মিসওয়ার বিন মাখরামাহ ও মারওয়ান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তারা উভয়েই একজন অন্যজনের হাদীছকে সত্যায়ন করেছেন। তারা উভয়েই বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হুদায়বিয়ার বছর মদীনা হতে বের হলেন। কিছু দূর অগ্রসর হয়ে তিনি বললেনঃ খালেদ বিন ওয়ালীদ কুরাইশদের অশ্বারোহী বাহিনীসহ গামীম নামক স্থানে অবস্থান করছে। কাজেই তোমরা ডান দিকের পথে চল। আল্লাহর শপথ! খালেদ মুসলিম বাহিনীর উপস্থিতি টের পেলনা যতক্ষণ না সে মুসলিম বাহিনীর পদধুলি উড়তে দেখল। সুতরাং কুরাইশদেরকে সতর্ক করার জন্য সে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। কিন্তু নবী (ﷺ) চলতে থাকলেন। তিনি যখন ছানিয়ায় পৌঁছলেন তখন তাঁকে নিয়ে তাঁর উষ্ট্রী বসে পড়ল। লোকেরা উষ্ট্রীকে চালাবার জন্য হাল হাল বলতে লাগল। কিন্তু সকল চেষ্টাই বৃথা গেল। পরিশেষে লোকেরা বলতে লাগলঃ কাসওয়া অবাধ্য হয়ে গেছে। কাসওয়া অবাধ্য হয়ে গেছে। নবী (ﷺ) বললেনঃ কাসওয়া অবাধ্য হয়নি এবং অবাধ্য হওয়া তার স্বভাবও নয় বরং; তাকে তিনিই বসিয়েছেন যিনি হাতীকে বসিয়েছিলেন। তারপর তিনি বললেনঃ সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে কুরাইশরা যদি আল্লাহর পক্ষ হতে সম্মানপ্রাপ্ত কোন জিনিষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাহলে আমি তা অবশ্যই মেনে নিব।
অতঃপর তিনি কাসওয়াকে ধমক দিলেন। সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে চলতে লাগল। বর্ণনাকারী বলেনঃ অতঃপর নবী (ﷺ) পথ পরিবর্তন করে চলতে লাগলেন। পরিশেষে তিনি হুদায়বিয়ার শেষ প্রান্তে গর্তের নিকট অবতরণ করলেন। তাতে ছিল সামান্য পানি। লোকেরা তা থেকে অল্প অল্প করে পানি নিচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে পানি শেষ হয়ে গেল। তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট পিপাসার অভিযোগ করল। তিনি তখন তার তীরের থলে থেকে একটি তীর বের করলেন এবং লোকদেরকে এটি পানিতে পুঁতে দেয়ার আদেশ দিলেন। আল্লাহর শপথ! তীরটি পুঁতে দেয়ার সাথে সাথে পানি উপছে উঠল। এমনকি তারা সবাই তৃপ্তি সহকারে পান করল। এমন সময় বুদাইল বিন ওরকা তার গোত্র খুযাআর কিছু লোকসহ উপস্থিত হল। তারা ছিল তিহামা অঞ্চলে বসবাসকারী এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শুভাকাঙ্খী। বুদাইল বললঃ আমি কা'ব বিন লুআই এবং আমের বিন লুআইকে হুদায়বিয়ার গভীর ঝরণার নিকট দেখে এসেছি। তারা সেখানে অবস্থান করছে। তাদের সাথে রয়েছে দুগ্ধবতী উষ্ট্রী। তারা আপনার সাথে যুদ্ধ করবে এবং আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করতে বাধা দিবে।
নবী (ﷺ) বললেনঃ আমরা কারো সাথে যুদ্ধ করার জন্য আসিনি। বরং; আমরা উমরাহ পালন করতে এসেছি। তবে কুরাইশদেরকে যুদ্ধ দুর্বল করে ফেলেছে এবং তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছে। তারা যদি চায় তাহলে আমি তাদের সাথে কিছু দিনের জন্য সন্ধি চুক্তি করতে চাই। এই সময়ের মধ্যে তারা আমাদের ও আরবের সাধারণ লোকদের মধ্যে কোন রূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হতে বিরত থাকবে। আমি যদি বিজয়ী হই তাহলে কুরাইশরা চাইলে অন্যান্য লোকদের মত তারা আমার ধর্মে প্রবেশ করতে পারে। আর যদি তারা তা না চায় তাহলে তারা কিছুদিন বিশ্রাম গ্রহণ করুক। তারা যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে আল্লাহর পথে শহীদ না হওয়া পর্যন্ত আমি এই দ্বীনের জন্য লড়াই করতে থাকব। আর আল্লাহ অবশ্যই তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। বুদাইল বললঃ আমি তাদেরকে আপনার কথা জানিয়ে দিব। রাবী বলেনঃ বুদাইল রওয়ানা হল এবং কুরাইশদের নিকট গিয়ে বললঃ আমরা এই লোকটির নিকট হতে এসেছি এবং তাকে কিছু কথা বলতে শুনেছি। তোমরা যদি চাও তাহলে কথাটি তোমাদেরকে শুনাব। এ কথা শুনে তাদের কতিপয় নির্বোধ লোক বললঃ তার সম্পর্কে আমাদেরকে কোন সংবাদ দেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে তাদের জ্ঞানী লোকগণ বললঃ তাকে যা বলতে শুনেছ তা আমাদেরকে শুনাও। সে বললঃ আমি তাকে এই এই কথা বলতে শুনেছি।
মোটকথা সে নবী (ﷺ) কে যা বলতে শুনেছে তার পুরো বর্ণনা দিল। তারপর উরওয়া বিন মাসউদ দাঁড়িয়ে বললঃ হে লোক সকল! তোমরা কি আমার সন্তান সমতুল্য নও? তারা বললঃ হ্যাঁ। আবার সে বললঃ আমি কি তোমাদের পিতার সমতুল্য নই? তারা বললঃ হ্যাঁ। সে পুনরায় বললঃ তোমরা কি আমাকে কোন বিষয়ে অপবাদ দিয়েছ? (তোমরা কি আমাকে অবিশ্বাস কর?) তারা সকলেই বললঃ না। সে আবার বললঃ তোমরা কি জাননা, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করার জন্য উকাযবাসীকে ডেকেছিলাম? তারা যখন আসতে অস্বীকার করল আমি কি তখন আমার অনুগত ব্যক্তি, সন্তান ও আত্মীয়দেরকে নিয়ে তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসি নি? তারা বললঃ হ্যাঁ। উরওয়া বললঃ এই ব্যক্তি তোমাদের জন্য একটি সুন্দর প্রস্তাব পেশ করেছে। তোমরা তা গ্রহণ করে নাও। আমাকে অনুমতি দাও। আমি তার কাছে যাই। তারা বললঃ তুমি যাও।
উরওয়া নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে কথা বলতে লাগল। নবী (ﷺ) বুদাইলকে যে ধরণের কথা বলেছিলেন তাকেও অনুরূপ কথা বললেন। উরওয়া তখন বললঃ হে মুহাম্মাদ! আপনার সম্প্রদায়ের মূলৎপাটনে আপনার লাভ কী? আপনি কি আপনার পূর্বে কোন আরব কর্তৃক তার সম্প্রদায়ের মূলৎপাটনের কথা শুনেছেন? আর যদি এর বিপরীত হয় অর্থাৎ আপনার পতন হয় তাহলে আল্লাহর শপথ! আমি আপনার সাথীদের মধ্যে কোন সম্ভ্রান্ত লোক দেখতে পাচ্ছিনা, বরং বিভিন্ন লোক জড়ো হয়েছে যারা আপনাকে নিঃসঙ্গ ফেলে রেখে পালিয়ে যাবে। আবু বকর (রাঃ) তখন বললেনঃ লাত দেবীর (মূর্তির) গুহ্যদ্বার চাঁটগে। আমরা আল্লাহর রাসূলকে ছেড়ে পলায়ন করব? উরওয়া বললঃ এই লোকটি কে? লোকেরা বললঃ আবু বকর। উরওয়া বললঃ ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! আপনি যদি আমার এমন একটি উপকার না করতেন যার বিনিময় এখনও দিতে পারি নি তাহলে আপনার কথার কঠোর উত্তর দিতাম। বর্ণনাকারী বলেনঃ অতঃপর উরওয়া নবী (ﷺ)-এর সাথে কথা বলতে লাগল।
উরওয়া নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে কথা বলার সময় তাঁর দাড়িতে হাত দিত। মুগীরা বিন শু'বা নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাথার নিকট দাঁড়িয়েছিলেন। তার হাতে ছিল তরবারি এবং মাথায় ছিল লৌহবর্ম। উরওয়া নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দাড়ির দিকে হাত বাড়ালে মুগীরা (রাঃ) তরবারির বাট দিয়ে তার হাতে আঘাত করতেন এবং বলতেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দাড়ি থেকে হাত সরিয়ে নাও। উরওয়া মাথা উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ লোকটি কে? তারা বললঃ মুগীরা বিন শু'বা। সে বললঃ ও হে ধোকাবাজ! আমি কি তোমার ধোকাবাজির শাস্তি থেকে তোমাকে রক্ষা করিনি? ঘটনার বিবরণ এই যে, মুগীরা জাহেলী যামানায় এক দল লোকের সাথে সফরে বের হয়েছিলেন। পথিমধ্যে তিনি তার সাথীদেরকে হত্যা করে তাদের মাল ছিনিয়ে নেন। (এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝগড়ার সূচনা হলে উরওয়া বিন মাসউদের প্রচেষ্টায় তা মীমাংসা হয়) পরবর্তীতে মুগীরা মদীনায় আগমণ করে ইসলাম গ্রহণ করেন।
অতঃপর নবী (ﷺ) বললেনঃ তোমার ইসলাম আমার নিকট গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তোমার মালের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। অতঃপর উরওয়া বাঁকা দৃষ্টিতে রাসূল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীদের দিকে দৃষ্টি দিতে থাকল। রাবী বলেনঃ আল্লাহর শপথ! রাসূল (ﷺ) থুথু ফেললে তা কোন না কোন সাহাবীর হাতে পড়ত এবং তা তাঁরা নিজের চেহারা ও শরীরে মর্দন করতেন। তিনি কোন আদেশ করলে তারা দ্রুত তা বাস্তবায়ন করতেন। তিনি অযু করলে অযুর অতিরিক্ত পানি সংগ্রহ করার জন্য সাহাবীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেত এবং তিনি যখন কথা বলতেন তখন তারা তার সামনে আওয়াজ উঁচু করতেন না। তাঁর সম্মানার্থে তারা তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না।
অতঃপর উরওয়া গোত্রীয় লোকদের নিকট ফেরত এসে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! আমি অনেক বাদশার নিকট গমণ করেছি। রোম সম্রাট, পারস্য সম্রাট এবং নাজাশীর দরবারে যাওয়ারও সুযোগ আমার হয়েছে। আল্লাহর শপথ! কোন বাদশাকে দেখিনি যে, তার সভাসদরা তাকে এমন সম্মান করে যেমন সম্মান করে থাকে মুহাম্মাদ (ﷺ) কে তাঁর সাহাবীগণ। তিনি থুথু ফেললে তা কোন না কোন সাহাবীর হাতে পড়ত এবং তা তাঁরা নিজের চেহারা ও শরীরে মর্দন করতেন। তিনি কোন আদেশ করলে তারা দ্রুত তা বাস্তবায়ন করতেন। তিনি অযু করলে অযুর অতিরিক্ত পানি সংগ্রহ করার জন্য সাহাবীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেত এবং তিনি যখন কথা বলতেন তখন তারা তার সামনে আওয়াজ উঁচু করতেন না। তাঁর সম্মানার্থে তারা তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। তিনি তোমাদের জন্য সুন্দর এক প্রস্তাব করেছেন। তোমরা তা মেনে নাও। অতঃপর বনী কেনানা গোত্রের এক লোক বললঃ আমাকে তার কাছে যাওয়ার অনুমতি দাও। তারা বললঃ যাও।
সে যখন নবী (ﷺ) এবং তার সাহাবীদের কাছাকাছি পৌঁছল তখন তিনি বললেনঃ এ হল অমুক ব্যক্তি এবং সে এমন এক গোত্রের লোক যারা কুরবানীর জন্য প্রেরিত উটকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। সুতরাং তোমরা কুরবানীর পশু তার সামনে উপস্থিত কর। তাঁরা তার সামনে কুরবানীর পশু পেশ করল এবং তালবীয়া পাঠরত অবস্থায় তাকে সম্বর্ধনা জানাল। এ দৃশ্য দেখে সে বললঃ সুবহানাল্লাহ! এ সমস্ত লোককে কাবা ঘর যিয়ারত হতে বঞ্চিত করা মোটেই শোভনীয় নয়। সে তার সাথীদের নিকট গিয়ে বললঃ আমি দেখে আসলাম, কুরবানীর পশুর গলায় মালা পরিয়ে দেয়া হয়েছে এং কুরবানীর আলামত লাগানো হয়েছে। তাদেরকে কাবা ঘর হতে বাঁধা দেয়া আমি উচিত মনে করিনা। অতঃপর মিকরাজ বিন হাফস নামক এক লোক দাঁড়িয়ে বললঃ আমাকে অনুমতি দাও। আমি গিয়ে দেখি। তারা বললঃ যাও। সে যখন তাদের নিকটবর্তী হল নবী (ﷺ) বললেনঃ এই মিকরাজ। সে একজন অসৎ লোক। সে নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে কথা বলতে শুরু করল। কথা চলা অবস্থায় সুহাইল বিন আমর আগমণ করল।
নবী (ﷺ) তখন বললেনঃ এখন তোমাদের কাজ সহজ হয়ে গেছে। সুহাইল এসে নবী (ﷺ) কে বললঃ আপনি আমাদের ও আপনাদের মাঝে একটি সন্ধিপত্র লেখার ব্যবস্থা করুন। নবী (ﷺ) লেখক ডেকে বললেনঃ লেখ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”। সুহাইল বললঃ রাহমান? আল্লাহর কসম! রাহমান কে আমি জানি না। বরং আপনি “বিসমিকা আল্লাহুম্মা” লেখার আদেশ দিন। যেমনটি আপনি প্রথমে লেখতেন। মুসলিমগণ বললেনঃ আল্লাহর শপথ! আমরা “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” ছাড়া অন্য কিছু লেখবনা। নবী (ﷺ) বললেনঃ আচ্ছা লেখঃ “বিসমিকা আল্লাহুম্মা”। অতঃপর নবী (ﷺ) বললেনঃ এটি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে কৃত সন্ধিপত্র। তখন সুহাইল বললঃ আল্লাহর শপথ! আমরা যদি জানতাম যে আপনি আল্লাহর রাসূল তাহলে আপনাকে কখনই আমরা কাবা ঘরে প্রবেশ করতে বাঁধা দিতামনা এবং আপনার সাথে যুদ্ধও করতামনা। বরং আপনি লিখার আদেশ দিনঃ “আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ হতে”।
তখন নবী (ﷺ) বললেনঃ আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল। যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছ। যাই হোক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ-ই লেখ। তবে শর্ত থাকবে যে, আমাদেরকে কাবা ঘরের তাওয়াফ করার জন্য তাতে প্রবেশ করতে যেন কোন প্রকার বাধা না দেয়া হয়। সুহাইল বললঃ আল্লাহর শপথ! এমন হতে পারেনা। কারণ এমন হলে আরবরা এই মর্মে সমালোচনা করবে যে, আমরা বাধ্য হয়ে এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছি। তবে আগামী বছর আমরা এ প্রস্তাব মানতে পারি। তাই লেখা হল। অতঃপর সুহাইল বললঃ আরো শর্ত থাকে যে, আমাদের কোন লোক আপনার নিকট গমণ করলে আপনি তাকে আমাদের নিকট ফেরত দিবেন। যদিও সে আপনার দ্বীনের অনুসারী হয়ে থাকে। এ কথা শুনে মুসলিমগণ বললেনঃ সুবহানাল্লাহ! কিভাবে তাকে মুশরিকদের নিকট ফেরত দেয়া হবে? অথচ সে মুসলিম হয়ে আগমণ করেছে।
এমন সময় আবু জানদাল পায়ে বেড়ী পরা অবস্থায় মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মুসলিমদের নিকট উপস্থিত হলেন। সুহাইল বললঃ হে মুহাম্মাদ! সর্বপ্রথম যে বিষয়টির মীমাংসা করব তা এই যে, আপনি তাকে আমার নিকট ফেরত দিবেন। নবী (ﷺ) বললেনঃ আমরা এখনও চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর করিনি। সুহাইল বললঃ আল্লাহর শপথ! তাহলে তোমার সাথে আমি কোন বিষয়ের উপরই সন্ধি করব না। নবী (ﷺ) বললেনঃ ঠিক আছে, তুমি শুধু আমাকে এই লোকটিকে আমার সাথে থাকার অনুমতি দাও। সে বললঃ আমি অনুমতি দিবনা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দ্বিতীয়বার বললেনঃ তাকে আমার সাথে থাকার অনুমতি দাও। সুহাইল বললঃ না, আমি তা করব না। মিকরাজ বলে উঠলঃ ঠিক আছে আমরা তাকে আপনার নিকট থাকার অনুমতি দিলাম।
আবু জানদাল তখন বললেনঃ হে মুসলিমগণ! আমাকে কি মুশরিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হবে? অথচ আমি মুসলিম হিসাবে এখানে এসেছি। তোমরা কি দেখছনা, আমি কি অবস্থায় আছি? প্রকৃতপক্ষে তাঁকে আল্লাহর রাস্তায় কঠোর শাস্তি দেয়া হয়েছিল।
উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বলেনঃ আমি নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে বললামঃ আপনি কি আল্লাহর সত্য নবী নন? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি বললামঃ আমরা কি সত্যের উপর নই? আমাদের শত্রুরা কি বাতিলের উপর নয়? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ অবশ্যই। আমি বললামঃ তাহলে আমরা কেন আমাদের দ্বীনকে অপদস্ত করব? তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর রাসূল। আমি তার নাফরমানী করিনা। তিনি আমার সাহায্যকারী। আমি বললামঃ আপনি কি আমাদেরকে বলেন নি যে, আমরা কাবায় প্রবেশ করে কাবার তাওয়াফ করব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তবে আমি কি তোমাকে এই সংবাদ দিয়েছি যে, এ বছরই আসব? উমার (রাঃ) বলেনঃ আমি বললামঃ না।
তখন তিনি বললেনঃ তুমি অবশ্যই কাবায় আসবে এবং এর তাওয়াফ করবে। উমার (রাঃ) বলেনঃ অতঃপর আমি আবু বকরের নিকট গিয়ে বললামঃ হে আবু বকর! ইনি কি আল্লাহর সত্য নবী নন? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি বললামঃ আমরা কি সত্যের উপর নই? আমাদের শত্রুরা কি বাতিলের উপর নয়? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি বললামঃ তাহলে আমরা কেন আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে এত অপমান সহ্য করব? আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ হে উমার! তিনি আল্লাহর রাসূল। তিনি তাঁর প্রভুর অবাধ্য হতে পারেন না। তিনি অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবেন। তাই তিনি যে আদেশ করেন তা বাস্তবায়ন কর। আল্লাহর শপথ! তিনি অবশ্যই সত্যের উপর আছেন। আমি বললামঃ তিনি কি আমাদেরকে এ কথা বলেন নি যে, আমরা অচিরেই কাবায় প্রবেশ করব এবং উমরাহ পালন করব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তবে তিনি কি এ কথা বলেছেন তুমি এ বছরই আগমণ করবে? আমি বললামঃ না। তিনি বললেনঃ তুমি অবশ্যই আসবে এবং কাবা ঘরের তাওয়াফ করবে।
উমার (রাঃ) বলেনঃ এ সমস্ত অযথা প্রশ্ন করার কারণে আমি কতিপয় ভাল আমল করলাম। বর্ণনাকারী বলেনঃ চুক্তিপত্র লেখার কাজ শেষ করে নবী (ﷺ) সাহাবীদেরকে বললেনঃ তোমরা দাঁড়াও, কোরবানী কর এবং মাথা কামাও। বর্ণনাকারী বলেনঃ আল্লাহর শপথ! তিনি এ কথাটি তিনবার বলার পরও কেও উঠে দাঁড়াল না। যখন কেও দাঁড়ালনা তখন তিনি উম্মে সালামার কাছে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর নিকট ব্যাপারটি বর্ণনা করলেন। উম্মে সালামা বললেনঃ হে আল্লাহর নবী! আপনি যদি তা চান তাহলে আপনি বের হোন। কারো সাথে কোন কথা না বলে আপনার কোরবানীর উট জবাই করুন এবং নাপিতকে ডেকে আপনার মাথা কামিয়ে নিন। সুতরাং তিনি বের হয়ে কারো সাথে কোন কথা না বলে তাঁর কোরবানীর জন্তু জবাই করে দিলেন এবং নাপিতকে ডেকে মাথা কামিয়ে ফেললেন। লোকেরা এ দৃশ্য দেখে উঠে দাঁড়াল এবং কোরবানী করে ফেলল। একে অপরের মাথা কামাতে লাগল। দ্রুত মাথা কামানোর দৃশ্য দেখে আশঙ্কা হল যে, একে অপরকে হত্যা করে ফেলবে। এরপর কতিপয় মুমিন মহিলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমতে আগমণ করলেন। তখন আল্লাহর এই বাণী অবতীর্ণ হয়ঃ
(يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِذَا جَآءَكُمُ ٱلْمُؤْمِنَـٰتُ مُهَـٰجِرَٰتٍۢ فَٱمْتَحِنُوهُنَّ ۖ ٱللَّهُ أَعْلَمُ بِإِيمَـٰنِهِنَّ ۖ فَإِنْ عَلِمْتُمُوهُنَّ مُؤْمِنَـٰتٍۢ فَلَا تَرْجِعُوهُنَّ إِلَى ٱلْكُفَّارِ ۖ لَا هُنَّ حِلٌّۭ لَّهُمْ وَلَا هُمْ يَحِلُّونَ لَهُنَّ ۖ وَءَاتُوهُم مَّآ أَنفَقُوا۟ ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ أَن تَنكِحُوهُنَّ إِذَآ ءَاتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ ۚ وَلَا تُمْسِكُوا۟ بِعِصَمِ ٱلْكَوَافِرِ)
“হে মুমিনগণ! তোমাদের নিকট যখন ঈমানদার মহিলাগণ হিজরত করে আগমণ করে তখন তাদেরকে পরীক্ষা কর। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জান যে, তারা ঈমানদার তবে তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠিও না। এরা তাদের জন্য হালাল নয় আর তারা (কাফেররা) এদের জন্য হালাল নয়। কাফেররা যা ব্যয় করেছে তা তাদের দিয়ে দাও। এই নারীদেরকে প্রাপ্য মোহরানা দিয়ে বিবাহ করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবেনা। আর তোমরা কাফের নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখোনা”। (সূরা মুমতাহানাঃ ১০)
সেদিন উমার (রাঃ) তাঁর দুই মুশরিক স্ত্রীকে তালাক দেন। তাদের একজনকে মুআবীয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং অন্য জনকে সাফওয়ান বিন উমাইয়া বিয়ে করে নেয়।
অতঃপর নবী (ﷺ) মদীনায় ফেরত গেলেন। অতঃপর আবু বাসীর নামে কুরাইশ বংশের একজন মুসলিম তাঁর নিকট আসলেন। কুরাইশরা তার সন্ধানে দু'জন লোক পাঠায়। তারা বললঃ আপনি আমাদের সাথে কৃত সন্ধির কথা স্মরণ করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে আগত দু'জন লোকের কাছে ফেরত দিলেন। তারা যখন তাকে নিয়ে যুল হুলায়ফা পর্যন্ত পৌঁছল তখন তারা খেজুর খেতে লাগল। এ সময় আবু বাসীর দু'জনের একজনকে বললেনঃ আল্লাহর শপথ! হে অমুক! তোমার তরবারিটি অতি সুন্দর। এ কথা শুনে সে কোষ হতে তরবারি বের করে বললঃ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আল্লাহর কসম! এটি একটি ভাল তলোওয়ার। আমি এটিকে কয়েকবার পরীক্ষা করেছি।
আবু বাসীর বললেনঃ আমাকে একটু দেখাও। আমি তা দেখব। সে তরবারিটি তাকে দিল। তরবারিটি নিয়ে তাকে এক আঘাতে হত্যা করে ফেলল। অপর লোকটি পালিয়ে মদীনায় আসে এবং দৌঁড়াতে দৌড়াতে মসজিদে প্রবেশ করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে দেখে বললেনঃ একে ভীত মনে হচ্ছে। সে নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে গিয়ে বললঃ আল্লাহর শপথ! আমার সাথীকে নিহত করা হয়েছে এবং (সুযোগ পেলে) আমাকেও হত্যা করা হত। ইতিমধ্যেই আবু বাসীর আগমণ করে বললেনঃ হে আল্লাহর নবী! আল্লাহ আপনার অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন। আপনি আমাকে কাফেরদের নিকট সোপর্দ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এই কথা শুনে নবী (ﷺ) বললেনঃ তোমার মায়ের অকল্যাণ হোক! এখন তো যুদ্ধের জন্য আগুন জ্বলে উঠবে। তার যদি কোন সাহায্যকারী থাকত! এ কথা শুনে তিনি বুঝতে পারলেন যে, অচিরেই রাসূল (ﷺ) তাকে পুনরায় মুশরিকদের নিকট ফিরিয়ে দিবেন। তাই তিনি সেখান থেকে বের হয়ে সমুদ্র তীরে চলে গেলেন।
রাবী বলেনঃ এদিকে আবু জানদাল বিন সুহাইল তাদের নিকট থেকে পালিয়ে এসে আবু বাসীরের সাথে মিলিত হন। এরপর থেকে কুরাইশদের নিকট হতে কোন মুসলিম পালিয়ে আসতে সক্ষম হলে সেও আবু বাসীরের সাথে মিলিত হত। পরিশেষে তাদের একটি দল তৈরী হয়ে গেল। আল্লাহর শপথ! যখন তারা শুনত কুরাইশদের কোন কাফেলা সিরিয়ার দিকে যাচ্ছে, তখন তারা তাদের গতিরোধ করে তাদেরকে হত্যা করতেন এবং তাদের মালামাল লুট করে নিতেন। তাই কুরাইশরা নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে আল্লাহ এবং আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে কিছু লোক পাঠাল যে, তিনি যেন আবু বাসীর ও তার লোকজনকে লুটতরাজ থেকে বিরত রাখেন। এখন থেকে যে কোন লোক মুসলিম হয়ে মদীনায় গেলে আর তাকে ফেরত দিতে হবেনা।
অতএব নবী (ﷺ) তাদের ডেকে পাঠান। আল্লাহ তাআলা তখন এই আয়াত নাযিল করেনঃ
(وَهُوَ ٱلَّذِى كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُم بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنۢ بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ ------ ٱلْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ ٱلْجَـٰهِلِيَّةِ)
“তিনি সেই মহান সত্তা যিনি মক্কা উপত্যকায় কাফেরদের হাতকে তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাতকে তাদের হাত থেকে বিরত রেখেছেন তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর ------ কেননা কাফেররা তাদের অন্তরে মূর্খতাযুগের জেদ পোষণ করত”। (সূরা ফাত্হঃ ২৪-২৬)
তাদের জেদের কারণেই তাঁরা এ কথার স্বীকৃতি দেয়নি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তারা “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বাক্যটিও গ্রহণ করেনি"। এমনকি তারা মুসলিম ও কাবা ঘরের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। (আলোকিত প্রকাশনীঃ ১১৬৪)