মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
(৫) অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন।
(৮) তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে।
অত্র সূরায় দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে : (১) ইহুদী-নাছারা ও মুশরিকদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য (১-৫ আয়াত)। (২) কাফির-মুশরিকদের শাস্তি ও ঈমানদারগণের পুরস্কার (৬-৮ আয়াত)।
গুরুত্ব :
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উবাই ইবনে কা‘বকে বললেন, إِنَّ اللهَ أَمَرَنِىْ أَنْ أَقْرَأَ عَلَيْكَ ( لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَرُوْا ) قَالَ وَسَمَّانِىْ لَكَ؟ قَالَ « نَعَمْ » فَبَكَى - ‘আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমার উপরে সূরা বাইয়েনাহ পাঠ করি। উবাই বললেন, আল্লাহ আপনার নিকটে আমার নাম বলেছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন উবাই (খুশীতে) কাঁদতে লাগলেন’।[1]
ইমাম কুরতুবী বলেন, এর মধ্যে ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের শিক্ষাদানের তাৎপর্যগত বিষয়টি ( فقه ) ফুটে ওঠে। অন্য একজন বিদ্বান বলেন, এর মধ্যে এই শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, যেন কেউ নিম্নস্তরের কাউকে শিক্ষাদানে কুণ্ঠাবোধ না করে। উল্লেখ্য যে, উবাই ইবনে কা‘ব ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চারণ পদ্ধতি দ্রুত ধারণে সক্ষম ছাহাবী (কুরতুবী)। সেকারণ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে সূরাটি শুনালেন। যাতে তিনি হুবহু অন্যকে শিখাতে পারেন। অত্র হাদীছে সূরাটির গুরুত্বের সাথে সাথে উবাই ইবনে কা‘বের উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে এই মর্মে যে, আল্লাহর মহান দরবারে তার নামটি বাছাই করা হয়েছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
তাফসীর :
(১) لَمْ يَكُنِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ مُنْفَكِّيْنَ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ الْبَيِّنَةُ ‘আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে এবং মুশরিকরা (তাদের মূর্খতা হ’তে) বিরত হ’ত না, যতক্ষণ না তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হয়’।
ইবনু কাছীর বলেন, আহলে কিতাব অর্থ আরব ও আজমের ইহুদী-নাছারাগণ এবং মুশরিক অর্থ মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসকগণ’ (ইবনু কাছীর)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এখানে আহলে কিতাব বলে মদীনার ইহুদী গোত্র বনু নাযীর, বনু কুরায়যা ও বনু কায়নুকা বুঝানো হয়েছে এবং মুশরিকগণ বলতে মদীনা ও মক্কার এবং আশপাশের মুশরিক সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)। তবে ‘মুশরিক’ অর্থ আহলে কিতাবও হ’তে পারে। কেননা তারা তাওহীদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং আল্লাহর কিতাব থেকে তারা কোন ফায়েদা হাছিল করেনি। যেমন আজকালকের মুসলমানদের অবস্থা।
مُنْفَكِّيْنَ অর্থ منتهين عن كفرهم ومائلين عنه ‘কুফরী থেকে বিরত এবং তা থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারীগণ’। مُنْفَكِّيْنَ অর্থ تاركين ‘পরিত্যাগকারী’ হ’তে পারে। অর্থাৎ যখন রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে এলেন, তখন তারা তাঁকে পরিত্যাগ করল। যেমন আল্লাহ বলেন, فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ فَلَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَافِرِيْنَ ‘অতঃপর যখন তাদের নিকট সেই পরিচিত বস্ত্ত (কুরআন বা মুহাম্মাদ) আসল, তখন তারা তাকে অস্বীকার করল। অতএব কাফিরদের উপর আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হৌক’ (বাক্বারাহ ২/৮৯; কুরতুবী)।
ইহুদীদের অনেকে ওযায়ের (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলত। নাছারাদের অনেকে ঈসা (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলত (তওবা ৯/৩০)। কেউ খোদ ঈসা ও তার মাকে ‘উপাস্য’ বলত (মায়েদাহ ৫/১১৬)। কেউ ঈসাকে ‘তিন উপাস্যের অন্যতম’ বলত (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তারা তাদের পীর-আউলিয়াদেরকে ‘রব’-এর আসনে বসিয়েছিল (তওবা ৯/৩১)। ফলে আল্লাহ প্রেরিত কিতাব তওরাত ও ইনজীলের অনুসারী হওয়ার দাবীদার হ’লেও তারা তাওহীদ তথা একত্ববাদ থেকে বহু দূরে ছিটকে পড়েছিল। বিভিন্ন শয়তানী যুক্তি দিয়ে তারা তাদের কপোলকল্পিত এসব শিরকী আক্বীদা-বিশ্বাস ও রেওয়াজকে টিকিয়ে রেখেছিল। তওরাত ও ইনজীলকে তারা বিকৃত করে ফেলেছিল (বাক্বারাহ ২/৭৫-৭৯)। ফলে এমন সত্যগ্রন্থ তাদের সামনে ছিল না, যা তাদেরকে ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে বিরত রাখতে পারে। অবশেষে যখন কুরআন নাযিল হ’তে লাগলো, তখন তাদের অনেকে কুফরী বিশ্বাস থেকে বিরত হ’ল এবং ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’ল। প্রখ্যাত ইহুদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের প্রথম দিনেই ইসলাম কবুল করেন। পরবর্তীতে ত্বাঈ গোত্রের খ্রিষ্টান নেতা ‘আদী বিন হাতেম, আবদুল ক্বায়েস গোত্রের খ্রিষ্টান নেতা জারূদ ইবনুল ‘আলা আল-‘আবদী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ইসলাম কবুল করেন।
পক্ষান্তরে মক্কা-মদীনা ও তার আশপাশের মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসক মুশরিকদের কাছে কোন ইলাহী কিতাব ছিল না। তাদের সব কিছু রীতি-নীতি ছিল সমাজনেতাদের মনগড়া এবং তা ছিল পুরোদস্ত্তর শোষণমূলক। তবুও বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রসম-রেওয়াজের প্রতি তাদের ছিল একটা অন্ধ আবেগ, যা ছাড়তে তারা প্রস্ত্তত ছিল না। কিন্তু কুরআনের স্পষ্ট সত্যের আলো বিকশিত হওয়ার পর তাদের অনেকের ঘোর কেটে যায় এবং তারা ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। যদিও এর জন্য তাদের অনেককে চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয়। হারাতে হয় ঘর-বাড়ি, জন্মস্থান এমনকি জীবন। এটা কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাব যুগেই নয়, বরং পরবর্তী যুগেও মানুষ সর্বদা অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে এসেছে এবং আসতে থাকবে। আর সাথে সাথে অন্ধকারের কীটেরা তাদের উপর নির্যাতন চালাবে। কেননা কুরআন আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ গ্রন্থ। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তা মানুষকে আলোর পথে ডাকবে ও সর্বদা মানুষ আলোর পথে আসবে।
حَتَّى تَأْتِيَهُمُ الْبَيِّنَةُ - ‘যতক্ষণ না তাদের কাছ সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হয়’। অর্থাৎ কুরআন ও তার বাহক রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যেকথা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
(২) رَسُوْلٌ مِّنَ اللهِ يَتْلُوْ صُحُفاً مُّطَهَّرَةً ‘তিনি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত একজন রাসূল, যিনি আবৃত্তি করেন পবিত্র পত্রসমূহ’।
অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হ’তে সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসাবে তাদের নিকটে আগমন করেন রাসূল, যিনি তাদের নিকট তেলাওয়াত করেন পবিত্র কুরআন। এখানে رَسُوْلٌ অর্থ মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যাজ্জাজ বলেন, رَسُوْلٌ এখানে পূর্বের আয়াতে বর্ণিত اَلْبَيِّنَةُ হ’তে ‘বদল’ হওয়াতে مرفوع বা পেশযুক্ত হয়েছে (কুরতুবী)। نكرة বা অনির্দিষ্টবাচক শব্দ ব্যবহার করে রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা বুঝানো হয়েছে। مِنَ اللهِ ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে’ বলার মাধ্যমে তাঁর সম্মানকে আরও উন্নীত করা হয়েছে। সাথে সাথে সন্দেহবাদীদের মোক্ষম জবাব দেওয়া হয়েছে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন, وَأَرْسَلْنَاكَ لِلنَّاسِ رَسُولاً وَكَفَى بِاللهِ شَهِيْدًا ‘আমরা তোমাকে মানবজাতির জন্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (নিসা ৪/৭৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُوْنَ لِلْعَالَمِيْنَ نَذِيْرًا ‘বরকতময় তিনি যিনি স্বীয় বান্দার (মুহাম্মাদের) উপর ফুরক্বান (কুরআন) নাযিল করেছেন। যাতে তিনি বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হ’তে পারেন’ (ফুরক্বান ২৫/১)। এই বান্দা নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। যিনি মানুষের মধ্যে হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী’।[2] যিনি আল্লাহর নিকট থেকে জিব্রীলের মাধ্যমে অহিপ্রাপ্ত হয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৯৭)।
تَلاَ يَتْلُوْ تِلاَوَةً অর্থ আবৃত্তি করা। এজন্য কুরআন পাঠ করাকে তেলাওয়াত করা বলা হয়। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ‘যখন আমরা কুরআন পাঠ করি, তখন তুমি উক্ত পাঠের অনুসরণ কর’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৮)। ‘তেলাওয়াত’ পরিভাষাটি কুরআনের সঙ্গে খাছ। যা হুবহু মুছহাফে উছমানীর আবৃত্তি হবে, অন্য কোন ক্বিরাআতের নয়। যেমন আলোচ্য আয়াতে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর ক্বিরাআত হ’ল - لَمْ يَكُنِ الْمُشْركُوْنَ وأهْلُ الْكِتَابِ مُنْفَكِّيْنَ ইবনুল ‘আরাবী বলেন, وهى جائزة فى مَعرِض البيان لا فى معرض الةلاوة ‘এটি তাফসীরের ক্ষেত্রে বলা জায়েয, তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে নয়’ (কুরতুবী)। কেননা তেলাওয়াত বলতে সেটাই বুঝাবে যা হবে কুরায়শী ক্বিরাআত এবং যে ক্বিরাআতের উপরে ইজমায়ে ছাহাবা হয়েছে এবং যা মুছহাফে ওছমানী হিসাবে এককভাবে মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত হয়েছে। অন্য কিছু পাঠ করাকে ‘তেলাওয়াত’ বলা যাবে না। বললে সেটা হবে কুরআনের সাথে চরম বেআদবী।
صُحُفاً مُّطَهَّرَةً ‘পবিত্র পত্রসমূহ’। অর্থাৎ কুরআন, যা থেকে তিনি পাঠ করে শুনাতেন। যা ‘লওহে মাহফূযে’ অর্থাৎ আল্লাহর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে ‘সুরক্ষিত ফলকে’ লিপিবদ্ধ ছিল (বুরূজ ৮৫/২১-২২, ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭৭-৭৮)। অন্যত্র এর ব্যাখ্যা এসেছে এভাবে, فِيْ صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ، مَّرْفُوْعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ، بِأَيْدِيْ سَفَرَةٍ، كِرَامٍ بَرَرَةٍ - ‘এটা লিখিত আছে সম্মানিত পত্রসমূহে’। ‘যা উচ্চ ও পবিত্র ’। ‘যা লিখিত হয়েছে লিপিকারগণের হাতে’। ‘যারা মহান ও পূত-চরিত্র’ (‘আবাসা ৮০/১৩-১৬)।
مُّطَهَّرَةٍ বা ‘পবিত্র’ অর্থ, مبرأة من الزور والكذب والباطل ‘যা বানোয়াট, মিথ্যা ও বাতিল হ’তে মুক্ত’। منقاة من الشرك ‘যা সকল প্রকার শিরক হ’তে মুক্ত ونزيهة من الرذائل এবং ‘অশ্লীলতা হ’তে পবিত্র’। صُحُفٌ একবচনে صَحِيْفَةٌ অর্থ লেখার পাত্র। এখানে ফলক বা কাগজ বুঝানো হয়নি। বরং লিখিত বস্ত্ত বুঝানো হয়েছে। কুরআন প্রথমে রাসূল (ছাঃ)-এর হৃদয়ে প্রক্ষিপ্ত হ’ত (বাক্বারাহ ২/৯৭)। সেখান থেকে তিনি মুখে পাঠ করে শুনাতেন। লিখিত কুরআন দেখে তিনি তেলাওয়াত করতেন না। কেননা তিনি উম্মী ছিলেন। না কিছু দেখে পড়তে পারতেন, না লিখতে পারতেন (কুরতুবী)। ফলে এখানে صُحُفاً مُّطَهَّرَةً বা ‘পবিত্র পত্রসমূহ’ বলতে রাসূল (ছাঃ)-এর হৃদয়পটে অংকিত কুরআনের বাণীসমূহ বুঝানো হয়েছে। যা সকল প্রকার মিথ্যা ও ত্রুটিসমূহ হ’তে পবিত্র। আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ ‘সামনে বা পিছন থেকে এতে কোন মিথ্যা প্রবেশ করে না। এটি প্রজ্ঞাময় ও মহা প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪২)।
(৩) فِيْهَا كُتُبٌ قَيِّمَةٌ ‘যাতে রয়েছে সরল বিধান সমূহ’। كُتُبٌ অর্থ مَكْتُوْبٌ ‘লিখিত বস্ত্ত’। সে হিসাবে كُتُبٌ ও صُحُفٌ সমার্থবোধক। এখানে كُتُبٌ অর্থ أحكام ‘বিধান সমূহ’ (কুরতুবী)।
قَيِّمَةٌ অর্থ مستقيمة ناطقة بالحق ‘সরল ও সত্য বর্ণনাকারী’ (তানতাভী)। ইবনু জারীর বলেন, عادلة مستقيمة ليس فيها خطأ ‘ন্যায়পূর্ণ ও সরল বাক্য, যাতে কোন ভুল নেই’। এর অর্থ হ’তে পারে محكمة অর্থাৎ ‘বিধান সম্বলিত’। যেমন আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِيْ أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ - ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমার উপরে কিতাব নাযিল করেছেন, যার মধ্যে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট বিধান সম্বলিত। আর এগুলিই হ’ল কিতাবের মূল অংশ’ (আলে ইমরান ৩/৭)। অর্থাৎ রাসূল তাদের নিকটে এমন কিতাব থেকে আবৃত্তি করে শুনান, যা স্পষ্ট বিধানসমূহ দ্বারা সমৃদ্ধ।
(৪) وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِيْنَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ ‘আর কিতাবধারীরা বিভক্ত হয়েছে তাদের নিকটে সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হওয়ার পরেই’।
অর্থাৎ শেষনবীর আগমনের ব্যাপারে তারা ইতিপূর্বে সবাই একমত ছিল এবং তাঁর আগমনের অপেক্ষায় উন্মুখ ছিল। কেননা কিতাবধারী ইহুদী-নাছারাগণ তাদের কিতাবে লিখিত শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শুভাগমনের বিষয়ে আগে থেকেই জানতো। যেমন আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ ‘(কল্যাণ তাদেরই প্রাপ্য) যারা সেই নিরক্ষর রাসূলের অনুসরণ করে চলে, যাঁর কথা তারা তাদের নিকটে রক্ষিত তওরাত ও ইনজীলে লিখিত পেয়ে থাকে’ ... (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। এতদ্ব্যতীত বনু ইসরাঈলের সর্বশেষ নবী হযরত ঈসা (আঃ) স্বীয় উম্মতকে এ বিষয়ে আগাম সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ عِيٍْسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ إِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّراً بِرَسُوْلٍ يَّأْتِيْ مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ - ‘আর স্মরণ কর যখন মারিয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে ইস্রাঈল সন্তানগণ। আমি তোমাদের নিকটে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আসবেন। যার নাম হবে আহমাদ’ (ছফ ৬১/৬)।
বস্ত্ততঃ এই সুসংবাদের কারণেই বায়তুল মুক্বাদ্দাস এলাকা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর বহু ইহুদী মদীনায় এসে আগাম বসবাস শুরু করে দেয় ও নিজেদের হিব্রু ভাষা ত্যাগ করে আরবী ভাষা শিখে নেয়। যাতে শেষনবীর আবির্ভাবের সাথে সাথে তারা সবার আগে তাকে বরণ করে নিতে পারে। দেখা গেল যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় আগমনের সাথে সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের মত ইহুদীদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা ও বিজ্ঞ আলেম ইসলাম কবুল করলেন। কিন্তু বাকী দুনিয়াদার ইহুদী সমাজপতিরা যখন দেখল যে, মুহাজির ও আনছাররা ইসলাম কবুল করে আগেই তার ছাহাবী হয়ে গেছেন, সেখানে তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হয়ত খাটবে না, ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিল এবং অজুহাত তুলল যে, শেষনবী আসবেন ইসহাকের বংশে। কিন্তু ইনি তো ইসমাঈলের বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল তাদের মনগড়া অজুহাত মাত্র। যার কোনই ভিত্তি ছিল না। বরং তারা শেষনবীকে ঠিকই চিনেছিল যেভাবে তাদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, اَلَّذِيْنَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُوْنَهُ كَمَا يَعْرِفُوْنَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيْقاً مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُوْنَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ ‘যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছিলাম (অর্থাৎ ইহুদী-নাছারাগণ) তাকে চিনে, যেমন তারা চিনে তাদের সন্তানদের। অথচ তাদের একটি দল জেনে-শুনে সত্য গোপন করে’ (বাক্বারাহ ২/১৪৬)।
এভাবেই তারা কেউ ঈমান আনে ও কেউ কুফরী করে বিভক্ত হয়ে যায়। আর এটা ছিল স্রেফ তাদের যিদ ও হঠকারিতা মাত্র। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا تَفَرَّقُوْا إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْياً بَيْنَهُمْ ‘তাদের কাছে ইলম (কুরআন) এসে যাওয়ার পরেই তারা বিভক্ত হয়ে যায় পরস্পরে হঠকারিতার কারণে’ (শূরা ৪২/১৪)। বস্ত্ততঃ ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তাদের মতভেদের কারণই ছিল তাদের হঠকারিতা। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلاَمُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম ধর্ম। আর কিতাবধারীরা এটি গ্রহণে আপোষে মতভেদ করেছে তাদের নিকট ইলম (কুরআন) এসে যাওয়ার পর পরস্পরে হঠকারিতা বশে’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। মুসলিম উম্মাহকে এ বিষয়ে সাবধান করে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُوْنُواْ كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُوْلَـئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ - ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ এসে যাওয়ার পরেও পরস্পরে মতভেদ করেছে। ওদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)।
কিন্তু দুর্ভাগ্য মুসলমানের! তারা আল্লাহর সাবধানবাণীকে অগ্রাহ্য করে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে শত দলে বিভক্ত হয়েছে ও আপোষে হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে তাদের উপর দুনিয়াতেই আল্লাহর গযব নেমে এসেছে। ইসলামী খেলাফত হারানোর মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক ঐক্য ধ্বংস হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে তারা দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এখন তারা ইহুদী-নাছারা ও কুফরী শক্তির লেজুড়বৃত্তির মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে ফিরছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِىْ مَا أَتَى عَلَى بَنِى إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ ‘আমার উম্মতের অবস্থা বনু ইস্রাঈলের মতই হবে এক জোড়া জুতার পারস্পরিক সামঞ্জস্যের ন্যায়। বনু ইস্রাঈল ৭২ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে একটি ফের্কা ব্যতীত। লোকেরা বলল, তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِىْ ‘যে তরীকার উপর আমি ও আমার ছাহাবীগণ আছি’। হাকেম-এর বর্ণনায় এসেছে الْيَوْمَ ‘আজকের দিনে’।[3] মোটকথা স্রেফ যিদ ও হঠকারিতা বশে ইহুদী-নাছারাগণ সেদিন কুরআন ও তার বাহক শেষনবী মু হাম্মাদ (ছাঃ)-কে অস্বীকার করেছিল। আজও তাদের সে অবস্থার তেমন কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।
(৫) وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ - ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন’।
অর্থাৎ ইহুদী-নাছারাদের মূল কিতাবে তাওহীদের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার বিপরীতে তারা শিরকে লিপ্ত হয়েছে। যেমন অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পীর-আউলিয়া ও মরিয়ম-তনয় মসীহ ঈসাকে রব-এর আসনে বসিয়েছে। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তারা যেসব বস্ত্তকে শরীক সাব্যস্ত করে, সেসব থেকে তিনি পবিত্র’ (তওবা ৯/৩১)।
مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ অর্থ ইবাদতকে আল্লাহর জন্য খালেছ করা। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, قُلْ إِنِّيْ أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّيْنَ ‘তুমি বল যে, আমি আদিষ্ট হয়েছি খালেছ আনুগত্য সহকারে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য’ (যুমার ৩৯/১১)। ইমাম কুরতুবী বলেন, এই আয়াতের মধ্যে দলীল রয়েছে আল্লাহর ইবাদত সমূহে ‘নিয়ত’ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে। কেননা ইখলাছ হ’ল কলবের আমল, যা দ্বারা কেবল আল্লাহর চেহারা অন্বেষণ করা হয়, অন্যের নয়’। আর যা না হ’লে বান্দার কোন আমল কবুল হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[4] আল্লাহ কেবল مُخْلَصًا অর্থাৎ খালেছ বলেই ক্ষান্ত হননি। বরং حُنَفَاءُ শব্দ উল্লেখ করেছেন। যার অর্থ مائلين عن الأديان كلها إلى دين الإسلام خاصة - ‘সকল দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নির্দিষ্টভাবে কেবল ইসলামের দিকে রুজু হওয়া’। যেমন ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন, إِنِّيْ وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيْفاً وَّمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ - ‘আমি আমার চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে ফিরিয়ে দিলাম সেই সত্তার দিকে, যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (আন‘আম ৬/৭৯)। অন্যত্র তাওহীদের ব্যাখ্যা আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। যেমন وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوْتَ - ‘আমরা প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর কাছে রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত হ’তে বিরত থাকো’ (নাহল ১৬/৩৬)।
এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, إِنَّ الْعِبَادَةَ لاَ تَحْصُلُ إِلاَّ بِالْكُفْرِ بِالطَّاغُوْتِ ‘ত্বাগূতকে অস্বীকার করা ব্যতীত ইবাদত হাছিল হওয়া সম্ভব নয়’ এবং তাওহীদ ও শিরকের জগাখিচুড়ী আল্লাহর নিকটে কখনোই কবুলযোগ্য নয়। আর ত্বাগূত হ’ল, كل معبود من دون الله كالشيطان والكاهن والصنم وكل من دعا الى الضلال ‘আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্য। যেমন শয়তান, গণৎকার, মূর্তি এবং ঐ সকল বস্ত্ত যা মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করে’ (কুরতুবী)। পারিভাষিক অর্থে, الطَّاغُوْتُ أَن يَّتَحَاكَمَ الرَّجُلُ اِلَى مَا سِوَى الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ مِنَ الْبَاطِلِ ‘কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে যে বাতিলের নিকট ফায়ছালা নিয়ে যাওয়া হয়, সেটাই হ’ল ত্বাগূত’ (ইবনু কাছীর -মর্মার্থ)।
وَيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ‘এবং তারা ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে’।
অর্থাৎ খালেছ আনুগত্য সহকারে এবং একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করার সাথে সাথে ছালাত ও যাকাত আদায় করবে। এখানে তিনটি আমল একত্রে বলা হয়েছে। এক- নিয়তকে আল্লাহর জন্য খালেছ করা, যা হ’ল কলবের আমল। দুই- ছালাত কায়েম করা, যা হ’ল দৈহিক আমল এবং তিন- যাকাত আদায় করা, যা হ’ল আর্থিক আমল। তিনটিকেই একত্রে ইবাদত বলা হয়েছে। যাকে ইবাদতে ক্বালবী, ইবাদতে বদনী ও ইবাদতে মালী বলা যেতে পারে। ইমাম যুহরী, ইমাম শাফেঈ প্রমুখ বিদ্বানগণ এ আয়াত থেকে দলীল নিয়েছেন এই মর্মে যে, ‘আমল ঈমানের অংশ’ (ইবনু কাছীর)।
‘ছালাত কায়েম করা’ অর্থ ছালাত ওয়াক্ত মোতাবেক আদায় করা এবং তার ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত সমূহের যথাযথ হেফাযত করা। ইবনু কাছীর বলেন, ছালাত হ’ল দৈহিক ইবাদত সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ( أشرف عبادات البدن )।
‘যাকাত আদায় করা’ অর্থ হকদারগণের নিকট যথার্থভাবে পৌঁছে দেওয়া (কুরতুবী)। যাকাত হ’ল আর্থিক ইবাদত সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যা ফকীর-মিসকীনদের প্রতি দয়ার গ্যারান্টি। ইবনু কাছীর বলেন, যাকাত হ’ল দরিদ্র ও মুখাপেক্ষীদের প্রতি দয়াশীলতা ( الإحسان الى الفقراء والمحاويج )।
অর্থাৎ শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস এবং ছালাত ও যাকাত যথাযথভাবে আদায় করাটাই হ’ল প্রকৃত দ্বীন ও সরল পথ। যাতে কোন মিথ্যা ও বক্রতা নেই।
(৬) إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أُوْلَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ - ‘আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরী করে এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে চিরকাল থাকবে। এরা হ’ল সৃষ্টির অধম’।
যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللهِ الَّذِيْنَ كَفَرُوا فَهُمْ لاَ يُؤْمِنُوْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই যারা কুফরী করে। অতঃপর তারা ঈমান আনে না’ (আনফাল ৮/৫৫)।
অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ কাফেরদের দুনিয়া ও আখেরাতের অবস্থান সম্পর্কে খবর দিয়েছেন। দুনিয়ায় তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে একেবারেই মর্যাদাহীন ও সৃষ্টির অধম এবং আখেরাতে তারা হবে জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা।
(৭) إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُوْلَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির সেরা’।
অর্থাৎ ঈমান ও আমলে ছালেহ যার মধ্যে একত্রিতভাবে পাওয়া যাবে, সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকটে সৃষ্টির সেরা। শুধুমাত্র বিশ্বাস বা শুধুমাত্র সৎকর্ম শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। এ আয়াতের উপরে ভিত্তি করে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ও একদল বিদ্বান মুমিনদের মর্যাদা ফেরেশতাদের উপরে নির্ধারণ করেছেন (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
‘ঈমান’ অর্থ একমাত্র উপাস্য হিসাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্ব করা ও তাঁর সাথে কাউকে শরীক বা তুলনীয় মনে না করা। রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষনবী ও সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তদাতা হিসাবে বিশ্বাস করা এবং তাঁর সাথে কোন ব্যক্তিকে শরীক বা তুলনীয় মনে না করা। ‘আমলে ছালেহ’ অর্থ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুমোদিত নেক আমল এবং তার আলোকে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহ। যারা এটা করেন, তারাই হ’লেন সৃষ্টির সেরা মানুষ। বিশ্বাস ও কর্মগত এই পার্থক্যের কারণেই মুমিন ও কাফিরের মধ্যে বিয়ে-শাদী ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী আয়াতে কাফিরদের নিকৃষ্ট অবস্থান বর্ণনার পর অত্র আয়াতে তার বিপরীতে মুমিনদের সর্বোচ্চ অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে।
(৮) جَزَاؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيهَا أَبَداً رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ - ‘তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তার উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’।
অত্র আয়াতে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের পরকালীন পুরস্কারের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাদেরকে পরকালে ‘জান্নাতে আদন’ প্রতিদান হিসাবে দেওয়া হবে। عَدْنٍ অর্থ الإقامة বা বসবাস। عَدَنَ يَعْدِنُ عَدْنًا عُدُوْنًا অর্থ أَقَامَ ‘বসবাস করা’। যেখান থেকে এসেছে مَعْدِنٌ অর্থ খনি। মুফাসসিরগণ বলেন, ‘আদন’ হ’ল بُطْنَانُ الْجَنَّةِ ‘বাগিচার মধ্যস্থল’ (কুরতুবী)। মূলতঃ ‘আদন’ একটি জান্নাতের নাম, যা অন্যান্য জান্নাত থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। যা কেবল আল্লাহর ইলমে রয়েছে।
خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَداً ‘যেখানে তারা অনন্তকাল ধরে বসবাস করবে’। যার কোন বিরতি হবে না বা সেখানে তাদের মৃত্যু হবে না।
رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ - ‘আল্লাহ তাদের উপরে সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপর সন্তুষ্ট’। অর্থাৎ আল্লাহ তাদের আমলের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তারাও তাদের আমলের কল্পনাতীত প্রতিদান পেয়ে আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট হয়েছে।
ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ ‘এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’।
الخوف والخشية অর্থ ভয়। তবে الخوف অর্থ ‘সাধারণ ভয়’ এবং الخشية অর্থ ‘বিশেষ ভয়’ যার শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকে। এখানে আল্লাহভীতিকে সেই অর্থে আনা হয়েছে। যার ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে। আর এই ভীতিই হ’ল ‘প্রকৃত সৌভাগ্যের উৎস’ ( مَلاَكُ السعادةِ الحقيقية )।
خَشِيَ অর্থ خاف الله فى السر والعلانية فتناهى عن المعاصى ‘গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করে। অতঃপর পাপ সমূহ থেকে বিরত হয়’। সে ভয় করে আল্লাহ কৃত ফরয সমূহ পালনের মাধ্যমে এবং তাঁর নিষেধ সমূহ বর্জনের মাধ্যমে। এই ভয়টা কেমন সে সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের সামনে আল্লাহর কথা বলা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। অতঃপর যখন আল্লাহর আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী সম্বলিত সামঞ্জস্যপূর্ণ কিতাব নাযিল করেছেন, যা বারবার পঠিত হয়। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের গাত্রচর্ম ভয়ে শিহরিত হয়। অতঃপর তাদের দেহ ও মন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে’ (যুমার ৩৯/২৩)। অতএব শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ইবাদত সমূহের নাম তাক্বওয়া নয়, বরং হৃদয়ের আল্লাহভীতিই হ’ল প্রকৃত তাক্বওয়া। যা আল্লাহ দেখে থাকেন।
জান্নাতীদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى - ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করে ও প্রবৃত্তিপরায়ণতা হ’তে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৪০-৪১)। সে আল্লাহ প্রেরিত শরী‘আত অনুযায়ী ইবাদত করে এমনভাবে যেন সে আল্লাহকে দেখছে। আর যদি তা না পারে, তবে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই দেখছেন। যেমন হাদীছে জিব্রীলে এসেছে, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ - ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তুমি তাকে দেখছ। আর যদি তা না পার, তাহ’লে (বিশ্বাস রাখো যে,) তিনি তোমাকে দেখছেন’।[5] আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيْزِ الرَّحِيْمِ، الَّذِيْ يَرَاكَ حِيْنَ تَقُوْمُ، وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِيْنَ، إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ - ‘তুমি ভরসা কর মহাপরাক্রান্ত পরম দয়াময়ের উপরে’। ‘যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি ছালাতে দন্ডায়মান হও’। ‘এবং মুছল্লীদের সাথে উঠাবসা কর’। ‘নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (শো‘আরা ২৬/২১৭-২০)। বস্ত্ততঃ তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতিই হ’ল সবকিছুর মূল। জান্নাত কেবল তাদেরই ঠিকানা হবে। اللهم اجعلنا منهم ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তাদের মধ্যে শামিল কর! আমীন!!
সারকথা :
সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা এবং সকল ব্যাপারে যথার্থভাবে তাঁকে ভয় করার মাধ্যমেই আল্লাহর রেযামন্দী হাছিল করা সম্ভব।
[1]. বুখারী হা/৪৯৫৯, মুসলিম হা/৭৯৯; মিশকাত হা/২১৯৬।
(৫) অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন।
(৮) তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে।
অত্র সূরায় দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে : (১) ইহুদী-নাছারা ও মুশরিকদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য (১-৫ আয়াত)। (২) কাফির-মুশরিকদের শাস্তি ও ঈমানদারগণের পুরস্কার (৬-৮ আয়াত)।
গুরুত্ব :
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উবাই ইবনে কা‘বকে বললেন, إِنَّ اللهَ أَمَرَنِىْ أَنْ أَقْرَأَ عَلَيْكَ ( لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَرُوْا ) قَالَ وَسَمَّانِىْ لَكَ؟ قَالَ « نَعَمْ » فَبَكَى - ‘আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমার উপরে সূরা বাইয়েনাহ পাঠ করি। উবাই বললেন, আল্লাহ আপনার নিকটে আমার নাম বলেছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন উবাই (খুশীতে) কাঁদতে লাগলেন’।[1]
ইমাম কুরতুবী বলেন, এর মধ্যে ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের শিক্ষাদানের তাৎপর্যগত বিষয়টি ( فقه ) ফুটে ওঠে। অন্য একজন বিদ্বান বলেন, এর মধ্যে এই শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, যেন কেউ নিম্নস্তরের কাউকে শিক্ষাদানে কুণ্ঠাবোধ না করে। উল্লেখ্য যে, উবাই ইবনে কা‘ব ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চারণ পদ্ধতি দ্রুত ধারণে সক্ষম ছাহাবী (কুরতুবী)। সেকারণ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে সূরাটি শুনালেন। যাতে তিনি হুবহু অন্যকে শিখাতে পারেন। অত্র হাদীছে সূরাটির গুরুত্বের সাথে সাথে উবাই ইবনে কা‘বের উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে এই মর্মে যে, আল্লাহর মহান দরবারে তার নামটি বাছাই করা হয়েছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
তাফসীর :
(১) لَمْ يَكُنِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ مُنْفَكِّيْنَ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ الْبَيِّنَةُ ‘আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে এবং মুশরিকরা (তাদের মূর্খতা হ’তে) বিরত হ’ত না, যতক্ষণ না তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হয়’।
ইবনু কাছীর বলেন, আহলে কিতাব অর্থ আরব ও আজমের ইহুদী-নাছারাগণ এবং মুশরিক অর্থ মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসকগণ’ (ইবনু কাছীর)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এখানে আহলে কিতাব বলে মদীনার ইহুদী গোত্র বনু নাযীর, বনু কুরায়যা ও বনু কায়নুকা বুঝানো হয়েছে এবং মুশরিকগণ বলতে মদীনা ও মক্কার এবং আশপাশের মুশরিক সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)। তবে ‘মুশরিক’ অর্থ আহলে কিতাবও হ’তে পারে। কেননা তারা তাওহীদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং আল্লাহর কিতাব থেকে তারা কোন ফায়েদা হাছিল করেনি। যেমন আজকালকের মুসলমানদের অবস্থা।
مُنْفَكِّيْنَ অর্থ منتهين عن كفرهم ومائلين عنه ‘কুফরী থেকে বিরত এবং তা থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারীগণ’। مُنْفَكِّيْنَ অর্থ تاركين ‘পরিত্যাগকারী’ হ’তে পারে। অর্থাৎ যখন রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে এলেন, তখন তারা তাঁকে পরিত্যাগ করল। যেমন আল্লাহ বলেন, فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ فَلَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَافِرِيْنَ ‘অতঃপর যখন তাদের নিকট সেই পরিচিত বস্ত্ত (কুরআন বা মুহাম্মাদ) আসল, তখন তারা তাকে অস্বীকার করল। অতএব কাফিরদের উপর আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হৌক’ (বাক্বারাহ ২/৮৯; কুরতুবী)।
ইহুদীদের অনেকে ওযায়ের (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলত। নাছারাদের অনেকে ঈসা (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলত (তওবা ৯/৩০)। কেউ খোদ ঈসা ও তার মাকে ‘উপাস্য’ বলত (মায়েদাহ ৫/১১৬)। কেউ ঈসাকে ‘তিন উপাস্যের অন্যতম’ বলত (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তারা তাদের পীর-আউলিয়াদেরকে ‘রব’-এর আসনে বসিয়েছিল (তওবা ৯/৩১)। ফলে আল্লাহ প্রেরিত কিতাব তওরাত ও ইনজীলের অনুসারী হওয়ার দাবীদার হ’লেও তারা তাওহীদ তথা একত্ববাদ থেকে বহু দূরে ছিটকে পড়েছিল। বিভিন্ন শয়তানী যুক্তি দিয়ে তারা তাদের কপোলকল্পিত এসব শিরকী আক্বীদা-বিশ্বাস ও রেওয়াজকে টিকিয়ে রেখেছিল। তওরাত ও ইনজীলকে তারা বিকৃত করে ফেলেছিল (বাক্বারাহ ২/৭৫-৭৯)। ফলে এমন সত্যগ্রন্থ তাদের সামনে ছিল না, যা তাদেরকে ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে বিরত রাখতে পারে। অবশেষে যখন কুরআন নাযিল হ’তে লাগলো, তখন তাদের অনেকে কুফরী বিশ্বাস থেকে বিরত হ’ল এবং ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’ল। প্রখ্যাত ইহুদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের প্রথম দিনেই ইসলাম কবুল করেন। পরবর্তীতে ত্বাঈ গোত্রের খ্রিষ্টান নেতা ‘আদী বিন হাতেম, আবদুল ক্বায়েস গোত্রের খ্রিষ্টান নেতা জারূদ ইবনুল ‘আলা আল-‘আবদী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ইসলাম কবুল করেন।
পক্ষান্তরে মক্কা-মদীনা ও তার আশপাশের মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসক মুশরিকদের কাছে কোন ইলাহী কিতাব ছিল না। তাদের সব কিছু রীতি-নীতি ছিল সমাজনেতাদের মনগড়া এবং তা ছিল পুরোদস্ত্তর শোষণমূলক। তবুও বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রসম-রেওয়াজের প্রতি তাদের ছিল একটা অন্ধ আবেগ, যা ছাড়তে তারা প্রস্ত্তত ছিল না। কিন্তু কুরআনের স্পষ্ট সত্যের আলো বিকশিত হওয়ার পর তাদের অনেকের ঘোর কেটে যায় এবং তারা ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। যদিও এর জন্য তাদের অনেককে চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয়। হারাতে হয় ঘর-বাড়ি, জন্মস্থান এমনকি জীবন। এটা কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাব যুগেই নয়, বরং পরবর্তী যুগেও মানুষ সর্বদা অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে এসেছে এবং আসতে থাকবে। আর সাথে সাথে অন্ধকারের কীটেরা তাদের উপর নির্যাতন চালাবে। কেননা কুরআন আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ গ্রন্থ। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তা মানুষকে আলোর পথে ডাকবে ও সর্বদা মানুষ আলোর পথে আসবে।
حَتَّى تَأْتِيَهُمُ الْبَيِّنَةُ - ‘যতক্ষণ না তাদের কাছ সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হয়’। অর্থাৎ কুরআন ও তার বাহক রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যেকথা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
(২) رَسُوْلٌ مِّنَ اللهِ يَتْلُوْ صُحُفاً مُّطَهَّرَةً ‘তিনি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত একজন রাসূল, যিনি আবৃত্তি করেন পবিত্র পত্রসমূহ’।
অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হ’তে সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসাবে তাদের নিকটে আগমন করেন রাসূল, যিনি তাদের নিকট তেলাওয়াত করেন পবিত্র কুরআন। এখানে رَسُوْلٌ অর্থ মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যাজ্জাজ বলেন, رَسُوْلٌ এখানে পূর্বের আয়াতে বর্ণিত اَلْبَيِّنَةُ হ’তে ‘বদল’ হওয়াতে مرفوع বা পেশযুক্ত হয়েছে (কুরতুবী)। نكرة বা অনির্দিষ্টবাচক শব্দ ব্যবহার করে রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা বুঝানো হয়েছে। مِنَ اللهِ ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে’ বলার মাধ্যমে তাঁর সম্মানকে আরও উন্নীত করা হয়েছে। সাথে সাথে সন্দেহবাদীদের মোক্ষম জবাব দেওয়া হয়েছে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন, وَأَرْسَلْنَاكَ لِلنَّاسِ رَسُولاً وَكَفَى بِاللهِ شَهِيْدًا ‘আমরা তোমাকে মানবজাতির জন্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (নিসা ৪/৭৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُوْنَ لِلْعَالَمِيْنَ نَذِيْرًا ‘বরকতময় তিনি যিনি স্বীয় বান্দার (মুহাম্মাদের) উপর ফুরক্বান (কুরআন) নাযিল করেছেন। যাতে তিনি বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হ’তে পারেন’ (ফুরক্বান ২৫/১)। এই বান্দা নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। যিনি মানুষের মধ্যে হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী’।[2] যিনি আল্লাহর নিকট থেকে জিব্রীলের মাধ্যমে অহিপ্রাপ্ত হয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৯৭)।
تَلاَ يَتْلُوْ تِلاَوَةً অর্থ আবৃত্তি করা। এজন্য কুরআন পাঠ করাকে তেলাওয়াত করা বলা হয়। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ‘যখন আমরা কুরআন পাঠ করি, তখন তুমি উক্ত পাঠের অনুসরণ কর’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৮)। ‘তেলাওয়াত’ পরিভাষাটি কুরআনের সঙ্গে খাছ। যা হুবহু মুছহাফে উছমানীর আবৃত্তি হবে, অন্য কোন ক্বিরাআতের নয়। যেমন আলোচ্য আয়াতে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর ক্বিরাআত হ’ল - لَمْ يَكُنِ الْمُشْركُوْنَ وأهْلُ الْكِتَابِ مُنْفَكِّيْنَ ইবনুল ‘আরাবী বলেন, وهى جائزة فى مَعرِض البيان لا فى معرض الةلاوة ‘এটি তাফসীরের ক্ষেত্রে বলা জায়েয, তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে নয়’ (কুরতুবী)। কেননা তেলাওয়াত বলতে সেটাই বুঝাবে যা হবে কুরায়শী ক্বিরাআত এবং যে ক্বিরাআতের উপরে ইজমায়ে ছাহাবা হয়েছে এবং যা মুছহাফে ওছমানী হিসাবে এককভাবে মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত হয়েছে। অন্য কিছু পাঠ করাকে ‘তেলাওয়াত’ বলা যাবে না। বললে সেটা হবে কুরআনের সাথে চরম বেআদবী।
صُحُفاً مُّطَهَّرَةً ‘পবিত্র পত্রসমূহ’। অর্থাৎ কুরআন, যা থেকে তিনি পাঠ করে শুনাতেন। যা ‘লওহে মাহফূযে’ অর্থাৎ আল্লাহর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে ‘সুরক্ষিত ফলকে’ লিপিবদ্ধ ছিল (বুরূজ ৮৫/২১-২২, ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭৭-৭৮)। অন্যত্র এর ব্যাখ্যা এসেছে এভাবে, فِيْ صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ، مَّرْفُوْعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ، بِأَيْدِيْ سَفَرَةٍ، كِرَامٍ بَرَرَةٍ - ‘এটা লিখিত আছে সম্মানিত পত্রসমূহে’। ‘যা উচ্চ ও পবিত্র ’। ‘যা লিখিত হয়েছে লিপিকারগণের হাতে’। ‘যারা মহান ও পূত-চরিত্র’ (‘আবাসা ৮০/১৩-১৬)।
مُّطَهَّرَةٍ বা ‘পবিত্র’ অর্থ, مبرأة من الزور والكذب والباطل ‘যা বানোয়াট, মিথ্যা ও বাতিল হ’তে মুক্ত’। منقاة من الشرك ‘যা সকল প্রকার শিরক হ’তে মুক্ত ونزيهة من الرذائل এবং ‘অশ্লীলতা হ’তে পবিত্র’। صُحُفٌ একবচনে صَحِيْفَةٌ অর্থ লেখার পাত্র। এখানে ফলক বা কাগজ বুঝানো হয়নি। বরং লিখিত বস্ত্ত বুঝানো হয়েছে। কুরআন প্রথমে রাসূল (ছাঃ)-এর হৃদয়ে প্রক্ষিপ্ত হ’ত (বাক্বারাহ ২/৯৭)। সেখান থেকে তিনি মুখে পাঠ করে শুনাতেন। লিখিত কুরআন দেখে তিনি তেলাওয়াত করতেন না। কেননা তিনি উম্মী ছিলেন। না কিছু দেখে পড়তে পারতেন, না লিখতে পারতেন (কুরতুবী)। ফলে এখানে صُحُفاً مُّطَهَّرَةً বা ‘পবিত্র পত্রসমূহ’ বলতে রাসূল (ছাঃ)-এর হৃদয়পটে অংকিত কুরআনের বাণীসমূহ বুঝানো হয়েছে। যা সকল প্রকার মিথ্যা ও ত্রুটিসমূহ হ’তে পবিত্র। আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ ‘সামনে বা পিছন থেকে এতে কোন মিথ্যা প্রবেশ করে না। এটি প্রজ্ঞাময় ও মহা প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪২)।
(৩) فِيْهَا كُتُبٌ قَيِّمَةٌ ‘যাতে রয়েছে সরল বিধান সমূহ’। كُتُبٌ অর্থ مَكْتُوْبٌ ‘লিখিত বস্ত্ত’। সে হিসাবে كُتُبٌ ও صُحُفٌ সমার্থবোধক। এখানে كُتُبٌ অর্থ أحكام ‘বিধান সমূহ’ (কুরতুবী)।
قَيِّمَةٌ অর্থ مستقيمة ناطقة بالحق ‘সরল ও সত্য বর্ণনাকারী’ (তানতাভী)। ইবনু জারীর বলেন, عادلة مستقيمة ليس فيها خطأ ‘ন্যায়পূর্ণ ও সরল বাক্য, যাতে কোন ভুল নেই’। এর অর্থ হ’তে পারে محكمة অর্থাৎ ‘বিধান সম্বলিত’। যেমন আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِيْ أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ - ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমার উপরে কিতাব নাযিল করেছেন, যার মধ্যে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট বিধান সম্বলিত। আর এগুলিই হ’ল কিতাবের মূল অংশ’ (আলে ইমরান ৩/৭)। অর্থাৎ রাসূল তাদের নিকটে এমন কিতাব থেকে আবৃত্তি করে শুনান, যা স্পষ্ট বিধানসমূহ দ্বারা সমৃদ্ধ।
(৪) وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِيْنَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ ‘আর কিতাবধারীরা বিভক্ত হয়েছে তাদের নিকটে সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হওয়ার পরেই’।
অর্থাৎ শেষনবীর আগমনের ব্যাপারে তারা ইতিপূর্বে সবাই একমত ছিল এবং তাঁর আগমনের অপেক্ষায় উন্মুখ ছিল। কেননা কিতাবধারী ইহুদী-নাছারাগণ তাদের কিতাবে লিখিত শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শুভাগমনের বিষয়ে আগে থেকেই জানতো। যেমন আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ ‘(কল্যাণ তাদেরই প্রাপ্য) যারা সেই নিরক্ষর রাসূলের অনুসরণ করে চলে, যাঁর কথা তারা তাদের নিকটে রক্ষিত তওরাত ও ইনজীলে লিখিত পেয়ে থাকে’ ... (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। এতদ্ব্যতীত বনু ইসরাঈলের সর্বশেষ নবী হযরত ঈসা (আঃ) স্বীয় উম্মতকে এ বিষয়ে আগাম সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ عِيٍْسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ إِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّراً بِرَسُوْلٍ يَّأْتِيْ مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ - ‘আর স্মরণ কর যখন মারিয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে ইস্রাঈল সন্তানগণ। আমি তোমাদের নিকটে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আসবেন। যার নাম হবে আহমাদ’ (ছফ ৬১/৬)।
বস্ত্ততঃ এই সুসংবাদের কারণেই বায়তুল মুক্বাদ্দাস এলাকা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর বহু ইহুদী মদীনায় এসে আগাম বসবাস শুরু করে দেয় ও নিজেদের হিব্রু ভাষা ত্যাগ করে আরবী ভাষা শিখে নেয়। যাতে শেষনবীর আবির্ভাবের সাথে সাথে তারা সবার আগে তাকে বরণ করে নিতে পারে। দেখা গেল যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় আগমনের সাথে সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের মত ইহুদীদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা ও বিজ্ঞ আলেম ইসলাম কবুল করলেন। কিন্তু বাকী দুনিয়াদার ইহুদী সমাজপতিরা যখন দেখল যে, মুহাজির ও আনছাররা ইসলাম কবুল করে আগেই তার ছাহাবী হয়ে গেছেন, সেখানে তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হয়ত খাটবে না, ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিল এবং অজুহাত তুলল যে, শেষনবী আসবেন ইসহাকের বংশে। কিন্তু ইনি তো ইসমাঈলের বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল তাদের মনগড়া অজুহাত মাত্র। যার কোনই ভিত্তি ছিল না। বরং তারা শেষনবীকে ঠিকই চিনেছিল যেভাবে তাদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, اَلَّذِيْنَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُوْنَهُ كَمَا يَعْرِفُوْنَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيْقاً مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُوْنَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ ‘যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছিলাম (অর্থাৎ ইহুদী-নাছারাগণ) তাকে চিনে, যেমন তারা চিনে তাদের সন্তানদের। অথচ তাদের একটি দল জেনে-শুনে সত্য গোপন করে’ (বাক্বারাহ ২/১৪৬)।
এভাবেই তারা কেউ ঈমান আনে ও কেউ কুফরী করে বিভক্ত হয়ে যায়। আর এটা ছিল স্রেফ তাদের যিদ ও হঠকারিতা মাত্র। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا تَفَرَّقُوْا إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْياً بَيْنَهُمْ ‘তাদের কাছে ইলম (কুরআন) এসে যাওয়ার পরেই তারা বিভক্ত হয়ে যায় পরস্পরে হঠকারিতার কারণে’ (শূরা ৪২/১৪)। বস্ত্ততঃ ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তাদের মতভেদের কারণই ছিল তাদের হঠকারিতা। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلاَمُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম ধর্ম। আর কিতাবধারীরা এটি গ্রহণে আপোষে মতভেদ করেছে তাদের নিকট ইলম (কুরআন) এসে যাওয়ার পর পরস্পরে হঠকারিতা বশে’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। মুসলিম উম্মাহকে এ বিষয়ে সাবধান করে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُوْنُواْ كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُوْلَـئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ - ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ এসে যাওয়ার পরেও পরস্পরে মতভেদ করেছে। ওদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)।
কিন্তু দুর্ভাগ্য মুসলমানের! তারা আল্লাহর সাবধানবাণীকে অগ্রাহ্য করে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে শত দলে বিভক্ত হয়েছে ও আপোষে হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে তাদের উপর দুনিয়াতেই আল্লাহর গযব নেমে এসেছে। ইসলামী খেলাফত হারানোর মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক ঐক্য ধ্বংস হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে তারা দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এখন তারা ইহুদী-নাছারা ও কুফরী শক্তির লেজুড়বৃত্তির মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে ফিরছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِىْ مَا أَتَى عَلَى بَنِى إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ ‘আমার উম্মতের অবস্থা বনু ইস্রাঈলের মতই হবে এক জোড়া জুতার পারস্পরিক সামঞ্জস্যের ন্যায়। বনু ইস্রাঈল ৭২ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে একটি ফের্কা ব্যতীত। লোকেরা বলল, তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِىْ ‘যে তরীকার উপর আমি ও আমার ছাহাবীগণ আছি’। হাকেম-এর বর্ণনায় এসেছে الْيَوْمَ ‘আজকের দিনে’।[3] মোটকথা স্রেফ যিদ ও হঠকারিতা বশে ইহুদী-নাছারাগণ সেদিন কুরআন ও তার বাহক শেষনবী মু হাম্মাদ (ছাঃ)-কে অস্বীকার করেছিল। আজও তাদের সে অবস্থার তেমন কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।
(৫) وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ - ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন’।
অর্থাৎ ইহুদী-নাছারাদের মূল কিতাবে তাওহীদের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার বিপরীতে তারা শিরকে লিপ্ত হয়েছে। যেমন অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পীর-আউলিয়া ও মরিয়ম-তনয় মসীহ ঈসাকে রব-এর আসনে বসিয়েছে। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তারা যেসব বস্ত্তকে শরীক সাব্যস্ত করে, সেসব থেকে তিনি পবিত্র’ (তওবা ৯/৩১)।
مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ অর্থ ইবাদতকে আল্লাহর জন্য খালেছ করা। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, قُلْ إِنِّيْ أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّيْنَ ‘তুমি বল যে, আমি আদিষ্ট হয়েছি খালেছ আনুগত্য সহকারে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য’ (যুমার ৩৯/১১)। ইমাম কুরতুবী বলেন, এই আয়াতের মধ্যে দলীল রয়েছে আল্লাহর ইবাদত সমূহে ‘নিয়ত’ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে। কেননা ইখলাছ হ’ল কলবের আমল, যা দ্বারা কেবল আল্লাহর চেহারা অন্বেষণ করা হয়, অন্যের নয়’। আর যা না হ’লে বান্দার কোন আমল কবুল হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[4] আল্লাহ কেবল مُخْلَصًا অর্থাৎ খালেছ বলেই ক্ষান্ত হননি। বরং حُنَفَاءُ শব্দ উল্লেখ করেছেন। যার অর্থ مائلين عن الأديان كلها إلى دين الإسلام خاصة - ‘সকল দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নির্দিষ্টভাবে কেবল ইসলামের দিকে রুজু হওয়া’। যেমন ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন, إِنِّيْ وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيْفاً وَّمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ - ‘আমি আমার চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে ফিরিয়ে দিলাম সেই সত্তার দিকে, যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (আন‘আম ৬/৭৯)। অন্যত্র তাওহীদের ব্যাখ্যা আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। যেমন وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوْتَ - ‘আমরা প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর কাছে রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত হ’তে বিরত থাকো’ (নাহল ১৬/৩৬)।
এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, إِنَّ الْعِبَادَةَ لاَ تَحْصُلُ إِلاَّ بِالْكُفْرِ بِالطَّاغُوْتِ ‘ত্বাগূতকে অস্বীকার করা ব্যতীত ইবাদত হাছিল হওয়া সম্ভব নয়’ এবং তাওহীদ ও শিরকের জগাখিচুড়ী আল্লাহর নিকটে কখনোই কবুলযোগ্য নয়। আর ত্বাগূত হ’ল, كل معبود من دون الله كالشيطان والكاهن والصنم وكل من دعا الى الضلال ‘আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্য। যেমন শয়তান, গণৎকার, মূর্তি এবং ঐ সকল বস্ত্ত যা মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করে’ (কুরতুবী)। পারিভাষিক অর্থে, الطَّاغُوْتُ أَن يَّتَحَاكَمَ الرَّجُلُ اِلَى مَا سِوَى الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ مِنَ الْبَاطِلِ ‘কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে যে বাতিলের নিকট ফায়ছালা নিয়ে যাওয়া হয়, সেটাই হ’ল ত্বাগূত’ (ইবনু কাছীর -মর্মার্থ)।
وَيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ‘এবং তারা ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে’।
অর্থাৎ খালেছ আনুগত্য সহকারে এবং একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করার সাথে সাথে ছালাত ও যাকাত আদায় করবে। এখানে তিনটি আমল একত্রে বলা হয়েছে। এক- নিয়তকে আল্লাহর জন্য খালেছ করা, যা হ’ল কলবের আমল। দুই- ছালাত কায়েম করা, যা হ’ল দৈহিক আমল এবং তিন- যাকাত আদায় করা, যা হ’ল আর্থিক আমল। তিনটিকেই একত্রে ইবাদত বলা হয়েছে। যাকে ইবাদতে ক্বালবী, ইবাদতে বদনী ও ইবাদতে মালী বলা যেতে পারে। ইমাম যুহরী, ইমাম শাফেঈ প্রমুখ বিদ্বানগণ এ আয়াত থেকে দলীল নিয়েছেন এই মর্মে যে, ‘আমল ঈমানের অংশ’ (ইবনু কাছীর)।
‘ছালাত কায়েম করা’ অর্থ ছালাত ওয়াক্ত মোতাবেক আদায় করা এবং তার ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত সমূহের যথাযথ হেফাযত করা। ইবনু কাছীর বলেন, ছালাত হ’ল দৈহিক ইবাদত সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ( أشرف عبادات البدن )।
‘যাকাত আদায় করা’ অর্থ হকদারগণের নিকট যথার্থভাবে পৌঁছে দেওয়া (কুরতুবী)। যাকাত হ’ল আর্থিক ইবাদত সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যা ফকীর-মিসকীনদের প্রতি দয়ার গ্যারান্টি। ইবনু কাছীর বলেন, যাকাত হ’ল দরিদ্র ও মুখাপেক্ষীদের প্রতি দয়াশীলতা ( الإحسان الى الفقراء والمحاويج )।
অর্থাৎ শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস এবং ছালাত ও যাকাত যথাযথভাবে আদায় করাটাই হ’ল প্রকৃত দ্বীন ও সরল পথ। যাতে কোন মিথ্যা ও বক্রতা নেই।
(৬) إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أُوْلَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ - ‘আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরী করে এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে চিরকাল থাকবে। এরা হ’ল সৃষ্টির অধম’।
যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللهِ الَّذِيْنَ كَفَرُوا فَهُمْ لاَ يُؤْمِنُوْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই যারা কুফরী করে। অতঃপর তারা ঈমান আনে না’ (আনফাল ৮/৫৫)।
অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ কাফেরদের দুনিয়া ও আখেরাতের অবস্থান সম্পর্কে খবর দিয়েছেন। দুনিয়ায় তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে একেবারেই মর্যাদাহীন ও সৃষ্টির অধম এবং আখেরাতে তারা হবে জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা।
(৭) إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُوْلَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির সেরা’।
অর্থাৎ ঈমান ও আমলে ছালেহ যার মধ্যে একত্রিতভাবে পাওয়া যাবে, সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকটে সৃষ্টির সেরা। শুধুমাত্র বিশ্বাস বা শুধুমাত্র সৎকর্ম শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। এ আয়াতের উপরে ভিত্তি করে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ও একদল বিদ্বান মুমিনদের মর্যাদা ফেরেশতাদের উপরে নির্ধারণ করেছেন (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
‘ঈমান’ অর্থ একমাত্র উপাস্য হিসাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্ব করা ও তাঁর সাথে কাউকে শরীক বা তুলনীয় মনে না করা। রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষনবী ও সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তদাতা হিসাবে বিশ্বাস করা এবং তাঁর সাথে কোন ব্যক্তিকে শরীক বা তুলনীয় মনে না করা। ‘আমলে ছালেহ’ অর্থ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুমোদিত নেক আমল এবং তার আলোকে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহ। যারা এটা করেন, তারাই হ’লেন সৃষ্টির সেরা মানুষ। বিশ্বাস ও কর্মগত এই পার্থক্যের কারণেই মুমিন ও কাফিরের মধ্যে বিয়ে-শাদী ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী আয়াতে কাফিরদের নিকৃষ্ট অবস্থান বর্ণনার পর অত্র আয়াতে তার বিপরীতে মুমিনদের সর্বোচ্চ অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে।
(৮) جَزَاؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيهَا أَبَداً رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ - ‘তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তার উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’।
অত্র আয়াতে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের পরকালীন পুরস্কারের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাদেরকে পরকালে ‘জান্নাতে আদন’ প্রতিদান হিসাবে দেওয়া হবে। عَدْنٍ অর্থ الإقامة বা বসবাস। عَدَنَ يَعْدِنُ عَدْنًا عُدُوْنًا অর্থ أَقَامَ ‘বসবাস করা’। যেখান থেকে এসেছে مَعْدِنٌ অর্থ খনি। মুফাসসিরগণ বলেন, ‘আদন’ হ’ল بُطْنَانُ الْجَنَّةِ ‘বাগিচার মধ্যস্থল’ (কুরতুবী)। মূলতঃ ‘আদন’ একটি জান্নাতের নাম, যা অন্যান্য জান্নাত থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। যা কেবল আল্লাহর ইলমে রয়েছে।
خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَداً ‘যেখানে তারা অনন্তকাল ধরে বসবাস করবে’। যার কোন বিরতি হবে না বা সেখানে তাদের মৃত্যু হবে না।
رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ - ‘আল্লাহ তাদের উপরে সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপর সন্তুষ্ট’। অর্থাৎ আল্লাহ তাদের আমলের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তারাও তাদের আমলের কল্পনাতীত প্রতিদান পেয়ে আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট হয়েছে।
ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ ‘এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’।
الخوف والخشية অর্থ ভয়। তবে الخوف অর্থ ‘সাধারণ ভয়’ এবং الخشية অর্থ ‘বিশেষ ভয়’ যার শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকে। এখানে আল্লাহভীতিকে সেই অর্থে আনা হয়েছে। যার ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে। আর এই ভীতিই হ’ল ‘প্রকৃত সৌভাগ্যের উৎস’ ( مَلاَكُ السعادةِ الحقيقية )।
خَشِيَ অর্থ خاف الله فى السر والعلانية فتناهى عن المعاصى ‘গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করে। অতঃপর পাপ সমূহ থেকে বিরত হয়’। সে ভয় করে আল্লাহ কৃত ফরয সমূহ পালনের মাধ্যমে এবং তাঁর নিষেধ সমূহ বর্জনের মাধ্যমে। এই ভয়টা কেমন সে সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের সামনে আল্লাহর কথা বলা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। অতঃপর যখন আল্লাহর আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী সম্বলিত সামঞ্জস্যপূর্ণ কিতাব নাযিল করেছেন, যা বারবার পঠিত হয়। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের গাত্রচর্ম ভয়ে শিহরিত হয়। অতঃপর তাদের দেহ ও মন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে’ (যুমার ৩৯/২৩)। অতএব শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ইবাদত সমূহের নাম তাক্বওয়া নয়, বরং হৃদয়ের আল্লাহভীতিই হ’ল প্রকৃত তাক্বওয়া। যা আল্লাহ দেখে থাকেন।
জান্নাতীদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى - ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করে ও প্রবৃত্তিপরায়ণতা হ’তে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৪০-৪১)। সে আল্লাহ প্রেরিত শরী‘আত অনুযায়ী ইবাদত করে এমনভাবে যেন সে আল্লাহকে দেখছে। আর যদি তা না পারে, তবে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই দেখছেন। যেমন হাদীছে জিব্রীলে এসেছে, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ - ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তুমি তাকে দেখছ। আর যদি তা না পার, তাহ’লে (বিশ্বাস রাখো যে,) তিনি তোমাকে দেখছেন’।[5] আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيْزِ الرَّحِيْمِ، الَّذِيْ يَرَاكَ حِيْنَ تَقُوْمُ، وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِيْنَ، إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ - ‘তুমি ভরসা কর মহাপরাক্রান্ত পরম দয়াময়ের উপরে’। ‘যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি ছালাতে দন্ডায়মান হও’। ‘এবং মুছল্লীদের সাথে উঠাবসা কর’। ‘নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (শো‘আরা ২৬/২১৭-২০)। বস্ত্ততঃ তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতিই হ’ল সবকিছুর মূল। জান্নাত কেবল তাদেরই ঠিকানা হবে। اللهم اجعلنا منهم ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তাদের মধ্যে শামিল কর! আমীন!!
সারকথা :
সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা এবং সকল ব্যাপারে যথার্থভাবে তাঁকে ভয় করার মাধ্যমেই আল্লাহর রেযামন্দী হাছিল করা সম্ভব।
[1]. বুখারী হা/৪৯৫৯, মুসলিম হা/৭৯৯; মিশকাত হা/২১৯৬।
(৫) অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন।
(৮) তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে।
অত্র সূরায় দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে : (১) ইহুদী-নাছারা ও মুশরিকদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য (১-৫ আয়াত)। (২) কাফির-মুশরিকদের শাস্তি ও ঈমানদারগণের পুরস্কার (৬-৮ আয়াত)।
গুরুত্ব :
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উবাই ইবনে কা‘বকে বললেন, إِنَّ اللهَ أَمَرَنِىْ أَنْ أَقْرَأَ عَلَيْكَ ( لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَرُوْا ) قَالَ وَسَمَّانِىْ لَكَ؟ قَالَ « نَعَمْ » فَبَكَى - ‘আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমার উপরে সূরা বাইয়েনাহ পাঠ করি। উবাই বললেন, আল্লাহ আপনার নিকটে আমার নাম বলেছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন উবাই (খুশীতে) কাঁদতে লাগলেন’।[1]
ইমাম কুরতুবী বলেন, এর মধ্যে ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের শিক্ষাদানের তাৎপর্যগত বিষয়টি ( فقه ) ফুটে ওঠে। অন্য একজন বিদ্বান বলেন, এর মধ্যে এই শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, যেন কেউ নিম্নস্তরের কাউকে শিক্ষাদানে কুণ্ঠাবোধ না করে। উল্লেখ্য যে, উবাই ইবনে কা‘ব ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চারণ পদ্ধতি দ্রুত ধারণে সক্ষম ছাহাবী (কুরতুবী)। সেকারণ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে সূরাটি শুনালেন। যাতে তিনি হুবহু অন্যকে শিখাতে পারেন। অত্র হাদীছে সূরাটির গুরুত্বের সাথে সাথে উবাই ইবনে কা‘বের উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে এই মর্মে যে, আল্লাহর মহান দরবারে তার নামটি বাছাই করা হয়েছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
তাফসীর :
(১) لَمْ يَكُنِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ مُنْفَكِّيْنَ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ الْبَيِّنَةُ ‘আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে এবং মুশরিকরা (তাদের মূর্খতা হ’তে) বিরত হ’ত না, যতক্ষণ না তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হয়’।
ইবনু কাছীর বলেন, আহলে কিতাব অর্থ আরব ও আজমের ইহুদী-নাছারাগণ এবং মুশরিক অর্থ মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসকগণ’ (ইবনু কাছীর)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এখানে আহলে কিতাব বলে মদীনার ইহুদী গোত্র বনু নাযীর, বনু কুরায়যা ও বনু কায়নুকা বুঝানো হয়েছে এবং মুশরিকগণ বলতে মদীনা ও মক্কার এবং আশপাশের মুশরিক সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)। তবে ‘মুশরিক’ অর্থ আহলে কিতাবও হ’তে পারে। কেননা তারা তাওহীদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং আল্লাহর কিতাব থেকে তারা কোন ফায়েদা হাছিল করেনি। যেমন আজকালকের মুসলমানদের অবস্থা।
مُنْفَكِّيْنَ অর্থ منتهين عن كفرهم ومائلين عنه ‘কুফরী থেকে বিরত এবং তা থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারীগণ’। مُنْفَكِّيْنَ অর্থ تاركين ‘পরিত্যাগকারী’ হ’তে পারে। অর্থাৎ যখন রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে এলেন, তখন তারা তাঁকে পরিত্যাগ করল। যেমন আল্লাহ বলেন, فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ فَلَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَافِرِيْنَ ‘অতঃপর যখন তাদের নিকট সেই পরিচিত বস্ত্ত (কুরআন বা মুহাম্মাদ) আসল, তখন তারা তাকে অস্বীকার করল। অতএব কাফিরদের উপর আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হৌক’ (বাক্বারাহ ২/৮৯; কুরতুবী)।
ইহুদীদের অনেকে ওযায়ের (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলত। নাছারাদের অনেকে ঈসা (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলত (তওবা ৯/৩০)। কেউ খোদ ঈসা ও তার মাকে ‘উপাস্য’ বলত (মায়েদাহ ৫/১১৬)। কেউ ঈসাকে ‘তিন উপাস্যের অন্যতম’ বলত (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তারা তাদের পীর-আউলিয়াদেরকে ‘রব’-এর আসনে বসিয়েছিল (তওবা ৯/৩১)। ফলে আল্লাহ প্রেরিত কিতাব তওরাত ও ইনজীলের অনুসারী হওয়ার দাবীদার হ’লেও তারা তাওহীদ তথা একত্ববাদ থেকে বহু দূরে ছিটকে পড়েছিল। বিভিন্ন শয়তানী যুক্তি দিয়ে তারা তাদের কপোলকল্পিত এসব শিরকী আক্বীদা-বিশ্বাস ও রেওয়াজকে টিকিয়ে রেখেছিল। তওরাত ও ইনজীলকে তারা বিকৃত করে ফেলেছিল (বাক্বারাহ ২/৭৫-৭৯)। ফলে এমন সত্যগ্রন্থ তাদের সামনে ছিল না, যা তাদেরকে ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে বিরত রাখতে পারে। অবশেষে যখন কুরআন নাযিল হ’তে লাগলো, তখন তাদের অনেকে কুফরী বিশ্বাস থেকে বিরত হ’ল এবং ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’ল। প্রখ্যাত ইহুদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের প্রথম দিনেই ইসলাম কবুল করেন। পরবর্তীতে ত্বাঈ গোত্রের খ্রিষ্টান নেতা ‘আদী বিন হাতেম, আবদুল ক্বায়েস গোত্রের খ্রিষ্টান নেতা জারূদ ইবনুল ‘আলা আল-‘আবদী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ইসলাম কবুল করেন।
পক্ষান্তরে মক্কা-মদীনা ও তার আশপাশের মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসক মুশরিকদের কাছে কোন ইলাহী কিতাব ছিল না। তাদের সব কিছু রীতি-নীতি ছিল সমাজনেতাদের মনগড়া এবং তা ছিল পুরোদস্ত্তর শোষণমূলক। তবুও বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রসম-রেওয়াজের প্রতি তাদের ছিল একটা অন্ধ আবেগ, যা ছাড়তে তারা প্রস্ত্তত ছিল না। কিন্তু কুরআনের স্পষ্ট সত্যের আলো বিকশিত হওয়ার পর তাদের অনেকের ঘোর কেটে যায় এবং তারা ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। যদিও এর জন্য তাদের অনেককে চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয়। হারাতে হয় ঘর-বাড়ি, জন্মস্থান এমনকি জীবন। এটা কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাব যুগেই নয়, বরং পরবর্তী যুগেও মানুষ সর্বদা অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে এসেছে এবং আসতে থাকবে। আর সাথে সাথে অন্ধকারের কীটেরা তাদের উপর নির্যাতন চালাবে। কেননা কুরআন আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ গ্রন্থ। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তা মানুষকে আলোর পথে ডাকবে ও সর্বদা মানুষ আলোর পথে আসবে।
حَتَّى تَأْتِيَهُمُ الْبَيِّنَةُ - ‘যতক্ষণ না তাদের কাছ সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হয়’। অর্থাৎ কুরআন ও তার বাহক রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যেকথা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
(২) رَسُوْلٌ مِّنَ اللهِ يَتْلُوْ صُحُفاً مُّطَهَّرَةً ‘তিনি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত একজন রাসূল, যিনি আবৃত্তি করেন পবিত্র পত্রসমূহ’।
অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হ’তে সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসাবে তাদের নিকটে আগমন করেন রাসূল, যিনি তাদের নিকট তেলাওয়াত করেন পবিত্র কুরআন। এখানে رَسُوْلٌ অর্থ মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যাজ্জাজ বলেন, رَسُوْلٌ এখানে পূর্বের আয়াতে বর্ণিত اَلْبَيِّنَةُ হ’তে ‘বদল’ হওয়াতে مرفوع বা পেশযুক্ত হয়েছে (কুরতুবী)। نكرة বা অনির্দিষ্টবাচক শব্দ ব্যবহার করে রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা বুঝানো হয়েছে। مِنَ اللهِ ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে’ বলার মাধ্যমে তাঁর সম্মানকে আরও উন্নীত করা হয়েছে। সাথে সাথে সন্দেহবাদীদের মোক্ষম জবাব দেওয়া হয়েছে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন, وَأَرْسَلْنَاكَ لِلنَّاسِ رَسُولاً وَكَفَى بِاللهِ شَهِيْدًا ‘আমরা তোমাকে মানবজাতির জন্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (নিসা ৪/৭৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُوْنَ لِلْعَالَمِيْنَ نَذِيْرًا ‘বরকতময় তিনি যিনি স্বীয় বান্দার (মুহাম্মাদের) উপর ফুরক্বান (কুরআন) নাযিল করেছেন। যাতে তিনি বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হ’তে পারেন’ (ফুরক্বান ২৫/১)। এই বান্দা নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। যিনি মানুষের মধ্যে হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী’।[2] যিনি আল্লাহর নিকট থেকে জিব্রীলের মাধ্যমে অহিপ্রাপ্ত হয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৯৭)।
تَلاَ يَتْلُوْ تِلاَوَةً অর্থ আবৃত্তি করা। এজন্য কুরআন পাঠ করাকে তেলাওয়াত করা বলা হয়। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ‘যখন আমরা কুরআন পাঠ করি, তখন তুমি উক্ত পাঠের অনুসরণ কর’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৮)। ‘তেলাওয়াত’ পরিভাষাটি কুরআনের সঙ্গে খাছ। যা হুবহু মুছহাফে উছমানীর আবৃত্তি হবে, অন্য কোন ক্বিরাআতের নয়। যেমন আলোচ্য আয়াতে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর ক্বিরাআত হ’ল - لَمْ يَكُنِ الْمُشْركُوْنَ وأهْلُ الْكِتَابِ مُنْفَكِّيْنَ ইবনুল ‘আরাবী বলেন, وهى جائزة فى مَعرِض البيان لا فى معرض الةلاوة ‘এটি তাফসীরের ক্ষেত্রে বলা জায়েয, তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে নয়’ (কুরতুবী)। কেননা তেলাওয়াত বলতে সেটাই বুঝাবে যা হবে কুরায়শী ক্বিরাআত এবং যে ক্বিরাআতের উপরে ইজমায়ে ছাহাবা হয়েছে এবং যা মুছহাফে ওছমানী হিসাবে এককভাবে মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত হয়েছে। অন্য কিছু পাঠ করাকে ‘তেলাওয়াত’ বলা যাবে না। বললে সেটা হবে কুরআনের সাথে চরম বেআদবী।
صُحُفاً مُّطَهَّرَةً ‘পবিত্র পত্রসমূহ’। অর্থাৎ কুরআন, যা থেকে তিনি পাঠ করে শুনাতেন। যা ‘লওহে মাহফূযে’ অর্থাৎ আল্লাহর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে ‘সুরক্ষিত ফলকে’ লিপিবদ্ধ ছিল (বুরূজ ৮৫/২১-২২, ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭৭-৭৮)। অন্যত্র এর ব্যাখ্যা এসেছে এভাবে, فِيْ صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ، مَّرْفُوْعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ، بِأَيْدِيْ سَفَرَةٍ، كِرَامٍ بَرَرَةٍ - ‘এটা লিখিত আছে সম্মানিত পত্রসমূহে’। ‘যা উচ্চ ও পবিত্র ’। ‘যা লিখিত হয়েছে লিপিকারগণের হাতে’। ‘যারা মহান ও পূত-চরিত্র’ (‘আবাসা ৮০/১৩-১৬)।
مُّطَهَّرَةٍ বা ‘পবিত্র’ অর্থ, مبرأة من الزور والكذب والباطل ‘যা বানোয়াট, মিথ্যা ও বাতিল হ’তে মুক্ত’। منقاة من الشرك ‘যা সকল প্রকার শিরক হ’তে মুক্ত ونزيهة من الرذائل এবং ‘অশ্লীলতা হ’তে পবিত্র’। صُحُفٌ একবচনে صَحِيْفَةٌ অর্থ লেখার পাত্র। এখানে ফলক বা কাগজ বুঝানো হয়নি। বরং লিখিত বস্ত্ত বুঝানো হয়েছে। কুরআন প্রথমে রাসূল (ছাঃ)-এর হৃদয়ে প্রক্ষিপ্ত হ’ত (বাক্বারাহ ২/৯৭)। সেখান থেকে তিনি মুখে পাঠ করে শুনাতেন। লিখিত কুরআন দেখে তিনি তেলাওয়াত করতেন না। কেননা তিনি উম্মী ছিলেন। না কিছু দেখে পড়তে পারতেন, না লিখতে পারতেন (কুরতুবী)। ফলে এখানে صُحُفاً مُّطَهَّرَةً বা ‘পবিত্র পত্রসমূহ’ বলতে রাসূল (ছাঃ)-এর হৃদয়পটে অংকিত কুরআনের বাণীসমূহ বুঝানো হয়েছে। যা সকল প্রকার মিথ্যা ও ত্রুটিসমূহ হ’তে পবিত্র। আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ ‘সামনে বা পিছন থেকে এতে কোন মিথ্যা প্রবেশ করে না। এটি প্রজ্ঞাময় ও মহা প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪২)।
(৩) فِيْهَا كُتُبٌ قَيِّمَةٌ ‘যাতে রয়েছে সরল বিধান সমূহ’। كُتُبٌ অর্থ مَكْتُوْبٌ ‘লিখিত বস্ত্ত’। সে হিসাবে كُتُبٌ ও صُحُفٌ সমার্থবোধক। এখানে كُتُبٌ অর্থ أحكام ‘বিধান সমূহ’ (কুরতুবী)।
قَيِّمَةٌ অর্থ مستقيمة ناطقة بالحق ‘সরল ও সত্য বর্ণনাকারী’ (তানতাভী)। ইবনু জারীর বলেন, عادلة مستقيمة ليس فيها خطأ ‘ন্যায়পূর্ণ ও সরল বাক্য, যাতে কোন ভুল নেই’। এর অর্থ হ’তে পারে محكمة অর্থাৎ ‘বিধান সম্বলিত’। যেমন আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِيْ أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ - ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমার উপরে কিতাব নাযিল করেছেন, যার মধ্যে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট বিধান সম্বলিত। আর এগুলিই হ’ল কিতাবের মূল অংশ’ (আলে ইমরান ৩/৭)। অর্থাৎ রাসূল তাদের নিকটে এমন কিতাব থেকে আবৃত্তি করে শুনান, যা স্পষ্ট বিধানসমূহ দ্বারা সমৃদ্ধ।
(৪) وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِيْنَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ ‘আর কিতাবধারীরা বিভক্ত হয়েছে তাদের নিকটে সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হওয়ার পরেই’।
অর্থাৎ শেষনবীর আগমনের ব্যাপারে তারা ইতিপূর্বে সবাই একমত ছিল এবং তাঁর আগমনের অপেক্ষায় উন্মুখ ছিল। কেননা কিতাবধারী ইহুদী-নাছারাগণ তাদের কিতাবে লিখিত শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শুভাগমনের বিষয়ে আগে থেকেই জানতো। যেমন আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ ‘(কল্যাণ তাদেরই প্রাপ্য) যারা সেই নিরক্ষর রাসূলের অনুসরণ করে চলে, যাঁর কথা তারা তাদের নিকটে রক্ষিত তওরাত ও ইনজীলে লিখিত পেয়ে থাকে’ ... (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। এতদ্ব্যতীত বনু ইসরাঈলের সর্বশেষ নবী হযরত ঈসা (আঃ) স্বীয় উম্মতকে এ বিষয়ে আগাম সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ عِيٍْسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ إِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّراً بِرَسُوْلٍ يَّأْتِيْ مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ - ‘আর স্মরণ কর যখন মারিয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে ইস্রাঈল সন্তানগণ। আমি তোমাদের নিকটে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আসবেন। যার নাম হবে আহমাদ’ (ছফ ৬১/৬)।
বস্ত্ততঃ এই সুসংবাদের কারণেই বায়তুল মুক্বাদ্দাস এলাকা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর বহু ইহুদী মদীনায় এসে আগাম বসবাস শুরু করে দেয় ও নিজেদের হিব্রু ভাষা ত্যাগ করে আরবী ভাষা শিখে নেয়। যাতে শেষনবীর আবির্ভাবের সাথে সাথে তারা সবার আগে তাকে বরণ করে নিতে পারে। দেখা গেল যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় আগমনের সাথে সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের মত ইহুদীদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা ও বিজ্ঞ আলেম ইসলাম কবুল করলেন। কিন্তু বাকী দুনিয়াদার ইহুদী সমাজপতিরা যখন দেখল যে, মুহাজির ও আনছাররা ইসলাম কবুল করে আগেই তার ছাহাবী হয়ে গেছেন, সেখানে তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হয়ত খাটবে না, ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিল এবং অজুহাত তুলল যে, শেষনবী আসবেন ইসহাকের বংশে। কিন্তু ইনি তো ইসমাঈলের বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল তাদের মনগড়া অজুহাত মাত্র। যার কোনই ভিত্তি ছিল না। বরং তারা শেষনবীকে ঠিকই চিনেছিল যেভাবে তাদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, اَلَّذِيْنَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُوْنَهُ كَمَا يَعْرِفُوْنَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيْقاً مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُوْنَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ ‘যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছিলাম (অর্থাৎ ইহুদী-নাছারাগণ) তাকে চিনে, যেমন তারা চিনে তাদের সন্তানদের। অথচ তাদের একটি দল জেনে-শুনে সত্য গোপন করে’ (বাক্বারাহ ২/১৪৬)।
এভাবেই তারা কেউ ঈমান আনে ও কেউ কুফরী করে বিভক্ত হয়ে যায়। আর এটা ছিল স্রেফ তাদের যিদ ও হঠকারিতা মাত্র। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا تَفَرَّقُوْا إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْياً بَيْنَهُمْ ‘তাদের কাছে ইলম (কুরআন) এসে যাওয়ার পরেই তারা বিভক্ত হয়ে যায় পরস্পরে হঠকারিতার কারণে’ (শূরা ৪২/১৪)। বস্ত্ততঃ ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তাদের মতভেদের কারণই ছিল তাদের হঠকারিতা। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلاَمُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম ধর্ম। আর কিতাবধারীরা এটি গ্রহণে আপোষে মতভেদ করেছে তাদের নিকট ইলম (কুরআন) এসে যাওয়ার পর পরস্পরে হঠকারিতা বশে’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। মুসলিম উম্মাহকে এ বিষয়ে সাবধান করে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُوْنُواْ كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُوْلَـئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ - ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ এসে যাওয়ার পরেও পরস্পরে মতভেদ করেছে। ওদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)।
কিন্তু দুর্ভাগ্য মুসলমানের! তারা আল্লাহর সাবধানবাণীকে অগ্রাহ্য করে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে শত দলে বিভক্ত হয়েছে ও আপোষে হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে তাদের উপর দুনিয়াতেই আল্লাহর গযব নেমে এসেছে। ইসলামী খেলাফত হারানোর মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক ঐক্য ধ্বংস হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে তারা দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এখন তারা ইহুদী-নাছারা ও কুফরী শক্তির লেজুড়বৃত্তির মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে ফিরছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِىْ مَا أَتَى عَلَى بَنِى إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ ‘আমার উম্মতের অবস্থা বনু ইস্রাঈলের মতই হবে এক জোড়া জুতার পারস্পরিক সামঞ্জস্যের ন্যায়। বনু ইস্রাঈল ৭২ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে একটি ফের্কা ব্যতীত। লোকেরা বলল, তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِىْ ‘যে তরীকার উপর আমি ও আমার ছাহাবীগণ আছি’। হাকেম-এর বর্ণনায় এসেছে الْيَوْمَ ‘আজকের দিনে’।[3] মোটকথা স্রেফ যিদ ও হঠকারিতা বশে ইহুদী-নাছারাগণ সেদিন কুরআন ও তার বাহক শেষনবী মু হাম্মাদ (ছাঃ)-কে অস্বীকার করেছিল। আজও তাদের সে অবস্থার তেমন কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।
(৫) وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ - ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন’।
অর্থাৎ ইহুদী-নাছারাদের মূল কিতাবে তাওহীদের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার বিপরীতে তারা শিরকে লিপ্ত হয়েছে। যেমন অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পীর-আউলিয়া ও মরিয়ম-তনয় মসীহ ঈসাকে রব-এর আসনে বসিয়েছে। অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তারা যেসব বস্ত্তকে শরীক সাব্যস্ত করে, সেসব থেকে তিনি পবিত্র’ (তওবা ৯/৩১)।
مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ অর্থ ইবাদতকে আল্লাহর জন্য খালেছ করা। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, قُلْ إِنِّيْ أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّيْنَ ‘তুমি বল যে, আমি আদিষ্ট হয়েছি খালেছ আনুগত্য সহকারে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য’ (যুমার ৩৯/১১)। ইমাম কুরতুবী বলেন, এই আয়াতের মধ্যে দলীল রয়েছে আল্লাহর ইবাদত সমূহে ‘নিয়ত’ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে। কেননা ইখলাছ হ’ল কলবের আমল, যা দ্বারা কেবল আল্লাহর চেহারা অন্বেষণ করা হয়, অন্যের নয়’। আর যা না হ’লে বান্দার কোন আমল কবুল হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[4] আল্লাহ কেবল مُخْلَصًا অর্থাৎ খালেছ বলেই ক্ষান্ত হননি। বরং حُنَفَاءُ শব্দ উল্লেখ করেছেন। যার অর্থ مائلين عن الأديان كلها إلى دين الإسلام خاصة - ‘সকল দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নির্দিষ্টভাবে কেবল ইসলামের দিকে রুজু হওয়া’। যেমন ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন, إِنِّيْ وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيْفاً وَّمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ - ‘আমি আমার চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে ফিরিয়ে দিলাম সেই সত্তার দিকে, যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (আন‘আম ৬/৭৯)। অন্যত্র তাওহীদের ব্যাখ্যা আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। যেমন وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوْتَ - ‘আমরা প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর কাছে রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত হ’তে বিরত থাকো’ (নাহল ১৬/৩৬)।
এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, إِنَّ الْعِبَادَةَ لاَ تَحْصُلُ إِلاَّ بِالْكُفْرِ بِالطَّاغُوْتِ ‘ত্বাগূতকে অস্বীকার করা ব্যতীত ইবাদত হাছিল হওয়া সম্ভব নয়’ এবং তাওহীদ ও শিরকের জগাখিচুড়ী আল্লাহর নিকটে কখনোই কবুলযোগ্য নয়। আর ত্বাগূত হ’ল, كل معبود من دون الله كالشيطان والكاهن والصنم وكل من دعا الى الضلال ‘আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্য। যেমন শয়তান, গণৎকার, মূর্তি এবং ঐ সকল বস্ত্ত যা মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করে’ (কুরতুবী)। পারিভাষিক অর্থে, الطَّاغُوْتُ أَن يَّتَحَاكَمَ الرَّجُلُ اِلَى مَا سِوَى الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ مِنَ الْبَاطِلِ ‘কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে যে বাতিলের নিকট ফায়ছালা নিয়ে যাওয়া হয়, সেটাই হ’ল ত্বাগূত’ (ইবনু কাছীর -মর্মার্থ)।
وَيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ‘এবং তারা ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে’।
অর্থাৎ খালেছ আনুগত্য সহকারে এবং একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করার সাথে সাথে ছালাত ও যাকাত আদায় করবে। এখানে তিনটি আমল একত্রে বলা হয়েছে। এক- নিয়তকে আল্লাহর জন্য খালেছ করা, যা হ’ল কলবের আমল। দুই- ছালাত কায়েম করা, যা হ’ল দৈহিক আমল এবং তিন- যাকাত আদায় করা, যা হ’ল আর্থিক আমল। তিনটিকেই একত্রে ইবাদত বলা হয়েছে। যাকে ইবাদতে ক্বালবী, ইবাদতে বদনী ও ইবাদতে মালী বলা যেতে পারে। ইমাম যুহরী, ইমাম শাফেঈ প্রমুখ বিদ্বানগণ এ আয়াত থেকে দলীল নিয়েছেন এই মর্মে যে, ‘আমল ঈমানের অংশ’ (ইবনু কাছীর)।
‘ছালাত কায়েম করা’ অর্থ ছালাত ওয়াক্ত মোতাবেক আদায় করা এবং তার ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত সমূহের যথাযথ হেফাযত করা। ইবনু কাছীর বলেন, ছালাত হ’ল দৈহিক ইবাদত সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ( أشرف عبادات البدن )।
‘যাকাত আদায় করা’ অর্থ হকদারগণের নিকট যথার্থভাবে পৌঁছে দেওয়া (কুরতুবী)। যাকাত হ’ল আর্থিক ইবাদত সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যা ফকীর-মিসকীনদের প্রতি দয়ার গ্যারান্টি। ইবনু কাছীর বলেন, যাকাত হ’ল দরিদ্র ও মুখাপেক্ষীদের প্রতি দয়াশীলতা ( الإحسان الى الفقراء والمحاويج )।
অর্থাৎ শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস এবং ছালাত ও যাকাত যথাযথভাবে আদায় করাটাই হ’ল প্রকৃত দ্বীন ও সরল পথ। যাতে কোন মিথ্যা ও বক্রতা নেই।
(৬) إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أُوْلَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ - ‘আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরী করে এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে চিরকাল থাকবে। এরা হ’ল সৃষ্টির অধম’।
যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللهِ الَّذِيْنَ كَفَرُوا فَهُمْ لاَ يُؤْمِنُوْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই যারা কুফরী করে। অতঃপর তারা ঈমান আনে না’ (আনফাল ৮/৫৫)।
অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ কাফেরদের দুনিয়া ও আখেরাতের অবস্থান সম্পর্কে খবর দিয়েছেন। দুনিয়ায় তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে একেবারেই মর্যাদাহীন ও সৃষ্টির অধম এবং আখেরাতে তারা হবে জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা।
(৭) إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُوْلَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির সেরা’।
অর্থাৎ ঈমান ও আমলে ছালেহ যার মধ্যে একত্রিতভাবে পাওয়া যাবে, সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকটে সৃষ্টির সেরা। শুধুমাত্র বিশ্বাস বা শুধুমাত্র সৎকর্ম শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। এ আয়াতের উপরে ভিত্তি করে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ও একদল বিদ্বান মুমিনদের মর্যাদা ফেরেশতাদের উপরে নির্ধারণ করেছেন (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
‘ঈমান’ অর্থ একমাত্র উপাস্য হিসাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্ব করা ও তাঁর সাথে কাউকে শরীক বা তুলনীয় মনে না করা। রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষনবী ও সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তদাতা হিসাবে বিশ্বাস করা এবং তাঁর সাথে কোন ব্যক্তিকে শরীক বা তুলনীয় মনে না করা। ‘আমলে ছালেহ’ অর্থ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুমোদিত নেক আমল এবং তার আলোকে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহ। যারা এটা করেন, তারাই হ’লেন সৃষ্টির সেরা মানুষ। বিশ্বাস ও কর্মগত এই পার্থক্যের কারণেই মুমিন ও কাফিরের মধ্যে বিয়ে-শাদী ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী আয়াতে কাফিরদের নিকৃষ্ট অবস্থান বর্ণনার পর অত্র আয়াতে তার বিপরীতে মুমিনদের সর্বোচ্চ অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে।
(৮) جَزَاؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيهَا أَبَداً رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ - ‘তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তার উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’।
অত্র আয়াতে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের পরকালীন পুরস্কারের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাদেরকে পরকালে ‘জান্নাতে আদন’ প্রতিদান হিসাবে দেওয়া হবে। عَدْنٍ অর্থ الإقامة বা বসবাস। عَدَنَ يَعْدِنُ عَدْنًا عُدُوْنًا অর্থ أَقَامَ ‘বসবাস করা’। যেখান থেকে এসেছে مَعْدِنٌ অর্থ খনি। মুফাসসিরগণ বলেন, ‘আদন’ হ’ল بُطْنَانُ الْجَنَّةِ ‘বাগিচার মধ্যস্থল’ (কুরতুবী)। মূলতঃ ‘আদন’ একটি জান্নাতের নাম, যা অন্যান্য জান্নাত থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। যা কেবল আল্লাহর ইলমে রয়েছে।
خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَداً ‘যেখানে তারা অনন্তকাল ধরে বসবাস করবে’। যার কোন বিরতি হবে না বা সেখানে তাদের মৃত্যু হবে না।
رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ - ‘আল্লাহ তাদের উপরে সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপর সন্তুষ্ট’। অর্থাৎ আল্লাহ তাদের আমলের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তারাও তাদের আমলের কল্পনাতীত প্রতিদান পেয়ে আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট হয়েছে।
ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ ‘এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’।
الخوف والخشية অর্থ ভয়। তবে الخوف অর্থ ‘সাধারণ ভয়’ এবং الخشية অর্থ ‘বিশেষ ভয়’ যার শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকে। এখানে আল্লাহভীতিকে সেই অর্থে আনা হয়েছে। যার ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে। আর এই ভীতিই হ’ল ‘প্রকৃত সৌভাগ্যের উৎস’ ( مَلاَكُ السعادةِ الحقيقية )।
خَشِيَ অর্থ خاف الله فى السر والعلانية فتناهى عن المعاصى ‘গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করে। অতঃপর পাপ সমূহ থেকে বিরত হয়’। সে ভয় করে আল্লাহ কৃত ফরয সমূহ পালনের মাধ্যমে এবং তাঁর নিষেধ সমূহ বর্জনের মাধ্যমে। এই ভয়টা কেমন সে সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের সামনে আল্লাহর কথা বলা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। অতঃপর যখন আল্লাহর আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী সম্বলিত সামঞ্জস্যপূর্ণ কিতাব নাযিল করেছেন, যা বারবার পঠিত হয়। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের গাত্রচর্ম ভয়ে শিহরিত হয়। অতঃপর তাদের দেহ ও মন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে’ (যুমার ৩৯/২৩)। অতএব শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ইবাদত সমূহের নাম তাক্বওয়া নয়, বরং হৃদয়ের আল্লাহভীতিই হ’ল প্রকৃত তাক্বওয়া। যা আল্লাহ দেখে থাকেন।
জান্নাতীদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى - ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করে ও প্রবৃত্তিপরায়ণতা হ’তে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৪০-৪১)। সে আল্লাহ প্রেরিত শরী‘আত অনুযায়ী ইবাদত করে এমনভাবে যেন সে আল্লাহকে দেখছে। আর যদি তা না পারে, তবে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই দেখছেন। যেমন হাদীছে জিব্রীলে এসেছে, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ - ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তুমি তাকে দেখছ। আর যদি তা না পার, তাহ’লে (বিশ্বাস রাখো যে,) তিনি তোমাকে দেখছেন’।[5] আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيْزِ الرَّحِيْمِ، الَّذِيْ يَرَاكَ حِيْنَ تَقُوْمُ، وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِيْنَ، إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ - ‘তুমি ভরসা কর মহাপরাক্রান্ত পরম দয়াময়ের উপরে’। ‘যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি ছালাতে দন্ডায়মান হও’। ‘এবং মুছল্লীদের সাথে উঠাবসা কর’। ‘নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (শো‘আরা ২৬/২১৭-২০)। বস্ত্ততঃ তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতিই হ’ল সবকিছুর মূল। জান্নাত কেবল তাদেরই ঠিকানা হবে। اللهم اجعلنا منهم ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তাদের মধ্যে শামিল কর! আমীন!!
সারকথা :
সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা এবং সকল ব্যাপারে যথার্থভাবে তাঁকে ভয় করার মাধ্যমেই আল্লাহর রেযামন্দী হাছিল করা সম্ভব।
[1]. বুখারী হা/৪৯৫৯, মুসলিম হা/৭৯৯; মিশকাত হা/২১৯৬।
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।