HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
তালাক ও তাহলীল
লেখকঃ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তালাক ও তাহলীল
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ০৯
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০০১ ইং
৪র্থ মুদ্রণ: আগষ্ট ২০১১ ইং
নির্ধারিত মূল্য : ২০ (বিশ) টাকা মাত্র।
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ০৯
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০০১ ইং
৪র্থ মুদ্রণ: আগষ্ট ২০১১ ইং
নির্ধারিত মূল্য : ২০ (বিশ) টাকা মাত্র।
হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, মিলন ও বিচ্ছেদ মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য সাথী। সবকিছুকে সমন্বয় করেই মানুষ তার চূড়ান্ত ঠিকানার দিকে এগিয়ে চলে। এভাবে চলার পথে তার জীবন চাকা যাতে পথ হারিয়ে গতিহীন না হয়ে পড়ে, সেজন্য সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ প্রেরিত হয়েছে। সেই পথনির্দেশ বা হেদায়াত মেনে চললে জীবনের গাড়ী সঠিক পথে চলবে। নইলে পথভ্রষ্ট হয়ে ধ্বংস হবে। মানুষের পারিবারিক জীবন দু’জন অচেনা নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি কৌশলের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম ও ভালোবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। সৃষ্টির স্বাভাবিক গতি হ’ল সেটাই। কিন্তু কখনো কখনো সেখানে সৃষ্টি হয় বিভেদ, যার পরিণতিতে আসে বিচ্ছেদ। যেটি আল্লাহর কাম্য নয়। কিন্তু তিনি সেটা হ’তে দেন অন্যদের শিক্ষা হাছিলের জন্য এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও তার জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য।
আল্লাহর অপসন্দনীয় বস্ত্ত সমূহের অন্যতম হ’ল স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ বা ‘তালাক’ ব্যবস্থা। কিন্তু তিনি তালাককে সিদ্ধ করেছেন এবং তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী দান করেছেন। সেই নিয়মের বাইরে গেলেই দেখা দেয় বিকৃতি। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। তালাক ও তাহলীল অমনিভাবে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার নাম। তিন তালাক তিন মাসে না দিয়ে এক মজলিসে তিন তালাক বায়েন দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে হারামকে হালাল করার নোংরা কৌশল হিসাবে ‘তাহলীল’ বা হিল্লা প্রথা। জাহেলী যুগের আরবরা এ কাজ করত। ইসলাম এসে তা নিষিদ্ধ করে। অথচ উম্মতের কিছু বিদ্বানের মতামতের উপর ভিত্তি করে ফেলে আসা সেই জাহেলিয়াত পুনরায় মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। ফলে অসংখ্য মুসলিম নারী-পুরুষ আজ এই অন্যায় প্রথার শিকার হচ্ছে। বক্ষমান নিবন্ধে আমরা এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা পেশ করেছি। যাতে মানুষ জানতে পারে যে, ‘হিল্লা’ কখনোই ইসলামী প্রথা নয়। এটি স্রেফ একটি জাহেলী কুপ্রথা মাত্র। যার মূলোৎপাটন করা আমাদের আশু করণীয়।[1]
[1]. উল্লেখ্য যে, ২০০০ সালের ২রা ডিসেম্বর নওগাঁ যেলার এক পল্লীতে হিল্লা-র একটি ঘটনা নিয়ে দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হাইকোর্ট ‘হিল্লা’সহ সকল প্রকারের ফৎওয়া অবৈধ ও দন্ডনীয় অপরাধ বলে রায় দেন (রিট আবেদন নং ৫৮৯৭/২০০০, রায় ১.১.২০০১ ইং)। এ সময় আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরি এবং তা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অতঃপর মাসিক আত-তাহরীক ২০০১-এর ফেব্রুয়ারী (৪র্থ বর্ষ ৫ম) সংখ্যায় দরসে কুরআন ও দরসে হাদীছ বিভাগে ‘তালাক’ ও ‘হিল্লা প্রথা’র উপরে যথাক্রমে দু’টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বর্তমান পুস্তিকাটি মূলতঃ উক্ত নিবন্ধদ্বয়ের সমষ্টি। -প্রকাশক।
আল্লাহর অপসন্দনীয় বস্ত্ত সমূহের অন্যতম হ’ল স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ বা ‘তালাক’ ব্যবস্থা। কিন্তু তিনি তালাককে সিদ্ধ করেছেন এবং তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী দান করেছেন। সেই নিয়মের বাইরে গেলেই দেখা দেয় বিকৃতি। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। তালাক ও তাহলীল অমনিভাবে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার নাম। তিন তালাক তিন মাসে না দিয়ে এক মজলিসে তিন তালাক বায়েন দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে হারামকে হালাল করার নোংরা কৌশল হিসাবে ‘তাহলীল’ বা হিল্লা প্রথা। জাহেলী যুগের আরবরা এ কাজ করত। ইসলাম এসে তা নিষিদ্ধ করে। অথচ উম্মতের কিছু বিদ্বানের মতামতের উপর ভিত্তি করে ফেলে আসা সেই জাহেলিয়াত পুনরায় মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। ফলে অসংখ্য মুসলিম নারী-পুরুষ আজ এই অন্যায় প্রথার শিকার হচ্ছে। বক্ষমান নিবন্ধে আমরা এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা পেশ করেছি। যাতে মানুষ জানতে পারে যে, ‘হিল্লা’ কখনোই ইসলামী প্রথা নয়। এটি স্রেফ একটি জাহেলী কুপ্রথা মাত্র। যার মূলোৎপাটন করা আমাদের আশু করণীয়।[1]
[1]. উল্লেখ্য যে, ২০০০ সালের ২রা ডিসেম্বর নওগাঁ যেলার এক পল্লীতে হিল্লা-র একটি ঘটনা নিয়ে দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হাইকোর্ট ‘হিল্লা’সহ সকল প্রকারের ফৎওয়া অবৈধ ও দন্ডনীয় অপরাধ বলে রায় দেন (রিট আবেদন নং ৫৮৯৭/২০০০, রায় ১.১.২০০১ ইং)। এ সময় আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরি এবং তা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অতঃপর মাসিক আত-তাহরীক ২০০১-এর ফেব্রুয়ারী (৪র্থ বর্ষ ৫ম) সংখ্যায় দরসে কুরআন ও দরসে হাদীছ বিভাগে ‘তালাক’ ও ‘হিল্লা প্রথা’র উপরে যথাক্রমে দু’টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বর্তমান পুস্তিকাটি মূলতঃ উক্ত নিবন্ধদ্বয়ের সমষ্টি। -প্রকাশক।
আল্লাহ বলেন,
الطَّلاَقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوْفٍ أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ وَلاَ يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَأْخُذُوْا مِمَّا آتَيْتُمُوْهُنَّ شَيْئاً إِلاَّ أَن يَّخَافَا أَلاَّ يُقِيْمَا حُدُوْدَ اللهِ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ يُقِيْمَا حُدُوْدَ اللهِ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيْمَا افْتَدَتْ بِهِ ، تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلاَ تَعْتَدُوْهَا وَمَن يَّتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ µ ( البقرة ২২৯)-
فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلاَ تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجاً غَيْرَهُ ، فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَّتَرَاجَعَا إِنْ ظَنَّا أَن يُّقِيْمَا حُدُوْدَ اللهِ ، وَتِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ µ ( البقرة ২৩০)-
অনুবাদ (ই.ফা.বা.) : এই তালাক দুইবার। অতঃপর স্ত্রীকে হয় বিধিমত রাখিয়া দিবে অথবা সদয়ভাবে মুক্ত করিয়া বিদায় দিবে। তোমরা তোমাদের স্ত্রীকে যাহা প্রদান করিয়াছ, তন্মধ্য হইতে কোন কিছু গ্রহণ করা তোমাদের পক্ষে বৈধ নহে; অবশ্য যদি তাহাদের উভয়ের আশংকা হয় যে, তাহারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করিয়া চলিতে পারিবে না। এবং তোমরা যদি আশংকা কর যে, তাহারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করিয়া চলিতে পারিবে না, তবে স্ত্রী কোন কিছুর বিনিময়ে নিষ্কৃতি পাইতে চাহিলে তাহাতে তাহাদের কাহারও কোন অপরাধ নাই। এইসব আল্লাহর সীমারেখা। তোমরা উহা লংঘন করিও না। যাহারা এইসব সীমারেখা লংঘন করে তাহারাই জালিম’ (বাক্বারাহ ২/২২৯)।
‘অতঃপর যদি সে তাহাকে তালাক দেয়, তবে সে তাহার জন্য বৈধ হইবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সহিত সংগত না হইবে। অতঃপর সে যদি তাহাকে তালাক দেয়, আর তাহারা উভয়ে মনে করে যে, তাহারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, তবে তাহাদের পুনর্মিলনে কাহারও কোন অপরাধ হইবে না। এইগুলি আল্লাহর সীমারেখা, জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ ইহা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৩০)।
উপরোক্ত আয়াত দু’টির ব্যাখ্যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলেছে, ‘এই তালাক’ অর্থ যে তালাকের পর ‘ইদ্দতের মধ্যে ইচ্ছা করিলে স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণ করা যায়, এখানে সেই ‘তালাক রাজ‘ঈ-র কথা বলা হইয়াছে (ঐ, বঙ্গানুবাদ, টীকা : ১৫৮)।‘নিষ্কৃতি পাইতে চাহিলে’ অর্থ ‘মহর’ অথবা কিছু অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাহিতে পারে। শরী‘আতের পরিভাষায় ইহাকে ‘খুলা’ বলে’ (টীকা : ১৫৯)। ‘অতঃপর যদি সে তালাক দেয়’ অর্থ দুই তালাকের পর তৃতীয় তালাক দিলে স্বামী স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণ করিতে পারে না (টীকা : ১৬০)।[1]
শানে নুযূল :
জনৈক আনছার ব্যক্তি একদা রাগান্বিত হয়ে তার স্ত্রীকে বলে, আল্লাহর কসম! তোমাকে আমি কখনোই আশ্রয় দেব না এবং বিচ্ছিন্নও করব না। স্ত্রী বলল, কিভাবে? লোকটি বলল, তোমাকে তালাক দেব। তারপর ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তোমাকে ফিরিয়ে নেব। এইভাবে চলতে থাকবে। তখন উক্ত মহিলা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে আসে। এমতাবস্থায় অত্র আয়াত নাযিল হয়।[2]
আয়াতের ব্যাখ্যা :
অত্র আয়াতদ্বয়ে ইসলামের তালাক বিধান সংক্ষেপে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। জাহেলী আরবে মহিলাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হ’ত। তাদেরকে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে বারবার তালাক দেওয়া হ’ত ও ফিরিয়ে নেওয়া হ’ত। ফলে মহিলাদের ইয্যতের সুরক্ষা, তাদের উপর নির্যাতন বন্ধ এবং নারী-পুরুষের চিরন্তন পারিবারিক জীবনে স্থিতিশীলতা আনয়নের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পক্ষ হ’তে চূড়ান্ত তালাক বিধান নেমে আসে। যেখানে বলে দেওয়া হয় যে, তালাক দিবে ঠান্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে দু’মাসে দু’বার। এরপর তৃতীয় মাসে তৃতীয় তালাক দিলে চূড়ান্তভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যাবে। এক্ষণে তালাকের আলোচনার পূর্বে আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করব।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের গুরুত্ব :
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক নেককার নারী-পুরুষকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন (নূর ২৪/৩২)। অন্য আয়াতে বিবাহ বন্ধনকে আল্লাহ তাঁর অন্যতম নিদর্শন হিসাবে বর্ণনা করেছেন (রূম ৩০/২১)। অন্যত্র তিনি এই বন্ধনকে ‘কঠিন বন্ধন’ ( مِيْثَاقًا غَلِيْظًا ) হিসাবে বর্ণনা করেছেন (নিসা ৪/২১)। হাদীছে বলা হয়েছে, ‘দুনিয়া একটি সম্পদ। আর তার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ হ’ল নেককার স্ত্রী’।[3] অন্য হাদীছে বিবাহকে ‘দ্বীনের অর্ধাংশ’ বলা হয়েছে।[4]
ইসলাম নারী-পুরুষের বৈবাহিক বন্ধনকে একটি পবিত্র বন্ধন হিসাবে বিবেচনা করে। এই বন্ধনের পবিত্রতার উপরে তার ভবিষ্যৎ বংশধারার পবিত্রতা নির্ভর করে (নিসা ৪/১)। এর ভিত্তিতে তার সহায়-সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ণীত হয় (নিসা ৪/১১)। অন্যান্য চুক্তির ন্যায় পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ চুক্তি সম্পাদিত হ’লেও এখানে উভয়ের অভিভাবক সহ দু’জন ঈমানদার ও জ্ঞানবান সাক্ষীর প্রয়োজন হয়।[5] শুধুমাত্র নারী-পুরুষ দু’জনের সম্মতিতে বিবাহ হয় না। অলি ও দু’জন সাক্ষী এবং স্বামী-স্ত্রীর ঈজাব-কবুল ছাড়াও একটি যরূরী বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত আছে, সেটি হ’ল বিবাহের ‘খুৎবা’ যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত।[6] যার মাধ্যমে কুরআনের আয়াত ও হাদীছ শুনানো হয় এবং যার মাধ্যমে উভয়কে চিরস্থায়ী এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করার বিষয়ে উপস্থিত উভয়পক্ষের দায়িত্বশীল অভিভাবকবৃন্দ ছাড়াও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্কে সাক্ষী রাখা হয়। যদিও এটি কোন আইনী সাক্ষী নয়, কিন্তু এটি অদৃশ্য এলাহী সাক্ষী। যার গুরুত্ব ঈমানদার স্বামী-স্ত্রীর নিকটে সবচাইতে বেশী। যার অনুভূতি উভয়ের হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং উভয়কে সুখে-দুখে, বিপদে-আপদে সংসার জীবনের টানাপোড়েনে সর্বদা হাসি-কান্নার সাথী হিসাবে অটুট ঐক্য ও ভালবাসা বজায় রেখে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে উদ্বুদ্ধ করে।
বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সৃষ্টি হয় আগত সন্তানদের নতুন বংশধারা। স্বামী-স্ত্রী তখন পিতা-মাতা হিসাবে তাদের সন্তানদের অভিভাবকে পরিণত হন। অসহায় কচি বাচ্চাদের লালন-পালন ও তাদের জীবনের উন্নতিই তখন বাপ-মায়ের প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার সম্পর্কের পাশাপাশি তখন আরেকটি স্নেহের সেতুবন্ধন রচিত হয়। একদিকে স্বামী-স্ত্রীর নিবিড় প্রেমের বন্ধন, অন্যদিকে সন্তানদের প্রতি উভয়ের অপত্য স্নেহের অভিন্ন আকর্ষণ। এভাবে স্বামী-স্ত্রীর জীবন হয়ে ওঠে একক লক্ষ্যে ও অভিন্ন স্বার্থে ভাস্বর, মহীয়ান ও গরিয়ান। ইহকালে তাদের সংসার হয় স্নেহ-ভালবাসায় আপ্লুত ও সুষমামন্ডিত এবং পরকালে তাদের জীবন হয় আল্লাহর বিশেষ পরিতোষ লাভে ধন্য। ইসলাম বিবাহের এই পবিত্র বন্ধনকে তাই সাধ্যপক্ষে টিকিয়ে রাখতে চায়।
[1]. বঙ্গানুবাদ আল-কুরআনুল করীম (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশনা-২, ৭ম মুদ্রণ ১৯৮৩) পৃঃ ৫৭।
[2]. ইবনু জারীর, ইবনু আবী হাতেম, তিরমিযী, হাকেম, মুওয়াত্ত্বা, তাফসীরে ইবনে কাছীর ও তাফসীরে কুরতুবী।
[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৮৩ ‘বিবাহ’ অধ্যায়-১৩, পরিচ্ছেদ-১।
[4]. ত্বাবারাণী, হাকেম, ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/১০৮; বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত হা/৩০৯৬ ‘বিবাহ’ অধ্যায়-১৩, পরিচ্ছেদ-৩, সনদ হাসান, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩০।
[5]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩১৩০, ৩১; ইরওয়া হা/১৮৩৯, ১৮৪৪, ৬/২৩৫-৫৫।
[6]. আহমাদ, তিরমিযী, শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৩১৪৯।
الطَّلاَقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوْفٍ أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ وَلاَ يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَأْخُذُوْا مِمَّا آتَيْتُمُوْهُنَّ شَيْئاً إِلاَّ أَن يَّخَافَا أَلاَّ يُقِيْمَا حُدُوْدَ اللهِ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ يُقِيْمَا حُدُوْدَ اللهِ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيْمَا افْتَدَتْ بِهِ ، تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلاَ تَعْتَدُوْهَا وَمَن يَّتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ µ ( البقرة ২২৯)-
فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلاَ تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجاً غَيْرَهُ ، فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَّتَرَاجَعَا إِنْ ظَنَّا أَن يُّقِيْمَا حُدُوْدَ اللهِ ، وَتِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ µ ( البقرة ২৩০)-
অনুবাদ (ই.ফা.বা.) : এই তালাক দুইবার। অতঃপর স্ত্রীকে হয় বিধিমত রাখিয়া দিবে অথবা সদয়ভাবে মুক্ত করিয়া বিদায় দিবে। তোমরা তোমাদের স্ত্রীকে যাহা প্রদান করিয়াছ, তন্মধ্য হইতে কোন কিছু গ্রহণ করা তোমাদের পক্ষে বৈধ নহে; অবশ্য যদি তাহাদের উভয়ের আশংকা হয় যে, তাহারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করিয়া চলিতে পারিবে না। এবং তোমরা যদি আশংকা কর যে, তাহারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করিয়া চলিতে পারিবে না, তবে স্ত্রী কোন কিছুর বিনিময়ে নিষ্কৃতি পাইতে চাহিলে তাহাতে তাহাদের কাহারও কোন অপরাধ নাই। এইসব আল্লাহর সীমারেখা। তোমরা উহা লংঘন করিও না। যাহারা এইসব সীমারেখা লংঘন করে তাহারাই জালিম’ (বাক্বারাহ ২/২২৯)।
‘অতঃপর যদি সে তাহাকে তালাক দেয়, তবে সে তাহার জন্য বৈধ হইবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সহিত সংগত না হইবে। অতঃপর সে যদি তাহাকে তালাক দেয়, আর তাহারা উভয়ে মনে করে যে, তাহারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, তবে তাহাদের পুনর্মিলনে কাহারও কোন অপরাধ হইবে না। এইগুলি আল্লাহর সীমারেখা, জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ ইহা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৩০)।
উপরোক্ত আয়াত দু’টির ব্যাখ্যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলেছে, ‘এই তালাক’ অর্থ যে তালাকের পর ‘ইদ্দতের মধ্যে ইচ্ছা করিলে স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণ করা যায়, এখানে সেই ‘তালাক রাজ‘ঈ-র কথা বলা হইয়াছে (ঐ, বঙ্গানুবাদ, টীকা : ১৫৮)।‘নিষ্কৃতি পাইতে চাহিলে’ অর্থ ‘মহর’ অথবা কিছু অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাহিতে পারে। শরী‘আতের পরিভাষায় ইহাকে ‘খুলা’ বলে’ (টীকা : ১৫৯)। ‘অতঃপর যদি সে তালাক দেয়’ অর্থ দুই তালাকের পর তৃতীয় তালাক দিলে স্বামী স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণ করিতে পারে না (টীকা : ১৬০)।[1]
শানে নুযূল :
জনৈক আনছার ব্যক্তি একদা রাগান্বিত হয়ে তার স্ত্রীকে বলে, আল্লাহর কসম! তোমাকে আমি কখনোই আশ্রয় দেব না এবং বিচ্ছিন্নও করব না। স্ত্রী বলল, কিভাবে? লোকটি বলল, তোমাকে তালাক দেব। তারপর ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তোমাকে ফিরিয়ে নেব। এইভাবে চলতে থাকবে। তখন উক্ত মহিলা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে আসে। এমতাবস্থায় অত্র আয়াত নাযিল হয়।[2]
আয়াতের ব্যাখ্যা :
অত্র আয়াতদ্বয়ে ইসলামের তালাক বিধান সংক্ষেপে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। জাহেলী আরবে মহিলাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হ’ত। তাদেরকে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে বারবার তালাক দেওয়া হ’ত ও ফিরিয়ে নেওয়া হ’ত। ফলে মহিলাদের ইয্যতের সুরক্ষা, তাদের উপর নির্যাতন বন্ধ এবং নারী-পুরুষের চিরন্তন পারিবারিক জীবনে স্থিতিশীলতা আনয়নের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পক্ষ হ’তে চূড়ান্ত তালাক বিধান নেমে আসে। যেখানে বলে দেওয়া হয় যে, তালাক দিবে ঠান্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে দু’মাসে দু’বার। এরপর তৃতীয় মাসে তৃতীয় তালাক দিলে চূড়ান্তভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যাবে। এক্ষণে তালাকের আলোচনার পূর্বে আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করব।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের গুরুত্ব :
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক নেককার নারী-পুরুষকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন (নূর ২৪/৩২)। অন্য আয়াতে বিবাহ বন্ধনকে আল্লাহ তাঁর অন্যতম নিদর্শন হিসাবে বর্ণনা করেছেন (রূম ৩০/২১)। অন্যত্র তিনি এই বন্ধনকে ‘কঠিন বন্ধন’ ( مِيْثَاقًا غَلِيْظًا ) হিসাবে বর্ণনা করেছেন (নিসা ৪/২১)। হাদীছে বলা হয়েছে, ‘দুনিয়া একটি সম্পদ। আর তার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ হ’ল নেককার স্ত্রী’।[3] অন্য হাদীছে বিবাহকে ‘দ্বীনের অর্ধাংশ’ বলা হয়েছে।[4]
ইসলাম নারী-পুরুষের বৈবাহিক বন্ধনকে একটি পবিত্র বন্ধন হিসাবে বিবেচনা করে। এই বন্ধনের পবিত্রতার উপরে তার ভবিষ্যৎ বংশধারার পবিত্রতা নির্ভর করে (নিসা ৪/১)। এর ভিত্তিতে তার সহায়-সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ণীত হয় (নিসা ৪/১১)। অন্যান্য চুক্তির ন্যায় পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ চুক্তি সম্পাদিত হ’লেও এখানে উভয়ের অভিভাবক সহ দু’জন ঈমানদার ও জ্ঞানবান সাক্ষীর প্রয়োজন হয়।[5] শুধুমাত্র নারী-পুরুষ দু’জনের সম্মতিতে বিবাহ হয় না। অলি ও দু’জন সাক্ষী এবং স্বামী-স্ত্রীর ঈজাব-কবুল ছাড়াও একটি যরূরী বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত আছে, সেটি হ’ল বিবাহের ‘খুৎবা’ যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত।[6] যার মাধ্যমে কুরআনের আয়াত ও হাদীছ শুনানো হয় এবং যার মাধ্যমে উভয়কে চিরস্থায়ী এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করার বিষয়ে উপস্থিত উভয়পক্ষের দায়িত্বশীল অভিভাবকবৃন্দ ছাড়াও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্কে সাক্ষী রাখা হয়। যদিও এটি কোন আইনী সাক্ষী নয়, কিন্তু এটি অদৃশ্য এলাহী সাক্ষী। যার গুরুত্ব ঈমানদার স্বামী-স্ত্রীর নিকটে সবচাইতে বেশী। যার অনুভূতি উভয়ের হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং উভয়কে সুখে-দুখে, বিপদে-আপদে সংসার জীবনের টানাপোড়েনে সর্বদা হাসি-কান্নার সাথী হিসাবে অটুট ঐক্য ও ভালবাসা বজায় রেখে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে উদ্বুদ্ধ করে।
বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সৃষ্টি হয় আগত সন্তানদের নতুন বংশধারা। স্বামী-স্ত্রী তখন পিতা-মাতা হিসাবে তাদের সন্তানদের অভিভাবকে পরিণত হন। অসহায় কচি বাচ্চাদের লালন-পালন ও তাদের জীবনের উন্নতিই তখন বাপ-মায়ের প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার সম্পর্কের পাশাপাশি তখন আরেকটি স্নেহের সেতুবন্ধন রচিত হয়। একদিকে স্বামী-স্ত্রীর নিবিড় প্রেমের বন্ধন, অন্যদিকে সন্তানদের প্রতি উভয়ের অপত্য স্নেহের অভিন্ন আকর্ষণ। এভাবে স্বামী-স্ত্রীর জীবন হয়ে ওঠে একক লক্ষ্যে ও অভিন্ন স্বার্থে ভাস্বর, মহীয়ান ও গরিয়ান। ইহকালে তাদের সংসার হয় স্নেহ-ভালবাসায় আপ্লুত ও সুষমামন্ডিত এবং পরকালে তাদের জীবন হয় আল্লাহর বিশেষ পরিতোষ লাভে ধন্য। ইসলাম বিবাহের এই পবিত্র বন্ধনকে তাই সাধ্যপক্ষে টিকিয়ে রাখতে চায়।
[1]. বঙ্গানুবাদ আল-কুরআনুল করীম (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশনা-২, ৭ম মুদ্রণ ১৯৮৩) পৃঃ ৫৭।
[2]. ইবনু জারীর, ইবনু আবী হাতেম, তিরমিযী, হাকেম, মুওয়াত্ত্বা, তাফসীরে ইবনে কাছীর ও তাফসীরে কুরতুবী।
[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৮৩ ‘বিবাহ’ অধ্যায়-১৩, পরিচ্ছেদ-১।
[4]. ত্বাবারাণী, হাকেম, ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/১০৮; বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত হা/৩০৯৬ ‘বিবাহ’ অধ্যায়-১৩, পরিচ্ছেদ-৩, সনদ হাসান, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩০।
[5]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩১৩০, ৩১; ইরওয়া হা/১৮৩৯, ১৮৪৪, ৬/২৩৫-৫৫।
[6]. আহমাদ, তিরমিযী, শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৩১৪৯।
ইহুদীদের নিকটে তালাক :
ইহুদীদের নিকটে কোন ওযর ছাড়াই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া চলে। তবে এটাকে তারা ভালো মনে করে না। তাদের নিকটে ওযর বা ত্রুটি দু’ধরনের: (ক) দেহগত ত্রুটি। যেমন চোখে কম দেখা, চোখ টেরা হওয়া, মুখ দুর্গন্ধযুক্ত হওয়া, পিঠ কুঁজো হওয়া, ল্যাংড়া হওয়া, বন্ধ্যা হওয়া ইত্যাদি। (খ) চরিত্রগত ত্রুটি। যেমন বেশরম হওয়া, বাজে বক বক করা, অপরিচ্ছন্ন থাকা, কৃপণ ও কঠোর প্রকৃতির হওয়া, অবাধ্য হওয়া, অপচয়কারিণী হওয়া, পেটুক হওয়া, পেট মোটা বা ভুঁড়িওয়ালী হওয়া, খাদ্যলোভী হওয়া, তুচ্ছ বিষয়ে গর্বকারিণী হওয়া ইত্যাদি। তবে যেনা হ’ল তাদের নিকটে সবচেয়ে বড় ত্রুটি। এজন্য কেবল যেনার প্রচার হওয়াই যথেষ্ট। প্রমাণের দরকার নেই। পক্ষান্তরে স্বামীর যত ত্রুটিই থাকুক না কেন, স্ত্রী তার কাছ থেকে তালাক নিতে পারে না। এমনকি যদি স্বামীর যেনা প্রমাণিত হয়, তবুও নয়।
খৃষ্টানদের নিকটে তালাক :
খৃষ্টান মাযহাবগুলির মধ্যে প্রধান হ’ল তিনটি: ক্যাথলিক, অর্থোডক্স ও প্রটেষ্ট্যানট। ক্যাথলিক মাযহাবে তালাক একেবারে নিষিদ্ধ। স্ত্রী চরিত্রে অবিশ্বাস বা খেয়ানত জনিত কারণ ঘটলে তাদের বিছানা পৃথক রাখা হয় এবং এভাবে তিলে তিলে কষ্ট দেওয়া হয়। তবুও তালাকের মাধ্যমে উভয়ে পৃথক হয়ে যায় না। একাধিক বিবাহ খৃষ্টান ধর্মীয় গাম্ভীর্যের বিরোধী। কেননা ইনজীল মারকুস-এর কথিত ৮ ও ৯ আয়াতের বর্ণনা মতে ‘স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলে একটি দেহ। ... অতএব আল্লাহ যাদেরকে একত্রিত করেছেন, মানুষ তাদেরকে পৃথক করতে পারে না’ ( يكون الإثنان جسدا واحدا ... فالذى جمعه الله لايفرقه إنسان ) খৃষ্টানদের বাকী দু’টি মাযহাবে সীমিত কয়েকটি ক্ষেত্রে তালাক সিদ্ধ। যার প্রধান হ’ল পারস্পরিক অবিশ্বাস বা খেয়ানত। কিন্তু এই অবস্থায় তাদের মধ্যে তালাক সিদ্ধ হ’লেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য দ্বিতীয় বিবাহ নিষিদ্ধ।
জাহেলী যুগের তালাক :
প্রাক-ইসলামী যুগে জাহেলী আরবে নারীদের নির্যাতন করার জন্য তালাককে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হ’ত। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিত। আবার ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিত। এইভাবে শতাধিকবার তালাক ও রাজ‘আতের ঘটনা ঘটত। কখনো কোন স্বামী বলে বসতো, আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে কখনোই তালাক দিব না, ঘরে আশ্রয়ও দেব না। স্ত্রী বলত, সেটা কিভাবে সম্ভব? স্বামী বলত, তোমাকে তালাক দিব। তারপর ইদ্দত শেষ হবার আগেই ফিরিয়ে নেব। আবার তালাক দেব। আবার ফিরিয়ে নেব। এভাবেই চলবে। তোমাকে শান্তিতে থাকতেও দেব না, যেতেও দেব না। এই ঘটনা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানানো হ’লে তিনি চুপ থাকেন। অতঃপর দরসের আলোচ্য আয়াত ‘তালাক মাত্র দু’বার’... নাযিল হয়। অর্থাৎ মাত্র দু’বারই তালাক দিয়ে ফেরত নেওয়া যাবে। তৃতীয় বারে আর নয়। তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।[1]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, দ্বিতীয় স্বামী কৃর্তক স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে তার পূর্বতন স্বামীর নিকটে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান আল্লাহর পক্ষ থেকে মহিলাদের প্রতি একটি বড় ধরনের অনুগ্রহ। কেননা তাওরাতের বিধান মতে সে আর বিবাহ করতে পারে না। ইনজীলের বিধান মতে তাদের মধ্যে স্থায়ীভাবে তালাক নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের শরী‘আত বান্দার কল্যাণ বিচারে পূর্ণাংগ ও স্থিতিশীল। ফলে ঐ স্বামীকে চতুর্থবারের সুযোগ দিয়েছে’। অর্থাৎ সে তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে বিদায় করার পরে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলেও সেই স্বামী কর্তৃক স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা হ’লে পুনরায় পূর্ব স্বামী তাকে গ্রহণ করতে পারে’। তবে কোন কৌশলের আশ্রয় নিলে দ্বিতীয় স্বামী ‘ভাড়াটে ষাঁড়’ হবে (ইবনু মাজাহ, সনদ হাসান)। তাদের ঐ বিয়ে বাতিল হবে এবং প্রথম স্বামীর জন্য তা হালাল হবে না।[2]
[1]. সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো : ১৪১২/১৯৯২) ২/২৮০-৮২ পৃঃ।
[2]. ছালেহ বিন ফাওযান, আল-মুলাখখাছুল ফিক্বহী (দার ইবনুল জাওযী, ৫ম মুদ্রণ ১৪১৭/১৯৯৬), পৃঃ ৩১৭-১৮।
ইহুদীদের নিকটে কোন ওযর ছাড়াই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া চলে। তবে এটাকে তারা ভালো মনে করে না। তাদের নিকটে ওযর বা ত্রুটি দু’ধরনের: (ক) দেহগত ত্রুটি। যেমন চোখে কম দেখা, চোখ টেরা হওয়া, মুখ দুর্গন্ধযুক্ত হওয়া, পিঠ কুঁজো হওয়া, ল্যাংড়া হওয়া, বন্ধ্যা হওয়া ইত্যাদি। (খ) চরিত্রগত ত্রুটি। যেমন বেশরম হওয়া, বাজে বক বক করা, অপরিচ্ছন্ন থাকা, কৃপণ ও কঠোর প্রকৃতির হওয়া, অবাধ্য হওয়া, অপচয়কারিণী হওয়া, পেটুক হওয়া, পেট মোটা বা ভুঁড়িওয়ালী হওয়া, খাদ্যলোভী হওয়া, তুচ্ছ বিষয়ে গর্বকারিণী হওয়া ইত্যাদি। তবে যেনা হ’ল তাদের নিকটে সবচেয়ে বড় ত্রুটি। এজন্য কেবল যেনার প্রচার হওয়াই যথেষ্ট। প্রমাণের দরকার নেই। পক্ষান্তরে স্বামীর যত ত্রুটিই থাকুক না কেন, স্ত্রী তার কাছ থেকে তালাক নিতে পারে না। এমনকি যদি স্বামীর যেনা প্রমাণিত হয়, তবুও নয়।
খৃষ্টানদের নিকটে তালাক :
খৃষ্টান মাযহাবগুলির মধ্যে প্রধান হ’ল তিনটি: ক্যাথলিক, অর্থোডক্স ও প্রটেষ্ট্যানট। ক্যাথলিক মাযহাবে তালাক একেবারে নিষিদ্ধ। স্ত্রী চরিত্রে অবিশ্বাস বা খেয়ানত জনিত কারণ ঘটলে তাদের বিছানা পৃথক রাখা হয় এবং এভাবে তিলে তিলে কষ্ট দেওয়া হয়। তবুও তালাকের মাধ্যমে উভয়ে পৃথক হয়ে যায় না। একাধিক বিবাহ খৃষ্টান ধর্মীয় গাম্ভীর্যের বিরোধী। কেননা ইনজীল মারকুস-এর কথিত ৮ ও ৯ আয়াতের বর্ণনা মতে ‘স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলে একটি দেহ। ... অতএব আল্লাহ যাদেরকে একত্রিত করেছেন, মানুষ তাদেরকে পৃথক করতে পারে না’ ( يكون الإثنان جسدا واحدا ... فالذى جمعه الله لايفرقه إنسان ) খৃষ্টানদের বাকী দু’টি মাযহাবে সীমিত কয়েকটি ক্ষেত্রে তালাক সিদ্ধ। যার প্রধান হ’ল পারস্পরিক অবিশ্বাস বা খেয়ানত। কিন্তু এই অবস্থায় তাদের মধ্যে তালাক সিদ্ধ হ’লেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য দ্বিতীয় বিবাহ নিষিদ্ধ।
জাহেলী যুগের তালাক :
প্রাক-ইসলামী যুগে জাহেলী আরবে নারীদের নির্যাতন করার জন্য তালাককে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হ’ত। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিত। আবার ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিত। এইভাবে শতাধিকবার তালাক ও রাজ‘আতের ঘটনা ঘটত। কখনো কোন স্বামী বলে বসতো, আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে কখনোই তালাক দিব না, ঘরে আশ্রয়ও দেব না। স্ত্রী বলত, সেটা কিভাবে সম্ভব? স্বামী বলত, তোমাকে তালাক দিব। তারপর ইদ্দত শেষ হবার আগেই ফিরিয়ে নেব। আবার তালাক দেব। আবার ফিরিয়ে নেব। এভাবেই চলবে। তোমাকে শান্তিতে থাকতেও দেব না, যেতেও দেব না। এই ঘটনা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানানো হ’লে তিনি চুপ থাকেন। অতঃপর দরসের আলোচ্য আয়াত ‘তালাক মাত্র দু’বার’... নাযিল হয়। অর্থাৎ মাত্র দু’বারই তালাক দিয়ে ফেরত নেওয়া যাবে। তৃতীয় বারে আর নয়। তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।[1]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, দ্বিতীয় স্বামী কৃর্তক স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে তার পূর্বতন স্বামীর নিকটে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান আল্লাহর পক্ষ থেকে মহিলাদের প্রতি একটি বড় ধরনের অনুগ্রহ। কেননা তাওরাতের বিধান মতে সে আর বিবাহ করতে পারে না। ইনজীলের বিধান মতে তাদের মধ্যে স্থায়ীভাবে তালাক নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের শরী‘আত বান্দার কল্যাণ বিচারে পূর্ণাংগ ও স্থিতিশীল। ফলে ঐ স্বামীকে চতুর্থবারের সুযোগ দিয়েছে’। অর্থাৎ সে তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে বিদায় করার পরে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলেও সেই স্বামী কর্তৃক স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা হ’লে পুনরায় পূর্ব স্বামী তাকে গ্রহণ করতে পারে’। তবে কোন কৌশলের আশ্রয় নিলে দ্বিতীয় স্বামী ‘ভাড়াটে ষাঁড়’ হবে (ইবনু মাজাহ, সনদ হাসান)। তাদের ঐ বিয়ে বাতিল হবে এবং প্রথম স্বামীর জন্য তা হালাল হবে না।[2]
[1]. সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো : ১৪১২/১৯৯২) ২/২৮০-৮২ পৃঃ।
[2]. ছালেহ বিন ফাওযান, আল-মুলাখখাছুল ফিক্বহী (দার ইবনুল জাওযী, ৫ম মুদ্রণ ১৪১৭/১৯৯৬), পৃঃ ৩১৭-১৮।
‘তালাক্ব’ ( الطلاق ) অর্থ : বদ্ধনমুক্তি। যেমন বলা হয়: أُطْلِقَ الْأسِيْرُ ‘বন্দী মুক্ত হয়েছে’। শারঈ পরিভাষায় তালাক অর্থ : স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা। ইসলামে তালাককে অপসন্দ করা হয়েছে। যদিও বেদ্বীনী, অবাধ্যতা, যেনাকারিতা প্রভৃতি চূড়ান্ত অবস্থায় এটাকে জায়েয রাখা হয়েছে এবং তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। দরসে বর্ণিত আয়াতের আলোকে এক্ষণে আমরা ইসলামের তালাক বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করব।
ইসলামে তালাকের অধিকার সীমিত করা হয়েছে তিনবারের মধ্যে। প্রথম দু’বার ‘রাজ‘ঈ’ ও শেষেরটি ‘বায়েন’। অর্থাৎ ইসলামে তালাকের বিধান রাখা হ’লেও স্বামীকে ভাববার ও সমঝোতার সুযোগ দেওয়া হয় স্ত্রীর তিন ঋতু বা তিন মাসকাল যাবত। এর মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। যাকে ‘রাজ‘আত’ বলা হয়। কিন্তু গভীর ভাবনা-চিন্তার পর ঠান্ডা মাথায় তৃতীয়বার তালাক দিলে তখন আর ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।
তালাকের পদ্ধতি :
(১) স্ত্রীকে তার ঋতুমুক্তির পর পবিত্র অবস্থার শুরুতে মিলন ছাড়াই স্বামী প্রথমে এক তালাক দিবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় তিন ঋতুর ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে রাজ‘আত করতে পারে। অর্থাৎ ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পরে ফেরত নিতে চাইলে তাকে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে হবে। ইদ্দতকালে স্ত্রী স্বামীগৃহে অবস্থান করবে। অবস্থানকালে স্বামী স্ত্রীকে খোরপোষ দিবে। এটিই হ’ল তালাকের সর্বোত্তম পন্থা।
(২) সহবাসহীন তোহরে প্রথম তালাক দিয়ে ইদ্দতের মধ্যে পরবর্তী তোহরে ২য় তালাক দিবে এবং ইদ্দতকাল গণনা করবে। অতঃপর পরবর্তী তোহরের শুরুতে তৃতীয় তালাক দিবে ও ঋতু আসা পর্যন্ত সর্বশেষ ইদ্দত পালন করবে। তৃতীয়বার তালাক উচ্চারণ করলে স্ত্রীকে আর ফেরৎ নেওয়া যাবে না। অতএব ২য় তোহরে ২য় তালাক দিলে ৩য় তোহরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানেও পূর্বের ন্যায় যাবতীয় বিধান বহাল থাকবে (বাক্বারাহ ২/২২৯; তালাক ৬৫/১)। ইসলামের সোনালী যুগে এই তালাকই চালু ছিল। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَآءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ لاَ تُخْرِجُوْهُنَّ مِنْ بُيُوْتِهِنَّ وَلاَ يَخْرُجْنَ إِلاَّ أَنْ يَأْتِيْنَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَتِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ وَمَنْ يَّتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ لاَ تَدْرِيْ لَعَلَّ اللهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْراً µ ( الطلاق ১)-
‘হে নবী! যদি আপনি স্ত্রীদের তালাক দিতে চান, তাহ’লে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দিন এবং ইদ্দত গণনা করতে থাকুন। আপনি আপনার প্রভু সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকুন। সাবধান তালাকের পর স্ত্রীদেরকে গৃহ হ’তে বিতাড়িত করবেন না, আর তারাও যেন স্বামীগৃহ ছেড়ে বহির্গত না হয়। অবশ্য তারা যদি খোলাখুলিভাবে ফাহেশা কাজে লিপ্ত হয়, তাহ’লে স্বতন্ত্র কথা। এগুলি আল্লাহকৃত সীমারেখা। যে ব্যক্তি উক্ত সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজের উপরে যুলুম করে। কেননা সে জানে না যে, তালাকের পরেও আল্লাহ কোন (সমঝোতার) পথ বের করে দিতে পারেন’ (তালাক্ব ৬৫/১)।
উক্ত আয়াতের তাৎপর্য এই যে, তালাক হ’ল মূলতঃ ইদ্দতের তালাক, আকস্মিক বা যুগপৎ তালাক নয়। স্বামী-স্ত্রীকে অবশ্যই নির্ধারিত ইদ্দত গণনা করতে হবে। এজন্য কমপক্ষে তিন ঋতু মুক্তির তিন মাস স্বামী অবকাশ পাবেন যে, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে পারবেন কি-না। এছাড়াও স্ত্রীকে স্বামীগৃহেই অবস্থান করতে হবে। এর দ্বারা উভয়কে পুনর্মিলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, এগুলি হ’ল আল্লাহকৃত ‘হুদূদ’ বা সীমারেখা, যা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ।
এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল : এক মজলিসে একসাথে তিন তালাক বায়েন দিলে উক্ত সীমারেখা পালন করা যায় কি? যেখানে প্রথম তালাকের ইদ্দতকাল এক ঋতু শেষে ২য় তালাক। অতঃপর ২য় তালাকের ইদ্দতকাল ২য় ঋতু শেষে ৩য় তালাক- এভাবে হিসাব করে বিরতিসহ ইদ্দত গণনার কোন সুযোগ থাকে কি? যদি না থাকে, তাহ’লে সেটা কোন্ ধরনের তালাক হবে? কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোথাও এরূপ তালাকের কোন অস্তিত্ব আছে কি?
বিভিন্ন ফিক্বহ গ্রন্থে তালাককে আহসান, হাসান ও বিদ‘আত তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং কুরআন-হাদীছে বর্ণিত উপরোক্ত তালাক বিধানকে ‘সুন্নী তালাক’ ও আবিষ্কৃত একত্রিত তিন তালাককে ‘বেদ‘ঈ তালাক’ নামে অভিহিত করা হয়েছে (হেদায়া ২/৩৫৪-৫৫)। অথচ মুসলমান ‘সুন্নাত’ মানতে পারে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই ‘বিদ‘আত’ মানতে পারে না। কেননা দ্বীনের নামে সকল প্রকার বিদ‘আত প্রত্যাখাত[1] এবং বিদ‘আতের একমাত্র পরিণাম হ’ল জাহান্নাম।[2] অথচ বিদ‘আতী তালাককে আইনসিদ্ধ করার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে পাপের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। সুন্নাতী তালাকের স্থলে বিদ‘আতী তালাক সিদ্ধ করে ‘তাহলীল’-এর ন্যায় জাহেলী আরবের নোংরা কুপ্রথাকে অসিদ্ধ ফাসিদ ক্বিয়াসের মাধ্যমে ইসলামী সমাজে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যার সরাসরি ও অসহায় শিকার হচ্ছে এদেশের সরল-সিধা মুসলিম নারী সমাজ।
উল্লেখ্য যে, সূরায়ে তালাক্ব-এর ২য় আয়াতের وَأَشْهِدُوا ذَوَيْ عَدْلٍ مِّنْكُمْ ) ) আলোকে ছাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী ও ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ), তাবেঈগণের মধ্যে আত্বা, ইবনু জুরায়েজ ও ইবনু সীরীন এবং ইমামিয়া শী‘আ বিদ্বান মন্ডলী তালাকের ক্ষেত্রেও দু’জন ন্যায়বান সাক্ষীর শর্ত আরোপ করেন। যেরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। তবে প্রাচীন ও আধুনিক সকল যুগের অন্যান্য বিদ্বানদের নিকটে তালাক কেবলমাত্র স্বামীর অধিকার। এর জন্য কোন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। কেননা এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও জমহূর ছাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে কোনরূপ প্রমাণ নেই’।[3]
উপরোক্ত তালাক বিধানে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলাম বাধ্যগত অবস্থায় তালাক জায়েয রাখলেও মূলতঃ সেটা তার কাম্য নয়। বরং স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি ও তাদেরকে পুনরায় দাম্পত্য জীবনে ফিরে আসার সকল বৈধ সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। তাকে এক মাস, দু’মাস, তিন মাস যাবত চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছে। ইদ্দতকালে স্ত্রীকে স্বামীগৃহে অবস্থানের সুযোগ দিয়েছে। সবশেষে দ্বিতীয়বার পর্যন্ত ‘তালাক্ব’ শব্দটি উচ্চারণ করলেও কুরআন ‘তৃতীয় তালাক’ বা ‘তালাক্বে বায়েন’ (বিচ্ছিন্নকারী তালাক) কথাটি উচ্চারণ করেনি। বরং ইঙ্গিতে বলেছে, দ্বিতীয়বার তালাক দেওয়ার পরে এক্ষণে সে তার স্ত্রীকে সুন্দরভাবে রাখুক অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’।
জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কুরআনে দু’বার তালাক দেবার কথা পাচ্ছি। কিন্তু তৃতীয় তালাক কোথায়? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’।[4] অর্থাৎ আল্লাহ চান না যে, বান্দা স্বীয় স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দিক। কেননা তৃতীয় তালাক দিলে সে আর তার স্ত্রীকে ফেরত পাবে না। যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে এবং সেই স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়। আর সেটা নিতান্তই কল্পনার বস্ত্ত।
কুরতুবী বলেন, বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’ দ্বারা দুই তালাকের পরে তৃতীয় তালাক বুঝানো হয়েছে। আর এটা বুঝা গেছে পরবর্তী বক্তব্য فَإِنْ طَلَّقَهَا .... ‘অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়’ আয়াতাংশ দ্বারা। অতঃপর বিদ্বানগণ এবিষয়ে একমত হয়েছেন যে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে এক তালাক অথবা দুই তালাক দিবে, সে ব্যক্তি তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু যদি তৃতীয়বার তালাক দেয়, তাহ’লে ঐ স্ত্রী তার জন্য আর হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে অন্য স্বামীকে বিবাহ করবে’। আর এটিই কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য ( محكم القران )। যাতে কারু কোনরূপ মতভেদ নেই’।[5]
আল্লাহ এতই মেহেরবান যে, সর্বশেষ তৃতীয়বার তালাকের কারণে উক্ত স্বামী ও স্ত্রীকে চিরকালের মত পরস্পরের জন্য নিষিদ্ধ করেননি। বরং যদি কখনও দ্বিতীয় স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়, তখন সে পুনরায় তার পূর্বতন স্বামীর কাছে ফিরে আসতে পারে, যদি উভয়ে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে রাযী হয়। এতেই বুঝা যায় যে, বিবাহের পবিত্র বন্ধনকে আল্লাহ পাক কত বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্য কতভাবেই না বান্দাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
[1]. মু্ত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১০৪ ‘কিতাব ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘কিভাবে ঈদায়নের খুৎবা দিতে হবে’ অনুচ্ছেদ।
[3]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯০-৯২ পৃঃ।
[4]. আহমাদ, ইবনু আবী হাতেম, ইবনু মারদুভিয়াহ, ইবনু কাছীর ১/২৭৯-৮০ পৃঃ।
[5]. তাফসীরে কুরতুবী, বাক্বারাহ ২২৯।
ইসলামে তালাকের অধিকার সীমিত করা হয়েছে তিনবারের মধ্যে। প্রথম দু’বার ‘রাজ‘ঈ’ ও শেষেরটি ‘বায়েন’। অর্থাৎ ইসলামে তালাকের বিধান রাখা হ’লেও স্বামীকে ভাববার ও সমঝোতার সুযোগ দেওয়া হয় স্ত্রীর তিন ঋতু বা তিন মাসকাল যাবত। এর মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। যাকে ‘রাজ‘আত’ বলা হয়। কিন্তু গভীর ভাবনা-চিন্তার পর ঠান্ডা মাথায় তৃতীয়বার তালাক দিলে তখন আর ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।
তালাকের পদ্ধতি :
(১) স্ত্রীকে তার ঋতুমুক্তির পর পবিত্র অবস্থার শুরুতে মিলন ছাড়াই স্বামী প্রথমে এক তালাক দিবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় তিন ঋতুর ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে রাজ‘আত করতে পারে। অর্থাৎ ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পরে ফেরত নিতে চাইলে তাকে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে হবে। ইদ্দতকালে স্ত্রী স্বামীগৃহে অবস্থান করবে। অবস্থানকালে স্বামী স্ত্রীকে খোরপোষ দিবে। এটিই হ’ল তালাকের সর্বোত্তম পন্থা।
(২) সহবাসহীন তোহরে প্রথম তালাক দিয়ে ইদ্দতের মধ্যে পরবর্তী তোহরে ২য় তালাক দিবে এবং ইদ্দতকাল গণনা করবে। অতঃপর পরবর্তী তোহরের শুরুতে তৃতীয় তালাক দিবে ও ঋতু আসা পর্যন্ত সর্বশেষ ইদ্দত পালন করবে। তৃতীয়বার তালাক উচ্চারণ করলে স্ত্রীকে আর ফেরৎ নেওয়া যাবে না। অতএব ২য় তোহরে ২য় তালাক দিলে ৩য় তোহরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানেও পূর্বের ন্যায় যাবতীয় বিধান বহাল থাকবে (বাক্বারাহ ২/২২৯; তালাক ৬৫/১)। ইসলামের সোনালী যুগে এই তালাকই চালু ছিল। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَآءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ لاَ تُخْرِجُوْهُنَّ مِنْ بُيُوْتِهِنَّ وَلاَ يَخْرُجْنَ إِلاَّ أَنْ يَأْتِيْنَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَتِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ وَمَنْ يَّتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ لاَ تَدْرِيْ لَعَلَّ اللهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْراً µ ( الطلاق ১)-
‘হে নবী! যদি আপনি স্ত্রীদের তালাক দিতে চান, তাহ’লে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দিন এবং ইদ্দত গণনা করতে থাকুন। আপনি আপনার প্রভু সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকুন। সাবধান তালাকের পর স্ত্রীদেরকে গৃহ হ’তে বিতাড়িত করবেন না, আর তারাও যেন স্বামীগৃহ ছেড়ে বহির্গত না হয়। অবশ্য তারা যদি খোলাখুলিভাবে ফাহেশা কাজে লিপ্ত হয়, তাহ’লে স্বতন্ত্র কথা। এগুলি আল্লাহকৃত সীমারেখা। যে ব্যক্তি উক্ত সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজের উপরে যুলুম করে। কেননা সে জানে না যে, তালাকের পরেও আল্লাহ কোন (সমঝোতার) পথ বের করে দিতে পারেন’ (তালাক্ব ৬৫/১)।
উক্ত আয়াতের তাৎপর্য এই যে, তালাক হ’ল মূলতঃ ইদ্দতের তালাক, আকস্মিক বা যুগপৎ তালাক নয়। স্বামী-স্ত্রীকে অবশ্যই নির্ধারিত ইদ্দত গণনা করতে হবে। এজন্য কমপক্ষে তিন ঋতু মুক্তির তিন মাস স্বামী অবকাশ পাবেন যে, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে পারবেন কি-না। এছাড়াও স্ত্রীকে স্বামীগৃহেই অবস্থান করতে হবে। এর দ্বারা উভয়কে পুনর্মিলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, এগুলি হ’ল আল্লাহকৃত ‘হুদূদ’ বা সীমারেখা, যা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ।
এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল : এক মজলিসে একসাথে তিন তালাক বায়েন দিলে উক্ত সীমারেখা পালন করা যায় কি? যেখানে প্রথম তালাকের ইদ্দতকাল এক ঋতু শেষে ২য় তালাক। অতঃপর ২য় তালাকের ইদ্দতকাল ২য় ঋতু শেষে ৩য় তালাক- এভাবে হিসাব করে বিরতিসহ ইদ্দত গণনার কোন সুযোগ থাকে কি? যদি না থাকে, তাহ’লে সেটা কোন্ ধরনের তালাক হবে? কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোথাও এরূপ তালাকের কোন অস্তিত্ব আছে কি?
বিভিন্ন ফিক্বহ গ্রন্থে তালাককে আহসান, হাসান ও বিদ‘আত তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং কুরআন-হাদীছে বর্ণিত উপরোক্ত তালাক বিধানকে ‘সুন্নী তালাক’ ও আবিষ্কৃত একত্রিত তিন তালাককে ‘বেদ‘ঈ তালাক’ নামে অভিহিত করা হয়েছে (হেদায়া ২/৩৫৪-৫৫)। অথচ মুসলমান ‘সুন্নাত’ মানতে পারে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই ‘বিদ‘আত’ মানতে পারে না। কেননা দ্বীনের নামে সকল প্রকার বিদ‘আত প্রত্যাখাত[1] এবং বিদ‘আতের একমাত্র পরিণাম হ’ল জাহান্নাম।[2] অথচ বিদ‘আতী তালাককে আইনসিদ্ধ করার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে পাপের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। সুন্নাতী তালাকের স্থলে বিদ‘আতী তালাক সিদ্ধ করে ‘তাহলীল’-এর ন্যায় জাহেলী আরবের নোংরা কুপ্রথাকে অসিদ্ধ ফাসিদ ক্বিয়াসের মাধ্যমে ইসলামী সমাজে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যার সরাসরি ও অসহায় শিকার হচ্ছে এদেশের সরল-সিধা মুসলিম নারী সমাজ।
উল্লেখ্য যে, সূরায়ে তালাক্ব-এর ২য় আয়াতের وَأَشْهِدُوا ذَوَيْ عَدْلٍ مِّنْكُمْ ) ) আলোকে ছাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী ও ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ), তাবেঈগণের মধ্যে আত্বা, ইবনু জুরায়েজ ও ইবনু সীরীন এবং ইমামিয়া শী‘আ বিদ্বান মন্ডলী তালাকের ক্ষেত্রেও দু’জন ন্যায়বান সাক্ষীর শর্ত আরোপ করেন। যেরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। তবে প্রাচীন ও আধুনিক সকল যুগের অন্যান্য বিদ্বানদের নিকটে তালাক কেবলমাত্র স্বামীর অধিকার। এর জন্য কোন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। কেননা এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও জমহূর ছাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে কোনরূপ প্রমাণ নেই’।[3]
উপরোক্ত তালাক বিধানে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলাম বাধ্যগত অবস্থায় তালাক জায়েয রাখলেও মূলতঃ সেটা তার কাম্য নয়। বরং স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি ও তাদেরকে পুনরায় দাম্পত্য জীবনে ফিরে আসার সকল বৈধ সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। তাকে এক মাস, দু’মাস, তিন মাস যাবত চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছে। ইদ্দতকালে স্ত্রীকে স্বামীগৃহে অবস্থানের সুযোগ দিয়েছে। সবশেষে দ্বিতীয়বার পর্যন্ত ‘তালাক্ব’ শব্দটি উচ্চারণ করলেও কুরআন ‘তৃতীয় তালাক’ বা ‘তালাক্বে বায়েন’ (বিচ্ছিন্নকারী তালাক) কথাটি উচ্চারণ করেনি। বরং ইঙ্গিতে বলেছে, দ্বিতীয়বার তালাক দেওয়ার পরে এক্ষণে সে তার স্ত্রীকে সুন্দরভাবে রাখুক অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’।
জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কুরআনে দু’বার তালাক দেবার কথা পাচ্ছি। কিন্তু তৃতীয় তালাক কোথায়? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’।[4] অর্থাৎ আল্লাহ চান না যে, বান্দা স্বীয় স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দিক। কেননা তৃতীয় তালাক দিলে সে আর তার স্ত্রীকে ফেরত পাবে না। যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে এবং সেই স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়। আর সেটা নিতান্তই কল্পনার বস্ত্ত।
কুরতুবী বলেন, বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’ দ্বারা দুই তালাকের পরে তৃতীয় তালাক বুঝানো হয়েছে। আর এটা বুঝা গেছে পরবর্তী বক্তব্য فَإِنْ طَلَّقَهَا .... ‘অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়’ আয়াতাংশ দ্বারা। অতঃপর বিদ্বানগণ এবিষয়ে একমত হয়েছেন যে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে এক তালাক অথবা দুই তালাক দিবে, সে ব্যক্তি তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু যদি তৃতীয়বার তালাক দেয়, তাহ’লে ঐ স্ত্রী তার জন্য আর হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে অন্য স্বামীকে বিবাহ করবে’। আর এটিই কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য ( محكم القران )। যাতে কারু কোনরূপ মতভেদ নেই’।[5]
আল্লাহ এতই মেহেরবান যে, সর্বশেষ তৃতীয়বার তালাকের কারণে উক্ত স্বামী ও স্ত্রীকে চিরকালের মত পরস্পরের জন্য নিষিদ্ধ করেননি। বরং যদি কখনও দ্বিতীয় স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়, তখন সে পুনরায় তার পূর্বতন স্বামীর কাছে ফিরে আসতে পারে, যদি উভয়ে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে রাযী হয়। এতেই বুঝা যায় যে, বিবাহের পবিত্র বন্ধনকে আল্লাহ পাক কত বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্য কতভাবেই না বান্দাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
[1]. মু্ত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১০৪ ‘কিতাব ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘কিভাবে ঈদায়নের খুৎবা দিতে হবে’ অনুচ্ছেদ।
[3]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯০-৯২ পৃঃ।
[4]. আহমাদ, ইবনু আবী হাতেম, ইবনু মারদুভিয়াহ, ইবনু কাছীর ১/২৭৯-৮০ পৃঃ।
[5]. তাফসীরে কুরতুবী, বাক্বারাহ ২২৯।
‘খোলা’ ( الْخُلْعُ ) অর্থ : কাপড় খুলে ফেলা। পবিত্র কুরআনে স্বামী-স্ত্রীকে ‘পরস্পরের জন্য পোষাক’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭) স্বরূপ বলা হয়েছে। স্বামীর নিকট থেকে স্ত্রী কোন কিছুর বিনিময়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়াকেই শারঈ পরিভাষায় ‘খোলা’ বলা হয়।[1]
মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের কন্যা জামীলা কিংবা সাহ্ল আনছারী (রাঃ)-এর কন্যা হাবীবাহ নাম্নী জনৈকা মহিলা একদিন ফজরের অন্ধকারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এসে তার স্বামী ছাবিত বিন ক্বায়েস বিন শাম্মাস-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, সে তাকে মেরেছে ও অঙ্গহানি করেছে। সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি তার দ্বীন বা চরিত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি না বরং তার বেঁটে অবয়ব ও কুৎসিত চেহারার অভিযোগ করি। হে রাসূল! যদি আল্লাহর ভয় না থাকত তাহ’লে বাসর রাতে আমি তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করতাম’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাবিতকে ডাকালেন ও তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে ‘মোহর’ স্বরূপ আমার সবচেয়ে মূল্যবান দু’টি খেজুর বাগান দিয়েছিলাম, যা তার অধিকারে আছে। যদি সেটা আমাকে ফেরত দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন মহিলাকে বললেন, তুমি কি বলতে চাও। মহিলাটি বলল হাঁ। ফেরৎ দেব। চাইলে আরো বেশী দেব’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাবিতকে বললেন, তুমি তোমার স্ত্রীকে পৃথক করে দাও। অতঃপর তাই করা হ’ল।[2]
ইবনু জারীর বলেন যে, উপরোক্ত ঘটনা উপলক্ষে অত্র আয়াত (বাক্বারাহ ২২৯-এর দ্বিতীয়াংশ) নাযিল হয়। আবদুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ইসলামের ইতিহাসে এটাই হ’ল ‘খোলা’-র প্রথম ঘটনা এবং এটাই হ’ল খোলা-র মূল দলীল।[3]
‘খোলা’ মূলতঃ ‘ফিসখে নিকাহ’ বা বিবাহ মুক্তি। কুরআনে দু’টি তালাক দেওয়ার পরে তৃতীয় তালাক-এর পূর্বে মালের বিনিময়ে বিবাহ মুক্তি বা ‘খোলা’-এর কথা এসেছে। এতে বুঝা যায় যে, ‘খোলা’ তালাক নয়, বরং বিচ্ছেদ মাত্র। যদি খোলা তালাকই হ’ত, তবে শেষের তালাকটি চতুর্থ তালাক বলে গণ্য হ’ত। অথচ সকল বিদ্বান একমত যে, শেষে যে তালাক-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি তৃতীয় তালাক, চতুর্থ তালাক নয়। নবী করীম (ছাঃ) ছাবেত বিন ক্বায়েস (রাঃ)-এর স্ত্রীকে ‘খোলা’ করে নেওয়ার পর তাকে ‘খোলা’র ইদ্দত স্বরূপ এক ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।[4]
উক্ত হাদীছটিও প্রমাণ করে যে, ‘খোলা’ তালাক নয়। কারণ যদি তালাক হ’ত, তবে উক্ত মহিলাকে তিনি তিন ‘তোহর’ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলতেন। বুখারী শরীফে ‘খোলা’র ক্ষেত্রে যে ‘তালাক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কেননা উক্ত হাদীছটি ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত। পক্ষান্তরে আবূ দাউদ, নাসাঈ, মুওয়াত্ত্বা বর্ণিত খোলাকারিণী মহিলা ছাবিত-এর স্ত্রী জামীলা বা হাবীবাহ্-র বর্ণনায় এসেছে وَخَلِّ سبِيْلَهَا অর্থাৎ ‘মহিলাকে ছেড়ে দাও’। অতএব এ বিষয়ে উক্ত মহিলার বক্তব্যই অগ্রাধিকারযোগ্য।[5]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘খোলা’ যে তালাক নয়, তার প্রমাণ হ’লঃ তালাকের ক্ষেত্রে আল্লাহ যে তিনটি বিধানের কথা বলেছেন সেগুলির যেগুলির সব ক’টি ‘খোলা’তে পাওয়া যায় না। তিনটি নিম্নরূপ-
(১) ‘তালাকে রাজঈ’র পর স্বামী তার স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে বিনা বিবাহে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ‘খোলা’ হ’লে স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত তা পারবে না।
(২) ‘তালাক’ তিনটি পর্যন্ত সীমিত। সুতরাং তালাকের সংখ্যা পূর্ণ হয়ে গেলে স্ত্রীর অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ ও মিলন না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু ‘খোলা’য় স্ত্রীকে অপর কারো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই প্রথম স্বামীর কাছে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফিরে যেতে পারবে।
(৩) ‘খোলা’র ইদ্দত হ’ল এক ঋতু। পক্ষান্তরে সহবাস কৃত স্ত্রীর তালাকের ইদ্দত তিন তোহর’।[6]
ঋতুকালে বা পবিত্রকালে, সহবাস কৃত বা সহবাসহীন, সকল অবস্থায় স্ত্রী ‘খোলা’ করতে পারে (ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩২৩)। ‘মহরানা’ ফিরিয়ে দিয়ে বা অন্য কোন মালের বিনিময়ে ‘খোলা’ করাই দলীল সম্মত। তবে মালের বিনিময় ছাড়াও ‘খোলা’ সংঘটিত হ’তে পারে। বিশেষ করে স্বামীর পক্ষ থেকে যদি স্ত্রীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কুমতলব থাকে, তবে সেখানে মালের বিনিময় ছাড়াই আদালত উভয়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। কারণ হাদীছে এসেছে, لاَ ضَرَرَ وَلاَضِرَارَ ‘কোন ক্ষতি করা চলবে না, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া যাবে না’।[7]
চার খলীফাসহ ছাহাবী বিদ্বানগণের মতে খোলা তালাকের ইদ্দত হ’ল এক ঋতুকাল। কিন্তু জমহূর বিদ্বানগণের মতে অন্যান্য তালাকের ন্যায় এতেও স্ত্রী তিন ঋতুকাল পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে।[8] স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত ইদ্দত কালের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে নেওয়া জায়েয নয়।[9] ইদ্দতকালের মধ্যে উভয়ের সম্মতিতে পুনরায় বিবাহ হ’তে পারে।[10] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
أَيُّمَا اِمْرَأَةٍ سَأَلَتْ زَوْجَهَا طَلاَقًا فِيْ غَيْرِ مَا بَأْسٍ فَحََرَامٌ عَلَيْهَا رَائِحَةُ الجَنَّةِ -
‘যে মহিলা তার স্বামীর নিকট থেকে কোন ক্ষতির আশংকা ছাড়াই তালাক প্রার্থনা করবে, সে মহিলা জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না’।[11]
[1]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩১৯ পৃঃ।
[2]. বুখারী, মুওয়াত্ত্বা, আবুদাঊদ, ইবনু জারীর, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ; ইবনু কাছীর ১/২৮১-৮২; মিশকাত হা/৩২৭৪ ‘বিবাহ’ অধ্যায়-১৩ ‘খোলা ও তালাক’ অনুচ্ছেদ-১১; ইবনু হাজার দু’টিকে পৃথক ঘটনা মনে করেন। শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো : ১৩৯৮/১৯৭৮ খৃঃ) ‘খোলা’ অনুচ্ছেদ, ৮/৪৩ পৃঃ।
[3]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/২৮১ পৃঃ।
[4]. আবু্দাঊদ হা/২২২৯-৩০, তিরমিযী হা/১১৮৫, নাসাঈ হা/৩৪৯৭, ইবনু মাজাহ হা/২০৫৮, হাদীছ ছহীহ; নায়লুল আওত্বার ৮/৪১ পৃঃ।
[5]. নায়লুল আওত্বার ৮/৪৫-৪৬।
[6]. নায়লুল আওত্বার ৮/৪৬-৬৭।
[7]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১৮৯৬।
[8]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১৮৯৫, ৯৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩২৩,৩২৭-২৮।
[9]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/২৮৩-৮৪; কুরতুবী ৩/১৪৩-৪৫।
[10]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩২৪।
[11]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩২৭৯।
মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের কন্যা জামীলা কিংবা সাহ্ল আনছারী (রাঃ)-এর কন্যা হাবীবাহ নাম্নী জনৈকা মহিলা একদিন ফজরের অন্ধকারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এসে তার স্বামী ছাবিত বিন ক্বায়েস বিন শাম্মাস-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, সে তাকে মেরেছে ও অঙ্গহানি করেছে। সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি তার দ্বীন বা চরিত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি না বরং তার বেঁটে অবয়ব ও কুৎসিত চেহারার অভিযোগ করি। হে রাসূল! যদি আল্লাহর ভয় না থাকত তাহ’লে বাসর রাতে আমি তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করতাম’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাবিতকে ডাকালেন ও তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে ‘মোহর’ স্বরূপ আমার সবচেয়ে মূল্যবান দু’টি খেজুর বাগান দিয়েছিলাম, যা তার অধিকারে আছে। যদি সেটা আমাকে ফেরত দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন মহিলাকে বললেন, তুমি কি বলতে চাও। মহিলাটি বলল হাঁ। ফেরৎ দেব। চাইলে আরো বেশী দেব’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাবিতকে বললেন, তুমি তোমার স্ত্রীকে পৃথক করে দাও। অতঃপর তাই করা হ’ল।[2]
ইবনু জারীর বলেন যে, উপরোক্ত ঘটনা উপলক্ষে অত্র আয়াত (বাক্বারাহ ২২৯-এর দ্বিতীয়াংশ) নাযিল হয়। আবদুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ইসলামের ইতিহাসে এটাই হ’ল ‘খোলা’-র প্রথম ঘটনা এবং এটাই হ’ল খোলা-র মূল দলীল।[3]
‘খোলা’ মূলতঃ ‘ফিসখে নিকাহ’ বা বিবাহ মুক্তি। কুরআনে দু’টি তালাক দেওয়ার পরে তৃতীয় তালাক-এর পূর্বে মালের বিনিময়ে বিবাহ মুক্তি বা ‘খোলা’-এর কথা এসেছে। এতে বুঝা যায় যে, ‘খোলা’ তালাক নয়, বরং বিচ্ছেদ মাত্র। যদি খোলা তালাকই হ’ত, তবে শেষের তালাকটি চতুর্থ তালাক বলে গণ্য হ’ত। অথচ সকল বিদ্বান একমত যে, শেষে যে তালাক-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি তৃতীয় তালাক, চতুর্থ তালাক নয়। নবী করীম (ছাঃ) ছাবেত বিন ক্বায়েস (রাঃ)-এর স্ত্রীকে ‘খোলা’ করে নেওয়ার পর তাকে ‘খোলা’র ইদ্দত স্বরূপ এক ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।[4]
উক্ত হাদীছটিও প্রমাণ করে যে, ‘খোলা’ তালাক নয়। কারণ যদি তালাক হ’ত, তবে উক্ত মহিলাকে তিনি তিন ‘তোহর’ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলতেন। বুখারী শরীফে ‘খোলা’র ক্ষেত্রে যে ‘তালাক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কেননা উক্ত হাদীছটি ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত। পক্ষান্তরে আবূ দাউদ, নাসাঈ, মুওয়াত্ত্বা বর্ণিত খোলাকারিণী মহিলা ছাবিত-এর স্ত্রী জামীলা বা হাবীবাহ্-র বর্ণনায় এসেছে وَخَلِّ سبِيْلَهَا অর্থাৎ ‘মহিলাকে ছেড়ে দাও’। অতএব এ বিষয়ে উক্ত মহিলার বক্তব্যই অগ্রাধিকারযোগ্য।[5]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘খোলা’ যে তালাক নয়, তার প্রমাণ হ’লঃ তালাকের ক্ষেত্রে আল্লাহ যে তিনটি বিধানের কথা বলেছেন সেগুলির যেগুলির সব ক’টি ‘খোলা’তে পাওয়া যায় না। তিনটি নিম্নরূপ-
(১) ‘তালাকে রাজঈ’র পর স্বামী তার স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে বিনা বিবাহে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ‘খোলা’ হ’লে স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত তা পারবে না।
(২) ‘তালাক’ তিনটি পর্যন্ত সীমিত। সুতরাং তালাকের সংখ্যা পূর্ণ হয়ে গেলে স্ত্রীর অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ ও মিলন না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু ‘খোলা’য় স্ত্রীকে অপর কারো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই প্রথম স্বামীর কাছে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফিরে যেতে পারবে।
(৩) ‘খোলা’র ইদ্দত হ’ল এক ঋতু। পক্ষান্তরে সহবাস কৃত স্ত্রীর তালাকের ইদ্দত তিন তোহর’।[6]
ঋতুকালে বা পবিত্রকালে, সহবাস কৃত বা সহবাসহীন, সকল অবস্থায় স্ত্রী ‘খোলা’ করতে পারে (ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩২৩)। ‘মহরানা’ ফিরিয়ে দিয়ে বা অন্য কোন মালের বিনিময়ে ‘খোলা’ করাই দলীল সম্মত। তবে মালের বিনিময় ছাড়াও ‘খোলা’ সংঘটিত হ’তে পারে। বিশেষ করে স্বামীর পক্ষ থেকে যদি স্ত্রীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কুমতলব থাকে, তবে সেখানে মালের বিনিময় ছাড়াই আদালত উভয়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। কারণ হাদীছে এসেছে, لاَ ضَرَرَ وَلاَضِرَارَ ‘কোন ক্ষতি করা চলবে না, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া যাবে না’।[7]
চার খলীফাসহ ছাহাবী বিদ্বানগণের মতে খোলা তালাকের ইদ্দত হ’ল এক ঋতুকাল। কিন্তু জমহূর বিদ্বানগণের মতে অন্যান্য তালাকের ন্যায় এতেও স্ত্রী তিন ঋতুকাল পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে।[8] স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত ইদ্দত কালের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে নেওয়া জায়েয নয়।[9] ইদ্দতকালের মধ্যে উভয়ের সম্মতিতে পুনরায় বিবাহ হ’তে পারে।[10] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
أَيُّمَا اِمْرَأَةٍ سَأَلَتْ زَوْجَهَا طَلاَقًا فِيْ غَيْرِ مَا بَأْسٍ فَحََرَامٌ عَلَيْهَا رَائِحَةُ الجَنَّةِ -
‘যে মহিলা তার স্বামীর নিকট থেকে কোন ক্ষতির আশংকা ছাড়াই তালাক প্রার্থনা করবে, সে মহিলা জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না’।[11]
[1]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩১৯ পৃঃ।
[2]. বুখারী, মুওয়াত্ত্বা, আবুদাঊদ, ইবনু জারীর, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ; ইবনু কাছীর ১/২৮১-৮২; মিশকাত হা/৩২৭৪ ‘বিবাহ’ অধ্যায়-১৩ ‘খোলা ও তালাক’ অনুচ্ছেদ-১১; ইবনু হাজার দু’টিকে পৃথক ঘটনা মনে করেন। শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো : ১৩৯৮/১৯৭৮ খৃঃ) ‘খোলা’ অনুচ্ছেদ, ৮/৪৩ পৃঃ।
[3]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/২৮১ পৃঃ।
[4]. আবু্দাঊদ হা/২২২৯-৩০, তিরমিযী হা/১১৮৫, নাসাঈ হা/৩৪৯৭, ইবনু মাজাহ হা/২০৫৮, হাদীছ ছহীহ; নায়লুল আওত্বার ৮/৪১ পৃঃ।
[5]. নায়লুল আওত্বার ৮/৪৫-৪৬।
[6]. নায়লুল আওত্বার ৮/৪৬-৬৭।
[7]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১৮৯৬।
[8]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১৮৯৫, ৯৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩২৩,৩২৭-২৮।
[9]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/২৮৩-৮৪; কুরতুবী ৩/১৪৩-৪৫।
[10]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩২৪।
[11]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩২৭৯।
‘যে তালাক দ্বারা স্ত্রী চূড়ান্তভাবে পৃথক হয়ে যায়, তাকে তালাকে বায়েন বা বিচ্ছিন্নকারী তালাক বলে’। এটি চারটি অবস্থায় হ’তে পারে।-
১. সহবাসের পূর্বেই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া। এই তালাকের কোন ইদ্দতকাল নেই, বরং তালাকের পরেই স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারে।
২. মালের বিনিময়ে স্বামীর নিকট থেকে স্ত্রী তালাক গ্রহণ করা। ‘খোলা’ তালাকের সময় স্বামী তখনই মালের বিনিময়ে পাবে, যখন সে পূর্বেই স্ত্রীর মহরানা সম্পূর্ণ পরিশোধ করে রাখবে। নচেৎ স্ত্রীর নিকট থেকে বিনিময়ের দাবী করা যাবে না।
৩. যখন তৃতীয় তালাক পূর্ণ হবে। যেমন প্রথমবার পবিত্র হওয়ার পরেই সহবাসহীন অবস্থায় এক তালাক দিল। ২য় বার একইভাবে তালাক দিল। তৃতীয় বার একইভাবে তালাক দিল। কিন্তু এবার আর ফেরৎ নিতে পারবে না। কেননা ঐ তালাক এবার ‘বায়েন’ তালাকে পরিণত হ’ল। এরপর তার পক্ষে আর পূর্ব স্বামীর কাছে ফিরে যাবার পথ নেই। যতক্ষণ না সে অন্যত্র স্বেচ্ছায় বিবাহ করে ও স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা হয়।
৪. স্বামীর কোন মারাত্মক ত্রুটির কারণে বা দীর্ঘ কারাবাসের কারণে বা দীর্ঘদিন স্বামী নিখোঁজ হওয়ার কারণে আদালতের মাধ্যমে স্ত্রী কর্তৃক বিবাহ বাতিল করা। এটাকে ‘ফিস্খে নিকাহ’ বলে।[1]
[1]. আবদুল্লাহ বিন যায়েদ আলে মাহমূদ, আত-তালাকুস সুন্নী ওয়াল বেদ‘ঈ (ক্বাতার : সরকারী প্রকাশনা ১৯৮৪), পৃঃ ৬২।
১. সহবাসের পূর্বেই স্ত্রীকে তালাক দেওয়া। এই তালাকের কোন ইদ্দতকাল নেই, বরং তালাকের পরেই স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারে।
২. মালের বিনিময়ে স্বামীর নিকট থেকে স্ত্রী তালাক গ্রহণ করা। ‘খোলা’ তালাকের সময় স্বামী তখনই মালের বিনিময়ে পাবে, যখন সে পূর্বেই স্ত্রীর মহরানা সম্পূর্ণ পরিশোধ করে রাখবে। নচেৎ স্ত্রীর নিকট থেকে বিনিময়ের দাবী করা যাবে না।
৩. যখন তৃতীয় তালাক পূর্ণ হবে। যেমন প্রথমবার পবিত্র হওয়ার পরেই সহবাসহীন অবস্থায় এক তালাক দিল। ২য় বার একইভাবে তালাক দিল। তৃতীয় বার একইভাবে তালাক দিল। কিন্তু এবার আর ফেরৎ নিতে পারবে না। কেননা ঐ তালাক এবার ‘বায়েন’ তালাকে পরিণত হ’ল। এরপর তার পক্ষে আর পূর্ব স্বামীর কাছে ফিরে যাবার পথ নেই। যতক্ষণ না সে অন্যত্র স্বেচ্ছায় বিবাহ করে ও স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা হয়।
৪. স্বামীর কোন মারাত্মক ত্রুটির কারণে বা দীর্ঘ কারাবাসের কারণে বা দীর্ঘদিন স্বামী নিখোঁজ হওয়ার কারণে আদালতের মাধ্যমে স্ত্রী কর্তৃক বিবাহ বাতিল করা। এটাকে ‘ফিস্খে নিকাহ’ বলে।[1]
[1]. আবদুল্লাহ বিন যায়েদ আলে মাহমূদ, আত-তালাকুস সুন্নী ওয়াল বেদ‘ঈ (ক্বাতার : সরকারী প্রকাশনা ১৯৮৪), পৃঃ ৬২।
১. ক্রোধানদ্ধ অবস্থার তালাক : ক্রোধান্ধ অবস্থায় মানুষ স্বাভাবিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে। সেকারণে দাম্পত্য জীবনের সিদ্ধান্তকারী এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ক্রুদ্ধ অবস্থায় দিলে ইসলামী শরী‘আত ঐ তালাককে অগ্রাহ্য করেছে। ক্রোধান্ধ বলতে ঐ ক্রোধকে বুঝতে হবে, যে ক্রোধে স্বামী তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে’।[1]
২. পাগল, মাতাল বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থার তালাক : এই অবস্থায় দেওয়া কোন তালাক গ্রাহ্য হবে না। এইরূপ এক ব্যক্তিকে খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয নেশা করার শাস্তি স্বরূপ (আশি) বেত মেরেছিলেন। অতঃপর তার স্ত্রীকে তার কাছে ফেরৎ দিয়েছিলেন।[2] হানাফী মাযহাব মতে এই অবস্থায় তালাক পতিত হবে (কুদূরী পৃঃ ১৭৩)।
৩. যবরদস্তি তালাক : স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করে বা ভয়-ভীতি বা প্রতারণা করে তার নিকট থেকে তালাক আদায় করা নিষিদ্ধ। বরং ঐসব স্ত্রীর জন্য ‘খোলা’ তালাকের ব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে।
ছাহাবায়ে কেরাম যবরদস্তি তালাককে তালাক হিসাবে গণ্য করতেন না (যাদুল মা‘আদ ৫/১৮৯)। জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে যবরদস্তি তালাক পতিত হবে না। তবে হানাফী মাযহাব মতে তালাক পতিত হবে। কেননা হাদীছে এসেছে, বিবাহ, তালাক ও রাজ‘আত এই তিনটি বিষয়ে হাসি-ঠাট্টা গ্রহণযোগ্য নয়’। অর্থাৎ তা পতিত হবে।[3]
জবাব: হাসি-ঠাট্টা আর যবরদস্তি এক বস্ত্ত নয়। অতএব যবরদস্তি তালাক পতিত না হওয়াই হাদীছ সম্মত।
৪. ঋতুকালে বা নেফাস অবস্থায় তালাক, সহবাসকৃত পবিত্র অবস্থায় তালাক, সহবাসহীন একই তোহরে একত্রিত বা পৃথক পৃথকভাবে তিন তালাক প্রদান করা। ক্রুদ্ধ, পাগল, বেহুঁশ, যবরদস্তি, অজ্ঞান, নাবালক বা নিন্দ্রাবস্থায় উচ্চারিত বা প্রদত্ত তালাককে তালাক গণ্য না করার দলীল সমূহ নিম্নরূপ :
(১) আল্লাহ বলেন, ... কেবল ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যাকে যবরদস্তি করা হয়েছে। অথচ তার অন্তর ঈমানের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত রয়েছে’ (নাহ্ল ১৬/১০৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তিনটি ব্যাপারে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে (ক) ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগরিত হয় (খ) নাবালক শিশু যতক্ষণ না বালেগ হয় (গ) জ্ঞানহারা ব্যক্তি যতক্ষণ না সুস্থ জ্ঞান ফিরে পায়’।[4] তিনি আরও বলেন, তালাক নেই ও দাসমুক্তি নেই ‘ইগলাক্ব’ অবস্থায়।[5] আবু দাঊদ বলেন, ‘ইগলাক্ব’ গালাক্ব ধাতু হ’তে উৎপন্ন। যার অর্থ বন্ধ হওয়া। ক্রোধান্ধ, পাগল ও যবরদস্তির অবস্থায় মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি লোপ পায়। তাই এ অবস্থাকে ‘ইগলাক্ব’ বলা হয় (ঐ, হাশিয়া)।
উপরে বর্ণিত অবস্থার তালাক সমূহকে কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও শারঈ তালাক বলে গণ্য করা হয়নি। তথাপি একে পরবর্তীতে ‘তালাক্বে বেদ‘ঈ’ বা বিদ‘আতী তালাক নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং একত্রিতভাবে তিন তালাক দিলে ঐ ব্যক্তি গোনাহগার হবে ( وكان عاصيًا )। কিন্তু তা সত্ত্বেও তালাক হয়ে যাবে বলা হয়েছে।[6]
[1]. আল-ফিক্বহুল ইসলামী ৭/৩৬৫।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৫/১৯১; মুহাল্লা ৯/৪৭৩-৭৪, মাসআলা নং ১৯৬৪।
[3]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৩২৮৪; আল-ফিক্বহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহূ ৭/৩৬৭; সনদ হাসান, ইরওয়া হা/১৮৬২, ৬/২২৪।
[4]. ছহীহ আবু দাঊদ হা/৩৭০৩।
[5]. ছহীহ আবু দাঊদ হা/১৯১৯; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১৬৬৫; মিশকাত হা/৩২৮৫।
[6]. কুদূরী, পৃঃ ১৭০; হেদায়া ২/৩৫৫।
২. পাগল, মাতাল বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থার তালাক : এই অবস্থায় দেওয়া কোন তালাক গ্রাহ্য হবে না। এইরূপ এক ব্যক্তিকে খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয নেশা করার শাস্তি স্বরূপ (আশি) বেত মেরেছিলেন। অতঃপর তার স্ত্রীকে তার কাছে ফেরৎ দিয়েছিলেন।[2] হানাফী মাযহাব মতে এই অবস্থায় তালাক পতিত হবে (কুদূরী পৃঃ ১৭৩)।
৩. যবরদস্তি তালাক : স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করে বা ভয়-ভীতি বা প্রতারণা করে তার নিকট থেকে তালাক আদায় করা নিষিদ্ধ। বরং ঐসব স্ত্রীর জন্য ‘খোলা’ তালাকের ব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে।
ছাহাবায়ে কেরাম যবরদস্তি তালাককে তালাক হিসাবে গণ্য করতেন না (যাদুল মা‘আদ ৫/১৮৯)। জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে যবরদস্তি তালাক পতিত হবে না। তবে হানাফী মাযহাব মতে তালাক পতিত হবে। কেননা হাদীছে এসেছে, বিবাহ, তালাক ও রাজ‘আত এই তিনটি বিষয়ে হাসি-ঠাট্টা গ্রহণযোগ্য নয়’। অর্থাৎ তা পতিত হবে।[3]
জবাব: হাসি-ঠাট্টা আর যবরদস্তি এক বস্ত্ত নয়। অতএব যবরদস্তি তালাক পতিত না হওয়াই হাদীছ সম্মত।
৪. ঋতুকালে বা নেফাস অবস্থায় তালাক, সহবাসকৃত পবিত্র অবস্থায় তালাক, সহবাসহীন একই তোহরে একত্রিত বা পৃথক পৃথকভাবে তিন তালাক প্রদান করা। ক্রুদ্ধ, পাগল, বেহুঁশ, যবরদস্তি, অজ্ঞান, নাবালক বা নিন্দ্রাবস্থায় উচ্চারিত বা প্রদত্ত তালাককে তালাক গণ্য না করার দলীল সমূহ নিম্নরূপ :
(১) আল্লাহ বলেন, ... কেবল ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যাকে যবরদস্তি করা হয়েছে। অথচ তার অন্তর ঈমানের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত রয়েছে’ (নাহ্ল ১৬/১০৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তিনটি ব্যাপারে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে (ক) ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগরিত হয় (খ) নাবালক শিশু যতক্ষণ না বালেগ হয় (গ) জ্ঞানহারা ব্যক্তি যতক্ষণ না সুস্থ জ্ঞান ফিরে পায়’।[4] তিনি আরও বলেন, তালাক নেই ও দাসমুক্তি নেই ‘ইগলাক্ব’ অবস্থায়।[5] আবু দাঊদ বলেন, ‘ইগলাক্ব’ গালাক্ব ধাতু হ’তে উৎপন্ন। যার অর্থ বন্ধ হওয়া। ক্রোধান্ধ, পাগল ও যবরদস্তির অবস্থায় মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি লোপ পায়। তাই এ অবস্থাকে ‘ইগলাক্ব’ বলা হয় (ঐ, হাশিয়া)।
উপরে বর্ণিত অবস্থার তালাক সমূহকে কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও শারঈ তালাক বলে গণ্য করা হয়নি। তথাপি একে পরবর্তীতে ‘তালাক্বে বেদ‘ঈ’ বা বিদ‘আতী তালাক নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং একত্রিতভাবে তিন তালাক দিলে ঐ ব্যক্তি গোনাহগার হবে ( وكان عاصيًا )। কিন্তু তা সত্ত্বেও তালাক হয়ে যাবে বলা হয়েছে।[6]
[1]. আল-ফিক্বহুল ইসলামী ৭/৩৬৫।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৫/১৯১; মুহাল্লা ৯/৪৭৩-৭৪, মাসআলা নং ১৯৬৪।
[3]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৩২৮৪; আল-ফিক্বহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহূ ৭/৩৬৭; সনদ হাসান, ইরওয়া হা/১৮৬২, ৬/২২৪।
[4]. ছহীহ আবু দাঊদ হা/৩৭০৩।
[5]. ছহীহ আবু দাঊদ হা/১৯১৯; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১৬৬৫; মিশকাত হা/৩২৮৫।
[6]. কুদূরী, পৃঃ ১৭০; হেদায়া ২/৩৫৫।
দরসে বর্ণিত ও সূরায়ে তালাকে বর্ণিত কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ পাক সকল প্রকার তালাকের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।[1] যেমন (১) সহবাসহীন স্ত্রীকে তালাক প্রদান। এই তালাকের কোন ইদ্দতকাল নেই (২) সহবাসকৃত স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক প্রদান। এই স্ত্রীর স্বামীর উপরে হারাম হয়ে যাবে, যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে ও সেখান থেকে স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা হয় (৩) খোলা, যা তিন তালাকের বাইরে এবং স্ত্রীর পক্ষ হ’তে স্বামীর নিকট থেকে মালের বিনিময়ে যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয় (৪) তালাকে রাজঈ, যেখানে এক বা দুই তালাক দেওয়ার পরে স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে বা ইদ্দতের পরেও স্বামী ফেরৎ নিতে পারে।
প্রত্যেক তালাকেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি ও ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতি রয়েছে। সেইসব পদ্ধতির বাইরে তালাক দিলে তা বিদ‘আত হবে, যা প্রত্যাখ্যাত। ঋতুকাল বা নেফাস অবস্থায় তালাক দেওয়া, এক মজজিসে তিন তালাক দেওয়া বা একই তুহরে পৃথকভাবে তিন তালাক দেওয়া, উপরে বর্ণিত চার প্রকার তালাকের বাইরে সম্পূর্ণ বিদ‘আতী প্রথা। তালাক কোন খেলনার বস্ত্ত নয় যে, একে ইচ্ছামত ব্যবহার করা যায়। তবুও যদি কেউ এরূপ করে বসে, তাহ’লে রাসূলের যামানায় তাকে এক তালাকে রাজ‘ঈ গণ্য করা হ’ত। যাতে অনুতপ্ত স্বামী-স্ত্রী পুনরায় একত্রিত হ’তে পারে এবং সংশোধন ও সমঝোতার সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু ঐ বিদ‘আতী তালাককে বায়েন তালাকের কঠোর সিদ্ধান্ত প্রদান করার ফলে মুসলিম পারিবারিক জীবনে নেমে এসেছে অশান্তির গাঢ় অনানিশা। আর তা থেকে নিষ্কৃতির জন্য তাহলীল-এর যে পথ বাৎলানো হয়েছে, তা আরও অন্ধকার ও আরও নোংরা। ধর্মের নামে প্রকাশ্য ব্যভিচারের এই নোংরা প্রথা বন্ধ করার জন্য দায়িত্বশীল ওলামায়ে কেরামকে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। যদি কখনো দেশে ইসলামী সরকার আসে, তখন তাদেরকে এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে অবশ্যই পৌঁছতে হবে।
সবশেষে বলা চলে যে, বর্তমানে বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে এই বিদ‘আতী তালাকই প্রায় সর্বত্র চালু রয়েছে। সুন্নাতী নিয়মে তালাকের খবরই অনেকে জানে না। অতএব ‘তাহলীল’-এর কুপ্রথা বন্ধ করতে চাইলে এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার বিদ‘আতী তালাকের প্রথা আগে বন্ধ করতে হবে এবং জনগণকে শারঈ তালাকের সুষম বিধান সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। -আমীন!!
[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ (বৈরুত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ ২৯তম সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬) ৫/২২৪-২৫।
প্রত্যেক তালাকেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি ও ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতি রয়েছে। সেইসব পদ্ধতির বাইরে তালাক দিলে তা বিদ‘আত হবে, যা প্রত্যাখ্যাত। ঋতুকাল বা নেফাস অবস্থায় তালাক দেওয়া, এক মজজিসে তিন তালাক দেওয়া বা একই তুহরে পৃথকভাবে তিন তালাক দেওয়া, উপরে বর্ণিত চার প্রকার তালাকের বাইরে সম্পূর্ণ বিদ‘আতী প্রথা। তালাক কোন খেলনার বস্ত্ত নয় যে, একে ইচ্ছামত ব্যবহার করা যায়। তবুও যদি কেউ এরূপ করে বসে, তাহ’লে রাসূলের যামানায় তাকে এক তালাকে রাজ‘ঈ গণ্য করা হ’ত। যাতে অনুতপ্ত স্বামী-স্ত্রী পুনরায় একত্রিত হ’তে পারে এবং সংশোধন ও সমঝোতার সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু ঐ বিদ‘আতী তালাককে বায়েন তালাকের কঠোর সিদ্ধান্ত প্রদান করার ফলে মুসলিম পারিবারিক জীবনে নেমে এসেছে অশান্তির গাঢ় অনানিশা। আর তা থেকে নিষ্কৃতির জন্য তাহলীল-এর যে পথ বাৎলানো হয়েছে, তা আরও অন্ধকার ও আরও নোংরা। ধর্মের নামে প্রকাশ্য ব্যভিচারের এই নোংরা প্রথা বন্ধ করার জন্য দায়িত্বশীল ওলামায়ে কেরামকে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। যদি কখনো দেশে ইসলামী সরকার আসে, তখন তাদেরকে এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে অবশ্যই পৌঁছতে হবে।
সবশেষে বলা চলে যে, বর্তমানে বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে এই বিদ‘আতী তালাকই প্রায় সর্বত্র চালু রয়েছে। সুন্নাতী নিয়মে তালাকের খবরই অনেকে জানে না। অতএব ‘তাহলীল’-এর কুপ্রথা বন্ধ করতে চাইলে এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার বিদ‘আতী তালাকের প্রথা আগে বন্ধ করতে হবে এবং জনগণকে শারঈ তালাকের সুষম বিধান সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। -আমীন!!
[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ (বৈরুত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ ২৯তম সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬) ৫/২২৪-২৫।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ الْمُحَلِّلَ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ رواه ابو داود وابن ماجه والترمذى . وفى رواية عنه : لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ الْمُحَلِّلَ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ رواه الدارمي باسناد صحيح -
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِالتَّيْسِ الْمُسْتَعَارِ؟ قَالُوْا : بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : هُوَ الْمُحَلِّلُ، لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ الْمُحَلِّلَ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ رواه ابن ماجه والبيهقى والحاكم باسناد حسن كما قاله الألبانى -
অনুবাদঃ (১) আবদুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, আল্লাহ লা‘নত করেছেন হালালকারী ও যার জন্য হালাল করা হয় উভয় ব্যক্তিকে’। তাঁর থেকে অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লা‘নত করেছেন’..।[1] (২) উক্ববা বিন আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে ভাড়াটে ষাঁড় সম্পর্কে খবর দিব না? ছাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই হে রাসূলুল্লাহ। তখন তিনি বললেন, সে হ’ল ঐ হালালকারী ব্যক্তি। আল্লাহ লা‘নত করেছেন হালালকারী ও যার জন্য হালাল করা হয় উভয় ব্যক্তিকে’।[2]
‘তাহলীল’ অর্থ : হালাল করা। প্রচলিত অর্থে একত্রিত তিন তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীকে তার পূর্ব স্বামীর নিকটে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় একজনকে স্বল্প সময়ের জন্য স্বামীত্বে বরণ করে সহবাস শেষে তালাক নিয়ে প্রথম স্বামীর জন্য তাকে হালাল করা। এদেশে এই ধরনের বিবাহকে ‘হিল্লা’ বিবাহ বলা হয়।
বুলূগুল মারামের ভাষ্যগ্রন্থ সুবুলুস সালাম-এর লেখক আল্লামা ছান‘আনী বলেন, এ হাদীছ হ’ল তাহলীল হারাম হওয়ার দলীল। কেননা হারামকারী ব্যতীত অন্যের উপরে লা‘নত করা হয় না। আর প্রত্যেক হারাম বস্ত্ত নিষিদ্ধ। এখানে নিষিদ্ধতার দাবী হ’ল বিবাহ ভঙ্গ হওয়া। ....তাহলীল-এর অনেকগুলি পদ্ধতি লোকেরা বর্ণনা করেছেন। লা‘নত-এর কারণে সকল প্রকার পদ্ধতির তাহলীল বা হিল্লা বিবাহ বাতিল (ফাসিদ)।[3]
তিরমিযীর ভাষ্যকার আবদুর রহমান মুবারকপুরী বলেন, তাবেঈন ছাড়াও মুজতাহিদ ফক্বীহদের মধ্যে শাফেঈ, আহমাদ, ইসহাক্ব, সুফিয়ান ছাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক প্রমুখ সবাই উক্ত হাদীছের উপরে আমল করে তাহলীলকে হারাম বলেছেন ও এর উপরেই তাঁদের ফৎওয়া রয়েছে।
পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও তাঁর শিষ্যবৃন্দ তাহলীলকে জায়েয রেখেছেন এবং মাননীয় ‘হেদায়া’ লেখক উক্ত হাদীছ দ্বারা দলীল এনেছেন। অতঃপর হেদায়া-র ভাষ্যকার আল্লামা যায়লা‘ঈ যুক্তি দেখিয়েছেন যে,
لَمَّا سَمَّاهُ مُحَلِّلاً دَلَّ عَلَىَ صِحَّةِ النِّكَاحِ لِأنَّ الْمُحَلِّلَ هُوَ الْمُثْبِتُ لِلْحَلِّ فَلَوْ كَانَ فَاسِدًا لَمَا سَمَّاهُ مُحَلِّلاً -
‘যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ ব্যক্তিকে হালালকারী বলেছেন, তখন এটাই ‘তাহলীল’-এর বিবাহ সিদ্ধ হওয়ার দলীল। কেননা হালালকারী ব্যক্তি পূর্ব স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে প্রতিষ্ঠিত করে। অতএব যদি তাহলীল-এর বিবাহ বাতিল হ’ত, তাহ’লে ঐ ব্যক্তিকে হালালকারী বলা হ’ত না’।[4] তিরমিযীর ভাষ্যকার আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী আরফুশ শাযীতে বলেন, আমাদের নিকটে প্রসিদ্ধ কথা এই যে, তাহলীল-এর শর্তটি পাপযু্ক্ত হ’লেও বিবাহ সিদ্ধ হবে।.... আমাদের কোন কোন কিতাবে রয়েছে যে, যদি শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত না করা হয়, তাহ’লেও একজন মুসলমান ভাইয়ের উপকার করার জন্য হালালকারী ব্যক্তি ছওয়াবের অধিকারী হবে’। বরং কোন কোন হানাফী গ্রন্থে পরিষ্কার বলা আছে যে, উভয়ের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত থাকলেও হালালকারী ব্যক্তি ছওয়াবের অধিকারী হবে ( انه مأجور ) তাদের মধ্যকার (পারিবারিক) ‘ইছলাহ’ বা সংশোধনের জন্য। বলতেকি এ প্রথাই এদেশে (উপমহাদেশে) চালু আছে এবং তারা এর মাধ্যমে নেকীর কাজ করছেন বলে মনে করে থাকেন।[5]
জবাবে বলা চলে যে, হাদীছে ‘হালালকারী’ কথাটি বলা হয়েছে হালালকারী ব্যক্তির নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী। যদিও এটি আল্লাহর নিকটে হারাম। যেমন মুশরিক ও বিদ‘আতীরা নেকীর কাজ মনে করেই শিরক ও বিদ‘আত সমূহ করে থাকি। যদিও সেগুলি আল্লাহর নিকটে হারাম। কেননা যে ব্যক্তি তাহলীল করে, সে স্রেফ এই নিয়তেই করে যে, এর মাধ্যমে ঐ মহিলাটিকে তার পূর্ব স্বামীর নিকটে ফিরে যাবার পথ খুলে দেবে এবং তাকে তার জন্য আইনসিদ্ধ করে দেবে। মুখে বলুক বা না বলুক শর্ত করুক বা না করুক, প্রচলিত তাহলীল বা হিল্লা বিবাহ মানেই হ’ল এটা। তাহলীল কখনোই স্থায়ী বিবাহ নয়। এটি স্রেফ অস্থায়ী ও সাময়িক বিবাহ। অতএব শরী‘আতের দৃষ্টিতে একে বিবাহ বলা অন্যায়।
তাহলীল-এর হুকুম :
ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় এটিকে سِفَاحٌ বা ‘যেনা বলে গণ্য করতাম’। তিনি বলেন, এরা দু’জনেই ব্যভিচারী। যদিও তারা ২০ বছর যাবত স্বামী-স্ত্রী নামে দিন যাপন করে’।[6] ওমর ফারূক (রাঃ) বলতেন, ‘হালালকারী’ ব্যক্তি বা যার জন্য হালাল করা হয়েছে, এমন কাউকে আনা হ’লে আমি তাকে স্রেফ ‘রজম’ করব।[7] অর্থাৎ ব্যভিচারীর শাস্তির ন্যায় বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে অতঃপর পাথর মেরে মাথা ফাটিয়ে শেষ করে দেব।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, তাহলীল-এর সময় মুখে শর্ত করুক বা না করুক, মদীনাবাসী বিদ্ধানমন্ডলী এবং আহলুল হাদীছ ও তাদের ফক্বীহদের নিকটে ঐ বিবাহ বাতিল। কেননা এই সাময়িক বাহ্যিক বিবাহ মিথ্যা ও ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ প্রেরিত শরী‘আতে এটা সিদ্ধ নয় এবং এটা কোন কিছুকে সিদ্ধ করতে পারে না। কেননা এর ক্ষতিকারিতা কারো নিকটে গোপন নয়’।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আল্লাহর দ্বীন পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। তা কখনোই হারাম পন্থায় কোন নারীকে হালাল করার অনুমতি দেয় না। যতক্ষণ কোন পশু স্বভাবের পুরুষকে ‘ভাড়াটে ষাঁড়’ হিসাবে উক্ত কাজে ব্যবহার না করা হয়। তিনি বলেন, কিভাবে কোন হারাম বস্ত্ত অন্যকে হালাল করতে পারে? কিভাবে কোন অপবিত্র বস্ত্ত অন্যকে পবিত্র করতে পারে?
সাইয়িদ সাবিক্ব বলেন, ‘এটাই সঠিক কথা এবং একথাই বলেন, ইমাম মালেক আহমাদ, ছাওরী, আহলুয যাহের এবং অন্যান্য ফক্বীহগণ। যেমন হাসান বছরী, ইবরাহীম নাখঈ, ক্বাতাদাহ, লাইছ, ইবনুল মুবারক প্রমুখ। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা ও যুফার (রহঃ) বলেন, তাহলীল-এর সময় যদি শর্ত করে তাহ’লে বিবাহ সিদ্ধ হবে। তবে তা মাকরূহ হবে। কেননা অন্যায় শর্তের জন্য বিবাহ বাতিল হ’তে পারে না। ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ)-এর মতে উক্ত বিবাহ বাতিল (ফাসিদ) হবে। কেননা এটি সাময়িক বিবাহ (যা শারঈ বিবাহের উদ্দেশ্য বিরোধী)। ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)-এর মতে বিবাহ সিদ্ধ হবে। তবে পূর্ব স্বামীর জন্য স্ত্রী হালাল হবে না’।[8] মোট কথা কুরআনে বর্ণিত নিয়মানুসারে তিন তুহরে তিন তালাক দেওয়ার পরে স্ত্রী স্বেচ্ছায় অন্য স্বামী গ্রহণ করবে।
অতঃপর যদি কখনো সেই স্বামী স্বেচ্ছায় তালাক দেয় এবং পূর্ব স্বামী তাকে পুনরায় আগ্রহের সাথে গ্রহণ করতে চায়, তখনই কেবল ঐ স্ত্রী তার প্রথম স্বামীর নিকটে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত আসতে পারে। এ ব্যতীত অন্য কোন হীলা-বাহানা ও কৌশল করে ‘তাহলীল’ নামক নোংরা পন্থার আশ্রয় নিয়ে পূর্ব স্বামীর নিকটে ফিরে আসার কোন সুযোগ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) দেননি। যদিও উপমহাদেশে এই নোংরা প্রথাই চলছে ইসলামের নামে ও কুরআন-সুন্নাহর দোহাই দিয়ে। অথচ বাস্তবে এটি চালু হয়েছে উম্মতের একটি দলের মাযহাবী তাক্বলীদের দুঃখজনক পরিণতি হিসাবে। যেমন-
মিশকাতের বাংলা অনুবাদক নূর মোহাম্মাদ আজমী উক্ত হাদীছের (নং ৪০৬২, ৬/৩২৩ পৃঃ) ব্যাখ্যায় বলেন, অপর হাদীছে হালালকারীকে ধারের ষাঁড় বলা হয়েছে। কেহ কাহারো তিন তালাক দেওয়া নারী এ শর্তে বিবাহ করিল যে, সে সহবাস করিয়া ছাড়িয়া দিবে যাহাতে প্রর্থম স্বামী বিবাহ করিতে পারে- এই ব্যক্তিকে ‘মুহাল্লেল’ হালালকারী বলে। ইমাম আবু হানিফার মতে এইরূপ বিবাহ জায়েজ, তবে মাকরূহ তাহরিমী। কিন্তু ইমাম আবু ইউছুফ, মালেক (একমত অনুসারে শাফেয়ী) ও ইমাম আহমদের মতে এইরূপ বিবাহ ফাছেদ। প্রথম স্বামীর পক্ষে ঐ নারীর বিবাহ জায়েয নহে। হাঁ, শর্তে আবদ্ধ না হইয়া যদি কেহ প্রথম স্বামীর উপকারার্থে বিবাহ করে এবং পরে ছাড়িয়ে দেয় তাহাতে সে পুণ্য লাভ করিবে। হাদীছ তার প্রতি প্রযোজ্য নহে’।
সৈয়দ আবুল আ‘লা মওদূদী ‘তাহলীল’ বা পাতানো বিয়ে সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, ‘এ ধরনের বিয়েতে আগে থেকেই শর্ত থাকে যে, নারীকে তার পূর্ব স্বামীর জন্য হালাল করার নিমিত্তে এক ব্যক্তি তাকে বিয়ে করবে এবং সহবাস করার পর তালাক দিবে। ইমাম আবু ইউসুফের (রহঃ) মতে এ ধরনের শর্তযুক্ত বিয়ে আদৌ বৈধ হয় না। ইমাম আবু হানীফার (রহ:) মতে এভাবে তাহলীল হয়ে যাবে, তবে কাজটি মাকরূহ তাহরিমী বা হারাম পর্যায়ের মাকরূহ’। এরপরে তিনি (দরসে বর্ণিত) দু’টি হাদীছ এনে কোনরূপ মন্তব্য ছাড়াই আলোচনা শেষ করেছেন।[9]
তাহলীল-এর কারণ :
সাময়িক উত্তেজনার বশে অথবা অজ্ঞতা বশে স্বামী কখনো স্ত্রীকে তিন তালাক একত্রে দিয়ে বসে। ফলে তালাকের সংখ্যাগত সীমা শেষ হওয়ার কারণে তার অনুশোচনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এমতাবস্থায় স্ত্রীর প্রেম, সন্তানের মায়া ও সংসারের শৃংখলা রক্ষার স্বার্থে সে স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার জন্য একসময় মরিয়া হয়ে ওঠে। ওদিকে স্ত্রীর অবস্থা হয় আরো করুণ। চোখের পানি ছাড়া তার আর কিছুই বলার থাকে না। নিজ হাতে সাজানো সংসারের মায়া তাকে পাগলিনী করে ফেলে। উভয়ের এই নাযুক মানসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা স্বামী-স্ত্রী পুনর্মিলনের জন্য যেকোন কাজ করতে রাযী হয়ে যায়। আর এসময়েই ‘তাহলীল’-এর নোংরা পদ্ধতি পেশ করা হয় ধর্মের নামে। যা তারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কবুল করে নেয়।
[1]. ছহীহ নাসাঈ হা/৩১৯৮; ছহীহ তিরমিযী হা/৮৯৩-৯৪; দারেমী হা/২২৫৮; মিশকাত হা/৩২৯৬-৯৭।
[2]. ইবনু মাজাহ, বায়হাক্বী, হাকেম, সনদ হাসান; ইরওয়াউল গালীল ৬/৩০৯-১০; যাদুল মা‘আদ ৫/১০০-০১।
[3]. সুবুলুস সালাম হা/৯৩৬; ৪/২৯৬৯।
[4]. নাছবুর রা’য়াহ (মাকতাবা ইসলামিয়্যাহ, ২য় সংষ্করণ ১৩৯৩/১৯৭৩), পৃঃ ২৪০।
[5]. তুহফাতুল আহ্ওয়াযী শারহু তিরমিযী হা/১১২৯-এর ভাষ্য, ৪/২৬৪-৬৭; আরবী মিশকাত পৃঃ ২৮৪ টীকা-১৩।
[6]. ত্বাবারাণী, বায়হাক্বী, হাকেম, ইরওয়া হা/১৮৯৮, ৬/৩১১।
[7]. ইবনুল মুনযির, মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক; ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৩৪।
[8]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/১৩৫-৩৬।
[9]. তাফহীমুল কুরআন বঙ্গানুবাদ ১৭/২০৭-৮।
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِالتَّيْسِ الْمُسْتَعَارِ؟ قَالُوْا : بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : هُوَ الْمُحَلِّلُ، لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ الْمُحَلِّلَ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ رواه ابن ماجه والبيهقى والحاكم باسناد حسن كما قاله الألبانى -
অনুবাদঃ (১) আবদুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, আল্লাহ লা‘নত করেছেন হালালকারী ও যার জন্য হালাল করা হয় উভয় ব্যক্তিকে’। তাঁর থেকে অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লা‘নত করেছেন’..।[1] (২) উক্ববা বিন আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে ভাড়াটে ষাঁড় সম্পর্কে খবর দিব না? ছাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই হে রাসূলুল্লাহ। তখন তিনি বললেন, সে হ’ল ঐ হালালকারী ব্যক্তি। আল্লাহ লা‘নত করেছেন হালালকারী ও যার জন্য হালাল করা হয় উভয় ব্যক্তিকে’।[2]
‘তাহলীল’ অর্থ : হালাল করা। প্রচলিত অর্থে একত্রিত তিন তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীকে তার পূর্ব স্বামীর নিকটে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় একজনকে স্বল্প সময়ের জন্য স্বামীত্বে বরণ করে সহবাস শেষে তালাক নিয়ে প্রথম স্বামীর জন্য তাকে হালাল করা। এদেশে এই ধরনের বিবাহকে ‘হিল্লা’ বিবাহ বলা হয়।
বুলূগুল মারামের ভাষ্যগ্রন্থ সুবুলুস সালাম-এর লেখক আল্লামা ছান‘আনী বলেন, এ হাদীছ হ’ল তাহলীল হারাম হওয়ার দলীল। কেননা হারামকারী ব্যতীত অন্যের উপরে লা‘নত করা হয় না। আর প্রত্যেক হারাম বস্ত্ত নিষিদ্ধ। এখানে নিষিদ্ধতার দাবী হ’ল বিবাহ ভঙ্গ হওয়া। ....তাহলীল-এর অনেকগুলি পদ্ধতি লোকেরা বর্ণনা করেছেন। লা‘নত-এর কারণে সকল প্রকার পদ্ধতির তাহলীল বা হিল্লা বিবাহ বাতিল (ফাসিদ)।[3]
তিরমিযীর ভাষ্যকার আবদুর রহমান মুবারকপুরী বলেন, তাবেঈন ছাড়াও মুজতাহিদ ফক্বীহদের মধ্যে শাফেঈ, আহমাদ, ইসহাক্ব, সুফিয়ান ছাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক প্রমুখ সবাই উক্ত হাদীছের উপরে আমল করে তাহলীলকে হারাম বলেছেন ও এর উপরেই তাঁদের ফৎওয়া রয়েছে।
পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও তাঁর শিষ্যবৃন্দ তাহলীলকে জায়েয রেখেছেন এবং মাননীয় ‘হেদায়া’ লেখক উক্ত হাদীছ দ্বারা দলীল এনেছেন। অতঃপর হেদায়া-র ভাষ্যকার আল্লামা যায়লা‘ঈ যুক্তি দেখিয়েছেন যে,
لَمَّا سَمَّاهُ مُحَلِّلاً دَلَّ عَلَىَ صِحَّةِ النِّكَاحِ لِأنَّ الْمُحَلِّلَ هُوَ الْمُثْبِتُ لِلْحَلِّ فَلَوْ كَانَ فَاسِدًا لَمَا سَمَّاهُ مُحَلِّلاً -
‘যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ ব্যক্তিকে হালালকারী বলেছেন, তখন এটাই ‘তাহলীল’-এর বিবাহ সিদ্ধ হওয়ার দলীল। কেননা হালালকারী ব্যক্তি পূর্ব স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে প্রতিষ্ঠিত করে। অতএব যদি তাহলীল-এর বিবাহ বাতিল হ’ত, তাহ’লে ঐ ব্যক্তিকে হালালকারী বলা হ’ত না’।[4] তিরমিযীর ভাষ্যকার আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী আরফুশ শাযীতে বলেন, আমাদের নিকটে প্রসিদ্ধ কথা এই যে, তাহলীল-এর শর্তটি পাপযু্ক্ত হ’লেও বিবাহ সিদ্ধ হবে।.... আমাদের কোন কোন কিতাবে রয়েছে যে, যদি শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত না করা হয়, তাহ’লেও একজন মুসলমান ভাইয়ের উপকার করার জন্য হালালকারী ব্যক্তি ছওয়াবের অধিকারী হবে’। বরং কোন কোন হানাফী গ্রন্থে পরিষ্কার বলা আছে যে, উভয়ের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত থাকলেও হালালকারী ব্যক্তি ছওয়াবের অধিকারী হবে ( انه مأجور ) তাদের মধ্যকার (পারিবারিক) ‘ইছলাহ’ বা সংশোধনের জন্য। বলতেকি এ প্রথাই এদেশে (উপমহাদেশে) চালু আছে এবং তারা এর মাধ্যমে নেকীর কাজ করছেন বলে মনে করে থাকেন।[5]
জবাবে বলা চলে যে, হাদীছে ‘হালালকারী’ কথাটি বলা হয়েছে হালালকারী ব্যক্তির নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী। যদিও এটি আল্লাহর নিকটে হারাম। যেমন মুশরিক ও বিদ‘আতীরা নেকীর কাজ মনে করেই শিরক ও বিদ‘আত সমূহ করে থাকি। যদিও সেগুলি আল্লাহর নিকটে হারাম। কেননা যে ব্যক্তি তাহলীল করে, সে স্রেফ এই নিয়তেই করে যে, এর মাধ্যমে ঐ মহিলাটিকে তার পূর্ব স্বামীর নিকটে ফিরে যাবার পথ খুলে দেবে এবং তাকে তার জন্য আইনসিদ্ধ করে দেবে। মুখে বলুক বা না বলুক শর্ত করুক বা না করুক, প্রচলিত তাহলীল বা হিল্লা বিবাহ মানেই হ’ল এটা। তাহলীল কখনোই স্থায়ী বিবাহ নয়। এটি স্রেফ অস্থায়ী ও সাময়িক বিবাহ। অতএব শরী‘আতের দৃষ্টিতে একে বিবাহ বলা অন্যায়।
তাহলীল-এর হুকুম :
ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় এটিকে سِفَاحٌ বা ‘যেনা বলে গণ্য করতাম’। তিনি বলেন, এরা দু’জনেই ব্যভিচারী। যদিও তারা ২০ বছর যাবত স্বামী-স্ত্রী নামে দিন যাপন করে’।[6] ওমর ফারূক (রাঃ) বলতেন, ‘হালালকারী’ ব্যক্তি বা যার জন্য হালাল করা হয়েছে, এমন কাউকে আনা হ’লে আমি তাকে স্রেফ ‘রজম’ করব।[7] অর্থাৎ ব্যভিচারীর শাস্তির ন্যায় বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে অতঃপর পাথর মেরে মাথা ফাটিয়ে শেষ করে দেব।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, তাহলীল-এর সময় মুখে শর্ত করুক বা না করুক, মদীনাবাসী বিদ্ধানমন্ডলী এবং আহলুল হাদীছ ও তাদের ফক্বীহদের নিকটে ঐ বিবাহ বাতিল। কেননা এই সাময়িক বাহ্যিক বিবাহ মিথ্যা ও ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ প্রেরিত শরী‘আতে এটা সিদ্ধ নয় এবং এটা কোন কিছুকে সিদ্ধ করতে পারে না। কেননা এর ক্ষতিকারিতা কারো নিকটে গোপন নয়’।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আল্লাহর দ্বীন পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। তা কখনোই হারাম পন্থায় কোন নারীকে হালাল করার অনুমতি দেয় না। যতক্ষণ কোন পশু স্বভাবের পুরুষকে ‘ভাড়াটে ষাঁড়’ হিসাবে উক্ত কাজে ব্যবহার না করা হয়। তিনি বলেন, কিভাবে কোন হারাম বস্ত্ত অন্যকে হালাল করতে পারে? কিভাবে কোন অপবিত্র বস্ত্ত অন্যকে পবিত্র করতে পারে?
সাইয়িদ সাবিক্ব বলেন, ‘এটাই সঠিক কথা এবং একথাই বলেন, ইমাম মালেক আহমাদ, ছাওরী, আহলুয যাহের এবং অন্যান্য ফক্বীহগণ। যেমন হাসান বছরী, ইবরাহীম নাখঈ, ক্বাতাদাহ, লাইছ, ইবনুল মুবারক প্রমুখ। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা ও যুফার (রহঃ) বলেন, তাহলীল-এর সময় যদি শর্ত করে তাহ’লে বিবাহ সিদ্ধ হবে। তবে তা মাকরূহ হবে। কেননা অন্যায় শর্তের জন্য বিবাহ বাতিল হ’তে পারে না। ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ)-এর মতে উক্ত বিবাহ বাতিল (ফাসিদ) হবে। কেননা এটি সাময়িক বিবাহ (যা শারঈ বিবাহের উদ্দেশ্য বিরোধী)। ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)-এর মতে বিবাহ সিদ্ধ হবে। তবে পূর্ব স্বামীর জন্য স্ত্রী হালাল হবে না’।[8] মোট কথা কুরআনে বর্ণিত নিয়মানুসারে তিন তুহরে তিন তালাক দেওয়ার পরে স্ত্রী স্বেচ্ছায় অন্য স্বামী গ্রহণ করবে।
অতঃপর যদি কখনো সেই স্বামী স্বেচ্ছায় তালাক দেয় এবং পূর্ব স্বামী তাকে পুনরায় আগ্রহের সাথে গ্রহণ করতে চায়, তখনই কেবল ঐ স্ত্রী তার প্রথম স্বামীর নিকটে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত আসতে পারে। এ ব্যতীত অন্য কোন হীলা-বাহানা ও কৌশল করে ‘তাহলীল’ নামক নোংরা পন্থার আশ্রয় নিয়ে পূর্ব স্বামীর নিকটে ফিরে আসার কোন সুযোগ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) দেননি। যদিও উপমহাদেশে এই নোংরা প্রথাই চলছে ইসলামের নামে ও কুরআন-সুন্নাহর দোহাই দিয়ে। অথচ বাস্তবে এটি চালু হয়েছে উম্মতের একটি দলের মাযহাবী তাক্বলীদের দুঃখজনক পরিণতি হিসাবে। যেমন-
মিশকাতের বাংলা অনুবাদক নূর মোহাম্মাদ আজমী উক্ত হাদীছের (নং ৪০৬২, ৬/৩২৩ পৃঃ) ব্যাখ্যায় বলেন, অপর হাদীছে হালালকারীকে ধারের ষাঁড় বলা হয়েছে। কেহ কাহারো তিন তালাক দেওয়া নারী এ শর্তে বিবাহ করিল যে, সে সহবাস করিয়া ছাড়িয়া দিবে যাহাতে প্রর্থম স্বামী বিবাহ করিতে পারে- এই ব্যক্তিকে ‘মুহাল্লেল’ হালালকারী বলে। ইমাম আবু হানিফার মতে এইরূপ বিবাহ জায়েজ, তবে মাকরূহ তাহরিমী। কিন্তু ইমাম আবু ইউছুফ, মালেক (একমত অনুসারে শাফেয়ী) ও ইমাম আহমদের মতে এইরূপ বিবাহ ফাছেদ। প্রথম স্বামীর পক্ষে ঐ নারীর বিবাহ জায়েয নহে। হাঁ, শর্তে আবদ্ধ না হইয়া যদি কেহ প্রথম স্বামীর উপকারার্থে বিবাহ করে এবং পরে ছাড়িয়ে দেয় তাহাতে সে পুণ্য লাভ করিবে। হাদীছ তার প্রতি প্রযোজ্য নহে’।
সৈয়দ আবুল আ‘লা মওদূদী ‘তাহলীল’ বা পাতানো বিয়ে সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, ‘এ ধরনের বিয়েতে আগে থেকেই শর্ত থাকে যে, নারীকে তার পূর্ব স্বামীর জন্য হালাল করার নিমিত্তে এক ব্যক্তি তাকে বিয়ে করবে এবং সহবাস করার পর তালাক দিবে। ইমাম আবু ইউসুফের (রহঃ) মতে এ ধরনের শর্তযুক্ত বিয়ে আদৌ বৈধ হয় না। ইমাম আবু হানীফার (রহ:) মতে এভাবে তাহলীল হয়ে যাবে, তবে কাজটি মাকরূহ তাহরিমী বা হারাম পর্যায়ের মাকরূহ’। এরপরে তিনি (দরসে বর্ণিত) দু’টি হাদীছ এনে কোনরূপ মন্তব্য ছাড়াই আলোচনা শেষ করেছেন।[9]
তাহলীল-এর কারণ :
সাময়িক উত্তেজনার বশে অথবা অজ্ঞতা বশে স্বামী কখনো স্ত্রীকে তিন তালাক একত্রে দিয়ে বসে। ফলে তালাকের সংখ্যাগত সীমা শেষ হওয়ার কারণে তার অনুশোচনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এমতাবস্থায় স্ত্রীর প্রেম, সন্তানের মায়া ও সংসারের শৃংখলা রক্ষার স্বার্থে সে স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার জন্য একসময় মরিয়া হয়ে ওঠে। ওদিকে স্ত্রীর অবস্থা হয় আরো করুণ। চোখের পানি ছাড়া তার আর কিছুই বলার থাকে না। নিজ হাতে সাজানো সংসারের মায়া তাকে পাগলিনী করে ফেলে। উভয়ের এই নাযুক মানসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা স্বামী-স্ত্রী পুনর্মিলনের জন্য যেকোন কাজ করতে রাযী হয়ে যায়। আর এসময়েই ‘তাহলীল’-এর নোংরা পদ্ধতি পেশ করা হয় ধর্মের নামে। যা তারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কবুল করে নেয়।
[1]. ছহীহ নাসাঈ হা/৩১৯৮; ছহীহ তিরমিযী হা/৮৯৩-৯৪; দারেমী হা/২২৫৮; মিশকাত হা/৩২৯৬-৯৭।
[2]. ইবনু মাজাহ, বায়হাক্বী, হাকেম, সনদ হাসান; ইরওয়াউল গালীল ৬/৩০৯-১০; যাদুল মা‘আদ ৫/১০০-০১।
[3]. সুবুলুস সালাম হা/৯৩৬; ৪/২৯৬৯।
[4]. নাছবুর রা’য়াহ (মাকতাবা ইসলামিয়্যাহ, ২য় সংষ্করণ ১৩৯৩/১৯৭৩), পৃঃ ২৪০।
[5]. তুহফাতুল আহ্ওয়াযী শারহু তিরমিযী হা/১১২৯-এর ভাষ্য, ৪/২৬৪-৬৭; আরবী মিশকাত পৃঃ ২৮৪ টীকা-১৩।
[6]. ত্বাবারাণী, বায়হাক্বী, হাকেম, ইরওয়া হা/১৮৯৮, ৬/৩১১।
[7]. ইবনুল মুনযির, মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক; ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৩৪।
[8]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/১৩৫-৩৬।
[9]. তাফহীমুল কুরআন বঙ্গানুবাদ ১৭/২০৭-৮।
তালাকের শারঈ পদ্ধতি হিসাবে কুরআন ও হাদীছে স্বামীকে কমপক্ষে তিন মাস ভাববার অবকাশ দেওয়া হয়েছে। যাতে ইদ্দতের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে একটা সমঝোতার পথ বেরিয়ে যায়। এছাড়াও উভয় পরিবারের বা পরিবারের বাইরে এক এক জন প্রতিনিধি নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করার নির্দেশও সূরা নিসা ৩৫ আয়াতে দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُواْ حَكَماً مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَماً مِّنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيْدَا إِصْلاَحاً يُوَفِّقِ اللّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلِيْماً خَبِيْراً -
‘আর যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হবার আশংকা কর, তাহ’লে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন শালিস প্রেরণ কর। যদি তারা উভয়ে মীমাংসা কামনা করে, তাহ’লে আল্লাহ তাদেরকে সহায়তা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সবকিছু অবহিত’ (নিসা ৪/৩৫)। বস্ত্ততঃ উভয় পক্ষের দূরদর্শী ও আল্লাহভীরু অভিভাবকগণ অথবা কোন শক্তিশালী নিরপেক্ষ সংস্থা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সংস্থার পক্ষে সরকার এই দায়িত্ব পালন করবেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إنِ اشْتَجَرُوْا فَالسُّلْطَانُ وَلِىٌّ مَّنْ لاَ وَلِىَّ لَهاَ -
‘যদি তারা আপোষে ঝগড়া করে, তাহ’লে শাসনকর্তা অভিভাবক হবেন ঐ ব্যক্তির জন্য, যার কোন অভিভাবক নেই’।[1]
তালাকের উক্ত শারঈ পন্থা অবলম্বন করলে স্বামী-স্ত্রীকে এভাবে চোরাপথ তালাশ করতে হ’ত না। এক বা দুই তালাক দিয়ে রেখে দিলে ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে বা ইদ্দত চলে গেলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে তারা পুনরায় মিলিত হ’তে পারত। বস্ত্ততঃ ইসলামের দেওয়া এই বিধানই কেবল যুক্তি সম্মত ও ভদ্রোচিত পন্থা। এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল যদি কেউ শারঈ পন্থা বাদ দিয়ে বিদ‘আতী পন্থায় এক মজলিসে তিন তালাক একত্রিতভাবে বা একই তুহরে তিন তালাক পৃথক পৃথকভাবে দিয়ে দেয়, তা’হলে তার স্ত্রী চিরতরে তালাক হবে কি-না।
[1]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৮৩৫; তিরমিযী, ইবনু মাজাহ প্রভৃতি; ইরওয়া হা/১৮৪০, ৬/২৪৩।
وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُواْ حَكَماً مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَماً مِّنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيْدَا إِصْلاَحاً يُوَفِّقِ اللّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلِيْماً خَبِيْراً -
‘আর যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হবার আশংকা কর, তাহ’লে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন শালিস প্রেরণ কর। যদি তারা উভয়ে মীমাংসা কামনা করে, তাহ’লে আল্লাহ তাদেরকে সহায়তা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সবকিছু অবহিত’ (নিসা ৪/৩৫)। বস্ত্ততঃ উভয় পক্ষের দূরদর্শী ও আল্লাহভীরু অভিভাবকগণ অথবা কোন শক্তিশালী নিরপেক্ষ সংস্থা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সংস্থার পক্ষে সরকার এই দায়িত্ব পালন করবেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إنِ اشْتَجَرُوْا فَالسُّلْطَانُ وَلِىٌّ مَّنْ لاَ وَلِىَّ لَهاَ -
‘যদি তারা আপোষে ঝগড়া করে, তাহ’লে শাসনকর্তা অভিভাবক হবেন ঐ ব্যক্তির জন্য, যার কোন অভিভাবক নেই’।[1]
তালাকের উক্ত শারঈ পন্থা অবলম্বন করলে স্বামী-স্ত্রীকে এভাবে চোরাপথ তালাশ করতে হ’ত না। এক বা দুই তালাক দিয়ে রেখে দিলে ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে বা ইদ্দত চলে গেলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে তারা পুনরায় মিলিত হ’তে পারত। বস্ত্ততঃ ইসলামের দেওয়া এই বিধানই কেবল যুক্তি সম্মত ও ভদ্রোচিত পন্থা। এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল যদি কেউ শারঈ পন্থা বাদ দিয়ে বিদ‘আতী পন্থায় এক মজলিসে তিন তালাক একত্রিতভাবে বা একই তুহরে তিন তালাক পৃথক পৃথকভাবে দিয়ে দেয়, তা’হলে তার স্ত্রী চিরতরে তালাক হবে কি-না।
[1]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৮৩৫; তিরমিযী, ইবনু মাজাহ প্রভৃতি; ইরওয়া হা/১৮৪০, ৬/২৪৩।
কুরআনী নীতি অনুযায়ী তিন তুহরে তালাক না দিয়ে যদি কেউ অন্যায়ভাবে একই সাথে তিন তালাক দেয়, তবে সে তালাক বর্তাবে কি-না, এ বিষয়ে বিদ্বানগণের মতভেদকে চারভাগে বিভক্ত করা যায়। একদল বিদ্বান বলেন, এর দ্বারা কিছুই বর্তাবে না। ২য় দল বলেন, তিন তালাক পতিত হবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি গোনাহগার হবে। ৩য় দল বলেন, সহবাসকৃত নারীর উপরে তিন তালাক বর্তাবে ও সহবাসহীন নারীর উপরে এক তালাক বর্তাবে। ৪র্থ দল বলেন, এক তালাক রাজ‘ঈ হবে। নিম্নে চার দলের বক্তব্য সমূহ সংক্ষেপে আলোচিত হ’ল।-
১ম দলের দলীল সমূহ : তাঁদের মূল দলীল (ক) সূরায়ে বাক্বারাহ ২২৮-২৯ ও সূরায়ে তালাক ১ম ও ২য় আয়াত। অতঃপর (খ) হাদীছের দলীল হ’ল-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ طَلَّقَ امْرَآَتَهُ وَهِىَ حَائِضٌ فِى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَأَلَ عُمَرُ رَسُوْلَ للهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ ذَلِكَ، فَقَالَ : مُرْهُ فَلْيُرَاجِعْهَا، ثُمَّ لِيُمْسِكْهَا حَتَّى تَطْهُرَ، ثُمَّ تَحِيْضَ ثُمَّ تَطْهُرَ ثُمَّ إِنْ شَاءَ أَمْسَكَ بَعْدُ وَإِنْ طَلَّقَ قَبْلَ أنْ يَمَسَّ، فِتِلْكَ الْعِدَّةُ الَّتِىْ أَمَرَ اللهُ أَنْ تُطَلَّقَ لَهَا النِّسَاءُ، متفق عليه -
وفى روايةٍ اللبخارى : وَحُسِبَتْ تَطْلِيْقَةٌ، وفىِ رواية لمسلم : قَال عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ : فَرَدَّهَا عَلىَّ وَلَمْ يَرَهَا شَيْئاً، وَقَالَ : إِذاَ طَهُرَتْ فَلْيُطَلِّقْ أَوْ لِيُمْسِكْ -
‘আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় স্বীয় স্ত্রীকে ঋতুকালীন সময়ে তালাক দেন। তখন ওমর (রাঃ) উক্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি ওমর (রাঃ)-কে বলেন, আপনি আব্দুল্লাহ্কে বলুন যেন সে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় ও ঘরে রাখে পরবর্তী তুহর পর্যন্ত। অতঃপর সে পুনরায় ঋতুবর্তী হবে ও ঋতুমুক্ত হবে। তখন ইচ্ছা করলে সে তাকে রেখে দিবে অথবা সহবাসের পূর্বেই তালাক দিবে। এটাই হ’ল ইদ্দত তালাকপ্রাপ্তা নারীদের জন্য, যা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন’ (বুখারী ও মুসলিম)। বুখারীর অপর বর্ণনায় এসেছে ‘ঋতুকালীন অবস্থার উক্ত তালাককে এক তালাক গণ্য করা হয়’। মুসলিম-এর অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেন, অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্ত্রীকে আমার নিকটে ফিরিয়ে দিলেন এবং ‘তিনি এটাকে কিছুই গণ্য করলেন না’ এবং বললেন, যখন সে ঋতুমুক্ত হবে, তখন তাকে তালাক দাও অথবা রেখে দাও’।[1]
অর্থাৎ ইবনু ওমর (রাঃ) ঋতুকালীন সময়ে স্ত্রীকে তালাক দিলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে ফিরিয়ে নিতে বলেন এবং ‘তিনি এটাকে কিছুই গণ্য করেননি’ (আহমাদ, আবু দাঊদ, নাসাঈ)। কেননা এটি নিয়ম বহির্ভূত ছিল। নিয়ম হ’ল স্ত্রীকে তার পবিত্রতার শুরুতে সহবাসহীন অবস্থায় তালাক প্রদান করা। [2] অনুরূপভাবে সুন্নাতী তরীকার বাইরে একত্রিতভাবে তিন তালাক দিলে তাকে কিছুই গণ্য করা হবে না।
উল্লেখ্য যে, ইবনু ওমর (রাঃ)-এর নিজস্ব রায় একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার পক্ষে ছিল বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এটাও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি পরে তার উক্ত রায় হ’তে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করেন’ (যেমন উপরে উল্লেখিত বুখারীর অপর বর্ণনায় ঋতুকালীন তালাককে এক তালাক গণ্য করার কথা এসেছে)।[3] তাছাড়া ‘ছাহাবীর মরফূ রেওয়ায়াত তার নিজস্ব মতামতের বিপরীতে গ্রহণীয় হয়ে থাকে’।[4]
(গ) এটা বিদ‘আত বলে গণ্য হবে, আর বিদ‘আত সর্বদা প্রত্যাখ্যাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ، ‘যে ব্যক্তি এমন কাজ করল, যে বিষয়ে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[5] তাছাড়া وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِىْ النَّارِ - ‘বিদ‘আতের একমাত্র পরিণাম হ’ল ভ্রষ্টতা। আর ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।[6]
মন্তব্য: যেহেতু একত্রিত তিন তালাক পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (ছা:)-এর সুন্নাত বহির্ভূত সেহেতু তা বিদ‘আত ও প্রত্যাখ্যাত।
‘কিছুই গণ্য করেননি’ অর্থ বিচ্ছিন্নকারী তালাক গণ্য করেননি। বরং এক তালাকে রাজ‘ঈ গণ্য করেছেন, যা বুখারীর অপর বর্ণনায় এসেছে এবং যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। ইবনু তায়মিয়াহ বলেন, هذا قول مبتدع لايعرف لقائله سلف من الصحابة والتابعين لهم باحسان، ‘এটি সম্পূর্ণ নতুন কথা। ছাহাবা ও তাবেঈনের কারু নিকট থেকে এরূপ কথা শোনা যায়নি’।[7]
[1]. বুলূগুল মারাম হা/১০০৬।
[2]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৬।
[3]. হাশিয়া মুহাল্লা ৯/৩৯৪।
[4]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৬।
[5]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০।
[6]. নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘ঈদায়েনের খুৎবা কিভাবে দিতে হবে’ অনুচ্ছেদ।
[7]. মাজমূ‘আ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ ৩৩/৮২।
১ম দলের দলীল সমূহ : তাঁদের মূল দলীল (ক) সূরায়ে বাক্বারাহ ২২৮-২৯ ও সূরায়ে তালাক ১ম ও ২য় আয়াত। অতঃপর (খ) হাদীছের দলীল হ’ল-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ طَلَّقَ امْرَآَتَهُ وَهِىَ حَائِضٌ فِى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَأَلَ عُمَرُ رَسُوْلَ للهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ ذَلِكَ، فَقَالَ : مُرْهُ فَلْيُرَاجِعْهَا، ثُمَّ لِيُمْسِكْهَا حَتَّى تَطْهُرَ، ثُمَّ تَحِيْضَ ثُمَّ تَطْهُرَ ثُمَّ إِنْ شَاءَ أَمْسَكَ بَعْدُ وَإِنْ طَلَّقَ قَبْلَ أنْ يَمَسَّ، فِتِلْكَ الْعِدَّةُ الَّتِىْ أَمَرَ اللهُ أَنْ تُطَلَّقَ لَهَا النِّسَاءُ، متفق عليه -
وفى روايةٍ اللبخارى : وَحُسِبَتْ تَطْلِيْقَةٌ، وفىِ رواية لمسلم : قَال عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ : فَرَدَّهَا عَلىَّ وَلَمْ يَرَهَا شَيْئاً، وَقَالَ : إِذاَ طَهُرَتْ فَلْيُطَلِّقْ أَوْ لِيُمْسِكْ -
‘আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় স্বীয় স্ত্রীকে ঋতুকালীন সময়ে তালাক দেন। তখন ওমর (রাঃ) উক্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি ওমর (রাঃ)-কে বলেন, আপনি আব্দুল্লাহ্কে বলুন যেন সে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় ও ঘরে রাখে পরবর্তী তুহর পর্যন্ত। অতঃপর সে পুনরায় ঋতুবর্তী হবে ও ঋতুমুক্ত হবে। তখন ইচ্ছা করলে সে তাকে রেখে দিবে অথবা সহবাসের পূর্বেই তালাক দিবে। এটাই হ’ল ইদ্দত তালাকপ্রাপ্তা নারীদের জন্য, যা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন’ (বুখারী ও মুসলিম)। বুখারীর অপর বর্ণনায় এসেছে ‘ঋতুকালীন অবস্থার উক্ত তালাককে এক তালাক গণ্য করা হয়’। মুসলিম-এর অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেন, অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্ত্রীকে আমার নিকটে ফিরিয়ে দিলেন এবং ‘তিনি এটাকে কিছুই গণ্য করলেন না’ এবং বললেন, যখন সে ঋতুমুক্ত হবে, তখন তাকে তালাক দাও অথবা রেখে দাও’।[1]
অর্থাৎ ইবনু ওমর (রাঃ) ঋতুকালীন সময়ে স্ত্রীকে তালাক দিলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে ফিরিয়ে নিতে বলেন এবং ‘তিনি এটাকে কিছুই গণ্য করেননি’ (আহমাদ, আবু দাঊদ, নাসাঈ)। কেননা এটি নিয়ম বহির্ভূত ছিল। নিয়ম হ’ল স্ত্রীকে তার পবিত্রতার শুরুতে সহবাসহীন অবস্থায় তালাক প্রদান করা। [2] অনুরূপভাবে সুন্নাতী তরীকার বাইরে একত্রিতভাবে তিন তালাক দিলে তাকে কিছুই গণ্য করা হবে না।
উল্লেখ্য যে, ইবনু ওমর (রাঃ)-এর নিজস্ব রায় একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার পক্ষে ছিল বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এটাও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি পরে তার উক্ত রায় হ’তে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করেন’ (যেমন উপরে উল্লেখিত বুখারীর অপর বর্ণনায় ঋতুকালীন তালাককে এক তালাক গণ্য করার কথা এসেছে)।[3] তাছাড়া ‘ছাহাবীর মরফূ রেওয়ায়াত তার নিজস্ব মতামতের বিপরীতে গ্রহণীয় হয়ে থাকে’।[4]
(গ) এটা বিদ‘আত বলে গণ্য হবে, আর বিদ‘আত সর্বদা প্রত্যাখ্যাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ، ‘যে ব্যক্তি এমন কাজ করল, যে বিষয়ে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[5] তাছাড়া وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِىْ النَّارِ - ‘বিদ‘আতের একমাত্র পরিণাম হ’ল ভ্রষ্টতা। আর ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।[6]
মন্তব্য: যেহেতু একত্রিত তিন তালাক পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (ছা:)-এর সুন্নাত বহির্ভূত সেহেতু তা বিদ‘আত ও প্রত্যাখ্যাত।
‘কিছুই গণ্য করেননি’ অর্থ বিচ্ছিন্নকারী তালাক গণ্য করেননি। বরং এক তালাকে রাজ‘ঈ গণ্য করেছেন, যা বুখারীর অপর বর্ণনায় এসেছে এবং যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। ইবনু তায়মিয়াহ বলেন, هذا قول مبتدع لايعرف لقائله سلف من الصحابة والتابعين لهم باحسان، ‘এটি সম্পূর্ণ নতুন কথা। ছাহাবা ও তাবেঈনের কারু নিকট থেকে এরূপ কথা শোনা যায়নি’।[7]
[1]. বুলূগুল মারাম হা/১০০৬।
[2]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৬।
[3]. হাশিয়া মুহাল্লা ৯/৩৯৪।
[4]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৬।
[5]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০।
[6]. নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘ঈদায়েনের খুৎবা কিভাবে দিতে হবে’ অনুচ্ছেদ।
[7]. মাজমূ‘আ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ ৩৩/৮২।
এই দল বলেন, একত্রিত তিন তালাকে তিন তালাকই পতিত হবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি গোনাহগার হবে ( وَكاَنَ عَاصِيًا )। অবশ্য ইমাম যুফার-এর মতে তিন তালাক পতিত হবে না। বরং পৃথক পৃথকভাবে পতিত হবে। কেননা একত্রিত তিন তালাক দেওয়া বিদ‘আত।[1]
তারা কুরআনী আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা দেন এভাবে যে, কুরআনে উত্তম পন্থাটি বর্ণিত হয়েছে। তার অর্থ এটা নয় যে, এর বিপরীতটা করলে তালাক হবে না। কুরআনী নির্দেশের বিরোধী হ’লেও কিতাব, সুন্নাহ, ইজমা, আছার ও ক্বিয়াস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ অবস্থায় তিন তালাক হবে (আল-ফিক্বহুল ইসলামী ৭/৪১০)। যেমন-
(১) সূরায়ে বাক্বারাহ ২৩৬ আয়াতে বলা হয়েছে, فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلاَ تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ - ‘যদি সে তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, তবে তার জন্য তা আর হালাল নয়, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করে’।
অত্র আয়াতে একত্রিত তিন তালাক বা পৃথক পৃথক তিন তালাক, এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।[2] তাছাড়া ২২৯ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর সীমারেখা অতিক্রম করে, তারা যালেম’। কিন্তু একত্রিতভাবে তিন তালাক দেওয়াকে ‘হারাম’ বলা হয়নি।[3] অতএব এক মজলিসে তিন তালাক দিলে তিন তালাক-ই কার্যকরী হবে।
জবাব : (ক) বাক্বারাহ ২২৯-২৩০ এবং সূরায়ে তালাক্ব ১-২ আয়াত ইদ্দত অনুযায়ী পৃথক পৃথকভাবে তালাক দেওয়ার স্পষ্ট দলীল (খ) ছহীহ হাদীছ সমূহে পৃথক পৃথকভাবে তালাক দেওয়ার স্পষ্ট বিধান ও ব্যাখ্যা এসেছে (গ) সীমা লংঘন করাটাই নিষিদ্ধ হওয়ার বড় দলীল। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘যারা নিজ স্ত্রী ও দাসী ব্যতীত অন্যকে কামনা করে, তারা সীমা লংঘনকারী’ (মুমিনূন ২৩/৬-৭)।এর অর্থ কি তাহ’লে অন্য মহিলার সঙ্গে যেনা করা হালাল হবে? (নাঊযুবিল্লাহ)। (ঘ) তালাক দিলেই যদি স্ত্রী হারাম হয়ে যায়, তাহ’লে উক্ত আয়াতের অধীনে ঋতু অবস্থার তালাক, সহবাসকৃত পবিত্র অবস্থার তালাক গণ্য হবে কি? অনুরূপভাবে এক মজলিসে একত্রিত তিন তালাকও গণ্য হবে না।
(২) ‘ওয়াইমির ‘আজলানী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপস্থিতিতে তাঁর নির্দেশের পূর্বেই স্বীয় স্ত্রীকে তিন তালাক দেন।[4] এক্ষণে যদি এক সাথে তিন তালাক দেওয়াটা গুনাহের কাজ হ’ত, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উহা স্বীকার করে নিতেন না।
জবাব : এখানে স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর বিরুদ্ধে যেনার অভিযোগ ছিল এবং লে‘আনের ঘটনা ছিল। নিয়ম হ’ল: উভয়পক্ষে লে‘আনের ফলে সাথে সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায়। পৃথকভাবে তালাক দেওয়ায় কোন প্রয়োজন হয় না। অতএব সাধারণ অবস্থার তালাকের সঙ্গে লে‘আনকে তুলনা করা চলে না। এই সময় তিন তালাক বলাটা বাহুল্য কথা মাত্র। তাছাড়া বুখারীর বর্ণনায় এসেছে ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিদের্শের আগেই সে তিন তালাক দেয়’। অতএব এর কোন কার্যকারিতা নেই।
(৩) আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রিফা‘আহ তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেন। অতঃপর স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ করে। কিন্তু সেখানেও তালাকপ্রাপ্তা হয়। তখন ঐ মহিলা তার পূর্ব স্বামীর সাথে পুনরায় বিবাহিত হ’তে পারবে কি-না, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামীর সাথে সহবাস করবে’।[5]
জবাব : উক্ত হাদীছে এক মজলিসে তিন তালাকের কথা নেই। বরং সে তাকে স্বাভাবিক নিয়মে তিন তুহরে তিন তালাক দিয়েছিল বলেই বুঝতে হবে। কেননা রাসূলের যামানায় ‘বায়েন তালাক’ বলতে তিন তুহরে তালাকই বুঝাতো।
(৪) আবু হাফ্ছ ইবনুল মুগীরাহ আল-মাখযূমী তার স্ত্রী ফাতেমা বিনতে ক্বায়েসকে তিন তালাক দিয়ে খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ)-এর সাথে ইয়ামন চলে যান। তখন উক্ত স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে জিজ্ঞেস করলেন ইদ্দত পালনকালে তার খোরপোষ সম্পর্কে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এই সময়ে তার জন্য কোন খোরপোষ নেই। তবে যদি তুমি গর্ভবতী হও’ (অর্থাৎ সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত তুমি খোরপোষ পাবে)। [6]
জবাব : অত্র হাদীছে এক মজলিসে তিন তালাকের কোন কথা নেই। বরং অন্য বর্ণনায় ‘আলবাত্তাতা’ শব্দ এসেছে। যা দ্বারা বায়েন তালাক বুঝানো হয়। আর তিন তালাক বায়েন প্রাপ্তা স্ত্রীর জন্য স্বামীর পক্ষ হ’তে কোন খোরপোষের দায়িত্ব নেই।
(খ) মুসলিম-এর বর্ণনায় (হা/১৪৮০) পরিষ্কার এসেছে اَخِرَ ثَلاَثِ تطليقاتٍ ‘শেষ তৃতীয় তালাক’ বলে। অতএব এটি যে তিন মাসে তিন তালাক ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই’।[7]
(৫) ‘উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) বলেন, আমার দাদা তার স্ত্রীকে একসঙ্গে ১০০০ তালাক দেন। তখন আমার আববা রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে গেলেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তোমার দাদা তালাক দেওয়ার সময় আল্লাহকে ভয় করেনি। তার অধিকারে মাত্র তিনটি। বাকী ৯৯৭টি বাড়াবাড়ি ও যুলম হয়েছে। আল্লাহ চাইলে তাকে আযাব দিবেন, চাইলে ক্ষমা করবেন’।[8]
জবাব : হাদীছটি যঈফ ও মওযূ।[9]
(৬) আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) তাঁর স্ত্রীকে ঋতু অবস্থায় তালাক দেন। অতঃপর বাকী দুই ঋতুর সময় বাকী দুই তালাক দিতে উদ্যত হন। এখবর রাসূল (ছাঃ)-এর কানে গেলে তিনি বলেন, হে আব্দুল্লাহ! এভাবে আল্লাহ তোমাকে নির্দেশ দেননি। নিশ্চয়ই তুমি নিয়মে ভুল করেছ (অর্থাৎ স্ত্রীকে পবিত্র অবস্থায় তালাক দিতে হবে)। ...তখন ইবনে ওমর বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! যদি আমি তিন তালাক দিতাম, তাহ’লে কি স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারতাম? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। সে পৃথক হয়ে যেত এবং তোমার গোনাহ হ’ত’ (দারাকুৎনী)।
জবাব : হাদীছটি মুনকার’। ছহীহ হাদীছ সমূহে এর বিপরীত বর্ণিত হয়েছে।[10]
(৭) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি বিদ‘আতী পন্থায় তালাক দিবে, আমরা তার বিদ‘আতকে তার উপর অপরিহার্য করে দেব’।
জবাব : হাদীছটি মুনকার’।[11]
(৮) ওমর (রাঃ) খেলাফতকালে বলেন, লোকেরা তালাকের ব্যাপার খুব জলদী করছে। অথচ সে কাজে তাদের অবকাশ দেওয়া হয়েছিল। এক্ষণে যদি কেউ এরূপ জলদী করে, তবে আমরা তার উপরে সেটা জারি করে দেব’।[12]
জবাব : এটি ছিল ওমর (রাঃ)-এর ইজতেহাদ মাত্র। তা দ্বারা রাজ‘ঈ তালাক-এর কুরআনী পদ্ধতিকে বাতিল করা যায় না। ওমর (রাঃ) এটি করেছিলেন লোকদের ভয় দেখাবার জন্য সাময়িক কঠোরতা হিসাবে। কিন্তু এতে তার উদ্দেশ্য মোটেই হাছিল হয়নি বিধায় মৃত্যুর পূর্বে তিনি লজ্জিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।[13]
[1]. হেদায়া ২/৩৫৫; কুদূরী পৃঃ ১৭০; শরহে বেকায়া ২/৬৩; মিরক্বাত ৬/২৯৩।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৫/২৩০।
[3]. মিরক্বাত ৬/২৯৩।
[4]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৩৩০৪ ‘লি‘আন’ অনুচ্ছেদ।
[5]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৩২৯৫।
[6]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৩২৪।
[7]. যাদুল মা‘আদ ৫/২০৪।
[8]. ত্বারারানী, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ।
[9]. সিলসিলা যাঈফা হা/১২১১।
[10]. মুহাল্লা ৯/৩৯২ টীকা; দারাকুৎনী, ইরওয়া হা/২০৫৪, হা/২০৫৪, ৭/১১৯।
[11]. মুহাল্লা ৯/৩৯৩ টীকা।
[12]. মুসলিম হা/১৪৭২।
[13]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান (কায়রো : দারুত তুরাছ আল-আরাবী ১৪০৩/১৯৮৩) ১/২৭৬।
তারা কুরআনী আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা দেন এভাবে যে, কুরআনে উত্তম পন্থাটি বর্ণিত হয়েছে। তার অর্থ এটা নয় যে, এর বিপরীতটা করলে তালাক হবে না। কুরআনী নির্দেশের বিরোধী হ’লেও কিতাব, সুন্নাহ, ইজমা, আছার ও ক্বিয়াস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ অবস্থায় তিন তালাক হবে (আল-ফিক্বহুল ইসলামী ৭/৪১০)। যেমন-
(১) সূরায়ে বাক্বারাহ ২৩৬ আয়াতে বলা হয়েছে, فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلاَ تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ - ‘যদি সে তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, তবে তার জন্য তা আর হালাল নয়, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করে’।
অত্র আয়াতে একত্রিত তিন তালাক বা পৃথক পৃথক তিন তালাক, এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।[2] তাছাড়া ২২৯ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর সীমারেখা অতিক্রম করে, তারা যালেম’। কিন্তু একত্রিতভাবে তিন তালাক দেওয়াকে ‘হারাম’ বলা হয়নি।[3] অতএব এক মজলিসে তিন তালাক দিলে তিন তালাক-ই কার্যকরী হবে।
জবাব : (ক) বাক্বারাহ ২২৯-২৩০ এবং সূরায়ে তালাক্ব ১-২ আয়াত ইদ্দত অনুযায়ী পৃথক পৃথকভাবে তালাক দেওয়ার স্পষ্ট দলীল (খ) ছহীহ হাদীছ সমূহে পৃথক পৃথকভাবে তালাক দেওয়ার স্পষ্ট বিধান ও ব্যাখ্যা এসেছে (গ) সীমা লংঘন করাটাই নিষিদ্ধ হওয়ার বড় দলীল। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘যারা নিজ স্ত্রী ও দাসী ব্যতীত অন্যকে কামনা করে, তারা সীমা লংঘনকারী’ (মুমিনূন ২৩/৬-৭)।এর অর্থ কি তাহ’লে অন্য মহিলার সঙ্গে যেনা করা হালাল হবে? (নাঊযুবিল্লাহ)। (ঘ) তালাক দিলেই যদি স্ত্রী হারাম হয়ে যায়, তাহ’লে উক্ত আয়াতের অধীনে ঋতু অবস্থার তালাক, সহবাসকৃত পবিত্র অবস্থার তালাক গণ্য হবে কি? অনুরূপভাবে এক মজলিসে একত্রিত তিন তালাকও গণ্য হবে না।
(২) ‘ওয়াইমির ‘আজলানী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপস্থিতিতে তাঁর নির্দেশের পূর্বেই স্বীয় স্ত্রীকে তিন তালাক দেন।[4] এক্ষণে যদি এক সাথে তিন তালাক দেওয়াটা গুনাহের কাজ হ’ত, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উহা স্বীকার করে নিতেন না।
জবাব : এখানে স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর বিরুদ্ধে যেনার অভিযোগ ছিল এবং লে‘আনের ঘটনা ছিল। নিয়ম হ’ল: উভয়পক্ষে লে‘আনের ফলে সাথে সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায়। পৃথকভাবে তালাক দেওয়ায় কোন প্রয়োজন হয় না। অতএব সাধারণ অবস্থার তালাকের সঙ্গে লে‘আনকে তুলনা করা চলে না। এই সময় তিন তালাক বলাটা বাহুল্য কথা মাত্র। তাছাড়া বুখারীর বর্ণনায় এসেছে ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিদের্শের আগেই সে তিন তালাক দেয়’। অতএব এর কোন কার্যকারিতা নেই।
(৩) আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রিফা‘আহ তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেন। অতঃপর স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ করে। কিন্তু সেখানেও তালাকপ্রাপ্তা হয়। তখন ঐ মহিলা তার পূর্ব স্বামীর সাথে পুনরায় বিবাহিত হ’তে পারবে কি-না, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামীর সাথে সহবাস করবে’।[5]
জবাব : উক্ত হাদীছে এক মজলিসে তিন তালাকের কথা নেই। বরং সে তাকে স্বাভাবিক নিয়মে তিন তুহরে তিন তালাক দিয়েছিল বলেই বুঝতে হবে। কেননা রাসূলের যামানায় ‘বায়েন তালাক’ বলতে তিন তুহরে তালাকই বুঝাতো।
(৪) আবু হাফ্ছ ইবনুল মুগীরাহ আল-মাখযূমী তার স্ত্রী ফাতেমা বিনতে ক্বায়েসকে তিন তালাক দিয়ে খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ)-এর সাথে ইয়ামন চলে যান। তখন উক্ত স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে জিজ্ঞেস করলেন ইদ্দত পালনকালে তার খোরপোষ সম্পর্কে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এই সময়ে তার জন্য কোন খোরপোষ নেই। তবে যদি তুমি গর্ভবতী হও’ (অর্থাৎ সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত তুমি খোরপোষ পাবে)। [6]
জবাব : অত্র হাদীছে এক মজলিসে তিন তালাকের কোন কথা নেই। বরং অন্য বর্ণনায় ‘আলবাত্তাতা’ শব্দ এসেছে। যা দ্বারা বায়েন তালাক বুঝানো হয়। আর তিন তালাক বায়েন প্রাপ্তা স্ত্রীর জন্য স্বামীর পক্ষ হ’তে কোন খোরপোষের দায়িত্ব নেই।
(খ) মুসলিম-এর বর্ণনায় (হা/১৪৮০) পরিষ্কার এসেছে اَخِرَ ثَلاَثِ تطليقاتٍ ‘শেষ তৃতীয় তালাক’ বলে। অতএব এটি যে তিন মাসে তিন তালাক ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই’।[7]
(৫) ‘উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) বলেন, আমার দাদা তার স্ত্রীকে একসঙ্গে ১০০০ তালাক দেন। তখন আমার আববা রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে গেলেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তোমার দাদা তালাক দেওয়ার সময় আল্লাহকে ভয় করেনি। তার অধিকারে মাত্র তিনটি। বাকী ৯৯৭টি বাড়াবাড়ি ও যুলম হয়েছে। আল্লাহ চাইলে তাকে আযাব দিবেন, চাইলে ক্ষমা করবেন’।[8]
জবাব : হাদীছটি যঈফ ও মওযূ।[9]
(৬) আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) তাঁর স্ত্রীকে ঋতু অবস্থায় তালাক দেন। অতঃপর বাকী দুই ঋতুর সময় বাকী দুই তালাক দিতে উদ্যত হন। এখবর রাসূল (ছাঃ)-এর কানে গেলে তিনি বলেন, হে আব্দুল্লাহ! এভাবে আল্লাহ তোমাকে নির্দেশ দেননি। নিশ্চয়ই তুমি নিয়মে ভুল করেছ (অর্থাৎ স্ত্রীকে পবিত্র অবস্থায় তালাক দিতে হবে)। ...তখন ইবনে ওমর বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! যদি আমি তিন তালাক দিতাম, তাহ’লে কি স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারতাম? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। সে পৃথক হয়ে যেত এবং তোমার গোনাহ হ’ত’ (দারাকুৎনী)।
জবাব : হাদীছটি মুনকার’। ছহীহ হাদীছ সমূহে এর বিপরীত বর্ণিত হয়েছে।[10]
(৭) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি বিদ‘আতী পন্থায় তালাক দিবে, আমরা তার বিদ‘আতকে তার উপর অপরিহার্য করে দেব’।
জবাব : হাদীছটি মুনকার’।[11]
(৮) ওমর (রাঃ) খেলাফতকালে বলেন, লোকেরা তালাকের ব্যাপার খুব জলদী করছে। অথচ সে কাজে তাদের অবকাশ দেওয়া হয়েছিল। এক্ষণে যদি কেউ এরূপ জলদী করে, তবে আমরা তার উপরে সেটা জারি করে দেব’।[12]
জবাব : এটি ছিল ওমর (রাঃ)-এর ইজতেহাদ মাত্র। তা দ্বারা রাজ‘ঈ তালাক-এর কুরআনী পদ্ধতিকে বাতিল করা যায় না। ওমর (রাঃ) এটি করেছিলেন লোকদের ভয় দেখাবার জন্য সাময়িক কঠোরতা হিসাবে। কিন্তু এতে তার উদ্দেশ্য মোটেই হাছিল হয়নি বিধায় মৃত্যুর পূর্বে তিনি লজ্জিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।[13]
[1]. হেদায়া ২/৩৫৫; কুদূরী পৃঃ ১৭০; শরহে বেকায়া ২/৬৩; মিরক্বাত ৬/২৯৩।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৫/২৩০।
[3]. মিরক্বাত ৬/২৯৩।
[4]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৩৩০৪ ‘লি‘আন’ অনুচ্ছেদ।
[5]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৩২৯৫।
[6]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৩২৪।
[7]. যাদুল মা‘আদ ৫/২০৪।
[8]. ত্বারারানী, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ।
[9]. সিলসিলা যাঈফা হা/১২১১।
[10]. মুহাল্লা ৯/৩৯২ টীকা; দারাকুৎনী, ইরওয়া হা/২০৫৪, হা/২০৫৪, ৭/১১৯।
[11]. মুহাল্লা ৯/৩৯৩ টীকা।
[12]. মুসলিম হা/১৪৭২।
[13]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান (কায়রো : দারুত তুরাছ আল-আরাবী ১৪০৩/১৯৮৩) ১/২৭৬।
অনুরূপভাবে আরও ইজতিহাদী ঘটনাসমূহ রয়েছে। যেমন মদ্য পানকারীকে ওমর ফারূক (রাঃ) ৮০ বেত মারেন। তার মাথা মুন্ডন করেন ও দেশছাড়া করেন। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্রেফ ৪০ বেত মেরেছিলেন।[1] আবুবকর (রাঃ) জনৈক পায়ুকামীকে এবং আলী (রাঃ) তাঁকে ‘আল্লাহর অবতার’ দাবীকারী এক দল যিন্দীক্বকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলেন। অথচ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কোন প্রাণীকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে নিষেধ করেছেন। ছাহাবায়ে কেরাম গর্ভাবস্থা দেখেই যেনার শাস্তি এবং মদের গন্ধ পেয়েই মদ্যপানের শাস্তি দিয়েছিলেন সাক্ষীর অপেক্ষা করেননি।[2]
মদীনার বাজারে লোক সমাগম বৃদ্ধি পাওয়া ওছমান গণী (রাঃ) জুম‘আর খুৎবার সময় মূল আযানের পূর্বে ‘যাওরা’ বাজারে আরেকটি আযানের প্রচলন করলেন (বুখারী, মিশকাত হা/১৪০৪)। এমনিভাবে খিলাফতে রাশিদাহর যুগে সময় ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় ইজতিহাদের ভিত্তিতে অনেক কিছু প্রশাসনিক নির্দেশ সাময়িকভাবে জারি করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে এলাহী বিধান চিরন্তন ও চিরস্থায়ী।
(৯) ইবনু মাস‘ঊদ ও ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা এসেছে যে, যদি কেউ তালাক দেয় একথা বলে যে, আমার স্ত্রীর উপর আসমানের তারকারাজির সংখ্যায় তালাক দিলাম। তাঁরা বলেন, এর দ্বারা প্রয়োজনীয় সংখ্যক তিন তালাকই পতিত হবে। বাকী সব বেকার হবে। ক্বাযী শুরাইহ বলেন, যদি কেউ পৃথিবীর সকল নারীর স্বামী হয় ও এভাবে তালাক দেয়, তবে তার উপরে সকল স্ত্রীই হারাম হয়ে যাবে।[3]
(১০) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে অন্য একটি ‘আছারে’ বলা হয়েছে যে, একত্রিত তিন তালাক দানকারী স্বামীকে তিনি বলতেন, যদি তুমি আল্লাহ্কে ভয় করতে, তাহ’লে তোমার জন্য তিনি একটা পথ বের করে দিতেন। অর্থাৎ তিন তালাক একত্রে দেওয়ার ফলে এখন তোমার জন্য সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।[4]
জবাব : এমনিতরো বহু ‘আছার’ মুওয়াত্ত্বা মালেক, মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, দারাকুৎনী প্রভৃতিতে এসেছে। যার অধিকাংশ যঈফ, মুনকার, মওযূ ও কয়েকটা ‘ছহীহ’ কিন্তু এগুলি অগ্রহণযোগ্য। কারণ বুখারী ও মুসলিমে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকেই এর বিরোধী বক্তব্য মওজূদ রয়েছে। যেখানে রাসূলের ও আবুবকরের যামানায় এবং ওমরের যামানায় প্রথম দুই বা তিন বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত বলে বলা হয়েছে।
[1]. আওনুল মা‘বূদ হা/২১৭১-এর ভাষ্য; ৬/২৪২।
[2]. আহলেহাদীছ আন্দোলন (ডক্টরেস থিসিস), পৃঃ ১৯০।
[3]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৪/১৩ ‘তালাক্ব’ অধ্যায় ১৩ অনুচ্ছেদ।
[4]. ত্বাহাভী, মুহাল্লা ৯/৩৯৩।
মদীনার বাজারে লোক সমাগম বৃদ্ধি পাওয়া ওছমান গণী (রাঃ) জুম‘আর খুৎবার সময় মূল আযানের পূর্বে ‘যাওরা’ বাজারে আরেকটি আযানের প্রচলন করলেন (বুখারী, মিশকাত হা/১৪০৪)। এমনিভাবে খিলাফতে রাশিদাহর যুগে সময় ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় ইজতিহাদের ভিত্তিতে অনেক কিছু প্রশাসনিক নির্দেশ সাময়িকভাবে জারি করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে এলাহী বিধান চিরন্তন ও চিরস্থায়ী।
(৯) ইবনু মাস‘ঊদ ও ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা এসেছে যে, যদি কেউ তালাক দেয় একথা বলে যে, আমার স্ত্রীর উপর আসমানের তারকারাজির সংখ্যায় তালাক দিলাম। তাঁরা বলেন, এর দ্বারা প্রয়োজনীয় সংখ্যক তিন তালাকই পতিত হবে। বাকী সব বেকার হবে। ক্বাযী শুরাইহ বলেন, যদি কেউ পৃথিবীর সকল নারীর স্বামী হয় ও এভাবে তালাক দেয়, তবে তার উপরে সকল স্ত্রীই হারাম হয়ে যাবে।[3]
(১০) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে অন্য একটি ‘আছারে’ বলা হয়েছে যে, একত্রিত তিন তালাক দানকারী স্বামীকে তিনি বলতেন, যদি তুমি আল্লাহ্কে ভয় করতে, তাহ’লে তোমার জন্য তিনি একটা পথ বের করে দিতেন। অর্থাৎ তিন তালাক একত্রে দেওয়ার ফলে এখন তোমার জন্য সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।[4]
জবাব : এমনিতরো বহু ‘আছার’ মুওয়াত্ত্বা মালেক, মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, দারাকুৎনী প্রভৃতিতে এসেছে। যার অধিকাংশ যঈফ, মুনকার, মওযূ ও কয়েকটা ‘ছহীহ’ কিন্তু এগুলি অগ্রহণযোগ্য। কারণ বুখারী ও মুসলিমে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকেই এর বিরোধী বক্তব্য মওজূদ রয়েছে। যেখানে রাসূলের ও আবুবকরের যামানায় এবং ওমরের যামানায় প্রথম দুই বা তিন বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত বলে বলা হয়েছে।
[1]. আওনুল মা‘বূদ হা/২১৭১-এর ভাষ্য; ৬/২৪২।
[2]. আহলেহাদীছ আন্দোলন (ডক্টরেস থিসিস), পৃঃ ১৯০।
[3]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৪/১৩ ‘তালাক্ব’ অধ্যায় ১৩ অনুচ্ছেদ।
[4]. ত্বাহাভী, মুহাল্লা ৯/৩৯৩।
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে ত্বাঊস প্রমুখাৎ আবুছ ছাহবা বর্ণিত পূর্বে উল্লেখিত হাদীছ আলোচনা শেষে শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, একত্রিত তিন তালাক বিষয়ে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর দু’টি মত পরিলক্ষিত হয়। এক- তিন তালাকই পতিত হবে। অধিকাংশ বর্ণনা এর পক্ষেই। দুই- একটি মাত্র তালাক পতিত হবে । যেমন ইকরিমার ছহীহ সূত্রে আবুদাঊদ বর্ণনা করেন, إذا قال انتِ طالقٌ ثلاثًا بفَمٍ واحد فهى واحدةً ‘যখন স্বামী এক সাথে বলবে, ‘তোমাকে তিন তালাক’ তখন তা একটি বলে গণ্য হবে’। ইবনু আববাস (রাঃ)-এর শেষোক্ত মতটি গ্রহণ করা আমাদের জন্য ওয়াজিব। এ কারণে যে এর পক্ষে ত্বাউস প্রমুখ হ’তে মুসলিম প্রভৃতি গ্রন্থে মরফূ ও ছহীহ হাদীছ সমূহ বর্ণিত হয়েছে’। আবুদাঊদ বলেন যে, ইবনু আববাস (রাঃ) তাঁর প্রথম মত হ’তে শোষোক্ত মতের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।[1]
[1]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৭/১২১-২২।
[1]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৭/১২১-২২।
কুরআন ও ছহীহ হাদীছের স্পষ্ট বিধান মওজূদ থাকতে সেখানে কারু কোন রায় বা যুক্তি চলে না (আহযাব ৩৩/৩৬)। তালাকের স্পষ্ট বিধান পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও এবং রাসূল (ছাঃ)-এর যামানা, আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল এবং ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালের প্রথম দুই বা তিন বছর কুরআনী তালাকের বাস্তব প্রচলন থাকার পরেও একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক বায়েন গণ্য করার প্রথা চালু হয় মূলতঃ কিছু যুক্তির দোহাই পেড়ে। যা পূর্বের আলোচনায় প্রমাণিত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, আমরা কি যুক্তির অনুসরণ করব? না সুন্নাহর অনুসরণ করব?
ওমর ফারূক (রাঃ) নিজে হজ্জে তামাত্তুকে অপসন্দ করতেন। অথচ তাঁর বড় ছেলে আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হজ্জে তামাত্তু করেন। ফলে লোকেদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, أفرسولُ الله صلى الله عليه وسلم أحَقُّ أنْ يُّتَّبَعَ سنتُه ام سنةُ عُمَرَ؟ ‘রাসূলের সুন্নাত অধিক অনুসরণ যোগ্য, না ওমরের সুন্নাত? [1]
অনুরূপভাবে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, لو كان الدينُ بالرأى لكان أسفلُ الخُف أولى بالمسح من أعلاه - ‘যদি দ্বীন মানুষের রায় অনুযায়ী হ’ত, তাহ’লে মোযার উপরে মাসাহ করার চেয়ে তার নীচে মাসাহ করা অধিক উত্তম হ’ত।[2]
ওমর ফারূক (রাঃ) নিঃসন্দেহে ভাল নিয়তে কাজ করেছিলেন ও তালাকের ব্যাপারে আইনী কঠোরতা আরোপ করেছিলেন। শাসক হিসাবে এরূপ সাময়িক অধিকার ইসলামী আমীরদের রয়েছে। কিন্তু এটাতো মানতেই হবে যে, এলাহী বিধান চিরন্তন। তাই যত কঠোরতাই দেখানো হৌক না কেন, দুর্বল জীব মানুষ যেকোন সময় সীমা অতিক্রম করে যেতে পারে এবং সেটাই হয়েছে। ফলে উক্ত কঠোরতার পরিণামে নিষ্কৃতির পথ না পেয়ে তাহলীল-এর ন্যায় নোংরা পথ বেছে নিতে মুসলিম স্বামী-স্ত্রী বাধ্য হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। অতএব আমাদের উচিত ছিল কুরআনী তালাক বিধানের দিকে ফিরে যাওয়া। কিন্তু না গিয়ে একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার কঠোর ও বিদ‘আতী প্রথাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। যেমন-
(১) পাকিস্তানের প্রধান মুফতী মাওলানা মুহাম্মাদ শফী স্বীয় তাফসীরে উক্ত আয়াতের সুন্দর আলোচনা শেষে ‘একত্রে তিন তালাক’ শিরোনামে বলেন, ‘এ প্রশ্নের যুক্তিভিত্তিক উত্তর এই যে, কোন কাজের পাপ কাজ হওয়া তার প্রতিক্রিয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে না। অন্যায়ভাবে হত্যা করা পাপ হ’লেও যাকে গুলী করে বা কোন অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়, সে নিহত হয়েই যায়। এই গুলী বৈধভাবে করা হ’ল, কি অবৈধভাবে করা হয়েছে, সেজন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে না। চুরি সব ধর্মমতেই পাপ, কিন্তু যে অর্থ-সম্পদ চোরাই পথে পাচার করা হয়, তা তো হাতছাড়া হয়েই গিয়েছে। এমনিভাবে যাবতীয় অন্যায় ও পাপের একই অবস্থা যে, এর অন্যায় ও পাপ হওয়া এর প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধার সৃষ্টি করে না। এই মূলনীতির ভিত্তিতে শরী‘আত প্রদত্ত নীতি-নিয়মের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে প্রয়োজন ব্যতীত স্বীয় সমস্ত ক্ষমতাকে শেষ করে দেয়া এবং একই সঙ্গে তিন তালাক দিয়ে নিষ্কৃতি লাভ করা যদিও রাসূল (ছাঃ)-এর অসন্তুষ্টির কারণ, যা পূর্ববর্তী বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, এজন্য সমগ্র উম্মত একবাক্যে একে নিকৃষ্ট পন্থা বলে উল্লেখ করেছে এবং কেউ কেউ নাজায়েযও বলেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি কেউ এ পদক্ষেপ নেয়, তবে এর ফলাফলও তাই হবে, বৈধ পথে অগ্রসর হ’লে যা হয়। অর্থাৎ তিন তালাক হয়ে যাবে এবং শুধু প্রত্যাহার নয়, বিবাহ বন্ধন নবায়নের সুযোগও আর থাকবে না। হুযূর (সাঃ)-এর মীমাংসাই এ ব্যাপারে বড় প্রমাণ যে, তিনি অসন্তুষ্ট হয়েও তিন তালাকই কার্যকরী করেছেন। হাদীস গ্রন্থে অনুরূপ বহু ঘটনার বর্ণনা রয়েছে’।[3]
জবাব : অথচ আমরা দেখতে পাই যে, কুরআনে বর্ণিত প্রথম দু’টি তালাককে তালাক বলা হ’লেও তা বন্দুকের গুলীর মত ছিল না। কেননা তা ছিল রাজ‘ঈ তালাক। যা দিলে স্ত্রীকে ফেরৎ পাওয়া যায়। অথচ বন্দুকের গুলীতে কারু রাজ‘আত হয় না বরং মৃত্যু হয়। দ্বিতীয়তঃ রাসূল (ছাঃ) অসন্তুষ্ট হ’লেও তিন তালাক কার্যকরী করেছেন- এমন কোন বিশুদ্ধ দলীল কোথাও নেই, ইতিপূর্বের আলোচনায় যা প্রমাণিত হয়েছে।
(২) পাকিস্তানের অন্যতম খ্যাতনামা আলেম মাওলানা মওদূদী স্বীয় তাফসীরে উক্ত বিষয়ের পক্ষে যুক্তি দিয়ে গিয়ে বলেন, ‘এর উপমা দেওয়া যায় যে, কোন এক পিতা তার ছেলেকে তিন শত টাকা দিয়ে বললেন, তুমিই এ টাকার মালিক, যেভাবে ইচ্ছা তুমি এ টাকা খরচ করতে পার। এরপর তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, যে অর্থ আমি তোমাকে দিলাম তা তুমি সতর্কতার সাথে উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে খরচ করবে যাতে তা থেকে যথাযথ উপকার পেতে পার। আমার উপদেশের তোয়াক্কা না করে তুমি যদি অসতর্কভাবে অন্যায় ক্ষেত্রে তা খরচ করে কিংবা সমস্ত অর্থ একসাথে খরচ করে ফেল তাহ’লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি খরচ করার জন্য আর কোন টাকা-পয়সা তোমাকে দিব না। এখন পিতা যদি এই অর্থের পুরোটা ছেলেকে আদৌ না দেয়, তাহ’লে সে ক্ষেত্রে এসব উপদেশের কোন অর্থই হয় না। যদি এমন হয় যে, উপযুক্ত ক্ষেত্র ছাড়াই ছেলে তা খরচ করতে চাচ্ছে, কিন্তু টাকা তার পকেট থেকে বের হচ্ছে না অথবা পুরো তিন শত টাকা খরচ করে ফেলা সত্ত্বেও মাত্র একশত টাকাই তার পকেট থেকে বের হচ্ছে এবং সর্বাবস্থায় দুইশত টাকা তার পকেটেই থেকে যাচ্ছে, তাহ’লে এই উপদেশের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই’।[4]
জবাব : দুর্ভাগ্য তিনি তিনটি তালাককে তিনশত টাকার সাথে তুলনা করেছেন। টাকা যদি হারিয়ে যায় বা কেউ চুরি বা ছিনতাই করে নেয়, বা কাউকে হাদিয়া দেওয়া হয়, তাহ’লে কি টাকার উপরে কোন মালিকানা থাকে? এছাড়া টাকা একটি বস্ত্ত মাত্র, যা ফেলে দিলে চুকে গেল। কিন্তু তালাক কি তাই? তালাকের নির্দিষ্ট নিয়ম-পদ্ধতি আছে, যা না মানলে তালাক হিসাবে গণ্য হয় না। এর সঙ্গে দু’টি জীবন, সংসার ও সন্তান পালনের দায়বদ্ধতা জড়িত আছে। একে ফেলনা মনে করার কোন কারণ নেই। আর সেকারণেই রাসূল (ছাঃ) ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা হচ্ছে? আমরা কি তাই করছি না? রাসূলের এই ক্রোধকে সোজা অর্থে গ্রহণ না করে আমরা বাঁকা অর্থে গ্রহণ করেছি এবং তাঁর ক্রোধের কারণ একত্রিত তিন তালাককে আমরা তিন তালাক গণ্য করেছি। কাল ক্বিয়ামতের মাঠে রাসূল (ছাঃ) যদি ক্রুদ্ধ হয়ে শাফা‘আত না করেন, তখন বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম কি জওয়াবদিহী করবেন, ভেবে দেখেছেন কি?
উল্লেখ্য যে, মাওলানা মওদূদী স্বীয় তাফহীমুল কুরআনে সূরায়ে বাক্বারাহর উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে দীর্ঘ আলোচনার অবতারণা করেছেন[5] এবং একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার পক্ষে ৩টি হাদীছ ও অন্যূন ১১টি আছার পেশ করেছেন। পেশকৃত হাদীছ সমূহের মধ্যে তিনটিই যঈফ ও মুনকার। এরপর ছাহাবায়ে কেরামের উক্তি বা ‘আছার’গুলির প্রায় সবই মুছান্নাফে আবদুর রাযযাক, মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, মুওয়াত্ত্বা, দারাকুৎনী, আবুদাঊদ, ত্বাহাভী প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে। যার মধ্যে (ক) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে চারটি আছার-এর তিনটি ছহীহ ও যঈফ (খ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে দু’টি আছার-এর একটি যঈফ ও একটি ছহীহ (গ) হযরত ওছমান ও আলী (রাঃ) থেকে দু’টি আছার-এর একটি যঈফ ও একটি মওযূ বা জাল। বাকীগুলির অবস্থাও অনুরূপ। যে সমস্ত আছার ছহীহ সূত্রে বর্ণিত সেগুলি বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত মওকূফ হাদীছের বিরোধী হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য। মাওলানা মওদূদী ওমর (রাঃ)-এর যুগের কথিত ইজমা দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-এর ও আবুবকর (রাঃ)-এর যুগের প্রচলিত সুন্নাহকে অগ্রহণযোগ্য বলতে চেয়েছেন।[6] যা নিতান্তই অযৌক্তিক।
পক্ষান্তরে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত ও বুখারী-মুসলিম সংকলিত ছহীহ মরফূ হাদীছগুলি, যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ), আবুবকর ও ওমরের যুগের প্রথম দুই বা তিন বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত। তার পক্ষে মাওলানা কোন কথা বলেননি। তিনি বিদ‘আতী তালাকের পক্ষে যুক্তি পেশ করলেও কুরআন ও সুন্নাতে নববীর পক্ষে যুক্তি পেশ করেননি।
(৩) মিশকাত শরীফের বাংলা অনুবাদক মাওলানা নূর মোহাম্মাদ আজমী বলেন, মাহমূদ বিন লবীদের হাদীছ (১৮নং) হইতে বুঝা যায় যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া বিদ‘আত ও হারাম। তাবেয়ীনদের মধ্যে হজরত তাউছ ও ইকরেমা বলেন, যেহেতু ইহা সুন্নাতের বিপরীত অতএব ইহাকে সুন্নাত অনুসারে এক তালাকই (রজয়ী) গণ্য করিতে হইবে। ছাহাবীদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ বিন আববাছ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর ও ওমরের খেলাফতের দুই বছর কাল (একসাথে) তিন তালাক এক তালাকই ছিল। অতঃপর হযরত ওমর বলিলেন,.. সুতরাং এখন হইতে আমাদের ইহাকে (তিন তালাক রূপে) কার্যকরী করিয়া দেওয়াই উচিত’। রাবী বলেন, ‘অতঃপর তিনি উহাকে কার্যকরী করিয়াছিলেন।
কিন্তু জম্হুরে ছাহাবা, তাবেয়ীন ও ইমামগণ সকলেই বলেন, একসাথে তিন তালাক দেওয়া বেদআত ও গোনাহর কাজ, তবে ইহাতে তিন তালাক হইয়া যাইবে’।... মোটকথা, এ আলোচনা দ্বারা... দেখা গেল যে, ইহার উপর মুজতাহিদ ছাহাবীগণের ইজমা হইয়া গিয়াছে এবং পরবর্তী ইমামগণও ইহার উপর একমত হইয়াছেন।[7]
জবাব : ইজমা-এর দাবী অগ্রহণযোগ্য। কেননা ‘ইজমা’ বলতে উম্মতের ঐক্যমত বুঝায়। অথচ সকল ছাহাবী এ বিষয়ে একমত হননি। যা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। দ্বিতীয়তঃ ইজমায়ে ছাহাবা সুন্নাতে নববীকে বাতিল করতে পারে না। তৃতীয়তঃ পরবর্তী সকল ইমাম এ ব্যাপারে একমত হননি। অতএব ইজমা-র দাবী অযৌক্তিক।
(৪) বোখারী শরীফের বাংলা অনুবাদক মাওলানা আজিজুল হক ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ঃ শিরোনামে বলেন,
এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তিন তালাক প্রবর্তিত হওয়া ইহাই পূর্বাপর সকল ইমামগণের স্থির সিদ্ধান্ত।...বিশিষ্ট ইমামগণের পর উক্ত বিষয়ে ভিন্ন মতামতও দেখা দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহা অত্যন্ত দুর্বল ও সমর্থহীন এবং অতি ক্ষুদ্র একটি লা-মজহাবী উপদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দুঃখের বিষয় আখেরী যামানার ধর্মীয় বিপর্যয়ের স্রোতে ঐ দুর্বল মতামতও ভাসিয়া আসিয়াছে এবং অপেক্ষাকৃত সহজ সুলভ হওয়ায় তাহাও এক শ্রেণীর লোকের সহায়তা পুষ্ট হইয়া বহু মুখের চর্চার বস্ত্ত ইহয়া উঠিয়াছে’।[8]
তিনি বলেন, এক সঙ্গে তিন তালাক যদি শুধু এক তালাক গণ্য হইত, তবে এখানে হযরতের ঐরূপ ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির কোন কারণই ছিল না; এক তালাক দেওয়ার কোন ঘটনায় হযরত (ছাঃ) ঐরূপ রাগান্বিত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছেন বলিয়া কোথাও দেখা যায় না। ...সুতরাং একত্রে তিন তালাক দেওয়া কোরআনের বিধানে প্রাপ্ত অধিকার অনাবশ্যক প্রয়োগ করাই সাব্যস্ত হয়, যাহা কোরআন নিয়া খেলা করারই নামান্তর। কিন্তু খেলা করতঃ কাহারও উপর আঘাত করিলে সেই আঘাতের পরিণাম প্রতিক্রিয়া অবশ্যই প্রবর্তিত হয় এবং সেই জন্যই ঐরূপ খেলা রাগ ও অসন্তুষ্টি কারণ হইয়া থাকে।[9]
জবাব : এ বিষয়ে যে ভিন্নমত আছে, সেকথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাদেরকে লা-মজহাবী বলে মনের ঝাল মিটিয়েছেন। যেটা কোন মুহাদ্দিছ বিদ্বানের এবং কোন নিরপেক্ষ জ্ঞানী আলেমের আচরণ হ’তে পারে না। তিনি রাসূলের ক্রোধকে পরোয়া না করলেও আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ক্রোধ থেকে বাঁচতে চাই।
(৫) মাওলানা আশরাফ আলী থানভী বলেন, এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তাহাও তালাক। যেমন, যদি কেহ তার স্ত্রীকে বলে যে, তোকে তিন তালাক বা এইরূপ বলে ‘তোকে তালাক’ ‘তোকে তালাক’ ‘তোকে তালাক’, তবে তিন তালাক হইয়া বায়েন মোগাল্লাযা হইয়া যাইবে’।[10]
(৬) মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম বলেন, স্বামী স্ত্রীকে এক সঙ্গে কিংবা সুন্নতী নিয়মে তিন তালাক দিলে সে স্ত্রীকে ফিরিয়ে রাখার কোনো উপায় থাকে না। সে তার জন্যে হারাম হয়ে যায়, হারাম হয়ে যায়- বলতে হবে- চিরতরে, তবে শরীয়ত একটি মাত্র উপায়ই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তা হলোঃ ‘সে স্ত্রীলোকটি অপর স্বামী বিয়ে করবে’। তারপর সেই দ্বিতীয় স্বামী যদি তালাক দেয় তার পরে যদি তারা পুনর্মিলিত হ’তে চায় এবং আল্লাহর বিধান কায়েম রাখতে পারবে বলে যদি মনে করে, তাহলে তাদের দু’জনের পুনরায় বিবাহিত হতে কোন দোষ নেই’ (বাক্বারাহ ২৩০)।
কিন্তু যদি রাগের বশবর্তী হয়ে অথবা পরিণাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে একসঙ্গে তিন তালাকই দিয়ে দেয়,...এরপর যে দুঃখ ও অনুতাপ জাগে স্বামীর অন্তরে, তার প্রতিকারের কোনো উপায়ই থাকে না তার হাতে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, তিন তালাক দেওয়ার পরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা বসবাস করতে থাকে। এ হচ্ছে সুস্পষ্টরূপে জ্বিনার অবস্থা, নিঃসন্দেহে তা’ হারাম। তাই কোনো লোকেরই এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়া উচিত নয়। এর পরিণাম তালাকদাতা স্বামীকেই ভোগ করতে হয়। আর সে পরিণাম অত্যন্ত দুঃখময়, নিতান্ত অবাঞ্ছনীয় এবং অত্যন্ত মর্মাান্তিক।[11]
মন্তব্য : সকলের একই দলীয় সুর। অহি-র বিধানকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করার অপচেষ্টা মাত্র। অথচ ঈমানের দাবী হ’ল- অহি-র বিধানের পক্ষে যুক্তি পেশ করা, বিপক্ষে নয়। অহেতুক বিতর্ক নয়, কিতাব ও সুন্নাতের প্রতি অটুট আনুগত্যের মধ্যেই ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি নিহিত।
[1]. মুসনাদে আহমাদ ২/৯৫।
[2]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৪৭।
[3]. বঙ্গানুবাদ তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলনা মুহিউদ্দীন খান ১৪১৩ হিঃ, পৃঃ ১২৮।
[4]. তাফহীমুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মুজাম্মিল হক (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী ৩য় সংষ্করণ ১৯৯৭), ১৭/২১০ পৃঃ।
[5]. ঐ, বঙ্গানুবাদ পৃঃ ১৯৯-২১০।
[6]. তাফহীমুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মুজাম্মিল হক (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী ৩য় সংষ্করণ ১৯৯৭), পৃঃ ২০৩-৪।
[7]. বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী ২য় মুদ্রণ, ১৯৮৭) ৬/৩১৯-২০।
[8].বঙ্গানুবাদ : বোখারী শরীফ (ঢাকা : হামিদিয়া লাইব্রেরী, ৫ম সংষ্করণ ১৪১৭/১৯৯৭) ৬/১৬৭।
[9]. প্রাগুক্ত ৬/১৬৭-৬৮।
[10]. বঙ্গানুবাদ বেহেশতী জেওর, অনুবাদ: মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ৯ম মুদ্রণ ১৯৯০), দ্বিতীয় ভলিউম, ৪র্থ খন্ড পৃঃ ৩২।
[11]. পরিবার ও পারিবারিক জীবন (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম প্রকাশ ১৯৮৩), পৃঃ ৫৯৭, ৫৯৬।
ওমর ফারূক (রাঃ) নিজে হজ্জে তামাত্তুকে অপসন্দ করতেন। অথচ তাঁর বড় ছেলে আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হজ্জে তামাত্তু করেন। ফলে লোকেদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, أفرسولُ الله صلى الله عليه وسلم أحَقُّ أنْ يُّتَّبَعَ سنتُه ام سنةُ عُمَرَ؟ ‘রাসূলের সুন্নাত অধিক অনুসরণ যোগ্য, না ওমরের সুন্নাত? [1]
অনুরূপভাবে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, لو كان الدينُ بالرأى لكان أسفلُ الخُف أولى بالمسح من أعلاه - ‘যদি দ্বীন মানুষের রায় অনুযায়ী হ’ত, তাহ’লে মোযার উপরে মাসাহ করার চেয়ে তার নীচে মাসাহ করা অধিক উত্তম হ’ত।[2]
ওমর ফারূক (রাঃ) নিঃসন্দেহে ভাল নিয়তে কাজ করেছিলেন ও তালাকের ব্যাপারে আইনী কঠোরতা আরোপ করেছিলেন। শাসক হিসাবে এরূপ সাময়িক অধিকার ইসলামী আমীরদের রয়েছে। কিন্তু এটাতো মানতেই হবে যে, এলাহী বিধান চিরন্তন। তাই যত কঠোরতাই দেখানো হৌক না কেন, দুর্বল জীব মানুষ যেকোন সময় সীমা অতিক্রম করে যেতে পারে এবং সেটাই হয়েছে। ফলে উক্ত কঠোরতার পরিণামে নিষ্কৃতির পথ না পেয়ে তাহলীল-এর ন্যায় নোংরা পথ বেছে নিতে মুসলিম স্বামী-স্ত্রী বাধ্য হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। অতএব আমাদের উচিত ছিল কুরআনী তালাক বিধানের দিকে ফিরে যাওয়া। কিন্তু না গিয়ে একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার কঠোর ও বিদ‘আতী প্রথাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। যেমন-
(১) পাকিস্তানের প্রধান মুফতী মাওলানা মুহাম্মাদ শফী স্বীয় তাফসীরে উক্ত আয়াতের সুন্দর আলোচনা শেষে ‘একত্রে তিন তালাক’ শিরোনামে বলেন, ‘এ প্রশ্নের যুক্তিভিত্তিক উত্তর এই যে, কোন কাজের পাপ কাজ হওয়া তার প্রতিক্রিয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে না। অন্যায়ভাবে হত্যা করা পাপ হ’লেও যাকে গুলী করে বা কোন অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়, সে নিহত হয়েই যায়। এই গুলী বৈধভাবে করা হ’ল, কি অবৈধভাবে করা হয়েছে, সেজন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে না। চুরি সব ধর্মমতেই পাপ, কিন্তু যে অর্থ-সম্পদ চোরাই পথে পাচার করা হয়, তা তো হাতছাড়া হয়েই গিয়েছে। এমনিভাবে যাবতীয় অন্যায় ও পাপের একই অবস্থা যে, এর অন্যায় ও পাপ হওয়া এর প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধার সৃষ্টি করে না। এই মূলনীতির ভিত্তিতে শরী‘আত প্রদত্ত নীতি-নিয়মের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে প্রয়োজন ব্যতীত স্বীয় সমস্ত ক্ষমতাকে শেষ করে দেয়া এবং একই সঙ্গে তিন তালাক দিয়ে নিষ্কৃতি লাভ করা যদিও রাসূল (ছাঃ)-এর অসন্তুষ্টির কারণ, যা পূর্ববর্তী বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, এজন্য সমগ্র উম্মত একবাক্যে একে নিকৃষ্ট পন্থা বলে উল্লেখ করেছে এবং কেউ কেউ নাজায়েযও বলেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি কেউ এ পদক্ষেপ নেয়, তবে এর ফলাফলও তাই হবে, বৈধ পথে অগ্রসর হ’লে যা হয়। অর্থাৎ তিন তালাক হয়ে যাবে এবং শুধু প্রত্যাহার নয়, বিবাহ বন্ধন নবায়নের সুযোগও আর থাকবে না। হুযূর (সাঃ)-এর মীমাংসাই এ ব্যাপারে বড় প্রমাণ যে, তিনি অসন্তুষ্ট হয়েও তিন তালাকই কার্যকরী করেছেন। হাদীস গ্রন্থে অনুরূপ বহু ঘটনার বর্ণনা রয়েছে’।[3]
জবাব : অথচ আমরা দেখতে পাই যে, কুরআনে বর্ণিত প্রথম দু’টি তালাককে তালাক বলা হ’লেও তা বন্দুকের গুলীর মত ছিল না। কেননা তা ছিল রাজ‘ঈ তালাক। যা দিলে স্ত্রীকে ফেরৎ পাওয়া যায়। অথচ বন্দুকের গুলীতে কারু রাজ‘আত হয় না বরং মৃত্যু হয়। দ্বিতীয়তঃ রাসূল (ছাঃ) অসন্তুষ্ট হ’লেও তিন তালাক কার্যকরী করেছেন- এমন কোন বিশুদ্ধ দলীল কোথাও নেই, ইতিপূর্বের আলোচনায় যা প্রমাণিত হয়েছে।
(২) পাকিস্তানের অন্যতম খ্যাতনামা আলেম মাওলানা মওদূদী স্বীয় তাফসীরে উক্ত বিষয়ের পক্ষে যুক্তি দিয়ে গিয়ে বলেন, ‘এর উপমা দেওয়া যায় যে, কোন এক পিতা তার ছেলেকে তিন শত টাকা দিয়ে বললেন, তুমিই এ টাকার মালিক, যেভাবে ইচ্ছা তুমি এ টাকা খরচ করতে পার। এরপর তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, যে অর্থ আমি তোমাকে দিলাম তা তুমি সতর্কতার সাথে উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে খরচ করবে যাতে তা থেকে যথাযথ উপকার পেতে পার। আমার উপদেশের তোয়াক্কা না করে তুমি যদি অসতর্কভাবে অন্যায় ক্ষেত্রে তা খরচ করে কিংবা সমস্ত অর্থ একসাথে খরচ করে ফেল তাহ’লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি খরচ করার জন্য আর কোন টাকা-পয়সা তোমাকে দিব না। এখন পিতা যদি এই অর্থের পুরোটা ছেলেকে আদৌ না দেয়, তাহ’লে সে ক্ষেত্রে এসব উপদেশের কোন অর্থই হয় না। যদি এমন হয় যে, উপযুক্ত ক্ষেত্র ছাড়াই ছেলে তা খরচ করতে চাচ্ছে, কিন্তু টাকা তার পকেট থেকে বের হচ্ছে না অথবা পুরো তিন শত টাকা খরচ করে ফেলা সত্ত্বেও মাত্র একশত টাকাই তার পকেট থেকে বের হচ্ছে এবং সর্বাবস্থায় দুইশত টাকা তার পকেটেই থেকে যাচ্ছে, তাহ’লে এই উপদেশের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই’।[4]
জবাব : দুর্ভাগ্য তিনি তিনটি তালাককে তিনশত টাকার সাথে তুলনা করেছেন। টাকা যদি হারিয়ে যায় বা কেউ চুরি বা ছিনতাই করে নেয়, বা কাউকে হাদিয়া দেওয়া হয়, তাহ’লে কি টাকার উপরে কোন মালিকানা থাকে? এছাড়া টাকা একটি বস্ত্ত মাত্র, যা ফেলে দিলে চুকে গেল। কিন্তু তালাক কি তাই? তালাকের নির্দিষ্ট নিয়ম-পদ্ধতি আছে, যা না মানলে তালাক হিসাবে গণ্য হয় না। এর সঙ্গে দু’টি জীবন, সংসার ও সন্তান পালনের দায়বদ্ধতা জড়িত আছে। একে ফেলনা মনে করার কোন কারণ নেই। আর সেকারণেই রাসূল (ছাঃ) ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা হচ্ছে? আমরা কি তাই করছি না? রাসূলের এই ক্রোধকে সোজা অর্থে গ্রহণ না করে আমরা বাঁকা অর্থে গ্রহণ করেছি এবং তাঁর ক্রোধের কারণ একত্রিত তিন তালাককে আমরা তিন তালাক গণ্য করেছি। কাল ক্বিয়ামতের মাঠে রাসূল (ছাঃ) যদি ক্রুদ্ধ হয়ে শাফা‘আত না করেন, তখন বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম কি জওয়াবদিহী করবেন, ভেবে দেখেছেন কি?
উল্লেখ্য যে, মাওলানা মওদূদী স্বীয় তাফহীমুল কুরআনে সূরায়ে বাক্বারাহর উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে দীর্ঘ আলোচনার অবতারণা করেছেন[5] এবং একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার পক্ষে ৩টি হাদীছ ও অন্যূন ১১টি আছার পেশ করেছেন। পেশকৃত হাদীছ সমূহের মধ্যে তিনটিই যঈফ ও মুনকার। এরপর ছাহাবায়ে কেরামের উক্তি বা ‘আছার’গুলির প্রায় সবই মুছান্নাফে আবদুর রাযযাক, মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, মুওয়াত্ত্বা, দারাকুৎনী, আবুদাঊদ, ত্বাহাভী প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে। যার মধ্যে (ক) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে চারটি আছার-এর তিনটি ছহীহ ও যঈফ (খ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে দু’টি আছার-এর একটি যঈফ ও একটি ছহীহ (গ) হযরত ওছমান ও আলী (রাঃ) থেকে দু’টি আছার-এর একটি যঈফ ও একটি মওযূ বা জাল। বাকীগুলির অবস্থাও অনুরূপ। যে সমস্ত আছার ছহীহ সূত্রে বর্ণিত সেগুলি বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত মওকূফ হাদীছের বিরোধী হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য। মাওলানা মওদূদী ওমর (রাঃ)-এর যুগের কথিত ইজমা দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-এর ও আবুবকর (রাঃ)-এর যুগের প্রচলিত সুন্নাহকে অগ্রহণযোগ্য বলতে চেয়েছেন।[6] যা নিতান্তই অযৌক্তিক।
পক্ষান্তরে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত ও বুখারী-মুসলিম সংকলিত ছহীহ মরফূ হাদীছগুলি, যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ), আবুবকর ও ওমরের যুগের প্রথম দুই বা তিন বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত। তার পক্ষে মাওলানা কোন কথা বলেননি। তিনি বিদ‘আতী তালাকের পক্ষে যুক্তি পেশ করলেও কুরআন ও সুন্নাতে নববীর পক্ষে যুক্তি পেশ করেননি।
(৩) মিশকাত শরীফের বাংলা অনুবাদক মাওলানা নূর মোহাম্মাদ আজমী বলেন, মাহমূদ বিন লবীদের হাদীছ (১৮নং) হইতে বুঝা যায় যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া বিদ‘আত ও হারাম। তাবেয়ীনদের মধ্যে হজরত তাউছ ও ইকরেমা বলেন, যেহেতু ইহা সুন্নাতের বিপরীত অতএব ইহাকে সুন্নাত অনুসারে এক তালাকই (রজয়ী) গণ্য করিতে হইবে। ছাহাবীদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ বিন আববাছ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর ও ওমরের খেলাফতের দুই বছর কাল (একসাথে) তিন তালাক এক তালাকই ছিল। অতঃপর হযরত ওমর বলিলেন,.. সুতরাং এখন হইতে আমাদের ইহাকে (তিন তালাক রূপে) কার্যকরী করিয়া দেওয়াই উচিত’। রাবী বলেন, ‘অতঃপর তিনি উহাকে কার্যকরী করিয়াছিলেন।
কিন্তু জম্হুরে ছাহাবা, তাবেয়ীন ও ইমামগণ সকলেই বলেন, একসাথে তিন তালাক দেওয়া বেদআত ও গোনাহর কাজ, তবে ইহাতে তিন তালাক হইয়া যাইবে’।... মোটকথা, এ আলোচনা দ্বারা... দেখা গেল যে, ইহার উপর মুজতাহিদ ছাহাবীগণের ইজমা হইয়া গিয়াছে এবং পরবর্তী ইমামগণও ইহার উপর একমত হইয়াছেন।[7]
জবাব : ইজমা-এর দাবী অগ্রহণযোগ্য। কেননা ‘ইজমা’ বলতে উম্মতের ঐক্যমত বুঝায়। অথচ সকল ছাহাবী এ বিষয়ে একমত হননি। যা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। দ্বিতীয়তঃ ইজমায়ে ছাহাবা সুন্নাতে নববীকে বাতিল করতে পারে না। তৃতীয়তঃ পরবর্তী সকল ইমাম এ ব্যাপারে একমত হননি। অতএব ইজমা-র দাবী অযৌক্তিক।
(৪) বোখারী শরীফের বাংলা অনুবাদক মাওলানা আজিজুল হক ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ঃ শিরোনামে বলেন,
এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তিন তালাক প্রবর্তিত হওয়া ইহাই পূর্বাপর সকল ইমামগণের স্থির সিদ্ধান্ত।...বিশিষ্ট ইমামগণের পর উক্ত বিষয়ে ভিন্ন মতামতও দেখা দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহা অত্যন্ত দুর্বল ও সমর্থহীন এবং অতি ক্ষুদ্র একটি লা-মজহাবী উপদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দুঃখের বিষয় আখেরী যামানার ধর্মীয় বিপর্যয়ের স্রোতে ঐ দুর্বল মতামতও ভাসিয়া আসিয়াছে এবং অপেক্ষাকৃত সহজ সুলভ হওয়ায় তাহাও এক শ্রেণীর লোকের সহায়তা পুষ্ট হইয়া বহু মুখের চর্চার বস্ত্ত ইহয়া উঠিয়াছে’।[8]
তিনি বলেন, এক সঙ্গে তিন তালাক যদি শুধু এক তালাক গণ্য হইত, তবে এখানে হযরতের ঐরূপ ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির কোন কারণই ছিল না; এক তালাক দেওয়ার কোন ঘটনায় হযরত (ছাঃ) ঐরূপ রাগান্বিত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছেন বলিয়া কোথাও দেখা যায় না। ...সুতরাং একত্রে তিন তালাক দেওয়া কোরআনের বিধানে প্রাপ্ত অধিকার অনাবশ্যক প্রয়োগ করাই সাব্যস্ত হয়, যাহা কোরআন নিয়া খেলা করারই নামান্তর। কিন্তু খেলা করতঃ কাহারও উপর আঘাত করিলে সেই আঘাতের পরিণাম প্রতিক্রিয়া অবশ্যই প্রবর্তিত হয় এবং সেই জন্যই ঐরূপ খেলা রাগ ও অসন্তুষ্টি কারণ হইয়া থাকে।[9]
জবাব : এ বিষয়ে যে ভিন্নমত আছে, সেকথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাদেরকে লা-মজহাবী বলে মনের ঝাল মিটিয়েছেন। যেটা কোন মুহাদ্দিছ বিদ্বানের এবং কোন নিরপেক্ষ জ্ঞানী আলেমের আচরণ হ’তে পারে না। তিনি রাসূলের ক্রোধকে পরোয়া না করলেও আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ক্রোধ থেকে বাঁচতে চাই।
(৫) মাওলানা আশরাফ আলী থানভী বলেন, এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তাহাও তালাক। যেমন, যদি কেহ তার স্ত্রীকে বলে যে, তোকে তিন তালাক বা এইরূপ বলে ‘তোকে তালাক’ ‘তোকে তালাক’ ‘তোকে তালাক’, তবে তিন তালাক হইয়া বায়েন মোগাল্লাযা হইয়া যাইবে’।[10]
(৬) মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম বলেন, স্বামী স্ত্রীকে এক সঙ্গে কিংবা সুন্নতী নিয়মে তিন তালাক দিলে সে স্ত্রীকে ফিরিয়ে রাখার কোনো উপায় থাকে না। সে তার জন্যে হারাম হয়ে যায়, হারাম হয়ে যায়- বলতে হবে- চিরতরে, তবে শরীয়ত একটি মাত্র উপায়ই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তা হলোঃ ‘সে স্ত্রীলোকটি অপর স্বামী বিয়ে করবে’। তারপর সেই দ্বিতীয় স্বামী যদি তালাক দেয় তার পরে যদি তারা পুনর্মিলিত হ’তে চায় এবং আল্লাহর বিধান কায়েম রাখতে পারবে বলে যদি মনে করে, তাহলে তাদের দু’জনের পুনরায় বিবাহিত হতে কোন দোষ নেই’ (বাক্বারাহ ২৩০)।
কিন্তু যদি রাগের বশবর্তী হয়ে অথবা পরিণাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে একসঙ্গে তিন তালাকই দিয়ে দেয়,...এরপর যে দুঃখ ও অনুতাপ জাগে স্বামীর অন্তরে, তার প্রতিকারের কোনো উপায়ই থাকে না তার হাতে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, তিন তালাক দেওয়ার পরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা বসবাস করতে থাকে। এ হচ্ছে সুস্পষ্টরূপে জ্বিনার অবস্থা, নিঃসন্দেহে তা’ হারাম। তাই কোনো লোকেরই এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়া উচিত নয়। এর পরিণাম তালাকদাতা স্বামীকেই ভোগ করতে হয়। আর সে পরিণাম অত্যন্ত দুঃখময়, নিতান্ত অবাঞ্ছনীয় এবং অত্যন্ত মর্মাান্তিক।[11]
মন্তব্য : সকলের একই দলীয় সুর। অহি-র বিধানকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করার অপচেষ্টা মাত্র। অথচ ঈমানের দাবী হ’ল- অহি-র বিধানের পক্ষে যুক্তি পেশ করা, বিপক্ষে নয়। অহেতুক বিতর্ক নয়, কিতাব ও সুন্নাতের প্রতি অটুট আনুগত্যের মধ্যেই ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি নিহিত।
[1]. মুসনাদে আহমাদ ২/৯৫।
[2]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৪৭।
[3]. বঙ্গানুবাদ তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলনা মুহিউদ্দীন খান ১৪১৩ হিঃ, পৃঃ ১২৮।
[4]. তাফহীমুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মুজাম্মিল হক (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী ৩য় সংষ্করণ ১৯৯৭), ১৭/২১০ পৃঃ।
[5]. ঐ, বঙ্গানুবাদ পৃঃ ১৯৯-২১০।
[6]. তাফহীমুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মুজাম্মিল হক (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী ৩য় সংষ্করণ ১৯৯৭), পৃঃ ২০৩-৪।
[7]. বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী ২য় মুদ্রণ, ১৯৮৭) ৬/৩১৯-২০।
[8].বঙ্গানুবাদ : বোখারী শরীফ (ঢাকা : হামিদিয়া লাইব্রেরী, ৫ম সংষ্করণ ১৪১৭/১৯৯৭) ৬/১৬৭।
[9]. প্রাগুক্ত ৬/১৬৭-৬৮।
[10]. বঙ্গানুবাদ বেহেশতী জেওর, অনুবাদ: মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ৯ম মুদ্রণ ১৯৯০), দ্বিতীয় ভলিউম, ৪র্থ খন্ড পৃঃ ৩২।
[11]. পরিবার ও পারিবারিক জীবন (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম প্রকাশ ১৯৮৩), পৃঃ ৫৯৭, ৫৯৬।
এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার বিষয়টি অনুসরণীয় চার ইমামের প্রতি সম্বন্ধ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিষয়টিতে আমরা নিশ্চিন্ত নই। কেননা পরবর্তীকালে এমন বহু কিছু তাঁদের মাযহাব হিসাবে চালু হয়েছে, যে বিষয়ে তাঁদের থেকে কোন বিশুদ্ধ বর্ণনা সূত্র নেই। কেননা চার ইমামের মধ্যে শাফেঈ (রহঃ) ব্যতীত বাকী তিনজনের কেউই ফেক্হী বিষয়ে কোন গ্রন্থ রচনা করে যাননি। এক্ষণে তাঁদের মাযহাব বলে গৃহীত মাসআলা সমূহের সংকলন হিসাবে যে সকল বিরাট বিরাট ফিক্হগ্রন্থ পরবর্তীকালে রচিত ও প্রচারিত হয়েছে, পরীক্ষায় দেখা যাবে যে, সেগুলিতে সংকলিত অধিকাংশ মাসআলা কিংবা সবগুলোই তাঁদের অনুসারী পরবর্তী বিদ্বানগণের রচিত। আবুল ফাৎহ মুহাম্মাদ বিন আবুল হাসান ইবনু দাক্বীকুল ঈদ (মৃতঃ ৭০২ হিঃ) চার মাযহাবে প্রচলিত ছহীহ হাদীছ বিরোধী ফৎওয়া সমূহের একটি বিরাট সংকলন তৈরী করেছিলেন। যার ভূমিকাতে তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ‘এই মাসআলাগুলি চার ইমামের নামে চার মাযহাবে চালু থাকলেও এগুলোকে তাঁদের দিকে সম্পর্কিত করা হারাম’। এগুলির মাধ্যমে তাঁদের উপরে মিথ্যারোপ করা হয়েছে মাত্র’। আল্লামা তাফ্তাযানী, শা‘রাবী, অলিউল্লাহ দেহলভী, মোল্লা মুঈন সিন্ধী, আবদুল হাই লাক্ষ্ণৌবী প্রমুখ বিদ্বানগণ সকলেই একথা স্বীকার করেছেন।[1]
(১) উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হানাফী আলেম মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী একত্রিত তিন তালাক সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই অবস্থায় হানাফী মাযহাব অনুযায়ী তিন তালাক পতিত হবে এবং ‘তাহলীল’ ব্যতীত তার সাথে পূর্ব স্বামীর পুনর্বিবাহ সিদ্ধ হবে না।
কিন্তু এমন যরূরী অবস্থায় যেমন স্বামীর নিকট থেকে উক্ত মহিলার পৃথক হওয়া কঠিন কিংবা তাতে ক্ষতির আশংকা বেশী, সেই অবস্থায় অন্য কোন ইমামের তাক্বলীদ করায় ক্ষতি নেই। যেমন এর দৃষ্টান্ত রয়েছে নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর ক্ষেত্রে। এখানে হানাফীগণ ইমাম মালেক (রহঃ)-এর মাযহাব (চার বছর)-এর উপরে আমল করা জায়েয মনে করেন। তবে তিন তালাকের ক্ষেত্রে এটাই উত্তম হবে যে, ঐ ব্যক্তি যেন কোন শাফেঈ আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিয়ে তার উপরে আমল করে’ [ফাতাওয়া রশীদিয়াহ (করাচী : মুহাম্মাদ আলী কারখানায়ে কুতুব, তাবি), পৃঃ ৪৬২]।
(২) অন্যতম সেরা আলেম মাওলানা রশীদ আহমাদ গাংগোহী একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করেন এবং ‘হালাল’ ব্যতীত পুনর্বিবাহের কোন পথ খোলা নেই বলে ফৎওয়া দেন’ (ঐ, পৃঃ ৪৬২)। কিন্তু তাঁর নিজস্ব মত বা মাসলাক হিসাবে বর্ণনা করেন যে, যে মাসআলায় ছাহাবা ও মুজতাহিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, সে মাসআলায় নিজের তাহকীক অনুযায়ী বা কোন হকপন্থী মুজতাহিদ-এর তাক্বলীদকে অগ্রগণ্য মনে করে তার উপরে আমল করবে। বিরোধী মতকে কোনরূপ তিরষ্কার করবে না। বরং যরূরী অবস্থায় তার উপরে আমল করবে। এ কারণে এ দুর্বল বান্দা হানাফী মাযহাবের হওয়া সত্ত্বেও অন্য কোন মাযহাবের অনুসারীকে তিরষ্কার করে না এবং নিজের মাযহাযকেও অযথা অন্যের উপরে প্রাধ্যন্য দিতে চেষ্টিত হয় না।... প্রয়োজনে শাফেঈ মাযহাবের উপরে আমল করায় কোন দোষ নেই। তবে সেটা যেন নফসের খাহেশ পূরণের উদ্দেশ্যে না হয়। বরং যদি শারঈ দলীলের ভিত্তিতে হয় তাহ’লে তাতে কোন দোষ নেই’ (ঐ, পৃঃ ৪)।
[1]. আহলেহাদীছ আন্দোলন (ডক্টরেট থিসিস), পৃঃ ১৭২।
(১) উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হানাফী আলেম মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী একত্রিত তিন তালাক সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই অবস্থায় হানাফী মাযহাব অনুযায়ী তিন তালাক পতিত হবে এবং ‘তাহলীল’ ব্যতীত তার সাথে পূর্ব স্বামীর পুনর্বিবাহ সিদ্ধ হবে না।
কিন্তু এমন যরূরী অবস্থায় যেমন স্বামীর নিকট থেকে উক্ত মহিলার পৃথক হওয়া কঠিন কিংবা তাতে ক্ষতির আশংকা বেশী, সেই অবস্থায় অন্য কোন ইমামের তাক্বলীদ করায় ক্ষতি নেই। যেমন এর দৃষ্টান্ত রয়েছে নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর ক্ষেত্রে। এখানে হানাফীগণ ইমাম মালেক (রহঃ)-এর মাযহাব (চার বছর)-এর উপরে আমল করা জায়েয মনে করেন। তবে তিন তালাকের ক্ষেত্রে এটাই উত্তম হবে যে, ঐ ব্যক্তি যেন কোন শাফেঈ আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিয়ে তার উপরে আমল করে’ [ফাতাওয়া রশীদিয়াহ (করাচী : মুহাম্মাদ আলী কারখানায়ে কুতুব, তাবি), পৃঃ ৪৬২]।
(২) অন্যতম সেরা আলেম মাওলানা রশীদ আহমাদ গাংগোহী একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করেন এবং ‘হালাল’ ব্যতীত পুনর্বিবাহের কোন পথ খোলা নেই বলে ফৎওয়া দেন’ (ঐ, পৃঃ ৪৬২)। কিন্তু তাঁর নিজস্ব মত বা মাসলাক হিসাবে বর্ণনা করেন যে, যে মাসআলায় ছাহাবা ও মুজতাহিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, সে মাসআলায় নিজের তাহকীক অনুযায়ী বা কোন হকপন্থী মুজতাহিদ-এর তাক্বলীদকে অগ্রগণ্য মনে করে তার উপরে আমল করবে। বিরোধী মতকে কোনরূপ তিরষ্কার করবে না। বরং যরূরী অবস্থায় তার উপরে আমল করবে। এ কারণে এ দুর্বল বান্দা হানাফী মাযহাবের হওয়া সত্ত্বেও অন্য কোন মাযহাবের অনুসারীকে তিরষ্কার করে না এবং নিজের মাযহাযকেও অযথা অন্যের উপরে প্রাধ্যন্য দিতে চেষ্টিত হয় না।... প্রয়োজনে শাফেঈ মাযহাবের উপরে আমল করায় কোন দোষ নেই। তবে সেটা যেন নফসের খাহেশ পূরণের উদ্দেশ্যে না হয়। বরং যদি শারঈ দলীলের ভিত্তিতে হয় তাহ’লে তাতে কোন দোষ নেই’ (ঐ, পৃঃ ৪)।
[1]. আহলেহাদীছ আন্দোলন (ডক্টরেট থিসিস), পৃঃ ১৭২।
এই দল বলেন, সহবাসকৃত নারীর উপরে তিন তালাক বর্তাবে ও সহবাসহীন নারীর উপরে এক তালাক বর্তাবে। তাঁদের দলীল নিম্নরূপ :
(১) আবুদাঊদ বর্ণিত আবুছ ছাহবা প্রমুখাৎ ইবনু আববাসের হাদীছ, যেখানে বলা হয়েছে-
أَنَّ الرَّجُلَ كَانَ إَِذَا طَلَّقَ إِمْرَأَتَهُ ثَلاَثًا قَبْلَ أْنْ يَدْخُلَ بِهَا جَعَلُوْهَا وَاحِدَةً عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَصَدْرًا مِّنْ إِمَارَةِ عُمَرَ، فَلَمَّا رَأى عُمَرُ النَّاسَ قَدْ تَتَابَعُوْا فِيْهَا قَالَ : أجِيْزُوْهُنَّ عَلَيْهِمْ -
অর্থাৎ ‘কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীকে সহবাসের পূর্বেই তিন তালাক দিত, লোকেরা তাকে এক তালাক গণ্য করত। এই নিয়ম জারি ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় এবং আবু বকর (রাঃ)-এর যামানায় ও ওমর (রাঃ)-এর যামানার প্রথম দিকে। অতঃপর যখন ওমর উক্ত ব্যাপারে লোকদের ব্যস্ততা দেখতে পান, তখন বলেন, একত্রিত তিন তালাককে ওদের উপরে জারি করে দাও’।[1]
জবাব : উক্ত হাদীছে একটি কথা বর্ধিতভাবে এসেছে, قَبْلَ أنْ يَّدْخُلَ بِهَا অর্থাৎ ‘ঐ স্ত্রী যার সাথে স্বামী এখনও সহবাস করেনি’। আলবানী বলেন যে, এই অংশটি ‘মুনকার’ এবং ছহীহ মুসলিম-এর রেওয়াতের বিপরীত। অতএব এর অর্থ হ’ল এই যে, সহবাসকৃত হউক বা না হউক সকল বিবাহিতা নারীর ক্ষেত্রে সে যুগে একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত।[2]
(২) ওমর (রাঃ) কর্তৃক তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করায় সিদ্ধান্তটি সহবাসকৃত নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং আবুছ ছাহবা প্রমুখাৎ ইবনু আববাস বর্ণিত হাদীছটি সহবাসহীন নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এভাবেই উভয় হাদীছের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব এবং এটাই ক্বিয়াসের অনুকুলে’।
জবাব : ইবনু আববাস বর্ণিত আবুদাঊদের হাদীছের উক্ত অংশটি ‘মুনকার’। যা ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। অতঃপর ওমর ফারূক (রাঃ)-এর সিদ্ধান্তটি ইজতেহাদী। যা কুরআন ও সুন্নাহ প্রদত্ত শারঈ তালাক বিধানকে বাতিল করতে পারে না। অতএব এই দলের বক্তব্য দলীল সম্মত নয়। বিশুদ্ধ ক্বিয়াসেরও অনুকূলে নয়।
[1]. আবুদাঊদ হা/২১৯৯।
[2]. সিলসিলা যাঈফাহ হা/১১৩৩; ইরও’য়া ৭/১২২।
(১) আবুদাঊদ বর্ণিত আবুছ ছাহবা প্রমুখাৎ ইবনু আববাসের হাদীছ, যেখানে বলা হয়েছে-
أَنَّ الرَّجُلَ كَانَ إَِذَا طَلَّقَ إِمْرَأَتَهُ ثَلاَثًا قَبْلَ أْنْ يَدْخُلَ بِهَا جَعَلُوْهَا وَاحِدَةً عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَصَدْرًا مِّنْ إِمَارَةِ عُمَرَ، فَلَمَّا رَأى عُمَرُ النَّاسَ قَدْ تَتَابَعُوْا فِيْهَا قَالَ : أجِيْزُوْهُنَّ عَلَيْهِمْ -
অর্থাৎ ‘কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীকে সহবাসের পূর্বেই তিন তালাক দিত, লোকেরা তাকে এক তালাক গণ্য করত। এই নিয়ম জারি ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় এবং আবু বকর (রাঃ)-এর যামানায় ও ওমর (রাঃ)-এর যামানার প্রথম দিকে। অতঃপর যখন ওমর উক্ত ব্যাপারে লোকদের ব্যস্ততা দেখতে পান, তখন বলেন, একত্রিত তিন তালাককে ওদের উপরে জারি করে দাও’।[1]
জবাব : উক্ত হাদীছে একটি কথা বর্ধিতভাবে এসেছে, قَبْلَ أنْ يَّدْخُلَ بِهَا অর্থাৎ ‘ঐ স্ত্রী যার সাথে স্বামী এখনও সহবাস করেনি’। আলবানী বলেন যে, এই অংশটি ‘মুনকার’ এবং ছহীহ মুসলিম-এর রেওয়াতের বিপরীত। অতএব এর অর্থ হ’ল এই যে, সহবাসকৃত হউক বা না হউক সকল বিবাহিতা নারীর ক্ষেত্রে সে যুগে একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত।[2]
(২) ওমর (রাঃ) কর্তৃক তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করায় সিদ্ধান্তটি সহবাসকৃত নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং আবুছ ছাহবা প্রমুখাৎ ইবনু আববাস বর্ণিত হাদীছটি সহবাসহীন নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এভাবেই উভয় হাদীছের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব এবং এটাই ক্বিয়াসের অনুকুলে’।
জবাব : ইবনু আববাস বর্ণিত আবুদাঊদের হাদীছের উক্ত অংশটি ‘মুনকার’। যা ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। অতঃপর ওমর ফারূক (রাঃ)-এর সিদ্ধান্তটি ইজতেহাদী। যা কুরআন ও সুন্নাহ প্রদত্ত শারঈ তালাক বিধানকে বাতিল করতে পারে না। অতএব এই দলের বক্তব্য দলীল সম্মত নয়। বিশুদ্ধ ক্বিয়াসেরও অনুকূলে নয়।
[1]. আবুদাঊদ হা/২১৯৯।
[2]. সিলসিলা যাঈফাহ হা/১১৩৩; ইরও’য়া ৭/১২২।
এই দল বলেন যে, একত্রিত তিন তালাক এক তালাকে রাজ‘ঈ হিসাবে গণ্য হবে। ইদ্দতকালের মধ্যে রাজ‘আতের মাধ্যমে এবং ইদ্দত শেষ হ’লে নতুন বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীকে ফেরত নিতে পারবে। তাঁদের দলীল :
(১) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,
كَانَ الطَّلاَقُ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ اللهُ وَسَلَّمَ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَسَنَتَيْنِ مِنْ خِلاَفَةِ عُمَرَ طَلاَّقُ الثَّلاَثِ وَاحِدَةً فَقَالَ عُمَرُ : إنْ النَّاسَ قَدِ اسْتَعْجَلُوْا فِىْ أَمْرٍ كَانَتْ لَهُمْ فِِيْهِ أَنَاةٌ فَلَوْ أمْضَيْنَاهُ عَلَيْهِمْ فَأمْضَاهُ عَلَيْهِمْ فَأمْضاَهُ عَلَيْهِمْ، رواه مسلم
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথম দু’বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত। অতঃপর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বললেন, লোকেরা এমন এক বিষয়ে দ্রুততা দেখাচ্ছে, যে বিষয়ে তাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা যদি এটা তাদের উপরে জারি করে দিতাম। অতঃপর তিনি এটা তাদের উপরে জারি করে দিলেন’।[1]
মন্তব্য : এ হাদীছে স্পষ্টভাবে এসেছে যে, একত্রিত তিন তালাক এক তালাক বলে গণ্য হ’ত রাসূল (ছাঃ)-এর যামানা থেকেই। উক্ত সরল বিধান-এর অপব্যবহার দেখে ওমর ফারূক (রা:) কঠোরতা অবলম্বন করার মনস্থ করেন ও সে মতে আইন জারি করেন। রাষ্ট্রনেতা হিসাবে সামাজিক শৃংখলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তিনি সাময়িকভাবে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি এর দ্বারা আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করেননি। বরং তালাক-এর বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত: এটিকে ইজমা হিসাবে গণ্য করা যাবে না। কেননা কুরআনী নির্দেশ ও সুন্নাতের স্পষ্ট প্রমাণাদি ও ছাহাবীদের সম্মিলিত আমল মওজূদ থাকতে তার বিরুদ্ধে ইজমা অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দাবী করলেও তা গ্রাহ্য হবে না।
(২) আবু ছাহবা একদা ইবনু আববাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করেন,
أَتَعْلَمُ اَنَّمَا كَانَتِ الثُّلاَثُ تُجْعَلُ وَاحَدِةً عَلَى عَهْدِ النَّبِىِّ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَ ثَلاَثًا مِنْ إِمَارَةِ عُمَرَ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ : نَعَمْ،
‘আপনি কি জানেন যে, রালূলুল্লাহ (ছাঃ), আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথম দিকে তিন বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত? তিনি বললেন, হাঁ।[2]
(৩) মাহমূদ বিন লাবীদ বর্ণিত হাদীছ,
قل : أُخِبْرَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ رَجُلٍ طَلَّقَ اَمْرَأَتَهُ ثَلاَثَ تَطْليقاتٍ جميعًا، فَقَامَ غَضْبَانَ ثُمَّ قاَلَ : أَيُلْعَبُ بِكتابِ الله عَزَّ وَجَلَّ وَأَنَا بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ ؟ " حَتىَّ قَامَ رَجُلٌ فَقَالَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ألاَ أقْتُلُهُ ؟ . رواه النسائي -
‘তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে খবর দেওয়া হ’ল, যে তার স্ত্রীকে একত্রে তিন তালাক দিয়েছেন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং বলেন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা করা হবে? অথচ আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে আছি। একজন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি ওকে কতল করে দেব না’? [3]
মন্তব্য : কনিষ্ঠ ছাহাবী মাহমূদ বিন লাবীদ-এর উক্ত রেওয়ায়াতকে অনেকে ‘মুরসাল’ বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) দৃঢ়তার সাথে বলেন যে মাখরামাহ তার পিতা হ’তে শোনেন নি। তবে তিনি তার পিতার লিখিত কিতাব হ’তে বর্ণনা করেছেন। ইবনু মুঈনও অনুরূপ কথা বলেছেন। তাঁর থেকে ইমাম মুসলিম স্বীয় ছহীহ-তে কয়েকটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। অতএব অত্র হাদীছ ‘মুরসাল’ নয়; বরং ‘মুত্তাছিল’। হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী স্বীয় ‘বুলূগুল মারামে’ অত্র হাদীছকে ‘ছহীহ’ বলেছেন। তিনি বলেন যে, এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত।[4]
এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি তালাকের শব্দ সংখ্যা ও পদ্ধতি নিয়ে খেলা করেছে। আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করেছে। কেননা রাজ‘ঈ তালাক হিসাবে এক বা দুই তালাক দেওয়াই হ’ল আল্লাহ প্রদত্ত অহি-র বিধান। অথচ সে তা বাদ দিয়ে উক্ত বিধানকে হালকা করে দেখেছে। আর রাসূলের রাগের কারণ সেটাই। কিন্তু এর ফলে ‘তিন তালাকই প্রযোজ্য হয়েছিল’ এ দাবীর পক্ষে কোন দলীল নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে একত্রিত তিন তালাককে এক তালাকে রাজ‘ঈ গণ্য করা হ’ত বলে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে আমরা দেখে এসেছি।
(৪) কুরআনী আয়াত الطَّلاَقُ مَرَّتَانِ ‘তালাক দু’বার’ কথাটিই একত্রিত তিন তালাকের সরাসরি বিরোধী। কেননা এর অর্থ একটির পর একটি। শুধু মৌখিক শব্দে নয়; বরং পদ্ধতি ও প্রকৃতিতে। কেননা ‘মার্রাতা-ন’ অর্থ দু’বার। দু’বার অর্থ একবারের পর দ্বিতীয় বার। অর্থাৎ সহবাসহীন পবিত্র অবস্থার শুরুতে প্রথম তালাক দিবে। অতঃপর একইভাবে দ্বিতীয়বার পবিত্র হওয়ার শুরুতে দ্বিতীয় তালাক দিবে। এই দুই তালাক রাজ‘ঈ হবে। অর্থাৎ ইদ্দতকালের মধ্যে তাকে বিনা বিবাহে এবং ইদ্দতকাল শেষে হয়ে গেলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে পারবে। আয়াতের নির্গলিতার্থ এটাই। এর অর্থ কখনোই এটা নয় যে, একত্রে দুই তালাক বললেই দুই তালাক হয়ে গেল। যেমন কুরআনে অন্যত্র এসেছে ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ ‘অতঃপর তুমি তোমার দৃষ্টিকে ফিরাও দ্বিতীয়বার’ ... (মুল্ক ৬৭/৪)। এর অর্থ প্রথমবারের পর দ্বিতীয়বার। অমনিভাবে হাদীছে এসেছে, اَلْمَرْأةُ إِذَا صَلَّتْ خَمْسَهَا ‘যখন কোন মহিলা তার উপরে ফরযকৃত পাঁচ ছালাত আদায় করবে’...।[5] এর অর্থ পাঁচ ওয়াক্তে পাঁচ বার সুন্নাতী তরীকায় ছালাত আদায় করা। ছালাত ছালাত ছালাত পাঁচবার একত্রে বলা হয়। দ্বিতীয়তঃ সূরায়ে তালাক্ব-এর ১ম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা একত্রিত তিন তালাক দিলে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এভাবে কুরআনী নির্দেশ লংঘন করে একত্রিত তিন তালাক দিলে তা কিভাবে তিন তালাক হিসাবে গণ্য করা হ’তে পারে?
(৫) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,
طَلَّقَ عَبْدُ يَزِيْدَ أبُوْ رُكَانَةَ أُمَّ رُكَانَةَ، فَقَالَ لَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلِيْهِ وَسَلَّمَ : رَاجِعِ امْرأَتَكَ أُمَّ رُكَانَةَ وَإخْوَتَهُ فَقَالَ : إِنِّىْ طَلَّقْتُهَا ثَلاَثاً ياَ رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ قَدْ عَلِمْتُ، رَجِعْهاَ وَتَلاَ يَاأَيُّهَا النَبِىُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ الأية، رواه أبوداؤد- ح /২১৯৬،
وَفِىْ لَفْظٍ لِأَحْمَدَ ح /২৩৮৭: طَلَّقَ رُكَانَةُ امْرأَتَهُ ثَلاَثًا فِىْ مَجْلِسٍ وَاحِدٍ، فَحَزِنَ عَلَيْهَا حُزْنًا شَدِيْدًا، قَالَ فَسَأَلَهُ رَسُوْلُ الله صَلّى الله عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : كَيْفَ طَلَّقْتَهَا؟ قَال : طَلَّقْتُهَا ثَلاَثًا فَقَالَ : فىْْ مَجْلِسٍ وَاحِدٍ؟ قَال : نعم، قال : فَإِنَّمَا تِلْكَ وَاحِدَةً فَارْجِعْهَا إِنْ شْئْتَ، قَالَ : فَرَاجَعَهاَ -
‘আব্দু ইয়াযীদ আবু রুকানা তার স্ত্রী উম্মে রুকানাকে তালাক দেন। এতে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত হন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাব তালাক দিয়েছ? তিনি বললেন, এক মজলিসে তিন তালাক দিয়েছি। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, আমি জানি। ওটা এক তালাক হয়েছে। তুমি স্ত্রীকে ফেরত নাও। অতঃপর তিনি সূরা তালাক্ব-এর ১ম আয়াতটি পাঠ করে শুনান।[6] আবু ইয়ালা একে ছহীহ বলেছেন।
মন্তব্য : ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, রুকানার এ হাদীছকে অনেকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের কারণে। কিন্তু অনুরূপ সনদে তারাই আবার বিভিন্ন আহকাম বিষয়ে দলীল গ্রহণ করেছেন।[7] তবে অত্র হাদীছ সনদ ও মতন উভয় দিক দিয়ে ছহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছে আবুদাঊদ স্বীয় সুনানে[8] এবং আব্দুর রাযযাক স্বীয় মুছান্নাকে ইবনু জুরাইজের সূত্রে জনৈক বনূ রাফে‘ হ’তে, অতঃপর ইকরিমা অতঃপর ইবনু আববাস হ’তে। আহমাদ বর্ণনা করেছে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের সূত্রে এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বিশ্বস্ত’।[9]
উল্লেখ্য যে, আবুদাঊদ অন্য সূত্রে উক্ত হাদীছ বর্ণনা করেন। যেখানে البةة ) ‘আলবাত্তাতা’ শব্দ এসেছে (হা/২২০৮)। যার অর্থ ‘নিশ্চিত তালাক’। রাসূল (ছাঃ) তাকে কসম করতে বলেন, তখন তিনি বলেন যে, আমি এক তালাকের নিয়ত করেছিলাম। বলে রাসূল (ছাঃ) তাকে তার স্ত্রী ফেরৎ নিতে বলেন। এক্ষণে প্রশ্ন: যদি ঐ ব্যক্তি একত্রিত তিন তালাক বায়েন দেওয়ার নিয়ত করত, তাহ’লে তাই-ই পতিত হ’ত।
জবাব : হাদীছটি ‘মুযত্বারাব’। ইমাম আহমাদ বলেন, এর সকল সূত্রই যঈফ। ইমাম বুখারীও একে ‘যঈফ’ বলেছেন।[10]
[1].মুসলিম হা/ ১৪৭২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৯।
[2]. মুসলিম হা/১৪৭৩।
[3]. নাসাঈ হা/৩৪৩০।
[4]. মুহাল্লা ৯/৩৮৮ টীকা; মাসআলা ১৯৪৫; যাদুল মা‘আদ ৫/২২০-২১।
[5].মিশকাত হা/৩২৫৪।
[6]. আবুদাঊদ হা/২১৯৬; আহমাদ হা/২৩৮৭; আওনুল মা‘বূদ ৬/২৭৯; যাদুল মা‘আদ ৫/২২৯।
[7]. নায়লুল আওত্বার ৮/২১।
[8]. ছহীহ আবু দাউদ হা/১৯২২।
[9]. হাশিয়া মুহাল্লা ৯/৩৯১।
[10]. যাদুল মা‘আদ ৫/২৪১; ইরওয়াউল গালীল হা/২০৬৩, ৭/১৩৯।
(১) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,
كَانَ الطَّلاَقُ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ اللهُ وَسَلَّمَ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَسَنَتَيْنِ مِنْ خِلاَفَةِ عُمَرَ طَلاَّقُ الثَّلاَثِ وَاحِدَةً فَقَالَ عُمَرُ : إنْ النَّاسَ قَدِ اسْتَعْجَلُوْا فِىْ أَمْرٍ كَانَتْ لَهُمْ فِِيْهِ أَنَاةٌ فَلَوْ أمْضَيْنَاهُ عَلَيْهِمْ فَأمْضَاهُ عَلَيْهِمْ فَأمْضاَهُ عَلَيْهِمْ، رواه مسلم
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথম দু’বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত। অতঃপর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বললেন, লোকেরা এমন এক বিষয়ে দ্রুততা দেখাচ্ছে, যে বিষয়ে তাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা যদি এটা তাদের উপরে জারি করে দিতাম। অতঃপর তিনি এটা তাদের উপরে জারি করে দিলেন’।[1]
মন্তব্য : এ হাদীছে স্পষ্টভাবে এসেছে যে, একত্রিত তিন তালাক এক তালাক বলে গণ্য হ’ত রাসূল (ছাঃ)-এর যামানা থেকেই। উক্ত সরল বিধান-এর অপব্যবহার দেখে ওমর ফারূক (রা:) কঠোরতা অবলম্বন করার মনস্থ করেন ও সে মতে আইন জারি করেন। রাষ্ট্রনেতা হিসাবে সামাজিক শৃংখলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তিনি সাময়িকভাবে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি এর দ্বারা আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করেননি। বরং তালাক-এর বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত: এটিকে ইজমা হিসাবে গণ্য করা যাবে না। কেননা কুরআনী নির্দেশ ও সুন্নাতের স্পষ্ট প্রমাণাদি ও ছাহাবীদের সম্মিলিত আমল মওজূদ থাকতে তার বিরুদ্ধে ইজমা অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দাবী করলেও তা গ্রাহ্য হবে না।
(২) আবু ছাহবা একদা ইবনু আববাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করেন,
أَتَعْلَمُ اَنَّمَا كَانَتِ الثُّلاَثُ تُجْعَلُ وَاحَدِةً عَلَى عَهْدِ النَّبِىِّ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَ ثَلاَثًا مِنْ إِمَارَةِ عُمَرَ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ : نَعَمْ،
‘আপনি কি জানেন যে, রালূলুল্লাহ (ছাঃ), আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথম দিকে তিন বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত? তিনি বললেন, হাঁ।[2]
(৩) মাহমূদ বিন লাবীদ বর্ণিত হাদীছ,
قل : أُخِبْرَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ رَجُلٍ طَلَّقَ اَمْرَأَتَهُ ثَلاَثَ تَطْليقاتٍ جميعًا، فَقَامَ غَضْبَانَ ثُمَّ قاَلَ : أَيُلْعَبُ بِكتابِ الله عَزَّ وَجَلَّ وَأَنَا بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ ؟ " حَتىَّ قَامَ رَجُلٌ فَقَالَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ألاَ أقْتُلُهُ ؟ . رواه النسائي -
‘তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে খবর দেওয়া হ’ল, যে তার স্ত্রীকে একত্রে তিন তালাক দিয়েছেন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং বলেন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা করা হবে? অথচ আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে আছি। একজন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি ওকে কতল করে দেব না’? [3]
মন্তব্য : কনিষ্ঠ ছাহাবী মাহমূদ বিন লাবীদ-এর উক্ত রেওয়ায়াতকে অনেকে ‘মুরসাল’ বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) দৃঢ়তার সাথে বলেন যে মাখরামাহ তার পিতা হ’তে শোনেন নি। তবে তিনি তার পিতার লিখিত কিতাব হ’তে বর্ণনা করেছেন। ইবনু মুঈনও অনুরূপ কথা বলেছেন। তাঁর থেকে ইমাম মুসলিম স্বীয় ছহীহ-তে কয়েকটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। অতএব অত্র হাদীছ ‘মুরসাল’ নয়; বরং ‘মুত্তাছিল’। হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী স্বীয় ‘বুলূগুল মারামে’ অত্র হাদীছকে ‘ছহীহ’ বলেছেন। তিনি বলেন যে, এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত।[4]
এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি তালাকের শব্দ সংখ্যা ও পদ্ধতি নিয়ে খেলা করেছে। আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করেছে। কেননা রাজ‘ঈ তালাক হিসাবে এক বা দুই তালাক দেওয়াই হ’ল আল্লাহ প্রদত্ত অহি-র বিধান। অথচ সে তা বাদ দিয়ে উক্ত বিধানকে হালকা করে দেখেছে। আর রাসূলের রাগের কারণ সেটাই। কিন্তু এর ফলে ‘তিন তালাকই প্রযোজ্য হয়েছিল’ এ দাবীর পক্ষে কোন দলীল নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে একত্রিত তিন তালাককে এক তালাকে রাজ‘ঈ গণ্য করা হ’ত বলে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে আমরা দেখে এসেছি।
(৪) কুরআনী আয়াত الطَّلاَقُ مَرَّتَانِ ‘তালাক দু’বার’ কথাটিই একত্রিত তিন তালাকের সরাসরি বিরোধী। কেননা এর অর্থ একটির পর একটি। শুধু মৌখিক শব্দে নয়; বরং পদ্ধতি ও প্রকৃতিতে। কেননা ‘মার্রাতা-ন’ অর্থ দু’বার। দু’বার অর্থ একবারের পর দ্বিতীয় বার। অর্থাৎ সহবাসহীন পবিত্র অবস্থার শুরুতে প্রথম তালাক দিবে। অতঃপর একইভাবে দ্বিতীয়বার পবিত্র হওয়ার শুরুতে দ্বিতীয় তালাক দিবে। এই দুই তালাক রাজ‘ঈ হবে। অর্থাৎ ইদ্দতকালের মধ্যে তাকে বিনা বিবাহে এবং ইদ্দতকাল শেষে হয়ে গেলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে পারবে। আয়াতের নির্গলিতার্থ এটাই। এর অর্থ কখনোই এটা নয় যে, একত্রে দুই তালাক বললেই দুই তালাক হয়ে গেল। যেমন কুরআনে অন্যত্র এসেছে ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ ‘অতঃপর তুমি তোমার দৃষ্টিকে ফিরাও দ্বিতীয়বার’ ... (মুল্ক ৬৭/৪)। এর অর্থ প্রথমবারের পর দ্বিতীয়বার। অমনিভাবে হাদীছে এসেছে, اَلْمَرْأةُ إِذَا صَلَّتْ خَمْسَهَا ‘যখন কোন মহিলা তার উপরে ফরযকৃত পাঁচ ছালাত আদায় করবে’...।[5] এর অর্থ পাঁচ ওয়াক্তে পাঁচ বার সুন্নাতী তরীকায় ছালাত আদায় করা। ছালাত ছালাত ছালাত পাঁচবার একত্রে বলা হয়। দ্বিতীয়তঃ সূরায়ে তালাক্ব-এর ১ম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা একত্রিত তিন তালাক দিলে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এভাবে কুরআনী নির্দেশ লংঘন করে একত্রিত তিন তালাক দিলে তা কিভাবে তিন তালাক হিসাবে গণ্য করা হ’তে পারে?
(৫) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,
طَلَّقَ عَبْدُ يَزِيْدَ أبُوْ رُكَانَةَ أُمَّ رُكَانَةَ، فَقَالَ لَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلِيْهِ وَسَلَّمَ : رَاجِعِ امْرأَتَكَ أُمَّ رُكَانَةَ وَإخْوَتَهُ فَقَالَ : إِنِّىْ طَلَّقْتُهَا ثَلاَثاً ياَ رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ قَدْ عَلِمْتُ، رَجِعْهاَ وَتَلاَ يَاأَيُّهَا النَبِىُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ الأية، رواه أبوداؤد- ح /২১৯৬،
وَفِىْ لَفْظٍ لِأَحْمَدَ ح /২৩৮৭: طَلَّقَ رُكَانَةُ امْرأَتَهُ ثَلاَثًا فِىْ مَجْلِسٍ وَاحِدٍ، فَحَزِنَ عَلَيْهَا حُزْنًا شَدِيْدًا، قَالَ فَسَأَلَهُ رَسُوْلُ الله صَلّى الله عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : كَيْفَ طَلَّقْتَهَا؟ قَال : طَلَّقْتُهَا ثَلاَثًا فَقَالَ : فىْْ مَجْلِسٍ وَاحِدٍ؟ قَال : نعم، قال : فَإِنَّمَا تِلْكَ وَاحِدَةً فَارْجِعْهَا إِنْ شْئْتَ، قَالَ : فَرَاجَعَهاَ -
‘আব্দু ইয়াযীদ আবু রুকানা তার স্ত্রী উম্মে রুকানাকে তালাক দেন। এতে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত হন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাব তালাক দিয়েছ? তিনি বললেন, এক মজলিসে তিন তালাক দিয়েছি। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, আমি জানি। ওটা এক তালাক হয়েছে। তুমি স্ত্রীকে ফেরত নাও। অতঃপর তিনি সূরা তালাক্ব-এর ১ম আয়াতটি পাঠ করে শুনান।[6] আবু ইয়ালা একে ছহীহ বলেছেন।
মন্তব্য : ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, রুকানার এ হাদীছকে অনেকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের কারণে। কিন্তু অনুরূপ সনদে তারাই আবার বিভিন্ন আহকাম বিষয়ে দলীল গ্রহণ করেছেন।[7] তবে অত্র হাদীছ সনদ ও মতন উভয় দিক দিয়ে ছহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছে আবুদাঊদ স্বীয় সুনানে[8] এবং আব্দুর রাযযাক স্বীয় মুছান্নাকে ইবনু জুরাইজের সূত্রে জনৈক বনূ রাফে‘ হ’তে, অতঃপর ইকরিমা অতঃপর ইবনু আববাস হ’তে। আহমাদ বর্ণনা করেছে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের সূত্রে এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বিশ্বস্ত’।[9]
উল্লেখ্য যে, আবুদাঊদ অন্য সূত্রে উক্ত হাদীছ বর্ণনা করেন। যেখানে البةة ) ‘আলবাত্তাতা’ শব্দ এসেছে (হা/২২০৮)। যার অর্থ ‘নিশ্চিত তালাক’। রাসূল (ছাঃ) তাকে কসম করতে বলেন, তখন তিনি বলেন যে, আমি এক তালাকের নিয়ত করেছিলাম। বলে রাসূল (ছাঃ) তাকে তার স্ত্রী ফেরৎ নিতে বলেন। এক্ষণে প্রশ্ন: যদি ঐ ব্যক্তি একত্রিত তিন তালাক বায়েন দেওয়ার নিয়ত করত, তাহ’লে তাই-ই পতিত হ’ত।
জবাব : হাদীছটি ‘মুযত্বারাব’। ইমাম আহমাদ বলেন, এর সকল সূত্রই যঈফ। ইমাম বুখারীও একে ‘যঈফ’ বলেছেন।[10]
[1].মুসলিম হা/ ১৪৭২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৯।
[2]. মুসলিম হা/১৪৭৩।
[3]. নাসাঈ হা/৩৪৩০।
[4]. মুহাল্লা ৯/৩৮৮ টীকা; মাসআলা ১৯৪৫; যাদুল মা‘আদ ৫/২২০-২১।
[5].মিশকাত হা/৩২৫৪।
[6]. আবুদাঊদ হা/২১৯৬; আহমাদ হা/২৩৮৭; আওনুল মা‘বূদ ৬/২৭৯; যাদুল মা‘আদ ৫/২২৯।
[7]. নায়লুল আওত্বার ৮/২১।
[8]. ছহীহ আবু দাউদ হা/১৯২২।
[9]. হাশিয়া মুহাল্লা ৯/৩৯১।
[10]. যাদুল মা‘আদ ৫/২৪১; ইরওয়াউল গালীল হা/২০৬৩, ৭/১৩৯।
১ম দলের বক্তব্য পরিস্কার। তাঁরা কুরআনী আয়াতসমূহ ও হাদীছসমূহকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং বিদ‘আতী তালাককে বাতিল গণ্য করেছেন। ২য় দলের বক্তব্যে তাবীলের আশ্রয় স্পষ্ট। এখানে স্ব স্ব রায়-এর পক্ষে দলীলকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতদ্ব্যতীত ওমর (রাঃ)-এর ইজতেহাদী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাময়িকভাবে জারি করা কঠোর প্রশাসনিক নির্দেশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ৩য় দলের বক্তব্য রেওয়ায়াত ও দিরায়াত-এর বিরোধী। ৪র্থ দলের বক্তব্য কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগের সাথে সামঞ্জস্যশীল।
মিসর ও সিরিয়াতে শেষোক্ত দলের বক্তব্য সরকারী আইন হিসাবে স্বীকৃত। যেমন সিরীয় আইনের ৯১ ধারায় বলা হয়েছে যে, স্বামী তার স্ত্রীকে তিনটি তালাক দেওয়ার অধিকার রাখে। ৯২ ধারায় বলা হয়েছে যে, শাব্দিকভাবে হৌক বা ইঙ্গিতে হৌক কয়েকটি তালাক একত্রে মিলিতভাবে দিলে তদ্বারা একটির বেশী পতিত হবে না।[1]
১৯৬১ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তিত মুসলিম পারবারিক আইনেও এর স্বীকৃতি মেলে। বাংলাদেশেও উক্ত আইন সরকারীভাবে চালু আছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশে তালাক আল-আহসান বা তালাক আল-হাসানের সহিত তালাক আল-বিদাতের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। কারণ এই অর্ডিন্যান্সের বিধান অনুযায়ী তালাক যে প্রকারেই ঘোষণা করা হোক না কেন উহা সঙ্গে সঙ্গে বলবৎ হবে না। তালাক ঘোষণার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে যে দিন নোটিশ প্রদান করা হবে সেদিন হ’তে ৯০ দিন অতিবাহিত হবার পর তালাক বলবৎ হবে’।[2]
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে, ‘যে কোন আকারে তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্র সম্ভব বিষয়টি লিখিতভাবে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়্যারম্যানকে জানাতে হবে এবং চেয়াম্যানকে প্রদত্ত লিখিত নোটিশের এক কপি নকল অপর পক্ষকে (স্বামী বা স্ত্রী) দিতে হবে। এই নোটিশ দেয়ার বিধান অমান্য করলে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার শাস্তি হবে’।
তালাক যে পক্ষই দিক না কেন, যেদিন চেয়ারম্যানকে নোটিশ দেয়া হবে, সেদিন থেকে নববই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক বলবৎ হবে না। তবে স্বামী তালাক দিয়ে থাকলে এবং তালাকের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে নববই দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত এ দু’টির মধ্যে যে মেয়াদটি দীর্ঘতর, সেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর তালাক বলবৎ হবে।
নোটিশ পাবার দিন হ’তে তিরিশ দিন সময়ের মধ্যে চেয়ারম্যান একটি শালিশী পরিষদ গঠন করবে। চেয়ারম্যান, একজন স্বামীর প্রতিনিধি এবং একজন স্ত্রীর প্রতিনিধি এই তিন জনকে নিয়ে শালিশী পরিষদ গঠিত হবে। এই পরিষদ স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ মিটিয়ে তাদেরকে তালাক হ’তে বিরত থাকতে রাজী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
পারিবারিক আইন অর্ডিন্যান্সের এই বিধানটি পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা নিসার ৩৫ নং আয়াতের নির্দেশ অনুসারে প্রণয়ন করা হয়েছে।[3]
[1]. আল-ফিক্বহুস ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহূ (বৈরুত : দারুল ফিক্র ৩য় সংস্করণ ১৯৮৯), পৃঃ ৪০৭।
[2]. এস,বি. রহিম, মুসলিম জুরিসপ্রুডেন্স, ২য় সংষ্করণ ১৯৭৬, পৃঃ ১৪৯; 7/(3) Takaq: Sub-scction (5), a talaq,....shall not be effective until the expiration of nintey days from the day on which notice under sub-section (1) is delivered to the Chairman.
Modes of talaq: Talaq-i-bidaat, as in actual practice now-a-days, consists in the pronouncement of 3 talaqs in one sitting which immediately therefter severs the marriage tie and the divorce becomes irrevocale (Talaq-i-bain). This from has its sanction under Hanafi Law and not recognised by the Shia as also the shafi schools. The Muslim Family Laws Ordinace, 1961, PP. 60-62.
[3]. ওসমান গণি, মুসলিম আইন (ঢাকা : খোশরোজ কিতাব মহল, ২য় সংষ্করণ ১৯৭৩), পৃঃ ১১৬-১৭। 7/(3) Talaq: (4) Within thirty days of the receipt of notice under sub-Section (1). The Chairman shall constitute an Arbitration Council for the purposee of bringing about a reconcilliation between the parties, and the Arbiration Council shall take all steps necessary to bring about such reconciliation. The Muslim Family Laws Ordinance, 1961. pp. 60.
মিসর ও সিরিয়াতে শেষোক্ত দলের বক্তব্য সরকারী আইন হিসাবে স্বীকৃত। যেমন সিরীয় আইনের ৯১ ধারায় বলা হয়েছে যে, স্বামী তার স্ত্রীকে তিনটি তালাক দেওয়ার অধিকার রাখে। ৯২ ধারায় বলা হয়েছে যে, শাব্দিকভাবে হৌক বা ইঙ্গিতে হৌক কয়েকটি তালাক একত্রে মিলিতভাবে দিলে তদ্বারা একটির বেশী পতিত হবে না।[1]
১৯৬১ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তিত মুসলিম পারবারিক আইনেও এর স্বীকৃতি মেলে। বাংলাদেশেও উক্ত আইন সরকারীভাবে চালু আছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশে তালাক আল-আহসান বা তালাক আল-হাসানের সহিত তালাক আল-বিদাতের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। কারণ এই অর্ডিন্যান্সের বিধান অনুযায়ী তালাক যে প্রকারেই ঘোষণা করা হোক না কেন উহা সঙ্গে সঙ্গে বলবৎ হবে না। তালাক ঘোষণার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে যে দিন নোটিশ প্রদান করা হবে সেদিন হ’তে ৯০ দিন অতিবাহিত হবার পর তালাক বলবৎ হবে’।[2]
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে, ‘যে কোন আকারে তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্র সম্ভব বিষয়টি লিখিতভাবে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়্যারম্যানকে জানাতে হবে এবং চেয়াম্যানকে প্রদত্ত লিখিত নোটিশের এক কপি নকল অপর পক্ষকে (স্বামী বা স্ত্রী) দিতে হবে। এই নোটিশ দেয়ার বিধান অমান্য করলে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার শাস্তি হবে’।
তালাক যে পক্ষই দিক না কেন, যেদিন চেয়ারম্যানকে নোটিশ দেয়া হবে, সেদিন থেকে নববই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক বলবৎ হবে না। তবে স্বামী তালাক দিয়ে থাকলে এবং তালাকের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে নববই দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত এ দু’টির মধ্যে যে মেয়াদটি দীর্ঘতর, সেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর তালাক বলবৎ হবে।
নোটিশ পাবার দিন হ’তে তিরিশ দিন সময়ের মধ্যে চেয়ারম্যান একটি শালিশী পরিষদ গঠন করবে। চেয়ারম্যান, একজন স্বামীর প্রতিনিধি এবং একজন স্ত্রীর প্রতিনিধি এই তিন জনকে নিয়ে শালিশী পরিষদ গঠিত হবে। এই পরিষদ স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ মিটিয়ে তাদেরকে তালাক হ’তে বিরত থাকতে রাজী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
পারিবারিক আইন অর্ডিন্যান্সের এই বিধানটি পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা নিসার ৩৫ নং আয়াতের নির্দেশ অনুসারে প্রণয়ন করা হয়েছে।[3]
[1]. আল-ফিক্বহুস ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহূ (বৈরুত : দারুল ফিক্র ৩য় সংস্করণ ১৯৮৯), পৃঃ ৪০৭।
[2]. এস,বি. রহিম, মুসলিম জুরিসপ্রুডেন্স, ২য় সংষ্করণ ১৯৭৬, পৃঃ ১৪৯; 7/(3) Takaq: Sub-scction (5), a talaq,....shall not be effective until the expiration of nintey days from the day on which notice under sub-section (1) is delivered to the Chairman.
Modes of talaq: Talaq-i-bidaat, as in actual practice now-a-days, consists in the pronouncement of 3 talaqs in one sitting which immediately therefter severs the marriage tie and the divorce becomes irrevocale (Talaq-i-bain). This from has its sanction under Hanafi Law and not recognised by the Shia as also the shafi schools. The Muslim Family Laws Ordinace, 1961, PP. 60-62.
[3]. ওসমান গণি, মুসলিম আইন (ঢাকা : খোশরোজ কিতাব মহল, ২য় সংষ্করণ ১৯৭৩), পৃঃ ১১৬-১৭। 7/(3) Talaq: (4) Within thirty days of the receipt of notice under sub-Section (1). The Chairman shall constitute an Arbitration Council for the purposee of bringing about a reconcilliation between the parties, and the Arbiration Council shall take all steps necessary to bring about such reconciliation. The Muslim Family Laws Ordinance, 1961. pp. 60.
মনে করুন ২য় দলের ছেলের সাথে ৪র্থ দলের মেয়ের বিবাহ হ’ল। কিন্তু দু’বছর পরেই স্বামী তার স্ত্রীকে একত্রে তিন তালাক দিল এবং স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিল। অল্পদিন পরেই উভয়ের মধ্যে অনুশোচনা জাগলো এবং পুনর্বিবাহের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। ২য় দলের ছেলের পিতা তাহলীল-এর শর্ত আরোপ করেন। পক্ষান্তরে ৪র্থ দলের মেয়ের পিতা বিনা তাহলীলেই জামাইয়ের নিকটে মেয়েকে ফেরত দিতে চান। এমতাবস্থায় ইসলামী আদালতের বিচারক কি বিচার করবেন? কারণ ছেলে ও মেয়ের মাযহাব এক নয়। অথচ দু’টি জীবন মিলেই একটি সংসার। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মাযহাবকে অক্ষুণ্ণ রাখতে গেলে সংসার জীবন বিপর্যস্ত হবে। এমতাবস্থায় দেশের অধিকাংশ মুসলমান-এর মাযহাব অনুযায়ী গঠিত সংবিধান মোতাবেক যদি আদালত ‘তাহলীল’-এর পক্ষে রায় দেন, তাহ’লে ৪র্থ দলের মেয়ের বাবা রাযী হবেন কি? অথবা আদালত দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী তাহলীল ছাড়াই পুনর্বিবাহের নির্দেশ দিবেন। অধিকাংশের রায়-কে এড়িয়ে আদালত সে রিস্ক নিতে যাবেন কি-না, সেটাই বিচার্য বিষয়। দেশে ইসলামী বিধান জারি করতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলি বিষয়টি আগেই ফায়ছালা করুন।
পরিশেষে বলা চলে যে, তালাক দু’বার অর্থ কেবল মুখে দু’বার বলা নয়; বরং সূরায়ে বাক্বারাহ ও সূরায়ে তালাক্বে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী ইদ্দত পালনের উদ্দেশ্যে তালাক দিতে হবে এবং ফিরে পাবার সকল সুযোগ খুলে রাখতে হবে। নইলে স্রেফ মুখে তালাক তালাক তালাক তিনবার বললে ‘তালাকে বায়েন’ হবে না। যেমন মুখে ছালাত ছালাত ছালাত পাঁচবার বললে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের ফরয আদায় হয় না।
ইতিপূর্বে বর্ণিত বিদ্বানদের চারটি দলের মধ্যে প্রথম দল তালাকের সংখ্যাকেই কোন গুরুত্ব দেননি। এতে তালাকের সংখ্যাগত গুরুত্বকে লঘু করে দেখা হয়েছে। ২য় দল তালাক-এর সংখ্যাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এতে তালাকের নিয়ম-পদ্ধতিকে হালকা করে দেখা হয়েছে। ফলে তালাকের অন্তর্নিহিত সামাজিক উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে এবং তালাকের কুরআনী পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। ৩য় দলের আলোচনা অগ্রহণযোগ্য। ৪র্থ দল সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে প্রচলিত তালাক বিধানের দিকে ফিরে গেছেন।
ইতিপূর্বে বর্ণিত বিদ্বানদের চারটি দলের মধ্যে প্রথম দল তালাকের সংখ্যাকেই কোন গুরুত্ব দেননি। এতে তালাকের সংখ্যাগত গুরুত্বকে লঘু করে দেখা হয়েছে। ২য় দল তালাক-এর সংখ্যাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এতে তালাকের নিয়ম-পদ্ধতিকে হালকা করে দেখা হয়েছে। ফলে তালাকের অন্তর্নিহিত সামাজিক উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে এবং তালাকের কুরআনী পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। ৩য় দলের আলোচনা অগ্রহণযোগ্য। ৪র্থ দল সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ ও রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে প্রচলিত তালাক বিধানের দিকে ফিরে গেছেন।
যেহেতু বিদ্বানগণ একত্রিত তিন তালাক-এর ব্যাপারে মতভেদ করেছেন এবং কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়েছেন, সে কারণ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আমাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে যেতে হবে এবং নিরপেক্ষতার দাবীও সেটাই। তাছাড়া তাতে পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণ নিঃসন্দেহে বেশী। যেমন আল্লাহ বলেন,
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً -
‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে ঝগড়া কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটাই হবে উত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা’ (নিসা ৪/৫৯)। নইলে তিন তালাকের শব্দের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করতে গিয়ে স্বামী ও স্ত্রীকে তাহলীলের মত নোংরা পথের দিকে ঠেলে দিতে হবে, যা কারু কাম্য নয়।
অতএব আসুন! আমরা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে ফিরে যাই এবং নিজেদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে শান্তিময় করে তুলি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। -আমীন!!
هذا الذى ادَّى إليه علمُنَا + وبه ندين الله كلَّ زمانِ
أراد الله تيسرًا وأنْتُمْ + من التعسير عندكم ضروبُ
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً -
‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে ঝগড়া কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটাই হবে উত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা’ (নিসা ৪/৫৯)। নইলে তিন তালাকের শব্দের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করতে গিয়ে স্বামী ও স্ত্রীকে তাহলীলের মত নোংরা পথের দিকে ঠেলে দিতে হবে, যা কারু কাম্য নয়।
অতএব আসুন! আমরা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে ফিরে যাই এবং নিজেদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে শান্তিময় করে তুলি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। -আমীন!!
هذا الذى ادَّى إليه علمُنَا + وبه ندين الله كلَّ زمانِ
أراد الله تيسرًا وأنْتُمْ + من التعسير عندكم ضروبُ
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন