‘আবদুল্লাহ ইবনু কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যতগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তার মধ্যে তাবূক যুদ্ধ ব্যতীত আমি আর কোন যুদ্ধ থেকে পেছনে থাকিনি। তবে আমি বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করিনি। কিন্তু উক্ত যুদ্ধ থেকে যাঁরা পেছনে পড়ে গেছেন, তাদের কাউকে ভর্ৎসনা করা হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেবল কুরাইশ দলের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের এবং তাঁদের শত্রু বাহিনীর মধ্যে অঘোষিত যুদ্ধ সংঘটিত করেন। আর আকাবার রাতে যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের থেকে ইসলামের উপর অঙ্গীকার গ্রহণ করেন, আমি তখন তাঁর সঙ্গে ছিলাম। ফলে বদর প্রান্তরে উপস্থিত হওয়াকে আমি প্রিয়তর ও শ্রেষ্ঠতর বলে বিবেচনা করিনি। যদিও আকাবার ঘটনা অপেক্ষা লোকদের মধ্যে বদরের ঘটনা বেশী মাশহুর ছিল।
আর আমার অবস্থার বিবরণ এই, তাবূক যুদ্ধ থেকে আমি যখন পেছনে থাকি তখন আমি এত অধিক সুস্থ, শক্তিশালী ও সচ্ছল ছিলাম যে আল্লাহ্র কসম! আমার কাছে কখনো ইতোপূর্বে কোন যুদ্ধে একই সঙ্গে দু’টো যানবাহন জোগাড় করা সম্ভব হয়নি, যা আমি এ যুদ্ধের সময় জোগাড় করেছিলাম। আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে অভিযান পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করতেন, বাহ্যত তার বিপরীত দেখাতেন। এ যুদ্ধ ছিল ভীষণ উত্তাপের সময়, অতি দূরের যাত্রা, বিশাল মরুভূমি এবং বহু শত্রুসেনার মোকাবালা করার। কাজেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ অভিযানের অবস্থা মুসলিমদের কাছে প্রকাশ করে দেন যাতে তারা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সামান জোগাড় করতে পারে।
কা‘ব (রাঃ) বলেন, যার ফলে যে কোন লোক যুদ্ধাভিযান থেকে বিরত থাকতে ইচ্ছে করলে তা সহজেই করতে পারত এবং ওয়াহী মারফত এ খবর না জানানো পর্যন্ত তা সংগোপন থাকবে বলে সে ধারণা করত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এমন সময় যখন ফল-মূল পাকার ও গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়ার সময় ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং এবং তাঁর সঙ্গী মুসলিম বাহিনী অভিযানে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফেলেন। আমিও প্রতি সকালে তাঁদের সঙ্গে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। মনে মনে ধারণা করতে থাকি, আমি তো যখন ইচ্ছে পারব। এই দোটানায় আমার সময় কেটে যেতে লাগল। এদিকে অন্য লোকেরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর সাথী মুসলিমগণ রওয়ানা করলেন অথচ আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আমি মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা ঠিক আছে, এক দু’দিনের মধ্যে আমি প্রস্তুত হয়ে পরে তাঁদের সঙ্গে গিয়ে মিলব। এভাবে আমি প্রতিদিন বাড়ি হতে প্রস্তুতি নেয়ার উদ্দেশে বের হই, কিন্তু কিছু না করেই ফিরে আসি। আবার বের হই, আবার কিছু না করে ঘরে ফিরে আসি। ইত্যবসরে বাহিনী অগ্রসর হয়ে অনেক দূর চলে গেল। আর আমি রওয়ানা করে তাদের সঙ্গে রাস্তায় মিলিত হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতে লাগলাম। আফসোস যদি আমি তাই করতাম! কিন্তু তা আমার ভাগ্যে জোটেনি। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রওয়ানা হওয়ার পর আমি লোকদের মধ্যে বের হয়ে তাদের মাঝে বিচরণ করতাম। এ কথা আমার মনকে পীড়া দিত যে, আমি তখন (মাদীনাহ্) মুনাফিক এবং দুর্বল ও অক্ষম লোক ব্যতীত অন্য কাউকে দেখতে পেতাম না। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাবূক পৌঁছার আগে পর্যন্ত আমার ব্যাপারে আলোচনা করেননি। অনন্তর তাবূকে এ কথা তিনি লোকদের মাঝে বসে জিজ্ঞেস করে বসলেন, কা‘ব কী করল? বানী সালামাহ গোত্রের এক লোক বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তার ধন-সম্পদ ও অহঙ্কার তাকে আসতে দেয়নি। এ কথা শুনে মুআয ইবনু জাবাল (রাঃ) বললেন, তুমি যা বললে তা ঠিক নয়। হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহ্র কসম, আমরা তাঁকে উত্তম ব্যক্তি বলে জানি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নীরব রইলেন।
কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, আমি যখন জানতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাদীনাহ মুনাওয়ারায় ফিরে আসছেন, তখন আমি চিন্তিত হয়ে গেলাম এবং মিথ্যা ওজুহাত খুঁজতে থাকলাম। মনে স্থির করলাম, আগামীকাল এমন কথা বলব যাতে করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ক্রোধকে ঠাণ্ডা করতে পারি। আর এ সম্পর্কে আমার পরিবারস্থ জ্ঞানীগুণীদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে থাকি। এরপর যখন প্রচারিত হল যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাদীনায় এসে পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন আমার অন্তর থেকে মিথ্যা দূর হয়ে গেল। আর মনে দৃঢ় প্রত্যয় হল যে, এমন কোন উপায়ে আমি তাঁকে কখনো ক্রোধমুক্ত করতে সক্ষম হব না, যাতে মিথ্যার লেশ থাকে। অতএব আমি মনে মনে স্থির করলাম যে, আমি সত্য কথাই বলব। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকাল বেলায় মাদীনায় প্রবেশ করলেন। তিনি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমে মাসজিদে গিয়ে দু’রাক‘আত সলাত আদায় করতেন, তারপর লোকদের সামনে বসতেন। যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরূপ করলেন, তখন যারা পশ্চাদপদ ছিলেন তাঁরা তাঁর কাছে এসে শপথ করে করে অপারগতা ও আপত্তি পেশ করতে লাগল। এরা সংখ্যায় আশির অধিক ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাহ্যত তাদের ওযর-আপত্তি গ্রহণ করলেন, তাদের বাই‘আত করলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কিন্তু তাদের অন্তরের অবস্থা আল্লাহ্র হাওয়ালা করে দিলেন। [কা‘ব (রাঃ) বলেন] আমিও এরপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে হাজির হলাম। আমি যখন তাঁকে সালাম দিলাম তখন তিনি রাগান্বিত চেহারায় মুচকি হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, এসো। আমি সে মতে এগিয়ে গিয়ে একেবারে তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে তুমি অংশগ্রহণ করলে না? তুমি কি যানবাহন ক্রয় করনি? তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, করেছি। আল্লাহ্র কসম! এ কথা সুনিশ্চিত যে, আমি যদি আপনি ব্যতীত দুনিয়ার অন্য কোন ব্যক্তির সামনে বসতাম তাহলে আমি তার অসন্তুষ্টিকে ওযর-আপত্তি পেশের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করতাম। আর আমি তর্কে পটু। কিন্তু আল্লাহ্র কসম আমি পরিজ্ঞাত যে, আজ যদি আমি আপনার কাছে মিথ্যা কথা বলে আমার প্রতি আপনাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করি তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দিতে পারেন। আর যদি আপনার কাছে সত্য প্রকাশ করি যাতে আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, তবুও আমি এতে আল্লাহ্র ক্ষমা পাওয়ার অবশ্যই আশা করি। না, আল্লাহ কসম, আমার কোন ওযর ছিল না। আল্লাহ্র কসম! সেই যুদ্ধে আপনার সঙ্গে না যাওয়ার সময় আমি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, সে সত্য কথাই বলেছে। তুমি এখন চলে যাও, যতদিনে না তোমার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ফায়সালা করে দেন। তাই আমি উঠে চলে গেলাম। তখন বানী সালিমার কতিপয় লোক আমার অনুসরণ করল। তারা আমাকে বলল, আল্লাহ্র কসম! তুমি ইতোপূর্বে একটি ওযর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে পেশ করে দিতে পারতে না? আর তোমার এ অপরাধের কারণে তোমার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ক্ষমা প্রার্থনাই তো যথেষ্ট ছিল। আল্লাহ্র কসম! তারা আমাকে বারবার কঠিনভাবে ভর্ৎসনা করতে থাকে। ফলে আমি পূর্ব স্বীকারোক্তি থেকে ফিরে গিয়ে মিথ্যা বলার বিষয়ে মনে মনে চিন্তা করতে থাকি। এরপর আমি তাদের বললাম, আমার মতো এ কাজ আর কেউ করেছে কি? তারা জওয়াব দিল, হ্যাঁ, আরও দু’জন তোমার মতো বলেছে এবং তাদের ব্যাপারেও তোমার মতো একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তারা কে কে? তারা বলল, একজন মুরারা ইবনু রবী আমরী এবং অপরজন হলেন, হিলাল ইবনু ‘উমাইয়াহ ওয়াকিফী। এরপর তারা আমাকে জানালো যে, তারা উভয়ে উত্তম মানুষ এবং তারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সেজন্য দু’জনেই আদর্শস্থানীয়। যখন তারা তাদের নাম উল্লেখ করল, তখন আমি পূর্ব মতের উপর অটল রইলাম।
আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মধ্যকার যে তিনজন তাবূকে অংশগ্রহণ হতে বিরত ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলতে মুসলিমদের নিষেধ করে দিলেন। তদনুসারে মুসলিমরা আমাদের এড়িয়ে চলল। আমাদের প্রতি তাদের আচরণ বদলে ফেলল। এমনকি এ দেশ যেন আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেল। এ অবস্থায় আমরা পঞ্চাশ রাত অতিবাহিত করলাম।
আমার অপর দু’জন সাথী তো সংকট ও শোচনীয় অবস্থায় নিপতিত হলেন। তারা নিজেদের ঘরে বসে বসে কাঁদতে থাকেন। আর আমি যেহেতু অধিকতর যুবক ও শক্তিশালী ছিলাম তাই বাইরে বের হতাম, মুসলিমদের জামা‘আতে সলাত আদায় করতাম, বাজারে চলাফেরা করতাম কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা বলত না। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খিদমতে হাযির হয়ে তাঁকে সালাম দিতাম। যখন তিনি সলাত শেষে মজলিসে বসতেন তখন আমি মনে মনে বলতাম ও লক্ষ্য করতাম, তিনি আমার সালামের জবাবে তার ঠোঁটদ্বয় নেড়েছেন কি না। তারপর আমি তাঁর কাছাকাছি জায়গায় সলাত আদায় করতাম এবং গোপন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে দেখতাম যে, আমি যখন সলাতে মগ্ন হতাম তখন তিনি আমার প্রতি দৃষ্টি দিতেন, আর যখন আমি তাঁর দিকে তাকাতাম তখন তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেন। এভাবে আমার প্রতি মানুষদের কঠোরতা ও এড়িয়ে চলা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে। একদা আমি আমার চাচাত ভাই ও প্রিয় বন্ধু আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ)-এর বাগানের প্রাচীর টপকে ঢুকে পড়ে তাঁকে সালাম দেই। কিন্তু আল্লাহ্র কসম তিনি আমার সালামের জওয়াব দিলেন না। আমি তখন বললাম, হে আবূ ক্বাতাদাহ! আপনাকে আমি আল্লাহ্র কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আপনি কি জানেন যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ভালবাসি? তখন তিনি নীরবতা পালন করলেন। আমি পুনরায় তাঁকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি এবারও কোন জবাব দিলেন না। আমি আবারো তাঁকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই ভাল জানেন। তখন আমার চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। আমি আবার প্রাচীর টপকে ফিরে এলাম।
কা‘ব (রাঃ) বলেন, একদা আমি মাদীনাহর বাজারে হাটছিলাম। তখন সিরিয়ার এক বণিক যে মাদীনাহর বাজারে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করার উদ্দেশে এসেছিল, সে বলছে, আমাকে কা‘ব ইবনু মালিকের সঙ্গে কেউ পরিচয় করে দিতে পারে কি? তখন লোকেরা তাকে আমার প্রতি ইশারা করে দেখিয়ে দিল। তখন সে এসে গাস্সানি বাদশার একটি পত্র আমার কাছে হস্তান্তর করল। তাতে লেখা ছিল, পর সমাচার এই, আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সাথী আপনার প্রতি জুলম করেছে। আর আল্লাহ আপনাকে মর্যাদাহীন ও নিরাশ্রয় সৃষ্টি করেননি। আপনি আমাদের দেশে চলে আসুন, আমরা আপনার সাহায্য-সহানুভূতি করব। আমি যখন এ পত্র পড়লাম তখন আমি বললাম, এটাও আর একটি পরীক্ষা। তখন আমি চুলা খুঁজে তার মধ্যে পত্রটি নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিলাম। এ সময় পঞ্চাশ দিনের চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে এক সংবাদবাহক আমার কাছে এসে বলল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি আপনার স্ত্রী হতে পৃথক থাকবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি তাকে তালাক দিয়ে দিব, না অন্য কিছু করব? তিনি উত্তর দিলেন, তালাক দিতে হবে না বরং তার থেকে পৃথক থাকুন এবং তার নিকটবর্তী হবেন না। আমার অপর দু’জন সঙ্গীর প্রতি একই আদেশ পৌঁছালেন। তখন আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার পিত্রালয়ে চলে যাও। আমার সম্পর্কে আল্লাহ্র ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত তুমি সেখানে থাক।
কা‘ব (রাঃ) বলেন, আমার সঙ্গী হিলাল ইবনু উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! হিলাল ইবনু উমাইয়া অতি বৃদ্ধ, এমন বৃদ্ধ যে, তাঁর কোন খাদিম নেই। আমি তাঁর খেদমত করি, এটা কি আপনি অপছন্দ করেন? নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, না, তবে সে তোমার বিছানায় আসতে পারবে না। সে বলল, আল্লাহ্র কসম! এ সম্পর্কে তার কোন অনুভূতিই নেই। আল্লাহ্র কসম! তিনি এ নির্দেশ পাওয়ার পর থেকে সর্বদা কান্নাকাটি করছেন। [কা‘ব (রাঃ) বলেন] আমার পরিবারের কেউ আমাকে পরামর্শ দিল যে, আপনিও যদি আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে অনুমতি চেয়ে নিতেন যেমনভাবে হিলাল ইবনু উমাইয়ার স্ত্রীকে অনুমতি দেয়া হয়েছে তার খিদমত করার জন্য। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট অনুমতি চাইব না। আমি যদি তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুমতি চাই তবে তিনি কী বলেন, তা আমার জানা নেই। আমি তো নিজেই আমার খিদমতে সক্ষম। এরপর আরও দশরাত কাটালাম। এভাবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেন তখন থেকে পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হল। এরপর আমি পঞ্চাশতম রাত শেষে ফাজরের সলাত আদায় করলাম এবং আমাদের এক ঘরের ছাদে এমন অবস্থায় বসে ছিলাম যে অবস্থার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা (কুরআনে) বর্ণনা করেছেন। আমার জান-প্রাণ দুর্বিষহ এবং গোটা জগৎটা যেন আমার জন্য প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় শুনতে পেলাম এক চীৎকারকারীর চীৎকার। সে সালা পর্বতের উপর চড়ে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করছে, হে কা‘ব ইবনু মালিক! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কা‘ব (রাঃ) বলেন, এ শব্দ আমার কানে পৌঁছামাত্র আমি সাজদায় পড়ে গেলাম। আর আমি বুঝলাম যে, আমার সুদিন ও খুশীর খবর এসেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাজরের সলাত আদায়ের পর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে আমাদের তওবা কবূল হওয়ার সুসংবাদ প্রকাশ করেন। তখন লোকেরা আমার এবং আমার সঙ্গীদ্বয়ের কাছে সুসংবাদ দিতে থাকে এবং তড়িঘড়ি একজন অশ্বারোহী আমার কাছে আসে এবং আসলাম গোত্রের অপর এক ব্যক্তি দ্রুত আগমন করে পর্বতের উপর আরোহণ করতঃ চীৎকার দিতে থাকে। তার চীৎকারের শব্দ ঘোড়া অপেক্ষাও দ্রুত পৌঁছল। যার শব্দ আমি শুনেছিলাম সে যখন আমার কাছে সুসংবাদ প্রদান করতে আসল, আমার তখন নিজের পরনের দু’টো কাপড় ব্যতীত আমার কাছে আর কোন কাপড় ছিল না। আমি দু’টো কাপড় ধার করে পরিধান করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে রওয়ানা হলাম। লোকেরা দলে দলে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে আসতে লাগল। তারা তওবা কবূলের মুবারকবাদ জানাচ্ছিল। তারা বলছিল, তোমাকে মুবারকবাদ যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমার তওবা কবূল করেছেন।
কা‘ব (রাঃ) বলেন, অবশেষে আমি মাসজিদে প্রবেশ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে বসা ছিলেন এবং তাঁর চতুষ্পার্শ্বে জনতার সমাবেশ ছিল। ত্বলহা ইবনু ‘উবাইদুল্লাহ (রাঃ) দ্রুত উঠে এসে আমার সঙ্গে মুসাফাহা করলেন ও মুবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম! তিনি ব্যতীত আর কোন মুহাজির আমার জন্য দাঁড়াননি। আমি ত্বলহার ব্যবহার ভুলতে পারব না।
কা‘ব (রাঃ) বলেন, এরপর আমি যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম জানালাম, তখন তাঁর চেহারা আনন্দের আতিশয্যে ঝকমক করছিল। তিনি আমাকে বললেন, তোমার মা তোমাকে জন্মদানের দিন হতে যতদিন তোমার উপর অতিবাহিত হয়েছে তার মধ্যে উৎকৃষ্ট ও উত্তম দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর। কা‘ব বলেন, আমি আরয করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ! এটা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহ্র পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, আমার পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন খুশী হতেন তখন তাঁর চেহারা এত উজ্জ্বল ও ঝলমলে হত যেন পূর্ণিমার চাঁদের ফালি। এতে আমরা তাঁর সন্তুষ্টি বুঝতে পারতাম। আমি যখন তাঁর সম্মুখে বসলাম তখন আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার তওবা কবূলের শুকরিয়া স্বরূপ আমার ধন-সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পথে দান করতে চাই। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমার কিছু মাল তোমার কাছে রেখে দাও। তা তোমার জন্য উত্তম। আমি বললাম, খাইবারে অবস্থিত আমার অংশটি আমার জন্য রাখলাম।
আমি আরয করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ! আল্লাহ তা‘আলা সত্য বলার কারণে আমাকে রক্ষা করেছেন, তাই আমার তওবা কবূলের নিদর্শন ঠিক রাখতে আমার বাকী জীবনে সত্যই বলব। আল্লাহ্র কসম! যখন থেকে আমি এ সত্য বলার কথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে জানিয়েছি, তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার জানা মতে কোন মুসলিমকে সত্য কথার বিনিময়ে এরূপ নিয়ামত আল্লাহ দান করেননি যে নিয়ামত আমাকে দান করেছেন। [কা‘ব (রাঃ) বলেন] যেদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মুকে সত্য কথা বলেছি সেদিন হতে আজ পর্যন্ত অন্তরে মিথ্যা বলার ইচ্ছাও করিনি। আমি আশা পোষণ করি যে, বাকী জীবনও আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মিথ্যা থেকে রক্ষা করবেন।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এ উপর এ আয়াত অবতীর্ণ করেন “আল্লাহ অনুগ্রহপরায়ণ হলেন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি এবং মুহাজিরদের প্রতি ....... এবং তোমরা সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।” (সূরাহ আততাওবাহ ৯/১১৭-১১৭)।
[কা‘ব (রাঃ) বলেন] আল্লাহর শপথ! ইসলাম গ্রহণের পর থেকে কখনো আমার উপর এত উৎকৃষ্ট নিয়ামত আল্লাহ প্রদান করেননি যা আমার কাছে শ্রেষ্ঠতর, তা হল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আমার সত্য বলা ও তাঁর সঙ্গে মিথ্যা না বলা, যদি মিথ্যা বলতাম তবে মিথ্যাচারীদের মতো আমিও ধ্বংস হয়ে যেতাম। সেই মিথ্যাচারীদের সম্পর্কে যখন ওয়াহী অবতীর্ণ হয়েছে তখন জঘন্য অন্তরের সেই লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ “তোমরা তাদের নিকট ফিরে আসলে তারা আল্লাহ্র শপথ করবে ....... আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়ের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।” (সূরাহ আততাওবাহ ৯/৯৫-৯৬)। কা‘ব (রাঃ) বলেন, আমাদের তিনজনের তওবা কবূল করতে বিলম্ব করা হয়েছে যাদের তওবা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবূল করেছেন যখন তাঁরা তার কাছে শপথ করেছে, তিনি তাদের বাই‘আত গ্রহণ করেছেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আমাদের বিষয়টি আল্লাহ্র ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্থগিত রেখেছেন।
এর প্রেক্ষাপটে আল্লাহ বলেন “সেই তিনজনের প্রতিও যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল।” (সূরাহ আত্তওবাহ ৯/১১৮)। কুরআনের এ আয়াতে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়নি যারা তাবূক যুদ্ধ থেকে পিছনে ছিল ও মিথ্যা কসম করে ওযর-আপত্তি জানিয়েছিল এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও তা গ্রহণ করেছিলেন। বরং এ আয়াতে তাদের প্রতি ইশারা করা হয়েছে আমরা যারা পেছনে ছিলাম এবং যাদের প্রতি সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। (বুখারী পর্ব ৬৪ অধ্যায় ৮০ হাদীস নং ৪৪১৮; মুসলিম ৪৯ অধ্যায় ৯, হাঃ ২৭৬৯)