HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
একজন ইমামের দায়-দায়িত্ব
লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
৩
ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের শুরুতেই আসে একজন ইমামের অধ্যয়ন, মুতালায়া, ও পড়া-শোনা করার বিষয়টি; কেননা ইমাম হচ্ছেন নিদেনপক্ষে ধর্মীয় নেতা_ বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক নেতা নাই বা বললাম _ আর একজন নেতাকে তার নিজস্ব বলয়ে যথার্থ যোগ্যতার প্রমাণ রাখা খুবই জরুরি। একজন ইমামের অধ্যয়ন-পঠনের আকার প্রকৃতি কী হবে তা ইমামের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বলয় নির্ধারণের পর পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আশা রাখি। তবু এখানে, এ-সংক্রান্ত একটা প্রাথমিক ছক আঁকা যায়। আর তা হল নিম্নরূপ:
নামাজের মাসআলা-মাসায়েল বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞানার্জন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থ ও ফেকার কিতাবসমূহের সালাত অধ্যায় রপ্ত করে রাখা জরুরি। নামাজ বিষয়ক জ্ঞানের প্রবাহ ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝে এসব অধ্যায় মুতালাআ-অধ্যয়ন আবশ্যক বলে মনে করি। তাছাড়াও বিশেষভাবে রচিত নামাজ বিষয়ক গ্রন্থগুলোও সংগ্রহে রাখা প্রয়োজন।
নামাজের হুকুম আহকাম মাসায়েল বিষয়ক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ইসলামের সামগ্রিক জীবনাচার, পথ ও পদ্ধতি, বিধি-বিধান সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ অধ্যয়ন করা একজন ইমামের জন্য আবশ্যক বলে মনে করি; কেননা একজন ইমামের দায়-দায়িত্ব কেবল ইমামতিতেই শেষ হয়ে যায় না, তাকে বরং মুখোমুখি হতে হয় নানাধর্মী প্রশ্নের, যার শরিয়তসিদ্ধ উপযুক্ত সমাধান বের করা অতীব জরুরি।
ভাষাগত দক্ষতা অর্জন
ক. আরবি ভাষা : আরবি ভাষায় লিখিত কিতাবাদি বোঝার উপযোগী ভাষাগত জ্ঞান রাখা প্রত্যেক ইমামেরই কর্তব্য। কুরআন, কুরআনের তাফাসির; হাদিস, হাদিসের শুরুহাত, ফেকাহ, উসুলে ফেকাহ ইত্যাদির মৌলিক গ্রন্থগ্রলো আরবি ভাষায়। সে হিসেবে আরবি ভাষা বোঝার মতো দক্ষতা অর্জন খুবই জরুরি। অন্যথায় ইসলামি জীবনবোধের সঠিক উপস্থাপন, বিধি-বিধানের সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সর্বোপরি সঠিক অর্থে ইসলামের প্রতিনিধিত্বকরণ সম্ভব হয়ে উঠ'বে না। বাংলা অথবা ঊর্দু ভাষার আশ্রয়ে ইসলামী জবীনবোধের সঠিক ভাবোদ্ধার সবসময় নিরাপদ নয় বললে ভুল হবে না। কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের সুধারণা থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যে সবকিছুই শ ভাগ বিশুদ্ধতার সাথে বুঝতে পেরেছেন তার গ্যারান্টি আমাদেরকে কে দেবে?
খ. বাংলা ভাষা: বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা। আমাদের মুখাতাব, মুসুল্লি, শ্রোতা, পাঠক সবাই বাঙ্গালী, বাঙলা-ভাষাভাষী। তাই বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন না করলে ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস, আদর্শ, জীবনদর্শন, স্পষ্টাকারে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, তথা البلاغ المبين (আল-বালাগুল মুবিন) এর দায়িত্ব পালন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না।
শুধু তাই নয় বরং বাংলা ভাষায় সিদ্ধহস্ত না হলে إعلاء كلمة الله (এলায়ে কালেমাতুল্লাহ) এর দায়িত্ব _ অন্তত আমাদের বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে _ আঞ্জাম দেওয়া আমাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়েব। আর যেহেতু আমাদের মুহতারাম আয়েম্মাদের হাতে _ আমার ধারণা মতে_ যথেষ্ট সময় থাকে, তাই একটু গুরুত্ব দিলেই এ বিষয়টি সম্পন্ন হতে পারে বলে বিশ্বাস। উলামা মাশায়েখ ও আয়েম্মাদের জন্য বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লামা আবুলহ হাসান আলী আন নাদভী রা. এর একটি বক্তব্য নিবিষ্টচিত্তে, নতুন করে অনুধাবন করা আবশ্যক বলে মনে করি। ১৪ মার্চ ১৯৮৪ সালে জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোগঞ্জে সমবেত উলামা মাশায়েখদের উদ্দেশে তিনি বলেন:
( বাংলা ভাষাকে আপনারা অস্পৃশ্য মনে করবেন না। বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্য চর্চায় কোনো পুণ্য নেই, যত পুণ্য সব আরবি আর ঊর্দূতে, এ ধারণা বর্জন করুন। এটা নিছক মূর্খতা, নিজেদেরকে বাংলা ভাষায় বিরল প্রতিভারূপে গড়ে তুলুন। আপনাদের প্রত্যেককে হতে হবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক, সাহিত্যিক, ও বাগ্মী বক্তা। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আপনাদের থাকতে হবে দৃপ্ত পদচারণা, লেখনী হতে হবে রস-সিক্ত ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারি যেন আজকের ধর্মবিমুখ শিক্ষিত তরুণ-সমাজ ও অমুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের লেখনী ছেড়ে আপনাদের সাহিত্য কর্ম নিয়েই মেতে উঠে, বিভোর হয়ে থাকে। ) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা ২৫ ] তিনি আরো বলেন:
( দেশের ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমরা যদি উদাসীন ও নির্লিপ্ত থাকি তবে তা স্বাভাবিকভাবেই অনৈসলামিক শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ফলে যে ভাষা ও সাহিত্য হতে পারত ইসলাম প্রচারের কার্যকর মাধ্যম, তাই হয়ে দাঁড়াবে শয়তানের শক্তিশালী বাহন। ) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা ২৯]
তিনি আরো বলেন : ( আমার কথা মনে রাখবেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে। দুটি শক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। অমুসলিম শক্তির হাত থেকে এবং অনৈসলামি শক্তির হাত থেকে। আনৈসলামি শক্তি বলতে সেই সব নামধারী মুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের কথাই আমি বোঝাতে চাচ্ছি যাদের মন-মগজ এবং চিন্তা ও কর্ম ইসলামি নয়। মোট কথা, এ উভয় শক্তির হাত থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। এমন অনবদ্য সাহিত্য গড়ে তুলুন যেন অন্য দিকে কেউ আর ফিরেও না তাকায়।) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা২৭ ]
নাদভী রা. এর এ বক্তব্যের পর উলামা মাশায়েখ ও আয়েম্মাদের জন্য বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন যে কতটুকু প্রয়োজন সে ব্যাপারে নতুন কিছু বলার থাকে না।
আমল আখলাকে দৃঢ়তা আনার জন্য প্রতিদিনই তাফসিরসহ আল কুরআনুল কারিম সাধ্যমত অধ্যয়ন, রিয়াজুসসালেহীন ও অন্যান্য হাদিসগ্রন্থসমূহ থেকে প্রতিদিনই দুএকটি হাদিস অধ্যয়ন করা ইমামদের জন্য আবশ্যক বলে মনে করি।
ব্যক্তিত্বগঠন বিষয়ক নানামুখী বইপুস্তক ও গবেষণা সংগ্রহে রাখা ও অধ্যয়ন করাও ইমামদের জন্য জরুরি বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।
জীবনে সফলতা অর্জন কীভাবে সম্ভব এ বিষয়ে গবেষণাধর্মী ও উৎসাহবেঞ্জক বইপুস্তক অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ড. আয়েজ আল কারনীর ( لا تحزن (, مفتاح النجاح ) ) মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের ( زار حيات ) এবং ডেল কার্নেগির রচনাসমগ্র বিশেষভাবে অধ্যায়নের পরামর্শ দিচ্ছি।
সময় নিয়ন্ত্রণের কৌশল বিষয়ক বইপুস্তক অধ্যয়ন করা আবশ্যক; কেননা একজন ইমামের প্রতিটি মুহূর্ত সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজে ব্যয় হতে হবে। শুধু জীবিকানির্বাহ নয়, বরং ইসলাম, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য একজন ইমামকে উল্লেখযোগ্য কিছু করে যেতে হবে, যা কঠিনভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত সম্ভবপর নয়। অবশ্য এ বিষয়ে অনেকেরই উৎসাহ-আগ্রহ রয়েছে নিশ্চিতরূপেরই, তবে পথ ও পদ্ধতি না জানা থাকায় চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকেই। তাই এ বিষয়ে সহায়ক গ্রন্থসমূহের অধ্যয়ন আবশ্যক বলে মনে করি।
পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বিষয়ক সহায়ক বইপুস্তক অধ্যয়ন ইমামের জন্য জরুরি; কেননা অপরিকল্পিত জীবন ব্যর্থ হতে বাধ্য। পরিকল্পনা- সফল মানুষের আচ্ছাদন, তাই এ বিষয়টিকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতে হবে এবং সহায়ক গ্রন্থ, ট্রেনিং কোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে সফল পরিকল্পক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
বক্তৃতা কখনো কখনো যাদুর কাজ করে, হাদিসে এসেছে إن من البيان لسحرا [ হায়ছামি, মাজমাউযাওয়ায়েদ:৮/১১৯] বড় বড় আন্দোলন বক্তৃতার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে বলে একটা কথা আছে। বাস্তবতার সাক্ষীও তাই। সে হিসেবে একজন ইমামের জন্য বক্তৃতায় সিদ্ধহস্ত হওয়া খুবই জরুরি। তবে বক্তৃতার মাধ্যমে শ্রোতাকে প্রভাবিত করার জন্য সুরের মূর্ছনা প্রবাহিত করা আবশ্যক নয়, এর জন্য বরং প্রয়োজন কিছু কলাকৌশল রপ্ত করার এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করে যাওয়ার। এ ক্ষেত্রে ডেল কার্নেগির ‘ বক্তৃতা শিখবেন কীভাবে’ খুবই উপকারী একটি গ্রন্থ। বক্তৃতার কলাকৌশল শেখার পাশাপাশি কথা বলার কৌশলও ইমামদের রপ্ত করা উচিত। বর্তমানে আমাদের দেশেও এসব ব্যাপারে প্রশিক্ষণ হচ্ছে যাতে অংশ নেওয়া ইমামদের জন্য উপকারী হবে বলে বিশ্বাস।
ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ের প্রতি একজন ইমামকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে আর তা হল, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, মসজিদভিত্তিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। নিজের ছেলেমেয়ের ব্যাপারে অযত্নবান থেকে সারাক্ষণ সামাজিক ও দাওয়াতি কার্যক্রমে নিজেকে নিবিষ্ট রাখা যেমন উচিত নয়, তেমনি নিজের পরিবার ও সন্তানকে ঘিরেই সকল দৌড়ঝাঁপ সম্পন্ন করাও উচিত নয়। ইমামকে বরং, এ ক্ষেত্রে, ভারসাম্য রক্ষা করে সকল ক্ষেত্রে সমান সফলতার ছাপ রাখতে হবে।
সামাজিক ক্ষেত্রে ইমামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা ইমামের সামনে প্রায়শঃ হাজির করা হয়। তাই সমাজ ও সামাজিক সমস্যা বিষয়ে একজন ইমামের যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান থাকা জরুরি। ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি সকল সমস্যার জন্য দায়ী, এ কথা যেমন শতভাগ সত্য, তদ্রুপভাবে এটাও সত্য যে আধুনিক সমাজের গতিপ্রকৃতি, অবকাঠামো, সামাজিক সম্পর্কের জটিলতা, আকার প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা অর্জিত না হলে ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে একটি সুস্থ সমাজের বিনির্মাণ কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন, কেবল একটি দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে। এমনকী মসজিদের আওতাধীন সমাজভুক্ত মানুষদের সমস্যাগুলো যথার্থরূপে নিরীক্ষণ করাও অনেকটা কঠিন হবে বই কি। তাই একজন ইমামের সমাজবিজ্ঞান বিষয়েও যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান অর্জন জরুরি বলে মনে করি।
ইমাম যেহেতু ইসলাহি ও দাওয়াতি কাজের সাথে জড়িত থাকেন, তাই মানুষের মনমানসিকতা বোঝা, এবং সে অনুসারে প্রতিটি মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপসমূহ নির্ধারণের তাগিদে প্রত্যেক ইমামের জন্য মনোবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন ও কমপক্ষে প্রাথমিক কিছু ধারণা অর্জন আবশ্যক বলে মনে করি।
যুগের ভাষায় ইসলামি মূল্যবোধের নবতর উপস্থাপনের প্রয়োজনে আয়েম্মায়ে কেরামদেরকে আরো যেসব বিষয় অধ্যয়ন-মুতালাআর আওতায় আনতে হবে এবং নিদেনপক্ষে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করতে হবে তা হল: আধুনিক তর্কশাস্ত্র, আধুনিক দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান, সাংবাদিকতা, প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞান, এডুকেশনাল সাইন্স, জীব বিজ্ঞান, সৌর বিজ্ঞান, বংশানুগতি বিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান, অর্থনীতি বিজ্ঞান ইত্যাদি।
নামাজের মাসআলা-মাসায়েল বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞানার্জন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থ ও ফেকার কিতাবসমূহের সালাত অধ্যায় রপ্ত করে রাখা জরুরি। নামাজ বিষয়ক জ্ঞানের প্রবাহ ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝে এসব অধ্যায় মুতালাআ-অধ্যয়ন আবশ্যক বলে মনে করি। তাছাড়াও বিশেষভাবে রচিত নামাজ বিষয়ক গ্রন্থগুলোও সংগ্রহে রাখা প্রয়োজন।
নামাজের হুকুম আহকাম মাসায়েল বিষয়ক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ইসলামের সামগ্রিক জীবনাচার, পথ ও পদ্ধতি, বিধি-বিধান সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ অধ্যয়ন করা একজন ইমামের জন্য আবশ্যক বলে মনে করি; কেননা একজন ইমামের দায়-দায়িত্ব কেবল ইমামতিতেই শেষ হয়ে যায় না, তাকে বরং মুখোমুখি হতে হয় নানাধর্মী প্রশ্নের, যার শরিয়তসিদ্ধ উপযুক্ত সমাধান বের করা অতীব জরুরি।
ভাষাগত দক্ষতা অর্জন
ক. আরবি ভাষা : আরবি ভাষায় লিখিত কিতাবাদি বোঝার উপযোগী ভাষাগত জ্ঞান রাখা প্রত্যেক ইমামেরই কর্তব্য। কুরআন, কুরআনের তাফাসির; হাদিস, হাদিসের শুরুহাত, ফেকাহ, উসুলে ফেকাহ ইত্যাদির মৌলিক গ্রন্থগ্রলো আরবি ভাষায়। সে হিসেবে আরবি ভাষা বোঝার মতো দক্ষতা অর্জন খুবই জরুরি। অন্যথায় ইসলামি জীবনবোধের সঠিক উপস্থাপন, বিধি-বিধানের সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সর্বোপরি সঠিক অর্থে ইসলামের প্রতিনিধিত্বকরণ সম্ভব হয়ে উঠ'বে না। বাংলা অথবা ঊর্দু ভাষার আশ্রয়ে ইসলামী জবীনবোধের সঠিক ভাবোদ্ধার সবসময় নিরাপদ নয় বললে ভুল হবে না। কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের সুধারণা থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যে সবকিছুই শ ভাগ বিশুদ্ধতার সাথে বুঝতে পেরেছেন তার গ্যারান্টি আমাদেরকে কে দেবে?
খ. বাংলা ভাষা: বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা। আমাদের মুখাতাব, মুসুল্লি, শ্রোতা, পাঠক সবাই বাঙ্গালী, বাঙলা-ভাষাভাষী। তাই বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন না করলে ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস, আদর্শ, জীবনদর্শন, স্পষ্টাকারে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, তথা البلاغ المبين (আল-বালাগুল মুবিন) এর দায়িত্ব পালন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না।
শুধু তাই নয় বরং বাংলা ভাষায় সিদ্ধহস্ত না হলে إعلاء كلمة الله (এলায়ে কালেমাতুল্লাহ) এর দায়িত্ব _ অন্তত আমাদের বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে _ আঞ্জাম দেওয়া আমাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়েব। আর যেহেতু আমাদের মুহতারাম আয়েম্মাদের হাতে _ আমার ধারণা মতে_ যথেষ্ট সময় থাকে, তাই একটু গুরুত্ব দিলেই এ বিষয়টি সম্পন্ন হতে পারে বলে বিশ্বাস। উলামা মাশায়েখ ও আয়েম্মাদের জন্য বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লামা আবুলহ হাসান আলী আন নাদভী রা. এর একটি বক্তব্য নিবিষ্টচিত্তে, নতুন করে অনুধাবন করা আবশ্যক বলে মনে করি। ১৪ মার্চ ১৯৮৪ সালে জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোগঞ্জে সমবেত উলামা মাশায়েখদের উদ্দেশে তিনি বলেন:
( বাংলা ভাষাকে আপনারা অস্পৃশ্য মনে করবেন না। বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্য চর্চায় কোনো পুণ্য নেই, যত পুণ্য সব আরবি আর ঊর্দূতে, এ ধারণা বর্জন করুন। এটা নিছক মূর্খতা, নিজেদেরকে বাংলা ভাষায় বিরল প্রতিভারূপে গড়ে তুলুন। আপনাদের প্রত্যেককে হতে হবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক, সাহিত্যিক, ও বাগ্মী বক্তা। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আপনাদের থাকতে হবে দৃপ্ত পদচারণা, লেখনী হতে হবে রস-সিক্ত ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারি যেন আজকের ধর্মবিমুখ শিক্ষিত তরুণ-সমাজ ও অমুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের লেখনী ছেড়ে আপনাদের সাহিত্য কর্ম নিয়েই মেতে উঠে, বিভোর হয়ে থাকে। ) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা ২৫ ] তিনি আরো বলেন:
( দেশের ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমরা যদি উদাসীন ও নির্লিপ্ত থাকি তবে তা স্বাভাবিকভাবেই অনৈসলামিক শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ফলে যে ভাষা ও সাহিত্য হতে পারত ইসলাম প্রচারের কার্যকর মাধ্যম, তাই হয়ে দাঁড়াবে শয়তানের শক্তিশালী বাহন। ) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা ২৯]
তিনি আরো বলেন : ( আমার কথা মনে রাখবেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে। দুটি শক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। অমুসলিম শক্তির হাত থেকে এবং অনৈসলামি শক্তির হাত থেকে। আনৈসলামি শক্তি বলতে সেই সব নামধারী মুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের কথাই আমি বোঝাতে চাচ্ছি যাদের মন-মগজ এবং চিন্তা ও কর্ম ইসলামি নয়। মোট কথা, এ উভয় শক্তির হাত থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। এমন অনবদ্য সাহিত্য গড়ে তুলুন যেন অন্য দিকে কেউ আর ফিরেও না তাকায়।) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা২৭ ]
নাদভী রা. এর এ বক্তব্যের পর উলামা মাশায়েখ ও আয়েম্মাদের জন্য বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন যে কতটুকু প্রয়োজন সে ব্যাপারে নতুন কিছু বলার থাকে না।
আমল আখলাকে দৃঢ়তা আনার জন্য প্রতিদিনই তাফসিরসহ আল কুরআনুল কারিম সাধ্যমত অধ্যয়ন, রিয়াজুসসালেহীন ও অন্যান্য হাদিসগ্রন্থসমূহ থেকে প্রতিদিনই দুএকটি হাদিস অধ্যয়ন করা ইমামদের জন্য আবশ্যক বলে মনে করি।
ব্যক্তিত্বগঠন বিষয়ক নানামুখী বইপুস্তক ও গবেষণা সংগ্রহে রাখা ও অধ্যয়ন করাও ইমামদের জন্য জরুরি বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।
জীবনে সফলতা অর্জন কীভাবে সম্ভব এ বিষয়ে গবেষণাধর্মী ও উৎসাহবেঞ্জক বইপুস্তক অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ড. আয়েজ আল কারনীর ( لا تحزن (, مفتاح النجاح ) ) মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের ( زار حيات ) এবং ডেল কার্নেগির রচনাসমগ্র বিশেষভাবে অধ্যায়নের পরামর্শ দিচ্ছি।
সময় নিয়ন্ত্রণের কৌশল বিষয়ক বইপুস্তক অধ্যয়ন করা আবশ্যক; কেননা একজন ইমামের প্রতিটি মুহূর্ত সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজে ব্যয় হতে হবে। শুধু জীবিকানির্বাহ নয়, বরং ইসলাম, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য একজন ইমামকে উল্লেখযোগ্য কিছু করে যেতে হবে, যা কঠিনভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত সম্ভবপর নয়। অবশ্য এ বিষয়ে অনেকেরই উৎসাহ-আগ্রহ রয়েছে নিশ্চিতরূপেরই, তবে পথ ও পদ্ধতি না জানা থাকায় চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকেই। তাই এ বিষয়ে সহায়ক গ্রন্থসমূহের অধ্যয়ন আবশ্যক বলে মনে করি।
পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বিষয়ক সহায়ক বইপুস্তক অধ্যয়ন ইমামের জন্য জরুরি; কেননা অপরিকল্পিত জীবন ব্যর্থ হতে বাধ্য। পরিকল্পনা- সফল মানুষের আচ্ছাদন, তাই এ বিষয়টিকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতে হবে এবং সহায়ক গ্রন্থ, ট্রেনিং কোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে সফল পরিকল্পক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
বক্তৃতা কখনো কখনো যাদুর কাজ করে, হাদিসে এসেছে إن من البيان لسحرا [ হায়ছামি, মাজমাউযাওয়ায়েদ:৮/১১৯] বড় বড় আন্দোলন বক্তৃতার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে বলে একটা কথা আছে। বাস্তবতার সাক্ষীও তাই। সে হিসেবে একজন ইমামের জন্য বক্তৃতায় সিদ্ধহস্ত হওয়া খুবই জরুরি। তবে বক্তৃতার মাধ্যমে শ্রোতাকে প্রভাবিত করার জন্য সুরের মূর্ছনা প্রবাহিত করা আবশ্যক নয়, এর জন্য বরং প্রয়োজন কিছু কলাকৌশল রপ্ত করার এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করে যাওয়ার। এ ক্ষেত্রে ডেল কার্নেগির ‘ বক্তৃতা শিখবেন কীভাবে’ খুবই উপকারী একটি গ্রন্থ। বক্তৃতার কলাকৌশল শেখার পাশাপাশি কথা বলার কৌশলও ইমামদের রপ্ত করা উচিত। বর্তমানে আমাদের দেশেও এসব ব্যাপারে প্রশিক্ষণ হচ্ছে যাতে অংশ নেওয়া ইমামদের জন্য উপকারী হবে বলে বিশ্বাস।
ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ের প্রতি একজন ইমামকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে আর তা হল, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, মসজিদভিত্তিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। নিজের ছেলেমেয়ের ব্যাপারে অযত্নবান থেকে সারাক্ষণ সামাজিক ও দাওয়াতি কার্যক্রমে নিজেকে নিবিষ্ট রাখা যেমন উচিত নয়, তেমনি নিজের পরিবার ও সন্তানকে ঘিরেই সকল দৌড়ঝাঁপ সম্পন্ন করাও উচিত নয়। ইমামকে বরং, এ ক্ষেত্রে, ভারসাম্য রক্ষা করে সকল ক্ষেত্রে সমান সফলতার ছাপ রাখতে হবে।
সামাজিক ক্ষেত্রে ইমামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা ইমামের সামনে প্রায়শঃ হাজির করা হয়। তাই সমাজ ও সামাজিক সমস্যা বিষয়ে একজন ইমামের যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান থাকা জরুরি। ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি সকল সমস্যার জন্য দায়ী, এ কথা যেমন শতভাগ সত্য, তদ্রুপভাবে এটাও সত্য যে আধুনিক সমাজের গতিপ্রকৃতি, অবকাঠামো, সামাজিক সম্পর্কের জটিলতা, আকার প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা অর্জিত না হলে ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে একটি সুস্থ সমাজের বিনির্মাণ কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন, কেবল একটি দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে। এমনকী মসজিদের আওতাধীন সমাজভুক্ত মানুষদের সমস্যাগুলো যথার্থরূপে নিরীক্ষণ করাও অনেকটা কঠিন হবে বই কি। তাই একজন ইমামের সমাজবিজ্ঞান বিষয়েও যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান অর্জন জরুরি বলে মনে করি।
ইমাম যেহেতু ইসলাহি ও দাওয়াতি কাজের সাথে জড়িত থাকেন, তাই মানুষের মনমানসিকতা বোঝা, এবং সে অনুসারে প্রতিটি মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপসমূহ নির্ধারণের তাগিদে প্রত্যেক ইমামের জন্য মনোবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন ও কমপক্ষে প্রাথমিক কিছু ধারণা অর্জন আবশ্যক বলে মনে করি।
যুগের ভাষায় ইসলামি মূল্যবোধের নবতর উপস্থাপনের প্রয়োজনে আয়েম্মায়ে কেরামদেরকে আরো যেসব বিষয় অধ্যয়ন-মুতালাআর আওতায় আনতে হবে এবং নিদেনপক্ষে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করতে হবে তা হল: আধুনিক তর্কশাস্ত্র, আধুনিক দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান, সাংবাদিকতা, প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞান, এডুকেশনাল সাইন্স, জীব বিজ্ঞান, সৌর বিজ্ঞান, বংশানুগতি বিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান, অর্থনীতি বিজ্ঞান ইত্যাদি।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন