মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
সূরাটিতে চারটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এক- সমাজের দুর্বল শ্রেণীর জনৈক অন্ধ ব্যক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে জনৈক অহংকারী ও ধনশালী সমাজনেতার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার কারণে রাসূল (ছাঃ)-কে তিরস্কার (১-১০ আয়াত)। দুই- কুরআনের গুরুত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা (১১-১৬ আয়াত)। তিন- অবিশ্বাসীদের ধিক্কার দিয়ে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রতিপালনের ইতিহাস বর্ণনা (১৭-৩২)। চার- অবশেষে তাদের পরিণতি হিসাবে পুনরুত্থান দিবসে কারু প্রফুল্ল বদন ও কারু মসীলিপ্ত চেহারা বর্ণনা (৩৩-৪২)।
শানে নুযূল :
মা আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, অত্র সূরাটি অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম সম্পর্কে (মক্কায়) নাযিল হয়। তিনি কোন একটি বিষয় জানার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক মুশরিক নেতার সাথে কথা বলছিলেন। এভাবে কথার মধ্যে কথা বলায় (অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইবনে উম্মে মাকতূম পীড়াপীড়ি করায়) রাসূল (ছাঃ) বিরক্ত হন এবং তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঐ নেতার প্রতি মনোনিবেশ করেন, যাতে তিনি হেদায়াত প্রাপ্ত হন। তখন অত্র আয়াতসমূহ নাযিল হয়।[1]
উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমের কারণে তিরস্কারমূলক এই স্মরণীয় আয়াতগুলি নাযিল হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে খুবই সমাদর করতেন।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধে গমনকালে তাকে প্রায়ই মদীনার প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। জীবনীকারগণ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদর, ওহোদ, হামরাউল আসাদ ও বিদায় হজ্জ সহ মোট ১৩ বার মদীনা ত্যাগকালে তাকে মদীনার দায়িত্ব দিয়ে যান।[3] বেলাল তাহাজ্জুদ ও সাহারীর আযান দিতেন এবং তিনি ফজরের আযান দিতেন।[4] মূলতঃ এ সবই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে তাকে বিশেষ মর্যাদা দানের ফল। আর এই মর্যাদা দানের কারণ ছিল তার উপলক্ষে সূরার প্রথম আয়াতগুলি নাযিল হওয়া। নিঃসন্দেহে এটি ছিল অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। যতদিন দুনিয়া থাকবে ও কুরআনের পাঠক থাকবে, ততদিন মানুষ অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমের নাম স্মরণ করবে। এই সৌভাগ্য হযরত আবুবকর (তওবা ৯/৪০), আয়েশা (নূর ২৪/১১-২৬) ও যায়েদ বিন হারেছাহ (আহযাব ৩৩/৩৭) ব্যতীত আর কারো হয়নি।
এ ধরনের তিরস্কারমূলক আয়াত আরও কয়েকটি নাযিল হয়েছে বিভিন্ন উপলক্ষে। যেমন- (১) সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) বলেন, সূরা আন‘আম ৫২ আয়াতটি রাসূল (ছাঃ)-এর ছয়জন দরিদ্র ছাহাবী সম্পর্কে নাযিল হয়। যারা সর্বদা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটবর্তী থাকতেন। তারা হলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ, বেলাল, ছোহায়েব, আম্মার, খাববাব ও রাবী নিজে। এতে কুরায়েশ নেতারা বলল, أهؤلاء من الله عليهم من بيننا؟ أفنحن نكون تبعا لهؤلاء হে মুহাম্মাদ! এ লোকগুলিকেই কি আল্লাহ বেছে নিয়ে আপনার উপর অনুগ্রহ করেছেন? আর আমরা এদের অনুগত হব? এদের সরিয়ে দিন। তাহ’লে আমরা আপনার অনুসারী হ’তে পারি। তখন সূরা আন‘আমের ৫২-৫৩ আয়াত নাযিল হয় এবং রাসূল (ছাঃ)-কে একাজে নিষেধ করে বলা হয় যে,
‘তুমি তাদেরকে বিতাড়িত করবে না, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের ইবাদত করে তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য। তাদের কোনকিছুর হিসাব নেবার দায়িত্ব তোমার নয় এবং তোমার কোনকিছুর হিসাব নেবার দায়িত্ব তাদের নয়। এরপরেও যদি তুমি তাদের সরিয়ে দাও, তাহ’লে তুমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। ‘এমনিভাবে আমরা একজনের দ্বারা অপরজনকে পরীক্ষায় নিপতিত করি, যাতে তারা বলে, এদেরকেই কি আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে বেছে নিয়ে অনুগ্রহ করেছেন? অথচ আল্লাহ কি তার কৃতজ্ঞ বান্দাদের সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত নন’?[5]
(২) ইবনু কাছীর বলেন, একই ধরনের ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ সূরা কাহফের ২৮-২৯ আয়াত নাযিল করেন। যেখানে বলা হয়, وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَهُ وَلاَ تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيْدُ زِيْنَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ... ‘তুমি নিজেকে তাদের সাথে ধরে রাখো যারা সকালে ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে আহবান করে তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। তুমি তাদের থেকে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে না পার্থিব জীবনের জৌলুস কামনায়....’।
(৩) মুশরিক নেতাদের মিথ্যারোপ ও নানাবিধ যুলুম ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাসূল (ছাঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম ফল লাভের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিয়ে আল্লাহ সূরা ‘ক্বলম’ ৪৮ আয়াতটি নাযিল করেন। যাতে বলা হয়, فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلاَ تَكُنْ كَصَاحِبِ الْحُوْتِ إِذْ نَادَى وَهُوَ مَكْظُوْمٌ - ‘তুমি তোমার পালনকর্তার আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ কর এবং মাছওয়ালা (ইউনুসের) মত হয়ো না। যখন সে দুঃখভরা মনে প্রার্থনা করেছিল’ (ক্বলম ৬৮/৪৮)। এখানে ইউনুস (আঃ)-এর ঘটনা উল্লেখ করে রাসূল (ছাঃ)-কে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ ইউনুস (আঃ) নিজ কওমকে বারবার দাওয়াত দিয়ে ব্যর্থ হন। অবশেষে ক্ষুব্ধ হয়ে তিন দিনের মধ্যে আল্লাহর গযব আসার ভয় দেখান এবং সম্ভবতঃ নিজ সিদ্ধান্তে এলাকা ছেড়ে চলে যান (আম্বিয়া ২১/৮৭)। এতে আল্লাহ নাখোশ হন এবং তাকে মাছের পেটে কিছু সময়ের জন্য রাখা হয়। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে মাছ তাকে তার এলাকার নিকটবর্তী নদীর কিনারে উগরে দেয়। তিনি সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে দেখেন যে, তারা সবাই তওবা করেছে এবং তার অপেক্ষায় উদ্বেগাকুল হয়ে আছে। ইউনুস (আঃ) তখন নিজের ভুল বুঝতে পারেন।
বলা বাহুল্য, রাসূল (ছাঃ)-কে এইভাবে তিরস্কার ও উপদেশ দানের মধ্যে সমাজ সংস্কারক ঈমানদার নেতৃবৃন্দের জন্য মূল্যবান শিক্ষণীয় বিষয় নিহিত রয়েছে।
তাফসীর :
(১) عَبَسَ وَتَوَلَّى ‘ভ্রুকুঞ্চিত করল ও মুখ ফিরিয়ে নিল’।
عَبَسَ يَعْبِسُ عَبَسًا وَعَبُوْسًا অর্থ كلح بوجهه ‘মুখ বেযার করা’। تَوَلَّى অর্থ أعرض بوجهه ‘মুখ ফিরিয়ে নেয়া’ (কুরতুবী)। এখানে ‘মুখ ফিরিয়ে নিল’ বলতে রাসূল (ছাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু عَبَسْتَ ও تَوَلَّيْتَ ‘মধ্যম পুরুষ’ ব্যবহার না করে ক্রিয়া দু’টিতে নাম পুরুষ ( صيغة غائب ) ব্যবহার করা হয়েছে রাসূল (ছাঃ)-এর মর্যাদার প্রতি খেয়াল রেখে। কেননা কোন সম্মানী ব্যক্তির ত্রুটি নির্দেশ করার জন্য তাকে সরাসরি না বলে ইঙ্গিতে বলাটাই ভদ্র পন্থা।
(২) أَنْ جَآءَهُ الْأَعْمَى ‘এজন্য যে, তার নিকটে একজন অন্ধ লোক এসেছে’।
অর্থ لِأَنْ جَآءَهُ الْأَعْمَى (এজন্য যে, তার নিকটে একজন অন্ধ লোক এসেছে)। এটি বাক্যে مفعول له হয়েছে।
এই অন্ধ লোকটি হলেন প্রসিদ্ধ মুওয়াযযিন ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)। অনেকে তাঁর নাম আমর ( عمرو ) বলেছেন। পিতার নাম ক্বায়েস বিন যায়েদাহ। তবে মায়ের বেটা হিসাবেই তিনি প্রসিদ্ধ। তিনি হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)-এর মামাতো ভাই এবং প্রথম দিকে ইসলাম কবুলকারী মুহাজিরগণের অন্যতম।
(৩) وَمَا يُدْرِيْكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى ‘তুমি কি জানো? সে হয়তো পরিশুদ্ধ হ’ত’।
وَمَا يُدْرِيْكَ অর্থ وَمَا يُعْلِمُكَ ‘কে তোমাকে জানালো’? وَمَا يُدْرِيْكَ ‘অজানা’ অর্থে এবং وَمَا اَدْرَاكَ ‘নিশ্চিতভাবে জানা’ অর্থে আসে। যেমন, وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْقَارِعَةُ ‘তুমি কি জানো করাঘাতকারী কে’? অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে সেটি ক্বিয়ামত। পক্ষান্তরে وَمَا يُدْرِيْكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى অর্থ لعله يتطهر من الجهل والذنوب ‘হয়তো সে অজ্ঞতা ও পাপ থেকে পরিশুদ্ধ হ’ত’। বিষয়টি নিশ্চিত নয়।
এখানে ‘সে’ অর্থ অন্ধব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম। ‘পরিশুদ্ধ হওয়া’ বলতে দ্বীনের আলোকে হৃদয় পরিশুদ্ধ হওয়া বুঝানো হয়েছে। আর হৃদয় পরিশুদ্ধ হ’লে মানুষ গোনাহ থেকে পরিশুদ্ধ হ’তে উদ্বুদ্ধ হয়। পূর্বের আয়াতে নামপুরুষ ব্যবহার করা হয়েছিল সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। অতঃপর বর্তমান আয়াতে সরাসরি মধ্যম পুরুষ ব্যবহার করা হয়েছে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করে। এটা না করে নামবাচক ক্রিয়া ব্যবহার করলে তাঁকে উপেক্ষা করা বুঝাতো। যা রাসূল (ছাঃ)-এর মনঃকষ্টের কারণ হ’ত।
(৪) أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى ‘অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো। অতঃপর সে উপদেশ তার উপকারে আসতো’।
يَذَّكَّرُ অর্থ يتعظ بما تقول ‘তোমার বক্তব্য থেকে সে উপদেশ গ্রহণ করতো’। الذِّكْرَى অর্থ العِظَةُ ‘উপদেশ বা ওয়ায’। যা মানুষকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং দুনিয়ার সংঘাতবিক্ষুব্ধ মানসিক অবস্থা থেকে সাময়িকভাবে হ’লেও মুক্তি দেয়। এর ফলে মানুষ আল্লাহর বিধানসমূহ মানতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং হারাম সমূহ থেকে বিরত হয়। এ কারণেই বলা হয়েছে فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى ‘অতঃপর সে উপদেশ তার উপকার করত’। অবশ্য হৃদয়ে সিলমোহর করা হঠকারী লোকদের কথা স্বতন্ত্র।
অত্র আয়াতদ্বয়ে প্রমাণ রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গায়েব জানতেন না। তিনি কেবল অতটুকুই জানতে পারতেন, যতটুকু তাঁকে ‘অহি’ মারফত জানানো হ’ত। দ্বিতীয়তঃ এ বিষয়েরও প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি ‘অহি’ থেকে কোন কিছুই লুকাতেন না। কেননা যদি তিনি উম্মতের নিকটে অহি-র কোন অংশ গোপন করতেন, তাহ’লে আল্লাহর নিকট থেকে লজ্জা পাওয়ার এই আয়াতগুলি তিনি প্রকাশ করতেন না। ইবনু যায়েদ বলেন, একথা বলা হয়ে থাকে যে, لو أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كتم شيئًا من الوحي كتم هذا عن نفسه ‘যদি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘অহি’ থেকে কিছু লুকাতেন, তাহ’লে এ বিষয়টি নিজে থেকে লুকিয়ে রাখতেন’ (ক্বাসেমী)।
তৃতীয়তঃ ইমাম রাযী বলেন, নবীগণের নিষ্পাপত্বের বিরোধী যারা, তারা এই ঘটনা থেকে দলীল নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে গোনাহগার বানাতে চায়। অথচ এটি আদৌ কোন গোনাহ ছিল না। কেননা অন্ধ ব্যক্তিটি ছিল আগে থেকেই মুসলিম। কথার জবাব পরে দিলেও চলতো। কিন্তু অন্য ব্যক্তিটি ছিল একজন মুশরিক নেতা। তিনি হেদায়াত পেলে তার মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম কবুল করবে, এটাই ছিল তাঁর প্রত্যাশা। এটাতে দোষের কিছুই ছিল না। বরং এর মধ্যেই দ্বীনের কল্যাণ বেশী ছিল। কিন্তু আল্লাহ এটা পসন্দ করেননি। কারণ হেদায়াত কেবল তাঁরই হাতে নিবদ্ধ (ক্বাসেমী)।
চতুর্থতঃ এর মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয় যে, শী‘আদের দাবী ডাহা মিথ্যা। কেননা তারা বলে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলী (রাঃ)-কে যে কুরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন, যাকে ‘মুছহাফে ফাতেমা’ বলা হয়, তা এই কুরআনের চাইতে তিনগুণ বড় এবং বর্তমান কুরআনের একটি হরফও সেখানে নেই’।[6]
পঞ্চমতঃ অত্র আয়াতদ্বয়ে ‘অন্তর পরিশুদ্ধ’ ( يَزَّكَّى ) -কে ‘উপদেশ দানের’ ( يَذَّكَّرُ ) পূর্বে আনা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, উপদেশদাতার সঙ্গলাভ আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য অধিক আবশ্যক। কেননা উপদেশদাতার নিজস্ব আচরণ ও তার চরিত্রমাধুর্য উপদেশ গ্রহিতার হৃদয়ে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করে।
(৫) أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى ‘অথচ যে ব্যক্তি বেপরওয়া’।
اسْتَغْنَى অর্থ اسْتَغْنى بماله وقوته عن سماع القرآن والهداية ‘শক্তি ও ধন-সম্পদের অধিকারী হওয়ার কারণে যে ব্যক্তি কুরআন শ্রবণ ও হেদায়াত লাভ থেকে বেপরওয়া’ (ক্বাসেমী)। যে সমাজনেতার সঙ্গে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অতি মনোযোগ দিয়ে কথা বলছিলেন এবং যার কারণে অন্ধ আগমুতকের দিক থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, সেই ধনী অহংকারী ব্যক্তিটি কে সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকে বলেছেন অলীদ বিন মুগীরাহ। কেউ বলেছেন উমাইয়া বিন খালাফ, কেউ বলেছেন উবাই ইবনে খালাফ, কেউ বলেছেন উৎবা, শায়বাহ প্রমুখ একাধিক কুরায়েশ নেতা (কুরতুবী)।
(৬) فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى ‘তুমি তাকে নিয়েই ব্যস্ত আছো’।
التَصَدِّى অর্থ الإصغاء ‘মনোযোগ দেয়া’। এর মাদ্দাহ হ’ল الصَّدَى অর্থ العطش ‘পিপাসা’। এখানে অর্থ দাঁড়াল - أَمَّا الْغنىُّ فَأَنْتَ تَتَعَرَّضُ لَهُ لَعَلَّهُ يَهْتَدِىْ كَماَ يَتَعَرَّضُ العَطْشَانُ لِلْمَاءِ ‘ধনী ব্যক্তিটি যাতে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়, সেজন্য তুমি তার প্রতি গভীর মনোযোগী হয়েছ, যেমনভাবে তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি পানির প্রতি কাতর হয়’।
(৭) وَمَا عَلَيْكَ أَلاَّ يَزَّكَّى ‘বস্ত্ততঃ ঐ ব্যক্তি পরিশুদ্ধ না হ’লে তাতে তোমার কোন দোষ নেই’।
কেননা হেদায়াতের মালিক তুমি নও (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)। তোমার দায়িত্ব কেবল পৌঁছে দেয়া (শূরা ৪২/৪৮)। এরপর যদি কেউ পরিশুদ্ধ না হয় ও দ্বীন কবুল না করে, তাতে তোমার কোন দোষ হবে না। একথার মধ্যে আলেমগণের জন্য বিশেষ উপদেশ রয়েছে। তারা যেন শাসক ও ধনিক শ্রেণীর প্রতি অধিক মনোযোগী না হন। কেননা এই দু’টি শ্রেণী সাধারণত তাদের দুনিয়াবী স্বার্থের বাইরে কিছুই চিন্তা করতে পারে না। মানুষ এদের আনুগত্য করে কেবল দুনিয়াবী স্বার্থে। পক্ষান্তরে আখেরাতের পথপ্রদর্শক হিসাবে আলেমগণের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ থাকে অন্তরের অন্তঃস্থল হ’তে। দুনিয়াদাররা সর্বদা চায় আলেমগণকে তাদের স্বার্থে কাজে লাগাতে। আলেমরাও চান তাদেরকে হেদায়াত করতে। এটা স্রেফ আহবান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। তার বেশী নয়। তাদের প্রতি অধিক মনোযোগী হ’লে শয়তানী খপপরে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। ফলে ঐ আলেম তার দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই হারাবেন। দুনিয়া বলতে আমরা সম্মান ও মর্যাদাকে বুঝিয়েছি। যা আলেমদের প্রধান সম্বল। কেননা টাকা-পয়সা সাধারণতঃ জাহিলদের বেশী থাকে। পক্ষান্তরে কোন মুত্তাক্বী আলেম দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত হারাতে পারেন না।
(৮-৯) وَأَمَّا مَنْ جَآءَكَ يَسْعَى، وَهُوَ يَخْشَى ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তোমার নিকটে দৌড়ে এল’। ‘এমন অবস্থায় যে সে (আল্লাহকে) ভয় করে’।
যে ব্যক্তি বলতে অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমকে বুঝানো হয়েছে। যিনি দ্বীন শেখার তীব্র ক্ষুধা নিয়ে এবং পূর্ণ আল্লাহভীতি সহকারে দৌড়ে এসেছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে।
(১০) فَأَنْتَ عَنْهُ تَلَهَّى ‘অথচ তুমি তাকে অবজ্ঞা করলে’।
تَلَهَّى অর্থ تُعْرِضُ عَنْهُ بِوَجْهِكَ وتَشْتَغِلُ بِغَيْرِهِ ‘তুমি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে এবং অন্যের দিকে লিপ্ত হলে’। অর্থাৎ আল্লাহ চান দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে। ধনী-গরীব, উঁচু-নীচু কোন ভেদাভেদ করা যাবে না। সকলকে সমভাবে দাওয়াত দেওয়ার পর আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করতে হবে। তিনি যাকে খুশী হেদায়াতের আলোকে আলোকিত করবেন ও যাকে খুশী হেদায়াত থেকে বঞ্চিত করবেন।
অত্র আয়াতগুলিকে গরীবদের প্রতি দাওয়াতের ব্যাপারে অধিক মনোযোগী হওয়ার ও তাদেরকে দাওয়াতের মজলিসে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ধনী-গরীব সকলের প্রতি সমান ব্যবহারের ইসলামী আদব বিধৃত হয়েছে ।
সকলের প্রতি সমভাবে দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-কে তা‘লীম দেওয়ার পর এবার কুরআনের প্রকৃত মর্যাদা ও গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহ বলেন (১১-১৬ আয়াত)।-
(১১) كَلاَّ إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ ‘কখনই না! এটা তো উপদেশবাণী মাত্র’।
كَلاَّ ‘কখনই না’। এটি حرف ردع وزجر অর্থাৎ অস্বীকারকারী ও ধমকি দানকারী অব্যয়। এখানে এর অর্থ لاَ تَفْعَلْ هَكَذَا بَعْدَ الْيَوْمِ ‘আজকের পরে আর কখনো এরূপ করবে না’ (কুরতুবী)। অর্থাৎ দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধনী-গরীব, ছোট-বড় কোন বৈষম্য করবে না। কেননা إِنَّهَا ةَذْكِرَةٌ ‘এটি উপদেশবাণী মাত্র’। এখানে ‘এটি’ বলতে উক্ত তা‘লীম বা এই সূরা অথবা পুরা কুরআন মজীদকে বুঝানো হয়েছে। ةَذْكِرَةٌ স্ত্রীলিঙ্গ এবং কুরআন পুংলিঙ্গ হ’লেও ةَذْكِرَة অন্যত্র ‘কুরআন’ অর্থে এসেছে। যেমন كَلاَّ إِنَّهُ تَذْكِرَةٌ (মুদ্দাছছির ৭৪/৫৪)। কেননা কুরআন সর্বদা মানুষকে তার কল্যাণ বিষয়ে নির্দেশনা দেয় ও অকল্যাণ থেকে সাবধান করে।
(১২) فَمَنْ شَآءَ ذَكَرَهُ ‘অতএব যে চায় উপদেশ গ্রহণ করুক’।
ذَكَرَه অর্থ اتعظ بالقران ‘কুরআন দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করুক’ (কুরতুবী)। ইবনু কাছীর বলেন, فَمَنْ شَاءَ ذَكَرَ اللهَ تَعَالَى فِىْ جَمِيْعِ أُمُوْرِهِ ‘যে ব্যক্তি চায় তার সকল কাজকর্মে আল্লাহকে স্মরণ করুক’। আর আল্লাহকে স্মরণ করা মানেই তাকে ভয় করা, তাঁর বিধান মান্য করা ও অন্যায় থেকে বিরত হওয়া। যে ব্যক্তি মুখে কেবল ‘আল্লাহ’ শব্দে যিকর করে অথবা বিশাল তসবীহ ছড়া হাতে নিয়ে গণনা করে। অথচ অন্তরে আল্লাহকে ভয় করে না, বাস্তবে তাঁর বিধান মানে না ও অন্যায় থেকে বিরত হয় না, সে ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করে না। অত্র আয়াতে বুঝা যায় যে, মানুষ তার কর্মে স্বাধীন। সে ইচ্ছা করলে কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে, ইচ্ছা করলে না-ও পারে। এর মধ্যে অদৃষ্টবাদী জাবরিয়াদের প্রতিবাদ রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ‘তাসবীহমালায় গণনাকারী ব্যক্তি কতই না সুন্দর’ ( نِعْمَ الْمُذَكِّرُ السُّبْحَةَ ) মর্মে বর্ণিত মরফূ হাদীছটি মওযূ বা জাল।[7] অতএব প্রচলিত তাসবীহমালায় বা অন্য কিছু দ্বারা তাসবীহ গণনা করা সুন্নাত বিরোধী আমল। তাছাড়া এতে ‘রিয়া’ অর্থাৎ লোক দেখানোর সম্ভাবনা বেশী থাকে। আর ‘রিয়া’ হ’ল ছোট শিরক’।[8] ফলে তাসবীহ পাঠের সকল নেকী বরবাদ হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। অতএব এগুলি পরিত্যাজ্য।
তাসবীহ দু’হাতে বা বাম হাতে নয়। বরং ডান হাতে গণনা করতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খানাপিনাসহ সকল শুভ ও পবিত্র কাজ ডান হাতে করতেন এবং পায়খানা-পেশাব ও অন্যান্য কাজ বামহাতে করতেন।[9] আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ডান হাতে তাসবীহ গণনা করতে দেখেছি।[10] আর এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, ডান হাতের গণনা কড়ে আঙ্গুল দিয়ে শুরু করতে হয়, বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে নয়। কেননা ডান হাতের ডান পাশ কড়ে আঙ্গুল দিয়েই শুরু হয়েছে এবং এ আঙ্গুল দিয়ে গণনা শুরু করাটাই সহজ ও স্বভাবগত।
অন্যত্র এসেছে, َبلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيْدٌ، فِيْ لَوْحٍ مَّحْفُوْظٍ - ‘বরং সেটি হ’ল মর্যাদাপূর্ণ কুরআন’। ‘যা সুরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ’ (বুরূজ ৮৫/২১-২২)। এতে বুঝা যায় যে, কুরআন বহু পূর্বেই লিখিত। যা বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। উদ্দেশ্য যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়া এবং বিষয়বস্ত্তকে শ্রোতার নিকটে যুক্তিসিদ্ধ করা ও তার হৃদয়ে গ্রথিত করা। আর মানুষের স্বভাব যেহেতু সকল যুগে সমান, সেহেতু কুরআনী সমাধান সকল যুগের জন্য প্রযোজ্য।
(১৫-১৬) بِأَيْدِيْ سَفَرَةٍ، كِرَامٍ بَرَرَةٍ ‘(যা লিখিত হয়েছে) লিপিকার ফেরেশতাগণের হাতে’। ‘যারা উচ্চ সম্মানিত, পূত-চরিত্র’।
‘লিপিকার’ বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে, এ বিষয়ে ইবনু জারীর বলেন, الصحيح أن السفرة الملائكة - ‘সঠিক কথা এই যে, লিপিকারগণ হ’লেন ফেরেশতামন্ডলী’। ইমাম বুখারীও তাই বলেন। ইবনু আববাস ও মুজাহিদ বলেন, اَلسَّفَرَةُ أى الْكَتبَةُ وهُمُ الْمَلاَئِكَةُ الْكِرَامُ الْكَاتِبُوْنَ لِأَعْمَالِ الِْعبَادِ فىِ الْأَسْفَارِ الَّتِىْ هِىَ الكُتُبُ এখানে اَلسَّفَرَةُ অর্থ লেখকগণ। তারা হলেন ঐ সকল সম্মানিত ফেরেশতা, যারা বান্দার আমলনামা লিপিবদ্ধ করেন’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। একবচনে سافر ও سفير মাদ্দাহ السَّفْر السِّفْر দু’টিই হ’তে পারে। সীন যেরযুক্ত হ’লে অর্থ হবে, লেখকগণ। আর যবরযু্ক্ত হ’লে অর্থ হবে, সফরকারীগণ। অর্থাৎ ঐ সকল ফেরেশতা যারা আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে যাতায়াত করেন আল্লাহর হুকুম নিয়ে এবং বান্দাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকেন। এখানে লেখক ফেরেশতামন্ডলী অর্থ হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত, যা ইবনু জারীর বলেছেন।
كِرَامٌ একবচনে كَرِيْمٌ ‘সম্মানিত’ এবং بَرَرَةٌ একবচনে بَارٌّ ‘বিশ্বস্ত’। এক্ষণে كِرَامٍ بَرَرَةٍ অর্থ كِرَامٌ عَلىَ رَبِّهِمْ وَ صَادِقُوْنَ ِللهِ فِىْ أَعْمَالِهَمْ ‘তারা পালনকর্তার নিকটে সম্মানিত এবং কর্মে আল্লাহর নিকটে বিশ্বস্ত’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اَلَّذِىْ يَقْرأُ القُرْآنَ وَهُوَ حاَفِظٌ لَهُ وَ فِىْ رِوَايَةٍ : وَهُوَ ماَهِرٌ بِهِ، مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ ... متفق عليه ‘কুরআন অধ্যয়নকারী হাফেয ও দক্ষ (এবং এর উপর সনিষ্ঠ আমলকারী) মুমিন ব্যক্তি (ক্বিয়ামতের দিন) সম্মানিত ও পূত-পবিত্র ফেরেশতাগণের সাথে থাকবে’।[11]
কুরআনের মর্যাদা ও গুরুত্ব বর্ণনা শেষে অতঃপর আল্লাহ কুরআনে অবিশ্বাসীদের ধিক্কার দিচ্ছেন এবং মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিপালনের ইতিহাস এবং পুনরুত্থান দিবসে কারু প্রফুল্ল বদন ও কারু মসীলিপ্ত চেহারা বর্ণনা করছেন (১৭-৪২)।-
(১৭) قُتِلَ الْإِنْسَانُ مَا أَكْفَرَهُ ‘ধ্বংস হৌক মানুষ! সে কতই না অকৃতজ্ঞ।
কুরআন ও পুনরুত্থানে অবিশ্বাসী মানুষকে ধিক্কার দিয়ে আল্লাহ বলেন, قُتِلَ الْإِنْسَانُ مَا أَكْفَرَهُ অর্থ لُعِنَ الْإنْساَنُ مَا أَشَدُّ كُفْرَهُ ‘মানুষের উপরে লা‘নত! কতই না বড় তার কুফরী’! বিস্ময়কর কিছু বলার সময় আরবরা এভাবে বলে থাকে। যেমন أَخْزَاهُ اللهُ مَا أَظْلَمَهُ ‘আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করুন! কতই না বড় যালেম সে’!
ইবনু জারীর বলেন, এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, أَىُّ شَيْئٍ جَعَلَهُ كَافِرًا ؟ ‘কোন বস্ত্ত তাকে কাফের বানালো’? অর্থাৎ কোন জিনিস তাকে পুনরুত্থানে অবিশ্বাসী হতে প্ররোচিত করলো’? এখানে مَا أَكْفَرَهُ এর মধ্যেকার مَا অব্যয়টি استفهام توبيخ وتعجب ‘ধিক্কার ও বিস্ময়বোধক প্রশ্ন’ অর্থে এসেছে। কেননা প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তিরা কখনো পুনরুত্থান ও পরকালকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করতে পারে না। বস্ত্ততঃ অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভকারী মানুষের সত্তাই (দাহর ৭৬/১) তার মৃত্যু ও পুনরুত্থানের বড় সাক্ষী।
(১৮-১৯) مِنْ أَيِّ شَيْءٍ خَلَقَهُ، مِن نُّطْفَةٍ خَلَقَهُ فَقَدَّرَهُ ‘(সে কি ভেবে দেখে না) কি বস্ত্ত হ’তে (আল্লাহ) তাকে সৃষ্টি করেছেন? ‘শুক্রবিন্দু হ’তে। তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তার তাক্বদীর নির্ধারণ করেছেন’।
অত্র আয়াতগুলিতে মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে, যাতে অবিশ্বাসীরা তা স্মরণ করে ফিরে আসে এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ও অনুগত হয়। আল্লাহ বলেন, অবিশ্বাসীরা কি একথা ভেবে দেখে না যে, কি বস্ত্ত হ’তে আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন? বলেই আল্লাহ জবাব দিচ্ছেন- শুক্রবিন্দু হ’তে।
এখানে قَدَّرَهُ দু’টি অর্থ হ’তে পারে। একটি হ’ল سَوَّاهُ ‘তাকে পরিমিত করেছেন’। অর্থাৎ সুন্দর ও সুঠাম দৈহিক অবয়ব দান করেছেন। আরেকটি হ’ল, তাক্বদীর নির্ধারণ করেছেন। অর্থাৎ মাতৃগর্ভে ১২০ দিন থাকার পর ফেরেশতা এসে তার কপালে চারটি বস্ত্ত লিখে দেন। তার আয়ুষ্কাল, কর্মকান্ড, রিযিক এবং জান্নাতী না জাহান্নামী’। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বলেন, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই তোমাদের কেউ জান্নাতবাসীর ন্যায় আমল করবে, অতঃপর তার নিকটে পৌঁছতে এক হাত বাকী থাকবে, এমন সময় তার উপর তাক্বদীর বিজয়ী হবে এবং সে জাহান্নামবাসীর কর্ম সম্পাদন করবে ও জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অন্যজন জাহান্নামের কর্ম করবে তার নিকটে পৌঁছতে এক হাত বাকী থাকবে। এমন সময় তার উপর তাক্বদীর বিজয়ী হবে এবং সে জান্নাতবাসীর আমল করবে ও জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[12] অত্র হাদীছে তাক্বদীরকে অস্বীকারকারীদের প্রতিবাদ রয়েছে।
মানবশিশুর জন্ম ইতিহাস :
প্রথম মানুষ আদম (আঃ)-কে আল্লাহ সৃষ্টি করেছিলেন মাটির সারাংশ ( سُلاَلَةٍ مِنْ طِينٍ ) থেকে (মুমিনূন ২৩/১২)। অতঃপর আল্লাহর বিধান অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীর মিলনে পৃথিবীতে মানুষের বংশধারা অব্যাহত রয়েছে (নিসা ৪/১)। সন্তান ছেলে বা মেয়ে হওয়াটা পুরুষের শুক্রাণুর উপর নির্ভরশীল। এতে স্ত্রীর কোন ভূমিকা নেই। আল্লাহ বলেন, وَأَنَّهُ خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى- مِنْ نُطْفَةٍ إِذَا تُمْنَى ‘তিনি পুরুষ ও নারী জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেন (পুরুষের) বীর্য থেকে যখন তা (স্ত্রীর জরায়ুতে) নিক্ষেপিত হয়’ (নাজম ৫৩/৪৫-৪৬)। অতএব অধিক কন্যাসন্তান হ’লে স্ত্রীকে দায়ী করার মানসিকতা স্রেফ মূর্খতাসূলভ আচরণ মাত্র। ছেলে হৌক বা মেয়ে হৌক, তাতে স্বামী-স্ত্রীর কিছুই করার নেই। যদিও স্বামীর শুক্রাণু থেকেই সন্তানের বংশ নির্ধারিত হয়ে থাকে। পুরুষের একবারের স্খলিত বীর্যে কয়েক কোটি শুক্রাণু থাকে। যার পরিমাণ প্রতি মিলিলিটারে ২০ থেকে ৪০ মিলিয়ন। যার একটি মাত্র অণু স্ত্রীর ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হ’লেই আল্লাহর হুকুমে সন্তানের ভ্রুণ সৃষ্টি হয়। ঐ শুক্রাণুটি x জাতের হ’লে তাতে কন্যাসন্তান হয়, আর y জাতের হ’লে তাতে পুত্রসন্তান হয়। স্বামীর শুক্রাণু স্ত্রীর জারায়ুতে প্রবেশ করে স্ত্রীডিম্বের সাথে মিলিত হওয়ার পরপরই জরায়ুর মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং সেখানে স্বামীর ২৩টি ও স্ত্রীর ২৩টি ক্রোমোজম মিলিত হয়ে ‘সংমিশ্রিত বীর্য’ ( نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ )প্রস্ত্তত হয় (দাহর ৭৬/২)। যা প্রথম ছয়দিন বুদ্বুদ (Hollow-ball) আকারে থাকে। অতঃপর অবয়ব প্রাপ্ত হয়ে প্রথমে শুক্রবিন্দু, অতঃপর জমাট রক্তবিন্দু, তারপর গোশতপিন্ড, তারপর অস্থি-মজ্জা ও গোশত-চর্মসহ নতুন আকারে মানব শিশুর রূপ ধারণ করে (মুমিনূন ২৩/১৩-১৪)। অতঃপর চার মাস বয়সে আল্লাহ তাতে রূহ প্রেরণ করেন। এ সময় ফেরেশতা পাঠিয়ে তার কপালে চারটি বিষয় লিখে দেয়া হয়, যা হ’ল তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ব নির্ধারিত তাক্বদীর।[13] বাংলায় যাকে আমরা ‘ভাগ্য’ বলে থাকি।
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, মানবশিশু তার মায়ের গর্ভে রূহ প্রাপ্তির সাথে সাথে তার ভবিষ্যৎ জীবনের পূর্ণ রূপরেখা প্রাপ্ত হয়। যেমন ঔষধের প্রস্ত্ততকারক প্যাকেটের উপর ঔষধের মেয়াদকাল, তার ক্রিয়া ও ফলাফল লিখে দিয়ে থাকেন। ঔষধ প্রস্ত্তত হয় ফ্যাক্টরীতে বিজ্ঞানীর হাতে। আর মানবশিশু সৃষ্টি হয় মায়ের গর্ভে আল্লাহর সরাসরি নির্দেশনায় ‘একটির পর একটি স্তরে তিনটি কঠিন পর্দার অন্তরালে’ (যুমার ৩৯/৬)। আর সেখানেই লিখে দেয়া হয় তার জীবনের মেয়াদকাল, তার ভাল-মন্দ ক্রিয়া ও ফলাফল। একারণেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, اِعْمَلُوْا فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ لِماَ خُلِقَ لَهُ ‘তোমরা কাজ করে যাও। কেননা প্রত্যেকে ঐ কাজ সহজে করবে, যে জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে’।[14] বিস্ময়কর এই সৃষ্টি কৌশল এখানে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন মাত্র দু’টি শব্দে مِن نُّطْفَةٍ خَلَقَهُ فَقَدَّرَهُ ‘শুক্রবিন্দু হ’তে তাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তার তাক্বদীর নির্ধারণ করেছেন’। আল্লাহ মানব সৃষ্টির উৎস বলে দিলেন। এখন তাঁর দেয়া জ্ঞানশক্তি কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা যত বেশী গভীরে ডুব দিবেন, তত বেশী বিস্ময়কর তত্ত্ব ও তথ্যাদি জানতে পারবেন। যা তাদেরকে আরও বেশী আল্লাহভীরু ঈমানদার হতে উদ্বুদ্ধ করবে ইনশাআল্লাহ।
(২০) ثُمَّ السَّبِيْلَ يَسَّرَهُ ‘অতঃপর তার (ভূমিষ্ঠ হওয়ার) রাস্তা সহজ করে দিয়েছেন’।
এখানে ‘রাস্তা’ অর্থ মায়ের গর্ভ থেকে শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার রাস্তা বুঝানো হয়েছে। ইবনু আববাস (রাঃ), ইকরিমা, ক্বাতাদাহ, সুদ্দী, ইবনু জারীর সকলে একথা বলেন। বস্ত্ততঃ এ এক অপূর্ব সৃষ্টি কৌশল। মাতৃগর্ভে থাকার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে ব্যথা সঞ্চারের মাধ্যমে আল্লাহ তাকে গর্ভ থেকে ঠেলে বের করে দেন। আমরা সন্তান পেয়ে খুশী হই। কিন্তু যিনি গর্ভ সঞ্চার করালেন। অতঃপর অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, কার্বণ, আয়রণ ইত্যাদি পদার্থসহ এ যাবৎ আবিষ্কৃত মোট ৬০ প্রকার পদার্থ সহযোগে মাতৃগর্ভে শিশুর অবয়ব সৃষ্টি করলেন। অতঃপর মাতৃগর্ভে ৯ মাস ১০ দিন যাবৎ নাভীস্থিত ধমনীর মাধ্যমে মাতৃরক্তের নির্যাস দিয়ে শিশুকে পুষ্ট করলেন। তাকে রঙে-রূপে-স্বাস্থ্যে সুঠাম ও বুদ্ধি-জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন বাপ-মায়ের কোলের শান্তিরূপে ও তাদের চোখের পুত্তলীরূপে, অলক্ষ্যে থাকা সেই মহান আল্লাহর কথা কি আমরা কখনো স্মরণ করি? সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী, সুবহানাল্লাহিল ‘আযীম (মহা পবিত্র আল্লাহ এবং সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য। মহা পবিত্র আল্লাহ, যিনি মহান)।[15] অতএব তাঁর জন্যই সকল কৃতজ্ঞতা।
হাসান ইবনু যায়েদ প্রমুখ বিদ্বান ‘রাস্তা’ বলতে দুনিয়ায় ভাল-মন্দ বেছে চলার রাস্তা সহজ করার কথা বলেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيْلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُوْرًا ‘আমরা তার জন্য পথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে হয় সে কৃতজ্ঞ হৌক, নয় সে অকৃতজ্ঞ হৌক’ (দাহর ৭৬/৩)। অর্থাৎ যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই কাজ তার জন্য আমরা সহজ করে দিয়েছি। ইবনু কাছীর এই ব্যাখ্যাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন (ইবনু কাছীর)।
(২১) ثُمَّ أَمَاتَهُ فَأَقْبَرَهُ ‘অতঃপর তিনি তার মৃত্যু ঘটান ও তাকে কবরস্থ করেন’। এখানে مَاتَ ‘মৃত্যু হয়’ না বলে أَمَاتَهُ ‘তার মৃত্যু ঘটান’ বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষের মৃত্যু আল্লাহর হুকুমে হয়ে থাকে। তবে খুনী মানুষ খুন করে, তার অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহ খুন করেছেন। বরং তার অর্থ এই যে, আল্লাহ খুনীকে বাধা দেননি বা তার হাত অবশ করে দেননি। এর দ্বারা তিনি খুনীর জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়েছেন যে, সে আল্লাহর বাধ্য না অবাধ্য। যেহেতু সে অবাধ্যতা করেছে, তাই তাকে ইহকালে এবং পরকালে শাস্তি ভোগ করতে হবে। অবশ্য ইহকালে সে তওবা করলে এবং ইসলামী আদালত কর্তৃক যথাযথভাবে দন্ডপ্রাপ্ত হ’লে আল্লাহ তার পরকালের শাস্তি মওকুফ করতে পারেন।[16] এভাবে আল্লাহ দুনিয়াতে যালেম ও মযলূম উভয়ের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। মযলূমের পরীক্ষা এভাবে হয় যে, যুলুমের ফলে সে আল্লাহকে দায়ী করে তার অবাধ্য হয় কি-না বা তাঁকে ভুলে যায় কি-না। আর যালেমের পরীক্ষা এভাবে হয় যে, সে আল্লাহর ভয়ে যুলুম থেকে বিরত হয় কি-না।
فَأَقْبَرَهُ ‘অতঃপর তাকে তিনি কবরস্থ করান’ বলার মধ্যে মানুষের লাশকে সসম্মানে কবর দেওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা রূপে সম্মানিত করেছেন (বনু ইসরাঈল ১৭/৭০)। মৃত্যুর পরেও তার সম্মান বজায় থাকে। তাই তার লাশ যাতে মাটিতে পড়ে না থাকে এবং শিয়াল-কুকুর বা শকুনে খেয়ে অমর্যাদা না করে, সেজন্য তাকে সসম্মানে ও যথার্থ সমাদরে গোসল দিয়ে পূর্ণ মানবিক মর্যাদায় কবরস্থ করতে হবে। আজকাল রাষ্ট্রীয় মর্যাদার নামে মৃতকে স্যালুট দেওয়া, রাইফেলের গুলি ফুটানো ও বিউগলে বাঁশি বাজানোর এক অভিনব পদ্ধতি চালু হয়েছে। যার কোন নৈতিক, যৌক্তিক বা ইসলামী ভিত্তি নেই। স্রেফ লোক দেখানো ও অপচয় ব্যতীত এগুলি কিছুই নয়।
অনেকে মৃত্যুর আগে তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করে যান। অথচ দেহের মালিক আল্লাহর এতে কোন অনুমোদন নেই। রাসূল (ছাঃ) বলেন, মৃতের হাড্ডি ভাঙ্গা জীবিত ব্যক্তির হাড্ডি ভাঙ্গার ন্যায়’ ( كَسْرُ عَظْمِ الْمَيِّتِ كَكَسْرِهِ حَيًّا )।[17] তিনি মৃতের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিতে নিষেধ করেছেন।[18] অতএব জনকল্যাণের জন্যে হ’লেও এসব থেকে বিরত থাকাই কর্তব্য।
হাদীছে মাইয়েতকে পূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে গোসল ও কাফন-দাফনের সুন্দর নিয়ম-কানূন সমূহ বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর দাফনের পূর্বে মাইয়েতের পরকালীন জীবন সুখময় হবার প্রার্থনা জানিয়ে জানাযার সুন্দর ব্যবস্থা দেওয়া আছে। অতএব আগুনে পোড়ানোর মত নিষ্ঠুর পদ্ধতি বা অন্য কোনভাবে মানুষের মৃতদেহ সৎকার করা আল্লাহর প্রেরিত বিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আল্লাহর সবচাইতে প্রিয় সৃষ্টি মানুষের মরদেহকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করাতে আল্লাহ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। যারা এসব কাজ করেন, নিশ্চয় তারাও সহজভাবে এটা গ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু তাদেরকে তথাকথিত ধর্মের দোহাই দিয়ে এসব করাতে বাধ্য করেন কথিত ধর্মনেতা ও সমাজনেতারা। অথচ এগুলি আদৌ কোন ধর্ম নয়। বরং ধর্মের নামে অধর্ম এবং বানোয়াট রীতি মাত্র। কেননা প্রকৃত ধর্ম তাই যা আল্লাহ নাযিল করেছেন। আর তা হ’ল ইসলাম’ (আলে ইমরান ৩/১৯)।
(২২) ثُمَّ إِذَا شَاءَ أَنْشَرَهُ ‘অতঃপর যখন তিনি ইচ্ছা করবেন তাকে পুনর্জীবিত করবেন’। এখানে أَنْشَرَهُ অর্থ أَحْيَاهُ بَعْدَ مَوْتِهِ ‘মৃত্যুর পরে তাকে জীবিত করবেন’। মাদ্দাহ ‘নাশর’ বা ‘নুশূর’ অর্থ পুনরুত্থান বা পুনর্জীবন। ঘুম থেকে উঠে আমরা যে দো‘আ পাঠ করি, তার শেষে বলি ‘ওয়া এলাইহিন নুশূর’ ‘এবং তাঁর নিকটেই আমাদের পুনরুত্থান’। এ দো‘আ পাঠের মাধ্যমে প্রতিদিন আমাদেরকে ক্বিয়ামতের কথা স্মরণ করানো হয়। পুনরুত্থানের বাস্তব প্রমাণ পেশ করে আল্লাহ বলেন, وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ إِذَا أَنْتُمْ بَشَرٌ تَنْتَشِرُوْنَ - ‘তাঁর নিদর্শন সমূহের মধ্যে অন্যতম হ’ল এই যে, তিনি মাটি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন’। অতঃপর এখন তোমরা মানুষ হিসাবে (সারা পৃথিবীতে) ছড়িয়ে পড়েছ’ (রূম ৩০/২০)। তিনি আরও বলেন, وَانْظُرْ إِلَى الْعِظَامِ كَيْفَ نُنْشِزُهَا ثُمَّ نَكْسُوْهَا لَحْماً - ‘চেয়ে দেখ হাড্ডিগুলোর দিকে কিভাবে আমরা সেগুলিকে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর উপরে গোশতের আবরণ পরিয়ে থাকি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৯)। আয়াতটি নাযিল হয় বিগত যুগে পুনরুত্থানে বিস্ময়বোধকারী জনৈক ব্যক্তিকে তার মৃত্যুর একশ বছর পরে জীবিত করে তাকেই প্রমাণ হিসাবে পেশ করা উপলক্ষে (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كُلُّ إبْنِ آدَمَ يَأْكُلُهُ التُّرَابُ إِلاَّ عَجْبَ الذَّنْبِ مِنْهُ خُلِقَ وَفِيْهِ يُرَكَّبُ - ‘প্রত্যেক আদম সন্তানের দেহ মাটিতে খেয়ে ফেলবে, কেবল মেরুদন্ডের নীচের হাড্ডি ব্যতীত। তা থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাতেই তাকে পুনরায় অবয়ব দান করা হবে’।[19] বস্ত্ততঃ উক্ত অণুর নমুনা থেকে প্রত্যেক মানুষ তার পূর্বের রূপ নিয়ে পুনরুত্থিত হবে। যেমন বট ফলের ছোট্ট বীজ থেকে বিশাল বটবৃক্ষের উত্থান ঘটে। ডিএনএ টেস্ট করার মাধ্যমে মানুষ যদি হাযার বছর পূর্বে মৃত মানুষের খবর জানতে পারে, তাহ’লে আল্লাহর জন্য এগুলি কিছুই নয়।
(২৩) كَلاَّ لَمَّا يَقْضِ مَا أَمَرَهُ ‘কখনই না। সে পূর্ণ করেনি, যা তাকে (আল্লাহ) আদেশ করেছেন’।
كَلاَّ ধিক্কারসূচক অব্যয় ( حرف ردع )। অর্থাৎ ক্বিয়ামত হবে না বলে অবিশ্বাসীরা যে কথা বলে, তা কখনোই সঠিক নয়। বরং প্রকৃত কথা এই যে, মানুষ কখনোই আল্লাহর নির্দেশ মানেনি। সে কখনোই তার ওয়াদা এবং কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করেনি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) এ আয়াতটি পাঠ করে বলতেন, لم يف بالميثاق الذى أخذ عليه فى صلب آدم ‘মানুষ কখনোই তার ওয়াদা পূর্ণ করেনি, যা আদমের পিঠ থেকে বের করে তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল’ (কুরতুবী)। অর্থাৎ সেদিন আল্লাহ যখন আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন ألَسْتُ بِرَبِّكُمْ ‘আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই’? তখন জওয়াবে আমরা বলেছিলাম, بَلَى হ্যাঁ (আ‘রাফ ৭/১৭২)। কিন্তু দুনিয়ায় এসে শক্তি-সামর্থ্যের মালিক হয়ে সবকিছু অস্বীকার করছি আর বলছি আল্লাহ নেই, ক্বিয়ামত নেই, পরকালে জওয়াবদিহিতা নেই। অতএব খাও-দাও ফূর্তি করো। মুজাহিদ ও ক্বাতাদাহ বলেন, لا يقضى احد ما أمر به ‘মানুষকে আল্লাহর পক্ষ থেকে যা আদেশ করা হয়েছে, সে তা পূর্ণ করে না’ (কুরতুবী)।
এখানে সাধারণভাবে সকল মানুষকে ধিক্কার দিয়ে বলা হ’লেও এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হ’ল ‘অবিশ্বাসী মানুষ’ ( الإنسان الكافر )। কেননা অবিশ্বাসীরা আল্লাহর নিকটে কৃত ওয়াদা পালন করে না। আল্লাহর দ্বীন কবুল করে না। আল্লাহর দেওয়া ফরয-ওয়াজিব, হারাম-হালাল কিছুই মানে না। পক্ষান্তরে সত্যিকারের বিশ্বাসী মুমিন নর-নারীগণ সাধ্যমত আল্লাহর আদেশ-নিষেধসমূহ মান্য করে চলেন। কোন কোন আধ্যাত্মিক আলেম ( علماء الأرواح ) এই আয়াতের ভিত্তিতে বলতে চান যে, দুনিয়াতে ‘ইনসানে কামেল’ বা পূর্ণ মানুষ বলে কেউ নেই। বরং ‘ইনসানে ছালেহ’ বা সৎ মানুষ রয়েছে (তানতাভী)। আমরা মনে করি তাদের এই দাবী যথার্থ নয়। কেননা নবী-রাসূলগণ কেবল সৎ মানুষ ছিলেন না, তারা ছিলেন ইনসানে কামেল বা মানবতার পূর্ণাঙ্গ নমুনা, উসওয়ায়ে হাসানাহ’ (মুমতাহিনা ৬০/৬; আহযাব ৩৩/২১)। নবী-রাসূল ছাড়াও প্রথম যুগের মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণ এবং যুগে যুগে তাঁদের যথার্থ অনুসারী মুমিন নর-নারীগণ, যাদের উপরে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট হয়েছেন, তারাই সৃষ্টির সেরা’ (তওবাহ ৯/১০০; বাইয়েনাহ ৯৮/৭-৮)। তারা নিঃসন্দেহে ইনসানে কামেল।
মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনা ও তার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের পর এক্ষণে আল্লাহ মানুষের জন্য কিভাবে খাদ্য ও পানীয় যোগান দেন, তার বর্ণনা দিচ্ছেন। যাতে মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ্কে চিনে ও তাঁর অনুগত হয়।-
(২৪-৩২) فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ إِلَى طَعَامِهِ، أَنَّا صَبَبْنَا الْمَاءَ صَباًّ، ثُمَّ شَقَقْنَا الْأَرْضَ شَقًّا، فَأَنبَتْنَا فِيْهَا حَباًّ، وَّعِنَباً وَّقَضْباً، وَّزَيْتُوْناً وَّنخْلاً، وَّحَدَائِقَ غُلْباً، وَّفَاكِهَةً وَأَبًّا، مَّتَاعاً لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ - ‘অতএব মানুষ একবার লক্ষ্য করুক তার খাদ্যের দিকে (২৫) আমরা (কিভাবে তাদের জন্য) বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকি (২৬) অতঃপর ভূমিকে ভালভাবে বিদীর্ণ করি (২৭) অতঃপর তাতে উৎপন্ন করি খাদ্য-শস্য (২৮) আঙ্গুর ও শাক-সবজি (২৯) যয়তুন ও খর্জুর (৩০) ঘন পল্লবিত উদ্যানরাজি (৩১) এবং ফল-মূল ও ঘাস-পাতা (৩২) তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর ভোগ্যবস্ত্ত হিসাবে’।
شَقَّ يَشُقُّ شَقًّا অর্থ صَدَعَ ফাটানো, বিদীর্ণ করা, বিচ্ছিন্ন করা। সেখান থেকে شَقَقْنَا الْأَرْضَ بِالنَّبَاتِ ‘আমরা মাটিকে বিদীর্ণ করি অংকুরোদ্গমের মাধ্যমে’।
উপরে বর্ণিত আয়াতসমূহে মানুষের প্রতি আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহরাজির বর্ণনা দিয়েছেন। সাথে সাথে পুনরুত্থানের পক্ষে দলীল পেশ করেছেন যে, আমরা যেভাবে মৃত যমীন থেকে জীবন্ত উদ্ভিদরাজি বের করে আনি, অনুরূপভাবে মানুষের মাটি হয়ে যাওয়া দেহকে ক্বিয়ামতের দিন পুনর্জীবিত করব। কুরআনের এসব আয়াত সমূহে উদ্বুদ্ধ হয়ে একসময় মুসলিম স্পেন ও বাগদাদ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু উভয় স্থানে খেলাফতের পতনের সাথে সাথে মুসলমানদের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পতন শুরু হয় এবং মুসলিম উম্মাহর হাত থেকে বিজ্ঞানের নেতৃত্ব পাশ্চাত্যের হাতে চলে যায়। মুসলিম তরুণদের পুনরায় বিজ্ঞানের মূল উৎস কুরআন ও হাদীছের দিকে ফিরে আসতে হবে এবং তাদের হারানো নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে হবে। এজন্য অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কুরআনমুখী হতে হবে এবং কুরআন গবেষণায় সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
২৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ একবার তাকিয়ে দেখুক তার খাদ্যের দিকে’। তিনি কেন এটা বললেন? তার কারণ খাদ্য হ’ল মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান মাধ্যম। খাদ্যের মাধ্যমেই মানুষের দেহে শক্তি ও মাথায় বুদ্ধির যোগান হয়। দেহের প্রবৃদ্ধির যাবতীয় উপাদান ও প্রাণশক্তি আল্লাহ বিভিন্ন খাদ্যের মধ্যে সঞ্চিত রেখেছেন। এক এক খাদ্যের এক এক গুণ ও ক্ষমতা দান করেছেন। অতএব মানুষ যখন খাদ্য গ্রহণ করবে, তখন যেন সে চিন্তা করে যে, এই খাদ্য তার গুণ-ক্ষমতাসহ তার প্লেটে কে পাঠালো ও কিভাবে এলো।
বাংলাদেশে আমাদের প্রধান খাদ্য চাউল। যখন প্লেট থেকে এক লোকমা ভাত আমরা মুখে তুলি, তখন কি আমরা দেখি এই লোকমাটির সৃষ্টি রহস্য? ১০০ গ্রাম চাউলের মধ্যে কি কি উপাদান রয়েছে। কে এগুলি প্রয়োজনীয় পরিমাণে একত্রিত করে তাতে বিশেষ স্বাদ-গন্ধ ও প্রাণশক্তি দান করল? একটি ধানের বীজ থেকে সাতটি ধানের গাছ ও সাতটি ধানের গাছের প্রতিটির শীষে কে সাতশ ধান সৃষ্টি করলো ও সেখানে দুধ শুকিয়ে দানা শক্ত করল? ধানের উৎপাদনে কত মানুষের ও গরু-মহিষের শ্রম দিতে হ’ল? কৃষি-যন্ত্রপাতি তৈরী ও ব্যবহারে এবং কীটনাশক ঔষধ ও রাসায়নিক সার আবিষ্কারে কত মানুষের চিন্তা ও কর্মশক্তি ব্যয়িত হ’ল? প্রায় তিন মাস যাবত জমিতে ধান গাছটি কে বর্ধিত করল ও শুকালো? অতঃপর কেন তা শুকানোর পরেও গাছগুলি শীষসহ দাঁড়িয়ে থাকলো। এমনকি ঝড়ে গাছগুলি পড়ে গেলেও ধানগুলি কেন ঝরে পড়লো না? অতঃপর ধানগুলি কেটে এনে মাড়াই করে চাউল করে সরাসরি অথবা দেশের বাজার হতে কিংবা বিদেশ থেকে আমদানী হয়ে বাজারে আসার পর সেখান থেকে খরিদ করে বাড়ী এনে তা রান্না করে প্লেটে খাদ্যরূপে আমাদের সামনে আসতে কত কৃষক- শ্রমিক-মজুর, কত বিজ্ঞানী-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কত শত মানুষের শ্রম ও শ্রমঘণ্টা ব্যয় হয়েছে, তা কি আমরা কখনো চিন্তা করে দেখেছি? কে সেই মহান সত্তা যিনি আলো দিয়ে, উত্তাপ দিয়ে, বাতাস দিয়ে, বৃষ্টি দিয়ে উন্মুক্ত যমীনে আমাদের জন্য ধান-গম ও শাক-সবজি উৎপন্ন করলেন? কে আমাদের জন্য সুন্দর খাদ্য-ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে সম্পন্ন করলেন? আমার-আপনার সমস্ত দেহমন আপনা থেকেই বলে উঠবে, তিনি আল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। তিনি আমার মহান সৃষ্টিকর্তা ও দয়ালু পালনকর্তা। যিনি একক, যার কোন শরীক নেই। তাই খাওয়ার শুরুতে আল্লাহকে স্মরণ করে বলতে হয় ‘বিসমিল্লাহ’ এবং শেষে আল্লাহর প্রশংসা করে বলতে হয়, ‘আলহামদুলিল্লাহ’।
দেখুন যে নাইট্রোজেন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, সেই নাইট্রোজেন আমাদের খাদ্যের জন্য কত বড় বন্ধু? জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন জীবন রক্ষাকারী ঔষধের মত কাজ করে। এর উৎস হ’ল বজ্র ও বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ চমকের মাধ্যমে যে পরিমাণ নাইট্রোজেন পতিত হয় এবং বাতাস ও বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে মিশ্রিত হয়, তা বছরে প্রায় এক কোটি টন ইউরিয়া সারের কাজ দেয়। প্রতি একর জমিতে যার পরিমাণ পাঁচ পাউন্ডের মত। এভাবে মৃত যমীনকে আল্লাহ জীবিত করেন ও তার মাধ্যমে খাদ্য-শস্য উৎপাদন করেন।
এভাবে উদ্ভিদ জগতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, প্রায় পাঁচ লক্ষ প্রকারের ঊর্ধ্বে উদ্ভিদরাজি আমাদের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত রয়েছে (তানতাভী)। কোন উদ্ভিদ আমাদের খাদ্য যোগান দিচ্ছে। যেমন ধান, গম, শাক-সবজি ইত্যাদি। কোন উদ্ভিদ আমাদের পোষাকের যোগান দিচ্ছে, যেমন তুলা গাছ ইত্যাদি। কোন উদ্ভিদ আমাদের তৈল-মশলা ও সুগন্ধি, কোন উদ্ভিদ আমাদের জন্য ফল-ফলাদি, কোনটা দিচ্ছে ঔষধের যোগান, কোনটা দিচ্ছে গৃহ-সরঞ্জামাদির যোগান ইত্যাদি। উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি কেবল আমাদের ও আমাদের গবাদিপশুর খাদ্য ও ঔষধের যোগান দেয় না, বরং আমাদের জীবন রক্ষায় অকৃত্রিম বন্ধুর কাজ করে। বাতাসে শতকরা ৭৭ ভাগ নাইট্রোজেন ও ২১ ভাগ অক্সিজেন থাকে। আল্লাহর হুকুমে গাছগুলি সারাদিন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন ছাড়ে এবং সারারাত অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ে। এভাবে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেনের পরিমাণ ঠিক থাকে। এই পরিমাণে তারতম্য ঘটলে শ্বাস-প্রশ্বাসে তারতম্য ঘটবে এবং প্রাণীজগত মারা পড়বে। উল্লেখ্য যে, মানুষ অক্সিজেন টানে ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ে। কোন অবস্থাতেই মানুষ কার্বন-ডাই-অক্সাইড টানবে না। কারণ মানুষের নাককে সে নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কখনও অক্সিজেন হঠাৎ না পেলে আপনা থেকেই মুখ গহবর হা করে হাই উঠে যায় এবং পরক্ষণেই অক্সিজেন এসে গেলে মুখ বন্ধ হয়ে যায়। যদি অক্সিজেন ৫ মিনিট না আসত, তাহ’লে মুখের ঐ হা আর বন্ধ হতো না। ঐভাবেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হতো।
হে মানুষ! বৃক্ষরাজির এই অমূল্য অবদান কি কেউ ভুলতে পারবে? আল্লাহ যে সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা এটা কি তার অন্যতম প্রকৃষ্ট প্রমাণ নয়? এজন্যই তো কুরআনের সার নির্যাস সূরায়ে ফাতিহার প্রথম আয়াতেই প্রতি ছালাতের প্রতি রাক‘আতে আমরা পড়ি ‘আলহামদুলিল্লাহি রবিবল ‘আলামীন’- ‘কৃতজ্ঞতাপূর্ণ যাবতীয় প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালকের জন্য’। এখানে খালেক বা সৃষ্টিকর্তা না বলে রব বা পালনকর্তা বলার উদ্দেশ্য হ’ল এই যে, অবিশ্বাসী কাফের-মুশরিকরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে মানলেও পালনকর্তা হিসাবে মানতে চায় না। ফেরাঊন এজন্য নিজেকে ‘রব’ দাবী করেছিল। কিন্তু ‘খালেক’ দাবী করেনি।
হে পাঠক! আসুন এবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করি, কেন আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের খাদ্যের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বললেন? ধরুন। আপনি একজন বুদ্ধিমান চাষী। আপনি আপনার জমিতে ধান চাষ করবেন, না নেপিয়ার ঘাস চাষ করবেন? যদি আপনি ঘাসের চাষ করেন, তবে সেটা কেবল আপনার গবাদিপশুর খাদ্যের ব্যবস্থা হ’ল। কিন্তু আপনার ও আপনার সন্তানদের খাদ্যের ব্যবস্থা হ’ল না। আর যদি তামাকের চাষ করেন, তাহ’লে না আপনার খাদ্য হ’ল, না আপনার গবাদিপশুর খাদ্য হ’ল। কেননা তামাক এমন নিকৃষ্ট গাছ, যা ছাগল-গরু দূরে থাক, কুকুর-শূকরেও খায় না। যদিও সভ্য হওয়ার দাবীদার মানুষের কেউ কেউ তা মজা করে চিবিয়ে খায়। আবার বহুলোক তা মোড়কে ভরে তাতে আগুন ধরিয়ে সুখটান দিয়ে বংকিম ভঙ্গিতে ধোঁয়া উড়িয়ে বলেন, এর দ্বারা মগয গরম হয় ও বুদ্ধি বের হয়। অথচ তামাক হ’ল নেশাদার বৃক্ষ, যা মানুষকে মদমত্ত ও পথভ্রষ্ট করে।
পক্ষান্তরে যদি আপনি ধান চাষ করেন, তাহ’লে তাতে আপনার খাদ্য যেমন রয়েছে, আপনার গবাদিপশুর খাদ্যও তেমনি রয়েছে। এর মধ্যে আপনি দু’টি নে‘মত একত্রে পেলেন। এটাই হ’ল তুলনা ঐ দুই ব্যক্তির জন্য যাদের একজন নেক আমল করল ও অন্যজন বদ আমল করল। যে ব্যক্তি নেক আমল করল, সে ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ লাভ করল। কিন্তু যে ব্যক্তি বদ আমল করল, সে কেবল দুনিয়ায় সাময়িক কিছু উপকার পেল। কিন্তু আখেরাতের চিরস্থায়ী কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হ’ল। বস্ত্ততঃ বর্ণিত আয়াতগুলিতে বান্দার প্রতি আল্লাহর এটাই হ’ল আন্তরিক আহবান, যেন সে দুনিয়াতে এমন আমল করে যা তার ইহকালে ও পরকালে কাজে লাগে। অন্যত্র একথাটিই আল্লাহ বলেছেন এভাবে,
‘যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমরা তার জন্য সেই ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি ইহকালের ফসল কামনা করে, আমরা তাকে তার কিছু অংশ দেই। কিন্তু পরকালে তার কোনই অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)।
উপরে বর্ণিত আয়াতগুলিতে (২৪-৩২) কিভাবে বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে আল্লাহ মৃত যমীনকে সজীব করেন এবং সেখান থেকে মানুষ ও গবাদিপশুর জন্য খাদ্য-শস্য ও ফল-ফলাদি উৎপন্ন করেন ও বাগ-বাগিচা ও বন-জঙ্গল সৃষ্টির মাধ্যমে জীবকুলকে বাঁচিয়ে রাখেন- সবকিছু বর্ণনা করার পর অবশেষে ক্বিয়ামতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন (৩৩-৪২ আয়াত)।-
(৩৩) ‘অতঃপর যেদিন সেই নিনাদ আসবে (৩৪) সেদিন মানুষ পালাবে তার ভাই থেকে (৩৫) তার মা-বাপ (৩৬) এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে। (৩৭) প্রত্যেক মানুষের সেদিন এমন অবস্থা হবে যে, সে নিজেকে নিয়েই বিভোর থাকবে। (৩৮) অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে উজ্জ্বল (৩৯) সহাস্য, প্রফুল্ল (৪০) অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে ধূলি ধূসরিত। (৪১) কালিমালিপ্ত। (৪২) তারা হ’ল অবিশ্বাসী, পাপিষ্ঠ’।
الصَّاخَّةُ অর্থ الصيحة العظيمة التى تَصُخُّ الآذان ‘মহা নিনাদ যা কান ফাটিয়ে দেয়’। এখানে অর্থ النفخ في الصور يوم القيامة ‘ক্বিয়ামতের দিন শিঙ্গায় ফুঁকদান’। আর এটি হ’ল النفخة الثانية ‘দ্বিতীয় বারের ফুঁকদান’ (কুরতুবী)।
উপরের আয়াতগুলিতে ক্বিয়ামতের দিনের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। সেদিন মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। কেউ কারু দিকে তাকানোর ফুরছত পাবে না। সেই ভয়ংকর বিপদের দিনে একটি নেকী দিয়েও কেউ কাউকে সাহায্য করবে না। সবাই নাফসী নাফসী করবে।[20] এমনকি নারী-পুরুষের কেউ কারু গুপ্তাঙ্গের দিকেও তাকাবে না। স্ত্রী আয়েশার এমনি এক প্রশ্নের জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَا عَائِشَةُ الأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يَنْظُرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ ‘হে আয়েশা সেদিনকার অবস্থা এমন ভয়ংকর হবে যে, কেউ কারু দিকে তাকাবার ফুরছত পাবে না’।[21] সেদিন মানুষ তার প্রথম সৃষ্টির ন্যায় নগ্ন হয়ে উঠবে[22] এবং সেদিন প্রথম কাপড় পরানো হবে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে।[23] সেদিন কেউ শিশু বা বৃদ্ধ থাকবেনা। বরং প্রত্যেকের বয়স ৩০ অথবা ৩৩ বছর হবে।[24]
وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ مُّسْفِرَةٌ، ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌ অর্থাৎ ঐদিন মানুষের মধ্যে দু’টি দল হবে। একদল হবে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট। এরা হবে জান্নাতী।
وَوُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ، تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ ‘আরেকদল হবে মসীলিপ্ত চেহারা বিশিষ্ট। غَبَرَةٌ অর্থ غُبار বা ধোঁয়া ও ধূলি-বালি। قَةَرَةٌ বহুবচনে قَتَرٌ অর্থ আলকাতরা বা কালো রং।
أُوْلَئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ ‘এরা হ’ল অবিশ্বাসী ও পাপিষ্ঠের দল’। الْكَفَرَةُ وَالْفَجَرَةُ একবচনে الكافر والفاجر অর্থ অবিশ্বাসী ও পাপাচারী। অবিশ্বাসীরা কাফির, কপট বিশ্বাসীরা মুনাফিক এবং পাপিষ্ঠরা ফাসেক-ফাজির। আল্লাহ আমাদেরকে উক্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করুন। আমীন!!
সারকথা :
দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধনী-গরীব সকলকে সমান জ্ঞান করার শিক্ষা প্রদান এবং কুরআনে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী হওয়ার ভিত্তিতে পুনরুত্থান দিবসে দু’দল মানুষের দু’রকম অবস্থার বাণীচিত্র অংকন।
[1]. মুওয়াত্ত্বা হা/৬৯৩, তিরমিযী হা/৩৩৩১ সনদ ‘ছহীহ’। তিরমিযী অত্র বর্ণনাটিকে ‘গরীব’ বলেছেন। তবে এর অনেকগুলি ‘শাওয়াহেদ’ বা সমার্থক বর্ণনা রয়েছে বিধায় তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য। সম্ভবতঃ সেকারণে আলবানী একে ‘ছহীহ’ বলেছেন। এ বিষয়ে অন্য কোন বর্ণনা বিশুদ্ধ নয়।
[2]. মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৩১২৩, হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে।
[19]. বুখারী হা/৪৮১৪, মুসলিম হা/২৯৫৫, মিশকাত হা/৫৫২১।
[20]. বুখারী হা/৩৩৪০; মুসলিম হা/৩২৭; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩৬৪৪।
[21]. বুখারী হা/৬৫২৭, মুসলিম হা/২৮৫৯; মিশকাত হা/৫৫৩৬।
[22]. আম্বিয়া ২১/১০৪; বুখারী হা/৬৫২৭, মুসলিম হা/২৮৫৯; মিশকাত হা/৫৫৩৬।
[23]. বুখারী হা/৪৬২৫, মুসলিম হা/২৮৬০; মিশকাত হা/৫৫৩৫।
[24]. তিরমিযী হা/২৫৪৫, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫৬৩৯।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/340/7
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।