আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, যখন আমার বিষয়ে চর্চা হচ্ছিল যে বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না, তখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার প্রসঙ্গে বক্তব্য দিতে দাঁড়ালেন। তিনি তাশাহহূদ পড়ে আল্লাহ্ তা'আলার যথোপযুক্ত সুনাম ও গুনাগুন করার পর বলেনঃ তারপর তোমরা আমাকে ওইসব ব্যক্তির বিষয়ে বুদ্ধি দাও, যারা আমার সহধর্মিণীর ব্যাপারে অপবাদ দিয়েছে। আল্লাহ্র কসম! আমি আমার পরিবারের (স্ত্রীর) মধ্যে কখনো কোন দোষ দেখিনি। এসব ব্যাক্তি যার ব্যাপারে বদনাম রটিয়ে বেড়াচ্ছে, আল্লাহ্র কসম আমি এ ধরনের দুষ্কর্ম তার মধ্যে কখনও দেখিনি। সে (সাফওয়ান) আমার অনুপস্থিতিতে কখনও আমার ঘরে ঢুকেনি, আমি যখন উপস্থিত থাকতাম তখনই সে আমার ঘরে ঢুকত। আমি যখন সফরের কারনে ঘরে অনুপস্থিত থাকতাম তখন সেও আমার সঙ্গেই থাকতো।
সা'দ ইবনু মু'আয (রাঃ) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসুল! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এদের ঘাড় উড়িয়ে দেই। তখন খাযরাজ বংশের এক লোক উঠে দাঁড়ালো। হাসসান ইবনু সাবিতের মা এই বংশের সন্তান। লোকটি বলল তুমি মিথ্যাবাদী। আল্লাহ্র কসম, এরা যদি আওস গোত্রের লোক হত, তাহলে তুমি তাদের ঘাড় উড়িয়ে দেওয়া কখনও পছন্দ করতে না। তর্ক-বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যে, আওস ও খাজরায বংশদ্বয়ের মধ্যে মসজিদের ভেতরেই মারামারি লেগে যাওয়ার উপক্রম হল। অথচ এ (অপবাদ) বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। ওইদিন সন্ধারাতে আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে গেলাম। আমার সাথে মিসতাহর মাও ছিল। সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বলল, মিসতাহ শেষ হোক। আমি বললাম, হে! তুমি মা হয়ে ছেলের অমঙ্গল কামনা করছো? সে চুপ হয়ে গেলো। সে আবার হোঁচট খেলো এবং বলল, মিসতাহ শেষ হোক। আমি তাকে তিরস্কার করে বললাম, হে! তুমি কেমন মা, নিজের ছেলের অমঙ্গল ডাকছ? সে চুপ হয়ে গেলো। সে তৃতীয় বার হোঁচট খেলো এবং বলল, মিসতাহর সর্বনাশ হোক। আমি তাকে কঠোরভাবে বললাম, তুমি কেমন মা, নিজের ছেলের অমঙ্গল চাচ্ছ? সে বলল, আল্লাহ্র কসম আমি তোমার জন্যই তাকে গালমন্দ করছি। আমি প্রশ্ন করলাম আমার জন্য কিভাবে? ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, সে আমার নিকট সমস্ত ব্যাপার বর্ণনা করলো। আমি (তা শুনে) বললাম, এইসব কথা রটেছে নাকি? সে বলল হ্যাঁ। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি বাড়ি ফিরে আসলাম। আল্লাহর কসম! আমার এমন অবস্থা হল যে, যে জন্য এসেছিলাম সে প্রয়োজনের কথা ভুলেই গেলাম। আমার গায়ে জ্বর এসে গেলো। আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বললাম, আমাকে আমার বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিন। তিনি আমার সাথে একটি বালককে দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। আমি ঘরে ঢুকে উম্মু রুমানকে (মাকে) ঘরের নিচের অংশে দেখতে পেলাম। আর আবূ বকর (রাঃ) ঘরের উপরি তলে কুরআন পড়ছিলেন। মা প্রশ্ন করলেন, কন্যা তুমি কেন এসেছো? ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি মাকে সম্পূর্ণ বিষয়টি খুলে বললাম। কিন্তু আমি যেভাবে ভেঙ্গে পড়েছি তিনি ততটা ভারাক্রান্ত নন। তিনি বললেন, “কন্যা! ব্যাপারটাকে হাল্কা ভাবে নাও। আল্লাহর কসম! কোন পুরুষের সুন্দরী স্ত্রী থাকলে, সে তাঁর প্রিয়পাত্রী হলে এবং তাঁর সতীন থাকলে তারা তাঁর সাথে হিংসা করবে না, তার বিষয়ে কিছু রটাবে না এরুপ কমই হয়ে থাকে।
মোটকথা আমি যতটা দুঃখ পেলাম মা ততটা পেলেন না। আমি মাকে প্রশ্ন করলাম, আব্বাও কি ব্যাপারটা জানেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি ভারাক্রান্ত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আবু বকর (রাঃ) আমার কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি ঘরের উপরিতলে কুরআন পাঠ করছিলেন। তিনি নেমে এসে মাকে বললেন, ওর কি হয়েছে? মা বললেন, ওর বিষয়ে যে সব মিথ্যা বলা হচ্ছে, এ সংবাদ সে শুনে ফেলেছে। এ কথা শুনে বাবার দু চোখে পানি এলো। তিনি বললেন, কন্যা! তোমাকে আল্লাহ তা’আলার নামে কসম করে বলছি, তুমি তোমার ঘরে ফিরে যাও। আমি ঘরে ফিরে এলাম।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার ঘরে এসে আমার কাজের মেয়েকে আমার বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি তার মধ্যে কোন দোষ দেখিনি। তবে এতটুকু যে, সে ঘুমিয়ে পড়ত, আর বকরি এসে তার পেষা আটা খেয়ে যেত। তাঁর কিছু সাহাবী মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বললেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট সত্য কথা বল। তারা তাকে অনেক দাবালেন ও ধমকালেন। সে বলল, সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর কসম! আমি তাঁর ব্যাপারে তাই জানি স্বর্ণকার খাঁটি রঙ্গিন সোনা প্রসঙ্গে যা জানে। যে ব্যক্তিকে এই অপবাদের সাথে জড়ান হয়েছিল তাঁর কানেও এ খবর পৌঁছল। সে বলল, সুবহানআল্লাহ! আল্লাহ্র কসম! আমি কখনও কোন নারীর সতর খুলিনি। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, সে আল্লাহ্ তা'আলার রাস্তায় শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে।
তিনি বলেন, আমার পিতা মাতা খুব ভোরে আমার নিকট এলেন। তারা আমার নিকট থাকতেই রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসরের নামাজ আদায় করে আমার ঘরে এলেন। আমার পিতা মাতা আমার ডান দিক বাঁ দিক হতে আমাকে ঘিরে বসেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কালিমা শাহাদাত পাঠ করলেন, আল্লাহ্ তা'আলার যথোপযুক্ত সম্মান ও গুনাগুন করলেন, তারপর বললেনঃ হে ‘আয়িশাহ, তুমি যদি কোন মন্দ কাজ করে থাকো অথবা নিজের উপর জুলুম করে থাকো, তবে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা চাও। কেননা আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, এ সময় আনসার বংশের একজন স্ত্রীলোক আসে। সে দরজার নিকট বসে ছিল। আমি বললাম, আপনি কি এ মহিলাটির সামনে এ কথা বলতে লজ্জা বোধ করছেন না? মোটকথা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওয়াজ-নসীহত করলেন। আমি আমার পিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, আপনি তাঁর কথার উত্তর দিন। তিনি বললেন, আমি তাঁকে কি উত্তর দিবো? আমি আমার মা এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, আপনি তাঁকে এর উত্তর দিন। তিনিও বললেন, আমি তাঁকে কি বলবো?
তাদের কেউই যখন উত্তর দেননি, তখন আমি কালেমা শাহাদাত তিলাওয়াত করলাম, আল্লাহ্ তা'আলার যথোপযুক্ত সুনাম ও প্রশংসা করলাম, তারপর বললাম, আল্লাহ্র কসম! আমি যদি আপনাদের বলি, আমি কখনও তা করিনি এবং আল্লাহ্ তা'আলা সাক্ষী আছেন, আমি সত্যবাদিনী, তা আপনাদের নিকট আমার কোন উপকারে আসবেনা। কেননা আপনারা তা আলোচনা করেছেন এবং তাতে আপনাদের মন রঞ্জিত হয়েছে। আর আমি যদি বলি, আমি করেছি এবং আল্লাহ্ তা'আলা জানেন আমি তা করিনি, তখন আপনারা বলবেন, সে নিজেই নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে। আল্লাহ্র কসম! আমি আপনাদের এবং আমার জন্য কোন উদাহরন খুঁজে পাচ্ছি না। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি ইয়াকুব (আঃ) এর নাম স্মরণ করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। শুধু “ইউসুফ এর বাবা” স্মরনে আসছিলো। তিনি যখন বলেছিলেনঃ "পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা'আলা আমার সাহায্যস্থল"- (সুরা-ইউসুফ ১৮)। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, ঠিক সে সময় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট ওয়াহি অবতীর্ণ হতে লাগলো। আমরা চুপ থাকলাম। তাঁর উপর হতে ওয়াহীর অবস্থা দূর হলে আমি তাঁর মুখমন্ডলে আনন্দের ছাপ দেখতে পেলাম। তিনি তাঁর মুখমণ্ডলের ঘাম মুছছেন আর বলছেনঃ হে ‘আয়িশাহ, তোমার জন্য সুসংবাদ। আল্লাহ্ তা'আলা তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করেছেন। আয়িশা (রাঃ) বলেন, আমি তখন উত্তেজিত অবস্থায় ছিলাম। আমার পিতা মাতা আমাকে বললেনঃ উঠে তাঁর নিকট যাও। আমি বললাম, আল্লাহ্র কসম! আমি তাঁর নিকট উঠে যাব না, তাঁর সুনাম ও করব না এবং আপনাদের প্রশংসাও করব না। বরং আমি সে আল্লাহ্ তা’আলার সুনাম করবো যিনি আমার নির্দোষিতার ওয়াহী অবতীর্ণ করেছেন। আপনারা এ অপবাদ শুনেছেন, কিন্তু প্রত্যাখ্যান বা প্রতিহত করেন নি।
‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, জাহাশ-কন্যা যাইনাবের দীনদারীর জন্য আল্লাহ্ তা'আলা তাকে হিফাজাত করেছেন। সে ভালো ব্যতিত কখনও অন্য কিছু বলেনি। কিন্তু তাঁর বোন হামনা ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যারা এ অপবাদ রটায় তাদের মধ্যে ছিলঃ মিসতাহ, হাসান ইবনু সাবিত ও মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই। সে অপবাদ রটাত এবং তা ছড়িয়ে বেড়াত। সে ও হামনা ছিল এই আপত্তিকর অপবাদ ছড়ানোর বড় হোতা। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আবু বকর (রাঃ) কসম করেন যে, তিনি আর কখনও মিসতাহর কোনভাবে উপকার করবেন না (ভরন পোষণ বহন করবেন না)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা'আলা আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ "তোমাদের মধ্যে যারা (আবু বকর কে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে) ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন কসম না করে যে, তারা আত্মীয়, গরীব ও আল্লাহ্ তা'আলার পথে মুহাজিরদের (মিসতাহ কে লক্ষ করে বলা হচ্ছে) কিছুই দেবে না ... তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের কে মাফ করুন?" আল্লাহ্ তালা বড়ই ক্ষমাশীল, পরম করুনাময়" -(সূরা আন-নূর ২২)। আবু বকর (রাঃ) বলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই আপনার ক্ষমাপ্রার্থী। তিনি আগের মত মিসতাহর ভরণপোষণের ভার বহন করেন।
সহীহঃ বুখারী (৪৭৫৭), মুসলিম।