HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

সূদ

লেখকঃ শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

১২
অর্থনৈতিক কুফল
৮। সূদের শোষণ সার্বিক, দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক প্রকৃতির :

সূদভিত্তিক ব্যাংক ও বীমা ব্যবসার কারণে ছোট ছোট সঞ্চয় সমাবেশ ও সঞ্চালনের সুযোগে বিরাট পুঁজি গড়ে উঠছে। বীমা ও ব্যাংক ব্যবসায়ে নিযুক্ত মুষ্টিমেয় ব্যক্তি এই পুঁজি চড়া সূদে ঋণ দিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। একই সাথে ঋণ দেবার ক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্রের বাছ-বিচারের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক শ্রেণীবৈষম্য। অর্থাৎ, শ্রেণীবৈষম্য হরাস না পেয়ে আরও ব্যাপক, গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। উপরন্তু বাংলাদেশের সূদী ব্যাংকসমূহের অনেকগুলো তাদের প্রদত্ত সূদকে ক্ষেত্রবিশেষে ‘মুনাফার’ লেবাস পরিয়ে চালিয়ে দেবার অপচেষ্টাও করছে। ফলে প্রতারিত হচ্ছে সরলপ্রাণ ধর্মভীরু মানুষ।

সূদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে শোষণ যে কত সার্বিক ও কৌশলপূর্ণ তা একটা উদাহরণের সাহায্যে তুলে ধরা হ’ল। ব্যাংকে আমানতকারীরা যে অর্থ সঞ্চিত রাখে তার পুরোটা ব্যাংক কখনই নিজের কাছে গচ্ছিত রাখে না। সাধারণতঃ ঐ অর্থের ৯০% ঋণ দিয়ে থাকে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের। তারা এই অর্থের জন্য ব্যাংককে যে সূদ দেয় তা আদায় করে নেয় জনগণের নিকট হ’তেই তাদের প্রদত্ত সেবা ও পণ্যসামগ্রীর মূল্যের সঙ্গেই। এদের মধ্যে ঐসব আমানতকারীরাও রয়েছে যারা ব্যাংকে অর্থ রেখেছে সূদের মাধ্যমে নিশ্চিত নিরাপদ আয়ের উদ্দেশ্যে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদায়কৃত সূদ হ’তে একটা অংশ ব্যাংক পরিচালনা ও শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ডের জন্য রেখে বাকি অংশ আমানতকারীদের হিসাবে জমা করে দেয় তাদের প্রাপ্য সূদ বাবদ। এভাবেই ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলো মাছের তেলে মাছ ভেজে নেয়। অন্যদিকে প্রতারিত হয় আমানতকারীরা। কিন্তু তারা কি কখনও তা তলিয়ে দেখার অবকাশ পায়? বরং বছর শেষে পাশ বই বা কম্পিউটারাইজড একাউন্ট শীটে যখন জমার বিপরীতে সূদ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দেখে তখন তারা দৃশ্যতঃ পুলকিত বোধ করে। একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা পরিস্কার করে তুলে ধরা যেতে পারে।

উদাহরণ-১

লেনদেনের বিবরণ

সূদের হার

ক. আমানতকারী (=ভোক্তা) ব্যবসায়ী/উৎপাদনকারীকে সূদ বাবদ মূল্যের আকারে প্রদান করে-

খ. আমানতকারী ব্যাংক হ’তে সূদ বাবদ পায়-

১৬%



-৮%

=(ক-খ) ব্যাংকে সঞ্চয়ের বিপরীতে আমানতকারীর নীট লোকসান দাঁড়ায়-

= ৮%

বিদ্যমান সূদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতি ও আইন এবং সমষ্টি অর্থনীতির (Macroeconomics) কর্মকৌশলের প্রেক্ষিতে কোনভাবেই এই অদৃশ্য অথচ প্রকৃতই লোকসান তথা শোষণ প্রতিরোধের উপায় নেই। এর প্রতিবিধান রয়েছে একমাত্র ইসলামী বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং পদ্ধতির কর্মকৌশলের মধ্যে।

৯। সূদের কারণেই ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে :

কৃষকেরা ফসল ফলাবার তাগিদেই নিজেরা খেতে না পেলেও ঋণ করে জমি চাষ করে থাকে। প্রয়োজনের সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়া এদের জন্যে দুরূহ। তাই গ্রামেরই সচ্ছল লোকের দ্বারস্থ হয় তারা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একদল লোক এদেরকে সাহায্য করার জন্যে তৈরীই থাকে। গ্রামাঞ্চলে এসব সূদখোররা সাধারণতঃ ‘মহাজন’ নামেই অধিক পরিচিত। এরা শুধু গ্রামাঞ্চলেই আছে এমন নয়, নগরে-বন্দরে, গঞ্জে-মোকামেও এরা পরিচিত মুখ। এদের অনেকে আবার দাদন ব্যবসায়ী হিসাবেও পরিচিত। এরা প্রান্তিক কৃষক, বর্গাচাষী, ক্ষুদে ব্যবসায়ী সকলকেই টাকা ধার দেয়, ধান যোগান দেয়। শর্ত থাকে ফসল উৎপাদনের মৌসুমের শুরুতে অথবা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে নেওয়া ঋণের জন্যে ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিমাসে প্রতি হাযারে টাঃ ২০০/= হারে সূদ দিতে হবে। অথবা প্রতি মণ ধানের বদলে ঐ সময়ে দ্বিগুণ ধান দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। যুক্তি হ’ল, এরা টাকা বা ধান ঋণ দিয়ে ফসল উৎপাদনে সহায়তা করেছে। সুতরাং, এই উপকার বা সহযোগিতার বিনিময়ে কিছু ‘পারিতোষিক’ তো প্রাপ্য হ’তেই পারে। উল্লেখ্য, জাহিলীয়াতের যুগে আরব ভূখন্ডে এভাবে খেজুর লগ্নির প্রথা বহুল প্রচলিত ছিল। ফলে দেখা যায়, ফসল তোলার পর নগদ অর্থ বা ফসলের সূদসহ ঋণ পরিশোধের পর কৃষকের হাতে আর তেমন কিছুই উদ্বৃত্ত থাকে না। তাকে আবার ঋণ করতে হয় সংসার চালাবার জন্যে। ঋণের এই অশুভ চক্র হ’তে সে বেরিয়ে আসতে পারে না। ক্রমেই তার ঋণের পরিমাণ বাড়ে। এক সময়ে জমি-জিরাত ভিটেমাটি দখল করে নেয় জমিখেকো মহাজনরা।

কৃষকরা এই ঋণ শুধু যে গ্রামের মহাজনের কাছ থেকেই নেয় তা নয়। সরকারের কৃষি ব্যাংক থেকেও নেয়, নেয় অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সমবায় প্রতিষ্ঠান থেকেও। যথোপযুক্ত বা আশানুরূপ ফসল হওয়া সব সময়েই অনিশ্চিত। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো রয়েছেই। যদি ফসল আশানুরূপ না হয় বা আকস্মিক বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসল খুবই কম হয় বা মোটেই না হয় তবু কিন্তু কৃষককে নির্দিষ্ট সময়ান্তে সূদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। তখন হয় তাকে আবার নতুন ঋণের সন্ধানে বের হ’তে হয় অথবা জমি-জিরাত বেচে কিংবা বন্ধক রেখে সূদ আসলসহ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। তা না হ’লে কি মহাজন, কি ব্যাংক সকলেই আদালতে নালিশ ঠুকে তার সহায়-সম্পত্তি ক্রোক করিয়ে নিবে। নিলামে চড়াবে দেনার দায়ে।

প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে একটা উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। ধরা যাক, কোন ব্যাংক হ’তে আলু চাষের জন্য কৃষক ১৬% সূদে টাকা ১০,০০০/= ঋণ নিল। এজন্যে তাকে বছর শেষে বাড়তি টাঃ ১৬০০/= পরিশোধ করতে হবে। তাই ঐ কৃষকের জমিতে অবশ্যই আরও বেশী আলু উৎপন্ন হওয়া দরকার। আলুর দাম গড়ে টাঃ ৪০০/= মণ হ’লে বাড়তি চার মণ আলু উৎপাদন হওয়া চাই। মজা হ’ল আলুর ফলন বেশী হ’লে তা সবারই ক্ষেতে হবে। ফলে দাম পড়ে যাবে। আলুর দাম যদি মণ প্রতি টাঃ ৪০০/= হ’তে টাঃ ৩৫০/= তে নেমে আসে তাহ’লে চাষীর মণ প্রতি টাঃ ৫০/= অর্থাৎ ঐ আলুতেই তার টাঃ ২০০/= ঘাটতি থেকে যাবে। মোট বিক্রিত আলুতে ঘাটতির পরিমাণ যে আরও বেশী হবে তা বলাই বাহুল্য। উপরন্তু ঋণের পরিমাণ যত বেশী হবে ঘাটতির পরিমাণও তত বেশী হবে। বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র কী? ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের ২৭% ভূমিহীন ছিল। কিন্তু মাত্র ৩৭ বছরের মধ্যে এর চিত্র পাল্টে গেছে। ১৯৮৩-৮৪ সালের কৃষি শুমারী হ’তে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সংখ্যা মোট কৃষিনির্ভর পরিবারের ৬৮.৮% এ দাঁড়িয়েছে (সূত্র : স্ট্যাটিস্টিকাল পকেট বুক অব বাংলাদেশ ১৯৯৬, বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস, পৃ. ১৭৯)।

প্রসঙ্গতঃ মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর হ’তেই এদেশে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কৃষকদের অব্যাহতভাবে ঋণ দেওয়া শুরু করে। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা প্রদান রহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে তাঁর নির্দেশে দেওয়া একশ কোটি টাকার আই.আই.সি.পি. ঋণ দেওয়া হয়, যার প্রায় সবটাই আজও অনাদায়ী রয়ে গেছে। এরপরও বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা মুতাবিক তখন পর্যন্ত কৃষকদের কাছে প্রাপ্য পাঁচ হাযার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ মওকুফ করা হয়েছিল। এরপরেও কেন দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে? এর অন্যতম প্রধান কারণ সূদভিত্তিক ঋণ প্রদান বা গ্রহণ। শুধু এদেশেই নয়, যে সমস্ত দেশে কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক কৌশলগত কোন পরিবর্তন ঘটেনি অথবা মূল্য সহায়তা (price support) বা উপাদান ভর্তুকী (input subsidy) আকারে বিশেষ সরকারী সহায়তা দেওয়া হয়নি সেসব দেশে সূদনির্ভর লেনদেনে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা ক্রমেই ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে।

১০। সূদের ফলে একচেটিয়া কারবারের প্রসার ঘটে :

বড় বড় ব্যবসায়ীরা যে শর্তে ও যে সময়ের জন্য ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান হ’তে ঋণ পেতে পারে ছোট ব্যবসায়ীরা সেভাবে ঋণ পায় না। এজন্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও তারতম্য ঘটে। সে প্রতিযোগিতায় অসম সুবিধা ভোগের সুযোগ নিয়ে বড় কারবারী বা ব্যবসায়ী আরো বড় হয়। ছোট কারবারী বা ব্যবসায়ী টিকতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যায়। বৃহদায়তন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাই। এই জাতীয় শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুধু ব্যাংকই নয়, বিনিয়োগ কোম্পানী ও অনৈসলামী সরকারসমূহ যে বিশেষ সুবিধা ও ন্যূনতম সূদের হারে টাকা ঋণ দিয়ে থাকে, ছোট বা ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের জন্য আদৌ সে সুযোগ নেই। ফলে বড় শিল্পপতিরা প্রতিযোগিতাহীন বাজারে একচেটিয়া কারবারের সমস্ত সুযোগ লাভ করে। পরিণামে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো প্রকট হয়।

১১। সূদের কারণে মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যেই পুঁজি আবর্তিত হয় :

সূদ আদায় ও প্রদানের সামর্থ্যের কারণেই বিত্তবান ঋণদাতা ও গ্রহীতাদের হাতেই পুঁজি আবর্তিত হ’তে ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগ কোম্পানী তথা অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান এবং ধনিক শ্রেণীর মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন বা যোগসাজশ লক্ষ্য করা যায়। উপরন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে, অবৈধভাবে বা অন্য কোন উপায়ে কেউ প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করতে পারলে সূদের বদৌলতেই সে তা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে যেতে পারে। পক্ষান্তরে পর্যাপ্ত জামানত দিতে না পারার কারণে স্বল্পবিত্তদের এখানে কোন ঠাঁই নেই। ফলে বিত্তশালীরা একাধারে সমাজকে শোষণ করে এবং একচেটিয়া কারবারেরও প্রসার ঘটে। সমাজে সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক নানা বিপর্যয়। এজন্যেই আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আল-কুরআনে বলেছেন, كَيْ لاَ يَكُوْنَ دُوْلَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ، ‘সম্পদ যেন কেবলমাত্র (তোমাদের) ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়’ (হাশর ৫৯/৭)।

১২। সূদ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ :

সূদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনকারী উৎপাদন খরচের উপর পরিবহন খরচ, শুল্ক (যদি থাকে), অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় এবং স্বাভাবিক মুনাফা যোগ করে পণ্যসামগ্রীর বিক্রি মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে দ্রব্যের এই স্বাভাবিক মূল্যের উপর উপর্যুপরি সূদ যোগ করে দেওয়া হয়। দ্রব্য বিশেষের উপর তিন থেকে চার বার পর্যন্ত, ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশীবার সূদ যুক্ত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ আমাদের দেশের বস্ত্রশিল্পের কথাই ধরা যেতে পারে। এই শিল্পের প্রয়োজনে তুলা আমদানী করতে হয়। আমদানীকারকরা ব্যাংক হ’তে যে ঋণ নেয় বিদেশ থেকে তুলা আমদানীর জন্য তার সূদ যুক্ত হয় ঐ তুলার বিক্রয় মূল্যের উপর। এরপর সুতা তৈরীর মিল ব্যাংক হ’তে যে ঋণ নেয় তারও সূদ যুক্ত হয় ঐ তুলা থেকে তৈরী সুতার উপর। পুনরায় ঐ সুতা হ’তে কাপড় তৈরীর সময়ে বস্ত্রকল সংস্থা বা কোম্পানী যে ঋণ নেয় সেই সূদ যুক্ত হয় কাপড়ের উপর। এরপর কাপড়ের এজেন্ট বা ডিলার তার ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্যাংক হ’তে যে ঋণ নেয় তারও সূদ যোগ করে দেয় ঐ কাপড়ের কারখানা মূল্যের উপর। এভাবে চারটি স্তর বা পর্যায়ে সূদের অর্থ যুক্ত হয়ে বাজারে কাপড় যখন খুচরা দোকানে আসে বা প্রকৃত ভোক্তা ক্রয় করে তখন সে আসল মূল্যের চেয়ে অনেক বেশী দাম দিয়ে থাকে।

একটা নমুনা হিসাবের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হ’ল। ধরা যাক, বিদেশ হ’তে তুলা আমদানীর জন্যে কোন ব্যবসায়ী ব্যাংক হ’তে এক লক্ষ টাকা ঋণ নিল। এরপর বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে তা থেকে তৈরী কাপড় বাজারে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত সূদজনিত মূল্য বৃদ্ধির চিত্রটি কেমন দাঁড়াবে? সঠিক অবস্থা বোঝার জন্যে দুটো অনুমিতি (Assumption) এখানে ধরা হয়েছে : (ক) উৎপাদন, বিপণন, গুদামজাতকরণ প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাংক হ’তে ঋণ নেওয়া হয়েছে, এবং (খ) সূদের হার সকল ক্ষেত্রেই ১৬%। এই উদাহরণে বিভিন্ন পর্যায়ের অন্যান্য আবশ্যকীয় ব্যয় (যেমন- জাহাজ ভাড়া, কুলি খরচ, বিদ্যুৎ/জ্বালানী ব্যয়, গুদাম ভাড়া, পরিবহন ব্যয়, শ্রমিকের বেতন/মজুরী, সরকারী কর/শুল্ক ইত্যাদি) হিসাবের মধ্যে ধরা হয়নি।

উদাহরণ-২

ক. আমদানীকারীর আমদানীকৃত তুলার ক্রয়মূল্য টা: ১,০০,০০০/= হ’লে তার বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টাঃ ১,১৬,০০০/=।

খ. সুতা তৈরীর মিলের তুলার ক্রয়মূল্য টাঃ ১,১৬,০০০/= হ’লে সুতার বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টাকা: ১,৩৪,৫৬০/=।

গ. কাপড় তৈরীর মিলের সুতার ক্রয়মূল্য টাঃ ১,৩৪,৫৬০/= হ’লে কাপড়ের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টাঃ ১,৫৬,০৮৯/=।

ঘ. মিল হ’তে এজেন্ট/ডিলারের কাপড়ের ক্রয়মূল্য টাঃ ১,৫৬,০৮৯/= হ’লে কাপড়ের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টাঃ ১,৮১,০৬৪/=।

ঙ. এজেন্ট/ডিলারের কাছ থেকে পাইকারী বিক্রেতার কাপড়ের ক্রয়মূল্য টা: ১,৮১,০৬৪/= হ’লে তার বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টাঃ ২,১০,৬৪/=।

এখানে দেখা যাচ্ছে যে, যে তুলার ক্রয়মূল্য ছিল টাঃ ১,০০,০০০/= সেই তুলা হ’তে তৈরী কাপড় ভোক্তার নিকট পর্যন্ত পৌঁছাতে সূদ বাবদেই মূল্যের সাথে অতিরিক্ত টাঃ ১,১০,০৩৪/= যুক্ত হয়েছে, যা ভোক্তাকেই দিতে হবে। কারণ চূড়ান্ত বিচারে শেষ অবধি প্রকৃত ভোক্তাই মোট সূদের ভার বহন করে। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হচ্ছে সূদ দিতে না হ’লে অর্থাৎ সূদ উচ্ছেদ হ’লে এই অতিরিক্ত বিপুল অর্থ (টাকা পিছু অতিরিক্ত ১.১০ টাকা) ভোক্তাকে দিতে হ’ত না।

এভাবে দৈনন্দিন জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রত্যেকটিতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সূদ জড়িয়ে আছে। নিরুপায় ভোক্তাকে বাধ্য হয়েই সূদের জন্যে সৃষ্ট এই চড়া মূল্য দিতে হয়। কারণ সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে এছাড়া তার গত্যন্তর নেই। অথচ সূদ না থাকলে অর্থাৎ ইসলামী অর্থনীতি চালু থাকলে এই যুলুম হ’তে জনসাধারণ রেহাই পেত। এতে শুধু তাদের জীবন যাত্রার ব্যয়ই কম হ’ত না, জীবন যাপনের মান হ’ত আরো উন্নত।

১৩। সূদ মজুরী বৃদ্ধির অন্যতম বড় প্রতিবন্ধক :

সূদের হার উচ্চ থাকলে বিনিয়োগ থাকে ন্যূনতম কোঠায়। তখন শিল্প উদ্যোক্তার পক্ষে মুনাফা অর্জনই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়ে মজুরী বৃদ্ধি মানেই লোকসানের ঝুঁকি নেওয়া। সূদী-অর্থনীতিতে সূদের হার খুব কম থাকলে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশী হ’তে পারে কিন্তু পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধি পায় না। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ কম হওয়ার ফলে শ্রমিকের চাহিদাও কম থাকে। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের যোগান অনেক বেশী থাকায় শ্রমিকদের দিক থেকে মজুরী বৃদ্ধির দাবী উত্থাপন আদৌ সহজ হয় না। উপরন্তু বিদ্যমান কম মজুরীতেই চাহিদার চেয়ে শ্রমিকের যোগান বেশী হওয়ায় উদ্যোক্তারা মজুরী বৃদ্ধির দাবী সহজে মেনে নিতে চায় না। ফলে অনিবার্যভাবেই সংঘাত দেখা দেয়। শ্রমিকরা কর্মবিরতি, ঘেরাও, ধীরে চলো, ধর্মঘট, হরতাল, অবস্থান ধর্মঘট প্রভৃতি কর্মসূচীর আশ্রয় নেয়। পরিণামে মালিক পক্ষ ছাঁটাই, লেঅফ, লক আউট ইত্যাদি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। পূর্বেই বলা হয়েছে, সূদের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে বিক্রিও হরাস পায়। এই অবস্থায় মজুরী বৃদ্ধি পেলে মুনাফার হার হরাস পেয়ে সূদের হারের চেয়েও নিচে নেমে যেতে পারে। তাই মজুরী বৃদ্ধির কোন দাবীই শিল্প মালিকদের পক্ষে বিবেচনায় আনা সম্ভব হয় না।

এই কারণেই জাপানে মেইজী শাসন আমলে মজুরী বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের জোর দাবী থাকলেও যাইবাৎসু গোষ্ঠী তা মেনে নেয়নি, সরকারও এ ব্যাপারে শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। বৃটেনেও কৃষকদের স্বার্থে প্রণীত ১৮১৫ সালের শস্য আইন (Corn Law) ত্রিশ বছর পরেই বাতিল করা হয় শিল্পপতিদের স্বার্থে। শস্য আইন বহাল থাকলে গমের দাম বৃদ্ধি পেতো। এতে কৃষকেরা লাভবান হ’ত। কিন্তু শিল্প শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি করাও অপরিহার্য হয়ে পড়তো যার ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে শিল্পপতিদের মুনাফা হরাস পেতো। ফলে তাদের স্বার্থহানি ঘটতো। তাই তারা আন্দোলন করেছিল ঐ আইন বাতিল করার জন্যে।

১৪। সূদ দীর্ঘ মেয়াদী বৃহৎ বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে :

সূদনির্ভর ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলো দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজি আটকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এমন ধরনের বিনিয়োগে আদৌ উৎসাহ দেখায় না। এজন্যেই ব্যয়বহুল বড় শিল্প-কারখানা সূদী ব্যাংকের অর্থায়নে গড়ে উঠতে পারে না। এসব শিল্প-কারখানা স্থাপনে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় তা সূদের ভিত্তিতে যোগান দিলে প্রতি বছর বিপুল অংকের অর্থ সূদ হিসাবে পরিশোধ করতে হবে। বড় বড় মিল-কারখানা সাধারণতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়ে চালু হ’তে দুই হ’তে তিন বছরের gestation period প্রয়োজন হয়। এই দীর্ঘ সময়ে সূদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এমন অংক দাঁড়াবে যে সে বোঝা বহন করা লাভজনক শিল্পের পক্ষেও সম্ভব নয়। আর লোকসান হ’লে সূদে-আসলে ঋণের যে অংক দাঁড়ায় তা পরিশোধ করা কখনো সম্ভব হয় না। স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোক্তা তখন দেউলিয়া হ’তে বাধ্য হয়। একমাত্র মতলববাজ ঋণখেলাপীরাই তথ্যবিকৃতি ঘটিয়ে ব্যাংক হ’তে বড় আকারের বিনিয়োগ গ্রহণ করে শিল্প বা কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্যে। কারখানা গড়ে তুললেও তারা আর কখনও ঋণ পরিশোধ করে না। বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। এর অশুভ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয় দেশের অর্থনীতি।

১৫। সূদ সঞ্চয়কে অনুৎপাদনশীল সরকারী বিনিয়োগে উৎসাহিত করে :

সূদী অর্থনীতির ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংকাররা ঝুঁকিমুক্ত, নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে জনগণের গচ্ছিত আমানতের বিরাট এক অংশ ট্রেজারী বিল ক্রয়, বিনিময় বিল ভাঙানো, সরকারী সিকিউরিটি বা ঋণপত্র ক্রয় ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগের জন্যে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব দেখা দেয়। পরিণামে সূদের হার বৃদ্ধি পায় এবং পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতা আরো হরাস পায়। ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পরিমাণ হরাস পায়। যুগপৎ কর্মসংস্থানের সংকোচন হয় ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় সংকটের। এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত সরকারকেই এগিয়ে আসতে হয় সংকট মোচনের জন্যে।

১৬। সূদের কারণে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশঃ হরাস পেতে থাকে :

পূর্বেই দেখানো হয়েছে যে, সূদের কারণেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় অবশ্যম্ভাবীভাবে ও অপ্রতিহত গতিতে। উপরন্তু অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি ঘটার অন্যতম কারণও সূদ। এই দুইয়ের যোগফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমজীবী, সাধারণ কৃষিজীবী, নানা ধরনের পেশাজীবী ও বেতনভুক্ত কর্মচারীরা এই সাধারণ মানুষের কাতারে শামিল। এদের আয়ের স্তর ও পরিমাণ যেহেতু মোটামুটি একটা দীর্ঘ সময় ধরে একই রকম থাকে সেহেতু দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রয়ক্ষমতা হরাস পায়। ফলে একদিকে জীবন যাপনের মানের অবনতি ঘটে, অন্যদিকে বাজারে কার্যকর চাহিদারও সংকোচন ঘটে। এরই চূড়ান্ত পরিণাম হিসাবে কলকারখানায় মুনাফার পরিমাণ হরাস পায়, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনাও রুদ্ধ হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মুনাফার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্যে পুনরায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় শিল্প-উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা তখন কমে যায় আরও এক ধাপ।

১৭। সূদভিত্তিক ঋণে তৈরী প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হ’লে উদ্যোক্তা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে :

উদ্যোক্তা যতক্ষণ ব্যাংকের সূদ পরিশোধ করে ততক্ষণ ব্যাংক তার ঋণ মঞ্জুরী অব্যাহত রাখে। এমনকি ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি করে। কিন্তু যখনই কারবারে লোকসান দেখা দেয়, তখন ব্যাংক নতুন অর্থলগ্নি করা দূরে থাক পূর্বের ঋণ ফেরত দেবার জন্যেই চাপ দেয়। এই অবস্থায় উদ্যোক্তা মাথায় হাত দেয়। কারণ তার নিজের পুঁজি ছিল সামান্যই, পুরো ব্যাপারটিই ছিল পরের ধনে পোদ্দারী। ফলে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। পরিণামে গোটা কারবারটি বন্ধ বা ধ্বংস হয়ে যায়।

১৮। সূদভিত্তিক ঋণের কারণে ব্যক্তির/প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়াত্বের বোঝা চাপে সমগ্র জাতির ঘাড়ে :

বাংলাদেশ এর উজ্জ্বলতম উদাহরণ। ধনী ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিরা নির্দিষ্ট হারে সূদ প্রদানের অঙ্গীকারে তাদের দেওয়া Collateral বা জামানতের বিপরীতে ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হ’তে দশগুণ বা তারও বেশী পরিমাণ ঋণ পেয়ে থাকে। অর্থাৎ নিজেদের দশ লক্ষ টাকা থাকলে তারা এক কোটি টাকা ঋণ পায়। এক্ষেত্রে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব বা সম্পৃক্ততাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোটি টাকারও বেশী এই অর্থের ব্যবসা বা শিল্পে যে মুনাফা হয় তার সবটুকুই ভোগ করে ঐ ঋণগ্রহণকারী উদ্যোক্তা। ব্যাংকে অর্থ আমানতকারীরা সূদ পেলেও মুনাফার কোন অংশই তারা পায় না। অথচ লোকসানের কারণে ঐ প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হ’লে তার দায়ভার চাপে গোটা জাতির উপর। জনগণের সঞ্চয় তখন আর ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তার দৃশ্যমান লোকসান ঐ দশ লক্ষ টাকা হ’লেও (যদিও পূর্বের মুনাফা সে পুরোটা একাই ভোগ করেছে) জনসাধারণের লোকসান অনেক ক্ষেত্রে পুরো কোটি টাকাই। কষ্ট করে এই টাকা যারা সঞ্চয় করে ব্যাংকে আমানত রেখেছিল তাদেরই এখন ফতুর হবার পালা।

বাংলাদেশের ঋণখেলাপী শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সমুদয় সম্পত্তি বিক্রি করে দিলেও ব্যাংক হ’তে তাদের গৃহীত ঋণ শোধ হবার নয়। কারণ এর পেছনে অদৃশ্য হাতের কারসাজি কাজ করেছে। রাজনৈতিক মদদে ঋণ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্যরাই নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশের কোন তোয়াক্কা না করেই। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ প্রকল্প সমীক্ষাও করা হয়নি। শুধুমাত্র সূদের হিসাব কষেই কল্পিত মুনাফার লোভনীয় টোপ দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে হাযার হাযার কোটি টাকা, যা আর কোন দিনই ব্যাংকে ফিরে আসবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলো সরকারী তহবিলের মদদ পেলেও বেসরকারী ব্যাংকগুলো এই দায় উদ্ধারের জন্য কার মদদ পাবে?

১৯। সূদ অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতার মুখ্য কারণ :

একথা সর্বজনবিদিত যে পুঁজি বাজারে মূলধনের চাহিদা হরাস পেলে সূদের হার হরাস পায়, আবার মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সূদের হারও বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন দেশের সূদের হারের ওঠানামা কালীন সারির তথ্য (Time series data) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোন দেশে সূদের হার দীর্ঘকাল স্থিতিশীল থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে কোন কারণে তেজীভাব শুরু হ’লে মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পুঁজির যোগানদার তখন সূদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে পুঁজির চাহিদা হরাস পেতে শুরু করে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তা পূর্বের চেয়েও হরাস পায়। এর মুকাবিলায় সূদের হার আবারও হরাস করা হয়। পুনরায় মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সূদের হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এভাবে সূদের হারের ঘন ঘন ওঠানামার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিক্ষিপ্ত হয় অনিশ্চয়তার মধ্যে। এরই ফলে বিনিয়োগ, শেয়ার, পণ্য ও মুদ্রা বাজারে দারুণ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। এর বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে। বহু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়, বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। শেষ অবধি সরকারকে ৭০০ বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা ‘প্যাকেজ’ মঞ্জুর করতে হয়। তবু সেই মন্দার ধকল এখনও সামলে উঠতে পারেনি মার্কিন অর্থনীতি।

২০। সূদের দীর্ঘমেয়াদী কুফলস্বরূপ অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয় :

সূদভিত্তিক বিনিয়োগ ও ব্যবসার কারণে অর্থনীতিতে বারবার মন্দা ও তেজীভাবের আবর্তন হ’তে থাকে। এর ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সব সময় অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। যে কোন অর্থনীতির জন্যে এ অবস্থা অনাকাঙ্খিত। অর্থনীতিতে যখন তেজীভাব থাকে তখন সূদের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে সূদের হার যখন অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় তখন ঋণ গ্রহীতারা হিসাব করে যদি দেখে যে অতিরিক্ত সূদের হারের কারণে লাভের সম্ভাবনা কম, তখন তারা ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন পুঁজি বিনিয়োগে ভাটা পড়ে, উৎপাদন কমে যায়, শ্রমিক ছাঁটাই হয়, ব্যবসায়ে সৃষ্টি হয় মন্দা। এভাবে পুঁজির চাহিদা কমে গেলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশায় ব্যাংক সূদের হার কমিয়ে দেয়। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা নতুন করে ঋণ নিয়ে তখন উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দেয়। ক্রমে মন্দা কেটে গিয়ে পুনরায় তেজীভাবের সৃষ্টি হয়। এভাবে বারবার মন্দা ও তেজী অবস্থার সৃষ্টি অর্থনীতির জন্যে যে অত্যন্ত অশুভ ও ভয়াবহ পরিণতির জন্ম দেয় সে বিষয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির শ্রেষ্ঠ প্রবক্তারাও একমত।

অনেকের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সঞ্চয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সূদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সূদ আসলেই অর্থনীতির জন্যে অপরিহার্য নয়, সঞ্চয়ের জন্যে তো নয়ই। বরং তা অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। সূদনির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম পুরোধা বিশ্ববিশ্রুত অর্থনীতিবিদ লর্ড জন মেনার্ড কেইন্স তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ The General Theory of Employment, Interest and Money-তে প্রমাণ করেছেন সঞ্চয়ে সূদের কোন ভূমিকা নেই। সূদ বিদ্যমান না থাকলেও লোকে ব্যক্তিগত কারণেই অর্থ সঞ্চয় করবে। দুর্দিনের খরচ ও আকস্মিক বড় ধরনের ব্যয় মেটাবার প্রয়োজনেই তারা সঞ্চয় করে।

২১। সূদ ধন বণ্টনে অসমতার অন্যতম কারণ ও পূর্ণ কর্মসংস্থানের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক :

কেইন্স দেখিয়েছেন সূদের জন্যেই বরং বিনিয়োগ সীমিত হয়ে পড়ে। যে কোন দেশের অর্থনীতির পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সূদের উচ্চ হারের সময়ে বিনিয়োগের পরিমাণ হরাস পেয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মপ্রয়াস সংকুচিত হয়েছে। অপরদিকে সূদের হার যখন ন্যূনতম তখনই বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মপ্রয়াসও বেড়ে গেছে। কেইনসের মতে সূদের হার যখন শূন্য, তখনই পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্জনের লক্ষ্য পূরণ হয়। বাংলাদেশের শিল্পকারখানার সাম্প্রতিক অবস্থার প্রতি নজর দিলে এই সত্য সহজেই অনুধাবনযোগ্য। দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং রপ্তানী আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস গার্মেন্টস ও নীটওয়্যার শিল্পের কারখানা মালিকেরা সমস্বরে দাবী তুলেছে বিদ্যমান সূদের হার হরাস করার জন্যে। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের বর্তমান সূদের হার ১৬%-১৮% হ’তে হরাস করে ন্যূনতম ৫% বা তার নিচে নামিয়ে আনা না হ’লে তাদের লোকসান দিতে হবে, এমনকি কারখানা বন্ধ করে দিতে হ’তে পারে। অন্যান্য শিল্প-কারখানা মালিকেরাও অনুরূপ দাবী তুলেছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়েই বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের বর্তমান সূদের হারকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। (দ্রষ্টব্য: দৈনিক সংগ্রাম, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০০৮)। কারণ শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনই বন্ধ হবে না, লক্ষ লক্ষ শ্রমিকও বেকার হবে, সরকার হারাবে বিপুল রাজস্ব। সমগ্র অর্থনীতিতে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অনিবার্যভাবেই। একই সঙ্গে ব্যাংকেও অলস টাকার পাহাড় জমবে। তাছাড়া ধনবণ্টন, বিশেষতঃ মুনাফা ও মজুরীর ক্ষেত্রে সূদের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে এবং বিত্তশালীদেরই সূদের ভিত্তিতে বৃহৎ আকারের ঋণ প্রাপ্তির সুযোগের ফলে অনিবার্যভাবেই ধনবণ্টনে অসমতা সৃষ্টি হয়। বলাবাহুল্য, সূদ শুধু অর্থনৈতিক সাম্যেরই বিরোধী নয়, সামাজিক সম্প্রীতিরও বিরোধী।

২২। সূদ মুদ্রাস্ফীতিতে প্রত্যক্ষ ইন্ধন যোগায় :

অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ সূদ। সূদনির্ভর অর্থনীতিতে সূদের কারণে দ্রব্যমূল্য ক্রমশঃই বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি যুক্ত হ’লে দ্রব্যমূল্য হয় আরও ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জনসাধারণের আয় বৃদ্ধি পায় না। ফলে জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। সূদনির্ভর অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আমানতের বিপরীতে বহুগুণিতক ঋণ সৃষ্টি করতে সক্ষম। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান অধিক হারে উপার্জনের আশায় অর্থাৎ সূদ প্রাপ্তির জন্যে বিপুল পরিমাণে কাগুজে আমানতসৃষ্ট ঋণ দেয়। এক্ষেত্রে বাস্তবে অর্থ না থাকলেও ঋণ গ্রহীতার ক্রয়ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়, যার প্রতিফলন ঘটে দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার মূল্যের ক্ষেত্রে। পরিণামে অবধারিতভাবেই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।

উপরন্তু সূদী ব্যাংক গ্যারান্টির ভিত্তিতে অনেক অনুৎপাদনশীল ঋণ, ভোগ্যঋণ ও সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে। এসব ঋণের সঙ্গে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির কোন সংগতি থাকে না। অর্থাৎ, বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ে কিন্তু তার বিপরীতে পণ্যসামগ্রী ও সেবার যোগান বাড়ে না। ফলশ্রুতিতে অনিবার্যভাবেই সৃষ্টি হয় মুদ্রাস্ফীতির, যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে কোন পদক্ষেপই ফলপ্রসূ বা কার্যকর বিবেচিত হয় না। অথচ এই সময়ে ব্যবসায়ীরা বর্ধিত মূল্যে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লুটে নেয়। ব্যাংকের পক্ষেও বেশী পরিমাণে সূদ আদায়ের সুবিধা হয়। কিন্তু জনগণের, বিশেষতঃ সীমিত আয়ের লোকদের দুর্দশার সীমা-পরিসীমা থাকে না। তাদের জীবন যাপনের মানের অধোগতি হ’তে শুরু করে যা রোধ করা সহজে সম্ভব হয় না। শেষ অবধি জনতার অব্যাহত জোর দাবীর মুখে সরকার যখন সচেতন হয় কিছু একটা করার জন্যে, ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে যায়।

২৩। সূদ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্প স্বনির্ভর হওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধক :

দারিদ্র্য বিমোচন তথা আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য বর্তমানে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান বা মাইক্রো ক্রেডিটের ব্যবহার ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। কিন্তু এই উদ্যোগ প্রকৃত লক্ষ্য হাসিলে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ হ’তে প্রাপ্ত মুনাফার পরিমাণ প্রায়শঃই প্রান্তিক। সেই প্রান্তিক মুনাফাও শূন্য বা ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়ায় সূদ পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতার ফলে। আত্মকর্মসংস্থানমূলক ক্ষুদ্র প্রকল্পের জন্যে ঋণ নিয়ে সূদসহ মূলধন পরিশোধ করার সময়ে দেখা যায় কঠোর শ্রমের দ্বারা উপার্জিত বর্ধিত আয়ের প্রায় সবটুকুই তুলে দিতে হচ্ছে ঋণদাতা এনজিওর মাঠকর্মীদের হাতে। ফলে ঋণগ্রহীতার হাতে মুনাফা হিসাবে প্রায় কিছুই থাকছে না। অর্থাৎ লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে নিচ্ছে। এজন্যেই উদ্যোক্তার নিজের পুঁজি গড়ে উঠে না। নিজ হ’তেই উদ্যোগ গ্রহণ তার পক্ষে হয়ে দাঁড়ায় প্রায় অসম্ভব। এই সত্যই ফুটে উঠেছে মার্চ ২০১০-এ অনুষ্ঠিত পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (PKSF) সেমিনারে। আলোচকদের মতে সূদের হার ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে না আনলে স্বনির্ভরতা অর্জনের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

নিজের পুঁজি গড়ে না উঠলে মূলধনের জন্য পরনির্ভরশীলতা থেকেই যায়। তাকে পুঁজিপতির বা অর্থলগ্নিকারীর শরণাপন্ন হ’তেই হয়। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় থাকে ক্ষুদ্র ঋণদাতারা তথা এনজিওগুলো। এরা কখনই আন্তরিকভাবে চায় না যে, ঋণগ্রহীতারা প্রকৃতই স্বনির্ভর হয়ে উঠুক। তাহ’লে সূদ উপার্জনের উর্বর ক্ষেত্রগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে। এজন্যেই এরা লাভ-লোকসানের অংশীদারীভিত্তিক বিনিয়োগ নয়, সূদভিত্তিক ঋণ দিতেই অধিক আগ্রহী। বস্ত্ততঃ দারিদ্র্য বিমোচন নয়, এরা প্রকারান্তরে দারিদ্রে্যর চাষ করছে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন