HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কবর যিয়ারত ও কবরবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন

লেখকঃ শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কবর যিয়ারত ও কবরবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ

অনুবাদ: ড. আব্দুর কাদের

সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

কভার পেইজ থেকে
এ কিতাবটিতে কবর যিয়ারতের পদ্ধতি, বৈধ ও অবেধ অসীলা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে লেখক ওসীলা ও দো‘আ সংক্রান্ত প্রচলিত কতিপয় প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, এমনকি কুতুব, গাউস ও পূণ্যবান ব্যক্তিদের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।

মূল প্রশ্ন
ইমাম আহমাদ ইবন তাইমিয়্যাহ রহ.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: যে ব্যক্তি কবর যিয়ারত করে ও কবরবাসীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে কোনো রোগের জন্য অথবা ঘোড়ার আরোগ্যের জন্য অথবা কোনো বাহনের জন্য, তার মাধ্যমে রোগ দূরীকরনের প্রার্থনা করে, আর সে বলে, হে আমার নেতা; আমি তোমার আশ্রয়ে আছি, আমি তোমার ছত্র-ছায়ায় আছি, অমুক আমার ওপর যুলুম করেছে, অমুক আমাকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছা করেছে। সে আরও বলে, কবরবাসী আল্লাহ ও তার মাঝে মাধ্যম হবে। আবার তাদের কেউ কেউ ওলীদের মসজিদ খানকা ও তাদের জীবিত ও মৃত পীরদের নামে টাকা, উট, ছাগল, ভেড়া, তেল প্রভৃতি মানত করে। সে বলে, যদি আমার সন্তান সুস্থ হয় তবে আমার পীরের জন্য এটা, এটা এবং অনুরুপ কিছু। আবার তাদের কেউ কেউ তার পীরের দ্বারা উদ্ধার প্রার্থনা করে ঐ অবস্থায় তার অন্তর যেন দৃঢ় থাকে। আবার কেউ কেউ তার পীরের কাছে আসে এবং কবর স্পর্শ করে এবং তার কবরের মাটিতে চেহারা ঘর্ষণ করে, হাত দ্বারা কবরকে মাসেহ করে ও তা দিয়ে তার মুখ মাসেহ করে, অনুরূপ আরো অন্য কিছুও করে থাকে। আবার তাদের কেউ কেউ তার প্রয়োজন পূরণের ইচ্ছা করে তার পীরের কবরের কাছে গিয়ে বলে, হে অমুক! আপনার বরকতে (তা হোক) অথবা বলে আমার প্রয়োজনটা আল্লাহ এবং পীরের বরকতে পূর্ণ হয়েছে। আবার তাদের কেউ কেউ শামা গানের আমল করে এবং কবরের কাছে যায়, অতঃপর পীরের সামনে মাথা নত করে ও মাটিতে সাজদায় লুটিয়ে পড়ে। আবার তাদের কেউ কেউ বলে থাকে, সেখানে বাস্তবেই কোনো পূর্ণ গাউছ কুতুবের অস্তিত্ব আছে। সুতরাং আপনি আমাদেরকে ফাতওয়া দিন, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন আর এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।

জবাবের সূচনা
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. জবাবে বলেন,

সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রবের জন্য, যে দীন নিয়ে আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন এবং তাঁর কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন তা হলো: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, যার কোনো শরীক নেই। আর তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং তাঁর ওপর ভরসা করা। আর তার কাছে কল্যাণ লাভের জন্য এবং অনিষ্ট দূরীকরণের জন্য দো‘আ করা। যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿تَنزِيلُ ٱلۡكِتَٰبِ مِنَ ٱللَّهِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَكِيمِ ١ إِنَّآ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ٢ أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصُۚ وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ فِي مَا هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي مَنۡ هُوَ كَٰذِبٞ كَفَّارٞ ٣﴾ [ الزمر : ١، ٣ ]

“এ কিতাব পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হওয়া। নিশ্চয় আমরা আপনার কাছে এ কিতাব সত্যসহ নাযিল করেছি। কাজেই আল্লাহর ইবাদাত করুন তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। জেনে রাখুন, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে।হ তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে সে ব্যাপারে ফয়সালা করে দেবেন।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১-৩]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨﴾ [ الجن : ١٨ ]

“আর নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। কাজেই আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না। [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ১৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَأَقِيمُواْ وُجُوهَكُمۡ عِندَ كُلِّ مَسۡجِدٖ وَٱدۡعُوهُ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَۚ كَمَا بَدَأَكُمۡ تَعُودُونَ ٢٩ ﴾ [ الاعراف : ٢٩ ]

“আর আমার রব নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচারের। আর তোমরা প্রত্যেক সাজদাহ বা ইবাদতে তোমাদের লক্ষ্য একমাত্র আল্লাহকেই নির্ধারণ কর এবং তাঁরই আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁকে ডাক। [সূরা আল আ‘রাফ, আয়াত: ২৯]

আর আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا ٥٦ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحۡذُورٗا ٥٧﴾ [ الاسراء : ٥٦، ٥٧ ]

“বলুন, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ মনে কর তাদেরকে ডাক, অতঃপর দেখবে যে, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার বা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই ,তারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো তাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হতে পারে, আর তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয় আপনার রবের শাস্তি ভয়াবহ।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৬-৫৭]

সালফে সালেহীনদের একদল বলেন, কিছু সম্প্রদায় মসীহ, উযাইর ও ফিরিশতাদেরকে ডাকতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন ঐ সব যাদেরকে তোমরা ডেকে থাক তারা তো আমারই বান্দা, যেমনি তোমরা আমার বান্দা। তারা আমার অনুগ্রহ চায়, যেরূপে তোমরা আমার রহমত কামনা কর। তারা আমার শাস্তিকে ভয় পায় যেমনিভাবে তোমরা আমার আযাবকে ভয় কর। আর তারা আমার নৈকট্য চায় যেভাবে তোমরা আমার নৈকট্য চাও। অতঃপর যখন যারা নবীগণ ও ফেরেশ্তাগণের কাছে প্রার্থনা করে তাদের অবস্থা এমন, তাহলে অন্যদের অবস্থা কেমন হবে?

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَفَحَسِبَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَن يَتَّخِذُواْ عِبَادِي مِن دُونِيٓ أَوۡلِيَآءَۚ إِنَّآ أَعۡتَدۡنَا جَهَنَّمَ لِلۡكَٰفِرِينَ نُزُلٗا ١٠٢﴾ [ الكهف : ١٠٢ ]

“যারা কুফুরী করেছে তারা কি মনে করেছে যে, তারা আমার পরিবর্তে আমার বান্দাদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে? আমরা তো কাফেরদের আপ্যায়নের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জাহান্নাম। [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ১০২]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢ وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُۥۚ ٢٣﴾ [ سبا : ٢٢، ٢٣ ]

“বলুন, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ মনে করতে তাদেরকে ডাক। তারা আসমানসমূহে অণু পরিমাণ কিছুরও মালিক নয়, যমীনেও নয়। আর এ দুটিতে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের মধ্যে কেউ তাঁর সহায়কও নয়। আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন, সে ছাড়া তাঁর কাছে কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। অবশেষে যখন তাদের অন্তর থেকে ভয় বিদূরিত হয়, তখন তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তোমাদের রব কী বললেন? তার উত্তরে তারা বলে, ‘যা সত্য তিনি তা-ই বলেছেন।’ আর তিনি সমুচ্চ, মহান।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২-২৩]

সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সমস্ত সৃষ্টি জীব হতে ফিরিশতা, মানুষ ও অন্য যাদের ডাকা হয়, নিশ্চয় তারা বিন্দু পরিমাণ তার রাজত্বের মালিক নয়। আর তার রাজত্বে কোনো শরীকও নেই; বরং তিনি পবিত্র সত্ত্বা আর তারই রাজত্ব। তার জন্যই সকল প্রশংসা এবং তিনি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। আর নিশ্চয় তার কোনো সাহায্যকারী নেই, যে তাকে সাহায্য করবে, যেরূপ রাজার বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতাকারী থাকে। আর তার নিকট শাফা‘আতকারী তো একমাত্র তিনিই হবেন, যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট। ফলে এর মাধ্যমে শির্কের সকল দিককে নিষেধ করা হয়েছে।

কেননা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ডাকা হয় তারা হয়ত কোনো কিছুর মালিক হবেন অথবা মালিক হবেন না, আর যদি মালিক না হোন তখন তারা হয়তো (সে জিনিসে) অংশীদার হবেন অথবা অংশীদার হবেন না, আর যদি অংশীদার না হোন তবে হয়তো সাহায্যকারী হবেন অথবা হবেন (সে জিনিসের) যাচ্ঞাকারী-প্রার্থনাকারী (সুপারিশকারী)।

উপরোক্ত প্রথম তিন প্রকার অর্থাৎ আল্লাহর সাথে কোনো কিছুর মালিক হওয়া, তাঁর অংশীদার হওয়া ও তাঁর সাহায্যকারী হওয়া নিষিদ্ধ। আর চতুর্থটি অর্থাৎ সুপারিশ তাঁর অনুমতি ব্যতীত হবে না। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [ البقرة : ٢٥٥ ]

“কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৫]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَكَم مِّن مَّلَكٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ لَا تُغۡنِي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ًٔا إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ أَن يَأۡذَنَ ٱللَّهُ لِمَن يَشَآءُ وَيَرۡضَىٰٓ ٢٦﴾ [ النجم : ٢٦ ]

“আর আসমানসমূহে বহু ফিরিশ্তা রয়েছে; তাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হবে না, তবে আল্লাহর অনুমতির পর; যার জন্য তিনি ইচ্ছে করেন ও যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬]

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَمِ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ شُفَعَآءَۚ قُلۡ أَوَلَوۡ كَانُواْ لَا يَمۡلِكُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَعۡقِلُونَ ٤٣ قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ لَّهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٤٤﴾ [ الزمر : ٤٣، ٤٤ ]

“তবে কি তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সুপারিশকারী ধরেছে? বলুন, তারা কোনো কিছুর মালিক না হলেও এবং তারা না বুঝলেও বলুন, সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন, আসমানসমূহ ও যমীনের মালিকানা তাঁরই।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪৩-৪৪]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَيۡنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍۚ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ ٤﴾ [ السجدة : ٤ ]

“আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও উভয়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَأَنذِرۡ بِهِ ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ أَن يُحۡشَرُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ لَّعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ٥١﴾ [ الانعام : ٥١ ]

“আর আপনি এর দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করুন, যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের রব-এর কাছে সমবেত করা হবে এমন অবস্থায় যে, তিনি ছাড়া তাদের জন্য থাকবে না কোনো অভিভাবক বা সুপারিশকারী, যাতে তারা তাকওয়ার অধিকারী হয়।”[সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫১]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُؤۡتِيَهُ ٱللَّهُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحُكۡمَ وَٱلنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُواْ عِبَادٗا لِّي مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَٰكِن كُونُواْ رَبَّٰنِيِّ‍ۧنَ بِمَا كُنتُمۡ تُعَلِّمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ وَبِمَا كُنتُمۡ تَدۡرُسُونَ ٧٩ وَلَا يَأۡمُرَكُمۡ أَن تَتَّخِذُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ أَرۡبَابًاۗ أَيَأۡمُرُكُم بِٱلۡكُفۡرِ بَعۡدَ إِذۡ أَنتُم مُّسۡلِمُونَ ٨٠﴾ [ ال عمران : ٧٩، ٨٠ ]

“কোনো ব্যক্তির জন্য সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হেকমত ও নবুওয়াত দান করার পর তিনি মানুষকে বলবেন, আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা আমার দাস হয়ে যাও, বরং; তিনি বলবেন, তোমরা রব্বানী হয়ে যাও, যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দাও এবং যেহেতু তোমরা অধ্যয়ন কর , অনুরূপভাবে ফেরেশ্তাগণ ও নবীগণকে রবরূপে গ্রহণ করতে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দেন না। তোমাদের মুসলিম হওয়ার পর তিনি কি তোমাদেরকে কুফুরীর নির্দেশ দেবেন?” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৯-৮০]

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যখন ফিরিশতাগণ, নবীগণকে রব হিসেবে গ্রহণ করা শির্ক ও কুফুরী বলে সাব্যস্ত করেছেন, তখন তাদের থেকে নিম্ন পর্যায়ের লোক পীর-মাশাইখদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়?

ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য: বান্দা (আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও কাছে) যদি এমন সব বিষয় চায় যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ দিতে সক্ষম নয়। যেমন, মানুষ বা জীব জন্তুর রোগের আরোগ্য প্রার্থনা অথবা কোনো সুনির্দিষ্ট উৎস ব্যতীত দেনা পরিশোধ অথবা তার পরিবার পরিজনের ক্ষমা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের অন্যান্য বিপদ মুসীবত অথবা শত্রুর ওপর বিজয়ী হওয়া অথবা অন্তরের হিদায়াত ও গুনাহের ক্ষমা অথবা তার জান্নাতে প্রবেশ অথবা জাহান্নাম থেকে মুক্তি অথবা কোনো ইলম ও কুরআন শিক্ষা লাভ করা অথবা অন্তরের সুস্থতা এবং চরিত্রের সৌন্দর্য অথবা অন্তরের পরিশুদ্ধি ইত্যাদি, এগুলো হচ্ছে এমন সব কর্মকাণ্ডের উদাহরণ যার কোনোটিই আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের কাছে চাওয়া বৈধ নয়। কোনো ফিরিশতা, নবী, পীরের কাছে চাওয়া, চাই তিনি জীবিত হোন অথবা মৃত, তাদের কাছে এ বলা জায়েয নয় যে, আমার পাপ ক্ষমা করুন, আমাকে আমার শত্রুর ওপর বিজয়ী করুন, আমার রোগ সুস্থ করুন, আমাকে ক্ষমা করুন অথবা আমার পরিবার-পরিজনকে বা আমার সওয়ারীকে নিরাপত্তা দিন, অনুরূপ বিষয়সমূহ। তাই যে এসব কিছু কোনো সৃষ্ট-জীবের কাছে চায় তাহলে সে তার রবের সাথে অংশীদার স্থাপনকারী সেসব মুশরিকদের ন্যায়, যারা ফিরিশতা, নবীগণ ও মূর্তির আকৃতি তৈরি করে তাদের ইবাদত করে। অনুরূপ তারা নাসারাদের ন্যায়, যারা মসীহ ও তার মাকে ডাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ءَأَنتَ قُلۡتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَٰهَيۡنِ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ ١١٦﴾ [ المائ‍دة : ١١٦ ]

“স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ বলেন, হে ‘ঈসা ইবন মারইয়াম আপনি কি মানুষদের বলেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার মাকে দুই ইলাহ হিসেবে গ্রহণ কর?” [সূরা আল মায়েদা, আয়াত: ১১৬]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسِيحَ ٱبۡنَ مَرۡيَمَ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُوٓاْ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗاۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۚ سُبۡحَٰنَهُۥ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٣١﴾ [ التوبة : ٣١ ]

“তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগিদেরকে তাদের রবরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়াম-পুত্র মসীহকেও। অথচ এক ইলাহের ইবাদাত করার জন্যই তারা আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তা থেকে তিনি কত না পবিত্র!” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩১]

পক্ষান্তরে যে ব্যাপারে কোনো বান্দা সামর্থ্যবান তার কাছে কিছু কিছু অবস্থায় চাওয়া জায়েয আছে। কেননা সৃষ্ট-জীবের কাছে চাওয়া কখনও জায়েয করা হয়েছে, আবার কখনও তা নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَإِذَا فَرَغۡتَ فَٱنصَبۡ ٧ وَإِلَىٰ رَبِّكَ فَٱرۡغَب ٨﴾ [ الشرح : ٧، ٨ ]

“অতএব, আপনি যখনই অবসর পান তখনই কঠোর ইবাদাতে রত হোন, আর আপনার রবের প্রতি গভীর মনোযোগী হোন।” [সূরা আল-ইনশিরাহ, আয়াত: ৭-৮]

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন,

«إذا سألت فاسأل الله وإذا استعنت فاستعن بالله»

“যখন তুমি চাইবে তখন আল্লাহর কাছে চাইবে। যখন তুমি কোনো সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন সে সাহায্য তাঁর

কাছেই একমাত্র চাইবে।” [তিরমিযী, হাদীস নং ২৫১৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং (১/৩০৭ ও ১০/২৯৩, ৩০৩)]

আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণের একটি অসীয়ত করেছেন যে, তারা যেন মানুষের কাছে কিছু না চায়, আর তাই সাহাবীগণের কারও কারও হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলেও কারও কাছে বলতেন না যে, ‘আমাকে এটি উঠিয়ে দাও’। (সহীহ বুখারী ও মুসলিমের) হাদীসে সাব্যস্ত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«يدخل الجنة من أمتي سبعون ألفا بغير حساب، وهم الذين لا يسترقون، ولا يكتوون، ولا يتطيرون، وعلى ربهم يتوكلون»

“আমার উম্মতের মধ্যে বিনা হিসেবে সত্তর হাজার মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা হলো: যারা ঝাঁড়-ফুক চেয়ে বেড়ায় না, সেঁকা লাগায় না এবং পাখি উড়ায়ে ভাগ্য নির্ণয়ে বিশ্বাস করে না। আর তারা তাদের রবের ওপর ভরসা করে।” [সহীহ বুখারী, (৮/১২৪); সহীহ মুসলিম (১/১৯৭)।]

ইসতেরকা হলো: ঝাঁড় ফুক চাওয়া, আর এটি এক প্রকারের চাওয়া বা যাচ্ঞা। এতদসত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে, তিনি বলেন,

«ما من رجل يدعو له أخوه بظهر الغيب دعوة إلا وكل الله بها ملكاً كلما دعا لأخيه دعوة، قال الملك : ولك مثل ذلك»

“তোমাদের কোনো লোকের জন্য তার ভাই যখন তার অনুপস্থিতিতে দো‘আ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য একজন ফিরিশতা নিযুক্ত করেন, যখনই সে তার ভাইয়ের জন্য দো‘আ করে, তখনই ফিরিশতা বলে: তোমার জন্যও অনুরূপ হোক।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৩২; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫৩৪; মুসনাদে আহমাদ (৬/৪৫২)।]

আর দো‘আর ক্ষেত্রে অন্যতম শরী‘আতসম্মত পদ্ধতি হলো, অনুপস্থিত ব্যক্তি কর্তৃক অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য দো‘আ করা। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ওপর সালাত (দুরূদ) পাঠ করতে এবং আমাদের ওপর তার জন্য (আল্লাহর কাছে) ওসীলা (নামক মর্যাদাটি) প্রাপ্তির দো‘আ করতে আদেশ করেছেন। আর এর মাধ্যমে যে প্রতিদান পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে অবহিতও করেছেন। তিনি বলেছেন,

«إِذَا سَمِعْتُمُ الْمُؤَذِّنَ يُؤَذِّنُ فَقُولُوا كَمَا يَقُولُ، وَصَلُّوا عَلَىَّ، فَإِنَّهُ لَيْسَ أَحَدٌ يُصَلِّى عَلَىَّ صَلاَةً إِلاَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرًا، وَسَلُوا اللَّهَ لِىَ الْوَسِيلَةَ، فَإِنَّ الْوَسِيلَةَ مَنْزِلَةٌ فِى الْجَنَّةِ، لاَ يَنْبَغِى أَنْ تَكُونَ إِلاَّ لِعَبْدٍ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ، وَأَرْجُو أَنْ أَكُونَهُ، وَمَنْ سَأَلَهَا لِى حَلَّتْ عَلَيْهِ شَفَاعَتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ» .

“যখন তোমরা মুয়াযযিনের আযান শুনতে পাও তখন মুয়াযযিন যা বলে অনুরূপ বলো, অতঃপর আমার ওপর দুরূদ পাঠ করো। কেননা যে কেউ আমার ওপর একবার দুরূদ পড়ে তার ওপর আল্লাহ দশবার দুরূদ পড়েন। আর তোমরা আমার জন্য ওসীলা (নামক মর্যাদাটি) প্রাপ্তির দো‘আ করবে, কারণ তা জান্নাতের এমন এক স্তর যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল একজনের জন্যই থাকা সমীচীন, আর আমি আশা করবো যে, আমিই হবো সে বান্দাটি। সুতরাং যে কেউ আমার জন্য (আল্লাহর কাছে) ওসীলা নামক মর্যাদাটির প্রার্থনা করবে কিয়ামতের দিন তার জন্য আমার সুপারিশ বৈধতা পাবে”। [সহীহ বুখারী (১/১৫২); সুনান নাসাঈ (২/২৭); আবু দাউদ, হাদীস নং ৫২৯; মুসনাদে আহমাদ (৩/৩৫৪)।]

আর একজন মুসলিমের জন্য বৈধ হবে দো‘আ চাওয়া। হতে পারে যার কাছে দো‘আ চাওয়া হয়েছে সে তার চেয়ে বড় অথবা ছোট। কারণ, বড়ের কাছ থেকে ছোট ব্যক্তির কাছে দো‘আ করতে বলার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে উমরা আদায় করতে যাওয়ার সময় বিদায় জানাতে গিয়ে বলেন,

«لَا تَنْسَنَا يَا أُخَيَّ مِنْ دُعَائِكَ»

“হে ভাই, আমাকে তোমার দো‘আয় ভুলো না” [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৪৯৮। শাইখ আলবানী বলেন, হাদীসটি দুর্বল।]। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমাদেরকে তার জন্য দুরূদ পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার জন্য ওসীলা (নামক মহান মর্যাদা) লাভের দো‘আ করতে বলেছেন, তখন বলেছেন, যে কেউ তার ওপর একবার সালাত পড়বে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার ওপর দশবার সালাত পড়বে। আর যে ব্যক্তি তার জন্য ওসীলা নামক মহান মর্যাদা প্রাপ্তির জন্য দো‘আ করবে, তার জন্য কিয়ামতের দিন তাঁর সুপারিশ বৈধ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা বুঝা গেল যে, তাঁর এ চাওয়ার দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করাই উদ্দেশ্য। আর কেউ কোনো কিছু চাওয়া দ্বারা প্রার্থিত ব্যক্তির উপকার করা, আর কোনো কিছু চাওয়া দ্বারা কেবল নিজের উপকার সাধন হওয়া কামনা করা, এ দু’য়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অনুরূপভাবে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াইস আল-ক্বারনীর কথা উল্লেখ করে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন,

«فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ يَسْتَغْفِرَ لَكَ فَافْعَلْ»

“যদি তাকে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলতে পারো, তবে বলবে” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৪২।]।

অনুরূপভাবে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, আবু বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার মাঝে কোনো বিষয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললেন, “আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন”। তবে হাদীসে এসেছে, “আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কোনো বিষয় নিয়ে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ওপর রাগ করেছিলেন।”

তদ্রূপভাবে হাদীসে সাব্যস্ত হয়েছে যে, “কোনো কোনো সম্প্রদায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ঝাঁড়-ফুক চাইতেন, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ঝাঁড়-ফুক করতেন।”।

তাছাড়া সহীহ বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত আছে যে, মানুষ যখন অনাবৃষ্টিতে পড়ত তখন তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের জন্য বৃষ্টির প্রার্থনা করতে বলতেন, অতঃপর তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন ফলে বৃষ্টি হতো।

বুখারী ও মুসলিমে আরো এসেছে “উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দ্বারা বৃষ্টির প্রার্থনা করতেন, ফলে তিনি দো‘আ করতেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,

«اللهم إنا كنا إذا أجدبنا نتوسل إليك بنبينا فتسقينا وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا فيسقون»

“হে আল্লাহ! আমরা যখন অনাবৃষ্টি হতো তখন আপনার নবীর মাধ্যমে দো‘আ করতাম, ফলে আপনি আমাদের বৃষ্টি দিতেন। আর এখন আমরা আপনার নিকট নবীর চাচার দো‘আর মাধ্যমে চাচ্ছি সুতরাং আপনি আমাদের বৃষ্টি দিন, ফলে বৃষ্টি হতো।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০১০।]

অনুরূপভাবে সুনানের গ্রন্থসমূহে এসেছে, এক বেদুঈন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তাঁকে বলল, আমাদের কষ্ট হচ্ছে, আর পরিবার পরিজন ক্ষুধার্ত রয়েছে এবং মাল ধ্বংস হয়েছে, সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন। নিশ্চয় আমরা আপনার কাছে আল্লাহর দ্বারা সুপারিশ করছি এবং আল্লাহর কাছে আপনার দ্বারা সুপারিশ করছি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রাগান্বিতভাবে) তাসবীহ পাঠ (আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা) করলেন এমনকি এ বিষয়টি সাহাবীগণের চেহাবায়ও ফুটে উঠল। তারপর তিনি বললেন,

«ويحك إنه لا يستشفع بالله على أحد، إن الله أعظم من ذلك»

“তোমার জন্য আফসোস হচ্ছে, (তুমি কি জান না যে) আল্লাহ তা‘আলার দ্বারা কোনো সৃষ্টিজীবের কাছে সুপারিশ চাওয়া যায় না? মহান আল্লাহর মর্যাদা তার চেয়ে অনেক মহান।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০১২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫০৭।]

এ হাদীসে দেখা যায় যে, তিনি তার বক্তব্য “আল্লাহর কাছে আপনার দ্বারা সুপারিশ করছি” এ কথাটির স্বীকৃতি দিলেন, কিন্তু “আমরা আপনার কাছে আল্লাহর দ্বারা সুপারিশ করছি” এ কথাটি অস্বীকার করলেন। কেননা সুপারিশকারী সুপারিশকৃত সত্ত্বার কাছে কোনো কিছু কামনা করে। আর বান্দা তো শুধু আল্লাহর কাছেই চায় এবং তাঁর নিকটই সুপারিশ কামনা করে। আর মহান রব কোনো বান্দার কাছে চায় না এবং তার দ্বারা (কারও কাছে) সুপারিশও কামনা করা যায় না।

কবর যিয়ারতের শর‘ঈ পদ্ধতি
আর কবর যিয়াতের শর‘ঈ পদ্ধতি হলো, মৃতব্যক্তিকে সালাম দিবে এবং তার জন্য দো‘আ করবে, যেরূপে জানাযার সালাতে করা হয়, আর অনুরূপই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারত করার সময় তাঁর সাহাবীগণকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেন তারা বলে,

«السلام عليكم دار قوم مؤمنين، وإنا إن شاء الله بكم لاحقون، يرحم الله المستقدمين منا والمستأخرين، نسأل الله لنا ولكم العافية، اللهم لا تحرمنا أجرهم، ولا تفتنّا بعدهم»

“মুমিন বাসিন্দাদের প্রতি সালাম, এটি মুমিনদের ঘর। নিশ্চয় ইনশাআল্লাহ আমরা তোমাদের সাথে একত্রিত হবো। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের অগ্রজ ও অনুজদের ক্ষমা করুন। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য নিরাপত্তা চাচ্ছি। হে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং তাদের পরে কোনো বিপর্যয় দিবেন না”। [সহীহ মুসলিম (১/২১৭),আবু দাউদ, হাদীস নং ৩২৩৭।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলতেন,

«مَا مِنْ رَجُل يَمُرّ بِقَبْرِ أَخِيهِ كَانَ يَعْرِفهُ فِي الدُّنْيَا فَيُسَلِّم عَلَيْهِ إِلَّا رَدَّ اللَّه عَلَيْهِ رُوحه حَتَّى يُرَدّ عَلَيْهِ السَّلَام» .

“যে কোনো ব্যক্তি পরিচিত কোনো বান্দার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে এবং সালাম দেয় তখন আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি উত্তর দেওয়ার জন্য কবরস্থ ব্যক্তির রূহ বা আত্মাকে তার কাছে ফেরত দেন।” [হাদীসটি ইবন আব্দুল বার বর্ণনা করেছেন। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহসহ অনেকেই সহীহ বলেছেন, আর শাইখ আলবানী হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন।]

আর মহান আল্লাহ মৃত মুমিন ব্যক্তির জন্য দো‘আকারী জীবিত ব্যক্তিকে সাওয়াব দেন, যেমনটি যখন সে জানাযার সালাত পড়লে সাওয়াবপ্রাপ্ত হয়। একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কাজটি মুনাফিকের জন্য করতে বারণ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓۖ ٨٤﴾ [ التوبة : ٨٤ ]

“আর তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জন্য জানাযার সালাত পড়বেন না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবেন না”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৮৪]

সুতরাং শরী‘আত সমর্থিত যিয়ারতে মৃত ব্যক্তির নিকট জীবিত ব্যক্তির কোনো প্রয়োজন, কোনো চাওয়া, কোনো ওসীলা প্রদান ইত্যাদি কিছুই নেই; বরং সেখানে জীবিত ব্যক্তির দ্বারা মৃত ব্যক্তির উপকৃত হওয়ার বিষয়টি রয়েছে, যা তার জন্য জানাযার সালাত আদায় করার মতোই। আর আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যক্তির দো‘আ ও ইহসানের কারণে তার প্রতি রহম করেন এবং এ কাজের বিনিময়ে ব্যক্তিকে সওয়াব প্রদান করেন। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন,

«إذا مات الإنسانُ انقطع عملُه إلا من ثلاثةٍ إلا من صدقةٍ جاريةٍ أو علمٍ يُنْتَفَعُ به أو ولدٍ صالحٍ يدعو له»

“যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, তখন তার তিনটি আমল ব্যতীত সব বন্ধ হয়ে যায়, সাদাকাহ জারিয়াহ, উপকারী ইলম অথবা নেক সন্তান যা তার জন্য দো‘আ করবে”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৩১; মুসনাদে আহমাদ (২/৩৭২)।]

কোনো ব্যক্তি কর্তৃক নবী অথবা সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তির কবরের কাছে আসা ও তার কাছে চাওয়া এবং তার দ্বারা সাহায্য প্রার্থনা করার বিধান
আর যে ব্যক্তি কোনো নবীর কবর অথবা সৎলোকের কবরের কাছে যায় অথবা এমন জায়গায় যায় যাতে এ বিশ্বাস করে যে, এটি কোনো নবীর কবর অথবা সৎ ব্যক্তির কবর, যদিও বাস্তবে তা নয় এবং তার কাছে কিছু চায় ও তার দ্বারা মুক্তি প্রার্থনা করে, তার এ কাজটি তিন প্রকার হতে পারে:

প্রথম প্রকার: সে উক্ত নবী বা সৎলোকের কাছে তার প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনা জানাবে। যেমন, সে তার রোগমুক্তি চাইবে অথবা চতুস্পদজন্তুর রোগমুক্তি কামনা করবে অথবা তার ঋণ পরিশোধ চাইবে অথবা তার দ্বারা তার শত্রু থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ কামনা করবে অথবা তার নিজের বা তার পরিবার-পরিজন বা তার চতুস্পদ জন্তুর জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করবে অথবা অনুরূপ কিছু চাইবে যা মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ করতে সমর্থ নয়। বস্তুত এমন কিছু করা সুস্পষ্ট শির্ক। এ ধরনের ব্যক্তিদের তাওবা করে দীনে ইসলামে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হবে, অতঃপর যদি সে তাওবা করে ভালো, অন্যথায় তাকে বিচারের মাধ্যমে হত্যা করা হবে।

আর যদি সে বলে: আমি তার কাছে চাচ্ছি; কেননা তিনি আমার চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার অধিক নিকটবর্তী, যেন আমার এসব বিষয়ে তিনি আল্লাহর কাছে সুপারিশ করেন। কারণ, আমি তার দ্বারা আল্লাহর নিকট চাচ্ছি যেমনিভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে তার বিশেষ ও সহযোগীদের মাধ্যমে চাওয়া হয়। বস্তুত এ কাজগুলো মুশরিক ও নাসারাদের কাজ। কেননা তাদের ধারণা মতে তারা তাদের ধর্মীয়-পণ্ডিত ও পীর-দরবেশদেরকে সুপারিশকারী রূপে গ্রহণ করে থাকে এ আশায় যে তারা তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে সুপারিশ করবে। তাছাড়া মহান আল্লাহ মুশরিকদের বিষয়েও অবহিত করেছেন যে, তারা বলত:

﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ ٣﴾ [ الزمر : ٣ ]

“আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যেই করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত:৩]

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿أَمِ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ شُفَعَآءَۚ قُلۡ أَوَلَوۡ كَانُواْ لَا يَمۡلِكُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَعۡقِلُونَ ٤٣ قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ لَّهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٤٤﴾ [ الزمر : ٤٣، ٤٤ ]

“তবে কি তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সুপারিশকারী ধরেছে? বলুন, ‘তারা কোনো কিছুর মালিক না হলেও এবং তারা না বুঝলেও?’ বলুন, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন, আসমানসমূহ ও যমীনের মালিকানা তাঁরই, তারপর তাঁরই কাছে তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে।”

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍۚ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ ٤﴾ [ السجدة : ٤ ]

“তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” [সূর আস-সাজদাহ, আয়াত: ৪]

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِ﴾ [ البقرة : ٢٥٥ ]

কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে? [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৫]

এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা তার মাঝে ও সৃষ্টিজীবের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করেন। কেননা স্বভাবগতভাবে মানুষ তাদের মধ্যকার যে বড়, যাকে সে সম্মান করে থাকে, তার নিকট সুপারিশ কামনা করে এবং তাকে সুপারিশকারী হিসেবে চায়। ফলে তিনি উৎসাহী হয়ে অথবা ভীত হয়ে, লজ্জাশীল হয়ে অথবা ভালোবেসে অথবা অন্যান্য কারণে তার প্রয়োজন পূরণ করে থাকে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কোনো ব্যক্তিই সুপারিশ করে না, যতক্ষণ না সে সুপারিশকারী হিসেবে অনুমতি প্রাপ্ত হয়। সুতরাং সে আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছুই করবে না, আর সুপারিশকারীর সুপারিশও তার অনুমতি সাপেক্ষে। ফলে সকল বিষয়ের একচ্ছত্র অধিপতি হচ্ছেন একমাত্র মহান আল্লাহ।

একারণেই আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এসেছে, তিনি বলেন,

«لَا يَقُولَنّ أَحَدُكُمْ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي إِنْ شِئْتَ اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي إِنْ شِئْتَ لِيَعْزِمْ الْمَسْأَلَةَ فَإِنَّهُ لَا مُكْرِهَ لَهُ»

“তোমাদের কেউ এভাবে বলবে না যে, হে আল্লাহ! তুমি চাইলে আমাকে ক্ষমা কর, হে আল্লাহ। তুমি চাইলে আমাকে রহম কর। কিন্তু অবশ্যই সে চাওয়াকে দৃঢ় করবে। কেননা আল্লাহকে বাধ্য করার কেউ নেই।” [সহীহ বুখারী (৮/৯২); সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৬৭৮।]

সুতরাং হাদীসে স্পষ্ট হলো যে, নিশ্চয় মহান রব আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা তা করতে পারেন। কেউ তার ইচ্ছার ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি করার অধিকার রাখে না। অথচ দুনিয়ার মানুষদের মধ্যে কখনও কখনও সুপারিশকারী সুপারিশকৃত সত্ত্বাকে বাধ্য করে থাকে। অনুরূপ যাচ্ঞাকারী কখনও কখনও প্রার্থিত ব্যক্তির ওপর চাপ প্রয়োগ করে থাকে যখন সে তার কাছে বারবার চাইতে থাকে এবং তাকে চাওয়ার মাধ্যমে কষ্ট দিয়ে থাকে।

অতএব, অনুরাগ ও চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছা কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই হওয়া অবশ্যক। যেমন, মহান আল্লাহ বলেন,

﴿فَإِذَا فَرَغۡتَ فَٱنصَبۡ ٧ وَإِلَىٰ رَبِّكَ فَٱرۡغَب ٨﴾ [ الشرح : ٧، ٨ ]

“অতএব, আপনি যখনই অবসর পান তখনই কঠোর ইবাদাতে রত হোন, আর আপনার রবের প্রতিই গভীর আনুরাগী হোন”। [সূরা আশ-শারহ, আয়াত: ৭-৮]

আর ভয়-ভীতি হবে আল্লাহর জন্যই। যেমন, মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِيَّٰيَ فَٱرۡهَبُونِ ٤٠﴾ [ البقرة : ٤٠ ]

“আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর।” [সূরা আল বাকারা, আয়াত: ৪০]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿ فَلَا تَخۡشَوُاْ ٱلنَّاسَ وَٱخۡشَوۡنِ ٤٤﴾ [ المائ‍دة : ٤٤ ]

“কাজেই তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকেই ভয় কর।”[সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৪]

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দো‘আর মধ্যে তাঁর ওপর দুরূদ পড়তে আদেশ দিয়েছেন এবং এটাকে আমাদের দো‘আ কবুল হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। (অর্থাৎ রাসূলকে মাধ্যম বানাতে বলেন নি, বরং তার ওপর দুরূদ পাঠকে দো‘আ কবুলের কারণ হিসেবে বলেছেন)

অধিকাংশ পথভ্রষ্টরা বলে থাকে, অমুক ব্যক্তি আমার থেকে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী, আমি আল্লাহ থেকে দূরে। আমার পক্ষে এর মাধ্যম ব্যতীত দো‘আ করা অসম্ভব। এ জাতীয় বক্তব্য মূলতঃ মুশরিকদের বক্তব্য (ঈমানদার এ ধরনের কথা কখনো বলতে পারে না)। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ ١٨٦﴾ [ البقرة : ١٨٦ ]

“আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহবানে সাড়া দেই।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৬]

বর্ণনায় এসেছে যে, সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের রব কি নিকটবর্তী? যাতে আমরা তাকে গোপনে ডাকবো নাকি দূরবর্তী? যাতে আমরা তাকে শব্দ করে ডাকবো? অতঃপর মহান আল্লাহ এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।

অনুরূপ সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবীগণ কোনো এক সফরে ছিলেন এবং তারা জোরে জোরে তাকবীর পাঠ করছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أيها الناس أربعوا على أنفسكم فإنكم لا تدعون أصما ولا غائبا إنما تدعون سميعا بصيرا إن الذي تدعون أقرب إلى أحدكم من عنق راحلته»

হে মানুষ! তোমরা তোমাদের নিজেদের ওপর দয়া কর, কেননা তোমরা কোনো বধির ও অনুপস্থিত কাউকে ডাকছনা। বরং তোমরা ডাকছ এমন এক সত্ত্বাকে যিনি সর্বশ্রোতা ও নিকটবর্তী। নিশ্চয় তোমরা যে সত্ত্বাকে ডাকছ তিনি তোমাদের কারো কাছে তার বাহণের ঘাড় থেকেও নিকটবর্তী।” [সহীহ বুখারী (৪/৬৯); সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭০৪; সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫৩৮; জামে‘ তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭১ ।]

আর মহান আল্লাহ তার বান্দাদেরকে কেবল তারই কাছে সালাত ও দো‘আ করার আদেশ দিয়েছেন এবং তাদের সকলকে বলতে বলেছেন,

﴿إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ ٥﴾ [ الفاتحة : ٥ ]

“আমরা শুধু আপনারই ‘ইবাদাত করি এবং শুধু আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি,” [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৫]

আর তিনি মুশরিকদের থেকে বর্ণনা করেন যে, তারা বলত:

﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَى﴾ [ الزمر : ٣ ]

“আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]

তাই উক্ত মুশরিককে (যে বলে থাকে, ‘অমুক ব্যক্তি আমার থেকে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী, আমি আল্লাহ থেকে দূরে। আমার পক্ষে এর মাধ্যম ব্যতীত দো‘আ করা অসম্ভব’ তাকে) বলা হবে, যখন তুমি একে (পীর বা কবর বা ওলী ইত্যাদিকে) এ ধারণা করে ডাক যে, সে (আল্লাহর চেয়েও) তোমার অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবগত এবং তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করতে অধিক সক্ষম অথবা তোমার প্রতি অধিক দয়াপরবশ। তাহলে তা হবে অজ্ঞতা, গোমরাহী ও কুফুরী। আর যদি তুমি জানো যে, মহান আল্লাহ অধিক জ্ঞাত ও অধিক ক্ষমতাবান ও অধিক দয়াশীল তাহলে তাকে বাদ দিয়ে অন্যের কাছে কেন প্রার্থনা কর? তুমি কি শুন নি যা ইমাম বুখারী রহ. ও অন্যান্যরা জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সকল কাজে ইস্তেখারা করতে শিখিয়েছেন, যেমনিভাবে তিনি আমাদের কুরআনের সূরা শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

«إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالأَمْرِ فَليَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ مِنْ غَيْرِ الفَرِيضَةِ ثُمَّ لِيَقُلِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيمِ ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلاَّمُ الغُيُوبِ ، اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي أَوْ قَالَ عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ فَاقْدُرْهُ لي وَيَسِّرْهُ لي ثُمَّ بَارِكْ لي فِيهِ ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ الأَمْرَ شَرٌّ لي في ديني وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي أَوْ قَالَ في عَاجِلِ أمري وَآجِلِهِ ، فَاصْرِفْهُ عَنِّى وَاصْرِفْنِي عَنْهُ ، وَاقْدُرْ هَذَا لِي الخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي به»

“যখন কেউ কোনো বিশেষ কাজের ইচ্ছা করে সে যেন ফরয ব্যতীত দু’ রাকাত সালাত আদায় করে। তারপর সে যেন বলে, হে আল্লাহ! আমি আপনার জ্ঞানের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করছি এবং আপনার ক্ষমতার মাধ্যমে এ কাজ করার ক্ষমতা প্রার্থনা করছি। আপনার নিকট আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। নিঃসন্দেহে আপনি ক্ষমতাবান। আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আপনি সব কিছু জ্ঞাত, আমি কিছুই জানি না। আপনি সকল গায়েবী তথ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। হে আল্লাহ! আপনার ইলমে যদি এ কাজের মধ্যে আমার দীন ও জীবিকায় কল্যাণ নিহিত থাকে এবং পরিণামের দিক দিয়ে কাজটি ফলদায়ক হয়, তাহলে আপনি এ কাজটি বরাদ্দ করুন এবং তা আমার জন্য সহজ করুন। অতঃপর আমার জন্য তাতে বরকত দিন। আর যদি আপনার ইলমে এ কাজের মধ্যে আমার জন্য দীন ও জীবিকার দিক দিয়ে ক্ষতির আশংকা থাকে বা পরিণামে আমার জন্য অনিষ্টকর হয় তবে আপনি তা থেকে আমাকে বিরত রাখুন এবং আমাকে তা থেকে দুরে রাখুন আর আমার জন্য যেখানে কল্যাণ রয়েছে তা বরাদ্দ করুন। তারপর আপনি সেটার ওপর আমাকে সন্তুষ্টি দিন।” বর্ণনাকারী বলেন, ‘নিজ প্রয়োজন ও হাজতের কথা উল্লেখ করবে।” [সহীহ বুখারী (৩/৪০); আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীস নং ৪৮০; সুনান নাসাঈ, হাদীস নং ৩২৫৫।]

এখানে বান্দাকে আদেশ করা হয়েছে বলার জন্য যে,

«أَسْتَخِيرُكَ بِعِلمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيمِ»

“হে আল্লাহ আমি আপনার জ্ঞানের মাধ্যমে কল্যাণ প্রার্থনা করছি এবং আপনার ক্ষমতার মাধ্যমে এ কাজ করার ক্ষমতা প্রার্থনা করছি। আর আপনার নিকট আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি।” (অর্থাৎ বলা হয় নি যে অমুকের মাধ্যমে চাও বা অমুকের অনুগ্রহে চাও)

আর যদি তুমি জান যে, সে তোমার থেকে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী এবং তোমার থেকে অধিক মর্যাদাবান। তাহলে এটা একটি সত্য কথা, (কারণ, নবীগণ সাধারণ মানুষদের চেয়ে আল্লাহর বেশি নিকটবর্তী ও বেশি মর্যাদাবান) কিন্তু কথাটি সত্য হলেও তারা এর দ্বারা বাতিল উদ্দেশ্য নিয়েছে। কেননা সে তোমার থেকে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী ও মর্যাদাবান হওয়ার অর্থ হলো: তোমাকে যা দেওয়া হবে তাকে তোমার চেয়ে অধিক সাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া হবে। সে (নবী বা ওলী) আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী ও মর্যাদাবান হওয়ার অর্থ এ নয় যে, সরাসরি তুমি আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ যা শুনবে, যখন তুমি সে নবী বা ওলীকে ডাকবে তখন মহান আল্লাহ তোমার প্রয়োজন পূরণ অধিক ত্বরান্বিত করবেন। (বিষয়টি মোটেও এরকম নয়।) কেননা তুমি যদি সত্যি সত্যিই কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধী হও, আর ধরে নাও তোমার দো‘আও প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেল, যেহেতু তুমি দো‘আতে সীমালঙ্ঘন করেছ, তখন নবী ও সৎকর্মশীলগণ আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজে কখনও তোমার কোনো সহায়তা করবেন না। আল্লাহর অসন্তুষ্টি হয় এমন কিছুতে তারা কোনো প্রচেষ্টা চালাবেন না। আর যদি তুমি এমনটি (শাস্তিযোগ্য অপরাধী) না হও, তবে রহমত ও কবুলের জন্য তো আল্লাহই অধিক উত্তম।

অন্যের কাছে দো‘আ চাওয়ার বিধান, সে ব্যক্তি জীবিত হোক কিংবা মৃত
আর যদি তুমি বলো, এই নবী বা ওলী যখন আল্লাহকে ডাকবেন, তখন আল্লাহ তার ডাকে অধিক সাড়া দিবেন, আমি সরাসরি ডাকলে যে সাড়া পাবো না। বস্তুতই এটাই হলো দ্বিতীয় প্রকার।

দ্বিতীয় প্রকার: তা হলো তুমি তার কাছ থেকে কোনো কাজ না চাইবে না এবং তাকে আহ্বানও জানাবে না, কিন্তু তাকে তুমি তোমার জন্য দো‘আ করতে বলবে। যেমন তুমি জীবিত কারও কাছে গিয়ে বলবে, ‘আমার জন্য দো‘আ কর।’ যেমনটি সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ দো‘আ প্রার্থনা করতেন। এটা জীবিতদের কাছে চাওয়া জায়েয, যেমনটি পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে; কিন্তু মৃত নবী, ওলী ও অন্যান্যদের কাছে দো‘আ চাওয়া জায়েয হবে না। সুতরাং এভাবে বলা জায়েয হবে না যে, ‘আমার জন্য দো‘আ কর।’ আর এটা বলাও জায়েয হবে না যে, ‘আমাদের জন্য তোমার রবের কাছে কিছু চাও।’ কারণ সাহাবায়ে কেরাম ও তাবে‘ঈদের কেউ এমনটি করেন নি, এমনকি এমনটি করতে কোনো ইমামও নির্দেশ দেন নি। আর এ বিষয়ে কোনো হাদীসও আসে নি; বরং সহীহ হাদীসে সাব্যস্ত হয়েছে যে, যখন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সময়ে অনাবৃষ্টি দেখা দিল তখন তিনি আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দ্বারা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন। তিনি বলেছিলেন,

«اللهم إنا كنا إذا أجدبنا نتوسل إليك بنبينا فتسقينا وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا»

“হে আল্লাহ! আমরা যখন অনাবৃষ্টিতে পতিত হতাম তখন আমরা তোমার নিকট আমাদের নবীর দো‘আর মাধ্যমে প্রার্থনা করতাম। ফলে আমাদের বৃষ্টি দেওয়া হতো। আর এখন আমরা তোমার নিকট আমাদের নবীর চাচার দো‘আর মাধ্যমে চাচ্ছি। সুতরাং আমাদের বৃষ্টি দিন’ ফলে বৃষ্টি বর্ষিত হতো।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০১০; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ২৮৫০।] তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে যান নি একথা বলতে যে, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন এবং আমাদের জন্য বৃষ্টি চান। তারা কবরের কাছে এটাও বলতেন না যে, আমরা আপনার কাছে আমাদের ওপর যা আপতিত হয়েছে সে ব্যাপারে অভিযোগ করছি এবং অনুরূপ কিছু। কখনো কোনো সাহাবী এমনটি করেন নি। বরং এটি বিদ‘আত। আল্লাহ তা‘আলাও এ ব্যাপারে কোনো দলীল-প্রমাণ নাযিল করেন নি, বরং যখন তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে যেতেন তখন তারা তাঁর ওপর সালাম দিতেন। অতঃপর যখন দো‘আ করতে চাইতেন তখন পবিত্র কবরকে সামনে রেখে দো‘আ করতেন না; বরং সেখান থেকে সরে যেতেন এবং কিবলামুখী হতেন। তখন তারা কেবল এক আল্লাহকেই ডাকতেন, যাঁর কোনো শরীক নেই, যেমন তারা অন্যান্য স্থানেও কেবল আল্লাহকেই ডাকতো। (অর্থাৎ তারা দো‘আ কেবল আল্লাহর কাছেই করতেন, কবরবাসীর কাছে নয়)

আর এটা এ কারণে যে মুওয়াত্তা ও অন্যান্য হাদীসের গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এসেছে তিনি বলেছেন,

«اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَناً يُعْبَدُ، اشْتَدَّ غَضَبُ اللَّهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ»

“হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে এমন মূর্তি-বিগ্রহ বানাবে না, যার ইবাদত করা হয়। মহান আল্লাহর অধিক ক্রোধ আপতিত হয়েছে ঐ জাতির প্রতি যারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানায়।” [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, (১/১৮৫); মুসনাদে আহমাদ (২/২৪৬)।]

আর সুনান গ্রন্থসমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

«لاَ تَتَّخِذُوا قَبْرِي عِيدًا، وَلاَ بُيُوتَكُمْ قُبُورًا وَصَلُّوا عَلَيَّ حَيْثُ مَّا كُنْتُمْ فَإِنَّ صَلاَتَكُمْ تَبْلُغُنِي» .

“তোমরা আমার কবরকে ঈদের (সম্মেলন ও আনন্দ উৎসবের) স্থান বানাবে না। তোমরা যেখানে থাক সেখান থেকেই আমার ওপর সালাম পাঠাও। কেননা তোমাদের সালাত আমার কাছে পৌঁছানো হয়”। [সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ২০৪২; মুসনাদে আহমাদ (২/৩৬৮)।]

তাছাড়া সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার যে শয্যা থেকে আর আরোগ্য হন নি সে মৃত্যু শয্যায় বলেছিলেন,

«لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى، اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ»

“ইয়াহূদী ও নাসারাদের ওপর মহান আল্লাহর লা‘নত, এজন্যে যে তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়েছে”। [সহীহ বুখারী, (৩/১৫৬,১৯৮); সহীহ মুসলিম (১/৩৭৭)।] তিনি সাবধান করছেন সে কাজ থেকে যা তারা করেছে। আশেয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, “যদি এ সম্ভাবনা না হতো তবে অবশ্যই আল্লাহর রাসূলের কবর উন্মুক্ত ময়দানে দেওয়া হতো; কিন্তু তিনি কবরকে মসজিদ বানানো অপছন্দ করেছেন।

অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে বলেছিলেন:

«إنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ الْقُبُورَ مَسَاجِدَ أَلَا فَلَا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ فَإِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ»

“নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তীরা কবরসমূহে মসজিদ বানাতো। সাবধান, তোমরা কবরকে মসজিদ বানিও না। কেননা আমি তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছি।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৩২।]

তদ্রূপ সুনান আবু দাউদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন,

«لَعَنَ اللَّه زَائِرَات الْقُبُور وَالْمُتَّخِذِينَ عَلَيْهَا الْمَسَاجِد وَالسُّرُج»

“মহান আল্লাহ কবর যিয়ারতকারী মহিলাদের অভিসম্পাত দিয়েছেন এবং যারা তার উপর মসজিদ নির্মাণ ও আলোকচ্ছটার ব্যবস্থা করে।” [সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ৩২৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীস নং ৩২০।]

এ কারণে আমাদের আলেমগণ বলেছেন, কোনো কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ জায়েয নেই। তারা আরও বলেন, কবরের উদ্দেশ্যে মানত করা বৈধ নয় এবং আরও বৈধ নয় কবরের পার্শ্ববর্তী লোকদের জন্য কোনো কিছু মানত করা। না কোনো অর্থ, না কোনো তেল, না কোনো মোমবাতি, কোনো পানি বা অন্য কিছু। এ সবকিছুই অবাধ্যতার মানত। অথচ সহীহ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন,

«من نذر أن يطيع الله فليطعه، ومن نذر أن يعصي الله فلا يعصه»

“যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করার মানত করে সে যেন তাঁর আনুগত্য করে। আর যে আল্লাহর অবাধ্যতার মানত করে সে সেন অবাধ্যতা না করে।” [সহীহ বুখারী (৮/১৭৭); আবু দাউদ, হাদীস নং ৩২৮৯; জামে তিরমিযী, হাদীস নং ১৫২৬।] (অর্থাৎ অন্যায় কাজটির মানত করলেও তা পূরণ করা যাবে না)।

আর এজন্যই আলিমগণ মানতকারীর ওপর কসমের কাফফারা বর্তাবে কি? এ ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন, এ ব্যাপারে দু’ ধরণের বক্তব্য রয়েছে।

বস্তুত কবরের নিকট সালাত আদায় করা কিংবা মাযারে সালাত আদায় করা মুস্তাহাব বা এতে ফযীলত রয়েছে বলে আমাদের ইমামদের মধ্য থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য পূর্বসূরী বলেন নি। আর তারা এটাও বলেন নি যে, সেখানে সালাত আদায় ও দো‘আ করা অন্যান্য স্থানে সালাত আদায় ও দো‘আ করা থেকে উত্তম; বরং সকলের ঐকমত্যে মসজিদ ও ঘরে সালাত আদায় করা নবী ও ওলীদের কবরের নিকট সালাত আদায় থেকে উত্তম। চাই সেটা মাযার নামকরণ করা হোক বা না হোক।

আর আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদসমূহে এমন কিছু কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন যা মাযারে করতে অনুমতি দেন নি। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ أَن يُذۡكَرَ فِيهَا ٱسۡمُهُۥ وَسَعَىٰ فِي خَرَابِهَآۚ ١١٤﴾ [ البقرة : ١١٤ ]

“আর তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এগুলো বিরাণ করার চেষ্টা করে?” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১১৪] তিনি মাযারের ব্যাপারে তা বলেন নি। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ বলেন,

﴿َوَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِ﴾ [ البقرة : ١٨٧ ]

“আর তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় থাক।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭] মাযারে ই‘তিকাফ করতে বলা হয় নি।

﴿قُلۡ أَمَرَ رَبِّي بِٱلۡقِسۡطِۖ وَأَقِيمُواْ وُجُوهَكُمۡ عِندَ كُلِّ مَسۡجِدٖ﴾ [ الاعراف : ٢٩ ]

“বলুন, আমার রব আমাকে ইনসাফ করার নির্দেশ দিয়েছে, আরও নির্দেশ দিয়েছে যেন তোমরা তোমাদের চেহারাকে প্রতিষ্ঠিত কর প্রতিটি মসজিদের স্থানে”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২৯]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿إِنَّمَا يَعۡمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ وَلَمۡ يَخۡشَ إِلَّا ٱللَّهَۖ فَعَسَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ ٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٨﴾ [ التوبة : ١٨ ]

“তারাই তো আল্লাহর মসজিদের আবাদ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অতএব, আশা করা যায়, তারা হবে সৎপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨﴾ [ الجن : ١٨ ]

“আর নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। কাজেই আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না”। [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ১৮]

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«صلاة الرجل في الجماعة تفضل على صلاته في بيته وسوقه خمساً وعشرين درجة»

“কোনো ব্যক্তির মসজিদে সালাত আদায় করা বাড়ী ও বাজার হতে পঁচিশ গুণ বেশি মর্যাদাপূর্ণ।” [সহীহ মুসলিম (১/৩৭৮)।]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

«مَنْ بَنَى لِلَّهِ مَسْجِدًا بَنَى الله لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ»

“যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোনো মসজিদ নির্মাণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানাবেন।” অথচ কবর, যাকে মসজিদ বানানোর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত আছে এবং যে এমন কাজ করবে তাকে তিনি অভিসম্পাত দিয়েছেন। যা একাধিক সাহাবী ও তাবে‘ঈও উল্লেখ করেছেন। যেমনটি ইমাম বুখারী রহ. তার সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আর তাবরানী ও অন্যান্যরাও তাদের তাফসীরসমূহে বর্ণনা করেছেন। আর এ বিষয়টি ওয়াসিমা ও অন্যান্যগণ (কাসাসুল আম্বিয়া) গ্রন্থে আল্লাহ তা‘আলার নিন্মোক্ত বাণীর তাফসীরে বর্ণনা করেছেন:

﴿وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣﴾ [ نوح : ٢٣ ]

“আর তারা বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ, সুওয়া‘আ, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে”। [সূরা নূহ, আয়াত: ২৩] তারা বলেছেন, “এসব হচ্ছে নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের নেককার ব্যক্তিবর্গের নাম। অতঃপর যখন তারা মারা গেলো তারা তাদের কবরের প্রতি আসক্ত হলো। তারপর দীর্ঘসময় তাদের ওপর অতিবাহিত হলো, অতঃপর তারা তাদের আকৃতিগুলোকে মূর্তিরূপে গ্রহণ করে। বস্তুত কবরের প্রতি তাদের আসক্তি, সেগুলোর স্পর্শ, চুম্বন ও কবরবাসীদের নিকট দো‘আ করা প্রভৃতিই হলো শির্কের মূল-ভিত্তি এবং মূর্তিপূজার গোড়ার কথা। আর একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَناً يُعْبَدُ»

“হে আল্লাহ! আপনি আমার কবরকে এমন মূর্তি বানাবেন না, যার ইবাদত করা হয়।” [মুয়াত্তা মালেক (১/১৮৫); মুসনাদে আহমদ (২/২৪৬)।]

আর আলিমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, কোনো লোক যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর যিয়ারত করে অথবা তিনি ব্যতীত অন্যান্য নবী ও ওলীদের তথা সাহাবী ও আহলে বাইত ও অন্যান্যদের কবর যিয়ারত করে, সে তা স্পর্শ করবে না এবং চুম্বনও করবে না; বরং পৃথিবীতে পাথরসমূহের মধ্যে হাজরে আসওয়াদ ছাড়া আর কোনো পাথরকে চুম্বন করা বৈধ নয়। আর সে জন্যই সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

«والله إِنِّي لَأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ، وَلَوْلاَ أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُك»

“আল্লাহর শপথ করে বলছি। নিশ্চয় আমি জানি তুমি একটি পাথর মাত্র। কোনো ক্ষতি ও উপকার কারতে পার না, যদি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তবে তোমাকে চুম্বন করতাম না।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬১০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৭০।]

আর একারণেই ইমামগণের ঐকমত্যে কোনো ব্যক্তির জন্য সুন্নত নয় কাবাঘরের হাজরে ইসমাঈল বা হাতীম সংলগ্ন বাকী দুটি রুকন অথবা কাবার দেয়াল অথবা মাকামে ইবরাহীম অথবা বায়তুল মুকাদ্দাসের পাথর, কিংবা কোনো নবী বা ওলীর কবর চুম্বন অথবা স্পর্শ করা সুন্নাত নয়। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিম্বারের ওপর হাত রাখা, যা তখন বর্তমান ছিল, তাতেও তারা মতানৈক্য করেছেন। ইমাম মালেক রহ. ও অন্যান্যরা এটা মাকরূহ বলেছেন। কেননা এটা বিদ‘আত। আর মালেক যখন ‘আতা রহ.-কে এ কাজ করতে দেখলেন তখন তিনি তার থেকে ইলম গ্রহণ করেন নি। যদিও ইমাম আহমাদ ও অন্যান্যগণ এটাতে রুখসত বা ছাড় আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এমনটি করেছেন।

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর স্পর্শ করা ও চুমো দেওয়াকে সকল ইমাম অপছন্দ ও নিষিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন। কেননা তারা জানত যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শির্কের যাবতীয় উপায়-উপকরণ ও সকল ছিদ্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং আর তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আর দীনকে একনিষ্টভাবে একমাত্র সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন।

আর এর মাধ্যমেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ওলীর জীবদ্দশায় চাওয়া ও তার মৃত্যুর পর ও তার অনুপস্থিতিতে তার কাছে কোনো কিছু চাওয়ার মধ্যে পার্থক্য সুষ্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা তার জীবদ্দশায় কেউ তার ইবাদত করতে পারবে না। তাই যখন নবীগণ ও ওলীগণ জীবিত থাকেন তখন তারা তাদের উপস্থিতিতে কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করতে ছাড় দিতেন না; বরং তারা তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করতেন এবং এর জন্য তাদের শাস্তি দিতেন। আর এ কারণে মসীহ আলাইহিস সালাম বলেন,

﴿مَا قُلۡتُ لَهُمۡ إِلَّا مَآ أَمَرۡتَنِي بِهِۦٓ أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمۡۚ وَكُنتُ عَلَيۡهِمۡ شَهِيدٗا مَّا دُمۡتُ فِيهِمۡۖ فَلَمَّا تَوَفَّيۡتَنِي كُنتَ أَنتَ ٱلرَّقِيبَ عَلَيۡهِمۡۚ وَأَنتَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ شَهِيدٌ ١١٧﴾ [ المائ‍دة : ١١٧ ]

“আপনি আমাকে যে আদেশ করেছেন তা ছাড়া তাদেরকে আমি কিছুই বলি নি। তা এই যে, তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদাত কর এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের কাজকর্মের সাক্ষী, কিন্তু যখন আপনি আমাকে তুলে নিলেন তখন আপনিই তো ছিলেন তাদের কাজকর্মের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনিই সব বিষয়ে সাক্ষী”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ১১৭]

আর কোনো এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, ‘আল্লাহ ও আপনি চাইলে’, তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

«أجعلتني لله ندا قل ما شاء الله وحده»

“তুমি কি আমাকে আল্লাহর সাথে অংশীদার বানিয়েছো? বল, একমাত্র আল্লাহ যা চেয়েছেন।” [হাদীসটির সনদ হাসান পর্যায়ের। সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২১১৭; মুসনাদে আহমাদ (১/২১৪)।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

«لا تقولوا ما شاء الله وشاء محمد ولكن قولوا ما شاء الله ثم شاء محمد»

“তোমরা বলবে না, আল্লাহ ও মুহাম্মদ যা চেয়েছেন, কিন্তু তোমরা বলো: আল্লাহ যা চেয়েছেন তারপর মুহাম্মদ যা চেয়েছেন।” [হাদীসটির সনদ সহীহ। সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২১১৮; মুসনাদে আহমাদ(৫/৩৯৩)।]

আর যখন ছোট এক মেয়ে বলেছিল, ‘আমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল আছেন তিনি আগামীকাল যা হবে তা সম্পর্কে জানেন’, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«دَعِي هَذَا وَقُولِي الَّذِي كُنْتِ تَقُولِينَ»

“এটা ছেড়ে দাও এবং যেটা বলছিলে সেটা বলতে থাক।” [সহীহ বুখারী (২/৩৫২); মুসনাদে আহমাদ (৬/৩৫৯-৩৬০)।]

তিনি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,

«لا تطروني كما أطرت النصارى عيسى بن مريم فإنما أنا عبد فقولوا عبد الله ورسوله»

“তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না যেরূপে নাসারারা ইবন মারইয়ামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি তো একজন বান্দা বা দাস। অতএব, তোমরা বলো: “আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল”। [সহীহ বুখারী (৬/৩৫৪-৩৫৫); মুসনাদে আহমাদ (১/২৩-২৪)।]

আর যখন সাহাবীগণ তাঁর পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন,

«لَا تَقُومُوا كَمَا تَقُومُ الْأَعَاجِمُ، يُعَظِّمُ بَعْضُهَا بَعْضًا»

“তোমরা অনারবী লোকজন যে পদ্ধতিতে একে অপরকে দাঁড়িয়ে সম্মান করে সেভাবে আমাকে সম্মান করবে না।” [হাদীসটির সনদ দুর্বল। আবু দাউদ, হাদীস নং ৫২৩০; মুসনাদে আহমাদ (৫/২৫৩)।]

অনুরূপ আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, সাহাবীগণের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে আর কোনো প্রিয় ব্যক্তি ছিল না, আর সাহাবীগণ যখন তাঁকে দেখতো তখন দাঁড়াত না, যেহেতু তারা জানত যে, তিনি এটা অপছন্দ করেন।

তদ্রূপ মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাজদাহ করে বসল, তখন তিনি তাকে তা করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন,

«لَا يَصْلُحُ لِبَشَرٍ أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ، وَلَوْ صَلَحَ لِبَشَرٍ أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ، لَأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا، مِنْ عِظَمِ حَقِّهِ عَلَيْهَا»

“মানুষের জন্য অন্য কোনো মানুষকে সাজদাহ করা উপযোগী নয়। আর যদি আমি কাউকে সাজদাহ করার অনুমতি দিতাম তবে অবশ্যই তোমাদের স্ত্রীদের আদেশ দিতাম তারা যেন তার স্বামীকে সাজদাহ করে যেহেতু তার অধিকার বেশি।” [হাদীসটির সনদ দুর্বল, হাদীস সহীহ। মুসনাদে আহমদ (৫/২২৭); মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবাহ (৪/৩০৫)।]

অনুরূপভাবে “যখন আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে সে সব যিন্দীকদের নিয়ে আসা হলো যারা তার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল, সীমালঙ্ঘন করেছিল এবং তার ওপর ইলাহ হওয়ার বিশ্বাস আরোপ করেছিল তখন তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন।”

এই হচ্ছে আল্লাহর নবী ও অলীগণের কাজ। (তারা তাওহীদের সীমারেখা রক্ষা করে চলেন)। একমাত্র যে যমীনে অহংকার ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় সে-ই তো কেবল বাড়াবাড়ি ও অযথা সম্মান প্রদর্শনের স্বীকৃতি দেয়। যেমন, ফির‘আউন ও অন্যান্যরা; অনুরূপ পথভ্রষ্ট পীর-মাশাইখরাও এ কাজের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে, যারা উদ্দেশ্য হলো যমীনের বাড়াবাড়ি করা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করা। আর নবী ও ওলীদের নিয়ে ফেতনায় ফেলা এবং তাদেরকে রব সাব্যস্ত করা আর তাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করা, এসবই তাদের অনুপস্থিতিতে এবং তাদের মৃত্যুর পরই কেবল সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন, মসীহ ও উযাইয়ের সাথে (তাদের অনুসারীদের) শির্ক। (কারণ, তারা কেবল মাসীহ ও উযায়ের এর অনুপস্থিতি ও মৃত্যুর পরই তা করতে সমর্থ হয়েছিল)।

সুতরাং এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নেককার লোকদের জীবদ্দশায় ও উপস্থিতিতে চাওয়া এবং তাদের মৃত্যুর পর ও অনুপস্থিতিতে চাওয়ার পার্থক্য নির্দেশ করে। সাহাবী, তাবে‘ঈ ও তাবে-তাবে‘ঈগণের মধ্য থেকে এ উম্মতের কোনো গ্রহণযোগ্য পূর্বসূরী কেউই নবীগণের কবরে সালাত, দো‘আ ও তাদের নিকট অন্য কিছু প্রার্থনা করত না। আর তারা তাদের দ্বারা কোনো উদ্ধারও কামনা করতো না। তাদের অনুপস্থিতিতেও নয়, কবরের কাছেও নয়। অনুরূপভাবে তারা কবরের কাছে অবস্থানও করতো না।

অন্যতম বড় শির্ক হলো: কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো মৃত ব্যক্তি বা অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। যেমনটি প্রশ্নকারী উল্লেখ করেছেন। অনুরূপ বড় শির্ক হচ্ছে, বিপদের সময় তাদের দ্বারা উদ্ধার কামনা করা। যেমন এটা বলা যে, হে আমার অমুক নেতা! মনে হচ্ছে সে যেন এ আহ্বান দ্বারা তার কাছে কোনো ক্ষতি বা অনিষ্ট দূর করার প্রার্থনা করছে অথবা উপকার লাভ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করছে। বস্তুত এটাই তো ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার মা, পাদ্রী ও সংসার বিরাগীদের সাথে নাসারাদের আচরণ। অথচ সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টিজীব হলেন, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর তার সাহাবীগণ তার মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। তারপরও তাদের কেউ তার অনুপস্থিতিতে এবং মৃত্যুর পরে এমনটি করেন নি।

মূলত এ মুশরিকরা তাদের শির্কের সাথে মিথ্যারও সংমিশ্রণ ঘটায়। কেননা মিথ্যা শির্কের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ حُرُمَٰتِ ٱللَّهِ فَهُوَ خَيۡرٞ لَّهُۥ عِندَ رَبِّهِۦۗ وَأُحِلَّتۡ لَكُمُ ٱلۡأَنۡعَٰمُ إِلَّا مَا يُتۡلَىٰ عَلَيۡكُمۡۖ فَٱجۡتَنِبُواْ ٱلرِّجۡسَ مِنَ ٱلۡأَوۡثَٰنِ وَٱجۡتَنِبُواْ قَوۡلَ ٱلزُّورِ ٣٠ حُنَفَآءَ لِلَّهِ غَيۡرَ مُشۡرِكِينَ بِهِ﴾ [ الحج : ٣٠، ٣١ ]

“কাজেই তোমরা বেঁচে থাক মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে এবং বর্জন কর মিথ্যা কথা। আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে এবং তাঁর কোনো শরীক না করে।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩০-৩১]

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«عُدِلَتْ شَهَادَةُ الزُّورِ بِالْإِشْرَاكِ بِاللَّهِ» ثَلَاثَ مَرَّات»

“মিথ্যা সাক্ষ্য আল্লাহর সাথে শির্কের সমপর্যায়ে চলে গেছে” কথাটি তিনি দু’বার বা তিনবার বলেছেন।” [হাদীসটির সনদ দুর্বল। আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৫৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৩০০।]

আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ ٱلۡعِجۡلَ سَيَنَالُهُمۡ غَضَبٞ مِّن رَّبِّهِمۡ وَذِلَّةٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۚ وَكَذَٰلِكَ نَجۡزِي ٱلۡمُفۡتَرِينَ ١٥٢﴾ [ الاعراف : ١٥٢ ]

“নিশ্চয় যারা গো-বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদের ওপর তাদের রবের ক্রোধ ও লাঞ্ছনা আপতিত হবেই। আর এভাবেই আমরা মিথ্যা রটনাকারীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫২]

অনুরূপভাবে ইবরাহীম খলীল আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

﴿أَئِفۡكًا ءَالِهَةٗ دُونَ ٱللَّهِ تُرِيدُونَ ٨٦ فَمَا ظَنُّكُم بِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٨٧﴾ [ الصافات : ٨٦، ٨٧ ]

“তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে অলীক বা মিথ্যা ইলাহগুলোকে চাও? ‘তাহলে সকল সৃষ্টির রব সম্বন্ধে তোমাদের ধারণা কী?” [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৮৬-৮৭]

তাদের মারাত্মক মিথ্যাচারের উদাহরণ হলো, তাদের কেউ কেউ তার পীর সাহেব সম্পর্কে বলে, মুরীদ বা ভক্ত যদি পশ্চিমে থাকে আর তার পীর পূর্বে থাকে, তাতেও তাদের মধ্যকার পর্দা উন্মোচিত হয়ে যায় এবং সে মুরীদের ডাকে সাড়া দিবে। তারা আরও বলে, যদি পীর সাহেব এমন না হবেন তো তিনি পীর হতে পারেন না। আবার কখনও কখনও শয়তান তাদের গোমরাহ করে দেয়, যেমনিভাবে সে মুর্তিপজকদেরকে পথভ্রষ্ট করে। যেভাবে শয়তান জাহেলী যুগে আরবদেরকে মূর্তির মাধ্যমে পথভ্রষ্ট করত এবং তারকাপূজারী ও তন্ত্র-মন্ত্রবাদীদেরকে শির্ক ও জাদুর মাধ্যমে পথভ্রষ্ট করে। যেমনিভাবে তাতারী, হিন্দী, সুদানীসহ অন্যান্য মুশরিকদের মধ্যেও শয়তান প্রলুব্ধ ও সম্বোধণ ইত্যাদি করে বিভিন্নভাবে পথভ্রষ্ট করতো। ঠিক এসব পীর মুরিদদের বেলাতেও একই ধরনের কিছু কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে শিষধ্বনি ও হাততালি শুনার সময়। কেননা শয়তান তাদের ওপর অবতীর্ণ হয়। আবার তাদের কারও কারও অবস্থা হয় মূর্ছিতের অবস্থার মতো, যেমন তাদের মুখ থেকে ফেনা বের হয়, ময়লা বের হয়, বিকট চিৎকার হতে থাকে, এমনসব কথা বলে যা সে নিজে কিংবা উপস্থিত কেউই বুঝতে পারে না। অনুরূপ আরও কত কিছু যে এসব পথভ্রষ্টদের দ্বারা ঘটে থাকে তার ইয়ত্তা নেই।

সম্মান ও মর্যাদার দ্বারা ওসীলা করা
আর তৃতীয় প্রকার হচ্ছে, এটা বলা, “হে আল্লাহ তোমার কাছে অমুকের সত্ত্বার বিনিময়ে অথবা অমুকের বরকতে অথবা আপনার কাছে অমুকের মর্যাদা দ্বারা, আমার জন্য এটা এটা কর।” এটা অধিকাংশ লোক করে থাকে। কিন্তু কোনো সাহাবী, তাবে‘ঈ ও এ উম্মাতের সালাফ বা গ্রহণযোগ্য পূর্বসূরী থেকে এটি বর্ণিত হয় নি যে তারা এ ধরনের দো‘আ করতো। আর আমার কাছে এ বিষয়ে কোনো আলেমের পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়ে আসে নি, যা আমি পেশ করতে পারবো। তবে কেবল আমি ফকীহ আবু মুহাম্মদ ইবন আবদুস সালামের ফতোয়ায় দেখি যে, তিনি এ মর্মে ফাতওয়া দিয়েছিলেন যে, “কারোর ব্যাপারে (সত্ত্বা, বরকত, মর্যাদা ইত্যাদির মাধ্যমে চাওয়া) বৈধ নয়, তবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে যদি হাদীসটি বিশুদ্ধ হয়, তাহলে সেটি নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত থাকবে।” বস্তুত আবু মুহাম্মাদের এ ফাতওয়ায় বর্ণিত হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ হাদীসটি যা নাসাঈ ও তিরমিযী ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কোনো এক সাহাবীকে যে দো‘আ শিখিয়েছেন, সেটি। সে দো‘আটি হচ্ছে,

«اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى لِيَ، اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ»

“হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি এবং আপনার নবীর মাধ্যমে আপনার দিকে ফিরছি, যিনি রহমাতের নবী, হে মুহাম্মদ! হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে নিয়ে আমার রবের কাছে ফিরছি; যেন তিনি আমার প্রয়োজন পূরণ করেন। হে আল্লাহ, আপনি আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ কবুল কর।” [জামে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৭৮; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৩৮৫।] কেননা এ হাদীস দ্বারা একদল আলেম নবীর জীবদ্দশায় ও তার মৃত্যুর পর তার দ্বারা ওসীলা করা বৈধ বলেছেন।

যারা উপর্যুক্ত হাদীস দ্বারা রাসূলের ব্যক্তিসত্ত্বার ওসীলা দেওয়া জায়েয মনে করে তারা বলে ওসীলা করা দ্বারা সৃষ্টিজীবের কাছে দো‘আ করা বুঝায় না এবং সৃষ্টিজীবের কাছে উদ্ধার কামনাও বুঝায় না; বরং এর দ্বারা একমাত্র আল্লাহর কাছে দো‘আ ও উদ্ধার কামনাই উদ্দেশ্য। তবে সেটা রাসূলের সত্ত্বার ওসীলায় চাওয়া। যেমনিভাবে সুনান ইবন মাজাহতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে বের হওয়ার সময় দো‘আ করে বলতেন,

«اللهمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِحَقِّ السَّائِلِينَ عَلَيْكَ، وَبِحَقِّ مَمْشَايَ هَذَا، أَنِّي لَمْ أَخْرُجْ أَشِرًا، وَلاَ بَطَرًا، وَلاَ رِيَاءً، وَلاَ سُمْعَةً، خَرَجْتُ اتِّقَاءَ سَخَطِكَ وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِكَ، أَسْأَلُكَ أَنْ تُعِيذَنِي مِنَ النَّارِ، وَأَنْ تَغْفِرَ لِي، إِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ»

“হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার প্রার্থনাকারীদের অধিকারে এবং আমার এ হাটার অধিকারে চাই। কারণ, আমি তো কোনো আমার অনিষ্ট, ঔদ্ধত্য, অহংকার কিংবা সুখ্যাতির জন্য বের হই নি। আপনার অসন্তুষ্টির ভয়ে ও আপনার সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায় আমি বের হয়েছি। আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি আর আমার সকল অপরাধের ক্ষমা। কেননা আপনি ব্যতীত পাপ ক্ষমা করার কেউ নেই।” [হাদীসটির সনদ দুর্বল। সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৭৭৮; মুসনাদে আহমাদ (৩/২১)।]

তারা বলে: এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ওপর প্রার্থনাকারীদের অধিকারের মাধ্যমে ও সালাতের দিকে তার গমনের মাধ্যমে চেয়েছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের ওপর কিছু অধিকার নির্ধারণ করে নিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

﴿ وَكَانَ حَقًّا عَلَيۡنَا نَصۡرُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٤٧ ﴾ [ الروم : ٤٧ ]

“আর মুমিনদের সাহায্য করা তো আমার ওপর তাদের অধিকার।” (সূরা আর রূম: ৪৭)

অনুরূপভাবে তাঁর বক্তব্য :

﴿ كَانَ عَلَىٰ رَبِّكَ وَعۡدٗا مَّسۡ‍ُٔولٗا ١٦ ﴾ [ الفرقان : ١٦ ]

এ প্রতিশ্রুতি পূরণ আপনার রব-এরই দায়িত্ব। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ১৬]

তদ্রূপ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন,

«يا مُعاذ : هَلْ تَدْري ما حَقُّ اللهِ عَلى عِبادِهِ قُلْتُ : اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ : حَقُّ اللهِ عَلى عِبادِهِ أَنْ يَعْبُدوهُ وَلا يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئاً ثُمَّ قَال : هَلْ تَدْري ما حَقُّ الْعِبادِ عَلى اللهِ إِذَا فَعَلُوهُ قُلْتُ اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ : حَقُّ الْعِبادِ عَلى اللهِ أَنْ لا يُعَذِّبَهُمْ»

“হে মু‘আয! তুমি কি জান, বান্দার ওপর আল্লাহর হক কী? তিনি বলেন আল্লাহ ও তার রাসূল এ সম্পর্কে অধিক জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বান্দার ওপর আল্লাহর হক হলো: তাঁর ইবাদত করা এবং তার সাথে কোনো কিছু শরীক না করা। তুমি কি জান যদি তারা এটা করে তবে আল্লাহর ওপর বান্দার হক কী? নিশ্চয় তার ওপর তাদের হক হলো: তাদের শাস্তি না দেওয়া।” [হাদীসটি সহীহ। সহীহ বুখারী(৬/৪৪); মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৩০, ৪৯।]

অন্য হাদীসে এসেছে: “আল্লাহর ওপর অমুক হক রয়েছে।” যেমন, তার বাণী:

مَنْ شَرِبَ الْخَمْرَ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلاَةٌ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ، فَإِنْ تَابَ تَابَ الله عَلَيْهِ ، فَإِنْ عَادَ الثَّانِيَةَ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلاَةٌ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ، فَإِنْ تَابَ تَابَ الله عَلَيْهِ ، فَإِنْ عَادَ الثَّالِثَةَ لَمْ يُقْبَلْ لَهُ صَلاَةٌ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ، فَإِنْ تَابَ تَابَ الله عَلَيْهِ ، فَإِنْ عَادَ الرَّابِعَةَ لَمْ يُقْبَلْ لَهُ تَوْبَةٌ ، وَكَانَ حَقًّا عَلَى الله عَزَّ وَجَلَّ أَنْ يَسْقِيَهُ مِنْ طِينَةِ الْخَبَالِ ، قِيلَ : مَا طِينَةُ الْخَبَالِ ؟ قَالَ : عُصَارَةُ أَهْلِ النَّارِ .

“যে ব্যক্তি মদ পান করে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করা হবে না। যদি সে তাওবা করে তবে আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করেন। অতঃপর যদি পুনরায় পান করে, তবে পুনরায় চল্লিশ দিন তার সালাত কবুল করা হবে না। অতঃপর যদি পুনরায় তৃতীয়বার অথবা চতুর্থবার পান করে তখন আল্লাহর দায়িত্ব হলো তাকে ত্বীনাতুল খাবাল পান করানো।” জিজ্ঞেস করা হলো ‘ত্বীনাতুল খাবাল” কী? তিনি বলেন “জাহান্নামীদের পুঁজ।” [জামে তিরমিযী, হাদীস নং ১৮৬৩; মুসনাদে আহমাদ (২/৫৩)।] (এ হচ্ছে একদল লোকের বক্তব্য, যারা রাসূলের সত্ত্বা দিয়ে ওসীলা করা জায়েয মনে করে থাকে) কিন্তু অপর দল আলেমের বক্তব্য হলো:

«اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى لِيَ، اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ»

“হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি এবং আপনার নবীর মাধ্যমে আপনার দিকে ফিরছি, যিনি রহমাতের নবী, হে মুহাম্মাদ! হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে নিয়ে আমার রবের কাছে ফিরছি; যেন তিনি আমার প্রয়োজন পূরণ করেন। হে আল্লাহ, আপনি আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ কবুল কর।” [জামে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৭৮; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৩৮৫।] এ হাদীস দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর এবং তার অনুপস্থিতিতে তাঁর ওসীলা ধরা জায়েয প্রমাণিত হয় না। বরং এ হাদীস দ্বারা কেবল রাসূলের জীবদ্দশায় তাঁর উপস্থিতিতে ওসীলা করার বৈধতা সাব্যস্ত হচ্ছে। যেমনটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে,

«اللهم إنا كنا إذا أجدبنا نتوسل إليك بنبينا فتسقينا وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا»

“হে আল্লাহ! আমরা যখন অনাবৃষ্টিতে পতিত হতাম তখন আমরা তোমার নিকট আমাদের নবীর দো‘আর মাধ্যমে প্রার্থনা করতাম। ফলে আমাদের বৃষ্টি দেওয়া হতো। আর এখন আমরা তোমার নিকট আমাদের নবীর চাচার দো‘আর মাধ্যমে চাচ্ছি। সুতরাং আমাদের বৃষ্টি দিন, ফলে বৃষ্টি বর্ষিত হতো।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০১০; ইবনু হিব্বান, হাদীস নং ২৮৫০।]

আর এ ওসীলা হচ্ছে, তারা রাসূলের চাচার কাছে চাইতো যে, তিনি যেন তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করেন, ফলে তিনি তাদের জন্য দো‘আ করতেন এবং তারাও তার সাথে দো‘আ করতেন। আর তার সুপারিশ ও দো‘আ দ্বারা ওসীলা করতেন। যেমনিভাবে সহীহ বুখারীতে আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে: কোনো এক ব্যক্তি জুম‘আর দিনে বিচারালয়ের পার্শ্বস্থ দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দণ্ডায়মান হয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। অতঃপর লোকটি দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে অগ্রসর হলেন এবং বললেন,

«يا رسول الله هلكت الأموال وانقطعت السبل فادع الله يمسكها عنا قال فرفع رسول الله صلى الله عليه وسلم يديه ثم قال اللهم حوالينا ولا علينا اللهم على الآكام والظراب وبطون الأودية ومنابت الشجرة»

“হে আল্লাহর রাসূল! সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং পথ-ঘাট নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য দো‘আ করুন যেন আমাদের থেকে তা দুর হয়ে যায়। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত উত্তোলন করলেন। অতঃপর বললেন, “হে আল্লাহ আমাদের ওপর নয়, আমাদের আশে পাশে বৃষ্টি দিন, হে আল্লাহ উঁচু ভূমিতে, পাহাড়ে, উপত্যকার কোলে ও বনাঞ্চলে বর্ষন করুন।” [সহীহ বুখারী,(২/৫১,৫২,৩৬), মুসনাদে আহমাদ, হহাদীস নং ৮৯৭, সুনান আবু দাউদ,হাদিস নং ১১৭৪/১১৭৫।] বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমরা সুর্যের মধ্যে বের হলাম। এ হাদীসের মধ্যে তিনি বলেছেন, “আপনি আমাদের জন্য দো‘আ করুন যেন আমাদের থেকে তা দুর হয়ে যায়।” (যা দ্বারা বুঝা গেলো যে, তা দো‘আ ছিল, ব্যক্তিসত্ত্বার দ্বারা ওসীলা করা নয়)

আর সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমার মনে পড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে আবু তালিবের বক্তব্য, তিনি বলেছিলেন,

«وَأَبْيَضَ يُسْتَسْقَى الغَمَامُ بِوَجْهِهِ ... ثِمَالُ اليَتَامَى عِصْمَةٌ لِلْأَرَامِلِ»

“আর তিনি শুভ্র, তাঁর চেহারার বিনিময়ে বৃষ্টি লাভ হয়, তিনি ইয়াতিমদের ভারবহনকারী এবং বিধবাদের আশ্রয়স্থল”।

সুতরাং এটা ছিল বৃষ্টি ও অনুরূপ কাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা তাদের ওসীলা গ্রহণ; কিন্তু এটা কেবল তার জীবদ্দশাতেই ছিল, তার মৃত্যুর পরে তারা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দ্বারা সে রকম ওসীলা করেছিলেন, যে রকম ওসীলা ও বৃষ্টি প্রার্থনা তারা ইতোপূর্বে রাসূলের দ্বারা করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তারা তার কাছে আর কোনো প্রার্থনা করেন নি। তার অনুপস্থিতিতেও নয়, তার কবরের নিকটও নয় এবং অন্য কোনো কবরেও করেন নি।

অনুরূপভাবে মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সময়ে ইয়াযিদ ইবন আসওয়াদ আল জুরাশীর মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য দো‘আ করতেন। আর তিনি বলতেন, “হে আল্লাহ, আমরা আমাদের উত্তম ব্যক্তি দ্বারা আপনার নিকট শাফায়াত চাচ্ছি। হে ইয়াযীদ আল্লাহর দিকে তোমার হাত উত্তোলন কর। ফলে তিনি তার হাত উত্তোলন করলেন এবং দো‘আ করলেন। আর তারাও তার সাথে দো‘আ করল, ফলে বৃষ্টি হলো।”

এ কারণে আলেমগণ বলেন, ভাল ও কল্যাণময় ব্যক্তির মাধ্যমে বৃষ্টির প্রার্থনা করা মুস্তাহাব। অতঃপর যখন সেখানে আহলে বাইতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাওয়া যায় তখন তা হবে অধিক উত্তম; কিন্তু কোনো আলেমই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তির মৃত্যুর পর বা তার অনুপস্থিতে ওসীলা করা ও বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা শরী‘আতসম্মত বলে উল্লেখ করেন নি। আর তারা কোনো বৃষ্টি প্রার্থনা, কিংবা বিপদাপদে সাহায্য চাওয়া বা অন্যান্য কোনো দো‘আর ক্ষেত্রেই এ ধরনের ওসীলা করা মুস্তাহাব বলেন নি। অথচ ‘দু‘আ হচ্ছে ইবাদতের সার।

আর ইবাদতের ভিত্তি হলো সুন্নাহ ও অনুসরণ। প্রবৃত্তি ও নব আবিস্কার নয়। একমাত্র যা শরী‘আহসম্মত তা দ্বারাই ইবাদত করা যাবে। প্রবৃত্তি ও নব আবিস্কার দ্বারা ইবাদত করা যাবে না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُ﴾ [ الشورا : ٢١ ]

“নাকি তাদের এমন কতগুলো শরীক রয়েছে, যারা এদের জন্য দীন থেকে শরী‘আত প্রবর্তন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেন নি?” [সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ২১]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿ٱدۡعُواْ رَبَّكُمۡ تَضَرُّعٗا وَخُفۡيَةًۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ ٥٥﴾ [ الاعراف : ٥٥ ]

“তোমরা বিনিতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক; নিশ্চয় তিনি সীমালংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৫]

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«سيكون بعدي قوم من هذه الأمة يعتدون في الدعاء والطهور»

“অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে এক সম্প্রদায় হবে যারা দো‘আ ও পবিত্রতার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করবে। [আবু দাউদ, হাদীস নং ৯৬; বায়হাকি (১/১৯৭)।]

যে ব্যক্তি কোনো বিপদ ও ভয়ে পড়ে তার পীরের কাছে উদ্ধার চায় তার বিধান
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির নিকট কোনো বিপদ অথবা কোনো বিষয়ে ভীত হয়ে সে তার পীরের মাধ্যমে উদ্ধার কামনা করে, যেন উক্ত আপতিত বিষয়ে তার অন্তর সুদৃঢ় থাকে, প্রকৃতপক্ষে এটা শির্কের অন্তর্গত। আর এটা নাসারাদের দীনের কর্মের মত। কেননা কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই রহমত বর্ষণ করেন ও অনিষ্ট দূর করেন। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِن يَمۡسَسۡكَ ٱللَّهُ بِضُرّٖ فَلَا كَاشِفَ لَهُۥٓ إِلَّا هُوَۖ وَإِن يُرِدۡكَ بِخَيۡرٖ فَلَا رَآدَّ لِفَضۡلِهِۦۚ يُصِيبُ بِهِۦ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۚ وَهُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ١٠٧﴾ [ يونس : ١٠٧ ]

“আর যদি আল্লাহ আপনাকে কোনো ক্ষতির স্পর্শ করান, তবে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। আর যদি আল্লাহ আপনার মঙ্গল চান, তবে তাঁর অনুগ্রহ প্রতিহত করার কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তার কাছে সেটা পৌঁছান। আর তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১০৭]

﴿مَّا يَفۡتَحِ ٱللَّهُ لِلنَّاسِ مِن رَّحۡمَةٖ فَلَا مُمۡسِكَ لَهَاۖ وَمَا يُمۡسِكۡ فَلَا مُرۡسِلَ لَهُۥ مِنۢ بَعۡدِهِ﴾ [ فاطر : ٢ ]

“আল্লাহ মানুষের প্রতি কোনো অনুগ্রহ অবারিত করলে কেউ তা নিবারণকারী নেই এবং তিনি কিছু নিরুদ্ধ করতে চাইলে পরে কেউ তার উন্মুক্তকারী নেই।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ২]

﴿قُلۡ أَرَءَيۡتَكُمۡ إِنۡ أَتَىٰكُمۡ عَذَابُ ٱللَّهِ أَوۡ أَتَتۡكُمُ ٱلسَّاعَةُ أَغَيۡرَ ٱللَّهِ تَدۡعُونَ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٤٠ بَلۡ إِيَّاهُ تَدۡعُونَ فَيَكۡشِفُ مَا تَدۡعُونَ إِلَيۡهِ إِن شَآءَ وَتَنسَوۡنَ مَا تُشۡرِكُونَ ٤١﴾ [ الانعام : ٤٠، ٤١ ]

“বলুন, ‘তোমরা আমাকে জানাও, যদি আল্লাহর শাস্তি তোমাদের ওপর আপতিত হয় বা তোমাদের কাছে কিয়ামত উপস্থিত হয়, তবে কি তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও ডাকবে, যদি তোমরা সত্যবাদী হও? ‘না, তোমরা শুধু তাঁকেই ডাকবে, তোমরা যে দুঃখের জন্য তাঁকে ডাকছ তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদের সে দুঃখ দুর করবেন এবং যাকে তোমরা তাঁর শরীক করতে তা তোমরা ভুলে যাবে।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৪০, ৪১]

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا ٥٦ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحۡذُورٗا ٥٧﴾ [ الاسراء : ٥٦، ٥٧ ]

“বলুন, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ মনে কর তাদেরকে ডাক, অতঃপর দেখবে যে, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার বা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই; তারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো তাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হতে পারে, আর তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয় আপনার রবের শাস্তি ভয়াবহ।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৬, ৫৭]

ফলে সুস্পষ্ট যে, ফিরিশতা, নবী কিংবা অন্যান্য যাদেরকে ডাকা হয়, তরা তাদের থেকে অনিষ্ট দুর করতে সক্ষম নয়। আর পরিবর্তনও করতে পারে না।

সুতরাং যখন কারও বক্তব্য এটা হয় যে, আমি পীর সাহেবকে ডাকি যেন তিনি আমার জন্য শাফা‘আতকারী হন। তখন সেটা নাসারাদের দো‘আর অনুরূপ হবে। কেননা তারা মারইয়াম, তাদের পণ্ডিত ও দরবেশদের নিকট দো‘আ চাইত। অপরদিকে মুমিন তো কেবল তার প্রভুর কাছেই প্রত্যাশা করে, তাকেই ভয় করে এবং তাকেই একনিষ্ঠভাবে ইবাদতের জন্য ডাকে। আর ছাত্রের ওপর তার উস্তাদের হক হলো তার জন্য দো‘আ করা এবং তার ওপর রহমত প্রত্যাশা করা। কেননা সর্বশ্রেষ্ট মর্যাদাবান সৃষ্টি হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর তার সাহাবীগণ তার নির্দেশাবলী ও মর্যাদা সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত এবং সর্বাধিক তার অনুগত্যপরায়ন মানুষ। তাদের মধ্য হতে কাউকে তিনি আশ্রয়ের ও ভয়ের সময় আদেশ করেন নি এটা বলতে: হে আমার নেতা! হে আল্লাহর রাসূল! (এটা বলে শাফা‘আত চাওয়ার নির্দেশ রাসূল দেন নি।)। আর সাহাবীগণের কেউই রাসূলের জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুর পর এমনটি করেন নি; বরং তিনি তাদেরকে আল্লাহর যিকির ও দো‘আ পাঠ এবং তার ওপর সালাত ও সালাত পেশ করতে আদেশ দিয়েছেন। (যাতে আল্লাহর কাছে তাদের দো‘আ কবুল হয়, শাফা‘আত চাওয়ার মাধ্যমে নয়) দেখুন, কীভাবে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন বিপদে বলার জন্য। তিনি বলেন,

﴿ٱلَّذِينَ قَالَ لَهُمُ ٱلنَّاسُ إِنَّ ٱلنَّاسَ قَدۡ جَمَعُواْ لَكُمۡ فَٱخۡشَوۡهُمۡ فَزَادَهُمۡ إِيمَٰنٗا وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ وَنِعۡمَ ٱلۡوَكِيلُ ١٧٣ فَٱنقَلَبُواْ بِنِعۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَفَضۡلٖ لَّمۡ يَمۡسَسۡهُمۡ سُوٓءٞ وَٱتَّبَعُواْ رِضۡوَٰنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ ذُو فَضۡلٍ عَظِيمٍ ١٧٤﴾ [ ال عمران : ١٧٣، ١٧٤ ]

“এদেরকে লোকেরা বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জড়ো হয়েছে, কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এ কথা তাদের ঈমানকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা তারপর তারা আল্লাহর নি‘আমত ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল, কোনো অনিষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করে নি এবং আল্লাহ যাতে সন্তুষ্ট তারা তারই অনুসরণ করেছিল এবং আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। বলেছিল, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক!” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৭৩, ১৭]

সহীহ বুখারীতে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা হতে বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয় এ বাক্যগুলো ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আগুনে নিক্ষিপ্ত হবার সময় বলেছিলেন। আর তা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণ যখন তাদেরকে মানুষ বলেছিল যে, ‘নিশ্চয় মানুষ তোমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে’ তখন তারা বলেছিলেন।

অনুরূপভাবে সহীহ হাদীসে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদের সময় বলতেন,

«لا اله الا الله العظيم الحليم لا اله الا الله رب العرش الكريم لا اله الا الله رب السماوات الأرض ورب العرش العظيم»

“আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোনো সত্য মা‘বুদ নেই যিনি মহান ও ধৈর্যশীল। তিনি ব্যতীত কেনো সত্য মা‘বুদ নেই তিনি সম্মানিত আরশের মালিক। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোনো সত্য মা‘বুদ নেই, আসমান ও যমীনের রব এবং মহান আরশের রব।” [সহীহ বুখারী (১১/১২৩), সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৩০।]

এমনকি কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, তিনি এ দো‘আটি তাঁর আহলে বাইত তথা পরিবারের কোনো কোনো সদস্যকেও শিখিয়েছেন।

তাছাড়া সুনান গ্রন্থসমূহে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো বিপদে পতিত হতেন, তখন বলতেন,

» ياحي يا قيوم برحمتك أستغيث»

“হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী, তোমার রহমতের দ্বারা আমি উদ্ধার প্রার্থনা করছি।” [হাদীসটির সনদ দুর্বল। জামে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫২৪।]

আরও বর্ণিত আছে যে, তিনি তার কন্যা ফাতিমাকে নিন্মোক্ত দো‘আ শিখিয়েছেন,

«يا حي يا قيوم يا بديع السموات والأرض لا إله إلا أنت برحمتك أستغيث أصلح لي شأني كله ولا تكلني إلى نفسي طرفة عين ولا ألى أحد من خلقك»

“হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী, হে আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, তুমি ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বুদ নেই, তোমার রহমত দ্বারা আমি উদ্ধার প্রার্থনা করছি। আমার সকল কর্ম সংশোধন করে দাও। আমাকে আমার নিজের কাছে ক্ষনিকের জন্যও ন্যস্ত করো না এবং তোমার কোনো সৃষ্টজীবের কাছেও নয়।” [হাদীসটির সনদ দুর্বল। তাবরানী (১/১৫৯)।]

তাছাড়া মুসনাদে ইমাম আহমাদ ও সহীহ আবী হাতেম আল-বুস্তি রহ. আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে,

«مَا أَصَابَ أَحَدًا قَطُّ هَمٌّ، وَلاَ حُزْنٌ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ ابْنُ عَبْدِكَ ابْنُ أَمَتِكَ فِي قَبْضَتِكَ نَاصِيَتِي بِيَدِكَ مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ عَلَى أَحَدٍ فِي كِتَابِكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي وَنُورَ صَدْرِي وَجَلاءَ حُزْنِي وَنُورَ بَصَرِي وَذَهَابَ هَمِّي إِلاَّ أَذْهَبَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ هَمَّهُ وَحُزْنَهُ وَأَبْدَلَهُ مَكَانَهُ فَرَحًا قَالَ فَقِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ أَلاَ نَتَعَلَّمُهَا قَالَ بَلَى يَنْبَغِي لِمَنْ سَمِعَهَا أَنْ يَتَعَلَّمَهَا»

“কোনো লোক যখন কোনো বিপদ ও দুঃশ্চিন্তায় পড়ে বলে, হে আল্লাহ আমি আপনার বান্দা, আপনার এক বান্দার পুত্র এবং আপনার এক বাঁদীর পুত্র। আমার কপাল আপনার হাতে, আমার ওপর আপনার নির্দেশ কার্যকর, আমার ব্যাপারে আপনার ফয়সালা ন্যায়পূর্ণ। আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি আপনার নামের উসীলায়, যে নাম আপনি নিজের জন্য নিজে রেখেছেন অথবা আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন অথবা আপনার সৃষ্টজীবের কাউকে শিখিয়েছেন অথবা নিজ গায়েবী ইলমে নিজের জন্য একান্ত করে রেখেছেন-আপনি কুরআনকে বানিয়ে দিন আমার হৃদয়ের প্রশান্তি, আমার বক্ষের জ্যোতি, আমার দুঃখের অপসারণকারী এবং দুশ্চিন্তা দূরকারী। এটা বললে তার যাবতীয় বিপদ ও দুঃশ্চিন্তা দুর করে দিবেন, সেটার স্থান খুশিতে ভরপুর করে দিবেন। সাহাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তা মানুষদের শিখিয়ে দিবো না? রাসূল বললেন, অবশ্যই হ্যাঁ, যে কেউ তা শুনবে তার উচিত সেটা শিক্ষা গ্রহণ করা।” [হাদীসটির সনদ দুর্বল। মুসনাদে আহমাদ (১/৪৫২); ইবন হিব্বান, হাদীস নং ২৩৭২।]

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মাতকে বলেছেন,

«إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ آيَتَانِ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لاَ يَنْكَسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ وَلاَ لِحَيَاتِهِ يُخَوِّفُ اللَّهُ بِهِمَا عِبَادَهُ فَإِذَا رَأَيْتُمْ ذَلِكَ فَافْزَعُوا إِلَى الصلاة وذِكْرِ اللَّهِ والاستغفار»

“নিশ্চয় চন্দ্র ও সূর্য মহান আল্লাহর অন্যতম দু’টি নিদর্শন, কারও মৃত্যু কিংবা জীবনের কারণে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হয় না। আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে তার বান্দাদের ভীতি প্রদর্শন করেন। সুতরাং যখন তোমরা তা দেখবে তখন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহর সালাত, যিকির ও ক্ষমা প্রার্থনার দিকে ধাবিত হও”। [হাদীসটি সহীহ। সহীহ বুখারী (২/৫২৯); সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯০১; সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ১১৭৭।]

১০
শির্কের প্রথম প্রকাশ
বলা হয়ে থাকে যে, মক্কার যমীনে সর্বপ্রথম ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পরে আমর ইবন লুহাই আল খুযা‘ঈর মাধ্যমে শির্কের প্রচলন হয়। যাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নামে নাড়ীভুড়ি টানা হেচড়া করছে দেখেছেন। সে সর্বপ্রথম সায়েবা (মূর্তির উদ্দেশ্যে প্রাণী) ছেড়েছিল এবং সর্বপ্রথম ইবরাহীমের দীনে পরিবর্তন সাধন করেছিল। ঐতিহাসিকগণ বলেন, সে শামে প্রবেশ করে সেখানকার ‘বলকা’ নামক স্থানে কতিপয় মূর্তি পেল, সেখানকার অধিবাসীরা ধারণা করছিলো যে, এগুলো তাদের উপকার করতে সমর্থ এবং অনিষ্ট দুর করতেও সক্ষম। তখন আমর ইবন লুহাই সে মূর্তিগুলোকে মক্কায় নিয়ে আসে এবং আরবদের জন্য শির্ক ও মূর্তিপূজার প্রচলন করে।

আর ঐ সব কাজ যা আল্লাহ ও তার রাসূল হারাম করেছেন, যেমন শির্ক, জাদু, হত্যা, যিনা, মিথ্যা সাক্ষ্য ও মদপান প্রভৃতি নিষিদ্ধ কর্মসমূহ, কখনো কখনো এগুলোর মাধ্যমে কোনো কোনো ব্যক্তি বিশেষ কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত হয় যাকে সে উপকার লাভ কিংবা অপকার রোধের উপায় হিসাবে গণ্য করে থাকে। যদি এমনটি না হতো তবে কোনো অবস্থাতেই যেসব কাজে কোনো কল্যাণ নেই সেসব নিষিদ্ধ কাজে মানুষ প্রবৃত্ত হতো না। আর অজ্ঞতা অথবা প্রয়োজনই মানুষদেরকে কেবল নিষিদ্ধ কর্মে পতিত করে। পক্ষান্তরে খারাপ ও নিষিদ্ধ কর্ম সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তি কিরূপে এটি করে? আর যারা এসব কাজে প্রবৃত্ত হয়, তারা কখনো কখনো এসবের মধ্যে যে বিপর্যয় রয়েছে তা সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার কারণে তা করে থাকে কিংবা তাদের প্রয়োজন থাকায় তারা তাতে পতিত হয়। যেমন, সেগুলোর প্রতি প্রবৃত্তির আকর্ষণ। অথচ কখনো কখনো তাতে যে লাভ রয়েছে তা থেকে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি, কিন্তু তরা তা সম্পর্কে অবগত নয়। অজ্ঞতার কারণে অথবা প্রবৃত্তি তাদের ওপর এমনভাবে বিস্তার করে যে শেষ পর্যন্ত তারা সে অন্যায় কাজটি করে বসে। আর অধিকাংশ সময় প্রবৃত্তি চাহিদা ব্যক্তিকে এমন বানিয়ে ফেলে যে, সে সত্য সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে সক্ষম হয় না। কেননা কোনো বিষয়ে তোমার ভালোবাসা সেটার ব্যাপারে তোমাকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে ফেলে।

আর একারণে আলেম বা দীনের জ্ঞানী ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে। আবুল ‘আলিয়া বলেন, আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথীদেরকে মহান আল্লাহর নিন্মোক্ত বাণী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

﴿إِنَّمَا ٱلتَّوۡبَةُ عَلَى ٱللَّهِ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسُّوٓءَ بِجَهَٰلَةٖ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٖ﴾ [ النساء : ١٧ ]

“আল্লাহ অবশ্যই সেসব লোকের তাওবাহ কবুল করবেন যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করে এবং তাড়াতাড়ি তাওবাহ করে” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৭] তারা বলল: যে কেউই আল্লাহর অবাধ্য হয় সে অজ্ঞ বলে বিবেচিত। আর যে কেউ মৃত্যুর পূর্বে তাওবা করবে, সে তাড়াতাড়ি তাওবা করেছে বলে বিবেচিত হবে। বস্তুত এটা নিষিদ্ধ বিষয়ে যে সব অগ্রাধিকারসম্পন্ন অপকারিতা এবং নির্দেশিত বিষয়ে যে সব অগ্রাধিকারসম্পন্ন উপকারিতা রয়েছে তা বিস্তারিত বর্ণনার স্থান নয়; বরং মুমিনের জন্য এটা জানাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তা‘আলা যা আদেশ করেছেন তাতে রয়েছে নিশ্চিত গ্রহণযোগ্য স্বার্থ প্রাধান্যপ্রাপ্ত স্বার্থ। আর যা থেকে আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছেন তাতে রয়েছে নিশ্চিত বিপর্যয় অথবা প্রাধান্যপ্রাপ্ত বিপর্যয়। আর আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে যখন কোনো আদেশ করেন তখন তা আল্লাহর কোনো প্রয়োজন পূরণের জন্য করেন না, অনুরূপভাবে যখন কোনো নিষেধ করেন তখন সে বিষয়ে তার কৃপণতার জন্য করেন না, বরং তাদেরকে সেটার আদেশই করেন, যাতে তাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে এবং সেটা থেকেই নিষেধ করেন, যাতে তাদের জন্য বিপর্যয় রয়েছে। আর এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গুণান্বিত বলেছেন যে,

﴿يَأۡمُرُهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَىٰهُمۡ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡخَبَٰٓئِثَ﴾ [ الاعراف : ١٥٧ ]

“যিনি তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেন, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন, তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করেন।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৭]

১১
কবর স্পর্শ করা ও চুম্বন করা এবং গালের পার্শ্বদেশ কবরের ওপর লাগানোর বিধান বর্ণনা
আর কবর স্পর্শ করা, সেটা যার কবরই হোক না কেন, আর কবরকে চুম্বন করা ও তাতে গালের পার্শ্বদেশ লাগানো সকল মুসলিমদের ঐকমত্যে নিষেধ করা হয়েছে। যদিও তা কোনো নবীর কবরই হোক না কেন। আর এই উম্মাতের পূর্বসূরী ও ইমামগণের কেউ এটা করেন নি, বরং এটা শির্কের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣ وَقَدۡ أَضَلُّواْ كَثِيرٗاۖ ٢٤﴾ [ نوح : ٢٣، ٢٤ ]

“আর তারা বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ, সুওয়া‘আ, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে। ‘বস্তুত তারা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে”। [সূরা নূহ, আয়াত: ২৩-২৪]

আর পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এসব নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের সৎর্কমপরায়ন ব্যক্তিদের নাম। আর তারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঐসব কবরের উপর অবস্থান করেছিল। অতঃপর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর তারা সেসবের মূর্তি বানালো। বিশেষ করে যখন তারা এসবের সাথে মৃতের কাছে দো‘আ ও তার মাধ্যমে উদ্ধার প্রার্থনাকে যোগ করলো। পূর্বেই এসম্পর্কে বর্ণনা অতিবাহিত হয়েছে এবং সেখানে যে শির্ক রয়েছে তারও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং (বিদ‘আতী যিয়ারত) যা খৃস্টানদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও (শর‘ঈ যিয়ারতের) পার্থক্য স্পষ্ট করা হয়েছে।

১২
পীরদের সামনে মাথা নোয়ানো ও মাটি চুম্বন করার বিধান
আর বড় বড় পীর ও অন্যান্যদের নিকট মাথা নোয়ানো অথবা মাটি চুম্বন করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। বরং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতিত অন্য কারো জন্য সামান্য পিঠ বাঁকা করে ঝুঁকে পড়া থেকেও নিষেধ করা হয়েছে।

মুসনাদ ও অন্যান্য গ্রন্থে এসেছে যে, যখন মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু শাম দেশ থেকে ফিরে আসলেন তখন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাজদাহ করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এটা কি হে মু‘আয? উত্তরে তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমি সিরিয়াতে তাদেরকে দেখেছি যে তারা তাদের পাদ্রী ও বিশপকে সাজদাহ করছে, আর তারা তাদের নবীদের থেকেও অনুরূপ উল্লেখ করে থাকেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

يَا مُعَاذُ، إِنَّهُمْ كَذَبُوا عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ، لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِغَيْرِ الله عَزَّ وَجَلَّ، لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا لما عظم الله من حقه عليهافَقَالَ : «لاَ تَفْعَلُوا أَرَأَيْتَ لَوْ مَرَرْتَ بِقَبْرِى أَكُنْتَ سَاجِدًا؟» .

“হে মু‘আয তারা মিথ্যা বলেছে! যদি আমি কাউকে সাজদাহ করার আদেশ করতাম, তবে অবশ্যই স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামীকে তাদের ওপর অধিক অধিকারের জন্য সাজদাহ করতে বলতাম।” হে মু‘আয তুমি আমাকে জানাও যদি তুমি আমার কবরের কাছ দিয়ে অতিক্রম কর তবে কি তুমি তাতে সাজদাহ করবে? মু‘আয বললেন, না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তুমি এটা করবে না।” [প্রাগুক্ত।] অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমনটি বলেছেন।

বরং সহীহ গ্রন্থে জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে সাব্যস্ত আছে যে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথীদের সহ অসুস্থতার কারণে বসে সালাত আদায় করেছেন। আর তারা দাড়িয়ে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি তাদের বসতে আদেশ করলেন।

আর তিনি বললেন: “যেমনিভাবে অনারবগণ পরস্পর পরস্পরকে সম্মান দেখায় তোমরা আমাকে সেরূপ সম্মান দেখাবে না।” [প্রাগুক্ত।]

তিনি আরও বলেন,

«من سره أن يتمثل له الناس قياما فليتبوأ مقعده من النار»

“যে ব্যক্তি তার জন্য মানুষ দাঁড়িয়ে থাকাকে পছন্দ করে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।” [হাদীসটির সনদ সহীহ। সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ৫২২৯; জামে তিরমিযী, হাদীস নং ২৭৫৬; বুখারী, আদাবুল মুফরাদ, হাদীস নং ৯৭৭।]

সুতরাং যখন তাদেরকে দাঁড়াতে নিষেধ করা হলো, যখন তিনি বসা অবস্থায় ছিলেন, আর তারা ছিল সালাতে দণ্ডায়মান, যাতে সেটা তাদের মতো না হয় যারা তাদের বড়দের জন্য দণ্ডায়মান হয় এবং আরও জানিয়েছেন যে, দাঁড়িয়ে থাকায় যে সন্তুষ্ট হয় তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে, তাহলে কারও জন্য সাজদাহ করা ও মাথা নুইয়ে রাখা অথবা হাত চুম্বনের বিধান কেমন হতে পারে? উমার ইবন আবদুল আযীয রহ. যিনি তখন যমীনে আল্লাহর খলিফা ছিলেন, তিনি যখন কেউ আগমন করতো তখন তাকে মাটি চুম্বন থেকে ফিরে রাখতে এবং তাদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিয়েছিলেন।

মোটকথা, দণ্ডায়মান হওয়া, বসা, রুকু ও সাজদাহ কেবলমাত্র এক মা‘বুদের অধিকার। যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। আর একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার অধিকারে অন্য কারো অংশ থাকতে পারে না। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ كَانَ حَالِفًا فَلْيَحْلِفْ بِاللَّهِ أَوْ لِيَصْمُتْ» .

“যে ব্যক্তি শপথ করে সে যেন আল্লাহর নামে শপথ করে অথবা চুপ থাকে।” [হাদীসটি সহীহ। সহীহ বুখারী,(১১/৪৪১,৪৪২); সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৪৬।]

তিনি আরো বলেন,

«مَنْ حَلَفَ بِشَيْءٍ دُونَ اللهِ فَقَدْ أَشْرَك»

“যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর শপথ করে, সে তো নিশ্চয় শির্ক করলো।” [হাদীসটি সহীহ। জামে তিরমিযী, হাদীস নং ১৫৩৫; মুসনাদে আহমাদ,(২/৩৪)।]

অতএব, সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য, তার কোনো শরীক নেই,

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥﴾ [ البينة : ٥ ]

“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে, তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে। আর এটাই সঠিক দীন। [সূরা আল-বাইয়্যেনাহ, আয়াত: ৫]

অনুরূপভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

«إِنَّ اللَّهَ يَرْضَى لَكُمْ ثَلاَثًا رَضِىَ لَكُمْ أَنْ تَعْبُدُوهُ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَأَنْ تَعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلاَ تَفَرَّقُوا وَأَنْ تُنَاصِحُوا مَنْ ولاه اللَّهُ أَمْرَكُمْ»

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তিনটি বিষয়ে সন্তুষ্ট আছেন: তোমরা কেবল তাঁর ইবাদত করবে এবং তার সাথে কোনো কিছুর শরীক করবে না, তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সকলে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। আর তোমরা তোমাদের শাসক-আলেমগণ, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের কল্যাণকামী হবে।” [হাদীসটি সহীহ। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৫; মুয়াত্তা ইমাম মালেক (২/৯৯০); মুসনাদে আহমাদ(২/৩৬৭)।] আর ইবাদতকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করাই হলো ইবাদতের মূল।

আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত সুক্ষ্ম, প্রকাশ্য, তুচ্ছ, বড় সর্ব প্রকার শির্ক থেকে নিষেধ করেছেন। এমনকি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুতাওয়াতির তথা সন্দেহাতীতভাবে ধারাবাহিক বর্ণনার মাধ্যমে এসেছে যে, তিনি সূর্য উদয় ও অস্ত যাওয়ার সময় সালাত আদায়কে নিষেধ করেছেন। যা বিভিন্ন শব্দে এসেছে, কখনো তিনি বলেন,

«لا تحروا بصلاتكم طلوع الشمس ولا غروبها»

“তোমরা সূর্য উদয় ও অস্তের সময় সালাত আদায় করার জন্য লেগে থাকবে না।” [হাদীসটি সহীহ। সহীহ বুখারী (১/১৫২); সহীহ মুসলিম (১/৫৬৭)।]

আবার কখনো ফযরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত এবং আসরের পর হতে সুর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত সালাতকে নিষেধ করেছেন।

আবার কখনো তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সূর্য শয়তানের দুই শিং-এর উপর উদিত হয়। আর ঐ সময় কাফেররা তাকে সাজদাহ করে। ফলে ঐ সময় সালাত আদায়কে নিষেধ করা হয়েছে, যেহেতু ঐ একই সময় সাজদাহর মাধ্যমে মুশরিকদের সূর্যকে সাজদাহ করার সামঞ্জস্য হয়ে যায়। আর শয়তান তখন সূর্যের সাথে মিলিত হয় যেন তার জন্য সাজদাহ করা হয়। (যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামান্যতম সামঞ্জস্যতার কারণে) এগুলো থেকে নিষেধ করেছেন, তাহলে যেগুলো সুস্পষ্ট শির্ক ও মুশরিকদের সাথে সুস্পষ্ট সামঞ্জস্য বিধান করে থাকে তার অবস্থা কেমন হতে পারে?

অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন, যাতে তিনি আহলে কিতাবদেরকে সম্বোধন করেছেন,

﴿ قُلۡ يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ كَلِمَةٖ سَوَآءِۢ بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمۡ أَلَّا نَعۡبُدَ إِلَّا ٱللَّهَ وَلَا نُشۡرِكَ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَتَّخِذَ بَعۡضُنَا بَعۡضًا أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِۚ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَقُولُواْ ٱشۡهَدُواْ بِأَنَّا مُسۡلِمُونَ ٦٤﴾ [ ال عمران : ٦٤ ]

“আপনি বলুন, হে আহলে কিতাবগণ! এস সে কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া একে অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি।’ তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তোমরা বল, তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৪]

তাছাড়া তা আরও যে কারণে নিষিদ্ধ তা হলো, এতে আল্লাহ ব্যতীত আহলে কিতাবদের দ্বারা পরস্পরকে যে রব্বরূপে গ্রহণ করা হয়ে থাকে তার সাথে সাদৃশ্য সৃষ্টি হয়। আর আমাদেরকে অনুরূপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর যে কেউ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ, তাঁর সাহাবী ও তাবে‘ঈদের আদর্শ বাদ দিয়ে নাসারাদের আদর্শ গ্রহণ করে সে তো আল্লাহ ও তার রাসূল যে বিষয় আদেশ করেছেন তা ছেড়ে দিলো।

আর কোনো ব্যক্তির বক্তব্য: “আমার প্রয়োজনটি আল্লাহ ও তোমার (ব্যক্তি, পীর, কবর ইত্যাদির) বরকতে পূর্ণ হয়েছে।” এ ধরনের বক্তব্য মারাত্মকভাবে নিন্দনীয়, কেননা এ ধরনের বিষয়ে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে মিলিত করা জায়েয নেই। এমনকি কোনো বক্তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ‘আল্লাহ ও আপনি যা চান’, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তুমি কি আমাকে আল্লাহর অংশিদার বানাতে চাও? বরং বল, একমাত্র আল্লাহ যা চান।” আর তিনি তার সাহাবীদের বলেন, “তোমরা বলবে না যে, আল্লাহ যা চান ও মুহাম্মদ যা চান, বরং তোমরা বল: আল্লাহ যা চান অতঃপর যা মুহাম্মদ চান।” [হাদীসটি সহীহ। ইবন মাজাহ হাদীস নং ২১১৮; মুসনাদে আহমাদ (৫/ ২৯৩)।]

অন্য হাদীসের এসেছে, কোনো মুসলিম শুনতে পেলো যে, কেউ তাকে বলেছে, ‘তোমরা কতই না উত্তম জাতি হতে যদি না তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক না বানাতে অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করছ। অর্থাৎ তোমরা বলে থাক, আল্লাহ যা চান ও মুহাম্মদ যা চান। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এটা থেকে নিষেধ করলেন।

সহীহ গ্রন্থে যায়েদ ইবনে খালেদ থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে বৃষ্টির পরে হুদায়বিয়ায় ফজরের সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা কি জান তোমাদের রব্ব রাতে কি বলেছেন? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূল অধিক জানেন। তিনি বলেন,

«أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِى مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ، فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ، وَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِى وَمُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ» .

“তিনি বলেন, আমার বান্দাদের কেউ কেউ আমার ওপর মুমিন হয়েছে আবার কেউ কেউ কাফির হয়েছে। যারা বলেছে, “আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে আমাদের ওপর বৃষ্টি হয়েছে, সে আমার ওপর ঈমানদার এবং নক্ষত্রের ব্যাপারে কাফির, আর যে বলল আমরা ওমুক ওমুক নক্ষত্রের নিকটবর্তী হওয়া দ্বারা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি, সে আমার সাথে কুফরিকারী এবং নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাসী।” [হাদীসটি সহীহ। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪১৪৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৫০।]

আর যে সব উপায়-উপকরণসমূহ আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য নির্ধারণ করেছেন, সেগুলোকে আল্লাহর সাথে শরীক, অংশীদার, সাহায্যকারী বানানো যাবে না।

আর বক্তার বক্তব্য: ‘শাইখ বা পীরের বরকতে’ এর দ্বারা কখনো উদ্দেশ্য হতে পারে, শাইখের দো‘আয়। আর দো‘আ অনুপস্থিতির পক্ষ থেকে অতিদ্রুত কবুল হয়। আবার উক্ত ‘শাইখ বা পীরের বরকতে’ একথার দ্বারা উদ্দেশ্য করা হতে পারে, তিনি যা নির্দেশ করেছেন এবং যা শিক্ষা দিয়েছেন সেটার বরকতে। আবার ‘শাইখ বা পীরের বরকতে’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হতে পারে, তিনি যে হকের সাহায্য করেছেন এবং দীনের পথে সহযোগিতা করেছেন ইত্যাদি সবই সঠিক অর্থ। কিন্তু কখনও কখনও ‘শাইখ বা পীরের বরকতে’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য নেওয়া হয়ে থাকে, মৃত ব্যক্তি ও অনুপস্থিত ব্যক্তির দো‘আর বরকতে অর্জিত হয়েছে, তখনই তা নিষিদ্ধ হবে। কারণ, পীর সাহেব এ প্রভাব দ্বারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া অথবা তার পক্ষে এমন কাজ করা যা থেকে তিনি মূলত অপারগ অথবা তা করতে অক্ষম অথবা তিনি তার ইচ্ছাও করেন না, তারপরও সেগুলোতে পীরের অনুসরণ-অনুকরণ ও তার আনুগত্য প্রদর্শন নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় বিদ‘আত। আর তা বাতিল অর্থসমূহের অন্তর্ভুক্ত।

আর যাতে কোনো সন্দেহ নেই তা হচ্ছে, আল্লাহর আনুগত্যমূলক যে কোনো কাজ, মুমিনগণ কর্তৃক পরস্পরের জন্য কৃত দো‘আ ইত্যাদি দুনিয়া ও আখেরাতে উপকারী বলে সাব্যস্ত হবে, তবে এ সবই একান্তভাবে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত দ্বারাই সংঘটিত হবে। (অন্য কারও দ্বারা তা সম্ভব নয়)

১৩
তথাকথিত কুতুব, গাউস ও পূণ্যবান ব্যক্তির রহস্য উন্মোচন
আর প্রশ্নকর্তা কুতুব, গাউস ও পূণ্যবান ব্যক্তি সম্পর্কে যে প্রশ্ন করেছে, তার উত্তর হচ্ছে, এসব বিষয় কোনো কোনো লোক সাব্যস্ত করে থাকে, তারা এগুলোর ব্যাখ্যা এমন কিছু দিয়ে করে থাকে যা দীন ইসলামে বাতিল বলে গণ্য। যেমন, গাউস সম্পর্কে তাদের কারো কারো ব্যাখ্যা হলো: তিনি এমন ব্যক্তি যিনি হবেন সৃষ্টিজগতের সাহায্যকারী, যার মাধ্যমে সৃষ্টিজগৎ সাহায্য ও রিযিক প্রাপ্ত হয়। এমনকি এটাও বলে থাকে যে, ফিরিশতাদের সাহায্য ও সমুদ্রের মাছের রিযিক ইত্যাদিও তার মাধ্যমে হয়। বস্তুত এটা হলো ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে নাসারাদের বক্তব্যের মতো এবং আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ব্যাপারে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের বক্তব্যের অনুরূপ বক্তব্য। আর এটা সুস্পষ্ট শির্ক, যে ব্যক্তি তা বলবে, তাকে তা থেকে তাওবা করার জন্য বলা হবে। সুতরাং যদি সে তাওবা করে তাহলে ভালো, অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে। কেননা সৃষ্টিজগতের কাউকেই, ফিরিশতা হোক কিংবা মানুষ, তাকে এ ব্যক্তির মাধ্যমে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয় না।

আর এই কারণেই দার্শনিকগণ যে ‘দশ আকল’ বা বুদ্ধিভিত্তিক দশ ব্যক্তিত্ব, যাদেরকে তারা ফিরিশতা মনে করে থাকে, অনুরূপভাবে নাসারাগণ মসীহ সম্পর্কে যা বলে থাকে, তা সাব্যস্ত করা মুসলিমদের ঐকমত্যে সুস্পষ্ট শির্ক।

আর যদি সে লোকটি বলে, আমি ‘গাউস’ দ্বারা বুঝাই, যা তাদের কেউ কেউ বলে থাকে যে, জমিনে তিন শত দশের অধিক মানুষ রয়েছে। যাদেরকে তারা নামকরণ করেছেন নূজাবা হিসেবে। অতঃপর সেখান থেকে সত্তর জন হলো নাক্বীব, তাদের মধ্য হতে চল্লিশজন আবদাল, তাদের মধ্য হতে সাতজন আক্বতাব, আর তাদের মধ্যে চারজন আওতাদ, তাদের মধ্যে একজন হলো গাউস, আর তিনি স্থায়ীভাবে মক্কার অধিবাসী। আর যমীনবাসী যখন তাদের রিযিক কিংবা বিপদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তখন তারা সেসব তিনশত দশজনের অধিক মানুষের স্মরণাপন্ন হয়, আর তারা (৩১০ এর অধিক লোক) ঐসব সত্তরজনের কাছে আশ্রয় চায়, আর সত্তরজন চল্লিশজনের কাছে, চল্লিশজন সাতজনের কাছে, সাতজন চার জনের কাছে এবং চারজন একজনের স্মরণাপন্ন হয়। আবার তাদের কেউ কেউ এ লোকদের সংখ্যা, নামসমূহ ও মর্যাদার ব্যাপারে বেশি-কম করে বর্ণনা করে থাকে। কেননা এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য অনেক; এমনকি তাদের কেউ কেউ বলে থাকে, আকাশ থেকে সমকালীন গাউসের নামখচিত লেখা সবুজ কাগজ কা‘বার ওপর অবতীর্ণ হবে। যার নাম হবে খুদরাহ বা সবুজ। এমনকি তাদের কারও কারও নিকট ‘খাদরাহ’ নামক একটি মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বও রয়েছে। আর প্রত্যেক যুগেই খাদরাহ বা খিদির নামে একজন আছেন। বস্তুত এব্যাপারে তাদের মধ্যেই দু‘ধরনের বক্তব্য রয়েছে। তবে সত্য কথা এই যে, এ সব কিছু সম্পূর্ণ বাতিল ও মিথ্যা। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতে যার কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি এ উম্মতের পূর্বসূরীদের কেউ ও কোনো ইমাম এ জাতীয় কোনো কথা বলেন নি। আর পূর্ববর্তী বড় শাইখ যাদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করার যোগ্য মনে করা হয়, তাদের কেউই এমন কিছু বলেন নি।

এখানে সুস্পষ্ট যে, আমাদের নেতা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালকের রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর, উমার, ওসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম ছিলেন তাদের যুগের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আর তারা ছিলেন মদিনাতে, তারা কেউই মক্কাতে ছিলেন না।

আর তাদের কেউ কেউ সাহাবী মুগীরা ইবন শো‘বা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দাস হিলাল সম্পর্কে একটি হাদীস বর্ণনা করে বলেন যে সে নাকি তথাকথিত পূর্বোক্ত সাতজনের একজন। অথচ হাদীসটি এ শাস্ত্রের পণ্ডিত ব্যক্তিদের ঐকমত্যে বাতিল। যদিও আবু না‘ঈম রহ. তার ‘হিলইয়াতিল আউলিয়া’ গ্রন্থে এ জাতীয় কিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন। আর শাইখ আবু আবদুর রহমান আস-সুলামীও তার কোনো কোনো লেখনীতে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তুমি এগুলো দেখে ধোঁকা খেও না। কারণ, এসব গ্রন্থে সহীহ, হাসান, দুর্বল এমনকি বানোয়াট হাদীসও রয়েছে। আর আলেমগণের যে ব্যাপারে মতবিরোধ নেই তা হচ্ছে, মিথ্যা-বানোয়াট হাদীসই হচ্ছে মওদু‘ হাদীস। আর এসব গ্রন্থকার কখনো কখনো হাদীসশাস্ত্রের পণ্ডিতদের মত যা শুনেন তাই বর্ণনা করে থাকেন। তারা সেগুলোর কোনোটি সহীহ ও কোনোটি বাতিল তা নির্ণয় করে দেন না, কিন্তু কোনো গ্রহণযোগ্য হাদীসবিদ এ জাতীয় হাদীস বর্ণনা করেন না। কারণ, সহীহ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা এসেছে যে, তিনি বলেন,

«من حدث عني بحديثٍ يرى أنه كذبٌ فهو أحد الكاذبين»

“যে ব্যক্তি আমার থেকে কোনো হাদীস বর্ণনা করে, অথচ ধারণা করা হয় যে, এটি মিথ্যা; তাহলে সেও মিথ্যাবাদিদের অন্তর্ভুক্ত”।” [হাদীসটি সহীহ। সহীহ মুসলিমের ভূমিকা (১/৯); সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৯; মুসনাদে আহমাদ (৫/২০)।]

মোটকথা: মুসলিমগণ জানেন যে, তাদের ওপর অনুরাগ ও ভীতির সময় যে সব বিপদ-মুসিবত অবতীর্ণ হয়। যেমন, ইস্তেসকার বা বৃষ্টি প্রার্থনার সময় রিযিক চাওয়ার জন্য কৃত তাদের দো‘আ এবং সূর্য গ্রহণের সময়ে কৃত দো‘আ, আর বালা-মসীবত দূরীকরণে তাদের বিভিন্ন প্রচেষ্টা ইত্যাদি সময়ে একমাত্র মহান আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করে থাকেন, তাঁর সাথে তারা আর কাউকে শরীক করেন না। মুসলিমগণ কখনো তাদের কোনো প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো নিকট প্রত্যাবর্তন করে না; বরং জাহেলী যুগের মুশরিকগণও এ জাতীয় অবস্থায় কোনো মাধ্যম ব্যতীত আল্লাহর কাছে দো‘আ করত, ফলে তিনি তাদের দো‘আ কবুল করতেন। তুমি কি মনে কর যে, তাওহীদ ও ইসলাম গ্রহণ করার পর এ জাতীয় মাধ্যম গ্রহণ ছাড়া তাদের দো‘আ কবুল করবেন না, যে মাধ্যম গ্রহণের ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেন নি?!

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا مَسَّ ٱلۡإِنسَٰنَ ٱلضُّرُّ دَعَانَا لِجَنۢبِهِۦٓ أَوۡ قَاعِدًا أَوۡ قَآئِمٗا فَلَمَّا كَشَفۡنَا عَنۡهُ ضُرَّهُۥ مَرَّ كَأَن لَّمۡ يَدۡعُنَآ إِلَىٰ ضُرّٖ مَّسَّهُ﴾ [ يونس : ١٢ ]

“আর মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে, বসে বা দাঁড়িয়ে আমাদেরকে ডেকে থাকে। অতঃপর আমরা যখন তার দুঃখ-দৈন্য দূর করি, তখন সে এমনভাবে চলতে থাকে যেন তাকে দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর তার জন্য সে আমাদেরকে ডাকেই নি”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১২]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَإِذَا مَسَّكُمُ ٱلضُّرُّ فِي ٱلۡبَحۡرِ ضَلَّ مَن تَدۡعُونَ إِلَّآ إِيَّاهُۖ﴾ [ الاسراء : ٦٧ ]

“আর সাগরে যখন তোমাদেরকে বিপদ স্পর্শ করে তখন শুধু তিনি ছাড়া অন্য যাদেরকে তোমরা ডেকে থাক তারা হারিয়ে যায়”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৬৭]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿قُلۡ أَرَءَيۡتَكُمۡ إِنۡ أَتَىٰكُمۡ عَذَابُ ٱللَّهِ أَوۡ أَتَتۡكُمُ ٱلسَّاعَةُ أَغَيۡرَ ٱللَّهِ تَدۡعُونَ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٤٠ بَلۡ إِيَّاهُ تَدۡعُونَ فَيَكۡشِفُ مَا تَدۡعُونَ إِلَيۡهِ إِن شَآءَ وَتَنسَوۡنَ مَا تُشۡرِكُونَ ٤١ وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَآ إِلَىٰٓ أُمَمٖ مِّن قَبۡلِكَ فَأَخَذۡنَٰهُم بِٱلۡبَأۡسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ لَعَلَّهُمۡ يَتَضَرَّعُونَ ٤٢ فَلَوۡلَآ إِذۡ جَآءَهُم بَأۡسُنَا تَضَرَّعُواْ وَلَٰكِن قَسَتۡ قُلُوبُهُمۡ وَزَيَّنَ لَهُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٤٣﴾ [ الانعام : ٤٠، ٤٣ ]

“বলুন, ‘তোমরা আমাকে জানাও, যদি আল্লাহর শাস্তি তোমাদের ওপর আপতিত হয় বা তোমাদের কাছে কিয়ামত উপস্থিত হয়, তবে কি তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও ডাকবে, যদি তোমরা সত্যবাদী হও? ‘না, তোমরা শুধু তাঁকেই ডাকবে, তোমরা যে দুঃখের জন্য তাঁকে ডাকছ তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদের সে দুঃখ দুর করবেন এবং যাকে তোমরা তাঁর শরীক করতে তা তোমরা ভুলে যাবে। আর অবশ্যই আপনার আগে আমরা বহু জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি। অতঃপর তাদেরকে অর্থসংকট ও দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পাকড়াও করেছি, যাতে তারা অনুনয় বিনয় করে। সুতরাং যখন আমাদের শাস্তি তাদের ওপর আপতিত হল, তখন তারা কেন বিনীত হল না? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৪০-৪৩)

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদের জন্য সালাত আদায়ের মাধ্যমে অথবা সালাত ব্যতীত বৃষ্টি প্রার্থনা করেছেন। আর তিনি তাদের নিয়ে ইসতিসকার সালাত ও সূর্য গ্রহণের সালাত আদায় করেছেন। আর তিনি সালাতে কুনুত পড়তেন এবং মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতেন। অনুরূপভাবে খোলাফায়ে রাশেদীনগণ ও তাদের পরবর্তীরা এবং অনুরূপভাবে দ্বীনের ইমামগণ ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ সর্বদা এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন।

আর এ কারণে বলা হয়: তিনটি বিষয় রয়েছে যার কোনো ভিত্তি নেই। নু‘সাইরিয়া সম্প্রদায়ের ‘বাব’, রাফেদী-শিয়াদের পক্ষ থেকে অপেক্ষায় থাকা (পাহাড়ের গর্তে অবস্থানরত) ইমাম আর মূর্খদের ‘গাউস’।

কারণ, নুসাইরিয়ারা দাবী করে থাকে যে, তাদের একজন লোক রয়েছে, যাকে ‘বাব’ বলা হয়, তিনি উক্ত (গাউস) ধরনের। যে কি না তাদের জন্য পৃথিবীকে ঠিক রাখেন। এমন ধরনের লোক তাদের কাছেই থাকতে পারে (যার সম্পর্কে তারা এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে) কিন্তু তার ব্যাপারে নুসাইরিয়া সম্প্রদায় যা বলে তা বাতিল, মিথ্যা ও অসার কথা। তবে (রাফেদী-শিয়াদের তথাকথিত) মুহাম্মাদ, যার অপেক্ষায় তারা অপেক্ষমান এবং (মূর্খ সুফীদের তথাকথিত) মক্কায় অবস্থানকারী গাউস ইত্যাদি বাতিল ও মিথ্যা, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্বই নেই।

অনুরূপভাবে তাদের কেউ কেউ ধারণা পোষণ করে যে, কুতুব, গাউস, আল্লাহর ওলীগণকে সাহায্য করেন এবং তাদের সবাইকে চেনেন প্রভৃতি। এটাও বাতিল। অথচ আবু বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাও আল্লাহর সকল ওলীগণকে চিনতেন না এবং তাদের সাহায্যও করতেন না। তাহলে কীভাবে এসব পথভ্রষ্ট মিথ্যবাদী, প্রতারকরা? (এরা কীভাবে চিনতে পারে ও সাহায্য করতে পারে?) আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন ‘সর্বশ্রেষ্ঠ আদম সন্তান’ তিনিও তার উম্মতদেরকে একমাত্র ওযুর চিহ্ন দ্বারা চিনতে পারবেন। আর তাহলো শুভ্রতা ও সাদা রং। আর ঐসব আল্লাহর ওলীগণকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ গণনা করে শেষ করতে পারবে না। আর আল্লাহর নবীগণ, যারা তাদের ইমাম ও খতীব। সে নবী-রাসূলগণ তাদের নিজেদের অধিকাংশের সাথে পরিচিত নন, বরং আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا رُسُلٗا مِّن قَبۡلِكَ مِنۡهُم مَّن قَصَصۡنَا عَلَيۡكَ وَمِنۡهُم مَّن لَّمۡ نَقۡصُصۡ عَلَيۡكَۗ ٧٨﴾ [ غافر : ٧٨ ]

“আর অবশ্যই আমরা আপনার পূর্বে অনেক রাসূল পাঠিয়েছি। আমরা তাদের কারো কারো কাহিনী আপনার কাছে বিবৃত করেছি এবং কারো কারো কাহিনী আপনার কাছে বিবৃত করি নি।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৭৮]

আর মূসা আলাইহিস সালাম খিদির কে চিনতেন না, আর খিদির আলাইহিস সালামও মূসা আলাইহিস সালামকে চিনতেন না, বরং যখন মূসা আলাইহিস সালাম খিদিরকে সালাম করলো তখন খিদির তাকে বলল: কোনো যমীন থেকে সালাম আসল? তখন তিনি বললেন, আমি মূসা। তিনি বললেন, বনী ইসরাঈলের মূসা? মূসা আলাইহিস সালাম বললেন: হ্যাঁ!। কারণ, খিদির এর কাছে মূসার নাম ও তার খবরাখবর পৌঁছেছিল; কিন্তু তিনি তাকে চাক্ষুষভাবে জানতেন না। আর যে বলে যে, খিদির ওলীগণের নকীব অথবা তিনি সবকিছু জানেন, সে নিশ্চয় বাতিল কথা বলেছে।

১৪
খিযির আলাইহিস সালাম সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা
সত্যনিষ্ঠ আলেমদের নিকট সঠিক বক্তব্য হলো খিদির আলাইহিস সালাম মৃত। তিনি ইসলাম পান নি। যদি তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে অবশিষ্ট থাকতেন তাহলে অবশ্যই তার জন্য ওয়াজিব হতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনা এবং তার সাথে জিহাদ করা। যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর ও অন্যান্যদের ওপর এটা ওয়াজিব করেছেন। আর তিনি অবশ্যই মক্কা-মদীনায় অবস্থান করতেন। কাফির সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত থেকে তাদের জাহাজ মেরামত করার চেয়ে সাহাবীগণের সাথে উপস্থিত থেকে সংগ্রাম করা এবং দীনের সাহায্য সহযোগিতা করা তার জন্য উত্তম হতো। তিনি এমন মানুষদের থেকে দূরে অবস্থান করতেন না যাদেরকে উত্তম জাতি হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। আর তাদের থেকে গোপনও থাকতেন না।

তাছাড়া মুসলিমদের জন্য তাদের দীন ও দুনিয়ার কোনো বিষয়ে খিদির ও তার মতো কোনো অনুরূপ কোনো লোকের প্রয়োজনও নেই। কেননা মুসলিমগণ তো তাদের দীন সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছেন। যিনি তাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দিয়েছেন। আর তাদেরকে তাদের নবী বলেছেন:

«لو كان موسى حيا بين أظهركم ما حل له إلا أن يتبعنى»

“যদি মূসা জীবিত থাকতো অতঃপর তোমরা তাকে অনুসরণ করতে আর আমাকে ছেড়ে দিতে তাহলে অবশ্যই তোমরা পথভ্রষ্ট হতে।” [হাদীসটি সনদের দিক থেকে হাসান। মুসনাদে আহমাদ(৩/৩৮৭); সুনান দারেমী (১/১১৫)।]

আর ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম আকাশ থেকে যখন অবতীর্ণ হবেন তখন তিনি একমাত্র আল্লাহর কিতাব ও নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত দ্বারা বিচার-ফয়সালা করবেন। তাহলে খিদির ও অন্যন্যদের কী প্রয়োজন থাকতে পারে? আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকাশ থেকে ঈসা আলাইহিস সালাম এর প্রত্যাগমণ সম্পর্কে ও মুসলিমদের সাথে তার উপস্থিতির বিষয়টি তাদেরকে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন,

«كيف تهلك أمة أنا أولها وعيسى ابن مريم آخرها؟»

“কীভাবে ধ্বংস হবে একটি উম্মত, যার শুরুতে আমি রয়েছি আর তার শেষে রয়েছে ঈসা ইবন মারইয়াম।” [মুসান্নাফে ইবন আবি শাইবাহ (৫/২৯৯)।]

তাহলে যখন উপরোক্ত দু’জন নবী, (মুহাম্মাদ ও ঈসা) যারা মূসা, ইবরাহীম ও নূহসহ সর্বোত্তম রাসূল হিসেবে বিবেচিত আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইইহ ওয়াসাল্লাম আদম সন্তানদের নেতা, এরা কেউই এ উম্মত থেকে গোপনে অবস্থান করেন নি, সাধারণ ও বিশেষ কারও থেকেই নয়, তাহলে এমন কেউ কীভাবে এ উম্মত থেকে গোপনে অবস্থান করতে পারেন যিনি তাদের মত নন? (অর্থাৎ খিদির, কারণ তিনি তাদের মতো নন)। আর যদি খিদির সর্বদা জীবিতই ছিলেন তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তার নাম উচ্চারণ কেন করেন নি, তার সর্ম্পকে তার উম্মাতকে কেন কোনো সংবাদ দেন নি এবং তার সঠিক পথপ্রাপ্ত খলিফাগণও কেন কিছু বলেন নি?

আর কোনো বক্তার বক্তব্য: ‘নিশ্চয় খিদির ওলীগণের নকীব’ তার জবাবে বলা হবে, কে তাকে নকীব (দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা) নিযুক্ত করেছেন? অথচ সর্বোত্তম ওলীগণ হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীগণ। তাদের মধ্যে তো খিদির নেই। (তাহলে তাকে কে এ কাজে নিয়োগ দিল?) সাধারণত এ অধ্যায়ে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তার কিছু অংশ মিথ্যা। কিছু কোনো ব্যক্তির ধারণার ওপর নির্ভরশীল, যে কিনা কোনো ব্যক্তিকে দেখে ধারণা করলো যে নিশ্চয় সে খিদির। আর বলে বসল, নিশ্চয় সে খিদির।

যেমনিভাবে রাফেযীরা কোনো লোককে দেখে ধারণা করে বলে, নিশ্চয় সে অপেক্ষমান নিষ্পাপ ইমাম অথবা সে লোকটিই তা দাবী করে। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল থেকে বর্ণিত, তার কাছে খিদির সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে লোক তোমাকে অনুপস্থিত কারও দিকে ন্যস্ত করে সে তোমার সাথে ন্যায্য কাজটি করে নি, আর শয়তান ব্যতীত কেউ মানুষের মুখে এটা ছড়ায় নি। অন্য জায়গায় আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

১৫
যুগের কাউকে কুতুব ও গাউস নামে আখ্যায়িত করার বিধান
আর যদি প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, কুতুব, গাউস ও অন্যান্য পূণ্যবান ব্যক্তি, যিনি তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে বিবেচিত, তাহলে এটা তার উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একই সময়ে দু’জন সমমর্যাদার লোক থাকা অসম্ভব নয়, অনুরূপভাবে তিনজন ও চারজনও থাকতে পারে। সুতরাং কোনো সময়ে উত্তম ব্যক্তি একজনই হবেন এমনটি দৃঢ়ভাবে বলা কখনই সম্ভব নয়। বরং একদল লোক এমন হতে পারেন যাদের কেউ অপর কারও থেকে একদিকে উত্তম হবেন, অন্যজন অপরদিক থেকে উত্তম হবেন। এ বিষয়গুলো কাছাকাছি পর্যায়ের কিংবা সমপর্যায়ের।

তাছাড়া কোনো এক সময় যদি কোনো লোক সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে বিবেচিত হয়েও যান, তাকে কুতুব বা গাউস নামকরণ করা বিদ‘আত। কারণ, এ ধরনের নামকরণের ব্যপারে মহান আল্লাহ কোনো কিছু অবতীর্ণ করেন নি। আর উম্মাতের পূর্বসূরীদের কোনো ব্যক্তি ও ইমামগণ এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেন নি। অথচ পূর্বসূরীগণ তাদের কোনো কোনো মানুষের ব্যপারে ধারণা করতেন যে, অমুক ব্যক্তি তাদের মধ্যে সর্বোত্তম অথবা উক্ত ব্যক্তি সে যুগের উত্তম মানুষের অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু তারা সেসব ব্যক্তিদের ব্যাপারে তথাকথিত গাউস, কুতুব ইত্যাদি নাম ব্যবহার করেন নি। কেননা এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ কোনো কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। বিশেষ করে যারা এসব নামের প্রবর্তক তারা দাবী করে যে, প্রথম কুতুব হলেন হাসান ইবন আলী ইবন আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। অতঃপর পর্যায়ক্রমে পরবর্তী অন্যান্য মাশায়েখদের তালিকা রয়েছে। আর এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শিয়া-রাফেযী কোনো মত অনুযায়ীই এটা সঠিক নয়। কারণ, (যদি তাদের কথা শুদ্ধ হয়) তবে কোথায় আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী রাদিআল্লাহু আনহুমসহ অন্যান্য অগ্রগামী মুহাজির ও আনসারগণ? অথচ হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর সময় কেবল পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার কাছাকাছি ছিলেন। (বড় বড় সাহাবীগণের ওপর তাকে প্রাধান্য দেওয়ার রহস্য কী?)

এসব বক্তব্যের প্রবর্তক কোনো কোনো বড় শায়খ থেকে বর্ণনা করা হয় যে, কুতুব, গাউস ও পূর্ণবান ব্যক্তির জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের অনুরূপ হয়, তাদের ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা অনুযায়ী হয়। তাই (তাদের ধারণামতে) আল্লাহ যা জানেন তারাও তা জানে আর আল্লাহ যেটার ক্ষমতা রাখেন তারাও সেটার ক্ষমতা রাখে। আর তারা মনে করে থাকে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অনুরূপ ছিলেন। আর এটা তাঁর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে হাসান এর দিকে যায় এবং হাসান থেকে তার শিষ্যের কাছে ক্রমান্বয়ে যায়। একথা যখন আমার কাছে বর্ণনা করা হয় তখন আমি বর্ণনা করে বলি যে, এটা স্পষ্ট কুফুরী ও নিকৃষ্ট অজ্ঞতাপ্রসূত কথা। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যপারে এমনটি দাবী করা কুফুরী, তিনি ব্যতীত অন্যের ব্যাপারে সেটা আরও মারাত্মক কথা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُل لَّآ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِي خَزَآئِنُ ٱللَّهِ وَلَآ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ وَلَآ أَقُولُ لَكُمۡ إِنِّي مَلَكٌۖ﴾ [ الانعام : ٥٠ ]

“বলুন, ‘আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ভাণ্ডারসমূহ আছে, আর আমি গায়েবও জানি না এবং তোমাদেরকে এও বলি না যে, আমি ফিরিশতা।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫০]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُۚ﴾ [ الاعراف : ١٨٨ ]

“বলুন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম তবে তো আমি অনেক কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোনো অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না।” [সূরা আল-আ‘রাফ:১৮৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿يَقُولُونَ لَوۡ كَانَ لَنَا مِنَ ٱلۡأَمۡرِ شَيۡءٞ مَّا قُتِلۡنَا هَٰهُنَا﴾ [ ال عمران : ١٥٤ ]

“তারা বলে, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿يَقُولُونَ هَل لَّنَا مِنَ ٱلۡأَمۡرِ مِن شَيۡءٖۗ قُلۡ إِنَّ ٱلۡأَمۡرَ كُلَّهُ٥٤﴾ [ ال عمران : ١٥٤ ]

“নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল এ বলে যে, ‘আমাদের কি কোনো কিছু করার আছে’? বলুন, ‘সব বিষয় আল্লাহরই ইখতিয়ারে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿لِيَقۡطَعَ طَرَفٗا مِّنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَوۡ يَكۡبِتَهُمۡ فَيَنقَلِبُواْ خَآئِبِينَ ١٢٧ لَيۡسَ لَكَ مِنَ ٱلۡأَمۡرِ شَيۡءٌ أَوۡ يَتُوبَ عَلَيۡهِمۡ أَوۡ يُعَذِّبَهُمۡ فَإِنَّهُمۡ ظَٰلِمُونَ ١٢٨﴾ [ ال عمران : ١٢٧، ١٢٨ ]

“যাতে তিনি কাফেরদের এক অংশকে ধ্বংস করেন বা তাদেরকে লাঞ্ছিত করেন। ফলে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। তিনি তাদের তাওবা কবুল করবেন বা তাদেরকে শাস্তি দেবেন- এ বিষয়ে আপনার করণীয় কিছুই নেই। কারণ তারা তো যালেম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৭, ১২৮]

মহান আল্লাহ আরো বলেন,

﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ٥٦﴾ [ القصص : ٥٦ ]

“আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছে সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৫৬]

আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার জন্য আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি বলেন,

﴿مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَ﴾ [ النساء : ٨٠ ]

“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল, আর তিনি আমাদেরকে তার অনুসরন করার জন্য আদেশ দিয়েছেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০]

অতঃপর তিনি বলেন,

﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ ٣١﴾ [ ال عمران : ٣١ ]

“বলুন, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১]

আর তিনি আমাদেরকে তাঁর রাসূলকে শক্তিশালী করার, সম্মান করার ও সাহায্য করার জন্য আদেশ দিয়েছেন এবং তার জন্য কিছু হক নির্ধারণ করেছেন যা তিনি তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহতে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তিনি আমাদের জন্য ওয়াজিব করেছেন তিনি যেন আমাদের কাছে আমাদের নিজেদের ও পরিবার পরিজন থেকে অধিক ভালোবাসার মানুষ হন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱلنَّبِيُّ أَوۡلَىٰ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ مِنۡ أَنفُسِهِمۡۖ ٦﴾ [ الاحزاب : ٦ ]

“নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُكُمۡ وَإِخۡوَٰنُكُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٰلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا وَتِجَٰرَةٞ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ أَحَبَّ إِلَيۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٖ فِي سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٤﴾ [ التوبة : ٢٤ ]

বলুন, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহর) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত।’ আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৪]

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«والذي نفسي بيده، لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ» .

“যার হাতে আমার প্রাণ ঐ সত্ত্বার শপথ করে বলছি, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে প্রিয় হবো তার সন্তান-সন্তুতি, পিতা-মাতা ও সকল মানুষ থেকে প্রিয় হবো”। [হাদীসটি সহীহ। সহীহ বুখারী (১১/৫৯৩); মুসনাদে আহমাদ (৫/২৯৩)।]

আর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তো আমার কাছে সবকিছুর থেকে বেশি প্রিয় তবে আমার নিজ সত্ত্বা থেকে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতক্ষণ আমি তোমার কাছে তোমার সত্ত্বার থেকেও বেশি প্রিয় হবো, (ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না) তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, এখন আপনি আমার নিকট আমার নিজ সত্ত্বা থেকেও অধিক প্রিয়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এখন হে উমার (ঈমানের দাবী যথার্থ হয়েছে)।

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

«ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ : مَنْ كَانَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَمَنْ أَحَبَّ عَبْدًا لاَ يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَمَنْ يَكْرَهُ أَنْ يَعُودَ فِي الكُفْرِ، بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللَّهُ، مِنْهُ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ»

“তিনটি বস্তুর যার মধ্যে ঘটবে সে অবশ্যই ঈমানের স্বাদ লাভ করেছে, যার কাছে আল্লাহ ও তার রাসূল এতদোভয়ের বাইরের সবকিছু থেকে প্রিয় হবে, যে কেউ কাউকে কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই ভালোবাসবে আর যে কেউ কুফুরী থেকে আল্লাহ তাকে উদ্ধার করার পর সে তাতে ফিরে যাওয়া এমনভাবে অপছন্দ করবে যেমন আগুনে নিক্ষেপ করাকে অপছন্দ করে” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২১।]।

আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে তার নিজের হক-অধিকারসমূহ বর্ণনা করেছেন, যেগুলো কেবল তার জন্যই হতে পারে, অন্য কারও সেগুলো থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে তিনি তার রাসূলের অধিকারও বর্ণনা করেছেন আর মুমিনদের পরস্পরের অধিকারসমূহ বর্ণনা করেছেন। যা আমরা অন্য স্থানে বর্ণনা করেছি। আর তা যেমন আল্লাহর বাণী,

﴿وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَخۡشَ ٱللَّهَ وَيَتَّقۡهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَآئِزُونَ ٥٢﴾ [ النور : ٥٢ ]

“আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে তারাই কৃতকার্য।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫২] সুতরাং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য, ভয় এবং তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে একমাত্র আল্লাহর। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَلَوۡ أَنَّهُمۡ رَضُواْ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ سَيُؤۡتِينَا ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ وَرَسُولُهُۥٓ إِنَّآ إِلَى ٱللَّهِ رَٰغِبُونَ ٥٩﴾ [ التوبة : ٥٩ ]

“আর ভালো হত যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট হত এবং বলত, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, অচিরেই আল্লাহ আমাদেরকে দেবেন নিজ করুণায় এবং তাঁর রাসূলও; নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই প্রতি অনুরক্ত।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৫৯]

অতএব যেতে হবে আল্লাহ ও তার রাসূলের কাছে, কিন্তু অনুরক্ত হতে হবে কেবল আল্লাহর দিকে।

আর মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُوا ٧﴾ [ الحشر : ٧ ]

“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭] কেননা হালাল হলো আল্লাহ ও তার রাসূল যা হালাল করেছেন এবং হারাম হলো আল্লাহ ও তার রাসূল হারাম করেছেন। তবে সহায়, উপায় ও যথেষ্টতা কেবল আল্লাহর কাছেই প্রাপ্ত হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সাহাবায়ে কেরাম বলেছিলেন,

﴿وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ﴾ [ ال عمران : ١٧٣ ]

“আর তারা বলেছিল, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৩] তারা বলেন নি যে, ‘আমাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূল যথেষ্ট।’

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ حَسۡبُكَ ٱللَّهُ وَمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٤﴾ [ الانفال : ٦٤ ]

“হে নবী! আপনার জন্য ও আপনার অনুসারীদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬৪] অর্থাৎ আল্লাহ আপনার জন্য যথেষ্ট, অনুরূপভাবে মুমিনদের মধ্য থেকে যারা আপনার অনুসরণ করে তাদের জন্যও আল্লাহ যথেষ্ট।

এটাই হচ্ছে এ আয়াতের বিশুদ্ধ ও অকাট্য অর্থ, আর এজন্যই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারা উভয়েই সংকটের সময় বলেছিলেন,

﴿حَسۡبُنَا ٱللَّهُ وَنِعۡمَ ٱلۡوَكِيلُ﴾

“আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট আর তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক”।

মহান আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন এবং সবচেয়ে প্রজ্ঞাময়।

আর সালাত ও সালাম পেশ করুন আল্লাহ তা‘আলা তার সর্বোত্তম সৃষ্টি আমাদের নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, তার পরিবার এবং সাহাবীগণেরও ওপর।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন