HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
নাজাফ সম্মেলন
লেখকঃ সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আস-সুওয়াইদী
২
ভূমিকা الحمد لله رب العالمين , و صلى الله على سيدنا محمد و آله و صحبه و سلم و بعد :
(সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য; আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম (শান্তি) বর্ষিত হউক আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সমস্ত সাহাবীর প্রতি) । অতঃপর
ইসলামের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ মুসলিম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর অন্তর্ভুক্ত; আর তারা হলেন ঐসব লোক, যারা তাদের দীন ও শরীয়ত তথা বিধিবিধান অর্জন করেছেন আল্লাহর কিতাব থেকে ঠিক তেমনি করে, যেমনিভাবে সাহাবা ও তাবেঈনগণ অনুধাবন করেছেন; বিশুদ্ধ সুন্নাতে নববী থেকে যা ত্রুটিমুক্ত করেছেন ইমাম ও বিশ্বস্ত হাফেযগণ এবং সংকলন করেছেন সংকলনকারীগণ অত্যন্ত যত্নসহকারে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ হল: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুয়াত্তায়ে মালেক, সুনানু তিরমিযী, নাসাঈ, আবি দাঊদ, অতঃপর সুনানু ইবন মাযাহ ও মুসনাদু আল-ইমাম আহমদসহ এই স্তরের আরও যেসব গ্রন্থ রয়েছে। আর এসব কিতাবে বর্ণিত হাদিসসমূহের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে সত্য, তবে হাদিসগুলো বিশুদ্ধ যা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানগণ তাদের অতীত সম্পদ থেকে লিখে নিয়েছেন।
এই মর্যাদাসম্পন্ন ইমামগণ হাদিস বর্ণনা ও তার মান নির্ণয়ে কতগুলো নিয়ম-কানুন ও শর্ত নির্ধারণ করেছেন; তারা এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন যা তার গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তা একটি মর্যাদাপূর্ণ শাস্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর তার নাম হল ‘ইলম আল-সুন্নাহ’ ( علم السنة )।
যে উম্মত আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের হাদিস এবং তার উপর ভিত্তি করে কিয়াস ও নস তথা সুস্পষ্ট ভাষ্যের বিপরীত নয়, ইমামদের এমন ঐক্যবদ্ধ রায় ইজমা থেকে উদ্ভাবিত বিধি-বিধান অনুযায়ী কাজ করে, তারাই হলেন ‘আহলে সুন্নাত’। আর যেহেতু তারা হচ্ছে অধিকাংশ মুসলিম ও তাদের জামা‘আত, তাই তাদেরকে বলা হয় ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’।
খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী রয়েছে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সুন্নাহ’র গ্রন্থসমূহে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ মেনে চলে না, যেভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত মেনে চলে; যে দিকে আমরা ইতঃপূর্বে ইঙ্গিত দিয়েছি। কিন্তু তারা কিবলার অনুসারী হওয়া ও তাদের নামায ও হজের কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে শরীক হয়ে যায়। আর এই কম সংখ্যকের মধ্য থেকে যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের খুব কাছাকাছি, তারা হল যায়েদীয়া, অতঃপর ইবাদীয়া, অতঃপর ‘আল-শী‘আ আল-ইসনা ‘আশারীয়া’ অতঃপর আহমদীয়া লাহোর, যারা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মানে না। আর যারা তার নবুওয়াতকে স্বীকার করে, তারা উপরিউক্ত সম্প্রদায়গুলোর চেয়ে ইসলামী ঈমান থেকে বহু দূরে রয়েছে।
তাদের সাথে সংযুক্ত অপর সংখ্যালঘুরা হল ‘বাতেনীয়া’; তারা নিজেদেরকে কিবলার অনুসারী বলে গণ্য করে না, তবে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত বলে দাবি করে। আর নসসমূহ ও আকিদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে তাদের বিশেষ দর্শন রয়েছে। তাদের মগডালে রয়েছে ‘ইসমাঈলীয়া আল-বুহরা’, অতঃপর ‘ইসমাঈলীয়া আগাখাঁন’, ‘নুসাইরীয়া’ ও ‘দুরুয’। আর যাদেরকে ওদের মধ্যে গণ্য করা যায়, তারা হল: ‘আল-বাবীয়া’ ও ‘আল-বাহাইয়া’; যদিও তারা ইসলাম থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে এবং অনাহূত স্বতন্ত্র দীন আবিষ্কার করে প্রসিদ্ধ দীনসমূহের মধ্যে নতুন করে বিরোধ তথা মতপার্থক্য বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা তারা ইসলামের নাম থেকেও খারিজ হয়ে গেছে।
আর ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ ও ‘শী‘আ’ সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ শরীয়তের উৎসকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে এবং অভিমত পেশ করে যে, তিনি একাই মা‘সুম অর্থাৎ তিনি তাঁর রবের পক্ষ থেকে যা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর রিসালাতের পরিপূর্ণতার জন্য যা আবশ্যক, তা অর্জন ও পালনে তিনিই একমাত্র মা‘সুম তথা নিষ্পাপ। আর ‘আল-শী‘আ আল-ইসনা ‘আশারীয়া’ ( الشيعة الاثنا عشرية ) সম্প্রদায় দাবি করে যে, আমিরুল মুমেনীন আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর ধারাবাহিকতায় আরও এগারো জন মা‘সুম তথা নিষ্পাপ। যদিও খোদ আলী রা. তা নিজের জন্য দাবি করেন নি; অথবা তাঁর সন্তানদের কোন সন্তানও তার বা তাদের জন্য তা দাবি করে নি। আর শী‘আগণ মনে করে যে, এ দ্বাদশ ইমামও শরীয়তের উৎস, যা ঐসব সৎ ব্যক্তিদের (আল্লাহ তাঁদের প্রতি রহম করুন) বিশ্বাসের বিপরীত।
আমাদের এবং শী‘আদের মধ্যে অপর একটি পার্থক্য আরও মৌলিক। আর তা হল, যে শরীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের নিকট পৌঁছেছে, তা শুধু সত্যনিষ্ঠ সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনের মাধ্যমেই পৌঁছেছে। আর তাঁদের নিকট থেকে সত্যনিষ্ঠ হাফেয তাবেয়ীগণ ও তাঁদের পরবর্তীতে যারা আগমন করেছেন (আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি রহম করুন), তাদের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে।
সুতরাং সাহাবাগণই হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শরীয়তের বিশ্বস্ত বাহক। আর তারাই হলেন “মানবতার কল্যাণে সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ উম্মত”—তাদের শানে যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন। আর তাঁদের মধ্য থেকে যাঁরা মক্কা বিজয়ের পূর্বে আল্লাহর পথে ব্যয় করেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছে, তাদের জন্য আল্লাহর সকল সৃষ্টির চেয়ে তাঁর নিকট শ্রেষ্ঠ মর্যাদা রয়েছে; যেমন আল্লাহ তা‘আলা এ কারণে তাঁদের প্রশংসা করেছেন। আর আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্য কথা কে বলে? আর আল্লাহ তাঁদেরকে উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাঁদের পরবর্তীতে যারা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকাল পর্যন্ত তাঁর সাহচর্যের গৌরব অর্জন করেছেন, তিনি তাঁদেরকেও উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর আমরা যে এখন ইসলামের নিয়ামতের মধ্যে আছি; ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং উম্মতে মুহাম্মদীয়া অস্তিত্ব-এই সব কিছুই সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনদের যুদ্ধ-জিহাদ ও তাঁদের কর্মকাণ্ডের ফসল। যদি তাঁরা না থাকতেন, তবে আমরা এবং শী‘আরাও কাফির, পাপিষ্ঠ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতাম। পৃথিবীর উপরে অবস্থানরত প্রতিটি মুসলিমের প্রতিটি ভাল কর্মের যে সওয়াব রয়েছে, চাই সে মুসলিম সুন্নী হউক অথবা যায়েদীয়া হউক অথবা ইবাদীয়া হউক অথবা শী‘আ হউক; কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত তার প্রতিটি সওয়াব থেকে একটি অংশ আল্লাহ তা‘আলা ঐসব সাহাবা রা.-এর জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, যাঁরা বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ইসলামের অধীনে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেছেন। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁদেরকে উত্তম প্রতদান দিবেন। আর তাঁদের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে সততা দান করেছেন এবং তাঁদের শিষ্টাচারের দ্বারা আমাদেরকে শিষ্টাচারের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আর আমরা তাঁদের উত্তম আলোচনা করি এবং তাঁদের জন্য মাগফেরাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করি। আমীন!
এটাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনের মর্যাদা; আর এটাই তাঁর নিকট তাঁদের পুরস্কার। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এটাকে দ্বীন মনে করে। আরা তাঁরা সকলেই ছিলেন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ভাই ভাই। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’ ও তাঁর ভাই আবূ বকর, ওমর, ওসমান, আবূ ওবায়দা, সা‘দ ইবন আবি ওয়াক্কাস, তালহা ও যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তাঁদের প্রতিজনের অন্তরের মধ্যে তাঁর ভাইদের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ থাকা থেকে আল্লাহকে বেশি বেশি ভয় করতেন।
সাইয়্যেদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ঘাড়ে তাঁর ভাই খলিফা আবূ বকরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত বা শপথ ছিল; অতঃপর তাঁর ভাই আমিরুল মুমিনীন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি; অতঃপর তাঁর ভাই আমিরুল মুমিনীন ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি। তিনি তাঁদেরকে এত বেশি ভালবাসতেন যে, তিনি তাঁদের নামে তাঁর সন্তানদের নাম রেখেছেন; তাঁদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এত মজবুত ছিল যে, তিনি তাঁদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁদেরকে সহযোগিতা করেছেন। আর তাঁর কলিজার টুকরা দুই সন্তানকে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করার জন্য আমিরুল মুমিনীন ওসমান রা.-এর দরজায় পাহারা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁর রক্তের নিরাপত্তার জন্য তাঁর দুই সন্তানের রক্তকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। যদিও ওসমান রা. নিজে তাঁর আমিরুল মুমিনীন পদবীর গুণে তাঁদের দুইজনকে এবং সকল সাহাবাকে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেতে নির্দেশ দেননি মুসলিমদের রক্ত প্রবাহিত হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য; ফিতনার পরিধিকে সংকীর্ণ করার জন্য এবং দলীল কায়েমের ক্ষেত্রে নিজের পক্ষ থেকে গভীর চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের জন্য। আর তার কারণ হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে শাহাদাত ও জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আর আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আর তিনিও তাঁকে সন্তুষ্ট করেছেন।
পক্ষান্তরে শী‘আদের আকিদা-বিশ্বাস হচ্ছে যে, পাঁচজন ব্যতীত বাকি সকল সাহাবা কাফির হয়ে গেছেন (না‘উযুবিল্লাহ); তাঁরা হলেন: আলী, মিকদাদ, আবূ যর, সালমান আল-ফারসী ও আম্মার ইবন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম, তাদের এই আকিদা কুফরী ও বাতিল।
আর আলী রা. এবং তাঁন সন্তানদের মধ্য থেকে আরও এগারো ব্যক্তির মা‘সুম তথা নিষ্পাপ হওয়ার ব্যাপারে শী‘আদের আকিদা এবং এ তাদের (আলী রা. ও তার সন্তানদের) কাছ থেকে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিরা যা বর্ণনা করেছে তা-ই শরীয়ত; যদিও বর্ণনাকারী মিথ্যাবাদী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত হোক, তা সবই আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে একাই মা‘সুম তথা নিষ্পাপ, তিনি ব্যতীত এই উম্মতের আর কেউই নিষ্পাপ নয়; আর তিনিই একমাত্র শরীয়তের উৎস, যা তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাব ও তাঁর নিকট থেকে বর্ণিত সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ عَلَّمَهُۥ شَدِيدُ ٱلۡقُوَىٰ ٥﴾ [ سورة النجم : 3-5]
“এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। এ তো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়; তাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী (ফেরেশতা)।” —(সূরা আন-নাজম: ৩-৫)
আর এই ওহী বন্ধ হয়ে যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু বরন করে তাঁর মহান বন্ধুর নিকট চলে যাওয়ার সাথে সাথে। ফলে এর দ্বারা শরীয়তের দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে; সুতরাং তাঁর পরে আর কোন শরীয়ত নেই এবং তিনি ব্যতীত আর কেউ নিষ্পাপ নন। আর আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান চলবে না। আর আল্লাহর বিধানসমূহের উপর যা কিয়াস করা হয় এবং জাতির ইমামগণ যে বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, তা যদি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর দ্বারা প্রমাণিত কোন বিধানের বিপরীত না হয়, তবে তাও শরীয়তের বিধান বলে গণ্য হবে।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহবীগণ হলেন তাঁর শরীয়তের বাহক ও তার আমানতদার যাঁরা তাঁদের পরবর্তী আমানতদার তথা বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। কারণ, সাহবাগণ সকলেই ন্যায়পরায়ণ, যদিও তাঁদের মধ্যে জ্ঞান ও মর্যাদার দিক থেকে ব্যবধান ছিল। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ لَا يَسۡتَوِي مِنكُم مَّنۡ أَنفَقَ مِن قَبۡلِ ٱلۡفَتۡحِ وَقَٰتَلَۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡظَمُ دَرَجَةٗ مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَقَٰتَلُواْۚ وَكُلّٗا وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ ﴾ [ سورة الحديد : 10]
“তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে, তারা ও পরবর্তীরা সমান নয়। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ওদের অপেক্ষা, যারা পরবর্তী কালে ব্যয় করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”— (সূরা আল-হাদীদ: ১০)
সুতরাং যে ব্যক্তি মনে করবে যে, তাঁদের মধ্যে (আল্লাহ রক্ষা করুন) এমন কোন ব্যক্তি রয়েছে যার উপর ‘কল্যাণের প্রতিশ্রুতি’ কার্যকর হবে না, সে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ এবং কিতাবের স্পষ্ট ভাষ্যের বিরোধিতা করার কারণে কাফির হয়ে যাবে, আর এই কারণে সে ইসলামের বন্ধন থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
আর তাঁরা সকলেই ছিলেন পরস্পর ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ভাই ভাই। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ﴾ [ سورة الفتح : 29]
“তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।”— (সূরা আল-ফাতহ: ২৯)।
সুতরাং যে ব্যক্তি ধারণামাফিক বলে যে, তাঁদের কারো কারো অন্তরে তাঁর ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে, দরদ নেই; হিংসা ও বিশৃঙ্খলার মানসিকতা আছে, ভালবাসা ও স্বার্থত্যাগের মানসিকতা নেই, তবে সে আল-কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সাহাবীদের ব্যাপার নিয়ে কষ্ট দিল এবং আলী রা. যে উচ্চতা, সততা ও মান-মর্যাদার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তাকে কুৎসিত করে তাঁর প্রতি অসদাচরণ করল।
তাঁদের দৃষ্টিতে খেলাফতটা মূলতই ছিল একটা কষ্টকর বোঝা ও দায়িত্ব, যা ঐ ব্যক্তিই বহন করতে পারে, যে তাদের মধ্য থেকে ধার্মিক ও আনুগত্যপরায়ণ। আর তাদের মধ্যে কেউই তার (খেলাফতের) অধিকারী নয়, যতক্ষণ না সে খেলাফতের দায়িত্বের জন্য মনোনীত হবে। আর খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার ভোগবিলাস ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তারা (জনগণ) কৈফিয়ৎ তলব করার অধিকার রাখে। আর খোলাফায়ে রাশেদুনের চার খলিফাই একের পর এক তা প্রতিষ্ঠা করেছেন (তাঁদের সকলের উপর আল্লাহর শান্তি, রহমত ও সন্তুষ্টি)। সুতরাং পবিত্রতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক নিষ্কলুষতা, প্রাচুর্যতা, ইনসাফ, দূরদৃষ্টি এবং কল্যাণ ও হককে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন) ছিলেন অতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আলী রা. ছিলেন সকল সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন)-এর প্রতি মহব্বতপূর্ণ ব্যক্তি। আর তাঁদের শীর্ষে ছিলেন তাঁর ঐসব ভ্রাতৃবৃন্দ, যাঁরা তাঁর পূর্বে জাতির দায়িত্বভার বহন করেছেন। আর তিনি (আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু) অবহিত ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট তাঁদের মহান মর্যাদা সম্পর্কে এবং তাঁদের মধ্য থেকে যাঁর হাতেই আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করেছেন, আন্তরিকতার সাথে সততাসহকারে তার ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন, তাতে নিফাকী ছিল না। আর তিনি মোনাফেকী চরিত্র থেকে মুক্ত সুমহান ও সম্মানিত!! সুতরাং যে ব্যক্তি এর বিপরীত কিছু দাবি করে, সে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র নিন্দা করে; তাঁর পক্ষ থেকে সর্ম্কচ্ছেদ ও ক্রোধের উপযুক্ত হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে উপযুক্ত হয় লা‘নত ও জাহান্নামের।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ যা তাঁর সাহাবীগণ বহন করেছেন; তাঁদের পরবর্তীতে ইমামগণ তা পরিশুদ্ধ করেছেন; দুর্বলগুলো থেকে বিশুদ্ধ বর্ণাগুলো স্পষ্ট করেছেন; তার বর্ণনাকারীদের মধ্য থেকে বিশ্বস্ত-আমানতদারগণকে চিহ্নিত করেছেন ও তাঁদেরকে নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদীদের থেকে পৃথক করেছেন এবং আরও পৃথক করেছেন দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে যারা এই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে তা পরিণত হয়েছে এমন সহীহ সুন্নায়; অতীতের কোন ইতিহাসই এ রকম আমানত দেখাতে পারবে না, যেখানকার শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো তার সংরক্ষণে এমন চুড়ান্ত চেষ্টা-সাধনা করেছেন, যেমন মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ তাদের নবীর সুন্নাহকে পরিশুদ্ধ করা এবং তাকে বাতিলের পক্ষ অবলম্বনকারী মিথ্যাবাদী ও ফিতনা-ফাসাদ সম্প্রসারণকারীদের খেয়াল-খুশি থেকে মুক্ত রাখার জন্য ব্যয় করেছেন।
ইসলামের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পদ্ধতি ও শী‘আদের পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্ট করা এবং যে ভীতের উপর তার শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত তা নির্দিষ্ট করার পর আমরা পাঠককে জানানো ভাল মনে করি যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত শী‘আদের সাথে মৌলিকভাবে ‘ইসলাম’ এর নামে এবং ইসলামের প্রতি বন্ধুত্বের খাতিরে একমত হতে পারে।
অনুরূপভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ উভয় দলের মধ্যে যে সব বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে সেগুলোতে পরস্পর সহযোগিতা করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত খারাপ মনে করে না, তবে এই শর্তে যে, তারা তাদের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ বিষয়ে একে অপরের ওযর গ্রহণ করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যে সত্য উপলব্ধি করেছে তার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করবে, অনুরূপভাবে শী‘আরা তাদের নীতি ও কর্মকাণ্ড আঁকড়ে ধরে থাকতে অভ্যস্থ সে ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ না করবে। কেননা; পারস্পরিক পরিচিতি ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত। আর এই লাইনগুলোর লেখক ছিলেন চল্লিশ বছর থেকে এখন পর্যন্ত পারস্পরিক এই পরিচিতি ও সহযোগিতার দা‘ঈদের অন্যতম।
অতঃপর শী‘আদের মধ্য থেকে অপর এক দা‘ঈ’র আবির্ভাব হয় যে ইরান থেকে মিসরে গিয়ে হাজির হয়; যাতে সে ‘আল-তাকরিব বাইনাল-মাযাহিবিল-ইসলামীয়া’ তথা ‘ইসলামী মাযহাবসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন’ ( التقريب بين المذاهب الإسلامية ) নামক সংস্থার দিকে ডাকতে পারে। এ থেকে তার উদ্দেশ্য হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আদের মধ্য থেকে লিখিত নতুন নতুন জিনিস প্রকাশ করা। তবে ইবাদীয়ারা, তাদের কিছুসংখ্যক ওলামা মিসরে অবস্থান করা সত্ত্বেও তারা কিন্তু এ ধরনের তাকরীব বা ঐক্যের দিকে আহ্বান করে না।
আর আমরা প্রথম দিন থেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছিলাম যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ এ উভয় মাযহাবের মধ্য এই তাকরীব বা সমন্বয় সাধন অসম্ভব ও অযৌক্তিক! তাছাড়া তা বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে; কারণ, উভয় মাযহাবের প্রত্যেকটি মাযহাবই একটি বিশেষ নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর প্রতিটি মাযহাবই অপর মাযহাব থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত।
যে পদ্ধতির মাধ্যমে ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয় সম্ভব, তা হল দুই মাযহাবের কোন এক মাযহাবের অনুসারীদেরকে তার মাযহাব ছেড়ে দিতে হবে এবং অপর মাযহাবের অনুসারীদের সাথে মিশতে হবে। অথচ আমরা এই ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয়ের আহ্বায়ক ও তার দলবলকে এই ধরনের ছাড় দেয়ার প্রস্তুতি বা মানসিকতা আছে বলে অনুভব করি নি!! ফলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ তাদের মাযহাব ছেড়ে দেবেন এমন আশাই বাকি থাকল! অথবা তাদের এই পক্ষ থেকে কিছু এবং ঐ পক্ষ থেকে কিছু নিয়ে তৃতীয় আরেকটি মাযহাব গঠন করা! এর পর তাতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আদের রাজি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মানে হয় না; [কারণ তা কখনও হবে না] বরং তাতে ইসলামের মধ্যে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
যে কিতাবটি এখন আমরা পাঠকদের উদ্দেশ্যে পেশ করব, তা হল দুই পক্ষের এক পক্ষ কর্তৃক তার নীতিমালা থেকে ছাড় দেয়ার মাধ্যমে ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিত। সুতরাং ইরানের শী‘আ গবেষকবৃন্দ ও নাজাফের আলেমগণ ১১৫৬ হিজরির ২৫ শাওয়াল বৃহস্পতিবার জর্দান, আফগানিস্তান ও মা ওয়ারাউন নাহর (বুখারা ও তার সংশ্লিষ্ট এলাকা) নামক এলাকার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণের উপস্থিতিতে এই ঘটনা সম্পর্কিত আমাদের এই কিতাবের লেখক ইরাকের বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’র সভাপতিত্বে একত্রিত হয়েছেন। আর তাদের সম্মেলনটি ছিল এমন এক ছাদের নীচে যা ইমাম আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু’ [এ শব্দটির পরিবর্তে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলা উচিত। কারণ, বিশেষ করে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য এ শব্দটি ব্যবহারের কোন সঠিক ও সংগত কারণ নেই।]র দিকে সম্পর্কিত একটি কবরের পেছনে অবস্থিত। আর এই সম্মেলনে কী হচ্ছে, তা শুনার জন্য আরব, অনারব ও তুর্কিস্তানের বহু সংখ্যক লোকজন একত্রিত হয়েছে যার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়; যারা একত্রিত হয়েছে, তন্মধ্যে নাদির শাহের সৈন্যবাহিনী ও ঐসব অঞ্চলের লোকজনও ছিল। আর নাদির শাহ ছিলেন পরবর্তী যুগের ইরানের শ্রেষ্ঠ সম্রাট, যিনি সম্মেলনের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন।
অতঃপর শী‘আ আলেমগণ ও তাদের গবেষকবৃন্দ যাদের শীর্ষে ছিলেন তাদের ধর্মীয় গুরু মোল্লা বাশী, তারা সম্মিলিতভাবে স্বীকার করেছেন যে, তারা সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন-এর ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কাতারে নেমে আসবে; খবীস শাহ ইসমাঈল আল-সাফাওয়ীর সকল বিদ‘আত স্থগিত করবে এবং স্বীকৃতি দিবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের সময় সাহাবদের ঐক্যমতের ভিত্তিতেই তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, মর্যাদাবান ও অভিজ্ঞ ছিলেন খলিফা আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু; আর ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন যেমনিভাবে অপরাপর সকল সাহাবী তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন; আর তাঁদের ইজমা অকাট্য দলীল। অতঃপর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য আনুগত্যের শপথ আহ্বান করলেন; অতঃপর সকল সাহাবী তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন, আর ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুও তাঁদের সাথে ছিলেন। অতঃপর ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারেও তাঁদের ঐক্যবদ্ধ রায়ের প্রতিফলন ঘটে। আর তাঁর পরে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হন আলী রা. এবং তাঁদের মর্যাদা ও খেলাফতের ধারাবাহিকতা ছিল এই রকমের (তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট)। সুতরাং যে ব্যক্তি গালি দিবে অথবা এর বিপরীত মন্তব্য করবে, তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের পক্ষ থেকে লা‘নত। আর তারা সকলেই এই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি পত্রে স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
এই যে কাজটি শী‘আ গবেষকবৃন্দ ও তাদের আলেমগণ ১১৫৬ হিজরিতে সর্বসাধারণের উপস্থিতিতে করেছিল, তাকে ‘তাকরীব’ ( التقريب ) বা ‘সমন্বয়সাধন’ বলাটাই শুদ্ধ। কারণ, তা মৌলিকভাবে শী‘আ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী যাবতীয় মুকাফফিরাত (কুফরি’র দিকে সম্পর্ককারী বস্তু) থেকে মুক্ত।
কিন্তু নীতিগতভাবে দু’টি বিরোধপূর্ণ মাযহাবের মধ্যে ‘তাকরীব’ বা সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে সংশয়মূলক নতুন যে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, অথচ দুটি মাযহাবের প্রতিটিই তাদের স্ব-স্ব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত; সে দাওয়াতের কিছু উদ্দেশ্য এভাবে প্রকাশ ঘটছে যে, কোন কোন কূটনৈতিক পক্ষ এতে উদ্দীপনা যোগাচ্ছে, এমন নির্বুদ্ধিতার সাথে যা জ্ঞান ও শরীয়তের কোনটির সাথেই খাপ খায় না; তা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ উভয় মাযহাবের পক্ষ থেকেই সমানভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার উপযুক্ত। কারণ, তার থেকে উভয় মাযহাবের জন্যই কতগুলো অনর্থক বিষয় বা বিতর্কের জন্ম হবে, যার থেকে তৃতীয় আরেকটি মাযহাবের উত্থান হবে, যার দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো একটি ফিরকার উন্মেষ ঘটবে। আর আমরা শুনেছি যে, সিরিয়ার (শামের) শী‘আ গবেষক সাইয়্যিদ মুহসিন আমিন এই ‘তাকরীব’ ( التقريب )-এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন; আর এখন পর্যন্ত এটাকে সমর্থন করে কয়েকজন অখ্যাত শী‘আ ব্যক্তি (তাদের নির্ভরযোগ্য আলেম নয়) ছাড়া কেউ কোন বিবৃতি দেয় নি।
আর ‘সম্মেলন স্মারক’ ( كتاب المؤتمر ) যা আমরা এই ভূমিকার পরে উপস্থাপন করব, তা লিখিত হয়েছে সম্মেলনের সভাপতি সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’র কলমে। আর তা ১৩২৩ হিজরিতে কায়রোর আল-সা‘আদাত প্রকাশনা থেকে “আল-হুজাজুল-কাত‘ইয়্যা লি ইত্তিফাকিল-ফিরাকিল-ইসলামীয়া /ইসলামী ফিরকাসমূহের ঐক্যের অকাট্য দলীল” ( الحجج القطعية لاتفاق الفرق الإسلامية ) নামক শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তার প্রচারণা ছিল সীমিত পরিসরে এবং পরিধি ছিল সংকীর্ণ; ফলে আমি দেখেছি যে, অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিই তার ব্যাপারে অনবহিত। আর তার কোন কপি সংগ্রহ করার কোন উপায় ছিল না। তারপর যখন সন্দেহজনক এই ঐক্যের আহ্বানজনিত ফেতনা দেখতে পেলাম তখনই তা আমাকে এই গ্রন্থটিকে পুণঃপ্রকাশে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাছাড়া এজন্যও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘নাজাফ সম্মেলন’ ( مؤتمر النجف ) টি আমার জানামতে ইসলামী এ জাতীয় প্রথম পদক্ষেপ।
আর এই সম্মেলনের সভাপতি ও এই বইয়ের লেখক সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী হলেন আবূল বারাকাত ইবন সাইয়্যিদ হোসাইন ইবন মার‘ঈ ইবন নাসিরুদ্দীন; আর আল-সুওয়াইদী’র পরিবার হল বাগদাদের সম্ভ্রান্ত পরিবারসমূহের মধ্যে অন্যতম এবং আব্বাসীয় বংশের অন্তর্ভুক্ত, যারা দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী খেলাফতের দায়িত্ব পালনে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ ১১০৪ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১৭০ হিজরিতে মারা যান। এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করার সময় তার বয়স ছিল বায়ান্ন বছর।
তিনি যাদের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন, তারা হলেন: আহমদ ইবন আবিল কাসিম আল-মাদায়েনী আল-মাগরেবী, তার চাচা সাইয়্যিদ আহমদ ইবন মার‘ঈ আল-সুওয়াইদী, শাইখ সুলতান আল-জুবুরী, মুহাম্মদ ইবন ‘উকাইলা আল-মাক্কী, শাইখ আলী আল-আনসারী আল-আহসায়ী প্রমুখ; যারা ইরাক, হেজায ও সিরিয়া’র আলেম ছিলেন।
সাইয়্যিদ মাহমুদ শুকরী আল-আলুসী তার প্রশংসায় বলেন: “তিনি পুরো যমীনের শাইখ এবং সবার মতে শরীয়তের সৌন্দর্য বলে বিবেচিত।”
তার রচিত গ্রন্থসমূহ হল: শরহুন জালিলুন ‘আলা সহীহিল-ইমামিল-বুখারী ( شرح جليل على صحيح الإمام البخاري ); কিতাব আল-মুহাকামাহ বাইনা আল-দিমামীনী ওয়া আল-শুমুন্নী ( كتاب المحاكمة بين الدماميني و الشمني ); রাশফ আল-দারব ( رشف الضرب ); আল-নুফহাহ আল-মিসকিয়্যাহ ( النفحة المسكية ); আল-আমছাল আল-সায়েরা ( الأمثال السائرة ); শরহু দালায়েল আল-খায়রাত ( شرح دلائل الخيرات )। তার আরও একটি গ্রন্থের নাম “আর রিহলাতুল-মাক্কীয়া” ( الرحلة المكية ) যাতে আমরা নাজাফ সম্মেলন সম্পর্কে এই কিতাবে যা লিপিবদ্ধ করেছি, তা বিদ্যমান আছে। আর তিনি ঐ বছর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের নিমিত্তে হজ পালন করেছেন; কারণ, তিনি নিজ হাতে নাদির শাহ ও অধিকাংশ শী‘আকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদেরকে (তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট) গালি দানে বিরত থাকার কথা স্বীকার করতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহ সত্য ও কল্যাণ এবং উভয়ের অনুসারীদের অভিভাবক; আর সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।
মুহিব্বুদ্দীন আল-খতিব
(সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য; আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম (শান্তি) বর্ষিত হউক আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সমস্ত সাহাবীর প্রতি) । অতঃপর
ইসলামের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ মুসলিম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর অন্তর্ভুক্ত; আর তারা হলেন ঐসব লোক, যারা তাদের দীন ও শরীয়ত তথা বিধিবিধান অর্জন করেছেন আল্লাহর কিতাব থেকে ঠিক তেমনি করে, যেমনিভাবে সাহাবা ও তাবেঈনগণ অনুধাবন করেছেন; বিশুদ্ধ সুন্নাতে নববী থেকে যা ত্রুটিমুক্ত করেছেন ইমাম ও বিশ্বস্ত হাফেযগণ এবং সংকলন করেছেন সংকলনকারীগণ অত্যন্ত যত্নসহকারে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ হল: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুয়াত্তায়ে মালেক, সুনানু তিরমিযী, নাসাঈ, আবি দাঊদ, অতঃপর সুনানু ইবন মাযাহ ও মুসনাদু আল-ইমাম আহমদসহ এই স্তরের আরও যেসব গ্রন্থ রয়েছে। আর এসব কিতাবে বর্ণিত হাদিসসমূহের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে সত্য, তবে হাদিসগুলো বিশুদ্ধ যা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানগণ তাদের অতীত সম্পদ থেকে লিখে নিয়েছেন।
এই মর্যাদাসম্পন্ন ইমামগণ হাদিস বর্ণনা ও তার মান নির্ণয়ে কতগুলো নিয়ম-কানুন ও শর্ত নির্ধারণ করেছেন; তারা এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন যা তার গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তা একটি মর্যাদাপূর্ণ শাস্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর তার নাম হল ‘ইলম আল-সুন্নাহ’ ( علم السنة )।
যে উম্মত আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের হাদিস এবং তার উপর ভিত্তি করে কিয়াস ও নস তথা সুস্পষ্ট ভাষ্যের বিপরীত নয়, ইমামদের এমন ঐক্যবদ্ধ রায় ইজমা থেকে উদ্ভাবিত বিধি-বিধান অনুযায়ী কাজ করে, তারাই হলেন ‘আহলে সুন্নাত’। আর যেহেতু তারা হচ্ছে অধিকাংশ মুসলিম ও তাদের জামা‘আত, তাই তাদেরকে বলা হয় ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’।
খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী রয়েছে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সুন্নাহ’র গ্রন্থসমূহে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ মেনে চলে না, যেভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত মেনে চলে; যে দিকে আমরা ইতঃপূর্বে ইঙ্গিত দিয়েছি। কিন্তু তারা কিবলার অনুসারী হওয়া ও তাদের নামায ও হজের কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে শরীক হয়ে যায়। আর এই কম সংখ্যকের মধ্য থেকে যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের খুব কাছাকাছি, তারা হল যায়েদীয়া, অতঃপর ইবাদীয়া, অতঃপর ‘আল-শী‘আ আল-ইসনা ‘আশারীয়া’ অতঃপর আহমদীয়া লাহোর, যারা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মানে না। আর যারা তার নবুওয়াতকে স্বীকার করে, তারা উপরিউক্ত সম্প্রদায়গুলোর চেয়ে ইসলামী ঈমান থেকে বহু দূরে রয়েছে।
তাদের সাথে সংযুক্ত অপর সংখ্যালঘুরা হল ‘বাতেনীয়া’; তারা নিজেদেরকে কিবলার অনুসারী বলে গণ্য করে না, তবে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত বলে দাবি করে। আর নসসমূহ ও আকিদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে তাদের বিশেষ দর্শন রয়েছে। তাদের মগডালে রয়েছে ‘ইসমাঈলীয়া আল-বুহরা’, অতঃপর ‘ইসমাঈলীয়া আগাখাঁন’, ‘নুসাইরীয়া’ ও ‘দুরুয’। আর যাদেরকে ওদের মধ্যে গণ্য করা যায়, তারা হল: ‘আল-বাবীয়া’ ও ‘আল-বাহাইয়া’; যদিও তারা ইসলাম থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে এবং অনাহূত স্বতন্ত্র দীন আবিষ্কার করে প্রসিদ্ধ দীনসমূহের মধ্যে নতুন করে বিরোধ তথা মতপার্থক্য বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা তারা ইসলামের নাম থেকেও খারিজ হয়ে গেছে।
আর ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ ও ‘শী‘আ’ সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ শরীয়তের উৎসকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে এবং অভিমত পেশ করে যে, তিনি একাই মা‘সুম অর্থাৎ তিনি তাঁর রবের পক্ষ থেকে যা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর রিসালাতের পরিপূর্ণতার জন্য যা আবশ্যক, তা অর্জন ও পালনে তিনিই একমাত্র মা‘সুম তথা নিষ্পাপ। আর ‘আল-শী‘আ আল-ইসনা ‘আশারীয়া’ ( الشيعة الاثنا عشرية ) সম্প্রদায় দাবি করে যে, আমিরুল মুমেনীন আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর ধারাবাহিকতায় আরও এগারো জন মা‘সুম তথা নিষ্পাপ। যদিও খোদ আলী রা. তা নিজের জন্য দাবি করেন নি; অথবা তাঁর সন্তানদের কোন সন্তানও তার বা তাদের জন্য তা দাবি করে নি। আর শী‘আগণ মনে করে যে, এ দ্বাদশ ইমামও শরীয়তের উৎস, যা ঐসব সৎ ব্যক্তিদের (আল্লাহ তাঁদের প্রতি রহম করুন) বিশ্বাসের বিপরীত।
আমাদের এবং শী‘আদের মধ্যে অপর একটি পার্থক্য আরও মৌলিক। আর তা হল, যে শরীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের নিকট পৌঁছেছে, তা শুধু সত্যনিষ্ঠ সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনের মাধ্যমেই পৌঁছেছে। আর তাঁদের নিকট থেকে সত্যনিষ্ঠ হাফেয তাবেয়ীগণ ও তাঁদের পরবর্তীতে যারা আগমন করেছেন (আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি রহম করুন), তাদের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে।
সুতরাং সাহাবাগণই হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শরীয়তের বিশ্বস্ত বাহক। আর তারাই হলেন “মানবতার কল্যাণে সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ উম্মত”—তাদের শানে যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন। আর তাঁদের মধ্য থেকে যাঁরা মক্কা বিজয়ের পূর্বে আল্লাহর পথে ব্যয় করেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছে, তাদের জন্য আল্লাহর সকল সৃষ্টির চেয়ে তাঁর নিকট শ্রেষ্ঠ মর্যাদা রয়েছে; যেমন আল্লাহ তা‘আলা এ কারণে তাঁদের প্রশংসা করেছেন। আর আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্য কথা কে বলে? আর আল্লাহ তাঁদেরকে উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাঁদের পরবর্তীতে যারা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকাল পর্যন্ত তাঁর সাহচর্যের গৌরব অর্জন করেছেন, তিনি তাঁদেরকেও উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর আমরা যে এখন ইসলামের নিয়ামতের মধ্যে আছি; ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং উম্মতে মুহাম্মদীয়া অস্তিত্ব-এই সব কিছুই সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনদের যুদ্ধ-জিহাদ ও তাঁদের কর্মকাণ্ডের ফসল। যদি তাঁরা না থাকতেন, তবে আমরা এবং শী‘আরাও কাফির, পাপিষ্ঠ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতাম। পৃথিবীর উপরে অবস্থানরত প্রতিটি মুসলিমের প্রতিটি ভাল কর্মের যে সওয়াব রয়েছে, চাই সে মুসলিম সুন্নী হউক অথবা যায়েদীয়া হউক অথবা ইবাদীয়া হউক অথবা শী‘আ হউক; কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত তার প্রতিটি সওয়াব থেকে একটি অংশ আল্লাহ তা‘আলা ঐসব সাহাবা রা.-এর জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, যাঁরা বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ইসলামের অধীনে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেছেন। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁদেরকে উত্তম প্রতদান দিবেন। আর তাঁদের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে সততা দান করেছেন এবং তাঁদের শিষ্টাচারের দ্বারা আমাদেরকে শিষ্টাচারের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আর আমরা তাঁদের উত্তম আলোচনা করি এবং তাঁদের জন্য মাগফেরাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করি। আমীন!
এটাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈনের মর্যাদা; আর এটাই তাঁর নিকট তাঁদের পুরস্কার। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এটাকে দ্বীন মনে করে। আরা তাঁরা সকলেই ছিলেন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ভাই ভাই। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’ ও তাঁর ভাই আবূ বকর, ওমর, ওসমান, আবূ ওবায়দা, সা‘দ ইবন আবি ওয়াক্কাস, তালহা ও যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তাঁদের প্রতিজনের অন্তরের মধ্যে তাঁর ভাইদের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ থাকা থেকে আল্লাহকে বেশি বেশি ভয় করতেন।
সাইয়্যেদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ঘাড়ে তাঁর ভাই খলিফা আবূ বকরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত বা শপথ ছিল; অতঃপর তাঁর ভাই আমিরুল মুমিনীন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি; অতঃপর তাঁর ভাই আমিরুল মুমিনীন ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি। তিনি তাঁদেরকে এত বেশি ভালবাসতেন যে, তিনি তাঁদের নামে তাঁর সন্তানদের নাম রেখেছেন; তাঁদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এত মজবুত ছিল যে, তিনি তাঁদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁদেরকে সহযোগিতা করেছেন। আর তাঁর কলিজার টুকরা দুই সন্তানকে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করার জন্য আমিরুল মুমিনীন ওসমান রা.-এর দরজায় পাহারা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁর রক্তের নিরাপত্তার জন্য তাঁর দুই সন্তানের রক্তকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। যদিও ওসমান রা. নিজে তাঁর আমিরুল মুমিনীন পদবীর গুণে তাঁদের দুইজনকে এবং সকল সাহাবাকে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেতে নির্দেশ দেননি মুসলিমদের রক্ত প্রবাহিত হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য; ফিতনার পরিধিকে সংকীর্ণ করার জন্য এবং দলীল কায়েমের ক্ষেত্রে নিজের পক্ষ থেকে গভীর চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের জন্য। আর তার কারণ হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে শাহাদাত ও জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আর আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আর তিনিও তাঁকে সন্তুষ্ট করেছেন।
পক্ষান্তরে শী‘আদের আকিদা-বিশ্বাস হচ্ছে যে, পাঁচজন ব্যতীত বাকি সকল সাহাবা কাফির হয়ে গেছেন (না‘উযুবিল্লাহ); তাঁরা হলেন: আলী, মিকদাদ, আবূ যর, সালমান আল-ফারসী ও আম্মার ইবন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম, তাদের এই আকিদা কুফরী ও বাতিল।
আর আলী রা. এবং তাঁন সন্তানদের মধ্য থেকে আরও এগারো ব্যক্তির মা‘সুম তথা নিষ্পাপ হওয়ার ব্যাপারে শী‘আদের আকিদা এবং এ তাদের (আলী রা. ও তার সন্তানদের) কাছ থেকে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিরা যা বর্ণনা করেছে তা-ই শরীয়ত; যদিও বর্ণনাকারী মিথ্যাবাদী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত হোক, তা সবই আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে একাই মা‘সুম তথা নিষ্পাপ, তিনি ব্যতীত এই উম্মতের আর কেউই নিষ্পাপ নয়; আর তিনিই একমাত্র শরীয়তের উৎস, যা তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাব ও তাঁর নিকট থেকে বর্ণিত সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ عَلَّمَهُۥ شَدِيدُ ٱلۡقُوَىٰ ٥﴾ [ سورة النجم : 3-5]
“এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। এ তো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়; তাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী (ফেরেশতা)।” —(সূরা আন-নাজম: ৩-৫)
আর এই ওহী বন্ধ হয়ে যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু বরন করে তাঁর মহান বন্ধুর নিকট চলে যাওয়ার সাথে সাথে। ফলে এর দ্বারা শরীয়তের দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে; সুতরাং তাঁর পরে আর কোন শরীয়ত নেই এবং তিনি ব্যতীত আর কেউ নিষ্পাপ নন। আর আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান চলবে না। আর আল্লাহর বিধানসমূহের উপর যা কিয়াস করা হয় এবং জাতির ইমামগণ যে বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, তা যদি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর দ্বারা প্রমাণিত কোন বিধানের বিপরীত না হয়, তবে তাও শরীয়তের বিধান বলে গণ্য হবে।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহবীগণ হলেন তাঁর শরীয়তের বাহক ও তার আমানতদার যাঁরা তাঁদের পরবর্তী আমানতদার তথা বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। কারণ, সাহবাগণ সকলেই ন্যায়পরায়ণ, যদিও তাঁদের মধ্যে জ্ঞান ও মর্যাদার দিক থেকে ব্যবধান ছিল। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ لَا يَسۡتَوِي مِنكُم مَّنۡ أَنفَقَ مِن قَبۡلِ ٱلۡفَتۡحِ وَقَٰتَلَۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡظَمُ دَرَجَةٗ مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَقَٰتَلُواْۚ وَكُلّٗا وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ ﴾ [ سورة الحديد : 10]
“তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে, তারা ও পরবর্তীরা সমান নয়। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ওদের অপেক্ষা, যারা পরবর্তী কালে ব্যয় করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”— (সূরা আল-হাদীদ: ১০)
সুতরাং যে ব্যক্তি মনে করবে যে, তাঁদের মধ্যে (আল্লাহ রক্ষা করুন) এমন কোন ব্যক্তি রয়েছে যার উপর ‘কল্যাণের প্রতিশ্রুতি’ কার্যকর হবে না, সে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ এবং কিতাবের স্পষ্ট ভাষ্যের বিরোধিতা করার কারণে কাফির হয়ে যাবে, আর এই কারণে সে ইসলামের বন্ধন থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
আর তাঁরা সকলেই ছিলেন পরস্পর ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ভাই ভাই। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ﴾ [ سورة الفتح : 29]
“তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।”— (সূরা আল-ফাতহ: ২৯)।
সুতরাং যে ব্যক্তি ধারণামাফিক বলে যে, তাঁদের কারো কারো অন্তরে তাঁর ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে, দরদ নেই; হিংসা ও বিশৃঙ্খলার মানসিকতা আছে, ভালবাসা ও স্বার্থত্যাগের মানসিকতা নেই, তবে সে আল-কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সাহাবীদের ব্যাপার নিয়ে কষ্ট দিল এবং আলী রা. যে উচ্চতা, সততা ও মান-মর্যাদার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তাকে কুৎসিত করে তাঁর প্রতি অসদাচরণ করল।
তাঁদের দৃষ্টিতে খেলাফতটা মূলতই ছিল একটা কষ্টকর বোঝা ও দায়িত্ব, যা ঐ ব্যক্তিই বহন করতে পারে, যে তাদের মধ্য থেকে ধার্মিক ও আনুগত্যপরায়ণ। আর তাদের মধ্যে কেউই তার (খেলাফতের) অধিকারী নয়, যতক্ষণ না সে খেলাফতের দায়িত্বের জন্য মনোনীত হবে। আর খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার ভোগবিলাস ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তারা (জনগণ) কৈফিয়ৎ তলব করার অধিকার রাখে। আর খোলাফায়ে রাশেদুনের চার খলিফাই একের পর এক তা প্রতিষ্ঠা করেছেন (তাঁদের সকলের উপর আল্লাহর শান্তি, রহমত ও সন্তুষ্টি)। সুতরাং পবিত্রতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক নিষ্কলুষতা, প্রাচুর্যতা, ইনসাফ, দূরদৃষ্টি এবং কল্যাণ ও হককে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন) ছিলেন অতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আলী রা. ছিলেন সকল সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন)-এর প্রতি মহব্বতপূর্ণ ব্যক্তি। আর তাঁদের শীর্ষে ছিলেন তাঁর ঐসব ভ্রাতৃবৃন্দ, যাঁরা তাঁর পূর্বে জাতির দায়িত্বভার বহন করেছেন। আর তিনি (আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু) অবহিত ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট তাঁদের মহান মর্যাদা সম্পর্কে এবং তাঁদের মধ্য থেকে যাঁর হাতেই আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করেছেন, আন্তরিকতার সাথে সততাসহকারে তার ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন, তাতে নিফাকী ছিল না। আর তিনি মোনাফেকী চরিত্র থেকে মুক্ত সুমহান ও সম্মানিত!! সুতরাং যে ব্যক্তি এর বিপরীত কিছু দাবি করে, সে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র নিন্দা করে; তাঁর পক্ষ থেকে সর্ম্কচ্ছেদ ও ক্রোধের উপযুক্ত হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে উপযুক্ত হয় লা‘নত ও জাহান্নামের।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ যা তাঁর সাহাবীগণ বহন করেছেন; তাঁদের পরবর্তীতে ইমামগণ তা পরিশুদ্ধ করেছেন; দুর্বলগুলো থেকে বিশুদ্ধ বর্ণাগুলো স্পষ্ট করেছেন; তার বর্ণনাকারীদের মধ্য থেকে বিশ্বস্ত-আমানতদারগণকে চিহ্নিত করেছেন ও তাঁদেরকে নিকৃষ্ট মিথ্যাবাদীদের থেকে পৃথক করেছেন এবং আরও পৃথক করেছেন দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে যারা এই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে তা পরিণত হয়েছে এমন সহীহ সুন্নায়; অতীতের কোন ইতিহাসই এ রকম আমানত দেখাতে পারবে না, যেখানকার শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো তার সংরক্ষণে এমন চুড়ান্ত চেষ্টা-সাধনা করেছেন, যেমন মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ তাদের নবীর সুন্নাহকে পরিশুদ্ধ করা এবং তাকে বাতিলের পক্ষ অবলম্বনকারী মিথ্যাবাদী ও ফিতনা-ফাসাদ সম্প্রসারণকারীদের খেয়াল-খুশি থেকে মুক্ত রাখার জন্য ব্যয় করেছেন।
ইসলামের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পদ্ধতি ও শী‘আদের পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্ট করা এবং যে ভীতের উপর তার শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত তা নির্দিষ্ট করার পর আমরা পাঠককে জানানো ভাল মনে করি যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত শী‘আদের সাথে মৌলিকভাবে ‘ইসলাম’ এর নামে এবং ইসলামের প্রতি বন্ধুত্বের খাতিরে একমত হতে পারে।
অনুরূপভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ উভয় দলের মধ্যে যে সব বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে সেগুলোতে পরস্পর সহযোগিতা করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত খারাপ মনে করে না, তবে এই শর্তে যে, তারা তাদের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ বিষয়ে একে অপরের ওযর গ্রহণ করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যে সত্য উপলব্ধি করেছে তার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করবে, অনুরূপভাবে শী‘আরা তাদের নীতি ও কর্মকাণ্ড আঁকড়ে ধরে থাকতে অভ্যস্থ সে ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ না করবে। কেননা; পারস্পরিক পরিচিতি ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত। আর এই লাইনগুলোর লেখক ছিলেন চল্লিশ বছর থেকে এখন পর্যন্ত পারস্পরিক এই পরিচিতি ও সহযোগিতার দা‘ঈদের অন্যতম।
অতঃপর শী‘আদের মধ্য থেকে অপর এক দা‘ঈ’র আবির্ভাব হয় যে ইরান থেকে মিসরে গিয়ে হাজির হয়; যাতে সে ‘আল-তাকরিব বাইনাল-মাযাহিবিল-ইসলামীয়া’ তথা ‘ইসলামী মাযহাবসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন’ ( التقريب بين المذاهب الإسلامية ) নামক সংস্থার দিকে ডাকতে পারে। এ থেকে তার উদ্দেশ্য হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আদের মধ্য থেকে লিখিত নতুন নতুন জিনিস প্রকাশ করা। তবে ইবাদীয়ারা, তাদের কিছুসংখ্যক ওলামা মিসরে অবস্থান করা সত্ত্বেও তারা কিন্তু এ ধরনের তাকরীব বা ঐক্যের দিকে আহ্বান করে না।
আর আমরা প্রথম দিন থেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছিলাম যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ এ উভয় মাযহাবের মধ্য এই তাকরীব বা সমন্বয় সাধন অসম্ভব ও অযৌক্তিক! তাছাড়া তা বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে; কারণ, উভয় মাযহাবের প্রত্যেকটি মাযহাবই একটি বিশেষ নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর প্রতিটি মাযহাবই অপর মাযহাব থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত।
যে পদ্ধতির মাধ্যমে ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয় সম্ভব, তা হল দুই মাযহাবের কোন এক মাযহাবের অনুসারীদেরকে তার মাযহাব ছেড়ে দিতে হবে এবং অপর মাযহাবের অনুসারীদের সাথে মিশতে হবে। অথচ আমরা এই ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয়ের আহ্বায়ক ও তার দলবলকে এই ধরনের ছাড় দেয়ার প্রস্তুতি বা মানসিকতা আছে বলে অনুভব করি নি!! ফলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ তাদের মাযহাব ছেড়ে দেবেন এমন আশাই বাকি থাকল! অথবা তাদের এই পক্ষ থেকে কিছু এবং ঐ পক্ষ থেকে কিছু নিয়ে তৃতীয় আরেকটি মাযহাব গঠন করা! এর পর তাতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আদের রাজি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মানে হয় না; [কারণ তা কখনও হবে না] বরং তাতে ইসলামের মধ্যে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
যে কিতাবটি এখন আমরা পাঠকদের উদ্দেশ্যে পেশ করব, তা হল দুই পক্ষের এক পক্ষ কর্তৃক তার নীতিমালা থেকে ছাড় দেয়ার মাধ্যমে ‘তাকরীব’ তথা সমন্বয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিত। সুতরাং ইরানের শী‘আ গবেষকবৃন্দ ও নাজাফের আলেমগণ ১১৫৬ হিজরির ২৫ শাওয়াল বৃহস্পতিবার জর্দান, আফগানিস্তান ও মা ওয়ারাউন নাহর (বুখারা ও তার সংশ্লিষ্ট এলাকা) নামক এলাকার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণের উপস্থিতিতে এই ঘটনা সম্পর্কিত আমাদের এই কিতাবের লেখক ইরাকের বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’র সভাপতিত্বে একত্রিত হয়েছেন। আর তাদের সম্মেলনটি ছিল এমন এক ছাদের নীচে যা ইমাম আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু’ [এ শব্দটির পরিবর্তে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলা উচিত। কারণ, বিশেষ করে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য এ শব্দটি ব্যবহারের কোন সঠিক ও সংগত কারণ নেই।]র দিকে সম্পর্কিত একটি কবরের পেছনে অবস্থিত। আর এই সম্মেলনে কী হচ্ছে, তা শুনার জন্য আরব, অনারব ও তুর্কিস্তানের বহু সংখ্যক লোকজন একত্রিত হয়েছে যার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়; যারা একত্রিত হয়েছে, তন্মধ্যে নাদির শাহের সৈন্যবাহিনী ও ঐসব অঞ্চলের লোকজনও ছিল। আর নাদির শাহ ছিলেন পরবর্তী যুগের ইরানের শ্রেষ্ঠ সম্রাট, যিনি সম্মেলনের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন।
অতঃপর শী‘আ আলেমগণ ও তাদের গবেষকবৃন্দ যাদের শীর্ষে ছিলেন তাদের ধর্মীয় গুরু মোল্লা বাশী, তারা সম্মিলিতভাবে স্বীকার করেছেন যে, তারা সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন-এর ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কাতারে নেমে আসবে; খবীস শাহ ইসমাঈল আল-সাফাওয়ীর সকল বিদ‘আত স্থগিত করবে এবং স্বীকৃতি দিবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের সময় সাহাবদের ঐক্যমতের ভিত্তিতেই তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, মর্যাদাবান ও অভিজ্ঞ ছিলেন খলিফা আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু; আর ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন যেমনিভাবে অপরাপর সকল সাহাবী তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন; আর তাঁদের ইজমা অকাট্য দলীল। অতঃপর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য আনুগত্যের শপথ আহ্বান করলেন; অতঃপর সকল সাহাবী তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছেন, আর ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুও তাঁদের সাথে ছিলেন। অতঃপর ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারেও তাঁদের ঐক্যবদ্ধ রায়ের প্রতিফলন ঘটে। আর তাঁর পরে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হন আলী রা. এবং তাঁদের মর্যাদা ও খেলাফতের ধারাবাহিকতা ছিল এই রকমের (তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট)। সুতরাং যে ব্যক্তি গালি দিবে অথবা এর বিপরীত মন্তব্য করবে, তার উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের পক্ষ থেকে লা‘নত। আর তারা সকলেই এই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি পত্রে স্বাক্ষর ও সীলমোহর প্রদান করেছে।
এই যে কাজটি শী‘আ গবেষকবৃন্দ ও তাদের আলেমগণ ১১৫৬ হিজরিতে সর্বসাধারণের উপস্থিতিতে করেছিল, তাকে ‘তাকরীব’ ( التقريب ) বা ‘সমন্বয়সাধন’ বলাটাই শুদ্ধ। কারণ, তা মৌলিকভাবে শী‘আ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী যাবতীয় মুকাফফিরাত (কুফরি’র দিকে সম্পর্ককারী বস্তু) থেকে মুক্ত।
কিন্তু নীতিগতভাবে দু’টি বিরোধপূর্ণ মাযহাবের মধ্যে ‘তাকরীব’ বা সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে সংশয়মূলক নতুন যে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, অথচ দুটি মাযহাবের প্রতিটিই তাদের স্ব-স্ব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত; সে দাওয়াতের কিছু উদ্দেশ্য এভাবে প্রকাশ ঘটছে যে, কোন কোন কূটনৈতিক পক্ষ এতে উদ্দীপনা যোগাচ্ছে, এমন নির্বুদ্ধিতার সাথে যা জ্ঞান ও শরীয়তের কোনটির সাথেই খাপ খায় না; তা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শী‘আ উভয় মাযহাবের পক্ষ থেকেই সমানভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার উপযুক্ত। কারণ, তার থেকে উভয় মাযহাবের জন্যই কতগুলো অনর্থক বিষয় বা বিতর্কের জন্ম হবে, যার থেকে তৃতীয় আরেকটি মাযহাবের উত্থান হবে, যার দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো একটি ফিরকার উন্মেষ ঘটবে। আর আমরা শুনেছি যে, সিরিয়ার (শামের) শী‘আ গবেষক সাইয়্যিদ মুহসিন আমিন এই ‘তাকরীব’ ( التقريب )-এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন; আর এখন পর্যন্ত এটাকে সমর্থন করে কয়েকজন অখ্যাত শী‘আ ব্যক্তি (তাদের নির্ভরযোগ্য আলেম নয়) ছাড়া কেউ কোন বিবৃতি দেয় নি।
আর ‘সম্মেলন স্মারক’ ( كتاب المؤتمر ) যা আমরা এই ভূমিকার পরে উপস্থাপন করব, তা লিখিত হয়েছে সম্মেলনের সভাপতি সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী’র কলমে। আর তা ১৩২৩ হিজরিতে কায়রোর আল-সা‘আদাত প্রকাশনা থেকে “আল-হুজাজুল-কাত‘ইয়্যা লি ইত্তিফাকিল-ফিরাকিল-ইসলামীয়া /ইসলামী ফিরকাসমূহের ঐক্যের অকাট্য দলীল” ( الحجج القطعية لاتفاق الفرق الإسلامية ) নামক শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তার প্রচারণা ছিল সীমিত পরিসরে এবং পরিধি ছিল সংকীর্ণ; ফলে আমি দেখেছি যে, অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিই তার ব্যাপারে অনবহিত। আর তার কোন কপি সংগ্রহ করার কোন উপায় ছিল না। তারপর যখন সন্দেহজনক এই ঐক্যের আহ্বানজনিত ফেতনা দেখতে পেলাম তখনই তা আমাকে এই গ্রন্থটিকে পুণঃপ্রকাশে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাছাড়া এজন্যও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘নাজাফ সম্মেলন’ ( مؤتمر النجف ) টি আমার জানামতে ইসলামী এ জাতীয় প্রথম পদক্ষেপ।
আর এই সম্মেলনের সভাপতি ও এই বইয়ের লেখক সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী হলেন আবূল বারাকাত ইবন সাইয়্যিদ হোসাইন ইবন মার‘ঈ ইবন নাসিরুদ্দীন; আর আল-সুওয়াইদী’র পরিবার হল বাগদাদের সম্ভ্রান্ত পরিবারসমূহের মধ্যে অন্যতম এবং আব্বাসীয় বংশের অন্তর্ভুক্ত, যারা দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী খেলাফতের দায়িত্ব পালনে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ ১১০৪ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১৭০ হিজরিতে মারা যান। এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করার সময় তার বয়স ছিল বায়ান্ন বছর।
তিনি যাদের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন, তারা হলেন: আহমদ ইবন আবিল কাসিম আল-মাদায়েনী আল-মাগরেবী, তার চাচা সাইয়্যিদ আহমদ ইবন মার‘ঈ আল-সুওয়াইদী, শাইখ সুলতান আল-জুবুরী, মুহাম্মদ ইবন ‘উকাইলা আল-মাক্কী, শাইখ আলী আল-আনসারী আল-আহসায়ী প্রমুখ; যারা ইরাক, হেজায ও সিরিয়া’র আলেম ছিলেন।
সাইয়্যিদ মাহমুদ শুকরী আল-আলুসী তার প্রশংসায় বলেন: “তিনি পুরো যমীনের শাইখ এবং সবার মতে শরীয়তের সৌন্দর্য বলে বিবেচিত।”
তার রচিত গ্রন্থসমূহ হল: শরহুন জালিলুন ‘আলা সহীহিল-ইমামিল-বুখারী ( شرح جليل على صحيح الإمام البخاري ); কিতাব আল-মুহাকামাহ বাইনা আল-দিমামীনী ওয়া আল-শুমুন্নী ( كتاب المحاكمة بين الدماميني و الشمني ); রাশফ আল-দারব ( رشف الضرب ); আল-নুফহাহ আল-মিসকিয়্যাহ ( النفحة المسكية ); আল-আমছাল আল-সায়েরা ( الأمثال السائرة ); শরহু দালায়েল আল-খায়রাত ( شرح دلائل الخيرات )। তার আরও একটি গ্রন্থের নাম “আর রিহলাতুল-মাক্কীয়া” ( الرحلة المكية ) যাতে আমরা নাজাফ সম্মেলন সম্পর্কে এই কিতাবে যা লিপিবদ্ধ করেছি, তা বিদ্যমান আছে। আর তিনি ঐ বছর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের নিমিত্তে হজ পালন করেছেন; কারণ, তিনি নিজ হাতে নাদির শাহ ও অধিকাংশ শী‘আকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদেরকে (তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট) গালি দানে বিরত থাকার কথা স্বীকার করতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহ সত্য ও কল্যাণ এবং উভয়ের অনুসারীদের অভিভাবক; আর সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।
মুহিব্বুদ্দীন আল-খতিব
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন