّينُ ِللهِ، وَأَنْتُمْ تُرِيدُونَ أَنْ تُقَاتِلُوا حَتَّى تَكُونَ فِتْنَةٌ، وَيَكُونَ الدِّينُ لِغَيْرِ اللهِ ‘আমরা যুদ্ধ করেছি যাতে ফিৎনা (শিরক ও কুফর) না থাকে এবং দ্বীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। আর তোমরা যুদ্ধ করছ যাতে ফিৎনা (বিপর্যয়) সৃষ্টি হয় এবং দ্বীন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের (শত্রুর) জন্য হয়ে যায়’।[2] তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, هَلْ تَدْرِى مَا الْفِتْنَةُ؟ كَانَ مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم يُقَاتِلُ الْمُشْرِكِينَ، وَكَانَ الدُّخُولُ عَلَيْهِمْ فِتْنَةً، وَلَيْسَ كَقِتَالِكُمْ عَلَى الْمُلْكِ ‘তুমি কি জানো ফিৎনা কি? মুহাম্মাদ (ছাঃ) যুদ্ধ করতেন মুশরিকদের বিরুদ্ধে। আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটাই ছিল ফিৎনা। তোমাদের মত শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য যুদ্ধ নয়।[3] ইবনু হাজার বলেন, এখানে প্রশ্নকারী ব্যক্তি শাসকের বিরুদ্ধে উত্থানকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বৈধ মনে করত। পক্ষান্তরে ইবনু ওমর (রাঃ) এটাকে রাজনৈতিক বিষয়ভুক্ত মনে করতেন’।[4] অর্থাৎ তিনি কাফির ও মুশরিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সিদ্ধ মনে করতেন। কিন্তু মুসলিমের বিরুদ্ধে নয়।

উল্লেখ্য যে, ‘ক্ষমতা দখলের লড়াইকে ফিৎনা বলা হয়। বিদ্রোহীকে অনুগত করার লড়াইকে নয়। এটাই হ’ল জমহূর বিদ্বানগণের মত’।[5]

বর্তমানে সরকারী ও বিরোধীদলীয় হিংসা ও প্রতিহিংসার রক্তক্ষয়ী রাজনীতির যুগে উপরের হাদীছটি ছাড়াও আবু বাকরাহ (রাঃ) বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর অত্র হাদীছটি স্মরণীয়। যেখানে তিনি বলেন, সত্বর ফেৎনাসমূহের উদ্ভব হবে। সে সময় বসা ব্যক্তি হাঁটা ব্যক্তির চেয়ে এবং হাঁটা ব্যক্তি দৌড়ানো ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে। সে সময় তোমরা তোমাদের উট, ছাগপাল বা জমি-জমা নিয়ে থাক। অথবা পাথরে আঘাত করে তরবারি ভেঙ্গে দিয়ে ফিৎনার স্থান থেকে পালিয়ে বাঁচো। একথা তিনবার বলার পর তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের কাছে নির্দেশ পৌঁছেছি? অতঃপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সে সময় যদি কেউ তোমাকে কোন একটি দলে প্রবেশে বাধ্য করে, অতঃপর তুমি কারু অস্ত্রাঘাতে নিহত হও, তাহ’লে ঐ ব্যক্তি তার ও তোমার পাপভার নিজে বহন করবে এবং সে জাহান্নামী হবে’।[6]

উক্ত হাদীছ জানার পর নেতারা সাবধান হবেন কি? তারা কি তাদের কারণে নিহত বা নির্যাতিত কর্মীদের পাপভার ক্বিয়ামতের দিন নিজেদের কাঁধে নিতে রাযী আছেন? নাকি ‘মরলে শহীদ বাঁচলে গাযী’ বলে নিজেদের ছেলেদের বাদ দিয়ে অন্যদের ছেলেকে রক্তক্ষয়ী রাজনীতির মধ্যে ঠেলে দিবেন?

[1]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯, ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়, ১৫ অনুচ্ছেদ।

[2]. বুখারী হা/৪৫১৩।

[3]. বুখারী হা/৪৬৫১; ৭০৯৫।

[4]. ফাৎহুল বারী হা/৪৬৫০-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।

[5]. ফাৎহুল বারী হা/৭০৯৫-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ, ‘ফিৎনাসমূহ’ অধ্যায়, ১৩/৫১ পৃঃ।

[6]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩৮৫ ‘ফিৎনা সমূহ’ অধ্যায়।

১১
জিহাদ কোন ধরনের ফরয?
‘জিহাদ’ সকলের জন্য সর্বাবস্থায় ‘ফরযে আয়েন’ না জানাযার ছালাতের ন্যায় ‘ফরযে কিফায়াহ’ এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব বলেন, জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপরে সব সময়ের জন্য ফরয। ইবনু আত্বিইয়াহ বলেন, এ বিষয়ে উম্মতের ‘ইজমা’ বা ঐক্যমত রয়েছে যে, উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর জিহাদ ‘ফরযে কিফায়াহ’। তাদের কোন দল উক্ত দায়িত্ব পালন করলে বাকীদের উপর থেকে দায়িত্ব নেমে যায়। তবে যখন শত্রু ইসলামী খেলাফতের সীমানায় অবতরণ করে, তখন প্রত্যেক মুসলমানের উপরে জিহাদ ‘ফরযে আয়েন’ হয়ে যায়।[1] আত্বা ও ছাওরী বলেন, ‘জিহাদ’ ইচ্ছাধীন বিষয়। তাঁরা সূরা নিসা ৯৫ আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করেন। যেখানে জিহাদকারী ও বসে থাকা সকল মুমিনকে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। যুহরী ও আওযাঈ বলেন, আল্লাহ জিহাদকে সকল মুসলমানের উপরে ফরয করেছেন, তারা যুদ্ধ করুক কিংবা বসে থাকুক। যে ব্যক্তি যুদ্ধ করল, সে যথার্থ করল ও আশীষপ্রাপ্ত হ’ল। আর যে ব্যক্তি বসে রইল, সেও গণনার মধ্যে রইল। যদি তার নিকটে সাহায্য চাওয়া হয়, তাহ’লে সে সাহায্য করবে। আর যদি যুদ্ধে বের হওয়ার আহবান করা হয়, তাহ’লে যুদ্ধে বের হবে। আর যদি তাকে আহবান না করা হয়, তাহ’লে বসে থাকবে।[2]

ইবনু কাছীর শেষোক্ত মতকে সমর্থন করে বলেন, সেকারণেই ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ জিহাদ করল না। এমনকি জিহাদের কথা মনেও আনলো না, সে ব্যক্তি মুনাফেকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল’।[3] অনুরূপভাবে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘোষণা করেন, لاَ هِجْرَةَ بَعْدَ الْفَتْحِ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ، وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوا ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর হিজরত নেই। কিন্তু জিহাদ ও তার নিয়ত বাকী রইল। যখন তোমাদেরকে জিহাদের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা বের হবে’।[4] আল্লাহ বলেন َمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلاَ نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُون-َ ‘আর সমস্ত মুমিনের জন্য জিহাদে বের হওয়া সঙ্গত নয়। অতএব তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের জন্য কেন বের হ’ল না? যাতে তারা ফিরে এসে স্ব স্ব গোত্রকে সতর্ক করতে পারে এবং তারা নিজেরাও বাঁচতে পারে? (তওবাহ ৯/১২২)।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হোযায়েল গোত্রের লেহইয়ান শাখার বিরুদ্ধে একটি সেনাদল পাঠানোর সময় বলেন, প্রতি দু’জনের মধ্যে একজনকে পাঠাবে। কিন্তু নেকী দু’জনের মধ্যে ভাগ হবে’।[5] তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে মদীনার উপকন্ঠে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই মদীনাতে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা তোমাদের সঙ্গে অভিযানে বের হয়নি বা কোন ময়দান অতিক্রম করেনি। অথচ তারা তোমাদের ন্যায় নেকীর অধিকারী। ছাহাবীগণ বললেন, এরূপ লোক কি মদীনাতে আছে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ, তারা মদীনাতেই আছে। বিভিন্ন ওযর তাদেরকে আটকে রেখেছিল।[6] সাইয়িদ সাবিক্ব বলেন, এর কারণ এই যে, যদি জিহাদ প্রত্যেকের উপরে ফরয করা হ’ত তাহ’লে মানুষের দুনিয়াবী শৃংখলা বিনষ্ট হয়ে যেত। অতএব জিহাদ কিছু লোকের উপরেই মাত্র ওয়াজিব, সবার উপরে নয়।[7]

ছহীহ বুখারীর সর্বশেষ ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হিঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে জিহাদ ‘ফরযে কিফায়াহ’ হওয়ার মতামতই প্রসিদ্ধ রয়েছে। ... তবে যখন শত্রু ঘেরাও করে ফেলবে তখন ব্যতীত এবং শাসক যখন কাউকে জিহাদে বের হবার আদেশ করবেন তখন ব্যতীত। তিনি বলেন, স্বতঃসিদ্ধ কথা এই যে, কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপর নির্ধারিত। চাই সেটা হাত দিয়ে হৌক বা যবান দিয়ে হৌক বা মাল দিয়ে হৌক কিংবা অন্তর দিয়ে হৌক’।[8] ইমাম শাওকানীও এ কথা বলেন।[9]

উপরের আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ঈমান, ত্বাহারৎ, ছালাত ও ছিয়ামের ন্যায় ‘জিহাদ’ প্রত্যেক মুমিনের উপরে সর্বাবস্থায় ‘ফরয আয়েন’ নয়। বরং আযান, জামা‘আত, জানাযা ইত্যাদির ন্যায় ‘ফরযে কিফায়াহ’। যা উম্মতের কেউ আদায় করলে অন্যদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। না করলে সবাই গোনাহগার হয়।

এতে বুঝা যায় যে, সশস্ত্র জিহাদ ফরযে কিফায়াহ হ’লেও যবান ও অন্তরের জিহাদ মুমিনের উপর সর্বাবস্থায় ‘ফরযে আয়েন’।

[1]. কুরতুবী, বাক্বারাহ ২১৬ আয়াতের ব্যাখ্যা; ৩/৩৯।

[2]. মুখতাছার তাফসীরুল বাগাভী (রিয়াদ : ১ম সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬) বাক্বারাহ ২১৬ আয়াতের ব্যাখ্যা, ১/৭৭।

[3]. মুসলিম হা/১৯১০, মিশকাত হা/৩৮১৩ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[4]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮; তাফসীর ইবনু কাছীর ১/২৫৯।

[5]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮০০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১৫-১৬।

[7]. সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৪-৮৫।

[8]. ফাৎহুল বারী হা/ ২৮২৫-এর ব্যাখ্যা, ৬/৪৫ পৃঃ।

[9]. মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো : ১৩৯৮/১৯৭৮) ৯/১০৫ পৃঃ।

১২
ফরযে কিফায়াহ
ফরযে কিফায়াহ : যা চার প্রকার।-

(১) দ্বীনী ফরয : যেমন দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা, ইসলামের সত্যতার বিরুদ্ধে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির প্রতিবাদ করা, জানাযার ছালাত আদায় করা, ছালাতের জন্য আযান দেওয়া, জামা‘আত কায়েম করা ইত্যাদি।

(২) জীবিকা অর্জনের ফরয : যেমন কৃষিকাজ, শিল্পকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা বা অনুরূপ শিক্ষা ও উপায়-উপাদানসমূহ অর্জন করা। যা না করলে মানুষের দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিই হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

(৩) এমন ফরয, যা আদায়ের জন্য শাসকের নির্দেশ শর্ত : যেমন ‘জিহাদ’ করা, শারঈ ‘হদ’ বা দন্ডবিধি প্রয়োগ করা ইত্যাদি।[1] কেননা এগুলিতে শাসকের একক অধিকার রয়েছে।

(৪) জিহাদে পিতা-মাতা ও ঋণদাতার অনুমতি গ্রহণ :

জিহাদ যখন ‘ফরযে কিফায়াহ’ বা ইচ্ছাধীন ফরযের বিষয়ে পরিণত হবে, তখন জিহাদে যাওয়ার জন্য পিতা-মাতার অনুমতি গ্রহণ আবশ্যিক হবে। বরং এমতাবস্থায় জিহাদে গমন ঐব্যক্তির জন্য মোটেই সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি স্বীয় পরিবার, সন্তান-সন্ততি ও পিতা-মাতার খিদমতের দায়িত্ব হ’তে মুক্ত হ’তে পারবে না।[2] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহর নিকটে সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ওয়াক্ত মত ছালাত আদায় করা (অন্য বর্ণনায় এসেছে, আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা’[3])। আমি বললাম, তারপর কি? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সেবা করা। বললাম তারপর কি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’।[4] আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে জিহাদে গমনের অনুমতি চাইল। রাসূল (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছেন কি? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহ’লে তাঁদের মাঝেই জিহাদ কর (অর্থাৎ তাঁদের সেবা-যত্নে মনোনিবেশ কর)।[5] একইভাবে ইচ্ছাধীন জিহাদে গমনের পূর্বে ঋণদাতার অনুমতি প্রয়োজন হবে। কেননা শাহাদাত সকল গোনাহের কাফফারা হ’লেও ঋণের দায়িত্ব থেকে শহীদ ব্যক্তি মুক্ত নন।[6] সাইয়িদ সাবিক্ব বলেন, এমতাবস্থায় ঋণের সঙ্গে যুক্ত হবে তার অন্যান্য যুলুম সমূহ। যেমন মানুষ খুন করা, অন্যায়ভাবে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করা ইত্যাদি (ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৯১)।

(৫) এমন ফরয, যা আদায়ের জন্য শাসকের অনুমতি শর্ত নয় : যেমন সৎ কাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, নেকীর কাজে মানুষকে আহবান করা ও নিকৃষ্ট কর্ম সমূহ দূর করা ইত্যাদি।

এই সমস্ত কাজ প্রত্যেক মুমিনের উপরে ‘ফরযে আয়েন’ নয়। বরং উম্মতের কেউ সম্পাদন করলে অন্যের উপর থেকে ‘ফরযিয়াত’ দূরীভূত হয়।

এক্ষণে কোন্ কোন্ সময় জিহাদ প্রত্যেক মুমিনের উপরে ‘ফরযে আয়েনে’ পরিণত হয়, তা নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-

[1]. ফাৎহুল বারী হা/২৯৬৭ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ‘আমীরের অনুমতি গ্রহণ’ অনুচ্ছেদ ১১৩।

[2]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৬; ফাৎহুল বারী ‘জিহাদ’ অধ্যায় ‘জিহাদে গমনে পিতামাতার অনুমতি গ্রহণ’ অনুচ্ছেদ ১৩৮।

[3]. আহমাদ, আবুদাঊদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/৬০৭।

[4]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬৮।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৮১৭।

[6]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮০৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৬।

১৩
জিহাদ ফরযে আয়েন
(১) মুসলমানদের বাড়ীতে বা শহরে শত্রুবাহিনী উপস্থিত হ’লে : এই সময় সকল শহরবাসীর উপরে ফরয হ’ল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শত্রুকে প্রতিহত করা। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যুদ্ধ কর ঐসব কাফেরের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের দুয়ারে হানা দিয়েছে। তারা তোমাদের কঠোরতা অনুভব করুক। আর জেনে রেখো আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথে রয়েছেন’ (তওবাহ ৯/১২৩)।

তিনি বলেন, اِنْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالاً وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ - ‘যুবক হও বৃদ্ধ হও, একাকী হও বা দলবদ্ধভাবে হও, তোমরা বেরিয়ে পড় এবং তোমাদের মাল ও জান দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ’ (তওবাহ ৯/৪১)।

(২) শাসক যখন কাউকে যুদ্ধে বের হবার নির্দেশ দেন : يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلاَ قَلِيلٌ ‘তোমাদের কি হয়েছে যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে জিহাদে বের হবার জন্য বলা হয়, তখন তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাক। তোমরা কি আখেরাতের বদলে দুনিয়ার জীবনের উপরে তুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াবী জীবনের উপকরণ অতীব নগণ্য’ (তওবাহ ৯/৩৮)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর হিজরত নেই। কিন্তু জিহাদ ও নিয়ত বাকী রইল। এক্ষণে যখন তোমাদেরকে যুদ্ধে বের হবার নির্দেশ দেয়া হবে, তখন তোমরা বেরিয়ে পড়বে’।[1]

(৩) যুদ্ধের সারিতে উপস্থিত হ’লে : আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা (কাফির) বাহিনীর মুখোমুখি হবে, তখন দৃঢ়ভাবে কায়েম থাক এবং আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (আনফাল ৮/৪৫)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلاَ تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা কাফির বাহিনীর সাথে যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি হবে, তখন তাদের থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না’ (আনফাল ৮/১৫)।

(৪) যখন কেউ বাধ্য হয়। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ قُتِلَ دُونَ مَالِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ وَمَنْ قُتِلَ دُونَ دِينِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ وَمَنْ قُتِلَ دُونَ دَمِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ وَمَنْ قُتِلَ دُونَ أَهْلِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ ‘যে মুসলমান (১) তার সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (২) যে তার দ্বীন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (৩) যে তার জীবন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (৪) যে তার পরিবার রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ।[2]

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৫।

[2]. তিরমিযী হা/১৪২১, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৫২৯ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়।

১৪
জিহাদ কাদের উপরে ফরয ও কাদের উপরে নয়
সুস্থ, বয়ঃপ্রাপ্ত ও জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম পুরুষের উপরে জিহাদ ফরয, যখন তার নিকটে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের বাইরে জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ, সুযোগ ও সামর্থ্য থাকবে।[1] জিহাদ ফরয নয় কোন অমুসলিমের উপর, দুর্বলের উপর, নারী ও রোগীর উপর, শিশু ও পাগলের উপর। এইসব লোকদের কেউ জিহাদ থেকে দূরে থাকলেও তাদের উপর কোন দোষ বর্তাবে না। বরং জিহাদে এদের উপস্থিতি উপকারের চাইতে ক্ষতির কারণ বেশী হবে। আল্লাহ বলেন, لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا ِللهِ وَرَسُولِهِ ‘দুর্বলদের উপর, রোগীদের উপর, ব্যয়ভার বহনে অক্ষমদের উপর (জিহাদ থেকে দূরে থাকায়) কোন দোষ নেই, যখন তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি খালেছ অনুরাগ পোষণ করে’... (তওবাহ ৯/৯১)।

(ক) শিশু : আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, ওহোদের যুদ্ধে যোগদানের জন্য আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গেলাম, তখন আমার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। কিন্তু তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন না।[2] কেননা জিহাদ একটি ইবাদত, যা বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যতীত অন্যদের উপরে ফরয নয়।[3]

(খ) নারী : হযরত আয়েশা (রাঃ) একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মেয়েদের জন্য কি জিহাদ নেই? রাসূল (ছাঃ) বললেন, অবশ্যই আছে। তবে সে জিহাদে ক্বিতাল নেই (অর্থাৎ পরস্পরে যুদ্ধ নেই)। সেটি হ’ল হজ্জ ও ওমরাহ’।[4] হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পুরুষেরা যুদ্ধ করে, অথচ আমরা করি না। সম্পত্তির অংশ বণ্টনেও আমরা পুরুষের অর্ধেক পাই। তখন নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়, وَلاَ تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبُوا وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبْنَ وَاسْأَلُوا اللهَ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّ اللهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا ‘তোমরা এমন সব বিষয় আকাংখা করো না, যেসব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে একে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে, সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে, সেটা তার অংশ। তোমরা আল্লাহর নিকটে অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত’ (নিসা ৪/৩২)। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর উপার্জন তাদের নিজস্ব। তাদের যোগ্যতা ও কর্মক্ষেত্র পৃথক ও সুনির্দিষ্ট। অতএব একে অপরের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার আকাংখা করবে না। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করলে সে পূর্ণ নেকীর হকদার হবে।[5]

নারী ও পুরুষের লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার প্রবক্তাগণ ও তথাকথিত সাম্যের দাবীদারগণ আল্লাহর উক্ত বিধান মানবেন কি?

[1]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৫।

[2]. বুখারী ও মুসলিম; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৬।

[3]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৫।

[4]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/২৫৩৪।

[5]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৬ টীকা-১।

১৫
জিহাদে নারীর অংশগ্রহণ
নারীর উপর জিহাদ ফরয নয়। কিন্তু প্রয়োজনে তারাও তাতে অংশ নিতে পারে বিভিন্নভাবে সহযোগী হিসাবে। যেমন-

(১) চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা দান। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ওহোদ বিপর্যয়ের দিন আমি আয়েশা (রাঃ) ও (আমার মা) উম্মে সুলাইম (রাঃ)-কে পানির মশক পিঠে করে আহতদের নিকট গিয়ে গিয়ে পানি পান করাতে দেখেছি।[1] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, উম্মে সুলাইম ও তার সাথী আনছার মহিলাদের একটি দল যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের পানি পান করিয়েছে এবং আহতদের চিকিৎসা করেছে’।[2] ওহোদ যুদ্ধে আহত রাসূল (ছাঃ)-এর যখম সমূহ কন্যা ফাতিমা (রাঃ) নিজ হাতে পরিষ্কার করেন। রক্ত বন্ধ না হওয়ায় চাটাই পোড়ানো ছাই দিয়ে তিনি তা বন্ধ করেন।[3] এছাড়াও রাসূল (ছাঃ)-এর নিহত হবার খবর শুনে মদীনা থেকে সম্মানিতা মহিলাগণ দলে দলে দৌড়ে ওহোদের ময়দানে চলে আসেন।[4] উম্মে সালীত্ব আনছারী (রাঃ) ওহোদ যুদ্ধে মুজাহিদদের জন্য পানির মশক সেলাই করে দিয়েছিলেন।[5] রুবাই‘ বিনতে মু‘আউভিয (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে যুদ্ধে যেতাম এবং লোকদের পানি পান করাতাম ও তাদের খেদমত করতাম। আহত ও নিহতদের মদীনায় নিয়ে আসতাম’। ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, যরূরী প্রয়োজনে মহিলাগণ বেগানা পুরুষের চিকিৎসা করতে পারেন।[6]

(২) আত্মরক্ষার জন্য। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, হুনাইনের যুদ্ধে (আমার মা) উম্মে সুলাইমের হাতে খঞ্জর অর্থাৎ দু’ধারী লম্বা ছুরি দেখে রাসূল (ছাঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যদি কাফের সৈন্য আমার নিকটবর্তী হয়, তবে এ দিয়ে আমি তার পেট ফেড়ে ফেলব। জবাব শুনে রাসূল (ছাঃ) হেসে ফেলেন।[7]

(৩) সহযোগী যোদ্ধা হিসাবে। খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত ‘উবাদা বিন ছামেত (রাঃ)-এর স্ত্রী উম্মে হারাম বিনতে মিলহান (রাঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর স্ত্রী ফাখেতাহ বিনতে ক্বারাযাহর সাথে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (২৩-৩৫ হিঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ২৭ হিজরী সনে রোমকদের বিরুদ্ধে ইসলামের ইতিহাসের ১ম নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।[8]

উপরের আলোচনায় বুঝা গেল যে, যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও যুদ্ধে সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাসহ যে কোন দুর্বল ও অপারগ মুমিন অংশগ্রহণ করতে পারবেন। বরং দুর্বলদের সহযোগিতাকে উৎসাহিত করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا يَنْصُرُ اللهُ هَذِهِ الأُمَّةَ بِضَعِيفِهَا بِدَعْوَتِهِمْ وَصَلاَتِهِمْ وَإِخْلاَصِهِمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সাহায্য করেন এই উম্মতকে তার দুর্বল শ্রেণীর দ্বারা; তাদের দো‘আ ও দাওয়াতের মাধ্যমে এবং ছালাত ও খালেছ আন্তরিকতার মাধ্যমে’।[9] হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ابْغُونِى في الضُّعَفَاءَ فَإِنَّمَا تُرْزَقُونَ وَتُنْصَرُونَ بِضُعَفَائِكُمْ ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, তোমরা আমাকে দুর্বলদের মধ্যে সন্ধান কর। কেননা তোমরা রূযীপ্রাপ্ত হয়ে থাক এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাক তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে।[10]

এর অর্থ এটা নয় যে, মুসলমানদের সবাইকে দুর্বল হয়ে থাকতে হবে। বরং এর অর্থ হ’ল, মুসলিম উম্মাহর সকল সদস্য ও সদস্যার উপরে সর্বদা জিহাদ ফরয। তার মধ্যে কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, কেউ সহযোগিতা করবে। কেউ দো‘আ করবে। কিন্তু কেউ জিহাদ হ’তে বিরত থাকার আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করলে সে মুনাফিক হয়ে মরবে।[11]

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের পক্ষ হ’তে সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত সেনাবাহিনী সরাসরি যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করবে এবং অন্যেরা তাদের সহযোগিতা করবে। নিয়ত খালেছ থাকলে ও যুদ্ধ আল্লাহর জন্য হ’লে সকলেই জিহাদের পূর্ণ নেকী লাভে ধন্য হবেন ইনশাআল্লাহ। এমনকি ‘জিহাদের জন্য অমুসলিমদের নিকট থেকেও সাহায্য গ্রহণ করা জায়েয আছে, যদি তাদের থেকে কোনরূপ ক্ষতির আশংকা না থাকে’।[12]

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ফাৎহুল বারী হা/২৮৮০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৬৫ অনুচ্ছেদ।

[2]. মুসলিম হা/১৮১০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৪৭ অনুচ্ছেদ।

[3]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৩০৩৭ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ১৬৩ অনুচ্ছেদ।

[4]. সুলায়মান মানছুরপুরী, রাহমাতুল লিল আলামীন (দিল্লী : ১ম সংস্করণ, ১৯৮০ খৃঃ) ১/১০৯ পৃঃ।

[5]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৮৮১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৬৬ অনুচ্ছেদ।

[6]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৮৮৩-এর ব্যাখ্যা, ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৬৮ অনুচ্ছেদ।

[7]. মুসলিম হা/১৮০৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৪৭ অনুচ্ছেদ।

[8]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৮৭৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৬৩ অনুচ্ছেদ; আল-বিদায়াহ ৮/২৩২।

[9]. নাসাঈ হা/৩১৭৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৭।

[10]. বুখারী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৫২৩২, ৫২৪৬।

[11]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১৩।

[12]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৭।

১৬
জিহাদের মাধ্যম
যা চারটি : (১) অন্তর দিয়ে (২) যবান দিয়ে (৩) মাল দিয়ে এবং (৪) অস্ত্রের মাধ্যমে।

(ক) আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ - ‘মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, অতঃপর তাতে সন্দেহ পোষণ করেনি। আর নিজেদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। এরাই হ’ল সত্যনিষ্ঠ’ (হুজুরাত ৪৯/১৫)।

(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ ‘তোমাদের মধ্যে যখন কেউ কোন অন্যায় হ’তে দেখে, তখন সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। তাতে সক্ষম না হ’লে যবান দিয়ে প্রতিবাদ করবে। তাতেও সক্ষম না হ’লে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এটা হ’ল দুর্বলতম ঈমান’।[1]

(গ) তিনি বলেন, আমার পূর্বে আল্লাহ এমন কোন নবীকে তার উম্মতের মধ্যে পাঠাননি, যাদের মধ্যে তার একদল ‘হাওয়ারী’ ও মুখলেছ সাথী ছিল না। যারা তার সুন্নাতের উপর আমল করত ও তার আদেশ মেনে চলত। অতঃপর তাদের স্থলে এমন লোকেরা এল, যারা এমন কথা বলত যা তারা করত না এবং এমন কাজ করত যা তাদের আদেশ করা হয়নি। (আমার উম্মতের মধ্যেও এরূপ হবে) অতএব مَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে হাত দ্বারা জিহাদ করবে সে মুমিন, যে ব্যক্তি যবান দ্বারা জিহাদ করবে সে মুমিন, যে ব্যক্তি অন্তর দ্বারা জিহাদ করবে সে মুমিন। এরপরে সরিষাদানা পরিমাণও ঈমান নেই’।[2]

(ঘ) তিনি আরও বলেন, جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ ‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[3] ইমাম কুরতুবী বলেন, কুরআন ও হাদীছে মালের কথা আগে বলা হয়েছে। তার কারণ জিহাদের জন্য প্রথমে মালের প্রয়োজন হয়ে থাকে।[4]

আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যেমন ‘জিহাদ’, যবান ও কলমের মাধ্যমে ও নিরন্তর সাংগঠনিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আমল-আচরণে পরিবর্তন আনাটাও তেমনি ‘জিহাদ’। এর জন্য জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয় করাও তেমনি ‘জিহাদ’। বরং কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে জিহাদই স্থায়ী ফলদায়ক। যার মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তিত হয়।

দুনিয়াবী স্বার্থে যুদ্ধ-বিগ্রহকে ইসলাম কখনোই সমর্থন করেনি। বরং ইসলামী জিহাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হ’ল ‘সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা’। আর এজন্য সর্বতোভাবে শক্তি অর্জন করা যরূরী। যেমন আল্লাহ বলেন, وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لاَ تَعْلَمُونَهُمُ اللهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لاَ تُظْلَمُونَ - ‘তোমরা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সাধ্যমত শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখো। যার দ্বারা তোমরা ভীত করবে আল্লাহর শত্রুদের ও তোমাদের শত্রুদের এবং যাদেরকে তোমরা জানো না, কিন্তু আল্লাহ তাদের জানেন। আর তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় কর, তার পুরোপুরি প্রতিদান তোমাদের দেওয়া হবে এবং তোমাদের উপর মোটেই যুলুম করা হবে না’ (আনফাল ৮/৬০)।

আয়াতে বর্ণিত ‘ঘোড়া’ কথাটি এসেছে উদাহরণ স্বরূপ, তৎকালীন সময়ের প্রধান যুদ্ধবাহন হিসাবে। এর দ্বারা সকল যুগের সকল প্রকারের যুদ্ধোপকরণ বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘শক্তি’ কথাটি ‘আম’। এ দ্বারা অর্থ, অস্ত্র, কথা, কলম, সংগঠন সবই বুঝানো হয়েছে। এই আয়াতের মাধ্যমে কোন মুসলিম বা অমুসলিম রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলিম নাগরিকদের সশস্ত্র প্রস্ত্ততি গ্রহণের কথা বলা হয়নি। যেমন অনেকে ধারণা করে থাকেন। কেননা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্ত্ততি বা জিহাদ ঘোষণার অধিকার মুসলমানদের সর্বসম্মত আমীরের (আলে ইমরান ৩/৫৯) অর্থাৎ সরকারের। অন্য কারুর নয়।

মোট কথা মুশরিক ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে মুমিনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করাকে ‘জিহাদ’ বলে। এখানে গিয়ে জিহাদকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।-

[1]. মুসলিম হা/৪৯, মিশকাত হা/৫১৩৭।

[2]. মুসলিম হা/৫০; মিশকাত হা/১৫৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহ্কে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[3]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, দারেমী, মিশকাত হা/৩৮২১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[4]. কুরতুবী, সূরা তওবা ৪১ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য; ৮/১৩৯।

১৭
জিহাদের প্রকারভেদ
(১) নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ : নফসের মধ্যে খারাপ চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। সেকারণ নফসকে কলুষিত করে ও আখেরাতের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এমন সব সাহিত্য, পরিবেশ ও প্রচার মাধ্যম থেকে ও দুনিয়াবী জৌলুস থেকে নিজেকে সাধ্যমত দূরে সরিয়ে রাখতে হবে এবং সর্বদা দ্বীনী আলোচনা ও দ্বীনী পরিবেশের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে হবে। যেমন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন, وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلاَ تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلاَ تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا ‘তুমি নিজেকে ঐসব লোকদের সাথে ধরে রাখো, যারা তাদের প্রভুকে ডাকে সকালে ও সন্ধ্যায়। তারা কামনা করে কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। তুমি তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না। তুমি কি দুনিয়াবী জীবনের জৌলুস কামনা কর? তুমি ঐ ব্যক্তির অনুসরণ করো না, যার অন্তর আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল হয়েছে এবং সে প্রবৃত্তির অনুসারী হয়েছে ও তার কাজকর্মে সীমালংঘন এসে গেছে’ (কাহফ ১৮/২৮)।

ফাযালাহ বিন ওবায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِي اللهِ ‘মুজাহিদ সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে খুশী করার জন্য তার নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে’।[1] ছাহেবে তুহফাহ বলেন, এর অর্থ, যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে দমন করে এবং পাপ থেকে বিরত হয়ে আল্লাহ্র আনুগত্যে নিজেকে ধরে রাখে। আর এটাই হ’ল সকল জিহাদের মূল ( وجهادها اصل كل جهاد )। কেননা যে ব্যক্তি নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারে না, সে ব্যক্তি বাইরে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারে না’।[2] বস্ত্ততঃ অর্থের লোভ, পদের লোভ, নাম-যশের লোভ প্রভৃতি মনের রোগ মানুষকে প্রতিনিয়ত আল্লাহ্র পথে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রাখে। তাই এই ভিতরকার গোপন শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধ করা প্রয়োজন। এজন্যেই বলা হয়েছে,

أَشَدُّ الْجِهَادِ جِهَادُ الْهَوَى + وَمَا كَرَّمَ الْمَرْءَ اِلاَّ التُّقَى ‘সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ হ’ল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর মানুষকে সম্মানিত করে না আল্লাহভীতি ব্যতীত’।

(২) শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ : শয়তান জিন ও ইনসান উভয়ের মধ্য থেকে হ’তে পারে (নাস ১১৪/৬)। এদের দিনরাতের কাজ হ’ল বিভিন্ন ধোঁকার মাধ্যমে মুমিনকে পথভ্রষ্ট করা। আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا ‘এমনিভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু নিযুক্ত করেছি মানুষ ও জিন থেকে একদল শয়তানকে। যারা ধোঁকা দেওয়ার জন্য একে অপরকে কারুকার্য খচিত কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১২)। এদের থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ‘যখন তুমি ঐসব লোকদের দেখবে যে, আমার আয়াত সমূহে ছিদ্রান্বেষণে লিপ্ত হয়েছে, তখন তুমি তাদেরকে এড়িয়ে চলো, যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়’ (আন‘আম ৬/৬৮)।

এযুগে শয়তানের সবচেয়ে বড় ধোঁকা হ’ল গণতন্ত্র ও জঙ্গীবাদ। ক্ষমতা দখলের সুড়সুড়ি দিয়ে এ দু’টি মতবাদ মুসলিম সমাজকে পরস্পরে হানাহানি ও রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করেছে। তাদের নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি শেষ করে দিয়েছে এবং তাদের ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস করেছে।

এজন্য শয়তানের অনুসারী ব্যক্তি ও সংগঠন বর্জন করা ও তাদের থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। শিরক ও বিদ‘আতপন্থী এবং ভোগবাদী ও বস্ত্তবাদী শিক্ষা ও পরিবেশ বর্জন করা যরূরী। সাথে সাথে এসবের অনুসারী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে নিজেকে ও নিজের গৃহকে পরিচ্ছন্ন রাখা অপরিহার্য। এসবের স্থলে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছপন্থী ব্যক্তি ও সংগঠনভুক্ত থাকা, দ্বীনী শিক্ষা ও পরিবেশ অপরিহার্য করে নেওয়া এবং এর অনুসারী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেকে ও নিজের গৃহকে আলোকিত রাখা আবশ্যক।

(৩) কাফির-মুশরিক ও ফাসিক-মুনাফিকের বিরুদ্ধে জিহাদ : আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ‘হে নবী! তুমি জিহাদ কর কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের উপরে কঠোর হও। ওদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর কতইনা মন্দ ঠিকানা সেটি’ (তওবা ৯/৭৩; তাহরীম ৬৬/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে অস্ত্রের দ্বারা এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে যবান দ্বারা এবং অন্যান্য পন্থায় কঠোরতা অবলম্বনের দ্বারা’। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর হাত দ্বারা, না পারলে যবান দ্বারা, না পারলে ওদেরকে এড়িয়ে চল’। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, যবান দ্বারা দলীল কায়েম করার বিষয়টি হ’ল স্থায়ী জিহাদ’।[3] আধুনিক যুগে যবান, কলম ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যম একই গুরুত্ব বহন করে। বরং কলমই হ’ল স্থায়ী জিহাদ।

[1]. তিরমিযী হা/১৬২১।

[2]. তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিযী, হা/১৬৭১-এর ব্যাখ্যা।

[3]. কুরতুবী, সূরা তওবা ৭৩ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; ৮/১৮৭ পৃঃ।

১৮
২য় ভাগ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রকৃতি
(ক) মুসলিম হৌক অমুসলিম হৌক প্রতিষ্ঠিত কোন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলামের নীতি নয়। তবে ইসলাম বিরোধী হুকুম মানতে কোন মুসলিম নাগরিক বাধ্য নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِى مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই।[1] অতএব সর্বাবস্থায় তাওহীদের কালেমাকে সমুন্নত রাখা ও ইসলামী স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা মুসলমানের উপর ফরয দায়িত্ব। এমতক্ষেত্রে সরকারের নিকটে কুরআন ও হাদীছের বক্তব্য তুলে ধরাই হ’ল বড় জিহাদ। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ حَقٍّ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ ‘শ্রেষ্ঠ জিহাদ হ’ল অত্যাচারী শাসকের নিকটে হক কথা বলা।[2]

সরকারের নিকট বক্তব্য তুলে ধরার সর্বোত্তম পন্থা হ’ল, সরকার প্রধান বা তাঁর প্রতিনিধির সাথে নিরিবিলি সাক্ষাতে কথা বলা ও উপদেশ দেওয়া। এজন্য সরকারকে উদার ও সহনশীল হ’তে হবে। অহংকারী ও হঠকারী হওয়া চলবে না। হরতাল-ধর্মঘট, মারদাঙ্গা মিছিল ইত্যাদি গণতন্ত্রে সমর্থনযোগ্য হ’লেও ইসলাম এগুলি সমর্থন করে না। অতএব এগুলি কখনোই কোন উত্তম প্রক্রিয়া নয়। এতে সরকার ও জনগণ মুখোমুখি হয়। যাতে হিতে বিপরীত হবে এবং অহেতুক নির্যাতন ও রক্তপাত হবে। যা এখন গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারী ও বিরোধী দল অর্থই হ’ল পরস্পর সহিংস দু’টো দল। যা সমাজকে বিভক্ত করে ও রাষ্ট্রকে পঙ্গু ও গতিহীন করে দেয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَرَادَ أَنْ يَنْصَحَ لِسُلْطَانٍ بِأَمْرٍ فَلاَ يُبْدِ لَهُ عَلاَنِيَةً وَلَكِنْ لِيَأْخُذْ بِيَدِهِ فَيَخْلُوَ بِهِ فَإِنْ قَبِلَ مِنْهُ فَذَاكَ وَإِلاَّ كَانَ قَدْ أَدَّى الَّذِى عَلَيْهِ لَهُ ‘যে ব্যক্তি শাসককে উপদেশ দিতে চায়, সে যেন তা প্রকাশ্যে না দেয়। বরং তার কাছে নির্জন স্থানে দেয়। এক্ষণে তিনি সেটি গ্রহণ করলে তো ভালই। না করলে ঐ ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করল’।[3] সরকারের কাছে বক্তব্য পেশ করার এই ভদ্র পন্থাই হ’ল ইসলামী পন্থা। এতে উভয়পক্ষ পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও সহানুভূতিশীল থাকে। দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। এর বাইরে প্রচলিত হরতাল-ধর্মঘটের পন্থা একটা জংলী পন্থা বৈ কিছুই নয়।

অমুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণের সকল প্রকার ইসলামী প্রচেষ্টাই হ’ল ‘জিহাদ’। যখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় এবং তাওহীদের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে হয়। কিন্তু যদি বিনা প্রচেষ্টায় অনৈসলামী আইন মেনে নেওয়া হয় এবং তার উপর কোন মুসলমান সন্তুষ্ট থাকে, তাহ’লে সে অবশ্যই কবীরা গোনাহগার হবে। সাধ্যমত চেষ্টা সত্ত্বেও বাধ্য হ’লে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চাইতে হবে এবং শাসকের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করতে হবে।

(খ) শাসক মুসলিম ফাসেক হলে সে অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِىَ وَتَابَعَ، قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ أَفَلاَ نُقَاتِلُهُمْ؟ قَالَ لاَ مَا صَلَّوْا، لاَ مَا صَلَّوْا - ‘তোমাদের উপর অনেক শাসক নিযুক্ত হবে। যাদের কোন কাজ তোমরা পসন্দ করবে এবং কোন কাজ অপসন্দ করবে। এক্ষণে যে ব্যক্তি উক্ত অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করবে, সে দায়িত্বমুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি তা অপসন্দ করবে, সে (মুনাফেকী থেকে) নিরাপদ থাকবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্ট থাকবে ও তার অনুসরণ করবে। এ সময় ছাহাবীগণ বললেন, আমরা কি ঐ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। যতক্ষণ তারা ছালাত আদায় করে। না, যতক্ষণ তারা ছালাত আদায় করে’।[4]

অন্য হাদীছে এসেছে وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ قَالَ إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللهِ فِيهِ بُرْهَانٌ ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রমাণ ভিত্তিক সুস্পষ্ট কুফরী না দেখা পর্যন্ত মুসলিম শাসকদের আনুগত্যমুক্ত হওয়া যাবে না’।[5]

[1]. শারহুস সুন্নাহ, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৯৬, ৩৬৬৪ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[2]. আবুদাঊদ হা/৪৩৪৪, তিরমিযী; মিশকাত হা/৩৭০৫।

[3]. আহমাদ হা/১৫৩৬৯; হাকেম; আলবানী, যিলালুল জান্নাহ হা/১০৯৮, সনদ ছহীহ।

[4]. মুসলিম হা/১৮৫৪, শারহুস সুন্নাহ হা/২৪৫৯, মিশকাত হা/৩৬৭১।

[5]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৩৬৬৬।

১৯
‘প্রকাশ্য কুফরী’ (كُفْرٌ بَوَاحٌ) -এর ব্যাখ্যা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সুস্পষ্ট কুফরী না দেখা পর্যন্ত শাসকের আনুগত্যমুক্ত হয়ো না। সেটা কিভাবে?

( إِلاَّ أَنْ تَرَوْا ) অর্থ, তোমরা যাচাই করে দেখবে। কেবল ধারণা ও প্রচারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে না। ( كُفْرًا ) অর্থ, কেবল ফাসেকী বা কোন কবীরা গোনাহ যথেষ্ট নয়। বরং ইসলামকে পুরোপুরি অস্বীকার করা বুঝাবে। ( بَوَاحًا ) অর্থ, প্রকাশ্য। যাতে কোনরূপ অস্পষ্টতা বা গোপনীয়তা থাকে না। ( عِنْدَكُمْ ) অর্থ, তোমাদের জ্ঞানীদের নিকট। ( مِنَ اللهِ فِيهِ بُرْهَانٌ ) অর্থ, তার কুফরীর ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত কুরআন ও সুন্নাহর মযবুত দলীল থাকতে হবে। কোন দুর্বল প্রমাণ বা সন্দেহের ভিত্তিতে নয় কিংবা কোন দল বা ব্যক্তির একক সিদ্ধান্তে নয়। বরং কাউকে কাফের ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার থাকবে রাষ্ট্রীয় ইসলামী আদালতের শরী‘আত অভিজ্ঞ বিচারকমন্ডলীর অথবা দেশের হাদীছপন্থী বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে। অন্য কারু সিদ্ধান্তে নয়। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَيُّمَا رَجُلٍ قَالَ لأَخِيهِ يَا كَافِرُ ! فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا - ‘যদি কেউ তার ভাইকে বলে হে কাফের! তাহলে সেটা তাদের যেকোন একজনের উপর বর্তাবে’।[1]

এর দ্বারা ছোট কুফরী বুঝানো হয়েছে। কেননা কেউ কাউকে কাফের বললেই সে কাফের হয়ে যায় না। বরং কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে যাচাই সাপেক্ষে কুফরী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে এবং বারবার বুঝানো সত্ত্বেও স্বীয় অবিশ্বাসে অটল থাকলে তাকে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ হিসাবে গণ্য করা যাবে। কোন মুসলিম সরকারের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।

তবে কাফের সাব্যস্ত হ’লেই উক্ত শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরয, তা নয়। কারণ যুদ্ধ করার বিষয়টি শর্তসাপেক্ষ। আর তা হ’ল বৈধ কর্তৃপক্ষ, অনুকূল পরিবেশ এবং যথার্থ শক্তি ও পর্যাপ্ত সামর্থ্য থাকা। আল্লাহ বলেন, فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘তোমরা সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ৬৪/১৬)। তিনি বলেন, لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৮৬)। অন্যথায় তা আত্মহননের শামিল হবে। যা করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, وَلاَ تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ‘তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৯৫)।

[1]. বুখারী হা/৬১০৪; মুসলিম হা/৬০; মিশকাত হা/৪৮১৫।

২০
কাফের গণ্য করার ফল
উল্লেখ্য যে, কাফির ঘোষণা করা কেবল সরকারের বিরুদ্ধে নয়, যেকোন মুসলিমের বিরুদ্ধেও হতে পারে। আর কাফির গণ্য করে তাদের রক্ত ও ধন-সম্পদ যদি হালাল করা হয়, তাহলে মুসলিম উম্মাহ্র ঘরে-ঘরে বিপর্যয় নেমে আসবে। যেমন বাপকে ‘কাফের’ গণ্য করা হ’লে মায়ের সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হবে। সন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এমনকি তার জন্য পিতার রক্ত হালাল হবে। একই অবস্থা হবে ভাই ভাইয়ের ক্ষেত্রে, স্বামী ও স্ত্রীর ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের ক্ষেত্রে। আর যদি এটা কোন সরকারের বিরুদ্ধে হয়, তাহ’লে সেটা আরও কঠিন হবে এবং সারা দেশে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে। নিরপরাধ নারী-শিশু ও সাধারণ নির্দোষ মানুষ সরকারী জেল-যুলুম ও নির্যাতনের অসহায় শিকারে পরিণত হবে, যা আজকাল বিভিন্ন দেশে হচ্ছে।

কিছু লোক বোমা মেরে দ্বীন কায়েম করতে চায়। তারা অমুসলিমের চাইতে মুসলিম নেতাদের হত্যা করাকে বেশী অগ্রাধিকার দেয়। তাদের যুক্তি ‘রাহেগী মাক্ষী উসতক, যাবতাক রাহেগী নাজাসাত’ (‘মাছি অতক্ষণ থাকবে, যতক্ষণ দুর্গন্ধ থাকবে’)। অথচ শয়তান যেহেতু আছে, দুর্গন্ধ থাকবেই, মাছিও থাকবে। তবে মুমিন-কাফির যেই-ই হৌক নিরস্ত্র ও নিরপরাধ কোন মানুষকে হত্যা করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামী আদালত বা দায়িত্বশীল বৈধ কর্তৃপক্ষ ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যাযোগ্য আসামী সাব্যস্ত করতে পারে না। অথচ স্বেচ্ছাচারী কিছু চরমপন্থীর জন্য আজ নির্দোষ মুসলিম নর-নারী নিজ দেশে ও প্রবাসে ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন।

২১
মানুষ হত্যার পরিণাম
আল্লাহ বলেন, مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا، ‘যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কারু জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে’ (মায়েদাহ ৫/৩২)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَالَّذِىْ نَفْسِى بِيَدِهِ لَقَتْلُ مُؤْمِنٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ مِنْ زَوَالِ الدُّنْيَا ‘যাঁর হাতে আমার জীবন নিহিত তাঁর কসম করে বলছি, একজন মুমিনকে হত্যা করা অবশ্যই আল্লাহ্র নিকটে দুনিয়া লয় হয়ে যাওয়ার চাইতে অধিক ভয়ংকর’।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, لَزَوَالُ الدُّنْيَا أَهْوَنُ عِنْدَ اللهِ مِنْ قَتْلِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ ‘একজন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করার চাইতে দুনিয়া লয় হয়ে যাওয়া আল্লাহ্র নিকট অধিক হালকা বিষয়’।[2] এর অর্থ এটা নয় যে, কাফেরকে হত্যা করায় নেকী আছে। সেটা হ’লে রাসূল (ছাঃ) শীর্ষ কাফের নেতা আবু সুফিয়ানকে মক্কা বিজয়ের আগের রাতে নিরস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়ার পরেও তাকে কেন হত্যা করেননি? বরং তিনি তাকে মুসলিম হওয়ার সুযোগ দেন। পরদিন মক্কা বিজয়ের পর প্রদত্ত ভাষণে তিনি সকল কাফির-মুশরিককে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং রক্তপাতকে স্থায়ীভাবে হারাম করে দেন।[3] ফলে সবাই ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়।

[1]. নাসাঈ হা/৩৯৮৬; আলবানী, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩৬১।

[2]. নাসাঈ হা/৩৯৮৭; তিরমিযী হা/১৩৯৫; মিশকাত হা/৩৪৬২ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়।

[3]. সীরাতে ইবনে হিশাম (মিসর : বাবী হালবী, ২য় সংস্করণ ১৩৭৫/১৯৫৫) ২/৪০৩, ৪১৫; ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীক্বুল মাখতূম (কুয়েত : ২য় সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬) ৪০৫, ৪০৭ পৃঃ; বুখারী হা/১০৪; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭২৬।

২২
মুসলিম-এর নিদর্শন
এক্ষণে ‘মুসলিম’ কে? সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ شَهِدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا وَصَلَّى صَلاَتَنَا وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا فَهُوَ مُسْلِمٌ لَهُ مَا لِلْمُسْلِمِينَ وَعَلَيْهِ مَا عَلَى الْمُسْلِمِينَ ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্র রাসূল। আর যে ব্যক্তি আমাদের ক্বিবলাকে ক্বিবলা মানে, আমাদের ন্যায় ছালাত আদায় করে, আমাদের যবহকৃত প্রাণীর গোশত খায়, সে ব্যক্তি ‘মুসলিম’। তার জন্য সেই পুরস্কার, যা অন্য মুসলমানদের জন্য রয়েছে এবং তার উপরে সেই শাস্তি, যা অন্য মুসলমানদের উপরে প্রযোজ্য’।[1] অতএব উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ যার মধ্যে থাকবে, তিনিই ‘মুসলিম’। যদিও তিনি কবীরা গোনাহগার হন।

[1]. নাসাঈ হা/৩৯৬৮; বুখারী, মিশকাত হা/১৩।

২৩
কবীরা গোনাহগার কাফের নয়
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মুমিন থাকা অবস্থায় কোন ব্যভিচারী ব্যভিচার করতে পারে না, কোন চোর চুরি করতে পারে না, কোন মদ্যপ মদ্যপান করতে পারে না, কোন ডাকাত ডাকাতি করতে পারে না, কেউ গণীমতের মালে খেয়ানত করতে পারে না। অতএব তোমরা সাবধান হও! তোমরা সাবধান হও’! ইবনু আববাস-এর বর্ণনায় আরও এসেছে, ‘মুমিন থাকা অবস্থায় হত্যাকারী কাউকে হত্যা করতে পারে না’। এর ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) দুই হাতের আঙ্গুলগুলি পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে অতঃপর বের করে নিয়ে বলেন, যখন সে তওবা করে, তখন ঈমান তার মধ্যে আবার প্রবেশ করে। ইমাম বুখারী (রহঃ) অত্র হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে ‘মুমিন’ অর্থ ‘পূর্ণ মুমিন’ ( مُؤْمِنًا تَامًّا )। পাপ কাজের সময় ঈমানের নূর তার অন্তর থেকে বেরিয়ে যায়’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩)।

আর মুসলমান পরস্পরে যুদ্ধ করলেও তারা যে কাফের ও মুরতাদ হয় না, তার বড় প্রমাণ হ’ল সূরা হুজুরাত ৯ আয়াতটি। যেখানে আল্লাহ পরস্পরে যুদ্ধরত উভয়পক্ষকে ‘মুমিন’ বলে অভিহিত করেছেন।

২৪
উত্তরণের পথ
মুসলিম সমাজে কারু মধ্যে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ ( كُفْرٌ بَوَاحٌ ) দেখা গেলে প্রথমে তাকে উপদেশের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। অতঃপর বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও না পারলে ঐ ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলবে এবং তার হেদায়াতের জন্য আল্লাহ্র নিকট দো‘আ করবে। যদি সরকার অমুসলিম হয় ও ইসলামে বাধা সৃষ্টি করে অথবা মুসলিম সরকারের মধ্যে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ দেখা দেয় এবং ইসলামের সাথে দুশমনী করে, তাহলে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকলে বৈধ পন্থায় সেটা করবে। নইলে ছবর করবে এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মূলনীতি অনুসরণে ইসলামের পক্ষে জনমত গঠন করবে। এটাই নবীগণের তরীকা।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আত্মশুদ্ধি ও পরিচর্যার ( الةزكية والةربية ) মাধ্যমে সমাজশুদ্ধির কাজ করেছেন। আমাদেরকেও সেপথে এগোতে হবে। বাধা এলে তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন। পরে সক্ষমতা অর্জন করলে এবং আক্রান্ত হ’লে জিহাদ করেছেন কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে, কোন মুসলিম বা মুনাফিকের বিরুদ্ধে নয়। আমরা যদি ইসলামের অগ্রগতি ও মুসলিম উম্মাহ্র কল্যাণ চাই, তাহ’লে আমাদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর পথে চলতে হবে, অন্য পথে নয়। কবি আবু ওছমান সাঈদ বিন ইসমাঈল (২৩০-২৯৮ হিঃ) বলেন,

مَا بَالُ دِينِكَ تَرْضَى أَنْ تُدَنِّسَهُ + وَأَنَّ ثَوْبَكَ مَغْسُولٌ مِنَ الدَّنَسِ

تَرْجُو النَّجَاةَ وَلَمْ تَسْلُكْ مَسَالِكَهَا + إِنَّ السَّفِينَةَ لاَ تَجْرِي عَلَى الْيَبَسِ

‘তোমার দ্বীনের অবস্থা কি যে তুমি তাকে ময়লাযুক্ত করার উপর খুশী হয়ে গেছ? আর তোমার পোষাক ময়লা দিয়ে ধৌত করা হয়েছে’? ‘তুমি নাজাত চাও, অথচ সে পথে তুমি চলোনা। নিশ্চয়ই নৌকা কখনো শুকনা মাটিতে চলে না’।[1]

[1]. বায়হাক্বী শু‘আব, ১২ অধ্যায় ২/৩২৯ পৃঃ।

২৫
কাফির গণ্য করার মূলনীতি সমূহ
কাউকে কাফের বলতে গেলে যেসব মূলনীতি জানা আবশ্যক তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-

(১) এটি একটি শারঈ হুকুম। যা কুরআন ও সুন্নাহ্র ভিত্তিতেই সাব্যস্ত হবে। অন্য কোন ভিত্তিতে নয়।

(২) কাফের সাব্যস্ত হবে ব্যক্তির অবস্থা ভেদে। কেননা অনেকে ঈমান ও কুফরের পার্থক্য বুঝে না। ফলে প্রত্যেক বিদ‘আতী ও পাপী এমনকি একজন কবরপূজারীকেও কাফের সাব্যস্ত করা যায় না তার অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে।

(৩) কারু কথা, কাজ বা বিশ্বাসের ভিত্তিতেই কেবল তাকে কাফের বলা যাবে না, যতক্ষণ না তার কাছে দলীল স্পষ্ট করা হবে এবং সন্দেহ দূর করা হবে। এমনকি যদি কেউ অজ্ঞতাবশে কাউকে সিজদা করে, তবে তাকে কাফের বলা যাবে না। যেমন হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) শাম (সিরিয়া) থেকে ফিরে এসে রাসূল (ছাঃ)-কে সিজদা করেন। কেননা তিনি সেখানে নেতাদের সিজদা করতে দেখেছেন, তাই এসে রাসূলকে সিজদা করেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে নিষেধ করে দেন।[1] অতএব অজ্ঞতাবশে ইসলামের কোন বিধানকে অস্বীকার করলে তাকে ‘কাফের’ বলা যাবে না। যতক্ষণ না তাকে ভালভাবে বুঝানো হয়।

(৪) মুমিন কোন ক্ষেত্রে ঈমান বিরোধী কাজ করলেই তিনি ঈমানের গন্ডী থেকে বের হয়ে যান না বা ‘মুরতাদ’ হয়ে যান না। যেমন মক্কা অভিযানের গোপন তথ্য ফাঁস করে জনৈক মহিলার মাধ্যমে মক্কার নেতাদের কাছে পত্র প্রেরণ করা ও তা হাতেনাতে ধরা পড়ার মত হত্যাযোগ্য পাপ করা সত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) বদরী ছাহাবী হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ (রাঃ)-কে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেননি ও তাকে হত্যা করেননি। বরং তাকে ক্ষমা করে দেন তার কৈফিয়ত শ্রবণ করার পর।[2]

(৫) ইসলামের মূল বিষয়গুলি অস্বীকার করলে কাফের হবে, আর শাখাগুলি অস্বীকার করলে কাফের হবে না, এমনটি নয়। বরং শরী‘আতের প্রতিটি বিষয়ই পালনীয়। ছাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর কোন নির্দেশকেই অগ্রাহ্য করতেন না বরং প্রতিটি নির্দেশকেই সমভাবে গুরুত্ব ও মর্যাদা দিতেন।

(৬) একই ব্যক্তির মধ্যে ঈমান ও কুফর, তাওহীদ ও শিরক, তাক্বওয়া ও পাপাচার, সরলতা ও কপটতা দু’টিই একত্রিত হতে পারে।

আর এটাই হ’ল বাস্তব। তা না হ’লে তওবা ও ইস্তিগফারের কোন প্রয়োজন থাকত না। আর আহলে সুন্নাতের নিকট এটি একটি বড় মূলনীতি। যা খারেজী, মুরজিয়া, মু‘তাযিলা, ক্বাদারিয়া ও অন্যান্য ভ্রান্ত ফের্কা সমূহের বিপরীত।

বস্ত্ততঃ তাদের পথভ্রষ্টতার বড় কারণ এখানেই যে, তারা ঈমানকে এক ও অবিভাজ্য মনে করে। মুরজিয়ারা মনে করে যখন ঈমানের একাংশ থাকবে, তখন তার সবটাই থাকবে। পক্ষান্তরে খারেজীরা মনে করে যখন ঈমানের একাংশ চলে যাবে, তখন সবটাই চলে যাবে। আর একারণেই তারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে ‘কাফের’ ও ‘চিরস্থায়ী জাহান্নামী’ বলে এবং তার রক্তকে হালাল জ্ঞান করে। যেমন আজকাল চরমপন্থীরা মনে করে থাকে।

অথচ ‘কুরআন সৃষ্ট’ এই কুফরী মতবাদের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) তাঁর উপর নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতনকারী খলীফা মু‘তাছিম বিল্লাহ (২১৮-২২৭ হিঃ)-কে ‘কাফের’ বলেননি। বরং তার ইস্তিগফারের জন্য দো‘আ করেছেন একারণে যে, খলীফা ও তাঁর সাথীদের নিকট প্রকৃত বিষয়ের স্পষ্ট জ্ঞান ছিল না।[3]

সে যুগে খলীফা মু‘তাছিমের ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান ছিল, আজকের যুগে মুসলিম সরকার ও রাজনীতিকদের মধ্যে তার শতভাগের একভাগও আছে কি? অথচ তাদেরকে কাফের সাব্যস্ত করে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় যারা, তারা আল্লাহ্র কাছে কি কৈফিয়ত দিবে?

[1]. ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৩; ছহীহাহ হা/১২০৩।

[2]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৬২১৬।

[3]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া (রিয়াদ : ১৪০৪ হিঃ) ২৩/৩৪৮-৪৯; আবু ইয়া‘লা, তাবাক্বাতুল হানাবিলাহ (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/১৬৩-৬৭, ২৪০ পৃঃ।

২৬
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পরস্পরে কাফের গণ্য করার ধারাবাহিক ইতিহাস
উম্মতের মধ্যে প্রথম বিদ‘আতের সূচনা হয় পরস্পরকে ‘কাফির’ বলার মাধ্যমে। ৩৭ হিজরী সনে ছিফফীন যুদ্ধের সময় খারেজীদের মাধ্যমে যার উদ্ভব ঘটে। তারা হযরত আলী, ওছমান, তালহা, যুবায়ের, আবু মূসা আশ‘আরী, আমর ইবনুল ‘আছ ও মু‘আবিয়া (রাঃ) সহ উটের যুদ্ধে, ছিফফীন যুদ্ধে এবং উক্ত যুদ্ধ বন্ধে উভয় পক্ষের শালিশীতে সম্মত ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের ধারণা মতে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে উত্থান করা সিদ্ধ মনে করে। ফলে খারেজীরা হ’ল উম্মতের প্রথম ভ্রান্ত ফের্কা, যারা কবীরা গোনাহগার মুসলিমকে ‘কাফের’ বলে এবং তাকে হত্যা করা সিদ্ধ বলে। এদের সাথে সাথেই সৃষ্টি হয় আরেকটি চরমপন্থী ভ্রান্ত ফের্কা শী‘আ দল। যারা বলে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর পরে মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ, আবু যর গেফারী ও সালমান ফারেসী (রাঃ) ব্যতীত সকল ছাহাবী ধর্মত্যাগী ‘মুরতাদ’।[1] তাদের ধারণা মতে হযরত আবুবকর, ওমর, ওছমান এবং সকল মুহাজির ও আনছার ছাহাবী ও তৎপরবর্তী যুগে তাদের অনুসারীবৃন্দ যারা তাদের মতের বিরোধী, সবাই কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তাদের নিকটে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকদের কুফরী ইহূদী-নাছারাদের কুফরীর চাইতে নিকৃষ্ট। কেননা তারা হ’ল আসল কাফের এবং এরা হ’ল ধর্মত্যাগী কাফের। আর জন্মগত কাফিরের চাইতে ইসলামত্যাগী ‘মুরতাদ’ কাফির অধিক ঘৃণিত। এদের পরপরই একে একে ক্বাদারিয়া, জাবরিয়া, মুরজিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের উদ্ভব হ’তে থাকে। এরা সবাই একে অপরকে কাফির বলতে থাকে। এভাবেই শান্তিপ্রিয় মুসলিম উম্মাহ একটি পরস্পরে বিদ্বেষী উম্মতে পরিণত হয়। আল্লাহ রহম করেন আহলেহাদীছগণের উপরে, যারা রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সকল প্রকার বাড়াবাড়ি হ’তে মুক্ত হয়ে মধ্যপন্থী থাকেন এবং সর্বদা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উপর দৃঢ় থাকেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা এভাবেই থাকবেন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে। যদিও সকল যুগে বিদ‘আতীরা তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করবে। যেমন এ যুগেও করছে।

[1]. ইবরাহীম আর-রুহাইলী, আত-তাকফীর ওয়া যাওয়াবিতুহু (কায়রো : দার আহমাদ, ২য় সংস্করণ ১৪২৯/২০০৮) পৃঃ ৩৫।

২৭
আধুনিক যুগের চরমপন্থী নেতৃবৃন্দের কয়েকজন
১. সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী (ভারত ও পরে পাকিস্তান : ১৯০৩-১৯৭৯) : প্রথম যুগের চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আদের অনুকরণে আধুনিক যুগে কয়েকজন চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটে। যাদের যুক্তিবাদী লেখনীতে প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন দেশে ইসলামের নামে চরমপন্থী দলসমূহের উদ্ভব ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে এ দলের শীর্ষস্থানীয় হ’লেন মাওলানা মওদূদী। তাঁর পুরো লেখনীই পরিচালিত হয়েছে যেকোন উপায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল ‘জামায়াতে ইসলামী’ও একই উদ্দেশ্যে পরিচালিত। তিনি বলেছেন, ‘দ্বীন আসলে হুকূমতের নাম। শরী‘আত ঐ হুকূমতের কানূন। আর ইবাদত হ’ল ঐ কানূন ও বিধানের আনুগত্য করার নাম’ (খুৎবাত ৩২০ পৃঃ)। তাঁর ধারণা মতে ‘ছালাত-ছিয়াম, হজ্জ-যাকাত, যিকর ও তাসবীহ সবকিছু উক্ত বড় ইবাদতের জন্য প্রস্ত্ততকারী অনুশীলনী বা ট্রেনিং কোর্স মাত্র’ (তাফহীমাত ১/৬৯)। তাঁর মতে ইসলাম কোন বণিকের দোকান নয় যে, ইচ্ছামত কিছু মাল কিনবে ও কিছু ছাড়বে। বরং ইসলামের হয় সবটুকু মানতে হবে, নয় সবটুকু ছাড়তে হবে’।[1] তাঁর মতে ‘আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্য দু’টিই সমান। যদি ছালাত-ছিয়াম ইত্যাদি ইবাদত হুকূমত কায়েমের লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হয়, তাহ’লে আল্লাহর নিকট এ সবের কোন ছওয়াব মিলবে না’ (তাফহীমাত ১/৪৯-৬৩ পৃঃ)। তিনি বলেন, তার এই দাওয়াত যারা কবুল করবে না, তাদের অবস্থা হবে নবীযুগে ইসলামী দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী ইহূদীদের মত’ (রোয়েদাদ ২/১৯ পৃঃ)।

এতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের আক্বীদা বিগত যুগের চরমপন্থী খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত দলসমূহের অনুরূপ। সে যুগে তারা ছাহাবীদের ‘কাফের’ বলেছিল ও তাদের রক্ত হালাল করেছিল। এ যুগে এরা অন্য মুসলমানদের ‘ইহূদী’ অর্থাৎ কাফের ভাবছে ও তাদের রক্ত হালাল গণ্য করছে। সে যুগে যেমন যেভাবে হৌক ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, এ যুগেও তেমনি ব্যালট বা বুলেট যেভাবেই হৌক ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য এবং এটাই হ’ল তাদের দৃষ্টিতে বড় ইবাদত।

বস্ত্ততঃ মাওলানা মওদূদীর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তিনটি : (১) সর্বাত্মক দ্বীন ( كل دين ) -এর ধারণা। ফলে তাঁর মতে দ্বীনের কোন একটি অংশ ছাড়লেই সব দ্বীন চলে যাবে। (২) তাঁর নিকটে দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য পরিষ্কার না হওয়া এবং (৩) আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের প্রতি আনুগত্যকে এক করে দেখা। এই দর্শনের ফলে ইসলামী সরকারের বিরোধিতা করা এবং অনৈসলামী বা অমুসলিম সরকারের আনুগত্য করা দু’টিই শিরকে পরিণত হয়। যাতে সরকার ও জনগণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হবে। যেমন বর্তমানে হচ্ছে।

২. সাইয়িদ কুতুব (মিসর : ১৯০৬-১৯৬৬) : মাওলানা মওদূদীর লেখনীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একই ভাবধারায় তিনি লেখনী পরিচালনা করেছেন। সাথে সাথে তাঁর অনুসারী দল ‘ইখওয়ানুল মুসলেমীন’কে পরিচালিত করেছেন। তিনিও খারেজীদের ন্যায় মুসলিম উম্মাহকে হয় কাফের নয় মুমিন, এভাবে ভাগ করে বলেছেন, ‘লোকেরা আসলে মুসলমান নয় যেমন তারা দাবী করে থাকে। তারা জাহেলিয়াতের জীবন যাপন করছে। ... তারা ধারণা করে যে, ইসলাম এই জাহেলিয়াতকে নিয়েই চলতে পারে। কিন্তু তাদের এই ধোঁকা খাওয়া ও অন্যকে ধোঁকা দেওয়ায় প্রকৃত অবস্থার কোনই পরিবর্তন হবে না। না এটি ইসলাম এবং না তারা মুসলমান’ (মা‘আলিম ফিত-তারীক্ব পৃঃ ১৫৮)। তিনি বলেন, ‘কালচক্রে দ্বীন এখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহতে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। ... মানুষ প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে সর্বত্র মসজিদের মিনার সমূহে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ধ্বনি বারবার উচ্চারণ করে কোনরূপ বুঝ ও বাস্তবতা ছাড়াই। এরাই হ’ল সবচেয়ে বড় পাপী ও ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তির ( أثقلُ إثماً وأشدُّ عذاباً يومَ القيامة ) অধিকারী। কেননা তাদের কাছে হেদায়াত স্পষ্ট হওয়ার পরেও এবং তারা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে থাকার পরেও তারা মানুষপূজার দিকে ফিরে গেছে’।[2] তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে কোন মুসলিম রাষ্ট্র নেই বা কোন মুসলিম সমাজ নেই’।[3] তিনি মুসলমানদের সমাজকে জাহেলী সমাজ এবং তাদের মসজিদগুলিকে ‘জাহেলিয়াতের ইবাদতখানা’ ( مُعَابِدُ الْجَاهِلِيَّةِ ) বলে আখ্যায়িত করেছেন।[4] তিনি মাওলানা মওদূদীর ন্যায় আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্যকে সমান মনে করেছেন এবং অনৈসলামী সরকারের আনুগত্য করাকে ‘ঈমানহীনতা’ গণ্য করেছেন।[5] ‘একটি বিষয়েও অন্যের অনুসরণ করলে সে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে’ বলে তিনি ধারণা করেছেন।[6] তিনি বলেন, ইসলামে জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল, ইসলাম বিরোধী শাসনের বুনিয়াদ সমূহ ধ্বংস করে দেয়া এবং সে স্থলে ইসলামের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কায়েম করা।[7] এভাবে বিদ্বানগণ তাঁর অন্যান্য বই ছাড়াও কেবল তাফসীর ‘ফী যিলালিল কুরআনে’ আক্বীদাগত ও অন্যান্য বিষয়ে ১৮১টি ভুল চিহ্নিত করেছেন।[8]

মাওলানা মওদূদী ও সাইয়িদ কুতুবের চিন্তাধারায় কোন পার্থক্য নেই। কবীরা গোনাহগার মুসলমানদের তারা মুসলমান হিসাবে মেনে নিতে চাননি। বরং তাদেরকে মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলে ধারণা করেছেন। এর ফলে তাঁরা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সাথে সাথে পথচ্যুত করেছেন তাদের অনুসারী অসংখ্য মুসলিমকে। অথচ এর কোন বাস্তবতা এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেও ছিল না। তখনও মুসলমানদের মধ্যে ভাল-মন্দ, ফাসিক-মুনাফিক সবই ছিল। কিন্তু কাউকে তাঁরা কাফির এবং মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলতেন না। সেকারণ আধুনিক বিদ্বানগণ এসব দল ও এদের অনুসারী দলসমূহকে এক কথায় ‘জামা‘আতুত তাকফীর’ ( جماعة التكفير ) অর্থাৎ ‘অন্যকে কাফের ধারণাকারী দল’ বলে অভিহিত করে থাকেন। অথচ এইসব চরমপন্থী আক্বীদার ফলে যিনি মারছেন ও যিনি মরছেন, উভয়ে মুসলমান। আর এটাই তো শয়তানের পাতানো ফাঁদ, যেখানে তারা পা দিয়েছেন।

অতএব সকলের কর্তব্য হবে সর্বাবস্থায় আমর বিন মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করা এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের নিকট ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা।

[1]. হাকীম আবুল হাসান ওবায়দুল্লাহ খান, ইসলামী সিয়াসাত (শ্রীনগর, কাষ্মীর : ১৯৭৮) পৃঃ ২৩; রোয়েদাদে জামা‘আতে ইসলামী (দিল্লী : জুন ১৯৮২) ১/৬ পৃঃ।

[2]. সাইয়িদ কুতুব, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন (বৈরূত : দারুশ শুরূক্ব ১৭তম সংস্করণ ১৪১২ হিঃ) সূরা আন‘আম ১৯ আয়াতের ব্যাখ্যা, ২/১০৫৭ পৃঃ।

[3]. ঐ, সূরা হিজরের ভূমিকা, ৪/২১২২ পৃঃ।

[4]. ঐ, ইউনুস ৮৭ আয়াতের ব্যাখ্যা ৩/১৮১৬ পৃঃ।

[5]. ঐ, নিসা ৬০ আয়াতের ব্যাখ্যা, ২/৬৯৩ পৃঃ।

[6]. ঐ, ২/৯৭২ পৃঃ। - والإسلام منهج للحياة كلها . من اتبعه كله فهو مؤمن وفي دين الله ومن اتبع غيره ولو في حكم واحد فقد رفض الإيمان واعتدى على ألوهية الله، وخرج من دين الله . مهما أعلن أنه يحترم العقيدة وأنه مسلم -

[7]. ঐ, ৩/১৪৫১। - أن غاية الجهاد في الإسلام، هي هدم بنيان النظم المناقضة لمبادئه، وإقامة حكومة مؤسسة على قواعد الإسلام في مكانها واستبدالها بها -

[8]. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-হুসাইন, ফিৎনাতুত তাকফীর ওয়াল হাকেমিয়াহ (রিয়াদ : ১৪১৬ হিঃ) পৃঃ ৯৮; গৃহীত : المورد الزلال فى التنبيه على أخطاء الظلال لعبد الله بن محمد الدويش

২৮
সরকারের আনুগত্যমুক্ত হওয়া
সরকারের সুস্পষ্ট কুফরী প্রমাণিত হলে তার আনুগত্যমুক্ত হওয়া যাবে।[1] তবে সেটা কল্যাণকর হবে কি-না, সে বিষয়ে অবশ্যই দেশের বিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরাম কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিবেন এবং মুসলিম নাগরিকগণ তাদের অনুসরণ করবেন। শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ বেশী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে বিদ্রোহ করা যাবে না। বরং ধৈর্যধারণ করতে হবে, যতক্ষণ না আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন ফায়ছালা নাযিল হয়। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশালী’ (বাক্বারাহ ২/১০৯, তওবা ৯/২৪)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নেতা তারাই, যাদেরকে তোমরা ভালবাস এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে। তোমরা তাদের জন্য দো‘আ কর এবং তারাও তোমাদের জন্য দো‘আ করে। আর তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট নেতা তারাই, যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর এবং তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। তোমরা তাদের উপর লা‘নত কর, তারাও তোমাদের উপর লা‘নত করে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি সে সময় তাদের আনুগত্যমুক্ত হব না? তিনি বললেন, না। যতক্ষণ না তারা তোমাদের মধ্যে ছালাত কায়েম করে। না যতক্ষণ না তারা তোমাদের মধ্যে ছালাত কায়েম করে। أَلاَ مَنْ وَلِىَ عَلَيْهِ وَالٍ فَرَآهُ يَأْتِى شَيْئًا مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ فَلْيَكْرَهْ مَا يَأْتِى مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ وَلاَ يَنْزِعَنَّ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ ‘সাবধান! যখন কাউকে তোমাদের উপর শাসক নিযুক্ত করা হয়, অতঃপর তার মধ্যে আল্লাহর নাফরমানীর কোন কিছু পরিলক্ষিত হয়। তখন তোমরা সেই নাফরমানীর কাজটিকে অপসন্দ কর (অর্থাৎ সেটা করো না)। কিন্তু তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ো না’।

একই রাবী হতে অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْ وُلَاتِكُمْ شَيْئًا تَكْرَهُونَهُ فَاكْرَهُوا عَمَلَهُ وَلاَ تَنْزِعُوا يَدًا مِنْ طَاعَةٍ ‘যখন তোমরা তোমাদের শাসকদের কাছ থেকে এমন কিছু দেখবে যা তোমরা অপসন্দ কর, তখন তোমরা তার কাজটিকে অপসন্দ কর। কিন্তু আনুগত্যের হাত গুটিয়ে নিয়ো না’।[2] তিনি বলেন, مَنْ رَأَى مِنْ أَمِيرِهِ شَيْئًا يَكْرَهُهُ فَلْيَصْبِرْ عَلَيْهِ ‘কেউ তার শাসকের নিকট থেকে অপসন্দনীয় কিছু দেখলে সে যেন তাতে ধৈর্যধারণ করে’।[3] তিনি বলেন, أَدُّوا إِلَيْهِمْ حَقَّهُمْ وَسَلُوا اللهَ حَقَّكُمْ এমতাবস্থায় তাদের হক তাদের দাও এবং তোমাদের হক আল্লাহর কাছে চাও’।[4] فَإِنَّمَا عَلَيْهِمْ مَا حُمِّلُوا وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُم ‘কেননা তাদের পাপ তাদের উপর এবং তোমাদের পাপ তোমাদের উপর বর্তাবে’।[5]তিনি বলেন, أَعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ، فَإِنَّ اللهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ ‘তোমরা তাদের হক দিয়ে দাও। কেননা আল্লাহ শাসকদেরকেই জিজ্ঞেস করবেন তাদের শাসন সম্পর্কে’।[6]

উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, প্রকাশ্য কুফরীতে লিপ্ত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ক্ষেত্রে দু’টি পথ রয়েছে।-

১- যদি শাসক পরিবর্তনের সহজ পথ থাকে, তাহ’লে সেটা করা যাবে।

২- যদি এর ফলে সমাজে অধিক অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টির আশংকা থাকে, তাহ’লে ছবর করতে হবে ও সকল প্রকার ন্যায়সঙ্গত পন্থায় সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করতে হবে, যতদিন না তার চাইতে উত্তম কোন বিকল্প সামনে আসে। এর দ্বারাই একজন মুমিন আল্লাহর নিকটে দায়মুক্ত হ’তে পারবেন।

কিন্তু যদি তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করেন, সরকারকে সুপরামর্শ ও উপদেশ না দেন, বরং অন্যায়ে খুশী হন ও তা মেনে নেন, তাহ’লে তিনি গোনাহগার হবেন ও আল্লাহর নিকটে নিশ্চিতভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন। মূলতঃ এটাই হ’ল ‘নাহী ‘আনিল মুনকার’-এর দায়িত্ব পালন। যদি কেউ ঝামেলা ও ঝগড়ার অজুহাত দেখিয়ে একাজ থেকে দূরে থাকেন, তবে তিনি কুরআনী নির্দেশের বিরোধিতা করার দায়ে আল্লাহর নিকটে দায়ী হবেন।

শাসক বা সরকারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার সাথে সাথে তার কল্যাণের জন্য সর্বদা আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে হবে। কেননা শাসকের জন্য হেদায়াতের দো‘আ করা সর্বোত্তম ইবাদত ও নেকীর কাজ সমূহের অন্তর্ভুক্ত।

[1]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬৬ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[2]. মুসলিম হা/১৮৫৪-৫৫; মিশকাত হা/৩৬৭১ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬৮।

[4]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৭২।

[5]. মুসলিম হা/১৮৪৬, মিশকাত হা/৩৬৭৩।

[6]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৭৫।

২৯
জিহাদ ঘোষণা
শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার অধিকার হ’ল মুসলমানদের সর্বসম্মত আমীরের (নিসা ৪/৫৯)। অন্য কারু নয়। ‘সর্বসম্মত’ বলতে ঐ শাসক যার প্রতি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সকলে অনুগত থাকে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ ، وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّى دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّ الإِسْلاَمِ ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধের জন্য আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। যখন তারা এরূপ করবে, তখন আমার পক্ষ হ’তে তাদের জান ও মাল নিরাপদ থাকবে, ইসলামের হক ব্যতীত। আর তাদের (অন্তরের) হিসাব আল্লাহর উপর ন্যস্ত থাকবে’।[1]

এখানে রাসূল (ছাঃ) আদিষ্ট হয়েছেন, কেননা তিনি ছিলেন উম্মতের নেতা। তিনি মাদানী জীবনে আল্লাহর হুদূদ বা দন্ডবিধিসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখতেন। পরবর্তী সময়ে এই ক্ষমতা খলীফাগণ ও ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকগণ সংরক্ষণ করেন। কোন মুসলিম ব্যক্তি বা দল যে কোন সময়ে যে কারু উপরে উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না।

যেমন উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)-এর প্রসিদ্ধ হাদীছে এসেছে যে, সপ্তম হিজরীর রামাযান মাসে জুহায়না গোত্রের বিরুদ্ধে তিনি একটি ক্ষুদ্র সেনাদলের সাথে প্রেরিত হন। তখন তাঁর বয়স ছিল অনধিক ১৬ বছর। শত্রুপক্ষ পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের এক ব্যক্তি তার সামনে পড়ে যায় ও দ্রুত লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে। এটা তার চালাকি ভেবে তিনি তাকে হত্যা করে ফেলেন। পরে এ খবর শুনে রাসূল (ছাঃ) ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বলেন, أَفَلاَ شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ حَتَّى تَعْلَمَ أَقَالَهَا أَمْ لاَ؟ وَكَيْفَ تَصْنَعُ بِلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ إِذَا جَاءَتْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ ‘সে সত্যভাবে বলেছে কি-না তা জানার জন্য তুমি কেন তার হৃদয় ফেঁড়ে দেখলে না? ক্বিয়ামতের দিন যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এসে তোমার সামনে দাঁড়াবে, তখন তুমি কি করবে? একথা তিনি বারবার বলতে থাকেন (কঠিন পরিণতি বুঝানোর জন্য)’।[2] এই ঘটনার পর উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) কসম করেন যে, তিনি কোন মুসলিমের বিরুদ্ধে কখনোই যুদ্ধ করবেন না। সেকারণ তিনি আলী (রাঃ)-এর সময় উটের যুদ্ধে বা ছিফফীন যুদ্ধে যোগদান করেননি। হযরত সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)ও একই নীতির উপর ছিলেন। ইমাম কুরতুবী বলেন, فِيهِ دَلِيلٌ عَلَى تَرَتُّبِ الْأَحْكَامِ عَلَى الْأَسْبَابِ الظَّاهِرَةِ دُونَ الْبَاطِنَةِ এতে দলীল রয়েছে যে, বিধান প্রযোজ্য হবে বাহ্যিক বিষয়ের উপর, অন্তরের বিষয়ের উপর নয়’।[3]

উপরোক্ত হাদীছদ্বয়ে প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ব্যতীত কোন দল বা ব্যক্তি এককভাবে কারু বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ ঘোঘণা করতে পারে না। আর বাহ্যিক বিষয়ের উপরেই সিদ্ধান্ত হবে, কারু অন্তরের বিষয়ের উপর নয়।

[1]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১২, ‘ঈমান’ অধ্যায়।

[2]. আর-রাহীক্ব ৩৮৩ পৃঃ; মুসলিম হা/৯৬; আবুদাঊদ হা/২৬৪৩; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৪৫০।

[3]. বুখারী হা/৬৮৭২; ফাৎহুল বারী ১২/২০৪।

৩০
দণ্ডবিধি প্রয়োগ
ইসলামী হুদূদ বা দণ্ডবিধি সমূহ যে কেউ প্রয়োগ করতে পারে না। বরং এজন্য সর্বোচ্চ বৈধ কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে। আর তা হ’ল শারঈ আদালতের অভিজ্ঞ ও আল্লাহভীরু মুসলিম বিচারপতিগণ। যারা ইসলামী শরী‘আত অনুযায়ী ফায়ছালা দিবেন এবং দেশের শাসক তা কার্যকর করবেন। যদি কোন দেশে মুসলমানদের এরূপ কোন বৈধ শাসক না থাকে, তাহ’লে স্রেফ আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার-এর দাওয়াতই যথেষ্ট হবে। কেননা এটাই মুসলিম উম্মাহর প্রধান দায়িত্ব (আলে ইমরান ৩/১১০)। এতদ্ব্যতীত অন্যভাবে একে অপরের উপর উক্ত দন্ডবিধি প্রয়োগের কোন অবকাশ নেই। তাতে সমাজে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ বেশী হবে। সর্বোপরি ইসলাম থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিবে।

ইবনুল ‘আরাবী বলেন, মাল-সম্পদ ও অন্যান্য দাবী-দাওয়ার বিচার-ফায়ছালা অন্যেরা করতে পারে। কিন্তু দন্ডবিধি কার্যকর করার অধিকার কেবল শাসনকর্তার।[1]

অমুসলিম বা ধর্মনিরপেক্ষ দেশসমূহে মুসলিমদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী শাসন ও বিচার ব্যবস্থার জন্য পৃথক ইসলামী শারী‘আহ কাউন্সিল ও শারঈ আদালত থাকা আবশ্যক। যাতে মুসলিম নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে এবং তাদের মধ্যে বঞ্চনার ক্ষোভ ধূমায়িত না হয়।

[1]. কুরতুবী, মায়েদাহ ৪১ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য, ৬/১৭১ পৃঃ।

৩১
চরমপন্থী উদ্ভবের কারণ ও প্রতিকার
বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ইসলামের নামে চরমপন্থী দলসমূহ উদ্ভবের অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল সেইসব সরকারের চরমপন্থী আচরণসমূহ। গণতন্ত্রের নামে ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলি সচেতন ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনসমূহের উপর সর্বত্র নিষ্ঠুর দমননীতি চালাচ্ছে এবং ধার্মিক মুসলমানদেরকে তারা নিজেদের মনগড়া আইনে নির্যাতিত হতে বাধ্য করছে। যেমন প্রায় সকল মুসলিম দেশে সূদী অর্থনীতি চালু রয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের মুসলিম নাগরিকদের হারাম খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। দেশের আদালতগুলিতে ইহূদী-নাছারাদের তৈরী করা আইনে অথবা তাদের অনুকরণে সরকারের মনগড়া আইনে বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। এতে অধিকাংশেরই অন্যায় বিচারে জেল-ফাঁস হচ্ছে। ইসলামী বিচার ব্যবস্থা ও দন্ডবিধিসমূহকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ফলে সমাজবিরোধী ও দুর্নীতিবাজরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। অন্যদিকে দলবাজি রাজনীতির তিক্ত ফল হিসাবে যে যাকে প্রতিপক্ষ ভাবছে, তাকেই গুম, খুন, অপহরণ, পুলিশী নির্যাতন, মিথ্যা মামলা প্রভৃতি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও হাজতের নামে বছরের পর বছর ধরে নিরীহ নির্দোষ মানুষকে কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হচ্ছে। ক্ষমতায়নের নামে নারীকে পুরুষের পাশাপাশি বসানো হচ্ছে। সাথে সাথে স্বনির্ভরতার নামে তাদেরকে নির্মাণ শ্রমিক, শিল্প শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক প্রভৃতি অমানবিক ও ক্লেশকর কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। মুসলিম মেয়েদের পর্দা করা ফরয। অথচ তাদেরকে পর্দাহীনতায় উসকে দেওয়া হচ্ছে এবং ছেলেদের সঙ্গে সহশিক্ষায় ও সহকর্মকান্ডে বাধ্য করা হচ্ছে। এভাবে মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় অধিকার থেকে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে। অথচ ইসলামের বাইরে সবকিছুই হ’ল ‘জাহেলিয়াত’। যেসবের অনুসরণ করতে তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে মুসলমানদের মৌলিক অধিকারের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। আল্লাহ বলেন, أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُوْنَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوْقِنُوْنَ ‘তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধান কামনা করে? অথচ দৃঢ় বিশ্বাসীদের নিকটে আল্লাহর চাইতে বিধান দানে উত্তম আর কে আছে? (মায়েদাহ ৫/৫০)। অতএব ইসলামপন্থীদের চরমপন্থী বলার আগে গণতন্ত্রীদের আল্লাহদ্রোহিতা ও চরমপন্থী আচরণ বন্ধ করা আবশ্যক। সাথে সাথে নামধারী মুসলিম শাসকদের তওবা করে খাঁটি মুসলমান হওয়া প্রয়োজন। নইলে তারা আল্লাহর গযবের শিকার হবেন। যেখান থেকে বাঁচার কোন উপায় তাদের থাকবে না। তারা ইহকাল ও পরকাল দু’টিই হারাবেন।

৩২
মুমিনের করণীয়
এক্ষণে অমুসলিম বা ফাসেক মুসলিম উভয় সরকারের বিরুদ্ধে মুমিনের কর্তব্য হ’ল- (১) উত্তম পন্থায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করা।[1] (২) দেশে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য জনমত গঠন করা এবং বৈধপন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কেননা আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ আল্লাহ ঐ জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (রা‘দ ১৩/১১)। (৩) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা।[2] (৪) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা।[3] (৫) সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা।[4]

এভাবে সকল প্রকার বৈধ পন্থায় দেশে ইসলামী আইন ও বিধান প্রতিষ্ঠায় সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। যাতে সরকার ইসলামী দাবীর প্রতি নমনীয় হয়। কিন্তু কোন অবস্থাতেই আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকা যাবে না।

উল্লেখ্য যে, প্রতিষ্ঠিত কোন মুসলিম সরকারকে উৎখাতের কোন বৈধতা ইসলাম দেয়নি। এজন্য জিহাদ ও ক্বিতালের নামে সশস্ত্র বিদ্রোহ বা চরমপন্থী তৎপরতার কোন অনুমতি ইসলামে নেই। সাথে সাথে ব্যালটের নামে যে দলাদলির নির্বাচন ব্যবস্থা বর্তমানে চলছে, তা স্রেফ প্রতারণামূলক ও যবরদস্তিমূলক। এতে সমাজে বিভক্তি ও হিংসা-হানাহানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গণপ্রত্যাশা ও মানবাধিকার প্রতিনিয়ত পদদলিত হচ্ছে। এজন্য আল্লাহভীরু ও যোগ্য ব্যক্তিদের পরামর্শের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা এবং দল ও প্রার্থীবিহীন ইসলামী নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে জনমত গঠন করা সবচেয়ে যরূরী।

[1]. মুসলিম হা/৪৯, মিশকাত হা/৫১৩৭।

[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৬।

[3]. যেমন রাসূল (ছাঃ)-কে দাউস গোত্রের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করতে বলা হ’লে তিনি তাদের জন্য হেদায়াতের দো‘আ করে বলেন, اللهُمَّ اهْدِ دَوْسًا وَائْتِ بِهِمْ ‘হে আল্লাহ তুমি দাউস গোত্রকে হেদায়াত কর এবং তাদেরকে ফিরিয়ে আনো’। ছহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ক্বাস্তালানী বলেন, পরে দেখা গেল যে, অভিযোগকারী তুফায়েল বিন আমর ফিরে গিয়ে নিজ কওমকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তাতে তাদের শাসকসহ ৭০-৮০টি পরিবার মুসলমান হন ও ৭ম হিজরীতে খায়বরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হন। যার মধ্যে ছিলেন খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা দাওসী (রাঃ)। =(বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৫৯৯৬; বুখারী (দিল্লী ছাপা) ২/৬৩০ টীকা-১১)।

[4]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৮৯। যেমন ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে সংঘটিত রাজী‘ ও বি’রে মাঊনার হৃদয়বিদারক দু’টি ঘটনা, যেখানে যথাক্রমে ১০ জন ও ৭০ জন ছাহাবীকে শঠতার মাধ্যমে হত্যাকারী আযল ও ক্বারাহ এবং রে‘ল ও যাকওয়ান গোত্রগুলির বিরুদ্ধে রাসূল (ছাঃ) মাসব্যাপী কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ করেননি। এর জন্য কেউ কোন অনুযোগ করেনি বা রাসূল (ছাঃ)-কে ছেড়ে যায়নি।

৩৩
সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াতের ব্যাখ্যা
যেসব মুসলিম সরকার ইসলামী বিধান অনুযায়ী দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেনা বা যেসব আদালত তদনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা করেনা, তাদেরকে ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে তাদের হত্যা করার পক্ষে নিম্নের আয়াতটিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْكَافِرُوْنَ ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার বা শাসন করেনা, তারা কাফের’ (মায়েদাহ ৫/৪৪)। এর পরে ৪৫ আয়াতে রয়েছে ‘তারা যালেম’ ( فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ ) এবং ৪৭ আয়াতে রয়েছে, ‘তারা ফাসেক’ ( فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ )। একই অপরাধের তিন রকম পরিণতি : কাফের, যালেম ও ফাসেক।

এখানে ‘কাফের’ অর্থ ইসলাম থেকে খারিজ প্রকৃত ‘কাফের’ বা ‘মুরতাদ’ নয়। বরং এর অর্থ আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতাকারী কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি। কিন্তু চরমপন্থীরা এ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে মুসলিম সরকারকে প্রকৃত ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে এবং তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নামতে তরুণদের প্ররোচিত করে।

বিগত যুগে এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে চরমপন্থী ভ্রান্ত ফের্কা খারেজীরা চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ)-কে ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে তাঁকে হত্যা করেছিল। আজও ঐ ভ্রান্ত আক্বীদার অনুসারীরা বিভিন্ন দেশের মুসলিম বা অমুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যা বিশ্বব্যাপী ইসলামের শান্তিময় ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করছে। সম্ভবতঃ একারণেই রাসূল (ছাঃ) খারেজীদেরকে ‘জাহান্নামের কুকুর’ ( الْخَوَارِجُ كِلاَبُ النَّارِ ) বলেছেন।[1] মানাবী বলেন, এর কারণ হ’ল তারা ইবাদতে অগ্রগামী। কিন্তু অন্তরসমূহ বক্রতায় পূর্ণ। এরা মুসলমানদের কোন বড় পাপ করতে দেখলে তাকে ‘কাফের’ বলে ও তার রক্ত হালাল জ্ঞান করে। যেহেতু এরা আল্লাহর বান্দাদের প্রতি কুকুরের মত আগ্রাসী হয়, তাই তাদের কৃতকর্মের দরুণ জাহান্নামে প্রবেশকালে তারা কুকুরের মত আকৃতি লাভ করবে’।[2] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) এদেরকে ‘আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি’ ( شِرَارُ خَلْقِ اللهِ ) মনে করতেন। কেননা তারা কাফিরদের উদ্দেশ্যে বর্ণিত আয়াতগুলিকে মুসলিমদের উপরে প্রয়োগ করে থাকে’।[3] বস্ত্ততঃ উক্ত আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা সেটাই, যা ছাহাবায়ে কেরাম করেছেন। যেমন-

(১) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, مَنْ جَحَدَ مَا أَنْزَلَ اللهُ فَقَدْ كَفَرَ وَمَنْ أَقَرَّ بِهِ وَلَمْ يَحْكُمْ فَهُوَ ظَالِمٌ فَاسِقٌ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অস্বীকার করল সে কুফরী করল। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করল, কিন্তু সে অনুযায়ী বিচার করল না সে যালিম ও ফাসিক।[4] অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, لَيْسَ بِالْكُفْرِ الَّذِي يَذْهَبُونَ إِلَيْهِ إِنَّهُ لَيْسَ كُفْرًا يَنْقِلُ عَنِ الْمِلَّةِ، وَهُوَ كُفْرٌ دُوْنَ كُفْرٍ وَظُلْمٌ دُوْنَ ظُلْمٍ، وَفِسْقٌ دُوْنَ فِسْقٍ ‘তোমরা এ কুফরী দ্বারা যে অর্থ বুঝাতে চাচ্ছ, সেটা নয়। কেননা এটি ঐ কুফরী নয়, যা কোন মুসলমানকে ইসলামের গন্ডী থেকে বের করে দেয়। বরং এর দ্বারা বড় কুফরের নিম্নের কুফর, বড় যুলুমের নিম্নের যুলুম ও বড় ফিসকের নিম্নের ফিসক বুঝানো হয়েছে।[5]

(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ও হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, هِيَ عَامَّةٌ فِي كُلِّ مَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَالْيَهُودِ وَالْكُفَّارِ أَيْ مُعْتَقِدًا ذَلِكَ وَمُسْتَحِلاًّ لَهُ- فَأَمَّا مَنْ فَعَلَ ذَلِكَ وَهُوَ مُعْتَقِدٌ أَنَّهُ رَاكِبُ مُحَرَّمٍ فَهُوَ مِنْ فُسَّاقِ الْمُسْلِمِينَ، وَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ تَعَالَى إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ، وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ এটা মুসলিম, ইহূদী, কাফের সকল প্রকার লোকের জন্য সাধারণ হুকুম যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা করে না। অর্থাৎ যারা বিশ্বাসগতভাবে (আল্লাহর বিধানকে) প্রত্যাখ্যান করে এবং অন্য বিধান দ্বারা বিচার ও শাসন করাকে হালাল বা বৈধ মনে করে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি উক্ত কাজ করে, অথচ বিশ্বাস করে যে সে হারাম কাজ করছে, সে ব্যক্তি মুসলিম ফাসেকদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তার বিষয়টি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। তিনি চাইলে তাকে শাস্তি দিবেন, চাইলে তাকে ক্ষমা করবেন’ (কুরতুবী, মায়েদাহ ৪৪/আয়াতের তাফসীর)।

(৩) তাবেঈ বিদ্বান ইকরিমা, মুজাহিদ, আত্বা ও তাঊসসহ বিগত ও পরবর্তী যুগের আহলে সুন্নাত বিদ্বানগণের সকলে কাছাকাছি একই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।[6] এটাই হল ছাহাবী ও তাবেঈগণের ব্যাখ্যা। যারা হলেন আল্লাহর কিতাব এবং ইসলাম ও কুফর সম্পর্কে উম্মতের সেরা বিদ্বান ও সেরা বিজ্ঞ ব্যক্তি।

পরবর্তীরা এ ব্যাপারে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল চরমপন্থী। যারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে কাফের বলে ও তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী গণ্য করে এবং তার রক্ত হালাল মনে করে। এরা হ’ল প্রথম যুগের ভ্রান্ত ফের্কা ‘খারেজী’ ও পরবর্তী যুগে তাদের অনুসারী হঠকারী লোকেরা। আরেক দল এ ব্যাপারে চরম শৈথিল্যবাদ প্রদর্শন করে এবং কেবল হৃদয়ে বিশ্বাস অথবা মুখে স্বীকৃতিকেই পূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে করে। বস্ত্ততঃ এই দলের লোকসংখ্যাই সর্বদা বেশী। এরা পূর্ববর্তী ভ্রান্ত ফের্কা ‘মুর্জিয়া’ দলের অনুসারী। দু’টি দলই বাড়াবাড়ির দুই প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে।

আল্লাহ রহম করেছেন আহলেহাদীছগণের উপরে, যারা সকল বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত এবং সর্বদা মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকেন। তারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে কাফের বা পূর্ণ মুমিন বলেন না। বরং তাকে ফাসেক বা গোনাহগার মুমিন বলেন ও তাকে তওবা করে পূর্ণ মুমিন হওয়ার সুযোগ দেন। রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ যে ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে, তাদের মধ্যে ৭২ ফের্কাই জাহান্নামী হবে এবং মাত্র একটি ফের্কা শুরুতেই জান্নাতী হবে। তারা হ’লেন ভাগ্যবান সেইসব মুমিন, যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের তরীকার উপর দৃঢ় থাকবেন।[7]

ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী, তদীয় উস্তাদ আলী ইবনুল মাদীনী, ইয়াযীদ বিন হারূণ, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকসহ মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ বিদ্বানমন্ডলীর ঐক্যমতে তারা হ’লেন ‘আহলুল হাদীছ’ এবং তারাই হ’লেন ফির্কা নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল।[8] আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন-আমীন!

উল্লেখ্য যে, ‘আহলেহাদীছ’ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। কালেমা পাঠকারী সকলে ‘মুসলিম’ হলেও সকলে ‘আহলেহাদীছ’ নয়। কারণ সকলের মধ্যে আহলেহাদীছের মধ্যপন্থী বৈশিষ্ট্য নেই এবং নিঃশর্তভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার প্রতিজ্ঞা নেই।

(৪) আববাসীয় খলীফা মামূন (১৯৮-২১৮ হিঃ)-এর দরবারে জনৈক ‘খারেজী’ এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, কোন্ বস্ত্ত তোমাদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে? জবাবে সে বলল, আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত। তিনি বললেন, সেটি কোন আয়াত? সে বলল, সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াত। খলীফা বললেন, তুমি কি জানো এটি আল্লাহর নাযিলকৃত? সে বলল, জানি। খলীফা বললেন, এ বিষয়ে তোমার প্রমাণ কি? সে বলল, উম্মতের ঐক্যমত (ইজমা)। তখন খলীফা তাকে বললেন, তুমি যেমন আয়াত নাযিলের ব্যাপারে ইজমার উপরে খুশী হয়েছ, তেমনি উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়ও উম্মতের ইজমার উপরে সন্তুষ্ট হও’। সে বলল, আপনি সঠিক কথা বলেছেন। অতঃপর সে খলীফাকে সালাম দিয়ে বিদায় হ’ল’।[9]

(৫) সঊদী আরবের সাবেক প্রধান মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন বা বিচার করেনা, সে ব্যক্তি চারটি বিষয় থেকে মুক্ত নয় : (১) তার বিশ্বাস মতে মানুষের মনগড়া আইন আল্লাহর আইনের চাইতে উত্তম। অথবা (২) সেটি শারঈ বিধানের ন্যায়। অথবা (৩) শারঈ বিধান উত্তম, তবে এটাও জায়েয। এরূপ বিশ্বাস থাকলে সে কাফির এবং মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হয়ে যাবে। কিন্তু (৪) যদি সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য কোন বিধান বৈধ নয়। তবে সে অলসতা বা উদাসীনতা বশে বা পরিস্থিতির চাপে এটা করে, তাহ’লে সেটা ছোট কুফরী হবে ও সে কবীরা গোনাহগার হবে। কিন্তু মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হবে না’।[10]

যেমন হাবশার (ইথিওপিয়া) বাদশাহ নাজাশী ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং সে মর্মে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত দূতের নিকট তিনি বায়‘আত নিয়েছিলেন ও পত্র প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু দেশের নাগরিকগণ খ্রিষ্টান হওয়ায় তিনি নিজ দেশে ইসলামী বিধান চালু করতে পারেননি। এজন্য তিনি দায়ী ছিলেন না। বরং পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছিল। সেকারণ ৯ম হিজরীতে তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণকে নিয়ে তার গায়েবানা জানাযা পড়েন।[11] কারণ অমুসলিম দেশে তাঁর জানাযা হয়নি।[12]

(৬) শায়খ নাছেরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, কুফর, যুলুম, ফিসক সবগুলিই বড় ও ছোট দু’প্রকারের। যদি কেউ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা না করে, সূদী লেন-দেন, যেনা-ব্যভিচার বা অনুরূপ স্পষ্ট হারামগুলিকে হালাল জ্ঞান করে, সে বড় কাফের, যালেম ও ফাসেক হবে। আর বৈধ জ্ঞান না করে পাপ করলে সে ছোট কাফের, যালেম ও ফাসেক হবে ও মহাপাপী হবে’।[13] যা তওবা ব্যতীত মাফ হবে না।

[1]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৩, সনদ ছহীহ।

[2]. মানাবী, ফায়যুল ক্বাদীর শরহ ছহীহুল জামে‘ আছ-ছাগীর (বৈরূত : ১ম সংস্করণ ১৪১৫/১৯৯৪) ৩/৫০৯ পৃঃ।

[3]. ফাৎহুল বারী ৮৮ অধ্যায় ৬ অনুচ্ছেদ-এর তরজুমাতুল বাব, হা/৬৯৩০-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[4]. ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর, উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য; তাহকীক দ্রষ্টব্য : খালেদ আল-আম্বারী, উছূলুত তাকফীর পৃঃ ৬৪; ৭৫-৭৬ টীকাসমূহ।

[5]. হাকেম হা/৩২১৯, ২/৩১৩, সনদ ছহীহ; তিরমিযী হা/২৬৩৫।

[6]. সালাফ ও খালাফের ৩৯ জন বিদ্বানের ফৎওয়া দ্রষ্টব্য; উছূলুত তাকফীর ৬৪-৭৪ পৃঃ।

[7]. তিরমিযী হা/২৬৪১, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; মিশকাত হা/১৭১-১৭২।

[8]. খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ ও অন্যান্য; আলবানী, ছহীহাহ হা/২৭০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[9]. খত্বীব, তারীখু বাগদাদ ১০/১৮৬; যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১০/২৮০।

[10]. খালেদ আল-আম্বারী, উছূলুত তাকফীর (রিয়াদ : ৩য় সংস্করণ, ১৪১৭ হিঃ) ৭১-৭২।

[11]. আর-রাহীকুল মাখতূম ৩৫২ পৃঃ; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫২ ‘জানায়েয’ অধ্যায়।

[12]. আবুদাঊদ হা/৩২০৪ ‘জানায়েয’ অধ্যায় ৬২ অনুচ্ছেদ।

[13]. উছূলুত তাকফীর, ৭৪ পৃঃ।

৩৪
কাফের বলার দলীল হিসাবে আরও কয়েকটি আয়াত
সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াতটি ছাড়াও আরও কয়েকটি আয়াতকে মুসলমানকে ‘কাফের’ বলার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করা হয়। যেমন- সূরা নিসা ৬৫, তওবা ৩১, শূরা ২১ ও আন‘আম ১২১ প্রভৃতি।

(১) নিসা ৬৫। আল্লাহ বলেন, فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে’)।

সাইয়িদ কুতুব অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন ‘তাগূতের অনুসারী ঐসব লোকেরা ‘ঈমানের গন্ডী থেকে বেরিয়ে যাবে। মুখে তারা যতই দাবী করুক না কেন’।[1] অথচ ‘তারা মুমিন হতে পারবে না’ ( لاَ يُؤْمِنُوْنَ ) -এর প্রকৃত অর্থ হবে, ‘তারা পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না’ ( لاَ يَسْتَكْمِلُوْنَ الْإِيْمَانَ )। কারণ উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল দু’জন মুহাজির ও আনছার ছাহাবীর পরস্পরের জমিতে পানি সেচ নিয়ে ঝগড়া মিমাংসার উদ্দেশ্যে।[2] দু’জনই ছিলেন বদরী ছাহাবী এবং দু’জনই ছিলেন স্ব স্ব জীবদ্দশায় ক্ষমাপ্রাপ্ত ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। অতএব তাদের কাউকে মুনাফিক বা কাফির বলার উপায় নেই। কিন্তু চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আপন্থী মুফাসসিরগণ তাদের ‘কাফের’ বলায় প্রশান্তি বোধ করে থাকেন। তারা আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ নিয়েছেন ও সকল কবীরা গোনাহগারকে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেছেন। অথচ তারা আরবীয় বাকরীতি এবং হাদীছের প্রতি লক্ষ্য করেননি। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ . قِيلَ وَمَنْ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ الَّذِى لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايِقَهُ . ‘আল্লাহর কসম! ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় (৩ বার), যার প্রতিবেশী তার অনিষ্টকারিতা হতে নিরাপদ নয়’।[3] তিনি বলেন, وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ يُؤْمِنُ عَبْدٌ حَتَّى يُحِبَّ لِجَارِهِ أَوْ قَالَ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ . ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটা ভালবাসবে যা সে তার নিজের জন্য ভালবাসে’।[4] এসব হাদীছের অর্থ ঐ ব্যক্তি ঈমানহীন কাফের নয়, বরং পূর্ণ মুমিন নয়। একইভাবে কবীরা গোনাহগার মুমিন ‘কাফের’ হবে না বরং সে ‘পূর্ণ মুমিন’ হবে না।

(২) তওবা ৩১। আল্লাহ বলেন, اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ (‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের এবং মারিয়াম পুত্র মসীহ ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে। অথচ তাদের প্রতি কেবল এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র এক উপাস্যের ইবাদত করবে। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তারা যাদেরকে শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি সে সব থেকে পবিত্র’)।

অত্র আয়াতের তাফসীরে সাইয়িদ কুতুব বলেছেন, ‘এরা মুশরিক এবং তা ঐ শিরক, যা তাদেরকে মুমিনদের গন্ডী থেকে বের করে কাফিরদের গন্ডীতে প্রবেশ করাবে’।[5] অথচ এর ব্যাখ্যায় প্রায় সকল মুফাসসির বলেছেন যে, তারা তাদেরকে প্রকৃত ‘রব’ ভাবত না। বরং তাদের অন্যায় আদেশ-নিষেধসমূহ মান্য করত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ও যাহহাক বলেন, أَنَّهُمْ لَمْ يَأمُرُوْهُمْ أَنْ يَّسْجُدُوْا لَهُمْ وَلَكِنْ أَمَرُوْهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ فَأَطَاعُوْهُمْ فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَالِكَ أَرْبَابًا - ‘ইহূদী-নাছারাদের সমাজ ও ধর্মনেতাগণ তাদেরকে সিজদা করার জন্য বলেননি। বরং তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজে লোকদের হুকুম দিতেন এবং তারা তা মান্য করত। আর সেজন্যই আল্লাহ পাক ঐসব আলেম, সমাজনেতা ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’।[6] হযরত হুযায়ফা (রাঃ)ও অনুরূপ বলেন (কুরতুবী)।

ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, যদি কেউ আক্বীদাগত ভাবে হারামকে হালাল করায় বিশ্বাসী হয়, তবে সে কাফের হবে। কিন্তু যদি আক্বীদাগতভাবে এতে বিশ্বাসী না হয়। কিন্তু গোনাহের আনুগত্য করে, তবে সে কবীরা গোনাহগার হবে। এমনকি হারামকে হালালকারী ব্যক্তি যদি মুজতাহিদ হয় এবং তার কাছে উক্ত বিষয়ে সত্য অস্পষ্ট থাকে এবং সে আল্লাহকে সাধ্যমত ভয় করে, তবে সে ব্যক্তি তার গোনাহের জন্য আল্লাহর নিকট পাকড়াও হবে না’। তিনি বলেন, কুরআন ও হাদীছে বহু গোনাহের ক্ষেত্রে এরূপ কুফর ও শিরকের শব্দ বর্ণিত হয়েছে’।[7] বস্ত্ততঃ এটাই হল সঠিক ব্যাখ্যা। যা আহলেসুন্নাত বিদ্বানগণের নিকটে গৃহীত।

(৩) শূরা ২১। আল্লাহ বলেন, أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ وَلَوْلاَ كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِيْنَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘তাদের কি এমন কিছু শরীক আছে যারা তাদের জন্য দ্বীনের কিছু বিধান প্রবর্তন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? ক্বিয়ামতের দিন তাদের বিষয়ে ফায়ছালার সিদ্ধান্ত না থাকলে এখুনি তাদের নিষ্পত্তি হয়ে যেত। নিশ্চয়ই যালেমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (শূরা ৪২/২১)।

উক্ত আয়াতে একথা বর্ণিত হয়েছে যে, আইন প্রণয়নের অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। যার কোন শরীক নেই। এক্ষণে যদি কেউ তাতে ভাগ বসায় এবং নিজেরা আইন রচনা করে, তাহ’লে সে মুশরিক হবে। শিরকের উক্ত প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করেছেন খারেজী আক্বীদার অনুসারী মুফাসসিরগণ। ফলে যেসব মুসলিম সরকার কোন একটি আইনও রচনা করেছে, যা আল্লাহর আইনের অনুকূলে নয়, তাদেরকে তারা মুশরিক ও মুরতাদ ধারণা করেছেন এবং তাদেরকে হত্যা করা সিদ্ধ মনে করেছেন। অথচ পূর্বের আয়াতগুলির ন্যায় এ আয়াতের অর্থ তারা প্রকৃত মুশরিক নয়, বরং কবীরা গোনাহগার। কেননা এর প্রকৃত অর্থ আল্লাহর ইবাদতে শরীক করা নয়। বরং জিন ও ইনসানরূপী শয়তানরা হালাল ও হারামের যেসব বিধান রচনা করে, সে সবের অনুসরণ করা। কোন সরকার এগুলি করলে এবং আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে সেটাকে উত্তম, সমান অথবা সিদ্ধ মনে করলে ঐ সরকার স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হবে। কিন্তু তা মনে না করলে সে কবীরা গোনাহগার হবে। ইবনু জারীর, ইবনু কাছীরসহ আহলে সুন্নাতের সকল বিদ্বান এরূপ তাফসীর করেছেন।

(৪) আন‘আম ১২১। আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوْهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُوْنَ ‘যে সব পশু যবেহকালে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি, তা তোমরা ভক্ষণ করো না। নিশ্চয়ই সেটি ফাসেকী কাজ। শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের মনে কুমন্ত্রণা প্রবেশ করিয়ে দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করে। এক্ষণে যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তাহ’লে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/১২১)।

এখানেও পূর্বের ন্যায় প্রকাশ্য অর্থে মুশরিক ও কাফির অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন সাইয়েদ কুতুব বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ছোট একটি প্রশাখাগত বিষয়েও মানুষের রচিত আইনের অনুসরণ করবে, ঐ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ‘মুশরিক’ হবে। যদিও সে আসলে ‘মুসলমান’। অতঃপর তার কাজ তাকে ইসলাম থেকে শিরকের দিকে বের করে নিয়ে গেছে। যদিও সে মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্য দান অব্যাহত রাখে। কেননা ইতিমধ্যেই সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সাথে মিলিত হয়েছে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের আনুগত্য করেছে’।[8]

[1]. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন, ২/৮৯৫।-

فما يمكن أن يجتمع الإيمان، وعدم تحكيم شريعة الله، أو عدم الرضى بحكم هذه الشريعة . والذين يزعمون لأنفسهم أو لغيرهم أنهم «مؤمنون» ثم هم لا يحكمون شريعة الله في حياتهم، أو لا يرضون حكمها إذا طبق عليهم .. إنما يدعون دعوى كاذبة وإنما يصطدمون بهذا النص القاطع : «وَما أُولئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ» . فليس الأمر في هذا هو أمر عدم تحكيم شريعة الله من الحكام فحسب بل إنه كذلك عدم الرضى بحكم الله من المحكومين، يخرجهم من دائرة الإيمان، مهما ادعوه باللسان -

[2]. বুখারী হা/২৩৫৯; মুসলিম হা/২৩৫৭ ও অন্যান্য।

[3]. বুখারী হা/৬০১৬; মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬২ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ১৫ অনুচ্ছেদ।

[4]. বুখারী, মুসলিম হা/৪৫; মিশকাত হা/৪৯৬১।

[5]. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ৩/১৬৪২।-

فقد حكم الله سبحانه- عليهم بالشرك في هذه الآية- وبالكفر في آية تالية في السياق- لمجرد أنهم تلقوا منهم الشرائع فأطاعوها واتبعوها .. فهذا وحده- دون الاعتقاد والشعائر- يكفي لاعتبار من يفعله مشركاً بالله، الشرك الذي يخرجه من عداد المؤمنين ويدخله في عداد الكافرين -

[6]. তাফসীর ইবনু জারীর (বৈরূত ছাপা : ১৯৮৬), ১০/৮০-৮১ পৃঃ।

[7]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ঈমান (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় সংস্করণ ১৪০৮/১৯৮৮) পৃঃ ৬৭, ৬৯।

[8]. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন, আন‘আম ১২১ আয়াতের তাফসীর, ৩/১১৯৮ পৃঃ।-

من أطاع بشراً في شريعة من عند نفسه، ولو في جزئية صغيرة ، فإنما هو مشرك . وإن كان في الأصل مسلما ثم فعلها فإنما خرج بها من الإسلام إلى الشرك أيضاً . مهما بقي بعد ذلك يقول : أشهد أن لا إله إلا الله بلسانه . بينما هو يتلقى من غير الله، ويطيع غير الله -

৩৫
নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য
মুসলিম সরকারকে ‘কাফির’ বলা ছাড়াও এইসব মুফাসসিরগণ নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল ‘রাষ্ট্র কায়েম করা ও শাসনক্ষমতা দখল করা’ বলে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অপব্যাখ্যা করেছেন। যেমন,

(ক) শূরা ১৩। আল্লাহ বলেন, شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسَى وَعِيْسَى أَنْ أَقِيْمُوا الدِّينَ وَلاَ تَتَفَرَّقُوا فِيْهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِيْنَ مَا تَدْعُوْهُمْ إِلَيْهِ اللهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيْبُ ‘তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন সেই দ্বীন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমরা প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি ও যার আদেশ দিয়েছিলাম আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর ও তার মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। তুমি মুশরিকদের যে বিষয়ের দিকে আহবান কর, তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং তিনি পথ প্রদর্শন করেন ঐ ব্যক্তিকে, যে তাঁর দিকে প্রণত হয়’ (শূরা ৪২/১৩)।

অত্র আয়াতে বর্ণিত ‘আক্বীমুদ্দীন’ ( أَقِيْمُوا الدِّينَ ) অর্থ ‘তোমরা তাওহীদ কায়েম কর’। নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলকে আল্লাহ একই নির্দেশ দিয়েছিলেন। সকল মুফাসসির এই অর্থই করেছেন। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ ‘নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং ত্বাগূতকে বর্জন করো’ (নাহল ১৬/৩৬)। যার দ্বারা ‘তাওহীদে ইবাদত’ বুঝানো হয়েছে।

কিন্তু তারা অর্থ করেছেন ‘তোমরা হুকূমত কায়েম করো’। এর পক্ষে তারা একটি হাদীছেরও অপব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ، كُلَّمَا هَلَكَ نَبِىٌّ خَلَفَهُ نَبِىٌّ ‘নিশ্চয়ই বনু ইস্রাঈলকে পরিচালনা করতেন নবীগণ। যখন একজন নবী মারা যেতেন, তখন তার স্থলে আরেকজন নবী আসতেন’।[1]

এখানে تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ -এর অর্থ তারা করেছেন ‘নবীগণ বনু ইস্রাঈলদের মধ্যে রাজনীতি করতেন’। অর্থাৎ নবীগণ সবাই তাদের মত ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করেছেন। অতএব আমাদেরও সেটা করতে হবে। অথচ নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلاَّ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ فَمَنْ آمَنَ وَأَصْلَحَ فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ ‘আমরা নবীগণকে স্রেফ এজন্যই প্রেরণ করে থাকি যে, তারা (ঈমানদারগণকে জান্নাতের) সুসংবাদ দিবে ও (মুশরিকদের জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শন করবে। অতএব যে ব্যক্তি ঈমান আনে ও নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না’ (আন‘আম ৬/৪৮)। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তাকে বলতে বলেছেন, قُلْ لاَ أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَاءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلاَّ نَذِيرٌ وَبَشِيْرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُوْنَ ‘তুমি বল, যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমি আমার নিজের কোন কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক নই। যদি আমি অদৃশ্যের খবর রাখতাম, তাহ’লে আমি অধিক কল্যাণ অর্জন করতাম এবং কোনরূপ অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করত না। আমি বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য একজন ভয় প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদ দানকারী মাত্র’ (আ‘রাফ ৭/১৮৮)। আর মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব হ’ল ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার’। অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা (আলে ইমরান ৩/১১০)। যা সর্বাবস্থায় মুমিন করবে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী। এজন্য তাকে ইসলামী রাজনীতির নামে পৃথকভাবে কোন রাজনীতি করার প্রয়োজন হবে না বা ক্ষমতা দখল করতে হবে না। আর আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার-এর উদ্দেশ্য হবে মানুষকে শিরকের কলুষ-কালিমা থেকে পবিত্র করে আল্লাহর অনুগত বানানোর চেষ্টা করা। যেমন আল্লাহ শেষনবীকে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ بَعَثَ فِيْهِمْ رَسُولاً مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُبِيْنٍ ‘বিশ্বাসীদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদের নিকট তাদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনান ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত (কুরআন ও সুন্নাহ) শিক্ষা দেন। যদিও তারা ইতিপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল’(আলে ইমরান ৩/১৬৪; জুমু‘আহ ৬২/২)।

এতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যুগে যুগে নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল আখেরাতভোলা মানুষকে আখেরাতে সাফল্য লাভের পথ দেখানো। তাদেরকে নেকীর কাজে উৎসাহিত করা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা। রাসূলগণ ক্ষমতার লোভে রাজনীতি করতে দুনিয়ায় আসেননি। বরং তাদের কাজই ছিল ‘তাবশীর ও ইনযার’ তথা জান্নাতের সুসংবাদ শুনানো ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করা। আর এজন্য তাঁদের কর্মপদ্ধতি ছিল ‘তারবিয়াহ ও তাযকিয়াহ’ অর্থাৎ পরিচর্যা করা ও পাপ থেকে পরিশুদ্ধ করা। আজও মুমিনের কর্মপদ্ধতি সেটাই থাকবে। আর এটাই হ’ল সর্বোত্তম পদ্ধতি। যা রাসূল (ছাঃ) প্রতি খুৎবাতে বলতেন, ( وَخَيْرَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ ) ‘শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত’।[2]

অথচ প্রতি খুৎবায় ও ভাষণে ইসলামী নেতারা এ হাদীছ পাঠ করা সত্ত্বেও তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর শ্রেষ্ঠ হেদায়াত বাদ দিয়ে ইহূদী-নাছারাদের প্রতারণাপূর্ণ তন্ত্র-মন্ত্রের অনুসারী হয়েছেন। আর তাকেই তাঁরা বলছেন ‘ইসলামী রাজনীতি’। এভাবে তাঁরা হারামকে হালাল করেছেন পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে। অথচ উচিৎ ছিল প্রচলিত বাতিল মতবাদসমূহের বিরুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া হেদায়াতকে প্রতিষ্ঠা দানের জন্য জান-মাল বাজি রেখে প্রচেষ্টা চালানো ও জনগণকে সেদিকে পথ দেখানো। নবীগণ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে দ্বীন কায়েম করেননি। বরং আল্লাহর পথে দাওয়াতের মাধ্যমেই দ্বীন কায়েমের কাজ শুরু করেছিলেন। আমাদেরকেও সেইভাবে কাজ করতে হবে। জনৈক দাঈ-র ভাষায়, أَقِيْمُوا دَوْلَةَ الْإِسْلاَمِ فِى قُلُوْبِكُمْ، تَقُمْ لَكُمْ عَلَى أَرْضِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলাম কায়েম করো, তাহ’লে তোমাদের মাটিতে ইসলাম কায়েম হবে’। কেননা আক্বীদা পরিচ্ছন্ন না হ’লে কখনো আমল পরিচ্ছন্ন হবে না।

(খ) হাদীদ ২৫। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيْهِ بَأْسٌ شَدِيْدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ ‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণাদি সহকারে এবং তাদের সঙ্গে নাযিল করেছি কিতাব ও ন্যায়দন্ড। যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আর আমরা লৌহ নাযিল করেছি যার মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড শক্তি ও রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। যাতে আল্লাহ জেনে নিতে পারেন কে তাকে ও তার রাসূলদেরকে না দেখেও সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা শক্তিমান ও পরাক্রমশালী’ (হাদীদ ৫৭/২৫)।

খারেজীপন্থী মুফাসসিরগণ এখানে ‘লৌহ’ অর্থ করেছেন ‘Authority’ বা ‘শাসনশক্তি’। কেননা তাদের মতে ‘শাসনক্ষমতা প্রয়োগ ছাড়া মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়’। অথচ রাসূলগণ কেউই শাসনক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেননি। বরং তাঁরা হিকমত ও নছীহতের মাধ্যমেই সমাজ সংশোধন করেছেন। আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলী, হামযা কেউই অস্ত্রের ভয়ে বা শাসনশক্তির ভয়ে মুসলমান হননি।

কুরআনের এইরূপ অপব্যাখ্যার কারণেই দেখা যায় এইসব চরমপন্থী ও ক্ষমতালোভী দলের লোকেরা সর্বত্র ক্ষমতা পাবার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। এমনকি মসজিদ-মাদরাসার কমিটি দখল এবং ইমাম-মুওয়াযযিন ও শিক্ষক নিয়োগেও তাদের অপতৎপরতা সকলের চোখে পড়ে। ছালাত-ছিয়ামের ফরয ইবাদতকেও এরা ‘মুবাহ’ বলে থাকে। যা আদায় করলে নেকী আছে, না করলে গোনাহ নেই। কারণ তাদের মতে ‘সব ফরযের বড় ফরয’ হ’ল শাসনক্ষমতা দখল করা। সেটা কায়েম না থাকায় তাদের মতে ‘কোন ফরযই বাস্তবে ফরযের পজিশনে নেই। বরং ‘মুবাহ’ অবস্থায় আছে’। তারা তাদের দলের বাইরে কাউকে উদারভাবে ভালবাসতে পারে না। এমনকি কারু সাথে সরল মনে সালাম-মুছাফাহা করতে পারে না। কারণ অন্যেরা তাদের দৃষ্টিতে হয় কাফির নয় ইহূদী। হা-শা ওয়া কাল্লা।

বস্ত্ততঃ এই ধরনের খারেজী তাফসীর বহু যুবকের পথভ্রষ্টতার কারণ হয়েছে। তারা অবলীলাক্রমে মুসলিম সরকার ও সমাজকে কাফের ভাবছে ও তাদেরকে বোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, মুশরিকের আনুগত্য করলে মুমিন তখনই মুশরিক হবে, যখন বিশ্বাসগতভাবে সেটা করবে। কিন্তু যখন কর্মগতভাবে করবে, অথচ তার হৃদয় ঈমানে স্বচ্ছ থাকবে, তখন সে মুশরিক বা কাফির হবে না। বরং গোনাহগার হবে’।[3]

বস্ত্ততঃ অন্তর থেকে কালেমা শাহাদাত পাঠকারী কোন মুমিন কবীরা গোনাহের কারণে কাফের হয় না। এটিই হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের সর্বসম্মত আক্বীদা।

[1]. বুখারী হা/৩৪৫৫ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়, ৫০ অনুচ্ছেদ।

[2]. মুসলিম হা/৮৬৭; মিশকাত হা/১৪১।

[3]. কুরতুবী, আন‘আম ১২১ আয়াতের তাফসীর।-

قَالَ ابْنُ الْعَرَبِيِّ : إِنَّمَا يَكُونُ الْمُؤْمِنُ بِطَاعَةِ الْمُشْرِكِ مُشْرِكًا إِذَا أَطَاعَهُ فِي الِاعْتِقَادِ، فَأَمَّا إِذَا أَطَاعَهُ فِي الْفِعْلِ وَعَقْدُهُ سَلِيمٌ مُسْتَمِرٌّ عَلَى التَّوْحِيدِ وَالتَّصْدِيقِ فَهُوَ عَاصٍ -

৩৬
কুফরের প্রকারভেদ (أنواع الكفر)
উপরোক্ত আলোচনায় বুঝা গেল যে, কুফর দু’প্রকার : (১) বিশ্বাসগত কুফরী ( كفر اعتقادى ) যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। (২) কর্মগত কুফরী ( كفر عملى ) যা খারিজ করে দেয় না। তবে সে মহাপাপী হয়, যা তওবা ব্যতীত মাফ হয় না। প্রথমটি বড় কুফর ( كفر اكبر ) এবং দ্বিতীয়টি ছোট কুফর ( كفر اصغر )।

৩৭
বড় কুফরের উদাহরণ
আল্লাহ বলেন, (১) هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ‘তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় ‘কাফির’ ও কেউ হয় ‘মুমিন’। আর তোমরা যা কর, সবই আল্লাহ দেখেন’ (তাগাবুন ৬৪/২)। (২) قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ- لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ ‘তুমি বল, হে কাফিরগণ! আমি ইবাদত করি না যাদের তোমরা ইবাদত কর’ (কাফিরূন ১০৯/১-২)। (৩) لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللهَ ثَالِثُ ثَلاَثَةٍ وَمَا مِنْ إِلَهٍ إِلاَّ إِلَهٌ وَاحِدٌ ‘নিশ্চয়ই তারা কুফরী করেছে, যারা বলে, আল্লাহ তিন উপাস্যের অন্যতম। অথচ এক উপাস্য ভিন্ন অন্য কোন উপাস্য নেই’... (মায়েদাহ ৫/৭৩)। (৪) وَمَنْ يَتَبَدَّلِ الْكُفْرَ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের বদলে কুফরীকে অবলম্বন করে, সে ব্যক্তি সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়’ (বাক্বারাহ ২/১০৮)। (৫) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ ِللهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِى الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِى النَّارِ ‘তিনটি বস্ত্ত যার মধ্যে রয়েছে, সে তার মাধ্যমে ঈমানের স্বাদ পেয়েছে। (ক) যার নিকটে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সকল কিছু হ’তে প্রিয়তর (খ) যে ব্যক্তি কাউকে স্রেফ আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং (গ) যে ব্যক্তি কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপসন্দ করে, যা থেকে আল্লাহ তাকে মুক্তি দিয়েছেন, যেমন সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হ’তে অপসন্দ করে।[1]

(৬) তিনি বলেন, কাফের যখন কোন সৎকর্ম করে, তার বিনিময়ে আল্লাহ তাকে দুনিয়ায় খাদ্য দান করেন। পক্ষান্তরে আল্লাহ মুমিনের নেকীসমূহ আখেরাতের জন্য জমা রাখেন’।[2] (৭) বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি বলেন, وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, ইহূদী হৌক বা নাছারা হৌক এই উম্মতের যে কেউ আমার আগমনের খবর শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার উপরে ঈমান আনেনি, সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।[3]

[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮।

[2]. মুসলিম হা/২৮০৮; মিশকাত হা/৫১৫৯।

[3]. মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০।

৩৮
বড় কুফর (الكفر الأكبر) ৬ প্রকার
(১) ইসলামে মিথ্যারোপ করা (নমল ২৭/৮৩-৮৪) (২) তাকে অস্বীকার করা (নমল ২৭/১৪; বাক্বারাহ ২/৮৯) (৩) ইসলামের বিরুদ্ধে হঠকারিতা করা (বাক্বারাহ ২/৩৪) (৪) এড়িয়ে চলা (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩-৫) (৫) সন্দেহ পোষণ করা (ইবরাহীম ১৪/৯) (৬) অন্তরে অবিশ্বাস রাখা ও মুখে স্বীকার করা (নিসা ৪/৬১)।

এগুলি তিনভাবে হয়ে থাকে : (১) বিশ্বাসগতভাবে। যেমন কাউকে আল্লাহ বা তাঁর গুণাবলীতে শরীক সাব্যস্ত করা বা অসীলা নির্ধারণ করা। আল্লাহর ইবাদতের ন্যায় অন্যকে সম্মান প্রদর্শন করা। আল্লাহর ন্যায় অন্যকে মঙ্গলামঙ্গলের অধিকারী মনে করা। আল্লাহর স্ত্রী-পুত্র নির্ধারণ করা। তাঁর কৃত হারামকে যেমন সূদ-ব্যভিচার, মদ্যপান প্রভৃতিকে হালাল জ্ঞান করা ইত্যাদি। (২) কথার মাধ্যমে। যেমন আল্লাহ বা তাঁর রাসূলকে বা ইসলামকে গালি দেওয়া, হেয় করা, উপহাস ও ব্যঙ্গ করা। কুরআন বা তার কোন আয়াতকে অস্বীকার বা তাচ্ছিল্য করা (তওবাহ ৯/৬৫)। (৩) কাজের মাধ্যমে। যেমন কবরে বা ছবি-মূর্তি ও প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করা, সূর্য বা চন্দ্রকে সিজদা করা (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৭)। পবিত্র কুরআনকে তাচ্ছিল্যভরে ছুঁড়ে ফেলা বা পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি।

যদি কেউ এগুলি জেনে-বুঝে করে এবং বারবার বুঝানো সত্ত্বেও তার ভ্রান্ত বিশ্বাসে অটল থাকে এবং তওবা না করে, তাহ’লে সে স্পষ্ট কাফির এবং ইসলাম থেকে খারিজ ও ‘মুরতাদ’ বলে গণ্য হবে।

উল্লেখ্য যে, মুনাফিকরা বড় কাফের হ’লেও তারা ‘মুরতাদ’ হবে না এবং তাদের উপর দন্ডবিধি জারি হবে না। কেননা তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামকে স্বীকার করে। তবে আখেরাতে তারা কাফেরদের সাথেই একত্রে জাহান্নামে থাকবে (নিসা ৪/১৪০)। বরং তারা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে (নিসা ৪/১৪৫)।

৩৯
বড় কুফরীর পরিণতি
(ক) আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِمْ مِلْءُ الْأَرْضِ ذَهَبًا وَلَوِ افْتَدَى بِهِ أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ ‘নিশ্চয়ই যারা অবিশ্বাসী হয়েছে এবং অবিশ্বাসী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের কারু কাছ থেকে যমীন ভর্তি স্বর্ণও গ্রহণ করা হবে না। যদি নাকি তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তির বিনিময়ে তা দিতে চায়’(আলে ইমরান ৩/৯১)।

(খ) তিনি বলেন, وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلاَمِ دِيْنًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার থেকে সেটি কবুল করা হবে না। আর সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। (গ) তিনি আরও বলেন, وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ ثُمَّ أَعْرَضَ عَنْهَا إِنَّا مِنَ الْمُجْرِمِينَ مُنْتَقِمُوْنَ ‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বড় যালেম আর কে আছে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াত সমূহ দ্বারা উপদেশ দেওয়া হয়েছে। অতঃপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? নিশ্চয়ই আমরা পাপীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী’ (সাজদাহ ৩২/২২)।

(ঘ) আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ্র দ্বীন থেকে ফিরে যায় এবং কাফের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়, তার ইহকালে ও পরকালে সকল কর্মই নিস্ফল হয়ে যায়। তারা জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২১৭)। (ঙ) তার দুনিয়াবী শাস্তি হ’ল মৃত্যুদন্ড। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ ‘যে মুসলমান তার দ্বীন পরিবর্তন করল, তাকে হত্যা কর’।[1] যা আদালতের মাধ্যমে সরকার কার্যকর করবে। না করলে ঐ সরকার কবীরা গোনাহগার হবে এবং আখেরাতে তাকে আল্লাহ্র নিকটে জওয়াবদিহি করতে হবে।

[1]. বুখারী হা/৬৯২২, তিরমিযী হা/২১৫৮; মিশকাত হা/৩৫৩৩, ৩৪৬৬।

৪০
ছোট কুফর (الكفر الأصغر)
যারা ঈমানের ছয়টি রুকন ও ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, ইসলামের সকল বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ বিশ্বাস পোষণ করে, হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মনে করে। এতদসত্ত্বেও অজ্ঞতা, উদাসীনতা ও অলসতাবশে কিংবা পরিস্থিতির চাপে কোন কবীরা গোনাহ করে, সে ব্যক্তি কর্মগত কাফের বা ছোট কাফের হবে। সে মুসলিম উম্মাহ থেকে বহিষ্কৃত হবে না। যেমন-

(১) আল্লাহ বলেন, وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ আর যদি মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহ’লে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দলটি বাড়াবাড়ি করবে, তার বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না সে দলটি আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি দলটি ফিরে আসে তাহলে তাদের মধ্যে ইনছাফের সাথে মীমাংসা কর এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালবাসেন’(হুজুরাত ৪৯/৯)।

আয়াতটি নাযিল হয়েছিল মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলের সাথে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাথী খাঁটি মুসলমানদের মধ্যে উভয়ের উপস্থিতিতে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া একটি লড়াইকে কেন্দ্র করে। যা রাসূল (ছাঃ)-এর দ্রুত হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়।[1] অত্র আয়াতে মুমিনদের মধ্যকার দু’দলের ( مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ ) মধ্যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কাউকে আল্লাহ ‘কাফের’ আখ্যায়িত করেন নি। যেমন খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা ও তাদের অনুসারীরা সুন্নীদের প্রতি করে থাকে।

(২) قَالَتِ الْأَعْرَابُ آمَنَّا قُلْ لَمْ تُؤْمِنُوا وَلَكِنْ قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوْبِكُمْ وَإِنْ تُطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ لاَ يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ - ‘বেদুঈনরা বলে, আমরা ঈমান আনলাম। বল, তোমরা ঈমান আনোনি। বরং তোমরা বল, আমরা ইসলাম কবুল করলাম। এখনো পর্যন্ত তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, তাহ’লে তিনি তোমাদের আমলসমূহের কোন কিছুই হরাস করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১৪)। অত্র আয়াতে বেদুঈনদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি বলা হলেও তাদেরকে ইসলামের গন্ডি থেকে বহিষ্কৃত বলা হয় নি। কারণ আল্লাহ ও রাসূলের যথাযথ আনুগত্য না করাটা ছিল তাদের কর্মগত কুফরী; বিশ্বাসগত কুফরী নয়।

(৩) একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিচ্ছিলেন। এসময় তাঁর নাতি হাসান বিন আলী মিম্বরের উপরে ছিলেন। তিনি এসময় একবার ঐ বাচ্চার দিকে ও একবার উপস্থিত মুছল্লীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, إِنَّ ابْنِى هَذَا سَيِّدٌ ، وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ‘নিশ্চয়ই আমার এ বেটা হ’ল নেতা। ভবিষ্যতে আল্লাহ এর মাধ্যমে মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে সন্ধি করে দিবেন’।[2]

উল্লেখ্য যে, হযরত আলী (রাঃ) খারেজীদের হাতে নিহত হওয়ার পর পুত্র হাসান (রাঃ) খলীফা হন। অতঃপর যুদ্ধ পরিহার করে পাঁচ মাসের মধ্যে তিনি আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর অনুকূলে খেলাফত ত্যাগ করেন এবং ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যেকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নিরসন করেন। অত্র হাদীছে রাসূল (ছাঃ) আলী ও মু‘আবিয়া উভয়ের সমর্থক দু’টি বড় দলকে ‘মুসলিম’ বলে ( فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ) অভিহিত করেছেন। কাউকে কাফের বলেননি। উল্লেখ্য যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে তাঁর সত্যনবী হওয়ার অকাট্য প্রমাণ লুকিয়ে রয়েছে।

(৪) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং পরস্পরে যুদ্ধ করা কুফরী’।[3]

(৫) তিনি বলেন, إِثْنَتَانِ فِى النَّاسِ هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ الطَّعْنُ فِى النَّسَبِ وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ দু’জন মানুষের মধ্যে কুফরী রয়েছে : অন্যের বংশ সম্পর্কে তাচ্ছিল্য করা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা’।[4]

(৬) مَنْ أَتَى كَاهِناً أَوْ عَرَّافاً فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ ‘যে ব্যক্তি গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে এলো এবং সে যা বলল তা বিশ্বাস করল, ঐ ব্যক্তি মুহাম্মাদ-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার সাথে কুফরী করল’।[5]

(৭) لاَ تَرْغَبُوا عَنْ آبَائِكُمْ ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ أَبِيهِ فَهُوَ كُفْرٌ ‘তোমরা তোমাদের বাপ-দাদা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। কেননা যে ব্যক্তি তার পিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, সে কুফরী করল’।[6]

(৮) مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ فَقَدْ كَفَرَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করল, সে কুফরী করল’।[7]

(৯) তিনি বলেন, ‘(মে‘রাজের সময়) আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়। সেখানে অধিকাংশকে আমি নারীদের মধ্য থেকে দেখেছি। জিজ্ঞেস করা হ’ল, তারা কি আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করেছে? জবাবে তিনি বললেন, তারা তাদের স্বামীদের সাথে কুফরী করেছে। তারা স্বামীদের অনুগ্রহকে অস্বীকার করে। তুমি তার সাথে বহুদিন যাবৎ ভাল ব্যবহার করলেও যখনই তোমার মধ্যে কিছু ত্রুটি দেখে তখনই তারা বলে, কখনো তোমার মধ্যে আমি ভাল কিছু দেখিনি।[8]

(১০) বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِى كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ আমার মৃত্যুর পরে তোমরা একে অপরের গর্দান উড়িয়ে দিয়ে পুনরায় কাফের হয়ে যেয়ো না’।[9]

উপরের আয়াত ও হাদীছগুলি সব কর্মগত কুফরীর উদাহরণ। অতএব যদি কোন সরকার আক্বীদাগতভাবে ইসলামে বিশ্বাসী হয়, কিন্তু কর্মগতভাবে ইসলামের কোন বিধান লংঘন করে, তাহ’লে উক্ত সরকার কবীরা গোনাহগার হবে, কিন্তু কাফের হবে না। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, যদি সরকার ইসলামবিরোধী আইনে খুশী থাকে ও তাতে বিশ্বাসী হয়, তাহ’লে উক্ত কর্মগত কুফরী বিশ্বাসগত কুফরীতে পরিণত হয়ে যাবে এবং তারা তখন প্রকৃত কাফের হবে’।[10] একই হুকুম ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

[1]. আহমাদ হা/১২৬২৮, বুখারী হা/২৬৯১, মুসলিম হা/১৭৯৯।

[2]. বুখারী হা/২৭০৪; মিশকাত হা/৬১৩৫।

[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮১৪।

[4]. মুসলিম হা/৬৭।

[5]. আহমাদ, ছহীহাহ হা/৩৩৮৭; মিশকাত হা/৫৫১।

[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৩১৫।

[7]. তিরমিযী হা/১৫৩৫, মিশকাত হা/৩৪১৯।

[8]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৮২, ‘চন্দ্র গ্রহণের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

[9]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫৩৭ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়, ৪ অনুচ্ছেদ।

[10]. মুহাম্মাদ বিন হুসায়েন আল-ক্বাহত্বানী, ফাতাওয়াল আয়েম্মাহ (রিয়াদ : ১৪২৪ হিঃ) ১৫৩ পৃঃ; ফিৎনাতুত তাকফীর ওয়াল হাকেমিয়াহ, পৃঃ ৩৫।

৪১
ত্বাগূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
‘ত্বাগূত’ ( الطاغوت ) অর্থ শয়তান, মূর্তি, প্রতিমা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে, الطاغوتُ هو أن يتحاكمَ الرجلُ إلي ما سِوَي الكتابِ والسنةِ من الباطلِ ‘কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে অন্য কোন বাতিলের কাছে ফায়ছালা তলব করা’। মূলতঃ এটি হ’ল মুনাফিকদের স্বভাব। যেমন আল্লাহ বলেন, أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلاَلاً بَعِيدًا- وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُوْدًا - ‘তুমি কি তাদের দেখোনি যারা ধারণা করে যে, তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে যা তোমার উপর নাযিল হয়েছে তার উপর এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল হয়েছে তার উপর। তারা ত্বাগূতের নিকট ফায়ছালা পেশ করতে চায়। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাকে অস্বীকার করার জন্য। বস্ত্ততঃ শয়তান তাদেরকে দূরতম ভ্রষ্টতায় নিক্ষেপ করতে চায়’। ‘যখন তাদেরকে বলা হয়, এসো আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে, তখন তুমি কপট বিশ্বাসীদের দেখবে তোমার থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিবে’ (নিসা ৪/৬০-৬১)।

এক্ষণে কোন মুসলিম সরকার যদি কুরআন ও সুন্নাহর বিধান বাদ দিয়ে নিজেদের মনগড়া বিধান অনুযায়ী দেশ শাসন করে, তবে সে সরকার মুনাফিক ও কবীরা গোনাহগার হবে। কিন্তু যদি সেটাকে আল্লাহর বিধানের চাইতে উত্তম বা সমান বা দু’টিই সিদ্ধ মনে করে ও তাতে খুশী থাকে, তাহ’লে উক্ত সরকার প্রকৃত ‘কাফের’ হিসাবে গণ্য হবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে কোন মুসলিম ব্যক্তি বা সরকার কাফের সাব্যস্ত হলেই তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা ফরয নয়। যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে (পৃঃ ৪৫)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا ‘যারা মুমিন তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে এবং যারা কাফের তারা লড়াই করে ত্বাগূতের পথে। অতএব তোমরা শয়তানের বন্ধুদের সাথে যুদ্ধ কর। নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল সর্বদা দুর্বল হয়ে থাকে’ (নিসা ৪/৭৬)।

এ আয়াত থেকে দলীল নিয়ে অনেকে কবীরা গোনাহগার সরকার ও অন্যান্যদের হত্যা করা সিদ্ধ মনে করেন। অথচ এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কেননা মুসলমানদের মধ্যে যারা ত্বাগূতের বন্ধু, তারা হ’ল মুনাফিক। যা উপরের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আর কাফেরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ হ’লেও মুনাফিকের বিরুদ্ধে তা হবে নিরস্ত্র। যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে (পৃঃ ৪১)।

৪২
আত্মঘাতী হামলা
জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ কিছু ব্যক্তি আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে জান্নাত কামনা করে। অথচ ইসলামে আত্মহত্যা করা মহাপাপ। যতবড় মহৎ উদ্দেশ্যেই তা হৌক না কেন। কেননা জীবন যিনি দিয়েছেন, তা হরণ করার অধিকার কেবল তাঁরই, অন্য কারু নয়। জিহাদের ময়দানে আহত হয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর জনৈক মুসলিম সৈনিক আত্মহত্যা করলে রাসূল (ছাঃ) তাকে ‘জাহান্নামী’ বলে আখ্যায়িত করেন। কেননা তার শেষ আমলটি ছিল জাহান্নামীদের আমল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ ফাসেক-ফাজেরদের মাধ্যমেও এই দ্বীনকে সাহায্য করে থাকেন’।[1] আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতীব দয়াশীল (নিসা ৪/২৯)।

[1]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪২০২-০৩।

৪৩
দ্বীন ধ্বংস করে তিনজন
(ক) যিয়াদ বিন হুদায়ের (রাঃ) বলেন, আমাকে একদিন হযরত ওমর ফারূক (রাঃ) বললেন, তুমি কি জানো কোন্ বস্ত্ত ইসলামকে ধ্বংস করে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, ইসলামকে ধ্বংস করে তিনটি বস্ত্ত : (১) আলেমের পদস্খলন (২) আল্লাহর কিতাব নিয়ে মুনাফিকদের ঝগড়া এবং (৩) পথভ্রষ্ট নেতাদের শাসন’।[1]

(খ) খ্যাতনামা তাবেঈ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) বলেন, وَهَلْ أَفْسَدَ الدِّيْنَ إِلاَّ الْمُلُوْكُ + وَأَحْبَارُ سُوْءٍ وَرُهْبَانُهَا؟ ‘দ্বীনকে ধ্বংস করে মাত্র তিনজন : অত্যাচারী শাসকবর্গ, দুষ্টমতি আলেমরা ও ছূফী পীর-মাশায়েখরা’।

প্রথমোক্ত লোকদের সামনে ইসলামী শরী‘আত ও রাজনীতি সাংঘর্ষিক হলে তারা রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দেয় ও শরী‘আতকে দূরে ঠেলে দেয়।

দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা তাদের রায়-ক্বিয়াস ও যুক্তির সঙ্গে শরী‘আত সাংঘর্ষিক হলে নিজেদের রায়কে অগ্রাধিকার দেয় এবং হারামকে হালাল করে।

তৃতীয় শ্রেণীর লোকেরা তাদের কথিত কাশ্ফ ও রুচির বিরোধী হ’লে শরী‘আতের প্রকাশ্য হুকুম ত্যাগ করে ও কাশফকে অগ্রাধিকার দেয়।[2]

[1]. দারেমী হা/২১৪, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/২৬৯; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/২৫১।

[2]. শরহ আক্বীদা ত্বাহাভিয়া (বৈরূত ছাপা : ১৪০৪/১৯৮৪) ২০৪ পৃঃ।

৪৪
হকপন্থী দল
(ক) হযরত ছওবান (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন,

لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَالِكَ -

‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[1] এখানে ‘বিজয়ী’ অর্থ আখেরাতে বিজয়ী।

(খ) হযরত ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِّنْ أُمَّتِىْ يُقَاتِلُوْنَ عَلى الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ عَلى مَنْ نَاوَأَهُمْ حَتَّى يُقَاتِلَ آخِرُهُمُ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ، رواه أبوداؤد - ‘আমার উম্মতের মধ্যে সর্বদা একটি দল থাকবে যারা হক-এর উপর লড়াই করবে। তারা শত্রুপক্ষের উপর বিজয়ী থাকবে। তাদের সর্বশেষ দলটি দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করবে’।[2]

(গ) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى يُقَاتِلُوْنَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘আমার উম্মতের একটি দল ক্বিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা হক-এর উপর লড়াই করবে বিজয়ী অবস্থায়’।[3]

(ঘ) মু‘আবিয়া বিন কুররাহ স্বীয় পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى مَنْصُورِينَ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ- قَالَ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْمَاعِيلَ قَالَ عَلِىُّ بْنُ الْمَدِينِىِّ هُمْ أَصْحَابُ الْحَدِيثِ ‘চিরকাল আমার উম্মতের মধ্যে বিজয়ী একটি দল থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। এভাবে ক্বিয়ামত এসে যাবে’। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, (আমার উস্তাদ) আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, তারা হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’।[4]

বস্ত্ততঃ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে চিরকাল আহলুল হাদীছের উক্ত দল থাকবে এবং পথভোলা মানুষকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথে ডাকবে। তারাই হ’ল হাদীছে বর্ণিত ফিরক্বা নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল’।[5] যারা সর্বাবস্থায় পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের উপর আমল করে থাকে।[6] আল্লাহ আমাদেরকে আহলুল হাদীছের দলভুক্ত করুন এবং আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের সার্বক্ষণিক পাহারাদার মুজাহিদ হিসাবে কবুল করে নিন- আমীন!

উল্লেখ্য যে, আজকাল কিছু লোক বলছেন যে, সবাইকে কেবল ‘মুসলিম’ বলতে হবে, ‘আহলুল হাদীছ’ বলা যাবে না। কেউ বলছেন, ‘আহলুল হাদীছ’ বলা গেলেও তাদের ‘সংগঠন’ করা যাবে না। অথচ উপরে বর্ণিত হাদীছগুলিতে তাদেরকে একটি ‘দল’ ( طَائِفَةٌ ) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং অন্যান্য ‘মুসলিম’ থেকে তাদের ‘হকপন্থী’ হওয়ার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। মূলতঃ এগুলি শয়তানী ধোঁকা মাত্র। যাতে বাতিলপন্থীরা সংগঠিত হয়। কিন্তু হকপন্থীরা বিচ্ছিন্ন থাকে এবং কখনো সংগঠিত শক্তিতে পরিণত হ’তে না পারে। বিচ্ছিন্ন মুমিনগণ যখন নির্দিষ্ট ইসলামী লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ইমারতের অধীনে সংগঠিত হবে, তখনই সেটি একটি শক্তিতে পরিণত হবে। যা সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে। আর সেকারণেই বাতিলপন্থীরা সংগঠিত আহলেহাদীছদের ভয় পায়, বিচ্ছিন্ন আহলেহাদীছদের নয়। অতএব হকপন্থীরা সাবধান! তারা ‘ইমারত’ ও ‘বায়‘আত’ নিয়েও কথা তুলছেন। অথচ এগুলি রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বরং ক্বিয়ামত পর্যন্ত ফিরক্বা নাজিয়াহর অন্তর্ভুক্ত খাঁটি মুসলিমগণ সর্বদা উক্ত সুন্নাত অনুসরণ করে চলবেন। মজার কথা হ’ল, বাতিলপন্থীদের নেতৃত্ব কবুল করতে ও তাদের অন্ধ আনুগত্য করতে এইসব লোকদের কোন আপত্তি দেখা যায় না।

[1]. ছহীহ মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায় ৩৩, অনুচ্ছেদ ৫৩, হা/১৯২০; অত্র হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ ঐ, দেউবন্দ ছাপা শরহ নববী ২/১৪৩ পৃঃ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১ ‘ইল্ম’ অধ্যায় ও হা/৭৩১১-এর ভাষ্য ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়।

[2]. আবুদাউদ হা/২৪৮৪, মিশকাত হা/৩৮১৯।

[3]. মুসলিম হা/১৯২৩; মিশকাত হা/৫৫০৭ ‘ফিৎনা সমূহ’ অধ্যায়, ‘ঈসার অবতরণ’ অনুচ্ছেদ।

[4]. তিরমিযী হা/২১৯২, মিশকাত হা/৬২৮৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৭০২; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[5]. তিরমিযী হা/২৬৪১; ছহীহাহ হা/১৩৪৮; মিশকাত হা/১৭১।

[6]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৭, তিরমিযী হা/২৬৭৬, ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫।

৪৫
সার-সংক্ষেপ
উপরের আলোচনা সমূহের সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ।-

(১) জিহাদ নিরস্ত্র ও সশস্ত্র দু’ভাবে হ’তে পারে। প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াতের মাধ্যমে নিরস্ত্র জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। কিন্তু সশস্ত্র ক্বিতাল মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ব্যতীত অন্যের জন্য বৈধ নয়।

(২) যুদ্ধকালীন অবস্থায় আক্রান্ত এলাকার সকল মুসলমানের উপরে জিহাদ ‘ফরযে আয়েন’। কেউ সরাসরি যুদ্ধে রত হবে। কেউ যুদ্ধে বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোন মুসলিম রাষ্ট্র কোন অমুসলিম রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হ’লে আক্রান্ত রাষ্ট্রের সকল মুসলিম নাগরিকের উপরে জিহাদ ‘ফরযে আয়েন’ হবে। অন্য রাষ্ট্রের মুসলমানদের উপরে সেটা ‘ফরযে কেফায়াহ’। তারা আক্রান্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা দেবে।

(৩) শান্তির অবস্থায় কুরআন, হাদীছ, বিজ্ঞান, যুক্তি-প্রমাণ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থায় ইসলামকে অন্যান্য দ্বীনের উপরে বিজয়ী করার সংগ্রামকে বলা হবে ‘জিহাদ’। যাকে এযুগে ‘চিন্তার যুদ্ধ’ ( الْغَزْوُ الْفِكْرِيُّ ) বলা হয়। এই জিহাদে দৃঢ় ও আপোষহীন থাকা এবং জান-মাল ব্যয় করা নিঃসন্দেহে জান্নাত লাভের উত্তম অসীলা হবে।[1]

(৪) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে বসবাস করেও যারা অনৈসলামী আইনে শাসিত হচ্ছেন, তারা নিজ রাষ্ট্রে ইসলামী আইন ও শাসন জারির পক্ষে জনমত গঠন করবেন এবং তা পরিবর্তনের জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন। আর যারা অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে বসবাস করেন, তারা নিজেরা খাঁটি মুসলিম হবেন এবং ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচার করবেন। সাথে সাথে সেদেশে নিজেদের ইসলামী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বৈধভাবে প্রচেষ্টা চালাবেন এবং বাতিলের বিরুদ্ধে সাধ্যমত আপোষহীন থাকবেন। যেভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাক্কী জীবনে বাস করেছিলেন।

কিন্তু ‘অনৈসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা চূর্ণ করে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে ইসলামী জিহাদের মূল উদ্দেশ্য’[2] জিহাদের এই ধরনের ব্যাখ্যার পিছনে কুরআন, হাদীছ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবন থেকে সরাসরি কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। যদিও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ব্যতিত ইসলামী বিধানসমূহ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

অনুরূপভাবে ‘কবীরা গোনাহগার’ মুসলমানদের খতম করে সমাজকে ভেজালমুক্ত করার হঠকারী তৎপরতা কোন ‘জিহাদ’ নয়, ক্বিতালও নয়। আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন খলীফা হিসাবে। সাধারণ নাগরিক হিসাবে এই অধিকার কারু নেই। দ্বিতীয়তঃ যাকাত সহ যেকোন ফরযকে অস্বীকার করলে সে ‘কাফির’ হয়ে যায়। সে হিসাবে অনুরূপ কোন নামধারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন মুসলিম সরকার আজও কঠোর দন্ড দিতে পারেন। কিন্তু কোন সাধারণ নাগরিক ঐ দন্ড প্রদানের ক্ষমতা রাখেন না।

(৫) দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে জিহাদের ময়দানে শাহাদাত পিয়াসী সৈনিকের মত কুফর, শিরক ও যাবতীয় বাতিল প্রতিরোধে সদা তৎপর রাখতে হবে। অমনিভাবে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মুমিন-ফাসিক সকল ধরনের শাসকের নির্দেশ মতে[3] প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্ত্তত থাকতে হবে।

(৬) আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে মধ্যপন্থী উম্মত হিসাবে ঘোষণা করেছেন। যাতে তারা মানবজাতির উপর সাক্ষ্যদাতা হ’তে পারে (বাক্বারাহ ২/১৪৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। যে ব্যক্তি তা কঠোর করতে যাবে, তার পক্ষে তা কঠোর হয়ে পড়বে। অতএব তোমরা সৎকর্ম কর ও মধ্যপন্থা অবলম্বন কর।[4] তিনি বলেন, তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, তাড়িয়ে দিয়ো না।[5] অতএব আমাদেরকে যাবতীয় শৈথিল্যবাদী ও চরমপন্থী চিন্তা-চেতনা পরিহার করে সর্বদা মধ্যপন্থী নীতি অবলম্বন করতে হবে।

[1]. আলে ইমরান ১৪২, তওবাহ ১৬, ছফ ১১।

[2]. সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী, আল্লাহর পথে জিহাদ (অনুবাদ: মাওলানা আব্দুর রহীম, ঢাকা : মার্চ ১৯৭০) পৃঃ ৩৫।

[3]. ফাৎহুল বারী ‘জিহাদ’ অধ্যায় ‘ভাল ও মন্দ সবধরনের শাসকের অধীনে জিহাদ’ অনুচ্ছেদ-৪৪।

[4]. বুখারী, মিশকাত হা/১২৪৬।

[5]. বুখারী হা/৬৯, মুসলিম হা/১৭৩৪।

৪৬
উপসংহার
একজন মুমিন যেখানেই বসবাস করুক, সর্বদা তার জিহাদী চেতনা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’-এর মূলনীতি থেকে সে মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকতে পারবে না। বাতিলের সঙ্গে আপোষ করে নয়, বরং বাতিলের মুকাবিলা করেই তাকে এগোতে হবে। এজন্য নিরন্তর দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে সংস্কার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এককভাবে ও সুসংগঠিতভাবে। এভাবেই সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আসবে ইনশাআল্লাহ। আর এটাই হ’ল নবীগণের চিরন্তন তরীকা। কেননা একজন পথভোলা মানুষের আক্বীদা ও আমল পরিশুদ্ধ করা ও তাকে জান্নাতের পথ প্রদর্শন করা অন্য সকল কিছুর চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর ইসলাম তরবারীর জোরে নয় বরং তা প্রতিষ্ঠিত হবে তার অন্তর্নিহিত তাওহীদী চেতনার অজেয় শক্তির জোরে। একদিন যা পৃথিবীর সকল প্রান্তে মাটির ঘরে ও গরীবের পর্ণকুটিরেও প্রবেশ করবে ইনশাআল্লাহ।[1] আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

سبق پڑه پهر شجاعت كا صداقت كا أمانت كا

ليا جائيگا كام تجھ سے دنيا كى إمامت كا

‘সবক পড় আবার সত্যবাদিতার, বীরত্বের ও আমানতদারীর

তোমাকে দিয়ে কাজ নেওয়া হবে পৃথিবীর নেতৃত্ব প্রদানের’ (ইকবাল)

[1]. আহমাদ হা/১৬৯৯৮; ছহীহাহ হা/৩; মিশকাত হা/৪২।

৪৭
জিহাদ ও ক্বিতাল : এক নযরে
ইসলামী পরিভাষায় ‘জিহাদ’ অর্থ, আল্লাহর পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো’ এবং ‘ক্বিতাল’ অর্থ আল্লাহর পথে কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা’। দু’টি শব্দ অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে ‘জিহাদ’ বললে দু’টিই বুঝায় এবং ইসলামী পরিভাষায় এটিই অধিক পরিচিত ও সর্বাধিক গ্রহণীয় শব্দ (পৃঃ ১২)।

জিহাদের উদ্দেশ্য : আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করা ও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করা (পৃঃ ১৩)।

জিহাদ বিধান : বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। তবে সেটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কখনো নিরস্ত্র হবে, কখনো সশস্ত্র হবে। নিরস্ত্র জিহাদ মূলতঃ প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত ও হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার মাধ্যমে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে সশস্ত্র জিহাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত সামর্থ্য, বৈধ কর্তৃপক্ষ এবং আল্লাহর পথে নির্দেশ দানকারী আমীরের প্রয়োজন হবে। নইলে ছবর করতে হবে এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে (পৃঃ ২১-২৫)।

মুসলিমদের মধ্যে পরস্পরে যুদ্ধ নিষিদ্ধ (পৃঃ ২৫-২৭)।

জিহাদ ফরযে আয়েন হয় চারটি অবস্থায় : (১) মুসলমানদের বাড়ীতে বা শহরে শত্রুবাহিনী উপস্থিত হ’লে (২) শাসক যখন কাউকে যুদ্ধে বের হবার নির্দেশ দেন (৩) যুদ্ধের সারিতে উপস্থিত হ’লে এবং (৪) যখন কেউ বাধ্য হয় (পৃঃ ৩১)।

সুস্থ, বয়ঃপ্রাপ্ত ও জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম পুরুষের উপরে জিহাদ ফরয, যখন তার নিকটে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের বাইরে জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ, সুযোগ ও সামর্থ্য থাকবে (পৃঃ ৩৩)।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের পক্ষ হ’তে সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত সেনাবাহিনী সরাসরি যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করবে এবং অন্যেরা তাদের সহযোগিতা করবে। নিয়ত খালেছ থাকলে ও যুদ্ধ আল্লাহর জন্য হ’লে সকলেই তাতে জিহাদের পূর্ণ নেকী লাভে ধন্য হবেন ইনশাআল্লাহ। এমনকি জিহাদের জন্য অমুসলিমদের নিকট থেকেও সাহায্য গ্রহণ করা যাবে, যদি তাদের থেকে কোনরূপ ক্ষতির আশংকা না থাকে (পৃঃ ৩৬-৩৭)।

জিহাদের মাধ্যম ৪ টি : (১) অন্তর দিয়ে (২) যবান দিয়ে (৩) মাল দিয়ে এবং (৪) অস্ত্রের মাধ্যমে (পৃঃ ৩৭)।

জিহাদ ৩ প্রকার : (১) নফসের বিরুদ্ধে (২) শয়তানের বিরুদ্ধে (৩) কাফের-মুশরিক ও ফাসেক-মুনাফিকের বিরুদ্ধে (পৃঃ ৩৯-৪১)।

মুসলিম হৌক অমুসলিম হৌক প্রতিষ্ঠিত কোন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলামের নীতি নয়। তবে ইসলাম বিরোধী হুকুম মানতে কোন মুসলিম নাগরিক বাধ্য নয়। অতএব সর্বাবস্থায় তাওহীদের কালেমাকে সমুন্নত রাখা ও ইসলামী স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বৈধভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা করা মুসলমানের উপর ফরয দায়িত্ব। এমতক্ষেত্রে সরকারের নিকটে কুরআন ও হাদীছের বক্তব্য তুলে ধরাই বড় জিহাদ। যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় (পৃঃ ৪২)।

প্রকাশ্য কুফরী : কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে যাচাই সাপেক্ষে সরকারের কুফরী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে এবং বারবার বুঝানো সত্ত্বেও স্বীয় অবিশ্বাসে অটল থাকলে তাকে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ হিসাবে গণ্য করা যাবে। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, কাফের সাব্যস্ত হ’লেই উক্ত শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরয। কারণ যুদ্ধ করার বিষয়টি শর্ত সাপেক্ষ (পৃঃ ৪৪-৪৫)।

মুসলিম সমাজে কারু মধ্যে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ দেখা গেলে প্রথমে তাকে উপদেশের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও না পারলে ঐ ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলবে। সাথে সাথে তার হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করবে। যদি সরকার অমুসলিম হয় ও ইসলামে বাধা সৃষ্টি করে অথবা মুসলিম সরকারের মধ্যে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ দেখা দেয় এবং ইসলামের সাথে দুশমনী করে, তাহলে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকলে বৈধ পন্থায় সেটা করবে। নইলে ছবর করবে এবং আমর বিন মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মূলনীতি অনুসরণে ইসলামের পক্ষে জনমত গঠন করবে। এটাই নবীগণের চিরন্তন তরীকা (পৃঃ ৪৮)।

কাফির গণ্য করার মূলনীতি সমূহ : (১) কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতেই এটা সাব্যস্ত হবে ব্যক্তির অবস্থা ভেদে। (২) কাউকে কাফের সাব্যস্ত করা যায় না তার অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে। (৩) কারু কথা, কাজ বা বিশ্বাসের ভিত্তিতেই কেবল তাকে কাফের বলা যাবে না। যতক্ষণ না তার কাছে দলীল স্পষ্ট করা হবে এবং সন্দেহ দূর করা হবে। (৪) ঈমানের একটি শাখা কোন ব্যক্তির মধ্যে থাকলেই তাকে ‘মুমিন’ বলা যায় না। তেমনি কুফরের কোন অংশ কারু মধ্যে থাকলেই তাকে ‘কাফের’ বলা যায় না। (৫) ইসলামের মূল বিষয়গুলি অস্বীকার করলে কাফের হবে, আর শাখাগুলি অস্বীকার করলে কাফের হবে না, এমনটি নয়। বরং শরী‘আতের প্রতিটি বিষয়ই পালনীয়। (৬) একই ব্যক্তির মধ্যে ঈমান ও কুফর, তাওহীদ ও শিরক, তাক্বওয়া ও পাপাচার, সরলতা ও কপটতা দু’টিই একত্রিত হ’তে পারে। আহলে সুন্নাতের নিকট এটি একটি বড় মূলনীতি। যা খারেজী, মুরজিয়া, মু‘তাযিলা, ক্বাদারিয়া ও অন্যান্য ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের বিপরীত (পৃঃ ৪৯-৫০)।

মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পরস্পরে কাফের গণ্য করার ধারাবাহিক ইতিহাস (পৃঃ ৫১-৫৫)।

সরকারের সুস্পষ্ট কুফরী প্রমাণিত হলে তার আনুগত্যমুক্ত হওয়া যাবে। তবে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকলে বিদ্রোহ করা যাবে না। বরং ধৈর্যধারণ করতে হবে, যতক্ষণ না আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন ফায়ছালা নাযিল হয় (পৃঃ ৫৫)।

কারু বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার অধিকার হ’ল মুসলমানদের সর্বসম্মত আমীরের (নিসা ৪/৫৯)। অন্য কারু নয়। একইভাবে ইসলামী হুদূদ বা দন্ডবিধি সমূহ শাসক ব্যতীত অন্য কেউ প্রয়োগ করতে পারে না (পৃঃ ৫৭)।

অমুসলিম বা ফাসেক মুসলিম সরকার উভয়ের বিরুদ্ধে মুমিনের কর্তব্য হ’ল- (১) বৈধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো। (২) দেশে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। (৩) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা। (৪) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা। (৫) সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা (পৃঃ ৬১)।

সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অস্বীকার করল সে কুফরী করল। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করল, কিন্তু সে অনুযায়ী বিচার বা শাসন করল না সে যালিম ও ফাসিক। তিনি বলেন, এটি ঐ কুফরী নয়, যা কোন মুসলিমকে ইসলামের গন্ডী থেকে বের করে দেয়। বরং এর দ্বারা বড় কুফরের নিম্নের কুফর বুঝানো হয়েছে’। যার ফলে সে কবীরা গোনাহগার হয়’ (পৃঃ ৬২)।

কুফর দু’প্রকার : (১) বিশ্বাসগত কুফরী, যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। (২) কর্মগত কুফরী, যা খারিজ করে দেয় না। তবে সে কবীরা গোনাহগার হয়, যা তওবা ব্যতীত মাফ হয় না। প্রথমটি বড় কুফর এবং দ্বিতীয়টি ছোট কুফর (পৃঃ ৭৫)।

দ্বীন ধ্বংস করে তিনজন : (১) অত্যাচারী শাসকবর্গ (২) স্বেচ্ছাচারী ধর্মনেতাগণ (৩) ছূফী ও দরবেশগণ (পৃঃ ৮৫)।

একমাত্র হকপন্থী দল হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’। যারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে। আর এ বিজয় অর্থ আখেরাতের বিজয় (পৃঃ ৮৫-৮৭)।

একজন মুমিন যেখানেই বসবাস করুক, সর্বদা তার জিহাদী চেতনা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’-এর মূলনীতি থেকে সে মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকতে পারবে না। বাতিলের সঙ্গে আপোষ করে নয়, বরং বাতিলের মুকাবিলা করেই তাকে এগোতে হবে। এজন্য নিরন্তর দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে সংস্কার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এককভাবে ও সংগঠিতভাবে। এভাবেই সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আসবে ইনশাআল্লাহ (পৃঃ ৯০)।

--০--

سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك، اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب -

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন