মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
এই কালেমার ফযীলত এবং ইসলামে এর গুরুত্ব, বর্ণনাকারীর বর্ণনা এবং জ্ঞানীদের জ্ঞানের উর্ধ্বে। বরং এর ফযীলত এবং গুরুত্ব এত বেশি যা, মানুষের মনে এবং অন্তরেও কখনো উদিত হয় নি। তবে মুসলিম ব্যক্তিকে এই স্থানে একটি বড় এবং মহৎ বিষয় জানা উচিৎ, যা এই বিষয়ের মগজ এবং আসল, তা হচ্ছে, এই কালেমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা আছে যা বুঝা জরুরী। কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে যা আয়ত্ব করা প্রয়োজন। জ্ঞানীদের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে যে, এই কালেমার মানে না বুঝে শুধু মুখে উচ্চারণে কোনো লাভ নেই, অনুরূপভাবে তার চাহিদা অনুযায়ী আমল না করাতেও কোনো উপকার নেই। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আল্লাহ ব্যতীত তারা যাদের আহ্বান (ইবাদত) করে, তারা সুপারিশের অধিকারী নয়।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৬]
আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরগণ বলেন, অর্থাৎ কিন্তু যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দেয়। মুখে যা বলে, অন্তরে তা বিশ্বাস করে (শুধু তাদের সাক্ষ্যই উপকারে আসবে)। কারণ, সাক্ষ্যর দাবী হচ্ছে, যার সাক্ষী দেওয়া হচ্ছে তার সম্বন্ধে জ্ঞান রাখা। অজানা বিষয়ে সাক্ষ্য হয় না। অনুরূপ সাক্ষ্যের দাবী হচ্ছে সত্যতা এবং এটির বাস্তবায়ন। বুঝা গেল, এই কালেমার সাথে আমল ও সত্যতার সাথে সাথে এর সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা জরুরী। জ্ঞানের দ্বারাই বান্দা খৃষ্টানদের রীতি-নীতি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে, যারা না জেনে আমল করে। আমলের মাধ্যমে মানুষ ইয়াহূদীদের চরিত্র থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে, যারা জানে তবে আমল করে না। জ্ঞানের দ্বারাই বান্দা মুনাফিকদের চরিত্র থেকে নাজাত পায়, যারা অন্তরে যা আছে, প্রকাশ করে তার বিপরীত। এরপর বান্দা আল্লাহর সরল পথ অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাদের অন্তর্ভুক্ত হয় যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। যাদের প্রতি গযব বর্ষণ করেন নি এবং তারা পথভ্রষ্টও নয়।
সারকথা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য ও লাভজনক হবে যে ব্যক্তি এ কালেমার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক অর্থের জ্ঞান রাখে এবং তা বিশ্বাস করে ও আমল করে। যে যবানে বলে এবং বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমল করে কিন্তু অন্তুরে বিশ্বাস করে না সে তো মুনাফিক। আর যে মুখে বলে কিন্তু তার বিপরীত আমল করে শির্ক করে সে তো কাফির। অনুরূপ যে মুখে বলেছে কিন্তু এর কোনো জরুরী বিষয় এবং দাবীসমূহের কোনো কিছু অস্বীকার করার কারণে ইসলাম থেকে মুরতাদ হয়ে গেছে, এ কালেমা তার কোনো লাভ দিবে না যদিও সে হাজার বার তা পাঠ করে। অনুরূপ যে তা মুখে বলে অথচ সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্যে কোনো প্রকার ইবাদত করে, তারও কোনো লাভ দিবে না। যেমন, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দো‘আ-প্রার্থনা করা, যবেহ করা, মান্নত করা, ফরিয়াদ করা, ভরসা করা, দুঃখ কষ্টের সময় প্রত্যাবর্তন করা, আশা-আকাংখা করা, ভয় করা এবং ভালোবাসা ইত্যাদি। তাই যে ব্যক্তি ইবাদতের প্রকারসমূহের কোনো কিছু অন্যের জন্য করল, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করা যায় না, সে তো মহান আল্লাহর সাথে শরীক করল, যদিও সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়ে থাকে। কারণ, এই কালেমা, তাওহীদ ও ইখলাসের যে দাবী রাখে সে অনুযায়ী সে আমল করল না, যা প্রকৃত পক্ষে এই মহান কালেমার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। [তায়সীরুল আযীযিল হামীদ, পৃ. ৭৮।]
কারণ, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’এর অর্থ হচ্ছে: কোনো সত্য উপাস্য নেই একজন ব্যতীত, তিনি হচ্ছেন এক আল্লাহ; যার কোনো অংশীদার নেই।’ ‘ইলাহ’ অভিধানিক অর্থে উপাস্যকে বলা হয়। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই। যেমন, আল্লাহ বলেন,
“আপনার পূর্বে আমরা যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই দিয়েছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো (সত্য) উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫] এর সাথে আল্লাহর এই বাণীও ﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [ النحل : ٣٦ ] “অবশ্যই আমরা প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি যেন, তারা কেবল আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাগুত বর্জন করে।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬] এ দ্বারা স্পষ্ট হলো যে, ‘ইলাহ’ এর অর্থ মা‘বুদ (উপাস্য) এবং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ কেবল এক আল্লাহর জন্যই ইবাদত সুনিশ্চিত করা এবং তাগুতের ইবাদত থেকে বিরত থাকা। এ কারণে কুরাইশ কাফিরদেরকে যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করতে বলতেন, তখন তারা বলত:
“তুমি কি আমাদের নিকট শুধু এই উদ্দেশ্যে এসেছো, যেন আমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণ যাদের ইবাদত করতো তাদেরকে বর্জন করি?” [সুরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৭০] তারা এটি তখন বলে যখন তাদের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর দিকে আহ্বান করা হয়; কারণ তারা জানতো যে, এর অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত উপাসনার অস্বীকার এবং তা কেবল এক আল্লাহর জন্য সাব্যস্তকরণ, কোনো শরীক নেই। তাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমায় দু’টি বিষয় পরিলক্ষিত। একটি না বাচক আর একটি হ্যাঁ বাচক।
না বাচক হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপাসনার অস্বীকার। তাই আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু, ফিরিশতাবর্গ হোক বা নবীগণ, তারা উপাস্য নয়। তাদের কোনো উপাসনা হতে পারে না। এ ছাড়া অন্যরা তো আরও যোগ্য নয়।
আর হ্যাঁ বাচক হচ্ছে, শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ইবাদত সুনিশ্চিতকরণ। বান্দা তিনি ছাড়া আর কারও শরণাপন্ন হবে না। ... যেমন, দো‘আ-প্রার্থনা, কুরবানী এবং নযর-মান্নত ইত্যাদি।
কুরআনে কারীমে অনেক প্রমাণ আছে যা, তাওহীদের কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ প্রকাশ করে এবং উদ্দেশ্য বর্ণনা করে। তন্মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
“স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) তার পিতা এবং সম্প্রদায়কে বলেছিল: তোমরা যাদের পূঁজা কর তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে শুধু তাঁরই সাথে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাকে সৎ পথে পরিচালিত করবেন। এই ঘোষণাকে সে স্থায়ী বাণীরূপে রেখে গেছে তার পরবর্তীদের জন্যে যাতে তারা (শির্ক থেকে) প্রত্যাবর্তন করে।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ২৬-২৮]
আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীনে মুমিন বান্দার ঘটনা বর্ণনায় বলেন,
“আমার কী হয়েছে যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে আমি তাঁর ইবাদত করবো না? আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য মা‘বুদ গ্রহণ করবো? দয়াময় (আল্লাহ) আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধার করতেও পারবে না। এরূপ করলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়বো।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ২২-২৪]
“বল: আমি আদিষ্ট হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্য একনিষ্ট হয়ে তাঁর এবাদত করতে। আর আদিষ্ট হয়েছি, আমি যেন আত্মসমর্পণকারীদের অগ্রণী হই। বল: আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হই, তবে আমি ভয় করি মহা দিবসের শাস্তির। বল: আমি ইবাদত করি আল্লাহরই তাঁর প্রতি আমার আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১১-১৪]
আল্লাহ তা‘আলা ফির‘আউনের পরিবারের মুমিন লোকটির ঘটনা বর্ণনা করে বলেন,
“হে আমার কাওম, ব্যাপার কি, আমি তোমাদেরকে দাওয়াত দেই মুক্তির দিকে, আর তোমরা আমাকে দাওয়াত দাও জাহান্নামের দিকে। তোমরা আমাকে দাওয়াত দাও, যাতে আমি আল্লাহকে আল্লাহকে অস্বীকার করি এবং তাঁর সাথে শরীক করি এমন বস্তুকে, যার কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই। আমি তোমাদেরকে দাওয়াত দেই পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল আল্লাহর দিকে। এতে সন্দেহ নেই যে, তোমরা আমাকে যার দিকে আহ্বান কর, ইহকালে ও পরকালে তার কোনো দাওয়াত নেই! আমাদের প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকে এবং সীমালংঘনকারীরাই জাহান্নামী।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৪১-৪৩]
এ মর্মের প্রচুর আয়াত আছে যা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ বিশ্লেষণ করে। আর তা হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত কথিত শরীক ও সুপারিশকারীর ইবাদত থেকে মুক্ত হওয়া এবং কেবল এক আল্লাহর জন্য ইবাদত করা। এটাই হচ্ছে উত্তম তরীকা এবং সত্য দীন, যার কারণে আল্লাহ নবীদের প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর গ্রন্থসমূহ অবতীর্ণ করেছিলেন। শুধু বুলিস্বরূপ মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, অর্থ না বুঝা, দাবী অনুযায়ী আমল না করা, হয়তবা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্যেও ইবাদতের কিছু অংশ করা; যেমন প্রার্থনা করা, ভয় করা, কুরবানী দেওয়া, নযর-মান্নত ইত্যাদি করা। এরূপ করলে বান্দা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমাওয়ালার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। আর না কিয়ামতের দিনে এটি বান্দাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। [তাইসীরুল আযীযিল হামীদ, ১৪০।]
তাই জেনে রাখা ভালো যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ শুধু একটি বিশেষ্য নয় যে, যার কোনো অর্থ নেই। আর না শুধু একটি বাক্য যার কোনো সত্যতা নেই। আর না একটি শব্দ যার কোনো মর্ম নেই। যেমন, অনেকের ধারণা। যারা বিশ্বাস করে যে এই কালেমার আসল রহস্য হচ্ছে শুধু মুখে বলা, অন্তরে কোনো প্রকার অর্থের বিশ্বাস ছাড়াই। কিংবা শুধু মুখে উচ্চারণ করা কোনো প্রকারের বুনিয়াদ বা ভিত্তি স্থাপন ছাড়াই। এটা কখনও এই মহান কালেমার মর্যাদা নয়। বরং এটি একটি এমন বিশেষ্য যার আছে মহৎ অর্থ। একটি এমন শব্দ যার আছে উত্তম বিশ্লেষণ যা, সমস্ত বিশ্লেষণ হতে উৎকৃষ্ট। যার মূল কথা, আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত কিছুর উপাসনা হতে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করা এবং এক আল্লাহর উপাসনার দিকে মনযোগ দেওয়া, বিনয়-নম্রতার সাথে, লোভ-লালসার সাথে, আশা-ভরসার সাথে এবং দো‘আ-প্রার্থনার সাথে। তাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ওয়ালা কারো নিকট চাইবে না কিন্তু আল্লাহর কাছে, কারো কাছে ফরিয়াদ জানাবে না কিন্তু আল্লাহর দরবারে, ভরসা করবে না কারো ওপর, কিন্তু আল্লাহর প্রতি; আশা করবে না আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে, কুরবানী-নযরানা পেশ করবে না, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। আর না সে ইবাদতের কোনো অংশ গায়রুল্লাহর জন্যে করবে। সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর কাছে সেসব থেকে বিচ্ছেদের ঘোষণা জানাবে।
এটি অবগত হওয়ার পর জানা প্রয়োজন যে, আয়াতুল কুরসীতে তাওহীদের উজ্জ্বল দলীলসমূহ এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ইবাদতের হকদার কেবল তিনি। তিনি আল্লাহ একক, সকলের ওপর বিজয়ী। এই আয়াত উক্ত দলীলসমূহ পরস্পর ক্রমানুসারে একের পর এক এসেছে অত্যন্ত সুন্দর সাবলীলভাবে; যাতে তাওহীদের দলীলসমূহ ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে।
সংক্ষিপ্তাকারে এই প্রমাণাদির নিম্নে বর্ণনা দেওয়া হলো:
প্রথম প্রমাণ: ﴿ٱلۡحَيُّ﴾ (আল্ হাইউ) চিরঞ্জীব:
আল্লাহ তা‘আলাকে ইবাদতের ক্ষেত্রে এক জানার সম্পর্কে এটি স্পষ্ট প্রমাণ। তিনি পবিত্র চিরঞ্জীব হওয়ার গুণে গুণান্বিত, পূর্ণ জীবনের অধিকারী, অনাদি, যার ধ্বংস এবং পতন নেই, মন্দ এবং ত্রুটিমুক্ত, মহিমান্বিত, পবিত্র আমাদের রব্ব। এটি এমন জীবন যা আল্লাহর পূর্ণ গুণসমূহকে আবশ্যক করে। এ রকম গুণের অধিকারীই ইবাদত, রুকু এবং সাজদাহ পাওয়ার হকদার। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তুমি নির্ভর কর তাঁর ওপর যিনি চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৫৮]
আর যে জীবিত কিন্তু তার মৃত্যু আছে, কিংবা যে আসলেই মৃত কোনোভাবেই জীবিত নয়, কিংবা যা জড়পদার্থ যার জীবন নেই, এ রকম কোনো কিছুই কোনো প্রকারের ইবাদতের যোগ্য নয়। ইবাদতের যোগ্য তো তিনিই যিনি চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই।
দ্বিতীয় প্রমাণ : ﴿ٱلۡقَيُّومُ﴾ (আল্ ক্কাইয়্যূম):
অর্থাৎ নিজে স্বয়ং স্বপ্রতিষ্ঠিত, তার সৃষ্টিকে প্রতিষ্ঠাকারী। এই নামের দিকেই প্রত্যাবর্তন করে মহান আল্লাহর সকল কার্যগত গুণাবলী। আর এটা আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ সকল সৃষ্টিকুল থেকে পূর্ণ অমুখাপেক্ষী। কারণ তিনি নিজেই নিজের ধারক এবং সৃষ্টি থেকে অমুখাপেক্ষী। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“হে আমার বান্দারা! তোমরা কখনই আমার উপকার করার পর্যায়ে যেতে পারবে না যে আমার উপকার করবে, আবার আমার ক্ষতি করার পর্যায়েও যেতে পারবে না যে আমার ক্ষতি করবে”। সৃষ্টি থেকে আল্লাহ তা‘আলার অমুখাপেক্ষিতা সত্তাগত অমুখাপেক্ষিতা, কোনো বিষয়েই তিনি সৃষ্টির প্রয়োজন বোধ করেন না। সর্বক্ষেত্রে তিনি তাদের থেকে অমুখাপেক্ষী।
অনুরূপ এই নামটি আমাদের জানাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান এবং তাদের উপর রয়েছে তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। তিনি তাঁর মহান ক্ষমতার মাধ্যমে তাদেরকে সুস্থির রাখছেন। সমস্ত সৃষ্টি তাঁর মুখাপেক্ষী। চোখের পলক পড়া বরাবরও তাঁর থেকে অমুখাপেক্ষী নয়। ‘আরশ, কুরসী, আকাশসমূহ, যমীন, পর্বতরাজি, গাছ-পালা, মানুষ এবং জীব-জন্তু সবই তাঁর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ বলেন,
“তবে কি প্রত্যেক মানুষ যা করে তার যিনি পর্যবেক্ষক, তিনি এদের অক্ষম উপাস্যগুলোর মতো? আর তারা তাঁর জন্য অংশীদার সাব্যস্ত করছে। বলুন, তোমরা সে সব (মনগড়া) অংশীদারের নাম বল” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ৩৩]
“আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে সংরক্ষণ করেন যাতে ওরা স্থানচ্যুত না হয়, তারা স্থানচ্যুত হলে তিনি ব্যতীত কে তাদেরকে সংরক্ষণ করবে? তিনি অতি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ৪১]
“তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও যমীনের স্থিত হওয়া।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২৫] এই অর্থের প্রচুর আয়াত বর্ণিত হয়েছে যে, অর্থ বহন করে যে, তিনিই সমগ্র সৃষ্টির এবং সমগ্র জাহানের পরিচালক এবং পরিকল্পনাকারী।
এ দ্বারা জানা যায় যে, মহান আল্লাহ সকল কার্যগত গুণাবলী, যেমন সৃষ্টি করা, রূযী দেওয়া, পুরস্কৃত করা, জীবিত করা, মৃত্যু দেওয়া ইত্যাদি সবই এ (ক্কাইয়ূম) নামের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। কারণ, এটির দাবী হচ্ছে এই যে, তিনিই তার সৃষ্টিকুলকে সুস্থির করেছেন, সৃষ্টি, আহার, জীবন, মৃত্যু এবং পরিচালনার দিক থেকে। যেমনিভাবে মহান আল্লাহর সকল সত্তাগত গুণাবলী, উদাহরণস্বরূপ: শ্রবণ, দর্শন, হাত, জ্ঞান প্রভৃতি তাঁর নাম ‘হাই’ (চিরঞ্জীব) এর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়: সমস্ত সুন্দর নামাবলীর উৎস এই দু’টি নাম (আল-হাই ও আল-ক্বাইয়ূম)। এ কারণে ইসলামী মনীষীদের একদল এই দু’টি নামকে ইসমে ‘আযম বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, যাকে মাধ্যম করে বা যার উসীলা দিয়ে দো‘আ করলে দো‘আ কবুল করা হয়, প্রার্থনা করলে প্রার্থনা গ্রহণ করা হয়। আর উভয়ের মর্যাদার কারণে এটি তাওহীদের প্রমাণাদি এবং দলীলাদির গুরুত্বে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাই যার শান-মর্যাদা এই যে, তিনি চিরঞ্জীব, মৃত্যুহীন, ধারক সৃষ্টির পরিচালক, কোনো কিছুই তাঁকে পরাস্ত করতে পারে না। আর না কোনো কিছু্র অস্তিত্ব হতে পারে তাঁর আদেশ ছাড়া। এ রকম গুণের অধিকারীই তো ইবাদতের যোগ্য। অন্য কেউ না। আর তিনি ব্যতীত অন্যের ইবাদত ভ্রষ্টতারই নামান্তর। কারণ, তিনি ব্যতীত অন্য, হয় জড়পদার্থ, যার আসলে জীবন নেই, আর না হলে জীবিত ছিল কিন্তু মারা গেছে কিংবা জীবিত আছে কিন্তু অচিরেই মারা যাবে। আর না কোনো সৃষ্টির হাতে জগতের পরিচালনা ও পরিকল্পনার ক্ষমতা আছে বরং রাজত্ব ও পরিচালনা সবকিছু এক আল্লাহর হাতে।
“আর তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা তো খেজুরের আঁটির আবরণেরও অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে আহ্বান করলে তারা তোমাদের আহ্বান শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের আহ্বানে সাড়া দিবে না। তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছো তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞাত ন্যায় কেউই তোমাকে অবহিত করতে পারে না।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৩-১৪]
“বল, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে মা‘বুদ মনে কর তাদেরকে আহ্বান কর; করলে দেখবে তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করবার শক্তি নেই।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৬]
“আর তারা তাঁর পরিবর্তে মা‘বুদরূপে গ্রহণ করেছে অপরকে যারা কিছুই সৃষ্টি করে না, বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং তারা নিজেদের অপকার অথবা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না এবং জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের ওপরও কোনো ক্ষমতা রাখে না।” [সূরা আল-ফুরক্কান, আয়াত: ৩]
এ রকম দুর্বল-অক্ষমদের ইবাদত কীভাবে করা যায়!
তৃতীয় প্রমাণ: ﴿لَا تَأۡخُذُهُۥ سِنَةٞ وَلَا نَوۡمٞۚ﴾ (তাঁকে না তন্দ্রা আর না ঘুম স্পর্শ করে):
তন্দ্রা বলা হয় ঘুমের পূর্বাবস্থার ঘুম ঘুম ভাবকে। আর ঘুম তো সবার জানা। আল্লাহ তা‘আলা উভয় থেকে পবিত্র, কারণ তিনি পূর্ণ জীবন এবং পূর্ণ রক্ষকের অধিকারী। পক্ষান্তরে মানুষ এবং অন্যান্য সৃষ্টি জীবিত তবে মরণশীল। তাদের জীবনে প্রয়োজন হয় আরাম-বিরামের। কারণ, তারা ক্লান্ত-ব্যথিত হয়। আর ঘুমের কারণেই হচ্ছে ক্লান্ত ও শ্রান্তবোধ করা। তাই মানুষ ক্লান্তির পর ঘুম নিলে আরাম এবং শান্তি পায়। বুঝা গেল, মানুষ তার দুর্বলতা এবং অক্ষমতার কারণে ঘুমের মুখাপেক্ষী। সে ঘুমায়, তন্দ্রা নেয়, ক্লান্ত হয়, শ্রান্ত হয় এবং অসুস্থ হয়। এ রকম যার অবস্থা তার জন্যে কিভাবে ইবাদত করা হবে?
এই তথ্য থেকে একটি নিয়ম স্পষ্ট হয় যে, কুরআনে আল্লাহর সত্তার ব্যাপারে যা কিছু অস্বীকার করা হয়, তা দ্বারা মহান আল্লাহর পূর্ণতা প্রমাণ হয়। এ স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘুম ও তন্দ্রা অস্বীকার করা হয়েছে, তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবন, তদারকি, ক্ষমতা এবং শক্তির কারণে। আর এ সবকিছুই ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁকে জরুরীভাবে একক করা ও জানার প্রমাণাদি। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
“আল্লাহ তা‘আলা ঘুমায় না, আর না ঘুম তাঁকে শোভা পায়। তিনি (নেকী-বদীর) পরিমাপ নীচু করেন এবং উঁচু করেন। রাতের আমল দিনের পূর্বে এবং দিনের আমল রাতের পূর্বে তাঁর নিকট উঠানো হয়। তাঁর পর্দা জ্যোতি, যদি তিনি তা উন্মুক্ত করে দেন, তাহলে তাঁর চেহারার আলো সমস্ত সৃষ্টিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭৯।] তিনি সুমহান বরকতপূর্ণ।
চতুর্থ প্রমাণ: ﴿لَّهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ﴾ অর্থাৎ আকাশ ও যমীনে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক তিনি।
তিনি ব্যতীত আকাশ এবং যমীনের কোনো কিছুর কেউই মালিক নয়। অণু পরিমাণেরও মালিক নয়। যেমন, আল্লাহ বলেন,
“তুমি বল, তোমরা আহ্বান করা তাদেরকে, যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে মা‘বুদ মনে করতে। তারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং উভয়ের মধ্যে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের কেউ তার সহায়কও নয়।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২]
অর্থাৎ অণু পরিমাণের মালিক নয়, না তো স্বতন্ত্রভাবে আর না অংশী হিসেবে। ইহজীবনে মানুষ ততটুকুরই মালিক যতটুকু আল্লাহ তাকে মালিক করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তুমি বল, হে রাজ্যাধিপতি আল্লাহ! আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন এবং যার নিকট হতে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নেন, যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন; আপনারই হাতে কল্যাণ, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ২৬]
অতঃপর মানুষ ইহজীবনে যা কিছুর মালিক তার পরিণাম দু’য়ের একটি। মৃত্যুকালে হয় তাকে সম্পদ ছেড়ে চলে যেতে হবে, আর না হলে সম্পদই তাকে ছেড়ে বসবে, দূর্যোগ, দূর্ঘটনা বা অনুরূপ কোনো কারণে। সেই বাগান মালীদের ন্যায় যারা প্রভাতে ফল আহরণের কসম খায় এবং ইনশাআল্লাহ বলে না। অতঃপর সেই রাতে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে দূর্যোগ হানা দেয়। ফলে বাগান পুরে ছাই হয়ে যায়। লক্ষ্য করুন! সন্ধাকালে দামী বাগানের মালিক আর প্রভাতকালে নিঃস্ব। তাই মনে রাখা দরকার, বান্দা যা কিছুর মালিক তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই। তিনি দানকারী, বঞ্চিতকারী, সঙ্কীর্ণকারী, প্রশস্তকারী, নিম্নকারী, উর্ধ্বকারী, সম্মানদাতা এবং লাঞ্ছিতকারী। আদেশ তাঁরই। রাজত্ব তাঁরই। তাই তিনিই ইবাদতের হকদার। কারণ, তার হাতে আছে দেওয়া, না দেওয়া, সম্মান এবং অপমান। তিনি ব্যতীত কেউই কোনো প্রকার ইবাদতের হকদার নয়। বরং তারা সৃষ্টি, তারা বাধ্য এবং তারা স্রষ্টার অধীনস্ত।
যে এই জগতের মালিক নয়। অণু পরিমাণেরও স্বতস্ত্রভাবে মালিক নয়। তাহলে তার উদ্দেশ্যে ইবাদতের হকদার তো তিনি যিনি এই জগতের মহিমান্বিত বাদশাহ, সম্মানিত স্রষ্টা, পরিচালক প্রভূ যার কোনো অংশী নেই।
পঞ্চম প্রমাণ: ﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ (কে আছে যে, তাঁর সম্মুখে তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করবে?):
অর্থাৎ তার অনুমতি ব্যতীত কেউই সুপারিশ করতে পারবে না। কারণ, তিনি রাজা। আর তাঁর রাজত্বে তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না, কিছু করতেও পারে না।
(বল! সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ইখতিয়ারে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪৪] তাই এর আবেদন করা যাবে না তাঁর আদেশ ছাড়া। আর না এর দ্বারা ধন্য হওয়া যাবে তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া।
“আকাশসমূহে কত ফিরিশতা রয়েছে! তাদের কোনো সুপারিশ ফলপ্রসু হবে না, যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি দেন।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন মাকামে মাহমূদ নামক স্থানে সুাপারিশ করার মর্যাদা লাভ করবেন। তিনি নিজে আরম্ভ করবেন না যতক্ষণে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ না হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হবে,
“মাথা উঠাও এবং আবেদন কর, আবেদন গ্রহণ করা হবে। সুপারিশ কর, সুপারিশ কবুল করা হবে”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৩।]
অতঃপর জানা দরকার যে, সুপারিশকারীর সুপারিশ সবই লাভ করবে না, বরং তা কেবল মুওয়াহহিদ ও মুখলিসদের জন্য নির্দিষ্ট, মুশরিকদের তাতে কোনো অংশ নেই। সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“আমি আল্লাহর রাসূলকে জিজ্ঞাসা করি: হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের দিনে আপনার সুপারিশের কে বেশি সৌভাগ্যবান হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হে আবূ হুরায়রা! আমার মনে হচ্ছে, তোমার পূর্বে এ বিষয় সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করে নি, তুমিই প্রথম প্রশ্ন করেছ, যা হাদীসের প্রতি তোমার লিপ্সার পরিচয়। কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশের সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান সে, যে খাঁটি অন্তরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে”।
ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘আবূ হুরায়রার হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: «أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ القِيَامَةِ، مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ» “আমার সুপারিশের সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান ব্যক্তি সে যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়েছে” এটি তাওহীদের একটি রহস্য। আর তা হলো, সুপারিশ পাবে সে যে, শুধু আল্লাহর জন্যই ইবাদতকে মুক্ত করবে। যার তাওহীদ পূর্ণ হবে সেই শাফা‘আতের বেশি হকদার হবে। এমন নয় যে শির্ককারীও সুপারিশ লাভ করবে যেমন মুশরিকদের ধারণা”। [তাহ্যীবুস্ সুনান ৭/১৩৪।]
সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়য়া রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আরো বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
“প্রত্যেক নবীর একটি গৃহীত দো‘আ আছে। প্রত্যেকেই তা অগ্রিম করেন। আর আমি আমার দো‘আকে কিয়ামতের দিনে সুপারিশস্বরূপ আমার উম্মতের জন্যে গোপন রেখেছি। আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো প্রকার শির্ক না করে মারা যাবে সে ইনশাআল্লাহ তা পাবে”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৯।]
আল্লাহর প্রাপ্য অন্যকে দেওয়ার ব্যাপারে মুশরিকদের যে বিশ্বাস, এ প্রমাণে তা বাতিল করা হয়েছে। তাদের ধারণা, এ সকল (উপাস্য) সুপারিশকারী এবং মাধ্যমস্বরূপ। এরা তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। আল্লাহ বলেন,
“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন বস্তুসমূহেরও ইবাদত করে, যারা তাদের কোনো অপকারও করতে পারে না এবং তাদের কোনো উপকারও করতে পারে না, আর তারা বলে, এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৮]
“আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে সুপারিশ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]
এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই মৃত, পাথর, গাছ-পালা এবং অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে ইবাদত করা হয়। তাদের নিকট দো‘আ করা হয় এবং কুরবানী ও মান্নত করা হয়। প্রয়োজন পূরণ, বিপদ দুরীকরণ এবং বালা-মুসীবত থেকে পরিত্রানের প্রার্থনা করা হয়। তাদের বিশ্বাস, তারা তাদের আহ্বান শোনে, দো‘আ কবুল করে এবং চাহিদা পূরণ করে। এ সবই শির্ক ও ভ্রষ্টতা। প্রাচীন যুগে ও বর্তমানে সুপারিশের নামে তারা এর অনুশীলন করে আসছে। জানা দরকার, শাফা‘আতের তিনটি অধ্যায় আছে, যা ভ্রষ্ট দল জানে না, আর না হলে না জানার ভান করছে। তা হলো, আল্লাহর আদেশ ব্যতীত কোনো সুপারিশ হবে না। তারই জন্যে সুপারিশ হবে যার কর্ম ও কথার ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট। আর আল্লাহ সুবহানাহু তাওহীদবাদী না হলে কারও প্রতি সন্তুষ্ট হন না।
ষষ্ঠ প্রমাণ: ﴿يَعۡلَمُ مَا بَيۡنَ أَيۡدِيهِمۡ وَمَا خَلۡفَهُمۡۖ﴾ (তাদের সামনের ও পিছনের সবকিছুই তিনি জানেন।)
অর্থাৎ তাঁর জ্ঞান অতীত ও ভবিষ্যতের সবকিছুতে অন্তর্ভুক্ত। তাই তিনি জানেন যা অতীতে হয়েছে এবং যা ভবিষ্যতে হবে। তাঁর জ্ঞান সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে। তিনি সবকিছুর বিস্তারিত হিসাবে রেখেছেন। আর কিভাবেই বা তাঁর জ্ঞান সব সৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করবে না! অথচ তিনি সৃষ্টিকর্তা।
“আল্লাহ সপ্তাকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণে, এগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; ফলে তোমরা বুঝতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।” [সূরা আত-তালাক, আয়াত: ১২]
কথিত আছে, একদা এক নাস্তিক বলে: আমি সৃষ্টি করতে পারি। তাকে তার সৃষ্টি দেখাতে বলা হলো। সে কিছু মাংস নেয় এবং ছোট ছোট করে কাটে। তার মাঝে গোবর পুরে দেয়। তার পরে কৌটায় ভরে ছিপি এঁটে দেয় এবং এক ব্যক্তিকে দেওয়া হয় যে, তিন ধরে তা তার কাছে রাখে। অতঃপর সে আসে। ছিপি খোলা হয়। দেখা গেল কৌটা পোকায় ভর্তি। এবার নাস্তিক বললো: এই দেখ আমার সৃষ্টি!! ঘটনা ক্ষেত্রে উপস্থিত এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো: আচ্ছা এসবের সংখ্যা কত? তুমি কি এদের খাদ্য দান কর? কোনোটিরও উত্তর দিতে পারে না। এবার নাস্তিককে বলা হলো: স্রষ্টা সে যে সৃষ্টির পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখেন, পুরুষ ও স্ত্রী চিনেন, সৃষ্টিসমূহকে খাদ্য দান করেন এবং তাদের জীবনের সময়সীমা এবং বয়সের শেষ সীমা জানেন। তখন নাস্তিক হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। [আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ, তায়মী ১/১৩০।]
আমার মনে আছে, আমি এই ঘটনাটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুক্ত হওয়া ইসলামী দেশসমূহের কোনো এক দেশের এক ছাত্রের নিকট বর্ণনা করি। সে কিংকর্তব্যবিমৃঢ় হয়ে পড়ে, যখন সে উত্তর শ্রবণ করে এবং বলে: এ মহান প্রতিউত্তরটি কীভাবে আমাদের মাঝ থেকে লুক্কায়িত! সে বলে: কমিউনিস্টরা ক্লাসে এ সংশয় বর্ণনা করত। বিশেষ করে প্রাইমারি পর্যায়ের ছাত্রদের মাঝে। ফলে মুসলিম ছাত্রদের মাঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হত। সেই ছাত্র বলে, আমার সামনে এ রকম ঘটে। সে এ উত্তরটি বড় নজরে দেখে এবং মহান মনে করে।
যাই হোক, মহান আল্লাহ, তাওহীদকে তাঁরই জন্য জরুরীভাবে সাব্যস্তকরণের প্রমাণ এবং তাঁরই উদ্দেশ্যে দীনকে খাঁটি করণের প্রমাণ হিসেবে পেশ করছেন যে, তিনি সুবহানাহু সমস্ত সৃষ্টিকে তাঁর জ্ঞান দ্বারা পরিব্যপ্ত করে রেখেছেন এবং তাঁর জ্ঞান সমগ্র সৃষ্টিকুলকে অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে।
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে তাঁর অগোচর নয় অণু পরিমাণ কিছু কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু।” [সূরা সাবা, আয়াত: ৩] এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের আক্বীদার খণ্ডন করতঃ বলেন,
“তারা আল্লাহর বহু শরীক করেছে, তুমি বল: তোমরা তাদের পরিচয় দাও; তোমরা কি পৃথিবীর মধ্যে অথবা প্রকাশ্য বর্ণনা থেকে এমন কিছুর সংবাদ তাঁকে দিতে চাও যা তিনি জানেন না? না, বরং সুশোভিত করা হয়েছে কাফিরদের জন্যে তাদের প্রতারণাকে এবং তাদেরকে সৎপথ থেকে বাধা দান করা হয়েছে। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোনো পথ প্রদর্শক নেই।” [সূরা আর-রা‘আদ, আয়াত: ৩৩]
সপ্তম এবং অষ্টম প্রমাণ: ﴿وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيۡءٖ مِّنۡ عِلۡمِهِۦٓ إِلَّا بِمَا شَآءَۚ﴾ (তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন।):
এই বাণীতে সৃষ্টির অক্ষমতা এবং তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতা বর্ণিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তাদের খুবই সামান্য জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।
“তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিখিয়েছেন বাক্ প্রণালী।” [সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৩-৪]
দো‘আয়ে মাসুরায় উল্লেখ হয়েছে:
«اللهم علمني ما ينفعني»
“হে আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দাও তা, যা আমার জন্য লাভদায়ক”। তাই বান্দা জ্ঞানের কোনো অংশই অর্জন করতে পারে না, কেবল যখন আল্লাহ তাকে তাওফীক দেন এবং তার জন্য তা সহজ করেন তখনই সে তা অর্জন করতে পারে।
﴿إِلَّا بِمَا شَآءَ﴾ “কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন” এই বাণীতে তাওহীদের আর এক অন্য প্রমাণ বর্ণিত হয়েছে। সবকিছু আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। তিনি যা চান তা হয় আর যা চান না তা হয় না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি সামর্থ্য নেই। শাফে‘ঈ রহ. বলেন,
مَا شِئْتَ كَانَ، وإنْ لم أشَأْوَمَا شِئْتُ إن لَمْ تَشأْ لَمْ يكنْ
তুমি বান্দাদের সৃষ্টি করেছ যা তুমি পূর্ব থেকে জ্ঞাত।
তোমার জ্ঞানেই হয় তারুণ্য ও বার্ধক্য।
কারো প্রতি অনুগ্রহ কর, কাউকে কর অপমান।
কাউকে সাহায্য আর কাউকে কর না দান।
তাই কেউ হয় দুর্ভাগা আর কেউ ভাগ্যবান।
আর কেহ হয় অধম কেউ শ্রীমান।
নবম প্রমাণ: ﴿وَسِعَ كُرۡسِيُّهُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۖ﴾ (তাঁর কুরসী (পাদানি) সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে):
কুরসী আল্লাহ তা‘আলার বৃহৎ সৃষ্টির একটি। আল্লাহ সুবহানাহু এটির বর্ণনায় বলেন যে, আকাশ এবং যমীন পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। তার প্রশস্ততা, আকৃতির বড়ত্বতা এবং ক্ষেত্রের বিশালতার কারণে। ভূমণ্ডল এবং নভোমণ্ডলের তুলনা কুরসীর সাথে খুবই ক্ষীণ তুলনা। যেমন, কুরসীর তুলনা ‘আরশের সাথে দুর্বল তুলনা। আবূ যর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস এটি বিশ্লেষণ করে। তিনি বলেন,
“আমি মসজিদে হারামে প্রবেশ করি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একাকি দেখে তার পাশে বসে পড়ি এবং জিজ্ঞাসা করি: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি সর্বোত্তম কোন আয়াতটি অবতীর্ণ হয়? তিনি বলেন, “আয়াতুল কুরসী; কুরসীর তুলনায় আকাশ এবং যমীন, যেমন মরুভূমিতে পড়ে থাকা একটি বালা (আংটা)। আর আরশের শ্রেষ্ঠত্ব কুরসীর প্রতি যেমন মরুভূমির শ্রেষ্ঠত্ব সেই বালার প্রতি”। [হিল্ইয়াহ, ১/১৬৬, আযামাহ, ২/৬৪৮-৬৪৯, আসমা ওয়াস সিফাত, বায়হাকী, ২/৩০০-৩০১, শাইখ আলবানী সহীহ বলেন। সিলসিলা সহীহাহ, নং (১০৯)।]
হাদীসটি এই আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের স্থানে বর্ণিত হয়েছে, যেন বান্দা এই সৃষ্টির বড়ত্ব সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তুলনা করতে সমর্থ্য হয় তার এবং আকাশ ও যমীনের মাঝে। তারপর তার ও আরশে আযীমের মাঝে তুলনায় এর ক্ষুদ্র হওয়া সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে।
এখানে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে, মরুভূমিতে পড়ে থাকা ছোট বালার স্থান মরুভুমির তুলনায় কতখানি। (খুবই নগন্য) অনুরূপ কুরসীর অবস্থা ‘আরশের তুলনায়। অতঃপর যমীন আসমানের স্থান কুরসীর তুলনায় সেরূপ নগণ্য।
যদি আপনি চিন্তা করেন এই যমীনের সম্পর্কে যাতে আপনি চলা-ফেরা করেন, বেষ্টনকারী পাহাড়ের তুলনায়। বলুন তো, সাধারণ যমীনের তুলনায় পাহাড়সমূহের স্থান কতখানি। তারপর সমগ্র যমীনের (যমীনের অভ্যন্তর স্তর সহ) তুলনায় তার অবস্থান। তারপর আকশসমূহের তুলনায় এটির স্থান। তারপর কুরসীর তুলনায় এটির স্থান, যে কুরসী আকাশ এবং যমীনকে পরিব্যপ্ত করে আছে। তারপর ‘আরশে আযীমের তুলনায় এটির অবস্থান। যেন আপনি অনুভব করতে পারেন বৃত্তের অতি ক্ষুদ্রতা, যাতে আপনি বসবাস করেন। যেন এ চিন্তার মাধ্যমে জানতে পারেন মহান আল্লাহর সৃষ্টির বড়ত্ব, যা স্রষ্টা ও আবিষ্কারকের মহত্ত্বের প্রমাণ। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
«تفكروا في آلاء الله ولا تتفكروا في الله»
“তোমরা আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শণসমূহে চিন্তা কর, আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা কর না”। [শারহুল্ ইতেকাদ, লাআল্কায়ী, ২/২১০, শাইখ আলবানী হাসান বলেছেন। সিলসিলা সহীহাহ, নং ১৭৮৮।] এটি বরকতপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা যার দ্বারা বান্দা আবিষ্কারকের মহত্ত্বতা এবং স্রষ্টার পূর্ণতার সঠিক জ্ঞান পায়। জানতে পারে যে, তিনি আল্লাহ সুবহানুহু খুবই বড়, সুউচ্চ এবং সুমহান। এ কারনে কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন, এ স্থানে কুরসীর বর্ণনা, আল্লাহর সুউচ্চতা এবং তাঁর মহত্ত্বতার বর্ণনার উদ্দেশ্যে ভূমিকাস্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে, যা আয়াতের শেষাংশে উল্লেখ হয়েছে।
মুসলিম ব্যক্তি যখন এই মহত্ত্ব উপলব্ধি করবে, তখন তার রবের সম্মুখে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করবে এবং যাবতীয় ইবদত তাঁর জন্যে করবে। দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে, তিনিই ইবাদতের যোগ্য। অন্য কেউ না। জানতে পারবে যে, প্রত্যেক মুশরিক তার রবের যথার্থ সম্মান করে না। যেমন, আল্লাহু তা‘আলা বলেন,
“তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না। কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুষ্টিতে এবং আকাশমণ্ডলী থাকবে ভাজকৃত তাঁর ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাকে শরীক করে তিনি তার উর্ধ্বে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬৭] এবং তিনি বলেন,
“তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে চাচ্ছ না? অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে, তোমরা লক্ষ্য কর নি? আল্লাহ কীভাবে সৃষ্টি করেছেন সপ্তস্তরে বিন্যস্ত আকাশমণ্ডলী এবং সেখানে চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে? তিনি তোমাদের উদ্ভুত করেছেন মাটি থেকে। অতঃপর তাতে তিনি তোমাদেরকে প্রত্ত্যাবৃত্ত করবেন ও পরে পুনরুত্থিত করবেন এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে ভূমিকে করেছেন বিস্তৃত, যাতে তোমরা চলাফেরা করতে পার প্রশস্ত পথে।” [সূরা নূহ, আয়াত: ১৩-২০]
জানি না কোথায় গুম হয়ে যায় এই সমস্ত মুশরিকদের বিবেক-বুদ্ধি! যখন তারা তাদের বিনয়-নম্রতা, অসহায়তা-অক্ষমতা, আশা-আকাঙ্খা, ভয়-ভীতি, ভালোবাসা এবং কামনা-বাসনা নিবেদন করে, দুর্বল-অক্ষম সৃষ্টির কাছে, যারা নিজের লাভ-লোকসানের মালিক নয় অপরের মালিক হওয়া তো দুরের কথা; আর বিনয়-নম্রতা নিবেদন করা ছেড়ে দেয় মহান আল্লাহ এবং মর্যাদাবান স্রষ্টার উদ্দেশ্যে। তারা যা বলে তা থেকে তিনি কত উর্ধ্বে। তিনি পবিত্র তা থেকে যাকে তারা তাঁর সাথে শরীক করে থাকে।
দশম প্রমাণ: ﴿ وَلَا ئَُودُهُۥ حِفۡظُهُمَا﴾ (উভয়ের সংরক্ষণে তাঁকে বিব্রত হতে হয় না।):
এটিও আল্লাহর মাহাত্ম্য এবং তাঁর ক্ষমতা ও শক্তির পূর্ণতার বর্ণনা। আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি যে, কুরআনে না-সূচক কোনো কিছু শুধু না বলার জন্য ব্যবহৃত হয়না বরং তাতে আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতার প্রমাণ শামিল হয়। তাঁর বাণী: ( وَلَا يَئُودُهُ ) লা-ইয়াউদহু-অর্থাৎ তাঁকে চিন্তিত করে না, কাঠিন্যতায় ফেলে না এবং ক্লান্ত করে না। (হিফ্ যুহুমা)-উভয়ের সংরক্ষণ- অর্থাৎ আকাশ এবং যমীনের সংরক্ষণ। এতে তাঁর শক্তি ও ক্ষমতার পূর্ণতার প্রমাণ হয় এবং প্রমাণ হয় যে তিনি সংরক্ষক, আকশমণ্ডলী এবং যমীনের সংরক্ষণকারী। যেমন, আল্লাহ বলেন,
“নিশ্চয় আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনকে ধরে রাখেন যাতে এগুলো স্থানচ্যুত না হয়। আর যদি এগুলো স্থানচ্যুত হয়, তাহলে তিনি ছাড়া আর কে আছে যে এগুলোকে ধরে রাখবে? নিশ্চয় তিনি পরম সহনশীল, অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ”। [সূরা ফাতির, আয়াত: ৪১]
“তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও পৃথিবীর স্থিতি।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২৫] এতেও আল্লাহর প্রতি সমস্ত সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ হয়। তাদের অবস্থান তাঁর নির্দেশে এবং তাদের সংরক্ষণ তাঁর ইচ্ছায়। তাঁর ক্ষমতায় তিনি তাদের ধারক। সৃষ্টির ওপর কর্তব্য হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে তাঁর জন্য ইবাদত করা, তাঁরই উদ্দেশ্যে আনুগত্য খাঁটি করা। শির্ক ও শরীক হতে তাঁকে মুক্তকরণের ব্যাপারে এটি একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। দুর্বল সৃষ্টি এবং লাঞ্ছিত বান্দাকে কেমন করে তার প্রভূ ও স্রষ্টার সমতুল্য নির্ধারণ করা হতে পারে? কিভাবে সংরক্ষিত ব্যক্তি সংরক্ষকের সমতুল্য হতে পারে? সর্বক্ষেত্রে অভাবী, পদদলিত কেমন করে অভাবমুক্ত প্রসংশিতের সমকক্ষ হতে পারে। তাদের শির্ক থেকে তিনি উর্ধ্বে।
ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “এটা অজ্ঞতা এবং অত্যাচারের শেষ সীমা। কীভাবে মাটিকে মুনিবদের মুনিবের সাথে তুলনা করা হবে? কীভাবে দাসকে মালিকের মতো মনে করা হবে? কেমন করে দুর্বল, সত্তাগতভাবে অক্ষম, সত্তাগতভাবে অভাবী, সত্তাগতভাবে অস্তিত্বহীন হওয়াই যার আসল কথা, সে সত্তাগতভাবে অমুখাপেক্ষী, সত্তাগতভাবে সক্ষম, যার অমুখাপেক্ষিতা, ক্ষমতা, রাজত্ব, তাঁর সত্তার আবশ্যিক অংশ, তার সমকক্ষ হতে পারে? এর চেয়ে জঘন্য যুলুম আর কী হতে পারে? এর চেয়ে মারাত্মক কঠিন যুলুমপূর্ণ বিধান আর কী হতে পারে? যেখানে এমন সত্তাকে তার সৃষ্টির সমকক্ষ সাব্যস্ত করা হচ্ছে যার সমকক্ষ আসলে কেউ নেই। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহর জন্য যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আলো ও অন্ধকার; তা সত্ত্বেও কাফিররা অপর জিনিসকে তাদের রবের সমকক্ষ নিরূপণ করছে।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১]
মুশরিকরা সমকক্ষ নির্ধারণ করেছে আকাশ ও যমীন, আলো ও অন্ধকার সৃষ্টিকারীর সাথে এমন কাউকে, যে আকাশ ও যমীনের অনু পরিমাণ কোনো কিছুর, না নিজে মালিক, না অপরের জন্য মালিক। আফসোস এমন সমকক্ষ স্থাপনের, যাতে আছে বড় যুলুম ও বড় জঘন্যতা। [আল-জাওয়াব আল-কাফী ১৫৬।]
একাদশ এবং দ্বাদশ প্রমাণ: ﴿وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡعَظِيمُ﴾ (তিনি সুউচ্চ, মহীয়ান):
এ দু’টি তাওহীদের অন্যতম প্রমাণ। এগুলো প্রমাণ করছে যে, তিনি সুবহানাহুই ইবাদাতের হকদার, অন্য কেউ নয়। সমস্ত সৃষ্টির উপরে তাঁর উচ্চতা এবং তাঁর মাহাত্মের পূর্ণাঙ্গতা বর্ণনার মাধ্যমে এটি প্রকাশ করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী ( وَهُوَ الْعَلِيُّ ) এর মধ্যে বর্ণিত “আলিফ-লাম”টি ইস্তিগরাক তথা সম্পূর্ণবোধক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এটি উচ্চতা বলতে যা বুঝায়, সেরকম সব অর্থকে শামিল করে। যেমন, সত্তাগত উচ্চতা, ক্ষমতাগত উচ্চতা এবং মর্যাদাগত উচ্চতা। (কবি বলেন),
وله العلو من الوجوه جميعهاذاتًا وقهرًا مع علو الشان
অর্থ: তাঁর জন্য উচ্চতা সর্বক্ষেত্রে। অবস্থান ও সত্তাগত, ক্ষমতাসম্পর্কীয়, মর্যাদার উচ্চতাও বটে।
তাই তিনি তাঁর সত্তাসহ উঁচুতে রয়েছেন, সমস্ত সৃষ্টির উর্ধ্বে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“এ জন্যেও যে, আল্লাহ, তিনিই সত্য এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে এটা তো অসত্য এবং আল্লাহ- তিনিই তো সমুচ্চ, মহান।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৬২]
এবং তাঁর বাণী: ( الْعَظِيم ) এতে তাঁর মহত্বের প্রমাণ হয় এবং প্রমাণ হয় যে, তাঁর চেয়ে মহান আর কিছু নেই। আরও প্রমাণ হয় যে, মাখলুকের মর্যাদা, সে যত বড়ই হোক না কেন, তার অবস্থা এতই হীন যে তার সাথে মহান সৃষ্টিকর্তা এবং অস্তিত্বে আনয়নকারীর মহত্বের তুলনা করা যায় না।
“অহংকার আমার চাদর, বড়ত্ব আমার লুঙ্গি, যে ব্যক্তি উভয়ের মধ্যে কোনো একটি নেওয়ার চেষ্টা করবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব”। [আহমদ, শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন। হাদীস নং ৫৪০।]
এই নামের সাথে সম্পর্কিয় উপাসনাদির মধ্যে হচ্ছে বান্দা যেন তাঁর রবের সম্মান করে, তাঁর সামনে হীনতা অবলম্বন করে এবং তাঁর মহান সান্নিধ্যের উদ্দেশ্যে নম্রতা প্রকাশ করে। বিনয় নম্রতা এবং আনুগত্য কেবল তাঁরই জন্য করে। কিছু লোককে শয়তান ধোকা দিয়েছে তারা এই সত্যকে বদলে দিয়েছে এবং স্পষ্ট শির্কে নিমজ্জিত হয়েছে এবং শয়তানকে আল্লাহর সম্মানের আসনে বসিয়েছে। তারা বলছে: আল্লাহ তা‘আলা মহান মহিয়ান। তাঁর নৈকট্য, মধ্যস্থতাকারী, সুপারিশকারী, নিকটবর্তীকারী উপাস্য ছাড়া লাভ করা যেতে পারে না। আসলে কোনো বাতিলপন্থীই তার বাতিলের প্রচার-প্রসার ঘটাতে পারে না যতক্ষণ না সে বাতিলকে সত্যের মোড়কে পেশ করে।
আবদুর রহমান ইবন মাহদী রাহিমাহুল্লাহর কাছে জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায়ের কথা বলা হলো যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার গুণ সম্পর্কীয় হাদীসগুলোকে অস্বীকার করে এবং বলে: এই ধরনের গুণে গুণান্বিত হওয়া থেকে আল্লাহ তা‘আলা মহান। তখন তিনি বলেন, “এক সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছে সম্মানকে কেন্দ্র করে, তারা বলেছে: আল্লাহ তা‘আলা কিতাব অবতরণ করা কিংবা রাসূল প্রেরণ করা থেকে উর্ধ্বে। তারপর তিনি পড়েন:
“এই লোকেরা আল্লাহ তা‘আলার যথাযথ মর্যাদা উপলদ্ধি করে নি। যখন তারা বলেছে, আল্লাহ কোনো মানুষের ওপর কোনো কিছু অবতীর্ণ করেন নি।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯১], তারপর তিনি (ইবনে মাহদী) বলেন, অগ্নিপুজকরা তো সম্মানকে কেন্দ্র করেই ধ্বংস হয়েছে। তারা বলে: আল্লাহ এটি থেকে মহান যে আমরা তাঁর ইবাদত করব বরং আমরা ইবাদত করব তার যে আমাদের চেয়ে আল্লাহর অধিকতর নিকটবর্তী। তাই তারা সূর্যের ইবাদত করে এবং সাজদাহ করে। তখন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:
“যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে (তারা বলে,) আমরা তো এদের পূজা এজন্যেই করি যে, এরা আমাদেরকে সুপারিশ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩] [আল-হুজ্জাহ, তায়মী-১/৪৪০।]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সম্বন্ধে এটা তাদের ভ্রান্ত ধারণা, যা তাদেরকে আল্লাহর সাথে শির্ক এবং অংশী স্থাপনে লিপ্ত করেছে। মধ্যস্থতাকারী ও সুপারিশকারী সাব্যস্ত করছে, তারা মনে করছে এ দ্বারা তারা রাব্বুল আলামীনের সম্মানই করছে। বস্তুত সত্যিই যদি তারা তাদের প্রভূ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখত, তবে তারা তাঁর যথার্থ তাওহীদ সাব্যস্ত করতো।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/519/10
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।