HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
ইসলামে ‘তাকওয়া’র স্বরূপ ও সমাজ জীবনে এর প্রভাব
লেখকঃ ড. মোঃ ছানাউল্লাহ
একজন মুসলিমের সামাজিক জীবনমানের অপরিহার্য ও অনিবার্য গুণ হল তাকওয়া। এর অর্থ বেঁচে থাকা, সাবধানতা অবলম্বন করা ও ভয় করা। সাধারণত যে বোধ মানবীয় সহজাত প্রবৃত্তি (নফস) মানুষকে অন্যায়, অশ্লীল, খারাপ ও অনিষ্টিকর কথা, কাজ ও চিন্তা থেকে বিরত রাখে মুলত সেটাই হচ্ছে তাকওয়া। আর এ তাকওয়াই সমাজে মানবতাবোধ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধ নামে পরিচিত। উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব, সাদা-কালো নির্বিশেষে যে কোন মুসলিম নারী পুরুষ তাকওয়া অবলম্বন করে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক তথা সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করেন, তিনি ইসলামের দৃষ্টিতে মু্ত্তাকী নামে পরিচিত। মানুষের জীবনে সাফল্য অর্জনে তাকওয়ার প্রভাব অনবদ্য ও অপরিমেয়। বিশেষ করে সকল মুসলিমের সমাজ জীবনে তাকওয়ার সুদূর প্রসারী প্রভাব অনস্বীকার্য। সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নে তাকওয়া তথা সুস্থ মানসিকতা, মননশীলতা ও আল্লাহ ভীতির কোন বিকল্প হয় না। বর্তমান প্রবন্ধে উপর্যু্ক্ত দিকগুলোর পযালোচনা কুরআন, সুন্নাহ ও যুক্তির আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘তাকওয়া’ শব্দটি ইসলামের একটি মৌলিক পরিভাষা। এর আভিধানিক অর্থ হল- ভালভাবে বেঁচে থাকা [. কাযী নসির উদ্দীন আবদুল্লাহ ইব্নে ওমর ইব্ন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী (র), আনওয়ারুত তানযীল ওয়া আসরারুত তাবীল ওরফে তাফসীর বায়যাবী, দেওবন্দ, আল মাকতাবা আল আশরাফিয়া, তা.বি., পৃ: ১৬।], পরহেয করা, রক্ষা করা, দূরে থাকা, সচেতনতা, জবাবদিহীতা, সচ্ছতা, বিরত থাকা ও সাবধান থাকা। যিনি তাকওয়া অবলম্বন করেন, তাকে বলা হয় ‘মুত্তাকী’ আল্লামা যামাখশারী [৫৬৭-৫৩৮ হি.] বলেন, শাব্দিকভাবে ‘মুত্তাকী’ কর্তাবাচক বিশেষ্য, যা আরবদের কথা ‘ওয়াক্বাহু ফাত্তাক্বা’- ‘সে তাকে বাঁচিয়েছে, ফলে সে বেঁচে গেছে’ থেকে এসেছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা সে আগুন থেকে বেঁচে থাক, যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর [. আল কুরআন ২:২৪।]।” অন্যত্র বলা হয়েছে, “ আল্লাহুর শাস্তি থেকে তাদের রক্ষাকারী কেউ নেই [. আল কুরআন, ১৩:৩৪।]।” যে ঘোড়া কাঁদা ও ধুলোবালি থেকে নিজ ক্ষুর বাঁচিয়ে রাখে তাকে ‘ফারাস ওয়াক্বি’ বলা হয়। কারণ কষ্টদায়ক সামান্য কিছুর স্পর্শ থেকেও সে তার ক্ষুরকে রক্ষা করে [. আবুল কাশিম জারুল্লাহ মাহমূদ ইব্ন উমার আল যামাখশারী, আল-কাশ্শাফ ‘আন হাক্বায়িক্বি আল তানযীল ওয়া ‘উয়ূনি আল আক্বাবীল ফী ওযূহি আল তাবীল, মিশর, মাকতাবা মিশর, তা.বি, খণ্ড ১, পৃ. ৩৭।]।”
আভিধানিকভাবে তাকওয়া শব্দের আর এক অর্থ হল- ভয়, সতর্কতা ও জবাবদিহিতা। ‘তাকওয়াল্লাহ’ মানে ‘আল্লাহ্র বিষয়ে সতর্ক হওয়া’ [. fear is of many kinds : (1) the abject fear of the coward; (2) the fear of a child or an inexperienced person in the face of an unknoun danger; (3) the fear of a resonable man who wishes to protect. (4) the reverence which is akin to love. For it fears to doanything which is no pleasing to the object of love. The first is third is a many precaution against ebil as long as it is unconquered; and the fourth is the seed-bed of ighteousness. Those mature in faith cultivate the fourth : at earlier stages, the third or the second may be necessary; rhey are fear. But not the fear of Allah. The first is a feeling of which anyone should be ashamed. (the holy Quran-English tronslation of the meanings and commentary. Saudi Arabia : King Fahd Holy Quran printing complex- 1411 H.), p. 170-171, Footnote No. 247.] তাঁর (আল্লাহর) যাবতীয় নির্দেশসমূহ প্রতিপালন ও সকল নিষেধাধ্জ্ঞা থেকে দূরে থাকা, বেঁচে থাকার মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করা [. ড. ইবরাহীম মাদকূর, আল-মুজাম আল ওয়াসীত, দেওবন্দ, কুতুবখানা হুসাইনিয়াহ, তা.বি.,পৃ. ১০৫২।] এই দ্বিতীয় অর্থে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে তাকওয়া শব্দের ব্যবহার রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। [. আল-কুরআন. ২২:০১।]” নূহ (আ) , হূদ (আ), সালেহ (আ), লুত (আ) এবং শুআইব (আ) নিজ নিজ জাতিকে বলেছিলেন, “তোমরা কি আল্লাহ্কে ভয় করবে না?” [. আল-কুরআন. ২৬: ১০৬,১২৪, ১৪২, ১৬১, ১৭৭।] তাঁরা এও বলেছিলেন, “তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার অনুসরণ কর।” [. আল-কুরআন. ২৬: ১০৬,১২৪, ১৪২, ১৬১, ১৭৭।] সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তাকওয়া শব্দটি আভিধানিকভাবে দু’টি অর্থ ধারণ করে। এক, আত্মরক্ষা, বেঁচে থাকা, বিরত থাকা, মুক্ত থাকা, রক্ষা করা ও পরহেয করা। দুই, ভয়-ভীতি তথা কোন প্রকার অনিষ্ট ও ক্ষতিকর বিষয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা মিশ্রিত ভয় [. Taqwa, and the verbs and nouns connected with the root, signify : (1) the fear of Allah, which, according of wisdom: (2) rwstraingt, or guarding on’s tongue, hand and heart from evil: (3) hence righteousness, piety, good conduct. All these ideas are imtlied : in the translation, only one or other of these ideas can be indicated, according to the context. (the holy Quran-English tronslation of the meanings and commentary. Saudi Arabia : King Fahd Holy Quran printing complex- 1411 H.), p. 170-171, Footnote No. 26.]। ইসলামী শরী’আতের পরিভাষায় তাকওয়া অর্থ হল, আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ হতে দূরে থেকে ইসলাম নির্ধারিত পথে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করা। অথবা, যে কাজ করার কারণে মানুষকে আল্লাহ্র শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে, তা থেকে নিজেকে রক্ষা করা হচ্ছে তাকওয়া। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রাপ্ত করুণা, ভালবাসা, দয়া ও অনুগ্রহ হারানোর ভয় অন্তরে সদা জাগ্রত থাকার নাম তাকওয়া [. সম্পাদনা পরিষদ, ইসলমী বিশ্বকোষ, ঢাকা, ইফাবা, ১৯৯২, ১২শ খণ্ড, পৃ. ১০৭।]।
মুত্তাকীর পারিভাষিক সংজ্ঞায় কাযী নাসিরুদ্দীন বায়যাবী (র) [মৃ. ৬৮৫ হি] বলেন, “শরীয়তের পরিভাষায় মুত্তাকী বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যিনি নিজেকে এমন সব কিছু থেকে রক্ষা করেন, বাঁচিয়ে রাখেন, যা তাকে পরকালে ক্ষতির সম্মুখিন করবে” [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।]। আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইব্ন মাসউদ আল বগবী (র) [মৃ. ৫১০ হি] বলেন, “মুত্তাকী ঐ ব্যক্তি, যিনি শির্ক, কবীরা গুনাহ ও সকল প্রকার অশ্লীলতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। মুত্তাকী শব্দটি আল ইত্তিকাউ থেকে নির্গত। এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে দু‘বস্তুর মাঝখানের অন্তরাল-দেয়াল। যেমন এক হাদীসে আছে, সাহাবায়ে কিরামের উক্তি, “যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আড়াল করে থাকতাম। অর্থাৎ যখন যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যেত তখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আমাদের ও শুক্রদের মাঝখানে অন্তরায় করে রাখতাম। সুতরাং মুত্তাকী আল্লাহর আদেশ পালন এবং তাঁর নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকাকে তার এবং আল্লাহর শাস্তির মাঝখানে অন্তরায় তৈরী করে বলেই তাকে মুত্তাকী বলা হয়। [. আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগভী (মৃ. ৫১০ হি.), মা’আলিমুত তানযীল ফিত তাফসীর ওয়াত তাবীল, বৈরুত, দার আল ফিক্র, ১৯৮৫, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫।]” আল্লামা জারুল্লাহ যামাখশারী (রা) [মৃত. ৫৩৮ হি] বলেন, “ ইসলামী শরীআতের পরিভাষায় মুত্তাকী হল ঐ ব্যক্তি, যে নিজ সত্তাকে রক্ষা করে এমন বিষয় থেকে, যার জন্য সে শাস্তির উপযোগী হয়ে যায়; সেটি করণীয় হোক বা বর্জনীয়। [. আবুল কাশিম জারুল্লাহ মাহমূদ ইবন উমার আল যামাখশারী, আল-কাশশাফ ‘আন হাক্বায়িক্বি আল তানযীল ওয়া ‘উয়ূনি আল আক্বাবীল ফী ওযূহি আল তাবীল, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃ. ৩৭।]”
আভিধানিকভাবে তাকওয়া শব্দের আর এক অর্থ হল- ভয়, সতর্কতা ও জবাবদিহিতা। ‘তাকওয়াল্লাহ’ মানে ‘আল্লাহ্র বিষয়ে সতর্ক হওয়া’ [. fear is of many kinds : (1) the abject fear of the coward; (2) the fear of a child or an inexperienced person in the face of an unknoun danger; (3) the fear of a resonable man who wishes to protect. (4) the reverence which is akin to love. For it fears to doanything which is no pleasing to the object of love. The first is third is a many precaution against ebil as long as it is unconquered; and the fourth is the seed-bed of ighteousness. Those mature in faith cultivate the fourth : at earlier stages, the third or the second may be necessary; rhey are fear. But not the fear of Allah. The first is a feeling of which anyone should be ashamed. (the holy Quran-English tronslation of the meanings and commentary. Saudi Arabia : King Fahd Holy Quran printing complex- 1411 H.), p. 170-171, Footnote No. 247.] তাঁর (আল্লাহর) যাবতীয় নির্দেশসমূহ প্রতিপালন ও সকল নিষেধাধ্জ্ঞা থেকে দূরে থাকা, বেঁচে থাকার মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করা [. ড. ইবরাহীম মাদকূর, আল-মুজাম আল ওয়াসীত, দেওবন্দ, কুতুবখানা হুসাইনিয়াহ, তা.বি.,পৃ. ১০৫২।] এই দ্বিতীয় অর্থে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে তাকওয়া শব্দের ব্যবহার রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। [. আল-কুরআন. ২২:০১।]” নূহ (আ) , হূদ (আ), সালেহ (আ), লুত (আ) এবং শুআইব (আ) নিজ নিজ জাতিকে বলেছিলেন, “তোমরা কি আল্লাহ্কে ভয় করবে না?” [. আল-কুরআন. ২৬: ১০৬,১২৪, ১৪২, ১৬১, ১৭৭।] তাঁরা এও বলেছিলেন, “তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার অনুসরণ কর।” [. আল-কুরআন. ২৬: ১০৬,১২৪, ১৪২, ১৬১, ১৭৭।] সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তাকওয়া শব্দটি আভিধানিকভাবে দু’টি অর্থ ধারণ করে। এক, আত্মরক্ষা, বেঁচে থাকা, বিরত থাকা, মুক্ত থাকা, রক্ষা করা ও পরহেয করা। দুই, ভয়-ভীতি তথা কোন প্রকার অনিষ্ট ও ক্ষতিকর বিষয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা মিশ্রিত ভয় [. Taqwa, and the verbs and nouns connected with the root, signify : (1) the fear of Allah, which, according of wisdom: (2) rwstraingt, or guarding on’s tongue, hand and heart from evil: (3) hence righteousness, piety, good conduct. All these ideas are imtlied : in the translation, only one or other of these ideas can be indicated, according to the context. (the holy Quran-English tronslation of the meanings and commentary. Saudi Arabia : King Fahd Holy Quran printing complex- 1411 H.), p. 170-171, Footnote No. 26.]। ইসলামী শরী’আতের পরিভাষায় তাকওয়া অর্থ হল, আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ হতে দূরে থেকে ইসলাম নির্ধারিত পথে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করা। অথবা, যে কাজ করার কারণে মানুষকে আল্লাহ্র শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে, তা থেকে নিজেকে রক্ষা করা হচ্ছে তাকওয়া। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রাপ্ত করুণা, ভালবাসা, দয়া ও অনুগ্রহ হারানোর ভয় অন্তরে সদা জাগ্রত থাকার নাম তাকওয়া [. সম্পাদনা পরিষদ, ইসলমী বিশ্বকোষ, ঢাকা, ইফাবা, ১৯৯২, ১২শ খণ্ড, পৃ. ১০৭।]।
মুত্তাকীর পারিভাষিক সংজ্ঞায় কাযী নাসিরুদ্দীন বায়যাবী (র) [মৃ. ৬৮৫ হি] বলেন, “শরীয়তের পরিভাষায় মুত্তাকী বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যিনি নিজেকে এমন সব কিছু থেকে রক্ষা করেন, বাঁচিয়ে রাখেন, যা তাকে পরকালে ক্ষতির সম্মুখিন করবে” [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।]। আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইব্ন মাসউদ আল বগবী (র) [মৃ. ৫১০ হি] বলেন, “মুত্তাকী ঐ ব্যক্তি, যিনি শির্ক, কবীরা গুনাহ ও সকল প্রকার অশ্লীলতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। মুত্তাকী শব্দটি আল ইত্তিকাউ থেকে নির্গত। এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে দু‘বস্তুর মাঝখানের অন্তরাল-দেয়াল। যেমন এক হাদীসে আছে, সাহাবায়ে কিরামের উক্তি, “যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আড়াল করে থাকতাম। অর্থাৎ যখন যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যেত তখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আমাদের ও শুক্রদের মাঝখানে অন্তরায় করে রাখতাম। সুতরাং মুত্তাকী আল্লাহর আদেশ পালন এবং তাঁর নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকাকে তার এবং আল্লাহর শাস্তির মাঝখানে অন্তরায় তৈরী করে বলেই তাকে মুত্তাকী বলা হয়। [. আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগভী (মৃ. ৫১০ হি.), মা’আলিমুত তানযীল ফিত তাফসীর ওয়াত তাবীল, বৈরুত, দার আল ফিক্র, ১৯৮৫, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫।]” আল্লামা জারুল্লাহ যামাখশারী (রা) [মৃত. ৫৩৮ হি] বলেন, “ ইসলামী শরীআতের পরিভাষায় মুত্তাকী হল ঐ ব্যক্তি, যে নিজ সত্তাকে রক্ষা করে এমন বিষয় থেকে, যার জন্য সে শাস্তির উপযোগী হয়ে যায়; সেটি করণীয় হোক বা বর্জনীয়। [. আবুল কাশিম জারুল্লাহ মাহমূদ ইবন উমার আল যামাখশারী, আল-কাশশাফ ‘আন হাক্বায়িক্বি আল তানযীল ওয়া ‘উয়ূনি আল আক্বাবীল ফী ওযূহি আল তাবীল, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃ. ৩৭।]”
পবিত্র কুরআনের পনের জায়গায় তাকওয়া শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। [. যেমন, আল-কুরআন, ২:১৯৭, ২৩৭, ৫: ২.৮, ৭: ২৬. ৯: ১০৮, ২০: ১৩২, ২২: ৩২, ৩৭, ৪৮:২৬, ৪৯: ৩, ৫৮: ৯, ৭৪: ৫৬, ৯৬: ১২; মুহাম্মদ ফুয়াদ আবদুল বাকী, আল-মুজাম আল-মুফাহরাস লি আলফায্ আল কুরআন আল কারীম, বৈরুত, দার আল মারিফাহ্ ১ম মুদ্রণ ১৪২৩ হি./২০০২, পৃ. ৩৭৯।]” ‘আল-মুত্তাকুন’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে মোট ছয় জায়গায় এবং ‘আল-মুত্তাক্বীন’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে মোট ৪৩ জায়গায় [. মুহাম্মদ ফুয়াদ আবদুল বাকী, আল-মুজাম আল-মুফাহরাস লি আলফায্ আল কুরআন আল কারীম, প্রাগুক্ত,পৃ.৮৪৫-৮৪৬।]। এছাড়া ‘আলবিকায়াতু’ ও ‘আল-ইত্তিকাউ’ শব্দমূল থেকে গঠিত বিশেষ্য-বিশেষণ বা ক্রিয়ারূপে ব্যবহার রয়েছে প্রায় দু’শ জায়গায়। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত করণীয় বা বর্জনীয় প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়ের বর্ণনার সাথে ‘তাকওয়া’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। ‘তাকওয়া’র আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের সাথে মিল রেখে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অর্থ নির্ধারণ করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ এর কিছু নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
তাকওয়া অর্থ ঈমান। যেমন, আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “কুরআন মাজীদ মুত্তাকীদের তথা মু’মিনদের জন্য পথপ্রদর্শক [. আল কুরআন, ২:২; আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা)সহ অন্যান্য অনেক সাহাবা (রা) বেলন, তারা হলেন ঈমানদার ব্যক্তিগণ। আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন জারীর আল তাবারী (মৃ. ৩১০ হি.) জামিউল বায়ান ‘আন তাবীলি আয়িল কুরআন, বৈরুত দার আল ফিক্র, তা.বি. খণ্ড ১. পৃ.১৪৭।]” অন্যত্র বলা হয়েছে, “আর তিনি তাদের জন্য তাকওয়ার বাণী তথা তাওহীদের বাণী অর্থাৎ ঈমান অবধারিত করে দিলেন [আল-কুরআন. ৪৮: ২৬।]”। আরো বলা হয়েছে, “তারাতো ঐ ব্যক্তি যাদের অন্তরসমুহকে আল্লাহ তা‘আলা তাকওয়ার তথা ঈমানের জন্য নির্বাচন করেছেন। [. আল-কুরআন. ৪৯:০৩।]” “ফিরআউন সম্প্রদায়, তারা কি তাকওয়া অবলম্বন তথা ঈমান গ্রহণ করবে না? [. আল-কুরআন. ২৬:১১।]”
তাকওয়া অর্থ তাওবা-অনুশোচনা। যেমন, “আর যদি গ্রামের অধিবাসীরা ঈমান গ্রহণ করে ও তাকওয়া অবলম্বন করে অর্থাৎ তওবা করে তবে তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। [. আল-কুরআন. ৭:৯৬।]” তাকওয়া অর্থ আনুগত্য। যেমন, “তোমরা ভীত হও যে, আমি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই আনুগত্য কর [.. আল-কুরআন. ১৬:০২।]” অতএব, তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া আর কারও আনুগত্য করছ? [. আল-কুরআন. ১৬:২৬।]” “আর তোমরা ঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর অর্থাৎ তাঁর অবাধ্য হয়ো না। [. আল-কুরআন. ২৩:৫২।]”
তাকওয়া অর্থ নিষ্ঠা-আন্তরিকতা বা একাগ্রতা। যেমন, “ আর নিশ্চয়ই এটি মনের তাকওয়া অর্থাৎ মনের একাগ্রতা। [. আল-কুরআন. ২২:৩২।]”
তাকওয়া হচ্ছে মূল্যবোধ, মানসিক শুদ্ধতা ও দৃঢ়তা। এটি যে কোন ধরনের পদঙ্খলন থেকে মানুষকে রক্ষা করে; সকল মন্দ ও অশ্লীল কথা, কাজ ও পরিবেশ থেকে ফিরিয়ে রাখে; ‘খাহেশাতে নাফসানী’ তথা প্রবৃত্তির খেয়াল-খুশি বা অভিলাষ ও দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ে নিজের ক্ষতি করা থেকে এবং পরিবার, সমাজ ও দেশের ক্ষতি করা থেকে রক্ষা করে। জনমানব শূন্য নির্জন স্থানে বা দুর্নীতি করার অসংখ্য সহজ পথ উন্মুক্ত থাকার পরও যে শক্তি মানুষকে তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে মুক্ত রাখে তা-ই তাকওয়া। যাদের মনে তাকওয়া রয়েছে, তাদের ওপর শয়তান তথা দুষ্টচক্রের আক্রমণ ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা শক্তি জগ্রত হয়ে উঠে। [. আল-কুরআন. ৭ : ২০১-২০২।]”
তাকওয়া মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার শক্তি জাগ্রত করে। আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে বলেন, “হে বিশ্বাসীগণ, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাকওয়া অর্জন কর, তবে তিনি তোমাদের ভাল-মন্দ পার্থক্য করার শক্তি দান করবেন।... [. আল-কুরআন. ৮ : ২৯।].”অর্থাৎ তাকওয়ার ফলে মানুষের বিবেক বুদ্ধি প্রখর হয় এবং সুষ্ঠ বিচার-বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়। তাই সে সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দ চিনতে এবং তা অনুধাবন করতে ভূল করে না। তার হাতে তাকওয়ার আলোকবর্তিকা থাকার ফলে জীবন পথের মন্দ দিকসমূহ সে স্পষ্টত দেখতে পায়। বিবেচনার শক্তির প্রখরতা ও বুদ্ধিদীপ্ততা তার মধ্যে এমনভাবে কাজ করে যে, তার কাছে তখন ইহ-পারলৌকিক যে কোন বিষয়ের কোনটি সঠিক আর কোনটি ভূল তা স্পষ্টতই ধরা পরে। ফলে সে কোন সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ইতস্তত, দুর্বলতা ও হীনমন্যতা ছাড়াই দিবালোকের মত সুস্পষ্ট ও সঠিক পথে চলতে সক্ষম হয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “হে মু’মিনগণ ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর-তাকওয়া অর্জন কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। তিনি নিজ অনুগ্রহের দ্বিগুন প্রতিদান তোমাদেরকে দিবেন এবং তোমাদেরকে দিবেন জ্যোতি-আলো, যার সাহায্যে তোমরা পথ চলবে। [. আল-কুরআন. ৫৭ : ২৮।]” অর্থাৎ তাকওয়া জীবনকে এমন এক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করে, যা সকল প্রকার ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা, প্ররোচনা-প্রতারণা, প্রলভন-পদস্খলন থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে। অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর সমুদ্রে কম্পাস বা দিক-দর্শন যন্ত্র যেমন সমুদ্রভিযাত্রীকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে, সমস্যা-সংকুল জীবন পথে তাকওয়াও তেমনি মানুষকে নির্ভূল পথের সন্ধান দেয়।
তাকওয়া একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। শিষ্টের লালন ও দুষ্টের দমন নীতির পরিচায়ক একটি শক্তি। ভালকে গ্রহণ করার তীব্র আগ্রহ এবং মন্দকে পরিহার করে চলার দৃঢ় মনোবলই হচ্ছে তাকওয়া। মানুষের সকল সৎগুণের সঞ্জীবনী শক্তি হচ্ছে তাকওয়া। এ ক্ষেত্রে তাকওয়ার অধিকারী ব্যক্তিদের ইতবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ডের বর্ণনা সম্বলিত নিম্নোক্ত আয়াতগুলো প্রণিধানযোগ্য। যেমন, “এ গ্রন্থ (আল কুরআন) পথ প্রদর্শণকারী পরহেযগারদের জন্য। পরহেযগার হচ্ছে তারা, যারা অদৃশ্য বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে; এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সেসব বিষয়ের ওপর যা কিছু আপনার ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে, এবং যা কিছু আপনার পূর্ববর্তীদের ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তারা আখিরাতের প্রতিও দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে। [. আল-কুরআন. ২ : ২-৪।]”
এখানে তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে সৎকাজ সম্পাদন করা। কারণ, অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “ পবিত্র কুরআন সৎকর্মশীলগণের জন্য পথপ্রদর্শক ও অনুগ্রহ স্বরূপ। [. আল-কুরআন. ৩১ : ১-৫।]” আর সৎকর্মশীলগণের পরিচয়ে তা-ই বলা হয়েছে, যা মুত্তাকীগণের পরিচয়ে বিধৃত হলো।
অন্যত্র বলা হয়েছে, “শুধমাত্র পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরানোর মধ্যে কোন কল্যাণ নেই; বরং কল্যাণ হচ্ছে, যে ঈমান আনবে আল্লাহ্র ওপর, কিয়ামত দিবস, ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাবসমূহ ও নবী-রাসূলগণের ওপর; আর তাঁরই ভালবাসার মানসে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির-পথিক, ভিক্ষুক ও সর্ব প্রকার দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্তির জন্য সম্পদ ব্যয় করবে; আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে; আর যারা তাদের অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করে যখন তারা অঙ্গীকার করে এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী। আর তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই তাকওয়া অবলম্বনকারী-মৃত্তাকী। [. আল-কুরআন. ২ : ১৭৭।]” ‘তারাই হল সত্যাশ্রয়ী’ অংশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “আয়াতে বর্ণিত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন কর্মকান্ডসমূহ যখন তারা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখনই তারা মুত্তাকীরূপে পরিগণিত হবে। [.. শায়খ আবদুর রহমান ইবন হাসান, ফাতহুল মাজীদ, রিয়াদ, আল রিয়াসাহ আল ‘আম্মাহ, ১৯৮৩, পৃ. ৩৩৩।]” “তারাই তো সেসব লোক যারা সত্য প্রমাণিত করেছে, আর তারাই হল মুত্তাকী।” আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় আবূ হাইয়্যান (র) বলেছেন, ‘সত্যবাদীতা দিয়ে এখানে কথাবার্তায় সত্যবাদীতা বোঝানো হয়ে থাকতে পারে; যদি তা-ই হয় তবে তা হবে মিথ্যার বিপরীত। তখন এর অর্থ হবে তাদের কথাবার্তা তাদের তৃদয়ে যে ঈমান ও কল্যাণ রয়েছে তার অনুরূপ। সুতরাং তারা যদি কোন বিষয়ে সংবাদ দেয় তখন তা হয় এমন সত্য সংবাদ যার মধ্যে কোন মিথ্যা মিশ্রিত হয় না। [. মুহাম্মদ ইব্ন ইউসুফ ওরফে আবু হাইয়্যান আল-আন্দালুসী (৬৫৪-৭৫৪ হি,). তাফসীর আল রাহরুল মুহীত, কায়রো, দারুল কিতাব আল-ইসলামী, ৩য় মুদ্রণ, ১৪১৩ হি, /১৯৯২, খণ্ড ২ , পৃ. ৮।]” বস্তুত, “যারা সত্য নিয়ে এসেছে এবং যারা সত্যকে সত্য বলে গ্রহণ করেছে তারাইতো মুত্তাকী [. আল-কুরআন. ৩৯: ৩৩।]” সুতরাং জেনে-বুঝে কোন অন্যায়তো সে করেই না; বরং সঙ্গদোষ বা পরিবেশ-পরিস্থিতির শিকার হয়ে কোন অন্যায়, অনৈতিক বা পাপের কাজে প্রবৃত্ত হলে অথবা যে কোন ধরনের ভূল করলে মনে পড়ার সাথে সাথে সে নিজেকে সুধরে ফেলে [. আল-কুরআন. ৭ : ২২১।]। কোন কুসংস্কার বা গর্হিত কাজ যারা করে না তারই মুত্তাকী। “ঘরের পিছন দিক থেকে প্রবেশের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই; বরং কল্যাণ হচ্ছে পিছন দিক থেকে প্রবেশের মত কুসংস্কার বর্জন করে ঘরের দরজা দিয়ে-সামনের দিক থেকে প্রবেশ করা। [. আল-কুরআন. ২ : ১৮৯।]” কাযী নাসিরুদ্দীন বায়যাবী (র) বলেন, ‘কল্যানের অধিকারী সে ব্যক্তি, যে সকল হারাম ও শাহ্ওয়াত-লালসা থেকে বেঁচে থাকে। [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩।]” যুদ্ধ চলাকালীন কঠিন অবস্থায় ধৈর্যধারণের সাথে তাকওয়ার সংযোগ ঘটলে বিজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। “ আর যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তাদের প্রতারণায় তোমাদের কোনই ক্ষতি হবে না। [. আল-কুরআন. ৩ : ১২০।]” এ আয়াতসমূহে মানুষের জন্য কল্যাণকর বিষয়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং এগুলো তখনই মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে, যখন তারা এগুলো জীবনের বাঁকে বাঁকে মেনে চলে ও বাস্তবায়ন করে। আল্লাহ্ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন, “ হে ঈমানদারগণ ! তোমরা আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। [. আল-কুরআন. ৩: ১০২।]” এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবূ হাইয়্যান, ইব্নু মাসঊদ, রবী, কাতাদাহ (রা) ও হাসান বসরী (র) বলেন, ‘হাক্কা তুক্বাতিহি-যথাযথ ভয়’ হল প্রত্যেক কাজে আল্লাহর আনুগত্য করা, আনুগত্যের বিপরীতে কোন কাজ না করা, আল্লাহকে সর্বদা স্মরণ রাখা-কখনও কিস্মৃত না হওয়া এবং সর্বদা তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অকৃতজ্ঞ না হওয়া। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, ‘হাক্কা তুক্বাতিহি’ এর অর্থ হল, আল্লাহর সকল অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকা।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বিধানের কাজে কোন ব্যক্তির ভর্ৎসনা বা নিন্দা তাকে কুন্ঠিত করে না। সে ন্যায়-নীতি অবলম্বন করে সকল কাজ সামাধা করে; হোক সে কাজ তার নিজের অথবা তার সন্তানের অথবা তার পিতার বিরুদ্ধে। [. মুহাম্মদ ইব্নু ইউসুফ ওরফে আবু হাইয়্যান আল-আন্দালুসী (৬৫৪-৭৫৪ হি,). তাফসীর আল রাহরুল মুহীত, ৩য় খণ্ড, পৃ.১৭।]” এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কাযী নাসির উদ্দীন বায়যাবী (র) বলেন, “এখানে স্পষ্টত বা প্রচ্ছন্নভাবে প্রমাণ রয়েছে যে, এটি পূর্ণাঙ্গ মানবীয় গুনাবলী সম্বলিত একটি আয়াত। এখানে বর্ণিত সমুদয় বিষয় এর শাখা-প্রশাখাসহ মুলত তিন ভাগে বিভক্ত। এক. মানুষের আকিদা-বিশ্বাসের বিশুদ্ধতার বিবরণ, দুই. সুন্দর আচার-আচরণ এবং তিন. ব্যক্তি-মানসের কুদৃষ্টি-কালচার। প্রথমটির দিকে ইঙ্গিত রয়েছে আল্লাহর বাণী মান আমানা থেকে ওয়ান্নাবিয়্যীন’ পর্যন্ত অংশে, এবং তৃতীয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে ‘ওয়া আকামাস সালাতা’ থেকে শেষ পর্যন্ত অংশ দিয়ে। এ কারনেই আয়াতে বর্ণিত সমুদয় গুণের অধিকারী ব্যক্তিকে তার সুদৃঢ় ঈমান ও ই’তিকাদের ভিত্তিতে সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং তাকে মুত্তাকী বল হয়েছে তার সুন্দর ব্যবহার ও যথাযথ লেন-দেনের ভিত্তিতে। আর এ জন্যই মহানবী (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এ আয়াতের উপর আমল করল সে অবশ্যই তার ঈমান পরিপূর্ণ করল। [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৫।]”
তাকওয়ার দাবী হচ্ছে বেশি বেশি ভাল কাজ করা ও আল্লাহর ইবাদত করা। কল্যাণমূলক কাজে দ্রুত এগিয়ে আসা; চাই তা জাগতিক হোক বা পারলৌকিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন; “ আর তোমাদের প্রভূর ক্ষমার প্রতি এবং জান্নাতের প্রতি দ্রুত এগিয়ে যাও, যার পরিধি হচ্ছে আসমান ও যমীন, যা প্রস্তুত করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। (মুত্তাকী হচ্ছে তারা) যারা সচ্ছলতা ও অভাবের সময় (মানুষের প্রয়োজনে সম্পদ) ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগ-ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। আর আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালবাসেন। (মুত্তাকী তারাও) যারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের ওপর যুলম করে ফেললে (সাথে সাথে) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ্ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? আর তারা জেনে-শুনে নিজেদের (ভূল) কৃতকর্মসমূহ বারংবার করতে থাকে না। [. আল কুরআন, ৩ : ১৩৩-১৩৫।]” “তারা (আহলে কিতাবগণ) সবাই সমান নয়। আহলে কিতাবগনের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে যারা অবিচলভাবে আল্লাহ্র আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং রাতের গভীরে তারা সেজদায় রত থাকে। তারা আল্লাহ্র প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়: অকল্যাণ থেকে বারণ করে এবং সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে। আর এরাই হল সৎকর্মশীল। তারা যেসব সৎকাজ করবে, কোন অবস্থাতেই সেগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শণ করা হবে না. আর আল্লাহ্ মুত্তাকীদের বিষয়ে অবগত। [. আল কুরআন, ৩ : ১১৩-১১৫।]” এ আয়াতসমূহে বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটি বিষয়ই আমাদের বাস্তব জীবনে অবশ্য করণীয় ও পালনীয়। সুতরাং একজন মানুষ যত বেশী ভাল কাজ করবে তার মধ্যে ততবেশী তাকওয়া বদ্ধমূল হবে।
মুত্তাকীগণ অনুসন্ধিৎসু, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী হয়। দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবর্তন-বিবর্তন তাকে স্পর্শ করে, তাকে নাড়া দেয়, ঘটনার মূল কারণ সন্ধানে ব্যাপৃত করে। ফলে সে বিভিন্ন সূত্র আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ হয় এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখতে সক্ষম হয় [. আল কুরআন, ১০ : ৬।]। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্র তথা সৌর জগত এবং পৃথিবীর জীব-জন্তু, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষলতা, খাল-বিল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, রাত-দিনের পরিবর্তন ইত্যাদি মুত্তাকীদের কাছে গবেষণার উপাদান হয় এবং গবেষণার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এর থেকে উপকৃত হওয়ার বিষয়ও তাদের সাথে সম্পর্কিত, যারা তাকওযার অধিকারী [. আল কুরআন, ১০ :৬।]। বৃষ্টির পানি দিয়ে জমিতে উৎপন্ন ফল-ফসল ও উদ্ভিদের কথা চিন্তা করে এর উৎকর্ষ সাধন ও উৎপাদন বাড়ানোর ওপরও মুত্তাকীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে [. আল কুরআন, ১০ : ৩১।]।
বদান্যতা প্রদর্শন হচ্ছে তাকওয়া। বিয়ে করার সময় মোহর ধার্য করে বা পূর্ণমোহর প্রদান করে যদি বিয়ে সম্পন্ন হয় এবং যুক্তিসঙ্গত কোন কারণে সে বিয়ে বহাল রাখা সম্ভব না হয় তাহলে ইসলামের বিধান অনুযায়ী নারী (স্ত্রী) তার জন্য নির্ধারিত মোহরের অর্ধাংশের অধিকারী হবে। বাকী অর্ধেক পুরুষকে (স্বামীকে)ফিরিয়ে দিবে। তবে নারী সম্পূর্ণ মোহর ফিরিয়ে দিলে বা পুরুষ সম্পূর্ণ মোহর আদায় করে দিলে তা হবে বদান্যতার ব্যাপার। আর এ বদান্যতা-উদারতা পুরুষের পক্ষ থেকে হোক এটিই তাকওয়া [. আল কুরআন, ২ : ২৩৭।]। এমনিভাবে নিয়ম মোতাবেক স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে খোর –পোষ দেয়া তাকওয়ার অধিকারী ব্যাক্তির ওপর কর্তব্য [. আল কুরআন, ২ : ২৪১।] বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। সুতরাং বড় মনের অধিকারী হওয়া, উদারতা প্রদর্শন করা ও কর্তব্য কাজ যথাযথ সম্পাদন করা হল তাকওয়ার দাবী।
পৃথিবীতে বসবাসরত অসংখ্য মানুষের মধ্যে সবাই একত্ববাদের বিশ্বাসী নয়। আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলিম জাতি অন্যান্য কুফরী মতবাদে বিশ্বাসী জাতি-গোষ্ঠীর সাথে ব্যক্তিগত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পর্ক রক্ষা করা ও লেনদেন করাতে ইসলামে কোন বাধা নেই। কারণ, ইসলামে সংকীর্ণতা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। [. আল কুরআন, ২২ : ৭৮।] মুসলিম-অমুসলিম যে কোন ব্যক্তি, জাতি-গোষ্ঠি বা রাষ্ট্রের সাথে কৃত চুক্তি বা অঙ্গীকার পূর্ণ করা এবং তাতে আন্তরিক হওয়া তাকওয়ার অধিকারী ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য। এরুপ ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ্র ভালবাসার পাত্র বলে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। [. আল কুরআন, ৩ : ৭৬।] তবে সম্পর্ক রক্ষা ও লেন-দেনের আড়ালে েযন মুসলিমদের কৃষ্টি-কালচার, ধর্মীয় বিশ্বাস হারিয়ে না যায় এবং অমুসলিমদের কোন চক্রান্তে না পড়ে সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে চলার জন্য পবিত্র কুরআনে তাকওয়া শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে [. আল কুরআন, ৩ : ২৮।]।
স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ তাকওয়া। আয়-উপার্জন, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপনের সকল উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে স্বাবলম্বী হয়ে চলার নাম তাকওয়া। সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়া, স্থানীয় জনগণের ওপর বোঝা হওয়া, জীবন-জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে কারো গলগ্রহ হওয়া, হাত পাতা, ভিক্ষে করা ও পরনির্ভরশীল হওয়া তাকওয়া হতে পারে না। কেবল হাদীয়া-তোহ্ফার ওপর নির্ভর করে যারা জীবন-যাপন করে, তারা মুত্তাকী হতে পারে না। আত্মনির্ভরশীল জীবন গঠন এবং ব্যাক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের ওপর বোঝা হয়ে জীবন-যাপন থেকে বিরত থাকার মনোবৃত্তিকে তাকওয়া বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা হজ্জের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, “আর তোমরা পাথেয় সাথে নিয়ে নাও। নিশ্চয় সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। আর হে বুদ্ধিমানগণ! তোমরা আমাকেই ভয় করতে থাকো [. আল কুরআন, ২ : ১৯৭।]।এখানে তাকওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে, “এমন সহায়-সম্বল অবলম্বন যা থাকার ফলে অন্যের কাছে হাত পাততে হয় না [. জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী, তাফসীর জালালাইন, সিঙ্গাপুর : এদারা নশর ওয়া ইশা’আতে ইসলামিয়্যাহ্, তা.বি., পৃ . ২৯।]। এ আয়াতের শানে নুযুল ও ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “ এ আয়াতটি ইয়ামানের অধিবাসীদের প্রতি নাযিল হয়েছে। তারা হজ্জ করত এমন অবস্থায় যে, প্রয়োজনীয় খাদ্য-সামগ্রী কিছুই তারা সঙ্গে নিয়ে যেত না এবং বলত, আমরা আল্লাহর নির্ভরশীল। ফলে তারা স্থানীয় জনগণের ওপর বোঝা হয়ে থাকত। [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৭।]”কাজেই সর্বপ্রকার পরাধীনতা তথা জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থ-সামর্থ, শক্তি-সাহস, কৃষ্টি-কালচার,সংস্কতি-সভ্যতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে মুক্তি অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা মুত্তাকী হওয়ার জন্য একান্ত প্রয়োজন।
মুত্তাকী ব্যক্তিকে কতগুলো বিষয় বর্জন করে চলতে হয়। মানুষের মধ্যে দুটি পরস্পর বিরোধী প্রবনতা বা শক্তি পাশাপাশি সাংঘর্ষিক অবস্থানে বিদ্যমান। তা হল, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণ, আলো-অন্ধকার ইত্যাদি। এ পরস্পর বিরোধী দুই প্রবণতার মধ্য থেকে ভাল ও কল্যাণময় প্রবণতা বেছে নিয়ে সেটাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ফলে যত কঠিন পরীক্ষা ও অবস্থারই মুকাবিলার সম্মুখীন হোক না কেন, তা ধৈর্য ও সাহসের সাথে উত্তীর্ণ হওয়া এটাই প্রকৃত তাকওয়া। অর্থাৎ মানবীয় সহাজাত সুকুমার বৃত্তি বা আকাঙ্খা যা মানুষকে কুপ্রবৃত্তি তথা মন্দ কথা, খারাপ কাজ ও দুষ্ট চিন্তা থেকে বিরত রাখে, তাকেও তাকওয়া বলা হয়। যারা তাকওয়া অবলম্বনে জীবন যাপন করেন এবং মুত্তাকীদের নেতা বা আদর্শ যারা হতে চান, তারা যেসব বিষয় বর্জন করে জীবন যাপন করেন, এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন, “ আর যখন তারা (সম্পদ) ব্যয় করে তখন অনর্থক ব্যয় করে না, আবার কার্পণ্যও করে না; বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করে (ব্যয় করে)। [. আল কুরআন, ২৫ : ৬৭-৬৮, ৭২-৭৪।]”
এখানে আরও তিনটি আয়াত উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেখানে হারাম কাজের বিবরণ দিয়ে তা অনুধাবন করতে, স্মরণ করতে সর্বোপরি তা থেকে মুক্ত থাকতে বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “হে নবী ! আপনি বলুন, এসো, আমি তোমাদেরকে ঐ সব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রভূ তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। সেগুলো হল, আলল্লাহর সাথে অংশীদার করবে না, পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করবে অর্থাৎ তাদের অবাধ্য হবে না, নিজেদের সন্তানদেরকে দারিদ্রের কারণে হত্যা করবে না, আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। অশ্লীলতার কাছেও যাবে না, তা প্রকাশ্যেই হোক বা গোপেনে; যাকে হত্যা করা আল্লাহ্ হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করবে না; কিন্তু ন্যায়ভাবে। তিনি তোমাদরকে এ নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা অনুধাবন কর-বুঝতে পার। ইয়াতিমরা বয়ো:প্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত উত্তম পন্থা ব্যতীত তাদের সম্পদের কাছেও যাবে না। ন্যায়ের সাথে ওজন ও মাপ পূর্ণ করবে কম-বেশী করবেনা। আমি কাউকে সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেই না। আর যখন তোমরা কথা বলবে-বিচার করবে-হুকুম দিবে, তখন সুবিচার করবে যদিও সে আত্মীয় হয়। আল্লাহ্র অঙ্গীকার পূর্ণ করবে-কখনও তা ভঙ্গ করবে না। তিনি তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। আর অবশ্যই এটি আমার সঠিক পথ। অতএব তোমরা এ পথ অনুসরণ করবে ,মেনে চলবে এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করবে না; তাহলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর (আল্লাহর) পথ থেকে বিচ্চিন্ন করে দিবে। তিনি তোমদেরকে এ নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন কর-সংযত হও। [. আল কুরআন, ৬ : ১৫১-১৫৩।]”
ওজনে ও মাপে ক্রটি করাকে কুরআনে ‘তাতফীফ’ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ধ্বংস অনিবার্য তাতফীফকারীদের জন্য; যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয় তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় বা ওজন করে দেয় তখন কম করে দেয়। [. আল কুরআন, ৮৩ : ১-৩।]” এ ‘তাতফীফ’ শুধু ওজন করার সময় কম-বেশী করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়,; বরং অন্যের প্রাপ্যে ক্রটি করাও ‘তাতফীফ’ এর অন্তুর্ভূক্ত। ইমাম মালেক (র) তাঁর মুআত্তা গ্রন্থে হযরত ওমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তিকে নামাজের আরকানে (নামাজের মধ্যে রুকু-সিজদাসহ অবশ্য পালনীয় বিষয়সমূহে) ক্রটি করতে দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি তাতফীফ করেছ’ অর্থাৎ যথার্থরূপে নামায আদায় করনি। এ ঘটনা বর্ণনা করে ইমাম মালেক (র) বলেন, প্রাপ্য পুরোপুরি আদায় করা ও ক্রটি করা প্রত্যেক বিষয়ের মধ্যেই হয়ে থাকে শুধু ওজন ও মাপের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়।’ এতে বুঝা যায় যে, যে ব্যক্তি নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করে না, নির্ধারিত সময়ে কাজ না করে অযথা সময় নষ্ট করে বা অফিসের সময় অপচয় করে বা কাজে ফাঁকি দেয়, ক্রটি করে, সে-ও উপরিউক্ত আয়াতে বর্ণিত শাস্তির অন্তর্ভূক্ত হবে। সে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হোক বা সাধারণ কর্মচারী হোক, দিনমজুর হোক বা কোটিপতি হোক কিংবা ধর্মীয় কোন প্রতিষ্ঠানের কাজে নিয়োজিত হোক না কেন [. মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ) অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তাফসীর মাআরেফুল কোরআন, মদীনা মোনাওয়ারাহ, খাদেমুল হারামাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, ১৪১৩ হি. পৃ. ১৯১।]। এছাড়া কবীরা গুনাহ হিসাবে নির্ধারিত জঘন্য অপরধসমূহ থেকেও মুত্তাকীগণ অবশ্যই দূরে থাকেন। “ ইবনু ওমর (রা) থেকে কবীরা গুনাহর সংখ্যা সাতটি বলে বর্ণনা রয়েছে। সেগুলো হল, আল্লাহ্র সাথে শরীক করা, মু’মিন ব্যক্তিকে হত্যা করা, সতি-সাধ্বী নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা, মুসলিম পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, হেরেম শরীফে ইলহাদ-কুফরী করা। এর সাথে আবূ হুরায়রা (রা) ‘সুদ’-কে অন্তর্ভূক্ত করেন। আলী (রা) চুরি ও মদ্যপানকে কবীরা গুনাহ হিসাবে সংযোজন করেছেন। মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ কেউ ব্যভিচার, লাওয়াতাত-পায়ূকাম, যাদু, মিথ্যা সাক্ষ্য দান, মিথ্যা শপথ করা, হাইজ্যাক-ডাকাতি ও পরনিন্দা-পরচর্চাকেও কবীরা গুণাহের অন্তুর্ভূক্ত করেছেন। এ দু’টি তথা কবীরা ও সগীরা গুনাহ তুলনামূলকভাবে নির্নয় করার মত বিষয়। সুতরাং প্রত্যেকটি গুনাহ তার নীচের তুলনায় কবীরা এবং তার উপরের সগীরা বলে সাব্যস্ত হবে। [. শায়খ হাফেজ আহমদ ওরফে মোল্লাজিউন রাহ , (মৃ. ১১৩০ হি.), নূরুল আনওয়ার ফী শারহিল মানার, ঢাকা, এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১৩৮৭/১৯৬৮, পৃ. ২৬৬।]”
বাহ্যিক লজ্জা নিবারণ দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও গরম-ঠাণ্ডা থেকে মুক্ত থাকার জন্য যেমন পোশাক-পরিচ্ছদের প্রয়োজন তেমনি মানুষের সুকুমার বৃত্তি ও চরিত্রের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য তাকওয়া প্রয়োজন। তাকওয়ার পোশাক সকল কুপ্রবৃত্তি ও দুষ্কৃতি থেকে মানুষকে সর্বোতভাবে রক্ষা করে। আর এ কারণেই এটিকে বাহ্যিক পোশাকের চেয়ে উওম পোশাক বলে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “আর তাকওয়ার পোশাকই হল শ্রেষ্ঠ-উত্তম। [. আল কুরআন, ৭ : ২৬।]” তাকওয়ার পোশাকের ব্যাখ্যায় ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাযী (র) বেলন, “তাকওয়ার পোশাক হচ্ছে ইবনু আব্বাস (রা)-এর মতে সৎকর্ম, উরওয়া ইবনু যুবাইর (রা)-এর মতে মহান আল্লাহর ভয়, হাসান (রা)-এর মতে লজ্জা, ক্বাতাদাহ ও সুদ্দী (র)-এর মতে ঈমান, ইবনু যায়েদের মতে যুদ্ধের পোশাক, যা দিয়ে শক্রর আঘাত থেকে বাঁচা যায়। শেষোক্ত মতটি আবূ মুসলিম (র) গ্রহণ করেছেন। অথবা তাকওয়ার পোশাক হচ্ছে হচ্ছে হজ্জের পোশাক এবং বিনয়ের পোশাক। যেমন পশম বা তুলা দিয়ে তৈরি মোটা পোমাক। এটি জুবাইর (র) গ্রহন করেছেন। [. সাইয়েদ মাহমূদ আলুসী (মৃত্যু ১২৭ হি,), রুহুল মা’আনী ফী তাফসীরি কুরআনিল আযীমি ওয়া আল সাবয়িল মাছানী, বৈরুত, আল মাকতাবা আল তিজারিয়্যাহ মুসতাফা আহমদ আর বায, দার আল ফিকহ্, ১৪১৪/১৯৯৮, খণ্ড ৫, পৃ. ১৫৪।]” এখানে ইবনু আব্বাস (রা)-এর ব্যাখ্যাটি বেশি যুক্তিযুক্ত ও গ্রতিয়মান হয় [. The best clothing and ornament we could have comes from righteousness, which covers the nakedness of sin, and adorns us with virtues, (the holy Quran-English tronslation of the meanings and commentary. Saudi Arabia : King Fahd Holy Quran printing complex- 1411 H.), p. 403..]।জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র)ও ‘তাকওয়ার পোশাক’-এর ব্যাখ্যা ‘সৎকর্ম, যা তোমাদেরকে দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা করবে’ বলে ব্যক্ত করেছেন [. জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী, তাফসীর জালালাইন, প্রাগুক্ত, ১,পৃ. ১৩১।]। অর্থাৎ দেহের সুরক্ষা ও সৌন্দর্যের জন্য যেমন বাহ্যিক পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন, তেমনি মানুষের কর্মকান্ডের শুদ্ধতা, আচার-আচরনের যথার্থতা ও মাধুর্য রক্ষায় তাকওয়ার অনুশীলন অপরিহার্য।
তাকওয়া ও মুত্তাকী শব্দের বিপরীতে পবিত্র কুরআনে যেসব শব্দের ব্যবহার রয়েছে সেগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করলেও তাকওয়ার স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাকওয়া শব্দের বিপরীতে ব্যবহৃত শব্দগুলো হলো:
(ক) কুফর: ‘কুফর’ অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস করা, তাঁকে স্বীকার না করা; কুরআন ও হাদীসের অকাট্য প্রমাণ দ্বারা যেসব বিষয় বিশ্বাস করা ও পালন করা ফরয-অবশ্য পালনীয়রূপে নির্ধারিত, এর যে কোন একটি বা সবগুলোকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করাকে কুফর বল হয়। আর অবিশ্বাসী ও অস্বীকারকারীদেরকে ‘কাফির’ বলা হয়। কাফির ও মুত্তাকী উভয়ের পরিণীত উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, “কাফিরদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে.... এর বিপরীতে বলা হয়েছে ‘যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত-তাকওয়া অবলম্বনে জীবন যাপন করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হব। [. আল কুরআন, ৩৯ : ৭১-৭৩।]
(খ) ‘উদ্ওয়ান:” এর অর্থ হল সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ী , সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। [. আল কুরআন, ৫ : ২।]”
(গ) ‘ফুজূর’ ও ‘ফুজ্জার’: অন্যায়, অনাচার, পাপাচার ও দুষ্কর্মকে ‘ফুজুর’ বলা হয় এবং এসব অন্যায়ে লিপ্ত ব্যক্তিকে ‘ফুজ্জার’ বলা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “অতপর তাকে (নফ্সকে) অসৎকর্ম (ফুজুর) ও সৎকর্মের (তাকওয়া) জ্ঞান দান করেছেন। ” “ আমি কি মুত্তাকীগণকে অপরাধীদের সমান গণ্য করব?” [. আল কুরআন, ৩৮ :২৮।]
(ঘ) বাখিল’: ‘বাখিলা’ শব্দটি বখীল থেকে ক্রিয়াবাচক শব্দ। এর অর্থ কৃপণ। আল্লাহর দেয়া সম্পদে ইসলাম নির্ধারিত মানুষের অধিকার তথা যাকাতসহ অন্যান্য প্রাপ্য যে ঠিকমত আদায় করে না, তাকে বখীল বা কৃপণ বলা হয়। যারা মুত্তাকী তারা যথাযথভাবে সম্পদ ব্যয় করে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “সুতরাং কেউ দান করলে, মুত্তাকী হলে এবং যা উত্তম তা গ্রহণ কররে আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ। আর কেউ কার্পন্য করলে, নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলে এবং যা উত্তম তা বর্জন করলে, তার জন্য আমি সুগম করে দিব কঠোর পরিণামের পথ [. আল কুরআন, ৯২ : ৫-১০।]।
(ঙ) ‘আমক্বা’ : আমক্বা’ অর্থ বদনসীব বা হতভাগ্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এতে (লেলিহান অগ্নিতে) প্রবেশ করবে সে-ই, যে নিতান্ত হতভাগ্য-যে অস্বীকার করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়; আর সেখান থেকে অনেক দুরে রাখা হবে পরম মুত্তাকীকে-যে স্বীয় সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য। [. আল কুরআন, ৯২ : ১৫-১৮।]
(চ) ‘মুজরিম’: ‘মুজরিম’ অর্থ পাপী বা অপরাধী। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “যে দিন দয়াময়ের নিকট মুত্তাকীগণকে সম্মাণিত মেহমানরূপে সমবেত করব এবং অপরাধীদেরকে তৃঞ্চাতুর অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব। [. আল কুরআন, ১৯ : ৮৫-৮৬।]”
(ছ) ‘যালিম’: ‘যালিম’ অর্থ অত্যাচারী বা নির্যাতনকারী। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “পরে আমি মুত্তাকীগণকে উদ্দার করব এবং যালিমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দিব। [. আল কুরআন, ১৯ : ৭২।]”
তাকওয়া অর্থ ঈমান। যেমন, আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “কুরআন মাজীদ মুত্তাকীদের তথা মু’মিনদের জন্য পথপ্রদর্শক [. আল কুরআন, ২:২; আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা)সহ অন্যান্য অনেক সাহাবা (রা) বেলন, তারা হলেন ঈমানদার ব্যক্তিগণ। আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন জারীর আল তাবারী (মৃ. ৩১০ হি.) জামিউল বায়ান ‘আন তাবীলি আয়িল কুরআন, বৈরুত দার আল ফিক্র, তা.বি. খণ্ড ১. পৃ.১৪৭।]” অন্যত্র বলা হয়েছে, “আর তিনি তাদের জন্য তাকওয়ার বাণী তথা তাওহীদের বাণী অর্থাৎ ঈমান অবধারিত করে দিলেন [আল-কুরআন. ৪৮: ২৬।]”। আরো বলা হয়েছে, “তারাতো ঐ ব্যক্তি যাদের অন্তরসমুহকে আল্লাহ তা‘আলা তাকওয়ার তথা ঈমানের জন্য নির্বাচন করেছেন। [. আল-কুরআন. ৪৯:০৩।]” “ফিরআউন সম্প্রদায়, তারা কি তাকওয়া অবলম্বন তথা ঈমান গ্রহণ করবে না? [. আল-কুরআন. ২৬:১১।]”
তাকওয়া অর্থ তাওবা-অনুশোচনা। যেমন, “আর যদি গ্রামের অধিবাসীরা ঈমান গ্রহণ করে ও তাকওয়া অবলম্বন করে অর্থাৎ তওবা করে তবে তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। [. আল-কুরআন. ৭:৯৬।]” তাকওয়া অর্থ আনুগত্য। যেমন, “তোমরা ভীত হও যে, আমি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই আনুগত্য কর [.. আল-কুরআন. ১৬:০২।]” অতএব, তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া আর কারও আনুগত্য করছ? [. আল-কুরআন. ১৬:২৬।]” “আর তোমরা ঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর অর্থাৎ তাঁর অবাধ্য হয়ো না। [. আল-কুরআন. ২৩:৫২।]”
তাকওয়া অর্থ নিষ্ঠা-আন্তরিকতা বা একাগ্রতা। যেমন, “ আর নিশ্চয়ই এটি মনের তাকওয়া অর্থাৎ মনের একাগ্রতা। [. আল-কুরআন. ২২:৩২।]”
তাকওয়া হচ্ছে মূল্যবোধ, মানসিক শুদ্ধতা ও দৃঢ়তা। এটি যে কোন ধরনের পদঙ্খলন থেকে মানুষকে রক্ষা করে; সকল মন্দ ও অশ্লীল কথা, কাজ ও পরিবেশ থেকে ফিরিয়ে রাখে; ‘খাহেশাতে নাফসানী’ তথা প্রবৃত্তির খেয়াল-খুশি বা অভিলাষ ও দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ে নিজের ক্ষতি করা থেকে এবং পরিবার, সমাজ ও দেশের ক্ষতি করা থেকে রক্ষা করে। জনমানব শূন্য নির্জন স্থানে বা দুর্নীতি করার অসংখ্য সহজ পথ উন্মুক্ত থাকার পরও যে শক্তি মানুষকে তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে মুক্ত রাখে তা-ই তাকওয়া। যাদের মনে তাকওয়া রয়েছে, তাদের ওপর শয়তান তথা দুষ্টচক্রের আক্রমণ ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা শক্তি জগ্রত হয়ে উঠে। [. আল-কুরআন. ৭ : ২০১-২০২।]”
তাকওয়া মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার শক্তি জাগ্রত করে। আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে বলেন, “হে বিশ্বাসীগণ, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাকওয়া অর্জন কর, তবে তিনি তোমাদের ভাল-মন্দ পার্থক্য করার শক্তি দান করবেন।... [. আল-কুরআন. ৮ : ২৯।].”অর্থাৎ তাকওয়ার ফলে মানুষের বিবেক বুদ্ধি প্রখর হয় এবং সুষ্ঠ বিচার-বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়। তাই সে সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দ চিনতে এবং তা অনুধাবন করতে ভূল করে না। তার হাতে তাকওয়ার আলোকবর্তিকা থাকার ফলে জীবন পথের মন্দ দিকসমূহ সে স্পষ্টত দেখতে পায়। বিবেচনার শক্তির প্রখরতা ও বুদ্ধিদীপ্ততা তার মধ্যে এমনভাবে কাজ করে যে, তার কাছে তখন ইহ-পারলৌকিক যে কোন বিষয়ের কোনটি সঠিক আর কোনটি ভূল তা স্পষ্টতই ধরা পরে। ফলে সে কোন সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ইতস্তত, দুর্বলতা ও হীনমন্যতা ছাড়াই দিবালোকের মত সুস্পষ্ট ও সঠিক পথে চলতে সক্ষম হয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “হে মু’মিনগণ ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর-তাকওয়া অর্জন কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। তিনি নিজ অনুগ্রহের দ্বিগুন প্রতিদান তোমাদেরকে দিবেন এবং তোমাদেরকে দিবেন জ্যোতি-আলো, যার সাহায্যে তোমরা পথ চলবে। [. আল-কুরআন. ৫৭ : ২৮।]” অর্থাৎ তাকওয়া জীবনকে এমন এক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করে, যা সকল প্রকার ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা, প্ররোচনা-প্রতারণা, প্রলভন-পদস্খলন থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে। অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর সমুদ্রে কম্পাস বা দিক-দর্শন যন্ত্র যেমন সমুদ্রভিযাত্রীকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে, সমস্যা-সংকুল জীবন পথে তাকওয়াও তেমনি মানুষকে নির্ভূল পথের সন্ধান দেয়।
তাকওয়া একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। শিষ্টের লালন ও দুষ্টের দমন নীতির পরিচায়ক একটি শক্তি। ভালকে গ্রহণ করার তীব্র আগ্রহ এবং মন্দকে পরিহার করে চলার দৃঢ় মনোবলই হচ্ছে তাকওয়া। মানুষের সকল সৎগুণের সঞ্জীবনী শক্তি হচ্ছে তাকওয়া। এ ক্ষেত্রে তাকওয়ার অধিকারী ব্যক্তিদের ইতবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ডের বর্ণনা সম্বলিত নিম্নোক্ত আয়াতগুলো প্রণিধানযোগ্য। যেমন, “এ গ্রন্থ (আল কুরআন) পথ প্রদর্শণকারী পরহেযগারদের জন্য। পরহেযগার হচ্ছে তারা, যারা অদৃশ্য বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে; এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সেসব বিষয়ের ওপর যা কিছু আপনার ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে, এবং যা কিছু আপনার পূর্ববর্তীদের ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তারা আখিরাতের প্রতিও দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে। [. আল-কুরআন. ২ : ২-৪।]”
এখানে তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে সৎকাজ সম্পাদন করা। কারণ, অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “ পবিত্র কুরআন সৎকর্মশীলগণের জন্য পথপ্রদর্শক ও অনুগ্রহ স্বরূপ। [. আল-কুরআন. ৩১ : ১-৫।]” আর সৎকর্মশীলগণের পরিচয়ে তা-ই বলা হয়েছে, যা মুত্তাকীগণের পরিচয়ে বিধৃত হলো।
অন্যত্র বলা হয়েছে, “শুধমাত্র পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরানোর মধ্যে কোন কল্যাণ নেই; বরং কল্যাণ হচ্ছে, যে ঈমান আনবে আল্লাহ্র ওপর, কিয়ামত দিবস, ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাবসমূহ ও নবী-রাসূলগণের ওপর; আর তাঁরই ভালবাসার মানসে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির-পথিক, ভিক্ষুক ও সর্ব প্রকার দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্তির জন্য সম্পদ ব্যয় করবে; আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে; আর যারা তাদের অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করে যখন তারা অঙ্গীকার করে এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী। আর তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই তাকওয়া অবলম্বনকারী-মৃত্তাকী। [. আল-কুরআন. ২ : ১৭৭।]” ‘তারাই হল সত্যাশ্রয়ী’ অংশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “আয়াতে বর্ণিত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন কর্মকান্ডসমূহ যখন তারা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখনই তারা মুত্তাকীরূপে পরিগণিত হবে। [.. শায়খ আবদুর রহমান ইবন হাসান, ফাতহুল মাজীদ, রিয়াদ, আল রিয়াসাহ আল ‘আম্মাহ, ১৯৮৩, পৃ. ৩৩৩।]” “তারাই তো সেসব লোক যারা সত্য প্রমাণিত করেছে, আর তারাই হল মুত্তাকী।” আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় আবূ হাইয়্যান (র) বলেছেন, ‘সত্যবাদীতা দিয়ে এখানে কথাবার্তায় সত্যবাদীতা বোঝানো হয়ে থাকতে পারে; যদি তা-ই হয় তবে তা হবে মিথ্যার বিপরীত। তখন এর অর্থ হবে তাদের কথাবার্তা তাদের তৃদয়ে যে ঈমান ও কল্যাণ রয়েছে তার অনুরূপ। সুতরাং তারা যদি কোন বিষয়ে সংবাদ দেয় তখন তা হয় এমন সত্য সংবাদ যার মধ্যে কোন মিথ্যা মিশ্রিত হয় না। [. মুহাম্মদ ইব্ন ইউসুফ ওরফে আবু হাইয়্যান আল-আন্দালুসী (৬৫৪-৭৫৪ হি,). তাফসীর আল রাহরুল মুহীত, কায়রো, দারুল কিতাব আল-ইসলামী, ৩য় মুদ্রণ, ১৪১৩ হি, /১৯৯২, খণ্ড ২ , পৃ. ৮।]” বস্তুত, “যারা সত্য নিয়ে এসেছে এবং যারা সত্যকে সত্য বলে গ্রহণ করেছে তারাইতো মুত্তাকী [. আল-কুরআন. ৩৯: ৩৩।]” সুতরাং জেনে-বুঝে কোন অন্যায়তো সে করেই না; বরং সঙ্গদোষ বা পরিবেশ-পরিস্থিতির শিকার হয়ে কোন অন্যায়, অনৈতিক বা পাপের কাজে প্রবৃত্ত হলে অথবা যে কোন ধরনের ভূল করলে মনে পড়ার সাথে সাথে সে নিজেকে সুধরে ফেলে [. আল-কুরআন. ৭ : ২২১।]। কোন কুসংস্কার বা গর্হিত কাজ যারা করে না তারই মুত্তাকী। “ঘরের পিছন দিক থেকে প্রবেশের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই; বরং কল্যাণ হচ্ছে পিছন দিক থেকে প্রবেশের মত কুসংস্কার বর্জন করে ঘরের দরজা দিয়ে-সামনের দিক থেকে প্রবেশ করা। [. আল-কুরআন. ২ : ১৮৯।]” কাযী নাসিরুদ্দীন বায়যাবী (র) বলেন, ‘কল্যানের অধিকারী সে ব্যক্তি, যে সকল হারাম ও শাহ্ওয়াত-লালসা থেকে বেঁচে থাকে। [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩।]” যুদ্ধ চলাকালীন কঠিন অবস্থায় ধৈর্যধারণের সাথে তাকওয়ার সংযোগ ঘটলে বিজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। “ আর যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তাদের প্রতারণায় তোমাদের কোনই ক্ষতি হবে না। [. আল-কুরআন. ৩ : ১২০।]” এ আয়াতসমূহে মানুষের জন্য কল্যাণকর বিষয়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং এগুলো তখনই মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে, যখন তারা এগুলো জীবনের বাঁকে বাঁকে মেনে চলে ও বাস্তবায়ন করে। আল্লাহ্ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন, “ হে ঈমানদারগণ ! তোমরা আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। [. আল-কুরআন. ৩: ১০২।]” এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবূ হাইয়্যান, ইব্নু মাসঊদ, রবী, কাতাদাহ (রা) ও হাসান বসরী (র) বলেন, ‘হাক্কা তুক্বাতিহি-যথাযথ ভয়’ হল প্রত্যেক কাজে আল্লাহর আনুগত্য করা, আনুগত্যের বিপরীতে কোন কাজ না করা, আল্লাহকে সর্বদা স্মরণ রাখা-কখনও কিস্মৃত না হওয়া এবং সর্বদা তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অকৃতজ্ঞ না হওয়া। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, ‘হাক্কা তুক্বাতিহি’ এর অর্থ হল, আল্লাহর সকল অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকা।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বিধানের কাজে কোন ব্যক্তির ভর্ৎসনা বা নিন্দা তাকে কুন্ঠিত করে না। সে ন্যায়-নীতি অবলম্বন করে সকল কাজ সামাধা করে; হোক সে কাজ তার নিজের অথবা তার সন্তানের অথবা তার পিতার বিরুদ্ধে। [. মুহাম্মদ ইব্নু ইউসুফ ওরফে আবু হাইয়্যান আল-আন্দালুসী (৬৫৪-৭৫৪ হি,). তাফসীর আল রাহরুল মুহীত, ৩য় খণ্ড, পৃ.১৭।]” এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কাযী নাসির উদ্দীন বায়যাবী (র) বলেন, “এখানে স্পষ্টত বা প্রচ্ছন্নভাবে প্রমাণ রয়েছে যে, এটি পূর্ণাঙ্গ মানবীয় গুনাবলী সম্বলিত একটি আয়াত। এখানে বর্ণিত সমুদয় বিষয় এর শাখা-প্রশাখাসহ মুলত তিন ভাগে বিভক্ত। এক. মানুষের আকিদা-বিশ্বাসের বিশুদ্ধতার বিবরণ, দুই. সুন্দর আচার-আচরণ এবং তিন. ব্যক্তি-মানসের কুদৃষ্টি-কালচার। প্রথমটির দিকে ইঙ্গিত রয়েছে আল্লাহর বাণী মান আমানা থেকে ওয়ান্নাবিয়্যীন’ পর্যন্ত অংশে, এবং তৃতীয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে ‘ওয়া আকামাস সালাতা’ থেকে শেষ পর্যন্ত অংশ দিয়ে। এ কারনেই আয়াতে বর্ণিত সমুদয় গুণের অধিকারী ব্যক্তিকে তার সুদৃঢ় ঈমান ও ই’তিকাদের ভিত্তিতে সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং তাকে মুত্তাকী বল হয়েছে তার সুন্দর ব্যবহার ও যথাযথ লেন-দেনের ভিত্তিতে। আর এ জন্যই মহানবী (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এ আয়াতের উপর আমল করল সে অবশ্যই তার ঈমান পরিপূর্ণ করল। [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৫।]”
তাকওয়ার দাবী হচ্ছে বেশি বেশি ভাল কাজ করা ও আল্লাহর ইবাদত করা। কল্যাণমূলক কাজে দ্রুত এগিয়ে আসা; চাই তা জাগতিক হোক বা পারলৌকিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন; “ আর তোমাদের প্রভূর ক্ষমার প্রতি এবং জান্নাতের প্রতি দ্রুত এগিয়ে যাও, যার পরিধি হচ্ছে আসমান ও যমীন, যা প্রস্তুত করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। (মুত্তাকী হচ্ছে তারা) যারা সচ্ছলতা ও অভাবের সময় (মানুষের প্রয়োজনে সম্পদ) ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগ-ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। আর আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালবাসেন। (মুত্তাকী তারাও) যারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের ওপর যুলম করে ফেললে (সাথে সাথে) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ্ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? আর তারা জেনে-শুনে নিজেদের (ভূল) কৃতকর্মসমূহ বারংবার করতে থাকে না। [. আল কুরআন, ৩ : ১৩৩-১৩৫।]” “তারা (আহলে কিতাবগণ) সবাই সমান নয়। আহলে কিতাবগনের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে যারা অবিচলভাবে আল্লাহ্র আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং রাতের গভীরে তারা সেজদায় রত থাকে। তারা আল্লাহ্র প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়: অকল্যাণ থেকে বারণ করে এবং সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে। আর এরাই হল সৎকর্মশীল। তারা যেসব সৎকাজ করবে, কোন অবস্থাতেই সেগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শণ করা হবে না. আর আল্লাহ্ মুত্তাকীদের বিষয়ে অবগত। [. আল কুরআন, ৩ : ১১৩-১১৫।]” এ আয়াতসমূহে বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটি বিষয়ই আমাদের বাস্তব জীবনে অবশ্য করণীয় ও পালনীয়। সুতরাং একজন মানুষ যত বেশী ভাল কাজ করবে তার মধ্যে ততবেশী তাকওয়া বদ্ধমূল হবে।
মুত্তাকীগণ অনুসন্ধিৎসু, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী হয়। দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবর্তন-বিবর্তন তাকে স্পর্শ করে, তাকে নাড়া দেয়, ঘটনার মূল কারণ সন্ধানে ব্যাপৃত করে। ফলে সে বিভিন্ন সূত্র আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ হয় এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখতে সক্ষম হয় [. আল কুরআন, ১০ : ৬।]। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্র তথা সৌর জগত এবং পৃথিবীর জীব-জন্তু, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষলতা, খাল-বিল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, রাত-দিনের পরিবর্তন ইত্যাদি মুত্তাকীদের কাছে গবেষণার উপাদান হয় এবং গবেষণার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এর থেকে উপকৃত হওয়ার বিষয়ও তাদের সাথে সম্পর্কিত, যারা তাকওযার অধিকারী [. আল কুরআন, ১০ :৬।]। বৃষ্টির পানি দিয়ে জমিতে উৎপন্ন ফল-ফসল ও উদ্ভিদের কথা চিন্তা করে এর উৎকর্ষ সাধন ও উৎপাদন বাড়ানোর ওপরও মুত্তাকীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে [. আল কুরআন, ১০ : ৩১।]।
বদান্যতা প্রদর্শন হচ্ছে তাকওয়া। বিয়ে করার সময় মোহর ধার্য করে বা পূর্ণমোহর প্রদান করে যদি বিয়ে সম্পন্ন হয় এবং যুক্তিসঙ্গত কোন কারণে সে বিয়ে বহাল রাখা সম্ভব না হয় তাহলে ইসলামের বিধান অনুযায়ী নারী (স্ত্রী) তার জন্য নির্ধারিত মোহরের অর্ধাংশের অধিকারী হবে। বাকী অর্ধেক পুরুষকে (স্বামীকে)ফিরিয়ে দিবে। তবে নারী সম্পূর্ণ মোহর ফিরিয়ে দিলে বা পুরুষ সম্পূর্ণ মোহর আদায় করে দিলে তা হবে বদান্যতার ব্যাপার। আর এ বদান্যতা-উদারতা পুরুষের পক্ষ থেকে হোক এটিই তাকওয়া [. আল কুরআন, ২ : ২৩৭।]। এমনিভাবে নিয়ম মোতাবেক স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে খোর –পোষ দেয়া তাকওয়ার অধিকারী ব্যাক্তির ওপর কর্তব্য [. আল কুরআন, ২ : ২৪১।] বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। সুতরাং বড় মনের অধিকারী হওয়া, উদারতা প্রদর্শন করা ও কর্তব্য কাজ যথাযথ সম্পাদন করা হল তাকওয়ার দাবী।
পৃথিবীতে বসবাসরত অসংখ্য মানুষের মধ্যে সবাই একত্ববাদের বিশ্বাসী নয়। আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলিম জাতি অন্যান্য কুফরী মতবাদে বিশ্বাসী জাতি-গোষ্ঠীর সাথে ব্যক্তিগত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পর্ক রক্ষা করা ও লেনদেন করাতে ইসলামে কোন বাধা নেই। কারণ, ইসলামে সংকীর্ণতা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। [. আল কুরআন, ২২ : ৭৮।] মুসলিম-অমুসলিম যে কোন ব্যক্তি, জাতি-গোষ্ঠি বা রাষ্ট্রের সাথে কৃত চুক্তি বা অঙ্গীকার পূর্ণ করা এবং তাতে আন্তরিক হওয়া তাকওয়ার অধিকারী ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য। এরুপ ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ্র ভালবাসার পাত্র বলে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। [. আল কুরআন, ৩ : ৭৬।] তবে সম্পর্ক রক্ষা ও লেন-দেনের আড়ালে েযন মুসলিমদের কৃষ্টি-কালচার, ধর্মীয় বিশ্বাস হারিয়ে না যায় এবং অমুসলিমদের কোন চক্রান্তে না পড়ে সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে চলার জন্য পবিত্র কুরআনে তাকওয়া শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে [. আল কুরআন, ৩ : ২৮।]।
স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ তাকওয়া। আয়-উপার্জন, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপনের সকল উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে স্বাবলম্বী হয়ে চলার নাম তাকওয়া। সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়া, স্থানীয় জনগণের ওপর বোঝা হওয়া, জীবন-জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে কারো গলগ্রহ হওয়া, হাত পাতা, ভিক্ষে করা ও পরনির্ভরশীল হওয়া তাকওয়া হতে পারে না। কেবল হাদীয়া-তোহ্ফার ওপর নির্ভর করে যারা জীবন-যাপন করে, তারা মুত্তাকী হতে পারে না। আত্মনির্ভরশীল জীবন গঠন এবং ব্যাক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের ওপর বোঝা হয়ে জীবন-যাপন থেকে বিরত থাকার মনোবৃত্তিকে তাকওয়া বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা হজ্জের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, “আর তোমরা পাথেয় সাথে নিয়ে নাও। নিশ্চয় সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। আর হে বুদ্ধিমানগণ! তোমরা আমাকেই ভয় করতে থাকো [. আল কুরআন, ২ : ১৯৭।]।এখানে তাকওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে, “এমন সহায়-সম্বল অবলম্বন যা থাকার ফলে অন্যের কাছে হাত পাততে হয় না [. জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী, তাফসীর জালালাইন, সিঙ্গাপুর : এদারা নশর ওয়া ইশা’আতে ইসলামিয়্যাহ্, তা.বি., পৃ . ২৯।]। এ আয়াতের শানে নুযুল ও ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “ এ আয়াতটি ইয়ামানের অধিবাসীদের প্রতি নাযিল হয়েছে। তারা হজ্জ করত এমন অবস্থায় যে, প্রয়োজনীয় খাদ্য-সামগ্রী কিছুই তারা সঙ্গে নিয়ে যেত না এবং বলত, আমরা আল্লাহর নির্ভরশীল। ফলে তারা স্থানীয় জনগণের ওপর বোঝা হয়ে থাকত। [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৭।]”কাজেই সর্বপ্রকার পরাধীনতা তথা জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থ-সামর্থ, শক্তি-সাহস, কৃষ্টি-কালচার,সংস্কতি-সভ্যতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে মুক্তি অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা মুত্তাকী হওয়ার জন্য একান্ত প্রয়োজন।
মুত্তাকী ব্যক্তিকে কতগুলো বিষয় বর্জন করে চলতে হয়। মানুষের মধ্যে দুটি পরস্পর বিরোধী প্রবনতা বা শক্তি পাশাপাশি সাংঘর্ষিক অবস্থানে বিদ্যমান। তা হল, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণ, আলো-অন্ধকার ইত্যাদি। এ পরস্পর বিরোধী দুই প্রবণতার মধ্য থেকে ভাল ও কল্যাণময় প্রবণতা বেছে নিয়ে সেটাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ফলে যত কঠিন পরীক্ষা ও অবস্থারই মুকাবিলার সম্মুখীন হোক না কেন, তা ধৈর্য ও সাহসের সাথে উত্তীর্ণ হওয়া এটাই প্রকৃত তাকওয়া। অর্থাৎ মানবীয় সহাজাত সুকুমার বৃত্তি বা আকাঙ্খা যা মানুষকে কুপ্রবৃত্তি তথা মন্দ কথা, খারাপ কাজ ও দুষ্ট চিন্তা থেকে বিরত রাখে, তাকেও তাকওয়া বলা হয়। যারা তাকওয়া অবলম্বনে জীবন যাপন করেন এবং মুত্তাকীদের নেতা বা আদর্শ যারা হতে চান, তারা যেসব বিষয় বর্জন করে জীবন যাপন করেন, এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন, “ আর যখন তারা (সম্পদ) ব্যয় করে তখন অনর্থক ব্যয় করে না, আবার কার্পণ্যও করে না; বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করে (ব্যয় করে)। [. আল কুরআন, ২৫ : ৬৭-৬৮, ৭২-৭৪।]”
এখানে আরও তিনটি আয়াত উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেখানে হারাম কাজের বিবরণ দিয়ে তা অনুধাবন করতে, স্মরণ করতে সর্বোপরি তা থেকে মুক্ত থাকতে বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “হে নবী ! আপনি বলুন, এসো, আমি তোমাদেরকে ঐ সব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রভূ তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। সেগুলো হল, আলল্লাহর সাথে অংশীদার করবে না, পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করবে অর্থাৎ তাদের অবাধ্য হবে না, নিজেদের সন্তানদেরকে দারিদ্রের কারণে হত্যা করবে না, আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। অশ্লীলতার কাছেও যাবে না, তা প্রকাশ্যেই হোক বা গোপেনে; যাকে হত্যা করা আল্লাহ্ হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করবে না; কিন্তু ন্যায়ভাবে। তিনি তোমাদরকে এ নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা অনুধাবন কর-বুঝতে পার। ইয়াতিমরা বয়ো:প্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত উত্তম পন্থা ব্যতীত তাদের সম্পদের কাছেও যাবে না। ন্যায়ের সাথে ওজন ও মাপ পূর্ণ করবে কম-বেশী করবেনা। আমি কাউকে সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেই না। আর যখন তোমরা কথা বলবে-বিচার করবে-হুকুম দিবে, তখন সুবিচার করবে যদিও সে আত্মীয় হয়। আল্লাহ্র অঙ্গীকার পূর্ণ করবে-কখনও তা ভঙ্গ করবে না। তিনি তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। আর অবশ্যই এটি আমার সঠিক পথ। অতএব তোমরা এ পথ অনুসরণ করবে ,মেনে চলবে এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করবে না; তাহলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর (আল্লাহর) পথ থেকে বিচ্চিন্ন করে দিবে। তিনি তোমদেরকে এ নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন কর-সংযত হও। [. আল কুরআন, ৬ : ১৫১-১৫৩।]”
ওজনে ও মাপে ক্রটি করাকে কুরআনে ‘তাতফীফ’ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ধ্বংস অনিবার্য তাতফীফকারীদের জন্য; যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয় তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় বা ওজন করে দেয় তখন কম করে দেয়। [. আল কুরআন, ৮৩ : ১-৩।]” এ ‘তাতফীফ’ শুধু ওজন করার সময় কম-বেশী করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়,; বরং অন্যের প্রাপ্যে ক্রটি করাও ‘তাতফীফ’ এর অন্তুর্ভূক্ত। ইমাম মালেক (র) তাঁর মুআত্তা গ্রন্থে হযরত ওমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তিকে নামাজের আরকানে (নামাজের মধ্যে রুকু-সিজদাসহ অবশ্য পালনীয় বিষয়সমূহে) ক্রটি করতে দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি তাতফীফ করেছ’ অর্থাৎ যথার্থরূপে নামায আদায় করনি। এ ঘটনা বর্ণনা করে ইমাম মালেক (র) বলেন, প্রাপ্য পুরোপুরি আদায় করা ও ক্রটি করা প্রত্যেক বিষয়ের মধ্যেই হয়ে থাকে শুধু ওজন ও মাপের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়।’ এতে বুঝা যায় যে, যে ব্যক্তি নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করে না, নির্ধারিত সময়ে কাজ না করে অযথা সময় নষ্ট করে বা অফিসের সময় অপচয় করে বা কাজে ফাঁকি দেয়, ক্রটি করে, সে-ও উপরিউক্ত আয়াতে বর্ণিত শাস্তির অন্তর্ভূক্ত হবে। সে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হোক বা সাধারণ কর্মচারী হোক, দিনমজুর হোক বা কোটিপতি হোক কিংবা ধর্মীয় কোন প্রতিষ্ঠানের কাজে নিয়োজিত হোক না কেন [. মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ) অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তাফসীর মাআরেফুল কোরআন, মদীনা মোনাওয়ারাহ, খাদেমুল হারামাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, ১৪১৩ হি. পৃ. ১৯১।]। এছাড়া কবীরা গুনাহ হিসাবে নির্ধারিত জঘন্য অপরধসমূহ থেকেও মুত্তাকীগণ অবশ্যই দূরে থাকেন। “ ইবনু ওমর (রা) থেকে কবীরা গুনাহর সংখ্যা সাতটি বলে বর্ণনা রয়েছে। সেগুলো হল, আল্লাহ্র সাথে শরীক করা, মু’মিন ব্যক্তিকে হত্যা করা, সতি-সাধ্বী নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা, মুসলিম পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, হেরেম শরীফে ইলহাদ-কুফরী করা। এর সাথে আবূ হুরায়রা (রা) ‘সুদ’-কে অন্তর্ভূক্ত করেন। আলী (রা) চুরি ও মদ্যপানকে কবীরা গুনাহ হিসাবে সংযোজন করেছেন। মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ কেউ ব্যভিচার, লাওয়াতাত-পায়ূকাম, যাদু, মিথ্যা সাক্ষ্য দান, মিথ্যা শপথ করা, হাইজ্যাক-ডাকাতি ও পরনিন্দা-পরচর্চাকেও কবীরা গুণাহের অন্তুর্ভূক্ত করেছেন। এ দু’টি তথা কবীরা ও সগীরা গুনাহ তুলনামূলকভাবে নির্নয় করার মত বিষয়। সুতরাং প্রত্যেকটি গুনাহ তার নীচের তুলনায় কবীরা এবং তার উপরের সগীরা বলে সাব্যস্ত হবে। [. শায়খ হাফেজ আহমদ ওরফে মোল্লাজিউন রাহ , (মৃ. ১১৩০ হি.), নূরুল আনওয়ার ফী শারহিল মানার, ঢাকা, এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১৩৮৭/১৯৬৮, পৃ. ২৬৬।]”
বাহ্যিক লজ্জা নিবারণ দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও গরম-ঠাণ্ডা থেকে মুক্ত থাকার জন্য যেমন পোশাক-পরিচ্ছদের প্রয়োজন তেমনি মানুষের সুকুমার বৃত্তি ও চরিত্রের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য তাকওয়া প্রয়োজন। তাকওয়ার পোশাক সকল কুপ্রবৃত্তি ও দুষ্কৃতি থেকে মানুষকে সর্বোতভাবে রক্ষা করে। আর এ কারণেই এটিকে বাহ্যিক পোশাকের চেয়ে উওম পোশাক বলে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “আর তাকওয়ার পোশাকই হল শ্রেষ্ঠ-উত্তম। [. আল কুরআন, ৭ : ২৬।]” তাকওয়ার পোশাকের ব্যাখ্যায় ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাযী (র) বেলন, “তাকওয়ার পোশাক হচ্ছে ইবনু আব্বাস (রা)-এর মতে সৎকর্ম, উরওয়া ইবনু যুবাইর (রা)-এর মতে মহান আল্লাহর ভয়, হাসান (রা)-এর মতে লজ্জা, ক্বাতাদাহ ও সুদ্দী (র)-এর মতে ঈমান, ইবনু যায়েদের মতে যুদ্ধের পোশাক, যা দিয়ে শক্রর আঘাত থেকে বাঁচা যায়। শেষোক্ত মতটি আবূ মুসলিম (র) গ্রহণ করেছেন। অথবা তাকওয়ার পোশাক হচ্ছে হচ্ছে হজ্জের পোশাক এবং বিনয়ের পোশাক। যেমন পশম বা তুলা দিয়ে তৈরি মোটা পোমাক। এটি জুবাইর (র) গ্রহন করেছেন। [. সাইয়েদ মাহমূদ আলুসী (মৃত্যু ১২৭ হি,), রুহুল মা’আনী ফী তাফসীরি কুরআনিল আযীমি ওয়া আল সাবয়িল মাছানী, বৈরুত, আল মাকতাবা আল তিজারিয়্যাহ মুসতাফা আহমদ আর বায, দার আল ফিকহ্, ১৪১৪/১৯৯৮, খণ্ড ৫, পৃ. ১৫৪।]” এখানে ইবনু আব্বাস (রা)-এর ব্যাখ্যাটি বেশি যুক্তিযুক্ত ও গ্রতিয়মান হয় [. The best clothing and ornament we could have comes from righteousness, which covers the nakedness of sin, and adorns us with virtues, (the holy Quran-English tronslation of the meanings and commentary. Saudi Arabia : King Fahd Holy Quran printing complex- 1411 H.), p. 403..]।জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র)ও ‘তাকওয়ার পোশাক’-এর ব্যাখ্যা ‘সৎকর্ম, যা তোমাদেরকে দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা করবে’ বলে ব্যক্ত করেছেন [. জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী, তাফসীর জালালাইন, প্রাগুক্ত, ১,পৃ. ১৩১।]। অর্থাৎ দেহের সুরক্ষা ও সৌন্দর্যের জন্য যেমন বাহ্যিক পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন, তেমনি মানুষের কর্মকান্ডের শুদ্ধতা, আচার-আচরনের যথার্থতা ও মাধুর্য রক্ষায় তাকওয়ার অনুশীলন অপরিহার্য।
তাকওয়া ও মুত্তাকী শব্দের বিপরীতে পবিত্র কুরআনে যেসব শব্দের ব্যবহার রয়েছে সেগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করলেও তাকওয়ার স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাকওয়া শব্দের বিপরীতে ব্যবহৃত শব্দগুলো হলো:
(ক) কুফর: ‘কুফর’ অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস করা, তাঁকে স্বীকার না করা; কুরআন ও হাদীসের অকাট্য প্রমাণ দ্বারা যেসব বিষয় বিশ্বাস করা ও পালন করা ফরয-অবশ্য পালনীয়রূপে নির্ধারিত, এর যে কোন একটি বা সবগুলোকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করাকে কুফর বল হয়। আর অবিশ্বাসী ও অস্বীকারকারীদেরকে ‘কাফির’ বলা হয়। কাফির ও মুত্তাকী উভয়ের পরিণীত উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, “কাফিরদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে.... এর বিপরীতে বলা হয়েছে ‘যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত-তাকওয়া অবলম্বনে জীবন যাপন করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হব। [. আল কুরআন, ৩৯ : ৭১-৭৩।]
(খ) ‘উদ্ওয়ান:” এর অর্থ হল সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ী , সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। [. আল কুরআন, ৫ : ২।]”
(গ) ‘ফুজূর’ ও ‘ফুজ্জার’: অন্যায়, অনাচার, পাপাচার ও দুষ্কর্মকে ‘ফুজুর’ বলা হয় এবং এসব অন্যায়ে লিপ্ত ব্যক্তিকে ‘ফুজ্জার’ বলা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “অতপর তাকে (নফ্সকে) অসৎকর্ম (ফুজুর) ও সৎকর্মের (তাকওয়া) জ্ঞান দান করেছেন। ” “ আমি কি মুত্তাকীগণকে অপরাধীদের সমান গণ্য করব?” [. আল কুরআন, ৩৮ :২৮।]
(ঘ) বাখিল’: ‘বাখিলা’ শব্দটি বখীল থেকে ক্রিয়াবাচক শব্দ। এর অর্থ কৃপণ। আল্লাহর দেয়া সম্পদে ইসলাম নির্ধারিত মানুষের অধিকার তথা যাকাতসহ অন্যান্য প্রাপ্য যে ঠিকমত আদায় করে না, তাকে বখীল বা কৃপণ বলা হয়। যারা মুত্তাকী তারা যথাযথভাবে সম্পদ ব্যয় করে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “সুতরাং কেউ দান করলে, মুত্তাকী হলে এবং যা উত্তম তা গ্রহণ কররে আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ। আর কেউ কার্পন্য করলে, নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলে এবং যা উত্তম তা বর্জন করলে, তার জন্য আমি সুগম করে দিব কঠোর পরিণামের পথ [. আল কুরআন, ৯২ : ৫-১০।]।
(ঙ) ‘আমক্বা’ : আমক্বা’ অর্থ বদনসীব বা হতভাগ্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এতে (লেলিহান অগ্নিতে) প্রবেশ করবে সে-ই, যে নিতান্ত হতভাগ্য-যে অস্বীকার করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়; আর সেখান থেকে অনেক দুরে রাখা হবে পরম মুত্তাকীকে-যে স্বীয় সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য। [. আল কুরআন, ৯২ : ১৫-১৮।]
(চ) ‘মুজরিম’: ‘মুজরিম’ অর্থ পাপী বা অপরাধী। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “যে দিন দয়াময়ের নিকট মুত্তাকীগণকে সম্মাণিত মেহমানরূপে সমবেত করব এবং অপরাধীদেরকে তৃঞ্চাতুর অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব। [. আল কুরআন, ১৯ : ৮৫-৮৬।]”
(ছ) ‘যালিম’: ‘যালিম’ অর্থ অত্যাচারী বা নির্যাতনকারী। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “পরে আমি মুত্তাকীগণকে উদ্দার করব এবং যালিমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দিব। [. আল কুরআন, ১৯ : ৭২।]”
১. আলী ইব্ন আবূ তালিব (রা) বলেন, “তাকওয়া হচ্ছে পাপ কাজে জড়িয়ে থাকাকে ছেড়ে দেয়া এবং সৎকাজে প্রতারিত হওয়াকে ছেড়ে দেয়া [. ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাযী, বৈরুত, দার ইহইয়াউত তুরাছ আল আরাবী, ১৯৯৭, খণ্ড-১, পৃ. ২৬৮।]।” কুরআনের বাণী “হে মানবসমাজ! তোমরা তোমাদের প্রভূর ইবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার [. আল কুরআন, ২: ২১।]।” এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা কাযী নাসিরুদ্দীন বায়যাবী (র) বেলন, “এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর পথের পথিকদের সর্বশেষ স্তর। আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে কেবল আল্লাহমুখী হয়ে জীবন যাপন করা এবং ইবাদতকারী যেন তার ইবাদত দ্বারা প্রতারিত না হয়; বরং সে ভয় ও আশা নিয়ে ইবাদত করবে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলেছেন, “ তারা তাদের প্রভূর ইবাদত করে ভয়ে ভয়ে ও আশায় আশায়। তারা তাঁর রহমতের প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে [. কাযী নাসিরুদ্দীন আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১।]।”
২. উমর ইব্নু আবদুল আযীয (র) বলেন, “ আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা ছেড়ে দেয়া এবং তিনি যা ফরয করেছেন তা আদায় করার নাম হচ্ছে তাকওয়া [. আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী (মৃ. ৫১০ হি.), মা’আলিমুত তানযীল ফিত তাফসীর ওয়াত তাবীল, বৈরুত, দার আল ফিক্র, ১৯৮৫, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫।]”।
৩. আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) মুত্তাকীদের পরিচয় দিয়ে বলেন, “ যারা মহান আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে এমন সব কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিয়ে, যেগুলোর হারাম হওয়া সম্পর্কিত বিধান আল্লাহর দেয়া হেদায়েত তথা কুরআন ও হাদীস থেকে তারা জানে এবং অনুসরণের জন্য মহনবী (সা) যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহ্র রহমত কামনা করে [. আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন জারীর আল তাবারী (মৃ. ৩১০ হি.) জামিউল বায়ান ‘আন তাবীলি আয়িল কুরআন, বৈরুত দার আল ফিক্র, তা.বি. খণ্ড ১. পৃ.১৪৭। আদ্দুররুল মানসুর ফী আল তাফসীর আল মাছুর, প্রাগুক্ত, প. ৬০।]।” তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি নিজেকে শিরক, কবীরা গুনাহ ও অশ্লীল কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে বিরত রাখে, তাকে মুত্তাকী বলা হয়। [. সম্পদনা পরিষদ সম্পাদিত, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম,ঢাকা ইফাবা, পৃ. ৬৯৫।]”
৪. কালবী (র.) বলেন, “যারা গুনাহে কবীরা তথা বড় ধরনের অপবাদ থেকে বেঁচে থাকে, তারা হল মুত্তাকী [. আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন জারীর আল তাবারী (মৃ. ৩১০ হি.) জামিউল বায়ান ‘আন তাবীলি আয়িল কুরআন, বৈরুত দার আল ফিক্র, তা.বি. খণ্ড ১. পৃ.১৪৭।]।”
৫. হাসান (র.) বলেন, “ আল্লাহ্র ওপর আল্লাহ ব্যতীত কাউকে গ্রহণ না করা এবং সবকিছু তাঁর হাতে ন্যস্ত বলে জানা-এটিই হচ্ছে তাকওয়া।“তিনি আরও বলেন, “হারামের ভয়ে বহু হালালও যতক্ষণ মুত্তাকীগণ বর্জন করে চলেন ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকীদের মাঝে তাকওয়া বিদ্যমান থাকে। [. আবদুর রহমান জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী (র), আদ্দুররুল মানসুর ফী আল তাফসীর আল মাছুর, প্রাগুক্ত, প. ৬১।]” আল্লাহ্র বাণী “ লিলমুত্তাকীন [. আল কুরআন, ২ : ২।]”–এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “মুত্তাকী হচ্ছে তারা, যারা তাদের প্রতি যা হারাম করা হয়েছে তা থেকে দূরে থাকে এবং তাদের ওপর যা ফরয করা হয়েছে তা পালন করে [.আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন জারীর আল তাবারী (মৃ. ৩১০ হি.) জামিউল বায়ান ‘আন তাবীলি আয়িল কুরআন, প্রাগুক্ত।]।”
৬. ইবরাহীম ইব্নু আদহাম (র.) বলেন, “ সৃষ্টিজগত তোমার যবানে-কথায় কোন ক্রটি পাবে না, ফেরেশতাগণ তোমার কাজ-কর্মে ক্রটি পাবে না এবং আরশের অধিপতি আল্লাহ্ তোমার গোপনীয়তায় কোন ক্রটি পাবে না-এমন অবস্থার নাম তাকওয়া। [. ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাযী, বৈরুত, দার ইহইয়াউত তুরাছ আল আরাবী, ১৯৯৭, খণ্ড-১, পৃ. ২৬৮।]”
৭. ওয়াকেদী (র.) বলেন, “তাকওয়া হচ্ছে সত্যের জন্য তোমার মনকে সজ্জিতকরণ, যেমন তোমার বাহ্যিক অবস্থাকে চরিত্রের জন্য সাজিয়ে থাক [. প্রাগুক্ত।]।”
৮. আবদুল্লাহ ইব্ন মুবারক (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যদি কোন ব্যক্তি পরিহারযোগ্য একটি বিষয়েও সে করে তাহলে সে ব্যক্তি মুত্তাকীদের অন্তর্ভূক্ত হবে না [. আবদুর রহমান জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী (র), আদ্দুররুল মানসুর ফী আল তাফসীর আল মাছুর, প্রাগুক্ত, প. ৬১।]।"
৯. আবূ দারদা (রা.) বলেন, “ সম্পূর্ণ তাকওয়া হল বান্দা আল্লাহকে ভয় করবে (করণীয় বিষয়) ত্যাগ করতে গিয়ে কিছু হালালও বর্জন করবে এই ভয়ে যেন তাকে হারামে পড়তে না হয়; আর যেন সামন্য হালাল বর্জন যেন হারাম এবং হালালের মাঝখানে পর্দা-দেয়াল হয়ে যায়। [. প্রাগুক্ত।]”
১০. সুফইয়ান সাওরী (র.) বলেন, “যে বিষয়ে তোমর মনে সন্দেহ হয়, তা পরত্যাগ করার চেয়ে তাকওয়ার সহজ পথ আমার জানা নেই। [. আবদুল কাদের জিলানী (র), অনুবাদ-হাফেয মাওলানা আবদুল জলীল. গুনিয়াতুত তালেবীন, ঢাকা, ফেরদৌস পাবলিকেশন্স, তা.বি. খণ্ড ১, পৃ. ১৯০।]” সুতরাং সন্দেহপূর্ণ যে কোন কাজ থেকে বিরত থাকা এবং সবসময় নিজের নফসের হিসাব গ্রহণ করা হল তাকওয়া।
১১. শাহর ইব্নু হাউশার (র) বলেন, “মুত্তাকী হচ্ছেন তিনি, যিনি এমন বিষয়-আশায়ও বর্জন করেন, যাতে কোন ক্ষতি নেই এই ভয়ে যাতে ক্ষতি আছে তা থেকে যেন বেঁচে থাক যায়। [. আলাউদ্দীন আলী ইবন মুহাম্মদ আল বাগদাদী (মৃ. ৭২৫ হি.) লুবাতুত তাবীল ফী মা’আনিত তানযীল ওরফে তাফসীরে খাযেন, বৈরুত, দার আল ফিক্র, ১৩৯৯/১৯৭৯, খণ্ড ১, পৃ. ২৮।]”
১২. আতিয়া আল সাআদী (রা.) বলেন, “মুমিন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকী বলে গণ্য হয় না যতক্ষণ না সে এমন বিষয়ও পরিত্যাগ নাকরে যা ক্ষতির কারণ হতে পারে। [. আবদুর রহমান জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী (র), আদ্দুররুল মানসুর ফী আল তাফসীর আল মাছুর, বৈরুত, দার আল ফিক্র, ১৯৮৩, খণ্ড ১, প. ৬১।]”
১৩. ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) একবার উবাই ইব্নু কা’ব (রা)-কে বললেন, “আপনি তাকওয়া সম্পর্কে আমাকে বলুন। জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনি কি কখনও কন্টকাকীর্ণ পথ দিয়ে চলেছেন? ওমর (রা) বলেছেন, কাপড় চোপড় গুটিয়ে অত্যন্ত সাবধানে চলেছি। কা’ব (রা) বললেন, ওটাই তো তাকওয়া [. তাফসীর খাযেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮; মা’আলিমুত তানযীল, প্রাগুক্ত, পৃ.৩৫।]।” বস্তত: বিবেকের সার্বক্ষণিক সচেতনতা ও সতর্কতা, চেতনা ও অনুভূতির স্বচ্ছতা, নিরবচ্ছিন্ন সাবধানতা, জীবন পথের কন্টকসমূহ থেকে আ্ত্মরক্ষার প্রবণতা, অব্যাহত ভীতি-এ সবেরই নাম তাকওয়া। জীবন পথের কন্টকসমূহ হচ্ছে প্রবৃত্তির কুৎসিত কামনা, বাসনা ও প্ররোচনা। অন্যায় লোভ-লালসা, মোহ, ভয়-ভীতি ও শংকা, আশা পূরণে সক্ষম নয় এমন কারো কাছে মিথ্যা আশা পোষণ করা, ক্ষতি বা উপকার সাধনে সক্ষম নয় এমন কারো মিথ্যা ভয়ে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি [. সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন, অনুবাদ,-হাফেয মুনির উদ্দীন আহমদ, লণ্ডন, আল-কোরআন একাডেমি, ২০০৫, খণ্ড ১, পৃ. ৭২।]।
১৪. আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রা) বলেন, “তাকওয়া হচ্ছে নিজেকে অন্য যে কারোর তুলনায় উত্তম মনে না করা [. আলাউদ্দীন আলী ইবন মুহাম্মদ আল বাগদাদী (মৃ. ৭২৫ হি.) লুবাতুত তাবীল ফী মা’আনিত তানযীল ওরফে তাফসীরে খাযেন, প্রাগুক্ত, আবু মুহাম্মদ হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী (র), মা’আলিমুত তানযীল ফিত তাফসীর ওয়াত তাবীল, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫।]।” এ কথার অর্থ এ নয় যে, একজন মানুষ নিজেকে হীন, তুচ্ছ, নিকৃষ্ট ও অবহেলিত মনে করবে; বরং এ কথার প্রকৃত মর্ম হচ্ছে, আল্লাহ্র নির্দেশ পালন তথা ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্টীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামের যে বিধি-নিষেধ রয়েছে তা মানার ক্ষেত্রে সে ইবলিসের মত এ কথা বলবে না যে, “আমি তার [আদম (আ)] চেয়ে উত্তম-শ্রেষ্ঠ; আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন [. আল কুরআন, ৭ : ১২।]।” অর্থাৎ সে অহংকারী হবে না।
১৫. কোন কোন মুফাসসির বলেন, “তাকওয়া হচ্ছে মহানবী (সা) এর অনুসরণ করা। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ তা’আলার বাণী ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল ও ইহসান.... এর নির্দেশ দিয়েছেন’ এই বাণীতে তাকওয়ার সমাবেশ রয়েছে [. আবু মুহাম্মদ হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী (র) মা’আলিমুত তানযীল ফিত তাফসীর ওয়াত তাবীল, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫।]।”
২. উমর ইব্নু আবদুল আযীয (র) বলেন, “ আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা ছেড়ে দেয়া এবং তিনি যা ফরয করেছেন তা আদায় করার নাম হচ্ছে তাকওয়া [. আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী (মৃ. ৫১০ হি.), মা’আলিমুত তানযীল ফিত তাফসীর ওয়াত তাবীল, বৈরুত, দার আল ফিক্র, ১৯৮৫, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫।]”।
৩. আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) মুত্তাকীদের পরিচয় দিয়ে বলেন, “ যারা মহান আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে এমন সব কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিয়ে, যেগুলোর হারাম হওয়া সম্পর্কিত বিধান আল্লাহর দেয়া হেদায়েত তথা কুরআন ও হাদীস থেকে তারা জানে এবং অনুসরণের জন্য মহনবী (সা) যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহ্র রহমত কামনা করে [. আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন জারীর আল তাবারী (মৃ. ৩১০ হি.) জামিউল বায়ান ‘আন তাবীলি আয়িল কুরআন, বৈরুত দার আল ফিক্র, তা.বি. খণ্ড ১. পৃ.১৪৭। আদ্দুররুল মানসুর ফী আল তাফসীর আল মাছুর, প্রাগুক্ত, প. ৬০।]।” তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি নিজেকে শিরক, কবীরা গুনাহ ও অশ্লীল কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে বিরত রাখে, তাকে মুত্তাকী বলা হয়। [. সম্পদনা পরিষদ সম্পাদিত, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম,ঢাকা ইফাবা, পৃ. ৬৯৫।]”
৪. কালবী (র.) বলেন, “যারা গুনাহে কবীরা তথা বড় ধরনের অপবাদ থেকে বেঁচে থাকে, তারা হল মুত্তাকী [. আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন জারীর আল তাবারী (মৃ. ৩১০ হি.) জামিউল বায়ান ‘আন তাবীলি আয়িল কুরআন, বৈরুত দার আল ফিক্র, তা.বি. খণ্ড ১. পৃ.১৪৭।]।”
৫. হাসান (র.) বলেন, “ আল্লাহ্র ওপর আল্লাহ ব্যতীত কাউকে গ্রহণ না করা এবং সবকিছু তাঁর হাতে ন্যস্ত বলে জানা-এটিই হচ্ছে তাকওয়া।“তিনি আরও বলেন, “হারামের ভয়ে বহু হালালও যতক্ষণ মুত্তাকীগণ বর্জন করে চলেন ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকীদের মাঝে তাকওয়া বিদ্যমান থাকে। [. আবদুর রহমান জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী (র), আদ্দুররুল মানসুর ফী আল তাফসীর আল মাছুর, প্রাগুক্ত, প. ৬১।]” আল্লাহ্র বাণী “ লিলমুত্তাকীন [. আল কুরআন, ২ : ২।]”–এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “মুত্তাকী হচ্ছে তারা, যারা তাদের প্রতি যা হারাম করা হয়েছে তা থেকে দূরে থাকে এবং তাদের ওপর যা ফরয করা হয়েছে তা পালন করে [.আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন জারীর আল তাবারী (মৃ. ৩১০ হি.) জামিউল বায়ান ‘আন তাবীলি আয়িল কুরআন, প্রাগুক্ত।]।”
৬. ইবরাহীম ইব্নু আদহাম (র.) বলেন, “ সৃষ্টিজগত তোমার যবানে-কথায় কোন ক্রটি পাবে না, ফেরেশতাগণ তোমার কাজ-কর্মে ক্রটি পাবে না এবং আরশের অধিপতি আল্লাহ্ তোমার গোপনীয়তায় কোন ক্রটি পাবে না-এমন অবস্থার নাম তাকওয়া। [. ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাযী, বৈরুত, দার ইহইয়াউত তুরাছ আল আরাবী, ১৯৯৭, খণ্ড-১, পৃ. ২৬৮।]”
৭. ওয়াকেদী (র.) বলেন, “তাকওয়া হচ্ছে সত্যের জন্য তোমার মনকে সজ্জিতকরণ, যেমন তোমার বাহ্যিক অবস্থাকে চরিত্রের জন্য সাজিয়ে থাক [. প্রাগুক্ত।]।”
৮. আবদুল্লাহ ইব্ন মুবারক (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যদি কোন ব্যক্তি পরিহারযোগ্য একটি বিষয়েও সে করে তাহলে সে ব্যক্তি মুত্তাকীদের অন্তর্ভূক্ত হবে না [. আবদুর রহমান জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী (র), আদ্দুররুল মানসুর ফী আল তাফসীর আল মাছুর, প্রাগুক্ত, প. ৬১।]।"
৯. আবূ দারদা (রা.) বলেন, “ সম্পূর্ণ তাকওয়া হল বান্দা আল্লাহকে ভয় করবে (করণীয় বিষয়) ত্যাগ করতে গিয়ে কিছু হালালও বর্জন করবে এই ভয়ে যেন তাকে হারামে পড়তে না হয়; আর যেন সামন্য হালাল বর্জন যেন হারাম এবং হালালের মাঝখানে পর্দা-দেয়াল হয়ে যায়। [. প্রাগুক্ত।]”
১০. সুফইয়ান সাওরী (র.) বলেন, “যে বিষয়ে তোমর মনে সন্দেহ হয়, তা পরত্যাগ করার চেয়ে তাকওয়ার সহজ পথ আমার জানা নেই। [. আবদুল কাদের জিলানী (র), অনুবাদ-হাফেয মাওলানা আবদুল জলীল. গুনিয়াতুত তালেবীন, ঢাকা, ফেরদৌস পাবলিকেশন্স, তা.বি. খণ্ড ১, পৃ. ১৯০।]” সুতরাং সন্দেহপূর্ণ যে কোন কাজ থেকে বিরত থাকা এবং সবসময় নিজের নফসের হিসাব গ্রহণ করা হল তাকওয়া।
১১. শাহর ইব্নু হাউশার (র) বলেন, “মুত্তাকী হচ্ছেন তিনি, যিনি এমন বিষয়-আশায়ও বর্জন করেন, যাতে কোন ক্ষতি নেই এই ভয়ে যাতে ক্ষতি আছে তা থেকে যেন বেঁচে থাক যায়। [. আলাউদ্দীন আলী ইবন মুহাম্মদ আল বাগদাদী (মৃ. ৭২৫ হি.) লুবাতুত তাবীল ফী মা’আনিত তানযীল ওরফে তাফসীরে খাযেন, বৈরুত, দার আল ফিক্র, ১৩৯৯/১৯৭৯, খণ্ড ১, পৃ. ২৮।]”
১২. আতিয়া আল সাআদী (রা.) বলেন, “মুমিন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকী বলে গণ্য হয় না যতক্ষণ না সে এমন বিষয়ও পরিত্যাগ নাকরে যা ক্ষতির কারণ হতে পারে। [. আবদুর রহমান জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী (র), আদ্দুররুল মানসুর ফী আল তাফসীর আল মাছুর, বৈরুত, দার আল ফিক্র, ১৯৮৩, খণ্ড ১, প. ৬১।]”
১৩. ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) একবার উবাই ইব্নু কা’ব (রা)-কে বললেন, “আপনি তাকওয়া সম্পর্কে আমাকে বলুন। জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনি কি কখনও কন্টকাকীর্ণ পথ দিয়ে চলেছেন? ওমর (রা) বলেছেন, কাপড় চোপড় গুটিয়ে অত্যন্ত সাবধানে চলেছি। কা’ব (রা) বললেন, ওটাই তো তাকওয়া [. তাফসীর খাযেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮; মা’আলিমুত তানযীল, প্রাগুক্ত, পৃ.৩৫।]।” বস্তত: বিবেকের সার্বক্ষণিক সচেতনতা ও সতর্কতা, চেতনা ও অনুভূতির স্বচ্ছতা, নিরবচ্ছিন্ন সাবধানতা, জীবন পথের কন্টকসমূহ থেকে আ্ত্মরক্ষার প্রবণতা, অব্যাহত ভীতি-এ সবেরই নাম তাকওয়া। জীবন পথের কন্টকসমূহ হচ্ছে প্রবৃত্তির কুৎসিত কামনা, বাসনা ও প্ররোচনা। অন্যায় লোভ-লালসা, মোহ, ভয়-ভীতি ও শংকা, আশা পূরণে সক্ষম নয় এমন কারো কাছে মিথ্যা আশা পোষণ করা, ক্ষতি বা উপকার সাধনে সক্ষম নয় এমন কারো মিথ্যা ভয়ে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি [. সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন, অনুবাদ,-হাফেয মুনির উদ্দীন আহমদ, লণ্ডন, আল-কোরআন একাডেমি, ২০০৫, খণ্ড ১, পৃ. ৭২।]।
১৪. আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রা) বলেন, “তাকওয়া হচ্ছে নিজেকে অন্য যে কারোর তুলনায় উত্তম মনে না করা [. আলাউদ্দীন আলী ইবন মুহাম্মদ আল বাগদাদী (মৃ. ৭২৫ হি.) লুবাতুত তাবীল ফী মা’আনিত তানযীল ওরফে তাফসীরে খাযেন, প্রাগুক্ত, আবু মুহাম্মদ হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী (র), মা’আলিমুত তানযীল ফিত তাফসীর ওয়াত তাবীল, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫।]।” এ কথার অর্থ এ নয় যে, একজন মানুষ নিজেকে হীন, তুচ্ছ, নিকৃষ্ট ও অবহেলিত মনে করবে; বরং এ কথার প্রকৃত মর্ম হচ্ছে, আল্লাহ্র নির্দেশ পালন তথা ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্টীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামের যে বিধি-নিষেধ রয়েছে তা মানার ক্ষেত্রে সে ইবলিসের মত এ কথা বলবে না যে, “আমি তার [আদম (আ)] চেয়ে উত্তম-শ্রেষ্ঠ; আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন [. আল কুরআন, ৭ : ১২।]।” অর্থাৎ সে অহংকারী হবে না।
১৫. কোন কোন মুফাসসির বলেন, “তাকওয়া হচ্ছে মহানবী (সা) এর অনুসরণ করা। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ তা’আলার বাণী ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল ও ইহসান.... এর নির্দেশ দিয়েছেন’ এই বাণীতে তাকওয়ার সমাবেশ রয়েছে [. আবু মুহাম্মদ হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী (র) মা’আলিমুত তানযীল ফিত তাফসীর ওয়াত তাবীল, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫।]।”
‘তাকওয়া’ ‘বেঁচে থাকা’ অর্থে ব্যবহৃত হলে এর তিনটি স্তর পরিলক্ষিত হয়।
প্রথম স্তর হল কুফর ও শির্ক থেকে বেঁচে থাকা। এ অর্থে একজন সাধারণ মুসলিমকেও মুত্তাকী বলা যায়; যদিও তার থেকে গুনাহ্ প্রকাশ পেয়ে থাকে। এ অর্থ বুঝানোর জন্য পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় মুত্তাকূণ, মুত্তাকীন ও তাকওয়া শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
দ্বিতীয় স্তর- যা প্রকৃতপক্ষে কাম্য, তা হল এমন সব বিষয় থেকে বেঁচে থাকা যা আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর রাসূলের পছন্দনীয় নয়। কুরআন ও হাদীসে তাকওয়ার যেসব মর্যাদা ও কল্যাণ প্রতিশ্রুত হয়েছে তা এ স্তরের তাকওয়ার উপর ভিত্তি করেই হয়েছে।
তৃতীয় স্তরটি তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তর। সকল নবী-রাসূলগণ ও তাঁদের বিশেষ উত্তরাধিকারী ওলীগণ এ স্তরের তাকওয়া অর্জন করে থাকেন। এ স্তরের তাকওয়া হল অন্তরকে আল্লাহর ব্যতীত সবকিছু থেকে মুক্ত রাখা [. মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ) অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তাফসীর মাআরেফুল কোরআন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯১।]। উল্লেখিত মতের সাথে একমত পোষণ করে কাযী নাসিরুদ্দীন বায়যাবী (র) বলেন, ‘তাকওয়া’র তিনটি স্তর রয়েছে :
এক. শিরক থেকে মুক্ত হয়ে চিরস্থায়ী শাস্তি থেকে বেঁচে থাকা।
দুই. যা করলে পাপ হয় অথবা ছেড়ে দিলে পাপ হয় এমন সবকিছূ থেকে দূরে থাকা। কারো কারো মতে সামান্য ও ছোট-খাটো ক্রটি-বিচ্যুতি থেকেও বেঁচে থাকা। আর ইসলামী শরী’আতে এটিই তাকওয়া নামে পরিচিত। পবিত্র কুরআনের বাণী ‘আর যদি গ্রামের অধিবাসীরা ঈমান গ্রহণ করে ও তাকওয়া অবলম্বন করে’ বলে ‘তাকওয়া’র এ অর্থটি গ্রহণ করা হয়েছে।
তিন. নিজের অন্তরকে সত্য-সঠিক তথা আল্লাহ্ তা‘আলা থেকে ফিরিয়ে রাখে এমন কিছু থেকে পুত-পবিত্র থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহমুখী হওয়া। এটিই হচ্ছে প্রকৃত তাকওয়া যা আল্লাহর বাণী ‘তোমরা আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় কর’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. 16.]। তাফসীর জালালাইন এর টীকায়ও ‘তাকওয়া’র স্তর-বিন্যাস তিন প্রকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. সাধারণের তাকওয়া। তা হল কুফর থেকে বেঁচে থাকা।
দুই. খাছ লোকদের তাকওয়া, আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র সকল নির্দেশসমূহ পালন করা এবং তাঁর সকল নিষেধাজ্ঞা থেকে দুরে থাকা।
তিন. বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের তাকওয়া। আর তা হল আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে এমন সবকিছূ থেকে বেঁচে থাকা [. জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী, তাফসীর জালালাইন, সিঙ্গাপুর : এদারা নশর ওয়া ইশা’আতে ইসলামিয়্যাহ্, তা.বি., পৃ. ৪, টীকা নং ২০।]। এতে বুঝা যায় যে, পূর্ণ ইসলামই প্রকৃত পক্ষে তাকওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর রাসূল (সা)-এর পূর্ণ আনুগত্য করা এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাককেই তাকওয়া বলা হয় [. মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ) অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তাফসীর মাআরেফুল কোরআন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯১।]। বস্তুত তারাই মুত্তাকী, যাদের ঈমান ও ‘আমল দুটিই পূর্ণাঙ্গ। আর ঈমান ও আমল এ দুয়ের সমন্বয়ই ইসলাম [. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪।]।
ইমাম আল-গাযালী (র) তাকওয়ার চারটি স্তর বর্ণনা করেছেন।
এক. শরী’আতে যে সকল বস্তুকে হারাম করা হয়েছে, আল্লাহ্র ভয়ে সকল বস্তু থেকে বিরত থাকা। যেমন, মদ্যপান, ব্যভিচার, জুয়াখেলা ও সুদ খাওয়া প্রভৃতি হারাম কাজ থেকে আত্মরক্ষা করা। এটি সাধারণ মুমিনের তাকওয়া। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে বলা হয় মু’মিন।
দুই. হারাম বস্তুসমূহ হতে বিরত থাকার পর সন্দেহযু্ক্ত হালাল বস্তুসমূহ হতেও দূরে থাকা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে বলা হয় সালিহ। তিন. সকল হারাম বস্তু ও সন্দেহযু্ক্ত হালাল বস্তুসমূহ হতে দূরে থাকার পর আল্লাহ্র ভয়ে অনক সন্দেহবিহীন হালাল বস্তুও পরিত্যাগ করে, এ শ্রেণীকে মুত্তাকী বলা হয় । চার. তিন শ্রেণীর তাকওয়া আয়ত্ত করার পর এমন সকল হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা যা ইবাদাতে কোনরূপ সহায়তা করে না। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে বলা হয় ‘সিদ্দীক’ [. ইসলামী বিশ্বকোষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮-১০৯।]।
প্রথম স্তর হল কুফর ও শির্ক থেকে বেঁচে থাকা। এ অর্থে একজন সাধারণ মুসলিমকেও মুত্তাকী বলা যায়; যদিও তার থেকে গুনাহ্ প্রকাশ পেয়ে থাকে। এ অর্থ বুঝানোর জন্য পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় মুত্তাকূণ, মুত্তাকীন ও তাকওয়া শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
দ্বিতীয় স্তর- যা প্রকৃতপক্ষে কাম্য, তা হল এমন সব বিষয় থেকে বেঁচে থাকা যা আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর রাসূলের পছন্দনীয় নয়। কুরআন ও হাদীসে তাকওয়ার যেসব মর্যাদা ও কল্যাণ প্রতিশ্রুত হয়েছে তা এ স্তরের তাকওয়ার উপর ভিত্তি করেই হয়েছে।
তৃতীয় স্তরটি তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তর। সকল নবী-রাসূলগণ ও তাঁদের বিশেষ উত্তরাধিকারী ওলীগণ এ স্তরের তাকওয়া অর্জন করে থাকেন। এ স্তরের তাকওয়া হল অন্তরকে আল্লাহর ব্যতীত সবকিছু থেকে মুক্ত রাখা [. মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ) অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তাফসীর মাআরেফুল কোরআন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯১।]। উল্লেখিত মতের সাথে একমত পোষণ করে কাযী নাসিরুদ্দীন বায়যাবী (র) বলেন, ‘তাকওয়া’র তিনটি স্তর রয়েছে :
এক. শিরক থেকে মুক্ত হয়ে চিরস্থায়ী শাস্তি থেকে বেঁচে থাকা।
দুই. যা করলে পাপ হয় অথবা ছেড়ে দিলে পাপ হয় এমন সবকিছূ থেকে দূরে থাকা। কারো কারো মতে সামান্য ও ছোট-খাটো ক্রটি-বিচ্যুতি থেকেও বেঁচে থাকা। আর ইসলামী শরী’আতে এটিই তাকওয়া নামে পরিচিত। পবিত্র কুরআনের বাণী ‘আর যদি গ্রামের অধিবাসীরা ঈমান গ্রহণ করে ও তাকওয়া অবলম্বন করে’ বলে ‘তাকওয়া’র এ অর্থটি গ্রহণ করা হয়েছে।
তিন. নিজের অন্তরকে সত্য-সঠিক তথা আল্লাহ্ তা‘আলা থেকে ফিরিয়ে রাখে এমন কিছু থেকে পুত-পবিত্র থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহমুখী হওয়া। এটিই হচ্ছে প্রকৃত তাকওয়া যা আল্লাহর বাণী ‘তোমরা আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় কর’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে [. কাযী নাসির উদ্দীন আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর ইবন মুহাম্মদ আল-বায়যাবী, প্রাগুক্ত, পৃ. 16.]। তাফসীর জালালাইন এর টীকায়ও ‘তাকওয়া’র স্তর-বিন্যাস তিন প্রকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. সাধারণের তাকওয়া। তা হল কুফর থেকে বেঁচে থাকা।
দুই. খাছ লোকদের তাকওয়া, আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র সকল নির্দেশসমূহ পালন করা এবং তাঁর সকল নিষেধাজ্ঞা থেকে দুরে থাকা।
তিন. বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের তাকওয়া। আর তা হল আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে এমন সবকিছূ থেকে বেঁচে থাকা [. জালালুদ্দীন আল সুয়ূতী, তাফসীর জালালাইন, সিঙ্গাপুর : এদারা নশর ওয়া ইশা’আতে ইসলামিয়্যাহ্, তা.বি., পৃ. ৪, টীকা নং ২০।]। এতে বুঝা যায় যে, পূর্ণ ইসলামই প্রকৃত পক্ষে তাকওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর রাসূল (সা)-এর পূর্ণ আনুগত্য করা এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাককেই তাকওয়া বলা হয় [. মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ) অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তাফসীর মাআরেফুল কোরআন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯১।]। বস্তুত তারাই মুত্তাকী, যাদের ঈমান ও ‘আমল দুটিই পূর্ণাঙ্গ। আর ঈমান ও আমল এ দুয়ের সমন্বয়ই ইসলাম [. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪।]।
ইমাম আল-গাযালী (র) তাকওয়ার চারটি স্তর বর্ণনা করেছেন।
এক. শরী’আতে যে সকল বস্তুকে হারাম করা হয়েছে, আল্লাহ্র ভয়ে সকল বস্তু থেকে বিরত থাকা। যেমন, মদ্যপান, ব্যভিচার, জুয়াখেলা ও সুদ খাওয়া প্রভৃতি হারাম কাজ থেকে আত্মরক্ষা করা। এটি সাধারণ মুমিনের তাকওয়া। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে বলা হয় মু’মিন।
দুই. হারাম বস্তুসমূহ হতে বিরত থাকার পর সন্দেহযু্ক্ত হালাল বস্তুসমূহ হতেও দূরে থাকা। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে বলা হয় সালিহ। তিন. সকল হারাম বস্তু ও সন্দেহযু্ক্ত হালাল বস্তুসমূহ হতে দূরে থাকার পর আল্লাহ্র ভয়ে অনক সন্দেহবিহীন হালাল বস্তুও পরিত্যাগ করে, এ শ্রেণীকে মুত্তাকী বলা হয় । চার. তিন শ্রেণীর তাকওয়া আয়ত্ত করার পর এমন সকল হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা যা ইবাদাতে কোনরূপ সহায়তা করে না। এ শ্রেণীর মুত্তাকীকে বলা হয় ‘সিদ্দীক’ [. ইসলামী বিশ্বকোষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮-১০৯।]।
সামাজিক জীবন দর্শনে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তাকওয়ার পোশাক যারা আচ্ছাদিত তাদের কর্তৃক কোন রকম অন্যায় ও অসৎ কাজ হতে পারে না। অশ্লীলতা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, সুদ, ঘুষ, সম্পদ লুটপাট, কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করণ, ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত-মুস্তাহাবরূপে নির্ধারিত হাক্কুল্লাহ (আল্লাহর অধিকার) ও হাক্কুল ইবাদ (মানুষের প্রতি মানুষের ও সৃষ্টিজগতের প্রতি মানুষের যাবতীয় দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ) পালন উদাসীন থাকা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থেকে মুত্তাকীগণ জীবন যাপন করে। সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার পাশাপাশি দেশ ও জাতির উন্নয়নে গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে অবদান রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহ্ তাদেরই সঙ্গে আছে যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মপরায়ন [. আল কুরআন, ১৬ : ১২৮।]।” অন্যত্র বলা হয়েছে, “আল্লাহ্ মুত্তাকীদের অভিভাবক-বন্ধু [.আল কুরআন, ৪৫ : ১৯।]।”
তাকওয়া বা আন্তরিকতাবিহীন কোন কাজই সফলতা বয়ে আনে না। যে কোন কাজের প্রাণ হল তাকওয়া। বিশেষ করে ইবাদত হিসাবে যা কিছু করা হয় তা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য তাকওয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ, “ আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের কুরবানীই গ্রহণ করে থাকে। [. আল কুরআন, ৫: ২৭।]” অন্যত্র বলা হয়েছে, “ আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এগুলোর (কুরবানীর পশুর) গোশত এবং রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া-মনের একাগ্রতা। [. আল কুরআন, ২২: ৩৭।]” মূলত তাকওয়ার গুণ অর্জনের জন্যই ইসলামের যাবতীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সালাত, সাওম, যাকাত ও হজ্জসহ সকল মৌলিক কাজ অবশ্য পালনীয় করে দেয়া হয়েছে কেবল মানুষের মধ্যে সুপ্ত তাকওয়া [. অতঃপর তিনি (আল্লাহ) উহাকে (নফ্স তথা মানুষকে) ফুজুর-অসৎকর্মের এবং তাকওয়ার-সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। আল কুরআন, ৯১ : ৮।] গুণকে সমুন্নত করার জন্য। [. দ্রষ্টব্য আল কুরআন, ২: ২-৪, ১৮৩, সূরা হাজ্জ : ৩২, সূরা তাওবা ৯ :১০৩-১০৪, তাদের (পাপীদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তাদের নয়, যারা তাকওয়া-সাবধানতা অবলম্বন করে; তবে উপদেশ দেওয়া তাদের কর্তব্য যাতে তারাও সাবধানতা অবলম্বন করে। (আল-কুরআন, ৬ : ৬৯)] যে মানুষ যতবেশী তাকওয়ার অধিকারী হবে সে জাগতিক জীবনে সমাজে ততবেশী মর্যাদা ও সম্মানের যোগ্য হবে এবং পরকালে আল্লাহর কাছে বেশী সম্মনিত হবে। [. আল কুরআন, ৪৯ : ১৩। “হযরত আবূ হুরায়রা ৯রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞাস করা হল, কোন ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মাণিত-মর্যাদাবান? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে বেশী তাকওয়ার অধীকারী আল্লাহ্র কাছে সেই বেশী সম্মানিত-।” মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল আল বুখারী, সহীহ আল বুখারী, দেওবন্দ, মাকতাবা মোস্তফাঈ, তা.বি., খণ্ড ২, পৃ. ৬৭৯।] আর কে কত বেশী মুত্তাকি তা নিয়ে আত্মপ্রশংসা করার কোন সুযোগ নেই। কেননা আল্লাহই ভাল জানেন কে কত বেশী মুত্তাকী। [.আল কুরআন, ৫৩ : ৩২।] যারা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পারেন তারা আল্লাহর ভালবাসা লাভে ধন্য হন, আল্লাহ তাদের অতিবাহিত হয় বলে পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। [. আল কুরআন, ৬৫ : ২, ৩ ও ৫] ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী (র) বলেছেন, মুত্তাকীর মর্যাদা বর্ণনায় “হুদাল লিল মুত্তাকীন” (পবিত্র কুরআন মুত্তাকীদের জন্য পথপ্রদর্শক) আয়াতাংশটি ছাড়া যদি আর একটি আয়াতও না থাকত তবে তাদের মর্যাদা বর্ণনায় এটিই যথেষ্ট ছিল। কারণ তাঁর মতে পবিত্র কুরআন মুত্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শক। অন্য আয়াতে “আল-কুরআন হুদাল লিন নাস” অর্থাৎ‘পবিত্র কুরআন মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক। [. আল কুরআন, ২ : ১৮৫।]” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি সর্বজন বিদিত যে, কুরআন যার উপর অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর আহবান ছিল বিশ্বজনীন। [. আল কুরআন, ৭ : ১৫৮; সূরা সাবা ৩৪ : ৪৮; ২১ : ১০৭।] এতে বুঝা যাচ্ছে যে, সকল মানুষই মুত্তাকী তথা সবার মধ্যেই তাকওয়া রয়েছে। যার মধ্যে তাকওয়া নেই, সে যেন মানুষই নয়। [. ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাযী, তাফসীর কবীর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৮।] যামাখশারী (র) আল্লাহর বাণী“ অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাকওয়া অবলম্বন কর এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন কর এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, যদি তোমরা মু’মিন হও [. আল কুরআন, ৮: ০১।]” এর ব্যাখ্যায় বলেন, এ আয়াতে মহান আল্লাহ্ তাকওয়া অবলম্বন, নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করাকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ ও অবিচ্ছেদ্য দাবী বলে নির্ধারণ করেছেন। [.. মাহমূদ ইবন উমার আল যামাখশারী, আল-কাশ্শাফ আন হাক্বায়িক্বি আল তানযীল ওয়া উয়ূনি আল আক্বাবীল ফী ওযূহি আল তাবীল, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃ. ১৯৫।] সুতরাং তাকওয়া ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ নয়। আল্লাহর হক ও বান্দার হক উভয়টির মহত্ব ও গুরুত্ব বুঝানোর জন্য সূরা আন- নিসার প্রথম আয়াতটি শুরু করা হয়েছে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে এবং শেষও করা হয়েছে তাকওয়ার মাধ্যমে পরস্পরিক লেন-দেন সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়ে। সুতরাং মানুষের উচিত জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া অবরম্বন করা। [. মুহাম্মদ আল আস-সাবুনী, রাওয়ায়িউল কায়ান তাফসীর আয়াত আল আহকাম নিম আল কুরআন, সৌদি আরব, খণ্ড ১. পৃ,৪১৯।]
তাকওয়ার মৌলিকত্ব বাহ্যিকতার চেয়ে ভিতরটায় সম্পৃক্ত বেশী। গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে মহান আল্লাহকে ভয় করার মানসিকতা গড়ে তোলা এবং জীবনের সকল কর্মকাণ্ড তথা ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য, ঠিক-বেঠিক, হালাল-হারাম যা-ই করুক না কেন তা লিপিবদ্ধকরার জন্য ফেরেশতা নিয়োজিত রয়েছে। ছোট-বড় কোন কিছুই তার খতিয়ানে লেখা থেকে বাদ যাচ্ছে না। এক সময় সে তার কৃত সমুদয় কর্মকান্ড স্বচক্ষে দেখতে পাবে। এই অনুভূতি নিয়ে জীবন পরিচালনা করাই হল তাকওয়ার দাবী। তাকওয়া বাহ্যিক আড়ম্বরতা ও লোকিকতার কোন স্থান নেই। “মানুষের বাহ্যিক অবয়ব এবং সম্পদের প্রতি আল্লাহ তাকান না; বরং তিনি দেখেন মানুষের কর্মকাণ্ড এবং মন-মানসিকতা। [. সহীহ মুসলিম, উদ্ধৃত-আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী শারহুস সুন্নাহ, , বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৪/১৯৯২, খণ্ড ৭, পৃ. ৩৫৪।] মানব দেহের কোন স্থানে তাকওয়ার অবস্থান সে সম্পর্কে প্রিয় নবী (সা)-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য হল “তাকওয়া এখানে এবং তিনি তাঁর বুকের দিকে ইশারা করলেন।” [. সহীহ মুসলিম, উদ্ধৃত-আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী শারহুস সুন্নাহ, প্রগুক্ত।] অর্থাৎ যে মন বা অন্তকরণ মানুষের সকল কর্মকাণ্ডের চালিকা শক্তি সেই মনের শুদ্ধতাই হচ্ছে তাকওয়া। কেননা মানব দেহের এ অংশটি সুস্থ থাকলে পুরো দেহই সুস্থ-স্বাভাবিক থাকে বলে হাদীসে প্রমাণ রয়েছে। [. দেহে কাল্ব গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা)বলেন. “দেহের মধ্যে এমন একটি মাংশপিণ্ড রয়েছে, তা যখন সুস্থ ও রোগমুক্ত থাকে, সমস্ত দেহই সুস্থ্য ও রোগ শুণ্য থাকে। আর তা যখন রোগাক্রান্ত ও বিপর্যস্থ হয়ে পড়বে তখন সমস্ত দেহটিই রোগাক্রান্ত-বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তোমরা জেনে রেখো যে, তা-ই হলো কলব (আত্ম)।” (মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল আল-বুখারী, সহীহ আল বুখারী, দেওবন্দ, মাকতাবা মুস্তফাই, তা.বি.,খণ্ড ১, পৃ. ১৩।] পরকালে মুত্তাকীগণই জান্নাত লাভে ধন্য হবেন। “মুত্তাকীগণ থাকবেন প্রস্রবণ-বহুল জান্নাত। তাঁদেরকে বলা হবে তোমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তাতে প্রবেশ কর…..”। [. আল কুরআন, ৩: ১৩৩-১৩৮; ৪ : ৭৭; ৭ :১২৮, ১৬৯; ১২ : ৫৭, ১০৯; ১৩ : ৩৫; ১৫ : ৪৫-৪৮; ১৯ : ৬৩; ৯০; ২৮ :৮৩; ৩৮ : ৪৯;৪৩ : ৩৫; ৪৪: ৫১; ৪৭ : ১৫; ৫০: ৩১-৩৫; ৫১ : ১৫-১৯; ৫২:৫৪-৫৫; ৭৭ : ৪১-৪৪; ৭৮: ৩১-৩৬।]
তাকওয়ার ব্যক্তিগত , পারিবারিক ও সমাজ জীবনে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে মানব মনে ইতিবাচক মুল্যবোধ সৃষ্টি করে এবং তাকওয়ার অভাব মানব জীবনকে অস্থির, নিরাপত্তাহীন, পঙ্কিল ও দুর্বিসহ করে তোলা। কেননা, উপর্যূক্ত আলোচনায় দেখা যায়, তাকওয়া শুধু আল্লাহ্ ভীতির মাধ্যেই সীমিত নয়; বরং সত্য সন্ধান, সত্য গ্রহণ, সত্যের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা, আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভয় করা, আল্লাহর ভয়ের ভিত্তিতে দায়িত্ব সচেতনতা ও দায়িত্ব সচেতনতার সাথে কর্তব্য সম্পাদনই হচেছ তাকওয়া। অর্থাৎ মানব জীবনের সকল কর্মকান্ড ও তৎপরতাকে আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে পরিচালনা করা, আল্লাহ্র ইচ্ছানুযায়ী সকল কাজ সম্পাদন করা, আল্লাহ্ কর্তৃক নিষিদ্ধ পথ ও পন্থা পরিহার করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সৃষ্টিকূলের কল্যাণ কামনা করা, সর্বোপরি জবাবদিহিতামূলক সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন করাই প্রকৃত তাকওয়া। তাই নানা সমস্যায় জর্জরিত মুসলিম জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাঙ্খিত কল্যাণ লাভের জন্য প্রয়োজন মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকওয়া অর্জন এবং তাকওয়ার ভিত্তিতে জীবন গঠন। আমাদের সমাজে যে দিন থেকে পূর্ণরূপ প্রকৃত তাকওয়া সৃষ্টি হবে সেদিনই এ বিশৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজে শৃঙ্খলা ফিলে আসবে এবং সমাজ হবে সুখে-শান্তিতে সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল ও প্রাণবন্ত।
তাকওয়া বা আন্তরিকতাবিহীন কোন কাজই সফলতা বয়ে আনে না। যে কোন কাজের প্রাণ হল তাকওয়া। বিশেষ করে ইবাদত হিসাবে যা কিছু করা হয় তা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য তাকওয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ, “ আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের কুরবানীই গ্রহণ করে থাকে। [. আল কুরআন, ৫: ২৭।]” অন্যত্র বলা হয়েছে, “ আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এগুলোর (কুরবানীর পশুর) গোশত এবং রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া-মনের একাগ্রতা। [. আল কুরআন, ২২: ৩৭।]” মূলত তাকওয়ার গুণ অর্জনের জন্যই ইসলামের যাবতীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সালাত, সাওম, যাকাত ও হজ্জসহ সকল মৌলিক কাজ অবশ্য পালনীয় করে দেয়া হয়েছে কেবল মানুষের মধ্যে সুপ্ত তাকওয়া [. অতঃপর তিনি (আল্লাহ) উহাকে (নফ্স তথা মানুষকে) ফুজুর-অসৎকর্মের এবং তাকওয়ার-সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। আল কুরআন, ৯১ : ৮।] গুণকে সমুন্নত করার জন্য। [. দ্রষ্টব্য আল কুরআন, ২: ২-৪, ১৮৩, সূরা হাজ্জ : ৩২, সূরা তাওবা ৯ :১০৩-১০৪, তাদের (পাপীদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তাদের নয়, যারা তাকওয়া-সাবধানতা অবলম্বন করে; তবে উপদেশ দেওয়া তাদের কর্তব্য যাতে তারাও সাবধানতা অবলম্বন করে। (আল-কুরআন, ৬ : ৬৯)] যে মানুষ যতবেশী তাকওয়ার অধিকারী হবে সে জাগতিক জীবনে সমাজে ততবেশী মর্যাদা ও সম্মানের যোগ্য হবে এবং পরকালে আল্লাহর কাছে বেশী সম্মনিত হবে। [. আল কুরআন, ৪৯ : ১৩। “হযরত আবূ হুরায়রা ৯রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞাস করা হল, কোন ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মাণিত-মর্যাদাবান? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে বেশী তাকওয়ার অধীকারী আল্লাহ্র কাছে সেই বেশী সম্মানিত-।” মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল আল বুখারী, সহীহ আল বুখারী, দেওবন্দ, মাকতাবা মোস্তফাঈ, তা.বি., খণ্ড ২, পৃ. ৬৭৯।] আর কে কত বেশী মুত্তাকি তা নিয়ে আত্মপ্রশংসা করার কোন সুযোগ নেই। কেননা আল্লাহই ভাল জানেন কে কত বেশী মুত্তাকী। [.আল কুরআন, ৫৩ : ৩২।] যারা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পারেন তারা আল্লাহর ভালবাসা লাভে ধন্য হন, আল্লাহ তাদের অতিবাহিত হয় বলে পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। [. আল কুরআন, ৬৫ : ২, ৩ ও ৫] ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী (র) বলেছেন, মুত্তাকীর মর্যাদা বর্ণনায় “হুদাল লিল মুত্তাকীন” (পবিত্র কুরআন মুত্তাকীদের জন্য পথপ্রদর্শক) আয়াতাংশটি ছাড়া যদি আর একটি আয়াতও না থাকত তবে তাদের মর্যাদা বর্ণনায় এটিই যথেষ্ট ছিল। কারণ তাঁর মতে পবিত্র কুরআন মুত্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শক। অন্য আয়াতে “আল-কুরআন হুদাল লিন নাস” অর্থাৎ‘পবিত্র কুরআন মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক। [. আল কুরআন, ২ : ১৮৫।]” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি সর্বজন বিদিত যে, কুরআন যার উপর অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর আহবান ছিল বিশ্বজনীন। [. আল কুরআন, ৭ : ১৫৮; সূরা সাবা ৩৪ : ৪৮; ২১ : ১০৭।] এতে বুঝা যাচ্ছে যে, সকল মানুষই মুত্তাকী তথা সবার মধ্যেই তাকওয়া রয়েছে। যার মধ্যে তাকওয়া নেই, সে যেন মানুষই নয়। [. ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাযী, তাফসীর কবীর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৮।] যামাখশারী (র) আল্লাহর বাণী“ অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাকওয়া অবলম্বন কর এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন কর এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, যদি তোমরা মু’মিন হও [. আল কুরআন, ৮: ০১।]” এর ব্যাখ্যায় বলেন, এ আয়াতে মহান আল্লাহ্ তাকওয়া অবলম্বন, নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করাকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ ও অবিচ্ছেদ্য দাবী বলে নির্ধারণ করেছেন। [.. মাহমূদ ইবন উমার আল যামাখশারী, আল-কাশ্শাফ আন হাক্বায়িক্বি আল তানযীল ওয়া উয়ূনি আল আক্বাবীল ফী ওযূহি আল তাবীল, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, পৃ. ১৯৫।] সুতরাং তাকওয়া ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ নয়। আল্লাহর হক ও বান্দার হক উভয়টির মহত্ব ও গুরুত্ব বুঝানোর জন্য সূরা আন- নিসার প্রথম আয়াতটি শুরু করা হয়েছে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে এবং শেষও করা হয়েছে তাকওয়ার মাধ্যমে পরস্পরিক লেন-দেন সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়ে। সুতরাং মানুষের উচিত জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া অবরম্বন করা। [. মুহাম্মদ আল আস-সাবুনী, রাওয়ায়িউল কায়ান তাফসীর আয়াত আল আহকাম নিম আল কুরআন, সৌদি আরব, খণ্ড ১. পৃ,৪১৯।]
তাকওয়ার মৌলিকত্ব বাহ্যিকতার চেয়ে ভিতরটায় সম্পৃক্ত বেশী। গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে মহান আল্লাহকে ভয় করার মানসিকতা গড়ে তোলা এবং জীবনের সকল কর্মকাণ্ড তথা ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য, ঠিক-বেঠিক, হালাল-হারাম যা-ই করুক না কেন তা লিপিবদ্ধকরার জন্য ফেরেশতা নিয়োজিত রয়েছে। ছোট-বড় কোন কিছুই তার খতিয়ানে লেখা থেকে বাদ যাচ্ছে না। এক সময় সে তার কৃত সমুদয় কর্মকান্ড স্বচক্ষে দেখতে পাবে। এই অনুভূতি নিয়ে জীবন পরিচালনা করাই হল তাকওয়ার দাবী। তাকওয়া বাহ্যিক আড়ম্বরতা ও লোকিকতার কোন স্থান নেই। “মানুষের বাহ্যিক অবয়ব এবং সম্পদের প্রতি আল্লাহ তাকান না; বরং তিনি দেখেন মানুষের কর্মকাণ্ড এবং মন-মানসিকতা। [. সহীহ মুসলিম, উদ্ধৃত-আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী শারহুস সুন্নাহ, , বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৪/১৯৯২, খণ্ড ৭, পৃ. ৩৫৪।] মানব দেহের কোন স্থানে তাকওয়ার অবস্থান সে সম্পর্কে প্রিয় নবী (সা)-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য হল “তাকওয়া এখানে এবং তিনি তাঁর বুকের দিকে ইশারা করলেন।” [. সহীহ মুসলিম, উদ্ধৃত-আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন ইবন মাসউদ আল-বগবী শারহুস সুন্নাহ, প্রগুক্ত।] অর্থাৎ যে মন বা অন্তকরণ মানুষের সকল কর্মকাণ্ডের চালিকা শক্তি সেই মনের শুদ্ধতাই হচ্ছে তাকওয়া। কেননা মানব দেহের এ অংশটি সুস্থ থাকলে পুরো দেহই সুস্থ-স্বাভাবিক থাকে বলে হাদীসে প্রমাণ রয়েছে। [. দেহে কাল্ব গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা)বলেন. “দেহের মধ্যে এমন একটি মাংশপিণ্ড রয়েছে, তা যখন সুস্থ ও রোগমুক্ত থাকে, সমস্ত দেহই সুস্থ্য ও রোগ শুণ্য থাকে। আর তা যখন রোগাক্রান্ত ও বিপর্যস্থ হয়ে পড়বে তখন সমস্ত দেহটিই রোগাক্রান্ত-বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তোমরা জেনে রেখো যে, তা-ই হলো কলব (আত্ম)।” (মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল আল-বুখারী, সহীহ আল বুখারী, দেওবন্দ, মাকতাবা মুস্তফাই, তা.বি.,খণ্ড ১, পৃ. ১৩।] পরকালে মুত্তাকীগণই জান্নাত লাভে ধন্য হবেন। “মুত্তাকীগণ থাকবেন প্রস্রবণ-বহুল জান্নাত। তাঁদেরকে বলা হবে তোমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তাতে প্রবেশ কর…..”। [. আল কুরআন, ৩: ১৩৩-১৩৮; ৪ : ৭৭; ৭ :১২৮, ১৬৯; ১২ : ৫৭, ১০৯; ১৩ : ৩৫; ১৫ : ৪৫-৪৮; ১৯ : ৬৩; ৯০; ২৮ :৮৩; ৩৮ : ৪৯;৪৩ : ৩৫; ৪৪: ৫১; ৪৭ : ১৫; ৫০: ৩১-৩৫; ৫১ : ১৫-১৯; ৫২:৫৪-৫৫; ৭৭ : ৪১-৪৪; ৭৮: ৩১-৩৬।]
তাকওয়ার ব্যক্তিগত , পারিবারিক ও সমাজ জীবনে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে মানব মনে ইতিবাচক মুল্যবোধ সৃষ্টি করে এবং তাকওয়ার অভাব মানব জীবনকে অস্থির, নিরাপত্তাহীন, পঙ্কিল ও দুর্বিসহ করে তোলা। কেননা, উপর্যূক্ত আলোচনায় দেখা যায়, তাকওয়া শুধু আল্লাহ্ ভীতির মাধ্যেই সীমিত নয়; বরং সত্য সন্ধান, সত্য গ্রহণ, সত্যের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা, আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভয় করা, আল্লাহর ভয়ের ভিত্তিতে দায়িত্ব সচেতনতা ও দায়িত্ব সচেতনতার সাথে কর্তব্য সম্পাদনই হচেছ তাকওয়া। অর্থাৎ মানব জীবনের সকল কর্মকান্ড ও তৎপরতাকে আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে পরিচালনা করা, আল্লাহ্র ইচ্ছানুযায়ী সকল কাজ সম্পাদন করা, আল্লাহ্ কর্তৃক নিষিদ্ধ পথ ও পন্থা পরিহার করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সৃষ্টিকূলের কল্যাণ কামনা করা, সর্বোপরি জবাবদিহিতামূলক সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন করাই প্রকৃত তাকওয়া। তাই নানা সমস্যায় জর্জরিত মুসলিম জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাঙ্খিত কল্যাণ লাভের জন্য প্রয়োজন মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকওয়া অর্জন এবং তাকওয়ার ভিত্তিতে জীবন গঠন। আমাদের সমাজে যে দিন থেকে পূর্ণরূপ প্রকৃত তাকওয়া সৃষ্টি হবে সেদিনই এ বিশৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজে শৃঙ্খলা ফিলে আসবে এবং সমাজ হবে সুখে-শান্তিতে সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল ও প্রাণবন্ত।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন