HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইখলাস কেন ও কীভাবে

লেখকঃ গবেষণা পরিষদ আল-মুনতাদা আল-ইসলামী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
ইখলাস কেন ও কীভাবে

গবেষণা পরিষদ আল-মুনতাদা আল-ইসলামী

অনুবাদ: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

কভার পেইজ থেকে
ইবাদত পালনে ইখলাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইখলাস বর্জিত ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। ইখলাস কোনো আকস্মিক ঘটে যাওয়া বিষয় নয়। আল্লাহমুখী জীবনযাপনে নিরন্তর সাধনার ফলস্বরূপ অর্জিত হয় ইখলাস। বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে ইখলাসের সংজ্ঞা ও ইখলাস চর্চা ও অর্জনের পথ ও পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ইখলাসের সংজ্ঞা:
আভিধানিক অর্থে ইখলাস হলো কোনো বস্তুকে খালি কর বা পরিষ্কার করা। শরী‘আতের পরিভাষায় ইখলাস দ্বারা উদ্দেশ্য কী -তা নির্ণয়ে বিজ্ঞ আলিমদের মত ও মন্তব্য ভিন্ন ভিন্ন।

কেউ বলেছেন, ইখলাস হলো, ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক বলে গ্রহণ করা। যেমন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,

﴿وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا﴾ [ الكهف : ١١٠ ]

“সে যেন তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।” [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ১১০]

কারো মত হলো, অন্তরকে পঙ্কিলতায় মজ্জিত করে, এমন যাবতীয় নোংরামী ও অসুস্থতা থেকে অন্তরকে পবিত্র করা। ভিন্ন কারো মত-স্বতঃপ্রণদিত হয়ে আল্লাহর আনুগত্যে আত্মনিবেদন।

আবার কারো মত এই যে, ইখলাস হলো, আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন, তা পালন করা তার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ও যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে।

ভাষার পার্থক্য থাকলেও সংজ্ঞাগুলোর মূল বক্তব্য একই। যে মৌলিক নীতিমালাকে কেন্দ্র করে আলিমগণ ইখলাসের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন তা হলো, ইবাদত-বন্দেগী-সৎকর্ম বলতে যা কিছু আছে সবই একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য সম্পাদন করার নাম ইখলাস। আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ইবাদত পালন করলে তাকে ইখলাস বলে গণ্য করা হবে না। এমনিভাবে, সকল পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার উদ্দেশ্য কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন।

ইবাদত ও কর্মসম্পাদন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন ও ইখলাস আনয়নের বিভিন্ন রূপ হতে পারে- কেউ কেউ আল্লাহর ইবাদত করেন তার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা জ্ঞাপনার্থে অপর কেউ ইখলাসকে ভাবেন আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রবেশিকা, কারো উদ্দেশ্য থাকে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি লাভ। অপর কেউ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সুনিবীড় সম্পর্ক ও পরম আস্বাদ লাভে প্রয়াসী কিংবা পরকাল দিবসে মহান দীদারের নি‘আমত লাভে প্রত্যাশী যেদিন আল্লাহর সাক্ষাতে সারিবদ্ধ হবে বান্দাগণ। নির্দিষ্ট কোনো প্রাপ্তি, অপরপক্ষে কারো ইবাদতের লক্ষ্য নির্দিষ্ট কোনো সাওয়াব লাভ। কেউ কেউ আল্লাহর ভয়ে ভীত হন নির্দিষ্ট কোনো আযাবের কথা স্মরণ করে, অপর কেউ নির্দিষ্ট কোনো আযাবের কথা স্মরণ করে নেয়, আল্লাহকে ভয় করেন তার যে কোনো আযাবের ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে।

সন্দেহ নেই, ইবাদতে মানুষের ইচ্ছাবৃত্তির বৈচিত্র এক বিশাল অধ্যায়, একেক সময় তার মঝে ক্রিয়াশীল থাকে একেক ধরণের ইচ্ছা, কখনো সে প্রণোদনা লাভ করে একাধিক ইচ্ছার দ্বারা; কিন্তু ইচ্ছার এ বৈচিত্রও একক এক লক্ষ্যের প্রতি সততা ধাবিত বান্দা তার কাজ-কর্ম ও যাবতীয় মনোবৃত্তির দ্বারা একমাত্র আল্লাহকে পাওয়ার আকাঙ্খাকে তীব্র করে তোলে, অন্য কাউকে নয়। এ সবই ইখলাসেরই সত্যায়ন। এ সব ইচ্ছা যার মাঝে ক্রিয়াশীল, সেই সিরাতে মুস্তাকীমের অধিকারী, হিদায়াত ও বিশুদ্ধ লক্ষ্যপানে ধাবিত। তবে বান্দার উচিৎ তার ইবাদতকে আল্লাহর ভালোবাসা, ভীতি ও আশা থেকে কখনো বিযুক্ত করবে না। কারণ, ইবাদতের প্রতিষ্ঠাই এই ত্রিমাত্রিক লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে।

ইখলাসের মর্যাদা:
প্রকৃতপক্ষে, ইখলাসই হলো দীন ইসলামের মূল বিষয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥﴾ [ البينة : ٥ ]

“তাদেরকে এছাড়া কোনো নির্দেশ দেওয়া হয় নি যে, তারা খাঁটি মনে (ইখলাসের সাথে) একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে।” [সূরা আল-বাইয়্যেনাহ, আয়াত: ৫]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ١١﴾ [ الزمر : ١١ ]

“বলুন, আমি ইখলাসের সাথে আল্লাহর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১১]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ٢ أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصُۚ﴾ [ الزمر : ٢، ٣ ]

“আপনি ইখলাসের সাথে ইবাদত করুন। জেনে রাখুন, ইখলাসপূর্ণ ইবাদতই আল্লাহর জন্য।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ২-৩]

উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ইখলাসপূর্ণ ইবাদতকেই তার জন্য স্বীকৃতি প্রদান করেছেন-অল্প হোক কিংবা বেশি, বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র, যে কোনো ধরণের শির্ক হতে যা বিমুক্ত ও পরিশ্রুত। আয়াতগুলো স্পষ্ট ঘোষণা করে যে, দীন ইসলামে ইখলাস এক গুরুত্বপূর্ণ শর্তের নাম, তাবৎ আম্বিয়া এ প্রক্রিয়ারই স্বীকৃতি বহন করেন, দীনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, শরী‘আতের প্রতিটি অনুঘটনায় ইখলাসের অনুসন্ধান প্রমাণ করে ইখলাসের মার্যাদা ও গুরুত্ব।

ইখলাস, সন্দেহ নেই, নবী-রাসূলদের দাওয়াতের দাওয়াতের কুঞ্জিকা, যে নীতিমালা নিয়ে তারা আগত, তার মহোত্তম স্থানের অধিকারী।

যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [ النحل : ٣٦ ]

“আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য আমরা প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]

ইবন কাসির রহ. বলেন, এ আদেশ নিয়ে রাসূলগণ পৃথিবীতে আগমন করেন। নূহ আলাইহিস সালাম যে জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, সে জাতির মাঝেই সর্বপ্রথম যখন শির্কের উৎপত্তি হয়, তখন তাকে মানব জাতির জন্য প্রথম রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়, যে ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে, যার দাওয়াত বিস্তৃত ছিল জিন্ন-ইনসান ও পৃথিবীর তাবৎ জাতিবর্গের জন্য। পৃথিবীতে রাসূলরূপে আগত সকলের দায়িত্ব ছিল আল-কুরআনের ভাষায়-

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥﴾ [ الانبياء : ٢٥ ]

“আমরা তোমার পূর্বে এ আদেশ ব্যতীত কোনো রাসূল প্রেরণ করি নি যে, আমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫]

এ তাওহীদ ও ইখলাস হলো কলব বা হৃদয়ের কমের মাঝে সর্বোচ্চ স্তরের। এটাই বান্দার কর্মের উদ্দেশ্য ও পরিমাণে-মর্যাদায় সর্ববৃহৎ।

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বক্তব্যটির ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর দাসত্বের প্রাণ হলো অন্তরের কাজ। যদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা দাসত্ব করা হয়; কিন্তু অন্তর ইখলাস ও তাওহীদ থেকে শুন্য থাকে, তবে সে যেন একটি মৃতদেহ, যার কোনো রূহ নেই। নিয়ত হলো অন্তরের আমল। [বাদায়ে‘ আল-ফাওয়ায়েদ: ইবনুল কাইয়্যেম।]

ইখলাস হলো ইবাদত কবুলের দু’ শর্তের একটি। ইখলাস ব্যতীত কোনো ইবাদত কবুল হবে না।

নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ»

“আল্লাহ তা‘আলা শুধু সে আমলই গ্রহণ করেন, যা ইখলাসের সাথে এবং আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার উদ্দেশ্যে করা হয়।” [নাসাঈ, হাদীস নং ৩১৪০।]

যারা আল্লাহর ব্যাপারে ইখলাস অবলম্বন করেছে, আল্লাহ তাঁর কালামে প্রশংসার সাথে তাদের কথা আলোচনা করেছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কালীম মূসা আলাইহিস সালামের প্রসঙ্গে আল-কুরআনে উল্লেখ করেন-

﴿وَٱذۡكُرۡ فِي ٱلۡكِتَٰبِ مُوسَىٰٓۚ إِنَّهُۥ كَانَ مُخۡلَصٗا وَكَانَ رَسُولٗا نَّبِيّٗا ٥١ ﴾ [ مريم : ٥١ ]

“স্মরণ কর, এ কিতাবে মূসার কথা, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে ছিল রাসূল।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫১]

এমনিভাবে তিনি ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেছেন:

﴿كَذَٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلۡفَحۡشَآءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِينَ﴾ [ يوسف : ٢٤ ]

“আমরা তাকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্য এভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। সে ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত (ইখলাস অবলম্বনকারী) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা ইউসূফ, আয়াত: ২৪]

এমনিভাবে তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম সম্পর্কে বলেছেন:

﴿قُلۡ أَتُحَآجُّونَنَا فِي ٱللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمۡ وَلَنَآ أَعۡمَٰلُنَا وَلَكُمۡ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُخۡلِصُونَ ١٣٩﴾ [ البقرة : ١٣٩ ]

“বল, আল্লাহ সম্পর্কে তোমরা কি আমাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও? যখন তিনি আমাদের রব ও তোমাদেরও রব। আমাদের কর্ম আমাদের ও তোমাদের কর্ম তোমাদের এবং আমরা তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ (ইখলাস অবলম্বনকারী)।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৩৯]

এ সকল আয়াত থেকে বুঝে আসে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ইখলাস বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা। [আখলাকুন্নবী ফি আল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ: হাদ্দাদ।]

অপরদিকে ইখলাসশূণ্য ব্যক্তির জন্য এসেছে কঠোর হুশিয়ারী ও শাস্তির সংবাদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ﴾ [ النساء : ٤٨ ]

“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এ শির্ক ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৮]

যারা শির্ক করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা:

﴿وَقَدِمۡنَآ إِلَىٰ مَا عَمِلُواْ مِنۡ عَمَلٖ فَجَعَلۡنَٰهُ هَبَآءٗ مَّنثُورًا ٢٣﴾ [ الفرقان : ٢٣ ]

“আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি লক্ষ করব। অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২৩]

আয়াতটি উল্লেখের পর ইবনুল কাইয়্যেম রহ.-এর মন্তব্য এই যে, এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুলআলামীন ব্যর্থ কাজকে বুঝিয়েছেন, যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতিতে করা হয় নি অথবা তাঁর পদ্ধতিতে করা হয়েছিল, তবে একনিষ্ঠভাবে (ইখলাসের সাথে) আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয় নি। [মাদারিজুল সালেকীন।]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন কাসীর রহ. বলেন, মুশরিকরা রক্ষা লাভ ও শুভ পরিণতির আশায় পার্থিবে যে কর্মসম্পাদন করেছে, তা যারপরনাই মূল্যহীন, কিছুই নয়। কারণ, ইখলাস অথবা আল্লাহ প্রণীত বিধানের প্রতি আনুগত্য শরী‘আতের এ দু’টি আবশ্যকীয় শর্তের কোনোটিই তাতে উপস্থিত নেই। যে সকল কাজ খালেস আল্লাহর জন্য করা হয় না কিংবা শরী‘আতের অনুমোদিত পন্থায় পালন করা হয় না তা বাতিল বলে গণ্য, তাতে সন্দেহ নেই। (তাফসীর ইবন কাসীর)

হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى : أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ»

“আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি শরীকদের শির্ক অর্থাৎ অংশীদারদের অংশ গ্রহণ থেকে অমুখাপেক্ষী। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো আমল করে এবং এতে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে তাহলে আমি তাকে ও তার শির্কী কাজকে প্রত্যাখ্যান করি।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৮৫।]

হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلَّا لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا، لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَعْنِي رِيحَهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ»

“যে জ্ঞান অর্জন করা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তা যদি কেউ পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে করে তাহলে সে কিয়ামতের দিবসে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।” [আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৬৬৪।]

হাদীসে আরো এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ طَلَبَ العِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ العُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ النَّارَ»

“যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করবে আলিমদের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে অথবা মূর্খদের সাথে অহমিকা প্রদর্শনের জন্যে কিংবা মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।” [তিরমিযী, হাদীস নং ২৬৫৪।]

সুতরাং প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য যাবতীয় ইবাদতের ক্ষেত্রেই ইখলাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বান্দার কিছু আমল হবে ইখলাসে পূর্ণ, কিছু হবে শূণ্য, কিছু মুআমালায় ইখলাস হবে তার আদর্শ, অপর কিছু মুআলামা হবে ইখলাস থেকে বিচ্যুত এ খুবই গর্হিত বিষয়, এ কখনো স্বীকৃত নয় শরী‘আহ মোতাবেকে। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. ইখলাসের গুরুত্ব ও অবস্থান বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, ইখলাস ও আনুগত্য শূন্য আমল তুলনীয় এমন মুসাফিরের সাথে, যে অকাজের ধুলোয় পূর্ণ করেছে তার থলে এবং প্রচুর ক্লান্তি ও ঘর্মাক্ত দেহে অতিক্রম করছে মরুভুমির পর মরুভুমি, তার জন্য এ সফর নিশ্চয় নিষ্ফল ও শুভ পরিণতি শূন্য। [আল-ফাওয়ায়িদ: ইবনুল কাইয়্যেম।]

ইখলাস একটি কঠিন কাজ:

ইখলাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা সত্বেও আমরা বলব, নিঃসন্দেহে ইখলাস নফসের জন্য কঠিন একটি বিষয়। কারণ, নফস এবং প্রবৃত্তি ও নফসের আকাঙ্খার মাঝে ইখলাস এক কঠোর দেওয়াল ও বাধা হয়ে নিজেকে উপস্থিত করে। নিজ প্রবৃত্তি, সামাজিক অবস্থা ও শয়তানের কুমন্ত্রণা মোকাবেলা করে ইখলাস ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর ওপর অটল থাকতে সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। এ সংগ্রাম শুধু সাধারণ মানুষ করবে তা কিন্তু নয় বরং আলিম-উলামা, ইসলাম প্রচারক ও নেককার-মুত্তাকী সকলের প্রয়োজন। সুফিয়ান আস-সাওরী বলেন: আমার কাঝে নিজের নিয়ত ঠিক করার কাজটা যত কঠিন মনে হয়েছে অন্য কোনো কাজ আমার জন্য এত কঠিন ছিল না। কতবার নিয়ত ঠিক করেছি কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবার পাল্টে গেছে। [আল-জামে লি আখলাকির রাবী ওয়া আদাবুছ ছামে: খতীব বাগদাদী।]

ইউসূফ ইবন হুসাইন রাযী বলেন: দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো ইখলাসের ওপর অটল থাকা। আমি আমার অন্তর থেকে রিয়া (লোক দেখানো ভাবনা) দূর করার জন্য কত প্রচেষ্টা চালিয়েছি, সে দূর হয়েছে বটে তবে আবার ভিন্ন আকৃতিতে, ভিন্ন রূপে উপস্থিত হয়েছে। [জামে আল উলুম ওআল-হিকাম: ইবন রজব।]

সাহাল ইবন আব্দুল্লাহকে প্রশ্ন করা হলো, আপন প্রবৃত্তির নিকট কঠিনতম কর্ম কী? তিনি বললেন, ইখলাস। কেননা, প্রবৃত্তি কখনো ইখলাস গ্রহণ করতে চায় না। [সাফওয়াতু আস সাফওয়াহ: ইবনল জাওযী।]

তাই মন্দ কর্মে প্রণোদনাদাতা নফস বান্দার কাছে ইখলাসকে মন্দরূপে উপস্থাপন করে, দৃশ্যমান করে তোলে এমন রূপে, যা সে ঘৃণা করে মনেপ্রাণে। সে দেখায়, ইখলাস অবলম্বনের ফলে তাকে ত্যাগ করতে হবে বিলাসী মনোবৃত্তির দাসত্ব, সে তোষামুদি স্বভাব ও মেনে নেওয়ার দুর্বলতা মানুষকে সমাজের সকল শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ব্যাপক অবদান রাখে, তাও তাকে ছিন্ন করতে হবে আমূলে। সুতরাং বান্দা যখন তার আমলকে একনিষ্ঠতায় নিবিষ্ট করে, আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কেউ তার কর্মের উদ্দেশ্য হয় না, তখন বাধ্য হয়েই বিশাল একটি শ্রেণির সাথে তাকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়, তারাও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। একে অপরের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়।

এ জন্যে রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময় এ দো‘আ পাঠ করতেন:

«يَا مُقَلِّبَ القُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ»

“হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তর আপনার দীনের ওপর অবিচল রাখুন!” [তিরমিযী, হাদীস নং ৩৪৪৪।]

ইখলাসের ফলাফল:
ইখলাসের ফলাফল রয়েছে অনেক। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো:

১. জান্নাত লাভ:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

﴿إِلَّا عِبَادَ ٱللَّهِ ٱلۡمُخۡلَصِينَ ٤٠ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ رِزۡقٞ مَّعۡلُومٞ ٤١ فَوَٰكِهُ وَهُم مُّكۡرَمُونَ ٤٢ فِي جَنَّٰتِ ٱلنَّعِيمِ ٤٣﴾ [ الصافات : ٤٠، ٤٣ ]

“কিন্তু তারা নয় যারা আল্লাহুর একনিষ্ঠ (ইখলাস অবলম্বনকারী) বান্দা। তাদের জন্য রয়েছে নির্ধারিত রিযিক; ফলমূল, তারা হবে সম্মানিত, সুখদ কাননে।” [সূরা আস-সাফ্ফাত, আয়াত: ৪০-৪৩]

একটি প্রসিদ্ধ প্রবচন এই যে, সকল মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে, তবে জ্ঞানীরা বেঁচে যাবে। সকল জ্ঞানী ধ্বংস হয়ে যাবে, তবে যারা কাজ করেছে, তারা বেঁচে যাবে। যারা কাজ করেছে, তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে, তবে যারা ইখলাসের সাথে (একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য) কাজ করেছে, তারা মুক্তি পাবে। [মিনহাজ আল-কাসেদীন: আল-মাকদিসী।]

২. আমল কবুল হওয়া:
ইখলাস হলো আমল কবুলের শর্ত। ইবন কাসীর রহ. বলেছেন: দু’টো শর্তের সন্নিবেশ ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলা আমল গ্রহণ করবেন না। প্রথম শর্ত হলো আমলটি শরী‘আত অনুমোদিত হতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত আমলটি ইখলাস (একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য নিবেদিত) সহকারে শির্কমুক্ত ভাবে আদায় করতে হবে। (তাফসীরে ইবন কাসীর)

আল্লামা সাজী বলেছেন: পাঁচটি গুণের মাধ্যমে জ্ঞানের পূর্ণতা লাভ হয়। গুণ পাঁচটি হলো: আল্লাহর পরিচয় লাভ, হক বা যা সত্য তার সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া, ইখলাস বা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক কাজ করা এবং হালাল খাদ্য গ্রহণ করা। যদি এর একটি অনুপস্থিত থাকে তাহলে তার আমল (কর্ম) আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। [আল-জামে লিআহকামিল কুরআন: কুরতুবী।]

আল্লামা সিদ্দীক হাসান খান বলেন: ইখলাস যে আমলের শুদ্ধতা ও কবুলে একটি অন্যতম শর্ত এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। [আদ-দীনুল খালেছ: সিদ্দীক হাসান খান।]

প্রমাণ হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস:

«إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ»

“আল্লাহ তা‘আলা শুধু সে আমলই গ্রহণ করেন, যা ইখলাসের সাথে এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে করা হয়।” [নাসাঈ, হাদীস নং ৩১৪০।]

হাদীসে আরো এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِذَا جَمَعَ اللَّهُ الْأَوَّلِينَ وَالْآخِرِينَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ، نَادَى مُنَادٍ : مَنْ كَانَ أَشْرَكَ فِي عَمَلٍ عَمِلَهُ لِلَّهِ، فَلْيَطْلُبْ ثَوَابَهُ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ، فَإِنَّ اللَّهَ أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ»

“কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তা‘আলা যখন সকল মানুষকে একত্র করবেন তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত কাজে অন্য কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করেছে সে যেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে সেই শরীকের কাছ থেকে প্রতিদান বুঝে নেয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রকার অংশীদার ও অংশীদারিত্ব থেকে মুক্ত।” [ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪২০৩।]

৩. আখিরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফাআত লাভ:
বান্দা ইখলাস অবলম্বনের ক্ষেত্রে যত বেশি অগ্রগামী হবে সে কিয়ামতের দিন তত বেশি শাফা‘আত লাভের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।

আল্লাহর রাসূলের হাদীস এর প্রমাণ: রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ القِيَامَةِ، مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ»

“কিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত দ্বারা সবচেয়ে ভাগ্যবান হবে ঐ ব্যক্তি যে ইখলাসের সাথে (একনিষ্ঠভাবে) বলেছে আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই।’’ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৯।]

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন: এ হাদীসে তাওহীদের একটি সুক্ষ্ম রহস্য লুকায়িত আছে, তা এই যে, শাফা‘আত লাভের অন্যতম শর্ত হচ্ছে তাওহীদ অবলম্বন ও তাওহীদের পরিপন্থী বিষয় থেকে পৃথকীকরণ। যে ব্যক্তি তার তাওহীদকে যত বেশি উন্নত ও পূর্ণ করতে পারবে সে তত বেশি শাফা‘আত লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। যে শির্ক করবে তার জন্য কোনো শাফা‘আত নেই। [আদ-দীন আল-খালেস: সিদ্দীক হাসান খান।]

৪. হিংসা-বিদ্বেষ থেকে অন্তর পবিত্র থাকে:
যখন কোনো ব্যক্তির অন্তরে ইখলাস স্থান পেয়ে যায় তখন সে অনেক বিপদাপদ, দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকে। যেমন, আল্লাহর রাসূল রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন:

«ثَلَاثٌ لَا يُغِلُّ عَلَيْهِنَّ قَلْبُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ : إِخْلَاصُ الْعَمَلِ لِلَّهِ، وَالنُّصْحُ لِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ، وَلُزُومُ جَمَاعَتِهِمْ» .

“তিনটি বিষয়ে মুমিনের অন্তর খিয়ানত কর না। ইখলাসের সাথে আমলসমূহ আল্লাহর জন্য নিবেদন করা, মুসলিম নেতাদের কল্যাণ কামনা ও মুসলিম জামা‘আতের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকা।” [আহমদ: ৩/২২৫; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৩০।]

ইবন আব্দুল বার রহ. বলেন: এ তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকবে তার অন্তর কখনো দুর্বল হবে না। কপটতা বা নিফাকী থেকে সে পবিত্র থাকবে। [আত-তামহীদ ইবন আবদুল বার।]

১০
৫. গুনাহ মাফ ও অগণিত পুরস্কার লাভ:
যখন মুমিন ব্যক্তি ইখলাসসহ সকল আমল করবে তখন সে গুনাহ থেকে ক্ষমা পেয়ে যাবে এবং অনেক গুণে প্রতিদান লাভ করবে। যদিও কাজটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে ছোট অথবা পরিমাণে খুবই স্বল্প। এ ব্যাপারে ইবনুল মুবারক রহ. বলেন: “অনেক ক্ষুদ্র আমল আছে নিয়ত যাকে অনেক বড় করে দেয়। আবার অনেক বড় আমল আছে নিয়ত যাকে অনেক ছোট করে দেয়।’’ [সিয়ারু আলামিন নুবালা: আয-যাহাবী।]

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেছেন: অনেক আমল এমন আছে যা মানুষ পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে সম্পাদন করে। ফলে এ আমলটি ইখলাসের পূর্ণতার কারণে তার কবীরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। যেমন, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ’র হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কিয়ামাতের দিন আমার উম্মতের এক ব্যক্তির ব্যাপারে চিৎকার দেওয়া হবে। তার কাছে উপস্থিত করা হবে পাপকর্মের নিরানব্বইটি বিশাল নথি। প্রতিটি নথির ব্যপ্তি হবে দৃষ্টির দূরত্ব পরিমাণ। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি যে এ পাপকর্মগুলো করেছো তা কি তুমি অস্বীকার করবে? সে বলবে হে রব! আমি এগুলো অস্বীকার করতে পারি না। আল্লাহ বলবেন, তোমার ওপর যুলুম করা হবে না। এরপর হাতের তালু পরিমাণ একটা টিকেট বের করা হবে যাতে লেখা থাকবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু। সে বলবে এত বিশাল পাপের সম্মুখে এ ছোট টিকেটের কী মূল্য আছে? অতঃপর এ টিকেটটি একটি পাল্লায় রাখা হবে এবং তার পাপের বিশাল নথিগুলোকে রাখা হবে অপর পাল্লায়। টিকেটের পাল্লাই ভারী হবে। কারণ, এ ব্যক্তি ইখলাসের (একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য) সাথে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর সাক্ষ্য দিয়েছে বলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়েছে। নয়ত যে সকল কবীরাগুণাহে লিপ্ত ব্যক্তিরা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্য দিয়েছে, তারাও জাহান্নামে যাবে। হয়ত তারা ইখলাসের সাথে কালেমা পড়ে নি। এমনিভাবে যে পতিতা একটি পিপাসার্ত কুকুরকে কষ্ট করে পানি পান করিয়েছিল সে তা ইখলাসের সাথে করেছে বলেই তার পাপগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। নয়তো যে কোনো পতিতা এ কাজ করত, তার ক্ষমা পাওয়ার কথা ছিল।

এমনিভাবে যে ব্যক্তি পথের কাঁটা দূর করে দেওয়ার কারণে ক্ষমা পেয়েছিল সে তা ইখলাসের সাথে করার কারণে ক্ষমা পেয়েছে। নয়তো সকল কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিরা এ কাজটি করে ক্ষমা আদায় করে নিতে পারত।

পক্ষান্তরে:

অনেক বড় বড় ব্যক্তি বিরাট গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে কিন্তু তাতে ইখলাস (আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা) না থাকার কারণে তা ব্যর্থ হয়ে গেছে ও আমলকারী পুরষ্কার ও প্রতিদানের পরিবর্তে শাস্তির পাত্রে পরিণত হয়েছে। যেমন, হাদীসে এসেছে:

«إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ : فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ : قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ : كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُقَالَ : جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ، وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ : فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ : تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ : كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ : عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ : هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ، وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ : فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ : مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ، قَالَ : كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ : هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ» .

“কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে শহীদ হয়েছিল। তাকে হাযির করা হবে এবং আল্লাহ তার নি‘আমতের কথা তাকে বলবেন এবং সে তার প্রতি সকল নি‘আমত চিনতে পারবে। তখন আল্লাহ তাকে বলবেন তুমি কী কাজ করে এসেছে? সে বলবে, আমি আমার পথে যুদ্ধ করেছি, শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছ, তুমি তো যুদ্ধ করেছ লোকে তোমাকে বীর বলবে এ উদ্দেশ্যে। আর তা বলা হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে টেনে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তারপর এমন ব্যক্তির বিচার করা হবে, যে নিজে জ্ঞান অর্জন করেছে ও অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন তিলাওয়াত করেছে। তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তাকে তার নি‘আমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে স্বীকার করবে। তাকে জিজ্ঞেস করবেন কী কাজ করে এসেছে? সে বলবে আমি জ্ঞান অর্জন করেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি জ্ঞান অর্জন করেছ এ জন্য যে লোকে তোমাকে ক্বারী বলবে। আর তা বলা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেওয়া হবে তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার জন্য।

তারপর বিচার করা হবে এমন ব্যক্তির, যাকে আল্লাহ দুনিয়াতে সকল ধরণের সম্পদ দান করেছিলেন। তাকে হাযির করে আল্লাহ নি‘আমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে সকল নি‘আমত স্মরণ করবে। আল্লাহ বলবেন, কী করে এসেছ? সে বলবে, আপনি যে সকল খাতে খরচ করা পছন্দ করেন আমি তার সকল খাতে সম্পদ ব্যয় করেছি, কেবল আপনারই জন্য। আল্লাহ বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি সম্পদ এ উদ্দেশ্যে খরচ করেছ যে, লোকে তোমাকে দানশীল বলবে। আর তা বলা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯০৫।]

হাদীসে আরো এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوا : يا رسول الله وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ؟ قَالَ : الرِّيَاءُ ، يَقُولُ لَهُمْ يَوْمَ يجازي العباد بِأَعْمَالِهِمْ : اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاؤُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً» .

“আমি তোমাদের ব্যাপারে যে বিষয়ে ভয় করি, সে বিষয়ে সাবধান করতে চাই, তা হলো শির্ক আসগর বা ছোট শির্ক। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন হে রাসূল! ছোট শির্ক কী? তিনি বললেন: রিয়া (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কাজ করা)। যেদিন আল্লাহ তার বান্দাদের কর্মের প্রতিদান দিবেন, সে দিন তিনি বলবেন: দুনিয়াতে তোমরা যাদের দেখানোর জন্য কাজ করেছ আজ তাদের কছে যাও! দেখ তাদের কাছে প্রতিদান পাও কি-না।” [আহমদ, হাদীস নং ২২৫২৮; বগভী ফী শরহিস সুন্নাহ।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يقول : إني أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي فإنا منه بريء، هو للذي عمله» .

“আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: আমি শির্ক ও অংশীদার থেকে বে-পরোয়া। যে কোনো কাজে আমাকে ব্যতীত অন্য কাউকে শরীক করল আমি তার থেকে সম্পর্কমুক্ত। যার জন্য সে করেছে। সেটা তরই জন্য।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৮৫।]

১১
৬. আল্লাহর সাহায্য ও প্রতিষ্ঠা লাভ:
ঈমানদারদের আল্লাহর সাহায্য লাভ ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মূল উপাদান হলো ইখলাস বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّمَا يَنْصُرُ اللَّهُ هَذِهِ الْأُمَّةَ بِضَعِيفِهَا، بِدَعْوَتِهِمْ وَصَلَاتِهِمْ وَإِخْلَاصِهِمْ»

“আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ উম্মাতকে সাহায্য করেন তাদের দুর্বলদের কারণে, তাদের দো‘আ, সালাত ও ইখলাসের কারণে।” [নাসাঈ, হাদীস নং ৩১৭৮।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«بشر هذه الأمة بالنصر والسناء والتمكين، فمن عمل منهم عمل الآخرة للدنيا لم يكن له في الآخرة نصيب» .

“আমার উম্মতকে সাহায্য, প্রাচুর্য্য ও তাদের প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্পর্কে সুসংবাদ দাও। আর তাদের কেউ যদি আখিরাতের কাজ করে পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে, আখিরাতে তার কোনো অংশ নেই।” [সহীহ ইবন হিব্বান।]

আমাদের পূর্বসূরী সালফে সালেহীনদের জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, তারা আল্লাহুর সাহায্য লাভ করেছেন নিজেদের ঈমানী শক্তি, ইখলাস বা অন্তরের একনিষ্ঠতা ও ঈমান ও ইখলাসের আলোকে গঠিত পরিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসের মাধ্যমে।

উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু বলেছেন:

«فمن خلصت نيته في الحق ولو على نفسه كفاه الله ما بينه وبين الناس» .

“যে সত্যের ব্যাপার নিজ নিয়তকে খালেস করে নিয়েছে, যদিও তা তার নিজের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে মানুষের অপকারিতা অসহযোগের ক্ষেত্রে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হবে না।” [সুনানুল কুবরা: বায়হাকী।]

উক্ত মন্তব্য উল্লেখের পর ইবনুল কাইয়্যেম রহ. মন্তব্য করেন: বান্দা যখন আল্লাহর জন্য তার নিজের নিয়ত স্থির করে নেয় এবং তার ইচ্ছা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, জ্ঞান সবকিছু আল্লাহর জন্য হয়ে যায়, তখন আল্লাহর সাহায্য সর্বদা তার সাথে থাকে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে ও ইহসান করে আল্লাহ তাদের সথে আছেন। তাকওয়া ও ইহসানের মূল হলো সত্য প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হওয়া বা ইখলাস অবলম্বন করা। আল্লাহর ওপর জয়ী হতে পারে এমন কেউ নেই। যার সাথে আল্লাহ আছেন তার ওপর কেউ জয় লাভ করতে পারে না, পারে না তাকে কেউ পরাজিত করতে। যার সাথে আল্লাহ আছেন তার ভয় কিসের? [ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘য়ীন: ইবনুল কাইয়্যেম।]

১২
৭. মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও ভালোবাসা লাভ:
আল্লাহ তা‘আলা ইখলাস অবলম্বনকারী বান্দাদের জন্য মানুষের ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভের ফয়সালা করেন। পক্ষান্তরে যে মানুষের মন পাওয়ার জন্য মানুষের কাছে আস্থভাজন হওয়ার নিয়তে কাজ করে, সে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লাভ করতে পারে না। সে যা চায় তার উল্টোটাই পায়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللَّهُ بِهِ»

“যে মানুষকে শুনাতে চায় আল্লাহ তার কথা শুনিয়ে দেন। যে মানুষকে দেখাতে চায় আল্লাহ মানুষের কাছে তাকে দেখিয়ে দেন।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪৯৯।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:

«مَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ، فَرَّقَ اللَّهُ عَلَيْهِ أَمْرَهُ، وَجَعَلَ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ، وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلَّا مَا كُتِبَ لَهُ، وَمَنْ كَانَتِ الْآخِرَةُ نِيَّتَهُ، جَمَعَ اللَّهُ لَهُ أَمْرَهُ، وَجَعَلَ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ، وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ رَاغِمَةٌ»

“যে ব্যক্তির উদ্দেশ্য হবে পার্থিব স্বার্থ, আল্লাহ তার কাজগুলোকে এলোমেলো করে দিবেন। তার দু’চোখে দরিদ্রতা দিয়ে দিবেন। তার জন্য যা কিছু নির্ধারিত আছে এর বাইরে দুনিয়ার কিছুই সে লাভ করতে পারবে না। আর যার উদ্দেশ্য হবে আখিরাত, আল্লাহ তার কাজ-কর্ম গুছিয়ে দিবেন। তার অন্তরে সচ্ছলতা দান করবেন। দুনিয়ার সম্পদ অপমানিত হয়ে তার কাছে ফিরে আসবে।” [ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪১০৫।]

আমাদের পূর্বসূরী সালাফে সালেহীন এ বিষয়ে কতটা সচেতন ছিলেন তা অনুমান করা যায় মুজাহিদ রহ. এর কথায়। তিনি বলেন: বান্দা যখন তার অন্তর নিয়ে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হয় আল্লাহ তখন সকল সৃষ্ট জীবের অন্তর তার দিকে ঝুকিয়ে দেন।

ফুদাইল রহ. বলেন: যে কামনা করে আলোচিত হওয়ার জন্য, যার একান্ত আকাঙ্খা যে, মানুষ তাকে স্মরণ করুক, তাকে কিন্তু স্মরণ করা হয় না। আর যে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করে এবং মানুষ তাকে স্মরণ করুক এটা কামনা করে না, আসলে তাকেই স্বরণ করা হয়। [ই‘লাম আল-মুওয়াক্কি‘য়ীন: ইবনুল কাইয়্যেম।]

১৩
৮- বৈধ কাজগুলো ইবাদতে রূপান্তরিত হওয়া:
ইবাদত ও কাজে-কর্মে বান্দার একনিষ্ঠতা এবং বিশুদ্ধ নিয়ত তার পার্থিব কর্মগুলোকে উঁচু স্তরে উন্নীত করে এবং পরিণত করে গ্রহণযোগ্য ইবাদতে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«وَفِي بُضْعِ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ، قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ، أَيَأتِي أَحَدُنَا شَهْوَتَهُ وَيَكُونُ لَهُ فِيهَا أَجْرٌ؟ قَالَ : «أَرَأَيْتُمْ لَوْ وَضَعَهَا فِي حَرَامٍ أَكَانَ عَلَيْهِ فِيهَا وِزْرٌ؟ فَكَذَلِكَ إِذَا وَضَعَهَا فِي الْحَلَالِ كَانَ لَهُ أَجْرٌ»

“আর তোমাদের যৌনাঙ্গেও রয়েছে পূণ্য। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলু্ল্লাহ! আমাদের কেউ যদি তার যৌন চাহিদা পূর্ণ করে তাহলে কি পুরস্কার? তিনি বললেন, আচ্ছা তোমার মত কী, যদি কেউ অবৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটায় তাহলে তার কি পাপ হবে? এমনিভাবে যদি কেউ বৈধ পন্থায় তার যৌন চাহিদা পূর্ণ করে তাহলে পুরস্কার পাবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০০৬।]

কেন সে বৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটালেও সাওয়াব পাবে? কারণ, সে কাজটি করার সময় এ ধরণা করেছে যে, আমি বৈধ পন্থায় কাজটি করে সেই অবৈধ পন্থা থেকে বেঁচে থাকব, যেখানে আল্লাহ আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আমি তার প্রতি একনিষ্ঠ (মুখলিস) হতে পারব। আর এ ইখলাস প্রসূত ধরণার কারণেই তার সামান্য মানবিক চাহিদা মেটানোর কাজটাও সাওয়াবের কাজ হিসাবে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে।

হাদীস থেকে আরেকটি দৃষ্টান্ত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فَمِ امْرَأَتِكَ»

“তুমি যা কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে খরচ করবে অবশ্যই তার পুরস্কার পাবে। এমনকি, তুমি যা কিছু তোমার স্ত্রীর মুখে দিয়েছ তারও সাওয়াব পাবে।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৫।]

স্ত্রী সন্তানদের জন্য খরচ করা পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব। এখানে পাপ-পুণ্যের কী আছে? তবুও দেখুন, যদি কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রী সন্তানদের জন্য খরচ করার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত করে তাহলে সে সাওয়াব ও পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছে।

এমনিভাবে যদি কেউ নিজের খাওয়া-দাওয়ার জন্য ব্যয় করে এবং এর সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত করে, তাহলে সে সাওয়াব লাভ করছে। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন, যে ব্যক্তি কোনো বৈধ মানবিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে সামর্থ্য হাসিলের নিয়ত করবে তার এ চাহিদা পূরণের কাজটা আল্লাহর কাছে ইবাদত হিসেবে কবুল হবে ও সে এতে সাওয়াব পাবে। [মজমু‘ আল-ফাতাওয়া: ইবন তাইমিয়া।]

যেমন, আপনি নিয়ত করলেন যে, আমি এখন বাজারে কেনা-কাটায় জন্য যাব। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হলো এ কেনা-কাটার মাধ্যমে আমি খেয়ে-দেয়ে যে শক্তি অর্জন করব তা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে ব্যয় করব। বাস! আপনার এ নিয়তের কারণে বাজারে কেনা-কাটা করাটা আপনার ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। এটাইতো ইখলাস বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হওয়া। ইখলাস যেমন সাধারণ বৈধ কাজকে ইবাদতে রূপান্তরিত করে, তেমনি রিয়া বা লোক দেখানো উদ্দেশ্য ইবাদতকে বরবাদ করে প্রতিফল শূণ্য করে দেয়। যেমন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُبۡطِلُواْ صَدَقَٰتِكُم بِٱلۡمَنِّ وَٱلۡأَذَىٰ كَٱلَّذِي يُنفِقُ مَالَهُۥ رِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَلَا يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ﴾ [ البقرة : ٢٦٤ ]

“হে মুমিনগণ! দানের কতা বলে বেড়িয়ে এবং ক্লেশ দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে ঐ ব্যক্তির ন্যায় নিস্ফল করো না, যে নিজের ধন লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও শেষ দিবসে দিবসে ঈমান রাখে না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৬৪]

অর্থাৎ দানের কথা বলে বা খোঁটা দিয়ে যেভাবে দানের প্রতিফলকে ধ্বংস করা হয়, তেমনি মানুষকে দেখানোর বা শুনানোর জন্য দান করলে আল্লাহর কাছে তার প্রতিদান পাওয়া যায় না। বাহ্যিক দিক দিয়ে যদিও মনে হবে সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য দান করেছে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য হলো মানুষের প্রশংসা অর্জন। মানুষ তাকে দানশীল বলবে, তার দানের কথা প্রচার হলে মানুষ তাকে সমর্থন দিবে ইত্যাদি।

সাহাবী ‘উবাদাহ ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এক ব্যক্তি বলল, “আমি আমার এ তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করব। এর মাধ্যমে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করব ও মানুষের প্রশংসা পাব। উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বললেন, তুমি কিছুই পাবে না। তুমি কিছুই পাবে না। তৃতীয়বার উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আল্লাহ বলেছেন: আমি শির্ক ও অংশীদার থেকে বে-পরোয়া। যে ব্যক্তি আমার জন্য করা হয় এমন কোনো কাজে আমাকে ব্যতীত অন্য কাউকে শরীক করল আমি তার থেকে সম্পর্কমুক্ত। আমাকে ছাড়া যার জন্য সে করছে সেটা তারই জন্য বিবেচিত।’’ [ইহইয়া উলুমিদ্দীন: আল-গাযালী।]

১৪
৯. ইখলাসপূর্ণ নিয়তের মাধ্যমে পরিপূর্ণ আমলের সাওয়াব অর্জন:
কোনো কোনো সময় ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়তে কাজ করতে উদ্যোগী হয়, কিন্তু তার সম্পদের সীমাবদ্ধতা, শারীরিক দুর্বলতা-ইত্যাদি কারণে কাজটি সমাধা করতে পারে না। কখনো দেখা যায়, উক্ত ভালো কাজটি করার জন্য সে প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু কোনো কারণে কাজটি আঞ্জাম দিতে পারে নি। এমতাবস্থায় সে কাজটি সম্পন্ন করার সাওয়াব পেয়ে যাবে এবং তার ইখলাসের কারণে কাজটি যারা করতে পেরেছে তাদের সমমর্যাদা লাভ করবে।

যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ أَقْوَامًا بِالْمَدِينَةِ خَلْفَنَا، مَا سَلَكْنَا شِعْبًا وَلاَ وَادِيًا إِلَّا وَهُمْ مَعَنَا فِيهِ، حَبَسَهُمُ العُذْرُ»

“আমরা কয়েকটি দলকে মদীনায় রেখে এসেছি। আমরা যে পাহাড়ই অতিক্রম করি আর যে উপত্যকাই মাড়াই না কেন, তারা সেখানেই আমাদের সাথে রয়েছেন; কারণ ওযরই কেবল তাদেরকে আটকে রেখেছে।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৭৩৯।]

হাদীসে বর্ণিত সাহাবীগণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অভিযানে অংশ নিতে পারেন নি কোনো অসুবিধার কারণে; কিন্তু তাদের বিশুদ্ধ নিয়ত ও ইখলাস ছিল অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য। তাই তারা অংশ গ্রহণ না করেও অংশগ্রহণকারীদের সমমর্যাদার অধিকারী হলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন:

«مَنْ أَتَى فِرَاشَهُ وَهُوَ يَنْوِي أَنْ يَقُومَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ فَغَلَبَتْهُ عَيْنَاهُ حَتَّى أَصْبَحَ كُتِبَ لَهُ مَا نَوَى وَكَانَ نَوْمُهُ صَدَقَةً عَلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ»

“যে ব্যক্তি শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করবে -এ নিয়তে শুয়ে পড়ল। অবশেষে নিদ্রা তাকে কাবু করে ফেলল এবং সকাল হওয়ার আগে জাগতে পারল না। এমতাবস্থায় সে যা নিয়ত করেছিল তা তার জন্য লেখা হয়ে যাবে এবং এ নিদ্রা তার রবের পক্ষ থেকে তার ওপর দান হিসেবে ধরা হবে।” [নাসাঈ, হাদীস নং ১৭৮৭।]

তাহাজ্জুদের নিয়ত করেও এ ব্যক্তি তাহাজ্জুদ পড়তে পারল না বটে কিন্তু ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়তের কারণে সে তাহাজ্জুদের পূর্ণ সাওয়াব পাবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন:

«مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ، بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ، وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ»

“যে বিশুদ্ধ মনে জিহাদে শরীক হয়ে আল্লাহর কাছে শহীদ হওয়া কামনা করবে, আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন যদিও সে বিছানায় মৃত্যুবরণ করে।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯০৯।]

ইখলাস বা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে যে শহীদ হওয়ার আকাঙ্খা করবে, সে শহীদ না হতে পারলেও আল্লাহ তাকে তার ইখলাসের করণে শহীদের মর্যাদা দান করবেন। আরেকটি হাদীসে উল্লেখ করা যেতে পারে। তা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«قَالَ رَجُلٌ لَأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ، فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ زَانِيَةٍ، فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ تُصُدِّقَ اللَّيْلَةَ عَلَى زَانِيَةٍ، قَالَ : اللهُمَّ، لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ، لَأَتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ، فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ غَنِيٍّ، فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ : تُصُدِّقَ عَلَى غَنِيٍّ، قَالَ : اللهُمَّ، لَكَ الْحَمْدُ عَلَى غَنِيٍّ، لَأَتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ، فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِي يَدِ سَارِقٍ، فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ : تُصُدِّقَ عَلَى سَارِقٍ، فَقَالَ : اللهُمَّ، لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ، وَعَلَى غَنِيٍّ، وَعَلَى سَارِقٍ، فَأُتِيَ فَقِيلَ لَهُ : أَمَّا صَدَقَتُكَ فَقَدْ قُبِلَتْ، أَمَّا الزَّانِيَةُ فَلَعَلَّهَا تَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ زِنَاهَا، وَلَعَلَّ الْغَنِيَّ يَعْتَبِرُ فَيُنْفِقُ مِمَّا أَعْطَاهُ اللهُ، وَلَعَلَّ السَّارِقَ يَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ سَرِقَتِهِ»

“এক ব্যক্তি নিয়ত করল যে, আমি রাতে কিছু সাদাকা (দান) করব। যখন রাত এল সে সাদাকা করল। কিন্তু সাদকা পড়ল এক ব্যভিচারী মহিলার হাতে। সকাল হলে লোকজন বলতে শুরু করল, গত রাতে জনৈক ব্যক্তি এক ব্যভিচারীকে সাদাকা দিয়েছে। এ কথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ! ব্যভিচারীকে সাদাকা দেওয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা। আমি রাতে আবার একটি সাদাকা করব। পরের রাতে যখন সে সাদাকা করল, তা পড়ল একজন ধনীর হাতে। যখন সকাল হলো তখন লোকজন বলাবলি শুরু করল গত রাতে জনৈক ব্যক্তি এক ধনীকে সাদাকা দিয়েছে। এ কথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ! ধনীকে সাদাকা দেওয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা। আমি রাতে আবার একটি সাদাকা করব। যখন পরের রাতে সে সাদাকা করল, তা পড়ল একজন চোরের হাতে। যখন সকাল হলো তখন লোকজন বলতে শুরু করল, গত রাতে এক ব্যক্তি এক চোরকে সাদাকা দিয়েছে। এ কথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ! ব্যভিচারী, ধনী ও চোরকে সাদাকা দেওয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বলা হলো, তোমার সকল সাদাকাহ (দান)-ই কবুল করা হয়েছে। সম্ভবত তোমার সাদাকার কারণে ব্যভিচারী মহিলা তার পতিতাবৃত্তি থেকে ফিরে আসবে। ধনী ব্যক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহী হবে। চোর তার চুরি কর্ম থেকে ফিরে আসবে।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২২।]

দেখুন, এ ব্যক্তি তার সাদাকা বা দান করার ব্যাপারে এতটাই ইখলাস (আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়ত) গ্রহণ করেছিল যে, সাদাকা প্রদানে তার অতি গোপনীয়তা কাউকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে দেয় নি। এ গোপনীয়তা রক্ষার কারণে বার বার এ সাদাকা অনাকাংখিত হাতে পড়লেও সে তার ইখলাস থেকে সরে আসে নি। ইখলাস অবলম্বনে ছিল অটল। ফলে তার কোনো সাদাকা ব্যর্থ হয় নি।

ইবন হাজার রহ. বলেন, এ হাদীস দ্বারা বুঝে আসে দানকারী নিয়ত বিশুদ্ধ থাকলে তার দান অনাকাংখিত স্থানে পড়লেও তার দান বা সাদাকা আল্লাহর কাছে কবুল হবে। [ফাতহুল বারী: ইবন হাজার।]

১৫
১০. ইখলাস বিপদ মুসীবত থেকে মুক্তির কারণ:
নিয়তের ব্যাপারে ইখলাস অবলম্বন ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে আশ্রয় গ্রহণে সততা ও সত্যবাদিতা হলো দুনিয়া ও আখিরাতের বিপদাপদ থেকে মুক্তির মাধ্যমে।

বিষয়টি স্পষ্ট করে যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدۡ ضَلَّ قَبۡلَهُمۡ أَكۡثَرُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٧١ وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا فِيهِم مُّنذِرِينَ ٧٢ فَٱنظُرۡ كَيۡفَ كَانَ عَٰقِبَةُ ٱلۡمُنذَرِينَ ٧٣ إِلَّا عِبَادَ ٱللَّهِ ٱلۡمُخۡلَصِينَ ٧٤﴾ [ الصافات : ٧١، ٧٤ ]

“তাদের পূর্বেও পূর্ববর্তীদের অধিকাংশ বিপথগামী হয়েছিল এবং আমি তাদের মধ্যে সতর্ককারী প্রেরণ করেছিলাম। সুতরাং লক্ষ্য কর যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল, তাদের পরিণাম কী হয়েছিল! তবে আল্লাহর একনিষ্ঠ (ইখলাস অবলম্বনকারী) বান্দাদের কথা স্বতন্ত্র।” [সূরা আস-সাফ্ফাত, আয়াত: ৭১-৭৪]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿هُوَ ٱلَّذِي يُسَيِّرُكُمۡ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۖ حَتَّىٰٓ إِذَا كُنتُمۡ فِي ٱلۡفُلۡكِ وَجَرَيۡنَ بِهِم بِرِيحٖ طَيِّبَةٖ وَفَرِحُواْ بِهَا جَآءَتۡهَا رِيحٌ عَاصِفٞ وَجَآءَهُمُ ٱلۡمَوۡجُ مِن كُلِّ مَكَانٖ وَظَنُّوٓاْ أَنَّهُمۡ أُحِيطَ بِهِمۡ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ لَئِنۡ أَنجَيۡتَنَا مِنۡ هَٰذِهِۦ لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلشَّٰكِرِينَ ٢٢ فَلَمَّآ أَنجَىٰهُمۡ إِذَا هُمۡ يَبۡغُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّۗ﴾ [ يونس : ٢٢، ٢٣ ]

“তিনিই তোমাদিগকে জলে-স্থলে ভ্রমন করান এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও এবং এগুলো আরোহী নিয়ে অনুকুল বাতাসে বয়ে যায় এবং তারা এতে আনন্দিত হয়, অতঃপর এগুলো বাত্যাহত এবং সর্বদিক থেকে তরংগাহত হয় এবং তারা তা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেছে মনে করে, তখন তারা আনুগত্য ও ইখলাসের সাথে (বিশুদ্ধ চিত্তে) আল্লাহকে ডেকে বলে: তুমি আমাদেরকে এ থেকে উদ্ধার করলে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব। অতঃপর তিনি যখনই তাদেরকে বিপদমুক্ত করেন তখনই তারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে যুলুম করতে থাকে।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ২২-২৩]

এ রকম আরেকটি দৃষ্টান্ত, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا غَشِيَهُم مَّوۡجٞ كَٱلظُّلَلِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّىٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ فَمِنۡهُم مُّقۡتَصِدٞۚ وَمَا يَجۡحَدُ بِ‍َٔايَٰتِنَآ إِلَّا كُلُّ خَتَّارٖ كَفُورٖ ٣٢﴾ [ لقمان : ٣٢ ]

“যখন তরঙ্গ তাদের আচ্ছন্ন করে মেঘচ্ছায়ার মতো, তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তার আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্তে (ইখলাসের সাথে)।” [সূরা লুকমান, আয়াত: ৩২]

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন