HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
শরিয়া বিধানের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
লেখকঃ ইকবাল হোসাইন মাসুম
৪
‘মাকাসিদুশ শরিয়া’ শেখার গুরুত্বমাকাসিদুশ শরিয়া সম্পর্কিত জ্ঞানের গুরুত্ব কত অপরিসীম, সর্বযুগের বিজ্ঞ ওলামা ও ইসলামি স্কলারদের ভূমিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই তা অতি সহজে অনুভূত হয়। তাঁরা এ বিষয়ে আলোচনা, পাঠদান, গবেষণা ইত্যাদি কর্মে চেষ্টা-শ্রমের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে যারপর নাই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর এ গুরুত্ব প্রদানের কারণগুলো লুকিয়ে আছে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে-
মাকাসিদুশ শরিয়াকে সাধারণ বৈশিষ্ট্যাবলীর সাথে সামঞ্জস্যবিধান করা যার মাধ্যমে ইসলামি শরীয়তের স্বাতন্ত্র ফুটে উঠবে, যে এটি আল্লাহ প্রদত্ত বিশ্বজনীন ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তবধর্মী জীবন বিধান তথা শরিয়ত যা সর্বকালে সর্বস্থানে বাস্তবায়নযোগ্য। [আল ইসলাম: মাকাসিদুহু ওয়াখাসাইসুহু। ড. মুহাম্মাদ আকলাহ । ( পৃ:১০০)]
ইসলামি শরিয়তজ্ঞ-বিজ্ঞ আলেমেদীনদের পরিপক্করূপে উপলদ্ধি করতে পারা, যে শরীয়তে ইসলামিয়ার তাবত উদ্ধৃতি ও আহকামের অর্থ ও উদ্দেশ্য অনুধাবনযোগ্য- যুক্তি ও প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং মুসলিম যদিও তার ওপর আরোপিত যাবতীয় বিধি-বিধান কোন দ্বিধা-সংকোচ ব্যতীত যথাযথ বিশ্বাস ও পরিপূর্ণ তুষ্টি সহকারে গ্রহণ করে নেয় এবং কল্যাণের পূর্ণ একিন ও আস্থার সাথে বাস্তবায়ন করে চলে। তবে এ নিঃশর্ত মেনে নেয়া ও বাস্তবায়ন করার অর্থ এ নয় যে, এ বিধান প্রবর্তনের হিকমত ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানা যাবে না, তার ভেদ ও রহস্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা নিষিদ্ধ। ‘‘কেননা শরীয়তের বিধি-বিধান প্রবর্তনের দ্বারা কিন্তু উক্ত বিধি-বিধানই মূল লক্ষ্য নয় বরং মূল লক্ষ্য অন্যটি, আর তা হচ্ছে তার অর্থ ও উদ্দেশ্য এবং সেসব কল্যাণ ও উপকারিতা যার জন্যে এসব বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে’’। [ইমাম শাতবী। আল মুওয়াফাকাত (২/৩৮৫)।] এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি হুকুমেরই একটি স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য আছে। যা কখনো সহজে বুঝে আসে কখনো বুঝা কঠিন মনে হয়। কেউ বুঝে; কেউ বুঝেনা আবার কখনো কখনো কেউই বুঝেনা; সকলের নিকটই অস্পষ্ট থাকে। এর অর্থ এই নয় যে এর কোন লক্ষ্য ও তাৎপর্য নেই বরং মূল কারণ হচ্ছে, মহান আল্লাহ হয়ত কোন হিকমতের কারণে অস্পষ্ট করে রেখেছেন বা তা হৃদয়াঙ্গম করতে আমাদের বিবেক-বুদ্ধি অপারগ। বুঝে না আসলে তার কোন কারণ ও তাৎপর্য নেই বলে ধারণা করা ঠিক নয়। অনুরূপভাবে তাৎপর্য ও কার্যকারণ জানলেই একমাত্র বাস্তবায়ন করব; না হলে নয়- এরূপ ধারণা করাও সঙ্গত নয়।
শরীয়তের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা অনুসন্ধান ও অন্বেষণ করা এমনই একটি বিষয় যা ফিৎরত তথা মানব প্রকৃতির সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। আর এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বুনিয়াদ যার ওপর এ দ্বীনে ইসলামির ভিত্তি রাখা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে:
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ﴿30﴾ ( الروم :30)
অতএব তুমি একনিষ্ঠ হয়ে দীনের জন্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর প্রকৃতি, যে প্রকৃতির ওপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সূরা আর-রূম (৩০)।]
ফিৎরত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে প্রকৃতি যার ওপর আল্লাহ নিজ বৈশিষ্ট্য দিয়ে মানুষদের সৃষ্টি করেছেন মানুষ হিসাবে। এ কথার সারাংশ হচ্ছে: মানুষ এমন এক সৃষ্টি যার বিবেক-বুদ্ধি আছে- যার মাধ্যমে সে প্রয়োজনীয় বিষয়ে ধারণা লাভ করতে পারে। তার ভেতর সভ্যতা-সংস্কৃতির স্বভাব বিদ্যমান। তার রয়েছে এবাদত-আনুগত্য করার ক্ষমতা। সে সৃজিত হয়েছে এমন অনুভূতি দিয়ে যার সাহায্যে সে দৃশ্য ও শ্রবণযোগ্য বিষয় অনুধাবন করতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে সকল বিষয়ের মর্ম ও তত্ত্বব অনুসন্ধানের প্রবণতা। তাইতো প্রত্যেক আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধানের পিছনে কী রহস্য ও তাৎপর্য রয়েছে সে বিষয়ে জানতে ইসলামি শরিয়ত তার অনুগামীদের উৎসাহিত করেছে। এ কারণেই আমরা এমন অনেক শরয়ি বিধান দেখতে পাই যেগুলো বিধানকর্তার পক্ষ থেকে যুক্তিযুক্ত করেই প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিধান প্রবর্তনের সাথে সাথে কারণ ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে।
যেমন সালাতের বিধান প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ﴿45﴾( العنكبوت :45)
তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত কর এবং সালাত কায়েম করা। নিশ্চয় সালাম অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা কর। [সূরা আনকাবূত: (৪৫)।]
সিয়াম প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿183﴾ ( البقرة :183)
হে মোমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। [সূরা বাকারা: (১৮৩)।]
জাকাত সম্পর্কে বলেন:
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿103﴾ ( التوبة :103)
তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্যে দো‘আ কর, নিশ্চয় তোমার দো‘আ তাদের জন্যে প্রশান্তিদায়ক। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। [সূরা তাওবা (১০৩)।]
কিসাস সম্পর্কে বলা হয়েছে:
وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿179﴾ ( البقرة : 179)
হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্যে জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে। [সূরা বাকারা: (১৭৯)।]
মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ করণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ ﴿91﴾ ) المائدة :91 )
শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না? [সূরা মায়েদা: (৯১)।]
আমরা দেখলাম ইসলামি শরীয়তের আদেশ ও নিষেধগুলো যুক্তিনির্ভর, অযৌক্তিক বা অহেতুক কোন বিধান শরিয়ত অনুসারীদের ওপর আরোপ করা হয়নি। হ্যাঁ, সে কারণগুলো কখনো বুঝে আসে কখনো আসেনা, আবার বিধানকর্তার পক্ষ হতে কোন কোন ক্ষেত্রে বর্ণনা করা হয়েছে আবার কোথাও কোথাও কিছুই বলা হয়নি। এখন যদি কার্যকারণ বা যৌক্তিকতা বুঝে না আসে কিংবা এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা ও বর্ণনা পাওয়া না যায়, তাহলে এর অর্থ এই নয় যে, এ বিধানটি অযৌক্তিক বা এর পিছনে কোন কারণ নেই।
সুতরাং ইসলামি শরিয়ত স্বেচ্ছাচারী ও বল প্রয়োগকারী কোন বিধান নয়। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যবিহীন কতগুলো আদেশ নিষেধের সমষ্টিও নয়। অন্য ভাষায়, জমহুর ওলামার মতে ইসলামি শরীয়তের সবগুলো বিধানই যুক্তিনির্ভর। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৬)।] তার প্রতিটি বিধানেরই নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। আর এ সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামষ্টিকভাবে যুক্তিনির্ভর ও বোধগোম্য বরং কিছু কিছু আনুষঙ্গিক ব্যতিক্রম ছাড়া বিশদভাবেই যুক্তিনির্ভর ও বোধগোম্য। যেমন এবাদত ও আহকামের সংখ্যা, আঙ্গিক, স্বরূপ ইত্যাদি- যার জ্ঞান মহান আল্লাহ নিজ পর্যন্তই সীমিত রেখেছেন এবং যা ব্যাখ্যা করাও কঠিন ও প্রায় অসম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ সালাতের সংখ্যা, প্রত্যেক সালাতের রাকআতের সংখ্যা, সওমকে কেন এক মাস নির্দিষ্ট করা হল অনুরূপভাবে বিভিন্ন কাফ্ফারা, শাস্তি ও দন্ড ইত্যাদি। এসব বিষয় আল্লাহর বিধান হিসাবে আমরা পালন করব। যদিও এর কার্যকারণ ও যৌক্তিকতার ধারণা আমাদের না থাকে। তবে হ্যাঁ, বাস্তবিকতার নিরিখে এগুলোর ব্যাখ্যা কঠিন হলেও বিষয়গুলো কিন্তু অযৌক্তিক ও অহেতুক নয়। বরং যৌক্তিক ও উদ্দেশ্যনির্ভর।
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ‘‘এক কথায় এবাদত ও বিভিন্ন বিধি-বিধান প্রবর্তনের ভেতর বিধানকর্তা আল্লাহ তাআলার অবশ্যই কিছু লক্ষ্য আছে এবং সেসব বিধানেরও নির্দিষ্ট কিছু তাৎপর্য আছে, যার ব্যাখ্যা বিশদভাবে অনুধাবন করা মানব মস্তিষ্কের দ্বারা অসম্ভব হলেও সামষ্টিক ও সংক্ষিপ্তাকারে সম্ভব’’। [ই’লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন:(২/৮৮)।]
পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ‘মাকাসিদুশ শরিয়া-এর ইলম’ বা -শরয়ি বিধি-বিধান প্রবর্তনের তাৎপর্য সংক্রান্ত জ্ঞান- এর গুরুত্বের কথা অবলীলায় স্বীকার করেছেন। ইসলামি শরীয়তের সকল বিধি-বিধান শরিয়ত অনুসারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নানাবিধ কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে প্রবর্তিত হয়েছে মর্মে তাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট আকারে ব্যক্ত করেছেন।
ইমাম শাতেবি রহ. বলেন, ‘‘যখন প্রমাণিত হল যে, শরিয়ত প্রবর্তনের দ্বারা (প্রবর্তক) বিধানকর্তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইহকালীন ও পরকালীন স্বার্থ সংরক্ষণ করা, কল্যাণ নিশ্চিৎ করা, আর এটি এমনভাবে, যাতে নিয়ম-শৃংখলাতে কোনরূপ বিঘ্নতা সৃষ্টি না হয়; না পূর্ণাঙ্গরূপে না আনুষঙ্গিকরূপে। তাই এর প্রবর্তনটি এমন হওয়া চাই যা হবে চিরন্তন, পরিপূর্ণ ও ব্যাপকভিত্তিক, যা সর্বকালে, সর্বাবস্থায় সকল অনুসারীর জন্য সহজ হয়। আর ইসলামি শরিয়ত ও তার সকল বিধি-বিধানকে আমরা যখন এমনই পেলাম তাই সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্যে। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৩৭)।]
তিনি আরও বলেন:‘‘শরীয়তের প্রবর্তন শুধুমাত্র বান্দাদের নগদ ও ভবিষ্যৎ উভয় উপকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশেই হয়েছে’’। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৬)।]
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ‘‘শরীয়তে ইসলামিয়ার ভিত্তি ও বুনিয়াদ হচ্ছে অনেকগুলো হিকমত ও বান্দাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের ওপর। এটি সর্বোতভাবেই ইনসাফ, অনুগ্রহ ও তাৎপর্যময়। সুতরাং যে বিধানটি ইনসাফ থেকে বের হয়ে জুলম, রহমত থেকে বের হয়ে এর বিপরীত, কল্যাণ থেকে বের হয়ে অকল্যাণ এবং তাৎপর্যময়তা থেকে বের হয়ে অহেতুক ও লক্ষ্যহীন বলে বিবেচিত হবে সেটি শরীয়তের অন্তর্গত নয়, যদিও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সাপেক্ষে তার অন্তর্ভূক্ত ধরা হয়’’। [ই’লামুল মুওয়াকি‘ঈন (৩/৩)।]
ড. আব্দুল করিম যায়দান বলেন, ‘‘এখান থেকে আমরা দেখতে পাই যে, শরীয়তের প্রধান লক্ষ্যই হল বান্দার কল্যাণ ও স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের থেকে অকল্যাণ ও বিশৃংখলা বিদুরণ। আর এর মাধ্যমেই তাদের ইহকালীন ও পরকালীন উন্নতি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে। [আব্দুল করীম যায়দান: উসূলুদ দাওয়াহ (পৃ:২৯০)।]
যারা শরয়ি বিধানের যৌক্তিকতা, উদ্দেশ্যনিষ্ঠতা ও কল্যাণময়তার কথা অস্বীকার করে বলে, শরিয়ত হচ্ছে বিধানকর্তার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা ও চাপিয়ে দেয়া কিছু বিধি-নিষেধের নাম, তাদের এ অসার বক্তব্য খন্ডন করে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘‘এটি একটি অসার ধারণা মাত্র যা সুন্নাহ ও কল্যাণময় যুগত্রয়ের ইজমা দ্বারা প্রত্যাখ্যাত’’। [হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ (১/৫০)।]
শরয়ি বিধি-বিধানের তাৎপর্য ও কল্যাণময়তার এসব গুরুত্ব ও আবশ্যিকতার কথা বিবেচনা করে বিজ্ঞ শরিয়তবিদ, ইসলামি আইনজ্ঞ ও গবেষকগণ যারপর নাই পরিশ্রম ও গবেষণা করে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন কিংবা ফিকাহ বা উসূলে ফিকাহর কিতাবসমূহে স্বতন্ত্র অধ্যায় সংযোজন করেছেন। শরয়ি আহকামের তাত্ত্বিবক দিক বিশ্লেষণে দিনের পর দিন গবেষণাকর্ম চালিয়ে গিয়েছেন বিরামহীনভাবে। এক পর্যায়ে এসে এটি একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করেছে। মাকাসিদুশ শরিয়ার জ্ঞানের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা ইমাম শাতবী রহ. এর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকেও প্রতীয়মান। তিনি বলেন, একজন মুফতির পক্ষে ফতোয়া প্রদান বৈধ হওয়ার জন্যে শর্ত হচ্ছে, তার শরয়ি বিধি-বিধানের যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য সম্পর্কিত জ্ঞান পূর্ণাঙ্গরূপে থাকতে হবে। অন্যথায় তার পক্ষে ফতোয়া দেয়া বৈধ নয়। [দেখুন, আল-মুওয়াফাকাত (৪/১০৫) এবং আল-ইজতিহাদ, ড. নাদিয়া আল উমরী (পৃ:৯৬)।]
হ্যাঁ, মাকাসিদুশ শরিয়া তথা শরয়ি বিধি-বিধানের লক্ষ্য ও তাৎপর্য সবগুলোই অকাট্য ও সুস্পষ্ট। তবে কোন আনুষঙ্গিক বিষয়ে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ওলামাদের পারস্পরিক মতভিন্নতা এ সুস্পষ্টতার পরিপন্থী নয়। উদ্দেশ্য অকাট্য ও সুস্পষ্ট বলে তাদের সব মতবিরোধ উঠে যাবে, এমনটি জরুরি নয়।
যেমন: আল্লাহর দীন সহজ হওয়া আর ইসলামি শরীয়তের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে তাইসির তথা সহজ করা। এটি একটি স্বতসিদ্ধ ও অকাট্য বিষয়। এ ব্যাপারে সকলেই একমত, কোন ভিন্নমত নেই। তবে এ মূলনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক বিষয়েও সর্বাবস্থায় ওই অকাট্যতার গুণ পাওয়া যাবে, এমনটি সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে শরিয়তবিদদের মাঝে একটি বিষয়ে অবশ্যই মতানৈক্য হবে, তা হচ্ছে, সেই জটিলতা ও সমস্যাটি কি যার চাহিদা হচ্ছে তাইসির বা সহজীকরণ এবং সেটিই বা কি যা ওই তাইসির চায় না?
ইসলামি শরীয়তের বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য্য ও তার মনোমুগ্ধকর রহস্যাবলী প্রকাশার্থে মাকাসিদুশ শরিয়া বিষয়ে পঠন ও পাঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
একজন ফকিহ প্রকৃত অর্থে ততক্ষণ পর্যন্ত ফকিহ বলে স্বীকৃত হবে না যতক্ষণ না সে মাকাসিদুশ শরিয়া সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন করে ব্যুৎপত্তি অর্জন করবে। শরীয়তের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য এবং তার ভারসাম্যপূর্ণ নীতি সম্পর্কে নিজে অবহিত হয়ে অপর লোকদের অবগত করাতে পারবে, কিসে তাদের কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ, কোথায় তাদের উপকার, কোথায় ক্ষতি- মর্মে লোকদের সতর্ক করে একজন শরিয়তজ্ঞ হিসাবে নিজ দায়িত্ব পরিপূর্ণরূপে পালন করতে সক্ষম হবে।
মাকাসিদুশ শরিয়াকে সাধারণ বৈশিষ্ট্যাবলীর সাথে সামঞ্জস্যবিধান করা যার মাধ্যমে ইসলামি শরীয়তের স্বাতন্ত্র ফুটে উঠবে, যে এটি আল্লাহ প্রদত্ত বিশ্বজনীন ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তবধর্মী জীবন বিধান তথা শরিয়ত যা সর্বকালে সর্বস্থানে বাস্তবায়নযোগ্য। [আল ইসলাম: মাকাসিদুহু ওয়াখাসাইসুহু। ড. মুহাম্মাদ আকলাহ । ( পৃ:১০০)]
ইসলামি শরিয়তজ্ঞ-বিজ্ঞ আলেমেদীনদের পরিপক্করূপে উপলদ্ধি করতে পারা, যে শরীয়তে ইসলামিয়ার তাবত উদ্ধৃতি ও আহকামের অর্থ ও উদ্দেশ্য অনুধাবনযোগ্য- যুক্তি ও প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং মুসলিম যদিও তার ওপর আরোপিত যাবতীয় বিধি-বিধান কোন দ্বিধা-সংকোচ ব্যতীত যথাযথ বিশ্বাস ও পরিপূর্ণ তুষ্টি সহকারে গ্রহণ করে নেয় এবং কল্যাণের পূর্ণ একিন ও আস্থার সাথে বাস্তবায়ন করে চলে। তবে এ নিঃশর্ত মেনে নেয়া ও বাস্তবায়ন করার অর্থ এ নয় যে, এ বিধান প্রবর্তনের হিকমত ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানা যাবে না, তার ভেদ ও রহস্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা নিষিদ্ধ। ‘‘কেননা শরীয়তের বিধি-বিধান প্রবর্তনের দ্বারা কিন্তু উক্ত বিধি-বিধানই মূল লক্ষ্য নয় বরং মূল লক্ষ্য অন্যটি, আর তা হচ্ছে তার অর্থ ও উদ্দেশ্য এবং সেসব কল্যাণ ও উপকারিতা যার জন্যে এসব বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে’’। [ইমাম শাতবী। আল মুওয়াফাকাত (২/৩৮৫)।] এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি হুকুমেরই একটি স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য আছে। যা কখনো সহজে বুঝে আসে কখনো বুঝা কঠিন মনে হয়। কেউ বুঝে; কেউ বুঝেনা আবার কখনো কখনো কেউই বুঝেনা; সকলের নিকটই অস্পষ্ট থাকে। এর অর্থ এই নয় যে এর কোন লক্ষ্য ও তাৎপর্য নেই বরং মূল কারণ হচ্ছে, মহান আল্লাহ হয়ত কোন হিকমতের কারণে অস্পষ্ট করে রেখেছেন বা তা হৃদয়াঙ্গম করতে আমাদের বিবেক-বুদ্ধি অপারগ। বুঝে না আসলে তার কোন কারণ ও তাৎপর্য নেই বলে ধারণা করা ঠিক নয়। অনুরূপভাবে তাৎপর্য ও কার্যকারণ জানলেই একমাত্র বাস্তবায়ন করব; না হলে নয়- এরূপ ধারণা করাও সঙ্গত নয়।
শরীয়তের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা অনুসন্ধান ও অন্বেষণ করা এমনই একটি বিষয় যা ফিৎরত তথা মানব প্রকৃতির সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। আর এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বুনিয়াদ যার ওপর এ দ্বীনে ইসলামির ভিত্তি রাখা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে:
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ﴿30﴾ ( الروم :30)
অতএব তুমি একনিষ্ঠ হয়ে দীনের জন্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর প্রকৃতি, যে প্রকৃতির ওপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সূরা আর-রূম (৩০)।]
ফিৎরত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে প্রকৃতি যার ওপর আল্লাহ নিজ বৈশিষ্ট্য দিয়ে মানুষদের সৃষ্টি করেছেন মানুষ হিসাবে। এ কথার সারাংশ হচ্ছে: মানুষ এমন এক সৃষ্টি যার বিবেক-বুদ্ধি আছে- যার মাধ্যমে সে প্রয়োজনীয় বিষয়ে ধারণা লাভ করতে পারে। তার ভেতর সভ্যতা-সংস্কৃতির স্বভাব বিদ্যমান। তার রয়েছে এবাদত-আনুগত্য করার ক্ষমতা। সে সৃজিত হয়েছে এমন অনুভূতি দিয়ে যার সাহায্যে সে দৃশ্য ও শ্রবণযোগ্য বিষয় অনুধাবন করতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে সকল বিষয়ের মর্ম ও তত্ত্বব অনুসন্ধানের প্রবণতা। তাইতো প্রত্যেক আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধানের পিছনে কী রহস্য ও তাৎপর্য রয়েছে সে বিষয়ে জানতে ইসলামি শরিয়ত তার অনুগামীদের উৎসাহিত করেছে। এ কারণেই আমরা এমন অনেক শরয়ি বিধান দেখতে পাই যেগুলো বিধানকর্তার পক্ষ থেকে যুক্তিযুক্ত করেই প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিধান প্রবর্তনের সাথে সাথে কারণ ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে।
যেমন সালাতের বিধান প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ﴿45﴾( العنكبوت :45)
তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত কর এবং সালাত কায়েম করা। নিশ্চয় সালাম অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা কর। [সূরা আনকাবূত: (৪৫)।]
সিয়াম প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿183﴾ ( البقرة :183)
হে মোমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। [সূরা বাকারা: (১৮৩)।]
জাকাত সম্পর্কে বলেন:
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿103﴾ ( التوبة :103)
তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্যে দো‘আ কর, নিশ্চয় তোমার দো‘আ তাদের জন্যে প্রশান্তিদায়ক। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। [সূরা তাওবা (১০৩)।]
কিসাস সম্পর্কে বলা হয়েছে:
وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿179﴾ ( البقرة : 179)
হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্যে জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে। [সূরা বাকারা: (১৭৯)।]
মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ করণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ ﴿91﴾ ) المائدة :91 )
শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না? [সূরা মায়েদা: (৯১)।]
আমরা দেখলাম ইসলামি শরীয়তের আদেশ ও নিষেধগুলো যুক্তিনির্ভর, অযৌক্তিক বা অহেতুক কোন বিধান শরিয়ত অনুসারীদের ওপর আরোপ করা হয়নি। হ্যাঁ, সে কারণগুলো কখনো বুঝে আসে কখনো আসেনা, আবার বিধানকর্তার পক্ষ হতে কোন কোন ক্ষেত্রে বর্ণনা করা হয়েছে আবার কোথাও কোথাও কিছুই বলা হয়নি। এখন যদি কার্যকারণ বা যৌক্তিকতা বুঝে না আসে কিংবা এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা ও বর্ণনা পাওয়া না যায়, তাহলে এর অর্থ এই নয় যে, এ বিধানটি অযৌক্তিক বা এর পিছনে কোন কারণ নেই।
সুতরাং ইসলামি শরিয়ত স্বেচ্ছাচারী ও বল প্রয়োগকারী কোন বিধান নয়। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যবিহীন কতগুলো আদেশ নিষেধের সমষ্টিও নয়। অন্য ভাষায়, জমহুর ওলামার মতে ইসলামি শরীয়তের সবগুলো বিধানই যুক্তিনির্ভর। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৬)।] তার প্রতিটি বিধানেরই নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। আর এ সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামষ্টিকভাবে যুক্তিনির্ভর ও বোধগোম্য বরং কিছু কিছু আনুষঙ্গিক ব্যতিক্রম ছাড়া বিশদভাবেই যুক্তিনির্ভর ও বোধগোম্য। যেমন এবাদত ও আহকামের সংখ্যা, আঙ্গিক, স্বরূপ ইত্যাদি- যার জ্ঞান মহান আল্লাহ নিজ পর্যন্তই সীমিত রেখেছেন এবং যা ব্যাখ্যা করাও কঠিন ও প্রায় অসম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ সালাতের সংখ্যা, প্রত্যেক সালাতের রাকআতের সংখ্যা, সওমকে কেন এক মাস নির্দিষ্ট করা হল অনুরূপভাবে বিভিন্ন কাফ্ফারা, শাস্তি ও দন্ড ইত্যাদি। এসব বিষয় আল্লাহর বিধান হিসাবে আমরা পালন করব। যদিও এর কার্যকারণ ও যৌক্তিকতার ধারণা আমাদের না থাকে। তবে হ্যাঁ, বাস্তবিকতার নিরিখে এগুলোর ব্যাখ্যা কঠিন হলেও বিষয়গুলো কিন্তু অযৌক্তিক ও অহেতুক নয়। বরং যৌক্তিক ও উদ্দেশ্যনির্ভর।
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ‘‘এক কথায় এবাদত ও বিভিন্ন বিধি-বিধান প্রবর্তনের ভেতর বিধানকর্তা আল্লাহ তাআলার অবশ্যই কিছু লক্ষ্য আছে এবং সেসব বিধানেরও নির্দিষ্ট কিছু তাৎপর্য আছে, যার ব্যাখ্যা বিশদভাবে অনুধাবন করা মানব মস্তিষ্কের দ্বারা অসম্ভব হলেও সামষ্টিক ও সংক্ষিপ্তাকারে সম্ভব’’। [ই’লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন:(২/৮৮)।]
পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ‘মাকাসিদুশ শরিয়া-এর ইলম’ বা -শরয়ি বিধি-বিধান প্রবর্তনের তাৎপর্য সংক্রান্ত জ্ঞান- এর গুরুত্বের কথা অবলীলায় স্বীকার করেছেন। ইসলামি শরীয়তের সকল বিধি-বিধান শরিয়ত অনুসারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নানাবিধ কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে প্রবর্তিত হয়েছে মর্মে তাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট আকারে ব্যক্ত করেছেন।
ইমাম শাতেবি রহ. বলেন, ‘‘যখন প্রমাণিত হল যে, শরিয়ত প্রবর্তনের দ্বারা (প্রবর্তক) বিধানকর্তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইহকালীন ও পরকালীন স্বার্থ সংরক্ষণ করা, কল্যাণ নিশ্চিৎ করা, আর এটি এমনভাবে, যাতে নিয়ম-শৃংখলাতে কোনরূপ বিঘ্নতা সৃষ্টি না হয়; না পূর্ণাঙ্গরূপে না আনুষঙ্গিকরূপে। তাই এর প্রবর্তনটি এমন হওয়া চাই যা হবে চিরন্তন, পরিপূর্ণ ও ব্যাপকভিত্তিক, যা সর্বকালে, সর্বাবস্থায় সকল অনুসারীর জন্য সহজ হয়। আর ইসলামি শরিয়ত ও তার সকল বিধি-বিধানকে আমরা যখন এমনই পেলাম তাই সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্যে। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৩৭)।]
তিনি আরও বলেন:‘‘শরীয়তের প্রবর্তন শুধুমাত্র বান্দাদের নগদ ও ভবিষ্যৎ উভয় উপকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশেই হয়েছে’’। [আল-মুওয়াফাকাত (২/৬)।]
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ‘‘শরীয়তে ইসলামিয়ার ভিত্তি ও বুনিয়াদ হচ্ছে অনেকগুলো হিকমত ও বান্দাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের ওপর। এটি সর্বোতভাবেই ইনসাফ, অনুগ্রহ ও তাৎপর্যময়। সুতরাং যে বিধানটি ইনসাফ থেকে বের হয়ে জুলম, রহমত থেকে বের হয়ে এর বিপরীত, কল্যাণ থেকে বের হয়ে অকল্যাণ এবং তাৎপর্যময়তা থেকে বের হয়ে অহেতুক ও লক্ষ্যহীন বলে বিবেচিত হবে সেটি শরীয়তের অন্তর্গত নয়, যদিও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সাপেক্ষে তার অন্তর্ভূক্ত ধরা হয়’’। [ই’লামুল মুওয়াকি‘ঈন (৩/৩)।]
ড. আব্দুল করিম যায়দান বলেন, ‘‘এখান থেকে আমরা দেখতে পাই যে, শরীয়তের প্রধান লক্ষ্যই হল বান্দার কল্যাণ ও স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের থেকে অকল্যাণ ও বিশৃংখলা বিদুরণ। আর এর মাধ্যমেই তাদের ইহকালীন ও পরকালীন উন্নতি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে। [আব্দুল করীম যায়দান: উসূলুদ দাওয়াহ (পৃ:২৯০)।]
যারা শরয়ি বিধানের যৌক্তিকতা, উদ্দেশ্যনিষ্ঠতা ও কল্যাণময়তার কথা অস্বীকার করে বলে, শরিয়ত হচ্ছে বিধানকর্তার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা ও চাপিয়ে দেয়া কিছু বিধি-নিষেধের নাম, তাদের এ অসার বক্তব্য খন্ডন করে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘‘এটি একটি অসার ধারণা মাত্র যা সুন্নাহ ও কল্যাণময় যুগত্রয়ের ইজমা দ্বারা প্রত্যাখ্যাত’’। [হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ (১/৫০)।]
শরয়ি বিধি-বিধানের তাৎপর্য ও কল্যাণময়তার এসব গুরুত্ব ও আবশ্যিকতার কথা বিবেচনা করে বিজ্ঞ শরিয়তবিদ, ইসলামি আইনজ্ঞ ও গবেষকগণ যারপর নাই পরিশ্রম ও গবেষণা করে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন কিংবা ফিকাহ বা উসূলে ফিকাহর কিতাবসমূহে স্বতন্ত্র অধ্যায় সংযোজন করেছেন। শরয়ি আহকামের তাত্ত্বিবক দিক বিশ্লেষণে দিনের পর দিন গবেষণাকর্ম চালিয়ে গিয়েছেন বিরামহীনভাবে। এক পর্যায়ে এসে এটি একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করেছে। মাকাসিদুশ শরিয়ার জ্ঞানের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা ইমাম শাতবী রহ. এর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকেও প্রতীয়মান। তিনি বলেন, একজন মুফতির পক্ষে ফতোয়া প্রদান বৈধ হওয়ার জন্যে শর্ত হচ্ছে, তার শরয়ি বিধি-বিধানের যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য সম্পর্কিত জ্ঞান পূর্ণাঙ্গরূপে থাকতে হবে। অন্যথায় তার পক্ষে ফতোয়া দেয়া বৈধ নয়। [দেখুন, আল-মুওয়াফাকাত (৪/১০৫) এবং আল-ইজতিহাদ, ড. নাদিয়া আল উমরী (পৃ:৯৬)।]
হ্যাঁ, মাকাসিদুশ শরিয়া তথা শরয়ি বিধি-বিধানের লক্ষ্য ও তাৎপর্য সবগুলোই অকাট্য ও সুস্পষ্ট। তবে কোন আনুষঙ্গিক বিষয়ে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ওলামাদের পারস্পরিক মতভিন্নতা এ সুস্পষ্টতার পরিপন্থী নয়। উদ্দেশ্য অকাট্য ও সুস্পষ্ট বলে তাদের সব মতবিরোধ উঠে যাবে, এমনটি জরুরি নয়।
যেমন: আল্লাহর দীন সহজ হওয়া আর ইসলামি শরীয়তের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে তাইসির তথা সহজ করা। এটি একটি স্বতসিদ্ধ ও অকাট্য বিষয়। এ ব্যাপারে সকলেই একমত, কোন ভিন্নমত নেই। তবে এ মূলনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক বিষয়েও সর্বাবস্থায় ওই অকাট্যতার গুণ পাওয়া যাবে, এমনটি সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে শরিয়তবিদদের মাঝে একটি বিষয়ে অবশ্যই মতানৈক্য হবে, তা হচ্ছে, সেই জটিলতা ও সমস্যাটি কি যার চাহিদা হচ্ছে তাইসির বা সহজীকরণ এবং সেটিই বা কি যা ওই তাইসির চায় না?
ইসলামি শরীয়তের বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য্য ও তার মনোমুগ্ধকর রহস্যাবলী প্রকাশার্থে মাকাসিদুশ শরিয়া বিষয়ে পঠন ও পাঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
একজন ফকিহ প্রকৃত অর্থে ততক্ষণ পর্যন্ত ফকিহ বলে স্বীকৃত হবে না যতক্ষণ না সে মাকাসিদুশ শরিয়া সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন করে ব্যুৎপত্তি অর্জন করবে। শরীয়তের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য এবং তার ভারসাম্যপূর্ণ নীতি সম্পর্কে নিজে অবহিত হয়ে অপর লোকদের অবগত করাতে পারবে, কিসে তাদের কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ, কোথায় তাদের উপকার, কোথায় ক্ষতি- মর্মে লোকদের সতর্ক করে একজন শরিয়তজ্ঞ হিসাবে নিজ দায়িত্ব পরিপূর্ণরূপে পালন করতে সক্ষম হবে।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন