HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
শিশু সাহিত্যসাধনায় মুসলমান
লেখকঃ মিরাজ রহমান
৩
শিশুসাহিত্যসাধনায় মুসলমানমুসলমান লেখক-সাহিত্যিকরাও শিশুতোষ রচনার ক্ষেত্রে আশ্চর্য সব অবদান রাখতে সক্ষম হন। শিশুসাহিত্যসাধনার প্রথম যুগ থেকেই আমরা কিছু কিছু মুসলিম লেখককে সাহিত্যের এ শাখায় অংশগ্রহণ করতে দেখি। যেমন- হায়দার বক্স (১৮০৩), মুন্সী আবদুল আলী (১৮৮৩)
এরপর পরই আমরা এ পথে দেখতে পাই বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের পদচারণা। তিনি ‘পদ্য শিক্ষা’ (২খন্ড,১৮৮৯-১৮৯০) রচনার মাধ্যমে শিশুসাহিত্যসাধনায় মুসলমানদের অবদানের সার্থক উদ্বোধক হিসেবে পরিচিতি-প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এরপর মুহাম্মদ মিয়াজান (১৮৯৩) এবং মোসলেমুদ্দিন খান (১৮৯৪) সহ আরো কিছু মুসলিম লেখক এ পথে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেকালের শিশুসাহিত্যসাধনায় তারা নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হন। বলাবাহুল্য, পরবর্তীকালের শিশুসাহিত্যসাধনায় মুসলমানদের স্ব গৌরব পদচারণা এবং সুসাধনাময় জীবনের পিছনে তারাই ছিলেন মূল উৎসাহ। আসল উদ্যোগতা।
এরপর বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে মীর মোশাররফ হোসেন ‘মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা’ শীর্ষক শিশুতোষ পুস্তক রচনার মাধ্যমে খুব নাম করেন। তাদের অংশগ্রহণের পরপর অন্যান্য মুসলিম লেখকদের মাঝে শিশুসাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগের মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। এসময় অনেক মুসলিম লেখক নিজেদের এ সাধনায় নিয়োজিত করেন। অনেকে করেন নিজেকে এ পথে উৎসর্গ। তখনকার কয়েকজন মুসলিম লেখক-লেখিকাদের নাম উলেখ করা হলো- শেখ শাহ আবদুল্লাহ, তফাজ্জল হোসেন, আফজানুননেসা, আব্দুল ওয়াহেদ, মোহাম্মদ মোবারক আলী, আলী আকবর খান, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী ইমদাদুল হক, মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ, শেখ আব্দুল জববার, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার, শামসুন্নাহার, কাজী আকরম আলী, গোলাম মোস্তফা, আব্দুল কাদির, মইনুদ্দিন, ইব্রাহিম খা, আ.ন.ম. বজলুর রশীদ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী প্রমুখ।
অনেক শিশুব্রতী এবং মুসলমান সাহিত্যিকদের তৎকালীন শিশুসাহিত্য সাধনায় এতো বেশি অগ্রণী এবং সার্থক ভূমিকার পিছনে নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ছাড়াও যে বিষয়টি কাজ করেছিল, তা হলো- তখনকার মুসলমান প্রকাশক-সম্পাদকবৃন্দের উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদান। বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা মুসলমান লেখক-সাহিত্যিকদের শিশুতোষ পাঠ্যপুস্তক রচনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। সম্পাদকরা পত্রিকার পাতায় তাদের শিশুতোষ রচনা, গল্প, কবিতা এবং জীবন কাহিনি ছেপে তাদের উৎসাহ দান করতেন। হিন্দু লেখক-লেখিকাদের নিরঙ্কুশ হিন্দু সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ে শিশুতোষ সাধনার বিপরীতে মুসলমানদের এসব উদ্যোগ ছিল যুগোপযোগী এবং ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন রক্ষার সবচে’ বড় প্রয়াস। মুসলিম সংস্কৃতি, ইসলামি নীতি-ধর্ম-আদর্শ এবং ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়কে শিশুকিশোরদের সামনে পরিবেশনের জন্য পরম-উৎসাহ দান করে বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত, ভাষা বিজ্ঞানী ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন-
‘‘প্রথমেই চাই মুসলমান বালক-বালিকাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক। কি পরিতাপের বিষয়! আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম, শাম এবং গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে, গোপাল বড় ভালো ছেলে। কাসেম বা আব্দুল্লাহ কেমন ছেলে সে তা পড়িতে পায় না। তখন হইতেই তাহার মধ্যে সর্বনাশের বীজ উপ্ত হইল। স্বভাবত তাহার ধারনা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের মাঝে বড়লোক নাই। এসকল পুস্তক দ্বারা আমাদের মুসলমানিত্বহীন করা হয়।
একথা ঠিক বাংগালী মুসলমান বাংগালী হিন্দু সম্বন্ধে যতটুকু জানে, বাংগালী হিন্দু বাংগালী মুসলমান সম্বন্ধে তাহার এক আনাও জানে না। কাজেই মুসলমানগণ পাঠ্যপুস্তক সংকলনে হস্তক্ষেপ করিলে অধিক কৃতকার্য হইবেন বলিয়া আশা করা যায়। ...স্কুলপাঠ্যে হিন্দু রাজাদের সম্বন্ধে অগৌরবজনক কথা প্রায় ঢাকিয়া ফেলা হয় আর মুসলমানদের বেলায় ঢাক-ঢোল বাজাইয়া প্রকাশ করা হয়, গুণের কথা বড় একটা উলিখিত হয় না। ফলে দাঁড়ায় এই, ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়িয়া ছাত্ররা বুঝিল মুসলমান নিতান্ত অপদার্থ, অবিশ্বাসী, অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর জাতি। পৃথিবী হইতে তাহাদের শীঘ্র লোপ হওয়াই মঙ্গল।’’
একদিকে শিশুতোষ পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং মুসলমান সম্পাদিত শিশুকিশোর উপযোগী পত্রিকার পাতায় মুসলমানদের শিশুসাহিত্যসাধনা ধীরে ধীরে আরো গতিমান হয়ে উঠতে থাকে। তখনকার হিন্দু সম্পাদিত পত্রিকায় মুসলমান লেখকদের অংশগ্রহণ ছিল সীমাবদ্ধ এবং খুব নিয়ন্ত্রিত। তাদের প্রকাশনা ছিল নিজস্ব মানসিকতা মাফিক নির্বাচিত। হিন্দু সমাজ-সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। হিন্দুদের সম্পাদিত শিশুতোষ পত্রিকার পাশাপাশি মুসলমানদের সম্পাদিত যে সব পত্রিকা মুসলমান শিশুসাহিত্যিকদের শিশুসাহিত্যসাধনায় নিজস্ব গতি দাঁড় করাতে সহযোগিতা করেছিল তা হলো-
এ.কে ফজলুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বালক’ (১৯০১), টাঙ্গাইলের মাসিক ‘উৎসাহ’ (১৯১৩), মাসিক ‘বালক-নুর’, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত মাসিক ‘আঙুর’ (১৯২০), শাখাওয়াৎ হোসেন সম্পাদিত মাসিক ‘মকতব’ (১৯২৭), আফজাল উল হক সম্পাদিত মাসিক ‘শিশুমহল’ (১৯২৭), শেখ ফজলল করীম সম্পাদিত মাসিক ‘জমজম’ (১৯৩০), মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সম্পাদিত মাসিক ‘শিশুসওগত’ (১৯৩০), আব্দুল ওহাব সম্পাদিত মাসিক ‘গুলবাগিচা’ (১৯৩৭), মুহাম্মদ শফীউল্লাহ সম্পাদিত মাসিক ‘ফুলঝুরি’ (১৯৩৮), মওলভী রজীউর রহমান সম্পাদিত (পরে শাহেদ আলী সম্পাদিত) মাসিক (পরে পাক্ষিক) ‘প্রভাতী’ (১৯৪২), এমাদ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপাতা’ (১৯৪২) প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা অন্যতম। এসব পত্রিকার মাধ্যমে তখনকার শিশুসাহিত্য অনেকাংশে মুসলমানদের দখলে চলে এসেছিল।
ব্রিটিশ যুগকে শিশুসাহিত্যের বিকাশ এবং উদ্ভব যুগ বলা হয়। শিশুসাহিত্যসাধনার আদিপর্বে এসব পত্রিকা মুসলমান লেখকদের নানান আঙ্গিকে শিশুসাহিত্য সাধনার সুযোগ করে দেয়। বর্তমানে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন এমন নামীদামি অনেক শিশুসাহিত্যিকদের শিশুসাহিত্য বিষয়ক হাতেখড়ি হয় এসব পত্রিকার মাধ্যমে। মুসলিম শিশুসাহিত্যিকরা কেবল যে মুসলিম প্রকাশিত-সম্পাদিত পত্রিকায় লিখতেন এমনটা নয়, হিন্দুদের প্রকাশিত-সম্পাদিত বেশ কয়েকটি পত্রিকায় তারা লিখেছেন সিদ্ধহস্ত। যদিও সে লেখা-সুযোগ ছিল হিন্দুদের নিজস্ব সংস্কৃতিময়। সীমানাবদ্ধ এবং বিভিন্ন নিয়মনীতিবদ্ধ ছিল তা। তখন কিছু কিছু মুসলিম সাহিত্যিকরা কেবল শিশুসাহিত্যে নয় বরং সাহিত্যের গোটা আসরে নিজেদের এমন সর্বাঙ্গীণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল যে, হিন্দু প্রকাশিত-সম্পাদিত পত্রিকাতে তাদের নাম যাওয়াটাও সম্পাদক-পত্রিকার গর্বের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হত।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘তোষণী’ (১৯১০), ‘সোপান’ (১৯১০), ‘রাজভোগ’ (১৯২০), ‘পাপিয়া’ (১৯২৮) ইত্যাদি পত্রিকাতে কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, শেখ আব্দুল জববারদের মত মুসলিম লেখকরাও শিশুতোষ লেখা লিখেছেন। প্রসঙ্গত উলেখ্য, কলকাতা থেকে প্রকাশিত কিছু কিছু হিন্দু সম্পাদিত পত্রিকাতেও মুসলিম শিশুসাহিত্যিকদের লেখা ছাপতে দেখা যায়। তার মাঝে ‘মৌচাক’ (১৯২০), ‘শিশুসাথী’ (১৯২১) অন্যতম।
তৎকালে বিশেষভাবে শিশু পত্রিকা প্রকাশ ছাড়াও বিভিন্ন সাপ্তাহিক এবং দৈনিক পত্রিকাতেও শিশুদের জন্য আলাদা আয়োজন রাখা হত। সেখানেও এসব মুসলিম শিশুসাহিত্যিকরা সিদ্ধহস্তে লিখতেন। পত্রিকামহলও তাদের লেখা খুব সাজিয়ে গুছিয়ে ছাপাতেন।
‘বংগীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ প্রকাশিত পত্রিকার ছোটদের পাতার নাম ছিল ‘কোরাক’। কোরাকের জমিনে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, নজরুল ইসলাম এবং লুৎফুর রহমানের মত মুসলিম সাহিত্যিকরা শিশু রচনা লিখতেন। হিন্দুদের সম্পাদিত আনন্দবাজার, যুগান্তর, সত্যযুগ এসব পত্রিকার পাশাপাশি মুসলিম শিশুসাহিত্যিকরা দৈনিক আজাদ পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘মুকুলের মাহফিল’, দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার ‘মিতালী মজলিস’, সাপ্তাহিক মুহাম্মাদির ‘ছোটদের আসর’ এবং দৈনিক নবযুগের ‘আগুনের ফুলকিত’ ইত্যাদিতে বহু শিশুতোষ রচনা লিখেছেন। এসব পত্রিকার পাতা ঘিরে মুসলিম শিশুসাহিত্যিকরা নিজেদের মুক্তচিন্তা-ভাবনা প্রসূত আনন্দময় এক জগৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা ছিল তৎকালীন মুসলিম শিশুসাহিত্যিকদের সবচে’ বড় অর্জন। তৎকালীন লেখক-প্রকাশক-সম্পাদকদের অবদানের ফলে আমরা আজ এতো দূর এসে দাঁড়াতে পেরেছি। শিশুসাহিত্যসাধনায় খুঁজে পেয়েছি আপন ঠিকানা।
ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীকালে এসে মুসলিম শিশুসাহিত্যসাধনা পাঠ্যপুস্তক রচনা-সীমা ছাড়িয়ে অন্যান্য নানা দিক ও বিষয়ে প্রবেশ করে। তখন এয়াকুব আলী চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, সফিউদ্দিন আহমেদ, তোরাব আলী, জসিম উদ্দিন, কায়কোবাদ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ডা. মুহাম্মদ লুৎফুর রহমান, কাদের নেওয়াজ, শেখ আব্দুল জববার, বন্দে আলী মিয়া এসব মুসলমান লেখকরা পাঠ্যবিষয় বহির্ভূত শিশুসাহিত্য সাধনায় হাত দেন।
এরপর পরই আমরা এ পথে দেখতে পাই বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের পদচারণা। তিনি ‘পদ্য শিক্ষা’ (২খন্ড,১৮৮৯-১৮৯০) রচনার মাধ্যমে শিশুসাহিত্যসাধনায় মুসলমানদের অবদানের সার্থক উদ্বোধক হিসেবে পরিচিতি-প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এরপর মুহাম্মদ মিয়াজান (১৮৯৩) এবং মোসলেমুদ্দিন খান (১৮৯৪) সহ আরো কিছু মুসলিম লেখক এ পথে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেকালের শিশুসাহিত্যসাধনায় তারা নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হন। বলাবাহুল্য, পরবর্তীকালের শিশুসাহিত্যসাধনায় মুসলমানদের স্ব গৌরব পদচারণা এবং সুসাধনাময় জীবনের পিছনে তারাই ছিলেন মূল উৎসাহ। আসল উদ্যোগতা।
এরপর বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে মীর মোশাররফ হোসেন ‘মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা’ শীর্ষক শিশুতোষ পুস্তক রচনার মাধ্যমে খুব নাম করেন। তাদের অংশগ্রহণের পরপর অন্যান্য মুসলিম লেখকদের মাঝে শিশুসাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগের মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। এসময় অনেক মুসলিম লেখক নিজেদের এ সাধনায় নিয়োজিত করেন। অনেকে করেন নিজেকে এ পথে উৎসর্গ। তখনকার কয়েকজন মুসলিম লেখক-লেখিকাদের নাম উলেখ করা হলো- শেখ শাহ আবদুল্লাহ, তফাজ্জল হোসেন, আফজানুননেসা, আব্দুল ওয়াহেদ, মোহাম্মদ মোবারক আলী, আলী আকবর খান, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী ইমদাদুল হক, মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ, শেখ আব্দুল জববার, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার, শামসুন্নাহার, কাজী আকরম আলী, গোলাম মোস্তফা, আব্দুল কাদির, মইনুদ্দিন, ইব্রাহিম খা, আ.ন.ম. বজলুর রশীদ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী প্রমুখ।
অনেক শিশুব্রতী এবং মুসলমান সাহিত্যিকদের তৎকালীন শিশুসাহিত্য সাধনায় এতো বেশি অগ্রণী এবং সার্থক ভূমিকার পিছনে নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ছাড়াও যে বিষয়টি কাজ করেছিল, তা হলো- তখনকার মুসলমান প্রকাশক-সম্পাদকবৃন্দের উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদান। বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা মুসলমান লেখক-সাহিত্যিকদের শিশুতোষ পাঠ্যপুস্তক রচনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। সম্পাদকরা পত্রিকার পাতায় তাদের শিশুতোষ রচনা, গল্প, কবিতা এবং জীবন কাহিনি ছেপে তাদের উৎসাহ দান করতেন। হিন্দু লেখক-লেখিকাদের নিরঙ্কুশ হিন্দু সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ে শিশুতোষ সাধনার বিপরীতে মুসলমানদের এসব উদ্যোগ ছিল যুগোপযোগী এবং ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন রক্ষার সবচে’ বড় প্রয়াস। মুসলিম সংস্কৃতি, ইসলামি নীতি-ধর্ম-আদর্শ এবং ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়কে শিশুকিশোরদের সামনে পরিবেশনের জন্য পরম-উৎসাহ দান করে বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত, ভাষা বিজ্ঞানী ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন-
‘‘প্রথমেই চাই মুসলমান বালক-বালিকাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক। কি পরিতাপের বিষয়! আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম, শাম এবং গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে, গোপাল বড় ভালো ছেলে। কাসেম বা আব্দুল্লাহ কেমন ছেলে সে তা পড়িতে পায় না। তখন হইতেই তাহার মধ্যে সর্বনাশের বীজ উপ্ত হইল। স্বভাবত তাহার ধারনা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের মাঝে বড়লোক নাই। এসকল পুস্তক দ্বারা আমাদের মুসলমানিত্বহীন করা হয়।
একথা ঠিক বাংগালী মুসলমান বাংগালী হিন্দু সম্বন্ধে যতটুকু জানে, বাংগালী হিন্দু বাংগালী মুসলমান সম্বন্ধে তাহার এক আনাও জানে না। কাজেই মুসলমানগণ পাঠ্যপুস্তক সংকলনে হস্তক্ষেপ করিলে অধিক কৃতকার্য হইবেন বলিয়া আশা করা যায়। ...স্কুলপাঠ্যে হিন্দু রাজাদের সম্বন্ধে অগৌরবজনক কথা প্রায় ঢাকিয়া ফেলা হয় আর মুসলমানদের বেলায় ঢাক-ঢোল বাজাইয়া প্রকাশ করা হয়, গুণের কথা বড় একটা উলিখিত হয় না। ফলে দাঁড়ায় এই, ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়িয়া ছাত্ররা বুঝিল মুসলমান নিতান্ত অপদার্থ, অবিশ্বাসী, অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর জাতি। পৃথিবী হইতে তাহাদের শীঘ্র লোপ হওয়াই মঙ্গল।’’
একদিকে শিশুতোষ পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং মুসলমান সম্পাদিত শিশুকিশোর উপযোগী পত্রিকার পাতায় মুসলমানদের শিশুসাহিত্যসাধনা ধীরে ধীরে আরো গতিমান হয়ে উঠতে থাকে। তখনকার হিন্দু সম্পাদিত পত্রিকায় মুসলমান লেখকদের অংশগ্রহণ ছিল সীমাবদ্ধ এবং খুব নিয়ন্ত্রিত। তাদের প্রকাশনা ছিল নিজস্ব মানসিকতা মাফিক নির্বাচিত। হিন্দু সমাজ-সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। হিন্দুদের সম্পাদিত শিশুতোষ পত্রিকার পাশাপাশি মুসলমানদের সম্পাদিত যে সব পত্রিকা মুসলমান শিশুসাহিত্যিকদের শিশুসাহিত্যসাধনায় নিজস্ব গতি দাঁড় করাতে সহযোগিতা করেছিল তা হলো-
এ.কে ফজলুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বালক’ (১৯০১), টাঙ্গাইলের মাসিক ‘উৎসাহ’ (১৯১৩), মাসিক ‘বালক-নুর’, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত মাসিক ‘আঙুর’ (১৯২০), শাখাওয়াৎ হোসেন সম্পাদিত মাসিক ‘মকতব’ (১৯২৭), আফজাল উল হক সম্পাদিত মাসিক ‘শিশুমহল’ (১৯২৭), শেখ ফজলল করীম সম্পাদিত মাসিক ‘জমজম’ (১৯৩০), মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সম্পাদিত মাসিক ‘শিশুসওগত’ (১৯৩০), আব্দুল ওহাব সম্পাদিত মাসিক ‘গুলবাগিচা’ (১৯৩৭), মুহাম্মদ শফীউল্লাহ সম্পাদিত মাসিক ‘ফুলঝুরি’ (১৯৩৮), মওলভী রজীউর রহমান সম্পাদিত (পরে শাহেদ আলী সম্পাদিত) মাসিক (পরে পাক্ষিক) ‘প্রভাতী’ (১৯৪২), এমাদ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপাতা’ (১৯৪২) প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা অন্যতম। এসব পত্রিকার মাধ্যমে তখনকার শিশুসাহিত্য অনেকাংশে মুসলমানদের দখলে চলে এসেছিল।
ব্রিটিশ যুগকে শিশুসাহিত্যের বিকাশ এবং উদ্ভব যুগ বলা হয়। শিশুসাহিত্যসাধনার আদিপর্বে এসব পত্রিকা মুসলমান লেখকদের নানান আঙ্গিকে শিশুসাহিত্য সাধনার সুযোগ করে দেয়। বর্তমানে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন এমন নামীদামি অনেক শিশুসাহিত্যিকদের শিশুসাহিত্য বিষয়ক হাতেখড়ি হয় এসব পত্রিকার মাধ্যমে। মুসলিম শিশুসাহিত্যিকরা কেবল যে মুসলিম প্রকাশিত-সম্পাদিত পত্রিকায় লিখতেন এমনটা নয়, হিন্দুদের প্রকাশিত-সম্পাদিত বেশ কয়েকটি পত্রিকায় তারা লিখেছেন সিদ্ধহস্ত। যদিও সে লেখা-সুযোগ ছিল হিন্দুদের নিজস্ব সংস্কৃতিময়। সীমানাবদ্ধ এবং বিভিন্ন নিয়মনীতিবদ্ধ ছিল তা। তখন কিছু কিছু মুসলিম সাহিত্যিকরা কেবল শিশুসাহিত্যে নয় বরং সাহিত্যের গোটা আসরে নিজেদের এমন সর্বাঙ্গীণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল যে, হিন্দু প্রকাশিত-সম্পাদিত পত্রিকাতে তাদের নাম যাওয়াটাও সম্পাদক-পত্রিকার গর্বের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হত।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘তোষণী’ (১৯১০), ‘সোপান’ (১৯১০), ‘রাজভোগ’ (১৯২০), ‘পাপিয়া’ (১৯২৮) ইত্যাদি পত্রিকাতে কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, শেখ আব্দুল জববারদের মত মুসলিম লেখকরাও শিশুতোষ লেখা লিখেছেন। প্রসঙ্গত উলেখ্য, কলকাতা থেকে প্রকাশিত কিছু কিছু হিন্দু সম্পাদিত পত্রিকাতেও মুসলিম শিশুসাহিত্যিকদের লেখা ছাপতে দেখা যায়। তার মাঝে ‘মৌচাক’ (১৯২০), ‘শিশুসাথী’ (১৯২১) অন্যতম।
তৎকালে বিশেষভাবে শিশু পত্রিকা প্রকাশ ছাড়াও বিভিন্ন সাপ্তাহিক এবং দৈনিক পত্রিকাতেও শিশুদের জন্য আলাদা আয়োজন রাখা হত। সেখানেও এসব মুসলিম শিশুসাহিত্যিকরা সিদ্ধহস্তে লিখতেন। পত্রিকামহলও তাদের লেখা খুব সাজিয়ে গুছিয়ে ছাপাতেন।
‘বংগীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ প্রকাশিত পত্রিকার ছোটদের পাতার নাম ছিল ‘কোরাক’। কোরাকের জমিনে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, নজরুল ইসলাম এবং লুৎফুর রহমানের মত মুসলিম সাহিত্যিকরা শিশু রচনা লিখতেন। হিন্দুদের সম্পাদিত আনন্দবাজার, যুগান্তর, সত্যযুগ এসব পত্রিকার পাশাপাশি মুসলিম শিশুসাহিত্যিকরা দৈনিক আজাদ পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘মুকুলের মাহফিল’, দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার ‘মিতালী মজলিস’, সাপ্তাহিক মুহাম্মাদির ‘ছোটদের আসর’ এবং দৈনিক নবযুগের ‘আগুনের ফুলকিত’ ইত্যাদিতে বহু শিশুতোষ রচনা লিখেছেন। এসব পত্রিকার পাতা ঘিরে মুসলিম শিশুসাহিত্যিকরা নিজেদের মুক্তচিন্তা-ভাবনা প্রসূত আনন্দময় এক জগৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা ছিল তৎকালীন মুসলিম শিশুসাহিত্যিকদের সবচে’ বড় অর্জন। তৎকালীন লেখক-প্রকাশক-সম্পাদকদের অবদানের ফলে আমরা আজ এতো দূর এসে দাঁড়াতে পেরেছি। শিশুসাহিত্যসাধনায় খুঁজে পেয়েছি আপন ঠিকানা।
ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীকালে এসে মুসলিম শিশুসাহিত্যসাধনা পাঠ্যপুস্তক রচনা-সীমা ছাড়িয়ে অন্যান্য নানা দিক ও বিষয়ে প্রবেশ করে। তখন এয়াকুব আলী চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, সফিউদ্দিন আহমেদ, তোরাব আলী, জসিম উদ্দিন, কায়কোবাদ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ডা. মুহাম্মদ লুৎফুর রহমান, কাদের নেওয়াজ, শেখ আব্দুল জববার, বন্দে আলী মিয়া এসব মুসলমান লেখকরা পাঠ্যবিষয় বহির্ভূত শিশুসাহিত্য সাধনায় হাত দেন।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন