আবদুল্লাহ্ ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি বহুদিন ধরে উৎসুক ছিলাম যে, আমি ‘উমার ইব্নু খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করব, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিবিগণের মধ্যে কোন্ দু’জন সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেছেনঃ “তোমরা দু’জন যদি আল্লাহ্র নিকট তাওবাহ কর (তবে এটা উত্তম) কেননা, তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে।” এরপর একবার তিনি [‘উমার (রাঃ)] হাজ্জের জন্য রওয়ানা হলেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে হাজ্জে গেলাম। (ফিরে আসার পথে) তিনি ইস্তিনজার জন্য রাস্তা থেকে সরে গেলেন। আমি পানি পূর্ণ পাত্র হাতে তাঁর সাথে গেলাম। তিনি ইস্তিনজা করে ফিরে এলে আমি ওযূর পানি তাঁর হাতে ঢেলে দিতে লাগলাম। তিনি যখন ওযূ করছিলেন, তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আমীরুল মু’মিনীন! নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহধর্মিণীগণের মধ্যে কোন্ দু’জন, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেনঃ “তোমরা দু’জন যদি আল্লাহ্র কাছে তাওবাহ কর (তবে তোমাদের জন্য উত্তম), কেননা, তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে।” জবাবে তিনি বললেন, হে ইব্নু ‘আব্বাস! আমি তোমার প্রশ্ন শুনে অবাক হচ্ছি। তাঁরা দুজন তো ‘আয়িশাহ (রাঃ) ও হাফসাহ (রাঃ)। এরপর ‘উমার (রাঃ) এ ঘটনাটি বর্ণনা করলেন, “আমি এবং আমার একজন আনসারী প্রতিবেশি যিনি উমাইয়াহ ইব্নু যায়দ গোত্রের লোক এবং তারা মাদীনাহর উপকন্ঠে বসবাস করত। আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গে পালাক্রমে সাক্ষাত করতাম। সে একদিন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে যেত, আমি আর একদিন যেতাম। যখন আমি দরবারে যেতাম, ঐ দিন দরবারে ওয়াহী অবতীর্ণসহ যা ঘটত সবকিছুর খবর আমি তাকে দিতাম এবং সেও অনুরূপ খবর আমাকে দিত। আমরা কুরাইশরা নিজেদের স্ত্রীগণের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা যখন আনসারদের মধ্যে এলাম, তখন দেখতে পেলাম, তাদের স্ত্রীগণ তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করে চলেছে। সুতরাং আমাদের স্ত্রীরাও তাদের দেখাদেখি সেরূপ ব্যবহার করতে লাগল। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি নারাজ হলাম এবং তাকে উচ্চঃস্বরে কিছু বললাম, সেও প্রতি-উত্তর দিল। আমার কাছে এ রকম প্রতি-উত্তর দেয়াটা অপছন্দ হল। সে বলল, আমি আপনার কথার পাল্টা উত্তর দিচ্ছি এতে অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহ্র কসম, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিবিগণ তাঁর কথার মুখে মুখে পাল্টা উত্তর দিয়ে থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার একদিন এক রাত পর্যন্ত কথা না বলে কাটান। [‘উমার (রাঃ) বলেন], এ কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম এবং আমি বললাম, তাদের মধ্যে যারা এরূপ করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি আমার কাপড় পরিধান করলাম এবং আমার কন্যা হাফসাহর ঘরে প্রবেশ করলাম এবং বললামঃ হাফ্সা! তোমাদের মধ্য থেকে কারো প্রতি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি সারা দিন রাত পর্যন্ত অসন্তুষ্ট থাকেননি? সে উত্তর করল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। তোমরা কি এ ব্যাপারে ভীত হচ্ছো না যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হয়ে যাবেন? পরিণামে তোমরা ধ্বংসের মধ্যে পড়ে যাবে। সুতরাং তুমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে অতিরিক্ত কোন জিনিস দাবি করবে না এবং তাঁর কথার প্রতি-উত্তর করবে না এবং তাঁর সাথে কথা বলা বন্ধ করবে না। তোমার যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমার কাছে চেয়ে নেবে। আর তোমার সতীন তোমার চেয়ে অধিক রূপবতী এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অধিক প্রিয়- তা যেন তোমাকে বিভ্রান্ত না করে। এখানে সতীন বলতে ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে বোঝানো হয়েছে। ‘উমার (রাঃ) আরো বলেন, এ সময় আমাদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাস্সানের শাসনকর্তা আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবার উদ্দেশ্যে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রস্তুত করছে। আমার প্রতিবেশি আনসার তার পালার দিন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমত থেকে রাতে ফিরে এসে আমার দরজায় খুব জোরে করাঘাত করল এবং জিজ্ঞেস করল, আমি ঘরে আছি কিনা? আমি শংকিত অবস্থায় বেরিয়ে এলাম। সে বলল, আজ এক বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, সেটা কী? গাস্সানিরা কি এসে গেছে? সে বলল, না তার চেয়েও বড় ঘটনা এবং তা ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সহধর্মিণীগণকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন। আমি বললাম, হাফ্সা তো ধ্বংস হয়ে গেল, ব্যর্থ হলো। আমি আগেই ধারণা করেছিলাম, খুব শীগগীরই এরকম একটা কিছু ঘটবে। এরপর আমি পোশাক পরিধান করলাম এবং ফজরের সালাত নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে আদায় করলাম। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওপরের কামরায় (মাশরুবা) একাকী আরোহণ করলেন, আমি তখন হাফ্সার কাছে গেলাম এবং তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে এ ব্যাপারে পূর্বেই সতর্ক করে দেইনি? নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তোমাদের সকলকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন? সে বলল, আমি জানি না। তিনি ওখানে ওপরের কামরায় একাকী রয়েছেন। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মিম্বরের কাছে বসলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বসা ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই কাঁদছিল। আমি তাদের কাছে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমি এ অবস্থা সহ্য করতে পারছিলাম না। সুতরাং যে ওপরের কামরায় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থান করছিলেন আমি সেই ওপরের কামরায় গেলাম এবং তাঁর হাবশী কালো খাদিমকে বললাম, তুমি কি উমারের জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে যাবার অনুমতি এনে দেবে? খাদিমটি গেল এবং নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কথা বলল। ফিরে এসে উত্তর করল, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আপনার কথা বলেছি; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। তখন আমি ফিরে এলাম এবং যেখানে লোকজন বসা ছিল সেখানে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। তাই আবার এসে খাদেমকে বললাম! তুমি কি উমরের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে প্রবেশ করল এবং ফিরে এসে বলল, আপনার কথা বলেছি কিন্তু নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চুপ থেকেছেন। তাই আমি আবার ফিরে এসে মিম্বরের কাছে ঐ লোকজনের সাথে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। পুনরায় আমি খাদেমের কাছে গেলাম এবং বললাম, তুমি কি উমারের জন্য অনুমতি এনে দেবে? সে গেল এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে লাগল, আমি আপনার কথা উল্লেখ করলাম; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। যখন আমি ফিরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছি, এমন সময় খাদিমটি আমাকে ডেকে বলল, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি খেজুরের চাটাইর ওপর চাদরবিহীন অবস্থায় খেজুরের পাতা ভর্তি একটি বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরে পরিষ্কার চাটাইয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমি তাঁকে সালাম করলাম এবং দাঁড়ানো অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি কি আপনার বিবিগণকে ত্বলাক্ব দিয়েছেন? তিনি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না (অর্থাৎ ত্বলাক্ব দেইনি)। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার। এরপর আলাপটা নমনীয় করার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে থেকেই বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি যদি শোনেন তাহলে বলিঃ আমরা কুরাইশগণ, মহিলাদের ওপর আমাদের প্রতিপত্তি খাটাতাম; কিন্তু আমরা মাদীনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের ওপর নারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান। এ কথা শুনে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুচকি হাসলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! যদি আপনি আমার কথার দিকে একটু নজর দেন। আমি হাফ্সার কাছে গেলাম এবং আমি তাকে বললাম, তোমার সতীনের রূপবতী হওয়া ও রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রিয় পাত্রী হওয়া তোমাকে যেন ধোঁকায় না ফেলে। এর দ্বারা ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুনরায় মুচকি হাসলেন। আমি তাঁকে হাসতে দেখে বসে পড়লাম। এরপর আমি তাঁর ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আল্লাহ্র কসম, শুধুমাত্র তিনটি চামড়া ব্যতীত আর আমি তাঁর ঘরে উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখতে পেলাম না। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা‘আলা যাতে আপনার উম্মাতদের সচ্ছলতা দান করেন। কেননা, পারস্য ও রোমানদের প্রাচুর্য দান করা হয়েছে এবং তাদের দুনিয়ার আরাম প্রচুর পরিমাণে দান করা হয়েছে; অথচ তারা আল্লাহ্র ‘ইবাদাত করে না। এ কথা শুনে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সোজা হয়ে বসে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এখনো এ ধারণা পোষণ করছ? ওরা ঐ লোক, যারা উত্তম কাজের প্রতিদান এ দুনিয়ায় পাচ্ছে! আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল, আমার ক্ষমার জন্য আল্লাহ্র কাছে দোয়া করুন। হাফ্সা (রাঃ) কর্তৃক ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঊনত্রিশ দিন তাঁর বিবিগণ থেকে আলাদা থাকেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, আমি এক মাসের মধ্যে তাদের কাছে যাব না তাদের প্রতি গোস্বার কারণে। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। সুতরাং যখন ঊনত্রিশ দিন হয়ে গেল, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বপ্রথম ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাঁকে দিয়েই শুরু করলেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি কসম করেছেন যে, একমাসের মধ্যে আমাদের কাছে আসবেন না; কিন্তু এখন তো ঊনত্রিশ দিনেই এসে গেলেন। আমি প্রতিটি দিন এক এক করে হিসাব করে রেখেছি। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ঊনত্রিশ দিনেও একমাস হয়। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, এ মাস ২৯ দিনের। ‘আয়িশাহ (রাঃ) আরও বলেন, ঐ সময় আল্লাহ্ তা‘আলা ইখতিয়ারের (সূরা আহযাবের ২৮নং) আয়াত নাযিল করেন এবং তিনি তাঁর বিবিগণের মধ্যে আমাকে দিয়েই শুরু করেন এবং আমি তাঁকেই গ্রহণ করি। এরপর তিনি অন্য বিবিগণের অভিমত চাইলেন। সকলেই তাই বলল, যা ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছিলেন। (বুখারী পর্ব ৬৭ : /৮৩, হাঃ ৫১৯১; মুসলিম ১৮/৫, হাঃ ১৪৭৯)