HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইক্বামতে দ্বীন পথ ও পদ্ধতি

লেখকঃ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
ইক্বামতে দ্বীন পথ ও পদ্ধতি

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ

নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,

হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ১৯

ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,

মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০

১ম প্রকাশ : মার্চ ২০১৪ খ্রিঃ

নির্ধারিত মূল্য : ১২ টাকা মাত্র।

প্রথম ভাগ ইক্বামতে দ্বীন
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ -

অনুবাদ : ‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমরা প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি ও যার আদেশ দিয়েছিলাম আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর ও তার মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। আপনি মুশরিকদের যে বিষয়ের দিকে আহবান জানান, তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং তিনি পথ প্রদর্শন করেন ঐ ব্যক্তিকে, যে তাঁর দিকে প্রণত হয়’ (শূরা ১৩)।

শাব্দিক ব্যাখ্যা : (১) আক্বীমুদ্দীনা অর্থ : ‘তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর’। أَقَامَ يُقِيْمُ إِقَامَةً অর্থ দাঁড় করানো, প্রতিষ্ঠিত করা। باب إفعال থেকে أمر حاضر معروف বহুবচনে أَقِيْمُوْا ‘তোমরা দাঁড় করাও বা প্রতিষ্ঠিত কর’। দ্বীন ( دِيْنٌ ) অর্থ : ‘তাওহীদ এবং আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ সকল কাজ’। এর আরও অনেকগুলি অর্থ রয়েছে। যেমন : হিসাব-নিকাশ, আত্মসমর্পণ, মিল্লাত, আদত, হালত, সীরাত, অধিকার, শক্তি, শাসন, নির্দেশ, ফায়ছালা, আনুগত্য, পরহেযগারী, বদলা, বিজয়, গ্লানি, গোনাহ, যবরদস্তি, বাধ্যতা, অবাধ্যতা ইত্যাদি।[1] অত্র আয়াতে ‘দ্বীন’ অর্থ হ’ল توحيد الله وطاعته ‘আল্লাহর একত্ব ও তাঁর প্রতি আনুগত্য’।[2]

(২) অলা তাতাফার্রাকূ ফীহি অর্থ- ‘তোমরা এর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’। فَرَقَ يَفْرِقُ فَرْقًا وَفُرْقَانًا অর্থ- পৃথক করা। এখানে ‘ফারকুন’ ধাতু হ’তে باب تفعّل -এর আদেশসূচক ক্রিয়া হয়েছে। উক্ত বাব-এর خاصه বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ধাতুর অর্থ ‘স্বরূপে প্রকাশিত হওয়া’র অর্থে আয়াতের মর্ম দাঁড়ায় ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে দলে দলে বিভক্ত হয়ো না’।

ব্যাখ্যা : প্রথমেই দু’টি ‘আয়াতে মুতাশা-বিহাহ’ সহ সর্বমোট ৫০টি আয়াত সমৃদ্ধ এই মাক্কী সূরাটিতে অন্যান্য মাক্কী সূরার ন্যায় মূলতঃ আক্বীদা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচ্য ১৩ নং আয়াতে বর্ণিত ইক্বামতে দ্বীন বা তাওহীদ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিই হ’ল অত্র সূরার মুখ্য বিষয়। অন্য সকল বিষয় এই মুখ্য বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই আলোচিত হয়েছে।

অত্র আয়াতে আল্লাহ পাক মক্কাবাসী তথা দুনিয়াব্যাপী মুশরিক সমাজকে লক্ষ্য করে এরশাদ করেন যে, তোমাদের জন্য তোমাদের প্রভু আল্লাহ নির্ধারিত করেছেন সেই দ্বীন, যা তিনি নির্ধারিত করেছিলেন দুনিয়ার প্রথম রাসূল হযরত নূহ (আঃ)-এর উপরে। অতঃপর শ্রেষ্ঠ রাসূলগণের মধ্যে ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে। আর সেটা হ’ল ‘এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করা ও তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা’ ( هُوَ عِبَادَةُ اللهِ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ )।

যেমন আল্লাহ অন্যত্র ব্যাখ্যায় বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ ‘আমি আপনার পূর্বেকার সকল রাসূলের নিকটে একই বিষয় প্রত্যাদেশ করেছি যে, আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা কেবলমাত্র আমারই ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, اَلْأَنْبِيَاءُ إِخْوَةٌ مِنْ عَلاَّتٍ وَأُمَّهَاتُهُمْ شَتَّى وَدِينُهُمْ وَاحِدٌ ‘নবীগণ পরস্পরে বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁদের মায়েরা পৃথক। কিন্তু তাঁদের সকলের দ্বীন এক’।[3]

অর্থাৎ তাওহীদ-এর মূল বিষয়ে আমরা সবাই এক। যদিও শরী‘আত তথা ব্যবহারিক বিধান সমূহে আমাদের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ‘তোমাদের সকলের জন্য আমরা পৃথক পৃথক বিধি-বিধান ও পদ্ধতি সমূহ নির্ধারিত করেছি’ (মায়েদাহ ৪৮)। অতএব নূহ (আঃ) হ’তে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবীর অভিন্ন দ্বীন অর্থাৎ তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাত, ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ প্রভৃতি মৌলিক ইবাদত সমূহ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অত্র আয়াতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং সাথে সাথে এই সব মৌলিক বিষয়ে কোনরূপ মতভেদ ও দলাদলি না করার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ বলেন যে, তাওহীদের মূল আহবানের দিকে ফিরে আসা মক্কার মুশরিকদের জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। যদিও তারা নিজেদেরকে ইবরাহীমী দ্বীনের উপরে প্রতিষ্ঠিত বলে দাবী করত। হাদীছে এসেছে যে, كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى دِيْنِ قَوْمِهِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় কওমের দ্বীনের উপরে কায়েম ছিলেন’। অর্থাৎ ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর দ্বীনের উত্তরাধিকার হিসাবে তাদের মধ্যে বায়তুল্লাহ শরীফের ত্বাওয়াফ, সা‘ঈ, হজ্জ, ওমরাহ, বিবাহ-পদ্ধতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য সামাজিক রীতি-নীতি চালু ছিল। কিন্তু তাওহীদকে তারা বদলে ফেলেছিল। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাওহীদের মূল দাবীর উপরে অটল ছিলেন’।[4]

মক্কার মুশরিকগণ তাওহীদের কোন্ অংশ বদলে ফেলেছিল? তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করত। তারা আখেরাত ও ক্বিয়ামতে বিশ্বাসী ছিল।

তাহ’লে কোন্ সে কারণ ছিল যে, তারা ‘মুশরিক’ বলে অভিহিত হ’ল? তাদের রক্ত হালাল বলে ঘোষণা করা হ’ল? এর একটি মাত্র জওয়াব এই যে, তারা আল্লাহকে ‘খালেক্ব’ ও ‘রব’ হিসাবে মেনে নিলেও প্রবৃত্তিপূজা করতে গিয়ে দুনিয়াবী স্বার্থে তাঁর নাযিলকৃত হালাল-হারাম ও অন্যান্য ইবাদত ও বৈষয়িক বিধান সমূহ তারা মানেনি। এমনকি রাসূলকে ‘হক’ জেনেও অহংকার বশে তারা তাঁকে মানতে পারেনি। বরং সহিংস বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রেও তারা অন্যকে শরীক করেছিল। তাদের মৃত পূর্বসূরিদের মূর্তি বানিয়ে পবিত্র কা‘বা গৃহে স্থাপন করেছিল ও তাদের অসীলায় ও সুফারিশে পরকালে মুক্তি পাওয়ার বিশ্বাস পোষণ করেছিল। ফলে আল্লাহকে খুশী করার পরিবর্তে তারা ঐসব মূর্তিকে খুশী করার জন্য জানমাল কুরবানী করত। নযর-নিয়ায ও মানতের ঢল নামিয়ে দিত। এক কথায় ‘তাওহীদে রবূবিয়াত’কে তারা মেনে নিলেও ‘তাওহীদে উলূহিয়াত’ এবং ‘তাওহীদে আসমা ওয়াছ ছিফাত’-কে তারা মানেনি।

মক্কার সেকালের মুশরিকদের সাথে বাংলার বর্তমান নামধারী মুসলিমদের পার্থক্য কোথায়? এরাও নামের দিক দিয়ে মক্কার নেতাদের ন্যায় আব্দুল্লাহ, আব্দুল মুত্ত্বালিব, আবু ত্বালিব হ’লেও প্রবৃত্তিপূজার কারণে দুনিয়াবী স্বার্থে আল্লাহর নাযিলকৃত হারাম-হালাল ও অন্যান্য ইবাদত ও বৈষয়িক বিধান সমূহ মানেনা। প্রকাশ্যে অস্বীকার না করলেও পরোক্ষভাবে তারা এসবকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত সূদ ও সূদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি তথা জুয়া-লটারী-মুনাফাখোরীকে তারা আইনের মাধ্যমে চালু রেখেছে। পতিতাবৃত্তির মত হারাম ও জঘন্য প্রথাকে রাষ্ট্রীয় সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। সিনেমা, টেলিভিশন, ভিসিআর-ভিসিপির সাহায্যে ব্লু ফিল্ম, রাস্তাঘাটে, পত্র-পত্রিকায় সর্বত্র নগ্ন ছবি ও পর্ণো সাহিত্যের ছড়াছড়ির মাধ্যমে যৌন সুঁড়সুড়ি দিয়ে মানুষের প্রবৃত্তিকে উষ্কে দিয়ে যেনা-ব্যভিচারকে ব্যাপক রূপ দিয়েছে। নারী নির্যাতন আজ আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। জাহেলী যুগের গোত্রীয় রাজনীতি আজকের যুগে গণতন্ত্রের নামে দলবাজী তথা দলীয় হিংসা ও মারামারির রাজনীতিতে রূপ পরিগ্রহ করেছে। দলীয় স্বার্থে আইন ও ন্যায়বিচার এমনকি দেশের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে ইবাদতের নামে চালু হয়েছে অগণিত শিরক ও বিদ‘আতী প্রথা। জাহেলী যুগের মূর্তিপূজার বদলে চালু হয়েছে কবরপূজার শিরকী প্রথা। সে যুগের মুশরিকরা প্রাণহীন মূর্তির অসীলায় পরকালীন মুক্তি কামনা করত। এ যুগের মুসলিমরা কবরে শায়িত মৃত পীরের অসীলায় পরকালীন মুক্তি কামনা করে। সম্মান প্রদর্শনের নামে মূর্তির বদলে প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করা হচ্ছে। শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, মঙ্গলঘট, মঙ্গল প্রদীপ ইত্যাদির মাধ্যমে অগ্নিউপাসক ও হিন্দুয়ানী শিরক সমূহ রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করা হয়েছে। জাহেলী আরবের জঘন্য ‘হীলা’ প্রথা আজও ‘মাযহাবে’র দোহাই দিয়ে মুসলিম সমাজে চালু রাখা হয়েছে এবং এর ফলে অসংখ্য নারীর ইযযত নিয়ে ধর্মের নামে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। অনেক মা-বোন লজ্জায় ও গ্লানিতে আত্মহত্যা করছেন। অথচ ধর্মের (?) ও তথাকথিত ধর্মনেতাদের ভয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারছেন না তারা। ভারতীয় হিন্দু ও পারসিক অগ্নি উপাসকদের অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী কুফরী দর্শন আজকের ছূফী নামধারী মুসলিম মারেফতী পীর-ফকীরদের মাধ্যমে জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে ও তাদের খপপরে পড়ে সরলসিধা অসংখ্য ঈমানদার মুসলমান দৈনিক নিজেদের ঈমান খোয়াচ্ছেন।

তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী ও তার বিপরীত অদৃষ্টবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে যে রাসূল (ছাঃ) কঠোর ধমকি প্রদান করেছেন, সেই জাহেলী যুগের কুফরী দর্শন ইসলামের নামে এদেশের রেডিও-টিভিতে এবং অন্যত্র সমানে প্রচার করা হচ্ছে ও মানুষকে ইচ্ছাশক্তিহীন ‘পুতুল’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এভাবে ধর্মের নামে ও রাজনীতির নামে আল্লাহ প্রেরিত দ্বীনের বিরুদ্ধে আজ শতমুখী ষড়যন্ত্র চলছে। অতএব এ মুহূর্তে দ্বীনকে শিরক ও বিদ‘আত হ’তে মুক্ত করে তার আসল ও নির্ভেজাল আদি রূপে প্রতিষ্ঠিত করাই প্রকৃত দ্বীনদার মুমিনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। যা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই নূহ (আঃ) হ’তে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবীকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। আর এটাই হ’ল ‘ইক্বামতে দ্বীন’-এর প্রকৃত তাৎপর্য।

আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ বলেন, كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ অর্থাৎ ‘যেদিকে তোমরা আহবান কর, সে বিষয়টি মুশরিকদের উপরে খুবই ভারী বোধ হয়। তবে আল্লাহ তাঁর জন্য যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। তিনি তাঁর দিকে পথ প্রদর্শন করেন ঐ ব্যক্তিকে যে প্রণত হয়’। অর্থাৎ পূর্ণরূপে তাওহীদ গ্রহণ ও শিরক বর্জন মুশরিকদের জন্য খুবই কঠিন বিষয়। কারণ শিরক ও বিদ‘আতের লালন, পরিপোষণ ও পরিচর্যার মধ্যেই তাদের রুটি-রূযি ও সামগ্রিক দুনিয়াবী স্বার্থ জড়িত। এই সব স্বার্থ পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র ঐসকল ব্যক্তিই আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, যাদেরকে তিনি মনোনীত করেন ও পথ প্রদর্শন করেন।

এক্ষণে আমরা পিছন দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখব, অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় উম্মতের সেরা মনীষী ও বিদ্বানগণ কি বলেছেন।-

[1]. আল-মুনজিদ, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব।

[2]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর প্রমুখ।

[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত-আলবানী, হা/৫৭২২ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৩৬৫, ‘ফাযায়েল’ অধ্যায়।

[4]. ফীরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৬/১৯৮৬), পৃঃ ১৫৪৬।

‘ইক্বামতে দ্বীন’-এর অর্থ : মুফাসসিরগণের দৃষ্টিতে
(১) রঈসুল মুফাসসিরীন খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) (মৃঃ ৬৮ হিঃ) أَنْ أَقِيْمُوا الدِّيْنَ ‘তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর’-এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, أَنِ اتَّفِقُوْا فِى الدِّيْنِ ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাক’। এর পূর্বে তিনি ‘দ্বীন’ অর্থে বলেন, ‘ইসলাম’ ( دين الإسلام )।[1]

(২) ইবনু জারীর ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ) বলেন, সকল নবীকে আল্লাহ পাক যে হুকুম দিয়েছিলেন, সেটা ছিল দ্বীনে হক-এর প্রতিষ্ঠা। অতঃপর তিনি তাবেঈ বিদ্বান মুজাহিদ-এর বক্তব্য তুলে ধরেন যে, مَا اَوْصَاكَ بِهِ وَاَنْبِيَاءَهُ كُلَّهُمْ دِيْنٌ وَاحِدٌ ‘আল্লাহ আপনাকে ও তাঁর অন্য নবীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, সকল দ্বীনই এক’। অতঃপর ক্বাতাদাহ-এর উদ্ধৃতি পেশ করেন بِتَحْلِيْلِ الْحَلاَلِ وَتَحْرِيْمِ الْحَرَامِ ‘হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম’ গণ্য করার মাধ্যমে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর।[2]

(৩) কুরআনের যুগশ্রেষ্ঠ সূক্ষ্ম তত্ত্ববিদ ইমাম হাসান বিন মুহাম্মাদ নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৬ হিঃ) বলেন, هُوَ إِقَامَةُ الدِّيْنِ يَعْنِىْ إِقَامَتُ اُصُوْلِهِ مِنَ التَّوْحِيْدِ وَالنَّبُوَّةِ وَالْمَعَادِ وَنَحْوُ ذَلِكَ دُوْنَ الْفُرُوْعِ الَّتِىْ تَخْتَلِفُ بِحَسْبِ الْاَوْقَاتِ لِقَوْلِهِ تَعَالَى : لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّ مِنْهَاجًا - অর্থাৎ ‘দ্বীনের উছূল বা মূলনীতি সমূহ প্রতিষ্ঠিত কর। যেমন তাওহীদ, নবুঅত, আখেরাত বিশ্বাস বা অনুরূপ বিষয় সমূহ’। শাখা-প্রশাখা বিষয় সমূহ নয়, যা সময়ভেদে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, তোমাদের জন্য আমরা পৃথক পৃথক বিধি-বিধান ও পদ্ধতি সমূহ নির্ধারিত করেছি’ (মায়েদাহ ৪৮)।[3]

(৪) ইমাম মাওয়ার্দী (৩৬৪-৪৫০ হিঃ) সুদ্দী-র উদ্ধৃতি পেশ করেন, اِعْمَلُوْا بِهِ ‘দ্বীন অনুযায়ী আমল কর’। অতঃপর তাবেঈ বিদ্বান মুজাহিদ-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন, دِيْنُ اللهِ فِىْ طَاعَتِهِ وَتَوْحِيْدِهِ وَاحِدٌ ‘আল্লাহর দ্বীন তাঁর আনুগত্যে ও একত্বে একই’। অতঃপর নিজের পক্ষ থেকে তৃতীয় ব্যাখ্যা পেশ করে বলেন, جَاهِدُوْا عَلَيْهِ مَنْ عَانَدَهُ ‘আল্লাহর দ্বীনের বিরোধীদের সাথে জিহাদ কর’।[4]

(৫) ইমাম কুরতুবী (মৃঃ ৬৭১ হিঃ) বলেন, هُوَ تَوْحِيْدُ اللهِ وَطَاعَتُهُ الخ ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠিত কর’ অর্থ হ’ল : আল্লাহর তাওহীদ ও তাঁর আনুগত্য, তাঁর রাসূলগণের উপরে, কিতাব সমূহের উপরে, ক্বিয়ামত দিবসের উপরে এবং একজন মানুষকে মুসলিম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব বিষয় প্রয়োজন সবকিছুর উপরে ঈমান আনয়ন কর। অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন উম্মতের উপরে যেসকল শরী‘আত বা ব্যবহারিক বিধি-বিধান নির্ধারিত হয়েছে, সেগুলি এই আয়াতের বিষয়বস্ত্তর অন্তর্ভুক্ত নয়’।[5]

(৬) ইমাম বায়যাভী (মৃঃ ৬৮৫ হিঃ) বলেন, দ্বীন অর্থ যেসবের উপরে একীন রাখা ওয়াজিব, সেসবের উপরে ঈমান আনা এবং আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করা’ ( اَلْإِيْمَانُ بِمَا يَجِبُ تَصْدِيْقَهُ وَالطَّاعَةُ فِىْ اَحْكَامِ اللهِ )।[6]

(৭) হাফেয ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) বলেন, اَلدِّيْنُ الَّذِيْ جَاءَتْ بِهِ الرُّسُلُ كُلُّهُمْ هُوَ : عِبَادَةُ اللهِ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَإِنِ اخْتَلَفَتْ شَرَائِعُهُمْ وَمَنَاهِجُهُمْ অর্থাৎ ‘ঐ দ্বীন যা নিয়ে সকল রাসূল আগমন করেছিলেন, তা হ’ল একক আল্লাহর ইবাদত করা, যার কোন শরীক নেই। যদিও তাঁদের শরী‘আত ও কর্মধারা পৃথক ছিল’।[7]

(৮) ইমাম জালালুদ্দীন মাহাল্লী (৭৯১-৮৬৪ হিঃ) বলেন, ( هُوَ التَّوْحِيْدُ ) ‘সেটা হ’ল ‘তাওহীদ’।[8]

(৯) ইমাম শাওকানী (১১৭২-১২৫০ হিঃ) বলেন, أَيْ تَوْحِيْدُ اللهِ وَالْإِيْمَانُ بِهِ وَطَاعَةُ رُسُلِهِ وَقُبُوْلُ شَرَائِعِهِ ‘তা হ’ল আল্লাহর তাওহীদ ও তাঁর উপরে ঈমান আনা, তাঁর রাসূলগণের উপরে ঈমান আনা ও আল্লাহর শরী‘আত সমূহ কবুল করা’।[9]

(১০) আব্দুর রহমান বিন নাছির সা‘দী (১৩০৭-৭৬ হিঃ) বলেন, এর অর্থ হ’ল, أَمَرَكُمْ أَنْ تُقِيْمُوْا جَمِيْعَ شَرَائِعِ الدِّيْنِ أُصُوْلَهُ وَفُرُوْعَهُ، تُقِيْمُوْنَهُ بِأَنْفُسِكُمْ وَتَجْتَهِدُوْنَ فِىْ إِقَامَتِهِ عَلَى غَيْرِكُمْ ‘তোমরা মূল ও শাখাসমূহ সহকারে দ্বীনের সকল বিধি-বিধান নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত কর এবং অপরের মধ্যে তা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা কর। নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর। অন্যায় ও গোনাহের কাজে কাউকে সাহায্য করো না। ... অতঃপর দ্বীনের মূলনীতির ব্যাপারে এক থাকার পরে বিভিন্ন মাসায়েলের কারণে তোমরা দলে দলে বিভক্ত হয়ো না’।[10]

(১১) সাইয়িদ কুতুব (১৯০৬-৬৬ খৃঃ) অত্র সূরার শুরুতে সারমর্ম বর্ণনায় বলেন, সকল মাক্কী সূরার ন্যায় এ সূরাটিও আক্বীদা বিষয়ে বক্তব্য রেখেছে। তবে এ সূরাটিতে বিশেষভাবে অহী ও রিসালাতের বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। বরং যথার্থভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, এটাই হ’ল এ সূরার মুখ্য এবং প্রতিপাদ্য বিষয় ( اَلْمِحْوَرُ الرَّئِيْسِىُّ )। অতঃপর ‘আক্বীমুদ্দীন’-এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আমরা সূরার প্রথমে যে সারমর্ম ব্যাখ্যা করেছি, সেই হাক্বীক্বত বা সারবস্ত্তকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই এখানে নির্দেশ করা হয়েছে। ..... আর সেটা হ’ল ‘তাওহীদের হাক্বীক্বত’ ( حَقِيْقَةُ التَّوْحِيْدِ )।[11]

ছাহাবায়ে কেরামের সোনালী যুগ হ’তে আধুনিক যুগের সেরা মুফাসসিরগণের তাফসীর উপরে পেশ করা হ’ল। যেগুলির সারমর্ম হ’ল ‘ইক্বামতে দ্বীন’ অর্থ তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। আমরাও সেই ব্যাখ্যা পেশ করেছি। কিন্তু বর্তমান যুগের কোন কোন রাজনৈতিক মুফাসসির এই আয়াতটির ভিন্নরূপ ব্যাখ্যা দিয়ে দ্বীন অর্থ ‘হুকূমত’ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবীকে যেন এ নির্দেশ দিয়েই পাঠিয়েছিলেন যে, ‘তোমরা রাষ্ট্র কায়েম কর’। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে রত ওলামায়ে কেরামকে এজন্য তারা বলে থাকেন, ‘আপনারা খিদমতে দ্বীনে লিপ্ত আছেন। কিন্তু ইক্বামতে দ্বীন-এর জন্য কি করছেন? ‘ভাবখানা এই যে, ইক্বামতে দ্বীনের অর্থই হ’ল ইসলামী হুকুমত কায়েম করা ও এজন্য রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া এবং এর বাইরে সবকিছুই হ’ল ‘খিদমতে দ্বীন’। অথচ ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য চেষ্টা করা প্রত্যেক তাওহীদবাদী মুসলমানের উপরে অপরিহার্য দায়িত্ব। আর সেটা হ’ল ইক্বামতে দ্বীন-এর একটি অংশ। একমাত্র ইক্বামতে দ্বীন নয়। কেননা পূর্ণাঙ্গ তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অর্থই হ’ল পূর্ণাঙ্গ ইক্বামতে দ্বীন। যার অর্থ জীবনের সকল দিক ও বিভাগে কেবলমাত্র আল্লাহর বিধান ও দাসত্বকে কবুল করা ও তা বাস্তবায়িত করা। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করাও মুমিনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। যে দায়িত্ব পালন করতে সকল মুমিন ধর্মতঃ বাধ্য। কুরআন ও হাদীছের অসংখ্য স্থানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত ও শর্তাবলী বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষ করে এই আয়াতটিকে ‘হুকুমত কায়েমের নির্দেশ’ হিসাবে ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে প্রচারিত ‘ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা বস্ত্ত’ এই মর্মের চরমপন্থী ‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ’-এর বিপরীতে কিঞ্চিদধিক শতবর্ষ পরে ‘রাজনীতিই ধর্ম’ এই মর্মের অত্র চরমপন্থী মতবাদটি ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়। এই মতবাদ হুকুমত বা রাষ্ট্রক্ষমতাকেই আসল ‘দ্বীন’ গণ্য করে ও ইসলামের সকল ইবাদতকে উক্ত মূল দ্বীন কায়েমের জন্য ‘ট্রেনিং কোর্স’ বলে মনে করে।

[1]. ফীরোযাবাদী, তানভীরুল মিক্ববাস মিন তাফসীরে ইবনে আববাস (বৈরূত : দারুল ইশরাক্ব, ১ম সংস্করণ ১৪০৯/১৯৮৮), পৃঃ ৪৮৪।

[2]. আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর ত্বাবারী, জামে‘উল বায়ান ফী তাফসীরিল কুরআন (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ ১৪০৭/১৯৮৭), ১১শ খন্ড, ২৫শ পারা, পৃঃ ১০।

[3]. তাফসীরে ইবনে জারীর-এর সাথে হাশিয়ায় মুদ্রিত। প্রাগুক্ত ১১/২৮ পৃঃ।

[4]. আবুল হাসান আলী বিন হাবীব আল-মাওয়ার্দী আল-বাছরী, তাফসীরুল মাওয়ার্দী (কুয়েত : ওয়াক্ফ ও ইসলামী বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ১ম সংস্করণ ১৪০২/১৯৮২), ৩য় খন্ড, পৃঃ ৫১৪-১৫।

[5]. আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আনছারী আল-কুরতুবী, আল-জামি‘উ লি আহকা-মিল কুরআন (বৈরূত : দারু এহইয়াইত তুরাছিল আরাবী ১৪০৫/১৯৮৫), ১৬শ খন্ড, পৃঃ ১০-১১।

[6]. নাছিরুদ্দীন আবদুল্লাহ বিন ওমর আল-বায়যাভী, আনওয়ারুত তানযীল ওয়া আসরা-রুত তাভীল (মিসর : মুছতফা বাবী হালবী, ১ম সংস্করণ ‘তাফসীরে জালালায়েন’-এর হাশিয়াসহ ১৩৫৮/১৯৩৯), ২য় খন্ড, পৃঃ ১৮২।

[7]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাছীর দামেশকী, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ২য় সংস্করণ ১৪০৮/১৯৮৮), ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১১৮।

[8]. জালালুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাহাল্লী আল-মিছরী, তাফসীরে জালালায়েন (দিল্লী : কুতুবখানা রশীদিয়া, ১৩৭৬ হিঃ), পৃঃ ৪০২।

[9]. ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর (মিসর : মুছতফা বাবী হালবী, ২য় সংস্করণ ১৩৮৩/১৯৬৪), ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৫৩০।

[10]. আবদুর রহমান বিন নাছির আস-সা‘দী, তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান; তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ যুহরী নাজ্জার (রিয়ায : দারুল ইফতা, ১৪১০ হিঃ), পৃঃ ৫৯৯।

[11]. সাইয়িদ কুতুব, ফী যিলা-লিল কুরআন (বৈরূত : দারুশ শুরূক্ব, ১০ম সংস্করণ ১৪১২/১৯৮২), ৫ম খন্ড, পৃঃ ৩১৪৬-৪৭।

পর্যালোচনা
‘দ্বীন’ অর্থ ‘হুকুমত’ এই বিশ্বাস করলে তার জীবন রাজনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। পক্ষান্তরে দ্বীন অর্থ ‘তাওহীদ’ এই বিশ্বাস করলে তার জীবন তাওহীদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। ‘তাওহীদ’ হ’ল মূল এবং ‘হুকুমত’ হ’ল পূর্ণাঙ্গ ‘তাওহীদ’ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সহায়ক শক্তি মাত্র। সেটা কখনোই তাওহীদের জন্য শর্ত বা রুকন নয়। একজন মানুষের মুসলমান হওয়ার জন্য তাওহীদে বিশ্বাসী হওয়া শর্ত। হুকুমত কায়েম করা শর্ত নয়। ফলে যিনি দ্বীন অর্থ ‘তাওহীদ’ মনে করেন, তিনি তার জানমাল ব্যয় করবেন সার্বিক জীবনে সাধ্যপক্ষে ‘তাওহীদ’ প্রতিষ্ঠার জন্য। ইসলামী রাষ্ট্র থাক বা না থাক, এটা তার নিকটে মুখ্য বিষয় হবে না। পৃথিবীর সকল পরিবেশের ও সকল দেশের লোক তখন ইসলাম কবুল করতে উদ্বুদ্ধ হবে পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে। পক্ষান্তরে দ্বীন অর্থ ‘হুকুমত’ করলে ব্যালট হৌক বা বুলেট হৌক যেকোন প্রকারে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করাই তার নিকটে ‘প্রধান ইবাদত’ বলে গণ্য হবে। আর বাকী সকল কাজ তার নিকটে গৌণ মনে হবে। রাষ্ট্র কায়েম না করে মারা গেলে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে সে মরবে ও নিজেকে অপূর্ণ মুসলমান ভেবে হতাশাগ্রস্ত হবে।

মূলতঃ নবীগণ দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছিলেন আত্মভোলা মানবজাতিকে আল্লাহর দিকে ডাকতে। তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করতে। মানব জাতিকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দানের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। মানুষের আক্বীদা ও আমলের সংশোধনের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে সমাজ বিপ্লব ঘটাতে। মূলতঃ সমাজ পরিবর্তনের তুলনায় রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন অতীব তুচ্ছ ব্যাপার। ক্ষমতার হাত বদল সমাজ বদলে অতি সামান্যই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। তাইতো দেখা যায়, নবীগণ রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য লালায়িত ছিলেন না এবং তা পাবার জন্য লড়াইও করেননি। এমনকি একদিনের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক না হয়েও সারা বিশ্বের মানুষ তাঁদের ভক্ত অনুসারী ও সশ্রদ্ধ অনুগামী হয়েছে ও তাঁদেরকেই বিশ্বনেতা হিসাবে মেনে নিয়েছে।

মুমিন তার সার্বিক জীবনে দ্বীন কায়েম করবেন। যিনি জীবনের যে শাখায় কাজ করবেন, তিনি সেখানে দ্বীনের হেদায়েত মেনে চলবেন। যিনি ব্যবসায়ী হবেন, তিনি স্বীয় ব্যবসায়ে ‘ইক্বামতে দ্বীন’ করবেন। অর্থাৎ শরী‘আতের সীমারেখার মধ্যে থেকে তিনি হালাল ভাবে ব্যবসা করবেন। যিনি কর্মজীবী বা শ্রমজীবী হবেন, তিনি সঠিকভাবে তার কর্তব্য পালন করবেন ও মূল মালিক আল্লাহকে ভয় করবেন। যিনি রাজনীতি করবেন, তিনি ইসলামী পদ্ধতিতে রাজনীতি করবেন এবং শরী‘আতের বিধান সমূহ রাষ্ট্রীয়ভাবে বলবৎ করার চেষ্টা করবেন। যিনি জ্ঞানী ও মনীষী হবেন, তিনি স্বীয় জ্ঞান ও মেধাকে অন্যান্য মতাদর্শের উপরে ইসলামকে বিজয়ী করার পক্ষে ব্যয় করবেন। এক কথায় মুমিন তার ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যেখানে যে পরিবেশে থাকবেন, সেখানেই সর্বদা তাওহীদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবেন ও সাধ্যপক্ষে আল্লাহর আইন মেনে চলবেন। মূলতঃ একেই বলে ‘ইক্বামতে দ্বীন’। আর এভাবেই ইসলাম অন্যান্য দ্বীনের উপরে বিজয় লাভ করতে পারে।

দ্বিতীয় ভাগ দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি
إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ -

অনুবাদ : নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুমিনদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়। অতঃপর তারা মারে ও মরে। উপরোক্ত সত্য ওয়াদা মওজুদ রয়েছে তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে। আল্লাহর চেয়ে ওয়াদা পূর্ণকারী আর কে আছে? অতএব তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদের ক্রয়-বিক্রয়ের উপরে, যা তোমরা সম্পাদন করেছ তাঁর সাথে। আর সেটিই হ’ল মহান সফলতা’ (তাওবাহ ১১১)।

শানে নুযূল :

অত্র আয়াতটি বায়‘আতে আক্বাবায়ে কুবরায় অংশগ্রহণকারী আনছারদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়। নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে হজ্জের মওসুমে ইয়াছরিব থেকে মক্কায় আগত হাজীদের নিকট থেকে ‘মিনা’র ‘আক্বাবাহ’ নামক পাহাড়ী সুড়ঙ্গ পথে চন্দ্রালোকিত গভীর রজনীর আলো-আঁধারিতে এই বায়‘আত গ্রহণ করা হয়। পরপর তিন বছরের মধ্যে এটিই ছিল সর্ববৃহৎ ও মক্কার সর্বশেষ বায়‘আত। সেকারণ ‘বায়‘আতে আক্বাবাহ’ বলতে মূলতঃ এই সর্বশেষ বায়‘আতকেই বুঝায়। হাজীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে বর্তমানে ‘মিনা’-র উক্ত পর্বতাংশকে জামরায়ে আক্বাবাটুকু বাদ দিয়ে বাকীটা সমান করে দেওয়া হয়েছে। এই বায়‘আতেই তাওহীদ ভিত্তিক আক্বীদা ও আমল, বিরোধী পক্ষের সাথে জিহাদ এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে গেলে তাঁর নিরাপত্তা ও সহযোগিতার বিষয়ে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। বায়‘আত গ্রহণ কালে আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনছারী বলেন, اِشْتَرِطْ لِرَبِّكَ وَلِنَفْسِكَ مَا شِئْتَ ‘আপনি আপনার প্রভুর জন্য ও আপনার নিজের জন্য যা খুশী শর্তারোপ করুন’! তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,

أَشْتَرِطُ لِرَبِّىْ أَنْ تَعْبُدُوْهُ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا، وَاشْتَرِطُ لِنَفْسِىْ أَنْ تَمْنَعُوْنِىْ مِمَّا تَمْنَعُوْنَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ -

‘আমি আমার প্রতিপালকের জন্য এই শর্ত আরোপ করছি যে, তোমরা তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। অতঃপর আমার নিজের ব্যাপারে শর্ত হ’ল এই যে, তোমরা আমার হেফাযত করবে, যেমন তোমরা নিজেদের জান ও মালের হেফাযত করে থাক’। জবাবে তারা বলল : فَمَالَنَا إِذَا فَعَلْنَا ذَلِكَ ‘এসব করলে বিনিময়ে আমরা কি পাব’? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘জান্নাত’ ( اَلْجَنَّةُ )। তখন তারা খুশীতে উদ্বেলিত হয়ে বলে উঠল, رِبْحُ الْبَيْعِ لاَ نُقِيْلُ وَلاَ نَسْتَقِيْلُ ‘ব্যবসায়িক লাভের এই চুক্তি আমরা কখনোই ভঙ্গ করব না এবং ভঙ্গ করার আবেদনও করব না’। তখন অত্র আয়াত নাযিল হয়।[1] সেকারণ সূরা তাওবাহ ‘মাদানী’ সূরা হলেও এ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণে ‘মাক্কী’।

আয়াতের ব্যাখ্যা :

যেকোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তার প্রচারের সাথে সাথে চাই নিবেদিতপ্রাণ একদল মানুষ। দুনিয়াবী স্বার্থ থাকলে কখনোই নিবেদিতপ্রাণ হওয়া যায় না। আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসর্গিতপ্রাণ একদল মানুষ তৈরীর লক্ষ্যেই উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়।

‘ইসলাম’ এসেছে দাওয়াতের মাধ্যমে এবং ‘ইমারত’ এসেছে বায়‘আতের মাধ্যমে ( اَلْإِسْلاَمُ دَعْوَةٌ وَالْإِمَارَةُ بَيْعَةٌ )। বায়‘আত অর্থ : ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। আমীরের নিকটে ইসলামী আনুগত্যের চুক্তিকে বায়‘আত বলা হয়। কারণ এর বিনিময়ে জান্নাত লাভ হয়, যেমন মাল বিক্রয়ের বিনিময়ে অর্থ লাভ হয়। তিন বৎসর যাবত মক্কায় গোপন দাওয়াত দেওয়ার পর ৪র্থ নববী বর্ষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জের মওসুমে আগত বিভিন্ন গোত্রের নিকটে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। উল্লেখ্য যে, যুলক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ ও মুহাররম পরপর এই তিন মাস, অতঃপর ‘রজব’ মাস, মোট এই চার মাসে আরবদের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া ও মারামারি নিষিদ্ধ ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই সুযোগটি কাজে লাগান এবং নবুওয়াতের ৪র্থ বর্ষ থেকে ১০ম বর্ষ পর্যন্ত ৭ বছর সময়ের মধ্যে মোট ১৫টি গোত্রের নিকটে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে সক্ষম হন। কিন্তু কেউই তাঁর দাওয়াত কবুল করেনি। এসময় ১০ম নববী বর্ষের মধ্যভাগে রজব মাসে তিন দিন বা অনুরূপ নিকটতম ব্যবধানে স্নেহময় চাচা আবু ত্বালিব ও প্রাণপ্রিয়া স্ত্রী খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়। সাথে সাথে কুরায়েশদের অত্যাচার বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় তিনি কুরায়েশের শাখা গোত্র বনু জামাহ-এর সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ শক্তিশালী বনু ছাক্বীফ গোত্রের সমর্থন লাভের আশায় মক্কা থেকে ত্বায়েফ গমন করেন।

১০ম নববী বর্ষের শাওয়াল মাস মোতাবেক ৬১৯ খৃষ্টাব্দের মে মাসের শেষ কিংবা জুন মাসের শুরুতে প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যে বিশ্বস্ত গোলাম যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে স্রেফ পায়ে হেঁটে তিনি ৬০ মাইল দূরে ত্বায়েফ রওয়ানা হন। রাস্তায় যেখানে যে গোত্রকে পেয়েছেন, তিনি তাদের নিকটে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু কারু কাছ থেকেই তিনি সাড়া পাননি। অতঃপর ত্বায়েফ পৌঁছে তিনি বনু ছাক্বীফ গোত্রের তিন নেতা তিন ভাই আব্দ ইয়ালাইল, মাসঊদ ও হাবীব বিন ‘আমরের নিকটে দাওয়াত দেন ও অত্যাচারী কুরায়েশদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য কামনা করেন। কিন্তু তারা তাঁকে চরমভাবে নিরাশ করে। এমনকি তাঁর পিছনে তরুণ ছেলেদের লেলিয়ে দেয়। যারা তাঁকে মেরে-পিটিয়ে রক্তাক্ত করে তাড়িয়ে দেয় এবং তিন মাইল দূরে এক আঙ্গুর বাগানে এসে তিনি আশ্রয় নেন। এখানে বসেই তিনি ত্বায়েফবাসীর হেদায়াতের জন্য প্রসিদ্ধ দো‘আটি করেন।[2]

অতঃপর মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে ‘ক্বারনুল মানাযিল’ নামক স্থানে পৌঁছলে জিব্রীল (আঃ) পাহাড় সমূহের নিয়ন্ত্রক ( مَلَكُ الْجِبَالِ ) ফেরেশতাকে নিয়ে অবতরণ করেন এবং কা‘বা শরীফের উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্বের দু’পাহাড়কে (আবূ কুবাইস ও কু‘আইক্বিআন) একত্রিত করে তার মধ্যবর্তী মক্কার অধিবাসীদেরকে পিষে মেরে ফেলার অনুমতি প্রার্থনা করেন ( إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الْأَخْشَبَيْنِ لَفَعَلْتُ )। কিন্তু দয়াশীল রাসূল (ছাঃ) তাতে রাযী না হয়ে বলেন, بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا ‘আশা করি আল্লাহ এদের পৃষ্ঠদেশ থেকে এমন বংশধর সৃষ্টি করবেন, যারা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না’।[3] অতঃপর মক্কাভিমুখে রওয়ানা হয়ে নাখলা উপত্যকায় কয়েক দিন অবস্থান করেন। সেখানে আল্লাহ একদল জিনকে প্রেরণ করেন ও তারা কুরআন শুনে ঈমান আনয়ন করে। যাদের ঘটনা আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে পরে জানিয়ে দেন (আহক্বাফ ২৯-৩১ ও জিন ১-১৫)।

উপরোক্ত গায়েবী মদদের আশ্বাস ও জিনদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উদ্বুদ্ধ ও আশ্বস্ত হন এবং ইতিপূর্বেকার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে পুনরায় মক্কায় প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। তখন যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ) তাঁকে বলেন, হে রাসূল! যারা আপনাকে বের করে দিয়েছে, সেখানে আপনি কিভাবে প্রবেশ করবেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ একটা পথ বের করে দেবেন এবং তিনি তাঁর দ্বীনকে সাহায্য ও বিজয়ী করবেন’। অতঃপর তিনি হেরা গুহাতে আশ্রয় নিয়ে মক্কার বিভিন্ন নেতার নিকটে আশ্রয় চেয়ে সংবাদ পাঠাতে থাকেন। সবাই তাঁকে নিরাশ করে। একমাত্র মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী সম্মত হন এবং তার সহায়তায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ) সরাসরি কা‘বা গৃহে এসে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। তখন মুত্ব‘ইম ও তার ছেলেরা সশস্ত্র অবস্থায় তাঁকে পাহারা দিতে থাকে। অতঃপর তারা তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দেন। আবু জাহল প্রমুখ নেতাগণ যখন জানতে পারল যে, মুত্ব‘ইম ইসলাম গ্রহণ করেননি, কেবলমাত্র বংশীয় কারণেই মুহাম্মাদকে আশ্রয় দিয়েছে, তখন তারাও বিষয়টি মেনে নেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অতঃপর পরবর্তী হজ্জ মওসুমে বিপুল উৎসাহে দাওয়াত দিতে শরু করেন। এই সময় ইয়াছরিবের বিখ্যাত কবি সুওয়াইদ বিন ছামিত, খ্যাতনামা ছাহাবী আবু যার গিফারী, ইয়ামনের কবি ও গোত্রনেতা তুফায়েল বিন আমর, অন্যতম ইয়ামনী নেতা যিমাদ আল-আযদী ইসলাম গ্রহণ করেন।

[1]. তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৪০৬; কুরতুবী ৮/২৬৭।

[2]. আর-রাহীকুল মাখতূম পৃঃ ১২৬।

[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ; আর-রাহীক্ব পৃঃ ১২৭।

আক্বাবার ১ম বায়‘আত
১১ নববী বর্ষে ৬২০ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে ইয়াছরিবের খাযরাজ গোত্রের ৬ জন সৌভাগ্যবান যুবক হজ্জে আগমন করেন, যাদের নেতা ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ তরুণ আস‘আদ বিন যুরারাহ। বাকী পাঁচ জন হলেন, ‘আওফ ইবনুল হারিছ, রাফে‘ বিন মালেক, কুৎবা বিন ‘আমের, ‘উক্ববাহ বিন ‘আমের ও জাবের বিন ‘আবদুল্লাহ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবুবকর ও আলী (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মিনায় তাঁবুতে তাঁবুতে দাওয়াত দেওয়ার এক পর্যায়ে তাদের নিকটে পৌঁছেন। তারা ইতিপূর্বে ইয়াছরিবের ইহুদীদের নিকটে আখেরী নবীর আগমন বার্তা শুনেছিল। ফলে রাসূলের দাওয়াত তারা দ্রুত কবুল করে নেন। তারা তাঁর আগমনের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত ইয়াছরিবে শান্তি স্থাপিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং তাঁকে ইয়াছরিবে হিজরতের আমন্ত্রণ জানান।

বলা বাহুল্য, হজ্জ থেকে ফিরে গিয়ে উক্ত ছয় জনের ক্ষুদ্র দলটি ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন এবং পরবর্তী বছরে ১২ নববী বর্ষের হজ্জ মওসুমে জাবের বিন আবদুল্লাহ ব্যতিরেকে পুরানো ৫ জন ও নতুন ৭ জন মোট ১২ জন এসে মিনাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বায়‘আত করেন। এঁদের সবাই ছিলেন খাযরাজী ও ২ জন ছিলেন আউস গোত্রের। এটাই ছিল ‘আক্বাবার প্রথম বায়‘আত’ ( بَيْعَةُ الْعَقَبَةِ الْأُوْلَى )।

‘আক্বাবাহ’ অর্থ পাহাড়ী সুড়ঙ্গ পথ। এই পথেই মক্কা থেকে মিনায় আসতে হয়। এরই মাথায় মিনার পশ্চিম পার্শ্বে এই স্থানটি ছিল নির্জন। এখানে পাথর মেরে হাজী ছাহেবগণ পূর্ব প্রান্তে মিনার মসজিদে খায়েফের আশ-পাশে আশ্রয় নিয়ে রাত্রি যাপন করে থাকেন। এখানে ‘জামরায়ে কুবরা’ অবস্থিত। এখানেই ইসমাঈল (আঃ) ইবলীসকে প্রথম পাথর মেরেছিলেন। আর এখানেই ইসমাঈল বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মানবরূপী শয়তানদের বিরুদ্ধে অহি-র বিধান কায়েমের জন্য ঐতিহাসিক ‘বায়‘আত’ গ্রহণ করেন। ঐদিনের ঐ আক্বীদার বিপ্লব পরবর্তীতে শুধু মক্কা-মদীনা নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছুতে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে ও অবশেষে তা সার্বিক সমাজ বিপ্লব সাধন করে। ১২ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুমে ঐদিনকার বায়‘আতকারীদের মধ্যে নতুন আগত খ্যাতনামা ছাহাবী ‘উবাদাহ বিন ছামিত আনছারী (রাঃ) উক্ত বায়‘আতের বর্ণনা দিয়ে বলেন,

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ تَعَالَوْا بَايِعُونِى عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا، وَلاَ تَسْرِقُوا، وَلاَ تَزْنُوا، وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ، وَلاَ تَأْتُو بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ، وَلاَ تَعْصَوْا فِى مَعْرُوفٍ، فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ بِهِ فِى الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ عَلَيْهِ فِىْ الدُّنْيَا فَهُوَ إِلَى اللهِ، إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ، وَإِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ، فَبَايَعْتُهُ عَلَى ذَلِكَ -

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে ডেকে বলেন, এসো! আমার নিকটে তোমরা একথার উপরে বায়‘আত করো যে, (১) আল্লাহর সাথে কোনকিছুকে শরীক করবে না, (২) চুরি করবে না, (৩) যেনা করবে না, (৪) তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, (৫) কারু প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিবে না, (৬) শরী‘আতসম্মত কোন বিষয়ে অবাধ্যতা করবে না। যে ব্যক্তি উক্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করবে, তার জন্য পুরস্কার রয়েছে আল্লাহর নিকটে। কিন্তু যে ব্যক্তি এসবের মধ্যে কোন একটি করবে, অতঃপর দুনিয়াতে তার (আইন সংগত) শাস্তি হয়ে যাবে, সেটি তার জন্য কাফফারা হবে (এজন্য আখেরাতে তার সাজা হবে না)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এসবের কোন একটি করে, অতঃপর আল্লাহ তা গোপন রাখেন (যে কারণে তার শাস্তি হ’তে পারেনি) তাহ’লে উক্ত শাস্তির বিষয়টি আল্লাহর মর্জির উপরে নির্ভর করে। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে পরকালে শাস্তি দিতে পারেন, ইচ্ছা করলে মাফও করে দিতে পারেন’। রাবী ‘উবাদাহ বিন ছামেত বলেন, আমরা একথাগুলির উপরে তাঁর নিকটে বায়‘আত করলাম’।[1] বলা বাহুল্য যে, বায়‘আতের উক্ত ৬টি বিষয় তৎকালীন আরবীয় সমাজে প্রকটভাবে বিরাজমান ছিল। আজও বাংলাদেশে উক্ত বিষয়গুলি প্রকটভাবে বিরাজ করছে।

[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়।

বায়‘আতের অর্থ

ছাহেবে মির‘আত বলেন,

سُمِّيَتِ الْمُعَاهَدَةُ عَلَى الْإِسْلاَمِ بِالْمُبَايَعَةِ تَشْبِيْهًا لِّنَيْلِ الثَّوَابِ فِىْ مُقَابَلَةِ الطَّاعَةِ بِعَقْدِ الْبَيْعِ الَّذِىْ هُوَ مُقَابَلَةُ مَالٍ، كَأَنَّهُ بَاعَ مَا عِنْدَهُ مِنْ صَاحِبِهِ وَأَعْطَاهُ خَالِصَةَ نَفْسِهِ وَطَاعَتِهِ كَمَا فِىْ قَوْلِهِ تَعَالَى : ( إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ) الآية -

‘ইসলামের উপরে কৃত অঙ্গীকারকে বায়‘আত এজন্য বলা হয়েছে যে, ব্যবসায়িক চুক্তির বিপরীতে যেমন সম্পদ লাভ হয়, অনুরূপভাবে আমীরের নিকটে আনুগত্যের বিপরীতে পুণ্য লাভ হয়। সে যেন আমীরের নিকটে তার খালেছ হৃদয় ও খালেছ আনুগত্য বিক্রয় করে দেয়’। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান-মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে...’ (তাওবাহ ১১১)।[1]

‘আক্বাবায়ে ঊলা’-র এই প্রথম বায়‘আতের ধরন ছিল মহিলাদের বায়‘আতের ন্যায় হাতে হাত না রেখে মৌখিকভাবে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে।[2]

বায়‘আতে কুবরা :

অতঃপর উক্ত বায়‘আতকারীদের দাবীর প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছ‘আব বিন ‘উমায়ের নামক একজন তরুণ দাঈকে তাদের সাথে ইয়াছরিবে প্রেরণ করেন। তিনিই ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে মদীনায় প্রেরিত প্রথম দাঈ। সেখানে গিয়ে তিনি ও তাঁর মেযবান তরুণ ধর্মীয় নেতা আস‘আদ বিন যুরারাহ বিপুল উৎসাহে ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছাতে শুরু করেন। যার ফলশ্রুতিতে পরের বছর ১৩ নববী বর্ষের হজ্জ মওসুমে ৬২২ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যভাগের এক গভীর রাতে পূর্বোক্ত পাহাড়ী সুড়ঙ্গ পথে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলার একটি বিরাট দলের আগমন ঘটে। চাচা আববাস-কে সাথে নিয়ে যিনি তখনও ইসলাম কবুল করেননি, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের নিকটে গমন করেন ও রাত্রির প্রথম প্রহর শেষে নিঃশব্দ রজনীতে বায়‘আতের পূর্বে চাচা আববাস তাদেরকে এই বায়‘আতের পরকালীন গুরুত্ব এবং দুনিয়াতে সম্ভাব্য কষ্ট-দুঃখের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এতে তারা স্বীকৃত হ’লে বিগত দু’বছরে ইসলাম গ্রহণকারীদেরকে পরপর দাঁড় করানো হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের নিকটে কুরআন তেলাওয়াত অন্তে তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে কিছু বক্তব্য রাখেন। তখন তারা সকলে বলেন, আমরা আমাদের জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতির বিনিময়ে অত্র অঙ্গীকার করছি। কিন্তু এর বিনিময়ে আমরা কি পাব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘জান্নাত’ ( اَلْجَنَّةُ )। তখন তারা বললেন, أُبْسُطْ يَدَكَ ‘আপনার হাত বাড়িয়ে দিন’। অতঃপর আস‘আদ বিন যুরারাহ নেতা হিসাবে প্রথম তাঁর হাতে বায়‘আত করেন ও তারপর একে একে সকলে রাসূলের হাতে বায়‘আত করেন।[3] মহিলা দু’জন মুখে বলার মাধ্যমে বায়‘আত করেন। সৌভাগ্যবতী ঐ দু’জন মহিলা ছিলেন বনু মাঝেন গোত্রের নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব উম্মে ‘উমারাহ এবং বনু সালামাহ গোত্রের আসমা বিনতে ‘আমর উম্মে মুনী‘। উক্ত বায়‘আতের বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ :

قَالَ جَابِرٌ : قُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ عَلَى مَا نُبَايِعُكَ؟ قَالَ : عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِى النَّشَاطِ وَالْكَسَلِ وَعَلَى النَّفَقَةِ فِى الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ، وَعَلَى الأَمْرِ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْىِ عَنِ الْمُنْكَرِ، وَعَلَى أَنْ تَقُوْمُوْا فِي اللهِ لَا تَأْخُذُكُمْ فِيهِ لَوْمَةُ لَائِمٍ، وَعَلَى أَنْ تَنْصُرُوْنِىْ إِذَا قَدِمْتُ اِلَيْكُمْ وَتَمْنَعُونِىْ مِمَّا تَمْنَعُوْنَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ وَأَزْوَاجَكُمْ وَأَبْنَاءَكُمْ وَلَكُمُ الْجَنَّةُ- رواه احمد بإسناد حسن وصححه الحاكم وابن حبان، وروى ابن إسحاق ما يشبه هذا عن عبادة بن الصامت وفيه بند زائد وهو " وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الْأَمْرَ أَهْلَهُ " كما فى سيرة ابن هشام -

জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার নিকটে কি বিষয়ে বায়‘আত করব? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, (১) আনন্দে ও অলসতায় সর্বাবস্থায় আমার কথা শুনবে ও মেনে চলবে (২) কষ্টে ও স্বচ্ছলতায় (আল্লাহর রাস্তায়) খরচ করবে (৩) ভাল কাজের নির্দেশ দিবে ও অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করবে (৪) আল্লাহর পথে সর্বদা দন্ডায়মান থাকবে এবং উক্ত বিষয়ে কোন নিন্দুকের নিন্দাবাদকে পরোয়া করবে না (৫) যখন আমি তোমাদের নিকটে হিজরত করে যাব, তখন তোমরা আমাকে সাহায্য করবে এবং যেভাবে তোমরা তোমাদের জান-মাল ও স্ত্রী-সন্তানদের হেফাযত করে থাক, অনুরূপভাবে আমাকে হেফাযত করবে। বিনিময়ে তোমাদের জান্নাত লাভ হবে’।[4] এর সাথে সামঞ্জস্যশীল ইবনু ইসহাক্ব কর্তৃক ‘উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে আরেকটি ধারা উল্লেখিত হয়েছে যে, ‘আমরা নেতৃত্বের জন্য ঝগড়া করব না’।[5] এভাবেই বায়‘আত সমাপ্ত হয়।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত ৭৫ জনকে ১২ জন নেতার অধীনে ন্যস্ত করেন। যার মধ্যে ৯ জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের ও ৩ জন ছিলেন আউস গোত্রের। ঐ ১২ জন ‘নাক্বীব’ বা নেতার মধ্যে ‘খাযরাজ’ গোত্রের ৯ জন হ’লেন : (১) আস‘আদ বিন যুরারাহ (২) সা‘দ বিন রাবী‘ (৩) আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহাহ (৪) রাফে‘ বিন মালেক (৫) বারা বিন মা‘রূর (৬) আবদুল্লাহ বিন ‘আমর বিন হারাম, খ্যাতনামা ছাহাবী জাবের (রাঃ)-এর পিতা (৭) ‘উবাদাহ বিন ছামিত (৮) সা‘দ বিন ‘উবাদাহ (৯) মুনযির বিন ‘আমর। আউস গোত্রের তিন জন হ’লেন : (১) উসায়েদ বিন হুযায়ের (২) সা‘দ বিন খায়ছামাহ (৩) রেফা‘আহ বিন আবদুল মুনযির।[6] অতঃপর নেতা ও দায়িত্বশীল হিসাবে তাদের নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পুনরায় অঙ্গীকার ( مِيْثَاقٌ ) নেন ও বলেন যে, أَنْتُمْ عَلَى قَوْمِكُمْ بِمَا فِيْهِمْ كُفَلاَءُ كَكَفَالَةِ الْحَوَارِيِّيْنَ لِعِيْسَى ابْنِ مَرْيَمَ، وَأَنَا كَفِيْلٌ عَلَى قَوْمِىْ يَعْنِى الْمُسْلِمِيْنَ ‘তোমরা তোমাদের কওমের উপরে দায়িত্বশীল, যেমন হাওয়ারীগণ ঈসা ইবনে মারিয়ামের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল ছিলেন এবং আমি আমার কওমের উপরে (অর্থাৎ মুসলমানদের উপরে) দায়িত্বশীল’।[7]

এভাবে বিশ্ব ইতিহাসে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের সূচনা হয় ইমারত ও বায়‘আতের মাধ্যমে। এর ফলাফল সবারই জানা আছে। এই বায়‘আত ‘দ্বিতীয় আক্বাবার বায়‘আত’ বা ‘বায়‘আতে কুবরা’ (বৃহত্তম বায়‘আত) নামে খ্যাত। নিঃসন্দেহে এই বায়‘আতের মূল শিকড় প্রোথিত ছিল ঈমানের উপরে। যে ঈমান কোন দুনিয়াবী প্রলোভন, লোভ-লালসা ও ভয়-ভীতির কাছে মাথা নত করে না। যে ঈমানের সুবাতাস সমাজে প্রবাহিত হ’লে মানুষের আক্বীদা ও আমলে সূচিত হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যে ঈমানের বলেই মুসলমানগণ যুগে যুগে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের আসন অলংকৃত করতে সক্ষম হয়েছে। আজও তা মোটেই অসম্ভব নয়, যদি সেই ঈমান ফিরিয়ে আনা যায়।

[1]. মির‘আতুল মাফাতীহ, হা/১৮-এর ব্যাখ্যা ১/৭৫ পৃঃ।

[2]. আর-রাহীকুল মাখতূম পৃঃ ১৪৩; তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/৩৭৮ পৃঃ।

[3]. আর-রাহীকুল মাখতূম পৃঃ ১৫০-১৫১।

[4]. আহমাদ ‘হাসান’ সনদে এটি বর্ণনা করেছেন এবং হাকেম ও ইবনু হিববান একে ‘ছহীহ’ বলেছেন।

[5]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ১৪৯ টীকা-১।

[6]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/৪৩।

[7]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৫২।

দা‘ওয়াত ও বায়‘আত
‘দাওয়াত’-এর মাধ্যমে সাধারণভাবে জনগণকে দ্বীনের পথে আহবান করা হয়। এই আহবানে যবান, কলম ও আধুনিক সকল প্রকার প্রচার মাধ্যম ব্যবহৃত হ’তে পারে। এর জন্য কখনো একক ব্যক্তিই যথেষ্ট হন। যেমনভাবে বহু নবী একাকী দাওয়াত দিয়ে গেছেন। কিন্তু কোন সাথী জোটেনি। হাদীছে এসেছে যে, ক্বিয়ামতের দিন কোন কোন নবী এমনভাবে উঠবেন যে, মাত্র একজন উম্মত তাঁকে বিশ্বাস করেছে’।[1] বর্তমান যুগে সভা-সমিতিতে বা রেডিও-টিভিতে একাকী বক্তৃতা করে, বই লিখে, ইন্টারনেট-ওয়েবসাইট ইত্যাদি চালু করে এ ধরনের দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। যদিও তার প্রভাব পড়ে খুবই সামান্য।

পক্ষান্তরে ‘বায়‘আত’ হয়ে থাকে ইসলামী বিধিবিধান মেনে চলার আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকারের উপরে। একাকী হৌক বা সম্মিলিতভাবে হৌক ইসলামী বিধানকে নিজ জীবনে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়িত করাই হ’ল বায়‘আতের মূল উদ্দেশ্য। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জান্নাত লাভ।

ইসলামী আন্দোলনে দা‘ওয়াত ও বায়‘আত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কেননা ইসলাম নিঃসন্দেহে প্রচারধর্মী হ’লেও এর মূল উদ্দেশ্য হ’ল মানব সমাজে দ্বীনের বিধান সমূহের বাস্তবায়ন। সেজন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাথে সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টার গুরুত্ব অত্যধিক। সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য নির্দিষ্ট নেতৃত্বের অধীনে একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী প্রয়োজন। আর সে উদ্দেশ্যেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দা‘ওয়াত কবুলকারী ব্যক্তিদের বায়‘আত ও অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। অথচ বিশ্ব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে তিনি একাই যথেষ্ট ছিলেন তাঁর আনীত দাওয়াতকে তথা আল্লাহ প্রেরিত দ্বীনকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। প্রয়োজনে তিনি স্বীয় নবুঅতী শক্তিবলে ফেরেশতা মন্ডলীকে দিয়ে আবু জাহল, আবু লাহাবের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সহজে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি মানুষের কাছ থেকে গাল-মন্দ খেয়ে মানুষের গীবত-তোহমত এমনকি দৈহিক নির্যাতন সহ্য করে মানুষের দুয়ারেই গিয়েছেন ও তাদের নিকট থেকে স্ব স্ব জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার বায়‘আত ও অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন। কেউ উক্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করে জান্নাতের অধিকারী হয়েছেন। কেউ গোপনে বিরোধিতা করে ‘মুনাফিক্ব’ হয়েছে। কেউ অলসতা করে ‘ফাসিক্ব’ হয়েছে। কেউ প্রত্যাখ্যান করে ‘কাফির’ হয়েছে। শেষোক্ত তিনটি দল জাহান্নামী। যদিও তাদের জাহান্নামে অবস্থানের মেয়াদ কমবেশী হবে।

দুর্ভাগ্য এই যে, সমাজে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ‘ইমারত ও বায়‘আত’-এর এই সুন্নাতী ধারা এখন ছিনতাই হয়ে গেছে কিছু ভন্ড মা‘রেফতী ছূফীদের হাতে। বিভিন্ন বিদ‘আতী তরীকায় তারা লোকদেরকে তাদের মোহজালে আবদ্ধ করছে ও ভক্তির চোরাগলি দিয়ে মুরীদদের দ্বীন-ঈমান ধ্বংস করছে। সাথে সাথে তাদের পকেটও ছাফ করছে। হকপন্থী বলে দাবীদারগণ এগুলির বিরোধিতা করতে গিয়ে রাসূলের এই চিরন্তন সুন্নাতকেই প্রত্যাখ্যান করে বসেছেন। তাদের কেউ কেউ ইমারত ও বায়‘আতকে তাচ্ছিল্য করে বলেন, ‘এটি ছূফীদের তরীকা’। অথচ জামা‘আতবিহীন বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনের সুযোগে শয়তান তাদেরকে অনেক সময় প্রবৃত্তির গোলামে পরিণত করে। তারা সমাজ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে নিজেদের ভালমানুষী যাহির করেন। অথচ সামাজিক প্রয়োজনেই তারা বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনের আনুগত্য করে থাকেন। অথচ মুসলিম উম্মাহ ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করুক আর অনৈসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করুক, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য করার সাথে সাথে তাকে শরী‘আত অভিজ্ঞ আমীরের অধীনে জামা‘আতবদ্ধভাবে সামাজিক জীবন যাপন করতে হবে। তবেই তার জীবনে শৃংখলা ফিরে আসবে এবং বিভক্ত আনুগত্যের বিশৃংখল জীবনের অভিশাপ থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। সেই সাথে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ শক্তিশালী হবে।

[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৪ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায়।

দ্বীন বনাম হুকুমত
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে বর্ণিত যিন্দেগীতেই দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি বিধৃত হয়েছে। এর বাইরে দ্বীন কায়েমের কোন শর্ট-কাট রাস্তা নেই। বুলেট ও ব্যালটের মাধ্যমে হয়তবা সহজে রাজনৈতিক ক্ষমতা হাছিল করা যায়। কিন্তু দ্বীন কায়েম করা যায় না। ‘দ্বীন’ অর্থ ‘তাওহীদ’ যার দিকে নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী মানব জাতিকে আহবান জানিয়েছেন’ (শূরা ১৩)। যা প্রথমে স্ব স্ব আক্বীদা ও বিশ্বাসের জগতে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। অতঃপর কর্মজগতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯ খৃঃ) ও তাঁর অনুসারী রাজনৈতিক দলটি উক্ত আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে ‘দ্বীন’ অর্থ ‘হুকুমত’ বলেন। যেমন মাওলানা বলেন,

دين در اصل حكومت كا نام هے- شريعت اس حكومت كا قانون هے اور عبادت اس قانون و ضابطه كى پابندى هے -

‘দ্বীন আসলে হুকুমতের নাম। শরী‘আত হ’ল ঐ হুকুমতের কানূন। আর ইবাদত হ’ল ঐ আইন ও বিধানের আনুগত্য করার নাম’।[1]

অর্থাৎ নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী প্রেরিত হয়েছিলেন ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আর তাঁদের দৃষ্টিতে হুকুমত প্রতিষ্ঠাই হ’ল সবচেয়ে ‘বড় ইবাদত’। যেমন তাঁরা বলেন,

اس عبادت كى حقيقت جس كے متعلق لوگوں نے سمجه ركها هے كه وه محض نماز روزه اور تسبيح تهليل كا نام هے اور دنيا كے معاملات سے اس كو كچه سروكار نهيں، حالانكه در اصل صوم و صلاة اور حج و زكاة اور ذكر وتسبيح انسان كو اس بڑى عبادت كے لئے مستعد كرنيوالى تمرينات (Training courses) هيں -

‘উক্ত ইবাদতের তাৎপর্য যার সম্বন্ধে লোকেরা বুঝে রেখেছে যে, ওটা স্রেফ নামায-রোযা ও তাসবীহ-তাহলীলের নাম, দুনিয়াবী বিষয়ে এর কোন সম্পর্ক নেই। অথচ প্রকৃত কথা এই যে, ছওম ও ছালাত, হজ্জ ও যাকাত এবং যিকর ও তাসবীহ মানুষকে উক্ত ‘বড় ইবাদত’ অর্থাৎ ‘ইসলামী হুকুমত’ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্ত্ততকারী ‘ট্রেনিং কোর্স’ মাত্র।[2] সেকারণ তারা প্রায়ই বলেন, দ্বীনের খেদমত তো অনেক করলেন, এবার ইক্বামতে দ্বীন-এর জন্য কিছু করুন। অর্থাৎ তার দলের রাজনীতিতে যোগ দিন। পবিত্র কুরআনের এই ধরনের ব্যাখ্যা একটি মারাত্মক ভ্রান্তি এবং সালাফে ছালেহীনের পথ হ’তে স্পষ্ট বিচ্যুতি।[3]

মক্কার মুশরিকগণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। সেকারণ এক হিসাবে তারাও তাওহীদবাদী ছিল। কিন্তু ঐ তাওহীদ ছিল তাওহীদে রবূবিয়াত অর্থাৎ ‘রব’ বা প্রভু হিসাবে আল্লাহকে স্বীকার করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই তাওহীদের স্বীকৃতির মাধ্যমে একজন মানুষ ইসলামের গন্ডীর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। আর সেকারণেই মক্কার লোকদের কাছে শেষনবীর আগমন ঘটলো। বস্ত্ততঃ তাওহীদের মূল দাবীই হ’ল ‘তাওহীদে ইবাদত’ অর্থাৎ সার্বিক জীবনে আল্লাহর একক দাসত্ব কবুল করা। মক্কার মুশরিকরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রবৃত্তির দাসত্ব করে আখেরাতে মুক্তির জন্য সহজ রাস্তা মনে করে তাদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন নেককার মৃত ব্যক্তির ‘অসীলা’ কামনা করত। তাদের ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের মনগড়া বিধানের অন্ধ অনুসরণ করত। একেই বলে ‘শিরক’ যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। নবীগণ যুগে যুগে প্রেরিত হয়েছেন আত্মভোলা মানুষকে এইসব শিরকী চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করে সার্বিক জীবনে আল্লাহর একক দাসত্বের প্রতি আহবান জানাতে। কিতাব ও সুন্নাতের মাধ্যমে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আমাদেরকে তাওহীদের বিশ্বাসগত দিক-নির্দেশনা ও কর্মগত বাস্তবতার সর্বোত্তম নমুনা দেখিয়ে গেছেন। মানুষের আক্বীদা ও আমলের সংশোধনের মাধ্যমে তিনি প্রকৃত অর্থে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের পথ প্রদর্শন করে গেছেন।

মক্কার নেতারা যখন আবু ত্বালিবের নিকটে ‘তাওহীদ’-এর প্রচার বন্ধের শর্তে রাসূলকে নেতৃত্ব সমর্পণ সহ কতগুলি লোভনীয় সন্ধিপ্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের বলেছিলেন, আপনারা কেবল একটি কালেমার স্বীকৃতি দিন, তাহ’লেই আপনারা আরব ও আজমের নেতৃত্ব লাভ করবেন। এতে বিস্মিত হয়ে আবু জাহল বলল, তোমার পিতার কসম! যদি কথা সঠিক হয়, তবে একটি কেন দশটি কালেমা বলতেও আমরা প্রস্ত্তত আছি’। রাসূল (ছাঃ) তখন বললেন, আপনারা বলুন : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং বাকী সমস্ত উপাস্য পরিত্যাগ করুন’। এতে তারা হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, ‘সব ইলাহ বাদ দিয়ে কেবল এক আল্লাহর দাসত্ব করব, এটা বড় আশ্চর্য ব্যাপার’ (ছেয়াদ ৬)।[4] এখানে রাসূল (ছাঃ) নিজে ক্ষমতা অর্জনের চাইতে প্রকৃত তাওহীদ কবুলের বিনিময়ে তাদেরকে আরব-আজমের নেতৃত্ব লাভের ওয়াদা করেছিলেন। পক্ষান্তরে আরব নেতারা তাদের শিরকী আক্বীদার সাথে আপোষ করার বিনিময়ে রাসূলকে নেতৃত্ব সমর্পণ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। আবু জাহ্ল ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াবী স্বার্থ দেখেছিল। রাসূল (ছাঃ) চিরস্থায়ী আখেরাতের স্বার্থ দেখেছিলেন। সমাজের স্থায়ী শান্তি ও অগ্রগতির জন্য যেটা একমাত্র রাস্তা বা ছিরাতে মুস্তাক্বীম। বস্ত্ততঃ ক্ষমতার হাত বদল সমাজ বদলে অতি সামান্যই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। তারপরেও তা যদি সংক্ষিপ্ত ও নির্দিষ্ট মেয়াদভিত্তিক হয়। যেমন বর্তমান যুগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হয়ে থাকে।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই রাসূলের তরীকার অনুসারী হ’তে হবে। নিরন্তর দাওয়াতের মাধ্যমে আগে জনগণের আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধন করতে হবে। অতঃপর তাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে দ্বীন ও জনগণের কল্যাণে আসবে। নইলে শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী আমলের অধিকারী নামধারী ইসলামপন্থী একদল লোককে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসালে ইসলামের কল্যাণের চাইতে বরং ক্ষতিই হবে বেশী। তখন জনগণ ইসলাম থেকে হয়তবা চিরতরে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

জানা আবশ্যক যে, আমাদের নবীকে আল্লাহ পাক সশস্ত্র ‘দারোগা’ রূপে প্রেরণ করেননি (গাশিয়াহ ২২)। বরং তিনি এসেছিলেন জগদ্বাসীর জন্য ‘রহমত’ হিসাবে (আম্বিয়া ১০৭)। তাই ‘জিহাদ’-এর অপব্যাখ্যা করে শান্ত একটি দেশে বুলেটের মাধ্যমে রক্তগঙ্গা বইয়ে রাতারাতি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রঙিন স্বপ্ন দেখানো জিহাদের নামে স্রেফ প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। অনুরূপভাবে দ্বীন কায়েমের জন্য জিহাদের প্রস্ত্ততির ধোঁকা দিয়ে রাতের অন্ধকারে কোন নিরাপদ পরিবেশে অস্ত্র চালনা ও বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ সরলমনা তরুণদেরকে ইসলামের শত্রুদের পাতানো ফাঁদে আটকিয়ে ধ্বংস করার চক্রান্ত মাত্র।

[1]. আবুল আ‘লা মওদূদী, খুত্ববাত (দিল্লী : মারকাযী মাকতাবা ইসলামী ১৯৮৭), পৃঃ ৩২০।

[2]. আবুল আ‘লা মওদূদী, তাফহীমাত (উর্দূ) ১ম খন্ড, পৃঃ ৬৯ প্রকাশক : মারকাযী মাকতাবা ইসলামী, দিল্লী, জানুয়ারী ১৯৭৯।

[3]. বিস্তারিত জানার জন্য লেখকের ‘তিনটি মতবাদ’ বইটি পাঠ করুন।

[4]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ১১৪।

জিহাদের প্রস্ত্ততি
প্রস্ত্ততির অর্থ নৈতিক ও বৈষয়িক উভয় প্রকার প্রস্ত্ততি। দেশের তরুণ সমাজকে সুন্দর পরিবেশে সুশিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক চরিত্রে বলীয়ান করে গড়ে তুলতে হবে। সাথে সাথে আইনের সীমারেখার মধ্যে তাদেরকে দৈহিক সামর্থ্যে ও প্রয়োজনে প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্ত্তত রাখতে হবে। অবশ্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার স্বার্থে সশস্ত্র প্রস্ত্ততি হিসাবে দেশে সুশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনী সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্ত্তত রাখা হয়। এরপরেও কারো জন্য বেআইনীভাবে সশস্ত্র প্রস্ত্ততি গ্রহণের অনুমতি ইসলামে নেই। তবে দ্বীন ও রাষ্ট্রের হেফাযতের জন্য শহীদ বা গাযী হবার জিহাদী জাযবা সর্বদা হৃদয়ে লালন করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য।

তাওহীদ বিরোধী আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনই হ’ল সবচেয়ে বড় ‘জিহাদ’। নবীগণ সেই লক্ষ্যেই তাঁদের সমস্ত জীবনের সার্বিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত রেখেছিলেন। আর সেটা করতে গিয়েই তাঁদের উপর নেমে এসেছিল বাধা ও বিপদের হিমালয় সদৃশ মুছীবত সমূহ। জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত ইবরাহীমকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তরতাজা নবী যাকারিয়াকে সর্বসমক্ষে জীবন্ত করাতে চিরে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। মূসাকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। ঈসাকে পৃথিবী ছেড়ে আসমানে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমাদের নবীকে জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় অবস্থান নিতে হয়েছে। কারণ তাঁরা স্ব স্ব যুগের লোকদের প্রতিষ্ঠিত শিরকী আক্বীদার সংস্কার ও সার্বিক জীবনে এক আল্লাহর দাসত্বের আহবান জানিয়েছিলেন। তাঁরা কেউই অস্ত্র হাতে নিয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত হননি। বরং যখনই শিরকের শিখন্ডীরা অস্ত্র হাতে তাদেরকে উৎখাতের জন্য উদ্যত হয়েছে, তখনই তাওহীদের অনুসারীগণ তাদের মুকাবিলায় হয় তাদের জীবন দিয়েছেন, নয় আত্মরক্ষা করেছেন, শহীদ অথবা গাযী হয়েছেন। বদর, ওহোদ, খন্দক সকল যুদ্ধই হয়েছে মদীনায় আত্মরক্ষামূলক। যদি আক্রমণমূলক হ’ত, তাহ’লে এসব যুদ্ধ মক্কায় সংঘটিত হতো এবং তখন রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত হতেন। কিন্তু ইতিহাস সেকথা বলেনি।

বাস্তব কথা এই যে, যবরদস্তির মাধ্যমে একজনকে সাময়িকভাবে পদানত করা যায়। কিন্তু স্থায়ীভাবে অনুগত করা যায় না। ইসলাম আল্লাহর সর্বশেষ নাযিলকৃত ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। এ দ্বীন মানবজীবনকে তার মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর অনুগত বান্দায় পরিণত করতে চায়। অতএব দ্বীন কায়েমের নামে কিংবা জিহাদের নামে আমরা যেন অতি উৎসাহে এমন কিছু না করি, যা ইসলামের মূল রূহকে ধ্বংস করে দেয়। এর বিপরীতে জিহাদী জাযবাকে ধ্বংসকারী অদৃষ্টবাদী আক্বীদা নিঃসন্দেহে আরেকটি ভ্রান্ত আক্বীদা। এটি পানির নীচে ডুবন্ত মাইনের মত। যা মুসলমানের জিহাদী রূহকে সংগোপনে ধ্বংস করে দেয়।

বিশ্বে সর্বদা আদর্শের সংগ্রাম চলছে। উক্ত সংগ্রামে ইসলামকে বিজয়ী করা এবং দ্বীনকে শিরক ও বিদ‘আত মুক্ত করে তাকে তার নির্ভেজাল ও আদি রূপে প্রতিষ্ঠা করাই হ’ল দ্বীনদার মুমিনের সবচেয়ে বড় কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ ‘তোমরা জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[1]

অতএব আসুন! আল্লাহর দেওয়া মাল, আল্লাহর দেওয়া জান ও আল্লাহর দেওয়া যবান ও কলম আল্লাহর পথে ব্যয় করি এবং আল্লাহ বিরোধী মুশরিক শক্তির বিরুদ্ধে তথা আধুনিক জাহেলিয়াতের বিভিন্নমুখী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমরা সর্বমুখী প্রস্ত্ততি গ্রহণ করি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

مَا مِنْ نَبِىٍّ بَعَثَهُ اللهُ فِى أُمَّةٍ قَبْلِىْ إِلاَّ كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لاَ يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لاَ يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الْإِيْمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ - ( رواه مسلم عن ابن مسعود )

‘আমার পূর্বে এমন কোন নবী আল্লাহ প্রেরণ করেননি, যার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক তাঁর সহযোগী ছিল না। কিছু লোক ছিল যারা তাঁর সুন্নাত সমূহের অনুসরণ করত ও নির্দেশ সমূহ মেনে চলত। অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগে তাদের উত্তরসূরিগণ এমন সব কথা বলত, যা তারা করত না। আবার এমন সব কাজ করত, যা করতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এইসব লোকদের বিরুদ্ধে যারা হাত দ্বারা জিহাদ করবে, তারা মুমিন। যারা তাদের বিরুদ্ধে যবান দ্বারা জিহাদ করবে, তারা মুমিন। যারা হৃদয় দিয়ে জিহাদ করবে, তারাও মুমিন। এর বাইরে তার মধ্যে সরিষা দানা পরিমাণ ঈমান নেই’।[2]

অতএব শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে রুখে দাঁড়ানোই হ’ল প্রকৃত জিহাদ। আর তাওহীদের মর্মবাণীকে জনগণের নিকটে পৌঁছে দেওয়া ও তাদের মর্মমূলে প্রোথিত করাই হ’ল প্রকৃত দাওয়াত। তাই একই সাথে তাওহীদের ‘দাওয়াত’ ও তাওহীদ বিরোধী জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সর্বমুখী ‘জিহাদ’-ই হ’ল দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি।

[1]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, দারেমী, মিশকাত হা/৩৮২১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

১০
সার-সংক্ষেপ
উপরোক্ত আলোচনায় সার-সংক্ষেপ হিসাবে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন-

(১) দ্বীন কায়েম হয় মূলতঃ ব্যক্তির আক্বীদা ও আমলে। সমাজে ও রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম হওয়ার সাথে এটি শর্তযুক্ত নয়। তবে তা নিঃসন্দেহে সহায়ক ও পরিপূরক এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপরে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠা করা তার ঈমানী দায়িত্ব।

(২) দ্বীন কায়েমের একমাত্র লক্ষ্য হবে ‘জান্নাত’। অন্য কিছু নয়। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হ’লেও তার লক্ষ্য হবে ‘জান্নাত’। অন্য কিছু নয়। এটি হবে তার দাওয়াতের দুনিয়াবী পুরস্কার অথবা পরীক্ষা।

(৩) দ্বীন কায়েমের জন্য একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। বরং সমবেত প্রচেষ্টা যরূরী। যাকে ‘সংগঠন’ বলা হয়।

(৪) ইসলামী সংগঠন বা জামা‘আত-এর জন্য প্রয়োজন হ’ল আমীর, মামূর, বায়‘আত ও এত্বা‘আত’ অর্থাৎ নেতা, কর্মী, অঙ্গীকার ও আনুগত্য এবং উক্ত জামা‘আতে পুরুষ ও নারী সকলেই শামিল হবেন।

(৫) জান্নাত পাওয়ার লক্ষ্যে শক্তিশালী ও আমানতদার আমীরের অধীনে গঠিত জামা‘আতের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের নিরন্তর দাওয়াত ও আপোষহীন জিহাদী তৎপরতাই হ’ল সমাজে দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি।

(৬) শান্তির সময়ে কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু সশস্ত্র মুকাবিলার সম্মুখীন হ’লে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা চূড়ান্ত অবস্থায় ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক ভাবে (যেমন ফিলিস্তীন, কাষ্মীর, আফগানিস্তান ও ইরাকে এখন হচ্ছে)।

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আয়াতে বর্ণিত বায়‘আত বা চুক্তিনামার উদ্দেশ্য হাছিলে যারা দন্ডায়মান হবে এবং চুক্তি পূর্ণ করবে, তাদের জন্য থাকবে মহান সফলতা ও চিরস্থায়ী নে‘মত অর্থাৎ জান্নাত।[1] কুরতুবী বলেন, ক্বিয়ামত পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জান্নাতের উক্ত সুসংবাদ অবশ্যই রয়েছে’।[2]

[1]. তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৪০৬।

[2]. তাফসীরে কুরতুবী ৮/২৬৭।

১১
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
বাংলাদেশে সম্প্রতি ক্রমেই রাষ্ট্রঘাতি চক্রের চরমপন্থী রাজনৈতিক তৎপরতার পক্ষে ইসলামকে ব্যবহার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘শান্তি বাহিনী’-র নামে সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টির ন্যায় এটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তথ্যাভিজ্ঞ মহল দৃঢ়তার সাথে মত প্রকাশ করে থাকেন। যাই হোক তারা এদেশীয় কিছু লোককে দিয়ে ‘দ্বীন কায়েমের’ অপব্যাখ্যা সম্বলিত লেখনী যেমন জনগণের নিকটে সরবরাহ করছে, তেমনি অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত তরুণদেরকে ‘জিহাদের’ অপব্যাখ্যা দিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে উষ্কানি দিচ্ছে। পত্রিকান্তরে একই উদ্দেশ্যে তৎপর অন্যূন ১০টি ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের নাম এসেছে। এমনকি কোন কোন স্থানে এদের দেওয়াল লিখনও নযরে পড়ছে। বলা যায়, এদের সকলেরই উদ্দেশ্য সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা ও ইসলামী হুকুমত কায়েম করা। এজন্য তারা তাদের বইপত্র ও লিফলেটে কুরআনের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে যেসব বক্তব্য জনগণের নিকটে উপস্থাপন করেছে, তার সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ:

(১) তাওহীদ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হ’ল জিহাদ ও কিতাল তথা সশস্ত্র সংগ্রাম।

(২) ঈমানদারের আল্লাহ প্রদত্ত সংজ্ঞা (হুজুরাত ১৫) অনুযায়ী বর্তমান মুসলিম জাতি, বিশেষ করে আলেম সমাজ অবশ্যই মুমিন নয়; অতএব হয় তারা মুশরিক নয় কাফের।

(৩) আল্লাহ স্বয়ং মুমিনদের অভিভাবক (বাক্বারাহ ২৫৭)। অথচ মুসলমানরা সর্বত্র মার খাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ মুসলিম জাতির অভিভাবক নন এবং এ জাতি মুমিন নয়। অতএব যার ঈমান নেই, সে কাফির।

১২
খারেজী আক্বীদা
উপরের বক্তব্যগুলি পরখ করলে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ)-কে হত্যাকারী খারেজীদের চরমপন্থী জঙ্গীবাদী আক্বীদা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এরা إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ‘আল্লাহ ব্যতীত কারু শাসন নেই’ (ইউসুফ ৪০) এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে হযরত আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ) উভয়কে ‘কাফির’ এবং তাঁর রক্ত হালাল গণ্য করেছিল ও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আলী (রাঃ) তাদের উপরোক্ত বক্তব্যের জবাবে বলেছিলেন,

كَلِمَةٌ حَقٌّ يُرَادُ بِهَا جُوْرٌ، إِنَّمَا يَقُوْلُوْنَ أَنْ لاَ إِمَارَةَ وَلاَ بُدَّ مِنْ إِمَارَةٍ بِرَّةٌ اَوْ فَاجِرَةٌ ‘কথা ঠিক কিন্তু বাতিল অর্থ নেওয়া হয়েছে। এরা বলতে চায় যে, (আল্লাহ ব্যতীত কারু) শাসন নেই। অথচ অবশ্যই শাসন ক্ষমতায় ভাল ও মন্দ সব ধরনের লোকই আসতে পারে’।[1] মনে রাখা আবশ্যক যে, শরী‘আতের কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম বিশেষ করে খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রদত্ত ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। পরবর্তীকালে দেওয়া তার বিপরীত কোন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। আলী (রাঃ)-এর দেওয়া ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে তাঁর দল থেকে বহু লোক বেরিয়ে যায়। ইতিহাসে এরাই ‘খারেজী’ নামে পরিচিত। ছাহাবায়ে কেরাম নিজেদের মধ্যকার রাজনৈতিক বা বৈষয়িক মতবিরোধ এমনকি আপোষে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে কখনোই পরস্পরকে ‘কাফির’ বলতেন না। পরস্পরকে মেরে বা মরে গাযী বা শহীদ হবার গৌরব করতেন না। খারেজী ও শী‘আরাই প্রথম এই চরমপন্থী ধুয়া তুলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ফিৎনার সূচনা করে। রাসূলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সৃষ্ট ৭৩ ফেরকার মধ্যে ৭২ ফেরকাই হবে জাহান্নামী।[2] উপরোক্ত দু’টি ফেরকা উক্ত ৭২টি ভ্রান্ত ফেরকার অন্তর্ভুক্ত। শী‘আদের আক্বীদা মতে আলী (রাঃ) ব্যতীত বাকী তিন খলীফা ছিলেন কাফির ও জাহান্নামী (নাঊযুবিল্লাহ)। খারেজীদের আক্বীদা মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তার রক্ত হালাল। আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের নিকটে কবীরা গোনাহগার মুমিন কাফির নয় এবং তার রক্ত হালাল নয়। একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি মৃতের ন্যায় হলেও তাকে যেমন ‘প্রাণহীন মৃত’ বলা যায় না, তেমনি গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে সাময়িকভাবে ঈমানের দীপ্তি স্তিমিত হয়ে গেলেও কোন মুমিনকে ঈমানশূন্য ‘কাফির’ বলা যায় না। ‘ক্বিয়ামতের দিন রাসূলের শাফা‘আত তো মূলতঃ কবীরা গোনাহগার মুমিনদের জন্যই হবে’।[3]

ছহীহ হাদীছ ও ছাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যা মতে আহলেহাদীছগণের আক্বীদাই সঠিক এবং সেকারণ বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের দৃষ্টিতে কাফির নয়, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর কোন বিধানকে বিশ্বাসগতভাবে ও মৌলিকভাবে অস্বীকার করে। একইভাবে তাদের জান মাল ও ইযযত অন্যদের জন্য হালাল নয়। অথচ এইসব চরমপন্থীরা কুরআন-হাদীছের বিকৃত ব্যাখ্যা করে পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহকে ও তাদের সম্মানিত আলেম-ওলামাকে কাফির-মুশরিক বলে অভিহিত করছে ও তাদেরকে হত্যা করার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য ক্রমেই পরিবেশ ঘোলাটে করছে। অথচ ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমাজসেবার মুখোশে এদেশের হাযার হাযার নাগরিককে অহরহ ‘খৃষ্টান’ বানাচ্ছে, হিন্দু নেতারা এদেশকে ভারতের দখলীভুক্ত করার জন্য প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সেমিনারে বাংলাদেশের পৃথক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও পৃথক সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব বিলীন করার পক্ষে যুক্তি (?) পেশ করছে, কিন্তু এসব ব্যাপারে এইসব নামধারী মুজাহিদদের (?) কোন মাথাব্যথা নেই। মূলতঃ তারা ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছে এবং নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্বশূন্য করার বিদেশী নীল-নকশা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে।

খারেজীদের সম্পর্কে রাসূলের ভবিষ্যদ্বাণী

চরমপন্থী খারেজী আক্বীদার অনুসারী লোকদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন,

يَخْرُجُ فِي هَذِهِ الْأُمَّةِ ( وَلَمْ يَقُلْ : مِنْهَا ) قَوْمٌ تَحْقِرُونَ صَلاَتَكُمْ مَعَ صَلاَتِهِمْ وفى رواية : يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلاَتَهُ مَعَ صَلاَتِهِمْ، وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ، يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ يَمْرُقُوْنَ مِنْ الْإِسْلَامِ مُرُوْقَ السَّهْمِ مِنْ الرَّمِيَّةِ يَقْتُلُوْنَ أَهْلَ الْإِسْلَامِ وَيَدَعُوْنَ أَهْلَ الْأَوْثَانِ لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لَأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ

‘এই উম্মতের মধ্যে (তিনি বলেননি, মধ্য হ’তে। অর্থাৎ তারা মুসলিম নামেই থাকবে) এমন এক দল লোক বের হবে, তাদের ছালাতের সাথে তোমরা নিজেদের ছালাতকে হীন মনে করবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমাদের কেউ নিজেদের ছালাতকে তাদের ছালাতের সঙ্গে এবং তোমাদের ছিয়ামকে তাদের ছিয়ামের সঙ্গে তুলনা করলে তোমাদের নিজেদের ছিয়াম ও ছালাতকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। তারা সুন্দরভাবে কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা ইসলাম থেকে এমন তীব্র বেগে খারিজ হয়ে যাবে, যেমন ধনুক হ’তে তীর বের হয়ে যায়। ...তারা মুসলমানদের হত্যা করবে ও মূর্তিপূজারীদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেবে (অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আমি যদি তাদের পেতাম, তাহ‘লে ‘আদ’ জাতির ন্যায় তাদের হত্যা করে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিতাম’।[4]

ছহীহ মুসলিম-এর অন্য বর্ণনায় এসেছে যে,

سَيَخْرُجُ فِىْ آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ أَحْدَاثُ الْأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الْأَحْلاَمِ يَقُوْلُوْنَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ ... فَإِذَا لَقِيْتُمُوْهُمْ فَاقْتُلُوْهُمْ فَإِنَّ فِيْ قَتْلِهِمْ أَجْرًا لِّمَنْ قَتَلَهُمْ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقَيَامَةِ -

‘আখেরী যামানায় একদল তরুণ বয়সী বোকা লোক বের হবে, যারা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর কথা বলবে এবং কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না...। তোমরা তাদের পেলে হত্যা করবে। কেননা এদের হত্যাকারীর জন্য আল্লাহর নিকটে ক্বিয়ামতের দিন অশেষ নেকী রয়েছে’।[5]

উল্লেখ্য যে, খারেজীদের বিরুদ্ধে বর্ণিত হাদীছের আধিক্য ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।[6]

বলা আবশ্যক যে, এদের প্রথম যুগের নেতা বনু তামীম গোত্রের যুল-খুওয়াইছেরাহ নামক জনৈক ন্যাড়ামুন্ড ঘন শ্মশ্রুধারী মুসলিম (?) ব্যক্তি ইয়ামন থেকে আলী (রাঃ) প্রেরিত গণীমতের মাল বণ্টনের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘ইনছাফ কর’ এবং ‘আল্লাহকে ভয় কর’- বলে উপদেশ দিয়েছিল। এদেরই বিরাট একটি দলকে হযরত আলী (রাঃ) হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন। এদের লোকেরাই হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে ‘কাফির’ অভিহিত করে আলী (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল এবং মু‘আবিয়া (রাঃ) ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। ‘জিহাদের’ নামে এদের চরমপন্থী আক্বীদাকে উষ্কে দিয়ে বর্তমানে দেশদ্রোহী কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের হীন স্বার্থ উদ্ধারের নেশায় অন্ধ হয়ে গেছে। এদের থেকে সাবধান থাকা যরূরী।

[1]. দ্রঃ লেখক প্রণীত ‘তিনটি মতবাদ’ পৃঃ ২৮।

[2]. ছহীহ তিরমিযী হা/২১২৯; মিশকাত হা/১৭১ ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[3]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫৫৯৮, ৫৬০০ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়।

[4]. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৯৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৬৪২ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায়, ‘মু‘জিযার বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম ‘যাকাত’ অধ্যায় হা/১৪৭।

[5]. আলী (রাঃ) হ’তে, ছহীহ মুসলিম হা/১০৬৬ ‘যাকাত’ অধ্যায় হা/১৫৪ ‘খারেজীদের হত্যা করায় উৎসাহ প্রদান’ অনুচ্ছেদ ৪৮।

[6]. শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম, তাহক্বীক্ব : সালীম বিন ঈদ আল-হেলালী (সঊদী আরব : দার ইবনে আফফান ১৪১২/১৯৯২), ১/২৮ পৃঃ টীকা-৩।

১৩
সরকারের বিরুদ্ধে অপতৎপরতা
দেশের ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হৌক বা নিরস্ত্র হৌক যেকোন ধরনের অপতৎপরতা, ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ ইসলামে নিষিদ্ধ। বরং সরকারের জনকল্যাণমূলক যেকোন ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ মেনে চলতে যেকোন মুসলিম নাগরিক বাধ্য। কিন্তু কোনরূপ গুনাহের নির্দেশ মান্য করতে কোন মুসলমান বাধ্য নয়। কেননা ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোনরূপ আনুগত্য নেই’।[1] তবে অনুরূপ অবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। বরং তাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে হবে, উপদেশ দিতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে এবং সংশোধনের সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করতে হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يَكُونُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ تَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ، فَمَنْ أَنكَرَ فَقَدْ بَرِئَ، وَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ سَلِمَ، وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ، قَالُوا : أَفَلا نَقْتُلُهُمْ ؟ قَالَ : لا، مَا صَلَّوْا، لا مَا صَلَّوْا -

‘তোমাদের মধ্যে অনেক আমীর হবে, যাদের কোন কাজ তোমরা ভাল মনে করবে, কোন কাজ মন্দ মনে করবে। এক্ষণে যে ব্যক্তি ঐ মন্দ কাজের প্রতিবাদ করবে, সে মুক্তি পাবে। যে ব্যক্তি ঐ কাজকে অপসন্দ করবে, সেও নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি ঐ মন্দ কাজে সন্তুষ্ট থাকবে ও তার অনুসারী হবে। ছাহাবীগণ বললেন, আমরা কি তখন ঐ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন না। যতক্ষণ তারা ছালাত আদায় করে। না, যতক্ষণ তারা ছালাত আদায় করে’।[2]

‘আউফ বিন মালিক (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ وَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْ وُلَاتِكُمْ شَيْئًا تَكْرَهُونَهُ فَاكْرَهُوا عَمَلَهُ وَلَا تَنْزِعُوا يَدًا مِنْ طَاعَةٍ ‘যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে ছালাত কায়েম করে। অতঃপর তোমরা যখন তোমাদের শাসকদের নিকট থেকে এমন কিছু দেখবে, যা তোমরা অপসন্দ কর, তখন তোমরা তার কার্যকে অপসন্দ কর; কিন্তু তাদের থেকে আনুগত্যের হাত ছিনিয়ে নিও না’।[3]

এক্ষণে যদি সরকার প্রকাশ্যে কুফরী করে, তাহ’লে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে কি-না, এ বিষয়ে দু’টি পথ রয়েছে। ১- যদি শাসক পরিবর্তনের ক্ষমতা আছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস ও নিশ্চিত বাস্তবতা থাকে, তাহ’লে সেটা করা যাবে। ২- যদি এর ফলে সমাজে অধিক অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টির আশংকা থাকে, তাহ’লে ছবর করতে হবে ও যাবতীয় ন্যায়সঙ্গত পন্থায় সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করতে হবে, যতদিন না তার চাইতে উত্তম কোন বিকল্প সামনে আসে। এর দ্বারাই একজন মুমিন আল্লাহর নিকট থেকে দায়মুক্ত হতে পারবেন। কিন্তু যদি তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করেন, সরকারকে উপদেশ না দেন, বরং অন্যায়ে খুশী হন ও তা মেনে নেন, তাহ’লে তিনি গোনাহগার হবেন ও আল্লাহর নিকটে নিশ্চিতভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন। মূলতঃ এটাই হ’ল ‘নাহী ‘আনিল মুনকার’-এর দায়িত্ব পালন। যদি কেউ ঝামেলা ও ঝগড়ার অজুহাত দেখিয়ে একাজ থেকে দূরে থাকেন, তবে তিনি কুরআনী নির্দেশের বিরোধিতা করার দায়ে আল্লাহর নিকটে ধরা পড়বেন।

শাসক বা সরকারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার সাথে সাথে তার কল্যাণের জন্য সর্বদা আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে হবে। কেননা শাসকের জন্য হেদায়াতের দো‘আ করা সর্বোত্তম ইবাদত ও নেকীর কাজ সমূহের অন্তর্ভুক্ত। দাউস গোত্রের শাসক হাবীব বিন ‘আমর যখন বললেন যে, ‘আমি জানি একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। কিন্তু তিনি কে আমি জানি না’। তখন উক্ত গোত্রে রাসূলের নিযুক্ত দাঈ তুফায়েল বিন আমর দাঊসী (রাঃ) এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, إِنَّ دَوْسًا قَدْ هَلَكَتْ وَعَصَتْ وَأَبَتْ فَادْعُ اللهَ عَلَيْهِمْ ‘হে রাসূল! দাউস গোত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা নাফরমান হয়েছে ও আল্লাহকে অস্বীকার করেছে। অতএব আপনি তাদের উপরে বদ দো‘আ করুন’। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের জন্য কল্যাণের দো‘আ করে বললেন, اَللَّهُمَّ اهْدِ دَوْسًا وَائْتِ بِهِمْ ‘হে আল্লাহ! তুমি দাউস গোত্রকে হেদায়াত কর এবং তাদেরকে ফিরিয়ে আনো’। পরে দেখা গেল যে, ৭ম হিজরীতে খায়বার বিজয়ের সময় তুফায়েল বিন আমর (রাঃ) স্বীয় গোত্রের ৭০/৮০ টি পরিবার নিয়ে রাসূলের দরবারে হাযির হ’লেন। যাদের মধ্যে সর্বাধিক হাদীছজ্ঞ খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা দাউসী (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। যদি সেদিন দাউস গোত্রকে ধ্বংস করে দেওয়া হ’ত, তাহ’লে মুসলিম উম্মাহ হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর মত একজন মহান হাদীছজ্ঞ ছাহাবীর খিদমত হ’তে বঞ্চিত হ’ত।[4]

ইসলাম একটি বিশ্বজনীন দ্বীন। পৃথিবীর প্রতিটি জনবসতিতে ইসলাম প্রবেশ করবে। ধনীর সুউচ্চ প্রাসাদে ও বস্তীবাসীর পর্ণকুটিরে ইসলামের প্রবেশাধিকার থাকবে বাধাহীন গতিতে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত একদল হকপন্থী লোক চিরকাল খালেছ তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে যাবেন। যদিও তাদের সংখ্যা কম হবে। অবশেষে ইমাম মাহদীর আগমনের ফলে ও ঈসা (আঃ)-এর অবতরণকালে পৃথিবীর কোথাও ‘ইসলাম’ ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ইসলামের এই অগ্রযাত্রা তার রাষ্ট্রীয় শক্তির বলে হবে না, বরং এটা হবে তার তাওহীদী দাওয়াতের কারণে, মানবরচিত বিধানসমূহের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জর্জরিত ও নিষ্পিষ্ট মানবতার ক্ষুব্ধ উত্থানের কারণে এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি বান্দার চিরন্তন আনুগত্যশীল হৃদয়ের চৌম্বিক আকর্ষণের কারণে। যতদিন পৃথিবীতে একজন তাওহীদবাদী হকপন্থী মুমিন ব্যক্তি থাকবেন, ততদিন ক্বিয়ামত হবে না। পৃথিবীর সকল ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও শক্তিবলয়ের চাইতে একজন তাওহীদবাদী মুমিনের মর্যাদা আল্লাহর নিকটে অনেক বেশী। যার সম্মানে আল্লাহ পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখবেন (সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী)।

অতএব যে ধরনের রাষ্ট্রে বসবাস করি না কেন, প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হ’ল জনগণের নিকটে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছানো। একজন পথভোলা মানুষের আক্বীদা ও আমলের পরিবর্তন রাষ্ট্রশক্তি পরিবর্তনের চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

فَوَاللهِ لَأَنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلًا وَاحِدًا خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ ‘আল্লাহর কসম! যদি তোমার দ্বারা আল্লাহ একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটা তোমার জন্য সর্বোত্তম উট কুরবানী করার চেয়েও উত্তম হবে’।[5] ভারতে মুসলমানেরা সাড়ে ছয়শো বছর রাজত্ব করেছে। বাংলাদেশে ইংরেজরা ১৯০ বছর রাজত্ব করেছে। কিন্তু আক্বীদা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তা খুব সামান্যই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। অতএব রাষ্ট্রশক্তির জোরে নয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে তার অন্তর্নিহিত আদর্শিক শক্তির জোরে। তবে আল্লাহর বিধান সমূহের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও মানবতার সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য রাষ্ট্রশক্তি অর্জনের যেকোন বৈধ প্রচেষ্টা প্রত্যেক মুসলমানের উপরে অবশ্য কর্তব্য। তখন সেই ইসলামী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হবে তাওহীদের প্রচার-প্রসার ও তার যথার্থ বাস্তবায়ন। মূলতঃ তাওহীদের উপকারিতা ও শিরকের অপকারিতা তুলে ধরাই ইসলামী সরকার ও মুসলিম উম্মাহর প্রধান কর্তব্য। এই দায়িত্ব জামা‘আতবদ্ধভাবে পালন করার প্রতিই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।

বর্তমান যুগে যারা চরমপন্থী এবং দলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তারা বুলেট হৌক কিংবা ব্যালট হৌক যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকেন। আদর্শের বা নীতি-নৈতিকতার কথা এখন তাদের মুখে আর তেমন শোনা যায় না। পরস্পরের বিরুদ্ধে নোংরা গালাগালি, গীবত-তোহমত, ক্যাডারবাজি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বোমাবাজি, হরতাল-ধর্মঘট, গাড়ী ভাংচুর ও সম্পদের লুটতরাজ, সর্বত্র নেতৃত্ব দখল ও দলীয়করণ এগুলিই এখন রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। যেকোন মূল্যে ক্ষমতা পেতেই হবে। এমনকি ‘ক্ষমতা হাতে না পেলে দ্বীন কায়েম হবে না’ এমন একটা উন্মুত্ত চেতনা কিছু লোককে সর্বদা তাড়িয়ে ফিরছে। অথচ বাস্তবে দেখা গেছে যে, এইসব ইসলামী নেতাগণ যখনই ক্ষমতার একটু স্বাদ পেয়েছে, সাথে সাথেই তাদের ইসলামী জোশ উবে গেছে। দেশে প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আত সমূহকে তারা ‘দেশাচার’-এর নামে নির্বিবাদে হযম করে নিচ্ছেন। এমনকি হালাল-হারামের মত মৌলিক বিষয়গুলিতেও তাঁদের কোনরূপ উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না। বহু কথিত দ্বীন কায়েমের অর্থ কি তাহ’লে নিজের বা নিজ দলের জন্য দু’একটা এম,পি বা মন্ত্রীত্বের চেয়ার কায়েম করা? কিংবা দলীয় লোকদের সরকারী চাকুরী ও কন্ট্রাক্টরীর ব্যবস্থা করা? বর্তমানের বাংলাদেশী বাস্তবতা আমাদের তো সেকথাই বলে দেয়।

দ্বীন কায়েমের ভুল ব্যাখ্যার গোলক ধাঁধায় পড়ে এভাবে বহু লোক পথ হারিয়েছে। বর্তমানে জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কিছু তরুণকে সশস্ত্র বিদ্রোহে উষ্কে দেওয়া হচ্ছে। বাপ-মা, ঘরবাড়ি এমনকি লেখাপড়া ছেড়ে তারা বনে-জঙ্গলে ঘুরছে। তাদের বুঝানো হচ্ছে ছাহাবীগণ লেখাপড়া না করেও যদি জিহাদের মাধ্যমে জান্নাত পেতে পারেন, তবে আমরাও লেখাপড়া না করে জিহাদের মাধ্যমে জান্নাত লাভ করব। কি চমৎকার ধোঁকাবাজি! ইহুদী-খৃষ্টান-ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এগিয়ে যাক, আর অশিক্ষিত মুসলিম তরুণরা তাদের বোমার অসহায় খোরাক হৌক- এটাই কি শত্রুদের উদ্দেশ্য নয়? কিন্তু এইসব তরুণদের বুঝাবে কে? ওরা তো এখন জিহাদ ও জান্নাতের জন্য পাগল! কিন্তু তাদের জিহাদ কাদের বিরুদ্ধে? দেশের সরকারের বিরুদ্ধে? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে? দেশের অমুসলিম নেতাদের বিরুদ্ধে? কই তেমন তো কিছু শোনা যায় না? তবে এটা সব সময় শোনা যায় তাদের টার্গেট হ’ল অমুক ‘আহলেহাদীছ’ নেতা। কারণ আহলেহাদীছ আন্দোলনের নেতারাই কেবল ওদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। জনগণকে ওদের নেপথ্য নায়কদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেন। ওদের বিদেশী অর্থ ও অস্ত্রের যোগানদারদের সম্পর্কে সাবধান করে থাকেন।

মিথ্যা ফযীলতের ধোঁকা দিয়ে এবং তাক্বদীর ও তাবলীগের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যেমন হাযার হাযার মুসলমানকে নিষ্ক্রিয় করে পথে পথে চিল্লায় ঘুরানো হচ্ছে, দ্বীন কায়েমের নামে যেমন অসংখ্য মানুষকে অনৈসলামী রাজনীতির নোংরা ড্রেনে হাবুডুবু খাওয়ানো হচ্ছে, মা‘রেফাতের নামে কাশফ ও ইলহামের মায়া-মরীচিকায় যেমন অসংখ্য লোককে খানক্বাহ ও কবরপূজায় বন্দী করে ফেলা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যেমন মুসলমানদের হাত দিয়েই ইসলামকে জাতীয় সংসদ থেকে বের করে মসজিদে বন্দী করা হয়েছে, তেমনি সাম্প্রতিককালে জিহাদের ধোঁকা দিয়ে বহু তরুণকে বোমাবাজিতে নামানো হচ্ছে। অতএব হে জাতি! সাবধান হও!

[1]. শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৩৬৯৬; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৩৬ ‘নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা’ অধ্যায় ৭/২৫১ পৃঃ।

[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৭১, ‘নেতৃত্ব ও পদ মর্যাদা’ অধ্যায়; ঐ, বঙ্গানুবাদ ৭/২৩৩ পৃঃ।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৫৫।

[4]. ছহীহ বুখারী ২/৬৩০ পৃঃ টীকা-১১; ফাৎহুল বারী ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায়, ৭৫ অনুচ্ছেদ ৭/৭০৫ পৃঃ।

[5]. বুখারী, মুসলিম হা/২৪০৬ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ।

১৪
উপসংহার
পরিশেষে বলব যে, আল্লাহর রাসূলের প্রদর্শিত পদ্ধতিই দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি। নিজের এবং নিবেদিতপ্রাণ কিছু সাথীর দিনরাত নিরন্তর দাওয়াত ও জিহাদী তৎপরতার মাধ্যমেই তিনি জাহেলী আরবের শিরকী সমাজে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুগে যুগে সেপথেই তাওহীদ কায়েম হয়েছে, ইনশাআল্লাহ আজও হবে। দাওয়াতের জন্য একক ব্যক্তিই যথেষ্ট। কিন্তু জিহাদের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা অপরিহার্য, যাকে ‘সংগঠন’ বলা হয়। আর সেখানে গিয়েই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) জান্নাতের বিনিময়ে তাঁর অনুসারীদের নিকট থেকে বায়‘আত ও অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন এবং মুসলিম উম্মাহকে সর্বদা জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের এবং আমীরের আদেশ শ্রবণ ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।[1] এমনকি কোন নির্জন ভূমিতে তিনজন মুসলমান থাকলেও একজনকে ‘আমীর’ মেনে নিয়ে তাঁর আদেশ মতে সুশৃংখলভাবে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।[2] আজও যদি কেউ আন্তরিকভাবে দ্বীন কায়েম করতে চান, তবে তাকে ঐ পদ্ধতি ধরেই এগোতে হবে, যে পথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এগিয়েছিলেন। চাই তিনি বাংলাদেশে বসবাস করুন, চাই ভিনদেশে বসবাস করুন। সর্বাগ্রে তাকে নিজের ব্যক্তি জীবনে ও পারিবারিক জীবনে দ্বীন কায়েম করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীন কায়েমের জন্য যেকোন ন্যায়সঙ্গত পন্থা অবলম্বন করা যাবে। কিন্তু ‘তাওহীদ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হ’ল সশস্ত্র সংগ্রাম’ ‘ইসলামী হুকুমত কায়েম করাটাই হ’ল ইক্বামতে দ্বীন ও সবচেয়ে বড় ইবাদত’ ‘রাষ্ট্র কায়েম না করতে পারলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যাবে না’, এই সব ধারণাই হ’ল চরমপন্থী খারেজী আক্বীদার অনুরূপ। যা আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের আক্বীদা বহির্ভূত। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথের হেদায়াত দান করুন। আমীন!!

[1]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩৬৯৪।

[2]. আহমাদ, সনদ ছহীহ।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন