HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
আল্লাহর দিকে আহ্বান ও দাঈর গুণাবলি
লেখকঃ শাইখ আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন বায রহ.
৫
তৃতীয় বিষয়: দা‘ওয়াতের বিষয় বস্তুদা‘ওয়াত কর্মী বা দা‘ঈ লোক অপরকে কোন বিষয়ের প্রতি দা‘ওয়াত দিবে:
যে বস্তুর দিকে দা‘ওয়াত দেয়া হবে, আর যে বিষয়টি আল্লাহর পথে আহ্বানকারীগণকে মানুষদের নিকট ব্যাখ্য-বিশ্লেষনসহ উপস্থাপন করতে হবে, যেমনটি করেছিলেন যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ, সেটি হচ্ছে, ‘‘আল্লাহর সরল পথের দিকে দা‘ওয়াত’’। অন্যভাবে বললে ‘‘ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত’’। এটাই আল্লাহর সত্য ধর্ম এবং এটাই দা‘ওয়াত স্থল। যেমন আল্লাহ বলেছেন:
﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ﴾ [ النحل : ١٢٥ ]
‘তুমি তোমার রবের পথের দিকে আহ্বান কর’। অতএব আল্লাহর পথ হল ইসলাম, এটাই সিরাতুল মুসতাকিম, এটা ঐ দ্বীন যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন স্বীয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। এদিকেই দা‘ওয়াত দেয়া ফরয। কোন মাযহাব, কোন ব্যাক্তির বিশ্বাস-মতবাদ নয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের দিকে, সিরাতে মুস্তাকিমের দিকে, যা দিয়ে আল্লাহ স্বীয় নবী ও খলিল মুহাম্মদ আলাইহিসসালাতু ওয়াসসালামকে প্রেরণ করেছেন। এটাই কুরআনুল কারিম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হাদিস থেকে বুঝা যায়।
সিরাতে মুস্তাকিম তথা ইসলামের প্রতি দা‘ওয়াত দানের ক্ষেত্রে গুরুত্বের ক্রমধারা বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। তাই সর্বাগ্রে দা‘ওয়াত দিতে হবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির প্রতি।
এর মধ্যে সর্বপ্রথম দা‘ওয়াত হবে সহিহ আক্বিদাহর প্রতি, ইখলাস ও ইবাদত-উপাসনায় আল্লাহর তাওহীদের প্রতি, আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের উপর ঈমান আনয়নের প্রতি, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছুর সংবাদ দিয়েছেন সেগুলোর উপর ঈমান আনয়নের তার প্রতি। এগুলোই সিরাতুল মুস্তাকিমের ভিত্তিমূল। এটিই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এর প্রতি দা‘ওয়াতের প্রতিভূ। ব্যাপকভাবে এর বিশেষণ করলে অর্থ এই দাড়ায়, তাওহীদ তথা একত্ববাদ ও ইখলাসের দিকে দা‘ওয়াত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমানের দিকে দা‘ওয়াত। এ ব্যাপকতার ভিতর ঐ সকল বিষয়াদিও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যা সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সংবাদ দিয়েছেন এবং যা ইতঃপূর্বে ঘটেছে আর যা কেয়ামতের পূর্বে ও পরে ঘটবে, আর শেষ যমানায় যা যা সংঘটিত হবে।
একইভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক ফরযকৃত বিষয়াবলী যেমন, নামায কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রোযা পালন করা ও আল্লাহর পবিত্র ঘরে হজ্জ করার প্রতি দা‘ওয়াত।
আরও যুক্ত হয় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ, পবিত্রতা, লেন-দেন, বিবাহ-তালাক, ভরণ পোষণ, যুদ্ধ-শান্তি অর্থাৎ সকল ব্যাপারে আল্লাহর বিধান গ্রহণ করার প্রতি দা‘ওয়াত। কারণ আল্লাহর দ্বীন হচ্ছে ব্যাপক ও পরিপূর্ণ, ইহকাল ও পরকালে বান্দার যাবতীয় প্রয়োজন ও কল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করে।
আরো আহ্বান করবে উত্তম চরিত্র এবং সুন্দর কাজের দিকে, নিষেধ করবে অসৎ চরিত্র এবং খারাপ কাজ থেকে। সুতরাং তা হবে ইবাদাত (উপাসনা) ও ক্বিয়াদাত (নেতৃত্বদান)। একজন দা‘ওয়াত কর্মী একই সাথে ‘আবেদ (উপাসক) ও সেনাবাহিনীর কায়েদ (নেতা) হিসেবে গড়ে উঠবে।
অনুরূপভাবে দা‘ওয়াত ইবাদাত ও বিচার ব্যবস্থাকে শামিল করে, সুতরাং একজন দা‘ঈ যেভাবে নামায ও রোযা পালনকারী, তদ্রূপ সে আল্লাহর বিধান মত বিচারক ও আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়নকারীরূপে বিবেচিত হবে।
এভাবেই দা‘ওয়াত ইবাদাত ও জিহাদকেও শামিল করে, সে হিসাবে একজন দা‘ঈ আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে এবং যে আল্লাহর দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করবে।
দা‘ওয়াত হল- কুরআন ও হাতিয়ার, সুতরাং দা‘ঈ কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, শক্তি সাহস দিয়ে তা বাস্তবায়ন করবে আর যদি প্রয়োজন হয় অস্ত্র ব্যবহার করবে।
দা‘ওয়াত হল- রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা, তাই দা‘ঈ একই সাথে আহ্বান করবে উন্নত চরিত্র, ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দিকে এবং মুসলিমদের মাঝে হৃদ্যতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রতি দৃষ্টি দিবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا وَلَا تَفَرَّقُواْۚ﴾ [ ال عمران : ١٠٣ ]
‘তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।’ [সূরা আলে ইমরান:১০৩]
সম্মানিত পাঠক! আমরা আপাত দৃষ্টিতে বিচার করলে দ্বীন ইসলামীর বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পাব যে, আল্লাহর দ্বীন ঐক্যের দিকে আহ্বান করে, প্রজ্ঞাপূর্ণ বিশুদ্ধ রাজনীতির দিকে আহ্বান করে, যা পারস্পরিক সম্পর্ক ও মিল সৃষ্টি করে অমিল ও বিচ্ছিন্নতা দূর করে। হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ করে দূরত্ব ও ভিন্নতা অপসারণ করে।
ইসলামী জীবন বিধান আত্মার শুদ্ধিতা ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বকে সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানায়।
আবেদন জানায় নেক ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতার, আল্লাহ ও বান্দার জন্য কল্যাণ কামনার।
এমনি ভাবে আবেদন জানায় আমানত আদায় ও শরয়ী রীতি অনুযায়ী বিচার ও শাসন কার্য পরিচালনার এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন নি এমন বিচার পরিহারের দিকে। যেমন আল্লাহ বলেন:
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا وَإِذَا حَكَمۡتُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ أَن تَحۡكُمُواْ بِٱلۡعَدۡلِۚ﴾ [ النساء : ٥٨ ]
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানত তার হকদারের নিকট প্রত্যার্পণ করতে। এবং তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।’ [সূরা নিসা:৫৮]
এমনিভাবে দা‘ওয়াত হল, রাজনীতি ও অর্থনীতি; যেমনিকরে এটি রাজনীতি, ইবাদত ও জিহাদ। তাই এটি আহ্বান জানায় সুষম শর‘য়ী অর্থনীতির দিকে। জুলুম নির্ভর পুজিবাদী অর্থনীতি নয়, যা বৈধতা ও শালীনতার ধার ধারে না, বরং মূল লক্ষ্য হচ্ছে যেকোন পন্থায় সম্পদ উপার্জন করা। নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজমের অর্থনীতিও নয়, যাতে মানুষের সম্পদের প্রতি প্রতি কোন শ্রদ্ধবোধ নেই তাদের উপর জুলুম-নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ করতেও দ্বিধা-সংকোচ করে না। ইসলামী অর্থনীতি এর কোনটিই নয় বরং উভয় অর্থ ব্যবস্থার মাঝামাঝি, উভয় পথের মাঝামাঝি, দুইটি বাতিলের মাঝে একটি হক্ব-সঠিক পথ।
পাশ্চাত্য সমাজ সম্পদকে অনেক বড় করে দেখেছে তাই সম্পদ বৃদ্ধির অভিপায়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছে। সম্পদ জমা করার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল পন্থায় চেষ্টা করেছে এমনকি আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ পন্থাও। অন্যদিকে প্রাচ্যের সোভিয়েতী নাস্তিক্য সমাজ এবং যারা তাদের মতবাদ অবলম্বন করেছে তারা মানুষের সম্পদের ন্যূনতম মর্যাদা দেয় নি বরং গণমানুষের সম্পদ লুটপাট করে নিজেদের করে নিয়েছে; বৈধ করে নিয়েছে। এসব কাজ করতে তাদের বিবেক মোটেও বাধা দেয়নি। তারা জনসাধারণকে দাসে পরিণত করেছে, তাদের উপর নির্যাতন করেছে নির্দয়ভাবে। আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে, আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মসমূহকে অস্বীকার করেছে। তাদের মতবাদ ছিল, لاإله، والحياة مادة ‘কোন ইলাহ নেই, সম্পদ বা বস্তুই জীবন’। এভাবে সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে তারা নীতি- নৈতিকতা নিয়ে ভাবে নি, অবৈধ উপায়ে আহরণের ব্যাপারে সামান্যতম দ্বিধাও করে নি। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে কোনরূপ কসুর করে নি। মানুষ ও সম্পদ উপার্জন ও উপকৃত হওয়ার যে প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি আল্লাহ তাদের মধ্যে দিয়েছেন সে ব্যাপারটি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে নি। মানুষের মাঝে যে ক্ষমতা ও বিবেক ও তাদেরকে যে উপায়-উপকরণ আল্লাহ দিয়েছেন তা থেকে উপকৃত হতে সচেষ্ট হয় নি। সুতরাং তারা এটাও করে নি ওটাও করে নি।
ইসলাম জুলুম, প্রতারণা, সুদ ও অনৈতিক পন্থাকে এড়িয়ে অর্থনীতিতে সম্পদ উপার্জন ও সংরক্ষণের একটি বৈধ শরয়ী নীতি প্রবর্তন করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। যেমনি করে ইসলাম ব্যক্তি মালিকানা, যৌথ মালিকানাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এর স্বীকৃতি দিয়েছে আগেই। সুতরাং ইসলাম উক্ত দু’অর্থ ব্যবস্থার মধ্যবর্তী ব্যবস্থা। দু’অস্পষ্ট পন্থার মধ্যবর্তী পন্থা। ইসলাম সম্পদকে হালাল সাব্যস্ত করে তৎপ্রতি উৎসাহ দিয়েছে। প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতিতে উপার্জনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সাথে সাথে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য এবং আরোপিত বিধানাবলির ব্যাপারে উদাসীন হবার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ﴾ [ النساء : ٢٩ ]
‘হে মু’মিনগণ! তোমরা পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা ব্যতীত অন্যায় ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পত্তি গ্রাস করো না’ [সূরা নিসা, ২৯।]
নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বলেছেন:
«كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ، دَمُهُ، وَمَالُهُ، وَعِرْضُهُ»
‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের রক্ত, সম্পদ, সম্ভ্রম হারাম বা সম্মানিত আমানত (তা কোনোক্রমেই নষ্ট করা যাবে না)’ [মুসলিম: ২৫৬৪।]।
তিনি আরো বলেছেন:
«إنَّ دِمَاءَكُمْ وَأمْوَالَكُمْ وَأعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِيْ شَهْرِكُمْ فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا .....»
‘তোমাদের রক্ত, সম্পদ, সম্ভ্রম তোমাদের উপর এ সম্মানিত দিন এ সম্মানিত মাস এবং এ সম্মানিত শহরের মতই সম্মানিত’ [বুখারী : ৬৭।]।
তিনি আরো বলেছেন:
«لَأَنْ يَأْخُذَ أَحَدُكُمْ أَحْبُلًا، فَيَأْخُذَ حُزْمَةً مِنْ حَطَبٍ، فَيَبِيعَ، فَيَكُفَّ اللَّهُ بِهِ وَجْهَهُ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ النَّاسَ، أُعْطِيَ أَمْ مُنِعَ»
‘তোমাদের কেউ কিছু রশি সংগ্রহ করে, একটি লাকড়ির আঁটি সংগ্রহ করে বিক্রয়ের মাধ্যমে নিজের চেহারা তথা সম্ভ্রম রক্ষা করা লোকদের নিকট প্রার্থনা অপেক্ষা অতি উত্তম চাই লোকেরা দান করুন বা ফিরিয়ে দিক [বুখারী : ২৩৭৩।]।’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোন উপার্জন সবচেয়ে উত্তম, তিনি বললেন:
«عمل الرجل بيده وكل بيع مبرور»
“ব্যক্তির নিজ হাতের উপার্জন এবং প্রত্যেক বৈধ বেচা- কেনা [মুসনাদে আহমাদ ৪/১৪১।]।”
তিনি আরো বলেছেন:
«مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ، خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ»
“নিজ হাতে উপার্জিত সম্পদ থেকে আহারের চেয়ে উত্তম আহার আর কেউ গ্রহণ করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ নিজের উপার্জন থেকে আহার করতেন [বুখারী : ২০৭২।]।”
উপরোক্ত বিষয়গুলো আমাদের নিকট প্রচ্ছন্নভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলামী অর্থব্যবস্থা মধ্যপন্থী অর্থব্যবস্থা। পাশ্চাত্য ও তাদের অনুসারীদের অন্যায় পূঁজিবাদও নয়, আবার নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজমও নয়, যারা জনসম্পদকে নিজেদের সম্পদ জ্ঞান করেছে, সম্পদের প্রকৃত মালিকদের সম্মানকে অপদস্ত করেছে, কোনো ভ্রুক্ষেপই করে নি, সাধারণ জনগণকে দাসে পরিণত করেছে এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হালাল জ্ঞান করেছে। পক্ষান্তরে (ইসলামে) সম্পদ উপার্জনের অধিকার আপনার রয়েছে তবে শরিয়ত অনুমোদিত পন্থায়ই তা হওয়া উচিত। আপনিই আপনার সম্পদের ও তা উপার্জনের অধিক উপযুক্ত ব্যক্তি, তবে তা হতে হবে আল্লাহ প্রদর্শিত শরয়ী ও হালাল পথে।
ইসলাম তার অনুসারীদের ঈমানী ভ্রাতৃত্ব, পর হিতাকাংখিতা ও অপর মুসলিমকে সম্মান প্রদর্শনের প্রতি আহ্বান জানায় এবং হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতাসহ যাবতীয় অসদাচরণ হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ ﴾ [ التوبة : ٧١ ]
‘আর মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা হচ্ছে পরস্পর একে অপরের বন্ধু, [সূরা তাওবা, ৭১।]
﴿ إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ﴾ [ الحجرات : ١٠ ]
‘নিশ্চয় মু’মিনরা পরস্পর ভাই ভাই’ [সূরা হুজরাত, ১০।]
নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বলেন:
«المسلم أخو المسلم لا يظلمه ولا يحقره ولا يخذله»
এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে না, তাকে নিরাশ করে না...।
অতএব মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে অপর মুসলিম ভাইকে সম্মান করা, তুচ্ছ জ্ঞান না করা, তার প্রতি ন্যায়বিচার করা এবং শরিয়তসম্মত তার সকল অধিকার প্রদান করা। এসব দায়িত্ব পালন করা শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজিব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«إِنَّ المُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا»
“নিশ্চয় একজন মুমিন অপর মুমিনের সাথে যেন একটি স্থাপনা যার একাংশ অপর অংশকে শক্ত করে ধরে রাখে” [বুখারী : ৪৮১।]।
তিনি আরও বলেন,
« «الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ»
‘মুমিন মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ; আর মুমিন মুমিনের ভাই [আবু দাউদ: ৪৯১৮।]।
প্রিয় ভাই! আপনি আপনার মুমিন ভাইয়ের আয়না। ঈমানী ভ্রতৃত্বের বন্ধন যে ভীতের উপর প্রতিষ্ঠিত আপনি তার একটি ইট। আপনার ভাইয়ের অধিকারের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন, তার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হোন। তার সাথে হক, কল্যাণ ও সততার সাথে লেন-দেন করুন। আপনার একান্ত কর্তব্য হল ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে আঁকড়ে ধরা। কিছু অংশ গ্রহণ করলেন আর বাকি অংশ ছেড়ে দিলেন; এমনটি হলে চলবে না। আক্বীদা গ্রহণ করলেন আর আহকাম ও আমল ছেড়ে দিলেন কিংবা আহকাম ও আমল গ্রহণ করলেন আর আক্বিদা ছেড়ে দিলেন এমন যেন না হয়। বরং পুরো ইসলামকে গ্রহণ করুন; আক্বিদা, আমল, ইবাদত, জিহাদ, সামাজিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছু। অর্থাৎ ইসলামকে গ্রহণ করুন সামগ্রিকভাবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱدۡخُلُواْ فِي ٱلسِّلۡمِ كَآفَّةٗ وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٞ ٢٠٨ ﴾ [ البقرة : ٢٠٨ ]
‘হে মু’মিনগণ, তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবিষ্ট হও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ [সূরা রাকারা, ২০৮।]
সালাফে সালেহীনদের একটি বৃহৎ দল এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেছেন: এর অর্থ হল তোমরা পূর্ণাঙ্গ ‘নিরাপত্তা’ তথা ইসলামের মাঝে প্রবেশ কর।
ইসলামকে ‘নিরাপত্তা’ বলা হয়েছে, কারণ এটা নিরাপত্তার পথ, ইহকাল ও পরকালে মুক্তির পথ। সুতরাং এটা নিরাপত্তা ও আত্মসমর্পন। ইসলাম রক্তের হেফাযত করে, মানবতাকে নিরাপত্তার দিকে আহ্বান করে, এ জন্যই নির্ধারিত দন্ডবিধি, কেসাস, ও সত্যিকার জিহাদের প্রবর্তন করেছে (এরই মাধ্যমে বিরত রাখে রক্তপাত ও হানাহানি হতে)। অতএব এটা নিরাপত্তা ও আত্মসমর্পন, নিরাপত্তা ও ঈমান তথা সার্বিক স্বীকৃতি।
এজন্য আল্লাহ বলেছেন: ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّة অর্থাৎ ইসলামের সকল শাখায় প্রবেশ কর, কিছু গ্রহণ আর কিছু বর্জন এমনটি যেন না হয়। বরং তোমাদের কর্তব্য পুরো ইসলামকে আঁকড়ে ধরা। وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ‘‘আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না’’ অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ গুনাহ ও অবাধ্যতার রাস্তা গ্রহণ করো না। কারণ শয়তান গুনাহ ও অবাধ্যতার দিকে ডাকে এবং আল্লাহর দ্বীনকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে প্ররোচিত করে। অতএব দেখা যাচ্ছে শয়তান হচ্ছে সবচে’ বড় শত্রু, তাই প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে আঁকড়ে ধরা, তার যাবতীয় বিধি-বিধান নিয়মিত পালন করে চলা এবং আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধরা। একই সাথে মতবিরোধ ও বিচ্ছিন্নতার কারণসমূহ হতে দূরে থাকা। সুতরাং একজন মুসলিম হিসেবে আপনার করণীয় হচ্ছে, ইবাদাত-বন্দেগি, লেন-দেন, আচার-আচরণ, বিবাহ-তালাক, ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন এক কথায় মানবীয় সব কার্যাদি সম্পাদন করার ক্ষেত্রে আল্লাহর শরিয়ত পরিপূর্ণ রূপে মেনে চলা, শরিয়তের বিধি-বিধান মতে কাজ করা। এমনিভাবে শরিয়ত নির্ধারিত বিধি মেনে চলার ব্যাপারে যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা, শত্রু ও মিত্র মোট কথা সকল ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান সব ক্ষেত্রেই কার্যকর করা জরুরি, একজন আপনার মতের সাথে একমত পোষণ করেছে তাই তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন আর অন্যজন ভিন্নমত পোষণ করায় তার সাথে বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করবেন এটি কিন্তু কোনভাবেই ন্যায় সঙ্গত নয়। সুতরাং আপনাকে এসব ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। লক্ষ্য করে দেখুন, নবী সহচরবৃন্দের জীবনাচারের দিকে, কত মাসআলাতেই না তারা পরস্পর মতভিন্নতায় উপনীত হতেন অথচ এত কিছুর পরও তাদের মাঝে কি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থেকেছে। মাসআলা ও সিদ্ধান্তগত মতবিরোধের কারণে পারস্পরিক সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়ে নি। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন, আর তাদেরকে সন্তুষ্ট করুন।
সুতরাং মুমিন তার সার্বিক জীবন পরিচালনা করবে আল্লাহর বিধান মত। দ্বীনের হক সিদ্ধান্তের অনুকূলে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যুক্তি প্রমাণসহ দ্বীনকে সবার সামনে তুলে ধরবে। তবে দলিল প্রমাণ উহ্য এ ধরণের ইজতেহাদী বিষয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণের কারণে কোনোক্রমেই যেন অন্য ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করতে প্ররোচিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে খুবই সচেতনতার সাথে।
এমনিভাবে ঐ সব মাসআলাতেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেখানে আয়াত বা হাদীসের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হওয়ার অবকাশ রয়েছে। কারণ এ ওজর গ্রহণযোগ্য। তাই আপনার কর্তব্য হচ্ছে তার কল্যাণ কামনা করা, তার মঙ্গলের চিন্তা করা। এসমস্ত কারণে আপনাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ যাতে সৃষ্টি না হতে পারে সে সম্পর্কে সজাগ থাকা। কোনো শত্রু যেন আপনার বা আপনার ভাইয়ের উপর চড়াও না হতে পারে সে দিকেও খেয়াল রাখা। ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’।
ইসলাম ইনসাফের দ্বীন, হক এবং কল্যাণ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার দ্বীন, যেগুলো আল্লাহ ব্যতিক্রম ঘোষণা করেছেন সেগুলো ব্যতীত ইসলাম সাম্যের দ্বীন। এতে রয়েছে সর্বপ্রকার মঙ্গলের আহ্বান, উন্নত চরিত্রের প্রতি আহ্বান, সুন্দর কাজের প্রতি আহ্বান, ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের প্রতি আহ্বান এবং সকল অশ্লীল আচার-আচরণ থেকে দূরে থাকার আহ্বান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَٰنِ وَإِيتَآيِٕ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَيَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِ وَٱلۡبَغۡيِۚ يَعِظُكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَذَكَّرُونَ ٩٠ ﴾ [ النحل : ٩٠ ]
‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও নিকটাত্মীয়- পরিজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং নিষেধ করেন অশীলতা, অসৎকার্য ও সীমালঙ্ঘনকে, তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।’ [সূরা নাহল: ৯০।] আরও বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣ ﴾ [ الحجرات : ١٣ ]
‘হে লোকসকল! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।’ [সূরা হুজুরাত:১৩।]
সারকথা: ইসলামের দা‘ওয়াত প্রদানকারী (‘দা‘ঈ’) এর উচিত পরিপূর্ণ ইসলামের প্রতি দা‘ওয়াত দেয়া, মানুষের মাঝে কোন পার্থক্য ভেদাভেদ না করা। গোঁড়ামি করে এক মাযহাবকে বাদ দিয়ে অন্য মাযহাবের, কিংবা কোন গোত্রকে বাদ দিয়ে অন্য গোত্রের, অথবা কোন নেতা বা ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে অন্য নেতা বা ব্যক্তির পক্ষপাতিত্ব না করা। বরং তার লক্ষ্য হবে হক প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্লেষণ করা এবং মানুষদেরকে এর উপর অবিচল রাখা যদিও এটা করতে গিয়ে কারো কোনো মতামতের বিরোধিতা হয়।
যখন মানুষের মাঝে মতবাদ ও মাযহাবের প্রতি গোঁড়ামির ধারা শুরু হয় তখন তাদের কেউ কেউ এমনও বলে যে, অমুকের মাযহাব অমুকের মাযহাব হতে উত্তম, এতে করে মতবিরোধ ও দলাদলি সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে অবস্থা এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, কতিপয় মানুষ ভিন্ন মাযহাবালম্বী ইমামের ইমামতিতে নামায পড়ে না। শাফেয়ি মাযহাবের লোক হানাফি ইমামের পেছনে নামায় পড়ে না, অনুরূপভাবে হানাফি লোক মালেকি ও হাম্বলি ইমামের পেছনে। এমনটি উগ্রপন্থী-গোঁড়া লোকদের পক্ষ হতে হয়ে থাকে। এটা একটা বিশাল সমস্যা বরং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ। কারণ, সকল ইমামই হেদায়েতের পথ প্রদর্শক। ইমাম শাফে‘য়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আওযা‘ঈ, ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়াইহ প্রমুখ সকলেই হেদায়েতের পথ প্রদর্শক ও হকের দা‘ঈ হিসাবে স্বীকৃত। তারা মানুষদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহ্বান করেছেন, হকের দিকে পথনির্দেশ করেছেন। দা‘ওয়াতের এ গুরু দায়িত্ব সম্পাদন ক্ষেত্রে তারা অনেক জটিল জটিল বিষয়াদির সম্মুখীন হয়েছেন। সমাধান খুঁজতে গিয়ে দলিল প্রমাণ অস্পষ্ট থাকার কারণে পারস্পরিক মতভিন্নতায় পতিত হয়েছেন। এ ইজতেহাদের ক্ষেত্রে তারা হয়তো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদ, যার ফলে দ্বিগুণ সাওয়াব প্রাপ্ত হবেন, নয়তো ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদ যাতে একগুণ সাওয়াব প্রাপ্ত হবেন। তাহলে ইসলামের স্বীকৃত ইমামবৃন্দ সকলেই (সঠিক করুক বা ভুল) সাওয়াবের অধিকারী হয়েছেন। সুতরাং আপনার উচিত তাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নিজ মনে প্রতিষ্ঠিত করা, তাদের প্রতি রহমতের দো‘আ করা, তারা ইসলামের ইমাম, হেদায়েতের দিকে আহ্বানকারী ও সত্যান্বেষী বলে বিশ্বাস করা। তবে এ শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস যেন আপনাকে উগ্রতা, গোঁড়ামী ও অন্ধানুকরণের দিকে নিয়ে না যায় (যে বলবেন অমুকের মাযহাব সর্বাবস্থায় হক হওয়ার উপযোগী, অথবা অমুকের মাযহাব সর্বক্ষেত্রে সঠিক, ভুল করেই না, (না) এটা অবশ্যই ভুল।
আপনার দায়িত্ব হচ্ছে হক ও সত্য আঁকড়ে ধরা এবং দলিল পাওয়া গেলে হকের অনুসরণ করা, এতে অমুক বা অমুকের বিরোধিতা হলেও। অনুরূপভাবে গোঁড়ামি ও কারো অন্ধানুকরণ না করা। বরং ইমামগণের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে সচেতন থাকুন, স্ব স্থানে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দান করুন। তবে নিজ দ্বীন সম্পর্কে সর্বাধিক সতর্ক-সচেতন থাকুন। তাই হককে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করুন, যদি আপনার নিকট কেউ হক সম্পর্কে জানতে চায় তবে সঠিক পথনির্দেশ করুন। মহান আল্লাহকে ভয় করবেন, তাঁর অস্তিত্বের কথা সর্বাবস্থায় মনে জাগরুক রাখুন। এ বিশ্বাস রাখবেন যে হক একটাই। আর মুজতাহিদগণ যদি সঠিক করেন তাহলে দ্বিগুণ সাওয়াব আর ভুল করলে একগুণ। তবে এখানে আমরা মুজতাহিদ বলতে বুঝাচ্ছি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মুজতাহিদগণকে, যারা দ্বীন সম্পর্কে অভিজ্ঞ। ঈমান ও হিদায়াতের উপর অবিচল। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
দা‘ওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
দা‘ওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে (গোমরাহীর) অন্ধকার থেকে বের করে (হেদায়াতের) আলোয় নিয়ে আসা। হকের দিকে পথনির্দেশ করা যাতে তারা তা নিজেদের মাঝে ধারণ করতে পারে এবং জাহান্নাম ও আল্লাহর ক্রোধ হতে বাঁচতে পারে।
অনুরূপভাবে কাফেরদেরকে কুফরির অমানিশা থেকে বের করে হেদায়াতের নূর, অজ্ঞদেরকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলো এবং পাপীদেরকে পাপের কৃষ্ণতা থেকে মুক্ত করে আনুগত্যের দ্যূতির দিকে নিয়ে আসা। দা‘ওয়াতের মূল উদ্দেশ্য এটিই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
﴿ ٱللَّهُ وَلِيُّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ يُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِۖ﴾ [ البقرة : ٢٥٧ ]
‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন।’ [সূরা বাকারা. ২৫৭।]
রাসূলগণ প্রেরিত হয়েছেন মানুষদেরকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আনার জন্যে। এমনিভাবে হকের দা‘ঈগণও দা‘ওয়াতী কর্মে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন, আল্লাহর বান্দাদেরকে অন্ধকার হতে আলোয় নিয়ে আসার জন্যে, জাহান্নাম ও শয়তানের অনুসরণ এবং প্রবৃত্তি পূজা থেকে উদ্ধার করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের উদ্দেশ্যে।
যে বস্তুর দিকে দা‘ওয়াত দেয়া হবে, আর যে বিষয়টি আল্লাহর পথে আহ্বানকারীগণকে মানুষদের নিকট ব্যাখ্য-বিশ্লেষনসহ উপস্থাপন করতে হবে, যেমনটি করেছিলেন যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ, সেটি হচ্ছে, ‘‘আল্লাহর সরল পথের দিকে দা‘ওয়াত’’। অন্যভাবে বললে ‘‘ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত’’। এটাই আল্লাহর সত্য ধর্ম এবং এটাই দা‘ওয়াত স্থল। যেমন আল্লাহ বলেছেন:
﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ﴾ [ النحل : ١٢٥ ]
‘তুমি তোমার রবের পথের দিকে আহ্বান কর’। অতএব আল্লাহর পথ হল ইসলাম, এটাই সিরাতুল মুসতাকিম, এটা ঐ দ্বীন যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন স্বীয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। এদিকেই দা‘ওয়াত দেয়া ফরয। কোন মাযহাব, কোন ব্যাক্তির বিশ্বাস-মতবাদ নয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের দিকে, সিরাতে মুস্তাকিমের দিকে, যা দিয়ে আল্লাহ স্বীয় নবী ও খলিল মুহাম্মদ আলাইহিসসালাতু ওয়াসসালামকে প্রেরণ করেছেন। এটাই কুরআনুল কারিম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হাদিস থেকে বুঝা যায়।
সিরাতে মুস্তাকিম তথা ইসলামের প্রতি দা‘ওয়াত দানের ক্ষেত্রে গুরুত্বের ক্রমধারা বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। তাই সর্বাগ্রে দা‘ওয়াত দিতে হবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির প্রতি।
এর মধ্যে সর্বপ্রথম দা‘ওয়াত হবে সহিহ আক্বিদাহর প্রতি, ইখলাস ও ইবাদত-উপাসনায় আল্লাহর তাওহীদের প্রতি, আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের উপর ঈমান আনয়নের প্রতি, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছুর সংবাদ দিয়েছেন সেগুলোর উপর ঈমান আনয়নের তার প্রতি। এগুলোই সিরাতুল মুস্তাকিমের ভিত্তিমূল। এটিই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এর প্রতি দা‘ওয়াতের প্রতিভূ। ব্যাপকভাবে এর বিশেষণ করলে অর্থ এই দাড়ায়, তাওহীদ তথা একত্ববাদ ও ইখলাসের দিকে দা‘ওয়াত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমানের দিকে দা‘ওয়াত। এ ব্যাপকতার ভিতর ঐ সকল বিষয়াদিও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যা সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সংবাদ দিয়েছেন এবং যা ইতঃপূর্বে ঘটেছে আর যা কেয়ামতের পূর্বে ও পরে ঘটবে, আর শেষ যমানায় যা যা সংঘটিত হবে।
একইভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক ফরযকৃত বিষয়াবলী যেমন, নামায কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রোযা পালন করা ও আল্লাহর পবিত্র ঘরে হজ্জ করার প্রতি দা‘ওয়াত।
আরও যুক্ত হয় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ, পবিত্রতা, লেন-দেন, বিবাহ-তালাক, ভরণ পোষণ, যুদ্ধ-শান্তি অর্থাৎ সকল ব্যাপারে আল্লাহর বিধান গ্রহণ করার প্রতি দা‘ওয়াত। কারণ আল্লাহর দ্বীন হচ্ছে ব্যাপক ও পরিপূর্ণ, ইহকাল ও পরকালে বান্দার যাবতীয় প্রয়োজন ও কল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করে।
আরো আহ্বান করবে উত্তম চরিত্র এবং সুন্দর কাজের দিকে, নিষেধ করবে অসৎ চরিত্র এবং খারাপ কাজ থেকে। সুতরাং তা হবে ইবাদাত (উপাসনা) ও ক্বিয়াদাত (নেতৃত্বদান)। একজন দা‘ওয়াত কর্মী একই সাথে ‘আবেদ (উপাসক) ও সেনাবাহিনীর কায়েদ (নেতা) হিসেবে গড়ে উঠবে।
অনুরূপভাবে দা‘ওয়াত ইবাদাত ও বিচার ব্যবস্থাকে শামিল করে, সুতরাং একজন দা‘ঈ যেভাবে নামায ও রোযা পালনকারী, তদ্রূপ সে আল্লাহর বিধান মত বিচারক ও আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়নকারীরূপে বিবেচিত হবে।
এভাবেই দা‘ওয়াত ইবাদাত ও জিহাদকেও শামিল করে, সে হিসাবে একজন দা‘ঈ আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে এবং যে আল্লাহর দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করবে।
দা‘ওয়াত হল- কুরআন ও হাতিয়ার, সুতরাং দা‘ঈ কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, শক্তি সাহস দিয়ে তা বাস্তবায়ন করবে আর যদি প্রয়োজন হয় অস্ত্র ব্যবহার করবে।
দা‘ওয়াত হল- রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা, তাই দা‘ঈ একই সাথে আহ্বান করবে উন্নত চরিত্র, ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দিকে এবং মুসলিমদের মাঝে হৃদ্যতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রতি দৃষ্টি দিবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا وَلَا تَفَرَّقُواْۚ﴾ [ ال عمران : ١٠٣ ]
‘তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।’ [সূরা আলে ইমরান:১০৩]
সম্মানিত পাঠক! আমরা আপাত দৃষ্টিতে বিচার করলে দ্বীন ইসলামীর বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পাব যে, আল্লাহর দ্বীন ঐক্যের দিকে আহ্বান করে, প্রজ্ঞাপূর্ণ বিশুদ্ধ রাজনীতির দিকে আহ্বান করে, যা পারস্পরিক সম্পর্ক ও মিল সৃষ্টি করে অমিল ও বিচ্ছিন্নতা দূর করে। হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ করে দূরত্ব ও ভিন্নতা অপসারণ করে।
ইসলামী জীবন বিধান আত্মার শুদ্ধিতা ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বকে সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানায়।
আবেদন জানায় নেক ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতার, আল্লাহ ও বান্দার জন্য কল্যাণ কামনার।
এমনি ভাবে আবেদন জানায় আমানত আদায় ও শরয়ী রীতি অনুযায়ী বিচার ও শাসন কার্য পরিচালনার এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন নি এমন বিচার পরিহারের দিকে। যেমন আল্লাহ বলেন:
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا وَإِذَا حَكَمۡتُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ أَن تَحۡكُمُواْ بِٱلۡعَدۡلِۚ﴾ [ النساء : ٥٨ ]
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানত তার হকদারের নিকট প্রত্যার্পণ করতে। এবং তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।’ [সূরা নিসা:৫৮]
এমনিভাবে দা‘ওয়াত হল, রাজনীতি ও অর্থনীতি; যেমনিকরে এটি রাজনীতি, ইবাদত ও জিহাদ। তাই এটি আহ্বান জানায় সুষম শর‘য়ী অর্থনীতির দিকে। জুলুম নির্ভর পুজিবাদী অর্থনীতি নয়, যা বৈধতা ও শালীনতার ধার ধারে না, বরং মূল লক্ষ্য হচ্ছে যেকোন পন্থায় সম্পদ উপার্জন করা। নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজমের অর্থনীতিও নয়, যাতে মানুষের সম্পদের প্রতি প্রতি কোন শ্রদ্ধবোধ নেই তাদের উপর জুলুম-নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ করতেও দ্বিধা-সংকোচ করে না। ইসলামী অর্থনীতি এর কোনটিই নয় বরং উভয় অর্থ ব্যবস্থার মাঝামাঝি, উভয় পথের মাঝামাঝি, দুইটি বাতিলের মাঝে একটি হক্ব-সঠিক পথ।
পাশ্চাত্য সমাজ সম্পদকে অনেক বড় করে দেখেছে তাই সম্পদ বৃদ্ধির অভিপায়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছে। সম্পদ জমা করার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল পন্থায় চেষ্টা করেছে এমনকি আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ পন্থাও। অন্যদিকে প্রাচ্যের সোভিয়েতী নাস্তিক্য সমাজ এবং যারা তাদের মতবাদ অবলম্বন করেছে তারা মানুষের সম্পদের ন্যূনতম মর্যাদা দেয় নি বরং গণমানুষের সম্পদ লুটপাট করে নিজেদের করে নিয়েছে; বৈধ করে নিয়েছে। এসব কাজ করতে তাদের বিবেক মোটেও বাধা দেয়নি। তারা জনসাধারণকে দাসে পরিণত করেছে, তাদের উপর নির্যাতন করেছে নির্দয়ভাবে। আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে, আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মসমূহকে অস্বীকার করেছে। তাদের মতবাদ ছিল, لاإله، والحياة مادة ‘কোন ইলাহ নেই, সম্পদ বা বস্তুই জীবন’। এভাবে সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে তারা নীতি- নৈতিকতা নিয়ে ভাবে নি, অবৈধ উপায়ে আহরণের ব্যাপারে সামান্যতম দ্বিধাও করে নি। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে কোনরূপ কসুর করে নি। মানুষ ও সম্পদ উপার্জন ও উপকৃত হওয়ার যে প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি আল্লাহ তাদের মধ্যে দিয়েছেন সে ব্যাপারটি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে নি। মানুষের মাঝে যে ক্ষমতা ও বিবেক ও তাদেরকে যে উপায়-উপকরণ আল্লাহ দিয়েছেন তা থেকে উপকৃত হতে সচেষ্ট হয় নি। সুতরাং তারা এটাও করে নি ওটাও করে নি।
ইসলাম জুলুম, প্রতারণা, সুদ ও অনৈতিক পন্থাকে এড়িয়ে অর্থনীতিতে সম্পদ উপার্জন ও সংরক্ষণের একটি বৈধ শরয়ী নীতি প্রবর্তন করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। যেমনি করে ইসলাম ব্যক্তি মালিকানা, যৌথ মালিকানাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এর স্বীকৃতি দিয়েছে আগেই। সুতরাং ইসলাম উক্ত দু’অর্থ ব্যবস্থার মধ্যবর্তী ব্যবস্থা। দু’অস্পষ্ট পন্থার মধ্যবর্তী পন্থা। ইসলাম সম্পদকে হালাল সাব্যস্ত করে তৎপ্রতি উৎসাহ দিয়েছে। প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতিতে উপার্জনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সাথে সাথে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য এবং আরোপিত বিধানাবলির ব্যাপারে উদাসীন হবার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ﴾ [ النساء : ٢٩ ]
‘হে মু’মিনগণ! তোমরা পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা ব্যতীত অন্যায় ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পত্তি গ্রাস করো না’ [সূরা নিসা, ২৯।]
নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বলেছেন:
«كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ، دَمُهُ، وَمَالُهُ، وَعِرْضُهُ»
‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের রক্ত, সম্পদ, সম্ভ্রম হারাম বা সম্মানিত আমানত (তা কোনোক্রমেই নষ্ট করা যাবে না)’ [মুসলিম: ২৫৬৪।]।
তিনি আরো বলেছেন:
«إنَّ دِمَاءَكُمْ وَأمْوَالَكُمْ وَأعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِيْ شَهْرِكُمْ فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا .....»
‘তোমাদের রক্ত, সম্পদ, সম্ভ্রম তোমাদের উপর এ সম্মানিত দিন এ সম্মানিত মাস এবং এ সম্মানিত শহরের মতই সম্মানিত’ [বুখারী : ৬৭।]।
তিনি আরো বলেছেন:
«لَأَنْ يَأْخُذَ أَحَدُكُمْ أَحْبُلًا، فَيَأْخُذَ حُزْمَةً مِنْ حَطَبٍ، فَيَبِيعَ، فَيَكُفَّ اللَّهُ بِهِ وَجْهَهُ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ النَّاسَ، أُعْطِيَ أَمْ مُنِعَ»
‘তোমাদের কেউ কিছু রশি সংগ্রহ করে, একটি লাকড়ির আঁটি সংগ্রহ করে বিক্রয়ের মাধ্যমে নিজের চেহারা তথা সম্ভ্রম রক্ষা করা লোকদের নিকট প্রার্থনা অপেক্ষা অতি উত্তম চাই লোকেরা দান করুন বা ফিরিয়ে দিক [বুখারী : ২৩৭৩।]।’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোন উপার্জন সবচেয়ে উত্তম, তিনি বললেন:
«عمل الرجل بيده وكل بيع مبرور»
“ব্যক্তির নিজ হাতের উপার্জন এবং প্রত্যেক বৈধ বেচা- কেনা [মুসনাদে আহমাদ ৪/১৪১।]।”
তিনি আরো বলেছেন:
«مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ، خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ»
“নিজ হাতে উপার্জিত সম্পদ থেকে আহারের চেয়ে উত্তম আহার আর কেউ গ্রহণ করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ নিজের উপার্জন থেকে আহার করতেন [বুখারী : ২০৭২।]।”
উপরোক্ত বিষয়গুলো আমাদের নিকট প্রচ্ছন্নভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলামী অর্থব্যবস্থা মধ্যপন্থী অর্থব্যবস্থা। পাশ্চাত্য ও তাদের অনুসারীদের অন্যায় পূঁজিবাদও নয়, আবার নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজমও নয়, যারা জনসম্পদকে নিজেদের সম্পদ জ্ঞান করেছে, সম্পদের প্রকৃত মালিকদের সম্মানকে অপদস্ত করেছে, কোনো ভ্রুক্ষেপই করে নি, সাধারণ জনগণকে দাসে পরিণত করেছে এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হালাল জ্ঞান করেছে। পক্ষান্তরে (ইসলামে) সম্পদ উপার্জনের অধিকার আপনার রয়েছে তবে শরিয়ত অনুমোদিত পন্থায়ই তা হওয়া উচিত। আপনিই আপনার সম্পদের ও তা উপার্জনের অধিক উপযুক্ত ব্যক্তি, তবে তা হতে হবে আল্লাহ প্রদর্শিত শরয়ী ও হালাল পথে।
ইসলাম তার অনুসারীদের ঈমানী ভ্রাতৃত্ব, পর হিতাকাংখিতা ও অপর মুসলিমকে সম্মান প্রদর্শনের প্রতি আহ্বান জানায় এবং হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতাসহ যাবতীয় অসদাচরণ হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ ﴾ [ التوبة : ٧١ ]
‘আর মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা হচ্ছে পরস্পর একে অপরের বন্ধু, [সূরা তাওবা, ৭১।]
﴿ إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ﴾ [ الحجرات : ١٠ ]
‘নিশ্চয় মু’মিনরা পরস্পর ভাই ভাই’ [সূরা হুজরাত, ১০।]
নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বলেন:
«المسلم أخو المسلم لا يظلمه ولا يحقره ولا يخذله»
এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে না, তাকে নিরাশ করে না...।
অতএব মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে অপর মুসলিম ভাইকে সম্মান করা, তুচ্ছ জ্ঞান না করা, তার প্রতি ন্যায়বিচার করা এবং শরিয়তসম্মত তার সকল অধিকার প্রদান করা। এসব দায়িত্ব পালন করা শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজিব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«إِنَّ المُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا»
“নিশ্চয় একজন মুমিন অপর মুমিনের সাথে যেন একটি স্থাপনা যার একাংশ অপর অংশকে শক্ত করে ধরে রাখে” [বুখারী : ৪৮১।]।
তিনি আরও বলেন,
« «الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ»
‘মুমিন মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ; আর মুমিন মুমিনের ভাই [আবু দাউদ: ৪৯১৮।]।
প্রিয় ভাই! আপনি আপনার মুমিন ভাইয়ের আয়না। ঈমানী ভ্রতৃত্বের বন্ধন যে ভীতের উপর প্রতিষ্ঠিত আপনি তার একটি ইট। আপনার ভাইয়ের অধিকারের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন, তার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হোন। তার সাথে হক, কল্যাণ ও সততার সাথে লেন-দেন করুন। আপনার একান্ত কর্তব্য হল ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে আঁকড়ে ধরা। কিছু অংশ গ্রহণ করলেন আর বাকি অংশ ছেড়ে দিলেন; এমনটি হলে চলবে না। আক্বীদা গ্রহণ করলেন আর আহকাম ও আমল ছেড়ে দিলেন কিংবা আহকাম ও আমল গ্রহণ করলেন আর আক্বিদা ছেড়ে দিলেন এমন যেন না হয়। বরং পুরো ইসলামকে গ্রহণ করুন; আক্বিদা, আমল, ইবাদত, জিহাদ, সামাজিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছু। অর্থাৎ ইসলামকে গ্রহণ করুন সামগ্রিকভাবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱدۡخُلُواْ فِي ٱلسِّلۡمِ كَآفَّةٗ وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٞ ٢٠٨ ﴾ [ البقرة : ٢٠٨ ]
‘হে মু’মিনগণ, তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবিষ্ট হও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ [সূরা রাকারা, ২০৮।]
সালাফে সালেহীনদের একটি বৃহৎ দল এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেছেন: এর অর্থ হল তোমরা পূর্ণাঙ্গ ‘নিরাপত্তা’ তথা ইসলামের মাঝে প্রবেশ কর।
ইসলামকে ‘নিরাপত্তা’ বলা হয়েছে, কারণ এটা নিরাপত্তার পথ, ইহকাল ও পরকালে মুক্তির পথ। সুতরাং এটা নিরাপত্তা ও আত্মসমর্পন। ইসলাম রক্তের হেফাযত করে, মানবতাকে নিরাপত্তার দিকে আহ্বান করে, এ জন্যই নির্ধারিত দন্ডবিধি, কেসাস, ও সত্যিকার জিহাদের প্রবর্তন করেছে (এরই মাধ্যমে বিরত রাখে রক্তপাত ও হানাহানি হতে)। অতএব এটা নিরাপত্তা ও আত্মসমর্পন, নিরাপত্তা ও ঈমান তথা সার্বিক স্বীকৃতি।
এজন্য আল্লাহ বলেছেন: ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّة অর্থাৎ ইসলামের সকল শাখায় প্রবেশ কর, কিছু গ্রহণ আর কিছু বর্জন এমনটি যেন না হয়। বরং তোমাদের কর্তব্য পুরো ইসলামকে আঁকড়ে ধরা। وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ‘‘আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না’’ অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ গুনাহ ও অবাধ্যতার রাস্তা গ্রহণ করো না। কারণ শয়তান গুনাহ ও অবাধ্যতার দিকে ডাকে এবং আল্লাহর দ্বীনকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে প্ররোচিত করে। অতএব দেখা যাচ্ছে শয়তান হচ্ছে সবচে’ বড় শত্রু, তাই প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে আঁকড়ে ধরা, তার যাবতীয় বিধি-বিধান নিয়মিত পালন করে চলা এবং আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধরা। একই সাথে মতবিরোধ ও বিচ্ছিন্নতার কারণসমূহ হতে দূরে থাকা। সুতরাং একজন মুসলিম হিসেবে আপনার করণীয় হচ্ছে, ইবাদাত-বন্দেগি, লেন-দেন, আচার-আচরণ, বিবাহ-তালাক, ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন এক কথায় মানবীয় সব কার্যাদি সম্পাদন করার ক্ষেত্রে আল্লাহর শরিয়ত পরিপূর্ণ রূপে মেনে চলা, শরিয়তের বিধি-বিধান মতে কাজ করা। এমনিভাবে শরিয়ত নির্ধারিত বিধি মেনে চলার ব্যাপারে যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা, শত্রু ও মিত্র মোট কথা সকল ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান সব ক্ষেত্রেই কার্যকর করা জরুরি, একজন আপনার মতের সাথে একমত পোষণ করেছে তাই তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন আর অন্যজন ভিন্নমত পোষণ করায় তার সাথে বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করবেন এটি কিন্তু কোনভাবেই ন্যায় সঙ্গত নয়। সুতরাং আপনাকে এসব ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। লক্ষ্য করে দেখুন, নবী সহচরবৃন্দের জীবনাচারের দিকে, কত মাসআলাতেই না তারা পরস্পর মতভিন্নতায় উপনীত হতেন অথচ এত কিছুর পরও তাদের মাঝে কি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থেকেছে। মাসআলা ও সিদ্ধান্তগত মতবিরোধের কারণে পারস্পরিক সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়ে নি। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন, আর তাদেরকে সন্তুষ্ট করুন।
সুতরাং মুমিন তার সার্বিক জীবন পরিচালনা করবে আল্লাহর বিধান মত। দ্বীনের হক সিদ্ধান্তের অনুকূলে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যুক্তি প্রমাণসহ দ্বীনকে সবার সামনে তুলে ধরবে। তবে দলিল প্রমাণ উহ্য এ ধরণের ইজতেহাদী বিষয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণের কারণে কোনোক্রমেই যেন অন্য ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করতে প্ররোচিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে খুবই সচেতনতার সাথে।
এমনিভাবে ঐ সব মাসআলাতেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেখানে আয়াত বা হাদীসের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হওয়ার অবকাশ রয়েছে। কারণ এ ওজর গ্রহণযোগ্য। তাই আপনার কর্তব্য হচ্ছে তার কল্যাণ কামনা করা, তার মঙ্গলের চিন্তা করা। এসমস্ত কারণে আপনাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ যাতে সৃষ্টি না হতে পারে সে সম্পর্কে সজাগ থাকা। কোনো শত্রু যেন আপনার বা আপনার ভাইয়ের উপর চড়াও না হতে পারে সে দিকেও খেয়াল রাখা। ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’।
ইসলাম ইনসাফের দ্বীন, হক এবং কল্যাণ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার দ্বীন, যেগুলো আল্লাহ ব্যতিক্রম ঘোষণা করেছেন সেগুলো ব্যতীত ইসলাম সাম্যের দ্বীন। এতে রয়েছে সর্বপ্রকার মঙ্গলের আহ্বান, উন্নত চরিত্রের প্রতি আহ্বান, সুন্দর কাজের প্রতি আহ্বান, ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের প্রতি আহ্বান এবং সকল অশ্লীল আচার-আচরণ থেকে দূরে থাকার আহ্বান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَٰنِ وَإِيتَآيِٕ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَيَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِ وَٱلۡبَغۡيِۚ يَعِظُكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَذَكَّرُونَ ٩٠ ﴾ [ النحل : ٩٠ ]
‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও নিকটাত্মীয়- পরিজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং নিষেধ করেন অশীলতা, অসৎকার্য ও সীমালঙ্ঘনকে, তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।’ [সূরা নাহল: ৯০।] আরও বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣ ﴾ [ الحجرات : ١٣ ]
‘হে লোকসকল! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।’ [সূরা হুজুরাত:১৩।]
সারকথা: ইসলামের দা‘ওয়াত প্রদানকারী (‘দা‘ঈ’) এর উচিত পরিপূর্ণ ইসলামের প্রতি দা‘ওয়াত দেয়া, মানুষের মাঝে কোন পার্থক্য ভেদাভেদ না করা। গোঁড়ামি করে এক মাযহাবকে বাদ দিয়ে অন্য মাযহাবের, কিংবা কোন গোত্রকে বাদ দিয়ে অন্য গোত্রের, অথবা কোন নেতা বা ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে অন্য নেতা বা ব্যক্তির পক্ষপাতিত্ব না করা। বরং তার লক্ষ্য হবে হক প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্লেষণ করা এবং মানুষদেরকে এর উপর অবিচল রাখা যদিও এটা করতে গিয়ে কারো কোনো মতামতের বিরোধিতা হয়।
যখন মানুষের মাঝে মতবাদ ও মাযহাবের প্রতি গোঁড়ামির ধারা শুরু হয় তখন তাদের কেউ কেউ এমনও বলে যে, অমুকের মাযহাব অমুকের মাযহাব হতে উত্তম, এতে করে মতবিরোধ ও দলাদলি সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে অবস্থা এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, কতিপয় মানুষ ভিন্ন মাযহাবালম্বী ইমামের ইমামতিতে নামায পড়ে না। শাফেয়ি মাযহাবের লোক হানাফি ইমামের পেছনে নামায় পড়ে না, অনুরূপভাবে হানাফি লোক মালেকি ও হাম্বলি ইমামের পেছনে। এমনটি উগ্রপন্থী-গোঁড়া লোকদের পক্ষ হতে হয়ে থাকে। এটা একটা বিশাল সমস্যা বরং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ। কারণ, সকল ইমামই হেদায়েতের পথ প্রদর্শক। ইমাম শাফে‘য়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আওযা‘ঈ, ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়াইহ প্রমুখ সকলেই হেদায়েতের পথ প্রদর্শক ও হকের দা‘ঈ হিসাবে স্বীকৃত। তারা মানুষদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহ্বান করেছেন, হকের দিকে পথনির্দেশ করেছেন। দা‘ওয়াতের এ গুরু দায়িত্ব সম্পাদন ক্ষেত্রে তারা অনেক জটিল জটিল বিষয়াদির সম্মুখীন হয়েছেন। সমাধান খুঁজতে গিয়ে দলিল প্রমাণ অস্পষ্ট থাকার কারণে পারস্পরিক মতভিন্নতায় পতিত হয়েছেন। এ ইজতেহাদের ক্ষেত্রে তারা হয়তো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদ, যার ফলে দ্বিগুণ সাওয়াব প্রাপ্ত হবেন, নয়তো ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদ যাতে একগুণ সাওয়াব প্রাপ্ত হবেন। তাহলে ইসলামের স্বীকৃত ইমামবৃন্দ সকলেই (সঠিক করুক বা ভুল) সাওয়াবের অধিকারী হয়েছেন। সুতরাং আপনার উচিত তাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নিজ মনে প্রতিষ্ঠিত করা, তাদের প্রতি রহমতের দো‘আ করা, তারা ইসলামের ইমাম, হেদায়েতের দিকে আহ্বানকারী ও সত্যান্বেষী বলে বিশ্বাস করা। তবে এ শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস যেন আপনাকে উগ্রতা, গোঁড়ামী ও অন্ধানুকরণের দিকে নিয়ে না যায় (যে বলবেন অমুকের মাযহাব সর্বাবস্থায় হক হওয়ার উপযোগী, অথবা অমুকের মাযহাব সর্বক্ষেত্রে সঠিক, ভুল করেই না, (না) এটা অবশ্যই ভুল।
আপনার দায়িত্ব হচ্ছে হক ও সত্য আঁকড়ে ধরা এবং দলিল পাওয়া গেলে হকের অনুসরণ করা, এতে অমুক বা অমুকের বিরোধিতা হলেও। অনুরূপভাবে গোঁড়ামি ও কারো অন্ধানুকরণ না করা। বরং ইমামগণের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে সচেতন থাকুন, স্ব স্থানে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দান করুন। তবে নিজ দ্বীন সম্পর্কে সর্বাধিক সতর্ক-সচেতন থাকুন। তাই হককে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করুন, যদি আপনার নিকট কেউ হক সম্পর্কে জানতে চায় তবে সঠিক পথনির্দেশ করুন। মহান আল্লাহকে ভয় করবেন, তাঁর অস্তিত্বের কথা সর্বাবস্থায় মনে জাগরুক রাখুন। এ বিশ্বাস রাখবেন যে হক একটাই। আর মুজতাহিদগণ যদি সঠিক করেন তাহলে দ্বিগুণ সাওয়াব আর ভুল করলে একগুণ। তবে এখানে আমরা মুজতাহিদ বলতে বুঝাচ্ছি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মুজতাহিদগণকে, যারা দ্বীন সম্পর্কে অভিজ্ঞ। ঈমান ও হিদায়াতের উপর অবিচল। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
দা‘ওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
দা‘ওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে (গোমরাহীর) অন্ধকার থেকে বের করে (হেদায়াতের) আলোয় নিয়ে আসা। হকের দিকে পথনির্দেশ করা যাতে তারা তা নিজেদের মাঝে ধারণ করতে পারে এবং জাহান্নাম ও আল্লাহর ক্রোধ হতে বাঁচতে পারে।
অনুরূপভাবে কাফেরদেরকে কুফরির অমানিশা থেকে বের করে হেদায়াতের নূর, অজ্ঞদেরকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলো এবং পাপীদেরকে পাপের কৃষ্ণতা থেকে মুক্ত করে আনুগত্যের দ্যূতির দিকে নিয়ে আসা। দা‘ওয়াতের মূল উদ্দেশ্য এটিই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
﴿ ٱللَّهُ وَلِيُّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ يُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِۖ﴾ [ البقرة : ٢٥٧ ]
‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন।’ [সূরা বাকারা. ২৫৭।]
রাসূলগণ প্রেরিত হয়েছেন মানুষদেরকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আনার জন্যে। এমনিভাবে হকের দা‘ঈগণও দা‘ওয়াতী কর্মে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন, আল্লাহর বান্দাদেরকে অন্ধকার হতে আলোয় নিয়ে আসার জন্যে, জাহান্নাম ও শয়তানের অনুসরণ এবং প্রবৃত্তি পূজা থেকে উদ্ধার করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের উদ্দেশ্যে।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন