নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেনঃ জ্ঞান হবার পর থেকে আমি আমার পিতামাতাকে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম পালন করতে কখনও দেখিনি। আর এমন কোন দিন যায় নি যেদিনের দু'প্রান্তে সকাল সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের এখানে আসেন নি। মুসলিমদের উপর যখন অত্যাচার শুরু হল তখন একদিন আবু বকর মুহাজির বেশে আবিসিনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তিনি যখন বারকুল গিমাদ নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন তাঁর সাথে 'কারা' গোত্রের সরদার ইবনুদ দাগিনার সাক্ষাৎ হল। সে বললঃ হে আবু বকর! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেনঃ আমার গোত্রের লোকেরা আমাকে বের করে দিয়েছে। আমি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াব এবং আমার রবের এবাদত করব। ইবনুদ দাগিনা বললঃ আপনার মত লোক বেরিয়ে যেতে পারে না এবং আপনার মত লোককে বহিস্কার করাও চলে না। কেননা আপনি নিঃশ্বকে উপার্জনক্ষম করেন, আত্মীয়তার বন্ধনকে সংযুক্ত রাখেন, অপরের বোঝা নিজে বহন করেন, অতিথির আপ্যায়ন করেন এবং বিপদ-মুসীবতে সাহায্য করে থাকেন। সুতরাং আপনার আশ্রয়দাতা হিসাবে আমি থাকলাম। আপনি ফিরে যান এবং নিজ দেশে থেকেই আল্লাহর ইবাদত করতে থাকুন। তিনি ফেরত আসলেন এবং ইবনুদ দাগিনাও তাঁর সাথে গেল।
মক্কায় পৌছে ইবনুদ্ দাগিনা কোন এক সন্ধ্যায় সম্ভ্রান্ত কুরাইশদের সাথে কাবা ঘরের তাওয়াফ করল এবং তাদেরকে বললঃ আবু বকরের মত লোকের পক্ষে বেরিয়ে যাওয়াটা শোভনীয় নয় এবং তাঁর মত লোককে বহিস্কার করাটাও উচিত হয় না। তোমরা কি এমন একজন লোককে বের করে দিবে? যিনি নিঃস্বকে উপার্জনক্ষম করেন, আত্মীয়তার বন্ধনকে সংযুক্ত রাখেন, অপরের বোঝা নিজে বহন করেন, অতিথির আপ্যায়ন করেন এবং বিপদ-মুসীবতে সাহায্য করে থাকেন। এ কথা শুনে কুরাইশরা ইবনুদ দাগিনার আশ্রয় দানকে প্রত্যাখ্যান করলনা। তারা ইবনুদ দাগিনাকে বললঃ তুমি আবু বকরকে বলে দাও, তিনি যেন নিজ ঘরের মধ্যেই তাঁর রবের ইবাদত করেন, যত ইচ্ছা নামায পড়েন। তিনি যেন আমাদেরকে কষ্ট না দেন এবং এসব কাজ যেন প্রকাশ্যে না করেন। কেননা আমাদের ভয় হচ্ছে আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিরা বিভ্রান্তিতে পড়তে পারে। ইবনুদ দাগিনা আবু বকর (রাঃ) কে কথাটি জানিয়ে দিল। কিছু দিন আবু বকর অনুরূপভাবে নিজ ঘরে বসে নিজ রবের ইবাদত করতে থাকেন। প্রকাশ্যে নামায পড়েন না এবং নিজ বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও কুরআন তেলাওয়াত করেন না। তারপর আবু বকরের মনে একটি খেয়াল জাগল। তিনি তাঁর বাড়ির চত্বরে একটা নামাযের ঘর তৈরী করলেন এবং তাতে নামায পড়তে লাগলেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকলেন। এতে মুশরিকদের স্ত্রী ও সন্তানরা তাঁর কাছে ভীড় জমাতে লাগল। তাঁরা তার অবস্থা দেখে বিস্ময়বোধ করত এবং তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত। আবু বকর আল্লাহর ভালবাসায় বিগলিত হবার ফলে অতিশয় ক্রন্দনরত ব্যক্তি। তিনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন তখন তাঁর চোখ দু'টোকে আয়ত্বে রাখতে পারতেন না। এ ব্যাপারটি মুশরিক কুরাইশ প্রধানদের শঙ্কিত করে তুলল।
অতঃপর তারা ইবনুদ দাগিনাকে ডেকে পাঠালে সে তাদের নিকট আসল। তখন তারা বললঃ তোমার আশ্রয় প্রার্থনার কারণে আমরা আবু বকরকে এ শর্তে নিরাপত্তা দিয়েছিলাম যে, তিনি নিজ বাড়িতে থেকে তাঁর রবের ইবাদত করবেন। কিন্তু তিনি তা লঙ্ঘন করে নিজ বাড়ির চত্ত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন এবং প্রকাশ্যে তাতে নামায পড়ছেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করছেন। এতে আমাদের আশংকা হচ্ছে যে, তিনি আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিবেন। অতএব, আপনি তাকে বারণ করুন। যদি তিনি নিজ বাড়িতে থেকে নিজ রবের ইবাদত করে ক্ষান্ত হতে পারেন, তবে তাই তিনি করবেন। আর যদি তিনি এসব কাজ প্রকাশ্যভাবে ছাড়া করতে অস্বীকার করেন অর্থাৎ প্রকাশ্যেই করতে চান, তবে তাঁকে বলুনঃ তিনি যেন আপনার যিম্মাদারী ফিরিয়ে দেন। কেননা একদিকে আমরা যেমন আপনার নিরাপত্তা প্রদানকে ভঙ্গ করা অপছন্দ করি, অপরদিকে তেমনি আবু বকরের প্রকাশ্যভাবে ইবাদত করাকেও আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না।
আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ অতঃপর ইবনুদ দাগিনা আবু বকরের নিকট এসে বললঃ যে শর্তে আমি আপনার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম, তা আপনি বেশ ভাল করে জানেন। সুতরাং আপনি কাজকর্ম নিজ ঘরের মধ্যে সীমিত রাখুন অথবা আমার যিম্মাদারী আমাকে প্রত্যার্পন করুন। কারণ কোন ব্যক্তির সাথে আমি নিরাপত্তা চুক্তি করার পর আমার সেই চুক্তি লঙ্ঘন করা হয়েছে- আরবরা এ কথা শ্রবণ করুক, আমি সেটা পছন্দ করি না। এ কথা শুনে আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ আপনার আশ্রয় দানের প্রতিশ্রুতি আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। মহান আল্লাহর আশ্রয় প্রদানের প্রতিশ্রুতিতেই আমি সন্তুষ্ট।
সে সময় নবী (ﷺ) মক্কায় ছিলেন। তিনি মুসলিমদেরকে বললেনঃ তোমাদের হিজরতের দেশটি আমাকে দেখানো হয়েছে৷ সেখানে রয়েছে খেজুর গাছ। তার উভয় প্রান্তে রয়েছে কালো পাথর বিশিষ্ট ময়দান৷ এ কথা শুনে অনেকেই মদীনায় হিজরত করল। আর যারা আবিসিনিয়া রাজ্যে হিজরত করেছিল তাদের অধিকাংশই মদীনায় ফেরত আসল। আবু বকরও মদীনায় হিজরতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফেললেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেনঃ অপেক্ষা কর। কেননা আমি আশা করছি যে, আমাকে হিজরতের অনুমতি দেয়া হবে। আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ আমার বাপ আপনার জন্যে কোরবান হোক, আপনি কি এটা আশা করেন। রাসূল (ﷺ) বললেনঃ হ্যাঁ। ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথী হবার আশায় নিজেকে বিরত রাখলেন এবং তাঁর কাছে যে দু'টি উট ছিল তাদেরকে চার মাস পর্যন্ত বাবলা গাছের পাতা খাওয়াতে থাকলেন৷
আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ একদিন ঠিক দুপুর বেলা আমরা আবু বকরের ঘরে বসাছিলাম। এমন সময় কোন এক লোক আবু বকরকে বললঃ এই তো রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) চাদর দিয়ে মাথা আবৃত করে আগমণ করছেন। তাঁর আগমণটা এমন সময় ছিল যে সময় তিনি কখনও আসতেন না৷ তখন আবু বকর বললেনঃ আমার বাবা মা তাঁর জন্যে কোরবান হোক। কোন বিশেষ ব্যাপারই তাঁকে অসময়ে আসতে বাধ্য করেছে। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এসে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তাকে অনুমতি দেয়া হলে তিনি প্রবেশ করলেন। ভিতরে প্রবেশ করার পর নবী (ﷺ) আবু বকরকে বললেনঃ তোমার কাছে যারা বসে আছে, তাদের সবাইকে বাইরে যেতে বল। আবু বকর তখন বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক। এরা তো আপনারই পরিবার। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আবু বকর তখন বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার বাপ মা আপনার জন্য কোরবান হোক। আমি আপনার সহগামী হতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ হ্যাঁ। আবু বকর বললেনঃ আমার বাপ আপনার জন্য কোরবান হোক। এই দু'টি বাহনের একটি আপনি গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ মূল্যের বিনিময়ে।
আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ অতঃপর আমরা তাদের দু'জনের সফর প্রস্তুতি খুব দ্রুত সম্পন্ন করলাম এবং তাদের জন্য খাবার তৈরী করে একটি থলের মধ্যে ভরে দিলাম। আসমা বিনতে আবু বকর নিজের কোমর বন্দ থেকে কিছু অংশ কেটে নিয়ে তা দিয়ে থলেটার মুখ বেঁধে দিলেন। এ জন্যই আসমা (রাঃ) কে যাতুন নিতাকাইন বলা হয়।
আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও আবু বকর (রাঃ) সাওর পর্বতের একটি গুহায় গিয়ে উপনীত হলেন। সেখানে তারা তিন রাত লুকিয়ে থাকলেন। তাদের সাথে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আবু বকরও রাত্রি যাপন করতেন। তিনি ছিলেন একজন চতুর ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন তরুন। তিনি ভোর রাতে তাদের কাছ থেকে রওয়ানা হয়ে মক্কার কুরাইশদের সাথে সকাল বেলা এমনভাবে মিলিত হতেন যেন এখানেই তিনি রাত কাটিয়েছেন। অতঃপর তাদের দু'জনের বিরুদ্ধে যে সব কথা- বার্তা ও ষড়যন্ত্র হত, তার যা কিছুই তিনি শুনতেন তাই মনে রাখতেন এবং রাতের আঁধার ঘনীভূত হয়ে আসার সাথে সাথে ঐ খবরগুলো তাদের কাছে নিয়ে আসতেন।
আবু বকরের গোলাম আমের বিন ফুহায়রা দিনের বেলা তাদের নিকটই দুধেল বকরীর পাল চরিয়ে বেড়াত এবং রাতের কিয়দাংশ অতিবাহিত হলে সে ছাগল নিয়ে তাদের কাছে যেত। তারা দু'জনে অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে সেই বকরীর দুধ পান করে নিশ্চিন্তে রাত কাটিয়ে দিতেন। তারপর শেষ রাতের অন্ধকার থাকতেই আমের ইবনে ফুহায়রা বকরীগুলোকে হাঁকিয়ে নিয়ে যেত। সেই তিন রাতের প্রত্যেক রাতেই তিনি এরূপ করতেন। রাসূল (ﷺ) ও আবু বকর বনী আব্দ আদী গোত্রের দীল শাখার একজন লোককে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পথপ্রদর্শক হিসাবে ভাড়া করলেন। সে পথপ্রদর্শনে খুব অভিজ্ঞ ছিল। এ লোকটি আস বিন ওয়ায়েল আস্ সাহমী পরিবারের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল এবং কুরাইশদের ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁরা তাকে বিশ্বস্ত মনে করে তাদের উট দু'টিকে তার কাছে সোপর্দ করলেন। তার কাছ থেকে এ মর্মে প্রতিশ্রুতি নিলেন যে, তিন রাত পর তৃতীয় সকালে উট দু'টোকে নিয়ে সাওর পর্বতে পৌছে যাবে। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সে নির্ধারিত সময়ে এসে গেল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবু বকরের সাথে আবু বকরের গোলাম আমের ইবনে ফুহায়রা ও পথপ্রদর্শকটি যাত্রা করল। পথপ্রদর্শক তাদেরকে উপকূলের পথ ধরে নিয়ে চলল। সুরাকাহ্ বিন মালেক বলেনঃ কাফের কুরাইশদের দূতরা আমাদের কাছে আসল।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও আবু বকর উভয়ের প্রত্যেককে যে কেউ হত্যা করবে কিংবা বন্দী করবে তার জন্য তারা পুরস্কার ঘোষণা করল। একদিন আমি বনী মুদলিজের এক মজলিসে বসেছিলাম। এমন সময় ঐ গোত্রের একজন লোক এসে আমাদের মধ্যে দাঁড়াল। সে বললঃ হে সুরাকা! আমি এই মাত্র উপকূলের পথে কয়েকজন লোক দেখলাম। আমার ধারণা তারা মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীরাই হবেন। সুরাকা বলেনঃ আমি বুঝতে পারলাম, তারাই হবেন। কিন্তু আমি তাকে বললামঃ ঐ লোকেরা তারা নয়; বরং তুমি অমুককে ও অমুককে দেখেছ। তারা তো আমাদের চোখের সামনে দিয়েই চলে গেল। অতঃপর আমি মজলিসে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তারপর উঠে গিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম এবং আমার দাসীকে আদেশ করলাম সে যেন আমার ঘোড়াটাকে বের করে নিয়ে টিলার আড়ালে গিয়ে ঘোড়াটাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর আমি আমার বর্শাটাকে নিয়ে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আমি বর্শা ফলকের গোড়ার দিকটা নীচু করে ধরে এবং সূচাল দিকটা মাটির উপর রেখে টানতে টানতে আমার ঘোড়ার কাছে এসে পৌছলাম। অতঃপর ঘোড়ায় চড়ে আমি তাকে দ্রুত ছুটালাম। যাতে তা আমাকে দ্রুত পৌছিয়ে দেয়। আমি যখন তাদের নিকটবর্তী হলাম তখন আমাকে নিয়ে ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। ফলে আমি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলাম। আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম এবং তুনীরে (তীর রাখার থলের মধ্যে) হাত ঢুকিয়ে ভাগ্য নিরূপনের তীরগুলো বের করলাম। অতঃপর আমি ঐ তীর দিয়ে এ মর্মে ভাগ্য পরীক্ষা করলাম যে, আমি তাদের ক্ষতি করতে পারব কি না? কিন্তু আমার যা অপছন্দ তা-ই বের হল। তবুও আমি তীরগুলোর ইঙ্গিত উপেক্ষা করে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করলাম। ঘোড়া আমাকে নিয়ে কদম তালে চলতে লাগল।
অবশেষে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পেলাম। তিনি কোন দিকে তাকাচ্ছেন না। কিন্তু আবু বকর খুব বেশী এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। এমন সময় আমার ঘোড়ার সামনের পা দু'টো হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে গেড়ে গেল। ফলে আমি ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়লাম। আমি ঘোড়াটাকে ধমক দিলে সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু সে তার পা দু'টোকে বের করতে সক্ষম হচ্ছিল না। অবশেষে ঘোড়াটি যখন সোজা হয়ে দাঁড়াল, তখন হঠাৎ তার সম্মুখের পদদ্বয়ের চিহ্ন থেকে ধোঁয়ার ন্যায় ধুলি মেঘ আসমান পর্যন্ত ছেয়ে গেল। আমি আবার তীর দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করলাম। কিন্তু এবারও আমার যা অপছন্দ তা-ই প্রকাশ পেল। তখন আমি তাদেরকে নিরাপত্তার কথা বলে আহবান জানালাম। এতে তাঁরা থামলেন। আমি ঘোড়ায় আরোহন করে তাদের নিকটবর্তী হলাম। তাদের কাছে পৌঁছতে আমি যখন বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম, তাতে আমার ধারণা হল যে, রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যাপারটি খুব শীগগীরই ব্যাপক আকার ধারণ করবে। আমি তাঁকে বললামঃ নিশ্চয়ই আপনার গোত্র আপনার ব্যাপারে পুরস্কার ঘোষণা করেছে। লোকেরা তাদের ব্যাপারে যে ইচ্ছা পোষন করত সে সংবাদও আমি তাদেরকে জানিয়ে দিলাম এবং তাদের সামনে আমি পাথেয় অন্যান্য সামগ্রী পেশ করলাম। কিন্তু তাঁরা আমার কোন কিছুই গ্রহণ করলেন না এবং আমার কাছে কিছুই চাইলেন না। শুধু এতটুকু বললেনঃ আমাদের ব্যাপারটি গোপন রেখ। আর আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে একটি নিরাপত্তা পত্র লিখে দেয়ার আবেদন করলাম। তিনি আমের ইবনে ফুহায়রাকে আদেশ করলে সে এক টুকরা চামড়ার মধ্যে ভা আমাকে লিখে দিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন। পথিমধ্যে একদল উষ্ট্রারোহীর দলে যুবায়েরের সাথে নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাক্ষাত ঘটে। এরা ছিল সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকারী ব্যবসায়ী দল। যুবাইর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও আবু বকরকে সাদা কাপড় পরতে দিলেন।
এদিকে মদীনার মুসলমানেরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মক্কা থেকে বেরিয়ে আসার খবর জানতে পারল। তাই তারা প্রতিদিন সকাল বেলা কঙ্করময় ভূমিতে গিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করত এবং দুপুর রোদের তাপে ফিরে যেতে বাধ্য হত। একদিন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর তারা ফেরত গেল এবং নিজ নিজ ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিল। এ সময় এক ইহুদী স্বীয় প্রয়োজনে তাদের কোন একটি উঁচু টিলার উপর আরোহণ করল। সে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও তাঁর সাথীদেরকে সাদা পোষাক পরিহিত অবস্থায় মরীচিকা ভেদ করে আসতে স্পষ্ট দেখতে পেল। তখন ইহুদী লোকটা উচ্চস্বরে চীৎকার করে এ কথাটা না বলে থাকতে পারল না -হে আরব জাতি! তোমরা যে উদ্দেশ্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছ, এই তো তিনি এসে গেছেন। এ কথা শুনা মাত্রই মুসলমানেরা অস্ত্র হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে সাদরে গ্রহণ করার জন্যে বের হয়ে গেল। তাঁরা হারা নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মিলিত হলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে নিয়ে ডান দিকের পথ ধরে চলতে থাকলেন এবং বনী আমর বিন আওফ গোত্রে অবতরণ করলেন। সে দিনটি ছিল রবীউল আওয়াল মাসের কোন এক সোমবার।
তারপর আবু বকর (রাঃ) দাঁড়িয়ে মানুষের সাথে সাক্ষাত করতে লাগলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চুপচাপ বসে রইলেন। আনসারদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে ইতিপূর্বে দেখেনি, তারা এসে আবু বকরকে সালাম করতে লাগল। অবশেষে রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর যখন রোদের তাপ পড়ল এবং আবু বকর এগিয়ে এসে নিজ চাদর দিয়ে তাকে ছায়া দান করলেন তখন লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে চিনতে পারল। বনী আমর বিন আওফ গোত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং ঐ মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ও তাতে নামায আদায় করেন।
তারপর তিনি নিজ উষ্ট্রীর পিঠে আরোহণ করে যাত্রা শুরু করলেন। লোকেরা তাঁর সাথে হেঁটে চলল। অবশেষে উষ্ট্রীটি মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মসজিদের অর্থাৎ বর্তমান মসজিদে নববীর নিকট বসে পড়ল। ঐ স্থানটিতে সে সময় মুসলমানেরা নামায পড়ত এবং ঐ স্থানটি ছিল আসআদ বিন যুরারার আশ্রয়ে প্রতিপালিত সুহাইল ও সাহ্ল নামক দু'জন এতীম বালকের খেজুর শুকাবার খামার। রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উঠাটা যখন তাঁকে নিয়ে বসে পড়ল, তখন তিনি বললেনঃ ইনশা-আল্লাহ্ এটাই আমার আবাসস্থল হবে।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ ) বালক দু'টোকে ডেকে পাঠান এবং মসজিদ তৈরীর উদ্দেশ্যে তিনি তাদের কাছে ঐ জমিটার দাম জানতে চান। তারা বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! দাম নয়, বরং এ জমিটা আপনাকে দান করে দিচ্ছি। কিন্তু নবী (ﷺ) তা দান হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। অবশেষে তিনি জমিটা তাদের কাছ থেকে খরীদ করে নিলেন। তারপর তিনি সেখানে মসজিদ নির্মাণ করলেন। নির্মাণকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লোকদের সাথে ইট বহন করতে থাকেন। ইঁট বহনকালে নবী (ﷺ) বলতেনঃ এ বোঝা বহন খায়বারের বোঝা বহন নয়; এ বোঝা বহন অতীব পুন্যময় ও অত্যন্ত পবিত্র কাজ। তিনি আরো বলতেনঃ নিশ্চয়ই পরকালের প্রতিদানই প্রকৃত প্রতিদান। সুতরাং হে আল্লাহ্! আনসার ও মুহজিরদের প্রতি রহম করুন। (আলোকিত প্রকাশনীঃ ১৫৫২)