hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ

লেখকঃ ডঃ নাছের বিন সোলায়মান আল-ওমর

১৮
প্রকাশ্য সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার কারণ সমূহ
মানুষের মন সহজাতভাবেই ত্বরাপ্রবণ। তাই আল্লাহর দ্বীনের প্রকাশ্য বিজয় দ্রুত নিশ্চিত হ’লে স্বভাবতই সে খুশী হয়। আর কেনই বা হবে না- এ যে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় এবং বাতিল ও বাতিলপন্থীদের ডিগবাজি। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيْبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ -

‘অন্য যে লাভটি তোমরা ভালবাস, তাহ’ল আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। সুতরাং আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দিন’ (ছফ ৬১/১৩)। আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছি। তিনি বলেন,

وَقَاتِلُوْهُمْ حَتَّى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ لِلّهِ -

‘তোমরা তাদের (অমুসলমিদের) বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও, যে পর্যন্ত না ফিৎনার অবসান হয় এবং দ্বীন সামগ্রিকভাবে আল্লাহর তরে হয়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)।

অতএব তাড়াতাড়ি না করে আমাদের বরং সঠিক পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে এগিয়ে যেতে হবে। সময়মত আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ্য বিজয় দান করবেন ইনশাআল্লাহ। কিন্তু অনেকে এমনকি বিশেষ বিশেষ প্রচারক পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য ও দ্বীনের বিজয় সংঘটিত হওয়া অনেক দূরের ব্যাপার বলে মনে করেন। যার ফলে কখনও কখনও তারা হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন আবার কখনও কর্মপদ্ধতি বদলে ফেলেন। এই বিজয় ও সাহায্য কেন বিলম্বিত হচ্ছে তার কারণ তারা ভেবে দেখেন না। অথচ কারণগুলি জানা থাকলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব প্রচারক, সমাজ, আহবানকৃত ব্যক্তিবর্গ ও অনুসারীদের উপর পড়ত। সুতরাং এই কারণগুলি থাকা অত্যাবশ্যক। সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার কারণগুলিকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি।

(ক) নেতিবাচক কারণ ও (খ) ইতিবাচক কারণ।

নেতিবাচক কারণগুলি জানা থাকলে কিভাবে ঘাটতিগুলি পূরণ করা যায় এবং কিভাবে এর প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তার উপায় অবলম্বন করা যায়। অপরদিকে ইতিবাচক কারণগুলি জানা থাকলে প্রচারক আল্লাহ প্রদত্ত কর্মপদ্ধতি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকতে সমর্থ হয়, এই বিজয় ও সাহায্য ত্বরাণ্বিত হোক কিংবা বিলম্বিত হোক। এ বিষয় নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধারা হ’ল।

(১) সাহায্যের বৈধ কিছু উপকরণ সময় মত যোগাড় না হওয়া :

সাহায্য প্রদানের অনেক উপকরণ রয়েছে। যখন উপকরণগুলি কিংবা তার কিয়দংশ যোগাড় না থাকে তখনই সাহায্য পিছিয়ে যায়। কেননা নীতিশাস্ত্রকারদের মতে, উপকরণ তা-ই যার বিদ্যমানতায় কোন কিছু অস্তিত্ব পায় এবং অবিদ্যমানতায় তা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। হ’তে পারে উপকরণ উপস্থিত থাকলেও অন্য কোন কারণে সাহায্য পিছিয়ে যেতে পারে, কিন্তু উপকরণ সংগৃহীত না থাকলে যে সাহায্য পাওয়া যাবে না তা নিশ্চিত। যেমন সাহায্য প্রদানের একটি বিধিসম্মত উপকরণ হ’ল সমর প্রস্ত্ততি। আল্লাহ বলেন,

وَأَعِدُّواْ لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهِ عَدُوَّ اللّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِيْنَ مِن دُوْنِهِمْ لاَ تَعْلَمُوْنَهُمُ اللّهُ يَعْلَمُهُمْ -

‘তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যথাসাধ্য সমর শক্তি ও অশ্ববহর প্রস্ত্তত রাখ, যদ্বারা তোমরা ভীত করে রাখবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং তাদের বাদে অন্যান্যদেরকেও, যাদের তোমরা জান না কিন্তু আল্লাহ জানেন’ (আনফাল ৮/৬০)।

(২) বাধাবিঘ্ন হেতু সাহায্য পিছিয়ে যাওয়া :

যে বিষয়ের উপস্থিতি ছাড়া উদ্দেশ্য হাছিল হয় না তাকে বলা হয় ‘বাধা’। বিজয় হাছিলে এরূপ কোন বাধা থাকলে বিজয় অর্জিত হবে না, যদিও বাধা না থাকলে সেই বিজয় অর্জিত হবে, এমন কোন কথা নেই। ইসলামের বিরুদ্ধে এরূপ বাধা-বিপত্তি একটা-দু’টা নয়; বরং অনেক। যেমন যুলুম-নিপীড়নে অস্থির করে তোলা, কাফেরদের জীবনযাত্রা ও পাপ-পঙ্কিলতার প্রতি মুসলমানদের মনে ঝোঁক ও আগ্রহ তৈরী হওয়া, নেতার আদেশ অমান্য করা ইত্যাদি। সাহায্যের এসব বাধা-বিপত্তিও পরাজয়ের কারণ। এজন্য আমরা দেখতে পাই ওহোদ যুদ্ধে যখন বিজয়ের আলামত দেখা যাচ্ছিল, তখনই গিরিপথ মুখে নিয়োজিত তীরন্দাযরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদেশ লংঘন করে বসেন। ফলে আসন্ন বিজয় পরিণত হয় দুঃখজনক পরাজয়ে। যেমন আল্লাহ বলেন,

أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُم مُّصِيْبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّىْ هَـذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ -

‘কি ব্যাপার! তোমাদের উপর যখন মুছীবত আসল তখন তোমরা বললে, এ কোথা হ’তে আসল? অথচ তোমরা এর দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বলুন, এ তোমাদের নিজেদেরই পক্ষ হ’তে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)।

ইবনু ইসহাক, ইবনু জারীর, ইবনু আনাস ও সুদ্দী বলেন, আল্লাহর বাণী قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أنْفُسِكُمْ - এর অর্থ হ’ল আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ হেতু তোমরা এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছ। তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা সর্বক্ষণ স্ব স্ব স্থানে অবস্থান করবে। কিন্তু তোমরা তাঁর আদেশ লংঘন করেছ। আল্লাহ এখানে ‘আইনাইন’ গিরিপথে নিযুক্ত তীরন্দাযদের কথা বুঝিয়েছেন। তারা নিজেদের স্থান ত্যাগ করে গনীমত সংগ্রহে লিপ্ত হ’লে পিছন থেকে কাফের বাহিনী মুসলমানদের উপর আক্রমণের সুযোগ পায় এবং তাদের উপর্যুপরি হামলায় মুসলমানরা পরাজিত হয়। এদিকে হুনাইন যুদ্ধে কেন সাহায্য বিলম্বিত হয়েছিল তার কারণ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ বলেন,

لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللّهُ فِيْ مَوَاطِنَ كَثِيْرَةٍ وَّيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئاً وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُم مُّدْبِرِيْنَ -

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে বহু ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে হুনাইন দিবসে। সেদিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে’ (তওবা ৯/২৫)।

হুনাইন যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্য ছিল ১২ হাযার। তাই কিছু মুসলমান বলে বসল, স্বল্প সংখ্যক কাফের আজ এত বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে পরাভূত করতে পারবে না। এই একটি মাত্র কথা তাদের সাহায্য লাভে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আল্লাহ তাদের সংখ্যাধিক্যের হাতে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সংখ্যাধিক্য তাদের কোন উপকার করতে পারেনি। তারপর যখন বাধা অপসারিত হ’ল এবং বুঝে আসল সংখ্যাধিক্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না তখন কিন্তু সাহায্য ঠিকই এসেছিল। আসলে কাজের উপকরণ যোগাড় করার পর ভরসা রাখতে হবে আল্লাহর উপরই। তাহ’লেই অর্জিত হবে কাংখিত লক্ষ্য।

(৩) সঠিক কর্মনীতি পরিত্যাগ :

সঠিক কর্মনীতি হ’তে সরে দাঁড়ানো সাহায্য লাভের অন্যতম বাধা। এ সম্পর্কে সজাগ করার জন্য পৃথক শিরোনামে আমি বিষয়টি আলোচনা করেছি। আমি বর্তমান যুগের অনেক ইসলামী দল ও জিহাদী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ অনুসদ্ধান করেছি এবং তাদের বিজয় লাভে ব্যর্থতা ও ঘোষিত সুন্দর লক্ষ্য অর্জনে বিফলতা নিয়ে গবেষণা করেছি। এ সমস্ত দল আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য ও তাঁর আইন বাস্তয়ানে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আমার দৃষ্টিতে তাদের সাহায্য বঞ্চিত হওয়ার জলজ্যান্ত কারণ হ’ল, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে’র সঠিক কর্মনীতি হ’তে বিচ্যুতি হওয়া। আর এই বিচ্যুতিও ঘটেছে কখনও সমূলে, কখনও আংশিক। বিশেষ করে আক্বীদা ও আমলে। কেউ হয়ত ভাবতে পারে এই বিচ্যুতি তো খুবই সামান্য। কিন্তু আমি মনে করি, এই সামান্য বিচ্যুতিই সাংঘাতিক ক্ষতি ডেকে এনেছে এবং সাহায্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রধান প্রভাব ফেলেছে। এরূপ বিচ্যুতির মধ্যে রয়েছে-

(ক) আক্বীদার ক্ষেত্রে ঢিলেমি ও গড়িমসি দেখানো এবং আক্বীদাকে প্রথম সারির কোন বিষয় হিসাবে গণ্য না করা। অথচ আক্বীদাই হ’ল ইসলামের মৌল ভিত্তি ও অগ্রগণ্য বিষয়। আক্বীদার মাধ্যমেই একটি দলের সফলতা ও সঠিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।

(খ) শত্রু-মিত্রের ধারণা গুলিয়ে ফেলা। যালেম, আল্লাহদ্রোহীদের প্রতি ঝুঁকে পড়া এবং তাদের তোষামোদ করা।

(গ) দলীয় গোঁড়ামি, যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও তিক্ততা দেখা দিয়েছে। এ ধরনের বিচ্যুতির আরও অনেক দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে। অথচ এ সমস্ত মূলনীতি ও দলীল-প্রমাণ লিপিবদ্ধ করা এবং সেগুলিকে কলুষ-কালিমা মুক্ত রাখা একটি মূল্যবান কাজ। এছাড়া দাওয়াতী কর্মনীতির খুঁতহীনতা রক্ষা করা ও সঠিক পথে পরিচালনা করাও মূল বিষয়। একইভাবে শরী‘আতের মূলনীতি ও কায়দা-কানূনের সঙ্গে প্রতিটি কাজ মিলিয়ে দেখলে বাস্তবতা চাপা পড়ে ও কল্পিত সুবিধা লাভের যুক্তি দাঁড় করিয়ে শরী‘আতের পথ থেকে কেটে পড়ার যে ভয় থাকে, তা দূরীভূত হয়।

(৪) উম্মতের পরিপক্কতা ও যোগ্যতার অভাব :

আল্লাহর দ্বীন এক বিরাট ব্যাপার। এর দায়িত্ব বহনের জন্য এমন একটি দল দরকার, যারা দ্বীনের উপর এতটা দীর্ঘ সময় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যে, উহার ভার বহন ও জনগণের মাঝে প্রচারে তারা যথাযথই সক্ষম। কত জাতিই তো সাহায্য লাভের আগেই কষ্ট ও বন্ধুর ঘাঁটি পার হয়ে গেছে বরং সাহায্য অর্জনের জন্যই তারা জীবন দিয়েছে। এভাবে ঘাত-প্রতিঘাত সয়েই পরিপক্কতা, দক্ষতা। আর পরিপক্কতার হাত ধরে আসে স্থায়ী সাহায্য। অদক্ষ মানুষ সাহায্য পেলে তা কাজে লাগাতে পারে না।

তারপরও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় একটি পরিপক্ক ক্ষুদ্র শক্তি যথেষ্ট নয়। এজন্য দরকার বিশাল জনবল এবং তারা হবে নানা রকম ত্যাগ স্বীকারে মানসিকতা সম্পন্ন ও বিশেষ বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন। এটা করতে সময় প্রয়োজন। স্বল্প সময়ে বা সহজে তা হবে না। সুতরাং লোক তৈরি ও তাদের ট্রেনিং প্রদান সবচেয়ে কঠিন ও দুষ্কর। এজন্য আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১৩ বছর ধরে এক একজন লোককে ট্রেনিং দিয়েছেন এবং গ্রুপ গ্রুপ করে রিসালাতের বোঝা বহন ও প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার উপযোগী করে তৈরি করেছেন। ফলে তাঁদের একদল থাকছেন আরকাম (রাঃ)-এর গৃহে তো আরেক দল হিজরত করছেন হাবশায়। একবার সবাইকে আবু ত্বালিব গিরিপথে অন্তরীণাবদ্ধ হ’তে হচ্ছে তো পুনর্বার তারা হিজরত করেছেন মদীনায়।

এজাতীয় নানা কাজ এই উম্মতকে রিসালাতের ভার বহনোপযোগী করে তুলেছিল। এমনি করে শেষ পর্যন্ত দ্বীন পূর্ণতা পেয়েছিল এবং আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে বিরাট বিজয় দান করেছিলেন।

পূর্বের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, দ্বীনের পূর্ণতা ও তার প্রাসাদ বিনির্মাণের সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। সময় না হ’লে সাহায্য ও বিজয় আসবে না। দ্বীন যখন মানুষের উপর নযরদারী করতে পারবে, মানুষের মন যখন সেভাবে গঠিত হবে তখনই বিজয় আসবে। প্রচারকদের ততদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং সময় না হওয়াও সাহায্য ও বিজয় পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

(৫) সাহায্যের কদর অনুধাবনে অক্ষমতা :

কোন বড় রকমের কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার ছাড়াই দ্রুত সাহায্য নিশ্চিত হ’লে সেই সাহায্যপ্রাপ্ত জাতি সাহায্যের কদর বা মূল্য বুঝতে পারে না। সেজন্য তারা ঐ সাহায্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিজয়কে ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় শ্রমদান ও ত্যাগ স্বীকারে কুণ্ঠিত হয়। এই বাস্তবতা তুলে ধরতে আমি দু’টি উদাহরণ পেশ করছি।

প্রথমতঃ দারিদ্রে্যর নিমর্ম কষাঘাতে জর্জরিত কোন ব্যক্তি যখন স্বীয় চেষ্টা ও শ্রম দ্বারা সম্পদশালী-ধনাঢ্য মানুষে পরিণত হয়, তখন আমরা দেখতে পাই কতই না প্রাণান্তকর চেষ্টা করে তার অর্থবিত্ত হেফাযত করে। কোনরূপ বিপদ বা ঝুঁকি দেখা দিলে উহা রক্ষার্থে সে সম্ভাব্য সকল উপায়ই অবলম্বন করে। তার কারণ সে দারিদ্রে্যর স্বাদ ও লাঞ্ছনা উপভোগ করেছে। তারপর সম্পদ সঞ্চয় ও বর্ধনে কষ্ট-ক্লেশ স্বীকার করেছে। সুতরাং তার পক্ষে ঐ সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সহজ নয়। আল্লাহ তাকে দরিদ্রতা হ’তে উদ্ধার করার পর সে আবার উহার আবর্তে ফেঁসে যেতে ঠিক তদ্রূপ ঘৃণা করবে, যেমন সে আল্লাহর অনুগ্রহে কুফর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় তাতে ফিরে যেতে ঘৃণাবোধ করে।

কিন্তু তার সন্তানাদি ও উত্তরাধিকারীরা কি অত গুরুত্ব দিবে? তাদের অনেককেই দেখা যাবে তারা ঐ সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং কেউ কেউ তা অনর্থক উড়িয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত গরীব হয়ে যায়। তার কারণ, সে ঐ অর্থ-বিত্তের মূল্য কি তা জানেনি। তা উপার্জন ও সঞ্চয়ে কোন ক্লেশ ভোগ করেনি এবং তার পূর্বসূরীর মত অভাব-অভিযোগের স্বাদ আস্বাদনের সুযোগও তার হয়নি।

দ্বিতীয়তঃ অনুসদ্ধানে ধরা পড়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সাংঘাতিক রকম দুরূহ কাজ। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের শাসক ও খলীফাগণকে দেখা যায়, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং রাষ্ট্রের দুর্বল হওয়ার মত কারণ ঘটতে পারে এমন সব কিছুই সামাল দিতে তারা দ্বিগুণ চতুর্গুণ শ্রম ব্যয় করে যান। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা পিতৃ সম্পদের মালিক হওয়ার মতই রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিক হয়; তারা তখন রাষ্ট্র চালনা রেখে রাষ্ট্রের ফলভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র রক্ষায় যে ক্লেশ স্বীকার করা দরকার সে সম্বন্ধে তাদের কোন চেতনা থাকে না। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে দুর্বলতা ও ভাঙ্গন দেখা যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত উহা তার পতন ডেকে আনে।

এজন্যই কোন কষ্ট-ক্লেশ ছাড়া বিজয় এলে তা সময় বিশেষে স্থায়ী নাও হ’তে পারে এবং সে বিজয়েকে ধরে রাখাও কষ্টকর হতে পারে। এ কারণে আল্লাহর হিকমত বা কৌশল অনুসারে সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হয়, যাতে দ্বীনের কাজের গুরুত্ব সবার নিকট সমানভাবে অনুভূত হয় এবং এমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা বিজয়ের মূল্য কী ও তা কতটুকু দাম পাওয়ার উপযুক্ত তা জানতে পারে।

(৬) আল্লাহর মহাজ্ঞানে নিহিত হিকমত হেতু বিলম্ব :

কখনও মহান আল্লাহর জ্ঞানে রয়ে যায় যে, দ্বীনের বর্তমান আন্দোলনকারীরা জয়লাভ করলে বিজয়ের দাবী তথা অত্র ভূখন্ডে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, ছালাত কায়েম, যাকাত আদায় ইত্যাদি সম্ভব হবে না, তখন সাহায্য বিলম্বিত হয়। কেননা শুধু জয়লাভ তো কাম্য নয়; বরং জয় লাভের মাধ্যমে যা বাস্তবায়ন করতে হবে তার জন্যই উহা দরকার। সেটা হ’ল ফিৎনা বা আল্লাহদ্রোহী আইনের মূলোৎপাটন এবং সর্বতোভাবে আল্লাহর দ্বীনের বাস্তবায়ন। একথাই আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী হ’তে বোঝা যায়ঃ

وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ، الَّذِيْنَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِيْ الْأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلاَةَ وَآتَوُْا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ -

‘আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন, যারা তাঁকে সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী। যাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলে তারা ছালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর হাতে (হজ্জ ২২/৪০-৪১)। মানুষ বা দল বিশেষের জন্য আল্লাহর সাহায্য ত্বরান্বিত হয় আবার দল বিশেষের জন্য বিলম্বিত হয়। তার কারণ কখনও আমরা জানতে পারি, আবার কখনও জানতে পারি না। কিন্তু আল্লাহ সব কিছুই জানেন। তাই তিনি অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন।

বাস্তবে দেখা যায় একদল লোক অস্বচ্ছলতা ও কষ্টের সময় দৃঢ়তার পরিচয় দেয়, বালা-মুছীবতে অনমনীয়তা, অমুখাপেক্ষিতা, সততা ইত্যাদি প্রদর্শন করে; অথচ তারাই আবার সুখে-সম্পদে ও শান্তির সময়ে দুর্বল মনের পরিচয় দেয়, সততা থেকে পিছিয়ে আসে, লোভ-লালসা হেতু স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিবাজ হয়ে দাঁড়ায়। যে জাতির চারিত্রিক ও মানসিক অবস্থা এমন সে জাতি সাহায্য লাভের উপযুক্ত নয়। আল্লাহ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জ্ঞাত। যা হয়নি তা হ’লে কেমন হ’ত সেটাও তার জানা।

(৭) বাতিলের পরিচয় ফুটে না ওঠা :

যে বাতিলের বিরুদ্ধে দ্বীন প্রচারকগণ সংগ্রাম করছেন সেই বাতিল ও তার ধারক-বাহকরা অনেক সময় দ্বীন প্রচারকসহ অপরাপর মানুষের সম্পূর্ণ অগোচরে থেকে যায়। যারা কখনই বাতিলের পক্ষে যাবার নয় এবং বাতিলের আসল রূপ উদঘাটিত হ’লে যারা কখনই উহাকে মেনে নেবার নয়, তারাও বাতিল দ্বারা প্রতারিত হয়ে সময় বিশেষে উহার সহযোগী বনে যায়। এভাবে হক্বপন্থীদের মাঝে বাতিল ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে সুযোগমত তাদের ক্ষতি করে চলে। তাদের প্রভাবেও আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হয়। মুনাফিকদের ঘটনা-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক ছাহাবীই মুনাফেকীর অলিগলি সম্বন্ধে জানতেন না। মুনাফিক আছে জানলেও তারা মুনাফিকদের অনেক নাটের গুরুকে চিনতেন না। তারা বরং তাদের প্রতি সুধারণাই পোষণ করতেন।

বনী মুস্তালিক্ব যুদ্ধে মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুহাজির ছাহাবীগণের প্রসঙ্গে খুবই অশালীন উক্তি করেছিল। সূরা মুনাফিকূনের ৭ ও ৮ নং আয়াতে তা উল্লেখ আছে। তার সেই কথা বালক ছাহাবী যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানালে ওমর (রাঃ) তাঁকে বলেন, ‘আপনি আববাস বিন বিশরকে হুকুম দিন, সে তাকে হত্যা করুক। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘ওমর! তা কী করে হয়? লোকেরা তখন বলবে, মুহাম্মাদ তার নিজের লোকদের হত্যা করছে। তার চেয়ে বরং তুমি যাত্রার ঘোষণা দাও। এ থেকে অনেক লোকের দৃষ্টিতে মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবী গণ্য হ’তে থাকে। তাদের আসল পরিচয় তাদের সামনে অনুদঘাটিত থেকে গেছে। ওদের মুল পরিচয় হ’ল,

هُمُ الْعَدُوُّ فَاحْذَرْهُمْ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُوْنَ ‘ওরা শত্রু। সুতরাং ওদের সম্বন্ধে সাবধান থাকুন। আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন। ওরা উল্টো কোন দিকে যাচ্ছে? (মুনাফিকূন ৬৩/ ৪)।

এজন্যেই যখন বহু সংখ্যক লোকের নিকট তাদের আসল ভেদ ও পরিচয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-কে ঘটনাচক্রে বলেছিলেন, ‘হে ওমর, আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের কথা কি তোমার মনে পড়ে? আল্লাহর কসম, যেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, ‘ওকে হত্যা করুন’, সেদিন যদি আমি তাকে হত্যা করতাম তাহ’লে অবশ্যই তার পক্ষ নিয়ে অনেক বাহাদুর মাঠ কাঁপিয়ে তুলত। অথচ আজকে তাদেরকে আমি আদেশ দিলে অবশ্যই তাকে হত্যা করবে, কোন সমস্যা করবে না। ওমর বললেন, আল্লাহর কসম, আমি বুঝতে পারলাম আমাদের সেদিনের কথা হ’তে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গৃহীত ব্যবস্থা ছিল কল্যাণকর’।

এই হাদীছ সাহায্য ও বিজয় পিছিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত আমাদের বর্ণিত কারণের একটি অর্থবহ সূক্ষ্মচিত্র। তাই যাদের বাতিল চরিত্র সম্পূর্ণ উদঘাটিত হয়নি এমন লোকদের সাথে সংঘর্ষে জড়ালে মুসলিম উম্মাহর উপর তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। কেননা অনেক মুসলমান ওদের ভাল মনে করে ওদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে।

এরূপ অবস্থান গ্রহণের ঘটনা আয়েশা (রাঃ)-এর চরিত্রে বানাওয়াট কলঙ্ক লেপনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত অপবাদ সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, ‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে আব্দুল্লাহ বিন উবাই সম্পর্কে অভিযোগ করে বললেন, হে মুসলমানগণ, তোমরা এমন কে আছ, যে আমাকে ঐ ব্যক্তির হাত হ’তে উদ্ধার করতে পারবে যে আমার পরিবারকে কেন্দ্র করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আল্লাহর কসম, আমি আমার পরিবার সম্পর্কে ভাল বৈ অন্য কিছু জানি না। আর তারাও যে ব্যক্তির কথা বলছে তাকেও ভাল বৈ জানি না। সে আমার সঙ্গে ব্যতীত একা কোন দিন আমার পরিবারের সাথে দেখা করত না। তখন সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) উঠে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (ছাঃ)! আমি আপনাকে তার অপবাদ থেকে উদ্ধার করব। যদি সে আওস গোত্রের হয় তাহ’লে আমরা তার গর্দান উড়িয়ে দিব, আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের হয় তাহ’লে আপনি যা আদেশ করবেন আমরা সে মত কাজ করব। তারপর খাযরাজ গোত্রীয় সা‘দ বিন ঊবাদা (রাঃ) উঠে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তুমি অসত্য বলছ। তুমি তাকে হত্যা করবে না। তাকে হত্যা করার ক্ষমতা তোমার নেই। সে তোমার গোত্রের লোক হ’লে তাকে হত্যা করা তুমি পসন্দ করতে না। এই সা‘দ বিন উবাদা (রাঃ) কিন্তু খাযরাজের গোত্রপতি ও সৎ লোক ছিলেন। কিন্তু ঐ সময়ে তিনি জাত্যাভিমানে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। সা‘দের কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে সা‘দ বিন মু‘আযের চাচাত ভাই উসাইদ বিন হুযাইর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ, ‘তুমি মিথ্যা বলছ। আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। নিশ্চয়ই তুমি মুনাফিক। মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে তর্ক করছ’।

এতে আওস, খাযরাজ দুই দলই উত্তেজিত হয়ে পড়ল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে থাকতেই তারা সংঘর্ষ বাধাবার উপক্রম করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বারবার তাদের নিরস্ত হ’তে বলায় শেষ পর্যন্ত তারা থেমে গেল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও চুপ হয়ে গেলেন (বুখারী হা/৪১৪১, মুসলিম হা/২৭৭০)। কিছু মুসলমান হয়ত প্রত্যক্ষভাবে বাতিলপন্থীদের পক্ষ নেয় না, কিন্তু হক্বপন্থী প্রচারক ও কর্মীদের পক্ষেও তাদের অবস্থান খুবই শিথিল ও দ্বিধাজড়িত। কারণ বাতিলপন্থীরা যে বাতিলের উপর আছে সেরকম কোন পাকাপোক্ত বিশ্বাস তারা করে না। তারা বরং মনে করে এরাও মুসলমান। ফলে শত্রুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগ্রাম ও সংঘর্ষে এ জাতীয় মুসলমানেরা অংশ নিতে আগ্রহী হয় না। এরা নিজেদের উদারপন্থী হিসাবে যাহির করতে চায়। এভাবে কখনও কখনও মুসলমানদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি থেকে দলাদলি সৃষ্টি হয় এবং সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হয়।

(৮) সাংঘর্ষিক পরিবেশ :

সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার আরেকটি কারণ সাংঘর্ষিক পরিবেশ। সাংঘর্ষিক পরিবেশ কখনও কখনও সত্য, শুভ ও ন্যায়পরায়ণতাকে মেনে নেয়ার মত উপযোগী থাকে না। তাই ঐ পরিবেশের সাথে কোন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আগেই এমন কিছু কাজ করা প্রয়োজন, যাতে সংঘর্ষ বিদূরীত হয়ে উক্ত পরিবেশ সত্য, শুভ ও ন্যায়রায়ণতা গ্রহণে প্রস্ত্তত হয়। সে সব কাজের মধ্যে রয়েছে (১) ইসলামের বিরুদ্ধাচারী জাতিগুলি বাতিল ও ভ্রান্তির উপর বিদ্যমান এ কথাটি প্রচারে আইনানুগ সকল মাধ্যমকে ব্যবহার করা (২) তাদের যাবতীয় আপত্তির সদুত্তর নিয়ে মনস্ত্তষ্ট করা এবং ইসলামের প্রতি আহবান জানান। (৩) ইসলামের প্রকৃত মর্ম তুলে ধরা এবং প্রতিপক্ষ যে বাতিলের উপর আছে তার ক্ষতি সম্বন্ধে তাদের সচেতন করে তোলা। এসব কর্মকান্ড যুদ্ধ বা সংঘর্ষ বাধার আগে প্রতিপক্ষের হেদায়াতের মাধ্যম হ’তে পারে। যদি তা না হয় তবে সত্য জানার মাধ্যম তো হবেই। এ থেকেই যুদ্ধের পর সত্য গ্রহণের সুযোগ হ’তে পারে। এজন্যই যুদ্ধ বা সংঘর্ষ শুরুর আগেই ইসলামের দাওয়াত প্রদানের বিধান রয়েছে।

(৯) আল্লাহর দ্বীন গ্রহণে সাড়া না দেওয়া :

প্রচারকদের দিকে লক্ষ্য করলে তাদের সন্তোষজনক কর্মকান্ড হেতু সাহায্যের বিস্তর সম্ভাবনা কখনও কখনও দেখা দিলেও বাধা এসে দেখা দেয় যাদের মাঝে প্রচার চালান হচ্ছে তাদের কারণে। যেমন ৮নং ক্ষেত্রে বিধৃত হয়েছে। এ রকম একটি বাধা হ’ল, আল্লাহর পরিকল্পনায় এসব জাতির জন্য হেদায়াত না রাখা। এরা এত কট্টর বিরোধী ও পাপাচারী যে, হেদায়াতকে মোটেও সহ্য করতে রাযী নয়। ফলে আল্লাহ তাদের হেদায়াত করার ইচ্ছা বাদ দিয়েছেন এবং তাদের ললাটে গুমরাহী লিখে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, أَفَلَمْ يَيْأَسِ الَّذِيْنَ آمَنُوْاْ أَن لَّوْ يَشَاءُ اللّهُ لَهَدَى النَّاسَ جَمِيْعاً ‘তবে কি যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই সকল মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন’ (রা‘দ ১৩/৩১)।

فَمِنْهُمْ مَّنْ هَدَى اللّهُ وَمِنْهُمْ مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلالَةُ . ‘অতঃপর তাদের কিছু লোককে আল্লাহ সৎ পথে আনলেন এবং কিছু লোকের উপর গুমরাহী অবারিত হয়ে গেল’ (নাহল ১৬/৩৬)।

أُوْلَـئِكَ الَّذِيْنَ لَمْ يُرِدِ اللّهُ أَن يُطَهِّرَ قُلُوْبَهُمْ ‘ওরাই (ইহুদীরাই) তারা, যাদের অন্তরকে আল্লাহ নিষ্কলুষ করতে চাননি’ (মায়েদাহ ৫/৪১)। এমনিতর আরও অনেক আয়াত কুরআনে বিধৃত আছে।

(১০) প্রচারকের মৃত্যুর পরে বিজয় :

প্রচারকের মৃত্যুর পর বিজয় আসবে বলেও অনেক সময় আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হয়। তাছাড়া প্রচারকের জীবদ্দশায় যতটুকু বিজয় অর্জিত হয় তার মৃত্যুর পর তা থেকেও অনেক বড় মাপের বিজয় অর্জিত হয়। কেননা জয় মানে তো কর্মসূচীর জয়, ব্যক্তির নিজের জয় নয়। ব্যক্তি বা মানুষকে তো তার প্রচার ও সততার প্রতিদানে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করার দায়িত্ব মহান আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন, চাই সে জয়ী হোক কিংবা না হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَن يُقَاتِلْ فِيْ سَبِيْلِ اللّهِ فَيُقْتَلْ أَو يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيْهِ أَجْراً عَظِيْماً

‘যে আল্লাহর রাহে যু্&দ্ধ করে সে নিহত কিংবা জয়ী হোক তাকে শ্রীঘ্রই আমি মহাপুরস্কার প্রদান করব’ (নিসা ৪/৭৪)।

وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُواْ فِي سَبِيْلِ اللّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ -

‘যারা আল্লাহর রাহে যুদ্ধে নিহত হয় তাদের তুমি কখনই মৃত ভেব না। বরং তারা জীবিত; তারা তাদের প্রভুর নিকটে রিযিক প্রাপ্ত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)।

قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِيْ يَعْلَمُوْنَ، بِمَا غَفَرَ لِيْ رَبِّي وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُكْرَمِيْنَ -

‘তিনি বললেন, হায়! আমার কওম যদি জানতে পারত, কেন আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে স্থান দিয়েছেন’ (ইয়াসীন ৩৬/২৬-২৭)।

اُدْخُلُواْ الْجَنَّةَ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُوْنَ ‘তোমরা যে আমল করতে তার বদৌলতে (আজ) জান্নাতে প্রবেশ কর’ (নাহল ১৬/৩২)।

إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبَّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِىْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ- نَحْنُ أَوْلِيَاءُكُمْ فِىْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِىْ الْأَخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِىْ أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ -

‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর সে কথার উপর অবিচল থেকেছে* (মৃত্যুকালে) তাদের নিকট ফিরিশতা এসে বলবে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তাও করো না। তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তোমার বন্ধু আছি ইহকালে ও পরকালে। সেখানে তোমাদের মন যা চাইবে মিলবে এবং তোমরা মুখ ফুটে যা চাইবে তাও পাবে’ (হা-মীম সিজদা ৪১/৩০-৩১)।

কত প্রচারক অতীত হয়ে গেছেন যাদের জীবদ্দশায় দ্বীন জয়লাভ করেনি, অথচ তাদের মৃত্যুর পর তা বিশাল বিজয় লাভ করেছে। পরিখাওলাদের সেই বালকের কথাই ধরুন, যার আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-কে জেল খানাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি যে কর্মসূচী রেখে গিয়েছিলেন, কার্যক্রম এঁকে দিয়েছিলেন তা তার মৃত্যুর অনেক অনেক পরে এসে চরম সাফল্য লাভ করেছিল। এমন ঘটনা দু’ একটা নয়, অসংখ্য।

(১১) প্রচারকদের পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধিকরণ :

প্রচারকদের পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধ করার মানসে সাহায্য পিছিয়ে যায়। আবার তাতে এমন অনেক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাও থাকে, যা পরবর্তীকালের মানুষের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনে। মহান আল্লাহ বলেন,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُواْ مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللّهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللّهِ قَرِيْبٌ -

‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছে যে, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের মাঝে এখনও তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত অবস্থা উপস্থিত হয়নি। তাদেরকে দারিদ্র্য ও রোগ-শোক জাপটে ধরেছিল এবং তারা এমন (বিপদের) ঝাঁকুনি খেয়েছিল যে, স্বয়ং রাসূল এবং তার সঙ্গী মুমিনগণ পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটেই’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)।

অন্যত্র আয়াতে এসেছে,

أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوْا أَن يَّقُولُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْن -

‘মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ একথা বললেই তারা ছাড়া পেয়ে যাবে, তাদের কোন পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্বেকার লোকদের আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো অবশ্যই নির্ধারণ করে নিতে হবে, কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী’ (আনকাবূত ২৯/১-৩)।

প্রকাশ্য বিজয় ও সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার পিছনে এগুলি আমার নিকটে সুস্পষ্ট কারণ হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে। তবে বিজয় ও সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার এসব কারণ কখনও আমাদের নযরে ধরা পড়ে, আবার কখনও ধরা পড়ে না। যাই হোক, আমাদের যেটা প্রত্যয় রাখা যরূরী তা হ’ল, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যার্থে যত বৈধ উপায় আছে তা অবলম্বন করা। বিজয় বা সাহায্য কোনটাই হাতে ধরে বাস্তবে রূপায়িত করা আমাদের দায়িত্ব নয়। সেটা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ও তা‘আলার হাতে। وَماَ النَّصْرُ إلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ - ‘সাহায্য কেবল আল্লাহর পক্ষ হ’তে। আর সাহায্য কখন নিশ্চিত হবে তাও আল্লাহর জ্ঞানে নির্ধারিত আছে। নির্ধারিত সেই সময় না আসা পর্যন্ত কখনই সাহায্য আসবে না। আমাদের সীমিত ধারণা মত সাহায্য বাস্তবায়িত হবার নয়। আবার আল্লাহ যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হবেই এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে সাহায্য আসবে না। যারা সন্দেহের দোলায় দোদুল্যমান তারা সাহায্য লাভের যোগ্য নয়।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন