HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ
লেখকঃ ডঃ নাছের বিন সোলায়মান আল-ওমর
ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ
মূল : ডঃ নাছের বিন সোলায়মান আল-ওমর
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ৩০
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০১০
নির্ধারিত মূল্য : ৩০ (ত্রিশ) টাকা মাত্র।
মূল : ডঃ নাছের বিন সোলায়মান আল-ওমর
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
প্রকাশক : হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
নওদাপাড়া, রাজশাহী-৬২০৩,
হা.ফা.বা. প্রকাশনা- ৩০
ফোন ও ফ্যাক্স : ০৭২১-৮৬১৩৬৫,
মোবাইল : ০১৭৭০-৮০০৯০০
১ম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০১০
নির্ধারিত মূল্য : ৩০ (ত্রিশ) টাকা মাত্র।
حقيقة الانتصار বা ‘বিজয়ের স্বরূপ’ বইটির মূল লেখক ড. নাছের বিন সোলায়মান আল-ওমর ১৯৫২ সালে সঊদী আরবের আল-ক্বাসীম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি রিয়াদের মুহাম্মাদ বিন সঊদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঊলূমূল কুরআন’ বিভাগের প্রফেসর হিসাবে কর্মরত। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২০টির অধিক। তিনি ইসলামী বিশ্বের সমকালীন প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। তন্মধ্যে আলোচ্য বইটি অন্যতম। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘বিজয়’ কাকে বলে সে সম্পর্কে এ বইতে লেখক সারগর্ভ আলোচনা করেছেন। বর্তমান যুগে মুসলিম উম্মাহ দুনিয়াবী শক্তি ও সামর্থ্যের দিক দিয়ে কাফির শক্তির তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়ায় মুসলিম সমাজে এক ধরণের চাপা হতাশা ও মানসিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। একদিকে এলাহী দ্বীন ইসলামের চিরন্তন শ্রেষ্ঠত্ব, অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহর দুর্বলতর অবস্থান এই দ্বৈরথ তাদের মধ্যে নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে দুনিয়াবী সামর্থ্যের বিচারে নিজেদের পরাজিত দেখতে পেয়ে তারা পড়েছেন গোলকধাঁধায়। এমতাবস্থায় লেখক ইসলামের দৃষ্টিতে বিজয়ের স্বরূপ কী এবং একজন মুমিনের জীবনে প্রকৃত বিজয় কোন্টি তা সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন। মুসলিম উম্মাহর অতীত-বর্তমান ইতিহাস তুলে ধরে তিনি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, দুনিয়াবী ক্ষমতা ও বস্ত্তগত উপায়-উপকরণে সামর্থ্যবান হওয়াই বিজয় ও আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তির একমাত্র লক্ষণ নয়; বরং আল্লাহর সাহায্যের নানা দিক ও প্রকৃতি রয়েছে। তার যেকোন একটি বাস্তবায়িত হ’লে আল্লাহর প্রতিশ্রুত বিজয় ও সাহায্য বাস্তবায়িত হয়েছে বলে গণ্য হবে। কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটিতে লেখক বিজয়ের স্বরূপ বিশ্লেষণ, প্রকাশ্য সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার কারণ, বিজয়ী হওয়ার জন্য মুসলমানদের করণীয় ইত্যাদি বিষয়ের হৃদয়গ্রাহী বিশ্লেষণ করেছেন। বইটি সমকালীন ইসলামী আন্দোলনের জন্য একটি দিক-নির্দেশক ভূমিকা পালন করবে। আলেম-ওলামা ও দাঈগণ বইটি থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন বলে আমরা আশা রাখি। সাথে সাথে যারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে নেতিবাচক তৎপরতার আশ্রয় নিচ্ছে তাদের জন্যও বইটি চক্ষুউন্মীলক হ’তে পারে।
ইতিপূর্বে ডিসেম্বর’০৪ থেকে সেপ্টেম্বর’০৫ পর্যন্ত ১০ কিস্তিতে এ বইটির অনুবাদ মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় তখন থেকেই আমরা অনুবাদটিকে বই আকারে প্রকাশের চিন্তা করেছিলাম। সময়-সুযোগের অভাবে তা এতদিন সম্ভব হয়নি। বিলম্বে হ’লেও বইটি প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দ বোধ করছি এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি। প্রাসঙ্গিক বিচারে বইটির নাম ‘ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ’ রাখা হ’ল।
পরিশেষে সুলিখিত এই পুস্তকটির রচয়িতার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি অনুবাদক জনাব মুহাম্মাদ আব্দুল মালেককে। যিনি অসামান্য দক্ষতায় লেখকের মূল বক্তব্যকে প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সাথে সাথে প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ রাববুল আলামীন সকলকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টাকে কবুল করুন- আমীন!!
প্রকাশক
ইতিপূর্বে ডিসেম্বর’০৪ থেকে সেপ্টেম্বর’০৫ পর্যন্ত ১০ কিস্তিতে এ বইটির অনুবাদ মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় তখন থেকেই আমরা অনুবাদটিকে বই আকারে প্রকাশের চিন্তা করেছিলাম। সময়-সুযোগের অভাবে তা এতদিন সম্ভব হয়নি। বিলম্বে হ’লেও বইটি প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দ বোধ করছি এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি। প্রাসঙ্গিক বিচারে বইটির নাম ‘ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ’ রাখা হ’ল।
পরিশেষে সুলিখিত এই পুস্তকটির রচয়িতার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি অনুবাদক জনাব মুহাম্মাদ আব্দুল মালেককে। যিনি অসামান্য দক্ষতায় লেখকের মূল বক্তব্যকে প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সাথে সাথে প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ রাববুল আলামীন সকলকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টাকে কবুল করুন- আমীন!!
প্রকাশক
বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম
আধুনিক যুগে ইসলামী দা‘ওয়াত বা প্রচারকার্যের বাস্তব অবস্থা এবং তা করতে গিয়ে যে ঝুঁকি ও বিপদ-আপদের মুখোমুখি হ’তে হয় তা আমি ভেবে দেখেছি। আমি লক্ষ্য করেছি, মুসলিম জাতি এখন যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছে। তাদের মাঝে রেনেসাঁর অভ্যুদয় ঘটেছে, ইসলাম প্রচারকগণ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছেন। দেশে দেশে ইসলামী দলগুলি বিস্তার লাভ করছে। এমনকি তারা ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অনেক মুসলিম দেশে জিহাদী আন্দোলন চলছে। যেমন- আফগানিস্তান, ফিলিস্তীন, ইরিত্রিয়া, ফিলিপাইন ইত্যাদি। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, এখানে মুসলমানদের মাঝে অনেক বিষয়ে সঠিক তাৎপর্য অনুধাবনে শূন্যতা রয়েছে। যদিও কুরআন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এমনকি বিস্তারিত বর্ণনা উপস্থাপন করেছে। আমার মনে হয়েছে, প্রচার কাজ ও প্রচারকদের মধ্যে বিদ্যমান এই ত্রুটি-বিচ্যুতির বেশির ভাগ কারণ উক্ত বিষয়গুলির তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থতা।
( حقيقة الإنتصار ) ‘বিজয় লাভের তাৎপর্য’ এমনি একটি বিষয়। এ সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা এক বড় গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়েছে। যেমন প্রচারকগণের প্রচার কাজে তড়িৎফল প্রত্যাশা, প্রচার কাজে অবনতি, প্রচার কাজে হতাশা ও নৈরাশ্য ঘিরে ধরা এবং সর্বশেষে প্রচারকার্য থেকে সরে দাঁড়ান। এ জাতীয় মানসিকতার একটা নেতিবাচক প্রভাব যেমন প্রচার কার্যক্রমের উপর পড়ছে, তেমনি পড়ছে মুসলিম জাতির উপর।
তাই আমি এই অজ্ঞাত তাৎপর্য ও উহার শিক্ষা কুরআনুল কারীমের আলোকে তুলে ধরতে সঙ্কল্পবদ্ধ। সহায়তা, শুদ্ধতা, যথার্থতা ও সাহায্যের মিনতি আল্লাহর দরবারে করছি।
আধুনিক যুগে ইসলামী দা‘ওয়াত বা প্রচারকার্যের বাস্তব অবস্থা এবং তা করতে গিয়ে যে ঝুঁকি ও বিপদ-আপদের মুখোমুখি হ’তে হয় তা আমি ভেবে দেখেছি। আমি লক্ষ্য করেছি, মুসলিম জাতি এখন যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছে। তাদের মাঝে রেনেসাঁর অভ্যুদয় ঘটেছে, ইসলাম প্রচারকগণ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছেন। দেশে দেশে ইসলামী দলগুলি বিস্তার লাভ করছে। এমনকি তারা ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অনেক মুসলিম দেশে জিহাদী আন্দোলন চলছে। যেমন- আফগানিস্তান, ফিলিস্তীন, ইরিত্রিয়া, ফিলিপাইন ইত্যাদি। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, এখানে মুসলমানদের মাঝে অনেক বিষয়ে সঠিক তাৎপর্য অনুধাবনে শূন্যতা রয়েছে। যদিও কুরআন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এমনকি বিস্তারিত বর্ণনা উপস্থাপন করেছে। আমার মনে হয়েছে, প্রচার কাজ ও প্রচারকদের মধ্যে বিদ্যমান এই ত্রুটি-বিচ্যুতির বেশির ভাগ কারণ উক্ত বিষয়গুলির তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থতা।
( حقيقة الإنتصار ) ‘বিজয় লাভের তাৎপর্য’ এমনি একটি বিষয়। এ সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা এক বড় গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়েছে। যেমন প্রচারকগণের প্রচার কাজে তড়িৎফল প্রত্যাশা, প্রচার কাজে অবনতি, প্রচার কাজে হতাশা ও নৈরাশ্য ঘিরে ধরা এবং সর্বশেষে প্রচারকার্য থেকে সরে দাঁড়ান। এ জাতীয় মানসিকতার একটা নেতিবাচক প্রভাব যেমন প্রচার কার্যক্রমের উপর পড়ছে, তেমনি পড়ছে মুসলিম জাতির উপর।
তাই আমি এই অজ্ঞাত তাৎপর্য ও উহার শিক্ষা কুরআনুল কারীমের আলোকে তুলে ধরতে সঙ্কল্পবদ্ধ। সহায়তা, শুদ্ধতা, যথার্থতা ও সাহায্যের মিনতি আল্লাহর দরবারে করছি।
বিজয় লাভ কথাটির তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষের একটি ভুল ধারণা রয়েছে। তারা প্রচারকের বিজয় এবং দা‘ওয়াত ও দ্বীনের বিজয়কে গুলিয়ে ফেলে। আর তা থেকে সৃষ্টি হয় ভুল ধারণা। এ জাতীয় ভুল বুঝাবুঝি ও গুলিয়ে ফেলা থেকে এমন কতকগুলি নেতিবাচক বিষয় জন্ম লাভ করেছে, যার কুপ্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দ্বীন ও উম্মাহ উভয়ের উপর পড়ছে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হ’ল-
দ্বীনের একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রচারক সম্পর্কে অনেক সময় বহু লোকের ধারণা জন্মে যে, সে তার প্রচার কাজে বিজয় ও সাফল্য লাভ করতে পারেনি। কেননা যে লক্ষ্যের দিকে সে আহবান জানাচ্ছে এবং যা বাস্তবায়ন করতে সে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সে তা অর্জনে সক্ষম হয়নি। ফলে প্রচারকের কর্মপদ্ধতি নিয়ে তারা সন্দেহের চোরাবালিতে আটকে যায় এবং অনেককেই তার পেছন থেকে সটকে পড়তে দেখা যায়।
দ্রুত প্রচারফল ও লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশা আরেকটি নেতিবাচক দিক। অনেক প্রচারককেই এরূপ অবস্থার শিকার হ’তে দেখা যায়। একজন প্রচারক (দাঈ) যখন প্রচার কাজ শুরু করেন তখন তিনি একটি উত্তম কর্মপদ্ধতি এঁকে নেন। অতঃপর তদনুসারে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু যখন সময় পেরিয়ে যায় অথচ লক্ষ্যের কিছুই অর্জিত হয় না কিংবা সামান্য যা অর্জিত হয় তা তার শ্রম অনুপাতে মোটেও মনঃপূত হয় না, তখন তিনি তার সঠিক কর্মপদ্ধতিকে ভুল কর্মপদ্ধতি দ্বারা বদলে ফেলেন, যার মাধ্যমে তিনি দ্রুত ফল প্রত্যাশা করেন। তার উপর অর্পিত দায়িত্বের তাৎপর্য অনুধাবনে ভ্রান্তিতে পড়েছে এবং তিনি আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করার ফলেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ভুল ধারণা সৃষ্টির প্রেক্ষিতে এমনটা দেখা দেয়। দায়িত্ব পালন ও সাফল্য লাভের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান আছে তা এই শ্রেণীর প্রচারকগণের খেয়াল থাকে না কিংবা তারা তা মোটেও জানেন না।
এই উম্মতের প্রথম যামানার লোকদের সংস্কার যে রূপরেখার আলোকে সাধিত হয়েছে তার অনুসরণ ব্যতীত শেষ যামানার লোকদের সংস্কার কখনই সাধিত হবে না। সুতরাং একজন প্রচারক অবশ্যই ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে’র কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করবেন। আর তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি। ছহীহ হাদীছে এ কথাই বলা হয়েছে-
عَلَيْكُمْ بِِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ -
‘তোমাদের কর্তব্য আমার সুন্নাত ও সৎপথ প্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাতকে মেনে চলা। তোমরা উহা আঁকড়ে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে পড়ে থাকেব’।[1]
আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীতেও আমরা এ কথা বুঝতে পারি-
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيْماً فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِِعُوْا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيْلِهِ -
‘এটি আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করবে এবং বিভিন্ন পথের অনুসরণ করবে না, নতুবা উহা তোমাদেরকে তাঁর পথ হ’তে বিচ্ছিন্ন করে দিবে’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।
এরূপ আরও অনেক আয়াত ও হাদীছ রয়েছে, যা কুরআন ও হাদীছে উল্লিখিত কর্মপদ্ধতি অবলম্বনের অপরিহার্যতাকে ফরয গণ্য করে। কোন কোন জামা‘আত ও প্রচারকের একান্ত কামনা দ্বীনের বিজয় হোক। তাদের ধারণায় দ্বীনের বিজয় ও কুফরের পরাজয় দা‘ওয়াতী কাজের সফলতার মাপকাঠি। তারা একদিকে যালেমদের অত্যাচার ও দর কষাকষির সামনে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে অনুসারীদের তড়িৎ ফল প্রত্যাশা ও অসহিষ্ণুতার কারণে এমন কিছু পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করে যাতে তাদের ধারণা মতে দ্বীন বিজয়ী হবে এবং তার সুরক্ষার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এভাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের কিছু মৌলিক নীতিমালা থেকে সরে আসতে হয় এবং প্রচারককে সঠিক ও বেঠিক নীতিমালার মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করতে দেখা যায়। এভাবে তারা নিজের অজান্তেই প্রচারের সঠিক কর্মপদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে এবং ইসলামের শত্রুদের দর কষাকষি ও খেল-তামাশার সামনে মাথা নত করে বসে।
[1]. আহমাদ ৪/১২৬, ১২৭ পৃঃ; আবুদাঊদ হা/৪৬০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪৩; তিরমিযী হা/২৬৭৬ সনদ ছহীহ।
عَلَيْكُمْ بِِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ -
‘তোমাদের কর্তব্য আমার সুন্নাত ও সৎপথ প্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাতকে মেনে চলা। তোমরা উহা আঁকড়ে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে পড়ে থাকেব’।[1]
আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীতেও আমরা এ কথা বুঝতে পারি-
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيْماً فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِِعُوْا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيْلِهِ -
‘এটি আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করবে এবং বিভিন্ন পথের অনুসরণ করবে না, নতুবা উহা তোমাদেরকে তাঁর পথ হ’তে বিচ্ছিন্ন করে দিবে’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।
এরূপ আরও অনেক আয়াত ও হাদীছ রয়েছে, যা কুরআন ও হাদীছে উল্লিখিত কর্মপদ্ধতি অবলম্বনের অপরিহার্যতাকে ফরয গণ্য করে। কোন কোন জামা‘আত ও প্রচারকের একান্ত কামনা দ্বীনের বিজয় হোক। তাদের ধারণায় দ্বীনের বিজয় ও কুফরের পরাজয় দা‘ওয়াতী কাজের সফলতার মাপকাঠি। তারা একদিকে যালেমদের অত্যাচার ও দর কষাকষির সামনে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে অনুসারীদের তড়িৎ ফল প্রত্যাশা ও অসহিষ্ণুতার কারণে এমন কিছু পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করে যাতে তাদের ধারণা মতে দ্বীন বিজয়ী হবে এবং তার সুরক্ষার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এভাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের কিছু মৌলিক নীতিমালা থেকে সরে আসতে হয় এবং প্রচারককে সঠিক ও বেঠিক নীতিমালার মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করতে দেখা যায়। এভাবে তারা নিজের অজান্তেই প্রচারের সঠিক কর্মপদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে এবং ইসলামের শত্রুদের দর কষাকষি ও খেল-তামাশার সামনে মাথা নত করে বসে।
[1]. আহমাদ ৪/১২৬, ১২৭ পৃঃ; আবুদাঊদ হা/৪৬০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪৩; তিরমিযী হা/২৬৭৬ সনদ ছহীহ।
দ্বীন প্রচারের রাস্তা দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য। এটা নানা চড়াই-উতরাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ। তাই কম প্রচারককেই দেখা যায়, তারা স্বীয় প্রচার কাজে অবিচল ও দা‘ওয়াতী কর্মপদ্ধতিকে আঁকড়ে থেকে এই রাস্তা অতিক্রম করতে পেরেছেন। দেখা যায়, একজন প্রচারক প্রচার কাজে লিপ্ত হয়ে কয়েক বছর পার হওয়ার পরও যখন তার প্রচার কাজের সামান্য অগ্রগতিও দেখতে না পায় এবং একের পর এক কৌশল অবলম্বন করেও কোন ফল অর্জিত না হয়, তখন সে সন্দেহের চোরাবালিতে নিপতিত হয়। এমতাবস্থায় কখনও সে নিজেকে দোষারোপ করে, কখনও তার জাতিকে, আবার কখনও নিজের অনুসারী ও সহযোগীদের। পরিশেষে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এসব লোকের জন্য দা‘ওয়াত কোন কাজে আসবে না, তারা কোন প্রচারকের দা‘ওয়াতে সাড়া দেবে না। সে নিজের মনকে এই বলে প্রবোধ দিতে থাকে যে, ‘তোমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, তোমাকে শুধু নিজের ভাবনাই ভাবতে হবে। সুতরাং অন্যদের সালাম জানাও’। সে আল্লাহর বাণী, لَيْسَ عَلَيْكَ هُدَاهُمْ ‘তাদের সৎপথ গ্রহণের দায়িত্ব আপনার উপর নয়’ (বাক্বারাহ ২/২৭২) -এর অর্থ অনুধাবনে ভুলের শিকার হয় এবং আল্লাহর বাণী لاَيَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ، ‘তোমরা সৎপথে পরিচালিত হ’লে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’ (মায়েদাহ ৫/১০৫)-কে যথাস্থানে প্রয়োগ না করে অপপ্রয়োগ করে।
এভাবে ঐ প্রচারক তার জাতি সম্বন্ধে হতাশ হয়ে পড়ে। আল্লাহ যে তাদের হেদায়াত করবেন, এমন আশা আর তার মনে জাগে না। ফলে সে প্রচারকার্য থেকে হাত গুটিয়ে হাত বসে থাকে এবং স্বজাতি ও তাদের কর্মকান্ডকে এড়িয়ে চলতে থাকে।
সাহায্য ও বিজয়ের তাৎপর্য উপলব্ধিতে ব্যর্থতাই তার এই পরিণামের মূল কারণ। সে বুঝতে পারে না যে, তার জাতি তার আহবানে সাড়া না দেওয়া সত্ত্বেও সে তাদের নেতিবাচক কর্মকান্ডে ধৈর্য ধারণ করলে তা তার চাহিদা মত তাদের ঈমান আনয়ন ও তার অনুগামী হওয়া থেকে তার জন্য অনেক বেশী দামী পারিতোষিক, সঞ্চয় ও সাহায্য বলে বিবেচিত হ’তে পারে।
উল্লিখিত বিষয়গুলি ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘প্রচার কাজে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ সম্বন্ধে ভুল ধারণা থেকে জন্মলাভ করেছে। অনেক প্রচারকই দ্বীনের বিজয় ও প্রচারকের বিজয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। বর্ণিত আলোচনা হ’তে উপরিক্ত বিষয়ের গুরুত্ব, প্রচারক ও জ্ঞান পিপাসুদের জন্য একে ফুটিয়ে তোলা ও বিশদ বর্ণনার প্রয়োজনীয়তা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে কুরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে, যা বিজয় ও সাহায্যের অর্থ, প্রচারকের করণীয় এবং সেই করণীয় কাজ আর তার ফলাফল ও প্রভাবের মধ্যকার পার্থক্যকে তুলে ধরেছে।
এভাবে ঐ প্রচারক তার জাতি সম্বন্ধে হতাশ হয়ে পড়ে। আল্লাহ যে তাদের হেদায়াত করবেন, এমন আশা আর তার মনে জাগে না। ফলে সে প্রচারকার্য থেকে হাত গুটিয়ে হাত বসে থাকে এবং স্বজাতি ও তাদের কর্মকান্ডকে এড়িয়ে চলতে থাকে।
সাহায্য ও বিজয়ের তাৎপর্য উপলব্ধিতে ব্যর্থতাই তার এই পরিণামের মূল কারণ। সে বুঝতে পারে না যে, তার জাতি তার আহবানে সাড়া না দেওয়া সত্ত্বেও সে তাদের নেতিবাচক কর্মকান্ডে ধৈর্য ধারণ করলে তা তার চাহিদা মত তাদের ঈমান আনয়ন ও তার অনুগামী হওয়া থেকে তার জন্য অনেক বেশী দামী পারিতোষিক, সঞ্চয় ও সাহায্য বলে বিবেচিত হ’তে পারে।
উল্লিখিত বিষয়গুলি ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘প্রচার কাজে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ সম্বন্ধে ভুল ধারণা থেকে জন্মলাভ করেছে। অনেক প্রচারকই দ্বীনের বিজয় ও প্রচারকের বিজয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। বর্ণিত আলোচনা হ’তে উপরিক্ত বিষয়ের গুরুত্ব, প্রচারক ও জ্ঞান পিপাসুদের জন্য একে ফুটিয়ে তোলা ও বিশদ বর্ণনার প্রয়োজনীয়তা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে কুরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে, যা বিজয় ও সাহায্যের অর্থ, প্রচারকের করণীয় এবং সেই করণীয় কাজ আর তার ফলাফল ও প্রভাবের মধ্যকার পার্থক্যকে তুলে ধরেছে।
মহান আল্লাহ বলেন, ِإنَّالَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا فِى الْحَيَاةِ الدُّنْياَ وَيَوْمَ يَقُوْمُ الْأَشْهَادُ - ‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে ও বিশ্বাসীদেরকে পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীরা দন্ডায়মান হবে সেদিন সাহায্য করব’ (মুমিন ২৩/৫১)। وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘মুমিনদেরকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব’ (রূম ৩০/৪৭)। إِنْ تَنْصُْرُوْا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ ‘যদি তোমরা আল্লাহ্কে সাহায্য কর, তবে আল্লাহ তা‘আলাও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৭)। وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ ‘অবশ্যই আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে সাহায্য করবেন, যে তাঁকে সাহায্য করবে’ (হজ্জ ২২/৪০)।
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُوْرُوْنَ، وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ - ‘নিশ্চয়ই আমার কথা আমার রাসূলগণের ক্ষেত্রে পূর্বে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তারা অবশ্যই সাহায্যপ্রাপ্ত হবেন এবং আমার বাহিনী অবশ্যই বিজয়ী হবে’ (ছাফফাত ৩৭/১৭১-৭৩)। এই আয়াতগুলি ছাড়াও এরূপ আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা একজন প্রচারকের পক্ষে এলাহী সাহায্যের প্রমাণ বহন করে। চাই সে প্রচারক রাসূল হউন কিংবা মুমিন হউন। আল্লাহ প্রদত্ত এ সাহায্য আসবে আখেরাতের আগে দুনিয়াবী জীবনেই।
কুরআন-হাদীছ থেকে যা জানা যায় যে, অনেক নবীকে তাঁদের শত্রুরা হত্যা করে লাশ পর্যন্ত বিকৃত করে দিয়েছে। ইয়াহইয়া ও শু‘আইব (আঃ)-এর ক্ষেত্রে এরূপ ঘটেছিল। আবার অনেক নবীকে তাঁদের গোত্র হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। তাঁরা তাদের ছোবল থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল। যেমন ইবরাহীম (আঃ) স্বজাতি ও স্বদেশ ছেড়ে শাম দেশে হিজরত করেছিলেন। ঈসা (আঃ)-কে তাঁর জাতি যখন হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন আল্লাহ তাঁকে ঊর্ধ্বলোকে তুলে নিয়েছিলেন।
মুমিনদেরকেও অনুরূপ বর্বরতম শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কাউকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, কাউকে শহীদ করা হয়েছে, কেউ দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করেছেন। তবে এভাবে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া, হত্যার শিকার ও শাস্তি ভোগের পরও পার্থিব জীবনে আল্লাহর সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা কিভাবে বিশ্বাস করা যায়?
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কখনই বিলম্বিত হয় না। কিন্তু বিভিন্ন প্রকার সাহায্যের কথা বাদ দিয়ে আল্লাহর প্রকাশ্য সাহায্য ও দ্বীনের বিজয় লাভের মত একটি মাত্র সাহায্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করাতেই এরূপ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূল ও মুমিনদেরকে যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা যে কেবল এই শ্রেণীর সাহায্যই হ’তে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
আল্লাহ তাদেরকে যে সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা অবশ্যই অতীতে বাস্তবায়িত হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ। এতে কোন সন্দেহ নেই। আর তা আখেরাতের পূর্বে দুনিয়ার জীবনেই হবে।
এ বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখার জন্য বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত, نَصْرٌ বা ‘সাহায্য’ শব্দের মর্মার্থ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। আমাদের স্মৃতিতে এ কথা আগেই ধরে রাখা দরকার যে, সাহায্যের নানা দিক ও প্রকৃতি রয়েছে। তার যেকোন একটি বাস্তবায়িত হ’লে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে বলে গণ্য হবে। নানা প্রকৃতির এই সাহায্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিম্নে উপস্থাপন করা হ’ল :
(১) প্রত্যক্ষ বিজয় ও শত্রুর পরাজয় :
আল্লাহ তা‘আলা কখনও প্রচারকবৃন্দকে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিজয় দান করেন। শত্রু তখন তাদের পদানত হয়ে যায়। বহু নবী-রাসূল এভাবে শত্রুদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিজয় অর্জন করেছেন। দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ) এরূপ বিজয় অর্জন করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, وَقَتَلَ دَاوُدُ جَالُوْتَ وَآتَاهُ اللهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ، ‘দাঊদ জালূতকে হত্যা করেন এবং আল্লাহ তাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা দান করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)। وَكُلاَّ آتَيْنَا حُكْمًا وَّعِلْمًا، ‘উভয়কেই (দাঊদ ও সুলায়মানকে) আমি শাসন ক্ষমতা ও জ্ঞান দান করেছি’ (আম্বিয়া ২১/৭৯)। قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكاً لَّا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِّنْ بَعْدِي، ‘তিনি বললেন, রব আমার, আমাকে আপনি মার্জনা করুন এবং আমাকে এমন রাষ্ট্র দান করুন, যা আমার পর আর কারও জন্য সম্ভব হবে না’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৫)।
মূসা (আঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা ফির‘আউন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় দ্বীনকে বিজয়ী করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُواْ يَعْرِشُونَ ‘ফির‘আউন ও তার সম্প্রদায়ের শিল্প এবং তাদের নির্মিত প্রাসাদরাজি আমি ধ্বংস করে দিয়েছি’ (আ‘রাফ ৭/১৩৭)।
فَأَنْجَيْنَاكُمْ وَأَغْرَقْنَا آلَ فِرْعَوْنَ وَأَنْتُمْ تَنظُرُوْنَ - ‘অতঃপর আমি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছিলাম এবং ফির‘আউন সম্প্রদায়কে এমন করে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, যা তোমরা তাকিয়ে দেখছিলে’ (বাক্বারাহ ২/৫০)।
আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কেও আল্লাহ তা‘আলা খুব বড় আকারে সাহায্য করেছেন। বদর ও পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শত্রুদেরকে পদানত করেছেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হয়েছে এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحاً مُّبِيْناً ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দান করেছি সুস্পষ্ট বিজয়’ (ফাতহ ৪৮/১)।
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ، وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللَّهِ أَفْوَاجاً - ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, আর আপনি লোকদের দেখতে পাবেন, তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে’ (নাছর ১১০/১-২)। এ জাতীয় সাহায্য তো খুবই স্পষ্ট। ‘সাহায্য’ শব্দ উচ্চারণ করা মাত্রই এদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। কারণ (ক) প্রকাশ্য সাহায্য মানুষ চোখে দেখতে পায় এবং হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে। (খ) এ ধরনের সাহায্য একাধারে দ্বীন ও তার প্রচারক উভয়েরই বিজয়ের স্বাক্ষর বহন করে। (গ) মানব মনের কাঙ্খিত ও প্রিয় বিষয়ই হ’ল এরূপ সাহায্য। এ সাহায্য দ্রুত ফলদায়ক। আর যা দ্রুত ফলদায়ক তার প্রতি মনের আকর্ষণ আপনা-আপনি তৈরী হয়। এজন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন, وَأُخْرَى تُحِبُّوْنَهَا نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيْبٌ ‘তিনি দান করবেন তোমাদের বাঞ্ছিত আরও একটি অনুগ্রহ; আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়’ (ছাফফ ৬১/১৩)।
(২) মিথ্যারোপকারীদের ধ্বংসের মাধ্যমে সাহায্য :
কখনও মিথ্যারোপকারী কাফিরদের ধ্বংস সাধন এবং নবী-রাসূল ও তাঁদের সঙ্গী মুমিনদের নাজাত প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়। নূহ (আঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা এভাবে সাহায্য করেছিলেন। তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর কাফির জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
فَدَعَا رَبَّهُ أَنِّيْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ-َفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ بِمَاءٍ مُّنْهَمِرٍ، وَفَجَّرْنَا الْأَرْضَ عُيُوْناً فَالْتَقَى الْمَاءُ عَلَى أَمْرٍ قَدْ قُدِرَ، وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَّدُسُرٍ، تَجْرِيْ بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِّمَنْ كَانَ كُفِرَ -
‘তিনি (নূহ) তাঁর রবকে আহবান করে বললেন, আমি তো অসহায়, অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন। ফলে আমি উন্মুক্ত করে দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারি বর্ষণে এবং মৃত্তিকা হ’তে উৎসারিত করলাম প্রস্রবণ। অতঃপর সকল পানি মিলিত হ’ল এক পরিকল্পনা অনুসারে। তখন নূহকে আরোহন করালাম কাষ্ঠ ও কীলক নির্মিত এক নৌযানে। যা চলত আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এটা তার জন্য প্রতিদান যাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল’ (ক্বামার ৫৪/১০-১৪)।
একই পরিণতি ঘটেছিল হূদ (আঃ)-এর ক্বওমের। আল্লাহ বলেন,
فَأَنجَيْنَاهُ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِيْنَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا وَمَا كَانُواْ مُؤْمِنِيْنَ -
‘অনন্তর আমি তাঁকে ও তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে মুক্তি দিয়েছিলাম এবং যারা আমার বিধানাবলীকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল তাদের মূলচ্ছেদ করেছিলাম। বস্ত্ততঃ তারা মুমিন ছিল না’ (আ‘রাফ ৭/৭২)।
ছালেহ (আঃ)-এর জাতির পরিণতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُواْ فِيْ دَارِهِمْ جَاثِمِيْنَ ‘তাদেরকে ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল, ফলে তারা তাদের লোকালয়ে অধঃমুখী হয়ে পড়েছিল’ (আ‘রাফ ৭/৭৮)।
লূত (আঃ)-এর জাতির পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
-وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَّطَراً فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُجْرِمِيْنَ -
‘আমি তাদের উপর প্রবল বারিপাত করেছিলাম। সুতরাং পাপিষ্ঠদের পরিণতি কিরূপ দাঁড়িয়েছিল তা আপনি লক্ষ্য করুন’ (আ‘রাফ ৭/৮৪)।
শু‘আইব (আঃ)-এর জাতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
فَكَذَّبُوْهُ فَأَخَذَهُمْ عَذَابُ يَوْمِ الظُّلَّةِ إِنَّهُ كَانَ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ -
‘অতঃপর ওরা তাঁকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করল। ফলে ওদের মেঘাচ্ছন্ন দিবসে শাস্তি গ্রাস করল। এতো ছিল এক ভীষণ দিবসের শাস্তি’ (শু‘আরা ২৬/১৮৯)।
পাপিষ্ঠদের এভাবে কঠিন শাস্তিতে জর্জরিত করা নিশ্চয়ই প্রচারকদের প্রতি বিরাট সাহায্য এবং মিথ্যারোপকারী, দুর্মুখ নাস্তিক ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি লাঞ্ছনা ও নির্মম কষাঘাত। আল্লাহ অবশ্য পাপীদের অবকাশ দেন, তাই বলে চিরতরের জন্য অবকাশ দেন না। তিনি বলেন,
فَكُلاًّ أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ فَمِنْهُم مَّنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِباً وَّمِنْهُمْ مَّنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُم مَّنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَّنْ أَغْرَقْنَا وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوْا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ -
‘ওদের প্রত্যেককেই আমি তার অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলাম। ওদের কারও প্রতি প্রেরণ করেছিলাম প্রস্তরসহ প্রচন্ড ঝটিকা, কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ, কাউকে আমি প্রোথিত করেছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোন যুলুম করেননি; বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল’ (আনকাবূত ২৯/৪০)।
(৩) নবী-রাসূলগণের তিরোধানের পর শত্রুদের বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে সাহায্য :
যারা নবী-রাসূল ও দ্বীন প্রচারকদের প্রচারিত সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে, অনেক সময় নবী-রাসূলগণের মৃত্যুর পর আল্লাহ তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে থাকেন। ইয়াহইয়া (আঃ), শু‘আইব (আঃ)-এর হত্যাকারীদের ক্ষেত্রে এবং ঈসা (আঃ)-এর হত্যার প্রচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে এরূপ প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণ ও ঈমানদারগণকে পৃথিবীর জীবনেই সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/৫১)। এ আয়াতের মর্মার্থ প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে ‘আমি এই সাহায্য হয় যারা আমাকে মিথ্যুক গণ্য করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে রাসূলগণকে বিজয়ী করে করব, নয়তো রাসূলগণকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছে, রাসূলদের ধ্বংস ও ওফাতের পর ঐ প্রত্যাখ্যানকারীদের থেকে এই পার্থিব জীবনে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে করব। যেমন নবী শু‘আইব (আঃ)-কে হত্যা করার পর আমি তাকে সাহায্য করেছিলাম। তার হত্যাকারীদের উপর আমি ক্ষমতাশালী কিছু লোক নিযুক্ত করেছিলাম এবং তাদের হাতে হত্যাকারীদের নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলাম। ঈসা (আঃ)-এর হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের থেকে রোমকদের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিয়েছিলাম। তারা ওদের ধ্বংস করে দিয়েছিল। ইয়াহইয়া (আঃ)-কে যারা হত্যা করেছিল তাদের উপর আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ বখতে নছর (নেবুচাদ নেজার)-কে চাপিয়ে দিয়েছিলাম। এভাবে ইয়াহইয়া (আঃ)-এর হত্যাকারীদের থেকে তার মাধ্যমে আমি প্রতিশোধ নিয়েছিলাম’।[1] আল্লাহর বাণী, وَلَوْ يَشَاءُ اللهُ لاَنْتَصَرَ مِنْهُمْ - ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৪)। এসবই আল্লাহর উক্তির মর্ম।
(৪) জেল, হত্যা, বাস্ত্তভিটা হ’তে উৎখাত, যুলুম-নির্যাতন ইত্যাদি যা বাহ্যদৃষ্টিতে পরাজয়, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তা-ই বিজয় :
মানুষের বাহ্যদৃষ্টিতে উপরোক্ত বিষয়গুলি পরাজয় গণ্য হ’লেও অনেক সময় তা প্রকৃতপক্ষে বিজয়রূপেই প্রতিপন্ন হয়। একজন প্রচারকের নিহত হওয়া কি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়া নয়? আল্লাহ বলেন,
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ -
‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদেরকে তুমি কখনও মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত। তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তারা রিযিক প্রাপ্ত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
قِيْلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَ قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِيْ يَعْلَمُوْنَ، ِمَا غَفَرَ لِيْ رَبِّيْ وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُكْرَمِيْنَ -
‘বলা হ’ল, ‘যাও, জান্নাতে যাও। সে তখন বলল, হায় আফসোস! আমার জাতি যদি জানত যে, কেন আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করলেন এবং আমাকে সম্মানিতজনদের অন্তর্ভুক্ত করলেন’ (ইয়াসীন ৩৬/২৬-২৭)। আল্লাহ আরও বলেন,
قُلْ هَلْ تَرَبَّصُوْنَ بِنَا إِلاَّ إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ - ‘আপনি বলুন, তোমরা তো আমাদের জন্য দু’টি কল্যাণকর দিকের যেকোন একটির অপেক্ষা বৈ অন্য কিছু করছ না’ (তওবা ৯/৫২)।
অতএব ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে প্রচারক নিহত হ’লেও নানাদিক দিয়েই তা বিজয় বলে গণ্য হবে। -
(৫) শাহাদাতের অমিয় সুধা পানের মাধ্যমে বিজয় :
শাহাদাত মানব জীবনের জন্য চরম ও পরম বিজয়। আল্লাহ তা‘আলা এজন্যই এরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদেরকে তুমি কখনও মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত। তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তারা রিযিক প্রাপ্ত হয়। আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তাদের যা দান করেন তাতে তারা আনন্দিত’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯-১৭০)।
(৬) অত্যাচার ও বদনামের বিনিময়ে সাহায্য ও বিজয় :
যুলুম-অত্যাচার, বদনাম ইত্যাদি সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। কেননা অনেক সময় একজন প্রচারকের যাত্রাই শুরু হয় জেল-যুলুম, বদনামের মাধ্যমে। যেমন একজন প্রচারককে তার শত্রুদের পক্ষ হ’তে মানহানিকর কোন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হ’ল, অনেকে ভাবল এই প্রচারকের দফা-রফা হয়ে গেল। এরপর থেকে তার আর ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্ব বলে কিছুই থাকল না। কিন্তু পরে দেখা গেল ঐ অভিযোগই সেই প্রচারকের সম্মুখপানে অগ্রসরের বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এটাও নানাভাবে পরিস্ফূটিত হ’তে পারে। যথাঃ
উক্ত প্রচারক বদনাম ও জেল সম্পর্কে স্বীয় ব্যক্তিসত্তার উপর মানসিকভাবে বিজয়ী হয়। সে বুঝতে পারে জেলভীতি ও তার প্রকৃতি। তাই দ্বিতীয়বার যখন তাকে জেলে ঢুকান হয় তখন আল্লাহদ্রোহী শক্তির পক্ষ থেকে আগত ভয়-ভীতিকে সে আর পরওয়া করে না।
কোন্ পথ ও মত বাতিল তা প্রচারকের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়। কতক লোক চালাকি করে সত্যের সঙ্গে মিথ্যা ও ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়কে মিশ্রিত করে যে ফায়দা লুটছে, তা সে এখান থেকেই ধরতে পারে।
কে তার শত্রু আর কে মিত্র তা সে চিনতে পারে। যেমন কবি বলেছেন,
جَزَى اللهُ الشَّدَائِدَ عَنِّىْ كُلَّ خَيْرٍ
عَرَفْتُ بِهَا صَدِيْقِىْ مِنْ عَدُوِّىْ
‘বিপদকে আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে সবরকম প্রতিদান দিন। উহা দ্বারা আমি চিনতে পেরেছি কে আমার শত্রু কেবা আমার মিত্র’l তার শিষ্য ও শুভার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায়। যে সত্যের প্রতি সে আহবান জানায় তার আগ্রহী শ্রোতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় তা হাযার হাযারে গিয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখ থুবড়ে দেন। দেখতে দেখতেই তারা পরাজয়ের গ্লানি হজম করে। এসব কি আখিরাতের আগে দুনিয়ার জীবনেই বিজয় নয়?
সাহায্য ও বিজয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর ক্ষেত্রে আমাদের এমন একটি বাস্তবতার সামনে দন্ডায়মান হওয়া যরূরী, যা অনেকের সামনে অস্পষ্ট। সেটা হ’ল প্রচারকের এক প্রকার বিজয়। প্রচারককে যখন হত্যা, কারাদন্ড, শাস্তি প্রদান, ভিটে-মাটি ছাড়া ও দেশ থেকে বহিষ্কার করা ইত্যাদির সিদ্ধান্ত তার প্রতিপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয় তখন তাদের মধ্যেও নানা মানসিক কষ্ট ও যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। এমনকি শাস্তি দিয়েও তাদের স্বস্তি মেলে না। আরাম তখন হারাম হয়ে যায় এবং সৌভাগ্যের আলো কোথাও তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। নিষ্ঠুর উমাইয়া গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রখ্যাত তাবেঈ সাঈদ ইবনু জুবায়েরকে হত্যা করার পর এমনিভাবে নানা মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছিল। সে আরাম করে একটু ঘুমাতেও পারত না। ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ভীতবিহবল হয়ে জেগে উঠত আর বলত, ‘সাঈদকে নিয়ে আমার কি হবে’? এমনিতর দুঃখ ও পেরেশানীর মধ্যে কিছু দিন যেতে না যেতেই সে মারা যায়।
এই বাস্তবতার প্রতিধ্বনি পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে এসেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَإِذَا لَقُوْكُمْ قَالُواْ آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْاْ عَضُّواْ عَلَيْكُمُ الأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوْتُواْ بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللّهَ عَلِيْمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ، إِن تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِن تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُواْ بِهَا وَإِن تَصْبِرُواْ وَتَتَّقُواْ لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئاً إِنَّ اللّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ -
‘যখন তারা একান্তে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। পক্ষান্তরে তারা যখন পৃথক হয়ে যায় তখন তোমাদের উপর ক্ষোভে-দুঃখে আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। বলুন, ‘তোমরা তোমাদের ক্ষোভ, দুঃখ নিয়ে মরে যাও’। নিশ্চয়ই অন্তরে যা আছে তৎসম্পর্কে আল্লাহ সর্বজ্ঞ। যদি তোমাদের কোন কল্যাণ অর্জিত হয় তবে তা তাদের মনপীড়ার কারণ হয়। কিন্তু তোমাদের কোন অকল্যাণ স্পর্শ করলে তাতে ওরা খুব খুশি হয়। তবে যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর ও আল্লাহভীতি অবলম্বন কর, তাহ’লে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কর্মতৎপরতা পরিবেষ্টনকারী’ (আলে ইমরান ৩/১১৯-১২০)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَرَدَّ اللَّهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِغَيْظِهِمْ لَمْ يَنَالُوْا خَيْرًا -
‘আল্লাহ কাফেরদেরকে ক্ষোভসহ ফিরিয়ে দিলেন। তারা কোন কল্যাণ লাভ করতে পারল না’ (আহযাব ৩৩/২৫)।
অপরদিকে একই ক্ষেত্রে আমরা একজন প্রচারককে দেখি, তিনি সুখ ও শান্তির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী পেশ করে বলেন,
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُوْرُوْنَ، وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ -
‘আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্য আমার একথা আগে ভাগে নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, তারা অবশ্যই সাহায্য প্রাপ্ত হবে এবং আমার বাহিনী অবশ্যই বিজয়ী হবে’ (ছা-ফফাত ৩৭/১৭১-১৭৩)। কিছু আরবীয় পন্ডিতের মতে, ‘আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্য আমার কথা আগে ভাগে নিশ্চিত হয়েছে’ বাণীটির অর্থ ‘সৌভাগ্য’। অর্থাৎ তাদের জন্য সৌভাগ্য নিশ্চিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি হাদীছেও এ অর্থ লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেছেন,
عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَالِكَ لِأَحَدٍ إِلاَّ لِمُؤْمِنٍ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَّهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبََرَ فَكَانَ خَيْرًا لَّهُ -
‘মুমিনের বিষয় দেখ কি বিস্ময়কর! তার সবকিছুই কল্যাণময়। এটা মুমিন ছাড়া অন্যের বেলায় হয় না। সে যদি সুখ-সম্পদ লাভ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তাহ’লে তা তার জন্য কল্যাণময়; আবার দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয়ে ধৈর্যধারণ করে, সেটাও তার জন্য কল্যাণকর’।[2]
এই সত্যকে তুলে ধরেই শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছিলেন, ‘আমার শত্রু আমার থেকে কী প্রতিশোধ নেবে? আমার জান্নাত তো আমার বক্ষে। আমাকে হত্যা করলে তা হবে শাহাদত; আমাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করলে তা হবে ভ্রমণ, আমাকে জেলে পুরলে সেটা হবে আমার জন্য নির্জন বাস’।
এতেই আমরা বুঝতে পারি, কে বিজয়ী, আর কে পরাজিত। জয়-পরাজয়ের যে অর্থ মানুষ বাহ্যদৃষ্টিতে মনে রেখেছে তা থেকে উহা অনেক দূরে। এমনকি এতে এমন কিছু লুক্কায়িত সত্য আছে যা চর্মচোখে ধরা পড়ে না। কবি সত্যই বলেছেন,
اِصْبِرْ عَلَى مَضَضِ الْحَسُوْدِ فَإِنَّ صَبْرَكَ قَاتِلُهُ
فَالنَّارُ تَأُكُلُ بَعْضَهَا إِنْ لَمْ تَجِدْ مَا تَأْكُلُهُ -
‘হিংসুকের চোখ রাঙানির কোন পরওয়া নেই
ধৈর্য যে তা মিটিয়ে দেবে অবশ্যই।
অগ্নির ধর্ম নিজকে নিজে খেয়ে ফেলা
যখন পায় না উচিত মত খাদ্য খানা’।
(৭) মূল আদর্শে অটল থাকার মাধ্যমে বিজয় :
প্রচারক যে আদর্শের পথে মানুষকে আহবান জানাবেন তাতে যতই ঝড়-ঝঞ্ঝা, বাধা-বিপত্তি আসুক তিনি নিজে উহার উপর অবিচল থাকলে তা হবে তার জন্য সুস্পষ্ট বিজয়। তাতে করে তিনি সকল কামনা-বাসনা ও সন্দেহ-সংশয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন এবং সাহসিকতা ও অবিচলতার সাথে সকল বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হবেন। মূল আদর্শের উপর অবিচল থাকলেই কেবল প্রকাশ্য বিজয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। দেখা গেছে ইবরাহীম (আঃ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে অথচ তিনি তাঁর বিশ্বাসে অনড় থেকেছেন; এক বিন্দুও সরে দাঁড়াননি। ফলে বিজয়মাল্য তাঁরই গলচুম্বন করেছে। আল্লাহ বলেন,
قَالُوا ابْنُوْا لَهُ بُنْيَاناً فَأَلْقُوْهُ فِي الْجَحِيْمِ، فَأَرَدُوْا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِيْنَ -
‘তারা বলল, তাঁর জন্য একটি ইমারত তৈরী কর এবং তাঁকে উত্তপ্ত আগুনে ফেলে দাও। তারা তাঁকে নিয়ে চক্রান্তের সংকল্প করেছিল। ফলে আমি তাদেরকে ইতর শ্রেণীভুক্ত করে দিয়েছিলাম’ (ছা-ফফাত ৩৭/৯৭, ৯৮)।
ইমাম আহমাদ (রহঃ)-কে ‘কুরআন সৃষ্ট বস্ত্ত’ কথাটি মেনে নেয়ার জন্য দৈহিক ও মানসিকভাবে প্রচন্ড নির্যাতনের সম্মুখীন হ’তে হয়েছিল। কিন্তু তিনি শত্রুর যাবতীয় অত্যাচার, প্রলোভন ও অপচেষ্টার সামনে নতি স্বীকার না করে স্বীয় আদর্শে অটল থেকেছেন। ফলে বিজয় মাল্য তাঁর গলায় শোভা পেয়েছিল। উল্লেখ্য, তিনি সহ ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে’র বিশ্বাস হ’ল, আল-কুরআন আল্লাহর কালাম, যা ক্বাদীম বা অনাদি; উহা সৃষ্ট বস্ত্ত নয়।
গর্ত খননকারীদের শিকার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তবুও তারা দ্বীনের ব্যাপারে কোন আপোষ করেনি। বরং তারা আল্লাহর রাহে শহীদ হওয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। আর এভাবেই তারা হয়েছিলেন বিজয়ী। আল্লাহ বলেন, وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَن يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ ‘তারা পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল, এই একটি মাত্র দোষ ব্যতীত তারা তাদের থেকে অন্যকোন দোষ পায়নি’ (বুরূজ ৮৫/৮)।
এরূপ বিজয়ের অর্থই আমরা খাববাব (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে দেখতে পাই। কাফেরদের অসহনীয় অত্যাচারের দরুন দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গিয়ে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য দো‘আ করবেন না? তিনি তখন তাকে বলেছিলেন,
كَانَ الرَّجُلُ فِيْمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُلَهُ فِىْ الْأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيْهِ فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوْضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُنْشَقُّ بِإِثْنَيْنِ وَمَا يَمُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِيْنِهِ وِيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيْدِ مَادُوْنَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِيْنَهِ -
‘তোমাদের পূর্বকালে একজন ঈমানদার লোকের জন্য যমীনে গর্ত খুঁড়া হ’ত, অতঃপর তাকে তার মধ্যে রাখা হ’ত। তারপর করাত এনে তার মাথার উপর বসিয়ে উহা দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হ’ত। তবুও এ লোমহর্ষক কাজ দ্বীনের উপর অবিচল থাকতে তাকে বাধা সৃষ্টি করেনি। অনেক সময় লোহার চিরুনী দিয়ে তার হাড় ও শিরা-উপশিরা থেকে গোশত খুবলে তুলে ফেলা হ’ত। এরূপ কঠিনতম অত্যাচারও তাকে তার দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি’।[3]
এতে বুঝা গেল, দ্বীনের উপর অটল থাকা এবং সে জন্য যত বাধা-বিপত্তি ও যুলুম-অত্যাচার আসুক না কেন, তাতে পিছ পা না হওয়ার নামই বিজয়।
(৮) বলিষ্ঠ যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে বিজয় :
দ্বীন বা আদর্শের পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি প্রমাণ দাঁড় করাতে পারলে অনেক সময় প্রতিপক্ষ নিরুত্তর হয়ে যায়। তার কণ্ঠে তখন আর সাড়া-শব্দ থাকে না। আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُوْرُوْنَ -
‘আমার প্রেরিত বান্দাদের প্রসঙ্গে আমার এ কথা অগ্রে স্থির হয়ে গেছে যে, তারা অবশ্যই বিজয়ী হবে’ (ছা-ফফাত ৩৭/১৭১-১৭২)।
এ প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেন, আমার পক্ষ হ’তে আমার রাসূলগণের জন্য এ কথা আগেই সাব্যস্ত হয়ে গেছে যে, তারা সাহায্যপ্রাপ্ত ও বিজয়ী হবে। অর্থাৎ লাওহে মাহফূযে আমার পক্ষ থেকে ফায়ছালা করে রাখা হয়েছে যে, যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে তাদের সাহায্য ও বিজয় নিশ্চিত করা হবে। মুফাসসির সুদ্দী বলেন, إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمُنْصُوْرُوْنَ بِالْحُجَجِ، ‘তারা অবশ্যই দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্ত ও বিজয়ী হবে’।[4] আল্লাহর বাণী فَأَرَدُوْا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأسْفَلِيْنَ، ‘তারা তাঁর সম্বন্ধে চক্রান্ত করল, ফলে আমি তাদের ইতর শ্রেণীভুক্ত করে দিলাম’ (ছা-ফফাত ৯৮)। এ প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী বলেন, এ আয়াতের অর্থ- আমি ইবরাহীমের জাতিকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে অপদস্ত ও লাঞ্ছিত করে দিলাম এবং ইবরাহীমকে প্রমাণ উত্থাপনের মধ্য দিয়ে বিজয়ী করলাম।
একই অর্থ আমরা আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে পাই,
وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيْمَ عَلَى قَوْمِهِ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَّنْ نَّشَاءُ -
‘এসব প্রমাণ আমি ইবরাহীমকে তাঁর জাতির বিরুদ্ধে উত্থাপনের জন্য দিয়েছিলাম। আমি যাকে ইচ্ছা, মর্যাদায় উঁচুতে তুলে দেই’ (আন‘আম ৬/৮৩)। এই উঁচুতে তুলে দেয়াই তো বিজয়।
একইভাবে দেখুন, ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে তৎকালীন কাফের শাসক নমরূদ আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল এবং পরাজিত হয়েছিল। যার প্রকাশ ঘটেছে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে فَبُهِتَ الَّذِىْ كَفَرَ ‘কাফের লোকটি হতভম্ব হয়ে গেল’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)।
بُهِتَ অর্থ পরাজিত হওয়া, হতবাক হওয়া। অর্থাৎ কাফের লোকটি যুক্তি প্রমাণ উত্থাপনে ব্যর্থ হয়ে পরাজিত হ’ল, আর ইবরাহীম (আঃ) যুক্তি প্রমাণ দেখিয়ে জয়যুক্ত হ’লেন। এতে বুঝা গেল, বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে সক্ষম হওয়ার মাধ্যমে একজন প্রচারক যে বিজয় অর্জন করেন তা আসলেই বিজয়। দ্বীন বিজয়ের এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
একজন দ্বীন প্রচারক কোন সময় বা স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তার সময় যেমন পার্থিব জীবন, তেমনি পরকালীন জীবনও। তার প্রচারক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী। এজন্যই দেখা যায় একজন প্রচারক কোন স্থানে বিফল হ’লেও অন্য স্থানে সফল হন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে। তিনি প্রথম জীবনে মক্কায় সফলতা লাভ করতে পারেননি, কিন্তু হিজরতের পর প্রথমে মদীনায় ও পরে মক্কায় সফল হয়েছেন। অনুরূপ মূসা (আঃ) ফির‘আউনের দেশে সফল হননি। সেখান থেকে ফিলিস্তীনে এসে সফল হয়েছেন।
সময়ের আঙ্গিকে এক সময় কোন প্রচারক নিষ্প্রভ থাকলেও পরবর্তীকালে তিনি ঝলসে উঠেন। যেমন শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন, অথচ তাঁর দাওয়াতী কর্মসূচী তাঁর মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পর ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে এবং অব্যাহত গতিতে চলছে। এটি একটি সুবিদিত ও চাক্ষুষ বিজয়। অনেক প্রচারকই এক স্থানে পরাজিত ও অন্য স্থানে বিজয়ী হয়েছেন, এক সময়ে অত্যাচারিত হয়েছেন, অন্য সময়ে সফলতা লাভে ধন্য হয়েছেন, চাই তা তার জীবদ্দশায় হোক কিংবা মৃত্যুর পরে হোক।
(৯) শত্রুকে বাধাগ্রস্ত করাও বিজয় :
প্রচারকের নিরাপত্তা বিধান এবং শত্রুকে তার নাগাল পেতে বাধা দেয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রচারকের জন্য এক বিরাট সাহায্য। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, وَلاَ هُمْ يُنْصَرُوْنَ ‘তারা (কাফেররা) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৪৮)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেছেন, أىْ يُمْنَعُوْنَ অর্থাৎ তারা বাধাগ্রস্ত হবে। ইবনু আববাসও এরূপ একটি মত পোষণ করেছেন।[5] আল্লাহ বলেন,
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ -
‘আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা প্রচার করুন এবং মুশরিকদের থেকে নিরস্ত থাকুন। নিশ্চয়ই ঠাট্টাকারীদের থেকে রক্ষায় আমিই আপনার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)।
অত্র আয়াতের অর্থ প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী বলেন, আপনি আল্লাহর আদেশ প্রচার করুন এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবেন না। কেননা আল্লাহ আপনাকে তাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট। যারা আপনার বিরুদ্ধে শত্রুতার ঝান্ডা উত্তোলন করবে এবং আপনাকে নিপীড়ন করবে, তাদের হাত থেকেও রক্ষা করবেন, যেমন করে ঠাট্টাকারীদের হাত থেকে আপনাকে রক্ষায় তিনি যথেষ্ট। আল্লাহ আরও বলেন, وَاللّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ‘মানুষের হাত থেকে আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করবেন’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)।
আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের কয়েকটি নমুনা এখানে তুলে ধরা হ’ল। বলা চলে এগুলি সাহায্য ও বিজয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকার। আমরা যদি এগুলি নিয়ে চিন্তা করি, তারপর নবীদের আদর্শের সাথে মিলিয়ে দেখি, তাহ’লে দেখতে পাব, প্রত্যেক নবী-রাসূলের জীবনে সাহায্য ও বিজয়ের এক বা একাধিক প্রকার বাস্তবায়িত হয়েছিল। আমাদের নবীর জীবনেই দেখা যাক-
তাঁর প্রচারিত দ্বীন বিজয় ও পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
তাঁকে যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে তৎপর ছিল, তাদের অনেকেই বদর ও পরবর্তী যুদ্ধ সমূহে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
তিনি প্রতিপক্ষকে বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা লা-জওয়াব করে দিয়েছিলেন।
শত্রুর হাত থেকে তাঁর জীবনের হেফাযত ও নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছিল।
তাঁকে মক্কা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিজ জন্মস্থান ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে তিনি সফল হয়েছিলেন।
আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচল থেকে তিনি নির্ভীক চিত্তে সত্য প্রচার করেছিলেন।
আল্লাহ বলেন, وَلَوْلاَ أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَّ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئاً قَلِيْلاً ‘যদি আমি আপনাকে অবিচল না রাখতাম তাহ’লে অবশ্যই আপনি সামান্য হ’লেও ওদের প্রতি ঝুঁকে পড়তেন’ (বানী ইসরাঈল ১৭/৭৪)।
নবী-রাসূলগণ যে সব বিজয় পেয়েছেন তাতে ক্ষেত্রবিশেষে তারতম্য হ’তে পারে, কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়া নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এমনিভাবে প্রত্যেক মুমিনের জীবনেও আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিশ্চিত হওয়ার কথা; চাই তা তার জীবদ্দশায় হোক কিংবা মৃত্যুর পরে হোক। আল্লাহর নিম্নোক্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তা হবে,
إنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا فِىْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُوْمُ الْأشْهَادُ -
‘আমার রাসূলগণ ও মুমিনগণকে আমি অবশ্যই ইহজীবনে ও সাক্ষ্য দান (ক্বিয়ামত) দিবসে সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/৫১)।
বর্তমান আলোচনা থেকে আল্লাহপ্রদত্ত সাহায্য ও বিজয়ের অর্থ আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ কথাও পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ইচ্ছামত সাহায্য ও বিজয়ের একটি শ্রেণী নির্দিষ্ট করা আদৌ ঠিক নয়।
আমাদের বুঝতে হবে যে, ঘটনার আগে-পরে সর্বাবস্থায় হুকুম আল্লাহর। আমরা তাঁরই বান্দা, তাঁরই দাসত্ব প্রমাণে আমাদের সচেষ্ট হ’তে হবে। সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দ্বিধাহীন চিত্তে আল্লাহর সাহায্য যে অবশ্যম্ভাবী, সে কথা বিশ্বাস করলে তবেই দাসত্ব পূর্ণতা পাবে। হ্যাঁ কখনো হয়ত আমাদের মানবীয় দুর্বলতা হেতু আল্লাহর হিকমতের তাৎপর্য বুঝতে পারি না। কখনো কখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও সাহায্য বিলম্বিত হয়। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَكَانَ حَقّاً عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘মুমিনদের সাহায্য করা আমারই দায়িত্ব’ (রূম ৩০/৪৭)।
[1]. তাফসীরে ত্বাবারী ২৪/৭৪ পৃঃ।
[2]. মুসলিম হা/২৯৯৯ ‘যুহদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ- ১৪; আলবানী, মিশকাত হা/৫২৯৭।
[3]. বুখারী হা/৩৬১২; মিশকাত হা/৫৮৫৮।
[4]. তাফসীরে ত্বাবারী ২৩/১১৪ পৃঃ।
[5]. তাফসীরে ত্বাবারী ১/২৬৯ পৃঃ।
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُوْرُوْنَ، وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ - ‘নিশ্চয়ই আমার কথা আমার রাসূলগণের ক্ষেত্রে পূর্বে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তারা অবশ্যই সাহায্যপ্রাপ্ত হবেন এবং আমার বাহিনী অবশ্যই বিজয়ী হবে’ (ছাফফাত ৩৭/১৭১-৭৩)। এই আয়াতগুলি ছাড়াও এরূপ আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা একজন প্রচারকের পক্ষে এলাহী সাহায্যের প্রমাণ বহন করে। চাই সে প্রচারক রাসূল হউন কিংবা মুমিন হউন। আল্লাহ প্রদত্ত এ সাহায্য আসবে আখেরাতের আগে দুনিয়াবী জীবনেই।
কুরআন-হাদীছ থেকে যা জানা যায় যে, অনেক নবীকে তাঁদের শত্রুরা হত্যা করে লাশ পর্যন্ত বিকৃত করে দিয়েছে। ইয়াহইয়া ও শু‘আইব (আঃ)-এর ক্ষেত্রে এরূপ ঘটেছিল। আবার অনেক নবীকে তাঁদের গোত্র হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। তাঁরা তাদের ছোবল থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল। যেমন ইবরাহীম (আঃ) স্বজাতি ও স্বদেশ ছেড়ে শাম দেশে হিজরত করেছিলেন। ঈসা (আঃ)-কে তাঁর জাতি যখন হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন আল্লাহ তাঁকে ঊর্ধ্বলোকে তুলে নিয়েছিলেন।
মুমিনদেরকেও অনুরূপ বর্বরতম শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কাউকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, কাউকে শহীদ করা হয়েছে, কেউ দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করেছেন। তবে এভাবে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া, হত্যার শিকার ও শাস্তি ভোগের পরও পার্থিব জীবনে আল্লাহর সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা কিভাবে বিশ্বাস করা যায়?
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কখনই বিলম্বিত হয় না। কিন্তু বিভিন্ন প্রকার সাহায্যের কথা বাদ দিয়ে আল্লাহর প্রকাশ্য সাহায্য ও দ্বীনের বিজয় লাভের মত একটি মাত্র সাহায্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করাতেই এরূপ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূল ও মুমিনদেরকে যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা যে কেবল এই শ্রেণীর সাহায্যই হ’তে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
আল্লাহ তাদেরকে যে সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা অবশ্যই অতীতে বাস্তবায়িত হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ। এতে কোন সন্দেহ নেই। আর তা আখেরাতের পূর্বে দুনিয়ার জীবনেই হবে।
এ বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখার জন্য বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত, نَصْرٌ বা ‘সাহায্য’ শব্দের মর্মার্থ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। আমাদের স্মৃতিতে এ কথা আগেই ধরে রাখা দরকার যে, সাহায্যের নানা দিক ও প্রকৃতি রয়েছে। তার যেকোন একটি বাস্তবায়িত হ’লে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে বলে গণ্য হবে। নানা প্রকৃতির এই সাহায্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিম্নে উপস্থাপন করা হ’ল :
(১) প্রত্যক্ষ বিজয় ও শত্রুর পরাজয় :
আল্লাহ তা‘আলা কখনও প্রচারকবৃন্দকে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিজয় দান করেন। শত্রু তখন তাদের পদানত হয়ে যায়। বহু নবী-রাসূল এভাবে শত্রুদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিজয় অর্জন করেছেন। দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ) এরূপ বিজয় অর্জন করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, وَقَتَلَ دَاوُدُ جَالُوْتَ وَآتَاهُ اللهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ، ‘দাঊদ জালূতকে হত্যা করেন এবং আল্লাহ তাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা দান করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)। وَكُلاَّ آتَيْنَا حُكْمًا وَّعِلْمًا، ‘উভয়কেই (দাঊদ ও সুলায়মানকে) আমি শাসন ক্ষমতা ও জ্ঞান দান করেছি’ (আম্বিয়া ২১/৭৯)। قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكاً لَّا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِّنْ بَعْدِي، ‘তিনি বললেন, রব আমার, আমাকে আপনি মার্জনা করুন এবং আমাকে এমন রাষ্ট্র দান করুন, যা আমার পর আর কারও জন্য সম্ভব হবে না’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৫)।
মূসা (আঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা ফির‘আউন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় দ্বীনকে বিজয়ী করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُواْ يَعْرِشُونَ ‘ফির‘আউন ও তার সম্প্রদায়ের শিল্প এবং তাদের নির্মিত প্রাসাদরাজি আমি ধ্বংস করে দিয়েছি’ (আ‘রাফ ৭/১৩৭)।
فَأَنْجَيْنَاكُمْ وَأَغْرَقْنَا آلَ فِرْعَوْنَ وَأَنْتُمْ تَنظُرُوْنَ - ‘অতঃপর আমি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছিলাম এবং ফির‘আউন সম্প্রদায়কে এমন করে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, যা তোমরা তাকিয়ে দেখছিলে’ (বাক্বারাহ ২/৫০)।
আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কেও আল্লাহ তা‘আলা খুব বড় আকারে সাহায্য করেছেন। বদর ও পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শত্রুদেরকে পদানত করেছেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হয়েছে এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحاً مُّبِيْناً ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দান করেছি সুস্পষ্ট বিজয়’ (ফাতহ ৪৮/১)।
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ، وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللَّهِ أَفْوَاجاً - ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, আর আপনি লোকদের দেখতে পাবেন, তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে’ (নাছর ১১০/১-২)। এ জাতীয় সাহায্য তো খুবই স্পষ্ট। ‘সাহায্য’ শব্দ উচ্চারণ করা মাত্রই এদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। কারণ (ক) প্রকাশ্য সাহায্য মানুষ চোখে দেখতে পায় এবং হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে। (খ) এ ধরনের সাহায্য একাধারে দ্বীন ও তার প্রচারক উভয়েরই বিজয়ের স্বাক্ষর বহন করে। (গ) মানব মনের কাঙ্খিত ও প্রিয় বিষয়ই হ’ল এরূপ সাহায্য। এ সাহায্য দ্রুত ফলদায়ক। আর যা দ্রুত ফলদায়ক তার প্রতি মনের আকর্ষণ আপনা-আপনি তৈরী হয়। এজন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন, وَأُخْرَى تُحِبُّوْنَهَا نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيْبٌ ‘তিনি দান করবেন তোমাদের বাঞ্ছিত আরও একটি অনুগ্রহ; আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়’ (ছাফফ ৬১/১৩)।
(২) মিথ্যারোপকারীদের ধ্বংসের মাধ্যমে সাহায্য :
কখনও মিথ্যারোপকারী কাফিরদের ধ্বংস সাধন এবং নবী-রাসূল ও তাঁদের সঙ্গী মুমিনদের নাজাত প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়। নূহ (আঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা এভাবে সাহায্য করেছিলেন। তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর কাফির জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
فَدَعَا رَبَّهُ أَنِّيْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ-َفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ بِمَاءٍ مُّنْهَمِرٍ، وَفَجَّرْنَا الْأَرْضَ عُيُوْناً فَالْتَقَى الْمَاءُ عَلَى أَمْرٍ قَدْ قُدِرَ، وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَّدُسُرٍ، تَجْرِيْ بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِّمَنْ كَانَ كُفِرَ -
‘তিনি (নূহ) তাঁর রবকে আহবান করে বললেন, আমি তো অসহায়, অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন। ফলে আমি উন্মুক্ত করে দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারি বর্ষণে এবং মৃত্তিকা হ’তে উৎসারিত করলাম প্রস্রবণ। অতঃপর সকল পানি মিলিত হ’ল এক পরিকল্পনা অনুসারে। তখন নূহকে আরোহন করালাম কাষ্ঠ ও কীলক নির্মিত এক নৌযানে। যা চলত আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এটা তার জন্য প্রতিদান যাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল’ (ক্বামার ৫৪/১০-১৪)।
একই পরিণতি ঘটেছিল হূদ (আঃ)-এর ক্বওমের। আল্লাহ বলেন,
فَأَنجَيْنَاهُ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِيْنَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا وَمَا كَانُواْ مُؤْمِنِيْنَ -
‘অনন্তর আমি তাঁকে ও তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে মুক্তি দিয়েছিলাম এবং যারা আমার বিধানাবলীকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল তাদের মূলচ্ছেদ করেছিলাম। বস্ত্ততঃ তারা মুমিন ছিল না’ (আ‘রাফ ৭/৭২)।
ছালেহ (আঃ)-এর জাতির পরিণতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُواْ فِيْ دَارِهِمْ جَاثِمِيْنَ ‘তাদেরকে ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল, ফলে তারা তাদের লোকালয়ে অধঃমুখী হয়ে পড়েছিল’ (আ‘রাফ ৭/৭৮)।
লূত (আঃ)-এর জাতির পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
-وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَّطَراً فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُجْرِمِيْنَ -
‘আমি তাদের উপর প্রবল বারিপাত করেছিলাম। সুতরাং পাপিষ্ঠদের পরিণতি কিরূপ দাঁড়িয়েছিল তা আপনি লক্ষ্য করুন’ (আ‘রাফ ৭/৮৪)।
শু‘আইব (আঃ)-এর জাতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
فَكَذَّبُوْهُ فَأَخَذَهُمْ عَذَابُ يَوْمِ الظُّلَّةِ إِنَّهُ كَانَ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ -
‘অতঃপর ওরা তাঁকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করল। ফলে ওদের মেঘাচ্ছন্ন দিবসে শাস্তি গ্রাস করল। এতো ছিল এক ভীষণ দিবসের শাস্তি’ (শু‘আরা ২৬/১৮৯)।
পাপিষ্ঠদের এভাবে কঠিন শাস্তিতে জর্জরিত করা নিশ্চয়ই প্রচারকদের প্রতি বিরাট সাহায্য এবং মিথ্যারোপকারী, দুর্মুখ নাস্তিক ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি লাঞ্ছনা ও নির্মম কষাঘাত। আল্লাহ অবশ্য পাপীদের অবকাশ দেন, তাই বলে চিরতরের জন্য অবকাশ দেন না। তিনি বলেন,
فَكُلاًّ أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ فَمِنْهُم مَّنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِباً وَّمِنْهُمْ مَّنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُم مَّنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَّنْ أَغْرَقْنَا وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوْا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ -
‘ওদের প্রত্যেককেই আমি তার অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলাম। ওদের কারও প্রতি প্রেরণ করেছিলাম প্রস্তরসহ প্রচন্ড ঝটিকা, কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ, কাউকে আমি প্রোথিত করেছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোন যুলুম করেননি; বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল’ (আনকাবূত ২৯/৪০)।
(৩) নবী-রাসূলগণের তিরোধানের পর শত্রুদের বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে সাহায্য :
যারা নবী-রাসূল ও দ্বীন প্রচারকদের প্রচারিত সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে, অনেক সময় নবী-রাসূলগণের মৃত্যুর পর আল্লাহ তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে থাকেন। ইয়াহইয়া (আঃ), শু‘আইব (আঃ)-এর হত্যাকারীদের ক্ষেত্রে এবং ঈসা (আঃ)-এর হত্যার প্রচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে এরূপ প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণ ও ঈমানদারগণকে পৃথিবীর জীবনেই সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/৫১)। এ আয়াতের মর্মার্থ প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে ‘আমি এই সাহায্য হয় যারা আমাকে মিথ্যুক গণ্য করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে রাসূলগণকে বিজয়ী করে করব, নয়তো রাসূলগণকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছে, রাসূলদের ধ্বংস ও ওফাতের পর ঐ প্রত্যাখ্যানকারীদের থেকে এই পার্থিব জীবনে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে করব। যেমন নবী শু‘আইব (আঃ)-কে হত্যা করার পর আমি তাকে সাহায্য করেছিলাম। তার হত্যাকারীদের উপর আমি ক্ষমতাশালী কিছু লোক নিযুক্ত করেছিলাম এবং তাদের হাতে হত্যাকারীদের নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলাম। ঈসা (আঃ)-এর হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের থেকে রোমকদের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিয়েছিলাম। তারা ওদের ধ্বংস করে দিয়েছিল। ইয়াহইয়া (আঃ)-কে যারা হত্যা করেছিল তাদের উপর আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ বখতে নছর (নেবুচাদ নেজার)-কে চাপিয়ে দিয়েছিলাম। এভাবে ইয়াহইয়া (আঃ)-এর হত্যাকারীদের থেকে তার মাধ্যমে আমি প্রতিশোধ নিয়েছিলাম’।[1] আল্লাহর বাণী, وَلَوْ يَشَاءُ اللهُ لاَنْتَصَرَ مِنْهُمْ - ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৪)। এসবই আল্লাহর উক্তির মর্ম।
(৪) জেল, হত্যা, বাস্ত্তভিটা হ’তে উৎখাত, যুলুম-নির্যাতন ইত্যাদি যা বাহ্যদৃষ্টিতে পরাজয়, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তা-ই বিজয় :
মানুষের বাহ্যদৃষ্টিতে উপরোক্ত বিষয়গুলি পরাজয় গণ্য হ’লেও অনেক সময় তা প্রকৃতপক্ষে বিজয়রূপেই প্রতিপন্ন হয়। একজন প্রচারকের নিহত হওয়া কি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়া নয়? আল্লাহ বলেন,
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ -
‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদেরকে তুমি কখনও মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত। তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তারা রিযিক প্রাপ্ত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
قِيْلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَ قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِيْ يَعْلَمُوْنَ، ِمَا غَفَرَ لِيْ رَبِّيْ وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُكْرَمِيْنَ -
‘বলা হ’ল, ‘যাও, জান্নাতে যাও। সে তখন বলল, হায় আফসোস! আমার জাতি যদি জানত যে, কেন আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করলেন এবং আমাকে সম্মানিতজনদের অন্তর্ভুক্ত করলেন’ (ইয়াসীন ৩৬/২৬-২৭)। আল্লাহ আরও বলেন,
قُلْ هَلْ تَرَبَّصُوْنَ بِنَا إِلاَّ إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ - ‘আপনি বলুন, তোমরা তো আমাদের জন্য দু’টি কল্যাণকর দিকের যেকোন একটির অপেক্ষা বৈ অন্য কিছু করছ না’ (তওবা ৯/৫২)।
অতএব ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে প্রচারক নিহত হ’লেও নানাদিক দিয়েই তা বিজয় বলে গণ্য হবে। -
(৫) শাহাদাতের অমিয় সুধা পানের মাধ্যমে বিজয় :
শাহাদাত মানব জীবনের জন্য চরম ও পরম বিজয়। আল্লাহ তা‘আলা এজন্যই এরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদেরকে তুমি কখনও মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত। তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তারা রিযিক প্রাপ্ত হয়। আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তাদের যা দান করেন তাতে তারা আনন্দিত’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯-১৭০)।
(৬) অত্যাচার ও বদনামের বিনিময়ে সাহায্য ও বিজয় :
যুলুম-অত্যাচার, বদনাম ইত্যাদি সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। কেননা অনেক সময় একজন প্রচারকের যাত্রাই শুরু হয় জেল-যুলুম, বদনামের মাধ্যমে। যেমন একজন প্রচারককে তার শত্রুদের পক্ষ হ’তে মানহানিকর কোন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হ’ল, অনেকে ভাবল এই প্রচারকের দফা-রফা হয়ে গেল। এরপর থেকে তার আর ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্ব বলে কিছুই থাকল না। কিন্তু পরে দেখা গেল ঐ অভিযোগই সেই প্রচারকের সম্মুখপানে অগ্রসরের বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এটাও নানাভাবে পরিস্ফূটিত হ’তে পারে। যথাঃ
উক্ত প্রচারক বদনাম ও জেল সম্পর্কে স্বীয় ব্যক্তিসত্তার উপর মানসিকভাবে বিজয়ী হয়। সে বুঝতে পারে জেলভীতি ও তার প্রকৃতি। তাই দ্বিতীয়বার যখন তাকে জেলে ঢুকান হয় তখন আল্লাহদ্রোহী শক্তির পক্ষ থেকে আগত ভয়-ভীতিকে সে আর পরওয়া করে না।
কোন্ পথ ও মত বাতিল তা প্রচারকের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়। কতক লোক চালাকি করে সত্যের সঙ্গে মিথ্যা ও ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়কে মিশ্রিত করে যে ফায়দা লুটছে, তা সে এখান থেকেই ধরতে পারে।
কে তার শত্রু আর কে মিত্র তা সে চিনতে পারে। যেমন কবি বলেছেন,
جَزَى اللهُ الشَّدَائِدَ عَنِّىْ كُلَّ خَيْرٍ
عَرَفْتُ بِهَا صَدِيْقِىْ مِنْ عَدُوِّىْ
‘বিপদকে আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে সবরকম প্রতিদান দিন। উহা দ্বারা আমি চিনতে পেরেছি কে আমার শত্রু কেবা আমার মিত্র’l তার শিষ্য ও শুভার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায়। যে সত্যের প্রতি সে আহবান জানায় তার আগ্রহী শ্রোতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় তা হাযার হাযারে গিয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখ থুবড়ে দেন। দেখতে দেখতেই তারা পরাজয়ের গ্লানি হজম করে। এসব কি আখিরাতের আগে দুনিয়ার জীবনেই বিজয় নয়?
সাহায্য ও বিজয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর ক্ষেত্রে আমাদের এমন একটি বাস্তবতার সামনে দন্ডায়মান হওয়া যরূরী, যা অনেকের সামনে অস্পষ্ট। সেটা হ’ল প্রচারকের এক প্রকার বিজয়। প্রচারককে যখন হত্যা, কারাদন্ড, শাস্তি প্রদান, ভিটে-মাটি ছাড়া ও দেশ থেকে বহিষ্কার করা ইত্যাদির সিদ্ধান্ত তার প্রতিপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয় তখন তাদের মধ্যেও নানা মানসিক কষ্ট ও যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। এমনকি শাস্তি দিয়েও তাদের স্বস্তি মেলে না। আরাম তখন হারাম হয়ে যায় এবং সৌভাগ্যের আলো কোথাও তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। নিষ্ঠুর উমাইয়া গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রখ্যাত তাবেঈ সাঈদ ইবনু জুবায়েরকে হত্যা করার পর এমনিভাবে নানা মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছিল। সে আরাম করে একটু ঘুমাতেও পারত না। ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ভীতবিহবল হয়ে জেগে উঠত আর বলত, ‘সাঈদকে নিয়ে আমার কি হবে’? এমনিতর দুঃখ ও পেরেশানীর মধ্যে কিছু দিন যেতে না যেতেই সে মারা যায়।
এই বাস্তবতার প্রতিধ্বনি পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে এসেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَإِذَا لَقُوْكُمْ قَالُواْ آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْاْ عَضُّواْ عَلَيْكُمُ الأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوْتُواْ بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللّهَ عَلِيْمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ، إِن تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِن تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُواْ بِهَا وَإِن تَصْبِرُواْ وَتَتَّقُواْ لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئاً إِنَّ اللّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ -
‘যখন তারা একান্তে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। পক্ষান্তরে তারা যখন পৃথক হয়ে যায় তখন তোমাদের উপর ক্ষোভে-দুঃখে আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। বলুন, ‘তোমরা তোমাদের ক্ষোভ, দুঃখ নিয়ে মরে যাও’। নিশ্চয়ই অন্তরে যা আছে তৎসম্পর্কে আল্লাহ সর্বজ্ঞ। যদি তোমাদের কোন কল্যাণ অর্জিত হয় তবে তা তাদের মনপীড়ার কারণ হয়। কিন্তু তোমাদের কোন অকল্যাণ স্পর্শ করলে তাতে ওরা খুব খুশি হয়। তবে যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর ও আল্লাহভীতি অবলম্বন কর, তাহ’লে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কর্মতৎপরতা পরিবেষ্টনকারী’ (আলে ইমরান ৩/১১৯-১২০)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَرَدَّ اللَّهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِغَيْظِهِمْ لَمْ يَنَالُوْا خَيْرًا -
‘আল্লাহ কাফেরদেরকে ক্ষোভসহ ফিরিয়ে দিলেন। তারা কোন কল্যাণ লাভ করতে পারল না’ (আহযাব ৩৩/২৫)।
অপরদিকে একই ক্ষেত্রে আমরা একজন প্রচারককে দেখি, তিনি সুখ ও শান্তির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী পেশ করে বলেন,
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُوْرُوْنَ، وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ -
‘আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্য আমার একথা আগে ভাগে নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, তারা অবশ্যই সাহায্য প্রাপ্ত হবে এবং আমার বাহিনী অবশ্যই বিজয়ী হবে’ (ছা-ফফাত ৩৭/১৭১-১৭৩)। কিছু আরবীয় পন্ডিতের মতে, ‘আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্য আমার কথা আগে ভাগে নিশ্চিত হয়েছে’ বাণীটির অর্থ ‘সৌভাগ্য’। অর্থাৎ তাদের জন্য সৌভাগ্য নিশ্চিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি হাদীছেও এ অর্থ লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেছেন,
عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَالِكَ لِأَحَدٍ إِلاَّ لِمُؤْمِنٍ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَّهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبََرَ فَكَانَ خَيْرًا لَّهُ -
‘মুমিনের বিষয় দেখ কি বিস্ময়কর! তার সবকিছুই কল্যাণময়। এটা মুমিন ছাড়া অন্যের বেলায় হয় না। সে যদি সুখ-সম্পদ লাভ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তাহ’লে তা তার জন্য কল্যাণময়; আবার দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয়ে ধৈর্যধারণ করে, সেটাও তার জন্য কল্যাণকর’।[2]
এই সত্যকে তুলে ধরেই শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছিলেন, ‘আমার শত্রু আমার থেকে কী প্রতিশোধ নেবে? আমার জান্নাত তো আমার বক্ষে। আমাকে হত্যা করলে তা হবে শাহাদত; আমাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করলে তা হবে ভ্রমণ, আমাকে জেলে পুরলে সেটা হবে আমার জন্য নির্জন বাস’।
এতেই আমরা বুঝতে পারি, কে বিজয়ী, আর কে পরাজিত। জয়-পরাজয়ের যে অর্থ মানুষ বাহ্যদৃষ্টিতে মনে রেখেছে তা থেকে উহা অনেক দূরে। এমনকি এতে এমন কিছু লুক্কায়িত সত্য আছে যা চর্মচোখে ধরা পড়ে না। কবি সত্যই বলেছেন,
اِصْبِرْ عَلَى مَضَضِ الْحَسُوْدِ فَإِنَّ صَبْرَكَ قَاتِلُهُ
فَالنَّارُ تَأُكُلُ بَعْضَهَا إِنْ لَمْ تَجِدْ مَا تَأْكُلُهُ -
‘হিংসুকের চোখ রাঙানির কোন পরওয়া নেই
ধৈর্য যে তা মিটিয়ে দেবে অবশ্যই।
অগ্নির ধর্ম নিজকে নিজে খেয়ে ফেলা
যখন পায় না উচিত মত খাদ্য খানা’।
(৭) মূল আদর্শে অটল থাকার মাধ্যমে বিজয় :
প্রচারক যে আদর্শের পথে মানুষকে আহবান জানাবেন তাতে যতই ঝড়-ঝঞ্ঝা, বাধা-বিপত্তি আসুক তিনি নিজে উহার উপর অবিচল থাকলে তা হবে তার জন্য সুস্পষ্ট বিজয়। তাতে করে তিনি সকল কামনা-বাসনা ও সন্দেহ-সংশয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন এবং সাহসিকতা ও অবিচলতার সাথে সকল বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হবেন। মূল আদর্শের উপর অবিচল থাকলেই কেবল প্রকাশ্য বিজয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। দেখা গেছে ইবরাহীম (আঃ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে অথচ তিনি তাঁর বিশ্বাসে অনড় থেকেছেন; এক বিন্দুও সরে দাঁড়াননি। ফলে বিজয়মাল্য তাঁরই গলচুম্বন করেছে। আল্লাহ বলেন,
قَالُوا ابْنُوْا لَهُ بُنْيَاناً فَأَلْقُوْهُ فِي الْجَحِيْمِ، فَأَرَدُوْا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِيْنَ -
‘তারা বলল, তাঁর জন্য একটি ইমারত তৈরী কর এবং তাঁকে উত্তপ্ত আগুনে ফেলে দাও। তারা তাঁকে নিয়ে চক্রান্তের সংকল্প করেছিল। ফলে আমি তাদেরকে ইতর শ্রেণীভুক্ত করে দিয়েছিলাম’ (ছা-ফফাত ৩৭/৯৭, ৯৮)।
ইমাম আহমাদ (রহঃ)-কে ‘কুরআন সৃষ্ট বস্ত্ত’ কথাটি মেনে নেয়ার জন্য দৈহিক ও মানসিকভাবে প্রচন্ড নির্যাতনের সম্মুখীন হ’তে হয়েছিল। কিন্তু তিনি শত্রুর যাবতীয় অত্যাচার, প্রলোভন ও অপচেষ্টার সামনে নতি স্বীকার না করে স্বীয় আদর্শে অটল থেকেছেন। ফলে বিজয় মাল্য তাঁর গলায় শোভা পেয়েছিল। উল্লেখ্য, তিনি সহ ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে’র বিশ্বাস হ’ল, আল-কুরআন আল্লাহর কালাম, যা ক্বাদীম বা অনাদি; উহা সৃষ্ট বস্ত্ত নয়।
গর্ত খননকারীদের শিকার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তবুও তারা দ্বীনের ব্যাপারে কোন আপোষ করেনি। বরং তারা আল্লাহর রাহে শহীদ হওয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। আর এভাবেই তারা হয়েছিলেন বিজয়ী। আল্লাহ বলেন, وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَن يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ ‘তারা পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল, এই একটি মাত্র দোষ ব্যতীত তারা তাদের থেকে অন্যকোন দোষ পায়নি’ (বুরূজ ৮৫/৮)।
এরূপ বিজয়ের অর্থই আমরা খাববাব (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে দেখতে পাই। কাফেরদের অসহনীয় অত্যাচারের দরুন দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গিয়ে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য দো‘আ করবেন না? তিনি তখন তাকে বলেছিলেন,
كَانَ الرَّجُلُ فِيْمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُلَهُ فِىْ الْأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيْهِ فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوْضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُنْشَقُّ بِإِثْنَيْنِ وَمَا يَمُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِيْنِهِ وِيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيْدِ مَادُوْنَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِيْنَهِ -
‘তোমাদের পূর্বকালে একজন ঈমানদার লোকের জন্য যমীনে গর্ত খুঁড়া হ’ত, অতঃপর তাকে তার মধ্যে রাখা হ’ত। তারপর করাত এনে তার মাথার উপর বসিয়ে উহা দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হ’ত। তবুও এ লোমহর্ষক কাজ দ্বীনের উপর অবিচল থাকতে তাকে বাধা সৃষ্টি করেনি। অনেক সময় লোহার চিরুনী দিয়ে তার হাড় ও শিরা-উপশিরা থেকে গোশত খুবলে তুলে ফেলা হ’ত। এরূপ কঠিনতম অত্যাচারও তাকে তার দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি’।[3]
এতে বুঝা গেল, দ্বীনের উপর অটল থাকা এবং সে জন্য যত বাধা-বিপত্তি ও যুলুম-অত্যাচার আসুক না কেন, তাতে পিছ পা না হওয়ার নামই বিজয়।
(৮) বলিষ্ঠ যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে বিজয় :
দ্বীন বা আদর্শের পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি প্রমাণ দাঁড় করাতে পারলে অনেক সময় প্রতিপক্ষ নিরুত্তর হয়ে যায়। তার কণ্ঠে তখন আর সাড়া-শব্দ থাকে না। আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُوْرُوْنَ -
‘আমার প্রেরিত বান্দাদের প্রসঙ্গে আমার এ কথা অগ্রে স্থির হয়ে গেছে যে, তারা অবশ্যই বিজয়ী হবে’ (ছা-ফফাত ৩৭/১৭১-১৭২)।
এ প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেন, আমার পক্ষ হ’তে আমার রাসূলগণের জন্য এ কথা আগেই সাব্যস্ত হয়ে গেছে যে, তারা সাহায্যপ্রাপ্ত ও বিজয়ী হবে। অর্থাৎ লাওহে মাহফূযে আমার পক্ষ থেকে ফায়ছালা করে রাখা হয়েছে যে, যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে তাদের সাহায্য ও বিজয় নিশ্চিত করা হবে। মুফাসসির সুদ্দী বলেন, إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمُنْصُوْرُوْنَ بِالْحُجَجِ، ‘তারা অবশ্যই দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্ত ও বিজয়ী হবে’।[4] আল্লাহর বাণী فَأَرَدُوْا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأسْفَلِيْنَ، ‘তারা তাঁর সম্বন্ধে চক্রান্ত করল, ফলে আমি তাদের ইতর শ্রেণীভুক্ত করে দিলাম’ (ছা-ফফাত ৯৮)। এ প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী বলেন, এ আয়াতের অর্থ- আমি ইবরাহীমের জাতিকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে অপদস্ত ও লাঞ্ছিত করে দিলাম এবং ইবরাহীমকে প্রমাণ উত্থাপনের মধ্য দিয়ে বিজয়ী করলাম।
একই অর্থ আমরা আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে পাই,
وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيْمَ عَلَى قَوْمِهِ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَّنْ نَّشَاءُ -
‘এসব প্রমাণ আমি ইবরাহীমকে তাঁর জাতির বিরুদ্ধে উত্থাপনের জন্য দিয়েছিলাম। আমি যাকে ইচ্ছা, মর্যাদায় উঁচুতে তুলে দেই’ (আন‘আম ৬/৮৩)। এই উঁচুতে তুলে দেয়াই তো বিজয়।
একইভাবে দেখুন, ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে তৎকালীন কাফের শাসক নমরূদ আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল এবং পরাজিত হয়েছিল। যার প্রকাশ ঘটেছে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে فَبُهِتَ الَّذِىْ كَفَرَ ‘কাফের লোকটি হতভম্ব হয়ে গেল’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)।
بُهِتَ অর্থ পরাজিত হওয়া, হতবাক হওয়া। অর্থাৎ কাফের লোকটি যুক্তি প্রমাণ উত্থাপনে ব্যর্থ হয়ে পরাজিত হ’ল, আর ইবরাহীম (আঃ) যুক্তি প্রমাণ দেখিয়ে জয়যুক্ত হ’লেন। এতে বুঝা গেল, বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে সক্ষম হওয়ার মাধ্যমে একজন প্রচারক যে বিজয় অর্জন করেন তা আসলেই বিজয়। দ্বীন বিজয়ের এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
একজন দ্বীন প্রচারক কোন সময় বা স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তার সময় যেমন পার্থিব জীবন, তেমনি পরকালীন জীবনও। তার প্রচারক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী। এজন্যই দেখা যায় একজন প্রচারক কোন স্থানে বিফল হ’লেও অন্য স্থানে সফল হন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে। তিনি প্রথম জীবনে মক্কায় সফলতা লাভ করতে পারেননি, কিন্তু হিজরতের পর প্রথমে মদীনায় ও পরে মক্কায় সফল হয়েছেন। অনুরূপ মূসা (আঃ) ফির‘আউনের দেশে সফল হননি। সেখান থেকে ফিলিস্তীনে এসে সফল হয়েছেন।
সময়ের আঙ্গিকে এক সময় কোন প্রচারক নিষ্প্রভ থাকলেও পরবর্তীকালে তিনি ঝলসে উঠেন। যেমন শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন, অথচ তাঁর দাওয়াতী কর্মসূচী তাঁর মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পর ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে এবং অব্যাহত গতিতে চলছে। এটি একটি সুবিদিত ও চাক্ষুষ বিজয়। অনেক প্রচারকই এক স্থানে পরাজিত ও অন্য স্থানে বিজয়ী হয়েছেন, এক সময়ে অত্যাচারিত হয়েছেন, অন্য সময়ে সফলতা লাভে ধন্য হয়েছেন, চাই তা তার জীবদ্দশায় হোক কিংবা মৃত্যুর পরে হোক।
(৯) শত্রুকে বাধাগ্রস্ত করাও বিজয় :
প্রচারকের নিরাপত্তা বিধান এবং শত্রুকে তার নাগাল পেতে বাধা দেয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রচারকের জন্য এক বিরাট সাহায্য। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, وَلاَ هُمْ يُنْصَرُوْنَ ‘তারা (কাফেররা) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৪৮)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেছেন, أىْ يُمْنَعُوْنَ অর্থাৎ তারা বাধাগ্রস্ত হবে। ইবনু আববাসও এরূপ একটি মত পোষণ করেছেন।[5] আল্লাহ বলেন,
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ -
‘আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা প্রচার করুন এবং মুশরিকদের থেকে নিরস্ত থাকুন। নিশ্চয়ই ঠাট্টাকারীদের থেকে রক্ষায় আমিই আপনার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)।
অত্র আয়াতের অর্থ প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী বলেন, আপনি আল্লাহর আদেশ প্রচার করুন এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবেন না। কেননা আল্লাহ আপনাকে তাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট। যারা আপনার বিরুদ্ধে শত্রুতার ঝান্ডা উত্তোলন করবে এবং আপনাকে নিপীড়ন করবে, তাদের হাত থেকেও রক্ষা করবেন, যেমন করে ঠাট্টাকারীদের হাত থেকে আপনাকে রক্ষায় তিনি যথেষ্ট। আল্লাহ আরও বলেন, وَاللّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ‘মানুষের হাত থেকে আল্লাহ আপনাকে হেফাযত করবেন’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)।
আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের কয়েকটি নমুনা এখানে তুলে ধরা হ’ল। বলা চলে এগুলি সাহায্য ও বিজয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকার। আমরা যদি এগুলি নিয়ে চিন্তা করি, তারপর নবীদের আদর্শের সাথে মিলিয়ে দেখি, তাহ’লে দেখতে পাব, প্রত্যেক নবী-রাসূলের জীবনে সাহায্য ও বিজয়ের এক বা একাধিক প্রকার বাস্তবায়িত হয়েছিল। আমাদের নবীর জীবনেই দেখা যাক-
তাঁর প্রচারিত দ্বীন বিজয় ও পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
তাঁকে যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে তৎপর ছিল, তাদের অনেকেই বদর ও পরবর্তী যুদ্ধ সমূহে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
তিনি প্রতিপক্ষকে বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা লা-জওয়াব করে দিয়েছিলেন।
শত্রুর হাত থেকে তাঁর জীবনের হেফাযত ও নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছিল।
তাঁকে মক্কা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিজ জন্মস্থান ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে তিনি সফল হয়েছিলেন।
আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচল থেকে তিনি নির্ভীক চিত্তে সত্য প্রচার করেছিলেন।
আল্লাহ বলেন, وَلَوْلاَ أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَّ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئاً قَلِيْلاً ‘যদি আমি আপনাকে অবিচল না রাখতাম তাহ’লে অবশ্যই আপনি সামান্য হ’লেও ওদের প্রতি ঝুঁকে পড়তেন’ (বানী ইসরাঈল ১৭/৭৪)।
নবী-রাসূলগণ যে সব বিজয় পেয়েছেন তাতে ক্ষেত্রবিশেষে তারতম্য হ’তে পারে, কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়া নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এমনিভাবে প্রত্যেক মুমিনের জীবনেও আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিশ্চিত হওয়ার কথা; চাই তা তার জীবদ্দশায় হোক কিংবা মৃত্যুর পরে হোক। আল্লাহর নিম্নোক্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তা হবে,
إنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا فِىْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُوْمُ الْأشْهَادُ -
‘আমার রাসূলগণ ও মুমিনগণকে আমি অবশ্যই ইহজীবনে ও সাক্ষ্য দান (ক্বিয়ামত) দিবসে সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/৫১)।
বর্তমান আলোচনা থেকে আল্লাহপ্রদত্ত সাহায্য ও বিজয়ের অর্থ আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ কথাও পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ইচ্ছামত সাহায্য ও বিজয়ের একটি শ্রেণী নির্দিষ্ট করা আদৌ ঠিক নয়।
আমাদের বুঝতে হবে যে, ঘটনার আগে-পরে সর্বাবস্থায় হুকুম আল্লাহর। আমরা তাঁরই বান্দা, তাঁরই দাসত্ব প্রমাণে আমাদের সচেষ্ট হ’তে হবে। সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দ্বিধাহীন চিত্তে আল্লাহর সাহায্য যে অবশ্যম্ভাবী, সে কথা বিশ্বাস করলে তবেই দাসত্ব পূর্ণতা পাবে। হ্যাঁ কখনো হয়ত আমাদের মানবীয় দুর্বলতা হেতু আল্লাহর হিকমতের তাৎপর্য বুঝতে পারি না। কখনো কখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও সাহায্য বিলম্বিত হয়। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَكَانَ حَقّاً عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘মুমিনদের সাহায্য করা আমারই দায়িত্ব’ (রূম ৩০/৪৭)।
[1]. তাফসীরে ত্বাবারী ২৪/৭৪ পৃঃ।
[2]. মুসলিম হা/২৯৯৯ ‘যুহদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ- ১৪; আলবানী, মিশকাত হা/৫২৯৭।
[3]. বুখারী হা/৩৬১২; মিশকাত হা/৫৮৫৮।
[4]. তাফসীরে ত্বাবারী ২৩/১১৪ পৃঃ।
[5]. তাফসীরে ত্বাবারী ১/২৬৯ পৃঃ।
সাহায্য ও বিজয়ের তাৎপর্য বুঝার সাথে সাথে আমাদের উপর আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যও বুঝতে হবে। এই দায়িত্ব পালনের পরিমাণ অনুযায়ীই সাহায্য নিশ্চিত হবে। এখন আমাদের দায়িত্ব কি মানুষকে সৎপথে অধিষ্ঠিত করা, নাকি তাদের নিকট ঈমান ও সঠিক পথের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া? আমাদের দায়িত্ব কি মানুষকে ঈমান আনতে বাধ্য করা, নাকি তাদের নিকট ঈমানের রাস্তা তুলে ধরা?
নিশ্চয়ই নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব সংক্ষেপে একটি কথায় তুলে ধরা যায়। তাহ’ল ‘প্রচার’। বরং তাঁদের দায়িত্ব এই একটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা কতিপয় আয়াত থেকে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি। আল্লাহ বলেন,
فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ -
‘রাসূলগণের উপর সুস্পষ্ট প্রচার ব্যতীত আর কোন দায়িত্ব নেই’ (নাহল ১৬/৩৫)।
وَمَا عَلَى الرَّسُوْلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِيْنُ -
‘সুস্পষ্ট প্রচার ব্যতীত রাসূলের উপর আর কোন দায়িত্ব নেই’ (নূর ২৪/৫৪)।
فَإِنْ أَعْرَضُوْا فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظاً إِنْ عَلَيْكَ إِلَّا الْبَلَاغُ -
‘যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহ’লে আমি তো আপনাকে তাদের রক্ষক হিসাবে প্রেরণ করিনি। আপনার দায়িত্ব তো কেবল প্রচার’ (শূরা ৪২/৪৮)।
فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَإِنَّمَا عَلَى رَسُوْلِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِيْنُ -
‘যদি তোমরা পিছন ফিরে যাও তাহ’লে (জেনে রাখ) আমার রাসূলের দায়িত্ব তো কেবলই সুস্পষ্ট প্রচার’(তাগা-বুন ৬৪/১২)।
فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُواْ أَنَّمَا عَلَى رَسُوْلِنَا الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ -
‘যদি তোমরা পৃষ্ঠদেশে প্রত্যাবর্তন কর, তাহ’লে জেনে রাখ আমার রাসূলের দায়িত্ব তো কেবলই খোলাখুলি প্রচার’ (মায়েদাহ ৫/৯২)।
يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ -
‘হে রাসূল! আপনার নিকট আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন, তবে আপনি তাঁর রিসালাত পৌঁছে দিলেন না’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)।
وَإِنْ تَوَلَّوْاْ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلاَغُ -
‘যদি ওরা পিছন ফিরে যায় তাহ’লে আপনার দায়িত্ব তো কেবলই প্রচার’ (আলে ইমরান ৩/২০)।
উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেছেন, ‘আপনি যে ইসলাম ও বিশ্বপ্রভুর খালেছ (নির্ভেজাল) তাওহীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন তাতে যদি ওরা সাড়া না দিয়ে ওদের প্রতিষ্ঠিত মতে ফিরে যায়, তাহ’লে জেনে রাখুন, আপনি তো একজন প্রচারক। আমার যে সৃষ্টিকুলের মাঝে আমি আপনাকে পাঠিয়েছি তাদের নিকট রিসালাত পৌঁছে দেওয়া এবং আপনার প্রতি আমার আদিষ্ট বিষয়ে আমার আনুগত্য করা ব্যতীত আপনার আর কোন দায়িত্ব নেই’ (তাফসীর ত্বাবারী ৬/৮৩ পৃ.)।
একই আয়াত প্রসঙ্গে ইবনু আশূর বলেছেন, কাফিরদের প্রতি আপনার এই যে উক্তি ‘তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ?’ এ থেকে যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহ’লে আপনি সেজন্য কোন দন্ডের সম্মুখীন হবেন না। কেননা আপনার দায়িত্ব তো কেবলই প্রচার করা। এ আয়াতে فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلاَغُ আসলে আরবী ব্যাকরণ মাফিক শর্তের জওয়াব নয়। উহা জওয়াবের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে বাক্যটি জওয়াবের কারণ। সুতরাং জওয়াবের স্থলে উহার অবস্থিতি কথাটির মধ্যে এক অনুপম সংক্ষিপ্ততা ( إيجاز بديع ) এনে দিয়েছে। অর্থাৎ আপনি দুঃখ করবেন না এবং ভাববেন না যে, তাদের সৎপথ লাভ না করা এবং আপনার হাতে তাদের ইসলাম গ্রহণ না করা আপনারই ত্রুটির জন্য। কেননা আপনাকে তো কেবল প্রচার কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে। যাদের নিকট আপনি প্রচার করছেন তাদের সৎপথ আপনাকে অর্জন করিয়ে দিতে হবে এমন দায়িত্ব দিয়ে তো আপনাকে পাঠানো হয়নি।[1]
নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব যে শুধুই প্রচার করা, সে কথাটি আল-কুরআনে অন্যত্র জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাতে স্পষ্ট ব্যক্ত করা হয়েছে- মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব না নবীদের, না রাসূলদের, না অন্য কারো। আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيْعاً أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُوْنُوْا مُؤْمِنِيْن -
‘আপনার প্রতিপালক চাইলে ধরিত্রীর বুকে বুদ্ধিমান প্রাণী যারাই আছে এক এক করে সবাই ঈমান আনত। আপনি কি মানুষের উপর বল প্রয়োগ করবেন যে পর্যন্ত না তারা মুমিন হয়ে যায়’? (ইউনুস ১০/৯৯)।
إِنَّكَ لاَ تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِيْ مَنْ يَشَاءُ . ‘আপনি নিশ্চয়ই যাকে ভালবাসেন তাকেই সৎপথে আনতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ যাকে খুশি সৎপথে আনতে পারেন’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)।
فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلَى آثَارِهِمْ إِنْ لَّمْ يُؤْمِنُوْا بِهَذَا الْحَدِيْثِ أَسَفاً -
‘যদি তারা এই বাণীর প্রতি ঈমান না আনে, তাহ’লে সম্ভবত আপনি তাদের পেছনে আফসোস করে করেই আপনার জীবনকে ধ্বংস করে দিবেন’ (কাহফ ১৮/৬)।
لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ أَلاَّ يَكُوْنُوْا مُؤْمِنِيْنَ -
‘তারা মুমিন হচ্ছে না বলে সম্ভবতঃ আপনি আপনার জীবন বিনাশ করে দিবেন’ (শু‘আরা ২৬/৩)।
فَلاَ تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرَاتٍ -
‘তাদের জন্য আফসোস করে করে যেন আপনার জীবন নির্বাপিত হয়ে না যায়’ (ফাত্বির ৩৫/৮)।
মূলতঃ হক কথা বলার সাথেই আমাদের কর্তব্য সীমিত। আর সেটাই হ’ল ‘প্রচার’। যেমনটা নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-
وَقُلِ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ -
‘আপনি বলুন, হক তো তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত। সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা কুফরী করুক’ (কাহফ ১৮/২৯)।
নিম্নোক্ত দু’টি আয়াতের সাথে আমরা এ জাতীয় আয়াত আলোচনার সমাপ্তি টানব।
وَإِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ إِعْرَاضُهُمْ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَن تَبْتَغِيَ نَفَقاً فِي الأَرْضِ أَوْ سُلَّماً فِي السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِآيَةٍ وَلَوْ شَاءَ اللّهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدَى فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْجَاهِلِيْنَ -
‘তাদের ইসলাম বিমুখতা যদি আপনার পক্ষে কষ্টকর হয়, তবে সাধ্যায়ত্ব হ’লে আপনি ধরাবক্ষে কোন সুড়ঙ্গ কিংবা আকাশে কোন সিঁড়ি খুঁজে নিন, তারপর (আকাশ-পাতাল ফেড়ে) তাদের জন্য একটি নিদর্শন হাযির করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে হিদায়াতের উপর জমায়েত করতে পারতেন। সুতরাং আপনি মোটেও জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না’ (আন‘আম ৬/৩৫)।
অপরদিকে সূরা যারিয়াতের আয়াতে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রচারের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের ইসলাম বিমুখতা হেতু প্রচারক নিজে যদি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তবে সেজন্য তিনি তিরষ্কৃত হবেন না। তবে তাদের সকল নেতিবাচক দিক সত্ত্বেও প্রচার ও নছীহত চালিয়ে যেতে হবে। এই নছীহত দ্বীন বিমুখদের কাজে না লাগলেও দ্বীনদার মুমিনদের দ্বীনের উপর অবিচল থাকার লক্ষ্যে খুবই কাজে লাগবে। আল্লাহ বলেন,
فَتَوَلَّ عَنْهُمْ فَمَا أَنْتَ بِمَلُوْمٍ، وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِيْنَ -
‘অনন্তর আপনি ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। এতে আপনি তিরষ্কৃত হবেন না। আর নছীহত করতে থাকুন। কেননা নছীহত মুমিনদের জন্য কল্যাণবহ’ (যারিয়াত ৫১/৫৪, ৫৫)।
এ হ’ল সে সকল আয়াতের কিয়দাংশ, যা আল্লাহর কিতাবে এসেছে। এগুলিতে নবী-রাসূল ও প্রচারকদের দায়িত্ব সম্পর্কিত সীমারেখা এঁকে দেওয়া হয়েছে এবং অন্য যে কোন দায়িত্ব নাকচ করে দেওয়া হয়েছে, যা প্রচারকগণ সময়ে সময়ে নিজেদের দায়িত্ব বলে ভেবে থাকেন। অথচ বিষয়টা মোটেও তা নয়। আমাদের দায়িত্ব কেবল প্রচার করা, জবরদস্তি করা নয়। মানুষকে হেদায়াতের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, তাদের হেদায়াত নিশ্চিত করা নয়। খারাপ পরিবেশ পাল্টানোর জন্য শরী‘আত সম্মত পন্থা অবলম্বন করা, গোটা পরিবেশ পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়া নয়।
যখন আমরা এসব কথা অনুধাবন করব এবং তদনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাব তখনই আমরা আল্লাহর সাহায্যের তাৎপর্য বুঝতে পারব এবং জানতে পারব কে বিজয়ী এবং কে পরাভূত। কিন্তু যখন এসব বুনিয়াদি মৌলিক কথা ও গতিপথ প্রচারকের সামনে অনুপস্থিত থেকে যাবে, তখন তার রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে। সে সঙ্গে তার ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যাবে। এদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالاً، الَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعاً -
‘আপনি বলুন, আমি কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে অবহিত করব? তারা ওরাই, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনেই বৃথা হয়ে গেছে, অথচ তাদের ধারণা যে, তারা ভাল কাজ করে যাচ্ছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)।
যদিও আয়াত দু’টি কাফিরদের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে তবুও এর অর্থ কিছু কিছু নির্দেশনাসূত্রে ঐ সকল প্রচারককেও শামিল করবে।
[1]. আত-তাহরীর ওয়াত-তানভীর ৩/২০৫ পৃঃ।
নিশ্চয়ই নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব সংক্ষেপে একটি কথায় তুলে ধরা যায়। তাহ’ল ‘প্রচার’। বরং তাঁদের দায়িত্ব এই একটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা কতিপয় আয়াত থেকে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি। আল্লাহ বলেন,
فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ -
‘রাসূলগণের উপর সুস্পষ্ট প্রচার ব্যতীত আর কোন দায়িত্ব নেই’ (নাহল ১৬/৩৫)।
وَمَا عَلَى الرَّسُوْلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِيْنُ -
‘সুস্পষ্ট প্রচার ব্যতীত রাসূলের উপর আর কোন দায়িত্ব নেই’ (নূর ২৪/৫৪)।
فَإِنْ أَعْرَضُوْا فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظاً إِنْ عَلَيْكَ إِلَّا الْبَلَاغُ -
‘যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহ’লে আমি তো আপনাকে তাদের রক্ষক হিসাবে প্রেরণ করিনি। আপনার দায়িত্ব তো কেবল প্রচার’ (শূরা ৪২/৪৮)।
فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَإِنَّمَا عَلَى رَسُوْلِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِيْنُ -
‘যদি তোমরা পিছন ফিরে যাও তাহ’লে (জেনে রাখ) আমার রাসূলের দায়িত্ব তো কেবলই সুস্পষ্ট প্রচার’(তাগা-বুন ৬৪/১২)।
فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُواْ أَنَّمَا عَلَى رَسُوْلِنَا الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ -
‘যদি তোমরা পৃষ্ঠদেশে প্রত্যাবর্তন কর, তাহ’লে জেনে রাখ আমার রাসূলের দায়িত্ব তো কেবলই খোলাখুলি প্রচার’ (মায়েদাহ ৫/৯২)।
يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ -
‘হে রাসূল! আপনার নিকট আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন, তবে আপনি তাঁর রিসালাত পৌঁছে দিলেন না’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)।
وَإِنْ تَوَلَّوْاْ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلاَغُ -
‘যদি ওরা পিছন ফিরে যায় তাহ’লে আপনার দায়িত্ব তো কেবলই প্রচার’ (আলে ইমরান ৩/২০)।
উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেছেন, ‘আপনি যে ইসলাম ও বিশ্বপ্রভুর খালেছ (নির্ভেজাল) তাওহীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন তাতে যদি ওরা সাড়া না দিয়ে ওদের প্রতিষ্ঠিত মতে ফিরে যায়, তাহ’লে জেনে রাখুন, আপনি তো একজন প্রচারক। আমার যে সৃষ্টিকুলের মাঝে আমি আপনাকে পাঠিয়েছি তাদের নিকট রিসালাত পৌঁছে দেওয়া এবং আপনার প্রতি আমার আদিষ্ট বিষয়ে আমার আনুগত্য করা ব্যতীত আপনার আর কোন দায়িত্ব নেই’ (তাফসীর ত্বাবারী ৬/৮৩ পৃ.)।
একই আয়াত প্রসঙ্গে ইবনু আশূর বলেছেন, কাফিরদের প্রতি আপনার এই যে উক্তি ‘তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ?’ এ থেকে যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহ’লে আপনি সেজন্য কোন দন্ডের সম্মুখীন হবেন না। কেননা আপনার দায়িত্ব তো কেবলই প্রচার করা। এ আয়াতে فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلاَغُ আসলে আরবী ব্যাকরণ মাফিক শর্তের জওয়াব নয়। উহা জওয়াবের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে বাক্যটি জওয়াবের কারণ। সুতরাং জওয়াবের স্থলে উহার অবস্থিতি কথাটির মধ্যে এক অনুপম সংক্ষিপ্ততা ( إيجاز بديع ) এনে দিয়েছে। অর্থাৎ আপনি দুঃখ করবেন না এবং ভাববেন না যে, তাদের সৎপথ লাভ না করা এবং আপনার হাতে তাদের ইসলাম গ্রহণ না করা আপনারই ত্রুটির জন্য। কেননা আপনাকে তো কেবল প্রচার কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে। যাদের নিকট আপনি প্রচার করছেন তাদের সৎপথ আপনাকে অর্জন করিয়ে দিতে হবে এমন দায়িত্ব দিয়ে তো আপনাকে পাঠানো হয়নি।[1]
নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব যে শুধুই প্রচার করা, সে কথাটি আল-কুরআনে অন্যত্র জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাতে স্পষ্ট ব্যক্ত করা হয়েছে- মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব না নবীদের, না রাসূলদের, না অন্য কারো। আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيْعاً أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُوْنُوْا مُؤْمِنِيْن -
‘আপনার প্রতিপালক চাইলে ধরিত্রীর বুকে বুদ্ধিমান প্রাণী যারাই আছে এক এক করে সবাই ঈমান আনত। আপনি কি মানুষের উপর বল প্রয়োগ করবেন যে পর্যন্ত না তারা মুমিন হয়ে যায়’? (ইউনুস ১০/৯৯)।
إِنَّكَ لاَ تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِيْ مَنْ يَشَاءُ . ‘আপনি নিশ্চয়ই যাকে ভালবাসেন তাকেই সৎপথে আনতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ যাকে খুশি সৎপথে আনতে পারেন’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)।
فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلَى آثَارِهِمْ إِنْ لَّمْ يُؤْمِنُوْا بِهَذَا الْحَدِيْثِ أَسَفاً -
‘যদি তারা এই বাণীর প্রতি ঈমান না আনে, তাহ’লে সম্ভবত আপনি তাদের পেছনে আফসোস করে করেই আপনার জীবনকে ধ্বংস করে দিবেন’ (কাহফ ১৮/৬)।
لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ أَلاَّ يَكُوْنُوْا مُؤْمِنِيْنَ -
‘তারা মুমিন হচ্ছে না বলে সম্ভবতঃ আপনি আপনার জীবন বিনাশ করে দিবেন’ (শু‘আরা ২৬/৩)।
فَلاَ تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرَاتٍ -
‘তাদের জন্য আফসোস করে করে যেন আপনার জীবন নির্বাপিত হয়ে না যায়’ (ফাত্বির ৩৫/৮)।
মূলতঃ হক কথা বলার সাথেই আমাদের কর্তব্য সীমিত। আর সেটাই হ’ল ‘প্রচার’। যেমনটা নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-
وَقُلِ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ -
‘আপনি বলুন, হক তো তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত। সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা কুফরী করুক’ (কাহফ ১৮/২৯)।
নিম্নোক্ত দু’টি আয়াতের সাথে আমরা এ জাতীয় আয়াত আলোচনার সমাপ্তি টানব।
وَإِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ إِعْرَاضُهُمْ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَن تَبْتَغِيَ نَفَقاً فِي الأَرْضِ أَوْ سُلَّماً فِي السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِآيَةٍ وَلَوْ شَاءَ اللّهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدَى فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْجَاهِلِيْنَ -
‘তাদের ইসলাম বিমুখতা যদি আপনার পক্ষে কষ্টকর হয়, তবে সাধ্যায়ত্ব হ’লে আপনি ধরাবক্ষে কোন সুড়ঙ্গ কিংবা আকাশে কোন সিঁড়ি খুঁজে নিন, তারপর (আকাশ-পাতাল ফেড়ে) তাদের জন্য একটি নিদর্শন হাযির করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে হিদায়াতের উপর জমায়েত করতে পারতেন। সুতরাং আপনি মোটেও জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না’ (আন‘আম ৬/৩৫)।
অপরদিকে সূরা যারিয়াতের আয়াতে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রচারের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের ইসলাম বিমুখতা হেতু প্রচারক নিজে যদি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তবে সেজন্য তিনি তিরষ্কৃত হবেন না। তবে তাদের সকল নেতিবাচক দিক সত্ত্বেও প্রচার ও নছীহত চালিয়ে যেতে হবে। এই নছীহত দ্বীন বিমুখদের কাজে না লাগলেও দ্বীনদার মুমিনদের দ্বীনের উপর অবিচল থাকার লক্ষ্যে খুবই কাজে লাগবে। আল্লাহ বলেন,
فَتَوَلَّ عَنْهُمْ فَمَا أَنْتَ بِمَلُوْمٍ، وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِيْنَ -
‘অনন্তর আপনি ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। এতে আপনি তিরষ্কৃত হবেন না। আর নছীহত করতে থাকুন। কেননা নছীহত মুমিনদের জন্য কল্যাণবহ’ (যারিয়াত ৫১/৫৪, ৫৫)।
এ হ’ল সে সকল আয়াতের কিয়দাংশ, যা আল্লাহর কিতাবে এসেছে। এগুলিতে নবী-রাসূল ও প্রচারকদের দায়িত্ব সম্পর্কিত সীমারেখা এঁকে দেওয়া হয়েছে এবং অন্য যে কোন দায়িত্ব নাকচ করে দেওয়া হয়েছে, যা প্রচারকগণ সময়ে সময়ে নিজেদের দায়িত্ব বলে ভেবে থাকেন। অথচ বিষয়টা মোটেও তা নয়। আমাদের দায়িত্ব কেবল প্রচার করা, জবরদস্তি করা নয়। মানুষকে হেদায়াতের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, তাদের হেদায়াত নিশ্চিত করা নয়। খারাপ পরিবেশ পাল্টানোর জন্য শরী‘আত সম্মত পন্থা অবলম্বন করা, গোটা পরিবেশ পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়া নয়।
যখন আমরা এসব কথা অনুধাবন করব এবং তদনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাব তখনই আমরা আল্লাহর সাহায্যের তাৎপর্য বুঝতে পারব এবং জানতে পারব কে বিজয়ী এবং কে পরাভূত। কিন্তু যখন এসব বুনিয়াদি মৌলিক কথা ও গতিপথ প্রচারকের সামনে অনুপস্থিত থেকে যাবে, তখন তার রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে। সে সঙ্গে তার ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যাবে। এদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالاً، الَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعاً -
‘আপনি বলুন, আমি কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে অবহিত করব? তারা ওরাই, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনেই বৃথা হয়ে গেছে, অথচ তাদের ধারণা যে, তারা ভাল কাজ করে যাচ্ছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)।
যদিও আয়াত দু’টি কাফিরদের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে তবুও এর অর্থ কিছু কিছু নির্দেশনাসূত্রে ঐ সকল প্রচারককেও শামিল করবে।
[1]. আত-তাহরীর ওয়াত-তানভীর ৩/২০৫ পৃঃ।
প্রচারকের দায়িত্ব যে কেবল মাত্র প্রচার এই বোধ আমাদের মনে অঙ্কিত করা এবং বিষয়টির আরও ব্যাখ্যার জন্য আমরা কুরআন থেকে কতিপয় ঘটনাবহুল দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। পূর্বেকার নবী-রাসূল ও জাতি বিশেষে আগত প্রচারকদের আদর্শ সম্বলিত এই ঘটনাগুলিতে তাঁরা যে দাওয়াতী নীতি অবলম্বন করেছিলেন এবং তাতে যে ফল অর্জিত হয়েছিল তার চিত্র ফুটে উঠবে। এগুলি আমাদের ও আমাদের উত্তরসূরীদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে। যাতে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হয় এবং আলোচ্য বিষয়ের সাথে যথেষ্ট সম্পৃক্ত থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা ঘটনাগুলিকে সংক্ষেপে তুলে ধরলাম।
আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনের ২৯টি সূরায় নূহ (আঃ)-এর ঘটনা তুলে ধরেছেন। কোন কোন সূরায় একাধিকবারও বর্ণিত হয়েছে। একটি সূরা তো পূর্ণাঙ্গভাবে তাঁর ও তাঁর জাতি প্রসঙ্গেই অবতীর্ণ হয়েছে। সূরাটির নাম ‘নূহ’।
স্বীয় জাতির সঙ্গে নূহ (আঃ)-এর যে ঘটনা ঘটেছিল তা এক বিরাট কাহিনী, যা বহুবিধ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। সেকারণ উক্ত কাহিনী বিশেষ গুরুত্ব লাভে সক্ষম হয়েছে। এটি নানা বৈশিষ্ট্যমন্ডিতও বটে। কারণ:
(১) নূহ (আঃ) ছিলেন মানব জাতির জন্য প্রথম রাসূল। আর যিনি প্রথম হন তার কিছু বৈশিষ্ট্যও থাকে।
(২) নিজ জাতির মধ্যে সুদীর্ঘকাল তাঁর অবস্থান ছিল। তিনি এক নাগাড়ে ৯৫০ বছর স্বীয় জাতির মধ্যে দ্বীন প্রচার করেছেন।
(৩) তিনি ‘উলুল আযম’ বা দৃঢ়মনা রাসূল ছিলেন।
(৪) কুরআনে বেশী মাত্রায় তাঁর প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। ২৯টি সূরার ৪৩ স্থানে তাঁর কথা এসেছে। বলা চলে কুরআনের এক চতুর্থাংশ সূরায় প্রসঙ্গটি স্থান পেয়েছে। এক্ষণে আমরা এমন কিছু আয়াত তুলে ধরব, যাতে নূহ (আঃ) ও তাঁর জাতির মধ্যেকার ঘটনা বিধৃত আছে।
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوْحاً إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوْا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ إِنِّيْ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ -
‘নিশ্চয়ই আমি নূহকে তাঁর জাতির নিকট প্রেরণ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন উপাস্য নেই। আমি তোমাদের জন্য এক কঠিন দিবসের শাস্তির ভয় করি’ (আ‘রাফ ৭/৫৯)।
এই হচ্ছে নূহ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারকথা। তিনি তাদেরকে আল্লাহর ইবাদত ও তাওহীদের দিকে আহবান জানিয়েছিলেন এবং তাঁর বিরোধিতার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পরবর্তী স্তরে এসে যখন তাঁর জাতি তাঁর আহবানে সাড়া দিল না, উপরন্তু অহংকার প্রকাশ করল তখন তিনি যে দাওয়াত নিয়ে তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তা সূরা ইউনুসে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ نُوْحٍ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكُم مَّقَامِيْ وَتَذْكِيْرِيْ بِآيَاتِ اللّهِ فَعَلَى اللّهِ تَوَكَّلْتُ فَأَجْمِعُواْ أَمْرَكُمْ وَشُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ لاَ يَكُنْ أَمْرُكُمْ عَلَيْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُواْ إِلَيَّ وَلاَ تُنْظِرُوْنِ -
‘আপনি তাদেরকে নূহের ঘটনা পড়ে শুনান। যখন তিনি তাঁর জাতিকে বললেন, হে আমার জাতি! যদি তোমাদের নিকট আমার অবস্থান ও আল্লাহর আয়াতের মাধ্যমে আমার উপদেশ দান বড় কষ্টকর মনে হয় তাহ’লে আমি আল্লাহর উপর ভরসা করছি। সুতরাং তোমরা তোমাদের কাজ ও উপাস্যদেরকে গুছিয়ে নাও। তারপর তোমাদের কাজ যেন তোমাদের বিরুদ্ধেই দুঃখের আকর না হয় (সেদিকে লক্ষ্য রেখ)। অতঃপর তোমরা আমার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নাও এবং আমাকে কোন ছাড় দিও না’ (ইউনুস ১০/৭১)।
সূরা ‘হূদ’-এ নূহ (আঃ)-এর ঘটনা আরও বিস্তারিত আকারে এসেছে। তিনি যে তাদের সাথে বিতর্ক করেছেন, বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়েছেন, তাদের নিকট সৎপথের বিবরণ তুলে ধরেছেন সে সব কথা ঐ সূরায় তুলে ধরা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাঁর কওমের লোকেরা বলে বসল,
يَا نُوْحُ قَدْ جَادَلْتَنَا فَأَكْثَرْتَ جِدَالَنَا فَأْتِناَ بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ -
‘হে নূহ! তুমি আমাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা করছ এবং বিতন্ডায় অনেক বাড়াবাড়ি করছ। অতএব তুমি আমাদের যে (শাস্তির) প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ, তাই আমাদের জন্য নিয়ে এসো যদি তুমি সত্যবাদীদের একজন হও’ (হূদ ১১/৩২)।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্বন্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন,
وَأُوحِيَ إِلَى نُوْحٍ أَنَّهُ لَنْ يُؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ إِلاَّ مَنْ قَدْ آمَنَ فَلاَ تَبْتَئِسْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ، وَاصْنَعِ الْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا وَوَحْيِنَا وَلاَ تُخَاطِبْنِيْ فِي الَّذِيْنَ ظَلَمُواْ إِنَّهُم مُّغْرَقُوْنَ -
‘আর নূহের নিকট অহি প্রেরণ করা হ’ল যে, আপনার জাতির মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তারা ব্যতীত আর কেউ কখনও ঈমান আনবে না। সুতরাং তারা যা করছে সেজন্য আপনি দুঃখবোধ করবেন না। আপনি আমাদের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধান মত একটি জাহাজ তৈরী করুন। আর যালিমদের সম্বন্ধে আমাকে সম্বোধন করবেন না। ওরা ডুবে মরবে’ (হূদ ১১/৩৬, ৩৭)।
নূহ (আঃ)-এর ঘটনার সাথে জড়িত কিছু সংলাপ এখানে উপস্থাপন করা হ’ল-
(১) নূহ (আঃ) তাঁর জাতির মধ্যে কতদিন অবস্থান করেছিলেন?
জবাব : আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوْحاً إِلَى قَوْمِهِ فَلَبِثَ فِيْهِمْ أَلْفَ سَنَةٍ إِلاَّ خَمْسِيْنَ عَاماً -
‘আমি নূহকে তাঁর জাতির মাঝে প্রেরণ করেছিলাম। তিনি তাদের মাঝে ৫০ কম ১০০০ বছর অবস্থান করেছিলেন’ (আন‘কাবূত ২৯/১৪)।
(২) নূহ (আঃ) তাঁর প্রতিপালকের রিসালাত বা বার্তা প্রচারে যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন তা কী ছিল?
জবাব: তিনি তাদের সৎ পথে আনয়ন ও আল্লাহর দাসে পরিণত করতে সকল প্রকার বৈধ পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
قَالَ رَبِّ إِنِّيْ دَعَوْتُ قَوْمِيْ لَيْلاً وَنَهَاراً، فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِيْ إِلاَّ فِرَاراً، وَإِنِّيْ كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوْا أَصَابِعَهُمْ فِيْ آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوْا وَاسْتَكْبَرُوْا اسْتِكْبَاراً، ثُمَّ إِنِّيْ دَعَوْتُهُمْ جِهَاراً، ثُمَّ إِنِّيْ أَعْلَنتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَاراً -
‘তিনি বলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার জাতিকে রাত-দিন দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু আমার দাওয়াত তাদের পলায়নী মনোবৃত্তিই কেবল বৃদ্ধি করেছে। আপনি যাতে তাদের ক্ষমা করে দেন সে লক্ষ্যে যখনই আমি তাদের দাওয়াত দিয়েছি তখনই তারা তাদের কানের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, বস্ত্র দ্বারা নিজেদেরকে আচ্ছাদিত করেছে, হঠকারিতা দেখিয়েছে এবং চরম ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে। তারপরও আমি তাদেরকে উচ্চঃস্বরে দাওয়াত দিয়েছি। তাদের সামনে প্রকাশ্যে বলেছি এবং সঙ্গোপনেও খুব বলেছি’ (নূহ ৭১/৫-৯)।
(৩) তাঁর কওমের প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?
জবাব : আল্লাহ বলেন, قَالُوا أَنُؤْمِنُ لَكَ وَاتَّبَعَكَ الْأَرْذَلُوْنَ ‘তারা বলল, যেখানে হীন-তুচ্ছ লোকেরা তোমার অনুসরণ করছে সেখানে আমরা কি করে তোমার উপর ঈমান আনতে পারি? (শু‘আরা ২৬/১১১)।
নূহ (আঃ) এভাবে দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকলে এক পর্যায়ে তাঁর জাতির লোকেরা মারমুখী হয়ে উঠল এবং বলতে লাগল-
لَئِن لَّمْ تَنتَهِ يَا نُوْحُ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْمَرْجُوْمِيْنَ ‘হে নূহ! যদি তুমি প্রচারে বিরত না হও, তাহ’লে তুমি পাথরের আঘাতে ধরাশায়ীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (শু‘আরা ২৬/১১৬)।
(৪) নূহ (আঃ)-এর প্রতি কতজন ঈমান এনেছিল?
জবাব : স্বল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত তাঁর প্রতি কেউ ঈমান আনেনি। এমনকি তাঁর এক স্ত্রী ও এক পুত্রও তাঁর উপর ঈমান আনেনি। আল্লাহ বলেন,
قُلْنَا احْمِلْ فِيْهَا مِنْ كُلٍّ زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ وَأَهْلَكَ إِلاَّ مَنْ سَبَقَ عَلَيْهِ الْقَوْلُ وَمَنْ آمَنَ وَمَا آمَنَ مَعَهُ إِلاَّ قَلِيْلٌ -
‘আমি বললাম, আপনি উহাতে (জাহাজে) প্রত্যেক যুগল হ’তে দু’টি করে তুলে নিন। (তুলে নিন) যাদের প্রতি আগে ভাগেই শাস্তির কথা নিশ্চিত হয়ে গেছে তাদের বাদে আপনার পরিবারের সদস্যদেরকে এবং (তুলে নিন) তাদের, যারা ঈমান এনেছে। অবশ্য তাঁর সঙ্গে মাত্র স্বল্প সংখ্যক লোক ঈমান এনেছিল’ (হূদ ১১/৪০)।
যখন প্লাবন শুরু হয়ে গেল, আর নূহ (আঃ)-এর সেই কাফের পুত্র ডুবে যাওয়ার উপক্রম হ’ল, তখন তিনি আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করেন-
وَنَادَى نُوْحٌ رَّبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِيْ مِنْ أَهْلِيْ وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَأَنْتَ أَحْكَمُ الْحَاكِمِيْنَ، قَالَ يَا نُوْحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ -
‘নূহ তাঁর প্রতিপালককে ডেকে বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার পুত্র তো আমার পরিবারভুক্ত। আর আপনার প্রতিশ্রুতিও নিশ্চয়ই সত্য। আপনি শ্রেষ্ঠতম বিচারকও। তিনি বললেন, ‘হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়, সে অসৎ কর্মপরায়ণ’ (হূদ ১১/৪৫, ৪৬)।
ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلاً لِّلَّذِيْنَ كَفَرُوْا اِمْرَأَةَ نُوْحٍ وَاِمْرَأَةَ لُوْطٍ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئاً وَقِيْلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِيْن -
‘আল্লাহ কাফেরদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরছেন নূহের স্ত্রী ও লূতের স্ত্রীকে। তারা দু’জন ছিল আমার দু’জন অন্যতম সৎবান্দার বিবাহধীন। কিন্তু তারা তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলে আল্লাহর কোপ হ’তে তাঁরা তাদের কিছুমাত্র রক্ষা করতে পারেননি। বরং বলা হ’ল, ‘তোমরা দু’জন অপরাপর প্রবেশকারীদের সাথে আগুনে প্রবেশ কর’ (তাহরীম ৬৬/১০)।
(৫) শেষ পর্যন্ত নূহ (আঃ) কী বলেছিলেন?
জবাব : আল্লাহ বলেন,
َقالَ رَبِّ إِنَّ قَوْمِيْ كَذَّبُوْنِ، فَافْتَحْ بَيْنِيْ وَبَيْنَهُمْ فَتْحاً وَنَجِّنِيْ وَمَنْ مَّعِيْ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ -
‘তিনি বললেন, হে আমার প্রভু! আমার জাতি আমাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং আপনি আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়ছালা করে দিন। আর আমাকে ও আমার সঙ্গী মুমিনদেরকে মুক্তি দিন’ (শু‘আরা ২৬/১১৭-১১৮)।
فَدَعَا رَبَّهُ أَنِّي مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ ‘অনন্তর তিনি তাঁর প্রতিপালককে আহবান করলেন যে, আমি পরাস্ত; সুতরাং আপনি সাহায্য করুন’ (ক্বামার ৫৪/১০)।
وَقَالَ نُوْحٌ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِيْنَ دَيَّاراً، إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوْا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا -
‘নূহ বললেন, হে আমার প্রভু, ধরিত্রীর বুকে আপনি কোন কাফের গৃহবাসীকে রেহাই দিবেন না। আপনি যদি ওদের রেহাই দেন তাহ’লে ওরা আপনার বান্দাদেরকে পথহারা করবে, আর নিজেরা পাপাচারী কাফের ব্যতীত আর কিছু জন্ম দিবে না’ (নূহ ৭১/২৬, ২৭)।
(৬) এই কঠিন দুস্তর পারাবার পাড়ি দেওয়ার পর নূহ (আঃ)-এর জন্য বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল :
আল্লাহ বলেন,
وَدَعَا رَبَّهُ أَنِّيْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ، فَفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاء بِمَاء مُّنْهَمِرٍ، وَفَجَّرْنَا الْأَرْضَ عُيُوناً فَالْتَقَى الْمَاء عَلَى أَمْرٍ قَدْ قُدِرَ، وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَدُسُرٍ، تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا جَزَاء لِّمَن كَانَ كُفِرَ، وَلَقَد تَّرَكْنَاهَا آيَةً فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ -
‘তিনি তাঁর রবকে ডেকে বললেন, আমি পরাস্ত, সুতরাং আমাকে সাহায্য করুন। ফলে আমি মুষলধারে বারিপাত দ্বারা আকাশের দ্বার খুলে দিলাম এবং ভূমন্ডলে অনেক ঝর্ণা প্রবাহিত করলাম। ফলে একটি নির্ধারিত পর্যায়ে পানির প্রবাহ সম্মিলিত হ’ল। আমি তখন তাকে কাষ্ঠফলক ও পেরেক নির্মিত জলযানে আরোহণ করালাম, যা আমার গোচরে চলছিল। ইহা ছিল তার জন্য প্রতিদান, যাকে অমান্য করা হয়েছিল। আর আমি উহাকে নিদর্শন স্বরূপ রেখে দিয়েছি। সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি’? (ক্বামার ৫৪/১০-১৫)।
এই হ’ল নূহ (আঃ)-এর ঘটনা। তিনি প্রায় দশ দশটি শতাব্দী তাঁর কওমের মধ্যে কাটিয়েছেন। এতগুলো শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও কি ফল দাঁড়িয়েছে? আমরা দেখছি-
(ক) স্বল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত তাঁর কওম তাঁর উপর ঈমান আনেনি। কথিত আছে, তাদের সংখ্যা নূহ (আঃ) সহ তেরজন। ইবনু ইসহাক্ব বলেছেন, তারা হ’লেন নূহ, তাঁর তিন পুত্র সাম, হাম, ইয়াফিছ, তাদের তিন স্ত্রী এবং অন্য দু’জন লোক।
(খ) তাঁর স্ত্রী ও এক পুত্র তাঁর উপর ঈমান আনেনি। ইতিপূর্বে সে কথা বলা হয়েছে। অথচ তারা ছিল তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠজন।
(গ) এতদসত্ত্বেও তাঁকে বিজয়ী ও সাহায্যপ্রাপ্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। তাঁর জীবনে খুবই বড় মাপের বিজয় অর্জিত হয়েছিল। নিম্নের কথা ক’টিতে তা বুঝা যায়।
(১) দশ দশটি শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তিনি ধৈর্যশীল ও স্থিতিশীল থেকেছেন। তাঁর জাতির ষড়যন্ত্রের ফাঁদে তিনি পা দেননি এবং তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপেও প্রভাবিত হননি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَيَصْنَعُ الْفُلْكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ مَلَأٌ مِّن قَوْمِهِ سَخِرُواْ مِنْهُ قَالَ إِن تَسْخَرُواْ مِنَّا فَإِنَّا نَسْخَرُ مِنْكُمْ كَمَا تَسْخَرُوْنَ -
‘তিনি জাহায তৈরী করছিলেন আর যখনই তাঁর জাতির নেতৃবর্গ তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখনই তারা তাকে বিদ্রূপ করছিল। তিনি বলছিলেন, ‘যদি তোমরা আমাদের নিয়ে বিদ্রূপ কর তবে আমরাও তোমাদের নিয়ে বিদ্রূপ করব- যেমন তোমরা করছ’ (হূদ ১১/৩৮)।
(২) তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র হ’তে আল্লাহ কর্তৃক তিনি হেফাযতে ছিলেন। তারা যে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল তা তাদের কথাতেই প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। আল্লাহ বলেন, قَالُوْا لَئِنْ لَّمْ تَنْتَهِ يَا نُوْحُ لَتَكُونَنَّ مِنَ الْمَرْجُوْمِيْنَ ‘তারা বলল, হে নূহ! যদি তুমি বিরত না হও তাহ’লে তুমি প্রস্তরাঘাতের সম্মুখীন হবে’ (শু‘আরা ২৬/১১৬)।
(৩) তাঁর জাতির যারা ঈমান আনেনি সলিল-সমাধির মাধ্যমে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, وَأَغْرَقْنَا الَّذِيْنَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا إِنَّهُمْ كَانُواْ قَوْماً عَمِينَ ‘যারা আমার বিধানাবলীকে অস্বীকার করেছিল আমি তাদের পানিতে নিমজ্জিত করেছিলাম। তারা ছিল একটি জ্ঞানান্ধ জাতি’ (আ‘রাফ ৭/৬৪)।
(৪) নূহ (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী মুমিনগণ ডুবে মরা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, فَأَنْجَيْنَاهُ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ فِي الْفُلْكِ ‘অনন্তর আমি তাঁকে ও তাঁর সঙ্গে যারা জাহাযে ছিলেন সবাইকে মুক্তি দিয়েছিলাম’ (আ‘রাফ ৭/৬৪)। وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحِ وَدُسُرٍ، تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا . ‘আমি তাকে তক্তা ও কীলক নির্মিত জলযানে আরোহণ করিয়েছিলাম, যা আমার দৃষ্টিপথে চলছিল’ (ক্বামার ৫৪/১৩, ১৪)।
(৫) নূহ (আঃ)-এর সফলতা ও তাঁর জাতির ধ্বংসপ্রাপ্তি পরবর্তীকালে একটি শিক্ষণীয় আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী যুগের লোকদের মুখে মুখে আল্লাহ নূহ (আঃ)-এর খ্যাতি ছড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, وَلَقَد تَّرَكْنَاهَا آيَةً فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ ‘এই ঘটনাকে আমি নিদর্শন হিসাবে বাকী রেখেছি। সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি’? (ক্বামার ৫৪/১৫)। ذُرِّيَّةَ مَنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوْحٍ إِنَّهُ كَانَ عَبْداً شَكُوْراً ‘(তোমরা) তাদের সন্তান যাদেরকে আমি নূহের সঙ্গে তুলে নিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন একজন কৃতজ্ঞ বান্দা’ (ইসরা ১৭/৩)। سَلاَمٌ عَلَى نُوْحٍ فِي الْعَالَمِيْنَ ‘সমগ্র জগৎ ব্যাপী নূহের প্রতি শান্তি হোক’ (ছাফফাত ৩৭/৭৯)। إِنَّ اللّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহীম পরিবার ও ইমরান পরিবারকে সকল সৃষ্টি থেকে নির্বাচন করেছেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৩)।
নূহ ও তাঁর কওমের ঘটনা থেকে এভাবেই আল্লাহ প্রদত্ত সাহায্য ও বিজয় ফুটে উঠেছে।
নূহ (আঃ)-এর ঘটনা শেষ করার আগে আমরা সূরা ‘নূহ’-এ বর্ণিত একটি আয়াত পর্যালোচনা করতে চাই। সেখানে এরশাদ হয়েছে,
إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلاَ يَلِدُوْا إِلاَّ فَاجِراً كَفَّاراً -
‘আপনি যদি তাদের (কাফেরদের) রেহাই দেন তবে নিশ্চয়ই তারা আপনার বান্দাদেরকে পথহারা করবে এবং পাপাচারী অকৃতজ্ঞ মানুষ ছাড়া কাউকে তারা জন্ম দিবে না’ (নূহ ৭১/২৭)।
যেহেতু ঐ সময়ে নূহ (আঃ)-এর জাতি ব্যতীত আর কোন মানবগোষ্ঠীর বসতি ধরাবক্ষে ছিল না এবং তাদের মধ্যে কতিপয় লোক যারা নূহ (আঃ)-এর উপর ঈমান এনেছিলেন তারা ব্যতীত গোটা জাতি আল্লাহকে অস্বীকার করেছিল আর রাসূলের প্রতি হঠকারিতা দেখিয়েছিল, সেহেতু আল্লাহ নূহ ও সেই ক’জন মুমিনকে রেখে সেদিনের পৃথিবীর গোটা মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ফলে সত্যের পথে আপতিত বাধাবিঘ্ন প্রতিরোধকারী স্বল্প সংখ্যক হকের ঝাঞ্জাবাহকদের খাতিরে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যদিও তারা ছিল সংখ্যাগুরু। সে সময়ে রিসালাতের পতাকা বাহকরা ছাড়া যে আর কেউ বেঁচে ছিলেন না তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী - ذُرِّيَّةَ مَنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوْحٍ ‘তোমরা তাদের সন্তান, যাদের আমি নূহের সাথে কিশতীতে তুলে ছিলাম’ (ইসরা ১৭/৩)।
ইমাম ত্বাবারী এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন, ‘আদম সন্তানের যারাই এখন পৃথিবীর বুকে আছে তারা প্রত্যেকেই তাদের বংশধর, যাদেরকে আল্লাহপাক নূহ (আঃ)-এর সাথে জাহাযে তুলেছিলেন।
ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, সকল মানুষ তাদের বংশধর যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আঃ)-এর জাহাযে চড়িয়ে মুক্তি দিয়েছিলেন। মুজাহিদ বলেন, বেঁচে যাওয়া লোকগুলি ছিলেন নূহ (আঃ), তাঁর পুত্রদ্বয় ও তাদের স্ত্রীগণ। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা সংখ্যায় নারী-পুরুষ মিলে ছিলেন ১৩ জন।[1] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أُولَئكَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِّنْ النَّبِيِّنَ مِنْ ذُرَّيَّةِ آدَمَ وَ مِمِّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوْحٍ -
‘ওরাই সেই নবীগণ যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন- যারা ছিলেন আদমের বংশধর ও নূহের সাথে আমি যাদের (জাহাযে) চড়িয়েছিলাম তাদের বংশধরদের অন্তর্গত’ (মারইয়াম ১৯/৫৮)।
এখানে বিজয় দ্বারা কর্মনীতির বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। ব্যক্তির বিজয়কে নয়। আসল মূল্যায়ন ঈমান ও সত্যের প্রতি সাড়া দানকারীদের সংখ্যাধিক্যের সাথে জড়িত নয়; বরং ঐ কর্মনীতির সাথে জড়িত, যা তারা বয়ে বেড়ায়- চাই তাদের সংখ্যা কম হোক কিংবা বেশী হোক। এ জন্যই মাত্র কয়েকজন লোক যাদের সংখ্যা ১৩-এর বেশী নয় তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং আল্লাহর দাসত্বের অর্থ বলতে যা বুঝায় তা নিশ্চিত করেছিলেন। বিধায় তাদের রক্ষার্থে এবং যে কর্মনীতির প্রতিনিধিত্ব তারা করছিলেন ও ধারণ করছিলেন তা রক্ষার্থে তৎকালীন বিশ্বের তাবৎ মানবকে ধ্বংস করা হয়েছিল। অবশ্য সেখানে এমন ঝুঁকিও ছিল যে, ওদের ধ্বংস না করলে ঈমানদারদের ধ্বংসের ভয় ছিল। আর তাহ’লে তাদের বাহিত কর্মনীতি বা আদর্শও ধ্বংস হয়ে যেত। সে আশঙ্কাই তো ফুটে উঠেছে নূহ (আঃ)-এর এ প্রার্থনায়,
إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوْا إِلَّا فَاجِراً كَفَّارا-ً
‘যদি আপনি তাদের রেহাই দেন তাহ’লে ওরা আপনার বান্দাদেরকে পথহারা করবে এবং পাপাচারী অকৃতজ্ঞ নাস্তিক ব্যতীত জন্ম দিবে না’ (নূহ ৭১/২৭)।
এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদর যুদ্ধে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন এইভাবে যে,
اَللَّهُمَّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ مِنْ أَهْلِ الْإسْلاَمِ لاَ تُعْبَدْ فِىْ الْأَرْضِ -
‘হে আল্লাহ! যদি আপনি মুসলমানদের এই ক্ষুদ্র দলটিকে ধ্বংস করে দেন, তাহ’লে এই ধূলির ধরায় আর আপনার ইবাদত হবে না’।[2]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের কথায় সাড়া দিয়েছিলেন। তাঁকে বদর ও পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে সাহায্য করেছিলেন যেমন করে সাহায্য করেছিলেন নূহ (আঃ)-কে।
দ্বীন ইসলাম বিজয়ী হওয়ার এটিও একটি চিহ্ন যে, পৃথিবীতে কোন শক্তিই সকল মুমিনকে কখনই একবারে ধ্বংস করতে পারবে না। যেমনটা ভয় ছিল নূহ (আঃ)-এর যুগে ও আমাদের নবীর রিসালাত লাভের প্রথম যুগে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই অভয়বাণী শুনিয়ে গেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
لاَتَزَالُ طَائُِفَةٌ مِّنْ أُمَّتِىْ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللَّهِ لاَيَضُرُّهُمْ مَّنْ خَذَلَهُمْ أَوْخَالَفَهُمْ حَتَّى يَأُْتِىَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ -
‘আমার উম্মতের একটি অংশ সর্বদা আল্লাহর দ্বীনের উপর অটল থাকবে। তাদের অপদস্থ করতে প্রয়াসী কিংবা বিরোধিতাকারী কেউই তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমনিভাবে আল্লাহর আদেশ তথা ক্বিয়ামত এসে যাবে কিন্তু তারা ঐ অবস্থায়ই থেকে যাবে’।[3]
[1]. তাফসীরে ত্বাবারী, ১৫/১৯ পৃঃ ও ৮/২১৫ পৃঃ।
[2]. মুসলিম, হা/১৭৬৩, ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[3]. বুখারী হা/৩৬৪১ ‘মানকিব’ অধ্যায়, অনুচ্ছে- ২৪; মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/৬২৭৬।
স্বীয় জাতির সঙ্গে নূহ (আঃ)-এর যে ঘটনা ঘটেছিল তা এক বিরাট কাহিনী, যা বহুবিধ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। সেকারণ উক্ত কাহিনী বিশেষ গুরুত্ব লাভে সক্ষম হয়েছে। এটি নানা বৈশিষ্ট্যমন্ডিতও বটে। কারণ:
(১) নূহ (আঃ) ছিলেন মানব জাতির জন্য প্রথম রাসূল। আর যিনি প্রথম হন তার কিছু বৈশিষ্ট্যও থাকে।
(২) নিজ জাতির মধ্যে সুদীর্ঘকাল তাঁর অবস্থান ছিল। তিনি এক নাগাড়ে ৯৫০ বছর স্বীয় জাতির মধ্যে দ্বীন প্রচার করেছেন।
(৩) তিনি ‘উলুল আযম’ বা দৃঢ়মনা রাসূল ছিলেন।
(৪) কুরআনে বেশী মাত্রায় তাঁর প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। ২৯টি সূরার ৪৩ স্থানে তাঁর কথা এসেছে। বলা চলে কুরআনের এক চতুর্থাংশ সূরায় প্রসঙ্গটি স্থান পেয়েছে। এক্ষণে আমরা এমন কিছু আয়াত তুলে ধরব, যাতে নূহ (আঃ) ও তাঁর জাতির মধ্যেকার ঘটনা বিধৃত আছে।
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوْحاً إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوْا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ إِنِّيْ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ -
‘নিশ্চয়ই আমি নূহকে তাঁর জাতির নিকট প্রেরণ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন উপাস্য নেই। আমি তোমাদের জন্য এক কঠিন দিবসের শাস্তির ভয় করি’ (আ‘রাফ ৭/৫৯)।
এই হচ্ছে নূহ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারকথা। তিনি তাদেরকে আল্লাহর ইবাদত ও তাওহীদের দিকে আহবান জানিয়েছিলেন এবং তাঁর বিরোধিতার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পরবর্তী স্তরে এসে যখন তাঁর জাতি তাঁর আহবানে সাড়া দিল না, উপরন্তু অহংকার প্রকাশ করল তখন তিনি যে দাওয়াত নিয়ে তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তা সূরা ইউনুসে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ نُوْحٍ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكُم مَّقَامِيْ وَتَذْكِيْرِيْ بِآيَاتِ اللّهِ فَعَلَى اللّهِ تَوَكَّلْتُ فَأَجْمِعُواْ أَمْرَكُمْ وَشُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ لاَ يَكُنْ أَمْرُكُمْ عَلَيْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُواْ إِلَيَّ وَلاَ تُنْظِرُوْنِ -
‘আপনি তাদেরকে নূহের ঘটনা পড়ে শুনান। যখন তিনি তাঁর জাতিকে বললেন, হে আমার জাতি! যদি তোমাদের নিকট আমার অবস্থান ও আল্লাহর আয়াতের মাধ্যমে আমার উপদেশ দান বড় কষ্টকর মনে হয় তাহ’লে আমি আল্লাহর উপর ভরসা করছি। সুতরাং তোমরা তোমাদের কাজ ও উপাস্যদেরকে গুছিয়ে নাও। তারপর তোমাদের কাজ যেন তোমাদের বিরুদ্ধেই দুঃখের আকর না হয় (সেদিকে লক্ষ্য রেখ)। অতঃপর তোমরা আমার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নাও এবং আমাকে কোন ছাড় দিও না’ (ইউনুস ১০/৭১)।
সূরা ‘হূদ’-এ নূহ (আঃ)-এর ঘটনা আরও বিস্তারিত আকারে এসেছে। তিনি যে তাদের সাথে বিতর্ক করেছেন, বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়েছেন, তাদের নিকট সৎপথের বিবরণ তুলে ধরেছেন সে সব কথা ঐ সূরায় তুলে ধরা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাঁর কওমের লোকেরা বলে বসল,
يَا نُوْحُ قَدْ جَادَلْتَنَا فَأَكْثَرْتَ جِدَالَنَا فَأْتِناَ بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ -
‘হে নূহ! তুমি আমাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা করছ এবং বিতন্ডায় অনেক বাড়াবাড়ি করছ। অতএব তুমি আমাদের যে (শাস্তির) প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ, তাই আমাদের জন্য নিয়ে এসো যদি তুমি সত্যবাদীদের একজন হও’ (হূদ ১১/৩২)।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্বন্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন,
وَأُوحِيَ إِلَى نُوْحٍ أَنَّهُ لَنْ يُؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ إِلاَّ مَنْ قَدْ آمَنَ فَلاَ تَبْتَئِسْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ، وَاصْنَعِ الْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا وَوَحْيِنَا وَلاَ تُخَاطِبْنِيْ فِي الَّذِيْنَ ظَلَمُواْ إِنَّهُم مُّغْرَقُوْنَ -
‘আর নূহের নিকট অহি প্রেরণ করা হ’ল যে, আপনার জাতির মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তারা ব্যতীত আর কেউ কখনও ঈমান আনবে না। সুতরাং তারা যা করছে সেজন্য আপনি দুঃখবোধ করবেন না। আপনি আমাদের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধান মত একটি জাহাজ তৈরী করুন। আর যালিমদের সম্বন্ধে আমাকে সম্বোধন করবেন না। ওরা ডুবে মরবে’ (হূদ ১১/৩৬, ৩৭)।
নূহ (আঃ)-এর ঘটনার সাথে জড়িত কিছু সংলাপ এখানে উপস্থাপন করা হ’ল-
(১) নূহ (আঃ) তাঁর জাতির মধ্যে কতদিন অবস্থান করেছিলেন?
জবাব : আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوْحاً إِلَى قَوْمِهِ فَلَبِثَ فِيْهِمْ أَلْفَ سَنَةٍ إِلاَّ خَمْسِيْنَ عَاماً -
‘আমি নূহকে তাঁর জাতির মাঝে প্রেরণ করেছিলাম। তিনি তাদের মাঝে ৫০ কম ১০০০ বছর অবস্থান করেছিলেন’ (আন‘কাবূত ২৯/১৪)।
(২) নূহ (আঃ) তাঁর প্রতিপালকের রিসালাত বা বার্তা প্রচারে যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন তা কী ছিল?
জবাব: তিনি তাদের সৎ পথে আনয়ন ও আল্লাহর দাসে পরিণত করতে সকল প্রকার বৈধ পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
قَالَ رَبِّ إِنِّيْ دَعَوْتُ قَوْمِيْ لَيْلاً وَنَهَاراً، فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِيْ إِلاَّ فِرَاراً، وَإِنِّيْ كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوْا أَصَابِعَهُمْ فِيْ آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوْا وَاسْتَكْبَرُوْا اسْتِكْبَاراً، ثُمَّ إِنِّيْ دَعَوْتُهُمْ جِهَاراً، ثُمَّ إِنِّيْ أَعْلَنتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَاراً -
‘তিনি বলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার জাতিকে রাত-দিন দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু আমার দাওয়াত তাদের পলায়নী মনোবৃত্তিই কেবল বৃদ্ধি করেছে। আপনি যাতে তাদের ক্ষমা করে দেন সে লক্ষ্যে যখনই আমি তাদের দাওয়াত দিয়েছি তখনই তারা তাদের কানের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, বস্ত্র দ্বারা নিজেদেরকে আচ্ছাদিত করেছে, হঠকারিতা দেখিয়েছে এবং চরম ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে। তারপরও আমি তাদেরকে উচ্চঃস্বরে দাওয়াত দিয়েছি। তাদের সামনে প্রকাশ্যে বলেছি এবং সঙ্গোপনেও খুব বলেছি’ (নূহ ৭১/৫-৯)।
(৩) তাঁর কওমের প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?
জবাব : আল্লাহ বলেন, قَالُوا أَنُؤْمِنُ لَكَ وَاتَّبَعَكَ الْأَرْذَلُوْنَ ‘তারা বলল, যেখানে হীন-তুচ্ছ লোকেরা তোমার অনুসরণ করছে সেখানে আমরা কি করে তোমার উপর ঈমান আনতে পারি? (শু‘আরা ২৬/১১১)।
নূহ (আঃ) এভাবে দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকলে এক পর্যায়ে তাঁর জাতির লোকেরা মারমুখী হয়ে উঠল এবং বলতে লাগল-
لَئِن لَّمْ تَنتَهِ يَا نُوْحُ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْمَرْجُوْمِيْنَ ‘হে নূহ! যদি তুমি প্রচারে বিরত না হও, তাহ’লে তুমি পাথরের আঘাতে ধরাশায়ীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (শু‘আরা ২৬/১১৬)।
(৪) নূহ (আঃ)-এর প্রতি কতজন ঈমান এনেছিল?
জবাব : স্বল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত তাঁর প্রতি কেউ ঈমান আনেনি। এমনকি তাঁর এক স্ত্রী ও এক পুত্রও তাঁর উপর ঈমান আনেনি। আল্লাহ বলেন,
قُلْنَا احْمِلْ فِيْهَا مِنْ كُلٍّ زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ وَأَهْلَكَ إِلاَّ مَنْ سَبَقَ عَلَيْهِ الْقَوْلُ وَمَنْ آمَنَ وَمَا آمَنَ مَعَهُ إِلاَّ قَلِيْلٌ -
‘আমি বললাম, আপনি উহাতে (জাহাজে) প্রত্যেক যুগল হ’তে দু’টি করে তুলে নিন। (তুলে নিন) যাদের প্রতি আগে ভাগেই শাস্তির কথা নিশ্চিত হয়ে গেছে তাদের বাদে আপনার পরিবারের সদস্যদেরকে এবং (তুলে নিন) তাদের, যারা ঈমান এনেছে। অবশ্য তাঁর সঙ্গে মাত্র স্বল্প সংখ্যক লোক ঈমান এনেছিল’ (হূদ ১১/৪০)।
যখন প্লাবন শুরু হয়ে গেল, আর নূহ (আঃ)-এর সেই কাফের পুত্র ডুবে যাওয়ার উপক্রম হ’ল, তখন তিনি আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করেন-
وَنَادَى نُوْحٌ رَّبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِيْ مِنْ أَهْلِيْ وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَأَنْتَ أَحْكَمُ الْحَاكِمِيْنَ، قَالَ يَا نُوْحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ -
‘নূহ তাঁর প্রতিপালককে ডেকে বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার পুত্র তো আমার পরিবারভুক্ত। আর আপনার প্রতিশ্রুতিও নিশ্চয়ই সত্য। আপনি শ্রেষ্ঠতম বিচারকও। তিনি বললেন, ‘হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়, সে অসৎ কর্মপরায়ণ’ (হূদ ১১/৪৫, ৪৬)।
ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلاً لِّلَّذِيْنَ كَفَرُوْا اِمْرَأَةَ نُوْحٍ وَاِمْرَأَةَ لُوْطٍ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئاً وَقِيْلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِيْن -
‘আল্লাহ কাফেরদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরছেন নূহের স্ত্রী ও লূতের স্ত্রীকে। তারা দু’জন ছিল আমার দু’জন অন্যতম সৎবান্দার বিবাহধীন। কিন্তু তারা তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলে আল্লাহর কোপ হ’তে তাঁরা তাদের কিছুমাত্র রক্ষা করতে পারেননি। বরং বলা হ’ল, ‘তোমরা দু’জন অপরাপর প্রবেশকারীদের সাথে আগুনে প্রবেশ কর’ (তাহরীম ৬৬/১০)।
(৫) শেষ পর্যন্ত নূহ (আঃ) কী বলেছিলেন?
জবাব : আল্লাহ বলেন,
َقالَ رَبِّ إِنَّ قَوْمِيْ كَذَّبُوْنِ، فَافْتَحْ بَيْنِيْ وَبَيْنَهُمْ فَتْحاً وَنَجِّنِيْ وَمَنْ مَّعِيْ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ -
‘তিনি বললেন, হে আমার প্রভু! আমার জাতি আমাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং আপনি আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়ছালা করে দিন। আর আমাকে ও আমার সঙ্গী মুমিনদেরকে মুক্তি দিন’ (শু‘আরা ২৬/১১৭-১১৮)।
فَدَعَا رَبَّهُ أَنِّي مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ ‘অনন্তর তিনি তাঁর প্রতিপালককে আহবান করলেন যে, আমি পরাস্ত; সুতরাং আপনি সাহায্য করুন’ (ক্বামার ৫৪/১০)।
وَقَالَ نُوْحٌ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِيْنَ دَيَّاراً، إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوْا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا -
‘নূহ বললেন, হে আমার প্রভু, ধরিত্রীর বুকে আপনি কোন কাফের গৃহবাসীকে রেহাই দিবেন না। আপনি যদি ওদের রেহাই দেন তাহ’লে ওরা আপনার বান্দাদেরকে পথহারা করবে, আর নিজেরা পাপাচারী কাফের ব্যতীত আর কিছু জন্ম দিবে না’ (নূহ ৭১/২৬, ২৭)।
(৬) এই কঠিন দুস্তর পারাবার পাড়ি দেওয়ার পর নূহ (আঃ)-এর জন্য বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল :
আল্লাহ বলেন,
وَدَعَا رَبَّهُ أَنِّيْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ، فَفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاء بِمَاء مُّنْهَمِرٍ، وَفَجَّرْنَا الْأَرْضَ عُيُوناً فَالْتَقَى الْمَاء عَلَى أَمْرٍ قَدْ قُدِرَ، وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَدُسُرٍ، تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا جَزَاء لِّمَن كَانَ كُفِرَ، وَلَقَد تَّرَكْنَاهَا آيَةً فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ -
‘তিনি তাঁর রবকে ডেকে বললেন, আমি পরাস্ত, সুতরাং আমাকে সাহায্য করুন। ফলে আমি মুষলধারে বারিপাত দ্বারা আকাশের দ্বার খুলে দিলাম এবং ভূমন্ডলে অনেক ঝর্ণা প্রবাহিত করলাম। ফলে একটি নির্ধারিত পর্যায়ে পানির প্রবাহ সম্মিলিত হ’ল। আমি তখন তাকে কাষ্ঠফলক ও পেরেক নির্মিত জলযানে আরোহণ করালাম, যা আমার গোচরে চলছিল। ইহা ছিল তার জন্য প্রতিদান, যাকে অমান্য করা হয়েছিল। আর আমি উহাকে নিদর্শন স্বরূপ রেখে দিয়েছি। সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি’? (ক্বামার ৫৪/১০-১৫)।
এই হ’ল নূহ (আঃ)-এর ঘটনা। তিনি প্রায় দশ দশটি শতাব্দী তাঁর কওমের মধ্যে কাটিয়েছেন। এতগুলো শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও কি ফল দাঁড়িয়েছে? আমরা দেখছি-
(ক) স্বল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত তাঁর কওম তাঁর উপর ঈমান আনেনি। কথিত আছে, তাদের সংখ্যা নূহ (আঃ) সহ তেরজন। ইবনু ইসহাক্ব বলেছেন, তারা হ’লেন নূহ, তাঁর তিন পুত্র সাম, হাম, ইয়াফিছ, তাদের তিন স্ত্রী এবং অন্য দু’জন লোক।
(খ) তাঁর স্ত্রী ও এক পুত্র তাঁর উপর ঈমান আনেনি। ইতিপূর্বে সে কথা বলা হয়েছে। অথচ তারা ছিল তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠজন।
(গ) এতদসত্ত্বেও তাঁকে বিজয়ী ও সাহায্যপ্রাপ্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। তাঁর জীবনে খুবই বড় মাপের বিজয় অর্জিত হয়েছিল। নিম্নের কথা ক’টিতে তা বুঝা যায়।
(১) দশ দশটি শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তিনি ধৈর্যশীল ও স্থিতিশীল থেকেছেন। তাঁর জাতির ষড়যন্ত্রের ফাঁদে তিনি পা দেননি এবং তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপেও প্রভাবিত হননি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَيَصْنَعُ الْفُلْكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ مَلَأٌ مِّن قَوْمِهِ سَخِرُواْ مِنْهُ قَالَ إِن تَسْخَرُواْ مِنَّا فَإِنَّا نَسْخَرُ مِنْكُمْ كَمَا تَسْخَرُوْنَ -
‘তিনি জাহায তৈরী করছিলেন আর যখনই তাঁর জাতির নেতৃবর্গ তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখনই তারা তাকে বিদ্রূপ করছিল। তিনি বলছিলেন, ‘যদি তোমরা আমাদের নিয়ে বিদ্রূপ কর তবে আমরাও তোমাদের নিয়ে বিদ্রূপ করব- যেমন তোমরা করছ’ (হূদ ১১/৩৮)।
(২) তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র হ’তে আল্লাহ কর্তৃক তিনি হেফাযতে ছিলেন। তারা যে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল তা তাদের কথাতেই প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। আল্লাহ বলেন, قَالُوْا لَئِنْ لَّمْ تَنْتَهِ يَا نُوْحُ لَتَكُونَنَّ مِنَ الْمَرْجُوْمِيْنَ ‘তারা বলল, হে নূহ! যদি তুমি বিরত না হও তাহ’লে তুমি প্রস্তরাঘাতের সম্মুখীন হবে’ (শু‘আরা ২৬/১১৬)।
(৩) তাঁর জাতির যারা ঈমান আনেনি সলিল-সমাধির মাধ্যমে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, وَأَغْرَقْنَا الَّذِيْنَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا إِنَّهُمْ كَانُواْ قَوْماً عَمِينَ ‘যারা আমার বিধানাবলীকে অস্বীকার করেছিল আমি তাদের পানিতে নিমজ্জিত করেছিলাম। তারা ছিল একটি জ্ঞানান্ধ জাতি’ (আ‘রাফ ৭/৬৪)।
(৪) নূহ (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী মুমিনগণ ডুবে মরা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, فَأَنْجَيْنَاهُ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ فِي الْفُلْكِ ‘অনন্তর আমি তাঁকে ও তাঁর সঙ্গে যারা জাহাযে ছিলেন সবাইকে মুক্তি দিয়েছিলাম’ (আ‘রাফ ৭/৬৪)। وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحِ وَدُسُرٍ، تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا . ‘আমি তাকে তক্তা ও কীলক নির্মিত জলযানে আরোহণ করিয়েছিলাম, যা আমার দৃষ্টিপথে চলছিল’ (ক্বামার ৫৪/১৩, ১৪)।
(৫) নূহ (আঃ)-এর সফলতা ও তাঁর জাতির ধ্বংসপ্রাপ্তি পরবর্তীকালে একটি শিক্ষণীয় আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী যুগের লোকদের মুখে মুখে আল্লাহ নূহ (আঃ)-এর খ্যাতি ছড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, وَلَقَد تَّرَكْنَاهَا آيَةً فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ ‘এই ঘটনাকে আমি নিদর্শন হিসাবে বাকী রেখেছি। সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি’? (ক্বামার ৫৪/১৫)। ذُرِّيَّةَ مَنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوْحٍ إِنَّهُ كَانَ عَبْداً شَكُوْراً ‘(তোমরা) তাদের সন্তান যাদেরকে আমি নূহের সঙ্গে তুলে নিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন একজন কৃতজ্ঞ বান্দা’ (ইসরা ১৭/৩)। سَلاَمٌ عَلَى نُوْحٍ فِي الْعَالَمِيْنَ ‘সমগ্র জগৎ ব্যাপী নূহের প্রতি শান্তি হোক’ (ছাফফাত ৩৭/৭৯)। إِنَّ اللّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহীম পরিবার ও ইমরান পরিবারকে সকল সৃষ্টি থেকে নির্বাচন করেছেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৩)।
নূহ ও তাঁর কওমের ঘটনা থেকে এভাবেই আল্লাহ প্রদত্ত সাহায্য ও বিজয় ফুটে উঠেছে।
নূহ (আঃ)-এর ঘটনা শেষ করার আগে আমরা সূরা ‘নূহ’-এ বর্ণিত একটি আয়াত পর্যালোচনা করতে চাই। সেখানে এরশাদ হয়েছে,
إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلاَ يَلِدُوْا إِلاَّ فَاجِراً كَفَّاراً -
‘আপনি যদি তাদের (কাফেরদের) রেহাই দেন তবে নিশ্চয়ই তারা আপনার বান্দাদেরকে পথহারা করবে এবং পাপাচারী অকৃতজ্ঞ মানুষ ছাড়া কাউকে তারা জন্ম দিবে না’ (নূহ ৭১/২৭)।
যেহেতু ঐ সময়ে নূহ (আঃ)-এর জাতি ব্যতীত আর কোন মানবগোষ্ঠীর বসতি ধরাবক্ষে ছিল না এবং তাদের মধ্যে কতিপয় লোক যারা নূহ (আঃ)-এর উপর ঈমান এনেছিলেন তারা ব্যতীত গোটা জাতি আল্লাহকে অস্বীকার করেছিল আর রাসূলের প্রতি হঠকারিতা দেখিয়েছিল, সেহেতু আল্লাহ নূহ ও সেই ক’জন মুমিনকে রেখে সেদিনের পৃথিবীর গোটা মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ফলে সত্যের পথে আপতিত বাধাবিঘ্ন প্রতিরোধকারী স্বল্প সংখ্যক হকের ঝাঞ্জাবাহকদের খাতিরে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যদিও তারা ছিল সংখ্যাগুরু। সে সময়ে রিসালাতের পতাকা বাহকরা ছাড়া যে আর কেউ বেঁচে ছিলেন না তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী - ذُرِّيَّةَ مَنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوْحٍ ‘তোমরা তাদের সন্তান, যাদের আমি নূহের সাথে কিশতীতে তুলে ছিলাম’ (ইসরা ১৭/৩)।
ইমাম ত্বাবারী এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন, ‘আদম সন্তানের যারাই এখন পৃথিবীর বুকে আছে তারা প্রত্যেকেই তাদের বংশধর, যাদেরকে আল্লাহপাক নূহ (আঃ)-এর সাথে জাহাযে তুলেছিলেন।
ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, সকল মানুষ তাদের বংশধর যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আঃ)-এর জাহাযে চড়িয়ে মুক্তি দিয়েছিলেন। মুজাহিদ বলেন, বেঁচে যাওয়া লোকগুলি ছিলেন নূহ (আঃ), তাঁর পুত্রদ্বয় ও তাদের স্ত্রীগণ। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা সংখ্যায় নারী-পুরুষ মিলে ছিলেন ১৩ জন।[1] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أُولَئكَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِّنْ النَّبِيِّنَ مِنْ ذُرَّيَّةِ آدَمَ وَ مِمِّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوْحٍ -
‘ওরাই সেই নবীগণ যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন- যারা ছিলেন আদমের বংশধর ও নূহের সাথে আমি যাদের (জাহাযে) চড়িয়েছিলাম তাদের বংশধরদের অন্তর্গত’ (মারইয়াম ১৯/৫৮)।
এখানে বিজয় দ্বারা কর্মনীতির বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। ব্যক্তির বিজয়কে নয়। আসল মূল্যায়ন ঈমান ও সত্যের প্রতি সাড়া দানকারীদের সংখ্যাধিক্যের সাথে জড়িত নয়; বরং ঐ কর্মনীতির সাথে জড়িত, যা তারা বয়ে বেড়ায়- চাই তাদের সংখ্যা কম হোক কিংবা বেশী হোক। এ জন্যই মাত্র কয়েকজন লোক যাদের সংখ্যা ১৩-এর বেশী নয় তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং আল্লাহর দাসত্বের অর্থ বলতে যা বুঝায় তা নিশ্চিত করেছিলেন। বিধায় তাদের রক্ষার্থে এবং যে কর্মনীতির প্রতিনিধিত্ব তারা করছিলেন ও ধারণ করছিলেন তা রক্ষার্থে তৎকালীন বিশ্বের তাবৎ মানবকে ধ্বংস করা হয়েছিল। অবশ্য সেখানে এমন ঝুঁকিও ছিল যে, ওদের ধ্বংস না করলে ঈমানদারদের ধ্বংসের ভয় ছিল। আর তাহ’লে তাদের বাহিত কর্মনীতি বা আদর্শও ধ্বংস হয়ে যেত। সে আশঙ্কাই তো ফুটে উঠেছে নূহ (আঃ)-এর এ প্রার্থনায়,
إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوْا إِلَّا فَاجِراً كَفَّارا-ً
‘যদি আপনি তাদের রেহাই দেন তাহ’লে ওরা আপনার বান্দাদেরকে পথহারা করবে এবং পাপাচারী অকৃতজ্ঞ নাস্তিক ব্যতীত জন্ম দিবে না’ (নূহ ৭১/২৭)।
এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদর যুদ্ধে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন এইভাবে যে,
اَللَّهُمَّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ مِنْ أَهْلِ الْإسْلاَمِ لاَ تُعْبَدْ فِىْ الْأَرْضِ -
‘হে আল্লাহ! যদি আপনি মুসলমানদের এই ক্ষুদ্র দলটিকে ধ্বংস করে দেন, তাহ’লে এই ধূলির ধরায় আর আপনার ইবাদত হবে না’।[2]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের কথায় সাড়া দিয়েছিলেন। তাঁকে বদর ও পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে সাহায্য করেছিলেন যেমন করে সাহায্য করেছিলেন নূহ (আঃ)-কে।
দ্বীন ইসলাম বিজয়ী হওয়ার এটিও একটি চিহ্ন যে, পৃথিবীতে কোন শক্তিই সকল মুমিনকে কখনই একবারে ধ্বংস করতে পারবে না। যেমনটা ভয় ছিল নূহ (আঃ)-এর যুগে ও আমাদের নবীর রিসালাত লাভের প্রথম যুগে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই অভয়বাণী শুনিয়ে গেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
لاَتَزَالُ طَائُِفَةٌ مِّنْ أُمَّتِىْ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللَّهِ لاَيَضُرُّهُمْ مَّنْ خَذَلَهُمْ أَوْخَالَفَهُمْ حَتَّى يَأُْتِىَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ -
‘আমার উম্মতের একটি অংশ সর্বদা আল্লাহর দ্বীনের উপর অটল থাকবে। তাদের অপদস্থ করতে প্রয়াসী কিংবা বিরোধিতাকারী কেউই তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমনিভাবে আল্লাহর আদেশ তথা ক্বিয়ামত এসে যাবে কিন্তু তারা ঐ অবস্থায়ই থেকে যাবে’।[3]
[1]. তাফসীরে ত্বাবারী, ১৫/১৯ পৃঃ ও ৮/২১৫ পৃঃ।
[2]. মুসলিম, হা/১৭৬৩, ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[3]. বুখারী হা/৩৬৪১ ‘মানকিব’ অধ্যায়, অনুচ্ছে- ২৪; মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/৬২৭৬।
এই ঘটনা আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীনে উল্লেখ করেছেন। যেমন,
وَاضْرِبْ لَهُمْ مَّثَلاً أَصْحَابَ الْقَرْيَةِ إِذْ جَاءَهَا الْمُرْسَلُوْنَ، إِذْ أَرْسَلْنَا إِلَيْهِمُ اثْنَيْنِ فَكَذَّبُوْهُمَا فَعَزَّزْنَا بِثَالِثٍ فَقَالُوْا إِنَّا إِلَيْكُم مُّرْسَلُوْنَ، قَالُوا مَا أَنتُمْ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُنَا وَمَا أَنزَلَ الرَّحْمَنُ مِنْ شَيْءٍ إِنْ أَنتُمْ إِلاَّ تَكْذِبُوْنَ، قَالُوْا رَبُّنَا يَعْلَمُ إِنَّا إِلَيْكُمْ لَمُرْسَلُوْنَ، وَمَا عَلَيْنَا إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِينُ، قَالُوْا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِنْ لَّمْ تَنتَهُوْا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيْمٌ -
‘আপনি তাদের সামনে একটি জনপদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরুন। যখন তাদের নিকট রাসূলগণ গিয়েছিলেন এবং যখন আমি তাদের মাঝে দু’জন রাসূলকে পাঠিয়েছিলাম, তখন তারা ঐ দু’জনকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করেছিল। ফলে তৃতীয়জন দ্বারা আমি তাদের বল বৃদ্ধি করেছিলাম। তাঁরা (তিনজনে) বলেছিলেন, আমরা নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতি প্রেরিত রাসূল। তারা বলল, তোমরা আমাদের মত মানুষ বৈ নও; আর দয়াময় কোন কিছু অবতীর্ণ করেননি। তোমরা কেবলই মিথ্যাচার করছ। তাঁরা বললেন, আমাদের প্রতিপালক জানেন যে, আমরা নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতি প্রেরিত। আর সুস্পষ্ট প্রচার ব্যতীত আমাদের অন্য কোন দায়িত্ব নেই। তারা বলল, আমরা তোমাদেরকে অশুভ মনে করছি। যদি তোমরা বিরত না হও তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের গায়ে পাথর মারব এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের জ্বালাময়ী শাস্তি দেওয়া হবে’ (ইয়াসীন ৩৬/১৩-১৮)।
একটি জনপদ-মুফাসসিরদের ভাষায় যার নাম ‘এন্টিয়ক’, সেখানে দু’জন রাসূল প্রেরিত হন। যখন জনপদবাসীরা এ দু’জনের কথায় ঈমান আনল না তখন তৃতীয় রাসূল প্রেরিত হ’লেন। কিন্তু তাতে তাদের কুফরীর কোন পরিবর্তন ঘটল না। বরং তাদের বাড়াবাড়ি ও ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। তারা রাসূলদেরকে পাথর নিক্ষেপ ও হত্যার হুমকি দিল।
এখানে এসেই কি ঘটনার শেষ? না, বরং তাদের নিকট চতুর্থ একজন এসেছিলেন। তিনি ছিলেন তাদেরই ক্বওমের লোক এবং তাদের শুভাকাঙ্খী। আল্লাহ বলেন,
وَجَاءَ مِنْ أَقْصَى الْمَدِيْنَةِ رَجُلٌ يَسْعَى قَالَ يَا قَوْمِ اتَّبِعُوْا الْمُرْسَلِيْنَ -
‘শহরের দূরপ্রাপ্ত হ’তে এক ব্যক্তি দ্রুত এসে বলল, ‘হে আমার ক্বওম! তোমরা রাসূলদের অনুসরণ কর’ (ইয়াসীন ৩৬/২০)।
তিনি স্বীয় ক্বওমের মাঝে দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন, কিন্তু এবারে তারা তাঁকে কোন ধমক দিল না; বরং তাদের বিরোধিতা করার জন্য একেবারে হত্যা করে বসল। যালিম স্বৈরারীদের অবস্থা যুগে যুগে এমনই হয়। তারা কারও বিরোধিতা সহ্য করতে পারে না। চাই সে তাদের স্বগোত্রীয় হোক কিংবা ভিন গোত্রীয় হোক।
এমনি করে একটি জনপদে তিন জন রাসূল ও একজন প্রচারক আবির্ভূত হয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও তারা তাঁদের আহবানে সাড়া দেয়নি। শুধু তাই নয়, তারা বরং রাসূলগণকে যাচ্ছে তাই হুমকি দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেছেন, তারা তাঁদেরকে মেরে ফেলেছিল। চতুর্থ জনের হত্যার কথা তো কুরআনেই বলা হয়েছে।
পার্থিব মুল্যায়ন অনুসারে মনে হয়, এ সকল রাসূল বিজয় লাভ করেননি। তাঁদের মিশনে তাঁরা সফল হননি। চতুর্থ জন তো তার আবেগ ও ঈমান খুব দ্রুতই তাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন এবং তার ফলও তিনি তাৎক্ষণিক ভোগ করেছিলেন। যারা জয়-পরাজয়ের তাৎপর্য বোঝে না তাদের দৃষ্টিতে ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই মূল্যায়িত হয়। কিন্তু সত্যের যুক্তি ও নবুঅতের কার্যধারা ঘোষণা করছে, রাসূলগণ পরিষ্কার বিজয় অর্জন করেছিলেন এবং জনপদবাসীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নিম্নের বিষয়গুলোতে তাঁদের বিজয়বার্তা ফুটে উঠেছে।
(১) রাসূলগণ আল্লাহর রিসালাত প্রচারে সক্ষম হয়েছেন। জনপদবাসীরা প্রথম যখন তাদেরকে তাদেরই মত মানুষ হিসাবে তুলনা করেছিল তখন তারা তাদের নিকট নতি স্বীকার করেননি। দ্বিতীয়বার যখন তারা তাদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করতে থাকে তখনও তাঁরা কর্তব্যচ্যুত হননি। এই প্রচারই তো তাদের গুরু দায়িত্ব। আর যে ব্যক্তি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে সেই তো সফল। কুরআনের ভাষায় তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে وَمَا عَلَيْنَا إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ ‘আমাদের দায়িত্ব কেবল স্পষ্ট প্রচার’ (ইয়াসীন ৩৬/১৭)।
(২) ঐ জনপদের এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ ও প্রকাশ্যে রাসূলদের সহযোগিতা দান তাদের সকলের জন্য বিজয় হিসাবে গণ্য। এ জন্যই জনপদবাসীরা তাঁর প্রতি বেশী বর্বরতা দেখিয়েছে। কেননা তাঁর কারণে তারা অপমানিত হয়েছিল। তাদের অপমান বোধের মধ্যে ঐ রাসূলদের জন্য বিজয় রয়েছে।
(৩) উক্ত ইসলাম গ্রহণকারী প্রচারকের হত্যাকান্ডের মধ্যে তাঁর নিজের ও তাঁর কর্মপদ্ধতির বিজয় নিহিত রয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ تَرَبَّصُوْنَ بِنَا إِلاَّ إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ ‘আপনি বলুন, তোমরা আমাদের বেলায় দু’টি কল্যাণের যে কোন একটির প্রতিক্ষা বৈ অন্য কিছু করছ না’ (তওবা ৯/৫২)।
এ জন্যই তাঁর হত্যাকারীরা যখন বলেছিল, ‘জান্নাতে যা’ তখন তিনি তাঁর সাফল্য ও বিজয়কে স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরার মানসে বলেছিলেন,
يَا لَيْتَ قَوْمِي يَعْلَمُوْنَ، بِمَا غَفَرَ لِيْ رَبِّيْ وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُكْرَمِيْن -
‘হায় আফসোস! আমার কওম যদি জানত কেন আমার রব আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং সম্মানিতজনদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন’ (ইয়াসীন ২৬, ২৭)।
(৪) তাঁদের বিজয় কার্যকরী করতে গৃহীত চূড়ান্ত ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَى قَوْمِهِ مِن بَعْدِهِ مِنْ جُنْدٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَمَا كُنَّا مُنْزِلِيْنَ، إِنْ كَانَتْ إِلاَّ صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ خَامِدُوْنَ -
‘তাঁর (হত্যার) পর তাঁর জাতির নিকট আমি আকাশ থেকে কোন বাহিনী অবতীর্ণ করিনি এবং আমার তা করার দরকারও ছিল না। একটি মাত্র বিকট চীৎকার হয়েছিল। আর তাতেই তারা অধমুখী হয়ে পড়েছিল’ (ইয়াসীন ৩৬/২৮, ২৯)।
ইসলাম প্রচারকদের অবশ্যই জনপদবাসীদের ঘটনা পর্যালোচনা করা এবং তার চূড়ান্ত পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
একটি জনপদে তিন তিনজন রাসূল ও একজন প্রচারক এসেছিলেন। তাঁদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও জনপদবাসীরা ঈমান আনেনি। ঈমান আনয়নে তাদের ব্যর্থতা রাসূলদের সহযোগিতা দান এবং প্রচারকদের হক কথা বলা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কোন তাড়াহুড়া, আপস মীমাংসা তথা ছাড় দেওয়া কিংবা হতাশা এসে তাঁদের ঘিরে ধরেনি; বরং ইমাম ত্বাবারীর মতে এই প্রচারক তাঁর কওমের হাতে নিহত হওয়ার সময় তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর দরবারে দো‘আ করেছিলেন এই বলে যে, اَللَّهُمَّ اهْدِ قَوْمِىْ فَإنَّهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ - ‘হে আল্লাহ, আমার কওমকে হেদায়াত করুন। কেননা তারা অজ্ঞ’। আমরা তাঁর উক্তি, ‘হায়! আমার জাতি যদি জানত’- থেকে বুঝতে পারি, তিনি একথা আত্মতুষ্টি কিংবা নিজের কওমকে ক্ষুব্ধ করার মানসে বলেননি, তাদের হেদায়াতের জন্যই বরং বলেছিলেন। কেননা ইতিপূর্বে তারা বলেছিল, ‘দয়াময় আল্লাহ কোন কিছু অবতীর্ণ করেননি, তোমরা শুধুই মিথ্যা বলছ’- তারপরও যখন তারা জানতে পারল যে, তাদের গোত্রীয় এই লোকটি হকের উপর বিদ্যমান, তখন তিনি যে তাদের হেদায়াত লাভে বড় আশাবাদী হয়ে এ কথা বলেছিলেন তা বলাই বাহুল্য।
এভাবেই একজন দ্বীন প্রচারক মানবদরদী হয়ে থাকেন, কোন বিদ্বেষ ও হিংসার কালিমা তাকে স্পর্শ করে না। এ হচ্ছে মনের উপর বিজয়, যা বাহ্যিক বিজয় থেকে অগ্রণী। আর যে ব্যক্তি নিজের মনের উপর বিজয় লাভে ব্যর্থ সে কখনই অন্যের উপর বিজয় লাভ করতে পারে না।
وَاضْرِبْ لَهُمْ مَّثَلاً أَصْحَابَ الْقَرْيَةِ إِذْ جَاءَهَا الْمُرْسَلُوْنَ، إِذْ أَرْسَلْنَا إِلَيْهِمُ اثْنَيْنِ فَكَذَّبُوْهُمَا فَعَزَّزْنَا بِثَالِثٍ فَقَالُوْا إِنَّا إِلَيْكُم مُّرْسَلُوْنَ، قَالُوا مَا أَنتُمْ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُنَا وَمَا أَنزَلَ الرَّحْمَنُ مِنْ شَيْءٍ إِنْ أَنتُمْ إِلاَّ تَكْذِبُوْنَ، قَالُوْا رَبُّنَا يَعْلَمُ إِنَّا إِلَيْكُمْ لَمُرْسَلُوْنَ، وَمَا عَلَيْنَا إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِينُ، قَالُوْا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِنْ لَّمْ تَنتَهُوْا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيْمٌ -
‘আপনি তাদের সামনে একটি জনপদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরুন। যখন তাদের নিকট রাসূলগণ গিয়েছিলেন এবং যখন আমি তাদের মাঝে দু’জন রাসূলকে পাঠিয়েছিলাম, তখন তারা ঐ দু’জনকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করেছিল। ফলে তৃতীয়জন দ্বারা আমি তাদের বল বৃদ্ধি করেছিলাম। তাঁরা (তিনজনে) বলেছিলেন, আমরা নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতি প্রেরিত রাসূল। তারা বলল, তোমরা আমাদের মত মানুষ বৈ নও; আর দয়াময় কোন কিছু অবতীর্ণ করেননি। তোমরা কেবলই মিথ্যাচার করছ। তাঁরা বললেন, আমাদের প্রতিপালক জানেন যে, আমরা নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতি প্রেরিত। আর সুস্পষ্ট প্রচার ব্যতীত আমাদের অন্য কোন দায়িত্ব নেই। তারা বলল, আমরা তোমাদেরকে অশুভ মনে করছি। যদি তোমরা বিরত না হও তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের গায়ে পাথর মারব এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের জ্বালাময়ী শাস্তি দেওয়া হবে’ (ইয়াসীন ৩৬/১৩-১৮)।
একটি জনপদ-মুফাসসিরদের ভাষায় যার নাম ‘এন্টিয়ক’, সেখানে দু’জন রাসূল প্রেরিত হন। যখন জনপদবাসীরা এ দু’জনের কথায় ঈমান আনল না তখন তৃতীয় রাসূল প্রেরিত হ’লেন। কিন্তু তাতে তাদের কুফরীর কোন পরিবর্তন ঘটল না। বরং তাদের বাড়াবাড়ি ও ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। তারা রাসূলদেরকে পাথর নিক্ষেপ ও হত্যার হুমকি দিল।
এখানে এসেই কি ঘটনার শেষ? না, বরং তাদের নিকট চতুর্থ একজন এসেছিলেন। তিনি ছিলেন তাদেরই ক্বওমের লোক এবং তাদের শুভাকাঙ্খী। আল্লাহ বলেন,
وَجَاءَ مِنْ أَقْصَى الْمَدِيْنَةِ رَجُلٌ يَسْعَى قَالَ يَا قَوْمِ اتَّبِعُوْا الْمُرْسَلِيْنَ -
‘শহরের দূরপ্রাপ্ত হ’তে এক ব্যক্তি দ্রুত এসে বলল, ‘হে আমার ক্বওম! তোমরা রাসূলদের অনুসরণ কর’ (ইয়াসীন ৩৬/২০)।
তিনি স্বীয় ক্বওমের মাঝে দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন, কিন্তু এবারে তারা তাঁকে কোন ধমক দিল না; বরং তাদের বিরোধিতা করার জন্য একেবারে হত্যা করে বসল। যালিম স্বৈরারীদের অবস্থা যুগে যুগে এমনই হয়। তারা কারও বিরোধিতা সহ্য করতে পারে না। চাই সে তাদের স্বগোত্রীয় হোক কিংবা ভিন গোত্রীয় হোক।
এমনি করে একটি জনপদে তিন জন রাসূল ও একজন প্রচারক আবির্ভূত হয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও তারা তাঁদের আহবানে সাড়া দেয়নি। শুধু তাই নয়, তারা বরং রাসূলগণকে যাচ্ছে তাই হুমকি দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেছেন, তারা তাঁদেরকে মেরে ফেলেছিল। চতুর্থ জনের হত্যার কথা তো কুরআনেই বলা হয়েছে।
পার্থিব মুল্যায়ন অনুসারে মনে হয়, এ সকল রাসূল বিজয় লাভ করেননি। তাঁদের মিশনে তাঁরা সফল হননি। চতুর্থ জন তো তার আবেগ ও ঈমান খুব দ্রুতই তাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন এবং তার ফলও তিনি তাৎক্ষণিক ভোগ করেছিলেন। যারা জয়-পরাজয়ের তাৎপর্য বোঝে না তাদের দৃষ্টিতে ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই মূল্যায়িত হয়। কিন্তু সত্যের যুক্তি ও নবুঅতের কার্যধারা ঘোষণা করছে, রাসূলগণ পরিষ্কার বিজয় অর্জন করেছিলেন এবং জনপদবাসীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নিম্নের বিষয়গুলোতে তাঁদের বিজয়বার্তা ফুটে উঠেছে।
(১) রাসূলগণ আল্লাহর রিসালাত প্রচারে সক্ষম হয়েছেন। জনপদবাসীরা প্রথম যখন তাদেরকে তাদেরই মত মানুষ হিসাবে তুলনা করেছিল তখন তারা তাদের নিকট নতি স্বীকার করেননি। দ্বিতীয়বার যখন তারা তাদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করতে থাকে তখনও তাঁরা কর্তব্যচ্যুত হননি। এই প্রচারই তো তাদের গুরু দায়িত্ব। আর যে ব্যক্তি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে সেই তো সফল। কুরআনের ভাষায় তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে وَمَا عَلَيْنَا إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ ‘আমাদের দায়িত্ব কেবল স্পষ্ট প্রচার’ (ইয়াসীন ৩৬/১৭)।
(২) ঐ জনপদের এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ ও প্রকাশ্যে রাসূলদের সহযোগিতা দান তাদের সকলের জন্য বিজয় হিসাবে গণ্য। এ জন্যই জনপদবাসীরা তাঁর প্রতি বেশী বর্বরতা দেখিয়েছে। কেননা তাঁর কারণে তারা অপমানিত হয়েছিল। তাদের অপমান বোধের মধ্যে ঐ রাসূলদের জন্য বিজয় রয়েছে।
(৩) উক্ত ইসলাম গ্রহণকারী প্রচারকের হত্যাকান্ডের মধ্যে তাঁর নিজের ও তাঁর কর্মপদ্ধতির বিজয় নিহিত রয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ تَرَبَّصُوْنَ بِنَا إِلاَّ إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ ‘আপনি বলুন, তোমরা আমাদের বেলায় দু’টি কল্যাণের যে কোন একটির প্রতিক্ষা বৈ অন্য কিছু করছ না’ (তওবা ৯/৫২)।
এ জন্যই তাঁর হত্যাকারীরা যখন বলেছিল, ‘জান্নাতে যা’ তখন তিনি তাঁর সাফল্য ও বিজয়কে স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরার মানসে বলেছিলেন,
يَا لَيْتَ قَوْمِي يَعْلَمُوْنَ، بِمَا غَفَرَ لِيْ رَبِّيْ وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُكْرَمِيْن -
‘হায় আফসোস! আমার কওম যদি জানত কেন আমার রব আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং সম্মানিতজনদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন’ (ইয়াসীন ২৬, ২৭)।
(৪) তাঁদের বিজয় কার্যকরী করতে গৃহীত চূড়ান্ত ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَى قَوْمِهِ مِن بَعْدِهِ مِنْ جُنْدٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَمَا كُنَّا مُنْزِلِيْنَ، إِنْ كَانَتْ إِلاَّ صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ خَامِدُوْنَ -
‘তাঁর (হত্যার) পর তাঁর জাতির নিকট আমি আকাশ থেকে কোন বাহিনী অবতীর্ণ করিনি এবং আমার তা করার দরকারও ছিল না। একটি মাত্র বিকট চীৎকার হয়েছিল। আর তাতেই তারা অধমুখী হয়ে পড়েছিল’ (ইয়াসীন ৩৬/২৮, ২৯)।
ইসলাম প্রচারকদের অবশ্যই জনপদবাসীদের ঘটনা পর্যালোচনা করা এবং তার চূড়ান্ত পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
একটি জনপদে তিন তিনজন রাসূল ও একজন প্রচারক এসেছিলেন। তাঁদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও জনপদবাসীরা ঈমান আনেনি। ঈমান আনয়নে তাদের ব্যর্থতা রাসূলদের সহযোগিতা দান এবং প্রচারকদের হক কথা বলা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কোন তাড়াহুড়া, আপস মীমাংসা তথা ছাড় দেওয়া কিংবা হতাশা এসে তাঁদের ঘিরে ধরেনি; বরং ইমাম ত্বাবারীর মতে এই প্রচারক তাঁর কওমের হাতে নিহত হওয়ার সময় তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর দরবারে দো‘আ করেছিলেন এই বলে যে, اَللَّهُمَّ اهْدِ قَوْمِىْ فَإنَّهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ - ‘হে আল্লাহ, আমার কওমকে হেদায়াত করুন। কেননা তারা অজ্ঞ’। আমরা তাঁর উক্তি, ‘হায়! আমার জাতি যদি জানত’- থেকে বুঝতে পারি, তিনি একথা আত্মতুষ্টি কিংবা নিজের কওমকে ক্ষুব্ধ করার মানসে বলেননি, তাদের হেদায়াতের জন্যই বরং বলেছিলেন। কেননা ইতিপূর্বে তারা বলেছিল, ‘দয়াময় আল্লাহ কোন কিছু অবতীর্ণ করেননি, তোমরা শুধুই মিথ্যা বলছ’- তারপরও যখন তারা জানতে পারল যে, তাদের গোত্রীয় এই লোকটি হকের উপর বিদ্যমান, তখন তিনি যে তাদের হেদায়াত লাভে বড় আশাবাদী হয়ে এ কথা বলেছিলেন তা বলাই বাহুল্য।
এভাবেই একজন দ্বীন প্রচারক মানবদরদী হয়ে থাকেন, কোন বিদ্বেষ ও হিংসার কালিমা তাকে স্পর্শ করে না। এ হচ্ছে মনের উপর বিজয়, যা বাহ্যিক বিজয় থেকে অগ্রণী। আর যে ব্যক্তি নিজের মনের উপর বিজয় লাভে ব্যর্থ সে কখনই অন্যের উপর বিজয় লাভ করতে পারে না।
আল্লাহ তা‘আলা পরিখাওয়ালাদের প্রসঙ্গে বলেছেন,
قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ، النَّارِ ذَاتِ الْوَقُوْدِ، إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ، وَهُمْ عَلَى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ، وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَن يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْد -
‘ধ্বংস হোক ইন্ধনবিশিষ্ট আগুনের পরিখাওয়ালারা। যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল, আর মুমিনদের সঙ্গে কৃত আচরণ প্রত্যক্ষ করছিল। তাদের একটিই মাত্র অপরাধ ছিল যে, তারা পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল’ (বুরূজ ৮৫/৪-৮)।
পরিখাওয়ালাদের ঘটনা খুবই বিস্ময়কর। যে বিজয়ের আলোচনা আমরা করছি এ দৃষ্টান্ত তারই প্রতিচ্ছবি। মানুষ দলে দলে দ্বীন গ্রহণ করছে কিংবা বিজয়ীর আসনে দ্বীন আসীন হয়েছে- সেটাই যে বিজয় লাভের একমাত্র মাপকাঠি নয়; বরং প্রচারকের মানসিক দৃঢ়তা ও তার প্রোগ্রামের বিজয়ই যে চূড়ান্ত বিজয়, সে কথাই এ ঘটনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। ঘটনার গুরুত্ব হেতু এখানে হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) প্রদত্ত বর্ণনাটি সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরা হ’ল-
ছুহাইব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্বযুগে একজন রাজা ছিল। তার ছিল এক যাদুকর। যাদুকর বুড়ো হয়ে গেলে রাজাকে বলল, আমার বয়সে ভাটা পড়েছে, কখন মরি কে জানে। আপনি একটি বালককে আমার নিকট পাঠিয়ে দিন আমি তাকে যাদু শিখিয়ে দেব। রাজা এক বালককে পাঠাল। এদিকে যাদুকর ও রাজার বাসভবনের মাঝে ছিল এক খৃষ্টান সাধু। বালকটি যাদুকরের নিকট যাদু শেখাকালে একদিন ঐ সাধুর ডেরায় গিয়ে উঠল। সাধুর কথা তার খুব মনে ধরল। ফলে সে প্রায়শ সেখানে আসতে যেতে সাধুর কথা শুনত। ফলে যাদুকরের কাছে যেতে এবং বাড়ি যেতেও তার বিলম্ব হ’ত। এভাবে দেরী হওয়ায় যাদুকর তাকে মার লাগাত আর বলত, কিসে আটকা পড়েছিলে? আবার বাড়িতে গেলেও বাড়ির লোকেরা মারত আর বলত, রোজ রোজ এত দেরী কেন? ফলে সাধুর নিকট সে অভিযোগ করলে তিনি তাকে বলে দিলেন, যাদুকর মারতে চাইলে তুমি বলবে, বাড়ির লোকেরা আমাকে আটকে রেখেছিল। আর বাড়ির লোকেরা মারতে চাইলে বলবে, যাদুকর ঠেকিয়ে রেখেছিল। এভাবে চলতে চলতে একদিন সে দেখতে পেল এক ভয়ঙ্কর জন্তু মানুষের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভয়ে কেউ রাস্তা পার হ’তে পারছে না। তখন সে মনে মনে বলল, আজ আমি জেনে নেব, সাধুর কাজটাই আল্লাহর নিকট প্রিয়, না যাদুকরের? তারপর সে একটা পাথর নিয়ে বলল, হে আল্লাহ! যাদুকরের কাজের তুলনায় যদি সাধুর কাজ আপনার নিকট বেশী প্রিয় ও সন্তোষজনক হয়, তাহ’লে এই জন্তুটাকে হত্যা করে জনগণের যাতায়াতের সুযোগ করে দিন। এই বলে সে পাথরটি ছুঁড়ে মারল, আর অমনি জন্তুটি মারা পড়ল। ফলে লোকদের চলাচল শুরু হ’ল। বিষয়টি সে সাধুকে অবহিত করল। সাধু শুনে বলল, হে বৎস! তুমি আমার থেকেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছ। তোমাকে এ জন্য অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হ’তে হবে। যদি তুমি এমন কোন পরীক্ষায় পড় তাহ’লে আমার ঠিকানা জানিয়ে দিও না।
তারপর থেকে সেই বালক জন্মান্ধ, কুষ্ঠ ও অন্য সব রকম রুগীকে সুস্থ করে তুলতে লাগল। এদিকে রাজার ছিল এক সভাসদ। সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বালকের কথা শুনে সে তার নিকট অনেক উপহার নিয়ে গিয়ে বলল, আপনি আমাকে সুস্থ করে তুলুন। সে বলল, আমি তো কাউকে সুস্থ করতে পারি না, সুস্থ করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তুমি যদি আল্লাহর উপর ঈমান আনতে পার, তাহ’লে আমি আল্লাহর শানে তোমার জন্য দো‘আ করতে পারি। সে ঈমান আনলে বালকটি তার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করে। ফলে সে আরোগ্য লাভ করে। তারপর সে রাজদরবারে গিয়ে আগে যেভাবে আসন গ্রহণ করত সেভাবে আসন গ্রহণ করল। রাজা তাকে দেখে বলল, আরে তুমি কী করে চোখ ফিরে পেলে? সে বলল, আমার প্রভু ফিরিয়ে দিয়েছেন। রাজা বলল, আমি? সে বলল, না। আমার ও আপনার প্রভু যিনি সেই আল্লাহ। এ কথা শুনে রাজা ক্ষেপে গেল এবং কিভাবে এমন ঘটল তা জানার জন্য তার উপর নির্যাতন শুরু করল। অবশেষে সে রাজাকে বালকের সন্ধান দিয়ে দিল।
অতঃপর বালককে ডেকে আনা হ’ল। রাজা তাকে বলল, ‘প্রিয় বৎস! তুমি যাদুতে এত উন্নতি করেছ যে, জন্মান্ধ, কুষ্ঠ ইত্যাদি সকল রোগ ভাল করে দিচ্ছ? সে বলল, আমি কাউকে সুস্থ করতে পারি না; সুস্থ করেন তো আল্লাহ। রাজা বলল, আমি? সে বলল, না। রাজা বলল, তোমার কি আমি ছাড়াও অন্য প্রভু আছে? সে বলল, আমার ও আপনার প্রভু আল্লাহ। রাজা তখন তাকেও শাস্তি দিতে আরম্ভ করলে নিরুপায় হয়ে সে সাধুর কথা বলে দিল। রাজা সাধুকে ধরে এনে বলল, তোমার দ্বীন ত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকার করল। তখন রাজা তার মাথার সিঁথিতে করাত লাগিয়ে দেহ দু’ভাগ করে দিল। অতঃপর অন্ধকে দ্বীন ত্যাগ করতে বলল। কিন্তু সেও অস্বীকার করলে তাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হ’ল। এবার এল বালকের পালা। সে দ্বীন ত্যাগে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে রাজা তাকে কিছু লোকের হাতে দিয়ে একটি পাহাড়ে পাঠিয়ে দিল এবং বলে দিল, ‘যখন তোমরা শৃঙ্গদেশে পৌঁছে যাবে, তখন যদি এই ছেলে তার দ্বীন ত্যাগ করে তো ভাল, নতুবা তাকে সেখান থেকে নীচে গড়িয়ে ফেলে দেবে। তারা তাকে নিয়ে পাহাড় শৃঙ্গে উঠলে সে আল্লাহর নিকট নিবেদন করল, হে আল্লাহ! তোমার যা ইচ্ছে তার বিনিময়ে আমাকে এদের হাত থেকে হেফাযত কর। তখন পাহাড়টি প্রবলবেগে কেঁপে উঠল এবং সাথে সাথে আগত লোকগুলি নীচে গড়িয়ে পড়ে নিহত হ’ল। বালক পথ খোঁজ করতে করতে রাজদরবারে পৌঁছে গেল। রাজা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, তোমার সাথের লোকদের কী হয়েছে? সে বলল, আল্লাহ তাদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছেন।
এবারে রাজা তাকে কিছু লোকের হাওয়ালায় একটি জাহাযে পাঠিয়ে দিল এবং বলে দিল, যখন তোমরা গভীর সমুদ্রে পৌঁছে যাবে তখন সে তার দ্বীন ত্যাগ করলে খুবই ভাল, নতুবা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারবে। তারা তাকে গভীর সমুদ্রে নিয়ে গেল। সে সময় বালকটি এই বলে দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ! তুমি যা দিয়ে ইচ্ছে এদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর’। ফলে তারা সবাই ডুবে মারা গেল। বালক এসে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করল। রাজা তো অবাক। রাজা নিজের লোকদের কথা তাকে জিজ্ঞেস করলে বালক বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
তারপর বালক রাজাকে বলল, আমার আদেশ মত কাজ না করা পর্যন্ত আপনি যতই চেষ্টা করুন আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। রাজা বললেন, সেটা কি? বালক বলল, আপনি একটি প্রান্তরে সব লোক জমায়েত করবেন। তারপর আমাকে শূলে চড়িয়ে আমার তূণীর থেকে একটি তীর নিয়ে ‘বিসমিল্লাহি রবিবল গুলামি’ (এই বালকের প্রভু আল্লাহর নামে) বলে নিজে তীর ছুঁড়লেই কেবল আমাকে হত্যা করতে পারবেন। রাজা তাই করলেন এবং ধনুকে তীর জুড়ে উক্ত বাক্য বলে ছুঁড়ে মারল। তীর গিয়ে বালকের কানপট্টিতে লাগল। বালকটি তখন তীরবিদ্ধ স্থানে হাত দিয়ে মারা গেল। এ ঘটনা দেখে সমবেত জনতা বলে উঠল, ‘আমরা এই বালকের রবের প্রতি ঈমান আনলাম’।
রাজাকে তখন বলা হ’ল, আপনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই তো ঘটে গেল। সব লোকই ঈমানদার হয়ে গেল। এ কথা শুনে রাজা গলির মুখ বন্ধ করে দিতে আদেশ দিলেন, যেন কোন লোক বাইরে যেতে না পারে এবং সেখানে অনেকগুলি পরিখা খননের আদেশ দিলেন। পরিখাগুলিতে আগুন উত্তপ্ত করা হ’ল। অতঃপর রাজা আদেশ দিলেন, যে ব্যক্তি বালকের দ্বীন ত্যাগ করবে তাকে তোমরা রেহাই দিবে, কিন্তু যারা তা করবে না তাদের সবাইকে আগুনে ফেলে হত্যা করবে। এমতাবস্থায় ঈমানদাররা দৌড়াদৌড়ি শুরু করল এবং একে অপরকে আগুনে পড়া থেকে ঠেকাতে লাগল। এ সময় এক মহিলাকে তার দুগ্ধপোষ্য শিশু সমেত হাযির করা হ’ল। মনে হচ্ছিল যেন সে আগুনে পড়া থেকে পিছিয়ে আসতে চাচ্ছে। তখন শিশুটি বলে উঠল, ‘মা তুমি ধৈর্য ধর, কেননা তুমি হক্বের উপর আছ’।
এই হ’ল পরিখাওয়ালাদের লম্বা ঘটনা। এই ঘটনাকে ঘিরে বিজয়ের যে হাক্বীক্বত সাইয়েদ কুতুব (রহঃ) বর্ণনা করেছেন তা খুবই হৃদয়গ্রাহী। এ জন্য প্রথমে এতদসম্পর্কে তাঁর কথা সংক্ষেপে তুলে ধরা হ’ল:
পার্থিব বিচারে এখানে ঈমানের উপর তাগূত্বী শক্তি তথা স্বৈরাচারের বিজয় ফুটে উঠেছে। সৎ, নম্র, দৃঢ়চেতা ও বিজয়ী একটি ক্ষুদ্র দলের অন্তরে যে ঈমান এতটা বুলন্দ পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছিল, ঈমান ও কুফরের মাঝে সংঘটিত লড়াইয়ে তার কোন মূল্যই হয়নি। এ ঈমান কোন হিসাবেও আসে না। তাই পার্থিব হিসাবে এ ঘটনার শেষ পরিণতি আমাদের জন্য আফসোস ও বেদনাই বয়ে আনে। পার্থিব হিসাব মানুষের মনে এই বেদনাবিধুর পরিণতি সম্পর্কে যা-ই ভাবিয়ে তুলুক না কেন, কুরআন কিন্তু মুমিনদেরকে অন্য শিক্ষা দেয়; উন্মোচিত করে আরেক রহস্য।
নিশ্চয়ই জীবন এবং জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা স্বাদ-আহ্লাদ, দুঃখ-বেদনা, ভোগ ও বঞ্চনাই হিসাবের খাতায় বড় মূল্যবান বস্ত্ত নয় এবং তা এমন কোন পণ্যও নয় যা দিয়ে লাভ-লোকসান নির্ণিত হয়। আর বাহ্যিক বিজয়ের মধ্যেই সকল প্রকার জয় সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা নানা প্রকার জয়ের একটি।
সকল মানুষই মরণশীল, তবে প্রত্যেকের মৃত্যুর উপলক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সব লোকের ভাগ্যে উল্লিখিত ঈমানদারদের ন্যায় বিজয় জোটে না। সবাই ঈমানের এতটা উচ্চ শিখরে উঠতে পারে না। এতখানি অকুতোভয় ও স্বাধীনতা প্রদর্শন সবার কপালে জোটে না এবং সাহসের এতখানি উচ্চ স্তরে বিচরণ করার সৌভাগ্যও সকলের হয় না।
আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর অপার অনুগ্রহে একদল মানুষকে বাছাই করে নেন, যারা অন্যান্য মানুষের মতই মৃত্যুবরণ করে কিন্তু তাদের মৃত্যুর উপলক্ষ হয় অনেক সম্মানজনক। বহু লোকই এই সৌভাগ্যের নাগাল পায় না। ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাই এই মানুষগুলির নাম যুগ যুগ ধরে ভাস্বর হয়ে আছে।
এই মুমিনগণ দ্বীন-ঈমান ত্যাগ করে তাঁদের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তাতে তারা নিজেদের কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করতেন, আর সমগ্র মানবতা তাতে কতখানি ভূলুণ্ঠিত হ’ত তা কি পরিমাপ করা যেত? বিশ্বাসশূন্য জীবন অর্থহীন। বিশ্বাসের স্বাধীনতা বিহনে জীবন হয়ে পড়ে বিশ্বাদ। যালিম শাসকগোষ্ঠী দেহের উপর অত্যাচার চালিয়ে আত্মার উপরও শাসনদন্ড স্থাপন করতে পারলে মানবতার ক্ষতির আর কিইবা বাকী থাকে।
وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَن يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ ‘পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর উপর বিশ্বাসই তো ওদের দৃষ্টিতে তাদের একমাত্র অপরাধ’ (বুরূজ ৮৫/৮)।
এ এক জ্বলন্ত সত্য। আল্লাহর পথে আহবানকারী সকল দেশের সকল প্রজন্মের মুমিনদের এই সত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মূলতঃ মুমিন ও তাদের বিরুদ্ধ পক্ষের সংঘর্ষ উক্ত বিশ্বাসকে ঘিরেই, অন্য কিছুকে কেন্দ্র করে নয়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে শক্তি তাওহীদে বিশ্বাসকেই তাদের একমাত্র অপরাধ গণ্য করে। এই তাওহীদী আক্বীদাই তাদের ক্ষোভের অন্যতম কারণ।
সাইয়িদ কুতুবের এই সমীক্ষা উল্লেখের পর কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হ’ল:
(১) সাধু ও অন্ধের দৃঢ়তা :
অন্ধ লোকটি তার ঈমানকে বিজয়ী করার মুকাবেলায় জীবনের সকল স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন। সাধু লোকটিও আক্বীদা ও কুফরের সংঘর্ষে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি জীবনকে খুইয়ে বিনিময়ে ঈমান হেফাযত করেছেন। অন্ধ লোকটির জীবনে ঐ সামান্য সময়ে দু’বার বিজয় দেখা দিয়েছিল। (এক) রাজার নিকট তার যে পদমর্যাদা ছিল তা পরিত্যাগ করার সময়। এই পদমর্যাদা এক সময় তাকে অনেক প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকারী করেছিল। (দুই) বিশ্বাস রক্ষার্থে যখন সে জীবন বিসর্জন দিয়েছিল।
সাধু ও অন্ধ দু’জনেই আমাদের সামনে প্রকৃত বিজয়ের এক মহতী অর্থ স্থায়ীভাবে রেখে গেছেন। তারা এমনটা করেছেন কেবল দ্বীনের স্বার্থে। শাসকগোষ্ঠী যদি সত্যবাদী হ’ত তাহ’লে অবশ্যই জানতে পারত যে, দ্বীনের বিজয় মানে তাদের ঠিক সে কাজই করতে হবে যা সাধু ও অন্ধ লোকটি করেছে।
(২) বালকের বিস্ময়কর ভূমিকা :
বালকটি কেন রাজাকে তার হত্যার পন্থা বাতলে দিল? আর কেনইবা রাজার হাত থেকে আল্লাহর অনুগ্রহে বারবার রক্ষা পাওয়ার পরও সে তার প্রতিপালকের বাণী মানুষের মাঝে প্রচার এবং সত্য ধর্মের পথ নির্দেশ করতে জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিল না? এ এক বিরাট প্রশ্ন, যা মানুষের মনে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যারা বিজয়ের হাক্বীক্বত বুঝেনি তাদের মনে। আসলে বালকটি আল্লাহর রহমতে বুঝতে পেরেছিল যে, ‘সময়ের এক কথা এমন কিছু করতে পারে, যা অসময়ে কথিত হাযার কথা দিয়ে যুগ যুগ ধরেও করা সম্ভব নয়’।
(৩) জীবন নানা ঘাটের সমষ্টি :
জীবনে নানা ঘাট ও বাঁক ফিরে ফিরে আসে। এখানে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী তা ফায়ছালা হয়ে যায়। কখনও এমন সুযোগ এসে যায় যাকে হাতছাড়া কিংবা নষ্ট করে সাফাই গাওয়া ঠিক হয় না। প্রবাদ আছে- ‘যখন তোমার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে গ্রহণ কর’। এই বালকের সুবাসও ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সুবাস তার প্রতিপালকের বাণী প্রচার ব্যতীত আর কিছু নয়। জীবনের এই বাঁকে এসে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। সে যদি পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর রাহে জীবন দিতে কুণ্ঠিত হ’ত তাহ’লে কি তার জীবনের এত মূল্য হ’ত?
(৪) বোধশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও আক্বীদার বিজয় :
বোধশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও বিশ্বাস যখন ব্যক্তির মনে একটি প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি ও সত্য জীবন হিসাবে পরিবর্তিত হয়, তখন এগুলির বিজয় অর্জিত হয়। জীবনের কোন পাদটীকা বা এলোমেলো আচরণ ও চিন্তা থেকে এরূপ শক্তি জন্মে না। বালকটির ক্ষেত্রে দেখা যায় সে প্রায় ক্ষেত্রে একাধিকবার উক্ত শক্তিতে বলীয়ান হয়েছে।
সে তার বোধ ও বিচার শক্তির বদৌলতে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ে ও নিরাপদ উপায়ে তার দ্বীন ও আক্বীদাকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তার জাতি ও সমাজকে কুফরির অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোয় নিয়ে আসতে পেরেছিল।
সে তার আত্মিক ক্ষমতাবলে জীবনের সকল চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, কামনা-বাসনা, ভোগ-বিলাস ও যাবতীয় পার্থিব সম্পদের লালসার ঊর্ধ্বে উঠে উপযুক্ত সময়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।
সে ঐ মূর্খ রাজার উপর জয়যুক্ত হয়েছিল, আল্লাহ তা‘আলা যার বিবেক-বুদ্ধিকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে স্বহস্তে সে নিজের রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল। বস্ত্তত: চোখ অন্ধ হয়ে যায় না; বরং অন্ধ হয় অন্তর, যা বক্ষের মাঝে বাস করে।
লোকে অবাক মনে ভাবে- বালকটি কেন রাজাকে তার হত্যার উপায় বাতলে দিল। কিন্তু তারা ভাবে না যে, এর ফলে রাজা নিজ হাতে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে। সুতরাং অবাক মানতে হ’লে কোনটি সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত? বালকটি কী ঘটতে যাচ্ছে তার রহস্য সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকেও সাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু রাজাকে রাজ্যের নেশা ও ক্ষমতার মত্ততা অন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে সে ঐ সিদ্ধান্তকারী সংঘর্ষে বালকের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিল। তাতে মারা গিয়েছিল একজন কিন্তু বেঁচে গিয়েছিল পুরো একটি জাতি।
বালকটি মনে মনে যে ধ্যান ও কামনা করত এবং যে জন্য সে জীবন উৎসর্গ করেছিল তা বাস্তবায়িত হওয়ার মাধ্যমে সে জয়যুক্ত হয়েছিল। তার এই মহান আত্মত্যাগের ফলে লোকেরা ঈমান এনেছিল। তারা বলেছিল, اَمَنَّا بِاللهِ رَبِّ الغُلاَمِ، ‘আমরা এই বালকের রব আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম’। নিশ্চয়ই কাজের সূক্ষ্ম নকশা প্রণয়ন, পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং পরিকল্পনার ত্রুটিহীনতা সুস্পষ্ট সফলতা ও প্রকাশ্য বিজয় বলেই গণ্য হয়।
আল্লাহর পথে শাহাদাত লাভের মাধ্যমেও বালক বিজয় লাভ করেছিল। মানুষ তো সবাই মরণশীল, কিন্তু শাহাদাতের সৌভাগ্য জোটে কম লোকেরই।
পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা বালকের নাম স্থায়ীভাবে খুদাই করে দিয়েছেন। তার কথা মুমিনদের মুখে মুখে ফেরে। পরবর্তী প্রজন্ম হামেশাই তার সুখ্যাতি করছে। এটাও বালকের মহান বিজয়।
قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ، النَّارِ ذَاتِ الْوَقُوْدِ، إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ، وَهُمْ عَلَى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ، وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَن يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْد -
‘ধ্বংস হোক ইন্ধনবিশিষ্ট আগুনের পরিখাওয়ালারা। যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল, আর মুমিনদের সঙ্গে কৃত আচরণ প্রত্যক্ষ করছিল। তাদের একটিই মাত্র অপরাধ ছিল যে, তারা পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল’ (বুরূজ ৮৫/৪-৮)।
পরিখাওয়ালাদের ঘটনা খুবই বিস্ময়কর। যে বিজয়ের আলোচনা আমরা করছি এ দৃষ্টান্ত তারই প্রতিচ্ছবি। মানুষ দলে দলে দ্বীন গ্রহণ করছে কিংবা বিজয়ীর আসনে দ্বীন আসীন হয়েছে- সেটাই যে বিজয় লাভের একমাত্র মাপকাঠি নয়; বরং প্রচারকের মানসিক দৃঢ়তা ও তার প্রোগ্রামের বিজয়ই যে চূড়ান্ত বিজয়, সে কথাই এ ঘটনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। ঘটনার গুরুত্ব হেতু এখানে হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) প্রদত্ত বর্ণনাটি সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরা হ’ল-
ছুহাইব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্বযুগে একজন রাজা ছিল। তার ছিল এক যাদুকর। যাদুকর বুড়ো হয়ে গেলে রাজাকে বলল, আমার বয়সে ভাটা পড়েছে, কখন মরি কে জানে। আপনি একটি বালককে আমার নিকট পাঠিয়ে দিন আমি তাকে যাদু শিখিয়ে দেব। রাজা এক বালককে পাঠাল। এদিকে যাদুকর ও রাজার বাসভবনের মাঝে ছিল এক খৃষ্টান সাধু। বালকটি যাদুকরের নিকট যাদু শেখাকালে একদিন ঐ সাধুর ডেরায় গিয়ে উঠল। সাধুর কথা তার খুব মনে ধরল। ফলে সে প্রায়শ সেখানে আসতে যেতে সাধুর কথা শুনত। ফলে যাদুকরের কাছে যেতে এবং বাড়ি যেতেও তার বিলম্ব হ’ত। এভাবে দেরী হওয়ায় যাদুকর তাকে মার লাগাত আর বলত, কিসে আটকা পড়েছিলে? আবার বাড়িতে গেলেও বাড়ির লোকেরা মারত আর বলত, রোজ রোজ এত দেরী কেন? ফলে সাধুর নিকট সে অভিযোগ করলে তিনি তাকে বলে দিলেন, যাদুকর মারতে চাইলে তুমি বলবে, বাড়ির লোকেরা আমাকে আটকে রেখেছিল। আর বাড়ির লোকেরা মারতে চাইলে বলবে, যাদুকর ঠেকিয়ে রেখেছিল। এভাবে চলতে চলতে একদিন সে দেখতে পেল এক ভয়ঙ্কর জন্তু মানুষের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভয়ে কেউ রাস্তা পার হ’তে পারছে না। তখন সে মনে মনে বলল, আজ আমি জেনে নেব, সাধুর কাজটাই আল্লাহর নিকট প্রিয়, না যাদুকরের? তারপর সে একটা পাথর নিয়ে বলল, হে আল্লাহ! যাদুকরের কাজের তুলনায় যদি সাধুর কাজ আপনার নিকট বেশী প্রিয় ও সন্তোষজনক হয়, তাহ’লে এই জন্তুটাকে হত্যা করে জনগণের যাতায়াতের সুযোগ করে দিন। এই বলে সে পাথরটি ছুঁড়ে মারল, আর অমনি জন্তুটি মারা পড়ল। ফলে লোকদের চলাচল শুরু হ’ল। বিষয়টি সে সাধুকে অবহিত করল। সাধু শুনে বলল, হে বৎস! তুমি আমার থেকেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছ। তোমাকে এ জন্য অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হ’তে হবে। যদি তুমি এমন কোন পরীক্ষায় পড় তাহ’লে আমার ঠিকানা জানিয়ে দিও না।
তারপর থেকে সেই বালক জন্মান্ধ, কুষ্ঠ ও অন্য সব রকম রুগীকে সুস্থ করে তুলতে লাগল। এদিকে রাজার ছিল এক সভাসদ। সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বালকের কথা শুনে সে তার নিকট অনেক উপহার নিয়ে গিয়ে বলল, আপনি আমাকে সুস্থ করে তুলুন। সে বলল, আমি তো কাউকে সুস্থ করতে পারি না, সুস্থ করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তুমি যদি আল্লাহর উপর ঈমান আনতে পার, তাহ’লে আমি আল্লাহর শানে তোমার জন্য দো‘আ করতে পারি। সে ঈমান আনলে বালকটি তার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করে। ফলে সে আরোগ্য লাভ করে। তারপর সে রাজদরবারে গিয়ে আগে যেভাবে আসন গ্রহণ করত সেভাবে আসন গ্রহণ করল। রাজা তাকে দেখে বলল, আরে তুমি কী করে চোখ ফিরে পেলে? সে বলল, আমার প্রভু ফিরিয়ে দিয়েছেন। রাজা বলল, আমি? সে বলল, না। আমার ও আপনার প্রভু যিনি সেই আল্লাহ। এ কথা শুনে রাজা ক্ষেপে গেল এবং কিভাবে এমন ঘটল তা জানার জন্য তার উপর নির্যাতন শুরু করল। অবশেষে সে রাজাকে বালকের সন্ধান দিয়ে দিল।
অতঃপর বালককে ডেকে আনা হ’ল। রাজা তাকে বলল, ‘প্রিয় বৎস! তুমি যাদুতে এত উন্নতি করেছ যে, জন্মান্ধ, কুষ্ঠ ইত্যাদি সকল রোগ ভাল করে দিচ্ছ? সে বলল, আমি কাউকে সুস্থ করতে পারি না; সুস্থ করেন তো আল্লাহ। রাজা বলল, আমি? সে বলল, না। রাজা বলল, তোমার কি আমি ছাড়াও অন্য প্রভু আছে? সে বলল, আমার ও আপনার প্রভু আল্লাহ। রাজা তখন তাকেও শাস্তি দিতে আরম্ভ করলে নিরুপায় হয়ে সে সাধুর কথা বলে দিল। রাজা সাধুকে ধরে এনে বলল, তোমার দ্বীন ত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকার করল। তখন রাজা তার মাথার সিঁথিতে করাত লাগিয়ে দেহ দু’ভাগ করে দিল। অতঃপর অন্ধকে দ্বীন ত্যাগ করতে বলল। কিন্তু সেও অস্বীকার করলে তাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হ’ল। এবার এল বালকের পালা। সে দ্বীন ত্যাগে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে রাজা তাকে কিছু লোকের হাতে দিয়ে একটি পাহাড়ে পাঠিয়ে দিল এবং বলে দিল, ‘যখন তোমরা শৃঙ্গদেশে পৌঁছে যাবে, তখন যদি এই ছেলে তার দ্বীন ত্যাগ করে তো ভাল, নতুবা তাকে সেখান থেকে নীচে গড়িয়ে ফেলে দেবে। তারা তাকে নিয়ে পাহাড় শৃঙ্গে উঠলে সে আল্লাহর নিকট নিবেদন করল, হে আল্লাহ! তোমার যা ইচ্ছে তার বিনিময়ে আমাকে এদের হাত থেকে হেফাযত কর। তখন পাহাড়টি প্রবলবেগে কেঁপে উঠল এবং সাথে সাথে আগত লোকগুলি নীচে গড়িয়ে পড়ে নিহত হ’ল। বালক পথ খোঁজ করতে করতে রাজদরবারে পৌঁছে গেল। রাজা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, তোমার সাথের লোকদের কী হয়েছে? সে বলল, আল্লাহ তাদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছেন।
এবারে রাজা তাকে কিছু লোকের হাওয়ালায় একটি জাহাযে পাঠিয়ে দিল এবং বলে দিল, যখন তোমরা গভীর সমুদ্রে পৌঁছে যাবে তখন সে তার দ্বীন ত্যাগ করলে খুবই ভাল, নতুবা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারবে। তারা তাকে গভীর সমুদ্রে নিয়ে গেল। সে সময় বালকটি এই বলে দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ! তুমি যা দিয়ে ইচ্ছে এদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর’। ফলে তারা সবাই ডুবে মারা গেল। বালক এসে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করল। রাজা তো অবাক। রাজা নিজের লোকদের কথা তাকে জিজ্ঞেস করলে বালক বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
তারপর বালক রাজাকে বলল, আমার আদেশ মত কাজ না করা পর্যন্ত আপনি যতই চেষ্টা করুন আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। রাজা বললেন, সেটা কি? বালক বলল, আপনি একটি প্রান্তরে সব লোক জমায়েত করবেন। তারপর আমাকে শূলে চড়িয়ে আমার তূণীর থেকে একটি তীর নিয়ে ‘বিসমিল্লাহি রবিবল গুলামি’ (এই বালকের প্রভু আল্লাহর নামে) বলে নিজে তীর ছুঁড়লেই কেবল আমাকে হত্যা করতে পারবেন। রাজা তাই করলেন এবং ধনুকে তীর জুড়ে উক্ত বাক্য বলে ছুঁড়ে মারল। তীর গিয়ে বালকের কানপট্টিতে লাগল। বালকটি তখন তীরবিদ্ধ স্থানে হাত দিয়ে মারা গেল। এ ঘটনা দেখে সমবেত জনতা বলে উঠল, ‘আমরা এই বালকের রবের প্রতি ঈমান আনলাম’।
রাজাকে তখন বলা হ’ল, আপনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই তো ঘটে গেল। সব লোকই ঈমানদার হয়ে গেল। এ কথা শুনে রাজা গলির মুখ বন্ধ করে দিতে আদেশ দিলেন, যেন কোন লোক বাইরে যেতে না পারে এবং সেখানে অনেকগুলি পরিখা খননের আদেশ দিলেন। পরিখাগুলিতে আগুন উত্তপ্ত করা হ’ল। অতঃপর রাজা আদেশ দিলেন, যে ব্যক্তি বালকের দ্বীন ত্যাগ করবে তাকে তোমরা রেহাই দিবে, কিন্তু যারা তা করবে না তাদের সবাইকে আগুনে ফেলে হত্যা করবে। এমতাবস্থায় ঈমানদাররা দৌড়াদৌড়ি শুরু করল এবং একে অপরকে আগুনে পড়া থেকে ঠেকাতে লাগল। এ সময় এক মহিলাকে তার দুগ্ধপোষ্য শিশু সমেত হাযির করা হ’ল। মনে হচ্ছিল যেন সে আগুনে পড়া থেকে পিছিয়ে আসতে চাচ্ছে। তখন শিশুটি বলে উঠল, ‘মা তুমি ধৈর্য ধর, কেননা তুমি হক্বের উপর আছ’।
এই হ’ল পরিখাওয়ালাদের লম্বা ঘটনা। এই ঘটনাকে ঘিরে বিজয়ের যে হাক্বীক্বত সাইয়েদ কুতুব (রহঃ) বর্ণনা করেছেন তা খুবই হৃদয়গ্রাহী। এ জন্য প্রথমে এতদসম্পর্কে তাঁর কথা সংক্ষেপে তুলে ধরা হ’ল:
পার্থিব বিচারে এখানে ঈমানের উপর তাগূত্বী শক্তি তথা স্বৈরাচারের বিজয় ফুটে উঠেছে। সৎ, নম্র, দৃঢ়চেতা ও বিজয়ী একটি ক্ষুদ্র দলের অন্তরে যে ঈমান এতটা বুলন্দ পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছিল, ঈমান ও কুফরের মাঝে সংঘটিত লড়াইয়ে তার কোন মূল্যই হয়নি। এ ঈমান কোন হিসাবেও আসে না। তাই পার্থিব হিসাবে এ ঘটনার শেষ পরিণতি আমাদের জন্য আফসোস ও বেদনাই বয়ে আনে। পার্থিব হিসাব মানুষের মনে এই বেদনাবিধুর পরিণতি সম্পর্কে যা-ই ভাবিয়ে তুলুক না কেন, কুরআন কিন্তু মুমিনদেরকে অন্য শিক্ষা দেয়; উন্মোচিত করে আরেক রহস্য।
নিশ্চয়ই জীবন এবং জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা স্বাদ-আহ্লাদ, দুঃখ-বেদনা, ভোগ ও বঞ্চনাই হিসাবের খাতায় বড় মূল্যবান বস্ত্ত নয় এবং তা এমন কোন পণ্যও নয় যা দিয়ে লাভ-লোকসান নির্ণিত হয়। আর বাহ্যিক বিজয়ের মধ্যেই সকল প্রকার জয় সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা নানা প্রকার জয়ের একটি।
সকল মানুষই মরণশীল, তবে প্রত্যেকের মৃত্যুর উপলক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সব লোকের ভাগ্যে উল্লিখিত ঈমানদারদের ন্যায় বিজয় জোটে না। সবাই ঈমানের এতটা উচ্চ শিখরে উঠতে পারে না। এতখানি অকুতোভয় ও স্বাধীনতা প্রদর্শন সবার কপালে জোটে না এবং সাহসের এতখানি উচ্চ স্তরে বিচরণ করার সৌভাগ্যও সকলের হয় না।
আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর অপার অনুগ্রহে একদল মানুষকে বাছাই করে নেন, যারা অন্যান্য মানুষের মতই মৃত্যুবরণ করে কিন্তু তাদের মৃত্যুর উপলক্ষ হয় অনেক সম্মানজনক। বহু লোকই এই সৌভাগ্যের নাগাল পায় না। ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাই এই মানুষগুলির নাম যুগ যুগ ধরে ভাস্বর হয়ে আছে।
এই মুমিনগণ দ্বীন-ঈমান ত্যাগ করে তাঁদের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তাতে তারা নিজেদের কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করতেন, আর সমগ্র মানবতা তাতে কতখানি ভূলুণ্ঠিত হ’ত তা কি পরিমাপ করা যেত? বিশ্বাসশূন্য জীবন অর্থহীন। বিশ্বাসের স্বাধীনতা বিহনে জীবন হয়ে পড়ে বিশ্বাদ। যালিম শাসকগোষ্ঠী দেহের উপর অত্যাচার চালিয়ে আত্মার উপরও শাসনদন্ড স্থাপন করতে পারলে মানবতার ক্ষতির আর কিইবা বাকী থাকে।
وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَن يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ ‘পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর উপর বিশ্বাসই তো ওদের দৃষ্টিতে তাদের একমাত্র অপরাধ’ (বুরূজ ৮৫/৮)।
এ এক জ্বলন্ত সত্য। আল্লাহর পথে আহবানকারী সকল দেশের সকল প্রজন্মের মুমিনদের এই সত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মূলতঃ মুমিন ও তাদের বিরুদ্ধ পক্ষের সংঘর্ষ উক্ত বিশ্বাসকে ঘিরেই, অন্য কিছুকে কেন্দ্র করে নয়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে শক্তি তাওহীদে বিশ্বাসকেই তাদের একমাত্র অপরাধ গণ্য করে। এই তাওহীদী আক্বীদাই তাদের ক্ষোভের অন্যতম কারণ।
সাইয়িদ কুতুবের এই সমীক্ষা উল্লেখের পর কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হ’ল:
(১) সাধু ও অন্ধের দৃঢ়তা :
অন্ধ লোকটি তার ঈমানকে বিজয়ী করার মুকাবেলায় জীবনের সকল স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন। সাধু লোকটিও আক্বীদা ও কুফরের সংঘর্ষে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি জীবনকে খুইয়ে বিনিময়ে ঈমান হেফাযত করেছেন। অন্ধ লোকটির জীবনে ঐ সামান্য সময়ে দু’বার বিজয় দেখা দিয়েছিল। (এক) রাজার নিকট তার যে পদমর্যাদা ছিল তা পরিত্যাগ করার সময়। এই পদমর্যাদা এক সময় তাকে অনেক প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকারী করেছিল। (দুই) বিশ্বাস রক্ষার্থে যখন সে জীবন বিসর্জন দিয়েছিল।
সাধু ও অন্ধ দু’জনেই আমাদের সামনে প্রকৃত বিজয়ের এক মহতী অর্থ স্থায়ীভাবে রেখে গেছেন। তারা এমনটা করেছেন কেবল দ্বীনের স্বার্থে। শাসকগোষ্ঠী যদি সত্যবাদী হ’ত তাহ’লে অবশ্যই জানতে পারত যে, দ্বীনের বিজয় মানে তাদের ঠিক সে কাজই করতে হবে যা সাধু ও অন্ধ লোকটি করেছে।
(২) বালকের বিস্ময়কর ভূমিকা :
বালকটি কেন রাজাকে তার হত্যার পন্থা বাতলে দিল? আর কেনইবা রাজার হাত থেকে আল্লাহর অনুগ্রহে বারবার রক্ষা পাওয়ার পরও সে তার প্রতিপালকের বাণী মানুষের মাঝে প্রচার এবং সত্য ধর্মের পথ নির্দেশ করতে জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিল না? এ এক বিরাট প্রশ্ন, যা মানুষের মনে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যারা বিজয়ের হাক্বীক্বত বুঝেনি তাদের মনে। আসলে বালকটি আল্লাহর রহমতে বুঝতে পেরেছিল যে, ‘সময়ের এক কথা এমন কিছু করতে পারে, যা অসময়ে কথিত হাযার কথা দিয়ে যুগ যুগ ধরেও করা সম্ভব নয়’।
(৩) জীবন নানা ঘাটের সমষ্টি :
জীবনে নানা ঘাট ও বাঁক ফিরে ফিরে আসে। এখানে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী তা ফায়ছালা হয়ে যায়। কখনও এমন সুযোগ এসে যায় যাকে হাতছাড়া কিংবা নষ্ট করে সাফাই গাওয়া ঠিক হয় না। প্রবাদ আছে- ‘যখন তোমার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে গ্রহণ কর’। এই বালকের সুবাসও ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সুবাস তার প্রতিপালকের বাণী প্রচার ব্যতীত আর কিছু নয়। জীবনের এই বাঁকে এসে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। সে যদি পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর রাহে জীবন দিতে কুণ্ঠিত হ’ত তাহ’লে কি তার জীবনের এত মূল্য হ’ত?
(৪) বোধশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও আক্বীদার বিজয় :
বোধশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও বিশ্বাস যখন ব্যক্তির মনে একটি প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি ও সত্য জীবন হিসাবে পরিবর্তিত হয়, তখন এগুলির বিজয় অর্জিত হয়। জীবনের কোন পাদটীকা বা এলোমেলো আচরণ ও চিন্তা থেকে এরূপ শক্তি জন্মে না। বালকটির ক্ষেত্রে দেখা যায় সে প্রায় ক্ষেত্রে একাধিকবার উক্ত শক্তিতে বলীয়ান হয়েছে।
সে তার বোধ ও বিচার শক্তির বদৌলতে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ে ও নিরাপদ উপায়ে তার দ্বীন ও আক্বীদাকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তার জাতি ও সমাজকে কুফরির অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোয় নিয়ে আসতে পেরেছিল।
সে তার আত্মিক ক্ষমতাবলে জীবনের সকল চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, কামনা-বাসনা, ভোগ-বিলাস ও যাবতীয় পার্থিব সম্পদের লালসার ঊর্ধ্বে উঠে উপযুক্ত সময়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।
সে ঐ মূর্খ রাজার উপর জয়যুক্ত হয়েছিল, আল্লাহ তা‘আলা যার বিবেক-বুদ্ধিকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে স্বহস্তে সে নিজের রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল। বস্ত্তত: চোখ অন্ধ হয়ে যায় না; বরং অন্ধ হয় অন্তর, যা বক্ষের মাঝে বাস করে।
লোকে অবাক মনে ভাবে- বালকটি কেন রাজাকে তার হত্যার উপায় বাতলে দিল। কিন্তু তারা ভাবে না যে, এর ফলে রাজা নিজ হাতে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে। সুতরাং অবাক মানতে হ’লে কোনটি সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত? বালকটি কী ঘটতে যাচ্ছে তার রহস্য সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকেও সাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু রাজাকে রাজ্যের নেশা ও ক্ষমতার মত্ততা অন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে সে ঐ সিদ্ধান্তকারী সংঘর্ষে বালকের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিল। তাতে মারা গিয়েছিল একজন কিন্তু বেঁচে গিয়েছিল পুরো একটি জাতি।
বালকটি মনে মনে যে ধ্যান ও কামনা করত এবং যে জন্য সে জীবন উৎসর্গ করেছিল তা বাস্তবায়িত হওয়ার মাধ্যমে সে জয়যুক্ত হয়েছিল। তার এই মহান আত্মত্যাগের ফলে লোকেরা ঈমান এনেছিল। তারা বলেছিল, اَمَنَّا بِاللهِ رَبِّ الغُلاَمِ، ‘আমরা এই বালকের রব আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম’। নিশ্চয়ই কাজের সূক্ষ্ম নকশা প্রণয়ন, পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং পরিকল্পনার ত্রুটিহীনতা সুস্পষ্ট সফলতা ও প্রকাশ্য বিজয় বলেই গণ্য হয়।
আল্লাহর পথে শাহাদাত লাভের মাধ্যমেও বালক বিজয় লাভ করেছিল। মানুষ তো সবাই মরণশীল, কিন্তু শাহাদাতের সৌভাগ্য জোটে কম লোকেরই।
পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা বালকের নাম স্থায়ীভাবে খুদাই করে দিয়েছেন। তার কথা মুমিনদের মুখে মুখে ফেরে। পরবর্তী প্রজন্ম হামেশাই তার সুখ্যাতি করছে। এটাও বালকের মহান বিজয়।
ঘটনার চূড়ান্ত রূপ ধরা পড়েছে বালকের মৃত্যুর পরক্ষণে তার প্রভুর উপর জনগণের ঈমান আনয়নে। তারা এক আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল এবং ত্বাগূতকে অস্বীকার করেছিল। আর তখনই রাজার পাগলামি স্ব-রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সে হয়ে পড়েছিল দিশেহারা। ফলে সে তার দোর্দন্ডপ্রতাপ বজায় রাখতে এবং মানুষকে তার দাসানুদাসে পরিণত করতে ভয়ভীতি প্রদর্শনের সকল পন্থাই অবলম্বন করেছিল। কিন্তু কোনটাতেই কিছু না হওয়ায় সে অনেকগুলি পরিখা খনন করে তাতে আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছিল এবং নিজের জল্লাদ বাহিনীকে মুমিনদের ধরে ধরে আগুনে নিক্ষেপ করতে আদেশ দিয়েছিল। কাউকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ করে আগুনের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। বর্ণনায় এমন কিছু পাওয়া যায় না যে, এতসব ভীতিকর ব্যবস্থা সত্ত্বেও একজন মানুষ দ্বীন থেকে ফিরে গিয়েছিল কিংবা কাপুরুষতা দেখিয়েছিল। বরং তাঁদের মাঝে সাহসিকতা ও বাহাদুরীর বহিঃপ্রকাশই আমরা দেখতে পাই'। তাঁরা জড়াজড়ি করে আগুনের পানে এগিয়ে গেছে। বালকটি যেন তাদের মাঝে বীরত্ব ও দৃঢ়তার বীজ বপন করে গিয়েছিল। তাই তারা সেই দুরন্ত পথিকের সাথে মিলিত হ’তে এক পায়ে খাড়া হয়েছিল। যেন তারা দ্বীন রক্ষার্থে তাদের জীবন উৎসর্গ করতে খুব মজা পাচ্ছিল। আসলেই তো এ নশ্বর দেহ বিনাশী কিন্তু আত্মা অবিনাশী অমর। আল্লাহ বলেন,
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُواْ فِيْ سَبِيْلِ اللّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ -
‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদের তোমরা মোটেও মৃত মনে করো না। বরং তারা জীবিত, তাদের প্রভুর নিকট থেকে তার জীবিকা প্রাপ্ত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)। কবি বলেন,
مَنْ لَّمْ يَمُتْ بِالسَّيْفِ مَاتَ بِغَيْرِهِ + تَنَوَّعَتِ الْأَسْبَابُ وَالْمَوْتُ وَاحِدٌ -
‘তলোয়ারে মৃত্যু না হ’লে তব ভিন্ন পথে মরণ হবেই হবে,
কারণ যতই বিভিন্ন হোক মৃত্যু তোমার একই রবে’।
এই ঘটনার বর্ণনায় একটি অনন্য অবস্থার উল্লেখ রয়েছে। এক দুগ্ধবতী মা তার দুগ্ধপোষ্য শিশুর জন্য আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্তত করছিল। কিন্তু সে জানত না যে, শুধু দুধ পান করানো নয়, বরং সাথে সাথে সে শিশুটিকে ঈমান, বীরত্ব ও সাহসিকতাও পান করিয়ে চলেছিল। ফলে ঐ শিশুই তাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করল। তাই সে দৃপ্তপদে আগুনের পানে এগিয়ে গেল।
এ কোন্ সে উম্মাত, আর কোন্ সে জাতি? এরা তো তারাই, যারা দীর্ঘকাল ধরে কুফর ও শিরকের অন্ধকারে কাটিয়েছে। বছরের পর বছর ঐ রাজা তাদেরকে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছিল। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে যেই তারা ঈমানের পরিচয় পেল অমনি সঠিক কর্মনীতি কোনটা তা বুঝে ফেলল। যেন তারা ঈমানের পথে ঐ সাধুর মত সারাটি জীবনই কাটিয়েছে। অথবা ঈমানের প্রশিক্ষণ পেয়েছে যেমন করে ঐ বালক প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। এরই নাম ঈমান। এই ঈমান যখন হৃদয়ের সাথে মিশে যায় এবং আত্মাকে আলিঙ্গন করে তখন সে অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করে।
আমরা সাধু, অন্ধ ও বালকের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিজয় প্রত্যক্ষ করেছি, কিন্তু মুমিনদের এই ঘটনায় সমষ্টিগত বিজয় লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাসে এ ঘটনার নযীর খুব কমই মেলে। এরই নাম আক্বীদার নিষ্কলুষতা, কর্মনীতির দ্ব্যর্থহীনতা, পদ্ধতির খুঁত হীনতা এবং বিজয়ের তাৎপর্যের যথোপযুক্ত উপলব্ধি। এই কাহিনী শেষ করার আগে আমাদের মনে কতকগুলি প্রশ্ন জাগে-
উক্ত রাজা তার চেলাচামুন্ডা ও সৈন্য-সামন্তের পরিণতি কী দাঁড়িয়েছিল? মুমিনদের হত্যাকারীদের থেকে কি আল্লাহ কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি? তাদের রক্ত কি বৃথা গিয়েছিল? আমরা অবশ্য এই যালিমদের পরিণতি সম্পর্কে কুরআন ও হাদীছে আর কোন তথ্য পাই না। তবে মুমিনদের কষ্ট দানের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে,
إِنَّ الَّذِيْنَ فَتَنُوْا الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوْبُوْا فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمْ عَذَابُ الْحَرِيْقِ
‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদেরকে নির্যাতন করেছে অতঃপর তওবা করেনি, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি এবং জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি’ (বুরূজ ৮৫/১০)।
হাসান বছরী (রঃ) বলেন, ‘দেখ, কী করুণা ও বদান্যতা! তারা তাঁর প্রিয়জনদেরকে হত্যা করেছে অথচ তিনি তাদের তওবা ও ক্ষমার দিকে আহবান জানাচ্ছেন’।[1]
ঘটনার চূড়ান্ত পর্যায় বিজয়ের একটি বিশেষ অর্থ ফুটিয়ে তুলেছে। এখানে বিজয়ী কে? যে নিজের বিশ্বাস ও প্রভুর দ্বীনকে সাহায্য করতে গিয়ে কয়েক মিনিট আগুনে পুড়ল, তারপর জান্নাতুন নাঈমে প্রবেশ করল সেই, না যে দুনিয়ার ক’টা দিন আরাম আয়েশে কাটিয়ে তওবা না করে মারা গেল এবং জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করল সে?
এখানে কি আগুনে পোড়া প্রথম দল ও দ্বিতীয় দলের মধ্যে কোন তুলনা চলে? নাকি তুলনা চলে আখেরাতের আগুনে পোড়ার সাথে দুনিয়ার আগুনে পোড়ার? দু’য়ের মধ্যে কত তফাৎ, কী বিশাল পার্থক্য!
যেসব মুমিন দুনিয়ার আগুনে জ্বলল তাদের জন্য মঞ্জুর করা হ’ল জান্নাত, যার পাদদেশ দিয়ে স্রোতস্বীনি বয়ে চলেছে। তাদের এই অবিসংবাদিত ফল লাভ ঘোষণা করছে ‘উহা এক বিরাট সাফল্য’ (বুরূজ ৮৫/ ১১)।
[1]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/৪৯৬ পৃ:।
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُواْ فِيْ سَبِيْلِ اللّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ -
‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদের তোমরা মোটেও মৃত মনে করো না। বরং তারা জীবিত, তাদের প্রভুর নিকট থেকে তার জীবিকা প্রাপ্ত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)। কবি বলেন,
مَنْ لَّمْ يَمُتْ بِالسَّيْفِ مَاتَ بِغَيْرِهِ + تَنَوَّعَتِ الْأَسْبَابُ وَالْمَوْتُ وَاحِدٌ -
‘তলোয়ারে মৃত্যু না হ’লে তব ভিন্ন পথে মরণ হবেই হবে,
কারণ যতই বিভিন্ন হোক মৃত্যু তোমার একই রবে’।
এই ঘটনার বর্ণনায় একটি অনন্য অবস্থার উল্লেখ রয়েছে। এক দুগ্ধবতী মা তার দুগ্ধপোষ্য শিশুর জন্য আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্তত করছিল। কিন্তু সে জানত না যে, শুধু দুধ পান করানো নয়, বরং সাথে সাথে সে শিশুটিকে ঈমান, বীরত্ব ও সাহসিকতাও পান করিয়ে চলেছিল। ফলে ঐ শিশুই তাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করল। তাই সে দৃপ্তপদে আগুনের পানে এগিয়ে গেল।
এ কোন্ সে উম্মাত, আর কোন্ সে জাতি? এরা তো তারাই, যারা দীর্ঘকাল ধরে কুফর ও শিরকের অন্ধকারে কাটিয়েছে। বছরের পর বছর ঐ রাজা তাদেরকে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছিল। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে যেই তারা ঈমানের পরিচয় পেল অমনি সঠিক কর্মনীতি কোনটা তা বুঝে ফেলল। যেন তারা ঈমানের পথে ঐ সাধুর মত সারাটি জীবনই কাটিয়েছে। অথবা ঈমানের প্রশিক্ষণ পেয়েছে যেমন করে ঐ বালক প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। এরই নাম ঈমান। এই ঈমান যখন হৃদয়ের সাথে মিশে যায় এবং আত্মাকে আলিঙ্গন করে তখন সে অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করে।
আমরা সাধু, অন্ধ ও বালকের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিজয় প্রত্যক্ষ করেছি, কিন্তু মুমিনদের এই ঘটনায় সমষ্টিগত বিজয় লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাসে এ ঘটনার নযীর খুব কমই মেলে। এরই নাম আক্বীদার নিষ্কলুষতা, কর্মনীতির দ্ব্যর্থহীনতা, পদ্ধতির খুঁত হীনতা এবং বিজয়ের তাৎপর্যের যথোপযুক্ত উপলব্ধি। এই কাহিনী শেষ করার আগে আমাদের মনে কতকগুলি প্রশ্ন জাগে-
উক্ত রাজা তার চেলাচামুন্ডা ও সৈন্য-সামন্তের পরিণতি কী দাঁড়িয়েছিল? মুমিনদের হত্যাকারীদের থেকে কি আল্লাহ কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি? তাদের রক্ত কি বৃথা গিয়েছিল? আমরা অবশ্য এই যালিমদের পরিণতি সম্পর্কে কুরআন ও হাদীছে আর কোন তথ্য পাই না। তবে মুমিনদের কষ্ট দানের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে,
إِنَّ الَّذِيْنَ فَتَنُوْا الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوْبُوْا فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمْ عَذَابُ الْحَرِيْقِ
‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদেরকে নির্যাতন করেছে অতঃপর তওবা করেনি, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি এবং জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি’ (বুরূজ ৮৫/১০)।
হাসান বছরী (রঃ) বলেন, ‘দেখ, কী করুণা ও বদান্যতা! তারা তাঁর প্রিয়জনদেরকে হত্যা করেছে অথচ তিনি তাদের তওবা ও ক্ষমার দিকে আহবান জানাচ্ছেন’।[1]
ঘটনার চূড়ান্ত পর্যায় বিজয়ের একটি বিশেষ অর্থ ফুটিয়ে তুলেছে। এখানে বিজয়ী কে? যে নিজের বিশ্বাস ও প্রভুর দ্বীনকে সাহায্য করতে গিয়ে কয়েক মিনিট আগুনে পুড়ল, তারপর জান্নাতুন নাঈমে প্রবেশ করল সেই, না যে দুনিয়ার ক’টা দিন আরাম আয়েশে কাটিয়ে তওবা না করে মারা গেল এবং জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করল সে?
এখানে কি আগুনে পোড়া প্রথম দল ও দ্বিতীয় দলের মধ্যে কোন তুলনা চলে? নাকি তুলনা চলে আখেরাতের আগুনে পোড়ার সাথে দুনিয়ার আগুনে পোড়ার? দু’য়ের মধ্যে কত তফাৎ, কী বিশাল পার্থক্য!
যেসব মুমিন দুনিয়ার আগুনে জ্বলল তাদের জন্য মঞ্জুর করা হ’ল জান্নাত, যার পাদদেশ দিয়ে স্রোতস্বীনি বয়ে চলেছে। তাদের এই অবিসংবাদিত ফল লাভ ঘোষণা করছে ‘উহা এক বিরাট সাফল্য’ (বুরূজ ৮৫/ ১১)।
[1]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/৪৯৬ পৃ:।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে এমন কিছু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যার দ্বারা বিজয়ের মর্ম ও পরাজয় সম্পর্কিত আমাদের ভুল ধারণা অনুধাবন করা যায়। নিম্নের হাদীছগুলির প্রামাণ্য আলোচনা থেকে তা স্পষ্ট হবে।-
১নং হাদীছ:
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قاَلَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : عُرِضَتْ عَلَىَّ الْأُمَمُ فَأَخَذَ وَ النَّبِىُّ يَمُرُّ مَعَهُ النَّفَرُ النَّبِىُّ يَمُرُّ مَعَهُ الْأُمَّةُ وَالنَّبِىُّ يَمُرُّ مَعَهُ الْعَشْرَةُ وَالنَّبِىُّ يَمُرُّ مَعَهُ الْخَمْسَةُ وَالنَّبِىُّ يَمُرُّ وَحْدَهُ فَنَظَرْتُ فَإِذَا سَوَادٌ كَثِيْرٌ قُلْتُ يَاجِبْرِيْلُ هؤُلاَءِ أُمَّتِىْ قَالَ لاَوَلِكِنْ انْظُرْ إِلَى الْأفُقِ فَنَظَرْتُ فَإِذَا سَوَادٌ كَثِيْرٌ قَالَ هوُلاَءِ أُمَّتُكَ , وَهؤُلاءِ سَبْعُوْنَ ألْفًا قُدَّامُهُمْ لاَ حِسَابَ عَلَيْهِمْ وَلاَعَذَابَ -
আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বিভিন্ন উম্মতকে আমার সামনে উত্থাপন করা হ’ল। নবীগণ এক এক করে অতিক্রম করতে লাগলেন। দেখা গেল, কোন নবীর সাথে রয়েছে একটি দল, কোন নবীর সাথে রয়েছে একটি গোত্র, কোন নবীর সাথে দশ জন, কোন নবীর সাথে রয়েছে পাঁচ জন, আর কোন নবী অতিক্রম করছেন একাকী। তারপর আমি দেখলাম অনেক দল। আমি বললাম, ‘জিবরীল! এরা কি আমার উম্মত? তিনি বললেন, না। আপনি বরং দিগন্তের দিকে তাকান। আমি তাকিয়ে দেখলাম অনেক দল। তিনি বললেন, এরা সব আপনার উম্মত। এদের সামনে রয়েছে ৭০ হাযার লোক। তাদের না হবে হিসাব, না হবে আযাব’।[1]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عُرِضَتْ عَلَىَّ الْأُمَمُ فَجَعَلَ يَمُرُّ النَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلُ وَ النَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلاَنِ وَالنَّبِىُّ مَعَهُ الرَّهْطُ وَالنَّبِىُّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ -
‘বিভিন্ন উম্মতকে আমার সামনে পেশ করা হ’ল। দেখা গেল, একজন নবী অতিক্রম করছেন তাঁর সাথে রয়েছে একজন লোক। আরেক নবীর সাথে রয়েছে দু’জন, আরেক জনের সাথে রয়েছে অনধিক দশ জনের একটি দল। কোন নবী এমনও রয়েছেন সাথে একজনও নেই’।[2]
ছহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসের বাচনিক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে-
عُرِضَتْ عَلَىَّ الْأُمَمُ فَرَأَيْتُ النَّبِىَّ وَمَعَهُ الرُّهَيْطَ وَالنَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلُ والَرَّجُلاَنِ وَالنَّبِىُّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ إِذْ رُفِعَ لِىْ سَوَادٌ عَظِيْمٌ -
‘বিভিন্ন উম্মতকে আমার সামনে পেশ করা হ’ল। আমি দেখলাম, একজন নবীর সাথে রয়েছে (অনধিক দশজনের) ক্ষুদ্র একটি দল। আরেক নবীকে দেখলাম তাঁর সাথে রয়েছে একজন বা দু’জন লোক। আরেক নবীকে দেখলাম তাঁর সাথে একজনও নেই। ইতিমধ্যে আমার সামনে তুলে ধরা হ’ল একটি বিরাট দল’।[3]
আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে অত্র হাদীছগুলির সম্পর্ক নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে রয়েছে। রাসূলুল্লহ (ছাঃ) প্রথমে একটি বা বেশী মানুষের দল কিংবা বৃহৎ দল দেখতে পান। তারপর আরেকটি বেশী মানুষের দল দেখতে পান, যারা দিগন্ত জুড়ে ছিল। প্রথম দল ছিল মূসা (আঃ)-এর উম্মত এবং দ্বিতীয় দল হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মত। এই দৃশ্য মহানবী (ছাঃ)-এর প্রকাশ্য বিজয়ের এক প্রতিচ্ছবি। কেননা দ্বীনের প্রসার ও লোকদের উত্তরোত্তর ঈমান আনয়নের ফলেই এমন একটা পর্যায় ও সংখ্যায় তারা উপনীত হয়েছিল। এটাই সেই প্রথম শ্রেণীর বিজয়, যার আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। এমনিভাবে ঐ নবীও বিজয়ী, যাঁর সাথে একটি দল রয়েছে।
হাদীছে এসেছে, কোন নবী দশজন অনুসারী সহ অতিক্রম করেছেন, কোন নবীর সাথে ছিল পাঁচ জন, কারও সাথে ছিল মাত্র একজন, কেউবা ছিলেন একা। কিন্তু আমরা নবী-রাসূলগণের কারও বিজয়ে সন্দেহ করি না। আল্লাহ তো আমাদের সে রকমই বলেছেন,
إنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ َيَقُوْمُ الْأشْهاَدُ -
‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণ ও মুমিনদেরকে দুনিয়ার জীবন ও ক্বিয়ামত দিবসে সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/৫১)।
লক্ষ্য করুন, আমরা কোন নবীকে পাচ্ছি যে তিনি ক্বিয়ামত দিবসে দশজন অনুসারী নিয়ে হাযির হবেন। দ্বিতীয় জন হাযির হবেন পাঁচ জনকে নিয়ে, তৃতীয় জন দু’জনকে নিয়ে, চতুর্থ জন একজনকে নিয়ে এবং পঞ্চম জন একাই।
আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই নবীগণের দশ-পাঁচ বা দু-একজন অনুসারীর অনেকেই নবীগণের জীবনাবসানের পর ঈমান এনেছেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর যে সকল উম্মতকে দেখেছিলেন তারা কেবলই তাঁর জীবদ্দশায় ঈমান আনয়নকারী নন; বরং তারা অনেকে তাঁর জীবদ্দশায় ঈমান এনেছিলেন এবং অনেকে তাঁর জীবনাবসানের পর ঈমান এনেছিলেন। যদিও তিনি অন্য নবীগণের থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন, ছিলেন শেষ ও মোহরাঙ্কিত নবী।
এতে করে আমরা বুঝি, বিজয় শুধুই অনুসারীদের সংখ্যাধিক্য ও হুড়হুড় করে জনগণের ঈমান গ্রহণের মাঝে সীমিত নয়। এটা বিজয়ের নানা শ্রেণীর একটি। বিশেষ করে অনুসারীরা যখন সঠিক কর্মনীতির উপর বহাল থাকবে। ফলে সংখ্যার কম-বেশীতে কিছু আসবে-যাবে না। আর প্রত্যেক নবীরই আখেরাতের আগে দুনিয়াতেই আল্লাহ প্রদত্ত সাহায্য প্রাপ্তি সম্পর্কে আমরা কোন সন্দেহ করতে পারি না। তাঁরা যে স্বল্প সংখ্যক অনুসারী বানাতে পারলেন কিংবা মোটেও পারলেন না তবে কি তাঁরা আল্লাহর সাহায্য পাননি? অবশ্যই পেয়েছেন, কিন্তু অনুসারীদের সংখ্যা হিসাব করলে তা বোঝা যায় না।
অতএব ফলকথা এই দাড়াচ্ছে যে, এখানে সাহায্য ও বিজয়ের আরও অনেক শ্রেণী রয়েছে, যার এক বা একাধিক শ্রেণী ঐ নবীগণ পেয়েছেন। কিন্তু অনেকের মগযে এমনকি কোন কোন প্রচারকের নিকটও তা ধরা পড়ে না।
এই সত্য ও বাস্তবতাকে উপলব্ধিতে আনা ও উহার আঙ্গিকে আমাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া, বিজয় ও সাহায্যের অন্যতম শ্রেণী। বরং বিজয় নিশ্চিত করার প্রথম পদক্ষেপ।
২নং হাদীছ :
عَنْ خَبَّابِ بْنِ الْأَرَتِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ شَكَوْنَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً فِىْ ظِلِّ الْكَعْبَةِ، فَقُلْنَا : أَلاَ تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَوَ تَدْعُوْلَنَا فَقَالَ قَدْ كَانَ مَنْ قَبْلَكُمْ يْؤْخَذُ الرَّجُلُ فَيُحْفَرْ لَهُ فِى الْأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيْهَا، ثُمَّ يُؤْتِى بِالْمِنْشَارِ فَيُوْضَعُ عَلىَ رَأَسِهِ فَيُجْعَلُ نِصْفِيْنِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيْدِ مَا دُوْنَ لَحْمِهِ وَعَظْمِهِ مَا يَبْعَدُهُ ذَلِكَ عَنْ دِيْنِهِ وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ تَعَالىَ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يَِسِيْرَ الرَّاكِبُ مِنَ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ فَلاَ يَخَافُ إلاَّ الله وَالذِّئْبُ عَلىَ غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ -
‘খাববাব বিন আরাত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বার চত্বরে চাদরকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে ছিলেন। ইত্যবসরে আমরা তাঁর নিকট অভিযোগ করে বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য দো‘আ করবেন না? তিনি এ কথা শুনে বললেন, ‘তোমাদের পূর্ব যুগে কোন ঈমানদার লোককে ধরে আনা হ’ত, তার জন্য মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাতে তাকে রাখা হ’ত। তারপর করাত আনা হ’ত এবং তার মাথার উপর রেখে তাকে চিরে দু’ভাগ করে ফেলা হ’ত। আবার কোন সময় লোহার চিরুনী দিয়ে তার গোশত হাড্ডি আলাদা করে ফেলা হ’ত। এতসব কিছু সত্ত্বেও তাকে তার দ্বীন থেকে বিচ্যুত করা যেত না। আল্লাহর শপথ, অবশ্যই আল্লাহ এই দ্বীনকে পূর্ণতা দান করবেন। তখন একজন আরোহী (ইয়ামনের রাজধানী) ছান‘আ হ’তে হাযারামাউত (ইয়ামনের অন্য একটি শহর) পর্যন্ত দীর্ঘ পথ সফর করবে। এই সুদূর পথে সে আল্লাহ ও তার ছাগপালের উপর নেকড়ের ভয় ব্যতীত আর কোন ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা খুব তাড়াহুড়া করছ’।[4]
উক্ত হাদীছের পর্যালোচনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলি জানতে পারি:
(১) খাববাব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আল্লাহর সাহায্যের নিমিত্ত দো‘আ চাইতে এসেছিলেন। তাঁর কথায় বোঝা যায় কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণকে যে নানারূপ কষ্ট দিত, তার প্রতিকার বিধানের জন্য দো‘আ করতে বলেছিলেন। এরূপ প্রতিকার প্রতি বিধান প্রকাশ্য বিজয়ের অংশ। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে মোড় ঘুরিয়ে আরেক বিজয়ের বার্তা প্রদান করেছেন। তা হ’ল যাবতীয় কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেও আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচল থাকা। আর তাতে দ্বীন ও আক্বীদা রক্ষায় যদি একজন মুসলমানের জীবন কুরবানী হয়ে যায়, তবুও কোন পরওয়া নেই। এতে বাহ্যিকভাবে পরাজয় মনে হ’লেও মূলে বিজয় অর্জিত হবে। সে শহীদী মৃত্যুবরণ করবে এবং জান্নাত লাভ করবে।
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পরে তাঁকে প্রকাশ্য বিজয়ের কথাও বলেছেন। সেটা যে হবে তাও নিশ্চিত। কিন্তু এও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, দ্বীনের উপর অবিচলতা ও ধৈর্য-সহিষ্ণুতা ব্যতীত তা লাভ করা যাবে না।
(৩) আমরা লক্ষ্য করলে দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা উল্লেখ করেছেন এবং যে জন্য কসম খেয়েছেন তা হ’ল দ্বীন ইসলামের পূর্ণতা লাভ। ইসলাম যে তাঁরই হাতে পূর্ণতা লাভ করবে সে কথাই তিনি কসম করে উল্লেখ করেছেন। এই পূর্ণতা লাভ এক প্রকার বিজয়। তবে প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণী প্রচারকের জীবদ্দশায় নাও ঘটতে পারে। ছান‘আ থেকে হাযারমাউত পর্যন্ত একজন আরোহীর নির্বিঘ্নে ভ্রমণ নিশ্চিত হয়েছিল; কিন্তু তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ওফাতের পর। সুতরাং একজন প্রচারকের এ সম্পর্কে সজাগ থাকা কর্তব্য। তার খেয়াল রাখা দরকার যে, দ্বীনের বিজয় তার একার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।
(৪) ‘কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছ’ রাসূলের এই উক্তিটি খুবই বাস্তব। দ্বীন বিজয়ের উদগ্র বাসনায় অনেক প্রচারক এমন কিছু করে বসে, যা উহার বিজয়কে পিছিয়ে দেয়। তাড়াহুড়া এমনই একটি কাজ। এই প্রচারকরা তাদের কাজের ফলাফল দুনিয়ার জীবনেই শুধু নয়; বরং কাজে নামার প্রথমেই দেখতে চায়। অথচ এটা কোন নবী-রাসূলের জীবনেও ঘটেনি।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর সাহায্য, প্রচারকের ধৈর্য, চিত্তের দৃঢ়তা ও বৈরী অবস্থাকে মানসিকভাবে মেনে নেওয়া এবং সেই সঙ্গে তাড়াহুড়া না করা। তিনি আমাদেরকে এও শিখিয়েছেন যে, আমাদের মন-মগযে বিজয় বলতে যা অতি দ্রুত ভেসে ওঠে, বিজয় আসলে তার থেকেও ব্যাপকতর। উহা শুধু প্রকাশ্য বিজয়ের তথা শত্রুকে পদানত করার মাঝে সীমাবদ্ধ নয় এবং প্রকাশ্য বিজয় প্রচারকের জীবদ্দশায় নিশ্চিত হওয়া যরূরী নয়।
৩নং হাদীছ :
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِى اللهُ عَنْهُ قَالَ قاَلَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى االلهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّّ قَالَ مَنْ عَادَىِ لِىْ وَلِياًّ فَقَدْ أَذَِّنْتُهُ بِالْحَرْبِ -
‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কারণে আমার ওয়ালী বা বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা রাখবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি’।[5]
অত্র হাদীছ হ’তে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, মুমিন যখন দৃঢ় বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তার সাথে আছেন আর এ বিশ্বাস তার জন্য অপরিহার্যও বটে, তখন সে আল্লাহর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধু আল্লাহ তো অবশ্যই তার সাথে কষ্টদাতা ও শত্রুতাকারীর বিরুদ্ধে যু্দ্ধ ঘোষণা করছেন, তখন আল্লাহ যে তাকে সাহায্য করবেন সে বিশ্বাসও তাকে সন্দেহাতীতভাবে রাখতে হবে। কেননা এ সংঘর্ষ তো কেবল প্রচারক ও তার শত্রুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং আল্লাহ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এরূপ সংঘর্ষে কে বিজয়ী হবে আর কে পরাজিত হবে তা নির্ণয় করতে কোন যুক্তি-বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন পড়ে না। বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে একই রকম। কেননা বিজয়ের ধরন, স্থান ও কাল আল্লাহই নির্ধারণ করেন। যদিও অনেক ধরনের বিজয় আমাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টি, সীমাবদ্ধ কামনা ও মানবীয় চিন্তা-গবেষণায় ধরা পড়ে না।
অবশ্য আমাদের নিশ্চিত জেনে রাখতে হবে যে, এই সংঘর্ষ প্রথম থেকেই ছিন্নমূল, শুরুর আগেই এর ফলাফল পরিজ্ঞাত। এই বিশ্বাস সহ আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে যাব। আমরা তাড়াহুড়াও করব না, হতাশও হব না এবং এমন কোন পদক্ষেপও নিব না, যাতে আল্লাহর প্রতিশ্রুত নিশ্চিত সাহায্য থেকে বঞ্চিত হ’তে হয়।
৪ নং হাদীছ :
ইয়াসির তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া ও পুত্র আম্মার (রাঃ) প্রথম যুগের মুসলমান ছিলেন। যেহেতু ইয়াসির (রাঃ) মক্কার আদি বাসিন্দা ছিলেন না। তাই মক্কার নির্দয় নিষ্ঠুর মুশরিকরা তাঁদের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল। এহেন অত্যাচারের ফলেই সুমাইয়া (রাঃ) সর্বপ্রথম শহীদ হয়ে যান। কিন্তু তাদেরকে অত্যাচার মুক্ত করার ক্ষমতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছিল না। মুশরিকরা তাঁদের যে স্থানে নির্যাতন করত সেই পথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাঝে মাঝে যেতেন। তিনি তাঁদের ধৈর্যধারণে মানসিক সাহায্য যোগাতেন। উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِى اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى االلهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا مَرَّبِهِمْ وَهُمْ يُعَذَّبُوْنَ يَقُوْلُ صَبْرًَا آَلَ يَاسِرٍ فَإنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ -
ওছমান বিন আফফান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন তাদের উপর শাস্তি প্রদানকালে অতিক্রম করতেন তখন বলতেন, ‘ইয়াসির পরিবার! তোমরা ধৈর্যধারণ কর। কেননা তোমাদের প্রতিশ্রুত স্থান হ’ল জান্নাত’।[6] ধৈর্য-সহিষ্ণুতা বড় রকমের বিজয়। ধৈর্যের মাধ্যমে মানুষ তার কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে; পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। মহৎ মানুষদের চিহ্নই ধৈর্য। আল্লাহ বলেন, نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ ‘সে কত না ভাল বান্দা! সে ভীষণভাবে আল্লাহভিমুখী’।
ধৈর্যশীল মানুষ ধৈর্যের মাধ্যমে প্রথমতঃ নিজের উপর, দ্বিতীয়তঃ শত্রুর উপর জয়ী হয়, তৃতীয়তঃ সে তার বিশ্বাসের উৎসকে সাহায্য করে। আমরা যখন ইসলামের প্রথম দিকে বিজয়ের কথা আলোচনা করি তখন ইয়াসির (রাঃ)-এর পরিবারের ইয়াসির, সুমাইয়া ও আম্মারের কথা স্মরণ হয়। এই পরিবারটি দ্বীনের জন্য তাদের ধৈর্য, সংগ্রাম ও জীবন কুরবানীতে অগ্রণী ভূমিকা পালন হেতু সেই সব লোকের কাতারে শামিল হয়েছিলেন, যারা দ্বীন ইসলামের গৌরব ও বিজয়ের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছেন। তারা প্রথমতঃ নিজেরা জয়ী হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ মুশরিকদের উপর জয়ী হয়েছিলেন, তৃতীয়তঃ ইসলামকে সাহায্য করেছিলেন। এরপর তাদের জান্নাতের সুসংবাদ মিলেছে। আল্লাহ বলেন, فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ‘যে ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হ’ল এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হ’ল, সেই তো সফল হ’ল’ (আলে ইমরান ১৮৫)।
[1]. বুখারী হা/৬৫৪১।
[2]. বুখারী হা/৫৭৫২; মিশকাত হা/৫২৯৬।
[3]. মুসলিম হা/৩৭৪।
[4]. বুখারী হা/৩৬১২।
[5]. বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত হা/২২৬৬।
[6]. মুস্তাদরাক হাকেম হা/৫৬৪৬, ৩/৩৮৮-৮৯; শায়খ আলবানী একে ছহীহ বলেছেন- দ্রঃ ফিক্বহুস সিরাহ ১০৭ পৃ.।
১নং হাদীছ:
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قاَلَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : عُرِضَتْ عَلَىَّ الْأُمَمُ فَأَخَذَ وَ النَّبِىُّ يَمُرُّ مَعَهُ النَّفَرُ النَّبِىُّ يَمُرُّ مَعَهُ الْأُمَّةُ وَالنَّبِىُّ يَمُرُّ مَعَهُ الْعَشْرَةُ وَالنَّبِىُّ يَمُرُّ مَعَهُ الْخَمْسَةُ وَالنَّبِىُّ يَمُرُّ وَحْدَهُ فَنَظَرْتُ فَإِذَا سَوَادٌ كَثِيْرٌ قُلْتُ يَاجِبْرِيْلُ هؤُلاَءِ أُمَّتِىْ قَالَ لاَوَلِكِنْ انْظُرْ إِلَى الْأفُقِ فَنَظَرْتُ فَإِذَا سَوَادٌ كَثِيْرٌ قَالَ هوُلاَءِ أُمَّتُكَ , وَهؤُلاءِ سَبْعُوْنَ ألْفًا قُدَّامُهُمْ لاَ حِسَابَ عَلَيْهِمْ وَلاَعَذَابَ -
আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বিভিন্ন উম্মতকে আমার সামনে উত্থাপন করা হ’ল। নবীগণ এক এক করে অতিক্রম করতে লাগলেন। দেখা গেল, কোন নবীর সাথে রয়েছে একটি দল, কোন নবীর সাথে রয়েছে একটি গোত্র, কোন নবীর সাথে দশ জন, কোন নবীর সাথে রয়েছে পাঁচ জন, আর কোন নবী অতিক্রম করছেন একাকী। তারপর আমি দেখলাম অনেক দল। আমি বললাম, ‘জিবরীল! এরা কি আমার উম্মত? তিনি বললেন, না। আপনি বরং দিগন্তের দিকে তাকান। আমি তাকিয়ে দেখলাম অনেক দল। তিনি বললেন, এরা সব আপনার উম্মত। এদের সামনে রয়েছে ৭০ হাযার লোক। তাদের না হবে হিসাব, না হবে আযাব’।[1]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عُرِضَتْ عَلَىَّ الْأُمَمُ فَجَعَلَ يَمُرُّ النَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلُ وَ النَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلاَنِ وَالنَّبِىُّ مَعَهُ الرَّهْطُ وَالنَّبِىُّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ -
‘বিভিন্ন উম্মতকে আমার সামনে পেশ করা হ’ল। দেখা গেল, একজন নবী অতিক্রম করছেন তাঁর সাথে রয়েছে একজন লোক। আরেক নবীর সাথে রয়েছে দু’জন, আরেক জনের সাথে রয়েছে অনধিক দশ জনের একটি দল। কোন নবী এমনও রয়েছেন সাথে একজনও নেই’।[2]
ছহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসের বাচনিক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে-
عُرِضَتْ عَلَىَّ الْأُمَمُ فَرَأَيْتُ النَّبِىَّ وَمَعَهُ الرُّهَيْطَ وَالنَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلُ والَرَّجُلاَنِ وَالنَّبِىُّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ إِذْ رُفِعَ لِىْ سَوَادٌ عَظِيْمٌ -
‘বিভিন্ন উম্মতকে আমার সামনে পেশ করা হ’ল। আমি দেখলাম, একজন নবীর সাথে রয়েছে (অনধিক দশজনের) ক্ষুদ্র একটি দল। আরেক নবীকে দেখলাম তাঁর সাথে রয়েছে একজন বা দু’জন লোক। আরেক নবীকে দেখলাম তাঁর সাথে একজনও নেই। ইতিমধ্যে আমার সামনে তুলে ধরা হ’ল একটি বিরাট দল’।[3]
আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে অত্র হাদীছগুলির সম্পর্ক নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে রয়েছে। রাসূলুল্লহ (ছাঃ) প্রথমে একটি বা বেশী মানুষের দল কিংবা বৃহৎ দল দেখতে পান। তারপর আরেকটি বেশী মানুষের দল দেখতে পান, যারা দিগন্ত জুড়ে ছিল। প্রথম দল ছিল মূসা (আঃ)-এর উম্মত এবং দ্বিতীয় দল হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মত। এই দৃশ্য মহানবী (ছাঃ)-এর প্রকাশ্য বিজয়ের এক প্রতিচ্ছবি। কেননা দ্বীনের প্রসার ও লোকদের উত্তরোত্তর ঈমান আনয়নের ফলেই এমন একটা পর্যায় ও সংখ্যায় তারা উপনীত হয়েছিল। এটাই সেই প্রথম শ্রেণীর বিজয়, যার আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। এমনিভাবে ঐ নবীও বিজয়ী, যাঁর সাথে একটি দল রয়েছে।
হাদীছে এসেছে, কোন নবী দশজন অনুসারী সহ অতিক্রম করেছেন, কোন নবীর সাথে ছিল পাঁচ জন, কারও সাথে ছিল মাত্র একজন, কেউবা ছিলেন একা। কিন্তু আমরা নবী-রাসূলগণের কারও বিজয়ে সন্দেহ করি না। আল্লাহ তো আমাদের সে রকমই বলেছেন,
إنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ َيَقُوْمُ الْأشْهاَدُ -
‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণ ও মুমিনদেরকে দুনিয়ার জীবন ও ক্বিয়ামত দিবসে সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/৫১)।
লক্ষ্য করুন, আমরা কোন নবীকে পাচ্ছি যে তিনি ক্বিয়ামত দিবসে দশজন অনুসারী নিয়ে হাযির হবেন। দ্বিতীয় জন হাযির হবেন পাঁচ জনকে নিয়ে, তৃতীয় জন দু’জনকে নিয়ে, চতুর্থ জন একজনকে নিয়ে এবং পঞ্চম জন একাই।
আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই নবীগণের দশ-পাঁচ বা দু-একজন অনুসারীর অনেকেই নবীগণের জীবনাবসানের পর ঈমান এনেছেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর যে সকল উম্মতকে দেখেছিলেন তারা কেবলই তাঁর জীবদ্দশায় ঈমান আনয়নকারী নন; বরং তারা অনেকে তাঁর জীবদ্দশায় ঈমান এনেছিলেন এবং অনেকে তাঁর জীবনাবসানের পর ঈমান এনেছিলেন। যদিও তিনি অন্য নবীগণের থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন, ছিলেন শেষ ও মোহরাঙ্কিত নবী।
এতে করে আমরা বুঝি, বিজয় শুধুই অনুসারীদের সংখ্যাধিক্য ও হুড়হুড় করে জনগণের ঈমান গ্রহণের মাঝে সীমিত নয়। এটা বিজয়ের নানা শ্রেণীর একটি। বিশেষ করে অনুসারীরা যখন সঠিক কর্মনীতির উপর বহাল থাকবে। ফলে সংখ্যার কম-বেশীতে কিছু আসবে-যাবে না। আর প্রত্যেক নবীরই আখেরাতের আগে দুনিয়াতেই আল্লাহ প্রদত্ত সাহায্য প্রাপ্তি সম্পর্কে আমরা কোন সন্দেহ করতে পারি না। তাঁরা যে স্বল্প সংখ্যক অনুসারী বানাতে পারলেন কিংবা মোটেও পারলেন না তবে কি তাঁরা আল্লাহর সাহায্য পাননি? অবশ্যই পেয়েছেন, কিন্তু অনুসারীদের সংখ্যা হিসাব করলে তা বোঝা যায় না।
অতএব ফলকথা এই দাড়াচ্ছে যে, এখানে সাহায্য ও বিজয়ের আরও অনেক শ্রেণী রয়েছে, যার এক বা একাধিক শ্রেণী ঐ নবীগণ পেয়েছেন। কিন্তু অনেকের মগযে এমনকি কোন কোন প্রচারকের নিকটও তা ধরা পড়ে না।
এই সত্য ও বাস্তবতাকে উপলব্ধিতে আনা ও উহার আঙ্গিকে আমাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া, বিজয় ও সাহায্যের অন্যতম শ্রেণী। বরং বিজয় নিশ্চিত করার প্রথম পদক্ষেপ।
২নং হাদীছ :
عَنْ خَبَّابِ بْنِ الْأَرَتِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ شَكَوْنَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً فِىْ ظِلِّ الْكَعْبَةِ، فَقُلْنَا : أَلاَ تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَوَ تَدْعُوْلَنَا فَقَالَ قَدْ كَانَ مَنْ قَبْلَكُمْ يْؤْخَذُ الرَّجُلُ فَيُحْفَرْ لَهُ فِى الْأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيْهَا، ثُمَّ يُؤْتِى بِالْمِنْشَارِ فَيُوْضَعُ عَلىَ رَأَسِهِ فَيُجْعَلُ نِصْفِيْنِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيْدِ مَا دُوْنَ لَحْمِهِ وَعَظْمِهِ مَا يَبْعَدُهُ ذَلِكَ عَنْ دِيْنِهِ وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ تَعَالىَ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يَِسِيْرَ الرَّاكِبُ مِنَ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ فَلاَ يَخَافُ إلاَّ الله وَالذِّئْبُ عَلىَ غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ -
‘খাববাব বিন আরাত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বার চত্বরে চাদরকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে ছিলেন। ইত্যবসরে আমরা তাঁর নিকট অভিযোগ করে বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য দো‘আ করবেন না? তিনি এ কথা শুনে বললেন, ‘তোমাদের পূর্ব যুগে কোন ঈমানদার লোককে ধরে আনা হ’ত, তার জন্য মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাতে তাকে রাখা হ’ত। তারপর করাত আনা হ’ত এবং তার মাথার উপর রেখে তাকে চিরে দু’ভাগ করে ফেলা হ’ত। আবার কোন সময় লোহার চিরুনী দিয়ে তার গোশত হাড্ডি আলাদা করে ফেলা হ’ত। এতসব কিছু সত্ত্বেও তাকে তার দ্বীন থেকে বিচ্যুত করা যেত না। আল্লাহর শপথ, অবশ্যই আল্লাহ এই দ্বীনকে পূর্ণতা দান করবেন। তখন একজন আরোহী (ইয়ামনের রাজধানী) ছান‘আ হ’তে হাযারামাউত (ইয়ামনের অন্য একটি শহর) পর্যন্ত দীর্ঘ পথ সফর করবে। এই সুদূর পথে সে আল্লাহ ও তার ছাগপালের উপর নেকড়ের ভয় ব্যতীত আর কোন ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা খুব তাড়াহুড়া করছ’।[4]
উক্ত হাদীছের পর্যালোচনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলি জানতে পারি:
(১) খাববাব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আল্লাহর সাহায্যের নিমিত্ত দো‘আ চাইতে এসেছিলেন। তাঁর কথায় বোঝা যায় কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণকে যে নানারূপ কষ্ট দিত, তার প্রতিকার বিধানের জন্য দো‘আ করতে বলেছিলেন। এরূপ প্রতিকার প্রতি বিধান প্রকাশ্য বিজয়ের অংশ। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে মোড় ঘুরিয়ে আরেক বিজয়ের বার্তা প্রদান করেছেন। তা হ’ল যাবতীয় কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেও আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচল থাকা। আর তাতে দ্বীন ও আক্বীদা রক্ষায় যদি একজন মুসলমানের জীবন কুরবানী হয়ে যায়, তবুও কোন পরওয়া নেই। এতে বাহ্যিকভাবে পরাজয় মনে হ’লেও মূলে বিজয় অর্জিত হবে। সে শহীদী মৃত্যুবরণ করবে এবং জান্নাত লাভ করবে।
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পরে তাঁকে প্রকাশ্য বিজয়ের কথাও বলেছেন। সেটা যে হবে তাও নিশ্চিত। কিন্তু এও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, দ্বীনের উপর অবিচলতা ও ধৈর্য-সহিষ্ণুতা ব্যতীত তা লাভ করা যাবে না।
(৩) আমরা লক্ষ্য করলে দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা উল্লেখ করেছেন এবং যে জন্য কসম খেয়েছেন তা হ’ল দ্বীন ইসলামের পূর্ণতা লাভ। ইসলাম যে তাঁরই হাতে পূর্ণতা লাভ করবে সে কথাই তিনি কসম করে উল্লেখ করেছেন। এই পূর্ণতা লাভ এক প্রকার বিজয়। তবে প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণী প্রচারকের জীবদ্দশায় নাও ঘটতে পারে। ছান‘আ থেকে হাযারমাউত পর্যন্ত একজন আরোহীর নির্বিঘ্নে ভ্রমণ নিশ্চিত হয়েছিল; কিন্তু তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ওফাতের পর। সুতরাং একজন প্রচারকের এ সম্পর্কে সজাগ থাকা কর্তব্য। তার খেয়াল রাখা দরকার যে, দ্বীনের বিজয় তার একার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।
(৪) ‘কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছ’ রাসূলের এই উক্তিটি খুবই বাস্তব। দ্বীন বিজয়ের উদগ্র বাসনায় অনেক প্রচারক এমন কিছু করে বসে, যা উহার বিজয়কে পিছিয়ে দেয়। তাড়াহুড়া এমনই একটি কাজ। এই প্রচারকরা তাদের কাজের ফলাফল দুনিয়ার জীবনেই শুধু নয়; বরং কাজে নামার প্রথমেই দেখতে চায়। অথচ এটা কোন নবী-রাসূলের জীবনেও ঘটেনি।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর সাহায্য, প্রচারকের ধৈর্য, চিত্তের দৃঢ়তা ও বৈরী অবস্থাকে মানসিকভাবে মেনে নেওয়া এবং সেই সঙ্গে তাড়াহুড়া না করা। তিনি আমাদেরকে এও শিখিয়েছেন যে, আমাদের মন-মগযে বিজয় বলতে যা অতি দ্রুত ভেসে ওঠে, বিজয় আসলে তার থেকেও ব্যাপকতর। উহা শুধু প্রকাশ্য বিজয়ের তথা শত্রুকে পদানত করার মাঝে সীমাবদ্ধ নয় এবং প্রকাশ্য বিজয় প্রচারকের জীবদ্দশায় নিশ্চিত হওয়া যরূরী নয়।
৩নং হাদীছ :
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِى اللهُ عَنْهُ قَالَ قاَلَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى االلهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّّ قَالَ مَنْ عَادَىِ لِىْ وَلِياًّ فَقَدْ أَذَِّنْتُهُ بِالْحَرْبِ -
‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কারণে আমার ওয়ালী বা বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা রাখবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি’।[5]
অত্র হাদীছ হ’তে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, মুমিন যখন দৃঢ় বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তার সাথে আছেন আর এ বিশ্বাস তার জন্য অপরিহার্যও বটে, তখন সে আল্লাহর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধু আল্লাহ তো অবশ্যই তার সাথে কষ্টদাতা ও শত্রুতাকারীর বিরুদ্ধে যু্দ্ধ ঘোষণা করছেন, তখন আল্লাহ যে তাকে সাহায্য করবেন সে বিশ্বাসও তাকে সন্দেহাতীতভাবে রাখতে হবে। কেননা এ সংঘর্ষ তো কেবল প্রচারক ও তার শত্রুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং আল্লাহ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এরূপ সংঘর্ষে কে বিজয়ী হবে আর কে পরাজিত হবে তা নির্ণয় করতে কোন যুক্তি-বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন পড়ে না। বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে একই রকম। কেননা বিজয়ের ধরন, স্থান ও কাল আল্লাহই নির্ধারণ করেন। যদিও অনেক ধরনের বিজয় আমাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টি, সীমাবদ্ধ কামনা ও মানবীয় চিন্তা-গবেষণায় ধরা পড়ে না।
অবশ্য আমাদের নিশ্চিত জেনে রাখতে হবে যে, এই সংঘর্ষ প্রথম থেকেই ছিন্নমূল, শুরুর আগেই এর ফলাফল পরিজ্ঞাত। এই বিশ্বাস সহ আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে যাব। আমরা তাড়াহুড়াও করব না, হতাশও হব না এবং এমন কোন পদক্ষেপও নিব না, যাতে আল্লাহর প্রতিশ্রুত নিশ্চিত সাহায্য থেকে বঞ্চিত হ’তে হয়।
৪ নং হাদীছ :
ইয়াসির তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া ও পুত্র আম্মার (রাঃ) প্রথম যুগের মুসলমান ছিলেন। যেহেতু ইয়াসির (রাঃ) মক্কার আদি বাসিন্দা ছিলেন না। তাই মক্কার নির্দয় নিষ্ঠুর মুশরিকরা তাঁদের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল। এহেন অত্যাচারের ফলেই সুমাইয়া (রাঃ) সর্বপ্রথম শহীদ হয়ে যান। কিন্তু তাদেরকে অত্যাচার মুক্ত করার ক্ষমতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছিল না। মুশরিকরা তাঁদের যে স্থানে নির্যাতন করত সেই পথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাঝে মাঝে যেতেন। তিনি তাঁদের ধৈর্যধারণে মানসিক সাহায্য যোগাতেন। উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِى اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى االلهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا مَرَّبِهِمْ وَهُمْ يُعَذَّبُوْنَ يَقُوْلُ صَبْرًَا آَلَ يَاسِرٍ فَإنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ -
ওছমান বিন আফফান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন তাদের উপর শাস্তি প্রদানকালে অতিক্রম করতেন তখন বলতেন, ‘ইয়াসির পরিবার! তোমরা ধৈর্যধারণ কর। কেননা তোমাদের প্রতিশ্রুত স্থান হ’ল জান্নাত’।[6] ধৈর্য-সহিষ্ণুতা বড় রকমের বিজয়। ধৈর্যের মাধ্যমে মানুষ তার কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে; পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। মহৎ মানুষদের চিহ্নই ধৈর্য। আল্লাহ বলেন, نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ ‘সে কত না ভাল বান্দা! সে ভীষণভাবে আল্লাহভিমুখী’।
ধৈর্যশীল মানুষ ধৈর্যের মাধ্যমে প্রথমতঃ নিজের উপর, দ্বিতীয়তঃ শত্রুর উপর জয়ী হয়, তৃতীয়তঃ সে তার বিশ্বাসের উৎসকে সাহায্য করে। আমরা যখন ইসলামের প্রথম দিকে বিজয়ের কথা আলোচনা করি তখন ইয়াসির (রাঃ)-এর পরিবারের ইয়াসির, সুমাইয়া ও আম্মারের কথা স্মরণ হয়। এই পরিবারটি দ্বীনের জন্য তাদের ধৈর্য, সংগ্রাম ও জীবন কুরবানীতে অগ্রণী ভূমিকা পালন হেতু সেই সব লোকের কাতারে শামিল হয়েছিলেন, যারা দ্বীন ইসলামের গৌরব ও বিজয়ের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছেন। তারা প্রথমতঃ নিজেরা জয়ী হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ মুশরিকদের উপর জয়ী হয়েছিলেন, তৃতীয়তঃ ইসলামকে সাহায্য করেছিলেন। এরপর তাদের জান্নাতের সুসংবাদ মিলেছে। আল্লাহ বলেন, فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ‘যে ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হ’ল এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হ’ল, সেই তো সফল হ’ল’ (আলে ইমরান ১৮৫)।
[1]. বুখারী হা/৬৫৪১।
[2]. বুখারী হা/৫৭৫২; মিশকাত হা/৫২৯৬।
[3]. মুসলিম হা/৩৭৪।
[4]. বুখারী হা/৩৬১২।
[5]. বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত হা/২২৬৬।
[6]. মুস্তাদরাক হাকেম হা/৫৬৪৬, ৩/৩৮৮-৮৯; শায়খ আলবানী একে ছহীহ বলেছেন- দ্রঃ ফিক্বহুস সিরাহ ১০৭ পৃ.।
সূরা আছর একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সূরা। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এ সূরা সম্পর্কে বলেছেন,
لَوْ تَدَبَّرَ النَّاسُ هذِهِ السُّوْرَةَ لَوَسَعَتْهُمْ - ‘মানুষ যদি এই সূরা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করত, তাহ’লে আল্লাহর পথে চলার ক্ষেত্রে তাদের জন্য এই সূরা যথেষ্ট হ’ত।[1] উক্ত সূরায় খুব স্পষ্টভাবে বিজয়ের কর্মনীতি অঙ্কন করা হয়েছে। বিজয়ের পথ ও পদ্ধতি যে একটাই, সে কথার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে সব রকম ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটানো হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা কসম খেয়ে বলেছেন, মানুষ মাত্রই ক্ষতির মধ্যে। সবাই ধ্বংসের মধ্যে। তারপর তিনি এক শ্রেণীর লোককে ক্ষতিগ্রস্ত মানবমন্ডলী থেকে ব্যতিক্রম হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিরাই কেবল সফল, লাভবান ও বিজয়ী। অন্যরা নয়।
এই ব্যতিক্রমধর্মীদের মাঝে বিজয় ও সাফল্যের একত্রে চারটি গুণ বা শর্তের সমাবেশের কথা বলা হয়েছে। যথাঃ
(ক) ঈমান : اَلَّذِيْنَ أمَنُوْا ‘যারা ঈমান এনেছে’।
(খ) সৎকর্মশীলতা : وَعَمِِلُوْا الصّاَلِحَاتِ ‘যারা সৎকর্ম করে’।
(গ) হক্ব পথে থাকার জন্য পরষ্পরে উপদেশ দান: وَتََوَاصَوْا بِالْحَقِّ ‘যারা একে অপরকে হক পথে চলার উপদেশ দেয়’।
(ঘ) হক্ব পথে চলতে ধৈর্যধারণের জন্য পারষ্পরিক উপদেশ দান: وَتَوَاَصَوْا بِالصِّبْرِ ‘এবং যারা একে অপরকে ধৈর্য-সহিষ্ণুতার উপদেশ দেয়’।
এগুলিই হ’ল বিজয় লাভের শর্ত। যারা এই শর্তগুলি পূরণ করবে তারাই ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং মুক্তি পাবে। অর্থাৎ তারা বিজয়ী ও সফল হবে।
লক্ষণীয় হ’ল, আল্লাহ তা‘আলা বিজয়ের শর্তাবলীতে প্রচারের ফলাফল হাতে নাতে পাওয়ার কোন শর্ত আরোপ করেননি। এ শর্তও করেননি যে, প্রচারের ফলে সব লোকের হেদায়াত পেতে হবে বা প্রচারকদের আহবানে সবাইকে সাড়া দিতে হবে। মুসলমান যখন অত্র সূরায় উল্লেখিত চারটি র্শত পূরণ করবে, তখনই তাদের ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি ও বিজয় লাভের ফায়ছালা আল্লাহ শুনিয়েছেন। অন্যরা মুসলমানের দাওয়াতে সাড়া দিবে কিংবা তার লক্ষ্য অর্জিত হবে, নইলে সে যে ক্ষতি থেকে মুক্তি পাবে না, এমন কথা এখানে নেই। এসব কাজ প্রচারকের দায়িত্বে বর্তায় না। সাহায্য ও বিজয় লাভে এটি কোন আবশ্যকীয় দিকও নয়। এটি আল্লাহরই অনুগ্রহ ও অনুকম্পা (বাক্বারাহ ২/১০৫)। বরং এই সূরায় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যক্ত হয়েছে। বিজয়ের সাথে তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
(১) একে অপরকে হক পথে চলার উপদেশ দান :
মানুষ অনেক সময় হক্ব পথে চলতে দুর্বলতা বোধ করে। কখনও তার পদস্খলন ঘটে; কখনও সে হক্ব পথ থেকে একেবারে বিচ্যুত হয়ে যায়। এজন্যই হক্ব পথে চলতে তার জন্য এমন সহযোগী দরকার যে তাকে সঠিক কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে উপদেশ দিবে, তার দেখভাল করবে এবং বিচ্যুতি হ’তে রক্ষা করবে।
অধিকাংশই মনে করে তারা হক পথে রয়েছে, অথচ কখন যে তারা হক্ব পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভুল পথের অনুগামী হয়েছে তা তারা মোটেই বুঝতে পারে না। তারপরও তারা বলে, আমরা কেন বিজয়ী হ’তে পারলাম না? আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য পিছিয়ে যাওয়ার রহস্য কি? ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدَ أَنْفُسِكُمْ . ‘আপনি বলুন, তাতো তোমাদের নিজেদেরই কারণে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)।
সুতরাং হক পথে চলতে পারষ্পরিক উপদেশ দান করা বিজয় ও সাহায্য নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাদের প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন। এরূপ উপদেশ দান সমাজে চালু থাকলে মানুষ ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীম’ বা ইসলামের অভ্রান্ত সরল পথে অবিচল থাকতে সক্ষম হয়। বিচ্যুতির ভয় থাকে না।
(২) হক পথে চলতে পারষ্পরিক ধৈর্য-সহিঞ্চুতার উপদেশ দান :
কোন জিনিসের সময় না হ’তেই উহার ত্বরিত ফল প্রত্যাশীদের জন্য বিজয় লাভ কখনই সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ ব্যক্তির পক্ষে বিজয় লাভ। ধৈর্য-সহিষ্ণুতার পারষ্পরিক উপদেশে তাড়াহুড়া করার প্রবণতা দূর হয় এবং মুমিন হতাশ ও নৈরাশ্যের চোরাবালি থেকে মুক্তি পায়। এজন্যই কোন মুমিন বান্দা যখন হক পথ অবলম্বন করে, দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিহার করে দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে থাকে; লক্ষ্য অর্জনে তাড়াহুড়া করে না এবং তা বিলম্বিত হ’তে দেখে হতাশ হয় না বরং ধৈর্য ধরে, তখন বিজয় অবশ্যই তার পদচুম্বন করে। বরং এই হক পথ ও ধৈর্যকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারাই বিজয়। কেননা বিজয় অর্জন করতে হ’লে উক্ত দু’টি ব্যতীত লাভ করা সম্ভভ নয়।
[1]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৪/৫৪৭।
لَوْ تَدَبَّرَ النَّاسُ هذِهِ السُّوْرَةَ لَوَسَعَتْهُمْ - ‘মানুষ যদি এই সূরা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করত, তাহ’লে আল্লাহর পথে চলার ক্ষেত্রে তাদের জন্য এই সূরা যথেষ্ট হ’ত।[1] উক্ত সূরায় খুব স্পষ্টভাবে বিজয়ের কর্মনীতি অঙ্কন করা হয়েছে। বিজয়ের পথ ও পদ্ধতি যে একটাই, সে কথার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে সব রকম ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটানো হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা কসম খেয়ে বলেছেন, মানুষ মাত্রই ক্ষতির মধ্যে। সবাই ধ্বংসের মধ্যে। তারপর তিনি এক শ্রেণীর লোককে ক্ষতিগ্রস্ত মানবমন্ডলী থেকে ব্যতিক্রম হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিরাই কেবল সফল, লাভবান ও বিজয়ী। অন্যরা নয়।
এই ব্যতিক্রমধর্মীদের মাঝে বিজয় ও সাফল্যের একত্রে চারটি গুণ বা শর্তের সমাবেশের কথা বলা হয়েছে। যথাঃ
(ক) ঈমান : اَلَّذِيْنَ أمَنُوْا ‘যারা ঈমান এনেছে’।
(খ) সৎকর্মশীলতা : وَعَمِِلُوْا الصّاَلِحَاتِ ‘যারা সৎকর্ম করে’।
(গ) হক্ব পথে থাকার জন্য পরষ্পরে উপদেশ দান: وَتََوَاصَوْا بِالْحَقِّ ‘যারা একে অপরকে হক পথে চলার উপদেশ দেয়’।
(ঘ) হক্ব পথে চলতে ধৈর্যধারণের জন্য পারষ্পরিক উপদেশ দান: وَتَوَاَصَوْا بِالصِّبْرِ ‘এবং যারা একে অপরকে ধৈর্য-সহিষ্ণুতার উপদেশ দেয়’।
এগুলিই হ’ল বিজয় লাভের শর্ত। যারা এই শর্তগুলি পূরণ করবে তারাই ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং মুক্তি পাবে। অর্থাৎ তারা বিজয়ী ও সফল হবে।
লক্ষণীয় হ’ল, আল্লাহ তা‘আলা বিজয়ের শর্তাবলীতে প্রচারের ফলাফল হাতে নাতে পাওয়ার কোন শর্ত আরোপ করেননি। এ শর্তও করেননি যে, প্রচারের ফলে সব লোকের হেদায়াত পেতে হবে বা প্রচারকদের আহবানে সবাইকে সাড়া দিতে হবে। মুসলমান যখন অত্র সূরায় উল্লেখিত চারটি র্শত পূরণ করবে, তখনই তাদের ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি ও বিজয় লাভের ফায়ছালা আল্লাহ শুনিয়েছেন। অন্যরা মুসলমানের দাওয়াতে সাড়া দিবে কিংবা তার লক্ষ্য অর্জিত হবে, নইলে সে যে ক্ষতি থেকে মুক্তি পাবে না, এমন কথা এখানে নেই। এসব কাজ প্রচারকের দায়িত্বে বর্তায় না। সাহায্য ও বিজয় লাভে এটি কোন আবশ্যকীয় দিকও নয়। এটি আল্লাহরই অনুগ্রহ ও অনুকম্পা (বাক্বারাহ ২/১০৫)। বরং এই সূরায় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যক্ত হয়েছে। বিজয়ের সাথে তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
(১) একে অপরকে হক পথে চলার উপদেশ দান :
মানুষ অনেক সময় হক্ব পথে চলতে দুর্বলতা বোধ করে। কখনও তার পদস্খলন ঘটে; কখনও সে হক্ব পথ থেকে একেবারে বিচ্যুত হয়ে যায়। এজন্যই হক্ব পথে চলতে তার জন্য এমন সহযোগী দরকার যে তাকে সঠিক কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে উপদেশ দিবে, তার দেখভাল করবে এবং বিচ্যুতি হ’তে রক্ষা করবে।
অধিকাংশই মনে করে তারা হক পথে রয়েছে, অথচ কখন যে তারা হক্ব পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভুল পথের অনুগামী হয়েছে তা তারা মোটেই বুঝতে পারে না। তারপরও তারা বলে, আমরা কেন বিজয়ী হ’তে পারলাম না? আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য পিছিয়ে যাওয়ার রহস্য কি? ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدَ أَنْفُسِكُمْ . ‘আপনি বলুন, তাতো তোমাদের নিজেদেরই কারণে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)।
সুতরাং হক পথে চলতে পারষ্পরিক উপদেশ দান করা বিজয় ও সাহায্য নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাদের প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন। এরূপ উপদেশ দান সমাজে চালু থাকলে মানুষ ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীম’ বা ইসলামের অভ্রান্ত সরল পথে অবিচল থাকতে সক্ষম হয়। বিচ্যুতির ভয় থাকে না।
(২) হক পথে চলতে পারষ্পরিক ধৈর্য-সহিঞ্চুতার উপদেশ দান :
কোন জিনিসের সময় না হ’তেই উহার ত্বরিত ফল প্রত্যাশীদের জন্য বিজয় লাভ কখনই সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ ব্যক্তির পক্ষে বিজয় লাভ। ধৈর্য-সহিষ্ণুতার পারষ্পরিক উপদেশে তাড়াহুড়া করার প্রবণতা দূর হয় এবং মুমিন হতাশ ও নৈরাশ্যের চোরাবালি থেকে মুক্তি পায়। এজন্যই কোন মুমিন বান্দা যখন হক পথ অবলম্বন করে, দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিহার করে দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে থাকে; লক্ষ্য অর্জনে তাড়াহুড়া করে না এবং তা বিলম্বিত হ’তে দেখে হতাশ হয় না বরং ধৈর্য ধরে, তখন বিজয় অবশ্যই তার পদচুম্বন করে। বরং এই হক পথ ও ধৈর্যকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারাই বিজয়। কেননা বিজয় অর্জন করতে হ’লে উক্ত দু’টি ব্যতীত লাভ করা সম্ভভ নয়।
[1]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৪/৫৪৭।
মানুষের মন সহজাতভাবেই ত্বরাপ্রবণ। তাই আল্লাহর দ্বীনের প্রকাশ্য বিজয় দ্রুত নিশ্চিত হ’লে স্বভাবতই সে খুশী হয়। আর কেনই বা হবে না- এ যে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় এবং বাতিল ও বাতিলপন্থীদের ডিগবাজি। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيْبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ -
‘অন্য যে লাভটি তোমরা ভালবাস, তাহ’ল আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। সুতরাং আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দিন’ (ছফ ৬১/১৩)। আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছি। তিনি বলেন,
وَقَاتِلُوْهُمْ حَتَّى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ لِلّهِ -
‘তোমরা তাদের (অমুসলমিদের) বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও, যে পর্যন্ত না ফিৎনার অবসান হয় এবং দ্বীন সামগ্রিকভাবে আল্লাহর তরে হয়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)।
অতএব তাড়াতাড়ি না করে আমাদের বরং সঠিক পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে এগিয়ে যেতে হবে। সময়মত আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ্য বিজয় দান করবেন ইনশাআল্লাহ। কিন্তু অনেকে এমনকি বিশেষ বিশেষ প্রচারক পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য ও দ্বীনের বিজয় সংঘটিত হওয়া অনেক দূরের ব্যাপার বলে মনে করেন। যার ফলে কখনও কখনও তারা হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন আবার কখনও কর্মপদ্ধতি বদলে ফেলেন। এই বিজয় ও সাহায্য কেন বিলম্বিত হচ্ছে তার কারণ তারা ভেবে দেখেন না। অথচ কারণগুলি জানা থাকলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব প্রচারক, সমাজ, আহবানকৃত ব্যক্তিবর্গ ও অনুসারীদের উপর পড়ত। সুতরাং এই কারণগুলি থাকা অত্যাবশ্যক। সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার কারণগুলিকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি।
(ক) নেতিবাচক কারণ ও (খ) ইতিবাচক কারণ।
নেতিবাচক কারণগুলি জানা থাকলে কিভাবে ঘাটতিগুলি পূরণ করা যায় এবং কিভাবে এর প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তার উপায় অবলম্বন করা যায়। অপরদিকে ইতিবাচক কারণগুলি জানা থাকলে প্রচারক আল্লাহ প্রদত্ত কর্মপদ্ধতি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকতে সমর্থ হয়, এই বিজয় ও সাহায্য ত্বরাণ্বিত হোক কিংবা বিলম্বিত হোক। এ বিষয় নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধারা হ’ল।
(১) সাহায্যের বৈধ কিছু উপকরণ সময় মত যোগাড় না হওয়া :
সাহায্য প্রদানের অনেক উপকরণ রয়েছে। যখন উপকরণগুলি কিংবা তার কিয়দংশ যোগাড় না থাকে তখনই সাহায্য পিছিয়ে যায়। কেননা নীতিশাস্ত্রকারদের মতে, উপকরণ তা-ই যার বিদ্যমানতায় কোন কিছু অস্তিত্ব পায় এবং অবিদ্যমানতায় তা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। হ’তে পারে উপকরণ উপস্থিত থাকলেও অন্য কোন কারণে সাহায্য পিছিয়ে যেতে পারে, কিন্তু উপকরণ সংগৃহীত না থাকলে যে সাহায্য পাওয়া যাবে না তা নিশ্চিত। যেমন সাহায্য প্রদানের একটি বিধিসম্মত উপকরণ হ’ল সমর প্রস্ত্ততি। আল্লাহ বলেন,
وَأَعِدُّواْ لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهِ عَدُوَّ اللّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِيْنَ مِن دُوْنِهِمْ لاَ تَعْلَمُوْنَهُمُ اللّهُ يَعْلَمُهُمْ -
‘তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যথাসাধ্য সমর শক্তি ও অশ্ববহর প্রস্ত্তত রাখ, যদ্বারা তোমরা ভীত করে রাখবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং তাদের বাদে অন্যান্যদেরকেও, যাদের তোমরা জান না কিন্তু আল্লাহ জানেন’ (আনফাল ৮/৬০)।
(২) বাধাবিঘ্ন হেতু সাহায্য পিছিয়ে যাওয়া :
যে বিষয়ের উপস্থিতি ছাড়া উদ্দেশ্য হাছিল হয় না তাকে বলা হয় ‘বাধা’। বিজয় হাছিলে এরূপ কোন বাধা থাকলে বিজয় অর্জিত হবে না, যদিও বাধা না থাকলে সেই বিজয় অর্জিত হবে, এমন কোন কথা নেই। ইসলামের বিরুদ্ধে এরূপ বাধা-বিপত্তি একটা-দু’টা নয়; বরং অনেক। যেমন যুলুম-নিপীড়নে অস্থির করে তোলা, কাফেরদের জীবনযাত্রা ও পাপ-পঙ্কিলতার প্রতি মুসলমানদের মনে ঝোঁক ও আগ্রহ তৈরী হওয়া, নেতার আদেশ অমান্য করা ইত্যাদি। সাহায্যের এসব বাধা-বিপত্তিও পরাজয়ের কারণ। এজন্য আমরা দেখতে পাই ওহোদ যুদ্ধে যখন বিজয়ের আলামত দেখা যাচ্ছিল, তখনই গিরিপথ মুখে নিয়োজিত তীরন্দাযরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদেশ লংঘন করে বসেন। ফলে আসন্ন বিজয় পরিণত হয় দুঃখজনক পরাজয়ে। যেমন আল্লাহ বলেন,
أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُم مُّصِيْبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّىْ هَـذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ -
‘কি ব্যাপার! তোমাদের উপর যখন মুছীবত আসল তখন তোমরা বললে, এ কোথা হ’তে আসল? অথচ তোমরা এর দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বলুন, এ তোমাদের নিজেদেরই পক্ষ হ’তে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)।
ইবনু ইসহাক, ইবনু জারীর, ইবনু আনাস ও সুদ্দী বলেন, আল্লাহর বাণী قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أنْفُسِكُمْ - এর অর্থ হ’ল আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ হেতু তোমরা এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছ। তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা সর্বক্ষণ স্ব স্ব স্থানে অবস্থান করবে। কিন্তু তোমরা তাঁর আদেশ লংঘন করেছ। আল্লাহ এখানে ‘আইনাইন’ গিরিপথে নিযুক্ত তীরন্দাযদের কথা বুঝিয়েছেন। তারা নিজেদের স্থান ত্যাগ করে গনীমত সংগ্রহে লিপ্ত হ’লে পিছন থেকে কাফের বাহিনী মুসলমানদের উপর আক্রমণের সুযোগ পায় এবং তাদের উপর্যুপরি হামলায় মুসলমানরা পরাজিত হয়। এদিকে হুনাইন যুদ্ধে কেন সাহায্য বিলম্বিত হয়েছিল তার কারণ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللّهُ فِيْ مَوَاطِنَ كَثِيْرَةٍ وَّيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئاً وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُم مُّدْبِرِيْنَ -
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে বহু ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে হুনাইন দিবসে। সেদিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে’ (তওবা ৯/২৫)।
হুনাইন যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্য ছিল ১২ হাযার। তাই কিছু মুসলমান বলে বসল, স্বল্প সংখ্যক কাফের আজ এত বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে পরাভূত করতে পারবে না। এই একটি মাত্র কথা তাদের সাহায্য লাভে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আল্লাহ তাদের সংখ্যাধিক্যের হাতে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সংখ্যাধিক্য তাদের কোন উপকার করতে পারেনি। তারপর যখন বাধা অপসারিত হ’ল এবং বুঝে আসল সংখ্যাধিক্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না তখন কিন্তু সাহায্য ঠিকই এসেছিল। আসলে কাজের উপকরণ যোগাড় করার পর ভরসা রাখতে হবে আল্লাহর উপরই। তাহ’লেই অর্জিত হবে কাংখিত লক্ষ্য।
(৩) সঠিক কর্মনীতি পরিত্যাগ :
সঠিক কর্মনীতি হ’তে সরে দাঁড়ানো সাহায্য লাভের অন্যতম বাধা। এ সম্পর্কে সজাগ করার জন্য পৃথক শিরোনামে আমি বিষয়টি আলোচনা করেছি। আমি বর্তমান যুগের অনেক ইসলামী দল ও জিহাদী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ অনুসদ্ধান করেছি এবং তাদের বিজয় লাভে ব্যর্থতা ও ঘোষিত সুন্দর লক্ষ্য অর্জনে বিফলতা নিয়ে গবেষণা করেছি। এ সমস্ত দল আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য ও তাঁর আইন বাস্তয়ানে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আমার দৃষ্টিতে তাদের সাহায্য বঞ্চিত হওয়ার জলজ্যান্ত কারণ হ’ল, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে’র সঠিক কর্মনীতি হ’তে বিচ্যুতি হওয়া। আর এই বিচ্যুতিও ঘটেছে কখনও সমূলে, কখনও আংশিক। বিশেষ করে আক্বীদা ও আমলে। কেউ হয়ত ভাবতে পারে এই বিচ্যুতি তো খুবই সামান্য। কিন্তু আমি মনে করি, এই সামান্য বিচ্যুতিই সাংঘাতিক ক্ষতি ডেকে এনেছে এবং সাহায্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রধান প্রভাব ফেলেছে। এরূপ বিচ্যুতির মধ্যে রয়েছে-
(ক) আক্বীদার ক্ষেত্রে ঢিলেমি ও গড়িমসি দেখানো এবং আক্বীদাকে প্রথম সারির কোন বিষয় হিসাবে গণ্য না করা। অথচ আক্বীদাই হ’ল ইসলামের মৌল ভিত্তি ও অগ্রগণ্য বিষয়। আক্বীদার মাধ্যমেই একটি দলের সফলতা ও সঠিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।
(খ) শত্রু-মিত্রের ধারণা গুলিয়ে ফেলা। যালেম, আল্লাহদ্রোহীদের প্রতি ঝুঁকে পড়া এবং তাদের তোষামোদ করা।
(গ) দলীয় গোঁড়ামি, যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও তিক্ততা দেখা দিয়েছে। এ ধরনের বিচ্যুতির আরও অনেক দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে। অথচ এ সমস্ত মূলনীতি ও দলীল-প্রমাণ লিপিবদ্ধ করা এবং সেগুলিকে কলুষ-কালিমা মুক্ত রাখা একটি মূল্যবান কাজ। এছাড়া দাওয়াতী কর্মনীতির খুঁতহীনতা রক্ষা করা ও সঠিক পথে পরিচালনা করাও মূল বিষয়। একইভাবে শরী‘আতের মূলনীতি ও কায়দা-কানূনের সঙ্গে প্রতিটি কাজ মিলিয়ে দেখলে বাস্তবতা চাপা পড়ে ও কল্পিত সুবিধা লাভের যুক্তি দাঁড় করিয়ে শরী‘আতের পথ থেকে কেটে পড়ার যে ভয় থাকে, তা দূরীভূত হয়।
(৪) উম্মতের পরিপক্কতা ও যোগ্যতার অভাব :
আল্লাহর দ্বীন এক বিরাট ব্যাপার। এর দায়িত্ব বহনের জন্য এমন একটি দল দরকার, যারা দ্বীনের উপর এতটা দীর্ঘ সময় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যে, উহার ভার বহন ও জনগণের মাঝে প্রচারে তারা যথাযথই সক্ষম। কত জাতিই তো সাহায্য লাভের আগেই কষ্ট ও বন্ধুর ঘাঁটি পার হয়ে গেছে বরং সাহায্য অর্জনের জন্যই তারা জীবন দিয়েছে। এভাবে ঘাত-প্রতিঘাত সয়েই পরিপক্কতা, দক্ষতা। আর পরিপক্কতার হাত ধরে আসে স্থায়ী সাহায্য। অদক্ষ মানুষ সাহায্য পেলে তা কাজে লাগাতে পারে না।
তারপরও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় একটি পরিপক্ক ক্ষুদ্র শক্তি যথেষ্ট নয়। এজন্য দরকার বিশাল জনবল এবং তারা হবে নানা রকম ত্যাগ স্বীকারে মানসিকতা সম্পন্ন ও বিশেষ বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন। এটা করতে সময় প্রয়োজন। স্বল্প সময়ে বা সহজে তা হবে না। সুতরাং লোক তৈরি ও তাদের ট্রেনিং প্রদান সবচেয়ে কঠিন ও দুষ্কর। এজন্য আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১৩ বছর ধরে এক একজন লোককে ট্রেনিং দিয়েছেন এবং গ্রুপ গ্রুপ করে রিসালাতের বোঝা বহন ও প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার উপযোগী করে তৈরি করেছেন। ফলে তাঁদের একদল থাকছেন আরকাম (রাঃ)-এর গৃহে তো আরেক দল হিজরত করছেন হাবশায়। একবার সবাইকে আবু ত্বালিব গিরিপথে অন্তরীণাবদ্ধ হ’তে হচ্ছে তো পুনর্বার তারা হিজরত করেছেন মদীনায়।
এজাতীয় নানা কাজ এই উম্মতকে রিসালাতের ভার বহনোপযোগী করে তুলেছিল। এমনি করে শেষ পর্যন্ত দ্বীন পূর্ণতা পেয়েছিল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে বিরাট বিজয় দান করেছিলেন।
পূর্বের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, দ্বীনের পূর্ণতা ও তার প্রাসাদ বিনির্মাণের সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। সময় না হ’লে সাহায্য ও বিজয় আসবে না। দ্বীন যখন মানুষের উপর নযরদারী করতে পারবে, মানুষের মন যখন সেভাবে গঠিত হবে তখনই বিজয় আসবে। প্রচারকদের ততদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং সময় না হওয়াও সাহায্য ও বিজয় পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
(৫) সাহায্যের কদর অনুধাবনে অক্ষমতা :
কোন বড় রকমের কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার ছাড়াই দ্রুত সাহায্য নিশ্চিত হ’লে সেই সাহায্যপ্রাপ্ত জাতি সাহায্যের কদর বা মূল্য বুঝতে পারে না। সেজন্য তারা ঐ সাহায্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিজয়কে ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় শ্রমদান ও ত্যাগ স্বীকারে কুণ্ঠিত হয়। এই বাস্তবতা তুলে ধরতে আমি দু’টি উদাহরণ পেশ করছি।
প্রথমতঃ দারিদ্রে্যর নিমর্ম কষাঘাতে জর্জরিত কোন ব্যক্তি যখন স্বীয় চেষ্টা ও শ্রম দ্বারা সম্পদশালী-ধনাঢ্য মানুষে পরিণত হয়, তখন আমরা দেখতে পাই কতই না প্রাণান্তকর চেষ্টা করে তার অর্থবিত্ত হেফাযত করে। কোনরূপ বিপদ বা ঝুঁকি দেখা দিলে উহা রক্ষার্থে সে সম্ভাব্য সকল উপায়ই অবলম্বন করে। তার কারণ সে দারিদ্রে্যর স্বাদ ও লাঞ্ছনা উপভোগ করেছে। তারপর সম্পদ সঞ্চয় ও বর্ধনে কষ্ট-ক্লেশ স্বীকার করেছে। সুতরাং তার পক্ষে ঐ সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সহজ নয়। আল্লাহ তাকে দরিদ্রতা হ’তে উদ্ধার করার পর সে আবার উহার আবর্তে ফেঁসে যেতে ঠিক তদ্রূপ ঘৃণা করবে, যেমন সে আল্লাহর অনুগ্রহে কুফর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় তাতে ফিরে যেতে ঘৃণাবোধ করে।
কিন্তু তার সন্তানাদি ও উত্তরাধিকারীরা কি অত গুরুত্ব দিবে? তাদের অনেককেই দেখা যাবে তারা ঐ সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং কেউ কেউ তা অনর্থক উড়িয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত গরীব হয়ে যায়। তার কারণ, সে ঐ অর্থ-বিত্তের মূল্য কি তা জানেনি। তা উপার্জন ও সঞ্চয়ে কোন ক্লেশ ভোগ করেনি এবং তার পূর্বসূরীর মত অভাব-অভিযোগের স্বাদ আস্বাদনের সুযোগও তার হয়নি।
দ্বিতীয়তঃ অনুসদ্ধানে ধরা পড়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সাংঘাতিক রকম দুরূহ কাজ। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের শাসক ও খলীফাগণকে দেখা যায়, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং রাষ্ট্রের দুর্বল হওয়ার মত কারণ ঘটতে পারে এমন সব কিছুই সামাল দিতে তারা দ্বিগুণ চতুর্গুণ শ্রম ব্যয় করে যান। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা পিতৃ সম্পদের মালিক হওয়ার মতই রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিক হয়; তারা তখন রাষ্ট্র চালনা রেখে রাষ্ট্রের ফলভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র রক্ষায় যে ক্লেশ স্বীকার করা দরকার সে সম্বন্ধে তাদের কোন চেতনা থাকে না। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে দুর্বলতা ও ভাঙ্গন দেখা যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত উহা তার পতন ডেকে আনে।
এজন্যই কোন কষ্ট-ক্লেশ ছাড়া বিজয় এলে তা সময় বিশেষে স্থায়ী নাও হ’তে পারে এবং সে বিজয়েকে ধরে রাখাও কষ্টকর হতে পারে। এ কারণে আল্লাহর হিকমত বা কৌশল অনুসারে সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হয়, যাতে দ্বীনের কাজের গুরুত্ব সবার নিকট সমানভাবে অনুভূত হয় এবং এমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা বিজয়ের মূল্য কী ও তা কতটুকু দাম পাওয়ার উপযুক্ত তা জানতে পারে।
(৬) আল্লাহর মহাজ্ঞানে নিহিত হিকমত হেতু বিলম্ব :
কখনও মহান আল্লাহর জ্ঞানে রয়ে যায় যে, দ্বীনের বর্তমান আন্দোলনকারীরা জয়লাভ করলে বিজয়ের দাবী তথা অত্র ভূখন্ডে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, ছালাত কায়েম, যাকাত আদায় ইত্যাদি সম্ভব হবে না, তখন সাহায্য বিলম্বিত হয়। কেননা শুধু জয়লাভ তো কাম্য নয়; বরং জয় লাভের মাধ্যমে যা বাস্তবায়ন করতে হবে তার জন্যই উহা দরকার। সেটা হ’ল ফিৎনা বা আল্লাহদ্রোহী আইনের মূলোৎপাটন এবং সর্বতোভাবে আল্লাহর দ্বীনের বাস্তবায়ন। একথাই আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী হ’তে বোঝা যায়ঃ
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ، الَّذِيْنَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِيْ الْأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلاَةَ وَآتَوُْا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ -
‘আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন, যারা তাঁকে সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী। যাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলে তারা ছালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর হাতে (হজ্জ ২২/৪০-৪১)। মানুষ বা দল বিশেষের জন্য আল্লাহর সাহায্য ত্বরান্বিত হয় আবার দল বিশেষের জন্য বিলম্বিত হয়। তার কারণ কখনও আমরা জানতে পারি, আবার কখনও জানতে পারি না। কিন্তু আল্লাহ সব কিছুই জানেন। তাই তিনি অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন।
বাস্তবে দেখা যায় একদল লোক অস্বচ্ছলতা ও কষ্টের সময় দৃঢ়তার পরিচয় দেয়, বালা-মুছীবতে অনমনীয়তা, অমুখাপেক্ষিতা, সততা ইত্যাদি প্রদর্শন করে; অথচ তারাই আবার সুখে-সম্পদে ও শান্তির সময়ে দুর্বল মনের পরিচয় দেয়, সততা থেকে পিছিয়ে আসে, লোভ-লালসা হেতু স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিবাজ হয়ে দাঁড়ায়। যে জাতির চারিত্রিক ও মানসিক অবস্থা এমন সে জাতি সাহায্য লাভের উপযুক্ত নয়। আল্লাহ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জ্ঞাত। যা হয়নি তা হ’লে কেমন হ’ত সেটাও তার জানা।
(৭) বাতিলের পরিচয় ফুটে না ওঠা :
যে বাতিলের বিরুদ্ধে দ্বীন প্রচারকগণ সংগ্রাম করছেন সেই বাতিল ও তার ধারক-বাহকরা অনেক সময় দ্বীন প্রচারকসহ অপরাপর মানুষের সম্পূর্ণ অগোচরে থেকে যায়। যারা কখনই বাতিলের পক্ষে যাবার নয় এবং বাতিলের আসল রূপ উদঘাটিত হ’লে যারা কখনই উহাকে মেনে নেবার নয়, তারাও বাতিল দ্বারা প্রতারিত হয়ে সময় বিশেষে উহার সহযোগী বনে যায়। এভাবে হক্বপন্থীদের মাঝে বাতিল ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে সুযোগমত তাদের ক্ষতি করে চলে। তাদের প্রভাবেও আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হয়। মুনাফিকদের ঘটনা-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক ছাহাবীই মুনাফেকীর অলিগলি সম্বন্ধে জানতেন না। মুনাফিক আছে জানলেও তারা মুনাফিকদের অনেক নাটের গুরুকে চিনতেন না। তারা বরং তাদের প্রতি সুধারণাই পোষণ করতেন।
বনী মুস্তালিক্ব যুদ্ধে মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুহাজির ছাহাবীগণের প্রসঙ্গে খুবই অশালীন উক্তি করেছিল। সূরা মুনাফিকূনের ৭ ও ৮ নং আয়াতে তা উল্লেখ আছে। তার সেই কথা বালক ছাহাবী যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানালে ওমর (রাঃ) তাঁকে বলেন, ‘আপনি আববাস বিন বিশরকে হুকুম দিন, সে তাকে হত্যা করুক। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘ওমর! তা কী করে হয়? লোকেরা তখন বলবে, মুহাম্মাদ তার নিজের লোকদের হত্যা করছে। তার চেয়ে বরং তুমি যাত্রার ঘোষণা দাও। এ থেকে অনেক লোকের দৃষ্টিতে মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবী গণ্য হ’তে থাকে। তাদের আসল পরিচয় তাদের সামনে অনুদঘাটিত থেকে গেছে। ওদের মুল পরিচয় হ’ল,
هُمُ الْعَدُوُّ فَاحْذَرْهُمْ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُوْنَ ‘ওরা শত্রু। সুতরাং ওদের সম্বন্ধে সাবধান থাকুন। আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন। ওরা উল্টো কোন দিকে যাচ্ছে? (মুনাফিকূন ৬৩/ ৪)।
এজন্যেই যখন বহু সংখ্যক লোকের নিকট তাদের আসল ভেদ ও পরিচয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-কে ঘটনাচক্রে বলেছিলেন, ‘হে ওমর, আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের কথা কি তোমার মনে পড়ে? আল্লাহর কসম, যেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, ‘ওকে হত্যা করুন’, সেদিন যদি আমি তাকে হত্যা করতাম তাহ’লে অবশ্যই তার পক্ষ নিয়ে অনেক বাহাদুর মাঠ কাঁপিয়ে তুলত। অথচ আজকে তাদেরকে আমি আদেশ দিলে অবশ্যই তাকে হত্যা করবে, কোন সমস্যা করবে না। ওমর বললেন, আল্লাহর কসম, আমি বুঝতে পারলাম আমাদের সেদিনের কথা হ’তে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গৃহীত ব্যবস্থা ছিল কল্যাণকর’।
এই হাদীছ সাহায্য ও বিজয় পিছিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত আমাদের বর্ণিত কারণের একটি অর্থবহ সূক্ষ্মচিত্র। তাই যাদের বাতিল চরিত্র সম্পূর্ণ উদঘাটিত হয়নি এমন লোকদের সাথে সংঘর্ষে জড়ালে মুসলিম উম্মাহর উপর তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। কেননা অনেক মুসলমান ওদের ভাল মনে করে ওদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে।
এরূপ অবস্থান গ্রহণের ঘটনা আয়েশা (রাঃ)-এর চরিত্রে বানাওয়াট কলঙ্ক লেপনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত অপবাদ সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, ‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে আব্দুল্লাহ বিন উবাই সম্পর্কে অভিযোগ করে বললেন, হে মুসলমানগণ, তোমরা এমন কে আছ, যে আমাকে ঐ ব্যক্তির হাত হ’তে উদ্ধার করতে পারবে যে আমার পরিবারকে কেন্দ্র করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আল্লাহর কসম, আমি আমার পরিবার সম্পর্কে ভাল বৈ অন্য কিছু জানি না। আর তারাও যে ব্যক্তির কথা বলছে তাকেও ভাল বৈ জানি না। সে আমার সঙ্গে ব্যতীত একা কোন দিন আমার পরিবারের সাথে দেখা করত না। তখন সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) উঠে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (ছাঃ)! আমি আপনাকে তার অপবাদ থেকে উদ্ধার করব। যদি সে আওস গোত্রের হয় তাহ’লে আমরা তার গর্দান উড়িয়ে দিব, আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের হয় তাহ’লে আপনি যা আদেশ করবেন আমরা সে মত কাজ করব। তারপর খাযরাজ গোত্রীয় সা‘দ বিন ঊবাদা (রাঃ) উঠে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তুমি অসত্য বলছ। তুমি তাকে হত্যা করবে না। তাকে হত্যা করার ক্ষমতা তোমার নেই। সে তোমার গোত্রের লোক হ’লে তাকে হত্যা করা তুমি পসন্দ করতে না। এই সা‘দ বিন উবাদা (রাঃ) কিন্তু খাযরাজের গোত্রপতি ও সৎ লোক ছিলেন। কিন্তু ঐ সময়ে তিনি জাত্যাভিমানে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। সা‘দের কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে সা‘দ বিন মু‘আযের চাচাত ভাই উসাইদ বিন হুযাইর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ, ‘তুমি মিথ্যা বলছ। আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। নিশ্চয়ই তুমি মুনাফিক। মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে তর্ক করছ’।
এতে আওস, খাযরাজ দুই দলই উত্তেজিত হয়ে পড়ল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে থাকতেই তারা সংঘর্ষ বাধাবার উপক্রম করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বারবার তাদের নিরস্ত হ’তে বলায় শেষ পর্যন্ত তারা থেমে গেল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও চুপ হয়ে গেলেন (বুখারী হা/৪১৪১, মুসলিম হা/২৭৭০)। কিছু মুসলমান হয়ত প্রত্যক্ষভাবে বাতিলপন্থীদের পক্ষ নেয় না, কিন্তু হক্বপন্থী প্রচারক ও কর্মীদের পক্ষেও তাদের অবস্থান খুবই শিথিল ও দ্বিধাজড়িত। কারণ বাতিলপন্থীরা যে বাতিলের উপর আছে সেরকম কোন পাকাপোক্ত বিশ্বাস তারা করে না। তারা বরং মনে করে এরাও মুসলমান। ফলে শত্রুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগ্রাম ও সংঘর্ষে এ জাতীয় মুসলমানেরা অংশ নিতে আগ্রহী হয় না। এরা নিজেদের উদারপন্থী হিসাবে যাহির করতে চায়। এভাবে কখনও কখনও মুসলমানদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি থেকে দলাদলি সৃষ্টি হয় এবং সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হয়।
(৮) সাংঘর্ষিক পরিবেশ :
সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার আরেকটি কারণ সাংঘর্ষিক পরিবেশ। সাংঘর্ষিক পরিবেশ কখনও কখনও সত্য, শুভ ও ন্যায়পরায়ণতাকে মেনে নেয়ার মত উপযোগী থাকে না। তাই ঐ পরিবেশের সাথে কোন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আগেই এমন কিছু কাজ করা প্রয়োজন, যাতে সংঘর্ষ বিদূরীত হয়ে উক্ত পরিবেশ সত্য, শুভ ও ন্যায়রায়ণতা গ্রহণে প্রস্ত্তত হয়। সে সব কাজের মধ্যে রয়েছে (১) ইসলামের বিরুদ্ধাচারী জাতিগুলি বাতিল ও ভ্রান্তির উপর বিদ্যমান এ কথাটি প্রচারে আইনানুগ সকল মাধ্যমকে ব্যবহার করা (২) তাদের যাবতীয় আপত্তির সদুত্তর নিয়ে মনস্ত্তষ্ট করা এবং ইসলামের প্রতি আহবান জানান। (৩) ইসলামের প্রকৃত মর্ম তুলে ধরা এবং প্রতিপক্ষ যে বাতিলের উপর আছে তার ক্ষতি সম্বন্ধে তাদের সচেতন করে তোলা। এসব কর্মকান্ড যুদ্ধ বা সংঘর্ষ বাধার আগে প্রতিপক্ষের হেদায়াতের মাধ্যম হ’তে পারে। যদি তা না হয় তবে সত্য জানার মাধ্যম তো হবেই। এ থেকেই যুদ্ধের পর সত্য গ্রহণের সুযোগ হ’তে পারে। এজন্যই যুদ্ধ বা সংঘর্ষ শুরুর আগেই ইসলামের দাওয়াত প্রদানের বিধান রয়েছে।
(৯) আল্লাহর দ্বীন গ্রহণে সাড়া না দেওয়া :
প্রচারকদের দিকে লক্ষ্য করলে তাদের সন্তোষজনক কর্মকান্ড হেতু সাহায্যের বিস্তর সম্ভাবনা কখনও কখনও দেখা দিলেও বাধা এসে দেখা দেয় যাদের মাঝে প্রচার চালান হচ্ছে তাদের কারণে। যেমন ৮নং ক্ষেত্রে বিধৃত হয়েছে। এ রকম একটি বাধা হ’ল, আল্লাহর পরিকল্পনায় এসব জাতির জন্য হেদায়াত না রাখা। এরা এত কট্টর বিরোধী ও পাপাচারী যে, হেদায়াতকে মোটেও সহ্য করতে রাযী নয়। ফলে আল্লাহ তাদের হেদায়াত করার ইচ্ছা বাদ দিয়েছেন এবং তাদের ললাটে গুমরাহী লিখে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, أَفَلَمْ يَيْأَسِ الَّذِيْنَ آمَنُوْاْ أَن لَّوْ يَشَاءُ اللّهُ لَهَدَى النَّاسَ جَمِيْعاً ‘তবে কি যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই সকল মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন’ (রা‘দ ১৩/৩১)।
فَمِنْهُمْ مَّنْ هَدَى اللّهُ وَمِنْهُمْ مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلالَةُ . ‘অতঃপর তাদের কিছু লোককে আল্লাহ সৎ পথে আনলেন এবং কিছু লোকের উপর গুমরাহী অবারিত হয়ে গেল’ (নাহল ১৬/৩৬)।
أُوْلَـئِكَ الَّذِيْنَ لَمْ يُرِدِ اللّهُ أَن يُطَهِّرَ قُلُوْبَهُمْ ‘ওরাই (ইহুদীরাই) তারা, যাদের অন্তরকে আল্লাহ নিষ্কলুষ করতে চাননি’ (মায়েদাহ ৫/৪১)। এমনিতর আরও অনেক আয়াত কুরআনে বিধৃত আছে।
(১০) প্রচারকের মৃত্যুর পরে বিজয় :
প্রচারকের মৃত্যুর পর বিজয় আসবে বলেও অনেক সময় আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হয়। তাছাড়া প্রচারকের জীবদ্দশায় যতটুকু বিজয় অর্জিত হয় তার মৃত্যুর পর তা থেকেও অনেক বড় মাপের বিজয় অর্জিত হয়। কেননা জয় মানে তো কর্মসূচীর জয়, ব্যক্তির নিজের জয় নয়। ব্যক্তি বা মানুষকে তো তার প্রচার ও সততার প্রতিদানে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করার দায়িত্ব মহান আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন, চাই সে জয়ী হোক কিংবা না হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَن يُقَاتِلْ فِيْ سَبِيْلِ اللّهِ فَيُقْتَلْ أَو يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيْهِ أَجْراً عَظِيْماً
‘যে আল্লাহর রাহে যু্&দ্ধ করে সে নিহত কিংবা জয়ী হোক তাকে শ্রীঘ্রই আমি মহাপুরস্কার প্রদান করব’ (নিসা ৪/৭৪)।
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُواْ فِي سَبِيْلِ اللّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ -
‘যারা আল্লাহর রাহে যুদ্ধে নিহত হয় তাদের তুমি কখনই মৃত ভেব না। বরং তারা জীবিত; তারা তাদের প্রভুর নিকটে রিযিক প্রাপ্ত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)।
قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِيْ يَعْلَمُوْنَ، بِمَا غَفَرَ لِيْ رَبِّي وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُكْرَمِيْنَ -
‘তিনি বললেন, হায়! আমার কওম যদি জানতে পারত, কেন আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে স্থান দিয়েছেন’ (ইয়াসীন ৩৬/২৬-২৭)।
اُدْخُلُواْ الْجَنَّةَ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُوْنَ ‘তোমরা যে আমল করতে তার বদৌলতে (আজ) জান্নাতে প্রবেশ কর’ (নাহল ১৬/৩২)।
إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبَّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِىْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ- نَحْنُ أَوْلِيَاءُكُمْ فِىْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِىْ الْأَخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِىْ أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ -
‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর সে কথার উপর অবিচল থেকেছে* (মৃত্যুকালে) তাদের নিকট ফিরিশতা এসে বলবে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তাও করো না। তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তোমার বন্ধু আছি ইহকালে ও পরকালে। সেখানে তোমাদের মন যা চাইবে মিলবে এবং তোমরা মুখ ফুটে যা চাইবে তাও পাবে’ (হা-মীম সিজদা ৪১/৩০-৩১)।
কত প্রচারক অতীত হয়ে গেছেন যাদের জীবদ্দশায় দ্বীন জয়লাভ করেনি, অথচ তাদের মৃত্যুর পর তা বিশাল বিজয় লাভ করেছে। পরিখাওলাদের সেই বালকের কথাই ধরুন, যার আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-কে জেল খানাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি যে কর্মসূচী রেখে গিয়েছিলেন, কার্যক্রম এঁকে দিয়েছিলেন তা তার মৃত্যুর অনেক অনেক পরে এসে চরম সাফল্য লাভ করেছিল। এমন ঘটনা দু’ একটা নয়, অসংখ্য।
(১১) প্রচারকদের পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধিকরণ :
প্রচারকদের পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধ করার মানসে সাহায্য পিছিয়ে যায়। আবার তাতে এমন অনেক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাও থাকে, যা পরবর্তীকালের মানুষের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনে। মহান আল্লাহ বলেন,
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُواْ مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللّهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللّهِ قَرِيْبٌ -
‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছে যে, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের মাঝে এখনও তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত অবস্থা উপস্থিত হয়নি। তাদেরকে দারিদ্র্য ও রোগ-শোক জাপটে ধরেছিল এবং তারা এমন (বিপদের) ঝাঁকুনি খেয়েছিল যে, স্বয়ং রাসূল এবং তার সঙ্গী মুমিনগণ পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটেই’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)।
অন্যত্র আয়াতে এসেছে,
أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوْا أَن يَّقُولُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْن -
‘মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ একথা বললেই তারা ছাড়া পেয়ে যাবে, তাদের কোন পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্বেকার লোকদের আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো অবশ্যই নির্ধারণ করে নিতে হবে, কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী’ (আনকাবূত ২৯/১-৩)।
প্রকাশ্য বিজয় ও সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার পিছনে এগুলি আমার নিকটে সুস্পষ্ট কারণ হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে। তবে বিজয় ও সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার এসব কারণ কখনও আমাদের নযরে ধরা পড়ে, আবার কখনও ধরা পড়ে না। যাই হোক, আমাদের যেটা প্রত্যয় রাখা যরূরী তা হ’ল, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যার্থে যত বৈধ উপায় আছে তা অবলম্বন করা। বিজয় বা সাহায্য কোনটাই হাতে ধরে বাস্তবে রূপায়িত করা আমাদের দায়িত্ব নয়। সেটা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ও তা‘আলার হাতে। وَماَ النَّصْرُ إلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ - ‘সাহায্য কেবল আল্লাহর পক্ষ হ’তে। আর সাহায্য কখন নিশ্চিত হবে তাও আল্লাহর জ্ঞানে নির্ধারিত আছে। নির্ধারিত সেই সময় না আসা পর্যন্ত কখনই সাহায্য আসবে না। আমাদের সীমিত ধারণা মত সাহায্য বাস্তবায়িত হবার নয়। আবার আল্লাহ যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হবেই এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে সাহায্য আসবে না। যারা সন্দেহের দোলায় দোদুল্যমান তারা সাহায্য লাভের যোগ্য নয়।
وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيْبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ -
‘অন্য যে লাভটি তোমরা ভালবাস, তাহ’ল আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। সুতরাং আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দিন’ (ছফ ৬১/১৩)। আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছি। তিনি বলেন,
وَقَاتِلُوْهُمْ حَتَّى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ لِلّهِ -
‘তোমরা তাদের (অমুসলমিদের) বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও, যে পর্যন্ত না ফিৎনার অবসান হয় এবং দ্বীন সামগ্রিকভাবে আল্লাহর তরে হয়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)।
অতএব তাড়াতাড়ি না করে আমাদের বরং সঠিক পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে এগিয়ে যেতে হবে। সময়মত আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ্য বিজয় দান করবেন ইনশাআল্লাহ। কিন্তু অনেকে এমনকি বিশেষ বিশেষ প্রচারক পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য ও দ্বীনের বিজয় সংঘটিত হওয়া অনেক দূরের ব্যাপার বলে মনে করেন। যার ফলে কখনও কখনও তারা হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন আবার কখনও কর্মপদ্ধতি বদলে ফেলেন। এই বিজয় ও সাহায্য কেন বিলম্বিত হচ্ছে তার কারণ তারা ভেবে দেখেন না। অথচ কারণগুলি জানা থাকলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব প্রচারক, সমাজ, আহবানকৃত ব্যক্তিবর্গ ও অনুসারীদের উপর পড়ত। সুতরাং এই কারণগুলি থাকা অত্যাবশ্যক। সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার কারণগুলিকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি।
(ক) নেতিবাচক কারণ ও (খ) ইতিবাচক কারণ।
নেতিবাচক কারণগুলি জানা থাকলে কিভাবে ঘাটতিগুলি পূরণ করা যায় এবং কিভাবে এর প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তার উপায় অবলম্বন করা যায়। অপরদিকে ইতিবাচক কারণগুলি জানা থাকলে প্রচারক আল্লাহ প্রদত্ত কর্মপদ্ধতি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকতে সমর্থ হয়, এই বিজয় ও সাহায্য ত্বরাণ্বিত হোক কিংবা বিলম্বিত হোক। এ বিষয় নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধারা হ’ল।
(১) সাহায্যের বৈধ কিছু উপকরণ সময় মত যোগাড় না হওয়া :
সাহায্য প্রদানের অনেক উপকরণ রয়েছে। যখন উপকরণগুলি কিংবা তার কিয়দংশ যোগাড় না থাকে তখনই সাহায্য পিছিয়ে যায়। কেননা নীতিশাস্ত্রকারদের মতে, উপকরণ তা-ই যার বিদ্যমানতায় কোন কিছু অস্তিত্ব পায় এবং অবিদ্যমানতায় তা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। হ’তে পারে উপকরণ উপস্থিত থাকলেও অন্য কোন কারণে সাহায্য পিছিয়ে যেতে পারে, কিন্তু উপকরণ সংগৃহীত না থাকলে যে সাহায্য পাওয়া যাবে না তা নিশ্চিত। যেমন সাহায্য প্রদানের একটি বিধিসম্মত উপকরণ হ’ল সমর প্রস্ত্ততি। আল্লাহ বলেন,
وَأَعِدُّواْ لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهِ عَدُوَّ اللّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِيْنَ مِن دُوْنِهِمْ لاَ تَعْلَمُوْنَهُمُ اللّهُ يَعْلَمُهُمْ -
‘তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যথাসাধ্য সমর শক্তি ও অশ্ববহর প্রস্ত্তত রাখ, যদ্বারা তোমরা ভীত করে রাখবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং তাদের বাদে অন্যান্যদেরকেও, যাদের তোমরা জান না কিন্তু আল্লাহ জানেন’ (আনফাল ৮/৬০)।
(২) বাধাবিঘ্ন হেতু সাহায্য পিছিয়ে যাওয়া :
যে বিষয়ের উপস্থিতি ছাড়া উদ্দেশ্য হাছিল হয় না তাকে বলা হয় ‘বাধা’। বিজয় হাছিলে এরূপ কোন বাধা থাকলে বিজয় অর্জিত হবে না, যদিও বাধা না থাকলে সেই বিজয় অর্জিত হবে, এমন কোন কথা নেই। ইসলামের বিরুদ্ধে এরূপ বাধা-বিপত্তি একটা-দু’টা নয়; বরং অনেক। যেমন যুলুম-নিপীড়নে অস্থির করে তোলা, কাফেরদের জীবনযাত্রা ও পাপ-পঙ্কিলতার প্রতি মুসলমানদের মনে ঝোঁক ও আগ্রহ তৈরী হওয়া, নেতার আদেশ অমান্য করা ইত্যাদি। সাহায্যের এসব বাধা-বিপত্তিও পরাজয়ের কারণ। এজন্য আমরা দেখতে পাই ওহোদ যুদ্ধে যখন বিজয়ের আলামত দেখা যাচ্ছিল, তখনই গিরিপথ মুখে নিয়োজিত তীরন্দাযরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদেশ লংঘন করে বসেন। ফলে আসন্ন বিজয় পরিণত হয় দুঃখজনক পরাজয়ে। যেমন আল্লাহ বলেন,
أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُم مُّصِيْبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّىْ هَـذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ -
‘কি ব্যাপার! তোমাদের উপর যখন মুছীবত আসল তখন তোমরা বললে, এ কোথা হ’তে আসল? অথচ তোমরা এর দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বলুন, এ তোমাদের নিজেদেরই পক্ষ হ’তে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)।
ইবনু ইসহাক, ইবনু জারীর, ইবনু আনাস ও সুদ্দী বলেন, আল্লাহর বাণী قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أنْفُسِكُمْ - এর অর্থ হ’ল আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ হেতু তোমরা এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছ। তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা সর্বক্ষণ স্ব স্ব স্থানে অবস্থান করবে। কিন্তু তোমরা তাঁর আদেশ লংঘন করেছ। আল্লাহ এখানে ‘আইনাইন’ গিরিপথে নিযুক্ত তীরন্দাযদের কথা বুঝিয়েছেন। তারা নিজেদের স্থান ত্যাগ করে গনীমত সংগ্রহে লিপ্ত হ’লে পিছন থেকে কাফের বাহিনী মুসলমানদের উপর আক্রমণের সুযোগ পায় এবং তাদের উপর্যুপরি হামলায় মুসলমানরা পরাজিত হয়। এদিকে হুনাইন যুদ্ধে কেন সাহায্য বিলম্বিত হয়েছিল তার কারণ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللّهُ فِيْ مَوَاطِنَ كَثِيْرَةٍ وَّيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئاً وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُم مُّدْبِرِيْنَ -
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে বহু ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে হুনাইন দিবসে। সেদিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে’ (তওবা ৯/২৫)।
হুনাইন যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্য ছিল ১২ হাযার। তাই কিছু মুসলমান বলে বসল, স্বল্প সংখ্যক কাফের আজ এত বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে পরাভূত করতে পারবে না। এই একটি মাত্র কথা তাদের সাহায্য লাভে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আল্লাহ তাদের সংখ্যাধিক্যের হাতে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সংখ্যাধিক্য তাদের কোন উপকার করতে পারেনি। তারপর যখন বাধা অপসারিত হ’ল এবং বুঝে আসল সংখ্যাধিক্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না তখন কিন্তু সাহায্য ঠিকই এসেছিল। আসলে কাজের উপকরণ যোগাড় করার পর ভরসা রাখতে হবে আল্লাহর উপরই। তাহ’লেই অর্জিত হবে কাংখিত লক্ষ্য।
(৩) সঠিক কর্মনীতি পরিত্যাগ :
সঠিক কর্মনীতি হ’তে সরে দাঁড়ানো সাহায্য লাভের অন্যতম বাধা। এ সম্পর্কে সজাগ করার জন্য পৃথক শিরোনামে আমি বিষয়টি আলোচনা করেছি। আমি বর্তমান যুগের অনেক ইসলামী দল ও জিহাদী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ অনুসদ্ধান করেছি এবং তাদের বিজয় লাভে ব্যর্থতা ও ঘোষিত সুন্দর লক্ষ্য অর্জনে বিফলতা নিয়ে গবেষণা করেছি। এ সমস্ত দল আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য ও তাঁর আইন বাস্তয়ানে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আমার দৃষ্টিতে তাদের সাহায্য বঞ্চিত হওয়ার জলজ্যান্ত কারণ হ’ল, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে’র সঠিক কর্মনীতি হ’তে বিচ্যুতি হওয়া। আর এই বিচ্যুতিও ঘটেছে কখনও সমূলে, কখনও আংশিক। বিশেষ করে আক্বীদা ও আমলে। কেউ হয়ত ভাবতে পারে এই বিচ্যুতি তো খুবই সামান্য। কিন্তু আমি মনে করি, এই সামান্য বিচ্যুতিই সাংঘাতিক ক্ষতি ডেকে এনেছে এবং সাহায্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রধান প্রভাব ফেলেছে। এরূপ বিচ্যুতির মধ্যে রয়েছে-
(ক) আক্বীদার ক্ষেত্রে ঢিলেমি ও গড়িমসি দেখানো এবং আক্বীদাকে প্রথম সারির কোন বিষয় হিসাবে গণ্য না করা। অথচ আক্বীদাই হ’ল ইসলামের মৌল ভিত্তি ও অগ্রগণ্য বিষয়। আক্বীদার মাধ্যমেই একটি দলের সফলতা ও সঠিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।
(খ) শত্রু-মিত্রের ধারণা গুলিয়ে ফেলা। যালেম, আল্লাহদ্রোহীদের প্রতি ঝুঁকে পড়া এবং তাদের তোষামোদ করা।
(গ) দলীয় গোঁড়ামি, যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও তিক্ততা দেখা দিয়েছে। এ ধরনের বিচ্যুতির আরও অনেক দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে। অথচ এ সমস্ত মূলনীতি ও দলীল-প্রমাণ লিপিবদ্ধ করা এবং সেগুলিকে কলুষ-কালিমা মুক্ত রাখা একটি মূল্যবান কাজ। এছাড়া দাওয়াতী কর্মনীতির খুঁতহীনতা রক্ষা করা ও সঠিক পথে পরিচালনা করাও মূল বিষয়। একইভাবে শরী‘আতের মূলনীতি ও কায়দা-কানূনের সঙ্গে প্রতিটি কাজ মিলিয়ে দেখলে বাস্তবতা চাপা পড়ে ও কল্পিত সুবিধা লাভের যুক্তি দাঁড় করিয়ে শরী‘আতের পথ থেকে কেটে পড়ার যে ভয় থাকে, তা দূরীভূত হয়।
(৪) উম্মতের পরিপক্কতা ও যোগ্যতার অভাব :
আল্লাহর দ্বীন এক বিরাট ব্যাপার। এর দায়িত্ব বহনের জন্য এমন একটি দল দরকার, যারা দ্বীনের উপর এতটা দীর্ঘ সময় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যে, উহার ভার বহন ও জনগণের মাঝে প্রচারে তারা যথাযথই সক্ষম। কত জাতিই তো সাহায্য লাভের আগেই কষ্ট ও বন্ধুর ঘাঁটি পার হয়ে গেছে বরং সাহায্য অর্জনের জন্যই তারা জীবন দিয়েছে। এভাবে ঘাত-প্রতিঘাত সয়েই পরিপক্কতা, দক্ষতা। আর পরিপক্কতার হাত ধরে আসে স্থায়ী সাহায্য। অদক্ষ মানুষ সাহায্য পেলে তা কাজে লাগাতে পারে না।
তারপরও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় একটি পরিপক্ক ক্ষুদ্র শক্তি যথেষ্ট নয়। এজন্য দরকার বিশাল জনবল এবং তারা হবে নানা রকম ত্যাগ স্বীকারে মানসিকতা সম্পন্ন ও বিশেষ বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন। এটা করতে সময় প্রয়োজন। স্বল্প সময়ে বা সহজে তা হবে না। সুতরাং লোক তৈরি ও তাদের ট্রেনিং প্রদান সবচেয়ে কঠিন ও দুষ্কর। এজন্য আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১৩ বছর ধরে এক একজন লোককে ট্রেনিং দিয়েছেন এবং গ্রুপ গ্রুপ করে রিসালাতের বোঝা বহন ও প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার উপযোগী করে তৈরি করেছেন। ফলে তাঁদের একদল থাকছেন আরকাম (রাঃ)-এর গৃহে তো আরেক দল হিজরত করছেন হাবশায়। একবার সবাইকে আবু ত্বালিব গিরিপথে অন্তরীণাবদ্ধ হ’তে হচ্ছে তো পুনর্বার তারা হিজরত করেছেন মদীনায়।
এজাতীয় নানা কাজ এই উম্মতকে রিসালাতের ভার বহনোপযোগী করে তুলেছিল। এমনি করে শেষ পর্যন্ত দ্বীন পূর্ণতা পেয়েছিল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে বিরাট বিজয় দান করেছিলেন।
পূর্বের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, দ্বীনের পূর্ণতা ও তার প্রাসাদ বিনির্মাণের সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। সময় না হ’লে সাহায্য ও বিজয় আসবে না। দ্বীন যখন মানুষের উপর নযরদারী করতে পারবে, মানুষের মন যখন সেভাবে গঠিত হবে তখনই বিজয় আসবে। প্রচারকদের ততদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং সময় না হওয়াও সাহায্য ও বিজয় পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
(৫) সাহায্যের কদর অনুধাবনে অক্ষমতা :
কোন বড় রকমের কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার ছাড়াই দ্রুত সাহায্য নিশ্চিত হ’লে সেই সাহায্যপ্রাপ্ত জাতি সাহায্যের কদর বা মূল্য বুঝতে পারে না। সেজন্য তারা ঐ সাহায্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিজয়কে ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় শ্রমদান ও ত্যাগ স্বীকারে কুণ্ঠিত হয়। এই বাস্তবতা তুলে ধরতে আমি দু’টি উদাহরণ পেশ করছি।
প্রথমতঃ দারিদ্রে্যর নিমর্ম কষাঘাতে জর্জরিত কোন ব্যক্তি যখন স্বীয় চেষ্টা ও শ্রম দ্বারা সম্পদশালী-ধনাঢ্য মানুষে পরিণত হয়, তখন আমরা দেখতে পাই কতই না প্রাণান্তকর চেষ্টা করে তার অর্থবিত্ত হেফাযত করে। কোনরূপ বিপদ বা ঝুঁকি দেখা দিলে উহা রক্ষার্থে সে সম্ভাব্য সকল উপায়ই অবলম্বন করে। তার কারণ সে দারিদ্রে্যর স্বাদ ও লাঞ্ছনা উপভোগ করেছে। তারপর সম্পদ সঞ্চয় ও বর্ধনে কষ্ট-ক্লেশ স্বীকার করেছে। সুতরাং তার পক্ষে ঐ সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সহজ নয়। আল্লাহ তাকে দরিদ্রতা হ’তে উদ্ধার করার পর সে আবার উহার আবর্তে ফেঁসে যেতে ঠিক তদ্রূপ ঘৃণা করবে, যেমন সে আল্লাহর অনুগ্রহে কুফর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় তাতে ফিরে যেতে ঘৃণাবোধ করে।
কিন্তু তার সন্তানাদি ও উত্তরাধিকারীরা কি অত গুরুত্ব দিবে? তাদের অনেককেই দেখা যাবে তারা ঐ সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং কেউ কেউ তা অনর্থক উড়িয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত গরীব হয়ে যায়। তার কারণ, সে ঐ অর্থ-বিত্তের মূল্য কি তা জানেনি। তা উপার্জন ও সঞ্চয়ে কোন ক্লেশ ভোগ করেনি এবং তার পূর্বসূরীর মত অভাব-অভিযোগের স্বাদ আস্বাদনের সুযোগও তার হয়নি।
দ্বিতীয়তঃ অনুসদ্ধানে ধরা পড়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সাংঘাতিক রকম দুরূহ কাজ। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের শাসক ও খলীফাগণকে দেখা যায়, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং রাষ্ট্রের দুর্বল হওয়ার মত কারণ ঘটতে পারে এমন সব কিছুই সামাল দিতে তারা দ্বিগুণ চতুর্গুণ শ্রম ব্যয় করে যান। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা পিতৃ সম্পদের মালিক হওয়ার মতই রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিক হয়; তারা তখন রাষ্ট্র চালনা রেখে রাষ্ট্রের ফলভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র রক্ষায় যে ক্লেশ স্বীকার করা দরকার সে সম্বন্ধে তাদের কোন চেতনা থাকে না। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে দুর্বলতা ও ভাঙ্গন দেখা যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত উহা তার পতন ডেকে আনে।
এজন্যই কোন কষ্ট-ক্লেশ ছাড়া বিজয় এলে তা সময় বিশেষে স্থায়ী নাও হ’তে পারে এবং সে বিজয়েকে ধরে রাখাও কষ্টকর হতে পারে। এ কারণে আল্লাহর হিকমত বা কৌশল অনুসারে সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হয়, যাতে দ্বীনের কাজের গুরুত্ব সবার নিকট সমানভাবে অনুভূত হয় এবং এমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা বিজয়ের মূল্য কী ও তা কতটুকু দাম পাওয়ার উপযুক্ত তা জানতে পারে।
(৬) আল্লাহর মহাজ্ঞানে নিহিত হিকমত হেতু বিলম্ব :
কখনও মহান আল্লাহর জ্ঞানে রয়ে যায় যে, দ্বীনের বর্তমান আন্দোলনকারীরা জয়লাভ করলে বিজয়ের দাবী তথা অত্র ভূখন্ডে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, ছালাত কায়েম, যাকাত আদায় ইত্যাদি সম্ভব হবে না, তখন সাহায্য বিলম্বিত হয়। কেননা শুধু জয়লাভ তো কাম্য নয়; বরং জয় লাভের মাধ্যমে যা বাস্তবায়ন করতে হবে তার জন্যই উহা দরকার। সেটা হ’ল ফিৎনা বা আল্লাহদ্রোহী আইনের মূলোৎপাটন এবং সর্বতোভাবে আল্লাহর দ্বীনের বাস্তবায়ন। একথাই আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী হ’তে বোঝা যায়ঃ
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ، الَّذِيْنَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِيْ الْأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلاَةَ وَآتَوُْا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ -
‘আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন, যারা তাঁকে সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী। যাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলে তারা ছালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর হাতে (হজ্জ ২২/৪০-৪১)। মানুষ বা দল বিশেষের জন্য আল্লাহর সাহায্য ত্বরান্বিত হয় আবার দল বিশেষের জন্য বিলম্বিত হয়। তার কারণ কখনও আমরা জানতে পারি, আবার কখনও জানতে পারি না। কিন্তু আল্লাহ সব কিছুই জানেন। তাই তিনি অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন।
বাস্তবে দেখা যায় একদল লোক অস্বচ্ছলতা ও কষ্টের সময় দৃঢ়তার পরিচয় দেয়, বালা-মুছীবতে অনমনীয়তা, অমুখাপেক্ষিতা, সততা ইত্যাদি প্রদর্শন করে; অথচ তারাই আবার সুখে-সম্পদে ও শান্তির সময়ে দুর্বল মনের পরিচয় দেয়, সততা থেকে পিছিয়ে আসে, লোভ-লালসা হেতু স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিবাজ হয়ে দাঁড়ায়। যে জাতির চারিত্রিক ও মানসিক অবস্থা এমন সে জাতি সাহায্য লাভের উপযুক্ত নয়। আল্লাহ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জ্ঞাত। যা হয়নি তা হ’লে কেমন হ’ত সেটাও তার জানা।
(৭) বাতিলের পরিচয় ফুটে না ওঠা :
যে বাতিলের বিরুদ্ধে দ্বীন প্রচারকগণ সংগ্রাম করছেন সেই বাতিল ও তার ধারক-বাহকরা অনেক সময় দ্বীন প্রচারকসহ অপরাপর মানুষের সম্পূর্ণ অগোচরে থেকে যায়। যারা কখনই বাতিলের পক্ষে যাবার নয় এবং বাতিলের আসল রূপ উদঘাটিত হ’লে যারা কখনই উহাকে মেনে নেবার নয়, তারাও বাতিল দ্বারা প্রতারিত হয়ে সময় বিশেষে উহার সহযোগী বনে যায়। এভাবে হক্বপন্থীদের মাঝে বাতিল ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে সুযোগমত তাদের ক্ষতি করে চলে। তাদের প্রভাবেও আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হয়। মুনাফিকদের ঘটনা-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক ছাহাবীই মুনাফেকীর অলিগলি সম্বন্ধে জানতেন না। মুনাফিক আছে জানলেও তারা মুনাফিকদের অনেক নাটের গুরুকে চিনতেন না। তারা বরং তাদের প্রতি সুধারণাই পোষণ করতেন।
বনী মুস্তালিক্ব যুদ্ধে মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুহাজির ছাহাবীগণের প্রসঙ্গে খুবই অশালীন উক্তি করেছিল। সূরা মুনাফিকূনের ৭ ও ৮ নং আয়াতে তা উল্লেখ আছে। তার সেই কথা বালক ছাহাবী যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানালে ওমর (রাঃ) তাঁকে বলেন, ‘আপনি আববাস বিন বিশরকে হুকুম দিন, সে তাকে হত্যা করুক। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘ওমর! তা কী করে হয়? লোকেরা তখন বলবে, মুহাম্মাদ তার নিজের লোকদের হত্যা করছে। তার চেয়ে বরং তুমি যাত্রার ঘোষণা দাও। এ থেকে অনেক লোকের দৃষ্টিতে মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবী গণ্য হ’তে থাকে। তাদের আসল পরিচয় তাদের সামনে অনুদঘাটিত থেকে গেছে। ওদের মুল পরিচয় হ’ল,
هُمُ الْعَدُوُّ فَاحْذَرْهُمْ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُوْنَ ‘ওরা শত্রু। সুতরাং ওদের সম্বন্ধে সাবধান থাকুন। আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন। ওরা উল্টো কোন দিকে যাচ্ছে? (মুনাফিকূন ৬৩/ ৪)।
এজন্যেই যখন বহু সংখ্যক লোকের নিকট তাদের আসল ভেদ ও পরিচয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-কে ঘটনাচক্রে বলেছিলেন, ‘হে ওমর, আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের কথা কি তোমার মনে পড়ে? আল্লাহর কসম, যেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, ‘ওকে হত্যা করুন’, সেদিন যদি আমি তাকে হত্যা করতাম তাহ’লে অবশ্যই তার পক্ষ নিয়ে অনেক বাহাদুর মাঠ কাঁপিয়ে তুলত। অথচ আজকে তাদেরকে আমি আদেশ দিলে অবশ্যই তাকে হত্যা করবে, কোন সমস্যা করবে না। ওমর বললেন, আল্লাহর কসম, আমি বুঝতে পারলাম আমাদের সেদিনের কথা হ’তে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গৃহীত ব্যবস্থা ছিল কল্যাণকর’।
এই হাদীছ সাহায্য ও বিজয় পিছিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত আমাদের বর্ণিত কারণের একটি অর্থবহ সূক্ষ্মচিত্র। তাই যাদের বাতিল চরিত্র সম্পূর্ণ উদঘাটিত হয়নি এমন লোকদের সাথে সংঘর্ষে জড়ালে মুসলিম উম্মাহর উপর তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। কেননা অনেক মুসলমান ওদের ভাল মনে করে ওদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে।
এরূপ অবস্থান গ্রহণের ঘটনা আয়েশা (রাঃ)-এর চরিত্রে বানাওয়াট কলঙ্ক লেপনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত অপবাদ সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, ‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে আব্দুল্লাহ বিন উবাই সম্পর্কে অভিযোগ করে বললেন, হে মুসলমানগণ, তোমরা এমন কে আছ, যে আমাকে ঐ ব্যক্তির হাত হ’তে উদ্ধার করতে পারবে যে আমার পরিবারকে কেন্দ্র করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আল্লাহর কসম, আমি আমার পরিবার সম্পর্কে ভাল বৈ অন্য কিছু জানি না। আর তারাও যে ব্যক্তির কথা বলছে তাকেও ভাল বৈ জানি না। সে আমার সঙ্গে ব্যতীত একা কোন দিন আমার পরিবারের সাথে দেখা করত না। তখন সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) উঠে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (ছাঃ)! আমি আপনাকে তার অপবাদ থেকে উদ্ধার করব। যদি সে আওস গোত্রের হয় তাহ’লে আমরা তার গর্দান উড়িয়ে দিব, আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের হয় তাহ’লে আপনি যা আদেশ করবেন আমরা সে মত কাজ করব। তারপর খাযরাজ গোত্রীয় সা‘দ বিন ঊবাদা (রাঃ) উঠে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তুমি অসত্য বলছ। তুমি তাকে হত্যা করবে না। তাকে হত্যা করার ক্ষমতা তোমার নেই। সে তোমার গোত্রের লোক হ’লে তাকে হত্যা করা তুমি পসন্দ করতে না। এই সা‘দ বিন উবাদা (রাঃ) কিন্তু খাযরাজের গোত্রপতি ও সৎ লোক ছিলেন। কিন্তু ঐ সময়ে তিনি জাত্যাভিমানে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। সা‘দের কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে সা‘দ বিন মু‘আযের চাচাত ভাই উসাইদ বিন হুযাইর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ, ‘তুমি মিথ্যা বলছ। আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। নিশ্চয়ই তুমি মুনাফিক। মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে তর্ক করছ’।
এতে আওস, খাযরাজ দুই দলই উত্তেজিত হয়ে পড়ল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে থাকতেই তারা সংঘর্ষ বাধাবার উপক্রম করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বারবার তাদের নিরস্ত হ’তে বলায় শেষ পর্যন্ত তারা থেমে গেল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও চুপ হয়ে গেলেন (বুখারী হা/৪১৪১, মুসলিম হা/২৭৭০)। কিছু মুসলমান হয়ত প্রত্যক্ষভাবে বাতিলপন্থীদের পক্ষ নেয় না, কিন্তু হক্বপন্থী প্রচারক ও কর্মীদের পক্ষেও তাদের অবস্থান খুবই শিথিল ও দ্বিধাজড়িত। কারণ বাতিলপন্থীরা যে বাতিলের উপর আছে সেরকম কোন পাকাপোক্ত বিশ্বাস তারা করে না। তারা বরং মনে করে এরাও মুসলমান। ফলে শত্রুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগ্রাম ও সংঘর্ষে এ জাতীয় মুসলমানেরা অংশ নিতে আগ্রহী হয় না। এরা নিজেদের উদারপন্থী হিসাবে যাহির করতে চায়। এভাবে কখনও কখনও মুসলমানদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি থেকে দলাদলি সৃষ্টি হয় এবং সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হয়।
(৮) সাংঘর্ষিক পরিবেশ :
সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার আরেকটি কারণ সাংঘর্ষিক পরিবেশ। সাংঘর্ষিক পরিবেশ কখনও কখনও সত্য, শুভ ও ন্যায়পরায়ণতাকে মেনে নেয়ার মত উপযোগী থাকে না। তাই ঐ পরিবেশের সাথে কোন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আগেই এমন কিছু কাজ করা প্রয়োজন, যাতে সংঘর্ষ বিদূরীত হয়ে উক্ত পরিবেশ সত্য, শুভ ও ন্যায়রায়ণতা গ্রহণে প্রস্ত্তত হয়। সে সব কাজের মধ্যে রয়েছে (১) ইসলামের বিরুদ্ধাচারী জাতিগুলি বাতিল ও ভ্রান্তির উপর বিদ্যমান এ কথাটি প্রচারে আইনানুগ সকল মাধ্যমকে ব্যবহার করা (২) তাদের যাবতীয় আপত্তির সদুত্তর নিয়ে মনস্ত্তষ্ট করা এবং ইসলামের প্রতি আহবান জানান। (৩) ইসলামের প্রকৃত মর্ম তুলে ধরা এবং প্রতিপক্ষ যে বাতিলের উপর আছে তার ক্ষতি সম্বন্ধে তাদের সচেতন করে তোলা। এসব কর্মকান্ড যুদ্ধ বা সংঘর্ষ বাধার আগে প্রতিপক্ষের হেদায়াতের মাধ্যম হ’তে পারে। যদি তা না হয় তবে সত্য জানার মাধ্যম তো হবেই। এ থেকেই যুদ্ধের পর সত্য গ্রহণের সুযোগ হ’তে পারে। এজন্যই যুদ্ধ বা সংঘর্ষ শুরুর আগেই ইসলামের দাওয়াত প্রদানের বিধান রয়েছে।
(৯) আল্লাহর দ্বীন গ্রহণে সাড়া না দেওয়া :
প্রচারকদের দিকে লক্ষ্য করলে তাদের সন্তোষজনক কর্মকান্ড হেতু সাহায্যের বিস্তর সম্ভাবনা কখনও কখনও দেখা দিলেও বাধা এসে দেখা দেয় যাদের মাঝে প্রচার চালান হচ্ছে তাদের কারণে। যেমন ৮নং ক্ষেত্রে বিধৃত হয়েছে। এ রকম একটি বাধা হ’ল, আল্লাহর পরিকল্পনায় এসব জাতির জন্য হেদায়াত না রাখা। এরা এত কট্টর বিরোধী ও পাপাচারী যে, হেদায়াতকে মোটেও সহ্য করতে রাযী নয়। ফলে আল্লাহ তাদের হেদায়াত করার ইচ্ছা বাদ দিয়েছেন এবং তাদের ললাটে গুমরাহী লিখে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, أَفَلَمْ يَيْأَسِ الَّذِيْنَ آمَنُوْاْ أَن لَّوْ يَشَاءُ اللّهُ لَهَدَى النَّاسَ جَمِيْعاً ‘তবে কি যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই সকল মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন’ (রা‘দ ১৩/৩১)।
فَمِنْهُمْ مَّنْ هَدَى اللّهُ وَمِنْهُمْ مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلالَةُ . ‘অতঃপর তাদের কিছু লোককে আল্লাহ সৎ পথে আনলেন এবং কিছু লোকের উপর গুমরাহী অবারিত হয়ে গেল’ (নাহল ১৬/৩৬)।
أُوْلَـئِكَ الَّذِيْنَ لَمْ يُرِدِ اللّهُ أَن يُطَهِّرَ قُلُوْبَهُمْ ‘ওরাই (ইহুদীরাই) তারা, যাদের অন্তরকে আল্লাহ নিষ্কলুষ করতে চাননি’ (মায়েদাহ ৫/৪১)। এমনিতর আরও অনেক আয়াত কুরআনে বিধৃত আছে।
(১০) প্রচারকের মৃত্যুর পরে বিজয় :
প্রচারকের মৃত্যুর পর বিজয় আসবে বলেও অনেক সময় আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হয়। তাছাড়া প্রচারকের জীবদ্দশায় যতটুকু বিজয় অর্জিত হয় তার মৃত্যুর পর তা থেকেও অনেক বড় মাপের বিজয় অর্জিত হয়। কেননা জয় মানে তো কর্মসূচীর জয়, ব্যক্তির নিজের জয় নয়। ব্যক্তি বা মানুষকে তো তার প্রচার ও সততার প্রতিদানে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করার দায়িত্ব মহান আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন, চাই সে জয়ী হোক কিংবা না হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَن يُقَاتِلْ فِيْ سَبِيْلِ اللّهِ فَيُقْتَلْ أَو يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيْهِ أَجْراً عَظِيْماً
‘যে আল্লাহর রাহে যু্&দ্ধ করে সে নিহত কিংবা জয়ী হোক তাকে শ্রীঘ্রই আমি মহাপুরস্কার প্রদান করব’ (নিসা ৪/৭৪)।
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُواْ فِي سَبِيْلِ اللّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ -
‘যারা আল্লাহর রাহে যুদ্ধে নিহত হয় তাদের তুমি কখনই মৃত ভেব না। বরং তারা জীবিত; তারা তাদের প্রভুর নিকটে রিযিক প্রাপ্ত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)।
قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِيْ يَعْلَمُوْنَ، بِمَا غَفَرَ لِيْ رَبِّي وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُكْرَمِيْنَ -
‘তিনি বললেন, হায়! আমার কওম যদি জানতে পারত, কেন আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে স্থান দিয়েছেন’ (ইয়াসীন ৩৬/২৬-২৭)।
اُدْخُلُواْ الْجَنَّةَ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُوْنَ ‘তোমরা যে আমল করতে তার বদৌলতে (আজ) জান্নাতে প্রবেশ কর’ (নাহল ১৬/৩২)।
إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبَّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِىْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ- نَحْنُ أَوْلِيَاءُكُمْ فِىْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِىْ الْأَخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِىْ أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ -
‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর সে কথার উপর অবিচল থেকেছে* (মৃত্যুকালে) তাদের নিকট ফিরিশতা এসে বলবে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তাও করো না। তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তোমার বন্ধু আছি ইহকালে ও পরকালে। সেখানে তোমাদের মন যা চাইবে মিলবে এবং তোমরা মুখ ফুটে যা চাইবে তাও পাবে’ (হা-মীম সিজদা ৪১/৩০-৩১)।
কত প্রচারক অতীত হয়ে গেছেন যাদের জীবদ্দশায় দ্বীন জয়লাভ করেনি, অথচ তাদের মৃত্যুর পর তা বিশাল বিজয় লাভ করেছে। পরিখাওলাদের সেই বালকের কথাই ধরুন, যার আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-কে জেল খানাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি যে কর্মসূচী রেখে গিয়েছিলেন, কার্যক্রম এঁকে দিয়েছিলেন তা তার মৃত্যুর অনেক অনেক পরে এসে চরম সাফল্য লাভ করেছিল। এমন ঘটনা দু’ একটা নয়, অসংখ্য।
(১১) প্রচারকদের পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধিকরণ :
প্রচারকদের পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধ করার মানসে সাহায্য পিছিয়ে যায়। আবার তাতে এমন অনেক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাও থাকে, যা পরবর্তীকালের মানুষের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনে। মহান আল্লাহ বলেন,
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُواْ مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللّهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللّهِ قَرِيْبٌ -
‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছে যে, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের মাঝে এখনও তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত অবস্থা উপস্থিত হয়নি। তাদেরকে দারিদ্র্য ও রোগ-শোক জাপটে ধরেছিল এবং তারা এমন (বিপদের) ঝাঁকুনি খেয়েছিল যে, স্বয়ং রাসূল এবং তার সঙ্গী মুমিনগণ পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটেই’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)।
অন্যত্র আয়াতে এসেছে,
أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوْا أَن يَّقُولُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْن -
‘মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ একথা বললেই তারা ছাড়া পেয়ে যাবে, তাদের কোন পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্বেকার লোকদের আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো অবশ্যই নির্ধারণ করে নিতে হবে, কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী’ (আনকাবূত ২৯/১-৩)।
প্রকাশ্য বিজয় ও সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার পিছনে এগুলি আমার নিকটে সুস্পষ্ট কারণ হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে। তবে বিজয় ও সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার এসব কারণ কখনও আমাদের নযরে ধরা পড়ে, আবার কখনও ধরা পড়ে না। যাই হোক, আমাদের যেটা প্রত্যয় রাখা যরূরী তা হ’ল, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যার্থে যত বৈধ উপায় আছে তা অবলম্বন করা। বিজয় বা সাহায্য কোনটাই হাতে ধরে বাস্তবে রূপায়িত করা আমাদের দায়িত্ব নয়। সেটা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ও তা‘আলার হাতে। وَماَ النَّصْرُ إلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ - ‘সাহায্য কেবল আল্লাহর পক্ষ হ’তে। আর সাহায্য কখন নিশ্চিত হবে তাও আল্লাহর জ্ঞানে নির্ধারিত আছে। নির্ধারিত সেই সময় না আসা পর্যন্ত কখনই সাহায্য আসবে না। আমাদের সীমিত ধারণা মত সাহায্য বাস্তবায়িত হবার নয়। আবার আল্লাহ যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হবেই এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে সাহায্য আসবে না। যারা সন্দেহের দোলায় দোদুল্যমান তারা সাহায্য লাভের যোগ্য নয়।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বর্তমানে অনেক দাঈ এবং ইসলামী দল দ্বীন বিজয়ে আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হ’তে দেখে বেশ উদ্বিগ্ন। একদিকে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের প্রত্যাশা ও চূড়ান্ত সংগ্রাম; অন্যদিকে প্রচুর শ্রম ব্যয় ও যথেষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যখন লক্ষ্য অর্জিত হয় না, তখন প্রচারের আংশিক ফল লাভের প্রত্যাশায় তারা বেশ কিছু ছাড় দিয়ে বসে। এসব ছাড়ের প্রকৃতি ও মাত্রা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, যা কখনও কম কখনও বেশী হয়।
এ গ্রন্থে আমরা যে নীতি-পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, তার আলোকে বিজয়ের প্রত্যাশায় ছাড় দেওয়া সম্পর্কে কুরআনুল কারীম থেকে অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেছি। আমরা তিনটি ঘটনা অবগত হ’তে পেরেছি, যেখানে কুরআন তার প্রতিবিধান করেছে এবং আমাদের জন্য এমন এক কর্মপন্থা এঁকে দিয়েছে, যাকে আশ্রয় করে পদস্খলন কিংবা বিচ্যুতি ছাড়া আমরা অনায়াসে চলতে পারব। এখানে প্রতিটি বিষয় ও তার প্রতিবিধানের ফর্মুলা প্রথমে উল্লেখ করব এবং সব শেষে এ বিষয়ে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তার সারমর্ম তুলে ধরব।-
১ম বিষয় : সূরা কাফিরূনের শানে নুযুল :
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করল যে, তারা তাঁকে সম্পদ দিবে, যা পেয়ে তিনি মক্কার ধনাঢ্য ব্যক্তিকে পরিণত হবেন, যে নারী তাঁর পসন্দ হয় তার সাথেই তাঁকে বিবাহ দিবে এবং তাঁর পিছনে সমর্থন যোগাবে। বিনিময় হ’ল তিনি তাদের প্রভুদের গালমন্দ করবেন না বা খারাপ কিছু বলবেন না। আর যদি তিনি তা একান্তই না পারেন তবে বিকল্প একটি প্রস্তাব আমরা পেশ করছি। তাতে আমাদের উভয়ের মঙ্গল রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সেটা কি? তারা বলল, ‘আপনি এক বছর আমাদের উপাস্য দেবতা লাত ও উয্যার ইবাদত করবেন, আমরা এক বছর আপনার মা‘বূদ আল্লাহর ইবাদত করব’। তিনি উত্তরে বললেন, ‘অপেক্ষা কর, দেখি আমার প্রভুর পক্ষ থেকে কি বিধান আসে। তখন ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে সূরা কাফিরূন অবতীর্ণ হল, قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ، لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ ‘(হে নবী ! ) আপনি বলুন, ওহে কাফিররা, তোমরা যার ইবাদত কর আমি তার ইবাদত করি না’ ...(কাফিরূন)। আল্লাহ আরও অবতীর্ণ করলেন,
قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّيْ أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُوْنَ، ..... بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُن مِّنْ الشَّاكِرِيْنَ -
‘(হে রাসূল) আপনি (মুশরিকদের) বলুন, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করতে আমাকে আদেশ করছ, হে মূর্খরা? ....আপনি বরং আল্লাহরই ইবাদত করুন এবং কৃতজ্ঞদের মাঝে থাকুন’ (যুমার ৬৪-৬৬; তাফসীরে ত্বাবারী ৩০/৩৩১)।
ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) আরও বলেন, ইয়াকূবের সনদে বাখতারীর আযাদ কৃত গোলাম সাঈদ বিন মিনা হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ওয়ালীদ বিন মুগীরা, আছ বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব ও উমাইয়া বিন খালফ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে দেখা করে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আসুন, আমরা আপনার মা‘বূদের ইবাদত করি, আর আপনি আমাদের মা‘বূদের ইবাদত করুন। এভাবে আমাদের সব কাজে আপনাকে অংশীদার করে নেই। ফলত: যে দ্বীন নিয়ে আপনি আবির্ভূত হয়েছেন তা যদি আমাদের দ্বীন থেকে শ্রেষ্ঠ হয় তাহ’লে আমরা তাতে আপনার সাথে শরীক হ’তে পারব এবং তা থেকে আমাদের অংশ নিতে পারব। আবার আমাদের দ্বীন যদি আপনার দ্বীন থেকে শ্রেষ্ঠ হয় তাহ’লে আপনি আমাদের সাথে শরীক হয়ে আপনার অংশ গ্রহণ করতে পারবেন’। তখন আল্লাহ তা‘আলা সূরা কাফিরূন নাযিল করলেন।[1]
শানে নুযূলের এই ঘটনাগুলিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাদের খাতিরে কিছু ছাড় দিতে অনুরোধ করেছিল। বিনিময়ে তারাও কিছু ছাড় দিতে চেয়েছিল। এমনি করে তারা দু’পক্ষ এক বিন্দুতে মিলিত হ’তে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল।
কেউ হয়ত বলতে পারেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যদি তাদের সঙ্গে ঐক্যমত হ’তেন এবং তাদের নিকট আগে আল্লাহর ইবাদতের দাবী করতেন, তাহ’লে তারা ইবাদত করতে গিয়ে ইসলামকে ভালমত জানত ও বুঝত। ফলে তারা আর ইসলাম বিমুখ হ’ত না। এতে ইসলামের একটি বড় অর্জন তথা বিজয় নিশ্চিত হ’ত। দূর হ’ত সেই অত্যাচার-নির্যাতন, যার মুখোমুখি মুসলমানরা প্রতিনিয়ত হচ্ছিল। ঐ ব্যক্তির কথার উত্তরে বলা যায়, আল্লাহ এরূপ ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ، وَلاَ أَنتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ - ‘আমি তোমাদের উপাস্য মা‘বূদদের ইবাদতকারী নই। আর তোমরাও আমার মা‘বূদের ইবাদতকারী নও (কাফিরূন ১০/২-৩)। অবশেষে তিনি বলেছেন, لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ ‘তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন, আমার জন্য আমার দ্বীন’ (কাফিরূন ১০৯/৬)।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি একান্তই দ্বীনের মূলীভূত। এখানে দর কষাকষির কোন অবকাশ নেই এবং বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। এটি আক্বীদাগত বিষয়। বরং বলা চলে, এটাই আক্বীদাগত মূল ভিত্তি। আর আক্বীদার বিষয়ে কখনো কোন ছাড় নেই। এ রকম বলার হেতু এই যে, কিছু নির্দিষ্ট মুশরিককে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে এখানে সম্বোধন করেছেন, যাদের সম্বন্ধে তাঁর জানা আছে যে, তারা কস্মিনকালেও ঈমান আনবে না। তাই আল্লাহ তাঁর নবীকে বলে দিতে আদেশ করেছেন যে, ওদের আশা ও মনষ্কামনায় গুড়েবালি। এ ধরণের সমঝোতা কোন কালেই হবে না, না আপনার পক্ষ থেকে, না ওদের পক্ষ থেকে। এভাবে নবী করীম (ছাঃ)-কেও আল্লাহ হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের ঈমানদার হওয়া ও চিরস্থায়ী সাফল্য লাভের যে বাসনা আপনি লালন করেন, তা কখনো পূরণ হবে না। বাস্তবে তাদের এ রকমই ঘটেছিল। তারা সফল ও কৃতকার্য না হয়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তারা কেউ কেউ বদরে তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়েছে এবং কেউ কেউ তার আগেই কাফির হিসাবে মারা গিয়েছে।*
বস্ত্ততঃ এই ঘটনায় ইসলামের বর্তমান ও ভবিষ্যতের শত্রুদের বহুবিধ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র মুকাবেলার একটি সুস্পষ্ট কর্মপদ্ধতি অঙ্কিত হয়েছে।
২য় ঘটনা: সূরা আন‘আমের ৫২নং আয়াতের শানে নুযূল :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ ‘যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করে তাদেরকে আপনি তাড়িয়ে দিবেন না’ (আন‘আম ৬/৫২)। অত্র আয়াতের শানে নুযূল প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, কয়েকজন কুরাইশ নেতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর নিকটে তখন ছুহাইব, আম্মার, বেলাল, খাববাব প্রমুখ হতদরিদ্র মুসলমানগণ উপবিষ্ট ছিলেন। তখন তারা বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি তোমার কওমকে ফেলে কিভাবে এদের নিয়ে সন্তুষ্ট আছ? আমাদের মধ্য হ’তে কি আল্লাহ তা‘আলা কেবল এদেরই অনুগৃহীত করেছেন, আমরা কি এদের তল্পিবাহক হব? তুমি এদের তাড়িয়ে দাও, তোমার নিকটে এদের বসতে দিও না। তাহ‘লে হয়ত আমরা তোমার অনুসরণ করতে পারি। তখন আল্লাহ উক্ত আয়াত নাযিল করেন।
অন্য বর্ণনায় ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) তাবেঈ মুজাহিদের বরাতে বলেছেন, বেলাল ও ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মজলিসে বরাবর বসতেন। কুরাইশরা তাদের প্রতি নাক সিটকিয়ে বলে, এরা দু’জন সহ এদের মত ছোট লোকেরা যদি না থাকত তাহ’লে আমরা মুহাম্মাদের নিকটে বসতাম। তখন উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।[2]
অন্য বর্ণনায় খাববাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, কুরাইশরা নবী করীম (ছাঃ)-কে বলেছিল, ‘আমরা আপনার নিকট এমন বৈঠক ও আসন পসন্দ করি, যাতে সমগ্র আরব আমাদের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারে। কেননা আপনার নিকট আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দল আসা যাওয়া করে। এসব চাকর-বাকরদের সঙ্গে তারা আমাদেরকে দেখুক এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই আমরা যখন আসব তখন আপনি ওদের উঠিয়ে দিবেন। আমরা চলে গেলে চাইলে ওদের নিয়ে বসবেন। তখন উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।[3]
এসব বর্ণনাগুলিকে নিম্নোক্ত হাদীছটি জোরাল করে, যা মুসলিম শরীফে সংকলিত হয়েছে। আবুবকর ইবনু শায়বা (রাঃ)-এর বরাতে সা‘দ ইবনু আবি ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা ছয়জন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। মুশরিকরা তা দেখে তাঁকে বলল, ‘আপনি এদেরকে আপনার দরবার থেকে তাড়িয়ে দিন। এরা আমাদের উপর বাহাদুরী করবে তা হ’তে পারে না’। উক্ত ছয়জনের একজন আমি। অপর ক’জন হ’লেন ইবনু মাস‘ঊদ, হুযাইল গোত্রীয় একজন ও বেলাল। আর দু’জনের নাম আমি ভুলে গেছি। এ কথায় হয়ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মনে কোন ভাবোদয় হয়েছিল। তাই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন।[4]
আয়াতের শানে নুযূল পর্যালোচনা ও আমলে নিলে এমন অনেক ভুল পরিকল্পনার অবসান ঘটত, যেগুলি করতে অনেক প্রচারক ও ইসলামী দল অগ্রসর হয়ে থাকে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে অত্যন্ত ভালবাসেন এবং দ্বীনকে বিজয়ী করার তীব্র আকাঙ্খার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁŠছাতে এসব পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। কিন্তু লক্ষ্য যতই মহৎ হোক না কেন তা সাধনের উপায় মোটেও মহৎ নয়।
যেমন- ইসলামী দলগুলির মধ্যে কোন একটি দল অমুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে পাওয়া যাচ্ছে, যারা আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহবান ও ইসলামের বাণী প্রচার-প্রসারে সচেষ্ট আছে। কিন্তু ঐ রাষ্ট্র তাদের বলছে, তোমাদের স্বীকৃতি দেওয়া ও দাওয়াতী কার্যক্রমের কিছু সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা তোমাদের সাথে সমঝোতা করতে প্রস্ত্তত আছি। তবে শর্ত হ’ল, তোমাদের দলের অমুক অমুক ব্যক্তিকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে এবং অমুক অমুককে দলেই রাখতে পারবে না। কেননা যে দলে এই লোকগুলি আছে তাদের আমরা স্বীকৃতি দিতে পারি না। অথচ দল ঐ লোকগুলির মধ্যে কোন ভুলভ্রান্তি পায়নি। এমনকি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উক্ত দাবী তোলার পূর্বে তারা এ সম্পর্কে কোন চিন্তাও করেনি। আসলে তাদের তো কোন দোষ নেই। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের ছোট ও অপসন্দ করার মানসে তাদের চাচ্ছে না।
সুধী পাঠক! এমতাবস্থায় কি আপনাদের মনে হয় ঐ দল রাষ্ট্রের উত্থাপিত আপোষ ফর্মূলা একেবারে পায়ে ঠেলে বলতে পারবে, وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَنْ يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْد-ِ ‘আসলে কিছুই না, আমাদের নেতা ও ভাইদের একমাত্র অপরাধ হ’ল, তারা পরাক্রমশালী প্রশংসাময় আল্লাহতে বিশ্বাসী’ (বুরূজ ৮৫/৮)। নাকি তারা দর কষাকষি শুরু করবে, যা তথাকথিত ‘সুবিধা’ নামে আখ্যায়িত? দাওয়াতের সুবিধা লাভ ও সম্ভাব্য নানা অর্জন নিশ্চিত করার নামে ঐ ভাইদের যদি দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ক্ষণিকের জন্য তা বৈধ ধরা হয়, তাহ’লে পরিণামই বা কি দাঁড়াবে? কিছু কিছু দলের বাস্তবতা থেকে আমাদের ধারণা, বর্তমান কালের লোকেরা এরূপ দরাদরিতে পড়ে যাবে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাক্কী যুগেই এরূপ দর কষাকষির মূল্লোচ্ছেদ করে দিয়েছেন এবং আমাদের জন্য এমন এক নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা এক বাক্যে পালনীয়। তাতে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ নেই। আল্লাহ বলেন,
مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِّنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِم مِّن شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُوْنَ مِنَ الظَّالِمِيْن -
‘তাদের হিসাব দেওয়ার নূন্যতম দায়িত্ব আপনার উপর নেই এবং আপনার হিসাব দেওয়ার নূন্যতম দায়িত্বও তাদের উপর নেই। তাহ’লে আপনি কেন তাদের তাড়িয়ে দিবেন? এরূপ করলে আপনি যালিমদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে যাবেন’ (আন‘আম ৬/৫২)।
কী ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারী! যিনি মানবকুল শ্রেষ্ঠ এবং রাসূলদের নেতা তিনি যদি কোন ছাহাবীকে তাড়ানোর কাজ করতেন তাহ’লে দাওয়াতের ও ইসলামের স্বার্থেই কেবল করতেন, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। যদিও এরূপ ঘটা তাঁর পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ অচিন্তনীয়। তবুও যদি তিনি এটা করতেন তবে যালিমদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে পড়তেন। এরূপ দাবী ও দরাদরির সময় আমাদের করণীয় নীতি কী হবে তাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। যখন আমাদের সামনে বিপক্ষরা এরূপ স্বার্থ ও সুবিধার টোপ ফেলবে তখন আমাদের বলতে হবে - وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاء فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاء فَلْيَكْفُرْ ‘আপনি বলুন, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আসে। অতএব যার ইচ্ছা সে মুমিন হোক, আর যার ইচ্ছা সে কাফির থাকুক’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)। অতএব এটাই আমাদের দায়িত্ব, এটাই আমাদের যিম্মাদারী। আমরা হক কথা বলব, তাতে লোকে ঈমান আনে আনুক, আর কাফের থাকে থাকুক আমাদের কিছুই আসে যায় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَفَلَمْ يَيْأَسِ الَّذِينَ آمَنُواْ أَن لَّوْ يَشَاءُ اللّهُ لَهَدَى النَّاسَ جَمِيْعًا ‘তবে কি যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই সকল মানবকে সৎ পথে পরিচালিত করতে পারতেন?’ (রা‘দ ১৩/৩১)। মূল কথা হ’ল সমস্যা যখন মূলনীতির সঙ্গে জড়িত হয় তখন নীতির প্রশ্নে কোন আপোষরফা ও ছাড় প্রদানের অবকাশ থাকে না।
৩য় ঘটনা: সূরা ‘আল-ফাত্হ’ এর বিষয়-বস্ত্ত :
ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলকা‘দাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন হুদায়বিয়া থেকে মদীনা ফিরে যাচ্ছিলেন তখন সূরা আল-ফাত্হ নাযিল হয়। এর আগে মক্কার মুশরিকরা তাঁর মসজিদুল হারামে যাওয়ার পথ রোধ করেছিল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ওমরাহ পালন করা। কিন্তু মুশরিকদের বাধার মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে উভয় পক্ষ একটি সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল। শর্ত করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ বছর ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর ওমরাহ করতে আসবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদল ছাহাবীর অমত ও অসন্তুষ্টি সত্ত্বে প্রতিপক্ষের কথা মেনে নিয়েছিলেন। অসন্তুষ্ট ছাহাবীদের একজন ছিলেন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)। হুদায়বিয়ার সন্ধির ঘটনা অনেক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। এই ঘটনা বেশ লম্বা। সংক্ষেপে আমাদের আলোচ্য অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট অংশটুকু তুলে ধরা হ’ল-
ছহীহ বুখারীতে এসেছে, নবী করীম (ছাঃ) সন্ধির জন্য তাঁর লেখককে ডাকলেন এবং বললেন লেখ, ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’। তখন (অপরপক্ষের সন্ধি প্রস্ত্ততকারী) সুহাইল বলল, আল্লাহ শপথ ‘রহমান’ শব্দ কী তা আমি জানি না। তুমি বরং আগে যেমন লিখতে তেমনিভাবে ‘বিসমিকা আল্লাহু-হুম্মা’ লেখ। তখন মুসলিম লেখক বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ ছাড়া লিখব না। কিন্তু নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ই লেখা তারপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, লেখ ‘এতদশর্তে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সন্ধি করছেন’। এ কথা শোনা মাত্রই সুহাইল বলে উঠল, ‘আমরা যদি তোমাকে আল্লাহর রাসূলই জানতাম তাহ’লে ওমরাহ করতে বাধা দেব কেন? আর যুদ্ধই বা করব কেন? তুমি বরং লেখ, ‘আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ’। এতে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল, যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা মনে করছ। ঠিক আছে- ‘আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ’ই লেখা হোক’।[5]
সন্ধির শর্তাবলীতে আরও ছিল আগামী বছর আসলে আমরা মক্কা হ’তে বের হয়ে যাব, তারপর তুমি তোমার সাথীদের নিয়ে সেখানে প্রবেশ করবে। নবী করীম (ছাঃ)-এর কোন ছাহাবী (মক্কা থেকে) অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে তাঁর নিকট গমন করলে তিনি তাকে ফেরৎ পাঠাবেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে যারা আছেন তাদের কেউ মক্কায় কুরাইশদের আশ্রয়ে এলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে না’।[6]
এ ছিল সন্ধির কিছু অংশ। এ কারণেই ওমর (রাঃ)-এর কানে যখন রাসূলের সন্ধি স্থাপনের দৃঢ় সংকল্পের কথা পেঁŠছল, তখন তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন এবং রাসূলের নিকটে কৈফিয়ত তলবের সুরে বলেছিলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি মুসলিম নই? ওরা কি মুশরিক নয়? তিনি বললেন, ‘অবশ্যই’। ওমর (রাঃ) বললেন, তাহ’লে আমরা কেন আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে এমন অপমান মেনে নেব? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আমি কখনই তাঁর আদেশের বিরোধিতা করব না। আর তিনি আমাকে শেষ করে দিবেন না।[7]
এই সন্ধিকে ওমর (রাঃ) দ্বীনের মধ্যে অপমানজনক বলে গণ্য করেছিলেন এবং প্রথম দৃষ্টিতে কিছু শর্ত মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। অথচ সেই সন্ধিকেই আল্লাহ তা‘আলা তার সকল শর্তসহই ‘স্পষ্ট বিজয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, তোমরা তো মক্কা বিজয়কে বিজয় বলে গণ্য করে থাক, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধিকেই বিজয় গণ্য করে থাকি। বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেন, তোমরা তো মক্কা বিজয়কে বিজয় বলে মনে কর। অবশ্য সেটিও একটি বিজয়, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়াতে সংঘটিত বাই‘আতুর রিযওয়ানকেই বিজয় মনে করি।[8] মুসনাদে আহমাদে আছে নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
نَزَلَ عَلَّى الْباَرِحَةَ سُوْرَةٌ أَحَبُّ إلَّى مِنَ الدُّنْياَ وَماَ فِيْهَا إنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِيْنًا -
‘আজ রাতে আমার উপর একটি সূরা নাযিল হয়েছে, যা আমার নিকট দুনিয়া ও দুনিয়াস্থ সমস্ত কিছুর তুলনায় প্রিয়তর’ তাহ’ল ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি’।[9] আহমাদের আরেক বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) হুদায়বিয়া থেকে ফেরার পথে নাযিল হয় - لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَماَ تَأَخَّرَ، ‘আল্লাহ আপনার জীবনের পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করার জন্য (আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছে)’ (ফাতাহ ৪৮/২)। নবী করীম (ছাঃ) তখন বলেন, আজ রাতে আমার উপর এমন একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যা আমার নিকট ধরাপৃষ্ঠের সমুদয় জিনিস থেকেও প্রিয়। তারপর তিনি সূরাটি পড়ে শুনান।[10]
আমরা এ ঘটনায় দেখতে পাচ্ছি যে, কয়েকটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার কাফির কুরাইশদের মতে মত দিয়েছিলেন। যেমন-
১. ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’-এর স্থলে ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ লেখায়।
২. ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর স্থলে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লেখায়।
৩. পরবর্তী বছর মক্কায় প্রবেশ পিছিয়ে দেওয়া।
৪. মুশরিকদের কেউ তার অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে মুসলমান হয়ে মদীনায় গেলে তাকে তাদের নিকট ফেরত পাঠানোর শর্তে। যদিও মুসলামনদের কেউ মুশরিক হয়ে মক্কায় এলে তারা তাকে ফেরত দেবে না। বরং ছাহাবীদের কেউ কেউ যখন সন্ধির কিছু শর্ত নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন, তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের বলেছিলেন, ‘তারা আমার নিকট যে কাজের কথাই বলবে তাতে যদি আল্লাহর মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয় তবে আমি তা-ই মঞ্জুর করব’।[11]
মুশরিকদের দেয়া যে সব শর্ত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) মেনে নিয়েছিলেন আমরা যদি তা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করি তাহ’লে দেখতে পাব, এগুলি না ইসলামের আক্বীদার সাথে জড়িত, না তার বুনিয়াদী নীতির সাথে জড়িত। এই ঘটনা এবং সূরা কাফিরূন ও সূরা আন‘আমে বর্ণিত ঘটনার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এই সন্ধিতে না বাতিলের স্বীকৃতি আছে, না তাকে সম্মতি দেয়া হয়েছে। আর তা হবেই বা কী করে- যেখানে আল্লাহ একে ‘স্পষ্ট বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সন্ধির চারটি দাবীকে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় নিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
‘বিস্মিকা আল্লা-হুমা’ লেখায় শারঈ কোন বাধা নেই। কেননা কোন মুসলিম যদি ‘রহমান’ ও ‘রহীম’ নাম দু’টি ব্যাখ্যাসূত্রে ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ না পড়ে তাহ’লে সে পাপী হবে না।
আর ‘মু হাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ নিয়ে কথা হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তো প্রকৃতই আব্দুল্লাহর পুত্র ছিলেন। তাই তিনি একথা মেনে নিয়েছিলেন। সেই সাথে মানব স্মৃতিতে কোন বৈরি সন্দেহের অবকাশ যাতে না জন্মাতে পারে সেজন্য তিনি বলে দিয়েছিলেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল, যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা বলছ। এভাবে কথার গোল দূর হয়ে যাওয়ায় বিষয়টির বৈধতা নিয়ে সমস্যা থাকছে না।
এছাড়া তাদের এ বছরে ফিরে গিয়ে পরবর্তী বছরে আগমনের কথা সুযোগ-সুবিধার সাথে জড়িত একটি বিষয়। সুবিধা অনুপাতে এ ধরনের শর্ত গ্রহণযোগ্য। ঐ বছর ওমরাহ না করে পরবর্তী বছর ওমরাহ করার কথা মেনে নেয়ায় নির্বিঘ্ন সন্ধিটা হ’তে পেরেছিল। এদিকে ওমরাহ করতে না পারায় ছাহাবীগণ ছিলেন আবেগতাড়িত ও ক্ষুদ্ধ। এত ক্ষুদ্ধ আবেগে সাড়া না দেয়ায় ভালই হয়েছে। তাদের আবেগে সাড়া দিয়ে এবছরেই যেকোন মূল্যে ওমরাহ করতে হবে মর্মে মেনে নিলে বরং ক্ষতি হ’ত। আর আবেগতাড়িত মুহূর্তে সে ক্ষতি অনুমান করা সম্ভব হয় না।
মুসলিম হয়ে আগমনকারীকে মুশরিকদের নিকট হস্তান্তরের ভেতর তাদেরই মুছীবত রয়েছে। যেমন আবু জান্দাল (রাঃ)-এর বেলায় হয়েছিল। খোদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আবু জান্দাল! ধৈর্য ধর ও পুণ্য লাভের নিয়ত কর। আল্লাহ তোমাকে ও তোমার সাথে জড়িত অসহায়দের মুক্তির একটা সুরাহা অবশ্যই করে দিবেন।[12] আবু বছিরকেও আল্লাহ তা‘আলা উপায় করে দিয়েছিলেন। তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মুসলমান হয়ে মদীনায় এলে কাফেররা তাকে সন্ধি মোতাবেক ফিরিয়ে নিতে আসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন দুঃখ করে বলেছিলেন, وَيْلُ أُمَّةٍ مِسْعَرِ حَرْبٍ، لَوْ كَانَ مَعَهُ أَحَدٌ - ‘যে জাতি যুদ্ধ উষ্কে দেয় তার জন্য বড়ই পরিতাপ! হায় তার (আবু বছিরের) সাথে যদি কেউ হ’ত’।[13] কিন্তু এই দু’জনকে ফেরৎ দানের মাধ্যমেই মুসলমানদের বিরাট বিজয়ের সূচনা হয়েছিল।
উপরোক্ত ঘটনাগুলি ও তৎসংক্রান্ত কুরআনের মীমাংসা আলোচনার পর আমাদের শিরোনাম ‘বিজয়ের প্রত্যাশায় ছাড় প্রদান’-এর একটু জরীপ করে দেখা যাক। ‘ছাড় দেয়া’ কথাটির অর্থ গ্রহণে অনেক দাঈ ও ইসলামী দল তালগোল পাকিয়ে ফেলে। প্রত্যেকেই স্ব স্ব সুবিধামত ছাড় প্রদান করেন এবং তার সপক্ষে দলীল দেন। সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করেন না। আমরা এক্ষেত্রে চরম ও নরম মধ্যম অবস্থানে থাকতে চাই। আমরা আগেও বলেছি যে, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সার্বিক দিক-নির্দেশক মৌলিক অধ্যয়ন। ছাড় দেয়া সংক্রান্ত বিষয়টি এমনভাবে অধ্যয়ন করতে হবে যাতে তার মাঝে সব রকম দলীল জমা হয় এবং এ সংক্রান্ত নানা সমস্যা ও তাদের গতি-প্রকৃতি, হাল-অবস্থা তুলে ধরা হয়। এভাবে অগ্রসর হ’লে বিষয়টির মীমাংসা ও জটখোলায় সহযোগিতা মিলবে।
ছাড় প্রদানের বিষয়ে পূর্বে যা আলোচিত হয়েছে তাতে আমাদের সামনে মূলতঃ দু’টি দিক প্রতিভাত হয়েছে।
এক: নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করতে কোন ছাড় প্রদানের অবকাশ নেই। যথা- (১) ইসলামের মৌলিক আক্বীদা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে। (২) যে সকল বিষয় ইসলামের বুনিয়াদ বা ভিত্তি বলে স্বীকৃত তার যেকোন বিষয়ে (৩) কুরআন, সুন্নাহ এবং ছাহাবীদের ইজমা দ্বারা অকাট্যভাবে নির্ণীত ইসলামের আইন ও বিধি-বিধানের যে কোনটিতে।
দুই: শরী‘আতের সামষ্টিক ও সাধারণ বিধির আলোকে সমঝোতা করা বা ছাড় প্রদানের অবকাশ রয়েছে। যথা:
(১) ইজতিহাদ বা গবেষণার মাধ্যমে যে সব সমস্যা সমাধানযোগ্য সে ক্ষেত্রে (২) ইসলাম প্রচারের কৌশল, মাধ্যম ও পর্যায়ের ক্ষেত্রে। (৩) শারঈ রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে।
উল্লেখ্য, শরী‘আতের সামষ্টিক ও সাধারণ বিধির মধ্যে তিনটি দিক রয়েছে-
(ক) دَرْءُ الْمَفَاسِدِ وَحَلْبُ الْمَصاَلِحِ ‘বিশৃঙ্খলা দূরীকরণ ও কল্যাণ আনয়ন’। সুতরাং তা যদি না আসে তাহ’লে আপোষরফা অর্থহীন।
(খ) سَدُّ الذََّرَائِعُ ‘অপরাধের দ্বার ও ফাঁক-ফোকর বন্ধ করা’। দেখতে হবে যে, প্রতিপক্ষকে ছাড় দিলে অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি বন্ধ হবে, না বাড়বে। যদি বন্ধ হয় তাহ’লে ছাড় দিয়ে আপোষ করা যাবে।
(গ) اَلْمَصَالِحُ الْمُرْسَلَةُ وَالْإِسْتِحْسَانُ وَغَيْرُِهَا - ‘মাছালিহি মুরসালা’ ও ‘ইস্তিহ্সান’ অর্থাৎ ‘অন্তর্নিহি কল্যাণের আলোকে সিদ্ধান্ত’সহ অন্যান্য প্রসিদ্ধ নীতিমালা। এধরনের বিধি-বিধান মেনে ছাড় প্রদান ও সমঝোতার ঝুঁকি কেবল তারাই নিতে পারেন, যারা জ্ঞানবৃদ্ধ পন্ডিত, অভিজ্ঞ। যাঁদের মধ্যে ইজতিহাদের যোগ্যতা আছে। পরিশেষ বলব, আমাদের সমস্ত কামনা ও আগ্রহ আল্লাহর দ্বীনকে ঘিরে। আমাদের লক্ষ্য হবে অন্যান্য দ্বীন বা জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থার উপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। এজন্য কোনক্রমেই শারঈ কর্মনীতির বাইরে আমাদের যাওয়া চলবে না। কেননা লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে অবৈধ পন্থা কখনই বৈধ হয়ে যায় না।
[1]. তাফসীরে ত্বাবারী ৩০/৩৩১ পৃঃ।
[2]. তাফসীরে ত্বাবারী ৭/২০২ পৃঃ।
[3]. তাফসীরে ত্বাবারী ৭/২০১ পৃ: সূরা আন‘আম ৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা।
[4]. মুসলিম হা/২৪১৩; তাফসীরে ইবনু কাছীর ৩/৮০ পৃঃ।
[5]. বুখারী হা/২৭৩১ ও ২৭৩২।
[6]. আহমাদ ৪/৩৩০ পৃ:; ইবনু কাছীর ৪/১৯৬ পৃ:।
[7]. আহমাদ ৪/৩৩০ পৃ ; ইবনু কাছীর ৪/১৯৬ পৃ:।
[8]. বুখারী হা/৩৮৩৮।
[9]. ফাতহ ১; ইবনু কাছীর ৪/১৮২ পৃ:।
[10]. আহমাদ, ইবনু কাছীর ৪/১৮২ পৃ:।
[11]. বুখারী হা/২৭৩১, ২৭৩২।
* আবু বছির (রাঃ) ফেরৎ যাওয়ার পথে তাঁর সঙ্গী দু’জন থেকে কৌশল করে মুক্তি লাভ করেন এবং লোহিত তীরবর্তী ‘ঈছ’ নামক স্থানে ডেরা স্থাপন করেন। এ সংবাদ পেয়ে মক্কার নির্যাতিত মুসলমানরা ঈছে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে মুসলমানদের একটি বড়-সড় জমায়েত হয়ে গেলে তাঁরা সুযোগ পেলেই ঐ পথে আগত কুরাইশ কাফেলা আক্রমণ শুরু করে। এতে কুরাইশরা যারপর নাই বিচলিত হয়ে ওঠে। তাদের জনবল, অর্থবল ক্ষয় হ’তে দেখে শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট সন্ধি থেকে মুসলমানদের ফেরৎ দানের শর্ত প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে আবু বছির (রাঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ মদীনায় ফিরে আসার সুযোগ পান (সীরাত গ্রন্থ সমূহ দ্রঃ)- অনুবাদক}
[12]. আহমাদ ৪/৩২৫; ইবনু কাছীর ৪/১৯৭।
[13]. বুখারী হা/২৭৩১; মিখকাত হা/৪০৪২।
এ গ্রন্থে আমরা যে নীতি-পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, তার আলোকে বিজয়ের প্রত্যাশায় ছাড় দেওয়া সম্পর্কে কুরআনুল কারীম থেকে অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেছি। আমরা তিনটি ঘটনা অবগত হ’তে পেরেছি, যেখানে কুরআন তার প্রতিবিধান করেছে এবং আমাদের জন্য এমন এক কর্মপন্থা এঁকে দিয়েছে, যাকে আশ্রয় করে পদস্খলন কিংবা বিচ্যুতি ছাড়া আমরা অনায়াসে চলতে পারব। এখানে প্রতিটি বিষয় ও তার প্রতিবিধানের ফর্মুলা প্রথমে উল্লেখ করব এবং সব শেষে এ বিষয়ে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তার সারমর্ম তুলে ধরব।-
১ম বিষয় : সূরা কাফিরূনের শানে নুযুল :
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করল যে, তারা তাঁকে সম্পদ দিবে, যা পেয়ে তিনি মক্কার ধনাঢ্য ব্যক্তিকে পরিণত হবেন, যে নারী তাঁর পসন্দ হয় তার সাথেই তাঁকে বিবাহ দিবে এবং তাঁর পিছনে সমর্থন যোগাবে। বিনিময় হ’ল তিনি তাদের প্রভুদের গালমন্দ করবেন না বা খারাপ কিছু বলবেন না। আর যদি তিনি তা একান্তই না পারেন তবে বিকল্প একটি প্রস্তাব আমরা পেশ করছি। তাতে আমাদের উভয়ের মঙ্গল রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সেটা কি? তারা বলল, ‘আপনি এক বছর আমাদের উপাস্য দেবতা লাত ও উয্যার ইবাদত করবেন, আমরা এক বছর আপনার মা‘বূদ আল্লাহর ইবাদত করব’। তিনি উত্তরে বললেন, ‘অপেক্ষা কর, দেখি আমার প্রভুর পক্ষ থেকে কি বিধান আসে। তখন ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে সূরা কাফিরূন অবতীর্ণ হল, قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ، لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ ‘(হে নবী ! ) আপনি বলুন, ওহে কাফিররা, তোমরা যার ইবাদত কর আমি তার ইবাদত করি না’ ...(কাফিরূন)। আল্লাহ আরও অবতীর্ণ করলেন,
قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّيْ أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُوْنَ، ..... بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُن مِّنْ الشَّاكِرِيْنَ -
‘(হে রাসূল) আপনি (মুশরিকদের) বলুন, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করতে আমাকে আদেশ করছ, হে মূর্খরা? ....আপনি বরং আল্লাহরই ইবাদত করুন এবং কৃতজ্ঞদের মাঝে থাকুন’ (যুমার ৬৪-৬৬; তাফসীরে ত্বাবারী ৩০/৩৩১)।
ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) আরও বলেন, ইয়াকূবের সনদে বাখতারীর আযাদ কৃত গোলাম সাঈদ বিন মিনা হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ওয়ালীদ বিন মুগীরা, আছ বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব ও উমাইয়া বিন খালফ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে দেখা করে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আসুন, আমরা আপনার মা‘বূদের ইবাদত করি, আর আপনি আমাদের মা‘বূদের ইবাদত করুন। এভাবে আমাদের সব কাজে আপনাকে অংশীদার করে নেই। ফলত: যে দ্বীন নিয়ে আপনি আবির্ভূত হয়েছেন তা যদি আমাদের দ্বীন থেকে শ্রেষ্ঠ হয় তাহ’লে আমরা তাতে আপনার সাথে শরীক হ’তে পারব এবং তা থেকে আমাদের অংশ নিতে পারব। আবার আমাদের দ্বীন যদি আপনার দ্বীন থেকে শ্রেষ্ঠ হয় তাহ’লে আপনি আমাদের সাথে শরীক হয়ে আপনার অংশ গ্রহণ করতে পারবেন’। তখন আল্লাহ তা‘আলা সূরা কাফিরূন নাযিল করলেন।[1]
শানে নুযূলের এই ঘটনাগুলিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাদের খাতিরে কিছু ছাড় দিতে অনুরোধ করেছিল। বিনিময়ে তারাও কিছু ছাড় দিতে চেয়েছিল। এমনি করে তারা দু’পক্ষ এক বিন্দুতে মিলিত হ’তে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল।
কেউ হয়ত বলতে পারেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যদি তাদের সঙ্গে ঐক্যমত হ’তেন এবং তাদের নিকট আগে আল্লাহর ইবাদতের দাবী করতেন, তাহ’লে তারা ইবাদত করতে গিয়ে ইসলামকে ভালমত জানত ও বুঝত। ফলে তারা আর ইসলাম বিমুখ হ’ত না। এতে ইসলামের একটি বড় অর্জন তথা বিজয় নিশ্চিত হ’ত। দূর হ’ত সেই অত্যাচার-নির্যাতন, যার মুখোমুখি মুসলমানরা প্রতিনিয়ত হচ্ছিল। ঐ ব্যক্তির কথার উত্তরে বলা যায়, আল্লাহ এরূপ ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ، وَلاَ أَنتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ - ‘আমি তোমাদের উপাস্য মা‘বূদদের ইবাদতকারী নই। আর তোমরাও আমার মা‘বূদের ইবাদতকারী নও (কাফিরূন ১০/২-৩)। অবশেষে তিনি বলেছেন, لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ ‘তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন, আমার জন্য আমার দ্বীন’ (কাফিরূন ১০৯/৬)।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি একান্তই দ্বীনের মূলীভূত। এখানে দর কষাকষির কোন অবকাশ নেই এবং বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। এটি আক্বীদাগত বিষয়। বরং বলা চলে, এটাই আক্বীদাগত মূল ভিত্তি। আর আক্বীদার বিষয়ে কখনো কোন ছাড় নেই। এ রকম বলার হেতু এই যে, কিছু নির্দিষ্ট মুশরিককে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে এখানে সম্বোধন করেছেন, যাদের সম্বন্ধে তাঁর জানা আছে যে, তারা কস্মিনকালেও ঈমান আনবে না। তাই আল্লাহ তাঁর নবীকে বলে দিতে আদেশ করেছেন যে, ওদের আশা ও মনষ্কামনায় গুড়েবালি। এ ধরণের সমঝোতা কোন কালেই হবে না, না আপনার পক্ষ থেকে, না ওদের পক্ষ থেকে। এভাবে নবী করীম (ছাঃ)-কেও আল্লাহ হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের ঈমানদার হওয়া ও চিরস্থায়ী সাফল্য লাভের যে বাসনা আপনি লালন করেন, তা কখনো পূরণ হবে না। বাস্তবে তাদের এ রকমই ঘটেছিল। তারা সফল ও কৃতকার্য না হয়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তারা কেউ কেউ বদরে তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়েছে এবং কেউ কেউ তার আগেই কাফির হিসাবে মারা গিয়েছে।*
বস্ত্ততঃ এই ঘটনায় ইসলামের বর্তমান ও ভবিষ্যতের শত্রুদের বহুবিধ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র মুকাবেলার একটি সুস্পষ্ট কর্মপদ্ধতি অঙ্কিত হয়েছে।
২য় ঘটনা: সূরা আন‘আমের ৫২নং আয়াতের শানে নুযূল :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ ‘যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করে তাদেরকে আপনি তাড়িয়ে দিবেন না’ (আন‘আম ৬/৫২)। অত্র আয়াতের শানে নুযূল প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, কয়েকজন কুরাইশ নেতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর নিকটে তখন ছুহাইব, আম্মার, বেলাল, খাববাব প্রমুখ হতদরিদ্র মুসলমানগণ উপবিষ্ট ছিলেন। তখন তারা বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি তোমার কওমকে ফেলে কিভাবে এদের নিয়ে সন্তুষ্ট আছ? আমাদের মধ্য হ’তে কি আল্লাহ তা‘আলা কেবল এদেরই অনুগৃহীত করেছেন, আমরা কি এদের তল্পিবাহক হব? তুমি এদের তাড়িয়ে দাও, তোমার নিকটে এদের বসতে দিও না। তাহ‘লে হয়ত আমরা তোমার অনুসরণ করতে পারি। তখন আল্লাহ উক্ত আয়াত নাযিল করেন।
অন্য বর্ণনায় ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) তাবেঈ মুজাহিদের বরাতে বলেছেন, বেলাল ও ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মজলিসে বরাবর বসতেন। কুরাইশরা তাদের প্রতি নাক সিটকিয়ে বলে, এরা দু’জন সহ এদের মত ছোট লোকেরা যদি না থাকত তাহ’লে আমরা মুহাম্মাদের নিকটে বসতাম। তখন উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।[2]
অন্য বর্ণনায় খাববাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, কুরাইশরা নবী করীম (ছাঃ)-কে বলেছিল, ‘আমরা আপনার নিকট এমন বৈঠক ও আসন পসন্দ করি, যাতে সমগ্র আরব আমাদের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারে। কেননা আপনার নিকট আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দল আসা যাওয়া করে। এসব চাকর-বাকরদের সঙ্গে তারা আমাদেরকে দেখুক এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই আমরা যখন আসব তখন আপনি ওদের উঠিয়ে দিবেন। আমরা চলে গেলে চাইলে ওদের নিয়ে বসবেন। তখন উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।[3]
এসব বর্ণনাগুলিকে নিম্নোক্ত হাদীছটি জোরাল করে, যা মুসলিম শরীফে সংকলিত হয়েছে। আবুবকর ইবনু শায়বা (রাঃ)-এর বরাতে সা‘দ ইবনু আবি ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা ছয়জন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। মুশরিকরা তা দেখে তাঁকে বলল, ‘আপনি এদেরকে আপনার দরবার থেকে তাড়িয়ে দিন। এরা আমাদের উপর বাহাদুরী করবে তা হ’তে পারে না’। উক্ত ছয়জনের একজন আমি। অপর ক’জন হ’লেন ইবনু মাস‘ঊদ, হুযাইল গোত্রীয় একজন ও বেলাল। আর দু’জনের নাম আমি ভুলে গেছি। এ কথায় হয়ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মনে কোন ভাবোদয় হয়েছিল। তাই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন।[4]
আয়াতের শানে নুযূল পর্যালোচনা ও আমলে নিলে এমন অনেক ভুল পরিকল্পনার অবসান ঘটত, যেগুলি করতে অনেক প্রচারক ও ইসলামী দল অগ্রসর হয়ে থাকে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে অত্যন্ত ভালবাসেন এবং দ্বীনকে বিজয়ী করার তীব্র আকাঙ্খার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁŠছাতে এসব পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। কিন্তু লক্ষ্য যতই মহৎ হোক না কেন তা সাধনের উপায় মোটেও মহৎ নয়।
যেমন- ইসলামী দলগুলির মধ্যে কোন একটি দল অমুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে পাওয়া যাচ্ছে, যারা আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহবান ও ইসলামের বাণী প্রচার-প্রসারে সচেষ্ট আছে। কিন্তু ঐ রাষ্ট্র তাদের বলছে, তোমাদের স্বীকৃতি দেওয়া ও দাওয়াতী কার্যক্রমের কিছু সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা তোমাদের সাথে সমঝোতা করতে প্রস্ত্তত আছি। তবে শর্ত হ’ল, তোমাদের দলের অমুক অমুক ব্যক্তিকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে এবং অমুক অমুককে দলেই রাখতে পারবে না। কেননা যে দলে এই লোকগুলি আছে তাদের আমরা স্বীকৃতি দিতে পারি না। অথচ দল ঐ লোকগুলির মধ্যে কোন ভুলভ্রান্তি পায়নি। এমনকি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উক্ত দাবী তোলার পূর্বে তারা এ সম্পর্কে কোন চিন্তাও করেনি। আসলে তাদের তো কোন দোষ নেই। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের ছোট ও অপসন্দ করার মানসে তাদের চাচ্ছে না।
সুধী পাঠক! এমতাবস্থায় কি আপনাদের মনে হয় ঐ দল রাষ্ট্রের উত্থাপিত আপোষ ফর্মূলা একেবারে পায়ে ঠেলে বলতে পারবে, وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَنْ يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْد-ِ ‘আসলে কিছুই না, আমাদের নেতা ও ভাইদের একমাত্র অপরাধ হ’ল, তারা পরাক্রমশালী প্রশংসাময় আল্লাহতে বিশ্বাসী’ (বুরূজ ৮৫/৮)। নাকি তারা দর কষাকষি শুরু করবে, যা তথাকথিত ‘সুবিধা’ নামে আখ্যায়িত? দাওয়াতের সুবিধা লাভ ও সম্ভাব্য নানা অর্জন নিশ্চিত করার নামে ঐ ভাইদের যদি দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ক্ষণিকের জন্য তা বৈধ ধরা হয়, তাহ’লে পরিণামই বা কি দাঁড়াবে? কিছু কিছু দলের বাস্তবতা থেকে আমাদের ধারণা, বর্তমান কালের লোকেরা এরূপ দরাদরিতে পড়ে যাবে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাক্কী যুগেই এরূপ দর কষাকষির মূল্লোচ্ছেদ করে দিয়েছেন এবং আমাদের জন্য এমন এক নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা এক বাক্যে পালনীয়। তাতে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ নেই। আল্লাহ বলেন,
مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِّنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِم مِّن شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُوْنَ مِنَ الظَّالِمِيْن -
‘তাদের হিসাব দেওয়ার নূন্যতম দায়িত্ব আপনার উপর নেই এবং আপনার হিসাব দেওয়ার নূন্যতম দায়িত্বও তাদের উপর নেই। তাহ’লে আপনি কেন তাদের তাড়িয়ে দিবেন? এরূপ করলে আপনি যালিমদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে যাবেন’ (আন‘আম ৬/৫২)।
কী ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারী! যিনি মানবকুল শ্রেষ্ঠ এবং রাসূলদের নেতা তিনি যদি কোন ছাহাবীকে তাড়ানোর কাজ করতেন তাহ’লে দাওয়াতের ও ইসলামের স্বার্থেই কেবল করতেন, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। যদিও এরূপ ঘটা তাঁর পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ অচিন্তনীয়। তবুও যদি তিনি এটা করতেন তবে যালিমদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে পড়তেন। এরূপ দাবী ও দরাদরির সময় আমাদের করণীয় নীতি কী হবে তাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। যখন আমাদের সামনে বিপক্ষরা এরূপ স্বার্থ ও সুবিধার টোপ ফেলবে তখন আমাদের বলতে হবে - وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاء فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاء فَلْيَكْفُرْ ‘আপনি বলুন, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আসে। অতএব যার ইচ্ছা সে মুমিন হোক, আর যার ইচ্ছা সে কাফির থাকুক’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)। অতএব এটাই আমাদের দায়িত্ব, এটাই আমাদের যিম্মাদারী। আমরা হক কথা বলব, তাতে লোকে ঈমান আনে আনুক, আর কাফের থাকে থাকুক আমাদের কিছুই আসে যায় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَفَلَمْ يَيْأَسِ الَّذِينَ آمَنُواْ أَن لَّوْ يَشَاءُ اللّهُ لَهَدَى النَّاسَ جَمِيْعًا ‘তবে কি যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই সকল মানবকে সৎ পথে পরিচালিত করতে পারতেন?’ (রা‘দ ১৩/৩১)। মূল কথা হ’ল সমস্যা যখন মূলনীতির সঙ্গে জড়িত হয় তখন নীতির প্রশ্নে কোন আপোষরফা ও ছাড় প্রদানের অবকাশ থাকে না।
৩য় ঘটনা: সূরা ‘আল-ফাত্হ’ এর বিষয়-বস্ত্ত :
ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলকা‘দাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন হুদায়বিয়া থেকে মদীনা ফিরে যাচ্ছিলেন তখন সূরা আল-ফাত্হ নাযিল হয়। এর আগে মক্কার মুশরিকরা তাঁর মসজিদুল হারামে যাওয়ার পথ রোধ করেছিল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ওমরাহ পালন করা। কিন্তু মুশরিকদের বাধার মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে উভয় পক্ষ একটি সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল। শর্ত করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ বছর ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর ওমরাহ করতে আসবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদল ছাহাবীর অমত ও অসন্তুষ্টি সত্ত্বে প্রতিপক্ষের কথা মেনে নিয়েছিলেন। অসন্তুষ্ট ছাহাবীদের একজন ছিলেন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)। হুদায়বিয়ার সন্ধির ঘটনা অনেক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। এই ঘটনা বেশ লম্বা। সংক্ষেপে আমাদের আলোচ্য অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট অংশটুকু তুলে ধরা হ’ল-
ছহীহ বুখারীতে এসেছে, নবী করীম (ছাঃ) সন্ধির জন্য তাঁর লেখককে ডাকলেন এবং বললেন লেখ, ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’। তখন (অপরপক্ষের সন্ধি প্রস্ত্ততকারী) সুহাইল বলল, আল্লাহ শপথ ‘রহমান’ শব্দ কী তা আমি জানি না। তুমি বরং আগে যেমন লিখতে তেমনিভাবে ‘বিসমিকা আল্লাহু-হুম্মা’ লেখ। তখন মুসলিম লেখক বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ ছাড়া লিখব না। কিন্তু নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ই লেখা তারপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, লেখ ‘এতদশর্তে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সন্ধি করছেন’। এ কথা শোনা মাত্রই সুহাইল বলে উঠল, ‘আমরা যদি তোমাকে আল্লাহর রাসূলই জানতাম তাহ’লে ওমরাহ করতে বাধা দেব কেন? আর যুদ্ধই বা করব কেন? তুমি বরং লেখ, ‘আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ’। এতে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল, যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা মনে করছ। ঠিক আছে- ‘আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ’ই লেখা হোক’।[5]
সন্ধির শর্তাবলীতে আরও ছিল আগামী বছর আসলে আমরা মক্কা হ’তে বের হয়ে যাব, তারপর তুমি তোমার সাথীদের নিয়ে সেখানে প্রবেশ করবে। নবী করীম (ছাঃ)-এর কোন ছাহাবী (মক্কা থেকে) অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে তাঁর নিকট গমন করলে তিনি তাকে ফেরৎ পাঠাবেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে যারা আছেন তাদের কেউ মক্কায় কুরাইশদের আশ্রয়ে এলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে না’।[6]
এ ছিল সন্ধির কিছু অংশ। এ কারণেই ওমর (রাঃ)-এর কানে যখন রাসূলের সন্ধি স্থাপনের দৃঢ় সংকল্পের কথা পেঁŠছল, তখন তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন এবং রাসূলের নিকটে কৈফিয়ত তলবের সুরে বলেছিলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি মুসলিম নই? ওরা কি মুশরিক নয়? তিনি বললেন, ‘অবশ্যই’। ওমর (রাঃ) বললেন, তাহ’লে আমরা কেন আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে এমন অপমান মেনে নেব? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আমি কখনই তাঁর আদেশের বিরোধিতা করব না। আর তিনি আমাকে শেষ করে দিবেন না।[7]
এই সন্ধিকে ওমর (রাঃ) দ্বীনের মধ্যে অপমানজনক বলে গণ্য করেছিলেন এবং প্রথম দৃষ্টিতে কিছু শর্ত মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। অথচ সেই সন্ধিকেই আল্লাহ তা‘আলা তার সকল শর্তসহই ‘স্পষ্ট বিজয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, তোমরা তো মক্কা বিজয়কে বিজয় বলে গণ্য করে থাক, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধিকেই বিজয় গণ্য করে থাকি। বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেন, তোমরা তো মক্কা বিজয়কে বিজয় বলে মনে কর। অবশ্য সেটিও একটি বিজয়, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়াতে সংঘটিত বাই‘আতুর রিযওয়ানকেই বিজয় মনে করি।[8] মুসনাদে আহমাদে আছে নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
نَزَلَ عَلَّى الْباَرِحَةَ سُوْرَةٌ أَحَبُّ إلَّى مِنَ الدُّنْياَ وَماَ فِيْهَا إنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِيْنًا -
‘আজ রাতে আমার উপর একটি সূরা নাযিল হয়েছে, যা আমার নিকট দুনিয়া ও দুনিয়াস্থ সমস্ত কিছুর তুলনায় প্রিয়তর’ তাহ’ল ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি’।[9] আহমাদের আরেক বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) হুদায়বিয়া থেকে ফেরার পথে নাযিল হয় - لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَماَ تَأَخَّرَ، ‘আল্লাহ আপনার জীবনের পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করার জন্য (আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছে)’ (ফাতাহ ৪৮/২)। নবী করীম (ছাঃ) তখন বলেন, আজ রাতে আমার উপর এমন একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যা আমার নিকট ধরাপৃষ্ঠের সমুদয় জিনিস থেকেও প্রিয়। তারপর তিনি সূরাটি পড়ে শুনান।[10]
আমরা এ ঘটনায় দেখতে পাচ্ছি যে, কয়েকটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার কাফির কুরাইশদের মতে মত দিয়েছিলেন। যেমন-
১. ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’-এর স্থলে ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ লেখায়।
২. ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর স্থলে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লেখায়।
৩. পরবর্তী বছর মক্কায় প্রবেশ পিছিয়ে দেওয়া।
৪. মুশরিকদের কেউ তার অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে মুসলমান হয়ে মদীনায় গেলে তাকে তাদের নিকট ফেরত পাঠানোর শর্তে। যদিও মুসলামনদের কেউ মুশরিক হয়ে মক্কায় এলে তারা তাকে ফেরত দেবে না। বরং ছাহাবীদের কেউ কেউ যখন সন্ধির কিছু শর্ত নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন, তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের বলেছিলেন, ‘তারা আমার নিকট যে কাজের কথাই বলবে তাতে যদি আল্লাহর মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয় তবে আমি তা-ই মঞ্জুর করব’।[11]
মুশরিকদের দেয়া যে সব শর্ত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) মেনে নিয়েছিলেন আমরা যদি তা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করি তাহ’লে দেখতে পাব, এগুলি না ইসলামের আক্বীদার সাথে জড়িত, না তার বুনিয়াদী নীতির সাথে জড়িত। এই ঘটনা এবং সূরা কাফিরূন ও সূরা আন‘আমে বর্ণিত ঘটনার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এই সন্ধিতে না বাতিলের স্বীকৃতি আছে, না তাকে সম্মতি দেয়া হয়েছে। আর তা হবেই বা কী করে- যেখানে আল্লাহ একে ‘স্পষ্ট বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সন্ধির চারটি দাবীকে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় নিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
‘বিস্মিকা আল্লা-হুমা’ লেখায় শারঈ কোন বাধা নেই। কেননা কোন মুসলিম যদি ‘রহমান’ ও ‘রহীম’ নাম দু’টি ব্যাখ্যাসূত্রে ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ না পড়ে তাহ’লে সে পাপী হবে না।
আর ‘মু হাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ নিয়ে কথা হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তো প্রকৃতই আব্দুল্লাহর পুত্র ছিলেন। তাই তিনি একথা মেনে নিয়েছিলেন। সেই সাথে মানব স্মৃতিতে কোন বৈরি সন্দেহের অবকাশ যাতে না জন্মাতে পারে সেজন্য তিনি বলে দিয়েছিলেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল, যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা বলছ। এভাবে কথার গোল দূর হয়ে যাওয়ায় বিষয়টির বৈধতা নিয়ে সমস্যা থাকছে না।
এছাড়া তাদের এ বছরে ফিরে গিয়ে পরবর্তী বছরে আগমনের কথা সুযোগ-সুবিধার সাথে জড়িত একটি বিষয়। সুবিধা অনুপাতে এ ধরনের শর্ত গ্রহণযোগ্য। ঐ বছর ওমরাহ না করে পরবর্তী বছর ওমরাহ করার কথা মেনে নেয়ায় নির্বিঘ্ন সন্ধিটা হ’তে পেরেছিল। এদিকে ওমরাহ করতে না পারায় ছাহাবীগণ ছিলেন আবেগতাড়িত ও ক্ষুদ্ধ। এত ক্ষুদ্ধ আবেগে সাড়া না দেয়ায় ভালই হয়েছে। তাদের আবেগে সাড়া দিয়ে এবছরেই যেকোন মূল্যে ওমরাহ করতে হবে মর্মে মেনে নিলে বরং ক্ষতি হ’ত। আর আবেগতাড়িত মুহূর্তে সে ক্ষতি অনুমান করা সম্ভব হয় না।
মুসলিম হয়ে আগমনকারীকে মুশরিকদের নিকট হস্তান্তরের ভেতর তাদেরই মুছীবত রয়েছে। যেমন আবু জান্দাল (রাঃ)-এর বেলায় হয়েছিল। খোদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আবু জান্দাল! ধৈর্য ধর ও পুণ্য লাভের নিয়ত কর। আল্লাহ তোমাকে ও তোমার সাথে জড়িত অসহায়দের মুক্তির একটা সুরাহা অবশ্যই করে দিবেন।[12] আবু বছিরকেও আল্লাহ তা‘আলা উপায় করে দিয়েছিলেন। তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মুসলমান হয়ে মদীনায় এলে কাফেররা তাকে সন্ধি মোতাবেক ফিরিয়ে নিতে আসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন দুঃখ করে বলেছিলেন, وَيْلُ أُمَّةٍ مِسْعَرِ حَرْبٍ، لَوْ كَانَ مَعَهُ أَحَدٌ - ‘যে জাতি যুদ্ধ উষ্কে দেয় তার জন্য বড়ই পরিতাপ! হায় তার (আবু বছিরের) সাথে যদি কেউ হ’ত’।[13] কিন্তু এই দু’জনকে ফেরৎ দানের মাধ্যমেই মুসলমানদের বিরাট বিজয়ের সূচনা হয়েছিল।
উপরোক্ত ঘটনাগুলি ও তৎসংক্রান্ত কুরআনের মীমাংসা আলোচনার পর আমাদের শিরোনাম ‘বিজয়ের প্রত্যাশায় ছাড় প্রদান’-এর একটু জরীপ করে দেখা যাক। ‘ছাড় দেয়া’ কথাটির অর্থ গ্রহণে অনেক দাঈ ও ইসলামী দল তালগোল পাকিয়ে ফেলে। প্রত্যেকেই স্ব স্ব সুবিধামত ছাড় প্রদান করেন এবং তার সপক্ষে দলীল দেন। সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করেন না। আমরা এক্ষেত্রে চরম ও নরম মধ্যম অবস্থানে থাকতে চাই। আমরা আগেও বলেছি যে, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সার্বিক দিক-নির্দেশক মৌলিক অধ্যয়ন। ছাড় দেয়া সংক্রান্ত বিষয়টি এমনভাবে অধ্যয়ন করতে হবে যাতে তার মাঝে সব রকম দলীল জমা হয় এবং এ সংক্রান্ত নানা সমস্যা ও তাদের গতি-প্রকৃতি, হাল-অবস্থা তুলে ধরা হয়। এভাবে অগ্রসর হ’লে বিষয়টির মীমাংসা ও জটখোলায় সহযোগিতা মিলবে।
ছাড় প্রদানের বিষয়ে পূর্বে যা আলোচিত হয়েছে তাতে আমাদের সামনে মূলতঃ দু’টি দিক প্রতিভাত হয়েছে।
এক: নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করতে কোন ছাড় প্রদানের অবকাশ নেই। যথা- (১) ইসলামের মৌলিক আক্বীদা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে। (২) যে সকল বিষয় ইসলামের বুনিয়াদ বা ভিত্তি বলে স্বীকৃত তার যেকোন বিষয়ে (৩) কুরআন, সুন্নাহ এবং ছাহাবীদের ইজমা দ্বারা অকাট্যভাবে নির্ণীত ইসলামের আইন ও বিধি-বিধানের যে কোনটিতে।
দুই: শরী‘আতের সামষ্টিক ও সাধারণ বিধির আলোকে সমঝোতা করা বা ছাড় প্রদানের অবকাশ রয়েছে। যথা:
(১) ইজতিহাদ বা গবেষণার মাধ্যমে যে সব সমস্যা সমাধানযোগ্য সে ক্ষেত্রে (২) ইসলাম প্রচারের কৌশল, মাধ্যম ও পর্যায়ের ক্ষেত্রে। (৩) শারঈ রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে।
উল্লেখ্য, শরী‘আতের সামষ্টিক ও সাধারণ বিধির মধ্যে তিনটি দিক রয়েছে-
(ক) دَرْءُ الْمَفَاسِدِ وَحَلْبُ الْمَصاَلِحِ ‘বিশৃঙ্খলা দূরীকরণ ও কল্যাণ আনয়ন’। সুতরাং তা যদি না আসে তাহ’লে আপোষরফা অর্থহীন।
(খ) سَدُّ الذََّرَائِعُ ‘অপরাধের দ্বার ও ফাঁক-ফোকর বন্ধ করা’। দেখতে হবে যে, প্রতিপক্ষকে ছাড় দিলে অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি বন্ধ হবে, না বাড়বে। যদি বন্ধ হয় তাহ’লে ছাড় দিয়ে আপোষ করা যাবে।
(গ) اَلْمَصَالِحُ الْمُرْسَلَةُ وَالْإِسْتِحْسَانُ وَغَيْرُِهَا - ‘মাছালিহি মুরসালা’ ও ‘ইস্তিহ্সান’ অর্থাৎ ‘অন্তর্নিহি কল্যাণের আলোকে সিদ্ধান্ত’সহ অন্যান্য প্রসিদ্ধ নীতিমালা। এধরনের বিধি-বিধান মেনে ছাড় প্রদান ও সমঝোতার ঝুঁকি কেবল তারাই নিতে পারেন, যারা জ্ঞানবৃদ্ধ পন্ডিত, অভিজ্ঞ। যাঁদের মধ্যে ইজতিহাদের যোগ্যতা আছে। পরিশেষ বলব, আমাদের সমস্ত কামনা ও আগ্রহ আল্লাহর দ্বীনকে ঘিরে। আমাদের লক্ষ্য হবে অন্যান্য দ্বীন বা জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থার উপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। এজন্য কোনক্রমেই শারঈ কর্মনীতির বাইরে আমাদের যাওয়া চলবে না। কেননা লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে অবৈধ পন্থা কখনই বৈধ হয়ে যায় না।
[1]. তাফসীরে ত্বাবারী ৩০/৩৩১ পৃঃ।
[2]. তাফসীরে ত্বাবারী ৭/২০২ পৃঃ।
[3]. তাফসীরে ত্বাবারী ৭/২০১ পৃ: সূরা আন‘আম ৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা।
[4]. মুসলিম হা/২৪১৩; তাফসীরে ইবনু কাছীর ৩/৮০ পৃঃ।
[5]. বুখারী হা/২৭৩১ ও ২৭৩২।
[6]. আহমাদ ৪/৩৩০ পৃ:; ইবনু কাছীর ৪/১৯৬ পৃ:।
[7]. আহমাদ ৪/৩৩০ পৃ ; ইবনু কাছীর ৪/১৯৬ পৃ:।
[8]. বুখারী হা/৩৮৩৮।
[9]. ফাতহ ১; ইবনু কাছীর ৪/১৮২ পৃ:।
[10]. আহমাদ, ইবনু কাছীর ৪/১৮২ পৃ:।
[11]. বুখারী হা/২৭৩১, ২৭৩২।
* আবু বছির (রাঃ) ফেরৎ যাওয়ার পথে তাঁর সঙ্গী দু’জন থেকে কৌশল করে মুক্তি লাভ করেন এবং লোহিত তীরবর্তী ‘ঈছ’ নামক স্থানে ডেরা স্থাপন করেন। এ সংবাদ পেয়ে মক্কার নির্যাতিত মুসলমানরা ঈছে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে মুসলমানদের একটি বড়-সড় জমায়েত হয়ে গেলে তাঁরা সুযোগ পেলেই ঐ পথে আগত কুরাইশ কাফেলা আক্রমণ শুরু করে। এতে কুরাইশরা যারপর নাই বিচলিত হয়ে ওঠে। তাদের জনবল, অর্থবল ক্ষয় হ’তে দেখে শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট সন্ধি থেকে মুসলমানদের ফেরৎ দানের শর্ত প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে আবু বছির (রাঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ মদীনায় ফিরে আসার সুযোগ পান (সীরাত গ্রন্থ সমূহ দ্রঃ)- অনুবাদক}
[12]. আহমাদ ৪/৩২৫; ইবনু কাছীর ৪/১৯৭।
[13]. বুখারী হা/২৭৩১; মিখকাত হা/৪০৪২।
(১) দাওয়াত দাতা যখন সাহায্যের স্বরূপ বুঝতে পারবেন, তখন দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দেওয়া, অন্যায়, দুর্নীতি, অপরাধ ইত্যাদি উৎখাতে জোর তৎপরতা চালানোর ব্যাপারে এবং মানুষকে সৎপথে আনার অবিরাম চেষ্টায় কোনরূপ শিথিলতা দেখানো তার জন্য মোটেও ঠিক হবে না। কেননা শয়তানের কাজই হ’ল মানুষকে খোঁচান। সে তাকে বুঝায়- দেখ, তোমার কাজ তো প্রচার করা। ফলাফল তো আর তোমার হাতে নয়। সেটা তো আল্লাহর হাতে। তাহ’লে ওদের পথে না আসার জন্য তুমি কেন এত চিন্তা করছ? যে জিনিস তোমার আয়ত্তে নেই তার জন্য ক্লেশ ভোগ কর কেন? দু’একবার যা প্রচার করেছ তা-ই যথেষ্ট, আর দরকার নেই।
আবার সে এই বলেও কুমন্ত্রণা দেয় যে, এই লোকগুলির মধ্যে ভাল কিছু নেই। তুমি তাদের দু’তিনবার তো দাওয়াত দিয়েছ । এতেই যথেষ্ট হয়েছে। তাতে যদি ওরা পথে না আসে তাহ’লে তুমি তো নিরুপায়। সব সময় জোঁকের মত ওদের পেছনে লেগে থাকা কী দরকার? তাতে তোমার শক্তি ক্ষয় হবে। এসব না করে রবং অন্য কিছুতে মন দাও। তাতে তোমারও ভাল হবে, আবার সময়টাও কাজে লাগবে। এরপর থেকে দাওয়াত দাতা একটু একটু করে পিছু হটতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত দাওয়াত দেওয়া ছেড়ে দেয়। সে লোকদের সংশ্রব ত্যাগ করে এবং তাদের অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ দেয়। একজন দাওয়াত দাতার এহেন অবস্থায় উপনীত হওয়া মোটেই কাম্য নয়।
সাহায্য ও বিজয়ের প্রকৃত অর্থ অনুভব করতে পারলে তার বরং আরও মনোবল বেড়ে যাবে। সে নিজের লক্ষ্য অর্জনে সব্যসাচীর ন্যায় তৎপরতা চালাবে। তাতে হয় দ্বীনের স্পষ্ট বিজয় অর্জিত হবে, নয় খোদ দাওয়াত দাতা বিজয়ী হবে। দাওয়াত দাতা বেদনার্ত ও আনন্দিত অবশ্যই হবে। কিন্তু এ বেদনা ও আনন্দকে অবশ্যই ইতিবাচক ও কার্যকরী হ’তে হবে। তার বেদনা যেন তাকে হতাশ না করে, বরং স্বীয় সম্প্রদায়কে দুনিয়া-আখিরাতের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে, জাতিকে সৎপথ প্রদর্শন করতে এবং মানুষকে আল্লাহর গোলাম বানাতে সদা তৎপর ও আগ্রহী করে তোলে।
(২) প্রত্যেক দাওয়াত দাতাকে নিজের জন্য একটি কর্মনীতি অবশ্যই এঁকে নিতে হবে। সে ঐ কর্মনীতি মেনে চলবে এবং কিছু লক্ষ্য স্থির করে তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এ জন্য আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ থেকে সাহায্য নেবে। যে সমাজে সে বাস করে তার চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে এবং যে যুগে তার আগমন সেই যুগের বাস্তবতার প্রতি খেয়াল রেখে সে লক্ষ্য স্থির করবে।
কোন কোন দাওয়াত দাতাকে দেখা যায়, কিছুকাল দাওয়াতী কাজ পরিচালনার পর লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হ’ল তা পিছনে ফিরে দেখে। তারপর যখন দেখে আংশিক বা যৎসামান্য লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে এবং নির্ধারিত লক্ষ্যের বিশাল অংশ পড়ে রয়েছে তখন তার মনে হয়, তার কর্মনীতি ব্যর্থ হয়েছে, মিশন সফল হচ্ছে না এবং সে দাওয়াতী কাজে লাভবান হ’তে পারেনি বরং লোকসানের বোঝা উঠিয়েছে। তারপর সে নিরাশ হয়ে পড়ে এবং দাওয়াতী কাজ বন্ধ করে দেয়।
এটি একটি ভয়াবহ পদক্ষেপ। যেখানে কোন কোন নবীর হাতে একজন লোকও হেদায়াতের পথে আসেনি, তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের দাওয়াতী কাজের সফলতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি এবং থেমেও থাকেননি। সেখানে যে ব্যক্তি কোন নবী না হওয়ার পরও তার লক্ষ্য কিছুটা অর্জিত হয়েছে সে কেন সংশয়ের ঘোরে পতিত হবে? দু’একজন লোকের হেদায়াত লাভই কি কম? লক্ষ্য করুন আলী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছিলেন, فَوَاللهِ لَأنْ يَّهْدِىَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدً خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ - ‘আল্লাহর শপথ! তোমার চেষ্টায় আল্লাহ একজন লোককেও হেদায়াত দান করলে তা হবে তোমার জন্য অনেক লাল উট থেকেও শ্রেষ্ঠ’।[1] এ হাদীছ মাত্র একজন লোকের হেদায়াত লাভও প্রচারকের জন্য মহাবিজয় নির্দেশ করে।
(৩) বিজয়ের যত প্রকার আছে তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ’ল, নিজের মনের উপর বিজয়। আসলে দাওয়াত দাতা নিজের মন ও প্রবৃত্তির উপর বিজয় লাভ করার আগ পর্যন্ত অন্য কোন বিজয় অর্জন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُمْ مُّصِيْبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّى هَـذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ ‘তোমাদের উপর যখন এমন বিপদ চেপে বসল, যার দ্বিগুণ বিপদ ইতিপূর্বে তোমাদের উপর চেপেছে তখন তোমরা বললে, বিপদ কোথা থেকে এলো? আপনি বলুন, ‘এ তোমাদের নিজেদেরই পক্ষ থেকে এসেছে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)। তিনি আরো বলেন, إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির চলমান অবস্থার পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন নিজেরা করে’ (রা‘দ ১৩/১১)।
এজাতীয় আয়াত পবিত্র কুরআনে আরও আছে। এতদপ্রেক্ষিততে বলা যায়, যখন সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হবে তখন আমরা তার কারণ অনুসদ্ধান করব প্রথমে নিজেদের মধ্যে, তারপর অন্যত্র। কেননা বিপদ বুঝেই সাবধানতা। বিপদ যদি নিজেরা ঘটাই তাহ’লে সেটা বন্ধ না করে অন্যদের পক্ষ থেকে আগত বিপদের মোকাবেলা করা কখনো সম্ভব নয়।
[1]. বুখারী হা/২৯৪২; মুসলিম হা/২৪০৬।
আবার সে এই বলেও কুমন্ত্রণা দেয় যে, এই লোকগুলির মধ্যে ভাল কিছু নেই। তুমি তাদের দু’তিনবার তো দাওয়াত দিয়েছ । এতেই যথেষ্ট হয়েছে। তাতে যদি ওরা পথে না আসে তাহ’লে তুমি তো নিরুপায়। সব সময় জোঁকের মত ওদের পেছনে লেগে থাকা কী দরকার? তাতে তোমার শক্তি ক্ষয় হবে। এসব না করে রবং অন্য কিছুতে মন দাও। তাতে তোমারও ভাল হবে, আবার সময়টাও কাজে লাগবে। এরপর থেকে দাওয়াত দাতা একটু একটু করে পিছু হটতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত দাওয়াত দেওয়া ছেড়ে দেয়। সে লোকদের সংশ্রব ত্যাগ করে এবং তাদের অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ দেয়। একজন দাওয়াত দাতার এহেন অবস্থায় উপনীত হওয়া মোটেই কাম্য নয়।
সাহায্য ও বিজয়ের প্রকৃত অর্থ অনুভব করতে পারলে তার বরং আরও মনোবল বেড়ে যাবে। সে নিজের লক্ষ্য অর্জনে সব্যসাচীর ন্যায় তৎপরতা চালাবে। তাতে হয় দ্বীনের স্পষ্ট বিজয় অর্জিত হবে, নয় খোদ দাওয়াত দাতা বিজয়ী হবে। দাওয়াত দাতা বেদনার্ত ও আনন্দিত অবশ্যই হবে। কিন্তু এ বেদনা ও আনন্দকে অবশ্যই ইতিবাচক ও কার্যকরী হ’তে হবে। তার বেদনা যেন তাকে হতাশ না করে, বরং স্বীয় সম্প্রদায়কে দুনিয়া-আখিরাতের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে, জাতিকে সৎপথ প্রদর্শন করতে এবং মানুষকে আল্লাহর গোলাম বানাতে সদা তৎপর ও আগ্রহী করে তোলে।
(২) প্রত্যেক দাওয়াত দাতাকে নিজের জন্য একটি কর্মনীতি অবশ্যই এঁকে নিতে হবে। সে ঐ কর্মনীতি মেনে চলবে এবং কিছু লক্ষ্য স্থির করে তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এ জন্য আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ থেকে সাহায্য নেবে। যে সমাজে সে বাস করে তার চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে এবং যে যুগে তার আগমন সেই যুগের বাস্তবতার প্রতি খেয়াল রেখে সে লক্ষ্য স্থির করবে।
কোন কোন দাওয়াত দাতাকে দেখা যায়, কিছুকাল দাওয়াতী কাজ পরিচালনার পর লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হ’ল তা পিছনে ফিরে দেখে। তারপর যখন দেখে আংশিক বা যৎসামান্য লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে এবং নির্ধারিত লক্ষ্যের বিশাল অংশ পড়ে রয়েছে তখন তার মনে হয়, তার কর্মনীতি ব্যর্থ হয়েছে, মিশন সফল হচ্ছে না এবং সে দাওয়াতী কাজে লাভবান হ’তে পারেনি বরং লোকসানের বোঝা উঠিয়েছে। তারপর সে নিরাশ হয়ে পড়ে এবং দাওয়াতী কাজ বন্ধ করে দেয়।
এটি একটি ভয়াবহ পদক্ষেপ। যেখানে কোন কোন নবীর হাতে একজন লোকও হেদায়াতের পথে আসেনি, তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের দাওয়াতী কাজের সফলতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি এবং থেমেও থাকেননি। সেখানে যে ব্যক্তি কোন নবী না হওয়ার পরও তার লক্ষ্য কিছুটা অর্জিত হয়েছে সে কেন সংশয়ের ঘোরে পতিত হবে? দু’একজন লোকের হেদায়াত লাভই কি কম? লক্ষ্য করুন আলী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছিলেন, فَوَاللهِ لَأنْ يَّهْدِىَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدً خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ - ‘আল্লাহর শপথ! তোমার চেষ্টায় আল্লাহ একজন লোককেও হেদায়াত দান করলে তা হবে তোমার জন্য অনেক লাল উট থেকেও শ্রেষ্ঠ’।[1] এ হাদীছ মাত্র একজন লোকের হেদায়াত লাভও প্রচারকের জন্য মহাবিজয় নির্দেশ করে।
(৩) বিজয়ের যত প্রকার আছে তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ’ল, নিজের মনের উপর বিজয়। আসলে দাওয়াত দাতা নিজের মন ও প্রবৃত্তির উপর বিজয় লাভ করার আগ পর্যন্ত অন্য কোন বিজয় অর্জন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُمْ مُّصِيْبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّى هَـذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ ‘তোমাদের উপর যখন এমন বিপদ চেপে বসল, যার দ্বিগুণ বিপদ ইতিপূর্বে তোমাদের উপর চেপেছে তখন তোমরা বললে, বিপদ কোথা থেকে এলো? আপনি বলুন, ‘এ তোমাদের নিজেদেরই পক্ষ থেকে এসেছে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)। তিনি আরো বলেন, إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির চলমান অবস্থার পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন নিজেরা করে’ (রা‘দ ১৩/১১)।
এজাতীয় আয়াত পবিত্র কুরআনে আরও আছে। এতদপ্রেক্ষিততে বলা যায়, যখন সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হবে তখন আমরা তার কারণ অনুসদ্ধান করব প্রথমে নিজেদের মধ্যে, তারপর অন্যত্র। কেননা বিপদ বুঝেই সাবধানতা। বিপদ যদি নিজেরা ঘটাই তাহ’লে সেটা বন্ধ না করে অন্যদের পক্ষ থেকে আগত বিপদের মোকাবেলা করা কখনো সম্ভব নয়।
[1]. বুখারী হা/২৯৪২; মুসলিম হা/২৪০৬।
উপরে উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সবশেষে বলা যায় যে, দাওয়াত দাতার বিজয় ও আল্লাহর সাহায্য লাভের স্বরূপ নিম্নের কয়েকটি দফার সাথে যুক্ত। যেমন-
(১) সকল বিষয় থেকে বিমুক্ত হয়ে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা এবং খাঁটি মনে তার কাজ করা : আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَاْ أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ -
‘বলুন! আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছুই আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র সৃষ্টির প্রতিপালক। তাঁর কোন শরীক নেই। এ কথা বলতেই আমি আদিষ্ট হয়েছি, আর আমিই প্রথম আত্মসমর্পণকারী’ (আন‘আম ৬/১৬২-১৬৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَمَا أُمِرُوْا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ وَيُقِيْمُوْا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوْا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ -
‘তাদেরকে (আহলে কিতাব, কাফির, মুশরিক ইত্যাকার সকল শ্রেণীর মানুষকে) কেবল এই আদেশই দেওয়া হয়েছে যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, ছালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে। আর সেটাই হ’ল সরল দ্বীন’ (বাইয়িনাহ ৯৮/৫)। তাই যে আমল আললাহর জন্য খাuঁটভাবে ও নিষ্ঠার সাথে পালিত হয় না, তা প্রত্যাখ্যাত ও অগ্রাহ্য হওয়ারই সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত।
(২) সদা সর্বদা নিখুঁত কর্মনীতি অবলম্বন করা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ যে আদর্শের উপর ছিলেন তদনুযায়ী গৃহীত কর্মনীতি হ’ল নিখুঁত কর্মনীতি। এটাই হ’ল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের কর্মনীতি, সাহায্যপ্রাপ্ত ও মুক্তিপ্রাপ্ত দলের কর্মনীতি। যাদেরকে কোন অপমান বা কোনরূপ বিরোধিতা সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। তারা সত্যের নির্ভীক সৈনিক হিসাবেই থেকে যাবে যতদিন না আল্লাহর আদেশ তথা ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। আল্লাহ বলেন,
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْماً فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ -
‘এই আমার পথ, যা সরল-সোজা। সুতরাং তোমরা কেবল উহারই অনুসরণ কর। অন্য সব পথের অনুসরণ করো না। নচেৎ এরা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে’ (আন‘আম ৬/১৫৩)। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضاَءِ لَيْلُهَا كَنَهَارهَا لاَ يَزِيْغُُ عَنْهَا بَعْدِىْ إِلاَّ هَالِكَ - ‘আমি তোমাদেরকে একটি উজ্জ্বল মিল্লাত বা আদর্শের উপর রেখে যাচ্ছি, যার জন্য রাত-দিন উভয়ই সমান। আমার মৃত্যুর পর এই মিল্লাত থেকে যে দূরে সরে যাবে কেবল সেই ধ্বংসে নিপতিত হবে।’
(৩) প্রচারক যে বিষয়ের প্রতি আহবান জানাবেন উক্ত বিষয় নিজে পূর্ণরূপে আকঁড়ে ধরা ও আমরণ তার উপর অবিচল থাকা :
আল্লাহ বলেন,
فَاسْتَمْسِكْ بِالَّذِْي أُوحِيَ إِلَيْكَ إِنَّكَ عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِْيمٍ -
‘সুতরাং আপনার নিকট যে অহি বা প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে আপনি তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকুন। নিশ্চয়ই আপনি সরল পথে আছেন’ (যুখরূফ ৪৩/৪৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَمَنْ يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى -
‘যে ব্যক্তি সৎকর্মশীল হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে সে এক মযবুত রশিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে’ (লোক্বমান ৩১/২২)।
أَتَأْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُوْنَ الْكِتَابَ أَفَلاَ تَعْقِلُوْنَ، وَاسْتَعِيْنُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيْرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِيْنَ -
‘তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে আর নিজেদের বেলায় ভুলে থাকবে! অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন কর। তোমরা কি কিছুই বুঝ না? তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই বিনয়ীগণ ব্যতীত আর সকলের নিকট উহা বড়ই কঠিন’ (বাক্বারাহ ২/ ৪৪-৪৫)।
সুতরাং কর্মপদ্ধতির উপর অটল থাকা সাহায্য লাভের শক্তিশালী উপকরণ ও চিহ্ন। বরং দেখা যায়, বাতিলপন্থী কোন ব্যক্তি যখন তার বাতিল মতের উপর অনড় থাকে তখন প্রায়শঃ সে জয়লাভ করে। অথচ তার লক্ষ্য কেবল এই পৃথিবীতেই অর্জিত হয়। তাহ’লে যে সত্য পথের উপর আছে সে কেন বিজয়ী হবে না?
(৪) সত্যকে প্রকাশ্যে প্রচার করা, শিথিলতা প্রদর্শন না করা, প্রতারণা না করা এবং সর্বদা অকুতোভয় থাকা : আল্লাহ বলেন,
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ -
‘অনন্তর আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদেরকে উপেক্ষা করুন। বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আপনার জন্য আমিই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ -
‘আপনি বলুন, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত। সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা কাফির থাকুক’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ -
‘হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করুন। যদি তা না করেন তবে তো আপনি তাঁর বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন’ (মায়েদাহ ৫/ ৬৭)।
(৫) ধৈর্যধারণ, হতাশ না হওয়া এবং আল্লাহর বান্দাদের জন্য তাঁর প্রতিশ্রুত সাহায্য লাভে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা :
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُورُوْنَ، وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ -
‘আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্য আমার কথা আগে স্থির হয়ে আছে যে, তারা অবশ্যই সাহায্য প্রাপ্ত হবে এবং আমার বাহিনীই হবে বিজয়ী’ (ছাফফাত ৩৭/১৭১-৭৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,
إنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ َيَقُوْمُ الْأَشْهاَدُ -
‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে ও মুমিনদেরকে পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীগণ দন্ডায়মান হবে সেদিন সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/ ৫১)। আল্লাহ আরো বলেন,
حَتَّى إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّسُلُ وَظَنُّواْ أَنَّهُمْ قَدْ كُذِبُواْ جَاءَهُمْ نَصْرُنَا -
‘এমনকি যখন রাসূলগণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁদের ধারণা হয়েছিল যে, তাঁদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, এমনি সময় তাঁদের নিকট আমাদের সাহায্য এসে পেঁŠছল’ (ইউসুফ ১২/১১০)। فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِل لَّهُمْ - ‘সুতরাং আপনি ধৈর্যধারণ করুন, যেমন করে ধৈর্যধারণ করেছিলেন দৃঢ়চেতা রাসূলগণ এবং তাঁদের জন্য তাড়াহুড়া করবেন না’ (আহক্বাফ ৪৬/৩৫)। فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَلاَ يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِيْنَ لَا يُوْقِنُوْنَ - ‘সুতরাং আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যারা অবিশ্বাসী তারা যেন আপনাকে অস্থিরমতি না ভাবে’ (রূম ৩০/৬০)। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ اصْبِرُوْاْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ -
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর, ধৈর্যধারণে প্রতিযোগিতা কর, অটল-স্থির থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে’ (আলে ইমরান ৩/২০০)।
উক্ত দফাগুলি যখন প্রচারকগণের মধ্যে এক সাথে বর্তমান থাকবে ইনশাল্লাহ তখনই সাহায্য নিশ্চিত হবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কখনই লংঘিত হবে না। বরং কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে এই দফাগুলি বাস্তবে ফুটে উঠলে সেটাই হবে মহাবিজয়। তারপরে যে সাহায্য আসবে তা হবে এই বিজয়েরই স্মারক ও চিহ্নবাহী। আল্লাহ রাববুল আলামীন সকল প্রচারক ও ইসলামী দলকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাহায্য ও বিজয়ের স্বরূপ বুঝার তাওফীক্ব দান করুন এবং তাঁর দ্বীনকে সর্বত্র বিজয়ী করুন- আমীন!!
(১) সকল বিষয় থেকে বিমুক্ত হয়ে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা এবং খাঁটি মনে তার কাজ করা : আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَاْ أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ -
‘বলুন! আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছুই আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র সৃষ্টির প্রতিপালক। তাঁর কোন শরীক নেই। এ কথা বলতেই আমি আদিষ্ট হয়েছি, আর আমিই প্রথম আত্মসমর্পণকারী’ (আন‘আম ৬/১৬২-১৬৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَمَا أُمِرُوْا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ وَيُقِيْمُوْا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوْا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ -
‘তাদেরকে (আহলে কিতাব, কাফির, মুশরিক ইত্যাকার সকল শ্রেণীর মানুষকে) কেবল এই আদেশই দেওয়া হয়েছে যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, ছালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে। আর সেটাই হ’ল সরল দ্বীন’ (বাইয়িনাহ ৯৮/৫)। তাই যে আমল আললাহর জন্য খাuঁটভাবে ও নিষ্ঠার সাথে পালিত হয় না, তা প্রত্যাখ্যাত ও অগ্রাহ্য হওয়ারই সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত।
(২) সদা সর্বদা নিখুঁত কর্মনীতি অবলম্বন করা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ যে আদর্শের উপর ছিলেন তদনুযায়ী গৃহীত কর্মনীতি হ’ল নিখুঁত কর্মনীতি। এটাই হ’ল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের কর্মনীতি, সাহায্যপ্রাপ্ত ও মুক্তিপ্রাপ্ত দলের কর্মনীতি। যাদেরকে কোন অপমান বা কোনরূপ বিরোধিতা সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। তারা সত্যের নির্ভীক সৈনিক হিসাবেই থেকে যাবে যতদিন না আল্লাহর আদেশ তথা ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। আল্লাহ বলেন,
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْماً فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ -
‘এই আমার পথ, যা সরল-সোজা। সুতরাং তোমরা কেবল উহারই অনুসরণ কর। অন্য সব পথের অনুসরণ করো না। নচেৎ এরা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে’ (আন‘আম ৬/১৫৩)। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضاَءِ لَيْلُهَا كَنَهَارهَا لاَ يَزِيْغُُ عَنْهَا بَعْدِىْ إِلاَّ هَالِكَ - ‘আমি তোমাদেরকে একটি উজ্জ্বল মিল্লাত বা আদর্শের উপর রেখে যাচ্ছি, যার জন্য রাত-দিন উভয়ই সমান। আমার মৃত্যুর পর এই মিল্লাত থেকে যে দূরে সরে যাবে কেবল সেই ধ্বংসে নিপতিত হবে।’
(৩) প্রচারক যে বিষয়ের প্রতি আহবান জানাবেন উক্ত বিষয় নিজে পূর্ণরূপে আকঁড়ে ধরা ও আমরণ তার উপর অবিচল থাকা :
আল্লাহ বলেন,
فَاسْتَمْسِكْ بِالَّذِْي أُوحِيَ إِلَيْكَ إِنَّكَ عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِْيمٍ -
‘সুতরাং আপনার নিকট যে অহি বা প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে আপনি তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকুন। নিশ্চয়ই আপনি সরল পথে আছেন’ (যুখরূফ ৪৩/৪৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَمَنْ يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى -
‘যে ব্যক্তি সৎকর্মশীল হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে সে এক মযবুত রশিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে’ (লোক্বমান ৩১/২২)।
أَتَأْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُوْنَ الْكِتَابَ أَفَلاَ تَعْقِلُوْنَ، وَاسْتَعِيْنُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيْرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِيْنَ -
‘তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে আর নিজেদের বেলায় ভুলে থাকবে! অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন কর। তোমরা কি কিছুই বুঝ না? তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই বিনয়ীগণ ব্যতীত আর সকলের নিকট উহা বড়ই কঠিন’ (বাক্বারাহ ২/ ৪৪-৪৫)।
সুতরাং কর্মপদ্ধতির উপর অটল থাকা সাহায্য লাভের শক্তিশালী উপকরণ ও চিহ্ন। বরং দেখা যায়, বাতিলপন্থী কোন ব্যক্তি যখন তার বাতিল মতের উপর অনড় থাকে তখন প্রায়শঃ সে জয়লাভ করে। অথচ তার লক্ষ্য কেবল এই পৃথিবীতেই অর্জিত হয়। তাহ’লে যে সত্য পথের উপর আছে সে কেন বিজয়ী হবে না?
(৪) সত্যকে প্রকাশ্যে প্রচার করা, শিথিলতা প্রদর্শন না করা, প্রতারণা না করা এবং সর্বদা অকুতোভয় থাকা : আল্লাহ বলেন,
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ -
‘অনন্তর আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদেরকে উপেক্ষা করুন। বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আপনার জন্য আমিই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ -
‘আপনি বলুন, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত। সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা কাফির থাকুক’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ -
‘হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করুন। যদি তা না করেন তবে তো আপনি তাঁর বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন’ (মায়েদাহ ৫/ ৬৭)।
(৫) ধৈর্যধারণ, হতাশ না হওয়া এবং আল্লাহর বান্দাদের জন্য তাঁর প্রতিশ্রুত সাহায্য লাভে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা :
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُورُوْنَ، وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ -
‘আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্য আমার কথা আগে স্থির হয়ে আছে যে, তারা অবশ্যই সাহায্য প্রাপ্ত হবে এবং আমার বাহিনীই হবে বিজয়ী’ (ছাফফাত ৩৭/১৭১-৭৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,
إنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ َيَقُوْمُ الْأَشْهاَدُ -
‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে ও মুমিনদেরকে পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীগণ দন্ডায়মান হবে সেদিন সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/ ৫১)। আল্লাহ আরো বলেন,
حَتَّى إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّسُلُ وَظَنُّواْ أَنَّهُمْ قَدْ كُذِبُواْ جَاءَهُمْ نَصْرُنَا -
‘এমনকি যখন রাসূলগণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁদের ধারণা হয়েছিল যে, তাঁদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, এমনি সময় তাঁদের নিকট আমাদের সাহায্য এসে পেঁŠছল’ (ইউসুফ ১২/১১০)। فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِل لَّهُمْ - ‘সুতরাং আপনি ধৈর্যধারণ করুন, যেমন করে ধৈর্যধারণ করেছিলেন দৃঢ়চেতা রাসূলগণ এবং তাঁদের জন্য তাড়াহুড়া করবেন না’ (আহক্বাফ ৪৬/৩৫)। فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَلاَ يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِيْنَ لَا يُوْقِنُوْنَ - ‘সুতরাং আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যারা অবিশ্বাসী তারা যেন আপনাকে অস্থিরমতি না ভাবে’ (রূম ৩০/৬০)। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ اصْبِرُوْاْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ -
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর, ধৈর্যধারণে প্রতিযোগিতা কর, অটল-স্থির থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে’ (আলে ইমরান ৩/২০০)।
উক্ত দফাগুলি যখন প্রচারকগণের মধ্যে এক সাথে বর্তমান থাকবে ইনশাল্লাহ তখনই সাহায্য নিশ্চিত হবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কখনই লংঘিত হবে না। বরং কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে এই দফাগুলি বাস্তবে ফুটে উঠলে সেটাই হবে মহাবিজয়। তারপরে যে সাহায্য আসবে তা হবে এই বিজয়েরই স্মারক ও চিহ্নবাহী। আল্লাহ রাববুল আলামীন সকল প্রচারক ও ইসলামী দলকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাহায্য ও বিজয়ের স্বরূপ বুঝার তাওফীক্ব দান করুন এবং তাঁর দ্বীনকে সর্বত্র বিজয়ী করুন- আমীন!!
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন