HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

শরিয়া বিধানের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য

লেখকঃ ইকবাল হোসাইন মাসুম

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
শরিয়া বিধানের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য

ইকবাল হোসাইন মাসুম

সম্পাদনা : আলী হাসান তৈয়ব

ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

শরিয়া বিধানের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
ধর্মে বিশ্বাসী প্রতিটি ব্যক্তিই নিজ নিজ বিশ্বাস মতে কোন না কোনভাবে এবাদত-বন্দেগী, অর্চণা-উপাসনা করে থাকে। বরং এটি প্রতিটি মানুষের সৃষ্টিগত প্রকৃতির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। এবাদত-আনুগত্যের স্বভাব নিয়েই পৃথিবীতে তার আবির্ভাব। প্রকৃতির টানেই সে এবাদত-উপাসনা করতে বাধ্য। তবে সব উপাসক-এবাদতকারীর সকল এবাদত-উপাসনাই প্রকৃত উপাস্য ও মা’বুদ মহাবিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তিনি সেসব এবাদত-উপাসনাই গ্রহণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার অনুমোদন তিনি দিয়েছেন এবং যা সম্পাদিত হবে তাঁর মনোনীত ব্যক্তিবর্গ-আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-এর আদর্শের অনুবর্তিতায়। পৃথিবীর শুরু থেকেই যুগে যুগে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন বিধি-বিধান দিয়ে অসংখ্য নবি-রাসূল প্রেরণ করেছেন, যার ধারা সমাপ্ত হয়েছে নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের মধ্য দিয়ে। আর আল্লাহ প্রদত্ত সেসব বিধি-বিধান ও আদেশ-নিষেধকেই শরিয়ত বলা হয়।

এখন জানার বিষয় হচ্ছে মাকাসিদুশ শরিয়া তথা এ শরিয়ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য কী? এর দ্বারা শরিয়ত অনুগামীদের লাভ কী? যেসব বিধি-বিধান তাদের মেনে চলতে হয়, সেসবের তাৎপর্য ও হিকমত তাদের পক্ষে অনুধাবন করা কি সম্ভব? বা আদৌ কি সেগুলোর পিছে কোন হিকমত লুকিত আছে?

এ প্রসঙ্গে সর্ব প্রথম কলম ধরেন উসূলে ফিকহ (ইসলামি আইনের মূলনীতি) এর প্রখ্যাত ইমাম আল্লামা শাতবী রহ.। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আরো ব্যাপকভাবে গবেষণা করেন যুগে যুগে বহু গবেষক। যেমন আল্লামা মুহাম্মাদ তাহির বিন আশুর রহ., ড. মুহাম্মাদ আল আকলাহ, আল্লামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ. প্রমুখ। আমরা বক্ষমাণ নিবন্ধে এ বিষয়ে কিছু ধারণা নেয়ার প্রয়াস পাব।

সংজ্ঞা:
আল্লামা মুহাম্মাদ তাহির বিন আশুর রহ. [আল্লামা মুহাম্মাদ তাহির বিন আশুর রহ, গ্রান্ড মুফতি তিউনেশিয়া , তাঁর বিখ্যাত রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে, আত তাহরীর ওয়া তানবীর, মাকাসিদিশ শরীআতিল ইসলামিয়া, মুত্যু: ১৩৯৩ হি:। দ্রষ্টব্য আল আলাম (১৭৪/৬)।] এর মতে, মাকাসিদুশ শরিয়া বলতে সেসব দর্শন ও তাৎপর্যকে বুঝানো হয়, বিধান প্রবর্তনের সময় বিধানকর্তা আল্লাহ যেসবের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিধান প্রবর্তন করেছেন। [মাকাসিদিশ শরীআতিল ইসলামিয়া। (পৃ:৫০)]

শায়খ ইলাল আল ফাসী রহ. বলেন, মাকাসিদুশ শরিয়া দ্বারা উদ্দেশ্য, সেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, প্রজ্ঞাময় বিধানকর্তা প্রতিটি বিধান প্রবর্তনের সময় যার প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। [উস্তাদ ইলাল আল ফাসী রহ. মাকাসিদুশ শরীআতি ওয়া মাকারিমুহা। (পৃ:৭)]

এসব সংজ্ঞা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হচ্ছে যে, মাকাসিদুশ শরিয়া দ্বারা উদ্দেশ্য, সেসব মহান লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কল্যাণকর তাৎপর্য; দয়াময় বিধানদাতা যার বাস্তবায়ন ও সেগুলোতে উপনীত হওয়া কামনা করেন তাঁর পক্ষ থেকে আরোপিত নুসূস তথা শরয়ি উদ্ধৃতি কিংবা প্রদত্ত বিধানাবলী সম্পাদনের মাধ্যমে।

‘মাকাসিদুশ শরিয়া’ শেখার গুরুত্ব
মাকাসিদুশ শরিয়া সম্পর্কিত জ্ঞানের গুরুত্ব কত অপরিসীম, সর্বযুগের বিজ্ঞ ওলামা ও ইসলামি স্কলারদের ভূমিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই তা অতি সহজে অনুভূত হয়। তাঁরা এ বিষয়ে আলোচনা, পাঠদান, গবেষণা ইত্যাদি কর্মে চেষ্টা-শ্রমের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে যারপর নাই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর এ গুরুত্ব প্রদানের কারণগুলো লুকিয়ে আছে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে-

মাকাসিদুশ শরিয়াকে সাধারণ বৈশিষ্ট্যাবলীর সাথে সামঞ্জস্যবিধান করা যার মাধ্যমে ইসলামি শরীয়তের স্বাতন্ত্র ফুটে উঠবে, যে এটি আল্লাহ প্রদত্ত বিশ্বজনীন ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তবধর্মী জীবন বিধান তথা শরিয়ত যা সর্বকালে সর্বস্থানে বাস্তবায়নযোগ্য। [আল ইসলাম: মাকাসিদুহু ওয়াখাসাইসুহু। ড. মুহাম্মাদ আকলাহ । ( পৃ:১০০)]

ইসলামি শরিয়তজ্ঞ-বিজ্ঞ আলেমেদীনদের পরিপক্করূপে উপলদ্ধি করতে পারা, যে শরীয়তে ইসলামিয়ার তাবত উদ্ধৃতি ও আহকামের অর্থ ও উদ্দেশ্য অনুধাবনযোগ্য- যুক্তি ও প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং মুসলিম যদিও তার ওপর আরোপিত যাবতীয় বিধি-বিধান কোন দ্বিধা-সংকোচ ব্যতীত যথাযথ বিশ্বাস ও পরিপূর্ণ তুষ্টি সহকারে গ্রহণ করে নেয় এবং কল্যাণের পূর্ণ একিন ও আস্থার সাথে বাস্তবায়ন করে চলে। তবে এ নিঃশর্ত মেনে নেয়া ও বাস্তবায়ন করার অর্থ এ নয় যে, এ বিধান প্রবর্তনের হিকমত ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানা যাবে না, তার ভেদ ও রহস্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা নিষিদ্ধ। ‘‘কেননা শরীয়তের বিধি-বিধান প্রবর্তনের দ্বারা কিন্তু উক্ত বিধি-বিধানই মূল লক্ষ্য নয় বরং মূল লক্ষ্য অন্যটি, আর তা হচ্ছে তার অর্থ ও উদ্দেশ্য এবং সেসব কল্যাণ ও উপকারিতা যার জন্যে এসব বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে’’। [ইমাম শাতবী। আল মুওয়াফাকাত (২/৩৮৫)।] এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি হুকুমেরই একটি স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য আছে। যা কখনো সহজে বুঝে আসে কখনো বুঝা কঠিন মনে হয়। কেউ বুঝে; কেউ বুঝেনা আবার কখনো কখনো কেউই বুঝেনা; সকলের নিকটই অস্পষ্ট থাকে। এর অর্থ এই নয় যে এর কোন লক্ষ্য ও তাৎপর্য নেই বরং মূল কারণ হচ্ছে, মহান আল্লাহ হয়ত কোন হিকমতের কারণে অস্পষ্ট করে রেখেছেন বা তা হৃদয়াঙ্গম করতে আমাদের বিবেক-বুদ্ধি অপারগ। বুঝে না আসলে তার কোন কারণ ও তাৎপর্য নেই বলে ধারণা করা ঠিক নয়। অনুরূপভাবে তাৎপর্য ও কার্যকারণ জানলেই একমাত্র বাস্তবায়ন করব; না হলে নয়- এরূপ ধারণা করাও সঙ্গত নয়।

শরীয়তের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা অনুসন্ধান ও অন্বেষণ করা এমনই একটি বিষয় যা ফিৎরত তথা মানব প্রকৃতির সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। আর এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বুনিয়াদ যার ওপর এ দ্বীনে ইসলামির ভিত্তি রাখা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে:

فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ﴿30﴾ ( الروم :30)

অতএব তুমি একনিষ্ঠ হয়ে দীনের জন্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর প্রকৃতি, যে প্রকৃতির ওপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সূরা আর-রূম (৩০)।]

ফিৎরত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে প্রকৃতি যার ওপর আল্লাহ নিজ বৈশিষ্ট্য দিয়ে মানুষদের সৃষ্টি করেছেন মানুষ হিসাবে। এ কথার সারাংশ হচ্ছে: মানুষ এমন এক সৃষ্টি যার বিবেক-বুদ্ধি আছে- যার মাধ্যমে সে প্রয়োজনীয় বিষয়ে ধারণা লাভ করতে পারে। তার ভেতর সভ্যতা-সংস্কৃতির স্বভাব বিদ্যমান। তার রয়েছে এবাদত-আনুগত্য করার ক্ষমতা। সে সৃজিত হয়েছে এমন অনুভূতি দিয়ে যার সাহায্যে সে দৃশ্য ও শ্রবণযোগ্য বিষয় অনুধাবন করতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে সকল বিষয়ের মর্ম ও তত্ত্বব অনুসন্ধানের প্রবণতা। তাইতো প্রত্যেক আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধানের পিছনে কী রহস্য ও তাৎপর্য রয়েছে সে বিষয়ে জানতে ইসলামি শরিয়ত তার অনুগামীদের উৎসাহিত করেছে। এ কারণেই আমরা এমন অনেক শরয়ি বিধান দেখতে পাই যেগুলো বিধানকর্তার পক্ষ থেকে যুক্তিযুক্ত করেই প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিধান প্রবর্তনের সাথে সাথে কারণ ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে।

যেমন সালাতের বিধান প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:

اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ﴿45﴾( العنكبوت :45)

তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত কর এবং সালাত কায়েম করা। নিশ্চয় সালাম অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা কর। [সূরা আনকাবূত: (৪৫)।]

সিয়াম প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿183﴾ ( البقرة :183)

হে মোমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। [সূরা বাকারা: (১৮৩)।]

জাকাত সম্পর্কে বলেন:

خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿103﴾ ( التوبة :103)

তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্যে দো‘আ কর, নিশ্চয় তোমার দো‘আ তাদের জন্যে প্রশান্তিদায়ক। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। [সূরা তাওবা (১০৩)।]

কিসাস সম্পর্কে বলা হয়েছে:

وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿179﴾ ( البقرة : 179)

হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্যে জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে। [সূরা বাকারা: (১৭৯)।]

মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ করণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন:

إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ ﴿91﴾ ) المائدة :91 )

শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না? [সূরা মায়েদা: (৯১)।]

আমরা দেখলাম ইসলামি শরীয়তের আদেশ ও নিষেধগুলো যুক্তিনির্ভর, অযৌক্তিক বা অহেতুক কোন বিধান শরিয়ত অনুসারীদের ওপর আরোপ করা হয়নি। হ্যাঁ, সে কারণগুলো কখনো বুঝে আসে কখনো আসেনা, আবার বিধানকর্তার পক্ষ হতে কোন কোন ক্ষেত্রে বর্ণনা করা হয়েছে আবার কোথাও কোথাও কিছুই বলা হয়নি। এখন যদি কার্যকারণ বা যৌক্তিকতা বুঝে না আসে কিংবা এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা ও বর্ণনা পাওয়া না যায়, তাহলে এর অর্থ এই নয় যে, এ বিধানটি অযৌক্তিক বা এর পিছনে কোন কারণ নেই।

সুতরাং ইসলামি শরিয়ত স্বেচ্ছাচারী ও বল প্রয়োগকারী কোন বিধান নয়। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যবিহীন কতগুলো আদেশ নিষেধের সমষ্টিও নয়। অন্য ভাষায়, জমহুর ওলামার মতে ইসলামি শরীয়তের সবগুলো বিধানই যুক্তিনির্ভর। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৬)।] তার প্রতিটি বিধানেরই নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। আর এ সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামষ্টিকভাবে যুক্তিনির্ভর ও বোধগোম্য বরং কিছু কিছু আনুষঙ্গিক ব্যতিক্রম ছাড়া বিশদভাবেই যুক্তিনির্ভর ও বোধগোম্য। যেমন এবাদত ও আহকামের সংখ্যা, আঙ্গিক, স্বরূপ ইত্যাদি- যার জ্ঞান মহান আল্লাহ নিজ পর্যন্তই সীমিত রেখেছেন এবং যা ব্যাখ্যা করাও কঠিন ও প্রায় অসম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ সালাতের সংখ্যা, প্রত্যেক সালাতের রাকআতের সংখ্যা, সওমকে কেন এক মাস নির্দিষ্ট করা হল অনুরূপভাবে বিভিন্ন কাফ্ফারা, শাস্তি ও দন্ড ইত্যাদি। এসব বিষয় আল্লাহর বিধান হিসাবে আমরা পালন করব। যদিও এর কার্যকারণ ও যৌক্তিকতার ধারণা আমাদের না থাকে। তবে হ্যাঁ, বাস্তবিকতার নিরিখে এগুলোর ব্যাখ্যা কঠিন হলেও বিষয়গুলো কিন্তু অযৌক্তিক ও অহেতুক নয়। বরং যৌক্তিক ও উদ্দেশ্যনির্ভর।

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ‘‘এক কথায় এবাদত ও বিভিন্ন বিধি-বিধান প্রবর্তনের ভেতর বিধানকর্তা আল্লাহ তাআলার অবশ্যই কিছু লক্ষ্য আছে এবং সেসব বিধানেরও নির্দিষ্ট কিছু তাৎপর্য আছে, যার ব্যাখ্যা বিশদভাবে অনুধাবন করা মানব মস্তিষ্কের দ্বারা অসম্ভব হলেও সামষ্টিক ও সংক্ষিপ্তাকারে সম্ভব’’। [ই’লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন:(২/৮৮)।]

পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ‘মাকাসিদুশ শরিয়া-এর ইলম’ বা -শরয়ি বিধি-বিধান প্রবর্তনের তাৎপর্য সংক্রান্ত জ্ঞান- এর গুরুত্বের কথা অবলীলায় স্বীকার করেছেন। ইসলামি শরীয়তের সকল বিধি-বিধান শরিয়ত অনুসারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নানাবিধ কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে প্রবর্তিত হয়েছে মর্মে তাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট আকারে ব্যক্ত করেছেন।

ইমাম শাতেবি রহ. বলেন, ‘‘যখন প্রমাণিত হল যে, শরিয়ত প্রবর্তনের দ্বারা (প্রবর্তক) বিধানকর্তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইহকালীন ও পরকালীন স্বার্থ সংরক্ষণ করা, কল্যাণ নিশ্চিৎ করা, আর এটি এমনভাবে, যাতে নিয়ম-শৃংখলাতে কোনরূপ বিঘ্নতা সৃষ্টি না হয়; না পূর্ণাঙ্গরূপে না আনুষঙ্গিকরূপে। তাই এর প্রবর্তনটি এমন হওয়া চাই যা হবে চিরন্তন, পরিপূর্ণ ও ব্যাপকভিত্তিক, যা সর্বকালে, সর্বাবস্থায় সকল অনুসারীর জন্য সহজ হয়। আর ইসলামি শরিয়ত ও তার সকল বিধি-বিধানকে আমরা যখন এমনই পেলাম তাই সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্যে। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৩৭)।]

তিনি আরও বলেন:‘‘শরীয়তের প্রবর্তন শুধুমাত্র বান্দাদের নগদ ও ভবিষ্যৎ উভয় উপকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশেই হয়েছে’’। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৬)।]

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ‘‘শরীয়তে ইসলামিয়ার ভিত্তি ও বুনিয়াদ হচ্ছে অনেকগুলো হিকমত ও বান্দাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের ওপর। এটি সর্বোতভাবেই ইনসাফ, অনুগ্রহ ও তাৎপর্যময়। সুতরাং যে বিধানটি ইনসাফ থেকে বের হয়ে জুলম, রহমত থেকে বের হয়ে এর বিপরীত, কল্যাণ থেকে বের হয়ে অকল্যাণ এবং তাৎপর্যময়তা থেকে বের হয়ে অহেতুক ও লক্ষ্যহীন বলে বিবেচিত হবে সেটি শরীয়তের অন্তর্গত নয়, যদিও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সাপেক্ষে তার অন্তর্ভূক্ত ধরা হয়’’। [ই’লামুল মুওয়াকি‘ঈন (৩/৩)।]

ড. আব্দুল করিম যায়দান বলেন, ‘‘এখান থেকে আমরা দেখতে পাই যে, শরীয়তের প্রধান লক্ষ্যই হল বান্দার কল্যাণ ও স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের থেকে অকল্যাণ ও বিশৃংখলা বিদুরণ। আর এর মাধ্যমেই তাদের ইহকালীন ও পরকালীন উন্নতি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে। [আব্দুল করীম যায়দান: উসূলুদ দাওয়াহ (পৃ:২৯০)।]

যারা শরয়ি বিধানের যৌক্তিকতা, উদ্দেশ্যনিষ্ঠতা ও কল্যাণময়তার কথা অস্বীকার করে বলে, শরিয়ত হচ্ছে বিধানকর্তার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা ও চাপিয়ে দেয়া কিছু বিধি-নিষেধের নাম, তাদের এ অসার বক্তব্য খন্ডন করে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘‘এটি একটি অসার ধারণা মাত্র যা সুন্নাহ ও কল্যাণময় যুগত্রয়ের ইজমা দ্বারা প্রত্যাখ্যাত’’। [হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ (১/৫০)।]

শরয়ি বিধি-বিধানের তাৎপর্য ও কল্যাণময়তার এসব গুরুত্ব ও আবশ্যিকতার কথা বিবেচনা করে বিজ্ঞ শরিয়তবিদ, ইসলামি আইনজ্ঞ ও গবেষকগণ যারপর নাই পরিশ্রম ও গবেষণা করে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন কিংবা ফিকাহ বা উসূলে ফিকাহর কিতাবসমূহে স্বতন্ত্র অধ্যায় সংযোজন করেছেন। শরয়ি আহকামের তাত্ত্বিবক দিক বিশ্লেষণে দিনের পর দিন গবেষণাকর্ম চালিয়ে গিয়েছেন বিরামহীনভাবে। এক পর্যায়ে এসে এটি একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করেছে। মাকাসিদুশ শরিয়ার জ্ঞানের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা ইমাম শাতবী রহ. এর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকেও প্রতীয়মান। তিনি বলেন, একজন মুফতির পক্ষে ফতোয়া প্রদান বৈধ হওয়ার জন্যে শর্ত হচ্ছে, তার শরয়ি বিধি-বিধানের যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য সম্পর্কিত জ্ঞান পূর্ণাঙ্গরূপে থাকতে হবে। অন্যথায় তার পক্ষে ফতোয়া দেয়া বৈধ নয়। [দেখুন, আল-মুওয়াফাকাত (৪/১০৫) এবং আল-ইজতিহাদ, ড. নাদিয়া আল উমরী (পৃ:৯৬)।]

হ্যাঁ, মাকাসিদুশ শরিয়া তথা শরয়ি বিধি-বিধানের লক্ষ্য ও তাৎপর্য সবগুলোই অকাট্য ও সুস্পষ্ট। তবে কোন আনুষঙ্গিক বিষয়ে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ওলামাদের পারস্পরিক মতভিন্নতা এ সুস্পষ্টতার পরিপন্থী নয়। উদ্দেশ্য অকাট্য ও সুস্পষ্ট বলে তাদের সব মতবিরোধ উঠে যাবে, এমনটি জরুরি নয়।

যেমন: আল্লাহর দীন সহজ হওয়া আর ইসলামি শরীয়তের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে তাইসির তথা সহজ করা। এটি একটি স্বতসিদ্ধ ও অকাট্য বিষয়। এ ব্যাপারে সকলেই একমত, কোন ভিন্নমত নেই। তবে এ মূলনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক বিষয়েও সর্বাবস্থায় ওই অকাট্যতার গুণ পাওয়া যাবে, এমনটি সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে শরিয়তবিদদের মাঝে একটি বিষয়ে অবশ্যই মতানৈক্য হবে, তা হচ্ছে, সেই জটিলতা ও সমস্যাটি কি যার চাহিদা হচ্ছে তাইসির বা সহজীকরণ এবং সেটিই বা কি যা ওই তাইসির চায় না?

ইসলামি শরীয়তের বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য্য ও তার মনোমুগ্ধকর রহস্যাবলী প্রকাশার্থে মাকাসিদুশ শরিয়া বিষয়ে পঠন ও পাঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

একজন ফকিহ প্রকৃত অর্থে ততক্ষণ পর্যন্ত ফকিহ বলে স্বীকৃত হবে না যতক্ষণ না সে মাকাসিদুশ শরিয়া সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন করে ব্যুৎপত্তি অর্জন করবে। শরীয়তের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য এবং তার ভারসাম্যপূর্ণ নীতি সম্পর্কে নিজে অবহিত হয়ে অপর লোকদের অবগত করাতে পারবে, কিসে তাদের কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ, কোথায় তাদের উপকার, কোথায় ক্ষতি- মর্মে লোকদের সতর্ক করে একজন শরিয়তজ্ঞ হিসাবে নিজ দায়িত্ব পরিপূর্ণরূপে পালন করতে সক্ষম হবে।

শরীয়তের প্রসিদ্ধ কয়েকটি উদ্দেশ্য
পূর্বেই আলোচনা হয়েছে যে, শরিয়ত প্রবর্তনের লক্ষ্যই হচ্ছে ইহকাল ও পরকালে বান্দাদের কল্যাণ ও উপকার নিশ্চিত করা। আমরা এখন সেই উদ্দেশ্যাবলীর প্রধান ও প্রসিদ্ধ কয়েকটি সম্পর্কে আলোকপাত করব:

ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতা
এটি ইসলামি শরীয়তের অন্যতম স্বাতন্ত্র এবং এটিই এর প্রধানতম শিআর-নিদর্শন যা তার বাস্তবতা ও সৌন্দর্যময়তা ঘোষণা করে।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ ﴿90﴾ ) النحل :90 (

নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ, সদাচার ও নিকটাত্মীয়দের দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। [সূরা নাহল:৯০।]

উপকারিতা ও স্বার্থ সংরক্ষণ
আর এটি সেগুলোই যা মাকাসিদুশ শরিয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে অথবা বিরোধপূর্ণ। আর এ মাকাসিদের অগ্রভাগেই রয়েছে, মানব জীবনের অতি জরুরী পাঁচটি জিনিস- দ্বীন, জীবন, সম্পদ, বুদ্ধি-বিবেক ও বংশ পরম্পরার সংরক্ষণ। এর অধীনে রয়েছে এগুলোর চেয়ে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি, যার প্রতি সুন্দর-সাবলীল জীবন মুখাপেক্ষী। [আল ইসলামু মাকাসিদুহু ওয়া খাসাইসুহু (পৃ:১২০)।]

সহজীকরণ ও জটিলতার নিরসন
শরয়ি বিধি-বিধান প্রবর্তনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, সহজসাধ্যতা ও মানুষের ওপর সহজ করণ, তাদের থেকে জটিলতা ও সঙ্কীর্ণতা নিরসন করণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের অন্যতম তাৎপর্যও এটিই । এরশাদ হচ্ছে:

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آَمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ﴿157﴾) الأعراف :157(

যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবি; যার গুণাবলী তারা নিজেদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্যে পবিত্র বস্ত্ত হালাল করে আর অপবিত্র বস্ত্ত হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃংখল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ইমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং সাথে যে নূর নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। [সূরা আরাফ (১৫৭)।]

কোরআনুল করিমের বিভিন্ন আয়াতে একথা খুবই সুস্পষ্ট আকারে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, শরয়ি বিধান প্রবর্তনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে এ তাইসির বা সহজীকরণ। তবে সহজসাধ্যতা শরীয়তের লক্ষ্য হলেও এ কথা ভাবার অবকাশ নেই যে শরীয়তের সব বিধানই এ তাইসীরের ওপর চলবে এবং সকল মানুষ সর্বাবস্থায় ও সকল ব্যাপারে সহজসাধ্যতা বজায় রেখে কাজ করবে। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে যেখানে তাইসির বা সহজীকরণের পরিবেশ ও শর্তাদি বিদ্যমান থাকবে কেবল সেখানেই এটি বাস্তবায়িত হবে। সুতরাং সহজীকরণ একটি সাধারণ শরয়ি উদ্দেশ্য। তবে অন্যান্য উদ্দেশ্যের ন্যায় এটিও প্রারম্ভিক উদ্দেশ্য যার বাস্তবায়নের জন্যে শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য।

আল্লামা শাতবী রহ. এদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ইসলামে সহজসাধ্যতার অর্থ এই নয় যে, শরিয়ত আরোপিত দায়িত্ব আদায় ও বিধান পালনে কোন কষ্ট নেই। সকল বিধান পালনই কষ্টমুক্ত। কেননা এমন ধারণা কোন কোন দায়িত্ব অর্পণের উদ্দেশ্যের সাথে অসঙ্গতি বরং বিরোধপূর্ণ। যেমন বিভিন্ন পরীক্ষা ও কষ্ট-মুসিবত। [আল মুওয়াফাকাত: (২/১৩১)।]

মাকাসিদুশ শরিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতার মন্দ পরিণতি
ইত:পূর্বে আমরা মাকাসিদুশ শরিয়া সম্পর্কে জ্ঞান লাভের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ও প্রসিদ্ধ কিছু মাকাসিদ সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে জানতে পেরেছি। এর মাধ্যমে অবশ্যই করে আমাদের বুঝে এসেছে যে মাকাসিদ সম্বন্ধে অজ্ঞতা (ফতোয়া প্রদানকারীর (মুফতি) পক্ষ থেকে) ভুল বিধান ও মাসআলা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। কেননা ‘‘শরয়ি হুকুমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অজ্ঞতা কখনো কখনো কোন কোন মানুষকে সে হুকুম অস্বীকার করতে প্ররোচিত করতে পারে। কারণ তার ধারণা ও বিশ্বাস হচ্ছে বিধানকর্তা আল্লাহ শরয়ি বিধান অবশ্যই বান্দার কল্যাণ ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে দিয়ে থাকেন সেটি ব্যক্তি কেন্দ্রিক হোক কিংবা গোষ্ঠি কেন্দ্রিক। অতএব হুকুমের সাথে যখন গ্রহণযোগ্য কোন কল্যাণের সম্পর্ক থাকবে না অথবা বিধানটি যখন কল্যাণ ও স্বার্থ বিরোধী দেখতে পাবে। তখন সে এটিকে এ কথার দলিল ও প্রমাণ হিসাবে জ্ঞান করবে যে এ বিধানটি শরয়ি কোন বিধান নয়। একে লোকেরা ব্যাখ্যা বা ইজতিহাদের মাধ্যমে শরীয়তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে’’। [ড. ইউসুফ আল কারযাভী, আল মারজাইয়্যাতুল উলইয়া ফিল ইসলাম। (পৃ:২৪০)।]

সুতরাং একজন ফকিহর জন্যে অবশ্যই সচেতনতা ও জ্ঞানের ব্যুৎপত্তি থাকতে হবে। মাকাসিদ সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা ও অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে হবে নিয়মিত। এ সম্বন্ধে ধারণার অপ্রতুলতা নিয়ে ইসলামের ওপর চলা ও ফতোয়া প্রদান করা এককথায় অসম্ভব। প্রাজ্ঞ আলেমে রববানীদের এ থেকে পিছিয়ে থাকার কোন সুযোগ নেই। কারণ এ সম্বন্ধে তাদের পিছিয়ে থাকার অর্থই হবে মাকাসিদুশ শরিয়া ও তার তাৎপর্যগুলো শরিয়ত অনুসারীদের থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। আর এরই মাধ্যমে ইসলামি ফিকহ সন্দেহযুক্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। ইসলাম বিদ্বেষীরা বলবে, ইসলামি শরিয়ত একটি অনগ্রসরমান, কঠিন, অহেতুক ও সেকেলে জীবন ব্যবস্থার নাম। যাতে মানব জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির কোন ধারা ও নিয়ম-নীতি নেই। মানুষের কল্যাণ সাধন এবং ক্ষতি প্রতিরোধের কোন বিধি-ব্যবস্থা নেই।

ফতোয়ার উদ্দেশ্য যখন শরয়ি বিধান ও বিধানকর্তার আদেশ-নিষেধ বাস্তবতার ওপর নিয়ে আসা এবং প্রত্যেক ফতোয়া তলবকারীর নিকট বিধানকর্তার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা ও প্রমাণিত করা। আর অবস্থার বিভিন্নতা ও সকল ফতোয়া তলবকারীর ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন থাকবে। তবে সে উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন রূপ অবস্থা ও ব্যক্তির ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হতে পারে। তাই প্রত্যেক ফতোয়া প্রদানকারীকে এক্ষেত্রে যথেষ্ট চিন্তা ও বিচক্ষণতার সাথে কাজ নিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে বিধানকর্তার উদ্দেশ্য যাতে ঠিক থাকে। অবস্থা ও ফতোয়া তলবকারীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ বিধি হচ্ছে ব্যক্তি ও অবস্থার বিভিন্নতায় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত থাকবে। পরিবর্তন হবে শুধুমাত্র ফতোয়া। আর এ পরিবর্তনটিও সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যেই।

এর উদহারণ যেমন আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা, যখন তাঁর নিকট জনৈক ব্যক্তি ফতোয়া চেয়েছিলেন এ মর্মে যে, হত্যাকারীর জন্য তওবার কোন সুযোগ আছে কি না?

ঘটনার বিবরণ হচ্ছে, হাদিসে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট এসে বলল, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মোমিনকে হত্যা করবে তার জন্যে তওবার সুযোগ আছে কি না? তিনি বললেন, না। জাহান্নাম ভিন্ন তার কোন গতি নেই। ওই ব্যক্তি চলে গেলে উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ইত:পূর্বে আমাদের এমনই ফতোয়া দিয়েছেন? আপনিতো আমাদের ফতোয়া দিয়েছেন যে, হত্যাকারীর তওবা গ্রহণযোগ্য। জবাবে ইবনে আববাস বললেন, আমি তাকে রাগান্বিত দেখতে পেয়েছি, সে কোন মোমিনকে হত্যা করতে চায়। বর্ণনাকারী বলেন, তখন তারা ওই ব্যক্তির পেছনে পেছনে একজনকে পাঠাল এবং তারা তাকে সেরূপই দেখতে পেল। [মুসান্নাফ ইবনু আবি শায়বা, কিতাবুদ দিয়াত, (৫/৪৩৫)]

তওবার প্রতি উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে বিধানকর্তার উদ্দেশ্য যখন মানুষের আত্মশুদ্ধি, তাদেরকে সত্য ও সৎ পথে প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং অন্যায় অপরাধের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে তা হতে তাদের বিরত রাখা। আর ওই ব্যক্তির উদ্দেশ্য ছিল তওবার সুযোগ গ্রহণ করে শরিয়ত প্রবর্তকের উদ্দেশ্যের বিপরীতে কাজ করা। তাই ইবনে আববাস রা. ফতোয়া দিলেন তার তওবার কোন সুযোগ নেই। হয়ত এ ফতোয়া তাকে তার পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখবে এবং সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে যা বিধানদাতার মূল উদ্দেশ্য। [ড. নোমান জোগায়ম,তুরুকুল কাশফ আন মাকাসিদিশ শারে।পৃ:৪৯]

এ উদাহরণ থেকে আমরা সুস্পষ্টরূপে জানতে পারি যে, মাকাসিদুশ শরিয়া তথা শরয়ি বিধানের তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা শরিয়ত অনুসারীকে বিভ্রান্তিতে নিপতিত করে। সুযোগ পেলেই তার ইমানকে নাড়িয়ে দেয়। তাই লোকদের মাঝে এ শাস্ত্রের প্রসার একান্ত জরুরী। ইলম পিপাসুদের উচিৎ এ বিদ্যা আহরণে তৎপর ও সক্রিয় হওয়া। যাতে কখনো তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিধানকর্তার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের বিপরীত ও সাঙ্ঘর্ষিক না হয়। কারণ মুকাল্লাফ তথা শরিয়ত অনুসারীর জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে তার উদ্দেশ্য শরিয়ত-প্রবর্তকের উদ্দেশ্যের অনুকূলে হওয়া।

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন