ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর স্ত্রীগণের মধ্যে থেকে যে দু’জন মহিলা সম্পর্কে ‘উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করার জন্য বহুদিন যাবৎ আগ্রহ প্রকাশ করে আসছিলাম যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেনঃ “তোমাদের দু’জনের হৃদয় অন্যায় প্রবণ হয়েছে মনে করে তোমরা যদি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্র দিকে ফিরে আসো তাহলে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন”। (সূরাহ্ আত্ তাহরীম ৬৬ : ৪)
পরিশেষে ‘উমার (রাঃ) হাজ্জ পালনের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন এবং আমিও হাজ্জ পালনের জন্য তাঁর সফরসঙ্গী হলাম। এরপর (হাজ্জ সমাপন করে ফেরার পথে) আমরা কোন এক রাস্তা দিয়ে চলার সময় ‘উমার (রাঃ) এক পার্শ্বে মোড় নিলেন। আমিও পানির বদনাসহ তাঁর সঙ্গে রাস্তার পাশে গেলাম। তিনি তাঁর হাজত পূরণ করলেন এবং আমার কাছে এলেন। আমি তাঁর উভয় হাতে পানি ঢাললাম, তিনি ওযু করে নিলেন। তখন আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণের সে দুজন মহিলা কারা ছিলো যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ
‘উমার (রাঃ)বললেন, হে ইবনু ‘আব্বাস! এতো তোমার জন্য আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে হচ্ছে (তুমি এত বিলম্বে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কেন?) যুহরী (রহঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! তিনি [‘উমার (রাঃ)] জিজ্ঞাসিত বিষয়টি (ইবনু ‘আব্বাসের এ বিষয়ে বিলম্বে প্রশ্ন করাকে) অপছন্দ করলেও তা বর্ণনা করতে কিছুই গোপন করলেন না। তিনি বললেন, তাঁরা দুজন ছিল হাফ্সাহ্ ও ‘আয়িশা (রাঃ)। এরপর তিনি ঘটনার বিবরণ দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, আমরা কুরায়শ বংশের লোকেরা (জাহিলিয়্যাত যুগে) আমাদের স্ত্রীদের উপর প্রভুত্ব করে চলতাম। যখন আমরা মাদীনায় এলাম তখন এমন লোকদের দেখতে পেলাম যাদের উপর তাদের স্ত্রীরা প্রভাব বিস্তার করছিল। এমনি পরিবেশে আমাদের নারীরা তাদের (মাদীনাহ্বাসীদের) নারীদের অভ্যাস রপ্ত করতে শুরু করে দেয়। তিনি বলেন, সে সময় মাদীনার উচ্চভূমির অধিবাসী বানূ উমাইয়্যাহ্ ইবনু যায়দের বংশধরদের মধ্যে আমার বসতবাটি ছিল। এরপর একদিন আমি আমার স্ত্রীর উপর রাগান্বিত হলাম। সে আমার কথার প্রত্যুত্তর করতে লাগল। আমি আমার সঙ্গে তার প্রত্যুত্তর করাকে খুবই অপ্রিয় মনে করলাম। সে বলল, আপনার সঙ্গে আমার কথার প্রত্যুত্তর করাকে অপছন্দ করছেন কেন? আল্লাহর কসম! নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও তো তাঁর সঙ্গে কথার প্রত্যুত্তর করে থাকে। এমনকি তিনি তাঁদের কেউ কেউ তাঁকে সারা দিন রাত বিচ্ছিন্ন করে রাখে। তখন আমি রওনা করে (আমার মেয়ে) হাফ্সার কাছে চলে এলাম। এরপর আমি তাকে বললাম, তুমি কি রসূলুল্লাহ (সাঃ,-এর সঙ্গে প্রত্যুত্তর কর? সে বলল, হাঁ। আমি বললাম, তোমাদের মধ্যে কি কেউ তাঁকে সারা দিন রাত বিচ্ছিন্ন করে রাখে? সে বলল, হাঁ। আমি বললাম, তোমাদের যে কেউ এরূপ আচরণ করে সে আসলেই দুর্ভাগা ও ক্ষতিগ্রস্ত। তোমাদের মধ্যে কি কেউ বিপদমুক্ত ও নিরাপদ হতে পারে যদি আল্লাহ তাঁর রসূলের ক্রোধের কারণে ক্রুদ্ধ হন। এরূপ হলে তো তার ধ্বংস অনিবার্য। তুমি কখনো রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে তাঁর কথার প্রত্যুত্তরে লিপ্ত হয়ো না এবং তাঁর কাছে কোন কিছু দাবী করবে না, তোমার মনে যা চায় তা আমার কাছে চাইবে। তোমার সতীন তোমার চাইতে অধিকতর সুন্দরী এবং রসূলুল্লাহ-(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট তোমার তুলনায় অধিকতর প্রিয়পাত্রী। সে যেন তোমাকে ধোঁকায় পতিত না করে ফেলে। এর দ্বারা তিনি [‘উমার (রাঃ)] ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বুঝাতে চাইছেন। তিনি বলেন, আমার একজন আনসারী প্রতিবেশী ছিলেন। আমরা দুই বন্ধু পালাক্রমে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে (তাঁর মজলিসে) যেতাম। একদিন তিনি উপস্হিত থাকতেন, অপরদিন আমি উপস্হিত হতাম। এভাবে তিনি আমাকে ওয়াহী ইত্যাদির খবর দিতেন, আমিও অনুরূপ খবর তাকে পৌছাতাম। সে সময় আমরা বেশ করে আলোচনা করতে ছিলাম যে, গাস্সানী বাদশাহ নাকি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা জন্য ঘোড়ার ক্ষুরে নাল লাগাচ্ছে। একদিন আমার বন্ধু রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে গেলেন এবং ‘ইশার সময় (রাত্রিকালে) আমার কাছে (ফিরে) এলেন। তিনি এসে আমার ঘরের দরজা খটখটালেন এবং আমাকে ডাকলেন। আমি তাঁর ডাক শুনে তাঁর কাছে ছুটে এলাম। তিনি বললেন, একটি বিরাট কাণ্ড ঘটে গেছে। আমি বললাম, সে কী? গাস্সানীরা তাহলে এসে গেছে নাকি? তিনি বললেনঃ না, তারা আসেনি বরং ব্যাপার তার চাইতেও সাংঘাতিক ও দীর্ঘতর। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সহধর্মিনীদের ত্বলাক্ব দিয়েছেন। তখন আমি বললাম, হাফ্সাহ্ হতাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি পূর্ব থেকেই ধারণা পোষণ করে আসছিলাম যে, এমন একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এরপর আমি ফাজরের সলাত আদায় করে প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় পরিধান করলাম। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে সরাসরি হাফসার কাছে উপস্থিত হলাম। তখন সে কাঁদছিল। আমি বললাম, রসূলল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তোমাদেরকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন। সে (শ্বাসরুদ্ধ করে) বলল, আমি জানি না। তবে তিনি তাঁর ঐ বালাখানায় নির্জনবাস করছেন। আমি তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ খাদিমের কাছে বললাম ‘উমারের (প্রবেশের) জন্য অনুমতি প্রার্থনা করো। এরপর সে ভিতরে প্রবেশ করল এবং পরক্ষনেই বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকাল। এরপর সে বলল, আমি তাঁর (রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর) কাছে আপনার কথা উত্থাপন করেছি কিন্তু তিনি নীরব আছেন (কিছুই বলছেন না)। অতঃপর আমি চলে এলাম এবং মিম্বারের কাছে এসে বসে পড়লাম। তখন আমি দেখতে পেলাম সেখানে একদল লোক বসা আছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি খানিকটা বসলাম। এরপর আমার মনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমার উপর প্রভাব বিস্তার করল। তখন আমি সেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটির কাছে চলে এলাম এবং তাকে বললাম, ‘উমারের জন্য ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে এসো। সে ভেতরে প্রবেশ করল এবং বেরিয়ে এসে আমাকে বলল, আমি আপনার বিষয়টি তাঁর সামনে উত্তাপন করেছি কিন্তু তিনি নীরব আছেন। আমি যখন পিছনে ফিরে চললাম অমনি সে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটি আমাকে ডাক দিয়ে বলল, আপনি প্রবেশ করুন; তিনি আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। আমি ভিতরে প্রবেশ করে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম দিলাম। আমি দেখতে পেলাম, তিনি খেজুর পাতার তৈরি একটি চাটাই এর উপর হেলান দিয়ে আরাম করছেন যা তাঁর পাঁজরে চাটাইয়ের দাগ বসিয়ে দিয়েছে। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রসূল! আপনি কি আপনার সহধর্মিনীগণকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন? তিনি তাঁর মাথা উঁচিয়ে আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং বললেন, না। আমি বললাম, আল্লাহ আকবার। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। হে আল্লাহ্র রসূল! আপনি বিষয়টি ভেবে দেখূনঃ আমরা যখন মাদীনায় এলাম তখন দেখতে পেলাম, এখানকার পুরুষ লোকদের উপর তাদের স্ত্রীরা প্রভুত্ব বিস্তার করে আসছে। এতে তাদের দেখাদেখি আমাদের স্ত্রীরাও তাদের অভ্যাস রপ্ত করতে শুর করে দিয়েছে। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি রাগান্বিত হলাম। অমনি সে আমার কথার প্রত্যুত্তর শুরু করে দিল। আমি তার প্রত্যুত্তর করাকে খুবই খারাপ মনে করলাম। সে বলে ফেলল, আপনার সঙ্গে প্রত্যুত্তর করাকে আপনি এত খারাপ মনে করছেন কেন? আল্লাহ্র কসম! নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও তো তাঁর কথার প্রত্যুত্তর করে থাকে, এমনকি তাঁদের কেউ কেউ তাঁকে সারা দিন রাত বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি বললাম, তাঁদের মধ্যে কেউ এমন আচরন করলে সে হতভাগ্য ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে থেকে কারো উপর রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাগান্বিত হওয়ার কারণে যদি আল্লাহ ক্রদ্ধ হয়ে যান তাহলে তার পতন ও ধ্বংস অনিবার্য। তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃদু স্বরে হেসে উঠলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রসূল! আমি হাফসার কাছে গিয়ে তাকে বলে দিয়েছি যে, তোমার সতীন সৌন্দর্যে তোমার তুলনায় অগ্রগামিনী এবং রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে তোমার চাইতে অধিকতর আদরিনী- তা যেন তোমাকে ধোঁকার জালে আবদ্ধ করতে না পারে। এতে আবার তিনি মুচকি হাসি দিলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রসূল! আমি আপনার সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে চাই। তিনি বললেনঃ হাঁ, করতে পার। অতঃপর আমি বললাম এবং মাথা উঠিয়ে তাঁর কোঠার (এদিক ওদিক) তাকিয়ে দেখলাম। আল্লাহ্র কসম! আমি সেখানে তিনখানি চামড়া ব্যতীত নয়ন জুড়ানো তেমন কিছু দেখতে পাইনি। আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রসূল! আপনি আল্লাহ্র কাছে দু’আ করুন যেন তিনি আপনার উম্মাতকে প্রাচুর্য দান করেন। পারসিক ও রোমাকদের তো বৈষয়িক সুখ সমৃদ্ধি দান করা হয়েছে অথচ তারা আল্লাহ্র ‘ইবাদাত (আনুগত্য) করে না। তখন তিনি সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, হে খাত্ত্বাবের পুত্র! তুমি কি সন্দেহের জালে আচ্ছন্ন আছো। আসলে তারা তো এমন সম্প্রদায় যাদের পার্থিব জীবনে ক্ষণিকের তরে সুখ সমৃদ্ধি দান করা হয়েছে। আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রসূল! আপনি আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি তাঁর সহধর্মিনীগণের আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে কসম করেছিলেন যে, দীর্ঘ একমাস তাদের সঙ্গে একত্রে অতিবাহিত করবেন না। শেষাবধি আল্লাহ তাঁকে এ আচরণের জন্য তিরষ্কার করেন। (ই.ফা. ৩৫৫৮, ই.সে. ৩৫৫৮)