HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
খলিফা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে ইনসাফপন্থীদের কিছু বাণী
লেখকঃ আব্দুল মুহসিন ইবন হামদ আল-আব্বাদ
৮
মুয়াবিয়া সম্পর্কে ইনসাফপন্থীদের বাণী:ইবন কুদামাহ (লুম‘আতুল ই‘তিকাদ) গ্রন্থে বলেন, “মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান মুমিনদের খালু, আল্লাহর ওহি লেখক ও মুসলিমদের একজন খলিফা। তাদের সবার ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন ও তাদের সবাইকে সন্তুষ্ট করুন”।
(আকীদাতুত তাহাভিয়া) গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার বলেন, “মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিমদের প্রথম বাদশাহ, মুসলিমদের যত বাদশাহ হবে তাদের ভেতর তিনিই শ্রেষ্ঠ”।
ইমাম যাহাবী রহ. (সিয়ারু আলামিন নুবালা) গ্রন্থে বলেন, “মুয়াবিয়া ছিলেন আমিরুল মুমিনীন ও ইসলামের বাদশাহ”।
ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেন: আহমদ ইবন হাম্বল বলেছেন, “আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী ছিলেন খলিফা। জিজ্ঞেস করা হলো: মুয়াবিয়া সম্পর্কে কী বলেন, তিনি উত্তর দিলেন: আলীর যুগে আলী থেকে অধিক কেউ খিলাফতের যোগ্য ছিল না, আর মুয়াবিয়ার ওপর আল্লাহ রহম করুন”।
ইবন আবুদ দুনিয়া বর্ণনা করেন, উমার ইবন আব্দুল আযীয বলেছেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখলাম, তার পাশে আবু বকর ও উমারকেও বসা দেখলাম। আমি তাকে সালাম দিয়ে বসে যাই, এমতাবস্থায় আলী ও মুয়াবিয়াকে আনা হল এবং তাদেরকে একটি ঘরে দাখিল করে দরজা বন্ধ করা হল। আমি দেখলাম আলী খুব দ্রুত বের হলেন, আর বললেন, কাবার রবের কসম, আমার পক্ষেই ফয়সালা করা হয়েছে। অতঃপর মুয়াবিয়া খুব দ্রুত বের হলেন এবং বললেন, কাবার রবের কসম, আমাকে ক্ষমা করা হয়েছে”।
ইবন আসাকির বর্ণনা করেন: আবু যুর‘আহ আর-রাযীকে জনৈক ব্যক্তি বলল, আমি মুয়াবিয়াকে পছন্দ করি না, তিনি বললেন, কেন? সে বলল: কারণ সে আলীর সাথে যুদ্ধ করেছে। আবু যুর‘আহ বললেন, মুয়াবিয়ার রব খুব রহমশীল, আর মুয়াবিয়ার বিবাদীও খুব ভদ্র, তাদের মাঝে তোমাকে প্রবেশ করার অধিকার কে দিল?
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলকে মুয়াবিয়া ও আলীর মাঝে সংঘটিত ঘটনাবলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি উত্তর দিলেন:
﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسَۡٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٤١﴾ [ البقرة : 141]
“সেটা ছিল একটি উম্মত, যারা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের জন্য আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্য। আর তারা যা করেছে সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে না”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪১]
এ কথাই বলেছেন একাধিক আদর্শ পুরুষ। মুয়াবিয়া সম্পর্কে ইবন মুবারককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বললেন, আমি এমন ব্যক্তি সম্পর্কে কি বলব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বলেছেন, «سمع الله لمن حمده» তার পশ্চাতে সে বলেছে: «ربنا ولك الحمد» আমরা সবাই জানি যে, সামিয়া অর্থ ইস্তাজাবাহ, অর্থাৎ আল্লাহ কবুল করেছেন। মুয়াবিয়া রাসূলের পেছনে সালাত পড়েছেন, তিনি যখন সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলেছেন, তার পশ্চাতে মুয়াবিয়া রাব্বানা লাকাল হামদ বলেছেন। এ ফযীলত সমালোচকদের নেই। ইবন মুবারককে কেউ জিজ্ঞেস করল: কে উত্তম, মুয়াবিয়া না উমার ইবন আব্দুল আযীয? তিনি বললেন, মুয়াবিয়ার নাকের মাটিও উমার ইবন আব্দুল আযীয থেকে উত্তম”।
মুয়াফা ইবন ইমরানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: কে উত্তম, মুয়াবিয়া না উমার ইবন আব্দুল আযীয? তিনি রেগে গেলেন এবং প্রশ্নকারীকে বললেন, কোনো সাহাবীকে তুমি তাবেঈনদের সমান গণ্য কর? মুয়াবিয়া রাসূলের সাথী, শ্যালক, লেখক ও আল্লাহর ওহীর আমানতদার”।
ফাদল ইবন যিয়াদ বলেন, আবু আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসকে যে গাল-মন্দ করে, তাকে কি রাফেযী বলা যাবে? তিনি উত্তর দিলেন: সাহাবীদের ব্যাপারে একমাত্র তারাই (রাফেযীরাই গালি দেওয়ার) দুঃসাহস দেখায়, যাদের অন্তরে খারাপি রয়েছে। অন্তরে খারাপি না থাকলে কেউ কোনো সাহাবীর অসম্মান করতে পারে না।
মুহাম্মদ ইবন মুসলিম সূত্রে ইবন মুবারক বর্ণনা করেন, ইবরাহিম ইবন মায়সারাহ বলেছেন, আমি কখনো দেখি নি উমার ইবন আব্দুল আযীয কাউকে প্রহার করেছেন, তবে এক ব্যক্তিকে কয়েকটি বেত্রাঘাত করতে দেখেছি, যে মুয়াবিয়াকে গাল-মন্দ করেছিল”।
আবু তাওবাহ বলেন, মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের জন্য পর্দা স্বরূপ, যে কেউ এ পর্দা উন্মুক্ত করার দুঃসাহস দেখাবে, সে তার ভেতরে প্রবেশ করারও দুঃসাহস করবে, সন্দেহ নেই”।
উপরের অধিকাংশ বর্ণনা আল-বিদায়াহ ও আল-নিহায়াহ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত, যা ইবন কাসির রহ. মুয়াবিয়া প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেছেন। [আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (৮/১৩০-১৩৯)।]
ইমাম বুখারী (ফাযায়েলুস সাহাবাহ) সংক্রান্ত অধ্যায়ে একটি অনুচ্ছেদ কায়েম করেছেন, যার শিরোনাম: (মুয়াবিয়ার আলোচনা সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ) এতে তিনি তিনটি হাদীস উল্লেখ করেছেন:
১. ইবন আবু মুলাইকাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “মুয়াবিয়া এশার পর এক রাকাত দিয়ে বিতর পড়েছেন, তখন ইবন আব্বাসের নিকট কেউ এসে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল, তিনি বললেন, তাকে করতে দাও। কারণ, তিনি রাসূলুল্লাহর সাহচর্য গ্রহণ করেছেন”।
২. ইবন আবু মুলাইকাহ থেকে বর্ণিত, ইবন আব্বাসকে বলা হলো: আমিরুল মুমিনীন মুয়াবিয়াকে আপনি কিছু বলবেন কি? কারণ, সে এক রাকাত দিয়ে বিতর পড়েছে। তিনি বললেন, তিনি ফকীহ”।
৩. মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, কিন্তু তোমরা যে সালাত আদায় কর, সে সালাত তাকে আদায় করতে দেখি নি। তিনি আমাদেরকে আসরের পর দু’রাকাত সালাত থেকে নিষেধ করেছেন”।
হাফিয ইবন হাজার বুখারীর ব্যাখ্যায় বলেন, “ইমাম বুখারী মুয়াবিয়া সম্পর্কে যিকর শব্দ উল্লেখ করেছেন, যার বাংলা অর্থ আলোচনা। ফযীলত বা গুণাবলি অর্থ প্রকাশ করে এমন শব্দ তিনি ব্যবহার করেননি, কারণ অনুচ্ছেদের হাদীস থেকে মুয়াবিয়ার ফযীলত প্রমাণ হয় না, তবে ইবন আব্বাস তাকে যে ফকীহ ও সাহাবী বলেছেন এ থেকে তার ফযীলত প্রমাণ হয়। মুয়াবিয়ার ফযীলত সম্পর্কে ইবন আবু আসিম একটি পুস্তিকা লিখেছেন। অনুরূপ তার ফযীলত সম্পর্কে আরও লিখেছেন আবু উমার ও আবু বকর নাক্কাশ। এসব গ্রন্থে তারা মুয়াবিয়ার ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন, যার বেশ কিছু হাদীসকে ইবনুল জাওযী মাওদু‘আত গ্রন্থে বানোয়াট বলেছেন। অতঃপর ইবনুল জাওযী বলেন, ইসহাক ইবন রাহওয়াইহ বলেছেন, মুয়াবিয়ার ফযীলত সংক্রান্ত বিশুদ্ধ কোনো হাদীস নেই। এ রহস্যের কারণেই ইমাম বুখারী উস্তাদের কথা আমলে নিয়ে মুয়াবিয়ার ফযীলত বা গুণাবলি বলেন নি; বরং এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন, যার বাংলা অর্থ আলোচনা, তবে তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে ইজতিহাদ করেছেন, যার দ্বারা রাফেযীরা প্রত্যাখ্যাত হয়”। [ফাতহুল বারি (৭/১০৩-১০৪)।]
সহীহ মুসলিমে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুয়াবিয়া সম্পর্কে বলেছেন, “আল্লাহ তার পেট পূর্ণ না করুন”। মুসলিম স্বীয় সনদে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমি বাচ্চাদের সাথে খেলতে ছিলাম, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে পড়েন, ফলে আমি দরজার আড়ালে লুকিয়ে যাই। তিনি আমাকে দু’হাত দিয়ে ঘাড়ের উপর আঘাত করলেন এবং বললেন, যাও, মুয়াবিয়াকে ডেকে আন। তিনি বলেন, আমি গেলাম এবং ফিরে এসে বললাম মুয়াবিয়া খাচ্ছে। তিনি আবার বললেন, যাও, তাকে ডেকে আন। তিনি বলেন, আমি ফিরে এসে বললাম, মুয়াবিয়া খাচ্ছে। তখন তিনি বললেন, «لا أشبع الله بطنه» আল্লাহ তার পেট পূর্ণ না করুন।
ইমাম মুসলিম এ হাদীসের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দো‘আ সংক্রান্ত হাদীসগুলো সমাপ্ত করেছেন, যার উদ্দেশ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে বদ দো‘আ ও গাল-মন্দ প্রকাশ পায়, যদি ঐ ব্যক্তি তার উপযুক্ত না হয়, তাহলে এগুলো তার জন্য পবিত্রতা, রহমত ও সাওয়াবের দো‘আয় পরিণত হয়, অতএব, মুয়াবিয়া সম্পর্কে বাহ্যত বদ-দো‘আ প্রকৃতপক্ষে দো‘আ, যেমন তিনি অন্যান্য সাহাবীর ক্ষেত্রে বলেছেন, «تربت يمينك» তোমার হাত ধুলো মলিন হোক। «وثكلتك أمك» তোমার সর্বনাশ হোক। «عَقْرَى حَلْقَى» তোমার সন্তান না হোক। «لاكبرت سنك» তোমার বয়স না বাড়ুক।
ইমাম মুসলিম এ জাতীয় কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, তার ভেতর মুয়াবিয়ার হাদীস একটি। তার পূর্বে রয়েছে আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস। আনাস বলেন, উম্মে সুলাইমের নিকট এক ইয়াতীম মেয়ে ছিল, উম্মে সুলাইম মূলত তারই মা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াতিম মেয়েটি দেখে বলেন, “তুমিই কি সেই মেয়ে, তুমি তো বড় হয়ে গিয়েছ, তোমার বয়স না বাড়ুক”। মেয়েটি উম্মে সুলাইমের নিকট কাঁদতে কাঁদতে গেল। উম্মে সুলাইম বললেন, হে মেয়ে, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বদ-দো‘আ করেছেন। এখন থেকে আমি বড় হবো না। উম্মে সুলাইম মাটিতে ওড়না হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে দ্রুত রাসূলকে গিয়ে ধরলেন। রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু বললেন, হে উম্মে সুলাইম, কি হয়েছে? সে বলল: আল্লাহর রাসূল, আমার ইয়াতিম মেয়েটিকে আপনি বদ-দো‘আ করেছেন? তিনি বললেন, উম্মে সুলাইম, সে কি? সে বলল: মেয়েটি মনে করছে, আপনি তাকে বদ-দো‘আ করেছেন, যেন তার বয়স না বাড়ুক। আনাস বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন। অতঃপর বললেন, হে উম্মে সুলাইম, আমার রবের নিকট আমর শর্তগুলো তুমি জান না, আমার রবের কাছে শর্ত করেছি যে, আমি একজন মানুষ, মানুষ যেরূপ সন্তুষ্ট হয় আমিও সেরূপ সন্তুষ্ট হই, মানুষ যেরূপ রাগ করে আমিও সেরূপ রাগ করি। আমার যে উম্মতের ওপর আমি বদ-দো‘আ করি, যার উপযুক্ত সে নয়, সেটিকে তার জন্য পবিত্রতা ও নৈকট্য বানিয়ে দিন, যার বিনিময়ে কিয়ামতের দিন আপনি তাকে নৈকট্য দিবেন”।
এ হাদীস শেষে ইমাম মুসলিম মুয়াবিয়ার দো‘আ সংক্রান্ত হাদীস এনেছেন, যাতে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তার পেট পূর্ণ না করুন। লক্ষ্য করুন, ইমাম মুসলিম একটি জটিল বিষয়কে খুব চমৎকারভাবে সমাধান করেছেন, অন্যথায় মুয়াবিয়া সম্পর্কে অনেকের ধারণা খারাপ হত। এটাই তার কিতাবের এক বড় বৈশিষ্ট্য। এখানে প্রমাণ হয় তার সূক্ষ্ম বুঝ ও তীক্ষ্ণ ইজতিহাদ। আল্লাহ তার ওপর রহম করুন।
ইমাম নাওয়াওয়ী মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, “ইমাম মুসলিম এ হাদীস থেকে বুঝেছেন, মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বদ দো‘আর উপযুক্ত ছিলেন না, তাই এখানে তার আলোচনা করেছেন। ইমাম মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য মুহাদ্দিস এটাকে মুয়াবিয়ার প্রশংসা গণ্য করেছেন, কারণ তারা জেনেছেন পরবর্তীতে এটা মুয়াবিয়ার জন্য দো‘আয় পরিণত হয়েছে।
﴿وَمَن قُتِلَ مَظۡلُومٗا فَقَدۡ جَعَلۡنَا لِوَلِيِّهِۦ سُلۡطَٰنٗا فَلَا يُسۡرِف فِّي ٱلۡقَتۡلِۖ إِنَّهُۥ كَانَ مَنصُورٗا ٣٣﴾ [ الإسراء : 33]
ইবন কাসির রহ. আল্লাহ তা‘আলার উক্ত বাণীর তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, অত্র আয়াতের ব্যাপকতা থেকে ইবন আব্বাস বুঝেছেন যে, মুয়াবিয়া কর্তৃত্বের অধিকারী ও রাজত্বের মালিক হবেন। কারণ, তিনি উসমানের অলী তথা অভিভাবক ছিলেন। উসমানকে মযলুম অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট দাবি করেছেন, যেন তার কাছে উসমানের হত্যাকারীদের সোপর্দ করা হয়, তিনি তাদের থেকে কিসাস নিবেন; কারণ, তিনি উমাওয়ী তথা উসমানের বংশধর। এ দিকে আলী চেয়েছেন তার কাছে সুযোগ আসুক, যেন তার ক্ষমতা দৃঢ় ও পরিপক্ব হয়, তাই মুয়াবিয়াকে বলছেন আমার হাতে আগে শামকে সোপর্দ করুন। মুয়াবিয়া শামকে সোপর্দ করতে অস্বীকার করেন, যতক্ষণ না তার নিকট উসমানের হত্যাকারীদের সোপর্দ করা হয়। এ অজুহাতে তিনি ও শামের লোকেরা আলীর নিকট বায়‘আত থেকে বিরত থাকেন, অতঃপর দীর্ঘ সময় পর মুয়াবিয়া শক্তিশালী হন ও তার নিকট রাজত্ব চলে যায়, যেমন ইবন আব্বাস এই আয়াত থেকে ইজতিহাদ করেছেন। এটা আশ্চর্য ঘটনার একটি”। [তাফসীরে ইবন কাসির (৩/৩৮)।]
সহীহ বুখারীতে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আনসারিদের মহব্বত করা ঈমানের নিদর্শন, আর তাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা নিফাকের নিদর্শন”।
হাফিয ইবন হাজার (ফাতহুল বারি) গ্রন্থে বলেন, আনসারদের ফযীলত তাদেরও হাসিল হবে, যারা আনসারদের ন্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্য করার কাজে অংশীদারি হবে। অতঃপর তিনি বলেন, সহীহ মুসলিমে আলী রাদিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন, “মুমিন ছাড়া কেউ তোমাকে মহব্বত করবে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ তোমাকে অপছন্দ করবে না”। এ ফযীলত অন্যান্য সাহাবীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
(আল-মুফহিম) এর গ্রন্থকার বলেন, “যেসব যুদ্ধ-বিগ্রহ সাহাবীদের মাঝে সংঘটিত হয়েছে, তাতে যদিও একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ ছিল, তবে সেটা নিফাক পর্যায়ের ছিল না, বরং কোনো এক বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ছিল, যার থেকে বিরোধিতার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য কেউ কাউকে নিফাকের দোষে দুষ্ট বলেন নি, এসব ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা ছিল মুজতাহিদের মত, যে ঠিক করেছে তার দু’টি সাওয়াব আর যে ভুল করেছে তার একটি সাওয়াব। আল্লাহ তা‘আলা ভালো জানেন। [ফাতহুল বারি: (১/৬৩)]
শাইখ ইয়াহইয়া ইবন আবু বকর আমেরী ইয়ামানী আবু মুসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবনী আলোচনায় বলেন, মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম বর্ণনা করেছেন: “ইসলামের শুরুতে আলীর বিদ্বেষ নিফাকের আলামত ছিল। কারণ, সে ছিল মুনাফিকদের আতঙ্ক। অনুরূপ হাদীসে এসেছে আনসারদের বিদ্বেষও নিফাকের আলামত। আবার আনসারদের মহব্বত যেরূপ ঈমানের আলামত, আলীর মহব্বতও ঈমানের আলামত।
মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম আরও বলেন, খারেজিরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পছন্দ করে না; বরং তাকে কাফির বলে অথচ তারা মুনাফিক নয়, তবে তাদের অপরাধ অনেক বড়। দলীল বলে, তারা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন দল। অনুরূপ বাতেনিরা আলিকে মহব্বত করে, অথচ সবার কাছে তারা কাফির। রাফেযীরাও আলিকে মহব্বত করে, অথচ তাদের গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা সবার নিকট স্পষ্ট। যাই বলা হোক যার অন্তর পরিশুদ্ধ এবং যার দীন সঠিক আছে, তার থেকে কখনো সাহাবীদের গাল-মন্দ, তাদের ছিদ্রান্বেষণ ও সমালোচনা প্রকাশ পেতে পারে না। আল্লাহর নিকট পানাহ চাই”। [রিয়াদুল মুস্তাতাবাহ পৃ. ১৯৫।]
ইমাম যাহাবী (মিযানুল ই‘তিদাল) গ্রন্থে বলেন, “যদি প্রশ্ন করা হয়, একজন বিদ‘আতীকে কিভাবে আপনারা নির্ভরযোগ্য বলেন এবং সেকাহ রাবী তথা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বিশেষণ, যেমন আদালাত ও ইতকান দ্বারা কীভাবে তাকে বিশেষায়িত করেন? বিদ‘আতী কীভাবে আদিল তথা নির্ভরযোগ্য হয়?! এ প্রশ্নের উত্তর: বিদ‘আত দু’প্রকার: ছোট বিদ‘আত, যেমন সীমালঙ্ঘন ও অতিরঞ্জন ব্যতীত শিয়া মতবাদ। তাবে‘ঈ ও তাদের কতক অনুসারীর ভেতর এ জাতীয় বিদ‘আত ছিল, যদিও তাদের দীনদারি, তাকওয়া ও সততার ঘাটতি ছিল না। এমতাবস্থায় তাদের হাদীস যদি প্রত্যাখ্যান করা হয়, তাহলে হাদীসের বিরাট অংশ হাতছাড়া হবে সন্দেহ নেই। অতএব, গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া হাদীসের বড় অংশ প্রত্যাখ্যান করা একটি বড় ভুল, সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয় প্রকার, বড় বিদ‘আত। যেমন, পরিপূর্ণভাবে রাফেযী হওয়া, রাফেযী মতবাদ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, আবু বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখদের সম্মানহানি করা। এ জাতীয় মতবাদ প্রচার করা বড় বিদ‘আত। এরূপ বিদ‘আতী নির্ভরযোগ্য নয়, বরং লাঞ্ছিত। বর্তমান এমন কোনো রাফেযী নেই যে সত্যবাদী ও বিশ্বাসযোগ্য, বরং মিথ্যাই তাদের প্রতীক, তুকইয়া ও নেফাকই তাদের বৈশিষ্ট্য। অতএব, তাদের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। পূর্বযুগে সীমালঙ্ঘনকারী শিয়া দ্বারা তাদেরকে বুঝানো হত, যারা উসমান, যুবায়ের, তালহা, মুয়াবিয়া ও কিছু সংখ্যক সাহাবী সম্পর্কে, যারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, বিরূপ মন্তব্য ও গাল-মন্দ করত। আমাদের যুগে সীমালঙ্ঘনকারী রাফেযীর অর্থ যারা তাদেরকে কাফির বলে এবং আবু বকর ও ওমরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এটা তাদের স্পষ্ট গোমরাহী, বলার অপেক্ষা রাখে না”। [মিযানুল ই‘তিদাল (১/৫)।]
কতক মুহাদ্দিস শিয়া মতাবলম্বী দোষে দুষ্ট ছিলেন, যেমন আবু নু‘আইম ফাদল ইবন দুকান, তিনি ইমাম বুখারীর উস্তাদ। হাফিয ইবন হাজার বলেন, “স্মৃতি শক্তি ও নির্ভুলতার ক্ষেত্রে তার অনেক প্রশংসা রয়েছে, তবে শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার কারণে অনেকে তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, এতদসত্ত্বেও সহীহ সনদে প্রমাণিত, তিনি বলেছেন, মুয়াবিয়াকে গাল-মন্দ করেছি, মালায়েকারা এমন কোনো পাপ আমার ওপর লিপিবদ্ধ করে নি”। [মুকাদ্দামাতুল ফাতহ পৃ. (৪৩৪)]
শিয়া দোষে দুষ্ট আরেকজন মুহাদ্দিস হলেন মুহাম্মদ ইবন ফুদাইল ইবন গাযওয়ান কুফি। তার সম্পর্কে হাফিয ইবন হাজার বলেন, যারা তার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন, তার কারণ ছিল তিনি শিয়া মতাদর্শী। আহমদ ইবন আলী বলেন, আমাদেরকে আবু হাশিম বলেছেন, তিনি মুহাম্মদ ইবন ফুদাইলকে বলতে শুনেছেন: আল্লাহ উসমানের ওপর রহম করুন, আল্লাহ তাকে রহম না করুন, যে উসমানের ওপর রহমতের দো‘আ করে না। আবু হাশিম আরও বলেন, আমি তার ভেতর আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের নিদর্শন দেখেছি, আল্লাহ তাকে রহম করুন”। [মুকাদ্দামাতুল ফাতহ পৃ. ৪৪১।]
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সাহাবীকে গাল-মন্দ বা লা‘নত করা বৈধ নয়, যে তাদের কাউকে লানত করে, যেমন মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান, আমর ইবনুল আস ও তাদের সমমর্যাদার কোনো সাহাবীকে অথবা তাদের থেকে উত্তম কোনো সাহাবীকে, যেমন আবু মুসা আশআরি, আবু হুরায়রা ও তাদের সমমর্যাদার কোনো সাহাবী, অথবা তাদের থেকেও উত্তম কোনো সাহাবী, যেমন তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম, উসমান ইবন আফফান, আলী ইবন আবু তালিব, অথবা আবু বকর ও উমার ইবনুল খাত্তাব অথবা মুমিনদের মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুম বা তাদের ছাড়া কোনো সাহাবীকে গাল-মন্দ করে, সকল ইমামের নিকট সে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত, তবে শাস্তি স্বরূপ সে হত্যার যোগ্য, না তার থেকে নিম্ন পর্যায়ের কোনো শাস্তির যোগ্য এ নিয়ে তারা দ্বিমত পোষণ করেছেন।
ইবন তাইমিয়াহ আরও বলেন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এমন কোনো মুহাজির নেই, যিনি নেফাকের দোষে দুষ্ট ছিলেন, বরং তারা সবাই মুমিন এবং তাদের সবার ঈমানের পক্ষে সাক্ষী রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান ও তার ন্যায় অন্যান্য সাহাবী, যারা ফাতহে মক্কার পর ইসলাম গ্রহণ করেছেন, সবাই নাজাত প্রাপ্ত দলের সদস্য, যেমন ইকরিমাহ ইবন আবু জাহল, হারিস ইবন হিশাম, সুহাইল ইবন আমর, সাফওয়ান ইবন উমাইয়াহ ও আবু সুফিয়ান ইবন হারিস ইবন আব্দুল মুত্তালিবসহ অন্যান্য সাহাবী। মুসলিমরা সবাই একমত যে, তাদের সবার ইসলাম সঠিক ছিল, পরবর্তীতে কেউ তাদেরকে নেফাকের দোষে দুষ্ট বলেননি। আর মুয়াবিয়া তো ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকেই ওহি লিখনির কাজে লিপ্ত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, উমারের খিলাফতের যুগে যখন ইয়াযিদ ইবন আবু সুফিয়ান মারা যায়, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ইয়াযিদের ভাই মুয়াবিয়াকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। আর উমার ইবনুল খাত্তাবের তীক্ষ্ণ মেধার স্বীকৃতি সর্বত্রই ছিল, মানুষ সম্পর্কে তার জানা-শুনা সবচেয়ে বেশি, তিনি দৃঢ়ভাবে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ও হক সম্পর্কে সবার চেয়ে বেশি জানতেন।
তিনি আরও বলেন, উমার কখনো কোনো মুনাফিককে মুসলিমদের নেতা নির্বাচন করেননি, আর না করেছেন আবু বকর, তাদের কেউ নিকট আত্মীয়কেও নেতা নির্বাচন করেন নি। আল্লাহর রাস্তায় তারা কোনো তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় করতেন না”।
তিনি আরও বলেন, এ কথা স্পষ্ট যে, মুয়াবিয়া, আমর ইবনুল আস ও তাদের ন্যায় অন্যান্য সাহাবীর মাঝে ফিতনা ছিল, তবুও তাদের স্বপক্ষের কিংবা বিপক্ষের কেউ তাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যা বলার অপবাদ দেন নি; বরং পরবর্তী সকল আলেম ও তাবে‘ঈ একমত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে তারা সত্যবাদী এবং হাদীসের ব্যাপারে তারা সবাই বিশ্বাসযোগ্য। পক্ষান্তরে মুনাফিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নিরাপদ নয়; বরং নবীকে তারা মিথ্যা বলেছে ও তার সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার করেছে।
তিনি আরও বলেন, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত সবাই একমত যে, কোনো সাহাবী অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আত্মীয় অথবা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কোনো মনীষী নিষ্পাপ নয়; বরং তাদের থেকে পাপ প্রকাশ পাওয়া সম্ভব, তবে তওবার কারণে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও তাদের মর্তবা বুলন্দ করবেন এবং অন্যান্য নেকি ও পাপ মোচনকারীর বিনিময়ে তাদেরকে ক্ষমা করবেন।
তিনি আরও বলেন, এসব কথা হচ্ছে সাহাবীদের নিশ্চিত পাপের ক্ষেত্রে, তবে যেখানে সাহাবীগণ ইজতিহাদ করেছেন, সেখানে কখনো ঠিক করেছেন কখনো ভুল করেছেন। যদি ঠিক করেন, দু’টি সাওয়াব, আর ভুল করলে একটি সাওয়াব, ভুলটি ক্ষমা।
তিনি আরও বলেন, আলীর সাথে যুদ্ধ করার সময় মুয়াবিয়া খিলাফতের দাবি করেননি, নিজের খিলাফতের জন্য বাই‘আতও নেন নি, আবার খলিফা হিসেবেও যুদ্ধ করেন নি, তিনি খিলাফতের হকদার জন্যও যুদ্ধ করেন নি; বরং তারা আলীর খিলাফতের স্বীকারোক্তি প্রদান করত। যে তাকে জিজ্ঞেস করত তাকে তিনি বলতেন খিলাফতের হকদার আলি। তিনি ও তার সাথীদের কেউ আলী ও তার সাথীদের সাথে যুদ্ধ করাকে বৈধ জানতেন না, বরং আলী ও তার সাথীগণ দেখলেন মুয়াবিয়া ও তার অনুসারীদের থেকে আনুগত্য আদায় ও তাকে বাই‘আত করানো জরুরি। কারণ, মুসলিমদের খলিফা একজনই হবেন। অতএব, তারা বিদ্রোহী, খলিফাকে বায়‘আত দিচ্ছে না, অধিকন্তু তারা শক্তির অধিকারী তাই তাদের বায়‘আত জরুরি। এসব চিন্তা করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের সাথে যুদ্ধ করবেন যেন আনুগত্যের ওয়াজিব তারা সোপর্দ করে এবং একচ্ছত্র আনুগত্য ও মুসলিম উম্মার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দিকে মুয়াবিয়া ও তার সাথীগণ দেখলেন বায়‘আত দেওয়া ওয়াজিব নয়, বাই‘আতের জন্য যদি তাদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তারা জুলমের স্বীকার হবেন। তাদের যুক্তি ছিল, উসমানকে মযলুমভাবে হত্যা করা হয়েছে, আসলেও তাই, আর তার হত্যাকারীরা ছিল আলীর দলে। তারা প্রভাবশালী, ক্ষমতাও তাদের হাতে ছিল।
তিনি আরও বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আম্মারকে সীমালঙ্ঘনকারী দল হত্যা করবে”। এ হাদীস চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে না যে, মুয়াবিয়া ও তার সাথীরা এ বাণীর উপযুক্ত, বরং সম্ভাবনা আছে, এ হাদীস দ্বারা তাদরেকে বুঝানো হয়েছে, যারা আম্মারের ওপর হামলা করে হত্যা করেছে, অর্থাৎ বাহিনীর একটি অংশ এবং আম্মারের হত্যায় যারা খুশি তারাও তাদের ন্যায়। এটা স্পষ্ট যে, মুয়াবিয়ার দলে এমন অনেক লোক ছিল, যারা আম্মারের হত্যায় সন্তুষ্ট ছিল না। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস ও অন্যান্য সাহাবী, বরং মুয়াবিয়া ও আমর ইবন আস সবাই আম্মারের হত্যাকে অপছন্দ করেছেন”। [মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান। ইবন তাইমিয়া রচিত।]
মোদ্দাকথা: সাহাবীদের মাঝে যেসব ফিতনা সংঘটিত হয়েছে, বুদ্ধিমানের উচিৎ সেসব ব্যাপারে তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করা। তাদের সম্পর্কে ভালো কথা বলা। সকল সাহাবীর ক্ষেত্রে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব ও মহব্বত রাখা। আর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যে, তারা ইজতিহাদ করে একটি সাওয়াব বা দু’টি সাওয়াবের ভেতর ছিলেন। তাহাভীয়া গ্রন্থের ব্যাখ্যায় আলী ও মুয়াবিয়ার ইখতিলাফের দিকে ইঙ্গিত করে খুব সুন্দর কথা বলা হয়েছে: “আমরা তাদের সবাইকে ভালো বলি:
﴿رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [ الحشر : ١٠ ]
“হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন”। [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]
অতঃপর তিনি বলেন, যে ফিতনা আলী রাদিয়াল্লাহুর যুগে হয়েছে, সেসব থেকে আল্লাহ আমাদের হাতকে মুক্ত রেখেছেন, আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের জবানকে নিজ দয়া ও অনুগ্রহে তার থেকে মুক্ত রাখেন।
আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।
(আকীদাতুত তাহাভিয়া) গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার বলেন, “মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিমদের প্রথম বাদশাহ, মুসলিমদের যত বাদশাহ হবে তাদের ভেতর তিনিই শ্রেষ্ঠ”।
ইমাম যাহাবী রহ. (সিয়ারু আলামিন নুবালা) গ্রন্থে বলেন, “মুয়াবিয়া ছিলেন আমিরুল মুমিনীন ও ইসলামের বাদশাহ”।
ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেন: আহমদ ইবন হাম্বল বলেছেন, “আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী ছিলেন খলিফা। জিজ্ঞেস করা হলো: মুয়াবিয়া সম্পর্কে কী বলেন, তিনি উত্তর দিলেন: আলীর যুগে আলী থেকে অধিক কেউ খিলাফতের যোগ্য ছিল না, আর মুয়াবিয়ার ওপর আল্লাহ রহম করুন”।
ইবন আবুদ দুনিয়া বর্ণনা করেন, উমার ইবন আব্দুল আযীয বলেছেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখলাম, তার পাশে আবু বকর ও উমারকেও বসা দেখলাম। আমি তাকে সালাম দিয়ে বসে যাই, এমতাবস্থায় আলী ও মুয়াবিয়াকে আনা হল এবং তাদেরকে একটি ঘরে দাখিল করে দরজা বন্ধ করা হল। আমি দেখলাম আলী খুব দ্রুত বের হলেন, আর বললেন, কাবার রবের কসম, আমার পক্ষেই ফয়সালা করা হয়েছে। অতঃপর মুয়াবিয়া খুব দ্রুত বের হলেন এবং বললেন, কাবার রবের কসম, আমাকে ক্ষমা করা হয়েছে”।
ইবন আসাকির বর্ণনা করেন: আবু যুর‘আহ আর-রাযীকে জনৈক ব্যক্তি বলল, আমি মুয়াবিয়াকে পছন্দ করি না, তিনি বললেন, কেন? সে বলল: কারণ সে আলীর সাথে যুদ্ধ করেছে। আবু যুর‘আহ বললেন, মুয়াবিয়ার রব খুব রহমশীল, আর মুয়াবিয়ার বিবাদীও খুব ভদ্র, তাদের মাঝে তোমাকে প্রবেশ করার অধিকার কে দিল?
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলকে মুয়াবিয়া ও আলীর মাঝে সংঘটিত ঘটনাবলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি উত্তর দিলেন:
﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسَۡٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٤١﴾ [ البقرة : 141]
“সেটা ছিল একটি উম্মত, যারা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের জন্য আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্য। আর তারা যা করেছে সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে না”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪১]
এ কথাই বলেছেন একাধিক আদর্শ পুরুষ। মুয়াবিয়া সম্পর্কে ইবন মুবারককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বললেন, আমি এমন ব্যক্তি সম্পর্কে কি বলব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বলেছেন, «سمع الله لمن حمده» তার পশ্চাতে সে বলেছে: «ربنا ولك الحمد» আমরা সবাই জানি যে, সামিয়া অর্থ ইস্তাজাবাহ, অর্থাৎ আল্লাহ কবুল করেছেন। মুয়াবিয়া রাসূলের পেছনে সালাত পড়েছেন, তিনি যখন সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলেছেন, তার পশ্চাতে মুয়াবিয়া রাব্বানা লাকাল হামদ বলেছেন। এ ফযীলত সমালোচকদের নেই। ইবন মুবারককে কেউ জিজ্ঞেস করল: কে উত্তম, মুয়াবিয়া না উমার ইবন আব্দুল আযীয? তিনি বললেন, মুয়াবিয়ার নাকের মাটিও উমার ইবন আব্দুল আযীয থেকে উত্তম”।
মুয়াফা ইবন ইমরানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: কে উত্তম, মুয়াবিয়া না উমার ইবন আব্দুল আযীয? তিনি রেগে গেলেন এবং প্রশ্নকারীকে বললেন, কোনো সাহাবীকে তুমি তাবেঈনদের সমান গণ্য কর? মুয়াবিয়া রাসূলের সাথী, শ্যালক, লেখক ও আল্লাহর ওহীর আমানতদার”।
ফাদল ইবন যিয়াদ বলেন, আবু আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসকে যে গাল-মন্দ করে, তাকে কি রাফেযী বলা যাবে? তিনি উত্তর দিলেন: সাহাবীদের ব্যাপারে একমাত্র তারাই (রাফেযীরাই গালি দেওয়ার) দুঃসাহস দেখায়, যাদের অন্তরে খারাপি রয়েছে। অন্তরে খারাপি না থাকলে কেউ কোনো সাহাবীর অসম্মান করতে পারে না।
মুহাম্মদ ইবন মুসলিম সূত্রে ইবন মুবারক বর্ণনা করেন, ইবরাহিম ইবন মায়সারাহ বলেছেন, আমি কখনো দেখি নি উমার ইবন আব্দুল আযীয কাউকে প্রহার করেছেন, তবে এক ব্যক্তিকে কয়েকটি বেত্রাঘাত করতে দেখেছি, যে মুয়াবিয়াকে গাল-মন্দ করেছিল”।
আবু তাওবাহ বলেন, মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের জন্য পর্দা স্বরূপ, যে কেউ এ পর্দা উন্মুক্ত করার দুঃসাহস দেখাবে, সে তার ভেতরে প্রবেশ করারও দুঃসাহস করবে, সন্দেহ নেই”।
উপরের অধিকাংশ বর্ণনা আল-বিদায়াহ ও আল-নিহায়াহ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত, যা ইবন কাসির রহ. মুয়াবিয়া প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেছেন। [আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (৮/১৩০-১৩৯)।]
ইমাম বুখারী (ফাযায়েলুস সাহাবাহ) সংক্রান্ত অধ্যায়ে একটি অনুচ্ছেদ কায়েম করেছেন, যার শিরোনাম: (মুয়াবিয়ার আলোচনা সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ) এতে তিনি তিনটি হাদীস উল্লেখ করেছেন:
১. ইবন আবু মুলাইকাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “মুয়াবিয়া এশার পর এক রাকাত দিয়ে বিতর পড়েছেন, তখন ইবন আব্বাসের নিকট কেউ এসে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল, তিনি বললেন, তাকে করতে দাও। কারণ, তিনি রাসূলুল্লাহর সাহচর্য গ্রহণ করেছেন”।
২. ইবন আবু মুলাইকাহ থেকে বর্ণিত, ইবন আব্বাসকে বলা হলো: আমিরুল মুমিনীন মুয়াবিয়াকে আপনি কিছু বলবেন কি? কারণ, সে এক রাকাত দিয়ে বিতর পড়েছে। তিনি বললেন, তিনি ফকীহ”।
৩. মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, কিন্তু তোমরা যে সালাত আদায় কর, সে সালাত তাকে আদায় করতে দেখি নি। তিনি আমাদেরকে আসরের পর দু’রাকাত সালাত থেকে নিষেধ করেছেন”।
হাফিয ইবন হাজার বুখারীর ব্যাখ্যায় বলেন, “ইমাম বুখারী মুয়াবিয়া সম্পর্কে যিকর শব্দ উল্লেখ করেছেন, যার বাংলা অর্থ আলোচনা। ফযীলত বা গুণাবলি অর্থ প্রকাশ করে এমন শব্দ তিনি ব্যবহার করেননি, কারণ অনুচ্ছেদের হাদীস থেকে মুয়াবিয়ার ফযীলত প্রমাণ হয় না, তবে ইবন আব্বাস তাকে যে ফকীহ ও সাহাবী বলেছেন এ থেকে তার ফযীলত প্রমাণ হয়। মুয়াবিয়ার ফযীলত সম্পর্কে ইবন আবু আসিম একটি পুস্তিকা লিখেছেন। অনুরূপ তার ফযীলত সম্পর্কে আরও লিখেছেন আবু উমার ও আবু বকর নাক্কাশ। এসব গ্রন্থে তারা মুয়াবিয়ার ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন, যার বেশ কিছু হাদীসকে ইবনুল জাওযী মাওদু‘আত গ্রন্থে বানোয়াট বলেছেন। অতঃপর ইবনুল জাওযী বলেন, ইসহাক ইবন রাহওয়াইহ বলেছেন, মুয়াবিয়ার ফযীলত সংক্রান্ত বিশুদ্ধ কোনো হাদীস নেই। এ রহস্যের কারণেই ইমাম বুখারী উস্তাদের কথা আমলে নিয়ে মুয়াবিয়ার ফযীলত বা গুণাবলি বলেন নি; বরং এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন, যার বাংলা অর্থ আলোচনা, তবে তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে ইজতিহাদ করেছেন, যার দ্বারা রাফেযীরা প্রত্যাখ্যাত হয়”। [ফাতহুল বারি (৭/১০৩-১০৪)।]
সহীহ মুসলিমে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুয়াবিয়া সম্পর্কে বলেছেন, “আল্লাহ তার পেট পূর্ণ না করুন”। মুসলিম স্বীয় সনদে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমি বাচ্চাদের সাথে খেলতে ছিলাম, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে পড়েন, ফলে আমি দরজার আড়ালে লুকিয়ে যাই। তিনি আমাকে দু’হাত দিয়ে ঘাড়ের উপর আঘাত করলেন এবং বললেন, যাও, মুয়াবিয়াকে ডেকে আন। তিনি বলেন, আমি গেলাম এবং ফিরে এসে বললাম মুয়াবিয়া খাচ্ছে। তিনি আবার বললেন, যাও, তাকে ডেকে আন। তিনি বলেন, আমি ফিরে এসে বললাম, মুয়াবিয়া খাচ্ছে। তখন তিনি বললেন, «لا أشبع الله بطنه» আল্লাহ তার পেট পূর্ণ না করুন।
ইমাম মুসলিম এ হাদীসের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দো‘আ সংক্রান্ত হাদীসগুলো সমাপ্ত করেছেন, যার উদ্দেশ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে বদ দো‘আ ও গাল-মন্দ প্রকাশ পায়, যদি ঐ ব্যক্তি তার উপযুক্ত না হয়, তাহলে এগুলো তার জন্য পবিত্রতা, রহমত ও সাওয়াবের দো‘আয় পরিণত হয়, অতএব, মুয়াবিয়া সম্পর্কে বাহ্যত বদ-দো‘আ প্রকৃতপক্ষে দো‘আ, যেমন তিনি অন্যান্য সাহাবীর ক্ষেত্রে বলেছেন, «تربت يمينك» তোমার হাত ধুলো মলিন হোক। «وثكلتك أمك» তোমার সর্বনাশ হোক। «عَقْرَى حَلْقَى» তোমার সন্তান না হোক। «لاكبرت سنك» তোমার বয়স না বাড়ুক।
ইমাম মুসলিম এ জাতীয় কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, তার ভেতর মুয়াবিয়ার হাদীস একটি। তার পূর্বে রয়েছে আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস। আনাস বলেন, উম্মে সুলাইমের নিকট এক ইয়াতীম মেয়ে ছিল, উম্মে সুলাইম মূলত তারই মা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াতিম মেয়েটি দেখে বলেন, “তুমিই কি সেই মেয়ে, তুমি তো বড় হয়ে গিয়েছ, তোমার বয়স না বাড়ুক”। মেয়েটি উম্মে সুলাইমের নিকট কাঁদতে কাঁদতে গেল। উম্মে সুলাইম বললেন, হে মেয়ে, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বদ-দো‘আ করেছেন। এখন থেকে আমি বড় হবো না। উম্মে সুলাইম মাটিতে ওড়না হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে দ্রুত রাসূলকে গিয়ে ধরলেন। রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু বললেন, হে উম্মে সুলাইম, কি হয়েছে? সে বলল: আল্লাহর রাসূল, আমার ইয়াতিম মেয়েটিকে আপনি বদ-দো‘আ করেছেন? তিনি বললেন, উম্মে সুলাইম, সে কি? সে বলল: মেয়েটি মনে করছে, আপনি তাকে বদ-দো‘আ করেছেন, যেন তার বয়স না বাড়ুক। আনাস বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন। অতঃপর বললেন, হে উম্মে সুলাইম, আমার রবের নিকট আমর শর্তগুলো তুমি জান না, আমার রবের কাছে শর্ত করেছি যে, আমি একজন মানুষ, মানুষ যেরূপ সন্তুষ্ট হয় আমিও সেরূপ সন্তুষ্ট হই, মানুষ যেরূপ রাগ করে আমিও সেরূপ রাগ করি। আমার যে উম্মতের ওপর আমি বদ-দো‘আ করি, যার উপযুক্ত সে নয়, সেটিকে তার জন্য পবিত্রতা ও নৈকট্য বানিয়ে দিন, যার বিনিময়ে কিয়ামতের দিন আপনি তাকে নৈকট্য দিবেন”।
এ হাদীস শেষে ইমাম মুসলিম মুয়াবিয়ার দো‘আ সংক্রান্ত হাদীস এনেছেন, যাতে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তার পেট পূর্ণ না করুন। লক্ষ্য করুন, ইমাম মুসলিম একটি জটিল বিষয়কে খুব চমৎকারভাবে সমাধান করেছেন, অন্যথায় মুয়াবিয়া সম্পর্কে অনেকের ধারণা খারাপ হত। এটাই তার কিতাবের এক বড় বৈশিষ্ট্য। এখানে প্রমাণ হয় তার সূক্ষ্ম বুঝ ও তীক্ষ্ণ ইজতিহাদ। আল্লাহ তার ওপর রহম করুন।
ইমাম নাওয়াওয়ী মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, “ইমাম মুসলিম এ হাদীস থেকে বুঝেছেন, মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বদ দো‘আর উপযুক্ত ছিলেন না, তাই এখানে তার আলোচনা করেছেন। ইমাম মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য মুহাদ্দিস এটাকে মুয়াবিয়ার প্রশংসা গণ্য করেছেন, কারণ তারা জেনেছেন পরবর্তীতে এটা মুয়াবিয়ার জন্য দো‘আয় পরিণত হয়েছে।
﴿وَمَن قُتِلَ مَظۡلُومٗا فَقَدۡ جَعَلۡنَا لِوَلِيِّهِۦ سُلۡطَٰنٗا فَلَا يُسۡرِف فِّي ٱلۡقَتۡلِۖ إِنَّهُۥ كَانَ مَنصُورٗا ٣٣﴾ [ الإسراء : 33]
ইবন কাসির রহ. আল্লাহ তা‘আলার উক্ত বাণীর তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, অত্র আয়াতের ব্যাপকতা থেকে ইবন আব্বাস বুঝেছেন যে, মুয়াবিয়া কর্তৃত্বের অধিকারী ও রাজত্বের মালিক হবেন। কারণ, তিনি উসমানের অলী তথা অভিভাবক ছিলেন। উসমানকে মযলুম অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট দাবি করেছেন, যেন তার কাছে উসমানের হত্যাকারীদের সোপর্দ করা হয়, তিনি তাদের থেকে কিসাস নিবেন; কারণ, তিনি উমাওয়ী তথা উসমানের বংশধর। এ দিকে আলী চেয়েছেন তার কাছে সুযোগ আসুক, যেন তার ক্ষমতা দৃঢ় ও পরিপক্ব হয়, তাই মুয়াবিয়াকে বলছেন আমার হাতে আগে শামকে সোপর্দ করুন। মুয়াবিয়া শামকে সোপর্দ করতে অস্বীকার করেন, যতক্ষণ না তার নিকট উসমানের হত্যাকারীদের সোপর্দ করা হয়। এ অজুহাতে তিনি ও শামের লোকেরা আলীর নিকট বায়‘আত থেকে বিরত থাকেন, অতঃপর দীর্ঘ সময় পর মুয়াবিয়া শক্তিশালী হন ও তার নিকট রাজত্ব চলে যায়, যেমন ইবন আব্বাস এই আয়াত থেকে ইজতিহাদ করেছেন। এটা আশ্চর্য ঘটনার একটি”। [তাফসীরে ইবন কাসির (৩/৩৮)।]
সহীহ বুখারীতে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আনসারিদের মহব্বত করা ঈমানের নিদর্শন, আর তাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা নিফাকের নিদর্শন”।
হাফিয ইবন হাজার (ফাতহুল বারি) গ্রন্থে বলেন, আনসারদের ফযীলত তাদেরও হাসিল হবে, যারা আনসারদের ন্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্য করার কাজে অংশীদারি হবে। অতঃপর তিনি বলেন, সহীহ মুসলিমে আলী রাদিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন, “মুমিন ছাড়া কেউ তোমাকে মহব্বত করবে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ তোমাকে অপছন্দ করবে না”। এ ফযীলত অন্যান্য সাহাবীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
(আল-মুফহিম) এর গ্রন্থকার বলেন, “যেসব যুদ্ধ-বিগ্রহ সাহাবীদের মাঝে সংঘটিত হয়েছে, তাতে যদিও একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ ছিল, তবে সেটা নিফাক পর্যায়ের ছিল না, বরং কোনো এক বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ছিল, যার থেকে বিরোধিতার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য কেউ কাউকে নিফাকের দোষে দুষ্ট বলেন নি, এসব ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা ছিল মুজতাহিদের মত, যে ঠিক করেছে তার দু’টি সাওয়াব আর যে ভুল করেছে তার একটি সাওয়াব। আল্লাহ তা‘আলা ভালো জানেন। [ফাতহুল বারি: (১/৬৩)]
শাইখ ইয়াহইয়া ইবন আবু বকর আমেরী ইয়ামানী আবু মুসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবনী আলোচনায় বলেন, মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম বর্ণনা করেছেন: “ইসলামের শুরুতে আলীর বিদ্বেষ নিফাকের আলামত ছিল। কারণ, সে ছিল মুনাফিকদের আতঙ্ক। অনুরূপ হাদীসে এসেছে আনসারদের বিদ্বেষও নিফাকের আলামত। আবার আনসারদের মহব্বত যেরূপ ঈমানের আলামত, আলীর মহব্বতও ঈমানের আলামত।
মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম আরও বলেন, খারেজিরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পছন্দ করে না; বরং তাকে কাফির বলে অথচ তারা মুনাফিক নয়, তবে তাদের অপরাধ অনেক বড়। দলীল বলে, তারা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন দল। অনুরূপ বাতেনিরা আলিকে মহব্বত করে, অথচ সবার কাছে তারা কাফির। রাফেযীরাও আলিকে মহব্বত করে, অথচ তাদের গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা সবার নিকট স্পষ্ট। যাই বলা হোক যার অন্তর পরিশুদ্ধ এবং যার দীন সঠিক আছে, তার থেকে কখনো সাহাবীদের গাল-মন্দ, তাদের ছিদ্রান্বেষণ ও সমালোচনা প্রকাশ পেতে পারে না। আল্লাহর নিকট পানাহ চাই”। [রিয়াদুল মুস্তাতাবাহ পৃ. ১৯৫।]
ইমাম যাহাবী (মিযানুল ই‘তিদাল) গ্রন্থে বলেন, “যদি প্রশ্ন করা হয়, একজন বিদ‘আতীকে কিভাবে আপনারা নির্ভরযোগ্য বলেন এবং সেকাহ রাবী তথা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বিশেষণ, যেমন আদালাত ও ইতকান দ্বারা কীভাবে তাকে বিশেষায়িত করেন? বিদ‘আতী কীভাবে আদিল তথা নির্ভরযোগ্য হয়?! এ প্রশ্নের উত্তর: বিদ‘আত দু’প্রকার: ছোট বিদ‘আত, যেমন সীমালঙ্ঘন ও অতিরঞ্জন ব্যতীত শিয়া মতবাদ। তাবে‘ঈ ও তাদের কতক অনুসারীর ভেতর এ জাতীয় বিদ‘আত ছিল, যদিও তাদের দীনদারি, তাকওয়া ও সততার ঘাটতি ছিল না। এমতাবস্থায় তাদের হাদীস যদি প্রত্যাখ্যান করা হয়, তাহলে হাদীসের বিরাট অংশ হাতছাড়া হবে সন্দেহ নেই। অতএব, গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া হাদীসের বড় অংশ প্রত্যাখ্যান করা একটি বড় ভুল, সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয় প্রকার, বড় বিদ‘আত। যেমন, পরিপূর্ণভাবে রাফেযী হওয়া, রাফেযী মতবাদ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, আবু বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখদের সম্মানহানি করা। এ জাতীয় মতবাদ প্রচার করা বড় বিদ‘আত। এরূপ বিদ‘আতী নির্ভরযোগ্য নয়, বরং লাঞ্ছিত। বর্তমান এমন কোনো রাফেযী নেই যে সত্যবাদী ও বিশ্বাসযোগ্য, বরং মিথ্যাই তাদের প্রতীক, তুকইয়া ও নেফাকই তাদের বৈশিষ্ট্য। অতএব, তাদের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। পূর্বযুগে সীমালঙ্ঘনকারী শিয়া দ্বারা তাদেরকে বুঝানো হত, যারা উসমান, যুবায়ের, তালহা, মুয়াবিয়া ও কিছু সংখ্যক সাহাবী সম্পর্কে, যারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, বিরূপ মন্তব্য ও গাল-মন্দ করত। আমাদের যুগে সীমালঙ্ঘনকারী রাফেযীর অর্থ যারা তাদেরকে কাফির বলে এবং আবু বকর ও ওমরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এটা তাদের স্পষ্ট গোমরাহী, বলার অপেক্ষা রাখে না”। [মিযানুল ই‘তিদাল (১/৫)।]
কতক মুহাদ্দিস শিয়া মতাবলম্বী দোষে দুষ্ট ছিলেন, যেমন আবু নু‘আইম ফাদল ইবন দুকান, তিনি ইমাম বুখারীর উস্তাদ। হাফিয ইবন হাজার বলেন, “স্মৃতি শক্তি ও নির্ভুলতার ক্ষেত্রে তার অনেক প্রশংসা রয়েছে, তবে শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার কারণে অনেকে তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, এতদসত্ত্বেও সহীহ সনদে প্রমাণিত, তিনি বলেছেন, মুয়াবিয়াকে গাল-মন্দ করেছি, মালায়েকারা এমন কোনো পাপ আমার ওপর লিপিবদ্ধ করে নি”। [মুকাদ্দামাতুল ফাতহ পৃ. (৪৩৪)]
শিয়া দোষে দুষ্ট আরেকজন মুহাদ্দিস হলেন মুহাম্মদ ইবন ফুদাইল ইবন গাযওয়ান কুফি। তার সম্পর্কে হাফিয ইবন হাজার বলেন, যারা তার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন, তার কারণ ছিল তিনি শিয়া মতাদর্শী। আহমদ ইবন আলী বলেন, আমাদেরকে আবু হাশিম বলেছেন, তিনি মুহাম্মদ ইবন ফুদাইলকে বলতে শুনেছেন: আল্লাহ উসমানের ওপর রহম করুন, আল্লাহ তাকে রহম না করুন, যে উসমানের ওপর রহমতের দো‘আ করে না। আবু হাশিম আরও বলেন, আমি তার ভেতর আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের নিদর্শন দেখেছি, আল্লাহ তাকে রহম করুন”। [মুকাদ্দামাতুল ফাতহ পৃ. ৪৪১।]
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সাহাবীকে গাল-মন্দ বা লা‘নত করা বৈধ নয়, যে তাদের কাউকে লানত করে, যেমন মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান, আমর ইবনুল আস ও তাদের সমমর্যাদার কোনো সাহাবীকে অথবা তাদের থেকে উত্তম কোনো সাহাবীকে, যেমন আবু মুসা আশআরি, আবু হুরায়রা ও তাদের সমমর্যাদার কোনো সাহাবী, অথবা তাদের থেকেও উত্তম কোনো সাহাবী, যেমন তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম, উসমান ইবন আফফান, আলী ইবন আবু তালিব, অথবা আবু বকর ও উমার ইবনুল খাত্তাব অথবা মুমিনদের মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুম বা তাদের ছাড়া কোনো সাহাবীকে গাল-মন্দ করে, সকল ইমামের নিকট সে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত, তবে শাস্তি স্বরূপ সে হত্যার যোগ্য, না তার থেকে নিম্ন পর্যায়ের কোনো শাস্তির যোগ্য এ নিয়ে তারা দ্বিমত পোষণ করেছেন।
ইবন তাইমিয়াহ আরও বলেন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এমন কোনো মুহাজির নেই, যিনি নেফাকের দোষে দুষ্ট ছিলেন, বরং তারা সবাই মুমিন এবং তাদের সবার ঈমানের পক্ষে সাক্ষী রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান ও তার ন্যায় অন্যান্য সাহাবী, যারা ফাতহে মক্কার পর ইসলাম গ্রহণ করেছেন, সবাই নাজাত প্রাপ্ত দলের সদস্য, যেমন ইকরিমাহ ইবন আবু জাহল, হারিস ইবন হিশাম, সুহাইল ইবন আমর, সাফওয়ান ইবন উমাইয়াহ ও আবু সুফিয়ান ইবন হারিস ইবন আব্দুল মুত্তালিবসহ অন্যান্য সাহাবী। মুসলিমরা সবাই একমত যে, তাদের সবার ইসলাম সঠিক ছিল, পরবর্তীতে কেউ তাদেরকে নেফাকের দোষে দুষ্ট বলেননি। আর মুয়াবিয়া তো ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকেই ওহি লিখনির কাজে লিপ্ত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, উমারের খিলাফতের যুগে যখন ইয়াযিদ ইবন আবু সুফিয়ান মারা যায়, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ইয়াযিদের ভাই মুয়াবিয়াকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। আর উমার ইবনুল খাত্তাবের তীক্ষ্ণ মেধার স্বীকৃতি সর্বত্রই ছিল, মানুষ সম্পর্কে তার জানা-শুনা সবচেয়ে বেশি, তিনি দৃঢ়ভাবে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ও হক সম্পর্কে সবার চেয়ে বেশি জানতেন।
তিনি আরও বলেন, উমার কখনো কোনো মুনাফিককে মুসলিমদের নেতা নির্বাচন করেননি, আর না করেছেন আবু বকর, তাদের কেউ নিকট আত্মীয়কেও নেতা নির্বাচন করেন নি। আল্লাহর রাস্তায় তারা কোনো তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় করতেন না”।
তিনি আরও বলেন, এ কথা স্পষ্ট যে, মুয়াবিয়া, আমর ইবনুল আস ও তাদের ন্যায় অন্যান্য সাহাবীর মাঝে ফিতনা ছিল, তবুও তাদের স্বপক্ষের কিংবা বিপক্ষের কেউ তাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যা বলার অপবাদ দেন নি; বরং পরবর্তী সকল আলেম ও তাবে‘ঈ একমত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে তারা সত্যবাদী এবং হাদীসের ব্যাপারে তারা সবাই বিশ্বাসযোগ্য। পক্ষান্তরে মুনাফিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নিরাপদ নয়; বরং নবীকে তারা মিথ্যা বলেছে ও তার সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার করেছে।
তিনি আরও বলেন, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত সবাই একমত যে, কোনো সাহাবী অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আত্মীয় অথবা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কোনো মনীষী নিষ্পাপ নয়; বরং তাদের থেকে পাপ প্রকাশ পাওয়া সম্ভব, তবে তওবার কারণে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও তাদের মর্তবা বুলন্দ করবেন এবং অন্যান্য নেকি ও পাপ মোচনকারীর বিনিময়ে তাদেরকে ক্ষমা করবেন।
তিনি আরও বলেন, এসব কথা হচ্ছে সাহাবীদের নিশ্চিত পাপের ক্ষেত্রে, তবে যেখানে সাহাবীগণ ইজতিহাদ করেছেন, সেখানে কখনো ঠিক করেছেন কখনো ভুল করেছেন। যদি ঠিক করেন, দু’টি সাওয়াব, আর ভুল করলে একটি সাওয়াব, ভুলটি ক্ষমা।
তিনি আরও বলেন, আলীর সাথে যুদ্ধ করার সময় মুয়াবিয়া খিলাফতের দাবি করেননি, নিজের খিলাফতের জন্য বাই‘আতও নেন নি, আবার খলিফা হিসেবেও যুদ্ধ করেন নি, তিনি খিলাফতের হকদার জন্যও যুদ্ধ করেন নি; বরং তারা আলীর খিলাফতের স্বীকারোক্তি প্রদান করত। যে তাকে জিজ্ঞেস করত তাকে তিনি বলতেন খিলাফতের হকদার আলি। তিনি ও তার সাথীদের কেউ আলী ও তার সাথীদের সাথে যুদ্ধ করাকে বৈধ জানতেন না, বরং আলী ও তার সাথীগণ দেখলেন মুয়াবিয়া ও তার অনুসারীদের থেকে আনুগত্য আদায় ও তাকে বাই‘আত করানো জরুরি। কারণ, মুসলিমদের খলিফা একজনই হবেন। অতএব, তারা বিদ্রোহী, খলিফাকে বায়‘আত দিচ্ছে না, অধিকন্তু তারা শক্তির অধিকারী তাই তাদের বায়‘আত জরুরি। এসব চিন্তা করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের সাথে যুদ্ধ করবেন যেন আনুগত্যের ওয়াজিব তারা সোপর্দ করে এবং একচ্ছত্র আনুগত্য ও মুসলিম উম্মার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দিকে মুয়াবিয়া ও তার সাথীগণ দেখলেন বায়‘আত দেওয়া ওয়াজিব নয়, বাই‘আতের জন্য যদি তাদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তারা জুলমের স্বীকার হবেন। তাদের যুক্তি ছিল, উসমানকে মযলুমভাবে হত্যা করা হয়েছে, আসলেও তাই, আর তার হত্যাকারীরা ছিল আলীর দলে। তারা প্রভাবশালী, ক্ষমতাও তাদের হাতে ছিল।
তিনি আরও বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আম্মারকে সীমালঙ্ঘনকারী দল হত্যা করবে”। এ হাদীস চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে না যে, মুয়াবিয়া ও তার সাথীরা এ বাণীর উপযুক্ত, বরং সম্ভাবনা আছে, এ হাদীস দ্বারা তাদরেকে বুঝানো হয়েছে, যারা আম্মারের ওপর হামলা করে হত্যা করেছে, অর্থাৎ বাহিনীর একটি অংশ এবং আম্মারের হত্যায় যারা খুশি তারাও তাদের ন্যায়। এটা স্পষ্ট যে, মুয়াবিয়ার দলে এমন অনেক লোক ছিল, যারা আম্মারের হত্যায় সন্তুষ্ট ছিল না। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস ও অন্যান্য সাহাবী, বরং মুয়াবিয়া ও আমর ইবন আস সবাই আম্মারের হত্যাকে অপছন্দ করেছেন”। [মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান। ইবন তাইমিয়া রচিত।]
মোদ্দাকথা: সাহাবীদের মাঝে যেসব ফিতনা সংঘটিত হয়েছে, বুদ্ধিমানের উচিৎ সেসব ব্যাপারে তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করা। তাদের সম্পর্কে ভালো কথা বলা। সকল সাহাবীর ক্ষেত্রে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব ও মহব্বত রাখা। আর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যে, তারা ইজতিহাদ করে একটি সাওয়াব বা দু’টি সাওয়াবের ভেতর ছিলেন। তাহাভীয়া গ্রন্থের ব্যাখ্যায় আলী ও মুয়াবিয়ার ইখতিলাফের দিকে ইঙ্গিত করে খুব সুন্দর কথা বলা হয়েছে: “আমরা তাদের সবাইকে ভালো বলি:
﴿رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [ الحشر : ١٠ ]
“হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন”। [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]
অতঃপর তিনি বলেন, যে ফিতনা আলী রাদিয়াল্লাহুর যুগে হয়েছে, সেসব থেকে আল্লাহ আমাদের হাতকে মুক্ত রেখেছেন, আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের জবানকে নিজ দয়া ও অনুগ্রহে তার থেকে মুক্ত রাখেন।
আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন