মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
আল্লাহ তা‘আলার নান্দনিক নাম ও গুণসমগ্র কিছু আদর্শিক নীতিমালা
লেখকঃ শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমীন রহ.
২৩
চতুর্থ মূলনীতি: কুরআন ও সুন্নাহর টেক্সট বা ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ তা-ই যা টেক্সট বা ভাষ্যসমূহ সামনে আসার পর তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে। এ বাহ্যিক অর্থ কনটেক্সট বা বাক্যের পূর্বাপর সম্পর্ক অনুযায়ী এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কথা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/520/23
একই শব্দ এক কনটেক্সট-এ এক অর্থ দেয় আবার অন্য কনটেক্সট-এ অন্য অর্থ দেয়। শব্দমালার গাঁথুনি একভাবে হলে তার অর্থ হয় এক ধরনের আবার অন্যভাবে হলে তার অর্থ হয় অন্যধরনের।
যেমন আরবী القرية (আল কারইয়াহ) শব্দটির অর্থ কখনো হয় জাতি, আবার কখনো হয় বাড়িঘর যেখানে কোনো জাতির লোকেরা বসবাস করে।
নিশ্চয় আমরা এ জনপদের অধিবাসীদের ধ্বংস করব। (সূরা আল আনকাবুত: ১৯: ৩১)
আরেকটি উদাহরণ: আপনি হয়তো বলবেন যে, ‘আমি এ জিনিসটি আমার দু‘হাত দিয়ে বানিয়েছি।’ এখানে আপনার দু‘হাত এবং আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীতে উল্লিখিত দু‘হাতের মধ্যে আদৌ কোনো সাদৃশ্য নেই। বাণীটি হলো এই:
﴿لِمَا خَلَقۡتُ بِيَدَيَّۖ﴾ [ص: ٧٥ ]
আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি। (সূরা সাদ: ৩৮: ৭৫)
আপনি যে বাক্যটি বলেছেন সেখানে ‘দু‘হাত’কে সৃষ্টিজীব মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব এখানে হাত বলতে তাই বুঝাবে যা সৃষ্টিজীবের জন্য উপযোগী। আর আল কুরআনের আয়াতে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দু‘হাতকে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব তা হবে এমন হাত যা সৃষ্টিকর্তার জন্য উপযোগী। সুতরাং স্বচ্ছ প্রকৃতি ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিই এটা বলতে পারে না যে সৃষ্টিকর্তার হাত সৃষ্টিজীবের হাতের মতো অথবা এর উল্টো।
আরেকটি উদাহরণ এই যে, আপনি যদি বলেন: ‘আপনার কাছে তো শুধু যায়েদ।’ এবং ‘যায়েদ তো শুধু আপনার কাছে।’ তাহলে উভয় বাক্যের শব্দমালা অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও অর্থের দিক থেকে আলাদা। প্রথম বাক্যের অর্থ হলো যে আপনার কাছে যায়েদ ছাড়া অন্যকোনো মানুষ নেই। আর দ্বিতীয় বাক্যের অর্থ হলো, যায়েদ কোথাও নেই তবে আপনার কাছে। যায়েদের সঙ্গে আপনার কাছে অন্যান্য লোকজনও থাকতে পারে। অতএব শব্দের ঘটন-কাঠামোর কারণে অর্থের ভিন্নতা আসে এ বিষয়টি স্পষ্ট।
এ আলোচনার পর বলব যে, সিফাত-কেন্দ্রিক টেক্সট বা ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ তাই যা এ টেক্সট বা ভাষ্যগুলো দেখামাত্র মস্তিষ্কে আসে। আর এ ক্ষেত্রে মানুষ তিন দলে বিভক্ত হয়েছে:
প্রথম দল: এ টেক্সট বা ভাষ্যগুলো থেকে যে বাহ্যিক অর্থ বুঝা যায় সে অর্থকেই আল্লাহর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতিতে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছে এবং এ টেক্সটগুলোর অর্থনির্দেশ এখানেই সীমিত রেখেছে। এই দলটি হলো সালাফে সালেহীনদের দল; যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ যার ওপর ছিলেন তার ওপর একত্র হয়েছেন। যারা প্রকৃত অর্থে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আত খেতাবে ভূষিত এবং এ খেতাবটি কেবল তাদের জন্যই।
তাঁরা উল্লিখিত বক্তব্যের ওপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন। যেমন ইবনে আবদিল বার র. বলেন, ‘আহলে সুন্নাত আল কুরআন ও সুন্নায় যেসব সিফাত উল্লিখিত হয়েছে তা স্বীকার করে নেওয়া ও তার ওপর ঈমান আনার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তারা উক্ত সিফাতগুলোকে রূপক অর্থে নয় বরং প্রকৃত অর্থে বহন করার ব্যাপারেও একমত হয়েছেন। তবে তারা কোনো অর্থেরই আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ করেন না।
কাজী আবু ইয়া‘লা তার কিতাব ‘ইবতালুত তাবিল’ এ উল্লেখ করেন, ‘এই সংবাদগুলো [অর্থাৎ সিফাত-বিষয়ক টেক্সটগুলো] প্রত্যাখ্যান করা বৈধ নয়। এ ব্যাপারে তাবিল প্রক্রিয়ায় মশগুল হওয়াও বৈধ নয়। বরং এ টেক্সটগুলোকে তার বাহ্যিক অর্থে বহন করা ওয়াজিব এবং এটাও বিশ্বাস করা ওয়াজিব যে তা আল্লাহ তা‘আলার সিফাত; যা সৃষ্টিবস্তুর সিফাততুল্য নয়। আর এ ক্ষেত্রে ‘তাশবীহ’তেও বিশ্বাস করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ র. ও অন্যান্য ইমামগণ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। [ ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ ইবনে আবদুল বার ও কাজী আবু ইয়ালা থেকে উক্ত বক্তব্য তার ‘আল ফাতওয়া আল হামুবিয়া’-এ উল্লেখ করেছেন। (দ্র: মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড ৫,পৃষ্ঠা ৮৭ -৮৯ )
এটাই হলো বিশুদ্ধ মাযহাব এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ সোজা পথ। আর তা দু‘কারণে:
প্রথম কারণ: আল্লাহ তা‘আলার নাম ও সিফাত সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহয় যা এসেছে তার যথার্থ ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এ পথেই সম্ভব। বস্তুনিষ্ঠ ও ইনসাফপূর্ণভাবে যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নায় এ বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করবে তার সামনে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টাকারে ধরা পড়বে।
দ্বিতীয় কারণ: আমরা হয়তো বলব যে, সালাফগণ যা বলেছেন তাই হক ও সত্য অথবা বলব যে সালাফগণ ছাড়া অন্যান্যরা যা বলেছেন তা সত্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে দ্বিতীয় কথাটি বাতিল। কেননা দ্বিতীয় কথাটিকে বাতিল না বললে এর যুক্তিগত দাবি এটা দাঁড়ায় যে, সালাফগণ অর্থাৎ সাহাবী ও তাবে‘ঈগণ সরাসরি অথবা বাহ্যিকভাবে বাতিল কথা বলেছেন এবং একবারের জন্যও তারা সরাসরি ও বাহ্যিকভাবে যা বিশ্বাস করা ওয়াজিব এমন হক কথা বলেননি। এর অর্থ দাঁড়ায়, সালাফগণ হয়তো সত্য সম্পর্কে জাহেল ছিলেন অথবা সত্য তাদের জানা ছিল কিন্তু তারা তা গোপন করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সালাফগণ উভয় বিষয় থেকেই পবিত্র ছিলেন। অতএব সত্য যে কেবল সালাফগণের সঙ্গেই এতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকল না।
দ্বিতীয় দল: যারা সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থকে বাতিল করে দিয়েছেন এই ভেবে যে তা আল্লাহর জন্য উপযোগী নয়। আর এটাই হলো তাশবীহ তথা সাদৃশ্যকরণ। তারা তাশবীহনির্ভর অর্থকেই বহাল রেখেছেন। এ দলটিই হলো মুশাব্বিহাদের দল। এদের মতামত কয়েক কারণে বাতিল ও হারাম:
প্রথমত: এটা সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বিরুদ্ধে অন্যায় এবং তার যে অর্থ রয়েছে সেটাকে নাকচ করে দেওয়া। এটা কি করে বলা সঙ্গত যে এ টেক্সটসমূহকে বাহ্যিক অর্থের ওপর বহন করলে তা তাশবীহ হয়ে যায়, অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [ الشورى : ١١ ]
তাঁর মত কিছু নেই। (সূরা আশ-শূরা: ৪২: ১১)
অর্থাৎ যারা এ টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ বাতিল করে দেন তারা এই মনে করে বাতিল করে দেন যে বাহ্যিক অর্থগুলো সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাদের এ ধারণাটিই হলো মূলত তাশবীহ; কেননা আল্লাহর সিফাতের সঙ্গে সৃষ্টিজীবের সিফাতের আদৌ কোনো তুলনা হয় না। তারাই বরং এ ধরণের অযাচিত তুলনার আশ্রয় নেয়।
দ্বিতীয়ত: আকল-বুদ্ধি দ্বারা এটি স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে সৃষ্টিকর্তা সত্তাগত এবং গুণগতভাবে সর্বদিক থেকেই সৃষ্টিজীব হতে সম্পূর্ণ আলাদা। অতএব সৃষ্টিকর্তার সিফাত সৃষ্টিজীবের সিফাতের সমতুল্য হবে এটা কিভাবে কল্পনা করা যায়?
তৃতীয়ত: মুশাব্বিহ বা ‘সাদৃশ্য স্থাপনকারী ব্যক্তি’ সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহ থেকে যা বুঝেছে তা সালাফ তথা উত্তম পূর্বপুরুষদের বুঝ থেকে ভিন্ন। অতএব তা বাতিল।
[একটি সন্দেহ ও তার উত্তর]
আর যদি মুশাব্বিহ তথা সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তি বলে: আমি আল্লাহ তা‘আলার অবতরণ, আল্লাহ তা‘আলার হাত ইত্যাদির দ্বারা তা-ই বুঝি যা সৃষ্টিজীবের রয়েছে; কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাদের বোধগম্য ভাষাতেই তাঁর বাণী পাঠিয়েছেন, তবে এর উত্তর তিনভাবে দেওয়া যায়:
প্রথমত: যিনি বাণী পাঠিয়েছেন স্বয়ং তিনিই নিজ সম্পর্কে বলেছেন:
সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। (সূরা আল বাকারা: ২: ২২)
আর আল্লাহ তা‘আলার সকল কথাই সত্য এবং একটি অন্যটিকে সমর্থন করে। অতএব এ ক্ষেত্রে কোনো বৈপরিত্ব নেই।
দ্বিতীয়ত: সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হবে: তুমি কি বুঝতে পার না যে আল্লাহ তা‘আলার একটি সত্তা রয়েছে যা অন্যান্য সত্তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়? উত্তরে সে বলবে, হ্যাঁ, বুঝতে পারি। এবার তাকে বলা হবে, তাহলে তুমি এটা কেন বুঝবে না যে আল্লাহ তা‘আলার সিফাত রয়েছে যা অন্যসব সিফাত থেকে ভিন্ন। কারণ সত্তার ব্যাপারে যা প্রযোজ্য তা সিফাতেরও ব্যাপারেও প্রযোজ্য। আর যে ব্যক্তি সত্তা ও সিফাতের মধ্যে পার্থক্য করল সে বৈপরীত্যের আশ্রয় নিল।
তৃতীয়ত: সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তিকে বলা হবে, তুমি কি দেখ না যে মাখলুকাতের মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে যার নাম অভিন্ন কিন্তু প্রকৃতি ও আকার-ধরনের বিবেচনায় একটি অন্যটি থেকে ভিন্ন? সে বলবে, হ্যাঁ দেখি। এরপর তাকে বলা হবে যদি তুমি মাখলুকাতের মধ্যে এ পার্থক্য মেনে নাও, তবে খালিক ও মাখলুকের মধ্যে পার্থক্য কেন মেনে নাও না। অথচ খালিক ও মাখলুকের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। বরং খালিক ও মাখলুকের মধ্যে সাদৃশতা একটি অসম্ভব ব্যাপার। সিফাত-বিষয়ক ষষ্ঠ মূলনীতিতে এ বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে।
তৃতীয় দল: যারা বলে যে সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ বাতিল এবং তা আল্লাহর জন্য উপযোগী নয়। বরং তা হলো তাশবীহ বা সাদৃশ্য স্থাপন। এরপর তারা বাহ্যিক অর্থকে আল্লাহর জন্য উপযোগী পদ্ধতিতে মেনে নেয়াকেও অস্বীকার করেন। এরা হলো আহলে তা‘তীল অর্থাৎ অর্থশূণ্যকারী সম্প্রদায়। তাদের এই অর্থশূণ্যকরণ প্রক্রিয়া নাম ও সিফাত উভয় ক্ষেত্রেই অথবা শুধু সিফাতের ক্ষেত্রে অথবা নাম ও সিফাত এ দুয়ের মধ্যে যেকোনো একটির ক্ষেত্রে সেটা তারা করে থাকে। তারা নাম ও সিফাত সংবলিত এ টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ থেকে সরে এসে নিজদের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী সেগুলোর অর্থ নির্ধারণ করেছে। তবে তারা এ অর্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত পথ অবলম্বন করেছে। তারা এটার নাম দিয়েছে তা’বিল বা ব্যাখ্যা, কিন্তু আসলে তা তাহরীফ বা বিকৃতি।
তাদের এ মতামত কয়েক কারণে বাতিল:
প্রথমত: এটা আল্লাহ ও তার রাসূলের বাণীর বিপক্ষে স্পর্ধা প্রদর্শন; কারণ তারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের বাণীর এমন অর্থ করেছে যা বাতিল এবং আল্লাহর জন্য অনুপযোগী, বরং আল্লাহর উদ্দেশের বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয়ত: এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, অথচ আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে স্পষ্ট আরবী ভাষায় খেতাব করেছেন। যাতে মানুষ আল্লাহর কালামকে আরবী ভাষার দাবি অনুযায়ী বুঝতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলেছেন; অতএব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীকে আরবী ভাষার বাহ্যিক অর্থ ও দাবি অনুযায়ী বুঝতে হবে। তবে আল্লাহর (সত্ত্বা, নাম ও গুণের) ক্ষেত্রে সে অর্থের আকার-প্রকৃতি, ধরণ ও তুলনা নির্ধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
তৃতীয়ত: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে বাহ্যিক অর্থে না নিয়ে এমন অর্থে নেওয়া যা বাহ্যিক অর্থের বিপরীত, নিশ্চয় একটি হারাম কাজ এবং অজ্ঞতাবশত আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলা যা তিনি বলেন নি। বিষয়টি যে হারাম তা নিম্নোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায়:
বল, ‘আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ- যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরীক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উপরে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না’। (সূরা আল আরাফ: ৭: ৩৩)
“আর যে ব্যাপারে তোমার জ্ঞান নেই সেটার অনুসরণ করো না, নিশ্চয় কান, চোখ এবং অন্তর এসব কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সূরা আল ইসরা: ১৭: ৩৬)
অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে বিপরীত কোনো অর্থে ব্যবহার করল সে এমন বিষয়ের অনুসরণ করল যার ব্যাপারে তার কোনো ইলম নেই এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলল যার ব্যাপারে তার কোনো জ্ঞান নেই; কারণ:
এক. সে ধারণা করল যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীর উদ্দেশ্য এরকম নয়, অথচ এরকমটাই বাণীর বাহ্যিক অর্থ।
দুই. সে ধারণা করল যে বাণীর উদ্দেশ্য অন্যটা; যা বাহ্যত বাণী থেকে বুঝা যাচ্ছে না।
আর এটা আমাদের জানা যে, আল কুরআনের কোনো শব্দের যদি দুটি অর্থ থাকে এবং উভয়টিই সমান সম্ভাবনাময় হয়, তাহলে এই দুই অর্থের মধ্যে একটিকে নির্ধারণ করে দেওয়া বৈধ নয়; কেননা এতে অজ্ঞতাবশত আল্লাহর ওপর এমন কথা বলা হবে যা তিনি বলেননি। বিষয়টি যদি এমনই স্পর্শকাতর হয়ে থাকে, তাহলে আপনিই বলুন, যদি কেউ বাহ্যিক অর্থ বর্জন করে এমন অনগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অর্থকে নির্ধারিত করে দেয় যা তার বিপরীত, তাহলে সে কি ধরনের অন্যায়ের আশ্রয় নেয়?
এর উদাহরণ: ইবলীসকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস, আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সিজদাবনত হতে কিসে তোমাকে বাধা দিল? (সূরা সাদ: ৩৮: ৭৫)
এই আয়াতের অর্থ নির্ধারণে যদি কেউ বাহ্যিক অর্থ থেকে সরে গিয়ে বলে যে, এখানে দু‘হাত বলতে মূলত হাত বুঝানো হয়নি বরং এখানে হাত দ্বারা বুঝানো হয়েছে এই এই। তাহলে এই ব্যক্তিকে বলব যে আপনি যে বাহ্যিক অর্থকে নাকচ করে দিলেন এর পক্ষে আপনার দলিল কি? আর যে অর্থকে আপনি প্রমাণ করলেন তার সপক্ষে প্রমাণ কি? সে যদি দলিল নিয়ে আসতে পারে তো ভালো, কিন্তু সে দলিল পাবে কোথায়। অতএব সে যা নাকচ করল এবং যা প্রমাণ করল উভয় ক্ষেত্রেই সে ইলম ব্যতীত আল্লাহর ওপর এমন কথা বলল যা আল্লাহ তা‘আলা বলেননি।
চতুর্থত: আহলে তা‘তীল তথা ‘আল্লাহর নাম ও গুণের ভাষ্যসমূহকে অর্থশূণ্যকারী’ সম্প্রদায়ের কথা এজন্যও প্রত্যাখ্যাত যে সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, এ উম্মতের উত্তম পূর্বপুরুষ ও ইমামগণ যার ওপর ছিলেন তার বিরুদ্ধে যাওয়া। অতএব তা বাতিল। কেননা হক ও সত্য তো নিঃসন্দেহে তাই যার ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, এ উম্মতের উত্তম পূর্বপুরুষ ও ইমামগণ ছিলেন।
পঞ্চমত: এ ধরনের ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে বলা হবে, আল্লাহ তা‘আলা নিজ সম্পর্কে যতটুকু জানেন তুমি কি তার থেকেও বেশি জান? সে নিশ্চয় উত্তরে বলবে যে না, জানি না।
এবার তাকে প্রশ্ন করে বলা হবে: আল্লাহ তা‘আলা নিজ সম্পর্কে যা জানিয়েছেন তা কি হক ও সত্য? সে নিশ্চয় উত্তরে বলবে, হ্যাঁ, হক ও সত্য।
এরপর তাকে বলা হবে: আল্লাহ তা‘আলার বাণী যে বিশুদ্ধতম ও স্পষ্টতম বাণী, তা কি তুমি বিশ্বাস কর? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ, বিশ্বাস করি।
এরপর তাকে বলা হবে: তাহলে তুমি কি মনে কর যে, আল্লাহ তা‘আলা এই টেক্সটসমূহের অর্থ কি তা অস্পষ্ট আকারে রেখে দেবেন যাতে মানুষ তার বুদ্ধি-বিবেচনা ব্যবহার করে তা উদ্ধার করে নেয়। উত্তরে সে অবশ্যই বলবে: না।
এ গেল আল-কুরআনের টেক্সটসমূহের কথা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নায় সিফাত-বিষয়ক যেসব টেক্সট এসেছে তার ব্যাপারে একই ধরনের প্রশ্ন করা যায়। অতঃপর বলা যায় যে: তুমি কি আল্লাহর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও অধিক জান? সে বলবে, না, জানিনা।
এরপর তাকে বলা হবে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ সম্পর্কে যা বলেছেন তা কি হক ও সত্য? সে বলবে, হ্যাঁ, হক ও সত্য।
এরপর তাকে বলা হবে: তুমি কি এমন কাউকে জান যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী? উত্তরে সে অবশ্যই বলবে, না।
এরপর তাকে বলা হবে: তুমি কি এমন কাউকে জান যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে উম্মতের জন্য অধিক শুভাকাঙ্ক্ষী? সে অবশ্যই বলবে, না।
এরপর তাকে বলা হবে: যদি তুমি উল্লিখিত কথাগুলো স্বীকার করে নাও, তাহলে কেন তোমার যথেষ্ট সাহস হয় না যে তুমি আল্লাহর জন্য ঠিক তা সাব্যস্ত করবে যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন এবং যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছেন, প্রকৃত ও আল্লাহর জন্য উপযোগী বাহ্যিক অর্থ হিসেবে। অথচ দেখা যায় যে প্রকৃত ও বাহ্যিক অর্থ নাকচ করে দেওয়া এবং এর স্থলে বিপরীত অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে তুমি বাহাদুরী দেখাও।
এতে তোমার কি ক্ষতি যে, আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য তাঁর কিতাবে যা সাব্যস্ত করেছেন তুমিও তা তাঁর জন্য সাব্যস্ত করবে। অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাতে আল্লাহর জন্য উপযোগীভাবে যা সাব্যস্ত করেছেন তুমিও তা সাব্যস্ত করবে। অতএব কুরআন-সুন্নায় সাব্যস্ত করা ও অসাব্যস্ত করার বিষয়ে যা কিছু এসেছে তুমি তা মেনে নেবে। এটাইকি তোমার জন্য সঠিক ও নিরাপদ নয়? কারণ তোমাকে তো কিয়ামতের ময়দানেই জিজ্ঞাসা করা হবে:
‘তোমরা রাসূলদেরকে কী জবাব দিয়েছিলে?’ (সূরা আল কাসাস: ২৮: ৬৫)
তুমি যদি সিফাত-বিষয়ক বাণীসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে নিয়ে তার অন্যকোনো অর্থ কর, এটা কি তোমার জন্য বিপদের কারণ হবে না, কেননা হতে পারে যে তুমি যে অর্থ করেছ সেটা উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হলো অন্যটা।
ষষ্ঠত: আহলে তা‘তীল তথা আল্লাহর নাম ও গুণের ভাষ্যসমূহকে অর্থশূণ্যকারীদের কথা এজন্যও অগ্রহণযোগ্য যে তা মেনে নিলে কিছু অযাচিত সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। অতএব তা বাতিল। যেমন:
এক. আহলে তা‘তীল: সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে এ জন্যে সরিয়ে নেয় যে তারা মনে করে থাকে এগুলোর বাহ্যিক অর্থ এ অনুভূতি দেয় অথবা এ দাবি করে যে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজীব সদৃশ। অথচ আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টিজীব সদৃশ মনে করা কুফরি; কেননা তাতে আল কুরআনের ওই আয়াতকে অস্বীকার করা হয় যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [ الشورى : ١١ ]
‘তাঁর মত কিছু নেই।’ (সূরা আশ-শূরা: ৪২: ১১)
নু‘আইম ইবনে হাম্মাদ আল-খুযা‘ঈ, যিনি ইমাম বুখারী র. এর একজন উস্তাদ ছিলেন, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে মাখলুকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ করল সে কাফের হয়ে গেল। আর আল্লাহ তা‘আলা নিজকে যেভাবে গুণান্বিত করেছেন এবং তাঁর রাসূল তাঁকে যেভাবে গুণান্বিত করেছেন তাতে কোনো তাশবীহ তথা সাদৃশ্যকরণ নেই।’
আর এটা স্পষ্ট যে সবচেয়ে বড় বাতিল বিষয় হচ্ছে, মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর বাহ্যিক অর্থকে এমন মনে করা যে তাতে সৃষ্টিজীবের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া বাধ্য করে এবং তাতে কুফরি হওয়া আবশ্যক হয়ে যায় অথবা সেটাতে নিপতিত হওয়ার সন্দেহে পড়তে হয়।
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলার কিতাব যা তিনি নাযিল করেছেন সকল বিষয়ের বর্ণনা হিসেবে, মানুষের জন্য হিদায়েত হিসেবে, অন্তরে থাকা সকল ব্যাধির চিকিৎসা ও প্রস্ফুটিত আলো হিসেবে, হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসেবে, সে কিতাবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাম ও সিফাত সম্পর্কে কি ধরনের বিশ্বাস পোষণ করতে হবে তা স্পষ্টভাবে বলে দেবেন না বরং বিষয়টি মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেবেন যে, তারা যা ইচ্ছা তা সাব্যস্ত করবে এবং যা ইচ্ছা তা অসাব্যস্ত করবে, এটা কি করে সম্ভব! অতএব এ ধরনের বিশ্বাসই বরং বাতিল।
তৃতীয়ত: আহলে তা‘তীলের কথা মেনে নিলে বলতে হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুলাফায়ে রাশেদা, সাহাবায়ে কেরাম, সালাফগণ এবং আয়েম্মায়ে কিরাম মহান আল্লাহর সিফাত-বিষয়ে যা জানার প্রয়োজন ছিল তা জানা এবং প্রচার করার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন; কেননা আহলে তা‘তীল ‘তাবিল’ এর নামে যেসব কথা বলেছেন এসব কথার একটি অক্ষরও তাঁরা বলেননি।
অতএব হয়তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুলাফায়ে রাশেদা, সাহাবায়ে কেরাম, সালাফগণ এবং আয়েম্মায়ে কিরাম সিফাত-বিষয়ে যথার্থ জ্ঞানার্জন বিষয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন অথবা উম্মতের উদ্দেশে তা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। আর উভয় কথাই বাতিল।
চতুর্থত: আহলে তা‘তীলের কথা মেনে নিলে বলতে হয় যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা সাব্যস্ত করেছেন তা নাকচ করে দেওয়া বৈধ। অর্থাৎ যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ وَجَآءَ رَبُّكَ﴾ [ الفجر : ٢٢ ]
‘এবং তোমার রব আসবেন।’ (সূরা: আল ফাজর: ৮৯: ২২)
সেখানে বলা শুদ্ধ হবে যে, না, আল্লাহ তা‘আলা আসবেন না। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে বলেছেন যে,
«ينزل ربنا إلى السماء الدنيا»
‘আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতেই নিম্নাকাশে অবতরণ করেন’,
সেখানে বলা শুদ্ধ হবে যে, না, আল্লাহ তা‘আলা অবতরণ করেন না। কারণ তারা উল্লিখিত আয়াত এবং হাদীসের অর্থ করতে গিয়ে বলেন যে এখানে ‘আসা’ এবং ‘অবতরণ’ করাকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা রূপক অর্থে, প্রকৃত অর্থে নয়। অর্থাৎ তাদের ধারণা মতে এখানে অর্থ হবে, ‘আল্লাহর নির্দেশ আসা’। রূপক অর্থের বড় আলামত হলো প্রকৃত অর্থকে নাকচ করে দেওয়া শুদ্ধ হওয়া। আর আল্লাহ এবং তার রাসূল যা সাব্যস্ত করেছেন তা নাকচ করে দেওয়া জঘন্যতম বাতিল বিষয়। অন্যকোনো অর্থে তাবিল করার দ্বারা এ বাতুলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না; কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীর কনটেক্সটে এমন কোনো ইশারা নেই যার দ্বারা বুঝা যাবে যে এখানে অর্থ হলো ‘নির্দেশ আসা’।
[সিফাত বিষয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায়ের মতবাদের খণ্ডন]
আহলে তা‘তীলের কেউ কেউ আল্লাহ তা‘আলার সকল সিফাতের ক্ষেত্রে এই রূপক অর্থ নেওয়ার নীতি অনুসরণ করে, অথবা তারা আল্লাহর নামসমূহকেও এ নীতির আওতায় শামিল করে। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা ভিন্ন পথ ধরেন অর্থাৎ কিছু সিফাতকে সাব্যস্ত করেন আবার কিছু সিফাতকে অসাব্যস্ত করেন। যেমন আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায়। তাদের বুদ্ধি-বিবেচনার আলোকে যেটি বোধগম্য মনে হয়েছে সেটি তারা সাব্যস্ত করে, আবার যেটি তাদের কাছে অবোধ্যগম্য মনে হয়েছে তা তারা নাকচ করে দিয়েছে।
তাদের জন্য আমাদের বক্তব্য হলো: আপনার বুদ্ধি-বিবেচনার বোধগম্যতার নিরিখে যা নাকচ করে দিয়েছেন, তা বুদ্ধি-বিবেচনার দলিল দিয়েই প্রমাণ করা যায়, পাশাপাশি ওহীর প্রমাণ তো আছেই।
এর উদাহরণ: তারা ‘ইরাদাহ’ অর্থাৎ ‘ইচ্ছা’র সিফাতকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেন। পক্ষান্তরে ‘রহমত’ অর্থাৎ ‘করুণা’র সিফাতকে নাকচ করে দেন। ‘ইচ্ছা’র সিফাতকে তারা ওহী ও যুক্তি এ উভয়টির আলোকে সাব্যস্ত করেন। তন্মধ্যে
ওহী থেকে সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে তাদের দলিল হলো, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করেন। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৩)
পক্ষান্তরে সেটা সাব্যস্ত করার জন্য তাদের পক্ষ থেকে যুক্তির দলিল হলো: সৃষ্টিকুলের বিভিন্নতা এবং প্রতিটি সৃষ্টিকে আলাদা সত্তা ও গুণ প্রদান করা এ কথারই প্রমাণ যে আল্লাহ তা‘আলা ‘ইচ্ছা’র গুণে গুণান্বিত।
কিন্তু তারা আল্লাহর জন্য রহমত বা ‘করুণা’র গুণকে এ যুক্তিতে নাকচ করে দিয়েছে যে, করুণা করার দাবি হলো, যার প্রতি করুণা করা হবে তার জন্য করুণাকারী নরম হয়ে যাবেন। আর এই নরম হয়ে যাওয়া আল্লাহর ক্ষেত্রে অসম্ভব, অকল্পনীয় বিষয়। [সুতরাং তাদের মতে রহমত গুণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা যাবে না]
এরপর তারা যেসব আয়াত ও হাদীসে রহমতের কথা আছে সেসব আয়াত ও হাদীসকে তাবিল তথা অপব্যাখ্যা করে বলেন যে এখানে রহমতের অর্থ ‘কর্ম’ অথবা ‘কর্ম’ করার ইচ্ছা। অতএব তারা الرحيم (আর রাহীম) শব্দের অর্থ করেন, ‘নিয়ামতদাতা’, অথবা ‘নিয়ামত প্রদানের ইচ্ছাকারী’।
এদের জন্য আমাদের বক্তব্য হলো: ‘রহমত’ গুণটি আল্লাহ তা‘আলার জন্য ওহী দ্বারা প্রমাণিত। আর সংখ্যা ও ধরনের বিবেচনায় রহমত গুণটি যতভাবে সাব্যস্ত হয়েছে, ‘ইচ্ছা’ সিফাতটি ততভাবে সাব্যস্ত হয়নি। তা নাম হিসেবে এসেছে, যেমন:
এর পাশাপাশি রহমত সিফাতটি যুক্তির মাধ্যমেও প্রমাণ করা যায়। আর তা এভাবে যে, বান্দাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতসমূহ অনবরত বর্ষিত হওয়া এবং তাদের ওপর থেকে আপদ-বিপদ উঠিয়ে নেওয়া এ কথার প্রমাণ যে আল্লাহ তা‘আলা রহমতের গুণে গুণান্বিত। আর এ নিয়ামত বর্ষিত হওয়া এবং বিপদ উঠে যাওয়ার বিষয়টি ইচ্ছার গুণের তুলনায় রহমতের গুণকে অধিক পরিষ্কারভাবে বুঝায়; কেননা এ বিষয়টি সাধারন মানুষ ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সবার কাছেই স্পষ্ট। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার সঙ্গে তা সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি কেবল বিশেষ ব্যক্তিদের কাছেই পরিষ্কার।
আর রহমত গুণটিকে এই অজুহাতে নাকচ করে দেওয়া যে, তা মেনে নিলে বলতে বাধ্য হতে হয় যে, যিনি রহমকারী তিনি নরম হয়ে যান, অতএব তা আল্লাহর ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য। এ কথার জবাব হলো: যদি উল্লিখিত কারণে ‘রহমত’ সিফাতকে নাকচ করে দেওয়া হয়, তবে অভিন্ন কারণে ‘ইচ্ছা’ সিফাতকেও নাকচ করে দেওয়া যাবে; কেননা ইচ্ছা বলা হয়, এমন বিষয়ের প্রতি ইচ্ছাকারীর ঝুঁকে পড়া যার দ্বারা সে কোনো উপকারসাধন অথবা ক্ষতিকর বিষয়কে দমন করতে চান। অতএব ‘ইচ্ছা’র দাবি হলো প্রয়োজনগ্রস্ত থাকা। আর আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রয়োজন থেকে পবিত্র।
উত্তরে যদি বলা হয়: আপনি ‘ইচ্ছা’র যে সংজ্ঞা দিলেন তাতো হলো সৃষ্টিজীবের ইচ্ছার সংজ্ঞা, তাহলে বলব যে রহমতের ব্যাপারে আপনারা যা বলেন, সেটাও তো সৃষ্টিজীবের রহমতের বর্ণনা। সৃষ্টিকর্তার রহমত তো সম্পূর্ণ ভিন্ন, যার হাকীকত মানুষের জানা নেই।
এই আলোচনা দ্বারা আহলে তা‘তীল তথা সিফাত-বাতিলকারী সম্প্রদায়ের সকল বক্তব্যই খণ্ডিত হয়ে গেল, হোক সাধারণ তা‘তীল অথবা বিশেষ তা‘তীল।
অতএব এটা এখন স্পষ্ট যে আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায় আল্লাহর (যে সব) নাম ও সিফাত (সাব্যস্ত করে তা) সাব্যস্ত করতে গিয়ে মুতাযিলা ও জাহমিয়া সম্প্রদায়ের যুক্তি খণ্ডনের ক্ষেত্রে যা বলেন তা দিয়ে আসলে তাদের যুক্তি খণ্ডিত হয় না। আর তা দু কারণে:
এক. মুতাযিলা ও জাহমিয়া সম্প্রদায়ের যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে যে পথে গমন করা হলো, সেটা হলো বিদ‘আতী পথ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সালাফ ও ইমামগণ এ পথের ওপর ছিলেন না। আর মুতাযিলা ও জাহমিয়াদের বিদআতকে অপর বিদআত দিয়ে দমন সমুচিত নয়, বরং বিদআতকে সুন্নত দিয়ে দমন করতে হয়।
দ্বিতীয়ত: মুতাযিলা ও জাহামিয়া সম্প্রদায় অভিন্ন ধরনের যুক্তির আশ্রয় নিয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদীদের বক্তব্যকে খণ্ডন করতে পারে যে যুক্তির আশ্রয় নিয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদীরা আহলে সুন্নাতের মতকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছে। তারা বলতে পারে যে: আপনারা যুক্তিভিত্তিক দলিলের আশ্রয় নিয়ে সিফাত নাকচ করাকে নিজেদের জন্য বৈধ করে নিয়েছেন এবং ওহীর দলিল দ্বারা যা প্রমাণিত হয়েছে তা আপনার তাবিল করেছেন। তাহলে আমরা যুক্তিভিত্তিক দলিলের আশ্রয়ে যা নাকচ করলাম এবং ওহীর দলিলকে যেভাবে তাবিল করলাম তা আমাদের ক্ষেত্রে অবৈধ ভাবার কারণ কি? আপনারও বুদ্ধিনির্ভর যুক্তি দেন আমরাও বুদ্ধিনির্ভর যুক্তি দিই। তাহলে আমাদের বুদ্ধি অশুদ্ধ এবং আপনাদের বুদ্ধি শুদ্ধ হওয়ার কারণ কি? অতএব আমাদের কথা অস্বীকার করার জন্য স্রেফ মনোবৃত্তির অনুসরণ ছাড়া আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণই দেখছি না।
এটি একটি অকাট্য যুক্তি এবং জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের পক্ষ থেকে আশ‘আরী ও মাতুরিদীদের বাকরুদ্ধ করার মতো প্রমাণ। এ যুক্তি-প্রমাণ খণ্ডানোর একটিই পথ, আর তা হলো সালাফদের মাযহাব যারা এ পথকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন এবং আল্লাহর জন্য ওইসব নাম ও সিফাত সাব্যস্ত করেন যা আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য তাঁর কিতাবে সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে সাব্যস্ত করেছেন। যে সাব্যস্তকরণ প্রক্রিয়ায় নেই কোনো তুলনা নির্ধারণ অথবা আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ আর না আছে কোনো অর্থশূণ্যকরণ অথবা বিকৃতিসাধন। আসলে আল্লাহ তা‘আলা যদি কারো জন্যে আলোর ব্যবস্থা না করেন তাহলে নিজ থেকে কেউ আলোর ব্যবস্থা করতে পারেন না। ইরশাদ হয়েছে:
আর আল্লাহ যাকে নূর দেন না তার জন্য কোনো নূর নেই। (সূরা আন-নূর: ২৪: ৪০)
দ্রষ্টব্য: উল্লিখিত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে,
প্রত্যেক মু‘আত্তিল (সিফাতের বাহ্যিক অর্থ বাতিলকারী) ব্যক্তিই ‘মুমাচ্ছিল’ (অর্থাৎ সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে তুলনাকারী) অনুরূপভাবে প্রত্যেক মুমাচ্ছিল (সৃষ্টিজীবের গুণাগুণের সঙ্গে আল্লাহর গুণাগুণের তুলনাকারী) ব্যক্তিই মু‘আত্তিল (সিফাতকে অর্থহীনকারী)।
তন্মধ্যে মু‘আত্তিল (সিফাতকে অর্থশূণ্যকারী) কিভাবে তা তা‘তীল (অর্থহীন) করে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। এখন থেকে যায় মু‘আত্তিল (সিফাতের বাহ্যিক অর্থ বাতিলকারী ব্যক্তি) কিভাবে মুমাচ্ছিল (আল্লাহর সিফাতকে সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে তুলনাকারী) সেটা প্রসঙ্গে। এ ব্যাপারে বলা যায় যে, সিফাতকে অর্থহীনকারী এ জন্যই তা অর্থহীন করে যে তার ধারণা মতে, বাহ্যিক অর্থ রেখে দিলে আল্লাহর সিফাত সৃষ্টিজীবের সিফাততুল্য হয়ে যায়, এ কারণেই সে তা অর্থহীন করে দেয়। অতএব সে প্রথমে সৃষ্টিজীবের সঙ্গে তুলনা করছে এবং পরে বাতিলকরণ প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিচ্ছে।
এবার আসা যাক মুমাচ্ছিল (আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে তুলনাকারী) এর প্রসঙ্গে। তুলনাকারী একদিকে সে তুলনাকারী অপরদিকে সে সেগুলোকে অর্থহীন ধারণাকারী। বস্তুত সে তিন কারণে এগুলোকে অর্থহীনকারী হিসেবে পরিণত হয়েছে:
এক. সে খোদ ওই টেক্সটকেই অর্থহীন করে দিয়েছে যার দ্বারা সিফাত প্রমাণ করা হয়। কেননা সে এ টেক্সটকে এমনভাবে বুঝেছে যার দ্বারা সৃষ্টিজীবের সঙ্গে আল্লাহর তা‘আলার তুলনা হয়ে যায়। যদিও এ টেক্সটে আদৌ কোনো তুলনা নেই; কেননা তা আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে এমনভাবে সাব্যস্ত করছে যেমনভাবে তা আল্লাহর জন্য উপযোগী।
দুই. সে প্রত্যেক ওই টেক্সটকে অন্তঃসারশূণ্য করে দিয়েছে যার দ্বারা সৃষ্টিজীবের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার তুলনাহীনতা প্রমাণিত হয়।
তিন. সে আল্লাহ তা‘আলাকে তাঁর যথাযথ ওয়াজিব পূর্ণাঙ্গ গুণাবলী থেকে বিমুক্ত করে দিয়েছে, কারণ, সে অপূর্ণাঙ্গ মাখলুকের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলাকে তুলনা করেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/520/23
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।