HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

হাদীছের প্রামাণিকতা

লেখকঃ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
হাদীছের প্রামাণিকতা

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

প্রকাশক : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,

হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ২০

ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,

মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০

১ম প্রকাশ : ১৪২৫ হিঃ/১৪১০ বাং/২০০৪ ইং

২য় সংস্করণ : ১৪৩৩ হিঃ/১৪১৮ বাং/২০১২ ইং

নির্ধারিত মূল্য : ৩০ (ত্রিশ) টাকা মাত্র।

হাদীছের প্রামাণিকতা
عَنْ أَبِىْ رَافِعٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَى أَرِيكَتِهِ يَأْتِيْهِ الأَمْرُ مِنْ أَمْرِى مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُوْلُ لاَ أَدْرِى مَا وَجَدْنَا فِى كِتَابِ اللهِ اتَّبَعْنَاهُ ، رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُوْ دَاؤُدَ وَالتِّرْمِذِىُّ -

অনুবাদ : আবু রাফে‘ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আমি যেন তোমাদের কাউকে এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে, আর তার কাছে আমার কোন আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা পৌঁছলে সে বলবে যে, আমি এসব কিছু জানিনা। যা আল্লাহর কিতাবে পাব, তারই আমরা অনুসরণ করব’।[1]

হাদীছের ব্যাখ্যা :

উপরোক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী বিধৃত হয়েছে যে, মুসলমানদের মধ্যকার একদল লোক হাদীছকে অগ্রাহ্য করবে এবং নিজেদেরকে শুধু কুরআনের অনুসারী বলে দাবী করবে। এর অন্তর্নিহিত কারণও উক্ত হাদীছে ইঙ্গিতে বলে দেওয়া হয়েছে যে, ঐসব লোকেরা হবে বিলাসী ও দুনিয়াদার। এরা হাদীছে বর্ণিত ইসলামের বিস্তারিত আদেশ ও নিষেধাবলীর পাবন্দী হ’তে নিজেদেরকে মুক্ত করে নিজ নিজ স্বেচ্ছাচারিতা বহাল রাখার জন্য কুরআনের অনুসারী হওয়ার দাবী করবে। কারণ কুরআনে মূল বিষয়গুলিই মাত্র বর্ণিত হয়েছে, ব্যাখ্যা আসেনি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় কথা, কর্ম ও সম্মতিমূলক আচরণের মাধ্যমে কুরআনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বাস্তব নমুনা পেশ করে গেছেন। এমনকি কুরআনে বর্ণিত হয়নি, এমন অনেক বিষয় রাসূল (ছা্ঃ) কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছে, যা উম্মতের জন্য অবশ্য পালনীয়। কেননা কুরআনে আল্লাহ নিজেই বলেছেন,

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا، ( الحشر 7)- ‘আমার রাসূল তোমাদের নিকটে যা নিয়ে আসেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)।

অথচ উক্ত লোকগুলি মুখে ও কলমে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসাগীতি গাইলেও তাঁর আদেশ-নিষেধ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার জন্য বিভিন্ন চোরাপথ তালাশ করে। আর সেকারণে তারা হাদীছকে প্রকাশ্যে অথবা পরোক্ষে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে।

দ্বিতীয়তঃ কুরআনের ব্যাখ্যা যদি হাদীছে না আসত, তাহ’লে এই সব পন্ডিত লোকগুলি কুরআনের ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করতে পারত, যেভাবে ইহুদী-নাছারা পন্ডিতেরা তাওরাত-ইঞ্জীলের করেছে। তারা কেবল অপব্যাখ্যাই করেনি বরং মূল তাওরাত-ইঞ্জীলের মধ্যে শব্দ ও বাক্য সংযোজন ও বিয়োজন করে উক্ত এলাহী গ্রন্থদ্বয়কে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে। ফলে ইহুদী-নাছারাগণ মূল তাওরাত-ইঞ্জীল থেকে বঞ্চিত হয়ে তাদের ধর্মযাজকদের পায়রবী করছে। ইসলামকেও যাতে অনুরূপ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায়, সেজন্য ‘আলেম’ নামধারী স্বার্থদুষ্ট কিছু দুনিয়াদার লোক হাদীছকে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার পথে প্রধান অন্তরায় বিবেচনা করে হাদীছের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই এ ষড়যন্ত্র চলে আসছে, যা আজও অব্যাহত আছে। এই ষড়যন্ত্রের ধরণ ও পদ্ধতি বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপ হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ও প্রচারমূলক আন্দোলন ছাহাবাযুগ থেকে এযাবত অব্যাহত রয়েছে, যা ইতিহাসে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ নামে পরিচিতি।

দুনিয়ায় প্রেরিত ১ লক্ষ ২৪ হাযার পয়গাম্বর ও তন্মধ্যকার ৩১৫ জন রাসূলের কারুরই পূর্ণাঙ্গ জীবনী ও তাঁদের কথা, কর্ম ও সম্মতিমূলক আচরণসমূহ সুরক্ষিত নেই একমাত্র মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ব্যতীত। কারণ তিনি হ’লেন শেষনবী, বিশ্বনবী ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের বাস্তব রূপকার। মূলতঃ ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ও কুরআনের সর্বযুগীয় সমাধান হওয়া নির্ভর করছে হাদীছের বিদ্যমানতা ও বিশুদ্ধতার উপরে । আর সেকারণ আল্লাহ তাঁর প্রেরিত অহি-র হেফাযতের দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়েছেন (হিজ্র ১৫/৯)। যা তিনি অন্যান্য এলাহী কিতাবের জন্য নেননি। কুরআন ও হাদীছ দু’টিই আল্লাহর ‘অহি’ এবং দু’টিই আমরা একই নবীর মুখ দিয়ে শুনেছি। অতএব দু’টিই অভ্রান্ত এবং দু’টিরই হেফাযতের দায়িত্ব খোদ আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কিছু বাছাইকৃত বান্দা ক্বিয়ামত পর্যন্ত যুগে যুগে এর হেফাযত, খেদমত, অনুসরণ ও বাস্তবায়নে জীবনপাত করে যাবেন, এটাই তাঁর প্রকাশ্য ওয়াদা (বাক্বারাহ ২/১০৫)। আল্লাহ আমাদেরকে উক্ত দলের অন্তর্ভুক্ত করুন-আমীন।

১. আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, বায়হাক্বী; সনদ ছহীহ, মিশকাত, আলবানী হা/১৬২; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৫৪ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

হাদীছ-এর গুরুত্ব (أهمية الحديث)
১. ‘হাদীছ’ সরাসরি আল্লাহর ‘অহি’। কুরআন ‘অহিয়ে মাত্লু’ যা তেলাওয়াত করা হয়। কিন্তু হাদীছ ‘অহিয়ে গায়ের মাত্লু’ যা তেলাওয়াত করা হয় না। যেমন-

(ক) আল্লাহ বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى ، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى ‘রাসূল তাঁর ইচ্ছামত কিছু বলেন না। কেবলমাত্র অতটুকু বলেন, যতটুকু তাঁর নিকটে ‘অহি’ করা হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)।

(খ) তিনি অন্যত্র বলেন,

وَأَنْزَلَ اللهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا - ‘আল্লাহ আপনার উপরে নাযিল করেছেন কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) এবং আপনাকে শিখিয়েছেন, যা আপনি জানতেন না। আপনার উপরে আল্লাহর অনুগ্রহ অপরিসীম’ (নিসা ৪/১১৩)।

(গ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْقُرْآنَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ، أَلاَ يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ عَلَيْكُمْ بِهَذَا الْقُرْآنِ فَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَلاَلٍ فَأَحِلُّوهُ وَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُوْلُ اللهِ كَمَا حَرَّمَ اللهُ ... رواه أبو داؤدَ والترمذيُّ -

‘জেনে রাখো! আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি ও তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত। সাবধান! এমন একটি সময় আসছে যখন বিলাসী মানুষ তার গদিতে বসে বলবে, তোমাদের জন্য এ কুরআনই যথেষ্ট। সেখানে যা হালাল পাবে, তাকেই হালাল জানবে এবং সেখানে যা হারাম পাবে, তাকেই হারাম জানবে। অথচ আল্লাহর রাসূল যা হারাম করেছেন তা আল্লাহ কর্তৃক হারাম করার অনুরূপ’।[1] এখানে ‘কুরআন’ হ’ল ‘প্রকাশ্য অহি’ এবং তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত হ’ল ‘হাদীছ’ যা ‘অপ্রকাশ্য অহি’।[2] (ঘ) জিব্রীল (আঃ) সরাসরি নেমে এসে মানুষের বেশে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের মজলিসে বসে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ইসলাম, ঈমান, ইহসান প্রভৃতি বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন।[3]

২. হাদীছ হ’ল কুরআনের ব্যাখ্যা স্বরূপ। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ - ‘আমরা আপনার নিকটে ‘যিক্র’ নাযিল করেছি, যাতে আপনি লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত বিষয়গুলি তাদের নিকটে ব্যাখ্যা করে দেন এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহ্ল ১৬/৪৪)।

৩. হাদীছের অনুসরণ ব্যতীত কেউ মুমিন হ’তে পারে না। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا - ( النساء 65)-

‘আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনোই মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়সমূহে আপনাকেই একমাত্র সমাধানকারী হিসাবে গ্রহণ করবে। অতঃপর আপনার দেওয়া ফায়ছালা সম্পর্কে তারা তাদের মনে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ পোষণ না করবে এবং অবনতচিত্তে তা গ্রহণ না করবে’ (নিসা ৪/৬৫)।

৪. হাদীছের বিরোধিতা করার কোন এখতিয়ার মুমিনের নেই। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُبِينًا - ( الأحزاب 36)-

‘কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর পক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেওয়া ফায়ছালার ব্যাপারে (ভিন্নমত পোষণের) কোনরূপ এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল, সে স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হ’ল’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।

৫. হাদীছ মেনে নেওয়া উম্মতের উপরে অপরিহার্য। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا، ‘আমার রাসূল তোমাদেরকে যা প্রদান করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)।

৬. হাদীছ অনুসরণের মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত। যেমন আল্লাহ বলেন,

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ - ( آل عمران 31)-

‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ সমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়’ (আলে ইমরান ৩/৩১)। অত্র আয়াতে একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহর ভালোবাসার সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ শর্তযুক্ত। অতএব হাদীছের অনুসরণ ব্যতীত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব নয়।

৭. হাদীছের বিরোধিতা করা কুফরী। যেদিকে ঈঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,

قُلْ أَطِيعُوا اللهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ -

‘আপনি বলে দিন যে, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের। যদি তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে (তারা জেনে রাখুক যে,) আল্লাহ কখনোই কাফেরদের ভালবাসেন না’ (আলে ইমরান ৩/৩২)।

৮. বিবাদীয় বিষয়ে কিতাব ও সুন্নাহর দিকেই ফিরে যেতে হবে, অন্যদিকে নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً - ( النساء 59)- ‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে ঝগড়া কর, তাহ’লে তোমরা বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। সেটাই হবে উত্তম ও পরিণামের দিক দিয়ে সুন্দরতম’ (নিসা ৪/৫৯)।

৯. হাদীছের অনুসরণ অর্থ আল্লাহর অনুসরণ। যেমন আল্লাহ বলেন,

مَن يُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظًا - ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল, আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিল, আমরা তাদের উপরে আপনাকে পাহারাদার হিসাবে প্রেরণ করিনি’ (নিসা ৪/৮০)।

১০. হাদীছের বিরোধিতায় জাহান্নাম অবধারিত। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ( الجن 23)- ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল, তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হ’ল। সেখানে সে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে’ (জিন্ন ৭২/২৩)।

১১. হাদীছের বিরোধিতা করলে দুনিয়া ও আখেরাতে ফিৎনায় পড়া অবশ্যম্ভাবী। যেমন আল্লাহ বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ - ‘যারা রাসূলের আদেশ-নিষেধের বিরোধিতা করে, তারা যেন এ বিষয়ে ভয় করে যে, তাদেরকে (দুনিয়াবী জীবনে) গ্রেফতার করবে নানাবিধ ফিৎনা এবং (পরকালীন জীবনে) গ্রেফতার করবে মর্মান্তিক আযাব’ (নূর ২৪/৬৩)।

১২. হাদীছের সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়া মুনাফিকের লক্ষণ। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَيَقُولُونَ آمَنَّا بِاللهِ وَبِالرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّى فَرِيقٌ مِنْهُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُولَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ - وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيْقٌ مِنْهُمْ مُعْرِضُوْنَ - ( النور ৪৭-৪৮)-

‘তারা বলে আমরা আল্লাহ ও রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি ও তাঁর আনুগত্য করি। অতঃপর তাদের মধ্যকার একদল লোক পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। বস্ত্ততঃ তারা মুমিন নয়।’ ‘অনুরূপভাবে যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়ছালার দিকে আহবান করা হয়, তখন তাদের মধ্যকার একদল লোক মুখ ফিরিয়ে নেয় (নূর ২৪/৪৭-৪৮)। ‘অথচ মুমিনদের কথা এরূপ হওয়া উচিত যে, যখন তাদেরকে ফায়ছালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হবে তখন তারা বলবে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১)।

(খ) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُوْلِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْكَ صُدُوْدًا - ( النساء 61)- ‘যখন তাদেরকে বলা হয় যে, তোমরা এস ঐ সত্যের দিকে, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং এস রাসূলের দিকে, তখন আপনি মুনাফিকদের দেখবেন যে, তারা আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে (বা আপনার নিকটে আসা থেকে লোকদের পথ রুদ্ধ করে দেবে)’ (নিসা ৪/৬১)।

১৩. রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত তথা হাদীছের অনুসরণকে ওয়াজিব করে আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অন্যূন ৪০ জায়গায় বর্ণনা করেছেন।

১৪. ছাহাবায়ে কেরাম হাদীছকে আল্লাহ প্রেরিত ‘অহি’ হিসাবেই বিশ্বাস করতেন। যেমন আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন যে, একদা জনৈকা মহিলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! পুরুষেরা আপনার সব হাদীছ নিয়ে গেল। এক্ষণে আমাদেরকে আপনি নিজের থেকে একটা দিন নির্দিষ্ট করে দিন, যেদিন আমরা আপনার নিকটে আসব এবং আপনি আমাদেরকে শিখাবেন, যা আল্লাহ আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের জন্য একটা দিন ও স্থান নির্দিষ্ট করে দেন ও সেখানে আগমন করেন। অতঃপর তাদেরকে শিক্ষা দেন যা আল্লাহ তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন’।[4]

এখানে তিনটি বিষয় সাব্যস্ত হয় (১) রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় পুরুষ ও নারী সকলে হাদীছ শিক্ষাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন (২) পুরুষের ন্যায় মহিলাগণও রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হাদীছ শিখতে আসতেন (৩) হাদীছকে তাঁরা সবাই আল্লাহর সরাসরি ‘অহি’ হিসাবে বিশ্বাস করতেন।

১৫. হাদীছের উপরে বিশ্বাস রাখা বা না রাখাই হ’ল মুমিন ও কাফিরের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا فَقَدْ عَصَى اللهَ ، وَمُحَمَّدٌ فَرَقٌ بَيْنَ النَّاسِ ، رواه البخارىُّ - ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ হ’লেন লোকদের মধ্যে হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী মানদন্ড’।[5]

১৬. হাদীছ অমান্য করলে জাহান্নামী হ’তে হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى قِيْلَ وَمَنْ أَبَى؟ قَالَ : مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى ، رواه البخارىُّ -

‘আমার প্রত্যেক উম্মত জান্নাতে যাবে। কেবল তারা ব্যতীত, যারা অসম্মত হবে। জিজ্ঞেস করা হ’ল ‘অসম্মত’ কারা? তিনি বললেন, যারা আমার আনুগত্য করল, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যারা আমার অবাধ্যতা করবে, তারাই হ’ল অসম্মত’।[6]

১৭. হারাম ও হালালের বিধান প্রদানে হাদীছের স্থান কুরআনের ন্যায়। বরং তার চেয়ে বেশী। যেমন গৃহপালিত গাধা, দন্ত-নখরওয়ালা হিংস্র পশু ও পক্ষী কুরআনে হারাম করা হয়নি, অথচ হাদীছে হারাম করা হয়েছে।[7] কুরআনে সকল মৃত এবং রক্তকে হারাম করা হয়েছে’ (বাক্বারাহ ২/১৭৩)। অথচ হাদীছে দু’প্রকার মৃত অর্থাৎ মাছ ও টিড্ডি পাখি[8] এবং দু’প্রকার রক্ত অর্থাৎ কলিজা ও প্লীহাকে হালাল করা হয়েছে।[9]

১৮. হাদীছ কেবল কুরআনের ব্যাখ্যাকারী নয়, বরং অনেক সময় কুরআনই হাদীছের প্রত্যয়নকারী।

যেমন (ক) হিজরতের পূর্বে মক্কায় ১২ নববী বর্ষে সংঘঠিত মি‘রাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয় এবং জিব্রীল (আঃ) এসে রাসূল (ছাঃ)-কে ওযূ ও ছালাতের নিয়ম-কানূন শিক্ষা দেন এবং তখন থেকেই ছাহাবায়ে কেরাম নিয়মিত ওযূসহ ছালাত আদায় করতে থাকেন। অথচ ওযূর ফরয পদ্ধতি সর্ম্পকে সূরা মায়েদাহর ৬ নং আয়াত নাযিল হয় মি‘রাজের ঘটনার ৮ বছর পরে ৬ষ্ঠ হিজরীতে মদীনায়। (খ) মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) বলেন, ইহুদীদের শনিবার ও নাছারাদের রবিবার সাপ্তাহিক উপাসনার দিনের বিপরীতে আনছার ছাহাবীগণ মদীনায় আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে শুক্রবার জুম‘আর ছালাত আদায় শুরু করেন এবং তাঁরাই সর্বপ্রথম ‘জুম‘আহ’ নামকরণ করেন। কেননা এদিনের পূর্বনাম ছিল ‘আরূবাহ’ ( العروبة )। পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হিজরত করে এলে জুম‘আ ফরয হওয়ার আয়াত সম্বলিত সূরা জুম‘আ নাযিল হয়।[10]

তবে যেহেতু হাদীছের বিশাল ভান্ডারের সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণ কুরআনের ন্যায় ‘মুতাওয়াতির’ বা অবিরত ধারায় বর্ণিত ও সকলের নিকটে সমভাবে ও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি, সেকারণ বিদ্বানগণ হাদীছকে কুরআনের পরে দ্বিতীয় স্তরে রেখেছেন। তবে কুরআনের সংক্ষিপ্ত, অস্পষ্ট ও মৌলিক বিধান সমূহের বিপরীতে বিস্তারিত, সুস্পষ্ট এবং মৌলিক ও বিস্তৃত বিধানাবলী সম্বলিত হাদীছ শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা মুমিন জীবনে সর্বাধিক। যা ব্যতীত পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামী জীবন যাপন করা মুমিনের জন্য আদৌ সম্ভবপর নয়।

১৯. হাদীছের অনুসরণ ব্যতীত মুমিনের সকল নেক আমল বিফলে যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلاَ تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ - ( محمد 33)- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমরা তোমাদের আমলসমূহকে বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)।

২০. আক্বীদা ও আহকাম সকল বিষয়ে হাদীছ হ’ল চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী।

যেমন (১) কবর আযাব, ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণ ও ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে অবতরণ, মাহদীর আগমন, দাজ্জালের আবির্ভাব প্রভৃতি আক্বীদাগত বিষয় (২) ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জের নিয়ম-কানূন ইত্যাদি ইবাদতগত বিষয় (৩) ব্যবসা-বাণিজ্যসহ হালাল-হারামের অর্থনৈতিক বিধানসমূহ, স্ত্রীর সাথে তার বোন ও খালা-ফুফুকে বিবাহ না করা, রক্ত সম্পর্কীয়দের ন্যায় দুগ্ধ সম্পর্কীয়দের সাথে বিবাহের নিষিদ্ধতাসহ বিবাহ ও তালাকের বিস্তারিত নিয়ম ও বিধানসমূহ, পৌত্রের সম্পত্তিতে দাদীর উত্তরাধিকার, সামাজিক জীবনে আমীরের আনুগত্য, বিবাহিত ও অবিবাহিত যেনাকারের শাস্তির পার্থক্য, মদ্যপান, অঙ্গচ্ছেদন ও ক্ষতিকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের শাস্তিবিধানসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াবলীর বিস্তারিত বিধি-বিধান কেবলমাত্র হাদীছের মাধ্যমেই আমরা প্রাপ্ত হয়েছি। সেকারণ হাদীছের অনুসরণ ব্যতীত ইসলামের অনুসরণ কল্পনা করা অসম্ভব।

[1]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৩।

[2]. ড. মুহাম্মাদ আবু শাহবাহ, দিফা‘ ‘আনিস সুন্নাহ (কায়রো : মাকতাবাতুস সুন্নাহ ১৪০৯/১৯৮৯) পৃ: ১৫।

[3]. হাদীছে জিব্রীল, মুসলিম, মিশকাত হা/২।

[4]. বুখারী, মিশকাত হা/১৭৫৩; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৬৬১ ‘জানাযা’ অধ্যায় ‘মৃতের জন্য ক্রন্দন’ অনুচ্ছেদ।

[5]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৪ ‘কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[6]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩।

[7]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৩; মুসলিম, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪১০৫, ৪১০৬।

[8]. এক প্রকার ছোট মরুপক্ষী; যা সচরাচর আরবরা শিকার করে খেত।

[9]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ প্রভৃতি, মিশকাত হা/৪১৩২ ‘শিকার ও যবহ’ অধ্যায়, ‘যে সব বস্ত্ত খাওয়া হালাল ও হারাম’।

[10]. তাফসীর কুরতুবী ১৮/৯৮ সূরা জুম‘আ ৯ আয়াতের ব্যাখ্যা।

অধঃপতনের কারণ (سبب الانحطاط)
মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের বহুবিধ কারণের মধ্যে সবচাইতে বড় কারণ হ’ল কুরআন ও সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। কুরআন ও হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণ ও এতদুভয়ের প্রকাশ্য ও সরলার্থের উপরে আমল ও গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে লোকেরা ক্রমে দলপূজা ও ব্যক্তি পূজায় লিপ্ত হয়। আর এগুলি শুরু হয় মূলতঃ রাজনৈতিক ও দুনিয়াবী স্বার্থকে কেন্দ্র করে। আবুবকর (রাঃ)-এর আড়াই বছরের খেলাফতকাল ব্যয়িত হয় মূলতঃ ইসলামের প্রতিরক্ষার কাজে তথা ‘মুরতাদ’ বা ধর্মত্যাগীদের ঢল ঠেকানো, যাকাত অস্বীকারকারীদের ও ভন্ডনবীদের ফেৎনা, বিদেশী বৈরী শক্তির হামলা মুকাবিলা করা ইত্যাদি কাজে। ওমর (রাঃ)-এর ১০ বছরের খেলাফতকালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং মুসলিম শক্তির বিজয়াভিযান এগিয়ে চলে বাধাহীন গতিতে। মুসলমানদের জীবনযাত্রায় সচ্ছলতা ফিরে আসে। ওছমান গণী (রাঃ)-এর ১২ বছরের খেলাফতকালের প্রথমার্ধ্ব ব্যাপী এই অভিযান অব্যাহত থাকে ও মুসলিম শক্তি তৎকালীন পৃথিবীতে একক বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু এরি মধ্যে কিছু বিলাসী লোক দ্বীনকে দুনিয়া হাছিলের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে। ইহুদী সন্তান আবদুল্লাহ বিন সাবা প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে ঐসব দুনিয়াদার লোকদেরকে খেলাফতের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকে। ফলে রাজনৈতিক বিশৃংখলা দেখা দেয়। যার পরিণতিতে তৃতীয় খলীফা ওছমান (রাঃ) ও পরে চতুর্থ খলীফা আলী (রাঃ) নিহত হন। চরমপন্থী খারেজীরা আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ) উভয়কে এবং মিক্বদাদ, সালমান ফারেসী ও আবু যার গেফারীসহ হাতে গণা কয়েকজন ব্যতীত সকল ছাহাবীকে ‘কাফের’ বলতে থাকে। এইভাবে নেতৃস্থানীয় ছাহাবীগণকে ‘কাফের’ বলার কারণে উম্মতের মধ্যে তাঁদের বিশাল ভাবমূর্তি ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। যে কেউ তাঁদের সমালোচনায় সাহসী হয়ে ওঠে। ফলে মুসলিম ঐক্য হুমকির মুখে পড়ে যায়। মদীনা ও দামেষ্ক এবং পরে কূফা ও দামেষ্ক রাজনৈতিক বিভক্তির দুই কেন্দ্রে পরিণত হয়। অতঃপর আববাসীয় আমলে বাগদাদে একক রাজধানী স্থাপিত হয়।

উপরোক্ত রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে মসজিদ, মাদরাসা সর্বত্র আক্বীদাগত বির্তক শুরু হয়ে যায়। বছরার মা‘বাদ জুহানী (মৃঃ ৮০হিঃ) তাক্বদীরকে অস্বীকার করে। জাহম বিন ছাফওয়ান সমরকন্দী (নিহত ১২৮ হিঃ) আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করে। ওয়াছিল বিন ‘আত্বা (৮০-১৩১ হিঃ) বছরায় মু‘তাযিলা মতবাদের জন্ম দেয়। তারা যুক্তির আলোকে ছহীহ হাদীছসমূহের যাচাই শুরু করে এবং তাদের মন মত না হ’লে তাকে অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাতে থাকে অথবা নিজেদের মন মত করে নেওয়ার জন্য অপব্যাখ্যা ও দূরতম ব্যাখ্যা শুরু করে দেয়।

মোটকথা কুরআন ও সুন্নাহর মূল বাহক ও প্রচারক মহামান্য ছাহাবীগণের বিরুদ্ধে কুচক্রীরা মেতে ওঠে। ইহুদী-খৃষ্টান থেকে ধর্মান্তরিত নও-মুসলিম লোকেরাই মূলতঃ এই চক্রান্তে নেতৃত্ব দেয়। যাতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হাদীছ শাস্ত্রকে বাতিল প্রমাণ করা যায়। আর হাদীছকে বাতিল বা অগ্রহণযোগ্য কিংবা সন্দেহযুক্ত প্রমাণ করতে পারলেই কুচক্রীদের উদ্দেশ্য সফল হবে। কেননা হাদীছের স্তম্ভের উপরেই ইসলামের সুউচ্চ প্রাসাদ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

ছাহাবীগণের ভূমিকা (موقف الصحابة)
ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের শিষ্য তাবেঈনে এযাম সর্বদা হাদীছের পাহারাদার হিসাবে দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় ভূমিকা পালন করে গেছেন। হাদীছের নামে মিথ্যা বর্ণনা, হাদীছের অপব্যাখ্যা, দূরতম ব্যাখ্যা ইত্যাদি থেকে তাঁরা ছিলেন বহু যোজন দূরে। এসব বিষয় ছিল তাঁদের স্বপ্নেরও বাইরে। এ কারণে তাঁরা জনগণের মধ্যে ‘আহলুল হাদীছ’ ‘আহলুস সুন্নাহ’ ইত্যাদি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁদের বিরোধীরা ‘আহলুল বিদ‘আ’ তথা বিদ‘আতী নামে অভিহিত হতে থাকে (মুক্বাদ্দামা মুসলিম পৃ. ১৫)।

উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক গোলযোগের ফলে ছাহাবীগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হ’লেও তাঁদের মধ্যে আক্বীদাগত কোন বিভক্তি দেখা দেয়নি। তাঁরা পরস্পরকে ‘কাফির’ বলেননি বা কারুর রক্ত হালাল বলেননি। তাঁদের মধ্যে যা কিছু বিরোধ ছিল, তা ছিল স্রেফ ইজতিহাদী মতবিরোধ। যাঁর ইজতিহাদ সঠিক ছিল, তিনি দ্বিগুণ ছওয়াব পাবেন এবং যাঁর ইজতিহাদ বেঠিক ছিল, তিনি একগুণ ছওয়াব পাবেন।

বছরায় থাকাকালীন সময়ে একদা ছাহাবী ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে হাদীছ শুনাচ্ছিলেন। তখন একজন লোক এসে বলল, হে আবু নাজীদ! আপনি আমাদেরকে কুরআন শুনান। ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) তখন লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা কি ছালাত আদায় কর না? তোমরা কি যাকাত আদায় কর না? তাহ’লে তা কার দেওয়া পদ্ধতিতে আদায় কর? লোকটি বলল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে এসব বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। অতঃপর লোকটি নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল : أَحْيَيْتَنِي أَحْيَاكَ اللهُ ‘আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন!’[1]

উমাইয়া বিন খালিদ একবার সকল মাসআলা কুরআন থেকে বের করার চেষ্টা করেন। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মুক্বীম অবস্থায় ও ভীতির অবস্থায় ছালাত আদায়ের বিষয় কুরআনে পাই। কিন্তু সফরে ছালাত আদায়ের বিষয় তো কুরআনে পাই না। তখন ইবনু ওমর (রাঃ) তাকে বললেন, يَا ابْنَ أَخِي، إِنَّ اللهَ بَعَثَ إِلَيْنَا مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلاَ نَعْلَمُ شَيْئًا، فَإِنَّمَا نَفْعَلُ كَمَا رَأَيْنَا مُحَمَّدًا يَفْعَلُ - ‘হে ভাতিজা! মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে আল্লাহ আমাদের নিকট পাঠিয়েছিলেন, যখন আমরা কিছুই জানতাম না। নিশ্চয়ই আমরা করে থাকি, যেমনভাবে আমরা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে করতে দেখেছি’।[2]

তবে এই ধরনের প্রশ্ন তৎকালীন মুসলিম সমাজে ব্যাপকতা লাভ করেনি। বরং ব্যক্তি পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। আর মূলতঃ ইরাকের বছরাতেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল। সেকারণ বছরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাবেঈ বিদ্বান আইয়ূব সাখতিয়ানী (৬৮-১৩১ হিঃ) নিজ শহরের লোকদের চূড়ান্তভাবে বলে দেন যে, إِذَا حَدَّثْتَ الرَّجُلَ بِالسُّنَّةِ فَقَالَ : دَعْنَا مِنْ هَذَا وَحَدِّثْنَا مِنَ الْقُرْآنِ فَاعْلَمْ أَنَّهُ ضَآلٌّ وَمُضِلٌّ - ‘যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে হাদীছ শুনাবে, তখন সে যদি বলে যে, ছাড় এসব, আমাদেরকে কুরআন শুনাও, তখন তুমি জেনো যে, ঐ লোকটি নিজে পথভ্রষ্ট এবং অন্যকে পথভ্রষ্টকারী’।[3]

ব্যক্তি পর্যায়ে হাদীছ বিরোধী উক্ত মনোভাব সীমাবদ্ধ থাকলেও দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে এসে বেশ কিছু লোককে পাওয়া যায়, যারা পুরা হাদীছ শাস্ত্রকেই অস্বীকার করে অথবা ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছসমূহকে অস্বীকার করে। যদিও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক সামাজিক জীবনে এর ব্যাপক প্রভাব তখনও পড়েনি, আজও পড়েনি। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। তবে হাদীছ বিরোধী ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে ও পরোক্ষে সর্বদা অব্যাহত ছিল, আজও আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই লোকেরা এখন আর বাইরের কেউ নয়, বরং ঘরের। ইসলামের বড় বড় বিদ্বান হিসাবে যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত। এক্ষণে বিগত ও বর্তমান যুগের প্রকাশ্য ও পরোক্ষ হাদীছ বিরোধীদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব। যাতে সাধারণ মুসলমানগণ এদের ধোঁকায় না পড়েন।

[1]. মুস্তাদরাকে হাকেম ১/১০৯-১০ পৃঃ।

[2]. মুস্তাদরাকে হাকেম ১/২৫৮ পৃঃ।

[3]. ছালাহুদ্দীন মকবূল আহমাদ, যাওয়াবে‘ ফী ওয়াজহিস সুন্নাহ (রিয়াদ : দার আলমিল কুতুব) তাবি, পৃঃ ৪৬।

প্রাচীন যুগের হাদীছ অস্বীকারকারীগণ (منكرو السنة قديماً)
১. খারেজী ( خارجي ) : এরা প্রথমে আলী (রাঃ)-এর দলভুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্দেশ্য দু’জন ছাহাবীকে শালিশ মেনে নেওয়ায় এরা তাঁর বিরোধী হয়ে যায় এবং শ্লোগান তোলে যে, لاَ حُكمَ إِلاَّ لِلَّهِ ‘কোন হুকুমদাতা নেই আল্লাহ ব্যতীত’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কাউকে শালিশ মানিনা। অতঃপর উক্ত শালিশীর সমর্থক সকল ছাহাবীকে তারা ‘কাফির’ বলে এবং তাঁদের বর্ণিত ফিৎনা পরবর্তী সকল হাদীছকে তারা অস্বীকার করে।

২. শী‘আ ( شيعة ) : আলী (রাঃ)-এর ভন্ড সমর্থক এই দলের লোকেরা তাদের ধারণা মতে হাতে গণা কয়েকজন ছাহাবী ব্যতীত সকল ছাহাবীকে ‘কাফির’ বলে এবং তাঁদের বর্ণিত হাদীছসমূহকে অস্বীকার করে। তাদের পসন্দমত কিছু ছাহাবীর বর্ণিত হাদীছসমূহকেই মাত্র তারা গ্রহণ করে থাকে।

৩. মু‘তাযিলা ( معةزلة ) : বুদ্ধিবাদী এই দলটির অতি যুক্তিবাদী তৎপরতায় প্রমাণিত হয় যে, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এই মতের অনুসারী লোকেরা পুরা হাদীছ শাস্ত্রকেই অস্বীকার করেছে। এমনকি যুক্তির বাইরে হওয়ায় তারা কুরআনের অবোধ্য বিষয়গুলি ( إعجاز القران ) এবং রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জিযাসমূহকে ( معجزة ) অস্বীকার করেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে তারা ‘সেরা মিথ্যুক’ ( أكذَبُ الناسِ ) বলতেও দ্বিধা বোধ করেনি। ছাহাবী ও তাবেঈগণের ফৎওয়াসমূহকে তারা তাচ্ছিল্য করে এবং তাঁদেরকে মূর্খ ও মুনাফিক বলে। এমনকি তাঁদেরকে স্থায়ীভাবে জাহান্নামী বলে (নাঊযুবিল্লাহ) (যাওয়াবে‘ পৃঃ ৫৯)।

তবে সঠিক কথা এই যে, উপরোক্ত ভ্রান্ত দলগুলি পুরা হাদীছ শাস্ত্রকে অস্বীকার করেনি। বরং তাদের স্বার্থের বিরোধী হাদীছসমূহকেই মূলতঃ তারা অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে। যেমন খারেজীরা আহলে বায়তের মর্যাদায় বর্ণিত হাদীছসমূহকে অস্বীকার করে। মু‘তাযিলারা আল্লাহর গুণাবলী সংক্রান্ত হাদীছসমূহকে অস্বীকার করে। যদিও ঐসব দলগুলি অন্যান্য প্রশাখাগত বিষয়ে বর্ণিত কিছু কিছু হাদীছ মান্য করে থাকে।

ইবনু হাযম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হিঃ) বলেন, মুসলিম উম্মাহর সকল দল-উপদল বিশ্বস্ত একক বর্ণনাকারীর বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ভুক্ত হাদীছ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতেন। এ ব্যাপারে উম্মতের মধ্যে ঐক্যমত ছিল। কিন্তু ১ম শতাব্দী হিজরীর শেষের দিকে কিছু মু‘তাযিলা দার্শনিক এই নীতির ব্যত্যয় ঘটান এবং ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছসমূহে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন’।[1] এই মু‘তাযিলী যুক্তিবাদী ঢেউ বিভিন্ন ফিক্বহী মাযহাবের বিদ্বানগণের মধ্যেও লাগে কেবলমাত্র আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ ব্যতীত। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

[1]. আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২৬/২০০৫) পৃঃ ১২৬।

আধুনিক যুগে হাদীছ অস্বীকারকারীগণ (منكرو السنة حديثًا)
ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে মাথা চাড়া দেওয়া হাদীছ বিরোধী দলগুলির অপতৎপরতা পরবর্তীতে স্থান বিশেষে ধিকি ধিকি ভাবে টিকে থাকলেও মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের অব্যাহত প্রতিরোধের মুখে তা ব্যাপকতা লাভ করতে পারেনি। এমনকি আববাসীয় খলীফা মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক্ব বিল্লাহর (১৯৮-২৩২ হিঃ/৮১৩-৪৭ খৃঃ) সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও যুক্তিবাদের নামে ভ্রান্ত মু‘তাযিলা মতবাদ বৃহত্তর মুসলিম জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা লাভে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। যদিও ঐসময় আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপরে নেমে আসে ভূমিকম্পসদৃশ বিপদ-মুছীবত ও যুলুম-অত্যাচারসমূহ। এভাবে শত রাজনৈতিক নির্যাতন ও জেল-যুলুম সহ্য করেও তাঁদের দৃঢ় প্রতিরোধ সাধারণ জনগণের হৃদয় জয় করে। যা হাদীছ শাস্ত্রের পবিত্রতা ও উচ্চ মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়ক হয়।

কিন্তু পঞ্চম শতাব্দী হিজরী থেকে সপ্তম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত (৪৮০-৬৯১হিঃ/১০৯৫-১২৯১খৃঃ=২০২/১৯৬ বছর) ফিলিস্তীন উদ্ধারের নামে খ্রিষ্টান ইউরোপের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রায় দু’শো বছর ব্যাপী সংঘটিত ‘ক্রুসেড’ যুদ্ধে পরাজিত ও ব্যর্থ খ্রিষ্টান নেতারা মুসলিম বিশ্বকে করায়ত্ত করার জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। তারা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের নীলনকশা অংকন করে এবং এজন্য বিশেষ কিছু শিক্ষিত লোক নিয়োগ করে। যারা আরবী ও ইসলামী সাহিত্য বিষয়ে গবেষণা ও অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেন। অন্যদিকে আর্থিকভাবে দুর্বল মুসলিম দেশগুলিতে সমাজ কল্যাণের নামে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে মানবপ্রেমিক সেজে তারা সামনে আসে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে ইসলামী গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে তারা বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে থাকে। যা মুসলমানেরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে করতে সক্ষম হয়নি। মূল্যবান স্কলারশিপ দিয়ে মুসলিম দেশসমূহের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাগুলিকে তারা গবেষণার নামে নিজেদের দেশে নিয়ে যায় এবং উচ্চতর ডিগ্রী ও লোভনীয় সুযোগ-সুবিধার ফাঁদে ফেলে তাদেরকে মানসিক গোলামে পরিণত করে। তারা ইসলামকে প্রাচীন ভেবে তাকে আধুনিক করার সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। কেউ কেউ তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসকে ইসলামী লেবাস পরিধান করাতে সচেষ্ট হন। এভাবে তাদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান দিক ছিল এই যে, ‘আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট হাদীছের কোন প্রয়োজন নেই’। কেননা হাদীছ হ’ল ‘যান্নী’ বা ধারণা নির্ভর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে এগুলি লিপিবদ্ধ আকারে রেখে যাননি। সেকারণ এতে অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে একক রাবীর বর্ণিত হাদীছসমূহকে, যাকে ‘খবরে ওয়াহেদ’ বলা হয়।

অতঃপর ঐসব লোকগুলি ‘সংস্কার’-এর নাম নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাদের গুরু ‘প্রাচ্যবিদ’ (Orientalist) নামে খ্যাত ইউরোপীয় খ্রিষ্টান পন্ডিতদের অনুকরণে কাজ করতে থাকেন। মুক্তবুদ্ধির নামে তারা কথিত মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার বিরুদ্ধে তরুণদের উত্তেজিত ও আকৃষ্ট করতে থাকেন। এইভাবে ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস এবং ছাহাবী ও তাবেঈগণের ঈমানী দৃঢ়তা সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরাই ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরূপে মুসলিম সমাজে আবির্ভূত হন ও তাদের দেওয়া ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যায় সমাজে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। মুসলমান নামধারী এইসব কলমী মুনাফিকরাই ইসলামের স্থায়ী ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়, যা সশস্ত্র ‘ক্রুসেড’ যুদ্ধের মাধ্যমে করা সম্ভব হয়নি।

এইসব মুক্তবুদ্ধি ইসলামী চিন্তাবিদগণ কয়েকভাবে বিভক্ত। কেউ পুরো হাদীছ শাস্ত্রের বিরুদ্ধে ‘সন্দেহবাদ’ আরোপ করেছেন। কেউ শুধুমাত্র ‘খবরে ওয়াহেদ’ জাতীয় হাদীছগুলিতে সন্দেহ সৃষ্টি করেছেন। কেউ হাদীছ বাদ দিয়ে কেবলমাত্র কুরআনের অনুসারী হওয়ার দাবী করেছেন। কেউ নিজের স্বার্থের কিছু হাদীছকে স্বীকার করেছেন, বাকীগুলিকে অস্বীকার বা অপব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে হাদীছ শাস্ত্রকে সরাসরি অস্বীকার করেননি, তবে যুক্তির নামে এমন সব অপযুক্তির অবতারণা করেছেন, যা হাদীছ অস্বীকারকারীদের চেয়েও অধিক ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে এবং যা লোকদের নিকটে হাদীছের উচ্চ মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে।

পাশ্চাত্যে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গোল্ডযিহের (১৮৫০-১৯২১), জোসেফ শাখত, মার্গোলিয়থ, গ্যাষ্টন ওয়াট, টমাস আর্ণল্ড, কার্ল ব্রোকেলম্যান, আর.এ. নিকলসন, এ.জে. আরবেরী, আলফ্রেড হিউম, হ্যামিল্টন এ.আর. গীব, মন্টগোমারী ওয়াট, এস.এম. যুইমার, এ.জে. ভিনসিক, হেনরী ল্যামেন্স (১৮৬৮-১৯৫১) প্রমুখ।

পক্ষান্তরে প্রাচ্যে এই আন্দোলনের উৎস ভূমি হ’ল প্রধানতঃ দু’টি। ১. মিসরে মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুহু (১৮৪৯-১৯০৫) ও তাঁর অনুসারীবৃন্দ ২. ভারতে স্যার সৈয়দ আহমাদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) ও তাঁর অনুসারীবৃন্দ।

মিসরীয় স্কুল (مدرسة المصر)
১. মুফতী মুহাম্মাদ আsবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫ খৃঃ)

এই বিখ্যাত মিসরীয় পন্ডিত আধুনিক মিসরে ‘সংস্কার’ আন্দোলনের নেতা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। যখন পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আরব বিশ্বের উপরে তাদের কালো থাবা বিস্তার করে এবং আরবীয় ইসলামী সংস্কৃতিকে মধ্যযুগীয় কুসংস্কার হিসাবে চিত্রিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগে ও এরই অন্যতম দিক হিসাবে ইসলামের ভিত নাড়িয়ে দেবার জন্য হাদীছ শাস্ত্রের প্রামাণিকতার বিরুদ্ধে নানাবিধ চত্রুান্ত শুরু করে, তখন তাদের এই চত্রুান্ত জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েন বহু ইসলামী পন্ডিত। মুফতী মুহাম্মাদ আবদুহু ছিলেন তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। যদিও ইসলামের পক্ষে তাঁর ছিল জোরালো ভূমিকা।

যেমন তিনি বলেন,

إن المسلمين ليس لهم إمام فى هذا العصر غير القران وإن الإسلام الصحيح هو ماكان عليه الصدر الأول قبل ظهور الفتن -

‘এ যুগে মুসলমানদের জন্য কোন ইমাম বা নেতা নেই ‘কুরআন’ ব্যতীত। সত্যিকারের ইসলাম সেটাই, যা ইসলামের প্রথম শতকে ফিৎনা সৃষ্টির পৃর্বে ছিল’। তিনি আরও বলেন, لا يمكن أن يعةبر حديث من أحاديث الآحاد دليلا على العقيدة - ‘খবরে ওয়াহেদ পর্যায়ভুক্ত কোন হাদীছকে আক্বীদা বিষয়ে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়’ (যাওয়াবে‘ পৃঃ ৭২)।

ডঃ মুছত্বফা সাবাঈ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে মুফতী মুহাম্মাদ আবদুহু আধুনিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কারক। তিনি স্বীয় যুগের অতুলনীয় ইসলামী দার্শনিক ছিলেন। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শত্রুদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রহরীর ন্যায় কলমী যোদ্ধা ছিলেন। সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বে চিন্তাধারার ক্ষেত্রে শতবর্ষব্যাপী বৈকল্যের আঁধারে আলোর সঞ্চার করেছিলেন। তথাপি তিনি ছিলেন হাদীছ শাস্ত্রে খুবই কম জ্ঞানের অধিকারী। তিনি ইসলামের পক্ষে মানতিক্ব বা তর্কশাস্ত্র ও যুক্তিবাদের অস্ত্রের উপর অধিক ভরসা করতেন’।

মিসরীয় স্কুলের বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত সৈয়দ রশীদ রিযা (১৮৬৫-১৯৩৫ খৃঃ) ও ডঃ তাওফীক্ব ছিদক্বী প্রথম জীবনে মুফতী মুহাম্মাদ আবদুহু-র অনুসারী ছিলেন। সৈয়দ রশীদ রিযা-র জগদ্বিখ্যাত পত্রিকা ‘আল-মানার’-য়ে এই সময় হাদীছের প্রামাণিকতার বিরুদ্ধে অনেক নিবন্ধ প্রকাশিত হ’ত। যেমন ডঃ তাওফীক্ব ছিদক্বী লিখিত প্রবন্ধ الإسلام هو القران وحده ‘ইসলাম বলতে একমাত্র কুরআনকেই বুঝায়’।[1] বলা বাহুল্য, সৈয়দ রশীদ রিযা এইসব লেখনীর সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। কিন্তু তাঁদের উস্তাদ মুফতী মুহাম্মাদ আবদুহু-র মৃত্যুর পরে যখন আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদের হাদীছ শাস্ত্রের প্রতি অবহেলা এবং বিভিন্ন ফিক্বহী মাযহাব ও দর্শন শাস্ত্রের প্রতি তাদের অতি উৎসাহ ও গভীর পান্ডিত্য প্রত্যক্ষ করেন, তখন তিনি মিসরে ‘সুন্নাতের ঝান্ডা উড্ডীনকারী’ হিসাবে আবির্ভূত হন। তিনি হাদীছের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের উত্থাপিত প্রশ্নসমূহের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে থাকেন এবং বিভিন্ন ফেক্বহী মাযহাবে হাদীছ বিরোধী যেসব ফৎওয়া লিপিবদ্ধ রয়েছে, তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন। পরবর্তীকালে মিসরের কুখ্যাত হাদীছ দুশমন আবু রাইয়াহর আবির্ভাবকালে যদি তিনি জীবিত থাকতেন, তবে সৈয়দ রশীদ রিযা যে তার প্রথম প্রতিবাদকারী হ’তেন, এতে কোন সন্দেহ নেই (আস-সুন্নাহ পৃঃ ৩০)। ডঃ তাওফীক্ব ছিদক্বীও আল্লাহর রহমতে তাঁর পূর্বের ভূমিকা পরিত্যাগ করেন ও সৈয়দ রশীদ রিযা-র সাথে ঐক্যমতে সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেন।[2]

২. ডঃ আহমাদ আমীন (১৮৮৬-১৯৫৪ খৃঃ)

এই মিসরীয় পন্ডিত ‘ফাজরুল ইসলাম’ ‘যুহাল ইসলাম’ ও ‘যুহরুল ইসলাম’ নামে সাড়া জাগানো তিনটি গ্রন্থের বিখ্যাত লেখক। এই গ্রন্থসমূহে তিনি ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদগণের পদাংক অনুসরণ করেন এবং হাদীছ শাস্ত্রের বিশাল ভান্ডারে সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টি করেন। এভাবে তিনি জমহূর মুসলিম বিদ্বানগণের গৃহীত তরীকার বাইরে চলে যান। ‘ফাজরুল ইসলাম’ গ্রন্থে তিনি ‘হাদীছ’ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। যেখানে তিনি চর্বির মধ্যে বিষ মিশিয়েছেন ও হক্ব-এর সাথে বাতিল মিশ্রিত করেছেন। দুঃখের বিষয় এই যে, উক্ত ভ্রান্ত আক্বীদার উপরেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। বরং তাঁর ভ্রান্ত আক্বীদার বই পড়ে বহু লোক ভ্রান্ত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। যেমন তিনি বলেন,

وقد وضع العلماء للجرح والتعديل قواعد ليس هنا محل ذكرها ولكنهم والحق يقال عنوا بنقد الإسناد أكثر مما عنوا بنقد المتن ... حتى نري البخاري نفسه على جليل قدره ورقيق بحثه يثبت أحاديث دلت الحوادث الزمنية والمشاهدة التجربية على أنها غير صحيحة لا قتصاره على نقد الرجال -

‘বিদ্বানগণ হাদীছ বর্ণনাকারী রাবীদের সমালোচনায় বহু নিয়ম-বিধান প্রণয়ন করেছেন। যার সবকিছু এখানে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি তাঁরা হাদীছের মতনের (Text) চাইতে সনদের (Chain of narrators) সমালোচনাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।.....এমনকি যদি আমরা খোদ বুখারীকে দেখি, তবে দেখব যে, সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সত্ত্বেও সমকালীন ঘটনাবলী ও বাস্তব অভিজ্ঞতা সমূহ প্রমাণ করে যে, তাঁর গৃহীত হাদীছ সমূহ ছহীহ নয়, কেবল রাবীদের সমালোচনায় তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার কারণে’।[3] আহমাদ আমীনের এই মন্তব্য যে নির্জলা মিথ্যা বরং মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের বিরুদ্ধে নিছক অপবাদ, একথা উছূলে হাদীছের সাধারণ ছাত্রও খবর রাখেন। বরং বলা চলে যে, উপরোক্ত মন্তব্য তাঁর নিজস্ব গবেষণাপ্রসূত নয়; বরং তাঁর অনুসরণীয় খ্রিষ্টান পন্ডিতগণের মন্তব্যের অনুকরণ মাত্র। যেমন প্রাচ্যবিদ গ্যাষ্টন ওয়াট বলেন, হাদীছ শাস্ত্রবিদগণ হাদীছ সর্ম্পকে গভীর গবেষণা করেছেন। কিন্তু সেগুলি ছিল সব রাবী ও সনদের সমালোচনামুখী। .....তাঁরা ‘মতনে’র সমালোচনা করেননি’। উক্ত প্রাচ্যবিদ খ্রিষ্টান পন্ডিতের বক্তব্য আর মুসলিম পন্ডিত ডঃ আহমাদ আমীনের বক্তব্যে ও মন্তব্যে কোন পার্থক্য নেই।

ডঃ আহমাদ আমীনের ছেলে ‘হুসায়েন’ পিতার চেয়ে আরও একধাপ এগিয়ে গেছেন। যিনি স্বীয় دليل المسلم الحزين إلى مقتضى السلوك فى القرن العشرين বইয়ের মধ্যে ইসলামের মূলনীতিসমূহ ও বিশেষ করে সুন্নাতে নববী সর্ম্পকে তীব্র হিংসাত্মক বক্তব্যসমূহ সন্নিবেশিত করেছেন। উক্ত বইটি ১৯৮৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বই প্রদর্শনীতে ‘শ্রেষ্ঠ বই’ হিসাবে পুরস্কার লাভ করেছে।

উক্ত বইয়ে তিনি বলেন, ‘আহমাদ আমীন আমাদের উপরে ‘ছালাত’-কে ‘ফরয’ করে যাননি। তিনি চোরের হাত কাটা ঐসময় সিদ্ধ মনে করতেন, যখন খোলা ময়দানে কোন পথিকের নিকট থেকে চুরি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এটি কোন গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে না। অতএব বর্তমান অবস্থায় এই হুকুম অবশ্যই পরিবর্তন করা উচিত’।

মহিলাদের পর্দা সম্পর্কে তিনি বলেন, ليس للحجاب أيّ علاقة بالإسلام ‘পর্দার সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই’.....। এরূপ বহু অশোভন ও অনর্থক কথায় ভরে আছে পৃথিবীর কথিত ঐ ‘শ্রেষ্ঠ গ্রন্থটি’!

ডঃ আহমাদ আমীনের আরেক অনুসারী পন্ডিত ইসমাঈল আদহাম ১৩৫৩ হিজরীতে প্রকাশিত عن ةاريخ السنة নামক নিবন্ধে বলেন, ছহীহ গ্রন্থসমূহে যেসব হাদীছ লিপিবদ্ধ আছে, সেসবের ভিত্তি মযবুত নয়, বরং সন্দেহপূর্ণ এবং সেসবের মধ্যে জাল হওয়ার দোষাবলী অগ্রগণ্য’ ( بل هي مشكوك فيها ويغلب عليها صفة الوضع )।

৩. মাহমূদ আবু রাইয়াহ

এই পন্ডিত ব্যক্তি সুন্নাতে নববী তো বটেই সরাসরি ছাহাবীগণের প্রতি হিংসাপরায়ণ। বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ যে মহান ছাহাবীর নিকট থেকে সবচেয়ে বেশী হাদীছ লাভ করেছে, হাদীছের শ্রেষ্ঠ হাফেয ছাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর উপরেই তার ক্রোধ সবচেয়ে বেশী। রাসূল (ছাঃ)-এর খাছ দো‘আপ্রাপ্ত ও আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রাপ্ত অনুপম চরিত্র মাধুর্যের অধিকারী এই মানুষটিকে কালিমালিপ্ত করার জন্য মিসরীয় পন্ডিত তার একটি বইয়ের নাম তাচ্ছিল্যভরে রেখেছেন شيخ المضيرة أبو هريرة ‘মযীরাহ’ খাদ্যের ভক্ষক আবু হুরায়রা’। আবু হুরায়রা (রাঃ) উক্ত খাদ্যটি পসন্দ করতেন বলে ছা‘আলাবী ও বদী‘উয্যামান হামাযানী প্রমুখ বর্ণনা করেছেন। যদিও এইসব সাহিত্যিকদের মাধ্যমে প্রচারিত উক্ত বর্ণনার কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই’।[4]

অনুরূপভাবে তার রচিত أضواء على السنة المحمدية বইয়ের মধ্যেও হাদীছ ও আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার করেছেন। সুন্নী নামধারী এই পন্ডিত মূলতঃ শী‘আ ছিলেন। যা তার লেখনীতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

উপরোক্ত মাহমূদ আবু রাইয়াহর লেখনীসমূহকে পুঁজি করে আরেকজন পন্ডিত সাইয়িদ ছালেহ আবুবকর একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম الأضواء القرآنية فى اكتساح الأحاديث الإسرائيلية وتطهير البخارى منها ‘ইস্রাঈলী হাদীছসমূহকে ঝাড়ু দেওয়ার জন্য এবং বুখারীকে ঐসব থেকে পবিত্র করার জন্য কুরআনী জ্যোতিসমূহ’। উক্ত বইয়ে তিনি ছহীহ বুখারীর ১০০ টি হাদীছ বাছাই করেছেন, যেগুলি তার মতে ইহুদীদের রচিত এবং ইমাম বুখারী সেগুলিকে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন (নাঊযুবিল্লাহ) ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে সম্বন্ধ করেছেন। তার এই বাছাইয়ের জন্য তিনি প্রামাণ্য দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন নিকৃষ্টতম হাদীছ দুশমন মাহমূদ আবু রাইয়াহর বইসমূহকে।

অনুরূপ আরেকজন পন্ডিত আহমাদ যাকী আবু শাদী, যিনি স্বীয় বই ثورة الإسلام (‘ইসলামের বিপ্লব’ পৃঃ ৪৪)-য়ে বলেন,

هذه سنن ابن ماجة والبخارى وجميع كتب الحديث والسنة طافحة بأحاديث وأخبار لا يمكن أن يقبل صحتها العقل ولا نرضي نسبتها إلى الرسول وأغلبها يدعو إلى السخرية بالإسلام والمسلمين والنبى الأعظم والعياذ بالله -

‘এই যে সুনান ইবনু মাজাহ ও বুখারী বা হাদীছ ও সুন্নাহর কিতাবসমূহ, যা হাদীছ ও খবরসমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ, জ্ঞানের পক্ষে এগুলির বিশুদ্ধতা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এগুলিকে রাসূলের দিকে সম্বন্ধ করতে আমরা রাযী নই। বরং এগুলির অধিকাংশই ইসলাম, মুসলমান ও মহান নবীর প্রতি ঠাট্টার দিকে আহবান করে। ‘আমরা এসব থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই’।

উপরোক্ত পন্ডিতগণ ছাড়াও মুক্তবুদ্ধি ইসলামী চিন্তাবিদ নামে খ্যাত আরও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি আছেন, যারা চেতনে বা অবচেতনে বুঝে বা না বুঝে প্রাচীন বা আধুনিক হাদীছ দুশমনদের চটকদার যুক্তিবাদের খপ্পরে পড়ে ইসলামের নামেই ইসলামের মূল স্তম্ভ হাদীছ শাস্ত্রের প্রামাণিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যা তাদের লেখনী সমূহ দ্বারা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। ঐসকল ব্যক্তি ও তাদের বইসমূহের কয়েকটি নিম্নরূপ :

১. ডঃ আলী হাসান আব্দুল কাদের نظرة عامة في تاريخ الفقه الإسلامي ‘ইসলামী ফিক্বহের ইতিহাসের উপরে সাধারণ দৃষ্টিপাত’।

২. শায়খ মুহাম্মদ ‘ইমারাহ الإسلام والوحدة ‘ইসলাম ও ঐক্য’।

৩. মুহাম্মাদ আল-গাযালী السنة النبوية بين أهل الفقه وأهل الحديث ‘সুন্নাতে নববী : ফিক্বহবিদ ও হাদীছবিদগণের মধ্যখানে’।

৪. মুহাম্মদ আহমাদ খালাফুল্লাহ العدل الإسلامي ‘ইসলামী ন্যায়নীতি’।

৫. ডঃ হাসান তোরাবী تاريخ التجديد الإسلامي ‘ইসলামী সংস্কারবাদের ইতিহাস’।

অনুরূপভাবে ডঃ আব্দুল হামীদ মুতাওয়াল্লী মত পোষণ করেন যে, ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ভুক্ত হাদীছসমূহ দ্বারা কোন বিধানগত হুকুম সাব্যস্ত হবে না’। অন্যেরা বলেন, এসবের দ্বারা কোন ‘হুদূদ’ বা শাস্তি বিধান সাব্যস্ত করা যাবে না। অন্য একজন পন্ডিত শায়খ শালতূত ‘ছহীহ’ ও ‘মুতাওয়াতির’ হাদীছ সমূহের বিরুদ্ধে গিয়ে শেষ যামানায় ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ সম্পর্কিত আক্বীদাকে অস্বীকার করেন। অন্য একজন পন্ডিত হামাদ সাঈদান মত পোষণ করেন যে, শেষ দিকের সংকলনগুলিতে দুশমনরা ছহীহ বুখারীতে বহু মওযূ বা জাল হাদীছ জুড়ে দিয়েছে’। বস্ত্ততঃ একথা বলে তিনি নিজেকে অজ্ঞ ও হাদীছ দুশমনদের কাতারে শামিল করেছেন। এমনিভাবে তিনি তাঁর কোন কোন বইয়ে কবর আযাবের সর্বসম্মত আক্বীদার ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণ করেছেন। যে বিষয়টি মু‘তাযিলাগণ ব্যতীত কোন মুসলমান অস্বীকার করেনি।

ডঃ হাসান তোরাবী ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করার দন্ড, ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ প্রভৃতিকে অস্বীকার করেন। এতদ্ব্যতীত তাঁর বইসমূহে রয়েছে ভয়ংকর ভ্রান্তিসমূহ। অথচ এই ব্যক্তি সূদানে শরী‘আতী আইন কায়েম করার জন্য সোচ্চার। জানিনা সুন্নাতে নববীকে বাদ দিয়ে এবং হাদীছ শাস্ত্রকে অস্বীকার করে তিনি কার শরী‘আত দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চান।

আরব বিশ্বের নামকরা সাহিত্যিকদের মধ্যে ইসলামের ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে যিনি সবচাইতে নগ্ন হামলা চালিয়েছেন, তিনি হ’লেন মিসরের অন্ধ সাহিত্যিক ও সমালোচক ডঃ ত্বহা হুসাইন (১৩০৭-১৩৯৩ হিঃ/১৮৮৯-১৯৭৩ খৃঃ)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদার উপরে আঘাত হেনে তাঁর লিখিত বই على هامش السيرة (‘চরিত্রের আশে পাশে’)-এর ৫০ পৃষ্ঠায় شوق الحبيب إلى الحبيب ‘প্রিয়তমের প্রতি প্রিয়তমের আর্কষণ’ শিরোনামে উম্মুল মু’মেনীন যায়নাব বিনতে জাহশের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর বিবাহের ঘটনা অত্যন্ত নগ্ন ভাষায় পেশ করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এই বইটি মিসরীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে দেশের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে।

চার্লস ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮২) বিবর্তনবাদের অন্ধ সমর্থক ও নাস্তিক্যবাদী দর্শনের অনুসারী অন্যতম মিসরীয় সাহিত্যিক নাজীব মাহফূয (১৯১১-২০০৬) সম্ভবতঃ ইসলাম সর্ম্পকে তাঁর কপট লেখনীর পুরস্কার হিসাবেই ১৯৮৮ সালে আন্তর্জাতিক ‘নোবেল’ প্রাইজে ভূষিত হয়েছিলেন। যার বিষদুষ্ট বই সমূহ এখন বাজারে বহুল প্রচলিত। বাংলাদেশের অনেক ব্যক্তি তার প্রশংসায় মুক্তকচ্ছ।

[1]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ৭৪, গৃহীত : আল-মানার ৯ম বর্ষ ৭ ও ১২ সংখ্যা।

[2]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ৭৫, গৃহীত : আল-মানার ১০ম বর্ষ... দ্রঃ।

[3]. ড. আহমাদ আমীন, ফাজরুল ইসলাম (মিসর : ১৯৭৫) পৃঃ ২১৭-২১৮।

[4]. ড. মুছত্বফা আস-সাবাঈ, আস-সুন্নাহ (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৪র্থ সংস্করণ ১৪০৫/ ১৯৮৫) পৃঃ ৩৩৫।

ভারতীয় স্কুল (مدرسة الهند)
১. স্যার সৈয়দ আহমাদ খান (১৮১৭-১৮৯৮ খৃঃ)

আরব বিশ্বে মিসরীয় পন্ডিত মুফতী মুহাম্মাদ আবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫ খৃঃ) ও তাঁর অনুসারীদের ফিৎনার সমসাময়িক কালে ভারত উপমহাদেশে স্যার সৈয়দ আহমাদ খান ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ এই ফিৎনার সূতিকাগার হিসাবে গণ্য হয়।

ডঃ আহমাদ আমীনের ভাষায় هو في الهند أشبه شيئ بالشيخ محمد عبده في مصر ‘মিসরে মুফতী মুহাম্মাদ আবদুহু-র ন্যায় তিনি ছিলেন ভারতে’। তিনি বলেন, والإصلاح عندهما إصلاح العقلية ‘তাদের দু’জনের সংস্কার কার্য ছিল যুক্তিবাদ ভিত্তিক সংস্কার’।

সৈয়দ আহমাদ খান যদিও ভারতে ইংরেজ শাসনের সমর্থক ছিলেন। তথাপি তিনি তাদের খৃষ্টানীকরণের তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি তাদের বিরুদ্ধে ও ইসলামের পক্ষে জোরালো কলমী যুদ্ধ চালিয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি কুরআন-হাদীছের চাইতে মানতিক্ব ও যুক্তিবাদের উপরে অধিক নির্ভর করেছেন। তাঁর জ্ঞান তাঁর ইল্মের চাইতে বেশী ছিল। কুরআনের যুক্তি ভিত্তিক তাফসীর করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘কুরআন যখন সঠিকভাবে বুঝা যাবে, তখন তা জ্ঞানের সাথে মিলে যাবে।..... অতএব জ্ঞান ও রুচির আলোকে তাফসীর করা ওয়াজিব’। এর ফলে তিনি তাঁর জ্ঞান ও রুচি বিরোধী বহু আয়াত ও ছহীহ হাদীছের ভুল অর্থ ও দূরতম তাবীল করেছেন। জ্ঞান মোতাবেক না হওয়ায় তিনি নবীদের মু‘জেযাকে অস্বীকার করেছেন এবং বহু ছহীহ হাদীছকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর আক্বীদাসমূহের ছিটেফোঁটা নিম্নরূপ :

(১) হৃদয়ের বিশ্বাসকেই মাত্র ঈমান বলা হয়। যদি কেউ হৃদয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে, সে ব্যক্তি মুমিন। যদিও সে অন্য ধর্মের বাহ্যিক নিদর্শনাদির সাথে সামঞ্জস্য রাখে। যেমন হিন্দুদের ন্যায় গলায় ও বগলের নীচ দিয়ে পৈতা ঝুলানো, ইহুদী-খৃষ্টান ও মজূসীদের ন্যায় কোমরে বেল্ট বা শিকল পরিধান করা কিংবা গলায় ক্রুশ (বা তার সদৃশ বস্ত্ত) ঝুলানো, তাদের পূজা- পার্বণ, বড় দিন ইত্যাদি উৎসবাদিতে যোগদান করা (২) ‘নবুঅত’ উন্নত চরিত্রের একটি দৃঢ় স্বভাবগত ক্ষমতার নাম (৩) নবীদের মু‘জেযা তাঁদের নবুঅতের প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত নয় (৪) কুরআন উন্নত ভাষা ও অলংকারের জন্য معجز বা হতবুদ্ধিকারী নয়; বরং হেদায়াত ও শিক্ষাসমূহের কারণে (৫) কুরআনের কোন আয়াত শব্দগত, অর্থগত বা হুকুমগত কোন দিক দিয়েই ‘মানসূখ’ বা হুকুম রহিত নয় (৬) আসমানী কোন কিতাবে কখনোই কোন ‘তাহরীফ’ বা শাব্দিক পরিবর্তন হয়নি (৭) রাসূল (ছাঃ)-এর পরবর্তী খলীফাগণ ‘নবুঅতের প্রতিনিধি’ নন ইত্যাদি।

তাঁর এই কল্পনানির্ভর অতি যুক্তিবাদী ধ্যান-ধারণা বহু বিলাসী পন্ডিতের মনোজগতে নাড়া দেয় এবং তারাও একই পথ ধরে হাদীছ অস্বীকারের চোরা পথ বেছে নেন। যেমন মৌলবী চেরাগ আলী, আব্দুল্লাহ চকড়ালবী, আহমাদ দ্বীন অমৃতসরী প্রমুখ পন্ডিত প্রকাশ্যে বলতে থাকেন যে, দ্বীনী বিষয়সমূহে কুরআনই যথেষ্ট, হাদীছের কোন প্রয়োজন নেই। তবে যেগুলি তাদের প্রবৃত্তির অনুকূলে হ’ত, সেগুলিকে তারা গ্রহণ করতেন।

২. চেরাগ আলী

সৈয়দ আহমাদ খানের চিন্তাধারার অনুসারী মৌলবী চেরাগ আলী বলেন, ‘সত্য-মিথ্যার মানদন্ড হিসাবে হাদীছের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা চূড়ান্ত বিচারে হাদীছের উপরে ভরসা করা সম্ভব নয়’।

৩. আব্দুল্লাহ চকড়ালবী

সৈয়দ আহমাদ খানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইনি ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে হাদীছ অস্বীকারের আন্দোলন শুরু করেন এবং বেশ কিছু বই রচনা করেন। তিনি বলেন, ‘লোকেরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে মিথ্যারোপ করেছে এবং তার নামে হাদীছ বর্ণনা করেছে’। তিনি তাঁর দলীয় লোকদের জন্য ছালাতের নতুন নিয়ম-বিধি জারি করেন এবং বলেন যে, আযান ও এক্বামত দেওয়া বিদ‘আত। এ ধরনের আরও কিছু বিদ‘আতী নিয়ম তিনি চালু করেন।

৪. মুহিববুল হক আযীমাবাদী

সৈয়দ আহমাদ খানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইনি পাটনাতে ইনকারে হাদীছের আন্দোলন শুরু করেন, যেমন আব্দুল্লাহ চকড়ালবী লাহোরে আন্দোলন শুরু করেন।

৫. নাযীর আহমাদ দেহলভী

আরবী ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। তিনি হাদীছের রাবীদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এরা মূর্খ। এরা হাদীছের তাৎপর্য বুঝে না’। তিনি বৃদ্ধ বয়সে কুরআন হেফয করেন এবং উর্দূ ভাষায় কুরআনের তরজমা ও তাফসীর করেন। উক্ত তাফসীরের মধ্যে তিনি অগ্রাহ্য কথা সমূহ ভরে দিয়েছেন।

৬. আহমাদ দ্বীন অমৃতসরী

আব্দুল্লাহ চকড়ালবীর সহযোগী এই ব্যক্তি পূর্ব পাঞ্জাবের অমৃতসরে ইনকারে হাদীছের আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। ‘আল-উম্মাতুল ইসলামিয়াহ’ (ইসলামী দল) নামক দলের তিনি প্রতিষ্ঠাতা।

৭. এনায়াতুল্লাহ মাশরেক্বী

লন্ডনের কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী এই পন্ডিত উগ্র আধুনিকতার ঝান্ডা উড্ডীন করেন ও সালাফে ছালেহীনের পথ থেকে বিচ্যুত হন। তিনি আলেমদের থেকে ও তাঁদের অনুসৃত ইসলাম থেকে নিজেকে বিমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনি হাদীছ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তার বইসমূহে দ্বীনের মূলনীতিসমূহের ব্যাপারে বিদ্রুপ করেন। তিনি শুধুমাত্র কুরআনের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনার মূলনীতি সমূহ তৈরী করেন এবং এজন্য ১০ টি উছূল বা মূলনীতি নির্ধারণ করেন ও ধারণা করেন যে, এগুলিই হ’ল কুরআনের সারবস্ত্ত ও রিসালাতের মূল কথা।

৮. ক্বাযী মুহাম্মাদ শফী‘

হাদীছ সম্পর্কে তার লেখনীসমূহে বহু বিচ্যুতি রয়েছে। যেমন তিনি বলেন, ‘বহু হাদীছ এমন রয়েছে, যা যৌন সাহিত্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখে’ (নাঊযুবিল্লাহ)।

৯. আসলাম জয়রাজপুরী

হাদীছ অস্বীকারকারীদের মধ্যে উপমহাদেশে শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম। ইনি হাদীছ অস্বীকারকারীদের নেতা গোলাম আহমাদ পারভেয-এর প্রধান সহযোগী, বরং উস্তায ছিলেন। ইনিই হাদীছের বিরুদ্ধে তার নষ্ট চিন্তাধারা সমূহ ‘মাক্বামে হাদীছ’ (হাদীছের স্থান) নামে উর্দূতে দু’খন্ডে বই আকারে প্রকাশ করেন।

১০. গোলাম আহমাদ পারভেয

‘আহলে কুরআন’ (কুরআনের অনুসারী) নামক হাদীছ বিরোধী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এই ব্যক্তি তার সংগঠনের মুখপত্র ‘তুলূ‘এ ইসলাম’ ( طلوع إسلام বা ইসলামের উদয়) নামক পত্রিকার মাধ্যমে এবং হাদীছের বিরুদ্ধে বহু বই ও পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে ইনকারে হাদীছের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কুরআন ও হাদীছের ইল্মে অজ্ঞ কতিপয় ইংরেজী শিক্ষিত পন্ডিত বিজাতীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাদীছের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক দুশমনী শুরু করেন। তাদের প্রতিপাদ্য বিষয় হ’ল : আধুনিক যুগে প্রাচীন যুগের ফেলে আসা হাদীছের অনুসরণ বাতিল।’

ডঃ মুহাম্মাদ মুছত্বফা আ‘যমী বলেন, প্রাচীন ও আধুনিক যুগের সকল মুনকিরে হাদীছ ছালাত, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি ফরযসমূহ ও এসবের ত্রিুয়ানুষ্ঠানসমূহ কবুল করে নিয়েছে। কিন্তু ‘আহলে কুরআন’ গ্রুপ এমন কট্টর হাদীছ দুশমন যে, তারা এসব সর্বজন গৃহীত ইবাদত সমূহকেও অস্বীকার করেছে। তারা বলে যে, ‘কুরআন আমাদের বারবার ছালাতের ও যাকাতের হুকুম করেছে। এভাবে পুনরুক্তি না করে আল্লাহ ইচ্ছা করলে এসবের ব্যাখ্যা দিতে পারতেন এবং বলতে পারতেন ‘তোমরা যোহর, আছর ও এশা চার রাক‘আত, মাগরিব তিন রাক‘আত ও ফজর দু’রাক‘আত পড়; কিন্তু তিনি এসব বলেননি। অতএব আনুষ্ঠানিকভাবে ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি ইবাদতের কোন বাধ্যবাধকতা নেই’।

এতেই বুঝা যায়, তারা হাদীছের বিরোধিতায় কতদূর পৌঁছে গেছে। তারা বুঝে না যে, কুরআন ও হাদীছ উভয়ের বর্ণনাকারী হ’লেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং উভয়ের বাহক ও প্রচারক হ’লেন ছাহাবায়ে কেরাম। তারা হাদীছকে অস্বীকার করে পরোক্ষভাবে রাসূলকেই অস্বীকার করেছে (নাঊযুবিল্লাহ)।

হাদীছ দুশমনদের উক্ত কাতারে অগ্রণীদের মধ্যে উর্দূ পত্রিকা ‘নুকার’ ( نُكَار ‘নিষ্কৃতি’)-এর সম্পাদক নিয়ায ফতেহপুরী এবং ইনকারে হাদীছ বিষয়ে বিভিন্ন পুস্তিকার লেখক গোলাম জীলানী বার্ক্ব ছিলেন অন্যতম। হাদীছের প্রামাণিকতার বিরুদ্ধে তাদের বহু ভ্রান্তিকর ও অমার্জনীয় লেখনীসমূহ রয়েছে। তবে তারা উভয়ে মৃত্যুর পূর্বে তওবা করে গেছেন (আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করুন!)। কিন্তু যে সকল লেখনী তাদের বেরিয়ে গেছে[1], যা লোকদের জন্য স্থায়ী ভ্রান্তির উৎস হয়ে আছে, সেগুলি পড়ে যেন কোন অল্প বুদ্ধি লোক বিভ্রান্ত না হন, সেদিকে সুধী পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

[1]. নিয়ায ফতেহপুরী রচিত উর্দূ ‘ছাহাবিয়াত’ বইটি ‘মহিলা সাহাবী’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেছেন জনাব গোলাম সোবহান সিদ্দিকী। প্রকাশক : আল-ফালাহ পাবলিকেশন্স, ঢাকা। যেখানে ১৪ জন মহিলা ছাহাবীর জীবনী আলোচিত হয়েছে। আলোচনায় লেখক তাঁর উদ্দেশ্য ঠিক রেখেছেন। যেমন মা আয়েশা (রাঃ)-এর জীবনী আলোচনা শেষে ‘একটি পর্যালোচনা’ শিরোনামে তিনি বলেন, তিনি (অর্থাৎ আয়েশা (রাঃ) যা কিছু বলতেন, যে ব্যাখ্যা করতেন, তা ছিল সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং যুক্তি নির্ভর। তাঁর এমন বর্ণনা খুব কমই পাওয়া যাবে, যা বিশ্বাস করার জন্য অহেতুক ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে।.... তিনি ছিলেন অন্ধ অনুকরণের ঘোর বিরোধী। রাসূলে খোদার কথা ও কাজের সত্যিকার তাৎপর্যে উপনীত হওয়ার জন্য সর্বদা চেষ্টা করতেন তিনি। শরীয়তে সবচেয়ে যুক্তিযুক্তের অনুবর্তনের যে প্রবল ধারা তার বর্ণনা থেকে প্রতিভাত হয়, তা সাধারণতঃ অন্য কারো বর্ণনায় পরিলক্ষিত হয় না’ (মহিলা সাহাবী পৃঃ ৬৫)।

পাঠক! নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, লেখক এখানে মা আয়েশা (রাঃ)-এর যুক্তিবাদী মেধাকেই অগ্রগণ্য করেছেন। তাঁর হাদীছ অনুসরণকে নয়। অথচ আলী (রাঃ) বলেছেন, যদি দ্বীন মানুষের ‘রায়’ বা জ্ঞান মোতাবেক হ’ত, তাহ’লে মোযার নীচে মাসাহ করা উত্তম হ’ত মোযার উপরে মাসাহ করার চাইতে’ (আবুদাঊদ হা/১৬২ ‘মাসাহ’ অনুচ্ছেদ নং ৬৩)। নিঃসন্দেহে ইসলাম জ্ঞান ও যুক্তিবাদী র্ধম। কিন্তু তাই বলে তার সবকিছুই সর্বদা সকলের যুক্তি ও জ্ঞান মোতাবেক হবে, এমনটি কখনোই নয়। কেননা মানুষের জ্ঞান সবার সমান নয় এবং আল্লাহর জ্ঞানের সাথে মানুষের জ্ঞান তুলনীয় নয়। অতএব চোখ-কান খোলা রেখে এসব লেখকদের বই পড়তে হবে। নইলে নিজের অজান্তেই এদের পাতানো ফাঁদে আটকে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাবে। -লেখক।

১০
হাদীছ বিরোধীদের অভিযোগসমূহ (إدعاء منكري الحديث)
হাদীছ বিরোধী পন্ডিতগণের অভিযোগসমূহ প্রধানতঃ পাঁচটি। যা মূলতঃ মু‘তাযিলা পন্ডিতদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছিল। সেখান থেকে আধুনিক প্রাচ্যবিদগণ নিয়েছেন। অতঃপর সেখান থেকে আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদ নামে খ্যাত কিছু মুসলিম পন্ডিত নকল করেছেন। নিম্নে এগুলির সার-সংক্ষেপ প্রদত্ত হ’ল :

(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে হাদীছসমূহ লিপিবদ্ধ হয়নি।

(২) ছাহাবীগণ হাদীছ লেখার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞার তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝেছিলেন বলেই তাঁরা হাদীছ লিপিবদ্ধ করেননি।

(৩) রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর একশত বৎসর পরে প্রথম হাদীছ সংকলিত হয়। পরে তা হারিয়ে যায়। অতঃপর তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে এসে লোকদের মুখ থেকে শুনে তা পুনরায় লিপিবদ্ধ করা হয়।

(৪) জাল হাদীছসমূহ ছহীহ হাদীছসমূহের সাথে মিশে যায়। যা পরে পৃথক করা সম্ভব হয়নি।

(৫) মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ হাদীছ বাছাইয়ের যে সব মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন, তার সমস্তটাই সনদ ও রাবীদের সমালোচনায় কেন্দ্রীভূত। মতনের (Text) আসল-নকল যাচাইয়ের প্রতি তাঁরা যথাযথ নযর দেননি।

অথচ উক্ত অভিযোগগুলির সবই মিথ্যা। বরং সূর্যের মুখে ধুলা ছিটানোর শামিল। হাদীছ শাস্ত্রের একজন সাধারণ পাঠকও এসব কথার জবাব দিতে পারেন।

১১
হাদীছ বিরোধীদের যুক্তিসমূহ (أدلة منكري الحديث)
১. কুরআন সকল বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করেছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ‘আমরা কিতাবে কোন কিছু ছাড়িনি’ (আন‘আম ৬/৩৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ ‘আর আমরা আপনার উপরে কুরআন নাযিল করেছি (মানুষের প্রয়োজনীয়) সকল বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হিসাবে’ (নাহল ১৬/৮৯)। অতএব হাদীছের প্রয়োজন নেই (যাওয়াবে‘ পৃঃ ৩১৯)।

প্রথম আয়াতের ‘কিতাব’ অর্থ হ’ল, ‘লওহে মাহফূয’। যেখানে আল্লাহ মানুষের দ্বীন-দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সকল বিষয় লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, কিছুই ছাড়েননি বা লিখতে ভুলেন নি।

দ্বিতীয় আয়াতের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাই হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ২৩ বছরের দীর্ঘ নবুঅতী জীবন। যাঁর কথা, কর্ম ও সম্মতি সমূহ ‘হাদীছ’ হিসাবে উম্মতের নিকট মওজুদ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘আমার রাসূল তোমাদের যা প্রদান করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। এখানে ‘প্রদান করেন’ অর্থ ‘আদেশ করেন’ (ইবনু কাছীর)। যেমন ‘আব্দুল ক্বায়েস’ গোত্রের প্রতিনিধি দল রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এলে তিনি তাদেরকে চারটি বিষয়ে আদেশ করেন ও চারটি বিষয় নিষিদ্ধ করেন। অতঃপর তিনি উক্ত আয়াতটি পাঠ করেন।[1] অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَمَا نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ فَاجْتَنِبُوْهُ ‘যখন আমি তোমাদের কোন বিষয়ে আদেশ দেই, তখন তোমরা তা সাধ্যমত পালন কর। আর যখন কোন বিষয়ে নিষেধ করি, তখন তা থেকে বিরত হও’।[2]

একদা আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হাদীছ শুনালেন, لَعَنَ اللهُ الْوَاشِمَاتِ وَالْمُوتَشِمَاتِ وَالْمُتَنَمِّصَاتِ وَالْمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ الْمُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ ‘আল্লাহ লা‘নত করেছেন ঐ সমস্ত নারীর প্রতি যারা অন্যের শরীরে উল্কি অংকন করে, নিজ শরীরে উল্কি অংকন করায়, যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রুর চুল উপড়ে ফেলে ও দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। যে সব নারী আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি আনয়ন করে।’ একথা বনু আসাদের জনৈকা মহিলা উম্মে ইয়াকূবের নিকট পেঁŠছলে তিনি ইবনু মাসঊদের নিকটে এসে বললেন, আপনি কি এরূপ কথা বলেছেন? ইবনু মাসঊদ বললেন, আমি কেন তাকে লা‘নত করব না, যাকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) লা‘নত করেছেন এবং যা আল্লাহর কিতাবে রয়েছে? তখন মহিলাটি বলল, আমার কাছে রক্ষিত কুরআনের কোথাও একথা পাইনি। জবাবে ইবনু মাসঊদ বললেন, যদি তুমি কুরআন ভালভাবে পড়, তাহ’লে পাবে। তুমি কি দেখনি আল্লাহ বলেছেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ ... ‘আমার রাসূল তোমাদের যা আদেশ করেন, তা গ্রহণ কর ... (হাশর ৫৯/৭)। তখন মহিলাটি বলল, হাঁ। ইবনু মাসঊদ বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে উক্ত কাজে নিষেধ করেছেন’। তখন মহিলাটি বলল, আমার ধারণা আপনার পরিবারে এরূপ আছে। ইবনু মাসঊদ বললেন, যাও দেখে আসো। মহিলাটি ভিতরে গিয়ে তেমন কিছু না পেয়ে ফিরে এল। তখন ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বললেন, যদি এরূপ থাকত, তাহ’লে তুমি আমাদের দু’জনকে (স্বামী-স্ত্রীকে) একত্রে পেতে না (অর্থাৎ তালাক হয়ে যেত)’।[3]

মোটকথা সুন্নাহর মাধ্যমেই কুরআন تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْئٍ ‘সকল বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা’ হয়েছে। অতএব হাদীছ ব্যতীত কুরআন অনুসরণ করা সম্ভব নয়।

২. কুরআন আল্লাহ সহজ করেছেন। অতএব হাদীছের প্রয়োজন নেই। যেমন আল্লাহ বলেছেন, وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ ‘আমরা কুরআনকে সহজ করেছি উপদেশ লাভের জন্য। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (ক্বামার ৫৪/১৭, ২২, ৩২, ৪০)।

উত্তর : এখানে কুরআন সহজ হওয়ার অর্থ হ’ল, এর শিক্ষা-দীক্ষা সহজ-সরল ও বাস্তবায়নযোগ্য। যেমন ছালাত কায়েম কর, যাকাত দাও, ছিয়াম রাখ, হজ্জ কর। পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। অন্যায় ও অশ্লীলতা হ’তে দূরে থাক ইত্যাদি। এগুলি যেকোন কুরআন পাঠক সহজে বুঝতে পারেন। কিন্তু কুরআন অনুধাবনের অর্থ তা নয়। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ - ‘এই কিতাব যা আমরা আপনার নিকট নাযিল করেছি, তা বরকতমন্ডিত। তা এজন্য নাযিল করেছি যাতে লোকেরা এর আয়াতসমূহ গবেষণা করে এবং জ্ঞানীরা এ থেকে উপদেশ হাছিল করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)। তিনি জ্ঞানীদের তিরষ্কার করে বলেন, أَفَلاَ يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوْبٍ أَقْفَالُهَا؟ ‘কেন তারা কুরআন গবেষণা করেনা? নাকি তাদের হৃদয় সমূহ তালাবদ্ধ?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)। কুরআন গবেষণা ও তার মর্ম অনুধাবন ও সেখান থেকে বিধি-বিধান নির্ধারণ ও উপদেশ আহরণের জন্য প্রয়োজন কুরআনের ভাষা ও অলংকার জ্ঞানে পরিপক্কতা অর্জন করা ও অন্যান্য যরূরী বিষয়াদিতে দক্ষতা লাভ করা। বস্ত্ততঃ কুরআনের প্রথম ব্যাখ্যাতা হ’লেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। অতঃপর ছাহাবায়ে কেরাম, যাদের কাছে তিনি কুরআন বর্ণনা করেছেন, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, বিধানসমূহ বাস্তবায়ন করেছেন ও উপদেশ প্রদান করেছেন। যা লিপিবদ্ধ আছে ‘হাদীছ’ ও ‘আছারে’। অতএব হাদীছ ব্যতীত কুরআন অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

৩. আল্লাহ কেবল কুরআন হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, হাদীছের নয়।

উত্তর : আল্লাহ বলেছেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ‘আমরা যিকর নাযিল করেছি এবং আমরাই এর হেফাযতকারী’ (হিজর ১৫/৯)। এখানে ‘যিকর’ অর্থ যেমন ‘কুরআন’ তেমনি ‘হাদীছ’। বরং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শরী‘আতের হেফাযতকারী হ’লেন আল্লাহ। কেননা ইসলাম হ’ল পূর্ণাঙ্গ দ্বীন এবং তা মানবজাতির জন্য আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম (মায়েদাহ ৫/৩)। অতএব শত্রুরা যতই চক্রান্ত করুক, একে ধ্বংস করার ক্ষমতা কারু নেই। আল্লাহ এর হেফাযতকারী। অতএব ‘যিকর’ কেবলমাত্র কুরআন নয়, বরং হাদীছ সহ পূর্ণাঙ্গ শরী‘আত। আল্লাহ বলেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ ‘অতএব তোমরা জিজ্ঞেস কর জ্ঞানীদের যদি তোমরা না জানো’ (নাহল ১৬/৪৩)। এখানে ‘আহলুয যিকর’ অর্থ আল্লাহর দ্বীনে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ (16) إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ (17) فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ (18) ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ (19) ‘আপনি ‘অহি’ আয়ত্ব করার জন্য দ্রুত জিহবা সঞ্চালন করবেন না’। ‘নিশ্চয়ই তা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদের’। ‘অতএব যখন আমরা (জিব্রীলের মাধ্যমে) তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন’। ‘অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমাদেরই’(ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)। এখানে ‘বিশদ ব্যাখ্যা’ অর্থ ‘হাদীছ’, যা অহি ও ইলহামের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রদান করেছেন। অতএব কুরআন ও হাদীছ দু’টিরই হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহর।

ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, শরী‘আত অভিজ্ঞ বিদ্বানগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই যে, আল্লাহ প্রেরিত সকল ‘অহি’ যিকরের অন্তর্ভুক্ত এবং সকল ‘অহি’ সংরক্ষিত। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ যা হেফাযত করে থাকেন। আর আল্লাহ যার হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, তা সকল প্রকার ক্ষতি হ’তে নিরাপদ এবং যা চিরকালের জন্য সকল প্রকার তাহরীফ বা পরিবর্তন ও বাতিলকরণ হ’তে মুক্ত।’ তিনি বলেন, ‘যারা যিকর অর্থ স্রেফ ‘কুরআন’ বলেন, তাদের এ দাবী মিথ্যা ও প্রমাণহীন। বরং কুরআন ও সুন্নাহ সবটাই ‘অহি’ এবং সবটাই যিকরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ ‘আর আমরা আপনার প্রতি ‘যিকর’ নাযিল করেছি মানুষকে ব্যাখ্যা করে দেওয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে। যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহল ১৬/৪৪)।

বস্ত্ততঃ রাসূল (ছাঃ) প্রদত্ত ব্যাখ্যা ও তাঁর প্রদর্শিত পথই হ’ল ‘সুন্নাহ’ বা ‘হাদীছ’ যা ছাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি ও লেখনীর মাধ্যমে চিরকালের জন্য কুরআনের ন্যায় সংরক্ষিত হয়ে আছে।

[1]. নাসাঈ হা/৫৬৪৩ ‘পানীয়’ অধ্যায় ৩৬ অনুচ্ছেদ; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৭।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৫, ‘মানাসিক’ অধ্যায়-১০।

[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৪৩১, ‘পোষাক’ অধ্যায়-২২, ‘চুল আঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ-৩।

১২
উপমহাদেশে হাদীছ বিরোধী সংগঠন সমূহ
( فرق المنكرين في الحديث في شبه القارة الهندية )

উপমহাদেশে হাদীছ বিরোধীদের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের আলীগড়, অমৃতসর প্রভৃতি শহর। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে এটি পাকিস্তানের লাহোরে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে বসে তারা ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে লিপ্ত হয়। ভারতেও এর রেশ চলতে থাকে। পাশ্চাত্য বিশ্বে এর অপপ্রচার ব্যাপ্তি লাভ করে। উর্দূভাষী না হওয়ায় বাংলাভাষী মুসলমানগণের অধিকাংশ এদের করাল থাবা থেকে বেঁচে গেছে। কিন্তু ইতিমধ্যে এদের কারু কারু বই বাংলাভাষায় অনুদিত হয়ে ব্যাপকহারে প্রচারিত হওয়ায় তরুণ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজের অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন এবং দেশে হাদীছ বিরোধী মনোভাব ক্রমে মাথাচাড়া দিচ্ছে।

বর্তমানে হাদীছ বিরোধীদের কয়েকটি ফের্কা পাকিস্তানে সংগঠিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যেমন :

১. আহলে কুরআন ( فرقہ أهل قرآن )

আব্দুল্লাহ চকড়ালবী প্রতিষ্ঠিত এই দলের পুরো নাম ‘আহলুয্ যিকরে ওয়াল কুরআন’ যার বর্তমান নেতা মুহাম্মাদ আলী রাসূল লাক্ভী। পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে এর অফিস রয়েছে। এ দলের মুখপত্র ‘বালাগুল কুরআন’ ( بلاغ القرآن ) পত্রিকার মাধ্যমে এদের ভ্রান্ত আক্বীদা পাকিস্তানে সর্বত্র প্রচারিত হচ্ছে। অথচ কুরআনেরই নির্দেশ অনুযায়ী রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুসরণ করা ফরয। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দিবেন’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।

২. উম্মাতে মুসলিমাহ ( فرقہ أمة مسلمة )

আব্দুল্লাহ চকড়ালবীর অনুসারী খাজা আহমদ দ্বীন প্রথমে ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের অমৃতসরে এই দলের গোড়াপত্তন করেন। ১৯৪৭-এর পরে এই দল লাহোরে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এখানেই তাদের প্রধান কেন্দ্র এবং ‘ফায়যে ইসলাম’ ( فيض إسلام ) পত্রিকা তাদের প্রধান মুখপত্র।

৩. তাহরীকে তা‘মীরে ইনসানিয়াত ( فرقہ تعمير إنسانيت )

আব্দুল খালেক মালূহ কর্তৃক লাহোরে প্রতিষ্ঠিত এই দলের তরুণ ও তুখোড় নেতা ক্বাযী কেফায়াতুল্লাহ উর্দূ, আরবী ও ইংরেজীতে বহু বই লিখে তার দলের আদর্শ প্রচার করে চলেছেন।

৪. ফের্কা তুলূ‘এ ইসলাম ( فرقہ طلوع إسلام )

গোলাম আহমাদ পারভেয কর্তৃক প্রথমে হিন্দুস্তানে প্রতিষ্ঠিত এই দলটির নেতারা ১৯৪৭-এর পরে লাহোরে এসে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার প্রচার শুরু করেন এবং পাকিস্তানের প্রায় সকল শহরে শাখা কায়েম করেন। ইউরোপের বিভিন্ন শহরেও এ দলের শাখা রয়েছে। যেখান থেকে হাদীছ বিরোধী আক্বীদা সমূহ নিয়মিতভাবে প্রচার করা হয়। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আহমাদ পারভেয ৩০ টির উপর বই লেখেন। যার কোন কোনটি ৩ বা ৪ খন্ডে সমাপ্ত। তবে এই দলের দবদবা অনেকটা হরাস পেয়েছে দলের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে ১৯৬১ সালে প্রায় এক হাযার ওলামায়ে কেরামের সম্মিলিতভাবে ‘কুফরী’ ফৎওয়া প্রদানের কারণে। করাচীর ‘মাদরাসা ‘আরাবিয়া ইসলামিয়াহ’ এই মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করে।

১৩
আহলেহাদীছ সংগঠনসমূহের প্রতিরোধ আন্দোলন
( حركة جمعيات أهل الحديث خلاف المنكرين )

উপরোক্ত দল সমূহের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে উপমহাদেশের আহলেহাদীছ সংগঠনগুলি জোরালো ভূমিকা পালন করে। এসময় অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম ছাড়াও তিনজন আহলেহাদীছ বিদ্বান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁদের পরিচালিত তিনটি প্রসিদ্ধ পত্রিকার মাধ্যমে। (১) মাওলানা মুহাম্মাদ হোসায়েন বাটালবী (মৃঃ ১৯২০ খৃঃ) স্বীয় ‘ইশা‘আতুস সুন্নাহ’ ( إشاعة السنہ ) পত্রিকার মাধ্যমে (২) মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (১৮৬৮-১৯৪৮খৃঃ) স্বীয় ‘আহলেহাদীছ’ ( أہلحديث ) পত্রিকার মাধ্যমে এবং মাওলানা আত্বাউল্লাহ হানীফ ভূজিয়ানী (১৩২৭-১৪০৮ হিঃ/১৯১০-১৯৮৮ খৃঃ) স্বীয় ‘আল-ই‘তিছাম’ ( الإعتصام ) পত্রিকার মাধ্যমে। সাথে সাথে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত আহলেহাদীছ সংগঠনসমূহ এবং তাঁদের লিখিত বিভিন্ন বই ও পুস্তিকাসমূহ হাদীছের প্রামাণিকতার পক্ষে এবং হাদীছ বিরোধীদের বিপক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু এঁরা নন। বরং উপমহাদেশের সকল আহলেহাদীছ বিদ্বান যুগে যুগে হাদীছ অস্বীকারকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আপোষহীন জিহাদ চালিয়ে গেছেন। যেকোন নিরপেক্ষ গবেষক একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।

১৪
হাদীছে সন্দেহবাদীদের কয়েকজন
( بعض المتشككين في الحديث )

অমুসলিমদের কেউ হাদীছের বিরুদ্ধে লিখলে মুসলমানেরা তা সহজে গ্রহণ করে না। পক্ষান্তরে মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ যখন হাদীছের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে লেখেন, তখন মুসলমানদের অধিকাংশ তা গ্রহণ না করলেও কিছু লোক অবশ্যই তা গ্রহণ করেন। কিন্তু মুশকিল হয় তখনই, যখন দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তি দেশে ইসলামী আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেছেন, ইসলামের পক্ষে জান-মাল, সময় ও শ্রমের কুরবানী দিচ্ছেন, অথচ ইসলামী আইনের অন্যতম মূল উৎস ‘হাদীছ’-এর প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। একদিকে তিনি হাদীছের পক্ষে কথা বলছেন, অন্যদিকে তার লেখনী ও বক্তব্য হাদীছ বিরোধীদের পক্ষে মযবুত দলীল হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে, এমন ধরনের ইসলামী চিন্তাবিদগণের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর আক্বীদা ও আমলের সর্বাধিক ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। এমনি ধরনের দু’একজন সুপ্রসিদ্ধ ও প্রভাবশালী আলেমের দৃষ্টান্ত উদাহরণ স্বরূপ নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।-

১. মাওলানা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯ খৃঃ)

সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের আওরঙ্গাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি جماعت إسلامى (‘জামায়াতে ইসলামী’ -ইসলামী দল) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং ترجمان القرآن ‘তারজুমানুল কুরআন’ (কুরআনের মুখপত্র) নামে একটি উর্দূ মাসিক পত্রিকা বের করেন। তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপরে অসংখ্য বই ও পুস্তিকা প্রণয়ন করেন। নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারা ও পাশ্চাত্যের ইসলাম বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে তাঁর আকর্ষণীয় ও যুক্তিপূর্ণ লেখনী বহু লোকের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয় ও তারা ইসলামের জন্য জান-মাল উৎসর্গ করতে প্রস্ত্তত হয়ে যায়।

১৯৪৭-এর পরে তিনি পাকিস্তানের লাহোরে হিজরত করেন ও পাকিস্তানে ইসলামী হুকূমত প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তানে মাওলানা আব্দুর রহীম (১৯১৮-১৯৮৭) তাঁর বইসমূহ বাংলায় অনুবাদ করেন। ফলে বাংলাদেশে তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থকে। পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে এই দল বর্তমানে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

মাওলানা মওদূদী বিভিন্ন বিষয়ে বেশুমার লেখনীর অধিকারী ছিলেন। ফলে অনেক কিছু ভুল হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। তিনি নিজেও সেকথা স্বীকার করেছেন এবং তাঁর তাফসীর ‘তাফহীমুল কুরআন’-এর প্রথম সংস্করণের অনেক বিষয় তিনি পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করেছেন। যেমন সূরা বাক্বারাহ ২০৩ আয়াত ও সূরা নিসা ১১ আয়াতের ভুল তাফসীর তিনি পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করেছেন। অনুরূপভাবে তাঁর পত্রিকা ‘তারজুমানুল কুরআনে’ (৪র্থ বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা ১৯৫৫ পৃঃ ৩৭৯)। যখন তিনি মোতা‘ ( نكاح متعہ ) বা ঠিকা বিবাহ জায়েয ফৎওয়া দিলেন, তখন ওলামায়ে কেরামের প্রতিবাদের মুখে পরে তিনি তা থেকে প্রত্যাবর্তন করেন এবং স্বীয় ‘রাসায়েল ও মাসায়েল’ বইয়ের মধ্যে এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন ।[1] যদিও শী‘আরা তাঁর উক্ত ফৎওয়া নিজেদের পক্ষে ও সুন্নীদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু ‘তাফহীমুল কুরআনে’ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংত্রুান্ত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যায় তিনি ভ্রান্ত ফির্কা মু‘তাযিলাদের অনুকরণে যেসব তাবীল করেছেন, তা থেকে প্রত্যাবর্তন করেননি।

অনুরূপভাবে মু‘জেযা সংক্রান্ত কিছু কিছু আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি তাবীলের আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন সূরা আম্বিয়া ৭৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘পাহাড়সমূহ ও পক্ষীকুলকে আমি দাঊদ-এর জন্য অনুগত করে দিয়েছি, যারা তাসবীহ পাঠ করে’-এর ব্যাখ্যা তিনি এভাবে করেছেন যে, দাঊদ (আঃ) যখন তাঁর সুন্দর কণ্ঠে আল্লাহর প্রশংসা করতেন, তখন পাহাড়সমূহ তাঁর মিষ্টিমধুর আওয়াযের কারণে কেঁপে কেঁপে উঠত এবং পক্ষীকুল দাঁড়িয়ে যেত’। ‘পর্বত সমূহের অনুগত হওয়া’কে ‘সুর লহরীতে প্রকম্পিত হওয়া’র এই কাল্পনিক ব্যাখ্যার জন্য খ্যাতনামা মুফাসসির আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, এটি তাফসীর নয়, বরং তাহরীফ অর্থাৎ কুরআনের মর্ম পরিবর্তন (দ্রঃ তাফসীরে মাজেদী)। এধরনের আরও বহু উদাহরণ বিদ্বানগণ উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এসব বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম ভুল ধরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রত্যাবর্তন করেননি। অথচ এসব ভুলের মূল কারণ হ’ল, কুরআনের তাফসীর করার সময় হাদীছের প্রতি গুরুত্ব কম দেওয়া এবং যুক্তিবাদের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়া।

অনুরূপভাবে তিনি হাদীছ শাস্ত্র, হাদীছের প্রামাণিকতা, সনদ ও মতনের বিশুদ্ধতা যাচাই ইত্যাদি বিষয়ে মুহাদ্দেছীনের গৃহীত جرح وتعديل তথা ‘সমালোচনা ও পর্যালোচনা’র নীতিমালা সম্পর্কে অযৌক্তিক সন্দেহবাদ আরোপ করেছেন। বরং তাঁদের তীব্র সমালোচনায় তিনি এতদূর পৌঁছে গেছেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে হাদীছ অস্বীকারকারীদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। ফলে হাদীছ অস্বীকারকারী দলের নেতা গোলাম আহমাদ পারভেয মাওলানা মওদূদীর বক্তব্যকে নিজেদের পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করেন। যেমন তিনি স্বীয় পত্রিকায় লিখেন যে, ‘হাদীছ অস্বীকারের ব্যাপারে আমার ও মাওলানা মওদূদীর আক্বীদা একই রূপ। অতএব ‘জামায়াতে ইসলামী’ যেন এব্যাপারে আমার সাথে বেশী ঝগড়া না করে’।[2]

গোলাম আহমাদ পারভেয-এর উক্ত মন্তব্য সত্য নয় এবং মাওলানা মওদূদীও নিঃসন্দেহে হাদীছ অস্বীকারকারী নন। কিন্তু হাদীছ সংক্রান্ত তাঁর লেখনী সমূহ পরীক্ষা করে দেখলে তা পাঠককে হাদীছ অস্বীকারের চূড়ান্ত সীমায় চলে যেতে বাধ্য করে। এর কারণ (১) তিনি হাদীছ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের গৃহীত মূলনীতি ও পদ্ধতিসমূহের তোয়াক্কা না করে তার তীব্র সমালোচনা করেছেন (২) ‘কেবল রেওয়ায়াতের দিকে মুহাদ্দিছগণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন, দেরায়াতের দিকে রাখেননি’ বলে হাদীছ অস্বীকারকারীদের সুরে সুর মিলিয়ে তাঁদের উপরে অযথা তোহমত দিয়েছেন। (৩) বুখারী ও মুসলিমের কতিপয় হাদীছের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তিনি সন্দেহ পোষণ করেছেন (৪) ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছসমূহের বিশাল ভান্ডারকে তিনি ‘ধারণা নির্ভর’ হওয়ার দোষ চাপিয়ে তা অগ্রাহ্য করতে চেয়েছেন।

অথচ উপরের দাবীগুলির কোনটিই তাঁর নিজস্ব নয়, বরং বিগত যুগের মু‘তাযিলা দার্শনিক, আধুনিক কালের খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদগণ ও তাদের বশংবদ মুসলিম পন্ডিতগণ হাদীছের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ইতিপূর্বে উত্থাপন করেছেন, সেগুলিই মাওলানা নিজের যুক্তিবাদী ভাষায় আরো জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। শুধু তিনিই নন, তাঁর সাহিত্যের ভক্ত ও আন্দোলনের অনুসারীদের চিন্তাধারায়ও তার স্পষ্ট ছাপ পরিদৃষ্ট হয়। ফলে কুরআন-সুন্নাহর হুকূমত কায়েম করার শ্লোগান নিয়ে মাঠে নামলেও এই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সুন্নাতের পাবন্দী অতীব নগণ্য। ছহীহ হাদীছের প্রতি আকর্ষণবোধ বলা চলে শূন্যের কোঠায়। ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’ বলে শুদ্ধ-অশুদ্ধ সবকিছুকে তারা একাকার করতে চান। এমনকি শহীদ মিনারে যাওয়া ও সেখানে ফুল দেওয়ার মত শিরকী ও বিদ‘আতী বিষয়গুলিকেও তারা ‘পাপও নেই পুণ্যও নেই’ বলে হালকা করে দেখেন।[3]

[1] বঙ্গানুবাদ ‘রাসায়েল ও মাসায়েল’ (ঢাকা : শতাব্দী প্রকাশনী, ৩য় মুদ্রণ ২০০১), ৩/৩৭-৩৯ পৃঃ, গৃহীত: তরজুমানুল কুরআন (রবীউল আউয়াল ১৩৭৫ হিঃ/নভেম্বর ১৯৫৫ খৃঃ)।

[2]. তুলূ‘এ ইসলাম’ এপ্রিল-মে ১৯৫৫।

[3]. জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর আমীর মাওলানা মতীউর রহমান নিজামী ও সহ-সেক্রেটারী আব্দুল কাদের মোল্লার বক্তব্য দ্রষ্টব্য : দৈনিক ইনকিলাব ১১.১০.০২ ও ২২.৬.০৩ ইং।

১৫
‘হাদীছ’ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর আক্বীদা
( عقيدة المودودي في الحديث )

হাদীছ ও হাদীছ শাস্ত্রবিদগণ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর আক্বীদা লিখিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘মাসলাকে এ‘তেদাল’ ( مسلك اعتدال ) নামক নিবন্ধে, যার বঙ্গানুবাদ ‘সুষম মতবাদ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি হাদীছকে ‘যান্নী’ ( ظنى ) বা ‘ধারণা নির্ভর’ বলে অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন। যদিও এ ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছেন। তবুও অনেক ঘুরিয়ে তিনি যে কথাটি বুঝাতে চেয়েছেন তা এই যে, হাদীছের উপরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের কোন নিশ্চিত ভিত্তি নেই। কেননা বর্ণনাকারী একজন মানুষ হিসাবে ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। অতএব এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত সত্যে উপনীত হওয়ার একমাত্র পথ হ’ল ফক্বীহদের মর্ম অনুধাবন ( تفقہ ) ও তাঁদের বিশেষ রুচিবোধ ( خاص ذوق )। মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণকে তিনি সাংবাদিক ( أخبارى ) দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী বলে মনে করেন, যারা কেবল সংবাদের সত্যাসত্য যাচাই করেন, কিন্তু এর তাৎপর্য ( فقہ ) অনুধাবন করেন না। যেমন তিনি বলেন,

محدثين رحمهم الله كى خدمات مسلم ... كلام اس ميں نہيں بلكہ صرف اس امر ميں ہے كہ كليةً ان پر اعتماد كرنا كہاں تك درست ہے، بہر حال تہے تو انسان ہى ... پہر آپ كيسے كہ سكتے ہيں كہ جس كو وہ صحيح قرار ديتے ہيں وہ حقيقت ميں بہى صحيح ہے؟ ... مزيد برآں ظن غالب ان كو جس بنا پر حاصل ہوتا تہا وه بلحاظ روايت تہا نہ كہ بلحاظ درايت- ان كا نقطہ نظر زياده تر أخبارى ہوتا تہا ، فقہ ان كا اصل موضوع نہ تہا ... يہ ماننا پڑيگا كہ احاديث كے متعلق جو كچھ بہى تحقيقات انہوں نے كى ہے اس ميں دو طرح كى كمزورياں موجود ہيں، ايك بلحاظ اسناد اور دوسرے بلحاظ تفقہ -

‘মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের খিদমত সর্বস্বীকৃত।.... এতে কোন কথা নেই। কথা কেবল এ বিষয়ে যে, পুরোপুরিভাবে তাঁদের উপরে ভরসা করা কতটুকু সঠিক হবে। হাযার হৌক তাঁরা তো ছিলেন মানুষই। ...অতএব কিভাবে আপনি একথা বলতে পারেন যে, তাঁরা যে হাদীছকে ‘ছহীহ’ সাব্যস্ত করেছেন, আসলেই সেটা ছহীহ। ...অধিকন্তু যার কারণে তাদের মধ্যে হাদীছের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সর্বোচ্চ ধারণার সৃষ্টি হয়, সেটি হ’ল রেওয়ায়াতের (বর্ণনার) দৃষ্টিকোণ, দিরায়াতের (যুক্তি গ্রাহ্যতার) দৃষ্টিকোণ নয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বেশীর বেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গি, ফিক্বহ বা তাৎপর্য অনুধাবন তাদের বিয়ষবস্ত্ত ছিল না। ...অতএব একথা মানতেই হবে যে, হাদীছসমূহে যেসব গবেষণা তাঁরা করেছেন, তাতে দু’টি দিকে তাঁদের দুর্বলতা ছিল। ১- সনদের দিক দিয়ে ২- মর্ম অনুধাবনের দিক দিয়ে।[1]

প্রিয় পাঠক! নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কত সুন্দরভাবে তিনি ফিক্বহকে হাদীছের উপরে স্থান দিতে চেয়েছেন। অথচ কে না জানে যে, হাদীছের তাৎপর্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে স্থান-কাল পাত্র ভেদে মুজতাহিদ ফক্বীহগণের মধ্যে সকল যুগে মতভেদ হয়েছে। কিন্তু হাদীছের ভাষায় কোন পরিবর্তন হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ। অতএব হাদীছের বর্ণনার বিশুদ্ধতা যাচাই করাই হ’ল মুখ্য। আর বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য বর্ণনাকারীকে যাচাই করা সর্বাধিক প্রয়োজন। মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ তাই সনদ যাচাইয়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আর একারণেই তাবেঈ বিদ্বান আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১হিঃ) বলেছেন, اَلْإِسْنَادُ عِنْدِيْ مِنَ الدِّيْنِ، لَوْلاَ الْإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ ‘আমার নিকটে সনদ হ’ল দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। যদি সনদ যাচাই না হ’ত, তাহ’লে যে যা খুশি তাই বলত’ (মুক্বাদ্দামা মুসলিম পৃঃ ১৫)। মুহাদ্দিছগণ সনদ যাচাইয়ের সাথে সাথে হাদীছের ‘দিরায়াত’ বা যুক্তিগ্রাহ্যতা সূক্ষ্মভাবে যাচাই করেছেন। উছূলে হাদীছের ছাত্রগণ তা ভালভাবেই জানেন। অতএব মাওলানার উপরোক্ত মন্তব্য হাদীছ বিরোধীদের উত্থাপিত মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। যদিও মাওলানা হাদীছ অস্বীকারকারী ছিলেন না।

তিনি বলেন, ‘উপরোক্ত আলোচনায় একথা বুঝা গেছে যে, হাদীছকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানকারী ব্যক্তিগণ যেমন ভুলের উপরে আছে, তেমনি ঐ ব্যক্তিগণও ভুল থেকে নিরাপদ নন, যারা হাদীছের কেবল রেওয়ায়াতের উপরে ভরসা করে থাকেন। সঠিক রাস্তা ঐ দু’টির মাঝখানে রয়েছে। আর সেটি হ’ল ঐ রাস্তা, যা মুজতাহিদগণ অবলম্বন করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর ফিক্বহে আপনি এমন বহু মাসআলা দেখবেন, যা মুরসাল, মু‘যাল ও মুনক্বাতি‘ (ইত্যাদি ‘যঈফ’) হাদীছসমূহের উপরে ভিত্তিশীল। অথবা যেখানে শক্তিশালী সনদের হাদীছ বাদ দিয়ে দুর্বল সনদের হাদীছ গ্রহণ করা হয়েছে। অথবা যেখানে হাদীছ কিছু বলছে, ইমাম আবু হানীফা কিংবা তাঁর শিষ্যগণ কিছু বলছেন। ইমাম মালেকের অবস্থাও অনুরূপ’।[2]

একটু পরে গিয়ে মাওলানা হাদীছের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের দ্বিতীয় মানদন্ড ( دوسري كسوٹى ) নির্ধারণ করেছেন ফক্বীহদের বিশেষ রুচিকে ( خاص ذوق )। যার মাধ্যমে তাঁরা হাদীছ পরখ করেন এবং তাতে হৃদয়ে প্রশান্তি ( اطمينان ) লাভ করলে হাদীছটি গ্রহণ করেন। যদিও মুহাদ্দিছগণের দৃষ্টিতে তা ত্রুটিপূর্ণ ( مرجوح ) হয়’।[3]

যেমন তিনি বলেন,

يہ دوسرى كسوٹى كونسى ہے؟ہم اس سے پہلے اشارةً اس كا ذكر كئى مرتبہ كر چكے ہيں- جس شخص كو الله تفقہ كى نعمت سے سرفراز فرماتا ہے اس كے اندر قرآن اور سيرت رسول كے غائر مطالعہ سے ايك خاص ذوق پيدا ہو جاتا ہے جس كى كيفيّت بالكل ايسى ہے جيسے ايك پُرانے جوہرى كى بصيرت ... اس مقام پر پہونچ جانے كے بعد انسان اسناد كا زياده محتاج نہيں رہتا- وه اسناد كا مدد ضرور ليتا ہے مگر اس كے فيصلے كا مدار اس پر نہيں ہوتا -

‘এই দ্বিতীয় মানদন্ড কোনটি? ইতিপূর্বে আমরা কয়েকবার এ বিষয়ে ইঙ্গিতে উল্লেখ করেছি। আল্লাহ যাকে মর্ম অনুধাবনের অনুগ্রহে সিক্ত করেন, তার মধ্যে কুরআন ও রাসূল-চরিত গভীরভাবে অধ্যয়নের ফলে এক বিশেষ রুচিবোধ ( خاص ذوق ) সৃষ্টি হয়। যার প্রকৃতি ঠিক ঐরূপ, যেরূপ একজন পুরানো স্বর্ণকারের দূরদৃষ্টি।... এই স্থানে পৌঁছে যাবার পর মানুষ সনদের প্রতি বেশী মুখাপেক্ষী থাকেনা। সে সনদ থেকে অবশ্যই সাহায্য নেয়। কিন্তু সিদ্ধান্তের ভিত্তি তার উপরে থাকেনা’।[4]

চটকদার যুক্তির মাধ্যমে মাওলানা নিজেদের রায়-কে হাদীছের উপরে স্থান দিতে চেয়েছেন। যা ভ্রান্ত ফের্কা মু‘তাযিলাদের অনুকরণ বৈ কিছুই নয়।

কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, ব্যক্তিগত রুচিই যদি ছহীহ-যঈফ বাছাইয়ের ও হাদীছ কবুল করা বা না করার মানদন্ড হয়, তাহ’লে তো হাদীছের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। কেননা ব্যক্তিগত রুচি তো সবার এক নয়। তাছাড়া একথার অর্থ তাহ’লে কি হবে যে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) যঈফ হাদীছকে রায়-এর উপরে অগ্রাধিকার দিতেন? ছাহাবা, তাবেঈন ও উম্মতের সেরা বিদ্বানমন্ডলী ছহীহ হাদীছ পাওয়ার সাথে সাথে ইতিপূর্বেকার আমল ছেড়ে দিয়ে ছহীহ হাদীছের অনুসারী হয়েছেন কেন? এবং কেনই বা তাঁদের ‘রায়’ পরিত্যাগ করে ছহীহ হাদীছের অনুসারী হওয়ার জন্য স্ব স্ব অনুরক্তদের নির্দেশ দিয়ে গেলেন?

বস্ত্ততঃ মাওলানার উক্ত বক্তব্য একেবারেই কল্পনাপ্রসূত এবং বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেছেন যে, إِيَّاكُمْ وَالْقَوْلِ فِيْ دِيْنِ اللهِ بِالرَّأْيِ وَعَلَيْكُمْ بِاتِّبَاعِ السُّنَةِ فَمَنْ خَرَجَ عَنْهَا ضَلَّ - ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে ‘রায়’ অনুযায়ী কোন কথা বল না । তোমাদের কর্তব্য হ’ল সুন্নাহর অনুসরণ করা। যে ব্যক্তি সুন্নাহ থেকে বেরিয়ে গেল, সে পথভ্রষ্ট হ’ল’।[5] আর প্রথম ছহীহ হাদীছের সংকলন ‘মুওয়াত্ত্বা’র স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ত্ব ইমাম মালেক (৯৫-১৭৯ হিঃ)-এর বিরুদ্ধে এরূপ কথা বলা রীতিমত তোহমত বৈকি! এইসব মহামতি ইমামগণ কখনোই জেনেশুনে হাদীছের বিরুদ্ধে নিজেদের ‘রায়’-কে অগ্রাধিকার দেননি। বরং এ বিষয়ে তাঁদের সকলের বক্তব্য প্রায় একইরূপ ছিল যে, ছহীহ হাদীছই আমাদের মাযহাব।[6]

মাওলানার উক্ত প্রবন্ধ মাসিক ‘তারজুমানুল কুরআন’ মে ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হ’লে আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে প্রমাণ চেয়ে পত্র লিখলে তিনি জবাবে লিখেন যে, اس وقت ميرے پيش نظر مطلوبہ نظير نہيں ہے اور ويسے بہى نظيريں پيش كرنے سے بحث كا سلسلہ دراز ہوتا ہے ‘এ মুহূর্তে আমার সম্মুখে অনুরূপ কোন প্রমাণ নেই। তবে এসব প্রমাণ পেশ করতে গেলে আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়ে যায়’।[7]

মাওলানা তাঁর আলোচনায় ছহীহ হাদীছের উপরে মুজতাহিদগণের রায় ও তাঁদের ব্যক্তিগত রুচিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাকেই সঠিক পথ বলে মন্তব্য করেছেন। অথচ আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের চিরন্তন নীতি হ’ল, হাদীছ মওজুদ থাকতে ক্বিয়াস বৈধ নয়’ (আর-রিসালাহ পৃঃ ৫৯৯) এবং إِذَا وَرَدَ الْأَثَرُ بَطَلَ النَّظَرُ ‘যখনই হাদীছ পাওয়া যাবে, তখনই যুক্তি বাতিল হবে’।[8] তাছাড়া ফক্বীহগণের পরস্পরের মতভেদে ফিক্বহের কিতাবসমূহ ভরপুর। এমনকি ইমাম গাযযালী (রহঃ)-এর হিসাব মতে খোদ আবু হানীফা (রহঃ)-এর সমস্ত ফৎওয়ার দুই-তৃতীয়াংশের বিরোধিতা করেছেন তাঁর দুই প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহেমাহুমাল্লাহ)’।[9]

যে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) নিজের ব্যাপারে তাঁর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, لاَ تَرْوِ عَنِّى شَيْئًا فَإِنِّىْ وَاللهِ لاَ أَدْرِيْ مُخْطِئٌ أَنَا أَمْ مُصِيْبٌ ‘তুমি আমার পক্ষ থেকে কোন মাসআলা বর্ণনা কর না। কেননা আল্লাহর কসম! আমি জানি না আমি নিজ সিদ্ধান্তে বেঠিক না সঠিক’ (খত্বীব ১৩/৪০২), সেক্ষেত্রে মাওলানা মওদূদী কিভাবে বলতে পারেন যে, মুজতাহিদগণের রায় ও তাঁদের ব্যক্তিগত রুচিই হ’ল নিশ্চিত জ্ঞানলাভের সঠিক উপায়। তিনি কি তাহ’লে মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট পথ থেকে বের করে ইসলামী চিন্তাবিদগণের পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারার ধূম্রজালে আবদ্ধ করতে চান? এটা নিঃসন্দেহে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত পথ হ’তে বিচ্যুতি। যে পথে ভ্রান্তি আছে, সত্য নেই। অশান্তি আছে, প্রশান্তি নেই।

উল্লেখ্য যে, কুরআন ও হাদীছের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন (হিজর ১৫/৯, ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً ‘আমি তোমাদের নিকটে এসেছি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে’।[10] যার রাত্রি হ’ল দিবসের ন্যায় আলোকিত। এই আলোকিত দ্বীনকে সন্দেহবাদের অন্ধকারে ঢেকে দেবার অপপ্রয়াস থেকে প্রত্যেক মুমিনকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে।

দুর্ভাগ্য এই যে, যুক্তিবাদের ধাঁধানো চোখে আমরা অনেক সময় অন্ধকার দেখি। ফলে সহজ চিন্তার স্নিগ্ধ আলোকে আমরা অহি-র বিধানের প্রকাশ্য রাস্তা খুঁজে পেতে অনেক সময় ব্যর্থ হই। যে জন্য মাওলানা মওদূদীর ন্যায় ইসলামের একজন সিপাহসালারের অতি যুক্তিবাদী চক্ষু এমনকি ছহীহ বুখারীর হাদীছসমূহের বিশুদ্ধতাও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন তিনি বলেন,

كوئي شريف آدمى يہ نہيں كہ سكتا كہ حديث كا جو مجموعہ ہم تك پہونچا ہے وه قطعى طور پر صحيح ہے- مثلاً بخارى، جسكے بارے ميں اصح الكتب بعد كتاب الله كها جاتا ہے، حديث ميں كوئي بڑے سے بڑا غلو كرنيوالا بہى يہ نہيں كہ سكتا كہ اس ميں جو چھ سات ہزار احاديث درج ہيں وه سارى كى سارى صحيح ہے -

‘কোন শরীফ লোক এ কথা বলতে পারে না যে, হাদীছের যে সমষ্টি আমাদের নিকটে পৌঁছেছে, তার সবটা অকাট্যভাবেই ছহীহ। যেমন বুখারী, যাকে আল্লাহর কেতাবের পরে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ কিতাব বলা হয়, হাদীছের অতি বড় ভক্তও একথা বলতে পারে না যে, এর মধ্যে যে ছয়-সাত হাযার হাদীছ সংকলিত আছে, তার সবটাই ছহীহ’।[11] কি তাচ্ছিল্যভরা ভয়ংকর মন্তব্য! অথচ এ প্রসঙ্গে ভারতগুরু শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) বলেন,

أَمَّا الصَّحِيْحَانِ فَقَدِ اتَّفَقَ الْمُحَدِّثُوْنَ عَلَى أَنَّ جَمِيْعَ مَا فِيْهِمَا مِنَ الْمُتَّصِلِ الْمَرْفُوعِ صَحِيْحٌ بِالْقَطْعِ، وَأَنَّهُمَا مُتَوَاتِرَانِ إِلَى مُصَنِّفَيْهِمَا، وَأَنَّهُ كُلُّ مَنْ يُهَوِّنُ أَمْرَهُمَا فَهُوَ مُبْتَدِعٌ مُتَّبِعُ غَيْرِ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ - ( حجة الله البالغة 1/134)-

‘ছহীহায়েন অর্থাৎ ছহীহ বুখারী ও মুসলিম সম্পর্কে হাদীছ বিশারদ পন্ডিতগণ একমত হয়েছেন যে, এ দু’য়ের মধ্যে মুত্তাছিল মারফূ‘ যত হাদীছ রয়েছে, সবই অকাট্যভাবে ছহীহ। যে ব্যক্তি ঐ দুই গ্রন্থ সম্পর্কে হীন ধারণা পোষণ করবে, সে বিদ‘আতী এবং মুসলিম উম্মাহর বিরোধী তরীকার অনুসারী’।[12]

অথচ হাদীছের সনদ এবং বর্ণনাগত ও তাৎপর্যগত বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের ব্যাপারে ইমাম বুখারী (রহঃ) -এর কঠোর শর্তাবলী এবং ফিক্বহ বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতা কিংবদন্তীর ন্যায় প্রসিদ্ধ। হক্ব ও বাতিলের পার্থক্যকারী ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, وَالَّذِيْ نَفْسُ عُمَرَ بِيَدِهِ مَا قَبَضَ اللهُ تَعَالَى رُوْحَ نَبِيِّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلاَ رَفَعَ الْوَحْيَ عَنْهُ حَتَّى أَغْنَي أُمَّتَهُ كُلَّهُمْ عَنِ الرَّأْيِ - ‘যাঁর হাতে ওমরের জীবন তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নবীর রূহ কবয করেননি এবং ‘অহি’ উঠিয়ে নেননি, যতক্ষণ না তাঁর উম্মত সকল প্রকার ‘রায়’ (তথা যুক্তিবাদ) হ’তে মুক্ত হ’তে পেরেছে’।[13] অতএব মুজতাহিদগণের ‘রায়’ নয়, বরং মুহাদ্দিছগণের গৃহীত ছহীহ হাদীছই হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী মানদন্ড।

[1]. সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী, তাফহীমাত (দিল্লী: মারকাযী মাকতাবা ইসলামী, ১৯৭৯) ১/৩৫৬ পৃঃ।

[2]. তাফহীমাত ১/৩৬০ পৃঃ।

[3]. ঐ, ১/৩৬১।

[4]. ঐ, ১/৩৬১-৬২।

[5]. আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী (৮৯৮-৯৭৩হিঃ), মীযানুল কুবরা (দিল্লী ছাপাঃ ১২৮৬ হিঃ) ১/৬৩ পৃঃ।

[6]. ঐ, ১/৭৩।

[7]. তাফহীমাত ১/৩৬৬।

[8]. আলবানী, আল-হাদীছু হুজ্জিয়াতুন বিনাফসিহী, পৃঃ ২৭।

[9]. দ্রঃ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ (ডক্টরেট থিসিস) পৃঃ ১৮০; গৃহীত শারহু বেক্বায়াহ-এর মুক্বাদ্দামাহ (দিল্লী ছাপা ১৩২৭ হিঃ) পৃঃ ২৮ শেষ লাইন; ঐ দেউবন্দ ছাপা, তাবি, পৃঃ ৮)।

[10]. আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/১৭৭ ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[11]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ১৪৫, গৃহীত : সাপ্তাহিক আল-ই‘তিছাম লাহোর, ২৭ মে ও ৩ জুন ১৯৫৫।

[12]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (কায়রোঃ দারুত তুরাছ, ১৩৫৫ হিঃ) ১/১৩৪ পৃঃ।

[13]. মীযান ১/৬২।

১৬
‘যান্নী’-এর ব্যাখ্যা (شرح الظني)
খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদগণ ও তাদের অনুসারী মুসলিম পন্ডিতগণ হাদীছ শাস্ত্রের গভীরে প্রবেশ না করার ফলে ‘যান্ন’ ( ظن )-এর ব্যাখ্যায় দারুণভাবে ভ্রান্তিতে পড়েছেন। তাঁরা ‘যান্নী’-এর আভিধানিক অর্থ ‘ধারণা নির্ভর’ হিসাবে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন। অথচ প্রকৃত অর্থ তা নয়।

উর্দূতে ‘যান্ন’ কল্পনা বা ধারণা অর্থে ব্যবহৃত হ’লেও আরবীতে বিনা কারণে উক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয় না। যেমন ভাষাবিদ রাগেব ইসফাহানী বলেন,

الظَّنُّ : اِسْمٌ لِمَا يَحْصُلُ عَنْ أَمَارَةٍ، وَمَتَىَ قَوِيَتْ أَدَّتْ إِِلَى الْعِلْمِ، وَمَتَى ضَعُفَتْ جِدًّا لَمْ يَتَجَاوَزْ حَدَّ التَّوَهُّمِ -

‘যে জ্ঞান নির্দশনসমূহের মাধ্যমে অর্জিত হয়, তাকে ‘যান্ন’ বলা হয়। নিদর্শন ও প্রমাণাদি যখন শক্তিশালী হয়, তখন তা ইল্ম বা দৃঢ় বিশ্বাস অর্থে উপনীত হয়। আর যখন নিদর্শন ও প্রমাণাদি খুবই দুর্বল হয়, তখন তা ধারণার সীমা অতিত্রুম করে না’ (মুফরাদাত)। কুরআনে উপরোক্ত দুই অর্থেই ‘যান্ন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-

(১) ‘দৃঢ় বিশ্বাস’ ( الظن في معني اليقين ) অর্থে। যেমন-

(ক) আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلاَقُوْا رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ

‘(ঈমানদার তারাই, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে যে, নিশ্চয়ই তারা তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাত লাভ করবে এবং তারা তাঁরই নিকটে ফিরে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/৪৬)।

(খ) পাপীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَرَأَى الْمُجْرِمُونَ النَّارَ فَظَنُّوا أَنَّهُمْ مُوَاقِعُوهَا وَلَمْ يَجِدُوا عَنْهَا مَصْرِفًا ‘অপরাধীরা আগুন দেখে দৃঢ়ভাবে বুঝবে যে, তারা সেখানে পতিত হচ্ছে এবং তারা ওখান থেকে কোন পরিত্রাণস্থল পাবে না’ (কাহফ ১৮/৫৩)।

(গ) অতঃপর জান্নাতীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘ডানহাতে আমলনামা পাওয়ার পর খুশীতে তারা বলে উঠবে, هَاؤُمُ اقْرَءُوا كِتَابِيَهْ، إِنِّي ظَنَنْتُ أَنِّي مُلاَقٍ حِسَابِيَهْ ‘এই নাও! আমার আমলনামা, তোমরা পড়ে দেখ’। ‘আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখতাম যে, আমাকে অবশ্যই হিসাবের সম্মুখীন হ’তে হবে’ (হা-ক্কাহ ৬৯/২০)।

(ঘ) জিনেরা কুরআন শুনে বলেছিল, وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ نُعْجِزَ اللهَ فِي الْأَرْضِ وَلَنْ نُعْجِزَهُ هَرَبًا - ‘আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, আমরা কখনোই পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাস্ত করতে পারব না এবং পালিয়ে গিয়েও তাঁকে ব্যর্থ করতে পারব না’ (জিন্ন ৭১/১২)।

(২) ‘ধারণা’ ( الظن في معني الخرص ) অর্থে। যেমন-

(ক) আল্লাহ বলেন, إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ ‘অধিকাংশ লোক ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।

(খ) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَمَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنَّ الظَّنَّ لاَ يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا ‘(ফেরেশতা) বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা কেবল ধারণার অনুসরণ করে। অথচ সত্যের মুকাবিলায় ধারণার কোন মূল্য নেই’ (নাজ্ম ৫৩/২৮)।

মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ হাদীছকে যে ‘যান্ন’ বলেছেন, তার অর্থ হ’ল প্রথমোক্ত ‘যান্ন’। তার অর্থ কখনোই শেষোক্ত ‘যান্ন’ বা নিছক ধারণা ও কল্পনা নয়।

ইসলামী শরী‘আতে প্রথমোক্ত ‘যান্ন’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। চুরি, মদ্যপান ব্যভিচার, হত্যাকান্ড প্রভৃতি অপরাধের বিচার ও শাস্তি বিধানের জন্য আদালতের বিচারক বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ‘নিশ্চত ধারণা’য় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেন। দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম তদন্তের পর আসামীর ব্যাপারে ধারণা নিশ্চিত হ’লেই তবে তাকে দন্ড প্রদান করা হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের সর্বযুগের তাবৎ বিচার ব্যবস্থাই নির্ভর করছে ধারণার উপরে। নিশ্চিত ধারণার ভিত্তিতেই মানুষের জেল-ফাঁস হয়ে থাকে।

ইসলাম উক্ত রূপ ‘নিশ্চিত ও প্রমাণসিদ্ধ ধারণা’-কে শুধু সমর্থনই দেয়নি, বরং গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন মৃত্যুকালীন অছিয়তের সময় দু’জন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী রাখার নির্দেশ দানের পর কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘যদি তোমাদের সন্দেহ হয়, তবে উভয়কে ছালাতের পরে থাকতে বলবে। তারপর উভয়ে আল্লাহর নামে শপথ করবে যে, আমরা এই সাক্ষ্যের মাধ্যমে কোনরূপ স্বার্থ হাছিল করব না, যদিও তার নিকটাত্মীয় হয় এবং তারা বলবে যে, আমরা গোনাহ করব না, (যদি করি, তাহ’লে) সে অবস্থায় আমরা গোনাহগারদের অন্তর্ভুক্ত হব’। ‘অতঃপর যদি জানা যায় যে, উক্ত দু’জন সাক্ষী কোন পাপে লিপ্ত হয়েছে (অর্থাৎ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে), তাহ’লে অন্য দু’জন তাদের স্থলে দাঁড়িয়ে যাবে এবং দু’জনে আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে যে, আমাদের সাক্ষ্য অবশ্যই ঐ দু’জনের সাক্ষ্য অপেক্ষা সত্য এবং আমরা সীমালংঘনকারী নই। (যদি হই) তাহ’লে সেক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিতভাবে যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হ’য়ে যাব’ (মায়েদাহ ৫/১০৬-১০৭)।

উক্ত আয়াতে সাক্ষ্য মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সাক্ষ্য ‘যান্ন’ বা ধারণা নির্ভর প্রমাণিত হয়েছে। তথাপি পুনরায় সঠিক সাক্ষ্যের মাধ্যমেই বিষয়টি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে বিবাহের সাক্ষী, চুরির সাক্ষী, ব্যভিচারের সাক্ষী, হত্যাকান্ডের সাক্ষী প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে ন্যায়নিষ্ঠ সাক্ষীদের সাক্ষ্যের উপরেই নির্ভর করতে বলা হয়েছে। যদিও সাক্ষ্যের মাধ্যে সত্য-মিথ্যার আশংকা বিদ্যমান থাকে। বিচারক চূড়ান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিশ্চিত সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করবেন, এটাই সর্বদা কাম্য থাকে এবং বাদী-বিবাদী সকলেই উক্ত ‘রায়’ মেনে নেন ও সেমতে ফাঁসির দড়ির নীচে আসামী নিজের গলা বাড়িয়ে দেন। একইভাবে চিকিৎসক তাঁর সর্বোচ্চ ধারণার ভিত্তিতেই রোগ নির্ণয় করেন ও ঔষধ নির্বাচন করেন বা রোগীর অস্ত্রোপচার করেন। রোগী নির্বিবাদে তা মেনে নেন এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও বন্ড লিখে দিয়ে ডাক্তারের অস্ত্রোপচারের টেবিলে নিজেকে সমর্পণ করে দেন।

হাদীছের বিশুদ্ধতা প্রমাণের ক্ষেত্রেও মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ চিকিৎসক ও বিচারকের ন্যায় চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কেবল বর্ণনাকারীকে নয় বরং সনদ, মতন ও আনুষঙ্গিক সকল বিষয় যাচাই করেই তাঁরা হাদীছটি সত্য সত্যই রাসূল (ছাঃ)-এর কি-না সে বিষয়ে নিশ্চিত ধারণা লাভে সচেষ্ট হন। যেসব হাদীছের ক্ষেত্রে তাঁরা নিশ্চিত হন, সেগুলি ‘ছহীহ’ সাব্যস্ত হয়। আর যেগুলিতে নিশ্চিত হতে পারেন না, সেগুলি ‘যঈফ’ সাব্যস্ত হয়। বর্ণনাকারীর সংখ্যা সর্বস্তরে অগণিত হলে এবং তাতে মিথ্যার কোন অবকাশ না থাকলে এবং সেগুলি সর্বযুগে অবিরত ধারায় বর্ণিত ও গৃহীত হ’লে সেগুলিকে ‘মুতাওয়াতির’ ( متواتر ) বলা হয়। পক্ষান্তরে বর্ণনাকারী একজন বা একাধিক হ’লে তাকে ‘আহাদ’ ( آحاد ) বলা হয়।

ইবনু হাযম আন্দালুসী (রহঃ) বলেন,

القسم الثاني من الأخبار ما نقله الواحد عن الواحد فهذا إذا اتصل برواية العدول إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم وجب العمل به ووجب العلم بصحته أيضا -

‘যদি একজন সত্যনিষ্ঠ রাবী আরেকজন সত্যনিষ্ঠ রাবী থেকে বর্ণনা করেন এবং এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন সনদ বা বর্ণনাসূত্র পাওয়া যায়, তবে তার উপরে আমল ওয়াজিব হবে এবং তাকে বিশুদ্ধ জানাও ওয়াজিব হবে’। তিনি বলেন, এ বিষয়ে উম্মতের ইজমা বা ঐক্যমত রয়েছে এবং ইমাম আবু হানীফা, মালেক, শাফেঈ, আহমাদ, দাঊদ প্রমুখ বিদ্বানগণ থেকেও একই কথা প্রমাণিত হয়েছে’।

তিনি বলেন, পরবর্তী যুগের কিছু লোক ‘খবরে ওয়াহেদ’ ( خبر واحد ) সম্পর্কে সন্দেহবাদ আরোপ করতে চেয়েছেন। অথচ তারা বলে থাকেন যে, ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন, যা সূরায়ে মায়েদাহ ৩ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে এবং আল্লাহ নিজেই কুরআন ও হাদীছের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, যা সূরা হিজ্র ৯ ও ক্বিয়ামাহ ১৬-১৯ আয়াতসূমহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। এক্ষণে আধুনিক চিন্তাবিদগণের ধারণা মতে উক্ত পূর্ণাঙ্গ দ্বীনে যদি সন্দেহ সৃষ্টি করা হয় এবং তাতে সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত হয়ে যায় ও তা পার্থক্য করার সুযোগ না থাকে, তাহ’লে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ দ্বীন কিভাবে হবে? বরং উক্ত সন্দেহবাদ আরোপের মাধ্যমে দ্বীনের সুদৃঢ় ইমারতকে ধ্বংস করা হবে। অতএব এটাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত সত্য কথা যে, ন্যায়নিষ্ঠ রাবীদের মাধ্যমে বর্ণিত হাদীছ অকাট্ট ও বিশুদ্ধ এবং তার উপরে দৃঢ় বিশ্বাস ও আমল দু’টিই ওয়াজিব’।[1]

মাওলানা মওদূদী ‘মুতাওয়াতির’ হাদীছগুলিকে ‘ইয়াক্বীনী’ ( يقينى ) বা নিশ্চিত বিশ্বাসযোগ্য বলেছেন। কিন্তু ‘আহাদ’ হাদীছগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য বলেননি। এখানে গিয়ে তিনি মুজতাহিদগণের রায় ও তাদের ব্যক্তিগত রুচিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অথচ অল্প সংখ্যক ‘মুতাওয়াতির’ হাদীছ ব্যতীত ইসলামী শরী‘আতের বিশাল ভান্ডারের প্রায় সবটুকুই নির্ভর করে ‘আহাদ’ পর্যায়ের হাদীছসমূহের উপরে। ফলে ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছসমূহকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করার অর্থ পুরো ইসলামী শরী‘আতকে অবিশ্বাস করা। জানিনা সুন্নাহকে বাদ দিয়ে এঁরা ইসলামের নামে দেশে কিসের হুকুমত প্রতিষ্ঠা করবেন!

মূলতঃ ‘আহাদ’ পর্যায়ের হাদীছসমূহে যদি সত্যতা ও নিশ্চয়তার প্রমাণাদি মওজূদ থাকে, বিদ্বানগণ তা কবুল করে থাকেন এবং খোদ সংকলক যদি হাদীছের বিশুদ্ধতার অপরিহার্যতাকে নিজের জন্য শর্ত করে থাকেন, তবে ঐ হাদীছ নিঃসন্দেহে কবুলযোগ্য। চাই সেটা আক্বীদা বিষয়ে হৌক বা আহকাম বিষয়ে হৌক। যেমন বুখারী-মুসলিম সংকলিত ও হযরত ওমর ফারূক (রাঃ) বর্ণিত বিখ্যাত হাদীছ إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপরে নির্ভরশীল’(মুসলিম)। হাদীছটির একমাত্র রাবী ওমর (রাঃ) এবং এটি ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছ। হাদীছটি উম্মতের সকল বিদ্বান কবুল করে নিয়েছেন এবং এর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সংকলক মুহাদ্দিছগণ নিশ্চয়তা দিয়েছেন। অনুরূপভাবে ছাদাক্বাতুল ফিৎর ফরয হওয়ার হাদীছ, ফরয গোসলের হাদীছ প্রভৃতি খবরে ওয়াহেদের অন্তর্ভুক্ত।

ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, মূলতঃ ১ম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত আহলুস সুন্নাহ, খারেজী, শী‘আ,ক্বাদারিয়া সকলে ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছকে বিনা বাক্য ব্যয়ে কবুল করতেন। কিন্তু দ্বিতীয় শতাব্দীতে এসে মু‘তাযিলা দার্শনিকগণ ইজমায়ে উম্মতের বিরোধিতা করে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেন ও বিতর্কে লিপ্ত হন’।[2]

পরবর্তীকালে এদের কূটতর্কে বিভ্রান্ত হয়েছেন বহু বিদ্বান এবং সেই সুযোগ গ্রহণ করেছেন প্রাচ্যবিদ খ্রিষ্টান পন্ডিতগণ। আবার তাদেরই যুক্তিবাদের ধূম্রজালে আটকা পড়েছেন বহু আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদ। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন -আমীন!

[1]. ইসমাঈল সালাফী, হুজ্জিয়াতে হাদীছ (লাহোর ১৪০১ হিঃ/১৯৮১ খৃঃ) পৃঃ ১১৬-১১৭, গৃহীত : আল-ইহকাম ১/১০৮, ১১৪, ১২৩, ১২৪।

[2]. হুজ্জিয়াতে হাদীছ পৃঃ ১১২, গৃহীত : আল-ইহকাম ১/১১৪।

১৭
যুগে যুগে হাদীছ অস্বীকারকারীগণ (منكرو الحديث في العصور)
আল্লামা ইসমাঈল গুজরানওয়ালা (১৩১৪-১৩৭৮/১৮৯৫-১৯৬৮) প্রদত্ত যুগে যুগে হাদীছ অস্বীকারকারীদের তালিকাটি নিম্নে প্রদত্ত হ’ল :

খারেজী ( خارجي ) : এরা প্রধানতঃ রাসূল পরিবারের মর্যাদায় বর্ণিত হাদীছসমূহকে অস্বীকার করে। ২০০ হিজরীর পরে এদের আবির্ভাব ঘটে।

শী‘আ ( شيعہ ) : এরা ছাহাবীগণের মর্যাদায় বর্ণিত হাদীছসমূহকে অস্বীকার করে। ২০০ হিজরীর পরে এদের আবির্ভাব হয়।

মু‘তাযিলা ও জাহ্মিয়া ( معتزلہ و جهميہ ): এরা আল্লাহর গুণাবলী সংক্রান্ত হাদীছ সমূহকে অস্বীকার করে। ২২১ হিজরীর পরে এদের আবির্ভাব হয়।

ক্বাযী ঈসা ইবনে আবান ও তার অনুসারীগণ এবং পরবর্তী ফক্বীহদের মধ্যে ক্বাযী আবু যায়েদ দাবূসী প্রমুখ। তাদের দৃষ্টিতে গায়ের ফক্বীহ ছাহাবীগণের বর্ণিত হাদীছকে তারা অস্বীকার করেন। ২২১ হিজরীর পরে এদের আবির্ভাব ঘটে।

মু‘তাযিলা ও দার্শনিকদের সাথে ফক্বীহদের একটি ছোট দল। এরা উছূল ও ফুরূ‘ তথা মূল ও প্রশাখাগত সকল বিষয়ে খবরে ওয়াহেদ পর্যায়ের হাদীছসমূহের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। ৪০০ হিজরীর পর এদের আবির্ভাব হয়।

পাশ্চাত্য সভ্যতায় ভীত ইসলামী পন্ডিতগণ। যেমন মৌলবী চেরাগ আলী, স্যার সৈয়দ আহমাদ খান ও তাদের অনুসারীবৃন্দ। এরা হাদীছ শাস্ত্রে আনকোরা। তাদের ধারণা মতে হাদীছ সমূহ মূলতঃ ইতিহাসের সমষ্টি মাত্র। অতএব সেখান থেকে চাহিদামত তারা কিছু গ্রহণ করেছেন ও কিছু বর্জন করেছেন। ১৩০০ হিজরীর কাছাকাছি সময়ে এদের আবির্ভাব ঘটে।

মৌলবী আব্দুল্লাহ চকড়ালবী, মিস্ত্রী মুহাম্মাদ রামাযান গুজরানওয়ালা, মৌলবী হাশমত আলী লাহোরী, মৌলবী রফীউদ্দীন মুলতানী। ১৩০০ হিজরীর পরবর্তী এই সকল বিদ্বান হাদীছকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন।

মৌলবী আহমাদ দ্বীন অমৃতসরী, মিষ্টার গোলাম আহমাদ পারভেয। এরা স্যার সৈয়দ আহমাদের দ্বারা প্রভাবিত। তবে এরা জাহিল ও লাগামহীন। ১৪শ শতাব্দীর এই ব্যক্তিগণের নিকটে কুরআন, হাদীছ ও পুরা দ্বীনটাই একটা খেলা মাত্র। তাদের মতে বেশীর বেশী এটাকে একটা রাজনৈতিক দর্শন মনে করা যেতে পারে। যাকে যখন-তখন বদলানোর অধিকার আমাদের আছে। তবে মৌলবী আহমাদ দ্বীন কোন কোন ‘মুতাওয়াতির’ আমলকে এগুলি থেকে পৃথক মনে করতেন।

মাওলানা শিবলী নো‘মানী (১৮৫৭-১৯১৪), হামীদুদ্দীন ফারাহী, আবুল আ‘লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯), আমীন আহসান ইছলাহী এবং নাদওয়াতুল ওলামা লাক্ষ্ণৌ-এর বিদ্বানমন্ডলী। তবে সাইয়িদ সুলায়মান নাদভী (১৮৮৪-১৯৫৫) ব্যতীত। ১৩শ ও ১৪শ শতাব্দী হিজরীর এই শেষোক্ত বিদ্বানগণ হাদীছের অস্বীকারকারী নন। তবে এঁদের চিন্তাধারায় হাদীছের প্রতি গুরুত্বহীনতা ও তাচ্ছিল্যভাব ( استخفاف واستحقار ) প্রকাশ পায় এবং তাঁদের আলোচনায় হাদীছ অস্বীকারের চোরাপথ সমূহ খুলে যায়।[1]

[1]. হুজ্জিয়াতে হাদীছ পৃঃ ১১৩-১১৪।

১৮
২. মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া (১৩১৭-১৪০২ হিঃ/১৮৯৮-১৯৮২ খৃঃ)
তাবলীগ জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস (১৩০৩-১৩৬৩/১৮৮৫-১৯৪৪ খৃঃ)-এর নির্দেশত্রুমে অন্যতম নেতা মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া কান্ধলভী সাহারানপুরী ‘তাবলীগী নেছাব’ প্রণয়ন করেন। যাতে হেকায়াতে ছাহাবা এবং ফাযায়েলে নামায, তাবলীগ, যিকর, কুরআন, রামাযান, দরূদ, ছাদাক্বাত ও হজ্জসহ মোট ৯টি বিষয়ে দু’খন্ডে সমাপ্ত বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

উল্লেখ্য যে, ১৯২১ সালে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ‘মেওয়াত’ ( ميوات ) এলাকার ‘ফীরোযপুর নিমক’ ( فيروزپور نمك )গ্রামে প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত অস্তিত্ব লাভ করে। যেখানে মাওলানা ইলিয়াস (১৮৮৫-১৯৪৪ খৃঃ জন্মস্থান : মেওয়াত, হরিয়ানা, ভারত) তাঁর শিষ্যদের নিকট প্রায়ই যেতেন। একদা সেখানে থাকা অবস্থায় তাঁর কিছু শিষ্য এসে বলল যে, তারা কালেমা শিখানোর জন্য ও মসজিদে ছালাতে আসার জন্য বাড়ী বাড়ী গিয়ে লোকদের দাওয়াত দিয়ে থাকে। তাদের একাজটি তাঁর খুব পসন্দ হয় এবং অন্যান্য গ্রামেও দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি তাদের উৎসাহ দেন। এভাবেই প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আতের সূচনা হয়।[1]

তাবলীগী নেছাব ( تبليغى نصاب ) :

আহলেহাদীছের নিকটে ‘ছহীহায়েন’-এর যে মর্যাদা, তাবলীগী ভাইদের নিকটে ‘তাবলীগী নেছাব’-এর সেই মর্যাদা বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ কিতাবটিই তাদের নিকটে সর্বাধিক মর্যাদামন্ডিত এবং ঘরে-বাইরে, সফরে- অবসরে সর্বদা অতি যত্নের সাথে পঠিত। তাবলীগী নেছাবের লেখক ‘শায়খুল হাদীছ’ নামে খ্যাত। অথচ হাদীছের পিঠে মিষ্টিমুখে যে ছুরিকাঘাত তিনি করেছেন, তা অন্য কারু পক্ষে সম্ভব হয়েছে কি-না সন্দেহ। কুরআনের আয়াত ও হাদীছের অপব্যাখ্যার সাথে সাথে তিনি যেসব উদ্ভট ও কাল্পনিক মা‘রেফতী গল্পসমূহ জুড়ে দিয়েছেন, তা একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট। দুর্ভাগ্য যে, এই কিতাবটি বিভিন্ন মসজিদে জামা‘আত শেষে ইমাম অথবা তাবলীগের লোকেরা মুছল্লীদেরকে অতি বিনয় ও নম্রতার সাথে পড়ে শুনিয়ে থাকেন ও শেষে দলবদ্ধভাবে মুনাজাত (প্রার্থনা) করে থাকেন।

অথচ এগুলি পড়লে আল্লাহভক্তির স্থান দখল করে নেয় তথাকথিত মুরববী ও বুযর্গ ভক্তি। কুরআন-হাদীছের স্থান দখল করে নেয় বিভিন্ন তরীকার ছূফী ও তাদের কাশ্ফ ও কারামতের মিথ্যা ও অলীক কাহিনীসমূহ। মুছল্লীর মাথার মধ্যে তখন ঐসব ভিত্তিহীন কল্পকথা ঘুরপাক খেতে থাকে। আর ভাবে যে, কখন চিল্লায় গিয়ে ঐসব ছূফী বুযর্গের ন্যায় উচ্চ মর্যাদা লাভে ধন্য হব। আশ্চর্যের বিষয়, দারুল উলূম দেউবন্দের মসজিদেও নাকি এ কিতাবটি পড়ে মুছল্লীদের শুনানো হয় এবং এ যাবত তার এই বইটির প্রতিবাদে কেউ কোন বই প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায়নি। উপমহাদেশের বিশাল হানাফী জামা‘আতের হাযার হাযার হানাফী আলেম এ বইটিকে কিভাবে নীরবে সর্মথন দিয়ে চলেছেন।

ভেবে আশ্চর্য হ’তে হয় যে, ‘ইসরাঈলে’ ইসলামী বইপত্র নিষিদ্ধ, সেখানেও এ কিতাবের রয়েছে অবাধ প্রবেশাধিকার এবং এ কিতাবের প্রচারক তাবলীগী ভাইদের রয়েছে সেদেশে নির্বিঘ্নে পদচারণার ঢালাও অনুমতি। একইভাবে অনুমতি রয়েছে সেখানে কাদিয়ানীদের ব্যাপক প্রবেশাধিকারের। কাদিয়ানীদের হেড অফিস লন্ডনে ও ইসরাঈলের হাইফা নগরীতে। দু’টি আন্দোলনেরই উৎসস্থল ভারত উপমহাদেশ এবং দু’টিরই জন্ম বৃটিশ আমলে। কাদিয়ানীরা ধর্মদ্রোহী কাফের। কিন্তু তারা ইসলামের নামেই দেশে ও বিদেশে বিকৃত ইসলামের প্রচার করে থাকে। পক্ষান্তরে তাবলীগীরা ইসলামের গন্ডীর মধ্যে থেকেই ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা দেশ-বিদেশে প্রচার করে। আখেরাতে মুক্তির সন্ধানী হুঁশিয়ার মুমিনগণ সাবধানে পা ফেলবেন, এটাই কাম্য।

তাবলীগী নেছাবের অন্য বিষয় বাদ দিয়ে কেবল তাদের হাদীছ প্রচারের কয়েকটি নমুনা উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরা হ’ল :

১. ওমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আদম (আঃ) অপরাধ করার পর আল্লাহর আরশের দিকে তাকিয়ে দেখেন সেখানে লেখা আছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। তখন তিনি মুহাম্মাদের অসীলায় আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন। অতঃপর আল্লাহ আদমকে বলেন, যদি মুহাম্মাদ না হ’তেন, তাহ’লে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না’। অন্য একটি প্রসিদ্ধ জাল হাদীছ উক্ত মর্মে প্রচলিত আছে, ‘লাওলা-কা লামা খালাক্বতুল আফলা-কা’ (যদি আপনি না হ’তেন, তাহ’লে আসমান-যমীন কিছুই সৃষ্টি করতাম না)।[2]

অন্যত্র ‘ফাযায়েলে দরূদ শরীফে’ (পৃঃ ৮৫, গল্প নং ১৪) তিনি বলেছেন, ‘শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী স্বীয় ‘মাদারেজুন নবুঅত’ বইয়ে লিখেছেন যে, যখন হযরত হাওয়া-র জন্ম হ’ল, তখন হযরত আদম (আঃ) তার দিকে হাত বাড়াতে চাইলেন। ফেরেশতারা বললেন, ছবর কর, যতক্ষণ না বিয়ে হবে এবং মোহর না দেওয়া হবে। আদম (আঃ) বললেন, মোহর কি? ফেরেশতারা বললেন, ‘মুহাম্মাদ-এর উপর তিনবার দরূদ শরীফ পাঠ করুন’। এক রেওয়ায়াতে বিশ বারের কথা এসেছে।’ অথচ পবিত্র কুরআনে আদম সৃষ্টির ও তাঁর তওবা করার যে বর্ণনা রয়েছে (বাক্বারাহ ৩০-৩৯; আ‘রাফ ২৪), সেখানে এসবের কিছুই নেই।

পীর-আউলিয়াদের ‘অসীলা’ ধরে পরকালে মুক্তি পাওয়ার বৈধতা প্রমাণের জন্য এসব জাল হাদীছ ও মিথ্যা বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। এরা পীর ধরতে বলেন না, বরং ‘মুরববী’ ধরতে বলেন। যেমন শায়খুল হাদীছ ‘ফাযায়েলে তাবলীগে’ (পৃঃ ৩) বলেছেন, যুগের ওলামা-মাশায়েখ হযরতগণের রেযামন্দি ও সন্তুষ্টি পরকালীন নাজাতের অসীলা ও গোনাহের কাফফারা হয়ে থাকে...।’ অথচ কুরআন ও হাদীছের নির্দেশনা অনুযায়ী রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ ব্যতীত পরকালে মুক্তি পাবার কোন উপায় নেই (বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩)।

২. হযরত আদম (আঃ) হিন্দুস্তান থেকে পায়ে হেঁটে এক হাযার বার হজ্জ করেছেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নবীদের সাধারণ রীতি ছিল পায়ে হেঁটে হজ্জ করা।[3]

বাস্তবতা এই যে, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মদীনা থেকে মক্কায় সওয়ারীতে এসে বিদায় হজ্জ করেছিলেন। অথচ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর ন্যায় একজন প্রখ্যাত ছাহাবীর নামে এমন মিথ্যা বর্ণনা চালিয়ে দেওয়া হ’ল। একইভাবে আদম (আঃ) সম্পর্কিত বর্ণনাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। কেননা তাঁর মোট বয়স ছিল ৯৪০ অথবা ৯৬০ বছর।[4] তাছাড়া তিনি হিন্দুস্তানে বসবাস করেছেন বলে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে কোন প্রমাণ নেই।

৩. ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারত করবে, তার জন্য আমার শাফা‘আত ওয়াজিব হবে’। অন্য বর্ণনায় ‘যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পরে আমাকে যিয়ারত করবে, সে ব্যক্তি যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাত করল’। অন্য বর্ণনায় ‘যে ব্যক্তি হজ্জ করল, অথচ আমার কবর যিয়ারত করল না, সে আমার উপর যুলুম করল’।[5] হাদীছগুলি মওযূ বা জাল।[6] আর এটা স্পষ্ট যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যেয়ারত হজ্জের কোন অংশ নয়।

৪. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি ছালাত ক্বাযা করবে, যদিও সে তা পরে আদায় করে, তথাপি সময় মত ছালাত আদায় না করার কারণে ঐ ব্যক্তি এক হোক্ববা জাহান্নামে থাকবে। এক ‘হোক্ববা’ হ’ল ২ কোটি ৮৮ লক্ষ বছর।[7] পাঠক স্মরণ রাখুন, খন্দকের যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর পর পর কয়েক ওয়াক্ত ছালাত এবং খায়বার যুদ্ধে ফজরের ছালাত ক্বাযা হয়েছিল। এতদ্ব্যতীত ছাহাবায়ে কেরাম থেকেও ছালাত ক্বাযা করার বহু প্রমাণ দেখা যায়। তাহ’লে তাঁদের অবস্থা কী হবে?

৫. (ক) মুসলমানদের জিহাদী জাযবা খতম করার জন্য তিনি বিনা সনদে লেখেন, একদা রাসূল (ছাঃ) নাজদে সৈন্য পাঠান। তারা দ্রুত যুদ্ধ জয় করে গণীমতের মালামাল সহ ফিরে আসেন। এত দ্রুত ফিরে আসায় লোকেরা বিস্ময় প্রকাশ করলে রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে এর চাইতেও কম সময়ে এর চাইতেও বেশী গণীমত লাভকারী দল সম্পর্কে সংবাদ দিব না? তারা হ’ল ঐসব লোক, যারা ফজরের ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করে। অতঃপর সূর্যোদয়ের পরে দু’রাক‘আত ইশরাক্বের ছালাত আদায় করে’।[8] তিনি ইশারাক্বের দু’রাক‘আত ছালাতকে জিহাদের বিজয়ের চাইতেও উত্তম বলে গণ্য করেছেন।

(খ) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, কুযা‘আহ ( قضاعة ) গোত্রের দু’জন ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে একত্রে মুসলমান হ’লেন। পরে তাদের একজন শহীদ হয়ে গেলেন। আরেকজন একবছর পরে স্বাভাবিকভাবে মারা গেলেন। ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) পরে স্বপ্নে দেখেন যে, শহীদ ব্যক্তির আগেই ইনি জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। তিনি বলেন যে, এতে বিস্মিত হয়ে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তি কি এক রামাযানের পূর্ণ ছিয়াম ও একবছরে ছয় হাযারের বেশী রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করেনি?’[9] অর্থাৎ শাহাদাত লাভের চাইতে সুন্নাত-নফলের মর্যাদা বেশী।

এইভাবে সনদ বিহীন স্বপ্নের বর্ণনা ছাহাবী ও রাসূল (ছাঃ)-এর নামে লাগামহীন ভাবে লিখতে এইসব শায়খুল হাদীছের হৃদয় একটুও কেঁপে ওঠেনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে দখলদার ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের মুসলমানেরা যখন জিহাদ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তখনই দেউবন্দ-সাহারানপুরের এইসব ছূফী-শায়খুল হাদীছগণ মুসলমানদের জিহাদ থেকে বিমুখ করে বৃটিশের গোলামীর দিকে ফিরিয়ে নেবার এবং দ্বীনের নামে মুসলমানদের ঈমানী চেতনা বিনাশ করে তাবলীগের বেশে দেশ-বিদেশে ঘুরানোর মিশন নিয়ে মাঠে নেমে ছিলেন। আর তার পুরস্কার স্বরূপ তখন থেকে এযাবৎ তারা ইহুদী-খৃষ্টান প্রভাবিত সকল দেশে বিনা বাধায় তাদের কথিত তাবলীগী মিশন চালিয়ে যাচ্ছে।

(গ) ত্বাঊস বলেন, বায়তুল্লাহ দর্শন করা উত্তম হ’ল ঐ ব্যক্তির ইবাদতের চাইতে, যিনি ছিয়াম পালনকারী, রাত্রি জাগরণকারী এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী’।[10]

এখানে বায়তুল্লাহ দর্শনকে তিনি জিহাদের চাইতে উত্তম বলতে চেয়েছেন।

এতদ্ব্যতীত তাদের মধ্যে এই ‘মুনকার’ হাদীছটির খুবই প্রসিদ্ধি রয়েছে যে, رَجَعْنَا مِنَ الْجِهَادِ الْأَصْغَرِ إِلَى الْجِهَادِ الْأَكْبَرِ ‘আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরে এলাম’।[11] এর দ্বারা তারা তাদের হালক্বায়ে যিক্রের মজলিসগুলিকে ‘বড় জিহাদ’ এবং সশস্ত্র জিহাদের ময়দানকে ‘ছোট জিহাদ’ হিসাবে গণ্য করতে চেয়েছেন।[12]

৬. আবু হুরায়রা (রাঃ)-হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আমার উপর পঠিত দরূদ পুলছিরাত পার হওয়ার সময় ‘নূর’ (জ্যোতি) হবে। যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন আমার উপর ৮০ বার দরূদ পড়বে, তার আশি বছরের গোনাহ মাফ করা হবে’।[13]

[1]. দিল্লী : পাক্ষিক মাজাল্লা আহলেহাদীছ পৃঃ ৭. ২১শে জুন ১৯৮৬ ইং/১৩ই শাওয়াল ১৪০৬ হিঃ সম্পাদক ও লেখক : হাকীম মুহাম্মাদ আজমল খাঁ।

[2]. সিলসিলা যঈফাহ ওয়াল মওযূ‘আহ হা/২৫, ২৮২; ফাযায়েলে যিকর (মূল উর্দূ, দিল্লী : উর্দূ বাযার, মদীনা বুক ডিপো, ১৩৯৫হিঃ/১৯৭৫ খৃঃ) পৃঃ ৯৫।

[3]. ফাযায়েলে হজ্জ পৃঃ ৩৫।

[4]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৬৬২, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ; ঐ, হা/১১৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ; তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৫০৭২, ৮/৪৫৯ পৃঃ।

[5]. ফাযায়েলে হজ্জ ৯৬, ৯৭, ৯৮ পৃঃ।

[6]. দারাকুৎনী, ইরওয়াউল গালীল হা/১১২৭-২৮।

[7]. ফাযায়েলে নামায, পৃঃ ৩৯।

[8]. ফাযায়েলে নামায, পৃঃ ২০।

[9]. ফাযায়েলে নামায পৃঃ ১৫।

[10]. ফাযায়েলে হজ্জ, পৃঃ ৭৭।

[11]. সিলসিলা যঈফাহ ওয়াল মওযূ‘আহ হা/২৪৬০, হাদীছ ‘মুনকার’।

[12]. আব্দুর রহমান উমরী, তাবলীগী জামা‘আত আওর উসকা নিছাব (নয়াদিল্লী : দারুল কিতাব, ১৯৮৮ খৃঃ); পৃঃ ৮৪।

[13]. ফাযায়েলে দরূদ শরীফ ১/৩৮, হা/৪; সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৮০৪।

১৯
তাবলীগীদের অলীক কাহিনী সমূহের কিছু নমুনা
( بعض القصص المنكرة للتبليغيين )

১. ছূফী সাইয়িদ আহমাদ রিফা‘ঈ হজ্জের পরে মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারত করেন ৫৫৫ হিজরীতে এবং সেখানে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসায় দু’লাইন কবিতা পাঠ করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে তাঁর দু’হাত বের করে দিলেন ও রিফা‘ঈ তাতে চুমু খেলেন’। লেখক শায়খুল হাদীছ (?) মাওলানা যাকারিয়া এক ধাপ বাড়িয়ে বলেন যে, ঐ সময় সেখানে প্রায় ৯০,০০০ লোক উপস্থিত ছিলেন, যারা উক্ত দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। যাদের মধ্যে (‘বড় পীর’) আব্দুল কাদের জীলানী ( ৪৭০-৫৬১ হিঃ) উপস্থিত ছিলেন’।[1]

২. মাওলানা যাকারিয়া নিজের ‘দালায়েলুল খায়রাত’ বইটি লেখার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি একদা সফর অবস্থায় ওযূর পানির সংকটে পড়েন। দড়ি-বালতি না থাকার কারণে তিনি কূয়া থেকে পানি উঠাতে পারছিলেন না। একটি মেয়ে এ দৃশ্য দেখে কূয়ার নিকটে এসে তাতে থুথু নিক্ষেপ করল। সাথে সাথে কূয়ার পানি কিনারা পর্যন্ত উঠে এলো। লেখক বিস্মিত হয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, এটি দরূদ শরীফের বরকত। এ ঘটনার পর আমি উক্ত বইটি লিখি’।[2]

পাঠকগণ ভালভাবেই জানেন যে, হিজরতের পর পানির কষ্টে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম মদীনায় কিভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে জনৈক ইহুদীর নিকট থেকে ওছমান (রাঃ) বি’রে রূমাহ ( بئر رومة ) নামক বিখ্যাত কূয়াটি খরিদ করে সেটি মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দেন।[3] অথচ একটি সাধারণ বালিকার থুথু নিক্ষেপে কূয়া ভরে গেল। গল্প আর কাকে বলে!!

৩. শায়খ আবুল খায়ের আক্বত্বা‘ বলেন, আমি পাঁচদিন যাবত কিছু খেতে না পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ অন্তে তাঁর মেহমান হিসাবে তাঁর কবরের নিকটে ঘুমিয়ে গেলাম। এমতাবস্থায় স্বপ্নে আমার নিকটে রাসূল (ছাঃ) তাঁর তিন সাথী আবুবকর, ওমর ও আলী (রাঃ)-কে নিয়ে এলেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কপালে চুমু খেলাম। অতঃপর তিনি আমাকে একটি রুটি দান করলেন। অর্ধেক রুটি খাওয়া শেষ না হ’তেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখন দেখি যে, বাকী অর্ধেক রুটি আমার হাতে ধরা আছে’।[4]

তাবলীগী নেছাবের প্রায় সর্বত্র এ ধরনের উদ্ভট স্বপ্ন ও ভিত্তিহীন গল্পসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে। যা পাঠককে পথভ্রষ্ট করে মাত্র।

৪. দরূদেই জান্নাত :

(ক) জনৈক ছূফী বলেন, মিসত্বাহ নামে আমার এক প্রতিবেশী ছিল, যে সর্বদা মদে চূর হয়ে থাকত। তার দিন-রাতের কোন খবর থাকত না। আমি তাকে বহু উপদেশ দিয়েছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। আমি তাকে তওবা করতে বলতাম। কিন্তু সে তাও করেনি। অবশেষে যখন সে মারা গেল, তখন আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, সে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদার সাথে আছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আমি এক মুহাদ্দিছের মজলিসে ছিলাম। এক সময় তিনি বললেন, যে ব্যক্তি উচ্চৈঃস্বরে দরূদ পড়বে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে। একথা শুনে আমি জোরসে দরূদ পড়ি এবং অন্যেরাও পড়ে। ফলে ঐ মজলিসে উপস্থিত আমাদের সকলের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। আর সেকারণেই আমি আজ জান্নাতে এসেছি।[5]

শুধু মদখোর মিসত্বাহ নয়, ইমাম শাফেঈ (রাঃ)-এর মত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মহান ব্যক্তিও নাকি কেবল দরূদ পাঠের কারণে জান্নাত লাভ করেছেন। তাঁর অন্য নেক আমলের কারণে নয়। যেমন (খ) তাঁর একজন শাগরেদের বরাতে লেখা হয়েছে, আমি আমার উস্তাদের মৃত্যুর পরে তাঁকে স্বপ্নে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, উস্তাদজী কেমন আছেন? তিনি বললেন, আমাকে খুবই সম্মানের সাথে জান্নাতে নেওয়া হয়েছে। আর এসবই হয়েছে কেবলমাত্র দরূদের বরকতে’।[6]

নিকৃষ্ট পাপী ও শ্রেষ্ঠ পুণ্যবান দু’জনের দু’টি বানোয়াট গল্প দিয়ে লেখক শায়খুল হাদীছ বুঝাতে চেয়েছেন যে, আমলের কোন প্রয়োজন নেই; কেবল দরূদ পাঠ করলেই জান্নাত অবধারিত। জান্নাত লাভ যদি এতই সস্তা হ’ত, তাহ’লে ওহোদের ময়দানে রাসূল (ছাঃ)-এর দাঁত ভাঙতো না এবং তাঁর ও ছাহাবায়ে কেরামের জীবনে এত কষ্ট হ’ত না। শুধু ঘরে বসে দরূদ পড়লেই ইসলাম কায়েম হ’ত।

কেবল ছূফী ও ইমামের নামে নয় এবার সরাসরি ছাহাবী, তাবেঈ ও রাসূলের নামে মিথ্যাচার। যেমন (গ) হযরত আব্দুর রহমান বিন সামুরাহ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাইরে এলেন এবং আমাদের বললেন, আমি রাত্রিতে স্বপ্নে একটি আশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম যে, একজন ব্যক্তি পুলছেরাতের উপর কখনো পা ঘেঁষে চলছে, কখনো হাঁটুতে ভর করে চলছে, কখনো যেন কোন কিছুতে আটকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমার উপর দরূদ তার নিকটে পৌঁছে গেল এবং সে তাকে দাঁড় করিয়ে পুলছেরাত পার করে দিল।’ (ঘ) ‘বিখ্যাত তাবেঈ হযরত সুফিয়ান বিন ওয়ায়না (রাঃ) হযরত খালাফ থেকে বর্ণনা করেন যে, আমার এক বন্ধু ছিল যে আমার সঙ্গে হাদীছ পড়ত, তার মৃত্যু হয়ে গেল। আমি তাকে স্বপ্নে দেখলাম যে নতুন সবুজ কাপড় পরে সে দৌড়-ঝাপ করছে। আমি বললাম, তুমি তো আমার হাদীছের সহপাঠি ছিলে। তোমার এত উচ্চ সম্মান ও মর্যাদা কি কারণে হ’ল? সে বলল, হাদীছ তো আমি তোমার সাথেই লিখতাম। কিন্তু যখনই হাদীছের নীচে নবী করীম (ছাঃ)-এর নাম আসত, তখনই আমি তার নীচে ‘ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম’ লিখে দিতাম। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তারই বিনিময়ে আমাকে এই মহা সম্মান দান করেছেন, যা তুমি দেখছ’।[7]

এইসব ভিত্তিহীন গল্প দিয়ে এরা মুসলমানকে কুরআন-হাদীছ থেকে দুরে সরিয়ে নিয়ে পীর-মাশায়েখ, ছূফী-বুযর্গ ও বিদ‘আতী মুরববীদের গোলামে পরিণত করেছে এবং হাদীছ বাদ দিয়ে এদের অলীক কেচ্ছা-কাহিনী ও কাশফ-কারামতের উপর বিশ্বাসী করে গড়ে তুলেছে। অথচ নবী ব্যতীত অন্য কারু ইলহাম ও স্বপ্ন ইসলামে কোন দলীল হিসাবে গৃহীত নয়। সম্ভবতঃ এ কারণেই তাবলীগী ভাইয়েরা তাদের কোন তা‘লীমে কুরআনের তাফসীর বা কোন অনূদিত হাদীছ গ্রন্থ পাঠ করেন না। ফলে সারা জীবন তাবলীগ করেও এরা ছহীহ তরীকায় ছালাতটুকু আদায় করতে শিখে না। মসজিদগুলিতে এখন কুরআন-হাদীছের তা‘লীমের বদলে এদের এইসব মিথ্যা গল্পে ভরা তাবলীগী নেছাবের তা‘লীম হয়ে থাকে। কেননা তাদের শুনানো হয় যে, একবার তাবলীগে গেলে তার প্রতিটি নেক আমলের বিনিময়ে ঊনপঞ্চাশ কোটি নেকী হয়।[8]

এই নেকীর পাহাড় তাদের বর্তমান মুরববীদের আবিষ্কার। যেমন তারা এখন আবার চালু করেছে যে, যারা তাদের বার্ষিক ইজতেমায় (টঙ্গী) যায় এবং আখেরী মুনাজাতে অংশ নেয়, তারা একটি কবুল হজ্জের নেকী পায়। অর্থাৎ সে ঐদিনের মত পাপমুক্ত হয়, যেদিন তার মা তাকে নিষ্পাপ অবস্থায় প্রসব করেছিল। ফলে বহু লোক এখন মক্কায় হজ্জে যাওয়ার চাইতে টঙ্গী যাওয়াকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। সেখানে এখন প্রতিবছর লাখো মানুষের ঢল নামছে। অথচ বোকারা জানেনা যে, কোটি মানুষের জমায়েত হ’লেও তা কখনো হজ্জের নেকীর সাথে তুলনীয় নয়। এরপরেও সেখানে গিয়ে শেখার কিছু নেই, দেশী-বিদেশী ভাষায় ছয় উছূলের বর্ণনা আর তাবলীগী নেছাবের চর্বিত চর্বণ ছাড়া। মানুষ ভাবে এখানে এলাম, হজ্জের ছওয়াব পেলাম। বহু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ বিষয়ে উম্মতকে হুঁশিয়ার করে গিয়েছেন এই বলে যে, لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لاَ يُحَجَّ الْبَيْتُ ‘ক্বিয়ামত হবেনা যতদিন না বায়তুল্লাহর হজ্জ বন্ধ হয়’।[9] হ্যাঁ, সেটাই শুরু করেছে তাবলীগী ভাইয়েরা। ওদিকে আরেক দল ছুটছে ‘ওরসে’ গরু-খাসি নিয়ে মৃত পীরের অসীলায় ও তার গদ্দীনশীন হুযুরের দো‘আ ও তাবাররুক নিয়ে অভীষ্ট লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা জান্নাত পাবার মিথ্যা ধারণার বশবর্তী হয়ে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন!

‘ফাযায়েলে দরূদ শরীফে’ বর্ণিত ৫০টি গল্পের শেষ গল্পে মাওলানা যাকারিয়া বলেন, ফাযায়েলের পুস্তিকা সমূহ লিখার সময়কালে এই নাচীয ও তার অনেক বন্ধু স্বপ্নের মধ্যে সুসংবাদ প্রাপ্ত হন। শেষে ‘ফাযায়েলে দরূদ শরীফ’ লেখার সময় দু’বার স্বপ্ন দেখি যে, এই পুস্তিকা শেষে ক্বাছীদা (প্রশংসামূলক দীর্ঘ কবিতা) অবশ্যই লিখো। তখন আমি মোল্লা জামীর বিখ্যাত ক্বাছীদা লেখার সিদ্ধান্ত নিই। কেননা উক্ত ক্বাছীদা লিখে হজ্জে গেলে তিনি যখন মদীনায় গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তা পড়তে এরাদা করেন, তখন রাসূল (ছাঃ) মক্কার আমীরকে পরপর দু’বার স্বপ্নে বলে দেন যে, জামী যেন মদীনায় না আসে। তখন তাকে গ্রেফতার করে জেলখানায় রাখা হয়। পরে তৃতীয়বার স্বপ্নে তিনি আমীরকে বলেন যে, লোকটি অপরাধী নয়। তবে সে আমার প্রশংসায় ক্বাছীদা লিখেছে, যা সে আমার কবরে এসে পড়তে চায়। তাতে তার সাথে মুছাফাহার জন্য কবর থেকে আমার হাত বের হবে। তখন লোকদের মধ্যে ফিৎনার সৃষ্টি হতে পারে। সেজন্য আমি তাকে এখানে আসতে নিষেধ করেছি।’ এরপর তাকে জেল থেকে বের করা হয় ও উচ্চ সম্মান দেওয়া হয়। লেখক মাওলানা যাকারিয়া বলেন, উক্ত কাহিনী জানার কারণেই তাঁর লিখিত ক্বাছীদার প্রতি নাচীযের হৃদয় আকৃষ্ট হয় এবং এখনও পর্যন্ত সেই ধারণায় কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। অতঃপর তিনি ৩২ লাইনের ফার্সী ক্বাছীদা উর্দূ অনুবাদ সহ যোগ করেছেন (পৃঃ ১১২-১১৩)।

উপরে বর্ণিত কাহিনীর মাধ্যমে মাওলানা যাকারিয়ার কুরআন-হাদীছ বিরোধী আক্বীদা পরিষ্কার হয়ে গেছে। কেননা কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তুমি কোন কবরবাসীকে শুনাতে পারো না’ (ফাত্বির ৩৫/২২)। ‘তুমি কোন মৃতব্যক্তিকে শুনাতে পারো না’ (নামল ২৭/৮০)। মৃতব্যক্তি কারু উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। সেটা সম্ভব হলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কবরের পাশেই ইমামতি করা অবস্থায় খলীফা ওমর (রাঃ)-এর উপর আততায়ীর হামলা ও পরে শাহাদাত লাভ এবং মসজিদের পাশেই তৃতীয় খলিফা হযরত ওছমান গণী (রাঃ)-এর উপর বিদ্রোহীদের হামলা ও শাহাদাত লাভ রাসূল (ছাঃ) ঠেকিয়ে দিতেন বা অন্যদের স্বপ্ন দেখিয়ে ঠেকাতে বলতেন। অথচ উপরে বর্ণিত এক উদ্ভট স্বপ্নকেই মাওলানা যাকারিয়া তাঁর তাবলীগী নেছাব লেখার উদ্দেশ্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন, যা একেবারেই ইসলাম বিরোধী।

দলবদ্ধ চিল্লার প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের মধ্যে তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে দেউবন্দী ভ্রান্ত তা‘লীম ও ছূফী আক্বীদা-বিশ্বাস লোকদের হৃদয়ে প্রোথিত করা। মাওলানা যাকারিয়ার তাবলীগী নেছাবের মাধ্যমে যেটা সর্বত্র প্রচারিত হচ্ছে। সাথে সাথে এই জামা‘আতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াসের ভ্রান্ত আক্বীদা তার নিজ যবানীতে নিম্নরূপ :

‘স্বপ্নের মধ্যে বিশুদ্ধ জ্ঞান সমূহ প্রক্ষিপ্ত হয়। যা নবুঅতের চল্লিশ ভাগের একভাগ।’ ‘আজকাল স্বপ্নের মাধ্যমে আমার মধ্যে বিশুদ্ধ ইলম সমূহ ( علوم صحيحہ ) প্রক্ষিপ্ত হচ্ছে। এজন্য চেষ্টা করব যাতে আমার ঘুম বেশী হয়। ফলে মাথায় তেল মালিশ করায় তার ঘুম খুব বেশী হ’তে লাগল’। অতঃপর তিনি (মাওলানা ইলিয়াস) বললেন, اس تبليغ كا طريقہ بهى مجھ پر خواب ميں منكشف ہوا ‘তাবলীগের এই তরীকাও আমার উপর স্বপ্নের মধ্যে বিকশিত হয়েছে’।[10]

এইভাবে পুরা তাবলীগী নিছাব অলীক স্বপ্নে ও ভিত্তিহীন গল্পে ও কাহিনীতে ভরপূর। যা পড়লে ও শুনলে যে কেউ সব কাজ ও দায়িত্ব ছেড়ে কেবল স্বপ্ন ও কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করবে। ফলে মুখে ‘রাসূলের তরীকায় শান্তি’ বলে হর-হামেশা প্রচার চালালেও এটা মূলতঃ ইলিয়াসী তরীকার প্রচার, যা মানুষকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছমুখী না করে তাদের নিজেদের আবিষ্কৃত ভ্রান্ত তরীকামুখী করে।

[1]. ফাযায়েলে হজ্জ, ২/১৩০-১৩১ পৃঃ।

[2]. ফাযায়েলে দরূদ শরীফ ১/৮৩ গল্প নং ৬।

[3]. তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/৬০৬৬, সনদ হাসান; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/১৫৯৪।

[4]. ফাযায়েলে দরূদ পৃঃ ১০৫ গল্প নং ৪৮(২); ফাযায়েলে হজ্জ পৃঃ ১২৮ গল্প নং ৮।

[5]. ফাযায়েলে দরূদ শরীফ পৃঃ ৮৬ গল্প নং ১৭।

[6]. ফাযায়েলে দরূদ শরীফ পৃঃ ৮২, গল্প নং ৩।

[7]. ফাযায়েলে দরূদ শরীফ পৃঃ ৮৯ গল্প নং ২৩ ও ২৪।

[8]. এজন্য দু’টি যঈফ হাদীছ (আবুদাঊদ হা/২৪৯৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪; ইবনু মাজাহ হা/২৭৬১ অনুচ্ছেদ-৪, মিশকাত হা/৩৮৫৭) সাতশো দ্ধ সাত লক্ষ নেকী গুণ করে এই ঊনপঞ্চাশ কোটি বানানো হয়েছে।

[9] বুখারী হা/১৫৯৩; ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৪৭।

[10]. আব্দুর রহমান উমরী, তাবলীগী জামা‘আত আওর উসকা নিছাব (নয়াদিল্লী : দারুল কিতাব, ১৯৮৮ খৃঃ), পৃঃ ১৩; গৃহীত : মালফূযাতে মাওলানা ইলিয়াস পৃঃ ৫১।

২০
চিল্লা প্রথা (بدعة الأربعين)
চল্লিশ দিনের জন্য নিজস্ব খরচে তাবলীগে বের হওয়াকে ‘চিল্লা’ বলে। চিল্লা হ’ল তাবলীগীদের ভিত্তিমূলক রুকন ( الركن الأساسى )। যে ব্যক্তি চিল্লায় বের হয়, তাকে তারা মহববত করে, সম্মান করে ও তার অপরাধসমূহ ক্ষমা করে। আর যারা এর বিরোধিতা করে, তারা তাকে গ্রহণ করে না, যদিও সে ইসলামের ফরয-ওয়াজিবসমূহ পালন করে। প্রচলিত বিদ‘আতী তাবলীগকে শরী‘আত সিদ্ধ প্রমাণ করার জন্য তারা সূরা আলে ইমরানের ১১০ নং আয়াতে বর্ণিত أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ -এর অপব্যাখ্যা করে এটাকেই ‘চিল্লার পক্ষে কুরআনী নির্দেশ’ বলতে চেয়েছেন এবং এই মর্মে তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস নাকি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছেন এই মর্মে যে, إِنَّكَ أُخْرِجْتَ لِلنَّاسِ مِثْلَ الْأَنْبِيَاءِ ‘নিশ্চয়ই তুমি মানুষের জন্য আবির্ভূত হয়েছ নবীগণের ন্যায়।’ যদিও তিনি নিজে চিল্লায় যেতেন না। বরং অধিকাংশ সময় আব্দুল কুদ্দূস গাঙ্গোহীর কবরের পিছনে বসে থাকতেন এবং নূর সাঈদ বাদায়ূনীর কবরের নিকটে নিরালায় জামা‘আতে ছালাত আদায় করতেন।[1] অথচ কবরে ছালাত আদায় করা শরী‘আতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শায়খ তাক্বিউদ্দীন হেলালী বলেন, ‘চিল্লা তাদের দ্বীনের সারমর্ম’ ( خلاصة دينهم )। এর ভিত্তিতেই তারা পরস্পরে ভালবাসে অথবা শত্রুতা করে। অথচ এর মাধ্যমে তারা ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন, (১) এর মাধ্যমে তারা দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করে এবং সুন্নাতে রাসূলের বিরোধিতা করে (২) তারা স্ত্রী-সন্তানাদি ও পিতা-মাতার হক নষ্ট করে (৩) ছাত্রদেরকে তাদের দ্বীনী ইল্ম শিক্ষা করা থেকে বিরত রাখে (৪) তারা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা থেকে দূরে রাখে এবং তাদের মাধ্যমে যারা যাকাত ও ছাদাক্বা লাভ করত, তাদেরকে বঞ্চিত করে। এভাবে বহু বঞ্চিত মানুষের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে ও মানুষের কাছে জমা হয়’। তিনি বলেন, ‘ইসলাম আসার আগে ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পায়ে হেটে বহু দূরে চলে যেত। বাধ্য না হলে তারা কোন কিছুতে সওয়ার হতো না। অতঃপর জঙ্গলে বা অন্য কোথাও নিরালায় বসে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর হয়ে ঈশ্বর বন্দনায় লিপ্ত হতো। এভাবে তারা দিনের পর দিন কাটিয়ে দিত’। তিনি বলেন, ‘হে তাবলীগীরা! তোমাদের এই ঘরবাড়ি ছেড়ে চিল্লায় যাওয়ার প্রথা যদি ব্রাহ্মণদের ধর্ম থেকে না নেওয়াও হয়, তথাপি এটি হ’ল নিকৃষ্টতম বিদ‘আত ও নিকৃষ্টতম ভ্রষ্টতা। যা ভারতীয় মূর্তিপূজারীদের হুবহু অনুকরণ, যা তোমরা পুরোপুরিভাবে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছ। অথচ তোমাদের এই জোশ ও পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যয় করা ওয়াজিব ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের দিকে মানুষকে আহবানের কাজে’। তিনি বলেন, ‘তাবলীগীদের মাদরাসাগুলি মানুষের রায়-ক্বিয়াসের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় ও সেখানে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে সংকুচিত করা হয়’। তিনি বলেন, ‘তাবলীগীরা বলে, তাদের চিল্লার মাধ্যমে বহু অমুসলিম মুসলমান হয়’। উত্তরে একথা বলা যায় যে, ‘এতে শুরুটা ভাল হলেও পরিণামে মন্দ হয়। কেননা সে ছাহাবা, তাবেঈন ও সালাফে ছালেহীনের তরীকায় গড়ে ওঠে না। বরং তাবলীগীদের বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত রীতিতে গড়ে ওঠে। ফলে যে ব্যক্তি এভাবে তৈরী হয়, সে ব্যক্তির ইসলাম কবুলে খুশী হবার কিছু নেই। কেননা সে ৭২ ফের্কার অন্তর্ভুক্ত হয়, যাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জাহান্নামের দুঃসংবাদ দিয়েছেন’।[2]

চিল্লায় গিয়ে মানুষকে ছয় উছূল (কালেমা, ছালাত, ইলম ও যিকর, ইকরামুল মুসলিমীন, তাছহীহে নিয়ত, তাবলীগ) শিখানো হয়। ফলে ইসলামের ৫টি বুনিয়াদ শিক্ষা (ঈমান, ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ) গৌণ হয়ে যায়। অমনিভাবে ৪ মাযহাব ফরয সহ ১৩০ ফরয মুখস্ত করানো হয়। এছাড়া নানা দায়েমী ফরয, দায়েমী সুন্নাত, খানাপিনা-পেশাব-পায়খানা সহ নানাবিধ আদব, ফরয-ওয়াজিব ও সুন্নাতের বিরাট তালিকা মুখস্ত করানো, গাশত-তা‘লীম, সফর-মোশাওয়ারা, অতঃপর ফাযায়েলের বায়ান ইত্যাদির মধ্যে একজন মানুষকে সর্বদা ব্যস্ত রাখা হয়।[3] অথচ তাদেরকে কুরআন ও হাদীছ শিখানো হয় না। তাওহীদ ও শিরক, সুন্নাত ও বিদ‘আত বুঝানো হয় না। যেগুলি ইসলামের মৌলিক বিষয়।

[1]. আল-ক্বাওলুল বালীগ পৃঃ ২১৫, ১৬, ২৬।

[2]. আল-ক্বাওলুল বালীগ পৃঃ ২২২, ২২৩।

[3]. এক মোবাল্লেগের পয়লা নোট বই, ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ জুলফিকার আহমদ মজুমদার (ঢাকা : ১৯৭৮)।

২১
হাদীছ পরিবর্তনে মাযহাবী আলেমগণ
( علماء المذاهب في تحريف الحديث )

(১) শাফা‘আত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন شَفَاعَتِى لأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِى ‘আমার শাফা‘আত হবে আমার উম্মতের কাবীরা গোনাহগারদের জন্য’।[1]

মু‘তাযিলা বিদ্বানগণের মতে কাবীরা গোনাহগারগণ চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তারা শাফা‘আতের হকদার নয়। অতএব তারা এ হাদীছে ‘কাবায়ের’ অর্থ করেছে ‘ছালাওয়াত’ অর্থাৎ ‘ছালাতসমূহের অধিকারী মুমিনদের জন্যই আমার শাফা‘আত হবে’।

কেননা ‘ছালাত’ হ’ল বড় ইবাদত। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِينَ ‘ছালাত নিশ্চই বড় বিষয়, বিনত বান্দাগণের উপরে ব্যতীত’ (বাক্বারাহ ২/৪৫)।[2]

(২) বিতর : আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُوتِرُ بِثَلاَثٍ لاَ يَقْعُدُ إِلاَّ فِى آخِرِهِنَّ . ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন এবং শেষ রাক‘আত ব্যতীত বসতেন না’।[3] কিন্তু জনৈক হিন্দুস্তানী হানাফী আলেম তাঁদের মুদ্রিত ‘মুস্তাদরাকে হাকেমে’ নিজেদের মাযহাবের অনুকূলে সেখানে لاَ يَقْعُدُ পাল্টিয়ে لاَ يُسَلِّمُ করেছেন। অর্থাৎ তিনি শেষের রাক‘আত ব্যতীত ‘সালাম ফিরাতেন না’। কেননা হানাফীগণ তিন রাক‘আত বিতরের দ্বিতীয় রাক‘আতে বৈঠক করে থাকেন। অথচ মুস্তাদরাকের উক্ত হাদীছের নীচে ইমাম যাহাবীর ‘তালখীছে’ ঠিকই لاَ يَقْعُدُ শব্দ রয়েছে।[4] বায়হাক্বীতেও উক্ত হাদীছে لاَ يَقْعُدُ শব্দ এসেছে (৩/২৮ পৃঃ)।

(৩) তারাবীহ : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বিশ রাক‘আত তারাবীহর কোন হাদীছ নেই। অতএব ওমর ফারূক (রাঃ) থেকে বিশ রাক‘আত তারাবীহ প্রমাণের জন্য আবুদাঊদে বর্ণিত عِشْرِينَ لَيْلَةً -কে عِشْرِينَ رَكْعَةً করা হয়েছে হিন্দুস্তানে মুদ্রিত আবুদাঊদ গ্রন্থে।[5] অর্থাৎ ‘বিশ রাত্রি’কে ‘বিশ রাক‘আত’ বানানো হয়েছে। হাদীছটি হ’ল : হাসান বলেন যে, ওমর (রাঃ) উবাই বিন কা‘বের ইমামতিতে তারাবীহর ছালাতে সবাইকে একত্রিত করেন এবং তিনি তাদেরকে ২০ রাত্রি ছালাত আদায় করান’...।[6] উল্লেখ্য যে, আরব জগতের প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মাদ আলী ছাবূনী স্বীয় ‘তারাবীহ’ সংক্রান্ত বইয়ের ৫৬ পৃষ্ঠায় মুগনী ইবনু কুদামাহর বরাতে عِشْرِيْنَ رَكْعَةً লিখেছেন। এর দ্বারা তিনি উদ্ধৃতিতে ‘তাহরীফ’ (পরিবর্তন) করেছেন। কেননা মুগনীতে عِشْرِيْنَ لَيْلَةً রয়েছে। আহলেহাদীছগণের বিরুদ্ধে মুহাম্মাদ আলী ছাবূনীর বিদ্বেষ বিদ্বানগণের নিকটে বহুল পরিচিত। আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কিত তাঁর আক্বীদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধী।[7]

(৪) বাংলাদেশের বিভিন্ন বঙ্গানুবাদ তাফসীর ও হাদীছসমূহের কিতাবে মাযহাবী সংর্কীণতার ভুরি ভুরি প্রমাণ সুধী জনের নিকটে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ বঙ্গানুবাদ ‘মেশকাত শরীফে’ মু‘তাযিলা ও মুর্জিয়াদের অনুকূলে এবং হানাফী মাযহাবের পক্ষে হাদীছের ভুল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শায়খুল হাদীছ আযীযুল হক-এর বঙ্গানুবাদ বুখারীকে তো সরাসরি ‘রাদ্দুল বুখারী’ বলাই উত্তম। নানা টীকা-টিপ্পনী দিয়ে বুখারীর ছহীহ হাদীছগুলি রদ করাই যেন তাঁর বঙ্গানুবাদের মূল উদ্দেশ্য। কেননা ছহীহ বুখারীতে হানাফী মাযহাবের অনুকূলে ছালাতে নাভির নীচে হাত বাঁধা, নীরবে আমীন বলা, রাফ‘উল ইয়াদায়েন না করা, জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা না পড়া, বিশ রাক‘আত তারাবী পড়া ইত্যাদির কোন হাদীছ নাই। বরং এসবের বিপক্ষে হাদীছ রয়েছে। অতএব যে কোন মূল্যে সেগুলিকে রদ করার জন্য টিকাতে রীতিমত মাযহাবী কাঁচি চালানো হয়েছে।

(৫) উছূলে ফিক্বহ বা ‘ফিক্বহের মূলনীতিসমূহ’ নামে উছূলুশ শাশী, নূরুল আনওয়ার প্রভৃতি যেসব বই পরবর্তীকালে রচিত হয়েছে এবং যেগুলি উপমহাদেশের মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পাঠ্যবই হিসাবে গৃহীত হয়েছে, সেগুলিতে নিজেদের রচিত মূলনীতি বিরোধী ছহীহ হাদীছসমূহকে ন্যাক্কারজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যেমন ‘নূরুল আনওয়ার’-এর ‘খাছ’ অধ্যায়ে বর্ণিত ছালাতে তা‘দীলে আরকান ফরয হওয়ার বিষয়ে বুখারী ও মুসলিম-এর ছহীহ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করাসহ অন্যান্য উদাহরণ সমূহ। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬/১৭০৩-১৭৬২) বলেন,

وَأَمْثَالُ ذَلِكَ أُصُوْلٌ مُخَرَّجَةٌ عَلَى كَلاَمِ الْأَئِمَّةِ، وَأَنَّهُ لاَ تَصِحُّ بِهَا رِوَايَةٌ عَنْ أَبِيْ حَنِيْفَةَ وَصَاحِبَيْهِ -

‘অনুরূপ বিষয়গুলির সবই ইমামদের কথার উপরে ভিত্তি করে উছূল বের করা হয়েছে। অথচ এগুলির কোন একটিরও বর্ণনা আবু হানীফা ও তাঁর দুই শিষ্য থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়’।[8] এ কারণেই ভুক্তভোগীগণ উছূলে ফিক্বহ-কে ‘হাদীছ কাটা কাঁচি’ বলে থাকেন। অর্থাৎ নিজেদের মাযহাব বিরোধী ছহীহ হাদীছ সমূহকে কর্তন করার উদ্দেশ্যেই ‘উছূলে ফিক্বহ’ নামে পৃথক শাস্ত্র তৈরী করা হয়েছে।

(৪) ছালাতে নাভীর নীচে হাত বাঁধা : এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে কোন ছহীহ হাদীছ নেই। তাই মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহতে বর্ণিত হাদীছে (১/৩৯০) تَحْتَ السُّرَّةِ (নাভীর নীচে) কথাটি যোগ করে হাদীছ পরিবর্তন (তাহরীফ) করা হয়েছে। আর একাজটি করেছে করাচীর ‘এদারাতুল কুরআন ওয়াল উলূমিল ইসলামিয়াহ’ নামক প্রকাশনা সংস্থা’। ভারতের আনোয়ার শাহ কাষ্মীরীর ন্যায় বিখ্যাত হানাফী আলেমগণ যার প্রতিবাদ করেছেন।

(৫) রুকূর আগে ও পরে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা : হানাফী মাযহাবে এটা নাজায়েয। অথচ চার খলীফা ও আশারায়ে মুবাশশরাহ সহ অন্যূন ৫০ জন ছাহাবী থেকে এ বিষয়ে অন্যূন ৪০০ ছহীহ হাদীছ ও আছার বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু স্রেফ মাযহাবী গোঁড়ামীর কারণে ভারতের হায়দারাবাদ ছাপা মুসনাদে আবু ‘আওয়ানাতে বর্ণিত وَلاَ يَرْفَعُهَا থেকে واو বিলুপ্ত করে স্রে্ফ لاَ يَرْفَعُهَا করা হয়েছে। যাতে মূল অর্থ সম্পূর্ণরূপে উল্টে গিয়ে নিজেদের মাযহাবের পক্ষে অর্থ করা যায়। অর্থাৎ মূলে ছিল عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلاَةَ رَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى يُحَاذِيَ بِهِمَا وَقَالَ بَعْضُهُمْ : حَذْوَ مَنْكِبَيْهِ، وَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَرْكَعَ وَبَعْدَ مَا يَرْفَعُ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوعِ- وَلاَ يَرْفَعُهُمَا، وَقَالَ بَعْضُهُمْ : وَلاَ يَرْفَعُ بَيْنَ السَّجْدَتَيْنِ، وَالْمَعْنَى وَاحِدٌ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখেছি যখন তিনি ছালাত শুরু করেন তখন দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত উঁচু করেন এবং যখন রুকূতে যাওয়ার এরাদা করেন ও রুকূ থেকে মাথা উঠান। আর তিনি দু’হাত উঁচু করেননি, কেউ বলেছেন উঁচু করেননি দুই সিজদার মাঝে। অবশ্য অর্থ একই।’ অত্র বাক্যে وَلاَ يَرْفَعُهُمَا -এর واو (আর) শব্দটি বিলুপ্ত করলে অর্থ হবে হানাফী মাযহাব মতে তিনি রুকূতে যাওয়া এবং ওঠার সময় দু’হাত উঠাননি। অথচ মূল হাদীছ তার বিপরীত।[9]

শুধু তাই নয় খোদ ইমাম বুখারীর উস্তাদ হুমায়দীর (মৃ. ২১৯হিঃ) বিখ্যাত গ্রন্থ মুসনাদুল হুমায়দীতেও শাব্দিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন হাবীবুর রহমান আ‘যামীর তাহকীককৃত ভারতীয় ছাপা (১৩৮৭ হিঃ/১৯৬৩ খৃঃ) মুসনাদুল হুমায়দী হা/৬১৪-তে ইবনু ওমর (রাঃ) বর্ণিত রাফ‘উল ইয়াদায়েন-এর বিখ্যাত হাদীছে وَلاَ يَرْفَعُ بَيْنَ السَّجْدَتَيْنِ -এর আগে فَلاَ يَرْفَعُ وَلاَ بَيْنَ السَّجْدَتَيْنِ করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘রুকূতে যাওয়া ও রুকূ থেকে ওঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন না এবং দুই সিজদাতেও করতেন না।’[10]

(৬) ইমামের তাক্বলীদ এবং নিজেদের মাযহাব প্রমাণ করতে গিয়ে সূরা নিসা ৫৯ আয়াতের তাফসীরে শায়খ মাহমূদুল হাসান দেউবন্দী (মৃ. ১৩৩৯ হিঃ/১৯১৪খৃঃ) বৃদ্ধি করেছেন أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ وَأُوْلِى الْأَمْرِ مِنْكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ ‘তোমরা কোন বিষয়ে মতভেদ করলে সেটা ফিরিয়ে দাও আল্লাহ, রাসূল ও তোমাদের মধ্যেকার আদেশদানের অধিকারীদের নিকট’-অর্থাৎ ইমামদের নিকট।[11]

(৭) কুরআন সহজে মুখস্তযোগ্য হওয়ার পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ ، فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ؟ (ক্বামার ১৭) -এর মর্ম পরিবর্তন করে শায়খুল হাদীছ মাওলানা যাকারিয়া (মৃ. ১৪০২ হিঃ/১৯৮২ খৃঃ) অনুবাদ করেছেন, ہم نے كلام پاك كو حفظ كرنے كے لئے سہل كر ركها ہے، كوئى ہے حفظ كرنے والا؟ ‘আমরা কুরআনকে হিফয করার জন্য সহজ করেছি। আছে কি কেউ হেফযকারী?[12] অথচ অন্যান্য সকল বিদ্বান উক্ত আয়াতের অনুবাদ করেছেন, ‘আমরা কুরআনকে সহজ করেছি উপদেশ লাভের জন্য। অতএব আছে কি কেউ উপদেশ প্রহণকারী?’

এমনিভাবে অন্যান্য মাসআলার ব্যাপারেও হাদীছের মতন (Text) পরিবর্তন করা হয়েছে স্রেফ মাযহাবী গোঁড়ামীর বশবর্তী হয়ে। এমনকি কুরআনের কোন কোন আয়াতের পরিবর্তন আনা হয়েছে দুঃসাহসিকভাবে। এছাড়াও রয়েছে হাদীছের একাংশ, যা নিজ মাযহাবের অনূকূলে, সেটুকু গ্রহণ করা ও বাকী অংশ যা স্বীয় মাযহাবের প্রতিকূলে তা বর্জন করার অসংখ্য প্রমাণ। এমনকি ছহীহ হাদীছের অর্থ নিজ মাযহাবের অনুকূলে বিকৃত করার নযীরের কোন অভাব নেই। অনুরূপভাবে স্বীয় ইমামের পক্ষে ও অন্য মাযহাবের ইমামের বিরুদ্ধে নোংরা মন্তব্য করে হাদীছ বানানোর বহু প্রমাণ পেশ করা যাবে। বলা বাহুল্য, এগুলি হাদীছ অস্বীকার করার চাইতে কোন অংশে কম নয়। বরং তার চাইতে মারাত্মক। এছাড়াও রয়েছে যঈফ ও মওযূ হাদীছে ভরা, সাথে সাথে কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যায় ভরপুর কিতাবসমূহ। অথচ সেগুলির প্রচলন জনসাধারণের মধ্যে খুবই বেশী।

এদিকে ইঙ্গিত করেই খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (১৮৪৮-১৮৮৬ খৃঃ) হানাফী ও শাফেঈ মাযহাবের ‘হেদায়া’ ও ‘আল-ওয়াজীয’ প্রভৃতি বিশ্বস্ত ফিক্বহ গ্রন্থগুলির অমার্জনীয় হাদীছ বিরোধিতা সম্পর্কে বলেন যে, এগুলি مَمْلُوْءٌ مِنَ الْأَحَادِيْثِ الْمَوْضُوْعَةِ، لاَ سِيِّمَا الْفَتَاوَي ‘মওযূ’ যা জাল হাদীছ দ্বারা পরিপূর্ণ, বিশেষ করে ফৎওয়াসমূহের ক্ষেত্রে’।[13]

এ দেশের প্রেক্ষাপটে ইতিপূর্বে আলোচিত লেখকদের অধিকাংশ বই ছাড়াও ইমাম গায্যালীর ‘এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন’ বইটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও রয়েছে কম ইল্ম ধর্মীয় লেখকদের এবং মা‘রেফতী ছূফীদের অসংখ্য ভ্রান্তিকর লেখনী, যা হর-হামেশা মানুষের ঈমান ও আমলকে ত্রুটিপূর্ণ করে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে উক্ত লেখনীসমূহ নাস্তিক্যবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী লেখকদের সহায়ক হিসাবে কাজ করছে। অতএব আমাদের চোখ-কান সর্বদা খোলা রাখতে হবে। সম্ভবতঃ একারণেই খ্যাতনামা তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হিঃ) বলেছেন, إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِيْنٌ، فَانْظُرُوْا عَمَّنْ تَأْخُذُوْنَ دِيْنَكُمْ ‘নিশ্চয় কুরআন-হাদীছের ইল্মটাই হ’ল দ্বীন। অতএব তোমরা দেখ, কার নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করছ’।[14]

ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর উস্তাদ ইমাম অকী‘ (রহঃ) বলেন, من طلب الحديث كما جاءه فهو صاحب سنة، ومن طلب الحديث ليةقوَّي هواه فهو صاحب بدعة - ‘যে ব্যক্তি হাদীছ অনুসন্ধান করে যেভাবে তা এসেছে সেভাবে, ঐ ব্যক্তি সুন্নাতের অনুসারী। আর যে ব্যক্তি হাদীছ অনুসন্ধান করে তার নিজের ধারণাকে শক্তিশালী করার জন্য, ঐ ব্যক্তি বিদ‘আতী।’ তিনি আরও বলেন, أهل السنة يرون ما لهم وما عليهم وأهل البدعة لا يرون إلا ما لهم - ‘সুন্নাতের অনুসারীগণ দৃষ্টি দেন যা তাদের পক্ষে এবং বিপক্ষে। পক্ষান্তরে বিদ‘আতীগণ দৃষ্টি দেন কেবল যা তাদের পক্ষে।’[15] অর্থাৎ প্রকৃত আহলে সুন্নাত বা আহলেহাদীছগণ সর্বদা নিজেদের রায়ের উপরে ছহীহ হাদীছকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। সেটা তার নিজের ইচ্ছার পক্ষে হৌক বা বিপক্ষে হৌক, নির্বিবাদে তা মেনে নেন।

অনেকের ধারণা, হাদীছের খেদমত করলেই তিনি হাদীছপন্থী হয়ে থাকেন। কিন্তু আসলে তা নয়। মাযহাবী গোঁড়ামী এবং বিদ‘আতী আক্বীদার কারণে হাদীছের নূর তার উপর কার্যকর হয় না। তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ উপরের শায়খুল হাদীছগণ এবং দেউবন্দী ও ব্রেলভী শীর্ষস্থানীয় আলেমদের বিকৃত আক্বীদা ও আমলসমূহের উপরে লিখিত বই-কিতাব সমূহ।

মূলতঃ এসব কারণেই উপমহাদেশে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে ‘ওয়াহদাতুল উজূদ’ ও ‘হুলূল’ অর্থাৎ অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী কুফরী দর্শন। প্রচারিত হয়েছে বাতিল আক্বীদাসমূহ। যেমন, আল্লাহ নিরাকার। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। ‘আব্দ ও মা‘বূদে কোন পার্থক্য নেই। যত কল্লা তত আল্লাহ। মুহাম্মাদ (ছাঃ) নূরের তৈরী। তিনি সর্বত্র হাযির-নাযির। পীর-মাশায়েখগণ মরে গিয়েও কবরে বেঁচে থাকেন ও ভক্তদের আবেদন শুনেন ও তা পূরণ করেন’ ইত্যাদি শিরকী বিশ্বাস সমূহ। সেজন্যেই মানুষ ছালাত-ছিয়ামের চাইতে তথাকথিত মা‘রেফত হাছিল, মীলাদ-ক্বিয়াম ও কবরপূজার প্রতি বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে বললে তারা জোরের সাথে বলেন, اَلتَّفْرِيْقُ بَيْنَ الْعَبْدِ وَالْمَعْبُوْدِ هُوَ الشِّرْكُ بِعَيْنِهِ - ‘সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যে পার্থক্য করাটাই হ’ল প্রকৃত শিরক।’ এজন্য তারা কুরআনের আয়াতের বিকৃত অর্থ করতেও দ্বিধা করেননি। যেমন আল্লাহ বলেন, قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لاَ تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ ‘আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপরে যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না’ (যুমার ৩৯/৫৩)। এখানে عِبَادِيْ (আমার বান্দাগণ) অর্থ করা হয়েছে عِبَادُ الرَّسُولِ ‘রাসূলের বান্দাগণ’ (নাঊযুবিল্লাহ)।[16]

এছাড়াও রয়েছেন অতি সাম্প্রতিক ভারতীয় মুহাদ্দিছ শায়খ হাবীবুর রহমান আ‘যমী হানাফী (১৩১৯-১৪১৩হিঃ/১৯০০-১৯৯২খৃঃ), যিনি হাদীছের উপরে ৪০ খন্ডের বিশাল গ্রন্থরাজি সংকলন করেছেন এবং হাদীছের খেদমতে জীবনের ৬০ বছরের অধিক সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু তার মাযহাবী গোঁড়ামীতে কোনই পরিবর্তন আসেনি।[17] ফলে তার এই বিরাট খিদমত পন্ডশ্রম ব্যতীত কিছুই হয়নি। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন!

পরিশেষে বলব, হাদীছ হ’ল ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় মূল স্তম্ভ। কুরআন ও হাদীছ উভয়েরই হেফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। অতএব, হাদীছের প্রামাণিকতায় অবিশ্বাস বা সন্দেহ পোষণ কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ আমাদের দ্বীন ও ঈমানকে হেফাযত করুন- আমীন!

[1]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, প্রভৃতি, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/৫৫৯৮।

[2]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ৩১৯।

[3]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ৩২৫; মুস্তাদরাকে হাকেম।

[4]. মুস্তাদরাকে হাকেম (হায়দরাবাদ : ১৩৩৫ হিঃ/১৯১০খৃঃ) পৃঃ ১/৩০৪।

[5]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ৩২৮।

[6]. আবুদাঊদ হা/১৪২৯; ঐ, মিশকাত হা/১২৯৩ ‘কুনূত’ অনুচ্ছেদ, হাদীছ যঈফ।

[7]. বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : যাওয়াবে‘ পৃঃ ৩২৫-৩৩১।

[8]. হজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ ১/১৬০ পৃঃ।

[9]. যাওয়াবে‘ ৩৩৭ পৃঃ।

[10]. যাওয়াবে‘ ৩৪০ পৃঃ।

[11]. যাওয়াবে‘ ৩২১ পৃঃ (টীকা-২)।

[12]. ফাযায়েলে কুরআন মাজীদ পৃঃ ৫৫।

[13]. মুক্বাদ্দামা নাফে‘ কবীর পৃঃ ১৩।

[14]. মুক্বাদ্দামা মুসলিম; মিশকাত হা/২৭৩ ‘ইল্ম’ অধ্যায়।

[15]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ৩৫৪।

[16]. সাইয়েদ তালেবুর রহমান, আদ-দেউবন্দীয়াহ (রাওয়ালপিন্ডি, তাবি) পৃঃ ১৮-১৯; গৃহীত : হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী (মৃঃ ১২৭৬ হিঃ), শামায়েমে এমদাদিয়া (মাদানী কুতুবখানা, মুলতান, পাকিস্তান) পৃঃ ৩৭, ৭১, ৮১। ব্রেলভীদের আক্বীদা ও ইতিহাস সম্পর্কে দ্রষ্টব্য : ইহসান ইলাহী যহীর প্রণীত ‘আল-ব্রেলভিয়াহ : আক্বায়েদ ওয়া তারীখ’ (রিয়াদ : ১৪০৪/১৯৮৪)।

[17]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ৩১৪।

২২
করজোড়ে নিবেদন
সম্মানিত ওলামা ও সংশ্লিষ্ট সকলের নিকটে করজোড়ে নিবেদন, আমাদেরকে ভুল বুঝবেন না। একজন মুসলমান হিসাবে দায়িত্বের অংশ মনে করে স্রেফ উম্মতের ইছলাহের উদ্দেশ্যে আমরা উপরের বিষয়গুলি আলোচনায় এনেছি। যাতে আখেরাতে মুক্তির সন্ধানী ভাই-বোনদের পথ চলা সহজ হয়।

إِنْ أُرِيدُ إِلاَّ الْإِصْلاَحَ مَا اسْتَطَعْتُ وَمَا تَوْفِيقِي إِلاَّ بِاللهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ - ( هود ۸۸ )-

[শুকরিয়াসহ গ্রন্থপঞ্জীর নাম: (১) ছালাহুদ্দীন মকবূল আহমাদ প্রণীত زوابع في وجه السنة قديما وحديثا (২) ডঃ মুছত্বফা সাবাঈ প্রণীত السنة ومكانتها في التشريع الإسلامي (৩) ডঃ মুহাম্মাদ বিন আবু শাহবাহ প্রণীত دفاع عن السنة قديما وحديثا (৪) শায়খ আলবানী প্রণীত الحديث حجية بنفسه في العقائد والأحكام (৫) হামূদ বিন আব্দুল্লাহ তাওজীরী প্রণীত القول البليغ في التحذير من جماعة التبليغ (৬) শায়খ ইসমাঈল গুজরানওয়ালা প্রণীত حجيت حديث (৭) মাওলানা আব্দুর রঊফ নেপালী প্রণীত صيانة الحديث (৮) তাবেশ মাহদী রচিত تبليغي نصاب ايك مطالعہ (৯) আব্দুর রহমান উমরী প্রণীত تبليغي جماعة اور اس كا نصاب (১০) মাওলানা মওদূদী রচিত تفهيمات، خطبات (১১) মাওলানা যাকারিয়া প্রণীত فضائل أعمال تبليغى نصاب এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য গ্রন্থাবলী।]



سُبْحَانَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ - اللهُمَّ اغْفِرْلِى وَلِوَالِدَىَّ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ يَوْمَ يَقُوْمُ الحِسَابُ -

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন