HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব

লেখকঃ মাজেদ আলি হাসান হাবিব

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব

মাজেদ আলি হাসান হাবিব

অনুবাদ : মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান

সম্পাদনা : কাউসার বিন খালিদ

আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব
সমকালীন চৈতন্য জগতে, চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই, দৃষ্টিপাত করে লক্ষ্য করবেন, এবং বিমূঢ় হবেন যে, বোধ, চেতনা এবং চিন্তায় ব্যাপক পতন-উদ্দিষ্ট মর্মের তোয়াক্কা না করেই যত্রতত্র ব্যাখ্যা করা হচ্ছে বিভিন্ন শব্দের। এ গোত্রেরই একটি শব্দ হচ্ছে الأخوة في الله বা আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব।

الأخوة في الله বা আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব সে মজবুত বন্ধন, যা প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মাঝে সুদৃঢ় বন্ধন অটুট রাখে ; এ প্রেমের বন্ধন অন্য কিছু নয়, কেবল প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মাঝে আল্লাহর নৈকট্য সঞ্জাত প্রেম। ‘মোহাববাত’ বা প্রেম-ভালোবাসাকে, মুসলিম মনীষী ইমাম নববী, সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- যা প্রেমিকের ‘মত’, তার প্রতি ঝোঁক। ইবনে হাজর রহ. এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- ঝোঁক দ্বারা উদ্দেশ্য যা সর্বতোভাবে ঐচ্ছিক-পিতা-মাতা-বা যাদের সাথে সম্পর্ক-ভালোবাসা প্রাকৃতিক, এবং যে প্রেম-ভালোবাসা চাপিয়ে দেয়া-তা নয়। ভালোবাসা হচ্ছে, যাকে কল্যাণময় বলে জ্ঞান করে, বিশ্বাস করে, তা উদ্দেশ্য করা। [ফতহুল বারী : ১/৫৮]

সৎ ভ্রাতৃত্ব মানুষের আদি স্বভাবের গভীরে প্রোথিত, যা পর্যবসিত হয় নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দেয়ায়। আবু হুরাইরা রা. রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের কাছ থেকে তার, ও তার মায়ের জন্য মোমিনদের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কের প্রার্থনা করেছিলেন। রাসূল দোয়া করে বলেছিলেন- হে আল্লাহ ! আপনার মোমিন বান্দাদের মাঝে এই বান্দা ও তার মায়ের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন। এবং তাদের কাছেও মোমিনদের প্রিয় করে তুলুন। [মুসলিম।] কোরআনে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ .

অর্থ : বন্ধুরা সেদিন পরস্পর পরস্পরের শত্রু হবে-মুত্তাকিগণ ব্যতীত। [সূরা যুখরুফ : ৬৭]

কারণ, মুত্তাকিগণ ব্যতীত পার্থিবে অন্যদের বন্ধুত্ব ছিল আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কারো জন্য ; তাই কেয়ামত দিবসে তা পরিবর্তিত হয়েছে শত্রুতায়। তবে, যারা শিরক ও পাপাচার বিমুক্ত হয়ে তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদের ভ্রাতৃত্ব অক্ষয়-অটল, যে যাবৎ আল্লাহই হবেন তাদের ভালোবাসার একমাত্র সূত্র, তাদের ভ্রাতৃত্ব অব্যাহত থাকবে। [সা’দীর তাফসীর : পৃষ্ঠা : ৭৬৯] অপর স্থানে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ .

অতপর তারা যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে, এবং জাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই, আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতগুলো স্পষ্ট করে দেই। [সূরা তাওবা : আয়াত : ১১] আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ভ্রাতৃত্বের মেŠলিক ভিত্তি হচ্ছে পাপ হতে তওবা, সালাত কায়েম, জাকাত আদায়। ভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ ﴿৪৫﴾ ادْخُلُوهَا بِسَلَامٍ آَمِنِينَ ﴿৪৬﴾ وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَى سُرُرٍ مُتَقَابِلِينَ ﴿৪৭﴾ لَا يَمَسُّهُمْ فِيهَا نَصَبٌ وَمَا هُمْ مِنْهَا بِمُخْرَجِينَ ﴿৪৮﴾.

মুত্তাকিরা থাকবে জান্নাতে, প্রস্রবণসমূহের মাঝে ; তাদের বলা হবে, তোমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তাতে প্রবেশ কর ; আমি তাদের অন্তর হতে বিদ্বেষ দূর করব ; তারা ভ্রাতৃভাবে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে আসনে অবস্থান করবে। সেখানে তাদেরকে অবসাদ স্পর্শ করবে না, এবং তারা সেখান থেকে বহিষ্কৃতও হবে না। [সূরা হিজর : ৪৫-৪৮] উপরোক্ত আয়াত ও পূর্ববর্তী আলোচনা হতে আমরা দেখতে পাই যে, তাকওয়া ভিত্তিক ভ্রাতৃত্ব ব্যতীত যে কোন ভ্রাতৃত্ব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যাদের ভ্রাতৃত্ব আল্লাহর জন্য, আল্লাহকে ভিত্তি করে, তা অক্ষয়। জান্নাতে প্রবেশ অবধি অব্যাহত।

ভ্রাতৃত্বের মৌল ভিত্তি
ভ্রাতৃত্বের মৌল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা। আর ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা’-র মৌল ভিত্তি হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তা নির্বাচন করা। আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন, পছন্দ করেন পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের। যারা এহসানকারী, মুত্তাকি, ধৈর্যশীল, ন্যয়পরতা অবলম্বনকারী, আল্লাহর রাস্তায় জোটবদ্ধ হয়ে অংশগ্রহণ যাদের একান্ত কাম্য-আল্লাহ এদের সবাইকে আপন করে নিয়েছেন। আল্লাহর জন্য অপছন্দ করার মৌল ভিত্তিও, এমনিভাবে, হচ্ছে আল্লাহ যা অপছন্দ করেন, সকলের জন্য তা অপছন্দ করা। আল্লাহ তাআলা অপছন্দ করেন না জালেম ও সীমা-লঙ্ঘন কারীদের ; অপব্যয়ী, বিশৃঙ্খলা বিস্তারকারী, খিয়ানত ও অহংকার অবলম্বীদের তিনি আপন করেন না। যে ভ্রাতৃত্ব আল্লাহর জন্য, তা হবে সর্বব্যাপী, তাবৎ মোমিনদের পরিবেষ্টন করবে তা। তবে, তারতম্য হবে তাদের কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে। পাপাচারে লিপ্ত হয়ে, অতপর তা হতে তওবা করেছে, কিংবা যার ওপর ইসলামি শরিয়া ভিত্তিক আইনি শাস্তি কার্যকরী হয়েছে, তার সঙ্গে শত্রুতার আচরণ করা যাবে না,-যতক্ষণ সে ইসলামের গন্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখে ; রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম, এক হাদিসে পাওয়া যায়, জনৈক সাহাবির ওপর অভিশাপ প্রদানে বাধা দিয়েছেন, যার ওপর মদ্য-পানের শাস্তি কার্যকর করা হয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞা কয়েকবার উচ্চারণ করে তিনি বলেছেন : তোমরা তাকে লা’নত (অভিশাপ) দিয়ো না, আল্লাহর শপথ ! আমি নিশ্চিত যে সে আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভালোবাসে। [বুখারী : ৬৭৮]

এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ইবনে হাজরের মন্তব্য- পাপীর অন্তরে পাপের সংঘটন এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসা একই সময়ে সহাবস্থান সম্ভব। পুন: পুন: পাপ সংঘটনের পরও পাপীর অন্তর হতে আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসা ছিনিয়ে নেয়া হয় না। [ফতহুল বারী : ১২/৬৭৮]

উপরোলেখিত আলোচনা হতে এটা স্পষ্ট যে, ভ্রাতৃত্ব কখনো ব্যক্তিক হতে পারবে না, বরং ব্যক্তির সাথে কেবল তখনি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে যখন সে আল্লাহর নৈকট্য দ্বারা নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠবে। ভ্রাতৃত্বের পরিমাণে তারতম্য হবে আল্লাহর সাথে নৈকট্যের তারতম্যের ভিত্তিতে। প্রেমাস্পদ যতটা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত, তার সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনও হবে ততটা দৃঢ় ও মজবুত। আল্লাহর সাথে নৈকট্য ও দূরত্বের ভিত্তিতেই তারতম্য হবে ভ্রাতৃত্বে। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম সাহাবিদেরকে এক নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য লাঞ্ছনার বদ-দোয়া করতে শুনলেন, তিনি তাদেরকে এই বলে বাধা দিলেন যে, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের বিপক্ষে শয়তানের সহযোগী হয়ো না। [বুখারী : ৬৭৮] কারণ, নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি তাদের বদ-দোয়া শুনে তার ভ্রান্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাবে বৈ হ্রাস পাবে না ; এভাবে, সে ক্রমে আল্লাহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। বরং, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তোমরা তার মাগফিরাতের দোয়া কর, তাকে উপদেশ প্রদান কর-হয়তো এভাবেই সে পাপাচার পরিত্যাগে উদ্যোগী হয়ে উঠবে।

‘আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব’ মর্মের মানদন্ড
আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব, যা ব্যতীত ইমান কখনো পূর্ণতা লাভ করে না, তার মৌলিক মানদন্ড হচ্ছে-যা রাসূলে করিম সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম আমাদের অবগত করিয়েছেন এই বলে-সে সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ ! তোমাদের কেউ ততক্ষণ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে যে-কল্যাণ নিজের জন্য পছন্দ করে, তার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করে। [মুত্তাফাক আলাইহি] কিরমানি এর সাথে আরো সংযোজন করেন-এবং ঈমানের অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে যে-অকল্যাণ নিজের জন্য অপছন্দ করে, তা তার ভাইয়ের জন্যও অপছন্দ করবে। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম এ বিষয়টি উলেখ করেননি, কারণ, কোন কিছুকে ভালোবাসা বা পছন্দ করার অনিবার্য অর্থই হচ্ছে তার বিপরীত বিষয়কে অপছন্দ করা। তাই, রাসূল কেবল পছন্দনীয় বিষয়ের উলেখের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। [ফতহুল বারী ৫৮/১] আলামা ইবনে উসাইমীন, হাদিসটির ব্যাখ্যায় আরো সংযোজন করেন যে, এই শর্ত ব্যতীত পরিপূর্ণ মোমিন হবে না : কল্যাণের যা নিজের জন্য পছন্দ করে, তা তার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করবে ফলে সে সক্ষম হবে না তাদের সাথে প্রতারণা করতে, খিয়ানত করতে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করতে এবং সে সক্ষম হবে না তাদের বিরুদ্ধে জুলুম করতে-যেভাবে সে সক্ষম হয় না বা তার পক্ষে সম্ভব নয় নিজের ক্ষেত্রে এ আচার অবলম্বন করতে। এ হাদিস প্রমাণ করে, ব্যক্তি নিজের জন্য পছন্দনীয় কোন বিষয় যদি তার ভাইয়ের জন্য অপছন্দ করে, বা নিজের জন্য যা পছন্দ করে না, যদি তার ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করে (নির্বাচন করে) তবে সে মোমিন নয়। অর্থাৎ তার ইমান পরিপূর্ণতা সমৃদ্ধ নয়। এবং এ ধরনের আচার কবিরা গুনাহভুক্ত। [শরহু রিয়াযুস সালিহীন : ইবনে উসাইমিন ৬৪১/১]

বন্ধু বা সঙ্গীর মাঝে যে সমস্ত গুণ আবশ্যকীয়
মুসলমান মাত্রই অপর মুসলমানের জন্য দীনী ভাই। এর মানে এই নয় যে, আমরা সকলের সাথে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলি। নিম্নে আমরা এমন কিছু গুণ উলেখ করব, যা বন্ধু বা সঙ্গীর মাঝে থাকা আবশ্যকীয়। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম এরশাদ করেন-

মানুষ তার বন্ধুর ধর্মই গ্রহণ করে। সুতরাং, তোমাদের প্রত্যেকেই যেন বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করে। [আবু দাউদ : ২০৬২/৪, তিরমিযী : ৫০৯/৪] এ গুণসমূহের মাঝে অন্যতম হচ্ছে-

বন্ধু হতে হবে মুসলমান, যে তার কথায়, কর্মে দীনকে আঁকড়ে থাকবে। সৎকাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে বাধা প্রদান করবে।

ইসলামের আচরণীয় গুণ দ্বারা সমৃদ্ধ হবে, অভ্যাস ও আচরণে যা সুন্দর, সু-শোভনীয় বলে গৃহীত, তা রক্ষা করবে সযত্নে।

বন্ধুকে হতে হবে পরিচ্ছন্ন মানসিকতার অধিকারী, যাবতীয় কলুষতা ও ত্রুটি হতে বিমুক্ত, আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের নির্দেশের ওপর অবিচল ও দৃঢ়। কারণ, দুরাচার ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন কোন ব্যক্তির সাথে বন্ধুতার কোন অর্থ নেই। তাকে বিশ্বাস করা যায় না, তার আচার ও ব্যবহার সতত পরিবর্তনশীল। এমনিভাবে, তার সাহচর্য, এমনকি তার কৃতকর্মের দর্শনও বর্জনীয় সর্বার্থে। এর ফলে অন্তরে পাপের বিষয়টি লঘু হয়ে যায়, বিলুপ্ত হয় তার প্রতি ঘৃণা।

পার্থিবের প্রতি লোভী হতে পারবে না। কারণ, এটি পার্থিবের প্রতি আসক্তের গুণ। [আল উখুওয়াত : জাসিম বিন মুহাম্মদ আল ইয়াসীন, পৃষ্ঠা : ৯-১১] এবং এ আসক্তি খুবই সাময়িক। এক কবি বলেন : ‘যখন গুনবে, দেখবে মানুষ অসংখ্য, কিন্তু বিপদকালীন কাউকেই খুঁজে পাবে না।’

উপরোক্ত আলোচনাকে আমরা উমর ফারুক রা.-এর কথায় প্রতিফলিত এবং মৌলিক বক্তব্য হিসেবে দেখতে পাই। তিনি বলেন- তুমি সৎ ভ্রাতৃগণের সংসর্গ অবলম্বন কর, নিজেকে তাদের বলয়ে মিশিয়ে দাও। কারণ, স্বাচ্ছন্দ্যে তারা সৌন্দর্য হয়ে উপস্থিত হবে, বিপদে আসবে দুর্গ হয়ে। তোমার ভাইয়ের বিষয়টি (যদি সে কোন অপ্রীতিকর কিছু করে ফেলে) উত্তমভাবে বিবেচনা কর যতক্ষণ এ বিষয়ে ব্যাখ্যার কোন সূত্র না পাও। এবং এ বিষয়ে তার সাথে তুমি দূরত্ব বজায় রাখ, তোমার গোপন বিষয় তাকে অবগত করিয়ো না, এবং দীনের ব্যাপারে এমন ব্যক্তিদের পরামর্শ তুমি গ্রহণ কর, যারা আল্লাহকে ভয় করে। [মুখতাসারু মিনহাজিল কাসিদীন : ইবনে কুদামা, পৃষ্ঠা : ১১৪]

উপরোক্ত গুণাবলি সমৃদ্ধ ব্যক্তির সন্ধান পেলেই কেবল তার সাথে বন্ধুত্ব করবে, কারণ, আমরা এমন এক সময়ে বাস করি, যে সময়ে সৎ বন্ধু ও সঙ্গী পাওয়া খুবই দুর্লভ।

ভাইয়ের ওপর ভাইয়ের দায়িত্ব
প্রয়োজনের সময়ে সঙ্গ দেয়া এবং পাশে দাঁড়ানো। এর বিভিন্ন স্তর হতে পারে। প্রথমত: সর্বনিম্ন স্তর, অর্থাৎ যদি ভাই সাহায্য করে, তবে তাকে সাহায্য করা। দ্বিতীয়ত মধ্যবর্তী স্তর, অর্থাৎ সাহায্য প্রার্থনা ব্যতীতই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। তৃতীয়ত সর্বোচ্চ স্তর, অর্থাৎ ভাইয়ের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের তুলনায় অধিক গুরুত্ব প্রদান করা। আমাদের মহান পূর্বপুরুষদের মাঝে এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয় যে, কারো মৃত্যুর পর তিনি দীর্ঘ চলিশ বছর অনবরত তার পরিবারকে সেবা দিয়ে গেছেন, তাদের প্রয়োজনসমূহ অভিভাবকের অনুরূপ পূরণ করেছেন।

ভাইয়ের উপস্থিতিতে কিংবা অনুপস্থিতিতে, সর্বাবস্থায় তার দোষ-ত্রুটি উলেখ হতে বিরত থাকা। এবং সরাসরি তার বিরোধিতায় লিপ্ত না হওয়া-তবে বিষয়টি যদি আমর বিল মা’রুফ ও নেহী আনিল মুনকারের পর্যায়-ভুক্ত হয়, তবে তা বৈধ এবং সিদ্ধ বলে গণ্য হবে। [প্রাগুক্ত : পৃষ্ঠা : ১১৫]

তার ভুল-ত্রুটিকে ক্ষমা সুন্দর মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখা। ত্রুটিহীন মানুষের কল্পনা এক অবাস্তব কল্পনা, এটি সর্বৈবে ভিত্তিহীন একটি বিষয়। বরং, যে ব্যক্তির মাঝে অনুত্তমের তুলনায় উত্তম আচরণ অধিক-হারে বিদ্যমান, সেই আমাদের কাছে পরম ব্যক্তিত্ব। ইবনে মুবারক রহ. বলেন, মোমিন অপরের মাঝে অপারগতার সন্ধান করে, আর মোনাফিক খুঁজে বেড়ায় ত্রুটি ও পদস্খলন।

ভালো এবং মন্দ-উভয় অবস্থায় তাকে সহায়তা প্রদান করা।

ভাইয়ের কষ্টকে বরদাশত না করা, এবং তার প্রতিকারার্থে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ভাইয়ের দু:খ-কষ্টে ভারাক্রান্ত হওয়া।

সাক্ষাৎকালীন সালাম প্রদান। তার ডাকে সাড়া দেওয়া। অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া। ইন্তেকাল করলে জানাজায় শরিক হওয়া। যদি উপদেশ চায়, তবে সৎ উপদেশ প্রদান করা।

ভাইয়ের কল্যাণে উৎফুল হওয়া, এবং কল্যাণ পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান, নিজের কল্যাণে উৎফুল হয়ে উঠা এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় রত হওয়ার মতই।

মুসলিম ভাইদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম এরশাদ করেন - জালিম এবং মাজলুম-উভয় অবস্থায় তুমি তোমার ভাইকে সহযোগিতা করো। এক ব্যক্তি বলল, যখন ব্যক্তি মাজলুম হবে তাকে সহযোগিতা করব। কিন্তু যখন সে জালেম হবে, তাকে কীভাবে সহযোগিতা করব? রাসূল বললেন : তোমরা তাকে জুলুম হতে বাধা প্রদান করবে, এটিই তার জন্য সহযোগিতা। [বুখারী : ৬৯৫২] এ হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইবনে উসাইমীন রহ. বলেন : উক্ত হাদিসে প্রশ্নকারী বলেছিল : হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি বলুন, যদি সে জালিম হয়, তবে কীভাবে তাকে সহযোগিতা করব? সে কিন্তু এ কথা বলেনি যে, এ অবস্থায় আমি তাকে সহযোগিতা করব না। সে বরং, বলেছে, আমি কীভাবে তাকে সহযোগিতা করব? অর্থাৎ তাকে তো অবশ্যই সহযোগিতা করব, কিন্তু তার প্রক্রিয়াটি কি হবে? রাসূল এর উত্তরে বলেছেন : তাকে জুলুম হতে বাধা প্রদান করবে, এটিই তার জন্য সহযোগিতা। যদি দেখ জালিম মানুষের ওপর অত্যাচার করছে, তবে তাকে বাধা প্রদান করবে, এটিই তার জন্য সহযোগিতা। এ হাদিসের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, উক্ত প্রক্রিয়ায় জালিম এবং মাজলুম-উভয়কে সহযোগিতা করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য। [শরহু রিয়াযিস সালেহিন : পৃষ্ঠা : ৬৪২ ; প্রাগুক্ত।]

কঠিন বিষয়গুলো তার জন্য সহজ করে তোলা।

সর্বদা তার জন্য দোয়া করা।

উপদেশ প্রদান। আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন : মোমিন তার ভাইয়ের জন্য আয়না তুল্য, মোমিন অপর মোমিনের ভাই স্বরূপ। সে তার সম্পদ রক্ষা করে এবং তার অবর্তমানে তা হেফাজত করে।। [ইমাম বুখারী আদাবে মুফরাদ গ্রন্থে হাদীসটি উলেখ করেছেন, আলবানী উক্ত হাদীসকে ‘হাসান’ বলেছেন।]

মানুষের জন্য নয়, আল্লাহর জন্য এখলাস ও বিশ্বস্ততা অবলম্বন করা। বিশ্বস্ততার মর্ম হচ্ছে সহমর্মিতা ও ভালোবাসার ওপর অটল থাকা এবং ব্যক্তির মৃত্যু অবধি, এমনকি, মৃত্যুর পরও অব্যাহত রাখা। মৃত্যুর পর-কারণ, অপরের প্রতি ভালোবাসার প্রাপ্তি পরকালীন, পার্থিব নয় কোন অর্থেই। যদি মৃত্যুর পূর্বে তাতে ব্যাঘাত ঘটে, তবে এ যাবৎকালের সব কিছু বিফলে পর্যবসিত হবে। খাদিজা রা.-এর জীবৎকালে যে নারী রাসূলের পরিবারে যাতায়াত করতেন, পরবর্তীতে তার অনুপস্থিতিতে যখন উক্ত নারী রাসূলের দরবারে আগমন করতেন, তিনি তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। এ ঘটনাটি এ বিষয়টির জন্য সর্বোত্তম দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।

সহজ আচরণে তাকে আপুত করা, অতিরঞ্জন এবং কঠিন আচরণ পরিহার করা। এ প্রসঙ্গে ইমাম জাফর সাদেক বলেন : আমার কাছে সে ভাইয়ের সাহচর্য কষ্টকর, যে আমার কাছে নিজেকে উপস্থিত করে কঠিন করে, এবং আমি তার থেকে বেঁচে থাকি। আর সহজ এমন ব্যক্তির সাহচর্য, যার সাথে আমি নিজের মত থাকতে পারি। যেভাবে আমি একাকী থাকি, সেভাবে তার সাথেও কাটাতে পারি।

আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর সাক্ষাৎ করা। এ প্রসঙ্গে রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন : আমি কি তোমাদের জান্নাতীদের সুসংবাদ দেব না? নবি জান্নাতে অবস্থান করবেন, শহীদ জান্নাতে অবস্থান করবেন, সিদ্দীক জান্নাতে অবস্থান করবেন, নবজাতক জান্নাতে অবস্থান করবে এবং যে ব্যক্তি শহরের কোথাও তার ভাইয়ের সাথে আল্লাহর জন্য মিলিত হয়, সেও জান্নাতে অবস্থান করবে। [সহীহ জামে সগীর : পৃষ্ঠা : ২৬০১]

শোভনীয় সামাজিকতা
উত্তম সামাজিকতার শোভা হচ্ছে অহংকারহীন গাম্ভীর্যে নিজেকে পূর্ণ করে তোলা। লাঞ্ছনা এড়িয়ে নিজেকে বিনয়ের ভূষণে সজ্জিত করা। ভয় এবং তাচ্ছিল্য পরিহার করে স্মিত মুখে শত্রু কিংবা বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করা। ভরা মজলিসে অবস্থান করার সময় অযথা নাকে আঙুল দেয়া পরিহার করা, হাই তোলা, থুথু ফেলা, ইত্যাদি বর্জন করা। বক্তার প্রতি পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করবে। অযথা পিছনে ফিরে তাকাবে না। হাসি তামাশা এড়িয়ে যাবে।

ভ্রাতৃত্বের উদ্বোধক
কিছু মৌলিক আচরণীয় নীতিমালা রয়েছে যার সঠিক অনুবর্তনের ফলে মানুষের মনে গভীর হৃদ্যতা এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জেগে উঠে। তার অন্যতম হচ্ছে ভালো-মন্দ যাবতীয় ক্ষেত্রে নিজের সাথে অপরের তুলনা করা এবং সে অনুসারে অপরের সাথে আচরণ করা। পরস্পর সহমর্মিতা, ভালোবাসা বাড়িয়ে তোলে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের আদান-প্রদান, আন্তরিকতার বহি:প্রকাশের মাধ্যমে। হাদিসে এসেছে-তোমরা পরস্পর মুসাফাহা কর, বিদ্বেষ লোপ পাবে। একে অপরকে হাদিয়া প্রদান কর, ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। এবং ঘৃণা দূরীভূত হবে। [মুআত্তা মালেক : ৯০৮/২] পারস্পরিক সালাম ও হাদিয়া প্রদান বিদ্বেষী মনোভাব গলিয়ে দিয়েছে, একে-অপরের মাঝে হৃদ্যতা সৃষ্টি করেছে-এমন দৃষ্টান্ত আমরা অহরহ দেখতে পাব। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন - সে সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ ! তোমরা ইমান আনয়ন ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পারস্পরিক হৃদ্যতা ব্যতীত তোমাদের ইমান আনয়ন পূর্ণাঙ্গ হবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছুর সন্ধান দেব না, যা পালন করলে তোমরা একে অপরে হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ হবে? তোমরা নিজেদের মাঝে সালামের প্রচলন ঘটাও। [সহীহ জামে : ৭০৮১] ভাইয়ের প্রতি সহমর্মিতা ও হৃদ্যতার সর্বোত্তম উদাহরণ হচ্ছে তার অনুপস্থিতিতে, অজ্ঞাতে তার জন্য দোয়া করা। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন : মুসলিম তার ভাইয়ের অজ্ঞাতে তার জন্য যে দোয়া করে, তা কবুল করা হয়। (দোয়াকালীন) তার সম্মুখে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকেন, যখনই সে তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণের দোয়া করে, নিয়োজিত ফেরেশতা বলেন : আমীন, তোমাকেও এরূপ প্রদান করা হোক। [মুসলিম : ৮৮] ইমাম নববী রহ. বলেন : মহান সালাফগণ যখনই নিজের জন্য দোয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন ভাইয়ের জন্য অনুরূপ দোয়া করতেন। কারণ, এর ফলে তার দোয়া কবুল করা হয় এবং ভাইয়ের জন্য দোয়ার সমপরিমাণ তাকেও প্রদান করা হয়। [হা যিহি আখলাকুনা : ১৬৬-১৬৮।] মানুষের মাঝে এ জাতীয় হৃদ্যতার সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ় করে তোলে অপরের সাথে স্মিত সম্ভাষণ, বিনয় ও করুণার আচরণ, আন্তরিক উপস্থাপন। এভাবে, যাবতীয় মতবিরোধ লোপ পায়, বিদ্বেষ বিলুপ্ত হয়, দৈহিকভাবে নানা কাঠামে বিভক্ত হলেও, মানুষ আন্তরিকভাবে হয়ে উঠে এক, সুমহান ঐক্যে একই মনোভাবনার অভিলাষী। ফুজাইল বিন আয়াজতআবেদুল হারামাইনতমন্তব্য করেন : কোন ব্যক্তির তার সঙ্গীদের সাথে হৃদ্যতামূলক আচরণ করা, উত্তম সামাজিকতার অনুবর্তী হওয়া রাত জেগে এবাদত এবং দিনভর রোযা রাখার চেয়ে উত্তম। [আল ওফিয়্যাত : ৪৮/৪]

ভ্রাতৃত্বের সুফল
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন :

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا .

তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো : তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। [সূরা আলে ইমরান : ১০৩]

ভ্রাতৃত্ব আল্লাহ প্রদত্ত এক পরম নেয়ামত, তিনি প্রিয় বান্দা ও নির্বাচিত বন্ধুদের তা দান করেন। ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে ফুল ও পলবে শোভিত এক বরকতপূর্ণ বৃক্ষ, নানাভাবে নিরবধি যা ফলদায়ক। ভ্রাতৃত্বের অন্যতম সুফল এই-

ঈমানের স্বাদ অনুভব, এবং সৌভাগ্যবানদের জীবন উপভোগ করা যায়।

ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধদের আল্লাহ তাআলা তার করুণা দ্বারা পরিবেষ্টন করে রাখেন। কেয়ামতের ভয়াবহ দিবসে তাদের রক্ষা করেন।

আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ব ও হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ যারা, তারা সেদিন শান্ত ও উৎফুল সময় যাপন করে, যেদিন একমাত্র আল্লাহ পাকের আরশের ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, এবং সেদিন যে-সাত শ্রেণির লোকদের ছায়া প্রদান করবেন, তারা তাদের অন্যতম হিসেবে গণ্য হবে। আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত এক মুত্তাফাক আলাইহি হাদিসে এসেছে, রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম এরশাদ করেন : সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তার ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত ভিন্ন কোন ছায়া থাকবে না...(তাদের মাঝে তিনি উলেখ করেন)...এমন দু ব্যক্তিকে, যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবেসেছে। তার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাকেই কেন্দ্র করে। [মুত্তাফাক আলাইহি]

যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একে-অপরে ভালোবাসায় আবদ্ধ হন, তারা অনুভব করেন এক অনাবিল আন্তর স্বাদ, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।

আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এক মজবুত রজ্জু, যে ব্যক্তি একে আঁকড়ে থাকবে, সে নাজাত পাবে।

আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিগণ কেয়ামতের ভয়াবহ দিবসে আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামত প্রাপ্ত নবি, সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহীনদের সাথে অবস্থান করবেন।

আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ব্যক্তির আন্তর শুদ্ধতা, সৌকর্য মন্ডিত আমল, আল্লাহ ভীতি, তাকওয়া, তার কিতাবের প্রতি সম্মান এবং রাসূলের সুন্নতের প্রেমের প্রমাণ বহন করে।

এ ছাড়াও, হে আমার প্রিয় ভাই, আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্বের রয়েছে আরো বিচিত্র সুফল, সঙ্কুচিত কলেবরে উলেখ সম্ভব নয় বলে আমরা এখানে তার উলেখ হতে বিরত থাকলাম। আল্লাহ পাক কেবল তারই উদ্দেশ্যে ভালোবাসা এবং শত্রুতা পোষণকে ইসলামের অন্যতম শক্তিশালী রজ্জু হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যেমন এক রিওয়ায়েতে এসছে-ঈমানের অন্যতম রজ্জু হচ্ছে আল্লাহর জন্য বন্ধুতা, তারই জন্য শত্রুতা, এবং আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, তারই জন্য বিদ্বেষ পোষণ। [সহীহ জামে : ২৫৩৯]

মানবীয় এই আন্তর আবেগের পরিপূর্ণ বিকাশ ও তার সফল রূপায়ণ ব্যতীত, কখনই, ইমান পূর্ণাঙ্গ হবে না। সুতরাং ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে, তারই জন্য ঘৃণার বশবর্তী হবে, দান করবে আল্লাহর জন্য, তারই জন্য দানের হাত গুটিয়ে নিবে, নিশ্চয় তার ইমান পূর্ণতা প্রাপ্ত হবে।’ [সহীহ জামে : ৫৯৬৫]

শয়তানের মন্ত্রণার বিরোধিতা, প্রবৃত্তিকে শাসন করার অনুপম স্বাদ আস্বাদনে যে আগ্রহী, এবং কেবল আল্লাহ, তার রাসূল, এবং মোমিনদের সদর্থে ভ্রাতৃত্ব লালনের অপরিমেয় সৌভাগ্য আহরণে ব্যগ্র, এটিই তার জন্য একমাত্র পথ : হাদিসে এসেছে-তিনটি গুণ যার মাঝে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের আস্বাদ লাভ করবে : আল্লাহ ও তার রাসূল তার নিকট সর্বাধিক প্রিয় বলে গণ্য হবেন, মানুষকে ভালোবাসবে কেবল আল্লাহর জন্য, আল্লাহ তাআলা কুফুর হতে বিমুক্ত করার পর তাতে ফিরে যাওয়া ততটাই অপছন্দ করবে, যেমন অপছন্দ করে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে। [মুত্তাফাক আলাইহি]

১০
আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব বাস্তবায়নে প্রতিকূলতা ও বাধা
আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনার পরও, পাঠক বিশেষের মন্তব্য হতে পারে, এ প্রক্রিয়ার অনৈতিক দিকগুলো এড়ানো এবং তাকে যথার্থ অর্থে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা রূপে রূপায়ণ করার রক্ষাকবচ কি হবে? এর বিবিধ ভালো দিক রয়েছে, এবং তুলনায় সেগুলোই অধিকাংশ সন্দেহ নেই, কিন্তু এর সংঘটনে, পাশাপাশি, রয়েছে এমন কিছু প্রতিকূলতা ও বিপদ যা এড়িয়ে যাওয়া এবং যা হতে নিজেকে রক্ষা করা অতীব আবশ্যক। নিম্নে আমরা এ সংক্রান্ত আলোচনা উপস্থাপনে প্রয়াস পাব।

১১
প্রথম বাধা : স্বার্থপরতা, আমিত্ব, অহমিকা
মানুষের মাঝে যদি স্বার্থপরতা ও আমিত্ব প্রকট হয়ে দেখা দেয়, তবে তা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়, নষ্ট হয়ে যায় একে একে তার চরিত্রের যাবতীয় গুণ-বৈশিষ্ট্য। অহমিকা যদি হয়ে উঠে ব্যক্তির চরিত্রের প্রধান উপাদান, তবে লোপ পায় তার কল্যাণ, জেগে উঠে তার মাঝে এক কঠিন দুরাচারী সত্তা। তাকে আবদ্ধ করে সংকীর্ণ এমন এক ইতর বলয়ে, যেখানে সে নিজেকে ব্যতীত ভিন্ন কাউকে দেখতে পায় না। এ কারণেই রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম এরশাদ করেন : অহংকার হচ্ছে সত্যের অপলাপ, এবং মানুষের সাথে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা।

১২
দ্বিতীয় বাধা : অপরের সাথে তাচ্ছিল্য ও উপহাস করা
উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট করে চূড়ান্তভাবে। মূর্খতা ও অনবধানতার ফলে মানুষের মাঝে এ আচরণের উদ্ভব ঘটে। দুর্বলের দৌর্বল্যের দাবিই হচ্ছে তাকে সহায়তা করা। বিভ্রান্তকে ঠাট্টা নয় ; পথ দেখানোই হচ্ছে মানবিকতা।

১৩
তৃতীয় বাধা : বংশ ও বিত্ত নিয়ে গর্ব
মুসলমানদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সংরক্ষণ ও রূপায়ণ, তাদের মাঝে চাপিয়ে দেওয়া শ্রেণিভেদ দূরীকরণ, সামাজিক যাবতীয় সাম্য সংঘটনের লক্ষ্যে ইসলাম বংশ অহমিকাকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। কারণ, আদম আ. মানব জাতির পিতা, এবং সেই সূত্রে সকলই একই বংশের, একই রক্তের উত্তরাধিকারী। কারো মাঝে কোন তারতম্য নেই।

১৪
চতুর্থ বাধা : মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আল্লাহর আইনকে মান্য না করা
ইসলামি সমাজব্যবস্থার অনুবর্তনই তার সদস্যদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব সংঘটনের অন্যতম চালিকাশক্তি। এ সমাজব্যবস্থার অন্যতম গুণ হবে এই যে, এর সদস্যরা একে অপরকে ভালোবাসবে আল্লাহর জন্য, তারই জন্য বিদ্বেষ পোষণ করবে অপরের প্রতি, দান করবে তারই জন্য, দানের হাত গুটিয়ে নিবে তারই স্মরণে। এমন সমাজ ব্যবস্থার প্রধান চালিকা শক্তি ও প্রণোদনা হবেন মহান আল্লাহ তাআলা। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا .

অর্থ : কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ ! তারা মোমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার ওপর অর্পণ না করে ; অতপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়। [সূরা নিসা : ৬৫]

১৫
পঞ্চম বাধা : আল্লাহ প্রদত্ত বিধান পরিত্যাগ
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন : মূর্খতা কিংবা প্রবৃত্তির প্রতারণার শিকার হয়ে মানুষ যখন আল্লাহর দেয়া বিধান পরিত্যাগ করে, তখন তাদের মাঝে জন্ম নেয় শত্রুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কারণ, তখন সকলের সম্মিলিত কোন দায় থাকে না যাকে কেন্দ্র করে তারা একত্রিত হবে। তারা, বরং, বিভক্ত হয়ে পড়ে, তুষ্ট থাকে যে যার মতিতে। [আল উখুওয়া : ৩৮-৪১] উলেখিত প্রতিকূলতা ও বিপদকেই রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম দীনের মুন্ডনকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি এরশাদ করেন : পারস্পরিক বিশৃঙ্খলাই মুন্ডনকারী। আমি বলছি না যে, তা চুল মুন্ডন করে, বরং তা দীন মুন্ডন করে। [আবু দাঊদ, তিরমিযী।]

আমরা আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন।

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন