HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা

লেখকঃ মোঃ এনামুল হক

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা

মোঃ এনামুল হক

সম্পাদনা : ড. মোঃ আবদুল কাদের

ভূমিকা
ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থায় সালাতের গুরুত্ব যেমন অপরিহার্য তেমনি যাকাতের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। যাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুখী সমৃদ্ধিশালী প্রগতিশীল কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আল্লাহর বাণী—

﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰة﴾ [ البقرة :43]

তোমরা সালাত কায়েম কর যাকাত দাও। [. আল-কুরআনুল কারীম, সূরা বাক্বারাহ: আয়াত ৪৩,৮৩,১১০, ২৭৭; সূরা নিসা: ৭৭, ১৬২; সূরা আন নুর: ৫৬; সূরা আহযাব: ৩৩; সূরা মুজ্জামিল:২০।] উনিশ শতকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার সূচনা হলেও মূলত বিশ শতকে পশ্চাত্যে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ কল্যাণ নীতির উদ্ভব ঘটে। [. Mohammad Khalid. Welfare State-A case study of Pakistan. p. 52.53.] একবিংশ শতকে কল্যাণ রাষ্ট্র বলতে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা উন্নয়নকেই বুঝায়। অধ্যাপক বেনহাম (Benham) এ কথাই বলেন। তার মতে ‘‘ যে রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাই কল্যাণ রাষ্ট্র।’’ [. Benham-Economics. p. 35] আর সামাজিক নিরপত্তা বলতে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নূন্যতম অর্থনৈতিক প্রয়োজন পুরণের নিশ্চয়তাকেই বুঝায়। জি.ডি. এইস. কোল (G.D.H. Cole) এর মতে, ‘‘কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে নাগরিকের একটি সাধারণ জীবন যাত্রার মানের নিশ্চয়তা থাকে।’’ [. মোঃ আবুল কাশেম ভূঁইয়া, সামাজিক নিরাপত্তায় যাকাত, (প্রবন্ধ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০০৬, পৃ. ১২৩।]

পুঁজিবাদী সমাজে সরকারীভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান নেই বলেই সেখানে জনগণকে মুষ্টিমেয় ধনকুবের বা পুঁজিপতিদের কৃপার দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে থাকতে হয়। এখানে ডলার পুজায় নিবেদিত সাইলক পুঁজিপতিরা লৌকিকতার খাতিরে কিছু দান করেন, মহানুভবতা বা সংবেদনশীলতার জন্য নয়; মেথ্য আরনল্ড শোষণ ও বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদি সমাজ চিত্রকে তুলে ধরেন এভাবে ‘‘আমাদের অসাম্য উচ্চশ্রেণীকে বৈষয়িক করে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ইতর, আর নিম্ন শ্রেণীকে বর্বর করে তোলে।’’ [. Mirza Mohammad Hussain, Islam and Socialism. p. 122.] পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ-নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য শ্রমিক, জনতা সমাজতন্ত্রের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু এখানেও অবস্থা তথৈবচ। সমাজতন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বের যাতাকলে শ্রমিক জনগণ নিপীড়িত। There is a little room for even a genuine philanthropic deed when all human beings are turned into robots employed and paid by the vast sprowling fumbling leviathan of the soviets. [.প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬২।] ‘‘সেখানে সত্যিকার জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের সুযোগ নেই বললেই চলে। যেখানে সকল মানুষ রোবট কর্মচারীতে পরিণত হয় এবং শক্তিশালী সোভিয়েত এর এক বিরাট সংখ্যক আনাড়ীদের দ্বারা বেতন প্রদত্ত হয়।’’ সমাজতন্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ হতে পারে এমন- সমাজতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে সামাজিক অন্যায় অবিচারের এক অতি নিকৃষ্ট রূপ। যার দৃষ্টান্ত কোন নমরুদ, ফিরাউন ও চেংগিস খানের শাসনকালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক বা একাধিক ব্যক্তি বসে একটি সামাজিক দর্শন রচনা করলো। তারপর সরকারের সীমাহীন এখতিয়ারের বদৌলতে এ দর্শনকে অন্যায়ভাবে একটি দেশে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দিল। মানুষের ধন-সম্পদ কেড়ে নেয়া হলো। জমি-জমা, ক্ষেত-খামার অযাচিতভাবে হস্তগত করা হলো। কল-কারখানা রাষ্ট্রয়াত্ত করা হলো। সমগ্র দেশকে এমন এক জেলখানায় পরিণত করা হলো যে সমালোচনা, বিচার প্রার্থনা, অভিযোগ, মামলা দায়ের ইত্যাদি কাজ করা এবং বিচার বিভাগীয় সুবিচারের সকল পথ বন্ধ হয়ে গেল। দেশে কোন দল থাকবে না, কোন সংগঠন থাকবে না, যেখানে থেকে মানুষ তাদের মুখ খুলতে পারে; কোন প্রেস-মিডিয়া থাকবে না যার সাহায্যে মানুষ তাদের অভিমত প্রকাশ করতে পারে; কোন বিচারালয় থাকবে না, যার দুয়ারে সুবিচারের জন্য মানুষ ধর্ণা দিতে পারে।

এখানে প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রটি এই যে, তা ব্যক্তিকে সীমাতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়ে পরিবার, গোত্র, সমাজ ও জাতির ওপর জুলম নিষ্পেষণ করার পূর্ণ লাইসেন্স দিয়েছিল এবং সামষ্টিক কল্যাণের জন্য সমাজের কাজ করার শক্তি শিথিল করে দিয়েছিল। অপরদিকে দ্বিতীয় ব্যবস্থা তথা সমজতন্ত্রে ত্রুটি এই ছিল যে, রাষ্ট্রকে সীমাহীন ক্ষমতা দান করে ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র ও সমাজের স্বাধীনতা প্রায় একেবারেই খতম করে দিয়েছে। তারপর ব্যক্তিবর্গ থেকে সমষ্টির কাজ নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে এতো বেশি কর্তৃত্ব দান করে যে, ব্যক্তি ব্যক্তিসত্তার পরিবর্তে একটি মেশিনের প্রাণহীন যন্ত্রাংশের রূপ ধারণ করে। [. প্রাগুক্ত।]

পুঁজিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি যখন ব্যর্থ, তখন পুঁজিবাদের সংস্কারিতরূপ ‘‘কল্যাণরাষ্ট্রে’’ সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত আংশিক ছাড়া সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। [. মোঃ আবুল কাশেম ভূঁইয়া, সামাজিক নিরাপত্তায় যাকাত, (প্রবন্ধ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০০৬, পৃ. ১২৪।] কল্যাণ রাষ্ট্রের ইংরেজ প্রবক্তা উইলিয়াম বেভারিজ প্রদত্ত সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার সমালোচনায় তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেন, ‘‘আমি মিথ্যা আশ্বাস এবং অবান্তর কল্পনাশ্রয়ী দর্শনের মাধ্যমে জনগণের সাথে প্রতারণা করতে চাই না।’’ [. Mohammad Khalid. Welfare State-A case study of Pakistan. p. 52.53.]

এ কথা ধ্রূব সত্য যে, পুঁজিবাদ ও কল্যাণ রাষ্ট্র একই আয়নার দুটো পিঠ। ওদিকে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং কল্যাণ রাষ্ট্র উদ্দেশ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে একই বিন্দু থেকে উৎসারিত। এই তিনটি মতবাদ কেবল বৈষয়িক বা বস্তগত তথা প্রযুক্তিনির্ভর উন্নতি সমৃদ্ধি চায়, আত্মিক, নৈতিক ও মানবিক উৎকর্ষ সেখানে উপেক্ষিত। অথচ আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং মানবিক-সামাজিক মূল্যবোধের উপস্থিতি ছাড়া বস্ত্তগত উন্নতি ফলপ্রসু ও কার্যকর হয় না। [. মোঃ আবুল কাশেম ভূঁইয়া, সামাজিক নিরাপত্তায় যাকাত, (প্রবন্ধ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০০৬, পৃ. ১২৪।]

আলড়ুয়াস হ্যক্সলি তাইতো বলেন- ‘এটি এমন এক স্পষ্ট পশ্চাদগামী পৃথিবী যেখানে কেবল প্রযুক্তির সদর্প বিচরণ চলে। প্রযুক্তিগত প্রগতি ধ্রূব, কিন্তু বদান্যতার প্রসারণ ছাড়া প্রযুক্তিগত প্রগতি মূল্যহীন। বরং মূল্যহীনতার চেয়েও ক্ষতিকর।’ [. Mirza Mohammad Hussain, Islam and Socialism. p. 165]

মানুষ একাধারে আত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক, জৈবিক ইত্যাদি উপাদানের সমন্বয়ে সমন্বিত জীব। মানব এককে আত্মা, মন, নৈতিক চেতনা, যৌন তাড়না, বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, পরার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা, দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালবাসা, হিংসা-বিদ্বেষ, বিনয়-অহমিকা, আবেগ-উচ্ছাস, ক্রোধ-উত্তেজনা, রাগ-অনুরাগ ইত্যাদি বিদ্যমান। এসব উপাদানের মধ্যে আত্মারই অবস্থান শীর্ষ। আত্মার অনুপস্থিতিতে মানব অবয়ব লাশ বা পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। পরিশোধিত ও উৎকর্ষিত আত্মা যথার্থ মানবিক অভিপ্রায়কে জাগ্রত করে। আর জাগ্রত মানবিক অভিপ্রায় যখন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিব্যাপ্ত হবে তখনই সামাজিক কল্যাণ নিরাপত্তা সম্বলিত সুষম ও ভারসাম্যমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ জীবন দর্শন এবং এর সামাজিক রাষ্ট্রিক বলয়ে আত্মিক দিক নিবাসিত। ধর্মাশ্রয়ী জীবন দর্শনেই আত্মিক উৎকর্ষ মন্ডিত সুষম সমাজ বিন্যাস সম্ভব। [. প্রাগুক্ত, সামাজিক নিরাপত্তায় যাকাত, পৃ. ১২৫।]

আগামী ৫০ বছরের উন্নতি সমৃদ্ধি কোন ধরনের গবেষণার ওপর নির্ভরশীল প্রশ্নের উত্তরে ড. চালর্স ষ্টেইনমেজ ( Dr. Charles Stinmetz) বলেন, I think that the greatest discoveries will be made along spiritual times. Some day People will learn that material things do not bring happiness and are of little use in making men and women creative and powerful. Then the Scientist of the world will turn their laboratories over to the study of god and the spiritual forces which as yet have been hardly scratched. When that they comes, the world will see more advancement in one generation in has the last four. [. M. Raihan Sharif, Islamic Social fram work.] অর্থাৎ ‘‘আমি মনে করি, সর্বশ্রেষ্ঠ আবিস্কার হবে আধ্যাত্মিকতার পথ ধরে। একদিন মানুষ বুঝতে পারবে যে, বস্তগত জিনিস মানুষের সুখ-শান্তি আনে না এবং এগুলো নর-নারীকে সৃজনশীল ও ক্ষমতাশালী করতে খুব কমই কাজে আসে। তখন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণাগারগুলোকে আল্লাহ, প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক চেতনার দিকে ঘুরিয়ে নেবে যার সম্পর্কে বর্তমানে খুব কমই আলোচিত হয়। তখন বিশ্ব এক প্রজন্মে অনেক সমৃদ্ধি দেখবে যা বিগত চার প্রজন্ম দেখেনি।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক হলো দারিদ্রতা। ক্রমবর্ধমান দারিদ্রতা বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নকারী দেশসমূহের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় দারিদ্র বিমোচন গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে স্থান পেয়েছে বহু পূর্বেই। বিভিন্ন দেশের সরকারের পরিকল্পিত প্রয়াসের ফলে দারিদ্রের প্রকটতা কিছুটা হ্রাস পেলেও এর ব্যাপকতা ও গভীরতা মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। সর্বোচ্ছ বিশ্ব সংস্থা (জাতিসংঘ) কর্তৃক ঘোষিত ‘Millennium development Goals’ এর অন্যতম প্রধান অঙ্গ দারিদ্র বিমোচন। [. মোঃ জাকির হোসাইন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থা (প্রবন্ধ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, জানুয়ারী-মার্চ, ২০০৬, পৃ. ৯৮।]

এতো কিছুর পরেও দারিদ্র কমে না বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে, মাত্র কয়টা টাকার জন্য নারী তার সতীত্ব পর্যন্ত বিকিয়ে দিচ্ছে। ‘মা’ তার সন্তানকে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বিক্রি করে দিচ্ছে। ডাষ্টবিনের ময়লা পচা-বাসি খাবার খাওয়ার জন্য কুকুর মানুষ এক সাথে লড়াই করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতিদিন দারিদ্রতার কারণে মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। পৃথিবীর লাখ লাখ বনী আদম তপ্ত মরুভূমিতে খাদ্যহীন, আশ্রয়হীনভাবে উদ্ধাস্ত অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, ইরাক, ভারত, সুদান, কঙ্গো তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

এতো গেল এশিয়া আর আফ্রিকার কথা। স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আয়হীন পরিবার আছে, যাদের বাৎসরিক আয় ৮/১০ হাজার ডলারের বেশি নয়। ১৯৮৭ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গরীব লোকের সংখ্য ছিল ৩২.৫ মিলিয়ন যা সেখানকার মোট জনসংখ্যা ১৩.৫% । এর সংখ্যা আরো বেশি হবে কারণ গৃহহীন পরিবার বাদেই উক্ত পরিসংখ্যান। ১৯৯৫ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর BAAS ও USIS -এর উদ্যোগে আয়োজিত কর্মশালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কিবরিয়াউল খালেক তার ‘আমেরিকায় দারিদ্র্য’ নামক প্রবন্ধ উক্ত তথ্য প্রদান করেন।

সম্প্রতি ইউএনডিপি ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বিশ্বে প্রতিটি ১ ডলারের নীচে আয় এমন দরিদ্র লোকের সংখ্যা বলা হয়েছে ১২৫ কোটি। যার মধ্যে শুধু এশিয়াতেই ৯৫ কোটি এবং বাংলাদেশে এর পরিমাণ ৫ কোটি। [. মোহাম্মাদ মুস্তাফিজুর রহমান, দারিদ্র বিমোচন ও মানব সেবায় বিশ্বনবীর আদর্শ।]

সামাজিক ব্যাধি নামক দারিদ্রের নির্মম নিষ্ঠুর যাতনায় ক্ষুধার্ত মানুষ যে কোন অপরাধ করতে পারে। দারিদ্রপূর্ণ সমাজে মানবতাবোধ লোপ পায়। মানুষ যে কোন নিষ্ঠুর আচরণে জড়িয়ে পড়ে দারিদ্র্যের কারণে মানুষ আক্বিদা-বিশ্বাস মোটকথা ধর্মকেও বিসর্জন দিতে পারে। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বহু দেশের অসংখ্য মানুষ শুধু দারিদ্র্যের কারণে এনজিওদের প্রলোভনে পড়ে ধর্ম ত্যাগ করছে। মহানবী (সা.) এর ব্যাপারে বলেছেন ‘এটি অত্যন্ত সংগত কথা যে দারিদ্র মানুষকে কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। [. বায়হাকী, তিবরানী।] শুধু এ কারণে মহানবী (স.) দারিদ্রতা ও কুফরী হতে একসাথে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট কুফরী ও দারিদ্র্যতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’’ [. আস সুনান লি আবি দাউদ, সুলাইমান ইবন আশআছ।]

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী এ ব্যাপারে বলেন, ‘‘ইসলাম ধনাঢ্যতাকে আল্লাহর নি’আমাত মনে করে যার শোকর আদায় করা উচিত। আর দারিদ্রকে মনে করে মুছিবাত যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা আবশ্যক।’’ [. ড. ইউসুফ আল কারযাভী, মুশকিলাতুল ফাকর অ-কাইফা আলাজাহাল ইসলাম।] দারিদ্র্য মানুষের সুষম চিন্তা শক্তিকে বিলুপ্ত করে দেয়। ইমাম আবু হানিফা (রহ) এ প্রসঙ্গে বলেন ‘যার বাড়িতে আটা নেই তার নিকট কোন পরামর্শ নিতে যেয়ো না। কারণ তার চিন্তা বিক্ষুব্ধ হতে বাধ্য। একবার ইমাম আবু হানিফা (রহ) এর এক শিষ্য মুহাম্মদ ইবন হাসানকে তার পরিচারিকা এসে বললো যে, তার ঘরের আটা শেষ হয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন ‘আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন এ খবরে আমার মাথা থেকে ৪০টি ফিকহি মাসআলা উধাও হয়ে গিয়েছে।’

আশ্চর্যের বিষয় হলো দারিদ্রের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও বিশ্বের মোট সম্পদের পরিমাণ মোট জনসংখ্যার প্রয়োজনের তুলনায় কিন্তু কম নয়, বরং অনেক বেশি। আসলে মূল সমস্যা হলো বন্টন ব্যবস্থায়। যে সমস্যার সমাধানে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার কার্যকারিতা ঐতিহাসিক প্রমাণিত। [. মোহাম্মাদ মুস্তাফিজুর রহমান, দারিদ্র বিমোচন ও মানব সেবায় বিশ্বনবীর আদর্শ।]

যাকাতভিত্তিক সমাজে কারো পক্ষে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার কোন সুযোগ নেই। আবার কারো পক্ষে গরীব থাকার সম্ভাবনাও নেই। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান। আর ইসলামের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংগ হলো যাকাত। আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআনে বলেছেন

﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ﴾ [ البقرة :43]

তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও।’’ [. আল-কুরআন, সূরা আল বাকারা: ৪৩,৮৩, ১১০, ২৭৭ আয়াত।] আল্লাহ আরো বলেন-

﴿خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم ﴾ [ التوبة :103]

তাদের সম্পদ হতে যাকাত (সাদাকা) গ্রহণ করবে, যা দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে। [. আল-কুরআন, সূরা আত-তাওবা:১০৩।] হযরত আবু বকর (রা) বলেছেন, যে যাকাত প্রদানে ছলচাতুরী করবে, তার কাছ থেকে আমি যাকাত এবং সম্পদের অর্ধেক আদায় করব।’’ [.ড. ইউসুফ আলী কারযাভী, মুশকিলাতুল ফাকর অ-কাইফ আলাজাহাল ইসলাম, আল মাওয়ারিদী: আল আহকামুল সুলতানিয়াহ।]

আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ভাষায় যাকাতকে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিধান বলা যায়। বলতে দ্বিধা নেই, যখন পাশ্চাত্যে বিশ্ব শতকের মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, তখন সাত শতকে ইসলাম সামাজিক নিরাপত্তা বিধান তথা সমাজকল্যাণ নীতির ফলপ্রসু প্রয়োগ করে যথার্থ কল্যাণ রাষ্ট্রের মডেল বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছে, যখন এ পৃথিবীতে সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার নাম নিশানাও ছিল না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম নির্দেশিত যাকাত ব্যবস্থা অনিবার্য ফলগুধারায় এ বাস্তবতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।

যদি বৃটেনের রাণী এলিজাবেথের আমলের ‘‘ poor law-1601”- কে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের দৃষ্টান্ত হিসেবেও ধরা হয় তাহলে তারও ১ হাজার বছর পূর্বে আর যদি ১৮৮৩ সালে জামার্নীতে ‘বিসমার্ক’ সম্মেলনে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য গৃহীত ‘‘ Accisdesital Insurance Act” কে দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া হয় তাহলে তারও ১২৫০ বছর পূর্বে ইসলাম যাকাত নামক সামাজিক নিরাপত্তা স্কীম সফলতার সাথে রাষ্ট্রে প্রবর্তন করেছে।’’ [. মোঃ আবুল কাশেম ভূঁইয়া, সামাজিক নিরাপত্তায় যাকাত, (প্রবন্ধ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০০৬, পৃ. ১২৬।] এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ খালিদ বলেন, যা হোক ৬২২ খিষ্টাব্দে কল্যাণ রাষ্ট্রের ইতিহাসে এক মাইল ফলক। এ বছর মুহাম্মাদ (স.) মদিনায় হিজরত করেন এবং সেখানে সাম্য, স্বাধীনতা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে লিখিত ইতিহাসে বিশ্বের প্রথম কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা ছিল এরিজাবেথিয়ান দারিদ্র আইন ১৬০১ এর অনেক আগের। [. Mohammad Khalid, Welfare state- A case study of Pakistan. p.07]

যাকাত এর আভিধানিক পরিচয়
যাকাত একটি ব্যাপক প্রত্যয়। এটি আরবী শব্দ زكوة থেকে গেৃহীত। যার অর্থ পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধতা। যাকাতের আরেক অর্থ পরিবর্ধন (Growth) [.ইসলামী বিশ্বকোষ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন), ২১ খন্ড।] শুধু তাই নয়, যাকাত একাধারে পবিত্রতা, বর্ধিত হওয়া, আর্শীবাদ (Blessing) এবং প্রশংসা অর্থেও ব্যবহৃত হয়, কুরআন ও হাদিসে যাকাতের এ সব তাৎপর্য নিহিত। [.Mirza Mohammad Hussain, Islam and socialism, p. 166.] আল্লামা জুরযানী বলেন - الزكاة فى اللغة الزيادة [.আল্লামা জুরজানী, আত-তা’রীফাত (করাচী: কাদিমী কুতুবখানা, তা.বি) পৃ. ৮৩।] অর্থাৎ যাকাতের আভিধানিক অর্থ অতিরিক্ত। মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন, যাকাত শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে প্রবৃদ্ধি (Growth), প্রবৃদ্ধি লাভ (Increa8uuuse), প্রবৃদ্ধির কারণ (To Cause to grow) ইত্যাদি যা আল্লাহ প্রদত্ত বারাকাত (Blessing) থেকে অর্জিত হয়। [. মাওলানা আব্দুর রহীম, যাকাত(ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০০৪), পৃ. ১৪।]

ইসলাম বিশ্বকোষে যাকাতের অর্থ সম্পর্কে আছে, যাকাত অর্থ পবিত্রতা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা। [. ইসলামী বিশ্বকোষ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), ২১ খন্ড।]

আল্লামা শাওকানী বলেন,

الزكاة مأخوذة من الزكاء وهو النماء- زكا الشيئ اذا نما وزاد رجل زكا أي زائد الخير- وسمى جزء منى المال زكوة أى زيادة مع أنه نقص منه لأنها تكثر بر كته بذلك أو تكثر أجر صاحبه -

যাকাত শব্দটি মূল زكاء এর অর্থ প্রবৃদ্ধি, বর্ধিত হওয়া। কোন জিনিস বৃদ্ধি পেলে এই শব্দ বলা হয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া। খুব বেশী কল্যাণকময় হলে তা زكى বলা হয়। আর ধন সম্পদের একটা অংশ বের করে দিলে তাকে যাকাত বা প্রবৃদ্ধি পাওয়া বলা হয়, অথচ তাকে কমে। তা বলা হয় এ জন্য যে যাকাত দিলে তাকে বরকত বেড়ে যায় বা যাকাত দাতা অধিক সওয়াবের অধিকারী হয়। [. আল্লামা শাওকানী, তাফসীর ফতহুল কাদীর, ১ম খন্ড (করাচী: আল-মাকতাবাতুল হাবীবিয়্যাহ, তা.বি) পৃ. ৬২।]

ইবনুল মানযুর বলেন, যাকাত শব্দের অর্থ হলো পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ও আধিক্য। [. ইবনুল মানযুর আল আফরিকী, লিসানুল আরব, ১৪ খন্ড(বৈরুত: দারুল ফিকর, তা.বি), পৃ. ৩৫৮।]

সাদী আবু জীব বলেন, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে সম্পদ কমলেও প্রকারান্তে এর পরিবর্ধন ঘটে। এছাড়া এর মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে সমাজ হয় মুক্ত ও পবিত্র। [. সা‘দী আবু জীব, আল-কামূসুল ফিকহী (করাচী: ইদারাতুল কুরআন, তা.বি), পৃ. ১৫৯।]

আবুল হাসান বলেন, যাকাতের অর্থ الطهارة والنماء والبركة والمدح পবিত্রতা, বৃদ্ধি, বরকত ও প্রশংসা। [. আবুল হাসান, তানজীমুল আশতাত, ২য় খন্ড( দেওবন্দ: জিয়া বুক ডিপো, প্রথম প্রকাশ, ১৯৮৫ খ্রী), পৃ. ২।]

আল মুজামুল অসীতে আছে, আভিধানিক অর্থ زكا যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশী হয়। زكا فلان অমুক ব্যক্তি যাকাত দিয়েছে অর্থ-সুস্থ ও সুসংবদ্ধ হয়েছে।

অতএব, যাকাত হচ্ছে বরকত, পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া, প্রবৃদ্ধি লাভ, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা- সুসংবদ্ধতা। [. ইব্রাহীম মাদকুর, আল-মুজামুল অসীত, ১ম খন্ড (কায়রো: দারুল মাআরিফ, ২য় সংস্কার, ১৯৭২) পৃ. ৩৯৬।]

যাকাত এর পারিভাষিক পরিচয়
ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পুরণের পর সম্পদে পূর্ণ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলা হয়। [. ড. কালাজী, মুজামু লুগাতিল ফুকাহা (করাচী: ইদারাতুল কুরআন, তা.বি), পৃ. ২৩৩।]

আল্লামা জুরজানী বলেন:

الزكاة فى الشرع عبارة عن إيجاب طائفة من المال فى مال مخصوص لمالك مخصوص

ইউসুফ কারযাভী বলেন, শরীয়াতের দৃষ্টিতে যাকাত ব্যবহৃত হয় ধন-মালে সুনির্দিষ্ট ও ফরযকৃত অংশ বোঝানোর জন্য। যেমন পাওয়ার যোগ্য অধিকারী লোকদের নির্দিষ্ট অংশের ধন-মাল দেওয়াকে যাকাত বলা হয়। [. আল্লামা ইউসুফ কারযাভী, ইসলামের যাকাত বিধান, অনুবাদ: মাওলানা আ: রহীম, ১ম খন্ড (ই.ফা.বা, ২য় প্রকাশ, ২০০৮) পৃ. ৪৯।]

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, যাকাত আল্লাহ নির্দেশিত অংশ ধন-মাল থেকে হকদারদের দিয়ে দেয়া, যাতে মন-আত্মা পবিত্র হয় এবং ধন-মাল পরিচ্ছন্ন হয় ও বৃদ্ধি পায়। [. ইমাম ইবনে তাইমিয়া, মজমুয়ায়ে ফতওয়া, ২য় খন্ড, পৃ. ৮।]

নিজের অর্থ সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ অভাবী মিসকিনদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়াকে যাকাত বলে। এটাকে যাকাত বলার কারণ হল এভাবে যাকাত দাতার অর্থ সম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র -পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যাকাতের শরয়ী অর্থই তো, আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে কোন মালদার ব্যক্তি কর্তৃক কোন হকদার ব্যক্তিকে তার মালের নির্ধারিত অংশ অর্পন করা।

যাকাত ফরয হওয়ার সময়কাল
ইসলামী বিশ্বকোষ এর ভাষ্যমতে, আল-কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮২ বার যাকাতের কথা বলা হয়েছে। আল-কুরআনে প্রত্যক্ষভাবে ৩২ বার যাকাত এর কথা বলেছেন। এর মধ্যে নামায ও যাকাতের কথা একত্রে বলেছেন ২৮ বার। ফুয়াদ আব্দুল বাকী বর্ণনা করেছেন, আল-কুরআনে মোট ১৯টি সুরায় ২৯টি আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়। [. ফুয়াদ আব্দুল বাকী, আল-মুজামুল মুফহারাস লি আলফাযিল কুরআনিল কারীম ( কায়রো: দারুল হাদীস, ১৯৮৮ খ্রী), পৃ. ৪২০-৪২১।] আল-কুরআনের সূরা আত তাওবার ৬০ নং আয়াত দ্বারা যাকাত ফরয হয়। আয়াতটি হলো:

﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيم﴾ [ التوبة :60]

দ্বিতীয় হিজরীতে রোজা ফরয হওয়ার পরপরই শাওয়াল মাসে যাকাত ফরয হয় এবং নবম হিজরীতে এটি পুর্ণাঙ্গরূপে কার্যকর করা হয়। হাফিয ইবন হাজর বলেন, যাকাত হিজরতের ২য় বৎসরেই ফরয হয়েছে, রমযানের সিয়াম ফরয হওয়ার পূর্বে। সায়াদ ইবন উবাদাহ বর্ণিত হাদীস থেকেও তা-ই প্রমাণিত।

امرنا رسول الله (ص) بصدقة الفطر قبل أن تنزل الزكوة ئم نزلت فرضية الفرضية الزكوة

রাসূল(সা) যাকাত সংক্রান্ত হুকুম নাযিল হওয়ার পূর্বে সাদকায়ে ফিতর দেয়ার জন্য আমাদের আদেশ করেছিলেন। যাকাত ফরয হওয়ার কথা নাযিল হয়েছে তার পরে। [. আল কুরআন, সূরা তাওবা:৬০।]

যাকাতের গুরুত্ব
ইসলামের ৫টি স্তম্ভ বা ভিত্তির একটি যাকাত। ঈমান ও নামাযের পরেই যাকাতের স্থান। আল্লাহর কালাম আল কুরআনে যাকাতের ব্যাপারে বারবার গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল-কুরআনের নামায কায়েমের কথা বলার সাথে সাথে অনেক স্থানে যাকাত আদায়ের প্রসঙ্গটিও এসেছে। [. আল্লামা ইবন হাজর আসকালানী, ফাতহুল বারী শরহি বুখারী, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৭১।] আল্লাহর বাণী

﴿ وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِلزَّكَوٰةِ فَٰعِلُونَ ﴾ [ المؤمنون :4]

অর্থাৎ যারা যাকাতদানে সক্রিয়। [. আল কুরআনুল কারীম, সূরা আল মুমিনুন, আয়াত ৪।]

যাকাত পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও ফরয ছিল।

স্মর্তব্য যে, যাকাত ব্যবস্থা শুধু উম্মতে মুহাম্মদী (সা.) এর উপর নয় বরং অতীতের সকল নবীদের উম্মতের ওপরও অপরিহার্য পালনীয় ও প্রচলিত ছিল। তবে সম্পদের পরিমাণ এবং ব্যয়ের খাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছিল। আল কুরআনুল কারীমে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। যেমন সাইয়্যেদুনা ইবরাহীম (আ.) এবং তার বংশের নবীদের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন:

﴿وَجَعَلۡنَٰهُمۡ أَئِمَّةٗ يَهۡدُونَ بِأَمۡرِنَا وَأَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡهِمۡ فِعۡلَ ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَإِقَامَ ٱلصَّلَوٰةِ وَإِيتَآءَ ٱلزَّكَوٰةِ﴾ [ الأنبياء :73]

এবং তাদেরকে করেছিলাম নেতা। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করতো। তাদেরকে ওহী প্রেরণ করেছিলাম সৎকর্ম করতে, সালাত কায়েম করতে এবং যাকাত প্রদান করতে। [. আল কুরআন, সূরা আল আম্বিয়া: ৭৩।]

ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে

﴿وَكَانَ يَأۡمُرُ أَهۡلَهُۥ بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ﴾ [ مريم :55]

সে তার পরিজনর্বগকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিত। [. আল কুরআন, সূরা মারয়াম: ৫৫।]

মূসা (আ) এর প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

﴿وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ فَسَأَكۡتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰة﴾ [ الأعراف :156]

َ আর আমি আমার দয়া তা-তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যপ্ত। সুতরাং আমি তা তাদের জন্য নির্ধারিত করব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনে বিশ্বাস করে। [. আল কুরআন, সূরা আল- আরাফ:১৫৬।]

ঈসা (আ.) এর সময়কার অবস্থা বর্ণনায় রাববুল আলামীন,

﴿وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيۡنَ مَا كُنتُ وَأَوۡصَٰنِي بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ مَا دُمۡتُ حَيّٗا﴾ [ مريم :31].

যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি ততোদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে। [. আল কুরআন, সূরা মারয়াম: ৩১।]

মোটকথা, সে প্রাচীন যামানা থেকেই সকল নবী-রাসূলদের উম্মতের ওপর নামায ও যাকাত ফরয হিসেবে পালনীয় ছিলো। কোন নবীর সময়কালেই দ্বীন ইসলাম দুটো ফরয থেকে মুক্ত ছিল না। তবে উম্মতে মুসলিমার বর্তমান পর্যায়ে ধনীদের সম্পদ পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে হিসেব করত: প্রতিবছর যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। [. আব্দুল খালেক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যাকাত: ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০০৩ ইং) পৃ. ৬৮।] যাকাত দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের মধ্যে আল্লাহ নির্ধারিত অবশ্য কর্তব্য ও বাধ্যতামুলক প্রদেয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

যাকাতের ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীন ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অভিমত
যাকাতের ফরযিয়্যাত বিষয়ে ইসলামের সোনালী যুগের মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) এর সান্নিধ্যে ধন্য সাহাবায়ে কিরাম বিশেষ করে খুলাফায়ে কিরামগণ গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। পাশাপাশি পরবর্তীকালীন ইসলামী চিন্তাবিদগণ তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন: হযরত আবু বকর (রা) বলেন, ‘যারা যাকাত দিতে ছল চাতুরীর আশ্রয় নেবে আমি তাদের কাছ থেকে যাকাত এবং সম্পদের অর্ধেক আদায় করবো।’ ওমর (রা.) বলেন, ‘‘আমি যদি আগে বুঝতে পারতাম তাহলে বিত্তশালীদের অতিরিক্ত সম্পদ গরীব ও মুহাজিরদের মাঝে ভাগ করে দিতাম।’’ [. মোহাল্লাহ ইবন হাজম, উদ্ধৃত।]

আলী (রা.) বলেন, ‘‘অভাবগ্রস্থদের অভাব দূরীকরণে বিত্তশালীদের ধন-সম্পদের ওপর অনেক দায়িত্ব বর্তায়। যদি ক্ষধার্ত ও নাঙ্গা মানুষ থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে সম্পদশালীরা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না।’’ [. Mirza Mohammad Hussain, Islam and socialism.]

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বলেন, ‘‘তোমাদের সম্পত্তিতে যাকাত এবং এর অতিরিক্ত আরো দাবি আছে।’’

ইমাম কুরতুবী লিখেছেন, ‘‘মুসলিম জনসমষ্টির ওপর বিপদ বা অভাব দেখা দিলে যাকাত দেয়া এবং অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা ধনী লোকদের জন্য ওয়াজিব।’’ [. ইমাম কুরতুবী, তাফসীর কুরতবী।]

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা বলেন, ‘বুভুক্ষকে খাবার খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে পরিধেয় দেওয়া ফরযে কিফায়া হিসেবে জরুরী হয়ে পড়ে।’’ [. ইবন তাইমিয়া, মাজমূ‘উল ফতোয়া।] আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী বলেন, ‘‘যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সব অভাবগ্রস্থ ও দুদর্শাগ্রস্থ মানুষের অভাব দূর করা ও অর্থনৈতিকভাবে পূর্ণবাসন করা সম্ভব। যাকাত অভাবগ্রস্থকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে যাতে সে আর অভাবগ্রস্থ না থাকে।’’ [. আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী, ফিকহুত যাকাত, ইসলামের যাকাত বিধান, অনুবাদ: মাওলানা আব্দুর রহীম, (ই.ফা. ২য় প্রকাশ ২০০৮), ২য় খন্ড।]

মূলত যাকাত ব্যবস্থার দ্বারা ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা দারিদ্রমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন। যাকাত দুস্থ গরীবদের প্রতি ধনীদের কোন দয়া বা অনুগ্রহ নয়, বরং অধিকার বা হক, এটাই প্রকৃত সত্য ও শাশ্বত কথা।

যাকাত বণ্টনের খাতসমূহ
যাকাত বণ্টনের ব্যাপারে আল-কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে:

﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ﴾ [ التوبة :60]

অর্থাৎ সাদাকাহ (যাকাত) তো কেবল নি:স্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। [. আল কুরআন, সূরা তাওবা: ৬০।]

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আলোকে যাকাত ব্যয়ের খাত ৮টি। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে পেশ করছি:

১. নিঃস্ব ফকীর ( الفقير ): ফকীহ বলা হয় যার কোন সম্পদ নেই, নেই তার উপযোগী হালাল উপার্জন, যদ্বারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। যার খাওয়া-পরা ও থাকার স্থান নেই। অন্যান্য নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। আবার কেউ বলেছেন, ফকীর সে যার সামান্য সম্পদ আছে। তবে জীবন ধারণের জন্য অপরের ওপর নির্ভর করে।

ফকীরের সংজ্ঞায় আল্লামা তাবারী বলেন, المحتاج المتعفف الذى لايسأل সে অভাবগ্রস্থ যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলেছে, কারোর নিকটই কিছুর প্রার্থনা করে না। [. ইমাম মুহাম্মদ ইবন জরীর আত -তাবারী, তাফসীরে জামিউল বায়ান ( বৈরুত: দারু ইহইয়াতুছ তুরাছিল আরাবী, ১৪৩১ হি/ ২০০১ খ্রি.), ১০ খন্ড, পৃ. ১৭৯।]

ইবনে আববাস, হাসান আল বসরী, মুজাহিদ, ইকরামা ও জহুরীর মতে: ফকীর এমন ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের কাছে হাত পাতে না। তবে এক্ষেত্রে ফকীহদের সংজ্ঞা বিষয়ক ইমাম শাফিয়ীর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নরূপ। তিনি বলেন, ফকীর ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কর্মজীবি নয় , যার কোন সম্পদ নেই। ইমাম আবু হানিফা সহ অন্যান্য আহলুর রায়গণ বলেন -الفقير أحسن حالا من المسكين ومن الناس মিসকীন অপেক্ষা ফকীরের অবস্থা উত্তম। [. আল খাযিন, লুবাবুত তা’বীল ফী মা’আনীত-তানযীল, ২য় খন্ড (বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ২০০৪) পৃ. ৩৭৩।]

মুলকথা হলো, এ পর্যায়ের লোকদেরকে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে।

এ খাতটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে আল্লাহ ৮টি খাতের মধ্যে সর্ব প্রথমে উল্লেখ করেছেন। আর আরবী বাচনিক রীতি আছে, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা সর্বপ্রথম বলা।

২. অভাবগ্রস্থ মিসকীন ( المسكين ) : মিসকীন বলা হয় যার এমন পরিমাণ সম্পদ আছে যাদ্বারা তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়। মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, মিসকীন সেই যার কোন কিছুই নেই। [. মুহাম্মদ আলী সাবুনী, সাফাওয়াতুত তাফসীর, ১ম খন্ড (দারুস সাবুনী: মাদীনাতু নাসর, ১১৯৭ খৃ),পৃ. ৫০৫।] আবার কেউ কেউ বলেন, মিসকীন সে যার কিছু সম্পদ আছে কিন্তু লজ্জা সম্মানের ভয়ে কারো কাছে হাত পাতে না যারা। তারা জীবন-জীবিকার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা করার পরও প্রয়োজন মত উপার্জন করতে পারেন না। এতকিছুর পরও নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। হাদীসে মিসকীনের পরিচয়ে বলা হয়েছে: «الذى لا يجد غنى يغنية ولا يفطن له فيصدق عليه ولا يقوم فيسأل الناس» যে ব্যক্তি তার প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ পায় না আর না তাকে বুঝতে বা চিনতে পারা যায়, যার জন্য লোকেরা তাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে। আর না সে লোকদের কাছে কিছু চায়। [. মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল বুখারী, আসসহীহ লি-বুখারী, আস-সহীহ লি-মুসলিম।]

আল-ফাতওয়া আল-হিন্দিয়ায় বর্ণিত আছে, মিসকীন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কিছুই নেই, যে মানুষের কাছে হাত পাতে বেড়ায় এবং খোরাক-পোশাকের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়। [.মাওলানা শায়খ নিজামুদ্দিন ও উলামা পরিষদ, আল-ফাতওয়া আল-হিন্দিয়াহ, ১ম খন্ড (বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৯১), পৃ. ১৮৯-১৮৮।]

এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ (সা.) এর হাদীস উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেন, সেই লোক মিসকীন নয়, যাকে একটি বা দুটি খেজুর অথবা দু-এক লোকমা খাবারের লোভ দ্বারে দ্বারে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। বরং মিসকীন সে যে কারো কাছে চায় না। এ সম্পর্কে জানতে হলে কুরআনের এ আয়াত পাঠ কর, তারা মানুষকে আগলে ধরে সাহায্য চায় না। [. মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল বুখারী, আস সহীহ বুখারী(রিয়াদ: দারুল সালাম, ১৯৯১ খ্রী), পৃ. ৭৭২।]

যেসব লোকদের প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ যাকাতের খাত থেকে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে হযরত ওমর (রা) বলেন إذا أعطيتم فأغنوا যখন দিবেই, তখন ধনী বানিয়ে দাও সচ্ছল বানিয়ে দাও। [.আমওয়াল, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৬৫।]

উপরে বর্ণিত দুটি খাতকে সর্বাগ্রে উল্লেখ করাতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা দারিদ্র দুর করা ও ফকীর মিসকীনদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানই যাকাত ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। আর যাকাতের আসল উদ্দেশ্যই তাই।

৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী ( العامل ): যারা যাকাত আদায়কারী, সংরক্ষণকারী, পাহারাদার, লেখক, হিসাব রক্ষক এবং তার বণ্টনকারী এদের সবাইকে যাকাতের ফান্ড থেকে বেতন দিতে হবে। তবে এমন যেন না হয় যে, আমিলদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে যাকাতের কোন অর্থ অবশিষ্ট না থাকে, সে ক্ষেত্রে তাদেরকে আদায়কৃত যাকাতের অর্ধেকের বেশী দেয়া যাবে না। [. মাওলানা শায়খ নিজামুদ্দিন ও উলামা পরিষদ, আল-ফাতওয়া আল-হিন্দিয়াহ, ১ম খন্ড (বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৯১), পৃ. ১৮৮।] আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যবস্থা এজন্য করেছেন, যেন তারা মালের মালিকদের থেকে অন্য কিছু গ্রহণ না করেন। বরং এটা আসলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের আওতায় পড়ে। রাষ্ট্রই এর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, গঠন ও পরিচালনা করবে। এসব লোককে নিয়োগও দিবে রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের নিযুক্তির শর্তাবলী অন্যতম হচ্ছে:

ক) তাকে মুসলিম হতে হবে;

খ) পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ্য বিবেকসম্পন্ন হতে হবে;

গ) যাকাতের বিধান সম্পর্কে ইলম থাকতে হবে;

ঘ) আমানতদারী ও কাজের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে;

ঙ) স্বাধীন মুসলিম নিয়োগ করতে হবে, ক্রীতদাস নয়।

৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য ( مؤ لفة القلوب ) : ইসলামের জন্য যাদের মন আকর্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে এমন লোকদের যাকাতের খাত থেকে প্রদান করা। মুয়াল্লাফাতুল কুলুব কারা তা নির্ণয়ে ফকীহ ও আলিমদের মতামত হচ্ছে:

ইমাম যুহরী বলেন: المؤلفة من أسلم من يهودى أو نصرانى وإن كان غنيا যে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ইসলাম কবুল করবে, সে-ই এর মধ্যে গণ্য, সে যদি ধনী হয় তবুও। [. ইমাম মুহাম্মদ ইবন জরীর আত তাবারী, তাফসীর জামিউল-বায়ান( বৈরুত: দারু ইহইয়াতুছ তুরাছিল আরাবী, ২০০১), ১০ খন্ড, পৃ. ১৮০।]

ইমাম কুরতুবী বলেন, وهم قوم كانوا في صدر الإسلام ممن يظهر الإسلام يتألفون يدفع سهم من الصدقة اليهم لضعف يقينهم তাদেরকে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব বলা হয়, যারা ইসলামী যুগে প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু ইসলামের প্রতি তাদের বিশ্বাস দুর্বল হওয়ায় যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদেরকে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত করা। [. ইমাম আল কুরতুবী, আল জামিউলি আহকামিল কুরআন, ৮ম খন্ড (বৈরুত: আল মাওয়াকিফ, ১৯৯৮খ্রী) পৃ. ৫০৫ৎ&]

মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, هم قوم من أشرف العرب أعطاهم رسول الله صلى الله عليه وسلم ليتألف قلوبهم على الإسلام মুয়াল্লাফাতুল কুলুব হলেন, আরবদের উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্বদের বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের দিকে তাদের হৃদয় জয় করার নিমিত্তে উপঢৌকন প্রদান করতেন। [. মুহাম্মদ আলী সাবুনী, সাফাওয়াতুত তাফাসীর, ১ম খন্ড (দারুস সাবুনী: মাদানাতু নাসর, ১৯৯৭ খ্রী), পৃ. ৫০৫।]

এ শ্রেণীর লোকদের কয়েকটি পর্যায়ে আছে, যেমন:

ক) এমন লোক যাকে অর্থ-সম্পদ দিলে সে বা তার গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়। যেমন এ রকম অনেক ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

খ) নতুন ইসলাম কবুলকারী লোকেরা, তাদেরকে যাকাতের খাত থেকে প্রদান। যে অন্য ধর্মের লোক সে যখন ইসলাম কবুল করবে, সেই এর মধ্যে গণ্য । সে যদি ধনী হয় তবুও তাকে এ ফান্ড থেকে দেয়া যাবে।

গ) দুর্বল ঈমানের লোকেরা, এমন লোক যাদেরকে অর্থ প্রদান করলে ঈমান দৃঢ় ও শক্তিশালী হবে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদে তাদের থেকে বেশী আনুকুল্য পাওয়া যাবে। মহানবী (সা) এ শ্রেণীর লোকদেরকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমাতের মাল বেশী বেশী প্রদান করতেন। ফলে তারা ইসলামী আদর্শে আরো দৃঢ়তা ও অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছিলেন। [. মাওলানা আব্দুর রহীম, যাকাত (ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০০৪) পৃ. ১২৪।]

ঘ) কাফির বা অন্য ধর্মের লোক। যাকে অর্থ উপহার দিলে তারা গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়। [. ইবনুল আবিদীন, রদ্দুল মুহতার, ৩য় খন্ড (বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়াহ, ১৯৯৪ খ্রী), পৃ. ২৮৭।] এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাফওয়ান ইবন উমায়্যাহকে হুনাইন যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমাতের মাল থেকে প্রদান করেছিলেন। অথচ সে সময়ে তিনি মুশরিক ছিলেন। সাফওয়ান বলেন, মহানবী (সা.) এরূপভাবে আমার প্রতি তার দানের হাত সম্প্রসারিত করতে লাগলেন অবশেষে তিনি আমার কাছে সবচেয়ে ভাল মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেন। পরবর্তীতে তিনি মহানবী (সা.) এর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করেছিলেন বলে জানা যায়। [. ইবনুল কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযিম, ২য় খন্ড (কায়রো: মুয়াস্সাসাতুল মুখতার, ২০০২ খ্রী) পৃ. ৩৬৫-৩৬৬।]

ঙ) শত্রু পক্ষের প্রতিবন্ধকতা ও শত্রুতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এমন শ্রেণীর লোক যার দুষ্কৃতির ভয় করা হয়, সীমান্তে অমুসলিম শত্রু দেশের আক্রমণ প্রতিরক্ষা ও মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে পারে এমন লোক, তাদেরকে যাকাতের ফান্ড থেকে অর্থ প্রদান করা। [. সাইয়েদ রশীদ রিদ্বা, তাফসিরুল মানার, ১ম খন্ড (কায়রো: মুয়াস্সালাতুল মুখতার, তা.বি), পৃ. ৫৪৭।]

৫. দাসমুক্তির জন্য ( الرقاب ) : যে ক্রীতদাস তার মালিককে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবন্ধ হয়েছে। এখানে এ পর্যায়ে মুসলিম যুদ্ধবন্ধীও এ খাতের আওতায় পড়বে। কাযী ইবনুল আরাবী বলেন, মুসলিম দাসকে যখন মুক্ত করতে যাকাতের খাত থেকে দেয়া যাবে, ঠিক তেমনি মুসলিম বন্দীকে কাফিরদের দাসত্ব শৃঙখলা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম বলে বিবেচিত হবে। [. কাযী ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন, ২য় খন্ড, পৃ. ৯৫৬।] এ বিষয়ে বিখ্যাত তাফসীরকারক সাইয়্যেদ রশীদ রিযা বলেন, فى الرقاب বলে যাকাতের যে ব্যয় খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিসমূহকে মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা যাবে। [. সাইয়েদ রশীদ রিদ্বা, তাফসিরুল মানার, ১ম খন্ড ( কায়রো: মুয়াস্সালাতুল মুখতার, তা.বি), পৃ. ৫৪৭।]

৬. ঋণভারাক্রান্তদের জন্য ( الغارمون ) : এমন ব্যক্তি যে ঋণভারাক্রান্ত অবস্থায় নিপতিত, তাকে যাকাতের ফান্ড থেকে সাহায্য করা। তবে যে কোন অসৎ কাজে বা অপব্যয়ের কারণে ঋণভারাক্রান্ত হয়েছে তাওবা না করা পর্যন্ত যাকাতের ফান্ড দেয়া যাবে না। আবার ঋণভারাক্রান্ত এর পর্যায়ে যেমন জীবিত ব্যক্তি শামিল, তেমনি মৃত্যু ব্যক্তিও এর আওতায় পড়ে। মৃতব্যক্তি যিনি ঋণ রেখে মারা গিয়েছেন। ইমাম কুরতুবী (রা.) তাই বলেছেন। [. ইমাম কুরতুবী, আল জামি লি আহকামিল কুরআন, ৮ম খন্ড, (বৈরুত: আল মাওয়াফিক, ১৪০৮ খ্রী) পৃ. ১১৭।]

ইবনুল হুমাম বলেছেন, গারিমুন হচ্ছে সে সমস্ত লোক যাদের উপর ঋণের বোঝা চেপে আছে অথবা লোকদের নিকট পাওনা আছে কিন্তু তারা তা আদায় করছে না, তাকে গারিমুন বলার প্রচলন আছে। [. ইবনুল হুমাম, ফাতহুল কাদীর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৪-২০৫।]

আল্লাহর পথে: আল্লাহর পথ বলতে আকীদা বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয় যে পথ, তাই আল্লামা রশীদ আহমদ বলেছেন, فى سبيل الله ইসলামী শাসন পুন:প্রতিষ্ঠার চেষ্টা প্রচেষ্টার কাজই ফী সাবিলিল্লাহর খাত। অর্থাৎ ইসলামী জীবন বিধান পুন:প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো, যেখানে ইসলামী আইন বিধান বাস্তবায়িত হবে, মুসলিম সভ্যতার পুনরাভ্যুদয়, মুসিলম উম্মতের পুনজার্গরণ, ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, আচার-আচরণ, শরীয়াত, চরিত্র ইত্যাদি সবকিছু পুরামাত্রায় কার্যকর হবে। [. সাইয়েদ রশীদ রিদ্বা, তাফসিরুল মানার, ১ম খন্ড ( কায়রো: মুয়াস্সালাতুল মুখতার, তা.বি), পৃ. ৫৪৭।]

ইবনুল আসীর বলেন, فى سبيل الله এর অর্থ এমন কার্যক্রমকে বুঝায় যা খালিস নিয়্যাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, তা ফরয নফল ও বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগীকে বুঝায়। [. ইবনে কাসির, আ্ল বিদায়াহ ওয়ন নিহায়া, ২য় খন্ড, পৃ. ১৬৫।]

জালালুদ্দিন সুয়ুতী বলেন, فى سبيل الله এর অর্থ যারা জিহাদের কাছে নিয়োজিত আছে। [. জালালুদ্দিন সুয়ুতী, তাফসীরে জালালাইন (দেওবন্দ: কুতুবখানা রাশিদিয়াহ, তা.বি), পৃ. ১৬১।]

সলফে সালেহীনদের মতে ফী সাবিলিল্লাহ আল্লাহর দ্বীনের প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী দেশষমূহের প্রতিরক্ষার জন্য পরিচালিত প্রচেষ্টা সাধনা ও সামগ্রিক তৎপরতাকে বুঝায়। এখানে فى سبيل الله অর্থ স্বশস্ত্র সংগ্রামকে বুঝানো হয়েছে। [. আহমাদ মুস্তফা আল-মারাগী, তাফসীর আল-মারাগী, ৪র্থ খন্ড( বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইসলামিয়্যাহ, ১৯৯৮ খ্রী), পৃ. ১১৯।]

ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের চেষ্টা সাধনা ও অর্থ শক্তি দ্বারা লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলার বাধাদানে নিয়োজিত হলে বিত্তশালী মুসলিমদের কর্তব্য হবে তাদের শক্তি, সামর্থ ও অর্থ দ্বারা কুফরী শক্তি প্রতিরোধকারীদের সাহায্য করা। তাই এরূপ সাহায্য করাই ফরয যাকাতের একটি অংশ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। [. ড. বেলাল হোসেন, যাকাত: আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এর ভূমিকা, প্রবন্ধ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক ষ্টাডিজ গবেষণা পত্রিকা, ২০০৬-২০০৭, ১ম খন্ড, পৃ. ৮৭।]

মূলত আল্লাহর পথের পর্যায় ও স্তর অনেক। যেসব কাজের নির্দেশনা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই এর আওতায় পড়বে। ওলামায়ে কিরামদের বিশ্লেষণে জিহাদের কয়েকটি পর্যায়ের অন্যতম হচ্ছে:

এক. দাওয়াত ইলাল্লাহ, আল্লাহর পথে আপামর মানুষকে দাওয়াত দেয়া। যুগে যুগে সকল নবী রাসূলগণ তাদের সমসাময়িক জনগণকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন। তারা বলেছেন

﴿ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُ ﴾ [ الأعراف :59]

অর্থ হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতিত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। [. আল কুরআন, সূরা আল- আরাফ, ৫৯, ৬৫, ৭২, ৮৫, সূরা হুদ: ৬১, ৮২ আয়াত।] দাওয়াত ইলাল্লাহর কর্মকৌশল, দাওয়াত প্রদানের কাঙিখত মান এবং পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ﴾ [ النحل :125]

‌তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়। তোমার প্রতিপালক তার পথ ছেড়ে কে বিপদগামী হয়, সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত এবং সৎ পথে আছে তাও তিনি সবিশেষ অবহিত। [. আল কুরআন, সূরা আন নাহল, ১২৫ আয়াত।]

দুই. নিজেকে সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা। আল্লাহ বলেন: ‘‘কথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তির চেয়ে যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে আমি তো অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। [. আল কুরআন, সূরা হা-মীম আস সাজদাহ, ৩৩।]

তিন. জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ: আল্লাহর বাণী, ﴿وَجَٰهِدُواْ فِي ٱللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِۦۚ ﴾ [ الحج :78] আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ কর আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত। [. আল কুরআন, সূরা হাজ্জ: ৭৮।]

৮. মুসাফিরদের জন্য: এমন যার নিজ আবাসস্থলে সম্পদ আছে, কিন্তু সফরে সে বিপদগ্রস্থ ও নি:স্ব তাকে যাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য করা। তবে সে সফর পাপের কাজের বা অনুরূপ পর্যায়ের কোন সফর হওয়া যাবে না।

আল্লামা তাবারী মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, যাকাতের সম্পদ ধনী হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের নি:স্ব পথিকের একটি হক রয়েছে। যদি সে তার নিজের ধন-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। [. ইমাম মুহাম্মদ ইবন জরীর আত তাবারী, তাফসীরে জামিউল বায়ান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০।]

মুসাফিরদেরকে খোরাক-পোশাকের ব্যয় এবং লক্ষ্যস্থল পর্যন্ত পৌঁছার জন্য যা প্রয়োজন অথবা তার ধন-মাল পথিমধ্যে কোথাও থাকলে তা যেখানে রয়েছে, সে পর্যন্ত পৌঁছার খরচ যাকাতের ফান্ড থেকে দিতে হবে। [. মাওলানা আব্দুর রহীম, যাকাত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৪।]

কতুটুকু পরিমাণ দিতে হবে এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়। এক: যাতায়াত ও অবস্থানের প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া অতিরিক্ত দেয়া যাবে না। দুই. প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করা তার বৈধ হবে। [. ইবনুল আবিদীন, রাদ্দুল মুহতার, ৩য় খন্ড (বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়াহ, ১৯৯৪ খ্রী) পৃ. ২৯০।]

যাকাত না দেয়ার কঠোর শাস্তি
যাকাত দিবে না কিংবা অস্বীকারকারীদের কঠোর ও ভয়াবহ শাস্তির ভয় প্রদর্শন করা বর্ণিত হয়েছে হাদীসে। এখানে ভয় প্রদর্শনের মূলে চেতনাহীন মন মানসে চেতনা সৃষ্টি এবং লোভী ও স্বার্থপর মানুষকে দানশীল বানানোর উদ্দেশ্যে নিহিত আছে। মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (স.) যাকাত দানে উৎসাহ প্রদান ও ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে লোকদেরকে কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

১০
পরকালীন শাস্তি
যাকাত প্রদান না করলে তার ভয়াবহ শাস্তি বর্ণনায় কুরআনের ভাষ্য:

﴿وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ﴾ [ التوبة :34-35]

‘‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভুত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে, সেদিন বলা হবে এটাই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভুত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভুত করেছিলে তা আস্বাদন কর। [. আল কুরআন, সূরা তাওবা: ৩৪-৩৫।]

﴿ٱلَّذِينَ يَبۡخَلُونَ وَيَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبُخۡلِ وَيَكۡتُمُونَ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦۗ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٗا مُّهِينٗا ﴾ [ النساء :37]

‘‘যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহর নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তা গোপন করে, আর আমি আখিরাতে কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি।’’ [. আল কুরআন, সূরা আন নিসা: ৩৭।]

এ ব্যাপারে শাস্তির ভয়াবহতা হাদীসে বর্ণিত আছে:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ - يَعْنِي بِشِدْقَيْهِ - ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ، ثُمَّ تَلاَ : ( لَا يَحْسِبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ ) " الآيَةَ

আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ যাকে ধন-মাল দিয়েছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে, তা হলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিশধর অজগরের যার দুচোখের উপর দুটো কালো চি‎হ্ন রয়েছে রূপ ধারণ করবে। বলবে, আমিই তোমার ধন-মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়। অত:পর রাসূল (সা.) এর আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে, তাদের জন্য এটা মঙ্গল, এটা যেন তারা মনে না করে। না এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যাতে তারা কৃপণতা করবে কিয়ামতের দিন সেটাই তাদের গলায় বেড়ী হবে। আসমান ও জমিনের স্বত্বাধিকারী একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত আছেন। [. মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল বুখারী, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩১৫ (দেওবন্দ; মাকতাবাহ শিরকায়ে মুখতার, প্রকাশ ১৯৮৫ খ্রী), পৃ. ১৮৮।], [. আল কুরআন, সূরা আলে ইমরান: ১৮০।]

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে:

عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، أَنَّ أَبَا صَالِحٍ ذَكْوَانَ، أَخْبَرَهُ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : «مَا مِنْ صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلَا فِضَّةٍ، لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا، إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحُ مِنْ نَارٍ، فَأُحْمِيَ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ، فَيُكْوَى بِهَا جَنْبُهُ وَجَبِينُهُ وَظَهْرُهُ، كُلَّمَا بَرَدَتْ أُعِيدَتْ لَهُ، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ [ص:681] سَنَةٍ، حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ، فَيَرَى سَبِيلَهُ، إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِمَّا إِلَى النَّار » قِيلَ : يَا رَسُولَ اللهِ، فَالْإِبِلُ؟ قَالَ : «وَلَا صَاحِبُ إِبِلٍ لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا، وَمِنْ حَقِّهَا حَلَبُهَا يَوْمَ وِرْدِهَا، إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، بُطِحَ لَهَا بِقَاعٍ قَرْقَرٍ، أَوْفَرَ مَا كَانَتْ، لَا يَفْقِدُ مِنْهَا فَصِيلًا وَاحِدًا، تَطَؤُهُ بِأَخْفَافِهَا وَتَعَضُّهُ بِأَفْوَاهِهَا، كُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ أُولَاهَا رُدَّ عَلَيْهِ أُخْرَاهَا، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ، فَيَرَى سَبِيلَهُ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِمَّا إِلَى النَّارِ»

আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, স্বর্ণ ও রৌপ্যের যে মালিকই তার উপর ধার্য হক আদায় করে দেবে না, কিয়ামতের দিন সেগুলোকে তার পার্শ্বে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হবে। পরে তার উপর জাহান্নামের আগুনে তাপ দেয়া হবে, সে উত্তপ্ত বস্ত্ত দ্বারা তার পার্শ্ব, ললাট ও পৃষ্ঠে দাগ দেয়া হবে; সে দিন যার সময়কাল ৫০ হাজার বছরের সমান দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত লোকদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করা হবে। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে। হয় জান্নাতের দিকে নতুবা জাহান্নামের দিকে। গরু বা ছাগলের মালিকও যদি তার উপর ধার্য হক আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তা নিয়ে আসা হবে, সেগুলো নিজেদের দু‘ভাবে বিভক্ত পায়ের খুর দিয়ে মালিককে লাথি মারবে এবং তার শিং দ্বারা তাকে গুঁতোবে যখনই তার উপর অপরটি এসে যাবে, প্রথমটি প্রত্যাহার করা হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার বান্দাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন, যে দিনের সময়কাল তোমাদের গণনামতে ৫০ হাজার বছরের সমান। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে, হয় জান্নাতের দিকে নতুবা জাহান্নামের দিকে। [. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৪৭।]

১১
যাকাত না দেয়ার বৈষয়িক শাস্তি
আল্লহার নির্দেশিত এ হুকুম যাকাত না দিলে বৈষয়িক শাস্তির বিষয় বর্ণিত হয়েছে:

মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, যে লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাদের কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করে দিবেন। [. তিবরানী ফিল আওসাত, হাকিম, ইমাম বায়হাকী হাসিদটি উদ্ধৃত করে অতিরিক্ত উল্লেখ করে «ولا منع قوم الزكاة إلا حبس الله عنهم القطر» যে জাতি যাকাত দেয় না, তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেয়া হয়। হাকেম বলেন ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদিসটি সহীহ) আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী, ফিকহুয যাকাত, বাংলা: ইসলামের যাকাত বিধান, অনুবাদ: মাওলানা আব্দুর রহীম, ১ম খন্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দ্বিতীয় প্রকাশ, ২০০৮) পৃ. ৯৮।]

অপর একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, ওদের ধন-মালের যাকাত দিতে অস্বীকার করে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ করিয়েছে মাত্র। কেবল জন্তু জানোয়ারের কারণেই তাদের বৃষ্টিপাত হয়। [. আস সুনান লি ইবন মাজাহ, হাদীস নং- ৪০১৯।]

১২
শরীয়াতসম্মত শাস্তি
যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের জন্য শরীয়াতসম্মত শাস্তির কথাও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রশাসক এ শাস্তি কার্যকর করবেন। রাসূল (সা.) বলেছেন-যে লোক সাওয়াব পাওয়ার আশায় যাকাত দিবে সে তার সাওয়াব অবশ্যই পাবে। আর যে তা দিতে নারাজ হবে, আমি তা অবশ্যই গ্রহণ করব তার ধন-মালের অংশ থেকে। তা হচ্ছে আমাদের রব-এর বহু সুনিদিষ্ট সিদ্ধান্তের অন্যতম। মুহাম্মদ (সা) এর বংশধরের লোকদের পক্ষে তা থেকে কিছু গ্রহণ করা হালাল নয়। [. বায়হাকী, ;আবু দাউদ, নাসাঈ।] আবু বকর রাষ্ট্রপ্রধান অবস্থায় যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ : لَمَّا تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاسْتُخْلِفَ أَبُو بَكْرٍ بَعْدَهُ، وَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ العَرَبِ، قَالَ عُمَرُ لِأَبِي بَكْرٍ : كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ؟ وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : « أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا : لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، فَمَنْ قَالَ : لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ، إِلَّا بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ »، فَقَالَ : وَاللَّهِ لَأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ، فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ المَالِ، وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عِقَالًا كَانُوا يُؤَدُّونَهُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهِ، فَقَالَ عُمَرُ : «فَوَاللَّهِ مَا هُوَ إِلَّا أَنْ رَأَيْتُ اللَّهَ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِي بَكْرٍ لِلْقِتَالِ، فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الحَقُّ»

রাসূল (সা.) বলেন, আমি লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর সাক্ষ্য দিবে। তারা যদি তা করে তাহলে তাদের রক্ত তথা জান ও মাল আমার নিকট নিরাপত্তা পেয়ে গেল। তবে ইসলামের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু করার প্রয়োজন হলে তা তাদের উপর বর্তাবে। হযরত আবু বকর(রা) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে বলেন, অবশ্যই আমি যুদ্ধ- লড়াই করবো যদি কেউ সালাত ও যাকাতের ব্যাপারে পার্থক্য সৃষ্টি করে। কেননা যাকাত মালের হক। আল্লাহর কসম, যদি কেউ একটি ছাগল ছানা দিতে অস্বীকৃতি জানায় যা তারা রাসূল (সা.) এর যামানায় দিত, তাহলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়াই করবো। [. মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল বুখারী, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩১২ (দেওবন্দ; মাকতাবাহ শিরকায়ে মুখতার, প্রকাশ ১৯৮৫ খ্রী), মুসলিম, নাসাঈ।]

১৩
যেসব মালে যাকাত ফরয হয়
১. পশু ও জন্তু সম্পদের যাকাত: উষ্ট্রের সংখ্য ৫-৯ টি হলে =১টি ছাগী, আবার ১০-১৪ টি হলে =২টি ছাগী এবং ১৪-১৯টি পর্যন্ত =৩টি ছাগী। এভাবে পর্যায়ক্রমে গরু-মহিষ কমপক্ষে ৩০টি হলে ১ বছর বয়সী ১টি বাছুর যাকাত ফরয। তবে শর্ত মালিকানায় একবছর অতিবাহিত হওয়া। ছাগল ও ভেড়া কমপক্ষে ৪০টি হতে ১২০টিতে ১টি ছাগী, ১২১টি হতে ২০০টি পর্যন্ত ২টি ছাগী এভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ঘোড়া ও উট পালন করলে তার যাকাত আদায় করতে হবে।

২. স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত: সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ বা এর তৈরি অলংকার, রৌপ্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি বা এর অলংকার অথবা স্বর্ণ-রৌপ্য উভয়ই থাকলে উভয়েরই মোট মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের সমান হলে, তার বাজার মূল্য ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

৩. ব্যবসায় পণ্যের যাকাত: ব্যবসায়ের মজুদ পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যের বেশী হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

৪. কৃষি সম্পদের যাকাত: কৃষির উৎপন্ন ফসলের ক্ষেত্রে এ যাকাত আদায় করতে হবে তার নাম ওশর। এ ক্ষেত্রে নিসাব হলো, সেচবিহীন জমির ফসলের শতকরা ১০ ভাগ এবং সেচপ্রদানকৃত জমির ফসলের শতকরা ২০ অংশ। আবার নিসাব পরিমাণ ২৬ মন ১০ সের মতান্তরে ৩০ মন না হলে ওশর দিতে হবে না।

৫. মধুর যাকাত: ৫ অসাকের মূল্য হিসেবে মধুর নিসাব ধার্য হবে। অর্থাৎ ৬৫৩ কিলোগ্রাম হলে তাতে ওশর দিতে হবে।

৬. খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত: খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদে এক-পঞ্চমাংশ যাকাত দিতে হবে।

৭. নগদ টাকা ও মজুদ সম্পদের যাকাত: নগদ টাকা বা মজুদ ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যামানের বেশী হলে তার ওপর শতকরা ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

১৪
যে সব সম্পদের যাকাত দিতে হয় না
নিসাবের কম পরিমান সম্পদ,

নিসাব বছরের মধ্যেই অর্জিত ও ব্যয়িত সম্পদ

ব্যবহার্য সামগ্রী

শিক্ষা উপকরণ,

ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা যা বসবাস কিংবা কলকারখানা হিসেবে ব্যবহৃত

যন্ত্রপাতি ও সাজ সরঞ্জাম

ব্যবহার্য যানবাহন

ব্যবহার্য পশু,

ওয়াকফকৃত সম্পত্তি

পোষা পাখি ও হাঁস মুরগী।

১৫
আর্থ-সামাজিক উন্নযনে যাকাতের ভূমিকা
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি এ প্রসঙ্গে বলেন, জরুরী পরিস্থিতিতে যাকাতের রেটের কোন সীমারেখা নেই। যে যত বেশী দান করবে সবার জন্য ততই মঙ্গলজনক। বিভিন্ন তহবিল গঠনে যে প্রচারণা চালানো হয় যাকাত তাদের সব লক্ষ্যই পুরণ করে। [. D. Hammudul Abdalati, Islam is focus.]

মহান রাববুল আলামীন, মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) খুলাফায়ে রাশেদীনসহ সকল ইমাম ও ইসলামী চিন্তাবিদ যাকাতের ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে বলা যেতে পারে যাকাত আদায় করা আমাদের জন্য অপরিহার্য করণীয় কাজ এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি যাকাত। যে ব্যাপারে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই। যাকাত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অর্থ ক্ষুধা-দারিদ্র, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, চাঁদাবাজী, দুর্নীতি, হতাশা, শ্রেণী বৈষম্য, অসহনশীলতা, অনৈক্য, দুশ্চিন্তামুক্ত, পারস্পারিক সহযোগিতা সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদে সকল সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য দূর হয়ে সাম্য মৈত্রী ভ্রাতৃত্ব কল্যাণময়তা বিরাজ করে। পরস্পর এগিয়ে আসে একে অপরের দুঃখ দুর্দশা মোচন করতে। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে ভ্রাতৃত্ব ও ভারসাম্যমূলক এই সামাজিক ব্যবস্থার নাম আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। যে সমাজ আমাদের কাছে স্বপ্নের সোনার হরিণ, আজকের আধুনিক ধনতান্ত্রিক বিশ্ব যে সমাজের কথা কল্পনাও করতে পারে না, সে সমাজ উপহার দিয়েছে ইসলাম এখন থেকে আরো প্রায় পনের শত বছর আগে। খুন, রাহাজানি, হত্যা-কলহ, সুদ, ক্ষুধা, দারিদ্র, অন্যায়-অবিচার, অনৈতিকতা, শ্রেণী বৈষম্য, যিনা ব্যাভিচার, হত্যা ধর্ষণসহ সব অন্যায় অসামাজিক কাজ ছিল যে সমাজের অলংকার, সে শতধাবিভক্ত সমাজকে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা) স্বপ্নের সোনালী সমাজে পরিণত করেছিলেন ইসলাম নামক শান্তির নির্ঝরণীয় মাধ্যমে। যাকাত ছিল যে সমাজের সকল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের রূপকার। নিম্নে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যাকাতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার বিবরণ বর্ণনা করার প্রচেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ।

১. দুশ্চিন্তামুক্ত সমাজ গঠন: এ কথা আজ অবিসংবাদিত সত্য যে, যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতি সম্পূর্ণরুপে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারে। একটি সুখী, সুন্দর ও উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় করতে হবে। এর ফলে যে শুধু অসহায় এবং দুস্থ মানবতারই কল্যাণ হবে তা নয়, সমাজে আয় বন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেকখানি হ্রাস পাবে। [. শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, অর্থনীতি পুজিবাদ ও ইসলাম (ঢাকা: গ্রন্থমেলা, ২০০৩), পৃ. ১০৯।] কোন ব্যক্তির কাছে অর্থ-সম্পদ নেই; যাকাত তাকে অর্থের যোগান দেবে, মৃত্যুর পরে তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের লালন-পালন করবে, বেকার, অক্ষম, বিকলাঙ্গ, রুগ্ন ও বিধবাদের সম্মানজনক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দেবে। এর সহজ সরল সমীকরণ এ যে, আজ এক ব্যক্তি বিত্তবান আছে বিধায় সে অন্যদেরকে সাহায্য করবে। কারণ কাল সে যদি অভাবী হড়ে পড়ে, তখন অন্যরা তাকে সহযোগিতা করবে। মারা গেলে স্ত্রী, সন্তান, সন্ততির অবস্থা কি হবে সে চিন্তারও কোন দরকার নেই। কারণ তার দায়িত্বও যাকাত ব্যবস্থার সফরে টাকা শেষ হয়ে গেলে কি হবে? এ চিন্তা থেকেও মুক্তি দেবে যাকাত। এক্ষেত্রে সমাজের একজন সদস্যের দায়িত্ব হলো সে তার সম্পদের অতিরিক্ত অংশ হতে একট নির্দিষ্ট পরিমাণ যাকাত ফান্ডে দিয়ে রাখবে যাতে এ অর্থ তার দুঃসময়ে রক্ষা করতে পারে। এভাবে যদি কোন ব্যক্তির জীবনে অর্থ চিন্তা না থাকে, ক্ষুধার চিন্তা না থাকে, তার স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতির দারিদ্রের ভয় না থাকে, তাহলে সম্পূর্ণরূপে হতাশামুক্ত সমাজ গঠিত হবে। আর যে সমাজে অর্থ চিন্তা থাকে না, সে সমাজে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, আত্মসাৎ, জবরদখল, সুদ-ঘুষসহ সব অনৈতিক কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

২. যাকাত ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে আর্থ-সামাজিক সেতুবন্ধন: প্রকৃতপক্ষে যাকাত ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দুর করে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ইসলামী নৈতিকতা ও অর্থনৈতিক বিধান মেনে চললে সমাজে কখনও ধনী দরিদ্রের আকাশ চুম্বি পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে না। বর্তমানে শ্রেণী বিভক্ত, বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার কারণে এক শ্রেণীর লোক সব সময় অবহেলিত। একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই পারে শ্রেণীহিন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। প্রকৃতপক্ষে যাকাত, সাদকা দান উপঢৌকন, আপ্যায়ন, খাদ্য বিতরন, সালাম বিনিময় এ সকলের মাধ্যমে সম্প্রীতি, ঐক্যবোধ পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদের সকল বৈষম্য দুর হয়ে সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বভিত্তিক কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই ইসলামে সামাজিক বৈষম্য দুর করে সাম্য মৈত্রীর সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাকাত বিধান এক বিষ্ময়কার ব্যবস্থার নাম। [. মাওলানা আবুল কাসেম মুহাম্মদ ছিফাতুল্লাহ, ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং।]

৩. যাকাত ব্যবস্থায় ধনীদের সম্পদে দরিদ্রের অধিকার: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ দারিদ্রমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন। যাকাত দুস্থ দারিদ্রের প্রতি ধনীদের দয়া বা অনুকম্পা নয় বরং অধিকার। [. জয়নুল আবেদীন মজুমদার, হযরত ওমর (রা) শাসনমলে অর্থ ব্যবস্থা।] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,

﴿ وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ﴾ [ الذاريات :19]

এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিতদের হক। [. আল কুরআন, সূরা আয -যারিয়াত: ১৯।] অন্যত্র বলা হয়েছে ধনীদের যা প্রদান করতে বলা হয়েছে তা বদান্যতা নয়, বরং গরীবদের অধিকার حق অধিকার হিসেবেই তা গরীবদের নিকট ফেরত আসা উচিত। বস্ত্তত গরীবরাই তাদের শ্রম দ্বারা জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি করে। [. জয়নুল আবেদীন মজুমদার, হযরত ওমর (রা) শাসনমলে অর্থ ব্যবস্থা।]

৪. অভাব, দুর্দশা, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনে যাকাত: যাকাতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার দারিদ্র বিমোচন, যা সামাজিক নিরাপত্তার মূল চালিকা শক্তি। যাকাত বন্টনের ৮টি খাতের মধ্যে ৪টি খাতই (ফকির, মিসকিন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্থ) সর্বহারা, অসহায়, অভাবগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিত। এছাড়া নও মুসলিমের খাতটাও বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে এর মধ্যে আসতে পারে।

ওমর (রা.) মিসকিনের খাতটিকেও সম্প্রসারিত করে বেকার বা কর্ম-সংস্থানহীনদেরকেও এর অন্তর্ভুক্ত করেন। অথচ এর ১২০০ বছর পরে উইলিয়াম বেভারিজ এটাকে কল্যাণ নীতির অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়া অষ্টম খাতটিও সামাজিক অভাবে পতিতদের জন্য। এর দ্বারা বুঝা যায় দারিদ্র দূর করাই যাকাতের মূল লক্ষ্য। [. আবুল কাশেম ভুঁইয়া, সামাজিক নিরাপত্তায় যাকাত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৬।] শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ) এর কথায় শুনা যায় তারই প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন, Zakat has been ordained to serve two purposes; self discipline and provision against social destitution. [. Mirza Mohammad Hussain, Islam and Socialism.] অর্থাৎ যাকাত দুটি লক্ষ্যে নিবেদিত আত্মশৃঙ্খলা অর্জন ও সামাজিক দারিদ্র নিরসন।

বিংশ শতাব্দির বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. হাম্মুদাহ আব্দালাতি বলেন, Zakat mitigates to a minimum the suffering of the ready and poor members of society. It is a most comforting conslation to the less fortunate people. Yet it is a loud appeal to everybody to rool up his sulves and improve his lot. [. D. Hammudul Abdalati, Islam is focus.]

যাকাত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুঃখ কষ্ট নিবারণ করে। এটি অভাবীদের জন্য স্বস্তি ও ভাগ্যোন্নয়নের শ্রেষ্ঠ উপায়। দুঃস্থ, অভাবগ্রস্থ, মানুষের সমাধানে যাকাতই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যাকাত অভাবগ্রস্থকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে যাতে সে আর অবভাগ্রস্থ না থাকে। কোন কোন ফকীহ মত প্রকাশ করেছেন যে, যাকাত গ্রহীতাকে এক বছরের প্রয়োজন পুরণ করে দিতে হবে। কেউ কেউ আবার সারা জীবনের প্রয়োজন পুরণ করে দেওয়ার কথাও বলেছেন। উমার (রা) বলেছেন যখন দিবেই তখন স্বচ্ছল বানিয়ে দাও। [. আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী, ইসলামের যাকাত বিধান, ২য় খন্ড।]

দারিদ্র মানুষের পয়লা নম্বরের দুশমন। যে কোন সমাজ ও দেশের জন্য এটা জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজের হতাশা ও বঞ্চনার অনুভুতির সৃষ্টি হয় দারিদ্রের মাধ্যমে। পরিণামে দেখা দেয় মারাত্মক সামাজিক সংঘাত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য যাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে ইসলামের সোনালী যুগ থেকে। [. শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামী অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ।]

মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা দরিদ্র লোকের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করো। তাদের প্রতি সাধ্যমত অনুগ্রহ ও উপকার করো। আখিরাতের পথে তারা তোমাদের জন্য সংগৃহীত ধন এবং প্রধান সম্বল। কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাববুল আলামিন দরিদ্রের প্রতি আদেশ করবেন যে, পৃথিবীতে যারা তোমাদের এক লোকমা অন্ন এবং এক ঢোক পানি দান করেছে, এক প্রস্থ বস্ত্র দান করেছে আজ তোমরা তাদের হাত ধরে জান্নাতে চলে যাও। [. ইমাম গাজ্জালী(রা). কিমিয়ায়ে সাআদাত।] ওমর (রা) বলেছেন, আমার রাজ্যে ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায় তাহলে তার জন্য আমি উমরকে আল্লাহর কাছে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িযে জবাবদিহি করতে হবে।

৫. যাকাত সম্পদ পবিত্র করে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপন করে:

মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে যাকাত দেয় তা তার নিজের জন্য পবিত্রকারী। [. আল্লামা ইউসুফ আলী কারযাভী, ইসলামের যাকাত বিধান, ২য় খন্ড।] এ কাজটিকে যাকাত বলার কারণ হলো এভাবে যাকাতদাতার অর্থসম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া অর্থ সম্পদ থেকে আল্লাহর বান্দাদের অধিকার বের করে দেয় না, তার অন্তরে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই। সে সাথে তার আত্মা থেকে যায় অপবিত্র। কেননা আল্লাহ যে তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এ জন্য তার অন্তরে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের আসছে

﴿ خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم ﴾

‘তাদের সম্পদ হতে যাকাত (সাদাকা) গ্রহণ করবে, যা দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে।’ [. আল কুরআন, সূরা আত তাওবা: ১০৩।]

যাকাত ধনী ব্যক্তিদের সম্পদকে পবিত্র করে। যে পরিমাণ অর্থ সম্পদ যাকাত হিসেবে ধনীদের উপর ফরয হয় তাতে দাতার কোন নৈতিক ও আইনগত অধিকার থাকে না। এ অর্থ সম্পদ গ্রহীতার অধিকার হিসেবেই চি ‎‎ হ্নিত হয়। দাতা যাকাত দিতে ব্যর্থ হলে তার অর্থ এ দাঁড়ায় যে তিনি অন্যের সম্পদ বেআইনী ভোগ দখল করছেন। এ বেআইনী সম্পদকে ভোগ দখল করার কারণে তার সব সম্পদ অপবিত্র হয়ে যায়। যাকাত কেবল দাতার সম্পদকে পবিত্র করে না বরং তার হৃদয়কে সুনির্মল ও প্রসারিত করে। তার মন-মানস আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা চেতনামূলক হয়ে সমাজ কেন্দ্রিক সঞ্জিবিত হয়। সাথে সাথে সম্পদ লিপ্সা ও স্বার্থপরতা ইত্যাদি দূর হয়। যাকাত প্রাপ্তির ফলে গ্রহীতার মন থেকে ধনীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, শত্রুতা ও ঘৃণার মানসিকতা দূর হয়ে যায়। [. আবুল কাশেম ভুঁইয়া, সামাজিক নিরাপত্তায় যাকাত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৬।] যার কারণে সমাজের সর্বস্তরে সম্প্রীতি বিরাজ করে সহমর্মিতা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়।

৬. যাকাত মজুদদারী বন্ধ করে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করে:

যাকাত অর্থ সম্পদ দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে বন্টন করার মাধ্যমে শুধু সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না বরং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে বাজারে কার্যকর চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। [. শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামী অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ।] গতিশীল হয় অর্থনীতি। আমরা যে সমাজে বসবাস করি তার কল্যাণ ও উন্নতির সাথেই আমাদের কল্যাণ ও উন্নতি জড়িত। এ কথা সত্য যে, আপনি যদি আপনার অর্থ সম্পদ হতে আপনার অপরাপর ভাইদের সাহায্য করেন তবে তা আবর্তিত হয়ে বহু কল্যাণ সাথে নিয়ে আপনার কাছেই ফিরে আসবে। কিন্তু, যদি সংকীর্ন দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে তা নিজের কাছেই জমা করে রাখেন কিংবা কেবল নিজের ব্যক্তি স্বার্থে ব্যয় করেন তবে শেষ পর্যন্ত তা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে বাধ্য।

আবার মজুদদারিকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার অর্থ সম্পদ চল্লিশ দিনের বেশী জমা রাখবে সে জাহান্নামী। [. সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩০৮, তিরমিযী, ২৩৯২ নং হাদীস।] মজুদদারীর কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয় এবং দ্রব্য মূল্য হুহু করে বেড়ে যায়। ইসলাম মজুদ সম্পদের ওপর যাকাত ধার্য করার কারণে অর্থ সম্পদ মজুদ করাকে নিরুৎসাহিত করেছে।

৭. যাকাত ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা দেয়

প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে কোন ব্যক্তি যদি তার অর্থ সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়, ঋণগ্রস্থ হয়ে যায় তাহলে যাকাত তার ঋণ পরিশোধ করবে, তার হারানো ব্যবসা বা অর্থ সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ সহযোগিতা করবে। এখানে বলা দরকার যে তারা এমন ঋণগ্রস্থ যে, নিজের অর্থ সম্পদ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করলে আর নিসাব পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে থাকে না। এমন ব্যক্তি উপার্জনশীল হোক, ফকীর বলে পরিচিত হোক কিংবা ধনী হোক সর্বাবস্থায় তাকে যাকাত থেকে সাহায্য করা যেতে পারে। [. প্রাগুক্ত।]

এ ব্যবস্থার কারণ হলো ইসলাম কখনও কোন ব্যক্তির ওপর যুলুম করে না। ব্যক্তি যখন ধনী ছিল তখন তার অর্থ থেকে রাষ্ট্র উপকৃত হয়েছে আর সে যখন দরিদ্র হয়ে গেছে তখন তাকে ইসলাম ফেলে দেবে? কখনো নয় বরং তার হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য যাকাত তার দয়ার ভান্ডারকে উন্মুক্ত করে দেবে।

যাকাত আদায়ের আটটি খাতের মধ্যে ঋণমুক্তি তাইতো একটি অন্যতম খাত। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন:

﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ﴾ [ التوبة :60]

‘সাদকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। [. আল কুরআন, সূরা আত তাওবা: ৬০।]

৮. অমুসলিমদের ব্যাপারে যাকাতের নীতি

অমুসলিমদের যাকাতের অর্থ লাভ করতে পারবে কিনা, এ ব্যাপারে আইম্মায়ে কিরামগণ বলেছেন, তা হলো যাকাতের অর্থ অমুসলিমদের দেওয়া যাবে না। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে .... যাকাত তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে এবং তোমাদের গরীবদের মাঝে বণ্টন করা হবে। [. মুহাম্মদ ইসমাঈল বুখারী, সহীহ বুখারী, যাকাত অধ্যায়(দেওবন্দ: মাকাতাবাহ শিরকায়ে মুখতাব, প্রকাশ ১৯৯৫খ্রী), পৃ. ১৮৭।]

এ ব্যাপারে বক্তব্য হলো যাকাত নয় বরং বাইতুলমাল হতে অমুসলিমদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। হযরত ওমর (রা.) এক ইয়াহুদীকে ভিক্ষা করতে দেখে বাইতুলমাল হতে তার ভাতার ব্যবস্থা করে দেন।

ইমাম আবু ইউসুফ (রহ) তার কিতাবুল খারাজ এর মধ্যে লিখেছেন, হযরত ওমর ফারুক (রা.)এর শাসনামলে ইরাকের হিরাবাসী খ্রিষ্টানদের সাথে যে চুক্তি হয় তাতে লিখিত ছিল যে বৃদ্ধ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে কিংবা কোন বিপদে পড়েছে কিংবা পূর্বে ধনী ও স্বচ্ছল ছিল এখন দরিদ্র হয়ে পড়েছে আর সমাজের লোকেরা তাকে ভিক্ষা দিতে শুরু করেছে এরূপ ব্যক্তি যতদিন ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক থাকবে ততদিন তার ধার্য জিযিয়া প্রত্যাহার হবে এবং মুসলিমদের বায়তুলমাল হতে তার ও তার পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। [. মাওলানা আব্দুর রহীম, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা। ইমাম আবু ইউসুফ তার কিতাবুল খারাজ গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত।] আসলে যাকাত কেবল মুসলিমদের হক, অমুসলিমরা যাকাত পাবে না। তবে অমুসলিমদেরকে সাধারণ দান খয়রাত অবশ্যিই দেয়া যাবে।

৯. শিক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যাকাতের ভূমিকা

জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক অনেক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যাকাতের অর্থ দিয়ে গরীব অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের বই পুস্তক, খোরাক, পোশাক, শিক্ষা উপকরণসহ লিল্লাহবোর্ডিং এ উন্নততর ও গুণগত শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে গরীব অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া যাবে।

১০. উৎপাদন বৃদ্ধিতে যাকাতের ভূমিকা

আল্লাহ প্রদত্ত ও নির্দেশিত যাকাত ব্যবস্থায় অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যাকাত নিঃস্ব ব্যক্তিদের ভিক্ষার হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করে। যে কোন উৎপাদন কাজে শ্রমের সাথে পুজির সংযোজন অনস্বীকার্য। মানুষ তার শ্রমের মাধ্যমে বিষ্ময়কর উন্নয়ন ঘটাতে পারে, কাজে লাগাতে পারে অসংখ্য প্রকৃতির সম্পদকে, পারে মরুভূমিকে উর্বর জমিতে পরিণত করতে। তবে এর জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার যা অর্থনীতির ভাষায় পুঁজি দ্রব্য বলা হয়ে থাকে। পুঁজির অভাবে বহু কর্মক্ষম দারিদ্র জনগোষ্ঠী বেকারত্ব জীবন যাপন করছে। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে এই সকল দরিদ্র জনশক্তিকে উৎপাদন কর্মকান্ডে ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। [. মোঃ আবুল কালাম আজাদ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুষম বণ্টনের কৌশল হিসেবে যাকাত: তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, দারিদ্র বিমোচন ইসলাম, নূরুল ইসলাম মানিক সম্পাদিত (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৫খ্রী), পৃ. ২২৮।]

১১. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের আরো কতিপয় পদক্ষেপ

এদেশের তথা সারা পৃথিবীতে অসংখ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিজ পরিবারের গলগ্রহ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কারণে পাশ্চাত্য পরিবার প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার কারণে বৃদ্ধ বয়সে সেখানকার নারী পুরুষেরা তাদের সন্তান সন্ততি হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সরকারের করুনায় বেঁচে থাকে। অথচ যাকাত দিতে পারে তাদের সুন্দর স্বপ্নীল জীবনের নিরাপত্তা।

কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা অর্থের অভাবে কন্যা বিবাহ দিতে পারে না। এ সমস্ত অক্ষম পিতার কন্যার বিয়েতে যাকাত তার নিজস্ব ফান্ড থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে দিয়ে দিবে।

মুসাফিরদের সাহায্য প্রদান, দরিদ্র শিশুদের পুষ্টি সাহায্য, ইয়াতীম প্রতিপালনে ব্যবস্থা গ্রহণ, শীত বস্ত্ত বিতরণ, স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার, নও-মুসলিম পুর্ণবাসন, ইউনিয়ন মেডিকেল সেন্টার স্থাপন, অসহায় মায়েদের প্রসবকালীন সাহায্য প্রদান, ঋণগ্রস্থ কৃষকদের ঋণ পরিশোধে সহায়তাসহ নানামুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে যাকাত তার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী শান্তির সমাজ কায়েমে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

এছাড়া দ্বীনী শিক্ষা অর্জনে সহযোগিতা, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্হা না করা পর্যন্ত ভাতা প্রদান, দুস্থ পরিবারের জন্য গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পশু কিনতে সাহায্য দান, গৃহহীনদের গৃহ তৈরী করে দেওয়া, অসহায় গরীব মানুষের গৃহস্থালী আসবাবপত্র ক্রয় করতে সহযোগিতা করাসহ সব প্রকার উন্নয়ন কর্মসূচীতে যাকাতের সরব উপস্থিতিই সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ, জাতি,ডিজিটাল সমাজ গড়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে।

যাকাতের মূল উদ্দেশ্যই তো ক) গরীবের প্রয়োজন পুরণ, খ) ধনীরা তাদের কষ্টোপার্জিত সম্পদকে বিলিয়ে দেয়ার চেতনা ও গ) আল্লাহর নৈকট্য লাভ এ টার্গেট পুরণ করার নিমিত্তেই আর্থ-সামাজিক বহুবিধ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। [. আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ন(ঢাকা: জনতা পাবলিকেশন, ২য় প্রকাশ, ২০০৩ খ্রী), পৃ. ৫১৮।]

১৬
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থার সফলতার সম্ভাবনা
যাকাত ব্যবস্থা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখার সামর্থ বিষয়ে বলা যায়, এদেশের মেজরিটি পার্সেন্ট দরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নযনের মাধ্যমে তাদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানোর মতো অর্থনৈতিক যোগান এদেশের বিভিন্ন খাত থাকে যাকাত পর্যাপ্ত পরিমাণে পাবে কিনা বা পাওয়া সম্ভব কিনা সেটা আলোচনার প্রয়োজন।

ব্যক্তির হাতে মজুদ নগদ অর্থ, গৃহে বা ব্যাংকে রাখা স্বর্ণালংকার ও গোপনে রাখা ডলার/পাউন্ড বাদে শুধু ব্যাংকে সঞ্চিত মেয়াদি আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিটের কথাই উল্লেখ করা যায় যা নূন্যতম এক বছরের জন্য রাখা হয়। বাংলাদেশের সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধিনে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটাসটিকস প্রকাশিত “Statistical yearbook of Bangladesh” এর তথ্যানুসারে ১৯৯৫-৯৬ অর্থ বছরে দেশে মেয়াদী সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল নিম্নরূপ:

ক. তফসীল ব্যাংকসমূহের সঞ্চয়= ৩১,২৩১.১৭ কোটি টাকা

খ. পোষ্টাল সেভিংস সমূহের সঞ্চয়= ০৬,৩২১.৪৭ কোটি টাকা

গ. সকারের সঞ্চয় প্রকল্পে = ৬২,২৮৬.৮০ কোটি টাকা

সর্বমোট = ৯৯,৮৩৯.৪৪ কোটি টাকা

শতকরা ২.৫% যাকাত ধরলে এর যাকাত আসে প্রায় ২,৪৯৬ কোটি টাকা। অনুরূপভাবে এদেশের ছাহিবে নিসাব পরিমাণ ফসলের অধিকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ওশর আদায় করলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে আরো অন্তত: ১,০০০ কোটি টাকার বেশি। সবকিছু বাদ দিলেও দেখা যাচ্ছে শুধু মেয়াদী আমানত এবং ফসলে ওশর থেকে প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকা আসা সম্ভব। [. শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামী অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ।]

এছাড়া এখনও অনেকগুলো খাত আছে যেখান থেকে যাকাত আসা সম্ভব। আর এই পরিসংখ্যান হলো এখন থেকে প্রায় এক যুগেরও আগের। বর্তমানে তো এই অর্থের পরিমাণ আরো বেশি আসতে বাধ্য।

বাংলাদেশের ১৬ লাখ পরিবার রয়েছে ছিন্নমূল ও ঠিকানাহীন। এছাড়া আরো ৩২ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের সামান্য আশ্রয় থাকলেও কোন জমি জমা নেই। এবার যদি প্রতি বছর এদেশের ৫,০৩৫ টি ইউনিয়ন ও পৌর ওয়ার্ড এর মধ্যে ৩৫০০ কোটি টাকা ভাগ করে দেয়া হয় তাহলে প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌর ওয়ার্ড পাবে প্রায় ৬৯ লক্ষ টাকা। এই টাকা হতে ৪০ হাজার করে যদি একেকটি পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে উক্ত পরিবারের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য আর কোন সমস্যা থাকে না। আর প্রতি বছর প্রতিটি পৌর ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের ১৫০ জন ব্যক্তি এভাবে টাকা পেয়ে স্বাবলম্বী হতে থাকলে দশ বছরে বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত হয়ে যাবে। [. মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, দারিদ্র বিমোচন ও মানব সেবায় বিশ্ব নবীর আদর্শ।]

প্রভুত সম্ভাবনাময় আমাদের এ সুজলা সোনার বাংলাদেশ। এখানে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্য, বনজ সম্পদ, পশু সম্পদ, পানি সম্পদ, আর সব চাইতে বড় হলো ১৫ কোটি মানব সম্পদ। কিন্তু, এ সব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার না থাকায় বৈষম্যমূলক বণ্টননীতির কারণে সম্পদের অদক্ষ ব্যবহারের ফলে আমরা আস্তে আস্তে অসীম সম্ভাবনা থাকার পরেও প্রতিনিয়ত দারিদ্রের সাথে লড়াই করছি, হাত পাতছি পাশ্চাত্যের কাছে। আর তারা আমাদেরকে ইচ্ছা মতো যতটুকু না ঋণ দিচ্ছে তার চাইতে বেশি দিচ্ছে উপদেশ। যা আমাদের জাতির অস্তিত্বকে সংকটের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। তারা আমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি ‘‘ম্যালথাসের দেশ উন্নয়নের টেস্ট কেস’’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

শুধু তাই নয়, বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা আমাদেরকে আরো বলছে, Success in solving its (Bangladesh) economics problem would be a convincing evidence that no other country in the world need face extreme poverty.

অথচ এক সময় এদেশ ছিল পৃথিবীর মানুষের স্বপ্নের আবাসভুমি। শোনা যায় শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় ৮মন চাউল পাওয়া যেত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বাংলাদেশ সহযোগিতা করত। আর আজ; যে দেশের মাটিতে সোনা ফলে, যে দেশের গাছে গাছে দেখা যায় নানান রকম ফুল-ফলের সমাহার, যে দেশের নদী, খাল বিলগুলোতে দেখা যায় রূপালী মাছের সমাহার, যে দেশে আছে ৩০ কোটি হাত; সে দেশের সংসদে বৈদেশিক ঋণ ছাড়া বাজেট পেশ হয় না। বন্যার্তদের সহযোগিতা করা যায় না, নদী-খাল-বিল খনন হয় না। সে দেশের মায়েরা মাত্র দু‘মুঠো অন্নের জ্বালায়, এক প্রস্থ কাপড়ের জন্য, একটুখানি মাথা গুঁজার ঠাই এর জন্য অসুস্থ সন্তান-সন্তুতি, বাবা মায়ের স্বামীর চিকিৎসার জন্য নিজেদের সতীত্বকে পর্যন্ত বিক্রি করে, নিজের গর্ভজাত সন্তানকে মাত্র ২০০ টাকায় বিক্রি করে দেয়। অথচ বেশি কিছু নয় শুধুমাত্র যাকাত ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণের মাধ্যমে ১০ বছর বা আরও কম সময়ের এদেশকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত করা সম্ভব। গৃহহীনের গৃহ, বস্ত্রহীনদের বস্ত্র, ক্ষধার্তকে অন্ন রোগগ্রস্থকে সুস্থতা, ঋণগ্রস্তকে ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা, বৃদ্ধ, অসহায় বনী আদমকে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার মাধ্যমে এ দেশকে আর্থ-সামাজিক উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে সক্ষম শুধু ইসলাম প্রদত্ত যাকাত ব্যবস্থা। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি খুন-রাহজানি, যিনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ-লুণ্ঠন, জোরদখল, টেন্ডারবাজী, আত্মসাৎ, শ্রেণী বৈষম্যসহ সকল প্রকার সমাজ বিধ্বংসী কাজ নিরসনকল্পে সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ-জাতি পৃথিবী গঠনে সক্ষম একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই।

১৭
সমাপনী
পরের সুখে হাসব সবাই কাঁদব সবার দুখে,

নিজের খাবার বিলিয়ে দিব অনাহারীর মুখে,

আপনাকে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনি পরে

সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকেই আমরা পরের তরে।

কবিতায় কবি তার মনের যে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন, মহান রাববুল আলামীন যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় পনের শত বছর পূর্বে মানব মনে সে অনুভূতি জাগ্রত করার কার্যকরী পথ দেখিয়েছেন।

সমাজ বিজ্ঞানী ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি তাইতো যথার্থই বলেছেন, কুরআনিক শব্দ যাকাত কেবল বদান্যতা দান, সদয়তা, সরকারী কর, ঐচ্ছিক দান ইত্যাদিকেই অন্তর্ভূক্ত করে না, উপরন্ত এটা এসব কল্যাণকামী মন-মানস এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার সুসমন্বিতরূপ। [. D. Hammudah Abdalati, Islam is focus.]

আর এ চেতনার মূলকথা হলো মানুষ মানুষের দুঃখে এগিয়ে আসবে, অন্যের কষ্টতে নিজের কষ্ট মনে করবে, পাওনাদার দেনাদারকে স্বত:স্ফুর্তভাবে ক্ষমা করে দেবে, দরিদ্র অভাবী প্রতিবেশীর দুঃখ দুর্দশা মোচনে এগিয়ে আসবে। তাহলে প্রত্যেক নাগরিক তার জান-মাল পরিবার পরিজন সন্তান-সন্তুতির নিরাপত্তা ফিরে পাবে, যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর হবে শ্রেণী বৈষম্য, কৌলিন্য ইত্যাদি।

একথা সত্য যে, অধিকাংশ সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হয় দরিদ্রতার কারণে। এ সমস্যার প্রতিবিধান করার জন্য যাকাত ইসলামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যাকাতের অর্থসম্পদ প্রাপ্তির ফলে দারিদ্রের জীবন যেমন আনন্দ ও নিরাপদ হয় তেমনি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয়। [. শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, অর্থনীতি পুজিবাদ ও ইসলাম ( ঢাকা: গ্রন্থমেলা, ২০০৩), পৃ. ১১০।]

ফিরে আসবে আবার সেইদিন, যেদিন হযরত ওমর (রা.) যাকাতের অর্থ দেওয়ার লোক খুঁজে পেতেন না, গহীন রাতে সুন্দরী মহিলা রাস্তা দিয়ে একাকী চললেও সে থাকতো নিরাপদ, প্রত্যেকেই ছিল প্রত্যেকের জীবনের রক্ষাকর্তা, কেউ কারো জন্য মান হানিকর কিছু করা থেকে বিরত থাকত। যে দিনের কথা বলেছেন ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি, It is authentically reported that there were times in the history of the Islamic administration when there was no person eligible to receive Zakah. Every subject Muslim, Christian and Jew of the vast Islamic empire had enough to satisfy his needs and the rulers had to deposit the Zakah collections in the public treassury. [. D. Hammudah Abdalati, Islam is focus.]

ইসলামী সোনালী শাসনকালের ইতিহাসে এমন এক সময় ছিল যখন যাকাত নেওয়ার মতো লোক ছিল না। তখন মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইয়াহুদী সকল নাগরিক তার অভাব মোচনে সক্ষম ছিল। শাসকবর্গ যাকাতের অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা রাখত। এখনও সে পরিবেশ আসতে পারে, যদি যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি এবং সুষম বণ্টননীতি নিশ্চিত করা যায়। আল্লাহ তাওফিক দিন। আমীন!

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন