HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

হিংসা ও অহংকার

লেখকঃ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
হিংসা ও অহংকার

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

প্রকাশক : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,

হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ৪৯

ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,

মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০

১ম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ

নির্ধারিত মূল্য : ৩০ (ত্রিশ) টাকা মাত্র।

ভূমিকা
মানব সমাজে শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্টকারী দু’টি দুরারোগ্য ব্যাধির নাম ‘হিংসা ও অহংকার’। দুনিয়াবী কোন ঔষধ দিয়ে এ দু’টি রোগ সারানোর কোন উপায় নেই। উক্ত দু’টি বিষয়ে মাসিক আত-তাহরীক-এর দরসে হাদীছ (১৬/৮ সংখ্যা মে ২০১৩) ও দরসে কুরআন (১৭/৬ সংখ্যা মার্চ ২০১৪)-এর নিয়মিত কলামে মাননীয় লেখকের দু’টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধ দু’টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে আমরা সম্মানিত লেখকের মাধ্যমে দু’টি নিবন্ধকে একত্রে পরিমার্জিত করে বই আকারে প্রকাশ করলাম। স্বভাবতঃই এতে অনেক কিছুর সংযোজন ও বিয়োজন ঘটেছে। যা বিষয়বস্ত্তটিকে আরও পরিণত করেছে। খোলা মনে পাঠ করলে এর দ্বারা আল্লাহ অনেককে উক্ত ব্যাধি থেকে মুক্তি দিবেন বলে আশা করি।

আল্লাহ মাননীয় লেখক এবং তাঁর পিতা-মাতা ও পরিবারবর্গকে ইহকালে ও পরকালে সর্বোত্তম পারিতোষিক দান করুন- আমীন!

প্রথম ভাগ হিংসা
মানব মনের রোগসমূহের মধ্যে একটি কঠিন রোগের নাম হ’ল ‘হিংসা’। যা মানুষকে পশুর চাইতে নীচে নামিয়ে দেয়। হিংসার পারিভাষিক অর্থ تَمَنَّى زَوَالَ نِعْمَةِ الْمَحْسُوْدِ ‘হিংসাকৃত ব্যক্তির নে‘মতের ধ্বংস কামনা করা’। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَسُلِّطَ عَلَى هَلَكَتِهِ فِى الْحَقِّ ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْحِكْمَةَ ، فَهْوَ يَقْضِى بِهَا وَيُعَلِّمُهَا ‘দু’টি বস্ত্ত ভিন্ন অন্য কিছুতে হিংসা সিদ্ধ নয়। ১. আল্লাহ যাকে মাল দিয়েছেন। অতঃপর সে তা হক-এর পথে ব্যয় করে। ২. আল্লাহ যাকে প্রজ্ঞা দান করেছেন। সে তা দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং শিক্ষা দেয়’।[1] এটিকে মূলতঃ হিংসা বলা হয় না, বরং ঈর্ষা বলা হয়। ইমাম রাযী বলেন, যখন আল্লাহ তোমার কোন ভাইকে কোন নে‘মত দান করেন, আর তুমি যদি তার উক্ত নে‘মতের ধ্বংস কামনা কর, তাহ’লে সেটি হ’ল হিংসা ( الْحَسَدُ )। আর যদি তুমি নিজের জন্য অনুরূপ নে‘মত কামনা কর, তাহ’লে সেটি হ’ল ঈর্ষা ( الْغِبْطَةُ )। হিংসা নিষিদ্ধ এবং ঈর্ষা সিদ্ধ, বরং আকাংখিত। উক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটাই বলতে চেয়েছেন। ইমাম নববী বলেন, হিংসা দু’প্রকারের: প্রকৃত ( حقيقي ) ও রূপক ( مجازي )। প্রকৃত হিংসা হল, تمنى زوال النعمة عن صاحبها ‘ব্যক্তির নে‘মত দূর হয়ে যাওয়ার কামনা করা’। এটি সর্বসম্মতভাবে হারাম। পক্ষান্তরে রূপক হ’ল ঈর্ষা ( الغبطة )। যা অন্যের অনুরূপ নে‘মত কামনা করে, তার নে‘মত দূর হওয়ার কামনা ছাড়াই। এরূপ ঈর্ষা করা দুনিয়াবী ব্যাপারে ‘মুবাহ’ এবং দ্বীনী ব্যাপারে ‘মুস্তাহাব’। যেমন ইবাদতে রাত্রি জাগরণে প্রতিযোগিতা করা, দান-ছাদাক্বায় প্রতিযোগিতা করা ইত্যাদি।[2]

উদাহরণ স্বরূপ তাবুকের যুদ্ধে গমনের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সকলের নিকট দান চাইলেন, তখন ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন যে, আমি আমার অর্ধেক মাল-সম্পদ নিয়ে হাযির হ’লাম। আর মনে মনে ভাবলাম, আজ আমি আবুবকরকে ছাড়িয়ে যাব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, مَا أَبْقَيْتَ لأَهْلِكَ؟ ‘তুমি তোমার পরিবারের জন্য কি রেখে এসেছ? বললাম, অতটা। এরপর আবুবকর এলেন তার সব মাল-সম্পদ নিয়ে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তিনি বললেন, أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ ‘আমি তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি’। তখন আমি বললাম, لاَ أُسَابِقُكَ إِلَى شَىْءٍ أَبَدًا ‘কোন ব্যাপারেই আমি কখনো আপনার সাথে পেরে উঠিনি’।[3]

এটা ছিল আখেরাতে নেকী অর্জনের প্রতিযোগিতা। তাই এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু যখন এটি দুনিয়াবী সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা হবে। সেখানে প্রথমে হিংসা না থাকলেও পরে তা পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষে রূপ নেবে। যেমন আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বললেন, إِذَا فُتِحَتْ عَلَيْكُمْ فَارِسُ وَالرُّومُ أَىُّ قَوْمٍ أَنْتُمْ যখন তোমরা পারস্য ও রোমক সাম্রাজ্য জয় করবে, তখন তোমরা কেমন হবে? আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ বললেন, যেমন আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন أَوْ غَيْرَ ذَلِكَ، تَتَنَافَسُونَ ثُمَّ تَتَحَاسَدُونَ ثُمَّ تَتَدَابَرُونَ ثُمَّ تَتَبَاغَضُونَ أَوْ نَحْوَ ذَلِكَ বরং অন্য কিছু। তোমরা প্রতিযোগিতা করবে। অতঃপর পরস্পরে হিংসা করবে। অতঃপর পরস্পরকে পরিত্যাগ করবে। অতঃপর পরস্পরে বিদ্বেষ করবে বা অনুরূপ করবে’।[4] তিনি বলেন, فَوَاللهِ مَا الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ وَلَكِنِّى أَخْشَى أَنْ تُبْسَطَ الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا فَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের দরিদ্রতাকে ভয় পাইনা। বরং আমি তোমাদের ব্যাপারে ভয় পাই যে, তোমাদের উপর দুনিয়াবী প্রাচুর্য আসবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর এসেছিল। অতঃপর তোমরা প্রতিযোগিতা করবে। যেমন তারা করেছিল। অতঃপর প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করেছিল’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَتُلْهِيَكُمْ كَمَا أَلْهَتْهُمْ ‘তোমাদেরকে উদাসীন করে দিবে, যেমন তাদেরকে উদাসীন করেছিল’। [6]

উক্ত হাদীছে যে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে, তার দু’টি দিক রয়েছে। এক- যদি উক্ত প্রাচুর্যকে ধ্বংস করার চিন্তা কারু মাথায় আসে, তবে সেটা হবে ‘হিংসা’। যা নিন্দনীয়। দুই- যদি তার হেদায়াত কামনা করে এবং নিজেও অনুরূপ প্রাচুর্যের কামনা করে, তবে সেটা হবে বৈধ ও প্রশংসনীয়। যাকে কুরআনে ও হাদীছে ‘তানাফুস’ ( التنافس ) বা প্রতিযোগিতা বলা হয়েছে।

[1]. বুখারী হা/৭৩; মিশকাত হা/২০২ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[2]. মুসলিম শরহ নববী হা/৮১৬-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।

[3]. আবুদাঊদ হা/১৬৭৮; তিরমিযী হা/৩৬৭৫; মিশকাত হা/৬০২১।

[4]. মুসলিম হা/২৬৬২; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৬।

[5]. তিরমিযী হা/২৪৬২, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৭।

[6]. বুখারী হা/৬৪২৫; মুসলিম হা/২৯৬১; মিশকাত হা/৫১৬৩।

হিংসার প্রতি নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা
কুরআন থেকে :

(১) হিংসুকদের অনিষ্টকারিতা হ’তে বাঁচার জন্য আল্লাহ আমাদের প্রার্থনা করতে বলেছেন - وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ ‘(হে আল্লাহ!) আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই হিংসুকের অনিষ্টকারিতা হতে যখন সে হিংসা করে’ (ফালাক্ব ১১৩/৫)। ইমাম রাযী বলেন, আল্লাহ মানুষের সকল নষ্টের মূল হিসাবে এখানে ‘হিংসা’ দিয়ে সূরা শেষ করেছেন। যেমন শয়তানের সকল অনিষ্টের মূল হিসাবে ‘মনে খটকা সৃষ্টি’ (ওয়াসওয়াসা) দিয়ে সূরা নাস শেষ করেছেন’। যা তারতীরের দিক দিয়ে কুরআনের শেষ সূরা। এর মাধ্যমে মানুষকে মানুষের হিংসা থেকে এবং শয়তানের ধোঁকা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। কেননা এ দু’টি থেকে বাঁচার অন্য কোন উপায় নেই আল্লাহর রহমত ব্যতীত। হুসাইন বিন ফযল বলেন, আল্লাহ এই সূরাতে যাবতীয় মন্দকে একত্রিত করেছেন এবং ‘হিংসা’ দিয়ে শেষ করেছেন এটা বুঝানোর জন্য যে এটাই হ’ল সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাব’।

বস্ত্ততঃ যে সমাজে হিংসার প্রসার যত বেশী, সে সমাজে অশান্তি তত বেশী। সমাজে অতক্ষণ যাবত কল্যাণ ও শান্তি বিরাজ করে, যতক্ষণ সেখানে হিংসার প্রসার না ঘটে। যামরাহ বিন ছা‘লাবাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا لَمْ يَتَحَاسَدُوْا ‘মানুষ অতক্ষণ কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ তারা পরস্পরে হিংসা না করবে’।[1]

(২) আল্লাহ নিজেই হিংসাকে নিন্দা করেছেন। যেমন তিনি আহলে কিতাবদের বদস্বভাব বর্ণনা করে বলেন, أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللهُ مِن فَضْلِهِ ‘তবে কি তারা লোকদের (মুসলমানদের) প্রতি এজন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ হতে কিছু দান করেছেন? (নিসা ৪/৫৪)। অত্র আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী বলেন, وَالْحَسَدُ مَذْمُومٌ وَصَاحِبُهُ مَغْمُومٌ وَهُوَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ ‘হিংসা নিন্দনীয় এবং হিংসুক ব্যক্তি সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। হিংসা সকল নেকী খেয়ে ফেলে যেমন আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে’ (কুরতুবী)।

হাদীছ থেকে :

(১) হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন وَلاَ تَبَاغَضُوْا ولاَ تَحَاسَدُوْا وَلاَ تَدَابَرُوْا وَلاَتَقَاطَعُوْا وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا ‘তোমরা পরস্পরে বিদ্বেষ করো না, হিংসা করো না, একে অপরকে পরিত্যাগ করো না, একে অপরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না। তোমরা পরস্পরে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[2] অত্র হাদীছে মানবতাকে হত্যাকারী কয়েকটি দুরারোগ্য ব্যাধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইসলামী সমাজকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে দেয়। এখানে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হলেও তা মূলতঃ একটি থেকে উৎসারিত। আর তা হ’ল ‘হিংসা’। এই মূল বিষবৃক্ষ থেকেই বাকীগুলি কাঁটাযুক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ডাল-পালার ন্যায় বেরিয়ে আসে। হাসান বাছরী বলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে হিংসা রয়েছে। যতক্ষণ সেটি অবাধ্যতা ও যুলুমের দিকে সীমা অতিক্রম না করে, ততক্ষণ তা মানুষের কোন ক্ষতি করে না’।[3]

(২) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, تُفْتَحُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَفِيْ رِوَايَةٍ : تُعْرَضُ الأَعْمَالُ فِى كُلِّ يَوْمِ خَمِيسٍ وَاثْنَيْنِ فَيَغْفِرُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِى ذَلِكَ الْيَوْمِ لِكُلِّ امْرِئٍ لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا إِلاَّ امْرَأً كَانَتْ بَيْنَهُ وَبَيْنَ أَخِيهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ ارْكُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا ارْكُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজা সমূহ খোলা হয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ দু’দিন বান্দার আমলনামা আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। অতঃপর আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি এমন সবাইকে মাফ করা হয়। কেবল ঐ দু’জন ব্যতীত যাদের পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বিদ্যমান রয়েছে। বলা হয়, এদের ছাড়, যতক্ষণ না এরা আপোষে মীমাংসা করে নেয়’।[4]

যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করে, তার ঈমান হয় ত্রুটিপূর্ণ। হিংসা তার সমস্ত নেকীকে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন ধীরে ধীরে কাঠকে খেয়ে ফেলে। এভাবে সে নিজের আগুনে নিজে জ্বলে-পুড়ে মরে। পরিণামে তার পূর্বে কৃত সৎকর্মসমূহের নেকীগুলিও ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায়। ঐ অবস্থায় তার মৃত্যু হ’লে সে নিঃস্ব অবস্থায় আল্লাহর কাছে চলে যায়।

সালাফে ছালেহীনের বক্তব্য সমূহ :

(১) হযরত মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, كُلُّ النَّاسِ أَسْتَطِيْعُ أَنْ أَرْضِيَهُ إِلاَّ حَاسِدُ نِعْمَةٍ، فَإِنَّهُ لاَ يُرْضِيْهِ إِلاَّ زَوَالُهَا ‘সকল মানুষকে আমি খুশী করতে সক্ষম, কেবল হিংসুক ব্যতীত। কেননা সে অন্যের নে‘মত দূর না হওয়া পর্যন্ত খুশী হয় না’।[5]

(২) তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হিঃ) বলেন, দুনিয়াবী কোন ব্যাপারে আমি কোন ব্যক্তিকে হিংসা করি না। কেননা সে ব্যক্তি যদি জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহ’লে আমি কিভাবে দুনিয়াবী বিষয়ে তাকে হিংসা করব? অথচ জান্নাতের তুলনায় দুনিয়া অতীব তুচ্ছ। আর যদি ঐ ব্যক্তি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহ’লে আমি কিভাবে তাকে দুনিয়াবী বিষয়ে হিংসা করব? অথচ ঐ ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে?[6]

(৩) অন্যতম তাবেঈ হাসান বাছরী (২১-১১০ হিঃ) বলেন, হিংসুকের চাইতে বড় কোন যালেমকে আমি দেখিনি যে মযলূমের মতোই। কেননা সে বেঁচে থাকে। অথচ দুঃখ তার অবশ্যম্ভাবী এবং দুশ্চিন্তা তার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী’।[7]

(৪) আবু হাতেম দারেমী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ) বলেন, জ্ঞানীর উপর ওয়াজিব হ’ল সর্বাবস্থায় হিংসা হ’তে দূরে থাকা। কেননা হিংসার সবচাইতে নীচু স্তর হ’ল তাক্বদীরের উপর সন্তুষ্টি পরিত্যাগ করা এবং আল্লাহ স্বীয় বান্দার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তার বিপরীত কামনা করা। তিনি বলেন, الحسدُ من أخلاقِ اللِّئَامِ، وتركُه من أفعال الكِرام، ولكلِّ حريقٍ مُطْفِئٌ، ونارُ الحسدِ لا تَطْفَأُ হিংসা হ’ল নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের চরিত্র এবং তা পরিত্যাগ করা হ’ল মর্যাদাবান ব্যক্তিদের কর্ম। আর প্রত্যেক আগুনের নির্বাপক আছে। কিন্তু হিংসার আগুন নির্বাপিত হয় না’।[8]

(৫) আবুল লাইছ সমরকন্দী (মৃঃ ৩৭৩ হিঃ) বলেন, হিংসাকৃত ব্যক্তির আগেই হিংসুকের নিকট পাঁচটি শাস্তি পৌঁছে যায়। (ক) দুশ্চিন্তা, যা বিচ্ছিন্ন হয় না। (খ) কষ্ট, যার কোন পুরস্কার পাওয়া যায় না। (গ) তিরষ্কার, যাকে প্রশংসা করা হয় না (ঘ) আল্লাহর ক্রোধ অর্জন করা এবং (ঙ) তার জন্য (কল্যাণ কর্মের) তাওফীকের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া।[9]

[1]. ত্বাবারাণী হা/৮১৫৭; ছহীহাহ হা/৩৩৮৬।

[2]. বুখারী, ফাৎহুলবারী, হা/৬০৭৬; মুসলিম হা/২৫৫৯; মিশকাত হা/৫০২৮।

[3]. ফাৎহুল বারী হা/৬০৬৫।

[4]. মুসলিম হা/২৫৬৫; মিশকাত হা/৫০২৯-৩০।

[5]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশ্ক্ব ৫৯/২০০ পৃঃ।

[6]. বায়হাক্বী, যুহ্দ আল-কাবীর ৩১৫ পৃঃ।

[7]. ইবনু আব্দি রবিবহী, আল-ইক্বদুল ফারীদ ২/২৭০ পৃঃ।

[8]. আবু হাতেম দারেমী, রওযাতুল উক্বালা ১৩৪ পৃঃ।

[9]. শিহাবুদ্দীন আবশীহী, আল-মুসতাত্বরাফ ২২১ পৃঃ।

হিংসার পরিণাম
(ক) দুনিয়াবী পরিণতি :

হিংসুক ব্যক্তি অন্যকে ক্ষতি করার আগে সে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেননা (১) শুরুতেই সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। হিংসা দূর না হওয়া পর্যন্ত এটাই তার জন্য স্থায়ী দুনিয়াবী শাস্তি। (২) তার চেহারা সর্বদা মলিন থাকে। তার সাথে তার পরিবারে হাসি ও আনন্দ থাকে না। (৩) অন্যের ক্ষতি করার চক্রান্তে ও ষড়যন্ত্রে সে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে সে সর্বদা ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকে। নিশুতি রাতে বাঁশঝাড়ে কঞ্চির শব্দে কল্পিত জিনের ভয়ে হার্টফেল করার মত হিংসুক ব্যক্তিও সর্বদা কল্পিত শত্রুর ভয়ে আড়ষ্ট থাকে। (৪) তারই মত লোকেরা তার বন্ধু হয়। ফলে সৎ সঙ্গ থেকে সে বঞ্চিত হয়। (৫) ঘুণ পোকা যেমন কাঁচা বাঁশকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খায়, হিংসুক ব্যক্তির অন্তর তেমনি হিংসার আগুন কুরে কুরে খায়। এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়, যেমন ঘুণে ধরা বাঁশ হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে শেষ হয়ে যায়।

বিশ্বে যত অশান্তি তার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল পারস্পরিক হিংসা ও প্রতিহিংসা। হিংসা ও বিদ্বেষ মানবতাকে হত্যা করে। হিংসুক ব্যক্তি কোন অবস্থায় শান্তি পায় না। তার কোন সৎবন্ধু জোটে না। সে কখনোই সুপথপ্রাপ্ত হয় না। তার হৃদয়-মন থাকে সর্বদা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মত। যেখান থেকে সর্বদা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, ধোঁকা ও মিথ্যাচারের দুর্গন্ধযুক্ত স্ফুলিঙ্গ সমূহ নির্গত হয়। সে সর্বদা নিজেকে বিজয়ী ভাবে। অথচ সেই-ই সবচেয়ে পরাজিত। সে নিজেকে বীর ভাবে, অথচ সেই-ই সবচেয়ে ভীরু। ভীত-চকিত সর্পের ন্যায় সে তার কল্পিত প্রতিপক্ষকে ছোবল মারার জন্য সর্বদা ফণা উঁচিয়ে থাকে। এভাবে আমৃত্যু সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। ফলে হিংসা-বিদ্বেষ অন্যকে হত্যা করার আগে হিংসুককে হত্যা করে। এদিক দিয়ে বিচার করলে হিংসাকেই বড় ন্যায় বিচারক বলতে হয়। কেননা সে সর্বাগ্রে হিংসুককে শাস্তি দেয়, অতঃপর অন্যকে। হিংসুক ব্যক্তি শত চেষ্টায়ও তা গোপন রাখতে পারে না। কেননা শত্রুকে ঘায়েল করার পূর্বে সে নিজেই ঘায়েল হয়। যার নমুনা তার চেহারায় ও কর্মে ফুটে ওঠে। জনৈক কবি তাই বলেন,

يا حاسداً لي على نعمتي + أتدري على من أسأتَ الأدبْ

أسأتَ على الله في فعلهِ + لأنكَ لم ترضَ لي ما قسمْ

فأخزاكَ ربي بأنْ زادني + وسدَّ عليكَ وجوهَ الطلبْ

(১) ‘হে হিংসুক ব্যক্তি! যে আমার নে‘মতে হিংসা করে থাক। তুমি কি জানো তুমি কার সাথে মন্দ আচরণ করো? (২) তুমি আল্লাহর কর্মকে মন্দ বলে থাক। কেননা তিনি আমাকে যা (রহমত) বণ্টন করেছেন তুমি তাতে সন্তুষ্ট নও। (৩) অতএব আমার প্রভু তোমাকে লাঞ্ছিত করুন এ কারণে যে তিনি আমাকে রহমত বেশী দিয়েছেন। আর তোমার উপরে তা বন্ধ করেছেন’।[1]

সৎকর্মশীল ঈমানদ্রন্যর হিংসার শিকার হন। তারা আসামী হন, কিন্তু সহজে বাদী হন না। যুগে যুগে এটাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এজন্য প্রবাদ বাক্য হয়ে রয়েছে, هل مَاتَ الْبُخَارِيُّ غَيْرَ مَحْسُوْدٍ ؟ ‘ইমাম বুখারী কি হিংসুকের হামলা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করতে পেরেছেন’? অন্য একজন পন্ডিত বলেন, الناسُ حاسدٌ ومحسودٌ، ولكلِّ نعمةٍ حَسودٌ ‘মানুষ হিংসুক ও হিংসাকৃত। আর প্রত্যেক নে‘মতের জন্যই হিংসুক রয়েছে’। এর পরেও প্রকৃত মুমিনগণ পাল্টা হিংসা করেন না। বিদ্বেষ করেন না। বরং প্রতিপক্ষের হেদায়াত কামনা করেন। কবি কুমায়েত আল-আসাদী বলেন,

إن يحسدونني فإني غيرُ لائمهم + قبلي من الناس أهلُ الفضل قد حُسِدُوا

فدام لي ولهم ما بي وما بهم + ومات أكثرُنا غيظاً بما يجدُ

أنا الذي يجدوني في صدورهم + لا أرتقي صدراً منها ولا أرِدُ

(১) তারা যদি আমাকে হিংসা করে, পাল্টা আমি তাদের নিন্দা করব না। কেননা আমার পূর্বে বহু কল্যাণময় ব্যক্তি হিংসার শিকার হয়েছেন। (২) অতএব আমার ও তাদের সঙ্গে (আল্লাহর রহমত) যা ছিল, তা থাকবে। অথচ আমাদের অধিকাংশ মানুষ মারা গেছে যা সে পেয়েছে তাতে ক্রুদ্ধ অবস্থায়। (৩) আমি সেই ব্যক্তি যে, তারা আমাকে সর্বদা তাদের বুকের মধ্যে পাবে। যেখান থেকে আমি না ফিরে গেছি, না অবতরণ করেছি’।[2]

(খ) আখেরাতের পরিণতি :

মৃত্যুর পর কবরে তাকে গ্রাস করে ভয়াবহ আযাব। অতঃপর কিয়ামতের দিন সে উঠবে ভীত-নমিত ও মলিন চেহারায় অধোমুখি হয়ে। আল্লাহ বলেন, وَوُجُوْهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ- تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ- أُوْلَئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ ‘অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে ধূলি-ধূসরিত’। ‘কালিমালিপ্ত’। তারা হ’ল অবিশ্বাসী পাপিষ্ঠ’ (‘আবাসা ৮০/৪০-৪২)। তাদেরকে দেখে যেমন দুনিয়াতে চেনা যেত। আখেরাতেও তেমনি চেনা যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, يُعْرَفُ الْمُجْرِمُوْنَ بِسِيمَاهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِيْ وَالْأَقْدَامِ ‘অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের চেহারা দেখে। অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে কপালের চুল ও পা ধরে’ (রহমান ৫৫/৪১)।

[1]. মুছত্বফা হাশেমী, জাওয়াহিরুল আদব ২/৪৮৭।

[2]. জাওয়াহিরুল আদব ২/২৭০।

হৃদয়কে হিংসামুক্ত রাখার উপায় সমূহ
(১) আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা : হিংসা হ’ল শয়তানী আমল। শয়তান সর্বদা মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। তাই তার হাত থেকে বাঁচার জন্য শয়তানের প্রতি তীব্র ঘৃণা থাকা এবং তার বিরুদ্ধে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা আবশ্যক। অতএব যখনই কারু প্রতি হিংসার উদ্রেক হয়, তখনই আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রজীম বলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করবে এবং বাম দিকে তিনবার থুক মারবে ।[1] আল্লাহ বলেন, وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘অতঃপর শয়তান যখনই তোমাকে কুমন্ত্রণা দেয়, তখনই তুমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৬)।

(২) হিংসার বুদ্বুদ হৃদয়ে উত্থিত হওয়ার সাথে সাথে তা মুছে ফেলা এবং অন্যদিকে মন দেওয়া। কেননা এটি মনের মধ্যে গোপনে আসে ও দ্বীনকে শেষ করে দেয়। যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمُ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِىَ الْحَالِقَةُ لاَ أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعْرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ- وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَفَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِمَا يُثَبِّتُ ذَاكُمْ لَكُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ ‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের রোগ তোমাদের মধ্যে গোপনে প্রবেশ করবে। আর তা হ’ল হিংসা ও বিদ্বেষ, যা সবকিছুর মুন্ডনকারী। আমি বলছি না, চুল মুন্ডনকারী। বরং তা হবে দ্বীনকে মুন্ডনকারী। যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না ঈমান আনবে। আর তোমরা ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের খবর দিব না, কোন বস্ত্ত তোমাদের মধ্যে ভালবাসাকে দৃঢ় করবে? তোমরা পরস্পরে বেশী বেশী সালাম কর’।[2] আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِيَّاكُمْ وَسُوءَ ذَاتِ الْبَيْنِ فَإِنَّهَا الْحَالِقَةُ- قَالَ أَبُو عِيسَى يَعْنِى الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ ‘তোমরা পারস্পরিক বিদ্বেষের মন্দ হ’তে বেঁচে থাক। কেননা এটি দ্বীনের মুন্ডনকারী’।[3]

(৩) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহ বান্দাকে নে‘মত দেন তাকে পরীক্ষার জন্য। মুমিন এতে খুশী হয় ও শুকরিয়া আদায় করে। সে বিপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং এর উত্তম প্রতিদান কামনা করে। কিন্তু কাফির-মুনাফিক এতে ক্রুদ্ধ হয় এবং অন্যকে হিংসা করে। আল্লাহ বলেন, أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُم مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُم بَعْضاً سُخْرِيّاً وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ ‘তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করে? আমরাই পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকা বণ্টন করি এবং তাদেরকে একে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি। যাতে তারা পরস্পরে কাজ নিতে পারে। আর তারা যা জমা করে, তার চাইতে তোমার প্রতিপালকের রহমত অনেক উত্তম’ (যুখরুফ ৪৩/৩২)।

(৪) আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা : যত কষ্টই হৌক বা যত কঠিনই হৌক, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে নিয়ে হিংসা থেকে নিবৃত্ত হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ‘আমার রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর। আর যা থেকে নিষেধ করেন, তা বর্জন কর’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরো বলেন, وَمَن يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর সেটাই হ’ল মহা সফলতা’ (নিসা ৪/১৩)। কেননা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে তার রহমত লাভ করা পার্থিব সকল কিছুর চাইতে উত্তম। আল্লাহ বলেন, هُنَالِكَ الْوَلاَيَةُ لِلَّهِ الْحَقِّ هُوَ خَيْرٌ ثَوَاباً وَخَيْرٌ عُقْباً ‘সবকিছুর অভিভাবকত্ব আল্লাহর। যিনি সত্য। পুরস্কার দানে ও পরিণাম নির্ধারণে তিনিই শ্রেষ্ঠ’ (কাহফ ১৮/৪৪)।

(৫) হিংসার জ্বলন সম্পর্কে চিন্তা করা : হিংসুক ব্যক্তি হিংসার আগুনে নিজেই জ্বলে মরে এবং সে কেবল নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। তার অন্তরে সুখ বলে কিছু থাকে না। সর্বদা অন্যের ধ্বংস চিন্তায় বিভোর থাকায় নিজেকেই সে ধ্বংস করে ফেলে। সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা তাকে দৈহিক ও মানসিক রোগীতে পরিণত করে। কোন ব্যাপারেই সে স্বাভাবিক ও সুন্দর সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আশপাশের সবাইকে সে তার শত্রু ভাবতে থাকে। হিংসায় বুঁদ হওয়ার ফলে সে সর্বদা অস্বাভাবিক আচরণ করে। আল্লাহ বলেন, وَلاَ يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ إِلاَّ بِأَهْلِهِ ‘কুট চক্রান্ত কেবল তার মালিককেই পরিবেষ্টন করে থাকে’ (ফাত্বির ৩৫/৪৩)। তিনি বলেন, قُلْ مُوْتُوْا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ ‘(হে নবী) তুমি বল, তোমরা নিজেদের আক্রোশে জ্বলে-পুড়ে মরো। আল্লাহ অন্তরের বিষয়ে সম্যক অবগত’ (আলে ইমরান ৩/১১৯)। এভাবে হিংসায় যে কোন ফায়েদা নেই সেটা চিন্তা করলে মানুষ এই নোংরা স্বভাব থেকে ফিরে আসবে।

(৬) লোকে তাকে ঘৃণা করে, এটা উপলব্ধি করা : হিংসা ভিতরের বস্ত্ত। যা দেখা যায় না। কিন্তু সেটি প্রকাশ পায় মানুষের কর্মে ও আচরণে। যেমন আল্লাহ বলেন, قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ ‘তাদের মুখ দিয়ে বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। আর যা তাদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তা আরও অনেক বেশী’ (আলে ইমরান ৩/১১৮)। অতএব হিংসুক ব্যক্তি যত দ্রুত তার প্রতি মানুষের ঘৃণা বুঝতে পারবে, সে তত দ্রুত ফিরে আসবে।

(৭) আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হিংসা বর্জন করা : যখন মানুষ জানবে যে, হিংসায় জাহান্নাম ও তা পরিত্যাগে জান্নাত, তখন সে চিরস্থায়ী জান্নাত পাওয়ার আশায় ক্ষণস্থায়ী তুচ্ছ বস্ত্ত পরিত্যাগ করবে। আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى- فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى ‘আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হ’তে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৪০-৪১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ ‘যা তোমার উপকারে আসবে, সেদিকে তুমি প্রলুব্ধ হও’।[4]

(৮) সকল কাজের বিনিময় আল্লাহর নিকটে কামনা করা : মুসলমানকে আল্লাহর পথে সংগ্রামে পরস্পরকে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় থাকতে বলা হয়েছে (ছফ ৬১/৪)। এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত মনে আমরা পরস্পরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারব এবং এর বিনিময় স্রেফ আল্লাহর নিকটে কামনা করব। যেমন প্রত্যেক নবী বলেছেন, وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلاَّ عَلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় চাই না। আমার বিনিময় তো কেবল বিশ্বপালক আল্লাহর নিকটেই রয়েছে’ (শো‘আরা ২৬/১০৯, ১২৭. ১৪৫, ১৬৪, ১৮০)।

(৯) এছাড়া নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়া আবশ্যক। যা আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীকে শিখিয়ে দিয়েছেন, رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيْمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلاَّ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوْفٌ رَحِيْمٌ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ও আমাদের সেইসব ভাইকে তুমি ক্ষমা কর, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে। আর তুমি আমাদের অন্তরে মুমিনদের বিরুদ্ধে কোনরূপ বিদ্বেষ সঞ্চার করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই তুমি স্নেহশীল ও দয়াবান’ (হাশর ৫৯/১০)।

[1]. মুসলিম হা/২২০৩; মিশকাত হা/৭৭, ঈমান অধ্যায় ‘মনের খটকা’ অনুচ্ছেদ।

[2]. তিরমিযী হা/২৫১০, মিশকাত হা/৫০৩৯, হাদীছ হাসান।

[3]. তিরমিযী হা/২৫০৮; মিশকাত হা/৫০৪১।

[4]. মুসলিম হা/২৬৬৪, মিশকাত হা/৫২৯৮।

হিংসুকের অনিষ্ট থেকে বাঁচার উপায় সমূহ
(১) হিংসায় ছবর করা ও পাল্টা হিংসা না করা : আল্লাহ বলেন, وَإِنْ تَصْبِرُوْا وَتَتَّقُوْا لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا ‘যদি তোমরা ছবর কর ও আল্লাহভীরুতা অবলম্বন কর, তাহ’লে ওদের চক্রান্ত তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’ (আলে ইমরান ৩/১২০)। শিশু ইউসুফকে বাঘে খেয়েছে বলে তার মিথ্যা রক্ত মাখানো জামা দেখানোর পর পিতা ইয়াকূব (আঃ) ছেলেদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা (মিথ্যা) কাহিনী বানিয়ে দিয়েছে। অতএব এখন ছবর করাই উত্তম। আর তোমরা যেসব কাহিনী শুনাচ্ছ, সে বিষয়ে আল্লাহই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল’ (ইউসুফ ১২/১৮)। আল্লাহ ইয়াকূরেব দো‘আ কবুল করেছিলেন এবং কূয়ায় সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে উঠিয়ে আল্লাহ ইউসুফকে মিসরের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন।

(২) আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করা : আল্লাহ বলেন, وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْراً ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন। আল্লাহ তার আদেশ পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বস্ত্তর পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন’ (তালাক ৬৫/৩)। বস্ত্ততঃ এটাই হল সবচেয়ে বড় উপায়।

(৩) হিংসুক ব্যক্তির প্রতি সদাচরণ করা : আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِيْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيْمٌ ‘ভাল ও মন্দ সমান নয়। তুমি ভাল দিয়ে মন্দকে প্রতিরোধ কর। তাহ’লে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৪)। আবুদ্দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ؟ صَلاَحُ ذَاتِ الْبَيْنِ فَإِنَّ فَسَادَ ذَاتِ الْبَيْنِ هِىَ الْحَالِقَةُ ‘আমি কি তোমাদেরকে ছিয়াম-ছাদাক্বা ও ছালাতের চেয়েও উত্তম কোন বিষয়ের খবর দিব? আর তা হ’ল পারস্পরিক বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া। কেননা পরস্পরের বিবাদ দ্বীনকে মুন্ডনকারী’।[1]

(৪) গোনাহ থেকে তওবা করা : বিপদাপদ বান্দার নিজের কারণেই এসে থাকে (আলে ইমরান ৩/১৬৫)। সে নিজের অজান্তেই অনেক গোনাহ করে থাকে। অথবা জেনেশুনে কিংবা বাধ্য হয়ে করে। আর বান্দা যা জানে, তার চাইতে বহুগুণ বেশী গোনাহ তার রয়েছে, যা সে জানে না। অমনিভাবে যেসব গোনাহের কথা তার স্মরণে আছে, তার চাইতে বহুগুণ বেশী গোনাহ তার স্মরণে থাকে না। তাই সর্বদা বান্দাকে জানা-অজানা সকল পাপের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয় এবং খালেছ অন্তরে তওবা করতে হয়। তাতে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে হিংসুক ব্যক্তির অনিষ্ট হতে তাকে রক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ثُمَّ نُنَجِّي رُسُلَنَا وَالَّذِينَ آمَنُواْ كَذَلِكَ حَقّاً عَلَيْنَا نُنجِ الْمُؤْمِنِينَ ‘অতঃপর আমরা নাজাত দিয়ে থাকি আমাদের রাসূলদের এবং একইভাবে মুমিনদের। কেননা আমাদের উপর হক হ’ল মুমিনদের নাজাত দেওয়া’ (ইউনুস ১০/১০৩)। তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا تُوْبُوْا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَّصُوْحاً عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لاَ يُخْزِي اللهُ النَّبِيَّ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ نُوْرُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُوْرَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধভাবে তওবা কর। যাতে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপ সমূহ মোচন করে দেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করান, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। যেদিন আল্লাহ স্বীয় নবী ও তার সাথী মুমিনদের লজ্জিত করবেন না। তাদের নূর তাদের সম্মুখে ও ডাইনে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই তুমি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (তাহরীম ৬৬/৮)।

কিয়ামতের দিন পুলছেরাত পার হবার সময় স্ব স্ব নেক আমল অনুযায়ী মুমিনদের সম্মুখে জ্যোতি থাকবে এবং তাদের ডান হাতে আমলনামা থাকবে। যেখানে জান্নাতের সুসংবাদ থাকবে। এ সময় মুনাফিকদের সম্মুখে জ্যোতি নিভে যাবে। তখন মুমিনগণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, যেন পুলছেরাত পার হওয়া পর্যন্ত তাদের জ্যোতি অব্যাহত থাকে। আর এটা তারা ঐসময় বলবে, যখন মুনাফিকরা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলবে, ‘তোমরা একটু থামো। আমরা তোমাদের থেকে কিছু জ্যোতি নিয়ে নিই। বলা হবে, তোমরা পিছনে ফিরে গিয়ে জ্যোতি তালাশ কর’... (হাদীদ ৫৭/১৩)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মুমিনদের জন্য জ্যোতিকে অব্যাহত রাখবেন।[2] আর এসবই হবে তাদের খালেছ তওবার ফল হিসাবে। আনাস (রাঃ) বলেন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী এবং ভুলকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’ল তওবাকারীগণ’।[3]

(৫) সকল চিন্তাকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া : হিংসা কারু কোন ক্ষতি করতে পারে না আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। যেমন তিনি বলেন, وَإِن يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ وَإِن يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلاَ رَآدَّ لِفَضْلِهِ يُصَيبُ بِهِ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيْمُ ‘যদি আল্লাহ তোমার কোন অকল্যাণ করেন, তবে তা দূর করার কেউ নেই তিনি ব্যতীত। আর যদি তিনি তোমার প্রতি কল্যাণের ইচ্ছা করেন, তবে তার অনুগ্রহকে ফিরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে যা চান তাকে তা দান করে থাকেন। বস্ত্ততঃ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইউনুস ১০/১০৭)।

ওহোদ যুদ্ধে দান্দান মুবারক শহীদ হলে মুখের রক্ত মুছতে মুছতে রাসূল (ছাঃ) দুঃখ করে বলেছিলেন, يْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوا وَجْهَ نَبِيِّهِمْ ‘ঐ জাতি কিভাবে সফলকাম হবে যারা তাদের নবীর চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে’? এছাড়াও তিনি সেদিন চারজন কাফের নেতার নাম ধরে তাদের বিরুদ্ধে লা‘নত করেছিলেন। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করে বলেন, لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ ‘তিনি তাদের ক্ষমা করবেন না শাস্তি দিবেন, সে ব্যাপারে তোমার কিছুই করার নেই। কারণ ওরা সীমালংঘনকারী’ (আলে ইমরান ৩/১২৮)। পরে দেখা গেল ঐ চারজন নেতাকে আল্লাহ ইসলাম কবুলের তাওফীক দান করেন এবং মৃত্যু অবধি তাদের ইসলাম সুন্দর ছিল’।[4]

উপরোক্ত আয়াত নাযিলের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-কে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ যে যালেমদের শাস্তি দিবেনই, সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা কুনূতে নাযেলাহ পাঠ নিষেধ করা হয়নি। কেননা ওহোদের ঘটনার পরের বছর ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে সংঘটিত রাজী‘ ও বি’রে মা‘ঊনার মর্মন্তুদ ঘটনায় বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে যথাক্রমে ১০ জন ও ৭০ জন শ্রেষ্ঠ ছাহাবীর অসহায়ভাবে শাহাদাত বরণের পর তিনি হত্যাকারী সম্প্রদায়গুলির বিরুদ্ধে একমাস ব্যাপী প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।[5] আল্লাহ অবশ্যই হিংসুক যালেমকে শাস্তি দিবেন দুনিয়াতে ও আখেরাতে। দুনিয়াতে মযলূমের জীবদ্দশায় বা তার মৃত্যুর পরে এ শাস্তি হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় হিংসুক আবু জাহলরা শাস্তি পেয়েছে এবং তাঁর মৃত্যুর পরে ভন্ডনবী মুসায়লামা কাযযাব আবুবকর (রাঃ)-এর সময় ইয়ামামার যুদ্ধে নিহত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ‘(আখেরাতে) কঠিন শাস্তি দেওয়ার আগে আমরা অবশ্যই (দুনিয়াতে) তাদেরকে লঘু শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব। যাতে তারা ফিরে আসে’ (সাজদাহ ৩২/২১)।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার কোন প্রিয় বান্দার ( مَنْ عَادَى لِىْ وَلِيًّا ) সাথে দুশমনী করল, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ( فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ ) ঘোষণা দিলাম’।[6] অতএব মুমিনের প্রতি হিংসাকারীর শাস্তির বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। তিনি হেদায়াত করবেন, যেমন ওহোদ যুদ্ধের কাফের নেতাদের করেছিলেন। অথবা ইহকালে ও পরকালে চরম শাস্তি দিবেন, ‘যেরূপ শাস্তি কেউ দিতে পারে না’ (ফজর ৮৯/২৫-২৬)।

[1]. তিরমিযী হা/২৫০৯; আবুদাঊদ হা/৪৯১৯; মিশকাত হা/৫০৩৮।

[2]. ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হাদীদ ১২-১৩ এবং তাহরীম ৮ আয়াত।

[3]. তিরমিযী হা/২৪৯৯, ইবনু মাজাহ হা/৪২৫১; মিশকাত হা/২৩৪১।

[4]. আহমাদ হা/১৪১০৪, তিরমিযী হা/৩০০২-০৫; ঐ চারজন ছিলেন আবু সুফিয়ান, হারেছ বিন হিশাম, ছাফওয়ান বিন উমাইয়া (তিরমিযী হা/৩০০৪) এবং সুহায়েল বিন আমর (বুখারী হা/৪০৭০)।

[5]. বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১২৮৯-৯১ ‘কুনূত’ অনুচ্ছেদ।

[6]. বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত হা/২২৬৬।

মুসলমানদের উন্নতির কারণ
ইসলামের সোনালী যুগে মুসলমানদের উন্নতি ও বিশ্ব বিজয়ের মূলে কারণ ছিল তাদের পারস্পরিক মহববত-ভালোবাসা ও বিদ্বেষমুক্ত হৃদয়ের সৃদৃঢ় বন্ধন। তারা অন্যের দুঃখ-বেদনাকে নিজের সাথে ভাগ করে নিতেন। তারা অন্যের জন্য সেটাই ভালবাসতেন, যেটা নিজের জন্য ভালবাসতেন। হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য ঐ বস্ত্ত ভালবাসবে, যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’।[1] এ বিষয়ে মক্কার মুহাজির মুসলমানদের জন্য মদীনার আনছারগণের অনন্য ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلاَ يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘যারা (মক্কা হ’তে মুহাজিরদের আগমনের) পূর্ব থেকেই মদীনায় বসবাস করত এবং ঈমান এনেছিল, তারা (আনছাররা) মুহাজিরদের ভালবাসে এবং তাদেরকে যা (সম্পদ ও উচ্চ সম্মান) দেওয়া হয়েছে, তা পাওয়ার জন্য নিজেদের অন্তরে কোনরূপ প্রয়োজন অনুভব করে না। আর তারা নিজেদের উপরে তাদের অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদের নিজেদেরই ছিল অন্নকষ্ট। বস্ত্ততঃ যারা হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)। এমনকি যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যু পথযাত্রী মুসলিম সৈনিক তৃষ্ণার্ত অন্য সৈনিকের স্বার্থে নিজে পানি পান না করেই প্রাণত্যাগ করে মৃত্যুর দুয়ারে মানবতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন। যেমন ইয়ারমূকের যুদ্ধে ঘটেছিল।[2] ইতিহাসে এর কোন তুলনা নেই।

আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বসে আছি। এমন সময় তিনি বললেন, يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘এখন তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে’। অতঃপর আনছারদের একজন ব্যক্তি আগমন করল। যার দাড়ি দিয়ে ওযূর পানি টপকাচ্ছিল ও তার বাম হাতে জুতা জোড়া ছিল। দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন রাসূল (ছাঃ) একই রূপ বললেন এবং পরক্ষণে একই ব্যক্তির আগমন ঘটলো। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মজলিস থেকে উঠলেন, তখন আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ তাঁর পিছু নিলেন। ...আনাস (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন যে, আমি তার বাসায় একরাত বা তিন রাত কাটাই। কিন্তু তাকে রাতে ছালাতের জন্য উঠতে দেখিনি। কেবল ফজরের জন্য ওযূ করা ব্যতীত। তাছাড়া আমি তাকে সর্বদা ভাল কথা বলতে শুনেছি। এভাবে তিনদিন তিনরাত চলে গেলে আমি তার আমলকে হীন মনে করতে লাগলাম ( كِدْتُ أَنْ أَحْتَقِرَ عَمَلَهُ )। আমি তখন ঐ ব্যক্তিকে বললাম, আপনার সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) এই কথা বলেছিলেন এবং আমিও আপনাকে গত তিনদিন যাবৎ লক্ষ্য করছি। কিন্তু আপনাকে বড় কোন আমল করতে দেখলাম না ( فَلَمْ أَرَكَ تَعْمَلُ كَبِيْرَ عَمَلٍ )। তা’হলে কোন বস্ত্ত আপনাকে ঐ স্থানে পৌঁছিয়েছে, যার সুসংবাদ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে শুনিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি যা করি তাতো আপনি দেখেছেন। অতঃপর যখন আমি চলে আসার জন্য পিঠ ফিরাই, তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, مَا هُوَ إِلاَّ مَا رَأَيْتَ غَيْرَ أَنِّىْ لاَ أَجِدُ فِىْ نَفْسِىْ لِأَحَدٍ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ غِلاًّ وَلاَ أَحْسُدُ أَحَداً عَلَى خَيْرٍ أَعْطَاهُ اللهُ إِيَّاهُ ‘আপনি যা দেখেছেন, তাতো দেখেছেন। তবে আমি আমার অন্তরে কোন মুসলিমের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ রাখি না এবং আমি কারু প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত কোন কল্যাণের উপর হিংসা পোষণ করি না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন আমর বললেন, هَذِهِ الَّتِىْ بَلَغَتْ بِكَ وَهِىَ الَّتِىْ لاَ نُطِيْقُ ‘এটিই আপনাকে উক্ত স্তরে পৌঁছেছে। এটি এমন এক বস্ত্ত যা আমরা করতে সক্ষম নই।[3]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَجْتَمِعَانِ فِىْ قَلْبِ عَبْدٍ الإِيْمَانُ وَالْحَسَدُ ‘কোন বান্দার অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না’।[4] অর্থাৎ মুমিনের অন্তরে হয় ঈমান থাকবে, নয় হিংসা থাকবে। ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে ঈমান থাকবে না। মুমিন কখনো হিংসুক নয়, হিংসুক কখনো মুমিন নয়। অর্থাৎ পূর্ণ মুমিন নয়। হিংসা মুমিনদের পরস্পরে ভাই হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এই বাধা দূর না করা পর্যন্ত মুমিন সমাজ আপোষে ভাই ভাই হ’তে পারবে না।

মুমিন সর্বদা অন্যের শুভ কামনা করে। যেমন সে সর্বদা নিজের শুভ কামনা করে। যেমন তামীম দারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الدِّينُ النَّصِيْحَةُ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত’।[5] অর্থাৎ এখলাছ। যা পরস্পরের শুভ কামনা ও অকল্যাণ প্রতিরোধের মাধ্যমে অর্জিত হয়। হযরত জারীর বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বায়‘আত করেছিলাম ছালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য শুভ কামনার উপর’।[6]

বস্ত্ততঃ প্রথম যুগের মুসলমানেরা ছিলেন পারস্পরিক ভালোবাসায় একটি দেহের ন্যায়। যারা পরস্পরকে সাহায্য করতেন। পরস্পরের দোষ গোপন করতেন। পরস্পরের ব্যথায় সমব্যথী হ’তেন। নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তুমি মুমিনদের পারস্পরিক দয়া, ভালবাসা ও স্নেহকে দেখবে একটি দেহের ন্যায়। যার এক অঙ্গ ব্যথাতুর হলে সর্বাঙ্গ ব্যথাতুর হয় অনিদ্রা ও জ্বরের মাধ্যমে’।[7] নিঃসন্দেহে তারা ছিলেন আল্লাহর পথে সংগ্রামে পারস্পরে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়, যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন (ছফ ৬১/৪)। এযুগেও মুসলিম উম্মাহর উন্নতি ও অগ্রগতির সেটাই হ’ল আবশ্যিক পূর্বশর্ত।

[1]. বুখারী হা/১৩, মুসলিম হা/৪৫; মিশকাত হা/৪৯৬১।

[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/১১।

[3]. হাকেম পৃঃ ৩/৭৯ হা/৪৩৮০, হাকেম ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। আহমাদ হা/১২৭২০, আরনাঊত্ব ছহীহ বলেছেন; আলবানী প্রথমে ছহীহ পরে যঈফ বলেছেন (তারাজু‘আতুল আলবানী হা/৪৮)।

[4]. নাসাঈ হা/৩১০৯, সনদ হাসান।

[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯৬৬।

[6]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯৬৭।

[7]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৩।

হিংসুকদের চটকদার যুক্তিসমূহের কিছু নমুনা
হিংসুক ব্যক্তি তার চাকচিক্যপূর্ণ কথা ও আকর্ষণীয় যুক্তির মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা বলে ও মিথ্যাকে সত্য বলে। এ বিষয়ে (১) ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর শিষ্য খ্যাতনামা তাবেঈ ইকরিমা (মৃঃ ১০৭ হিঃ) বিগত যুগে বনু ইস্রাঈলদের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, তাদের মধ্যে তিনজন বিখ্যাত কাযী বা বিচারপতি ছিলেন। পরে তাদের একজন মারা গেলে অন্যজন তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি বিচারকার্য চালাতে থাকলেন। এমন সময় একদিন আল্লাহ জনৈক ফেরেশতাকে পাঠালেন। যিনি ঘোড়ায় চড়ে একজন ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যে ব্যক্তি বাছুরসহ তার গাভীকে পানি পান করাচ্ছিল। ফেরেশতা বাছুরটিকে তার দিকে ডাক দিলেন। তাতে বাছুরটি ঘোড়ার পিছে পিছে চলল। তখন ঐ লোকটি ছুটে এসে তার বাছুরটিকে ফিরিয়ে নিতে চাইল এবং বলল, হে আল্লাহর বান্দা! এটি আমার বাছুর এবং আমার এই গাভীর বাচ্চা। ফেরেশতা বললেন, বরং ওটা আমার বাছুর এবং আমার এই ঘোড়ার বাচ্চা। কেউ দাবী না ছাড়লে অবশেষে তারা কাযীর কাছে গেলেন। বাছুরের মালিক বলল, এই লোকটি আমার বাছুরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে ডাকল, আর বাছুরটি তার পিছে পিছে চলে গেল। অথচ বাছুরটি আমার। কিন্তু এখন সে আমাকে ফেরৎ দিচ্ছে না। উত্তরে বিবাদী ফেরেশতা বললেন এমতাবস্থায় যে, তার হাতে তিনটি বেত ছিল। যার অনুরূপ কোন বেত সচরাচর দেখা যায় না। তার মধ্যে একটি বেত তিনি বিচারকের হাতে দিয়ে বললেন, আপনি এটা দিয়ে আমাদের মাঝে ফায়ছালা করুন। বিচারক বললেন, কিভাবে? বিবাদী বললেন, আমরা বাছুরটাকে ঘোড়া ও গাভীর পিছনে ছেড়ে দিব। অতঃপর বাছুরটি যার পিছে পিছে যাবে, সেটি তার হবে। বিচারক সেটাই করলেন। দেখা গেল যে, বাছুরটি ঘোড়ার পিছু নিল। তখন বিচারক বাছুরটি ঘোড়ার বলে রায় দিলেন।

বাছুরের মালিক এ রায় মানল না। সে বলল, আমি আরেকজন বিচারকের কাছে যাব। সেখানে গিয়ে উভয়ে পূর্বের মত বাছুরটিকে নিজের বলে দাবী করল এবং আগের মত যুক্তি প্রদর্শন করল। সেখানেও একই রায় হ’ল। তখন বাদী তাতে রাযী না হয়ে তৃতীয় বিচারকের কাছে গেল। বিবাদী তাকে এবার তৃতীয় বেতটি দিলেন। কিন্তু তিনি তা নিতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন, আমি আজকে তোমাদের বিচার করব না। তারা বলল, কেন করবেন না? তিনি বললেন, কেননা আমি আজ ঋতুবতী। বিবাদী ফেরেশতা একথা শুনে বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ! পুরুষ লোক কখনো ঋতুবতী হয়? তখন বিচারক বললেন, ঘোড়া কখনো গরুর বাছুর জন্ম দেয়? অতঃপর তিনি বাছুরটিকে গাভীর মালিককে দিয়ে দিলেন। এবার ফেরেশতা বললেন, আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করেছেন। তিনি তোমার উপর খুশী হয়েছেন এবং ঐ দুই বিচারকের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন’।[1]

(২) মক্কার নেতাদেরকে শয়তান যুক্তি শিখিয়ে দিল। সেমতে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গিয়ে প্রশ্ন করল, মৃত বকরীকে কে হত্যা করে? জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ। তখন শয়তান বলল, দেখ তোমরা যেটা যবহ কর, সেটা হালাল। আর আল্লাহ যেটা যবহ করেন, সেটা হারাম। তাহ’লে তোমরাই আল্লাহর চেয়ে উত্তম। তখন আয়াত নাযিল হ’ল, وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ ‘যে সব পশু (যবহের সময়) তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় না, সেগুলি থেকে তোমরা খেয়োনা। নিশ্চয়ই এটি পাপ। আর শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কুমন্ত্রণা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করে। (মনে রেখ) যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তাহ’লে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/১২১; তাফসীর ইবনু কাছীর)।

[1]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/২৫৬।

১০
হিংসুকদের কিছু দৃষ্টান্ত
(১) ইবলীসের হিংসা : আদম (আঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা দেখে ইবলীস হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। সে নিজেকে আদমের চাইতে শ্রেষ্ঠ দাবী করে তাঁকে সম্মানের সিজদা করেনি। সে যুক্তি দিয়ে বলেছিল, خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ ‘আল্লাহ তুমি আমাকে আগুন দিয়ে তৈরী করেছ এবং আদমকে তৈরী করেছ মাটি দিয়ে’ (আ‘রাফ ৭/১১-১২)। অতএব আগুন কখনো মাটিকে সিজদা করতে পারে না। তার এই যুক্তিবাদের ফলে সে অভিশপ্ত হয় এবং জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়। এভাবে আসমানে প্রথম হিংসা করে ইবলীস এবং সেই-ই প্রথম আদম ও হাওয়াকে বিভ্রান্ত করে। ফলে তারাও জান্নাত থেকে আল্লাহর হুকুমে নেমে যান। আদমের ও তার সন্তানদের প্রতি ইবলীসের উক্ত হিংসা আজও অব্যাহত রয়েছে। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে (আরাফ ৭/১৩-১৫; হিজর ১৫/৩৩-৩৮)।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, الحاسد شبيه بإبليس، وهو في الحقيقة من أتباعه؛ لأنه يطلب ما يحبه الشيطان من فساد الناس وزوال نعم الله عنهم، كما أن إبليس حسد آدم لشرفه وفضله، وأبى أن يسجد له حسدا، فالحاسد من جند إبليس ‘হিংসুক ব্যক্তি ইবলীসের ন্যায়। সে শয়তানের অনুসারী। কেননা সে শয়তানের চাহিদা মতে সমাজে বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় এবং অন্যের উপর আল্লাহর নে‘মতসমূহের ধ্বংস কামনা করে। যেমন ইবলীস আদমের উচ্চ মর্যাদা ও তার শ্রেষ্ঠত্বকে হিংসা করেছিল এবং তাকে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি ইবলীসের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত।[1]

(২) হাবীলের প্রতি কাবীলের হিংসা :

আদম-পুত্র কাবীল তার ছোট ভাই হাবীলকে হত্যা করেছিল হিংসা বশে। কারণ আল্লাহভীরু হাবীলের কুরবানী আল্লাহ কবুল করেছিলেন। কিন্তু দুনিয়াদার কাবীলের কুরবানী আল্লাহ কবুল করেননি। অথচ এতে হাবীলের কিছুই করার ছিলনা। এতদসত্ত্বেও কাবীল তাকে হত্যা করে। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) তুমি লোকদের নিকট আদমের দুই পুত্রের ঘটনা সত্য সহকারে বর্ণনা কর। যখন তারা কুরবানী পেশ করে। অতঃপর একজনের কুরবানী কবুল হয়, কিন্তু অপর জনের কুরবানী কবুল হয়নি। তখন সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। জবাবে সে বলল, আল্লাহ তো কেবল মুত্তাক্বীদের কুরবানী কবুল করে থাকেন’। ‘যদি তুমি আমার দিকে হাত বাড়াও আমাকে হত্যা করার জন্য, আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দিকে হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্বচরাচরের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৭-২৮)।

বলা বাহুল্য, এটাই ছিল মানবেতিহাসের প্রথম হত্যাকান্ডের ঘটনা। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত হত্যাকান্ড হবে, তার পাপের একটা অংশ ক্বাবীলের আমলনামায় লেখা হবে। কেননা সেই-ই প্রথম এর সূচনা করেছিল।[2] এভাবে আসমানে প্রথম হিংসা করেছিল ইবলীস এবং যমীনে প্রথম হিংসা করেছিল ক্বাবীল। তাই ভাল-র প্রতি হিংসা চিরন্তন।

(৩) ইউসুফের প্রতি তার ভাইদের হিংসা :

নবী ইউসুফের ১০ জন বিমাতা ভাই ছিল। যারা ছিল তার আপন খালার সন্তান। ইউসুফ ও বেনিয়ামীনের মা মারা যাওয়ায় মাতৃহারা দুই শিশুপুত্রের প্রতি পিতা নবী ইয়াকূবের পিতৃস্নেহ স্বভাবতই বেশী ছিল। তন্মধ্যে ইউসুফের প্রতিই তাঁর আসক্তি ছিল বেশী তার অলৌকিক গুণাবলীর কারণে। তদুপরি শিশুকালে ইউসুফের দেখা স্বপ্নবৃত্তান্ত শোনার পর পিতা তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং অজানা আশংকায় তাকে সর্বক্ষণ চোখের উপর রাখতেন। ফলে বিমাতা ভাইয়েরা তার প্রতি হিংসায় জ্বলে ওঠে এবং শিশু ইউসুফকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত বিষয়ে সূরা ইউসুফ নাযিল হয়। যাতে পূরা ঘটনা সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে (দ্রঃ নবীদের কাহিনী ১ম খন্ড)।

(৪) ইহূদী-নাছারাদের হিংসা :

এরাই ইসলাম ও ইসলামের নবীর প্রতি সবচেয়ে বেশী হিংসাকারী। তাদের বংশ বনু ইসহাক থেকে শেষনবী না হয়ে বনু ইসমাঈলের কুরায়েশ বংশ থেকে হওয়ায় তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি হিংসায় অন্ধ ছিল। অথচ তাদের কিতাব তাওরাত-ইনজীলে শেষনবী হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ও তাঁর পূর্ণ পরিচয় আগেই বর্ণিত হয়েছে (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। কিন্তু তারা তাঁর উচ্চ মর্যাদাকে বরদাশত করতে পারেনি। ফলে তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসারী মুমিনদের চাইতে মক্কার কাফিরদের অধিকতর হেদায়াতপ্রাপ্ত বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। যেমন আল্লাহ বলেন, أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ أُوْتُوْا نَصِيْبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُوْنَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوْتِ وَيَقُوْلُوْنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا هَؤُلاَءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا سَبِيلاً- أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ لَعَنَهُمُ اللهُ وَمَنْ يَلْعَنِ اللهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ نَصِيْرًا - ‘তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে ইলাহী কিতাবের কিছু অংশ দেওয়া হয়েছে, যারা প্রতিমা ও শয়তানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং কাফিরদের বলে যে, তারাই মুমিনদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’। ‘এদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিসম্পাৎ করেন, তার জন্য তুমি কোন সাহায্যকারী পাবে না’ (নিসা ৪/৫১-৫২)।

মুমিনদের প্রতি হিংসা ছাড়াও তারা তাদেরকে ইসলাম ত্যাগ করে ইহূদী-নাছারাদের দলভুক্ত হওয়ার আকাংখা পোষণ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَدَّ كَثِيرٌ مِّنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُم مِّن بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّاراً حَسَداً مِّنْ عِندِ أَنفُسِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ فَاعْفُواْ وَاصْفَحُواْ حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরেও অন্তর্নিহিত বিদ্বেষ বশতঃ আহলে কিতাবদের অনেকে তোমাদেরকে ঈমান আনার পরেও কাফির বানাতে চায়। এমতাবস্থায় তোমরা ওদের ক্ষমা কর এবং এড়িয়ে চল আল্লাহর আদেশ না আসা পর্যন্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর উপরে ক্ষমতাবান’ (বাক্বারাহ ২/১০৯)।

ইবনু কাছীর বলেন, অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ আহলে কিতাবদের রীতি-নীতি অনুসরণ করা হ’তে বিরত থাকার ব্যাপারে মুমিনদের সাবধান করেছেন। গোপনে ও প্রকাশ্যে তারা যে সর্বদা মুসলমানদের শত্রুতা করবে, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন। মুসলমানদের ও তাদের নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা জানা সত্ত্বেও তারা এটা করে থাকে স্রেফ হিংসার বশবর্তী হয়ে’ (ঐ, তাফসীর)। আল্লাহ বলেন, وَلَن تَرْضَى عَنكَ الْيَهُودُ وَلاَ النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ قُلْ إِنَّ هُدَى اللهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءهُم بَعْدَ الَّذِي جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللهِ مِن وَلِيٍّ وَلاَ نَصِيْرٍ ‘ইহূদী ও নাছারাগণ কখনোই তোমার উপরে খুশী হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসারী হবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১২০)। এখানে শেষনবী (ছাঃ)-কে বলা হ’লেও তা মূলতঃ উম্মতে মুহাম্মাদীকে বলা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর প্রতি ইহূদী-খ্রিষ্টান অপশক্তির অতীত ও বর্তমান আচরণ অত্র আয়াতের বাস্তব প্রমাণ বহন করে।

(৫) কুরায়েশ কাফিরদের হিংসা :

আল্লাহ স্বীয় নবী মুহাম্মাদকে নবুঅত ও রিসালাত দ্বারা সম্মানিত করেছেন। কিন্তু তাঁর নিজ বংশ কুরায়েশ নেতারা হিংসায় জ্বলে ওঠে তাঁর এই উচ্চ মর্যাদার কারণে। তাদের ধারণা মতে নবুঅতের সম্মান তাদের মত নেতাদের পাওয়া উচিৎ ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَقَالُوا لَوْلاَ نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ- أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ؟ ‘আর তারা বলে যে, এই কুরআন কেন নাযিল হলো না দুই জনপদের কোন বড় নেতার উপরে? (অর্থাৎ মক্কার নেতা আবু জাহল অথবা ত্বায়েফের নেতা ওরাওয়া ইবনু মাসঊদের উপর)’? ‘তবে কি তোমার প্রতিপালকের রহমত তারাই বণ্টন করবে?’ (যুখরুফ ৪৩/৩১-৩২)।

কুরায়েশ নেতারা কিরূপ শ্রেষ্ঠত্বের কাঙাল ছিল যে, নিজেদের বংশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীকে পেয়েও তারা সর্বদা তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করেছে। তারা তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপবাদ দিয়েছে ও যুদ্ধ করেছে কেবল উক্ত মর্যাদা নিজেরা না পাওয়ার হিংসা থেকেই।

(৬) মুনাফিকদের হিংসা :

মুনাফিকরা ইসলাম যাহির করে ও কুফরীকে অন্তরে লালন করে। তাদের হৃদয় সর্বদা খাঁটি মুমিনদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ও কপটতায় পূর্ণ থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيْطٌ ‘তোমাদের কোন কল্যাণ স্পর্শ করলে তারা নাখোশ হয়। আর তোমাদের কোন অমঙ্গল হলে তারা খুশী হয়। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর ও আল্লাহভীরু হও, তাহলে ওদের চক্রান্ত তোমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে, সবই আল্লাহর আয়ত্তাধীনে রয়েছে’। (আলে ইমরান ৩/১২০)।

মক্কায় মূলতঃ কাফির ও মুসলমানদের সংঘর্ষ ছিল। কিন্তু মদীনায় গিয়ে যোগ হয় ইহূদী ও মুনাফিকদের কপটতা। যা ছিল কাফিরদের ষড়যন্ত্রের চাইতে মারাত্মক। ৩য় হিজরীতে ওহোদের যুদ্ধে গমনকারী এক হাযার মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে সাড়ে তিনশ’ মুনাফিকের পশ্চাদগমন ছিল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে আল্লাহভীরু নেতাদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে অমূল্য উপদেশ ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। অথচ সর্বদা মুনাফিকরা ভাবে যে, তারাই লাভবান। যদিও প্রকৃত অর্থে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ভাবে তাদের চতুরতা কেউ ধরতে পারবে না। অথচ তারাই সবচেয়ে বোকা। কেননা দেরীতে হলেও তাদের কপটতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَنْ لَنْ يُخْرِجَ اللهُ أَضْغَانَهُمْ- وَلَوْ نَشَاءُ لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِيْمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ وَاللهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُمْ- وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِيْنَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِيْنَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ -

‘যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ তাদের হৃদয়ের গোপন বিদ্বেষ কখনোই প্রকাশ করে দেবেন না’? ‘আমরা চাইলে তোমাকে তাদের দেখাতাম। তখন তুমি তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারতে এবং তাদের কথার ভঙ্গিতে তুমি তাদের অবশ্যই বুঝে নিতে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তোমাদের কর্মসমূহ সম্যক অবগত’। ‘আর আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা নেব। যতক্ষণ না আমরা (প্রমাণসহ) জানতে পারব তোমাদের মধ্যে কারা সত্যিকারের মুজাহিদ এবং কারা সত্যিকারের ধৈর্যশীল। বস্ত্ততঃ আমরা তোমাদের অবস্থা সমূহ যাচাই করে থাকি’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৯-৩১)।

পরপর তিনটি আয়াতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মুনাফিকদের গোপন বিদ্বেষ সাময়িকভাবে চাপা থাকলেও তা অবশেষে প্রকাশিত হয়। আর এর মাধ্যমেই আল্লাহ তার পথের প্রকৃত মুজাহিদ ও দৃঢ়চিত্ত বান্দাদের পরীক্ষা নেন। এভাবে তিনি সর্বাবস্থায় মুমিন ও মুনাফিকের কার্যক্রম যাচাই করে থাকেন।

বস্ত্ততঃ মুনাফিকদের কপটতা মুমিনদের সরলতা ও স্বচ্ছতার প্রতি হিংসা থেকে উদ্ভূত হয়। আর মুমিনদের প্রতি মুনাফিকদের এই হিংসা চিরন্তন।

(৭) নেতৃত্বের প্রতি হিংসা :

নেতৃত্বের প্রতি হিংসা করা ও তার বিরুদ্ধে অন্যকে উসকে দেওয়া শয়তানের অন্যতম প্রধান কাজ। কারণ এর ফলেই সমাজে বিভক্তি ও অশান্তি সৃষ্টি হয়। আর সেটাই হ’ল শয়তানের প্রধান কাম্য। ইসলামী নেতৃত্ব নির্বাচনে এর কোন সুযোগ নেই। কারণ এখানে যোগ্য ও তাক্বওয়াশীল ব্যক্তিদের মাধ্যমে দল ও প্রার্থীবিহীনভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন হয়। এখানে নেতৃত্বের জন্য আকাংখী হওয়া যায় না, লোভ করা যায় না বা প্রার্থী হওয়া যায় না।[3] নেতা পরামর্শ নিবেন। কিন্তু পরামর্শ মানতে তিনি বাধ্য নন (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। তিনি শরী‘আত বিরোধী কোন নির্দেশ দিতে পারেন না।[4] নেতার কোন কাজ অপসন্দনীয় হ’লে ছবর করবে। কেননা যদি কেউ জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়, অতঃপর মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে সে জাহেলী মৃত্যু বরণ করবে’।[5] ফলে ইসলামী সমাজে অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের কোন সুযোগ নেই। এর অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল আমীরের ইসলামী নির্দেশ পালনের মধ্যে নেকী পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ عَصَى اللهَ ، وَمَنْ يُطِعِ الأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِى ، وَمَنْ يَعْصِ الأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِى ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল...।[6] এরপরেও শয়তান সেখানে কাজ করে এবং নানা অজুহাত বের করে সংগঠনে ও সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে।

(৮) ভাল-র প্রতি হিংসা :

মানুষ অনেক সময় ভাল-র প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। যেমন নবী-রাসূলগণের প্রতি, ইসলামের প্রতি, কুরআন ও হাদীছের প্রতি, সমাজের সত্যসেবী দ্বীনদারগণের প্রতি এবং বিশেষ করে সমাজ সংস্কারক মুত্তাক্বী আলেমগণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা পাপাচারী মানুষের স্বভাবগত বিষয়। যেমন (ক) সৃষ্টির সূচনায় প্রথম পাপ ছিল আদম (আঃ)-এর প্রতি ইবলীসের হিংসার পাপ। আদমের উচ্চ সম্মান দেখে সে হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। তাকে আদমের প্রতি সম্মানের সিজদা করতে বলা হলে সে করেনি। ফলে সে জান্নাত থেকে চিরকালের মত বিতাড়িত হয় (বাক্বারাহ ২/৩৪-৩৮)। অনুরূপভাবে (খ) আদম-পুত্র কাবীল তার ভাই হাবীলকে হত্যা করে হিংসা বশে। কারণ পশুপালক হাবীল ছিল মুত্তাকী পরহেযগার ও শুদ্ধ হৃদয়ের মানুষ। সে আল্লাহকে ভালবেসে তার সর্বোত্তম দুম্বাটি আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানীর জন্য পেশ করে। অথচ তার কৃষিজীবী ভাই ক্বাবীল তার ক্ষেতের ফসলের নিকৃষ্ট একটা অংশ কুরবানীর জন্য পেশ করে। ফলে আল্লাহ তারটা কবুল না করে হাবীলের উৎকৃষ্ট কুরবানী কবুল করেন এবং আসমান থেকে আগুন এসে তা উঠিয়ে নিয়ে যায়। এতে ক্বাবীল হিংসায় জ্বলে ওঠে ও হাবীলকে হত্যা করে (মায়েদাহ ৫/২৭-৩০)। পরবর্তীকালে (গ) ইহূদী-নাছারাগণ শেষনবীকে চিনতে পেরেও এবং তাঁকে শ্রেষ্ঠ জেনেও মানেনি স্রেফ হিংসা বশে (বাক্বারাহ ২/১৪৬)।

(ঘ) আবু জাহল শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য বলে স্বীকার করেও মেনে নেয়নি তার বনু মখযূম গোত্রে জন্ম না হয়ে বনু হাশেম গোত্রে জন্ম হওয়ার কারণে এবং নিজেদের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে।[7]

(ঙ) যুগে যুগে অসংখ্য সত্যসেবী আলেম ও নেতা নির্যাতিত হয়েছেন স্রেফ কুচক্রীদের হিংসার কারণে। তারা নিজেদের হিংসা গোপন করার জন্য ভাল-র বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা রটনা করে। তাকে নানাভাবে কষ্ট দেয়, এমনকি দেশত্যাগে বাধ্য করে ও হত্যার চেষ্টা করে। যেমন শেষনবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধীরা করেছিল। অথচ তিনি এজন্য আদৌ দায়ী ছিলেন না। যদিও প্রবাদ আছে যে, ‘এক হাতে তালি বাজে না’। ‘যা রটে, তার কিছু না কিছু ঘটে’। ‘দশ যেখানে আল্লাহ সেখানে’। অথচ নবী-রাসূলগণ ও তাঁদের নিখাদ অনুসারী সৎকর্মশীল নেতা ও নেককার মুমিন নর-নারীদের বিরুদ্ধে যাবতীয় ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত একপক্ষীয় হয়ে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব রটানো হয়, সবই মিথ্যা। সকল যুগে এর অসংখ্য নযীর রয়েছে। বর্তমান যুগেও এমন নযীরের কোন অভাব নেই।

[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম, বাদায়ে‘উল ফাওয়ায়েদ ২/২৩৪।

[2]. বুখারী হা/৩৩৩৫, মুসলিম হা/১৬৭৭; মিশকাত হা/২১১ ‘ইল্ম’ অধ্যায়।

[3]. বুখারী হা/২২৬১, মুসলিম হা/১৭৩৩; মিশকাত হা/৩৬৮৩ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[4]. মুসলিম হা/১৮৩৮, মিশকাত হা/৩৬৬২ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[5]. বুখারী হা/৭১৪৩, মুসলিম হা/১৮৪৯; মিশকাত হা/৩৬৬৮ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[6]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬১ ’নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[7]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৬; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৩/৬৪।

১১
হিংসুকের নিদর্শন
(১) সাক্ষাতে সুন্দর কথা বলে। অসাক্ষাতে নিন্দা করে এবং বিপদ এলে খুশী হয়। কোন কল্যাণ দেখলে চুপ থাকে। কিন্তু অকল্যাণ দেখলে খুশীতে মুখর হয়। জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি এমন কোন শত্রুকে চান যে কখনো বন্ধু হয়ে ফিরে না আসুক? উত্তরে তিনি বলেন, হিংসুককে। যে সর্বদা আমাকে দেওয়া আল্লাহর নে‘মতের ধ্বংস কামনা করে’।

১২
মুমিনের কর্তব্য
একজন মুসলিমের কর্তব্য হ’ল সর্বদা সাদা মনের অধিকারী থাকা। তার অন্তরে যেন কারু প্রতি হিংসার কালিমা না থাকে। যদি কোন কারণ বশতঃ সেটা কখনো এসেই যায়, তবে বুদ্বুদের মত যেন তা উবে যায়। কচুর পাতার পানির মত যেন তা সঙ্গে সঙ্গে ঝরে যায়। হৃদয় যেন সকলের প্রতি উদার থাকে এবং শত্রু-মিত্র সকলের প্রতি হেদায়াতের আকাংখী থাকে। এমন অবস্থায় নিদ্রা যাবে, যেন তার হৃদয়ের কোণে কারু প্রতি হিংসার কালো মেঘ জমে না থাকে। কেননা এই নিদ্রা তার চিরনিদ্রা হ’তে পারে।

আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি বললেন, كُلُّ مَخْمُوْمِ الْقَلْبِ صَدُوْقِ اللِّسَانِ ‘প্রত্যেক শুদ্ধহৃদয় ও সত্যভাষী ব্যক্তি’। লোকেরা বলল, সত্যভাষীকে আমরা চিনতে পারি। কিন্তু শুদ্ধহৃদয় ব্যক্তিকে আমরা কিভাবে চিনব? জবাবে তিনি বললেন, هُوَ التَّقِىُّ النَّقِىُّ لاَ إِثْمَ فِيْهِ وَلاَ بَغْىَ وَلاَ غِلَّ وَلاَ حَسَدَ ‘সে হবে আল্লাহভীরু ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়; যাতে কোন পাপ নেই, সত্যদ্রোহিতা নেই, বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই’।[1] তাছাড়া বলা হয়ে থাকে. الْحَسُودُ لاَ يَسُودُ ‘হিংসুক কখনো নেতৃত্ব দিতে পারে না’। অতএব হিংসা ও প্রতিহিংসামূলক ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অধিকাংশ হাদীছের শুরুতে বলেছেন, وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ ‘আমার জীবন যার হাতে নিহিত’। এর মাধ্যমে তিনি সর্বদা নিজের মৃত্যু ও আল্লাহকে স্মরণ করতেন। আমরাও যদি ভাবি আমাদের জীবনের সুইচ আল্লাহর হাতে। যেকোন সময় তা অফ হয়ে যাবে আল্লাহর হুকুমে। অথবা ভাবি, যেকোন সময়ে আমার চোখের আলো নিভে যাবে ও জীবনের স্পন্দন থেমে যাবে তাঁর হুকুমে, তাহ’লে কি হিংসা-বিদ্বেষ কারু মনে দানা বাঁধতে পারবে? অতএব হিংসার আগুন থেকে আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন-আমীন!

[1]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬; মিশকাত হা/৫২২১; ছহীহাহ হা/৯৪৮।

১৩
দ্বিতীয় ভাগ অহংকার
إِنَّ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوْا عَنْهَا لاَ تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلاَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِيْنَ -

‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ার সমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না ছুঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি’ (আ‘রাফ ৭/৪০)।

অত্র আয়াতে আল্লাহ কুফরী বশে বা অজ্ঞতা বশে বলেননি, বরং ‘অহংকার বশে’ বলেছেন। ফলে অহংকারী কাফেরের জান্নাতে প্রবেশ করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ ছুঁচের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ অসম্ভব। কাফের তওবা করে ঈমান আনতে পারে, অজ্ঞ ব্যক্তি জানার পরে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু অহংকারী ব্যক্তি স্বীয় অহংকারের উপর অটল থাকে ও এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়। অহংকার তাই মারাত্মক পাপ। যা সাধারণতঃ হিংসার পরেই আসে এবং যা অধিকাংশ পাপের উৎস। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ মানুষকে অহংকারের পাপ ও তার ভয়াবহ পরিণতি বিষয়ে সাবধান করেছেন।

‘অহংকার’ মানব স্বভাবের একটি নিকৃষ্ট অংশ। বিশুদ্ধ-অশুদ্ধ সকল আক্বীদা-বিশ্বাসের লোকের মধ্যেই থাকে। এর উপকারিতার চেয়ে অনিষ্টকারিতা বেশী। একে দমন করে সৎকর্মে লাগানোর মধ্যেই মানুষের কৃতিত্ব নির্ভর করে। মানুষের মধ্যে ষড়রিপু হ’ল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এর মধ্যে ‘মদ’ হ’ল দম্ভ, গর্ব, অহংকার। ‘মাৎসর্য’ হ’ল ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। প্রতিটি রিপুই মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট এবং প্রতিটির দক্ষ ব্যবহার কাম্য। যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি-লবণ প্রতিটিই খাদ্যের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু অধিক বা অন্যায় ব্যবহারে প্রতিটিই ক্ষতিকর। জীবনে চলার পথে ষড়রিপু আমাদের সার্বক্ষণিক সাথী। এগুলি ডাক্তারের আলমারিতে সাজানো ‘পয়জন’ (Poison)-এর শিশির মত। যা তিনি প্রয়োজন মত রোগীর প্রতি ব্যবহার করেন। অথবা মটর গাড়ীর ইঞ্জিনে রাখা আগুনের বাক্সের মত। যাকে সর্বদা পাখা দিয়ে বাতাস করা হয় এবং ড্রাইভার সর্বদা গিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ীর গতি কমবেশী করে থাকেন। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ৬টি আগুনের মধ্যে ‘মদ’ বা অহংকার হ’ল অন্যতম প্রধান স্ফুলিঙ্গ। যা একবার জ্বলে উঠলে ও নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানব গাড়ীটাকে পুড়িয়ে বা ধ্বংস করে ছাড়ে।

অহংকারের আরবী নাম ‘কিব্র’ ( الْكِبْر )। যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করাই এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। নিম্নের হাদীছটিতে এর পরিণতি ও ব্যাখ্যা দু’টিই বর্ণিত হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,

لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ . قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً . قَالَ : إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ، الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ -

‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোষাক সুন্দর হৌক, তার জুতা জোড়া সুন্দর হৌক। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। কিন্তু ‘অহংকার’ হ’ল ‘সত্যকে দম্ভের সাথে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[1]

এর অর্থ এটা নয় যে, অহংকার করলেই সে জাহান্নামে যাবে। বরং এর অর্থ হ’ল সত্য জেনেও মিথ্যার উপরে যিদ করা এবং নানা অজুহাতে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। আর ‘অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’ অর্থ হ’ল সর্বদা নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় মনে করা এবং অন্যের কাছে সর্বদা নিজের উচ্চ মূল্যায়ন কামনা করা। ফলে তার চাহিদা মতে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়াতেই সে অন্যকে হেয় জ্ঞান করে।

আবু ওয়াহাব আল-মারওয়াযী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারককে প্রশ্ন করলাম ‘অহংকার’ ( الْكِبْر ) কাকে বলে? তিনি বললেন, মানুষকে হেয় জ্ঞান করা। পুনরায় প্রশ্ন করলাম, ‘আত্মম্ভরিতা’ ( العُجْب ) কাকে বলে? তিনি বললেন, তোমার কাছে যা আছে, অন্যের কাছে তা নেই বলে ধারণা করা।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনটি নাজাত দানকারী ও তিনটি ধ্বংসকারী বস্ত্ত থেকে মানুষকে সাবধান করেছেন। নাজাত দানকারী তিনটি বস্ত্ত হল, (১) গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা। (২) খুশীতে ও অখুশীতে সত্য কথা বলা এবং (৩) সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতার মধ্যবর্তী অবস্থা বেছে নেওয়া। অতঃপর ধ্বংসকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল, (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। তিনি বলেন, এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক ( وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ )।[3]

শায়খুল ইসলাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, التَّكَبُّرُ شَرٌّ مِنَ الشِّرْكِ فَإِنَّ الْمُتَكَبِّرَ يَتَكَبَّرُ عَنْ عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى، وَالْمُشْرِكَ يَعْبُدُ اللهَ وَغَيْرَهُ . ‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্ব করে এবং সাথে অন্যেরও করে’।[4]

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, أصُوْلُ الْخَطَايَا كُلِّهَا ثَلاَثَةٌ : الْكِبْرُ وَهُوَ الَّذِيْ أصَارَ إِبْلِيسَ إِلَى مَا أصاره، والْحِرْصُ وَهُوَ الَّذِي أخرجَ آدمَ من الْجنَّة، والْحَسَدُ وَهُوَ الَّذِي جرأ أحدَ بني آدمَ على أَخِيه، فَمَن وقِيَ شَرَّ هَذِه الثَّلاَثَة فقد وقى الشَّرَّ كلَّه- فالكفرُ من الْكِبْر والمعاصي من الْحِرْص وَالْبَغْيُ وَالظُّلمُ من الْحَسَد - সমস্ত পাপের উৎস হ’ল তিনটি।- (১) অহংকার, যা ইবলীসের পতন ঘটিয়েছিল। (২) লোভ, যা জান্নাত থেকে আদম-কে বের করে দিয়েছিল। (৩) হিংসা, যা আদম (আঃ)-এর এক সন্তানের বিরুদ্ধে অপর সন্তানকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল। যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি বস্ত্তর অনিষ্ট হ‘তে বেঁচে থাকতে পারবে সে যাবতীয় অনিষ্ট হ‘তে বাঁচতে পারবে। কেননা কুফরীর মূল উৎস হ’ল ‘অহংকার’। পাপকর্মের উৎস হ’ল ‘লোভ’। আর বিদ্রোহ ও সীমালংঘনের উৎস হ’ল ‘হিংসা’।[5]

অহংকার ও আত্মম্ভরিতা দু’টিই বড়াই ও বড়ত্বের একক উৎস থেকে উৎসারিত। বস্ত্ততঃ এ রোগে যে আক্রান্ত হয়, সে নিজেকে নিজে ধ্বংস করে। তার দ্বারা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সংগঠন, এমনকি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়।

[1]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ।

[2]. সিয়ারু আ‘লামিল নুবালা ৮/৪০৭।

[3]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ); সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫১২২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫০।

[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ৩য় প্রকাশ ১৯৯৬ খৃঃ) ২/৩১৬ পৃঃ।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৩৯৩/১৯৭৩) ৫৮ পৃঃ।

১৪
অহংকারের নিদর্শন সমূহ
(১) দম্ভভরে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা : এটাই হ’ল প্রধান নিদর্শন। যা উপরের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। এটি করা হয়ে থাকে মূলতঃ দুনিয়াবী স্বার্থের নিরিখে। কখনো পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে, কখনো ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বার্থের দোহাই দিয়ে বা অন্য কোন কারণে।

(২) নিজেকে সর্বদা অন্যের চাইতে বড় মনে করা : যেমন ইবলীস আদমের চাইতে নিজেকে বড় মনে করেছিল এবং আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল। সে যুক্তি দিয়েছিল, أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا ‘আমি কি তাকে সিজদা করব, যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? (ইসরা ১৭/৬১)। এই যুক্তি ও অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাকে বলেন, فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ ‘বের হয়ে যাও এখান থেকে। কেননা তুমি অভিশপ্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬)। মানব সমাজেও যারা অনুরূপ অবাধ্য ও শয়তানী চরিত্রের অধিকারী, তারা সমাজে ও সংগঠনে এভাবেই ধিকৃত ও বহিষ্কৃত হয়। তবে যারা আল্লাহর জন্য বিতাড়িত ও নির্যাতিত হন, তারা ইহকালে ও পরকালে পুরস্কৃত হন।

(৩) অন্যের আনুগত্য ও সেবা করাকে নিজের জন্য অপমানজনক মনে করা : এই প্রকৃতির লোকেরা সাধারণতঃ উদ্ধত হয়ে থাকে। এরা মনে করে সবাই আমার আনুগত্য ও সেবা করবে, আমি কারু আনুগত্য করব না। এরা ইহকালে অপদস্থ হয় এবং পরকালে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لاَ يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا - ‘পরকালের ঐ গৃহ আমরা তৈরী করেছি ঐসব লোকদের জন্য, যারা এ দুনিয়াতে উদ্ধত হয় না ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।

উম্মুল হুছায়েন (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا ‘যদি তোমাদের উপর একজন নাক-কান কাটা হাবশী ক্রীতদাসও আমীর নিযুক্ত হন, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালনা করেন, তোমরা তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর’।[1] আল্লাহকে খুশি করার নিয়তে যিনি যত বিনয়ী ও আনুগত্যশীল হন, তিনি তত সম্মানিত হন এবং আখেরাতে পুরস্কৃত হন।

(৪) নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করা :

শক্তিশালী ব্যক্তি, সমাজনেতা, রাষ্ট্রনেতা কিংবা যেকোন পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তি বা কর্মকর্তা ও ধনিক শ্রেণীর কেউ কেউ অনেক সময় নিজেকে এরূপ ধারণা করে থাকেন। তিনি ভাবতেই পারেন না যে, আল্লাহ যেকোন সময় তার কাছ থেকে উক্ত নে‘মত ছিনিয়ে নিতে পারেন। আবু জাহল এরূপ অহংকার করেছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তার অভিজ্ঞ পারিষদবর্গ ও শক্তিশালী জনবলের ভয় দেখিয়েছিল। জবাবে আল্লাহ বলেছিলেন, فَلْيَدْعُ نَادِيَهُ، سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ - ‘ডাকুক সে তার পারিষদবর্গকে’। ‘অচিরেই আমরা ডাকব আযাবের ফেরেশতাদেরকে’ (‘আলাক্ব ৯৬/১৭-১৮)। পরিণতি কি হয়েছিল, সবার জানা। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, كَلاَّ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى، أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى ‘কখনই না। মানুষ অবশ্যই সীমালংঘন করে’। ‘কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (‘আলাক্ব ৯৬/৬-৭)। আল্লাহ একেক জনকে একেক মেধা, প্রতিভা ও যোগ্যতা দিয়ে দুনিয়াতে সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রত্যেক মানুষই পরস্পরের মুখাপেক্ষী। কেউ অভাবমুক্ত নয়। তাই মানুষের জন্য অহংকার শোভা পায় না। আল্লাহ কেবল ‘মুতাকাবিবর’ (অহংকারী)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন আল্লাহ বলেন, الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِيْ ‘অহংকার’ আমার চাদর এবং ‘বড়ত্ব’ আমার পায়জামা। অতএব যে ব্যক্তি ঐ দু’টির কোন একটি আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য টানাটানি করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব’।[2] অতএব সকল প্রকার অহঙ্কার ও শ্রেষ্ঠত্বের মালিক তিনি। তাই অহংকার কেবল তাঁরই জন্য শোভা পায়।

(৫) লোকদের কাছে বড়ত্ব যাহির করা ও নিজের ত্রুটি ঢেকে রাখা :

মূসা (আঃ) যখন ফেরাঊনকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর নিদর্শন দেখালেন, তখন ফেরাঊন ভীত হ’ল। কিন্তু নিজের দুর্বলতা ঢেকে রেখে সে তার লোকদের জমা করল। অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বলল, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى- فَأَخَذَهُ اللهُ نَكَالَ الْآخِرَةِ وَالْأُولَى - ‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা’। ‘ফলে আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন’ (নাযে‘আত ৭৯/২৩-২৪)।

বস্ত্ততঃ ফেরাঊনী চরিত্রের লোকের কোন অভাব সমাজে নেই। সমাজ দুষণের জন্য প্রধানতঃ এসব লোকেরাই দায়ী।

একবার হযরত উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর পিছে পিছে একদল লোককে চলতে দেখে খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর প্রতি চাবুক উঁচু করলেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তাঁকে মারলেন। তখন তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে খলীফা বললেন, هَذَا ذِلَّةٌ لِلتَّابِعِ وَفِتْنَةٌ لِلْمَتْبُوْعِ ‘এটা অনুসরণকারীর জন্য লাঞ্ছনাকর এবং অনুসৃত ব্যক্তিকে ফিৎনায় নিক্ষেপকারী’।[3] প্রখ্যাত তাবেঈ সাঈদ বিন জুবায়ের (৪৬-৯৫ হিঃ) তাঁর অনুগমনকারীদের প্রতি অনুরূপ বক্তব্য রেখেছিলেন।[4] এখানে ‘ফিৎনা’ অর্থ অহংকার। অথচ উবাই বিন কা‘ব (রাঃ)-এর ন্যায় বিখ্যাত ছাহাবীর জন্য এরূপ ফিৎনায় পড়ার কোন অবকাশ ছিল না। কিন্তু খলীফা ওমর (রাঃ) চেয়েছিলেন উবাইয়ের মনের মধ্যে যেন কণা পরিমাণ অহংকারের উদয় না হয়। তিনি চেয়েছিলেন যেন তার এক ভাই অহেতুক অহংকারের দোষে দোষী হয়ে জাহান্নামে পতিত না হয়। এটাই হ’ল পরস্পরের প্রতি ইসলামী ভালোবাসার সর্বোত্তম নমুনা। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী।

উল্লেখ্য যে, উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন সংকলনকারী চারজন ছাহাবীর অন্যতম এবং যার সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, তোমরা চারজনের নিকট থেকে কুরআন পাঠ শিখে নাও, তাদের একজন ছিলেন উবাই।[5] শুধু তাই নয়, একদিন রাসূল (ছাঃ) তাকে ডেকে বলেন, আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমার উপর সূরা বাইয়েনাহ পাঠ করি। উবাই বললেন, আল্লাহ আপনার নিকট আমার নাম বলেছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন উবাই (খুশীতে) কাঁদতে লাগলেন’।[6]

এরূপ দৃষ্টান্ত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকেও এসেছে। তিনি তাঁর পিছনে অনুসরণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন,

لَوْ تَعْلَمُونَ ذُنُوبِي مَا وَطِئَ عَقِبِي رَجُلاَنِ وَلَحَثَيْتُمْ عَلَى رَأْسِي التُّرَابَ، وَلَوَدِدْتُ أَنَّ اللهَ غَفَرَ لِي ذَنْبًا مِنْ ذُنُوبِي -

‘আমার যে কত পাপ রয়েছে তা যদি তোমরা জানতে, তাহ’লে দু’জন লোকও আমার পিছনে হাঁটতে না এবং অবশ্যই তোমরা আমার মাথায় মাটি ছুঁড়ে মারতে। আমি চাই আল্লাহ আমার গোনাহসমূহ মাফ করুন’।[7]

(৬) অন্যকে নিজের তুলনায় ছোট মনে করা :

মূসা ও হারূণ (আঃ) ফেরাঊনের কাছে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে গেলে তারা বলেছিল, فَقَالُوا أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَيْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُونَ ‘আমরা কি এমন দু’ব্যক্তির উপরে বিশ্বাস স্থাপন করব যারা আমাদেরই মত মানুষ এবং তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে’? (মুমিনূন ২৩/৪৭)।

মক্কার কাফের নেতারাও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে বেলাল, খোবায়েব, ছুহায়েব, ইবনু মাসঊদ প্রমুখ দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সরিয়ে দিতে বলেছিল, যাতে তারা তাঁর সঙ্গে বসে পৃথকভাবে কথা বলতে পারেন। তখন আয়াত নাযিল হয়,

وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِمْ مِنْ شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُونَ مِنَ الظَّالِمِينَ - ( الأنعام ৫২)-

‘যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের ইবাদত করে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে সরিয়ে দিয়ো না। তাদের কোন আমলের হিসাব তোমার দায়িত্বে নেই এবং তোমার কোন আমলের হিসাব তাদের দায়িত্বে নেই। এরপরেও যদি তুমি তাদের সরিয়ে দাও, তাহ’লে তুমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/৫২)।

ধনে-জনে ও পদমর্যাদায় নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি মনের মধ্যে কোন তুচ্ছভাব উদ্রেক হওয়াটা অহংকারের লক্ষণ। অতএব এই স্বভাবগত রোগ কঠিনভাবে দমন করা অবশ্য কর্তব্য।

অন্যকে হেয় গণ্যকারী ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তারা ঐসব দুর্বল শ্রেণীর লোকদের পায়ের নীচে থাকবে। এটি হবে তাদেরকে দুনিয়ায় হেয় জ্ঞান করার বদলা স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِى صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَيُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ فِى جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُولَسَ تَعْلُوهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةِ الْخَبَالِ -

‘অহংকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন উঠবে মানুষের চেহারা নিয়ে পিঁপড়া সদৃশ। সর্বত্র লাঞ্ছনা তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। অতঃপর তাদের ‘বূলাস’ নামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেখানে লেলিহান অগ্নি তাদেরকে ঢেকে ফেলবে। সেখানে তারা জাহান্নামীদের পোড়া দেহের গলিত পুঁজ-রক্তে পূর্ণ ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক নদী থেকে পান করবে।[8]

একদিন ছাহাবী আবু যর গিফারী (রাঃ) নিগ্রো মুক্তদাস বেলাল (রাঃ)-কে তার কালো মায়ের দিকে সম্বন্ধ করে কিছু বললে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে ধমক দিয়ে বলেন, يَا أَبَا ذَرٍّ أَعَيَّرْتَهُ بِأُمِّهِ إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ ‘হে আবু যর! তুমি তাকে তার মায়ের নামে তাচ্ছিল্য করলে? তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত রয়েছে’।[9] আবু যর গিফারীর ন্যায় একজন নিরহংকার বিনয়ী ছাহাবীর একদিনের একটি সাময়িক অহংকারকেও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বরদাশত করেননি।

(৭) মানুষের সাথে অসদ্ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি কঠোর হওয়া : এটি অহংকারের অন্যতম লক্ষণ। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদিন জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাক্ষাৎপ্রার্থী হ’ল। তিনি বললেন, তোমরা ওকে অনুমতি দাও। সে তার গোত্রের কতই না মন্দ ভাই ও কতই না মন্দ পুত্র! অতঃপর যখন লোকটি প্রবেশ করল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার সাথে অতীব নম্রভাবে কথা বললেন। পরে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি লোকটি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলেন। আবার সুন্দর আচরণ করলেন, ব্যাপারটা কি? জবাবে তিনি বললেন, হে আয়েশা! إِنَّ شَرَّ النَّاسِ مَنْ تَرَكَهُ النَّاسُ اتِّقَاءَ فُحْشِهِ ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি যাকে লোকেরা পরিত্যাগ করে ও ছেড়ে যায় তার ফাহেশা কথার ভয়ে’।[10]

(৮) শক্তি বা বুদ্ধির জোরে অন্যের হক নষ্ট করা : এটি অহংকারের একটি বড় নিদর্শন। আল্লাহ কাউকে বড় করলে সে উদ্ধত হয়ে পড়ে এবং যার মাধ্যমে তিনি বড় হয়েছেন ও যিনি তাকে বড় করেছেন সেই বান্দা ও আল্লাহকে সে ভুলে যায়। সে এই কথা ভেবে অহংকারী হয় যে, আমি আমার যোগ্যতা বলেই বড় হয়েছি। ফলে সে আর অন্যকে সম্মান করে না। সে তখন শক্তির জোরে বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অন্যের হক নষ্ট করে। এই হক সম্মানের হতে পারে বা মাল-সম্পদের হতে পারে। অন্যায়ভাবে কারু সম্মানের হানি করলে ক্বিয়ামতের দিন অহংকারী ব্যক্তিকে পিঁপড়া সদৃশ করে লাঞ্ছনাকর অবস্থায় হাঁটানো হবে।[11] অথবা তাকে ঐ মাল-সম্পদ ও মাটির বিশাল বোঝা মাথায় বহন করে হাঁটতে বাধ্য করা হবে।[12]

(৯) অধীনস্তদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা ও তাদেরকে নিকৃষ্টভাবে খাটানো : অহংকারী মালিকেরা তাদের অধীনস্ত শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতি এরূপ আচরণ করে থাকে। যা তাদের জাহান্নামী হবার বাস্তব নিদর্শন। এই স্বভাবের লোকেরা এভাবে প্রতিনিয়ত ‘হাক্কুল ইবাদ’ নষ্ট করে থাকে। অতঃপর তাদের হক পূরণ না করে নিজেরা ঘন ঘন হজ্জ ও ওমরায় যায়। আর ভাবে যে, সদ্য ভূমিষ্ট সন্তানের ন্যায় তারা পাপমুক্ত হয়ে ফিরে এল। আদৌ নয়। আল্লাহর হক আদায়ের মাধ্যমে কখনোই বান্দার হক বিনষ্টের কাফফারা আদায় হয় না। বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ ، فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ ‘তুমি মযলূমের দো‘আ থেকে বেঁচে থাক। কেননা মযলূমের দো‘আ ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই (অর্থাৎ সাথে সাথে কবুল হয়ে যায়)।[13] الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যুলুম কিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে’।[14] তিনি একদিন বলেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? সবাই বলল, যার কোন ধন-সম্পদ নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত নিয়ে হাযির হবে। অতঃপর লোকেরা এসে অভিযোগ করে বলবে যে, তাকে ঐ ব্যক্তি গালি দিয়েছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, তার মাল গ্রাস করেছে, হত্যা করেছে, প্রহার করেছে। অতঃপর তার নেকী থেকে তাদের একে একে বদলা দেওয়া হবে। এভাবে বদলা দেওয়া শেষ হবার আগেই যখন তার নেকী শেষ হয়ে যাবে, তখন বাদীদের পাপ থেকে নিয়ে তার উপর নিক্ষেপ করা হবে। অবশেষে ঐ ব্যক্তিকে জাহানণামে নিক্ষেপ করা হবে।[15] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই হকদারকে তার হক আদায় করে দেয়া হবে। এমনকি শিংওয়ালা ছাগল যদি শিংবিহীন ছাগলকে গুঁতো মেরে কষ্ট দিয়ে থাকে, সেটারও বদলা নেওয়া হবে (মানুষকে ন্যায়বিচার দেখানোর জন্য)।[16]

তিনি বলেন, ابْغُونِى فِيْ ضُعَفَائِكُمْ فَإِنَّمَا تُرْزَقُونَ وَتُنْصَرُونَ بِضُعَفَائِكُمْ ‘তোমরা আমাকে তোমাদের দুর্বলদের মধ্যে তালাশ কর। কেননা তোমাদেরকে রূযী পৌঁছানো হয় ও সাহায্য করা হয় তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে।[17] এর অর্থ তোমরা আমার সন্তুষ্টি তালাশ কর দুর্বলদের প্রতি তোমাদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে। তিনি বলেন, যখন খাদেম তোমার খাবার নিয়ে আসে, তখন তাকে খাইয়ে তুমি শুরু কর। অথবা তাকে সাথে বসাও বা তাকে এক লোকমা খাদ্য দাও।[18] আল্লাহ বলেন, তোমরা মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলো’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যেখানেই তুমি থাক, আল্লাহকে ভয় কর। আর মন্দের পিছে পিছে উত্তম আচরণ কর। তাহ’লে মন্দ দূরীভূত হয়ে যাবে’।[19] আল্লাহ বলেন, ভাল ও মন্দ সমান নয়। অতএব তুমি মন্দকে ভাল দ্বারা প্রতিহত কর। তাহলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৪)।

(১০) মিথ্যা বা ভুলের উপর যিদ করা : এটি অহংকারের অন্যতম নিদর্শন। নবীগণ যখন লোকদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন, তখন তারা বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করত এবং নিজেদের ভুল ও মিথ্যার উপরে যিদ করত। যদিও শয়তান তাদেরকে (এর মাধ্যমে) জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তির দিকে আহবান করে (লোকমান ৩১/২১)।

কেবল কাফেরদের মধ্যে নয়, বরং মুসলমানদের মধ্যেও উক্ত দোষ পরিলক্ষিত হয়। যেমন শিরক ও বিদ‘আতে অভ্যস্ত লোকেরা বিভিন্ন অজুহাতে উক্ত পাপের উপর টিকে থাকে। অমনিভাবে বিচারক ও শাসক শ্রেণী তাদের ভুল ‘রায়’ থেকে ফিরে আসেন না। বরং একটি অন্যায় প্রবাদ চালু আছে যে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। অথচ মানুষের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। খলীফা ওমর (রাঃ) যখন আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-কে কূফার গভর্ণর করে পাঠান, তখন তাকে লিখে দেন যে, তুমি গতকাল কোন সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকলে সেখান থেকে ফিরে আসতে কোন বস্ত্ত যেন তোমাকে বাধা না দেয়। কেননা الرُّجُوعُ إِلىَ الْحَقِّ خَيْرٌ مِنَ التَّمَادِى فِى الْبَاطِلِ ‘মিথ্যার উপরে টিকে থাকার চাইতে সত্যের দিকে ফিরে আসা অধিক উত্তম’।[20]

খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৯৯-১০১ হিঃ) বলতেন, مَا مِنْ كِتَابٍ أَيْسَرُ عَلَىَّ رَدًّا مِنْ كِتَابٍ قَضَيْتُ بِهِ ثُمَّ أَبْصَرْتُ أَنَّ الْحَقَّ فِى غَيْرِهِ فَفَسَخْتُهُ ‘আমি সিদ্ধান্ত দিয়েছি এমন কোন বিষয় বাতিল করা আমার নিকটে সবচেয়ে সহজ, যখন আমি দেখি যে তার বিপরীতটাই সত্য।[21]

আব্দুর রহমান বিন মাহদী (৩৫-১৯৮ হিঃ) বলেন, আমরা এক জানাযায় ছিলাম। যেখানে ওবায়দুল্লাহ বিন হাসান উপস্থিত ছিলেন, যিনি তখন রাজধানী বাগদাদের বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। আমি তাঁকে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি ভুল উত্তর দেন। তখন আমি বললাম, أصلحك الله، القول في هذه المسألة كذا وكذا ‘আল্লাহ আপনাকে সংশোধন হওয়ার তাওফীক দিন! এ মাসআলার সঠিক উত্তর হ’ল এই, এই। তখন তিনি কিছুক্ষণ দৃষ্টি অবনত রাখেন। অতঃপর মাথা উঁচু করে দু’বার বলেন, إذًا أرجع وأنا صاغر ‘এখন আমি প্রত্যাবর্তন করলাম এবং আমি লজ্জিত’। অতঃপর বললেন, لأن أكون ذنبا في الحق أحب إلي من أن أكون رأسا في الباطل ‘ভুল স্বীকার করে হক-এর লেজ হওয়া আমার নিকট অধিক প্রিয় বাতিলের মাথা হওয়ার চাইতে’।[22] অর্থাৎ হক-এর অনুসারী হওয়া বাতিলের নেতা হওয়ার চাইতে অনেক উত্তম।

[1]. মুসলিম হা/১৮৩৮; মিশকাত হা/৩৬৬২।

[2]. আবুদাঊদ হা/৪০৯০; মিশকাত হা/৫১১০ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ।

[3]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩১২৪৪; দারেমী হা/৫২৩, সনদ জাইয়িদ।

[4]. মুসনাদ দারেমী হা/৫২৭, সনদ হাসান।

[5]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬১৯০, ৬১৯৫।

[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২১৯৬ ‘কুরআনের ফযীলত সমূহ’ অধ্যায়।

[7]. হাকেম হা/৫৩৮২ সনদ ছহীহ।

[8]. তিরমিযী হা/১৮৬২, ২৪৯২, মিশকাত হা/৩৬৪৩, ৫১১২।

[9]. বুখারী, ফৎহ সহ হা/৩০।

[10]. বুখারী হা/৬০৫৪; মুসলিম হা/২৫৯১, মিশকাত হা/৪৮২৯।

[11]. তিরমিযী হা/২৪৯২।

[12]. আহমাদ, মিশকাত হা/২৯৫৯; ছহীহাহ হা/২৪২।

[13]. বুখারী হা/১৩৯৫, মুসলিম হা/১৯, মিশকাত হা/১৭৭২।

[14]. বুখারী হা/২৪৪৭, মুসলিম হা/২৫৭৯, মিশকাত হা/৫১২৩।

[15]. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭ ‘যুলুম’ অনুচ্ছেদ।

[16]. মুসলিম হা/২৫৮২; মিশকাত হা/৫১২৮।

[17]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪, মিশকাত হা/৫২৪৬।

[18]. ইবনু মাজাহ হা/৩২৯১, আহমাদ হা/৩৬৮০।

[19]. আহমাদ, তিরমিযী হা/১৯৮৭, মিশকাত হা/৫০৮৩।

[20]. দারাকুৎনী হা/৪৪২৫-২৬; বাগাভী, শারহুস সুন্নাহ ১০/১১৪; বায়হাক্বী ১০/১১৯, হা/২০১৫৯। প্রসিদ্ধ এই পত্রটির সনদ, মতন ও সময়কাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পত্রটির সত্যতার ( في أصل الرواية ) বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : রিয়াদ, মাজাল্লা বহূছুল ইলমিয়াহ, ১৭ তম সংখ্যা, যুলক্বা‘দাহ- ছফর ১৪০৬-০৭ হিঃ)।

[21]. বায়হাক্বী ১০/১১৯, হা/২০১৬০।

[22]. তারীখু বাগদাদ ১০/৩০৮।

১৫
অহংকারের কারণসমূহ
১. অন্যের সম্মান দেখে অহংকারী হওয়া :

আদমের উচ্চ সম্মান দেখে ইবলীস অহংকারী হয়ে ওঠে এবং সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلاَّ إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ -

‘অতঃপর যখন আমরা ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর। তখন তারা সবাই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার দেখালো। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল (বাক্বারাহ ২/৩৪)।

যুগে যুগে এটা জারি আছে। যেজন্য নবী-রাসূলগণ ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ সর্বদা অহংকারী সমাজনেতাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও অহংকারীরা সর্বদা নিজেদের সাফাই গেয়ে মিথ্যা বলে থাকে।

২. মালের আধিক্য :

অধিক ধন-সম্পদ মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে তোলে। মাল ও সন্তান মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। কিন্তু মানুষ অনেক সময় এর দ্বারা ফেৎনায় পতিত হয় এবং অহংকারে স্ফীত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ ক্বারূণের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

إِنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْفَرِحِينَ - ... قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلاَ يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ -

‘ক্বারূণ ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। আমরা তাকে এমন ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম, যার চাবিসমূহ বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিকদের পসন্দ করেন না।’ ... ‘সে বলল, এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চাইতে শক্তিতে প্রবল ছিল এবং সম্পদে প্রাচুর্যময় ছিল। আর অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না (তারা সরাসরি জাহান্নামে যাবে)’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৬, ৭৮)।

ক্বারূণী ধন সবাই পেতে চায়। কিন্তু তা মানুষকে অহংকারী করে তোলে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ -

‘অতঃপর আমরা ক্বারূণকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে ধ্বসিয়ে দিলাম। ফলে তার পক্ষে এমন কোন দল ছিল না, যে আল্লাহর শাস্তি হতে তাকে সাহায্য করতে পারে এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮১)।

৩. ইলম :

ইলম অনেক সময় আলেমকে অহংকারী বানায়। দু’ধরনের লোকের মধ্যে এটা দেখা যায়। জন্মগতভাবে বদ চরিত্রের লোকেরা যখন ইলম শিখে, তখন ইলমকে তার বদস্বভাবের পক্ষে কাজে লাগায়। এইসব আলেমরা কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করে এবং নিজেকে অন্যদের তুলনায় বড় আলেম বলে যাহির করে। এদের মধ্যে ইলম থাকলেও সেখানে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি থাকে না। তাদের সকল কাজে লক্ষ্য থাকে দুনিয়া অর্জন করা ও মানুষের প্রশংসা কুড়ানো। যা তাদেরকে অহংকারী করে ফেলে। যেমন আববাসীয় যুগের শ্রেষ্ঠ কবি আবুত ত্বাইয়েব আহমাদ বিন হুসাইন আল-মুতানাববী (৩০৩-৩৫৪ হিঃ)[1] বলেন,

مَا مُقامِي بِأَرْضِ نَخْلَةَ إلاَّ + كمُقامِ الْمَسيحِ بين الْيَهُودِ

‘নাখলার জনপদে আমার অবস্থান ইহূদীদের মাঝে মসীহ ঈসার অবস্থানের ন্যায়।’

অনুরূপভাবে অন্ধ কবি আবুল ‘আলা আল-মা‘আররী (৩৬৩-৪৪৯ হিঃ) বলেন,

وأنِّي وإنْ كنتُ الأخيرَ زمانُهُ + لَآتٍ بِمَا لَمْ تَسْتَطِعْهُ الْأَوَائِلُ

‘আমি যদিও কালের হিসাবে শেষে এসেছি। তথাপি আমি যা এনেছি, তা পূর্বের লোকেরা আনতে সক্ষম হয়নি’।[2]

দ্বিতীয় কারণ হ’ল, অল্প বিদ্যা। যেমন কিছু ইলম শিখেই নিজেকে অন্যের তুলনীয় মনে করা এবং একথা বলা যে, هُمْ رِجَالٌ وَنَحْنُ رِجَالٌ ‘তারাও মানুষ ছিলেন, আমরাও মানুষ’।[3] অর্থাৎ আমরা ও তারা সমান। এটা তাদের অহংকারের পরিচয়। সেজন্যেই প্রবাদ আছে ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’। নিঃসন্দেহে পূর্ববর্তী বিদ্বানগণের মর্যাদা অনেক বেশী। কেননা তাদের ইলমের পথ ধরেই পরবর্তীরা এসেছেন। তাছাড়া সমকালীন প্রত্যেকেই পৃথক গুণ ও মেধার অধিকারী। অতএব কেউ কারু সমান নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রত্যেকেই পৃথকভাবে সম্মান পাওয়ার যোগ্য।

প্রকৃত ইলম হ’ল সেটাই যা মানুষকে বিনয়ী ও আল্লাহভীরু বানায়। ইমাম মালেক বিন আনাস (৯৩-১৭৯ হিঃ)-কে ৪৮ টি প্রশ্ন করা হ’লে তিনি ৩২ টি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, لاَ أَدْرِي ‘আমি জানি না’।[4] বহু মাসআলায় তিনি বলতেন, তুমি অন্যকে জিজ্ঞেস কর।’ ‘কাকে জিজ্ঞেস করব? এরূপ প্রশ্নের উত্তরে তিনি কারু নাম না করে বলতেন, আলেমদের জিজ্ঞেস কর’। তিনি মৃত্যুকালে কাঁদতে থাকেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি আমার ‘রায়’ অনুযায়ী যত ফৎওয়া দিয়েছি প্রতিটির বদলায় যদি আমাকে চাবুক মারা হ’ত! ... হায় যদি আমি কোন ফৎওয়া না দিতাম!।[5] বহু ইখতেলাফী মাসআলায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলতেন, আমি জানি না’।[6]

ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ) বলতেন, عِلْمُنَا هَذَا رَأْيٌ وَهُوَ أَحْسَنُ مَا قَدَرْنَا عَلَيْهِ ، وَمَنْ جَاءَنَا بِأَحْسَنَ مِنْهُ قَبِلْنَاهُ مِنْهُ ‘আমাদের ইলম হ’ল ‘রায়’। আমাদের নিকটে এটাই সর্বোত্তম হিসাবে অনুমিত হয়েছে। যে ব্যক্তি এর চেয়ে উত্তম নিয়ে আসবে, আমরা তার কাছ থেকে সেটা গ্রহণ করব’।[7] পরবর্তী যুগে সালাফে ছালেহীনের একটা সাধারণ রীতি ছিল এই যে, তাঁরা নিজস্ব রায় থেকে কিছু লিখলে শেষে বলতেন, واللهُ أَعْلَمُ بِالصِّدْقِ وَالصَّوَابِ ‘আল্লাহ সত্য ও সঠিক সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত’।

সত্যসন্ধানী আল্লাহভীরু আলেমদের দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই কেবল আল্লাহকে ভয় করে থাকে’ (ফাত্বির ৩৫/২৮)। এখানে ‘আলেম’ বলতে দ্বীনী ইলমের অধিকারীদের বুঝানো হয়েছে। কেননা দুনিয়াবী ইলম কাফের-মুশরিকরাও শিখে থাকে। কিন্তু তারা আল্লাহভীরু নয়। আর দুনিয়াবী ইলম কাউকে আল্লাহভীরু বানায় না আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ব্যতীত।

পক্ষান্তরে যারা ইলমকে দুনিয়া হাছিলের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে, তাদের বিষয়ে হাদীছে কঠিন হুঁশিয়ারী এসেছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রথম বিচার করা হবে শহীদ, আলেম ও দানশীল ব্যক্তিদের। অতঃপর দুনিয়াসর্বস্ব নিয়তের কারণে তাদেরকে উপুড়মুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[8] কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য হাদীছে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইলম শিখল আলেমদের সাথে তর্ক করার জন্য এবং মূর্খদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।[9] আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত অন্য হাদীছে তিনি আরও বলেন, مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি ইলম শিখে যদ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, অথচ সে তা শিখে পার্থিব সম্পদ লাভের জন্য, ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।[10]

অথচ যে ব্যক্তি স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মানুষকে কল্যাণের পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন। ফেরেশতারা তার (নিরাপত্তার জন্য) তাদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেন। তাছাড়া ফেরেশতামন্ডলী, আসমান ও যমীনবাসীগণ, এমনকি পানির মাছ ও গর্তের পিঁপড়ারাও তার জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। এইসব আলেম হ’লেন ‘নবীগণের ওয়ারিছ’ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ অর্থাৎ তাঁদের ইলমের উত্তরাধিকারী। কেননা নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম ছেড়ে যাননি, কেবল ইলম ব্যতীত। যে ব্যক্তি সেই ইলম লাভ করেছে, সে ব্যক্তি পূর্ণভাবেই তা লাভ করেছে’ (অর্থাৎ সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ ইলম সে লাভ করেছে)।[11] নিজে ইলম না শিখলেও যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীছ এর ইলম যথাযথভাবে অন্যের নিকট পৌঁছে দিবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য দো‘আ করে বলেন, نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلَّغَهُ كَمَا سَمِعَ فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার চেহারা উজ্জ্বল করুন! কেননা যার কাছে ইলম পৌঁছানো হয়, তিনি অনেক সময় শ্রবণকারীর চাইতে অনেক বেশী হেফাযতকারী বা জ্ঞানী হয়ে থাকেন’।[12]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলতেন, لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ ‘অধিক হাদীছ বর্ণনা প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়। বরং আল্লাহভীতিই হ’ল প্রকৃত জ্ঞান’।[13]

অতএব আল্লাহকে চেনা ও জানা এবং আল্লাহভীতি অর্জন করাই হ’ল ইলম হাছিলের মূল লক্ষ্য। আল্লাহভীতি সৃষ্টি হলেই বাকী সবকিছুর জ্ঞান তার জন্য সহজ হয়ে যায়। কুরআন ও হাদীছ হ’ল সকল ইলমের খনি। সেখানে গবেষণা করলে মানবীয় চাহিদার সকল দিক ও বিভাগ পরিচ্ছন্ন হয়ে গবেষকের সামনে ফুটে ওঠে। আল্লাহর রহমতে তার অন্তর জগত খুলে যায়। ফলে সে অহংকারমুক্ত হয়।

৪. পদমর্যাদা :

উচ্চ পদমর্যাদা মানুষের মধ্যে অনেক সময় অহংকার সৃষ্টি করে। মূর্খরা এটাকে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করে। জ্ঞানীরা এর মাধ্যমে মানব কল্যাণে অবদান রাখেন। পদমর্যাদা একটি কঠিন জওয়াবদিহিতার বিষয়। যিনি যত বড় দায়িত্বের অধিকারী, তাকে তত বড় জওয়াবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، فَالإِمَامُ الَّذِى عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ وَهِىَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ ، وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِه-ِ ‘মনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাসাধারণের দায়িত্বশীল। তিনি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। ব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর গৃহ ও সন্তানাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। চাকর তার মনিবের মাল-সম্পদ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[14]

যে ব্যক্তি পদমর্যাদা বা দায়িত্ব পেয়ে অহংকারী হয় এবং পদের অপব্যবহার করে, তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে লোকদের উপর দায়িত্বশীল নিয়োগ করেন। অতঃপর সে তাদের সাথে খেয়ানতকারী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন’।[15] মূলতঃ যুলুম-খেয়ানত সবকিছুর উৎপত্তি হয় পদমর্যাদার অহংকার থেকে। তাই জান্নাত পিয়াসী বান্দাকে এ বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرْفَعُ لَهُ بِقَدْرِ غَدْرِهِ أَلاَ وَلاَ غَادِرَ أَعْظَمُ غَدْرًا مِنْ أَمِيرِ عَامَّةٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের কোমরে একটা করে ঝান্ডা স্থাপন করা হবে। যা তার খেয়ানতের পরিমাণ অনুযায়ী উঁচু হবে। মনে রেখ, সেদিন সবচেয়ে উঁচু ঝান্ডা হবে প্রধান শাসকের খেয়ানতের ঝান্ডা’।[16] অতএব পদমর্যাদা যেন মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি না করে; বরং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে কৈফিয়ত দেয়ার ভয়ে হৃদয় যেন সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে, আল্লাহর নিকটে সর্বদা সেই তাওফীক কামনা করতে হবে।

৫. বংশ মর্যাদা :

বংশ মর্যাদা মানুষের উচ্চ সম্মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদন্ড। এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে, যতক্ষণ বংশের লোকেরা বিনয়ী ও চরিত্রবান থাকে। উক্ত দু’টি গুণ যত বৃদ্ধি পায়, বংশের সম্মান ও মর্যাদা তত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি সেখানে কথায় ও আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়, তাহলে কচুর পাতার পানির মত উক্ত সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ أَوْحَى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلاَ يَبْغِى أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ ‘আল্লাহ আমাকে প্রত্যাদেশ করেছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও। তোমাদের কেউ যেন একে অপরের উপর গর্ব না করে এবং একে অপরের উপর ঔদ্ধত্য প্রদর্শন না করে’।[17]

তিনি বলেন, লোকেরা যেন তাদের (মুশরিক) বাপ-দাদার নামে গর্ব করা হ’তে বিরত থাকে, যারা মরে জাহান্নামের অঙ্গারে পরিণত হয়েছে ... নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদার অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। এক্ষণে সে আল্লাহভীরু মুমিন ( مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ ) অথবা হতভাগ্য পাপী ( فَاجِرٌ شَقِيٌّ ) মাত্র। মানবজাতি সবাই আদমের সন্তান। আর আদম হ’ল মাটির তৈরী’ (অতএব অহংকার করার মত কিছুই নেই)।[18] তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ ‘তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না, যেরূপ খ্রিষ্টানরা মারিয়ামপুত্র ঈসার ব্যাপারে করেছে। আমি আল্লাহর একজন বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা বলো, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[19]

সঙ্গত কারণে বিশেষ অবস্থায় বংশ মর্যাদাকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন (ক) বৈবাহিক সমতার ক্ষেত্রে।[20] (খ) রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে। যেমন পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে যান, الأَئِمَّةُ مِنْ قُرَيْشٍ ‘নেতা হবেন কুরায়েশদের মধ্য থেকে’।[21] তাঁর মৃত্যুর পরে খলীফা নির্বাচন নিয়ে মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হ’লে উক্ত হাদীছটির মাধ্যমে সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। অতঃপর সবাই মুহাজির নেতা আবুবকর (রাঃ)-কে খলীফা হিসাবে মেনে নেন। এই সিলসিলা খেলাফতে রাশেদাহ, খিলাফতে বনু উমাইয়া ও আববাসীয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (গ) যুদ্ধকালীন সময়ে। যেমন হোনায়েন যুদ্ধে শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় সৃষ্ট মহা সংকটকালে দৃঢ়চেতা রাসূল (ছাঃ) খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, أَنَا النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ، أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ ‘আমিই নবী মিথ্যা নই। আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র।’ রাবী বলেন, সেদিন তাঁর চাইতে দৃঢ় কাউকে দেখা যায়নি’।[22]

এখানে তিনি আরবের শ্রেষ্ঠ বংশের নেতার পুত্র হিসাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন। এর দ্বারা তিনি শত্রুদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান আমি বুক দিতে জানি, পিঠ দিতে জানি না। বস্ত্ততঃ তাঁর এই হুমকিতে দারুণ কাজ হয়। মাত্র ২০ দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী কুরায়েশ নেতা আববাস, আবু সুফিয়ান বিন হারেছ, হাকীম বিন হিযাম সহ অন্যেরা সবাই দ্রুত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে এসে দাঁড়ান এবং মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। শত্রুপক্ষ নিমেষে পরাজিত হয় ও পালিয়ে যায়।

বংশ মর্যাদার এই তারতম্যকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করলেই সেটা দোষের হয়। অন্যায়ভাবে বংশের গৌরব করাকে তিনি ‘জাহেলিয়াতের অংশ’ ( عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ ) বলে ধিক্কার দিয়েছেন।[23]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَخِيَارُكُمْ فِى الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِى الإِسْلاَمِ إِذَا فَقِهُوا তোমাদের মধ্যে যারা জাহেলী যুগে উত্তম ছিলে, তারা ইসলামী যুগেও উত্তম, যদি তারা দ্বীনের জ্ঞানে পারদর্শী হয়’।[24] হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর প্রশংসায় তিনি বলেন, الْكَرِيمُ ابْنُ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ يُوسُفُ بْنُ يَعْقُوبَ بْنِ إِسْحَاقَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ সম্ভ্রান্তের পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত ও তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁরা হ’লেন ইবরাহীম, তাঁর পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব এবং তাঁর পুত্র ইউসুফ’।[25] এতে বুঝা যায় যে, বংশমর্যাদা প্রশংসিত। কিন্তু অন্যায়ভাবে তার ব্যবহারটা নিন্দনীয়।

ইসলামে দ্বীন ও আল্লাহভীতিকে সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। যেমন দ্বীন ও তাক্বওয়ার কারণেই কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তদাস বেলাল উচ্চ সম্মান লাভ করেছিলেন। ওমর (রাঃ) বলতেন, أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا، يَعْنِى بِلاَلاً ‘আবুবকর আমাদের নেতা এবং তিনি মুক্ত করেছেন আমাদের নেতাকে (অর্থাৎ বেলালকে)’।[26] মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে কা‘বাগৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিতে বলেন। তার এই উচ্চ সম্মান দেখে কুরায়েশ নেতারা সমালোচনা করেছিলেন।[27] ওযূ নষ্ট হলেই তাহিইয়াতুল ওযূ এবং আযানের পরেই মসজিদে তাহিইয়াতুল মাসজিদ-এর নফল ছালাত আদায়ের নিয়মিত সদভ্যাসের কারণেই জান্নাতে বেলালের অগ্রগামী পদশব্দ স্বপ্নের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শুনেছিলেন ও তার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।[28]

বস্ত্ততঃ ইসলামের উদার সাম্যের কারণেই কুরায়েশ নেতা আবুবকর ও ওমরের পাশাপাশি পায়ে পা লাগিয়ে ছালাতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন আবিসিনিয়ার বেলাল হাবশী, রোমের ছুহায়েব রূমী, পারস্যের সালমান ফারেসী প্রমুখ ক্রীতদাসগণ। কোটি কোটি মুসলমান তাদের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে দো‘আ করে বলেন, ‘রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু’ (আল্লাহ তার উপরে সন্তুষ্ট হউন!)। স্রেফ দ্বীনের কারণে বেলাল এখানে উচ্চ সম্মানিত। পক্ষান্তরে কুফরীর কারণে তার মনিব উমাইয়া বিন খালাফ হলেন অপমানিত ও লাঞ্ছিত। অথচ তিনি ছিলেন অন্যতম কুরায়েশ নেতা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আপন চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী। অতএব ইসলামে বংশ মর্যাদা স্বীকৃত ও প্রশংসিত হলেও দ্বীন ও তাক্বওয়া না থাকলে তা নিন্দিত ও মূল্যহীন। এখানে সকলের সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হ’ল ঈমান ও তাক্বওয়া। মুসলমান সবাই ভাই ভাই। দাস-মনিবে কোন প্রভেদ নেই। পৃথিবীর কোন সমাজ ব্যবস্থায় এর কোন নযীর নেই। কেবল অহংকারী ব্যক্তিরাই এর বিপরীত আচরণ করে থাকে।

৬. ইবাদত ও নেক আমল :

ইবাদত ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হ’লেও তা অনেক সময় মুমিনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে।

বহু নেককার ও ইবাদতগুযার ব্যক্তি অলি-আউলিয়া, গাউছ-কুতুব-আবদাল, পীর-মাশায়েখ ইত্যাদি লকবে অভিহিত হন। তারা ভক্তের ভক্তি রসে আপ্লুত হ’তে ভালবাসেন। নযর-নেয়ায, পদসেবা গ্রহণ ইত্যাদি তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। যা তাদের মধ্যে লোভ ও অহংকার সৃষ্টি করে।

খাত্ত্বাবী বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) একবার খোরাসানের এক বিখ্যাত দরবেশের খানক্বায় গেলেন। কিন্তু তিনি তাঁর দিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তখন তাকে বলা হ’ল, আপনি কি জানেন ইনি কে? ইনি হ’লেন আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীছ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক’। একথা শুনে দরবেশ দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে তাঁর নিকটে ওযর পেশ করলেন ও তাঁকে উপদেশ দিতে বললেন। তখন তিনি তাকে বললেন, إِذَا خَرَجْتَ مِنْ مَنْزِلِكَ فَلا يَقَعْ بَصَرُكَ عَلَى أَحَدٍ إِلا أُرِيتَ أَنَّهُ خَيْرٌ مِنْكَ ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন তুমি যাকেই দেখবে, তাকেই তোমার চাইতে উত্তম বলে মনে করবে’।[29]

পক্ষান্তরে সালাফে ছালেহীনের নীতি ছিল এই যে, তারা সর্বদা নিজেকে অন্যের চাইতে হীন মনে করতেন। যেমন (ক) বকর বিন আব্দুল্লাহ মুযানী (মৃঃ ১০৬ হিঃ) বলেন, نَظَرْتُ إِلَى أَهْلِ عَرَفَاتٍ ظَنَنْتُ أَنَّهُ قَدْ غُفِرَ لَهُمْ لَوْلاَ أَنِّي كُنْتُ فِيهِمْ بِهِ ‘আমি আরাফাতের ময়দানে অবস্থানরত সকলের দিকে দেখলাম এবং ভাবলাম যে, এদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়েছে, যদি না আমি এদের মধ্যে থাকতাম’। অর্থাৎ কেবল আমাকেই ক্ষমা করা হয়নি।[30]

(খ) ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুজাদ্দিদ খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৬১-১০১ হিঃ)-কে বলা হ’ল, আপনি মারা গেলে আমরা আপনাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কক্ষে দাফন করব। জওয়াবে তিনি বললেন, لأن ألقى الله بكل ذنب غير الشرك أحب إلي من أن أرى نفسي أهلاً لذلك ‘শিরক ব্যতীত যাবতীয় পাপ নিয়ে আল্লাহর কাছে হাযির হওয়াটা আমার নিকট অধিক প্রিয় ঐ স্থানে কবরস্থ হওয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করার চাইতে’।[31] এর মাধ্যমে তিনি নিজের হীনতা প্রকাশ করেছেন।

(গ) আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে বসেছিলাম। এমন সময় তিনি বললেন, ‘আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) মৃত্যুকালে স্বীয় পুত্রকে অছিয়ত করে বলেন, আমি তোমাকে দু’টি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি ও দু’টি বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি। নির্দেশ হ’ল তুমি বলবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কেননা আসমান ও যমীনের সবকিছু যদি এক হাতে রাখা হয় এবং এটিকে যদি এক হাতে রাখা হয়, তাহলে এটিই ভারি হবে। দ্বিতীয় হ’ল ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’। কেননা এটি সকল বস্ত্তর তাসবীহ এবং এর মাধ্যমেই সকল সৃষ্টিকে রূযী দেওয়া হয়। আর আমি তোমাকে নিষেধ করে যাচ্ছি দু’টি বস্ত্ত থেকে : শিরক ও অহংকার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলা হ’ল, আমরা সুন্দর জুতা পরি, সুন্দর পোষাক পরিধান করি, লোকেরা আমাদের কাছে এসে বসে- এগুলি কি অহংকার হবে? তিনি বললেন, না। বরং অহংকার হ’ল, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে হেয় জ্ঞান করা।[32]

সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও নিজের ভুলের উপর যিদ ও হঠকারিতার বিষয়টি বেশী দেখা যায় শিরক-বিদ‘আত ও তাকলীদপন্থী লোকদের মধ্যে, দল ও রাষ্ট্র নেতাদের মধ্যে এবং মূর্খ ও ধর্মান্ধ লোকদের মধ্যে। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই গর্বিত থাকে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজেকে সংশোধনের আকাংখা তাদের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। বংশের নেতারা বড়াই করেন তাদের আভিজাত্য নিয়ে। নারীরা অহংকার করে তাদের সৌন্দর্য নিয়ে, ধনীরা অহংকার করে তাদের ধন নিয়ে, আলেমরা অহংকার করেন তাদের ইলম ও অনুসারী দল নিয়ে, দলনেতারা অহংকার করেন তাদের দল নিয়ে, রাষ্ট্রনেতারা অহংকার করেন তাদের শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে। অথচ সব অহংকারই ধূলায় মিশে যাবে আল্লাহর একটি ‘কুন’ শব্দে। অতএব হে মানুষ! অহংকারী হয়ো না, বিনয়ী হও। উদ্ধত হয়ো না, কৃতজ্ঞ হও। অতীত ভুলো না, সামনে তাকাও। জন্মের আগে তুমি কিছুই ছিলে না, এখুনি অচল বা পাগল হয়ে গেলে তুমি হিসাবযোগ্য কিছুই থাকবে না। অতএব অহংকার করো না।

[1]. কথিত আছে যে, নবুঅত দাবী করার কারণে তিনি ‘মুতানাববী’ নামে পরিচিত হন।

[2]. ইবনু খাল্লিকান, অফিয়াতুল আ‘ইয়ান ১/৪৫০ পৃঃ।

[3]. ইবনু হাযম, আল-ইহকাম (কায়রো : দারুল হাদীছ ১৪২৬/২০০৫) ৪/৫৮৪।

[4]. মুহাম্মাদ বিন আলাবী, মালেক বিন আনাস (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ ২০১০ খৃঃ) পৃঃ ৩২।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কেঈন ১/৭৬।

[6]. ঐ, ১/৩৩।

[7]. ঐ ১/৭৫।

[8]. মুসলিম হা/১৯০৫, মিশকাত হা/২০৫।

[9]. তিরমিযী হা/৩১৩৮ হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/২২৫ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[10]. আহমাদ, আবুদাঊদ হা/৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/২২৭।

[11]. তিরমিযী হা/২৬৮৫, আবুদাঊদ হা/৩৬৪১, মিশকাত হা/২১২-২১৩।

[12]. ইবনু মাজাহ হা/২৩২, তিরমিযী হা/২৬৫৭, দারেমী হা/২৩০, মিশকাত হা/২৩০-৩১।

[13]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১৪৭ পৃঃ।

[14]. বুখারী হা/৭১৩৮, মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫।

[15]. মুসলিম হা/১৪২ ‘ঈমান’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৩৬৮৬।

[16]. মুসলিম হা/১৭৩৮, মিশকাত হা/৩৭২৭।

[17]. মুসলিম হা/২৮৬৫; মিশকাত হা/৪৮৯৮ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘পরস্পরে গর্ব’ অনুচ্ছেদ।

[18]. তিরমিযী হা/৩২৭০; আবুদাঊদ হা/৫১১৬; মিশকাত হা/৪৮৯৯।

[19]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।

[20]. বুখারী হা/৫০৯০, মুসলিম হা/১৪৬৬, মিশকাত হা/৩০৮২ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।

[21]. আহমাদ হা/১২৩২৯, ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৫৮, বুখারী হা/৭১৩৯, ফাৎহুল বারী, উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ, ইরওয়াউল গালীল হা/৫২০।

[22]. বুখারী হা/৩০৪২, মুসলিম হা/১৭৭৬, মিশকাত হা/৪৮৯৫।

[23]. তিরমিযী হা/৩৯৫৫, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৮৯৯।

[24]. বুখারী হা/৪৬৮৯, মুসলিম হা/২৩৭৮, মিশকাত হা/৪৮৯৩।

[25]. বুখারী হা/৩৩৯০; তিরমিযী হা/৩৩৩২; মিশকাত হা/৪৮৯৪।

[26]. বুখারী হা/৩৭৫৪।

[27]. সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪১৩।

[28]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩২২; তিরমিযী, আহমাদ, মিশকাত হা/১৩২৬ ‘ঐচ্ছিক ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

[29]. খাত্ত্বাবী, আল-উযলাহ (কায়রো : মাতবা‘আ সালাফিয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৩৯৯ হিঃ) ৮৯ পৃঃ।

[30]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৮২৫২।

[31]. ইবনুল জাওযী, ছাইদুল খাত্বের (দামেশক: দারুল কলম, ১ম সংস্করণ ২০০৪ খৃঃ) ২৯৫ পৃঃ।

[32]. আহমাদ হা/৬৫৮৩; ছহীহাহ হা/১৩৪।

১৬
পরিণতি
দুনিয়াতে অহংকারের পরিণতি হ’ল লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে এর পরিণতি হ’ল ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ অর্থাৎ জাহান্নামীদের পুঁজ-রক্ত পান করা। যার অন্তরে যতটুকু অহংকার সৃষ্টি হবে, তার জ্ঞান ততটুকু হরাস পাবে। যদি কারু অন্তরে অহংকার স্থিতি লাভ করে, তবে তার জ্ঞানচক্ষু অন্ধ হয়ে যায়। বোধশক্তি লোপ পায়। সে অন্যের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কাম্য সম্মান না পেলে সে মনোকষ্টে মরতে বসে। তার চেহারায় ও আচরণে, যবানে ও কর্মে কেবলি অহংকারের দুর্গন্ধ বের হ’তে থাকে। ফলে মানুষ তার থেকে ছিটকে পড়ে। এক সময় সে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। একাকীত্বের যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে। কিন্তু বাইরে ঠাট বজায় রাখে। এভাবেই সে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যায়। বদরের যুদ্ধে আবু জাহল মরার সময় বলেছিল, ‘আমার চাইতে বড় কোন মানুষকে তোমরা হত্যা করেছ কি’? অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘মদীনার ঐ চাষারা ব্যতীত যদি অন্য কেউ আমাকে হত্যা করত’?[1]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হ’ল দুর্বল এবং যাদেরকে লোকেরা দুর্বল ভাবে। কিন্তু তারা যদি আল্লাহর নামে কসম দিয়ে কিছু বলে, আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হ’ল বাতিল কথার উপর ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারী’।[2] অর্থাৎ হকপন্থী মুমিনগণ দুনিয়াবী দৃষ্টিতে দুর্বল হ’লেও আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে সবল। কেননা তাদের দো‘আ দ্রুত কবুল হয় এবং আল্লাহর গযবে অহংকারী ধ্বংস হয়।

পবিত্র কুরআনে জাহান্নামীদের প্রধান দোষ হিসাবে তাদের অহংকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا ... قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ - ‘কাফিরদের দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে’... ‘তখন তাদেরকে বলা হবে তোমরা জাহান্নামের দরজা সমূহে প্রবেশ কর সেখানে চিরকাল থাকার জন্য। অতএব অহংকারীদের বাসস্থান কতই না নিকৃষ্ট’ (যুমার ৩৯/৭১-৭২)। এখানে কাফিরদের বাসস্থান না বলে ‘অহংকারীদের বাসস্থান’ বলা হয়েছে। কেননা কাফিরদের কুফরীর মূল কারণ হ’ল তাদের সত্য প্রত্যাখ্যানের দম্ভ ও অহংকার।

[1]. বুখারী হা/৩৯৬২, মুসলিম হা/১৮০০, মিশকাত হা/৪০২৯।

[2]. বুখারী হা/৪৯১৮, মুসলিম হা/২৮৫৩, মিশকাত হা/৫১০৬ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ।

১৭
অহংকার দূরীকরণের উপায় সমূহ
অহংকার মানুষের ভিতরে লুক্কায়িত একটা বিষের নাম। একে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। কিন্তু একে দমিয়ে রাখতে হবে, যেন মাথা উঁচু করতে না পারে। যেমন ঝাড়িয়ে সাপের বিষ নামাতে হয়। মনের মধ্যে এই বিষ-এর এর উদয় হ’লেই বুদ্বুদের মত একে হাওয়া করে দিতে হবে। তাই অহংকার দূরীকরণের জন্য কেবল আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং এ রোগের রীতিমত চিকিৎসা ও প্রতিষেধক প্রয়োজন। নিম্নে এ বিষয়ে বর্ণিত হ’ল।-

১. নিজের সৃষ্টি ও মৃত্যুর কথা সর্বদা স্মরণ করা :

মানুষ তার জন্মের সময় উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না (দাহর ৭৬/১)। মৃত্যুর পর সে লাশে পরিণত হবে। আর মৃত্যুর ঘণ্টা সর্বদা তার মাথার উপর ঝুলে আছে। হুকুম হলেই তা বেজে উঠবে এবং তার রূহ যার হুকুমে তার দেহে এসেছিল তার কাছেই চলে যাবে। তার প্রাণহীন অসাড় দেহটা পড়ে থাকবে দুনিয়ায় পোকার খোরাক হবার জন্য।

আল্লাহ বলেন,

أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ- وَضَرَبَ لَنَا مَثَلاً وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِ الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ- قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ -

‘মানুষ কি দেখে না যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি একটি শুক্রাণু হ’তে? অথচ সে এখন হয়ে পড়েছে প্রকাশ্যে বিতর্ককারী’। ‘মানুষ আমাদের সম্পর্কে নানা উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়। আর বলে, কে এই পচা-গলা হাড়-হাড্ডিকে পুনর্জীবিত করবে’? ‘তুমি বলে দাও, ওকে পুনর্জীবিত করবেন তিনি, যিনি ওটাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। বস্ত্ততঃ তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৯)।

তিনি বলেন, أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ ‘যেখানেই তোমরা থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে গ্রাস করবেই। যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান কর’ (নিসা ৪/৭৮)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ يَعْنِى الْمَوْتَ ‘তোমরা স্বাদ ধ্বংসকারী বস্ত্তকে বেশী বেশী স্মরণ কর’ অর্থাৎ মৃত্যুকে।[1]

অতএব মানুষের জন্য অহংকার করার মত কিছু নেই। কেননা সে তার রোগ-শোক. বার্ধক্য-জ্বরা কিছুকেই প্রতিরোধ করতে পারে না। শতবার ঔষধ খেলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার রোগ সারে না। শত চেষ্টাতেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার বিপদ দূরীভূত হয় না। ফলে সে একজন অসহায় ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তার উচিত সর্বদা নিরহংকার ও বিনয়ী থাকা।

২. আখেরাতে জওয়াবদিহিতার ভয়ে ভীত হওয়া :

ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে দিয়ে আল্লাহ বলবেন, اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا ‘তোমার আমলনামা তুমি পাঠ কর। আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট’ (ইসরা ১৭/১৪)। অতঃপর যখন তারা স্ব স্ব আমলনামা দেখবে, তখন সে সময়কার অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لاَ يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلاَ كَبِيرَةً إِلاَّ أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلاَ يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا -

‘সেদিন উপস্থিত করা হবে প্রত্যেকের আমলনামা। অতঃপর তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকিত। এ সময় তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়নি, সবকিছুই লিখে রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সমূহকে সম্মুখে উপস্থিত দেখতে পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কারু প্রতি যুলুম করেন না’ (কাহফ ১৮/৪৯)।

অর্থাৎ আল্লাহ যাকে যে নে‘মত দিয়েছেন ও দুনিয়াবী দায়িত্ব প্রদান করেছেন, আল্লাহর নিকটে তার যথাযথ জওয়াবদিহিতার কথা সর্বদা স্মরণ করতে হবে এবং কিভাবে সে দায়িত্ব আরও সুন্দরভাবে পালন করা যায়, তার জন্য সর্বদা চেষ্টিত থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ মানুষের হায়াত ও মঊত সৃষ্টি করেছেন, কে তাদের মধ্যে সুন্দরতম আমল করে, সেটা পরীক্ষা করার জন্য’ (মুল্ক ৬৭/২)। অতএব এই তীব্র দায়িত্বানুভূতি তাকে অহংকারের পাপ হ’তে মুক্ত রাখবে ইনশাআল্লাহ। أَحْسَنَ عَمَلاً ‘সুন্দরতম আমল’ অর্থ ‘শরী‘আতের আলোকে সর্বাধিক শুদ্ধ আমল এবং অন্তরের দিক দিয়ে সর্বাধিক বিশুদ্ধ কর্ম। যা স্রেফ আল্লাহর জন্য নিবেদিত এবং সকল প্রকার রিয়া ও শ্রুতি হ’তে মুক্ত’। উল্লেখ্য যে, এখানে أَكَثَرَ عَمَلاً ‘অধিক আমল’ বলা হয়নি। অতএব শিরক বিমুক্ত এবং ছহীহ সুন্নাহ অনুমোদিত সৎকর্ম সংখ্যায় ও পরিমাণে অল্প হ’লেও তাই-ই ‘সুন্দরতম আমল’ হিসাবে আল্লাহর নিকটে গ্রহণীয় হবে।

(ক) হযরত ওমর (রাঃ) খেলাফতের দায়িত্বে (১৩-২৩/৬৩৪-৬৪৩ খৃঃ) থাকা অবস্থায় বলতেন, لَوْ مَاتَتْ سَخْلَةٌ عَلَى شَاطِئِ الْفُرَاتِ ضَيْعَةً لَخِفْتُ أَنْ أُسْأَلَ عَنْهَا ‘যদি ফোরাত নদীর কূলে একটি ভেড়ার বাচ্চাও হারানো অবস্থায় মারা যায়, তাতে আমি ভীত হই যে, সেজন্য আমাকে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’।[2]

(খ) খলীফা হারূনুর রশীদ (১৭০-১৯৩ হিঃ), যিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ব্যাপী বিশাল ইসলামী খেলাফতের অধিকারী ছিলেন, তিনি একদিন রাস্তায় চলছিলেন। এমন সময় জনৈক ইহূদী তার সাথে সাক্ষাৎ করল। সে তাকে বলল, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহকে ভয় করুন’। তখন খলীফা ঘোড়া থেকে নামলেন ও মাটিতে সিজদা করলেন। অতঃপর ইহূদীটিকে বললেন, তোমার প্রয়োজন কি বল? সে বলল এবং তিনি তার প্রয়োজন মিটালেন। অতঃপর যখন তাকে বলা হ’ল, আপনি একজন ইহূদীর জন্য সওয়ারী থেকে নামলেন? জবাবে তিনি বললেন, তার কথা শুনে আমার নিম্নোক্ত আয়াতটি স্মরণ হ’ল, যেখানে আল্লাহ বলেছেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ ‘যখন তাকে বলা হয় ‘আল্লাহকে ভয় কর’ তখন তার আত্মসম্মান তাকে পাপে স্ফীত করে তোলে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর অবশ্যই তা নিকৃষ্টতম ঠিকানা’।[3]

একজন সাধারণ ইহূদী প্রজার সাথে ক্ষমতাধর খলীফা হারূণ যদি এরূপ নম্র আচরণ করতে পারেন, তাহ’লে অন্যদের সাথে তিনি কেমন নিরহংকার আচরণ করতেন, সেটা সহজে অনুমেয়। এই ঘটনায় ইসলামী খেলাফতে অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি সর্বোত্তম সদাচরণের প্রমাণ পাওয়া যায়। যা কথিত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলিতে মুসলমানদের প্রতি কল্পনাও করা যায় না।

৩. নিজেকে জানা ও আল্লাহকে জানা :

প্রথমেই নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে যে, প্রাণহীন শুক্রাণু থেকে সে জীবন পেয়েছে। আবার সে মারা যাবে। অতএব তার কোন অহংকার নেই। অতঃপর আল্লাহ সম্পর্কে জানবে যে, তিনিই তাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। তিনিই তাকে শক্তি দিয়ে মেধা দিয়ে পূর্ণ-পরিণত মানুষে পরিণত করেছেন। তাঁর দয়ায় তার সবকিছু। অতএব প্রতি পদে পদে আল্লাহর দাসত্ব ব্যতীত তার কিছুই করার নেই। আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ ‘আমি জিন ও ইনসান সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার দাসত্ব করার জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। অতএব নিজেকে সর্বদা আল্লাহর দাস মনে করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অহংকার দূর করার প্রধান ঔষধ।

৪. যেসব বিষয় মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে, সেগুলিকে তুচ্ছ মনে করা : যেমন বংশের অহংকার, ধনের অহংকার, পদমর্যাদার অহংকার, বিশেষ কোন নে‘মতের অহংকার। এগুলি সবই আল্লাহর দান। তিনি যেকোন সময় এগুলি ফিরিয়ে নিতে পারেন। আমরা হর-হামেশা এগুলো দেখতে পাচ্ছি যে, বহু জ্বালাময়ী বক্তা সুস্থ থেকেও নির্বাক হয়ে আছেন, বহু লেখক লুলা হয়ে গেছেন, বহু ধনী নিঃস্ব হয়েছেন, বহু নেতা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। বহু শক্তিমান পুরুষ প্যারালাইজড হয়ে বা স্ট্রোক হয়ে বা বার্ধক্যে জরজর হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তাদের অসহায় চেহারাগুলি চিন্তা করলেই নিজের মধ্য থেকে অহংকার নিমেষে হারিয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, انْظُرُوا إِلَى مَنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ (যদি তুমি সুখী হতে চাও), তাহ’লে যে ব্যক্তি তোমার চেয়ে নীচু, তার দিকে তাকাও। কখনো উপরের দিকে তাকিয়ো না। তাহ’লে তোমাকে দেওয়া আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তুমি হীন মনে করবে না’।[4] অহংকার দূরীকরণে এটি একটি মহৌষধ।

৫. ইচ্ছাকৃতভাবে হীনকর কাজ করা :

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْصِفُ نَعْلَهُ وَيَخِيطُ ثَوْبَهُ وَيَعْمَلُ فِى بَيْتِهِ كَمَا يَعْمَلُ أَحَدُكُمْ فِى بَيْتِهِ وقالت : كَانَ بَشَراً مِنَ الْبَشَرِ يَفْلِى ثَوْبَهُ وَيَحْلُبُ شَاتَهُ وَيَخْدُمُ نَفْسَهُ -

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের জুতা নিজে ছাফ করতেন, কাপড় সেলাই করতেন ও বাড়ির নানাবিধ কাজ করতেন, যেমন তোমরা করে থাক। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) অন্যান্য মানুষের ন্যায় একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কাপড়ের উকুন বাছতেন, ছাগী দোহন করতেন এবং নিজের অন্যান্য কাজ করতেন।[5] মসজিদে নববী নির্মাণের সময়, খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের সময় তিনি নিজে মাটি কেটেছেন ও পাথর বহন করেছেন। বিভিন্ন সফরে তিনি ছাহাবীদের সঙ্গে বিভিন্ন কাজে অংশ নিয়েছেন।

তাঁর অনুসরণে ছাহাবায়ে কেরামও এরূপ করতেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) একদিন কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে বাজার অতিক্রম করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আব্দুল্লাহ! আল্লাহ কি আপনাকে এ কাজ করা থেকে মুখাপেক্ষীহীন করেননি? (অর্থাৎ আপনার তো যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ রয়েছে! আপনি কেন একাজ করছেন?) জবাবে তিনি বললেন, بَليَ، وَلَكِن أَرَدْتُ أَنْ أَدْفَعَ الْكِبْرَ ‘হ্যাঁ! কিন্তু আমি এ কাজের মাধ্যমে আমার অহংকার দূর করতে চাই। কেননা আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[6]

অতএব সাধ্যে কুলায় এমন যেকোন হীনকর কাজ করার মানসিকতা অর্জন করতে পারলে মনের মধ্য থেকে সহজে অহংকার দূর হয়ে যাবে। যেমন আপনি অফিসের বস। টেবিলের ধূলা নিজে মুছলেন, মাকড়সার জালগুলো নিজে দূর করলেন, প্রয়োজনে টয়লেট ছাফ করলেন, এমনকি ঘরটা ঝাড়ু দিলেন। এসব ছোটখাট কাজ হলেও এগুলির মাধ্যমে অহংকার দূর হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যের নিকট সম্মান বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি নিজের কাজ নিজে করায় রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুসরণের ছওয়াব পাওয়া যায়। লোকেরা আপনাকে সামনে নিয়ে মিছিল করতে চায়, আপনার ছবি তুলতে চায়, আপনার নামে প্রশংসামূলক শ্লোগান দিতে চায়, আপনার সামনে আপনার নামে অভিনন্দন পত্র পাঠ করতে চায়, আপনি সুযোগ দিবেন না অথবা এড়িয়ে যাবেন।

৬. আল্লাহ সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন, সবসময় একথা মনে রাখা :

আল্লাহ বলেন, إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ- مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ ‘মনে রেখ দু’জন গ্রহণকারী ফেরেশতা মানুষের ডানে ও বামে বসে সর্বদা তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে’। ‘সে মুখে যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য সদা তৎপর প্রহরী তার নিকটেই অবস্থান করে’ (ক্বাফ ৫০/১৭-১৮)।

হাদীছে জিব্রীলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর, যেন তুমি তাকে দেখছ। যদি তা না পারো, তবে এমনভাবে যেন তিনি তোমাকে দেখছেন’।[7]

৭. গরীব ও ইয়াতীমদের সঙ্গে থাকা ও রোগীর সেবা করা :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা আমাকে দুর্বলদের মধ্যে তালাশ কর’।[8] অর্থাৎ তাদের প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে আমার সন্তুষ্টি অন্বেষণ কর। জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে তার অন্তর কঠিন হওয়ার অভিযোগ পেশ করলে তিনি তাকে বললেন, امْسَحْ رَأْسَ الْيَتِيمِ وَأَطْعِمِ الْمِسْكِينَ ‘তুমি ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাও এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান কর।[9] তিনি বলেন, إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا عَادَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ لَمْ يَزَلْ فِى خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ একজন মুসলমান যখন অন্য একজন মুসলমান রোগীর সেবা করে, তখন সে জান্নাতের বাগিচায় অবস্থান করে, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে’।[10] তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত ছিলাম। কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে আমি আপনার সেবা করব? অথচ আপনি বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা পীড়িত ছিল, অথচ তুমি তার সেবা করোনি? যদি তুমি তাকে সেবা করতে, তাহ’লে তুমি আমাকে সেখানে পেতে’।[11]

বস্ত্ততঃ যেকোন সেবামূলক কাজ যদি নিঃস্বার্থ হয় এবং পরকালীন লক্ষ্যে হয়, তবে সেগুলি অহংকার চূর্ণ করার মহৌষধ হিসাবে আল্লাহর নিকটে গৃহীত হয় এবং বান্দা জাহান্নাম থেকে বেঁচে যায়। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জনৈক তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি মরুভূমিতে একটি কূয়ায় নেমে পানি পান শেষে উঠে দেখেন যে, একটি তৃষ্ণার্ত কুকুর পিপাসায় মরণাপন্ন হয়ে জিভ বের করে মাটিতে মুখ ঘষছে। তখন লোকটি পুনরায় কূয়ায় নেমে নিজের চামড়ার মোযা ভরে পানি এনে কুকুরটিকে পান করান এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান’। অন্য বর্ণনায় এসেছে বনু ইস্রাঈলের জনৈকা বেশ্যা মহিলা একটি কুকুরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় কূয়ার চারপাশে ঘুরতে দেখে নিজের ওড়নায় মোযা বেঁধে কূয়া থেকে পানি তুলে তাকে পান করায়। ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন’।[12]

৮. নিজের সৎকর্মগুলি আল্লাহর নিকটে কবুল হচ্ছে কি-না সেই ভয়ে সর্বদা ভীত থাকা :

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিম্নোক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ- أُولَئِكَ يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُونَ ‘আর যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত অন্তরে। এজন্য যে, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে’। ‘তারা দ্রুত সম্পাদন করে তাদের সৎকর্ম সমূহ এবং তারা সেদিকে অগ্রগামী হয়’ (মুমিনূন ২৩/৬০-৬১)। আমি বললাম, এরা কি তারাই যারা মদ্যপান করে ও চুরি করে? তিনি বললেন,

لاَ يَا بِنْتَ الصِّدِّيقِ وَلَكِنَّهُمُ الَّذِينَ يَصُومُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَتَصَدَّقُونَ وَهُمْ يَخَافُونَ أَنْ لاَ يُقْبَلَ مِنْهُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِى الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُونَ -

‘না হে ছিদ্দীকের কন্যা! বরং এরা হ’ল তারাই যারা ছিয়াম রাখে, ছালাত আদায় করে ও ছাদাক্বা করে এবং তারা সর্বদা ভীত থাকে এ ব্যাপারে যে, তাদের উক্ত নেক আমলগুলি কবুল হচ্ছে কি-না। তারাই সৎকর্ম সমূহের প্রতি দ্রুত ধাবমান হয়’।[13]

৯. ভুলক্রমে বা উত্তেজনা বশে অহংকার প্রকাশ পেলে সাথে সাথে বান্দার কাছে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لأَحَدٍ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَىْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ، ‘যদি কেউ তার ভাইয়ের সম্মানহানি করে বা অন্য কোন বস্ত্তর ব্যাপারে তার প্রতি যুলুম করে, তবে সে যেন তা আজই মিটিয়ে নেয়। সেদিন আসার আগে, যেদিন কোন দীনার ও দিরহাম তার সঙ্গে থাকবে না...।[14]

অন্যতম জ্যেষ্ঠ তাবেঈ মুত্বার্রিফ বিন আব্দুল্লাহ (মৃঃ ৯৫ হিঃ) হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পক্ষ হ’তে নিযুক্ত খোরাসানের গভর্ণর মুহাল্লাব বিন আবূ ছুফরাকে একদিন দেখলেন রাস্তা দিয়ে খুব জাঁক-জমকের সাথে যেতে। তিনি সামনে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর বান্দা! কিভাবে তুমি রাস্তায় চলছ, যা আল্লাহকে ক্রুদ্ধ করে? একথা শুনে মুহাল্লাব বললেন, আপনি কি আমাকে চিনেন? তাবেঈ বিদ্বান বললেন, نعم، أَوَّلُكَ نُطْفَةٌ مَذِرَةٌ، وَآخِرُكَ جِيفَةٌ قَذِرَةٌ، وَأَنْتَ فِيمَا بَيْنَ ذَلِكَ تَحْمِلُ الْعَذِرَةَ ‘অবশ্যই চিনি। তোমার শুরু হ’ল একটি নিকৃষ্ট শুক্রাণু থেকে এবং শেষ হ’ল একটি মরা লাশ হিসাবে। আর তুমি এর মধ্যবর্তী সময়ে বহন করে চলেছ পায়খানার ময়লা’। একথা শুনে মুহাল্লাব জাঁক-জমক ছেড়ে সাধারণভাবে চলে গেলেন।[15]

১০. অহংকারী পোষাক ও চাল-চলন পরিহার করা :

পোষাক স্বাভাবিক ও সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন হ’তে হবে। কেননা আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন’[16] এবং তিনি বান্দার উপর তাঁর নে‘মতের নিদর্শন দেখতে ভালবাসেন’।[17] কিন্তু স্বাভাবিক পোষাকের বাইরে অপ্রয়োজনে আড়ম্বরপূর্ণ কোন পোষাক পরিধান করা ‘রিয়া’-র পর্যায়ে পড়ে যাবে। যা কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। যাতে অনেকে ফেৎনায় পড়েন ও তার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি হয়। অনেক মসজিদে বিশেষ মুছল্লীদের জন্য বিশেষ স্থান ও জায়নামায দেখা যায়। এমনকি কারু জন্য বিশেষ দরজাও নির্দিষ্ট থাকে। যেগুলি নিঃসন্দেহে অহংকারের পর্যায়ভুক্ত।

১১. গোপন আমল করা :

নিরহংকার ও রিয়ামুক্ত হওয়ার অন্যতম পন্থা হ’ল গোপন আমল করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ تَعَالَى فِى ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ ... وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ -

‘কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণীর লোক আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া পাবে, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন হ’ল ঐ ব্যক্তি ... যে গোপনে ছাদাক্বা করে এমনভাবে যে ডান হাত যা ব্যয় করে, বাম হাত তা জানতে পারে না এবং ঐ ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর দু’চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়’।[18]

এজন্য তাহাজ্জুদের ছালাত রাত্রির শেষ প্রহরে একাকী নিরিবিলি পড়তে বলা হয়েছে (মুযযাম্মিল ৭৩/২-৩, ২০)।

১২. আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা :

যদি কেউ আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে পারে, তবে তার চোখের পানিতে অহংকার ধুয়ে-মুছে ছাফ হয়ে যাবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكَى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ حَتَّى يَعُودَ اللَّبَنُ فِى الضَّرْعِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, সে ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না। যেমন দুধ পুনরায় পালানে প্রবেশ করে না’।[19] তিনি বলেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহ’লে তোমরা কাঁদতে বেশী, হাসতে কম।[20] তিনি বলেন, আল্লাহর কসম আমি জানি না। আল্লাহর কসম আমি জানিনা। অথচ আমি আল্লাহর রাসূল; কি হবে সেদিন আমার ও কি হবে সেদিন তোমাদের’।[21] হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের অনেক পাপকে চুলের চাইতে সূক্ষ্ম মনে কর। অথচ রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় আমরা সেগুলিকে ধ্বংসকারী মনে করতাম’।[22] এক্ষণে অহংকারের মত মহাপাপ হৃদয়ে জাগ্রত হ’লে সেটাকে দ্রুত দমন করতে হবে, যা সহজেই অনুমেয়।

১৩. মানুষকে ক্ষমা করা ও সর্বদা নম্রতা অবলম্বন করা :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ ‘বান্দা কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর যখন সে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয় অবলম্বন করে, তখন তিনি তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেন’।[23] তিনি বলেন, إِنَّ الرِّفْقَ لاَ يَكُونُ فِى شَىْءٍ إِلاَّ زَانَهُ وَلاَ يُنْزَعُ مِنْ شَىْءٍ إِلاَّ شَانَهُ ‘কোন বস্ত্ততে নম্রতা থাকলে সেটি তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং তা প্রত্যাহার করা হ’লে সেটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে’।[24]

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বিনয় ও আনুগত্য মানুষকে উঁচু ও সম্মানিত করে। পক্ষান্তরে অহংকার ও আত্মগর্ব মানুষকে নীচু ও লাঞ্ছিত করে।

১৪. নিরহংকার হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা :

অহংকার থেকে মুক্ত থাকার জন্য নিম্নের দো‘আটি পাঠ করা যেতে পারে।-

اللهُ أَكْبَرُ كَبِيراً وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيراً وَسَبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً- اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ مِِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ -

অর্থ : আল্লাহ সর্বোচ্চ, আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা, সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর প্রশংসাসহ আল্লাহর জন্য সকল পবিত্রতা। আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি বিতাড়িত শয়তান হ’তে এবং তার প্ররোচনা, তার ফুঁক ও তার কুমন্ত্রণা হ’তে। উক্ত হাদীছে نَفْخُهُ বা ‘শয়তানের ফুঁক’-এর অর্থ সম্পর্কে রাবী ‘আমর বিন মুর্রা বলেন, সেটা হ’ল الْكِبْرُ অর্থাৎ ‘অহংকার’।[25]

এছাড়াও সূরা ফালাক্ব ও নাস পড়া উচিৎ। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে পারে না এবং কোন আশ্রয়প্রার্থী আশ্রয় চাইতে পারে না এ দু’টি সূরার তুলনায় অন্য কিছুর মাধ্যমে’।[26]

[1]. তিরমিযী হা/২৩০৭, মিশকাত হা/১৬০৭।

[2]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৪১৫, তারীখু ত্বাবারী ৪/২০২; সনদ হাসান লিগাইরিহী।

[3]. কুরতুবী, সূরা বাক্বারাহ ২০৬ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।

[4]. বুখারী হা/৬৪৯০, মুসলিম হা/২৯৬৩, মিশকাত হা/৫২৪২।

[5]. বুখারী হা/৬৭৬; আহমাদ হা/২৫৩৮০, ২৬২৩৭, মিশকাত হা/৫৮২২।

[6]. ত্বাবারাণী হা/৩৬৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৫৭।

[7]. বুখারী হা/৫০, মুসলিম হা/৮, মিশকাত হা/২।

[8]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪; ছহীহাহ হা/৭৭৯; মিশকাত হা/৫২৪৬।

[9]. আহমাদ, ত্বাবারাণী; ছহীহাহ হা/৮৫৪; মিশকাত হা/৫০০১।

[10]. মুসলিম হা/২৫৬৮, মিশকাত হা/১৫২৭।

[11]. মুসলিম হা/২৫৬৯, মিশকাত হা/১৫২৮।

[12]. বুখারী হা/৩৪৬৭; মুসলিম হা/২২৪৪।

[13]. তিরমিযী হা/৩১৭৫; ছহীহাহ হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৩৫০ ‘ক্রন্দন ও আল্লাহভীতি’ অনুচ্ছেদ।

[14]. বুখারী হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১২৬ ‘যুলুম’ অনুচ্ছেদ।

[15]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা মা‘আরিজ ৩৯ আয়াত।

[16]. মুসলিম হা/৯১, মিশকাত হা/৫১০৮।

[17]. তিরমিযী হা/২৮১৯, আহমাদ হা/১৯৯৪৮; মিশকাত হা/৪৩৫০, ৪৩৭৯।

[18]. বুখারী হা/১৪২৩, মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

[19]. তিরমিযী হা/১৭৩৩; মিশকাত হা/৩৮২৮।

[20]. বুখারী হা/৬৬৩১; মিশকাত হা/৫৩৩৯।

[21]. বুখারী হা/৩৯১৯; মিশকাত হা/৫৩৪০।

[22]. বুখারী হা/৬৪৯২; মিশকাত হা/৫৩৫৫।

[23]. মুসলিম হা/২৫৮৮; মিশকাত হা/১৮৮৯।

[24]. মুসলিম হা/২৫৯৪; মিশকাত হা/৫০৬৮।

[25]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৭৭৭; আলবানী, সনদ ছহীহ লিগাইরিহী।

[26]. নাসাঈ হা/৫৪৩৮; সনদ হাসান ছহীহ।

১৮
যে অহংকার শোভনীয়
(১) যখন মানুষ মিথ্যা ছেড়ে সত্যের অনুসারী হয়, তখন সে তার জন্য অহংকার করতে পারে। যেমন কুফর ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করা। (২) যদি কেউ জাল ও যঈফ হাদীছ ছেড়ে ছহীহ হাদীছের উপর আমল শুরু করে, তবে তার জন্য সে গর্ব করতে পারে। (৩) যখন কোন ব্যক্তি বাতিল ছেড়ে ফিরক্বা নাজিয়াহর অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন সে ঐ জামা‘আতের উপর গর্ব করতে পারে। যেমন হযরত ছওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَ هُمْ كَذَالِكَ -

‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[1] আর ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঐ হকপন্থী জামা‘আত হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’।[2] তিনি বলেন, যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামা‘আতবদ্ধ জীবনকে অপরিহার্য করে নেয়’।[3] (৪) হকপন্থী দলের নামে অহংকার। যেমন হোনায়েন-এর যুদ্ধের দিন বিপর্যয়কর অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হুকুমে উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী আববাস (রাঃ) হোদায়বিয়ার বৃক্ষতলে মৃত্যুর উপরে বায়‘আত গ্রহণকারী ছাহাবীদের ডেকে বলেন, أَيْنَ أَصْحَابُ السَّمُرَةِ ‘সামুরা বৃক্ষের সাথীরা কোথায়? يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ ‘হে আনছারগণ! একইভাবে বাতিলের অন্ধকারে আহলেহাদীছ-এর পরিচয় নিঃসন্দেহে সত্যের অহংকার। যা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। (৫) উচ্চ বংশের অহংকার। যেমন একই যুদ্ধে একই অবস্থার খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে তেজস্বী কণ্ঠে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে ওঠেন, أَنَا النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ + أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ ‘আমি নবী, মিথ্যা নই। আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র’।[4]

খ্রিষ্টানদের সাথে সন্ধির জন্য তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী সেখানে খলীফাকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বায়তুল মুক্বাদ্দাস সফরকালে খলীফা ওমর (রাঃ) যখন একাকী খালি পায়ে উটের লাগাম ধরে হাঁটতে শুরু করেন, তখন সাথী আবু ওবায়দাহ (রাঃ) এতে আপত্তি করেন। জবাবে ওমর (রাঃ) বলেন, إِنَّا كُنَّا أَذَلَّ قَوْمٍ فَأَعَزَّنَا اللهُ بِالْإِسْلاَمِ فَمَهْمَا نَطْلُبُ الْعِزَّةَ بِغَيْرِ مَا أَعَزَّنَا اللهُ بِهِ أَذَلَّنَا اللهُ ‘আমরা ছিলাম নিকৃষ্ট জাতি। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। অতএব যে কারণে আল্লাহ আমাদের মর্যাদা দান করেছেন, তা ছেড়ে অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান তালাশ করলে আল্লাহ আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, إِناَّ قَوْمٌ أَعَزَّنَا اللهُ بِالْإِسْلاَمِ ، فَلَنْ نَبْتَغِيْ الْعِزَّ بِغَيْرِهِ ‘আমরা সেই জাতি যাদেরকে আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এর বাইরে অন্য কিছুর মাধ্যমে আমরা সম্মান চাই না’।[5]

[1]. ছহীহ মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায়-৩৩, অনুচ্ছেদ-৫৩, হা/১৯২০; অত্র হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ ঐ, দেউবন্দ ছাপা শরহ নববী ২/১৪৩ পৃঃ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১ ‘ইল্ম’ অধ্যায় ও হা/৭৩১১-এর ভাষ্য ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা।

[2]. তিরমিযী হা/২১৯২, ছহীহুল জামে‘ হা/৭০২; মিশকাত হা/৬২৮৩।

[3]. তিরমিযী হা/২৪৬১।

[4]. মুসলিম হা/১৭৭৬; বুখারী হা/২৮৬৪; মিশকাত হা/৫৮৮৮, ৫৮৮৯।

[5]. হাকেম ১/৬১-৬২, হা/২০৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫১; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, শিরোনাম: ‘ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়’ ৭/৫৬।

১৯
উপসংহার
হাফেয যাহাবী (রহঃ) বলেন, অহংকারের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম প্রকার হ’ল ইলমের অহংকার। কেননা তার ইলম তার কোন কাজে আসেনা। যে ব্যক্তি আখেরাতের জন্য জ্ঞানার্জন করে, জ্ঞান তার অহংকারকে চূর্ণ করে দেয় এবং তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। যে নিজেকে হীন মনে করে এবং সর্বদা নিজের হিসাব নিয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। একটু উদাসীন হ’লেই ভাবে এই বুঝি ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত হ’লাম ও ধ্বংস হয়ে গেলাম। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলম শিখে গর্ব করার জন্য ও নেতৃত্ব লাভের জন্য, সে অন্যের উপর অহংকার করে ও তাদেরকে হীন মনে করে। আর এটিই হ’ল সবচেয়ে বড় অহংকার ( أَكْبَرُ الْكِبْر )। আর ঐ ব্যক্তি কখনই জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। লা হাওলা অলা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।[1]

পরিশেষে বলব, জাত-পাত, দল-মত ও যাবতীয় মিথ্যার অহংকার ছেড়ে আল্লাহ প্রেরিত মহাসত্যের দিকে ফিরে আসা এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করা আল্লাহর সৃষ্টি হিসাবে প্রত্যেক মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। বান্দার কোন অহংকার থাকলে তা হবে কেবল সত্যের অহংকার। অন্য কিছুর জন্য নয়। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِهَا خَرُّوا سُجَّداً وَسَبَّحُوا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ ‘আমাদের আয়াত সমূহে কেবল তারাই (প্রকৃত) ঈমান আনে, যখন তারা উক্ত আয়াত সমূহ দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হয়, তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিপালকের প্রশংসা জ্ঞাপন করে এমন অবস্থায় যে, তারা কোনরূপ অহংকার প্রদর্শন করে না’ (সাজদাহ ৩২/১৫)। অত্র আয়াতটি পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে সাথে সাথে একটি সিজদা করা মুস্তাহাব। এটি কুরআনের ১০ম সিজদা। আল্লাহ আমাদেরকে মিথ্যা অহমিকা ও তার কুফল হ’তে রক্ষা করুন- আমীন!

سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك، اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب -

[1]. যাহাবী, আল-কাবায়ির (বৈরূত : দারুন নাদওয়াতিল জাদীদাহ পৃঃ ৭৮।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন