HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

দু’টি সাক্ষী (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) এর অর্থ ও তাদের প্রত্যেকের জরুরী বিষয়

লেখকঃ মাননীয় শাইখ আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুর রাহমান ইবন জিবরীন

চতুর্থ অধ্যায়: (মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল) সাক্ষীর অর্থ সম্পর্কে।
তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য একসঙ্গে উচ্চারণ করার নাম যেহেতু شهادة এবং তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য যেহেতু পরস্পর এমনভাবে সংযুক্ত যে, একটি অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না, তাই যে ব্যক্তি উল্লেখিত দু’টি সাক্ষ্য দিবে তার উপর শাহাদাত শব্দটির অর্থ জানা আবশ্যক, এর মর্মার্থকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা এবং জীবনে ও চলার পথে তা বাস্তবায়ন করা ওয়াজিব। প্রিয় পাঠক আপনি যখন জানলেন যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দ্বারা শুধু জবানের উচ্চারণ উদ্দেশ্য নয়, তখন উহার সঙ্গে যুক্ত বাক্য (মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল) এর ব্যাপারেও অনুরূপ কথা প্রযোজ্য। বরং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বিশ্বাস করা এবং তার অর্থ ও দাবিকে আঁকড়ে ধরা জরুরি। অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস করা যে, তিনি তাঁর মহান প্রভুর পক্ষ হতে প্রেরিত হয়েছেন। ইসলামী শরীয়তকে রেসালাত হিসাবে তাঁর উপর অর্পন করেছেন এবং উম্মতের নিকট তা পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব সোপর্দ করেছেন। সেই সঙ্গে সমস্ত জাতির উপর তাঁর রেসালাত কবুল করে নেয়া ও তাঁর পথে চলা আবশ্যক করেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে কয়েকটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে তাঁর অনুসরণ করা, যথাযথভাবে রেসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা এবং এর দ্বারা উপকৃত হওয়া যাবে। বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

প্রথম বিষয়:এই রেসালাতের জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই উপযুক্ত হওয়া।আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,আর তোমার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং মনোনীত করেন।সূরা কাসাস, আয়াত: ৬৮আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,“আল্লাহ্ এ বিষয়ে সুপরিজ্ঞাত যে, কোথায় স্বীয় রেসালাত প্রেরণ করতে হবে”।সূরা আনআম, আয়াত: ১২৪আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,“নিশ্চয়ই তারা ছিল আমার মনোনিত ও উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত”।সূরা সোয়াদ, আয়াত: ৪৭

এ ধরণের অন্যান্য আয়াতসমূহ যা আমাদের জানাচ্ছে যে, আল্লাহর রাসূলগণ মানুষ জাতির অন্তর্ভূক্ত, যাদেরক আল্লাহ তাআলা মর্যাদাবান, মনোনীত ও পবিত্র করেছেন, ফলে তারা তার রেসালাত বহন করার উপযুক্ত হয়েছেন। আর তার শরীয়ত ও দীনের জন্য বিশ্বস্ত এবং তার মাঝে ও তাঁর বান্দাদের মধ্যস্থতাকারী হয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা কতিপয় জাতির কথা উল্লেখ করেছেন, যারা তাদের রাসূলগণকে মিথ্যুক বলেছিল। তারা তাদের রাসূলগণকে বলেছিল, إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا “তোমরা তো কেবল আমাদের মতোই মানুষ”।সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১০তখন রাসূলদের জবাব ছিল তারা বলল, إِنْ نَحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ “আমরা তোমাদের মতো মানুষ, কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার ওপর অনুগ্রহ করেন”।সূরা ইবরাহীম: আয়াত: ১১আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সর্বশেষ ও সর্বোত্তম নবী, আর আল্লাহ তাঁকে এমন কিছু দ্বারা বিশেষিত করেছেন যা তাঁর পূর্বে অন্য কারো জন্য হাসিল হয়নি, তাই নিঃসন্দেহে তিনি এই বিশেষ মনোনয়ন ও নির্বাচনের বড় অংশীদার, যার কারণে তিনি সমগ্র মাখলুক জিন ওইনসানের নিকট প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ “নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের উপর রয়েছো”।সূরা কালাম, আয়াত: ৪সহীহ মুসলিমে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, كان خلقه القرآن “তাঁর চরিত্র ছিল কুরআন”।অর্থাৎ কুরআনের মধ্যে যেসব মহান চারিত্রিক গুণাবলী ও সর্বোত্তম আমল রয়েছে এবং যার সৌন্দর্য ও যথার্থতার ব্যাপারে প্রত্যেক বিবেকবান সাক্ষ্য প্রদান করেন, তিনি তা বাস্তবায়ন করতেন। তাঁর উপর অহী নাযিল হওয়ার আগেও তিনি বিশ্বস্থতা, সত্যবাদিতা, ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষা করা চারিত্রিক পবিত্রতাসহ অন্যান্য উন্নত গুণের বিরাট অংশের অধিকারী ছিলেন, যে কারণে মক্কার লোকেরা তাকে الصادق الأمين বা সত্যবাদি বিশ্বস্ত বলেই জানত। নবুওয়াতের পরে উক্ত চারিত্রিক গুণাবলী তাঁর মধ্যে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সুদৃঢ় হয়েছে। তিনি ভদ্রতা, বদান্যতা, সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা, মানবতা, কৃতজ্ঞতা, ন্যায়পরায়নতা, চারিত্রিক পবিত্রতা, বিনয়-নম্রতা, বীরত্ব এবং অনুরূপ অন্যান্য উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা অলংকৃত ছিলেন। সীরাতে নববী ও ইতিহাসের কিতাবগুলোতে তাঁর এই উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর অনেক দৃষ্টান্ত লিখিত রয়েছে। দৃশ্যমান জিনিসের অস্থিত্ব অস্বীকারকারী ব্যতীত কেউ তাঁর মহান চারিত্রিক গুণাবলীতে মতভেদ করতে পারে না।

অনুরূপ তিনি কৃপণতা, লোভ, যুলুম, অত্যাচার, অহংকার, মিথ্যাবাদিতা, কাপুরুষতা, অপারগতা, অলসতা, চুরি এবং বিশ্বাসঘাতকতাসহ অন্যান্য ঐসব দোষ-ত্রুটি এবং নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে মুক্ত ছিলেন, যা মানুষের ভারত্ব নষ্ট করে ফেলে, মানবতা দূর করে দেয় এবং যাতে বিশেষিত মানুষ ঘৃণ্য ও নিকৃষ্টে পরিণত হয়।

দ্বিতীয় বিষয়:ভুল-ত্রুটি থেকে তার নিষ্পাপ হওয়া:

উম্মত একমত যে, নবীগণ কবীরা গুনাহ থেকে মা’সুম ও মুক্ত। কেননা কবীরা গুনাহ নবুওয়াতের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পরিপন্থি। অধিকন্তু আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাঁর রেসালাতের দায়িত্ব দিয়ে মানব জাতির নিকট পাঠিয়েছেন। তাই তাদের জন্য জাতির সামনে আদর্শ হওয়া আবশ্যক। সেই সঙ্গে তিনি তাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন তারা যেন মানুষকে কুফুরী, গুনাহ, আনুগত্যহীনতা ও পাপাচার থেকে সতর্ক করেন। যদি তাদের থেকে এসব অন্যায় ও পাপাচার প্রকাশিত হয়, তাহলে শত্রুরা তাদের দোষ-ত্রুটি ধরার সুযোগ পেয়ে যেতো এবং তাদের শরীয়তকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অযুহাত পেতো। আর এটি আল্লাহর হেকমতের বিপরীত। তাই আল্লাহ তাআলা স্বীয় রহমতে তাদেরকে এসব অন্যায় আচরণ থেকে হেফাযত করেছেন এবং তা থেকে মানুষকে নিষেধ করা ও এর ভয়াবহ পরিণতির কথা বর্ণনা করার দায়িত্ব তাদেরকে দিয়েছেন। যেমন তাদেরকে এবাদত গোজার ও আখেরাত অভিমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ বানিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের ঐসব উপকরণ সংগ্রহ করার আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছেন, যা মানুষকে আখেরাতের সুখ-শান্তি লাভের জন্য আমল করার পথে বাধা সৃষ্টি করে। তবে সগীরা গুনাহর ব্যাপারে কথা হলো, নবীদের কারো থেকে তা কখনো নিজস্ব ইজতেহাদ করার কারণে হতে পারে। কিন্তু তাদেরকে এতে বহাল রাখা হয় না। তাই নবীদের দ্বারা কখনো কখনো সগীরা গুনাহ হলে তা তাদের ন্যায়পরায়নতাকে নষ্ট করে দেয় না এবং এটি নবুওয়াতের মর্যাদার পরিপন্থিও নয়। এটি শুধু একারণে হয় যে, তারাও মানুষ এবং এটি দেখানোর জন্য যে, তাদের কেউ ইলমুল গায়েবের সীমায় পৌঁছতে পারেনি ও তাদের কাউকে প্রভুত্বের কোনো বিশেষণ দেয়া সঠিক নয়।

মুফাসসির এবং আলেমগণ কতক সংঘটিত বিষয় উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বাণী,আর তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না তাদেরকে, যারা নিজ রবকে সকাল সন্ধ্যায় ডাকে, তারা তার সন্তুষ্টি চায়।সূরা আনআম, আয়াত: ৫২এবং তার বাণীআমি তোমাকে যে ওহী দিয়েছি, তা থেকে তারা তোমাকে প্রায় ফিতনায় ফেলে দিয়েছিল, যাতে তুমি আমার নামে এর বিপরীত মিথ্যা রটাতে পার এবং তখন তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত। আর আমি যদি তোমাকে অবিচল না রাখতাম, তবে অবশ্যই তুমি তাদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়তে।সূরা ইসরা, আয়াত: ৭৩-৭৪

এ ধরণের যে সব ঘটনা তিনি স্বীয় ইজতিহাদ অনুযায়ী বাহ্যিক কল্যাণের আশায় করেছেন, আল্লাহ জানেন যে তা হাসিল হবে না।

আর পাপাচার ও কবীরা গুনাহর ক্ষেত্রে কথা হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে ও তা সমর্থন করা হতে বাচিয়ে রেখেছেন। কেননা তা রেসালাত ও (আল্লাহর) মনোনীত হওয়ার বিপরীত এবং তার নিজের থেকে কুফুর, অপকর্ম ও অবাধ্যতা থেকে যে সতর্কবাণী বর্ণিত হয়েছে তারও বিপরীত। তবে তার নিকট যে শরীয়ত অহী করা হয়েছে তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে উম্মতের ঐক্যমতে তার নির্ভুল হওয়ার বিষয়টি বিদগ্ধ আলেমগণ উল্লেখ করেছেন। বরং সমস্ত নবীই আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে যে অহী ও শরীয়তের তাবলীগ করেছেন, তাতে তারা মা’সুম বা ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলেন। বরং আল্লাহ তাআলা আমাদের নবীকে নবুওয়াতের পূর্বেই শির্ক, অশ্লীলতা ও অন্যান্য অপকর্ম থেকে হেফাযত করেছেন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, জাহেলী যুগের লোকেরা যেসব কাজ করতো, আমি কখনো তা করার কল্পনা করিনি এবং আমি কখনো খারাপ কাজ করার ইচ্ছাও পোষণ করিনি, এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা আমাকে তাঁর রেসালাতের দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছেন। ইমাম কাযী ইয়ায তাঁর আশ-শিফা নামক কিতাবে এবং অন্যান্য স্থানে একথা উল্লেখ করেছেন।

ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ তাআলার হেফাযত ও সংরক্ষণাধীন থেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যৌবনে পদার্পন করেছেন। তিনি যেহেতু তাঁকে রেসালাতের বিরাট দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করবেন, তাই তাঁকে জাহেলিয়াতের কদর্যতা ও দোষ-ত্রুটি থেকে সংরক্ষণ করেছেন। অথচ তিনি তখন তাঁর গোত্রের ধর্মের উপরেই ছিলেন। যৌবনে পদার্পন করে তিনি তাঁর গোত্রের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব, সর্বোন্নত চরিত্র, মেলামেশায় সর্বাধিক ভদ্র, প্রতিবেশীর সাথে সর্বোত্তম আচরণ, সুমহান চারিত্রিক স্বভাব এবং আমানতদারীতে সর্বাধিক সত্যবাদী রূপে পরিচিত ছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজের চারিত্রিক পবিত্রতা ও মর্যাদাকে সংরক্ষণ করণার্থে অশ্লীলতা এবং ঐসব চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি থেকে সর্বাধিক দূরে অবস্থান করেছেন, যা মানুষকে কলুষিত করে ফেলে। একারণে তাঁকে স্বীয় গোত্রের মধ্যে আল-আমীন বা সত্যবাদি বিশ্বস্ত বলে ডাকা হতো। কেননা আল্লাহ তাআলা শৈশবকালে এবং জাহেলী যুগে তাঁর মধ্যে এগুনটির সমাহার ঘটিয়েছেন।

তৃতীয় বিষয়:মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের ব্যাপকতা:অন্যান্য নবীদের উপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য দ্বারা খাস করা হয়েছে। জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত মুত্তাফাক আলাইহি হাদীছে তার জবানেই তার কতক উল্লেখ করা হয়েছে।“আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে, যা আমার পূর্বে কাউকেও দেওয়া হয়নি। (১) আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যে, একমাস দূরত্বেও তা প্রতিফলিত হয়; (২) সমস্ত যমীন আমার জন্য পবিত্র ও সালাত আদায়ের উপযোগী করা হয়েছে। কাজেই আমার উম্মতের যে কোন লোক ওয়াক্ত হলেই সালাত আদায় করতে পারবে; (৩) আমার জন্য গানীমাতের মাল হালাল করে দেওয়া হয়েছে, যা আমার পূর্বে আর কারো জন্য হালাল করা হয়নি; (৪) আমাকে (ব্যাপক) শাফা‘আতের অধিকার দেয়া হয়েছে; (৫) সমস্ত নবী প্রেরিত হতেন কেবল তাঁদের সম্প্রদায়ের জন্য, আর আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য।আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন“আমি লাল ও সাদা চামড়া সবার কাছে প্রেরিত”।মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।এরই ভিত্তিতে সমগ্র মানব জাতির ওপর তাঁরই অনুসরণ ও আনুগত্য করা আবশ্যক। কারণ, তাঁর উম্মতের সমস্ত মানুষই দাওয়াত প্রাপ্ত উম্মত। আল্লাহ তাআলা বলেন,“আর আমি তোমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদ দাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে পাঠিয়েছি”।সূরা সাবা, আয়াত: ২৮অর্থাৎ, সমগ্র মানুষের জন্য।আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,“বল, হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর রাসূল”সূরা আরাফ, আয়াত: ১৫৮কুরআনের সম্বোধনসমূহ সমগ্র মানুষকে লক্ষ্য করেই এসেছে। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী:“হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের রবের এবাদত করো”।সূরা বাকারা, আয়াত: ২১আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,হে মানুষ, অবশ্যই তোমাদের নিকট রাসূল এসেছে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য নিয়ে। সুতরাং তোমরা ঈমান আন, তা তোমাদের জন্য উত্তম হবে।সূরা নিসা, আয়াত: ১৭০আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট প্রমাণ এসেছে এবং আমি তোমাদের নিকট স্পষ্ট আলো নাযিল করেছি।সূরা নিসাম, আয়াত: ১৭৪এখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তিনি তাঁর রবের পক্ষ হতে যা নিয়ে এসেছেন, সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।এ সব নস স্পষ্ট করে যে, সমস্ত মানুষ তাঁর রিসালাতের অনুসরণ করার আদেশপ্রাপ্ত এবং তাঁর আনুগত্য করতে বাধ্য। আর এটিও প্রসিদ্ধ যে, তিনি যেমনিভাবে মানুষের জন্য প্রেরিত ঠিক তেমনই জিন জাতির জন্যও প্রেরিত। এ কথার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বাণী দ্বারা দলীল দেওয়া হয়:আর স্মরণ কর, যখন আমি জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তারা কুরআন পাঠ শুনছিল। যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হল, তখন তারা বলল, ‘চুপ করে শোন। তারপর যখন পাঠ শেষ হল তখন তারা তাদের কওমের কাছে সতর্ককারী হিসেবে ফিরে গেল।সূরা আহকাফ, আয়াত: ২৯তাঁর এ বাণী পর্যন্ত:‘হে আমাদের কওম, আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি ঈমান আন।সূরা আহকাফ, আয়াত: ৩১অনুরূপ আল্লাহ তাআলার বাণী:বল, ‘আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয় জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শুনেছে। অতঃপর বলেছে, ‘আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সত্যের দিকে হিদায়াত করে; অতঃপর আমরা তাতে ঈমান এনেছি।সূরা জিন, আয়াত: ১-২ইহুদী-খৃষ্ঠানরা মনে করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাত শুধু আরবদের জন্য। তাঁর রেসালাত সত্য হওয়ার নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করার পর, অনেক মু'জেযা দ্বারা তাঁর রেসালাতকে শক্তিশালী করার বিষয়টি জেনে এবং তাঁর প্রচুর অনুসারী দেখেও তারা এ কথা বলেছে। তারা এ কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে যে, তিনি তাঁর রবের পক্ষ হতে প্রেরিত হয়েছেন। কিন্তু অহংকার, পদমর্যাদার লোভ এবং পার্থিব স্বার্থ তাদেরকে তাঁর অনুসরণ বর্জন করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তারা তাঁর সত্যবাদিতা, তাঁর রেসালাতের সত্যতা দেখে স্বীকার করেছে যে, তাঁর উপর অবতীর্ণ কিতাব আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অহী ছাড়া আর কিছুই নয়। তা সত্ত্বেও কুরআনে তাদেরকে সম্বোধন করে যেসব আদেশ করা হয়েছে, তা তারা গ্রহণ করেনি। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, وَآمِنُوا بِمَا أَنْزَلْتُ مُصَدِّقًا لِمَا مَعَكُمْ وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍ بِهِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَإِيَّايَ فَاتَّقُونِ وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ “আর তোমাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারীস্বরূপ আমি যা নাযিল করেছি তার প্রতি তোমরা ঈমান আন এবং তোমরা তা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। আর তোমরা আমার আয়াতসমূহ সামান্যমূল্যে বিক্রি করো না এবং কেবল আমাকেই ভয় কর। আর সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করো না”।সূরা বাকারা, আয়াত: ৪১-৪২অনুরূপ আয়াত আরো রয়েছে।চতুর্থ বিষয়:তার রিসালাত পৌঁছানো:আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও আর যদি তুমি না কর তবে তুমি তাঁর রিসালাত পৌঁছালে না।সূরা মায়িদা, আয়াত: ৬৭এর মাধ্যমে তাঁকে তাঁর মহান প্রভুর পক্ষ হতে রেসালাতের বাণী পৌঁছানোর দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে। এটি তিনি অবশ্যই করেছেন। এটি শুধু তাঁরই দায়িত্ব ছিল না। বরং এটি ছিল সমস্ত রাসূল আলাইহিমুস সালামদের কাজ। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরই একজন ছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنْ عَلَيْكَ إِلَّا الْبَلَاغُ “শুধু পৌঁছিয়ে দেয়াই তোমার দায়িত্ব”।সূরা শুরা, আয়াত: ৪৮এবং তিনি বলেছেন,“পরিষ্কার ভাষায় শুনিয়ে দেয়া ছাড়া রাসূলের আর কোন দায়িত্ব নেই”।সূরা নূর, আয়াত: ৫৪তাঁর সাহাবীগণ তার এ পৌঁছানো ও বর্ণনার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,একটি পাখি তার দু’টি ডানা মেললে শিক্ষণীয় কি তার ইমল আমাদের জন্য উল্লেখ করা ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করেননি।

আহমাদ ইবন মাজাহ রাহিমাহুল্লাহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,

لقد تركتكم على مثل البيضاء، ليلها كنهارها، لا يزيغ عنها بعدي إلا هالك “আমি তোমাদেরকে একটি উজ্জ্বল পথে রেখে যাচ্ছি, যার রাত দিনের মতই। আমার পরে বদনসীব ব্যতীত অন্য কেউ তা থেকে বিচ্যুত হতে পারেনা”।

সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

আমার পূর্বে প্রেরিত প্রত্যেক নবীর উপর আবশ্যক ছিল, তিনি তাঁর উম্মতের জন্য যা কল্যাণকর জানবেন তা তাদেরকে জানিয়ে দিবেন এবং তাদের জন্য যা ক্ষতিকর জানবেন তা থেকে তাদেরকে সতর্ক করবেন।

এটি সুপ্রসিদ্ধ যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ জাতি ও দেশের লোকদেরকে প্রথমে দাওয়াত দেওয়া আরম্ভ করেছেন। অতঃপর আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অংশের আরবদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন। অতঃপর তাদের পার্শ্ববতী লোকদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি মরুবাসী ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত আরব গোত্রগুলোর কাছে পত্র পাঠিয়ে আল্লাহর দীনের দাওয়াত দিয়েছেন এবং এই রেসালাত কবুল করার আহবান জানিয়েছেন। অতঃপর তিনি ইয়ামান, বাহরাইন ও অন্যান্য অঞ্চলে দাঈগণকে পাঠিয়েছেন। অতঃপর ইসলামী শরীয়তের দিকে দাওয়াত দিয়ে পারস্য ও রোমক সম্রাটদের নিকট চিঠি পাঠিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর দাওয়াত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং দূর ও কাছের সকলের নিকট তাঁর দাওয়াত প্রসিদ্ধ হয়ে গেলো।

অতঃপর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ কাউকে হিদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য থেকে কারো উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে।

সূরা নাহাল, আয়াত:৩৬

এভাবেই তাঁর মৃত্যুর পরে সাহাবীগণ তাঁর দীনের দাওয়াত দিয়েছেন এবং যারা সেই দ্বীন কবুল করতে অস্বীকার করেছে তাদের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করেছেন। যতক্ষণ না তারা ইসলামে প্রবেশ করেছে অথবা জিযিয়া দিয়ে লাঞ্ছনা ও অপমানকে আবশ্যক করে নিয়েছে, যার ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই দীনের দাওয়াত পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে গিয়েছে। ইতিহাসের কিতাবগুলোতে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে। এদত সত্ত্বেও যে লোক দেশের দূর প্রান্তে বাস করে এবং যদি ধরে নেয়া হয় যে, সে এই শরীয়ত সম্পর্কে একেবারেই শুনেনি, তাহলে তার হুকুম হবে আহলে ফাতরাত বা যাদের কাছে কোনো রাসূল পাঠানো হয়নি তাদের মতই। তা সত্ত্বেও সে সত্য দীন অনুসন্ধানের ব্যাপারে আদিষ্ট, যেই দীনের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যে দীন তার আশপাশের লোকেরা পালন করে।

পঞ্চম বিষয়:

খাতমুন নবুওয়াত বা নবুওয়তের সমাপ্তি:

যেহেতু এই শরীয়ত পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্য এবং দুনিয়ার সকল প্রান্তের সমস্ত মানুষকে এটি কবুল করে নেয়ার আদেশ করা হয়েছে। তার একমাত্র কারণ এটি সর্বশেষ শরীয়ত এবং সর্বশেষ আসমানী রেসালাত। অতএব আমাদের ওপর বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আখেরী নবী ও সর্বশেষ রাসূল। আল্লাহ তাআলা বলেন,

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ “মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ”।

সূরা আহযাব, আয়াত: ৪০

خاتم শব্দের تا বর্ণে ফাতহ (যবর) ও কাসরাহ (যের) উভয়ভাবে পঠিত। মূলত খাতাম ঐ জিনিষকে বলা হয়, যা দ্বারা পূর্বোক্ত বিষয় সমাপ্ত করা হয়। চিঠি লিখা শেষ হলে যা দ্বারা ছিল লাগানো হয়, তাকেও খাতাম বলা হয়। যাতে চিঠির সাথে সম্পর্কহীন আর কিছু যোগ করার সুযোগ না থাকে। মোট কথা আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য যেসব নবী পাঠিয়েছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশেষ। তিনি সর্বশেষ নবী হওয়া থেকে সর্বশেষ রাসূল হওয়া আবশ্যক হয়। মুসলিম ও অন্যান্য ইমাম আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مثلي ومثل الأنبياء قبلي كمثل رجل بنى بنيانا، فأحسنه وأجمله إلا موضع لبنة من زاوية من زواياه، فجعل الناس يطوفون به وبعجبون له، ويقولون : هلا وضعت هذه اللبنة؟ ! قال : فأنا اللبنـة وأنا خاتـم النبيين “আমার ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের উপমা হচ্ছে সে লোকের মতো যে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলো। তবে প্রাসাদের একপার্শ্বে মাত্র একটি ইটের স্থান খালী রেখে দিলো। লোকেরা প্রাসাদটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এর প্রশংসা করতে লাগলো এবং বলতে লাগলো, কেন এ ইটটি স্থাপন করা হলো না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি হলাম সেই ইট। আমিই সর্বশেষ নবী”।

মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ জাবের ইবন মুতইম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

إن لي أسماء : أنا محمد، وأنا الماحي الذي يمحو الله بي الكفر، وأنا الحاشر الذي يحشر الناس على قدمي، وأنا العاقب الذي ليس بعده نبي আমার অনেক নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মাদ ও আহমাদ। আমি আল-মাহী (নিশ্চিহ্নকারী)। আমার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা কুফরকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। আমি আল-হাশির (সমবেতকারী)। কিয়ামতের দিন সকল মানুষকে আমার পশ্চাতে একত্রিত করা হবে। আমি আল-আকিব (সর্বশেষ আগমণকারী)। আমার পর আর কোনো নবী নেই”।

সুনানে আবূ দাউদ ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু এর দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

وأنه سيكون في أمتي كذابون ثلاثون، كلهم يزعم أنه نبي، وأنا خاتم النبيين لا نبي بعدي “আমার উম্মতের মধ্যে আমার পরে ত্রিশজন মিথ্যুকের আগমণ ঘটবে। তারা সবাই নবুওয়াতের দাবী করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী। আমার পরে আর কোনো নবী নেই”।

সুতরাং বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী। তার পরে যে ব্যক্তি নবুওয়াত দাবি করবে, সে মিথ্যুক। আখেরী যামানায় ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম যখন অবতরণ করবেন, তখন তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শরীয়ত দ্বারা বিচার-ফয়সালা করবেন। তিনি এই উম্মতের একজন মানুষের মতই হবেন। তার উপর অহী নাযিল হলেও তিনি এই পবিত্র শরীয়ত বর্জন করবেন না। অতএব এই উম্মতের যে ব্যক্তি নবুওয়াত বা রেসালাতের দাবি করবে সে মিথ্যুক, প্রতারক, পথভ্রষ্ট এবং পথভ্রষ্টকারী। যদিও সে সাধারণ ও মুর্খ লোকদেরকে অলৌকিক ঘটনা ও ভেলকিবাজি দেখায় এবং বিভিন্ন প্রকার যাদু এবং জাঁকালো কিছু দেখাতে সক্ষম হয়। আসওয়াদ আনাসী এবং মুসায়লামা কায্যাবের হাতে এ ধরণের কিছু শয়তানী অবস্থা এবং বাজে, মিথ্যা ও বানোয়াট জিনিষ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রত্যেক বিবেকবান লোকের সামনেই এগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট হওয়ার কথা সুস্পষ্ট। আসওয়াদ আনাসী ও মুসায়লাহ কায্যাব ব্যতীত আরো যারা নবুওয়াত দাবি করেছিল, তাদের কিছু অনুসারী তৈরী হয়েছিল এবং তারা কিছুটা শক্তিও অর্জন করেছিল। তাদের কারণে কিছু লোক বিভ্রান্ত হয়েছে। এদের সর্বশেষ ব্যক্তি হলো গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী। তার ফিতনা যখন ছড়িয়ে পড়লো তখন ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের অনেক সম্প্রদায় ও গোষ্ঠি তার ফিতনায় আক্রান্ত হয়েছে। এমনিভাবে কিয়ামত পর্যন্ত যারাই নবুওয়াত দাবি করবে, তাদের কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। তাদের সর্বশেষ হবে মিথ্যুক দাজ্জাল। তার ফিতনার বিষয়টি সুন্নাতে বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্য উম্মতকে সাবধান করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব, কার নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়’? তারা অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক চরম মিথ্যাবাদী ও পাপীর নিকট।

সূরা শুআরা, আয়াত: ২২১-২২২

এটি প্রমাণ করে যে, উপরোক্ত মিথ্যুকদের কাছে শয়তান আসে এবং তাদেরকে ধারণা দেয় যে, তাদের কাছে যা আসে তা আল্লাহর পক্ষ হতে অহী। তবে সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর রীতি-নীতি হলো তিনি সত্য বিষয়ের ওপ নূর স্থাপন করেন। আর মিথ্যা ও বানোয়াট বিষয়ের ব্যাপারে কথা হলো জ্ঞানীদের সামনে তার মুখোশ উন্মুক্ত হয়।

ষষ্ঠ বিষয়:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি উম্মতের করণীয়:

আমরা যখন জানলাম যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তাতে তিনি সত্যবাদী, তার রিসালাত সত্য এবং তাকে সত্যারোপ করা ওয়াজিব। বস্তুত এটিই হচ্ছে মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল সাক্ষীর অর্থ, যার দাবি হচ্ছে তাকে সত্যারোপ করা অতঃপর তার অনুসরণ করার মাধ্যমে ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া। আর এর পশ্চাতে যে সাওয়াব আছে এবং তা ত্যাগ করাতে যে পাপ আছে তাতে ঈমান আনয়ন করা। কারণ আমাদের ওয়াজিব হচ্ছে আমরা তা বাস্তবায়ন করবো এবং আমাদের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাবো। আর তা রূপায়িত হবে কুরআন ও সুন্নাহতে যে নির্দেশসমূহ রয়েছে তা বাস্তবায়ন করার দ্বারা, যেমন:

প্রথমত: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনা:

আল্লাহ তাআলা তাঁর নির্দেশ দিয়েছেন যেমন তিনি আল্লাহ, ফেরেশতা এবং আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তিনি এর ওপর প্রচুর ছাওয়াব দান ও তা ছাড়ার ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নির্ধারণ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا “হে মুমিনগণ, তোমরা ঈমান আনয়ন করো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে নাযিল করেছেন। আর যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং শেষ দিনকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে।

সূরা নিসা, আয়াত: ১৩৬

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তিনি স্বীয় রহমতে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন, আর তোমাদেরকে নূর দেবেন যার সাহায্যে তোমরা চলতে পারবে এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।

সূরা হাদীদ, আয়াত: ২৮

আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنْزَلْنَا “তাই ঈমান আনয়ন করো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই নূর বা আলোর প্রতি যা আমি নাযিল করেছি”।

সূরা তাগাবুন, আয়াত: ৮

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ও তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে।

সূরা আরাফ, আয়াত: ১৫৮

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরো বলেন,

আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনে না তবে নিশ্চয় আমি কাফিরদের জন্য প্রস্তুত করেছি জ্বলন্ত আগুন।

সূরা ফাতাহ, আয়াত: ১৩

এ বিষয়ে এ ছাড়া আরো অনেক আয়াত রয়েছে।

মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ ও অন্যারা আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমার প্রতি ও আমি যা নিয়ে এসেছি তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে”।

জিবরীলের হাদীস নামী প্রসিদ্ধ হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বলে ঈমানের ব্যাখ্যা করেছেন:

“তুমি আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেস্তা, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ,আখেরাত দিবস ও তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান আনবে”।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনয়ন করার অত্যাবশ্যকীয় দাবি হলো, তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে যা নিয়ে এসেছেন, তা সত্যায়ন করা এবং তাঁর রেসালাতের সত্যতায় বিশ্বাস করা। কেননা ঈমানের মূল হচ্ছে কোনো বিষয়ের প্রতি অন্তর দিয়ে দৃঢ় বিশ্বাস করা এবং আস্থাশীল হওয়া। অতঃপর জেনে-বুঝে এবং বিশ্বাস সহকারে জবান দিয়ে তা উচ্চারণ করা। অতঃপর কাজকর্মের মাধ্যমে ঈমানের দাবি বাস্তবায়ন করা। এসব বিষয়ের সমন্বয়ে ঈমান পরিপূর্ণ হয় এবং এই পরিপূর্ণ ঈমানই নাজাতের উসীলা হবে। মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, অন্তরের বিশ্বাস ছাড়া এ সাক্ষ্য দেয়া অনর্থক। এরূপ সাক্ষ্য দানকারীর সাক্ষ্য কোনো উপকার করবে না। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা মুনাফেকদেরকে মিথ্যুক বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।

সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত: ১

দ্বিতীয়ত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করার আদেশ ও তাঁর অবাধ্যতা থেকে সতর্ক করা:

আর সন্দেহ নেই যে, তাঁর আনুগত্য করাই তাঁর প্রতি ঈমানের আলামত। কারণ তাঁর সততায় দৃঢ় বিশ্বাস করার দাবি হলো তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে যা পৌঁছিয়েছেন তাতে তাঁর আনুগত্য করা। অতএব যে ব্যক্তি অহংকার কিংবা অলসতাবশত তাতে তাঁর পুরোপুরি কিংবা তার অংশ বিশেষের বিরোধিতা করল সে তাঁর রেসালাতের সাক্ষীতে সত্যাবাদী নয়। অধিকন্তু আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমের অনেক স্থানে তাঁর আনুগত্য করার আদেশ করেছেন। তিনি বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ “হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান এনে থাকো”।

সূরা নিসা, আয়াত: ৫৯

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَاحْذَرُوا فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ “আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রাসূলের আর সাবধান হও। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রাখ যে, আমার রাসূলের দায়িত্ব শুধু সুস্পষ্ট প্রচার।

সূরা মায়িদা, আয়াত: ৯২

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,

قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا “বলো, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে সে শুধু তার উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরাই দায়ী। আর যদি তোমরা তার আনুগত্য কর তবে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে”।

সূরা নূর, আয়াত: ৫৪

অনুরূপ অর্থে আল্লাহ তা‘আলা বাণী:

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا “রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও”।

সূরা হাশর, আয়াত: ৭

বরং রাসূলের আনুগত্য করার ওপর প্রচুর ছাওয়াব নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ “আর তোমরা আনুগত্য কর রাসূলের, যাতে তোমাদেরকে দয়া করা হয়”।

সূরা আল-ইমরান, আয়াত: ১৩২

আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন,

আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহা সাফল্য অর্জন করল।

সূরা আহযাব, আয়াত: ৭১

অনুরূপভাবে তার নাফরমানীর ওপর ভয়াবহ শাস্তির ধমক দিয়েছেন।

আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর এটা মহা সফলতা। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক আযাব।

সূরা নিসা, আয়াত: ১৩-১৪

আর জাহান্নামীদের থেকে তাদরে কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন:

يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَ “হায় আফসোস! যদি আমরা আল্লাহ ও তার রসূলের আনুগত্য করতাম”৷

সূরা আহযাব, আয়াত: ৬৬

সহীহ হাদীসে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণি, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

من أطاعني فقد أطاع الله، ومن عصاني فقد عصى الله “যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্য হল সে আল্লাহর অবাধ্য হল”।

এর অর্থ হলো, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বিষয়ের আদেশ করেন আল্লাহ যা তাঁর নিকট প্রত্যাদেশ করেন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা তাঁর রবেরই অনুগত্য করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا “যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হল, তবে আমরা তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি”।

সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০

বুখারী রাহিমাহুল্লাহ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

সব মানুষই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে সে ব্যক্তি নয়, যে অস্বীকার করে। তাঁরা বললেন, কিভাবে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে আমার নাফরমানী করল সেই অস্বীকার করল”।

আর সন্দেহ নেই যে, তাঁর আনুগত্য হলো, তিনি যে আদেশ করেছেন তা করা এবং তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে দূরে থাকা। সেই সঙ্গে তিনি যা নিয়ে এসেছেন, তা মেনে নেওয়া, তাঁর ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, তাঁর শরীয়তের ওপর আপত্তি তোলা ছেড়ে দেওয়া অথবা তাঁর তার বিধানের পরিবর্তন ও সমালোচনা না করা।

তৃতীয় বিষয়: তিনি উম্মতকে তাঁর অনুসরণ ও তাঁর সুন্নত মেনে চলার আদেশ করেছেন।

আল্লাহ তার ওপর হিদায়াত ও ক্ষমাকে নির্ধারণ করেছেন। এবং তাঁকে আল্লাহ তাআলার প্রতি সত্যিকার ভালোবাসার নিদর্শন করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ “তোমরা তাঁর অনুসরণ করো। এতে করে তোমরা সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে”।

সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৫৮

ইহুদী খৃষ্টানরা যখন দাবি করলো যে, তারা আল্লাহর পুত্র ও তাঁর প্রিয়জন, তখন তিনি পরীক্ষার আয়াত নাযিল করলেন। আর তা হলো তার বাণী:

বল, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। বল, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর’। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না।

সূরা আল-ইমরান, আয়াত: ৩১-৩২

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا “অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে”।

সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১

নিঃসন্দেহে বান্দাদের উপর আবশ্য হলো, তারা তাদের রবকে ভালোবাসবে। যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন প্রকার নেয়ামত দিয়েছেন। তবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করার উপর এই ভালোবাসা অর্জিত হওয়া এবং তা গৃহিত হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। যারা তাঁর অনুসরণ করবে বিনিময় স্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য এই ছাওয়াব রেখেছেন যে, তিনি তাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তাদেরকে ক্ষমা করবেন। তবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণের আলামত হলো তাঁর অনুসরণ করা, তাঁর পথে চলা, তাঁর জীবনী, আমল এবং এবাদতের রীতি-নীতির অনুকরণ করা। সেই সঙ্গে তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে দূরে থাকা এবং তার এমন বিরোধিতা থেকে সতর্ক থাকা, যার কারণে মানুষ তাঁর অনুকরণ থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে যায়। যেমন সহীহ বুখারীতে নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন,

যে আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে আমার (উম্মত) থেকে নয়।

চতুর্থতঃ ইলাহকে অন্তর ও দেহে সত্যিকারভাবে ভালোবাসা।

বরং তাঁর মহব্বতকে অন্য সব কিছুর উপর অগ্রাধিকার দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

বল, ‘তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত’। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।

সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ২৪

দেখুন, এখানে কীভাবে আল্লাহ তা‘আলা এ আটটি প্রকারের কোন একটিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসার উপর অগ্রাধিকার দেয়াকে তিরস্কার করেছেন। যেগুলোর প্রতি সাধারণত মানুষের মন আকৃষ্ট হয় এবং যে জন্য মানুষ এ দুনিয়ার জীবনকে আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসার ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর তিনি তাদেরকে “অপেক্ষা করো...” শব্দে ধমক দিয়েছেন। অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করো। এটি আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও তাঁর রাগের প্রতিক্রিয়া, যার কারণে শাস্তি নাযিল হয়। এতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা ওয়াজিব হওয়ার চূড়ান্ত প্রমাণ রয়েছে। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর হাদীসে গুরুত্বসহ সাব্যস্ত করেছেন। যেমন: আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর হাদীসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাণী:

“যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকে, সে তার দ্বারা ঈমানের মিষ্টতা লাভ ক’রে: আল্লাহ ও তাঁর রসূল তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে অধিক প্রিয় হবে; কাউকে ভালোবাসলে কেবল আল্লাহ’র জন্যই ভালবাসবে। আর কুফরী থেকে তাকে আল্লাহর বাঁচানোর পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করবে, যেমন সে নিজেকে আগুনে নিক্ষিপ্ত করাকে অপছন্দ করে।”

মুত্তাফাকুন আলাইহি। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আনাস —রাযিয়াল্লাহু আনহু— থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম— বলেছেন:

“তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সন্তান, তার পিতা ও সকল মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হই”।

উমার ইবনুল-খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন বললেন:

আল্লাহর কসম! অবশ্যই আপনি আমার নিকট সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয়। তবে আমার জীবনের চেয়ে বেশি প্রিয় নন। তখন তিনি বললেন:

না, হে উমার! এখনো তুমি পরিপক্ক ঈমানদার হতে পারোনি যতক্ষণ না আমি তোমার নিকট তোমার জীবনের চেয়ে বেশি প্রিয় হবো। তখন (উমার) রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন: আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই আপনি আমার নিকট সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয় এমনকি আমার জীবনের চেয়েও। তখন তিনি বললেন: এখন হয়েছে হে উমার!

এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।

হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর ভালোবাসার একটি সুফল হলো পরকালে তাঁর সাথে জমায়েত হওয়া। কারণ যখন জনৈক ব্যক্তি তাঁকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো তখন তিনি বললেন:

তুমি সেদিনের জন্য কী প্রস্তুত করেছো? সে বললো: আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই প্রস্তুত করিনি। তখন তিনি বললেন: তুমি যাকে ভালোবেসেছো তার সাথেই তুমি থাকবে।

বিশুদ্ধ গ্রন্থদ্বয়ে ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

ব্যক্তি তার সাথেই থাকবে যাকে সে ভালবাসে।

এটিই এ ভালোবাসার প্রতিদান ও পুরস্কার হিসেবে যথেষ্ট। তবে সত্যিকারের ভালোবাসা তাঁর অনুসরণ করতে, তাঁর শিষ্টাচারে শিষ্ট হতে ও তাঁর সুন্নাতকে সবার সন্তুষ্টির উপর প্রাধান্য দিতে বাধ্য করে। তেমনিভাবে তা আবশ্যক করে যে তাঁকে ভালোবাসে ও বন্ধু মনে করে তার ভালোবাসাকে এবং যে তাঁকে ঘৃণা করে ও শত্রু মনে করে তার ঘৃণাকে। যদিও সে খুবই নিকটের কেউ হয়। যে ব্যক্তি এ বৈশিষ্ট্যকে পরিপূর্ণরূপে ধারণ করেছে সেই এ ভালোবাসায় সত্যবাদী। আর যে ব্যক্তি এর ব্যতিক্রম করেছে অথবা এতে কোন ধরনের ত্রুটি করেছে তাহলে তার ভালোবাসা ততটুকুই ত্রুটিপূর্ণ হবে।

পঞ্চমতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া এবং তাঁকে শক্তিশালী করা।

যেভাবে আল্লাহর বাণীতে উল্লিখিত হয়েছে:

“যেন তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনো এবং তাঁকে শক্তিশালী ও সম্মানিত করো।

সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ৯

আর আল্লাহ তা‘আলা বাণী:

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না। এ আশঙ্কায় যে তোমাদের সকল আমল-নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না। নিশ্চয় যারা আল্লাহর রাসূলের নিকট নিজদের আওয়াজ অবনমিত করে, আল্লাহ তাদেরই অন্তরগুলোকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করেছেন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।

সূরা আল-হুজুরাত: ১,৩

আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে তাঁর সামনে তাঁর আনীত বিধানের বিপরীত কোন মত ও দৃষ্টিকোণ পেশ করতে নিষেধ করেছেন। আর তিনি তাদের নিষেধ করেছেন তাঁর সামনে আওয়াজকে উঁচু করতে অথবা বিনা অজুহাতে তাঁর সাথে জোরে কথা বলতে। এবং এর ওপর তিনি তাদের আমল নষ্টের হুমকি দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“তোমরা রাসূলের ডাকাকে তোমাদের নিজেদের মধ্যকার একে অপরকে ডাকার ন্যায় বানাবে না”।

সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩

অর্থাৎ তোমরা তাঁকে তাঁর মূল নামে ডেকো না যেমনিভাবে তোমাদের কেউ অন্যকে ডাকে। বরং তোমরা তাঁকে তাঁর বিশিষ্ট নামে ডাকো। যেমন, তোমরা বলবে: হে আল্লাহর নবী! অথবা হে আল্লাহর রাসূল! কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে বিশেষ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বে বিশেষিত করেছেন।

তাঁকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া এবং তাঁকে শক্তিশালী করার অংশ হচ্ছে তাঁর সুন্নাতকে সম্মান করা এবং তাঁর অনুসারীদের মনে তার মর্যাদা সুউচ্চ করা। যার দ্বারা তাঁর অনুসরণ ও তাঁর আদেশ মানা এবং তার নিষেধ থেকে পরহেয করা সহজ হয়।

ষষ্টত: তাঁর নিকট বিচার প্রার্থী হওয়া, তাঁর ফায়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়া ও তাঁর ওপর আপত্তি করা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তোমরা যদি কোন ব্যাপারে ঝগড়ায় লিপ্ত হও তাহলে সেটিকে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দিবে”।

সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৯

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

“যারা তাঁর আদেশের বিপরীত করে তাদের এ ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত যে, যেন তাদেরকে কোন ফিতনা কিংবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি না পেয়ে বসে”।

সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩

সকল উম্মত একমত যে, তাঁর (মৃত্যুর) পর তাঁর সুন্নতের দিকেই ফিরে যেতে ও বিচার প্রার্থী হতে হবে। এ আয়াতগুলোতে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ হারাম এবং তাঁর সুন্নাতের বিকল্প অনুসন্ধান না করার পক্ষে মহা প্রমাণ রয়েছে। দেখুন, কীভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আদেশ অমান্যকারীদেরকে ফিতনা দ্বারা সতর্ক করেছেন, আর ফিতনা হচ্ছে শিরক বা বক্রতা এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দ্বারা সতর্ক করেছেন। আর কীভাবে তিনি তাদের ঈমান না থাকার ব্যাপারে কসম খেয়েছেন যতক্ষণ না তারা তাঁকে নিজেদের মধ্যকার সৃষ্ট সকল দ্বন্দ্বের ফায়সালাকারী বানাবে এবং তার সিদ্ধান্তকে মেনে নিবে। আর তাদের অন্তরে উক্ত ফায়সালার ব্যাপারে কোন ধরনের সংকোচ বা মনোকষ্ট না থাকবে। বস্তুতঃ যে ব্যক্তি তাঁর সুন্নাতের বিধান জানার পরও সেটিকে অবহেলা করে ও হাল্কা ভেবে তা পরিত্যাগ করেছে এবং তার বিকল্প হিসেবে মানব রচিত বিধি-বিধান, মতামত ও প্রচলন ইত্যাদিকে গ্রহণ করেছে তার জন্য এ হুমকি ও ধমকিই যথেষ্ট।

সপ্তম বিষয়:

(নবী) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা ও ভারসাম্যতা বজায় রাখা।

আল্লাহর নীতি তাঁর সৃষ্টির মাঝে বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ি সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে সদা চালু রয়েছে এবং প্রত্যেক জাতি থেকেই কমবেশি বাড়াবাড়ি ও ত্রুটি সংঘটিত হয়। এজন্যই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর অনুসারী উম্মতকে তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে এবং তাঁকে আল্লাহর খাঁটি অধিকার থেকে কোন কিছু দিতে সতর্ক করেছেন। যা নিচের আলোচনা থেকে আরো সুস্পষ্ট হয়:

প্রথমতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে যাননি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

বলুন, “আমি তো কেবল তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তবে আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয়”।

সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ১১০

আয়াতটি স্পষ্ট করেছে যে, তিনি কেবল ওহী দ্বারা বিশেষিত।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

“বল, ‘পবিত্র মহান আমার রব! আমি তো একজন মানব-রাসূল ছাড়া কিছু নই’?”

সূরা আল-ইসরা, আয়াত ৯৩

এটি তখনই বলা হয়েছে যখন মুশরিকরা তারঁ কাছে যমীন বাহমান হওয়া বা আসমান তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করা ইত্যাদি কামনা করে, তখন তিনি তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, যিনি একাজগুলো করতে ক্ষমতা রাখেন তিনি হলেন তাঁর রব যিনি একক। আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেবল রিসালাত কর্তৃক বিশিষ্ট হয়েছেন যার দায়িত্ব আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন।

পূর্বের উম্মতগণ কর্তৃক রাসূলদের রিসালাতের ব্যাপারে তাদেরকে মানুষ বলে আপত্তি করার বিষয়টি আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা হূদ কিংবা সালেহ এর সম্প্রদায় সম্পর্কে তার বাণীতে বলেছেন:

‘সে কেবল তোমাদের মত একজন মানুষ, সে তাই খায় যা থেকে তোমরা খাও এবং সে তাই পান করে যা থেকে তোমরা পান কর’। ‘আর যদি তোমরা তোমাদের মতই একজন মানুষের আনুগত্য কর, তবে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।

সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত ৩৩,৩৪

আর তিনি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে মিথ্যারোপকারীদের ব্যাপারে বলেন, তারা বললো:

“এ রাসূলের কী হলো যে, সে খানা খায় এবং বাজারে হাঁটাচলা করে“।

সূরা আল-ফুরকান, আয়াত:৭

অর্থাৎ, সে কামাই ও রিযিক অনুসন্ধানের জন্য চেষ্টা করে। ফলে তিনি তার উত্তর এভাবে প্রদান করেন:

“আর তোমার পূর্বে যত নবী আমি পাঠিয়েছি, তারা সবাই আহার করত এবং হাট-বাজারে চলাফেরা করত।

সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২০

অর্থাৎ তারা ফিরিশতা নয়। কারণ, মানুষ সাধারণত ফিরিশতাদেরকে দেখার ক্ষমতা রাখে না। বরং যদি আল্লাহ ফিরিশতাকে পাঠাতেন, তারা তাঁকে দেখতে পেতো না যতক্ষণ না তিনি মানুষের আকৃতি ধারণ করতেন। তখনও সন্দেহের সৃষ্টি হতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

আর যদি রাসূলকে ফেরেশতা বানাতাম তবে তাঁকে পুরুষ মানুষই বানাতাম। ফলে তারা যে সন্দেহ করে, সে সন্দেহেই তাদেরকে রেখে দিতাম।

সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯

যখন তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে সালাতে ভুল সংঘটিত হলো, তারা তাঁকে তা এ মনে করে স্মরণ করিয়ে দেয়নি যে, হয়তোবা সালাতকে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তখন তিনি বললেন:

“আমি তো কেবল তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমিও ভুলে যাই যেমন তোমরাও ভুলে যাও। অতএব, যখন আমি ভুলে যাই তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিবে”।

মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)

যেহেতু রাসূলগণ মানুষ তখন আল্লাহর কোন হক কর্ম বা গূণ যাই হোক তাঁদেরকে দেয়া উচিত নয়।

দ্বিতীয়তঃ রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গায়েব জানেন না।

তিনি ততটুকুই সংবাদ দেন যতটুকু আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সংবাদ দিয়েছেন ও তাঁর নিকট ওহী করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

বল, ‘তোমাদেরকে আমি বলি না, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডারসমূহ রয়েছে এবং আমি গায়েব জানি না এবং তোমাদেরকে বলি না, নিশ্চয় আমি ফেরেশতা। আমি কেবল তাই অনুসরণ করি যা আমার কাছে ওহী প্রেরণ করা হয়’।

সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫০

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

আপনি বলুন: আমি নতুন কোন রাসূল নই। আর আমি জানি না যে, আমার ও তোমাদের সাথে কী আচরণ করা হবে।

সূরা আল-আহকাফ. আয়াত: ৯

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

“আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে আমি বেশি বেশি কল্যাণ গ্রহণ করতাম এবং আমাকে কোন অকল্যাণই স্পর্শ করতো না”।

সূরা আল-আ’রাফ. আয়াত: ১৮৮

অতএব আল্লাহ ছাড়া কেউই গায়েব জানে না। তবে তিনি তাঁর কতক সৃষ্টির নিকট তার কিছু প্রকাশ করেন মু’জিযা ও তার সততার প্রমাণ স্বরূপ। যেমন: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী, আর তিনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তবে তাঁর মনোনীত রাসূল ছাড়া। আর তিনি তখন তার সামনে ও তার পিছনে প্রহরী নিযুক্ত করবেন।”।

সূরা আল-জিন: ২৬-২৭

অর্থাৎ তিনি তাঁর মনোনীত ব্যক্তিবর্গ তথা তাঁর রাসূলগণকে পূর্ব বা পরের কিছু গায়েবী বিষয় জানিয়ে দেন। যা নিম্নোক্ত আল্লাহর বাণীটির বিরোধী নয়:

বলুন, আল্লাহ ছাড়া আসমানসমূহে ও জমিনে যারা আছে তারা গায়েব জানে না। আর কখন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে তা তারা অনুভব করতে পারে না।

সূরা আন-নামাল: আয়াত : ৬৫

ভবিষ্যত বিষয়াদি সম্পর্কে হাদীসসমূহে যে সংবাদগুলো এসেছে তা সেই ওহী যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে ফিরিশতা রাসূলের মাধ্যমে অবগত করেছেন অথবা তার ওপর যা খুলে দিয়েছেন বা তাকে ইলহাম করেছেন। যখন এ হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পূর্বেকার অন্যান্য রাসূলগণের বৈশিষ্ট্য, তখন আল্লাহর কোন অধিকার যেমন তাঁরই ইবাদত করা যিনি একক তাদেরকে সোপর্দ করা যাবে না। এবং যে বৈশিষ্ট্য রবের সাথে খাস সে সব বৈশিষ্ট দ্বারা তাদেরকে বিশেষিত করা যাবে না। এ জন্যই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রবী’ ইবনু মু‘আওয়িযের নিকটে থাকা সেই মেয়ে দু’টির নিম্নোক্ত কথাকে প্রত্যাখ্যান করলেন:

আমাদের মাঝে এমন এক নবী আছেন যিনি আগামী কালের সবকিছুই জানেন।

এটি ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন।

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন:

কেউ যদি তোমাকে বলে, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ আগামী দিনের সবকিছুই জানেন তাহলে তুমি তাকে বিশ্বাস করো না।

এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।

জিবরীল (আলাইহিস-সালাম) এর হাদীসে এসেছে, যখন তিনি কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন:

“এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত (ব্যক্তি) জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে বেশী অবহিত নয়। তবে আমি তোমাকে তার নিদর্শন সম্পর্কে সংবাদ দিব: যখন কৃতদাসী তার মনিবকে প্রসব করবে। আর যখন তুমি নগ্নপদ, বস্ত্রহীন ও দরিদ্র ছাগলের রাখালদেরকে অট্টালিকার ওপর গর্ব করতে দেখবে।” পাঁচটি বিষয় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। অতঃপর তিনি পাঠ করেন, “নিশ্চয় আল্লাহর নিকট কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। আর তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং জরায়ূতে যা আছে, তা তিনি জানেন। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ স্থানে সে মারা যাবে।

মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)

এ পাঁচটিই হলো গায়েবের চাবিকাঠি যা আল্লাহর বাণীতে উল্লিখিত হয়েছে:

“তাঁর কাছেই রয়েছে গায়েবের সবগুলো চাবি যেগুলো তিনি ছাড়া আর কেউই জানে না।

সূরা আল-আন‘আম: আয়াত: ৫৯

সুতরাং যে ব্যক্তি এগুলোর কোনটির জ্ঞানের দাবি করলো অথবা এগুলোর কোনটিকে কোন মানুষের সাথে সম্পৃক্ত করলো, সে নিশ্চয়ই মিথ্যুক।

তৃতীয়তঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজেই নিজের কোন লাভ-ক্ষতির মালিক নন। অন্যের তো দূরের কথা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“বল, ‘আমি আমার নিজের কোন উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান।

সূরা আল-আ’রাফ: আয়াত: ১৮৮

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

“হে রাসূল! আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কোন ক্ষতি বা হিদায়েতের মালিক নই”।

সূরা আল-জিন: আয়াত: ২১

আর তা এ কারণেই যে, নিশ্চয়ই রাজত্ব আল্লাহর জন্যই যিনি একক। তাঁর হাতেই সকল লাভ ও ক্ষতি এবং দান ও বঞ্চিত করণ। তিনিই সকল ক্ষমতার মালিক। তাঁর ফায়সালা প্রতিরোধ ও তাঁর হুকুম প্রত্যাখ্যান করার কেউ নেই।আর নবীগণসহ তাঁর সৃষ্টির সবাই তাঁর মালিকানাধীন। যাদেরকে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী শামিল করে:

“তারা আসমানসমূহ ও যমীনের মধ্যে অণু পরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়। আর এ দু’য়ের মধ্যে তাদের কোন অংশীদারিত্ব নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সাহায্যকারীও নয়।

সূরা সাবা: আয়াত: ২২

শাইখুল-ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) এ আয়াত শেষে বলেন: আল্লাহ তা‘আলা তিনি ছাড়া অন্য সবকিছুকেই অস্বীকার করেছেন যেগুলোর সাথে মুশরিকরা সম্পৃক্ত হয়। যেমন তিনি অন্যের মালিকানা বা অংশীদারিত্ব বা আল্লাহর সহযোগী হওয়াকে অস্বীকার করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন,

এ বিষয়ে তোমার কোনো অধিকার নেই।

সূরা আলে ইমরান: আয়াত : ১২৮

এটি তখনই বলা হয়েছে যখন উহুদের যুদ্ধে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মাথা ফাটিয়ে ও তাঁর সামনের দাঁত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল, তখন তিনি বলেন,

কীভাবে সে জাতি সফলকাম হবে যারা নিজেদের নবীর মাথা ফাটিয়েছে?!

অথবা এটি ছিল যখন (নবী) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার কিছু মুশরিকের ওপর কুনূত পড়ে বদ-দু‘আ করতে ছিলেন, তখন আল্লাহ তা অপন্দ করলেন এবং তাঁকে সংবাদ দিলেন যে, সকল ব্যাপার একমাত্র আল্লাহর জন্য। এ ব্যাপারে তাঁর কোন কিছুই করার নেই।

বিশুদ্ধ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে ভীতি প্রদর্শন করেন এবং তাদের তিনি বলেন:

তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। আমি আল্লাহর থেকে তোমাদের কোন উপকারে আসবো না।

এমনকি এ কথা তিনি তা নিজের চাচা, ফুফী এবং মেয়েকেও বললেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে,

তোমরা নিজেদেরকে কিনে নাও।

অর্থাৎ আল্লাহর তাওহীদ ও তাঁর জন্য ইবাদাতকে খাঁটি করে এবং তিনি যার আদেশ করেছেন তা মেনে ও তিনি যার থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থেকে (জান্নাত কিনে নাও)। কারণ, এতেই রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি, বংশ ও আত্মীয়তার উপর নয়। তিনি এর মাধ্যমে এমন কিছু লোকের সন্দেহ দূর করলেন যারা মনে করে যে, তিনি তাঁর আত্মীয়দের জন্যে যথেষ্ট হবেন ও তাদের জন্য সুপারিশ করবেন। এ চিন্তাটি বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে দানা বেঁধেছে ও তাদের ভেতর অনুপ্রবেশ করেছে। তাই আপনি তাদেরকে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বংশের সাথে শুধু সম্পৃক্ততার উপর নির্ভরশীল হতে ও তাকে সম্মানজনক বলে মনে করতে দেখবেন। তারা মনে করে যে, মুক্তি ও সুপারিশ আমল ছাড়াই হাসিল যাবে। বরং তারা তাঁর আদর্শের বিরোধিতা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ করে। তেমনিভাবে আরেকটি দল রয়েছে যারা তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ ছাড়া কেবল তাঁর মনগড়া ভালোবাসাকে ধারণ করে আছে। তারা বিশ্বাস করে যে, তিনি এ মনগড়া ভালোবাসার ভিত্তিতেই তাদের জন্য সুপারিশ করবেন। যদিও তার ভালোবাসার আলামত তথা তাঁর অনুসরণ ও তাঁর দেখানো পথের বিপরীতে চলে। অথচ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজেই নিজের লাভ-ক্ষতির মালিক নন এবং তিনি আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করলে নিজের উপর থেকে আযাব ও ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সক্ষম নন, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছ থেকে কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না এবং তিনি ছাড়া কখনো আমি কোন আশ্রয়ও পাব না।

সূরা আল-জিন, আয়াত: ২২

তাহলে তাঁর নিকটের (আত্মীয়ের) বা দূরের (অনাত্মীয়ের) অবস্থা কীরূপ হবে?!

অথচ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজ আত্মীয়দেরকে স্পষ্ট বলেছেন, তিনি না তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন, না তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, না তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবেন। বরং তাদের আমলগুলোই তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে।

বিশুদ্ধ হাদীসে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচা আবু তালিবের হিদায়েতের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিনি তাতে সক্ষম হননি। যখন তাঁর মৃত্যু উপস্থিত হলো, তিনি তার কাছে এসে বললেন:

“হে চাচা! বলুন, “আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই” এ কালিমা দ্বারা আল্লাহর নিকট আপনার জন্যে সুপারিশ করবো।

তখন খারাপ সাথীরা তাকে শয়তানী যুক্তি শেখালো।ফলে তার শেষ কথা ছিলো, সে আব্দুল-মুত্তালিবের ধর্মের উপরই রয়েছে। এ ব্যাপারেই আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী নাযিল হয়েছে,

নিশ্চয় আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে আপনি হিদায়াত দিতে পারবেন না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন।

সূরা আল-কাসাস: আয়াত: ৫৬

এ ঘটনায় সেই মুশরিকদের সন্দেহ বাতিলের সর্ববৃহৎ প্রমাণ রয়েছে যারা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে এবং তাঁর নিকট বিপদ দূর করা ও গুনাহ মাফ কামনা করে। আর কঠিন বিপদের সময় তাঁর নাম ধরে ইয়া রাসূলাল্লাহ ইত্যাদি বলে চিৎকার করে।

বলাবাহুল্য যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ও তাদের তুলনায় আল্লাহর অতি নিকটবর্তী এবং সম্মানের দিক দিয়ে তাদের তুলনায় মহান, অধিকন্তু তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর সময় হিদায়েতের ওপর আগ্রহী ছিলেন, তা সত্তেও তিনি তা করতে পারেননি। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য দুর্ভাগ্য লিখে রেখেছেন। উপরন্তু তিনি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার প্রতিজ্ঞা করেন, আল্লাহ তাঁর থেকেও তাঁকে নিষেধ করেছেন এভাবে:

নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা আত্মীয় হয়। তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে, নিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।”।

সূরা আত-তাওবাহ: আয়াত: ১১৩

এতে দলীল রয়েছে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অন্যের লাভ বা ক্ষতির মালিক নন। যদিও সে তাঁকে ডাকে, তাঁকে আশা করে ও তাঁর নাম ধরে চিৎকার করে। যদিও সে মনে করে যে, সে তাঁকে কঠিনভাবে ভালোবাসে। যদি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট অন্তরসমূহের হিদায়েত অথবা বিপদ দূর করার কোন কিছু থাকতো তাহলে এর সর্বাধিক উপযুক্ত ছিলো তাঁর সেই বড় চাচা যে তাঁর অভিভাবকত্ব ও তাঁকে রক্ষা করেছে এবং তাঁর ও মুশরিকদের কষ্টদানের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। যখন তিনি তাকে হিদায়েত দিতে ও রক্ষা করতে পারলেন না তাহলে অন্যরা তো আরো আগে।

চতুর্থতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জন্য আল্লাহর গোলাম হওয়াই সম্মান ও ফযীলতের বিষয়:

বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থদ্বয়ে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে প্রমাণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:

তোমরা আমার বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না, যেমনটি খৃষ্টানরা ইবনু মারইয়্যাম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি তো কেবল বান্দা। তাই তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল।

শাইখ সুলাইমান ইবনু আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) এ হাদীস সম্পর্কে কিতাবুত-তাওহীদের ব্যাখ্যার ২৭২ পৃষ্ঠায় বলেন: তার বাণী:

আমি তো কেবল বান্দা। তাই তোমরা বলো: আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।

অর্থাৎ তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করো না যেমনিভাবে খ্রিস্টানরা ‘ঈসা (আলাইহিস-সালাম) এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে তাঁর মাঝে রুবূবিয়্যাতের দাবি করেছে। বরং আমি হচ্ছি আল্লাহর বান্দা। অতএব, তোমরা তা দিয়েই আমার পরিচয় দিবে যেমনিভাবে আমার প্রতিপালক তা দিয়েই আমার পরিচয় দিয়েছেন। তোমরা বলবে: আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। কিন্তু কবরপূজারীরা তাঁর আদেশের বিরোধিতা না করে ও তাঁর নিষেধাজ্ঞায় লিপ্ত না হয়ে ক্ষান্ত হয়নি। এমনকি তারা তাঁর চরম বিরোধিতা করেছে। আর তারা মনে করছে যে, যদি তারা তাঁকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলে গুণান্বিত করে এবং (বিশ্বাস করে যে,) তাঁকে ডাকা যাবে না, তাঁর দ্বারা সাহায্য চাওয়া যাবে না, তাঁর জন্য মানত করা যাবে না, তাঁর বসতঘরের চতুষ্পার্শ্বে তাওয়াফ করা যাবে না এবং তাঁর হাতে কোনো কিছুই নেই এবং তিনি আল্লাহর জানানো ছাড়া কোন গায়েব জানেন না, তাহলে তাঁর অধিকার খর্ব ও তাঁকে অসম্মান করা হবে। তাই তারা তাঁকে তাঁর মর্যাদার উপরে উন্নীত করেছে এবং তাঁর মাঝে এমন কিছু দাবি করেছে যা খ্রিস্টানরা ‘ঈসা (আলাইহিস-সালাম) এর মধ্যে দাবি করেছে অথবা তার কাছাকাছি। তাই তারা তাঁর নিকট গুনাহ মাফ ও বিপদ দূর করার প্রার্থনা করে।

শাইখুল-ইসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) কোনো এক কিতাবে তাঁর যুগের জনৈক লোক থেকে ইস্তেগাসাহ সম্পর্কে উল্লেখ করেন যে, সে যেসব বিষয়ে কেবল আল্লাহ ছাড়া কারো নিকট ফরিয়াদ করা যায় না সেসব বিষয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে ফরিয়াদ করা বৈধ বলেন। সে এ বিষয়ে একটি কিতাবও লিখেছে। আর সে বলতো, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গায়েবের সকল চাবির জ্ঞান রাখেন যার জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ রাখে না।

তাঁর মতো আরেকজন থেকে তিনি বর্ণনা করেন, যে শিক্ষকতা করতো এবং তাকে ফতোয়াদাতা বলা হতো সে বলতো, আল্লাহ যা জানেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তা জানেন এবং আল্লাহ যা করতে সক্ষম তিনিও তা করতে সক্ষম। তাঁর মৃত্যুর পর এ গোপন রহস্যটি হাসানের নিকট স্থানান্তরিত হয়, অতঃপর হাসানের বংশধারা হয়ে তা আবুল হাসান শাযিলীর পর্যন্ত স্থানান্তরিত হয়।

তারা বলে, এটি হলো সমগ্র গুণেগুনান্বিত সত্তা গাউস কুতুবের স্থান। তাদেরই কেউ আল্লাহর বাণী সম্পর্কে বলে,

আর সকাল-সন্ধ্যায় তোমরা তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর।

সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ৯

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি সকাল-বিকাল পবিত্রতা ঘোষণা করেন।

তাদের কেউ বলে, আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ইবাদাত করি। ফলে তারা রাসূলকে মা’বূদ বানাতো।

আমি বলি, বূসিরী বলেছে:

নিশ্চয়ই আপনার অনুগ্রহেই দুনিয়া ও তার সতীন (আখেরাত)। আর আপনার জ্ঞানসমূহের কিয়দংশই হলো লূহ ও কলমের জ্ঞান।

তিনি দুনিয়া ও আখিরাতকে তার দান বলেই আখ্যায়িত করলেন। তিনি নিশ্চিত করলেন যে, তিনি লাওহে মাহফূযে যা রয়েছে তা জানেন। আর এ বক্তব্যই শাইখুল-ইসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) ঐ শিক্ষক থেকে বর্ণনা করেছেন। এর সবই সুস্পষ্ট কুফর।

আশ্চর্য ব্যাপার হলো শয়তানই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ভালোবাসা এবং তাঁর সম্মান ও অনুসরণের রূপে তাদের সামনে এগুলো তুলে ধরেছে। এটিই হলো অভিশপ্তের কাজ। কারণ, তার আবশ্যক কাজই তো হলো সত্যকে মিথ্যার সাথে মিলিয়ে সকল ডাকে সারাদানকারী পশুরূপীদের মাঝে চালু করা। যারা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত নয় এবং যারা শক্ত কোন খুঁটির নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেনি। কারণ এটি সম্মান নয়। সম্মানের মূল স্থান হলো অন্তর, মুখ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর তারা তার থেকে সবচেয়ে দূরে। কারণ, অন্তরের সম্মান হলো তাঁকে বান্দা ও রাসূল বিশ্বাস করার পরবর্তী ধাপ, যেমন তাঁর ভালোবাসাকে নিজের জীবন, পিতা-মাতা, সন্তান ও সকল মানুষের ভালোবাসার উপর প্রাধান্য দেয়া। আর এ মহব্বতকে সত্যারোপ করে দু’টি জিনিস:

দুটির একটি: তাওহীদকে ভেজাল মুক্ত করা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটিকে ভেজাল মুক্ত করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে তিনি সব দিক থেকে শির্কের কারণসমূহ ও তার মাধ্যমগুলো নির্মূল করেছেন। এমনকি জনৈক ব্যক্তি তাঁকে বলল: আল্লাহ ও আপনি যা চেয়েছেন। তিনি বললেন:

তুমি কি আমাকে আল্লাহর শরীক বানালে?! বরং আল্লাহ একাই যা চেয়েছেন।

এটি আহমাদ বর্ণনা করেন। তিনি গাইরুল্লাহর নামে কসম খেতে নিষেধ করেছেন। তিনি জানিয়ে দেন যে, এটি শির্ক। আর তিনি কবরের দিকে সালাত আদায় বা কবরকে মসজিদ বানাতে অথবা মেলার জায়গা বানাতে অথবা কবরের উপর বাতি জ্বালাতে নিষেধ করেন। বরং তাঁর দীনের ভিত্তিই হলো এ মূল নীতির উপর যা নাজাতের যাঁতার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি যেভাবে স্বীয় কথা, কাজ ও তাওহীদ বিরোধী মাধ্যমসমূহ বন্ধের মাধ্যমে সেটিকে সাব্যস্ত করেছেন তা আর কেউ করেননি। অতএব রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সম্মান (তাওহীদের ক্ষেত্রে) তাঁকে অনুসরণ দ্বারা হয়, তাঁর বিধোধিতা দ্বারা হয় না।

দ্বিতীয়টি হলো, ধর্মের মূল ও শাখাগুলোর সকল সূক্ষ্ম ও অসূক্ষ্ম বিষয়ে তাঁকে এককভাবে বিচারক মনে করে তাঁর খাঁটি অনুসরণ করা। উপরন্তু তাঁর বিচারে সন্তুষ্ট হয়ে সেটিকে মাথা পেতে মেনে নেয়া এবং তার বিরোধী ও বিপরীত মত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করা। যাতে তিনিই হন একক ফায়সালাকারী যাঁর কথা গ্রহণ ও অনুসরণ করা হয় এবং যার বিপরীতটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। যেমনিভাবে তাঁর প্রতিপালক হচ্ছেন একক মা’বূদ, পূজ্য ও স্রষ্টা, যাঁর নিকট ফরিয়াদ করা হয়, যাঁর উপর ভরসা করা হয়, যাঁর নিকট আশা ও যাঁকে ভয় করা হয়, গুনাহ মাফ ও বিপদ দূর করার জন্য যাঁর নিকট এককভাবে আশা করা হয়, যাঁর দানই হলো দুনিয়া ও আখিরাত, যিনি সকল সৃষ্টিকে এককভাবে সৃষ্টি করেছেন, তাদেরকে এককভাবে রিযিক দিচ্ছেন, এককভাবে তাদের পুনরুত্থান করবেন, যিনি ক্ষমা ও দয়া করেন, হিদায়েত দেন ও পথভ্রষ্ট করেন, যিনি এককভাবে কাউকে ভাগ্যবান ও দুর্ভাগা করেন। এসব ব্যাপারে অন্য কারো কোন ক্ষমতা নেই। সে যেই হোক না কেন। না নবী, না জিব্রীল, না অন্য কেউ। এটিই হলো সত্যিকারের সম্মান যা সম্মানিত সত্তার অবস্থা মাফিক। যা সম্মানকারীর দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের জন্য উপকারী এবং যা তার ঈমানের জন্য বাধ্যতামূলক ও আবশ্যক। আর মুখের সম্মান হলো তাঁর যথোপযুক্ত প্রশংসা করা যেভাবে তাঁর প্রতিপালক ও তিনি নিজের প্রশংসা করেছেন, যাতে কোন বাড়াবাড়ি ও ত্রুটি নেই। যেমন করেছে কবরপূজারীরা। কারণ, তারা তাঁর প্রশংসায় চরম বাড়াবাড়ি করেছে। আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সম্মান হলো তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁর দীনকে বিজয়ী করার চেষ্টা করা। তাঁর আনীত ধর্মের সাহায্য করা ও তাঁর বিরোধীদের সাথে জিহাদ করা।

মোট কথা, উপকারী সম্মান হলো তাঁর দেয়া সংবাদকে বিশ্বাস করা, তাঁর আদেশের আনুগত্য করা, তাঁর নিষিদ্ধ ও তিরস্কৃত বিষয় থেকে বিরত থাকা, তাঁর জন্য শত্রুতা ও মিত্রতা এবং ভালোবাসা ও ঘৃণা করা। তাঁকে এককভাবে ফায়সালাকারী মানা, তাঁর বিচারে সন্তুষ্ট থাকা এবং তিনি ছাড়া কোন তাগূতকে মেনে না নেয়া, যার নিকট ফয়সালা নিয়ে যাওয়া হয়, বরং যা তাঁর কথার মাফিক হবে তা গ্রহণ করবে। আর যা তাঁর কথার বিরোধী হবে তা প্রত্যাখ্যাত করবে, বা বিশ্লেষণ করবে বা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। আল্লাহ সাক্ষী আর তিনি সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট এবং তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর রাসূলগণ ও আওলিয়ায়ে কিরাম এ ব্যাপারে সাক্ষী যে, তাওহীদপন্থীদের বিরোধী কবরপূজারীরা এমন নয়। আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই।

এটি হলো শাইখুল-ইসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) এর কথা। তিনি তাঁর যুগের ও পূর্বের এমন কিছু তাওহীদের ব্যাপারে মূর্খ জাতির বর্ণনা দিয়েছেন যারা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ভালোবাসার দাবি করে তাঁর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি তারা তাঁকে এমন কিছু বিশেষণে বিশেষিত করেছে যেগুলোর উপযুক্ত আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়। যেমন: ক্ষমতা, জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণ। এমনকি তারা তাঁর জন্য আল্লাহর খাঁটি অধিকারও ব্যয় করে। যেমন: দু‘আ, আশা, তাঁর দিকে সকল ব্যাপারকে সোপর্দ করা ও তাঁর উপর ভরসা করা। শাইখ সুলাইমান (রাহিমাহুল্লাহ) কিতাবুত-তাওহীদের ব্যাখ্যা গ্রন্থের ১৮৬ ও তৎপরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রশংসায় যারা বাড়াবাড়ি করেছে তাদের কিছু কথা উল্লেখ করেছেন। তেমনিভাবে তিনি বূসিরীর বুরদাহ নামক কবিতার কিছু পংক্তি উল্লেখ করেছেন। যেমন: তার কথা,

হে সম্মানিত সৃষ্টি! আমার আর কে আছে ব্যাপক বিপদ আসলে আমি আপনাকে ছাড়া যার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করতে পারি।

এর পরের আরো কয়েকটি পংক্তি। এরপর তিনি তাতে থাকা সুস্পষ্ট শির্কের বর্ণনা দেন। আর তিনি আল-বারায়ীর কিছু কবিতাও উল্লেখ করেন যাতে সে প্রচুর অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করেছে এবং স্বীয় রবকে ভুলে সুস্পষ্টভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইবাদাতে পতিত হয়েছে। অনুরূপভাবে না’মী “মা‘আরিযুল-আলবাব” নামক কিতাবের ১৬৯ ও তৎপরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে বাড়াবাড়িকারীদের কিছু কথা ও মৃতদের সাথে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে তাদের কিছু অতিরঞ্জনের কথাও উল্লেখ করেছেন। তম্মধ্যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে সুস্পষ্ট শিরক সম্বলিত কিছু পংক্তিও রয়েছে। যেগুলোর শুরু হলো তার কথা:

হে আমার মনিব! হে দীনের নির্যাস! হে আমার নির্ভরতার জায়গা! হে আমার ভরসা! বরং হে আমার ভাণ্ডার! এবং হে আমার গর্ব!

আমি যে বস্তুর প্রয়োজনের আশঙ্কা করছি সে ব্যাপারে আপনিই আমার আশ্রয়স্থল। এমনকি আপনি দুনিয়ার বিপদের ক্ষেত্রেও আমার আশ্রয়স্থল।

এ জাতীয় আরো অনেকগুলো শির্কী কবিতা। তিনি এগুলোর ব্যাপারে এভাবে টিকা লিখেন যে, আমি জানি না এ চাওয়ার ধরণ ও উদ্দেশ্য হাসিল করার অবস্থার পর স্রষ্টা কোন অর্থে (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে) আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী থাকলো?!

এ খবীস মুশরিক শিরকের আর কোন্ বিষয়টিই বাকি রাখলো?! কারণ, মূর্তিপূজারী মুশরিকরাও আল্লাহ ছাড়া তারা যেগুলোর ইবাদাত করে তাদেরকে এর কিংবা এর চেয়ে ছোট বস্তুরও উপযুক্ত করে না।

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজ উম্মতের ব্যাপারে এ ধরনের বাড়াবাড়ির আশঙ্কা করেছেন এবং তিনি তাদেরকে এর কারণগুলোর ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আবু দাউদ (রাহিমাহুল্লাহ) একটি সুন্দর সূত্রে আব্দুল্লাহ ইবনুশ-শিখখীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন:

একদা আমি বনু আমিরের প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে বললাম: আপনি হলেন আমাদের মনিব। তখন তিনি বললেন: মনিব হলেন আল্লাহ তা‘আলা। আমরা বললাম: আপনি হলেন আমাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠ ও মহান ব্যক্তি। তখন তিনি বললেন: তোমরা এ কথা বলতে পারো বা এর কিছুটা।

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত:

কিছু লোক বললো: হে আল্লাহর রাসূল! হে আমাদের সর্বোত্তম ও সর্বেোত্তমের ছেলে! হে আমাদের নেতা ও আমাদের নেতার ছেলে! তখন তিনি বললেন: হে মানুষ! তোমরা নিজেদের কথা বলে যাও। তবে শয়তান যেন তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট না করে। আমি হলাম মুহাম্মাদ, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে অবস্থানে রেখেছেন তা থেকে তোমরা আমাকে আরো উপরে উঠাবে সেটা আমি পছন্দ করি না।

নাসায়ী উক্ত হাদীসটিকে সুন্দর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

হাদীসের ভাণ্ডারে এ জাতীয় অনেক বর্ণনা রয়েছে। যেমন: রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বাণী:

নিশ্চয়ই আমার কাছে কোন কিছুর ফরিয়াদ করা যাবে না। কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করা যাবে।

ত্বাবরানী এটি বর্ণনা করেছেন।

পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বললেন:

আল্লাহ যা চেয়েছেন ও আপনি যা চেয়েছেন। তিনি বললেন: “তুমি কি আমাকে আল্লাহর সদৃশ বানালে? বরং আল্লাহ একাই যা চেয়েছেন:

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকল সৃষ্টির নেতা, তাদের মধ্যকার সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম। কিন্তু তিনি প্রশংসাকে অপছন্দ করতেন বিশেষ করে প্রশংসিতের সামনে। এমনকি তিনি বলেন:

যখন তোমরা প্রশংসাকারীদের সাক্ষাত পাবে, তাদের চেহারায় মাটি ছিঁটিয়ে দাও।

মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এটির কারণ সম্মুখ প্রশংসা প্রশংসিতকে অহমিকা ও অহঙ্কারে ফেলে দেয়, যা আমলগুলোকে নষ্ট করে দেয় অথবা তা তাওহীদের পূর্ণতার পরিপন্থী।

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজ রবের গোলামিতে গর্ববোধ করতেন। সেটি হলো তাঁর সামনে লাঞ্ছিত ও অবনত হওয়া। এটি মূলত সম্মান ও ফযীলতের ব্যাপার। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বাণীতে বান্দা বলে তাঁকে উল্লেখ করেছেন:

“তোমরা যদি আমার বান্দার উপর নাযিলকৃত কুর‘আনের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে থাকো

সূরা আল-বাক্বারাহ: আয়াত: ২৩

তাঁর আরেকটি বাণীতে:

“পবিত্র সেই সত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রিভ্রমণ করিয়েছেন।

সূরা আল-ইসরা: আয়াত: ১

তাঁর আরেকটি বাণীতে:

“সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর বান্দার উপর কিতাব নাযিল করেছেন”।

সূরা আল-কাহফ: আয়াত: ১

এবং তার বাণী:

“আর নিশ্চয়ই যখন আল্লাহর বান্দা দাঁড়িয়ে তাঁকে ডাকছিলো”।

সূরা আল-জিন: আয়াত: ১৯

কারণ, আল্লাহ তা‘আলার গোলামি চায় চরম লাঞ্ছনা ও চূড়ান্ত ভালোবাসা। আর আল্লাহর জন্য লাঞ্ছনা দাবি করে নতিস্বীকার, ভয় ও আল্লাহর জন্য অবনত হওয়া এবং নিজকে নিচু, নিন্দিত ও তাঁর দেয়া দায়িত্বে ত্রুটিকারী মনে করা। ফলে সে নিজকে তিরস্কার করবে এবং নিজ রবের দয়া ও অনুগ্রহের কথা স্বীকার করবে। অনুরূপভাবে তাঁর ভালোবাসার দাবি হচ্ছে এমন কথা, কাজ ও ইচ্ছাকে ভালোবাসা বা ঘৃণা করা যেগুলোকে আল্লাহ ভালোবাসেন বা ঘৃণা করেন। ফলে এরই মাধ্যমে রব্বুল-আরবাব তথা আল্লাহর গোলামির পূর্ণতার প্রকাশ ঘটবে।

পঞ্চমতঃ তাঁর মৃত্যু অন্যান্য রাসূল ও নবীদের মৃত্যুর ন্যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“নিশ্চয়ই তিনিও মরবেন এবং তোমরাও মরবে।

সূরা আয-যুমার: আয়াত: ৩০

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

আর আপনার পূর্বে কোন মানুষকে আমরা স্থায়ী জীবন দান করিনি; সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি অনন্ত জীবনসম্পন্ন হয়ে থাকবে?

সূরা আল-আম্বিয়া: ৩৪-৩৫

সব মুসলমান এ কথা মানে যে, নিশ্চয়ই পূর্বেকার সব নবী মৃত্যু বরণ করেছেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের জন্য দুনিয়াতে যতটুকু জীবন নির্ধারণ করেছেন তা শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলে তাঁরা এখন বারযাখী জগতের অধিবাসী। যেহেতু কুর‘আনের উদ্ধৃতি শহীদদের জীবন আছে বলে দাবি করে যেমন: আল্লাহর বাণী:

আর যারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত। তাদেরকে রিযিক দেয়া হয়।

সূরা আ-ল-ইমরান: আয়াত: ১৬৯

তাহলে নবীগণ এ জীবনের আরো বেশি উপযুক্ত। আবার এ কথাও সবার জানা যে, শহীদগণ এ দুনিয়ার জীবন থেকে বেরিয়ে গেছেন এবং তাঁদের সম্পদ ওয়ারিশদের মাঝে বন্টন করা হয়েছে, তাঁদের স্ত্রীরা অন্যদের জন্য হালাল হয়ে গিয়েছে। এটি তাঁদের মৃত্যুর সুস্পষ্ট দলীল। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে তাঁর নিম্নোক্ত বাণীতে মৃত বলতে নিষেধ করেছেন:

যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা অনুভব করতে পার না।

সূরা আল-বাকারাহ: আয়াত: ১৫৪

এ জীবনের ধরন আমরা জানি না। তবে আমরা এ কথা নিশ্চিত জানি যে, তাদের রূহগুলো তাদের শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে, তাদের বয়সও শেষ হয়ে গিয়েছে এবং তাদের আমলগুলোও খতম হয়ে গিয়েছে। বিশুদ্ধ হাদীসে তাদের জীবনের ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে যে, তাদের রূহগুলোকে সবুজ পাখির পেটে রাখা হয়েছে। আর সেগুলো জান্নাতের গাছে ঝুলে আছে। এ বর্ণনা এ কথা নিশ্চিত করে যে, তাদের রূহগুলো তাদের শরীরগুলোকে ছেড়ে গিয়েছে। তারা এ বিশেষ জীবন দ্বারাই বিশেষিত হয়েছে।

আর এ কথা জানা যে, নবী ও রাসূলগণ সর্বাবস্থায় এ জীবনের বেশি উপযুক্ত। তবে এ জীবন তাদেরকে কারো ডাকে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা দেয় না এবং না কারো আবেদনে কোন কিছু দেয়ার সুযোগ দেয়। তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহর নবী বারযাখী জীবনে রয়েছেন, যা শহীদদের জীবনের চেয়ে আরো পরিপূর্ণ। তবে তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর শরীরটি জীর্ণ শীর্ণ হওয়া থেকে বাঁচবে। যেমন: আবু দাঊদের সূত্রে আউস ইবনু আউস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:

তোমাদের দিনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো জুমু‘আর দিন। সুতরাং তোমরা সেদিনে বেশি বেশি আমার উপর দরূদ পাঠাও। কারণ, তোমাদের দরূদগুলো আমার নিকট উপস্থাপন করা হয়। সাহাবায়ে কিরাম বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! কীভাবে আপনার নিকট উপস্থাপন করা হবে; অথচ আপনার হাড়গুলো তখন জীর্ণশীর্ণ হয়ে যাবে? তিনি বললেন: আল্লাহ তা‘আলা যমীনের ওপর নবীদের শরীর খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন।

এ হাদীসটি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল যে, তাঁর রূহ তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে এবং সেটিকে সুদূর উপরের বন্ধু তথা আল্লাহর নিকট উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। যেমন তা ছিলো দুনিয়া থেকে তাঁর বিদায় নেয়ার সময়কার শেষ আবেদন।

তেমনিভাবে হাদীসে আবু হুরাইরাহর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বাণীটি বর্ণিত হয়েছে যে,

“কোন মুসলমান আমার উপর সালাম দিলে আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট আমার রূহটি ফেরত দেন যাতে আমি তার সালামের উত্তর দিতে পারি”।

এটি আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন।

এ উত্তর দেয়ার ধরনে মতভেদ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলাই এ সম্পর্কে ভালো জানেন। আবু দাঊদ (রাহিমাহুল্লাহ) একটি হাসান সূত্রে আবু হুরাইরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:

তোমরা নিজেদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করো না, আর আমার কবরকে ঈদ বা মেলায় পরিণত করো না এবং তোমরা আমার ওপর দুরূদ পড়ো। কারণ, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন তোমাদের দুরূদ আমার কাছে পৌঁছে যায়।

হাফিয যিয়া মুখতারাহ নামক কিতাবে এবং অন্যরা আলী ইবনু হুসাইন ইবনু আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি একদা জনৈক ব্যক্তিকে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কবরের একটি ফাঁকা জায়গায় ঢুকে সেখানে দু‘আ করতে দেখলে তিনি তাকে নিষেধ করেন এবং তিনি বলেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি হাদীসের কথা বলবো না যা আমি আমার পিতার সূত্রে আমার নানা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে শুনেছি। তিনি বলেন:

তোমরা আমার কবরকে ঈদ বা মেলায় পরিণত করো না। আর তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করো না। কারণ, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন তোমাদের সালাম আমার কাছে পৌঁছে যায়।

আর সা‘ঈদ ইবনু মানসূর বলেন: আব্দুল-আযীয ইবনু মুহাম্মাদ আমার নিকট বর্ণনা করেন যে, সুহাইল ইবনু আবী সুহাইল আমাকে সংবাদ দিলেন যে, একদা হাসান ইবনু হাসান ইবনু আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) আমাকে কবরের পাশে দেখলে তিনি আমাকে ডেকে বললেন: কী হলো, আমি তোমাকে কবরের পাশে দেখছি কেন? আমি বললাম: আমি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে সালাম দিয়েছি। তিনি বললেন: যখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করবে তখন সালাম দিবে। অতঃপর তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,

তোমরা আমার কবরকে ঈদ বা মেলাক্ষেত্রে পরিণত করো না। আর তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করো না। বরং তোমরা যে কোন জায়গা থেকে আমার উপর দরূদ পাঠ করো। কারণ, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন তোমাদের দরূদ আমার কাছে পৌঁছে যায়। ইহুদিদের উপর আল্লাহর লা’নত পড়ুক যারা নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। তোমরা ও উনদুলুসের অধীবাসী সবাই এ ক্ষেত্রে সমান।

এসব বর্ণনা প্রমাণ করে যে, (তার নিকট সালাম পৌঁছার) বিষয়টি সালাফদের নিকট প্রসিদ্ধ ছিল এবং তারা এ সুন্নাতটির হিফাযত ও প্রচারে খুব আগ্রহী ছিলেন। আর তার বাণীর অর্থ:

তোমরা নিজেদের ঘরগুলোকে কবর বানিয়ো না।

অর্থাৎ, সালাত আদায়, দু‘আ ও কুর‘আন তিলাওয়াত করা থেকে তোমরা ঘরকে বিরান বানিয়ো না। ফলে তা কবরের মতো হবে, যেখানে সালাত আদায় করা জায়েয নয়। এখানে উদ্দেশ্য নফল সালাত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বাণী: তোমরা আমার কবরকে ঈদ বা মেলায় পরিণত করো না। এখানে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিশেষভাবে ও নির্দিষ্ট জমায়েতের ঘটন করে তাঁর কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছেন। যাতে তা ঈদে পরিণত না হয়। যেখানে নির্দিষ্ট সময়ে মানুষ বারবার একত্রিত হয় এবং সেখানে খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা হয়। যা প্রত্যেক বছর একবার বা কয়েকবার ঘুরে আসে। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, আমরা যেখানেই থাকিনা কেন আমাদের দরূদগুলো তাঁর নিকট পৌঁছে যায়। অর্থাৎ, দূর ও কাছ থেকে তাঁর নিকট সালাত ও সালাম পৌঁছানো যায়। অতএব, কবরের পাশে গিয়ে তাঁকে সালাত ও সালাম দেয়ার কোন বিশেষত্ব নেই। এটিই হলো হাসান ইবনু হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) এর কথার অর্থ। তিনি বলেছিলেন, তোমরা ও উনদুলুসবাসীরা একই সমান।

সুতরাং যে ব্যক্তি শুধু সালাম দেয়ার ইচ্ছায় কবরের কাছে গেলো; তার উদ্দেশ্য মসজিদ নয় তাহলে সে কবরকে ঈদে পরিণত করলো। যেমনটি হাসান ইবনু হাসান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বুঝেছেন।

ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) মদীনাবাসীদের জন্য এ ব্যাপারটি অপছন্দ করতেন যে, যখনই কোন ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে তখনই সে নবীর কবরের পাশে আসবে। কারণ, সালাফরা এমন করতেন না। তিনি বলেন: এ উম্মতের শেষ ভাগকে তাই শুদ্ধ করবে যা তার প্রথম ভাগকে শুদ্ধ করেছিল। সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিয়ীরা অধিকাংশ সময় খুলাফায়ে রাশিদীনের পেছনে মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করে সালামের পর নিজেদের গন্তব্যে চলে যেতেন অথবা বসে বসে কুর‘আন তিলাওয়াত ও ইবাদাত করতেন। প্রত্যেক সালাতের পর কবরের নিকট যাওয়া তাঁদের কাছ থেকে সংরক্ষিত হয়নি। বরং তাঁরা তাশাহহুদের মধ্যেই সালাত ও সালাম বলে যথেষ্ট করতেন। আর এটি কবরের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে উত্তম। অথচ তাঁরা আয়িশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এর জীবদ্দশায় ও তারপরে ওলীদ ইবনু আব্দিল-মালিকের যুগে মসজিদের বাড়তি অংশে কবরকে ঢুকানোর পর কবরের চতুষ্পার্শ্বে দেয়াল নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত কবরের নিকট পৌঁছুতে পারতেন। বস্তুত সাহাবায়ে কিরাম সর্বাবস্থায় কবরের পাশে গিয়ে সালাত ও সালামে অভ্যস্ত ছিলেন না। তাঁদের কেউ কেউ বাইরের সফর থেকে আসলে তাঁকে সালাম দিয়ে চলে যেতেন, যেমন ইবনু উমর থেকে বর্ণিত। অন্য কোন সাহাবী থেকে তা সংরক্ষিত নয়। আর তিনিও তা সর্বদা করতেন না। সুতরাং তা সর্বদা বারবার করা বিদ‘আত এবং আল্লাহর পাশাপাশি তাঁর কাছে কিছু চাওয়া ও তাঁকে সম্মান করার বাহনও বটে।

ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যে ব্যক্তি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে সালাম দিয়ে তার নিজের জন্য দু‘আ করতে চায় সে যেন কবরমুখী না হয়ে বরং কিবলামূখী হয়, যা দিকসমূহের উত্তম দিক ও দু‘আ কবুল হওয়ার সম্ভাবনাময়। তবে ইমাম মালিক থেকে একটি কাহিনী বর্ণিত, তিনি খলীফা মানসূরকে বললেন, কেন আপনি কবরের দিক থেকে চেহারা ফিরিয়ে নিচ্ছেন? বরং আপনি কবরমুখী হয়ে তাঁর সুপারিশ কামনা করুন—এটি একটি মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনী। যেমনটি উলামায়ে কিরাম অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছেন।

ষষ্ঠতঃ শুধু নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কবর যিয়ারতের জন্য সফরকে নিষেধ করা।

সিহাহ, সুনান ও মাসানীদে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি বলেন:

“তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও সফরের বন্দোবস্ত করা যাবে না: মসজিদুল-হারাম, আমার এ মসজিদ ও মসজিদে আক্বসা”।

এর মানে হলো, ইবাদাতের উদ্দেশ্যে কোন জায়গা বা ভূখণ্ডের দিকে এ বিশ্বাসে সফর করা নিষেধ যে তাতে আমল করলে বহুগুণ সাওয়াব পাওয়া যাবে অথবা অন্য জায়গার উপর এর বিশেষত্ব রয়েছে। এ নিষেধের মধ্যে রয়েছে কবরসমূহের উদ্দেশ্যে যদিও তা নবীগণের কবর হয় সফর করা। কারণ, এটি সেগুলোকে ঈদ বা মেলাক্ষেত্র বানানোর সামিল। আর এটি কবরবাসীদের মাঝে এমন কিছু বিশ্বাস করার সামিল যা আল্লাহর পাশাপাশি তাদের ইবাদাতের কারণ হয়। যেমনটি এ যুগের ও পূর্ব যুগের মুশরিকদের মধ্যে ঘটেছে। যেমন তারা তাদের ধারণা মতে তথাকথিত ওলীদের কবরে যাওয়ার জন্য লম্বা লম্বা সফর করে, অনেক কষ্টক্লেশ সহ্য করে ও প্রচুর সম্পদ খরচ করে। যখন তারা এ সব মাজারে পৌঁছায় তখন তারা সেখানে তারা তাদের বাহনকে থামায় এবং তারা এ সব মৃতদের চিৎকার ও ডাকাডাকি আরম্ভ করে। তারা সেখানে এমন কিছু আমল করে যা আল্লাহ রাব্বুল-আলামীন ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন কবরগুলোর তাওয়াফ করা, সেগুলোর মাটি হাত দিয়ে মাসেহ করা, তাদের কাছে দু‘আ করা এবং তাদের জন্য যবেহ ও কুরবানী করা ইত্যাদি।

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিনিটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও সফর করার নিষেধাজ্ঞার ভেতর এটিই আশঙ্কা করেছেন।

এ ব্যাপারে শাইখুল-ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) একটি পুস্তিকা রচনা করেন। সেখানে শুধু নবী ও নেককারদের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করার বিধান সম্পর্কে আলেমগণের মতভেদ তুলে ধরেন। তিনি নিষিদ্ধ হওয়াকে প্রাধান্য দেন। তিনি ইবনু বাত্ত্বা, আবুল-ওয়াফা ইবনু আক্বীল, জুওয়াইনী, কাজী ইয়ায ও অন্যদের এটিই মত ছিল উল্লেখ করেন। বরং এটি অধিকাংশ আলিমেরই কথা। ইমাম মালিক তাই স্পষ্ট করে বলেছেন। ইমামগণ থেকে কেউ তাঁর বিরোধিতা করেননি। তবে এর অর্থ এ নয় যে, সফর করা ছাড়া হলেও কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ। বরং হাদীসে এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং এটি আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। একজন যিয়ারতকারী মৃতদের জন্য দু‘আ ও রহমত প্রার্থনা করে। আর এটি তার নিকটস্থ কবরস্থানেই পালন করা যায়। কারণ, কোন এলাকা কবরস্থান থেকে খালি নয়। কিন্তু দূর দেশের কোন কবর কিংবা ভূখণ্ডের জন্য যানবাহন প্রস্তুত ও সফর করা সাধারণত কবরস্থ ব্যক্তি মহান এবং তাকে সম্মান করা, তাকে ডাকা ও তার নিকট কিছু আশা করা যায় বিশ্বাস থেকে হয়। ফলে সে তার জন্য খাঁটি ইবাদাত সমর্পণ করে। অতএব তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও সফর করার নিষেধাজ্ঞা এসেছে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

ইমাম আহমাদ ও অন্যরা ইবনু উমর ও আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তাঁরা ত্বর পাহাড়ে সালাত আদায়ের জন্য সফর করতে নিষেধ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও সফর করা নিষেধের হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলা ত্বর পাহাড়ের কথা উল্লেখ করে সেটিকে পবিত্র উপত্যকা ও বরকতময় ভূখণ্ড বলে আখ্যায়িত করেন এবং সেখানেই তাঁর বান্দা মূসা (আলাইহিস-সালাম) এর সাথে তিনি কথা বলেন।

অতএব, যে ব্যক্তি মসজিদে নববীর উদ্দেশ্যে মদীনায় সফর করে যাতে এক ওয়াক্ত সালাত আদায় এক হাজার সালাত আদায়ের সমান হয়, তার সফরটি ইবাদত ও নৈকট্য লাভের কারণ হবে। তবে মসজিদে সালাত আদায়ের পর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), সাহাবায়ে কিরাম এবং শহীদদের কবরে গিয়ে সালাম ও তাদের জন্য দু‘আ করা বৈধ।

কিন্তু যে ব্যক্তি শুধু কবরের উদ্দেশ্যে সফর করে তার ওপর সালাম বা তার নিকট দু‘আ করার জন্যে, তার সফরটি নিকৃষ্ট বিদ‘আত। কারণ, সে হাদীসের বিরোধিতা করল।

তোমরা আমার কবরকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা আমার ওপর দরূদ পড়। কারণ, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন তোমাদের দরূদ আমার কাছে পৌঁছে যায়।

কবর শরীফের যিয়ারতের ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসগুলোর সবই দুর্বল বা বানোয়াট। যেমনটি আলেমগণ বিশ্লেষণ করেছেন। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আল্লাহই তাওফীকদাতা।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন