HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
নাজাফ সম্মেলন
লেখকঃ সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আস-সুওয়াইদী
الحمد لله رب العالمين , و صلى الله على سيدنا محمد و آله و صحبه و سلم و بعد :
(সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য; আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম (শান্তি) বর্ষিত হউক আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সমস্ত সাহাবীর প্রতি) । অতঃপর
ইসলামের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ মুসলিম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর অন্তর্ভুক্ত; আর তারা হলেন ঐসব লোক, যারা তাদের দীন ও শরীয়ত তথা বিধিবিধান অর্জন করেছেন আল্লাহর কিতাব থেকে ঠিক তেমনি করে, যেমনিভাবে সাহাবা ও তাবেঈনগণ অনুধাবন করেছেন; বিশুদ্ধ সুন্নাতে নববী থেকে যা ত্রুটিমুক্ত করেছেন ইমাম ও বিশ্বস্ত হাফেযগণ এবং সংকলন করেছেন সংকলনকারীগণ অত্যন্ত যত্নসহকারে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ হল: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুয়াত্তায়ে মালেক, সুনানু তিরমিযী, নাসাঈ, আবি দাঊদ, অতঃপর সুনানু ইবন মাযাহ ও মুসনাদু আল-ইমাম আহমদসহ এই স্তরের আরও যেসব গ্রন্থ রয়েছে। আর এসব কিতাবে বর্ণিত হাদিসসমূহের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে সত্য, তবে হাদিসগুলো বিশুদ্ধ যা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানগণ তাদের অতীত সম্পদ থেকে লিখে নিয়েছেন।
এই মর্যাদাসম্পন্ন ইমামগণ হাদিস বর্ণনা ও তার মান নির্ণয়ে কতগুলো নিয়ম-কানুন ও শর্ত নির্ধারণ করেছেন; তারা এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন যা তার গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তা একটি মর্যাদাপূর্ণ শাস্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর তার নাম হল ‘ইলম আল-সুন্নাহ’ ( علم السنة )।
যে উম্মত আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের হাদিস এবং তার উপর ভিত্তি করে কিয়াস ও নস তথা সুস্পষ্ট ভাষ্যের বিপরীত নয়, ইমামদের এমন ঐক্যবদ্ধ রায় ইজমা থেকে উদ্ভাবিত বিধি-বিধান অনুযায়ী কাজ করে, তারাই হলেন ‘আহলে সুন্নাত’। আর যেহেতু তারা হচ্ছে অধিকাংশ মুসলিম ও তাদের জামা‘আত, তাই তাদেরকে বলা হয় ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’।
খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী রয়েছে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সুন্নাহ’র গ্রন্থসমূহে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ মেনে চলে না, যেভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত মেনে চলে; যে দিকে আমরা ইতঃপূর্বে ইঙ্গিত দিয়েছি। কিন্তু তারা কিবলার অনুসারী হওয়া ও তাদের নামায ও হজের কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে শরীক হয়ে যায়। আর এই কম সংখ্যকের মধ্য থেকে যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের খুব কাছাকাছি, তারা হল যায়েদীয়া, অতঃপর ইবাদীয়া, অতঃপর ‘আল-শী‘আ আল-ইসনা ‘আশারীয়া’ অতঃপর আহমদীয়া লাহোর, যারা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মানে না। আর যারা তার নবুওয়াতকে স্বীকার করে, তারা উপরিউক্ত সম্প্রদায়গুলোর চেয়ে ইসলামী ঈমান থেকে বহু দূরে রয়েছে।
তাদের সাথে সংযুক্ত অপর সংখ্যালঘুরা হল ‘বাতেনীয়া’; তারা নিজেদেরকে কিবলার অনুসারী বলে গণ্য করে না, তবে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত বলে দাবি করে। আর নসসমূহ ও আকিদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে তাদের বিশেষ দর্শন রয়েছে। তাদের মগডালে রয়েছে ‘ইসমাঈলীয়া আল-বুহরা’, অতঃপর ‘ইসমাঈলীয়া আগাখাঁন’, ‘নুসাইরীয়া’ ও ‘দুরুয’। আর যাদেরকে ওদের মধ্যে গণ্য করা যায়, তারা হল: ‘আল-বাবীয়া’ ও ‘আল-বাহাইয়া’; যদিও তারা ইসলাম থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে এবং অনাহূত স্বতন্ত্র দীন আবিষ্কার করে প্রসিদ্ধ দীনসমূহের মধ্যে নতুন করে বিরোধ তথা মতপার্থক্য বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা তারা ইসলামের নাম থেকেও খারিজ হয়ে গেছে।
আর ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ ও ‘শী‘আ’ সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ শরীয়তের উৎসকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে এবং অভিমত পেশ করে যে, তিনি একাই মা‘সুম অর্থাৎ তিনি তাঁর রবের পক্ষ থেকে যা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর রিসালাতের পরিপূর্ণতার জন্য যা আবশ্যক, তা অর্জন ও পালনে তিনিই একমাত্র মা‘সুম তথা নিষ্পাপ। আর ‘আল-শী‘আ আল-ইসনা ‘আশারীয়া’ ( الشيعة الاثنا عشرية ) সম্প্রদায় দাবি করে যে, আমিরুল মুমেনীন আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর ধারাবাহিকতায় আরও এগারো জন মা‘সুম তথা নিষ্পাপ। যদিও খোদ আলী রা. তা নিজের জন্য দাবি করেন নি; অথবা তাঁর সন্তানদের কোন সন্তানও তার বা তাদের জন্য তা দাবি করে নি। আর শী‘আগণ মনে করে যে, এ দ্বাদশ ইমামও শরীয়তের উৎস, যা ঐসব সৎ ব্যক্তিদের (আল্লাহ তাঁদের প্রতি রহম করুন) বিশ্বাসের বিপরীত।
আমাদের এবং শী‘আদের মধ্যে অপর একটি পার্থক্য আরও মৌলিক। আর তা হল, যে শরীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের নিকট পৌঁছেছে, তা শুধু সত্যনিষ্ঠ সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনের মাধ্যমেই পৌঁছেছে। আর তাঁদের নিকট থেকে সত্যনিষ্ঠ হাফেয তাবেয়ীগণ ও তাঁদের পরবর্তীতে যারা আগমন করেছেন (আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি রহম করুন), তাদের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে।
সুতরাং সাহাবাগণই হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শরীয়তের বিশ্বস্ত বাহক। আর তারাই হলেন “মানবতার কল্যাণে সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ উম্মত”—তাদের শানে যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন। আর তাঁদের মধ্য থেকে যাঁরা মক্কা বিজয়ের পূর্বে আল্লাহর পথে ব্যয় করেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছে, তাদের জন্য আল্লাহর সকল সৃষ্টির চেয়ে তাঁর নিকট শ্রেষ্ঠ মর্যাদা রয়েছে; যেমন আল্লাহ তা‘আলা এ কারণে তাঁদের প্রশংসা করেছেন। আর আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্য কথা কে বলে? আর আল্লাহ তাঁদেরকে উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাঁদের পরবর্তীতে যারা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকাল পর্যন্ত তাঁর সাহচর্যের গৌরব অর্জন করেছেন, তিনি তাঁদেরকেও উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর আমরা যে এখন ইসলামের নিয়ামতের মধ্যে আছি; ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং উম্মতে মুহাম্মদীয়া অস্তিত্ব-এই সব কিছুই সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনদের যুদ্ধ-জিহাদ ও তাঁদের কর্মকাণ্ডের ফসল। যদি তাঁরা না থাকতেন, তবে আমরা এবং শী‘আরাও কাফির, পাপিষ্ঠ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতাম। পৃথিবীর উপরে অবস্থানরত প্রতিটি মুসলিমের প্রতিটি ভাল কর্মের যে সওয়াব রয়েছে, চাই সে মুসলিম সুন্নী হউক অথবা যায়েদীয়া হউক অথবা ইবাদীয়া হউক অথবা শী‘আ হউক; কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত তার প্রতিটি সওয়াব থেকে একটি অংশ আল্লাহ তা‘আলা ঐসব সাহাবা রা.-এর জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, যাঁরা বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ইসলামের অধীনে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেছেন। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁদেরকে উত্তম প্রতদান দিবেন। আর তাঁদের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে সততা দান করেছেন এবং তাঁদের শিষ্টাচারের দ্বারা আমাদেরকে শিষ্টাচারের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আর আমরা তাঁদের উত্তম আলোচনা করি এবং তাঁদের জন্য মাগফেরাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করি। আমীন!
এটাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনের মর্যাদা; আর এটাই তাঁর নিকট তাঁদের পুরস্কার। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এটাকে দ্বীন মনে করে। আরা তাঁরা সকলেই ছিলেন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ভাই ভাই। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’ ও তাঁর ভাই আবূ বকর, ওমর, ওসমান, আবূ ওবায়দা, সা‘দ ইবন আবি ওয়াক্কাস, তালহা ও যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তাঁদের প্রতিজনের অন্তরের মধ্যে তাঁর ভাইদের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ থাকা থেকে আল্লাহকে বেশি বেশি ভয় করতেন।
সাইয়্যেদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ঘাড়ে তাঁর ভাই খলিফা আবূ বকরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত বা শপথ ছিল; অতঃপর তাঁর ভাই আমিরুল মুমিনীন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি; অতঃপর তাঁর ভাই আমিরুল মুমিনীন ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি। তিনি তাঁদেরকে এত বেশি ভালবাসতেন যে, তিনি তাঁদের নামে তাঁর সন্তানদের নাম রেখেছেন; তাঁদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এত মজবুত ছিল যে, তিনি তাঁদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁদেরকে সহযোগিতা করেছেন। আর তাঁর কলিজার টুকরা দুই সন্তানকে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করার জন্য আমিরুল মুমিনীন ওসমান রা.-এর দরজায় পাহারা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁর রক্তের নিরাপত্তার জন্য তাঁর দুই সন্তানের রক্তকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। যদিও ওসমান রা. নিজে তাঁর আমিরুল মুমিনীন পদবীর গুণে তাঁদের দুইজনকে এবং সকল সাহাবাকে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেতে নির্দেশ দেননি মুসলিমদের রক্ত প্রবাহিত হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য; ফিতনার পরিধিকে সংকীর্ণ করার জন্য এবং দলীল কায়েমের ক্ষেত্রে নিজের পক্ষ থেকে গভীর চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের জন্য। আর তার কারণ হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে শাহাদাত ও জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আর আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আর তিনিও তাঁকে সন্তুষ্ট করেছেন।
পক্ষান্তরে শী‘আদের আকিদা-বিশ্বাস হচ্ছে যে, পাঁচজন ব্যতীত বাকি সকল সাহাবা কাফির হয়ে গেছেন (না‘উযুবিল্লাহ); তাঁরা হলেন: আলী, মিকদাদ, আবূ যর, সালমান আল-ফারসী ও আম্মার ইবন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম, তাদের এই আকিদা কুফরী ও বাতিল।
আর আলী রা. এবং তাঁন সন্তানদের মধ্য থেকে আরও এগারো ব্যক্তির মা‘সুম তথা নিষ্পাপ হওয়ার ব্যাপারে শী‘আদের আকিদা এবং এ তাদের (আলী রা. ও তার সন্তানদের) কাছ থেকে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিরা যা বর্ণনা করেছে তা-ই শরীয়ত; যদিও বর্ণনাকারী মিথ্যাবাদী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত হোক, তা সবই আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে একাই মা‘সুম তথা নিষ্পাপ, তিনি ব্যতীত এই উম্মতের আর কেউই নিষ্পাপ নয়; আর তিনিই একমাত্র শরীয়তের উৎস, যা তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাব ও তাঁর নিকট থেকে বর্ণিত সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ عَلَّمَهُۥ شَدِيدُ ٱلۡقُوَىٰ ٥﴾ [ سورة النجم : 3-5]
“এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। এ তো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়; তাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী (ফেরেশতা)।” —(সূরা আন-নাজম: ৩-৫)
আর এই ওহী বন্ধ হয়ে যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু বরন করে তাঁর মহান বন্ধুর নিকট চলে যাওয়ার সাথে সাথে। ফলে এর দ্বারা শরীয়তের দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে; সুতরাং তাঁর পরে আর কোন শরীয়ত নেই এবং তিনি ব্যতীত আর কেউ নিষ্পাপ নন। আর আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান চলবে না। আর আল্লাহর বিধানসমূহের উপর যা কিয়াস করা হয় এবং জাতির ইমামগণ যে বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, তা যদি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর দ্বারা প্রমাণিত কোন বিধানের বিপরীত না হয়, তবে তাও শরীয়তের বিধান বলে গণ্য হবে।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহবীগণ হলেন তাঁর শরীয়তের বাহক ও তার আমানতদার যাঁরা তাঁদের পরবর্তী আমানতদার তথা বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। কারণ, সাহবাগণ সকলেই ন্যায়পরায়ণ, যদিও তাঁদের মধ্যে জ্ঞান ও মর্যাদার দিক থেকে ব্যবধান ছিল। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ لَا يَسۡتَوِي مِنكُم مَّنۡ أَنفَقَ مِن قَبۡلِ ٱلۡفَتۡحِ وَقَٰتَلَۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡظَمُ دَرَجَةٗ مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَقَٰتَلُواْۚ وَكُلّٗا وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ ﴾ [ سورة الحديد : 10]
“তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে, তারা ও পরবর্তীরা সমান নয়। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ওদের অপেক্ষা, যারা পরবর্তী কালে ব্যয় করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”— (সূরা আল-হাদীদ: ১০)
সুতরাং যে ব্যক্তি মনে করবে যে, তাঁদের মধ্যে (আল্লাহ রক্ষা করুন) এমন কোন ব্যক্তি রয়েছে যার উপর ‘কল্যাণের প্রতিশ্রুতি’ কার্যকর হবে না, সে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ এবং কিতাবের স্পষ্ট ভাষ্যের বিরোধিতা করার কারণে কাফির হয়ে যাবে, আর এই কারণে সে ইসলামের বন্ধন থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
আর তাঁরা সকলেই ছিলেন পরস্পর ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ভাই ভাই। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ﴾ [ سورة الفتح : 29]
“তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।”— (সূরা আল-ফাতহ: ২৯)।
সুতরাং যে ব্যক্তি ধারণামাফিক বলে যে, তাঁদের কারো কারো অন্তরে তাঁর ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে, দরদ নেই; হিংসা ও বিশৃঙ্খলার মানসিকতা আছে, ভালবাসা ও স্বার্থত্যাগের মানসিকতা নেই, তবে সে আল-কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সাহাবীদের ব্যাপার নিয়ে কষ্ট দিল এবং আলী রা. যে উচ্চতা, সততা ও মান-মর্যাদার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তাকে কুৎসিত করে তাঁর প্রতি অসদাচরণ করল।
তাঁদের দৃষ্টিতে খেলাফতটা মূলতই ছিল একটা কষ্টকর বোঝা ও দায়িত্ব, যা ঐ ব্যক্তিই বহন করতে পারে, যে তাদের মধ্য থেকে ধার্মিক ও আনুগত্যপরায়ণ। আর তাদের মধ্যে কেউই তার (খেলাফতের) অধিকারী নয়, যতক্ষণ না সে খেলাফতের দায়িত্বের জন্য মনোনীত হবে। আর খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার ভোগবিলাস ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তারা (জনগণ) কৈফিয়ৎ তলব করার অধিকার রাখে। আর খোলাফায়ে রাশেদুনের চার খলিফাই একের পর এক তা প্রতিষ্ঠা করেছেন (তাঁদের সকলের উপর আল্লাহর শান্তি, রহমত ও সন্তুষ্টি)। সুতরাং পবিত্রতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক নিষ্কলুষতা, প্রাচুর্যতা, ইনসাফ, দূরদৃষ্টি এবং কল্যাণ ও হককে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন) ছিলেন অতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আলী রা. ছিলেন সকল সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন)-এর প্রতি মহব্বতপূর্ণ ব্যক্তি। আর তাঁদের শীর্ষে ছিলেন তাঁর ঐসব ভ্রাতৃবৃন্দ, যাঁরা তাঁর পূর্বে জাতির দায়িত্বভার বহন করেছেন। আর তিনি (আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু) অবহিত ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট তাঁদের মহান মর্যাদা সম্পর্কে এবং তাঁদের মধ্য থেকে যাঁর হাতেই আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করেছেন, আন্তরিকতার সাথে সততাসহকারে তার ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন, তাতে নিফাকী ছিল না। আর তিনি মোনাফেকী চরিত্র থেকে মুক্ত সুমহান ও সম্মানিত!! সুতরাং যে ব্যক্তি এর বিপরীত কিছু দাবি করে, সে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র নিন্দা করে; তাঁর পক্ষ থেকে সর্ম্কচ্ছেদ ও ক্রোধের উপযুক্ত হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে উপযুক্ত হয় লা‘নত ও জাহান্নামের।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ যা তাঁর সাহাবীগণ বহন করেছেন; তাঁদের পরবর্তীতে ইমামগণ তা পরিশুদ্ধ করেছেন; দুর্বলগুলো থেকে বিশুদ্ধ বর্ণাগুলো স্পষ্ট করেছেন; তার বর্ণনাকারীদের মধ্য থেকে বিশ্বস্ত-আমানতদারগণকে চিহ্নিত করেছেন ও তাঁদেরকে নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদীদের থেকে পৃথক করেছেন এবং আরও পৃথক করেছেন দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে যারা এই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে তা পরিণত হয়েছে এমন সহীহ সুন্নায়; অতীতের কোন ইতিহাসই এ রকম আমানত দেখাতে পারবে না, যেখানকার শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো তার সংরক্ষণে এমন চুড়ান্ত চেষ্টা-সাধনা করেছেন, যেমন মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ তাদের নবীর সুন্নাহকে পরিশুদ্ধ করা এবং তাকে বাতিলের পক্ষ অবলম্বনকারী মিথ্যাবাদী ও ফিতনা-ফাসাদ সম্প্রসারণকারীদের খেয়াল-খুশি থেকে মুক্ত রাখার জন্য ব্যয় করেছেন।
ইসলামের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পদ্ধতি ও শী‘আদের পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্ট করা এবং যে ভীতের উপর তার শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত তা নির্দিষ্ট করার পর আমরা পাঠককে জানানো ভাল মনে করি যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত শী‘আদের সাথে মৌলিকভাবে ‘ইসলাম’ এর নামে এবং ইসলামের প্রতি বন্ধুত্বের খাতিরে একমত হতে পারে।
অনুরূপভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ উভয় দলের মধ্যে যে সব বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে সেগুলোতে পরস্পর সহযোগিতা করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত খারাপ মনে করে না, তবে এই শর্তে যে, তারা তাদের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ বিষয়ে একে অপরের ওযর গ্রহণ করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যে সত্য উপলব্ধি করেছে তার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করবে, অনুরূপভাবে শী‘আরা তাদের নীতি ও কর্মকাণ্ড আঁকড়ে ধরে থাকতে অভ্যস্থ সে ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ না করবে। কেননা; পারস্পরিক পরিচিতি ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত। আর এই লাইনগুলোর লেখক ছিলেন চল্লিশ বছর থেকে এখন পর্যন্ত পারস্পরিক এই পরিচিতি ও সহযোগিতার দা‘ঈদের অন্যতম।
অতঃপর শী‘আদের মধ্য থেকে অপর এক দা‘ঈ’র আবির্ভাব হয় যে ইরান থেকে মিসরে গিয়ে হাজির হয়; যাতে সে ‘আল-তাকরিব বাইনাল-মাযাহিবিল-ইসলামীয়া’ তথা ‘ইসলামী মাযহাবসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন’ ( التقريب بين المذاهب الإسلامية ) নামক সংস্থার দিকে ডাকতে পারে। এ থেকে তার উদ্দেশ্য হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আদের মধ্য থেকে লিখিত নতুন নতুন জিনিস প্রকাশ করা। তবে ইবাদীয়ারা, তাদের কিছুসংখ্যক ওলামা মিসরে অবস্থান করা সত্ত্বেও তারা কিন্তু এ ধরনের তাকরীব বা ঐক্যের দিকে আহ্বান করে না।
আর আমরা প্রথম দিন থেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছিলাম যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ এ উভয় মাযহাবের মধ্য এই তাকরীব বা সমন্বয় সাধন অসম্ভব ও অযৌক্তিক! তাছাড়া তা বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে; কারণ, উভয় মাযহাবের প্রত্যেকটি মাযহাবই একটি বিশেষ নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর প্রতিটি মাযহাবই অপর মাযহাব থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত।
যে পদ্ধতির মাধ্যমে ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয় সম্ভব, তা হল দুই মাযহাবের কোন এক মাযহাবের অনুসারীদেরকে তার মাযহাব ছেড়ে দিতে হবে এবং অপর মাযহাবের অনুসারীদের সাথে মিশতে হবে। অথচ আমরা এই ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয়ের আহ্বায়ক ও তার দলবলকে এই ধরনের ছাড় দেয়ার প্রস্তুতি বা মানসিকতা আছে বলে অনুভব করি নি!! ফলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ তাদের মাযহাব ছেড়ে দেবেন এমন আশাই বাকি থাকল! অথবা তাদের এই পক্ষ থেকে কিছু এবং ঐ পক্ষ থেকে কিছু নিয়ে তৃতীয় আরেকটি মাযহাব গঠন করা! এর পর তাতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আদের রাজি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মানে হয় না; [কারণ তা কখনও হবে না] বরং তাতে ইসলামের মধ্যে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
যে কিতাবটি এখন আমরা পাঠকদের উদ্দেশ্যে পেশ করব, তা হল দুই পক্ষের এক পক্ষ কর্তৃক তার নীতিমালা থেকে ছাড় দেয়ার মাধ্যমে ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিত। সুতরাং ইরানের শী‘আ গবেষকবৃন্দ ও নাজাফের আলেমগণ ১১৫৬ হিজরির ২৫ শাওয়াল বৃহস্পতিবার জর্দান, আফগানিস্তান ও মা ওয়ারাউন নাহর (বুখারা ও তার সংশ্লিষ্ট এলাকা) নামক এলাকার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণের উপস্থিতিতে এই ঘটনা সম্পর্কিত আমাদের এই কিতাবের লেখক ইরাকের বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’র সভাপতিত্বে একত্রিত হয়েছেন। আর তাদের সম্মেলনটি ছিল এমন এক ছাদের নীচে যা ইমাম আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু’ [এ শব্দটির পরিবর্তে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলা উচিত। কারণ, বিশেষ করে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য এ শব্দটি ব্যবহারের কোন সঠিক ও সংগত কারণ নেই।]র দিকে সম্পর্কিত একটি কবরের পেছনে অবস্থিত। আর এই সম্মেলনে কী হচ্ছে, তা শুনার জন্য আরব, অনারব ও তুর্কিস্তানের বহু সংখ্যক লোকজন একত্রিত হয়েছে যার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়; যারা একত্রিত হয়েছে, তন্মধ্যে নাদির শাহের সৈন্যবাহিনী ও ঐসব অঞ্চলের লোকজনও ছিল। আর নাদির শাহ ছিলেন পরবর্তী যুগের ইরানের শ্রেষ্ঠ সম্রাট, যিনি সম্মেলনের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন।
অতঃপর শী‘আ আলেমগণ ও তাদের গবেষকবৃন্দ যাদের শীর্ষে ছিলেন তাদের ধর্মীয় গুরু মোল্লা বাশী, তারা সম্মিলিতভাবে স্বীকার করেছেন যে, তারা সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন-এর ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কাতারে নেমে আসবে; খবীস শাহ ইসমাঈল আল-সাফাওয়ীর সকল বিদ‘আত স্থগিত করবে এবং স্বীকৃতি দিবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের সময় সাহাবদের ঐক্যমতের ভিত্তিতেই তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, মর্যাদাবান ও অভিজ্ঞ ছিলেন খলিফা আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু; আর ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন যেমনিভাবে অপরাপর সকল সাহাবী তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন; আর তাঁদের ইজমা অকাট্য দলীল। অতঃপর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য আনুগত্যের শপথ আহ্বান করলেন; অতঃপর সকল সাহাবী তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন, আর ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুও তাঁদের সাথে ছিলেন। অতঃপর ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারেও তাঁদের ঐক্যবদ্ধ রায়ের প্রতিফলন ঘটে। আর তাঁর পরে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হন আলী রা. এবং তাঁদের মর্যাদা ও খেলাফতের ধারাবাহিকতা ছিল এই রকমের (তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট)। সুতরাং যে ব্যক্তি গালি দিবে অথবা এর বিপরীত মন্তব্য করবে, তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের পক্ষ থেকে লা‘নত। আর তারা সকলেই এই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি পত্রে স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
এই যে কাজটি শী‘আ গবেষকবৃন্দ ও তাদের আলেমগণ ১১৫৬ হিজরিতে সর্বসাধারণের উপস্থিতিতে করেছিল, তাকে ‘তাকরীব’ ( التقريب ) বা ‘সমন্বয়সাধন’ বলাটাই শুদ্ধ। কারণ, তা মৌলিকভাবে শী‘আ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী যাবতীয় মুকাফফিরাত (কুফরি’র দিকে সম্পর্ককারী বস্তু) থেকে মুক্ত।
কিন্তু নীতিগতভাবে দু’টি বিরোধপূর্ণ মাযহাবের মধ্যে ‘তাকরীব’ বা সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে সংশয়মূলক নতুন যে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, অথচ দুটি মাযহাবের প্রতিটিই তাদের স্ব-স্ব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত; সে দাওয়াতের কিছু উদ্দেশ্য এভাবে প্রকাশ ঘটছে যে, কোন কোন কূটনৈতিক পক্ষ এতে উদ্দীপনা যোগাচ্ছে, এমন নির্বুদ্ধিতার সাথে যা জ্ঞান ও শরীয়তের কোনটির সাথেই খাপ খায় না; তা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ উভয় মাযহাবের পক্ষ থেকেই সমানভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার উপযুক্ত। কারণ, তার থেকে উভয় মাযহাবের জন্যই কতগুলো অনর্থক বিষয় বা বিতর্কের জন্ম হবে, যার থেকে তৃতীয় আরেকটি মাযহাবের উত্থান হবে, যার দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো একটি ফিরকার উন্মেষ ঘটবে। আর আমরা শুনেছি যে, সিরিয়ার (শামের) শী‘আ গবেষক সাইয়্যিদ মুহসিন আমিন এই ‘তাকরীব’ ( التقريب )-এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন; আর এখন পর্যন্ত এটাকে সমর্থন করে কয়েকজন অখ্যাত শী‘আ ব্যক্তি (তাদের নির্ভরযোগ্য আলেম নয়) ছাড়া কেউ কোন বিবৃতি দেয় নি।
আর ‘সম্মেলন স্মারক’ ( كتاب المؤتمر ) যা আমরা এই ভূমিকার পরে উপস্থাপন করব, তা লিখিত হয়েছে সম্মেলনের সভাপতি সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’র কলমে। আর তা ১৩২৩ হিজরিতে কায়রোর আল-সা‘আদাত প্রকাশনা থেকে “আল-হুজাজুল-কাত‘ইয়্যা লি ইত্তিফাকিল-ফিরাকিল-ইসলামীয়া /ইসলামী ফিরকাসমূহের ঐক্যের অকাট্য দলীল” ( الحجج القطعية لاتفاق الفرق الإسلامية ) নামক শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তার প্রচারণা ছিল সীমিত পরিসরে এবং পরিধি ছিল সংকীর্ণ; ফলে আমি দেখেছি যে, অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিই তার ব্যাপারে অনবহিত। আর তার কোন কপি সংগ্রহ করার কোন উপায় ছিল না। তারপর যখন সন্দেহজনক এই ঐক্যের আহ্বানজনিত ফেতনা দেখতে পেলাম তখনই তা আমাকে এই গ্রন্থটিকে পুণঃপ্রকাশে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাছাড়া এজন্যও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘নাজাফ সম্মেলন’ ( مؤتمر النجف ) টি আমার জানামতে ইসলামী এ জাতীয় প্রথম পদক্ষেপ।
আর এই সম্মেলনের সভাপতি ও এই বইয়ের লেখক সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী হলেন আবূল বারাকাত ইবন সাইয়্যিদ হোসাইন ইবন মার‘ঈ ইবন নাসিরুদ্দীন; আর আল-সুওয়াইদী’র পরিবার হল বাগদাদের সম্ভ্রান্ত পরিবারসমূহের মধ্যে অন্যতম এবং আব্বাসীয় বংশের অন্তর্ভুক্ত, যারা দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী খেলাফতের দায়িত্ব পালনে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ ১১০৪ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১৭০ হিজরিতে মারা যান। এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করার সময় তার বয়স ছিল বায়ান্ন বছর।
তিনি যাদের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন, তারা হলেন: আহমদ ইবন আবিল কাসিম আল-মাদায়েনী আল-মাগরেবী, তার চাচা সাইয়্যিদ আহমদ ইবন মার‘ঈ আল-সুওয়াইদী, শাইখ সুলতান আল-জুবুরী, মুহাম্মদ ইবন ‘উকাইলা আল-মাক্কী, শাইখ আলী আল-আনসারী আল-আহসায়ী প্রমুখ; যারা ইরাক, হেজায ও সিরিয়া’র আলেম ছিলেন।
সাইয়্যিদ মাহমুদ শুকরী আল-আলুসী তার প্রশংসায় বলেন: “তিনি পুরো যমীনের শাইখ এবং সবার মতে শরীয়তের সৌন্দর্য বলে বিবেচিত।”
তার রচিত গ্রন্থসমূহ হল: শরহুন জালিলুন ‘আলা সহীহিল-ইমামিল-বুখারী ( شرح جليل على صحيح الإمام البخاري ); কিতাব আল-মুহাকামাহ বাইনা আল-দিমামীনী ওয়া আল-শুমুন্নী ( كتاب المحاكمة بين الدماميني و الشمني ); রাশফ আল-দারব ( رشف الضرب ); আল-নুফহাহ আল-মিসকিয়্যাহ ( النفحة المسكية ); আল-আমছাল আল-সায়েরা ( الأمثال السائرة ); শরহু দালায়েল আল-খায়রাত ( شرح دلائل الخيرات )। তার আরও একটি গ্রন্থের নাম “আর রিহলাতুল-মাক্কীয়া” ( الرحلة المكية ) যাতে আমরা নাজাফ সম্মেলন সম্পর্কে এই কিতাবে যা লিপিবদ্ধ করেছি, তা বিদ্যমান আছে। আর তিনি ঐ বছর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের নিমিত্তে হজ পালন করেছেন; কারণ, তিনি নিজ হাতে নাদির শাহ ও অধিকাংশ শী‘আকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদেরকে (তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট) গালি দানে বিরত থাকার কথা স্বীকার করতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহ সত্য ও কল্যাণ এবং উভয়ের অনুসারীদের অভিভাবক; আর সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।
মুহিব্বুদ্দীন আল-খতিব
(সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য; আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম (শান্তি) বর্ষিত হউক আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সমস্ত সাহাবীর প্রতি) । অতঃপর
ইসলামের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ মুসলিম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর অন্তর্ভুক্ত; আর তারা হলেন ঐসব লোক, যারা তাদের দীন ও শরীয়ত তথা বিধিবিধান অর্জন করেছেন আল্লাহর কিতাব থেকে ঠিক তেমনি করে, যেমনিভাবে সাহাবা ও তাবেঈনগণ অনুধাবন করেছেন; বিশুদ্ধ সুন্নাতে নববী থেকে যা ত্রুটিমুক্ত করেছেন ইমাম ও বিশ্বস্ত হাফেযগণ এবং সংকলন করেছেন সংকলনকারীগণ অত্যন্ত যত্নসহকারে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ হল: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুয়াত্তায়ে মালেক, সুনানু তিরমিযী, নাসাঈ, আবি দাঊদ, অতঃপর সুনানু ইবন মাযাহ ও মুসনাদু আল-ইমাম আহমদসহ এই স্তরের আরও যেসব গ্রন্থ রয়েছে। আর এসব কিতাবে বর্ণিত হাদিসসমূহের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে সত্য, তবে হাদিসগুলো বিশুদ্ধ যা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানগণ তাদের অতীত সম্পদ থেকে লিখে নিয়েছেন।
এই মর্যাদাসম্পন্ন ইমামগণ হাদিস বর্ণনা ও তার মান নির্ণয়ে কতগুলো নিয়ম-কানুন ও শর্ত নির্ধারণ করেছেন; তারা এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন যা তার গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তা একটি মর্যাদাপূর্ণ শাস্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর তার নাম হল ‘ইলম আল-সুন্নাহ’ ( علم السنة )।
যে উম্মত আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের হাদিস এবং তার উপর ভিত্তি করে কিয়াস ও নস তথা সুস্পষ্ট ভাষ্যের বিপরীত নয়, ইমামদের এমন ঐক্যবদ্ধ রায় ইজমা থেকে উদ্ভাবিত বিধি-বিধান অনুযায়ী কাজ করে, তারাই হলেন ‘আহলে সুন্নাত’। আর যেহেতু তারা হচ্ছে অধিকাংশ মুসলিম ও তাদের জামা‘আত, তাই তাদেরকে বলা হয় ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’।
খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী রয়েছে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সুন্নাহ’র গ্রন্থসমূহে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ মেনে চলে না, যেভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত মেনে চলে; যে দিকে আমরা ইতঃপূর্বে ইঙ্গিত দিয়েছি। কিন্তু তারা কিবলার অনুসারী হওয়া ও তাদের নামায ও হজের কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে শরীক হয়ে যায়। আর এই কম সংখ্যকের মধ্য থেকে যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের খুব কাছাকাছি, তারা হল যায়েদীয়া, অতঃপর ইবাদীয়া, অতঃপর ‘আল-শী‘আ আল-ইসনা ‘আশারীয়া’ অতঃপর আহমদীয়া লাহোর, যারা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মানে না। আর যারা তার নবুওয়াতকে স্বীকার করে, তারা উপরিউক্ত সম্প্রদায়গুলোর চেয়ে ইসলামী ঈমান থেকে বহু দূরে রয়েছে।
তাদের সাথে সংযুক্ত অপর সংখ্যালঘুরা হল ‘বাতেনীয়া’; তারা নিজেদেরকে কিবলার অনুসারী বলে গণ্য করে না, তবে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত বলে দাবি করে। আর নসসমূহ ও আকিদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে তাদের বিশেষ দর্শন রয়েছে। তাদের মগডালে রয়েছে ‘ইসমাঈলীয়া আল-বুহরা’, অতঃপর ‘ইসমাঈলীয়া আগাখাঁন’, ‘নুসাইরীয়া’ ও ‘দুরুয’। আর যাদেরকে ওদের মধ্যে গণ্য করা যায়, তারা হল: ‘আল-বাবীয়া’ ও ‘আল-বাহাইয়া’; যদিও তারা ইসলাম থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে এবং অনাহূত স্বতন্ত্র দীন আবিষ্কার করে প্রসিদ্ধ দীনসমূহের মধ্যে নতুন করে বিরোধ তথা মতপার্থক্য বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা তারা ইসলামের নাম থেকেও খারিজ হয়ে গেছে।
আর ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ ও ‘শী‘আ’ সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ শরীয়তের উৎসকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে এবং অভিমত পেশ করে যে, তিনি একাই মা‘সুম অর্থাৎ তিনি তাঁর রবের পক্ষ থেকে যা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর রিসালাতের পরিপূর্ণতার জন্য যা আবশ্যক, তা অর্জন ও পালনে তিনিই একমাত্র মা‘সুম তথা নিষ্পাপ। আর ‘আল-শী‘আ আল-ইসনা ‘আশারীয়া’ ( الشيعة الاثنا عشرية ) সম্প্রদায় দাবি করে যে, আমিরুল মুমেনীন আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর ধারাবাহিকতায় আরও এগারো জন মা‘সুম তথা নিষ্পাপ। যদিও খোদ আলী রা. তা নিজের জন্য দাবি করেন নি; অথবা তাঁর সন্তানদের কোন সন্তানও তার বা তাদের জন্য তা দাবি করে নি। আর শী‘আগণ মনে করে যে, এ দ্বাদশ ইমামও শরীয়তের উৎস, যা ঐসব সৎ ব্যক্তিদের (আল্লাহ তাঁদের প্রতি রহম করুন) বিশ্বাসের বিপরীত।
আমাদের এবং শী‘আদের মধ্যে অপর একটি পার্থক্য আরও মৌলিক। আর তা হল, যে শরীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের নিকট পৌঁছেছে, তা শুধু সত্যনিষ্ঠ সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনের মাধ্যমেই পৌঁছেছে। আর তাঁদের নিকট থেকে সত্যনিষ্ঠ হাফেয তাবেয়ীগণ ও তাঁদের পরবর্তীতে যারা আগমন করেছেন (আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি রহম করুন), তাদের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে।
সুতরাং সাহাবাগণই হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শরীয়তের বিশ্বস্ত বাহক। আর তারাই হলেন “মানবতার কল্যাণে সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ উম্মত”—তাদের শানে যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন। আর তাঁদের মধ্য থেকে যাঁরা মক্কা বিজয়ের পূর্বে আল্লাহর পথে ব্যয় করেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছে, তাদের জন্য আল্লাহর সকল সৃষ্টির চেয়ে তাঁর নিকট শ্রেষ্ঠ মর্যাদা রয়েছে; যেমন আল্লাহ তা‘আলা এ কারণে তাঁদের প্রশংসা করেছেন। আর আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্য কথা কে বলে? আর আল্লাহ তাঁদেরকে উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাঁদের পরবর্তীতে যারা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকাল পর্যন্ত তাঁর সাহচর্যের গৌরব অর্জন করেছেন, তিনি তাঁদেরকেও উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর আমরা যে এখন ইসলামের নিয়ামতের মধ্যে আছি; ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং উম্মতে মুহাম্মদীয়া অস্তিত্ব-এই সব কিছুই সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনদের যুদ্ধ-জিহাদ ও তাঁদের কর্মকাণ্ডের ফসল। যদি তাঁরা না থাকতেন, তবে আমরা এবং শী‘আরাও কাফির, পাপিষ্ঠ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতাম। পৃথিবীর উপরে অবস্থানরত প্রতিটি মুসলিমের প্রতিটি ভাল কর্মের যে সওয়াব রয়েছে, চাই সে মুসলিম সুন্নী হউক অথবা যায়েদীয়া হউক অথবা ইবাদীয়া হউক অথবা শী‘আ হউক; কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত তার প্রতিটি সওয়াব থেকে একটি অংশ আল্লাহ তা‘আলা ঐসব সাহাবা রা.-এর জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, যাঁরা বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ইসলামের অধীনে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেছেন। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁদেরকে উত্তম প্রতদান দিবেন। আর তাঁদের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে সততা দান করেছেন এবং তাঁদের শিষ্টাচারের দ্বারা আমাদেরকে শিষ্টাচারের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আর আমরা তাঁদের উত্তম আলোচনা করি এবং তাঁদের জন্য মাগফেরাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করি। আমীন!
এটাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনের মর্যাদা; আর এটাই তাঁর নিকট তাঁদের পুরস্কার। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এটাকে দ্বীন মনে করে। আরা তাঁরা সকলেই ছিলেন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ভাই ভাই। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’ ও তাঁর ভাই আবূ বকর, ওমর, ওসমান, আবূ ওবায়দা, সা‘দ ইবন আবি ওয়াক্কাস, তালহা ও যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তাঁদের প্রতিজনের অন্তরের মধ্যে তাঁর ভাইদের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ থাকা থেকে আল্লাহকে বেশি বেশি ভয় করতেন।
সাইয়্যেদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ঘাড়ে তাঁর ভাই খলিফা আবূ বকরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত বা শপথ ছিল; অতঃপর তাঁর ভাই আমিরুল মুমিনীন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি; অতঃপর তাঁর ভাই আমিরুল মুমিনীন ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি। তিনি তাঁদেরকে এত বেশি ভালবাসতেন যে, তিনি তাঁদের নামে তাঁর সন্তানদের নাম রেখেছেন; তাঁদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এত মজবুত ছিল যে, তিনি তাঁদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁদেরকে সহযোগিতা করেছেন। আর তাঁর কলিজার টুকরা দুই সন্তানকে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করার জন্য আমিরুল মুমিনীন ওসমান রা.-এর দরজায় পাহারা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁর রক্তের নিরাপত্তার জন্য তাঁর দুই সন্তানের রক্তকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। যদিও ওসমান রা. নিজে তাঁর আমিরুল মুমিনীন পদবীর গুণে তাঁদের দুইজনকে এবং সকল সাহাবাকে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেতে নির্দেশ দেননি মুসলিমদের রক্ত প্রবাহিত হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য; ফিতনার পরিধিকে সংকীর্ণ করার জন্য এবং দলীল কায়েমের ক্ষেত্রে নিজের পক্ষ থেকে গভীর চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের জন্য। আর তার কারণ হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে শাহাদাত ও জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আর আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আর তিনিও তাঁকে সন্তুষ্ট করেছেন।
পক্ষান্তরে শী‘আদের আকিদা-বিশ্বাস হচ্ছে যে, পাঁচজন ব্যতীত বাকি সকল সাহাবা কাফির হয়ে গেছেন (না‘উযুবিল্লাহ); তাঁরা হলেন: আলী, মিকদাদ, আবূ যর, সালমান আল-ফারসী ও আম্মার ইবন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম, তাদের এই আকিদা কুফরী ও বাতিল।
আর আলী রা. এবং তাঁন সন্তানদের মধ্য থেকে আরও এগারো ব্যক্তির মা‘সুম তথা নিষ্পাপ হওয়ার ব্যাপারে শী‘আদের আকিদা এবং এ তাদের (আলী রা. ও তার সন্তানদের) কাছ থেকে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিরা যা বর্ণনা করেছে তা-ই শরীয়ত; যদিও বর্ণনাকারী মিথ্যাবাদী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত হোক, তা সবই আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে একাই মা‘সুম তথা নিষ্পাপ, তিনি ব্যতীত এই উম্মতের আর কেউই নিষ্পাপ নয়; আর তিনিই একমাত্র শরীয়তের উৎস, যা তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাব ও তাঁর নিকট থেকে বর্ণিত সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ عَلَّمَهُۥ شَدِيدُ ٱلۡقُوَىٰ ٥﴾ [ سورة النجم : 3-5]
“এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। এ তো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়; তাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী (ফেরেশতা)।” —(সূরা আন-নাজম: ৩-৫)
আর এই ওহী বন্ধ হয়ে যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু বরন করে তাঁর মহান বন্ধুর নিকট চলে যাওয়ার সাথে সাথে। ফলে এর দ্বারা শরীয়তের দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে; সুতরাং তাঁর পরে আর কোন শরীয়ত নেই এবং তিনি ব্যতীত আর কেউ নিষ্পাপ নন। আর আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান চলবে না। আর আল্লাহর বিধানসমূহের উপর যা কিয়াস করা হয় এবং জাতির ইমামগণ যে বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, তা যদি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর দ্বারা প্রমাণিত কোন বিধানের বিপরীত না হয়, তবে তাও শরীয়তের বিধান বলে গণ্য হবে।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহবীগণ হলেন তাঁর শরীয়তের বাহক ও তার আমানতদার যাঁরা তাঁদের পরবর্তী আমানতদার তথা বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। কারণ, সাহবাগণ সকলেই ন্যায়পরায়ণ, যদিও তাঁদের মধ্যে জ্ঞান ও মর্যাদার দিক থেকে ব্যবধান ছিল। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ لَا يَسۡتَوِي مِنكُم مَّنۡ أَنفَقَ مِن قَبۡلِ ٱلۡفَتۡحِ وَقَٰتَلَۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡظَمُ دَرَجَةٗ مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَقَٰتَلُواْۚ وَكُلّٗا وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ ﴾ [ سورة الحديد : 10]
“তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে, তারা ও পরবর্তীরা সমান নয়। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ওদের অপেক্ষা, যারা পরবর্তী কালে ব্যয় করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”— (সূরা আল-হাদীদ: ১০)
সুতরাং যে ব্যক্তি মনে করবে যে, তাঁদের মধ্যে (আল্লাহ রক্ষা করুন) এমন কোন ব্যক্তি রয়েছে যার উপর ‘কল্যাণের প্রতিশ্রুতি’ কার্যকর হবে না, সে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ এবং কিতাবের স্পষ্ট ভাষ্যের বিরোধিতা করার কারণে কাফির হয়ে যাবে, আর এই কারণে সে ইসলামের বন্ধন থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
আর তাঁরা সকলেই ছিলেন পরস্পর ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ভাই ভাই। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ﴾ [ سورة الفتح : 29]
“তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।”— (সূরা আল-ফাতহ: ২৯)।
সুতরাং যে ব্যক্তি ধারণামাফিক বলে যে, তাঁদের কারো কারো অন্তরে তাঁর ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে, দরদ নেই; হিংসা ও বিশৃঙ্খলার মানসিকতা আছে, ভালবাসা ও স্বার্থত্যাগের মানসিকতা নেই, তবে সে আল-কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সাহাবীদের ব্যাপার নিয়ে কষ্ট দিল এবং আলী রা. যে উচ্চতা, সততা ও মান-মর্যাদার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তাকে কুৎসিত করে তাঁর প্রতি অসদাচরণ করল।
তাঁদের দৃষ্টিতে খেলাফতটা মূলতই ছিল একটা কষ্টকর বোঝা ও দায়িত্ব, যা ঐ ব্যক্তিই বহন করতে পারে, যে তাদের মধ্য থেকে ধার্মিক ও আনুগত্যপরায়ণ। আর তাদের মধ্যে কেউই তার (খেলাফতের) অধিকারী নয়, যতক্ষণ না সে খেলাফতের দায়িত্বের জন্য মনোনীত হবে। আর খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার ভোগবিলাস ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তারা (জনগণ) কৈফিয়ৎ তলব করার অধিকার রাখে। আর খোলাফায়ে রাশেদুনের চার খলিফাই একের পর এক তা প্রতিষ্ঠা করেছেন (তাঁদের সকলের উপর আল্লাহর শান্তি, রহমত ও সন্তুষ্টি)। সুতরাং পবিত্রতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক নিষ্কলুষতা, প্রাচুর্যতা, ইনসাফ, দূরদৃষ্টি এবং কল্যাণ ও হককে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন) ছিলেন অতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আলী রা. ছিলেন সকল সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন)-এর প্রতি মহব্বতপূর্ণ ব্যক্তি। আর তাঁদের শীর্ষে ছিলেন তাঁর ঐসব ভ্রাতৃবৃন্দ, যাঁরা তাঁর পূর্বে জাতির দায়িত্বভার বহন করেছেন। আর তিনি (আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু) অবহিত ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট তাঁদের মহান মর্যাদা সম্পর্কে এবং তাঁদের মধ্য থেকে যাঁর হাতেই আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করেছেন, আন্তরিকতার সাথে সততাসহকারে তার ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন, তাতে নিফাকী ছিল না। আর তিনি মোনাফেকী চরিত্র থেকে মুক্ত সুমহান ও সম্মানিত!! সুতরাং যে ব্যক্তি এর বিপরীত কিছু দাবি করে, সে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র নিন্দা করে; তাঁর পক্ষ থেকে সর্ম্কচ্ছেদ ও ক্রোধের উপযুক্ত হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে উপযুক্ত হয় লা‘নত ও জাহান্নামের।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ যা তাঁর সাহাবীগণ বহন করেছেন; তাঁদের পরবর্তীতে ইমামগণ তা পরিশুদ্ধ করেছেন; দুর্বলগুলো থেকে বিশুদ্ধ বর্ণাগুলো স্পষ্ট করেছেন; তার বর্ণনাকারীদের মধ্য থেকে বিশ্বস্ত-আমানতদারগণকে চিহ্নিত করেছেন ও তাঁদেরকে নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদীদের থেকে পৃথক করেছেন এবং আরও পৃথক করেছেন দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে যারা এই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে তা পরিণত হয়েছে এমন সহীহ সুন্নায়; অতীতের কোন ইতিহাসই এ রকম আমানত দেখাতে পারবে না, যেখানকার শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো তার সংরক্ষণে এমন চুড়ান্ত চেষ্টা-সাধনা করেছেন, যেমন মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ তাদের নবীর সুন্নাহকে পরিশুদ্ধ করা এবং তাকে বাতিলের পক্ষ অবলম্বনকারী মিথ্যাবাদী ও ফিতনা-ফাসাদ সম্প্রসারণকারীদের খেয়াল-খুশি থেকে মুক্ত রাখার জন্য ব্যয় করেছেন।
ইসলামের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পদ্ধতি ও শী‘আদের পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্ট করা এবং যে ভীতের উপর তার শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত তা নির্দিষ্ট করার পর আমরা পাঠককে জানানো ভাল মনে করি যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত শী‘আদের সাথে মৌলিকভাবে ‘ইসলাম’ এর নামে এবং ইসলামের প্রতি বন্ধুত্বের খাতিরে একমত হতে পারে।
অনুরূপভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ উভয় দলের মধ্যে যে সব বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে সেগুলোতে পরস্পর সহযোগিতা করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত খারাপ মনে করে না, তবে এই শর্তে যে, তারা তাদের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ বিষয়ে একে অপরের ওযর গ্রহণ করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যে সত্য উপলব্ধি করেছে তার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করবে, অনুরূপভাবে শী‘আরা তাদের নীতি ও কর্মকাণ্ড আঁকড়ে ধরে থাকতে অভ্যস্থ সে ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ না করবে। কেননা; পারস্পরিক পরিচিতি ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত। আর এই লাইনগুলোর লেখক ছিলেন চল্লিশ বছর থেকে এখন পর্যন্ত পারস্পরিক এই পরিচিতি ও সহযোগিতার দা‘ঈদের অন্যতম।
অতঃপর শী‘আদের মধ্য থেকে অপর এক দা‘ঈ’র আবির্ভাব হয় যে ইরান থেকে মিসরে গিয়ে হাজির হয়; যাতে সে ‘আল-তাকরিব বাইনাল-মাযাহিবিল-ইসলামীয়া’ তথা ‘ইসলামী মাযহাবসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন’ ( التقريب بين المذاهب الإسلامية ) নামক সংস্থার দিকে ডাকতে পারে। এ থেকে তার উদ্দেশ্য হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আদের মধ্য থেকে লিখিত নতুন নতুন জিনিস প্রকাশ করা। তবে ইবাদীয়ারা, তাদের কিছুসংখ্যক ওলামা মিসরে অবস্থান করা সত্ত্বেও তারা কিন্তু এ ধরনের তাকরীব বা ঐক্যের দিকে আহ্বান করে না।
আর আমরা প্রথম দিন থেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছিলাম যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ এ উভয় মাযহাবের মধ্য এই তাকরীব বা সমন্বয় সাধন অসম্ভব ও অযৌক্তিক! তাছাড়া তা বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে; কারণ, উভয় মাযহাবের প্রত্যেকটি মাযহাবই একটি বিশেষ নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর প্রতিটি মাযহাবই অপর মাযহাব থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত।
যে পদ্ধতির মাধ্যমে ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয় সম্ভব, তা হল দুই মাযহাবের কোন এক মাযহাবের অনুসারীদেরকে তার মাযহাব ছেড়ে দিতে হবে এবং অপর মাযহাবের অনুসারীদের সাথে মিশতে হবে। অথচ আমরা এই ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয়ের আহ্বায়ক ও তার দলবলকে এই ধরনের ছাড় দেয়ার প্রস্তুতি বা মানসিকতা আছে বলে অনুভব করি নি!! ফলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ তাদের মাযহাব ছেড়ে দেবেন এমন আশাই বাকি থাকল! অথবা তাদের এই পক্ষ থেকে কিছু এবং ঐ পক্ষ থেকে কিছু নিয়ে তৃতীয় আরেকটি মাযহাব গঠন করা! এর পর তাতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আদের রাজি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মানে হয় না; [কারণ তা কখনও হবে না] বরং তাতে ইসলামের মধ্যে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
যে কিতাবটি এখন আমরা পাঠকদের উদ্দেশ্যে পেশ করব, তা হল দুই পক্ষের এক পক্ষ কর্তৃক তার নীতিমালা থেকে ছাড় দেয়ার মাধ্যমে ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিত। সুতরাং ইরানের শী‘আ গবেষকবৃন্দ ও নাজাফের আলেমগণ ১১৫৬ হিজরির ২৫ শাওয়াল বৃহস্পতিবার জর্দান, আফগানিস্তান ও মা ওয়ারাউন নাহর (বুখারা ও তার সংশ্লিষ্ট এলাকা) নামক এলাকার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণের উপস্থিতিতে এই ঘটনা সম্পর্কিত আমাদের এই কিতাবের লেখক ইরাকের বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’র সভাপতিত্বে একত্রিত হয়েছেন। আর তাদের সম্মেলনটি ছিল এমন এক ছাদের নীচে যা ইমাম আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু’ [এ শব্দটির পরিবর্তে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলা উচিত। কারণ, বিশেষ করে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য এ শব্দটি ব্যবহারের কোন সঠিক ও সংগত কারণ নেই।]র দিকে সম্পর্কিত একটি কবরের পেছনে অবস্থিত। আর এই সম্মেলনে কী হচ্ছে, তা শুনার জন্য আরব, অনারব ও তুর্কিস্তানের বহু সংখ্যক লোকজন একত্রিত হয়েছে যার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়; যারা একত্রিত হয়েছে, তন্মধ্যে নাদির শাহের সৈন্যবাহিনী ও ঐসব অঞ্চলের লোকজনও ছিল। আর নাদির শাহ ছিলেন পরবর্তী যুগের ইরানের শ্রেষ্ঠ সম্রাট, যিনি সম্মেলনের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন।
অতঃপর শী‘আ আলেমগণ ও তাদের গবেষকবৃন্দ যাদের শীর্ষে ছিলেন তাদের ধর্মীয় গুরু মোল্লা বাশী, তারা সম্মিলিতভাবে স্বীকার করেছেন যে, তারা সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন-এর ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কাতারে নেমে আসবে; খবীস শাহ ইসমাঈল আল-সাফাওয়ীর সকল বিদ‘আত স্থগিত করবে এবং স্বীকৃতি দিবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের সময় সাহাবদের ঐক্যমতের ভিত্তিতেই তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, মর্যাদাবান ও অভিজ্ঞ ছিলেন খলিফা আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু; আর ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন যেমনিভাবে অপরাপর সকল সাহাবী তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন; আর তাঁদের ইজমা অকাট্য দলীল। অতঃপর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য আনুগত্যের শপথ আহ্বান করলেন; অতঃপর সকল সাহাবী তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন, আর ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুও তাঁদের সাথে ছিলেন। অতঃপর ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারেও তাঁদের ঐক্যবদ্ধ রায়ের প্রতিফলন ঘটে। আর তাঁর পরে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হন আলী রা. এবং তাঁদের মর্যাদা ও খেলাফতের ধারাবাহিকতা ছিল এই রকমের (তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট)। সুতরাং যে ব্যক্তি গালি দিবে অথবা এর বিপরীত মন্তব্য করবে, তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের পক্ষ থেকে লা‘নত। আর তারা সকলেই এই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি পত্রে স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
এই যে কাজটি শী‘আ গবেষকবৃন্দ ও তাদের আলেমগণ ১১৫৬ হিজরিতে সর্বসাধারণের উপস্থিতিতে করেছিল, তাকে ‘তাকরীব’ ( التقريب ) বা ‘সমন্বয়সাধন’ বলাটাই শুদ্ধ। কারণ, তা মৌলিকভাবে শী‘আ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী যাবতীয় মুকাফফিরাত (কুফরি’র দিকে সম্পর্ককারী বস্তু) থেকে মুক্ত।
কিন্তু নীতিগতভাবে দু’টি বিরোধপূর্ণ মাযহাবের মধ্যে ‘তাকরীব’ বা সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে সংশয়মূলক নতুন যে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, অথচ দুটি মাযহাবের প্রতিটিই তাদের স্ব-স্ব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত; সে দাওয়াতের কিছু উদ্দেশ্য এভাবে প্রকাশ ঘটছে যে, কোন কোন কূটনৈতিক পক্ষ এতে উদ্দীপনা যোগাচ্ছে, এমন নির্বুদ্ধিতার সাথে যা জ্ঞান ও শরীয়তের কোনটির সাথেই খাপ খায় না; তা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ উভয় মাযহাবের পক্ষ থেকেই সমানভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার উপযুক্ত। কারণ, তার থেকে উভয় মাযহাবের জন্যই কতগুলো অনর্থক বিষয় বা বিতর্কের জন্ম হবে, যার থেকে তৃতীয় আরেকটি মাযহাবের উত্থান হবে, যার দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো একটি ফিরকার উন্মেষ ঘটবে। আর আমরা শুনেছি যে, সিরিয়ার (শামের) শী‘আ গবেষক সাইয়্যিদ মুহসিন আমিন এই ‘তাকরীব’ ( التقريب )-এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন; আর এখন পর্যন্ত এটাকে সমর্থন করে কয়েকজন অখ্যাত শী‘আ ব্যক্তি (তাদের নির্ভরযোগ্য আলেম নয়) ছাড়া কেউ কোন বিবৃতি দেয় নি।
আর ‘সম্মেলন স্মারক’ ( كتاب المؤتمر ) যা আমরা এই ভূমিকার পরে উপস্থাপন করব, তা লিখিত হয়েছে সম্মেলনের সভাপতি সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’র কলমে। আর তা ১৩২৩ হিজরিতে কায়রোর আল-সা‘আদাত প্রকাশনা থেকে “আল-হুজাজুল-কাত‘ইয়্যা লি ইত্তিফাকিল-ফিরাকিল-ইসলামীয়া /ইসলামী ফিরকাসমূহের ঐক্যের অকাট্য দলীল” ( الحجج القطعية لاتفاق الفرق الإسلامية ) নামক শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তার প্রচারণা ছিল সীমিত পরিসরে এবং পরিধি ছিল সংকীর্ণ; ফলে আমি দেখেছি যে, অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিই তার ব্যাপারে অনবহিত। আর তার কোন কপি সংগ্রহ করার কোন উপায় ছিল না। তারপর যখন সন্দেহজনক এই ঐক্যের আহ্বানজনিত ফেতনা দেখতে পেলাম তখনই তা আমাকে এই গ্রন্থটিকে পুণঃপ্রকাশে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাছাড়া এজন্যও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘নাজাফ সম্মেলন’ ( مؤتمر النجف ) টি আমার জানামতে ইসলামী এ জাতীয় প্রথম পদক্ষেপ।
আর এই সম্মেলনের সভাপতি ও এই বইয়ের লেখক সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী হলেন আবূল বারাকাত ইবন সাইয়্যিদ হোসাইন ইবন মার‘ঈ ইবন নাসিরুদ্দীন; আর আল-সুওয়াইদী’র পরিবার হল বাগদাদের সম্ভ্রান্ত পরিবারসমূহের মধ্যে অন্যতম এবং আব্বাসীয় বংশের অন্তর্ভুক্ত, যারা দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী খেলাফতের দায়িত্ব পালনে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ ১১০৪ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১৭০ হিজরিতে মারা যান। এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করার সময় তার বয়স ছিল বায়ান্ন বছর।
তিনি যাদের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন, তারা হলেন: আহমদ ইবন আবিল কাসিম আল-মাদায়েনী আল-মাগরেবী, তার চাচা সাইয়্যিদ আহমদ ইবন মার‘ঈ আল-সুওয়াইদী, শাইখ সুলতান আল-জুবুরী, মুহাম্মদ ইবন ‘উকাইলা আল-মাক্কী, শাইখ আলী আল-আনসারী আল-আহসায়ী প্রমুখ; যারা ইরাক, হেজায ও সিরিয়া’র আলেম ছিলেন।
সাইয়্যিদ মাহমুদ শুকরী আল-আলুসী তার প্রশংসায় বলেন: “তিনি পুরো যমীনের শাইখ এবং সবার মতে শরীয়তের সৌন্দর্য বলে বিবেচিত।”
তার রচিত গ্রন্থসমূহ হল: শরহুন জালিলুন ‘আলা সহীহিল-ইমামিল-বুখারী ( شرح جليل على صحيح الإمام البخاري ); কিতাব আল-মুহাকামাহ বাইনা আল-দিমামীনী ওয়া আল-শুমুন্নী ( كتاب المحاكمة بين الدماميني و الشمني ); রাশফ আল-দারব ( رشف الضرب ); আল-নুফহাহ আল-মিসকিয়্যাহ ( النفحة المسكية ); আল-আমছাল আল-সায়েরা ( الأمثال السائرة ); শরহু দালায়েল আল-খায়রাত ( شرح دلائل الخيرات )। তার আরও একটি গ্রন্থের নাম “আর রিহলাতুল-মাক্কীয়া” ( الرحلة المكية ) যাতে আমরা নাজাফ সম্মেলন সম্পর্কে এই কিতাবে যা লিপিবদ্ধ করেছি, তা বিদ্যমান আছে। আর তিনি ঐ বছর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের নিমিত্তে হজ পালন করেছেন; কারণ, তিনি নিজ হাতে নাদির শাহ ও অধিকাংশ শী‘আকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদেরকে (তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট) গালি দানে বিরত থাকার কথা স্বীকার করতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহ সত্য ও কল্যাণ এবং উভয়ের অনুসারীদের অভিভাবক; আর সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।
মুহিব্বুদ্দীন আল-খতিব
الحمد لله رب العالمين , و الصلاة و السلام على رسوله سيدنا محمد خاتم الأنبياء و المرسلين , و على آله و أصحابه الطاهرين .
(সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম তাঁর রাসূল আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যিনি সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং শান্তি বর্ষিত হউক তাঁর পরিবার-পরিজন ও পুত-পবিত্র সাহাবীদের প্রতি) । অতঃপর—
যখন আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্য কাঙ্খিত শরীয়তের পৃষ্ঠপোষকতা দান এবং বিদ‘আতপন্থী ও অপকর্মের প্ররোচনাদানকারীদেরকে প্রতিরোধ করাটাকে সহজ করে দিয়েছেন, তখন তিনি যে আমাকে আমার মনোবাসনা পূর্ণ করার ও তার দ্বারা সামগ্রীকভাবে ইসলামপন্থীদের সংশোধন করার; আমার হাতে সত্যকে জারি রাখার; আমার আলোচনা দ্বারা বাতিলের আগুন প্রশমিত করার তৌফিক প্রদান করলেন এবং শী‘আরা যে সমস্ত বাতিলের উপর ছিল, যেমন সাহাবীগণকে গালি দেওয়া, তাঁদেরকে কাফির বলা, আলী ইবন আবি তালিব রা.-কে সবচেয়ে মর্যাদাশীল ও খিলাফতের একমাত্র হকদার বলে দাবি করা, মু‘তা বিবাহকে (সাময়িক বিবাহকে) বৈধ করা, ওযুর সময় পদযুগল মাসেহ করা ইত্যাদি ধরনের নিকৃষ্ট কাজ, বিদ‘আত, সুস্পষ্ট ও মুতাওয়াতের পর্যায়ের গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা থেকে তাদেরকে বিরত রাখার তাওফিক দান করেছেন; তাঁর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমি তাঁর সম্মানিত ঘর বাইতুল্লাহ্র হজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
আর এই কাহিনীর সারসংক্ষেপ হল, যখন পারসিক রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ল এবং আফগান রাষ্ট্র তাদের ইস্পাহান রাজ্য দখল করে নিল [আর এই ঘটনা ঘটেছিল ১১৩৫ হিজরিতে কালযাবী গোত্রের আমীর মাহমুদ আফগানীর হাতে; আর সে ছিল আমীর উয়াইসের পুত্র। আর তারা ছিল মূলত: কান্দাহার এলাকার। তার জীবনীর জন্য দ্রষ্টব্য— আল-দীন, সামী বেগ ( الدين سامي بك ), পৃ. ৪২২২]; আর ওসমানী রাজবংশও -আল্লাহ তাদের রাষ্ট্রকে তৌফিক দিয়ে সাহায্য করুন- তারাও কিছু এলাকার মালিক হল। আর এই ঘটনা ঘটেছিল আফগানগণ কর্তৃক ‘শাহ হোসাইন’ নিহত হওয়ার পর। অতঃপর তার ছেলে তহমাসেব আত্মপ্রকাশ করল হত্যা ও অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য; ফলে তার চতুষ্পাশে অবস্থানরত পারসিকগণ ঐক্যবদ্ধ হল। অবশেষে তাকে ঘিরে একত্রিত হল বহু জনগণ, যাদের মধ্যে নাদির শাহও ছিল।
তহমাসেব প্রজাদের বিষয়াদি নিয়ে খুব কমই চিন্তা-ভাবনা করত; সে মদ পানেই মত্ত থাকত। ফলে নাদির শাহ তার খুব কাছের মানুষে পরিণত হল; এমনকি এক পর্যায়ে সে হয়ে গেল তার শাসন ক্ষমতার একমাত্র অবলম্বন [অর্থাৎ তার উযির। আর তাদের পরিভাষা ছিল যে, তারা উযিরকে ‘রাষ্ট্রের অবলম্বন’ ( اعتماد الدولة ) উপাধিতে ভূষিত করত।] (উযির) এবং সে তার ক্ষমতার যাবতীয় বিষয় তার নিকট অর্পণ করল।
অতঃপর এই নাদির শাহ রাজ্যসমূহ উদ্ধার করতে শুরু করল; আর তারই ধারাবাহিকতায় আফগানের হাত থেকে ইস্ফাহানকে উদ্ধার করল এবং তাদেরকে বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত করল। অতঃপর তাকে ‘তহমাসেব কুলী’ উপাধিতে ভূষিত করা হল; যার অর্থ হল ‘তহমাসেবের গোলাম’। আর এই উপাধি তার উপর এমন প্রাধান্য বিস্তার করল যে, তাকে তার প্রথম বা পূর্ব নামে চেনা যেত না।
অতঃপর তার চিন্তা ও পরিকল্পনার ব্যাপ্তি সম্প্রসারিত হল ওসমানী সম্রাজ্যের হাতে নিয়ন্ত্রিত রাজ্যসমূহের দিকে; সেগুলোকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য এবং যথারীতি সে বাগদাদকে অবরুদ্ধ করার জন্য এক বড় ধরনের সৈন্য সমাবেশ করল; আর তখন বাগদাদের শাসনকর্তা ছিলেন উযিরে আযম ফিল্ড মার্শাল ওসমানী রাষ্ট্রের ডান হাত উযিরের পুত্র উযির মরহুম হাসান পাশা’র ছেলে আহমদ পাশা। আর উল্লেখিত উযির এই বহিরাগত বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করতে আদিষ্ট ছিলেন না; বরং তিনি আদিষ্ট ছিলেন কিল্লা’র অভ্যন্তরীণভাগ হেফাযত করার জন্য। এমনকি তার পাগড়ি যদি দেয়ালের বাইরেও পড়ে যেত, তবে তিনি তা উদ্ধারের জন্য বের হতেন না! আর তার সাথে ছিলেন তিন উযির: কুরা মুস্তফা পাশা, সারি মুস্তফা পাশা ও জামাল উগলী আহমদ পাশা।
এই বিদ্রোহী বাগদাদকে আট মাস যাবত অবরুদ্ধ করে রাখে; এমনকি শেষ পর্যন্ত তাদের খাদ্যসম্ভার শেষ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা ঘোড়া ও গাধার মাংস ভক্ষণ করে, এমনকি তারা বিড়াল ও কুকুরের মাংসও ভক্ষণ করেছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে বাগদাদ থেকে হটিয়ে দিলেন এবং তার থেকে বাগদাদকে উদ্ধার করলেন। আর তা সম্ভব হয়েছে এইভাবে যে, ওসমানী সম্প্রদায় তার বিরুদ্ধে টবাল ওসমান পাশার নেতৃত্বে সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করল; অতঃপর তিনি বাগদাদমুখী হলেন। এক পর্যায়ে তিনি ‘তহমাসেব কুলী’সহ পারসিক সৈন্যগণকে পরাজিত করলেন এবং তাদেরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলেন; কিন্তু তা সম্ভব হয়েছে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর।
অতঃপর সে (নাদির শাহ) পরাজয় ও পতনের পরে দ্বিতীয় বারের মত আগমন করে এবং বাগদাদকে অবরুদ্ধ করে ফেলে; আর তখনও বাগদাদের প্রশাসনিক প্রধান বা উযির ছিলেন আহমদ পাশা। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার থেকে বাগদাদকে মুক্ত করেছেন।
অতঃপর সে (নাদির শাহ) মনোযোগ দিল রোমের ‘আরযন রোম’ এর প্রতি; আল্লাহ তা‘আলা তার থেকে রোমকেও মুক্ত করেছেন। আর সে যখন ‘মাগান’ নামক মরুভূমিতে ফিরে এল, তখন পারসিকগণ তার নিকট তার ব্যবস্থাপনায় রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে বায়‘আত গ্রহণ করে। আর সেই বায়‘আতের তারিখ ও শ্লোগান ছিল “যা ঘটেছে তার মধ্যে কল্যাণ” সন ১১৪৮ হি.। আর যে ব্যক্তি তার এই বায়‘আতের ব্যাপারে সম্মত ছিল না, সে ব্যক্তি উল্লেখিত তারিখ ও শ্লোগানকে পরিবর্তন করেছে এবং বলেছে: “যা ঘটেছে তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই”; আর তাও একই তারিখে হয়েছে, অর্থাৎ ১১৪৮ হিজরিতে।
অতঃপর সে (নাদির শাহ) মনোযোগ দিল ভারত অভিযানের দিকে; আর সেই দেশে তার অভিযান চলতে থাকে ভারত রাজ্যের (বর্তমান পাকিস্তানের) করাচী’র ‘জাহানাবাদ’ দখল করা পর্যন্ত। অনেক সংঘর্ষের পর সে তার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। অতঃপর সে সেখানকার (ভারতের) বাদশা শাহ মুহাম্মদের সাথে সন্ধি করে এবং ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ গ্রহণ করে যা গণনার বাইরে এবং শাহ মুহাম্মদের উপর নির্ধারিত অংক ও শ্রেণীর মালামাল বার্ষিক কর হিসেবে ধার্য করে। অতঃপর সে ভারত ত্যাগ করে এবং তুর্কিস্তান অভিযানের দিকে মনোযোগ দেয় এবং বলখ ও বুখারার উপর কর্তৃত্ব লাভ করে।
মোটকথা আফগান, তুর্কিস্তান ও সমগ্র ইরানের অধিবাসীগণ তার বশ্যতা স্বীকার করে। আর পারসিকদের ধারণা যে, ভারতের অধিবাসী ও তাদের শাসক শাহ মুহাম্মদসহ সকলেই তার নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেছে। আর শাহ মুহাম্মদ হলেন তার উকিল বা প্রতিনিধি। আর এই জন্যই তিনি নিজেকে শাহানশাহ উপাধিতে ভূষিত করেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে যেন এই নাম ব্যতীত অন্য কোন নামে ডাকা না হয়; আর যে ব্যক্তি তার ব্যাপারে এই নাম ব্যতীত অন্য কোন নাম ব্যবহার করবে, তাকে সে সতর্ক করে দিয়েছে।
অতঃপর সে (নাদির শাহ) স্থিতি ও স্থায়িত্বের উদ্দেশ্যে মনোযোগ দিল দাগিস্তান অভিযানের দিকে; আর সেই সময়ের মধ্যে তার দুতগণের মাধ্যমে সে সার্বক্ষণিক ওসমানী রাষ্ট্রের খোজ-খবর রাখত। একবার সে তাদের নিকট থেকে রুহা সীমানা থেকে আব্বাদান অঞ্চলের খোঁজ-খবর নিত; তার এই রাজ্যটি তৈমুরের পক্ষ থেকে ওয়ারিস হিসেবে প্রাপ্ত বলে ধারণা করা হত। কারণ, সে দাবি করত যে, সেই তার (তৈমুরের) ওয়ারিস। আর সে তাদের নিকট এই স্বীকৃতিও তলব করত যে, এখন যে শী‘আ মাযহাবের উপর তারা প্রতিষ্ঠিত, তা হল জাফর সাদিকের মাযহাব এবং তা হক (সত্য)! আর তারা বলে: ইসলামের মাযহাব পাঁচটি। আর সে তার (জাফর সাদিকের) জন্য পবিত্র কাবা ঘরে পঞ্চম স্তম্ভের দাবি করে! সে আরও দাবি করে যে, সে যুবাইদার পথ থেকে হজের রাস্তা শুরু করবে এবং কুপ, জলাশয় বা চৌবাচ্চাসমূহ ইত্যাদি সংস্কার করবে। আর সে এও দাবি করে যে, সে হবে হাজিদের আমীর। আর যখন সে ইরাকের পথে বের হবে, তখন একজন আগে আগে গিয়ে জনগণকে সরিয়ে দেবে এবং ঠিক একই নিয়মে সে ফিরে আসবে!!
তার জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এই চেষ্টা-সাধনার মিশন অবিরাম চলতে থাকে। এমনকি সে ইরাকীদের অধিকাংশ এলাকা ধ্বংস করে দেয়। আর সেখানে বিশৃঙ্খলা চলছিল ১১৫৬ হিজরি পর্যন্ত। অতঃপর আরবগণ যুদ্ধের সরঞ্জামাদিসহ বিশাল বাহিনী নিয়ে ইরাকে আগমন করল এবং বহু দলে বিভক্ত হয়ে ঐ ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ল। বাগদাদ অবরোধ করে রাখার জন্য প্রায় সত্তর হাজার সৈন্য রেখে দেয়া হল; আর বসরা অবরোধ করে রাখার জন্য প্রায় নব্বই হাজার সৈন্য প্রেরণ করা হল। অতঃপর তারা তাকে ছয় মাস যাবত অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তবে তারা বসরাবাসীকে কামান ও বন্দুক দ্বারা আঘাত করেছিল। আর বাগদাদ অবরোধের ক্ষেত্রে তারা তার থেকে প্রায় এক ফরসখ দূরে ছিল; আর অবরোধের ধরন ছিল সেখানকার প্রধান প্রশাসক আহদম পাশা’র সাথে দেন-দরবারের মাধ্যমে।
আর নাদির শাহ ও তার বাকি সৈন্যগণ মনোযোগ দিল ‘শাহারযুর’ অভিযানের দিকে; সেখানকার অধিবাসীগণ তার বশ্যতা স্বীকার করল। অনুরূপভাবে অপরাপর সকল কুর্দি ও আরবগণও তার বশ্যতা স্বীকার করল। অতঃপর সে ‘কিরকুক কেল্লা’-র দিকে অভিযান পরিচালনা করল এবং তা আট দিন অবরুদ্ধ করে রাখল; ঐ বার সে তার উপর বিশ হাজার বার কামান হামলা করেছে এবং তার সমসংখ্যক বার বোমা হামলাও করেছে। ফলে তারা আত্মসমর্পন করেছে এবং তার বশ্যতা স্বীকার করেছে। অতঃপর সে ইরবেলের দিকে অভিযান পরিচালনা করে; তাতে তার অধিবাসীগণ তার নিকট আত্মসমর্পন করেছে এবং তার বশ্যতা স্বীকার করেছে।
অতঃপর সে মসুলের দিকে অভিযান পরিচালনা করে এমতাবস্থায় যে, তার সাথে প্রায় দুই লক্ষ যোদ্ধা ছিল। সে সাত দিন ধরে তার অধিবাসীদের উপর প্রায় চল্লিশ হাজার বার কামানের গোলা বর্ষণ করেছে এবং তার সমসংখ্যক বার বোমা হামলাও করেছে। অতঃপর তার অধিবাসীগণ তাদের যাবতীয় বিষয়াদি হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলার নিকট ন্যস্ত করে; অতঃপর সে বিস্ফোরকের জন্য গর্ত খনন করে এবং তা বারুদ ও সীসা দ্বারা ভর্তি করে। একপর্যায়ে তাতে সে আগুন জ্বালিয়ে দেয়; ফলে তা তার জন্য শোচনীয় পরিণতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর সে যখন উপলব্ধি করতে পারল যে, সে দীর্ঘকাল ব্যয় করেও সেখানে সফলতা অর্জন করতে পারবে না, তখন সে সেখান থেকে প্রস্থান করল এবং তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে বাগদাদ অভিমুখে রওয়ানা দিল; অতঃপর সে আমগমন করল এবং সাইয়্যিদুনা মূসা ইবন জাফরের এলাকায় (নগরে) [বর্তমানে এই এলাকাকে ‘আল-কাযেমীয়া’ নামে নামকরণ করা হয়।] অবতরণ করল। অতঃপর সে তার মূসা ইবন জাফর ও মুহাম্মদ আল-জাওয়াদের কবর যিয়ারত করল। অতঃপর কাছাকাছি সময়ে সে দাজলা নদী অতিক্রম করে ইমাম আবূ হানিফা রহেমাহুল্লাহু তা‘আল’র কবর যিয়ারত করে [বর্তমানে ইমাম আবূ হানিফা রহেমাহুল্লাহু তা‘আল’র কবরের স্থানকে ‘আল-‘আজমীয়া’ নামে নামকরণ করা হয়।]।
আর দূতগণ সার্বক্ষণিক তার ও আহমদ পাশাকে নিয়ে মতবিরোধ করতে থাকে যে, সে (আহমদ পাশা) শী‘আ মাযহাবের বিশুদ্ধতার পক্ষে দেয়া মতামতের দাবি প্রত্যাহার করে নিয়েছে! আর শী‘আ মাযহাবই জাফর সাদিকের মাযহাব- এই বিশ্বাসও প্রত্যাহার করে নিয়েছে! অতঃপর সে ইমাম আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র যিয়ারতের উদ্দেশ্যে নাজাফ অভিমুখে রওয়ানা দিল; আরও উদ্দেশ্য ছিল যাতে সে স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত গম্বুজটি দেখতে পাবে।
সুতরাং সাওয়াল মাসের একুশ তারিখ রবিবার মাগরিবের পূর্ব মুহূর্তে আমি বসা ছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে উজির আহমদ পাশা’র এক দূত এসে আমাকে তার নিকট ডাকল। অতঃপর আমি মাগরিবের নামাযের পর গেলাম এবং প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করলাম; অতঃপর আমার দিকে তার (আহমদ আগা’র) কতিপয় অন্তরঙ্গ বন্ধু ও বিনোদন সঙ্গী বের হয়ে আসল। অতঃপর সে (আহমদ আগা) বলল:
কেন আপনাকে তলব করা হয়েছে, তা কি আপনি জানেন?
আমি বললাম: না
সে বলল: পাশা চাচ্ছেন আপনাকে নাদির শাহ’র নিকট পাঠাতে!
আমি বললাম: কী জন্য?
সে বলল: নিশ্চয় সে (অর্থাৎ নাদির শাহ) আলেমদের সাথে এমন একজন আলেমকে চাচ্ছে যিনি শী‘আ মাযহাবের অবস্থা নিয়ে পারসিকদের সাথে আলোচনা করবেন এবং তা বাতিল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে দলিল পেশ করবেন; আর পারসিকগণ তার বিশুদ্ধতার উপর দলিল পেশ করবে। সুতরাং আমাদের আলেম [অর্থাৎ— আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেম।] যদি পরাজিত হয়, তবে সে পঞ্চম মাযহাবকে [অর্থাৎ— আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেম পঞ্চম মাযহাবকে স্বীকৃতি দিবে ও সত্য বলে মেনে নেবে ।] স্বীকৃতি দিতে ও মেনে নিতে বাধ্য হবে!!
এই কথা যখন আমার কানে ধাক্কা দিল, তখন আমার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল এবং আমার মাংসপেশীগুলো কেঁপে উঠল; আর আমি বললাম:
হে আহমদ আগা! তুমি জান যে, রাফেযীগণ একগুঁয়ে ও অহঙ্কারী সম্প্রদায়! তারা কিভাবে আমার কথা মেনে নেবে?! আর বিশেষ করে তারা তারা অন্ধ বিশ্বাসের পেরেকে আবদ্ধ ও সংখ্যায় অধিক। আর এই শাহ হল যালিম, অন্যায়কারী ও অত্যাচারী। সুতরাং কিভাবে আমি তার মাযহাবকে বাতিল ও তার রায়কে মূর্খতা ও বোকামী বলার দুঃসাহস করি?! আবার কিভাবেই বা তাদের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে, অথচ তারা আমাদের মতের স্বপক্ষের সকল হাদিসকে অস্বীকার করে; তারা হাদিসের ছয়টি প্রসিদ্ধ কিতাবসহ হাদিসের অন্যান্য কিতাবের বিশুদ্ধতার কথা স্বীকার করে না। আর তারা প্রত্যেকটি আয়াতকে তাবীল তথা অপব্যাখ্যা করে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে এবং বলে: দলিল যখন সন্দেহযুক্ত হয়, তখন তার দ্বারা দলিল দেয়ার উপযুক্ততা বাতিল বলে গণ্য হয়, যেমন তারা বলে থাকে: দলিল হওয়ার পূর্ব শর্ত হল তার উপর তার্কিক তথা বিবাদকারীগণ ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ইজতিহাদী (গবেষণামূলক) বিষয়গুলো ধারণার ফায়দা দেয়, সুতরাং কিভাবে আমি তাদের নিকট মোজা’র উপর মাসেহের বৈধতা প্রমাণ করব, অথচ তা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত? অতএব আমি যদি বলি: মোজা’র উপর মাসেহের হাদিস বর্ণনা করেছেন প্রায় সত্তরজন সাহাবী যাঁদের মধ্যে আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুও একজন, তখন তারা বলবে: আমাদের নিকট মোজা’র উপর মাসেহের অবৈধতা প্রমাণিত একশতেরও বেশি সাহাবী’র বর্ণনা দ্বারা যাঁদের মধ্যে আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা রয়েছেন! আর আমি যদি বলি: তোমরা মোজা’র উপর মাসেহের অবৈধতার ব্যাপারে প্রমাণ স্বরূপ যেসব হাদিস পেশ করেছ সেগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট! তখন তারা বলবে: অনুরূপভাবে তোমরাও মোজা’র উপর মাসেহের বৈধতার ব্যাপারে প্রমাণ স্বরূপ যেসব হাদিস পেশ করেছ সেগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট! সুতরাং যা তাদের জওয়াব, তাই আমাদের জওয়াব! অতএব এ ধরনের আলোচনার দ্বারা কী ফায়দা হবে?! সুতরাং উযির মহোদয়ের নিকট আমার প্রত্যাশা যে, তিনি আমাকে এ ধরনের কষ্টসাধ্য কাজ থেকে রুখসত দেবেন এবং এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি হানাফী অথবা শাফেয়ী মতাবলম্বী মুফতি প্রেরণ করবেন। কারণ, এ ধরনের আলোচনার জন্য তাঁরাই হবেন যথোপযুক্ত।
অতঃপর আহমদ আগা বলেন: এটা অসম্ভব, পাশা মহোদয় এই কাজের জন্য আপনাকেই মনোনীত করেছেন, সুতরাং আপনি তা মেনে নিবেন, আপনার পক্ষ থেকে এর ব্যতিক্রম কিছু তিনি চান না। অতএব তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনি টু শব্দটিও উচ্চারণ করবেন না।
আল-সুয়াইদী বলেন: অতঃপর আমি উযির আহমদ পাশা’র সাথে ঐ রাত্রের অব্যবহিত সকালে একত্রিত হলাম; সে আমার সঙ্গে এই বিষয় বা কাজের বিশেষত্ব নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা করল এবং সে বলল:
আমি আল্লাহ তা‘লার নিকট প্রার্থনা করছি যে, তিনি যেন আপনার দলিল-প্রমাণকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করেন এবং আপনার ভাষায় সঠিক বিষয়টি প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করে দেন। আলোচনা হওয়া না হওয়া আপনার ইচ্ছা ও স্বাধীনতার উপর নির্ভর করছে। তবে সম্পূর্ণভাবে আলোচনাকে পরিত্যাগ করবেন না; বরং আপনি তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত উপলক্ষে কিছু আলোচনা পেশ করুন যাতে পারসিকগণ জানতে পারে যে, আপনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। আর আপনি যদি তাদের পক্ষ থেকে ইনসাফের বিষয় উপলব্ধি করতে পারেন এবং তারাও সঠিক বিষয় প্রকাশের ইচ্ছা পোষণ করে, তবে আপনি তাদের সাথে আলোচনা করুন এবং আপনাকে তাদের নিকট পেশ করুন।
অতঃপর তিনি বলেন: শাহ নাজাফে আছেন। আর আমি চাচ্ছি আপনাকে বুধবার সকালে তার নিকট নিয়ে যাব। আর সে আমার জন্য গৌরবোজ্জল পোষাক, বাহন ও খাদেম নিয়ে আসল। আমার সাথে তার বাহনের খাদেমও পাঠিয়ে দিল। আর আমরা পারসিক দুতগণের মুখোমুখি হলাম যারা আমাদের খোঁজে এসেছেন।
অতঃপর আমরা সাওয়াল মাসের ২২ তারিখ সোমবার আসরের সালাতের পূর্বমুহূর্তে বের হলাম এবং পথিমধ্যে আমি উভয় পক্ষের দলিলসমূহ নিয়ে জলপনা-কল্পনা করতে থাকলাম; আর যখন প্রশ্ন উত্থাপন হবে, তখন তার জওয়াবসমূহ কেমন হবে তা নিয়ে ভাবতে লাগলাম!
আর এটা আমার সার্বক্ষণিক অভ্যাস ও স্বভাব-প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল, দলিলের কল্পনা ও সন্দেহ-সংশয় দূর করার চিন্তা-ভাবনা ছাড়া আর অন্য কোন চিন্তা আমার ছিল না; এমনকি আমি তাদের ধারণা ও সন্দেহ-সংশয়ের উপর ভিত্তি করে একশ’র অধিক দলিল-প্রমাণ কল্পনা করে ঠিক করে ফেলেছি! আর প্রতিটি দলিলকে কেন্দ্র করে একটি বা দুইটি বা তিনটি করে জওয়াবও ঠিক করেছি!
আর পথিমধ্যে আমি সঙ্কট ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি, এমনকি আমার প্রস্রাব তাজা রক্তে পরিণত হয়েছে। অতঃপর আমি দুবাইস ইবন মাযিদের সমাবেশস্থলে প্রবেশ করেছি; তখন তা ছিল পারসিকদের নিয়ন্ত্রণে। অতঃপর আমি সেখানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কতিপয় ব্যক্তির সাক্ষাত পেয়েছি; তারা আমাকে সংবাদ দিলেন যে, শাহ এই মাস‘আলা’র জন্য তার দেশের প্রত্যেক মুফতিকে একত্রিত করেছে; এখন পর্যন্ত তাদের (মুফতিদের) সংখ্যা পৌঁছেছে সত্তর জনে, যাদের প্রত্যেকেই রাফেযী!!
অতঃপর যখন আমি এই কথা শুনতে পেলাম, তখন আমি ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ এবং ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’ পড়লাম [অর্থাৎ- আমি বললাম: " لا حول و لا قوة إلا بالله " এবং " إنا لله و إنا إليه راجعون "]; আর মনে মনে আরও কিছু বাক্য আবৃত্তি করলাম এবং বললাম: আমি যদি মনে করি যে, আমি বাহাস বা আলোচনার জন্য আদিষ্ট হইনি, তবে এর দ্বারা আমার মন পরিতৃপ্ত হবে না। আর যদি তাদের সাথে আলোচনা করি, তবে আমি আশঙ্কা করি যে, তারা আমার ব্যাপারে বাস্তবতার বিপরীত কথা শাহের কানে পৌঁছাবে।
অতঃপর আমি আমার মত ও চিন্তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম যে, আমি শাহের অনুপস্থিতিতে তাদের সাথে আলোচনায় বসব না! আমি তাকে বললাম: আমার (বিতর্কমূলক) আলোচনার জন্যে এমন একজন অভিজ্ঞ বিচারকের প্রয়োজন রয়েছে, যিনি না হবেন সুন্নী, যাতে কেউ এই অপবাদ দিতে না পারে যে, তিনি আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন; আবার না হবেন শী‘আ, যাতে কেউ এই অপবাদও দিতে না পারে যে, তিনি তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তখন আমরা এমন এক আলেমের প্রয়োজন অনুভব করি, যিনি হয় ইহুদী হবেন, না হয় খ্রিষ্টান হবেন অথবা এমন এক ব্যক্তি হবেন, যিনি সুন্নী এবং শী‘আ নন! আর আমি তাকে বললাম: আমরা আপনাকে পছন্দের লোক মনে করি! আর আপনিই আমাদের মধ্যে বিচারকের ভূমিকা পালন করবেন; আর আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন আপনাকে জিজ্ঞাসা করবেন! সুতরাং আপনি আমাদের বক্তব্য শ্রবণ করুন, যাতে আপনার নিকট সত্য বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
অতঃপর আমি কল্পনা করলাম যে, যদি তার রায় তাদের পক্ষে চলে যায়, তখন আমি তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হব এবং তার সাথে আমার কথোপকথন হবে; যদিও তা আমার জীবন নাশের দিকে নিয়ে যায়! আর এই সব কিছুই চলছে আমার কল্পনার রাজ্যে।
অতঃপর আমি উল্লেখিত সমাবেশস্থল থেকে প্রতিশ্রুত বুধবার রাতের এশার নামাযের শেষ ওয়াক্তে বের হয়ে গেলাম; আর সে রাতটি ছিল হালকা বৃষ্টি আর কুয়শাচ্ছন্ন রাত্রি [ الدث শব্দের অর্থ: হালকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আরব ব্যক্তি বলেন: “আকাশ আমাদের উপর হালকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বর্ষণ করেছে; তাতে উৎকৃষ্ট জাতের ঘোড়া অসন্তুষ্ট এবং যা মুসাফিরকে কষ্ট দেয়”।]; মানুষ তার নিজের হাতটি পর্যন্ত দেখতে পায় না; আর তা ঐ রাতের চেয়ে কঠিন ভায়াবহ ও প্রচণ্ড শীতল, যার বর্ণনায় কবি বলেন:
“জমাট বাঁধা শিশিরে আচ্ছাদিত এমন এক রাত্রি
যার কোন প্রান্তে কুকুর দেখতে পায়না লম্বা-মোটা রশি”
অতঃপর আমরা ঐ রাতে ভ্রমণ করতে লাগলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ‘যূল কিফল’ এর কবর খ্যাত নামক স্থানে এসে পৌঁছালাম। আর তা হল সমাবেশস্থল ও নাজাফের মধ্যকার দূরত্বের অর্ধেক পথ। সুতরাং আমরা সীমানা প্রাচীরের বাইরে অবতরণ করলাম এবং সামান্য সময় বিশ্রাম নিলাম। অতঃপর আবার ভ্রমণ করলাম এবং ‘বিরে দানদান’ ( بئر دندان ) নামক স্থানের কাছে ফজরের নামায আদায় করলাম। অতঃপর হন্তদন্ত হয়ে শাহের দূত এসে আমাকে বলল:
আপনি দ্রুত চলুন! কারণ, এই সময়ের মধ্যেই শাহ আপনাকে আহ্বান করবেন। অথচ আমার এবং শাহের তাঁবু’র মধ্যকার দূরত্ব ছিল দুই ফরসখ। অতঃপর আমি দুতকে বললাম:
শাহের কেমন অভ্যাস, সে যখন তার রাজ্যের কারও নিকট দূত প্রেরণ করেন, তখন কি তাকে আমার মত রাস্তায় তলব করেন, না কি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, তারপর তলব করেন?
সে বলল: তিনি আপনাকে ব্যতীত আর কাউকে এভাবে রাস্তায় তলব করেন নি; আর তাছাড়া আপনাকে ব্যতীত আর কাউকে কোন দিন তলব করেন নি!
অতঃপর অন্ধকার কেটে গেল; আর আমি মনে মনে বললাম: শাহ তোমাকে এত দ্রুত এ জন্যই তলব করেছে যে, সে ইমামীয়া মাযহাবের স্বীকৃতি ও সত্যায়ণের শর্তে তোমাকে আশ্রয় দেবেন ও রক্ষা করবেন। সুতরাং তুমি যদি তার আহ্বানে সাড়া দাও, তবে সে তোমাকে সম্পদের প্রলোভন দেখাবে; অন্যথায় সে এই কাজে তোমাকে বাধ্য করবে! সুতরাং তোমার অভিমত কী?! অতএব, আমি এই পথে বের হয়েছি এই শর্তে যে, আমি হক কথা বলব, তাতে আমার জীবন যদি ধ্বংস হয়ে যায় যাক; কোন প্রলোভন আমাকে নত করতে পারবে না এবং কোন ভয়-ভীতি আমাকে টলাতে পারবে না!
আর আমি বললাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দিন ইন্তিকাল করেছেন, সেদিন ইসলামের অগ্রযাত্রা থেমে গিয়েছিল; অতঃপর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কারণে তা আবার চলতে শুরু করে। “আল-কুরআন সৃষ্ট”— এই কথার বেড়াজালে দ্বিতীয় বারের মত আবার তার অগ্রযাত্রা থেমে গেল; অতঃপর আহমদ ইবন হাম্বল র.-এর কারণে তা আবার অগ্রসর হতে শুরু করে। আর আজকের এই দিনে ইসলামের অগ্রযাত্রা তৃতীয় বারের মত থেমে গেল; সুতরাং যদি আমি তার অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেই, তবে তার যাত্রা চিরদিনের জন্য থেমে যাবে। এর থেকে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই, আর যদি অগ্রসর করতে পারি, তবে তা চিরদিন অগ্রসরমান থাকবে; সুতরাং তার চলা থেমে যাওয়া এবং চলমান থাকা তার অনুসারীদের থেমে যাওয়া ও চলমান থাকার উপর নির্ভরশীল। আর সন্দেহ নেই যে, ঐ শ্রেণীর লোকদের নিকট এই ফকিরের ব্যাপারে সুপ্রসিদ্ধ উত্তম ধারণা রয়েছে; সুতরাং তারা আমার ব্যাপারে বিশ্বাস করে যে, নিশ্চয় তারা নিকট ভাল ভালই; আর মন্দ মন্দই।
অতঃপর আমি আমার নিয়তকে সুদৃঢ় করলাম, আমার অন্তরকে ভাল করলাম এবং মৃত্যুর জন্য আমার মনকে প্রস্তুত করলাম, এমনকি তাকে আমি সহজ-সরল মনে করলাম এবং আমি বললাম: আমি বিশ্বাস স্থাপন করেছি আল্লাহ’র প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি এবং পরকালের প্রতি; আমি আরও বিশ্বাস করি যে, তাকদীরের ভাল ও মন্দ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আর আমি আমার বাহনকে তাড়া করছি আর বার বার শাহাদাতাইন পাঠ করছি। অতঃপর লম্বা খেজুর বৃক্ষের মত বড় সুউচ্চ দু’টি নিশানা দেখা গেল; আমি এতদুভয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমাকে বলা হল: এই দু’টি হল শাহের নিশানা বা নিদর্শন, যেগুলো সে পুঁতে রেখেছে যাতে সৈন্য বাহিনী’র শীর্ষস্থানীয় সৈনিকগণ তাদের তাঁবু বা শিবিরে অবতরণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারে। কারণ, তাদের মধ্য থেকে এমন কেউ কেউ রয়েছে, যারা অবতরণ করবে দুই নিশানা’র ডান পাশ দিয়ে; আবার এমন কেউ কেউ রয়েছে, যারা অবতরণ করবে দুই নিশানা’র বাম পাশ দিয়ে ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
অতঃপর আমরা সফর করতে করতে তাঁবুসমূহ দেখতে পেলাম; আর তার তাঁবুটি ছিল বড় বড় সুউচ্চ সাতটি খুঁটি দ্বারা তৈরি। অতঃপর আমরা তাদের নিকট ‘কাশক খানা’ নামে পরিচিত মহলে এসে হাজির হলাম। আর তা হল সামনা সামনি এমন কতগুলো তাঁবু যার প্রত্যেক পাশে রয়েছে গম্বুজ আকৃতির পনেরটি করে তাঁবু; যাতে রয়েছে একটি প্রাসাদ বা হলঘর, কিন্তু তাতে খুঁটি নেই। শাহের তাঁবুর সাথে সংযুক্ত তাঁবুসমূহের একবারে মাথার তাঁবুর সাথে সংযুক্ত রয়েছে একটি বারান্দা বা করিডোর, তার মাঝখানে রয়েছে একটি দরজা, তার উপর রয়েছে একটি পর্দা; আর ডান পাশের তাঁবুসমূহের মধ্যে রয়েছে প্রায় চার হাজার বন্দুকধারী যারা রাতে এবং দিনে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে; আর বাম পাশটি উম্মুক্ত তাতে রয়েছে কতগুলো অনির্ধারিত আসন।
অতঃপর আমি যখন ‘কাশক খানা’-এর নিকটবর্তী হলাম, তখন অবতরণ করলাম; অতঃপর আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এক ব্যক্তি বের হয়ে আসল এবং আমাকে অভিবাদন ও সম্মান জানাল। আর সে আমাকে পাশা ও তার বিশেষ অনুসারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে লাগল; আর পাশা’র অনুসারীদের ব্যাপারে তার এত বেশি জানা-শুনার কারণে আমি অবাক হতে লাগলাম। অতঃপর সে যখন আমার নিকট থেকে তা জানতে পারল, তখন বলল:
মনে হচ্ছে যেন আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না!
আমি বললাম: হ্যাঁ।
অতঃপর সে বলল: আমি আবদুল করীম বেগ। এক সময় আহমদ পাশা’র দরবারের খাদেম ছিলাম। এই কতদিন হল আমাকে ইরানী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দূত হিসেবে ওসমানী রাষ্ট্রে প্রেরণ করা হল।
সুতরাং সে যখন আমার সাথে আলাপ-আলোচনা করছিল, ঠিক তখনই আমাদের নিকট নয় ব্যক্তি আগমন করল। অতঃপর তার নজর যখন তাদের উপর পড়ল, তখন সে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে গেল; অতঃপর তারা আমাকে সালাম পেশ করল, আর আমিও তাদের প্রতি সালাম পেশ করলাম এমতাবস্থায় যে, আমি বসা, তাদের কাউকে চিনি না। অতঃপর আবদুল করীম আমাকে একে একে তাদের সবাইকে পরিচয় করে দিতে শুরু করল এবং আমাকে বলল:
এই হলেন রাজ্যসমূহের মানদণ্ড হাসান খান। আর ওনি হলেন মুস্তফা খান। আর ওনি হলেন নজর আলী খান। আর ওনি হলেন মির্জা কাফী।
অতঃপর আমি যখন ‘রাজ্যসমূহের মানদণ্ড’ ( معيار الممالك )-এর কথা শুনতে পেলাম, তখনই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম; অতঃপর সে এবং তার সঙ্গীগণ আমার সাথে মুসাহাফা (করমর্দন) করল এবং আমাকে অভিবাদন জানাল। আর ‘রাজ্যসমূহের মানদণ্ড’ ( معيار الممالك ) হল শাহের উযির, কুরজির অধিবাসী ও শাহ হোসাইনের দাস।
অতঃপর তারা আমাকে বলল: অনুগ্রহ করে শাহের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য চলুন।
অতঃপর তারা বারান্দার মাঝখানের পর্দাটি উঠাল; অতঃপর তার পিছনে অপর আরও একটি বারান্দা এবং উভয়ের মধ্যকার প্রশস্ততা হল তিন গজ; সেখানে নিয়ে তারা আমাকে দাঁড় করাল এবং বলল:
যখন আমরা থামব, তখন আপনি থামবেন; আর যখন আমরা হাঁটব, তখন আপনিও হাঁটবেন?
অতঃপর আমরা বাম দিক থেকে চলতে শুরু করলাম এবং বারান্দা অতিক্রম শেষ হয়ে গেল; আর তখন দেখা গেল এক প্রশস্ত আবরণ (পর্দা) যার দ্বারা করিডোর বা গ্যালারীকে ঘিরে রাখা হয়েছে, যা দূর থেকে দেখা যায়; আর তার মধ্যে রয়েছে তার স্ত্রীদের জন্য অনেকগুলো তাঁবু। অতঃপর আমি শাহের তাঁবু’র দিকে লক্ষ্য করলাম; আর সে আমার নিকট থেকে একটি তীর নিক্ষেপ করার মত জায়গা পরিমাণ (তিনশত থেকে চারশত গজ পরিমাণ) দূরত্বে একটি উঁচু চেয়ারে বসে আছে। অতঃপর যখন আমার উপর তার নজর পড়ল, তখন সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল:
আবদুল্লাহ আফেনদিকে স্বাগতম! আমাকে আহমদ খান (অর্থাৎ আহমদ পাশা) সংবাদ দিয়েছে, সে বলেছে: আমি আপনার নিকট আবদুল্লাহ আফেনদিকে প্রেরণ করেছি।
অতঃপর সে আমাকে বলল: সামনে অগ্রসর হউন!
অতঃপর আমি প্রথম বারের মত সামনে অগ্রসর হলাম এবং থেমে গেলাম। সে আমাকে বলতে লাগল “সামনে অগ্রসর হউন!” আর আমি ছোট ছোট কদমে সামনে অগ্রসর হতে থাকলাম; শেষ পর্যন্ত আমি তার প্রায় পাঁচ গজ কাছাকাছি হয়ে গেলাম; অতঃপর আমি লম্বা এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যা তার বসা থেকেই বুঝা যাচ্ছিল এবং তার মাথায় রয়েছে পারসিকদের টুপির ন্যায় একটি সাদা চৌকা টুপি, আর তার উপরে রয়েছে মণি-মুক্তা, ইয়াকুত, হিরক ও সকল প্রকার অলঙ্কার খচিত পাগড়ি; আর তার গলায় রয়েছে মণি-মুক্তা’র একাধিক মালা এবং তার বাহুতেও অনুরূপ। আর মণি-মুক্তা, হিরক ও ইয়াকুত খচিত কাপড়ের টুকরা বেঁধে রাখা হয়েছে তার বাহুতে। আর তার চেহারায় বার্ধক্য ও বেশি বয়সের ছাপ প্রকাশ পাচ্ছিল; এমনকি তার সামনের সারির দাঁতগুলো পড়ে গেছে। অতএব সে প্রায় আশি বছর বয়সের ব্যক্তি; তার দাড়িগুলো কালো কলপ করা, কিন্তু সুন্দর; তার আরও রয়েছে দু’টি ভাজ পড়া ভ্রু এবং আরও আছে হালকা পীতবর্ণের কিন্ত সুন্দর দু’টি চোখ। মোটকথা তার চেহারা-ছবি খুবই সুন্দর।
সুতরাং যখন তার উপর আমার দৃষ্টি পড়ল, তখন আমার মন থেকে তার ভয় দূর হয়ে গেল। অতঃপর সে আমাকে তুর্কমেনিস্তানীয় ভাষায় (প্রথম বারের সম্বোধনের ন্যায়) সম্বোধন করল এবং আমাকে বলল:
আহমদ খানের অবস্থা কেমন?
অতঃপর আমি বললাম: ভাল ও উত্তম।
অতঃপর সে বলল: আপনি কি জানেন কেন আমি আপনাকে আহ্বান করেছি?
আমি বললাম: না!
অতঃপর সে বলল: আমার রাজ্য দু’টি ভাগে বিভক্ত: তুর্কিস্তান ও আফগান, তারা ইরানীদেরকে বলে: “তোমরা কাফির”। কুফর খুব মন্দ জিনিস! আমার রাজ্যে এটা শোভনীয় নয় যে, এক দল আরেক দলকে কাফির বলবে! এখন আমি আপনাকে আমার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি (উকিল) মনোনীত করছি, যাতে আপনি কুফর সংক্রান্ত সকল অপবাদ দূর করতে পারেন এবং তৃতীয় আরেকটি দলের পক্ষে অভিমত পেশ করবেন, যা তারা গ্রহণ করবে। আর আপনি যা কিছু দেখবেন অথবা শুনবেন, তা আমাকে জানাবেন এবং আহমদ খানের নিকট পৌঁছাবেন।
অতঃপর তিনি আমাকে বের হওয়ার সুযোগ করে দিলেন এবং আদেশ করলেন যে, আপনি আমার অতিথি কক্ষে রাষ্ট্রের উযিরের নিকট অবস্থান করুন; আরও আদেশ করলেন, যাতে আমি যোহরের নামাযের পর মোল্লা বাশী আলী আকবরের সঙ্গে একত্রিত হই।
অতঃপর আমি সেখান থেকে বের হলাম এমতাবস্থায় যে, আমি অত্যন্ত খুশি ও আনন্দিত। কারণ, পারসিকদের বিচারক আমার হাতে। আমি অতিথি কক্ষে আসলাম এবং কিছুক্ষণ বসলাম; অতঃপর উযির তার তাঁবু’র দিকে আসল এবং আমাকে খাবার গ্রহণের জন্য ডাকল। আর মেহমানদার ছিলেন নজর আলী খান এবং তার সহযোগিতায় ছিলেন আবদুল করীম বেগ ও আবূ যর বেগ। আর তারা সকলেই ছিলেন আমার খেদমতে নিয়োজিত।
অতঃপর আমি যখন উযিরের নিকট আগমন করলাম এবং তাকে সালাম পেশ করলাম, তখন জবাবস্বরূপ বসা অবস্থায় সে আমাকে সালাম দিল; আমার মনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হল যে, সে দাঁড়ায়নি কেন। অতঃপর আমি মনে মনে বললাম: আমাকে যখন বসতে দেয়া হবে, তখন আমি উযিরকে বলব: নিশ্চয় শাহ আদেশ করেছেন সকল কুফরি দূর করতে এবং এ জন্য সে আমাকে উকিল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে; সুতরাং আমি যে কুফরী দূর করব, তা হল তোমার থেকে প্রকাশিত কুফরী, কেননা তুমি আলেমদেরকে তুচ্ছ ও অপমান করার ইচ্ছা করেছ! আর তোমাকে হত্যা করে তা দূর করতে পারলেই খুশি হব!! অতঃপর আমি তার মজলিস থেকে উঠে শাহের নিকট গিয়ে পুরা ঘটনাটা তাকে বলব। আর এই সবটাই আমার মনের কল্পনা।
অতঃপর আমি যখন বসলাম, তখন সে দাঁড়াল এবং আমাকে অভিবাদন (মারহাবা) জানাল। আর সে হল খুব লম্বা ও ফর্সা মানুষ, চোখ দু’টি বড় বড় ও কলপ লাগানো দাড়ি; তবে সে বুদ্ধিমান লোক সকল কথপোকথন ও আলাপ-আলোচনা বুঝতে ও অনুধাবন করতে পারে। স্বভাবে সে নরম প্রকৃতির এবং চিন্তা-চেতনায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ঘেষা। যখন সে দাঁড়াল, তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, তাদের অভ্যাস হচ্ছে আগন্তুক ব্যক্তি বসার পর তারা দাঁড়ায়। অতঃপর তার নিকটে দুপরের খাবার খেলাম; অতঃপর মোল্লা বাশী’র সাথে সাক্ষাত কারার জন্য আমাদের নিকট ফরমান আসল। অতঃপর আমি আমার বাহনে আরোহন করলাম, আর মেহমানদারগণ আমার সামনে সামনে হাঁটতে লাগল। অতঃপর পথিমধ্যে লম্বা এক ব্যক্তি আমার থেকে সরে পড়ল, যার পোষাক আফগানের পোষাকের মত; অতঃপর সে আমাকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানাল। অতঃপর আমি তাকে বললাম:
তুমি কে?
অতঃপর সে বলল: আমি আফগান মুফতী মোল্লা হামযা আল-কালানজানী।
অতঃপর আমি বললাম: হে মোল্লা হামযা! তুমি কি আরবিতে ভাল পারদর্শী?
সে বলল: হ্যাঁ।
অতঃপর আমি বললাম: নিশ্চয় শাহ আদেশ করেছে ইরানীদের নিকট প্রত্যেক কাফের ফতোয়া দানকারীকে প্রত্যাহার করে নিতে। তারা কখনও কখনও কুফরী বিষয়ে আমার সাথে বিতর্ক করে; অথবা তারা কুফরী বিষয়ের কিছু কিছু দিক উল্লেখ করে না; আর আমরা তাদের অবস্থা জানতে পারি না এবং তাদের ইবাদত সম্পর্কেও জানতে পারি না। ফলে আমি তার কুফরী’র বিষয়ে উপলব্ধি করতে পারি না, যাতে তাকে তা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি, এমনকি তা দূর করতে পারি।
অতঃপর সে বলল: হে আমার গুরু! শাহের কথা দ্বারা প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকবেন। সে তো শুধু আপনাকে মোল্লা বাশী’র নিকট পাঠিয়েছে যাতে সে কথার মাঝে ও আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে আপনার সাথে আলোচনা করে নিতে পারে; সুতরাং আপনি তাদের থেকে সতর্ক থাকুন!
অতঃপর আমি বললাম: আমি তাদের বেইনসাফী’র আশঙ্কা করি।
সে বলল: আপনি তা থেকে নিরাপদ থাকুন; কারণ, শাহ এই মজলিসে গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে এবং এক গোয়েন্দার উপর আরেক গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে; অতঃপর আরেক গোয়েন্দার উপর আরেক গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে। আর গোয়েন্দাদের প্রত্যেকেই একজনের অবস্থা সম্পর্কে অপরজন কিছুই জানে না; সুতরাং শাহের নিকট অবাস্তব কিছু পৌঁছাবে না।
অতঃপর আমি যখন মোল্লা বাশী’র তাঁবুর নিকটবর্তী হলাম, তখন সে আমাকে স্বাগতম জানানোর জন্য পায়ে হেঁটে বের হয়ে আসল; আর সে হল খাটো আকৃতি ও ধূসর বর্ণের লোক, তার মাথার অর্ধেক পর্যন্ত কানপট্টির চিহ্ণ রয়েছে। অতঃপর আমি আমার বাহন থেকে অবতরণ করলাম, সে আমাকে স্বাগতম জানালো এবং তার উপরে মঞ্চে আমাকে বসালো; আর সে ছাত্রের মত করে বসল। অতঃপর মোল্লা বাশী আফগান মুফতীকে সম্বোধন করার আগ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কথা-বার্তা চলেছে। অতঃপর সে (মোল্লা বাশী) তাকে (আফগান মুফতীকে) বলল:
আজকে হাদী খাজা বাহরুল ইলমকে দেখেছ?
সে বলল: হ্যাঁ।
আর এই হাদী খাজা হলেন কাযী বুখারী, তার উপাধি হল “বাহরুল ইলম”, তিনি শাহের সেনা নিবাসে এসেছেন আমি আসার চার দিন পূর্বে, তার সাথে ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر ) [এটা সালফে সালেহীনদের পরিভাষা; ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر ) হল জাইহুন তথা আমু দরিয়া (Amudaria)-এর পূর্ব দিকে। এক সময়ে এর নামকরণ করা হয়েছিল চিতাবাঘের দেশ; অতঃপর ইসলামী যুগে এসে তার নামকরণ করা হয়: ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر )। আর জাইহুন তথা আমু দরিয়ার পশ্চিম দিকে সংযুক্ত রয়েছে খোরাসান ও খাওয়ারেযম নামের দু’টি প্রদেশ।]-এর ছয়জন আলেম ছিলেন; অতঃপর মোল্লা বাশী বলেন:
তাকে “বাহরুল ইলম” উপধিতে ভূষিত করা কিভাবে শুদ্ধ হল, অথচ জ্ঞানের সাথে তার কোন পরিচয় নেই?! আল্লাহর শপথ, যদি আমি তাকে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খিলাফতের ব্যাপারে দু’টি দলিল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, সে তার জবাব দিতে সক্ষম হবে না; বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিন্দাবাদে পারদর্শী কবিগণও তার জবাব দিতে সক্ষম হবে না! (এই কথাটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করেছেন), অতঃপর আমি তাকে বললাম:
সেই দু’টি দলিল কী, যার জবাব নেই?
তিনি বললেন: আলোচনা সম্পাদনার পূর্বে আমি আপনার নিকট জিজ্ঞাসা করতে চাই: আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “মর্যাদার দিক থেকে আমার সাথে তোমার অবস্থান তেমন, যেমন মূসার সাথে হারুনের অবস্থান, তবে আমার পরে আর কোন নবী নেই”- কি আপনাদের নিকট কি বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত? তখন আমি বললাম: হ্যাঁ, এটা মাশহুর হাদিস।
অতঃপর তিনি বলেন: এই হাদিসের বক্তব্য দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের হকদার।
আমি বললাম: এর থেকে এই দলিল নেয়ার হেতু কী?
তিনি বলেন: যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য নবুয়ত ছাড়া হারুন আ.-এর সকল মর্যাদা সাব্যস্ত করেছেন; আর ইস্তিসনা তথা পৃথক করাটা হল জ্ঞানের মানদণ্ড। সুতরাং আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য খিলাফত সাব্যস্ত হল; কারণ, খিলাফতটা হারুন আ.-এর সকল মর্যাদাকে অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা, তিনি যদি ঐ সময় বসবাস করতেন, তবে তিনি মূসা আ.-এর খলিফা হতেন।
অতঃপর আমি বললাম: আপনার স্পষ্ট কথা প্রমাণ করে যে, এই বিষয়টি সকল কিছুকে ইতিবাচক হিসেবে দেখে; সুতরাং সকল কিছুকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার উপায় কী?
তিনি বলেন: ইস্তিগরাক ( الاستغراق )-এর মধ্যে যে ইযাফত ( الإضافة ) রয়েছে, তার থেকে ইস্তিসনা ( الاستثناء )-এর ইঙ্গিত দ্বারা।
অতঃপর আমি বললাম: প্রথমত এই হাদিসটি নসসে জলী নয়। এর কারণ হল তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মতবিরোধ রয়েছে; কেউ বলেন: এটা সহীহ; আবার কেউ বলেন: এটা হাসান; আবার কেউ বলেন: এটা যঈফ; এমনকি ইবনুল জাওযী এটাকে মাউযু বলে দাবি করেছেন! সুতরাং তোমরা কিভাবে এর দ্বারা খিলাফত সাব্যস্ত করবে, অথচ তোমরাই তা প্রমাণের জন্য নসসে জলী’র শর্ত করে থাক।
অতঃপর তিনি বলেন: হ্যাঁ, আপনি যা উল্লেখ করেছেন, আমরা তা মানি। তবে আমাদের দলিল এটা নয়। বরং তা হল শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “তোমরা আলীকে মুমিনদের নেতা হিসেবে মেনে নাও” এবং হাদিসে ত্বায়ের ( حديث الطائر ) [অর্থাৎ প্রসিদ্ধ পাখির হাদিস।]-এর মত। কারণ, তোমরা দাবি কর যে, এই উভয় হাদিসই মাউযু; সুতরাং এই হাদিসের ব্যাপারে আমার কথাও তোমাদের কথার মতই। তবে আমার প্রশ্ন হল: তোমরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য খিলাফত সাব্যস্ত কর না কেন?
আমি বললাম: এই হাদিসটি কয়েকটি কারণে দলিল হওয়ার উপযুক্ত নয়:
তন্মধ্যে একটি কারণ হল: এখানে ইস্তিগরাক ( الاستغراق )-এর বিষয়টি নিষিদ্ধ; কারণ, হারুন আ.-এর সকল মর্যাদা মূসা আ.-এর সাথে নবী হিসেবে, আর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদের এবং তোমাদের সকলের ঐক্যমতে নবী নন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথেও নবী নন এবং তার পরেও নবী নন। সুতরাং হারুন আ.-এর জন্য নির্ধারিত ও প্রমাণিত মর্যাদাসমূহ যদি নবুয়ত ব্যতীত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে নবী হিসেবে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য সাব্যস্ত হত, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র নবী হওয়াটা দাবি করা যেত!! কারণ, তার সাথে নবুয়তকে ইস্তিসনা ( الاستثناء ) পৃথক করা হয়নি, আর তা (নবুয়ত) হারুন আ.-এর মর্যাদার অংশবিশেষ।
তাছাড়া হারুন আ.-এর সকল মর্যাদা সাব্যস্ত হয়েছে মূসা আ.-এর সহোদর ভাই হিসেবে; আর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাই নন। আর ‘আম যখন ইস্তিসনা ( الاستثناء ) ছাড়া খাস হয়, তখন তা ধারণা ভিত্তিক দলিলের ফায়দা দেয়।
সুতরাং বক্তব্যটিকে একটি মনযিল বা স্তরের উপর প্রয়োগ করা উচিত, যেমনিভাবে প্রকাশ্য ‘তা’ (ة) টি একবচন [অর্থাৎ " منزلة " শব্দের মধ্যকার ‘তা’ (ة) টি] বুঝায়। অতএব ইযাফত ( الإضافة ) অংশবিশেষের জন্য হবে এবং এ ক্ষেত্রে এটাই মূলনীতি। আর হাদিসের মধ্যে " إلا " অর্থ " لكن " যেমন তাদের কথা:
فلان جواد إلا أنه جبان أي لكنه .
অর্থাৎ অমুক দানবীর কিন্তু সে কাপুরুষ।
সুতরাং বিষয়টি প্রত্যাবর্তন করেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়, যার থেকে এ ক্ষেত্রে অনির্ধারিতভাবে কোন অংশকে উদ্দেশ্য করা হবে; আর এখানে আমরা শুধু বহির্ভাগকে নির্দিষ্ট করব; আর নির্ধারিত বলতে নির্দিষ্ট ঐ মনযিল বা মর্যাদা, যখন মূসা আ. হারুন আ.-কে বনী ইসরাঈলের উপর (সাময়িক) খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন এবং তার প্রমাণ হল আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী:
﴿ وَقَالَ مُوسَىٰ لِأَخِيهِ هَٰرُونَ ٱخۡلُفۡنِي فِي قَوۡمِي﴾ [ سورة الأعراف : 142]
অর্থাৎ আর মূসা তার ভাই হারুনকে বলল, আমার অনুপস্থিতিতে আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে তুমি আমার প্রতিনিধিত্ব করবে। (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৪২)
আর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মর্যাদাগত অবস্থান হল তাবুক যুদ্ধে সময় তাঁকে মদিনার খিলাফতের দায়িত্ব প্রদান। [অর্থাৎ মূসা আ. কর্তৃক তাঁর ভাই হারুন আ.-কে প্রতিনিধি নিয়োগ করার মত, যখন তিনি পাহাড়ে গিয়েছেন লওহ তথা লিখিত ফলকসমূহ নিয়ে ফিরে আসার জন্য। আর হাদিস: " أنت مني منزلة هارون و موسى " (আমার সাথে তোমার অবস্থান তেমন, যেমন মূসার সাথে হারুনের অবস্থান) মূলত তাবুক যুদ্ধের কাহিনী প্রসঙ্গে বর্ণিত; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুকের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মদিনা মুনাওয়ারা’র খিলাফতের দায়িত্ব প্রদান করেছেন; আর তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন: " أنت مني منزلة هارون و موسى " (আমার সাথে তোমার অবস্থান তেমন, যেমন মূসার সাথে হারুনের অবস্থান)... হাদিস । যেমন কয়েক লাইন পরে আল্লামা সুওয়াইদী’র কথার মধ্যে স্পষ্টভাবে এর বর্ণনা আসবে।]
অতঃপর মোল্লা বাশী বলেন: তাঁকে খলিফা নিয়োগ করার দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, তিনিই সর্বোত্তম এবং তাঁর পরে তিনিই খলিফা।
অতঃপর আমি বললাম: আপনি যা বলেছেন তাই যদি ঠিকভাবে প্রমাণিত হয়, তবে দাবি করা হবে যে, ইবন উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে খলিফা হওয়ার উপযুক্ত। কারণ, তিনি তাঁকে মদিনার খলিফা নিযুক্ত করেছেন! আর তিনি তাঁকে ছাড়া আরও অন্যকেও খলিফা নিযুক্ত করেছেন; সুতরাং আপনারা এই দলিল দ্বারা কেন অন্যকে বাদ দিয়ে শুধু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিশেষভাবে খলিফা হওয়ার উপযুক্ত বলে মনে করেন; অথচ খলিফা (সাময়িক) হওয়ার ক্ষেত্রে কয়েক জনের পূর্ণ অংশিদারিত্ব রয়েছে?!
আরও মজার বিষয় হল, এটা যদি মর্যাদার বিষয় হত, তবে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু মনে মনে নিজেকে তুচ্ছ ভেবে কষ্ট অনুভব করতেন না এবং বলতেন না: “আপনি কি আমাকে নারী, শিশু ও দুর্বলদের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন”?! তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মনকে সান্তনা দেয়ার জন্য বলেন: “তুমি কি পছন্দ করনা যে, আমার সাথে তোমার অবস্থান হবে তেমন, যেমন মূসার সাথে হারুনের অবস্থান”?!
অতঃপর তিনি বললেন: আপনাদের মূলনীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, শব্দের ব্যাপকতাই বিবেচ্য বিষয়, নির্দিষ্ট কোন সবব বা কারণ বিবেচ্য বিষয় নয়।
আমি বললাম: নিশ্চয় আমি নির্দিষ্ট কোন সবব বা কারণকে দলিল হিসেবে নির্ধারণ করিনি; এটা শুধু একটা قرينة বা ইঙ্গিত মাত্র যার দ্বারা কিছু অনর্থক বিষয়কে চিহ্নিত করা।
অবশেষে তিনি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন!!
অতঃপর তিনি বললেন: আমার নিকট আরও একটি দলিল রয়েছে যা কোন প্রকার তাবীল ( التأويل ) গ্রহণ করে না; আর তা হল আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿فَقُلۡ تَعَالَوۡاْ نَدۡعُ أَبۡنَآءَنَا وَأَبۡنَآءَكُمۡ وَنِسَآءَنَا وَنِسَآءَكُمۡ وَأَنفُسَنَا وَأَنفُسَكُمۡ ثُمَّ نَبۡتَهِلۡ فَنَجۡعَل لَّعۡنَتَ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰذِبِينَ ٦١ ﴾ [ سورة آل عمران : 61]
অর্থাৎ- “... তুমি তাকে বল: আস, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে ও তোমাদের নারীগণকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে, অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের দেই আল্লাহর লানত।” — (সূরা আলে ইমরান: ৬১)
আমি তাকে বললাম: এই আয়াত থেকে দলিল গ্রহণের কারণ কী?
তখন তিনি বললেন: তার কারণ হল, যখন নাজরানের খ্রিষ্টানগণ ‘মুবাহালা’ করার জন্য আগমন করল, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হোসাইনকে কোলে নিলেন; হাসানের হাত ধরলেন; ফাতিমাকে তাদের পিছনে এবং আলীকে তার (ফাতেমার) পিছনে রাখলেন; আর তিনি দো‘য়ার ক্ষেত্রে উত্তম ও মর্যাদাবানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
আমি বললাম: এটা ‘মানাকিব’ তথা মানুষের উত্তম গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত; ফযিলত তথা মর্যাদার বিষয় নয়। আর প্রত্যেক সাহাবীই এমন কিছু বিশেষ গুণের দ্বারা বিশেষিত যা অন্যের মধ্যে পাওয়া যায় না; প্রত্যেক সীরাত গ্রন্থের পাঠকই তা পরিস্কারভাবে অবগত আছেন। আর তাছাড়া আল-কুরআন নাযিল হয়েছে আরবদের বাকরীতি ও তাদের পারস্পরিক কথপোকথন পদ্ধতির আলোকে। যদি ধরা হয় যে, দুই গোষ্ঠীর দুই বড় মহান ব্যক্তির মধ্যে যুদ্ধ ও বিতর্ক সংঘটিত হল; একজন অপরজনকে বলল: তুমি ও তোমার বিশেষ গোষ্ঠীর লোক বের হও; আর আমি ও আমার বিশেষ গোষ্ঠীর লোক বের হচ্ছি; অতঃপর আমরা পরস্পর মোকাবিলা করব, অন্য গোষ্ঠীর কোন লোক আমাদের সাথে আসবে না। এই কথার অর্থ এই নয় যে, মহান ব্যক্তিদ্বয়ের সাথে তাদের বিশেষ গোষ্ঠীর চেয়ে অন্য কোন বীর পুরুষ পাওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে নিকটতম লোকদের উপস্থিতিতে দো‘য়াও বিনয়কে আবশ্যক করে তোলে, যাতে দো‘য়া দ্রুত কবুল হয়।
অতঃপর তিনি বললেন: এই ধরনের বিনয়-নম্রতা অধিক মহব্বত ব্যতীত সৃষ্টি হয় না।
আর আমি বললাম: এই ধরনের মহব্বত স্বভাব ও প্রকৃতির দিকে ধাবিত; যেমনিভাবে মানুষের ভালবাসা তার নিজের ও সন্তানের প্রতি তার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান ব্যক্তির চেয়েও অধিক বেশি। সুতরাং এই ধরনের ভালবাসা পাপ ও পুণ্য কিছুই দাবি বা আবশ্যক করে না। আর সীমিত ভালবাসা যা দু’টি অগ্রসর বস্তুর একটিকে আবশ্যক করে তোলে; আর তা হল ঐচ্ছিক ভালবাসা।
অতঃপর তিনি বললেন: আয়াতের মধ্যে আরও একটি দিক রয়েছে যা আফযালিয়ত তথা অধিক উত্তমতাকে আবশ্যক করে; আর তা হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের নফসকে আলী’র নফসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ, তাঁর কথার মধ্যে আছে " أبناءنا " (আমাদের ছেলে সন্তান), যার দ্বারা উদ্দেশ্য হল: হাসান ও হোসাইন; আর " نساءنا " (আমাদের স্ত্রী)-এর মধ্যে উদ্দেশ্য হল ফাতেমা; আর " أنفسنا " (আমাদের নফস)-এর মধ্যে আলী ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আর অন্য কেউ অবশিষ্ট নেই।
তখন আমি বললাম: আল্লাহই ভাল জানেন; আপনার তো দেখছি উসূল তথা মূলনীতিমালার ব্যাপারে কোন ধারণা নেই! বরং আপনি আরবীও ভাল জানেন না!! কিভাবে " أنفسنا " (আমাদের নফস)-এর ব্যাখ্যা করা হল; অথচ " الأنفس " হল جمع قلة যা " نا " -এর দিকে إضافة (সম্মন্ধ) হয়েছে; যার দ্বারা সকলকে বুঝায়। আর جمع (বহুবচন)-এর মোকাবিলায় جمع (বহুবচন)-এর দ্বারা এককসমূহকে বিভক্তকরণ আবশ্যক করে। যেমন আমাদের কথা:
" ركب القوم دوابهم " أي ركب كل واحد دابته .
অর্থাৎ- “সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের বাহনসমূহে আরোহন করল” অর্থাৎ— তাদের প্রত্যেকে তার বাহনে আরোহন করল।
আর এটা এমন একটি মাসআলা, যা উসূল তথা মূলনীতিমালার মধ্যেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়; আর جمع (বহুবচন)-এর ব্যাপারে চুড়ান্ত কথা হল: একের অধিক [অর্থাৎ " أنفسنا " (আমাদের নফস) শব্দটির মধ্যকার جمع (বহুবচন)-এর সিগাহ বা রূপটি একের অধিকের উপর প্রয়োগ হয়েছে; অর্থৎ- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু।] ব্যক্তি বা বস্তুর উপরই جمع (বহুবচন)-এর প্রয়োগ হবে। আর তা শ্রুত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী:
﴿ أُوْلَٰٓئِكَ مُبَرَّءُونَ مِمَّا يَقُولُونَۖ﴾ [ سورة النور : 26]
অর্থাৎ—“লোকে যা বলে, তারা তা থেকে পবিত্র”— (সূরা আন-নূর: ২৬); অর্থাৎ- আয়েশা ও সাফওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুমা।
এবং আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী:
﴿ فَقَدۡ صَغَتۡ قُلُوبُكُمَاۖ﴾ [ سورة التحريم : 4]
অর্থাৎ—“কারণ, তোমাদের হৃদয় ঝুঁকে পড়েছে।” — (সূরা আত-তাহরীম: ৪); অর্থাৎ- তাদের দু’জনের জন্য দু’টি হৃদয়ের বেশি হতে পারে না (অথচ قلوب শব্দ বহুবচন)। আহলুল মীযান [অর্থৎ- যুক্তিবিদ্যা ( علم المنطق )।] তথা তর্কশাস্ত্রবিদগণ جمع (বহুবচন)-এর পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে বলেন: একের অধিক বুঝানোর জন্যই جمع (বহুবচন)-এর ব্যবহার করা হয়। যেমনিভাবে হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র ক্ষেত্রে " الأبناء " শব্দটি ব্যবহার হয়েছে; আর রূপক অর্থে " النساء " শব্দটি শুধুমাত্র ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। হ্যাঁ, যদি " أنفسنا " (আমাদের নফস) শব্দটি " نفسي " শব্দ দ্বারা পরিবর্তন করা হয়, তবে কখনও কখনও প্রকাশ্য হিসাব অনুযায়ী একজনকে বুঝায়।
তাছাড়া আয়াতটি যদি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খিলাফতের উপর দলিল হতে পারে, তবে তা হাসান, হোসাইন ও ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের খিলাফতের উপরও সম্মিলিত অংশীদারিত্বের কারণে দলিল হতে পারে। তবে এ কথা কেউ বলে না; কেননা হাসান ও হোসাইন উভয় ছোট; আর ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা সকল নারীদের মত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন। সুতরাং আয়াতটি খিলাফতের উপর দলিল হতে পারে না।
অবশেষে তিনি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন!!
অতঃপর তিনি বললেন: আমার নিকট আরও একটি দলিল আছে; আর তা হল আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী:
﴿ إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَهُمۡ رَٰكِعُونَ ٥٥ ﴾ [ سورة المائدة : 55]
অর্থাৎ—“তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ যারা বিনত হয়ে সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়।” — (সূরা আল-মায়িদা: ৫৫)
তাফসীরবিদগণ একমত হয়েছেন যে, এই আয়াতটি আলী’র প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে, যখন তিনি তাঁর আংটিটি নামাযরত অবস্থায় ভিক্ষুককে দান করেছেন; আর " إنما " শব্দটি সীমিতকরণের জন্য; আর" الولي " শব্দটির অর্থ হল: “দানের ক্ষেত্রে তিনি তোমাদের চেয়ে উত্তম”।
তখন আমি বললাম: আমার নিকট এই আয়াতের অনেকগুলো জওয়াব রয়েছে।
আর আমি জওয়াব দেয়া শুরু করার পূর্বেই উপস্থিত কিছু সংখ্যক শী‘আ ফারসি ভাষায় মোল্লা বাশীকে সম্বোধন করে কিছু কথা বলল, যার অর্থ হচ্ছে: ওর সঙ্গে আলোচনা বাদ দাও; কারণ, সে একটা মূর্ত শয়তান! যখনই তুমি দলিলের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি বা অতিরঞ্জিত করছ, তখনই সে তোমাকে তার জওয়াব দিয়ে দিচ্ছে, আর তোমার মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে!!
অতঃপর সে আমার দিকে দৃষ্টি দিল এবং মুচকি হাসি হাসল! আর বলল:
নিশ্চয় আপনি একজন মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি, আপনি এর এবং অন্যান্য বিষয়ের জওয়াব দেবেন। কিন্তু আমার কথা তো ‘বাহরুল ইলম’-এর সাথে; তবে সে তো জওয়াব দিতে অক্ষম।
অতঃপর আমি বললাম: তোমার কথার শুরুতে যে কথা ছিল তা হল, “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিন্দাবাদে পারদর্শী কবিগণ তার জবাব দিতে সক্ষম হবে না!”?! সুতরাং সেই তো আমাকে তর্ক-বিতর্ক ও কথোপকথনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করেছে।
অতঃপর সে বলল: আমি পারসিক ব্যক্তি, আর আরবীও ভালভাবে বুঝতে পারি না, সুতরাং কোন কোন সময় আমার নিকট থেকে এমন শব্দ বের হয়ে যায়, যা আমার উদ্দেশ্য নয়!
অতঃপর আমি তাকে বললাম: তোমাকে আমি দু’টি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাই যার জওয়াব দিতে শী‘আ মতের অনুসারীগণ সক্ষম নয়!
তখন সে বলল: সেগুলো কী?
আমি বললাম: প্রথমটি হল, সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমের ব্যাপারে শী‘আদের অভিমত কী?
তখন সে বলল: তারা মুরতাদ হয়ে গেছে (পাঁচজন ব্যতীত, তারা হলেন: আলী, মিকদাদ, আবূ যর, সালমান ফারসী ও ‘আম্মার ইবন ইয়াসার); কেননা তারা খিলাফতের ব্যাপারে আলী’র নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেনি।
আমি বললাম: ব্যাপারটি যদি অনুরূপই হয়, তবে কিভাবে আলী তাঁর কন্যা উম্মে কুলসুমকে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমের নিকট বিয়ে দিয়েছিলেন??!
তখন সে বলল: তা জোরপূর্বক!
আমি বললাম: আল্লাহর কসম! আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারে তোমাদের আকিদা বা বিশ্বাস ঘাটতিপূর্ণ, যা কোন সামান্য মর্যাদার আরবও পছন্দ করবে না!! বনী হাশেম তো দূরে থাক, যারা আরবের নেতা, যাদের সম্মান হল আসল সম্মান , যাদের মর্যাদা হল আসল মর্যাদা, বংশগত দিক থেকে তাঁরা উচ্চ বংশের, মহত্বের দিক থেকে তাঁরা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও গর্বিত এবং তাঁদের অধিকাংশই উন্নত গুণাবলীর অধিকারী। একজন আদনা আরব তার ইজ্জত রক্ষায় তার জীবন বিলিয়ে দিতে পারে, তার স্ত্রীদের রক্ষায় মরতে পারে এবং তার ব্যক্তিসত্ত্বা তার স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনরে কারণেই শুধু সম্মানবোধ করে না। সুতরাং কিভাবে তোমরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ বিশ্বাস লালন কর, যা নিষ্ঠুর আরবগণ পর্যন্ত মানতে রাজি নয়; অথচ তিনি হলেন মহাবীর, বনী গালিবের সিংহ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে আল্লাহর সিংহ?! বরং আমরা কতজনকে দেখলাম, যে তার সন্তান-সন্তুতির জন্য লড়াই করেছে এবং নিহত হয়েছে।
সে বলল: হতে পারে ওমর উম্মে কুলসুমের আকৃতি ধারণকারীনী কোন জিনকে বিয়ে করেছেন?! [কুলাইনী “আল-ফুরু‘ মিনাল কাফী ( الفروع من الكافي ) নামক কিতাবের হা/২ পৃ.৩১১ -এর মধ্যে ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী কোথায় ইদ্দত পালন করবে’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেন: যখন ওমর ইন্তিকাল করে, তখন আলী উম্মে কুলসুমের নিকট গমন করেন; অতঃপর তাকে নিয়ে তার বাড়িতে আসেন। এই বর্ণনার অনুরূপ বর্ণনা করেছেন আবূ জাফর আল-তুসী তার ‘তাহযীবুল আহকাম’ ( تهذيب الأحكام ) নামক কিতাবের হা/২ পৃ.২৮০ -এর “বাবু ইদ্দাতিন নিসা”-এর মধ্যে।]
আমি বললাম: এটা তো প্রথমটার চেয়েও জঘন্য, এ ধরনের কথা কিভাবে বোধগম্য হয়?! আর আমরা যদি এই দরজা খুলে দেই, তবে শরীয়তের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যাবে; এমনকি যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর নিকট আসে, তবে সে এই কথা বলার সম্ভাবনা রাখে যে, তুমি জিন, আমার স্বামীর আকৃতি ধারণ করেছ, সুতরাং সে তাকে তার নিকট গমন করতে নিষেধ করবে। অতঃপর সে যদি দুইজন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী নিয়ে এসে সাক্ষ্য দেয়ার ব্যবস্থা করায় যে, সে অমুক, তবে তাদের ব্যাপারে এই কথা বলার সম্ভাবনা রয়েছে যে, তারা উভয়ে জিন, এই দুই ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির আকৃতি ধারণ করে এখানে এসেছে; আর এভাবে চলতে থাকবে ... এবং সম্ভাবনা রয়েছে যে, মানুষ কাউকে হত্যা করবে অথবা সে তার নিকট অধিকার (হক) দাবি করবে; অতঃপর তাকে সে বলবে: ঐ ঘটনায় আমি হক বা অধিকার দাবি করিনি; বরং সম্ভবত সে জিন, আমার আকৃতি ধারণ করেছে এবং জাফর সাদিক, যার মাযহাব অনুযায়ী তোমাদের ইবাদত- বন্দেগী হয়ে থাকে বলে তোমরা ধারণা করে থাক, সেও জিন তার (জাফর সাদিকের) আকৃতি ধারণ করেছে এবং স্বীকৃত এসব বিধি-বিধান তোমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে!!
অতঃপর আমি তাকে বললাম: অত্যাচারী খলিফার কর্মসমূহের বিধান কী? শী‘আদের নিকট তা কার্যকর কিনা?
তখন সে বলল: বিশুদ্ধ মনে করে না এবং কার্যকরও করে না।
অতঃপর আমি বললাম: আল্লাহ তোমাকে সন্ধান দিন, মুহাম্মদ ইবন হানাফীয়া ইবন আলী ইবন আবি তালিবের মা কোন বংশের লোক?
তখন সে বলল: বনী হানীফার।
অতঃপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম: বনী হানীফাকে কে বন্দী করেছে?!
সে বলল: আমি জানি না (অথচ সে মিথ্যা বলেছে)!
অতঃপর তাদের উপস্থিত আলেমদের কেউ কেউ বলল: তাদেরকে আবূ বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বন্দী করেছে।
অতঃপর আমি বললাম: আলী’র জন্য যুদ্ধবন্দী দাসীকে বিয়ে করা এবং তার থেকে সন্তান জন্ম দেওয়া কিভাবে বৈধ হল; অথচ তোমাদের ধারণা অনুযায়ী ইমাম অত্যাচারী খলিফার কোন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে না; আর লজ্জাস্থানের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা তো একটা স্বীকৃত বিষয়!
অতঃপর সে বলল: সম্ভবত তিনি তার পরিবারের নিকট তাকে দান করতে অনুরোধ করেছেন। অর্থাৎ- তারা তাকে তার সাথে বিয়ে দিয়েছে।
আমি বললাম: এই বিষয়ে দলিলের প্রয়োজন রয়েছে।
অতঃপর সে চুপসে গেছে!! আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত)।
অতঃপর আমি বললাম: আমি তোমার সামনে কোন হাদিস ও আয়াত নিয়ে আসিনি এই জন্য যে, যখনই আমি হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বলব, “প্রসিদ্ধ ছয়টি কিতাবের সংকলকদের কেউ অথবা অন্য কেই তা বর্ণনা করেছেন”, তখন তুমি বলবে: আমি তাকে বিশুদ্ধ বলি না, আর দলিলের শর্ত হল যে, তার ব্যাপারে বিবাদকারীগণ একমত হবেন। আর আমি যদি তোমার নিকট কোন আয়াত নিয়ে আসতাম এবং বলতাম, “তাফসীরবিদগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, তার হুকুম এই এবং তা নাযিল হয়েছে আবূ বকরের শানে”, তখন তুমি বলতে: তাফসীরবিদগণের ইজমা আলী’র দলিল হতে পারে না; দূরবর্তী কোন তাবীলের কথা উল্লেখ করতে এবং বলতে: দলিল যখন সন্দেহযুক্ত হবে, তখন তার দ্বারা দলিল পেশ করাটা বাতিল বলে গণ্য হবে। সুতরাং এটাই আমাকে প্রলুব্ধ করেছে আয়াত ও হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করা থেকে বিরত থাকতে।
অতঃপর শাহ আসল বিতর্ক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ফরমান জারি করলেন এবং নির্দেশ দিলেন ইরান, আফগান ও ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر )-এর আলেমদেরকে একত্রিত হয়ে পারস্পরিক ‘কাফির বলাবলির বিষয়গুলো’ দূর করার জন্য; আর আমি থাকব তাদের পর্যবেক্ষক, শাহের পক্ষের উকিল (প্রতিনিধি) এবং তিন ফিরকা (দল) যেসব ঐক্যমত পোষণ করবে তার সাক্ষী।
অতঃপর আমরা তাঁবুর সীমানা থেকে বের হলাম এমতাবস্থায় যে, আফগান, উজবেকিস্তান ও পারসিকগণ আঙুল দ্বারা আমার দিকে কী একটা ইঙ্গিত করছে; আর ঐ দিনটি ছিল দেখার মত এক দিন!!
(সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম তাঁর রাসূল আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যিনি সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং শান্তি বর্ষিত হউক তাঁর পরিবার-পরিজন ও পুত-পবিত্র সাহাবীদের প্রতি) । অতঃপর—
যখন আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্য কাঙ্খিত শরীয়তের পৃষ্ঠপোষকতা দান এবং বিদ‘আতপন্থী ও অপকর্মের প্ররোচনাদানকারীদেরকে প্রতিরোধ করাটাকে সহজ করে দিয়েছেন, তখন তিনি যে আমাকে আমার মনোবাসনা পূর্ণ করার ও তার দ্বারা সামগ্রীকভাবে ইসলামপন্থীদের সংশোধন করার; আমার হাতে সত্যকে জারি রাখার; আমার আলোচনা দ্বারা বাতিলের আগুন প্রশমিত করার তৌফিক প্রদান করলেন এবং শী‘আরা যে সমস্ত বাতিলের উপর ছিল, যেমন সাহাবীগণকে গালি দেওয়া, তাঁদেরকে কাফির বলা, আলী ইবন আবি তালিব রা.-কে সবচেয়ে মর্যাদাশীল ও খিলাফতের একমাত্র হকদার বলে দাবি করা, মু‘তা বিবাহকে (সাময়িক বিবাহকে) বৈধ করা, ওযুর সময় পদযুগল মাসেহ করা ইত্যাদি ধরনের নিকৃষ্ট কাজ, বিদ‘আত, সুস্পষ্ট ও মুতাওয়াতের পর্যায়ের গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা থেকে তাদেরকে বিরত রাখার তাওফিক দান করেছেন; তাঁর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমি তাঁর সম্মানিত ঘর বাইতুল্লাহ্র হজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
আর এই কাহিনীর সারসংক্ষেপ হল, যখন পারসিক রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ল এবং আফগান রাষ্ট্র তাদের ইস্পাহান রাজ্য দখল করে নিল [আর এই ঘটনা ঘটেছিল ১১৩৫ হিজরিতে কালযাবী গোত্রের আমীর মাহমুদ আফগানীর হাতে; আর সে ছিল আমীর উয়াইসের পুত্র। আর তারা ছিল মূলত: কান্দাহার এলাকার। তার জীবনীর জন্য দ্রষ্টব্য— আল-দীন, সামী বেগ ( الدين سامي بك ), পৃ. ৪২২২]; আর ওসমানী রাজবংশও -আল্লাহ তাদের রাষ্ট্রকে তৌফিক দিয়ে সাহায্য করুন- তারাও কিছু এলাকার মালিক হল। আর এই ঘটনা ঘটেছিল আফগানগণ কর্তৃক ‘শাহ হোসাইন’ নিহত হওয়ার পর। অতঃপর তার ছেলে তহমাসেব আত্মপ্রকাশ করল হত্যা ও অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য; ফলে তার চতুষ্পাশে অবস্থানরত পারসিকগণ ঐক্যবদ্ধ হল। অবশেষে তাকে ঘিরে একত্রিত হল বহু জনগণ, যাদের মধ্যে নাদির শাহও ছিল।
তহমাসেব প্রজাদের বিষয়াদি নিয়ে খুব কমই চিন্তা-ভাবনা করত; সে মদ পানেই মত্ত থাকত। ফলে নাদির শাহ তার খুব কাছের মানুষে পরিণত হল; এমনকি এক পর্যায়ে সে হয়ে গেল তার শাসন ক্ষমতার একমাত্র অবলম্বন [অর্থাৎ তার উযির। আর তাদের পরিভাষা ছিল যে, তারা উযিরকে ‘রাষ্ট্রের অবলম্বন’ ( اعتماد الدولة ) উপাধিতে ভূষিত করত।] (উযির) এবং সে তার ক্ষমতার যাবতীয় বিষয় তার নিকট অর্পণ করল।
অতঃপর এই নাদির শাহ রাজ্যসমূহ উদ্ধার করতে শুরু করল; আর তারই ধারাবাহিকতায় আফগানের হাত থেকে ইস্ফাহানকে উদ্ধার করল এবং তাদেরকে বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত করল। অতঃপর তাকে ‘তহমাসেব কুলী’ উপাধিতে ভূষিত করা হল; যার অর্থ হল ‘তহমাসেবের গোলাম’। আর এই উপাধি তার উপর এমন প্রাধান্য বিস্তার করল যে, তাকে তার প্রথম বা পূর্ব নামে চেনা যেত না।
অতঃপর তার চিন্তা ও পরিকল্পনার ব্যাপ্তি সম্প্রসারিত হল ওসমানী সম্রাজ্যের হাতে নিয়ন্ত্রিত রাজ্যসমূহের দিকে; সেগুলোকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য এবং যথারীতি সে বাগদাদকে অবরুদ্ধ করার জন্য এক বড় ধরনের সৈন্য সমাবেশ করল; আর তখন বাগদাদের শাসনকর্তা ছিলেন উযিরে আযম ফিল্ড মার্শাল ওসমানী রাষ্ট্রের ডান হাত উযিরের পুত্র উযির মরহুম হাসান পাশা’র ছেলে আহমদ পাশা। আর উল্লেখিত উযির এই বহিরাগত বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করতে আদিষ্ট ছিলেন না; বরং তিনি আদিষ্ট ছিলেন কিল্লা’র অভ্যন্তরীণভাগ হেফাযত করার জন্য। এমনকি তার পাগড়ি যদি দেয়ালের বাইরেও পড়ে যেত, তবে তিনি তা উদ্ধারের জন্য বের হতেন না! আর তার সাথে ছিলেন তিন উযির: কুরা মুস্তফা পাশা, সারি মুস্তফা পাশা ও জামাল উগলী আহমদ পাশা।
এই বিদ্রোহী বাগদাদকে আট মাস যাবত অবরুদ্ধ করে রাখে; এমনকি শেষ পর্যন্ত তাদের খাদ্যসম্ভার শেষ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা ঘোড়া ও গাধার মাংস ভক্ষণ করে, এমনকি তারা বিড়াল ও কুকুরের মাংসও ভক্ষণ করেছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে বাগদাদ থেকে হটিয়ে দিলেন এবং তার থেকে বাগদাদকে উদ্ধার করলেন। আর তা সম্ভব হয়েছে এইভাবে যে, ওসমানী সম্প্রদায় তার বিরুদ্ধে টবাল ওসমান পাশার নেতৃত্বে সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করল; অতঃপর তিনি বাগদাদমুখী হলেন। এক পর্যায়ে তিনি ‘তহমাসেব কুলী’সহ পারসিক সৈন্যগণকে পরাজিত করলেন এবং তাদেরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলেন; কিন্তু তা সম্ভব হয়েছে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর।
অতঃপর সে (নাদির শাহ) পরাজয় ও পতনের পরে দ্বিতীয় বারের মত আগমন করে এবং বাগদাদকে অবরুদ্ধ করে ফেলে; আর তখনও বাগদাদের প্রশাসনিক প্রধান বা উযির ছিলেন আহমদ পাশা। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার থেকে বাগদাদকে মুক্ত করেছেন।
অতঃপর সে (নাদির শাহ) মনোযোগ দিল রোমের ‘আরযন রোম’ এর প্রতি; আল্লাহ তা‘আলা তার থেকে রোমকেও মুক্ত করেছেন। আর সে যখন ‘মাগান’ নামক মরুভূমিতে ফিরে এল, তখন পারসিকগণ তার নিকট তার ব্যবস্থাপনায় রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে বায়‘আত গ্রহণ করে। আর সেই বায়‘আতের তারিখ ও শ্লোগান ছিল “যা ঘটেছে তার মধ্যে কল্যাণ” সন ১১৪৮ হি.। আর যে ব্যক্তি তার এই বায়‘আতের ব্যাপারে সম্মত ছিল না, সে ব্যক্তি উল্লেখিত তারিখ ও শ্লোগানকে পরিবর্তন করেছে এবং বলেছে: “যা ঘটেছে তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই”; আর তাও একই তারিখে হয়েছে, অর্থাৎ ১১৪৮ হিজরিতে।
অতঃপর সে (নাদির শাহ) মনোযোগ দিল ভারত অভিযানের দিকে; আর সেই দেশে তার অভিযান চলতে থাকে ভারত রাজ্যের (বর্তমান পাকিস্তানের) করাচী’র ‘জাহানাবাদ’ দখল করা পর্যন্ত। অনেক সংঘর্ষের পর সে তার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। অতঃপর সে সেখানকার (ভারতের) বাদশা শাহ মুহাম্মদের সাথে সন্ধি করে এবং ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ গ্রহণ করে যা গণনার বাইরে এবং শাহ মুহাম্মদের উপর নির্ধারিত অংক ও শ্রেণীর মালামাল বার্ষিক কর হিসেবে ধার্য করে। অতঃপর সে ভারত ত্যাগ করে এবং তুর্কিস্তান অভিযানের দিকে মনোযোগ দেয় এবং বলখ ও বুখারার উপর কর্তৃত্ব লাভ করে।
মোটকথা আফগান, তুর্কিস্তান ও সমগ্র ইরানের অধিবাসীগণ তার বশ্যতা স্বীকার করে। আর পারসিকদের ধারণা যে, ভারতের অধিবাসী ও তাদের শাসক শাহ মুহাম্মদসহ সকলেই তার নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেছে। আর শাহ মুহাম্মদ হলেন তার উকিল বা প্রতিনিধি। আর এই জন্যই তিনি নিজেকে শাহানশাহ উপাধিতে ভূষিত করেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে যেন এই নাম ব্যতীত অন্য কোন নামে ডাকা না হয়; আর যে ব্যক্তি তার ব্যাপারে এই নাম ব্যতীত অন্য কোন নাম ব্যবহার করবে, তাকে সে সতর্ক করে দিয়েছে।
অতঃপর সে (নাদির শাহ) স্থিতি ও স্থায়িত্বের উদ্দেশ্যে মনোযোগ দিল দাগিস্তান অভিযানের দিকে; আর সেই সময়ের মধ্যে তার দুতগণের মাধ্যমে সে সার্বক্ষণিক ওসমানী রাষ্ট্রের খোজ-খবর রাখত। একবার সে তাদের নিকট থেকে রুহা সীমানা থেকে আব্বাদান অঞ্চলের খোঁজ-খবর নিত; তার এই রাজ্যটি তৈমুরের পক্ষ থেকে ওয়ারিস হিসেবে প্রাপ্ত বলে ধারণা করা হত। কারণ, সে দাবি করত যে, সেই তার (তৈমুরের) ওয়ারিস। আর সে তাদের নিকট এই স্বীকৃতিও তলব করত যে, এখন যে শী‘আ মাযহাবের উপর তারা প্রতিষ্ঠিত, তা হল জাফর সাদিকের মাযহাব এবং তা হক (সত্য)! আর তারা বলে: ইসলামের মাযহাব পাঁচটি। আর সে তার (জাফর সাদিকের) জন্য পবিত্র কাবা ঘরে পঞ্চম স্তম্ভের দাবি করে! সে আরও দাবি করে যে, সে যুবাইদার পথ থেকে হজের রাস্তা শুরু করবে এবং কুপ, জলাশয় বা চৌবাচ্চাসমূহ ইত্যাদি সংস্কার করবে। আর সে এও দাবি করে যে, সে হবে হাজিদের আমীর। আর যখন সে ইরাকের পথে বের হবে, তখন একজন আগে আগে গিয়ে জনগণকে সরিয়ে দেবে এবং ঠিক একই নিয়মে সে ফিরে আসবে!!
তার জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এই চেষ্টা-সাধনার মিশন অবিরাম চলতে থাকে। এমনকি সে ইরাকীদের অধিকাংশ এলাকা ধ্বংস করে দেয়। আর সেখানে বিশৃঙ্খলা চলছিল ১১৫৬ হিজরি পর্যন্ত। অতঃপর আরবগণ যুদ্ধের সরঞ্জামাদিসহ বিশাল বাহিনী নিয়ে ইরাকে আগমন করল এবং বহু দলে বিভক্ত হয়ে ঐ ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ল। বাগদাদ অবরোধ করে রাখার জন্য প্রায় সত্তর হাজার সৈন্য রেখে দেয়া হল; আর বসরা অবরোধ করে রাখার জন্য প্রায় নব্বই হাজার সৈন্য প্রেরণ করা হল। অতঃপর তারা তাকে ছয় মাস যাবত অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তবে তারা বসরাবাসীকে কামান ও বন্দুক দ্বারা আঘাত করেছিল। আর বাগদাদ অবরোধের ক্ষেত্রে তারা তার থেকে প্রায় এক ফরসখ দূরে ছিল; আর অবরোধের ধরন ছিল সেখানকার প্রধান প্রশাসক আহদম পাশা’র সাথে দেন-দরবারের মাধ্যমে।
আর নাদির শাহ ও তার বাকি সৈন্যগণ মনোযোগ দিল ‘শাহারযুর’ অভিযানের দিকে; সেখানকার অধিবাসীগণ তার বশ্যতা স্বীকার করল। অনুরূপভাবে অপরাপর সকল কুর্দি ও আরবগণও তার বশ্যতা স্বীকার করল। অতঃপর সে ‘কিরকুক কেল্লা’-র দিকে অভিযান পরিচালনা করল এবং তা আট দিন অবরুদ্ধ করে রাখল; ঐ বার সে তার উপর বিশ হাজার বার কামান হামলা করেছে এবং তার সমসংখ্যক বার বোমা হামলাও করেছে। ফলে তারা আত্মসমর্পন করেছে এবং তার বশ্যতা স্বীকার করেছে। অতঃপর সে ইরবেলের দিকে অভিযান পরিচালনা করে; তাতে তার অধিবাসীগণ তার নিকট আত্মসমর্পন করেছে এবং তার বশ্যতা স্বীকার করেছে।
অতঃপর সে মসুলের দিকে অভিযান পরিচালনা করে এমতাবস্থায় যে, তার সাথে প্রায় দুই লক্ষ যোদ্ধা ছিল। সে সাত দিন ধরে তার অধিবাসীদের উপর প্রায় চল্লিশ হাজার বার কামানের গোলা বর্ষণ করেছে এবং তার সমসংখ্যক বার বোমা হামলাও করেছে। অতঃপর তার অধিবাসীগণ তাদের যাবতীয় বিষয়াদি হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলার নিকট ন্যস্ত করে; অতঃপর সে বিস্ফোরকের জন্য গর্ত খনন করে এবং তা বারুদ ও সীসা দ্বারা ভর্তি করে। একপর্যায়ে তাতে সে আগুন জ্বালিয়ে দেয়; ফলে তা তার জন্য শোচনীয় পরিণতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর সে যখন উপলব্ধি করতে পারল যে, সে দীর্ঘকাল ব্যয় করেও সেখানে সফলতা অর্জন করতে পারবে না, তখন সে সেখান থেকে প্রস্থান করল এবং তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে বাগদাদ অভিমুখে রওয়ানা দিল; অতঃপর সে আমগমন করল এবং সাইয়্যিদুনা মূসা ইবন জাফরের এলাকায় (নগরে) [বর্তমানে এই এলাকাকে ‘আল-কাযেমীয়া’ নামে নামকরণ করা হয়।] অবতরণ করল। অতঃপর সে তার মূসা ইবন জাফর ও মুহাম্মদ আল-জাওয়াদের কবর যিয়ারত করল। অতঃপর কাছাকাছি সময়ে সে দাজলা নদী অতিক্রম করে ইমাম আবূ হানিফা রহেমাহুল্লাহু তা‘আল’র কবর যিয়ারত করে [বর্তমানে ইমাম আবূ হানিফা রহেমাহুল্লাহু তা‘আল’র কবরের স্থানকে ‘আল-‘আজমীয়া’ নামে নামকরণ করা হয়।]।
আর দূতগণ সার্বক্ষণিক তার ও আহমদ পাশাকে নিয়ে মতবিরোধ করতে থাকে যে, সে (আহমদ পাশা) শী‘আ মাযহাবের বিশুদ্ধতার পক্ষে দেয়া মতামতের দাবি প্রত্যাহার করে নিয়েছে! আর শী‘আ মাযহাবই জাফর সাদিকের মাযহাব- এই বিশ্বাসও প্রত্যাহার করে নিয়েছে! অতঃপর সে ইমাম আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র যিয়ারতের উদ্দেশ্যে নাজাফ অভিমুখে রওয়ানা দিল; আরও উদ্দেশ্য ছিল যাতে সে স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত গম্বুজটি দেখতে পাবে।
সুতরাং সাওয়াল মাসের একুশ তারিখ রবিবার মাগরিবের পূর্ব মুহূর্তে আমি বসা ছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে উজির আহমদ পাশা’র এক দূত এসে আমাকে তার নিকট ডাকল। অতঃপর আমি মাগরিবের নামাযের পর গেলাম এবং প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করলাম; অতঃপর আমার দিকে তার (আহমদ আগা’র) কতিপয় অন্তরঙ্গ বন্ধু ও বিনোদন সঙ্গী বের হয়ে আসল। অতঃপর সে (আহমদ আগা) বলল:
কেন আপনাকে তলব করা হয়েছে, তা কি আপনি জানেন?
আমি বললাম: না
সে বলল: পাশা চাচ্ছেন আপনাকে নাদির শাহ’র নিকট পাঠাতে!
আমি বললাম: কী জন্য?
সে বলল: নিশ্চয় সে (অর্থাৎ নাদির শাহ) আলেমদের সাথে এমন একজন আলেমকে চাচ্ছে যিনি শী‘আ মাযহাবের অবস্থা নিয়ে পারসিকদের সাথে আলোচনা করবেন এবং তা বাতিল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে দলিল পেশ করবেন; আর পারসিকগণ তার বিশুদ্ধতার উপর দলিল পেশ করবে। সুতরাং আমাদের আলেম [অর্থাৎ— আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেম।] যদি পরাজিত হয়, তবে সে পঞ্চম মাযহাবকে [অর্থাৎ— আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেম পঞ্চম মাযহাবকে স্বীকৃতি দিবে ও সত্য বলে মেনে নেবে ।] স্বীকৃতি দিতে ও মেনে নিতে বাধ্য হবে!!
এই কথা যখন আমার কানে ধাক্কা দিল, তখন আমার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল এবং আমার মাংসপেশীগুলো কেঁপে উঠল; আর আমি বললাম:
হে আহমদ আগা! তুমি জান যে, রাফেযীগণ একগুঁয়ে ও অহঙ্কারী সম্প্রদায়! তারা কিভাবে আমার কথা মেনে নেবে?! আর বিশেষ করে তারা তারা অন্ধ বিশ্বাসের পেরেকে আবদ্ধ ও সংখ্যায় অধিক। আর এই শাহ হল যালিম, অন্যায়কারী ও অত্যাচারী। সুতরাং কিভাবে আমি তার মাযহাবকে বাতিল ও তার রায়কে মূর্খতা ও বোকামী বলার দুঃসাহস করি?! আবার কিভাবেই বা তাদের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে, অথচ তারা আমাদের মতের স্বপক্ষের সকল হাদিসকে অস্বীকার করে; তারা হাদিসের ছয়টি প্রসিদ্ধ কিতাবসহ হাদিসের অন্যান্য কিতাবের বিশুদ্ধতার কথা স্বীকার করে না। আর তারা প্রত্যেকটি আয়াতকে তাবীল তথা অপব্যাখ্যা করে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে এবং বলে: দলিল যখন সন্দেহযুক্ত হয়, তখন তার দ্বারা দলিল দেয়ার উপযুক্ততা বাতিল বলে গণ্য হয়, যেমন তারা বলে থাকে: দলিল হওয়ার পূর্ব শর্ত হল তার উপর তার্কিক তথা বিবাদকারীগণ ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ইজতিহাদী (গবেষণামূলক) বিষয়গুলো ধারণার ফায়দা দেয়, সুতরাং কিভাবে আমি তাদের নিকট মোজা’র উপর মাসেহের বৈধতা প্রমাণ করব, অথচ তা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত? অতএব আমি যদি বলি: মোজা’র উপর মাসেহের হাদিস বর্ণনা করেছেন প্রায় সত্তরজন সাহাবী যাঁদের মধ্যে আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুও একজন, তখন তারা বলবে: আমাদের নিকট মোজা’র উপর মাসেহের অবৈধতা প্রমাণিত একশতেরও বেশি সাহাবী’র বর্ণনা দ্বারা যাঁদের মধ্যে আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা রয়েছেন! আর আমি যদি বলি: তোমরা মোজা’র উপর মাসেহের অবৈধতার ব্যাপারে প্রমাণ স্বরূপ যেসব হাদিস পেশ করেছ সেগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট! তখন তারা বলবে: অনুরূপভাবে তোমরাও মোজা’র উপর মাসেহের বৈধতার ব্যাপারে প্রমাণ স্বরূপ যেসব হাদিস পেশ করেছ সেগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট! সুতরাং যা তাদের জওয়াব, তাই আমাদের জওয়াব! অতএব এ ধরনের আলোচনার দ্বারা কী ফায়দা হবে?! সুতরাং উযির মহোদয়ের নিকট আমার প্রত্যাশা যে, তিনি আমাকে এ ধরনের কষ্টসাধ্য কাজ থেকে রুখসত দেবেন এবং এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি হানাফী অথবা শাফেয়ী মতাবলম্বী মুফতি প্রেরণ করবেন। কারণ, এ ধরনের আলোচনার জন্য তাঁরাই হবেন যথোপযুক্ত।
অতঃপর আহমদ আগা বলেন: এটা অসম্ভব, পাশা মহোদয় এই কাজের জন্য আপনাকেই মনোনীত করেছেন, সুতরাং আপনি তা মেনে নিবেন, আপনার পক্ষ থেকে এর ব্যতিক্রম কিছু তিনি চান না। অতএব তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনি টু শব্দটিও উচ্চারণ করবেন না।
আল-সুয়াইদী বলেন: অতঃপর আমি উযির আহমদ পাশা’র সাথে ঐ রাত্রের অব্যবহিত সকালে একত্রিত হলাম; সে আমার সঙ্গে এই বিষয় বা কাজের বিশেষত্ব নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা করল এবং সে বলল:
আমি আল্লাহ তা‘লার নিকট প্রার্থনা করছি যে, তিনি যেন আপনার দলিল-প্রমাণকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করেন এবং আপনার ভাষায় সঠিক বিষয়টি প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করে দেন। আলোচনা হওয়া না হওয়া আপনার ইচ্ছা ও স্বাধীনতার উপর নির্ভর করছে। তবে সম্পূর্ণভাবে আলোচনাকে পরিত্যাগ করবেন না; বরং আপনি তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত উপলক্ষে কিছু আলোচনা পেশ করুন যাতে পারসিকগণ জানতে পারে যে, আপনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। আর আপনি যদি তাদের পক্ষ থেকে ইনসাফের বিষয় উপলব্ধি করতে পারেন এবং তারাও সঠিক বিষয় প্রকাশের ইচ্ছা পোষণ করে, তবে আপনি তাদের সাথে আলোচনা করুন এবং আপনাকে তাদের নিকট পেশ করুন।
অতঃপর তিনি বলেন: শাহ নাজাফে আছেন। আর আমি চাচ্ছি আপনাকে বুধবার সকালে তার নিকট নিয়ে যাব। আর সে আমার জন্য গৌরবোজ্জল পোষাক, বাহন ও খাদেম নিয়ে আসল। আমার সাথে তার বাহনের খাদেমও পাঠিয়ে দিল। আর আমরা পারসিক দুতগণের মুখোমুখি হলাম যারা আমাদের খোঁজে এসেছেন।
অতঃপর আমরা সাওয়াল মাসের ২২ তারিখ সোমবার আসরের সালাতের পূর্বমুহূর্তে বের হলাম এবং পথিমধ্যে আমি উভয় পক্ষের দলিলসমূহ নিয়ে জলপনা-কল্পনা করতে থাকলাম; আর যখন প্রশ্ন উত্থাপন হবে, তখন তার জওয়াবসমূহ কেমন হবে তা নিয়ে ভাবতে লাগলাম!
আর এটা আমার সার্বক্ষণিক অভ্যাস ও স্বভাব-প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল, দলিলের কল্পনা ও সন্দেহ-সংশয় দূর করার চিন্তা-ভাবনা ছাড়া আর অন্য কোন চিন্তা আমার ছিল না; এমনকি আমি তাদের ধারণা ও সন্দেহ-সংশয়ের উপর ভিত্তি করে একশ’র অধিক দলিল-প্রমাণ কল্পনা করে ঠিক করে ফেলেছি! আর প্রতিটি দলিলকে কেন্দ্র করে একটি বা দুইটি বা তিনটি করে জওয়াবও ঠিক করেছি!
আর পথিমধ্যে আমি সঙ্কট ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি, এমনকি আমার প্রস্রাব তাজা রক্তে পরিণত হয়েছে। অতঃপর আমি দুবাইস ইবন মাযিদের সমাবেশস্থলে প্রবেশ করেছি; তখন তা ছিল পারসিকদের নিয়ন্ত্রণে। অতঃপর আমি সেখানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কতিপয় ব্যক্তির সাক্ষাত পেয়েছি; তারা আমাকে সংবাদ দিলেন যে, শাহ এই মাস‘আলা’র জন্য তার দেশের প্রত্যেক মুফতিকে একত্রিত করেছে; এখন পর্যন্ত তাদের (মুফতিদের) সংখ্যা পৌঁছেছে সত্তর জনে, যাদের প্রত্যেকেই রাফেযী!!
অতঃপর যখন আমি এই কথা শুনতে পেলাম, তখন আমি ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ এবং ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’ পড়লাম [অর্থাৎ- আমি বললাম: " لا حول و لا قوة إلا بالله " এবং " إنا لله و إنا إليه راجعون "]; আর মনে মনে আরও কিছু বাক্য আবৃত্তি করলাম এবং বললাম: আমি যদি মনে করি যে, আমি বাহাস বা আলোচনার জন্য আদিষ্ট হইনি, তবে এর দ্বারা আমার মন পরিতৃপ্ত হবে না। আর যদি তাদের সাথে আলোচনা করি, তবে আমি আশঙ্কা করি যে, তারা আমার ব্যাপারে বাস্তবতার বিপরীত কথা শাহের কানে পৌঁছাবে।
অতঃপর আমি আমার মত ও চিন্তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম যে, আমি শাহের অনুপস্থিতিতে তাদের সাথে আলোচনায় বসব না! আমি তাকে বললাম: আমার (বিতর্কমূলক) আলোচনার জন্যে এমন একজন অভিজ্ঞ বিচারকের প্রয়োজন রয়েছে, যিনি না হবেন সুন্নী, যাতে কেউ এই অপবাদ দিতে না পারে যে, তিনি আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন; আবার না হবেন শী‘আ, যাতে কেউ এই অপবাদও দিতে না পারে যে, তিনি তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তখন আমরা এমন এক আলেমের প্রয়োজন অনুভব করি, যিনি হয় ইহুদী হবেন, না হয় খ্রিষ্টান হবেন অথবা এমন এক ব্যক্তি হবেন, যিনি সুন্নী এবং শী‘আ নন! আর আমি তাকে বললাম: আমরা আপনাকে পছন্দের লোক মনে করি! আর আপনিই আমাদের মধ্যে বিচারকের ভূমিকা পালন করবেন; আর আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন আপনাকে জিজ্ঞাসা করবেন! সুতরাং আপনি আমাদের বক্তব্য শ্রবণ করুন, যাতে আপনার নিকট সত্য বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
অতঃপর আমি কল্পনা করলাম যে, যদি তার রায় তাদের পক্ষে চলে যায়, তখন আমি তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হব এবং তার সাথে আমার কথোপকথন হবে; যদিও তা আমার জীবন নাশের দিকে নিয়ে যায়! আর এই সব কিছুই চলছে আমার কল্পনার রাজ্যে।
অতঃপর আমি উল্লেখিত সমাবেশস্থল থেকে প্রতিশ্রুত বুধবার রাতের এশার নামাযের শেষ ওয়াক্তে বের হয়ে গেলাম; আর সে রাতটি ছিল হালকা বৃষ্টি আর কুয়শাচ্ছন্ন রাত্রি [ الدث শব্দের অর্থ: হালকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আরব ব্যক্তি বলেন: “আকাশ আমাদের উপর হালকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বর্ষণ করেছে; তাতে উৎকৃষ্ট জাতের ঘোড়া অসন্তুষ্ট এবং যা মুসাফিরকে কষ্ট দেয়”।]; মানুষ তার নিজের হাতটি পর্যন্ত দেখতে পায় না; আর তা ঐ রাতের চেয়ে কঠিন ভায়াবহ ও প্রচণ্ড শীতল, যার বর্ণনায় কবি বলেন:
“জমাট বাঁধা শিশিরে আচ্ছাদিত এমন এক রাত্রি
যার কোন প্রান্তে কুকুর দেখতে পায়না লম্বা-মোটা রশি”
অতঃপর আমরা ঐ রাতে ভ্রমণ করতে লাগলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ‘যূল কিফল’ এর কবর খ্যাত নামক স্থানে এসে পৌঁছালাম। আর তা হল সমাবেশস্থল ও নাজাফের মধ্যকার দূরত্বের অর্ধেক পথ। সুতরাং আমরা সীমানা প্রাচীরের বাইরে অবতরণ করলাম এবং সামান্য সময় বিশ্রাম নিলাম। অতঃপর আবার ভ্রমণ করলাম এবং ‘বিরে দানদান’ ( بئر دندان ) নামক স্থানের কাছে ফজরের নামায আদায় করলাম। অতঃপর হন্তদন্ত হয়ে শাহের দূত এসে আমাকে বলল:
আপনি দ্রুত চলুন! কারণ, এই সময়ের মধ্যেই শাহ আপনাকে আহ্বান করবেন। অথচ আমার এবং শাহের তাঁবু’র মধ্যকার দূরত্ব ছিল দুই ফরসখ। অতঃপর আমি দুতকে বললাম:
শাহের কেমন অভ্যাস, সে যখন তার রাজ্যের কারও নিকট দূত প্রেরণ করেন, তখন কি তাকে আমার মত রাস্তায় তলব করেন, না কি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, তারপর তলব করেন?
সে বলল: তিনি আপনাকে ব্যতীত আর কাউকে এভাবে রাস্তায় তলব করেন নি; আর তাছাড়া আপনাকে ব্যতীত আর কাউকে কোন দিন তলব করেন নি!
অতঃপর অন্ধকার কেটে গেল; আর আমি মনে মনে বললাম: শাহ তোমাকে এত দ্রুত এ জন্যই তলব করেছে যে, সে ইমামীয়া মাযহাবের স্বীকৃতি ও সত্যায়ণের শর্তে তোমাকে আশ্রয় দেবেন ও রক্ষা করবেন। সুতরাং তুমি যদি তার আহ্বানে সাড়া দাও, তবে সে তোমাকে সম্পদের প্রলোভন দেখাবে; অন্যথায় সে এই কাজে তোমাকে বাধ্য করবে! সুতরাং তোমার অভিমত কী?! অতএব, আমি এই পথে বের হয়েছি এই শর্তে যে, আমি হক কথা বলব, তাতে আমার জীবন যদি ধ্বংস হয়ে যায় যাক; কোন প্রলোভন আমাকে নত করতে পারবে না এবং কোন ভয়-ভীতি আমাকে টলাতে পারবে না!
আর আমি বললাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দিন ইন্তিকাল করেছেন, সেদিন ইসলামের অগ্রযাত্রা থেমে গিয়েছিল; অতঃপর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কারণে তা আবার চলতে শুরু করে। “আল-কুরআন সৃষ্ট”— এই কথার বেড়াজালে দ্বিতীয় বারের মত আবার তার অগ্রযাত্রা থেমে গেল; অতঃপর আহমদ ইবন হাম্বল র.-এর কারণে তা আবার অগ্রসর হতে শুরু করে। আর আজকের এই দিনে ইসলামের অগ্রযাত্রা তৃতীয় বারের মত থেমে গেল; সুতরাং যদি আমি তার অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেই, তবে তার যাত্রা চিরদিনের জন্য থেমে যাবে। এর থেকে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই, আর যদি অগ্রসর করতে পারি, তবে তা চিরদিন অগ্রসরমান থাকবে; সুতরাং তার চলা থেমে যাওয়া এবং চলমান থাকা তার অনুসারীদের থেমে যাওয়া ও চলমান থাকার উপর নির্ভরশীল। আর সন্দেহ নেই যে, ঐ শ্রেণীর লোকদের নিকট এই ফকিরের ব্যাপারে সুপ্রসিদ্ধ উত্তম ধারণা রয়েছে; সুতরাং তারা আমার ব্যাপারে বিশ্বাস করে যে, নিশ্চয় তারা নিকট ভাল ভালই; আর মন্দ মন্দই।
অতঃপর আমি আমার নিয়তকে সুদৃঢ় করলাম, আমার অন্তরকে ভাল করলাম এবং মৃত্যুর জন্য আমার মনকে প্রস্তুত করলাম, এমনকি তাকে আমি সহজ-সরল মনে করলাম এবং আমি বললাম: আমি বিশ্বাস স্থাপন করেছি আল্লাহ’র প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি এবং পরকালের প্রতি; আমি আরও বিশ্বাস করি যে, তাকদীরের ভাল ও মন্দ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আর আমি আমার বাহনকে তাড়া করছি আর বার বার শাহাদাতাইন পাঠ করছি। অতঃপর লম্বা খেজুর বৃক্ষের মত বড় সুউচ্চ দু’টি নিশানা দেখা গেল; আমি এতদুভয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমাকে বলা হল: এই দু’টি হল শাহের নিশানা বা নিদর্শন, যেগুলো সে পুঁতে রেখেছে যাতে সৈন্য বাহিনী’র শীর্ষস্থানীয় সৈনিকগণ তাদের তাঁবু বা শিবিরে অবতরণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারে। কারণ, তাদের মধ্য থেকে এমন কেউ কেউ রয়েছে, যারা অবতরণ করবে দুই নিশানা’র ডান পাশ দিয়ে; আবার এমন কেউ কেউ রয়েছে, যারা অবতরণ করবে দুই নিশানা’র বাম পাশ দিয়ে ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
অতঃপর আমরা সফর করতে করতে তাঁবুসমূহ দেখতে পেলাম; আর তার তাঁবুটি ছিল বড় বড় সুউচ্চ সাতটি খুঁটি দ্বারা তৈরি। অতঃপর আমরা তাদের নিকট ‘কাশক খানা’ নামে পরিচিত মহলে এসে হাজির হলাম। আর তা হল সামনা সামনি এমন কতগুলো তাঁবু যার প্রত্যেক পাশে রয়েছে গম্বুজ আকৃতির পনেরটি করে তাঁবু; যাতে রয়েছে একটি প্রাসাদ বা হলঘর, কিন্তু তাতে খুঁটি নেই। শাহের তাঁবুর সাথে সংযুক্ত তাঁবুসমূহের একবারে মাথার তাঁবুর সাথে সংযুক্ত রয়েছে একটি বারান্দা বা করিডোর, তার মাঝখানে রয়েছে একটি দরজা, তার উপর রয়েছে একটি পর্দা; আর ডান পাশের তাঁবুসমূহের মধ্যে রয়েছে প্রায় চার হাজার বন্দুকধারী যারা রাতে এবং দিনে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে; আর বাম পাশটি উম্মুক্ত তাতে রয়েছে কতগুলো অনির্ধারিত আসন।
অতঃপর আমি যখন ‘কাশক খানা’-এর নিকটবর্তী হলাম, তখন অবতরণ করলাম; অতঃপর আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এক ব্যক্তি বের হয়ে আসল এবং আমাকে অভিবাদন ও সম্মান জানাল। আর সে আমাকে পাশা ও তার বিশেষ অনুসারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে লাগল; আর পাশা’র অনুসারীদের ব্যাপারে তার এত বেশি জানা-শুনার কারণে আমি অবাক হতে লাগলাম। অতঃপর সে যখন আমার নিকট থেকে তা জানতে পারল, তখন বলল:
মনে হচ্ছে যেন আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না!
আমি বললাম: হ্যাঁ।
অতঃপর সে বলল: আমি আবদুল করীম বেগ। এক সময় আহমদ পাশা’র দরবারের খাদেম ছিলাম। এই কতদিন হল আমাকে ইরানী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দূত হিসেবে ওসমানী রাষ্ট্রে প্রেরণ করা হল।
সুতরাং সে যখন আমার সাথে আলাপ-আলোচনা করছিল, ঠিক তখনই আমাদের নিকট নয় ব্যক্তি আগমন করল। অতঃপর তার নজর যখন তাদের উপর পড়ল, তখন সে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে গেল; অতঃপর তারা আমাকে সালাম পেশ করল, আর আমিও তাদের প্রতি সালাম পেশ করলাম এমতাবস্থায় যে, আমি বসা, তাদের কাউকে চিনি না। অতঃপর আবদুল করীম আমাকে একে একে তাদের সবাইকে পরিচয় করে দিতে শুরু করল এবং আমাকে বলল:
এই হলেন রাজ্যসমূহের মানদণ্ড হাসান খান। আর ওনি হলেন মুস্তফা খান। আর ওনি হলেন নজর আলী খান। আর ওনি হলেন মির্জা কাফী।
অতঃপর আমি যখন ‘রাজ্যসমূহের মানদণ্ড’ ( معيار الممالك )-এর কথা শুনতে পেলাম, তখনই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম; অতঃপর সে এবং তার সঙ্গীগণ আমার সাথে মুসাহাফা (করমর্দন) করল এবং আমাকে অভিবাদন জানাল। আর ‘রাজ্যসমূহের মানদণ্ড’ ( معيار الممالك ) হল শাহের উযির, কুরজির অধিবাসী ও শাহ হোসাইনের দাস।
অতঃপর তারা আমাকে বলল: অনুগ্রহ করে শাহের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য চলুন।
অতঃপর তারা বারান্দার মাঝখানের পর্দাটি উঠাল; অতঃপর তার পিছনে অপর আরও একটি বারান্দা এবং উভয়ের মধ্যকার প্রশস্ততা হল তিন গজ; সেখানে নিয়ে তারা আমাকে দাঁড় করাল এবং বলল:
যখন আমরা থামব, তখন আপনি থামবেন; আর যখন আমরা হাঁটব, তখন আপনিও হাঁটবেন?
অতঃপর আমরা বাম দিক থেকে চলতে শুরু করলাম এবং বারান্দা অতিক্রম শেষ হয়ে গেল; আর তখন দেখা গেল এক প্রশস্ত আবরণ (পর্দা) যার দ্বারা করিডোর বা গ্যালারীকে ঘিরে রাখা হয়েছে, যা দূর থেকে দেখা যায়; আর তার মধ্যে রয়েছে তার স্ত্রীদের জন্য অনেকগুলো তাঁবু। অতঃপর আমি শাহের তাঁবু’র দিকে লক্ষ্য করলাম; আর সে আমার নিকট থেকে একটি তীর নিক্ষেপ করার মত জায়গা পরিমাণ (তিনশত থেকে চারশত গজ পরিমাণ) দূরত্বে একটি উঁচু চেয়ারে বসে আছে। অতঃপর যখন আমার উপর তার নজর পড়ল, তখন সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল:
আবদুল্লাহ আফেনদিকে স্বাগতম! আমাকে আহমদ খান (অর্থাৎ আহমদ পাশা) সংবাদ দিয়েছে, সে বলেছে: আমি আপনার নিকট আবদুল্লাহ আফেনদিকে প্রেরণ করেছি।
অতঃপর সে আমাকে বলল: সামনে অগ্রসর হউন!
অতঃপর আমি প্রথম বারের মত সামনে অগ্রসর হলাম এবং থেমে গেলাম। সে আমাকে বলতে লাগল “সামনে অগ্রসর হউন!” আর আমি ছোট ছোট কদমে সামনে অগ্রসর হতে থাকলাম; শেষ পর্যন্ত আমি তার প্রায় পাঁচ গজ কাছাকাছি হয়ে গেলাম; অতঃপর আমি লম্বা এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যা তার বসা থেকেই বুঝা যাচ্ছিল এবং তার মাথায় রয়েছে পারসিকদের টুপির ন্যায় একটি সাদা চৌকা টুপি, আর তার উপরে রয়েছে মণি-মুক্তা, ইয়াকুত, হিরক ও সকল প্রকার অলঙ্কার খচিত পাগড়ি; আর তার গলায় রয়েছে মণি-মুক্তা’র একাধিক মালা এবং তার বাহুতেও অনুরূপ। আর মণি-মুক্তা, হিরক ও ইয়াকুত খচিত কাপড়ের টুকরা বেঁধে রাখা হয়েছে তার বাহুতে। আর তার চেহারায় বার্ধক্য ও বেশি বয়সের ছাপ প্রকাশ পাচ্ছিল; এমনকি তার সামনের সারির দাঁতগুলো পড়ে গেছে। অতএব সে প্রায় আশি বছর বয়সের ব্যক্তি; তার দাড়িগুলো কালো কলপ করা, কিন্তু সুন্দর; তার আরও রয়েছে দু’টি ভাজ পড়া ভ্রু এবং আরও আছে হালকা পীতবর্ণের কিন্ত সুন্দর দু’টি চোখ। মোটকথা তার চেহারা-ছবি খুবই সুন্দর।
সুতরাং যখন তার উপর আমার দৃষ্টি পড়ল, তখন আমার মন থেকে তার ভয় দূর হয়ে গেল। অতঃপর সে আমাকে তুর্কমেনিস্তানীয় ভাষায় (প্রথম বারের সম্বোধনের ন্যায়) সম্বোধন করল এবং আমাকে বলল:
আহমদ খানের অবস্থা কেমন?
অতঃপর আমি বললাম: ভাল ও উত্তম।
অতঃপর সে বলল: আপনি কি জানেন কেন আমি আপনাকে আহ্বান করেছি?
আমি বললাম: না!
অতঃপর সে বলল: আমার রাজ্য দু’টি ভাগে বিভক্ত: তুর্কিস্তান ও আফগান, তারা ইরানীদেরকে বলে: “তোমরা কাফির”। কুফর খুব মন্দ জিনিস! আমার রাজ্যে এটা শোভনীয় নয় যে, এক দল আরেক দলকে কাফির বলবে! এখন আমি আপনাকে আমার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি (উকিল) মনোনীত করছি, যাতে আপনি কুফর সংক্রান্ত সকল অপবাদ দূর করতে পারেন এবং তৃতীয় আরেকটি দলের পক্ষে অভিমত পেশ করবেন, যা তারা গ্রহণ করবে। আর আপনি যা কিছু দেখবেন অথবা শুনবেন, তা আমাকে জানাবেন এবং আহমদ খানের নিকট পৌঁছাবেন।
অতঃপর তিনি আমাকে বের হওয়ার সুযোগ করে দিলেন এবং আদেশ করলেন যে, আপনি আমার অতিথি কক্ষে রাষ্ট্রের উযিরের নিকট অবস্থান করুন; আরও আদেশ করলেন, যাতে আমি যোহরের নামাযের পর মোল্লা বাশী আলী আকবরের সঙ্গে একত্রিত হই।
অতঃপর আমি সেখান থেকে বের হলাম এমতাবস্থায় যে, আমি অত্যন্ত খুশি ও আনন্দিত। কারণ, পারসিকদের বিচারক আমার হাতে। আমি অতিথি কক্ষে আসলাম এবং কিছুক্ষণ বসলাম; অতঃপর উযির তার তাঁবু’র দিকে আসল এবং আমাকে খাবার গ্রহণের জন্য ডাকল। আর মেহমানদার ছিলেন নজর আলী খান এবং তার সহযোগিতায় ছিলেন আবদুল করীম বেগ ও আবূ যর বেগ। আর তারা সকলেই ছিলেন আমার খেদমতে নিয়োজিত।
অতঃপর আমি যখন উযিরের নিকট আগমন করলাম এবং তাকে সালাম পেশ করলাম, তখন জবাবস্বরূপ বসা অবস্থায় সে আমাকে সালাম দিল; আমার মনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হল যে, সে দাঁড়ায়নি কেন। অতঃপর আমি মনে মনে বললাম: আমাকে যখন বসতে দেয়া হবে, তখন আমি উযিরকে বলব: নিশ্চয় শাহ আদেশ করেছেন সকল কুফরি দূর করতে এবং এ জন্য সে আমাকে উকিল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে; সুতরাং আমি যে কুফরী দূর করব, তা হল তোমার থেকে প্রকাশিত কুফরী, কেননা তুমি আলেমদেরকে তুচ্ছ ও অপমান করার ইচ্ছা করেছ! আর তোমাকে হত্যা করে তা দূর করতে পারলেই খুশি হব!! অতঃপর আমি তার মজলিস থেকে উঠে শাহের নিকট গিয়ে পুরা ঘটনাটা তাকে বলব। আর এই সবটাই আমার মনের কল্পনা।
অতঃপর আমি যখন বসলাম, তখন সে দাঁড়াল এবং আমাকে অভিবাদন (মারহাবা) জানাল। আর সে হল খুব লম্বা ও ফর্সা মানুষ, চোখ দু’টি বড় বড় ও কলপ লাগানো দাড়ি; তবে সে বুদ্ধিমান লোক সকল কথপোকথন ও আলাপ-আলোচনা বুঝতে ও অনুধাবন করতে পারে। স্বভাবে সে নরম প্রকৃতির এবং চিন্তা-চেতনায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ঘেষা। যখন সে দাঁড়াল, তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, তাদের অভ্যাস হচ্ছে আগন্তুক ব্যক্তি বসার পর তারা দাঁড়ায়। অতঃপর তার নিকটে দুপরের খাবার খেলাম; অতঃপর মোল্লা বাশী’র সাথে সাক্ষাত কারার জন্য আমাদের নিকট ফরমান আসল। অতঃপর আমি আমার বাহনে আরোহন করলাম, আর মেহমানদারগণ আমার সামনে সামনে হাঁটতে লাগল। অতঃপর পথিমধ্যে লম্বা এক ব্যক্তি আমার থেকে সরে পড়ল, যার পোষাক আফগানের পোষাকের মত; অতঃপর সে আমাকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানাল। অতঃপর আমি তাকে বললাম:
তুমি কে?
অতঃপর সে বলল: আমি আফগান মুফতী মোল্লা হামযা আল-কালানজানী।
অতঃপর আমি বললাম: হে মোল্লা হামযা! তুমি কি আরবিতে ভাল পারদর্শী?
সে বলল: হ্যাঁ।
অতঃপর আমি বললাম: নিশ্চয় শাহ আদেশ করেছে ইরানীদের নিকট প্রত্যেক কাফের ফতোয়া দানকারীকে প্রত্যাহার করে নিতে। তারা কখনও কখনও কুফরী বিষয়ে আমার সাথে বিতর্ক করে; অথবা তারা কুফরী বিষয়ের কিছু কিছু দিক উল্লেখ করে না; আর আমরা তাদের অবস্থা জানতে পারি না এবং তাদের ইবাদত সম্পর্কেও জানতে পারি না। ফলে আমি তার কুফরী’র বিষয়ে উপলব্ধি করতে পারি না, যাতে তাকে তা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি, এমনকি তা দূর করতে পারি।
অতঃপর সে বলল: হে আমার গুরু! শাহের কথা দ্বারা প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকবেন। সে তো শুধু আপনাকে মোল্লা বাশী’র নিকট পাঠিয়েছে যাতে সে কথার মাঝে ও আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে আপনার সাথে আলোচনা করে নিতে পারে; সুতরাং আপনি তাদের থেকে সতর্ক থাকুন!
অতঃপর আমি বললাম: আমি তাদের বেইনসাফী’র আশঙ্কা করি।
সে বলল: আপনি তা থেকে নিরাপদ থাকুন; কারণ, শাহ এই মজলিসে গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে এবং এক গোয়েন্দার উপর আরেক গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে; অতঃপর আরেক গোয়েন্দার উপর আরেক গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে। আর গোয়েন্দাদের প্রত্যেকেই একজনের অবস্থা সম্পর্কে অপরজন কিছুই জানে না; সুতরাং শাহের নিকট অবাস্তব কিছু পৌঁছাবে না।
অতঃপর আমি যখন মোল্লা বাশী’র তাঁবুর নিকটবর্তী হলাম, তখন সে আমাকে স্বাগতম জানানোর জন্য পায়ে হেঁটে বের হয়ে আসল; আর সে হল খাটো আকৃতি ও ধূসর বর্ণের লোক, তার মাথার অর্ধেক পর্যন্ত কানপট্টির চিহ্ণ রয়েছে। অতঃপর আমি আমার বাহন থেকে অবতরণ করলাম, সে আমাকে স্বাগতম জানালো এবং তার উপরে মঞ্চে আমাকে বসালো; আর সে ছাত্রের মত করে বসল। অতঃপর মোল্লা বাশী আফগান মুফতীকে সম্বোধন করার আগ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কথা-বার্তা চলেছে। অতঃপর সে (মোল্লা বাশী) তাকে (আফগান মুফতীকে) বলল:
আজকে হাদী খাজা বাহরুল ইলমকে দেখেছ?
সে বলল: হ্যাঁ।
আর এই হাদী খাজা হলেন কাযী বুখারী, তার উপাধি হল “বাহরুল ইলম”, তিনি শাহের সেনা নিবাসে এসেছেন আমি আসার চার দিন পূর্বে, তার সাথে ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر ) [এটা সালফে সালেহীনদের পরিভাষা; ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر ) হল জাইহুন তথা আমু দরিয়া (Amudaria)-এর পূর্ব দিকে। এক সময়ে এর নামকরণ করা হয়েছিল চিতাবাঘের দেশ; অতঃপর ইসলামী যুগে এসে তার নামকরণ করা হয়: ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر )। আর জাইহুন তথা আমু দরিয়ার পশ্চিম দিকে সংযুক্ত রয়েছে খোরাসান ও খাওয়ারেযম নামের দু’টি প্রদেশ।]-এর ছয়জন আলেম ছিলেন; অতঃপর মোল্লা বাশী বলেন:
তাকে “বাহরুল ইলম” উপধিতে ভূষিত করা কিভাবে শুদ্ধ হল, অথচ জ্ঞানের সাথে তার কোন পরিচয় নেই?! আল্লাহর শপথ, যদি আমি তাকে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খিলাফতের ব্যাপারে দু’টি দলিল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, সে তার জবাব দিতে সক্ষম হবে না; বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিন্দাবাদে পারদর্শী কবিগণও তার জবাব দিতে সক্ষম হবে না! (এই কথাটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করেছেন), অতঃপর আমি তাকে বললাম:
সেই দু’টি দলিল কী, যার জবাব নেই?
তিনি বললেন: আলোচনা সম্পাদনার পূর্বে আমি আপনার নিকট জিজ্ঞাসা করতে চাই: আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “মর্যাদার দিক থেকে আমার সাথে তোমার অবস্থান তেমন, যেমন মূসার সাথে হারুনের অবস্থান, তবে আমার পরে আর কোন নবী নেই”- কি আপনাদের নিকট কি বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত? তখন আমি বললাম: হ্যাঁ, এটা মাশহুর হাদিস।
অতঃপর তিনি বলেন: এই হাদিসের বক্তব্য দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের হকদার।
আমি বললাম: এর থেকে এই দলিল নেয়ার হেতু কী?
তিনি বলেন: যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য নবুয়ত ছাড়া হারুন আ.-এর সকল মর্যাদা সাব্যস্ত করেছেন; আর ইস্তিসনা তথা পৃথক করাটা হল জ্ঞানের মানদণ্ড। সুতরাং আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য খিলাফত সাব্যস্ত হল; কারণ, খিলাফতটা হারুন আ.-এর সকল মর্যাদাকে অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা, তিনি যদি ঐ সময় বসবাস করতেন, তবে তিনি মূসা আ.-এর খলিফা হতেন।
অতঃপর আমি বললাম: আপনার স্পষ্ট কথা প্রমাণ করে যে, এই বিষয়টি সকল কিছুকে ইতিবাচক হিসেবে দেখে; সুতরাং সকল কিছুকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার উপায় কী?
তিনি বলেন: ইস্তিগরাক ( الاستغراق )-এর মধ্যে যে ইযাফত ( الإضافة ) রয়েছে, তার থেকে ইস্তিসনা ( الاستثناء )-এর ইঙ্গিত দ্বারা।
অতঃপর আমি বললাম: প্রথমত এই হাদিসটি নসসে জলী নয়। এর কারণ হল তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মতবিরোধ রয়েছে; কেউ বলেন: এটা সহীহ; আবার কেউ বলেন: এটা হাসান; আবার কেউ বলেন: এটা যঈফ; এমনকি ইবনুল জাওযী এটাকে মাউযু বলে দাবি করেছেন! সুতরাং তোমরা কিভাবে এর দ্বারা খিলাফত সাব্যস্ত করবে, অথচ তোমরাই তা প্রমাণের জন্য নসসে জলী’র শর্ত করে থাক।
অতঃপর তিনি বলেন: হ্যাঁ, আপনি যা উল্লেখ করেছেন, আমরা তা মানি। তবে আমাদের দলিল এটা নয়। বরং তা হল শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “তোমরা আলীকে মুমিনদের নেতা হিসেবে মেনে নাও” এবং হাদিসে ত্বায়ের ( حديث الطائر ) [অর্থাৎ প্রসিদ্ধ পাখির হাদিস।]-এর মত। কারণ, তোমরা দাবি কর যে, এই উভয় হাদিসই মাউযু; সুতরাং এই হাদিসের ব্যাপারে আমার কথাও তোমাদের কথার মতই। তবে আমার প্রশ্ন হল: তোমরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য খিলাফত সাব্যস্ত কর না কেন?
আমি বললাম: এই হাদিসটি কয়েকটি কারণে দলিল হওয়ার উপযুক্ত নয়:
তন্মধ্যে একটি কারণ হল: এখানে ইস্তিগরাক ( الاستغراق )-এর বিষয়টি নিষিদ্ধ; কারণ, হারুন আ.-এর সকল মর্যাদা মূসা আ.-এর সাথে নবী হিসেবে, আর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদের এবং তোমাদের সকলের ঐক্যমতে নবী নন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথেও নবী নন এবং তার পরেও নবী নন। সুতরাং হারুন আ.-এর জন্য নির্ধারিত ও প্রমাণিত মর্যাদাসমূহ যদি নবুয়ত ব্যতীত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে নবী হিসেবে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য সাব্যস্ত হত, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র নবী হওয়াটা দাবি করা যেত!! কারণ, তার সাথে নবুয়তকে ইস্তিসনা ( الاستثناء ) পৃথক করা হয়নি, আর তা (নবুয়ত) হারুন আ.-এর মর্যাদার অংশবিশেষ।
তাছাড়া হারুন আ.-এর সকল মর্যাদা সাব্যস্ত হয়েছে মূসা আ.-এর সহোদর ভাই হিসেবে; আর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাই নন। আর ‘আম যখন ইস্তিসনা ( الاستثناء ) ছাড়া খাস হয়, তখন তা ধারণা ভিত্তিক দলিলের ফায়দা দেয়।
সুতরাং বক্তব্যটিকে একটি মনযিল বা স্তরের উপর প্রয়োগ করা উচিত, যেমনিভাবে প্রকাশ্য ‘তা’ (ة) টি একবচন [অর্থাৎ " منزلة " শব্দের মধ্যকার ‘তা’ (ة) টি] বুঝায়। অতএব ইযাফত ( الإضافة ) অংশবিশেষের জন্য হবে এবং এ ক্ষেত্রে এটাই মূলনীতি। আর হাদিসের মধ্যে " إلا " অর্থ " لكن " যেমন তাদের কথা:
فلان جواد إلا أنه جبان أي لكنه .
অর্থাৎ অমুক দানবীর কিন্তু সে কাপুরুষ।
সুতরাং বিষয়টি প্রত্যাবর্তন করেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়, যার থেকে এ ক্ষেত্রে অনির্ধারিতভাবে কোন অংশকে উদ্দেশ্য করা হবে; আর এখানে আমরা শুধু বহির্ভাগকে নির্দিষ্ট করব; আর নির্ধারিত বলতে নির্দিষ্ট ঐ মনযিল বা মর্যাদা, যখন মূসা আ. হারুন আ.-কে বনী ইসরাঈলের উপর (সাময়িক) খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন এবং তার প্রমাণ হল আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী:
﴿ وَقَالَ مُوسَىٰ لِأَخِيهِ هَٰرُونَ ٱخۡلُفۡنِي فِي قَوۡمِي﴾ [ سورة الأعراف : 142]
অর্থাৎ আর মূসা তার ভাই হারুনকে বলল, আমার অনুপস্থিতিতে আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে তুমি আমার প্রতিনিধিত্ব করবে। (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৪২)
আর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মর্যাদাগত অবস্থান হল তাবুক যুদ্ধে সময় তাঁকে মদিনার খিলাফতের দায়িত্ব প্রদান। [অর্থাৎ মূসা আ. কর্তৃক তাঁর ভাই হারুন আ.-কে প্রতিনিধি নিয়োগ করার মত, যখন তিনি পাহাড়ে গিয়েছেন লওহ তথা লিখিত ফলকসমূহ নিয়ে ফিরে আসার জন্য। আর হাদিস: " أنت مني منزلة هارون و موسى " (আমার সাথে তোমার অবস্থান তেমন, যেমন মূসার সাথে হারুনের অবস্থান) মূলত তাবুক যুদ্ধের কাহিনী প্রসঙ্গে বর্ণিত; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুকের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মদিনা মুনাওয়ারা’র খিলাফতের দায়িত্ব প্রদান করেছেন; আর তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন: " أنت مني منزلة هارون و موسى " (আমার সাথে তোমার অবস্থান তেমন, যেমন মূসার সাথে হারুনের অবস্থান)... হাদিস । যেমন কয়েক লাইন পরে আল্লামা সুওয়াইদী’র কথার মধ্যে স্পষ্টভাবে এর বর্ণনা আসবে।]
অতঃপর মোল্লা বাশী বলেন: তাঁকে খলিফা নিয়োগ করার দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, তিনিই সর্বোত্তম এবং তাঁর পরে তিনিই খলিফা।
অতঃপর আমি বললাম: আপনি যা বলেছেন তাই যদি ঠিকভাবে প্রমাণিত হয়, তবে দাবি করা হবে যে, ইবন উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে খলিফা হওয়ার উপযুক্ত। কারণ, তিনি তাঁকে মদিনার খলিফা নিযুক্ত করেছেন! আর তিনি তাঁকে ছাড়া আরও অন্যকেও খলিফা নিযুক্ত করেছেন; সুতরাং আপনারা এই দলিল দ্বারা কেন অন্যকে বাদ দিয়ে শুধু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিশেষভাবে খলিফা হওয়ার উপযুক্ত বলে মনে করেন; অথচ খলিফা (সাময়িক) হওয়ার ক্ষেত্রে কয়েক জনের পূর্ণ অংশিদারিত্ব রয়েছে?!
আরও মজার বিষয় হল, এটা যদি মর্যাদার বিষয় হত, তবে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু মনে মনে নিজেকে তুচ্ছ ভেবে কষ্ট অনুভব করতেন না এবং বলতেন না: “আপনি কি আমাকে নারী, শিশু ও দুর্বলদের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন”?! তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মনকে সান্তনা দেয়ার জন্য বলেন: “তুমি কি পছন্দ করনা যে, আমার সাথে তোমার অবস্থান হবে তেমন, যেমন মূসার সাথে হারুনের অবস্থান”?!
অতঃপর তিনি বললেন: আপনাদের মূলনীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, শব্দের ব্যাপকতাই বিবেচ্য বিষয়, নির্দিষ্ট কোন সবব বা কারণ বিবেচ্য বিষয় নয়।
আমি বললাম: নিশ্চয় আমি নির্দিষ্ট কোন সবব বা কারণকে দলিল হিসেবে নির্ধারণ করিনি; এটা শুধু একটা قرينة বা ইঙ্গিত মাত্র যার দ্বারা কিছু অনর্থক বিষয়কে চিহ্নিত করা।
অবশেষে তিনি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন!!
অতঃপর তিনি বললেন: আমার নিকট আরও একটি দলিল রয়েছে যা কোন প্রকার তাবীল ( التأويل ) গ্রহণ করে না; আর তা হল আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿فَقُلۡ تَعَالَوۡاْ نَدۡعُ أَبۡنَآءَنَا وَأَبۡنَآءَكُمۡ وَنِسَآءَنَا وَنِسَآءَكُمۡ وَأَنفُسَنَا وَأَنفُسَكُمۡ ثُمَّ نَبۡتَهِلۡ فَنَجۡعَل لَّعۡنَتَ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰذِبِينَ ٦١ ﴾ [ سورة آل عمران : 61]
অর্থাৎ- “... তুমি তাকে বল: আস, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে ও তোমাদের নারীগণকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে, অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের দেই আল্লাহর লানত।” — (সূরা আলে ইমরান: ৬১)
আমি তাকে বললাম: এই আয়াত থেকে দলিল গ্রহণের কারণ কী?
তখন তিনি বললেন: তার কারণ হল, যখন নাজরানের খ্রিষ্টানগণ ‘মুবাহালা’ করার জন্য আগমন করল, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হোসাইনকে কোলে নিলেন; হাসানের হাত ধরলেন; ফাতিমাকে তাদের পিছনে এবং আলীকে তার (ফাতেমার) পিছনে রাখলেন; আর তিনি দো‘য়ার ক্ষেত্রে উত্তম ও মর্যাদাবানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
আমি বললাম: এটা ‘মানাকিব’ তথা মানুষের উত্তম গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত; ফযিলত তথা মর্যাদার বিষয় নয়। আর প্রত্যেক সাহাবীই এমন কিছু বিশেষ গুণের দ্বারা বিশেষিত যা অন্যের মধ্যে পাওয়া যায় না; প্রত্যেক সীরাত গ্রন্থের পাঠকই তা পরিস্কারভাবে অবগত আছেন। আর তাছাড়া আল-কুরআন নাযিল হয়েছে আরবদের বাকরীতি ও তাদের পারস্পরিক কথপোকথন পদ্ধতির আলোকে। যদি ধরা হয় যে, দুই গোষ্ঠীর দুই বড় মহান ব্যক্তির মধ্যে যুদ্ধ ও বিতর্ক সংঘটিত হল; একজন অপরজনকে বলল: তুমি ও তোমার বিশেষ গোষ্ঠীর লোক বের হও; আর আমি ও আমার বিশেষ গোষ্ঠীর লোক বের হচ্ছি; অতঃপর আমরা পরস্পর মোকাবিলা করব, অন্য গোষ্ঠীর কোন লোক আমাদের সাথে আসবে না। এই কথার অর্থ এই নয় যে, মহান ব্যক্তিদ্বয়ের সাথে তাদের বিশেষ গোষ্ঠীর চেয়ে অন্য কোন বীর পুরুষ পাওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে নিকটতম লোকদের উপস্থিতিতে দো‘য়াও বিনয়কে আবশ্যক করে তোলে, যাতে দো‘য়া দ্রুত কবুল হয়।
অতঃপর তিনি বললেন: এই ধরনের বিনয়-নম্রতা অধিক মহব্বত ব্যতীত সৃষ্টি হয় না।
আর আমি বললাম: এই ধরনের মহব্বত স্বভাব ও প্রকৃতির দিকে ধাবিত; যেমনিভাবে মানুষের ভালবাসা তার নিজের ও সন্তানের প্রতি তার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান ব্যক্তির চেয়েও অধিক বেশি। সুতরাং এই ধরনের ভালবাসা পাপ ও পুণ্য কিছুই দাবি বা আবশ্যক করে না। আর সীমিত ভালবাসা যা দু’টি অগ্রসর বস্তুর একটিকে আবশ্যক করে তোলে; আর তা হল ঐচ্ছিক ভালবাসা।
অতঃপর তিনি বললেন: আয়াতের মধ্যে আরও একটি দিক রয়েছে যা আফযালিয়ত তথা অধিক উত্তমতাকে আবশ্যক করে; আর তা হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের নফসকে আলী’র নফসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ, তাঁর কথার মধ্যে আছে " أبناءنا " (আমাদের ছেলে সন্তান), যার দ্বারা উদ্দেশ্য হল: হাসান ও হোসাইন; আর " نساءنا " (আমাদের স্ত্রী)-এর মধ্যে উদ্দেশ্য হল ফাতেমা; আর " أنفسنا " (আমাদের নফস)-এর মধ্যে আলী ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আর অন্য কেউ অবশিষ্ট নেই।
তখন আমি বললাম: আল্লাহই ভাল জানেন; আপনার তো দেখছি উসূল তথা মূলনীতিমালার ব্যাপারে কোন ধারণা নেই! বরং আপনি আরবীও ভাল জানেন না!! কিভাবে " أنفسنا " (আমাদের নফস)-এর ব্যাখ্যা করা হল; অথচ " الأنفس " হল جمع قلة যা " نا " -এর দিকে إضافة (সম্মন্ধ) হয়েছে; যার দ্বারা সকলকে বুঝায়। আর جمع (বহুবচন)-এর মোকাবিলায় جمع (বহুবচন)-এর দ্বারা এককসমূহকে বিভক্তকরণ আবশ্যক করে। যেমন আমাদের কথা:
" ركب القوم دوابهم " أي ركب كل واحد دابته .
অর্থাৎ- “সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের বাহনসমূহে আরোহন করল” অর্থাৎ— তাদের প্রত্যেকে তার বাহনে আরোহন করল।
আর এটা এমন একটি মাসআলা, যা উসূল তথা মূলনীতিমালার মধ্যেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়; আর جمع (বহুবচন)-এর ব্যাপারে চুড়ান্ত কথা হল: একের অধিক [অর্থাৎ " أنفسنا " (আমাদের নফস) শব্দটির মধ্যকার جمع (বহুবচন)-এর সিগাহ বা রূপটি একের অধিকের উপর প্রয়োগ হয়েছে; অর্থৎ- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু।] ব্যক্তি বা বস্তুর উপরই جمع (বহুবচন)-এর প্রয়োগ হবে। আর তা শ্রুত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী:
﴿ أُوْلَٰٓئِكَ مُبَرَّءُونَ مِمَّا يَقُولُونَۖ﴾ [ سورة النور : 26]
অর্থাৎ—“লোকে যা বলে, তারা তা থেকে পবিত্র”— (সূরা আন-নূর: ২৬); অর্থাৎ- আয়েশা ও সাফওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুমা।
এবং আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী:
﴿ فَقَدۡ صَغَتۡ قُلُوبُكُمَاۖ﴾ [ سورة التحريم : 4]
অর্থাৎ—“কারণ, তোমাদের হৃদয় ঝুঁকে পড়েছে।” — (সূরা আত-তাহরীম: ৪); অর্থাৎ- তাদের দু’জনের জন্য দু’টি হৃদয়ের বেশি হতে পারে না (অথচ قلوب শব্দ বহুবচন)। আহলুল মীযান [অর্থৎ- যুক্তিবিদ্যা ( علم المنطق )।] তথা তর্কশাস্ত্রবিদগণ جمع (বহুবচন)-এর পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে বলেন: একের অধিক বুঝানোর জন্যই جمع (বহুবচন)-এর ব্যবহার করা হয়। যেমনিভাবে হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র ক্ষেত্রে " الأبناء " শব্দটি ব্যবহার হয়েছে; আর রূপক অর্থে " النساء " শব্দটি শুধুমাত্র ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। হ্যাঁ, যদি " أنفسنا " (আমাদের নফস) শব্দটি " نفسي " শব্দ দ্বারা পরিবর্তন করা হয়, তবে কখনও কখনও প্রকাশ্য হিসাব অনুযায়ী একজনকে বুঝায়।
তাছাড়া আয়াতটি যদি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খিলাফতের উপর দলিল হতে পারে, তবে তা হাসান, হোসাইন ও ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের খিলাফতের উপরও সম্মিলিত অংশীদারিত্বের কারণে দলিল হতে পারে। তবে এ কথা কেউ বলে না; কেননা হাসান ও হোসাইন উভয় ছোট; আর ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা সকল নারীদের মত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন। সুতরাং আয়াতটি খিলাফতের উপর দলিল হতে পারে না।
অবশেষে তিনি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন!!
অতঃপর তিনি বললেন: আমার নিকট আরও একটি দলিল আছে; আর তা হল আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী:
﴿ إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَهُمۡ رَٰكِعُونَ ٥٥ ﴾ [ سورة المائدة : 55]
অর্থাৎ—“তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ যারা বিনত হয়ে সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়।” — (সূরা আল-মায়িদা: ৫৫)
তাফসীরবিদগণ একমত হয়েছেন যে, এই আয়াতটি আলী’র প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে, যখন তিনি তাঁর আংটিটি নামাযরত অবস্থায় ভিক্ষুককে দান করেছেন; আর " إنما " শব্দটি সীমিতকরণের জন্য; আর" الولي " শব্দটির অর্থ হল: “দানের ক্ষেত্রে তিনি তোমাদের চেয়ে উত্তম”।
তখন আমি বললাম: আমার নিকট এই আয়াতের অনেকগুলো জওয়াব রয়েছে।
আর আমি জওয়াব দেয়া শুরু করার পূর্বেই উপস্থিত কিছু সংখ্যক শী‘আ ফারসি ভাষায় মোল্লা বাশীকে সম্বোধন করে কিছু কথা বলল, যার অর্থ হচ্ছে: ওর সঙ্গে আলোচনা বাদ দাও; কারণ, সে একটা মূর্ত শয়তান! যখনই তুমি দলিলের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি বা অতিরঞ্জিত করছ, তখনই সে তোমাকে তার জওয়াব দিয়ে দিচ্ছে, আর তোমার মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে!!
অতঃপর সে আমার দিকে দৃষ্টি দিল এবং মুচকি হাসি হাসল! আর বলল:
নিশ্চয় আপনি একজন মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি, আপনি এর এবং অন্যান্য বিষয়ের জওয়াব দেবেন। কিন্তু আমার কথা তো ‘বাহরুল ইলম’-এর সাথে; তবে সে তো জওয়াব দিতে অক্ষম।
অতঃপর আমি বললাম: তোমার কথার শুরুতে যে কথা ছিল তা হল, “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিন্দাবাদে পারদর্শী কবিগণ তার জবাব দিতে সক্ষম হবে না!”?! সুতরাং সেই তো আমাকে তর্ক-বিতর্ক ও কথোপকথনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করেছে।
অতঃপর সে বলল: আমি পারসিক ব্যক্তি, আর আরবীও ভালভাবে বুঝতে পারি না, সুতরাং কোন কোন সময় আমার নিকট থেকে এমন শব্দ বের হয়ে যায়, যা আমার উদ্দেশ্য নয়!
অতঃপর আমি তাকে বললাম: তোমাকে আমি দু’টি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাই যার জওয়াব দিতে শী‘আ মতের অনুসারীগণ সক্ষম নয়!
তখন সে বলল: সেগুলো কী?
আমি বললাম: প্রথমটি হল, সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমের ব্যাপারে শী‘আদের অভিমত কী?
তখন সে বলল: তারা মুরতাদ হয়ে গেছে (পাঁচজন ব্যতীত, তারা হলেন: আলী, মিকদাদ, আবূ যর, সালমান ফারসী ও ‘আম্মার ইবন ইয়াসার); কেননা তারা খিলাফতের ব্যাপারে আলী’র নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেনি।
আমি বললাম: ব্যাপারটি যদি অনুরূপই হয়, তবে কিভাবে আলী তাঁর কন্যা উম্মে কুলসুমকে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমের নিকট বিয়ে দিয়েছিলেন??!
তখন সে বলল: তা জোরপূর্বক!
আমি বললাম: আল্লাহর কসম! আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারে তোমাদের আকিদা বা বিশ্বাস ঘাটতিপূর্ণ, যা কোন সামান্য মর্যাদার আরবও পছন্দ করবে না!! বনী হাশেম তো দূরে থাক, যারা আরবের নেতা, যাদের সম্মান হল আসল সম্মান , যাদের মর্যাদা হল আসল মর্যাদা, বংশগত দিক থেকে তাঁরা উচ্চ বংশের, মহত্বের দিক থেকে তাঁরা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও গর্বিত এবং তাঁদের অধিকাংশই উন্নত গুণাবলীর অধিকারী। একজন আদনা আরব তার ইজ্জত রক্ষায় তার জীবন বিলিয়ে দিতে পারে, তার স্ত্রীদের রক্ষায় মরতে পারে এবং তার ব্যক্তিসত্ত্বা তার স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনরে কারণেই শুধু সম্মানবোধ করে না। সুতরাং কিভাবে তোমরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ বিশ্বাস লালন কর, যা নিষ্ঠুর আরবগণ পর্যন্ত মানতে রাজি নয়; অথচ তিনি হলেন মহাবীর, বনী গালিবের সিংহ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে আল্লাহর সিংহ?! বরং আমরা কতজনকে দেখলাম, যে তার সন্তান-সন্তুতির জন্য লড়াই করেছে এবং নিহত হয়েছে।
সে বলল: হতে পারে ওমর উম্মে কুলসুমের আকৃতি ধারণকারীনী কোন জিনকে বিয়ে করেছেন?! [কুলাইনী “আল-ফুরু‘ মিনাল কাফী ( الفروع من الكافي ) নামক কিতাবের হা/২ পৃ.৩১১ -এর মধ্যে ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী কোথায় ইদ্দত পালন করবে’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেন: যখন ওমর ইন্তিকাল করে, তখন আলী উম্মে কুলসুমের নিকট গমন করেন; অতঃপর তাকে নিয়ে তার বাড়িতে আসেন। এই বর্ণনার অনুরূপ বর্ণনা করেছেন আবূ জাফর আল-তুসী তার ‘তাহযীবুল আহকাম’ ( تهذيب الأحكام ) নামক কিতাবের হা/২ পৃ.২৮০ -এর “বাবু ইদ্দাতিন নিসা”-এর মধ্যে।]
আমি বললাম: এটা তো প্রথমটার চেয়েও জঘন্য, এ ধরনের কথা কিভাবে বোধগম্য হয়?! আর আমরা যদি এই দরজা খুলে দেই, তবে শরীয়তের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যাবে; এমনকি যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর নিকট আসে, তবে সে এই কথা বলার সম্ভাবনা রাখে যে, তুমি জিন, আমার স্বামীর আকৃতি ধারণ করেছ, সুতরাং সে তাকে তার নিকট গমন করতে নিষেধ করবে। অতঃপর সে যদি দুইজন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী নিয়ে এসে সাক্ষ্য দেয়ার ব্যবস্থা করায় যে, সে অমুক, তবে তাদের ব্যাপারে এই কথা বলার সম্ভাবনা রয়েছে যে, তারা উভয়ে জিন, এই দুই ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির আকৃতি ধারণ করে এখানে এসেছে; আর এভাবে চলতে থাকবে ... এবং সম্ভাবনা রয়েছে যে, মানুষ কাউকে হত্যা করবে অথবা সে তার নিকট অধিকার (হক) দাবি করবে; অতঃপর তাকে সে বলবে: ঐ ঘটনায় আমি হক বা অধিকার দাবি করিনি; বরং সম্ভবত সে জিন, আমার আকৃতি ধারণ করেছে এবং জাফর সাদিক, যার মাযহাব অনুযায়ী তোমাদের ইবাদত- বন্দেগী হয়ে থাকে বলে তোমরা ধারণা করে থাক, সেও জিন তার (জাফর সাদিকের) আকৃতি ধারণ করেছে এবং স্বীকৃত এসব বিধি-বিধান তোমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে!!
অতঃপর আমি তাকে বললাম: অত্যাচারী খলিফার কর্মসমূহের বিধান কী? শী‘আদের নিকট তা কার্যকর কিনা?
তখন সে বলল: বিশুদ্ধ মনে করে না এবং কার্যকরও করে না।
অতঃপর আমি বললাম: আল্লাহ তোমাকে সন্ধান দিন, মুহাম্মদ ইবন হানাফীয়া ইবন আলী ইবন আবি তালিবের মা কোন বংশের লোক?
তখন সে বলল: বনী হানীফার।
অতঃপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম: বনী হানীফাকে কে বন্দী করেছে?!
সে বলল: আমি জানি না (অথচ সে মিথ্যা বলেছে)!
অতঃপর তাদের উপস্থিত আলেমদের কেউ কেউ বলল: তাদেরকে আবূ বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বন্দী করেছে।
অতঃপর আমি বললাম: আলী’র জন্য যুদ্ধবন্দী দাসীকে বিয়ে করা এবং তার থেকে সন্তান জন্ম দেওয়া কিভাবে বৈধ হল; অথচ তোমাদের ধারণা অনুযায়ী ইমাম অত্যাচারী খলিফার কোন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে না; আর লজ্জাস্থানের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা তো একটা স্বীকৃত বিষয়!
অতঃপর সে বলল: সম্ভবত তিনি তার পরিবারের নিকট তাকে দান করতে অনুরোধ করেছেন। অর্থাৎ- তারা তাকে তার সাথে বিয়ে দিয়েছে।
আমি বললাম: এই বিষয়ে দলিলের প্রয়োজন রয়েছে।
অতঃপর সে চুপসে গেছে!! আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত)।
অতঃপর আমি বললাম: আমি তোমার সামনে কোন হাদিস ও আয়াত নিয়ে আসিনি এই জন্য যে, যখনই আমি হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বলব, “প্রসিদ্ধ ছয়টি কিতাবের সংকলকদের কেউ অথবা অন্য কেই তা বর্ণনা করেছেন”, তখন তুমি বলবে: আমি তাকে বিশুদ্ধ বলি না, আর দলিলের শর্ত হল যে, তার ব্যাপারে বিবাদকারীগণ একমত হবেন। আর আমি যদি তোমার নিকট কোন আয়াত নিয়ে আসতাম এবং বলতাম, “তাফসীরবিদগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, তার হুকুম এই এবং তা নাযিল হয়েছে আবূ বকরের শানে”, তখন তুমি বলতে: তাফসীরবিদগণের ইজমা আলী’র দলিল হতে পারে না; দূরবর্তী কোন তাবীলের কথা উল্লেখ করতে এবং বলতে: দলিল যখন সন্দেহযুক্ত হবে, তখন তার দ্বারা দলিল পেশ করাটা বাতিল বলে গণ্য হবে। সুতরাং এটাই আমাকে প্রলুব্ধ করেছে আয়াত ও হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করা থেকে বিরত থাকতে।
অতঃপর শাহ আসল বিতর্ক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ফরমান জারি করলেন এবং নির্দেশ দিলেন ইরান, আফগান ও ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر )-এর আলেমদেরকে একত্রিত হয়ে পারস্পরিক ‘কাফির বলাবলির বিষয়গুলো’ দূর করার জন্য; আর আমি থাকব তাদের পর্যবেক্ষক, শাহের পক্ষের উকিল (প্রতিনিধি) এবং তিন ফিরকা (দল) যেসব ঐক্যমত পোষণ করবে তার সাক্ষী।
অতঃপর আমরা তাঁবুর সীমানা থেকে বের হলাম এমতাবস্থায় যে, আফগান, উজবেকিস্তান ও পারসিকগণ আঙুল দ্বারা আমার দিকে কী একটা ইঙ্গিত করছে; আর ঐ দিনটি ছিল দেখার মত এক দিন!!
ইরানের আলেমগণ ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সমাধির পেছনে অবস্থিত ছাদের নীচে একত্রিত হল। তাদের মধ্যে আরদালানের [আরদালান পশ্চিম ইরানের অঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি এলাকা; তার অধিবাসীগণ কুর্দি জাতির অন্তর্ভূক্ত। আর তার উত্তরে রয়েছে আযারবাইজান; আর পশ্চিমে রয়েছে ওসমানীয়া কুর্দি অঞ্চল; আর দক্ষিণে রয়েছে লারাস্তান এবং তার পূর্বে রয়েছে ইরাকে ‘আজম। আর তা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল: উত্তর অঞ্চল, তার প্রধান নগর হল সানা নগর এবং দক্ষিণ অঞ্চল যাকে ‘কারমানশাহ’ নামে নামকরণ করা হয়েছে, তার প্রধান নগর হল কারমানশাহ।] মুফতি ব্যতীত কোন সুন্নী আলেম ছিল না। অতঃপর আমি কাগজ-কলম চেয়ে নিলাম এবং তাদের প্রসিদ্ধ আলেমদের নাম লিপিবদ্ধ করে নিলাম। আর তারা হলেন:
১. মোল্লা বাশী আলী আকবর।
২. রেকাবের মুফতি আকা হোসাইন।
৩. মোল্লা মুহাম্মদ, লাহজানের ইমাম।
৪. আকা শরীফ, মুফতি মাশহাদ রেযা।
৫. মির্জা বুরহান, শিরওয়ানের কাযী।
৬. শাইখ হোসাইন, উরমিয়ার মুফতি।
৭. মির্জা আবূল ফদল, কুমের মুফতি।
৮. আলহাজ্ব সাদেক, জামের মুফতি।
৯. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ মাহদী, আস্ফাহানের ইমাম।
১০. আলহাজ্ব মুহাম্মদ যাকী, কারমানশাহের মুফতি।
১১. আলহাজ্ব মুহাম্মদ আল-ছামানী, সিরাযের মুফতি।
১২. মির্জা আসাদুল্লাহ, তাবরীযের মুফতি।
১৩. মোল্লা তালিব, মাযান্দারানের মুফতি।
১৪. মোল্লা মুহাম্মদ মাহদী, মাশহাদ রেযা’র উপ-প্রধানমন্ত্রী।
১৫. মোল্লা মুহাম্মদ সাদেক, বাখালখালের মুফতি।
১৬. মুহাম্মদ মুমিন, আস্তরাবাদের মুফতি।
১৭. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তকী, কাযবীনের মুফতি।
১৮. মোল্লা মুহাম্মদ হোসাইন, সাবযাওয়ারের মুফতি।
১৯. সাইয়্যেদ বাহাউদ্দীন, কারমানের মুফতি।
২০. সাইয়্যেদ আহমদ, আরদালানের মুফতি শাফেয়ী প্রমুখ আলেমগণ।
অতঃপর আফগানের আলেমগণ আগমন করলেন; আর আমি তাদের নামসমূহ লিখে নিলাম। তারা হলেন:
১. সম্মানিত শাইখ মোল্লা হামযা আল-কালানজানী আল-হানাফী, আফগানের মুফতি।
২. মোল্লা আমীন আফগানী আল-কালানজানী, আফগানের কাযী।
৩. মোল্লা তহা আফগানী আল-হানাফী, শিক্ষক, নাদিরাবাদ।
৪. মোল্লা দুনিয়া আল-খলিফী আল-হানাফী।
৫. মোল্লা নূর মুহাম্মদ আফগানী আল-কালানজানী আল-হানাফী।
৬. মোল্লা আবদুর রাজ্জাক আফগানী আল-কালানজানী আল-হানাফী।
৭. মোল্লা ইদ্রিস আফগানী আল-আবদালী আল-হানাফী।
তার কিছুক্ষণ পর ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر ) অঞ্চলের আলেমগণ আগমন করলেন; আর তাদের সংখ্যা ছিল সাতজন, তাদের সামনে ছিলেন একজন সম্মানিত শাইখ যার চেহারায় ছিল শ্রদ্ধাবোধের ছাপ এবং মাথায় ছিল পেঁচানো পাগড়ি, যা দর্শকদেরকে ইমাম আবূ হানিফার র.-এর ছাত্র আবূ ইউসুফ র.-কে স্মরণ করিয়ে দেয়। অতঃপর তিনি তাদের সালাম দিলেন; আর তারা তাঁকে আমার ডান পাশে বসিয়ে দিলেন। তবে আমার ও তাঁর মাঝে প্রায় পনের ব্যক্তির মত বসা ছিল; আর আফগানদের বসানো হয়েছে আমার বাম দিকে; অনুরূপভাবে এখানেও আমার ও তাঁর মাঝে প্রায় পনের ব্যক্তি বসা ছিল। আর এই বসানোর মধ্যেও পারসিকদের ষড়যন্ত্র ও কৌশল ছিল! তারা আশঙ্কা করেছিল যে, আমি তাদেরকে কিছু কথা তালকিন দেব অথবা তাদেরকে ইঙ্গিত দেব। অতঃপর আমি তাদের নামসমূহও লিখে নিলাম। তারা হলেন:
১. আল্লামা হাদী খাজা ওরফে বাহরুল ইলম, ইবন ‘আলাউদ্দীন আল-বুখারী আল-হানাফী, বুখারার কাযী।
২. মীর আবদুল্লাহ সদুর আল-বুখারী আল-হানাফী।
৩. কালান্দর খাজা আল-বুখারী আল-হানাফী।
৪. মোল্লা আমীদ সদুর আল-বুখারী আল-হানাফী।
৫. বাদশাহ মীর খাজা আল-বুখারী আল-হানাফী।
৬. মির্জা খাজা আল-বুখারী আল-হানাফী।
৭. মোল্লা ইবরাহীম আল-বুখারী আল-হানাফী।
অতঃপর যখন তাদেরকে বসানের পালা শেষ হল, মোল্লা বাশী বাহরুল ইলমকে সম্বোধন করে বললেন: তুমি কি এই ব্যক্তির পরিচয় জান? (তিনি আমাকে ইঙ্গিত করেন)।
তখন সে বলল: না।
সে (মোল্লা বাশী) বলল: তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মর্যাদাবান আলেমগণের অন্যতম শাইখ আবদুল্লাহ আফেনদী; উযির আহমদ পাশা’র শাহ তাকে এই মজলিসে হাজির হওয়ার জন্য তলব করেছেন। সুতরাং তিনি আমাদের মধ্যে বিচারক এবং শাহের প্রতিনিধি; অতএব যখন কোন হুকুমের উপর আমাদের রায় ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তিনি আমাদের সকলের উপর সাক্ষী থাকবেন। সুতরাং এখন তুমি তোমার সেসব বিষয় আমাদের নিকট খুলে বল, যেগুলোর কারণে তোমরা আমাদেরকে কাফির বলে থাক, যাতে তার উপস্থিতিতেই আমরা তা দূর করতে পারি। আর মূলত আমরা আবূ হানিফা’র মতানুসারে কাফির নই; ‘জামে‘উল উসূল’ ( جامع الأصول ) গ্রন্থে বলা হয়েছে, “ইসলামের পরিধি পাঁচটি মাযহাবের উপর” এবং তিনি পঞ্চম মাযহাব হিসেবে “ইমামীয়া মাযহাব”-কে গণ্য করেছেন। অনুরূপভাবে ‘মাওয়াকেফ’ ( المواقف ) গ্রন্থকারও “ইমামীয়া মাযহাব”-কে ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেছেন। আর আবূ হানিফা র. ‘আল-ফিকহুল আকবর’ ( الفقه الأكبر ) গ্রন্থে বলেছেন: “আমরা আহলুল কিবলাকে কাফির বলি না”। আর সাইয়্যিদ অমুক (সে তার স্পষ্ট নাম উল্লেখ করেছিলেন, তবে আমি ভুলে গেছি) “হেদায়া” গ্রন্থের শরাহ (ব্যাখ্যা) ‘আল-ফিকহুল হানাফী’ ( الفقه الحنفي )-এর মধ্যে বলেন: “বিশুদ্ধ কথা হল, ইমামীয়াগণ ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত”। কিন্তু পরবর্তী আলেমগণ তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে আমাদেরকে কাফির বলেছে, ঠিক একইভাবে আমাদের পরবর্তী আলেমগণ তোমাদেরকে কাফির বলেছে; অথচ আমরা এবং তোমরা কেউই কাফির নই। কিন্তু তুমি সেসব বিষয় আমাদের সামনে পেশ কর, যেগুলো তোমাদের পরবর্তী আলেমগণ উল্লেখ করেছে এবং যার কারণে তারা আমাদেরকে কাফির বলছে, যাতে আমরা তা দূর করতে পারি।
অতঃপর হাদী খাজা বলল:
শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে তোমরা গালি দেয়ার কারণে তোমরা কাফির।
তখন মোল্লা বাশী বলল: শায়খাইনকে গালি দেওয়াটা আমরা প্রত্যাহার করে নিলাম।
অতঃপর সে বলল: সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে তোমরা পথভ্রষ্ট ও কাফির বলার কারণে তোমরা কাফির।
তখন মোল্লা বাশী বলল: সাহাবীগণ সকলেই ন্যায়পরায়ণ; আল্লাহ তাদের প্রাতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট!
অতঃপর সে বলল: তোমরা মুতা‘ বিবাহকে (সাময়িক বিবাহকে) হালাল বল।
তখন মোল্লা বাশী বলল: এটা হারাম; আমাদের মধ্যকার নির্বোধরাই তা গ্রহণ করে!
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: তোমরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর মর্যাদা দিয়ে থাক এবং বলে থাক: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তিনিই (আলী) প্রকৃত খলিফা।
তখন মোল্লা বাশী বলল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সর্বোত্তম সৃষ্টি হল আবূ বকর ইবন আবি কুহাফা, তারপর ওমর ইবন খাত্তাব, তারপর ওসমান ইবন ‘আফফান এবং তারপর আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুম। আর তাঁদের খিলাফতের ধারাবাহিকতা হল তদ্রূপ, আমারা তাঁদের মর্যাদা বর্ণনার ক্ষেত্রে যেরূপ ধারাবাহিকতা উল্লেখ করেছি।
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: তোমাদের উসূল (মূলনীতিমালা) এবং আকিদা কী?
তখন মোল্লা বাশী বলল: আবূল হাসান আল-আশ‘আরী’র আকিদার ভিত্তিতে আমদের উসূল হল আশা‘য়েরা।
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: আমি তোমাদের শর্ত আরোপ করতে চাই যে, তোমরা দীনের মধ্যে যেসব সুনির্দষ্ট হারাম রয়েছে এবং যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে, তা হালাল করবে না এবং দীনের মধ্যে যেসব সুনির্দষ্ট হালাল রয়েছে এবং যা হালাল হওয়ার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে, তা হারাম করবে না।
তখন মোল্লা বাশী বলল: আমরা এই শর্ত মেনে নিলাম!
অতঃপর বাহরুল ইলম তাদের উপর আরও কিছু শর্ত আরোপ করল যা কাউকে কাফির বানায় না, যেমন কিছু শর্ত পূর্বে আলোচনা হয়েছে; আর তারা তাও গ্রহণ করেছে।
অতঃপর মোল্লা বাশী বাহরুল ইলমকে বলল: আমরা যখন সকল কিছু মেনে নিয়েছি, তখন তুমি আমাদেরকে ইসলামী ফিরকা তথা ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করছ তো?!
তখন বাহরুল ইলম চুপ থাকল, অতঃপর বলল:
শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে গালি দেয়া কুফরী।
তখন মোল্লা বাশী বলল: শায়খাইনকে গালি দেওয়াটা আমরা প্রত্যাহার করে নিলাম এবং আরও এই এইগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছি (পূর্বে উল্লেখিত শর্তের শেষ পর্যন্ত); তরপরও কি আমাদেরকে সত্যি সত্যি ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করবে, নাকি আমাদেরেকে কাফির বলে বিশ্বাস করবে?
তখন বাহরুল ইলম আবার চুপ থাকল, অতঃপর বলল:
শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে গালি দেয়া কুফরী।
তখন সে বলল: আমরা কি তা প্রত্যাহার করে নেই নি?
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: তোমরা আর কী প্রত্যাহার করে নিয়েছ?
তখন সে বলল: আমরা এই এইগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছি (পূর্বে উল্লেখিত শর্তের শেষ পর্যন্ত); সুতরাং এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি কি আমাদেরকে ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করবে?
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে গালি দেয়া কুফরী।
আর বাহরুল ইলমের বার বার একই কথা বলার উদ্দেশ্য হল, যার পক্ষ থেকে শায়খাইনকে গালি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে, হানাফী মাযহাব মতে তার তাওবা কবুল হবে না; আর ঐসব পারসিকদের পক্ষ থেকে গালি দেয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে প্রথমে, আর এই সময়ের মধ্যে তাদের গালি প্রত্যাহারকরণ তাদের কোন উপকারে আসবে না।
অতঃপর আফগান মুফতি মোল্লা হামযা বলেন: হে হাদী খাজা! এই মজলিসের পূর্বে তাদের পক্ষ থেকে শায়খাইনকে গালি দেয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, এই ব্যাপারে তোমার নিকট কোন প্রমাণ আছে কি?
সে বলল: না।
অতঃপর মোল্লা হামযা বলেন: তাদের নিকট থেকে তো মেনে নেয়ার মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে যে, তাদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না। সুতরাং কেন তুমি তাদেরকে ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করছ না?
বাহরুল ইলম বলল: ব্যাপারটি যখন এই রকম, তখন তারা মুসলিম। আমাদের জন্য যা, তাদের জন্যও তাই; আর আমাদের বিপক্ষে যা, তা তাদেরও বিপক্ষে।
অতঃপর তারা সকলেই দাঁড়িয়ে গেল এবং পরস্পর মুসাহাফা (করমর্দন) করল; আর তাদের একজন অপরজনকে বলল: “হে আমার ভাই তোমাকে স্বাগতম”! আর তিন দলই তাদের পক্ষ থেকে যা ঘটল, তার ব্যাপারে আমাকে সাক্ষী বানাল এবং তারা সকলেই তা মেনে নিল।
অতঃপর শাওয়াল মাসের ২৪ তারিখ বুধবার মাগরিবের কিছুক্ষণ পূর্বে সমাবেশ শেষ হল; তখন আমি দেখলাম আমদের মাথার উপর চতুর্দিকে বেষ্টনী দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পারিসিকদের মধ্য থেকে দশ হাজারেরও বেশি লোক!
আর যখন শাহের নিকট থেকে তার উজির [তিনি হচ্ছেন ই‘তিমাদুদ দৌলাহ, শাইখ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’ যার আতিথেয়তায় ছিলেন।] আগমন করল, আর সে সেখানে তার অভ্যাসমত রাতের চার ঘন্টা সময় কাটিয়েছে, তখন সে আমাকে বলল: শাহ আপনার কাজের প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, আপনার নিকট সালাম পাঠিয়েছেন এবং আপনার নিকট প্রত্যাশা করেছেন যে, আপনি যেন আগামী কাল তাদের সাথে প্রথম জায়গায় উপস্থিত হন। কারণ, আমি তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছি যে, তারা যেন তারা যা স্বীকার করেছে এবং মেনে নিয়েছে, তার সবকিছু একটা কাগজে লিখে নেয় এবং তাদের প্রত্যেকে স্বীয় নামের নীচে স্বাক্ষর ও সীল দিয়ে দেয়; আর আমি আপনার নিকট আশা করছি যে, আপনি কাগজের উপরে সামনের অংশে আপনার সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করবেন এইভাবে যে, তিন ফিরকা (দল) যা মেনে নিয়েছে এবং স্বীকার করেছে, তা আমি সাক্ষী হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছি এবং আপনার নামের নীচে আপনার স্বাক্ষর ও সীল দিয়ে দেবেন।
তখন আমি বললাম: আপনাকে অনেক ভালবাসা ও সম্মান।
১. মোল্লা বাশী আলী আকবর।
২. রেকাবের মুফতি আকা হোসাইন।
৩. মোল্লা মুহাম্মদ, লাহজানের ইমাম।
৪. আকা শরীফ, মুফতি মাশহাদ রেযা।
৫. মির্জা বুরহান, শিরওয়ানের কাযী।
৬. শাইখ হোসাইন, উরমিয়ার মুফতি।
৭. মির্জা আবূল ফদল, কুমের মুফতি।
৮. আলহাজ্ব সাদেক, জামের মুফতি।
৯. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ মাহদী, আস্ফাহানের ইমাম।
১০. আলহাজ্ব মুহাম্মদ যাকী, কারমানশাহের মুফতি।
১১. আলহাজ্ব মুহাম্মদ আল-ছামানী, সিরাযের মুফতি।
১২. মির্জা আসাদুল্লাহ, তাবরীযের মুফতি।
১৩. মোল্লা তালিব, মাযান্দারানের মুফতি।
১৪. মোল্লা মুহাম্মদ মাহদী, মাশহাদ রেযা’র উপ-প্রধানমন্ত্রী।
১৫. মোল্লা মুহাম্মদ সাদেক, বাখালখালের মুফতি।
১৬. মুহাম্মদ মুমিন, আস্তরাবাদের মুফতি।
১৭. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তকী, কাযবীনের মুফতি।
১৮. মোল্লা মুহাম্মদ হোসাইন, সাবযাওয়ারের মুফতি।
১৯. সাইয়্যেদ বাহাউদ্দীন, কারমানের মুফতি।
২০. সাইয়্যেদ আহমদ, আরদালানের মুফতি শাফেয়ী প্রমুখ আলেমগণ।
অতঃপর আফগানের আলেমগণ আগমন করলেন; আর আমি তাদের নামসমূহ লিখে নিলাম। তারা হলেন:
১. সম্মানিত শাইখ মোল্লা হামযা আল-কালানজানী আল-হানাফী, আফগানের মুফতি।
২. মোল্লা আমীন আফগানী আল-কালানজানী, আফগানের কাযী।
৩. মোল্লা তহা আফগানী আল-হানাফী, শিক্ষক, নাদিরাবাদ।
৪. মোল্লা দুনিয়া আল-খলিফী আল-হানাফী।
৫. মোল্লা নূর মুহাম্মদ আফগানী আল-কালানজানী আল-হানাফী।
৬. মোল্লা আবদুর রাজ্জাক আফগানী আল-কালানজানী আল-হানাফী।
৭. মোল্লা ইদ্রিস আফগানী আল-আবদালী আল-হানাফী।
তার কিছুক্ষণ পর ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر ) অঞ্চলের আলেমগণ আগমন করলেন; আর তাদের সংখ্যা ছিল সাতজন, তাদের সামনে ছিলেন একজন সম্মানিত শাইখ যার চেহারায় ছিল শ্রদ্ধাবোধের ছাপ এবং মাথায় ছিল পেঁচানো পাগড়ি, যা দর্শকদেরকে ইমাম আবূ হানিফার র.-এর ছাত্র আবূ ইউসুফ র.-কে স্মরণ করিয়ে দেয়। অতঃপর তিনি তাদের সালাম দিলেন; আর তারা তাঁকে আমার ডান পাশে বসিয়ে দিলেন। তবে আমার ও তাঁর মাঝে প্রায় পনের ব্যক্তির মত বসা ছিল; আর আফগানদের বসানো হয়েছে আমার বাম দিকে; অনুরূপভাবে এখানেও আমার ও তাঁর মাঝে প্রায় পনের ব্যক্তি বসা ছিল। আর এই বসানোর মধ্যেও পারসিকদের ষড়যন্ত্র ও কৌশল ছিল! তারা আশঙ্কা করেছিল যে, আমি তাদেরকে কিছু কথা তালকিন দেব অথবা তাদেরকে ইঙ্গিত দেব। অতঃপর আমি তাদের নামসমূহও লিখে নিলাম। তারা হলেন:
১. আল্লামা হাদী খাজা ওরফে বাহরুল ইলম, ইবন ‘আলাউদ্দীন আল-বুখারী আল-হানাফী, বুখারার কাযী।
২. মীর আবদুল্লাহ সদুর আল-বুখারী আল-হানাফী।
৩. কালান্দর খাজা আল-বুখারী আল-হানাফী।
৪. মোল্লা আমীদ সদুর আল-বুখারী আল-হানাফী।
৫. বাদশাহ মীর খাজা আল-বুখারী আল-হানাফী।
৬. মির্জা খাজা আল-বুখারী আল-হানাফী।
৭. মোল্লা ইবরাহীম আল-বুখারী আল-হানাফী।
অতঃপর যখন তাদেরকে বসানের পালা শেষ হল, মোল্লা বাশী বাহরুল ইলমকে সম্বোধন করে বললেন: তুমি কি এই ব্যক্তির পরিচয় জান? (তিনি আমাকে ইঙ্গিত করেন)।
তখন সে বলল: না।
সে (মোল্লা বাশী) বলল: তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মর্যাদাবান আলেমগণের অন্যতম শাইখ আবদুল্লাহ আফেনদী; উযির আহমদ পাশা’র শাহ তাকে এই মজলিসে হাজির হওয়ার জন্য তলব করেছেন। সুতরাং তিনি আমাদের মধ্যে বিচারক এবং শাহের প্রতিনিধি; অতএব যখন কোন হুকুমের উপর আমাদের রায় ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তিনি আমাদের সকলের উপর সাক্ষী থাকবেন। সুতরাং এখন তুমি তোমার সেসব বিষয় আমাদের নিকট খুলে বল, যেগুলোর কারণে তোমরা আমাদেরকে কাফির বলে থাক, যাতে তার উপস্থিতিতেই আমরা তা দূর করতে পারি। আর মূলত আমরা আবূ হানিফা’র মতানুসারে কাফির নই; ‘জামে‘উল উসূল’ ( جامع الأصول ) গ্রন্থে বলা হয়েছে, “ইসলামের পরিধি পাঁচটি মাযহাবের উপর” এবং তিনি পঞ্চম মাযহাব হিসেবে “ইমামীয়া মাযহাব”-কে গণ্য করেছেন। অনুরূপভাবে ‘মাওয়াকেফ’ ( المواقف ) গ্রন্থকারও “ইমামীয়া মাযহাব”-কে ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেছেন। আর আবূ হানিফা র. ‘আল-ফিকহুল আকবর’ ( الفقه الأكبر ) গ্রন্থে বলেছেন: “আমরা আহলুল কিবলাকে কাফির বলি না”। আর সাইয়্যিদ অমুক (সে তার স্পষ্ট নাম উল্লেখ করেছিলেন, তবে আমি ভুলে গেছি) “হেদায়া” গ্রন্থের শরাহ (ব্যাখ্যা) ‘আল-ফিকহুল হানাফী’ ( الفقه الحنفي )-এর মধ্যে বলেন: “বিশুদ্ধ কথা হল, ইমামীয়াগণ ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত”। কিন্তু পরবর্তী আলেমগণ তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে আমাদেরকে কাফির বলেছে, ঠিক একইভাবে আমাদের পরবর্তী আলেমগণ তোমাদেরকে কাফির বলেছে; অথচ আমরা এবং তোমরা কেউই কাফির নই। কিন্তু তুমি সেসব বিষয় আমাদের সামনে পেশ কর, যেগুলো তোমাদের পরবর্তী আলেমগণ উল্লেখ করেছে এবং যার কারণে তারা আমাদেরকে কাফির বলছে, যাতে আমরা তা দূর করতে পারি।
অতঃপর হাদী খাজা বলল:
শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে তোমরা গালি দেয়ার কারণে তোমরা কাফির।
তখন মোল্লা বাশী বলল: শায়খাইনকে গালি দেওয়াটা আমরা প্রত্যাহার করে নিলাম।
অতঃপর সে বলল: সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে তোমরা পথভ্রষ্ট ও কাফির বলার কারণে তোমরা কাফির।
তখন মোল্লা বাশী বলল: সাহাবীগণ সকলেই ন্যায়পরায়ণ; আল্লাহ তাদের প্রাতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট!
অতঃপর সে বলল: তোমরা মুতা‘ বিবাহকে (সাময়িক বিবাহকে) হালাল বল।
তখন মোল্লা বাশী বলল: এটা হারাম; আমাদের মধ্যকার নির্বোধরাই তা গ্রহণ করে!
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: তোমরা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর মর্যাদা দিয়ে থাক এবং বলে থাক: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তিনিই (আলী) প্রকৃত খলিফা।
তখন মোল্লা বাশী বলল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সর্বোত্তম সৃষ্টি হল আবূ বকর ইবন আবি কুহাফা, তারপর ওমর ইবন খাত্তাব, তারপর ওসমান ইবন ‘আফফান এবং তারপর আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুম। আর তাঁদের খিলাফতের ধারাবাহিকতা হল তদ্রূপ, আমারা তাঁদের মর্যাদা বর্ণনার ক্ষেত্রে যেরূপ ধারাবাহিকতা উল্লেখ করেছি।
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: তোমাদের উসূল (মূলনীতিমালা) এবং আকিদা কী?
তখন মোল্লা বাশী বলল: আবূল হাসান আল-আশ‘আরী’র আকিদার ভিত্তিতে আমদের উসূল হল আশা‘য়েরা।
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: আমি তোমাদের শর্ত আরোপ করতে চাই যে, তোমরা দীনের মধ্যে যেসব সুনির্দষ্ট হারাম রয়েছে এবং যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে, তা হালাল করবে না এবং দীনের মধ্যে যেসব সুনির্দষ্ট হালাল রয়েছে এবং যা হালাল হওয়ার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে, তা হারাম করবে না।
তখন মোল্লা বাশী বলল: আমরা এই শর্ত মেনে নিলাম!
অতঃপর বাহরুল ইলম তাদের উপর আরও কিছু শর্ত আরোপ করল যা কাউকে কাফির বানায় না, যেমন কিছু শর্ত পূর্বে আলোচনা হয়েছে; আর তারা তাও গ্রহণ করেছে।
অতঃপর মোল্লা বাশী বাহরুল ইলমকে বলল: আমরা যখন সকল কিছু মেনে নিয়েছি, তখন তুমি আমাদেরকে ইসলামী ফিরকা তথা ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করছ তো?!
তখন বাহরুল ইলম চুপ থাকল, অতঃপর বলল:
শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে গালি দেয়া কুফরী।
তখন মোল্লা বাশী বলল: শায়খাইনকে গালি দেওয়াটা আমরা প্রত্যাহার করে নিলাম এবং আরও এই এইগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছি (পূর্বে উল্লেখিত শর্তের শেষ পর্যন্ত); তরপরও কি আমাদেরকে সত্যি সত্যি ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করবে, নাকি আমাদেরেকে কাফির বলে বিশ্বাস করবে?
তখন বাহরুল ইলম আবার চুপ থাকল, অতঃপর বলল:
শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে গালি দেয়া কুফরী।
তখন সে বলল: আমরা কি তা প্রত্যাহার করে নেই নি?
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: তোমরা আর কী প্রত্যাহার করে নিয়েছ?
তখন সে বলল: আমরা এই এইগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছি (পূর্বে উল্লেখিত শর্তের শেষ পর্যন্ত); সুতরাং এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি কি আমাদেরকে ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করবে?
অতঃপর বাহরুল ইলম বলল: শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে গালি দেয়া কুফরী।
আর বাহরুল ইলমের বার বার একই কথা বলার উদ্দেশ্য হল, যার পক্ষ থেকে শায়খাইনকে গালি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে, হানাফী মাযহাব মতে তার তাওবা কবুল হবে না; আর ঐসব পারসিকদের পক্ষ থেকে গালি দেয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে প্রথমে, আর এই সময়ের মধ্যে তাদের গালি প্রত্যাহারকরণ তাদের কোন উপকারে আসবে না।
অতঃপর আফগান মুফতি মোল্লা হামযা বলেন: হে হাদী খাজা! এই মজলিসের পূর্বে তাদের পক্ষ থেকে শায়খাইনকে গালি দেয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, এই ব্যাপারে তোমার নিকট কোন প্রমাণ আছে কি?
সে বলল: না।
অতঃপর মোল্লা হামযা বলেন: তাদের নিকট থেকে তো মেনে নেয়ার মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে যে, তাদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না। সুতরাং কেন তুমি তাদেরকে ইসলামী ফিরকার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করছ না?
বাহরুল ইলম বলল: ব্যাপারটি যখন এই রকম, তখন তারা মুসলিম। আমাদের জন্য যা, তাদের জন্যও তাই; আর আমাদের বিপক্ষে যা, তা তাদেরও বিপক্ষে।
অতঃপর তারা সকলেই দাঁড়িয়ে গেল এবং পরস্পর মুসাহাফা (করমর্দন) করল; আর তাদের একজন অপরজনকে বলল: “হে আমার ভাই তোমাকে স্বাগতম”! আর তিন দলই তাদের পক্ষ থেকে যা ঘটল, তার ব্যাপারে আমাকে সাক্ষী বানাল এবং তারা সকলেই তা মেনে নিল।
অতঃপর শাওয়াল মাসের ২৪ তারিখ বুধবার মাগরিবের কিছুক্ষণ পূর্বে সমাবেশ শেষ হল; তখন আমি দেখলাম আমদের মাথার উপর চতুর্দিকে বেষ্টনী দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পারিসিকদের মধ্য থেকে দশ হাজারেরও বেশি লোক!
আর যখন শাহের নিকট থেকে তার উজির [তিনি হচ্ছেন ই‘তিমাদুদ দৌলাহ, শাইখ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’ যার আতিথেয়তায় ছিলেন।] আগমন করল, আর সে সেখানে তার অভ্যাসমত রাতের চার ঘন্টা সময় কাটিয়েছে, তখন সে আমাকে বলল: শাহ আপনার কাজের প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, আপনার নিকট সালাম পাঠিয়েছেন এবং আপনার নিকট প্রত্যাশা করেছেন যে, আপনি যেন আগামী কাল তাদের সাথে প্রথম জায়গায় উপস্থিত হন। কারণ, আমি তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছি যে, তারা যেন তারা যা স্বীকার করেছে এবং মেনে নিয়েছে, তার সবকিছু একটা কাগজে লিখে নেয় এবং তাদের প্রত্যেকে স্বীয় নামের নীচে স্বাক্ষর ও সীল দিয়ে দেয়; আর আমি আপনার নিকট আশা করছি যে, আপনি কাগজের উপরে সামনের অংশে আপনার সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করবেন এইভাবে যে, তিন ফিরকা (দল) যা মেনে নিয়েছে এবং স্বীকার করেছে, তা আমি সাক্ষী হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছি এবং আপনার নামের নীচে আপনার স্বাক্ষর ও সীল দিয়ে দেবেন।
তখন আমি বললাম: আপনাকে অনেক ভালবাসা ও সম্মান।
আর উল্লিখিত মাসের (শাওয়াল ১১৫৬ হি.) ২৫ তারিখ বৃহস্পতিবার যোহরের পূর্বে নির্দেশ আসল, যাতে আমরা সকলে প্রথম স্থানে উপস্থিত হই; ফলে আমরা সকলেই সেখানে একত্রিত হলাম, আর পারসিকগণ সমাধির দরজার দিকে গম্বুজের বাইরে বড় ধরেনের ভীড় করছিল যাদের সংখ্যা প্রায় ষাট হাজারে পৌঁছবে!!
অতঃপর আমরা যখন বসলাম, তখন তারা সাত বিগতের চেয়ে লম্বা এক পত্রিকা নিয়ে আসল; তার লাইনসমূহ তার দুই তৃতীয়াংশ পরিমাণ লম্বা; আর তৃতীয় একতৃতীয়াংশ চার ভাগে বিভক্ত, প্রত্যেক অংশকে ভাগ ভাগ করে দিয়েছে প্রায় চার আঙুল বা তার বেশি পরিমাণ সাদা অংশ দ্বারা; কিন্তু প্রথম লাইনসমূহরে চেয়ে অন্যান্য লাইনসমূহ অনেক ছোট। অতঃপর মোল্লা বাশী রেকাবের মুফতি আকা হোসাইনকে নির্দেশ দিলেন তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জনসমক্ষে পাঠ করার জন্য, আর সে ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী লম্বা মানুষ; অতঃপর সে পত্রিকাটি হাতে নিল, যা ফারসি ভাষায় লিখিত; তার মূলকথা ছিল:
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা রাসূল প্রেরণের প্রয়োজন মনে করলেন; ফলে তিনি রাসূলের পর রাসূল প্রেরণ করতে থাকলেন, শেষ পর্যন্ত আমাদের নবী মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত আসল।
আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন ইন্তিকাল করলেন, তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল; তখন সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম ঐক্যমত পোষণ করলেন যে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে যিনি মর্যাদাবান, উত্তম ও জ্ঞানী, তিনি হলেন আবূ বকর ইবন আবি কুহাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু । অতঃপর তারা তাঁর নিকট বায়‘আতের ব্যাপারে একমত হলেন এবং সকলেই তাঁর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন, এমনকি আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুও স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে কোন রকম জোর-জবরদস্তি ছাড়াই তাঁর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন; অতঃপর তাঁর বায়‘আত ও খিলাফত সমাপ্ত হল; আর সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের ইজমা হল অকাট্য দলিল, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্মানিত কিতাবে তাঁদের প্রশংসা করেছেন, তিনি বলেন:
﴿ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِِ﴾ [ سورة التوبة : 100]
“মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী...” — (সূরা তাওবা: ১০০)
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ لَّقَدۡۡ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ يُبَايِعُونَكَ تَحۡتَ ٱلشَّجَرَةِ ِ﴾ [ سورة الفتح : 18] الآية
“আল্লাহ তো মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা গাছের নীচে তোমার নিকট বায়‘আত গ্রহণ করল”। — (সূরা আল-ফাতহ: ১৮); আর সে সময় ওখানে সাতশত সাহাবী ছিলেন, তাঁরা সকলেই সিদ্দীকের নিকট বায়‘আতে উপস্থিত ছিলেন।
অতঃপর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের জন্য ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দিষ্ট করেছে; অতঃপর ইমাম আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ সকল সাহাবী তাঁর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন। আর ওসমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারেও তাঁদের ঐক্যবদ্ধ রায় ছিল।
অতঃপর ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাড়িতে শাহাদাত বরণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে কাউকে নির্দিষ্ট করে যেতে পারেন নি; সুতরাং খিলাফত শুন্য অবস্থায় রয়ে গেল; অতঃপর সাহাবীগণ ঐ সময়ে আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
আর তাঁরা চারজনই একই স্থানে এবং একই সময়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোন প্রকার দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও ঝগরা-ফ্যাসাদ সংঘটিত হয়নি; বরং তাঁদের প্রত্যেকেই একে অপরকে ভালবাসতেন এবং প্রশংসা ও গুণকীর্তন করতেন; এমনকি শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা সম্পর্কে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: তাঁরা উভয়ে ন্যায়পরায়ণ নেতা, তাঁরা হকের উপরে ছিলেন এবং হকের উপর মৃত্যু বরণ করেছেন। আর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তখন তিনি বলেন: তোমরা যে আমার নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেছ, তোমাদের মধ্যে কি আলী ইবন আবি তালিব ছিল?
সুতরাং হে ইরানের অধিবাসীগণ! তোমরা জেনে রাখ যে, তাঁদের মর্যাদা ও খিলাফত এই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী। সুতরাং যে কেউ তাঁদেরকে গালি দেবে অথবা তাঁদের ত্রুটি বর্ণনা করবে, তার সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি, পরিবার-পরিজন এবং তার রক্ত শাহের জন্য বৈধ; আর তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের লা‘নত!!
আর আমি হিজরি ১১৪৮ সালে মুগান মরুভূমিতে বায়‘আত গ্রহণের সময় তোমাদের সাথে গালি প্রত্যাহারের শর্ত আরোপ করেছিলাম; সুতরাং এখন আমি তা প্রত্যাহার করলাম। অতএব, যে ব্যক্তি (সাহাবীদেরকে) গালি দেবে, তাকে আমি হত্যা করব! তার সন্তান ও পরিবার-পরিজনকে বন্দী করব এবং তার মালামাল ক্রোক করব! ইরানের কোন প্রান্তে এবং তার আশে পাশে গালাগালি ও এ ধরনের কোন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড চলবে না। আর এই সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে ইতর ও অভদ্র শাহ ইসমাঈল আল-সাফাবী’র [ইবন শাইখ হায়দর ইবন শাইখ জুনাইদ ইবন শাইখ ইবরাহীম ইবন খাজা আলী ইবন শাইখ মূসা ইবন শাইখ সফিউদ্দীন ইসহাক আল-আরদাবেলী। শাহ ইসমাঈল ৮৯২ হিজরিতে জন্ম গ্রহণ করেছে এবং সাফাবী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছে; আর সে বাগদাদ দখল করেছে ৯১৫ হিজরিতে এবং ইরানের ইতিহাসে প্রথম বারের মত ৯১৬ হিজরিতে ঘোষণা করেছে যে, ইরানের রাষ্ট্রীয় মাযহাব হল শী‘আ মাযহাব; তার সাথে ৯২০ হিজরিতে সুলতান সলিম যুদ্ধ করে এবং তিনি ‘তাশালদিরান’ যুদ্ধে তার উপর বিজয় লাভ করেন; সে যুদ্ধে শাহ ইসমাঈল আহত হয় এবং পলায়ন করে। আর ঐ পরাজয়ের দশ বছর পর ৯৩০ হিজরিতে সে মারা যায় এবং আরদাবিলে তার পিতার পাশে তাকে দাফন করা হয়; সে যে শাস্তির উপযুক্ত, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাই তার উপর পতিত হোক!] আমলে। আর তার সন্তানগণ অব্যাহতভাবে তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত গালাগালি বৃদ্ধি পেয়েছে; বিদ‘আত ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভাঙ্গন ও অনৈক্য সম্প্রসারিত হল ৮৭৫ বছর ধরে। আর এই নিকৃষ্ট ও মন্দকর্মের প্রকাশের সময়কাল তিনশ বছর ।
(অতঃপর তিনি আরও অনেক কথা-বার্তা বলেন, যা এখানে আলোচনার অবকাশ নেই। আর এই পর্যন্তই লম্বা লেখাটির সমাপ্তি ঘটে)।
আর এই কাগজে যা এসেছে, তার কিছু বিষয়ে আমি [এ কথার বক্তা ( القائل ) হলেন আল্লামা শাইখ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী র.] আপত্তি উত্থাপন করেছি। যেমন আমি মোল্লা বাশীকে বললাম:
সাইয়্যিদুনা ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খিলাফত প্রসঙ্গে উল্লেখিত " النصب " শব্দের পরিবর্তে " العهد " শব্দটি ব্যবহার করুন। কারণ, " النصب " শব্দের মধ্যে কলঙ্ক রয়েছে যে, তারা নাসিবা ( الناصبة ); আর তোমরা নাসিবা ( الناصبة ) শব্দের তাফসীর কর ঐ ব্যক্তির দ্বারা যে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি ক্রোধের জ্বালায় নিজেকে ধ্বংস করেছে।
অতঃপর কতিপয় উপস্থিত ব্যক্তি আমার কথার বিরোধিতা করল এবং একজন বলল: এটা শব্দের প্রকাশ্য অর্থের বিপরীত; আর তার অর্থ হল আমি যা উল্লেখ করেছি; তাতে কারো মনে কিছু উদয় হবে না এবং কেউ তার ইচ্ছা করবে না; আর আমি আশঙ্কা করি তোমার কারণেই ফিতনা ছড়াবে। আর এই প্রসঙ্গে মোল্লা বাশীও তার মতই কথা বলল এবং সে চুপ করল।
আর আমি মোল্লা বাশীকে আরেকটি আপত্তির কথা বললাম:
নিশ্চয় শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র ব্যাপারে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কথা: " هما إمامان ... إلخ "-কে তোমরা কয়েকটি অর্থে প্রয়োগ কর, যেগুলো শায়খাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র ব্যাপারে মানানসই নয়।
অতঃপর ঐ প্রথম ব্যক্তিই পূর্বের ন্যায় আমার কথার প্রতিবাদ করল।
আর আমি তাকে (মোল্লা বাশীকে) আরেকটি আপত্তির কথা বললাম:
নিশ্চয় বায়‘আত গ্রহণের সময় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কথাটি আমাদের নিকট সত্য বলে প্রমাণিত নয়, বরং তা মিথ্যা ও বানোয়াট। সুতরাং আমি তোমাদের নিকট শায়খাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র প্রশংসায় তোমরা যা উল্লেখ করেছ, তা ব্যতীত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কথার উল্লেখ করব; যা তাঁদের সম্মান বর্ণনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। আবার তোমরা যা উল্লেখ করেছ, তা ব্যতীত তোমাদের নিকট আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রশংসার কথা উল্লেখ করব, যা সত্য বলে প্রমাণিত।
অতঃপর ঐ প্রথম ব্যক্তি আবার পূর্বের ন্যায় আমার কথার প্রতিবাদ করল।
এটা হল শাহের বক্তব্যের নীচের ছোট লাইনসমূহ; ইরানিদের ভাষায় তার অর্থ হল:
“গালি প্রত্যাহার করার শর্ত আমরা মেনে নিয়েছি; আর সাহাবীদের মর্যাদা ও খিলাফতের ধারাবাহিকতা কাগজে উল্লেখিত ধারাবাহিকতা অনুসারে সাব্যস্ত। সুতরাং আমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি গালি দেবে অথবা তার বিপরীত কিছু বলবে, তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের লা‘নত। আর আমাদের উপর নাদির শাহের গযব এবং আমাদের সম্পদ, রক্ত, সন্তান-সন্তুতি ও পরিবার-পরিজন তার জন্য বৈধ”!
অতঃপর তারা তাদের বক্তব্যের নীচের সাদা অংশে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
আর এর নীচের ছোট লাইনসমূহ ছিল নাজাফ, কারবালা, হিল ও খাওয়ারিযমের অধিবাসীদের ভাষায় (তার অর্থও প্রথমটির মত); অতঃপর তারাও তাদের বক্তব্যের নীচের উল্লেখিত সাদা অংশে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে। তাদের মধ্যে ছিল: সাইয়্যেদ নসরুল্লাহ যিনি ইবন কাত্তা নামে পরিচিত এবং শাইখ জাওয়াদ আন-নাজাফী আল-কুফী প্রমুখ।
আর তার নীচের ছোট লাইনসমূহ ছিল আফগানীদের ভাষায় এবং তার অর্থ হল:
“ইরানীগণ যখন তারা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা মেনে নিয়েছে এবং তাদের নিকট থেকে তার বিপরীত কোন কিছু প্রকাশ পায়নি, তখন তারা ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত; মুসলিমগণ যে সুযোগ-সুবিধা পাবে, তারাও তাই পাবে এবং যা তাদের বিপক্ষে, তা তাদেরও বিপক্ষে।
অতঃপর তারা তাদের নামের নীচের সাদা অংশে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
আর এর নীচের অংশে ছিল ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر )-এর আলেমগণের ভাষায় এবং তার অর্থ হল হুবহু আফগানীরা যা বলেছে তাই এবং তারাও তার নীচে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
অতঃপর এই ফকির [অর্থাৎ আল্লামা সুওয়াইদী নিজে] কাগজের সামনের অংশের উপরে তার সাক্ষ্য-সনদ লিখেছে এইভাবে: “তিন দল যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং মেনে নিয়েছে, আমি তা প্রত্যক্ষ করেছি এবং তারা আমাকে তাদের উপর সাক্ষী মনোনীত করেছে”। আর আমিও এর উপরে আমার নামের নীচে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছি।
আর সেই সময়টি ছিল দেখার মত, দুনিয়ার এক আজিব দৃশ্য! আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের জন্য ছিল এক আনন্দঘন মুহূর্ত; আর কোন যুগেই তার মত দৃশ্যের অবতারণা হয়নি। আর তার মত এমন আনন্দ উৎসবও তেমন দেখা যায় না। এই জন্য সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত।
অতঃপর শাহ রৌপ্যের পাত্রে মিষ্টান্ন সরবরাহ করলেন; আমরা তা ভক্ষণ করলাম; তার সাথে স্বর্ণের পাত্রে সুগন্ধির ধোঁয়া, যাতে আম্বরও ছিল আমরা খেলাম এবং সুগন্ধ গ্রহণ করলাম। অত:পর শাহ এ সুগন্ধির পাত্রটি আলী রা. এর কবরের জন্য ওয়াকফ করলেন [এ জাতীয় কাজ অবৈধ। শাহ যেহেতু সত্যিকার দ্বীন্ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল, তাই সে এ কাজ করেছিল। [সম্পাদক]]।
অতঃপর বের হলাম; ততক্ষণে দেখি পারস্য, আরব, তুরকিস্তান ও আফগানের বহু লোক আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত তাদের সংখ্যা গণনা সম্ভব নয়, তারা সবাই সমবেত হয়েছে। আর আমাদের বের হওয়াটা ছিল বৃহস্পতিবার যোহরের পর।
অতঃপর আমাকে দ্বিতীয়বারের মত শাহের দরবারে নিয়ে আসা হল, আমি পূর্বের ন্যায় সেখানে প্রবেশ করলাম; আর তিনি আমাকে সামনে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিতে থাকলেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম দিনের চেয়েও তার বেশি কাছাকাছি আমাকে নেয়া হল; অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আহমদ খানকেও উত্তম প্রতিদান দিন; আল্লাহর শপথ! দলিল-প্রমাণ সংস্কার, ফিতনা নিবারণ ও মুসলিমদের রক্ত প্রবাহিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে চেষ্টর ত্রুটি করা হয়নি! আল্লাহ ওসমান বংশের সুলতানকে সাহায্য করেছেন, আল্লাহ তার ইজ্জত দিয়েছেন; আর আমি তা আরও উপরে উঠিয়ে দিয়েছি।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: হে আবদুল্লাহ আফেনদী! আপনি ধারণা করবেন না যে, শাহানশাহ এই ধরনের গর্ব-অহঙ্কার করে। এটা এমন কাজ যা আল্লাহ তা‘আলা সহজ করে দিয়েছেন এবং আমাকে তার তাওফিক দান করেছেন। যেমন আমার হাতে সাহাবীদের গালি দেয়ার প্রথা দূর হল; অথচ ওসমান বংশীয় সুলতান সলিমের আমল থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত তারা কত সৈন্যসামন্ত প্রস্তুত করেছে, কত সম্পদ ব্যয় করেছে এবং কত জীবন ধ্বংস করেছে, যাতে এই গালি প্রথা দূর করতে পারে; কিন্তু তারা তাতে সফল হয়নি। আলহমদুলিল্লাহ (আল্লাহর প্রশংসা) আমি তা সহজে দূর করতে সক্ষম হয়েছি। পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, এই নিকৃষ্ট কাজটির সূচনা হয় ইতর শাহ ইসমাঈলের হাতে; আর তাকে প্ররোচিত করেছে এলাহজানের অধিবাসীগণ; আর তা আমাদের এই দিন পর্যন্ত চলছিল।
অতঃপর আমি তাকে বললাম: ইনশাআল্লাহু তা‘আলা অনারব সকলেই পূর্বে যেভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত ছিল আবার সেটার দিকে ফিরে আসবে।
তখন তিনি বললেন: ইনশাআল্লাহু তা‘আলা, কিন্তু আস্তে আস্তে একটার পর একটা করে। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: হে আবদুল্লাহ আফেনদী! আমি যদি গর্ব করি, তবে আমি গর্ব করে বলতে পারি যে, আমার এই মজলিসটি হল চারটি সাম্রাজ্যের সমন্বয়ে একটি মজলিস; সুতরাং আমি ইরানের সুলতান, তুকিস্তানের সুলতান, ভারত রাজ্যের সুলতান এবং আফগান সুলতান!! কিন্তু এই কাজটি সম্ভব হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা তাওফিক দান করার কারণে; আমার অসিলায় এটা সকল মুসলিমের উপর এক বিরাট অনুগ্রহ। কেননা, সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে গালি দেয়ার সংস্কৃতি দূর করেছি। আর আমি আশা করি যে, তাঁরা (সাহাবীগণ) আমার জন্য সুপারিশ করবেন।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: আমি চাচ্ছি যে, আপনাকে আহমদ খানের নিকট পাঠাতে; কারণ, আমি জানি সে আপনার অপেক্ষায় আছে; কিন্তু আমি আশা করি আপনি আগামী কাল পর্যন্ত থাকবেন। কারণ, আমি ফরমান জারি করেছি যে, আমরা কুফা মসজিদে জুম‘আর সালাত আদায় করব এবং আরও ফরমান জারি করেছি যে, মিম্বরে দাঁড়িয়েই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সাহাবীদের আলোচনা করতে। আমার পূর্বে [এর দ্বারা শাহের উদ্দেশ্য হল, প্রথমে সুলতান মাহমুদ খান ইবন সুলতান মুস্তফা খানকে ডাকা; সে ছিল তখন ওসমান বংশের সুলতান। আর শাহ নাদির তাকে তার বড় ভাইয়ের অবস্থানে নিয়োগ দিলেন এবং তাকে যথাযথ সম্মান দান করলেন। আর নিজেকে সুলতানের সামনে তার ছোট ভাই হিসেবে গণ্য করলেন; যা আপনি শীঘ্রই সামনের লেখায় দেখতে পাবেন; আল্লাহ এই শাহকে তাঁর ব্যাপক রহমত দ্বারা করুণা করুন এবং তার সম্মানকে উঁচু ইল্লিয়্যীনে সমুন্নত করুন।] আমার বড় ভাই ওসমান বংশের সুলতান জনাব খুনকারের জন্য দো‘আ করা হয়! আর সকল সুন্দর উপাধিগুলো উল্লেখ করা হয়! অতঃপর ছোট ভাইয়ের জন্য দো‘আ করা হয়, অর্থাৎ তার নিজের জন্য! কিন্তু খুনকারের দো‘আর চেয়ে আমার জন্য দো‘আ কম করা হয়। কারণ, ছোট ভাইয়ের কর্তব্য হল তার বড় ভাইকে সম্মান করা!!
অতঃপর তিনি বলেন: প্রকৃতপক্ষে সেই বড় এবং আমার চেয়ে সম্মানিত! কারণ, সে হল সুলতান (বাদশা) ইবন সুলতান; আর আমি যখন দুনিয়ায় আসি, তখন আমার বাব-দাদা কেউই সুলতান বা বাদশা ছিলেন না!
অতঃপর তিনি আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দিলেন, আমি তার নিকট থেকে বের হলাম; অতঃপর প্রত্যেক তাঁবুতে সাহাবীদের আলোচনা এবং তাঁদের গুণাবলী ও শৌর্য-বীর্যের বর্ণনা হতে লাগল; যেমন তারা আলোচনা করছিল আবূ বকর, ওমর ও ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুমের গুণাবলী ও মার্যাদার কথা এবং তার উপর কুরআনের আয়াত ও হাদিস থেকে দলিল উদ্ঘাটন করছিল; যার বর্ণনা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকজন পর্যন্ত করতে অপারগ ছিল। সাথে সাথে তারা সাহাবীগণকে গালির প্রবর্তন করার কারণে অনারবদের ও শাহ ইসমাঈলের মতের নিন্দা করছিল।
আর জুম‘আর দিন সকাল বেলায় তিনি কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন; আর নাজাফ থেকে তার দূরত্ব হল এক ফরসখ ও সামান্য কিছু। অতঃপর যখন যোহরের সময় নিকটবর্তী হল, তখন তিনি মুয়ায্যিনদেরকে আযানের নির্দেশ দিলেন এবং তারা জুম‘আর আযান ঘোষণা করল; অতঃপর আমি রাষ্ট্রের উযিরকে বললাম:
আমাদের মতে কুফার মসজিদে জুম‘আর সালাত শুদ্ধ নয়। ইমাম আবূ হানিফা র.-এর মতে শহর না হওয়ার কারণে; আর ইমাম শাফেয়ী র.-এর মতে শহরের অধিবাসীর সংখ্যা চল্লিশজন না হওয়ার কারণে।
অতঃপর তিনি বলেন: উদ্দেশ্য হল সেখানে আপনি উপস্থিত থেকে খুতবা শুনা। সুতরাং আপনি চাইলে সালাত আদায় করবেন, আর না চাইলে না।
অতঃপর আমি জামে মসজিদে গেলাম; তখন তাতে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের ভীড় দেখলাম; ইরানের সকল আলেম ও খানেরা উপস্থিত! আর তখন শাহের পক্ষ থেকে নিযুক্ত ইমাম ‘আলী মদদ’ মিম্বারের উপর ছিল; অতঃপর মোল্লা বাশী ও কারবালার আলেমদের মধ্যে পরামর্শ হল; এক পর্যায়ে মোল্লা বাশী ‘আলী মদদ’কে মিম্বর থেকে নামতে নির্দেশ দিলেন; আর কারবালায়ী মিম্বরে উঠল, আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সালাত ও সালাম পাঠ করল, অতঃপর বলল: “(সালাত ও সালাম) তাঁর পরের প্রথম খলিফা আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর এবং দ্বিতীয় খলিফা সত্যভাষী সাইয়্যেদুনা ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর”। কিন্তু সে " عمر "-এর "ر" অক্ষরে যের পড়ল; অথচ খতীব আরবি ভাষার ইমাম; কিন্তু এটা তার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যা অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া বুঝতে পারবে না! আর তা হল " عمر " শব্দটি عدل ও معرفة হওয়ার কারণে منع الصرف ; এই খবিস তা منصرف হিসেবে পড়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে যে, তাতে عدل ও معرفة নেই?! আল্লাহ তাকে খতিবের পদ থেকে সরিয়ে দিক এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে অপমান-অপদস্থ করুক।
অতঃপর সে বলল: “(সালাত ও সালাম) তৃতীয় খলিফা কুরআন সংকলনকারী ওসমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর; চতুর্থ খলিফা বনী গালিবের সিংহ সাইয়্যেদুনা আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর; আর তাঁর দুই সন্তান হাসান ও হোসাইন এবং বাকি সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমের উপর।
হে আল্লাহ! তুমি ‘আল্লাহর ছায়ার’ রাষ্ট্রকে জগতের মধ্যে কায়েম ও দায়েম রাখ; সে হল বনী আদমের সুলতানদের সুলতান, দ্বিতীয় ইসকান্দার যূল কারনাইন, খাদেমুল হারামাইন আশ-শারীফাইন, সুলতান মাহমুদ খান ইবন সুলতান মুস্তফা খান; আল্লাহ তার খিলাফতকে শক্তিশালী করুন; তার সাম্রাজ্যকে স্থায়ী করুন; তাঁর একত্ববাদের সৈনিকদেরকে কাফির সম্প্রদায়ের উপর বিজয় দান করুন”।
অতঃপর নাদির শাহের জন্য এর চেয়ে অনেক কম দো‘আ করল; কিছু ফারসি ভাষায়, আবার কিছু আরবি ভাষায়।
অতঃপর সে মিম্বর থেকে নামল, তারপর সালাতের ইকামত দেয়া হল; সে সামনে গেল এবং সালাতে দাখিল হল; তার সামনে পর্দা ঝুলিয়ে দেয়া হল এবং তার পেছনে আলেমগণ ডানে-বামে দাঁড়িয়ে গেল। অতঃপর সে সূরা ফাতিহা ও সূরা জুম‘আ পাঠ করল; তার দুই হাত উত্তোলন করল এবং রুকূর পূর্বে প্রকাশ্য উচ্চারণে কুনুত পাঠ করল; অতঃপর রুকূ করল এবং প্রকাশ্য উচ্চারণে রুকূর তাসবীহসমূহ পাঠ করল; অতঃপর " الله أكبر " বলে এবং " سمع الله لمن حمد " ও " ربنا لك الحمد " না বলেই রুকূ থেকে উঠল?! অতঃপর সোজা দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বারের মত প্রকাশ্য উচ্চারণে কুনুত পাঠ করল; অতঃপর সিজদায় গেল এবং সিজদার তাসবীহসমূহ পাঠ করল, আর তার সাথে উচ্চস্বরে আরও অন্য কিছু পাঠ করল; সিজদা থেকে মাথা উঠাল এবং দুই সিজদার মাঝখানে প্রকাশ্য উচ্চারণে কিছু পাঠ করল; অতঃপর দ্বিতীয় বারের মত সিজদা দিল এবং প্রকাশ্য উচ্চারণে প্রথম বারের মত সিজদার তাসবীহসমূহ পাঠ করল, সাথে আরও কিছু দো‘আ সংযুক্ত করল। অতঃপর দ্বিতীয় রাকাতের উদ্দেশ্যে দাঁড়াল এবং সূরা ফাতিহা ও সূরা মুনাফিকূন পাঠ করল; আর প্রথম রাকাতের মতই বাকি কাজগুলো করল এবং তাশাহ্হুদের জন্য বসল; অতঃপর আমাদের তাশাহুদের যা আছে, তার অনেক কিছুই সে পাঠ করল; তবে " السلام عليك أيها النبي و رحمة الله و بركاته " এই কথাটিও প্রকাশ্য উচ্চারণে পাঠ করল। অতঃপর তার দুই হাত তার মাথায় রাখা অবস্থায় শুধু ডান দিকে সালাম দিল।
অতঃপর শাহের পক্ষ থেকে অনেক মিষ্টি আসল এবং সেখানে মানুষের হৈচৈ ও ভীড় দেখা দিল; এমনকি তাতে মোল্লা বাশী’র মাথা থেকে পাগড়ি পড়ে গেল এবং তার মধ্যমা আঙুল আহত হল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম:
অতঃপর আমরা যখন বসলাম, তখন তারা সাত বিগতের চেয়ে লম্বা এক পত্রিকা নিয়ে আসল; তার লাইনসমূহ তার দুই তৃতীয়াংশ পরিমাণ লম্বা; আর তৃতীয় একতৃতীয়াংশ চার ভাগে বিভক্ত, প্রত্যেক অংশকে ভাগ ভাগ করে দিয়েছে প্রায় চার আঙুল বা তার বেশি পরিমাণ সাদা অংশ দ্বারা; কিন্তু প্রথম লাইনসমূহরে চেয়ে অন্যান্য লাইনসমূহ অনেক ছোট। অতঃপর মোল্লা বাশী রেকাবের মুফতি আকা হোসাইনকে নির্দেশ দিলেন তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জনসমক্ষে পাঠ করার জন্য, আর সে ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী লম্বা মানুষ; অতঃপর সে পত্রিকাটি হাতে নিল, যা ফারসি ভাষায় লিখিত; তার মূলকথা ছিল:
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা রাসূল প্রেরণের প্রয়োজন মনে করলেন; ফলে তিনি রাসূলের পর রাসূল প্রেরণ করতে থাকলেন, শেষ পর্যন্ত আমাদের নবী মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত আসল।
আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন ইন্তিকাল করলেন, তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল; তখন সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম ঐক্যমত পোষণ করলেন যে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে যিনি মর্যাদাবান, উত্তম ও জ্ঞানী, তিনি হলেন আবূ বকর ইবন আবি কুহাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু । অতঃপর তারা তাঁর নিকট বায়‘আতের ব্যাপারে একমত হলেন এবং সকলেই তাঁর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন, এমনকি আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুও স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে কোন রকম জোর-জবরদস্তি ছাড়াই তাঁর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন; অতঃপর তাঁর বায়‘আত ও খিলাফত সমাপ্ত হল; আর সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের ইজমা হল অকাট্য দলিল, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্মানিত কিতাবে তাঁদের প্রশংসা করেছেন, তিনি বলেন:
﴿ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِِ﴾ [ سورة التوبة : 100]
“মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী...” — (সূরা তাওবা: ১০০)
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ لَّقَدۡۡ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ يُبَايِعُونَكَ تَحۡتَ ٱلشَّجَرَةِ ِ﴾ [ سورة الفتح : 18] الآية
“আল্লাহ তো মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা গাছের নীচে তোমার নিকট বায়‘আত গ্রহণ করল”। — (সূরা আল-ফাতহ: ১৮); আর সে সময় ওখানে সাতশত সাহাবী ছিলেন, তাঁরা সকলেই সিদ্দীকের নিকট বায়‘আতে উপস্থিত ছিলেন।
অতঃপর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের জন্য ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দিষ্ট করেছে; অতঃপর ইমাম আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ সকল সাহাবী তাঁর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন। আর ওসমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারেও তাঁদের ঐক্যবদ্ধ রায় ছিল।
অতঃপর ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাড়িতে শাহাদাত বরণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে কাউকে নির্দিষ্ট করে যেতে পারেন নি; সুতরাং খিলাফত শুন্য অবস্থায় রয়ে গেল; অতঃপর সাহাবীগণ ঐ সময়ে আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
আর তাঁরা চারজনই একই স্থানে এবং একই সময়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোন প্রকার দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও ঝগরা-ফ্যাসাদ সংঘটিত হয়নি; বরং তাঁদের প্রত্যেকেই একে অপরকে ভালবাসতেন এবং প্রশংসা ও গুণকীর্তন করতেন; এমনকি শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা সম্পর্কে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: তাঁরা উভয়ে ন্যায়পরায়ণ নেতা, তাঁরা হকের উপরে ছিলেন এবং হকের উপর মৃত্যু বরণ করেছেন। আর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তখন তিনি বলেন: তোমরা যে আমার নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেছ, তোমাদের মধ্যে কি আলী ইবন আবি তালিব ছিল?
সুতরাং হে ইরানের অধিবাসীগণ! তোমরা জেনে রাখ যে, তাঁদের মর্যাদা ও খিলাফত এই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী। সুতরাং যে কেউ তাঁদেরকে গালি দেবে অথবা তাঁদের ত্রুটি বর্ণনা করবে, তার সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি, পরিবার-পরিজন এবং তার রক্ত শাহের জন্য বৈধ; আর তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের লা‘নত!!
আর আমি হিজরি ১১৪৮ সালে মুগান মরুভূমিতে বায়‘আত গ্রহণের সময় তোমাদের সাথে গালি প্রত্যাহারের শর্ত আরোপ করেছিলাম; সুতরাং এখন আমি তা প্রত্যাহার করলাম। অতএব, যে ব্যক্তি (সাহাবীদেরকে) গালি দেবে, তাকে আমি হত্যা করব! তার সন্তান ও পরিবার-পরিজনকে বন্দী করব এবং তার মালামাল ক্রোক করব! ইরানের কোন প্রান্তে এবং তার আশে পাশে গালাগালি ও এ ধরনের কোন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড চলবে না। আর এই সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে ইতর ও অভদ্র শাহ ইসমাঈল আল-সাফাবী’র [ইবন শাইখ হায়দর ইবন শাইখ জুনাইদ ইবন শাইখ ইবরাহীম ইবন খাজা আলী ইবন শাইখ মূসা ইবন শাইখ সফিউদ্দীন ইসহাক আল-আরদাবেলী। শাহ ইসমাঈল ৮৯২ হিজরিতে জন্ম গ্রহণ করেছে এবং সাফাবী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছে; আর সে বাগদাদ দখল করেছে ৯১৫ হিজরিতে এবং ইরানের ইতিহাসে প্রথম বারের মত ৯১৬ হিজরিতে ঘোষণা করেছে যে, ইরানের রাষ্ট্রীয় মাযহাব হল শী‘আ মাযহাব; তার সাথে ৯২০ হিজরিতে সুলতান সলিম যুদ্ধ করে এবং তিনি ‘তাশালদিরান’ যুদ্ধে তার উপর বিজয় লাভ করেন; সে যুদ্ধে শাহ ইসমাঈল আহত হয় এবং পলায়ন করে। আর ঐ পরাজয়ের দশ বছর পর ৯৩০ হিজরিতে সে মারা যায় এবং আরদাবিলে তার পিতার পাশে তাকে দাফন করা হয়; সে যে শাস্তির উপযুক্ত, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাই তার উপর পতিত হোক!] আমলে। আর তার সন্তানগণ অব্যাহতভাবে তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত গালাগালি বৃদ্ধি পেয়েছে; বিদ‘আত ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভাঙ্গন ও অনৈক্য সম্প্রসারিত হল ৮৭৫ বছর ধরে। আর এই নিকৃষ্ট ও মন্দকর্মের প্রকাশের সময়কাল তিনশ বছর ।
(অতঃপর তিনি আরও অনেক কথা-বার্তা বলেন, যা এখানে আলোচনার অবকাশ নেই। আর এই পর্যন্তই লম্বা লেখাটির সমাপ্তি ঘটে)।
আর এই কাগজে যা এসেছে, তার কিছু বিষয়ে আমি [এ কথার বক্তা ( القائل ) হলেন আল্লামা শাইখ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী র.] আপত্তি উত্থাপন করেছি। যেমন আমি মোল্লা বাশীকে বললাম:
সাইয়্যিদুনা ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খিলাফত প্রসঙ্গে উল্লেখিত " النصب " শব্দের পরিবর্তে " العهد " শব্দটি ব্যবহার করুন। কারণ, " النصب " শব্দের মধ্যে কলঙ্ক রয়েছে যে, তারা নাসিবা ( الناصبة ); আর তোমরা নাসিবা ( الناصبة ) শব্দের তাফসীর কর ঐ ব্যক্তির দ্বারা যে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি ক্রোধের জ্বালায় নিজেকে ধ্বংস করেছে।
অতঃপর কতিপয় উপস্থিত ব্যক্তি আমার কথার বিরোধিতা করল এবং একজন বলল: এটা শব্দের প্রকাশ্য অর্থের বিপরীত; আর তার অর্থ হল আমি যা উল্লেখ করেছি; তাতে কারো মনে কিছু উদয় হবে না এবং কেউ তার ইচ্ছা করবে না; আর আমি আশঙ্কা করি তোমার কারণেই ফিতনা ছড়াবে। আর এই প্রসঙ্গে মোল্লা বাশীও তার মতই কথা বলল এবং সে চুপ করল।
আর আমি মোল্লা বাশীকে আরেকটি আপত্তির কথা বললাম:
নিশ্চয় শায়খাইন তথা আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র ব্যাপারে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কথা: " هما إمامان ... إلخ "-কে তোমরা কয়েকটি অর্থে প্রয়োগ কর, যেগুলো শায়খাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র ব্যাপারে মানানসই নয়।
অতঃপর ঐ প্রথম ব্যক্তিই পূর্বের ন্যায় আমার কথার প্রতিবাদ করল।
আর আমি তাকে (মোল্লা বাশীকে) আরেকটি আপত্তির কথা বললাম:
নিশ্চয় বায়‘আত গ্রহণের সময় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কথাটি আমাদের নিকট সত্য বলে প্রমাণিত নয়, বরং তা মিথ্যা ও বানোয়াট। সুতরাং আমি তোমাদের নিকট শায়খাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র প্রশংসায় তোমরা যা উল্লেখ করেছ, তা ব্যতীত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কথার উল্লেখ করব; যা তাঁদের সম্মান বর্ণনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। আবার তোমরা যা উল্লেখ করেছ, তা ব্যতীত তোমাদের নিকট আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রশংসার কথা উল্লেখ করব, যা সত্য বলে প্রমাণিত।
অতঃপর ঐ প্রথম ব্যক্তি আবার পূর্বের ন্যায় আমার কথার প্রতিবাদ করল।
এটা হল শাহের বক্তব্যের নীচের ছোট লাইনসমূহ; ইরানিদের ভাষায় তার অর্থ হল:
“গালি প্রত্যাহার করার শর্ত আমরা মেনে নিয়েছি; আর সাহাবীদের মর্যাদা ও খিলাফতের ধারাবাহিকতা কাগজে উল্লেখিত ধারাবাহিকতা অনুসারে সাব্যস্ত। সুতরাং আমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি গালি দেবে অথবা তার বিপরীত কিছু বলবে, তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের লা‘নত। আর আমাদের উপর নাদির শাহের গযব এবং আমাদের সম্পদ, রক্ত, সন্তান-সন্তুতি ও পরিবার-পরিজন তার জন্য বৈধ”!
অতঃপর তারা তাদের বক্তব্যের নীচের সাদা অংশে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
আর এর নীচের ছোট লাইনসমূহ ছিল নাজাফ, কারবালা, হিল ও খাওয়ারিযমের অধিবাসীদের ভাষায় (তার অর্থও প্রথমটির মত); অতঃপর তারাও তাদের বক্তব্যের নীচের উল্লেখিত সাদা অংশে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে। তাদের মধ্যে ছিল: সাইয়্যেদ নসরুল্লাহ যিনি ইবন কাত্তা নামে পরিচিত এবং শাইখ জাওয়াদ আন-নাজাফী আল-কুফী প্রমুখ।
আর তার নীচের ছোট লাইনসমূহ ছিল আফগানীদের ভাষায় এবং তার অর্থ হল:
“ইরানীগণ যখন তারা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা মেনে নিয়েছে এবং তাদের নিকট থেকে তার বিপরীত কোন কিছু প্রকাশ পায়নি, তখন তারা ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত; মুসলিমগণ যে সুযোগ-সুবিধা পাবে, তারাও তাই পাবে এবং যা তাদের বিপক্ষে, তা তাদেরও বিপক্ষে।
অতঃপর তারা তাদের নামের নীচের সাদা অংশে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
আর এর নীচের অংশে ছিল ‘মা অরাউন্নহর’ ( ما وراء النهر )-এর আলেমগণের ভাষায় এবং তার অর্থ হল হুবহু আফগানীরা যা বলেছে তাই এবং তারাও তার নীচে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
অতঃপর এই ফকির [অর্থাৎ আল্লামা সুওয়াইদী নিজে] কাগজের সামনের অংশের উপরে তার সাক্ষ্য-সনদ লিখেছে এইভাবে: “তিন দল যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং মেনে নিয়েছে, আমি তা প্রত্যক্ষ করেছি এবং তারা আমাকে তাদের উপর সাক্ষী মনোনীত করেছে”। আর আমিও এর উপরে আমার নামের নীচে সই-স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছি।
আর সেই সময়টি ছিল দেখার মত, দুনিয়ার এক আজিব দৃশ্য! আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের জন্য ছিল এক আনন্দঘন মুহূর্ত; আর কোন যুগেই তার মত দৃশ্যের অবতারণা হয়নি। আর তার মত এমন আনন্দ উৎসবও তেমন দেখা যায় না। এই জন্য সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত।
অতঃপর শাহ রৌপ্যের পাত্রে মিষ্টান্ন সরবরাহ করলেন; আমরা তা ভক্ষণ করলাম; তার সাথে স্বর্ণের পাত্রে সুগন্ধির ধোঁয়া, যাতে আম্বরও ছিল আমরা খেলাম এবং সুগন্ধ গ্রহণ করলাম। অত:পর শাহ এ সুগন্ধির পাত্রটি আলী রা. এর কবরের জন্য ওয়াকফ করলেন [এ জাতীয় কাজ অবৈধ। শাহ যেহেতু সত্যিকার দ্বীন্ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল, তাই সে এ কাজ করেছিল। [সম্পাদক]]।
অতঃপর বের হলাম; ততক্ষণে দেখি পারস্য, আরব, তুরকিস্তান ও আফগানের বহু লোক আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত তাদের সংখ্যা গণনা সম্ভব নয়, তারা সবাই সমবেত হয়েছে। আর আমাদের বের হওয়াটা ছিল বৃহস্পতিবার যোহরের পর।
অতঃপর আমাকে দ্বিতীয়বারের মত শাহের দরবারে নিয়ে আসা হল, আমি পূর্বের ন্যায় সেখানে প্রবেশ করলাম; আর তিনি আমাকে সামনে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিতে থাকলেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম দিনের চেয়েও তার বেশি কাছাকাছি আমাকে নেয়া হল; অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আহমদ খানকেও উত্তম প্রতিদান দিন; আল্লাহর শপথ! দলিল-প্রমাণ সংস্কার, ফিতনা নিবারণ ও মুসলিমদের রক্ত প্রবাহিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে চেষ্টর ত্রুটি করা হয়নি! আল্লাহ ওসমান বংশের সুলতানকে সাহায্য করেছেন, আল্লাহ তার ইজ্জত দিয়েছেন; আর আমি তা আরও উপরে উঠিয়ে দিয়েছি।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: হে আবদুল্লাহ আফেনদী! আপনি ধারণা করবেন না যে, শাহানশাহ এই ধরনের গর্ব-অহঙ্কার করে। এটা এমন কাজ যা আল্লাহ তা‘আলা সহজ করে দিয়েছেন এবং আমাকে তার তাওফিক দান করেছেন। যেমন আমার হাতে সাহাবীদের গালি দেয়ার প্রথা দূর হল; অথচ ওসমান বংশীয় সুলতান সলিমের আমল থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত তারা কত সৈন্যসামন্ত প্রস্তুত করেছে, কত সম্পদ ব্যয় করেছে এবং কত জীবন ধ্বংস করেছে, যাতে এই গালি প্রথা দূর করতে পারে; কিন্তু তারা তাতে সফল হয়নি। আলহমদুলিল্লাহ (আল্লাহর প্রশংসা) আমি তা সহজে দূর করতে সক্ষম হয়েছি। পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, এই নিকৃষ্ট কাজটির সূচনা হয় ইতর শাহ ইসমাঈলের হাতে; আর তাকে প্ররোচিত করেছে এলাহজানের অধিবাসীগণ; আর তা আমাদের এই দিন পর্যন্ত চলছিল।
অতঃপর আমি তাকে বললাম: ইনশাআল্লাহু তা‘আলা অনারব সকলেই পূর্বে যেভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত ছিল আবার সেটার দিকে ফিরে আসবে।
তখন তিনি বললেন: ইনশাআল্লাহু তা‘আলা, কিন্তু আস্তে আস্তে একটার পর একটা করে। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: হে আবদুল্লাহ আফেনদী! আমি যদি গর্ব করি, তবে আমি গর্ব করে বলতে পারি যে, আমার এই মজলিসটি হল চারটি সাম্রাজ্যের সমন্বয়ে একটি মজলিস; সুতরাং আমি ইরানের সুলতান, তুকিস্তানের সুলতান, ভারত রাজ্যের সুলতান এবং আফগান সুলতান!! কিন্তু এই কাজটি সম্ভব হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা তাওফিক দান করার কারণে; আমার অসিলায় এটা সকল মুসলিমের উপর এক বিরাট অনুগ্রহ। কেননা, সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে গালি দেয়ার সংস্কৃতি দূর করেছি। আর আমি আশা করি যে, তাঁরা (সাহাবীগণ) আমার জন্য সুপারিশ করবেন।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: আমি চাচ্ছি যে, আপনাকে আহমদ খানের নিকট পাঠাতে; কারণ, আমি জানি সে আপনার অপেক্ষায় আছে; কিন্তু আমি আশা করি আপনি আগামী কাল পর্যন্ত থাকবেন। কারণ, আমি ফরমান জারি করেছি যে, আমরা কুফা মসজিদে জুম‘আর সালাত আদায় করব এবং আরও ফরমান জারি করেছি যে, মিম্বরে দাঁড়িয়েই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সাহাবীদের আলোচনা করতে। আমার পূর্বে [এর দ্বারা শাহের উদ্দেশ্য হল, প্রথমে সুলতান মাহমুদ খান ইবন সুলতান মুস্তফা খানকে ডাকা; সে ছিল তখন ওসমান বংশের সুলতান। আর শাহ নাদির তাকে তার বড় ভাইয়ের অবস্থানে নিয়োগ দিলেন এবং তাকে যথাযথ সম্মান দান করলেন। আর নিজেকে সুলতানের সামনে তার ছোট ভাই হিসেবে গণ্য করলেন; যা আপনি শীঘ্রই সামনের লেখায় দেখতে পাবেন; আল্লাহ এই শাহকে তাঁর ব্যাপক রহমত দ্বারা করুণা করুন এবং তার সম্মানকে উঁচু ইল্লিয়্যীনে সমুন্নত করুন।] আমার বড় ভাই ওসমান বংশের সুলতান জনাব খুনকারের জন্য দো‘আ করা হয়! আর সকল সুন্দর উপাধিগুলো উল্লেখ করা হয়! অতঃপর ছোট ভাইয়ের জন্য দো‘আ করা হয়, অর্থাৎ তার নিজের জন্য! কিন্তু খুনকারের দো‘আর চেয়ে আমার জন্য দো‘আ কম করা হয়। কারণ, ছোট ভাইয়ের কর্তব্য হল তার বড় ভাইকে সম্মান করা!!
অতঃপর তিনি বলেন: প্রকৃতপক্ষে সেই বড় এবং আমার চেয়ে সম্মানিত! কারণ, সে হল সুলতান (বাদশা) ইবন সুলতান; আর আমি যখন দুনিয়ায় আসি, তখন আমার বাব-দাদা কেউই সুলতান বা বাদশা ছিলেন না!
অতঃপর তিনি আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দিলেন, আমি তার নিকট থেকে বের হলাম; অতঃপর প্রত্যেক তাঁবুতে সাহাবীদের আলোচনা এবং তাঁদের গুণাবলী ও শৌর্য-বীর্যের বর্ণনা হতে লাগল; যেমন তারা আলোচনা করছিল আবূ বকর, ওমর ও ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুমের গুণাবলী ও মার্যাদার কথা এবং তার উপর কুরআনের আয়াত ও হাদিস থেকে দলিল উদ্ঘাটন করছিল; যার বর্ণনা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকজন পর্যন্ত করতে অপারগ ছিল। সাথে সাথে তারা সাহাবীগণকে গালির প্রবর্তন করার কারণে অনারবদের ও শাহ ইসমাঈলের মতের নিন্দা করছিল।
আর জুম‘আর দিন সকাল বেলায় তিনি কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন; আর নাজাফ থেকে তার দূরত্ব হল এক ফরসখ ও সামান্য কিছু। অতঃপর যখন যোহরের সময় নিকটবর্তী হল, তখন তিনি মুয়ায্যিনদেরকে আযানের নির্দেশ দিলেন এবং তারা জুম‘আর আযান ঘোষণা করল; অতঃপর আমি রাষ্ট্রের উযিরকে বললাম:
আমাদের মতে কুফার মসজিদে জুম‘আর সালাত শুদ্ধ নয়। ইমাম আবূ হানিফা র.-এর মতে শহর না হওয়ার কারণে; আর ইমাম শাফেয়ী র.-এর মতে শহরের অধিবাসীর সংখ্যা চল্লিশজন না হওয়ার কারণে।
অতঃপর তিনি বলেন: উদ্দেশ্য হল সেখানে আপনি উপস্থিত থেকে খুতবা শুনা। সুতরাং আপনি চাইলে সালাত আদায় করবেন, আর না চাইলে না।
অতঃপর আমি জামে মসজিদে গেলাম; তখন তাতে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের ভীড় দেখলাম; ইরানের সকল আলেম ও খানেরা উপস্থিত! আর তখন শাহের পক্ষ থেকে নিযুক্ত ইমাম ‘আলী মদদ’ মিম্বারের উপর ছিল; অতঃপর মোল্লা বাশী ও কারবালার আলেমদের মধ্যে পরামর্শ হল; এক পর্যায়ে মোল্লা বাশী ‘আলী মদদ’কে মিম্বর থেকে নামতে নির্দেশ দিলেন; আর কারবালায়ী মিম্বরে উঠল, আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সালাত ও সালাম পাঠ করল, অতঃপর বলল: “(সালাত ও সালাম) তাঁর পরের প্রথম খলিফা আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর এবং দ্বিতীয় খলিফা সত্যভাষী সাইয়্যেদুনা ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর”। কিন্তু সে " عمر "-এর "ر" অক্ষরে যের পড়ল; অথচ খতীব আরবি ভাষার ইমাম; কিন্তু এটা তার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যা অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া বুঝতে পারবে না! আর তা হল " عمر " শব্দটি عدل ও معرفة হওয়ার কারণে منع الصرف ; এই খবিস তা منصرف হিসেবে পড়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে যে, তাতে عدل ও معرفة নেই?! আল্লাহ তাকে খতিবের পদ থেকে সরিয়ে দিক এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে অপমান-অপদস্থ করুক।
অতঃপর সে বলল: “(সালাত ও সালাম) তৃতীয় খলিফা কুরআন সংকলনকারী ওসমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর; চতুর্থ খলিফা বনী গালিবের সিংহ সাইয়্যেদুনা আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর; আর তাঁর দুই সন্তান হাসান ও হোসাইন এবং বাকি সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমের উপর।
হে আল্লাহ! তুমি ‘আল্লাহর ছায়ার’ রাষ্ট্রকে জগতের মধ্যে কায়েম ও দায়েম রাখ; সে হল বনী আদমের সুলতানদের সুলতান, দ্বিতীয় ইসকান্দার যূল কারনাইন, খাদেমুল হারামাইন আশ-শারীফাইন, সুলতান মাহমুদ খান ইবন সুলতান মুস্তফা খান; আল্লাহ তার খিলাফতকে শক্তিশালী করুন; তার সাম্রাজ্যকে স্থায়ী করুন; তাঁর একত্ববাদের সৈনিকদেরকে কাফির সম্প্রদায়ের উপর বিজয় দান করুন”।
অতঃপর নাদির শাহের জন্য এর চেয়ে অনেক কম দো‘আ করল; কিছু ফারসি ভাষায়, আবার কিছু আরবি ভাষায়।
অতঃপর সে মিম্বর থেকে নামল, তারপর সালাতের ইকামত দেয়া হল; সে সামনে গেল এবং সালাতে দাখিল হল; তার সামনে পর্দা ঝুলিয়ে দেয়া হল এবং তার পেছনে আলেমগণ ডানে-বামে দাঁড়িয়ে গেল। অতঃপর সে সূরা ফাতিহা ও সূরা জুম‘আ পাঠ করল; তার দুই হাত উত্তোলন করল এবং রুকূর পূর্বে প্রকাশ্য উচ্চারণে কুনুত পাঠ করল; অতঃপর রুকূ করল এবং প্রকাশ্য উচ্চারণে রুকূর তাসবীহসমূহ পাঠ করল; অতঃপর " الله أكبر " বলে এবং " سمع الله لمن حمد " ও " ربنا لك الحمد " না বলেই রুকূ থেকে উঠল?! অতঃপর সোজা দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বারের মত প্রকাশ্য উচ্চারণে কুনুত পাঠ করল; অতঃপর সিজদায় গেল এবং সিজদার তাসবীহসমূহ পাঠ করল, আর তার সাথে উচ্চস্বরে আরও অন্য কিছু পাঠ করল; সিজদা থেকে মাথা উঠাল এবং দুই সিজদার মাঝখানে প্রকাশ্য উচ্চারণে কিছু পাঠ করল; অতঃপর দ্বিতীয় বারের মত সিজদা দিল এবং প্রকাশ্য উচ্চারণে প্রথম বারের মত সিজদার তাসবীহসমূহ পাঠ করল, সাথে আরও কিছু দো‘আ সংযুক্ত করল। অতঃপর দ্বিতীয় রাকাতের উদ্দেশ্যে দাঁড়াল এবং সূরা ফাতিহা ও সূরা মুনাফিকূন পাঠ করল; আর প্রথম রাকাতের মতই বাকি কাজগুলো করল এবং তাশাহ্হুদের জন্য বসল; অতঃপর আমাদের তাশাহুদের যা আছে, তার অনেক কিছুই সে পাঠ করল; তবে " السلام عليك أيها النبي و رحمة الله و بركاته " এই কথাটিও প্রকাশ্য উচ্চারণে পাঠ করল। অতঃপর তার দুই হাত তার মাথায় রাখা অবস্থায় শুধু ডান দিকে সালাম দিল।
অতঃপর শাহের পক্ষ থেকে অনেক মিষ্টি আসল এবং সেখানে মানুষের হৈচৈ ও ভীড় দেখা দিল; এমনকি তাতে মোল্লা বাশী’র মাথা থেকে পাগড়ি পড়ে গেল এবং তার মধ্যমা আঙুল আহত হল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম:
তখন আমি বললাম: খুতবার ব্যাপারে কোন কথা নেই; তবে সালাত আদায়ের পদ্ধতি চার মাযহাব থেকে আলাদা এক ব্যতিক্রম পদ্ধতি। সুতরাং শাহের উচিত এর উপর প্রশিক্ষণ দেয়া!
অতঃপর শাহকে এই বিষয়ে সংবাদ দেয়া হল, তাতে সে রেগে গেল এবং উযিরের সাথে আমাকে বলে পাঠাল:
আহমদ খানকে সংবাদ দাও যে, আমি যাবতীয় মতবিরোধ মিটেয়ে দেব, এমনকি মাটির উপরে সিজদার বিষয়টিও।
জুম‘আর দিন আমি মোল্লা বাশী’র সাথে একত্রিত হলাম এবং জা‘ফরীয়া মাযহাবের (জাফর সাদিকের মাযহাবের) বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরস্পর আলোচনা শুরু করলাম; প্রথমে আমি বললাম:
তোমরা যে মাযহাবের উপর ভিত্তি করে ইবাদত-বন্দেগী কর, তা বাতিল; কোন মুজতাহিদের ইজতিহাদ তার দিকে যায় না।
তখন সে বলল: এটা জাফর সাদিকের ইজতিহাদ।
অতঃপর আমি বললাম: এর মধ্যে জাফর সাদিকের কিছুই নেই; তোমরা জাফর সাদিকের মাযহাব সম্পর্কে জান না। সুতরাং তোমরা যদি বল: জাফর সাদিকের মাযহাবের মধ্যে ‘তাকিয়্যা’ [তাকিয়্যা’ হচ্ছে মানুষের মনের বিপরীত অভিমত প্রকাশ করা; অর্থাৎ ভিতর এক রকম, আর বাহির অন্য রকম। — অনুবাদক।] আছে, তবে প্রত্যেক মাসআলা ‘তাকিয়্যা’ হওয়ার সম্ভাবনার কারণে তোমরা এবং তোমাদের অন্যরা তার মাযহাব সম্পর্কে জান না। কারণ, তোমাদের পক্ষ থেকে একজন আমাকে সংবাদ দিয়েছে যে, তার কূপের মধ্যে যখন নাপাকি পতিত হয়, তখন তার ব্যাপারে তিনটি বক্তব্য: প্রথমত এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: এটা সমুদ্র কোন কিছুই তাকে অপবিত্র করতে পারে না। দ্বিতীয়ত: তার সবটকু পানি বের করে ফেলে দিতে হবে। তৃতীয়ত: তার থেকে সাত বালতি অথবা ছয় বালতি পানি বের করে দিতে হবে; তখন আমি তোমাদের কতিপয় আলেমকে জিজ্ঞাসা করলাম: এই তিনটি বক্তব্য দ্বারা তোমরা কিভাবে কি করবে?
জওয়াবে সে বলল: আমাদের মাযহাব হল, মানুষ যখন ইজতিহাদের যোগ্য হবে, তখন সে জাফর সাদিকের বক্তব্যগুলো নিয়ে গবেষণা করবে; অতঃপর তার থেকে একটিকে বিশুদ্ধ বলে মানবে।
অতঃপর আমি বললাম: বাকিগুলোর ব্যাপারে সে কী বলবে?
তখন সে বলল: সে বলবে: বাকিগুলো ‘তাকিয়্যা’!
অতঃপর আমি বললাম: যখন একজন ইজতিহাদ করল এবং এই বক্তব্য ছাড়া অন্য বক্তব্যকে বিশুদ্ধ বলল, তখন সে ঐ বক্তব্যের ব্যাপারে কী বলবে, যা প্রথম মুজতাহিদ (গবেষক) বিশুদ্ধ বলেছিল? তখন সে বলল: সে বলবে: তা হল ‘তাকিয়্যা’!
অতঃপর আমি বললাম: এ জন্যই জাফর সাদিকের মাযহাব নষ্ট হয়ে গেছে! কারণ, প্রত্যেক মাসআলার মধ্যেই ‘তাকিয়্যা’-এর সম্ভাবনা রয়েছে; কেননা এমন কোন আলামত (নিদর্শন) নেই, যার দ্বারা ‘তাকিয়্যা’ ও অন্যটির মধ্যে পার্থক্য করা যায়। অতঃপর ঐ আলেম থেমে গেল! তখন তোমার জওয়াব কী?!
তখন সেও থেমে গেল!! অতঃপর আমি তাকে বললাম:
তোমরা যদি বল: “জাফর সাদিকের মাযহাবের মধ্যে ‘তাকিয়্যা’ নেই” তবে তোমরা যে মাযহাবের উপর আছ, তা তার মাযহাব নয়। কারণ, তোমরা সকলেই ‘তাকিয়্যা’-এর কথা বল!
তখন মোল্লা বাশী থেমে গেল! অতঃপর আমি তার জন্য এটা ছাড়া আরও কিছু দলিল পেশ করলাম, যেগুলো প্রমাণ করে যে, তাদের সামনে যে মাযহাব বিদ্যমান, তা জাফর সাদিকের মাযহাব নয়।
অতঃপর শাহ আমাকে বাগদাদ ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন এবং আমার সাথে পত্রিকা ও খুতবার ফটোকপি পাঠালেন; সুতরাং এই যা ঘটল, তাতে আমি হজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।
হে আল্লাহ! তুমি এটা আমার জন্য সহজ করে দাও।
অতঃপর শাহকে এই বিষয়ে সংবাদ দেয়া হল, তাতে সে রেগে গেল এবং উযিরের সাথে আমাকে বলে পাঠাল:
আহমদ খানকে সংবাদ দাও যে, আমি যাবতীয় মতবিরোধ মিটেয়ে দেব, এমনকি মাটির উপরে সিজদার বিষয়টিও।
জুম‘আর দিন আমি মোল্লা বাশী’র সাথে একত্রিত হলাম এবং জা‘ফরীয়া মাযহাবের (জাফর সাদিকের মাযহাবের) বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরস্পর আলোচনা শুরু করলাম; প্রথমে আমি বললাম:
তোমরা যে মাযহাবের উপর ভিত্তি করে ইবাদত-বন্দেগী কর, তা বাতিল; কোন মুজতাহিদের ইজতিহাদ তার দিকে যায় না।
তখন সে বলল: এটা জাফর সাদিকের ইজতিহাদ।
অতঃপর আমি বললাম: এর মধ্যে জাফর সাদিকের কিছুই নেই; তোমরা জাফর সাদিকের মাযহাব সম্পর্কে জান না। সুতরাং তোমরা যদি বল: জাফর সাদিকের মাযহাবের মধ্যে ‘তাকিয়্যা’ [তাকিয়্যা’ হচ্ছে মানুষের মনের বিপরীত অভিমত প্রকাশ করা; অর্থাৎ ভিতর এক রকম, আর বাহির অন্য রকম। — অনুবাদক।] আছে, তবে প্রত্যেক মাসআলা ‘তাকিয়্যা’ হওয়ার সম্ভাবনার কারণে তোমরা এবং তোমাদের অন্যরা তার মাযহাব সম্পর্কে জান না। কারণ, তোমাদের পক্ষ থেকে একজন আমাকে সংবাদ দিয়েছে যে, তার কূপের মধ্যে যখন নাপাকি পতিত হয়, তখন তার ব্যাপারে তিনটি বক্তব্য: প্রথমত এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: এটা সমুদ্র কোন কিছুই তাকে অপবিত্র করতে পারে না। দ্বিতীয়ত: তার সবটকু পানি বের করে ফেলে দিতে হবে। তৃতীয়ত: তার থেকে সাত বালতি অথবা ছয় বালতি পানি বের করে দিতে হবে; তখন আমি তোমাদের কতিপয় আলেমকে জিজ্ঞাসা করলাম: এই তিনটি বক্তব্য দ্বারা তোমরা কিভাবে কি করবে?
জওয়াবে সে বলল: আমাদের মাযহাব হল, মানুষ যখন ইজতিহাদের যোগ্য হবে, তখন সে জাফর সাদিকের বক্তব্যগুলো নিয়ে গবেষণা করবে; অতঃপর তার থেকে একটিকে বিশুদ্ধ বলে মানবে।
অতঃপর আমি বললাম: বাকিগুলোর ব্যাপারে সে কী বলবে?
তখন সে বলল: সে বলবে: বাকিগুলো ‘তাকিয়্যা’!
অতঃপর আমি বললাম: যখন একজন ইজতিহাদ করল এবং এই বক্তব্য ছাড়া অন্য বক্তব্যকে বিশুদ্ধ বলল, তখন সে ঐ বক্তব্যের ব্যাপারে কী বলবে, যা প্রথম মুজতাহিদ (গবেষক) বিশুদ্ধ বলেছিল? তখন সে বলল: সে বলবে: তা হল ‘তাকিয়্যা’!
অতঃপর আমি বললাম: এ জন্যই জাফর সাদিকের মাযহাব নষ্ট হয়ে গেছে! কারণ, প্রত্যেক মাসআলার মধ্যেই ‘তাকিয়্যা’-এর সম্ভাবনা রয়েছে; কেননা এমন কোন আলামত (নিদর্শন) নেই, যার দ্বারা ‘তাকিয়্যা’ ও অন্যটির মধ্যে পার্থক্য করা যায়। অতঃপর ঐ আলেম থেমে গেল! তখন তোমার জওয়াব কী?!
তখন সেও থেমে গেল!! অতঃপর আমি তাকে বললাম:
তোমরা যদি বল: “জাফর সাদিকের মাযহাবের মধ্যে ‘তাকিয়্যা’ নেই” তবে তোমরা যে মাযহাবের উপর আছ, তা তার মাযহাব নয়। কারণ, তোমরা সকলেই ‘তাকিয়্যা’-এর কথা বল!
তখন মোল্লা বাশী থেমে গেল! অতঃপর আমি তার জন্য এটা ছাড়া আরও কিছু দলিল পেশ করলাম, যেগুলো প্রমাণ করে যে, তাদের সামনে যে মাযহাব বিদ্যমান, তা জাফর সাদিকের মাযহাব নয়।
অতঃপর শাহ আমাকে বাগদাদ ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন এবং আমার সাথে পত্রিকা ও খুতবার ফটোকপি পাঠালেন; সুতরাং এই যা ঘটল, তাতে আমি হজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।
হে আল্লাহ! তুমি এটা আমার জন্য সহজ করে দাও।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন